[পাঁচ]
নাটকের শো না থাকলে শনিবারের দুপুরটা পার্থর অবিমিশ্র সুখের সময়। শুধু ওই দিনটাই সকাল সকাল হেভি ব্রেকফাস্ট সেরে কাজে বেরিয়ে যায় পার্থ, দেড়টার মধ্যে প্রেসের ঝাঁপ বন্ধ করে সটান বাড়ি, এবং ভরপেট খেয়ে নিপাট ভাতঘুম। অন্তত পাঁচটা পর্যন্ত। তারপর উঠে, চোখ কচলে, হাই তুলে, ঝোলা ব্যাগটি নিয়ে আড্ডা দিতে চলল নাটকপাড়ায়। পুজোর আগে প্রেসে এখন যথেষ্ট কাজের চাপ, কিন্তু তার জন্য রুটিনে ব্যত্যয় ঘটে না পার্থর। দেড়টায় ছাপাখানা বন্ধ করবে, তত দেড়টাতেই করবে। ওভারটাইম-নীতিতে পার্থ বিশ্বাসী নয়।
আজ সেই নিয়মেই গড়ানোর তোড়জোড় করছিল পার্থ, মিতিন বাধ সাধল,—অ্যাই, এখন নো ঘুম। চলো, আমার সঙ্গে একটু বেরোতে হবে।
—জ্বালালে। এই রোদ্দুরে কোথায় যাবে? পুজোর বাজার?
—আজ্ঞে না স্যার, তোমার প্রতীক্ষায় বসে থাকলে আমার মার্কেটিং হয় না। আমি টুকটাক সেরে ফেলছি।…অন্য কাজ আছে।
—যেমন?
—একটা নাটকে অ্যাক্টিং করতে হবে।
নিদ্রিত বুমবুমের পাশে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল পার্থ, রহস্যের গন্ধ পেয়ে উঠে বসল,—কী রোল?
—রিহার্সালের সময় জানতে পারবে। চটপট রেডি হয়ে নাও।…আর হ্যাঁ, তোমার ক্যামেরায় ফিল্ম ভরা আছে না? ওটাও নিয়ে নিও।
পার্থর তন্দ্রা উবে গেল। পাঁচ মিনিটে জিনস টিশার্ট গলিয়ে তৈরি। মিতিন পরেছে চন্দন রঙের হ্যান্ডপ্রিন্ট সালোয়ার কামিজ, সঙ্গে একই রঙের ওড়না, চোখে সানগ্লাস। বুমবুমকে বিমলার জিম্মায় দিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ল দুজনে।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে পার্থকে সব ভাল করে বুঝিয়ে দিল মিতিন। চাপা উত্তেজনায় ছটফট করছে পার্থ। এরকম অভিযানে মিতিনের সঙ্গী হতে সে ভালইবাসে।
ভবানীপুর পৌঁছে গলিটা খুঁজে বার করতে সময় লাগল একটু। চায়ের দোকানের গা ঘেঁষে এক সরু রাস্তা। যত্রতত্র খানাখন্দ। নম্বর ধরে এগিয়ে এক জায়গায় থামল দুজনে। সামনে এক জীর্ণ বাড়ি, ইটখসা ঘা ঘা দেওয়াল। সদর দরজা আধখোলা, দেখে মনে হয় ভেতরে লুকোছাপা কিছু নেই।
কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এসেছে এক যুবক। অলস গলায় বলল,—কাকে খুঁজছেন?
মিতিন পলকে জরিপ করে নিল ছেলেটাকে। পরনে হাঁটুঝুল জিনস, খালি গা, উড়ু উড়ু চুল। ঢুলুঢুলু চোখ। ঘুমোচ্ছিল, না নেশা করেছে? একটু বেঁটে বটে, তবে দেখতে মন্দ নয়। টকটকে ফর্সা রং, মুখে বেশ একটা ফিল্মস্টার ফিল্মস্টার ভাব আছে।
এই তবে বিদিশার দাদা চিত্রভানু!
মিতিন হাত জোড় করে নমস্কার করল,—বিদিশা কী আছে?
—বিদিশা? এখানে? চিত্রভানু একবার মিতিনকে দেখল, একবার পার্থকে।
মিতিন মুখে কৃত্রিম বিস্ময় ফোটাল,—এটা কি সতেরোর দুই মহিম হালদার লেন নয়? বিদিশা দত্ত থাকে না এখানে?
—সবই ঠিক আছে, তবে সে পাখি উড়ে গেছে।
—বুঝলাম না।
চিত্রভানু চোখ টেরচা করল,—কদ্দিন বিদিশার সঙ্গে দেখা হয়নি?
সত্যি ভারী অমার্জিত বাচনভঙ্গি। মিতিন বলল,—তা প্রায় দেড় বছর।
—তাই বলুন। বিদিশার বিয়ে হয়ে গেছে।…আপনারা আসছেন কোত্থেকে?
উত্তর দেওয়ার আগেই অন্দর থেকে মহিলাকণ্ঠ,—কে রে ভানু? কে এসেছে?
মিতিন-পার্থকে আর একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে চিত্রভানু গলা চড়াল,—এই যে দ্যাখো না কারা সব বুলুকে খুঁজছে।
ভারতী দরজায় এলেন। গায়ের রংটি ফ্যাটফেটে ফর্সা, মুখচোখ ফোলা ফোলা, অ্যানিমিক ধরনের।
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই সানগ্লাস খুলে টুপ করে একটা প্রণাম করল মিতিন,—আমার নাম চন্দ্রিমা হালদার মাসিমা, বিদিশার সঙ্গে পড়তাম। স্কুলে। এ আমার স্বামী, সুপ্রকাশ হালদার। আমরা বিদিশার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম।
পার্থ মাথা নোওয়াল সামান্য, ভারিক্কি ভঙ্গিতে।
ভারতীর চোখ পার্থকেও ছুঁয়ে গেল,—কিন্তু বিদিশার তো গেল মাঘে বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি জানতে না?
—না মাসিমা। মাঝে আমরা বম্বে চলে গিয়েছিলাম তো।…কোথায় বিয়ে হল বিদিশার?
—সল্টলেকে। শ্বশুরবাড়ি খুব বড়লোক। হঠাৎ যোগাযোগ হয়ে গেল…। ভারতীর মুখে এক গাল হাসি।
—ঠিকানাটা একটু দেবেন?
—ঠিকানা? বি সি না সি বি কী যেন…! ভারতী ছেলের দিকে তাকালেন,—নম্বরটা কত যেন রে?
চিত্রভানু উদাস হয়ে গেল,—দরকারটা বলে যান, খবর দিয়ে দেব।
—বলছি। মিতিন ওড়নায় মুখ মুছল,—এক গ্লাস জল হবে মাসিমা?
—এমা ছি ছি, তোমরা বাইরে কেন? এসো, ভেতরে এসো।
চরম অবিন্যস্ত ঘর। রঙজ্বলা চাদরটা টেনেটুনে বসার জায়গা করে দিলেন ভারতী ভেতরে গেলেন জল আনতে। চিত্রভানু পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে, কী যেন খোঁজার ভান করছে কাচভাঙা শোকেসে। কী অসভ্য ছেলে রে বাবা, গায়ে একটা জামা গলিয়েও এল না!
চাপা অথচ চিত্রভানু যেন শুনতে পায় এমন স্বরে পার্থ বলল,—এই চলো, শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাটা নিয়ে কেটে পড়ি।
প্রত্যাশা মতোই চিত্রভানুর ঘাড় ঘুরেছে,—প্রয়োজনটা কি আমাদের বলার অসুবিধে আছে?
ছদ্ম অস্বস্তিতে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল পার্থ আর মিতিন।
ভারতী দুজনের জন্যই জল এনেছেন। সঙ্কুচিত মুখে বললেন,—শুধু জল দিলাম কিন্তু।
—তাতে কী আছে! মিতিন দ্রুত জলটা শেষ করে ফেলল। দম নিয়ে বসল গুছিয়ে,—হ্যাঁ, যে জন্য আসা…। আমার স্বামী বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তলেছে। এখন টিভি সিরিয়াল স্টার্ট করছে একটা। আশা নিরাশা। হিরোইনের জন্য ও একটা নতুন মুখ খুঁজছিল। ফ্রেশ, সুন্দরী…
পার্থ গলায় ওজন আনল,—হ্যাঁ, আমি ফ্রেশ কেসই লনচ করতে চাই। আমরা বিদিশার কথা ভাবছিলাম।
চিত্রভানু ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল,—বিদিশা কি আপনাদের বলেছিল সিরিয়ালে নামতে চায়?
—অনেক দিন আগে একবার বলেছিল। মানে সেই বছর দেড়েক আগে দেখা হয়েছিল যখন। আমার স্বামী ফিল্ম করে শুনে আগ্রহ দেখিয়েছিল খুব। তখন তো উপায় ছিল না, ও তখন চিংড়ি চাষের ওপর একটা ডুকমেন্টারি করছিল…। এখন যখন চান্স এসেছে…
—কিন্তু বুলু কি আর এখন ওসব করতে পারবে? ভারতীর কপালে ভাঁজ,— দাঁড়াও ওর বাবাকে ডেকে আনি।
—মেসোমশাই আছেন?
—আজ তো হাফ ডে, শনিবার। এই মাত্র অফিস থেকে ফিরে শুয়েছেন…
চিত্রভানু আড়ে আড়ে পার্থর কাঁধের ব্যাগটাকে দেখছিল। ভারতী চলে যেতেই বাঁকা স্বরে বলে উঠল,—আপনাদের কেসটা কী বলুন তো? আমি তো জানি সিরিয়ালে নামার জন্য মেয়েরা ডিরেক্টর প্রোডিউসারদের পায়ে পায়ে ঘোরে, আর আপনারা নায়িকা খুঁজতে বেরিয়েছেন?
পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল,—আমি সব খুঁজছি। নায়ক ভিলেন সাইডহিরো…। সব নতুন মুখ ইনট্রোডিউস করব।
—বাজেট কম বুঝি?
—বাহ্, এই লাইন সম্পর্কে তো বেশ জানেন! এক্সপিরিয়েন্স আছে কিছু?
—কেন? থাকলে রোলটোল দেবেন নাকি?
—করবেন? আপনার চেহারাটা বেশ একটু ডিফারেন্ট টাইপ। রোমান্টিক না, রাগেডও না…
ওষুধ ধরে গেল। চিত্রভানুর স্বর তলতল করছে,—অভিনয় একেবারেই করিনি তা নয়। বলতে গেলে অভিনয় আমাদের ব্লাডেই আছে। আমার বাবা একজন গ্রেট অ্যাক্টর, আমিও স্কুল কলেজে মাঝে মধ্যে…
—ব্যস ব্যস, তা হলেই চলবে। বাকিটা তো আমার হাতে…। গায়ে একটা ইয়ে গলিয়ে আসবেন, একটা ছবি নিই?
মুহূর্তে অন্তর্হিত হল চিত্রভানু।
পার্থ আলগা ঠেলল মিতিনকে,—কেমন দিলাম?
মিতিন নিচু গলায় বলল,—একটু রয়ে সয়ে। কথা কম বলো, নইলে সন্দেহ করবে। সত্যি সত্যি তো আর ডিরেক্টররা বাড়ি গিয়ে গিয়ে ছবি তুলে বেড়ায় না!
—আরে ছাড়ো, কমন পাবলিক ওসব থোড়াই জানে।
চিত্রভানু ফেরার আগে প্রভাকর ঘরে এলেন। লুঙ্গির ওপর এক্ষুনি হাফপাঞ্জাবি চড়িয়েছেন বোঝা যায়, হাত দিয়ে পাঞ্জাবিটাকে টানছেন ঘন ঘন। চেয়ারে বসে স্মিত মুখে বললেন,—তোমাদের মাসিমার কাছে শুনলাম সব।…কিন্তু একটা সমস্যা আছে যে বাবা। বুলুর শ্বশুরবাড়ি খুব বনেদি ফ্যামিলি, বাড়ির বউকে তারা অ্যাক্টিং করতে দেবে বলে মনে হয় না।
সুদখোর মহাজনের বংশধররাও বনেদি! মিতিন চোয়াল ফাঁক করল,—বিদিশার কিন্তু খুব ইচ্ছে ছিল মেলোমশাই!
—বুঝলাম। কিন্তু আমরা পাঠিয়েছি শুনলে জামাই রাগ করবে।
—বিদিশার বর বুঝি খুব রাগী?
—রাগী ঠিক নয়, মেজাজি। রইস বাড়ির রইস ছেলে তো…
ভারতী দরজা থেকে বলে উঠলেন,—ওসব থাক না মা। বিয়ে থা হয়ে গেছে, তোমার বন্ধু নয় এখন শুধু ঘরকন্নাই করুক।
প্রভাকর তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,—আমি অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে অভিনয় খুবই ভালবাসি…
—সে তো বোধহয় আপনি করেনও। আপনার ছেলে বলছিল…
—পুরনো নেশা। আমি ছেড়ে দিতে চাই, গ্রুপ আমায় ছাড়ে না। বলে প্রভাকর দত্ত না থাকলে দর্শকদের ধরে রাখবে কে?
—আপনি কোন গ্রুপে আছেন? পার্থ নড়ে বসল।
—নিষাদ। চেতলার। নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? এই তো আমাদের নেক্সড মানডে শো আছে। মুক্তাঙ্গনে। পারলে চলে এস।
চিত্রভানুর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। ভালই ড্রেস করে ফেলেছে এর মধ্যে। লালসাদা হাফশার্ট, চুলে টেরি, শর্টস ছেড়ে ট্রাউজারস। পার্থ পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। চিত্রভানুর তুলতে গিয়ে প্রভাকর ভারতীরও। তিন জনই আহ্লাদে আটখানা, চা পর্যন্ত এসে গেল। প্রভাকর ভারতী বিদিশার বিয়ে শ্বশুরবাড়ির গল্প করলেন বিস্তর, কিন্তু মেয়ের ঠিকানা দেওয়ার ব্যাপারটা কায়দা করে এড়িয়ে গেলেন।
পার্থই কথা বলছে বেশি, মিতিন লক্ষ করছিল তিনজনকে। চোখে পড়ল একটু বুঝি বা ছটফট করছে চিত্রভানু। কিছু যেন বলতে চায়। মিতিনরা উঠতেই এসেছে পিছন পিছন।
মোড়ে পৌঁছে বলল,—আপনাদের মাইরি ঘিলু শর্ট আছে। বুঝছেন বাবা-মা ঠিকানা দেবে না, তবু বসে বসে গেঁজিয়ে যাচ্ছেন!
মিতিন মৃদু হাসল,—বারে, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পছন্দ অপছন্দের কথাটা তাঁরা ভাববেন না?
—শ্বশুরবাড়ি নয়, বর। অর্চিষ্মানটা বহুৎ খোচো টাইপ আছে। টিভিতে নামার বাই চেপেছে শুনলে ওই বুলুকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে।
—বিদিশার বরের সঙ্গে আপনার বনিবনা নেই মনে হচ্ছে? মিতিন খোঁচাল সামান্য,—আপনাকে বুঝি পাত্তা দেয় না?
—কে চায় ওর পাত্তা! সঙ্গে সঙ্গে আগুনে ঘি পড়ল,—ব্যাটা টাকার কুমীর হয়ে বসে আছে বলে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না, সব সময়ে সন্দেহে মটমট করছে…! পার্থ সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল, অবলীলায় তার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে নিল চিত্রভানু। আগুন জ্বালিয়ে হুশ হুশ ধোঁয়া ছাড়ল,—জানেন কী রকম লোক? এই বছর দুই আগে…বিনা কারণে এক গণ্ডা লোককে দোকান থেকে ছাঁটাই করে দিল। বেচারারা এখন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরকম ছ্যাঁচড়া পার্টির সঙ্গে চিত্রভানু দত্ত সঙ্গত করে না।
—এত খবর জানলেন কোত্থেকে? বিদিশা গল্প করে বুঝি?
—পাগল! সে করবে পতিনিন্দা? সে তো এখন সতী নাম্বার ওয়ান। চিত্রভানুর ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি,—এসব খবর বাতাসে ওড়ে, চিত্রভানু ধরে নেয়। যাক গে থাক, আমার কথাটা কী ভাবলেন? দিচ্ছেন রোল? আরে ভাই, স্কোপ দিলে বুঝবেন চিত্রভানু দত্ত কিছু ফ্যালনা নয়।
—ছি ছি, আপনি ফ্যালনা হবেন কেন? পার্থ হাত রাখল চিত্রভানুর কাঁধে,—দেখেই বোঝা যায় আপনার মধ্যে কোয়ালিটি আছে। সত্যি বলতে কি, আপনার বোনের থেকে আপনি অনেক কম শাই। নেহাত ওর একটা আলাদা গ্ল্যমার আছে বলেই…
—ওই দেখিয়েই তো তরে গেল। চিত্রভানুর স্বরে ঝাঁজ,—তবে হ্যাঁ, রিয়েল লাইফে অ্যাক্টিংটা ও ভালই করে। বোনের কাদা আর ঘাঁটতে চাই না, আমায় একটু মনে রাখবেন তাহলেই হল।
চিত্রভানুকে কাটিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পার্থ বলল,—ওফ, দাদাটা একটা জিনিস বটে। পগেয়া মাল। আমি জন্মে কখনও কোনও দাদাকে বোন ভগ্নিপতির এমন কুচ্ছো গাইতে শুনিনি।
মিতিন সিটে হেলান দিল,—কিন্তু ছেলেটা খুব চালাক নয়। মনের ভাব গোপন করার ক্ষমতাও কম। বেসিকালি এটা ওস্তাদ ক্রিমিনালের লক্ষণ নয়।
—তার মানে সন্দেহের লিস্ট থেকে ছেলেটা বাদ?
—পুরোপুরি বাদ নয়। বিদিশা যে বাড়ি থেকে গয়নার বাক্সটা নিয়ে যাচ্ছিল, এটা যদি বাড়ির কেউ ব্ল্যাকমেলারকে জানিয়ে থাকে, তবে সে চিত্রভানুই। কারণ মা’টা একেবারেই সাদামাঠা, মনে তেমন প্যাঁচপোঁচ নেই। বাপটাও মেয়ের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। দুজনের কেউই মেয়েকে ইনসিকিওর দেখতে চায় না।
—মাকে দেখে তো মনে হল, বাক্সে মেয়ের প্রেমপত্র ছিল জানলে তদ্দণ্ডেই পুড়িয়ে দিতেন।
—হুম! মিতিন মাথা নাড়ল,—তবে বাবাটাকে আর একটু কালচার করা দরকার। তুমি ভদ্রলোকের নাটকের গ্রুপটাকে চেনো?
—নামটা শোনা। ছোট গ্রুপ। বছরে একটা দুটো শো করে আর কি।…দুটো দিন সময় দাও, প্রভাকর দত্তের ঠিকুজিকুষ্ঠি আমি হাজির করে দেব। পার্থ আবার একটা সিগারেট ধরাল,—কিন্তু ভাইটার বোন ভগ্নিপতির ওপর এত রাগ কেন বলো তো?
—তলিয়ে দেখতে হবে আরও। সাইকোলজিটা স্টাডি করতে হবে।
—সে তুমি যা ইচ্ছে করো, একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু ডেফিনিট। অর্ককে বাক্সের খবরটা ওই সাপ্লাই করেছিল। অত যার হিংসে…
—হয়তো দিয়েছিল। তবে অর্ককে নয়।
—কী করে শিওর হচ্ছ?
—কারণ কাল সন্ধেবেলা আমি অর্কদের বাড়ি গেছিলাম। ওর মাসির সঙ্গে দেখা করেছি।
—তাই? বলোনি তো?
—কাল তো তুমি রিহার্সাল থেকে ফিরলেই রাত এগারোটায়।…যাক গে শোনো, আমি গেছিলাম সাংবাদিক সেজে। বললাম, অর্ক রায় খুব প্রমিসিং অ্যাথ্লিট ছিল, ওকে নিয়ে নিয়ে একটা স্টোরি করব…। খুব ভেঙে পড়েছেন মহিলা, খালি কান্নাকাটি করছিলেন…। তবে হ্যাঁ, বললেন বিদিশা সত্যি সত্যি দু দিন অর্কর বাড়ি গেছিল। প্রথম যেদিন গিয়েছিল, তার পরের দিনটা ছিল রবিবার। সেদিন সকাল থেকে সন্ধে ঘরেই শুয়ে ছিল অর্ক, মাসিই তার সাক্ষী। এবং সেই দিনই গয়নার বাক্সটা চুরি হয়।
—ও নো। অর্ক তা হলে নির্দোষ?
—সেই সম্ভাবনাই বেশি।
—আচ্ছা, তুমি বিদিশার কথা এখানে তুললে কী করে?
—একটু ঘুরপথে যেতে হল। জিজ্ঞেস করলাম, অর্কর অ্যাথলিট বন্ধুরা বলছে একটা মেয়ের সঙ্গে নাকি অর্কর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকেই অর্ক নাকি অ্যাথলেটিক্সে কিছুটা পিছিয়ে পড়ে…? ব্যস, শুনেই বিদিশার বাপবাপান্ত শুরু করলেন মহিলা। তখনই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে…
একটুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। বিকেল শেষ হয়ে এসেছে, থোকা থোকা যানজটের মধ্যে দিয়ে শ্লথগতিতে এগোচ্ছে ট্যাক্সি। সাদার্ন অ্যাভিনিউতে পড়তেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল। কনে দেখা আলো মেখে অপরূপ হয়ে উঠেছে দু পারের গাছপালা। সুন্দর হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে, লেকের দিক থেকে। বাপ মাখা বাতাস।
মিতিন লেকের দিকে তাকিয়েছিল। আত্মগত ভাবে বলে উঠল,—চিত্রভানুই যে কাউকে খবর দিয়েছিল এমন কথাও কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। হয়তো ব্ল্যাকমেলারটা সত্যিই বিদিশাকে ফলো করছিল সেদিন। বাক্সটা পেয়ে যাওয়া চান্স অকারেন্স। আবার রবি যে সত্যি বলছে, তারই বা প্রমাণ কী?
পার্থ আলগা ভাবে বলল,—কী বিড়বিড় করছ?
—কিছু না। মিতিন হাসল,—ভাবছি সুতোটা কোন্ দিক দিয়ে টানব…
ঢাকুরিয়া এসে গেল। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছিল মিতিন, সহসা চোখ আটকাল সামনে দাঁড়ানো গাড়িটাতে। স্টিলব্লু মারুতি। অর্চিষ্মানদের বাড়ির গাড়ি না?
[ছয়]
বাড়িতে পা রেখে আরও চমকে গেল মিতিন। স্বয়ং বিদিশা এসেছে। ছোট্ট সোফায় একটু গুটিসুটি মেরে বসে আছে। সাজগোজ মোটামুটি পরিপাটি বটে, কিন্তু মুখ একেবারে কাগজের মতো সাদা।
মিতিকে দেখে বিদিশা প্রায় ডুকরে উঠল। স্থানকালপাত্র ভুলে আহত, পক্ষিণীর মতো ডানা ঝাপটে উড়ে এল কাছে। মিতিনের হাত আঁকড়ে ধরে বলল,—আমায় বাঁচান দিদি, আমার আর রক্ষা নেই…
থরথর কাঁপছে মেয়েটা। মিতিন তাকে ধরে আবার বসিয়ে দিল,—আহ্, শান্ত হও। বলো, কী হয়েছে?
—আবার সেই ফোনটা এসেছিল।
—কবে? কখন?
—খানিক আগে। না না, দুপুরে। দুটো আড়াইটের সময়। সেই কখন থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি…
নাটুকে দৃশ্যের দর্শকদের ওপর ঝলক চোখ বুলিয়ে নিল মিতিন। ড্রয়িংরুমের একদম মধ্যিখানে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বুমবুম, মুখে তার অসীম বিরক্তি। সম্ভবত বিদিশার কারণেই কাজ বেচারার বেরনো হয়নি, তাই। বিমলা দরজা খুলে দিয়ে কৌতূহলী মুখে তাকিয়ে। হতচকিত পার্থ টেরিয়ে টেরিয়ে বিদিশাকে দেখছিল, মিতিনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুড়ুৎ ভেতরে ঢুকে গেল।
বিমলাকে কফি বানাতে বলে বিদিশাকে নিয়ে সটান স্টাডিতে চলে এল মিতিন। মেয়েটাকে সোফায় বসিয়ে চালিয়ে দিল স্ট্যান্ডফ্যান। জিজ্ঞাসা করল,—জল খাবে?
—খেয়েছি।
পাশে বসে মেয়েটার পিঠে হাত রাখল মিতিন,—এবার ঠাণ্ডা মাথায় বলো তো লোকটা কী বলেছে?
—আরও বেশি টাকা চাইছে। পাঁচ লাখ।
—মিটার চড়ে গেল যে?
—কী জানি…বলছে এবার দিলে ছেড়ে দেবে। আর বিরক্ত করবে না।
—হুম। মিতিন উঠে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। পেনসিল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে কাগজে। বিদিশার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল,—কবে দিতে হবে টাকা?
—শনিবার।
—সামনের শনিবার?
—হ্যাঁ। আপনার শেখানো মতো আমি অনেক কাকুতি মিনতি করেছিলাম, একটা দিনও সময় দিল না।
—কী ভাবে দিতে হবে? সেই আগের বারের মতো? গাড়িতে?
—বলেনি। শুধু বলল, গতবারের মতো আর চালাকি করার চেষ্টা কোরো না, ঠিক সময়ে জানিয়ে দেব। বিদিশা আবার মিতিনের হাত চেপে ধরল,—আমার কী হবে দিদি? পাঁচ লাখের কথা আমি অর্চিষ্মানের সামনে উচ্চারণ করব কী করে? ও আর আমায় ক্ষমা করবে না। আমার সর্বস্ব গেল…
—অত ভয় পাচ্ছ কেন? টাকা দেবে না।
—টাকা না দিলে আমায় ছাড়বে কেন?
—ক্ষতিটাই বা কী করবে?
—যদি মেরে ফেলে? অর্কর মতো?
—হুম।…গাড়িতে এসেছ দেখলাম, ড্রাইভার কোথায়?
—আমিই চালিয়ে এসেছি।
—ড্রাইভার নিয়ে এলে না কেন?
—রবি আজ আসেনি। ভীষণ কামাই করে।
মিতিনের ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল। ভাবছে কী যেন। জিজ্ঞাসা করল,—রবি কাল এসেছিল?
—হ্যাঁ। শ্বশুরমশাই নিয়ে বেরিয়েছিলেন।
—কখন ফিরেছিল?
—বিকেল বিকেলই তো ফিরল। তারপর বাবা কর্নেল লাহিড়ির বাড়ি দাবা খেলতে চলে গেলেন।…ও হ্যাঁ দিদি, আর একটা কথা। যে ফোন করছিল, তার নাম্বার আমি পেয়ে গেছি। মানে টেলিফোন নাম্বার।
মিতিন এবার সত্যিই চমকেছে,—কী করে?
—অর্চিষ্মান কালই একটা আনসারিং মেশিন-কাম-কল রেকর্ডার এনে লাগিয়েছে টেলিফোনে। ওতেই উঠেছে নাম্বারটা। বলতে বলতে ছোট্ট পার্স খুলে একটা চিরকুট বের করল বিদিশা,—এই যে।
চিরকুটটা দেখল মিতিন। অফিসপাড়ার নম্বর। সঙ্গে সঙ্গে ডায়াল ঘোরাল। একবার দু’বান তিনবার…প্রতি বারই এনগেজড্। সম্ভবত কোনও পাবলিক বুথ। পরে যাচাই করে নিতে হবে। কিন্তু অর্চিষ্মান এরকম একটা মেশিন লাগিয়েছে, তাকে জানাল না কেন?
মিতিন টুকরো কাগজটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখল,—ওই মেশিনে ভয়েস রেকর্ড করা যায় না?
—যায়। তবে…আমি বাটন টিপতে ভুলে গেছি।
মিতিনের চোখের মণি স্থির হয়ে গেল—ভুলেই গেলে?
—না…মানে…লোকটার গলা শুনলেই এমন ভয় করে…আমাকে আজ অর্চিষ্মান খুব বকবে। বিদিশার গলা আবার কাঁপছে,—আপনি প্লিজ এবারকার মতো টাকাটা দিয়ে দিতে বলুন অর্চিষ্মানকে। লোকটা কথা দিয়েছে আর চাইবে না।
মিতিন বেশ বিরক্ত বোধ করল। গম্ভীর গলায় বলল,—তুমি কী চাও বলো তো? ব্ল্যাকমেলারটাকে ধরতে চাও? না টাকা দিয়ে মিটিমাট করে নিতে চাও?
বিদিশা উত্তর দিতে পারল না। কেমন বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।
মিতিন গলা আরও ভারী করল,—আমি তোমাকে যা বলতে বলেছিলাম, বলেছ? বলেছ, তোমার বর অর্কর কথা সব জেনে গেছে, তুমি আর তাকে ভয় পাও না?
বিদিশা দু দিকে মাথা নাড়ল।
—কেন বলোনি?
বিদিশা অস্ফুটে বলল,—মনে ছিল না।
—স্ট্রেঞ্জ! মিতিনের চোখ বড় বড়,—সত্যি করে বলো তো, লোকটা তোমায় প্রাণের ভয় দেখাচ্ছে, না অন্য কিছু বলছে?
চকিতে একবার মিতিনের দিকে তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিল বিদিশা,—আর কী বলবে?
—তুমি কিন্তু সত্যি কথা বলছ না বিদিশা। মিতিন ঢিলটা ছুড়ে দিল,—তুমি ব্ল্যাকমেলারটাকে আড়াল করতে চাইছ।
—আমি!
—ইয়েস, তুমি। আমি যেটা শিখিয়ে দিলাম, সেটা বলতে স্রেফ ভুলে গেলে, তোমার স্বামী তোমার জন্য রেকর্ডার কিনে আনলেন, ঠিক সময়ে চালানোর কথা তোমার মনে পড়ল না…! এক সপ্তাহ ধরে ভয়ে বাড়িতে বসে রয়েছ, নড়ছ না, অথছ ফোনটা পেয়েই দিব্যি সেজেগুজে নিজে গাড়ি চালিয়ে এতটা পথ চলে এলে শুধু বলতে, আমি যেন অর্চিষ্মানকে বলে ব্ল্যাকমেলারকে টাকাটা পাইয়ে দিই! নাহ্, আমার কেমন গণ্ডগোল লাগছে। এ কেস থেকে আমি হাত ধুয়ে ফেলছি। আমি এক্ষুনি তোমার বরকে সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, স্ত্রীর প্রাণ বাঁচানোই যদি শুধু উদ্দেশ্য হয়, তা হলে তিনি পয়সা দিয়ে পাহারাদার পুষুন। নয়তো পুলিশে যান।
রিসিভারে দিকে হাত বাড়াতেই খপ করে মিতিনের হাত চেপে ধরেছে বিদিশা,— প্লিজ দিদি…
—তুমি সব কথা খুলে বলছ না কেন? মিতিন আবার একটা ঢিল ছুড়ল,—বলো আমায়। কথা দিচ্ছি তোমার স্বামী জানবে না।
বিদিশা নিষ্পন্দ। নিথর। মাথা নিচু করে বসে আছে। কফি রেখে গেছে বিমলা, আপন মনে কাপ দুটো ধোঁয়া উড়িয়ে চলেছে।
মিতিন গলা একদম খাদে নামিয়ে ফেলল,—তুমি বড় নিষ্ঠুর মেয়ে বিদিশা। তোমার ভাল করতে গিয়ে একটা ছেলেকে মরতে হল, তুমি কি চাও না তার খুনি ধরা পড়ুক?
এবার বিদিশার গাল বেয়ে টপ টপ জল গড়াচ্ছে। ফুঁপিয়ে উঠল,—আমি খুব খারাপ মেয়ে…। আমি সব্বাইকে ঠকিয়েছি। আমার বরকে, শ্বশুরকে…। অর্চিষ্মান সব জানলে আমায় বাড়ি থেকে দূর করে দেবে।
—বলছি তো, কিচ্ছু জানবে না। তুমি শুধু আমায় বলো।
ধীরে ধীরে, থেমে থেমে, নিজেকে উন্মোচিত করল বিদিশা। শোনাল নিজের পূর্ব ইতিহাস, অরুণ মিহির ভাস্কর সকলের কথা। বলল, কেন সে এখনও ভয় পাচ্ছে ব্ল্যাকমেলারকে। মিতিনও প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। একটার পর একটা। মাঝের ফাঁকফোকরগুলো ভরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ভাস্করের সঙ্গে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের বিবরণ, ভাস্করের প্রতি বিদিশার সন্দেহ, পূষন অর্চিষ্মানের সঙ্গে ভাস্করের সম্পর্ক— কিছুই গোপন করল না বিদিশা।
মিহির অরুণকে সে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনছে না জেনেও তাদের হদিশ কোথায় পাওয়া যেতে পারে জিজ্ঞাসা করে নিল মিতিন।
কাহিনী শেষ করে নাক টানছে বিদিশা, চোখ মুছছে হাতের পিঠে। ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে মিতিনের দিকে, চোখ নামিয়ে নিচ্ছে।
মিতিন গুম হয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর প্রশ্ন কর,—তোমার এসব অতীত কাহিনী তোমার বাপের বাড়ির লোকরা জানে?
—না।
—দাদাও জানে না? সে তো তোমার প্রায় পিঠোপিঠি?
—কিছু কিছু হয়তো জানতেও পারে, বলতে পারব না। দাদার সঙ্গে আমার সেরকম ইন্টিমেসি ছিল না!
—তুমি বলেছিলে তোমার দাদার ঘরেই ট্রাঙ্কে ছিল বাক্সটা, সে কি তোমার লাভলেটারগুলো দেখেছিল?
—না। বাক্সটা মা অনেকদিন আগে আলমারিতে তুলে রেখেছিল। তাছাড়া চিঠিগুলো যেখানে ছিল, সেখান থেকে আমি ছাড়া আর কেউ বার করতে পারবে না।
—তুমি শিওর কেউ দেখেনি।
—মনে হয় না। দাদা দেখলে দাদার কথায় ঠিক প্রকাশ পেয়ে যেত। আমার দাদা একটু বেশি কথা বলে।
—হুঁ। মিতিন মাথা দোলাল,—তুমি বাড়ি চলে যাও। পৌঁছেই মিস্টার রুদ্রকে ব্ল্যাকমেলারের কথা জানিয়ে দিয়ো।
—বলব?
—ফোন যখন এসেছে, বলতে তো হবেই।…আমাকে প্রথম এসে যা বলেছিল, তাই বোলো।
—আপনার কাছে এসেছিলাম, বলব কি?
—যেচে বোলো না। পারলে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেয়ো।
—ঠিক আছে।
বিদিশাকে বিদায় জানিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এল মিতিন। বুমবুমের কার্টুনের খুব নেশা, বাপ ছেলে কার্টুন দেখছে টিভিতে। পার্থ অপাঙ্গে দেখল মিতিনকে। ঠোঁটের কোণে তার ইয়া বড় এক প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না।
মিতিন ভুরু নাচাল,—কী, আজ যে বড় আড্ডায় গেলে না?
পার্থ আড়মোড়া ভাঙল,—গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।
—কী মিথ্যেবাদী গো তুমি! সুন্দরী মেয়েটাকে দেখে সেঁটে গেলে, এটা বলতেও লজ্জা হচ্ছে?
পার্থ এতক্ষণে বিদিশা-প্রসঙ্গ তোলার ভরসা পেল। হাসছে,—যা বলেছ। অমন রূপসীকে দেখে আর নড়া যায়! এ যে একেবারে বসরাই গোলাপ।
—তুমি বসরাই গোলাপ দেখেছ?
—গল্প শুনেছি। তার নাকি যেমন গন্ধ, তেমন রূপ।
—হুঁ, গন্ধ আছে বটে। মিতিন মাথা দোলাল। সংক্ষেপে বিদিশা-উপাখ্যান শোনাল পার্থকে। বার বার কথাগুলো আওড়ালে তার একটা সুফলও আছে, কাহিনীর খুঁটিনাটিগুলো মস্তিষ্কে গেঁথে যায়।
পার্থর চোখ গোল গোল হয়ে গেছে। ছদ্ম আতঙ্কের সুরে বলল,—কী মেয়ের কেস করছ, অ্যাঁ? এ মেয়ে তো মেয়ে নয়, ডাকিনী নিশ্চয়।
—রূপ খুব সাংঘাতিক জিনিস, বুঝলে। রূপকে যদি কেউ পণ্য করে, তবে তার পরিণতি কখনই ভাল হয় না। এই মেয়ের ক্ষেত্রে আরও দুটো ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে। অশিক্ষা আর লোভ।
—আহা, ওভাবে দেখছ কেন? বিদিশাদেবী তাঁর রূপকে নিবেদন করতে চেয়েছেন। নানান দেবতার কাছে…
ব্যাপারটা সেই একই হল। নিজেকে ফুল বেলপাতা মনে করা, কিংবা কলা বাতাসা।…তবে হ্যাঁ, কেসটা এখন অনেক বেশি লজিকাল মনে হচ্ছে। ওই ব্ল্যাকমেলারকে এখনও ভয় পাওয়া, অর্চিষ্মানের সঙ্গে দূরত্ব…সবেরই জোরালো গ্রাউন্ড পাচ্ছি এখন।
—কিন্তু কেসটা একটু জটিল হয়ে গেল না? কতগুলো অচেনা চরিত্র এসে গেল! কাকে ছেড়ে কাকে ঘাঁটবে তুমি এখন? সব জায়গায় ট্যাপ করবেটা কী করে?
—হুঁ, ভাবছি…। মিতিন টিভির পর্দায় চোখ রাখল। এক ইঁদুরছানাকে তাড়া করছে একটা প্রকাণ্ড ভালুক। সম্ভাব্য অসম্ভাব্য অজস্র উপায়ে ভালুককে নাকাল করছে ইঁদুরছানা, একবার ভালুকের নাকের ভেতর ঢুকেও বেরিয়ে এল। বুমবুম হাততালি দিয়ে উঠল, হিহি হাসছে।
রাগে গরগর ভালুকটাকে দেখতে দেখতে মিতিন আনমনে বলল,—লুকোচুরিটা কে খেলছে জানতেই হবে। দেয়ার ইজ ওয়ান পার্টিকিউলার পারসন, এবং সে বিদিশার আদৌ অচেনা নয়…
—তুমি তো বললে বিদিশা কাকে সন্দেহ করছে! ওই ভাস্কর না কী যেন নাম? পার্থ টিভির সাউন্ড অল্প কমিয়ে দিল।
—হ্যাঁ, ভাস্কর। বিদিশার স্কুললাইফের প্রেমিক। তাকে তো বাজিয়ে দেখতেই হবে, কিন্তু কয়েকটা খটকা থেকে যাচ্ছে। যদি সে ব্ল্যাকমেলারই হয়, তা হলে দু দুবার ফোনে ভয় দেখানো, এমন কী টাকা দেওয়াটাও ফাইনালাইজড হয়ে যাওয়ার পর বিদিশাকে দেখা দিল কেন? অথবা বলা যায়, আদৌ তার দর্শনই বা মিলল কেন? তা হলে এমন কেউ কি আছে, যে ভাস্করকে শো করে বিদিশাকে বিভ্রান্ত করে দিতে চায়?
—তুমি কি পূষনের কথা বলছ?
—আমি পূষন অর্চনা দুজনের কথাই বলছি। অৰ্চনার সঙ্গে বিদিশার রিলেশনটা স্টাডি করতে হবে। পূষনকেও।
—আর সেই বাকি প্রেমিকগুলোকে?
—তাদের খোঁজও নিচ্ছি। কারণ একটা ব্যাপার পরিষ্কার, তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেও ব্ল্যাকমেলার অবহিত আছে। তাদের কারুর সঙ্গেও ব্লকমেলারের কানেকশান থাকাটা অসম্ভব নয়। এমন কী, ওদের কেউ ব্ল্যাকমেলার হলেও আমি অবাক হব না। বার্থ প্রেমিকরা প্রতিহিংসা থেকে কী করতে পারে, আর কী যে না করতে পারে…! তবে হ্যাঁ তাদের এখন খোঁজ করাটা…কে কোন লোকালিটিতে থাকে বিদিশা মোটামুটি বলে দিয়েছে। সুভাষ আর অজয়কে পাঠিয়ে তাদের আগে একবার তালাশ করে নিতে হবে।
—যাহ্ বাবা, তুমি ওই বজ্জাত ছোঁড়াটাকে একেবারে হিসেবের বাইরে করে দিলে? ওই চিত্রভানুটাকে?
—আমি কাউকেই হিসেবের বাইরে রাখিনি। বলতে কি, অর্চিষ্মান রুদ্রকেও নয়।
—অর্চিষ্মান? যাহ্, সে কেন হবে?
—কেন নয়? মুখে অর্চিষ্মান যতই বলুক, সে আদৌ অর্কর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত না, কথাটা সত্যি নাও হতে পারে। বিদিশার বক্তব্য অনুযায়ী অর্চিষ্মান অর্ককে দিঘায় দেখে থাকলেও থাকতে পারে। কারণ তার পরই অর্চিষ্মানের আচরণে সামান্যতম হলেও পরিবর্তন ঘটেছিল। অন্তত দিঘায়। মনে রেখো, দিঘা থেকে ফেরার পরই প্রথম ফোনটা আসে। তা ছাড়া বিদিশা, তার দাদা, তার বাবা, মা, প্রত্যেকের কথা থেকেই একটি ব্যাপার স্পষ্ট, অর্চিষ্মান একজন অত্যন্ত রাগী, এবং অহংবোধসম্পন্ন মানুষ। অর্ককে দেখেই হয়তো সন্দেহের জ্বালায় ওই ইঁদুর বেড়াল খেলাটা শুরু করেছিল অর্চিষ্মান! বউকে হয়তো সে যন্ত্রণাই দিতে চায়…
—কিন্তু টাকা? সে নিজের টাকা নিজেই নিচ্ছে? আই মিন নিয়েছে?
মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল,—শোন, অর্চিষ্মান রুদ্র খুব সহজ চিড়িয়া নয়। এই টাকা দেওয়া নেওয়াতে যেমন একজন কাল্পনিক ব্ল্যাকমেলারের অস্তিত্ব প্রমাণ হবে, তেমনি প্রবল মানসিক চাপে বিদিশার কিছু একটা ঘটে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিম্বা একটা কিছু ঘটে গেলে, এই যেমন অর্কর ঘটেছে, ওই ব্ল্যাকমেলিং ব্যাপারটাকে অ্যালিবাই হিসেবে খাড়া করতে পারবে অর্চিষ্মান। অ্যান্ড ফর দ্যাট রিজন, সে অনায়াসে সন্দেহের তালিকার বাইরে থেকে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু অর্থপ্রাপ্তিও ঘটবে অর্চিষ্মানের। মনে রেখো, মাত্র কদিন আগে বিদিশার নামে সে দশ লাখ টাকার একটা লাইফ ইনসিওরেন্স করিয়েছে।
—মাত্র দশ লাখ টাকার জন্য এত পয়সাঅলা একটা লোক বউকে হাপিস করে দেবে?
—খুবই সম্ভব। দুটো জোরালো গ্রাউন্ড আছে। টাকাপয়সার ব্যাপারে অর্চিষ্মান অতি ছ্যাঁচরা। সবিতাবাবু আমায় বলেছেন, দোকানের চুরির কেসটায় সে ইনসিওরেন্স কোম্পানি থেকে কুড়ি হাজার টাকা ক্লেম আদায় করেছে। অথচ সবিতাবাবু ডেডশিওর সেদিন ক্যাশবক্সে হাজারের বেশি ছিল না। কয়েকটা ফল্স ফার্নিচারের বিল এনট্রি করিয়ে…। মাত্র কুড়ি হাজারের জন্য যে এই কাজ করতে পারে, সে দশ লাখের জন্য কোথায় নামবে? সেকেন্ডলি, যদি অর্ককে সে দিঘায় দেখে থাকে, তার মতো ইগোটিস্ট লোকের পক্ষে সেটা নির্বিবাদে হজম করা কঠিন। কী, ঠিক বলছি?
—তা বলে মেরেই ফেলবে? পার্থ মাথা নাড়ল,—আমার তো মনে হয়েছে অর্চিষ্মান বিদিশাকে ভালইবাসে।
—তো কী! ভালবাসা একটা জটিল সমীকরণ মশাই। ওথেলো কি ডেজডিমোনাকে ভালবাসত না?
বুমবুম কার্টনের ফাঁকে ফাঁকে বাবা মার কথা শুনছিল। পুট করে বলে উঠল,— মোনালিসা আমায় ভালবাসে না মা।
কথাটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল মিতিনের। হাসি চেপে বলল,—কে মোনালিসা?
—আমার বন্ধু। আমাদের ক্লাসে পড়ে। মোনালিসা শুভমকে ভালবাসে।
—কী করে বুঝলি?
—মোনালিসা শুভমকে রোজ লজেন্স দেয়। আমায় দেয় না।
—অ। তো?
—আমি দুজনকেই স্লিপ থেকে ফেলে দেব।
মিতিন এবার সত্যি সত্যি গোমড়া হয়ে গেল। নীরস স্বরে পার্থকে বলল,—দেখেছ তো ভালবাসার মহিমা!
[সাত]
সকালবেলা ডাইনিং টেবিলে বসে ছেলেকে খাওয়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল মিতিন। চেষ্টা তো নয়, রীতিমতো যুদ্ধ। স্বহস্তে দুধে কর্নফ্লেক্স মিশিয়ে ছেলের মুখে চামচ ঠেসে ধরবে মিতিন,—বুমবুম প্রাণপণে থু থু করবে, ওমনি মিতিন ঠাস ঠাস চড় কষাবে বুমবুমকে, এটা মোটামুটি এক প্রাত্যহিক লড়াই।
আজ অন্য পন্থা নিয়েছে বুমবুম। মুখ টিপে আছে, কিছুতেই হাঁ করছে না।
মিতিন গনগনে চোখে তাকাল,—খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। তুমি ভীষণ খারাপ ছেলে হয়ে যাচ্ছ…
পার্থ এখনও বাজারে যায়নি। আজকের সব ক’টা কাগজ খুলে কালকের শব্দজব্দর উত্তর মেলাচ্ছে। মা ছেলের লড়াই তার গা-সওয়া, সে এতে অংশগ্রহণ করে না।
কী মনে হতে প্রশ্ন ছুড়ল,—কাল অত রাতে কে ফোন করেছিল গো?
মিতিন ছেলের নাক চেপে ধরে মুখে চামচ ঢুকিয়ে দিল,—রুদ্রমশাই, আবার কে।
—কী বলছিল? দু লাখটা পাঁচ লাখ হয়ে গেল কেন?
—ওই রকমই। খুব গজগজ করছিল। জিজ্ঞেস করছিল, টাকাটা রেডি রাখতে হবে কিনা।
—তুমি কী বললে?
—ব্ল্যাকমেলারটার মতোই বললাম। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ঠিক সময়ে জানিয়ে দেব।
—তোমারও কিন্তু এই মওকায় ফি বাড়িয়ে নেওয়া উচিত। দু লাখে যদি পঞ্চাশ হাজার হয়, পাঁচ লাখে সওয়া লাখ। নিদেনপক্ষে এক। অ্যাডভান্সটাও নিয়ে রাখো। ও যদি কালপ্রিট হয় আর কিচ্ছু জুটবে না।
মিতিন ছেলেকে আলগা ঠোনা মেরে আর এক ঢোক সদুগ্ধ ভুট্টাকুচি খাওয়াতে যাচ্ছিল, ফোন বেজে উঠেছে।
পার্থ ধরল। মুহূর্ত পরেই রিসিভারে হাত চেপে বলল,—নাও, শয়তানের নাম করতেই শয়তানের গলা। তোমার রুদ্রমশাই।
আঁচলে হাত মুছে মিতিন এসে রিসিভার তুলল,—বলুন?
—আবার একটা ঝঞ্ঝাট পেকেছে ম্যাডাম। অৰ্চিষ্মানের স্বর বেশ উত্তেজিত।
—কী হল?
—রবি মিসিং।
মিতিন খুব একটা চমকাল না। ঠাণ্ডা গলায় বলল,—কখন থেকে?
—কাল তো ব্যাটা কাজে আসেনি। আজ সকালে ওর বউ এসে হাজির, বলছে, গতকাল নাকি কাজে যাচ্ছে বলে বেরিয়েও ছিল। এখানেও আসেনি, রাতে বাড়িও ফেরেনি। কী করি বলুন তো?
—কী আর করবেন! বউটাকে নিয়ে গিয়ে থানায় একটা ডায়েরি করুন।…আপনি তো রবিকে নিয়ে খুব একটা বেরোন না, তাই না?
—খুব কম। কখনও সখনও কাজ থাকলে দোকানে ডাকি। ও তো এখন আছেই শুধু বাবা আর বিদিশার জন্য।
—পরশু দিন তো কাজে এসেছিল। আপনার সঙ্গে তখন দেখা হয়েছে?
—ওই সকালে বেরনোর সময়ে একবার।
—তখন কিছু বলেছিলেন নাকি? গয়নার বাক্সর কথা…?
অর্চিষ্মান নীরব।
একটুক্ষণ থেমে আছে অর্চিষ্মান। তারপর গলা শোনা গাল,—হ্যাঁ…মানে…মানে জেরার মতো করেছিলাম আর কি।
—বকাবকি করেছিলেন? পুলিশের ভয় দেখিয়েছিলেন?
অর্চিষ্মান নীরব।
মিতিন বিরক্ত স্বরে বলল,—আপনাকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে বারণ করেছিলাম মিস্টার রুদ্র।
—এ কী বলছেন? আমার চাকর, আমার ড্রাইভার…তাদের আমি প্রশ্ন করতে পারব না? আপনার কাজের সুবিধে করে দেওয়ার জন্যই তো…
—ব্যাপারটা আমার ওপরই ছেড়ে রাখা উচিত ছিল। যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, আমি দেখছি কী করা যায়। আপনি এখন আছেন বাড়িতে?
—আধঘণ্টাটাক আছি। আজ রোববার, দোকানে যেতেই হবে। নিলামের দিন…। আমার থাকাটা কি জরুরি?
একটু ভাবল মিতিন,—নাহ্ আপনি ডায়েরি করে চলে যান।
—বাবা খুব উতলা হয়ে পড়েছেন।…মুস্তাফি সাহেবকে কি একবার জানিয়ে রাখব?
—এক্ষুনি প্রয়োজন নেই।
—আর একটা কথা। আমার একটু তাড়া আছে…বাবা যদি রবির বউটাকে নিয়ে থানায় যান?
—যেতে পারেন। তবে বউটা এখন যেন চলে না যায়। আপনাদের ওখানেই থাকে।
—ঠিক আছে।…রবি মিসিং হলে কি আপনার খুব অসুবিধে হয়ে যাবে ম্যাডাম?
—দেখা যাক। বাই।
টেলিফোন রেখে একটুক্ষণ থম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিতিন। তারপর ফোন তুলে পটপট ডায়াল ঘোরাল,—অনিশ্চয় তালুকদার আছেন?
—কে বলছেন?
—প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়।
ক্ষণপরেই দূরভাষে অনিশ্চয় কণ্ঠ,—মর্নিং ম্যাডাম। সক্কাল সক্কাল…কী সংবাদ?
—আপনার একটু হেলপ চাই দাদা।
—সে তো বুঝেই গেছি। প্রয়োজন ছাড়া কি আমাকে স্মরণ করা হয়? কী কেস?
—একজনের বাড়ির ড্রাইভার গায়েব হয়েছে।
—আপনি কি আজকাল এই সব কেস করছেন?
—পেটের ধান্দা দাদা, কী করব বলুন?
—গাড়ি নিয়ে ভেগেছে? না গাড়ি ছাড়া?
—গাড়ি ছাড়া।
—গাড়ির পার্টস টাট্স সব যথাস্থানে আছে? ব্যাটারি? তেল?
—ওসব কিছু নয় দাদা। এটা একটা জটিল কেসের অংশ। মূল কেসটা আপনাকে পরে ডিটেলে বলব। মিতিন গলাটা আদুরে আদুরে করল,—আপাতত দাদা একটা কাজ আমার করে দিতেই হবে। আমার লোকের ড্রাইভার যে বাড়িতে চাকরি করত, সে বাড়ির লোকজনকে একটু ইন্টারোগেট করতে যাবে। লোকাল থানাকে বলুন কাইন্ডলি একজন কাউকে সঙ্গে দিতে।
—কোন থানা?
—সল্টলেক।
—ঝামেলা করলেন, সে তো আবার ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ।…ঠিক আছে, দেখছি। আপনার সেই ওই কেসটার কী হল? গয়না চুরি?
—ওটা শুক্রবারই মিটে গেছে। শুক্রবার গেছিলাম। মধ্যমগ্রামে। অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। বাড়ির গিন্নির বখা ভাইপোটাই গয়না সরিয়েছিল। গিন্নি গার্ড দিচ্ছিল ভাইপোকে।
—আপনি তো দেখছি কেলেঙ্কারি করে ফেলছেন। আমাদের ভাতরুটি গেল, হেঁ হেঁ হেঁ।
—কী যে বলেন দাদা? আপনারা শত কাজে বিজি থাকেন, আমরা একটু আপনাদের কাজ হালকা করি মাত্র।…তা হলে দাদা সল্টলেকের ব্যবস্থাটা করে দিচ্ছেন তো? ড্রাইভারটার নাম রবি, মালিকের নাম অর্চিষ্মান রুদ্র…
—কী রুদ্র?
— অর্চিষ্মান।
—অর্চিষ্মান? সূর্যের নাম? মনে থাকবে।
টেলিফোন রাখতেই কাগজের আড়াল থেকে পার্থ বলে উঠল,—লোকটাকে খুব কে-কে থিয়োরি দিয়ে ম্যানেজ করে যাচ্ছ, অ্যাঁ?
—মানে?
—কামিনী-কাঞ্চন থিয়োরি। কাঞ্চন তো নেই, কামিনীটাই মারছ।
—বাজে কথা বোলো না তো। মিতিন চোখ পাকিয়ে তাকাল,—যারা উইথ ইনটিগ্রিটি কাজ করে, তাদের ওসব কোনও থিয়োরি অ্যাপ্লাই করার দরকার হয় না। ওঠো তো, কাগজ পেনসিল নিয়ে না বসে চটপট বাজার সেরে এসো। আমি চাউমিন বানিয়ে রাখছি, খেয়েই বেরিয়ে পড়বে।
—কোথায়? পার্থ আকাশ থেকে পড়ল।
—প্রথমে সল্টলেক থানা, সেখান থেকে বিদিশাদের বাড়ি। রবি হাওয়া। গাইডলাইন তৈরি করে দিচ্ছি, সেই অনুযায়ী ওদের বাড়ির সকলকে ডিটেল জেরা করবে। বিদিশা, বিদিশার শ্বশুর, কাউকে ছাড়বে না। গাইডলাইনের বাইরে প্রশ্ন করতে পাবো, কিন্তু ব্ল্যাকমেলিং নিয়ে একটাও কথা নয়। আর মাথায় রাখবে, তুমি তখন পুলিশের লোক।
—রবিবারের সকালে পুলিশের লোক সাজাবে?
—অসুবিধে কি? তুমি তো নাটকে সব কিছুই সাজো।
বুমবুম খাওয়া ফেলে লাফিয়ে উঠল,—আমি পুলিশ হব। আমি বাবার সঙ্গে যাব।
—না। মিতিন আলগা ধমক দিল ছেলেকে,—তুমি এখন সবটুকু খেয়ে পড়তে বসবে। তোমাকে আমি সামনের রবিবার দিদার বাড়ি নিয়ে যাব।…আর মনে আছে তো, কাল স্কুলে গিয়ে আগে মোনালিসা আর শুভমের সঙ্গে ভাব করে নেবে? নইলে আমি কিন্তু কোত্থাও বেড়াতে নিয়ে যাব না।
বুমবুমের মুখ বেজার হয়ে গেল। পার্থ অবশ্য বাধ্য ছেলের মতো উঠে পড়েছে, পাঞ্জাবি ছড়িয়ে থলি হাতে বেরিয়ে গেল।
মিতিন রান্নাঘরে এল। জলে নুন ফেলে ডেকচি গ্যাসে বসাল, জল ফুটলে নুডল্স ছাড়বে। ছুরি দিয়ে বিন আর গাজর কুচি কুচি করছে।…রবিকে কি অর্চিষ্মানই সরাল? রবিকে দিয়েই কি চিঠিগুলো চুরি করিয়েছিল অর্চিষ্মান? কিন্তু তা হলে রবিকে জেরা করার কথাটা কেন চেপে গেল না? কথাটা হয়তো মিথ্যেও হতে পারে। হয়তো নিজেই কায়দা করে সরিয়ে দিয়ে এখন নিজের একটা বোকাচালাক ইমেজ খাড়া করতে চাইছে।…মিতিন দ্রুত হাতে পেঁয়াজ কুচোতে শুরু করল। হাত চলছে, মাথাও চলছে।…বাক্সটা পাওয়ার পর নয় অরুণ মিহিরের কথা অর্চিষ্মান জেনেছিল, কিন্তু তার আগে বিদিশাকে ফোন করেছিল কী করে? শুধুই অর্ককে দেখে? ঝট করে হঠাৎ কলরেকর্ডারই বা কিনল কেন? ভাস্করের সঙ্গে অর্চিষ্মনের ভাল পরিচয় আছে। কিন্তু কতদিনের? ভাস্কর কি কিছু…? মিহির অরুণের কথা ভাস্কর কতটা জানে?…
জল ফুটে গেছে। গাজর বিন জলে ফেলল মিতিন। হাঁক দিল,—বিমলা…?
বিমলা বিছানা তুলছিল। রান্নাঘরের দরজায় এল।
—তুই সুভাষের বাড়িটা চিনিস?
—হ্যাঁ, এই তো দাসপাড়ায়। মিষ্টির দোকানের গলিটায়।
—টক করে একবার যা তো। সুভাষকে বল আমি ডাকছি। জলদি ফিরবি, পথে আবার দাঁড়িয়ে আড্ডা মারিস না।
বিমলা উড়তে উড়তে চলে গেল।
রবিবারের অলস সকাল হঠাৎই দারুণ কর্মব্যস্ত এখন। বাজার থেকে ফিরে খচাখচ দাড়ি কামাল পার্থ। মিতিন চাউমিন বানিয়ে ফেলেছে, টেবিলে খাবার সাজিয়ে চলে গেছে স্টাডিতে, তৈরি করে দিচ্ছে পার্থর কাগজপত্র।
পার্থ বেরিয়ে যেতে মিতিন খানিক হাঁপ জিরোল। চা খেতে খেতে চোখ বোলাচ্ছে খবরের কাগজের পাতা। বিমলাকে রান্না বুঝিয়ে এবার স্নানে ঢুকবে। বুমবুমকেও করাবে স্নান।
সুভাষ এল কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। বছর তিরিশ বয়স, দারুণ চটপটে, কথাবার্তায় তুখোড়, চেহারায় তেমন ঔজ্জ্বল্য না থাকলেও বেশ বুদ্ধির ছাপ আছে। ছুটির দিনে ডাক পড়েছে বলে এতটুকু অসন্তুষ্টি নেই মুখে।
মিতিন বলল,—আজই কয়েকটা কাজ করতে হবে সুভাষ। দুটো লোকের এগজ্যাক্ট অ্যাড্রেস চাই। কাছেই, ভবানীপুর কালীঘাটের মধ্যেই। থার্ড আর একজন, মোটামুটি লোকালি নোন, পলিটিকালি ওয়েল কানেকটেড…এর সম্পর্কে বিশদ খবর চাই। মানে লোকটার টাকাপয়সা কেমন, নারীদোষ আছে কি না, কীসের কীসের ব্যবসা, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব কারা, আচার ব্যবহার কেমন, এই সব। দুটো লোকের ফোন নাম্বার দিচ্ছি। অচিষ্মান রুদ্র আর পূষন রায়। এদের যে কাউকে রিং করে লোকটার অ্যাড্রেস বার করতে পারো।…কাজগুলো খুব আরজেন্ট কিন্তু।
সুভাষ সব বুঝে নিয়ে বলল,—কালীঘাট পার্কের পিছনেরটা…মানে ওই মিহির সরকার…এটা চটপট হয়ে যাবে। ওখানে আমার প্রচুর চেনা।
—গুড। বেরিয়ে পড়ো।…ও হ্যাঁ, আর একটা ফোন নাম্বার রাখো। আমার মনে হচ্ছে এটা পাবলিক ফোন, তোমাকে এক্সচেঞ্জে গিয়ে ভেরিফাই করতে হবে। এ কাজটা অবশ্য কাল করলেও চলবে।
বুমবুমের এ বি সি ডি লেখা অনেকক্ষণ শেষ। ঘুরঘুর করছে টিভির আশেপাশে, সাহস করে কিছু বলতে পারছে না। ছেলেকে কাছে ডেকে আদর করল মিতিন, টিভির কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে দিল। আহা রে, ছেলেটা কাল থেকে বড্ড বকুনি খাচ্ছে।
পার্থ ফিরল প্রায় দুটো নাগাদ। খাওয়া দাওয়া সেরে, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে মিতিন তখন স্টাডিরুমে বসে দীপক ভাল্লা কেসের খুঁটিনাটি লিখছিল।
টেবিলে একতাড়া কাগজ ফেলে দিল পার্থ—এই নাও তোমার সব রিপোর্ট।
—এর মধ্যে হয়ে গেল?
—কী এমন ছাতার মাথা কাজ? গেলাম, সবাইকে প্রশ্ন করলাম, চলে এলাম।
—রবির বাড়ি দেখে এসেছ?
—ফেরার পথে গেছিলাম।
—কী দেখলে?
—সব লেখা আছে।…আমাকে আর ডিসর্টাব কোরো না, এক্ষুনি খেয়ে রিহার্সালে ছুটতে হবে। কাল যাইনি, আজ দেরি হলে অমলদা কান মুলে দেবে।
—প্রভাকর দত্তর কথাটা মাথায় রেখো। আমার হাতে কিন্তু আর একদম সময় নেই।
—জানি।
দীপক ভাল্লা সরিয়ে রবি খাঁড়াতে মনোযোগী হল মিতিন। প্রত্যেকের জবানবন্দি আলাদা আলাদা পাতায়। পড়তে পড়তে দরকারি অংশগুলো টুকছে মিতিন, সাজাচ্ছে মনোলগের ঢঙে। নাম ধরে ধরে।
দিননাথ—রবিকে আমিই ড্রাইভার হিসেবে বহাল করেছিলাম। বছর আষ্টেক আগে অ্যাম্বাসাডার বেচে মারুতি কিনি, তখন থেকে আছে। হাজারে ঢুকেছিল, এখন মাইনে বাইশশো। রবিকে পাঠিয়েছিল আমার জামাই। সম্ভবত রবি ওর কারখানার কোনও কর্মচারীর রিলেটিভ। আমার আগের ড্রাইভার বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। চোখেই দেখত না, তাই…। হাওড়া জেলায় রবির বাড়ি, আমতার দিকে। গ্রামের নামফাম জানি না। এখানে ফুলবাগানে ভাড়া থাকে, সে বাড়িও দেখিনি। ড্রাইভার হিসেবে রবি ভালই, হাত পাকা, নম্র ভদ্র, তবে একটু অলস প্রকৃতির। বাড়ির ডিউটি, কাজ কম, মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক কোথায় চলে যেত। আমি ইদানীং গাড়ি বড় একটা ব্যবহার করি না। আমার গানবাজনা শোনার শখ আছে। কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর শখটাই এখন নেশা। ফাংশানে গেলে অনেকক্ষণ লেগে যায়, শুধু শুধুই ড্রাইভার অতক্ষণ আটকে রাখার আমি পক্ষপাতী নই। বিদিশাই ওকে নিয়ে বেরোয় বেশি। শুক্রবার দুপুরে ঘণ্টাখানেকের জন্য বেরিয়েছিলাম আমি। টেপরেকর্ডারটা গণ্ডগোল করছিল, শ্যামবাজার মোড়ে একটা চেনা দোকানে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। একটু যেন তখন মনমরা ছিল, কারণ জিজ্ঞেস করিনি। নেশাভাঙ করত কিনা আমার জানা নেই। প্রেম করে ভেগেছে বলে আমার মনে হয় না। কুসঙ্গেও পড়তে পারে। হ্যাঁ, বিশ্বাসী ছিল।
পদ্মপাণি—রবি আগে আমায় খুব মান্যিগন্যি করত। বউদিমণি আসার পরে বদলে গেছিল। কামাই করেছ কেন জিজ্ঞেস করলে ফক্কুড়ি করত, ঠিক জবাব দিত না। মাঝে মাঝে ঘুরতে যেত কোথায়। বলত, কাজ নেই বসে বসে কী খই ভাজব! কোথায় যেত বলতে পারব না। দাদাই ওকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে। কর্তাবাবুকে অবশ্য ভয় পায় খুব, তিনি ডাক পাঠালে হাঁই হাঁই করে দৌড়ত। কর্তাবাবু কোনও ড্রাইভারকেই বেশি খাটাতে ভালবাসেন না। দোকান থেকে ফিরতে রাত হলে কর্তাবাবু ট্যাক্সিতেই ফিরতেন। শুনেছি অল্পস্বল্প মদ খেত রবি। মেয়েমানুষের দোষ আছে বলে আমার মনে হয় না। শুক্রবার কখন গেছে দেখিনি।
সুমতি—সংসারী মানুষ ছিল। বউ মেয়েকে খুব ভালবাসত। এবার পুজোয় বউ-এর জন্য কী দামি একখানা কাপড় কিনেছে, তিন মেয়ের জন্য ভাল ভাল জামা। কদিন আগে দেশে জমি কিনেছে। এমন মানুষ সব ছেড়ে পালাবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। পরশু চলে গিয়েও একবার ফিরে এসেছিল। এই রাত সাতটা আটটা নাগাদ। বলছিল কী বোনাসের জন্য এসেছে। মুখটা তখন ভার ভার ছিল।
মানদা—চা খেতে এসে রবিদাদা গল্প করত খুব। ঘরসংসারের কথাই বলত বেশি। আর একটা কথাও বলত। বউদিমণি এসে নাকি ওর কপাল ফিরে গেছে। বউমণি খুব টাকাপয়সা দিত বোধহয়। শুক্রবার কখন গেছে বলতে পারব না।
দেবলা খাঁড়া—আমাদের অনেকদিন বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ের বয়স ষোলো। মেজ চোদ্দো। ছোট দশ। চাপা স্বভাবের লোক আমার স্বামী, বাইরের কথা ঘরে এসে বলত না। বড় মেয়ের সম্বন্ধ দেখেছিল একটা, দেনাপাওনা নিয়ে কথা চলছিল। রোজ রোজ নেশা করত না, তবে পরশু রাতে চুর হয়ে ফিরেছিল। সকালেও গম্ভীর ছিল খুব। বেরনোর আগে বলেছিল আমার যদি কখনও কিছু হয়ে যায় মালিকদের কাছে যাস। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মানুষ নয়।
এই পর্যন্ত লিখে থামল মিতিন। বিদিশার বয়ানে আলগা চোখ বোলাল, লিখল না কিছু। রবির বাড়ির বর্ণনাটাও পড়ে নিল একবার। ফুলবাগানে প্রায় বস্তি এলাকায় দেড় কামরার বাসা। দেওয়াল পাকা, মাথায় টিনের চাল। চাকচিক্যহীন, তবে সম্প্রতি সাদাকালো টিভি কিনেছে একটা। একটা স্টিলের পুরনো আলমারি আছে।
কাগজগুলো ফাইলে ঢুকিয়ে একটুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল মিতিন। দুপুর ফুরিয়ে এসেছে, পার্টিশানের গায়ে কাটা ছোট্ট জানলা থেকে সরে গেছে আলো, ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে ফালি জায়গাটুকু।
হাত বাড়িয়ে টেবিলল্যাম্পটা জ্বালল মিতিন, নেভাল, আবার জ্বালল। ভাবছে। একটা সূক্ষ্ম আলোর রেখা যেন দেখা যায় না?
মিতিন আবার ফাইল খুলেছে। আবার ডুবল জবানবন্দিতে।
[আট]
সোমবারই ভাস্কর সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়ে গেল মিতিন। পাস্ট লাফই মোটেই সুবিধের নয়, ছিঁচকে চুরির বদনাম ছিল এক সময়ে, সম্ভবত পুলিশ রেকর্ডে নাম আছে। মোটামুটি ভদ্র বাড়িরই ছেলে, মামা বা কাকা কারুর সুবাদে বছর পাঁচেক আগে এক নামী নেতার পার্শ্বচর বনে যায়, তারই ল্যাংবোট হয়ে দিল্লি প্রস্থান, বেশ কিছুকাল রাজধানীতে কাটিয়ে দেড় দু বছর হল আবার ফিরেছে কলকাতায়। রাজনৈতিক দাদাদের আশীর্বাদে ভাস্কর এখন রীতিমতো ক্ষমতাবান মানুষ। সকলেই জানে ব্যবসা করে, কিন্তু কী ব্যবসা কেউ জানে না। মদ্যপান, নারীসঙ্গ, কোনও গুণেরই তার ঘাটতি নেই। তবে সে লোক খারাপ নয়, বেশ দিলদরিয়া টাইপ, বেশ কয়েকটা বড় সড় গানের জলসা বসিয়েছে পাড়ায়, রক্তদান শিবির করেছে, পুজোয় বিজ্ঞাপনও দিয়েছে প্রচুর টাকার, পাড়ার ছেলেছোকরারা তাকে ভালই বাসে। বাজারে গুজব, ভাস্কর এবার কাউন্সিলার ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে।
মিহিরের ঠিকানাও জোগাড় করে এনেছে সুভাষ। কালীঘাট পার্কের পিছনের রাস্তাতেই থাকে মিহির, ভাড়া বাড়িতে, মা বাবা দাদা বউদি সকলের সঙ্গে। সে এখন নামজাদা কোম্পানির সেলসম্যান, সকাল নটায় বেরিয়ে যায়, ফেরে সাড়ে সাতটা আটটায়। অতি সম্প্রতি বিয়ে করেছে মিহির, গত শ্রাবণে।
অরুণের খোঁজ পেতে অবশ্য সুভাষের কালঘাম ছুটে গেছে। কে এক নগণ্য অরুণ কবে যদুবাজারের ফুটপাথে চুড়ির দোকান দিয়েছিল, কোন কালে তা উঠেও গেছে, কে আর তার খবর রাখে! তার ওপর এখন পুজোর ভিড়, দোকানদাররা খদ্দের নিয়েই মজে আছে, কেউ কোনও উত্তরই দিতে চায় না। অনেক ঘুরে শেষে অরুণের এক কাকার সন্ধান পেয়েছে সুভাষ! হাওড়ার মঙ্গলাহাট থেকে বাচ্চাদের জামাপ্যান্ট কিনে এনে যদুবাজারে বেচেন তিনি, ছোট্ট একটা দোকানে বসে। অরুণের হাল সাকিন তিনি দিয়েছেন বটে, সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়ি ঝুড়ি নিন্দেও করেছেন ভাইপোর। সে এখন নাকি বিয়ে করে ঘরজামাই, থাকে অশোকনগরে। একেবারে বউ-এর পা-চাটা বনে গেছে সে, বছরে একবার কাকা কাকির মুখ দেখতে আসারও সময় পায় না, অথচ এই কাকাই তাকে এক সময়ে…
খবরগুলো নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা করল মিতিন। তারপর বিকেল নাগাদ অভিযানে নেমে পড়ল। প্রথমে ভাস্করের বাড়ি।
চিনতে বিশেষ অসুবিধে হল না। হাজরা বোডের ওপরই দোতলা বাড়ি। পুরনো, তবে জরাজীর্ণ নয়, সদ্য রঙও করা হয়েছে।
দরজা হাট করে খোলা। সামনেই বৈঠকখানা ঘর, সেখানে জনা পাঁচ ছয় যুবক কথা বলছে উচ্চৈঃস্বরে।
মিতিন দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল,—ভাস্করবাবু আছেন?
এক ত্রিশ বত্রিশের সুদর্শন যুবক উঠে এল,—বলুন। আমিই ভাস্কর।
—আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। পারসোনাল।
ভুরু কুঁচকে মিতিনকে দু এক সেকেন্ড দেখল ভাস্কর। তারপর ভেতর দিকে হাত দেখিয়ে বলল,—আসুন।…আমি আগে এদের সঙ্গে কথাটা সেরে নিই।
কোণের গদিঅলা চেয়ারে বসল মিতিন। ভাস্কর যুবকদের সঙ্গে কথা বলছে আবার, তবে তার স্বর আর তেমন উচ্চ নয়। পাড়ার পুজো নিয়ে আলোচনা চলছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ হঠাৎ মিতিনের দিকে দৃষ্টি চলে আসছে ভাস্করের। অস্বস্তিকর চাউনি, তবু চোখ সরাচ্ছিল না মিতিন। মাঝে মাঝে আলগা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল চারদিকে। দেওয়ালে অজস্র ছবি। প্রায় ছবিতেই ভাস্কর, কোনও না কোনও মন্ত্রীর সঙ্গে। একটা মা কালীর ছবিও ঝুলছে, পাশে কোনও এক গেরুয়াধারী বাবা। দুটো ফ্রেমেই টাটকা জবার মালা।
মিনিট দশেকের মধ্যে ছেলেগুলো উঠে গেল। একজন দরজা থেকে বলল,—তা হলে ভাস্করদা, আমরা লাইটের লোককে কিন্তু অ্যাডভান্স করছি না?
—দরকার নেই। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে।
ঘর ফাঁকা হতে ভাস্কর আবার সোফায় এসে বসল। মুখে ঈষৎ হাসি মাখিয়ে বলল,— ইয়েস ম্যাডাম? বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি?
মিতিন হাসল না। কেজো গলায় বলল,—আমি বিদিশার কাছ থেকে আসছি। আমি বিদিশার বন্ধু।
হাসিটা থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে,—কে বিদিশা?…আপনি কোন বিদিশার কথা বলছেন?
—আমি অর্চিষ্মান রুদ্রর স্ত্রীর কথা বলছি।
—ও। অর্চিষ্মান রুদ্র! আই মিন অক্শনিয়ার!..হ্যাঁ, বলুন।
—আপনার সঙ্গে বিদিশার কয়েক দিন আগে দেখা হয়েছিল?
—হ্যাঁ। হয়েছিল। পূষনবাবু…পূষন রায়ের মেয়ের জন্মদিনে। কেন বলুন তো?
মিতিন ভাস্করের চোখে চোখ রেখে বলল,—বিদিশাকে কেউ একজন ফোনে ভয় দেখাচ্ছে। বিদিশার ধারণা ওটা আপনি।
ক্ষণিকের জন্য চোখে মুখে একটা অবিশ্বাস ফুটে উঠল ভাস্করের। পরক্ষণেই হো হো হেসে উঠেছে,—আমি? আমি বিদিশাকে ভয় দেখাব? কেন?
—কারণটা আপনিই ভাল জানেন।
—না। জানি না।
—আপনার সঙ্গে বিদিশার পূর্ব পরিচয় ছিল, অস্বীকার করতে পারেন?
—কেন অস্বীকার করব? কিন্তু সেটা তো একটা ক্লোজড চ্যাপটার। বহুকাল আগেই চুকে বুকে গেছে।…আপনার বান্ধবীর ওপর আমার আর কণামাত্র আকর্ষণ নেই। হ্যাঁ…সেদিন অবশ্য আমি বিদিশাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি বিদিশার মতো একটা মেয়ে ওরকম একটা জম্পেশ হাজব্যান্ড জুটিয়ে ফেলেছে।
—বিদিশার মতো মেয়ে বলছেন কেন? বিদিশা কীসে কম?
—আপনার বন্ধুর সম্পর্কে আজে বাজে কমেন্ট করলে কি আপনার শুনতে ভাল লাগবে?…অত্যন্ত চিপ টাইপের মেয়ে।
মিতিন চোখের কোণ দিয়ে তাকাল,—আপনিও এমন কিছু দামি মানুষ নন!
মিতিন ভেবেছিল মন্তব্যটায় উত্তেজিত হয়ে পড়বে ভাস্কর। কিন্তু ভাস্কর সেদিকে গেলই না। মুচকি মুচকি হাসছে। সিগারেট দেশলাই বের করল পকেট থেকে, তবে সঙ্গে সঙ্গে ধরাল না। কপাল নাচিয়ে বলল,—কেসটা কী খুলে বলুন তো দেখি?
—একবার তো বললাম। সামওয়ান ইজ থ্রেটনিং হার।
—ঠিক আছে, ধরুন আমিই থ্রেট করছি। দেন?
—তা হলে বিদিশা পুলিশে খবর দিতে বাধ্য হবে।
—দিক। তা না করে আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে কেন? আবার জোরে হেসে উঠল ভাস্কর। হাসতে হাসতেই বলল,—আপনি কি শিওর আপনার বন্ধুকে কেউ ফোন করছে? মানে সত্যি সত্যি করছে?
—কেন? এ কথা বলছেন কেন?
—আমার তো মনে হচ্ছে, বিদিশা আমার সঙ্গে আবার রিলেশান তৈরি করতে চায়। পূষনবাবুর পার্টিতে ওর হাবভাব দেখে আমি আঁচ করেছিলাম। আমাকে না চেনার ভান করছে, ওদিকে আবার ঘুরে ঘুরে আমাকেই দেখছে…। ভাস্কর ফস করে সিগারেট ধরাল,—আপনাকে দূত করে পাঠায়নি তো?
লোকটার তো নিজের সম্পর্কে ভারী অহংকার? ঘুরপথে ক্ষমতা এসে গেলে এরকমই হয়, মানুষকে তখন আর মানুষ জ্ঞান করতে ইচ্ছে করে না।
ভাস্কর আবার বলল,—ও কি অর্চিষ্মান রুদ্রকে নিয়ে হ্যাপি নয়? অবশ্য না হওয়ারই কথা।..যা একখানা চিজ!
—কেন? তিনি কী করেছেন?
—হেভি মক্ষিচুষ। পিঁপড়ের পেট টিপে মধু খাওয়া পার্টি। তারপর আবার সন্দেহবাতিক। ভাস্কর লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল,—কিছুদিন আগে বার নিয়ে একটা ট্যাক্সের কেসে ফেঁসেছিল। পূষনবাবু…মানে ওর দিদির হাজব্যান্ড নিয়ে এসেছিল আমার কাছে। আমি সামহাউ ম্যানেজ করে দিই। তখনই দেখেছি দু পয়সা বের করতে চায় না, সব সময়ে ধারণা লোকে ওকে স্কুইজ করছে, সারাক্ষণ মুখটা ভেটকে আছে…কোনও সুন্দরী মেয়ে ওকে টলারেট করতে পারবে না।
—পুষনবাবুর সঙ্গে আপনার কদ্দিনের পরিচয়?
—কত আর, মাস পাঁচ ছয়।
—ব্যবসার সূত্রে?
—ওই আর কি। ঢালাই ঘরের মালিকরা মিলে একটা পার্টি দিয়েছিল। গভর্নমেন্টের দু চার জন ছিল, আমরাও কয়েক জন ছিলাম…
—পূষনবাবু লোক কেমন?।
—অর্চিষ্মান রুদ্রর চেয়ে ঢের ভাল। অনেক খোলামেলা। হেডে ব্রেন একটু কম আছে…
—মানে বোকা?
—বোকাই তো। একতরফা শ্যালকের জন্য করে যায়, শ্যালক কিন্তু তার কোনও ক্রাইসিসেই ফিরে তাকায় না। বলতে বলতে দুম করে থেমে গেল ভাস্কর,—এই দাঁড়ান, দাঁড়ান।…আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো? আপনি কি গোয়েন্দা নাকি?
মিতিন হাসল,—আমি বিদিশার ওয়েলউইশার। বন্ধু।
একটুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে মিতিনকে দেখল ভাস্কর। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল,—যেই হোন, আমার কিছু যায় আসে না। একটা কথা আবার আপনাকে স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, বিদিশার ব্যাপারে আমার আর কোনও ইন্টারেস্ট নেই। অর্চিষ্মান রুদ্রর সঙ্গে আমার কিছু কাজকারবারের কথা চলছে, বিদিশার পাল্লায় পড়ে আমি তা নষ্ট হতে দিতে রাজি নই।…আপনার আর কিছু জানার আছে?
নাহ্। মিতিন উঠে পড়ল,—ফোনের ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। বিদিশা সত্যিই খুব আপসেট হয়ে আছে।
—তো?
—আশা করি আমাদের এই মিটিংটা গোপন রাখবেন।
—কেন?
—কারণ আপনার এককালের বান্ধবী তাই চায়। আপনাকে সে এ ব্যাপারে রিকোয়েস্ট করতে বলেছে।
ভাস্কর আবার হা হা হেসে উঠল,—তার মানে আপনাদের সন্দেহের তালিকা থেকে আমায় বাদ দিয়ে দিলেন, তাই তো?
মিতিন উত্তর দিল না। সামান্য হেসে দরজার দিকে এগোল। ভাস্করও সঙ্গে সঙ্গে এসেছে,—আপনার নামটা তো জানা হল না?
—মিতিন। মিতিন মুখার্জি।
—সুইট নেম। ভাস্কর জিভ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। চাপা স্বরে বলল,— আপনার চেহারাটাও অ্যাট্রাকটিভ। আমাদের কি আর একদিন দেখা হতে পারে না?
মিতিন এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেলল,—নিশ্চয় পারে। বর আর ছেলেকে নিয়ে আসব একদিন। পুজোর সময়। বাই।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল মিতিন। ভাস্কর চ্যাটার্জি লোকটা কী! যার সঙ্গে একটা সময়ে চুটিয়ে প্রেম করেছে, হতে পারে অপরিণত ভালবাসা, তার সম্পর্কে কী অদ্ভুত রকম উদাসীন! হয় লোকটা খুবই লুচ্চা টাইপ, নয় ঝানু ক্রিমিনাল। রাজনীতির লোকদের সঙ্গে অবশ্য ঝানু ক্রিমিনালদের খুব তফাত নেই।
বাসস্টপে এসে মিতিন ঘড়ি দেখল। সওয়া পাঁচটা। কালীঘাট পার্ক এখান থেকে খুবই কাছে, কিন্তু এখন গিয়ে কোনও লাভ নেই। এই দু আড়াই ঘণ্টা সময় এখন কীকরবে মিতিন? ঝট করে একবার বাপের বাড়ি ঘুরে আসবে? বেহালা যেতে আসতে কতক্ষণই বা লাগে! থাক, এ সপ্তাহে কোথ্থাও যাওয়া নয়। বিদিশা এপিসোডের সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত মিতিনের শান্তি নেই।
বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা চিন্তা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়। আর একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল মিতিন। ছটার মধ্যে পৌঁছে গেছে ফুলবাগান। ঠিকানাটা মুখস্থই ছিল, জিজ্ঞেস করে করে সোজা রবির বাড়ি।
সন্ধে নেমে গেছে, আলো জ্বলছে রবির ঘরে। বাইরে থেকে মিতিন শুনতে পেল টিভি চলছে। টিভির আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যায় এক মহিলার গলা, খুব বকাবকি করছে মেয়েকে।
সরু গলির এক পাশ দিয়ে কাঁচা নর্মদা, ভকভক পচা গন্ধ বেরোচ্ছে। নাকে আঁচল চেপে মিতিন ডাকল,—রবি? রবি আছ নাকি?
মহিলার স্বর থেমে গেল। ফালি দালানে বেরিয়ে এসেছে। সে প্রশ্ন করার আগেই মিতিন বলল,—রবি ফিরেছে কাজ থেকে?
দেবলা দ্রুত দু দিকে মাথা নাড়ল,—না তো। কেন?
—রবি আমাকে বলেছিল একটা ভাল ড্রাইভার জোগাড় করে দেবে…
—সে তো এখানে নেই।
—কোথায় গেল?
উত্তর দিতে ইতস্তত করছে দেবলা। একটা বছর দশেকের মেয়ে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে, তার দিকে কড়া চোখে তাকাল, মেয়েটা সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল ভেতরে।
মিতিনের বুক থেকে স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যা আন্দাজ করেছিল তাই, গা ঢাকাই দিতে হয়েছে রবিকে। অর্থাৎ বাক্স চুরির ঘটনাটা কোনও ভাবেই আকস্মিক নয়।
বৃথা আর প্রশ্নে গেল না মিতিন। আলগা ভাবে বলল,—রবি এলে তুমি তা হলে একটু বলে দিয়ো, দিদিমণি ড্রাইভারের জন্য এসেছিল।
দেবলা ঘাড় নাড়ল।
সরে এল মিতিন। হাঁটতে হাঁটতে ফুলবাগানের মোড়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা রোল খেল, ফুটপাথের দোকান থেকে এক গ্লাস কালো চা’ও। চনচনে খিদেটা মিটতে পাশের বুথ থেকে বাড়িতে ফোন করা চেষ্টা করল কয়েক বার। লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। পার্থ কি ফিরে কোনও বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনিক আড্ডা জুড়ল? অসম্ভব নয়। মেয়েদের চেয়েও বেশিক্ষণ পার্থ গল্প করে ফোনে, জানে মিতিন।
আবার ট্যাক্সি ধরে হাজরা ফিরতে আটটা। কালীঘাট পার্কের পিছনের রাস্তাটায় পুজোর প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে, সামনে দাঁড়িয়ে গুলতানি করছে ছেলেরা, তাদের কাছে মিহিরের নাম ঠিকানাটা একবার যাচাই করে নিল মিতিন। তারপর একতলা বাড়িটার দরজায় এসে কড়া নাড়ছে।
দরজা খুলেছেন এক প্রৌঢ়—কাকে চাই?
—মিহিরবাবু কি ফিরেছেন?
—এই তো ঢুকল।…আপনি?
—আমি মিসেস মুখার্জি। মিহিরবাবুর অফিসকলিগ্।
—ও, আসুন আসুন…
মিতিন ঢুকল না। ব্যস্ত ভাব ফুটিয়ে বলল,—বসব না, এক্ষুনি চলে যাব। কাইন্ডলি একটু ডেকে দিন না।
ভদ্রলোক ভেতরে যাওয়ার অব্যবহিত পরেই মিহিরের আবির্ভাব। সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে মিতিনকে,—আমাকে খুঁজছেন আপনি?
—আপনিই তো মিহির সরকার?
—হ্যাঁ। কিন্তু আপনি …
মিতিন চাপা স্বরে বলল,—বিদিশাকে মনে আছে? আমি বিদিশার কাছ থেকে আসছি।
চকিতে একবার পিছনে তাকিয়ে নিল মিহির,—হঠাৎ? কী ব্যাপার?
—এখানে বলব? না বাইরে আসবেন?
মিহির স্পষ্টতই নার্ভাস। আর একবার ঘুরে ভেতরটা দেখে নিল,—চাৰ্চটার সামনে যান, আমি আসছি।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গ্রিক চার্চের গেটে এসেছে মিহির। হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। উত্তেজিত ভাবে বলল,—আমাকে আবার কী দরকার পড়ল বিদিশার?
মিতিন গম্ভীর মুখে বলল,—আপনি নিশ্চয়ই জানেন বিদিশার বিয়ে হয়ে গেছে?
—শুনেছি।
—খুব বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হয়েছে বিদিশার।
—হুঁ। মিহির সামান্য রুক্ষ হল,—আপনার প্রয়োজনটা বলুন।
ঝটপট কথাগুলো সাজিয়ে নিল মিতিন,—দেখুন, আমার বন্ধু এখন ওয়েল সেটলড্। সে আর অতীতের স্মৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে চায় না। নিশ্চয় কারণটা বুঝতে পারছেন?
মিহিরের মুখে কোনও প্রতিক্রিয়াই ফুটল না। নীরস স্বরে বলল,—আমি কী করতে পারি?
—আপনার কাছে ওর কিছু চিঠি আছে, কয়েকটা ফটোও। যদি কাইন্ডলি সেগুলো ফেরত দিয়ে দ্যান…
—ফটো? চিঠি? রসিকতা করতে এসেছেন আমার সঙ্গে? আপনার বন্ধু তো কবেই সব ফেরত নিয়ে গেছে।
একবার মিতিনের চমকানোর পালা,—বিদিশা নিয়ে গেছে? কবে?
—স্ট্রেঞ্জ! নিজেই দাদাকে পাঠিয়ে সব নিয়ে গেল…দাদা এসে কত কাকুতি মিনতি, ওগুলো দিয়ে দিন, একটা বড় জায়গায় বোনের বিয়ের কথা চলছে…! এই তো গত বছর পুজোর ঠিক পর পর দাদাটা এসেছিল।
মিতিন অস্ফুটে বলল,—দাদা এসেছিল? মানে চিত্রভানু?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই রকমই তো কী একটা নাম বলল! আমিও ভেবে দেখলাম, ওই মেয়ের চিঠি রেখে আমি আর কী করব…! মিহির চোখ সরু করল,—খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে? চিঠিগুলো কি তা হলে বিদিশার হাতে পৌঁছয়নি? নাকি আপনার বন্ধু আবার নতুন কোনও খেলা খেলতে চাইছে?
মিতিনের যেন কানেই গেল না কথাটা। বলল,—আপনি শিওর বিদিশার দাদাই এসেছিল?
—তা ছাড়া আর কে আসবে? কার না কার একটা সাদা অ্যাম্বাসাডার নিয়ে এসেছিল…
—সাদা অ্যাম্বাসাডার? মিতিন আবার হোঁচট খেল,—সঙ্গে আর কেউ ছিল?
—নাহ্, নিজেই তো চালাচ্ছিল গাড়ি।
—ও। মিতিন বিড়বিড় করে বলল,—তা হলে বোধহয় কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সরি, আপনাকে মিছিমিছি ডিসটার্ব করলাম।
—ঠিক আছে, কাইন্ডলি আর আমার কাছে আসবেন না। আমি একটা যথেষ্ট সম্মানিত জীবন যাপন করছি, আপনার বন্ধুর ব্যাপারে নতুন করে জড়ানোর আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরল মিতিন। ঘরে ঢুকতেই পার্থ ঘোষণা করল,—তোমার অর্চিষ্মান রুদ্রর ফোন এসেছিল।
বুমবুম পার্থর কাছে বসে কার্সিভ লেটার লেখা শিখছে। ছেলের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে মিতিন জিজ্ঞাসা করল,—কী বললেন মিস্টার রুদ্র?
—রবির ব্যাপারে কোনও খোঁজখবর পেলে কি না জানতে চাইছিল।
—আর?
—আর কিছু তো বলল না।
—তার মানে ব্ল্যাকমেলারের ফোন এখনও আসেনি?
—সত্যি, আর মাত্র চার দিন বাকি, কোথায় টাকাটা দিতে হবে জানাচ্ছে না তো?
—জানাবে। ঠিক জানিয়ে দেবে। মিতিন খাটে গিয়ে বসল,—একটা কাজ আছে। কাল দুপুরে তোমায় একবার আমার সঙ্গে বেরোতে হবে।
—কী কাজ?
—বলছি। আগে এক গ্লাস জল তো খেয়ে নিতে দাও।
[নয়]
ভরদুপুরে হিমায়িত পানশালা এখন জমজমাট। মদিরার উগ্র ঝাঁঝে বন্ধ কক্ষের বাতাস ম ম। সমবেত সংলাপ গুঞ্জন হয়ে ভাসছে হাওয়ায়, গ্লাসে গ্লাসে শব্দ বাজছে টং টাং। স্তিমিত আলোয় কারুর মুখ এখানে স্পষ্ট দেখা যায় না, নির্মিত হয়েছে এক রহস্যময় আবছায়া। বাজনাও চলছে নিচু গ্রামে। একটানা। টিমে লয়ে। অদ্ভুত এক ঝিম ধরানো সুর।
কোণের টেবিলে এই মাত্র বিয়ারের বোতল শেষ, চিত্রভানুর পানপাত্রে এখন টলটল করছে হুইস্কি। পার্থ অবশ্য এখনও বিয়ারেই পড়ে, মিতিনের সামনে সোডা মেশানো ফ্রেশ লাইম। পার্থ হাত মুখ নেড়ে কাল্পনিক টিভি সিরিয়ালের কাহিনী বানিয়ে চলেছে, ঘোর লাগা চোখে শুনছে চিত্রভানু।
চিত্রভানুর পরনে আজ টুকটুকে লাল শার্ট। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। মুখেও বেজায় গদগদ ভাব। সিরিয়ালঅলারা তাকে বাড়ি থেকে তুলে এনে বারে বসিয়ে মদ খাওয়াচ্ছে, তার জীবনে এ এক দুর্লভ ঘটনা। যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।
পার্থ একটু থামতেই চিত্রভানু জড়ানো গলায় বলে উঠল,—আমাকে আপনি সত্যিই রোলটা দিচ্ছেন তো?
—এখনও সন্দেহ আছে? আরে মশাই, আপনাকে তো আমি ব্রেক দিচ্ছি একটা। একেবারে হিরোর প্যারালাল রোল।
—আসলে কী জানেন? আপনার চেহারাটা সুপ্রকাশের খুব পছন্দ হয়ে গেছে। মিতিন আর একটু উসকে দিল,—আপনি তো ঠিক চকোলেটবয় হিরো টাইপ নন, আপনার মধ্যে একটা অ্যারোগ্যান্স মানে ঔদ্ধত্য আছে।
—এই ঔদ্ধতটাই আমি এনক্যাশ করতে চাই। পার্থ সিগারেট ধরাল। কায়দা করে গোল গোল ধোঁয়া ছাড়ছে,—অ্যাক্টিংটা কিন্তু আপনাকে খুব ভাল ভাবে করতে হবে।
—আমি জান লড়িয়ে দেব সুপ্রকাশদা। বড় চুমুকে পাত্র শেষ করল চিত্রভানু,— দেখবেন, আমি আপনাদের মোটেই ডোবাব না।
—দ্যাটস দা স্পিরিট। পার্থ কাম সুপ্রকাশ বিয়ারের গ্লাস টেবিলে নামাল,—আমার সিরিয়ালে বেশ কয়েকটা অ্যাকশান সিন আছে। আপনাকে ছোটখাটো স্টান্টও কিন্তু করতে হবে।
—ঝাড়পিট? ও আমি খুব পারব।
—পর্দার ঝাড়পিট কিন্তু অন্য রকম। সবটাই ফল্স, তবু রিস্ক থাকে। পার্থ হাসল,—সুইমি টুইমিং জানেন?
—পদ্মপুকুরে শিখেছিলাম। অবশ্য বহুকাল জলে নামিনি।
—ড্রাইভিং?
—শিখে নেব। আপনাদের শুটিং তো আর কালই শুরু হচ্ছে না!
মিতিন-পার্থ চোখচোখি হল। মিতিন জিজ্ঞাসা করল,—একদম গাড়ি চালাতে জানেন না?
—আমার তো আর গাড়িঅলা শ্বশুর নেই!..এক বন্ধুর গাড়ির ক্লাচ গিয়ার নিয়ে কদিন ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম, ব্যস ওই টুকুনই! তবে শিখতে সময় লাগবে না, এ আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।
—কী গাড়ি ছিল আপনার বন্ধুর? অ্যাম্বাসাডার?
—না, ফিয়াট। ইটালিয়ান। বহুৎ পুরনো। বন্ধুর ঠিক নয়, বন্ধু বাবার গাড়ি।
—ও।
মিতিন চুপ হয়ে গেল। কাল মিহিরের বাড়ি থেকে ফিরে অনেক ভেবেছে সে। কোনই কুলকিনারা পাচ্ছিল না। সন্দেহের তির এখন অনিবার্যভাবে চিত্রভানুর দিকেই ছুটে যায়, তবু মন যেন কিছুতেই সায় দিতে চায় না। বার বার মনে হয় কোথাও যেন একটা বড়সড় ফাঁকি রয়ে গেছে। কেউ একটা চতুর খেলা খেলছে মাঝখানে, মিতিন ঠিক ধরতে পারছে না খেলাটা। এখানে বসে, এই মুহূর্তে, সংশয়টা গাঢ়তর হচ্ছে আরও। অন্য কেউ নাম ভাঁড়িয়ে গিয়েছিল মিহিরের কাছে? কে সে?
পার্থ বেয়ারাকে ডেকে আবার হুইস্কি দিতে বলল চিত্রভানুকে। আজ পার্থর এটাই কাজ। চিত্রভানুকে পুরোপুরি মাতাল করে দেওয়া।
তা সেই পথে এগিয়েছেও চিত্রভানু। বিয়ার আর হুইস্কির মিশেলে তার এখন রীতিমতো তুরীয় দশা। আপন মনে মাথা দোলাচ্ছে, বোকা বোকা মুখে হাসছে অকারণে, ঢুলঢুলু চোখে দেখছে এপাশ ওপাশ।
মিতিন তাল বুঝে কথা পাড়ল,—আচ্ছা, আপনি মিহির সরকার বলে কাউকে চেনেন?
—কে মিহির? কোথাকার মিহির?
—আমাদের সিরিয়ালে অ্যাক্টিং করছে।…সে নাকি একসময়ে বিদিশার খুব বন্ধু ছিল। কালীঘাট পার্কের দিকে থাকে…
—অ, সেই মিহির! সাবান কোম্পানির ফিরিঅলা!
—ও, তার মানে আপনি চেনেন? মানে পরিচয় আছে আপনার সঙ্গে?
—দূর, বুলুর আশিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকতে যাবে কেন? আমি তো শুধু শালাদের ঠিকুজিগুলো জেনে রাখতাম। বোনটি আমার কোথায় কখন কী বাধিয়ে বসে…! আপনার বন্ধুর তো কেচ্ছা কম ছিল না।
—হ্যাঁ, স্কুলেও ও একটু উড়ুউড়ু ছিল বটে। মিতিন কাম চন্দ্রিমা ধরতাই দিল।
—সে সব মজনু কোথায় ফুটে গেছে। হা হা হা হা। বুলুর ভালবাসা হল পোলট্রিঅলাদের মুরগি পোষা। দানা খাওয়াচ্ছে, দানা খাওয়াচ্ছে, হঠাৎ কুচ করে একদিন গলাটা কেটে নিল।
মিতিন হাসতে হাসতে মাথা দোলাল,—দাদা হয়ে কিন্তু বোনের এত কুৎসা গাওয়া আপনার শোভা পায় না।
—হ্যাহ্, দাদা! বোন যেন দাদাকে কত সম্মান করে! উল্টো ট্যাঁকে গোঁজে, বুঝলেন? চিরটাকাল…। চিত্রভানুর গলা চড়তে চড়তে কেমন ছেতরে গেল,—কেন জানেন? ওই বাবা মা…। সারাক্ষণ দুজনে খালি মেয়ে নিয়ে নাচছে। মেয়ে যাই করুক, সাত খুন মাপ। আর ছেলের পান থেকে চুন খসলেই খিস্তি।
—তা, বিদিশাই তো জিতল শেষ পর্যন্ত! কত বড় ঘরে তার বিয়ে হয়েছে!
—বড় ঘর না ছাই, বলুন চামারের ঘর। ব্যাগে টাকা নিয়ে ফুটুনি মারতে পারলেই কি সব হল? বুলুর কোনও স্বাধীনতা আছে ওখানে? জানেন, বিয়ের পর একটা রাত বাপের বাড়ি কাটানোর পারমিশান পায়নি বুলু? নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু থাকার হুকুম থাকে কতক্ষণ? চিত্রভানু আঙুল নাচাল,—জানেন, বাবাকে আমি বিয়ের আগেই বলেছিলাম তোমার উড-বি জামায়ের টেম্পার ভাল নয়, আমি জানি। শুনে বাপ কী বলল জানেন? বলল, অ্যাই শালা কুলাঙ্গার, চুপ যা। যাদের পয়সা আছে, তাদের টেম্পার থাকবে, এতে তোর কী রে? এখন ঠ্যালা বোঝ, জামাইয়ের পয়সার গরমে গর্তে ঢুকে বসে থাকো।…দেখলেন না, মেয়ের ঠিকানা পর্যন্ত দেওয়ার মুরোদ নেই?
মিতিন টানটান হল,—আপনি অর্চিষ্মান রুদ্রকে আগে থেকেই চিনতেন নাকি?
—চিনতামও বটে, চিনতাম নাও বটে।
—সেটা কী রকম?
—আমার এক দোস্তের মুখে ওর নাম শুনেছি। সে ওই নিলামঘরে কাজ করত। চিত্রভানু ঢক করে খানিকটা তরল ঢেলে নিল গলায়। ঠোঁট কাঁপছে,—ওই শালা অর্চিষ্মান বিনা দোষে আমার বন্ধু সোনাদাকে তাড়িয়েছিল।
—ও। তার মানে আপনার সোনাদাই আপনাকে অর্চিষ্মানের গপ্পো বলেছে?
—ইয়েস। সোনাদা আমার গ্রেট ফ্রেন্ড। আমার গুরু। কী দেবতুল্য লোক, আহা! নিজে মিষ্টি খায় না, আমায় মিষ্টি খাওয়ায়। নিজে মাল খায় না, আমায় মাল খাওয়ায়! ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে সোনাদার। জানেন, সোনাদার টিপ্সে খেলে কত বার আমি ঘোড়ার মাঠে জিতেছি!
চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল মিতিনের, হাঁটু দিয়ে ঠেলল পার্থকে। পার্থ তড়িঘড়ি প্রশ্ন করে উঠল,—তা ভাই, আপনার এই সোনাদাটির ভাল নাম কি?
—ভাল নাম! হা হা হা। চিত্রভানু হাত ওল্টাল,—সোনাকে যে নামেই ডাকুন, সোনা তো সোনাই থাকবে।
দ্রব্যগুণে প্রায় শেক্সপিয়ার বনে গেছে চিত্রভানু। পার্থ আবার জিজ্ঞাসা করল,— সোনাদা কি আপনার পাড়ার বন্ধু?
—উহুঁ, স্বর্গ থেকে খসে পড়া বন্ধু। গত বছর মনসুন রেসের সময় মাঠে আমার রুপিয়া ফুড়ুৎ হয়ে গিয়েছিল, ওই সোনাদাই কোত্থেকে দেবদূতের মতো এসে…। নিজে টাকা ধার দিয়ে কুইনেলা খেলতে বলল…জানেন, সেদিন আমি দুশো তেতাল্লিশ টাকা জিতে ফিরেছিলাম!
—আপনার সোনাদা থাকেন কোথায়?
—ওই নর্থের দিকে। হেদোর কাছে কোথায় যেন। বলেই চিত্রভানু পার্থর হাত জড়িয়ে ধরেছে,—অ্যাই সুপ্রকাশদা, সোনাদার কথা ছাড়ুন না। আমার কথা বলুন। হবে তো আমাকে দিয়ে?
পার্থ পিঠ চাপড়াল চিত্রভানুর,—হবে না মানে? আপনার জোরেই তো সিরিয়াল দাঁড়াবে।
—আমি ফাটিয়ে দেব, দেখবেন। …দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব আমিও কামাতে পারি। ওই আপনাদের বিদিশা অনেক বড় বড় কথা শোনায় আমাকে।
বলতে বলতে স্বর ডুবে যাচ্ছে চিত্রভানুর, শরীর এলিয়ে পড়ছে। আর একটা হুইস্কি দিয়ে গিয়েছিল বেয়ারা, সেটাও পলকে শেষ। চোখ আর খুলে রাখার ক্ষমতা নেই, আধবোজা চোখে কী যেন বিড়বিড় করে চলেছে। তারই মধ্যে গ্লাস ঠুকছে টেবিলে, আরও পানীয় চাই।
মিতিন ফিসফিস করে পার্থকে বলল,—পুরো আউট, এবার একে সামলানো মুশকিল হবে। পকেটে ভাড়া গুঁজে দিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিই চলো।
চিত্রভানুকে নিয়ে বার থেকে বেরোল পার্থ-মিতিন। ঠিকঠাক ছেলেটাকে চালান করে দিয়ে নিজেরাও ট্যাক্সি ধরেছে একটা। বাড়ি ফিরছে।
বিয়ারের প্রভাবে পার্থরও এখন বেশ ফুরফুরে মেজাজ। মিতিনের পিঠে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল,—কী, অপারেশন সাকসেসফুল তো?
—মোটামুটি।
—মোটামুটি কেন? দারুণ সব ইনফরমেশন পেয়ে গেলে।
—হুঁ।
—চিত্রভানু যে মিহিরের কাছে যায়নি…
—এটা এখনও জোর দিয়ে বলতে পারো না। মিহিরকে চিত্রভানুর ছবিটা দেখিয়ে ভেরিফাই করে নিতে হবে। ইমিডিয়েটলি।
—আর ওই সোনাকে ট্রেস করবে কোথায়?
—দেখি। অনেকেরই এখন ভাল করে খোঁজ করা দরকার।
—একটা লোককে তুমি কিন্তু চোখ বুজে বাদ দিয়ে দিতে পারো।
—কে?
—বিদিশার বাবা। খোঁজ নিয়ে তো দেখেছি, লোকটা একটু বড়বড় করতে ভালবাসে বটে, বেসিকালি কিন্তু খারাপ নয়। সাধারণ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। তা ছাড়া লোকটা ভালই স্টেজ অ্যাক্টিং করে। বুঝতেই পারছ, স্টেজে যারা ভাল অভিনয় করে, তারা রিয়েল লাইফে অ্যাক্টিং করতে পারে না। যেমন রিয়েল লাইফে যারা ভাল অভিনয় করে, তারা স্টেজে একেবারে মিসফিট।
—তাই কি?
বলেই মিতিন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। পার্থও চোখ ঘুরিয়েছে বাইরে। শরতের বিকেল দেখছে। পথেঘাটে খুশি খুশি আলো, মানুষের মুখে আনন্দের আস্তরণ, পুজো বুঝি সত্যিই এসে গেল।
পার্থ বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়ল, কোন এক বন্ধুর বাড়ি যাবে। মিতিন বাড়ি এসে দেখল বিমলা বুমবুম দুজনেই সেজেগুজে তৈরি, বেরনোর জন্য ছটফট করছে।
মিতিন চা খাওয়ার কথা বলতেই বিমলার মুখ হাঁড়ি, ঢুকল রান্নাঘরে।
রান্নাঘর থেকেই বলল হঠাৎ,—তোমার অনেকবার ফোন এসেছিল গো বউদি। সেই দিদিমণি যে সেদিন তোমার কাছে এসে কাঁদছিল। কত বার যে করেছে…
মিতিনের ভুরু কুঁচকে গেল,—কখন থেকে করছে?
—অনেকক্ষণ। সেই দুপুর দুটো আড়াইটে থেকে। চার পাঁচবার তো করেছেই।
দ্রুত হাতে টেলিফোনের বোতাম টিপল মিতিন। তার গলা পেয়েই ওপার থেকে বিদিশার আর্ত স্বর উড়ে এসেছে,—আমার খুব ভয় করছে দিদি।
—কেন, কী হল?
—আপনি শিগগির একবার আসুন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
—আঃ, কী হয়েছে বলবে তো? লোকটার ফোন এসেছিল?
—না। তার চেয়েও মারাত্মক। বিদিশার স্বর থমকে রইল দু এক সেকেন্ড। তারপর অস্বাভাবিক নেমে গেল,—আজ একটা জিনিস পেয়েছি দিদি।
—কী জিনিস?
—আপনি ভাবতেও পারবেন না। মনে আছে…বলেছিলাম…অর্ক সেই লোকটার জামার একটা বোতাম ছিঁড়ে নিয়েছিল?
—হ্যাঁ, দেখেছি তো বোতামটা।…কেন?
—ওই বোতামছেঁড়া শার্টটা আজ বাড়িতেই পেয়েছি। অর্চিষ্মনের পুরনো জামাকাপড়ের ভেতর থেকে।
মিতিনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল,—কখন পেলে?
—এই দুপুরবেলা। খেয়ে উঠে ওর বাতিল শার্ট-প্যান্টগুলো বার করেছিলাম, তখনই একটা বোতামছেঁড়া শার্ট দেখে কেমন সন্দেহ হল। বোতামটা এনে মিলিয়ে দেখি হ্যাঁ…
—কোথায় ছিল শার্টপ্যান্টগুলো?
—আমাদের শোওয়ার ঘরের পাশে অ্যান্টিরুমে একটা টানা দেরাজ আছে, ওখানে।
—হঠাৎ পুরনো শার্টপ্যান্ট নিয়ে বসেছিলে যে?
—শ্বশুরমশায়ের কয়েকটা চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগ আছে। তারাই পুজোর আগে শ্বশুরমশায়ের কাছে পুরনো জামাকাপড় চেয়েছিল। উনি আমায় সকালে বললেন, দ্যাখ বাবলুর যদি কিছু বার করে দিতে পারিস…
—ও, তাই তুমি…! মিতিন একটু ভাবল,—আচ্ছা, শার্টটা ঠিক কোনখানে ছিল?
—দেরাজের নীচের তাকে।
—উঁহু। কী রকম অবস্থায় ছিল? জামাকাপড়ের একদম ওপর দিকে, না মাঝখানে, না তলায়?
—ওপরেই তো ছিল।…একদম ওপরে।
—তুমি কত দিন পর ওই দেরাজ খুলেছ?
—খুলি তো প্রায়ই। ওই নীচের তাকটায় হাত দেওয়া হয় না।
—কেমন করে রাখা ছিল শার্টটা? পাট পাট? না কোঁচকানো মোচকানো?
—এক সাইডে গোঁজা ছিল।
—তুমি যে শার্টপ্যান্টগুলো বার করেছ, বাড়ির কেউ দেখেছে?
—কে দেখবে?
—তোমাদের কাজের লোক? সুমতি পদ্মপাণি…?
—নাহ্।
—শোন, তা হলে আবার নিখুঁতভাবে আগের মতো করে সাজিয়ে শার্টপ্যান্টগুলো তুলে রাখো তাকটায়। আর এটা নিয়ে ভুলেও বরের সঙ্গে আলোচনা কোরো না।
—কিছু বিপদ হবে না তো দিদি?
—না। বিপদ হওয়ার হলে এতদিনে হয়ে যেত। ওটা নিয়ে তুমি আর বেশি ভেব না। কয়েকটা প্রশ্ন করছি, ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দাও।
—বলুন দিদি?
—তোমার গয়নার বাক্স চুরির গল্প তুমি বাপের বাড়ির কাউকে বলেছিলে কখনও? মা বাবা দাদা…?
—নাহ্। বলার সুযোগই হয়নি।
—তোমার বরের দোকান থেকে যে বছর দু আড়াই আগে কয়েকজন লোক ছাঁটাই হয়েছিল। জানো?
—জানি।
—কার কাছ থেকে শুনেছ? মিস্টার রুদ্র?
—না। ও আমাকে অফিসের কথা বলে না। পদ্মপাণির মুখে শুনেছি। পদ্মপাণিই তো এ বাড়ির গেজেট।
—হুঁ। আচ্ছা, তুমি কি বাপের বাড়িতে লোক ছাঁটাইয়ের গল্পটা করেছ কখনও?
—না তো। কেন দিদি? কী হয়েছে?
—সেরকম কিছু না, এমনিই জিজ্ঞেস করছি।…মিহির বলে তোমার যে বয়ফ্রেন্ড ছিল, তার কাছে কি কখনও কাউকে পাঠিয়েছিলে? চিঠি ছবি ফেরত আনতে?
—আমি! কই, না।
—আচ্ছা, ব্ল্যাকমেলারের ফোন তো শনিবারই আসে, তাই না?
—হ্যাঁ। দুপুরবেলা।
—ভাল করে মনে করে দ্যাখো তো, ওই ফোন আসার আগে বা পরে কখনও অৰ্চিষ্মানের ফোন এসেছিল কিনা?
—না মানে…। বিদিশা একটুক্ষণ চুপ,—প্রথম যেদিন ফোনটা এল, সেদিন অর্চিষ্মান খুব তাড়াতাড়ি ফিরেছিল। ফোন আসার এক দেড় ঘণ্টার মধ্যেই।…কিন্তু এ কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন দিদি?
—আরে বাবা, ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এগুলো জাস্ট জিজ্ঞাসা।…কাল মিস্টার রুদ্রর নিলামঘর বন্ধ না?
—আজও বন্ধ। তবে ও বারে আছে, ফিরতে রাত হবে।
—নিলামঘর না থাকলে সকালবেলা কটা নাগাদ উনি বারে যান?
—বাড়ি থেকে দশটা সওয়া দশটায় বেরোয়।
—ঠিক আছে, আমি আজ কালের মধ্যে যে কোনও দিন তোমার কাছে যেতে পারি। আর একটা কথা। এখন যে কোনও মোমেন্টে ব্ল্যাকমেলারের ফোন আসবে, তুমি কিন্তু তখন টেপ চালাতে ভুলো না। অ্যান্ড ডোন্ট গেট নার্ভাস।…রাখছি।
ফোন ছেড়ে সোফায় বসল মিতিন। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে, টানল কাপটা। বুমবুম বেরোচ্ছে বিমলার হাত ধরে, ছেলেকে আলগা টেনে কপালে চুমু খেল একটা।
বিমলা দরজা থেকে বলল,—সুভাষদা এসেছিল। তোমার জন্য অফিসঘরে কাগজ রেখে গেছে।
দরজা বন্ধ করে মিতিন স্টাডিতে ঢুকল। যে কটি কাজে পাঠিয়েছিল, সবকটারই পৃথক পৃথক রিপোর্ট সাজিয়ে রেখে গেছে সুভাষ। শেষ তথ্যটিতে চোখ বুলিয়ে হেসে ফেলল মিতিন। নাহ্, ব্ল্যাকমেলারটার রসিকতাবোধ আছে। পাবলিক বুথ থেকেই বিদিশাকে ফোন করেছিল বটে, তবে বুথটা একেবারে লালবাজারের গেটের সামনে।
একেই বলে বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা!