Love means never having to say you are sorry
একটু ভালবেসে ফেলেছিলুম, ঈশ্বর, এই কি আমার অপরাধ! তা হলে তুমি কেন নারী সৃষ্টি করলে! মুকু হস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল কোথাও যাবে বলে। আমাকে দেখে অবাক।
মুকু বললে, একী, তুমি কোথা থেকে এলে? অফিস থেকে?
মনে হচ্ছে, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?
তা একটু হয়েছি। ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে। তুমি তো ব্রহ্মচারী। তোমার বাবা গৃহী সন্ন্যাসী। তুমি একটা মেয়ের কাছে আসো কী করে! মেয়েরা তোমার কাছে যাবে, তোমার তপোভঙ্গ করাবার জন্যে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল!
তুমি কোথায় যাবে বলে সেজেগুজে বেরোলে?
যদি বলি একটা ছেলের কাছে!
তা হলে আমার অভিমান হবে।
যদি বলি সেই ছেলেটি হলে তুমি?
তা হলে আমার অভিমান হবে না।
আমি যদি আর একটু আগেই বেরিয়ে যেতুম, তা হলে তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত না।
তা অবশ্য হত না। মন খারাপ করে ফিরে যেতে হত।
চলো তা হলে দু’জনে মিলে কোথাও যাই।
তখনই মুকুকে কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। কেমন যেন একটা উড়ুউড়ু ভাব। অন্যের দুঃখের কথা মনে ধরবেনা। সুখে সে রয়েছে, সুখে সে থাকুক। মোর কথা তারে বোলো না, বোলো না। দেখলেই মনে হয় সুখী মেয়ে, আদুরে মেয়ে। দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা নেই। মরশুমি ফুলের মতো বাহারি। বড়লোকের মেয়ে। বাবা বড় অ্যাডভোকেট। মুকুর সবটাই কেমন ভাসাভাসা। আজ খুব সেজেছে। পিঙ্করঙের শাড়ি। কাঁচুলি ধরনের ব্লাউজ। চুলে শ্যাম্পু করেছে। ফুরফুর করে উড়ছে। গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। মুকু যথার্থই সুন্দরী। অন্য কোনও দিন হলে আমি হয়তো চনমন করে উঠতুম। যা আমার স্বভাব। আজ ভেতরটা কুঁকড়ে আছে।
মুকু বললে, আমাকে কিছু খাওয়াবে? ভীষণ খিদে পেয়েছে।
চলো। কোথায় খাবে বলো?
বেশ ভাল একটা জায়গায়, যেখানে নির্জনে কিছুক্ষণ বসা যাবে।
তা হলে তো পার্ক স্ট্রিটে যেতে হয়।
অত দূরে না, কাছাকাছি কোথাও।
হঠাৎ মনে হল ওয়াই এম সি এ রেস্তোরাঁয় গেলে হয়। দু’জনে ট্রামে উঠলুম। খালি ট্রাম। বসার জায়গার অভাব নেই। উঠে বড় অস্বস্তিতে পড়ে গেলুম। একটি আসনে বেশ আয়েশ করে বসে আছেন আমার পিতার প্রাণের বন্ধু, সেই জ্যোতিষী অক্ষয় কাকাবাবু। সামনের দিকে বসেছেন। আমরা পেছনে। কী একটা ভাবে তন্ময়। ঘাড় ঘোরালেই আমাদের দেখে ফেলবেন। দেখে ফেলুন। এটা আমি চাই না। মুকু এক বিস্ফোরক সুন্দরী। পাঞ্জাবি মহিলার মতো উগ্র সাজ। মুকুর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললুম, চলো পরের স্টপেজে নেমে যাই।
কেন?
ট্রামটা ভাল নয়।
এর চেয়ে ভাল ট্রাম কলকাতায় পাবে কোথায়?
হঠাৎ অক্ষয় কাকাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। আমি যতদূর সম্ভব মুখটা নিচু করে রাখলুম। পাশ দিয়ে চলে গেলেন দরজার দিকে। আমার গা ছুঁয়ে গেল তার পাঞ্জাবির পকেট। পকেটে মনে হয় হাত দেখার লেনসটা রয়েছে। ঠকাস করে আমার কাঁধে লাগল। সাবধানের মার নেই। আমি মাথা তুলিনি।
মুকু বললে, কাকে দেখে অমন করছ? পাওনাদার?
মাথা না তুলেই বললুম, এখন চুপ। আমাকে আড়াল করে রাখো।
ট্রাম থামল। থেমে আবার চলল। তখন আমি সাহস করে মাথা তুললুম।
মুকু বললে, ব্যাপারটা কী? অমন চোরের মতো লুকোলে কেন?
অক্ষয় কাকাবাবু।
কে অক্ষয় কাকাবাবু?
আমার বাবার বন্ধু।
তাতে হলটা কী? আমার সঙ্গে দেখলে তোমার চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে ভাববেন? তুমি এইরকম ভয়ে ভয়ে মেয়েদের সঙ্গে মেশো নাকি? তোমার সাহস নেই? ডরপুক! আমার যেমন বেণি তেমনি রবে চুল ভিজাব না। ভুখ লাগাব, ভুখে মরব তবু আমি জানতে দেব না। রাঁধিব বাড়িব, ব্যঞ্জন বাটিব তবু আমি হাঁড়ি ছোঁব না। পলিসিটা তোমার ভালই। তোমার বাবাকে বলে দেবেন, এই ভয়? আর কত দিন বাবার কাছে গোপালটি সেজে থাকবে? এইবার একটু উড়তে শেখো না! জীবনটাকে একটু দেখো না!
মুকু রাগে মুখ ঘোরাল জানলার দিকে। একটু রোগা হয়ে আগের চেয়ে দেখতে যেন আরও সুন্দর হয়েছে। আমার বন্ধু আশিসের কথা মনে পড়ছে। আশিস বলত, দেখ পিন্টু, এমন একটা বিয়ে করব যেন নিয়ে রাস্তায় বেরোতে গর্বে বুক দশ হাত হয়ে যায়। তেমন একটা বউয়ের সন্ধান আজও পায়নি। আশিস যদি মুকুকে দেখতে পায় তো ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। ডিগ্রি ডিপ্লোমার পেখম তুলে নাচবে। ওর ধারণা মেয়েরা এইসবেরই প্রেমে পড়ে। নিজেদের বাড়ি, সেকথাও বলতে ভোলে না। যেন বাড়ি আছে বলেই সুন্দরী মেয়েরা জামার বোতামের গর্তে গোলাপফুল হয়ে সেঁটে যাবে। মুকুর পাশে গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছি বলে আমার অবশ্য তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
ওয়াই এম সি এর রেস্তোরাঁয় ঢুকেই পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এই তো কয়েক বছর আগেই ছাত্রজীবনে আমরা প্রায়ই এখানে আসতুম। সস্তার খাওয়া ছিল, টোস্ট ওমলেট, চা। যেসব ভাগ্যবানের মেয়ে বন্ধু ছিল, তারা সোজা গিয়ে ঢুকত কেবিনে। লম্বা পরদার আড়ালে গল্প করার সুবিধে হত। এইরকম একটা কেবিনে আমাদের গ্রেট পার্থ আরতিকে চুমু খেয়েছিল। জীবনের প্রথম নারী-ওষ্ঠ চুম্বনের অভিজ্ঞতা। ছাদের নল দিয়ে অনর্গল বর্ষার জল বেরোবার মতো, টানা এক মাস গলগল করে কবিতা বেরোতে লাগল। খাতাপত্তর সব ভরে গেল। কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। পার্থর নিরীহ মা একদিন আমাদের সামনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ওরে আমার ছেলেটার কী হল! কেন এমন করছে! খেতে বসে, ডালেতে দুধেতে ঝোলেতে অম্বলেতে মিশিয়ে ফেলছে। জামার বোতাম ঘরে ঘরে মেলাতে পারছে না। সবাই বলছে, ছেলে তোমার সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। কৃষ্ণ-বিরহে মহাপ্রভুর এই অবস্থা হয়েছিল। আমরা কুঁইকুই করে হেসে মরি আর কী! বলতে পারছি না, মাসিমা, কৃষ্ণবিরহ নয়, ওষ্ঠে ওষ্ঠ ঠেকিয়ে এই অবস্থা হয়েছে। সন্ন্যাসী নয়, ছেলে আপনার গৃহী হবে। পেখম তুলেছে।
আমরা ধারের দিকে একটা কেবিন পেয়ে গেলাম। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করতে ছাত্রজীবনে ভয় পেতুম। সেই ভয় এখনও যায়নি। কেউ যদি দেখে ফেলে, কেউ যদি বলে দেয় বাড়িতে। মনে হয় ছবির মানুষও জীবন্ত। হঠাৎ বলে উঠবে, অ্যায়, কী কচ্চিস! তোর বাবাকে বলে দেব।
মুকু কেবিনের পরদাটা টানছে। বললুম, থাক না, খোলাই থাক না।
কেন? খোলা থাকবে কেন? পরদাটা তা হলে আছে কীসের জন্যে?
মুকু আমার পাশে বসল। আমি বললুম, উলটো দিকে বোসো না!
কেন? তোমাকে পুলিশে ধরবে? আজ আমি তোমার ভয় ভাঙাব। তোমাকে আজ আমি মানুষ করব!
শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে আমার শরীর। এখনই পরদা সরিয়ে বয় ঢুকবে। সে যখন দেখবে আমরা এইভাবে বসে আছি, ছি ছি, কী ভাববে! এইভাবে বসে থাকাকেই তো ইংরেজিতে বলে, কম্প্রোমাইজিং পজিশন। মুকু যে-ব্লাউজ পরেছে, সর্বাধুনিক ডিজাইনের। দুঃসাহসী মেয়েরা পরতে শুরু করেছে কলকাতায়। পরলেই লোকে কেমন কেমন নজরে তাকায়। আমিও তাকাই। ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে যায়। বিশ্রী একটা ভাব হয়। মুকুর কোমরের অনেকটা অংশ বেরিয়ে আছে। ধবধবে সাদা। গোলাপি ব্লাউজের তলা খাপ হয়ে বসে আছে। অস্বাভাবিক রকমের ভরাট বুক। যৌবন নয়, যৌবনের জোয়ার। ভয় আর লোভ দুটোই একসঙ্গে খেলা করছে আমার মনে। কখনও মনে হচ্ছে, আমি কী ভাগ্যবান! পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, হায়, কী সর্বনাশ! মুকু টেবিলের ওপর দু’হাত রেখে সামনে ঝুঁকে মেনু পড়ছে। আমি দেখছি মসৃণ চওড়া পিঠ। নিখুঁত একটি ঘাড়। পিঠে ছড়িয়ে আছে রেশমের মতো চুল। মুকু ইচ্ছে করলেই ফিমে নামতে পারে। বম্বের এক নায়িকা, যার এখন খুব নামডাক, অবিকল তার মতো দেখতে।
মুকু বললে, এইবার কী হবে! তুমি পালাবে কোথায়! পড়েছ মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। এইবার আমার কবলে তুমি। আমার যা প্রাণ চায় আমি তাই করব।
মুকু কঁধ দিয়ে আমাকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। আর ঠিক সেই সময় দুলে উঠল পরদা। প্রবীণ এক মানুষের মুখ। মুখটা ভিতরে, দেহটা বাইরে। শুধু একটিমাত্র প্রশ্ন, বলুন?
কী বলব মুকু?
কাটলেট আর চা।
লোকটি মুকুর দিকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে। মেয়েরা ক্রমশই স্বাধীন হচ্ছে। প্রেম ছাড়া পেয়েছে বাজারে। রেস্তোরাঁর কেবিন এখন কুঞ্জবন। সারাদিনে জোড়ায় জোড়ায় আসে আর চলে যায়। ভদ্রলোক দেখছেন, এ জোড়াটা কেমন!
দেয়াল আর মুকুর মাঝখানের খোপ থেকে আমি বলে উঠলুম, কাটলেট আর চা।
মুখ অদৃশ্য হল। পরদাটা দুলতে লাগল।
মুকু আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললে, বলল, কেমন লাগছে তোমার? কী ভাল, তাই না!
আমি তখনই মুকুকে সব কথা বলতে শুরু করলুম। দু’হাতে মুখ রেখে মুকু শুনছে। তার সব চপলতা চলে গেছে। মুকু যখন সিরিয়াস, তখন তার চেহারা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়।
সব শুনে মুকু বললে, তিনি চলে গেলেন? এইভাবে চলে গেলেন?
বলতে বলতে মুকু কেঁদে ফেলল, অমন একজন মানুষ চলে গেলেন। আমি তা হলে কী নিয়ে বাঁচব! মুকু মুখ নিচু করে আছে, টপটপ করে জল পড়ছে চোখ থেকে। টেবিলের পাশে, কোলে। হঠাৎ উঠে পঁড়াল। হাত বাড়িয়ে বললে, তোমার রুমালটা দাও। রুমালটা নিয়ে চোখ মুছে বললে, চলো।
সেকী, আমরা যে অর্ডার দিলুম।
দাম মিটিয়ে দাও। আমরা খাব না। খাওয়ার আর মুড নেই। তুমি জানো না মেসোমশাই আমার কতটা অধিকার করে আছেন! অমন ফ্যান্টাস্টিক মানুষ হয় না। আর দ্বিতীয় নেই। তোমার বাবা তো, তাই তুমি চিনতে পারোনি। তুমি একটা ছাগল। দেবতার আসন তুমি টলিয়ে দিয়েছ।
ছাগল বলায় রেগে যাওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু মুকুর ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। ওর উগ্র সাজ চটুল ব্যবহারের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর একটা মন। আমার পিতাকে যে এত শ্রদ্ধা করে সে আমারও শ্রদ্ধেয়।
ভদ্রলোক কাটলেট হাতে সামনে দাঁড়িয়ে। থতমত হয়ে গেছেন। বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কী! খুব ভদ্রভাবে বললেন, তেমন তো দেরি করিনি! উঠে পড়লেন?
আমি বললুম, দেরির জন্যে নয়। অন্য ব্যাপার। আপনি একটা প্যাকেট করে দিন। আমি দামটা দিয়ে দিই।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলুম। হনহন করে কিছু দূর হাঁটার পর জিজ্ঞেস করলুম, তুমি এখন কোথায় যাবে মুকু?
তোমাদের বাড়িতে।
বেশি রাত হয়ে গেলে তোমাকে তো আবার হস্টেলে ঢুকতে দেবে না।
সে আমি বুঝব। তুমি একটু কম চিন্তা করো।
আমরা একটা বাসে উঠে পড়লুম। বেজায় ভিড়। মানুষের চটকাঁচটকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুকু একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল। বাস যেন আর নড়তেই চায় না। দু’কদম যায় তো থেমে পড়ে। তিরিশ মিনিটের পথ যেতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। গলদঘর্ম হয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালুম। অন্ধকারে পঁড়িয়ে আছে ভূতের বাড়ির মতো। সদর দরজায় বিশাল এক তালা। বাইরের রকের একপাশে দুটো কুকুর শুয়ে আছে।
মুকু বললে, প্যাকেটটা ফেলে দাও না! বিশ্রী গন্ধ বেরোচ্ছে।
পয়সার জিনিস ফেলে দেব?
হ্যাঁ দেবে। ও আর কে খাবে? বাসে অত লোকের নিশ্বাস আর ছোঁয়াছুঁয়ির মধ্যে ছিল। খেলেই। অসুখ করবে। ওই কুকুরদুটোকে দিয়ে দাও।
কুকুরদুটো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। কাটলেটের গন্ধে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল।
তালাটা খুলে গভীর অন্ধকারে আমরা দুজনেই হাতড়াতে লাগলুম। সুইচবোর্ড আন্দাজ করে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলুম। ভয় করছে, সাপ থাকা অসম্ভব নয়। নীচের তলাটা একেবারেই ব্যবহার হয় না। হামেশাই সাপের সঙ্গে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হয়। মুকুর একটা হাত আমার কাঁধে। আমাকে ধরে ধরে আসছে। তার শাড়ির নীচের অংশ আমার পায়ে মাঝে মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার শরীরে তার শরীরের ভার। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। মন একটু উতলা হচ্ছে। কেউ কোথাও নেই। থকথকে আলকাতরার মতো অন্ধকার। মানুষের মন যখন ভাল থাকে না, তখনই সে দুটো ম খোঁজে। মদ আর নারী। এতকাল শুনেছিলুম, আজ অনুভব করছি। মনে হচ্ছে, কী আর হবে, যা হয় হবে! যতরকম অন্ধকার আছে, তাতেই জীবনটাকে ডুবিয়ে দিই। আলোর পথিক তো হওয়া গেল না। আঁধারকেই চিনি ভাল করে। এখন তো আমারই দিন। এই অন্ধকার ইমারতের আমিই সম্রাট।
অবশেষে সুইচবোর্ডে হাত ঠেকল। আলো যেন লাফিয়ে পড়ল মল্লবীরের মতো। সেই আলোয় মুকুকে মনে হল বেসামাল কোনও রাজনৰ্তকী। দু’পা এগোলেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ির তলায় বাগান করার যন্ত্রপাতি। নানা মাপের শাবল, কোদাল, খুরপি, ঝুড়ি, বালতি, ঝাড়ু। মুকু সিঁড়ির হাতল ধরে ধরে ওপরে উঠছে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই অক্লান্ত মাকড়সা এমাথা থেকে ওমাথা জাল বুনে বসে আছে। ভেবেই নিয়েছে, আর তো কেউ আসবে না। বিস্মৃতির সূক্ষ্ম পরদায় বাড়িটাকে ঢেকে দিই। অতি মিহি এক শবাচ্ছাদন। সিঁড়ির ধাপগুলো ভাঙাভাঙা। কথা হচ্ছিল, বাড়িটাকে ঢেলে মেরামত করার। সব ভেস্তে গেল।
সিঁড়ির প্রথম বাক পর্যন্ত নীচের আলো ছিল। দ্বিতীয় বাঁক পড়ে আছে অন্ধকারে। তৃতীয় বাঁক একেবারেই অনিশ্চিত। দ্বিতীয় বাঁকের মুখে মুকু থমকে গেল। আমি বললুম, দাঁড়াও, আমাকে আগে যেতে দাও। অন্ধকারে তুমি কোনও কিছুর হদিশ পাবে না।
সিঁড়ির ধাপ আমার মুখস্থ। তরতর করে উঠছিলুম। মুকু বললে, আমার কথা একটু ভাবো।
তুমি দাঁড়াও, আমি আলোটা আগে জ্বালি।
সব ঘরের আলো জ্বেলে দিলুম। সারাদিন বন্ধ ছিল। ঝাড়া-মোছা হয়নি। ধুলোধুলো লাগছে। প্রচুর চড়াই পাখি এ বাড়িতে আশ্রিত। তাদের এখন বাসা বাঁধার সময়। খড়কুটো এনে জড়ো করেছে। ভেন্টিলেটারে! সেইসব পড়েছে মেঝেতে। একটা ব্যাপারে মনে একটু খটকা লাগল। বাবা যে-টেবিলে বসে লেখাপড়া করতেন, তার সামনে একটা জানলা আছে। বেশ মনে পড়ছে জানালাটা আমি ভাল করে বন্ধ করে গিয়েছিলুম! এখন দেখছি একটা পাল্লা খোলা। কে খুলল? আমি তো ছিটকিনি বন্ধ করে গিয়েছিলুম। বেশ একটা ভয়ভয় করছে। এই বাড়িটার বদনাম আছে। নানা জনে নানা কথা বলে। অশরীরী কেউ ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে যায়নি তো!
মুকু টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। বই খাতা সব সুন্দর করে সাজানো। একপাশে পড়ে আছে। পার্কার কলম। সুন্দর সুন্দর পেপারওয়েট। কিছুকাল হল বাবা মডেলিং নিয়ে মেতেছিলেন। মাটি দিয়ে তৈরি করছিলেন নানা মূর্তি। হেলাফেলার নয়। সুন্দর কাজ। টেবিলের ওপর সম্প্রতি তৈরি একটা মূর্তি রয়েছে। দু’হাত তুলে এক বাউল নাচছে। মুকু টেবিলল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। নীল সিল্কের কাপড়ের শেড। মায়াবী আলোয় একটা সুখের ভাব। মুকুর মুখে ছায়া পড়েছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। মাথার দু’পাশে এলো চুলের ঢল। কলমটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মুকুর চোখে আবার জল এসে গেল।
আমি কেন মুকুর মতো কাঁদতে পারছি না! আমার ভেতরটা ক্রমশই কেন শান্ত হয়ে আসছে! আমার অনুভূতি কি মরে যাচ্ছে! মুকু কলমটা সযত্নে সাবধানে রেখে শোয়ার ঘরের দিকে চলে গেল। আমি একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে খানিক পায়চারি করে নিলুম। তারপর মনে হল মুকুর খিদে পেয়েছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
বাবার বিছানায় মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে মুকু। আমি আস্তে আস্তে তার পিঠে হাত রেখে বললুম, কিছু একটা খাবে তো? তোমার খিদে পেয়েছে!
মুকু পাশ ফিরে বললে, আর আমার খিদে নেই।
মুকু এমন একটা ভঙ্গিতে শুয়ে আছে মনে হচ্ছে আমিও শুয়ে পড়ি তার পাশে, তারপর যা হয় হবে। যা ঘটে ঘটুক। ভবিষ্যৎ এখন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আজই আমার বিয়ের রাত হোক না, ক্ষতি কী! আমাকে বাধা দেবার তো কেউ নেই। মন, ভেবে দেখো, মাত্র এক বিঘত দূরে এক মোহময়ী নারী। সারা শরীরে যার যৌবন খেলা করছে জোয়ারের জলের মতো। নির্জন, নিস্তব্ধ বাড়ি। একবার যদি সেইভাবে স্পর্শ করি ক্ষতি কী! স্বর্গসুখ তো কয়েক মুহূর্ত দূরে! হাতদুটো শুধু এগিয়ে যাক। কিছুক্ষণের মতো তুমি তোমার পরিবেশ ও জগৎ ভুলে থাকতে পারবে। দুঃখ ও দুশ্চিন্তার ওপর প্রেমের প্রলেপ নেমে আসবে। আবেগের ঝড়ে খড়কুটোর মতো সব উড়ে যাবে।
প্রায় আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলুম, এমন সময় মুকু ঝট করে উঠে বসল। গোলাপি আঁচল খুলে পড়ল। ভয়ংকর সেই দৃশ্য থেকে জোর করে চোখ সরালুম। প্রলোভন কী সাংঘাতিক জিনিস! চরিত্রকে দুর্ভেদ্য করতে হলে মানুষকে কোন লগ্নে জন্ম নিতে হয়! আজ বুঝতে পারছি, আমি সেইরকম কোনও লগ্নে জন্মাইনি। আমি শের নই, চুহা। বেড়াল আমাকে আধমরা করে একপাশে ফেলে রেখে নিজের থাবা চাটছে। আমার মনে হয় মূষিকলগ্নে জন্ম। আমি সকালেই আশ্রমে চলে যেতে পারতুম, স্বামী নির্মলানন্দজির কাছে। সেখানে গেলে, আজ আমি যে বিড়ম্বনায় পড়েছি তার চিরসমাধান হয়ে যেত। আমাকে তিনি শক্ত মুঠোয় ধরতে পারতেন। আমি সেই পথে না গিয়ে, গেলুম বিষ্টুদার কাছে পরামর্শ নিতে। সেখান থেকে বিষ্টুদার বাড়িতে। মনে জড়িয়ে নিয়ে এলুম টিপকে। আমার মনের খবর কেউ জানে না। একমাত্র আমিই জানি। মুকু কি জানে, এই মুহূর্তে আমার অন্তরআত্মা কীসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে! আমি যেন এক চামচ ঘি, আগুনে পড়ার জন্যে ছটফট করছি। একটা দেয়ালি পোকা!
মুকু সচেতন হয়ে গুছিয়ে নিল নিজেকে। বুঝতে পেরেছে আমি টলছি, যে-কোনও মুহূর্তে আঁপিয়ে পড়তে পারি।
মুকু বললে, তোমার রাতের কী ব্যবস্থা।
ব্যবস্থা মানে?
রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা করেছ?
কিছুই না!
সকালে কী করেছিলে?
নির্জলা একটা মিথ্যে কথা বেরিয়ে এল, কিছুই না। চর্ব-চুষ্য খেয়েছি, একথা বলা গেল না। নিজের শোক তা হলে যে তরল হয়ে যায়।
সারাদিন উপোস করে আছ?
ওই টুকটাক যা হয় কিছু খেয়ে নিয়েছি।
রান্নাঘরে কী মজুত আছে?
সবই আছে।
তা হলে চলো, রান্না বসাই। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল খিচুড়ি।
ঘড়িটা দেখেছ? তোমাকে তো এখুনি ফিরতে হবে। তা না হলে তোমাকে আর ঢুকতে দেবে না।
মুকু চাবুকের মতো উত্তর দিল, আমি যদি আর না ফিরি? মেসোমশাই আমাকে এই বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন।
তখন তিনি ছিলেন, এখন যে আমি একলা! পাঁচজনে কী বলবে?
পাঁচজন? সেই পাঁচজন কারা?
পাড়াপ্রতিবেশী।
তারা তোমার চরিত্রে কলঙ্ক দেবে? তাই তো! ভণ্ড তপস্বী! সন্ন্যাসী হবে! ভগবানের সঙ্গে শেকহ্যান্ড করবে শয়তান! আমার পবিত্র শিউলি ফুল! তোমার সেই কাকিমার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ছিল! সাহস থাকে তো সত্য কথা বলবে? আমার দিদিকে তুমি কী চোখে দেখেছিলে? পবিত্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর চোখে? তুমি ভাবো তোমাকে আমি চিনি না! ভণ্ডামির একটা সীমা আছে। তোমার মস্ত সুবিধে করে দিয়েছিল ওই বাঁজা মেয়েছেলেটা। তোমার আদরের কাকিমা। তোমার ওই বকধর্মের চোটে তোমার বাবাকে সব ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তুমি তাকে তাড়িয়েছ! আমি সব বুঝি। তুমি আমার দিদির পেছনে ঘেঁকছোঁক করতে। সেও আমি জানি। চোখ উলটে ধ্যান, সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গ, সব তোমার ভণ্ডামি। তুমি এক বেড়াল-তপস্বী। তুমি দেখবে, দেখতে চাও, এই মুহূর্তে তোমাকে আমি ফেলে দিতে পারি? সাতঘাটের জল খাইয়ে দিতে পারি? সে ক্ষমতা আমার শরীরের আছে।
একসঙ্গে অনেকগুলি তির এসে আমার বুক যেন ঝাঁঝরা করে দিল। ধরা পড়ে গেছি। রাগ হচ্ছে। উত্তর দেওয়া দরকার। আমি যদি বলি, তোমার জন্যেই তিনি চলে গেলেন? বুঝতে পেরেছিলেন, কী ঘটতে পারে। তার সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বানচাল হতে বসেছে। তিনি তোমাকে পছন্দ করেননি।
আজ্ঞে না! তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। পছন্দ করতেন না তোমাকে। তোমার ঘিনঘিনে শতখণ্ড ব্যক্তিত্বকে। তোমার ওই মাকড়সার জাল আমি ছিঁড়বই। যা হতে পারবে না কোনওদিন সেই হওয়ার চেষ্টা থেকে তোমাকে আমি ফেরাব। তুমি আমার চ্যালেঞ্জ। আমি এইখানে থাকব। ওই পাঁচজনের নাকের ডগা দিয়ে তোমাকে নিয়ে আমি ঘুরব। এমনভাবে ঘুরব, লোকে যাতে মনে করতে না পারে, আমরা ভাইবোন। মনে করুক চরিত্রহীন দুটো ছেলেমেয়ে। বিয়ে না করেই। স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকছে।
আমাদের পরিবারের মুখে চুনকালি পড়বে!
কারা দেবে সেই চুনকালি? যাদের নিজেদের মুখেই কালি। সেই তারা, যারা মেসোমশাইকে নোংরা বই আর কুৎসিত চিঠি পাঠিয়েছিল? তোমার বাবা, তোমার দাদু কখনও ভয় পেতেন না। তারাই ছিলেন প্রকৃত সাহসী, মহাপুরুষ। কী তুমি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর কথা বলছ! তোমাকে আজ রাতেই গেরুয়া পরিয়ে দিলে, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে যাবে! তোমাকে যদি আমি জড়িয়ে ধরি? তোমার সামনে দাঁড়িয়ে যদি আমি একে একে সব খুলতে থাকি?
মুকুর হাবভাব দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। মাঝে মাঝে ভয় হয় মানসিকভাবে ও সুস্থ কি না! ভয় হয় হিচককের ছবির চরিত্র না হয়ে ওঠে। কিছুই হয়তো বোঝা গেল না, ঝপ করে বুকে ছুরি বসিয়ে দিল, কি গলা টিপে ধরল! মনের ব্যাপার নদীর মতোই, কখন কোন ধারায় বইবে! এমন একরোখা মেয়ে সহসা দেখা যায় না। মুকু আমাকে হতবাক করে রেখে পাশের ঘরে চলে গেল। আলমারি খোলার শব্দ পেলুম। মুকু সবই জানে কোথায় কী আছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললে, একটা শাড়িটাড়ি কিছু দেবে তো! না কি এই বিয়ের পোশাকেই রান্নাঘরে ঢুকব?
তুমি তো জানেনা কোথায় কী আছে।
জানি বলেই জিজ্ঞেস করছি। শাড়ি এ বাড়িতে পাব কোথায়? শাড়ি পরার মানুষ কোথায়?
হঠাৎ মনে পড়ল কার বিবাহে উপহার দেওয়া হবে বলে একটা শাড়ি কেনা হয়েছিল, কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। সেই শাড়িটা কি তা হলে মুকুর জন্যেই আছে! নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে রেখেছে। যেমন পুজো পাবেন বলে ঈশ্বর পৃথিবীতে ফুলের বাগান করে রেখেছেন।