কেয়াপাতার নৌকো – দ্বিতীয় পর্ব
২.০১
অবনীমোহনের ধারণা, পুর্ব বাংলাকে চেনার মন্ত্র হেমনাথ-লারমোর-স্নেহলতার মতো মানুষদের হাতে রয়েছে এবং এই বাংলাকে না জানলে গোটা বাংলা দেশটাকেই জানা যাবে না। তার বিশ্বাস এখানে তাদের থাকা ব্যর্থ হবে না, অবেগপূর্ণ সুরে সেই কথাই তিনি বলে গেলেন। তারপর উৎসুক দৃষ্টিতে হেমনাথের দিকে তাকালেন।
অভিভূতের মতো শুনে যাচ্ছিলেন হেমনাথ। আচ্ছন্ন গলায় বললেন, তুমি যে এভাবে ভেবেছ,
আমি চিন্তাই করিনি।
অবনীমোহন হাসলেন। হেমনাথ আবার বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, পুব বাংলাকে না জানলে গোটা বাংলাদেশকে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
একটু চুপ।
তারপর অবনীমোহন বললেন, কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে মামাবাবু–
কী সমস্যা?
আমরা যদি এখানে থেকে যাই, ছেলেমেয়েগুলো পরীক্ষা টরীক্ষা দিতে পারবে না। তাতে একটা করে বছর নষ্ট।
পরীক্ষার জন্য আটকাবে না। আমি হেডমাস্টারকে বলে দেব, জানুয়ারি মাসে বিনুকে পরের ক্লাসে ভর্তি করে নেবে। অবশ্য অ্যাডমিসন টেস্ট দিতে হবে। আর সুধা সুনীতির জন্যে তো ভবতোষই আছে। ওদের কলেজে ভর্তি হতে অসুবিধা হবে না।
অবনীমোহন বললেন, ভবতোষবাবু সন্ধেবেলা এসেছিলেন। সুধা সুনীতির ভর্তির ব্যাপারে আমি তাকে একটু আভাস দিয়েছি। বলেছি, দু’একদিনের ভেতর আপনাকে নিয়ে তার বাড়ি যাব।
হেমনাথ বললেন, বেশ তো—
হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে অবনীমোহনকে চিন্তিত দেখাল। বললেন, ভর্তি তো করব, কিন্তু–
কী?
ওরা কলকাতা ইউনিভার্সিটির কোর্স করেছে। এখানে–
বাধা দিয়ে হেমনাথ বলে উঠলেন, সে জন্যে তোমার দুশ্চিন্তা নেই। এখানকার কলেজটা কলকাতা ইউনিভার্সিটির আন্ডারে। ঢাকা শহর বাদ দিলে ইস্টবেঙ্গলে যত স্কুল কলেজ আছে তার প্রায় সবগুলোই কলকাতা ইউনিভার্সিটির আওতায় পড়ে।
তাই নাকি! আমার জানা ছিল না। যাক, ভালই হয়েছে। অবনীমোহন নিশ্চিন্ত হলেন।
হেমনাথ খানিক ভেবে বললেন, এখানে তো থাকবে, কিন্তু কলকাতায় তোমার ব্যবসা ট্যবসা আছে না?
আছে।
তার কী হবে?
তুলে দেব। মাঝখানে একবার কলকাতায় যেতে হবে। সব বন্দোবস্ত করে সপ্তাখানেকের ভেতর ফিরে আসব। ভাবছি–
কী?
চুপচাপ হাত-পা গুটিয়ে তো বসে থাকা যাবে না। এখানে কিছু ধান জমিটমি কিনে চাষবাস করব। একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
বেশ তো। কালই তোমার মিতাকে একটা খবর পাঠাচ্ছি। তার কাছে অনেক জমির খোঁজ আছে।
মিতা মানে মজিদ মিঞা?
হ্যাঁ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেমনাথ আর অবনীমোহনের কথা গোগ্রাসে গিলছিল বিনু। হঠাৎ কে যেন চাপা গলায় ডেকে উঠল, ছুটোবাবু–
চমকে পেছন ফিরতেই দেখা গেল, বারান্দার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুগল। চোখাচোখি হতেই যুগল হাতছানি দিল।
পায়ে পায়ে ঘর থেকে বাইরে এল বিনু। বলল, ডাকছ কেন?
চাপা আনন্দের গলায় যুগল বলল, বড় বাহারের সম্বাদ (খবর) ছুটোবাবু, বড় বাহারের সম্বাদ–
বুঝতে না পেরে বিনু শুধলো, কী?
আপনেরা রাইজদাইতে থাকবেন।
তারা রাজদিয়াবাসী হবে, এতে সবাই খুশি। হেমনাথ-ঝিনুক-শিবানী-স্নেহলতা, সব্বাই। যুগলও যে খুশি হবে, মনে মনে বিনু তা জানত।
যুগল বলল, লন (চলুন) আমার লগে।
কেন?
মেলা কথা আছে।
বিনু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। অন্ধকারে যুগলের সঙ্গে তার ঘরে চলে এল। হাতড়ে হাতড়ে কোত্থেকে একটা হেরিকেন বার করে জ্বালিয়ে ফেলল যুগল। বলল, বয়েন–
বিনু পা ঝুলিয়ে চৌকিতে বসল। তারপর জানতে চাইল, কী কথা যেন বলবে—
তরাতরির কী দুটোবাবু, ধীরেসুস্থে শোনেন–
যুগলের চোখেমুখে আলো খেলে যাচ্ছে। দুই ঠোঁটের মধ্যিখানে আধফোঁটা একটু হাসি। বাইরেটা দেখে মনে হয়, প্রাণের ভেতর তার আনন্দের বান ডেকেছে। উৎসুক চোখে বিনু তাকিয়ে থাকল।
কিছুক্ষণ পর যুগল বলল, আইজ বিহান বেলায় বড়কত্তার লগে কমলাঘাট গ্যাছিলাম।
বিনু বলল, জানি।
হেইখানে কী হইছে জানেন ছুটোবাবু? কী?
খুশির সঙ্গে খানিকটা উত্তেজনা মিশিয়ে যুগল ফিসফিস করল, গোপাল দাসের লগে দেখা। হেও (সেও) কমলাঘাট আইছিল।
এত আনন্দের কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারল বিনু। তাকিয়েই ছিল। বলল, সেই জন্যেই বুঝি এত ফুর্তি?
যুগল শব্দ করে হাসতে লাগল।
বিনু আজকাল বিয়ের ব্যাপারে যুগলের সঙ্গে ঠাট্টা টাট্টা করে। রগড়ের গলায় বলল, শ্বশুরের সঙ্গে দেখা হলে কার না আনন্দ হয়!
যুগল বলল অহনও হউর হয় নাই কিলাম।
দুদিন পর হবে তো।
তা হইব। যুগল তক্ষুনি ঘাড় কাত করল।
বিনু শুধলো, গোপাল দাস কী বললে?
আমারে কিছু কয় নাই। কথা বারা যা কিছু বড়ত্তার লগেই হইছে। যুগল বলতে লাগল, গোপাল দাস কী কইছে জানেন?
কী?
বিয়ার সোময় পাখিরে যা-যা গয়নাগাটি দিব, বানাইয়া ফালাইছে। হার, চুড়ি, আংটি, কানের দুল, জামাইর আংটি-কিছু আর বাকি নাই। হেরপর অন্য জিনিসের কথা ধরেন। নয়া কাপড় চোপড়, টিনের ভোরঙ্গ, বিছনা-পাটি, আয়না কাকই বাসন-কোসন-হগল কিনা (কেনা) হইয়া গ্যাছে। বলতে বলতে একেবারে বিভোর হয়ে গেল যুগল। তার চোখ চকচক করতে লাগল।
বিনু বলল, এত তাড়াতাড়ি সব কিনে ফেলল?
যুগল অবাক, তরাতরি কই ছুটোবাবু! দিনের হিসাব কইরা দেখছেন?
বিনু ঘাড় নাড়ল, হিসেব করেনি।
যুগল বলল, কাত্তিক মাস শ্যাষ হইয়া আইল। আর ছয় দিন পর অঘান পইড়া যাইব। অদ্যানের মাঝামাজি ধান কাটা। একবার ধান কাটা আরম্ভ হইলে উয়াস (নিশ্বাস) ফালানের সময় পাইব না গোপাল দাস। এক-আধটুক জমিন তো হের (তার) না, এক লপ্তে বিশ কানি জমিন। বিশ কানিতে কত ধান হয়, চিন্তা কইরা দ্যাখেন। হেই হগল কাইটা কুইটা, সেইত্যা ঘরে তুলতে পৌষ-মাঘ দুইখান মাস যাইব গিয়া। হের পরেই ফাগুন মাস। আর–
আর কী? জিজ্ঞাসু চোখে বিনু তাকাল।
যুগল বলল, ফাগুন মাস পড়লেই বিয়া। এর ভিতরে কিনা-কাটা সাইরা না রাখলে চলে?
বিনুকে মাথা নাড়তেই হল, তা তো ঠিকই—
একটু ভেবে যুগল আবার বলল, দুই-একদিনের ভিতরেই গোপাল দাস আমাগো এইহানে আসব।
কেন?
বড়কত্তার কাছ থিকা পণের টাকা আদায় করতে।
বিনুর মনে পড়ে গেল, পাখির জন্য সেদিন আট কুড়ি টাকা পণ চেয়েছিল গোপাল দাস।
যুগল আবার বলল, ধান কাটার আগেই সগল ঝামেলা চুকাইয়া রাখতে চায় গোপাল দাস। হের পর ফাগুন পড়লেই পাখির আর আমার দুইজনের চাইর হাত এক কইরা দিব। ঝামেলা আগেই মিটাইয়া রাখন ভাল, না কী ক’ন ছুটোবাবু? সমর্থনের আশায় বিনুর চোখের দিকে তাকাল সে।
বিনু মাথা নাড়াল।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর যুগলই আবার শুরু করল, আমার বিয়ার সময় আপনেরে কিন্তুক বরযাত্রী যাইতে হইব ছুটোবাবু। না গ্যালে ছাড়ুম না।
বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, যাব, নিশ্চয়ই যাব।
আপনেরা এইহানে থাকবেন, আমার বিয়ায় যাইবেন–কী যে আনন্দ হইতে আছে ছুটোবাবু!
বিনু উত্তর দিল না।
যুগল বলতে লাগল, পাখি আর আমার ব্যাপারটা আপনে তো হগলই জানেন দুটোবাবু। হেই জল সাতরাইয়া পাখি আমার নায়ে আইল, তারে গান শুনাইলাম, তার লেইগা ছোঁক ছোঁক করতে করতে টুনি বইনের বাড়ি যাইতাম–কী না জানেন আপনে! আপনেরে যদি বিয়ার সোময় না পাইতাম, কী দুঃখু যে হইত!
বিনু এবারও চুপ করে থাকল।
ধীরে ধীরে কার্তিকের রাত গাঢ় হতে লাগল।
.
২.০২
পরের দিন সকালেই নৌকো দিয়ে যুগলকে কেতুগঞ্জে পাঠিয়ে দিলেন হেমনাথ। মজিদ মিঞাকে নিয়ে সে যখন ফিরল, হেমন্তের সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছে।
কদিন আগেও দুপুরবেলাটা অসহ্য লাগত। চারদিকে এত গাছপালা, এত জল, স্নিগ্ধ সুশ্যাম মাঠ, এমন অঢেল হাওয়া, তবু সূর্য মাথার ওপর এলে তাতে গা পুড়ে যেত।
কার্তিক মাস পড়তেই সূর্যটা কেমন যেন জুড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। রোদের স্বভাব যাচ্ছে দ্রুত বদলে। দুপুরবেলাগুলোও এখন বেশ আরামদায়ক। হাওয়াতে টান ধরেছে। শীত যে আসছে, এ তারই ভূমিকা।
মজিদ মিঞাকে আনবার জন্যই যুগলকে পাঠানো হয়েছিল। যেতে-আসতে যুগলের দুপুর হয়ে যাবে। মোটামুটি সময়ের এই হিসেব ধরে হেমনাথ আর অবনীমোহন বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছিলেন। বিনুও সেখানে ছিল।
আন্দাজটা মোটামুটি সঠিক। জানলা দিয়ে বিনুরা দেখতে পেল, যুগলের নৌকো পুকুরঘাটে এসে ভিড়েছে। ভিড়বার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পাড়ে নামল মজিদ মিঞা। তারপর উল্লসিত, উত্তেজিত গলায় চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করল, আমার মিতায় কই? ঠাউর ভাই কই?
মজিদকে দেখে সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। হেমনাথ গলা তুলে বললেন, এই যে আমরা।
কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মজিদ মিঞা বলল, কথাখান কি সত্য ঠাউর ভাই? বলে হেমনাথের দিকে তাকাল।
হেমনাথ শুধোলেন, কোন কথা?
আমার মিতায় নিকি রাইজদায় থাইকা যাইব?
হ্যাঁ।
অত বড় মানুষটা, প্রায় অবনীমোহনের সমবয়সী–আনন্দে উত্তজনায় কী করবে, কী না করবে যেন ভেবে পেল না। ছুটে এসে বিনুকে কোলেই তুলে নিল, তারপর আবেগের গলায় বলল, যুগইলা গিয়া যহন এই কথা কইল, আমি তো বিশ্বাসই করি নাই।
হেমনাথ বললেন, ঘরে আয়–
সবাই ঘরে গেল। মজিদ মিঞা বিনুকে ছাড়ে না, তাকে কোলে নিয়েই তক্তাপোশ বসল। বিনু বারকতক উসসুখ করল, কিন্তু মুক্তি পাওয়া গেল না।
মজিদ মিঞা বলল, বিহানবেলা বাইর হইতে আছি, যুগইলা গিয়া হাজির। তারে দেইখা আমি আটাস (অবাক), মনে মনে এটু ডরও ধরছিল। দরকার পড়লে ঠাউর ভাই নিজেই আমার বাড়িত যায়, তয় যুগইলা আইল কেন? কী সম্বাদ হেয় (সে) লইয়া আইছে, কে জানে।
হেমনাথ শুধোলেন, তারপর?
মজিদ মিঞা আর বলতে পারল না। পুকুরঘাট থেকে যুগল এসে কখন যে চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়েছে, কারোর খেয়াল নেই। সে বলল, হেরপর আমি যহন কইলাম, জামাইকত্তারা (অবনীমোহনরা) এইহানেই থাকব তহন মিঞাভাই তেনার পোলাপানেরে ডাইকা, বাপেরে ডাইকা, মায়েরে ডাইকা, ভাবীজানরে ডাইকা, কেতুগঞ্জের বেবাক মাইনষেরে ডাইকা চাইর দিক উথাল পাথাল কইরা ফেলাইল। মিঞাভাইর মুখে খালি একখান কথা, আমার কইলকাতার মিতায় এইবার রাইজদাবাসী হইব।
মুখময় কাঁচাপাকা দাড়ি। তার ফাঁকে জগতের সরলতম হাসিটি হেসে মজিদ মিঞা বলল, কথাখান শুইনা আহ্লাদে আটখান হইয়া গেছিলাম। আহ্লাদ হইলে মাইনষেরে ডাইকা ডাইকা কমু না?
মজিদের আনন্দ, মজিদের আন্তরিকতা প্রাণের ভেতরটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। অভিভূত অবনীমোহন বললেন, হাজার বার বলবেন—
মজিদ মিঞা যেন শুনতে পেল না। ঘোরের ভেতর থেকে বলে উঠল, আইজ বিহান বেলায় যার মুখ দেইখা যে উঠছিলাম, জন্ম জন্ম য্যান তার মুখ দেইখাই উঠি।
একটুক্ষণ চুপ।
তারপর মজিদ মিঞা নীরবতা ভাঙল, অহন কন কিসের লেইগা ডাইকা পাঠাইছেন—
হেমনাথ বললেন, খুব দরকারী কথা আছে তোর সঙ্গে—
মজিদ মিঞা উৎসুক চোখে তাকাল।
হেমনাথ বলতে লাগলেন, এখন না, খাওয়াদাওয়া কর। তারপর ধীরে সুস্থে শুনিস।
মজিদ মিঞার তর আর সয় না। বলল, না, অহনই ক’ন।
এইসময় ভেতর-বাড়ি থেকে করিম এসে জানায়, রান্নাবান্না হয়ে গেছে। স্নেহলতা বলে দিয়েছেন, এক্ষুনি যেন সবাই চান টান করে নেয়।
হেমনাথ বললেন, ওই যে তলব এসে গেছে। এখন যদি বসে বসে কথা বলতে থাকি, তোর আমার কারোর মাথাই বাঁচবে না।
খাওয়াদাওয়ার পর পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারল না মজিদ মিঞা। খেতে বসে সে বলল, ঠাউর ভাই, আমি কিন্তুক সোয়াস্তি পাইতে আছি না।
হেমনাথ তাকালেন, কেন?
ক্যান আবার। যে কথা কওনের লেইগা ডাইকা আনলেন অহনও তা কইতে আছেন না—
হেমনাথ হেসে ফেললেন, তুই বড় অস্থির মজিদ
মজিদ মিঞা তক্ষুনি ঘাড় কাত করল, লাখ কথার এক কথা। সত্যই আমি বড় অস্থির। ধৈয্য বড় কম।
সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না হেমনাথ। মনে মনে খানিক চিন্তা করে একসময় শুরু করলেন, অবনীর খুব ইচ্ছে এখানে কিছু জমিজমা কেনে। চাষ-আবাদ করতে চায়–
মজিদ মিঞা লাফিয়ে উঠল, এ তো বড় আনন্দের কথা–
আগে সবটা শোন। তারপর লাফাস।
আইচ্ছা কন–
হেমনাথ বলতে লাগলেন, আমি তো জমিজমার খবর রাখি না। তুই এ ব্যাপারে দেখেশুনে কিছু ভাল জমি অবনীমোহনকে কিনে দে। দেখিস, পরে যেন আবার মামলা মোকদ্দমা না বাধে।
মজিদ মিঞা বলল, জমিন কিনতে হইব না। হেমনাথ অবাক, না কিনলে পাবে কোত্থেকে?
আমার দ্যাড় শ’ কানি জমিন আছে। তার থিকা তিরিশ কানি মিতারে দিয়া দিমু। শখ মিটাইয়া তেনি চাষবাস করুক।
অবনীমোহন অভিভূত। কেউ যে এমন অক্লেশে মাত্র দুদিনের আলাপে অতখানি জমি দিয়ে দেবার কথা বলতে পারে তা যেন অভাবনীয়। তবু বিব্রত বোধ করতে লাগলেন অবনীমোহন। বললেন, না না, আপনার জমি দেবেন কেন?
মজিদ মিঞা বলল, দিলামই না হয়। আপনে আমার আপনজন না?
নিশ্চয়ই আপনজন। তবে–
অবনীমোহন কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই মজিদ মিঞা বলে উঠল, নিজের ভাই-বন্দুরে কেও যদিন কিছু দ্যায় তা নিতে দোষের কিছু আছে?
অবনীমোহন বললেন, দোষের কিছু না—
তয়?
নেবারও তো সীমা থাকা উচিত।
মজিদ মিঞা কোনও কথাই শুনতে চায় না। বিনে পয়সায় তার জমি নিতেই হবে। না নিলে চারধারে তাবত মানুষকে বলে দেবে কেউ যেন অবনীমোহনের কাছে জমি না বেচে।
মজিদ মিঞা কিছুতেই দাম নেবে না। ওদিকে অবনীমোহনও দাম ছাড়া জমি নেবেন না।
শেষ পর্যন্ত হাসতে হাসতে হেমনাথই মধ্যস্থতা করলেন। বললেন, দ্যাখ মজিদ, তোর কথাটা বুঝতে পারছি। অবনীমোহনকে তুই নিজের জন ভাবিস। সেদিক থেকে কিছু দিলে হাত পেতে নেওয়াই উচিত। কিন্তু অবনীমোহনের দিকটাও ভেবে দ্যাখ–
কুন দিক?
দাম দিয়ে না কিনলে কোনও জিনিসই নিজের মনে হয় না। মনে হয় দান নিচ্ছি। অবনী যদি দাম দিতে না পারত সেটা ছিল আলাদা কথা। তাই বলছিলাম কি–
কী?
বাজারে যা দাম, তুই তার চাইতে কিছু কম নে। ওটুকু সুবিধা করে দিলেই অবনী খুশি। বন্ধু ছাড়া, নিজের লোক ছাড়া কে-ই বা তা দেয়।
একটু চুপ করে থেকে মজিদ মিঞা বলল, আপনে যা কইলেন তাই হইব। কুনোদিন আপনের অবাইধ্য তো হই নাই। তয় একখান কথা–
বল।
আমি যে দাম কমু তার বেশি সিকি পয়সা দিলেও কিন্তুক নিতে পারুম না।
বেশ, তাই হবে। হেমনাথ হাসলেন।
মজিদ মিঞা বলল, তরাতরি খাইয়া দাইয়া লন, আইজই মিতারে জমিন দেখাইয়া দিমু।
খাওয়াদাওয়ার পর বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া গেল না। একরকম তাড়া দিয়েই অবনীমোহন আর হেমনাথকে নৌকোয় নিয়ে তুলল মজিদ মিঞা। বিনু সঙ্গ ছাড়ল না, সেও ওঁদের সঙ্গে নৌকোয় উঠল।
যুগলের এখনও চান-খাওয়া হয়নি। ঠিক হল, মজিদ মিঞা নিজেই নৌকো বেয়ে যাবে।
বিনু অবাক হয়ে গিয়েছিল, জমি দেখানোর ব্যাপারে সবার চাইতে বেশি উৎসাহ মজিদ মিঞার। অবনীমোহনরা রাজদিয়াবাসী হলে জগতে তার মতো সুখী বুঝিবা আর কেউ হবে না।
হেমন্তের প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জমি দেখা শুরু হল। মাটি অবশ্য দেখা গেল না। কেননা, কার্তিকের শেষাশেষি এই সময়টায় মাঠে জল আছে। আর সেই জলের ওপর মাথা তুলে আছে থোকা থোকা–একটানা দিগন্ত পর্যন্ত–ধানের মঞ্জরী। যেদিকে যতদূর চোখ ফেরানো যাক, মাঠের ঝাঁপি পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
কদিন আগেও ধানের রং সবুজ দেখেছে বিনু। নরম তুষের ভেতর তখন সবে দুধ জমেছে। আর এখন? ধানের খেতকে আর চেনাই যায় না। কোনও যাদুকর শ্যামল মাঠকে সোনালি লাবণ্যে কখন ভরে দিল, কে জানে।
জমি দেখাতে দেখাতে বিকেল হেলে গেল। ধানের মঞ্জরীর ভেতর দিয়ে পথ করে নৌকো চলেছে তো চলেছেই।
একসময় মজিদ মিঞা অবনীমোহনের উদ্দেশে বলল, এতগুলান জমিন দেখাইলাম, কুনটা পছন্দ হইল কন–
অবনীমোহন বললেন, আমার তো সব জমিই ভাল লাগল। চমৎকার ধান হয়ে আছে।
জোরে জোরে মাথা নেড়ে মজিদ মিঞা বলল, উঁহু–
কী?
এই চকের সব জমিনই ভালা না মিতা। এইর ভিতর সরস নীরস আছে।
তাই নাকি?
হ–মজিদ মিঞা ঘাড় কাত করল।
অবনীমোহন বললেন, আমি তো বুঝতে পারছি না। সব জায়গাতেই সুন্দর ধান ফলেছে।
মিতা, আপনে ভালা কইরা ধানটা খেয়াল করেন নাই। করলে বুঝতেন, যেই জমিনে ঘন হইয়া মোটা গোছে ধানগাছ ফনফনাই উঠছে হেই জমিনই ভাল জমিন। আর যেই জমিনে ধানগাছ পাতলা পাতলা, হেই জমিন তত ভালা না।
সত্যি, আমি অতটা খেয়াল করিনি।
মজিদ মিঞা বলল, জমিন চিনা (চেনা) সহজ না।
অবনীমোহন বললেন, নিশ্চয়ই। আমি বলি কি, আর ঘোরাঘুরিতে দরকার নেই। আপনি যে জমি পছন্দ করে দেবেন, আমি তাই নেব।
কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হল। মজিদ মিঞা বলল, হেই ভাল।
জমি দেখার পর ফেরার পালা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে গেল।
.
২.০৩
দিন দুই পর অবনীমোহন কলকাতা রওনা হলেন। ওখানকার সব ব্যবস্থা করে ফিরতে ফিরতে এক সপ্তাহ। রাজদিয়ায় ফিরেই জমি রেজিস্ট্রি করার ইচ্ছা। হেমনাথ এবং মজিদ মিঞাকে এ ব্যাপারে সব বন্দোবস্ত করে রাখতে বলেছেন তিনি। দুপুরের স্টিমারে অবনীমোহন চলে গেলেন।
বিকেলবেলা পুবের ঘরে সুধা আর বিনু বসে ছিল। সুনীতি জানালার শিক ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে গাইছিল?
ভালবাসিবে বলে ভালবাসি নে
আমার এই রীতি,
তোমা বই জানি নে।
বিধু মুখে মধুর হাসি
দেখিলে সুখেতে ভাসি,
তাই তোমারে দেখিতে আসি,
দেখা দিতে আসি নে।
গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গেল সুনীতি।
সুধা বলল, বেশ তো গাইছিলি, থামলি কেন?
ঠোঁট টিপে সুনীতি বলল, তোর বিধু মুখে মধুর হাসি দেখবার জন্যে কে আসছে দ্যাখ সুধা। উঠে দ্যাখ–
সুধা, তার সঙ্গে বিনু জানালার বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল, বাগান পেরিয়ে এদিকেই আসছে হিরণ।
অনেক দিন পর হিরণ এ বাড়িতে এল। পুজোর আগে নাটক টাটকের ব্যাপারে নিয়মিত হানা দিত সে। পুজোর পার বার দুই মোটে তাকে দেখা গেছে। বিজয়ার পরের দিন একবার, আরেক বার কোজাগরীর রাত্তিরে। তারপর থেকে হিরণ নিরুদ্দেশ।
এই তো সেদিন তার সঙ্গে আলাপ। দেখামাত্র বিনুদের জয় করে নিয়েছিল হিরণ। বিশেষ করে সুরমা আর অবনীমোহনের তো খুবই ভাল লেগেছে তাকে।
নিয়ম করে যে দু’বেলা আসছিল, হঠাৎ পনের কুড়ি দিন তার খোঁজখবর নেই। সুরমা এবং অবনীমোহন চিন্তিত হয়েছেন, রোজই হিরণের কথা বলাবলি করেছেন। হেমনাথের অবশ্য দুর্ভাবনা। নেই। হিরণকে তিনি চেনেন। হাসতে হাসতে বলেছেন, ওটা এরকমই। এল তো দিনে দশ বারই এল। তারপর এমন উধাও হল যে বিশ পঁচিশ দিন আর পাত্তাই নেই। হিরণের স্বাভাব জেনেও তার খোঁজে যুগলকে কয়েক দিন পাঠিয়েছেন। যুগল এসে জানিয়েছে, হিরণ নেই। কোথায় গেছে, বাড়ির লোকেরা জানে না।
বাগান পেরিয়ে একটু পর হিরণ পুবের ঘরে চলে এল। খুশির সুরে বলল, তিন ভাইবোনই এখানে আছ দেখছি।
হ্যাঁ। সুনীতি ঘাড় কাত করল। কণ্ঠস্বরে দোলা দিয়ে বলল, আপনি তো বেশ লোক মশাই–
হিরণ হকচকিয়ে গেল, কেন?
সেই যে লক্ষ্মীপুজোর দিন এলেন, তারপর আর পাত্তাই নেই। বাড়িতে লোক পাঠিয়েও খোঁজ পাওয়া যায় না। কোথায় নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন?
মানিকগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ওরা কিছুতেই ছাড়ল না। দিন পনের কুড়ি কাটিয়ে আসতে হল।
বাঃ বাঃ, চমৎকার!
ভয়ে ভয়ে হিরণ জিজ্ঞেস করল, কী?
সুনীতি বলল, পনের কুড়ি দিন উধাও হয়ে থাকলেন। বাড়িতে একটা খবরও তো পাঠাতে হয়।
রোজই ভেবেছি পাঠাব। পাঠাব পাঠাব করে পাঠানো আর হয়নি, শেষ পর্যন্ত চলে এলাম।
বাড়ির লোকেদের দুশ্চিন্তায় ফেলে কী লাভ?
বাড়ির লোকেরা দুশ্চিন্তা করে না। মাঝে মাঝেই আমি ডুব দিই, সবার এতে অভ্যেস হয়ে গেছে। হিরণ বলতে লাগল, সে যাক গে। আজই মানিকগঞ্জ থেকে ফিরেছি। স্টিমারঘাটে নেমে একটা সুখবর পেলাম। শুনে আমাদের বাড়িতে একবার দেখা দিয়েই আপনাদের এখানে ছুটতে ছুটতে আসছি।
সুনীতি শুধলো, কী এমন সুখবর যে ছুটে আসতে হল?
উৎসাহের গলায় হিরণ বলল, আপনারা নাকি কলকাতায় ফিরছেন না; রাজদিয়াতেই থেকে যাবেন?
আপনাকে কে বললে?
জীবন ঘোষ।
জীবন ঘোষ আবার কে?
হিরণ হাসল, সবাইকে কি আপনি চিনবেন? স্টিমারটের পাশে সারি সারি মিষ্টির দোকান দেখেছেন তো?
সুনীতি মাথা নেড়ে জানালো, দেখেছে।
হিরণ বলল, প্রথম দোকানটা জীবন ঘোষের।
সুনীতি অবাক। বিস্ময়ের সুরে বলল, মিষ্টির দোকানদারদের কাছেও এ খবর পৌঁছে গেছে।
ইয়েস ম্যাডাম। হিরণ জিজ্ঞেস করল, খবরটা ঠিক তো?
ঠিক।
হিরণের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উৎফুল্ল সুরে বলল, সত্যি গুড নিউজ। আমার কী আনন্দ যে হচ্ছে!
সুনীতির কপাল কুঁচকে গেল। ঘাড়খানা ঈষৎ হেলিয়ে চোখ আধাআধি বুজে নীরস গলায় শুধলো, আমরা থাকব, তাতে আপনার আনন্দ কেন হবে মশাই? বলেই আড়ে আড়ে সুধার দিকে তাকাল।
সুধার অবস্থা অবর্ণনীয়। মুখ নিচু করে সমানে নখ খুঁটে যাচ্ছে সে, খুঁটেই যাচ্ছে।
এদিকে হিরণ থতমত খেয়ে গেছে। ফস করে জোরালো ঝলমলে আলো নিবে গেলে যেমন হয়, তার মুখের চেহারা অবিকল সেইরকম। কাঁপা শিথিল গলায় বলল, বা রে, আপনারা থাকলে আমার আনন্দ হবে না?
এমনিতে সুনীতি বেশ গম্ভীর, মৃদুভাষিণী। চপলতা তরলতা তার ধারে কাছে নেই। কিন্তু হিরণকে এতদিন পর পেয়ে আজ যেন কী হয়ে গেছে। আপন স্বভাবের কথা মনেই নেই সুনীতির। প্রগলভতার ঈশ্বর বুঝিবা তার ওপর ভর করে বসেছে। কপালে আরও ক’টা ভঁজ ফেলে, চোখ আরও ছোট করে সে বলল, আনন্দের একটা কারণ তো থাকবে। সেটা কী?
সুধা আর বিনুকে দ্রুত এক পলক দেখে নিয়ে বিব্রত, বিপন্ন মুখে হিরণ বলল, মানে–মানে–আপনারা হেমদাদুর আত্মীয়। তাই–
হেমদাদুর আত্মীয় তো আপনার কী? আনন্দ হলে হেমদাদুরই হওয়া উচিত। সুনীতি আজ বড়ই নির্দয়।
হিরণ কী বলবে, ভেবে পেল না। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, গলায় স্বর ফুটল না।
একটু নীরবতা।
তারপর অতি দ্রুত সুনীতির মুখচোখের চেহারা বদলে যেতে লাগল। গলাখানা আগের মতো ঈষৎ বাঁকিয়েই রাখল সে। চোখের তারা দুটো উজ্জ্বল কালো মণির মতো কৌতুকে ঝিকমিক করতে লাগল। ঠোঁটের প্রান্তে আধোগোপন একটুখানি হাসি। তার সারা গায়ে অদৃশ্য ঢেউয়ের মতো কী যেন খেলে বেড়াতে লাগল।
খুব চাপা গলায় সুনীতি হঠাৎ ফিসফিস করল, বুঝলেন মশাই—
চকিত হিরণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভীরু গলায় সাড়া দিল, কী?
খুব আনন্দ হয়েছে, না?
হিরণ চুপ। কী উত্তর দেওয়া ঠিক হবে তা যেন স্থির করে উঠতে পারছে না। ক্ষণে নিঠুরা ক্ষণে মধুরা–সুনীতির এইরকম দ্রুত স্বভাব-বদল আগে আর কখনও দেখেনি সে।
রঙ্গিণী নায়িকার মতো লীলাভরে হাত নেড়ে সুনীতি বলল, পনের কুড়ি দিন উধাও হয়ে থেকে আজ এসে বলছেন, আনন্দ হয়েছে। ওভাবে আনন্দ প্রকাশ করে না মশাই–
ইতিমধ্যে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে হিরণ। মুখ তুলে একবার সুনীতিকে দেখে নিয়ে বলল, কিভাবে তা হলে করে?
সুধার কাছে জেনে নিন। বলেই বিনুর দিকে ফিরল সুনীতি, চল রে বিনু, আমরা বাগানে যাই–
হিরণের চোখেমুখে আগের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। রঙ্গিণী এবং নির্দয়া, দুই রূপেই যে সুনীতি মজা করেছে, এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে হিরণ। মাথাটা সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকিয়ে সে বলল, আপনি সত্যিই মহানুভব।
বলছেন?
একশ’বার।
বিনুকে নিয়ে দু’পা গিয়েই হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে পেছন ফিরল সুনীতি। বলল, দুনিয়ার সব স্কুলকলেজ খুলে গেছে। আপনার ইউনিভার্সিটি এ বছর খোলার আশা আছে?
নিশ্চয়ই আছে। হেসে হেসে হিরণ বলল, আজ থেকে তিনদিন পর খুলবে।
ইউনিভার্সিটি খুললেই তো ঢাকায় গিয়ে থাকবেন?
তা তো থাকতেই হবে।
কিন্তু–
কী?
একটু ভেবে সুনীতি বলল, একটানা ঢাকায় গিয়ে থাকলে চলবে না। মাঝে মাঝে এখানে এসে আনন্দ প্রকাশ করে যাবেন, বুঝলেন?
মাথাটা অনেকখানি হেলিয়ে হিরণ বলল, আপনার আদেশ মাথা পেতে নিলাম।
সুনীতি আর কিছু বলল না। বিনুকে সঙ্গে নিয়ে ইঙ্গিতময় একটু হেসে বাগানের দিকে চলে গেল।
.
কিছুক্ষণ পর ছুটতে ছুটতে সুধা বাগানে এল। হেমন্তের বাতাসে তার পিঠময় খোলা চুল উড়ছে, চোখের তারায় আগুনের হলকা খেলে যাচ্ছে। বুকটা ঢেউয়ের দোলায় একবার উঠছে, একবার নামছে। সুধা যেন এখন রণরঙ্গিণী।
বিনু সুনীতি এখানেই ছিল। বাগানের উত্তর দিকে খালের ধার ঘেঁষে একটা রোয়াইল ফলের গাছ। হলুদ রঙের গোল গোল ফলগুলি যেমন টক তেমনি সুস্বাদু। সুনীতি কেঁচড় ভরে পেড়ে নিয়েছিল, বিনু নিয়েছিল পকেট বোঝাই করে। তারপর বাগানময় ঘুরে ঘুরে টপাটপ মুখে ফেলেছিল।
সুধা এসে সোজা সুনীতির একটা হাত চেপে ধরল। এত জোরে ধরেছে যে বাহুর কোমল মাংসে নখ বসে গেছে।
সুনীতি বলল, উঃ, লাগে। ছাড় সুধা–যন্ত্রণায় তার চোখমুখ কুঁচকে গেছে।
সুধা ছাড়ল না। ধারাল গলায় বলল এটা কী হল?
কোনটা?
আমাকে আর হিরণবাবুকে ওভাবে রেখে চলে এলি যে?
যন্ত্রণার মধ্যেও হেসে ফেলল সুনীতি। গলা নামিয়ে ফিসফিস করল, তোরা তাই চেয়েছিলি যে।
সুধা খুব রেগে গেল, কী চাই, তোর কানে কানে বুঝি বলেছিলাম?
বলতে হবে কেন?
তবে?
আমি কি কচি খুকি, কিছুই বুঝি না?
সুধা ভেংচি কাটার মতো করে বলল, কচি খুকি হবি কেন, তুই সব্বার ঠাকুমা। বুঝবি আবার না? একেবারে অন্তর্যামী হয়ে বসে আছিস।
সুনীতি হাসতে লাগল, আছিই তো।
সুধা এবার খেপে উঠল, আমাকে আর হিরণবাবুকে নিয়ে আবার যদি এরকম করিস খুব খারাপ হয়ে যাবে।
কৌতুকের গলায় সুনীতি বলল, সত্যি! শব্দটার ওপর কণ্ঠস্বরের সবটুকু জোর ঢেলে দিল সে।
সত্যি না তো মিথ্যে?
সুনীতি এবার এক কান্ডই করল। আঙুলের ডগায় পানপাতার সরু সুছাঁদ প্রান্তের মতো সুধার মনোহর চিবুকটি তুলে ধরে মাথা দুলিয়ে বলল, আমার বেলায় বুঝি মনে ছিল না?
সুধা বলল, তোর সঙ্গে আবার কী করলাম?
এর ভেতরেই ভুলে গেলি?
কিছু করলে তো মনে থাকবে।
সুর টেনে টেনে সুনীতি বলল, কিচ্ছু করো নি?
সুধা বলল, না।
আনন্দবাবু আর আমাকে নৌকোয় তুলে সেদিন ঠেলে দিয়েছিল কে? এবার মনে পড়েছে? সুধার চিবুকটা আরেকটু ওপরে তুলল সুনীতি।
সুধা এবার হেসে ফেলল, তাই বুঝি শোধ তুললি?
ঠিক তাই। এবার থেকে মনে রাখবি, এক মাঘে শীত যায় না।
রাখব, তুইও রাখিস।
দুই বোন হাত ধরাধরি করে হঠাৎ গলা মিলিয়ে হেসে উঠল।
.
২.০৪
হিরণ ভবতোষ কিংবা মজিদ মিঞাই শুধু নয়, বিনুরা যে এখন থেকে রাজদিয়াতে থাকবে, এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে, এ খবরটা জানতে রাজদিয়ার কারোর আর বাকি রইল না। এবং মুখে মুখে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
সকাল নেই দুপুর নেই, আজকাল লোক আসছেই। নিকারীপাড়া মৃধাপাড়া কুমোরপাড়া কামারপাড়া যুগীপাড়া ঋষিপাড়াই বা কেন, দূর দূরান্তের গ্রামগঞ্জ থেকে জলস্রোতের মতো মানুষ আসছে। বিনুরা এখানে থাকবে, তাদের প্রতিবেশী হিসাবে পাওয়া যাবে–এতে সবাই আনন্দিত, গর্বিত। আনন্দ আর গর্বের কথাটা তারা আন্তরিক সুরে বলে যেতে লাগল।
বিনুদের জন্য সারা রাজদিয়া জুড়ে উৎসব শুরু হয়ে গেছে বুঝি। তাদের থাকার কথা শুনে লোক যে ছুটে আসতে পারে তা যেন ভাবাই যায় না।
বিস্মিত, অভিভূত সুরমা তো বলেই ফেলেছেন, যেখানকার মানুষ এত ভাল সে জায়গা স্বর্গ।
দেখতে দেখতে অঘ্রাণ মাস পড়ে গেল।
একদিন সকালবেলা দুই দিদি আর ঝিনুকের সঙ্গে দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় পড়তে বসেছিল বিন। কলকাতায় গিয়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষা অবশ্য দিতে হবে না। সেদিক থেকে দুর্ভাবনা না থাকলেও জানুয়ারি মাসে অ্যাডমিসন টেস্ট দিয়ে এখানকার স্কুলে ভর্তি হতে হবে। তাই বই টইগুলোর সঙ্গে একটু আধটু যোগাযোগ রাখা দরকার।
পড়াশোনা যখন চলছে, হঠাৎ কোত্থেকে যুগল এসে হাজির। উঠোনের কোণ থেকে ইশরায় বিনুকে ডেকে নিয়ে খুব উৎসাহের সুরে বলল, ছুটোবাবু, কাউঠার মাংসা খাইছেন কুনোদিন?
বিনু বলল, কাউঠ্যা কী?
কাউঠ্যা চিনেন না?
না।
যুগল এবার এমনভাবে তাকাল যাতে মনে হয়, কাউঠ্যা’ না চেনার ফলে জীবন একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেছে বিনুর। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর কাউঠ্যা’ নামক প্রাণীটির রূপগুণ বংশ-পরিচয়ের বিবরণ দিতে শুরু করল সে, কাউঠ্যা জলে থাকে, গোল দেখতে। পিঠের চারাখান লোহার লাখান শক্ত। কাউঠ্যার লাখান আরেকখান জলের পোক আছেকাছিম। কাছিমের দুই ধারে যে বাদি আছে তা খাইতে লাগে নাইরকলের লাখান। চাবাইলে কচ কচ করে।
সবটা বলা হল না। আধাআধি শুনেই বিনু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, তুমি কচ্ছপের কথা বলছ?
হ হ, কচ্ছম–
তাই বল। আমি ভাবলাম, না জানি কী। কাউঠা কাউঠ্যা করলে লোকে কখনও চিনতে পারে?
এবার বিব্রত হবার পালা যুগলের। হাত কচলাতে কচলাতে সে বলল, কী করুম ছুটোবাবু, আমরা তো আর এংরাজি-মেংরাজি শিখি নাই। আমরা কাউঠ্যাই কই–
ইংরেজি শেখার সঙ্গে ‘কাউঠ্যা’ বলার সম্পর্ক কী, বিনু ভেবে পেল না। এ ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বলল, কচ্ছপ আমি ঢের দেখেছি, তবে তার মাংস খাইনি।
মাংস যদি খাইতে হয়, লন আমার লগে। এক শালারে জলের তলে উদ্দিশ কইরা এক-নাইলা (যার একটিমাত্র ফলা) টেটা নিতে আইছি। গিয়াই গাথুম। যুগল বলতে লাগল, টেটা নিতে আইসা আপনের কথা মনে পড়ল ছুটোবাবু। ভাবলাম ডাইকা নিয়া যাই–
মাংসের লোভ খুব একটা নেই। জলের তলায় কোথায় কচ্ছপ দেখে এসেছে যুগল, কিভাবে সেটাকে গেঁথে ওপরে তুলবে, তাই ভেবে উত্তেজনা বোধ করতে লাগল বিনু। উৎসাহের সুরে বলল, চল–
এটু খাড়ন, টেটাটা নিয়া আসি।
ছুটে গিয়ে নিজের ঘর থেকে এক ফলাওলা একটা টেটা এবং এক টুকরো চ্যাপ্টা ভারী লোহার পাত নিয়ে এল যুগল। বলল, লন যাই–
বইপত্তর দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় ছড়িয়েই রইল। যুগলের পিছু পিছু ছুট লাগায় বিনু। এই মুহূর্তে, কোথায় কোন অদৃশ্যে বসে জলতলের এক প্রাণী তাকে অবিরাম হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে যেন।
উঠোন বাগান পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই হঠাৎ বিনুর মনে সন্দেহ দেখা দিল। আস্তে করে সে ডাকল, যুগল–
যুগল তক্ষুনি সাড়া দিল, কী ক’ন ছুটোবাবু?
সংশয়ের গলায় বিনু বলল, তুমি তো সেই কখন কচ্ছপটাকে দেখে এসেছ। সে কি এতক্ষণ আমাদের জন্যে বসে আছে! গিয়ে হয়তো দেখব, পালিয়ে গেছে।
বিজ্ঞের মতো একটু হাসল যুগল, কাউঠ্যার চরিত্তির আপনে জানেন না ছুটোবাবু—
যুগল ঠিক কী বলতে চায়, বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকল বিনু।
যুগল আবার বলল, শালারা অ্যামন আইলসা (অলস) যে সহজে লড়তে চায় না। দিনের পর দিন এক জাগায় শুইয়া থাকতে ভালবাসে। আমি যে কাউঠ্যাটারে ইট্র আগে দেইখা আইছি, হেইটা ঠিকই উইখানেই থাকব। তয়–
তবে কী?
আর কারোর নজরে পড়লে অন্য কথা।
বিনু শুধলো, আর কেউ দেখলে কী হবে?
যুগল হাতের অস্ত্রটা দেখিয়ে বলল, এইরকম টেটা দিয়া গাইথা নিয়া যাইব গা।
একটু চুপ।
তারপর যুগলই আবার শুরু করল, জানেন ছুটোবাবু, নানান জাতের কাউঠ্যা আছে। জউলা কাউঠা, কালি কাউঠা, সুন্দি কাউঠ্যা–
এক নাগাড়ে কত নাম যে বলে গেল যুগল! শুনতে শুনতে অবাক হয়ে গিয়েছিল বিনু। বলল, এত রকম কচ্ছপ!
হ।
আমাকে চিনিয়ে দেবে?
নিয্যস দিমু।
যুগল আরও যা বলল তা এইরকম। পূর্ব বাংলার জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যত পশুপাখি ঘুরে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায়, তাদের সবাইকে চেনে সে। কেমন তাদের স্বভাব, কোথায় তাদের বসতি, কিভাবে তাদের ধরতে হয়, এ সব সম্বন্ধে তার বিপুল জ্ঞান, বিশাল অভিজ্ঞতা। নিজের অভিজ্ঞতার সমস্তটুকুই অকাতরে সে ছোটবাবুর হাতে তুলে দেবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিনুরা স্টিমারঘাটের দিকে হাঁটছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সেই কাঠের পুলটার ওপর এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল যুগল। দেখাদেখি বিনুও দাঁড়াল।
যুগল বলল, আমরা আইসা গ্যাছি ছুটোবাবু।
বিনু বলল, এখানেই তোমার কচ্ছপ আছে?
হ। দেখবেন আসেন–
পুলের তলা দিয়ে খাল গেছে। বিনুকে নিয়ে পুলের ডান দিকে একেবারে জলের ধারে এসে দাঁড়াল যুগল।
হেমন্তের মাঝামাঝি এই সময়টায় জল শান্ত, স্থির। কোথাও সামান্য ঢেউ পর্যন্ত নেই।
খালের দিকে আঙুল বাড়িয়ে যুগল বলল, উই দ্যাখেন ছুটোবাবু, শালার কাউঠ্যা উইখানে আরাম কইরা শুইয়া আছে।
বিনু তাকাল। পলকহীন, তীক্ষ্ণ চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও অঘ্রাণের নিস্তরঙ্গ খালে অতল কালো জল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
পাশ থেকে সাগ্রহে যুগল শুধলো, দেখতে নি পাইছেন?
বিনু মাথা নাড়ল, না।
ভালা কইরা ঠওর করেন।
চোখদুটো আরও শাণিত করল বিনু। কিন্তু কোথাও কচ্ছপের চিহ্ন নেই। সে বলল, কোথায় তোমার কচ্ছপ?
ধিক্কারের গলায় যুগল বলল, কী চৌখ আপনের ছুটোবাবু! সামনে রইছে, অথচ দেখতে পান। উই যে দ্যাখেন–
এবার বিনু দেখতে পেল, অনেকক্ষণ পর পর জলের অতল থেকে একটা দুটো করে বুদ্বুদ উঠে আসছে।
বিনু বলল, ওগুলো তো বুজকুড়ি–
হ। উইগুলির তলেই শালার কাউঠা শুইয়া রইছে আর গলা বাইর কইরা পুটুর পুটুর ভুরভুরি ছাড়তে আছে। খাড় বউয়ার ভাই, এইবার তোমার নীলা সাঙ্গ করি–
যুগলের হাতে যে অস্ত্রটা ছিল, তার চেহারা মোটামুটি এইরকম। সরু মতো লম্বা একটা বাঁশের মাথায় ইস্পাতের ধারাল ফলা আটকানো। ফলার কাছাকাছি জায়গায় বাঁশটাকে ঘিরে সেই ভারী লোহার পাতটা পরিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল যুগল। ফলে ওটার ওজন বেড়ে গেল অনেকখানি। তারপর পুলের কিনারে এসে বুদ্বুদগুলি নিশানা করে খুব আস্তে টেটাটা ছুঁড়ে দিল।
আস্তে ছুড়লে কী হবে, লোহার পাতের ভারে অস্ত্রটা তীরের মতো জলের অতলে নেমে গেল।
একটু পর টেটার বাঁশ ধরে যুগল যখন টেনে তুলল, দেখা গেল, ফলার মাথায় সত্যি সত্যিই একটা কচ্ছপ। ফলাটা তার নরম মাংসল গলা ভেদ করে ওধারে চলে গেছে।
যুগল বলল, অঘ্ঘান পৌষ মাসে জল যহন থির হইয়া যায়, হেই সময় কাউঠারা কী করে জানেন ছুটোবাবু? জলের তলে গলা বাইর কইরা উয়াস ছাড়ে, হেই দেইখা ঠাওর করতে হয়। মনে থাকব তো? বলতে বলতে ক্ষিপ্র হাতে টেটার ফলা খুলে দড়ি দিয়ে কচ্ছপটার চার পা বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিল।
আজ থেকেই পাঠ শুরু করে দিয়েছে যুগল। বিনু বলল, থাকবে।
লন, এইবার বাড়ি যাই।
বাড়ির দিকে সবে পা বাড়িয়েছে, হঠাৎ বিনু দেখতে পেল, ডান ধারে ঠিক খালের ওপারে অদ্ভুত ধরনের বড় বড় সাতখানা নৌকো দাঁড়িয়ে আছে। রাজদিয়ায় আসার পর অনেক রকম নৌকো দেখেছে বিনু-গাছি, শালতি, কোষ, মহাজনী ভর। কিন্তু এইরকম নৌকো প্রথম দেখল।
অপার বিস্ময়ে বিনু শুধলো, ওগুলো কিসের নৌকো যুগল?
একপলক দেখে নিয়ে যুগল বলল, উইগুলা বেবাইজা (বেবাজিয়া) বহর। অনেক কাল পরে বেবাইজারা রাইজদায় আইল। লন যাই, ওগো ডাইকা বাড়িত লইয়া যাই–বলেই ছুটল।
যুগলের পেছনে ছুটতে ছুটতে বিনু বলল, বেবাইজা কী?
গ্যালেই বুঝতে পারবেন।
খানিকটা ছুটবার পর ডান ধারে খালের ওপর দিয়ে বাঁশের সাঁকো। সেটা পেরুলেই ওপারে সারি সারি বেবাজিয়া নৌকোর বহর।
সাঁকোর কাছাকাছি এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যুগল ডাকতে লাগল, বেবাইজা হে-এ-এ-এ—
ওপার থেকে কেউ সাড়া দিল, কিবা কও-ও-ও–
কার বহর?
আঞ্জুমান বেবাইজানীর।
মুখ ফিরিয়ে এবার বিনুর দিকে তাকাল যুগল, চিনা মানুষ। আঞ্জুমান বেবাইজানীরা বচ্ছরে একবার আমাগো এইহানে আসে–
সেই কৌতূহলটা মনের ভেতর টগবগ করছিল। বিনু আবার শুধলো, বেবাইজা কী বললে না তো–
ঈষৎ বিরক্ত হল যুগল, আপনের আর তর সয় না ছুটোবাবু। কইলাম, অগো বহরে গ্যালেই ট্যার পাইবেন। তা না–
বিনু কিছু বলল না, ঘাড় গোঁজ করে রইল।
বিনুর চোখমুখ দেখে হয়তো করুণাই হয়ে থাকবে। যুগল বলল, বাইদ্যা কারে কয় জানেন তো?
এতক্ষণে মনে পড়ে গেল। বেবাইজা শব্দটা আজই প্রথম শুনছে না বিনু, আগেও একবার শুনেছে। সেদিন রাত্রিবেলা সুজনগঞ্জের হাট থেকে ফেরার সময় মাঝনদীতে তাদের একটা বহরও দেখেছিল। ঢেঁড়াওলা হরিন্দ তার দুই সাকরেদ কাগা গাকে নিয়ে সেই বহরে উঠে কোন এক ইসলামপুরের দিকে পাড়ি জমিয়েছিল।
শব্দটা ঠিক বেবাইজা নয়, বেবাজিয়া। অর্থাৎ বেদে। এই জলের বেদেদের যে বেবাজিয়া বলে, বিনু কেমন করে জানবে? সেদিন হাট থেকে ফেরার সময় হেমনাথ তা কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
কলকাতায় ইরানী যাযাবরদের দেখেছে বিনু, ভূগোল বইতে আরব বেদুইনদের কথাও পড়েছে। তারা সব স্থলচর জীব, হেঁটে হেঁটে অথবা উটের পিঠে দেশদেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই খাল বিল-নদীর রাজ্যে তা তো আর সম্ভব নয়, নৌকোয় নৌকোয় জলচর মাছের মতো এখানকার বেবাজিয়ারা ভেসে বেড়ায়।
বিনু বলল, তোমাকে আর বুঝিয়ে দিতে হবে না। বেবজিয়াদের আমি আগেও দেখেছি।
যুগল বলল, ‘আগে দেইখা থাকলে বেবাইজা কী’ ‘বেবাইজা কী’ কইরা আমারে পাগল কইরা মারতে আছিলেন ক্যান?
আমার মনে পড়ছিল না যে।
একটু নীরবতা।
কাউঠ্যা নিয়া আর বেবাইজা বহরে যামু না। শালারে এইহানে বাইন্ধ্যা রাইখা যাই। হাতের কচ্ছপটাকে সাঁকোর সঙ্গে দ্রুত বাঁধতে লাগল যুগল।
বিনু কিছু বলল না।
বাঁধাছাদা হয়ে গেলে যুগল শুধলো, সাঁকো পার হইতে পারবেন নি ছুটোবাবু?
সরু একখানা বাঁশের ওপর দিয়ে ওপারে যেতে হবে। দু’ধারে যদিও হাত তিনেক উঁচুতে ধরনি (ধরবার জন্য অন্য একটি বাঁশ) রয়েছে, তবু বুক কাঁপতে লাগল বিনুর। আগে আর কখনও সাঁকো পার হয় নি সে।
অন্য সব ব্যাপারে যুগলের কাছে প্রচুর বীরত্ব দেখিয়েছে বিনু, কিন্তু সাঁকো পারাপারের কথায় তার মুখখানা ভারি করুণ দেখাল। মাথা নেড়ে আস্তে করে সে বলল, না।
আপনে কুনো কামের না ছুটোবাবু। আসেন, আমার হাত ধইরা পার হইবেন।
যুগলের হাত ধরে খাল পেরুতে পেরুতে তলার দিকে তাকাল বিনু। সাঁকোর অনেক নিচে অথৈ জল। একবার যদি হাত ফসকে যায়? যদিও সাঁতার শিখেছে, বুকের ভেতরটা টিপ টিপ করতে লাগল তার।
ওপারে গিয়ে যুগল চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কই গো বেবাইজা বেবাইজানীরা, কই গেলা হগল? বাইর হও দেখি–
যুগলের ডাকাডাকিতে নৌকোগুলোর ভেতর থেকে অদ্ভুত ধরনের জনাকয়েক মেয়ে পুরুষ বেরিয়ে এল।
সেদিন রাত্রিবেলা সুজনগঞ্জ থেকে ফেরার সময় মাঝনদীতে অন্য একটা বেদে-বহর সামনে পড়েছিল। একজন বেবাজিয়ার গলার আওয়াজও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারে তাদের স্পষ্ট দেখা যায় নি। আজ দিনের আলোয় জগতের বিচিত্র এক মানবগোষ্ঠীর দিকে অসীম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল সে।
মেয়েগুলোর পরনে ইরানী নৌকোর পালের মতো চিত্রবিচিত্র ঘাঘরা এবং খাটো খাটো জামা। রুক্ষ চুলে কাঠের কাকুই, টানা চোখে ছুরির ধার। হাতে পায়ে মেহেদি মাখা। সারা গায়ে অঢেল উদ্দাম যৌবন। পুরুষগুলির পরনে হয় ডোরাকাটা লুঙ্গি, নতুবা কুঁচি-দেওয়া ঢোলা পা-জামা। মাথায় ধনেশ পাখির পালক গোঁজা। সারা গায়ে তাদের উল্কির আঁকিবুকি। পাখি সাপ গরু ছাগলকত রকমের ছবি যে আঁকা!
মেয়ে হোক পুরুষ হোক, সবাই অত্যন্ত নোংরা, অপরিচ্ছন্ন। তাদের চিটচিটে পোশাক থেকে দুর্গন্ধ উঠে আসছে। মুখটুখ ধোবার অভ্যাস নেই, দাঁতের ওপর এক ইঞ্চির মতো পুরু হলুদ রঙের সর পড়ে আছে। হাত-পায়ের নখ বড় বড়। সেগুলোর মাথা খানিক ভেঙেছে, খানিক ক্ষয়ে গেছে।
যুগল বলল, তোমরা রাইজদা আইলা কবে?
একটি বেদেনী উত্তর দিল, আইজ, বিহান বেলায়—
থাকবা কয় দিন?
চকিদারে (চৌকিদারে) যা বাইন্ধা দিছে হেই আড়াই দিন। হের বেশি তো থাকনের উপায় নাই।
হ। হে তো ঠিক কথাই। যুগল মাথা নাড়ল। তারপর চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, হগলরে দেখতে পাই, কিন্তুক এই বহর যার হেই আঞ্জুমান বেবাইজানীরে তো দেখি না। হে গেল কই?
এই যে আমি পেছন দিক থেকে চিলের মতো তীক্ষ্ণ, সরু গলায় কেউ চেঁচিয়ে উঠল।
মুখ ফেরাতেই বিনু দেখতে পেল, সব চাইতে বড় নৌকোটার গলুইতে একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো পাটের ফেঁসোর মতো লালচে, জট পাকানো। গায়ের চামড়া কুঁচকে শিথিল। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, ঢিলে একটা খোলসই বুঝি পরে আছে। সারা গায়ে বেবাজিয়া পুরুষদের মতো উল্কি এবং রুপোর ভারী ভারী গয়না–মেখলা, তেঁতুলপাতা হার, চুটকি, কানে গোলাকার মস্ত চাকতি।
এত বয়স হয়েছে আঞ্জুমানের, তবু চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য সজীব। যেমন ধারাল তেমনি দূরভেদী। চিকন তীরের মতো তা বুঝি বুকের ভিতরে বিধে যায়।
যুগলও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এক মুখ হেসে বলল, আরে, এই যে তুমি। আছ ক্যামন?
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী বলল, ভালাই। বলেই ভুরুর ওপর হাত রেখে শুধলো, তুমি কেউগা? চিনা চিনা লাগে–
আমার নাম যুগল–
যুগল! চোখমুখ কুঁচকে স্মৃতির ভেতর কিছুক্ষণ হাতড়ে বেড়াল আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী। তারপর বলল, তোমারে কই দেখছি কও তো বাসী–
যুগল বলল, হ্যামকত্তার বাড়ি। আমি তেনার কাছে কামলা খাঁটি।
হ হ, এইবার মনে পড়ছে। চোখের তারায় হঠাৎ যেন আলো খেলে গেল আঞ্জুমান বেবাজিয়ানীর। সাগ্রহে শুধলো, হ্যমকত্তায় ক্যামন আছে?
যুগল বলল, ভালা, হ্যামকত্তায় কুনো সোময়ে মোন্দ থাকে না।
দেখা যাচ্ছে, এই ভবঘুরে যাযাবরের দলও হেমনাথকে চেনে। বিনু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল বিনুর ওপর। কিছুক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, অ যুগইলা, এই পোলাগা ক্যাঠা?
যুগল বলল, হ্যামকত্তার নাতি।
তাই নিকি?
হ।
ক্যামন নাতি? আমি জানতাম হ্যামকত্তার পোলা-মাইয়া নাই। তয় এই নাতিখান আইল কই থনে?
অঞ্জুমান বেবাজিয়ানী সোজা সহজ হিসেবটাই ধরে নিয়েছে। অর্থাৎ ছেলেমেয়ে থাকলে তবেই তো নাতি-নাতনীর সম্ভাবনা। যার ছেলেমেয়ে নেই তার ও সব আসবে কোত্থেকে? আকাশ থেকে নিশ্চয়ই পড়তে পারে না!
বিনুর সঙ্গে হেমনাথের সম্পর্কটা বুঝিয়ে দিল যুগল।
আঞ্জুমান বলল, হেই কও। ভাগনীর পোলা। কিন্তুক–
কী?
আমরা তো বচ্ছর বচ্ছর রাইজদা আসি। আইলেই হ্যামকত্তার বাড়ি যাই। কিন্তুক তেনার ভাগনী, ভাগনীর ঘরের নাতি-নাতকুড়েরে তো দেখি নাই।
যুগল বলল দেখবা ক্যামনে? ওনারা তো এইখানে এই পেরথম আইল।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী শুধলল, আগে আছিল কই?
বিনুরা কোথায় ছিল, যুগল জানিয়ে দিল।
এবার বিনুর দিকে ফিরে আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী সস্নেহে ডাকল, আসো গো ভাই, আমাগো নায়ে আসো–
দেশ-দেশান্তরের বেদেদের সম্বন্ধে অনেক ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছে বিনু। আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী ডাকতে তার বুকের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল। নিজের অজান্তে সে গিয়ে দাঁড়াল যুগলের পেছনে। ভীরু গলায় বলল, না।
এইটা ক্যামন কথা হইল! তুমি আমাগো হ্যামকত্তার নাতি। এই তরি (এখন পর্যন্ত) আইসা বহরে না আইলে মন নি ভালা লাগে? আসো আসো, ইট্টু মিঠাই খাইয়া যাও। তোমার নানার বাড়ি গিয়া আমরা কত কী খাইয়া আসি। কত খাতির পাই।
বিনু উত্তর দিল না, চুপ করে থাকল। তার মনোভাব বুঝতে পেরেছিল যুগল। বলল, আপনে কইলকাতার পোলা, বেবাইজা দেইখা ডরান?
বিনু এবারও চুপ।
যুগল বলল, অরা চিনা মানুষ। লন যাই। আহ্লাদ কইরা ডাকলে যাইতে হয়।
ভয়ও হচ্ছিল, আবার বেদে-বহর সম্বন্ধে অপার কৌতূহলও বোধ করছিল বিনু। সেদিন সুজনগঞ্জ থেকে ফেরার সময় হেমনাথ জানিয়েছিলেন, এই জলের দেশে বেবাজিয়ারা নৌকোয় নৌকোয় ভেসে বেড়ায়। নৌকোতেই তাদের ঘর-সংসার। এখানে শিশু জন্মায়, বুড়োরা মরে। যৌবন অসীম সম্ভবনায় এখানেই পুষ্পিত হয়ে ওঠে। জগতের বিচিত্র ভাসমান এই মানবগোষ্ঠী নৌকোর ওপরেই জীবনের ধারা অব্যাহত রাখে। শোক-দুঃখ, সুখ-আনন্দ, জন্ম-মৃত্যু, জীবনের এমন কোনও লীলাই নেই যা পাঁচ-সাতখানা হাজারমণী বিশাল নৌকোর মধ্যে ঘটে না যায়।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী আবার ডাকল, আসো গো শ্যামকত্তার নাতি। আমাগো ঘর-গিরস্থালি দেইখা যাও। ডরের কিছু নাই–
বুড়ি বেদেনী কি অন্তর্যামী? বেদে-বহরের ভেতরটা দেখার খুবই ইচ্ছা, তবু নিজের থেকে বিনু হয়তো যেত না। যুগলই একরকম জোর করে তাকে বেদে-বহরে নিয়ে তুলল।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী শুধলো, আগে কী করবা কও?
বেদেনী কী বলতে চায়, বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকল বিনু।
আঞ্জুমান এবার বুঝিয়ে দিল, আগে পান-তামুক-মিঠাই খাইবা, না আমাগো ঘর-গিরস্থালি দেখবা?
বিনু বলল, পান-তামাক আমি খাই না।
বুড়ি বেদেনী বেশ রঙ্গিণী। কপালে একটা চাপড় মেরে বলল, আ আমার কপাল!
ভয়ে ভয়ে বিনু শুধলো, কী হল?
রসাল কৌতুকের গলায় আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী বলল, পান খাও না, তামুক খাও না, কেমনতরো পুরুষ তুমি! বলতে বলতে বাদামী ভুরুর তলায় তার নীলচে চোখের মণি খাঁচার পাখির মতো ছটফট করতে লাগল।
বিনু এবার আর কিছু বলল না। তার মুখচোখ দেখে আঞ্জুমান কী বুঝল, কে জানে। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাউক থাউক, পান-তামুক খাইতে হইব না। বলতে বলতে আঙুলের ডগায় বিনুর থুতনিটা তুলে অল্প অল্প নাড়তে লাগল, অখনও মোচ গজায় নাই, এক্কেরে পোলাপান। আগে দাড়িমোচ গজাউক, পুরুষমানুষ হও। হের পর পান-তামুক খাইও। অহন মিঠাই খাও।
শুধু মিঠাই না, পাকা অমৃতসাগর কলা আর ক্ষীরাইও বিনুদের খেতে দিল আঞ্জুমান। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে সারা বহর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিজেদের ঘর-সংসার দেখাতে লাগল।
মোট সাতখানা নৌকো। একটা নৌকোয় শুধু সাপের ঝাপি। ছোটবড়, চৌকো, গোল–নানা আকারের অগণিত বেতের ডালা পর পর সাজানো। সেগুলোর ভেতর অসংখ্য রকমের সাপ– শঙ্খচূড়, কালজাতি, দুধরাজ, খরিস, লাউডগা, পাহাড়ী অজগর, শামুকভাঙা, চন্দ্ৰবোড়া। আরও কত কী!
একেকটা ডালা খোলে আঞ্জুমান, আর বিদচমকের মতো সাঁ করে সাপগুলো লেজের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। লিকলিকে সরু জিভ বার করে ফণা দোলাতে দোলাতে কুটিল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। আঞ্জুমান তাদের নাম-ধাম বংশ-পরিচয় মুখস্থ বলার মতো গড় গড় করে বলে যায়। সাপ দেখতে দেখতে এবং তাদের ইতিহাস শুনতে শুনতে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছিল বিনুর।
কোনও নৌকোয় শুধুই বিছানা। কালো চিটচিটে শতরঞ্চি-জড়ানো কাঁথা বালিশের স্তূপ একেবারে ছইয়ের মাথা পর্যন্ত ঠেকেছে। একটা নৌকোয় এসে দেখা গেল, সেখানে শুধু পশু আর পাখি। ছাগল, গরু, খচ্চর, ভেড়া, গোটা দুই বাঁদর এবং অগুনতি খাঁচার ভেতর নানারকম পাখি–শালিক, ময়না, টিয়া, মোহনচূড়া, ঝুটকলি, সিদ্ধিগুরু, কোড়াল, এমন কি বাজও রয়েছে।
আঞ্জুমানের পিছু পিছু ঘুরতে ঘুরতে শেষ নৌকোখানায় এসে পড়ল বিনুরা। বেবাজিয়া বহরের এটাই সব চাইতে ছোট নৌকো। আঞ্জুমান বলল, এইটা আমাগো পান্হা ঘর–
আঞ্জুমানকে অনেকক্ষণ দেখছে। বুড়ি বেদেনীর সহজ, আন্তরিক ব্যবহারে ভয় কেটে গিয়েছিল। বিনু শুধলো, পান্হা ঘর কী?
দেখ– সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল আঞ্জুমান।
দেখা গেল, উঁচু একটা বেদির ওপর মাটির সপ্তনাগ। তার মাথায় দেবী মনসার সিংহাসন। এমন মানসা-মূর্তি আগে আর কখনও দেখে নি বিনু। মাথার পেছন থেকে বরুণ ছত্র ধরেছে কালীয় নাগ। খরিস আর শঙ্খচূড় সাত লহর হার হয়ে বুকের কাছে ঝুলছে। মণিবন্ধে কঙ্কণ হয়েছে খৈজাতি। দেবীর সুডৌল বক্ষকুম্ভ কাঁচুলি হয়ে ঢেকেছে চক্রচুড় আর উদয়নাগ। লাউডগা আর কালচিতি, চন্দ্ৰবোড়া আর গোক্ষুর বুনে বুনে ঘাঘরা বানানো হয়েছে। দেবীর কটিতট থেকে তা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, আঙুলে আঙুলে অঙ্গুরী হয়েছে সুতোশঙ্খ। পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে মল হয়েছে দাঁড়াস। কর্ণভূষণ হয়ে দোদুল দুলছে সাদা চিতির ফণা। দেবীর চোখে বিষের কাজল, নিশ্বাসে গরল ঝরছে যেন অবিরল।
মনসামূর্তির সামনে অনেকগুলো ধুনুচি। সেগুলো থেকে ধূপের গন্ধ উঠে আসছে। খানকতক পেতলের সরাও চোখে পড়ল, সেগুলোতে কাঁচা দুধ আর সবরি কলা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানী বলল, এইটাই আমাগো আসল জাগা। মা মনসার ঘরে আমরা কুনো পাপ করি না, শত্রুরও যদি এইখানে আইসা আশয় লয় তার গায়ে হাত তুলি না। রোজ সন্ধ্যায় মনসার নামে এইখানে ছদ্গা (উৎসর্গ) হয়। আমরা বেবাইজা মাইয়ারা তখন ল্যাংটা হইয়া ধূপতি (ধুনুচি) নাচ নাচি। ‘ছদ্গা’র সময় পুরুষমানুষ এই ঘরে আইতে পারে না।
সবটা বুঝতে না পারলেও বিনু এটুকু বুঝল, এই পাহা ঘর বেদেদের কাছে অতি পবিত্র জায়গা। এখানে এমন কিছু তারা করে না যা অশুচি, যা অন্যায়, যা ধর্মবিরুদ্ধ।
আরও কিছুক্ষণ গল্পটল্প করার পর যুগল হঠাৎ বলল, অনেকখানি সোময় তোমাগো এইহানে কাটাইয়া গ্যালাম। অহন আমরা যাই।
আঞ্জুমান বলল, আইচ্ছা—
আমাগো বাড়ি যাইবা তো?
নিয্যস য্যামু। রাইজদায় আইসা হামকত্তার বাড়িত যামু না, আমার ঘেটিতে কয়টা মাথা! হেয়া ছাড়া–
কী?
কইলকাতা থনে তেনার নাতি আইছে, নাতিন আইছে, ভাগনী আইছে। যাইতে আমাগো হইবই। বিকালে যামু।
আইচ্ছা। এই বেলা ছুটবাবুরে কিছুই দেখাইলা না। উই বেলা গিয়া সাপখেলা দেখাইবা কিলাম।
দেখামু।
মনসার গান শুনাইবা—
শুনাম।
বিনু এইসময় বলে উঠল, যাবে কিন্তু। নিশ্চয়ই যাবে।
কিছুক্ষণ পর বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে বেদেদের সম্বন্ধে আরও কিছু চমকপ্রদ খবর দিল। যুগল। এরা অদ্ভুত জাত। মনসা পুজোও করে, আবার কেউ কেউ নামাজও পড়ে। অনেক খ্রিস্টানও এখানে এসে জুটেছে। সাপখেলা, বাঁদারখেলা, ছাগলখেলা, নানারকম শারীরিক কসরত এবং ভেল্কিবাজি দেখিয়ে ওরা পয়সা রোজগার করে। তা ছাড়া, সাপে কামড়ালে ওঝাগিরিও করে। কিন্তু এসব দিনের আলোর ব্যাপার। রাতের অন্ধকারেই ওদের আসল খেলা–সেটা হল চুরি। যেখানে বেবাজিয়া বহর ভেড়ে সে জায়গায় বাসিন্দাদের চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। সর্বক্ষণ তারা তটস্থ হয়ে থাকে।
আঞ্জুমান বেবাজিয়ানীরা এসেছে। রাজদিয়াতে এবার চুরির ধুম পড়ে যাবে।
.
বিকেলবেলা সত্যি সত্যিই আঞ্জুমান হেমনাথের বাড়ি এল। তার সঙ্গে এসেছে দু’টো যুবতী বেদেনী। আঞ্জুমান এবং তার সঙ্গিনীদের মাথায় পর পর সাজনো অনেকগুলো করে সাপের ঝাপি।
বাগান পেছনে ফেলে বার-বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই আঞ্জুমান চিলের মতো সরু গলায় পেঁচিয়ে উঠল, কই গ্যালেন হগলে–
বেদেনীরা যে আসবে সে খবর বাড়ি ফিরে ওবেলাই দিয়ে রেখেছিল বিনু। আঞ্জুমানের গলা পেয়ে সুরমা সুধা সুনীতি স্নেহলতা বিনু কিংবা যুগল-কেউ আর ঘরে বসে থাকতে পারল না। এধার থেকে ওধার থেকে ছুটোছুটি করে বেরিয়ে এল।
মাথা থেকে সাপের ঝাপি মাটিতে নামাল আঞ্জুমান। তারপর স্নেহলতার দিকে ফিরে বলল, আইলাম গো বইনদিদি– বলে হাসল।
স্নেহলতাও হাসলেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
আইজই আমরা রাইজদায় আইছি।
শুনেছি।
আঞ্জুমান বলতে লাগল, অন্য হগল বার এইহান থিকা যাওনের দিন আপনেগো বাড়ি আসি। এইবার কিলাম পেরথম দিনই আইলাম।
স্নেহলতা উত্তর দিলেন না। হাসিটুকু তার ঠোঁটে স্নিগ্ধ আভার মতো লেগে রইল।
আঞ্জুমান আবার বলল, এইবার রাইজদায় আইসা আমি আটাস (অবাক)!
স্নেহলতা উৎসুক হলেন, কেন?
বিহান বেলায় আপনেগো যুগইলার লগে এউকা সোন্দর ফুটফুইটা পোলা আমাগো বহরে গেছিল। শুনলাম পোলাগা নিকি আপনের নাতি। শুইনা আমার ধন্দ লাইগা গেল।
কেন?
আমি তো জানতাম আপনেগো পোলা মাইয়া নাই। নাই-ই যদিন, নাতিখান আইল কই থিকা? শ্যাষে যুগইলাই কইল, পোলাগা আপনের ভাগনীর ঘরের, কইলকাতা থিকা আসছে।
স্নেহলতা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
অঞ্জমান বলল, বিহান বেলায় নাতি গিয়া কইল সাপের খেলা দেখব, আমাগো আইতেও হইল। বড় মুখ কইরা নাতি দাওয়াত কইরা আইছে। হেই লেইগা পেরথম দিনই আইলাম।
ভাল করেছ।
টিয়াপাখির মতো লাল টুকটুকে ঠোঁট নেড়ে আঞ্জুমান বলল, মেলা কথা তো হইল। এইবার ভাগনী ভাগনী-জামাই দেখান। নাতিরে দেখছি, নাতিন দেখান।
স্নেহলতা বললেন, ভাগনী-জামাই তো দেখাতে পারব না। ক’দিন হল সে কলকাতায় গেছে। অন্য সবাই আছে, তাদের দেখাচ্ছি।
সুরমা সুধা এবং সুনীতির সঙ্গে আঞ্জুমানের আলাপ করিয়ে দিলেন স্নেহলতা।
আঞ্জুমান বলল, হগলের লগে আলাপ-সালাপ হইল, ভাগনী-জামাইরেই খালি দেখলাম না। আ আমার কপাল! বলতে বলতে তার চোখ সুরমার ওপর স্থির হল, আ গো বইনদিদি
স্নেহলতা সাড়া দিলেন কী বলছ?
ভাগনী আমাগো এমুন কাহিল ক্যান? শরীলখানে কিছু নাই য্যান ফুঁ দিলে উইড়া যাইব।
হ্যাঁ, ও ভারি রোগা। শরীরটা একেবারেই সারছে না। ওকে নিয়ে আমাদের বড্ড ভাবনা।
একটু চুপ করে থেকে আঞ্জুমান বলল, বাতাস লাগছে মনে লয়।
স্নেহলতা প্রায় হতাশার সুরেই বললেন, কী জানি, ক’বছর ধরেই তো এরকম চলছে। ডাক্তার কবিরাজ, ওষুধ বিষুধ বার মাস লেগেই আছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আঞ্জুমান বলল, ভাগনীরে একখান শিকড় দিয়া যামু। তামার তাবিজে ভইরা ভাগনীর কমরে (কোমরে) পরাইয়া দিয়েন। সাইরা যাইব।
আচ্ছা।
এবার সুধা সুনীতিকে ভাল করে লক্ষ করল আঞ্জুমান। বলল, কপালে সিন্দুর নাই, নাতিন দু’গা অবিয়াত মনে লাগে–
হ্যাঁ।
নাতিনগো বিয়ার সোময় দাওয়াত য্যান পাই। বলেই সুধা সুনীতির কাছে গিয়ে হাত ঘুরিয়ে ছড়া কাটল :
আইবা নি ভাই, যাইবা নি–
নাতিন খাওয়াইব সাধের মেজবানি!
বেদেনীর রকমসকম দেখে সুধা সুনীতি খিলখিল করে হেসে উঠল।
স্নেহলতা বললেন, নেমন্তন্ন তো করব, তোমাদের পাব কোথায়? ঘরদুয়ার কি কিছু আছে তোমাদের? সারা বছর শুধু ভেসে ভেসেই বেড়াও
কাক-পক্ষীর কাছে খবর দিয়া দিয়েন, ঠিক উড়াল দিয়া আইসা পড়ুম। আঞ্জুমান হাসতে লাগল।
খানিক নীরবতা।
তারপর আঞ্জুমান আবার শুরু করল, হগলের লগে দেখাশুনা হইল, হ্যামকত্তারেই খালি দেখি না।
তেনি কই?
স্নেহলতা বললেন, দুপুরবেলা আবদুলাপুর গেছে।
ফিরলে আমাগো কথা কইয়েন।
বলব।
পারলে আমাগো বহরে য্যান যায়।
আচ্ছা।
আঞ্জুমান বলল, আলাপ সালাপ হইয়া গেল। এইবার আমাগো পান-তামুক খাওয়ান গো বইনদিদি–
তার মুখ থেকে কথা খসবার আগেই যুগল আর করিম ছুটে গিয়ে তামাকের ডিবে, পানের ডাবর, আগুনের মালসা, হুঁকোটুকো নিয়ে এল। তারপর তামাক সেজে হুঁকোর মাথায় কলকে বসিয়ে আমাদের হাতে দিল। আঞ্জুমান এবং তার দুই সহচারী পালা করে তামাক খেতে লাগল এবং আয়েস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
বিনু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বেদেনী হলেও আঞ্জুমানেরা মেয়েমানুষ। আগে আর কখনও মেয়েমানুষকে তামাক খেতে দেখে নি বিনু। পায়ে পায়ে যুগলের কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাকল, এই–
যুগল মুখ ফেরাল, কী ক’ন।
ফিসফিস গলায় বিনু বলল, ওই দেখ, বেজিয়ানীরা তামাক খাচ্ছে।
বিনু ঠিক কী বলতে চায়, বুঝতে না পেরে যুগল তাকিয়ে থাকল।
পরে খুব সহজ গলায় যুগল বলল, খাইব না ক্যান? নিশার জিনিস হগলেই খাইতে পারে। তার পুরুষমানুষ মাইয়ামানুষ নাই। খালি কি এই বাইদানীরাইকামারপাড়ায়, যুগীপাড়ায় ঘুইরা দ্যাখেন গা। হগল বাড়িতেই দু’গা চাউরগা কইরা মাইয়ামানুষ হুক্কা খায়।
যত সহজে যুগল কথাগুলো বলল, ঠিক তত সহজে মেনে নিতে পারল না বিনু। আবার কী বলতে যাচ্ছিল সে, ঠিক সেইসময় সাপের ঝাঁপি খুলল বেদেনীরা। তিনটে কাঁপ থেকে তিনটে কাল কেউটে বিদ্যুৎচমকের মতো সাঁ করে লেজের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল।
এদিকে একটা বেদেনী তুমড়ি বাঁশ বার করে বাজাতে শুরু করেছে। বাঁশির তালে তালে সাপ তিনটে ফণা দোলাতে লাগল।
একজন বাঁশি বাজাচ্ছে। সাপের নাচের সঙ্গে সঙ্গে আঞ্জুমান সরু গলায় সুর করে গান ধরল :
চান্দ্ রাজার দাপট গেল বাতাসে মিশিয়া–
তৃতীয় বেদেনীটি গাইল :
হায় বিষহরির দোয়া!
আঞ্জুমান এক কলি করে গায়। তৃতীয় বেদেনীটি, হায় বিষহরির দোয়া’ বলে ধুয়ো ধরে। এই ভাবে গান চলতে লাগল।
বেউলা সতী কান্দে শোন আলুথালু হইয়া–
হায় বিষহরির দোয়া।
কালনাগিনী খাইল আজি সোনার লখাইরে–
হায় বিষহরির দোয়া।
সোনার অঙ্গ ভাসাইল গাঙ্গুনীর নীরে–
হায় বিষহরির দোয়া।
তাহার দোয়ায় সূর্য্য ওঠে পুবের আকাশে–
হায় বিষহরির দোয়া।
পরান পাইয়া ভেলায় বইসা লখাই হাসে–
হায় বিষহরির দোয়া।
গান চলছে। তার মধ্যেই যুগল ডেকে উঠল, ছুটোবাবু—
চোখকান ধ্যানজ্ঞান বেদেনীদের দিকে রেখে সাড়া দিল বিনু।
যুগল শুধলো, এইটা কী গান জানেন?
না।
ভাসানের গান। মা মনসা আছে না?
হ্যাঁ।
মনসার গানেরে ভাসানের গান কয়। মনে কইরা রাইখেন।
বিনু মাথা হেলিয়ে দিল, মুখে কিছু বলল না।
যুগল আবার বলল, অখন থনে আপনেরা তো এই দ্যাশে থাকবেন। শাওন মাসের শ্যাষে যহন মনসা পূজা হইব তহন থিকা ঘরে ঘরে ভাসানের গান শুনতে পাইবেন।
তাই নাকি?
হ।
গানটানের পর সাপ খেলা দেখিয়ে ক্ষীর-মুড়কির ফলার করল বেদেনীরা। আরেক প্রস্থ পান তামাক খেল। তারপর বকশিস হিসেবে একডালা ধান, চার আনা পয়সা, কিছু আনাজপাতি আদায় করল।
পান চিবুতে চিবুতে আঞ্জুমান বলল, এইবার যাই গো বইনদিদি—
স্নেহলতা বললেন, এখনই যাবে?
হ। চকিদারে থাকতে তো দিব আড়াই দিন। এইর ভিতরে রাইজদার হগল বাড়ি যাইতে হইব। বাড়ি তো আর এউক্কা দু’গা না–
বেবাজিয়ানীরা সাপের ঝাপি, ধানের ডালা টালা মাথায় চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল।
স্নেহলতা বললেন, আবার এস।
আঞ্জুমান বলল, এইবার আর আসন হইব না বইনদিদি। আইতে আইতে হেই ফিরা বচ্ছর।
হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল স্নেহলতার। তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, চলে তো যাচ্ছ, ভাগনীকে শিকড় দিয়ে গেলে না?
আমার লগে তো নাই। নায়ে আছে। যুগইলারে আমার লগে পাঠাইয়া দ্যান, দিয়া দিমু অনে।
আঞ্জুমানদের সঙ্গে যুগলকে বেদে-বহরে পাঠিয়ে দিলেন স্নেহলতা।
.
২.০৫
অবনীমোহন বলেছিলেন, দিন সাতেকের ভেতর কলকাতার সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসবেন। ফিরতে ফিরতে দু সপ্তাহ কেটে গেল।
সন্ধেবেলা পুবের ঘরের তক্তপোষে সুধা-সুনীতি-বিনু এবং ঝিনুক গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পড়তে বসেছিল। তাদের সামনে দুটো ঝকঝকে হেরিকেন।
হেমনাথও এই ঘরেই আছেন। তক্তপোষের ধার ঘেঁষে একটা ক্যাম্প খাট। তার ওপর কাত হয়ে শুয়ে মূল বাল্মীকি রামায়ণ পড়ছেন।
সময়টা অঘ্রাণের মাঝামাঝি। নিয়ম অনুয়ায়ী পৌষ থেকে শীত শুরু। নিয়ম যা-ই থাক, এ বছর শীতের যেন আর তর সইছে না, তার বড় তাড়া। হেমন্ত থাকতে থাকতেই হিমঋতু এসে দরজায় দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। কদিন ধরেই এলোমেলো উত্তরে বাতাস ছেড়েছে। আজ যেন সেটা হিমালয়ের বরফ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছে। কাজেই বিনুরা চাদর বা কম্বল, যে যা পেরেছে তাই জড়িয়ে পড়তে বসেছে।
এখন কৃষ্ণপক্ষ। বাইরে যতদূর চোখ যায়, চাপ চাপ অন্ধকার। চাঁদটা আজ নিরুদ্দেশ। আকাশ পুকুর বা ধানখেত-কিছুই বোঝা যায় না। সব অদৃশ্য, নিরবয়ব। শুধু কাছাকাছি যে জোনাকিরা উড়ছিল তাদের দেখা যাচ্ছে। আলোর ছুঁচের মতো এই পোকাগুলো অন্ধকারকে বিধে বিধে যাচ্ছিল।
হঠাৎ বাইরের উঠোন থেকে অবনীমোহনের গলা ভেসে এল, বিনু, সুধাকে আছিস রে, একটা আলো, টালো নিয়ে আয়। বড্ড অন্ধকার–
বিনু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর চেঁচামেচি জুড়ে দিল, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে–
সুধা সুনীতি সামনের হেরিকেন দুটো নিয়ে বাইরে ছুটল। হেমনাথও রামায়ণ রেখে ব্যস্ত গলায় ডাকাডাকি শুরু করলেন, কোথায় গো, কোথায় গেলে সব–অবনী এসেছে–বলতে বলতে বাইরে এলেন। তার পিছু পিছু ঝিনুকও এল।
চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘরের দিক থেকে স্নেহলতারাও ছুটে এলেন।
উঠোনের মাঝখানে অবনীমোহন দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার পেছনে তিন চারটে কুলি। কুলিদের মাথায় গন্ধমাদন চাপানো।
হেমনাথ বললেন, বড্ড ঠাণ্ডা। এস এস–ঘরে এস অবনী–
আলো দেখিয়ে অবনীমোহনকে ঘরে আনা হল। কুলিরা বারান্দায় মালপত্র নামিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেল।
এখন সবাই অবনীমোহনকে ঘিরে বসে আছে। স্নেহলতা বললেন, তুমি কেমন মানুষ বল তো অবনী! সাতদিনের নাম করে গিয়ে চোদ্দ দিন কাটিয়ে এলে। না একটা খবর, না একটা কিছু।
অবনীমোহন অপ্রতিভের মতো হাসলেন, ঝামেলা মেটাতে মেটাতে দেরি হয়ে গেল।
হেমনাথ বললেন, আজ যে আসবে আগে জানালে না কেন? লালমোহন কি ভবতোষের ফিটন। নিয়ে স্টিমারঘাটে যেতাম। স্টিমারঘাট থেকে আমাদের বাড়ি তো একটুখানি পথ নয়। শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলে।
অবনীমোহন বললেন, ভেবেছিলাম চিঠি লিখে জানাব। তারপর কেমন যেন আলস্য লেগে গেল। লিখি লিখি করে আর লেখা হল না।
সুরমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার মুখ বাঁকালেন, চিরদিন ওই এক স্বভাব।
আবনীমোহন হাসতে লাগলেন।
একটু নীরবতা। তারপর হেমনাথ বললেন, কলকাতার সব কাজ হয়ে গেছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আর যাবার দরকার নেই?
আজ্ঞে না। সমস্ত ঝাট চুকিয়েই এসেছি।
খানিক ভেবে হেমনাথ এবার শুধোলেন, তারপর বল, কলকাতায় গিয়ে কী দেখলে। ওখানকার হালচাল কী?
অবনীমোহন নড়ে চড়ে বসলেন। তাকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখাল। বললেন, ওই ফিরেই আপনাকে খবরটা দেব, তা নয়। কথায় কথায় একেবারে ভুলে গেছি।
হেমনাথ উৎসুক হলেন, কী খবর?
আপনি যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, অক্ষরে অক্ষরে তা মিলে গেছে মামাবাবু।
কিরকম, কিরকম?
সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। ইউরোপের যুদ্ধ বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসছে। পরশু রাত্তিরে কলকাতায় প্রথম ব্ল্যাক-আউটের মহড়া হয়ে গেল। ট্রেঞ্চ খুঁড়ে খুঁড়ে শহরটার কী অবস্থা যে করেছে! পনের ষোল দিনের খবরের কাগজ এনেছি। পড়লেই বুঝতে পারবেন–
উত্তেজনায় হেমনাথের গলা কাঁপতে লাগল, কোথায় খববের কাগজ?
আমার সুটকেসে–
অবনীমোহন উঠতে যাচ্ছিলেন, বাধা পড়ল। স্নেহলতা বললেন, উঁহু উঁহু, এখন না। যুদ্ধ নিয়ে মাতলে রাত কাবার হয়ে যাবে। ট্রেনে স্টিমারে দু’দিন কাটিয়ে এসেছে ছেলেটা। আগে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিক। তারপর ওসব হবে।
হেমনাথ তক্ষুনি সায় দিলেন, সেই ভাল, সেই ভাল। যাও অবনী, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে নাও।
সারা গায়ে দু’দিনের ক্লান্তি মাখা। আর আছে ট্রেন-স্টিমারের ধুলো। অবনীমোহন একেবারে স্নানই সেরে নিলেন।
হেমনাথের ধৈর্য থাকছিল না। পুবের ঘর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, তোমার স্নান হয়েছে অবনী?
ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে অবনীমোহনের গলা ভেসে এল, হয়েছে।
তা হলে এখানে চলে এস।
যাই মামাবাবু।
অবনীমোহন আবার যখন পুবের ঘরে এলেন তখন তার গায়ে দু’দিনের ধুলোবালি-ঘাম-মাখা পোশাক নেই। তার বদলে পাটভাঙা ধবধবে ধুতি আর হাফ শার্ট। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। গালে, গলায় এবং ঘাড়ের কাছে এখনও ফোঁটা ফোঁটা জল। স্নানের পর ভাল করে মোছেন নি বোধহয়।
এবার হেমনাথ গলা তুলে স্ত্রীকে ডাকলেন, স্নেহ–স্নেহ– এই বয়সেও স্ত্রীকে তিনি নাম ধরে ডাকেন।
রান্নাঘরের দিক থেকে স্নেহলতা সাড়া দিলেন, কী বলছ?
অবনীর খাবার এ ঘরে দিয়ে যাও—
আচ্ছা।
একটু পরে স্নেহলতা এলেন। তার এক হাতে কাঁসার থালা, তাতে ঘি-মাখানো চিড়ে ভাজা, নারকেল-কোরা আর দুটো চমচম সাজানো। আরেক হাতে চায়ের কাপ।
স্নেহলতা বললেন, এখন তোমাকে ভাত দিলাম না অবনী—
অবনীমোহন বললেন, না না, এখনই ভাত খাব কী, সবে তো সন্ধে। এখন চা-ই খাই।
হেমনাথ অধীর হয়েই ছিলেন। বললেন, খেতে খেতে কলকাতার কথা বল। যুদ্ধের হালচাল কিরকম দেখে এলে, শোনাও–
চায়ে চুমুক দিয়ে অবনীমোহন বললেন, অবস্থা খুব খারাপ মামাবাবু। পরশুর আগের দিন রাত্তির থেকে কলকাতায় ব্ল্যাক আউট আর এয়ার-রেড প্রিকশানের মহড়া চলছে। চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব।
এ কথা তো তুমি তখন বললে।
বলেছি নাকি?
হ্যাঁ। হেমনাথ ঘাড় কাত করলেন। সাগ্রহে শুধোলেন, তা মহড়াটা কিরকম হচ্ছে?
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, সন্ধের পর কলকাতার সব আলো নিবিয়ে সাইরেন বাজানো হয়। শকুনের কান্নার মতো কাঁপা কাঁপা একটানা সুর। তখন রাস্তায় কেউ থাকতে পারে না। হয় কাছাকাছি কোনও বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতে হবে। নইলে পার্ক টার্কের ট্রেঞ্চে গিয়ে লুকোতে হবে। তা না হলে এ-আর-পি’র লোকেরা ধরে নিয়ে যাবে। এক ঘণ্টা কি দুঘন্টা বাদে অল ক্লিয়ার সাউন্ড বাজলে আবার বাইরে বেরুনো চলবে।
তক্তপোষের একধারে বসে দম বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিল বিনু, চোখে পলক পড়ছিল না। রাত্রিবেলা সব আলো নিবে যাবার পর নির্জন রাস্তায় একটানা কান্নার মতো কোনও সুর যদি বাজতে থাকে, কলকাতা শহর কতখানি ভীতিকর হয়ে উঠতে পারে? ভয়ের সে ছবিটা পুরাপুরি কল্পনা করতে পারল না বিনু, তবে তার গা ছমছম করতে লাগল।
হঠাৎ বিনু বলে উঠল, সাইরেন কী?
অবনীমোহন তার দিকে ফিরে বললেন, শত্রুদের বিমান আক্রমণের আগে হুঁশিয়ার করে দেবার জন্যে একরকম সুর বাজানো হয়, তাকে বলে সাইরেন।
বিনুর কৌতূহল অসীম। সে আবার বলল, এ-আর-পি কাকে বলে? ট্রেঞ্চ কী?
অবনীমোহন বুঝিয়ে দিলেন।
একটু চুপ।
তারপর হেমনাথের দিকে আবার ঘুরে অবনীমোহন বললেন, আপনি শেষ কবে কলকাতায় গিয়েছিলেন মামাবাবু?
এক মুহূর্তও না ভেবে হেমনাথ বললেন, নাইনটিন টোয়েন্টি ফাইভেসেই যেবার দেশবন্ধু মারা গেলেন। উঃ, কলকাতায় সে শোকের দৃশ্য কোনওদিন ভুলব না। বলতে বলতে অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ হয়ে গেলেন হেমনাথ। তার চোখের সামনে শোকাচ্ছন্ন বিহ্বল মহানগর যেন ছবির মতো ফুটে উঠেছে।
অবনীমেহন বললেন, সেই কলকাতাকে এখন চিনতেই পারবেন না। পার্ক আর ফাঁকা জায়গা যেখানে যতটুকু পেয়েছে। ট্রেঞ্চ খুঁড়ে খুঁড়ে সর্বনাশ করে রেখেছে। শুধু কি ট্রেঞ্চ, প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির সদরে ব্যাফল ওয়াল তোলা হয়েছে, সেগুলোর সামনে বালির বস্তার স্তূপ। স্টেশনে, সিনেমা। হাউসে, রাস্তায়-ঘাটে–যেখানে যাবেন শুধু গভর্নমেন্টের পোস্টার।
কিসের পোস্টার?
নানা রকমের। যেমন গুজবে কান দেবেন না, গুজব রটাবেন না, দলে দলে সেনাবাহিনীতে নাম লেখান, দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করলে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
হেমনাথকে বেশ চিন্তিত দেখাল। কপাল জুড়ে এলোমেলো গভীর রেখা ফুটতে লাগল তার। ধীরে ধীরে বললেন, তোমার কী মনে হয় অবনী?
কী ব্যাপারে? অবনীমোহন জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।
কলকাতায় বোমা পড়তে পারে?
তার খুবই সম্ভাবনা।
কেমন করে বুঝলে?
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, এই তো পরশুর আগের দিন এক সরকারি বড়কর্তা মিস্টার সেমন্ড রেডিওতে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ফার ইস্টে অবস্থা যেভাবে ঘোরালো হয়ে উঠছে, তাতে কলকাতায় যে কোনওদিন বিমান আক্রমণ ঘটতে পারে। নইলে–
হেমনাথ শুধোলেন, নইলে কী?
এত ব্ল্যাক-আউট, এত ট্রেঞ্চ খোঁড়াখুঁড়ি আর এয়ার-রেড প্রিকশানের ঘটা চলছে কেন?
অন্যমনস্কের মতো হেমনাথ বললেন, তা তো বটেই। একটু চুপ করে থেকে গম্ভীর মুখে আবার বললেন, যুদ্ধ বাংলাদেশে এসে হাজির হলে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। সব ছারখার হয়ে যাবে। ওয়ারের আফটার এফেক্ট যে কী, ভাবতেই শিউরে উঠছি।
অবনীমোহন এবার আর কিছু বললেন না।
হেমনাথ বললেন, কলকাতায় আর কী দেখলে বল।
চারদিকে মিলিটারি ছাউনি পড়েছে। যেখানে যাবেন সেখানেই মিলিটারি। রাস্তাঘাটে যত গাড়ি দেখবেন তার বেশির ভাগই মিলিটারির-হেভি ট্রাক আর জিপের জন্যে হাঁটাই মুশকিল। মনে হয়, সমস্ত শহরটা মিলিটারির হাতে চলে গেছে। বলতে বলতে হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল অবনীমোহনের, আরেকটা ব্যাপার চোখে পড়ল মামাবাবু–
উৎসুক সুরে হেমনাথ জানতে চাইলেন, কী?
ব্যাঙের ছাতার মতো অলিতে গলিতে ব্যাঙ্ক গজাচ্ছে। পুজোর আগে যখন এখানে এলাম তখনও এত ব্যাঙ্ক দেখিনি। আমার তো ধারণা রোজ একটা করে ব্যাঙ্ক জন্মাচ্ছে।
যুদ্ধ বেধেছে, ইনফ্লেশন আরম্ভ হয়ে গেছে, ব্যাঙ্ক তো গজাবেই। দেখবে, টাকা এখন হাওয়ায় উড়তে থাকবে।
থাকবে কি, উড়তে শুরু করে দিয়েছে।
চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হেমনাথ তাড়া লাগালেন, এবার খবরের কাগজ বার কর অবনী–
হিন্দুস্থানী কুলিরা বারান্দায় বাক্স টাক্স এবং মালপত্তর নামিয়ে রেখে গিয়েছিল। অবনীমোহন বাইরে গিয়ে সুটকেস খুলে মাসখানেকের খবরের কাগজ বার করলেন।
কাগজগুলো হাতে পাওয়া মাত্র হেমনাথ ঝুঁকে পড়লেন। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগলেন, ২রা নভেম্বর। গ্রিসে ইতালীয় বাহিনীর অগ্রগতি। বৃটেন কর্তৃক টিরানায় বোমাবর্ষণ। তুরস্ক বর্তমানে যুদ্ধ বর্জন করিয়া চলিবে–প্রেসিডেন্ট ইনেনুর ঘোষণা।
৩রা নভেম্বর। মহারানী ভিক্টোরিয়ার জন্মস্থান কেনসিংটন প্রাসাদ বোমাবিধ্বস্ত। জার্মানির উপর প্রবল আক্রমণ–রাজকীয় বিমান-বহরের দাবী। জাপান হইতে আমেরিকানদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। রাষ্ট্রপতি আজাদ কর্তৃক কংগ্রেসের জরুরি অধিবেশন আহ্বান। ভারতরক্ষা আইনে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু গ্রেপ্তার, কারা প্রাচীরের অন্তরালে বিচার।
৪ঠা নভেম্বর। গ্রীসের সাহায্যার্থে বৃটিশ সেনাবাহিনীর অগ্রগতি। জাপান কর্তৃক শত্রুপক্ষের নৌবহর বাজেয়াপ্ত। জার্মান-অধিকৃত দেশগুলিতে-পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, চেকোশ্লোভাকিয়া, হল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ইত্যাদি ইত্যাদি নাৎসীদের নিদারুণ অত্যাচার।
৫ই নভেম্বর। দারদানেলেস সমস্যার সমাধান, জার্মানির মধ্যস্থতা। সোভিয়েট রাশিয়ার সহিত ইটালির সঙঘর্ষের সম্ভাবনা তিরোহিত। ডানিয়ুব সম্মেলন। বৃটিশ নোটের উত্তরে সোভিয়েট বক্তব্য এইরূপ, আমরা এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকিব। মলোটভের ইঙ্গিতপূর্ণ বার্লিন পরিদর্শন। দীর্ঘ ছাপ্পান্ন দিন পর লন্ডনবাসীদের একটি বোমাবর্ষণহীন রাত্রি অতিবাহিত।
৬ই নভেম্বর। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সম্প্রসারণ, ভারতবর্ষের যুদ্ধকালীন পরিকল্পনা। সমর-প্রস্তুতির প্রাথমিক ব্যয় তেত্রিশ কোটি টাকা। পরবর্তী প্রতি বছরে ব্যয় ষোল কোটি টাকা। অর্থের জন্য নূতন কর বসানো হইবে।
৭ই নভেম্বর। রুজভেল্ট তৃতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত। পশ্চিমের মরু রণাঙ্গনে বৃটিশ ট্যাঙ্কবাহিনী।
৮ই নভেম্বর। কালিনিনের সতর্কবাণী, রাশিয়া যুদ্ধ বর্জন করিয়া চলিবে। তবে কেহ তাহার সীমানা অতিক্রম করিতে চাহিলে চুর্ণ করিয়া দেওয়া হইবে।
৯ই নভেম্বর। আয়ারল্যান্ড নিরপেক্ষতা বজায় রাখিয়া চলিবে–ডি ভ্যালেরার ঘোষণা। টাওয়ার অফ লন্ডন বোমাবিধ্বস্ত। সোভিয়েট বাহিনীর প্রস্তুতি, সারা দেশে আপৎকালীন অবস্থা। ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি সভা। রাজেন্দ্র প্রসাদ, কৃপালনী, গান্ধীজি, পন্থ, রাজাগোপালাচারি, প্রফুল্ল ঘোষ, শঙ্কর রাও দেও প্রভৃতি নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি।
১০ই নভেম্বর। ফুয়েরার কর্তৃক সর্বপ্রকার সমর সম্ভার দিয়া মুসোললিনিকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত। পরলোকে চেম্বারলেন। মিউনিক প্যাক্টের জনক, ইতিহাসে যাঁহাকে গৌরবময় ব্যর্থতা’ আখ্যা দেওয়া হইয়াছে, তিনি আর নাই। নর্থের পর এমন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী বৃটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনও দেখা যায় নাই।
১১ই নভেম্বর। আফ্রিকার মরু অঞ্চলে যুদ্ধ সম্প্রসারিত। গাবান রক্ষার্থে ফরাসি সিদ্ধান্ত। জেনারেল দ্য গলের দৃঢ়তা।
১২ই নভেম্বর। হিটলার কর্তৃক বার্লিনে মলোটভের সংবর্ধনা। রুদ্ধদ্বার কক্ষে দীর্ঘ আলোচনার সময় রিবেনট্রপের উপস্থিতি। ফুয়েরার কর্তৃক অক্ষশক্তির প্রতি সোভিয়েট সাহায্য প্রার্থনা। সোভিয়েট সংবাদপত্রগুলি এ ব্যাপারে নীরব। লন্ডনে জল্পনা-কল্পনা।
পূর্ব রণাঙ্গনে ভয়াবহ জাপানি আক্রমণ। হাইনান ও ফরমোসায় বিপুল সৈন্য সমাবেশ। সায়গন, ফরাসি ইন্দোচিন ও কামরণ উপসাগরে অতর্কিত আক্রমণে সম্ভাবনা। সিঙ্গাপুরে চাঞ্চল্য।
১৭ই নভেম্বর। দীর্ঘ বিরতির পর লন্ডনে প্রবলতম বোমাবর্ষণ, প্রচন্ড নৈশ আক্রমণ। লণ্ডনবাসীদের ভুগর্ভে আশ্রয় গ্রহণ।
১৮ই নভেম্বর। সর্দার প্যাটেল কারারুদ্ধ। সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে মামলা। ভুলাভাই দেশাই কর্তৃক সত্যাগ্রহের সিদ্ধান্ত।
হেমনাথ পড়ে যেতে লাগলেন।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল বিনু। কোথায় টিরানা, কোথায় আড্রিয়াটিক সাগর আর এজিয়ান সাগর, কোথায় দারদানেলেস আর ডানিয়ুব এবং ইন্দোচিন-ভূগোলের কোন প্রান্তে এই নামগুলো ছড়িয়ে আছে, কে বলবে। বিনুর কল্পনা অতদূর পৌঁছয় না। কালিনিন কি রিবেনট্রপ, ডি ভ্যালেরা কিংবা টিমোশেঙ্কো, গোয়েবলস অথবা ইনে–এই সব নাম যাঁদের, তাদের চেহারাগুলো কতখানি ভয়াবহ তাই বা কে জানে।
কাগজ পড়া শেষ করে হেমনাথ মুখ তুললেন। অবনীমোহনের উদ্দেশে বললেন, অবস্থা তা হলে রীতিমতো ঘোরালোই হয়ে উঠেছে।
তাই তো মনে হচ্ছে। অবনীমোহন মাথা নাড়লেন।
আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় রাশিয়া এই যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারবে?
কী জানি, বুঝতে পারছি না।
খানিক চিন্তা করে হেমনাথ বললেন, চারদিকে যেরকম বেড়া আগুন তাতে রাশিয়া কতদিন গা বাঁচিয়ে থাকতে পারবে, সেইটেই হচ্ছে কথা। টার্কি বা আয়ারল্যান্ড নিউট্রাল থাকুক বা যুদ্ধে নামুক, তার গুরুত্ব তেমন নয়। কিন্তু রাশিয়ার মতো এত বড় দেশ যদি যুদ্ধে নামেওয়ারের চেহারাই যাবে বদলে।
সংশয়ের সুরে অবনীমোহন বললেন, এই তো সেদিন রাশিয়ায় রেভোলিউশন হয়ে গেল, এর মধ্যে যুদ্ধ করার মতো শক্তি কি ওদের হয়েছে?
একটা ব্যাপার তুমি বোধ হয় লক্ষ কর নি।
কী?
বৃটেন আর জার্মানি–দুই দেশই চাইছে রাশিয়া নিউট্রাল থাক। এর অর্থ কী?
অবনীমোহন উৎসুক চোখে তাকালেন।
হেমনাথ বলতে লাগলেন, নিশ্চয়ই তার শক্তি আছে। যে পক্ষে রাশিয়া যাবে তার পাল্লা ভারী হবে। শত্রুর পাল্লা ভারী হোক, কে-ই বা তা চায়। একটু থেমে আবার বললেন, একটা কথা তোমার খেয়াল নেই অবনী–
কী?
রেভোলিউশনের পর রাশিয়ার খবর দুনিয়ার লোক বিশেষ কিছুই জানে না। চারদিকে আয়রন কারটেন ফেলে ভেতরে ওরা কতদুর এগিয়ে গেছে, কে বলবে। আমার তো ধারণা, ধীরে ধীরে খুবই শক্তিধর হয়ে উঠেছে।
অবনীমোহন কিছু বললন না, আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। হেমনাথের কথাগুলো খুবই যুক্তি সঙ্গত। তার বিপক্ষে বলবার মতো কিছুই নেই।
কিছুক্ষণ চুপ। তারপর হেমনাথই আবার শুরু করলেন, আচ্ছা, এই যুদ্ধে বৃটেনের অবস্থা তোমার কী মনে হয়?
খুবই সঙ্গিন।
আমারও তাই মনে হয়। ব্যাটারা দারুণ ঠ্যাঙানি খাচ্ছে। হিটলার ওদের হাড়গোড় একেবারে ভেঙে দিচ্ছে। রয়াল এয়ার ফোর্স বলছে আমরা টিরানায় বোমা ফেলেছি, বার্লিন উড়িয়ে দিয়ে এসেছি–সব মিথ্যে, সব বাজে। ধাপ্পা দিয়ে দুনিয়ার কাছে মুখ রাখতে চাইছে আর কি। কিন্তু লোকে যা বুঝবার ঠিকই বুঝবে।
দেখা গেল, রাশিয়ার ব্যাপারে কিছু সংশয় থাকলেও বৃটেন সম্বন্ধে অবনীমোহন আর হেমনাথ সম্পূর্ণ একমত। চিন্তিত গম্ভীর মুখে হেমনাথ বলতে লাগলেন, ওয়ার বেধেছে, তা ঠেকাবার ক্ষমতা তো আমাদের নেই। তবে–
তবে কী?
ওয়ারটা যদি ইউরোপেই আটকে থাকত, মন্দের ভাল। নিজেরা কাটাকাটি করে মরত, আমরা দূরে থেকে দেখতাম। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। আগুন একেবারে দরজার সামনে এসে পড়েছে।
তাই তো মনে হচ্ছে।
এদেশে খুব দুর্দিন আসছে অবনী, খুবই দুর্দিন–একই কথা দু’বার করে উচ্চারণ করলেন হেমনাথ।
অবনীমোহন বললেন, তা বুঝতে পারছি। এদিকে বৃটিশ গভর্নমেন্ট কংগ্রেস নেতাদের একে একে জেলে নিয়ে পুরছে, বিচারের নামে ফার্স করছে। ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট একখানা করেছে বটে!
যা বলেছ। হেমনাথ বলতে লাগলেন, ওয়ারের খরচ চালাবার জন্য আবার ট্যাক্স বসাবে। হরামজাদারা ইন্ডিয়াকে এবার ঝাঁঝরা করে ছাড়বে। সাধারণ মানুষের কী দুরবস্থা হয়, এবার দেখো।
অবনীমোহন এবং হেমনাথ আসন্ন দুর্দিনের চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করতে লাগলেন যেন।
বিনু প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবু রাশিয়া-জাপান-হিটলার-চার্চিল-স্টালিন এবং মহাযুদ্ধ এই শব্দগুলির মধ্যে এমন প্রচন্ড আকর্ষণ আছে যে অন্য দিকে চোখ ফেরাতে পারছিল না সে, নিশ্বাস বন্ধ করে হেমনাথের আলোচনা শুনে যাচ্ছিল।
এদিকে আরেকটা ব্যাপার চলছিল। হেমনাথের পড়া খবরের কাগজগুলো নিয়ে সুধা-সুনীতি তক্তপোষের আরেক ধারে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। বিনুর কানে এখন তাদের ফিসফিসানি ভেসে আসছে।
সুনীতি বলছে, ‘দ্যাখ দ্যাখ’, ‘বিজলী’তে ‘পথ ভুলে’ আরম্ভ হয়েছে। প্রতিমা, ডি জি, পান্না, রণজিৎ রায় অভিনয় করছে। ইস, কলকাতায় থাকলে দেখতে পেতাম।
সুধা বলল, ‘উত্তরা’য় ন’সপ্তাহ ধরে ‘শাপমুক্তি’ চলছে। আসবার সময় দেখে এলাম। আর কোনও দিন দেখাই হবে না।
ধীরে ধীরে ঘুরে বসল বিনু। দেখল, দুই বোন সিনেমার পাতায় মুখ গুঁজে আছে। যুদ্ধ নিয়ে এত যে আলোচনা চলছে, সেদিকে তাদের এতটুকু লক্ষ্য নেই। তাদের দেখে মনে হয় না, পৃথিবীতে আদৌ কোনও সমস্যা আছে, দুই গোলার্ধ ঘিরে একটানা ভয়াবহ আগুনের চাকা ঘুরে চলেছে।
সুনীতি বলল, ‘ভবানীপুরে আমাদের বাড়ির কাছে ‘রূপালী’ সিনেমা। সেখানে হাঞ্চব্যাক অফ নতরদ্যাম’ চলছে। নাম ভূমিকায় চার্লস লটন।
সুধা বলল, চার্লস লটনের অ্যাক্টিং আমার খুব ভাল লাগে।
আমারও।
দ্যাখ সুধা, কলকাতায় কত ছবি চলছে। প্যারাডাইসে বন্ধন’, পূর্ণতে মধু বোস সাধনা বোসের রাজনৰ্তকী। কিছুই দেখতে পেলাম না।
কলকাতার মোহময় চিত্রজগৎ দুই বোনকে যেন হাতছানি দিয়ে চলেছে। নতুন নতুন কত বিচিত্র লোভনীয় ছবির মেলা বসেছে সেখানে, অথচ কিছুই তাদের দেখা হল না। সুধা সুনীতির কাছে এর চাইতে অপূরণীয় ক্ষতি আর কিছু নেই।