২.০৩ ‘দরজা ভাঙলেই গুলি করব!’

‘দরজা ভাঙলেই গুলি করব!’
[আকুঞ্জি মামলা
বিমল সাহা, অবসরপ্রাপ্ত সহ নগরপাল। যথাক্রমে ১৯৯৮ এবং ২০০৮ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’ এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রদত্ত পদক।
আমিনুল হক, অবসরপ্রাপ্ত সহ নগরপাল, ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’।
রাম থাপা, বর্তমানে বড়তলা থানার ওসি, ২০০৪ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রদত্ত ‘সেবা পদক’।
তরুণকুমার দে, ইনস্পেকটর। গোয়েন্দাবিভাগ।
ইন্দ্রনীল চৌধুরী, বৰ্তমানে হেয়ার স্ট্রিট থানার ওসি। ২০০৪ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘সেবা পদক’, ২০১৮ সালে সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান পুলিশ মেডেল’-এ।
শাকিলুর রহমান, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চে সহ নগরপাল হিসাবে কর্মরত।
তপন সাহা, পোর্ট ডিভিশনে সহ নগরপাল পদে কর্মরত।]

তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত
তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত
তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত
তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত…

নয়ের দশকের সেই সুপারহিট গান। লাস্যময়ী রবিনা ট্যান্ডনের লিপে। বাজছে ফুল ভলিউমে। তালে তালে উদ্দাম নাচছেন এক স্বল্পবাস সুন্দরী। যাঁর শরীরী বিভঙ্গের চুম্বক আচ্ছন্ন রেখেছে দর্শকদের। যিনি নাচতে নাচতেই উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন মোহিনী ভঙ্গিতে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে নিশিবাসর। ঠোক্কর লাগছে গ্লাসে-গ্লাসে। চিয়ার্স! উল্লাস!

ম্যানেজার ব্যস্তসমস্ত তদারকিতে। মধ্য কলকাতার এই বার-কাম-রেস্তোরাঁয় প্রায় দশ বছর হয়ে গেল তাঁর। মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদেরই ভিড় মূলত এখানে। ‘পুশ-পুল’ লেখা সুইংডোর নেই। এসি নেই। ফটফট করে ইংরেজি-বলা ওয়েটার নেই। যা যা থাকে অভিজাত এলাকার নিশিনিলয়ে, তার কিছুই নেই। তবু শনিবার সন্ধে হলেই স্বল্প পরিসরের এই বার কালো মাথায় টইটম্বুর। রাত ন’টার পর এখানে টেবিল খালি পাওয়া আর রাজ্য লটারিতে ফার্স্ট প্রাইজ়ের মধ্যে তফাত নেই বিশেষ।

—এক মিনিট শুনবেন?

ম্যানেজার ফিরে তাকান প্রশ্নকর্তার দিকে। মধ্যতিরিশের এক সপ্রতিভ যুবক। চোখে রিমলেস চশমা।

—হ্যাঁ বলুন, জায়গা তো এখন দেখছেনই খালি নেই। বাইরে অপেক্ষা করতে হবে।

যুবক হাসেন। গানবাজনা চলছে যা তারস্বরে, হ্যান্ডশেকের দূরত্বেও একে অন্যের কথা শুনতে পাওয়া দুষ্কর। যুবক কানের কাছে মুখ নামিয়ে আনেন ম্যানেজার ভদ্রলোকের, কিছু একটা বলতে। শোনামাত্র মুখের ভাব বদলে যায় ম্যানেজারের। দ্রুতপায়ে পৌঁছে যান বারের এক প্রান্তের কাঠের পাটাতনের কাছে। যেখানে কোমর দোলাচ্ছেন সুন্দরী যুবতী, গানের সঙ্গে সঙ্গত করতে বসে আছেন বাদ্যযন্ত্রীরা।

গানটা শেষ হওয়ার যা অপেক্ষা। যুবতীর কানে ফিসফিস করেন ম্যানেজার। ত্রস্ত পায়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসেন যুবতী। স্বল্পবেশেই বেরিয়ে আসেন বাইরে। চশমা-পরা যে যুবক একটু আগে ম্যানেজারকে কানে কানে কিছু বলার পরই এইসব, তিনিও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন বাইরে। এবং তাঁর পাশে উদয় হয়েছেন শক্তসমর্থ চেহারার আরও চারজন। যাঁদের মধ্যে দু’জন মহিলা।

সোজাসুজি নির্দেশ জারি করেন রিমলেস চশমার যুবক, নর্তকী যুবতীর চোখে চোখ রেখে।

—আপনাকে একবার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

যুবতী হতভম্ব। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সময় লাগে একটু।

—মানে? যেতে হবে মানে? কোথায় যেতে হবে? আপনারা কারা? কোথা থেকে আসছেন?

—লালবাজার।

.

.৩৮ রিভলভার। লোডেড। বুশ শার্টের নীচে কোমরে গোঁজা রয়েছে ওঁদের।

‘ওঁদের’ মানে ওঁদের আটজনের। উর্দি পরে আসেননি কেউই। সবাই প্লেন ড্রেসে আজ।

ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার আগে চোখাচোখি হয় ওঁদের। শুধু চোখাচোখিই। কথা হয় না কোনও। যা কথা হওয়ার, হয়ে গেছে আগে। কী কথা?

ঘরের ভিতর যারা আছে, তারা অত্যন্ত মারাত্মক প্রকৃতির। বেপরোয়া। সামান্যতম বিপদের গন্ধ পেলেই ধুমধাড়াক্কা গুলি চালাবে। বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। তেমন বুঝলে সঙ্গে সঙ্গে পালটা গুলি চালাতে হবে। ঘরে ঢোকার এবং বেরনোর এই একটাই রাস্তা। অনেক ভুগিয়েছে এরা। হাড়মাস কালি করে দিয়েছে। যা-ই হয়ে যাক, পালাতে দেওয়া যাবে না। হয় এসপার, নয় ওসপার।

মাঝরাত পেরিয়ে ঘড়িতে প্রায় তিনটে। এমন একটা সময়, যখন স্ট্রিট লাইটগুলো পর্যন্ত সামান্য স্তিমিত। ঢুলছে। এমন একটা সময়, যখন রাস্তার কুকুরগুলোও সাময়িক স্থগিত রেখেছে অপরিচিত আগন্তুক দেখলেই ‘ঘেউ ঘেউ’। জিরিয়ে নিচ্ছে দু’দণ্ড। পাড়া জাগিয়ে চিলচিৎকার করার সময় পরে অনেক পাওয়া যাবে।

ভেবেচিন্তেই বাছা হয়েছে সময়টা। নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতে কোনও দুর্ধর্ষ অপরাধীর আস্তানায় রেইড করতে গেলে ওটাই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওটাই ব্রাহ্মমুহূর্ত। যাকে ধরতে যাওয়া, তার ঘুমিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। আর একটা সুবিধে, আশেপাশের বাড়ি-ঘরদোরেও ঘুমিয়ে থাকেন বাসিন্দারা। রাস্তা থাকে শুনশান। পুলিশের গতিবিধির আগাম খবর অপরাধী পেয়ে যাবে স্থানীয় সূত্রে এবং চম্পট দেবে, সে আশঙ্কাও থাকে না বড় একটা।

কড়া নাড়া হল দরজায়। নেড়ে দরজার দু’পাশে ভাগ হয়ে গেলেন ওঁরা। সিনেমায় যেমন হয়। একদিকে চার, অন্যদিকে বাকি চার। উত্তর নেই ভিতর থেকে। ফের ঠক্ ঠক্ দরজায়। এবার জবাব এল।

—কে?

—পুলিশ। লালবাজার থেকে আসছি। দরজাটা খুলুন। দরকার আছে।

সেকেন্ড দশেকের নীরবতার পর ভিতর থেকে ফের ছিটকে এল উত্তর। গলার স্বরে মরিয়া ভাবটা স্পষ্ট।

—পুলিশ হোক আর যে-ই হোক, ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই গুলি করব।

গুলি করার হুমকি যে ফাঁকা আওয়াজ নয়, জানতেনই ঘরের বাইরে থাকা অফিসাররা। যাঁদের কোমরে গোঁজা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে উঠে এল নিমেষে। ট্রিগার স্পর্শ পেল আঙুলের।

দরজা যে ভাঙতে হতে পারে, সেটাও জানার মধ্যেই ছিল। এবং ছিল প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও। শাবল-গাঁইতি আনা হয়েছিল ব্যাগে করে।

প্রয়োজন হল না অবশ্য। তেমন পোক্ত দরজা নয়। সজোরে গোটা দশেক লাথিতেই কলকবজা দেহ রাখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে ছুটে এল গুলি। কাঁধ চেপে বসে পড়লেন এক অফিসার। পালটা গুলি চালানো ছাড়া উপায় কী আর?

সত্যিই এসপার-ওসপার!

.

—অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি জাস্ট একটা প্রশ্ন করে মিটিং শেষ করব!

নগরপালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান লালবাজারের কনফারেন্স রুমে উপস্থিত অফিসাররা। কী প্রশ্ন? থেমে থেমে ঠান্ডা গলায় বলতে থাকেন সিপি।

—হোয়াট নেক্সট? আমরা কি ছ’নম্বর ডাকাতিটার জন্য অপেক্ষা করব? আর ছয়ের পর সাত নম্বরের জন্য?

লালবাজারের কনফারেন্স রুমে নিশ্ছিদ্র নীরবতা নেমে আসে। পিন পড়লেও মনে হবে, চকলেট বোম ফাটল বুঝি। গোয়েন্দা বিভাগের Anti-dacoity বিভাগের সমস্ত অফিসার উপস্থিত। আছেন ডিসি ডিডি। সবার ঠোঁটে যেন সাইলেন্সার লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।

কী-ই বা বলবেন ওঁরা সিপি-র প্রশ্নের উত্তরে? বলার মুখ থাকলে তো বলবেন! তিন মাসের মধ্যে পাঁচ-পাঁচটা ডাকাতি শহরের বুকে! এবং ডাকাতদের ধরা তো দূরস্থান, চিহ্নিতই করা যায়নি এখনও। অথচ জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে যখন প্রথম ডাকাতিটা হয়েছিল, গোয়েন্দারা দূরতম কল্পনাতেও ভাবেননি, পরের কয়েক মাসে তাঁরা পেশাগত জীবনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন।

.

১৯ জুলাই, ১৯৯৭। শনিবার। ট্যাংরা অঞ্চলের ৫২ডি, রাধানাথ চৌধুরী রোডের ফেডারাল ব্যাংকে কোলাপসিবল গেট বন্ধ করার প্রস্তুতি চলছে। বেলা বারোটা প্রায় বাজতে চলল। শনিবার গ্রাহকদের জন্য ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায় বারোটায়। জনাচারেক গ্রাহক এখনও কাউন্টারে আছেন। ওঁরা কাজ সেরে বেরিয়ে গেলেই ঝাঁপ ফেলে দেওয়া হবে রুটিনমাফিক।

কোথায় কাউন্টার বন্ধ করা, আর কোথায় ঝাঁপ ফেলা! বারোটা বাজার আগেই ব্যাংকের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ছ’জন যুবক। যাদের চারজনের হাতে রিভলভার। বাকিদের হাতে ছুরি। যে চারজন গ্রাহক ক্যাশ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের দিকে রিভলভার তাক করে আদেশ দিল এক যুবক।

—একটাও শব্দ করবেন না। করলে জানে মেরে দেব। চুপচাপ ওখানে গিয়ে বসে থাকুন। যান ওখানে!

‘ওখানে’ মানে দেওয়ালের এক কোণে। কাঁপতে কাঁপতে সেখানে গিয়ে বসে পড়লেন চারজন। পাহারায় সামনে দাঁড়িয়ে রইল রিভলভারধারী।

ততক্ষণে ব্যাংকের ল্যান্ডলাইনের তার কেটে দিয়েছে যুবকের দল। দুই ক্যাশিয়ারকে টেনে বার করে এনেছে কাউন্টারের ভিতর থেকে। এবং টাকার গোছা গোছা বান্ডিল তিন যুবক ভরতে শুরু করেছে সঙ্গে আনা থলেতে।

ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রামচন্দ্রন নায়ার আর দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার গণপতি পেরুমল এবং সি জে অগাস্টিন হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন কেবিন থেকে। বাইরে কিছু একটা গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে। দুই যুবক নিমেষে রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে দিল রামচন্দ্রন আর পেরুমলের। অগাস্টিন থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নিজেই মাটিতে বসে পড়লেন।

ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের মাথায় রিভলভার ধরে এরপর স্ট্রংরুমে নিয়ে যাওয়া, ভল্ট খোলানো এবং ডাকাতদলের থলি দ্রুত ভরতি হয়ে যাওয়া টাকার বান্ডিলে। রামচন্দ্রন কিছু একটা বলতে গেলেন। ‘বারণ করলাম না শব্দ করতে?’ বলে রিভলভারের বাঁট দিয়ে সজোরে ভদ্রলোকের কপালে আঘাত করল এক যুবক। রক্তপাত অঝোরে। ব্যাংকের সমস্ত কর্মচারী নিথর বসে রইলেন নিজের নিজের চেয়ারে। চোখেমুখে প্রবল আতঙ্কের আঁকিবুকি নিয়ে।

আধঘণ্টার মধ্যে অপারেশন কমপ্লিট। আট লক্ষ আটচল্লিশ হাজার টাকা লুঠ করে তিনটে মোটর সাইকেলে সওয়ার হয়ে উধাও ডাকাতরা। এন্টালি থানার অফিসাররা যখন খবর পেয়ে এলেন, যখন এসে পৌঁছলেন গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা, তখনও আতঙ্কের ঘোর কাটেনি এলাকায়। তখনও ঘটনার বিবরণ দিতে গলা কাঁপছে ব্যাংকের কর্মচারীদের।

পোশাক কেমন ছিল?— হাফ শার্ট আর ট্রাউজার। চেহারা?— মাঝারি হাইট এবং দোহারা গড়ন সবারই। একজন ছাড়া। যে তুলনায় বেঁটে, মোটাসোটা। রামচন্দ্রনের ভাষায়, ‘hefty and bulky’।

কী ভাষায় কথা বলছিল?— পরিষ্কার জড়তাহীন বাংলায়।

কেউ কাউকে নাম ধরে ডেকেছিল, যতক্ষণ ব্যাংকের মধ্যে ছিল? —না।

কারও চেহারায় কোনও বিশেষত্ব চোখে পড়েছিল? টাকমাথা বা গালে আঁচিল? কপালে কাটা দাগ বা টেনে টেনে হাঁটা? কোনও কিছু এমন, যা দিয়ে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করা যায়? — না, তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না!

বয়স? —এই পঁচিশ-তিরিশের মধ্যে হবে আন্দাজ। শুধু ওই বেঁটে মোটা লোকটাকে দেখে বয়স সামান্য বেশি বলে মনে হয়েছে।

আবার দেখলে ওদের চিনতে পারবেন? —হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটা ডেফিনিটলি পারব।

.

ভারতীয় দণ্ডবিধিতে অপরাধের স্তরবিভেদ আছে। Offences against body, অর্থাৎ শারীরিক আঘাতজনিত অপরাধ। খুচরো মারামারি থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত। Offences against property, সম্পত্তির ক্ষতি সংক্রান্ত অপরাধ। পকেটমারি, ছিঁচকে চুরি থেকে ডাকাতি পর্যন্ত।

সম্পত্তিজনিত অপরাধের তালিকায় শীর্ষবাছাই, লেখা বাহুল্য, ডাকাতিই। Offences against property-র মধ্যে সাধারণভাবে কোন অপরাধকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত? বিশ্বের সমস্ত পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের এই প্রশ্নের জবাবে তিন অক্ষরের একটা শব্দই বরাদ্দ থাকে। ডাকাতি।

কেন, সহজবোধ্যই। একটা খুন হওয়ার নানারকম কারণ থাকতে পারে। সে টাকার লোভ বলুন, ব্যক্তিগত দ্বেষ বলুন, প্রেমঘটিত আক্রোশ বলুন বা যৌন-ঈর্ষা। কারণ সে যা-ই হোক, একটা বিচ্ছিন্ন খুন সামগ্রিকভাবে আমার-আপনার মধ্যে নিরাপত্তাবোধের তীব্র অভাব জাগিয়ে তোলে না। কিন্তু ডাকাতি? পাড়ায় যদি একটা দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়ে যায়, মারধর করে লুঠপাট চালিয়ে যায় ডাকাতরা? প্রতিবেশীদের মনে অবধারিত তৈরি হয় ভয় আর আতঙ্কের যুগলবন্দি। কাল ওই বাড়িটায় হয়েছে, পরশু যে আমার বাড়িতে হবে না, কী গ্যারান্টি?

এই কারণেই ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ‘ডাকাতি’-র চারটি পর্যায় চিহ্নিত করে শাস্তির বিধান রয়েছে। ডাকাতির জন্য জড়ো হওয়া। ডাকাতির জন্য অস্ত্রশস্ত্র সমেত প্রস্তুতি নিয়ে একত্রিত হওয়া। ডাকাতির চেষ্টা। এবং ডাকাতি সংঘটিত করা।

ডাকাতির মধ্যে আবার চরিত্রভেদ রয়েছে। বাড়িতে হতে পারে। দোকানে হতে পারে। পথচলতি গাড়ি থামিয়ে হতে পারে। কিনারা করা কতটা দুরূহ, সেটা যদি মানদণ্ড হয়, তবে পুলিশের কাছে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং হল ব্যাংক-ডাকাতি।

কেন তুলনায় বেশি চ্যালেঞ্জিং? গোপন কিছু নয়। দুর্বোধ্যও নয়। প্রথমত, সব ডাকাত ব্যাংক-ডাকাত নয়, কেউ কেউ ব্যাংক-ডাকাত। ব্যাংক-ডাকাতি একটা ‘specialized crime’, বাড়ি-গাড়ি-দোকানে ডাকাতির থেকে আলাদা। অন্য কোথাও ডাকাতির তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকি আর সাহস লাগে ব্যাংকলুঠে। যা করতে হয়, দিনের বেলায় করতে হয় ডাকাতদের। রাতবিরেতে আচমকা হানা দিয়ে কাজ হাসিল করার গল্প নেই কোনও। এবং যেহেতু দিনের বেলায়, যেহেতু গ্রাহক এবং কর্মীদের উপস্থিতিতে দুষ্কর্ম, ধরা পড়ে যাওয়ার চান্স ঢের বেশি। চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার চান্স বেশি। ডাকাতির সময় প্রতিরোধের মুখে পড়লে কী করব, লুঠের পর কীভাবে কোন রাস্তা দিয়ে কোথায় পালাব যত দ্রুত সম্ভব, কোথায় কীভাবে গা ঢাকা দেব, লুঠের টাকা কার কাছে কতটা থাকবে, সব নিখুঁত ভেবে রাখতে হয় আগে থেকে। সামান্য ভুলচুক হলেই ভরাডুবি অনিবার্য এবং শ্রীঘরযাত্রা।

দ্বিতীয়ত, কোনও বাড়ি বা দোকানে অতর্কিত হামলা করে ‘আলমারির চাবি কোথায়?’ বলা আর ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা-গয়নাগাটি কেড়ে নেওয়ার তুলনায় ব্যাংকলুঠ অনেক বেশি কঠিন। প্রথমটা পাস কোর্স হলে দ্বিতীয়টা অনার্স। আগে থেকে ব্যাংকের অবস্থানগত খুঁটিনাটি জেনে রাখতে হয়। সরেজমিনে দেখে যেতে হয় একাধিকবার। যাকে বলে recce করা।

ঢোকা-বেরনোর গেট কতটা প্রশস্ত, ক’টা ক্যাশ কাউন্টার, কতজন কর্মী, কে কোথায় বসেন, ম্যানেজারের ঘর কোনটা, স্ট্রং রুম কোথায়, সব মাথায় রেখে তবে প্ল্যান করে ব্যাংক-ডাকাতরা। এবং সবচেয়ে জরুরি, ব্যাংকে চড়াও হওয়ার সময়টা। পুরনো রেকর্ড খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, হয় ব্যাংক খোলার সময়, বা বন্ধ হওয়ার সময়, বা ভরদুপুরে সিংহভাগ ব্যাংক-ডাকাতি ঘটে থাকে। এমন একটা সময়ে, যখন গ্রাহকের ভিড় জমাট বাঁধেনি ব্যাংকে। দিনের শুরু বা শেষে যখন কর্মীরাও একটু অগোছালো, একটু ঢিলেঢালা। পেশাদারি প্ল্যানিংয়ে অপরাধটা হয় বলেই ব্যাংক-ডাকাতির কিনারা দুরূহতর হয়ে দাঁড়ায় তুলনামূলক ভাবে।

ফেডারাল ব্যাংকের ডাকাতিটার পর প্রথাসিদ্ধ পথেই এগিয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগ। এক, ব্যাংকের কর্মী এবং গ্রাহক যাঁরা ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের বিবরণ অনুযায়ী ব্যাংক-ডাকাতদের ছবি আঁকানো, ‘Portrait Parle’। এবং আঁকানোর পর সেই ছবি মিলিয়ে দেখা অতীতে ধরা পড়া ব্যাংক-ডাকাতদের সঙ্গে। ছবি ছড়িয়ে দেওয়া সোর্সদের মধ্যে। সোর্সদের ভূমিকায় পরে আসছি বিস্তারিত। এক লাইনে সেরে দেওয়া যাবে না এই কাহিনিতে।

দুই, শহরে তো বটেই, গত দশ বছরে রাজ্যের সমস্ত ব্যাংক-ডাকাতির রেকর্ড দেখা খুঁটিয়ে। যারা ধরা পড়েছিল পুরনো মামলায়, তাদের ছবির সঙ্গে কোনও মিল আছে ডাকাতদের? পুরনো গ্যাংগুলোর ‘মোডাস অপারেন্ডি’-র সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য? পুরনো কেসে ধৃত ডাকাতদের কারা কারা এখন জামিনে জেলের বাইরে? কী তাদের গতিবিধি? দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকিতে রূপান্তরের ঘটনা বাস্তবে তো আর খুব বেশি ঘটে না!

চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না anti-dacoity বিভাগের অফিসারদের। কিন্তু বহু চেষ্টাতেও সূত্র ছিল অমিল। প্রায় দু’মাস কেটে গিয়েছিল ট্যাংরার ডাকাতির পর। সমাধান ছিল অধরাই। এবং যত দেরি হচ্ছিল, প্রমাদ গুনছিলেন অফিসাররা। পুলিশে বলা হয়, ‘The best way to prevent the recurrence of a crime is to detect it.’ অপরাধের পুনরাবৃত্তিকে প্রতিহত করার সেরা রাস্তা একটাই। অপরাধের কিনারা করে ফেলা যথাসাধ্য দ্রুত। এক্ষেত্রে ‘ডিটেকশন’ এখনও দূর অস্ত। শহরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কয়েকশো ব্যাংক। সর্বত্র সবসময় নজরদারি সম্ভব, সম্ভব এভাবে ‘প্রিভেনশন’? যা মনে হচ্ছে, নতুন কোনও গ্যাং। বেপরোয়া এবং মরিয়া। একটা ক্রাইম করে সাধারণত থেমে যায় না এরা।

থামলও না। ১৯ জুলাইয়ের পর ৬ সেপ্টেম্বর। ট্যাংরার পর আলিপুর। ফেডারাল ব্যাংকের পর স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। মোমিনপুর ব্রাঞ্চ। সকাল ১১-২৫ থেকে ১১-৪৫, কুড়ি মিনিটের অপারেশন একই কায়দায়। রিভলভারের বাঁটের আঘাত ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেন্টের মাথায়। চার লক্ষ আট হাজার চারশো তেরো টাকা লুঠ করে ছ’জনের ডাকাতদল উধাও! একটা মারুতি এবং দুটো মোটরসাইকেলে করে।

আলিপুরের ডাকাতির সপ্তাহ তিনেক পরেই, ২৮ সেপ্টেম্বর, লেক থানা এলাকার স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার শাখায় হানা দিল ডাকাতরা। একটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে। সেই পাঁচ-ছয় জনের দল, সেই একই পদ্ধতি। আচরণ অবশ্য হিংস্রতর। ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী বাধা দিতে গেছিলেন, সটান গুলি চালিয়ে দিল এক ডাকাত। ভোজালির আঘাতে রক্ত ঝরল আরও তিনজন ব্যাংককর্মীর। গুলিবিদ্ধ নিরাপত্তারক্ষীকে এবং আহত হওয়া বাকিদের যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শরৎ বোস রোডের রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানে, তখন বাজে প্রায় দেড়টা। যার পনেরো মিনিট আগে, সোয়া একটা নাগাদ তিন লক্ষ আটষট্টি হাজার টাকা লুঠ করে চম্পট দিয়েছে ডাকাত দল।

ডাকাতি নম্বর চার, অক্টোবরের ২০ তারিখ। এবার ব্যাংকে নয়। অরবিন্দ সরণির একটা দোকানে। নাম, ‘ইন্ডিয়া ট্রেডিং কোম্পানি’। দুপুর একটার পরে তিনটে মোটরসাইকেল এসে ব্রেক কষল দোকানের সামনে। দোকানের কর্মচারীদের রিভলভার দেখিয়ে ক্যাশবাক্স ভেঙে পাঁচ লক্ষ টাকা লুঠ। এবার রিভলভার-ভোজালির পাশাপাশি নতুন সংযোজন, বোমা। পালানোর আগে দুটো বোমা রাস্তায় ছুড়ল ডাকাতরা। স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হলেন দু’জন পথচারী। ডাকাতদের চেহারার বিবরণ? আশঙ্কা সত্যি হল, মিলে গেল আগের তিনটে ঘটনার সঙ্গে।

পঞ্চম ঘটনা নভেম্বরের সাত তারিখে। এবার টার্গেট সিইএসসি-র গাড়ি। যাচ্ছিল শ্যামবাজারের অফিস থেকে ধর্মতলার সদর দফতর ভিক্টোরিয়া হাউসে। গাড়িতে প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ টাকা ছিল। ছিলেন সিইএসসি-র তিনজন কর্মী এবং এক বন্দুকধারী রক্ষী। দুপুর একটা নাগাদ মহাত্মা গাঁধী রোড আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ক্রসিংয়ের কাছে ক্যাশভ্যানের পথ আটকে দাঁড়াল তিনটে মোটরসাইকেল। ড্রাইভারের মাথায় এরপর রিভলভার ঠেকানো, রক্ষীর বন্দুক কেড়ে নেওয়া, এক কর্মীর মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে মেরে রক্তপাত ঘটানো এবং পঁচিশ লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার চারশো বারো টাকা নিয়ে তিরবেগে উধাও হয়ে যাওয়া পাঁচ-ছ’জনের দলের। যাদের চেহারার বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে শুনে পুলিশের সন্দেহের ন্যূনতম অবকাশও থাকল না, এরা ওরাই। একই গ্যাং। পাঁচজন মাঝারি হাইটের, দোহারা চেহারার। একজন বেঁটে, মোটাসোটা।

১৯ জুলাই, ৬ সেপ্টেম্বর, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০ অক্টোবর, ৭ নভেম্বর। চার মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাঁচটা দুঃসাহসিক ডাকাতি। লুঠ প্রায় পঞ্চাশ লাখের কাছাকাছি। যথেচ্ছ গুলি-বোমার ব্যবহার। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নড়ে গিয়েছিল লালবাজার। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। আশঙ্কা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ত্রিভুজে দমবন্ধ অবস্থা হয়েছিল গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারদের। কারা এরা? এরপর কবে? কোথায়? কখন?

দীর্ঘ বৈঠকের পর লালবাজারের কনফারেন্স রুমে কটাক্ষের সুরে এই প্রশ্নটাই ছুড়ে দিয়েছিলেন সিপি।

—হোয়াট নেক্সট? আমরা কি ছ’নম্বর ডাকাতির জন্য অপেক্ষা করব? আর ছয়ের পর সাত নম্বরের জন্য?

সরকারের উপরমহলে ডাকাতির ঘটনাগুলোর দ্রুত সমাধানে কলকাতা পুলিশের ব্যর্থতার জবাবদিহি করতে করতে সাময়িক ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল সিপি-র। যদিও নগরপাল জানতেন বিলক্ষণ, কী প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দারা। যাঁদের কাছে দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ডাকাতির ঘটনাগুলোর চুলচেরা পোস্টমর্টেমে।

এক, কলকাতার বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ‘গ্যাং’ এরা। রাজ্যের বাইরের নয়। বিহারের ডাকাত-অধ্যুষিত গয়া-পাটনা-বেগুসরাই-জামুইয়ের নয়। স্পষ্ট বাংলায় কথা বলেছে প্রত্যেকটা ঘটনায়। খোঁজখবরের কেন্দ্রস্থল তাই হওয়া উচিত শহর আর আশেপাশের জেলায়।

‘আশেপাশে’ শব্দটা শুনলে এমনিতে মনে হয় কাছেপিঠেই। খুব দূরে নয়, এমন কোনও জায়গা যেন। এক্ষেত্রে কিন্তু নামেই শুধু ‘আশেপাশে’। আসলে হাজার হাজার বর্গকিলোমিটারের বিস্তীর্ণ এলাকা। উত্তর ২৪ পরগনায় ব্যারাকপুর মহকুমার টিটাগড়, জগদ্দল, নোয়াপাড়া, নৈহাটি, বীজপুর। বারাসত সংলগ্ন এলাকার মধ্যমগ্রাম, আমডাঙা, দেগঙ্গা। সঙ্গে যোগ করুন বসিরহাট এবং বনগাঁ মহকুমার ব্যাপ্ত ভূখণ্ড। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বারুইপুর-জয়নগর-কুলতলি-গোসাবা-বাসন্তী-ক্যানিং-ধামাখালি এবং সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চল। হাওড়া-হুগলি তো আছেই। একদিকে সাঁতরাগাছি-ডোমজুড়-আন্দুল ইত্যাদি। অন্যদিকে চুঁচুড়া-পোলবা-ধনেখালি-মগরা-পাণ্ডুয়া-সিঙ্গুর-চণ্ডীতলা-জাঙ্গিপাড়া প্রভৃতি।

দুই, পাঁচটা ঘটনার একটাতেও মুখ ঢাকা ছিল না ডাকাতদের। অনেকেই দেখেছে চেহারাগুলো। মনে রেখেছে। অন্তত পঞ্চাশ-ষাট জনের সঙ্গে কথা বলে ছবি আঁকানো হয়েছে ছ’জনের। অথচ চিহ্নিত করা যায়নি। না পাওয়া গেছে পুরনো রেকর্ডে, না চিনতে পেরেছে সোর্সরা। নতুন গ্যাং, অথচ প্রতিটা ঘটনায় ‘এ টু জেড’ তুখোড় প্ল্যানিং। সিইএসসি-র টাকা কখন কোন রাস্তা দিয়ে শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলা যাবে, খবর ছিল নিখুঁত। অরবিন্দ সরণির দোকানের ক্যাশবাক্স ভাঙলে যে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে, অজানা ছিল না ওদের।

ডাকাতদের ছবি আঁকানোর অবশ্য প্রয়োজনই হত না আজকের দিন হলে। সব ব্যাংকে সিসি টিভি আছে আজকাল। এক মিনিটে ফুটেজ চলে আসে হাতে। ঘটনা ১৯৯৭-এর। তখন না ছিল সিসি টিভি, না ছিল হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ‘ইলেকট্রনিক ইনটেলিজেন্স’-এর সুবিধে থেকে বঞ্চিত ছিলেন সে-সময়ের তদন্তকারীরা। ভরসা ছিল শুধু ‘হিউম্যান ইনটেলিজেন্স’। সাদা বাংলায়, সোর্স।

সোর্স। যারা পুলিশকে খবর দেয়। কারা দেয়? অপরাধের খবর, অপরাধীর খবর কি ভারত সেবাশ্রম বা রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা দেবেন? অপরাধ-জগতের সঙ্গে যারা যুক্ত, অতীতে বা বর্তমানে, তারাই দেবে। তারাই দেবে খবর, অপরাধের সূত্রেই যাদের সঙ্গে কখনও কখনও যোগাযোগ হয়েছে পুলিশ অফিসারদের। যোগাযোগ থেকে ক্রমশ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে খবর আদানপ্রদানের।

সোর্স তৈরি করা এবং তাকে লালন করা এক শিল্পবিশেষ। যা আয়ত্ত না করতে পারলে সফল গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন দিনের শেষে স্রেফ সোনার পাথরবাটিই। একজন বিশ্বস্ত সোর্স তৈরি করতে কখনও কখনও লেগে যায় এক বছর বা তারও বেশি। এবং এমনও আকছার হয়, সেই সোর্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসারের ব্যক্তিগত স্তরে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অফিসারের বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়েছেন, হয়তো বিরল গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন। সবার আগে সেই সোর্স হাজির হয়ে যায়, ‘কী লাগবে স্যার, আমাকে বলুন।’ এবং প্রাণপাত দৌড়ঝাঁপে জোগাড় করে আনে নির্দিষ্ট গ্রুপের রক্তদাতা।

আবার সোর্সের পারিবারিক সুখদুঃখের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন অফিসাররা। সে সোর্সের ছেলেমেয়েদের জন্য পুজোর জামা কিনে দেওয়াই বলুন বা তাদের স্কুলকলেজে ভরতি হওয়ার জন্য অর্থসাহায্য করা। অবসর নেওয়ার পরও বহু অফিসারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থেকে যায় তাঁদের একসময়ের সোর্সদের। যে সম্পর্ক দাতা-গ্রহীতার ঊর্ধ্বে।

সোর্সকে ঠিকঠাক ‘হ্যান্ডল’ করতে না পারলে অবশ্য সেমসাইড গোলের সম্ভাবনা। সুযোগ পেলেই পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে অপব্যবহার করার প্রবণতা থাকে সোর্সদের একটা বড় অংশের। যারা মনে করে, পুলিশ অফিসারদের খবর দিই মানে অন্যত্র যা খুশি করার লাইসেন্স পাওয়া হয়ে গেছে।

অমুক জায়গায় হয়তো চোলাই মদের ঠেক বসেছে। তমুক জায়গায় হয়তো জুয়ার বোর্ড চলছে গোপনে। সোর্স গিয়ে টাকা আদায় করতে শুরু করে। না দিলে পুলিশকে জানিয়ে দেবে, এই ভয় দেখিয়ে। সোর্সকে তাই অনেক সময় ‘ম্যানমার্কিং’ করতে হয় অফিসারদের। এক সোর্সের পিছনে লাগাতে হয় অন্য সোর্স। যাতে কোনও সোর্স উইং দিয়ে ওভারল্যাপে গেলেই খবর আসে, এবং পত্রপাঠ থামিয়ে দেওয়া যায় কড়া ট্যাকলে। যাতে ‘সোর্স’ কোনভাবেই ‘রিসোর্স’ না হয়ে যায়।

পাঁচ সাব-ইনস্পেকটর তদন্ত করছিলেন ডাকাতির পাঁচটা মামলার। এন্টালির কেসের দায়িত্বে ছিলেন ইন্দ্রনীল চৌধুরী। আলিপুরের মামলায় তরুণকুমার দে। লেকের ব্যাংক ডাকাতির তদন্ত করছিলেন রাম থাপা। সিইএসসি-র টাকা লুঠের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন তপন সাহা এবং অরবিন্দ সরণির দোকানে ডাকাতির তদন্তভার ন্যস্ত হয়েছিল শাকিলুর রহমানের উপর। তবে যেহেতু প্রতিটি ঘটনাই সংশয়াতীত ভাবে ছিল একই দলের কীর্তি, তদন্তকারী অফিসাররা একত্রে ঝাঁপিয়েছিলেন সমাধানে। সকলের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটা করছিলেন anti-dacoity বিভাগের ওসি বিমল সাহা এবং অ্যাডিশনাল ওসি আমিনুল হক। তদন্তের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, ছিল বিমল-আমিনুলেরই দায়িত্বে।

যার যেখানে যা সোর্স ছিল, প্রত্যেককে খবর পাঠানো হয়েছিল। নগরপাল ঢালাও বরাদ্দ করেছিলেন ‘সোর্সমানি’। নির্দেশ ছিল স্পষ্ট, সোর্সকে যেখানে ইচ্ছে পাঠাও খবর নিতে। যেখানে ইচ্ছে, যতদিন ইচ্ছে থাকতে হয়, থাকুক। যত খরচ হয় হোক। কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু খবর চাই। পাকা খবর। যে-কোনও মূল্যে।

চারটে ‘জোন’-এ ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলোকে। হাওড়া, হুগলি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা। দশ-বারো জন সোর্সকে থাকা-খাওয়ার খরচ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রতিটি জোনে। সোর্সদের কাজকর্মের তত্ত্বাবধানে প্রতি টিমের সঙ্গে ছিলেন গোয়েন্দাবিভাগের অন্তত দু’জন অফিসার।

পাঁচ তদন্তকারী অফিসার, ইন্দ্রনীল-তরুণ-রাম-তপন-শাকিলুর সারা সপ্তাহ ধরে জেলাগুলোয় চক্কর দিয়ে বেড়াতেন। রোজ কথা বলতেন ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা সোর্স এবং অফিসারদের সঙ্গে।

এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তদন্তকারীরা, সোর্সের দেওয়া খবরের গুণাগুণ বিচারের বিলাসিতা ছিল না। সেই বিশেষ টিমের একজনের ভাষায়, ‘নাওয়াখাওয়া ভুলতে বসার অবস্থা হয়েছিল আমাদের। যে সোর্স যখন যা বলছে, অন্ধের মতো ছুটছি তখন। ক্লু হাতে না থাকলে যা হয়। কেউ বলল, নৈহাটির শিবদাসপুরে নাকি কয়েকটা ছেলে প্রচুর টাকা ওড়াচ্ছে। ছুটলাম নৈহাটি। পরের দিনই খবর এল হয়তো, আন্দুলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে কয়েক মাস ধরে সাত-আটজন লোক রয়েছে। সকালে বেরিয়ে যায়, রাতে ফেরে। কেউ জানে না কী করে ওরা। ব্যস, ছোটো আন্দুল। কিন্তু কোনও খবরই “ক্লিক” করছিল না।’

‘ক্লিক’ করার সামান্য আভাস মিলল ’৯৮-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি। প্রথম ডাকাতির পর প্রায় ছ’মাস অতিক্রান্ত তখন। মিনাখাঁয় একজন সোর্স কিছু খবর দিয়েছিল। সেই খবর যাচাই করতে আমিনুল হক সহ পাঁচ তদন্তকারী একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে রেইড করে ফিরছিলেন কলকাতায়। নিষ্ফলা রেইড। খবরটা ভুল ছিল।

গাড়ি ছুটছিল বাসন্তী হাইওয়ে দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হল ভোর হয়ে গেছে। শীতের ভোর। অফিসারদের সোয়েটার-শাল-জ্যাকেটকে বলে বলে গোল দিচ্ছে ফাঁকা হাইওয়ের উত্তুরে হাওয়া।

রাস্তার ধারের দু’-একটা চায়ের দোকান ঝাঁপ খুলেছে। ভোজেরহাটের এমনই একটা দোকানের সামনে গাড়ি ব্রেক কষল। অফিসাররা সিদ্ধান্ত নিলেন, একটু চা না হলেই নয়। ঘুমটা তো অন্তত কাটুক। হাড়-কাঁপানো ঠান্ডাটাও।

ভাঁড়ের চা, ধোঁওয়া-ওঠা। আয়েশি চুমুক দিতে দিতেই আমিনুল এবং বাকিরা লক্ষ করলেন, অন্তত পনেরো-কুড়িটা ট্রাক সার দিয়ে চলেছে বাসন্তীর দিকে। সবক’টা ইটবোঝাই। এ রাস্তায় তো এত ইটভাটা নেই! ইটভরতি ডজনখানেক ট্রাক যাচ্ছে কোথায়? কোনও ব্রেনওয়েভ নয়। কোনও মগজাস্ত্র নয়। নিছকই কৌতূহলে আমিনুল প্রশ্ন করেন চায়ের দোকানিকে।

—এতগুলো ট্রাক! সব কি ইটভাটায় যায়? এ রাস্তায় এত ইটভাটা আছে?

—না স্যার, ইটভাটা নয়। আকুঞ্জি মার্কেট তৈরি হচ্ছে তো ধামাখালিতে। ওখানে যাচ্ছে। রোজই এ সময় যায়। ইট যায়। সিমেন্ট যায়। বালি যায়।

—কী মার্কেট?

—আকুঞ্জি। আকুঞ্জি মার্কেট।

.

‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই’—তদন্তের চিরন্তন আপ্তবাক্য। ছাই উড়িয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। যোগাযোগ করা হল ধামাখালির দু’জন সোর্সের সঙ্গে, ‘খবর চাই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। কোথায় মার্কেট তৈরি হচ্ছে, কারা করছে, কত টাকা খরচ হচ্ছে, সব খবর চাই।’

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই খবর এল। ধামাখালির আকুঞ্জিপাড়ায় সবাই একডাকে চেনে আকুঞ্জি পরিবারকে। বিঘের পর বিঘের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মাছের ভেড়ির মালিক এই আকুঞ্জিরা। গলদা চিংড়ির রপ্তানিই প্রধান ব্যবসা। চাষবাসের জমিজমাও আছে যথেষ্ট। তবে ভেড়িই রোজগারের মূল উৎস। প্রচুর স্থানীয় লোক কাজ করে আকুঞ্জিদের ভেড়িতে। এলাকার অন্যতম সম্পন্ন পরিবার।

মাসখানেক আগে হাইওয়ে সংলগ্ন এলাকায় শুরু হয়েছে আকুঞ্জি মার্কেট তৈরির কাজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বসবে বাজার। একটা বড় বাজারের দীর্ঘদিনের অভাব স্থানীয় মানুষের। সেই অভাব দূর করতে উদ্যোগী হয়েছে আকুঞ্জিরা। কাজ চলছে ঝড়ের গতিতে। ইট-বালি-চুন-সুরকি বোঝাই গাড়ির দাপাদাপি লেগেই আছে।

শুধু বাজারই নয়, মাসদেড়েক হল পাড়ায় একটা মসজিদও তৈরি করে দিয়েছে আকুঞ্জিরা। নামাজ পড়তে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে দূরের মসজিদে যেতে হত এর আগে। অসুবিধে হত বয়স্কদের। এখন পাড়ার মধ্যেই প্রার্থনার সুব্যবস্থা। সৌজন্য, আকুঞ্জি পরিবার।

যথেষ্ট ধনী পরিবার ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ করে এত টাকা আসছে কোত্থেকে, যে রাতারাতি মসজিদ বানানো হয়ে গেল, বাজারও তৈরি হওয়ার মুখে? ভেড়ির কর্মচারীদের কাছে খোঁজ নিয়ে সোর্স জানাল, ব্যবসা চলছে আগের মতোই। মাছ রপ্তানির পরিমাণ যে হঠাৎ বেড়েছে, এমন নয়। তা হলে?

আকুঞ্জি পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হল বিস্তারিত। এবং যা জানা গেল, তাতে ‘সামান্য আলোর আভাস’ দেখতে পেলেন গোয়েন্দারা, দীর্ঘদিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ধুঁকতে থাকার পর রোগী জেনারেল বেডে ফেরার ছাড়পত্র পেলে যেমন হয়।

পরিবারের মাথা হলেন মধ্যপঞ্চাশের আবদুল কাদের আকুঞ্জি। চার ছেলে। বড়ছেলের বয়স তিরিশ, নাম আবদুল মাজেদ আকুঞ্জি। মেজোছেলে আঠাশ, নাম আবদুল ওয়াজেদ। সেজোর বয়স হয়েছে চব্বিশ-পঁচিশ, আবদুল ওয়াহেদ। ছোটছেলে স্কুলে পড়ে, আবদুল ওহিদ।

ছোটছেলেকে হিসেবের বাইরে রাখা হল। মাজেদ-ওয়াজেদ-ওয়াহেদ, বড়-মেজো-সেজো-র গতিবিধি কেমন?

জানা গেল, বড় এবং সেজো ভেড়ির কাজেই সাহায্য করে বাবাকে। মেজোছেলে, ওয়াজেদ আকুঞ্জি, নিয়মিত যাতায়াত করে কলকাতায়, ব্যবসার কাজে। কখনও মোটরসাইকেলে করে, কখনও পারিবারিক গাড়িতে। বেশিরভাগ সময়েই কলকাতাতেই থাকে ইদানীং। গত কয়েক মাস পাড়ার লোক খুব বেশি হলে

দু’-তিনবার এলাকায় দেখেছেন ওয়াজেদকে।

পাঁচটা ডাকাতিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী আঁকা ছয় ডাকাতের ছবি দেখানো হল স্থানীয় কয়েকজনকে। একটা ছবিকে প্রায় সবাই চিহ্নিত করলেন, ‘আরে! এ তো একদম ওয়াজেদ ভাইয়ের মতো দেখতে।’

ছবি দেখে লোকে চিনছে। হঠাৎ টাকা খরচ হচ্ছে জলের মতো। পরিবারের তরফে রাতারাতি এলাকায় তৈরি হচ্ছে মসজিদ। গড়ে উঠছে বাজার। কলকাতায় মেজোছেলে ওয়াজেদ পুরো মাসটাই কাটাচ্ছে। দেখাই যাচ্ছে না এলাকায়। এই পরিস্থিতিতে লালমোহনবাবু হলে যা বলতেন, সেটাই মাথায় ঘুরছিল গোয়েন্দাদের। ‘হাইলি সাসপিশাস!’

সব দিক বিচার করে একটাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল। আকুঞ্জিদের বাড়িতে ‘রেইড’ করার।

.

প্রায় তিন বিঘে জমির উপর বাড়ি। বাড়ি তো নয়, যেন দুর্গ। দশ-বারো ফুট উঁচু পাঁচিল। ঢোকার গেট একটাই। পুরো বাড়িটা ঘিরে ফেলতে পঞ্চাশ-ষাট জন লোকের দরকার ন্যূনতম।

সামান্যতম ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত ছিল না লালবাজার। একশো জন বাছাই করা পুলিশকর্মীকে জড়ো করা হয়েছিল ধামাখালিতে। হাজির ছিলেন আমিনুলের নেতৃত্বে অন্তত ডজনখানেক অফিসার। ঘড়ির কাঁটা যখন রাত তিনটে ছুঁতে চলেছে, আকুঞ্জিদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়া হল। জবাব এল না।

আগের রাত্রে সাদা পোশাকে কয়েকজন অফিসার ঘুরে গিয়েছিলেন জায়গাটা। একটা বড় ‘রেইড’ করার আগে সরেজমিনে যে ‘ঘুরে যাওয়াটা’ অসম্ভব জরুরি। কোথায় ‘রেইড’ হবে, কোন দিক দিয়ে ঢোকা হবে, ভিতরে কারা যাবে, বাইরে ‘ব্যাক-আপ’ হিসাবে কারা থাকবে, যাদের ধরতে যাওয়া হচ্ছে, তারা কোনদিক দিয়ে পালাতে পারে, এবং সেই পালানোর পথ কীভাবে বন্ধ করতে হবে… সমস্ত খুঁটিনাটি ছবি এঁকে আগেভাগে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ‘রেইড’-এ অংশ নেওয়া অফিসার-কর্মীদের। কার কখন কী দায়িত্ব, পরিষ্কার হয়ে যায় জলবৎ তরলং।

কড়া নেড়েও জবাব না এলে কী করা হবে, ভাবাই ছিল। আনা হয়েছিল বেশ কয়েকটা কাঠের সিঁড়ি। লাগানো হল পাঁচিলের গায়ে। জনা কুড়ি অফিসার-ফোর্স সিঁড়ি বেয়ে উঠে পাঁচিল টপকে নেমে পড়লেন বাড়ির ভিতরে। গেট খুলে দিলেন বাড়ির। বাকি ফোর্স ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকের হাতে হয় টর্চ, নয় ড্রাগন লাইট।

তিন বিঘে জমির উপর যেন একটুকরো গ্রাম। ছোট ছোট আটটা ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একটা পুকুর। গোরু-বাছুর বাঁধা রয়েছে একটা বড় গোয়ালঘরে। এক প্রান্তে দুটো গুদামঘর। ধান বোঝাই করা আছে। ধানের স্তূপ অবশ্য শুধু গুদামেই নয়, সাজানো রয়েছে বিস্তৃত জমির এখানে-ওখানে-সেখানে।

পুকুরের ঠিক পাশেই অন্যগুলোর তুলনায় একটু বড় একটা ঘর। যার কড়া নাড়তে দরজা খুলে ঘুমচোখে বেরিয়ে এলেন পরিবারের কর্তা। আবদুল কাদের আকুঞ্জি। শক্তপোক্ত চেহারা। ফতুয়া-লুঙ্গি পরিহিত ভদ্রলোক পুলিশ দেখে অবাক। শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন আমিনুলকে।

—কী ব্যাপার? আপনারা এভাবে সবাই মিলে আমার বাড়িতে… কী ব্যাপার?

—বলছি… আপনার ছেলেদের ডাকুন। আমরা লালবাজার থেকে আসছি। আপনার বাড়িটা সার্চ করব।

এবার সামান্য উত্তেজিত দেখায় সিনিয়র আকুঞ্জিকে।

—সার্চ করবেন মানে? কী সার্চ করবেন? আমরা কি চোর-ডাকাত নাকি? সার্চ ওয়ারেন্ট কোথায়? সার্চ করবেন বললেই হল? দেশে আইন নেই?

—আইনের আলোচনা আপনার সঙ্গে করতে আসিনি আকুঞ্জি সাহেব। আর চোর-ডাকাত কিনা সেটা তো আপনি ভাল বলতে পারবেন… আপনার ছেলেরা বলতে পারবে… কোথায় ওরা?

‘কোথায়’, সেটা জানতে ততক্ষণে আকুঞ্জিদের বাড়ির প্রতিটি কোনায় তল্লাশি শুরু করে দিয়েছে পুলিশবাহিনী। গুদামঘর-গোয়ালঘর-ধানের স্তূপ, কিছু বাদ নেই। কয়েকটা ঘর তালাবন্ধ ছিল। বাকিগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। বেরিয়ে এসেছেন বাড়ির কাজের লোকরাও।

পুরুষ সদস্য বলতে গৃহকর্তা নিজে ছাড়াও উপস্থিত চার ছেলের মধ্যে তিনজন। বড় মাজেদ, সেজো ওয়াহেদ এবং স্কুলপড়ুয়া ছোটছেলে ওহিদ।

—আপনার মেজোছেলে ওয়াজেদ কই?

—ও বেশিরভাগ সময় ব্যবসার কাজে কলকাতায় থাকে। মাসে এক-দু’দিন আসে।

—কোথায় থাকে কলকাতায়?

—সেটা বলতে পারব না।

—শেষ কবে এসেছিল এখানে?

—মাসখানেক আগে হবে।

—ভালই তো ব্যবসা আপনাদের, ডাকাতির মধ্যে না ঢুকলে চলছিল না?

এবার রাগে ফেটে পড়েন আকুঞ্জি সাহেব।

—মানে? বাড়ি বয়ে এসে যা খুশি বলবেন, যা খুশি করবেন? স্রেফ পুলিশ বলে? কে ডাকাতি করেছে? এপাড়ায় কতদিন ধরে আছি জানেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন না আমাদের ব্যাপারে! পুরো বাড়ি তছনছ করে দিচ্ছেন সার্চের নামে, আমি আপনাদের ছেড়ে দেব ভেবেছেন? কোর্টে যাব।

কোর্টে যাওয়ার সত্যিই সংগত কারণ থাকবে, অফিসাররা বুঝতে পারছিলেন তল্লাশির পর। কিছুই পাওয়া গেল না তন্নতন্ন করে খোঁজার পরও। রিভলভার না, গুলি না, বোমা না। ব্যাংকলুঠের একটা টাকাও না।

হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। সিনিয়র আকুঞ্জির প্রবল প্রতিবাদকে উপেক্ষা করেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দারা লালবাজারে নিয়ে এলেন মাজেদ আর ওয়াহেদকে।

নিয়ে তো এলেন। কিন্তু রাতভর ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করেও ডাকাতির ব্যাপারে স্বীকারোক্তি তো দূরের কথা, কোনও বাড়তি তথ্যও পাওয়া গেল না। দু’জনেই একই কথা আউড়ে গেলেন তোতাপাখির মতো, ‘ডাকাতির ব্যাপারে কিছুই জানি না আমরা।’

মেজোভাই ওয়াজেদ কোথায়? দুই ভাইয়ের একই উত্তর কাটা রেকর্ডকেও লজ্জা দিয়ে, ‘বিশ্বাস করুন, জানি না।’ গ্রেফতারির প্রশ্ন আসে অপরাধের সঙ্গে নির্দিষ্ট যোগসূত্র বা প্রমাণ পাওয়া গেলে তবেই। পাওয়া গেল না, এবং ছেড়ে দিতে হল দুই ভাইকে। সোর্সদের বলা হল গতিবিধির উপর নজর রাখতে।

নজরদারির ব্যাপারে একটা জরুরি সিদ্ধান্ত নিলেন গোয়েন্দাপ্রধান। হাওড়া-হুগলি-উত্তর ২৪ পরগনায় যে অফিসাররা ঘাঁটি গেড়েছিলেন সোর্সসহ, তাদের সবাইকে বলা হল দক্ষিণ ২৪ পরগনায় চলে আসতে। বামনঘাটা-ভোজেরহাট-ঘটকপুকুর-মিনাখাঁ-মালঞ্চ হয়ে ধামাখালি পর্যন্ত, সর্বত্র ছড়িয়ে গেলেন অফিসাররা। বৃত্তটা ছোট হয়ে এল অনেক। এলাকায় পাকাপাকি নোঙর ফেলে খবর জোগাড়ের চেষ্টা শুরু করল সোর্সরা। ওয়াজেদ আকুঞ্জি কোথায়?

খবর এল। দ্রুতই এল। ওয়াজেদ আকুঞ্জিকে সপ্তাহখানেক আগে দেখা গেছে ঘটকপুকুর এলাকায়। হাইওয়ের ধারে একটা চায়ের দোকানে সন্ধেবেলা এসেছিল মিনিট দশেকের জন্য। একজন লোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেছে মোটরসাইকেলে করে। দোকানির সঙ্গে কথা বললেন গোয়েন্দারা।

—লোকটা কার সঙ্গে কথা বলছিল চায়ের দোকানে?

—একটা বেঁটে মতো লোক, মোটাসোটা।

এই সেই ‘দুয়ে দুয়ে চার’-এর মুহূর্ত! বেঁটে মতো লোক? মোটাসোটা? Hefty and bulky? যেমনটা এফআইআর-এ লিখেছিলেন ফেডারাল ব্যাংকের ম্যানেজার রামচন্দ্রন? ঠিক যেমন চেহারার লোকের বিবরণ পাওয়া গেছে পাঁচটা ঘটনাতেই?

—চেনেন ওই বেঁটে লোকটাকে?

—এক-দু’বার এসেছে আমার এখানে চা খেতে। মুখ চিনি। নাম জানি না।

—হুঁ… বেঁটে লোকটা যার সঙ্গে কথা বলছিল, সে একা এসেছিল?

—না স্যার, সঙ্গে একটা মেয়ে ছিল।

—মেয়ে?

—হ্যাঁ স্যার, কুড়ি-বাইশ বছর বয়স হবে। খুব ফরসা। লম্বা। দারুণ দেখতে।

—মেয়েটিকে আগে এলাকায় দেখেছেন কখনও?

—না স্যার… আমি বরং লোকটা মেয়েটাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই বেঁটে মোটা লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একে তো আগে দেখিনি কখনও এদিকে?

—কী বলেছিল?

—বলেছিল, মেয়েটা নাকি নাচে। কলকাতায়।

পরের চব্বিশ ঘণ্টায় ঘটকপুকুর এবং সংলগ্ন এলাকার গ্রামগুলো সাদা পোশাকের পুলিশ এবং সোর্সরা চষে ফেলল। এবং জানা গেল ‘hefty and bulky’ লোকটির পরিচয়। আবদুল হাই গায়েন। বড়ালি গ্রামের বাসিন্দা। ইটভাটার মালিক। কলকাতায় চালের ব্যবসা করত একসময়। লরি চালাতে পারে। এলাকায় যথেষ্ট দাপট। ইটভাটার লরি পার্ক করা নিয়ে সম্প্রতি স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। হাতাহাতিও। আবদুল হাই নাকি শূন্যে গুলি চালিয়েছিল ঝামেলার সময়। বছর দুয়েক আগে চুরি-ছিনতাই জাতীয় কেসে নাকি একবার পুলিশে ধরাও পড়েছিল। ইদানীং বাড়িতে থাকছে না।

সন্দেহের-দ্বিধার-সংশয়ের আর জায়গা ছিল না। ছয় ডাকাতের দু’জন নিশ্চিতভাবে আকুঞ্জি এবং আবদুল হাই। এদের ধরতে পারলেই বাকি চারের হদিশ মিলবে।

কীভাবে ধরা হবে? হাতের কাছে তথ্য বলতে, আকুঞ্জিকে একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা গেছে। কলকাতায় নাচে। কোথায় নাচে? নিশ্চয়ই পানশালায়, কোনও বারে।

কলকাতার বারে নাচে, এমন একটা মেয়েকে খুঁজে বার করতে হবে। লম্বা-ফরসা-সুন্দরী। যার সঙ্গে ধামাখালির এক যুবকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে ইদানীং। এটুকু না পারলে আর কীসের লালবাজার? কীসের আর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা?

দু’জন সোর্সকে চিহ্নিত করা হল। যাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে কলকাতার সেইসব পানশালায়, যেখানে গানের পাশাপাশি টুকটাক নাচও হয়। বলে দেওয়া হল, ‘সন্ধে থেকে বারগুলোতেই কাটাও। যা খরচা হবে, আমরা দেব।’

দিনতিনেকের মধ্যেই খবর নিয়ে হাজির হল সোর্স। আসল নামটা লিখলাম না। নাম ধরা যাক আশিস। নিখরচায় সন্ধে থেকে ‘জলপথে’ থাকার সুযোগ পেয়ে যে জানপ্রাণ লাগিয়ে দিয়েছিল মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে।

—স্যার। ইলিয়ট রোডের কাছে বারটা। মেয়েটা হাতিবাগানের।

—কী করে বুঝলি, এই মেয়েটাই?

অঙ্কে এমএসসি করা লোককে যদি জিজ্ঞেস করেন এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফরমুলা? কী প্রতিক্রিয়া হবে? অনুকম্পার হাসিই তো! অবিকল সেই হাসি হাসলেন আশিস।

—কী যে বলেন স্যার! এটা বোঝা কোনও ব্যাপার হল? বারে নাচে, ফরসা-লম্বা আর সুন্দর দেখতে, এমন পাঁচটা মেয়ের খোঁজ পেলাম গত দু’দিনে। লোক ফিট করলাম পাঁচজনের পিছনে। এই হাতিবাগানের মেয়েটা কিছুদিন হল ট্যাক্সি করে বারে আসছে। আগে বাসে করে আসত। গলায় মাসখানেক হল সোনার নেকলেস পরছে। হেব্বি দামি ঘড়ি পরছে।

—আর?

—গত শনিবার একটা গাড়ি এসে বারের বাইরে অপেক্ষা করছিল। নাচ শেষ হওয়ার পর সেই গাড়িতে করে মেয়েটা বেরিয়ে গেছে। একটা ছেলে গাড়িটা চালাচ্ছিল। ছেলেটার ব্যাপারে তেমন কেউ বলতে পারছে না। তবে মেয়েটার চালচলন ইদানীং বদলে গেছে। হাতে মালকড়ি এসেছে হঠাৎ। আমি হাতিবাগানেও খোঁজ নিয়েছি। বাড়ির অবস্থা ভাল নয় তেমন টাকাপয়সার দিক দিয়ে। আপনি মিলিয়ে নেবেন স্যার, একেই খুঁজছেন। এই মেয়েটাই!

.

শেষ-জানুয়ারির শনিবারের রাত। লালবাজার থেকে প্লেন ড্রেসে রওনা দিলেন গোয়েন্দারা। ইলিয়ট রোডের বারের বাইরে অপেক্ষায় রইলেন বিমল-আমিনুল-রাম-তপনরা। সঙ্গে দুই মহিলা কনস্টেবল। ভিতরে ঢুকলেন রিমলেস চশমা পরিহিত ইন্দ্রনীল। বার তখন মাতোয়ারা। হিট হিন্দি গানের সঙ্গে কোমর দোলাচ্ছেন এক সুন্দরী। লম্বা এবং ফরসা।

‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত

তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত..’

গানের মাঝেই ম্যানেজারের কানে ইন্দ্রনীলের ফিসফিস। গান শেষ হওয়ার পরই তরুণীর শশব্যস্ত বেরিয়ে আসা বারের বাইরে।

—আপনাকে একবার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

—যেতে হবে মানে? কোথা থেকে আসছেন আপনারা?

—লালবাজার।

ড্রেস চেঞ্জ করতে যতটুকু সময়। সাদা টাটা সুমো গাড়িতে উঠে বসলেন তরুণী। টাটা সুমো স্টার্ট দিল। গন্তব্য লালবাজার।

পানশালার মেহফিলে তখন যুবতীর জায়গা নিয়েছে এক যুবক। শুরু হয়েছে নতুন গান। শাহরুখ খানের সিনেমার।

‘ইয়ে কালি কালি আঁখে

ইয়ে গোরে গোরে গাল…’

.

একটা মাঝারি মাপের ঘরে সাত-আটজন মিলে জেরা করতে শুরু করলেন যুবতীকে। এবং মিনিট পাঁচেকের বেশি নার্ভ ধরে রাখতে পারলেন না যুবতী। ওঁর আসল নামটা বদলে দেওয়া যাক। ধরা যাক, জয়শ্রী। স্বীকার করে নিলেন আকুঞ্জির সঙ্গে গড়ে ওঠা মাসদুয়েকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সম্পর্কের কী-কেন-কখন নিয়ে বিশেষ কৌতূহল ছিল না অফিসারদের। জানার ছিল একটা কথাই। কলকাতায় আকুঞ্জি থাকে কোথায়? উত্তর দেবেন কী, প্রশ্ন শোনামাত্রই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন জয়শ্রী।

—স্যার, জানতে পারলে ও মেরে ফেলবে আমাকে। সবসময় সঙ্গে রিভলভার থাকে ওর। সংসারটা আমাকে একা চালাতে হয়। মাসে মাসে চার হাজার করে টাকা দিত আমায়। সেই লোভে পড়ে… প্লিজ় স্যার, ও আমায় মেরে ফেলবে জানতে পারলে…

অফিসাররা নানাভাবে আশ্বস্ত করেন জয়শ্রীকে।

—কেউ জানবে না আপনার নাম। কেস ডায়েরিতে কোথাও থাকবে না। কোর্টে যেতে হবে না। কিস্যু করতে হবে না। কথা দিচ্ছি আমরা। বারের ম্যানেজারকে বলে দেব আমরা। আপনি শুধু জায়গাটা দেখিয়ে দেবেন, ব্যস। বললে আপনারই সুবিধে, ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। না বললেই বরং ফাঁসবেন।

আধঘণ্টা পর ধাতস্থ হলেন জয়শ্রী। যতটুকু জানতেন, বললেন। রাত আড়াইটে নাগাদ জয়শ্রীকে সঙ্গে নিয়ে চারটে অ্যামবাসাডর গাড়ি বেরল লালবাজার থেকে। প্রথম দুটো গাড়িতে জয়শ্রীকে বাদ দিয়ে আরোহীর সংখ্যা আট। প্রত্যেকে সাদা পোশাকে। কোমরে গোঁজা .৩২ রিভলভার। লোডেড। সঙ্গে একটা ব্যাগ। যাতে রইল শাবল-গাঁইতি।

তিন নম্বর গাড়িতে দু’জন মহিলা কনস্টেবল এবং একজন অফিসার। চতুর্থ গাড়িতে চার উর্দিধারী, বন্দুকসহ।

রবীন্দ্র সরণি-পোদ্দার কোর্ট-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-গিরিশ পার্ক-বিবেকানন্দ রোড-কাঁকুড়গাছি-উলটোডাঙা হয়ে চারটে গাড়ির প্রথম দুটো ঢুকে পড়ল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এলাকায়। কিছুটা এগিয়ে বাঁক নিল বাঁ দিকে। তিন আর চার নম্বর গাড়ি থেকে গেল উলটোডাঙা মোড়ে।

প্রথম দুটো গাড়িও থামল একটু পরেই। লেকটাউনের কালিন্দী হাউসিং প্রোজেক্ট থেকে একটু দূরে। একতলায় একটা ফ্ল্যাটের সামনে অফিসারদের নিয়ে গেলেন জয়শ্রী। ওঁর কাজ শেষ। পৌঁছে দেওয়া হল উলটোডাঙায়। যেখানে অপেক্ষমাণ তিন নম্বর গাড়িতে করে দু’জন অফিসার এবং একজন মহিলা কনস্টেবল জয়শ্রীকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন হাতিবাগানের বাড়িতে পৌঁছে দিতে।

দরজার দু’দিকে ভাগ হয়ে গেলেন অফিসাররা। পাঁচ তদন্তকারী ছাড়াও দলে ছিলেন সাব-ইনস্পেকটর মনোজ দাস এবং আরও দুই অফিসার। তাগড়াই চেহারার মনোজ (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটেশনে ডিএসপি হিসাবে কর্মরত) কলকাতা পুলিশে ডাকাবুকো অফিসার বলে পরিচিত ছিলেন।

প্রথমবারের কড়া নাড়ায় কোনও আওয়াজ নেই ঘরের ভিতর থেকে। দ্বিতীয়বারে ছিটকে এল মরিয়া উত্তর,— ‘পুলিশ হোক আর যেই হোক, ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেই গুলি করব।’

লাথি মেরে দরজা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে ছিটকে এল গুলি। লাগল মনোজের কাঁধে। অবিরাম রক্তপাত, ক্ষতস্থানে হাত চেপে মাটিতে বসে পড়লেন মনোজ। এবং ঘরের ভিতর থেকে দ্বিতীয় গুলি চলার আগেই পালটা গুলি চালালেন এক অফিসার। আকুঞ্জির কোমরের নীচে, ডান ঊরুর কাছে গুলি লাগল। এ-ই যে আকুঞ্জি, এক পলকের দেখাতেই বুঝলেন গোয়েন্দারা। আঁকানো ছবির সঙ্গে যথেষ্টরও বেশি মিল।

আকুঞ্জি একা ছিল না ফ্ল্যাটে। সঙ্গে ছিল আরেকজন। দু’জনের উপরই নিমেষে ঝাঁপালেন গোয়েন্দারা। কেড়ে নেওয়া হল আকুঞ্জির রিভলভার। অন্য লোকটিকে ধরাশায়ী করতেও লাগল খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। ওয়াকিটকিতে ততক্ষণে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন এক অফিসার, ‘মুভ টু কালিন্দী অ্যাট ওয়ান্স। কুইক!’ উলটোডাঙার মোড় থেকে চতুর্থ গাড়ি তখন তিরবেগে ছুটেছে লেকটাউনের দিকে।

গুলিগোলার আওয়াজে তখন ঘুম ভেঙে গেছে আশেপাশের বাসিন্দাদের। আতঙ্কে অনেকে বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়। এবং বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক অফিসারকে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন সতীর্থরা। দুই যুবককে একতলার ফ্ল্যাট থেকে টেনে বার করে আনছে পুলিশ। একজনের কোমরে দড়ি। আর একজন রক্তাক্ত। তাকেও তোলা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। আরে, এ তো চেনা মুখ। ভদ্র, নম্র ব্যবহার। মাসছয়েক হল এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। প্রোমোটারি করে বলেই জানে পাড়ার লোক। এ? এ ব্যাংক-ডাকাতির পান্ডা!

আহত মনোজ এবং ওয়াজেদ আকুঞ্জিকে নিয়ে যাওয়া হল আর জি কর হাসপাতালে। কালিন্দীর ফ্ল্যাট তল্লাশি করে পাওয়া গেল দুই আলমারি ভরতি টাকা। থরে থরে সাজানো, বিভিন্ন ব্যাংকের স্লিপ লাগানো টাকার বান্ডিল।

আকুঞ্জির সঙ্গের যুবকের নাম মনোজ সিং। যাকে লালবাজারে এনে শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। সব কিছু স্বীকার করা ছাড়া উপায় ছিল না ট্যাংরার দেবেন্দ্র চন্দ্র রোডের বাসিন্দা মনোজের। দ্রুত জানিয়ে দিল ডাকাতদলের বাকিদের নাম। ভোরেই বেরিয়ে পড়া হল রেইডে। সমর রায় ওরফে কালু গ্রেফতার হল ট্যাংরা থেকেই। কড়েয়ার একটা ভাড়াবাড়ি থেকে তোলা হল আরেক ডাকাত দীনেশ দাসকে। এন্টালির বিবিবাগানের গোপন ডেরায় হানা দিয়ে গ্রেফতার করা হল সরওয়ার খানকে। মনোজ-দীনেশ-সমর-সরওয়ার, সবারই বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে।

সমর-দীনেশরা জানত ঘটকপুকুরের কাছে আবদুল হাই গায়েনের সম্ভাব্য আস্তানার কথা। টিম পাঠিয়ে ডাকাতদলের একমাত্র ‘hefty and bulky’ সদস্যকে পাকড়াও করতে সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। হলও না। আকুঞ্জি-মনোজ-আবদুল-সরওয়ার-দীনেশ-সমর, পুরো গ্যাং শেষ পর্যন্ত কব্‌জায়। প্রথম ডাকাতির প্রায় ছ’মাস পরে।

কোথায় কখন ডাকাতি করা হবে, প্ল্যান করত দু’জন। আকুঞ্জিই ছিল দলের মাথা। সংলাপ-চিত্রনাট্য-পরিচালনা তারই। মুখ্য পরামর্শদাতা ছিল আবদুল, যার সঙ্গে আকুঞ্জির আলাপ বেশ কয়েক বছর আগে। আবদুলের আর্থিক টানাটানির সময় আকুঞ্জি টাকাপয়সা দিয়ে বিস্তর সাহায্য করেছিল। সেই থেকেই আবদুল আপাদমস্তক অনুগত আকুঞ্জির প্রতি।

পঁয়ত্রিশ বছরের আবদুল কলকাতার রাস্তাঘাট, অলিগলি চিনত হাতের তালুর মতো। প্রায় পাঁচ বছর বড়বাজারের একটা চাল ব্যবসায়ীর কাছে কাজ করেছে। লরি চালিয়ে চাল নিয়ে গেছে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। কোথায় কখন কীভাবে হানা দিলে দ্রুত কাজ হাসিল হবে আর পালানোও যাবে নিরাপদে, আবদুলই বুদ্ধি দিত আকুঞ্জিকে। এবং আবদুলই পুরনো পরিচয়ের সূত্রে জুটিয়েছিল টিমের বাকি চারজনকে। মনোজ-সমর ট্যাংরায় একই পাড়ার বাসিন্দা। কাঠবেকার দু’জনেই। দীনেশ এবং সরওয়ারেরও কাজকর্ম বিশেষ কিছু ছিল না। পাড়ায় খুচরো দাদাগিরির ইতিহাস ছিল কিছু।

যেখানে যেখানে ডাকাতি হয়েছিল, সেখানে তার আগের রাতে পুরো টিমকে নিয়ে হাজির হত আকুঞ্জি। জায়গাটা আরও আগে থেকে দেখে রাখত আবদুল। ডাকাতির পর যে রাস্তা দিয়ে চম্পট দিতে হবে, সেই রাস্তা দিয়ে এরা ‘ট্রায়াল রান’ দিত গভীর রাতে। পরের দিন যাতে কোনও বিভ্রান্তি না থাকে, পান থেকে যাতে চুন না খসে।

যে মোটরসাইকেলগুলো ব্যবহার হয়েছিল ডাকাতিতে, সবক’টাই চোরাই। জোগাড় করেছিল আবদুলই। ট্যাংরার ডাকাতিতে ব্যবহৃত হয়েছিল যে মারুতি গাড়ি, সেটাও চোরাই গাড়িই। খোঁজ মিলল না গাড়িগুলোর। আকুঞ্জিরই পরামর্শমতো মোটরসাইকেল দুটো আবদুল ধাপার মাঠের কাছে ফেলে দিয়ে এসেছিল পাঁচ নম্বর ডাকাতির পর। সেগুলো খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। পাওয়া গেলও না।

মারুতি গাড়িটা? বসিরহাটের টাকির বাসিন্দা এক পরিচিতের কাছ থেকে কয়েকদিনের জন্য গাড়িটা ধার নিয়েছিল আবদুল। যাওয়া হল সেই পরিচিতের বাড়ি। তালাচাবি বন্ধ করে মাসখানেক আগে বাড়ির বাসিন্দারা অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন।

আহত সাব-ইনস্পেকটর মনোজ সুস্থ হয়ে উঠলেন ক্রমশ। মাসখানেক পরে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন আকুঞ্জিও সুস্থ হয়ে উঠল। লালবাজারে জেরার মুখোমুখি হয়ে আকুঞ্জি প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিল সোজাসাপটা। বুঝে গিয়েছিল, ‘গেম ওভার’। কিছু লুকিয়ে আর লাভ নেই। বাকিরা সবটা বলে দিয়েছে। মিথ্যে বললে দুর্ভোগই বাড়বে। পুলিশ বিশ্বরূপ দেখিয়ে ছাড়বে।

—এত জমিজমা, মাছের এমন রমরমা ব্যবসা, নতুন গ্যাং তৈরি করে ডাকাতির প্ল্যান কী করে মাথায় এল? আর কেনই বা এল?

জবাবে আকুঞ্জি কোনও রাখঢাক করল না।

—ফ্যামিলি বিজ়নেসেই থাকলে যেমন চলছিল, তেমনই চলত স্যার। আমার আরও আরও অনেক বেশি বড়লোক হওয়ার ইচ্ছে হত। বিরাট দামি গাড়ি হবে। কলকাতায় বড় বাড়ি হবে। বিদেশে বেড়াতে যাওয়া হবে। সুন্দরী মেয়েরা ঘিরে থাকবে। অনেক টাকার স্বপ্ন দেখতাম।

—সুতরাং ব্যাংকলুঠ করা যাক, ঠিক করে ফেললি?

—ওটাই দেখলাম বেস্ট উপায় স্যার। আমার টার্গেট ছিল তিন-চার মাসে এক কোটি টাকা। বাবা আর ভাইদের সঙ্গে শুধু মাছের ব্যবসা করলে কোনওদিনই আর বেশি বড়লোক হওয়া যেত না।

—পাঁচটা মিলিয়ে তো লাখ পঞ্চাশেক মতো হয়েছিল। টার্গেটের মাত্র অর্ধেক…

—আর একটা বড় কাজ করে থেমে যেতাম স্যার।

গোয়েন্দাদের নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি হল। আরও একটা?

—সেটা কোথায়?

—মেট্রোর টাকা স্যার।

—কোন মেট্রো?

—বউবাজার মোড়ের কাছে একটা স্টেশন আছে না? নামটা ভুলে যাচ্ছি…

—সেন্ট্রাল?

—হ্যাঁ স্যার, সেন্ট্রাল… ওই স্টেশনের কাছে মাটির তলায় মেট্রোর অনেক টাকা রাখা হয় বলে খবর পেয়েছিলাম। ওই কাজটায় একবারে তিরিশ-চল্লিশ তো হতই।

ফের একে অন্যের দিকে তাকান অফিসাররা। সত্যিই আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাশস্টোর আছে একটা সেন্ট্রাল স্টেশনের প্রায় লাগোয়াই। অনেক টাকা থাকে। পুলিশের বন্দুকধারী থাকে পাহারায়। মেট্রো কর্তৃপক্ষের নিজস্ব গার্ডও থাকে। ছ’নম্বর ডাকাতিটা ওখানে হতে যাচ্ছিল?

—তা করলি না কেন কাজটা?

—আপনারা তো খুব দৌড়ঝাঁপ করছিলেন স্যার… তাই কিছুদিন চুপচাপ থেকে মামলা ঠান্ডা হওয়ার পর করব ভেবেছিলাম। লেকটাউনের যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলাম আটমাস আগে, ওখানেই থাকতাম ম্যাক্সিমাম টাইম।

—বাড়ির লোক জানত, তুই ডাকাতি করে বেড়াচ্ছিস? বাবা? ভাই?

—বাবা পুরোটা জানত না। বড়দাও না। তবে আন্দাজ করত কিছু একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়েছি। না হলে হুট করে বাজার-মসজিদ বানানোর এত টাকা পাব কোথায়? তবে সেজোভাই ওয়াহেদ জানত। ওর হাত দিয়ে লাখখানেক টাকা পাঠিয়েছিলাম একবার। বাড়িতে লুকিয়ে রাখতে।

—বাড়িতে কোথায়?

আকুঞ্জি চুপ করে থাকেন মিনিটখানেক। সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। আমিনুলের হুমকিতে সংবিৎ ফেরে।

—শোন, বাড়িতে টাকা থাকুক আর না-ই থাকুক, তুই বলিস আর না-ই বলিস, আমরা আবার যাব ধামাখালিতে। তোকে সঙ্গে নিয়েই যাব। তোর সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এবার পুরো তিনবিঘে জমি খুঁড়ে দেখব। প্রথমবার তো অত সময় হয়নি।

—ধানের পোয়ালের নীচে মাটিতে পুঁতে রাখতে বলেছিলাম ওয়াহেদকে।

‘পোয়াল’ বলতে ধানের স্তূপ। মাটি খুঁড়ে পাওয়াও গেল এক লক্ষ পঁচিশ হাজার, আকুঞ্জির বাড়িতে ফের রেইড করে।

পাঁচটা ঘটনায় মোট লুঠ হয়েছিল আটচল্লিশ লক্ষ আটশো পঁচিশ টাকা। যার মধ্যে উদ্ধার হয়েছিল কুড়ি লক্ষ দশ হাজার পাঁচ টাকা। যার সিংহভাগ কালিন্দীর ফ্ল্যাট থেকে। বাকি টাকার কিছুটা উদ্ধার হয়েছিল আন্দুলের কাছে একটা ফ্ল্যাট থেকে। যেটা ভাড়া নিয়েছিল আকুঞ্জি, যার সন্ধান জানত আবদুল।

টাকার বখরা? আকুঞ্জি বাকিদের বুঝিয়েছিল, তার কাছে লুঠের টাকা থাকাটাই নিরাপদ। তার কাছে অনেক জায়গা আছে লুকিয়ে রাখার। শেষ ডাকাতিটা হয়ে গেলে চূড়ান্ত ভাগবাটোয়ারা হবে। আবদুল এবং অন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল সাকুল্যে পঞ্চাশ হাজার। এবং নিজে নিয়ম করে টাকা ওড়াচ্ছিল মদ এবং মহিলার পিছনে।

পাঁচটা কেসেই চার্জশিট জমা পড়েছিল যথাসম্ভব দ্রুত। বহুসংখ্যক আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা হয়েছিল ডাকাতির জায়গাগুলো থেকে। যার কোনও না কোনওটা ম্যাচ করে গিয়েছিল ধৃত ছয় ডাকাতের ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে। বিচার চলাকালীন ঘটনাগুলোর সময় উপস্থিত একাধিক সাক্ষী সংশয়াতীত ভাবে ধৃতদের চিহ্নিত করেছিলেন Test Identification Parade-এ। আর বাজেয়াপ্ত টাকার বান্ডিলে ব্যাংকের স্লিপ তো ছিলই। আদালতে বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছিল আবদুল হাই, সমস্ত কিছু কবুল করে। আকুঞ্জি পরিবারের সেজোছেলে ওয়াহেদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল অপরাধীর অপরাধমূলক কাজের কথা জেনেও তা গোপন করার অভিযোগ (harbouring a criminal)।

আকুঞ্জি এবং অন্য পাঁচ ডাকাতের দোষী সাব্যস্ত হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা ছিল। যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ঘোষিত হয়েছিল দু’বছরের মধ্যেই। ওয়াহেদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল দশ বছরের কারাবাস।

কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু ‘পুনশ্চ’ এখনও বাকি। আকুঞ্জি পালানোর চেষ্টা করেছিল বিচার চলাকালীন। আলিপুর কোর্টে পুলিশের হাত ছাড়িয়ে মরিয়া দৌড় দিয়েছিল একদিন। একশো মিটার ধাওয়া করে ফিলমি কায়দায় ধরে ফেলেছিলেন এক শক্তসমর্থ কনস্টেবল।

সবে তিরিশ পেরনো আকুঞ্জি তীব্র অবসাদে ভুগতে শুরু করেছিল জেলে। কথা বলত না কারও সঙ্গে। খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল বললেই চলে। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল নীরোগ শরীরে। জেলযাপনে একের পর এক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। আকুঞ্জি মারা গিয়েছিল সাজার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই।

প্রবাদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না কখনও কখনও। লোভে পাপ। আর পাপে যা হওয়ার, তা- ই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *