পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ইরোকোয়া মিত্রসংঘ
জ্ঞাতি-স্বজন ও প্রতিবেশী গোষ্ঠীদের নিয়ে আত্মরক্ষার জন্যে মিত্রসংঘ গঠিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যখন তারা এই রকম সংগঠনের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে বা এ থেকে কাজ পায় তখন তারা একতাবদ্ধ হয়ে জোট বাঁধার কাজকে ক্রমশ জোরদার করতে থাকে। গোষ্ঠীদের মধ্যে চিরন্তন যুদ্ধ-বিবাদ লেগেই থাকত। এই অবস্থায় বুদ্ধিমান গোষ্ঠীরা জোট বেঁধে নিজেদের আরো শক্তিশালী করার কাজে লাগবে এটা স্বাভাবিক। তারা এতে বেশ ফল লাভ করে। সংগঠন ক্রমশ নিম্ন ও ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে উচ্চতর বৃহৎ সংগঠনে রূপান্তরিত হয়। গণ থেকে গোষ্ঠী, আবার গোষ্ঠী থেকে মিত্রসংঘ।
যখন আবিষ্কৃত হয় উত্তর আমেরিকায় বেশ কয়েকটা মিত্রসংঘের সাক্ষাৎ মেলে, যাদের অনেকের পরিকল্পনা ও কাঠামো ছিল বেশ উঁচু দরের। ইরাকোয়ারা ছিল পাঁচটা স্বাধীন গোষ্ঠী নিয়ে, ক্রিক মিত্রসংঘ ছটা গোষ্ঠী নিয়ে, ওটাওয়ার তিন, ডাকোটার সাত, মোকিরা সাতটা পুয়েবলো গোষ্ঠী নিয়ে, আর আজটেকরা ছিল মেক্সিকো উপত্যকায় তিনটে গোষ্ঠী নিয়ে। মেক্সিকো, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সর্বত্র ইণ্ডিয়ানরা দু-তিনটে জ্ঞাতি গোষ্ঠী নিয়ে মিত্রসংঘে সংগঠিত ছিল। গ্রামীণ ইণ্ডিয়ানদের অঞ্চলগুলো ছিল ছোট, তাই পাশাপাশি সংগঠন গঠনে তাদের কোনো অসুবিধা হয় নি। কিন্তু বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়েও মিত্রসংঘ দেখা গেছে, বিশেষ করে ইরোকোয়াদের মধ্যে। যেখানেই মিত্রসংঘ দেখা গেছে প্রমাণ করে যে সেখানকার লোকেরা উচ্চ মেধার অধিকারী।
উত্তর আমেরিকায় মিত্রসংঘের সবচেয়ে দুটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল ইরোকেয়া এবং আজটেকদের সংগঠন। সবাই তাদের সামরিক সুনামের কথা জানত, তা ছাড়া তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্যে এই মিত্রসংঘ সব দিক থেকে সুফল লাভ করে। ইরোকোয়াদের সম্বন্ধে আমরা ভালো তথ্য পেয়েছি। আজটেকরা জ্ঞাতিদের যৌথব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল না মিত্রসংঘে রূপান্তরিত হয়েছিল তা সঠিক জানা যায় নি।
যে পরিবেশে পড়ে এবং যে সূত্রের ওপর নির্ভর করে মিত্রসংঘ গড়ে উঠেছিল তা খুবই সরল। আগের সংগঠনের ওপর নির্ভর করে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তা স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠে। যেখানে একটা গোষ্ঠী কয়েকটা ভাগে বিভক্ত হয়ে পাশাপাশি স্বাধীনভাবে নিজস্ব এলাকা নিয়ে বাস করতে থাকে মিত্রসংঘ তাদের পুনর্মিলন ঘটায়। এখানে সংগঠনটা অবশ্য আরো উচ্চস্তরের হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের কথ্য ভাষায় প্রায় মিল থাকে। গণ সংগঠনের জ্ঞাতিত্ব প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠীতে লক্ষ করা যায়। তাই মিসংঘের মূলে রয়েছে গণ জ্ঞাতিত্ব। আর বাহ্যিক মিলটা হল যৌথ ভাষা। এক মৌল ভাষার বাইরে কোনো মিলসংঘ গঠিত হতে দেখা যায় নি। এই স্বাভাবিক বাধাটা অতিক্রম করলে এই সংগঠনে ভিন্ন ধরনের উপাদানের আমদানি ঘটত। অবশ্য দেখা গেছে কোনো এক গোষ্ঠীর অংশে হয়তো ভাষার অমিল, অথচ এরা মিত্রসংঘে গঠিত হয়েছে, যেমন নাসেজ[১] গোষ্ঠী, এরা মিত্রসংঘের সদস্য ছিল, কিন্তু এই ব্যতিক্রম আমাদের সর্বজনীন প্রতিপাদ্যকে নাকচ করে দেয় না। ভাষাগত বিভেদের জন্যে প্রচুর মিত্রসংঘ গঠিত হতে পারে নি। একই ভাষাভাষী গণ ও গোষ্ঠীগত অন্বয় না। থাকলে মিত্রসংঘ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
গণ সংগঠনভিত্তিক সমাজে নিম্ন, মধ্য বা উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগে তাই পৃথিবীর কোথাও রাজ্য গড়ে উঠতে পারে নি। গণ সমাজে রাজতন্ত্র চলা অসম্ভব। এটা সভ্যতা পর্যায়ের জিনিস। উচ্চ পর্যায়ের বর্বর যুগে গ্রিকদের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বৈরতন্ত্র দেখা গেছে। শাসন পদ্ধতি জনসাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটে এবং গণ সংগঠনের আওতায় বর্ধিত জনসাধারণের কাছে তা সম্পূর্ণ অপরিচিত জিনিস। এই গ্রিক স্বৈরতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে অন্যায়ভাবে ক্ষমতার দখল এবং এর মাঝে ভবিষ্যতের রাজতন্ত্রের বীজ লুকিয়ে ছিল এবং এর ফলে পরবর্তী কালের সব রাজত্ব গড়ে ওঠে। অবশ্য হিরোয়িক যুগের সময় তথাকথিত রাজত্বগুলো সামরিক গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। কীভাবে বিধানমণ্ডলের সাহায্যে মিত্রসংঘ গড়ে ওঠে সে সম্বন্ধে ইরোকোয়ারা একটা জ্বলন্ত নিদর্শন সৃষ্টি করে। এরা আসলে মিসিসিপির ওদিক থেকে আগত সম্ভবত ডাকোটাদের এক শাখা। প্রথমে এরা সেন্ট লরেন্স উপত্যকার মন্ট্রিলের কাছে বসবাস করতে থাকে। পরে অন্যান্য গোষ্ঠীদের শত্রুতার জন্যে নিউ ইয়র্কেরে মাঝামাঝি অঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য হয়। ওনটারিও হ্রদ ছাড়িয়ে তারপর তারা ওসউইগো নদীর কাছে বহুকাল বসবাস করতে থাকে। তখন তাদের কমপক্ষে তিনটে গোষ্ঠী ছিল : মোহক্, ওনোনডগা ও সেনেকা। বাকিরা ওনাইডা নামে পরিচিত হতে থাকে। ওনোনডাগা অথবা সেনেকা গোষ্ঠীর কিছু অংশ ক্যায়ুগা হ্রদের পশ্চিম তীরে ক্যায়ুগা নামে বাস করতে থাকে। ইরোকোয়ারা নিউ ইয়র্ক দখল করার আগে এখানে ছিল এ্যালগনকিন আদিবাসীরা। এদের উৎখাত করে হাডসনের পুবে ও জেনেসির পশ্চিমে পর্যন্ত গিয়ে তারা বসবাস করতে থাকে। পরে এরা মিত্রসংঘে আবদ্ধ হয়। যার ফলে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তারা নিশ্চিন্ত হয়। তারা গ্রামকে গ্রাম পাশাপাশি বাস করত, আর তাদের মোট সংখ্যা কখনো কুড়ি হাজারের বেশি ছাড়িয়ে যায় নি। এরা ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে আবিষ্কৃত হয়। প্রায় ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে তারা তাদের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয় : নিউ ইয়র্ক, পেনসিলভ্যানিয়া ও ওহায়োর[২] বিস্তৃত অঞ্চল, কানাডার কিছু অংশ এবং ওনটারিও হ্রদ এলাকা পর্যন্ত তাদের আধিপত্য ছিল। কলাকৌশলে ও শৌর্যে-বীর্যে তারা তখন সবচাইতে অগ্রণী রেড ইণ্ডিয়ান। যদিও তাদের সংখ্যা কমে গেছে তবু নিউ ইয়র্কে তাদের সংখ্যা বর্তমানে চার হাজার, কানাডায় এক হাজার এবং পশ্চিমে আরো এক হাজার, অবশ্য এখন এদের সংখ্যা কিছু কিছু বাড়ছে।
১৪০০-১৪৫০[৩] খ্রিস্টাব্দে এদের মিত্রসংঘ গঠিত হয় এবং ওপরে এদের যে অবস্থার বর্ণনা করা হল এদের তখন সেই অবস্থা ছিল। ইরোকোয়াদের পাঁচটি গোষ্ঠী ছিল। সবাই থাকত পাশাপাশি। আর এক ভাষায় কথা বলত। এ ছাড়া কিছু গণ যে সব গোষ্ঠীতে সাধারণ ছিল এ সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। যেহেতু সব জায়গাতে কিছু গণের মিল আছে তারা একটা মিত্রসংঘ গড়ার অনুপ্রেরণা পাবে এটা অস্বাভাবিক নয় এবং এতে তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। মহাদেশের অন্যান্য অংশে গোষ্ঠীরা প্রায় সব জায়গাতে এমন মিত্রসংঘ। গড়ে নি। এ থেকে ইরোকোয়াদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। তা ছাড়া মিত্রসংঘ যেহেতু মার্কিন আদিবাসীদের সর্বোচ্চ সংগঠন যেসব গোষ্ঠী সবচাইতে উন্নত কেবল তারা এর রূপ দিতে পারবে এটা ধারণা করাই স্বাভাবিক।
ইরোকোয়াদের কাছ থেকে জানা যায় যে তাদের মিত্রসংঘ গঠিত হত একটি বিজ্ঞজনের পরিষদ ও পাঁচটি গোষ্ঠীর প্রধানদের নিয়ে। এই ব্যাপারে তারা ওনোনডাগা হ্রদের উত্তর পারে সাইরাকিউস নামক জায়গায় বসত। সাকেমদের শিক্ষা দেবার জন্যে মাঝে মাঝে পরিষদের বৈঠক বসত। একে বিধানমণ্ডলের মতো মনে হলেও পূর্বে নিশ্চয় তারা আত্মরক্ষামূলক মৈত্রী গড়ে তোলে। পরে ব্যাপারটাকে স্থায়ী রূপ দেয় এবং আত্মরক্ষামূলক সংগঠন গড়ে তোলে।
এই পরিকল্পনার মূল উৎস একটি পৌরাণিক কাহিনী যা অন্তত একজন ঐতিহ্যবাহী ব্যক্তির মাঝে বর্ণিত আছে, যার নাম হাইও-ওয়েন্ট-হা, লঙ্গ ফেলোর বিখ্যাত কবিতার হিয়াওয়াথা এই পরিষদে উপস্থিত ছিল এবং ছিল প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। পরিষদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারে সে ওনোনাগাদের একজন বিজ্ঞ ব্যক্তিকে কাজে লাগাত, ডা-গো-নো-উই-ডা, দোভাষী হিসেবে এই ব্যক্তি প্রস্তাবিত মিত্রসংঘের কাঠামো সম্বন্ধে বর্ণনা করে। এই একই কাহিনী আরো বর্ণনা করে যে কাজটা শেষ হবার সাথে হা-ইয়ো ওয়েন্ট-হা, অলৌকিকভাবে একটি সাদা ডিঙি চড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়, এই সাদা ডিঙি তাকে নিয়ে বাতাস ভরে দূর শূনো চোখের আড়াল হয়ে যায়। এই কাহিনীতে আরো বলা আছে যে তার অদৃশ্যের পর অনান্য জ্ঞানী ব্যক্তিরা মিত্রসংঘ গড়ে তোলে। ইণ্ডিয়ানদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এটাকে একটা চরম বিজ্ঞতা বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে যথেষ্ট সত্য আছে। গণ সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে এটা তাদের চরম বিজ্ঞতার পরিচয় দেয় যা ইতিহাসে স্মবণীয় হয়ে। থাকবে। এটা আরো এক কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই জন্যে যে সেই বর্বর যুগের নিম্ন পর্বে মানুষ হাজার বাধা থাকা সত্ত্বেও কীরকম একটি সরকার ধারণা গড়ে তোলে।
এই মিত্রসংঘ কোন দুজন গড়ে তোলে তা নির্ধারণ করা মুশকিল। সেই নীরব ব্যক্তি হা-ইয়ো-ওয়েন্ট-হা হয়তো ইরোকোয়া বংশধারার একজন সত্যিকার লোকই ছিল।[৪] কিন্তু তাদের ঐতিহ্য এই ব্যক্তিকে এমন পৌরাণিক চরিত্র করে তুলেছে যে এই ব্যক্তিকে তাদের একজন মনে করা মুশকিল। যদি হিয়াওয়াথা কোনো সত্যিকার ব্যক্তি হয়ে থাকে তা হলে ডা-গা-নো-উই-ডা অবশ্যই তার নিচে স্থান পায়। আর যদি প্রথমোক্ত ব্যক্তিকে পৌরাণিক বলে ধরে নেওয়া হয় তা হলে এই মিত্রসংঘ গড়ার সকল কৃতিত্ব পায় এই দ্বিতীয় ব্যক্তি।
ইরোকোয়ারা বলে যে এই পরিষদ মিত্রসংঘ গড়ে তোলে এবং যে নিয়ম-কানুন এবং শাসন-নীতি গড়ে তোলে তা বংশপরম্পরায় চলে আসছে। এর অভ্যন্তরীণ সংগঠনে তেমন একটা কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। পরবর্তী সময়ে যখন টুসকারোরাদের গ্রহণ করা হয় তখন ভদ্রতার খাতিরে তাদের সাকেমদের সাধারণ পরিষদে সমমর্যাদায় বসানো হয়, কিন্তু সাকেঁদের মূল সংখ্যা বাড়ানো হয় নি। আর সত্যিকার অর্থে টুসকারোরা-সাকেমদল শাসকগোষ্ঠীর অংশ ছিল না।
ইরোকোয়া মিত্রসংঘের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো সংক্ষেপে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণিত হল :
১। পাঁচটি গোষ্ঠীর মধ্যে মিত্রসংঘ সংগঠিত হয়, যাদের মধ্যে অবশ্য গণের মিল ছিল। তারা সবাই এক সরকারের আওতায় আসে কিন্তু প্রত্যেকের অধিকার সমানভাবে বজায় থাকে। প্রতিটি গোষ্ঠী তাদের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখে। মিত্রসংঘ এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।
২। মিত্রসংঘ সাকেমদের নিয়ে একটি সাধারণ পরিষদ গঠন করে, সাকেমদের সংখ্যা ছিল সীমাবদ্ধ, সবার পদ ও সম্মান ছিল সমান, এদের ওপর মিত্রসংঘের সমস্ত কর্মভার দেওয়া থাকত।
৩। বেশ কিছু গোষ্ঠীর কিছু গণে পঞ্চাশ জন সাকেম সারা জীবনের জন্যে নির্বাচিত করে রাখা হত। কোনো কারণে কোনো পদ শূন্য হলে তাদের মাঝ থেকে একজনকে নিয়োগ করা হত। কিন্তু সাকেমদের নিয়োগের ব্যাপারে সাধারণ পরিষদ ছিল সর্বেসর্বা।
৪। মিত্রসংঘের সাকেরা তাদের গোষ্ঠীর সাকেম এবং এইসব গোষ্ঠীর প্রধানদের নিয়ে নিজেদের পরিষদ গঠন করে, গোষ্ঠীর ব্যাপারে যাদের ক্ষমতা অপরিসীম।
৫। প্রতিটি জনবিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মিত্রসংঘের পরিষদে সবার একমত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৬। সাধারণ পরিষদে সাকেমরা গোষ্ঠী ধরে ভোট দেয়, ফলে প্রতিটি গোষ্ঠীর ওপর একটা নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করছে।
৭। প্রতিটি গোষ্ঠীর পরিষদ সাধারণ পরিষদের আহ্বান জানাতে পারে, কিন্তু সাধারণ পরিষদ নিজে নিজে বসতে পারে না।
৮। সাধারণ পরিষদে কোনো সমস্যা আলোচনার জন্যে জনসাধারণের মাঝ থেকে কোনো বাগীকে আহ্বান করা হত। কিন্তু বিধি নিরূপণের ক্ষেত্র ছিল একমাত্র পরিষদের হাতে।
৯। মিত্রসংঘের কোনো প্রধান কার্যনির্বাহক ব্যক্তি বা তেমন কোনো পদ ছিল না।
১০। যৌথ সামরিক সেনাধ্যক্ষের প্রয়োজন বোধ করে তারা দু জন সেনাধ্যক্ষ নির্বাচন করে, যাতে একজন আরেকজনকে কিছুটা প্রভাবিত করে সমতা রক্ষা করতে পারে। তাই দুজনকে ক্ষমতা দেয়া হয়।
সংক্ষেপে উপযুক্ত মন্তব্যের কিছুটা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
মিত্রসংঘের জন্যে প্রতিটি গণে পঞ্চাশটি সাকেমের পদ নির্ধারিত করা থাকত। যখন পরিষদ চলতে থাকে এই সাকেমদের হাতে পরিষদ, আইন ও অন্যান্য কার্য সম্পাদনের ভার থাকে। মিত্রসংঘের পরিষদ কর্তৃক একজন সাকেমের অভিষেক হয়ে গেলে তার নাম নিয়ে নেওয়া হয় এবং তার ওপর সাকেম পদ অর্পিত হয়। এই নামেই সে তখন পরচিত হতে থাকে। এই সাকেমদের সবার ক্ষমতা ও পদ ছিল সমান। কোনো পদ শূন্য হলে গণের লোকেরা নূতন সাকেম নির্বাচিত করে দেয়।
এই সাকেম পদগুলো অবশ্য সব গোষ্ঠীর মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত ছিল না। এ সম্বন্ধে অবশ্য কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। মোহক্ গোষ্ঠীর সাকেম সংখ্যা ছিল নয়, ওনাইডাদের সংখ্যাও নয়, ওনোনাগাদের চৌদ্দ, ক্যায়ুগাদের দশ এবং সেনেকাদের সাকেম সংখ্যা হল আট। প্রথমে যে সংখ্যা ছিল, এখনো তা-ই আছে।
যখন ইরোকোয়া মিত্রসংঘ গঠিত হয় যেসব সাকেম সাধারণ পরিষদে সদস্য পদ লাভ করে নিচে তাদের নাম ও নামের অর্থের তালিকা দেওয়া হল :
মোহক্ গোষ্ঠী
১– (ক) ডা-গা-এ-ও-গা (নিরপেক্ষ” বা “ঢাল”
(খ) হা-ই-ওয়েন্ট-হা (“মাথা আঁচড়ানো”)
(গ) ডা-গা-নো-উই-ডা (“অক্লান্ত”–এরা কচ্ছপ গণের সাকেম।
২–(ক) সো-আ-এ-ওয়াহ (“ছোট ভাষণ”)।
(খ) ডা-ইয়ো-হো-গো (“কাটা হাতে”)।
(গ) ও-এ-আ-গো-ওয়া (“বড় নদীতে”)–এরা নেকড়ে গণের সাকেম।
৩- (ক) ডা-আন-নো-গা-এ-নেহ “সিং টানা”)
(খ) সা-ডা-গা-এ-ওয়া-ডেহ (“খিটখিটে”)
(গ) হ্যাস-ডা-ওয়েহ-সে-ওনট-হা (“র্যাটল সাপ ঝোলায়”)–এরা ভালুক গণের সাকেম।
ওনাইডা গোষ্ঠী
১– (ক) হো-ডাস-হা-টেহ (“বোঝা টানা মানুষ”)।
(খ) গা-নো-গুয়েহ-ইও- ডা (“বিড়ালের লেজে ঢাকা ব্যক্তি”)
(গ) ডাইও-হা-গুয়েন-ডা (“বুনো পথ”)–এরা নেকড়ে গণের সাকেম।
২–(ক) সো-নো-সাসে (“লম্বা দড়ি”)
(খ) টো-নো-আগা-ও (মাথা ধরা লোক”)
(গ) হা-ডে-আ-চুন-নেন্ট-হা (“নিজেকে গিলছে”)–এরা কচ্ছপ গণের সাকেম।
৩–(ক) ডা-ওয়া-ডা-ও-ইও (“প্রতিধ্বনির জায়গা”)
(খ) গা-নে-আ-ডুস-হা-ইয়েহ (“মাঠে যুদ্ধশিবির”)
(গ) হ-উস-হা-ডা-ও (“নিজেকে উত্তপ্তকারী”) এরা ভালুক গণের সাকেম।
ওনোনগা গোষ্ঠী
১–(ক) টো-ডো-ডা-হো (“আটকে যাওয়া তালুক গণ)
(খ) টো-নেস-সা-আহ
(গ) ডা-আট-গা-ডোস (“পাহারাদার ভালুক গণ)। এই সাকেম ও এর পূর্ববর্তী সাকেম ছিল টো-ডো-হোর উত্তরাধিকার সূত্রে পরিষদ সদস্য, এরা খুব সুনাম অর্জন করে।
২- (ক) গা-নেয়া-ডা-যে-ওয়েক (“তিক্ত দেহ” কাদাখোঁচা গণ)
(খ) আহ-ওয়া-গা-ইয়াট (কচ্ছপ গণ)।
(গ) ডা-আ-ইয়াট-গওয়া-এ।
৩–হো-নো-উই-না-টো (নেকড়ে গণ। এই সাকেম ওয়ামপুমদের উত্তরাধিকার
সূত্রে নির্ণীত সাকেম।)
৪- (ক) গা-ওয়া-না-সান-ডো (হরিণ গণ)
(খ) হা-এ-হো (হরিণ গণ)
(গ) হো-ইও-নে-আ-নে কচ্ছপ গণ)
(ঘ) সা-ডা-উন-সেহ (ভালুক গণ)
৫– (ক) সা-সো-গা-হা (“এক ঝলক দেখা” হরিণ গণ)
(খ) হোসা-হা-হো (“চাবড়ামুখো” কচ্ছপ গণ)
(গ) স্কা-নো-উন-ডে (“নদীর ওপরে” কচ্ছপ গণ)
ক্যাম্বুগা গোষ্ঠী
১– (ক) ডা-গা-ইয়া-ও (“ভীত ব্যক্তি”, হরিণ গণ)
(খ) ডা-যে-নোড়া–ওয়েহ-ও (সারস গণ)
(গ) গা-ডা-গউন-সা (ভালক গণ)
(ঘ) সো-ই-ওয়াসে (ভালুক গণ)
(ঙ) হা-ডে-আস-ইও-নো কচ্ছপ গণ)
২–(ক) ডা-ইও-ও-ইও-গো (জানা যায় নি)
(খ) যোট-হো-উইহ-কো (“খুব শীতল”, কচ্ছপ গণ)
(গ) ডে-আ-ওয়াটে-হো (সারস গণ)
৩–(ক) টো-ডা-এ-হে কাদাখোঁচা গণ)
(খ) ডেস-গা-হেহ (কাদাখোঁচা গণ)।
সেনেকা গোষ্ঠী
১–(ক) গা-নে-ও-ডি-ইও (“সুন্দর হ্রদ,” কচ্ছপ গণ)
(খ) সা-ডা-গা-ও-ইয়াসে (“সমতল স্বর্গ, কাদাখোঁচা গণ)
২–(ক) গা-নো-গি-এ (কচ্ছপ গণ)।
(খ) সা-গেহ-জোওয়া (“বড় কপাল”, শ্যেন গণ)
৩–(ক) সা-ডে-আ-নে-উস (“সহকারী”, ভালুক গণ)
(খ) নিস-হা-নে-আ-নেণ্ট (“পড়ন্ত বেলা”, কাদাখোঁচা গণ)
৪–(ক) গা-নো-গো-এ-ডা-উই (“চুল পোড়া”, কাদাখোঁচা গণ)।
(খ) ডো-নে-হো-গা-উইহ (‘মুক্ত দ্বার”, নেকড়ে গণ)
মোহক্ সাকেমদের মধ্যে দুজন মৃত্যুর আগে বলে যায় যে তাদের মৃত্যুর পর যেন কাউকে গ্রহণ না করা হয়। তাদের কথা অনুযায়ী আর কাউকে নেওয়া হয় নি এবং পদ দুটি ছিল শূন্য। এই দুজনের পদ শূন্য থাকায় সাধারণ পরিষদে মোট সদস্য ছিল আটচল্লিশ।
প্রতিটি সাকেমের একজন করে সহকারী ছিল এবং গণ কর্তৃক নির্বাচিত হত এবং সাকেমদের মতো অভিষেকের সাহায্যে তাদের গ্রহণ করা হত। তার কাজ হল প্রধানের সাথে সাথে থাকা, কোনো দরকারে সাহায্য করা, দূত হিসেবে কাজ করা, ইত্যাদি। যদি প্রধান সাকেম মারা যায় তার সহকারীই সাধারণত নির্বাচিত হবার সুযোগ পায়। ইরোকোয়াদের ভাষায় “বড় বাড়ির যুগল”। এই বড় বাড়ি মিত্রসংঘের প্রতীক।
মূল সাকেমদের নামে অন্যান্য সাকেমদের নামানুকরণ হয়। যেমন সেনেকা গোষ্ঠীর গা-নে-ও-ডি-ইও যদি মারা যায়, নূতন সাকেম হবে কচ্ছপ গণ থেকে এবং তার নাম। হবে পূর্বের সাকেমের নামে। অভিষেকের সময় তার নিজের নাম নিয়ে নেওয়া হবে। সেই আদি ব্যাপারটা এখনো চলে আসছে। বর্তমান ইরাকোয়া মিত্রসংঘকে দেখে মনে হয় তারা মিত্রসংঘের আদিম কাঠামোই বজায় রেখেছে, যদিও কিছুটা জটিল হয়েছে। কোনো পদ খালি হলে সাধারণ পরিষদের সভা ডাকা হয়।
পাঁচটি গোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত সরকার সব সময় স্বাধীন ছিল। এ ব্যাপারে কারো সঙ্গে কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাদের অঞ্চল ছিল নির্দিষ্ট সীমায় সীমায়িত। সেনেকাদের আট জন সাকেম ও অন্যান্য প্রধানদের নিয়ে পরিষদ গঠিত করে তারা গোষ্ঠীর স্বার্থ ও শাসনের ভার ঠিক করত। সংগঠন হিসেবে গোষ্ঠী মিত্রসংঘ সৃষ্টির ফলে মোটেই দুর্বল হয়ে পড়ে নি বা তার সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয় নি। এর ব্যবস্থা আমাদের বর্তমান সাধারণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রাদেশিক রাষ্ট্রের মতো। এই প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণ করা উচিত যে। ইরোকোয়ারা ১৭৫৫ সনে তাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সমান ভাষাভাষী দলগুলোকে এক করার সুপারিশ করে।
মিত্রসংঘে প্রতিটি গোষ্ঠীর স্থান ছিল সমান। এ থেকে বোঝা যায় এর মধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি ছিল না। বড় গোষ্ঠীর মিত্রসংঘে যোগ দেবার শর্ত হল তাদের সাকেম সংখ্যা হয় বেশি, যেমন ওনোনগাদের সাকেম সংখ্যা ছিল চৌদ্দ, কিন্তু সেনেকাদের সাকেম সংখ্যা। আট। সাকেম সংখ্যা বেশি হলে পরিষদে যে বেশি প্রভাব বিস্তার করবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু তেমন কোনো অতিরিক্ত আইনগত ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। তা ছাড়া কোনো গোষ্ঠীর সব সাকেম মিলে এক মত ব্যক্ত করত বা বিরুদ্ধতা করত। কোনো জনবিধি সৃষ্টির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীদের মধ্যে মিল হয়ে একমত হলে তবে তা সম্ভব।
মিত্রসংঘে গোষ্ঠীগুলো শুধু নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে সংযুক্ত হয় নি তারা তাদের জ্ঞাতি বন্ধনের গভীর বন্ধনের ফলে এই জোট বাঁধে। মিত্রসংঘ যদিও বাহ্যত গোষ্ঠীগত বন্ধনে আবদ্ধ, আসলে এর মূল প্রথিত গণ ঐক্যের মধ্যে। সর্বত্র কিছু গণ আছে সাধারণ, তাই এই জোট বাধা। মোহক্, ওনাইড, ওনোনগা, ক্যাযুগা বা সেনেকা এরা সবাই একই গণের লোক, এরা ভাই-বোন হিসেবে গণ্য, কারণ তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। তারা পরস্পরকে সেরকম আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। তাদের যখন পরস্পর দেখা হত একে অপরের গণের খবর জানতে চাইত, তারপর জানতে চাইত কোন সাকেমের বংশ। যার জোরে তারা তাদের অদ্ভুত জ্ঞাতি[৫] ধারা নির্ণয় করে নিজেদের সম্পর্ক ঠিক করত। পাঁচটা গোষ্ঠীতেই তিনটে গণ ছিল, সাধারণত তারা হল নেকড়ে, ভালুক ও কচ্ছপ গণ। এগুলো এবং আরো তিনটি গণ ছিল তিনটি গোষ্ঠীতে সাধারণ। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে একই গণ ভিন্ন ভিন্ন কথ্য ভাষায় কথা বলত, কিন্তু তাদের ভাষাগত মৌল অন্বয় এবং গণগত অন্বয়ের জন্যে তারা একে অপরকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করত। গোষ্ঠীর বাইরের এই মিলন এখনো চলে আসছে এবং আদিম কালের মতো প্রাথমিক অবস্থায় বিরাজ করছে। এতে মিত্রসংঘের মূল টানের ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয়। যদি পাঁচটি গোষ্ঠী মিত্রসংঘ থেকে পৃথক হয়ে যায় তাদের আত্মীয় বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে, এটা তারা কিছুটা ধারণা করত। আর তারা যদি কোনো সংঘর্ষে মাতে তাদের জ্ঞাতিগণের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধরতে হবে, নেকড়ে গণ দাঁড়াবে নেকড়ে গণের বিরুদ্ধে, ভালুক গণ ভালুক গণের বিরুদ্ধে, মোটকথা ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে লড়তে হবে। ইরোকোয়াদের ইতিহাস তাই প্রদর্শন করে যে তারা এটা অনুভব করে সবসময় আত্মীয় বন্ধন ও আনুগত্যকে সম্মান দেখিয়েছে। তাদের মিত্রসংঘের এই সুদীর্ঘ কালে তারা কখনো স্বেচ্ছাচার গ্রহণ করে নি। সংগঠনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে নি।
“বড় বাড়ি” (হো-ডে-নো-সোটে) নামে একটা মন্ত্রণালয় ছিল যা তাদের মিত্রসংঘের প্রতীক, আর তারা নিজেদের বলত “বড় বাড়ির লোক” (হো-ডে-নো-সাউ-নি)। এই একমাত্র নামে তারা তাদের চিহ্নিত করত এবং অন্যদের থেকে পার্থক্য বজায় রাখত। মিত্রসংঘ গড়ার ফলে একক গোষ্ঠীগত জীবনের চেয়ে গণ জীবন আরো জটিলতা লাভ করে, যদিও মূলত তা গণভিত্তিক সমাজ। অবশ্য এটা এমন একটা প্রগতির স্তর যেখানে নেশান বা জাতির ভিত্তি দেখা যাচ্ছে এবং এই অবস্থায় ন্যাশনালিটি বা জাতিত্ব প্রায় গড়ে উঠেছিল। একাঙ্গীভবনের এটাই শেষ স্তর। চারটি এথেনীয় গোষ্ঠী একাঙ্গীভূত হয়ে এটিকায় একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলে এবং ক্রমশ তাদের গোষ্ঠীদের নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানা লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে, কিন্তু গোষ্ঠীগত নাম এবং সংগঠন ঠিক আগের মতোই সক্রিয় থাকে, যদিও নিজস্ব স্বাধীন কোনো এলাকা আর নেই। তারপর যখন শহরভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজ উদ্ভূত হয় এবং যখন সবাই মিলে গণ বা গোষ্ঠী বিভেদ ছাড়াই একসাথে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পাকে এখানেই গোষ্ঠীর একাঙ্গীভবন সম্পূর্ণ হয়।
ল্যাটিন এবং সাবাইন গণসমূহের একাঙ্গীভবনের ফলে রোমান জাতির উদ্ভব ঠিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। গণভ্রাতৃত্ব এবং গোষ্ঠী হল মিত্রসংঘের পূর্ব স্তর। কিন্তু ল্যাটিন বা গ্রিকরা বর্বর যুগের শেষ পর্যায়ে সেই অবস্থায় ছিল না, তারা ছিল আলগা-আলগাভাবে গঠিত। তারা রক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক মৈত্রীজোট গঠন করে। ল্যাটিন ও গ্রিসের খবর আমাদের তেমন জানা নেই, সবই কালের বিস্মরণে তলিয়ে গেছে। একাঙ্গীভবনের ব্যাপারটা মিত্রসংঘ সংগঠনের অনেক পরের ব্যাপার। কিন্তু এটা একটা অনিবার্য পূর্বশর্ত যা না হলে জাতি, রাজনৈতিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হত না। ইরোকোয়াদের মধ্যে এই অবস্থা আসার সুযোগ ঘটে নি।
ওনোনডাগা উপত্যকায় ওনোনডাগা গোষ্ঠী ছিল সব গোষ্ঠীর মাঝখানে এবং তাদের ওখানে পরিষদের অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত থাকত, সম্ভবত এই শিখা সর্বদা জ্বলত, আর ওখানে সব সময় মিত্রসংঘের পরিষদের বৈঠক বসত। অবশ্য ওখানেই হতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। বার্ষিক বৈঠক ছাড়াও যে কোনো গোষ্ঠী পরিষদের অধিবেশন ডাকতে পারত। সাধারণত বার্ষিক অধিবেশন বসত শরৎকালে। পরিষদ নিজে নিজে এই অধিবেশন ডাকতে পারত না।
পরিষদের মৌল কাজ হল সাকেমদের গড়ে তোলা ও কোনো সাকেম মারা গেলে বা পদচ্যুত হলে তার জায়গায় নূতন সাকেম নিযুক্ত করা। তা ছাড়া নিজেদের কল্যাণের জন্যে অন্য যে কোনো কাজ সম্বন্ধেও আলোচনা করত। কাজ আরো বাড়ে যখন অন্য গোষ্ঠীদের সাথে কোনো লেনদেন শুরু হয়। এ ছাড়া তাদের কাজ হল জনসাধারণের দায়িত্ব সম্বন্ধে লক্ষ রাখা, শোক পালনের অনুষ্ঠান করা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা। যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি স্থাপন, ইত্যাদি জনকল্যাণের সব দায়িত্ব তার হাতে এসে যায়। সাধারণ পরিষদ ধর্মীয় উৎসবের ব্যবস্থা করে, কিন্তু শোক পরিষদ প্রায় একই রকম উৎসব ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হত। প্রথমে একে বলত শোক পরিষদ, কারণ শাসকের মৃত্যুর অনুষ্ঠান পালন করতে হত।
পাঠকের বিরক্তির কথা জেনেও এদের বেসামরিক এবং শোক পরিষদের কিছু কথা না বলে পারছি না, যা না করলে আদিম সমাজের অনেক কিছুই না বলা থেকে যায়।
বাইরের কোনো কোনো গোষ্ঠী যদি কোনো প্রস্তাব নিয়ে আসে তা পাঁচটি গোষ্ঠীর যে কোনো একটির মাধ্যমে আসতে পারে। গোষ্ঠী পরিষদ তখন ভেবে দেখে এই প্রস্তাব মিত্রসংঘর সাধারণ পরিষদে জানানো দরকার কি না। যদি জানানো দরকার হয় তখন নিকটবর্তী গোষ্ঠীদের ওয়ামপুর বেল্ট পাঠিয়ে জানানো হয় যে অসামরিক পরিষদ (হো-ডে ওস-সেহ) অমুক বিষয় নিয়ে, অমুক সময়, অমুক জায়গায় বসতে যাচ্ছে। পরবর্তী গোষ্ঠীর দায়িত্ব হল এই সংবাদ তার পার্শ্ববর্তী গোষ্ঠীকে জানিয়ে দেওয়া এবং এইভাবে সবাই ব্যাপারটা জেনে নেয়।[৬] নিয়মমাফিকভাবে না ডেকে কোনো পরিষদ বসানো হয় না।
সাকেমরা যখন পরিষদে মিলিত হয় পরিষদের মাঝখানে যে অগ্নিপিও প্রজ্বলিত থাকে তার দুপাশে তারা দু দল হয়ে বসে। এক দিকে মোহক্, ওনোনডগা ও সেনেকা সাকেমরা। এরা হল ভ্রাতৃ-গোষ্ঠী, বাকি দুটো গোষ্ঠীর পিতৃ-গোষ্ঠী। ঠিক একইভাবে বিপরীত গোষ্ঠীদ্বয় পরস্পর ভাই কিন্তু বিপরীত তিনটি গোষ্ঠীর ছেলে। এখানে আমরা গোষ্ঠীভিত্তিক ভ্রাতৃত্বের নীতি দেখতে পাই। দুটো ভ্রাতৃত্ব যেন কাজ করেছে। সেহেতু ওনাইডারা মোহকের বিভক্ত অংশ এবং ক্যায়ুগারা ওনোনডাগা বা সেনেকার অংশ তাই ওরা হল এদের চেয়ে ছোট গোষ্ঠী। তাই পরিষদে যখন গোষ্ঠীদের নাম করা হয় প্রথমে করা হবে। মোহকের। এদের গোষ্ঠী চিহ্ন “ঢাল” (ডা-গা-এ-ওড়া)। এর আগে ওনোনডাগা; এদের গোষ্ঠী চিহ্ন নামধারী” (হো-ডে-সান-নো-গে-টা)। কারণ এদের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে পঞ্চাশ জন মূল সাকেম নির্বাচনের।[৭] এরপর সেনেকা, তার চিহ্ন “দ্বাররক্ষী” (হো-নান-নে-হো-ওনটে)। তারা “বড় বাড়ির পশ্চিম দরজার স্থায়ী “দ্বাররক্ষী” ছিল। ওনাইডাদের চিহ্ন হল “বিশাল দক্ষ” (নে-আর-ডে-অন-ডার-গো ওয়ার)। ক্যায়ুগার চিহ্ন হল “বড় নল” (সোনুস-হোগওয়ার-টু-ওয়ার)। টুসকারোরারা যেহেতু পরে যোগ দেয় তাদের পালা আসে সবশেষে। আদি সমাজের এ ধরনের রূপটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
বাইরের গোষ্ঠীরা তাদের জ্ঞানী লোকদের এবং গোষ্ঠীপ্রধানদের পাঠিয়ে দিত পরিষদের বৈঠকে–তারা সেখানে তাদের মতামত ব্যক্ত করত। প্রথাগতভাবে পরিষদ শুরু হবার পরই একজন সাকেম সমস্ত প্রতিনিধিদের পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাদের এই একত্র হবার সুযোগ ঘটার জন্যে সব মহা-ভৌতিক শক্তিকে ধন্যবাদ জানায়। তারপর সে প্রতিনিধিদের জানায় যে পরিষদ এখন তাদের কথা শোনার জন্যে প্রস্তুত। তারপর কোনো প্রতিনিধি তার তথ্য প্রকাশ করে। যাতে সবাই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে পারে পরিষদ সেদিকে ভালোভাবে নজর দিত। নিজেদের দলের পক্ষে ভাষণ দিয়ে প্রতিনিধি পরিষদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করত ফলাফল জানার জন্যে। এরপরের কাজ হল সাকেমদের। তারা বাদানুবাদ করে একমত হলে তবেই তাদের কাজ শেষ। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেলে একজনের ওপর ভার পড়ত প্রতিনিধিকে সেটা বুঝিয়ে দেবার জন্য। এই বক্তা সাধারণত নেওয়া হয় সেই গোষ্ঠী থেকে যারা পরিষদ আহ্বান করেছে। যেখানে মতের মিল হত সেক্ষেত্রে ঝিনুকের বেল্ট, যাকে তাদের ভাষায় বলে ওয়ামপুর, বিনিময় করা হয়। এখানেই পরিষদের কাজ শেষ।
“এই বেন্ট আমার কথা রক্ষা করবে” ইরোকেয়া পরিষদের প্রধানের মন্তব্য হল এটা। এই কথা বলে সে তার কথার চিহ্নস্বরূপ বেন্ট দিয়ে দেয়। বিপরীত দলের হাতে এমনি অনেক বেল্ট দেওয়া হয় কোনো মধ্যস্থতার সময়। যে কথাগুলো মেনে নেওয়া হল তার জন্যে এই পক্ষ একটা করে বেল্ট ফেরত দেবে। তারা হয়তো বিশেষ কোনো কারণে হিসেব রাখা দরকারি মনে করত।
যে কোনো ব্যাপারই হোক সাকেমদের একমত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কোনো জনবিধি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। মিত্রসংঘের এই ছিল একটা প্রধান রীতি।[৮] সদস্যদের মত জানার জন্যে ভোট নেওয়া হত। পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা সংখ্যালঘিষ্ঠতা সম্বন্ধে তারা ছিল অজ্ঞ। কোনো সাকে তার নিজের মতামত দিতে পারে না যতক্ষণ না তার গোষ্ঠীর সাকেমরা একমত হয়। এইভাবে দেখা যাচ্ছে আট জন সেনেকা সাকেমদের চারটি শ্রেণী, তাই তাদের চার রকম মতামত হতে পারে। প্রথমে এক এক শ্রেণীর সাকেমদের একমত হওয়া দরকার। তারপর এই চার শ্রেণীর সাকেমদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলে। যাতে তারা আবার একমতে আসতে পারে। একমত হলে একজনকে ঠিক করে যে তাদের পক্ষ হয়ে বলবে, যা সেই গোষ্ঠীরও মত। বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাকেমরা একমত হলে পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু একমত হতে না পারলে সব কিছুই বিফলে যায় এবং পরিষদ ভেঙে যায়। পাঁচটি গোষ্ঠীর পাঁচ জন প্রতিভূর কাজ দেখে সব ব্যাপারটার ব্যাখ্যা মেলে। আজটেক মিত্রসংঘে এই একই পদ্ধতি ছিল।
এইভাবে প্রতিটি গোষ্ঠীকে সমান ক্ষমতা দান করা হয়। কখনো কোনো সাকেম যদি একরোখা হয়ে ওঠে বাকি সবাই তাক বোঝানোর চেষ্টা করে। তাতেও যদি বিফল হয় সমস্ত জিনিসটাই ভেস্তে যায়।
পরিষদের মূল কাজের মধ্যে শোক পালন একটি, যাকে বলে শোকনিমিত্ত পরিষদ (হেন-নুন-ডো-নুহ-সেহ), যখন কোনো সাকেমের মৃত্যু হয় তার জায়গায় নূতন সাকেম নিয়োগের ব্যাপারটা লোকেরা খুব উৎসাহের সাথে গ্রহণ করে। সাকেমদের নির্বাচন ও কাজ শেখানো সাধারণ পরিষদের মূল কাজ। সাধারণ পরিষদ বিশেষ একটা দিনক্ষণ ঠিক করে অভিষেক সম্পন্ন করে। সাধারণত মৃত সাকের্মের কোমরের ঝিনুকের ওয়ামপুম নূতন সাকেমকে পরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় এই ওয়ামপুম ওনোনডাগায় যেখানে পরিষদের অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হল যে মৃত সাকেমকে সৎকার করে ফেলা হয়েছে।
ইরোকোয়াদের সমাজ জীবনে এই উৎসব ও শোকনিমিত্ত পরিষদের ব্যস্ততা ভীষণ একটা সাড়া জাগায়। বহু দূরাঞ্চল থেকে লোকজন এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে আসে। উৎসব পাঁচ দিন ধরে চলে। প্রথমে ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে বিগত সাকেমের জন্যে শোক প্রকাশ করা হয়। সূর্য ওঠার ঠিক সাথে সাথে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই সময় অন্যান্য সাকেমরা তাদের গোষ্ঠীর লোকজন নিয়ে মার্চ করতে করতে এগিয়ে আসে অন্যান্য গোষ্ঠীর সাকেম ও অপেক্ষমাণ লোকজনদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে নেবার জন্য। যারা অনেক আগেই এই শুভ দিনের জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। পরস্পর অভিনন্দন বিনিময়ের পর কবিতার আকারে তারা সমস্বরে শোকগাথা আওড়াতে আওড়াতে পরিষদ যেখানে বসবে সেদিকে এগোতে থাকে। গোটা মিত্রসংঘই মৃত সাকেমের গুণগান করে। এ থেকে বর্বর জনগোষ্ঠীরা কেমন করে তাদের প্রধানদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার নমুনা মেলে। এই অংশের কাজ ও উদ্বোধনী উৎসব হতে হতেই প্রথম দিনের কাজ শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন নূতন সাকেমের অভিষেক শুরু হয় এবং এই অনুষ্ঠান চলে চতুর্থ দিন পর্যন্ত। সাধারণ পরিষদের মতো এখানেও সাকেমরা দু ভাগে ভাগ হয়ে বসে। যখন বড় তিন গোষ্ঠীর মাঝ থেকে সাকেম অভিষিক্ত হয় তখন অনুষ্ঠান পরিচালনা করে ছোট গোষ্ঠীর সামেরা এবং নূতন সাকেমকে পিতা হিসেবে অভিষিক্ত করে। আর যদি ছোট গোষ্ঠী থেকে সাকেম অভিষিক্ত হয় তখন বড়রা এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করে এবং নূতন সাকেমকে পুত্র হিসেবে অভিষিক্ত করে। এই বিশেষ পরিস্থিতি থেকে তাদের সামাজিক এবং সরকারি সংগঠনের অদ্ভুত চরিত্রের পরিচয় মেলে। ইরাকোয়াদের কাছে এই ধরনের লৌকিকতা ও বিভিন্ন সব ভাষণের বিশেষ এক গুরুত্ব বহন করে।
অন্যান্য জিনিসের মধ্যে সেই পুরোনো ওয়ামপুম বেল্টের সাথে মিত্রসংঘের যে নীতি সূত্র জড়িত তা নূতন সাকেমের সামনে পুনর্বার ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়। কোনো একজন বিজ্ঞ লোক, সাকেঁদের কেউ না হলেও চলে, ওয়ামপুমগুলো নিয়ে দুই অংশের সাকেমদের সামনে যাতায়াত করে যে সমস্ত কথা বোঝানো হয়েছে জানিয়ে দেয়। ইণ্ডিয়ানদের ধারণা ওয়ামপুমে যে প্রতীক আছে তা কোনো ব্যাখ্যাকারী বুঝিয়ে দিতে পারে। ওয়ামপুমের একটা দড়িতে লাল রঙে ছোট ছোট ঝিনুক বাঁধা থাকে অথবা নানা ধরনের ঝিনুক, এই ঝিনুকগুলো বিশেষ কাজের প্রতীক হিসেবে বাধা হয়েছে। এই ঝিনুক দেখে সেইসব কাজ ও দায়িত্ব সম্বন্ধে জানিয়ে দেওয়া হয়। দড়িতে বাধা এই ঝিনুকগুলোই ইরোকোয়াদের একমাত্র দৃশ্যগ্রাহ্য দলিল। কিন্তু এসবের ব্যাখ্যার জন্যে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ কোনো লোককে ডাকা হয়, যে তার স্মৃতি থেকে এসব প্রতাঁকের অর্থ বলে যায়। ওনোনগাদের একজন সাকেমকে এই কাজের ভার দেওয়া হয়। তার সাথে আরো দুজন নিযুক্ত করা হয় যারা ব্যাপারটা শিখে নিয়ে অনুষ্ঠানের সময় কবিতার মতো আউড়ে যাবে এবং ব্যাখ্যা করে দেবে। মিত্রসংঘ গঠিত হবার সময় বিজ্ঞ লোকদের ভাষণে এইসব ওয়ামপুমের (বেল্টের দড়ি ও ঝিনুকের ব্যাখ্যা থাকে। তাই সাকেঁদের শিক্ষা পরিষদকে এইসব ব্যাখ্যা ভালো করে জানতে হয় এবং নূতন করে এইসব কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। মিত্রসংঘের নীতি ও কাঠামো ও ইরোকোয়াদের ইতিহাস নূতন করে বারবার মনে করিয়ে দেয়। এই ওয়ামপুমে যেসব নীতি ও কাহিনী অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে সেই ঐতিহ্য বারবার তাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এই অনুষ্ঠান প্রতিদিন দুপুর পর্যন্ত চলে। বিকেলে চলে খেলাধুলা ও আমোদ প্রমোদ। ঠিক গোধূলি কালে উপস্থিত সবাইকে নৈশভোজ দেওয়া হয়। খাবার হল সিদ্ধ মাংস ও স্যুপ। পরিষদ ভবনের কাছেই খাবার রান্না করা হয় এবং সরাসরি চুলোর ওপর থেকে খাবার উঠিয়ে পরিবেশন করা হয়। খাওয়া শুরু হবার আগে একজন ত্বারস্বরে গলা ছেড়ে গুণগান করতে থাকে, পরে সবাই তার সাথে গলা মেলায়। তারপর সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় নাচ! এই উৎসব বেশ কদিন চলে এবং এরপরই সাকেমরা তাদের পদলাভ করে।
সাধারণপরিষদের মাধ্যমে সাকেম নিযুক্ত করার ক্ষেত্রে মিত্রসংঘ সংগঠকদের মাথায় ছিল তিনটি ইচ্ছা, গণের উত্তরাধিকার স্থায়ী করা, একটা স্বাধীন নির্বাচন এবং এই উৎসবের মাধ্যমে সবকিছু একবার পুরোপুরি খতিয়ে নেওয়া। এই ব্যবস্থা খাটাতে গেলে তাদের হাতে এমন ক্ষমতা থাকা উচিত যাতে তারা মনোনীত ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। এই ব্যাপারটা ঠিক কাজে লাগানো হয়েছিল কি না সেসম্বন্ধে আমার ঠিক জানা নেই। কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করার খবর পাওয়া যায় নি। ইরাকোয়াদের শাসনব্যবস্থায় এই সাকেম ব্যবস্থাকে নানা দিক থেকে বিচার করে বলা যায় এর একটা নিজস্বতা আছে এবং তাদের নিজস্ব পরিবেশের জন্যে এটা খুবই সুখকর হয়েছিল। এটা অল্প কয়েকজনের শাসন বা অলিগার্কি ধরনের শাসন ব্যবস্থা হলেও এটা সম্পূর্ণভাবে আদিম প্রতিনিধি প্রেরণমূলক গণতন্ত্র। জনসাধারণের নিজস্ব মতামতের একটা প্রবল ক্ষমতা এর ওপর কাজ করেছে। দেখা গেছে সাকেম বা প্রধানদের নির্বাচন বা বহিষ্কারের ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদ গণের মতামত শোনে। একজন বক্তা গণের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করে। তা ছাড়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাদের স্বেচ্ছাসেবাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এই সময়ের এবং ঠিক এর পরবর্তী জাতিতত্ত্বমূলক অধ্যায়েও গণসমাজে গণতান্ত্রিক নীতি ছিল প্রবল।
ইরাকোয়া ভাষায় একজন সাকেমের নাম হল, হো-ইয়ার-না- গো-ওয়ার, ‘জনসাধারণের একজন কৌসুলি’, এই ধরনের স্বাধীন গণতন্ত্রে একজন শাসকের নাম এটা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। এতে শুধু ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট নয়, বরং এটা গ্রিসের প্রধানদের পরিষদের সাথে তুলনীয়। গ্রিক প্রধানদের বলা হত ‘জনসাধারণের কৌসুলিগণ’।[৯] সাকেম পদের প্রকৃতি অনুযায়ী তারা একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক হতে পারে না, বরং জনসাধারণের মুক্ত নির্বাচনের জোরে তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। যে পদ্ধতি আদিম পর্যায়ে গড়ে উঠেছিল সেই পদ্ধতি আদিম পর্বের পরবর্তী তিন পর্যায় ও বর্বর যুগের পর্যায়েও চলে এবং গ্রিকদের মধ্য দিয়ে তা সভ্যতা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। গণভিত্তিক সমাজে গণতন্ত্র কী অপূর্বভাবে কাজ করেছে এ থেকে সেটিই বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
দ্বিতীয় স্তরের একজন প্রধানের পদ হল, হা-সা-নো-ওয়া-না, একটা উন্নত নাম’, এ থেকে বোঝা যায় বর্বররা ব্যক্তিগত উচ্চাশাকেও কীভাবে উৎসাহ দান করেছে। মানুষের প্রগতির ক্ষেত্রে সবাই যে সমান এতে সে কথাও প্রকাশ পায়। বাী, জ্ঞানী-গুণী এবং সেনাপতি এরা সবই দ্বিতীয় স্তরের প্রধান। এর একটা বড় কারণ সাকেমদের শুধু শান্তির কাজেই নিয়োগ করা হয়। সব দিক থেকে সেরা লোকদের বাদ দেওয়া হয় কারণ তাদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাজের ক্ষতি করবে। প্রধানদের পদ যেহেতু যোগ্যতা অনুসারে নির্ধারিত হয় তাই তা সবচাইতে কর্মক্ষম বা সেরা লোকের হাতে পড়ত। রেড জ্যাকেট, ব্রাশুট, গ্যারানগুলা, কর্নপ্ল্যান্টার, ফ্রস্ট, জনসন এবং আরো নামকরা ইরোকেয়া প্রধানরা সাকেম থেকে বিশিষ্ট এবং নামকরা লোক। আমেরিকার বর্ষপঞ্জির মধ্যে লোগান,[১০] হ্যাণ্ডসাম। লেক[১১] ও আজকাল ইলি এস.পার্কার[১২] ছাড়া তেমন কোনো সাকেমের নাম জায়গা পায় নি। ইরোকোয়াদের বাইরে তাদের নাম তেমন বিশিষ্ট হয়ে ওঠে নি।
যখন মিত্রসংঘ সংগঠিত হয় ওনোনগা প্রধানদের মধ্যে টো-ডো-ডা-হো ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী ও নামকরা। মিত্রসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই পদ অধিকার করে সে অনুভব করে তার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু অন্যের চোখে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ওনোনডগ গোষ্ঠীর সাকেম নির্বাচিত হয় এবং সাকেমদের তালিকায় তার নাম ছিল প্রথমে। তাকে সাহায্য করার জন্য দুজন সহকারী সাকেমও নির্বাচিত হয় এবং তাদের কাজ শিখিয়ে নেওয়া হয়। তখন থেকে এই টো- ডো-ডা-হা-এর পর থেকে ইরোকোয়াদের মধ্যেও সাকেম পদ খুব সম্মানজনক হয়ে ওঠে। ইরোকোয়াদের মধ্যে যে এই পদে থাকত অতি উৎসাহী উপনিবেশবাদীরা শীঘ্রই তাকে রাজার পদে উন্নীত করে। কিন্তু তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা শীঘ্রই দূর হয় এবং ইরাকোয়াদের মধ্যে এই অসম্ভব ধারণা যে খাপ খায় না তা তারা বুঝতে পারে। সাধারণ পরিষদে সে তার সমকক্ষদের সাথে আসন গ্রহণ করে। তা ছাড়া মিত্রসংঘের কোনো প্রধান কর্মাধ্যক্ষও ছিল না।
গোষ্ঠীসমূহের মিত্রসংঘ জোট বাঁধার সময়ে প্রথম প্রধান সেনাপতির হোস-গা-আ গেহ-ডা-গো-ওয়া) পদের আবির্ভাব ঘটে। দেখা যাচ্ছে গোষ্ঠীরা কোনো যুদ্ধে লিপ্ত হলে মিলিত সেনাদের পরিচালনা করার জন্যে একজন সাধারণ সেনাপতির প্রয়োজন। এই পদের অবতারণা মানব ইতিহাসের প্রগতিতে একটা পদক্ষেপ। এখান থেকে শুরু হয় সাধারণের শাসন থেকে সামরিক বিভাগের পৃথকীকরণ। কিন্তু পরবর্তী যুগেও যখন সামরিক মনোভাব প্রবল ছিল বুঝতে হবে সরকারের আসল চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। গণচেতনা কোনো রকম বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয় নি। সাধারণ সেনাপতির পদ সৃষ্টি হবার পর থেকে সরকারের ক্ষমতা এক জায়গা থেকে দু জায়গায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্রমশ সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়ায় দু-এর মধ্যবর্তী ক্ষমতা হিসেবে কাজ করা। এই নূতন কাজের জন্য একজন প্রধান কর্মাধ্যক্ষের বীজ রোপিত হয়। এই সাধারণ পদ থেকেই আসে রাজা, সম্রাট, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি। এই পদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে সামরিক প্রয়োজনে এবং এই উন্নয়ন খুব ন্যায়সঙ্গত। এর আবির্ভাব এবং উন্নয়নের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই খণ্ডে ঠিক জায়গায় এর প্রগতিমূলক উন্নয়নের ব্যাপারটা আমরা আলোচনা করব, দেখব কীভাবে ইরোকোয়াদের সেনাপতি, আজটেকদের টয়লি, গ্রিকদের ব্যাসিলিয়ুস ও রোমান গোষ্ঠীদের রেক্স-এ এর রূপান্তর ঘটে। সমস্ত জাতিতত্ত্বমূলক যুগে তাদের সবার মধ্যে এই পদটি একই ছিল, অর্থাৎ সামরিক গণতন্ত্রের সেনাপতি। ইরোকোয়া, আজটেক ও রোমানদের মধ্যে পদটা ছিল নির্বাচনমূলক বা কোনো একটা দল কর্তৃক স্থিরকৃত। অনুমান করা হয় গ্রিকদের মধ্যেও তা-ই ছিল। বলা হয়ে থাকে গ্রিকদের মধ্যে হোমারীয় যুগে ব্যাসিলিযুস পদ ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ণীত, অর্থাৎ পিতার পর পুত্র পদাভিষিক্ত হত। এই ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক। আসল চরিত্র থেকে এটা এত দূরে যে এ ধরনের বিষয় স্থাপিত করতে গেলে প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রয়োজন। গণ সমাজে নির্বাচন বা কোন দল কর্তৃক মনোনয়ন করার ব্যাপারটাই বেশি গ্রাহ্য হয়। যদি বেশির ভাগ জায়গাতে দেখা যেত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে চলছে, অর্থাৎ পিতার পর পুত্র পদাভিষিক্ত হচ্ছে, ইতিহাসে বা সভ্যতায় এসে যার নমুনা আমরা পাচ্ছি, তা হলে এ কথা মেনে নেওয়া যেত। দুর্ভাগ্যবশত সেই সমস্ত সমাজের পূর্ণ তথ্য এখনো আমাদের হাতে এসে পৌঁছয় নি। মানুষের আচরণের সূত্র নির্ধারণ করা তখনই সম্ভব যখন পূর্ণ তথ্য মিলবে। সম্ভবত উত্তরাধিকার নীতি প্রথমে গায়ের জোরেই চালিত হয়, পরে তা করা হয় জনসাধারণের মতামত নিয়ে। গ্রিক গোষ্ঠীসমূহের হোমারীয় যুগে এই পদ্ধতি চালু ছিল না।
ইরোকোয়া মিত্রসংঘ গঠিত হবার পর দুজন স্থায়ী সেনাপতি নিযুক্ত করা হয় এবং তাদের নামানুকরণ করা হয়। আর দুজনকেই করা হয় সেনেকা গোষ্ঠী থেকে। নেকড়ে গণের মাঝ থেকে একজনকে উত্তরাধিকার সূত্র অনুযায়ী নিয়োগ করা হয়, আর একজনকে করা হয় কাছিম গণ থেকে। দুজনকে সেনেকা গোষ্ঠী থেকে দেওয়া হয় এই জন্য যে আক্রমণটা পশ্চিম দিক থেকে আসার সম্ভাবনা, আর সেনেকারা পড়ে ওদিকে। সাকেম নির্বাচনের মতো এদের নির্বাচিত করা হত এবং সাধারণ পরিষদ এদের কাজ শিখিয়ে নিত। তারা পদ ও ক্ষমতায় ছিল সমান। আর এক তথ্যে জানা যাচ্ছে এদের পদ আরো পরে সৃষ্টি করা হয়। মিত্রসংঘ গঠিত হবার পরই তাদের কাছে সাধারণ পরিষদের অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে যে সামরিক শক্তি পরিচালনার জন্য কোনো পরিচালক ঠিক করা হয় নি। এই ভুল সংশোধনের জন্য পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয় যেখানে এই দু জন সামরিক নেতা ঠিক করা হবে। সাধারণ সেনাপতি হিসেবে তাদের কাজ হল যুদ্ধকালীন মিলিত সেনাদের চালনা করা এবং তাদের গোষ্ঠীর সেনাদের সাথে সংযোগ রক্ষা করা। কয়েক বছর আগে মৃত গভর্নর ব্ল্যাকস্নেক এই পদের প্রথমোক্তটিতে নিযুক্ত ছিলেন এবং দেখা যায় উত্তরাধিকার ব্যাপারটা রীতিমতো চলে আসছিল। দুজন সেনাপতি নির্বাচন করার পেছনে একটা সূক্ষ্ম চাল কাজ করছে; দুজনই ক্ষমতায় সমান, তাই একজনের ভুল আর একজন ধরতে পারবে। সামরিক ব্যাপারেও যাতে একনায়কত্ব না চলে তাই এই ব্যবস্থা। তারা অবশ্য এটা বিনা অভিজ্ঞতা থেকে করেছিল, পরে যেটা রোমানরা অভিজ্ঞতা থেকে করে, রেক্স পদ বিলোপ করে দুজন কনসাল নিযুক্ত করে। দুজন কনসাল হবার পরে তারা সামরিক শক্তির সমতা বিধান করবে এবং একে অপরকে সর্বেসর্বা হবার সুযোগ থেকে রহিত করবে। ইরোকোয়াদের মধ্যে অবশ্য এই পদ কখনো তেমন প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে নি।
আমেরিকান ইণ্ডিয়ান জাতিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ফলে যে মৌল বিষয়গুলো দেখা যায় তা হল গণ, ভ্রাতৃত্ব, গোষ্ঠী এবং মিত্রসংঘ। এগুলোই সামাজিক সংগঠনের মূল। এরপর আসছে সাকেম এবং প্রধানদের পদ ও তাদের দায়িত্ব, প্রধানদের পরিষদের দায়িত্ব এবং সবশেষে প্রধান সমর-নেতার পদ ও কার্যাবলি। এগুলো নির্ধারণ করতে পারলে সরকারের কাঠামো ও নীতি জানা হয়ে যায়। রীতি-প্রথা, শিল্প ও উদ্ভাবন এবং তাদের জীবনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে জ্ঞাত হলে বাকি ছবিটুকু পূর্ণ হয়। আমেরিকান পর্যবেক্ষকগণ প্রথমোক্ত বিষয়ে খুব অল্প নজর দিয়েছেন। উক্ত বিষয়ে এখনো প্রচুর তথ্য নেবার আছে। আমাদের বর্তমান জ্ঞান বড় সাধারণ, তাকে এখন বিশেষ ও তুলনামূলক করা উচিত। আদিম অবস্থা থেকে সভ্যতায় আসা পর্যন্ত মাঝের দুই পর্যায়ের দেখা মেলে মার্কিন ইণ্ডিয়ানদের মধ্যে। আমাদের অতীত পূর্বপুরুষগণ একের পর এক ঐ একই অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, ঐ একই রকম প্রতিষ্ঠান তাদের মাঝে গড়ে উঠেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমেরিকান ইণ্ডিয়ানদের জন্য আমাদের যত কম টান থাকে, তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের খুব ভালোভাবে জানায় যে আমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার উদাহরণ এগুলোই। আমাদের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল রয়েছে তার পূর্বের গণভিত্তিক সমাজে, যেখানে গণ, ভ্রাতৃত্ব এবং গোষ্ঠী হল সংগঠনের প্রধান ক্রম এবং প্রধানদের পরিষদ হল সরকারি কর্মের মূল হোতা। তাদের অনেক বিষয় ইরোকোয়া এবং অন্যান্য ইণ্ডিয়ানের মতো এক। মানবজাতির প্রতিষ্ঠানসমূহের তুলনামূলক পাঠের ক্ষেত্রে এই অভিমত নূতন দৃষ্টিকোণ খুলে দেবে।
গণভিত্তিক সামাজিক সংগঠনের একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল ইরাকোয়া মিত্রসংঘ। এতে মনে হয় গণভিত্তিক সমাজের সমস্ত প্রতিষ্ঠান বর্বর যুগের নিম্ন পর্যায়েই তারা অনুভব করেছিল। এই অবস্থা আরো উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়, কিন্তু অঞ্চল এবং সম্পত্তিভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজ গঠনের পরিকল্পনা তখনো তাদের ছিল না, যা স্থাপিত হলে গণভিত্তিক সংগঠনকে অপসারিত করে। ইরোকোয়ারা একটা ক্রান্তিকালে এসে আটকে ছিল, যার শেষ ধাপ হল সামরিক গণতন্ত্র। এ ছাড়া ব্যতিক্রম হিসেবে দু-এক জায়গায় দেখা যায় সাময়িকভাবে স্বেচ্ছাচার স্থান করে নিয়েছে। ইরাকোয়াদের গণতন্ত্র মূলতই ছিল গণতান্ত্রিক। কারণ এর মূলে আছে গণ সংগঠন, যার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ না হলেও আদিম ধরনের গণতন্ত্র কাজ করত। তা ছাড়া প্রতিটি গোষ্ঠীর ছিল স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সরকার। তারা অন্য গোষ্ঠীকে পরাজিত করে নিজেদের আওতায় আনত, যেমন ডেলাওয়ার গোষ্ঠী, কিন্তু উক্ত গোষ্ঠী তাদের নিজেদের প্রধানদের নিয়ে যে সরকার তার অধীন ছিল। মিত্রসংঘের ক্ষমতায় তাদের কোনো অবদান নেই। এই ধরনের সমাজে তখন বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক সরকারের আওতায় কাজ করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার, কারণ তাদের ভাষা ছিল পৃথক। এ ছাড়া বিজিত গোষ্ঠীর কাছ থেকে কর আদায় করার লাত ছাড়া অন্য কোনো লাভ ছিল না।
ইরোকেয়া মিত্রসংঘের যেসব খবর পাওয়া গেছে তা যদিও পুরো তথ্য নয়, তবু বর্তমান উপাদান দিয়ে অনেক প্রশ্নের সন্তোষনক উত্তর পাওয়া যায়। ইরোকোয়ারা খুব উৎসাহী ও বুদ্ধিমান জনসমষ্টি। তাদের মস্তিষ্কের উৎকর্ষ প্রায় গড় আর্যদের সমান। বাগিতায় পারঙ্গম, যুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ, অদম্য অধ্যবসায় ইত্যাদি গুণের জোরে ইতিহাসে তারা বিশেষ একটা স্থান করে নিয়েছে। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আদিম মানবসুলভ নৃশংস, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা মানবজাতির এক মহান পুণ্যি বলতে হবে। যে মিত্রসংঘ তারা গড়ে তুলেছিল তা তাদের দূরদৃষ্টি ও বিজ্ঞতার জ্বলন্ত নিদর্শন। শান্তি ছিল এর অন্যতম স্বীকৃত বিষয়। তারা তাদের বিবাদের কারণ দূর করার চেষ্টা করেছে একই সরকারের আওতায় এসে। এইভাবে দেখা গেছে এরি ও নিউট্রাল নেশান নামক গোষ্ঠীকে এই মিত্রসংঘে যোগ দিতে প্ররোচিত করে। তারা যোগ দিতে অসম্মত হলে নিজেদের সীমান্ত থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়। এক সরকারের আওতায় আসা থেকে তাদের বিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টির প্রমাণ মেলে। তাদের লোকসংখ্যা খুব একটা বিশাল ছিল না, কিন্তু উচ্চপদে বিশেষ যোগ্য লোককে জায়গা দিত। এতে তাদের লোকজনদের উচ্চমানের কথা প্রমাণ করে।
তাদের অবস্থা ও সামরিক ক্ষমতার জোরে তারা উত্তর আমেরিকায় ইংরেজ এবং ফরাসি এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর ভীষণ প্রভাব বিস্তার করে। যেহেতু উপনিবেশের প্রথম শতকে দু-এরই ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ছিল সমান, তাই নিউ ওয়ার্ল্ড অঞ্চলে ফরাসিরা ইরাকোয়াদের ক্ষমতার কথা ভেবে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা বাতিল করে।
গণের আদিম আকার সম্পর্কে জ্ঞান এবং সামাজিক পদ্ধতিতে একক হিসেবে এর যে সম্ভাবনা তা জানার পর গ্রিক ও রোমের গণসমূহের বুঝতে সাহায্য করবে। গ্রিক ও রোমানরা সভ্যতার দ্বারপ্রান্তে এসে ঠিক ইরোকোয়াদের মতো গণ, ভ্রাতৃত্ব ও গোষ্ঠী এই সামাজিক সংগঠনের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের সমাজ সংগঠিত করে। প্রায় দুই জাতিতত্ত্বমূলক পর্যায় তাদের অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছে। পুরুষ ধারায় বংশ পরিচয় নির্ণয় করা হচ্ছে, সম্পত্তি পেত ছেলেমেয়েরা, তা ছাড়া পরিবার পদ্ধতি দাঁড়িয়েছে একবিয়ে পরিবারে। সম্পত্তির বৃদ্ধির ফলে সম্পত্তি ক্ষমতা নির্ধারণের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তা ছাড়া দেয়াল দেওয়া শহরের মাঝে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বিতীয় ধরনের সরকারের মহাপরিকল্পনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যা রাজনৈতিক সমাজ। মানুষ যত সভ্যতার দিকে এগোতে থাকে আদিম গণভিত্তিক সমাজ আগের মতো আর সব চাহিদা মেটাতে পারে না। গণ ও গোষ্ঠী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অদৃশ্য হবার আগেই গ্রিক ও রোমানদের মধ্যে অস্ত্ৰিঞ্চল ও সম্পত্তিভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা স্থান করে নিতে থাকে। দ্বিতীয় ধারার সরকার গঠনের জন্যে দরকার গণ ভিত্তি ছাড়িয়ে নগর গড়ে তোলা এবং গণের বদলে অঞ্চলভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ। নগর পদ্ধতির উদ্ভব বর্বর যুগ ও সভ্য জগতের সীমারেখা।
—
১। ফরাসিরা তাদের বিতাড়িত করলে তারা ক্রীক মিত্রসংঘে গৃহীত হয়।
২। ১৬৫১–৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তারা তাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী এরিকে জেনেসি নদী ও এরি হ্রদের মধ্য অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং এর কিছুদিন পর নায়াগ্রা নদীর কাছ থেকে নিউট্রাল নেশাঙ্গ গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করে এবং এইভাবে তারা নিউ ইয়র্কের বাকি অঞ্চল দখল করে, বাকি থাকে শুধু নিম্ন হাডসন এবং লঙ্গ দ্বীপ।
৩। ইরোকোয়াদের মতে ইউরোপিয়ানদের প্রথম দেখার পর তারা দেড় শ থেকে দু শ বছর মিত্রসংঘ গড়ে স্থায়ীভাবে রয়েছে। ডেভিড কুসিক (একজন টুসকারোরা)-এর মতে সাকেম ব্যবস্থা আরো প্রাচীন।
৪। আমার বন্ধু ভাষাতত্ত্ববিদ হোরাশিও হল আমাকে তার এই একই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল।
৫। ভায়েদের ছেলেমেয়েরা পরস্পর ভাই-বোন, এদের ছেলেমেয়েদের ছেলেমেয়েরাও পরস্পর ভাই-বোন, এমনিভাবে চলতে থাকবে। বোনদের ছেলেমেয়েরা এবং তাদের ছেলেমেয়ের ছেলেমেয়েরাও এমনি একই। ভাই-বোনের ছেলেমেয়ের জ্ঞাতি ভাই-বোন, এদের ছেলেমেয়েরাও জ্ঞাতি ভাই-বোন, এমনিভাবে চলতে থাকবে। একই গণের সদস্যরা আত্মীয় সম্পর্ক কেউ কখনো ভোলে না।
৬। যে কোনো জাতি এই বেসামরিক পরিষদ ডাকতে পারে, তা কীভাবে ডাকা হয় এবং কীভাবে উদ্বোধিত হয় তা নিম্নে বর্ণিত হল ধরা যাক ওনোনডাগরা যদি এই ডাক দেয় তা হলে পুবে ওইডা এবং পশ্চিমে ক্যায়ুগাদের কাছে দূত পাঠাবে, এই দূতের কাছে একটা বেন্ট থাকবে যাতে লেখা থাকে কী কারণে পরিষদ ডাকা হচ্ছে এবং লেখা থাকে চাঁদের কত তারিখে অধিবেশন বসবে এবং বলা থাকে ওনোনগাদের পরিষদ-কুঞ্জে যেন তারা হাজির হয়। তখন এটা ক্যায়গা এবং ওনাইডদের দায়িত্ব যথাক্রমে সেনেকা এবং মোহক্দের জানানো। যদি পরিষদ ডাকা হয় কোনো শান্তি স্থাপনমূলক কাজে তা হলে সব সাকেম সাদা সিডার গাছের এক আটি করে কাঠ আনবে, যা শান্তির প্রতীক। যদি তা যুদ্ধের কাজে ডাকা হয় তা হলে সাকেমরা লাল সিডার গাছের কাঠ আনবে, যা যুদ্ধের প্রতীক।
বিভিন্ন জাতির সাকেমরা সেই নির্দিষ্ট দিনের প্রায় দু-একদিন আগে এসে পৌঁছত এবং পরিষদের জায়গার কাছেই তাঁবু গেড়ে থাকত। তারপর সেই নির্দিষ্ট দিনে সূর্য ওঠার সাথে সাথে ওনোনডাগা সাকেমরা আনুষ্ঠানিকভাবে অন্যান্য সাকেমদের গ্রহণ করে। সাকেরা তাদের তাঁবু থেকে পৃথক পৃথক মিছিল বের করে, সবার গায়ে চামড়ার আলখেল্লা এবং হাতে থাকে কাঠের আঁটি, তারা ওনোনডাগা কেমদের অপেক্ষা করে থাকা পরিষদ-কৃঙ্গের দিকে এগিয়ে যাবে। তারপর সাকেমরা বৃত্তাকারে গোল হয়ে দাঁড়ায়। একজন ওনোনডাগা সাকেম যে নেতা হিসেবে এদের মধ্যে কাজ করে সূর্যের দিকে পাশ ফিরে দাঁড়ায়। ইশারা দিলে তারা উত্তর দিক দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। বৃত্তের উত্তর কিনারকে বলা হয় “শীত পাশ” (ও-টো-ওয়া-গা), পশ্চিম কিনারকে বলা হয় অস্তগামী “সূর্যের দিকের পাশ” (হা গা-কোয়াস-গোয়া, দক্ষিণের কিনারকে বলে “চড়া রোদের পাশ” (এন-ড-ইহ-কোয়া) পুবের কিনারকে বলা হয় “উঠন্ত সূর্যের পাশ” (ট-কা-গুইট-কাস-গওয়া। এক লাইন করে তিন বার ঘোরার পর বৃত্তের মাথা এবং শেষ পর্যন্ত এক হয়ে যায় এবং নেতা সাকে সূর্যের দিকে ঘুরে তার কাঠের আঁটি রেখে দেয়। তাকে কেন্দ্র করে একে একে বাকিরা উত্তর দিকে তাদের কাঠের আঁটি রাখে, যার ফলে কাঠের আঁটি ভেতরে আর একটা বৃত্ত রচনা করে। তারপর সব সাকেম তাদের গায়ের আলখো খুলে মেলে তার ওপর পা আড়াআড়ি করে বসে, ঠিক যার যার কাঠের আঁটির পেছনে, তাদের পেছনে সহকারী সাকেমরা দাঁড়িয়ে থাকে। এর কয়েক মুহূর্ত পর নেতা সাকেম যে উৎসব পরিচালনা করছে দাঁড়িয়ে উঠে তার আঁটি থেকে দুটো কাঠের টুকরো নেয় আর নেয় কাঠে আগুন ধরাবার জন্য আর একটা কাঠ যা ঘসে আগুন ধরানো যায়। ঘসে আগুন ধরাবার পর সে তার নিজের কাঠে আগুন ধরায়, তারপর এক এক করে সবার আঁটিতে আগুন ধরায়। সবগুলো ভালো করে জ্বলে গেলে উৎসব পরিচালক সাকেম ইশারা করলে বাকি সবাই উঠে দাঁড়ায় এবং তুলন্ত আগুনের বৃত্তের চারপাশে সূর্যের মতো উত্তর দিক থেকে তিন বার ঘুরতে শুরু করে। ঘুরতে ঘুরতে সারা শরীরও ঘোরায় যাতে দেহের চারদিকে আগুনের আঁচ লাগে। এতে এই বোঝায় যে তারা যেন একে অপরের সাথে ভালো ব্যবহর করে এবং পরিষদের কাজে সহযোগিতা করে এবং ঐক্য বজায় রাখে। তারপর আবার নিজের নিজের আলখেল্লার ওপর বসে। এরপর উৎসব পরিচালক আবার উঠে দাঁড়ায় এবং তার আগুনে শান্তির মলে আগুন ধরায়। পরপর তিনবার ফুৎকার দেয়। প্রথম ফুৎকার দেয় আকাশের দিকে, দ্বিতীয় মাটির দিকে এবং তৃতীয় ফুৎকার দেয় সূর্যের দিকে। প্রথমটির অর্থ মহা ভৌতিক ক্ষমতাকে সে ধন্যবাদ জানায় তাকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এবং এই পরিষদে তাকে উপস্থিত হবার সুযোগ দেবার জন্যে। দ্বিতীয় ফুৎকারের অর্থ মাতা ধরিত্রীকে সে ধন্যবাদ দিচ্ছে যেসব শস্য দান করেছে যা আহার করে সে বেঁচে আছে সে জন্যে। তৃতীয়টি সূর্যকে ধন্যবাদ জানান, যে সূর্য কখনো আলো দেওয়া বন্ধ করে না এবং যে সবাইকে আলো দিচ্ছে। এসব কথায় বলা হয় না, তবে ঐ কাজের এই হল অর্থ। তারপর সে তার ডান দিকের লোককে যে উত্তর দিকে থাকে তার হাতে দেয়, সেও অমনি করে তিন বার, তারপর সে দেয় তার পাশের লোককে, এমনি চলতে থাকে যতক্ষণ না বৃত্ত পুরো হয়। এই ধোয়ার চোঙা ফোঁকার অর্থ তারা একজন আর একজনের কাছে বিশ্বস্ত থাকবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় রাখবে এবং একজন আরেকজনের সম্মান রক্ষা করবে।
এই অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হওয়া মানে পরিষদের উদ্বোধন হয়ে যাওয়া, যার ফলে এবার মল আলোচনা শুরু হতে পারে, যে জন্য এই পরিষদ ডাকা এবার তার কাজ শুরু হতে আর কোনো বাধা নেই।
৭। ওনোনগাদের ঐতিহ্যধারা থেকে জানা যায়, ওনোনডাগার একজন বিজ্ঞব্যক্তি পাঠায় যে গোষ্ঠীর অঞ্চলসমূহ পরিদর্শন করে এবং সাকেম নির্বাচন করে সময়মতো তাদের নাম জানিয়ে দেয়। এখানে দেখা যাচ্ছে যে সাকেম পদে সব গণের সমান সংখ্যা ছিল না।
৮। আমেরিকান বিপ্লবের রু হবার প্রথম দিকে ইবোকোয়ারা আমাদের মিত্রসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে একমত হতে পারে নি, কারণ তারা পরিষদে একমত হতে পারে নি। বেশ কিছু ওনাইড়া সাকেম এর বিরুদ্ধে মত দেয় এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধতা করে। মোহক্রা যেহেতু নিরপেক্ষ থাকবে না এবং সেনেকারা যুদ্ধের জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে গোষ্ঠী যুদ্ধ করবে সে তা করবে তার নিজের দায়িত্বে বা নিরপেক্ষ থাকতে পারে। সাধারণ পরিষদে এরি, নিউট্রাল নেশান, সুসকেহ্যানোক ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আমাদের ঔপনিবেশিক দলিল থেকে দেখা যায় ইরাকোয়া মিত্রসংঘের সাথে প্রচুর মধ্যস্থতা করা হয়েছে।
৯. এ্যাসকাইলাস, “পবির বিরুদ্ধে সাত জন”, ১০০৫।
১০. ক্যাযুগা সামেদের একজন।
১১. সেনেকাদের একজন সাকেম এবং ইকোকোয়াদের নূতন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা।
১২. সেনেকা চাকমাদের একজন।