দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রদ্ধেয় বিঠ্ঠল রামানুজ
শ্রীচরণে
Does the road wind up-hill all the way?
Yes, to the very end.
Will the day’s Journey take the whole long day?
From morn to night, my friend.
জগৎ যেমন চলছিল, ঠিক সেইরকমই চলছে। একজন মানুষের যাই হোক না কেন, বহু মানুষের তাতে কিছু যায় আসে না। পৃথিবী বড় উদাসীন। রাজপথ খোলা ফিতের মতো সুদূরে উধাও। ব্যস্ত মানুষ। ব্যস্ত যানবাহন। সবাই যাচ্ছে। কোথাও-না-কোথাও যাচ্ছে। দোকানপাটে গিজগিজ করছে মানুষ। রোদ যেন রুটি সেঁকছে। কাঁচের মতো আকাশ।
আমি হনহন করে অনেকটা হাঁটলুম। কোথায় যাব তা জানি না। পরামর্শ নেবার মতো কেউ নেই। হাঁটছি আর ভাবছি, থানায় যাব নাকি! একটা ডায়েরি করা যায়। তাতে যে ঘরের কথা বেরিয়ে আসবে। লজ্জার কথা। অফিসার প্রশ্ন করবেন, একজন প্রবীণ মানুষ হঠাৎ ভোররাতে বাড়ি ছেড়ে প্রায় একবস্ত্রে চলে গেলেন কেন? কী ঘটেছিল? একজন শিক্ষিত, সর্ব অর্থে সম্পন্ন মানুষ কেন চলে গেলেন? উপেক্ষা আর অত্যাচারের মাত্রা কতটা উঠেছিল? তুমি তো তার ছেলে? কী এমন করেছিলে? নেশাভাং করো? কোনও নারীঘটিত কেলেঙ্কারি? আমি তার কী উত্তর দোব? আমি তো বোঝাতে পারব না, মহাশয়, সে এক অদ্ভুত আত্মিক সংকট! মনের সেই অবস্থা, যখন মনে হয় আমার সব থেকেও কিছু নেই। আমি রিক্ত, শূন্য, শ্রান্ত।
তোমার কথা হেথা কেহ তো
বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া
পান করে শুধু হলাহল ।
এই তুমিকেই তো বোঝানো যাবে না। আমির সংসারে তুমি আবার কে? তারপর চাইবেন ছবি। জানতে চাইবেন, কোথায় যাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
আরও আধ মাইলটাক হাঁটার পর সিদ্ধান্তে এলুম, থানায় যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। থানার পরিবেশে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। সিদ্ধান্তে আসার পর আমার গতি মন্থর হল– তা হলে আমি চলেছি কোথায়! সারাভারত পদব্রজে ঘুরে বেড়ালেই কি আমার পিতা হরিশঙ্কর ফিরে আসবেন? তিনি.হঠকারী নন। আবেগের বশে কোনও কাজ করেন না। ক্ষণে ক্ষণে তার মত, তার সিদ্ধান্ত পালটায় না। ইস্পাত-কঠিন এক মানুষ। সব ছেড়ে, সব ঝুট হ্যায়, বলে চলে গেছেন। আমি থেমে পড়লুম। পথের পাশে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়। এলোমেলো ভাবনা আমাকে উতলাই করছে, কোনও পথ দেখাতে পারছে না। পিতার খাতায় তারই হাতে লেখা সেই লাইন ক’টি ফিরে ফিরে আসছে ‘যে-কর্তব্যের মুখ চেয়ে এতকাল পুতুল খেলছিলে, তোমার সেই উত্তরপুরুষ আজ তৈরি। জীবনের সুপথ, কুপথ, ঘুরপথ সবই চিনতে শিখেছে। স্নেহের শিকল কেটে এবার পাখিটিকে উড়িয়ে দাও। তার স্বাধীন ইচ্ছে তৈরি হয়েছে। আর তাকে প্রদীপের মতো আগলে রেখো না। এবার তাকে সাবালক হতে দাও। হাবুডুবু না খেলে সাঁতার শেখা যায় না। জেনে রাখো এক জঙ্গলে দুটো বাঘ থাকতে পারে না। তুমি তো বৃদ্ধ বাঘ হে!
হাঁটতে হাঁটতে আমি বাস রাস্তায় এসে পড়েছি। এদিকে ওদিকে বাসের ছোটাছুটি। হাঁ করে দেখছি সব। আমি যেন অন্য জগতের মানুষ। এইমাত্র পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছি অন্য কোনও গ্রহ থেকে। কোনও কিছুর সঙ্গেই আমার মনের যোগ নেই। জীবন্ত এক স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি। অভিমানে ভেতরটা ফুলে ফুলে উঠছে। পিতা পুত্রের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারেন! জগতের সামনে আমাকে কতটা ছোট করে গেলেন। তার মনে যাই থাক, পৃথিবী তো এর অন্য ব্যাখ্যা করবে! সবাই বলবে, আমি তাকে তাড়িয়েছি। সবাই বলবে, আমার জন্যেই তিনি আলাদা হয়ে গেলেন।
আমি এখন যাই কোথায়? অফিস তো মাথায় উঠল। কলকাতার হস্টেলে মুকু আছে। আমার প্রেমিকা। আমার জন্যেই সে কলকাতায় পড়তে এসেছে। ঠুনকো প্রেম নয়। অনেকদিন ধরেই লালন-পালন করছে। মুকুর কাছে যাব বলেই বেরিয়েছিলুম। এখন মনে হচ্ছে কী লাভ! প্রেম বড় সুখী। আমার জীবনের ভিত ভূমিকম্পে দুলে উঠেছে। পায়ের তলায় জমি আছে বলে মনেই হচ্ছে না। সুখের বাগানে বসেই প্রেমের বাঁশি বাজানো চলে। মরুভূমির তপ্ত বালিতে, মনসা গাছের ঝোঁপের পাশে বসে সুন্দরী রমণীর সোহাগের কথা ভাবা যায় না। মানুষ তখন কোনওরকমে বাঁচার কথাই ভাবে। সংসার মানে সমর্থন। একা একা হয় না। সবাই হাত তুলে সমর্থন জানাবে, তবেই না। আনন্দ। প্রেম মানে আনন্দ, প্রেমানন্দ।
আমি জানি, এখনই মুকুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, সে চলে আসবে। কোনও কিছুর পরোয়া করবে না সেই বেপরোয়া মেয়ে। বাড়ির সদরের বিশাল তালা খুলে, মুকুকে নিয়ে আমি সেই নিরানন্দ পুরীতে গিয়ে ঢুকতে পারি। হাসতে পারি, গাইতে পারি, ভোজসভা বসাতে পারি। মনে মনে ভাবতে পারি কে কার পিতা! সাধ করে কেউ বৈরাগী হতে চাইলে, আমি কী করতে পারি। আমি সানাই বাজিয়ে, আলোর মালা ঝুলিয়ে মুকুকে বিয়ে করতে পারি। আমি চাকরি করি। আমার পদোন্নতি হয়েছে। দেরাদুনে আমি বদলি হয়েছি। সেখানে নতুন যে লেবরেটারি হচ্ছে, আমি তার ভারপ্রাপ্ত। ব্যাঙ্কে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে সত্তর হাজার টাকা। ষাট-সত্তর ভরি সোনা বাড়িতে মজুত। আমি তো বড়লোক। আমি যদি সত্যসত্যই একটা স্কাউড্রেল হতুম আমার এই মনস্তাপ হত না। বরং আনন্দে নাচতুম, সব আমার। আমি রাজা। আমি মালিক।
আমি তা পারব না। কোথায় কোন সুদূরে আশ্রয়হীন এক মানুষ আকাশবৃত্তি করে দিন কাটাবেন, আর আমি থাকব সুখশয্যায়, যুবতীর নরম বুকে মুখ গুঁজে? এ হতে পারে না। তিনি পথে নেমে আমাকেও পথে নামার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।
ব্যস্তসমস্ত লোকজন আমার চারপাশ দিয়ে চলেছে পৃথিবীর কাজে। জীবনসমুদ্রে আমি দাঁড়িয়ে আছি নিঃসঙ্গ নাবিকের মতো। আমার জাহাজের হাল ভেঙে গেছে। কম্পাসের কাঁটা খুলে পড়ে গেছে। কিন্তু বিষয় কী সাংঘাতিক জিনিস! হঠাৎ মনে হল, বাড়িতে কয়েক লক্ষ টাকার জিনিস পড়ে আছে, আর আমি এক সামান্য তালার ভরসায় বাড়ি ফেলে রেখে কোথায় চলেছি! কতদিনের জন্যে চলেছি!
আমি যক্ষ। আমার পিতা আমাকে যক্ষ করে রেখে চলে গেলেন। এ কী ভয়ংকর শাস্তি! সকাল থেকে এক কাপ চা-ও পড়েনি পেটে। খিদেতে নাড়িভুড়ি জ্বলছে। ঠান্ডা জলে স্নান করার জন্যে শরীর ছটফট করছে। গাছের ছায়া ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও আর ভাল লাগছে না। অবশেষে নিজের সঙ্গে একটা সমঝোতা হল। কোনও ব্যাপারেই হঠকারিতা ভাল নয়। আগে বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। সোনাদানার একটা সুরক্ষার প্রয়োজন।
আবার আমি উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলুম। পরামর্শ নেবার মতো একজন কাছের মানুষের নাম মনে পড়েছে। তিনি হলেন বিষ্টুদা। এতক্ষণ ওই নামটা কেন মনে পড়েনি! মাইলটাক হেঁটে বিষ্টুদার দোকানে এসে হাজির হলুম। দোকান প্রায় খালি। আজ অফিসবার। এইসময় কে আর দোকানে থাকবে। বিষ্টুদা সবে টিফিন করতে বসেছেন। তার টুকটুকে ফরসা মেয়েটি খাবার এনেছে। বাড়ি থেকে। বিষ্টুদার প্রিয় খাবার, পরোটা, আলুর তরকারি। আমি ধপাস করে একটা বেঞ্চে বসে পড়লুম। আমার আর ক্ষমতা নেই।
একটা ঢোঁক গিলে বিষ্টুদা বললেন, কী হল? আজ তোমার ছুটি নাকি?
আপনার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। সবার আগে এক কাপ চা চাই। সকাল থেকে আমার এক গেলাস জলও জোটেনি।
সেকী? পরোটা খাবে? কৌটোয় আছে। খুব ভাল খেতে হয়েছে। টিপের মা খুব ভাল রাঁধে।
বিষ্টুদার মেয়ের নামটা খুব সুন্দর, টিপ। পরোটা আমারও খুব প্রিয় খাদ্য। পেট খালি। আগুনের মতো জ্বলছে। বললুম, খাব। আরও বললুম এই কারণে, আজ আর অন্য কিছু জোটার আশা নেই। কে রাঁধবে! উনুন ধরিয়ে রান্না চাপাবার মতো মনের অবস্থা আমার নেই।
টিপ হাসিমুখে অ্যালুমিনিয়ামের গোল টিফিনকৌটোটা আমার হাতে তুলে দিল। টিপের বয়েস হবে তেরো থেকে চোদ্দোর মধ্যে। অপূর্ব সুন্দরী। এই মেয়ের জন্যে বিষ্টুদার ভাবনার শেষ নেই। চারপাশের পরিস্থিতি ক্রমশই খুব জটিল হয়ে উঠছে। যুবশক্তি জেগে উঠেছে তো! পুলিশ দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। টিপকে দেখলে কেবলই মনে হয়, আমার যদি ওইরকম একজন বোন থাকত!
ময়ান দেওয়া ময়দার বাদামি করে ভাজা পরোটার একটা টুকরো মুখে তুলতে গিয়ে আমার হাত। থেমে গেল। কেমন করে খাব! কেবলই পিতার কথা মনে পড়ছে। এই মুহূর্তে তিনি কোথায়! তিনি তো পথেঘাটে দিন কাটানোয় অভ্যস্থ নন। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে অতিশয় খুঁতখুঁতে। বারেবারে চা খেতে ভালবাসেন। নিজস্ব বাথরুম ছাড়া অস্বস্তি বোধ করেন। মানুষের সঙ্গে তেমন মিশতে পারেন না। গ্রাম্য আলাপ-আলোচনা অপছন্দ করেন। এমন একজন মানুষ কেমন করে সন্ন্যাসী হবেন! সহসা গুরু বলে কারওকে মানতে পারেন না। তার পক্ষে আশ্রমজীবন তো অসহ্য হবে! অভুক্ত, অস্নাত সেই মানুষটির মুখ আমার চোখে ভেসে উঠেছে। পরোটা খাই কেমন করে! হাত ঠোঁটের কাছে উঠছে, আবার নেমে আসছে।
টিপ দেখছিল। বললে, তুমি খেতে পারছ না কেন? ঘেন্না করছে?
আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলুম। চোখে জল এসে গেল।
তুমি কাঁদছ?
বিষ্টুদা আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, একী? সত্যিই তো তুমি কাঁদছ। কী হয়েছে?
পরোটার টুকরোটা আলুর তরকারি সমেত মুখে ঢুকিয়ে দিলুম। এককথায় উত্তর দেবার মতো সহজ ঘটনা ঘটেনি
বিষ্টুদা বললেন, ব্যাটাছেলে যখন কাঁদে তখন বুঝতে হবে সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে।
পরোটা দু’খানা কোনওরকমে খেয়ে ফেললুম। টিপ বাটি, কৌটো, যাবতীয় সব নিয়ে বাড়ি চলে গেল। বিষ্টুদা বেশ তরিবাদি করে দু’কাপ চা করলেন। চা খেতে খেতে পুরো ঘটনাটা বিষ্টুদাকে বললুম। কোনও ঝগড়া নয়, কথা কাটাকাটি নয়, তেমন কোনও ভুল বোঝাবুঝি নয়। হঠাৎ সব ছেড়ে, যতদূর মনে হয় একেবারে শেষরাতে আমার সর্বাধিক প্রিয়, শ্রদ্ধেয় বাবা, কোনও নির্দেশ না রেখে, কোনও হদিস না দিয়ে চলে গেলেন।
আমাদের দুজনের জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। অর্থের জন্যে নয়। অর্থের অভাব আমাদের ছিল না। ধনী না হলেও গরিব ছিলুম না আমরা। মৃত্যু। মৃত্যুর পর মৃত্যু আমাদের সংসারের খোঁটা নড়িয়ে দিয়ে গেছে। সব এলোমেলো, ছত্রাকার। কোথাও একটা আদর্শের সংঘাতও ঘটছিল। একটা সন্দেহ খেলা করছিল দুজনের মনে। সেই সন্দেহের উৎস নারী। বিষ্টুদাকে সব কথা বলা গেল না। বলতে পারা গেল না। সন্দেহের মধ্যে একটা নীচতা থাকে যে! যাকে সন্দেহ করা হয় তার কিছু নয়, যে সন্দেহ করে সে-ই ছোট হয়ে যায়, সংকীর্ণ হয়ে যায়। আমি কিছুতেই বলতে পারলুম না, তবলাবাদক প্রফুল্লবাবু, যিনি আমার পিতার আশ্রয়ে ছিলেন, সন্দেহজনক অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন, সেই ভদ্রলোকের স্ত্রীকে ঘিরে পিতা-পুত্রে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছিল। বলতে পারলুম না আমি নিজে একটা কামুক, লম্পট। ভাবটা দেখাই সন্ন্যাসী হতে চাইলেই হতে পারি। আমি এক মহা ধার্মিক, বেদান্তবাদী, ত্যাগী। সাধুসঙ্গ করি। এটা আমার মুখোশ। আসলে আমি এক দুর্বলতম যুবক। কোপন স্বভাবের ভয়ংকর এক চরিত্র। বয়স, সম্পর্ক কিছুই আমি মানি না। দেহবাদী শয়তান আমি। সুযোগ পেলে যে-কোনও কুকর্ম আমি করতে পারি। আমার মুখ দেখে মনের ভাব পড়ার উপায় নেই। আমার ভেতর দুটো মানুষ বাস করে, সাধু আর শয়তান। সেই শয়তান কিন্তু প্রফুল্লবাবুর স্ত্রীতে আসক্ত। সেই নারী আবার পিতার ওপর নির্ভরশীল। দুৰ্জেয় নারীচরিত্র। ব্যাপারটা অতিশয় জটিল। পিতা হরিশঙ্কর পর্বতের মতোই অচল অটল। তাঁর মন বোঝার সাধ্য কারও নেই। তিনি গুপ্তযোগী। কিন্তু! এর মধ্যে একটা কিন্তু এসে হাজির হয়েছে। হঠাৎ আমার মনে হয়েছে, ব্রহ্মচারী পিতা কিঞ্চিৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমার পরলোকগতা মাতার স্মৃতি ক্রমশ ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে আসছে। সংসারের সমস্ত কর্তৃত্ব চলে যাচ্ছে ওই মহিলার হাতে। ওই মহিলা আমার পিতাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিলেন। ওই নিঃসন্তান মহিলার কামনা বাসনা নির্বাপিত হয়নি। যৌবন বিদায় নেয়নি তার শরীর থেকে। মুহূর্তে তিনি বাঘিনী হতে পারেন। একদিন ওই মহিলা আমারই এক দুর্বল মুহূর্তে আমাকে শরীর দান করেছিলেন। অক্লেশে। সেই দুর্বার আকর্ষণে আমি বড় অসহায় বোধ। করেছিলুম। সেই ছিল আমার জীবনের প্রথম যোষিৎ সংসর্গ। একই সঙ্গে প্রচণ্ড পাপবোধ আর পরমানন্দে আমি দীর্ণ হয়েছিলুম। সেইরাতেই একটা বোঝাঁপড়া হয়েছিল, সম্পর্ক যাই হোক আমরা স্বামী-স্ত্রী। বয়সের ব্যবধান বিচারের বিষয় নয়। আমি ভালবাসি, তুমিও ভালবাসো। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সেই মহিলা এক ত্রিভুজ তৈরি করে বসলেন। পিতার কঠিন বর্ম ভেদ করে জয় করে ফেললেন তার মন। আমার মায়ের আঁচলে যে চাবিয় গোছাটি বাঁধা থাকত সেটি চলে গেল তার আঁচলে। যেসব স্মৃতিতে আমরা ছাড়া বাইরের কারও হাত দেবার অধিকার ছিল না, সেই সব বস্তু তিনি নিঃসংকোচে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। আমার মায়ের জামাকাপড় সব টেনে টেনে বের করছেন, ঝাড়ছেন, গুছোচ্ছেন, প্রশ্ন করছেন। আমাদের সমস্ত গোপনীয়তার মধ্যে প্রবেশ করতে চাইছেন। একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার অযাচিত প্রয়াস। অবশেষে আমাকে রূঢ় হতে হল। কেন হলুম! আজ এই মুহূর্তে, বিষ্টুদাকে বলতে বসে সেই প্রশ্নের উত্তর পেলুম। ঈর্ষা। প্রচ্ছন্ন কাম। প্রবল অধিকারবোধ। জৈব তাগিদ। হাড়ে মজ্জায় লুকিয়ে বসে থাকা রিরংসা। কেন এই বিকৃতি? সেই জিজ্ঞাসার উত্তরও আমি যেন দিতে পারছি নিজেকে। বড় আগলে আগলে মানুষ করা হয়েছিল। মা-মরা এই ছেলেটিকে। পৃথিবী থেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা হয়েছিল। চেষ্টা করা হয়েছিল দেবোপম করার। নানাভাবে ঠেলার চেষ্টা হয়েছিল ব্রহ্মচর্যের দিকে। সন্ন্যাসীর আদর্শের দিকে। শৈশব থেকেই যে মা-হারা, যার পরিবারে শুধুই পুরুষ, নারী তো তার কাছে এক দুর্বার কৌতূহল। স্বাভাবিক থেকে যে বঞ্চিত, সে তো অস্বাভাবিকের দিকে ছুটবেই। মহাপুরুষ সে হবে কী করে? সে কি হওয়া যায়? হয়ে আসে।
বিষ্টুদা বললেন, মনমরা হয়ে বসে থেকো না। যা হয়েছে তা হয়েছে। যা হবে তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করো। সবচেয়ে বড় ভুল করেছ ওই মহিলা, মানে তোমার পাতানো কাকিমাকে মামার সঙ্গে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে।
তা না হলে যে বাবার নামে যা-তা বদনাম হচ্ছিল। আপনি জানেন, ডাকে একটা পারসেল এসেছিল? এই পাড়ারই কোনও বদমাশ পাঠিয়েছিল। সেই পারসেলের মধ্যে ছিল যৌনবিজ্ঞান, আর একটা চিঠি। অশ্লীলতম সেই চিঠি। কী লেখা ছিল জানেন? ‘নিজে কিনতে লজ্জা পাবেন ভেবে আমরা উপহার পাঠালুম। যে বউভাত হল না, মনে করুন এটি সেই বউভাতেরই উপহার। খাওয়াটা পাওনা রইল মাইরি। অন্নপ্রাশনে যেন বাদ না পড়ি। বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখি!
বিষ্টুদা উত্তেজিত হয়ে টুল ছেড়ে উঠে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন চা তৈরির টেবিলটার দিকে। নিজের মনেই বললেন, দুনিয়াটা শালা ভগবানের চিড়িয়াখানা। নেই কাজ তো খই ভাজ।
দু’কাপ চা তৈরি করে, এক কাপ আমাকে দিলেন, এক কাপ নিজে নিলেন, বুঝলে, এই পাড়াটা একেবারে থার্ডক্লাস হয়ে গেছে।
এটা করেছে, ওই মহিলার সেই লম্পট মামাশ্বশুটা।
মিস্টার বার্নিশ?
মিস্টার বার্নিশ মানে?
বার্নিশ করা জুতো পরে না? পাইপ লাগিয়ে সিগারেট খায়! গুরুদেব লোক। যুদ্ধের সময় মিলিটারি ইউনিফর্ম সাপ্লাই করে বহুত পয়সা কামিয়েছিল। তোমার ওই প্রফুল্লকাকা তো ওই বাড়িতেই ছিল। অনেকদিন ছিল, তারপর আর পারলে না। লোকটা একটা অমানুষ। আজ বাদে কাল ঘাটে যাবে এখনও খিদে গেল না। ভগবান এসব লোককেই বড়লোক করেন। কী বিচার মাইরি! সাধু মরে ভিক্ষে করে, শয়তানে মারে চামরমণি চাল।
বিষ্টুদা আবার টুলে এসে বসলেন। হাতে চায়ের কাপ। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে তা হলে দেখাশোনা করার কেউ রইল না?
নাঃ, একেবারে একা। আপনি আমাকে বলুন, এখন আমার কী করা উচিত! আমি একটা তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। অনেক দূর চলেও গিয়েছিলুম, শেষে আপনার পরামর্শ নেব বলে ফিরে। এলুম। আমার মাথায় আসছে না কিছু। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি।
তোমার সঙ্গে আমার মনে হয় পূর্বজন্মের কোনও সম্পর্ক ছিল। আত্মহত্যার কথা মনেও এনো না। কাপুরুষতা। জানো তো আমারও কেউ ছিল না। একেবারে অনাথ। মামার বাড়িতে পাত কুড়িয়ে মানুষ। লেখাপড়া ছেলেবেলায় হল না কেউ স্কুলে ভরতি করলে না বলে। চেহারাটা ভাল ছিল, কিছুকাল যাত্রাদলে নায়ক হয়েছিলুম। চরিত্রটা খরচ হয়ে যাবার ভয়ে পালিয়ে এলুম। নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখলুম। ছাপছোপ নেই, কিন্তু খুব একটা অশিক্ষিত নই। জীবন হল ঠান্ডা মাথায় অঙ্ক। কষা। দেখেশুনে পথ চলা। গর্তটর্তে পড়লেই বিপদ, আর পথে অনেক গর্ত থাকবেই। আপাতত তুমি একটা কাজ করো। বাড়ি যাও। চান করো। দাড়ি কামাও। বাবার চলে যাওয়াটা পাঁচকান কোরো না। চেষ্টা করো নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। যেন কিছুই হয়নি। আজ দুপুরে তুমি আমার বাড়িতে খাবে। খাওয়াদাওয়ার পর আমরা দুজনে একটা প্ল্যান করব।
আপনার বাড়িতে খেতে আমার লজ্জা করবে।
তার মানে তুমি আমাকে ঠিক আপন ভাবতে পারছ না। আর তা না হলে, আমাদের বাড়িতে খেতে তোমার ঘেন্না করছে। জাতের বিচার আসছে।
জাত আমাদের পরিবারের কেউই মানে না, বিষ্টুদা। ঠিক আছে, আমি সব সেরে আসছি।
সেই বিপুল বিশাল তালাটা খুলে আবার আমার গৃহপ্রবেশ। মন চাইছে না। পা যেন আর চলছে। না! এ যেন বইয়ের মলাট খুলে অক্ষর হয়ে যাওয়া। সারা বাড়িটা যেন স্তব্ধ সংগীতের মতো। প্রতিটি ইট যেন কথা বলতে চাইছে। প্রতিটি কোণে যেন ঘটনা জমে আছে। অজস্র ঘটনা। বিশাল এক উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে। বহুদিন আগের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে। ইঁদুরকল পাতা হয়েছিল। ভোরে উঠে দেখি ছোট্ট একটা ইঁদুর সেই কলে পড়েছে। পুঁতির মতো উজ্জ্বল দুটো চোখ। ভেলভেটের মতো মসৃণ চকচকে গা। ইঁদুরটা একেবারে শেষ মাথায় বসে আছে ভয়ে ভয়ে। মৃত্যুকে সবাই চেনে। নির্বোধ ইঁদুরও। কলটার সামনে গিয়ে বসতেই করুণ চোখে ইঁদুরটা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পেরেছিল, আমি এক ঘাতক। ইঁদুরটাকে আমি মারতে পারিনি। ছেড়ে দিয়েছিলুম। কী আর করবে! কিছু বই আর কাগজ কাটবে। বাড়িতে পা দিয়েই মনে হল, আমি সেই কলে-পড়া ইঁদুর। বিশাল এক কলে একা পড়ে আছি।
ঘরের আলনায় বাবার জামাকাপড় হ্যাঁঙারে ঝুলছে। সমস্ত জামা আর কাপড় পাট করে আলমারিতে তুলে রাখলুম। কী পরে গেছেন বুঝতে পারছি না। চটিজোড়া পড়ে আছে। নিউকাটটা নেই। একবার সন্দেহ হল, বাড়ির কোথাও নেই তো? মন কত অবুঝ! সত্যকে মেনে নিতে পারে না। গোটা বাড়িটা আবার আমি ঘুরে এলুম। বাথরুমে উঁকি মারলুম। নীচের সমস্ত ঘর। নীচের যে-ঘরে কাকিমা থাকতেন, সেই ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলুম। চৌকি। তার ওপর পুরু বিছানা। নিপাট চাদর। কাকিমা সবই ফেলে রেখে গেছেন! সামান্য কিছু নিয়ে গেছেন, যা না নিলেই নয়। সাধের সেই আয়নাটা পড়ে আছে কুলুঙ্গিতে। চিরুনি। চুলবাঁধার ফিতে। বড় একটা পাউডারের কৌটো। সিঁদুর। একপাতা টিপ। মেয়েলি যত কিছু সব পড়ে আছে। এসবের আর কোনও প্রয়োজন নেই সেই মহিলার, কারণ তিনি বিধবা হয়েছেন। সম্পূর্ণ নিরাশ্রয়, নিঃসন্তান এক মহিলা।
বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে হল, সংসারের যে ছেঁড়া টুকরোটি অবশিষ্ট ছিল, আমিই সেটাকে শেষ করে দিয়েছি। আর কিছু করার নেই। উঠে এলুম নির্জন দোতলায়। বাবার পড়ার টেবিলে রাজ্যের বই, নোটখাতা। একটু গোছগাছ করে রাখার চেষ্টা করলুম। যদি কোনওদিন ফিরে আসেন হঠাৎ। জানি সে সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি এগোতে জানেন। পেছোবার মানুষ তিনি নন।
যে-মেয়েটি কাজ করে সে এসে তালা ঝুলতে দেখে ফিরে গেছে। গত রাতের এঁটো থালাবাসন সব পড়ে আছে। ওগুলোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আমার এখন গুটোবার সময়। ফলাও করে ফেঁদে বসার দিন চলে গেছে।
বেশি না, গোটাকতক বাসন। কুয়োতলায় টেনে নিয়ে মাজতে বসে গেলুম। একবার গভীর জলের দিকে তাকালুম। এই কূপ থেকেই ঘনঘোর এক বর্ষার দুপুরে বলাইবাবু উপচে পড়েছিল। কচ্ছপ। কেমন পোষ মেনেছিল? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলুম! কচ্ছপ, কিন্তু ভীষণ ভদ্রলোক। সারা বাড়িতে আপন মনে ঘুরে বেড়াত। আবার কেমন? বলাইবাবু বলে ডাকলে, যেখানেই থাকুক, গুটিগুটি ঠিক ছুটে আসত। বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছি ভেবে, সকালে বলাইবাবুকে আবার কুয়োর মধ্যেই নামিয়ে দিয়েছিলুম। এখনও সে কি ওইখানেই আছে! বহুদিন জল ছাড়া। মরে গেল না তো! বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলুম, যদি একবার দেখা দেয় ক্ষণিকের জন্যে! বারকতক ডাকলুম, বলাইবাবু, বলাইবাবু! জল এক অন্য জগৎ। শব্দ সেখানে পৌঁছোবে না। ওই ছোট্ট কুপে বলাইবাবু কি বেঁচে থাকবে! তেমন পরিসর তো নেই! মরেই যাবে হয়তো! তার জীবনে এতকাল আমরাই হয়েছিলুম সঙ্গী। কত কী খেত! তার জন্যে বিশাল বড় মাটির গামলায় জল রাখা হত টইটম্বুর। মাঝে মাঝে সেই জলে নেমে সাঁতার কেটে আসত। ওই কুপে তার তো কোনও খাদ্য নেই!
বাসন মাজা হয়ে গেল। ভাল করে মুছে যথাস্থানে সাজিয়ে রাখলুম। বেশ বুঝতে পারছি, এই বাড়িতে একা আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। সে প্রশ্নও নেই। চাকরিটা আমি যদি না ছাড়ি, তা হলে আমাকে দেরাদুনে গিয়ে নতুন দায়িত্ব নিতে হবে। সেইখানেই ফেঁদে বসব নতুন ব্যবস্থা। উত্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি সম্ভব-অসম্ভব নানা কিছু ভাবতে লাগলুম। কোনও হদিশ না রেখে বাবার এই চলে যাওয়া, এ তো মৃত্যুরই সামিল। তিনি নেই। যদি সন্ন্যাস নেন, তা হলেও নেই। সংসারের কাছে তিনি অবর্তমান। তা হলে? তা হলে আমাকে তো আমার স্বাধীন পথেই চলতে হবে। এ সংসারে কে কার? একমাত্র আমিই আমার। তার অভিমান থাকতে পারে, আমার অভিমান থাকতে পারে না! পিতাই এখন আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার জ্যাঠামশাইয়ের ভায়রাভাইয়ের ছোট মেয়ে মুকু। মুকুর দিদি কনককে আমি ভালবেসে ফেলেছিলুম। সে ছিল আমার মনের মতো। তার চাবুকের মতো শরীর। তার রসবোধ, পরিমিতিবোধ, আপন করে নেবার ক্ষমতা আমাকে বিমুগ্ধ করেছিল। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। সেই কনক কিন্তু আমাকে ছেড়ে চলে গেল। শুধু আমাকে নয়, চলে গেল সংসার ছেড়ে। মনে হয়েছিল কনকও আমাকে ভালবাসে। আমার সে ধারণা ভুল। নারীচরিত্র দুয়ে। আমাকে ভালবাসলে কী ক্ষতি হত তার! আমি যে তাকে ভীষণ ভালবাসতুম। যে ভালবাসে মেয়েরা তাকে ভালবাসবে না। কিছুতেই না, কোনও দিনও না। এইটাই নিয়ম। যে ঘৃণা করবে, তাকেই জয় করার জন্যে এগিয়ে যাবে। সব লিভিংস্টোনের জাত। ডার্কেস্ট আফ্রিকা ছাড়া কিছুই মনে ধরে না। মুকুকে আমি তেমন ভালবাসতুম না, অথচ সেই মুকুই আমার জন্যে কলকাতায় চলে এল কায়দা করে, এম এ পড়ার ছুতোয়।
এই মুকুকে আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করে, দেরাদুনে গিয়ে শুরু করতে পারি আমার সর্বোত্তম নতুন জীবন। তোষা জীবন। পাহাড়ের কোলে সুরম্য বাংলো। টিয়াপাখি রঙের একটা গাড়ি, দু’পা দূরে মুসৌরি। তিন পা দূরে হরিদ্বার।
মাঝে মাঝে মানুষ দিবাস্বপ্ন দেখে। কল্পনায় প্রাসাদ রচনা করে। কারও কল্পনা বাস্তব হয়, কারও হয় না। ভেলভেটের বাক্সে জড়োয়ার অলংকারের মতো সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। মাঝে মাঝে জীবনের অলস মুহূর্তে বের করে নাড়াচাড়া করে। আবার তুলে রেখে দেয়। তাতেও কত সুখ! পাওয়ার চেয়ে না-পাওয়ার আনন্দ প্রভূত। বিষণ্ণতার চেয়ে একান্ত উপলব্ধি আর কী আছে! আমার বন্ধুর লেখা একটি কবিতা মনে পড়ছে:
শুরু না সমাপ্তি ভাল অথবা খারাপ
প্রতিটি প্রহর পল অনুপল মৃত্যু না জীবন
পৃথিবী যশোদা মাতা অথবা
পুতনা
ভালবাসা শেষ হলে স্বস্তি না বিষাদ
কে আগে লক্ষ্যের কাছে পৌঁছে যায় পঙ্গু না সক্ষম।