1 of 2

২.০৪ মেস্‌মেরিজমে ব্যবহৃত বিশেষ পাস

চতুর্থ পাঠ
মেস্
মেরিজমে ব্যবহৃত বিশেষ পাস

প্রথম খণ্ডের সপ্তম পাঠে বিবৃত হইয়াছে যে পাস দ্বারা জীবনীশক্তি, আকর্ষণী শক্তি বা মেস্‌মেরিক শক্তির প্রেরণ, বণ্টন, সঞ্চালন এবং লক্ষ্যাভিমুখে পরিচালন ক্রিয়া সম্পাদিত হয় এবং এই সকল কার্যের ফলেই মেস্‌মেরি বা মোহ নিদ্রা উৎপাদিত এবং অপসৃত হইয়া থাকে। সুতরাং কাহাকেও মেমোইজ করিতে কিম্বা মোহ নিদ্রা হইতে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পাসের ব্যবহার অপরিহার্য। উক্ত জীবনী বা আকর্ষণী শক্তি আঙ্গুলের অগ্রভাগ হইতে নিঃসৃত হইয়া থাকে, এজন্য বিশেষ প্রণালীতে হস্ত চালনা করিয়া ঐ সকল ক্রিয়া সম্পন্ন করিতে হয়।

মেস্‌মেরিক পাসের সংখ্যা চারিটি :–(১) দীর্ঘ পাস (Long or Full Length pass), (২) উপশম পাস (Relief Pass), (৩) ক্ষুদ্র বা স্থানীয় পাস (Short or Local Pass) (৪) এবং কেন্দ্রীভূত জীবনীশক্তি (Focussed Magnetism)। ইহাদের মধ্যে ৪র্থ ভিন্ন আর সকল গুলি পাসই স্পর্শযুক্ত ও স্পর্শহীন ভাবে এবং নিম্নগামী ও উৰ্দ্ধগামীরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। আর ৪র্থ পাসটি কেবল স্পর্শযুক্ত ভাবেই সৰ্ব্বদা প্রযুক্ত হয়। পাত্রকে মেস্‌মেরাইজ করিতে এই পাসগুলিকে নিম্নগামীরূপে, আর তাহাকে মোহ নিদ্রা হইতে প্রকৃতিস্থ করিতে উৰ্দ্ধগামীরূপে প্রদত্ত হইয়া থাকে।

স্পর্শযুক্ত নিম্নগামী দীর্ঘ পাসের প্রণালীঃ-এই পাস পাত্রের মাথার উপর হইতে আরম্ভ করতঃ পা পর্যন্ত আনিয়া শেষ করিতে হয়। ইহা করিতে কাৰ্যকারক উভয় হাতের আঙ্গুলগুলি অল্প ফাঁক ও প্রসারণ করতঃ উহাদিগকে (চেয়ারে উপবিষ্ট বা বিছানায় শায়িত) পাত্রের মাথার উপর পাশাপাশি ভাবে স্থাপন পূর্বক দুই-তিন সেকেণ্ড রাখিবে; পরে হাত দুইখানা ধীরে ধীরে কাপাইয়া কঁপাইয়া যথাক্রমে তাহার কপাল মুখ, চিবুক, বক্ষঃস্থল ইত্যাদির উপর দিয়া স্পর্শযুক্ত ভাবে বরাবর নীচের দিকে টানিয়া লইয়া আসিবে। যখন উহারা পায়ের শেষ সীমায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন সে উভয় হাতের আঙ্গুলগুলি মুষ্টিবদ্ধ করোন্তর হাত দুইখানাকে তাহার (পাত্রের) শরীরের দুই পার্শ্বে লইয়া গিয়া জোরের সহিত একবার ঝাড়িয়া ফেলিবে। হাতের মুঠায় ধূলা বা বালি থাকিলে উহা দূরে নিক্ষেপ করিতে যেমন ভাবে হাত বাড়িতে হয়, এই ঝাড়নটাও ঠিক সেইরূপ হইবে। ঝাড়নের বাতাস পাত্র বা তাহার নিজের গায়ে লাগিতে না পারে, হাত দুই খানাকে এরূপ দূরে লইয়া গিয়া ঝাড়িতে হইবে। হাত বাড়ার অব্যবহিত পরে সে পুনরায় উভয় হাতের আঙ্গুল গুলি মুষ্টিবদ্ধ করোন্তর হাত দুইখানাকে পাত্রের মাথার উপর লইয়া যাইবে এবং যখন উহারা সেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন আবার জোরের সহিত উহাদিগকে মাথার উপর ঝাড়িবে। এই বারের ঝাড়নের বাতাসটা সম্পূর্ণরূপে তাহার মাথার উপর গিয়া লাগা চাই। প্রথম ঝাড়ার পর যখন হাত দুইথানাকে মাথার উপর আনিবে, তখন উহাদিগকে পাত্রের শরীরের দুই পার্শ্বের বাহির দিয়া লইয়া যাইতে হইবে। কারণ উহাদিগকে তাহার শরীরের উপর দিয়া লইয়া গেলে, উহা বিপরীত বা উৰ্দ্ধগামী পাসের ন্যায় কাৰ্য করতঃ পূর্ব প্রদত্ত পাসের ক্রিয়া নষ্ট করিয়া ফেলিতে পারে। এজন্য একটি নিম্নগামী পাস দেওয়ার পর, হাত দুই খানাকে শরীরের বাহির দিয়া মাথার উপর লইয়া যাইতে হয়। দ্বিতীয় বারের ঝাড়ন শেষ হওয়া মাত্রই হাত দুইখানাকে আবার পূর্বের ধ্যায় মাথার উপর স্থাপন করতঃ উক্তরূপে পাস দিবে। যতক্ষণ পত্র মেস্‌মেরি নিদ্রায় অভিভূত না হয়, ততক্ষণ ক্রমাগত উহার পুনরাবৃত্তি করিবে।

স্পর্শহীন নিম্নগামী দীর্ঘ পাসের প্রণালী :—ইহা পূর্বোক্ত পাসেরই অনুরূপ; কেবল প্রভেদ এই যে, ইহাতে উভয় হাতের আঙ্গুল গুলিকে এমন জোরের সহিত টান্ করিয়া রাখিতে হয়, যেন উহারা পিছনের দিকে ধনুকের ন্যায় বাকিয়া থাকে। এইরূপে আঙ্গুলগুলি ঠিক করিয়া লইবার পর, হাত দুইখানাকে পাত্রের মাথার উপর (মাথা হইতে এক বা দেড় ইঞ্চি উচ্চে শূন্যের উপর) দুই-তিন সেকেণ্ড স্থাপন করিয়া রাখিবে; পরে উহাদিগকে নীচের দিকে ধীরে ধীরে টানিয়া আনিবে। বলা বাহুল্য যে, উহা করিবার সময় হাত দুইখানাকে শরীর হইতে বরাবর অতটুকু উচ্চে রাখিয়াই নীচের দিকে লইয়া আসিতে হইবে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বারের ঝাড়নও পূর্বোক্ত পাসের অনুরূপ হইবে।

উপশম পাসের প্রণালীঃ -ইহারও প্রয়োগ-প্রণালী দীর্ঘ পাসেরই অনুরূপ; কেবল প্রভেদ এই যে, নিম্নগামী দীর্ঘ পাস মাথা হইতে আরম্ভ করিয়া পা পর্যন্ত আসিয়া শেষ করিতে হয়; আর ইহা মাথা হইতে আরম্ভ করিয়া হাঁটু, কোমর, পেট, বক্ষঃস্থল, গলদেশ বা চিবুক পর্যন্ত আনিয়া সমাপ্ত করিতে হয়। পাত্রকে নিদ্রিত করিবার জন্য একাধিক্রমে কতকগুলি নিম্নগামী দীর্ঘ পাস দেওয়ার পর, সম্মোহনবিৎ শ্রম লাঘবের জন্য এই পাস ব্যবহার করিয়া থাকে; কিম্বা ইহা দীর্ঘ পাসের সহিতও পৰ্য্যায় ক্রমে প্রযুক্ত হইতে পারে। এই পাসেরও পূর্বে এবং পরে পূৰ্ব্বকথিত প্রণালীতে দুইবার হাত বাড়িতে হয়।

ক্ষুদ্র বা স্থানীয় পাসের প্রণালীঃ —এই পাস সাধারণতঃ চিকিৎসার জন্যই প্রযুক্ত হইয়া থাকে। শরীরের কোন স্থানে কোন রোগ হইলে রোগীকে সম্মোহিত না করিয়া তাহা আরোগ্যের উদ্দেশ্যে ইহা প্রয়োগ করা হয়। নিম্নগামী দীর্ঘ বা উপশম পাস যেমন পাত্রের মাথা হইতে আরম্ভ করিতে হয়, ইহা সেরূপে করা হয়না। এই পাস রোগাক্রান্ত স্থানের খানিকটা উপর হইতে আরম্ভ করিয়া উহার কিয়দ্র নীচের দিকে আনিয়া শেষ করিতে হয়। সম্মোহনবিৎ এই পাস দ্বারা। আকর্ষণী শক্তিকে কেবল রুগ্ন স্থানের উপর সঞ্চালন করিয়া থাকে এবং তাহাতেই রোগ আরোগ্য হয়। সুতরাং ইহা দ্বারা রোগীর শরীরের অন্য কোন স্থান আক্রান্ত বা প্রভাবিত হয়না। বিশেষ ভাবে হাত, পা, বুক, পিট বা অন্য কোন স্থানে কোন রোগ হইলে, রোগীকে মোহিত না করিয়া এই পাস দ্বারা তাহা আরোগ্যের চেষ্টা পাওয়া যায়। এই পাস অধিকাংশ স্থলে স্পর্শযুক্ত আর সর্বদাই নিম্নগামী হয় এবং উহার শেষে হাতখানাকে একবার ঝাড়িয়া ফেলিতে হয়।

(৫) কেন্দ্রীভূত আকর্ষণী শক্তির প্রয়োগ প্রণালীঃ-কাহারও শরীরের কোন অংশ পীড়িত হইলে তাহা আরোগ্যের জন্য সেইস্থানে কেন্দ্রীভূত আকর্ষণী শক্তির নিয়োগ আবশ্যক হইয়া থাকে। নিম্নোক্ত ভাবে ইহা করিতে হয়। দক্ষিণ হাতের আঙ্গুলগুলির পরস্পরের মধ্যে ঈষৎ ফাঁক রাথিয়া উহাদের অগ্রভাগগুলি অসংযুক্ত ভাবে একত্রিত করিবে। এখন আঙ্গুলের মাথাগুলি, পীড়িত স্থানের এক ইঞ্চি (শূন্যের) উপরে, ঐ স্থান লক্ষ্য করতঃ স্থাপন করিবে, অর্থাৎ আঙ্গুলের মাথাগুলিকে পীড়িত স্থান হইতে এক ইঞ্চি শূন্যের উপর উপুর করিয়া ধরিয়া রাখিবে। তৎপরে হাতখানাকে ধীরে ধীরে কাপাইবে এবং সেই সঙ্গে খুব একাগ্রমনে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করিবে যে, আঙ্গুলগুলির অগ্রভাগ হইতে যে আকর্ষণী শক্তি নিঃসৃত হইতেছে, তাহা পীড়িত স্থানে প্রবিষ্ট হইয়া ঐ স্থান নিরাময় করুক। ইহার সহিত আঙ্গুলগুলির উপর আস্তে আস্তে ফু দিলে, উহাদের অগ্রভাগ হইতে আকর্ষণী শক্তি নিঃসরণের বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে। কাহার শরীরের অংশে কোন বেদনা বা ঘা হইলে কিম্বা আঘাত লাগিয়া থেতলাইয়া গেলে, অথবা চক্ষু, কর্ণ বা অপর কোন ইন্দ্রিয় দুৰ্বল হইলে এই প্রণালীতে তাহা আরোগ্য করা যায়। পাত্রকে মেস্‌মেরাইজ করিবার সময় তাহার চক্ষু, কপাল বা ঘাড়ের গ্রন্থির উপর উক্তরূপে আঙ্গুলের মাথাগুলি মাঝে মাঝে ধরিয়া রাখিলে মোহ নিদ্রা উৎপাদনের বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে।

শারীরিক ও মানসিক আকর্ষণ স্পর্শ–মেস্‌মেরাইজ্‌ করিতে এই প্রক্রিয়া দুইটিও সর্বদা প্রযুক্ত হইয়া থাকে। যেহেতু উহাদের দ্বারাও মেস্‌মেরিক শক্তি পাত্রের শরীরাভ্যন্তরে সঞ্চালিত হইয়া থাকে। শারীরিক আকর্ষণী স্পর্শ (Physical Magnetic Contact) করিতে কাৰ্যকারক নিজের দক্ষিণ হাতের আঙ্গুলগুলি পাত্রের মাথার উপর স্থাপন পূৰ্ব্বক বৃদ্ধাঙ্গুলিটি তাহার নাসিকা-মূলে অল্প জোরে চাপিয়া ধরিয়া (যেন সে ব্যথা না পায়) অভীতি বিষয়ে তাহাকে মৌখিক বা মানসিক আদেশ দিয়া থাকে। এই প্রণালীতে আদেশ দিলে তাহা বেশ কার্যকর হয়। আর “মানসিক আকর্ষণী স্পর্শ” (Mental Magnetic Contact) সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার। পাত্রের নাসিকা মূলে স্থির ও প্রখর দৃষ্টি স্থাপন পূৰ্ব্বক খুব একাগ্রমনে মানসিক আদেশ দিলেই ইহা সম্পাদিত হইয়া থাকে। পাত্র মেস্‌মেরাইজড় হওয়ার পর সম্মোহনবিদের মনের সহিত তাহার মনের খুব গভীর ঐক্য স্থাপিত হইলেই বিশেষ ভাবে ইহা কার্যকর হয়। সুতরাং সকল অবস্থায় সকল পাত্রের উপর ইহা কায করেন।

বিপরীত বা উৰ্দ্ধগামী পাসের প্রণালী :—ইহা স্পর্শযুক্ত বা স্পর্শহীন উভয় রকমেই প্রযুক্ত হইয়া থাকে; কিন্তু সচরাচর ইহা স্পর্শহীন ভাবে নিম্নগামী পাসের ক্রিয়া নষ্ট বা বিদূরিত করিতে অর্থাৎ মোহিত ব্যক্তিকে প্রকৃতিস্থ করিতে প্রযুক্ত হইয়া থাকে। এই পাস পাত্রের পা হইতে আরম্ভ করতঃ মাথা পর্যন্ত আনিয়া শেষ করিতে হয়। নিম্নগামী পাসের সময় আঙ্গুলের অগ্রভাগ উপরের দিকে এবং মণিবন্ধ নীচের দিকে থাকে; আর ইহাতে আঙ্গুলের মাথাগুলি নিম্নাভিমুখে ও মণিবন্ধ উপরের দিকে অবস্থিত থাকিয়া হাত দুইখানা উদ্ধা দিকে চালিত হয়। উক্তরূপে পা হইতে সুরু হইয়া যখন পাসটি মাথা পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিয়াছে, তখন পাত্রের মাথার দুই পাশের বাহিরে হাত দুইখানাকে পূর্বোক্তরূপে একবার ঝাড়িয়া ফেলিবে (এই ঝাড়ার বাতাস ও তাহাদের কাহারও গায়ে লাগিবেনা)। সুতরাং নিম্নগামী দীর্ঘ পাসের সময় যেমন হাত দুইখানা উহার প্রারম্ভে ঝাড়িতে হয়, ইহাতে তাহা করিবার আবশ্যকতা নাই। বলা বাহুল্য যে, এই পাস করিবার সময় হাতের তালুদ্বয় পাত্রের শরীরের দিকে থাকিবে, যেহেতু হাতের পিঠ দ্বারা পাস করিলে উহার কোন ফলই হয়না। উচ্চগামী বা বিপরীত উপশম পাস দ্বারাও মোহ নিদ্রায় অভিভূত ব্যক্তিকে প্রকৃতিস্থ করা যায়। তাহা করিতে পাত্রের হাঁটু, কোমর, বুক বা গলদেশ হইতে পাসটি আরম্ভ করতঃ তাহার মাথা পর্যন্ত আনিয়া শেষ করিতে হয় এবং পাসের শেষে হাত দুইখানাকে পূৰ্ব্ব কথিত নিয়মে একবার ঝাড়িয়া ফেলিতে হয়।

স্পর্শযুক্ত ও স্পর্শহীন পাসের গুণের বিভিন্নতা :–পাত্রকে সতেজ বা উৎসাহিত করিতে, কিম্বা তাহার শরীরের অংশ বিশেষকে কঠিন বা সঙ্কোচিত করিতে, অথবা তাহার কোন বেদনা বা যন্ত্রণা দূরীভূত করিতে স্পর্শযুক্ত পাস, আর তাহাকে মেস্‌মেরিক বা মোহ নিদ্রায় অভিভূত করিয়া প্রচুর আরাম দিতে কিম্বা তাহার সমস্ত শরীর বা উহার অংশ বিশেষকে সঞ্জীবনী শক্তি (vitalising force) দ্বারা আক্রান্ত করিতে অথবা স্পর্শযুক্ত পাস দ্বারা উৎপাদিত মোহিতাবস্থা অপসৃত করতঃ তাহার জীবনী-শক্তিকে পুনরায় স্বাভাবিকাবস্থায় আনয়ন করিতে স্পর্শহীন পাস ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

স্পর্শযুক্ত ও স্পর্শহীন উভয় পাস দ্বারাই পাত্রকে নিদ্রিত এবং প্রকৃতিস্থ করিতে পারা যায়। কিন্তু স্পর্শযুক্ত পাসের উৎপাদিত নিদ্রা অপেক্ষা স্পর্শহীন পাসের নিদ্রা বেশী গভীর ও আরামপ্রদ হয়। মোহ নিদ্রার যে সকল স্তরে পাত্রের আত্মিক শক্তি সমূহের বিকাশ হয়, সেই সকল স্তর কেবল স্পর্শহীন পাসের সাহায্যেই উৎপাদিত হইয়া থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *