দ্বিতীয় অংশ
মাসখানেক হল কাজ করছে সান্তিয়াগো। স্ফটিক-দোকানে কাজ করে কেন যেন মনে ঠিক শান্তি নেই। কাউন্টারের পিছন থেকে দোকানি অহর্নিশি তাকে উপদেশ দিয়ে চলে। সাবধান হতে হবে। কিছু যেন ভেঙে না যায়।
তবু সে সেখানেই আছে। কারণ বুড়ো ভাম হলেও বণিক লোকটা তার সাথে ভাল ব্যবহার করে, ন্যায্য ব্যবহার করে। প্রতিটা পণ্যের জন্য ভাল একটা পয়সা জুটে যায় তার কপালে। আর পাই পাই করে জুমায় সে সেগুলো। খানিকটা হয়ে গেছে। হিসাব কষে ফেলল একদিন। এভাবে হররোজ খাটলেও বছর লেগে যাবে কয়েকটা ভেড়া কিনতে।
আমি এক কাজ করি, স্ফটিকগুলোর জন্য একটা ডিসপ্লে কে বানিয়ে ফেলি। বাইরে, পাহাড়ের গোড়ায় যারা যাতায়ত করে তাদের দেখাব। কী বলেন?
আমি এ সাহস দেখাইনি কখনো। লোকে যাবার সময় এক দুটা ধাক্কা দিয়ে গেলেই কেল্লা ফতে।
তাহলে আমার রাখাল জীবনের কথা বলি। মাঝে মাঝে পাল নিয়ে সাপের কাছে চলে এলে দু একটা ভেড়া মারা যায়। কিন্তু রাখালের জীবন। এজন্য থেমে থাকবে না। এগিয়ে যেতে হবে।
স্ফটিক দেখতে চাচ্ছে এক ক্রেতা। আজকাল সেই সময়ের কথা মনে পড়ে যায়, যখন তাঞ্জিয়ারের সবচে ব্যস্ত রাস্তা ছিল এটা।
ব্যবসার কিন্তু সত্যি সত্যি উন্নতি হয়েছে, ছেলেটাকে বলে সে, খরিদ্দার চলে যাবার পর, ভালই করছি, কী বল? তোমার ভেড়ার পাল পেতে বেশি দেরি নেই। জীবন থেকে বেশি কিছু চাও কেন?
কারণ আমাদের লক্ষণ দেখে চলতে হবে। বলেই ভুল বুঝতে পারে ছেলেটা। কারণ এ বণিক কখনো সালেমের মহান রাজার দেখা পায়নি। যে পায়নি, সে লক্ষণের মর্ম বুঝবে না।
একে বলে সৌভাগ্যের নীতি। যে শুরু করে তার কপাল। কারণ জীবন। চায় তোমার লক্ষ্য অর্জিত হোক। বলেছিল সেই সে বুড়ো লোক।
যা বোঝা বুঝে নিয়েছে বণিক। দোকানে সান্তিয়াগোর আসাটা আসলেই সুলক্ষণ। কিন্তু ছেলেটাকে কাজে নিয়ে পস্তাতে শুরু করল সে এক সময়। প্রাপ্যেরচেও বেশি নিচ্ছে সান্তিয়াগো। টাকার পাল্লা আরো ভারি হত তাকে আর একটু কম দিলে। তার আশা, ছেলেটা দ্রুত ফিরে যাবে ভেড়ার পালের দিকে।
পিরামিডে যেতে চাইতে কেন?
কারণ সব সময় সেগুলোর কথা শুনে এসেছি।
স্বপ্নের কথা বেমালুম গাপ করে যায় সে।
২.০২
কথা শুনে প্রথমে থমকে গিয়েছিল দোকানি। তারপর আবেগ চেপে রেখে বলে, আমার ধর্মে পাজটা কর্তব্য আছে। চারটা যে কেউ যে কোন জায়গায় পালন করতে পারে। নামাজ পড়া হল তেমনি এক কাজ। নিজের সম্পদ গরিবদের দেয়া, রোজা রাখা তেমনি কাজ।
থেমে যায় বণিক। চোখে অশ্রু। মনে মনে কিছু কথা বলে নবিকে উদ্দেশ্য করে। ইসলামি আইনের সবটুকু মানার ইচ্ছা ছিল তার।
পঞ্চম বাধ্যবাধকতাটা কী? প্রশ্ন করে সান্তিয়াগো।
দুদিন আগে বলেছিলে না, আমার ঘোরাঘুরি করার কোন স্বপ্নই নেই? হায়রে! সব মুসলমানের পঞ্চম বাধ্যবাধকতা হল তীর্থযাত্রা করা। হজ করা। জীবনে অন্তত একবার পবিত্র মক্কা নগরীতে যাবার কথা আমাদের।
মক্কা পিরামিডেরচে অনেক বেশি দূরে। তরুণ ছিলাম যখন, সব সময়। মনে ছিল একটা স্ফটিক ব্যবসা দেয়ার চিন্তা। কী করে টাকা জমিয়ে শুরু করা যায় সে চিন্তা। কোন একদিন টাকাপয়সা হবে, তারপর যেতে পারব মক্কায়।
দিন পেরিয়ে যায়। আস্তে আস্তে টাকা জমে। যাবার মত টাকা হয়ে গেছে আমার। দোকানটা কার কজায় রেখে যাব? একদিকে স্ফটিক একেবারে স্পর্শকাতর জিনিস, আরেকদিকে দোকানের সামনে দিয়ে লোকে এগিয়ে যায় মক্কার দিকে। কেউ কেউ ধনী। সাথে আছে বিশাল সফরসঙ্গি। উটের পাল, দাস, সহকারি। কি বাকিদের বেশিরভাগই আমারচে হতদরিদ্র।
যারা গেছে, ফিরে এসে সে কী আনন্দ! বাড়ির দরজায় টাঙিয়ে রাখে হজের চিহ্ন। তাদের একজন, পেশায় মুচি। বলেছিল, বছর ধরে মরুভূমিতে চলতে কোন ক্লান্তি লাগেনি। ক্লান্তি এসেছে এই তাঞ্জিয়ারের বাজারে জুতা বানানোর চামড়া কিনতে যাবার সময়।
তাহলে এখন মক্কায় যাচ্ছেন না কেন?
কারণ মক্কা যাবার আশাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। একই ধরনের দিন, একই দোকান, একই রকম জিনিস, একই খাবার দোকানের বস্তাপচা খাবার তবু একটা আশা মনে। ভয় হয়, স্বপ্নটা ক্ষয়ে গেলে বেঁচে থাকার আর কোন ইচ্ছাই অবশিষ্ট থাকবে না মনে।
তোমার স্বপ্ন ভেড়ার পাল আর পিরামিড। আমার আর তোমার মধ্যে তফাতটা কোথায় জান? তুমি স্বপ্নটাকে সত্যি করে পেতে চাও আর আমি ভয় পাই।
মরুভূমি পেরিয়ে যাবার কথা কল্পনা করেছি হাজারবার। পবিত্র পাথরের চত্বরে হাজির হলাম। তারপর স্পর্শ করার আগে চারপাশে ঘুরলাম সাতবার। আমার আশপাশে থাকা লোকজনের কথা ভেবেছি অনেকবার। আমরা কথা বলব। বলব প্রার্থনার কথা। প্রাপ্তির কথা। কিন্তু ভয় হয়, এসবই হয়ত খুব বেশি খুশি করতে পারবে না আমাকে, তবু, মনে সেই স্বপ্ন।
সেদিনই বণিক লোকটা সান্তিয়াগোকে অনুমতি দেয়। পথের পাশে পাহাড়ের গোড়ায় এক ডিসপ্লে কেস বানানোর অনুমতি।
সবাই তার স্বপ্নগুলোকে একভাবে সত্যি হতে দেখে না।
২.০৩
কেটে গেছে আরো দুটা মাস। বাইরের তাকটা দেখে অনেক ক্রেতা ভিড় করে দোকানে আজকাল।
ছ মাস। আর ছ মাস কাজ করলেই ফিরে যাওয়া যাবে স্পেনে। তারপর যাটটা ভেড়া কিনে নেয়ার পালা। তারপর আরো টুটা। এক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে যাবে পাল। ব্যবসা শুরু করা যাবে আরবদের সাথে। বিচিত্র ভাষাটা এখন বেশ রপ্ত হয়ে গেছে তো!
সেদিন, সেই সকালের পর আর কখনো সে ঊরিম আর ঘুমিমকে ব্যবহার করেনি। এখন তার কাছে মিশরের স্বপ্ন আর বণিকের কাছে মক্কার স্বপ্ন এক সমান। চোখে নতুন স্বপ্ন, তারিফায় ফিরে যাবে বিজয়ীর বেশে।
তোমার সব সময় ঠিকভাবে জানতে হবে, কী চাও। এখন সে জানে। হয়ত কোনদিন মরুভূমির বুকে সেই চোরের সাথে দেখা হয়ে যাবে। তারপর নিয়ে নেয়া যাবে টাকাপয়সা। তার প্রাপ্য কষ্টের টাকা। তখন দ্বিগুণ হবে ভেড়ার পাল।
সান্তিয়াগো নিজেকে নিয়ে গর্বিত। কাজ করে আনন্দ পায় আজকাল। শিখেছে অনেক নতুন ব্যাপার। কী করে স্ফটিকের কাজ করতে হয়, কী করে কথা বলতে হয় শব্দ ছাড়া… কী করে চিনতে হয় লক্ষণ।
এক বিকালে সে পাহাড়ের উপর এক লোকের দেখা পায়। লোকটা আক্ষেপ করে বলছে যে এখানে এত কষ্ট করে ওঠার পর পান করার মত কোন কিছু নেই।
লক্ষণ ঠিক ঠিক ধরে ফেলে সান্তিয়াগো। পরদিনই সে বলে বলে যে পাহাড়ে চড়তে আসা লোকজনের জন্য চা বিক্রি করা ভাল হতে পারে।
আশপাশে অনেক দোকানে চা বিক্রি হয়।
তাহলে আমরা স্ফটিকের কাপে বিক্রি করব। চা ভাল লাগবে তাদের। ভাল লাগবে গ্লাসগুলোও। যদি কিনে নেয়, তোফা। সৌন্দর্য সব সময় মানুষকে গলিয়ে ফেলে।
কোন সাড়া নেই বণিকের দিক থেকে। কিন্তু সে বিকালে নামাজ পড়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলে ডাকে ছেলেটাকে। এগিয়ে দেয় ধূমপানের বিচিত্র সরঞ্জাম, যাকে আরবিতে হুকা বলা হয়।
তুমি আসলে ক খুজছ?
আগেই বলেছি। আগে ফিরে পেতে হবে ভেড়ার পাল। তারপর টাকা। তারপর বাকি কাজ।
হুকাতে আরো কিছু কয়লার টুকরা দিয়ে কষে দম নেয় দোকানি।
তিরিশ বছর ধরে দোকান চালাই আমি। এই একই দোকান। ফটিকের নাড়িনক্ষত্র আমার হাতের তালুতে। এখন, স্ফটিকে করে চা বিক্রি করলে দোকানের পসার বাড়বে, কোন সন্দেহ নেই। তখন জীবনের ধারাটা বদলে নেয়া যাবে।
তাহলে, ভাল না?
আমি সব দেখেশুনে, যা যেমন আছে তা তেমন দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্ত্র এগিয়ে গেছে বন্ধুরা। কেউ হয়েছে ব্যাঙ্কুভাকাত, কেউ ডাকাতির শিকার, বাকিরা উন্নত।
সব সময় ভাবতাম আমার কপাল মন্দ। আসলে তা নয়। আমি দোকানটাকে সারা জীবন এ আকারেই দেখতে চেয়েছিলাম। তাই বাড়েনি। পরিবর্তনকে ভয় পাই কারণ জানি না পরিবর্তনের পর কী আসবে। যেমন আছি তেমন থাকতেই অভ্যাস ধরে গেছে একেবারে।
কী আর বলা যায় এ কথার পিঠে? বুড়ো দোকানদার বলে চলেছে এক নাগাড়ে, আমার জীবনে তুমি এক আশীর্বাদ। আজ এমন সব জিনিস দেখতে পাই যা আগে দেখতাম না। মানে বুঝতাম না। যে আশীর্বাদকেই তুমি অবজ্ঞা করবে সেটা হয়ে যাবে অভিশাপ। এখন সব বুঝি, সেই সাথে বেড়েছে হতাশা। বুঝতে পারছি, আসলে আমি পরিবর্তন চাই না। সেটাই কষ্ট দেয়।
তারিফার কোন এক রুটিওয়ালার জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে কাহিনী।
নেমে যাচ্ছে সূর্য। চলছে ধূমপান। তাদের কথা চলে আরবিতে। আর ছেলেটা সেজন্য গর্বিত। এক সময় মনে হত দুনিয়ায় যা শিখে নেয়ার শেখা যাবে ভেড়ার কাছ থেকে। কিন্তু আরবি?
আসলে ভেড়ারা খুব বেশি কিছু শিখাবে পারবে না। তাদের লক্ষ্য শুধু খাবার আর পানীয়। তুমি বরং তার জীবন থেকে এমি এম্নি নিজে নিজে কিছু শিখে নিতে পারবে।
মাকতুব। অবশেষে বলে বণিক।
কথাটার মানে কী?
মানে বুঝতে হলে আসলে তোমাকে আরবে জন্মাতে হবে। তোমার ভাষায় মোটামুটি বলা চলে, কথাটা লেখা ছিল।
তারপর, হুকা থেকে কয়লা সরাতে সরাতে মৃদুভাবে সান্তিয়াগোকে জানায় সে, চা বিক্রি করা যায়। বিক্রি করবে সে।
সব সময় নদী বেধে রাখা কোন কাজের কথা নয়।
২.০৪
পাহাড়চূড়ায় উঠে গেছে লোকটা। চরম ক্লান্তি দুজনের সারা গায়ে। তারপর সেখানে যখন স্ফটিকের এক দোকান দেখতে পায়, দেখতে পায় দারুণ চা পাওয়া যায়, পান করতে যায় তারা।
কী সুন্দর দামি স্ফটিকের গ্লাসে দেয়া হচ্ছে সামান্য চা টুকু!
আমার স্ত্রী কখনো এসব ব্যবহারের কথা ভাবেনি। লোকটা সে সন্ধ্যা কাটায় স্ফটিক ব্যবসায়ির সাথে। সেইসাথে কিনে নেয় অনেকগুলো স্ফটিকের পাত্র।
দ্বিতীয়জনের মত ভিন্ন। চা চা-ই। স্ফটিকে দাও আর যেখানেই দাও।
তৃতীয়জন বলে, প্রাচ্যে স্ফটিকে করে চা দেয়া চূড়ান্ত সৌজন্য আর সৌভাগ্যের প্রতিক। জাদুর শক্তি আছে স্ফটিকে।
বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে কথাগুলো। লোকে শুধু দোকান আর দোকানের নতুন কায়দা দেখার জন্যও উঠে আসে। যে দোকানের স্ফটিক এত সুন্দর সেখানে চা তো ভাল হবেই। অন্য দোকানগুলোও আস্তে আস্তে একই। পথ ধরে। স্ফটিকের বিক্রি বেড়ে যায় বহুগুণে। একই সাথে তাদের কেউ তো আর পাহাড়ের চূড়ায় নেই!
আস্তে আস্তে আরো দুজন কর্মচারি ভাড়া করতে হয় বণিককে। কত চা আর কত ফুটিক যে কিনতে হয় তাকে! লেখাজোকা নেই।
কেটে যায় মাসের পর মাস।
২.০৫
সূর্যাস্তের আগেই জেগে ওঠে ছেলেটা। আফ্রিকায় আসার পর পাকা এগারো মাস ন দিন কেটে গেছে।
সাদা লিলেনের লম্বাটে আরবি পোশাক পরে নেয় সে। শুধু আজকের দিনের জন্য কিনে আনা পোশাক। উটের চামড়া দিয়ে বেধে নেয় মাথার রুমালটা। নূতন চপ্পল পায়ে দিয়ে নিঃশব্দে নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে।
এখনো ঘুমে কাতর পুরো শহর। কয়েকটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেয়ে নেয় গরম গরম চা। স্ফটিকের পাত্রে করে। তারপর বসে পড়ে হুক্কা নিয়ে, সূর্যের আলো পড়ছে যে দরজায়, সেখানে।
কোনদিকে খেয়াল নেই তার। মরুর বাতাস ঝাঁপ্টা মারে চোখেমুখে। ধূমপান শেষ হলে হাত ঢোকায় পকেটে। কী তুলে আনবে সেখান থেকে ভেবে পায় না। বসে থাকে কয়েক মিনিট।
বেরিয়ে আসে একতাড় টাকা। একশ বিশটা ভেড়া কিনে নেয়ার মত টাকা, ফিরে যাবার ভাড়া, আফ্রিকা থেকে জিনিসপাতি নিজের দেশে আনা নেয়ার ব্যবসা করার ছাড়পত্র নেয়ার টাকা।
উঠে এসেছে বণিক। দুজনে মিলে আরো একটু চা পান করে।
চলে যাচ্ছি আজ, অবশেষে বলে ওঠে সান্তিয়াগো, ভেড়া কেনার টাকা হয়ে গেছে। মক্কা যাবার টাকা হয়ে গেছে।
কোন জবাব নেই বয়েসি লোকটার কন্ঠে।
আশীর্বাদ করবেন না? অনেক সহায়তা করেছেন আমাকে।
এখনো লোকটা চা তৈরি করছে। জবাব দেয় না কোন কথার। অবশেষে ফিরে তাকায়।
আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত। দোকানের হালচাল পাল্টে দিয়েছ তুমি। কিন্তু আসলে আমি তো মক্কায় যাব না। যেমন তুমিও জান, কিনে আনা হবে না ভেড়ার পাল।
কে বলেছে এসব কথা?
মাকতুব।
অবশেষে সান্তিয়াগো আশীর্বাদ পায়।
০৬.
তিন তিনটা বোঝা নিয়ে ঘুরে দাড়ায় সে পুরনো পাউচটার দিকে। তুলে নেয়। সেটা, তারপর পুরনো ভারি জামাটা নিতে নিতে ভাবে, পথে কাউকে দিয়ে দেয়া যাবে।
এবং ভারি জামার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে উরিম আর থুমিম। পড়ে যায় মাটিতে।
মনে পড়ে যায় বুড়ো লোকটার কথা। পাক্কা একটা বছর পেরিয়ে গেল। ভুলেই গিয়েছিল। সব ভুলে টাকার চিন্তা আর কঠিন শ্রম। স্পেনে ফিরে যাবে। সে, কিনবে ভেড়ার নতুন পাল।
কখনো স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিওনা, বলেছিল সালেমের রাজা, অনুসরণ করো ভাল লক্ষণগুলোকে।
পাথর দুটাকে কুড়িয়ে নিতে নিতে ভাবে সে, এক বছর ধরে খেটেছে। এখন ফিরে যাবার ইঙ্গিত দিল উরিম আর খুমিম।
আগে যা করে এসেছি সেসব করতেই ফিরে যাচ্ছি আমি। যদিও ভেড়ার পাল আমাকে আরবি শিখাতে পারবে না, তবু ফিরে যাচ্ছি।
কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার শিখিয়েছে ভেড়ার পাল। বিশ্বে কথার উপরেও একটা ভাষা আছে। যে ভাষা দিয়ে সে দোকানটাকে উঠিয়ে দিল অনেক উপরে। ভালবাসা আর প্রত্যয় নিয়ে গড়ে ওঠা ভাষার নাম উৎসাহ। চাওয়ার কিছু পাবার চেষ্টা করার ভাষা।
এখন তাঞ্জিয়ার কোন অচেনা শহর নয়, হয়ত পৃথিবীটাকেও এভাবে পরিচিত করে নেয়া যাবে। যাবে জয় করা।
যখন তুমি কিছু পাবার চেষ্টা কর, পুরো সৃষ্টি জগত ফিসফাস শুরু করে দেয় তোমাকে তা পাওয়ানোর জন্য। বলেছিল বয়েসি রাজা।
কিন্তু সে তো ডাকাতির কথা বলেনি, বলেনি অন্তহীন মরুভূমির কথা, সেসব মানুষের কথা যারা নিজের স্বপ্নটাকে চেনে, বাস্তবে রূপ দিতে চায় না। বলেনি, পিরামিড হল নিছক পাথরের সাজানো ঔপ। চাইলেই উঠানে বানিয়ে নেয়া যায় একটা, বলেনি, টাকা থাকলে আগেরটারচে বড় দেখে একপাল ভেড়া কেনা সম্ভব।
পাউচটা তুলে নেয় সে অবশেষে। দোকানে গিয়ে দেখে বিদেশি দুজনের সাথে আলাপে মশগুল হয়ে আছে দোকানি। দুজন ক্রেতা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এত সকালে এমন ভিড় সাধারণত জমে ওঠে না। যেখানে দাড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে এই প্রথম খেয়াল করল বয়েসি সেই রাজার চুলের সাথে বুড়ো দোকানির চুলের অনেক মিল। মনে পড়ে যায় প্রথম দিন খাবার মত কিছু ছিল না যখন তখনকার চকলেটওয়ালার নির্মল হাসিটুকুর কথা। বৃদ্ধ রাজার হাসির সাথে অনেক মিল ছিল সেটারও।
যেন লোকটা এখানেই কোথাও আছে। নিজের চিহ্ন ছড়িয়ে রেখেছে সর্বত্র। কিন্তু এসব লোকের কেউ কখনো দেখেনি বয়েসি লোকটাকে। অন্যদিকে কেউ যখনি নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিতে চায়, দেখা দেয় সেই রাজা। নানা রূপে। নানভাবে।
বিদায় না জানিয়ে চলে গেল সান্তিয়াগো। আরো লোকজনের সামনে কান্নাকাটি করতে মন সায় দিচ্ছিল না। অনেক শিখেছে। সবকিছু মিস করবে সে। মিস করলে এ জায়গাটাকে।
মনে গভীর প্রত্যয়, পুরো পৃথিবী জয় করার সাহস আছে তার।
কিন্তু আমি ফিরে যাব সেই পুরনো মাঠগুলোয়। চড়াব সেসব ভেড়া। কিন্তু কেন যেন সিদ্ধান্তের সাথে খুশি হতে পারছে না সে। একটা স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য সারাটা বছর খেটে শেষে কিনা সেটাকেই সামান্য মনে হয় এখন প্রতি মুহূর্তে।
হয়ত এজন্য যে সেটা আসলে তার স্বপ্ন নয়।
কে জানে… হয়ত স্ফটিক ব্যবসায়ির মত হতে পারলেই ভাল। মক্কায় নাহয় নাই যাওয়া হল। পকেট থেকে পাথর দুটা নিয়ে সে সেই প্রথম দিনের পানশালায় যায়। দোকানি এগিয়ে দেয় এক কাপ চা।
তখনি মনে আসে আরেক ভাবনা। আমি সব সময় রাখাল হতে পারব। যা শিখেছি তা ভুলে যাবার কোন উপায় নেই। কিন্তু পিরামিড? হয়ত দেখা হবে না কোনদিনও। বুকে সোনার পাত বসানো বয়েসি লোকটা আমার অতীত জানত। সে আসলেই এক রাজা, জ্ঞানী রাজা।
আন্দালুসিয়ার প্রান্তর মাত্র দু ঘন্টার পথ, এদিকে মিসরের পথে পড়ে আছে অন্তহীন এক বালুকাবেলা। সে জানে, ব্যাপারটা অন্যরকমও হতে পারে। হয়ত মূল লক্ষ্য আর মাত্র দু ঘন্টা দূরে। এ দু ঘন্টার জন্য পুরো একটা বছর চলে গেছে, যাক না।
আমি জানি কেন ফিরে যেতে চাচ্ছি পালের কাছে, ভেড়াদের চিনি, সেটা আর কোন সমস্যা নয়; তারা ভাল বন্ধু হতে পারবে সহজেই। কিন্তু মরুভূমি? বন্ধু হতে পারবে বিশাল মরুভূমি? যদি হতে পারে, তাহলে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারি আমি। না পেলে বাড়ি ফেরার পথ তো খোলা। হাতে অনেক টাকা জমে গেছে, আছে প্রচুর সময়। কেন নয়?
হঠাৎ খুশির একটা ঝলক বয়ে যায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে চাইলেই রাখাল হতে পারবে। পারবে ফুটিক ব্যবসায়ী হতে। পৃথিবীতে আরো অযুত নিযুত গুপ্তধন থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু তার নিজেরটুকুর স্বপ্ন দেখিয়েছিল এক জ্ঞানী রাজা। যে সে লোক তো এমন ভাগ্য পায় না!
পানশালা ছেড়ে যাবার সময় মনে মনে হিসাব কষে নেয় সান্তিয়াগো। স্ফটিক ব্যবসায়িকে পণ্য দেয়া এক লোক ক্যারাভান নিয়ে মরুভূমি পার হয় প্রায়ই।
সময় এসেছে। উরিম আর থুমিমকে হাতে তুলে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়।
আমি সব সময় কাছাকাছি চলে আসি, কারণ কেউ না কেউ তার নিজের লক্ষ্যটা চেনার চেষ্টা করে। বলেছিল বয়েসি রাজা।
সরবরাহকারীর মাল সামানের সাথে চলে গিয়ে পিরামিড আসলেই তত দূরে কিনা সেটা একটু খতিয়ে দেখতে খুব বেশি কি খরচ হয়ে যাবে?
২.০৭
ইংরেজ লোকটা বসে আছে বেঞ্চে। এমন এক বেঞ্চে যেটা অবস্থিত পশুর গায়ের গন্ধ, ঘাম আর ধূলাবালির এক গড়নে। খানিকটা গুদামঘরের মত, খানিকটা অন্যকিছু।
আমি কখনো ভাবিনি অবশেষে এমন কোন জায়গায় এসে ঠেকল। হাতে রাসায়নিক পত্রিকার পাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ দশটা বছর কাটিয়ে সবশেষে কিনা এখন এই গুদামঘরে!
কিন্তু তাকে এগিয়ে যেতে হবে। লক্ষণে বিশ্বাস করে সে। তার সারা জীবনের কষ্ট আর সারা জীবনের লক্ষ্য একটাই, দৃষ্টিজগতের একমাত্র সত্যিকার ভাষাটা বুঝতে শেখা। প্রথমে সমাজতত্ত্ব পড়েছিল, তারপর পড়েছে। ধর্ম, অবশেষে আলকেমি। বিচিত্র কিছু ভাষা চেনে সে, জানে বেশিরভাগ বড় ধর্মের প্রায় সব রীতিনীতি। কিন্তু এখনো পুরোদস্তুর এ্যালকেমিস্ট হয়ে উঠতে পারেনি।
কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের রহস্য যে উন্মোচন করেছে এক জীবনে! তারপর শিক্ষাদিক্ষা এমন এক লক্ষ্য নিতে বলল যার বাইরে তার যাবার ক্ষমতা নেই। সে বারবার মাথা কুটে মরেছে একজন এ্যালকেমিস্টের সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য। কিন্তু এই এ্যালকেমিস্ট লোকগুলোও কী আজব! তারা শুধু নিজেদের নিয়ে চিন্তা করে। প্রায় সবাই তাকে সহায়তা করবে না, সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। কে জানে, হয়ত আসল কাজের রহস্য ধরতে পারেনি- দ্য ফিলোসফারস স্টোনের রহস্য ধরতে পারেনি বলে বাকি জ্ঞানটুকু নিজের ভিতরেই রেখে দিতে চায় অষ্টপ্রহর।
বাবার রেখে যাওয়া বেশিরভাগ সম্পদই খুইয়ে বসেছে এতদিনে। ব্যর্থ হয়ে খুজে বেড়িয়েছে ফিলসফারস স্টোন। পৃথিবীর তাবৎ বড় লাইব্রেরিতে কাটিয়েছে অনেক অনেক সময়, কিনেছে এ্যালকেমির সবচে দামি দামি, দুর্লভ বই।
তেমনি এক বইতে পড়েছিল, সুপরিচিত এক আরব এ্যালকেমিস্ট এসেছিলেন ইউরোপে। বলা হত তার বয়স ছিল দুশ বছরেরও বেশি। বলা হত তিনি ফিলসফারস স্টোন হাসিল করেছেন। পেয়েছেন জীবনের পরশ পাথর।
ইংরেজ লোকটা এ কাহিনী পড়ে সত্যি মুগ্ধ হয়। কিন্তু তার কাছে এ শুধুই এক কাহিনী। কল্পকাহিনী। তারপর মরুভূমিতে কাজ করে আসা এক ভূতত্ত্ববিদ, তার বন্ধু, জানায় যে সত্যি সত্যি এক বয়েসি রহস্যময় ক্ষমতাধর আরব আছে।
বাস তার আল ফাইউম মরুদ্যানে, বলেছিল বন্ধু, মানুষ বলাবলি করে তার বয়স দুশ বছর। যে কোন ধাতুকে সোনায় পরিণত করতে পারে সে।
ইংরেজ লোকটা আর উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারেনি। সব ওয়াদা বাতিল করে মূল্যবান আর প্রয়োজনীয় বইগুলো বেধেছেদে রওনা হয়ে যায়। আর এখন কোথায় আছে? এক ধূলিমলিন দুর্গন্ধে ভরা গুদামঘরে বাইরে বিশাল এক ক্যারাভান তৈরি হচ্ছে। পাড়ি দিবে সাহারা। পেরিয়ে যাবে আল কাইউম।
আমাকে সেই মরার এ্যালকেমিস্টের দেখা পেতেই হবে, ভাবে ইংরেজ লোকটা। এখন আর পশুর গায়ের গন্ধ গা গুলিয়ে দেয় না।
এক কমবয়েসি আরব উঠে এল তার পাশে।
কোথায় যাচ্ছেন আপনি? প্রশ্ন করে তরুণ আরব।
মরুভূমির ভিতরে যাচ্ছি। বলেই ইংরেজ চোখ ফিরিয়ে নেয়। বই পড়তে হবে তাকে। এখন কথা বলতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। এখন শুধু বছরের পর বছর ধরে শেখা বিষয়গুলো ঝালিয়ে নেয়ার পালা। এ্যালকেমিস্ট কি একটু বাজিয়ে দেখবে না? আলবত দেখবে।
তরুণ আরবও বের করে নেয় একটা বই। তারপর পড়তে থাকে একমনে। বইটা স্প্যানিশে লেখা। ভলিই তো, ভাবে ইংরেজ। সে আরবিরচে স্প্যানিশ ভাল বলতে পারে, আর, যদি ছেলেটা আল ফাইউমে যাবার জন্য উঠে থাকে, তাহলে আর কোন কাজ না থাকলে কথা বলার মত কাউকে পাওয়া যাবে।
২.০৮
অবাক ব্যাপার, বলল ছেলে, বইটাকে ঝোলার ভিতর কবর দিতে দিতে, দু বছর ধরে বই শেষ করার তালে আছি, আর কয়েক পাতার বেশি যেতেই পারি
আর, যদি একজন রাজা এখানে নাক না গলাত, তাহলে সে থোড়াই পরোয়া করে এমন সব বইয়ের।
সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তার মনে এখনো কিছু তা-না-না-না আছে। একটা ব্যাপার বোঝা সহজ: সিদ্ধান্ত নেয়া আসলে কাজের শুরু মাত্র। সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়ে গেলে লোকে আসলে তীব্র, খরস্রোতা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর সে স্রোত তাকে কোথায়, কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে তা কেউ জানে না, সিদ্ধান্ত নেয়ার মুহূর্তে জানার প্রশ্নই ওঠে না।
প্রথমে চাইলাম গুপ্তধন খুজে বের করতে, কে জানত তখন কাজ করতে হবে স্ফটিকের দোকানে? এ বহরে ঢুকে তো গেলাম, তারপর কোথায় যাবে কে জানে!
পাশে বসে আছে এক ইংরেজ। একমনে বই পড়ছে। লোকটার খুব বেশি। বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নেই। সান্তিয়াগো ঢোকার সময় কী বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল! তবু বন্ধুত্ব পাতানোর বাকি আশাটা ডুবিয়ে দেয় ইংরেজের একমনে বই পড়ার দৃশ্য।
বই রেখে দিয়ে ভালই করেছে সে। এ লোকের মত দেখানোর দরকার কী। উরিম আর থুমিম নিয়ে খেলা শুরু করে সে।
অবাক চোখে একটু তাকিয়েই চিৎকার করে ওঠে অপরিচিত লোকটা, উরিম আর ঘুমিম!
এক ঝলক যেতে না যেতেই পকেটে চালান করে দেয় ছেলেটা জিনিসগুলোকে।
বিক্রির জন্য নয়, গম্ভীর সুরে বলে।
খুব বেশি দামি কিছুও নয়, পাল্টা জবাব ছোড়ে ইংরেজ, পাথুরে স্ফটিকের তৈরি। পৃথিবীতে অযুত নিযুত পাথুরে স্ফটিক আছে। অগুণতি। কিন্তু এসব জিনিস যে চেনে সে উরিম আর থুমিমও চিনবে। জানতাম না জিনিসগুলো পৃথিবীর এ অঞ্চলে।
আমাকে এক রাজা উপহার দিয়েছিলেন।
কোন জবাব নেই অচেনা লোকটার মুখে। বরং পকেট হাতড়ে একই রকম। দেখতে দুটা পাথর বের করে।
কী বললে? রাজা?
জানি, ভাবছ আমার মত ছেলের সাথে রাজা কোন দুঃখে কথা বলতে যাবে! আমিতো রাখাল ছেলে!
না, না। এক রাজাকে প্রথম দেখতে পায় রাখাল ছেলেরাই। বাকি দুনিয়া যখন তাকে অস্বীকার করে তখনো। তাই এ কথা বলার যো নেই যে রাজারা কশািন কালেও রাখালদের সাথে কথা বলবে না।
তার কথা থামে না, কে জানে, ছেলে হয়ত মর্ম ধরতে পারবে না, বাইবেলে লেখা আছে। এ বইতেই প্রথম উরিম আর থুমিমের ব্যাপারে জানতে পারি। ঈশ্বর শুধু এ রূপগুলোকেই ঐশ্বরিক হিসাবে মর্যাদা দিয়েছিলেন। যাজকরা সোনার বুক-পাতে রেখেছিল পাথরগুলোকে।
হঠাৎ এখানে, বদ্ধ গুদামঘরে থাকার ব্যাপারটা ভাল লাগতে শুরু করে ছেলেটার।
কে জানে, হয়ত এটা কোন লক্ষণ। প্রায় চিৎকার করে ওঠে ইংরেজ।
লক্ষণের ব্যাপারে কে বলেছিল তোমাকে?
জীবনের প্রতিটা ব্যাপারই কোন না কোন লক্ষণ। হাতের বৈজ্ঞানিক পত্রিকাটা বন্ধ করতে করতে বলে ইংরেজ লোকটা।
*একটা মহাজাগতিক ভাষা আছে, যে ভাষা সবাই বোঝে, কিন্তু ভুলে গেছে। আমি সেই মহাজাগতিক ভাষার সন্ধানে বেরিয়েছি। বেরিয়েছি আরো কিছু ব্যাপারের খোঁজে। এজন্যই আসা। এ মহাজাগতিক ভাষার ব্যাপারে জানে এমন কাউকে খুঁজতে এলাম। এলাম একজন এ্যালকেমিস্টকে খুঁজতে।
বাইরে আওয়াজ উঠলে কথা থেমে যায়।
এক ইয়া মোটা আরব বলে ওঠে, তোমাদের কপাল ভাল। দুজনেরই। আজ বহর ছেড়ে যাচ্ছে আল ফাইউমের দিকে।
কিন্তু, আমিতো মিশরে যাব।
আল ফাইউম মিশরেই। বিরক্ত হয় আরব, তুমি আবার কোন ধারার আরব, মিয়া?
এটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। মোটা আরব চলে যেতেই বলে ওঠে ইংরেজ, সময় সুযোগ পেলে ভাগ্য আর হঠাৎ ঘটা ব্যাপার নিয়ে রীতিমত বিশ্বকোষ লিখে বসতাম। সে ভাষায়। যেসব শব্দে মহাজাগতিক ভাষা লেখা হয়েছিল এককালে, সেসব শব্দে।
লোকটা আরো খোলাসা করে জানায় যে উরিম আর থুমিম নিয়ে তার সাথে দেখা হওয়াটা মোটেও কাকতালীয় নয়। বরং সে এ্যালকেমিস্টের সন্ধানে এসেছে কিনা তা জানতে চায় সে।
আমি গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়েছি, বলেই মনে মনে পস্তানো শুরু করে ছেলেটা।
কিন্তু বিচিত্র ইংরেজের যেন এসব বিষয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই।
অন্য অর্থে, আমিও। আমিতো ছাই জানিও না এ্যালকেমি ব্যাপারটা কী, মাত্র বলা শুরু করেছে সান্তিয়াগো এমন সময় গুদামঘরের লোকটা তাদের ডেকে নিল। বাইরে।
২.০৯
বহরের নেতা আমি, কালো চোখের দাড়িওয়ালা এক লোক বলে, আমার সাথে যাওয়া সব মানুষের জীবন আর মরণ নির্ভর করে আমার উপর। মরুভূমি হল উর্বশী এক নারী যে মাঝে মাঝে পাগল বানিয়ে ছাড়ে পুরুষদের।
প্রায় শ দুয়েক লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। আর শ চারেক জন্তু
জানোয়ার। উট আছে। আছে ঘোড়, গাধা, দুম্বা। মহিলা আছে, আছে অনেক। বাচ্চা আর বাকিরা পুরুষ। কোমরের খাপে তলোয়ার, কাধ থেকে বন্দুক ঝুলছে। ভাল কলরব উঠল চারধারে। দাড়িওয়ালা লোকটা কথাগুলো সবাইকে বারবার শোনায়।
জাত বিজাতের মানুষ আছে এখানে। একেকজনের দেবতা একেকজন, কারো ঈশ্বরের সাথে কারোটা নাও মিলতে পারে। কিন্তু আমি মাত্র এক ঈশ্বরের সেবা করি আর তিনি আল্লাহ। আল্লাহর নামে শুরু করছি, জানিয়ে দিচ্ছি, মরুর বুকে জিতে যাবার সব ধরনের চেষ্টা করব আমার তরফ থেকে। কিন্তু আপনাদের সবাইকে ঈশ্বরের নাম নিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে আমার সব কথা মানার চেষ্টা করবেন। যা-ই বলি না কেন, সব। মরুর বুকে অবাধ্যতার আরেক নাম আছে। মরণ।
গুঞ্জন ওঠে সবার মধ্যে। সবাই যার যার ঈশ্বরের কাছে ওয়াদা করছে। নিরবে। ছেলেটা যিশুর কাছে প্রতিজ্ঞা করে। চুপ করে থাকে ইংরেজ। পুরো আওয়াজ মিলিয়ে যায় ওয়াও! বলতে যত সময় লাগে তারচে একটু বেশি সময় পর। স্বর্গের কাছে নিরাপত্তা চায় কমবেশি সবাই।
তারপর সবার একই সাথে উঠে দাড়ানোর পালা। সান্তিয়াগো আর নাম না জানা ইংরেজের উট আছে। অনিশ্চয়তা মনে নিয়ে উঠে পড়ে তারা জন্তুগুলোর পিঠে। বইয়ের ভারে ইংরেজ লোকটার ঊট বেচারা রীতিমত ভারাক্রান্ত।
কাকতালের মত বেশ কিছু ব্যাপার আছে, বলল ইংরেজ লোকটা, কথা যেখানে ফুরিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে শুরু করছে সে, আমি এসেছি অন্য কারণে। এক বন্ধু বলল বয়স্ক আরবের কথা, যে কিনা…
চলতে শুরু করেছে ক্যারাভান। এখন আর ইংরেজের কথা শোনা যায় না।
সান্তিয়াগোর মনে অন্য ভাবনা। রহস্যময় এক শিকল সবাইকে বেধে রাখে অষ্টেপৃষ্ঠে। সে শিকলই টেনে নেয় তাকে আফ্রিকার কাছাকাছি এক শহরে, সেখানে দেখা হয় অবাক করা রাজার সাথে, বাবার দেয়া টাকাকড়ির মাধ্যমে পাওয়া ভেড়ার পাল বিকিয়ে দেয় সে, তারপর চলে আসে আরেক মহাদেশে, সেখানে ডাকাতি হয় সব পয়সা, কাজ করে স্ফটিকের দোকানে, তারপর এখন, যাত্রা শুরু করে…।
লোকে লক্ষ্যের যত কাছে চলে আসে ততই লক্ষ্যটা তার জন্য বড় হয়ে দেখা দেয়, ভাবে ছেলেটা।
পূবে চলছে ক্যারাভান। সকালে চলা শুরু হয়, সূর্যটা মাথার উপর এলে থামে, বিকালে আবার চলা।
ইংরেজ লোকটার সাথে খুব বেশি কথা হয়নি সান্তিয়াগোর। লোকটা তো বেশিরভাগ সময় বইতে মুখ গুজে থাকে।
কত বদলে গেছে পরিবেশ! এখন মৃদু তালে মিছিলের মত এগিয়ে যাচ্ছে তাদের বহর। বণিকেরা তীব্র ভাষায় নিয়ন্ত্রণ করে জন্তুগুলোকে, চাকরদের। গাইডরাও হন্যে হয়ে যায় সবাইকে ঠিক রাখতে গিয়ে।
কিন্তু মরুভূমির বুকে একটা শব্দই চিরকালের। বাতাসের হু হু শব্দ। এমনকি গাইডরাও পারতপক্ষে একে অন্যের সাথে কথা বলে না।
এ বালুময় প্রান্তর পার হয়েছি অনেকবার, একরাতে বলে উঠল এক উটচালক, কিন্তু মরুভূমি এত বড় আর দিগন্ত এত দূরে যে মানুষের নিজেকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হয়। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া গতি থাকে না।
বোঝে সান্তিয়াগো, কখনো সমুদ্র দেখলে বা বনে আগুন লাগলে এমনি মনে হয়। প্রাকৃতিক শক্তির সামনে কথা বেরুতে চায় না মুখ দিয়ে।
আমি ভেড়াদের কাছে শিখেছি, শিখেছি স্ফটিকের কাছ থেকে। এখন মরুর কাছ থেকে শেখার পালা। অনেক বয়েসি আর জ্ঞানী মনে হয়। মরুভূমিকে।
থামতেই চায় না বাতাস। মনে পড়ে যায় ছেলেটার, তারিফায় পা রাখার দিন কেল্লার উপর এমন বাতাস টের পেয়েছিল। মনে পড়ে যায় ভেড়াগুলোর পশমের কথা, মনে পড়ে, তারা এখনো সেই আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে ঘাস-পানির জন্য ঘুরছে।
এগুলো আর আমার ভেড়া নয়, স্মৃতিকাতরতা ছাড়িয়ে নিজেকে শোনায় সান্তিয়াগো, নতুন রাখালদের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এ্যাদ্দিনে। কে জানে, ভুলেও গেছে হয়ত। ভাল। ঘুরে বেড়ানো প্রাণিগুলো ঘুরে বেড়াতে জানে।
মনে পড়ে যায় সেই পুরনো বণিকের মেয়ের কথা। এতদিনে বিয়ে হয়ে গেছে না তার? কোন রুটিওয়ালার সাথে? নাকি কোন গল্প বলিয়ে, পড়তে জানা রাখালের সাথে? হতেই পারে। সে ছাড়া এমন আরো রাখাল থাকতে পারে। তারা হয়ত তার মতই মহাজাগতিক ভাষার ব্যাপার একটু আধটু বুঝতে পারে।
হাঞ্চ বলত মা সেসব মানুষকে। তারা এক সুতায় গাথা অতীত আর ভবিষ্যতের কথা বলতে জানে। কারণ কোথাও না কোথাও লেখা আছে সব ব্যাপার।
মাকতু বলে ছেলেটা, বণিকের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে।
মরুভূমিতে বালি আর বালি। কোথাও কোথাও পাথুরে এলাকা। এসব জায়গা সাবধানে এড়িয়ে যেতে হবে। পশুর ক্ষতি, পথ চলা মানুষেরও ক্ষতি। কোথাও দেখা যায় শুকনো হ্রদ। দেখা যায় হ্রদের তলায় জমে থাকা লবণের দেখা।
কখনো মারা যায় উট, মারা যেতে পারে উটচালক বা কোন যাত্রি। যাই হোক না কেন, অনন্য সে জায়গা নিয়ে নিবে। অন্তত মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে।
এসবের একটাই কারণ। পথচলা থেমে থাকবে না। ভ্রান্ত হবে না। মরুদ্যান দেখানো তারাগুলোর দিকে চলতে হয়। এসব সামনে আছে পাম গাছের ছায়া। খেজুরের ছায়া। পানি। খাবার। আর আছে মানুষ।
এতসব বিষয়ে শুধু একজনের কোন নজর নেই। ইংরেজ লোকটার। সে সারাক্ষণ বইতে মুখ গুজে থাকবে।
প্রথম দু একদিন সান্তিয়াগোও চেষ্টা করেছে বই পড়ার। পরে মনে হল ক্যারাভান চলতে থাকা, চারপাশে তাকিয়ে দেখা, এসবেই আসল আনন্দ। উটদের সাথে বন্ধুতু পাতালে মন্দ হয় না।
পাশে পাশে চলতে থাকা এক উটচালকের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। একজন। উটচালক, আরেকজন ভেড়ার পাল চালাত।
রাতের পর রাত তারা আগুনের পাশে বসে কিছুক্ষণের জন্য। তারপর নানা কথা হয়। একদিন উটওয়ালা ছেলেটা তার কাহিনী বলল।
আমি আগে আল কারিয়ামের কাছে থাকতাম। ছেলেপুলে ছিল, ছিল আয়ের উৎস। জীবনটা একভাবেই কেটে যেতে পারত। এক বছর দারুণ ফসল ফলে, আমরা সবাই মিলে মক্কা চলে যাই। জীবনের না পাওয়া একমাত্র আশাটাও পূর্ণ হয়। খুশিমনে মরতে পারব ভাবতেই ভাল লাগত।
একদিন কেপে উঠল গোটা পৃথিবী। ভেসে গেল নীলের দু কূল। সব সময় মনে হত, এসব অন্য কারো কপালে ঘটবে, আমার জীবন চলবে যেমন চলছে। প্রতিবেশীরা ভয়ে অস্থির। এবারের বন্যায় মরে যাবে সব ফলগাছ। স্ত্রী ভয় পায়, ছেলেমেয়ে মারা যেতে পারে। আমার ভয় আমার সবকিছু নিয়েই।
একেবারে শেষ হয়ে গেছে সব জমিজমা। আমাকে অন্য কাজ খুঁজতে হবে এবার। তাই আমি এখন উটওয়ালা। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনা আমাকে আল্লাহর ভুবনগুলো চিনতে শেখায়। অচেনাকে ভয় পাবার কিছু নেই যদি তুমি নিজের চাওয়া ও পাওয়াটুকু বুঝতে পার।
আমরা আমাদের যা আছে তা হারানোর ভয়ে কাতর হয়ে থাকি, আবার ভেবে খুব তুচ্ছ মনে হয় যে আমাদের জীবনের ইতিহাস আর এ পৃথিবীর ইতিহাস এক সূত্রে গাথা। এক হাতে গড়া।
মাঝে মাঝে এক ক্যারাভানের সাথে আরেকটার দেখা হয়ে যায়। সবগুলোতেই বিনিময়ের মত কিছু না কিছু থাকবে। যেন সত্যি সত্যি সব এক হাতে লেখা। চোর আর বর্বর উপজাতির ব্যাপারে আসে সাবধানবাণী। তারা। কালো পোশাকে নিঃশব্দে আসে। তারপর চলেও যায় একই ভাবে। চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।
এক রাতে সান্তিয়াগো আর ইংরেজ লোকটার বসার জায়গায় এগিয়ে আসে এক উটচালক।
গোত্রে গোত্রে যুদ্ধের গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। জানায় সে।
চুপ করে যায় তারা। বাকি সবাই কেমন যেন নিশ্রুপ। কেউ কিছু বলছে। আবার শব্দহীন ভাষার কথা মনে পড়ে যায় তার মহাজাগতিক ভাষা।
বিপদ আছে কিনা জিজ্ঞেস করে ইংরেজ।
একবার মরুভূমিতে ঢুকে পড়লে আর কোন উপায় নেই, বলল উটচালক, আর ফিরে যাবার কোন উপায় যেহেতু নেই, তোমাকে ভাবতে হবে কী করে সামনে চলা যায় সে কথা। বাকিটা আল্লাহর হাতে। বিপদও।
তারপর সে সেই রহস্যময় শব্দ উচ্চারণ করে কথা শেষ করে, মাকতুব।
তোমার বরং ক্যারাভানের দিকে আরেকটু নজর দেয়া উচিত। ইংরেজ লোকটাকে বলে সান্তিয়াগেী। আমরা অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাই, তার পরও, চলি একই গন্তব্যে।
আর তোমার আরো পড়া উচিত। বই হল ক্যারাভানের মত জিনিস। সব সময় এক লক্ষ্যে ধাবিত হয়।
বেড়ে গেল চলার গতি। সারাদিন তীব্র গতিতে চলা, তারপর রাতে আগুনের পাশে একত্র হওয়া। আগে যাও একটু আধটু কথা চালাচালি হত, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
এক রাতে শমন জারি করল ক্যারাভানের পরিচালক, আগুন জ্বালানো। যাবে না। দূর থেকে যেন ক্যারাভানের অস্তিত্ব বোঝা না যায়।
সবাই রাতে পশুর দলকে গোল করে শোয়ায়, তারপর মাঝখানে শুয়ে পড়ে নিজেরা। ঠাণ্ডার হাত থেকে বাচার জন্য। না চাওয়া বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য। এদিকে ক্যারাভানের দলনেতা লোকটাও সারা রাত পাহারাদার বসিয়ে রাখে।
এক রাতে ঘুমাতে পারছিল না ইংরেজ। আকাশে পূর্ণ চাদ। দু একজন ছাড়া সবাই ঘুমে কাতর। নিজের জীবনের কাহিনী বলে শোনায় সান্তিয়াগো।
ইংরেজ লোকটা স্ফটিক দোকানের কথায় অবাক হয়।
এই হল আমাদের সব আত্ম চালানোর রীতি। একেই বলে এ্যালকেমি। পৃথিবীর আত্ম। কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলেই শুধু জগতের আত্মার কাছে যাওয়া যাবে। শক্তিটা সব সময় সহায়তাপূর্ণ।
পৃথিবীর বুকে এই যে মানুষ, পশু, এমনকি শাক-সজির আত্মা যেমন আছে, তেমনি আছে ভাবনার হৃদয়। আমরা সে আত্মার অংশ বলেই এর অস্তি তু ঠিক ধরতে পারি না। ফটিকের দোকানে কাজ করার সময় তুমি হয়ত টের পেয়েছ যে টুকরাগুলোও সহায়তা করছে তোমাকে।
একটু ভাবে সান্তিয়াগো। তারপর চোখ তুলে বলে, মরুভূমি পেরিয়ে যাবার পথে আমি একমনে ক্যারাভান দেখেছি। ক্যারাভান আর মরু দুজনেই এক ভাষায় কথা বলে। নাহলে মরুভূমি তাকে পেরিয়ে যাবার অনুমতি দিত না। প্রতি মুহূর্তে ক্যারাভান সময়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। যদি সময় হয়ে থাকে, আমরা এগিয়ে যাব সামনে। মরুদ্যানের দিকে।
যদি কেউ এ ক্যারাভানে শুধু ব্যক্তিগত সাহস নিয়ে যোগ দিয়ে থাকে তো এ যাত্রা কতটা কষ্টের হবে সেটাও তাদের জানা থাকা দরকার।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারা দাড়িয়ে থাকে।
এ হল লক্ষণের জাদু। আমি খেয়াল করেছি কী করে গাইডরা লক্ষণ বিচার করে, কী করে কথা বলে মরুর হৃদয়ের সাথে।
ইংরেজ লোকটা বলল, আমার তাহলে ক্যারাভানের দিকে আরো নজর দেয়া দরকার।
আর আমার চেখে দেখা দরকার তোমার বইগুলো।
২.১০
বইগুলো আসলেই আজব ধরনের। সেখানে পারদের কথা আছে, আছে লবণের কথা। একই সাথে আছে ড্রাগন আর রাজাদের কথাও। সে সবটুকু বুঝে উঠতে পারে না। বইতে শুধু একটা ধারণা ভালভাবে দেয়া আছে। তা হল, সব আসলে এক শক্তিতে গঠিত।
আরেক বই দেখে জানতে পারল, এ্যালকেমির সাহিত্যে মাত্র কয়েকটা বাক্যের রাজত্ব।
এ হল এ্যামারল্ড ট্যাবলেট। সান্তিয়াগোকে কিছু শিখানোর ইচ্ছা আছে তার।
তাহলে আর এত বইয়ের দরকার কী?
যেন আমরা ঐ সামান্য কয়েক ছত্র বুঝে উঠতে পারি।
বিখ্যাত এ্যালকেমিস্টের কথা বলা আছে যে বইতে, সেটাই তাকে সবচে বেশি টানে। এ মানুষগুলো অদ্ভুত। ল্যাবরেটরিতে ধাতুর শুদ্ধতা নিয়ে তাদের পুরো জীবন উৎসর্গ করে দেয়। তারা বিশ্বাস করে যে একটা ধাতুকে অনেক বছর ধরে তাপ দিলে সে তার নিজের সমস্ত গুণ ছেড়ে যাবে, তখন যা বাকি থাকে তাই হল জগতের আত্মা। জগতের এই আত্মাই জগতের যে কোন ব্যাপার বুঝতে তাদের সহায়তা করে।
এ আবিষ্কারকে তার আসল কাজ নাম দেয়। আংশিক তরল আর আংশিক কঠিন।
ভাষাটা বোঝার জন্য তুমি কি শুধু মানুষ আর লক্ষণের দিকে তাকিয়ে থাকতে পার না? একদিন ধুম করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সান্তিয়াগো।
সবকিছু সরল করে ফেলার একটা রোগ ধরে গেছে তোমার। এ্যালকেমি খুব স্থির একটা বিষয়। খুব সিরিয়াস। আসল কর্তারা যেভাবে করে গেছেন সেভাবে প্রতিটা ধাপ মেনে চলতে হবে।
সে জানতে পারে, আসল কর্তাদের করা কাজের তরল অংশটুকু হল জীবনের অমৃত। সব রোগ সারিয়ে দিতে পারে এটা। এ্যালকেমিস্টরা এসব ব্যবহার করেই মারা যাওয়া ঠেকিয়ে রাখে। আর কঠিন অংশটার নাম ফিলোসফারস স্টোন।
ফিলোসফাস স্টোন পাওয়া কিন্তু মুখের কথা না। এ্যালকেমিস্টরা ল্যাবরেটরিতে বছরের পর বছর সময় ব্যয় করেছে, চোখ রেখেছে আগুনের প্রতি, ধাতুর প্রতি। আগুনের কাছে এত বেশি সময় কাটিয়েছে যে আস্তে আস্তে তাদের ছেড়ে দিতে হয় দুনিয়া, সব ধরনের রীতিরেওয়াজ। ধাতুর শুদ্ধতা আসলে তাদের শুদ্ধতা হয়ে যায়।
স্ফটিক দোকানি বলেছিল, এসব জিনিস পরিষ্কার করাটা ভাল, তাতে সান্তি য়াগোর মনে না বোধক চিন্তা আসতে পারবে না। আসলে মানুষ নিত্যদিনের কাজে এ্যালকেমির খোঁজ পেতে পারে।
এদিকে ফিলোসফারস স্টোনের বিচিত্র কিছু কেরামতি আছে। সামান্য একটু রূপাকে অনেক বেশি সোনায় পরিণত করা যায়। স্পর্শ করলেই।
এসব শুনে শুনে তার মনে স্বপ্ন জাগে, একদিন সেও কাজ করে দেখাবে। স্পর্শ দিয়ে হয়ত সেও আর সব ধাতুকে বানাবে স্বর্ণ। হলভেশিয়াস, ইলিয়াস, ফুলকেনেলি আর জিবারের মত। তাদের সবাই জীবন কাটিয়েছেন ভ্রমণ করে, কথা বলেছেন জ্ঞানীদের সাথে, অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অলৌকিক শক্তি আর সেইসাথে ছিল পরশপাথর বা ফিলোসফারস স্টোন আর জীবনামৃত।
আসল কাজ কীভাবে অর্জন করতে হয় দেখা লাগবে সান্তিয়াগোর। সে তাকায় বইতে। আর হতাশ হয় গ্রাফ, চার্ট, অঙ্ক আর টেকনিক্যাল কথাবার্তা দেখে।