Good night? ah! no, the hour is ill
Which severs those it should unite
স্মৃতির চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু নেই। বাথরুমের দরজার ফ্রেমে একটা ছোট পেরেক। সেই পেরেকে ঝুলছে টুথব্রাশ। বাবার টুথব্রাশ। নিয়ে যাননি সঙ্গে করে। বাড়িতে পরার চটি দরজার পাশে। কলম, রুমাল, পকেটঘড়ি। প্রিয় বই, নোটখাতা। হিসেবের খাতা। বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করামাত্রই কী অদ্ভুত এক নির্জনতা নেমে এল। হিমশীতল জল। যেন মৃত্যুর সঙ্গে, বিচ্ছেদের সঙ্গে কোলাকুলিগায়ে জল ঢেলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম। বিশাল বড় গোলমতো গায়ে মাখার সাবান জলে গলছে। গোলাপের গন্ধ। এই সাবান বাবার খুব প্রিয়। ইংরেজ আমলে সাবান আসত বিলেত থেকে। টার্কিশ বাথ সোপ। কেমিস্ট মানুষ। সাবান, পারফিউম, ট্যালকম পাউডার, ফেসক্রিম– এইসব খুব ভাল বুঝতেন। নিজে তৈরিও করতে পারতেন। সাবান তৈরির উপায় ছিল না, বড় প্ল্যান্টের প্রয়োজন। বয়লার চাই। বাষ্প খাওয়াতে হয় সাবানকে। আমাকে শেখাতেন, সাবানের সিজনিং কাকে বলে! সাবানে বুড়ো আঙুলের নখ বসিয়ে দেখবে, কড়কড় করে গুঁড়ো গুঁড়ো উঠলে বুঝবে, সিজনড সাবান। জাত ভাল। বাজার ছুঁড়ে দিশি সাবানের মধ্যে এই সাবানটাকেই তার মনে হয়েছিল প্রায় বিদেশির মতো। কত শৌখিন মানুষ ছিলেন! সবাই বলত, এ ম্যান অফ টেস্ট।
চৌবাচ্চার পাড়ে সাবানগোলা জল সাবানটাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ছড়াচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল আত্মহত্যা করলে কেমন হয়। নির্জন বাড়ি। কেউ কোথাও নেই। অনেক উঁচুতে একটা জানলা। তার বাইরে ঝোঁপঝাঁপ গাছের জটলা। শালিকের কর্কশ চিৎকার। এমন একটা ভিজেভিজে, মনমরা জায়গায় ঝুলে পড়তে মন্দ লাগবে না। ভীষণ একটা প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার ওপর? বড় মায়া নিজের জীবনের ওপর। সুন্দর সুন্দর দেশ দেখব। জীবনে বড় হব। আরও বড়। কত মানুষের সঙ্গে আলাপ করব। মেয়েদের ভালবাসা পাব। মানুষের প্রশংসা কুড়োব। এত সহজে শেষ করে দিলে চলে! স্নান শেষ হল।
অজস্র জানলা, দরজা। সব একে একে বন্ধ করলুম। ছাদের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ফুলগাছের টবগুলোর দিকে নজর চলে গেল। ঋতু ঘুরছে। রোদ নরম হয়ে আসছে। চন্দ্রমল্লিকায় এইবার ফুল আসবে। কে দেখবে! কে পরিচর্যা করবে! প্রেমিক যে সব ফেলে রেখে চলে গেছেন। কী নিঃসঙ্গ লাগছে নিজেকে?
পিতার শিক্ষা তো ভোলা যায় না। এক বাক্স মিষ্টি কিনে নিলুম। বিষ্টুদার বাড়িতে তো শুধু হাতে যাওয়া যায় না। টিপ দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ঠিক যেন দেবীপ্রতিমা। আমার কথা বোধহয় কিছু শুনেছে, তাই মুখে সেই সুন্দর হাসিটা লেগে নেই। বিষণ্ণ, থমথমে মুখ। জিজ্ঞেস করলে, আপনি এত দেরি করলেন? বাবা আর মা খুব ভাবছেন।
ভেতর থেকে টিপের মায়ের গলা ভেসে এল, হ্যাঁরে, এসেছে?
ছোট্ট একটা উঠোন। একপাশে একটা কলকে গাছ। ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে আছে। ঝোলাগুড়ের মতো রোদ মাখামাখি হয়ে আছে চারপাশে। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। মাটিতে ফাট ধরেছে। ঘাস ফুরফুর করছে। বিষ্টুদার বাড়িতে আগে কখনও আসিনি। মাঠকোঠা। চারপাশ তকতকে পরিষ্কার। দাওয়ার লাল মেঝে আয়নার মতো চকচক করছে। দুটো ভেলভেটের আসন পাশাপাশি পাতা। দু’গেলাস জল চাপা দেওয়া। কাসার গেলাস দুটো সোনার গেলাসের মতো ঝকঝক করছে।
টিপের মা যে এত সুন্দরী আমার জানা ছিল না। মা আর মেয়েকে প্রায় একই রকম দেখতে। সাধে বিষ্টুদা কবিতা লেখেন! গোটা পরিবার যেন সুখ আর শান্তির কোলে ঢলে আছে। ঘরদোর সব ছবির মতো সাজানো। সত্যিই, সুখ হল ঈশ্বরের দান। পূর্বজন্মের সুকৃতি। পরিষ্কার ধুতি আর গেঞ্জি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি বিষ্টুদা।
আমার হাতদুটো ধরে বললেন, এসে গেছ ভাই? আমি ভাবছিলুম, তুমি বোধহয় আর এলে না!
বিষ্টুদা আমাকে ধীরে ধীরে সাবধানে দাওয়ায় তুলে আনলেন, যেন না আনলে আমি পড়ে যাব। ভালবাসার স্পর্শ বেশ বোঝা যায়। একটা অনুভূতি ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে। এমন ভালবাসার স্পর্শ। আগে আমি কখনও পাইনি। শাসন পেয়েছি। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ পেয়েছি। আঁতে ঘা মারা কথা সহ্য করেছি প্রচুর। আদর্শের ট্রাক্টর কুদলে দিয়েছে আমাকে। আতঙ্ক ছাড়া আমার জীবনে কিছুই তো ছিল না। পেপারওয়েট চাপা এক খণ্ড কাগজের মতো আমার জীবন।
জুতোটা খুলে দরজার পাশে রাখো। সাবধানে ঘরে এসো, আমাদের চৌকাঠ আবার উঁচু উঁচু। বিষ্টুদার কত দিকে নজর। ঘর নয় তো, দেবালয়। খাটের ওপর টানটান করে পাতা নকশি চাদর। দুধসাদা কয়েকটা বালিশ। সমস্ত জিনিসপত্র নিখুঁত করে গোছানো। পেতলের জিনিস সব ঝকঝক করছে। রাধাকৃষ্ণ, ফুলদানি, মা লক্ষ্মী, গণেশ। দেয়ালে একটি মাত্র ক্যালেন্ডার, মা। দুর্গার। কোথাও কোনও প্রাচুর্য নেই, অথচ কী সুন্দর! একপাশে একটা টিনের চেয়ার। চেয়ারে একটা হাতের কাজ করা পুরু আসন। সেই চেয়ারে আমি বসলুম। বিষ্টুদার স্ত্রীর মাথায় ছোট্ট করে ঘোমটা ভোলা। তার তলায় এলিয়ে আছে ভিজে চুলের ঢল। কালো কুচকুচে। কী সুন্দর চুল! টিপ মায়ের মতোই চুল পেয়েছে।
বিষ্টুদা স্ত্রীকে বললেন, পিন্টুর সামনে তোমাকে আর ঘোমটা দিতে হবে না, খুলে ফেলল।
বউদি আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হেসে পাশের ঘরে চলে গেলেন। সেই হাসির রেশ অনেকক্ষণ আমার মনে লেগে রইল। অপূর্ব সুন্দর সাজানো দাঁত! বিষ্টুদা আমাকে বললেন, যাও, টিপের সঙ্গে গিয়ে হাত ধুয়ে এসো, আমরা এইবার খেতে বসি, অনেক বেলা হয়ে গেছে।
দাওয়ার একেবারে পুব মাথায় একটা জলের বালতি আর ঘটি। সামনেই একটা শিউলি গাছ। তলায় সবুজ ঘাসের উপর একরাশ ফুল বিছিয়ে রেখেছে। যেন ভোরবেলা পুজোয় বসেছিল। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে টিপ বললে, সকালে এক চুবড়ি তুলেছি। তাও কত! গাছটায় ফুল হয় বটে।
দাওয়া থেকে হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে দিলুম। টিপ আমার হাতে ধীরে ধীরে জল ঢালছে।
জমিতে সরু একটা নালি কাটা রয়েছে, সেই নালি বেয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে। মাথার ওপর সূর্য। টিপ যে কত ফরসা, সেই বুঝলুম। হাতদুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। ফ্লোরেসেন্ট। ছোট্ট একটা পাথর বসানো আংটি আঙুলে। সরু সোনার বালা। কারও কারও গায়ে সোনা ভীষণ উজ্জ্বল হয়। অঙ্গের গুণে। টিপ একেবারে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে গা লেগে যাচ্ছে। নীল একটা শাড়ি পরেছে। সাদা জামা। ব্লাউজের হাতা ওপর বাহুতে একেবারে কাপ হয়ে বসে আছে। লাল একটা তাগার অল্প একটু বাড়তি অংশ লিটলিট করে দুলছে। কিছুক্ষণের মতো আমি আমার জীবনসমস্যার বাইরে চলে গেলুম। সেই হিট গানের লাইন মনে ঘুরছে, সোনার হাতে সোনার কাঁকন।
পরিষ্কার পাট করা একটা গামছা টিপ আমাকে এগিয়ে দিল। একেবারে মুখোমুখি দুজনে। বাদাম-চেরা চোখ, বড় বড় পাতা ঘেরা। যেন নারকেল কুঞ্জের মধ্যে টলটলে নীল দিঘি। হাত মুছে গামছাটা ফিরিয়ে দিতে দিতে আমি একটু মুচকি হাসলুম। মুখে কোনও কথা সরছে না। বিস্ময়কর কিছু দেখলে মানুষের এমনই বাক্যহারা অবস্থা হয় বোধহয়।
টিপ বললে, চান করে উঠে চুল আঁচড়াতে ভুলে গেছেন। দাঁড়ান, চিরুনি আর আয়নাটা নিয়ে আসি।
চুল আঁচড়াইনি বুঝি? তাড়াতাড়ি এসেছি তো!
না আঁচড়েও বেশ ভাল দেখাচ্ছে।
টিপ একটা মেয়েদের চিরুনি, খুবই পরিষ্কার, তবুও দুই আঙুল চালিয়ে, ফুঁ দিয়ে, চোখের সামনে তুলে পরীক্ষা করে আমার হাতে দিল। চুল আঁচড়াতে গিয়ে বুঝলুম, মাথাটা মুছতেই ভুলে গেছি। চিরুনি চালানো মাত্রই টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ল।
টিপ বললে, একী মাথাটাই তো মোছা হয়নি! জল টসটস করছে। এইবার নির্ঘাত একটা অসুখে পড়বেন। গামছাটা এগিয়ে দিতে দিতে বললে, আগে মুছুন শুকনো করে।
আমার পেছন দিকটা ভিজে গেল চুলের জলে। একটু লজ্জা লজ্জা করছিল নিজের নোংরামির জন্য। টিপ কী ভাবছে! ভাবছে, ছেলেটা একটা জড়ভরত। চুল আঁচড়াবার পর টিপ বললে, দেখুন। তো, কী সুন্দর দেখাচ্ছে এইবার! টিপ পেছনে এসে জামার ওপর গামছা চেপে চেপে জল শুকোবার চেষ্টা করল। দু-একটা চুল লেগেছিল, দুআঙুলে তুলে দিল।
বিষ্টুদা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক পাল্লায় পড়েছ এইবার।
টিপ বললে, তোমার এই ছেলে এবার একটা শক্ত অসুখ বাধাবে। মাথা ডবডবে ভিজে। মুছতেই ভুলে গেছেন।
আমরা পাশাপাশি খেতে বসলুম দু’জনে। খুবই পরিচ্ছন্ন আয়োজন। টিপ আর বউদি পরিবেশন করছেন। মুখে ভাত তুলতে গিয়ে হাত থেমে গেল। মনে হল, আমি তো বেশ পরিপাটি আহারে বসলুম, আমার বাবা এখন এই মুহূর্তে কোথায়? তার কি কিছু জুটবে! বারেবারে চা খেতে ভালবাসতেন। খাওয়ার তরিবাদিও বেশ ছিল। যেখানে সেখানে, হোটেলে রেস্তোরাঁয় খেতে পারেন না। আজ মনে হয় উপবাস!
বিষ্টুদা আমাকে লক্ষ করছিলেন। বললেন, বুঝতে পেরেছি, তোমার মনে কী হচ্ছে! তবু খেতে হবে। শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে। অসুস্থ দুর্বল হয়ে পড়লে তো চলবে না। নাও খেয়ে নাও। মনটাকে শক্ত করো। এখন তোমার ওপর অনেক দায়িত্ব।
কেবল মনে পড়ে যাচ্ছে বিষ্টুদা। চোখের সামনে তাঁর মুখটা ভাসছে।
দেখো পিন্টু, দুঃখ হল মনের ব্যাপার, আর খাওয়া হল দেহের ব্যাপার। তুমি তো নিজেই দেখেছ প্রিয়জনকে শ্মশানে দাহ করে এসে মানুষ কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়ার চিন্তা করে। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী কি উপোস করে মারা যায়? না, স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী? মন কীরকম জানো, সমুদ্রের বেলাভূমির মতো। কোনও ছাপই চিরস্থায়ী নয়, কালের ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায়। নিজেকে শক্ত করো। একটা। ব্যাপার কী হয়েছে জানো, তোমাকে তোমার বাবা খুব আগলে আগলে মানুষ করেছেন। আসল পৃথিবীটা বুঝতে দেননি। এ বড় কঠিন ঠাঁই। লড়াইয়ের জায়গা। আমাকে দেখো। তোমাকে আগেই বলেছি, মামার বাড়িতে মানুষ। বিরাট পরিবার। জমিদারিই বলতে পারো। মামা আমাকে বলতেন, লেঠেল। যত কঠিন কাজ সব আমার ওপর। বাজার সরকার, ম্যানেজার, ঝাড়ুদার, কনট্রাক্টর। লেখাপড়ার দফারফা। শেষে মামার সঙ্গে শুরু হল আদর্শের লড়াই। বনিবনা হল না। নিত্য খিটিমিটি। একদিন দূর করে দিলেন। একটু হাতেপায়ে ধরলে আখের ফিরে যেত। চাই কী, একটা বাড়ির মালিক হওয়াও অসম্ভব ছিল না। আমি রফা করিনি। আমি আমার পথ ধরে চলেছি। জীবিকার জন্যে কী না করেছি! সিনেমা হলের গেটকিপার, ট্রেনে সঁতের মাজনের ফেরিঅলা, জমির দালাল, সবশেষে চা-অলা। গোলাগুলি অনেক চলেছে, দুর্গ কিন্তু ভেঙে পড়েনি। ভগবান যেমন সব কেড়ে নিয়েছেন আবার দিয়েছেনও। সবচেয়ে বড় দান ইতুর মতো বউ। ইতু না এলে, হয় আমি পাগল হয়ে যেতুম, নয় টিবিফিবি হয়ে পথের ধারে মরে পড়ে থাকতুম, কি আত্মহত্যা করতে হত। বিশ্বাস করো, আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী লোক অথচ আমার কিছুই নেই। দিন আনি দিন খাই। সুখে ঘুমোই। তুমি যদি সহজে কাবু হয়ে যাও, পৃথিবী তোমাকে আরও চেপে ধরবে।
টিপ আমার সামনে বসে আছে। ভারী করুণ মুখে বললে, লক্ষ্মীটি খেয়ে নিন, তা না হলে আমরা খেতে পারব না। মা উপোস করে আছে।
বেশ বুঝতে পারছি টিপ আমাকে দখল করে ফেলেছে। ইতুর মেয়ে টিপ। মায়ের মতোই তো হবে! গানটা মনে পড়ছে, যার কেহ নাই তুমি আছ তার। সেই তুমি দুঃসময়ে এইভাবেই পাশে এসে দাঁড়ায়। দেবতা তো মানুষের রূপ ধরেই আসেন।
রান্না এত অপূর্ব হয়েছে যে সব বাধা ভেসে চলে গেল। সামান্য মুগের ডাল তারই কী স্বাদ! কুচো কুচো নারকোল। লাল নটে শাক, কাবাব ফেলে খাওয়ার মতো। কতকাল আমি এত অপূর্ব রান্না খাইনি! নারকোলকোরা দিয়ে মোটার ঘণ্ট। মুচমুচে বেগুনি। বউদি কেমন করে জানলেন, আমি এইসবই ভালবাসি। বিষ্টুদার সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনি মনে একটা বল এনে দিয়েছে। খাওয়া শেষ হল। বেশ ভালই হল।
বিষ্টুদা ঘরে এসে বললেন, নাও, আধ ঘন্টাটাক একেবারে ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে থাকো। সব হজম হয়ে যাবে।
আমাদের পরামর্শ কখন হবে?
শুয়ে শুয়ে হবে। ধূমপানের অভ্যাস আছে?
না।
আমারও নেই। তুমি দেখছি একালের ছেলেদের কোনও গুণই পাওনি।
শুয়ে শুয়ে দেখছি, দেয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। সবচেয়ে বড় ছবি শরৎচন্দ্রের। বিষ্টুদা। শরৎচন্দ্রকে দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। অভিনেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি। জহর গাঙ্গুলী, অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, শিশির ভাদুড়ী। আরও অনেকে। আমি তাঁদের চিনি না। সাহিত্য আর নাটকে বিষ্টুদা মশগুল। ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক নাটকের সংলাপ গলগল করে বলে যেতে পারেন। ঝকঝকে আলমারিতে পরিপাটি করে সাজানো বই। বিষ্টুদার নিজের চেহারাও নায়কের মতো। যখন দোকানে তখন একরকম সাজপোশাক। কথা বলার ধরনধারণ। পাক্কা চা-অলা। হাঁটুর ওপর তোলা মালকেঁচা মারা ধুতি। একটা গেঞ্জি। শীতকালে ওরই ওপর একটা পুলওভার। ভোরবেলা আর রাতের দিকে মাথায় একটা মাফলারের পাগড়ি। হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল মানুষটিকে তখন সন্ন্যাসীর মতো দেখায়।
টিপ দু’গেলাস জল এনে টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে রেখে গেল। যাবার সময় জিজ্ঞেস করলে, আপনি পান খাবেন?
না ভাই, পান আমি খাই না।
বিষ্টুদা বললেন, একটু মশলা দিয়ে যা।
টিপ পরক্ষণেই মশলা নিয়ে এল। আমি হাত পাতলুম। টিপের ফরসা হাত আমার ডান তালুতে কাত হল, মৌরি, বড় এলাচ, সুপুরির ছোট ছোট টুকরো। মেয়েটার আঙুলগুলো কী লম্বা লম্বা! শিল্পী হাত। আমার আঙুলও লম্বা লম্বা, কিন্তু শিম্পাঞ্জির মতো। নিজের হাত দেখে নিজেই ঘাবড়ে যাই। শয়তানের হাত মনে হয় এইরকম ছিল। ছিল বলছি কেন? শয়তান তো এখনও আছে। তা না হলে, আমার কেন ইচ্ছে করছে টিপকে ভালবাসি? ভীষণ ভালবাসা। একমাত্র টিপই আমার এই পথে বসা জীবনকে ঘরে তুলতে পারে। টিপের পাশে মুকু লাগে না। লেখাপড়ায় সাংঘাতিক হলেও, একটু পুরুষালি ভাব। টিপ হল কবিতা, মুকু হল গদ্য। টিপ পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে, আমার চোখ যেন আটকে গেছে। আমার মতো মানুষকে কারও অন্দরমহলে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। আমার মন বড় বেসামাল।
বিষ্টুদা বললেন, তোমার এখন প্রথম কাজ হবে সোনাদানা যা আছে সব ব্যাঙ্কে জমা করে দেওয়া। কোন ব্যাঙ্কে তোমাদের অ্যাকাউন্ট?
স্টেট ব্যাঙ্ক।
আজ তুমি একটা লিস্ট তৈরি করো, সাবধানে। কাল আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে জমা করে আসব। তা হলে বিরাট এক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
আমার বাবাকে খুঁজে বের করার কী হবে বিষ্টুদা?
দেখো, থানার সাহায্য নেওয়া যায়। মিসিং পার্সনস স্কোয়াডে একটা ছবি দিয়ে ডায়েরি করালে ওরা অনুসন্ধান করবে। কাগজেও একটা বিজ্ঞাপন দিতে পারি আমরা। সেটা কিন্তু কেমন একটা বিদঘুঁটে ব্যাপার হবে। লোক জানাজানি। আমাদের পক্ষেও অপমানের, তার পক্ষেও অপমানের। পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে। অনুসন্ধানটা আমাদেরই করতে হবে তলে তলে।
আমরা কী করে করব?
কোথায় কোথায় যাওয়া সম্ভব ভেবে দেখো। কোনও আত্মীয়ের বাড়ি? কোনও আশ্রম?
আমাদের তো তেমন কোনও আত্মীয় নেই। এক মামা।
সেখানে যেতে পারেন?
অসম্ভব। এই কারণেই অসম্ভব, কারও বাড়ি গিয়ে একটা রাতও কখনও কাটাননি। অস্বস্তি বোধ করেন। বহুবার আমরা বেড়াতে গেছি। যেখানে গেছি ইচ্ছে করলে পরিচিত বন্ধুর বাড়িতে ওঠা যেত। ওঠেননি। সোজা চলে গেছি হোটেলে। বলতেন, এক এক সংসারের এক এক সুর। সেই সুরে সুর মেলানো কষ্টকর। অনেকে পারে আমি পারি না।
তা হলে কোথায় যেতে পারেন?
একবার ভাবছি হরিদ্বার থেকে আমার দাদুর কাছে এক সন্ন্যাসী আসতেন। দাদুর সমাধির রাতে তিনি হঠাৎ এসে হাজির। যেন আগেই জানতেন। সেই সন্ন্যাসীকে বাবার খুব মনে ধরেছিল। সাধারণত সাধু-সন্ন্যাসী তেমন পছন্দ করতেন না। এক ধরনের নাস্তিক ছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর আশ্রমে যেতে পারেন। যাওয়াটা অসম্ভব নয়।
সেই মহাপুরুষের নাম-ঠিকানা তুমি জানো?
না।
তোমার বাবা জানতেন?
সন্দেহ আছে। তিনি জানলে, আমিও জানতুম।
তা হলে সেখানে তিনি যাবেন কী করে? ঠিকানা না হয় না জানলেন, নামটা তো জানা দরকার।
তা ঠিক। তা হলে কোথায় যেতে পারেন?
এমনও হতে পারে সোজা কোনও হোটেলে গিয়ে উঠেছেন। কলকাতারই কোনও হোটেলে। সেখানে দিনকতক থেকে তোমাকে একটু শিক্ষা দিতে চাইছেন। সেটা রাগেও হতে পারে, আবার–ও হতে পারে। তোমাকে একটু হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছেন। ছোট ছেলেকে মা যেমন হাঁটতে শেখান। সত্যিই তো তুমি তার হাতধরা ছিলে। বুক দিয়ে আগলে আগলে রেখেছিলেন।
সঙ্গে তো কিছুই নিয়ে যাননি!
টাকা?
সেইটা আমি বলতে পারব না।
শোনো, তিনি প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, হিসেবি মানুষ, জেনেশুনে নিজেকে বিপদে ফেলবেন না। পথ চলতে কড়ি, একথা তিনি জানেন। সঙ্গে টাকা থাকলে আর কিছু নেওয়ার দরকার হয় না। মনে করে দেখো, আগের দিন তিনি ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন কি না!
মনে হয় গিয়েছিলেন।
বাড়ি গিয়ে চেক বইটা পাও কি না দেখো। কাউন্টার ফয়েলটা দেখো। কত টাকা কোন তারিখে তুলেছেন। ব্যস, প্রবলেম সলভড। উইদাউট টিকিটে ট্রাভেল করে জেলখানায় যাবার মানুষ তিনি নন। লোকের কাছে হাতপাতার মানুষও তিনি নন। আমার মনে হয় খুব একটা উতলা না হয়ে কয়েকদিন চুপচাপ দেখলে হয়। ফিরেও তো আসতে পারেন। কোনও বাবা তার ছেলেকে এত ভালবাসতেন না, তিনি যেমন তোমাকে বাসতেন। তোমার যেমন কষ্ট হচ্ছে, ছটফট করছ, তারও তো সেই একই অবস্থা।
তা হলে ব্যাঙ্কে যাবার প্রয়োজন নেই?
খুব আছে। অত সোনাদানা বাড়িতে কেউ ফেলে রাখে! তোমাদের ওই বিশাল বাড়ি আর তুমি একজন মাত্র প্রাণী।
আর আমার চাকরির কী হবে?
চাকরি করবে। চাকরি না করার প্রশ্ন আসছে কেন?
আমাকে যে দেরাদুনে বদলি করে দিয়েছে।
তা হলে অবশ্য খুবই মুশকিল। তোমার তো এখন বাইরে যাওয়া কোনওমতেই চলবে না। তুমি কর্তৃপক্ষকে বলো। তারা নিশ্চয়ই অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবেন।
আমার প্রোমোশনটা যে তা হলে হবে না। বাইরে পাঠাচ্ছিল বিরাট একটা প্রোমোশন দিয়ে।
ওই লোভটা তোমাকে ছাড়তে হবে ভাই।
আর একটা বাজে ব্যাপার আছে বিদা, ওই বাড়িতে রাত্তিরবেলা আমি একা থাকতে পারব না। ভূত আছে।
ভূতের ভয় অবশ্য আমারও আছে। তুমি এক কাজ করো, তুমি আমাদের বাড়িতে থাকো।
আমার লজ্জা করে।
লজ্জা? কীসের লজ্জা?
আমি কারও সামনে জামাকাপড় খুলতে পারি না।
এখানে কে তোমাকে উলঙ্গ হয়ে থাকতে বলেছে! পাজামা আর গেঞ্জি পরে শোবে।
আমি যে কারও বাড়ির বাথরুমে যেতে পারি না বিষ্টুদা।
আমাদের বাড়ির বাথরুম খুব ভাল জায়গায়। কারওকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন নেই। আলো জ্বালবে, ঢুকে পড়বে। আজ রাত থেকেই তুমি এখানে থাকবে, কিন্তু দামি গয়নাপত্তর যা আছে সব আজই নিয়ে আসবে এখানে। রাতটা আমাদের আলমারিতে থাকবে।
একা আমি গোছগাছ করতে পারব না বিষ্টুদা। আপনিও চলুন না!
এসব ব্যাপার আমার চেয়ে ইতু আর টিপ ভাল পারে। ওরা তোমার সঙ্গে যাবে, তোমাকে সাহায্য করবে। যেভাবে বলবে, সেইভাবে। এখন তুমি একটু বিশ্রাম করো।
কুঁকড়েমুকড়ে খাটের এক ধারে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলুম। বড় শান্ত সংসার। ইতু বউদির গলা তো শোনাই যায় না, টিপও সেইরকম। শালিকের কিচিরমিচির কানে আসছে। ঘুঘু ডাকছে উদাস সুরে। বিষ্টুদা আমার পাশেই শুয়ে আছেন চিত হয়ে, বুকের ওপর হাতদুটো জড়ো করে। বিষ্টুদার মনে হয় দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যাস। শ্বাসপ্রশ্বাস দীর্ঘ হয়েছে। আমি ডাকলুম, বিষ্টুদা।
বলো।
কলকাতার সমস্ত হোটেলে একবার খোঁজ করলে হয় না?
হয়; কিন্তু তিনি যদি অন্য নাম নিয়ে থাকেন? আর সেটাই সম্ভব।
কাল সারাটা দিন তা হলে হোটেলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি।
দেখতে পারো, তবে ব্যর্থ হবে। এখন মনে হচ্ছে অমন একজন মানুষ হোটেলে থাকবেন না। তিনি বাইরেই গেছেন কোথাও।
মানে হিমালয়ের দিকে?
আচ্ছা, তোমার বাবা তো বড় সরকারি চাকরি করতেন?
হ্যাঁ, এই কয়েকমাস হল রিটায়ার করেছেন।
আইডিয়া। যেখানেই থাকুন, পেনশন নেবার জন্যে মাসে একবার তাকে কলকাতায় আসতেই হবে। ওঁর পেনশনের তারিখটা তুমি যেভাবেই হোক বের করো। আমরা তক্কে তক্কে থাকব, ঠিক ধরে ফেলব। একবার ধরতে পারলে কোনও কথা নয়, সোজা তার পায়ের ওপর, যদি কোনও অপরাধ করে থাকি ক্ষমা করুন।
আমি তো কোনও অপরাধ করিনি।
শোনো, তোমার মনে হচ্ছে করোনি, কিন্তু করেছ। একটা কিছু হয়েছে। ভীষণ একটা আঘাত পেয়েছেন মনে। সেই অভিমান তাকে ঘর-ছাড়া করেছে।