1 of 4

২.০৪ সিন্দাবাদের চতুর্থ সমুদ্র-যাত্রা

সিন্দাবাদের চতুর্থ সমুদ্র-যাত্রা

পরদিন যথা সময়ে কুলি সিন্দবাদ এবং অন্যান্য শ্রোতারা এসে হাজির হয়। নাস্তাপানি শেষ করার পর বৃদ্ধ তার কাহিনী বলতে শুরু করে :

যদিও দারুণ ভোগ বিলাসের মধ্যে আমার দিন কাটছিলো। কিন্তু রক্তে আছে আমার ঘর-ছাড়ার নেশা। তাই বাগদাদের বৈচিত্র্যহীন বিলাসের জীবন-যাত্রা আমার ধাতে সইলো না। কিছুদিন যেতে না যেতেই বিদেশ যাত্রার ভূত আমার ঘাড়ে চেপে বসলো।

এবারও আমি অনেক বাছাই করা দামী দামী বাহারী সামগ্ৰী সওদা করলাম। যে-সব জিনিস সাধারণত বিদেশের বাজারে মেলে না, সেই জাতের জিনিসপত্র।

দিনক্ষণ দেখে একদিন বসরোহর বন্দর থেকে এক বিরাট জাহাজে চেপে বসলাম আমরা কয়েকজন সওদাগর।

দিনের পর দিন জাহাজ চলেছে। একদিন কাপ্তেন এসে বললো, এখুনি ঝড় উঠবে। আর এক পাও এগানো যাবে না। জাহাজ এই মাঝসমুদ্রেই নোঙর করতে হবে।

ঝড়ের কথা শুনে বুক শুকিয়ে গেলো। না জানি এবার কি বিপদ ঘটে। যদি উত্তাল ঢেউর দাপট সহ্য করতে না পেরে জাহাজটা উল্টে যায়–

মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড ঢেউ-এর ধাক্কায় আমাদের জাহাজটা খানখান হয়ে গেলো। সেই প্রবল জলোচ্ছাসের মধ্যে কে কোথায় তলিয়ে গেলো তার কোনও হদিশ করতে পারলাম না।

আল্লাহর অপার মেহেরবানী, আমি একখানা কাঠের পাটাতন আঁকড়ে ধরতে পেরেছিলাম। সেই পাটাতনখানা আশ্রয় করে ভাসতে ভাসতে এক সমুদ্র-সৈকতে এসে উঠলাম।

তখন আমার প্রায় মৃত-কল্প দশা। হিমের মতো ঠাণ্ডা জলে সারা শরীর সিটিকে গেছে। সারা রাত সৈকতের বালির উপরে অসাড়া অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইলাম। সকালবেলায় উঠে দেখি আমার পাশে আরও কয়েকজন সহযাত্রী শুয়ে আছে। আল্লাহর কৃপায় তারাও প্রাণে রক্ষা পেয়ে গেছে!

সমুদ্রতীর ছেড়ে আমরা গ্রামের পথে পা বাড়ালাম। কিছু দূর যেতেই একটা বাগানের মধ্যে একখানা সাদা রঙেরবাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটার কাছে আসতেই একদল উলঙ্গ কালো মানুষ বেরিয়ে এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। তাদের মুখে কোনও কথা নাই। শুধু ইশারায় পথ দেখিয়ে বাড়িটার ভিতরে নিয়ে এলো। প্রকাণ্ড প্রশস্ত একখানা ঘর। তার মাঝখানে সিংহাসনে আসীন এক সম্রাট।

সম্রাট আমাদের বসতে হুকুম করলেন। একটু পরে বড় বড় বারকোষে বোঝাই করে খানা এলো। খানা বলতে এক ধরনের অদ্ভুত মাংস। এ ধরনের মাংস আমি জীবনে কখনও দেখিনি। চেহারা দেখেই আমার ক্ষিদে তেষ্টা উবে গেলো। কিন্তু আমার সঙ্গীরা ক্ষিদের জ্বালায় সেই মাংসই গোগ্রাসে খেতে লাগলো। জাহাজ ডোবার পর থেকে খাওয়া দাওয়া হয়নি, ক্ষিদেয় পেট চো চো করে জুলছিলো, তাই আর কোনও দিকে দৃকপাত না করে গোটা বারকোষটাই সাবাড়ি করে দিলো তারা। আমি বসে বসে দেখলাম। আমার গা গুলিয়ে যাচ্ছিল ওদের ওই রাক্ষসের মতো গেলা দেখে।

খেয়েদেয়ে ওরা ঢেকুর তুলতে লাগলো। ভুরি ভোজের খানা। আমি কিন্তু নিরম্ব উপবাসীই রয়ে গেলাম। মরে গেলেও ঐ আজব খানা আমার মুখে উঠবে না।

খানাপিনা ব্যাপারে আমার এই খুঁতখুতে বাই সে-যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কেমন করে, সেই কথাই বলছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এই উলঙ্গ হাবাসী লোকগুলো নরখাদক। আর ঐ সম্রাট-সেও। তবে ওদের হাতে কোনও মানুষ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ওরা খায় না। প্রথমে তাকে কিছুদিন খাইয়ে-দাইয়ে বেশ মোটাসোটা নাদুসনুদুস করে তোলে। দেহে চর্বিনা গজালে নাকি মাংসের স্বাদ হয় না। তাই তারা খুব ভালো করে পেটপুরে খেতে দেয়। আদর যত্ন করে। খাটুনি-মেহনত একেবারেই করায় না। মোট কথা বড় তোয়াজে রাখে।

যে-সব মানুষ ধরা পড়ে তাদের মধ্যে মোটা-সোটা তাগড়াইগুলো থাকে সম্রাটের জন্য। বাকীগুলো খায় উলঙ্গ হাবসীরা। হাবসীরা মানুষের কাঁচা মাংস খেতেই ভালোবাসে। কিন্তু হাবাসী-সম্রাটের বিলাসিত অনেক। সে কখনও না পুডিয়ে খাবে না। তার খানা পাকবার কায়দাই আলাদা। বিরাট মানুষ সমান চুল্লীতে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। দাউ দাউ করা আগুনে কাঠগুলো পুড়ে যখন গনগনে আগুনের অঙ্গার হতে থাকে, সেই সময়, জ্যান্ত একটা মানুষের সর্বাঙ্গে তেল-মসলা-ঝালের গোলা মালিশ করা হয়। মানুষটা যখন লঙ্কার ঝালে ত্ৰাহি ত্ৰাহি ডাক ছাড়তে থাকে তখন হাবসীরা বুঝতে পারে, মসলায় সে জারিত হয়ে গেছে। এর পর তারা তাকে চুল্লীর নিচে নামিয়ে দেয়। আধাপোড়া মতো যখন হয়ে আসে তখন তারা সিকে গেঁথে আংরা। মানুষটাকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে। এর পর টুকরো টুকরো করে কেটে সম্রাটের সামনে ভোগ নিবেদন করে। আমি ওদের মুখেই শুনেছি, এই নরমাংসের কাবাব-এর স্বাদই নাকি আলাদা। একবার যে খেয়েছে তার মুখে মোরগ-মসাল্লামও নাকি পানসে লাগবে।

এই সব জানার পর থেকে আমি ক্ষিদে ভুলে গেলাম। শুধু পানি খেয়ে প্ৰাণ ধারণ করতে লাগলাম। উলঙ্গ হাবসীরা আমাদের সকলকে রাখালের হেপাজতে দিয়ে বললো, খুব সাবধানে চোখে চোখে রাখবি। একটাও যেন খোয়া না যায়। আর খুব ভালো করে চর্যাবি। দু-চার দিনের মধ্যেই যেন মোটাসোটা নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে সবাই। সম্রাটের ভোগে লাগবে। মনে থাকে যেন।

রাখাল আমাদের বনে জঙ্গলে মাঠে নিয়ে যায়। গাছের ফল পেড়ে এনে দেয়। ফসলের শুটি, রসালো আখ খাইয়ে পেট উঁই করে দেয় আমার সঙ্গীদের। আমি কিন্তু কিছু স্পর্শ করি না। ফলে, দিনে দিনে কৃশ হতে কৃশতার হতে থাকি। শেষে এমন হলো; গায়ে বল পাই না, শরীরের হাড়গোড় সব বেরিয়ে গেলো। রাখালটা ভাবে, এই লোকটা একটা আপদ। এক ফোটা মাংস লাগছে না। গায়ে উল্টে শুকিয়ে চেলা কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সম্রাট কেন, তার সাগরেদরাও খেতে চাইবে না বেটাকে।

রাখালটা আর আমার দিকে তেমন নজর রাখে না। সে শুধু তীক্ষ দৃষ্টি রাখে আমার বন্ধুদের ওপর। ওরা নির্বিবাদে খেয়েদেয়ে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে দিনকে দিন ঢাউস হতে থাকলো। হাবসীরা আর রাখোলও ওদের তদারকেই ব্যস্ত হয়ে থাকে। আমি যেন ওদের কাছে এক অবাঞ্ছিত অতিথি। নেহাত ফেলে দেওয়া যায় না। তাই রেখেছে-ভাবখানা এই।

তাদের এই ভাবেরই সুযোগ নিলাম আমি। একদিন রাখাল আমাদের চরাতে নিয়ে বেরিয়েছে। আমি কিছু দূর গিয়েই ধপাস করে পড়ে গেলাম। রাখাল জিজ্ঞেস করলো, কী? কী হলো?

আমি বললাম, না, কিছু না, মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো?

—ব্যামো? আরো ছো! শকুনে খাবে।

অর্থাৎ অসুস্থ মানুষের মাংস অভক্ষ্য। ওগুলো শেয়াল শকুনকে খেতে দেয়। তারা। আমাকে পথের ওপর ফেলে রেখে আমাদের বন্ধুদের তাডিয়ে নিয়ে রাখলটা এগিয়ে যেতে যেতে বলে, মাথাটা ঠিক হয়ে গেলে পিছনে পিছনে আয়। না হলে, ফেরার সময় নিয়ে য়াবো, এখানেই শুয়ে থাক।

এই—মউকা! রাখালটা চোখের আড়াল হতেই আমি বঁকা পথ ধরলাম। ঝোপ জঙ্গল ভেঙ্গে সবার অলক্ষে সমুদ্রের দিকে এগোতে থাকি।

কিন্তু কোথায় সমুদ্রতীর? সারা দিন সারা রাত চলার পরও কোনও সমুদ্রের কিনারা পাওয়া গেলো না। পরদিনও এইভাবে দুৰ্গম পথ অতিক্রম করে চলতে থাকি। শেষে আটদিনের দিন এক নতুন দেশে এসে হাজির হই। সেখানকার অধিবাসীরা দেখলাম, আমাদের মতোই সভ্য জগতের মানুষ। তাদের গায়ের রঙ শুভ্ব; কাপড়াচোপড় পরে।

একদল মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। ওরা তখন লঙ্কার ক্ষেত থেকে লঙ্কা তুলে বস্তাবন্দী করছিলো। আমাকে পরদেশী দেখে তারা কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়ালো। ওদের মুখের ভাষা আমারই মাতৃভাষা। কতকাল পরে অন্যের মুখে নিজের দেশের ভাষা শুনে কি যে ভালো লাগলো—

ওরা জিজ্ঞেস করে, কে বাছা তুমি? এমন কেন তোমার দশা?

আমি জবাব দিই, আমি বিদেশী মুসাফার। সমুদ্রে জাহাজ ডুবি হয়ে এই হাল হয়েছে। নরখাদকদের হাতে পড়েছিলাম। কোনওরকমে পালিয়ে এসেছি। আমার সঙ্গীরা এখনও তাদের খল্পরেই পড়ে রয়েছে।

আমার কাহিনী শুনে ওরা বিস্ময়াহত হয়। বলে, আহা, তোমার বুঝি অনেক কাল নাওয়া খাওয়া হয়নি?

আমি বলি, খাইনি, তাই বেঁচে গেছি। খাওয়া দাওয়ার লোভ সামলাতে না পারলে আর বাঁচতে হতো না।

ওরা আমাকে ওদের ঘরে নিয়ে গেলো। ভালো করে গোসল করলাম। এই প্রথম পেট পুরে খানা খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ওরা আমাকে একখানা জাহাজে করে দরিয়ার ওপরে একটা দ্বীপের শহরে নিয়ে গেলো। সেখানে থাকে ওদের সুলতান। শহরটা ভারি সুন্দর। অনেক দোকানপাট, অনেক লোকের বাস। সুলতানের দরবারে যাওয়ার পথে শহরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে দেখালো ওরা। আমাদের বাগদাদের মতোই নানারকম বাহারী জিনিসপত্র পাওয়া যায় সেখানকার বাজারে। পথঘাটগুলোও বেশ চওড়া। তাগড়াই ঘোড়া, উট, গাধা, খচ্চর সবই দেখতে পেলাম। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক লাগলো, জীন লাগাম ছাড়াই ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেছে সেখানকার সওয়ারীরা।

সুলতানের দরবারে আমাকে হাজির করা হলো। যথা বিহিত কুর্নিশ জানিয়ে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার দেশ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছ, জাঁহাপনা। কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, জীন লাগাম না লাগিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কেন এখানকার মানুষ? জীন লাগাম শুধু আরামদায়কই না, দেখতেও বড় বাহারী।

সুলতান অবাক হয়।–জীন লাগাম? সে কেমনতর বস্তু? আমার বাপ চোঁদপুরুষ তো তেমন কোনও জিনিসের নামও শোনেনি!

আমি বললাম, আপনি যদি হুকুম করেন, আমি আপনাকে বানিয়ে দেখাতে পারি। তারপর বুঝতে পারবেন, কত সুন্দর, সুখের, শখের আর দরকারী এই জীন লাগাম।

সুলতান বললো, বেশ তো করে দেখাও। যদি খুশি করতে পারো-তোমাকেও খুশি করে। দেব আমি।–

আমি বললাম, আমাকে একজন চৌকস ছুতোর দিতে হবে।

সুলতানের নির্দেশে শহরের সেরা সূত্বধর এলো আমার কাছে। আমি তাকে নক্সা একে বোঝালাম, কী বস্তু আমি বানাতে চাই। লোকটা কাঠের কাজে ওস্তাদ। যেমনটি আমি চাই-নিখুঁতভাবে সেই রকম একখানা কাঠের জীন বানিয়ে দিলো। এবার আমি ধুনুরীকে দিয়ে জীনের মাপের একখানা বাহারী গদী তৈরি করলাম। সোনার জরিতে কাজ করা নানা বর্মের এই গদা কাঠের জীনের ওপর বসিয়ে এটে দিলাম। এর পর এক দক্ষ কামারের সহায়তায় বানালোম একজোড়া লাগাম আর রেকবী।

সব যখন আমার পছন্দ মতো যথাযথভাবে তৈরি হয়ে গেলো, সুলতানের ঘোড়ােশাল থেকে বাছাই করে একটা তাগড়াই ঘোড়া নিয়ে এলাম আমি। সেই নতুন জীন লাগাম তার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে এলাম সুলতানের সামনে! সুলতান ক’দিন ধরে রোজই আমার কাজের খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। নতুন এই বস্তুটি দেখার আগ্রহে সে অধীর হয়েছিলো।

ঘোড়ার যে এমন মনোহর সাজ হতে পারে সুলতান ভাবতে পারেনি। খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো সে। আর তাঁর সইলো না, তখুনি সে লাফিয়ে উঠে বসলো ঘোড়ার পিঠে।

—বাঃ, বহুৎ বডিয়া চিজ তো? হুঁ—খুব আরাম—

–সুলতান খুব খুশি হয়ে আমাকে প্রচুর পরিমাণে ইনাম দিলো। উজির আমাকে বললো, বাঃ চমৎকার জিনিস তো। আমাকেও একটা বানিয়ে দাও।

তাকেও তৈরি করে দিলাম। একটা। সে-ও আমাকে অনেক পয়সাকডি উপহার দিলো। এরপর দরবারের আমির ওমরাহ, সেনাপতি একে একে সবাই ফরমাশ করতে থাকলো-সবাইকেই বানিয়ে দিলাম লাগাম জীন। বিনিময়ে পেলাম প্রচুর অর্থ। এইভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে, সেই শহরের আমি এক সেরা ধনী এবং মান্যগণ্য মানুষ হয়ে উঠলাম।

সুলতান আমাকে বহুৎ খাতির যত্ন করতে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমি তার পহেলা পেয়ারের মানুষ হয়ে গেলাম।

বললো, সিন্দবাদ। তুমি কি জান, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! তুমি তো আমার প্রাসাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। তোমাকে ছাড়া আমার এক দণ্ড চলে না, তোমার পরামর্শ ছাড়া কোনও একটা কাজ করতে পারি না। সুতরাং আমার এই মায়াবন্ধন ছিঁড়ে ফেলে যে দেশে পালাবে সে আমি হতে দেব না। এই কারণে আমি তোমাকে কঠিন বাঁধনে বাঁধতে চাই।

আমি বললাম, আদেশ করুন, জাঁহাপনা। আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য। আজ আমার যে এই ধনদৌলত ইজ্জত-সবই তো আপনার মেহেরবানীতে। সুতরাং আপনি যা হুকুম করবেন। আমি মাথা পেতে নেব।

—তাহলে, সুলতান বলে, তুমি আমার কথা মতো আমার প্রাসাদের একটি পরমা সুন্দরী মেয়েকে শাদী করে এখানে পাকাপাকি ভাবে সংসার পাতো! মেয়েটি রূপে গুণে অসাধারণ। সারা দেশে তার জুড়ি খুঁজে পাবে না। আমার বিশ্বাস, সে তোমাকে সুখ শাস্তি দুইই দিতে পারবে। আমি ভেবেছি, সে-ই পারবে তোমাকে এখানে ধরে রাখতে।

আমি লজ্জাবনত হয়ে বসে থাকি। ভেবে পাই না, কি এর জবাব দেব-কিভাবেই বা দেব।

সুলতান, আমাকে নীরব থাকতে দেখে, প্রশ্ন করলো, কী, চুপ করে রইলে কেন? জবাব দাও?

আমি কোনও রকমে কুণ্ঠিত ভাবে বলতে পারি, আমি আর কী বলবো জাঁহাপনা, সবই আপনার হাতে। আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। আমি আপনার দাসানুদাস।

সুলতানের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কাজীকে খবর দেওয়া হলো। তক্ষুণি সাক্ষীসাবুদ নিয়ে হাজির হলো কাজীসাহেব। এক ঘণ্টার মধ্যে শাদীনামা তৈরি হয়ে গেলো। শাহবংশের এক পরমাসুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ের সঙ্গে শাদী হয়ে গেলে আমার।

আমার সদ্য শাদী করা বিবি শুধু সুন্দরী আর শিক্ষিতাই নয়—সে তার মৃত পিতার অতুল ঐশ্বর্যের একমাত্র ওয়ারিশ। প্রাসাদোপম ইমারৎ, বিশাল ভূসম্পত্তি, বহু মূল্যবান ধনরত্ন এবং প্রচুর নগদ অর্থের সে মালিক। এছাড়া সুলতানও উপহার উপটৌকন দিলো অঢেল। আমাকে দিলো সে একখানা প্রাসাদ এবং আরও দিলেন বিশ্বস্ত লোকজন, দাসদাসী নফর বান্দা। এদের কেউই বাজার থেকে সদ্য কেনা নয়। বহুকাল সুলতান-প্রাসাদে একান্ত বশংবদ হয়ে কাজ করে এসেছে।

শাদীর পরে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। এত আনন্দ, এত প্রাণঢালা ভােলাবাসার স্বাদ এর আগে কখনও পাইনি। আমার যৌবনের বসন্তের রং ধরলো। নানা বাহারে, নানা ছন্দে বিকশিত হয়ে উঠলাম আমি।

এইভাবে অনেক দিন কেটে গেলো। যদিও সুলতানের কাছে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ, তবু অন্তরে, অতি সঙ্গোপনে, লালন করে চলেছি, একদিন না একদিন আমার বিবিকে সঙ্গে করে আমি আবার বাসভূমি বাগদাদে ফিরে আসবো।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। মানুষ নিয়তিকে এড়াতে পারে না। এবং তার ভবিতব্য কি তাও সে জানতে পারে না। নিয়তির হাতে সে খেলার পুতুল মাত্র।

একদিন আমার এক প্রতিবেশী বন্ধুর বিবি মারা গেলো। তার তারস্বরে কান্না শুনে আমি ছুটে গেলাম। নানাভাবে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার কোনও সাত্মনাই তার মড়াকান্না থামাতে পারলো না। আমি যতই তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করি, ততই সে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে।

আমি বোঝাতে চাই, দেখ, বিবি কারো চিরকাল বেঁচে থাকে না। তাই নিয়ে এত কান্নাকাটি করে কি করবে? এই তো তোমার জোয়ান বয়স, আবার শাদী করবে, আবার তোমার সংসার ভরে উঠবে। কেন এত দুঃখ করছি। আমি তোমাকে সুন্দরী মেয়ে দেখে শাদী দিয়ে দেব।

আমার বন্ধু আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলো, এসব তুমি কী বলছো, দোস্ত। আর একঘণ্টা বাদে যাকে সহমরণে মরতে হবে তার আবার নতুন করে শাদী করার কথা ওঠে কি করে?

আমি কিছুই বুঝতে পারি না তার কথা।—তার মানে? একঘণ্টা বাদে মরতে হবে কেন?

আমাকে অবাক হতে দেখে বন্ধুবর বললো, সেকি! তুমি জান না। আমাদের দেশের আইনকানুন। এদেশে স্বামী বা বিবি যে-ই আগে মরুক, তার সহমরণেই মরতে হবে অন্যজন্যকে। তা সে যদি স্বয়ং সুলতানও হন, কোনও রেহাই নাই।

আমি আঁৎকে উঠি। সৰ্ব্বনাশ! এমন জানিলে, কে শাদী করতো। এখন আমার বিবি যদি মারা যায়। তবে আমাকে মরতে হবে? একি কথা? কিন্তু আমি তো পরদেশী। এ দেশের আইনকানুন আমার ঘাড়ে চাপবে কেন? বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলতে পোর, দোস্ত তোমাদের দেশের এই বদখদ আইন আমার বেলাতেও খাটবে কিনা?

—আলবৎ খাটবে। এদেশে যে বাস করবে তা সে এদেশীই হোক, আর বিদেশীই হোক সকলের বেলাতেই সমানভাবে খাটবে।

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কান্নার আসল কারণটা কী? বিবি মারা যাওয়ার জন্য তার বিশেষ শোকতাপ নাই, নিজেকে মরতে হবে সেই আতঙ্কেই সে সারা।

যাই হোক বিপদের দিনে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার। তার এই অন্তিমযাত্রায় দু ফোঁটা চোখের জল ফেলাও তো আমার কর্তব্য।

পাড়াপাড়শীরা অনেকেই এলো। যথা নিয়মে মৃতদেহকে বয়ে নিয়ে চললো কিছু লোক। তার পিছনে আমার বন্ধু কাঁদতেকাঁদতে  চলে। আমরা চলি তার পিছনে। আমাদের চোখেও জল। সমবেদনার অশ্রু।

শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূর্ব পাহাড়ের পাদদেশে ওদের সমাধিক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্র বলা বোধ হয় ঠিক হলো না। একটা প্রকাণ্ড বড় ইদারা। তারা নিচে নামিয়ে দেওয়া হয় শবদেহটা। তারপর যাকে সহ-মরণে পাঠানো হবে তার পিঠে সাতখানা রুটী, এক কলসী জল আর হাতে দড়ি বেঁধে সেই ইন্দারার নিচে নামানো হয়। তলায় মাটি স্পর্শ করার পর উপর থেকে বলা হয়, এবার হাতের বাঁধন খুলে দড়ি ছেড়ে দাও। দডির বাঁধন সে খুলে দেয়। তখন দডিটা তুলে, ইদারার মুখে একটা পাথর চাপা দিয়ে তারা ঘরে ফিরে যায়। ব্যাচারী সাতটা রুটি খেয়ে যতদিন বাঁচতে পারে। ততদিন বেঁচে থাকে। তারপর অনাহারে, আতঙ্কে একদিন সে মরে যায়।

আমার বন্ধুর এই ভয়াবহ প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা দেখে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। মনে হলো, এখনি বুঝি আমি মুছা যাবো। কিন্তু না, নিজেকে কোনওরকমে সামলে নিয়ে ছুটে গেলাম সুলতানের কাছে। কোনওরকম ভূমিকা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম, আমার বিবি যদি আগে মারা যায়, আমাকে কী তার সঙ্গে সহমরণে যেতে হবে?

সুলতান বললো, নিশ্চয়ই। কিন্তু কেন, তোমার বিবি কি—

আমি বাধা দিয়ে বলি, না সে সব কিছু ঘটেনি। তবে ঘটতে তো পারে। সে ক্ষেত্রে আমাকে কেন মরতে হবে? আমি তো পরদেশী। আর তা ছাড়া ছেলে মেয়ে বিবি সবই তো আছে। আপনার দেশের আইনকানুন আমাকে মানতে হবে কেন?

—আলবৎ মানতে হবে। এদেশে বাস করলে, এদেশের মেয়েকে শাদী করলে এদেশের কানুন মানতেই হবে। সে তুমি যে-দেশের মানুষই হও।

আমার অবস্থা তখন উন্মাদের মতো। প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতেবাড়ি ফিরে এলাম। আসার পথে কেবল আতঙ্ক হচ্ছিল, যদিবাড়ি পৌঁছে দেখি, বিবি মরে গেছে! তখন? তখন কী হবে? শহরের প্রতিটি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। আমার শোকে সান্ত্বনা দিতে আসবে তারা। আমার বিরাট প্রাসাদ-এ তিল ধরনের ঠাই থাকবে না। লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। এর পর শবযাত্ৰায় সঙ্গী হতে আসবেন, সুলতান, উজির আমির সেনাপতি—সবাই। এদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানো যাবে না। বে-ঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।

কিন্তু না, ওসব কিছুই হয়নি। বিবি আমার বহাল তবিয়তেই আছেন। ধড়ে প্রাণ এলো।

কথায় আছে-খোদার মা’র দুনিয়ার বা’র। নসীব খারাপ, কিছু দিন যেতে না যেতে আমার বিবিজান অসুখে পড়লো। শরীর থাকলেই অসুখ-বিসুখ হয়। তাই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে? এই বলে মনকে প্রবোধ দিই। কিন্তু ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডর হয়। আমার দশাও তাই। শুধুই মনে শঙ্কা জাগে, যদি অসুখ না। সারে। যদি আর শয্যা ছেড়ে না। ওঠে সে?

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সত্যি সে আর সে-শয্যা ছেড়ে উঠলো না। খোদা তাকে কোলে তুলে নিলেন। আমার অবস্থা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছে তোমরা। কোরবানীর খাসীর মতো গলা বাড়িয়ে দিতে হবে ভেবে আমি শিউরে উঠলাম। পালাবো সে পথ নাই। আমার অগণিত শুভানুধ্যায়ীরা পিলপিল করে ধেয়ে এসে আমার প্রাসাদ ভরে ফেললো। সুলতানের প্রাসাদে খবর গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার দলবল নিয়ে সান্ত্বনা জানাতে এলো আমাকে। সুলতান সাশ্রু নয়নে বললো, বিধাতার বিধান মেনে নিতেই হবে, বাবা। এই সংসারের মায়া মহব্বাৎ, সব কাটিয়ে তোমাকে আজ তার দোসর হতে হবে। আমাদের শাস্ত্রের এই বিধান। এবং এর চেয়ে বেশি পুণ্য আর কিছুতে হয়না। হাসি মুখে তোমার বিবির অনুগামী হও, বেটা। মন পার্থিব কামনা বাসনা মুক্ত কর। দেখবে, তখন এই পার্থিব জগতে থাকতে আর মন চাইবে না।

সুলতানের এই বাকতালা আমার তখন অসহ্য মনে হচ্ছিল। এই লোকটার জন্যেই আজ আমার এই দশা। দেশে বিবি বাচ্চা থাকতে এখানে একটা মেয়েকে গছিয়ে দিলো সে। আর এত বড় হাড়ে-হারামজাদা, সব কথা খোলসা করে বলেনি আমায়! এইরকম বর্বর আইনকানুন আছে এদেশে সে-কথা আগে জানলে কে সোধে হাডি-কাঠে মাথা গলাতো?

ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতাম। বিবি-বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করতাম। শুধু এই সুলতান বেটাই আমাকে আটকে রেখে দিলো। বলে কিনা, তোমায় আমি ছাড়বো না। তোমাকে আমি পেয়ার করি। আমাকে ছেড়ে চলে গেলে প্ৰাণে বাঁচবো না।–তুমি এখানে শাদী করে সংসার পাতো। তখন কি বুঝেছিলাম, লোকটা আমাকে এখানকার মাটিতে জ্যান্ত কবর দেওয়ার ফন্দী আটছে!

আমি আর্তনাদ করে উঠলাম।–আমাকে আপনারা ছেড়ে দিন। আমি দেশে ফিরে যাবো। সেখানে আমার বিবি বালবাচ্চা আছে। আমি পরদেশী। এভাবে আমাকে মেরে ফেলা আপনাদের অন্যায়।

কিন্তু আমার কথায় কৰ্ণপাত করলো না কেউ। আমার বিবিকে শাদীর সাজে সাজানো হলো। দামী দামী রত্নালঙ্কারে মুড়ে দেওয়া হলো তার সারা শরীর। তারপর একখানা সাদা কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢেকে শব-দেহটা কাঁধে তুলে নিলো কয়েকজন।

শব-মিছিলের পুরো ভাগে আমার মৃত বিবি, তার পিছনে আমি, আমার পিছনে সুলতান, তারপর উজির আমির এবং অগণিত শুভানুধ্যায়ীরা। ধীর পদক্ষেপে আমরা এগিয়ে চলি সমাধি ক্ষেত্রের দিকে। সমুদ্র সন্নিহিত পর্বত পাদদেশে।

সেই ইঁদারার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমরা। শবদেহ নিচে নামানো হলো। আচার অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমার বিবির মৃত দেহটা ইদারার নিচে নামিয়ে দেওয়া হলো। এবার আমার পালা। একটা কলসীতে জল ভরে সঙ্গে সাতখানা রুটি আমার পিঠে বেঁধে দিলো। ওরা। আমি এবার ডুকরে কেঁদে উঠলাম।-দোহাই আপনাদের, আমাকে ছেড়ে দিন।

কিন্তু কেউ শুনলো না সে কথা। আমার হাতে পরিয়ে দিলো দডির ফাঁসী। তারপর কয়েকজনে মিলে জোর-জবরদস্তি করে নামিয়ে দিলো ইঁদারার নিচে।

উপর থেকে চিৎকার শোনা গেলো, ফাসটা খুলে দডিটা ছেড়ে দাও—

কিন্তু আমি ওদের কথা শুনলাম না। ঠিক করলাম দড়ি আমি ছাড়বে না। বারবার ওরা আমাকে হুকুম করতে থাকলো, দেরি করো না, দডিটা ছেড়ে দাও। আমরা ফিরে যেতে পারছি না।

তবু আমি ওদের কথা শুনলাম না। শেষে দডির আশা ছেড়ে, ইদারার মুখে পাথরচাপা দিয়ে ওরা চলে গেলো।

আমি সেই প্রায়ান্ধকার ইঁদারার তলদেশে, বসে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকলাম। কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে শেষে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাটা দিন সারাটা রাত অসাড় ঘুমে কেটে গেলো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। প্রচণ্ড ক্ষিদেয় পেট জ্বলছে। একখানা রুটি আর একটু জল খেলাম।

চারদিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম, অসংখ্য নরকঙ্কাল। কতকগুলো মৃতদেহে পচন ধরেছে। আর কতকগুলো এখনও আনকোরা। পচা দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু উপায়ই বা কী?

ভেবে ভেবে আতঙ্কিত হতে থাকলাম, এই রুটি কখানা ফুরিয়ে গেলে, একদিন অনাহারে শুকিয়ে মরে যেতে হবে এখানে। এই-ই আমার নিয়তি।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

তিনশো চরিতম রজনী সমাগত :

শাহরাজাদ আবার বলতে শুরু করে : আমি আমার নসীবের কথা ভাবছি। কেন এই পরিবাসে শাদী করার শখ হয়েছিলো আমার? দেশের ছেলে দেশে ফিরে গিয়ে বিবি বালবাচ্চাদের নিয়ে সুখে সংসার করতে পারতাম। কিন্তু ইউ কেন আমার এই দুর্মত হলো? এখন এইভাবে অপমৃত্যু বরণ করতে হলো? এর চেয়ে সেই হীরক পাহাড়ে সাপের গহ্বরে প্রাণ হারালে ক্ষতি কি ছিলো? কিংবা সেই নরখাদকরা যদি আমাকে কাবাব করেই খেত— তাতেই বা কি হতো। সেও মৃত্যু, এও মৃত্যু। সবচেয়ে ভালো হতো, যখন জাহাজখানা খানখান হয়ে গেলো, সেই সময় সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যাওয়া। সে মৃত্যু অনেক গৌরবের হতো।

আমি নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে থাকি। ইদারার দেওয়ালে কপাল ঠুকি। অসহায়ের মতো আর্তনাদ করি। কিন্তু কে শুনবে আমার সেই আকুল আবেদন।

এইভাবে সাতটা দিন কেটে গেলো। রুটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ক্ষিধেয় পেট জ্বলতে থাকে। তবুও এখনও ঐ একখণ্ড রুটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে পারছি আরও দু-একটা দিন হয়তো বাঁচতে পারবো। মউৎ শিয়রে এলে বাঁচার সাধ বড় বেশি করে জাগে।

ক্ষিদের বড় জ্বালা। খাবো না খাবো না করেও রুটির শেষ খণ্ডটুকু খেয়ে ফেললাম। এরপর আরও দুটি দিন কেটে গেলো। আর বুঝি বঁচা গেলো না, জঠরের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম, মৃত্যু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপ করতে থাকি।

হঠাৎ এক ঝলক আলো এসে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো আমার আশপাশ। উপরে তাকিয়ে দেখলাম, পাথরখানা সরে গেছে। একটি নতুন শব-দেহ নিচে নেমে আসছে। মৃতদেহটি একজন বৃদ্ধের। এর পরেই দড়ি বেয়ে নেমে এলো তার বিবি। পিঠে বাঁধা সাতখানা রুটি আর এক কলসী জল।

আমি উঠে গিয়ে নিয়ে এলাম কঙ্কালের একখানা পা। সেই হাড়ের ডান্ডা বসিয়ে দিলেম বুড়িটার মাথায়। একটাবাড়ি মারতেই সে লুটিয়ে পড়ে গেলো, আর একটাবাড়ি দিতেই সব শেষ।

এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড করতে হলো ঐ মাত্র সাতখানা রুটির জন্য। যেন তেন প্রকারে আমাকে প্ৰাণ ধারণ করতে হবে।–তখন আমার একমাত্র চিন্তা। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, কোনটা ধর্ম, কোনটা অধৰ্ম সে জ্ঞান বুদ্ধি তখন আমার লুপ্ত হয়ে গেছে।

সেই ক’খানা রুটি আর এক কলসী জলে আরও কয়েকদিন চললো। এর পর আবার একদিন কুপের মুখ উন্মুক্ত হলো। নেমে এলো একটি বিবির মৃতদেহ আর তার জীয়ন্ত স্বামী। মানুষের সংগ্রহ করলাম।

এইভাবে অনেক দিন বেঁচে থাকলাম আমি। এক একটা করে মৃত দেহ আসে; আর তার সঙ্গীকে হত্যা করি আমি।

একদিন আমি আমার জায়গায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা অদ্ভূত শব্দে ধড়মড় করে উঠে হাড়ের ডাণ্ডাটা হাতে বাগিয়ে ধরলাম। শব্দটা অনুসরণ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে থাকি। বেশ বুঝতে পারি, বড়সড় গোছের কোনও একটা প্রাণী ছুটে চলে গেলো। আমিও তার ছায়া অনুধাবন করে ছুটে চলি। ঘুটফুটে অন্ধকার। কিছুই নজরে আসে না। তবু চলতে থাকি। ব্যাপারটা কী—দেখতে হবে। এইভাবে অনেকক্ষণ চলার পর হঠাৎ একটি আলোর রশ্মি এসে পড়লো। আমার মুখে। সেই আলোর নিশানা ধরে আমি এগিয়ে চলি। ক্রমশ সামনেটা পরিষ্কার হয়ে আসে। আরও এগিয়ে যাই। আলোর বন্যায় চোখ আমার ঝালাসে গেলো। তখনও আমি কিন্তু ভাবতে পারছি না, এই আমার মুক্তির পথ। বরং মনে হলো, এ বুঝি আর একটা মৃত্যু কূপ। কিন্তু একটু পরেই আমার ভ্রম কাটলো। সেই দিবালোকে পরিষ্কার দেখলাম, একটি মাংসভুক জানোয়ার দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।

হিংস্র জানোয়াররা মড়ার লোভে পাহাড়ের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে এই মৃত্যুকুপের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। রাতের বেলায়, তারা চুপিসারে এসে লাশ টেনে নিয়ে চলে যায়।

জানায়ারটাকে অনুসরণ করে আমি এগিয়ে যাই। এবার আমি উন্মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। সামনে সমুদ্র। পিছনে খাড়াই পাহাড়। প্ৰাণ ভরে মুক্ত হওয়ায় নিশ্বাস নিই। দু-হাত তুলে তাকে প্রণতি জানাই।

ঋজু পাহাড়টা ওপারের শহরটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে যাওয়ার বা ওদিক থেকে এদিকে আসার কোনও উপায়ই নাই। একমাত্র সমুদ্র পাডি দেওয়া ছাড়া পালাবার কোনও পথ দেখতে পেলাম না।

খিদের জ্বালায় আবার আমি ফিরে গেলাম সেই মৃত্যু-কুপ-এ। সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আবার আসে নতুন শব। আবার সেই নরহত্যা-সেই রুটি জল সংগ্রহ। এইভাবে বেশ কিছুকাল কটালো।

সমুদ্রের ধারে এসে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকি। যদি কোনও জাহাজের মাস্তুল দেখতে পাই। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। মৃত্যুকূপ-এ এসে হীরে জহরৎ অলঙ্কারাদি সংগ্বহ করতে থাকি। কতকাল ধরে কত হাজার হাজার মানুষের সমাধি হচ্ছে এখানে। তার অর্ধেক নারী। তারা সবাই রত্নাভারণে সজ্জিতা হয়ে আসে। সেই সব অলঙ্কার ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ে আছে।

এক এক করে কুড়িয়ে এক জায়গায় পালা দিই। বিরাট স্তুপের মতো হয়ে ওঠে। শব্বাচ্ছাদনের মোট কাপড়ে বোঝাই করে পুট্টলী বাঁধতে থাকি। তারপর পুট্টলীগুলো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাই সমুদ্রের পড়ে।

দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর একখানা জাহাজ দেখতে পাই। মাথার পাগড়ী খুলে এদিক ওদিক দোলাতে থাকি। কাপ্তেনের যাতে এদিকে নজর পড়ে সে জন্য এধার ওধোর ছুটোছুটি করি। নসীব সাধ দিলো। কাপ্তেন সদয় হয়ে একখানা ছোট ডিঙি পাঠিয়ে দিলো আমার কাছে। পুটলীগুলো সঙ্গে নিয়ে নৌকায় চেপে বসলাম আমি। একটুক্ষণের মধ্যেই জাহাজে উঠে এলাম।

কাপ্তেন জিজ্ঞেস করলো, কে তুমি? এই হিংস্র জন্তুজানোয়ারের রাজ্যে এলেই বা কী করে। ঐ পাহাড়ের চুড়া ডিঙিয়ে এদিকে তো কোনও মানুষ আসতে পারেনি কখনও। আমি এই সমুদ্রে সারাটা জিন্দগী ঘুরে বেড়াচ্ছি। আজ পর্যন্ত ওখানে কোনও মানুষের ছায়া তো আমার চোখে পড়েনি! তুমি কী করে এলে ওখানে?

আমি বললাম, তা হলে শুনুন আমার কাহিনীঃ আজ আমি এক মুসাফীর। কিন্তু একদিন আমি ভাগ্য অন্বেষণে বাণিজ্য করতে বেরিয়েছিলাম। সমুদ্রের মধ্যে ঘুণী ঝড়ের মুখে আমাদের জাহাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আমি জাহাজের একখানা পাটাতনের কাঠ ধরে কোনও রকমে এইকুলে এসে উঠি।

আমি কিন্তু প্রথমটুকু ঠিকই বললাম, কিন্তু শেষের সব ঘটনাই বেমালুম চেপে গেলাম। বললাম, আমার সামানপত্র সবই খোয়া গেছে। শুধু কোনরকমে আঁকড়ে ধরেছিলাম আমার এই মূল্যবান হীরে জহরৎগুলো।

একখানা খুব দামী জড়োয়ার গহনা বের করে কাপ্তেনের হাতে দিয়ে বললাম, এটা আপনি রাখুন, যে উপকার আমার করলেন, সে ঋণ এই সামান্য হীরে জহরতে শোধ করা যায় না।

কাপ্তেন কিন্তু গ্রহণ করলেন না।–সো হয় না। তোমার কাছ থেকে একটা কানাকডি আমি নিতে পারবো না, বাবা। তুমি বিপদে পড়েছ, আমি নাবিক, তোমাকে উদ্ধার করে যথা স্থানে পৌঁছে দেওয়াই আমার কর্তব্য। এজন্য একটুও কুষ্ঠিত হয়ে না তুমি। এই দুস্তর সমুদ্র পথে চলতে চলতে কত মানুষকে আমি উদ্ধার করি। তাদের খানাপিনা সাজ-পোশাক এমন কি ঘরে ফেরার মতো সামান্য কিছু রাহা খরচও সাধা মতো দিই। কিন্তু ঐ আমার এক কথা, কারো কাছ থেকে একটা কপর্দকও আমি নিই না। তাই তোমার কাছ থেকেও কিছু নিতে পারবো না। ওটা তুমি রেখে দাও। শোন বাবা, এই দুনিয়াটা পান্থশালা, এখানে খোদাতালার নির্দেশে দুদিনের জন্য এসেছি আমরা। কাজ ফুরালেই চলে যাব। চলার পথে দুদিনের চেনাজানা, দেখাশোনা—সেই স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকে, যদি কখনও কারও এতটুকু উপকারে আসতে পারি।

কাপ্তেনের দীর্ঘ জীবন কামনা করে অনেক সুক্ৰিয়া জানালাম আমি। জাহাজ আবার চলতে থাকলো। অনেক শহর বন্দর দ্বীপ পার হয়ে চলতে থাকলাম।

জাহাজের খোলা পাটাতনে বসে সমুদ্রের ঘন নীল জলরাশির দিকে চেয়ে চেয়ে স্মৃতি রোমন্থন করি। মাঝে মাঝে শিউরে উঠি। আবার কখনও সন্দেহাকুল হয়ে ভাবি, যা মনে করতে পারি, সবই কি সত্যি সত্যি ঘটেছিলো? কোনও মানুষের জীবনে কী এই সব ঘটনা ঘটতে পারে? আমার মৃত বিবির সঙ্গে সেই মৃত্যু-কুপের দিনগুলো? উফ, ভাবা যায় না। এসব কথা বললে, কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে, হাসিসের মাত্রাটা বুঝি বেশি হয়ে গেছে!

আল্লাহ দোয়ায় একদিন বসরোহর বন্দরে এসে জাহাজ ভিড়লো। খুশিতে নেচে উঠলো মন। এতদিনে ভরসা হলো, দেশে ফিরতে পারবো। বসরা হয়। কয়েকটা দিন অবস্থান করার পর আমরা বাগদাদে এসে পৌঁছলাম।

আমাকে দেখে আপনজনদের আনন্দ আর ধরে না। তারা আশঙ্কা করেছিলো, আমার সলিল সমাধি ঘটেছে। আমার যে কী আনন্দ সে তোমাদের বোঝাতে পারবো না।

সাতদিন ধরে দীনভিখারী অনাথ আতুরদের ভুরি ভোজন করলাম। ফকির দরবেশদের দানধ্যান করলাম অনেক।

কিন্তু এও তেমন কিছু নয়, বৃদ্ধ সিন্দবাদ নাবিক বলতে থাকে, আগামীকাল তোমাদের যে কাহিনী শোনাবো তার কোনও তুলনা হয় না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা–

সেদিনও সে কুলি সিন্দবাদকে একশোটা সোনার মোহর দিয়ে বলে, কাল সকালে ঠিক সময়ে চলে আসবে, কেমন? আচ্ছা, এব্র সবাই এসো খানাপিনা সেরে নেওয়া যাক।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে সে দিনের মতো সকলে যে যার ঘরে চলে গেলো।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

তিনশো ছয়তম রজনী :

কুলি সিন্দবাদবাড়ি ফিরে আসে। সারা রাত তার চোখে ঘুম আসে না। বৃদ্ধ সিন্দাবাদের সেই বিচিত্র কাহিনীর সব জীয়ন্ত ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। পরদিন সকালে সে যখন আবার বৃদ্ধের বাড়িতে চলে আসে তখনও সে ভাবছে—কী করে সেই মৃত্যুকূপের মধ্যে এই মানুষটা একদিন অতগুলো বীভৎস দিন কাটাতে পেরেছিলো। আর কী করেই বা সে মৃত্যু গহ্বর থেকে নিজেকে উদ্ধার করেছিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *