What if the Universe wears a mask?
What if no latitudes exist
With lips they would not seal with putty
Against the winter’s blast?
সেতারের রিমঝিম ঝালার মতো রাত বাড়ছে। স্বস্তি তো কিছুই ছিল না, অস্বস্তি আরও বাড়ছে। মুকুর উত্তম-মধ্যম তিরস্কারে আমার ভণ্ডামির মুখোশ খুলে পড়ে যাবার উপক্রম। সারা ঘরে পায়চারি করছে। কখনও থমকে দাঁড়াচ্ছে জানলার সামনে। বাইরে রাতের পরদা ঝুলছে, তারার চুমকি বসানো। মোড়ের মাথায় খেয়ালি সঙ্ঘ। সেখানে উত্তরা নাটকের মহলা চলেছে। প্রবীণ আর নবীনদের দল। এই প্রথম দলে একজন মহিলা এসেছেন। এ পাড়ার দুঃসাহসী সুন্দরী মেয়ে। তার নাম মুক্তি। মুকু আর মুক্তি প্রায় একরকম। দু’জনেই সমান স্বাধীন। সমান সুন্দরী। মুক্তি আমাদের ক্লাসেই পড়ত। স্কুল থেকেই সে আগুন জ্বালিয়ে আসছে। এক শিক্ষক মহাশয়ের কোচিং ক্লাস ছিল। আমরাও সেখানে পড়তুম। সেই শিক্ষকের খুব ক্ষমতা ছিল। তিনি টেস্ট পরীক্ষা ও ফাঁইনাল ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রশ্ন আউট করতে পারতেন। তাই তার খুব পসার ও প্রতিপত্তি ছিল। একদিন মহা হইচই। শোনা গেল, সেই শিক্ষকমহাশয় মুক্তিকে কোলে বসিয়ে খুব ঘাঁটুঘাটু করছেন। আমরা, যারা কাঙালের দল, চেল্লাচিল্লি শুরু করে দিলুম। আমাদের স্কুলে ছাত্র-আন্দোলনের সেই সূত্রপাত। চরিত্রহীন শিক্ষকের পদত্যাগ চাই। শুধু পদত্যাগ নয়, শিক্ষকমহাশয়ের মাথা কামিয়ে ঘোল ঢেলে মিছিলে ঘোরানো হবে। বামপন্থী রাজনীতি তখন মাথা তুলতে শুরু করেছে। ছাত্রদের আর সেই প্রাচীন মেজাজ নেই। শিক্ষাগুরুর সামনে কেঁচো হয়ে থাকার দিন শেষ। প্রথমে হল ছাত্র ধর্মঘট। চিৎকার, চেঁচামেচি। ছাত্রনেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা। প্রধানশিক্ষক ঘেরাও। অতঃপর চেয়ার টেবিল ভাঙাভাঙি, অবশেষে ছোট মাপের কয়েকটা বোমা ফাটানো। সেই সময় স্কুলে একটা শাস্তি প্রচলিত ছিল, রাস্টিকেট করা। তিন নেতাকে সেই শাস্তি দেওয়া হল। ছাত্র-আন্দোলন আরও জোরদার হল। দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ। শেষে সেই মুক্তিকামী শিক্ষককে স্কুলের কম্পাউন্ডে ঘেরাও করা হল। কুৎসিত গালিগালাজ, দু’-একটা চড়চাপড়। ব্রহ্মতালুতে চাটা। শিক্ষকের ভাবমূর্তি চটকানো। শিক্ষককে শেষপর্যন্ত অপমানের বোঝা নিয়ে সরতে হল। পরে জেনেছিলুম, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। একটা ষড়যন্ত্র। অপূর্ব সেই রহস্যজাল! শিক্ষকমশাই যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়িটা ছিল পুরনো আমলের বিশাল বাড়ি। মুক্তির বাবা ওষুধের কারবার করে বেশ দু’পয়সা করেছিলেন। তিনি বেশ দাও মেরে বাড়িটা কিনলেন। ভেতর ভেতর হাত বদল। মাস্টারমশাই গোটা চল্লিশ টাকা ভাড়ায় অত বড় একটা বাড়ি ভোগ করছিলেন। তাকে তো তুলতে হবে। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। টাকার চেয়ে বড় দুনিয়ায় আর কী আছে! আমাদের সঙ্গে হেমন্ত বলে একটা ছেলে পড়ত। মহা তেওঁটে। সেই প্রথম রটালে। সন্ধের মুখে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে।
কী দেখে!
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আদিরসই শ্রেষ্ঠ রস। কোথায় লাগে খেজুর রস! হেমন্ত মনে মনে যা করতে চায়, সবই করিয়ে দিলে সেই নিরীহ সৎ শিক্ষককে দিয়ে। হেমন্ত আড়াল থেকে দেখছে মুক্তির অন্তর অঙ্গ। আমাদের ধমনীতে রক্ত টগবগ করে উঠল। কান গরম, চোখ লাল। সেই অঙ্কুরিত বয়সে ওইসব বর্ণনায় মানুষ পাগল হয়ে যায়। শুনতে শুনতে প্রদ্যোত আমাকে জড়িয়ে ধরে গাল। কামড়ে দিলে, যেন আমিই মুক্তি। মাঝখান থেকে হল কী? হেমন্তর নতুন একটা সাইকেল হল। ঠেলাগাড়িতে রাজ্যের মাল তুলে শিক্ষকমশাই চলে গেলেন পাড়া ছেড়ে। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসছে। চৈত্রের দুপুর। গাজনের গেরুয়া সন্ন্যাসীরা পথে হাঁকছেন, বাবা তারকনাথের চরণের সেবায় লাগি। ঠেলা চলেছে, পেছনে বিবর্ণ একটি ছাতা মাথায় মাস্টারমশাই হাঁটছেন। আর মুক্তি রাতারাতি হয়ে গেল নায়িকা। গৌরব বেড়ে গেল তার। ছেলেদের মধ্যে লাঠালাঠি, ফাটাফাটি। সবাই মুক্তির প্রেমিক হতে চায়।
মহলার শব্দে পাড়া কাঁপছে। হঠাৎ মনে হল, হেমন্তর সঙ্গে আমার তফাত কোথায়? সৎ, সাত্ত্বিক, আদর্শবান, আচার্যস্বরূপ এক মানুষকে দেশত্যাগী করে নিজে আঁকিয়ে বসেছি জমিদারের মতো। লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, সবই আমার আছে পুরোমাত্রায়। সর্বোপরি ভীরু। নিরাপদ নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে নড়তে চাইছি না।
মুকু সোজা এগিয়ে গেল কাপড়জামার আলমারির দিকে। এক টানে পাল্লাটা খুলে ফেলল। নাড়ানাড়ি করল খানিক। টেনে বার করল একটা শাড়ি। সেই ফিকে হলুদ রঙের শাড়িটা, যেটা আমি কাকিমাকে পুজোয় দোব বলে কিনেছিলুম। দেওয়া আর হল না।
মুকু শাড়িটা তুলে ধরে বললে, এটা কার? তোমার সেই কাকিমায়ের?
সহসা উত্তর দিতে পারলুম না। আমতা আমতা করে বললুম, পুজোর সময় দোব বলে কিনেছিলুম।
দিলে না কেন?
পরিস্থিতি বদলে গেল।
মুকু খাটে বসল। শাড়িটা কোলের ওপর। প্রশ্ন করল, সত্যি কথা বলো তো, ওই মহিলার সঙ্গে। তোমার সম্পর্কটা কী ছিল? আমি তোমার কনফেশন চাইছি।
কেন প্রশ্ন করছ মুকু? তুমি তো জানো। তুমি তো অনুমান করতে পারো। আমি একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলুম। এখন আবার ঠিক হয়ে গেছি।
তোমার লজ্জা করেনি? নিজের ওপর ঘৃণা আসেনি?
এসেছে। সামলাতে পারিনি নিজেকে।
তুমি না সন্ন্যাসী হবার স্বপ্ন দেখো? কথায় কথায় শঙ্কর, বুদ্ধ, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলো। তোমার লজ্জা করে না! বুঝতে পারো না তুমি কত ঘিনঘিনে! তুমি একটা পারভার্ট! আমার কাছে খুব বোলচাল মেরেছিলে। মুকু, আমি ব্রহ্মচারী। আমার পথ ভোগের নয় যোগের! কত রঙ্গই না জানেনা! এইভাবে চললে, তুমি কোথায় শেষ করবে জানো কি? বেশ্যালয়ে।
আমি চিৎকার করে উঠলুম, মুকু!
এ তোমার আর্তনাদ, ধমক নয়। নিজের কাছে নিজেই ধরা পড়ে গেছ। এইবার আমি তোমাকে ধরব। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি এখনও। আমি তোমার বাবার প্রতিনিধি।
তিনি কি তোমাকে পছন্দ করতেন?
না, করতেন না। তার প্রধান কারণ তুমি। তুমি যে কত দুর্বল চরিত্রের তিনি তা জানতেন। যে-কোনও মেয়ে একটা টুসকিতে তোমার ঠাটঠমকের দুর্গ ভেঙে দিতে পারে। প্রমাণ চাও? দেখবে, এখুনি তোমার কী করুণ অবস্থা আমি করে দিতে পারি? দেখতে চাও?
মুকুর হাতদুটো আমি ধরে ফেললুম, আমাকে তুমি বাঁচাও। তুমি আমাকে পড়ে ফেলেছ মুকু, খোলা বইয়ের মতো। আমি উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছি। এঁটো হয়ে গেছি। অপবিত্র হয়ে গেছি।
তুমি খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছ। মেয়েরা যে ধরনের চরিত্রকে ভয় পায়, ঘৃণা করে, তুমি ক্রমশই সেই ধরনের একটি চরিত্র হয়ে উঠছ। এই হলে জীবনে তুমি কোনওদিন সুখী হতে পারবে না, সুখীও করতে পারবে না কারওকে। শেষ পরিণতি আত্মহত্যা। আমার হাত ছাড়ো। তুমি কাপছ?
ভয়ে ভয়ে হাত ছেড়ে দিলুম। মুকুর চোখে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। অক্ষমের লেখা উপন্যাসের মতো অপাঠ্য।
মুকু বললে, ওই ঘরে ঠাকুরের কাছে আজ প্রদীপ ধূপ জ্বালিয়েছিলে?
না।
কেন?
আমরা তো এই সবে এলুম।
কথাটা তোমার মনে ছিল?
বোধহয় না।
নিষ্ঠা বলে একটা শব্দ আছে, জানো?
জানি।
তোমার কি তা আছে? একটা জিনিস তুমি কতদিন ধরে থাকতে পারো, হিসেব করে দেখেছ?
বেশিদিন পারি না।
তোমার স্বভাব হল মাছির স্বভাব। একবার এখানে বসছ, একবার ওখানে বসছ। কখনও ফুলে, কখনও গুয়ে। নতুন নতুন খেয়ালের পেছনে ছুটছ। নতুন নতুন মেয়ে। গলে যাওয়া আইসক্রিমের মতো বসে না থেকে উঠে পড়ো। বাথরুমে গিয়ে চান করো ভাল করে। ঠাকুরের জায়গায় প্রদীপ জ্বালো। ধূপ দাও। কিছুক্ষণ চুপচাপ আসনে বসে থাকো চোখ বুজিয়ে। রুটিন থেকে সরে গেলে চলবে না। আমি এই শাড়িটা পরছি।
তুমি হস্টেলে ফিরবে না?
একবার বলেছি, না। বারেবারে একই প্রশ্ন আমার ভাল লাগে না। কাল সকালে গিয়ে আমার মালপত্র সব নিয়ে চলে আসব চিরকালের জন্যে।
আমাকে তো দেরাদুনে ট্রান্সফার করেছে।
সে তো আরও ভাল। দু’জনেই যাব।
তোমার এম এ?
বিয়ের পর চিন্তা করা যাবে। দেরাদুন থেকে হরিদ্বার খুব কাছে। হৃষিকেশ, লছমনঝোলা, রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ। আমরা বাবাকে খুঁজতে বেরোব। আশ্রমে আশ্রমে। ঠিক পেয়ে যাব। পাহাড়, নদী, ঝরনা, এই তিনের মধ্যেই তো তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন। তাড়াতাড়ি বাথরুমে যাও। তোমার পরে আমি যাব।
সদরের কড়া নড়ে উঠল। আমরা দু’জনে স্তব্ধ হয়ে গেলুম। তিনি ফিরে এলেন নাকি? আমি ফিসফিস করে বললুম, কে বলো তো? বাবা?
কড়া নাড়ার ধরন দেখে বুঝতে পারছ না! এলোমেলো। ছন্দ নেই। কড়া নাড়ার ধরন দেখে ব্যক্তিত্ব বোঝা যায়। নতুন কেউ। ভয়ে ভয়ে নাড়ছে। যাও দেখে এসো।
দরজা খুলে অবাক হয়ে গেলুম। দাঁড়িয়ে আছেন টিপ আর টিপের মা।
বউদি বললেন, কত রাত হয়ে গেল! আরও একটু আগে আসা উচিত ছিল।
টিপ বললে, মাকে আমি সেই সন্ধে থেকে তাড়া লাগাচ্ছি, চলো, চলো, চলো। কাজ যেন আর শেষই হয় না।
বউদি বললেন, চলো, তোমার কোথায় কী আছে, সব গুছিয়ে নিয়ে একেবারে চলে যাই। তোমার জন্যে একটু অন্যরকম রাঁধতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। বেশিরভাগ রান্নাই অবশ্য টিপ বেঁধেছে। বললে, পিন্টুদাকে আজ জন্মদিনের খাওয়া খাওয়াব।
আমার গলা শুকিয়ে আসছে। মুকু তো আমাকে যেতে দেবে না। সবাই ওপরে উঠে এলুম। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মুকু রাজমহিষীর মতো। টিপ, ইতু বউদি দু’জনেই থতমত খেয়ে গেছেন। মুখেচোখে একটা অপ্রস্তুত ভাব। সেই ভাবটা কাটাবার জন্যে আমি তাড়াতাড়ি পরিচয় করিয়ে দিলুম, আমার মাসতুতো বোন মুকু। মুকু দু’হাত তুলে নমস্কার করল।
আমি আরও একটু যোগ করলুম, বাইরে থাকে। কলকাতায় এসেছে লেখাপড়া করার জন্যে।
বউদি নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন, পিন্টু আমাকে বউদি বলে। এই আমার মেয়ে টিপ।
মুকু আমার দিকে তাকিয়ে বললে, যাও দেরি কোরো না। তোমার অনেক কাজ পড়ে আছে। বিকেলের সাজে বউদিকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। কালো কুচকুচে চুল। টানটান খোঁপা। ডুরে শাড়ি। টিপ বেশ কুঁচিয়ে শাড়ি পরেছে। চুলে বিনুনি। ফুলের মতো সুন্দর। আমি পায়ে পায়ে বেরিয়ে এলুম ঘরের বাইরে। মুকু বোধহয় দেখাতে চাইছে আমার ওপর তার কতটা কর্তৃত্ব! মুকুর ভিতরে একটা ডিক্টেটর বসে আছে। শীত আসছে। জল বেশ ঠান্ডা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবছি, ব্যাপারটা বেশ জটিল হল। বউদিকে এখন আমি কী বলব? মুকু যেভাবে হাল ধরেছে, সহজে টাল খাবার নয়। ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালালুম। একগোছা ধূপ। সারাবাড়ি গন্ধে ভরে গেল। আসনে বসামাত্রই মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। এই আসন সাধকের আসন। বাবা বসতেন। কোনও আসনে দিনের পর দিন বসে অবিরত সৎ চিন্তা করলে, সেই আসনে শক্তি সঞ্চারিত হয়। সেই আসনে বসামাত্রই, আসন তাকে গ্রাস করে। অনধিকারী কেউ বসলে আসন তাকে ঠেলে ফেলে দেয়। একটা ঝিমঝিম শান্তির ভাব ছেয়ে আসছে শরীরে। মনে হচ্ছে, দেহের বাঁধন খুলে পড়ছে। কোথা থেকে কোথায় যেন চলেছি ভেসে ভেসে। এইভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকা যেত, কিন্তু উঠে পড়তে হল।
ঘরে ঢুকে দেখি মেয়েদের মজলিশ বসে গেছে। মুকু মধ্যমণি। বউদি তার গায়ের ওপর হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। টিপের মুখ উদ্ভাসিত। যাক, মুকু তা হলে মিশে গেছে!
বউদি বললেন, পুজো করে এলে?
মুকু বললে, ও তো ধ্যান-জপ নিয়েই থাকে। মাঝে মাঝে ভয় করে, সংসার ছেড়ে চলে না যায়!
বউদি বললেন, হবেই তো, এ যে সাধকের বাড়ি। রক্তে সাধনা আছে।
মুকুর কথায় অবাক হয়ে গেলুম। বলে কী! আমাকে ঠেলে কোথায় তুলছে! একটু আগে বললে, কাপুরুষ। পর্যাপ্ত তিরস্কার। এমন কথা নেই, যা বলেনি। এখন বলছে মহাপুরুষ।
মুকু বললে, চলো, রান্নাঘরে কোথায় কী আছে দেখে নিই। আজ তোমাকে বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না, প্লেন অ্যান্ড সিম্পল খিচুড়ি।
বউদি বললেন, সে আর কী কথা! তোমরা আমার ওখানে খাবে। আমি এতক্ষণ সব রান্না করলুম কীসের জন্যে?
মুকু বললে, সে আপনি একজনের জন্যে করেছেন, আমার কথা তো ছিল না। ও তা হলে যাক। আমি আমার মতো ফুটিয়ে নিই।
বউদি খপ করে মুকুর হাতদুটো ধরে বললেন, এ তুমি কী কথা বলছ? অভিমানের কথা। তুমি যে আসবে আমার কি তা জানা ছিল? আর সংসারে কেউ ঠিক ঠিক একজনের জন্যে রাঁধে না। সংসার অনেককে নিয়ে। তোমাদের দুজনকেই আমরা ধরে নিয়ে যাব।
টিপ মুকুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি কী সুন্দর! তুমি কত কী জানো? মুকুদি, তুমি আমাকে পড়াবে? আমার খুব লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে।
আমি যদি এখানে থাকি নিশ্চয় পড়াব তোমাকে। তুমি এত সুন্দর মেয়ে!
বউদি বললেন, আজ তা হলে তোমার সেইসব জিনিসপত্তর মেলানো হচ্ছে না?
আজ আর থাক বউদি। হাঙ্গামা করে দরকার নেই। মুকু এসেছে। যা করার কালই হবে।
আমি তা হলে একটু চায়ের চেষ্টা করি। মনটা চা-চা করছে।
বউদি বললেন, রাত নটার সময় আর চা খায় না। আমাদের বাড়িতে চলল। তখন দেখা যাবে।
এত তাড়াতাড়ি গিয়ে কী হবে? বিষ্টুদার দোকান বন্ধ হতে হতে সেই রাত এগারোটা!
ওর জন্য বসে থাকবে নাকি?
থাকব না! বিষ্টুদা ছাড়া কিছু জমে! ফাঁকাকাঁকা লাগবে।
মুকু বলল, বউদি, আপনারা এগিয়ে যান, আমরা দশটার মধ্যে যাচ্ছি।
নীচে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলুম। যাবার সময় টিপ বলল, মুকুদিকে আমার ভীষণ ভাল লেগে গেছে। আমি কিন্তু মাঝে মাঝে আসব।
মাঝে মাঝে কেন, তুমি রোজই এসো। তোমরা এলে আমার খুব ভাল লাগবে।
বউদি কানে কানে বললেন, তোমার কেমন বোন? সত্যি বলো তো? দূর সম্পর্কের?
আমার জ্যাঠাইমার বোনের ছোট মেয়ে।
বুঝেছি। বউদি মুখ টিপে একটু হাসলেন! আমার হাতে সামান্য চাপ দিয়ে বললেন, তা ভালই। শাসন করতে জানে।
মুকু দাঁড়িয়ে আছে খোলা জানলার সামনে। ঢুকতেই ফিরে তাকাল। ডুরে শাড়িটা বিছানার ওপর ছড়ানো। মুকু রাগরাগ গলায় বলল, নিজের সিদ্ধান্তে নিজে আসতে পারো না? নিজেকে ছড়িয়ে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতা তোমার। গোপনীয়তা রাখতে জানো না? ওঁরা কী করতে এসেছিলেন? যেখানে বাঘের ভয় সেইখানেই সন্ধে হয়। কাকিমা গেলেন তো বউদি এলেন। সঙ্গে আবার পরি! কিছু পারো বটে!
কী করব বলো, সকালে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কী করি, কোথায় যাই।
আমি কি মরে গিয়েছিলুম? আমার কাছে আসতে তোমার কী হয়েছিল?
তোমার কাছে যাব বলেই তো বেরিয়েছিলুম। বাসস্টপে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলুম। তখন আমার মন একেবারে ভেঙে গেছে।
তোমার মন কবে আস্ত ছিল? না ভোগে, না যোগে, আরশোলার মতো ফড়ফড় করে উড়ছে একবার এ দেয়াল একবার ও দেয়ালে। নিজেকে আগে একটু স্থির করো তো! তা না হলে তোমার সব যাবে। ভেসে যাবে।
মুকু, তুমি আমাকে আর বোকো না। বিশ্বাস করো, আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে।
সেইজন্যেই তো উত্তম-মধ্যম দিচ্ছি। তোমার মনটাকে ঘোরাবার চেষ্টা করছি। ওরা কী গোছগাছ করতে এসেছিল?
বাড়িতে অনেক সোনার গয়না রয়েছে। ওইভাবে তো ফেলে রাখা যায় না। বিষ্টুদা বলছিলেন, একটা লিস্টি করে ব্যাঙ্কে জমা করে দাও।
তুমি ওদের সামনে সেই গয়না বের করবে! বলিহারি তোমার বুদ্ধি! ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী করতে আছে?
ওঁরা সবাই ভীষণ ভাল মানুষ, তুমি জানো না।
যতই ভাল মানুষ হন, কাঙালকে শাকের খেত দেখাতে আছে?
তুমি ওঁদের কাঙাল বলছ?
সংসারী মানুষ মাত্রেই কাঙাল। কখন কী অভাবে পড়বেন বলা যায়। তখন তোমার কাছে আসবেন সাহায্যের জন্যে। ফেরাতে পারবে না। দিতেই হবে।
বিপদে সাহায্য করা খারাপ?
সাহায্য তারাই করতে পারেন, যাঁদের অনেক আছে। আর অনেক যাঁদের আছে, তারা কখনই সাহায্য করবেন না। তারা থাকেন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝামাঝি জায়গায় যাঁরা। আছেন তারাই মরেন। কত তুমি সাহায্য করবে? কজনকে তুমি সাহায্য করবে? একটু বুঝতে শেখো। অত হলহলে হলে চলবে না। পরিবারের গোপন কথা মানুষের মুখে মুখে ছড়ায়।
তুমি বড় সংসারী মুকু। বড় বেশি হিসেবি।
একজন বেহিসেবি হলে আর একজনকে তো হিসেবি হতেই হবে। তা না হলে ব্যালেন্স হবে কী করে? তোমার গয়নার লিস্ট আমি করে দোব। আজ রাতেই করে দোব। এখন চললা খেয়ে আসি।
দোরতাড়া বন্ধ করে রাস্তায় নেমে এলুম। কোথায় পা ফেলছিলুম জানি না, মুকু হাঁ হাঁ করে উঠল, দেখে দেখে, কীসের ওপর পা পড়ছে একবার দেখো। গোবর।
অতটা খেয়াল করিনি। সামলে নিলুম। মুকু শুধু হিসেবি নয়, সাবধানী। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা রাস্তা চলে গেছে সামনে পিছনে। ছাঁড়াছাড়া ল্যাম্পপোস্ট আলোর জাল ফেলে পোকা ধরছে। এ রকে ও রকে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে মানুষ পড়ে আছে। মিষ্টির দোকানের বাইরে ভিয়েন শেষ করে হাওয়া খেতে বসেছেন ঘর্মাক্ত হালুইকর। আমাদের পাড়ার বিখ্যাত মাতাল শামুদা তাঁতের মাকুর মতো টলে টলে ফিরছেন, একবার এদিকে একবার ওদিকে। এইসময় সামনাসামনি পড়ে গেলেই মহা বিপদ। দু’কাধ ধরে প্রেম বোঝাবার চেষ্টা করবেন। প্রেম কাকে বলে। খাঁটি প্রেম। পেটে পড়লেই ভদ্রলোক প্রেমের লাইনে চলে যাবেন, অথচ বিয়ে করেননি। ভাল চাকরি করেন। সকালে ফিটফাট ভদ্র। যত রাত বাড়তে থাকে ততই রূপান্তর! মধ্যরাতে সম্পূর্ণ বেসামাল। মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গান ধরেন, মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল। সুন্দর গলা।
মুকুকে বললুম, পা চালাও।
মুকু বললে, কেন?
টলমলে ওই ভদ্রলোক অতিশয় বিপজ্জনক। একবার ধরলে আর রক্ষে নেই।
জানো, ষাঁড় দেখলে আমি ভয় পাই না। আমি মগের দেশের মেয়ে। বাবার হাত ধরে আরাকানের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বার্মা থেকে পালিয়ে এসেছিলুম।
কথায় কথায় শামুদা আমাদের দূর দিয়ে আপনমনে চলে গেলেন। পড়তি জমিদার বংশের ছেলে। ভারী সুন্দর দেখতে।
মুকু বললে, মাতালরা ছাতাকে ভীষণ ভয় পায়।
যাঃ, ছাতাকে কেন ভয় পাবে?
সত্যি! আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। একদিন দুপুরবেলা হরি ঘোষ স্ট্রিটে আমাকে দেখে এক মাতালের প্রেম চাগিয়েছিল। আমার হাতে ছিল একটা ছাতা। ভটাস করে খুলতেই লোকটা ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে বললে, দেবী, দেবী, মাতা, জননী, বজ্রাঘাত কোরো না। জানো তো, বাঘ গুলির চেয়ে ভয় পায় হাচিকে? কেঁদো বাঘের সামনে ফাঁচ করে হেঁচে দেখো লেজ তুলে পালাবে! হাতিকে যদি পায়রার পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দাও দুদ্দাড় করে পালাবে!
এসব তুমি পরীক্ষা করে দেখেছ?
ছাতাটা করেছি। বাকিগুলো শুনেছি।
আমরাও ঢুকছি, বিষ্টুদাও ঢুকছেন। মুকুর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। পরিচয় করিয়ে দিলুম। বিষ্টুদা অসম্ভব খুশি হয়ে বললেন, ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন মা। ছেলেটা মহা বিপদে পড়েছে, কেউ দেখার নেই। পরামর্শ দেবার মতো কেউ নেই। কী খাবে, কোথায় শোবে, তারও কোনও ঠিক নেই। তুমি এসে যে কী ভাল করেছ! চলো চলো ভেতরে চলো।
শিউলির গন্ধে উঠোন ভরে আছে। গাছ একেবারে ফুলে ফুলে সাদা। মা আর মেয়ে দু’জনেই বেরিয়ে এলেন। বউদি মুকুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কী ভাল যে লাগছে! ঘর যেন আলো হয়ে গেল।
মুকু বললে, একটু বেশি বেশি হয়ে গেল। এ বাড়ির আলো আপনারা দুজনে।
বিষ্টুদা কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে হুড়হুড় করে চান করছেন। শীতশীত রাত। ঠান্ডা না লেগে যায়। সবই মানুষের অভ্যাস। অপূর্ব খাওয়া হল। যেন কোনও উৎসবের ভোজ!
মুকু বললে, বউদি, আপনি আর টিপ এইবার বসে যান, আমি পরিবেশন করি।
পরিবেশন করার কিছুই নেই গো, সব আমরা গুছিয়ে রেখেছি। তুমি শুধু আমাদের সামনে জমিয়ে বোসো, গল্প করি আর খাই।
বিষ্টুদা বললেন, আর গল্প করার সময় নেই। রাত হয়েছে বেশ। চলো, তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।
বেরিয়ে আসার সময় মুকু বললে, দেখে রাখো, একেই বলে লক্ষ্মীর সংসার। ঠিক যেন একটা আশ্রম। শান্তিকুঞ্জ। ভীষণ ভাল লাগছে, মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই।
বউদি বললেন, আজ রাতে না-ই বা গেলে। সবাই মিলে বেশ গল্প হবে।
কিন্তু! সেই আশি না কত ভরি সোনা! তারই টানে বাইরে তো রাত কাটানো যাবে না। ভীষণ চুরি হচ্ছে চারপাশে। যক্ষ হয়ে বিষয় আগলাতে হবে। বিছে হার, চন্দ্র হার, বাজু, বাউটি। মৃতাদের যত অলংকার।