কুমারের ক্রীড়ায় কালক্ষেপ না হয় এই নিমিত্ত রাজা নগরের প্রান্তে শিপ্রানদীর তীরে এক বিদ্যামন্দির প্রস্তুত করাইলেন। বিদ্যামন্দিরের এক পার্শ্বে অশ্বশালা ও নিম্নে ব্যায়ামশালা প্রস্তুত হইল; চতুর্দ্দিক্ উন্নত প্রাচীর দ্বারা পরিবৃত হইল। অশেষবিদ্যাপারদর্শী মহামহোপাধ্যায় অধ্যাপকগণ অতিযত্নে আনীত ও শিক্ষাপ্রদানে নিয়োজিত হইলেন। নরপতি শুভ দিনে স্বপুত্ত্র চন্দ্রাপীড় ও মন্ত্রিপুত্ত্র বৈশম্পায়নকে তাঁহাদিগের নিকটে সমর্পণ করিলেন। প্রতিদিন মহিষীর সহিত স্বয়ং বিদ্যামন্দিরে উপস্থিত হইয়া তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। রাজকুমার এরূপ বুদ্ধিমান্ ও চতুর ছিলেন যে, অধ্যাপকগণ তাঁহার নব নব বুদ্ধি-কৌশল দর্শনে চমৎকৃত ও উৎসাহিত হইয়া সমধিক পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক শিক্ষা দিতে লাগিলেন। তিনিও অনন্যমনা ও ক্রীড়াসক্তিরহিত হইয়া ক্রমে ক্রমে সমস্ত বিদ্যা অধ্যয়ন করিলেন। তাঁহার হৃদয়দর্পণে সমুদায় কলা সংক্রান্ত হইল। অল্পকালের মধ্যেই শব্দশাস্ত্র, বিজ্ঞানশাস্ত্র, রাজনীতি, ব্যায়ামকৌশল, অস্ত্র ও সঙ্গীত বিদ্যা, সর্ব্বদেশভাষা এবং কাব্য, নাটক, ইতিহাস প্রভৃতি সমুদায় শিখিলেন। ব্যায়ামপ্রভাবে শরীর এরূপ বলিষ্ঠ হইল যে, করভ সকল সিংহ দ্বারা আক্রান্ত হইলে যেরূপ নড়িতে পারে না, সেইরূপ তিনি ধরিলেও এক পা চলিতে পারিত না। ফলতঃ এরূপ পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী হইলেন যে, দশজন বলবান্ পুরুষ যে মুদ্গর তুলিতে পারেন না, তিনি অবলীলাক্রমে সেই মুদ্গর ধারণ পূর্ব্বক ব্যায়াম করিতেন।
ব্যায়াম ব্যতিরেকে আর সকল বিদ্যায় বৈশম্পায়ন চন্দ্রাপীড়ের অনুরূপ হইলেন। শৈশবাবধি একত্র বিদ্যাভ্যাস প্রযুক্ত পরস্পরের অকৃত্রিম প্রণয় ও অকপট মিত্রতা জন্মিল। বৈশম্পায়ন ব্যতিরেকে রাজকুমার একমুহূর্ত্তও একাকী থাকিতে পারিতেন না। বৈশম্পায়ন সর্ব্বদা রাজকুমারের নিকটবর্ত্তী থাকিতেন। এই রূপে বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস করিতে করিতে শৈশবকাল অতীত ও যৌবনকাল সমাগত হইল। চন্দ্রোদয়ে প্রদোষের যেরূপ রমণীয়তা হয়, গগনমণ্ডলে ইন্দ্রধনু উদিত হইলে বর্ষাকালের যেরূপ শোভা হয়, কুসুমোদ্গমে কল্পপাদপের যেরূপ শ্রী হয়, যৌবনারম্ভে রাজকুমার সেইরূপ পরমরমণীয়তা ধারণ করিলেন। বক্ষঃস্থল বিশাল, ঊরুযুগল মাংসল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, ভুজদ্বয় দীর্ঘ, স্কন্ধদেশ স্থূল এবং স্বর গম্ভীর হইল।
উত্তম রূপে বিদ্যাশিক্ষা হইলে আচার্য্যেরা বিদ্যালয় হইতে গৃহে যাইবার অনুমতি দিলেন। তদনুসারে রাজা চন্দ্রাপীড়কে বাটীতে আনাইবার নিমিত্ত শুভ দিনে অনেক তুরঙ্গ, মাতঙ্গ, পদাতি সৈন্য, সমভিব্যাহারে দিয়া সেনাধ্যক্ষ বলাহককে বিদ্যামন্দিরে পাঠাইয়া দিলেন। সমাগত অন্যান্য রাজগণও চন্দ্রাপীড়ের দর্শনলালসায় বিদ্যালয়ে গমন করিলেন। বলাহক বিদ্যামন্দিরে প্রবেশিয়া রাজকুমারকে প্রণাম করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, কুমার! মহারাজ কহিলেন, “আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইয়াছে। তুমি সমস্ত শাস্ত্র, সকল কলা ও সমুদায় আয়ুধবিদ্যা অভ্যাস করিয়াছ। এক্ষণে আচার্য্যেরা বাটী আসিতে অনুমতি দিয়াছেন। প্রজারা ও পরিজনেরা দেখিতে অতিশয় উৎসুক হইয়াছে। অতএব আমার অভিলাষ, তুমি অবিলম্বে বাটী আসিয়া দর্শনোৎসুক পরিজনদিগকে দর্শন দিয়া পরিতৃপ্ত কর এবং ব্রাহ্মণদিগের সমাদর, মানিলোকের মানরক্ষা, সন্তানের ন্যায় প্রজাদিগের প্রতিপালন ও বন্ধুবর্গের আনন্দোৎপাদন পূর্ব্বক পরম সুখে রাজ্য সম্ভোগ কর।” আপনার আরোহণের নিমিত্ত মহরাজ ত্রিভুবনের এক অমূল্য রত্নস্বরূপ, বায়ু ও গরুড়ের ন্যায় অতিবেগগামী, ইন্দ্রায়ুধনামা অপূর্ব্ব ঘোটক প্রেরণ করিয়াছেন। ঐ ঘোটক সাগরের প্রবাহমধ্য হইতে উত্থিত হয়, পারস্যদেশের অধিপতি মহারত্ন ও আশ্চর্য্য পদার্থ বলিয়া উহা মহারাজকে উপহার দেন। অনেক অশ্বলক্ষণবিৎ পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, উচ্চৈঃশ্রবার যে সকল সুলক্ষণ শুনিতে পাওয়া যায়, উহারও সেই সকল সুলক্ষণ আছে। ফলতঃ ইন্দ্রায়ুধ সামান্য ঘোটক নয়। আমরা ঐরূপ ঘোটক কখন দেখি নাই। দ্বারদেশে বদ্ধ আছে, অনুমতি হইলে আনয়ন করা যায়। দর্শনাভিলাষী রাজারাও সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া বাহিরে আপনার প্রতীক্ষা করিতেছেন।
বলাহক এই কথা কহিলে চন্দ্রাপীড় গম্ভীর স্বরে আদেশ করিলেন, ইন্দ্রায়ুধকে এই স্থানে লইয়া আইস। আজ্ঞামাত্র, অতি বৃহৎ, স্থূলকায়, মহাতেজস্বী, প্রচণ্ডবেগশালী, বলবান্ ইন্দ্রায়ুধ আনীত হইল। ঐ ঘোটক এরূপ বলিষ্ঠ ও তেজস্বী যে দুই বীর পুরুষ উভয় পার্শ্বে মুখের বল্গা ধরিয়াও উন্নমনের সময় মুখ নিম্ন করিয়া রাখিতে পারেন না, এরূপ উচ্চ যে, উন্নত পুরুষেরাও কর প্রসারিত করিয়া পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করিতে পারে না। চন্দ্রাপীড় সুলক্ষণসম্পন্ন অদ্ভুত অশ্ব অবলোকন করিয়া অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মনে মনে চিন্তা করিলেন, অসুর ও দেবগণ সাগর মন্থন করিয়া কি রত্ন লাভ করিয়াছেন? দেবরাজ ইন্দ্র ইহার পৃষ্ঠে আরোহণ করেন নাই তাঁহার ত্রৈলোক্যাধিপত্যই বিফল। জলনিধি তাঁহাকে সামান্য উচ্চৈঃশ্রবা ঘোটক প্রদান করিয়া প্রতারণা করিয়াছেন। দেবাদিদেব নারায়ণ যদি ইহাকে একবার নেত্রগোচর করেন, বোধ হয় পক্ষিরাজ গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণ জন্য তাঁহার আর অহঙ্কার থাকে না। পিতার কি আধিপত্য! ত্রিভুবনদুর্লভ এতাদৃশ রত্ন সকলও তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন। ইহার আকার ও লক্ষণ দেখিয়া বোধ হইতেছে, এ প্রকৃত ঘোটক নয়। কোন মহাত্মা শাপগ্রস্ত হইয়া অশ্বরূপে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবেন।
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। অশ্বের নিকট উপস্থিত হইয়া মনে মনে নমস্কার ও আরোহণজন্য অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা পূর্ব্বক পৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন ও বিদ্যালয় হইতে বহির্গত হইলেন। বহিঃস্থিত অশ্বারূঢ় নৃপতিগণ চন্দ্রাপীড়কে দেখিবামাত্র আপনাদিগকে কৃতার্থ বোধ করিলেন এবং সাক্ষাৎকারলালসায় ক্রমে ক্রমে সকলেই সম্মুখে আসিতে লাগিলেন। বলাহক একে একে সকলের নাম ও বংশের নির্দ্দেশ পূর্ব্বক পরিচয় দিয়া দিল। রাজকুমার মিষ্ট সম্ভাষণ দ্বারা যথোচিত সমাদর করিলেন। তাঁহাদিগের সহিত নানাপ্রকার সদালাপ করিতে করিতে সুখে নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। বন্দিগণ উচ্চৈঃস্বরে সুললিত মধুর প্রবন্ধে স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। ভৃত্যেরা চামর ব্যজন ও মস্তকে ছত্রধারণ করিল। বৈশম্পায়নও অন্য এক তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
চন্দ্রাপীড় ক্রমে ক্রমে নগরের মধ্যবর্ত্তী পথে সমাগত হইলেন। নগরবাসীরা সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক রাজকুমারের সুকুমার আকার অবলোকন করিতে লাগিল। নগরস্থ সমস্ত বাটীর দ্বার উদ্ঘাটিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, নগরী, চন্দ্রাপীড়কে দেখিবার নিমিত্ত একেবারে সহস্র সহস্র নেত্র উন্মীলন করিল। চন্দ্রাপীড় নগরে আসিতেছেন শুনিয়া রমণীগণ অতিশয় উৎসুক হইল এবং আপন আপন আরদ্ধ কর্ম্ম সমাপন না করিয়াই কেহ বা অলক্তক পরিতে পরিতে, কেহ বা কেশ বাঁধিতে বাঁধিতে বাটীর বহির্গত হইয়া, কেহ বা প্রাসাদোপরি আরোহণ করিয়া এক দৃষ্টিতে পথ পানে চাহিয়া রহিল। একবারে সোপানপরম্পরায় শত শত কামিনীজনের অসম্ভ্রমে পাদনিঃক্ষেপ করায় প্রাসাদমধ্যে একপ্রকার অভূতপূর্ব্ব ও অশ্রুতপূর্ব্ব ভূষণশব্দ সমুৎপন্ন হইল। গবাক্ষজালের নিকটে কামিনীগণের মুখপরম্পরা বিকসিত কমলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। স্ত্রীগণের চরণ হইতে আর্দ্র অলক্তক পতিত হওয়াতে ক্ষিতিতল পল্লবময় বোধ হইল। তাহাদিগের অঙ্গশোভায় নগর লাবণ্যময়, অলঙ্কারপ্রভায় দিগ্বলয় ইন্দ্রায়ুধময়, মুখমণ্ডলে ও লোচনপরম্পরায় গগনমণ্ডল চন্দ্রময়, পথ নীলোৎপলময় বোধ হইতে লাগিল। রাজকুমারের মোহিনী মূর্ত্তি দেখিয়া বিলাসিনীগণ চমৎকৃত ও মোহিত হইয়া পরস্পর পরিহাস পূর্ব্বক কহিতে লাগিল সখি! এই পৃথিবীতে সেই ধন্য ও সৌভাগ্যবতী, এই পুরুষরত্ন যাহার কর গ্রহণ করিবেন। আহা! এরূপ পরমসুন্দর পুরুষ ত কখন দেখি নাই। বিধি বুঝি পুরুষনিধি করিয়া ইঁহার সৃষ্টি করিয়া থাকিবেন। যাহা হউক, আজি আমরা অঙ্গবিশিষ্ট অনঙ্গকে প্রত্যক্ষ করিলাম। ফলতঃ নির্ম্মল জলে ও স্বচ্ছ স্ফটিকে যেরূপ প্রতিবিম্ব পতিত হয়, সেইরূপ কামিনীগণের হৃদয়দর্পণে চন্দ্রাপীড়ের মোহিনী মূর্ত্তি প্রতিবিম্বিত হইল। রাজকুমার ক্ষণকাল পরে তাহাদিগের দৃষ্টির অগোচর হইলেন, হৃদয়ের অগোচর কোন কালেই হইতে পারিলেন না। রাজকুমার রাজবাটীর সমীপবর্ত্তী হইলে পৌরাঙ্গণারা পুষ্পবৃষ্টির ন্যায় তাঁহার মস্তকে মঙ্গললাজাঞ্জলি বর্ষণ করিল।
ক্রমে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া ঘোটক হইতে অবতীর্ণ হইলেন। বলাহক অগ্রে অগ্রে পথ দেখাইয়া চলিল। রাজকুমার বৈশম্পায়নের হস্তধারণপূর্ব্বক রাজভবনে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, শত শত বলবান দ্বারপাল অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া দ্বারে দণ্ডায়মান আছে। দ্বারদেশ অতিক্রম করিয়া দেখিলেন, কোন স্থানে ধনু, বাণ, তরবারি প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র শস্ত্রে পরিপূর্ণ অস্ত্রশালা; কোন স্থানে সিংহ, গণ্ডার, করী, করভ, ব্যাঘ্র ভল্লূক প্রভৃতি ভয়ঙ্করপশুসমাকীর্ণ পশুশালা; কোন স্থানে নানা দেশীয়, সুলক্ষণসম্পন্ন, নানাপ্রকার অশ্বে বেষ্টিত মন্দুরা; কোন স্থানে কুররী, কোকিল, রাজহংস, চাতক, শিখণ্ডী, শুক, শারিকা প্রভৃতি পক্ষিগণের মধুর কোলাহলে পরিপূর্ণ পক্ষিশালা; কোন স্থানে বেণু, বীণা, মুরজ, মৃদঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রে বিভূষিত সঙ্গীতশালা; কোন স্থানে বিচিত্রচিত্রশোভিত চিত্রশালিকা শোভা পাইতেছে। কৃত্রিম ক্রীড়াপর্ব্বত, মনোহর সরোবর, সুরম্য জলযন্ত্র, রমণীয় উপবন স্থানে স্থানে রহিয়াছে। অশেষদেশভাষাজ্ঞ নীতিপরায়ণ ধার্ম্মিক পুরুষেরা ধর্ম্মাধিকরণমন্দিরে উপবেশন পূর্ব্বক ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মানুসারে বিচার করিতেছেন। সমাগত পুরুষেরা বিবিধরত্নাসনভূষিত সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। কোন স্থানে নর্ত্তকীরা নৃত্য, গায়কেরা সঙ্গীত ও বন্দিগণ স্তুতিপাঠ করিতেছে। জলচর পক্ষী সকল কেলি করিয়া বেড়াইতেছে। বালকবালিকাগণ ময়ূর ও ময়ূরীর সহিত ক্রীড়া করিতেছে। হরিণ ও হরিণীগণ মানুষসমাগমে ত্রস্ত হইয়া ভয়চকিতলোচনে বাটীর চতুর্দ্দিকে দৌড়িতেছে।
অনন্তর ছয় প্রকোষ্ঠ অতিক্রম করিয়া সপ্তম প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে প্রবেশিয়া মহারাজের আবাসগৃহের নিকটবর্ত্তী হইলেন। অন্তঃপুরপুরন্ধ্রীরা রাজকুমারকে দেখিবামাত্র আনন্দিত মনে মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। মহারাজ পরিষ্কৃত শয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে নিষণ্ণ আছেন, শরীররক্ষাধিকৃত অস্ত্রধারী দ্বারপালেরা সতর্কতা পূর্ব্বক প্রহরীর কার্য্য করিতেছে; এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় পিতার নিকটে উপস্থিত হইলেন। “মহারাজ! অবলোকন করুন” দ্বারপাল এই কথা কহিলে, রাজা দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক বৈশম্পায়ন সমভিব্যাহারী চন্দ্রাপীড়কে সমাগত দেখিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইলেন। করপ্রসারণ পূর্ব্বক প্রণত পুত্ত্রকে আলিঙ্গন করিলেন। তাঁহার স্নেহবিকসিত লোচন হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। বৈশম্পায়নকেও সমাদরে আলিঙ্গন করিয়া আসনে উপবেশন করিতে কহিলেন। ক্ষণকাল তথায় বসিয়া রাজকুমার জননীর নিকট গমন করিলেন। পুত্ত্রবৎসলা বিলাসবতী স্নিগ্ধ ও প্রীতিপ্রফুল্ল নয়নে পুত্ত্রকে পুনঃ পুনঃ নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ ও হস্ত দ্বারা গাত্রস্পর্শ পূর্ব্বক আপন উৎসঙ্গ দেশে বসাইলেন ও স্নেহসংবলিত মধুর বচনে বলিলেন, বৎস! তোমাকে নানা বিদ্যায় বিভূষিত দেখিয়া নয়ন ও মন পরিতৃপ্ত হইল। এক্ষণে বধূসহচারী দেখিলে সকল মনোরথ পূর্ণ হয়। এই কথা কহিয়া লজ্জাবনত পুত্ত্রের কপোলদেশে চুম্বন করিতে লাগিলেন।
রাজকুমার এই রূপে সমস্ত অন্তঃপুরবাসিনীদিগকে দর্শন দিয়া আহ্লাদিত করিলেন। পরিশেষে শুকনাসের ভবনে উপস্থিত হইলেন। অমাত্যের ভবনও এরূপ সমৃদ্ধিসম্পন্ন যে, রাজবাটী হইতে বিভিন্ন বোধ হয় না। শুকনাস সভামণ্ডপে বসিয়া আছেন। সমাগত সামন্ত ও ভূপতিগণ চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন, এমন সময়ে চন্দ্রাপীড় ও বৈশম্পায়ন তথায় প্রবেশিলেন। সকলে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সমাদরে সম্ভাষণ করিল। শুকনাস প্রণত পুত্ত্র ও রাজকুমারকে যুগপৎ আলিঙ্গন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পরে রাজনন্দনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস চন্দ্রাপীড়! অদ্য তোমাকে কৃতবিদ্য দেখিয়া মহারাজ যেরূপ সন্তুষ্ট হইয়াছেন, শত শত সাম্রাজ্যলাভেও তাদৃশ সন্তোষের সম্ভাবনা নাই। আজি গুরুজনের আশীর্ব্বাদ ও মহারাজের পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত সুকৃতি ফলিল। আজি কুলদেবতা প্রসন্ন হইলেন। প্রজাগণ কি ধন্য ও পুণ্যবান্! যাহাদিগের প্রতিপালনের নিমিত্ত তুমি ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়াছ। বসুমতী কি সৌভাগ্যবতী! যিনি পতিভাবে তোমার আরাধনা করিবেন। ভগবান্ যেরূপ নানা অবতার হইয়া ভূভার বহন করিয়া থাকেন, তুমিও সেইরূপ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া ভূভার বহন ও প্রজাদিগের প্রতিপালন কর। রাজকুমার শুকনাসের সভায় ক্ষণকাল অবস্থিতি করিয়া মনোরমার নিকট গমন ও ভক্তিপূর্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিলেন। তথা হইতে বাটী আসিয়া স্নান ভোজন প্রভৃতি সমুদায় কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া মহারাজের আজ্ঞানুসারে শ্রীমণ্ডপনামক প্রাসাদে গিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। শ্রীমণ্ডপের নিকটে ইন্দ্রায়ুধের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইল।
দিবাবসানে দিঙ্মণ্ডল লোহিত বর্ণ হইল। সন্ধ্যারাগে রক্তবর্ণ হইয়া চক্রবাকমিথুন ভিন্ন ভিন্ন দিকে উৎপতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, বিরহবেদনা স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে তাহাদিগের হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছে ও গাত্র হইতে রক্তধারা পড়িতেছে। সম্মানিত ব্যক্তিরা বিপদ্কালেও নীচ পদবীতে পদার্পণ করেন না, ইহাই জানাইবার নিমিত্ত রবি অস্তগমনকালেও পশ্চিমাচলের উন্নত শিখর আশ্রয় করিলেন। দিনকর অস্তগত হইলেন, কিন্তু রজনী সমাগতা হয় নাই। এই সময়ে তাপের বিগম ও অন্ধকারের অনুদয় প্রযুক্ত লোকের অন্তঃকরণ আনন্দে প্রফুল্ল হইল। সূর্য্যরূপ সিংহ অস্তাচলের গুহাশায়ী হইলে ধ্বান্তরূপ দন্তিযূথ নির্ভয়ে জগৎ আক্রমণ করিল। নলিনী দিনমণির বিরহে অলিরূপ অশ্রুজল পরিত্যাগ পূর্ব্বক কমলরূপ নেত্র নিমীলন করিল। বিহঙ্গমকুল কোলাহল করিয়া উঠিল। অনন্তর প্রজ্বলিত প্রদীপশিখা ও উজ্জ্বল মণির আলোকে রাজবাটীর তিমির নিরস্ত হইয়া গেল। চন্দ্রাপীড় পিতা মাতার নিকটে নানা কথা প্রসঙ্গে ক্ষণকাল ক্ষেপ করিয়া আহারাদি করিলেন। পরে আপন প্রাসাদে আগমন পূর্ব্বক কোমলশয্যামণ্ডিত পর্য্যঙ্কে সুখে নিদ্রা গেলেন।
প্রভাত হইলে পিতার অনুমতি লইয়া শিকারী কুক্কুর, শিক্ষিত হস্তী, বেগগামী অশ্ব ও অসংখ্য অস্ত্রধারী বীরপুরুষ সমভিব্যাহারে করিয়া মৃগয়ার্থ বনে প্রবেশিলেন। দেখিলেন, উদারস্বভাব সিংহ সম্রাটের ন্যায় নির্ভয়ে গিরিগুহায় শয়ন করিয়া আছে। হিংস্র শার্দ্দূল ভয়ঙ্কর আকার স্বীকার পূর্ব্বক পশুদিগকে আক্রমণ করিতেছে। মৃগকুল ত্রস্ত ও শশব্যস্ত হইয়া ত্বরিত বেগে ইতস্ততঃ দৌড়িতেছে। বন্য হস্তী দলবদ্ধ হইয়া চলিতেছে। মহিষকুল রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা ভয় প্রদর্শন করিয়া নির্ভয়ে বেড়াইতেছে। বরাহ, ভল্লূক, গণ্ডার প্রভৃতির ভীষণ আকার দেখিলে ও চীৎকার শব্দ শুনিলে কলেবর কম্পিত হয়। নিবিড় বন, তথায় সূর্য্যের কিরণ প্রায় প্রবেশ করিতে পারে না। রাজকুমার এতাদৃশ ভীষণ গহনে প্রবেশিয়া ভল্ল ও নারাচ দ্বারা ভল্লূক, সারঙ্গ, শূকর প্রভৃতি বহুবিধ বন্য পশু মারিয়া ফেলিলেন। কোন কোন পশুকে আঘাত না করিয়া কেবল কৌশলক্রমে ধরিলেন। মৃগয়াবিষয়ে এরূপ সুশিক্ষিত ছিলেন যে, উড্ডীন বিহগাবলীকেও অবলীলাক্রমে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন।
বেলা দুই প্রহর হইল। সূর্য্যমণ্ডল ঠিক্ মস্তকের উপরিভাগ হইতে অগ্নিময় কিরণ বিস্তার করিল। সূর্য্যের আতপে ও মৃগয়াজন্য শ্রমে একান্ত ক্লান্ত হওয়াতে রাজকুমারের সর্ব্বাঙ্গ ঘর্ম্মবারিতে পরিপ্লুত হইল। স্বেদার্দ্র শরীরে কুসুমরেণু পতিত হওয়াতে ও বিন্দু বিন্দু রক্ত লাগাতে যেন অঙ্গে অঙ্গরাগ ও রক্তচন্দন লেপন করিয়াছেন, বোধ হইল। ইন্দ্রায়ুধের মুখে ফেনপুঞ্জ ও শরীরে স্বেদজল বহির্গত হইল। সেই রৌদ্রে স্বহস্তে নব পল্লবের ছত্র ধরিয়া সমভিব্যাহারী রাজগণের সহিত মৃগয়ার কথা কহিতে কহিতে বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া তুরঙ্গ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তথায় মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ ও ক্ষণকাল বিশ্রামের পর স্নান করিয়া অঙ্গে অঙ্গরাগলেপন ও পট্টবসন পরিধান পূর্ব্বক আহারমণ্ডপে গমন করিলেন। আপনি আহার করিয়া স্বহস্তে ইন্দ্রায়ুধের ভোজনসামগ্রী আনিয়া দিলেন। সে দিন এইরূপে অতিবাহিত হইল।
পর দিন প্রাতঃকালে আপন প্রাসাদে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কৈলাসনামক কঞ্চুকী স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা এক সুন্দরী কুমারীকে সঙ্গে করিয়া তথায় উপস্থিত হইল, বিনীত বচনে কহিল, কুমার দেবী আদেশ করিলেন, এই কন্যাকে আপনার তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী করুন। ইনি কুলুতদেশীয় রাজার দুহিতা, নাম পত্রলেখা। মহারাজ কুলুতরাজধানী জয় করিয়া এই কন্যাকে বন্দী করিয়া আনেন ও অন্তঃপুরপরিচারিকার মধ্যে নিবেশিত করেন। রাণী পরিচয় পাইয়া আপন কন্যার ন্যায় লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছেন এবং অতিশয় ভাল বাসিয়া থাকেন, ইহাকে সামান্য পরিচারিকার ন্যায় জ্ঞান করিবেন না। সখী ও শিষ্যার ন্যায় বিশ্বাস করিবেন। রাজকন্যার সমুচিত সমাদর করিবেন। ইনি অতিশয় সুশীল ও সরলস্বভাব এবং এরূপ গুণবতী যে আপনাকে ইঁহার গুণে অবশ্য বশীভূত হইতে হইবেক। আপাততঃ ইঁহার কুল শীলের বিষয় কিছুই জানেন না বলিয়া কিঞ্চিৎ পরিচয় দিলাম। কঞ্চুকীর মুখে জননীর আজ্ঞা শুনিয়া নিমেষশূন্য লোচনে পত্রলেখাকে দেখিতে লাগিলেন। তাহার আকার দেখিয়াই বুঝিলেন ঐ কন্যা সামান্য কন্যা নহে। অনন্তর জননীর আদেশ গ্রহণ করিলাম বলিয়া কঞ্চুকীকে বিদায় দিলেন। পত্রলেখা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী হইয়া ছায়ার ন্যায় রাজকুমারের অনুবর্ত্তিনী হইল। রাজকুমারও তাহার গুণে প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া দিন দিন নব নব অনুরাগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।