২.০১ দ্বিতীয় পর্ব – সর্পদন্তের চেয়েও তীক্ষ্ম

দ্বিতীয় পর্ব – ‘সর্পদন্তের চেয়েও তীক্ষ্ম…’

২.১

আগ্রা, ১৬৪৭

সুবাসিত বাগানের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলেন শাহজাহান। গোলাপি আকাশের পটভূমিতে অশ্রুবিন্দুর ন্যায় গম্বুজের নিচে সাদা মার্বেলের জমকালো সমাধিস্তম্ভ দেখে মনে হল, ভাসছে। সুনিপুণ এই সৌন্দর্য দেখে দম বন্ধ হয়ে এল সম্রাটের। এর আগে আজকের দিনে মমতাজের ঘোড়শ মৃত্যুবার্ষিকীতে পাঠ করার জন্য কবিতা রচনা করে দিয়েছেন দরবারের একজন কবি।

পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে তোমার দৃষ্টি দোলা দেয়
স্মৃতির ভার তোমার পদাঙ্ককে সংকোচন করে দেয়
 মেঘে চোখের দৃষ্টিভ্রম করে দেয়,
খাঁটি পাথরের ঘর্ষণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়
 মদ ফটিকের ভেতর স্বচ্ছ দেখায়
যখন তারার থেকে আলো মার্বেলে প্রতিফলিত হয়
বাতির আনন্দ উৎসবে পুরো প্রাসাদ সুসজ্জিত হয়।

মমতাজের সবশেষ বিশ্রাম স্থানের অসাধারণ আকার আর উজ্জ্বলতা উভয়কেই তুলে এনেছেন কবি। চার বছর আগে দ্বাদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে, অস্থায়ী সমাধি থেকে নিয়ে আসা হয় মমতাজের মৃতদেহ। রত্নখচিত ফুল খোদাই করা সাদা মার্বেলের শবাধারে রাখা হয় মৃতদেহ। বাঁকানো লতাগুলো জীবনীশক্তি আর নবজন্মকে তুলে ধরেছে যেন তারা সত্যিই জন্মেছে এই মার্বেলের উপর। সাধারণ কালো মার্বেল দিয়ে সোজা-সাপ্টা করে লেখা হয়েছে এপিটাফ : এই অত্যুজ্জ্বল সমাধিটি আরজুমান বানু বেগমের, যাঁকে মমতাজ মহল উপাধিতে সম্মানীত করা হয়েছে। একাকী ঘণ্টাখানেক সমাধিগৃহে কাটান শাহজাহান। এরপর পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মাটির নিচে সমাধিগৃহ ছেড়ে উঠে যান মৃত সম্রাজ্ঞীর উদ্দেশে শোক পালনের জন্য অপেক্ষারত তাঁর পরিবার আর সভাসদদের কাছে। এখনো ঠিক একই কাজই করবেন তিনি।

তাঁকে যারা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে যে সময়ের সাথে সাথে কমে যাবে যন্ত্রণা, তাদের কথা বিশ্বাস করলে এখন আশাহত হতেন তিনি। যদিও শাসনকার্যের ভারে কিছু সময়ের জন্য চাপে ছিলেন তিনি, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেছে যে কী হারিয়েছেন। অনুভূতিগুলো এখনো এত তাজা যে মনে হচ্ছে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছেন সমাধি স্তম্ভে। তারপরেও কী হারিয়েছেন তা অনুভব না করতে পারার মানে এই নয় যে তিনি মমতাজকে ভুলে যাচ্ছেন, এই কাজটা কখনোই পারবেন না…অন্তত যা সৃষ্টি করেছেন খানিকটা আরাম মিলবে। এর চেয়ে সুন্দরভাবে আর কখনোই ফুটে উঠতো না তার ভালোবাসা আর হারানোর বেদনা।

এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি সমাধির কাজ। কারিগরেরা শেষ ছোঁয়া লাগাচ্ছে সীমানা দেয়ালের উপর সুন্দর করে বসানো লাল বালিপাথরের প্যাভিলিয়ানের উপর। এখানে সুর বাজাবে বাদকের দল। এছাড়াও সম্রাট নির্দেশ দিয়েছেন যেন মসজিদ আর অতিথিশালাগুলোকেও আরো চকচকে করে তোলা হয়। মাত্র গত মাসেই খাজনা আদায়কারীদের প্রধান কর্মকর্তা জানিয়েছে যে সমাধি নির্মাণের খরচ পৌঁছে গেছে পঞ্চাশ লাখ রুপিতে। ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে যে এহেন খরচে কোন এক সময় দেউলিয়া হতে বসবে টাকশাল, কিন্তু মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়েছেন শাহজাহান–মোগল সামাজ্য এতটাই বিত্তবান আর শক্তিশালী যে, কোন কিছুই অসম্ভব নয় যেমন রত্নখচিত তাজমহল; সমাধিস্তম্ভকে জনগণ ইতিমধ্যেই মমতাজ মহল থেকে সংক্ষিপ্ত করে তাজমহল ডাকা শুরু করেছে।

ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কত বড় এক উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন শাহজাহান…যুগের পর যুগ মহিমা গেয়ে যাবে তার নির্মিত দালান সমূহ, হোক সেটা ব্যক্তিগত ক্ষতির সৌধ তাজমহল অথবা দিল্লিতে সাম্রাজ্যের শক্তি হিসেবে গড়ে তোলা শহর শাহজাহানাবাদ। এতে সহজে তাঁর শাসনামল ভুলতে পারবে না ইতিহাস। পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় দক্ষিণে মোগল সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করেছেন আর কে জানে উত্তরে কতটা এগিয়ে যাবেন তিনি আর তাঁর উত্তরসূরীরা?

এ ভাবনার উদয় হতেই কাঁধের উপর দিয়ে পলক ফেলে দেখে নিলেন চার পুত্রকে সকলেই তাঁর মতই পরিধান করেছে শোকের শুভ্র পোশাক। ফটকদ্বারে একটা মাত্র বাজনার সাথে মৃদু তালে পা ফেলে পিতাকে অনুসরণ করছে। হেঁটে আসছে উত্তর দক্ষিণে বয়ে চলা পানির প্রবাহ আর মসৃণ বুদবুদঅলা মার্বেলের ঝরনার পাশ দিয়ে।

সমাধি স্তম্ভের কাছে পৌঁছতেই শুনতে পেলেন কালো আলখাল্লা পরিহিত মোল্লাগণ স্বর্গের উদ্যানে মমতাজের আত্মাকে গ্রহণ করার জন্য প্রার্থনা করছে। বালিপাথরের মঞ্চের কাছে পৌঁছে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন মার্বেলের তৈরি ছোট ভিত্তিমূল আর সমাধির মাঝখানের অষ্টভুজ প্রকোষ্ঠে। সোনালি ঝাড়বাতির আলোতে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। ঝুলন্ত সিল্কের দেয়াল আর ধিকিধিকি করে জ্বলা ধূনার ধোঁয়ায় বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন স্ফটিকের কণা।

পালিশ করা জাফরি কাটা পর্দার সামনে তার জন্য সংরক্ষিত আসনে বসলেন শাহজাহান। একটি মাত্র পাথরের ব্লক কেটে তৈরি করা রত্নখচিত এ জাল ঢেকে রেখেছে নিচের সমাধি গুহাতে শুয়ে থাকা মমতাজের কফিনের অনুরূপ মার্বেলের স্মৃতিস্তম্ভ, পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ আরবীয় মুক্তা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে এর উপর।

স্মরণ সভার আচার অনুষ্ঠান পালন করলেন মন দিয়ে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা শেষ হতেই আবারো ডুবে গেলেন স্মৃতির মাঝে। দুঃখের তীক্ষ্ণ শলাকা এসে আঘাত করল হৃদয়ে, তীব্রভাবে অনুভব করলেন যে একাকী হতে চাইছে মন। সমাধি ছেড়ে দ্রুত পিছন দিকে হেঁটে গেলেন দক্ষিণের প্রবেশদ্বারে। চাঁদের আলোয় ঝাপসা দেখাচ্ছে সাদা মার্বেলের ছাত্রি। প্রহরীরা উঠে দাঁড়ালেও থামলেন না। হনহন করে হেঁটে নিচে নদী তীরে নোঙর করে রাখা বজরার দিকে এগিয়ে চললেন। নাবিকেরা বুঝতেই পারেনি যে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন সম্রাট। দৌড় দিয়ে নামিয়ে দিল বজরায় ওঠার তক্তা। উল্টো দিকের বাগানে নিয়ে চলো আমাকে। আদেশ দিলেন সম্রাট।

মমতাজের সমাধি নির্মাণের কাজ তখন অর্ধেকও হয়নি এমন সময় তাজমহলের ঠিক অপর পাশে যমুনার তীরে নিজের মালিদেরকে দিয়ে মাহতাব বাগ নামে উদ্যান তৈরি করেন শাহজাহান–চন্দ্র আলোর উদ্যান। রাতের বেলা প্রস্ফুটিত হয় এরকম তীব্র সুগন্ধঅলা সব ফুলের চারা রোপণ করা হয় এ উদ্যানে। অনেক অনেক বছর আগে শাহজাহানের পিতৃপুরুষ বাবর একদা ক্রীড়াভূমি গড়ে তুলেছিলেন এ স্থানে। এখন এটি ব্যবহৃত হচ্ছে সম্রাট শাহজাহানের একান্ত ব্যক্তিগত স্থান হিসেবে। একাকী হেঁটে বেড়ান আত্মমগ্ন শাহজাহান, গভীরভাবে ধ্যান করেন স্মৃতিসৌধ নিয়ে।

যমুনার ঢেউয়ের তালে তালে অল্প অল্প দুলছে বজরা, তারপরেও দাঁড়িয়ে রইলেন শাহজাহান। বজরা তীরে নাক দিতেই নেমে যাবার । তক্তার জন্য অপেক্ষা না করেই তীরে নেমে গেলেন। এগিয়ে গেলেন নদীর দিকে, মুখ করে তাকিয়ে থাকা ছোট মার্বেলের আচ্ছাদনের দিকে। এর নিচে বসে স্তম্ভের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বন্ধ করে ফেললেন চোখ। ভেসে এলো শুধু তীরে পানির আছড়ে পড়ার মৃদু শব্দ।

কিছুক্ষণের জন্য মন জুড়ে রইল শুধুই মমতাজ। সেই রাতে মমতাজের চাহনি যখন বুঝতে পেরেছে আর বেশিক্ষণ বেঁচে রইবে না, কখনো ভুলতে পারবেন না। শাহজাহান–অথবা সেই সাহস, শেষ মুহূর্তে সময়গুলোতে একসাথে সহভাগিতা করেছেন দুজনে… মাঝে মাঝে মনে হয় শুধুমাত্র তখনই, বিচ্ছেদের সেই মুহূর্তে সত্যিকারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে কতটা গভীরভাবে ভালোবাসেন এই নারীকে। বিবাহের পর থেকে বছরের পর বছর মমতাজের শর্তহীন ভালোবাসাকে চিরস্থায়ী হিসেবে নিয়েছেন তিনি অন্ধকার মুহূর্তগুলোতে শক্তি শুষে নিয়েছেন এ ভালোবাসা থেকে। মমতাজের সৌন্দর্য আর মিষ্টি চরিত্র, মাংস আর পানীয়ের মতই টিকিয়ে রেখেছে তাঁকে। কিন্তু কখনো কি মমতাজের নিঃস্বার্থপরতা আর কষ্টসহিষ্ণুতার প্রশংসা করেছিলেন তিনি? মমতাজের শেষ মুহূর্তের উদ্বিগ্নতাও ছিল তাঁকে আর তাঁর সন্তানদের নিয়ে। আর এখানেই সম্ভবত মমতাজের কাছে হেরে গেছেন তিনি। পরিবারের হৃদয়ের স্পন্দন ছিল মমতাজ…তার কাছেই নিজ হৃদয়ের অনুভূতি আর চিন্তা তুলে ধরতেন ছেলেমেয়েরা। সমব্যথিতা অবচেতনেই মিশে ছিল মমতাজের চরিত্রে। কেন তিনিও একই হতে পারেন না? মাঝে মাঝে মনে হয় নিজ সন্তানেরাই যেন আগন্তুক তার কাছে। এর কারণ কি এটাই যে, নিজের পিতার সাথেও তাঁর সম্পর্ক বিদ্বেষপূর্ণ ছিল? অথবা এই কারণে যে একজন ম্রাট হিসেবে সাম্রাজ্যের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ও জনগণের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে আর তাই নিজের সন্তানদের জন্য সময় ব্যয় করা যাবে না?

যে কোন সংকটময় কালই একত্রিত করে তোলে পরিবারকে, এতে কোন সন্দেহ নেই। জাহানারা সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত উদ্বেগময় মাসগুলোতে ছেলেমেয়ের উপস্থিতিতে স্বস্তি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার পর থেকে কদাচিৎ আবার তাঁরা একত্রিত হয়েছিল–এমনকি মমতাজের মৃত্যুবার্ষিকীতেও নয়। ফলে কীভাবে তিনি তাদের সম্পর্কে জানবেন, বিশেষ করে পুত্রদের সম্পর্কে? বত্রিশ বছর বয়সী দারা, পিতার সব সময়কার সঙ্গী, দরবারে তেমন একটা অনুপস্থিত থাকেন না, কিন্তু মাত্র পনের মাসের ছোট শাহ সুজা? মৃত্যুবার্ষিকীর জন্যে আগ্রাতে ফিরে এসেছে কিন্তু পরিষ্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে বাংলাতে নিজের প্রশাসকের দায়িত্বে ফিরে যেতে পারলেই খুশি হবে। যদি আগ্রাতে গত কয়েক সপ্তাহের তার আচরণ ভেবে দেখা যায়, তাহলে বলতে হবে যে সম্ভবত দরবার থেকে দূরে থাকার স্বাধীনতা উপভোগ করছে শাহ সুজা পিতার কাছ থেকেও দূরে নিজের প্রদেশের উন্নতির উচ্চাকাঙ্খও আছে হয়ত। শাহজাহানের পিতা সুলভ সমালোচকের দৃষ্টিতে এখনো শাহ সুজা রয়ে গেছে পূর্বেকার মতই অলস আর আনন্দপিয়াসী। তারপরেও কি বলা যায় না যে এগুলো বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নেয়া তরুণের সহজাত প্রবৃত্তি যদিও এগুলো তার নয়?

ভ্রুকুটি করলেন শাহজাহান। তৃতীয় পুত্র এখনো তার কাছে এক বিস্ময়। যদিও কেউ তার সম্পর্কে লঘুতা বা চাপল্যের অভিযোগ আনতে পারবে না। আওরঙ্গজেবের বয়স প্রায় ত্রিশের কাছাকাছি। দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসেছে। চারিত্রিক দিক থেকে হয়ে উঠেছে আরো বেশি গম্ভীর আর আত্মমগ্ন। কদাচিৎ প্রকাশ করে নিজের ভাবনা যদিও শাহজাহানের সন্দেহ যে এর কোন কমতি নেই আওরঙ্গজেবের মাঝে। ঘন্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে ওলেমাদের সাথে ধর্মীয় বিষয় আলোচা করে আর নামাজ পড়ে। খাবার এবং পানের ব্যাপারে মিতাহারী আওরঙ্গজেব কখনো মাদকদ্রব্য স্পর্শ করেনি। শক্তি ব্যয় করে সামরিক দক্ষতা অর্জনে। এ ধরনের অত্যন্ত কঠোর, সাদাসিধা জীবন যদিও সমালোচনার কিছু নেই; কিন্তু একজন তরুণের ক্ষেত্রে কেমন যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুতাপের বিষয় এই যে, আওরঙ্গজেব দারার মত সামাজিক নয়। দুজনেরই ধর্মীয় আর দর্শন বিষয়ে আগ্রহী। কিন্তু দারা অপেক্ষাকৃত বেশি কৌতূহলী আর ভোলা মনের অধিকারী– বিরুদ্ধবাদীদের সাথে তর্কে অথবা নিজের ধারণা বদলাতে সদা প্রস্তুত–অন্যদিকে আওরঙ্গজেব কেবলমাত্র তাদের সঙ্গই পছন্দ করে যারা তার মতই একই মতাদর্শের ধ্বজাধারী।

পিতা পুত্রের এ দূরত্ব বলা যায় শীতল সম্পর্ক বেশ অপ্রতিভ একটি ব্যাপার। দারার সাথে কথা বলতে যদিও তিনি কোন সংকোচ বোধ করেন না; কিন্তু গুরুগম্ভীর আর মৌন স্বভাবের আওরঙ্গজেবের সাথে কী কথা বলবেন সেটাই ভেবে পান না। হতে পারে এর কারণ যে তিনি তাকে কমই দেখেছেন। আওরঙ্গজেবও ঠিক শাহ সুজার মতই সম্ভবত কারণের ভিন্নতা থাকতে পারে–যত শীঘ্র সম্ভব আগ্রা ত্যাগে উৎসাহী ছিল। শাহজাহানও এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছিলেন। তারপরেও মনে হয় আওরঙ্গজেব আরেকটু বেশি সময় রাজদরবারে কাটালেই ভালো করত। জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের কাছ থেকে শিখতে পারত কেমন করে সহজাতভাবেই সন্তুষ্ট করতে হয় অন্যদেরকে।

হঠাৎ করেই পদশব্দের আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে তাকালেন, কে এখানে?

আমি আব্বাজান। জাহানারার কণ্ঠ শুনলেন শাহজাহান। অন্ধকার থেকে পেছনে কয়েকজন সৈন্যসমেত বের হয়ে এলো জাহানারার পাণ্ডুর দেহাবয়ব। নারীদের জন্য তৈরি পর্দার ফাঁক দিয়ে আপনাকে দেখেছি সমাধি ছেড়ে আসতে। চিন্তা হচ্ছিল।

একা এসেছ তুমি?

রোশনারা আসতে চেয়েছিল আমার সাথে কিন্তু আমি জানিয়েছি যে এর প্রয়োজন নেই। আমার কয়েকজন সেবাদাসী আর আপনার কয়েকজন ভৃত্য নিয়ে নদী পার হয়ে এসেছি।

তাদেরকে বলো দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে। অনুগ্রহ করে বল…যোগ করলেন শাহজাহান। সন্দেহ করলেন জাহানারা হয়ত আপত্তি করতে চাইবে।

কিন্তু আমাকে নিশ্চয় থাকতে দেবে, তোমার সাথে?

দ্বিধা ভরে মাথা নাড়লেন সম্রাট। দ্রুত নিচে নেমে প্রহরীদের সাথে কথা বলে ফিরে এসে বসল জাহানারা।

মাত্রই আমি তোমাকে নিয়ে, তোমার ভাইবোনদের নিয়ে ভাবছিলাম….কেমন করে সবকিছু বদলে গেল তোমার আম্মাজান মারা যাবার পরে।

আমরা সবাই বেশ ছোট ছিলাম তখন, দারা আর আমি একটু বড় হয়েছিলাম, বাকিরা তো সবাই ছোট ছিল।

আর এখন তোমরা সকলে নারী-পুরুষ হয়ে গেছ, আমি বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। যখন আমি তরুণ ছিলাম সময় যেন চিরকালের মত একই থাকত–চির গ্রীষ্মকাল। অথচ এখন মনে হয় ঋতুগুলো আসছে আর যাচ্ছে। এমনকি আমার লাগান এই গাছের ফলগুলোও মনে হচ্ছে চোখের পলকে দ্রুত বড় হয়ে, পেকে পড়েও যাচ্ছে।

কিছুই না বলে নদী থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে শালটা আরেকটু ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল জাহানারা।

সম্ভবত, আমাকে কোথায় সমাস্থি করা হবে তা ঠিক করার সময় এসে গেছে। বলে চললেন শাহজাহান।

আব্বাজান…

কেন, এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে না? মৃত্যু এসে আমাদের সবাইকেই নিয়ে যাবে। প্রায়ই আমার মাথায় আসে তোমার মায়ের অনুরূপ একটি সমাধি নির্মাণের চিন্তা। এই জ্যোৎস্না উদ্যানেই হবে, তবে সাদা মার্বেল দিয়ে নয়, কালো মার্বেল দিয়ে। এমনকি দুজায়গার মাঝে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটা রুপালি সেতুর ভাবনাও আছে; যেন রাতের বেলা আমার আত্মা নদী পার হতে পারে মমতজের সাথে মিলিত হবার জন্য…কিন্তু সম্ভবত এটা একটু বেশিই আকাশকুসুম হয়ে যাচ্ছে, একজন মোগল সম্রাটের জন্যও।

পিতার দিকে তাকিয়ে জাহানারা ভাবতে চাইলো যে তিনি কি সত্যিই ভেবে চিন্তে এসব বলছেন কিনা। ইদানীংকালের বিভিন্ন ঘটনার কথা মাথায় রাখলে অবশ্য এটা বলা শক্ত হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে যেভাবে দেখে এসেছে, পিতা ছিলেন দৈনন্দিন বিষয়ে আগ্রহী, প্রয়োেগবাদী আর যে কোন ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। এরপরেই খেয়ালী এক একাকিত্বের মেঘ এসে ঢেকে ফেলে চেতনা। অনেক কাল আগেই একেবারে হৃদয়ের গম্ভীর হতেই ক্ষমা করে দিয়েছে জাহানারা, যদিও পুরোপুরি ভুলতে পারেনি কেমন করে একটা ঘটনা ঘটায় পুড়ে গিয়েছিল সে। তারপরেও গত কয়েক বছরে আবারো কাছাকাছি এসেছে পিতাকন্যা। এখন পিতার দিকে তাকিয়ে চোখ ভরে গেল অশ্রুতে। শাহজাহানের বয়স আর মানসিক বিপর্যস্ততা স্পষ্টতই চোখে পড়ছে। যদি আবারো তিনি আগের মত নিজের সত্যিকারের রূপ ফিরে পেতে পারতেন।

*

আমি আপনার মতামত চাই, আব্বাজান। আমার মনে হয় আমার কারিগরেরা ভালোই কাজ দেখিয়েছে। তারপরও সময় আছে যে কোন পরিবর্তন করার।

আজ সন্ধ্যায় আসব আমি। তুমিও আসবে আওরঙ্গজেব। দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাবার আগে দারার প্রাসাদ দেখার এটাই তোমার শেষ সুযোগ।

আমি দুর্গেই থাকতে চাই। দালানকোঠা তেমন টানে না আমাকে। এছাড়া রোশনারাকে দেখতে যাবো বলেও কথা দিয়েছিলাম।

এটা তো পরেও করতে পারবে। আমি চাই তুমি দারা আর আমার সঙ্গী হও। না চাইলেও গলার স্বর উঁচু হয়ে গেল শাহজাহানের। যেমনটা ইদানীং প্রায়শ ঘটছে, আজও তাঁকে ক্রোধান্বিত করে তুলেছে আওরঙ্গজেব। এখন যাও তোমরা দুজনেই। আমার আরো কিছু কাজ আছে।

দুই ঘণ্টা পরে যমুনার তীর ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন শাহজাহান। দুই পাশে দারা আর আওরঙ্গজেব। পেছনে প্রহরীদের ছোট্ট দল। এখনো ধূলিধূসরিত আর কাঁচা দেখালেও মার্চের উষ্ণ সূর্যের আলোয় বেশ দৃষ্টিনন্দন দেখাচ্ছে দারার নতুন প্রাসাদ। আঙিনাতে ঘোড়া থেকে নামতেই হলুদ আর সোনালি উর্দিধারী দারার ভৃত্যেরা এগিয়ে এলো লাগাম ধরতে। আগ্রহ নিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগলেন সম্রাট। হাওয়া বাতাস খেলছে এমন সব কক্ষের মাঝে দিয়ে নিচতলার ছাদে নিয়ে গেল দারা। এরপর মাঝখানের সমান্তরাল ছাদে, যেটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গম্বুজের মত ছত্রি। নাদিরা আর নারীদের দল সান্ধ্যবাতাস উপভোগ করতে পারবে। ব্যাখ্যা করে জানালো দারা।

মাথা নাড়লেন শাহজাহান। ভালোই কাজ করেছে তোমার কারিগরেরা। নিচতলায় পৌঁছে আবারো আওরঙ্গজেবের দিকে তাকালেন, তোমার কী মনে হয়?

বেশ সুন্দর। কিন্তু মনে হচ্ছে অর্থের ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা ছিল না।

বিস্মিত হল দারা। যেমনটা তোমাকে বলেছিলাম, আমার দ্বিতীয় পুত্র সিপিরের জন্ম উপলক্ষে এ নতুন প্রাসাদ নির্মাণের জন্য অর্থ এবং জমি দিয়েছেন আব্বাজান।

যদি আমাদের ভ্রমণ শেষ হয় তাহলে আমি আপনার অনুমতি নিয়ে দুর্গে ফিরে যেতে চাই।

পিতার দিকে তাকালেন আওরঙ্গজেব। বোরহানপুরের দক্ষিণে কর আদায় সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে একটা রিপোর্ট এসেছে আজ সকালে। আমি এখনো পড়া শেষ করিনি।

এবার উত্তর দিল দারা। ভ্রমণ এখনো শেষ হয়নি। তুমি তো আমায় ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখোইনি। আলোগ্লো থেকে আনা আয়নার সারি দিয়ে মুড়ে দিয়েছি চারপাশ আর আমার নকশাবিদ বেশ কয়েকটি হাওয়া সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে যেমনটা পারস্য আছে। ফলে গ্রীষ্মকালেও শীতল থাকবে। আব্বাজান এটা পুরোপুরি তৈরি হয়ে এলে আপনাকে দেখাতে নিয়ে যাবো–অন্দরসাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি এখনো। তাই চারপাশে ধুলা আর নোংরা, কিন্তু আমি চাই আগ্রা ত্যাগের আগে দেখে যাক আওরঙ্গজেব।

মাথা নাড়লেন শাহজাহান আর প্রায় ঘুরেই তাকাচ্ছিলেন এমন সময় অদ্ভুত স্বরে কথা বলে উঠল আওরঙ্গজেব না, আমি যাবো না।

আওরঙ্গজেব। পুত্রের দিকে তাকালেন শাহজাহান। তোমার দাক্ষিণাত্যের সমস্যা নিশ্চয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আওরঙ্গজেব উত্তরে জানালো, না, যেমনটা বলেছি, আমি ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখতে চাই না আর আবারো অনুমতি চাইছি চলে যাবার জন্য।

হতভম্ব হয়ে গেলেন শাহজাহান, নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ আওরঙ্গজেবের অভিব্যক্তিতে। কী হয়েছে তার? দারাকে তিনি এত সুন্দর একটি উপহার দিয়েছেন তাই কি অসন্তোষ হয়েছে সে? যদি তাই হয়, তাহলে মোটেই ভালো হয়নি ব্যাপারটা। সব পুত্রদের প্রতিই তিনি একেবারে মুক্তহস্ত। বালখিল্যতার কোন ইচ্ছেই নেই তার। আদেশ দিলেন,

আমি চাই ভাইয়ের অনুরোধে ঘরটি দেখতে যাবে তুমি।

আব্বাজান, আমাকে নির্দেশ দেয়ার আগে দয়া করে ভেবে দেখ কেন নইলে আপনাকে অমান্য করতে বাধ্য হব আমি।

ক্রমেই রাগ বাড়তে লাগল সম্রাটের। তোমার এমন আচরণের কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। ভাইয়ের সাথে অভদ্রতা আর আমার সাথে অবাধ্যতা করছ তুমি। পিতা হিসেবে আমি বলছি না যে দারার কথা মত কাজ কর, তোমার সম্রাট হিসেবে আদেশ দিচ্ছি।

তাহলে প্রজা হিসেবে প্রতিবাদ করলাম আমি!

লম্বা লম্বা পা ফেলে গিয়ে ছেলের পেশীবহুর কাঁধ আঁকড়ে ধরলেন শাহজাহান।

কী হয়েছে তোমার? যেমনটা বলেছি কর নয়ত শাস্তি দেব।

হতে পারে; কিন্তু অন্তত নিজের জীবন বাঁচাতে পারব আমি। এ কক্ষের কথা শুনেছি আমি–একটা মাত্র দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে, বেরোতে হবে। এর উদ্দেশ্যটাই বুঝতে পারছি না–হয়ত কোন ফাঁদ।

থ বনে গেল দারা। কী বলতে চাইছ তুমি? আমি তোমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছি?

কীভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি তা চাইছ না?

ধাক্কা দিয়ে আওরঙ্গজেবকে সরিয়ে দিলেন শাহজাহান। তুমি একটা ভণ্ড প্রতারক যদি এই অভিযোগ কর যে ভাই তোমাকে হত্যা করতে চাইছে। কক্ষটিতে যেতে জোর করব না আমি; কিন্তু এখনি সরে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।

আঙিনাতে বের হয়ে যেখানে ঘোড়াগুলো বেঁধে রাখা হয়েছে, চিৎকার করে প্রহরীদের সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দিলেন, অর্ধেক প্রহরী নিয়ে শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে এখনি দুর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। বাকিরা এখানেই অপেক্ষা করো।

ছেলের আচরণে আঘাত পেলেও আবারো কক্ষে ফিরে আসার সময় চেষ্টা করলেন গলার স্বর নিচু করতে। কোনমতেই চান না যেন বাইরের সৈন্যরা কিছু শুনে ফেলে। আওরঙ্গজেব, আগ্রা দুর্গে তোমার গৃহে ফিরে যাও, এক্ষুনি।

আব্বাজান, আমি…।

চুপ করো। তোমার অজুহাত শোনার কোন আগ্রহ নেই আমার। যাও! পুত্রের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন শাহজাহান। সূর্যস্নাত আঙিনার দিকে দ্রুত হেঁটে গেল আওরঙ্গজেব। একটু পরেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া গেল। রাগে রীতিমত কাঁপছেন বুঝতে পারলেন শাহজাহান। কুচক্রীকারীরা নিশ্চয়ই আওরঙ্গজেবের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে দারা তাকে মৃত দেখতে চায়। তার একগুয়ে অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা এমন ষড়যন্ত্রের ফল। না হলে কেন এই দাবি করল যে সে জানে তার উপর বিপদ নেমে আসছে?

*

রাগে হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণের জন্য প্রস্তরমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শাহজাহান। দারার দিকে তাকিয়ে দেখেন, অনিন্দ্যকান্তি মুখখানা ঘুরিয়ে রেখেছে অন্য দিকে, যেন পিতার চোখে চোখ না পড়ে যায়।

আওরঙ্গজেব একটা ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার আছে আমার। প্রথম আগ্রা দুর্গ তারপর পুত্রের গৃহে আসতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগলেও এখনো প্রশমিত হয়নি শাহজাহানের রাগ। মাথা ঠাণ্ডা হবার জন্য অপেক্ষা করলে ভালো হত, কিন্তু তৃতীয় পুত্রের এহেন অদ্ভুত আচরণের কারণ না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবেন না তিনি।

সেই সময়ে যা বলেছি, তার চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই আমার। অনড় আওরঙ্গজেবের অভিব্যক্তি।

তুমি পরিষ্কারভাবে বলেছ যে মাটির নিচের কক্ষে তোমাকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে দারার কোন একটা উদ্দেশ্যে ছিল।

মাথা নাড়লেও কিছু বলল না আওরঙ্গজেব।

 কেন? চিৎকার করে উঠলেন শাহজাহান। উত্তর দাও।

যদি আমি বলিও আপনি বিশ্বাস করবেন না আমাকে। দারা আমার বিরুদ্ধে আপনার মনে বিষ ঢেলেছে।

আওরঙ্গজেব, আমার সাথে রহস্য করে কথা বলবে না।

খানিকক্ষণ দ্বিধা করে কাঁধ ঝাঁকালে তাঁর পুত্র। ঠিক আছে, আপনি যেহেতু বাধ্য করছেন…আগ্রাতে ফেরার পর থেকে আমি দেখছি দারা কতটা বদলে গেছে। দারা কখনোই নম্র ছিল না আর এখন তো রাজদরবারে ঠিক একটা ময়ূরের মতই সদর্পে ঘুরে বেড়ায়। যখন সাম্রাজ্যের দূরতম কোণে বসে আমি আর শাহ সুজা আপনার কাজ করার চেষ্টা করছি, দারা এখানে আহ্লাদে পরিপাটি হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে…

তো তাহলে এই ব্যাপার নিয়ে তুমি হিংসা করছ!

প্রথমবারের মত হাসল আওরঙ্গজেব। হিংসা? না। আমি ঘৃণা করি দারাকে। ওর শুধু দেখনো ব্যাপারটা আছে, কোন সারবত্তা নেই। অনেক বছর ধরেই এটা সন্দেহ করেছি আমি। তার পুরো মনোযোগ কীভাবে শুধু নিজেকে জাহির করতে হয়। ও এমন ভাব করে যেন ইতিমধ্যেই তাকে আপনার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা তার ভাইয়েরা যেন কিছুই না। আমাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে পরীক্ষার আগে ভেবে দেখা উচিত।

সাবধানে কথা বলো আওরঙ্গজেব…

আপনি আমার সত্যিকারের ভাবনা আর অনুভূতি জানতে চেয়েছিলেন। যা শুনলেন তা যদি পছন্দ না হয় তাতে তো আমার কোন দোষ নেই। যেমনটা আমি বলেছি দারা উদ্ধত আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী…

কিন্তু তুমি যেমনটা দাবি করছ যে সে ভাবে তার ভাইয়েরা মূল্যহীন, তাহলে তোমাকে কেন হত্যা করতে চাইবে?

বাইরের পৃথিবীতে নিজেকে আপনার প্রিয়পুত্র হিসেবে জাহির করতে চায় দারা। আর আপনার স্বীকৃতি নিয়ে তার অবস্থানের ব্যাপারেও কোন ভয় নেই। কিন্তু গোপনে নিজের ভেতরে এ ভয়ে ভীত হয়ে থাকে যে, কোন একদিন আমরা কোন ভাই তাকে হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে বসব। সব সময় তো এটাই আমাদেরকে পথ দেখিয়েছে, রাজসিংহাসন নয়ত কফিন–আগেকার দিনে এটাই তো বলত সকলে, তাই না? আপনাকেও সিংহাসনের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছিল আর এই করতে গিয়ে নিজের দুজন সৎ ভাইকেও সরিয়ে দিয়েছিলেন পথ থেকে।

নিশ্চুপ রইলেন শাহজাহান। রাগ আর অপরাধবোধের মিশ্র অনুভূতি পাকিয়ে উঠছে বুকের মাঝে। বহু কষ্টে গলার স্বর সংযত রেখে বলে উঠলেন, এটা ভিন্ন ব্যাপার। আর কোন উপায় ছিল না আমার। আমি যা করেছি তা করেছি শুধুমাত্র এই কারণে যে নতুবা আমার সৎভাইয়েরাই আমাকে হত্যা করে ফেলত–বস্তুত তোমাকেও সম্ভাব্য শত্রুর হাত থেকে মুক্তি পেতে চাইত। কিন্তু এ সময় তো বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। এ ধরনের বর্বোরচিত নীতি আমার পরিবারে সহ্য করব না আমি। আমার সকল পুত্রই আপন ভাই, বড় হয়ে উঠেছে যত্নশীল পিতা-মাতার ছত্রছাত্রায়, যারা একে অপরকে ভালোবাসে, প্রতিদ্বন্দ্বী স্ত্রী আর উপপত্নীদের কাছ থেকে আসা ভাই-বোন নয় যে একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে।

আপনার ধারণা আমরা আপন ভাই, এই কারণই আমাদেরকে একসাথে বেঁধে রাখবে? দারাকে জিজ্ঞেস করুন, সেও কি এটা মনে করে কিনা? হাবিল আর কাবিলের কথা ভুলে গেছেন? ভাইদের মাঝে যুদ্ধ তো নতুন কিছু নয়।

এখনো তুমি আমাকে কোন প্রমাণ দিতে পারনি যে দারা তোমাকে আঘাত করতে চায় তোমার ভয় পুরোপুরি অমূলক, মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তা ছাড়া কিছু নয়…

না। এর চেয়ে বেশি। যেমনটা আমি বলেছি, দারা সন্দেহ করে যে সময় এলে পর তার কোন ভাই হয়ত সিংহাসনের জন্য তার সাথে লড়াইয়ে নামবে। শাহ সুজা ক্ষমতা পছন্দ করলেও, এমনকি তার নিজের উচ্চাকাঙ্খ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে অলস। মুরাদ এখনো ছোট এবং নিজেকে প্রমাণও করেনি। তাই এখন দারার একমাত্র ভয় আমাকে নিয়ে আর এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সে জানে যে আমিও তার মতই সামর্থ্য রাখি–সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। আমি নিশ্চিত যে দাক্ষিণাত্য থেকে রাজাদরবারে আমার ফিরে আসাটা ভালোভাবে নেয়নি সে। তার উদ্দেশ্য এতেই পূর্ণ হবে যদি আমি আর শাহ সুজার ক্ষেত্রে একই কথা খাটে– এখানে কেন্দ্রের প্রভাব আর আপনার কাছ থেকে দূরে থাকি। আর সব সময়ের জন্য আমি দূরে চলে গেলে তো আর কোন সমস্যাই রইল না। তার। সে জানে আমি তার ধ্যান-ধারণা সমর্থন করি না। সূফী রহস্যবাদের প্রতি তার আগ্রহ, আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের দুর্নাম করা। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আমাকে এক মোল্লা সাবধান করে দিয়েছে যে দারা নাকি বলেছে সাম্রাজ্যে আমার মত ধর্মান্ধ গোঁড়া লোকের প্রয়োজন নেই…

হাত তুললেন শাহজাহান। আওরঙ্গজেবের এসব ধারণা আর অভিযোগ শুনে মাথা এত গরম হয়ে উঠল যে, বুঝতেই পারছেন না কোত্থেকে থেকে শুরু করবেন।

তুমি ভুল বলছ। এটা তো প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার যে তোমার আর দারার মাঝে ভিন্নতা আছে, এমনকি তোমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝেও। বয়সকালে তোমরা দুজনেই প্রায় সমকক্ষ থাকতে। কিন্তু তোমার এই অদ্ভুত অভিযোগ, ভিত্তিহীন সন্দেহ বরদাশত করব না আমি। কোন সে মোল্লা যে ভাইয়ের বিরুদ্ধে তোমার মন বিষিয়ে তুলেছে?

আমি বলতে পারব না। বিশ্বস্ত হয়েই আমাকে জানিয়েছে আর আমিও কখনো তার নাম প্রকাশ করব না।

অনেক হয়েছে তোমার এই ঔদ্ধতপনা আর অবাধ্যতা…কী করবে আর কী করবে না তা নিয়ে এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমিই–আমি নই ম্রাট। দারার ভূগর্ভস্থ কক্ষ দেখতে যাবার আমার আদেশ অমান্য করেছ তুমি আর এখন বলছ যে নামটাও আমাকে বলবে না।

কক্ষের এ মাথা ও মাথা পায়চারি শুরু করলেন শাহজাহান। দারাকে বলছ যে ক্ষমতালোভী, উচ্চাকাংখী–কিন্তু নিজেই ঝুঁদ হয়ে আছ এতে– ভাইয়ের প্রতি হিংসার মনোভাব পোষণ করছ, এমনকি এটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও এটাই সত্যি।

হতে পারে আমি হিংসা করছি, যদিও আপনি যে কারণে ভাবছেন, সেই কারণে নয়। যখন দারা আর আমি মেহরুন্নিসার কাছে থেকে বড় হচ্ছিলাম, তখন আমি বুঝতে পারতাম যে আপনি দারাকেই বেশি ভালোবাসেন। এখনো মনে আছে লাহোর প্রাসাদের খাল থেকে উদ্ধার করতে আসার সময় কি করেছিলেন আপনি…কেমন করে দারার নাম ডেকেছিলেন আগে, আমার নয়–ওকে বাঁচিয়ে তোলাটাই আপনার প্রধান চিন্তা ছিল।

এটা পাগলামী। আমি তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি। আগেও বাসতাম। তুমি ততটাই আমার পুত্র, যতটা দারা। অপলক ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান।

বলছেন ঠিকই আপনি, কিন্তু এটা সত্যি নয়। যদি তাই হত, তাহলে দারাকেও কোন একটা প্রদেশে পাঠিয়ে দিতেন, যেমনটা পাঠিয়েছেন আমাকে আর শাহ সুজাকে। এর পরিবর্তে তাকে দরবারে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন, যেমন করে মা মুরগি আগলে রাখে প্রিয় ছানাকে। কী করেছে সে এ পর্যন্ত? লড়াই করেছে যেভাবে আমি করেছি? নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে সাম্রাজ্যের জন্যে? না। কেননা আপনার চোখে ওর জীবন এতটাই মূল্যবান যে ক্ষতির মুখে ফেলা যাবে না। এর বদলে যমুনার তীরে নিজের প্রাসাদে নিরুপদ্রব জীবন কাটাচ্ছে সে। তার হারেমের যে কোন নারীর মতই বখে যাওয়া, আহ্লাদে মাখা জীবন।

চুপ কর! আর শুনতে পারব না আমি। যা কিছু তুমি বলেছ আমাকে নিয়ে আর দারাকে নিয়ে, সবকিছুই তোমার ভ্রান্ত কল্পনা, কিন্তু বিপজ্জনক। কী ঘটবে যদি দরবারে এ খবর ফাঁস হয়ে যায় যে সম্রাটের দুই পুত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে–এমনকি একজন আরেকজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছে? শুধু ভেবে দেখো যে, কেমন করে এ ঘটনার ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করবে সীমান্তের ভেতরে আর বাইরে থাকা আমাদের শত্রুরা…কতটা অনিষ্ট ঘটাতে চাইবে তারা। আমি তোমাকে বলছি আওরঙ্গজেব, ভাইয়ের বিরুদ্ধে একতরফা এ অভিযোগের এখানেই ইতি ঘটাও। একই সাথে আমার বিরুদ্ধে আনা তোমার অভিযোগেরও।

পায়চারি থামিয়ে পুত্রের দিকে তাকালেন শাহজাহান।

আওরঙ্গজেব কিছুই না বললেও মুখের দৃঢ় অভিব্যক্তির অর্থ ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন সম্রাট। ছেলের এই পাগলামো মনোভাবের প্রতি ক্রোধান্বিত হবার পাশাপাশি তিনি এটাও ভেবে চিন্তিত হলেন যে, আওরঙ্গজেব নিজেকে এতটাই অপাংক্তেয় আর ব্রাত্যভাবে যে পিতা হিসেবে তাঁকেই শক্ত হতে হবে, দুর্বলতা দেখানো যাবে না আর এই আচরণ এখানেই খতম করতে হবে। নয়ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে এর পরিণতি? আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি নিশ্চিত হচ্ছি যে তোমার যৌক্তিক চিন্তাধারা ফিরে আসেনি, ততক্ষণ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে আমার রাজপ্রতিনিধি হিসেবে আর দায়িত্ব পালন করছ না তুমি।

আলোচনা শুরু হবার পর থেকে এই প্রথমবার শাহজাহান লক্ষ্য করে দেখলেন যে তীর নিশানাতে লেগেছে। দৃশ্যতই মূহ্যমান হয়ে গেল আওরঙ্গজেব।

আব্বাজান…।

না, এখনো শেষ করিনি আমি। অনির্দিষ্ট কালের জন্য আগ্রা দুর্গেই থাকবে তুমি। তোমার মানসিক অবস্থার এমন মুহূর্তে তোমাকে চোখের আড়াল করার ঝুঁকি নিতে চাই না আমি। আশা করি সামনের দিনগুলোতে নিজের বোকামি বুঝতে পেরে অনৈতিক অভিযোগ তুলে নেবে তুমি। ভাবতেও পারবে না যে আমাকে কতটা হতাশ করেছ তুমি।

নিজের খাস কামরায় ফিরে এসে খানিক বসে রইলেন শাহজাহান। এখনো ডুবে আছেন গভীর চিন্তায়। সময় হয়ে গেছে পরিবার আর বাইরের পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়ার যে কোন্ পুত্রকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখতে চান তিনি আর সমস্ত সন্দেহের অবসান করার–অথবা অযাচিত আশার–কনিষ্ঠ কোন পুত্রের যদি কিছু থেকে থাকে। তিনি বেঁচে থাকতে থাকতেই নিজেদের অসন্তুষ্টি মিটিয়ে নেবে তারা। বিবাদের আশংকাও দমন করতে পারবেন তিনি।

দুই দিন পরে, দর্শনার্থীদের সামনে নিজের জমকালো ময়ূর সিংহাসনে বসে গর্ববোধ করলেন শাহজাহান। এ ধরনের জৌলুস আর কোন শাসকই বা সৃষ্টি করতে পেরেছিল? তাঁর আদেশ মত সেনাপতি আর সভাসদগণ নিজেদের শ্রেষ্ঠ পোশাক আর রত্ন পরিধান করেই হাজির হয়েছেন আজ। কমলা রঙের সিল্কের আলখাল্লা আর হীরেখচিত হাতলওয়ালা ছুরি কোমরে ঝুলিয়ে জ্বলজ্বল করছে অশোক সিং। নিজের শাসনামলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করতে এসেছেন সম্রাট, তাই এমনটি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একবার সেদিকে তাকালেন শাহজাহান। দারার দুপাশে শাহ সুজা আর মুরাদ। হাত তুলে নীরবতা কায়েম করলেন সম্রাট। যদিও বহু খিলানঅলা কক্ষটাতে এমনিতেই নেমে এসেছে নৈঃশব্দের চাদর।

আজ তোমাদের সকলকে ডেকে পাঠানোর কারণ হল দরবারে আমার প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শুকোহকে সম্মানিত করা। এই মর্মে আমি তাকে হিসার ফিরোজা জায়গীর ও লোহিত বর্ণের শিবিকা স্থাপনের অধিকার প্রদান করলাম। কথা শেষ করার আগেই দেখতে পেলেন চারপাশে শুরু হয়ে গেছে চকিত দৃষ্টি বিনিময়। সবাই জানে তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন। দারাকে মোগল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন। খুব বেশি সময় লাগল না নিজ খাস কামরায় রুদ্ধ আওরঙ্গজেবের কানে এ সংবাদ পৌঁছাতে। এর তাৎপর্যও বুঝতে পারল সে। সম্ভবত অবশেষে পার্থিব পৃথিবীর সত্যিকারের রূপ বুঝতে পারবে আওরঙ্গজেব, মেনে নেবে যে সিংহাসন কখনো তার হবে না। মিথ্যে আশার চারা উপড়ে ফেলে, ভ্রাতৃ বিদ্বেষের তিক্ততা রোধ করার জন্য দ্রুত কাজ করতে হবে শাহজাহানকে। যাই হোক আল্লাহর ইচ্ছেতে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করেছেন তিনি। নিজের নিবুদ্ধিতা বুঝতে পারবে আওরঙ্গজেব, স্বীকার করে নেবে যে দারার উপস্থিতিতে সে কখনোই পিতার আনুকূল্য পাবে না। এটাও উপলব্ধি করতে পারবে যে তার ক্ষতি করার কোন কারণই নেই দারার–কখনোই দুজনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না– যদিও আওরঙ্গজেবের মত অহংকারী মানুষের পক্ষে হজম করা কঠিন হবে এ সত্য।

.

২.২

আব্বাজান, আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই …

কী হয়েছে জাহানারা? কোন সমস্যা নেই তো? তোমার স্বাস্থ্য…?

প্রায় প্রতিদিনই পালকিতে করে দুর্গে আসে জাহানারা। তারপরও পিতার কাছে পাঠানো অনুরোধ যেন তার সাথে তারই প্রাসাদে দেখা করেন শাহজাহান–পেয়ে অবাক হয়েছিলেন সম্রাট।

আমি ভালো আছি, আমার সম্পর্কে কিছু নয়, আওরঙ্গজেবের সম্পর্কে।

তো সে তোমাকে বলেছে তার সম্পর্কে ওকালতি করতে, তাই না?

না, সে জানেও না যে আমি তা করছি। কিন্তু পরিবারের মাঝে কোন ভুল দেখতে পেলে আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না তা। আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কিন্তু সম্ভবত আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি, যা আপনি পাচ্ছেন না।

নম্রভাবে হলেও এহেন পরিহাসে আঘাত পেলেন শাহজাহান।

আমি স্বচ্ছভাবেই দেখতে পেরেছি সব। আওরঙ্গজেবের উচিত নিজেকেই দোষ দেয়া। আমি ভেবেছিলাম যে সে একজন পুরুষ, কিন্তু তার আচরণ তো সে কথা বলে না।

আমিও মানছি তা…. আর আমার ধারণা আওরঙ্গজেব নিজেও এখন বুঝতে পারছে। তার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি আমি, শুনেছি ওর আবেগপ্রবণ সব কথা, চেষ্টা করেছি যুক্তি দিয়ে বোঝতে, সে স্বীকার করেছে যে মূখের মত কাজ করেছে। শুধু চেয়েছে আপনার কাছে প্রিয় হতে। এখন মিনতি করছে আপনি যেন তাকে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যেতে অনুমতি দিন…

আমি একজন যোগ্য পদমর্যাদার কর্মকর্তা খুঁজে পেয়েছি, তাই তার আর প্রয়োজন নেই।

আব্বাজান যখন আমি অসুস্থ ছিলাম আর আপনি আমার বিছানার পাশে বসে থাকতেন, মাঝে মাঝেই আমি শুনেছি যে আপনি আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করতেন যে আমি জীবন ফিরে পেলে আপনি যে কোন কিছু করতে রাজি। আমাকে পুনর্জীবন দান করেছেন আল্লাহ্, আর আমি তিনি নন–এখন এই দয়া চাইছি আপনার কাছে।

জাহানারা…

হা! আওরঙ্গজেব মন খারাপ করে আছে। ক্ষমা করে দিন তাকে, একসময় যেমন আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন আপনি। অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি দিন তাকে।

তারপর?

নতুন কোন কাজে নিয়োগ দিন। যদি দাক্ষিণাত্যে নাও হয়, অন্য কোথায় যেখানে সে তার মেধাশক্তি কাজে লাগাতে পারবে। এসবের অপচয় হবে না আর সে নিজেও দিনে দিনে তিক্তবিরক্ত হয়ে উঠবে না। মোটেই অসন্তুষ্ট করবে না আপনাকে। আর এটা শুধু আমার মন্তব্য নয়, আমি দারার সাথেও কথা বলেছি। যদিও প্রথমে সে নিজেও আওরঙ্গজেবের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ছিল–আওরঙ্গজেবের ভ্রান্ত ধারণার কথা নিয়ে কিন্তু তারপর জানিয়েছে যে শত্রুতার কোন ইচ্ছে নেই তার আর যদি আওরঙ্গজেব অনুতপ্ত হয় তাহলে সব ভুলে গিয়ে আওরঙ্গজেবের নতুন জীবন দেখতে রাজি সে।

কেন দারাকে এত অপছন্দ করে আওরঙ্গজেব? এটা কি শুধুই। হিংসা?

হতে পারে কিন্তু এতে যে শুধু আওরঙ্গজেবেরই দোষ তা নয়। আমার পোড়া ক্ষত থেকে সেরে ওঠার পর থেকে আমি দেখেছি যে তাদের মাঝে মনোমালিন্য বেড়ে চলেছে। আমারও মনে হয়েছে যে আপনার দাক্ষিণাত্য পেয়ে নিজের উপর বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে দারা–যদিও আমি নিশ্চিত যে অবচেতনেই হয়েছে এমনটা। আওরঙ্গজেবের মাঝে রসবোধ নেই, যেটা সে নিজেও জানে আর তাই দ্রুত বুঝেও ফেলে যদি কেউ তাকে অবমাননা করে–ইচ্ছেকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবেও বিশেষ করে দারা। তাই এভাবেই শুরু হয় প্রতিদ্বনদ্বতা।

কিছু কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বাভাবিক আমি জানি। কিন্তু আওরঙ্গজেব এমনভাবে কথা বলেছে যে সে দারাকে ঘৃণা করে। বড় ভাই তার সম্পর্কে এমন কী করেছে যে এত গভীরভাবে আহত হয়েছে সে?

খানিকটা দ্বিধার পর জাহানারা জানালো, তাদের মধ্যকার ধর্মীয় ভিন্নতা।

ধর্মীয়? আমি জানি দারা সুফীবাদে আগ্রহী আর আওরঙ্গজেব মোল্লাদের সাথে প্রচুর সময় কাটায়, কিন্তু কখনো তো কল্পনাই করিনি যে ধর্ম কখনো এত বিরোধের কারণ হতে পারে।

ভুল করেছেন আপনি। দারার চরিত্র সম্পর্কে জানেন আপনি সহিষ্ণু আর সবকিছু নিয়েই কৌতূহলী… আওরঙ্গজেব আমাদের সুন্নি পণ্ডিত আর মোল্লাদের সব কিছু মেনে চলে আর বিশ্বাস করে যে এদেরকে অমান্য করাটা ধর্মদ্রোহিতা। তার মতে দারার দর্শন ধর্মদ্রোহিতার সামিল আর আমাদের শাসনকার্যের অন্তরায়। আমি প্রায়ই তাকে বলতে শুনেছি যে মোগল সাম্রাজ্যের সমস্যা হল কঠোর আর সত্যিকারের মুসলিম পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি আমরা। দুর্নীতির জন্য আপনার কর্মচারীদের মাঝে হিন্দু আর শিয়াদেরকে দোষারোপ করে সে। আর বিশ্বাস করে যে আমাদের প্রশাসনকেও দূষিত করতে তুলছে এরাই। আমাকে এও জানিয়েছে যে, দাক্ষিণাত্যে থাকাকালীন অবৈধ সুদ আর অনৈতিকতার বহু উদাহরণ খুঁজে পেয়েছে যার পেছনে হাত রয়েছে আমাদের হিন্দু প্রজাদের জমিদারের হাতে দাসের মত নিঃশেষিত হচ্ছে পুরো গ্রাম। জমিদার তাদেরকে দারিদ্র আর ঋণের জালে জড়িয়ে রেখেছে।

এই ধরনের ক্ষেত্রে ধর্ম কোন ব্যাপার নয়, চরিত্রই আসল। যদি সে অপরাধের কথা জানতে পারে, তাহলে আমার রাজ প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব হচ্ছে এগুলোকে ঠিক করা।

অবশ্যই। আর আওরঙ্গজেবের মতে এ কাজটিই করতে চেয়েছে সে। কিন্তু তার মতে শাসনকার্যের একেবারে গভীরে পৌঁছে গেছে পচন। কট্টরবাদী মোল্লাদের উৎসাহে সে চায় প্রতিটি হিন্দুকে তার ভাষায় অবিশ্বাসীদের অপসারণ করতে হবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে।

তাহলে বলতে হয় যে সে একটা বোকা। আমার দাদাজান বুঝতে পেরেছিলেন যে সাম্রাজ্যকে একত্রে বেঁধে রাখতে হলে আর এর সমৃদ্ধি সাধন করতে হলে সকল প্রজার প্রতি সমান আচরণ করতে হবে অশোক সিংয়ের মত হিন্দু আর মুসলিম, সকলের জন্য। তুমি নিজে যেমন একবার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলে যে আমার বিশ্বস্ত আর আস্থাবান সভাসদ ও সেনা প্রধানদের মাঝে হিন্দু রয়েছে, আমাদের ধমনীতে বয়ে চলেছে রাজকীয় রাজপুত রক্ত।

একই কথা বলে দারাও আর এখানেই তাদের বিরোধ। শেষবার, দারার প্রাসাদ দর্শনের এক কি দুইদিন আগে, দুজনের প্রায় মারামারি লেগে যাবার দশা যখন আওরঙ্গজেব বলে বসে যে আমাদের উচিত হিন্দু মন্দির নির্মাণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

সম্ভবত দুইজনেই ভুলে গিয়েছিল যে আমিই এখনো সম্রাট আর আমিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব যে, আমার সাম্রাজ্যের উচ্চ পর্যায়ে কারা কাজ করবে আর কোন ধরনের ধর্মীয় দালান নির্মাণে আমরা অনুমতি প্রদান করব।

আমি আপনাকে ক্ষিপ্ত করে তোলার জন্য বলিনি। আমি শুধুমাত্র আমার ভাইদের মাঝে কোন সমস্যা হয়েছে তা বুঝিয়ে বলতে চেয়েছি।

তুমি যেটাকে ব্যাখ্যা বলছ, সেখানে তো কিছুই নেই যে আওরঙ্গজেব কেন ভাবছে দারা তাকে হত্য করতে চায়?

আওরঙ্গজেব এখন জানে যে সে অসঙ্গত আচরণ করেছে। কিন্তু তার মত করে দেখার চেষ্টা করুন। দারা সবসময় সতর্ক থাকে না। ছোটবেলা থেকেই আওরঙ্গজেবকে প্রলোভনে ফেলে মজা করতো দারা। এখন এই মধ্যবয়সেও সে জানে যে কোথায় টোপ ফেললে আওরঙ্গজেব দারাকে নিজের শত্রু ভাবা শুরু করবে, সন্দেহ গড়ে তুলবে আর দারার প্রতিটি কাজের বাঁকা অর্থ খুঁজবে…কিন্তু আওরঙ্গজেব জানিয়েছে যে সব কিছুই এখন অতীত আর সে একটা ভুল করেছে ভূগর্ভস্থ কক্ষ নিয়ে। আবারো আপনার আস্থা অর্জন করতে চাইছে। আমিও বিশ্বাস করি এটা সত্যি।

চুপ করে রইলেন শাহজাহান। জাহানারা কি ঠিক বলছে? দারার প্রাসাদের সেই ঘটনার পর থেকে দুর্গের মাঝে একেবারে নিঃশব্দ হয়ে আছে আওরঙ্গজেব। যদিও তার উপর খুব সূক্ষ্মভাবে নজরদারির ব্যবস্থা করেছেন সম্রাট, সন্দেহমূলক কিছুই পাওয়া যায়নি। কোন ধরনের রাজদ্রোহ বা সম্রাটের উত্তরসূরী হিসেবে দারার নাম ঘোষণার পর কোন অসন্তোষেরও আভাস পাওয়া যায়নি। আওরঙ্গজেব হয় খুব পাকা অভিনেতা অথবা সত্যিকার অর্থেই অনুতপ্ত হয়েছে।

আব্বাজান। অনুগ্রহ করে জানান যে আপনি তাকে ক্ষমা করেছেন। আর নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেন। অন্তত আপনার দরবারের সভায় যোগ দেবার অনুমতি প্রদান করেন, যেমন দারা আর মুরাদ অংশ নেয়। আওরঙ্গজেবকে এভাবে দূরে সরিয়ে রেখে দরবারের চোখেও তাকে খাটো করছেন। আমরা সবাই জানি যে ও অহংকারী প্রকৃতির; তাই আপনার কাছে প্রকাশ না করলেও এতে আহত হচ্ছে আওরঙ্গজেব।

তাকে খাটো বা নীচ দেখানোর কোন উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি শুধু তাকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছি। সে যে ধরনের আচরণ করেছে। তাতে এটাই প্রাপ্য। যদি, তোমার কথানুযায়ী ও নিজের ভুল বুঝে থাকে, তাহলে ঠিক আছে দরবারের সভায় যোগ দেবার অনুমতি দেয়া হবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে তার উপর। যদি আচরণে পরিবর্তন এনে থাকে তাহলে তার জন্য নতুন পদেরও ব্যবস্থা করব আমি। যদি তা না হয় তাহলে আমার কাছ থেকে সহৃদয়তার আর কোন আশা নেই …।

*

চার মাস পরে, ব্যক্তিগত দর্শনার্থীদের বিশাল কক্ষে সান্ধ্য বাতি জ্বেলে দিয়ে গেছে ভৃত্যেরা। সভাসদদের সামনে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন শাহজাহান। এদের মাঝে দারা, আওরঙ্গজেব আর মুরাদও আছে। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে মনোযোগ সহকারেই সব ধরনের আলোচনা শুনেছে আওরঙ্গজেব। কিন্তু নিজে থেকে তেমন কিছু না বললেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রায় খোশামোদের মত করেই একমত হয়েছে দারার বিভিন্ন যুক্তির সাথে। কর, ছোটখাট প্রজা রাষ্ট্রের বিদ্রোহ দমন কিংবা উত্তর থেকে দক্ষিণে পুরো সাম্রাজ্যকে একসাথে বেঁধে রাখা গ্রেট ট্রাংক রোডের উন্নয়ন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে মেতেছে সভাসদদের দল। হতে পারে যে দুই ভাইয়ের মাঝে ধূমায়িত বিষেদগার আসলে উঠে গেছে। অন্তত শাহজাহান সেরকমটাই আশা করলেন। হঠাৎ করেই একটা সুযোগ নিজে থেকেই এসে ধরা দিয়েছে তার রাজবংশের কাছে, যা হয়ত আর কখনো ঘটবে না–অন্তত তাঁর জীবদ্দশায় তো নয়ই। আর দুই পুত্রের বোকার মত তর্কের খাতিরে তিনি নিজের অথবা জ্যেষ্ঠ সেনাপতিদের মনোযোগ নষ্ট হতে দেবেন না।

মাথা তুলে, শুরু করলেন সম্রাট। এটা আমার কোন সাধারণ দৈনন্দিন সভা নয়। যুদ্ধ-সভায় বসেছি আমরা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাবুল আর বাদাকশান থেকে আমার প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সংবাদ পাঠাচ্ছে যে, অক্সাস নদীর পেছনে উজবেক গোত্রেরা নিজেদের মাঝে মারামারি করে সন্ত্রাস কায়েম করে রেখেছে নিজেদের ভূমিতে। আর এই বিশৃঙ্খলাই আমাদের জন্য সুযোগ।

আপনি কী বলতে চান জাহাপনা? জানতে চাইল সব সময়কার মত সোনালি রেশমী টিউনিক পরিহিত অশোক সিং।

আমার কথার অর্থ হচ্ছে, উজবেকদের হাতে এখন নিজেদেরকে প্রতিরক্ষার মত অবস্থা নেই। যদি আমরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে উত্তরে পৌঁছে বাল্ক দখল করে নিতে পারব। ব্যবসায়ের জন্য মূল্যবান এই শহর দখল করতে পারলে কাবুলে থাকা আমাদের ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত লাভবান হবে। কিন্তু বাল্ক হবে শুধুমাত্র সূচনা। একবার বাল্কে পৌঁছতে পারলে অক্সাস নদী পার হয়ে মাত্র ১৭০ মাইল দূরে থাকা সমরকন্দ দখল করে নিতে পারব। ভাগ্যদেবীর এনে দেয়া এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে সোনালি শহর হয়ে যাবে আমাদের…

একটু থেমে চারপাশের মুখগুলোর দিকে তাকালেন শাহজাহান। কেউ কেউ প্রশংসা করছে, কারো মুখে সন্দেহের আভাস, কিন্তু বেশিরভাগই বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে। কাউকেই নিজের সিদ্ধান্ত জানাননি তিনি, এমনকি দারাকেও নয়। বহুদিনের সযত্নে লালিত উচ্চাকাঙ্খ এটি। প্রায় সময়েই, নিদ্রাহীন অবস্থায় অন্ধকারে শুয়ে শুনতে থাকেন ভৃত্যের মুখে নিজের পূর্বপুরুষের লেখনী। সেই বালক বয়স থেকেই ভালোবাসেন বাবরনামা সিংহাসনের সন্ধানে আসা তরুণ ঘোড়সওয়ার শাহজাদা। কঠিন পরিস্থিতিতেও বিশ্বাস না হারানো; যত বিশালই হোক না সেই বিপদ, রোমাঞ্চিত করে তুলত শাহজাহানকে। তবে সবার উপরে দাগ কাটত বিশেষ একটি ঘটনা সমরকন্দ শাসন করার জন্য বাবরের দৃঢ় মনোভাব নিজের জীবদ্দশায় যা একবার নয় তিন তিনবার আক্রমণ করেছিলেন তিনি। যখন থেকে উজবেকদের সমস্যার কথা শুনছেন, তখন থেকেই এ আক্রমণের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন শাহজাহান।

আশ্চর্য হয়ে গেছ, সবাই। বলে চললেন শাহজাহান। ভুলে গেছ যে মোগলরা হিন্দুস্তানে আসার আগে আমরা অক্সাসের ওপরেই শাসন করতাম। আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর সমরকন্দকে নিজের রাজধানী তৈরি করেছিলেন আর পর পিতামহ বাবর এটি দখলও করেছিলেন। তাই ঐসব ভূমির উপর জন্মগত অধিকার আছে মোগলদের।

কিন্তু বাবর, সমরকন্দ ধরে রাখতে পারেননি, যত চেষ্টাই করুন না কেন। শেষপর্যন্ত উজবেকরা তাকে পরাজিত করেছিল। বলে উঠল দারা।

কারণ, তিনি সংখ্যায় কম ছিলেন। তার পেছনে বিশাল কোন সাম্রাজ্যের সম্পদ ছিল না, যেমনটা আছে আমার। এছাড়াও তাঁর শত্রুরা একত্রিত হয়েছিল শাইবানী খান নামে যুদ্ধবাজ উজবেক নেতার অধীনে। এখন এই মুহূর্তে উজবেকদের এ ধরনের কোন নেতা নেই।

আমি আপনার বক্তব্য বুঝতে পারছি, আব্বাজান। আলোচনায় অংশ নিল আওরঙ্গজেব। অক্সাস পার হয়ে যাওয়াই আমাদের ভাগ্য। আর যদি সফল হই তাহলে সমরকন্দ থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের শেষপর্যন্ত শাসন করব আমরাই–এতটা এমনকি তৈমুরও পারেননি।

মাথা নাড়লেন শাহজাহান, কক্ষের মাঝে একমাত্র আওরঙ্গজেবকেই মনে হল বুঝতে পেরেছে তার প্রস্তাব, আর এ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে–যদিও এতে মনঃক্ষুণ্ণ হলেন তিনি। সম্ভবত অন্যেরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।

তুমি নিশ্চিত যে পাঠানো প্রতিবেদনগুলো সম্পূর্ণ সত্য? খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল দারা। আমাদেরকে যেভাবে জানানো হয়েছে উজবেকরা কি সত্যিই এতটা হানাহানিতে লিপ্ত নিজেদের সাথে? আর যদি তা হয়ও, তারা যদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বিদেশী আক্রমণ ঠেকাতে একজোট হয়ে ওঠে?

আমার কর্মচারীদের পাঠানো সংবাদ বিশ্বাস করি আমি। একজন তো এমন বর্ণনাও দিয়েছে যে উজবেকদের এক গোত্র আরেক গোত্রের লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। অন্তত পাঁচ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করেছে। এদের মাঝে পুরুষদের পাশাপাশি নারী আর শিশুরাও আছে। রক্তক্ষয়ী জাতিগত বিবাদ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। একে অন্যের উপরে প্রতিশোধ নেবার উপরেই বেশি মনোযোগী এখন তারা। তাই যতক্ষণে আমাদের দিকে নজর দেবার ফুরসৎ পাবে, বহু দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু হ্যাঁ, ঘটনার অবশ্যই পরিবর্তন হতে পারে। আর তাই এখন আমাদেরকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আপনি সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন, জাহাপনা। উত্তরে কত সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে চান আপনি? জানতে চাইল অশোক সিং। বেশ বড়সড় আর সশস্ত্র সেনাবাহিনী প্রয়োজন হবে আমাদের। পাহাড়ের জীবনযাত্রা বেশ কঠিন আর আবহাওয়াও বৈরি।

সবকিছু নিয়ে সবিস্তারে পরে আলোচনা হবে। কিন্তু আমি বলব অন্তত পঞ্চাশ হাজার ঘোড়সওয়ার আর কামান নিয়ে দশ হাজার বন্দুকধারীর সাথে পদাতিক সৈন্যরাও যাবে, বান্ধের জন্য যাতে সমস্যা না হয়। এরপর অক্সাস পার হয়ে সমরকন্দ পৌঁছাতে আমরা যদি প্রয়োজন হয় তো, তারাও যাবে। এটি নির্ভর করবে উজবেকরা কতটা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তার উপর।

কিন্তু এ ধরনের বিশাল সেনাবাহিনী একত্রিত করার জন্য সময়ও দরকার। মনে করে দেখ যে অতীতের চেয়েও কতটা সময় বেশি চেয়েছে আমাদের প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সৈন্য সমাবেশ করার জন্য… আমাদের অভিজাত সম্প্রদায় রাজকীয় ব্যবহারের জন্য সৈন্য প্রস্তুত করার রীতিতে আলগা ভাব নিয়ে এসেছে। জোর দিয়ে বলে উঠল দারা।

দারার এতটা চিন্তিত হবার বা প্রশ্ন করার কোন দরকার নেই। ভাবলেশ শাহজাহান। আমি জানি, কিন্তু সৈন্য পাঠাতে দেরি করলেই শাস্তি দেয়া হবে। এছাড়া, বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। ইতিমধ্যেই ইংরেজ নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে দায়িত্ব দিয়েছি তিন হাজার ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ দেয়ার জন্য।

সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কে থাকবেন? জানতে চাইল অশোক সিং। এই একই প্রশ্ন নিয়ে ম্রাট নিজেও বেশ বিচলিত হয়ে আছেন।

কক্ষের পেছন দিকে আওরঙ্গজেব উঠে দাঁড়িয়ে সোজা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, দেখতে পেলেন শাহজাহান। দাক্ষিণাত্যে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে আওরঙ্গজেব আর তাই এক্ষেত্রেও সেই হতে পারে নিশ্চিত পছন্দ, একথা তিনি নিজেও জানেন। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই দারার। শাহ সুজা বহু দূরে বাংলাতে আর ডেকে পাঠাতেও সময় লাগবে। অন্যদিকে মুরাদ এখনো তরুণ এবং কোন চেষ্টাও করা হয়নি তাকে নিয়ে এর আগে। রাত জেগে গভীরভাবে তিনি ভেবে দেখেছেন যে আওরঙ্গজেবকে কী এ দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা। প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিলেন বিভিন্ন দিক থেকে এটাই হত যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত কিন্তু পুত্রের অযৌক্তিক আচরণের স্মৃতি এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন নি তিনি। যতই ভেবেছেন ততই উদ্বিগ্ন উঠেছেন। মনগড়া একটা ধারণার জন্য তাঁর আদেশ অমান্য করার পরও কি আওরঙ্গজেবের ব্যাপারে ঝুঁকি নেবেন তিনি? অথবা আওরঙ্গজেবের কাল্পনিক বা উস্কানিমূলক কথাবার্তা যদি জ্যৈষ্ঠ কর্মচারীদের মাঝে মতভেদ তৈরি করে?

প্রত্যূষের আলো কক্ষের মাঝে প্রবেশ করতেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে নতুন দায়িত্ব নেবার আগে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে আওরঙ্গজেবকে।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বভার দেয়া হবে, শাহজাদা মুরাদকে। আশ্চর্য হয়ে গেল সকলে আর মুরাদের চেহারায় ফুটে উঠল সত্যিকারের বিস্ময়। আমি জানি এটা তোমার জন্য প্রথম বড় কোন অভিযান মুরাদ। কিন্তু সময় এসেছে, তোমাকে শিখতে হবে যুদ্ধবিদ্যা আর আমি জানি যে আমাকে হতাশ করবে না তুমি। তোমাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য আর প্রতিদিনকার সমস্ত কিছু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিলাম অশোক সিং, তোমার উপর। নিজের সাহসের প্রমাণ দিয়েছ তুমি–আর নিজের সামরিক দক্ষতারও বহু বছর আগে যখন দাক্ষিণাত্যে একসাথে লড়াই করেছিলাম আমরা। আর ভালো কোন গুরু পাবে না আমার পুত্র।

কিন্তু আব্বাজান… এক পা সামনে এগিয়ে এলো আওরঙ্গজেব। আমাকে পাঠানো উচিত। মাত্র কি দেখাইনি যে আমিই একমাত্র বুঝতে পেরেছি তোমার উচ্চাশা? প্রমাণ দেইনি যে অর্ডার রাজার বিরুদ্ধে আমার প্রথম অভিযানের সময় থেকেই আমি একজন দক্ষ সেনাপ্রধান? দাক্ষিণাত্যের এককণা ভূমিও কি আমিও ছেড়েছি শক্তহস্তে? বিজাপুর আর গোলকুন্ডার শাসকদেরকে কি বাধ্য করিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে ভয় পেতে আর মোগলদের সাথে চুক্তি করতে? আমাকে বাল্কে যেতে দাও আর দেখ আমাদের কামানের আঘাতে কত দ্রুত কেঁপে ওঠে এর দেয়াল….

না, আওরঙ্গজেব, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।

 ভুল করেছ আর একদিন এর জন্য অনুশোচনাও করবে।

সারাটা কক্ষে সবার নিঃশ্বাস আটকে গেল বুঝতে পারলেন শাহজাহান। এই ধরনের অবাধ্যতার ভয়ই করেছিলেন তিনি। আওরঙ্গজেবকে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত সঠিকই হয়েছে আর তৎক্ষণাৎ আরো একটি সিদ্ধান্ত নিলেন ম্রাট কোন ধরনের পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই এ সিদ্ধান্ত তার পুত্র নিজেই ডেকে এনেছে নিজের উপর। আমি আবারো বলছি, আমি মনস্থির করে ফেলেছি। এছাড়া তোমার জন্য নতুন নিয়োগেরও ব্যবস্থা করেছি। আজকেই এটা ঘোষণা করার কোন ইচ্ছে ছিল না আমার; তোমাকে গুজরাট পাঠাচ্ছি। সেখানকার প্রাদেশিক শাসনকর্তা বেশ অসুস্থ আর বয়স্কও হয়ে গেছেন। তুমি এখন থেকে তার দায়িত্ব পালন করবে। তোমার অনেক কাজের মাঝে অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে জলদস্যুদের হাত থেকে আমাদের বাণিজ্যতরী আর তীর্থযাত্রীদের বহর কতটা নিরাপদে রাখছে ইংরেজরা, তার দেখাশোনা করা।

গুজরাট এক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল আওরঙ্গজেব। কিছুই না বলে সোজা তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। অন্যান্য অনেক সভাসদের মতই দারা নিজেও তাকিয়ে আছে মেঝের কার্পেটের দিকে; যেন চাইছে না যে কারো সাথে চোখের দৃষ্টি আটকে যায়। অন্যদিকে মুরাদ একবার তাকাচ্ছে আওরঙ্গজেবের দিকে, একবার পিতার দিকে।

যদি আপনি তাই চান, তো ঠিক আছে আমি গুজরাট যাবো। অবশেষে বলে উঠল আওরঙ্গজেব, যদিও চোখের মাঝে জ্বলতে থাকা আগুন উপহাস করছে শব্দগুলোকে।

ঠিক আছে। কয়েকদিনের মাঝেই রওনা হতে হবে তোমাকে। এখন আবার মনোযোগ ফিরিয়ে আনা যাক বাল্ক অভিযানের প্রসঙ্গে আমি চাই যথাযথ রসদ আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাত্রা করুক আমাদের সেনাবাহিনী আর তাই হাতে সময় একেবারে অল্প।

.

২.৩

একমাত্র আপনার সাথেই কথা বলতে পারি এখন আমি। বিপদের সময় যেমনি, তেমনি সমৃদ্ধির সময়েও আমাদের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন আপনি। জাহানারা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে নিকোলাস ব্যালান্টাইনকে যমুনার তীরে তার প্রাসাদের আঙিনাতে দেখা করতে বলেছে। কিন্তু বেশ কয়েক ঘণ্টা গভীরভাবে চিন্তা করার পর মনে হয়েছে এটাই যুক্তিযুক্ত। মাফ চাইছি। আপনি নিশ্চয়ই তৃষ্ণার্ত। সেবাদাসীর দিকে ফিরে জানালো, বরফ দিয়ে শরবত নিয়ে আসো।

এরপর মধ্যাহ্নের তপ্ত সূর্যালোক থেকে বাঁচতে তৈরি শামিয়ানার নিচে, নিজের বিপরীত প্রান্তে রাখা স্থূপীকৃত তাকিয়ার উপর বসার জন্য ইশারা করল নিকোলাসকে।

আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি, মাননীয়?

কয়েকদিনের মাঝেই পিতার সেনাবাহিনী উত্তরে যাত্রা করবে আর আপনিও তাদের সাথে যাবেন।

হ্যাঁ। বিদেশী সৈন্যদের প্রধান হিসেবে। নিজের বিস্ময় লুকাতে ব্যর্থ হল নিকোলাসের অভিব্যক্তি।

আমি একটু খোলামেলাভাবেই বলতে চাই যে আমি মুরাদকে নিয়ে চিন্তিত। এটা হতে যাচ্ছে আমার ভাইর প্রথম কোন গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। কিন্তু নেতৃত্ব দেবার পূর্ব অভিজ্ঞতা বা এসম্পর্কিত কোন প্রশিক্ষণ নেই তার। আমার বিশ্বাস যে আব্বাজান বেশ বড়সড় একটা ভুল করেছেন তাকে এ কাজে নিয়োগদান করে, কিন্তু একথা বলতে পারব না আমি।

উত্তরাঞ্চল সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞ অশোক সিং। কয়েক বছর আগে কাবুলের চারপাশের গোত্রসমূহকে ঠাণ্ডা করেছিল সে। আর শাহজাদাকেও দিক নির্দেশনা দিতে পারবে।

তিনি নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন। কিন্তু মুরাদকে চেনেন না আপনি। আমার পিতা যখন সম্রাট হন তখন মুরাদ ছোট্ট একটা শিশু আর মা মারা যাবার সময়েও বেশ ছোট ছিল। বড় হয়ে উঠেছে হারেমে। সুদর্শন চেহারা আর চঞ্চলতার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ পেয়ে বখে গেছে। মুরাদ বোকা নয় কিন্তু নিজের মত করে চলতে চায় আর একটু অবাধ্য…এমনকি মাথা গরমও করে ফেলে। ওর এই দিক সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই আমার পিতার। মুরাদ তাঁকে ভয় পায়–তাঁর উপস্থিতিতে সবসময়েই শ্রদ্ধাবনত আর বাধ্য থাকে কিন্তু তার সত্যিকারের প্রকৃতি সম্পর্কে আমি জানি। দরবার থেকে একবার দূরে যেতে পারলেই মুরাদের মাথায় চড়ে বসবে ক্ষমতার ভূত। একইভাবে হয়ত তাকে অতি উৎসাহী করে তুলবে। যদিও আমার পিতা একমত হবেন না, কিন্তু আমার ধারণা অশোক সিং–তিনি যদিও এখন সৎ বিশ্বস্ত সেনানায়ক-অচেনা আর অযাচিত পরিস্থিতিতে মুরাদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারবেন কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

ক্ষমা করুন, মাননীয়, কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে অন্য ভাইদের সাথে আলোচনা করলেই কি ভালো হত না?

আমার উদ্বিগ্নতাকে মোটেই আমল দেয়নি দারা শুকোহ্। তারও ধারণা যে মুরাদের কাঁধে দায়িত্ব পড়লেই ভালো হবে।

দারার সাথে সেই সংক্ষিপ্ত আলোচনার কথা স্মরণ করে হতাশ হল জাহানারা। আজকাল দরবারে নিজের নিমন্ত্রিত সুফী সাধকদের সাথে দর্শন আলোচনায় এতটাই মত্ত দারা যে, তার ভাষায় এইসব নারীসুলভ কুটকচালির জন্য সময় নেই এখন হাতে। শাহ সুজাও অনেক দূরে বাংলাতে আর আওরঙ্গজেব গুজরোটে নিজের গন্তব্যের পথে চলে গেছে। এছাড়াও … খানিকটা দ্বিধাভরে সতর্ক চোখে নিকোলাসের দিকে চকিত দৃষ্টি হানলো জাহানারা। যদি সে তাকে বিশ্বাসই না করে তাহলে এখানে ডেকেছেই বা কেন? যাই হোক নিজেকে জোর করে আবারো বলতে বাধ্য করল, আমার চিন্তার প্রতি তেমন একটা সহৃদয়তা দেখাবে না আওরঙ্গজেব।

তার ধারণা যে পিতার উচিত ছিল তাকেই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করা এবং এটাই সঠিক আওরঙ্গজেব একজন দক্ষ নেতা আর অভিজ্ঞ যোদ্ধা। তাই সেই-ই হওয়া উচিত ছিল প্রথম পছন্দ।

তাহলে সম্রাট কেন তাকে এ দায়িত্বের ভার অর্পণ করেননি?

যেমনটা আপনি এবং পুরো দরবার জানেন যে কিছুদিন আগে পিতা এবং আওরঙ্গজেবের মাঝে…কোন এক ব্যাপারে মতানৈক্য হয়েছিল। আর তাই হঠাৎ করে দাক্ষিণাত্যের দায়িত্ব থেকেও আওরঙ্গজেবকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আমার ধারণা উজবেক অভিযানের দায়িত্ব মুরাদকে দেয়ার মাধ্যমে আওরঙ্গজেবকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্থানে মুরাদকে বসিয়েছে। সত্যি কথা বলতে, আওরঙ্গজেবকে নিয়েও চিন্তা হচ্ছে আমার–দারা আর পিতার সাথে তার সম্পর্ক এতটাই নষ্ট হয়ে গেছে যে ঠিক করার হয়ত আর কোন উপায় নেই।

থেমে গেল জাহানারা। অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে দেখল গোলাপের সুগন্ধি মেশানো শরবতে চুমুক দিল নিকোলাস। এলোমেলো শুভ্র কেশ লুটিয়ে আছে রোদে পোড়া চেহারার উপর। অতীতের মতই কেন হয়ে যায় না দিনগুলি যখন তাদের মা জীবিত ছিলেন আর শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একত্রিত ছিল পুরো পরিবার? হঠাৎ করেই ছেলেবেলায় পৌঁছে গেল জাহানারা। শিবিকার পর্দার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে আছে নিকোলাসের দিকে, যার উপস্থিতিতেই ফিরে আসে ভরসা, জাহাঙ্গীরের হাত থেকে বাংলাতে পালিয়ে যাবার সময় একই সাথে পথ চলেছে তারা। বহু স্মৃতির মাঝে মনে পড়ে গেল হুগলীতে পর্তুগিজ প্রাঙ্গণে দারা আর তার সাথে খেলছে নিকোলাস, অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকা মায়ের চিন্তা থেকে সরিয়ে রেখেছে তাদেরকে। আওরঙ্গজেবকে শিখিয়ে দিচ্ছে কীভাবে তলোয়ার নিয়ে খেলতে হয় আর মুরাদের জন্য বানিয়ে দিচ্ছে খেলনা সৈন্য।

বহু কষ্টে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে এনে আবারো বলে উঠল জাহানারা, ছোটবেলা থেকেই আমি এবং আমার ভাই-বোনদের প্রতি যথেষ্ট দয়া দেখিয়েছেন আপনি। আর এই কারণেই এখন আমি আপনার কাছে অনুনয় করছি, অনুগ্রহ করে অন্তত আমার একটি চিন্তা কমবে যদি আপনি মুরাদের উপর নজরে রেখে পারেন তো তাকে শাসনও করবেন, উপদেশ দিয়ে সাহায্যও করবেন, একজন বিদেশী ও রাজকীয় ভাড়াটে সৈন্যদের প্রধান হিসেবে। একই সাথে একমাত্র আপনিই আছেন যাকে মুরাদ বাল্যকাল থেকেই জানে, অন্য সেনাপ্রধানদের চেয়ে আপনিই তার সাথে বেশি মিশতে পারবেন। যেখানে কিনা তার আচরণ যতই অযৌক্তিক আর নির্বোধের মত হোক না কেন সবাই তাকে শাহজাদা হিসেবে ভিন্ন চোখেই দেখবে।

আমি জ্যেষ্ঠ সেনাপ্রধানদের একজন নই আর যেমনটা আপনি ভাবছেন একজন বিদেশী হওয়াটা আমার জন্য সুবিধা বয়ে আনবে, তেমনি একই কারণে হয়তো তার কাছের মানুষের তালিকায় ঠাঁই দেয়া হবে না আমাকে।

তারপরেও আর যত অদ্ভুতই মনে হোক না কেন আমার অনুরোধ আপনার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করবেন। আর যখনই সুযোগ করতে পারবেন রাজকীয় পত্রবহক মারফত লিখবেন আমার কাছে। চট করে একবার উদাসীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের তিনজন সেবাদাসীর দিকে তাকাল জাহানারা। নিকোলাসের সাথে একটু একা হতে পারত যদি … কিন্তু এ ধরনের কোন ব্যাপার তো পুরোপুরি অচিন্ত্যনীয়। এমন না যে নিজের পরিচারিকাদের উপর বিশ্বাস নেই তার, কিন্তু রটনা ছড়ানোর লোভ সামলানো এমনকি বিশ্বস্তদের পক্ষেও কঠিন হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে নিকোলাসের দিকে এগিয়ে গেল জোহানারা; খানিক নিচু হয়ে নিজের হেনা রাঙানো হাত রাখল নিকোলাসের বাহুতে।

নিকোলাস… পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে যদি সত্যিই চিন্তিত না হতাম তাহলে, আমাদের প্রথা সম্পর্কে ভালোভাবেই জানেন আপনি, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে কখনোই নিমন্ত্রণ করতাম না এখানে। পুরুষদের পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ান, আপনি, অন্যদিকে আমি…

*

জাহাপনা, আপনার কাছে আরেকটি পত্র এসেছে।

পরিচালকের হাত থেকে মোড়াননা পত্ৰখানা হাতে নিয়েই দেখলেন যে অশোক সিংয়ের সীল লাগান। খুলে ফেললেন অধৈর্য ভঙ্গিতে। প্রায় এক মাস আগে মুরাদের অভিযান সম্পর্কে সংবাদ পেয়েছিলেন আর তাও ও আবার বাল্কে সেনাবাহিনী অগ্রসর হবার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ছিল শুধু।

জাহাপনা,
বাঙ্কের দিকে এগোতেই কঠিন অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে আমাদেরকে স্থানীয় শাসকবর্গ। আমাদের রসদের উপর লুটপাট চালানোর চেষ্টা করার পাশাপাশি হত্যাও করেছে যারা বাধা দিয়েছে তাদেরকে। যাই হোক, হতাশ হইনি আমরা। দশ দিন আগে তাঁবু তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম এমন সময় সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমাদের উপর আক্রমণ করে বসে আপনার পিতৃপুরুষ বাবরের শত্রু শাইবানী খানের এক উত্তরসুরীর নেতৃত্বে উজবেক বাহিনী। লড়াই করে হটিয়ে দিয়েছি তাদেরকে। নিজেদের শৃঙ্খলা বজায় রেখে রসদবাহী গাড়ির পেছনে থেকে গুলি ছুঁড়েছি। পরবর্তী দিন সকালবেলা, আপনার পুত্রের অনুমতি সাপেক্ষে, আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে ছুটে গেছি পলায়নপর শত্রুর পেছনে। প্রধান অংশকেই বাগে পেয়ে বাতাসের গতিতে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে বহু উজবেককে হত্যা করেছি, কিন্তু আমাদের তেমন ক্ষতিও হয়নি। দেহরক্ষীদের ভিড়ে হরিণের মত কাঁপছিল উজবেক শাহজাদা। কিন্তু গর্ব সহকারে জানাচ্ছি যে, রাজপুত বর্শা সমাপ্তি এনে দিয়েছে তার জীবন আর তার জনগণের প্রতিবন্ধকতা দুটোর উপরেই। আমাদের বিজয়ের ফলে পরিষ্কার হয়ে গেছে বাঙ্কের রাস্তা, যেখানে তিনদিন পরেই পৌঁছে গেছি আমরা। প্রথম দিকে শহর প্রধান আমাদের শর্ত সমূহকে কটুভাষা আর যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে খারিজ করে দেয়। যাই হোক, একদিন পর আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কামানের গোলা গিয়ে তার দেয়াল ফুটো করে দেয়ায় মন পরিবর্তন করে একজন হীন ব্যক্তির ন্যায় স্বরে ক্ষমা প্রার্থনাও করে। একই সাথে আত্মসমর্পণের শপথও করে, যদি আমরা আমাদের প্রস্তাব পুনরায় বিবেচনা করে দেখি তবেই। সময় বাঁচানোর জন্য–অভিযানের জন্য অনুকূল ঋতুর শেষ হওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায় আর এ অঞ্চলে এটি বেশ দুর্লভ–একই সাথে মানব জীবনের সুরক্ষার জন্যও, আমার পরামর্শনুযায়ী একমত হন আপনার পুত্র। বিজয়ীর বেশে বাঙ্কে প্রবেশ করি আমরা সবুজ ব্যানার উর্ধ্বে তুলে ধরে আর স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে বাদ্যধ্বনি। এরপর অক্সাসের তীরে গিয়ে সুবিধামত নদী পার হবার জায়গা খুঁজে বের করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অগ্রবর্তী সেনাবাহিনী বিশাল বড় নদীটার ঢেউ বেশ বিশ্বাসঘাতক–এরপর নৌকা সেতু বানাবার জন্য বাহন একত্রিত করার আর পর্যাপ্ত কাঠের ব্যবস্থা করার দায়িত্বও দেয়া হয়েছে তাদের উপর। এ অঞ্চলের কাঠের বেশ অভাব –কেননা কামান আর ভারী রসদ নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাবার জন্য ভেলা প্রয়োজন হবে। ঈশ্বরের মর্জি হলে, কয়েকদিনের মাঝেই নদীর ওপারে পৌঁছে সোনালি সমরকন্দের দিকে যাত্রা করব আমরা। উজবেকরা জানে যে আমরা আসছি–আমাদের সফলতা আর শক্তির সংবাদ হয়ত একত্রিত করবে তাদের যোদ্ধাদেরকে। কিন্তু যদি আমরা দ্রুত অগ্রসর হতে পারি–এর উপরেই বেশি জোর পরামর্শ দিচ্ছি আমি আমাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না তারা আর যেমনটা বাঙ্কে করেছি তেমনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করব সমরকন্দে।
আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পাঠিয়েছে আপনার পুত্র, এও জানাতে বলেছে যে আপনার পক্ষ থেকে এ অভিযানে অংশ নিতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত সে। সাথে আরো জানিয়েছে তৈমুরের রাজধানী দখল করা নিয়ে চেষ্টার কোন কমতি থাকবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনি। দীর্ঘস্থায়ী ও পরিপূর্ণ বিজয়ের সাথে আপনার ভূ-খণ্ডের সীমাও চিরকালের জন্য বৃদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর শাহজাদা মুরাদ।

চারপাশে কারা আছে ভুলে গিয়ে, পড়া শেষ হতেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন শাহজাহান, বিজয়ীর সালাম হিসেবে উর্ধ্বে তুলে ধরলেন বজ্রমুষ্টি। বিশাল সব প্রাসাদ আর মাদ্রাসা, ফলের বাগান, স্বর্ণ-প্রবাহিত নদী নিয়ে সমরকন্দ তাঁর হবে–বহুদিনের সযত্নে উচ্চাকাঙ্খ। এমনকি তাঁর পিতামহ মহান আকবরও এমন দুঃসাহসী পরিকল্পনা করার কথা চিন্তা করেননি। দেড়শ বছর পরে মোগলরা আবারো দাবি করছে তাদের পিতৃপুরুষের ভূমি। এ নিয়ে লিখবে তার জীবনীকারেরা, তারই ময়ূর সিংহাসনে বসে গর্বিত বোধ করবে বংশধরেরা। এর চেয়েও বড় কথা নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করছে মুরাদ। আওরঙ্গজেব অথবা দারা কেউই এতটা ভালো করতে পারতো না।

তো এখন নিজের সভাসদদের সাথে বসবেন তিনি। তবে তার আগে পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করতে চান এই সুসংবাদ। কয়েক মিনিট পরেই হারেমের বিশাল গিল্টি করা কাঠের দরজা মেলে ধরল খোঁজাদের দল। শাহজাহান প্রবেশ করতেই মাথা নিচু করে কুর্নিশ করল রাজপুত প্রহরীরা। দারা, তিনি জানেন শিকার করতে বাইরে গেছে, কিন্তু আশা করলেন জাহানারাকে খুঁজে পাবেন এখানে প্রায়ই নিজের কনিষ্ঠ ভগিনীদের দেখতে আসে সে। কিন্তু রোশানারার ঘরে আসতেই নিরাশ হলেন সম্রাট, একাকী বসে আছে রোশানারা। পিতার দিকে তাকিয়ে হাসল।

মুরাদের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ এসেছে। বাল্ক দখল করে নিয়েছে তারা আর শীঘ্রই অক্সাস পার হয়ে কয়েক দিনের মাঝেই সমরকন্দ পৌঁছে যাবে।

বেশ ভালো সংবাদ। আমাদের সাম্রাজ্যের কোন শত্রুই আর রইবে না! আনন্দ উদ্যাপনের জন্য ভোজের আয়োজনের নির্দেশ দেবে?

না… এখনো না। সমরকন্দের সংবাদের জন্য অপেক্ষা করা যাক আর এর পরেই এত বিশাল সমারোহে আনন্দ উদ্যাপন করা হবে যা আগে কখনোই দেখেনি হিন্দুস্তান আর মোগলেরা।

আমাদের সেনাবাহিনীর সফলতার সংবাদে খুশি হয়ে উঠবে আওরঙ্গজেব। গুজরাটে তার কাছে পত্র লিখব আমি–আর বাংলাতে শাহ সুজার কাছেও যেন তারা দুজনেই আমাদের আনন্দ সহভাগিতা করতে পারে?

না, আমার জন্যই ভোলা থাক এ দায়িত্ব। কিন্তু জাহানারা কোথায়? তাকেও জানাতে হবে।

তার নিজের প্রাসাদে। সাত্তি আল-নিসা গওহর আরাকে সেখানেই নিয়ে গেছে আজ।

সভাসদদেরকে সংবাদটা জানাবার পর আমি নিজেই সেখানে যাবো তাহলে।

কক্ষ ত্যাগের জন্য ইতিমধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে শাহজাহান। এমন সময় শুনতে পেলেন রোশনারা বলে উঠলো, আব্বাজান আমি জানি না সময়টা সঠিক কিনা : কিন্তু একটা ব্যাপার ঘটেছে যা আপনার জানা দরকার সম্ভবত।

এমন কিছু একটা ছিল রোশনারার কণ্ঠে যা ঠিক ভালো শোনাল না। ফিরে তাকালেন সম্রাট। কী হয়েছে?

কয়েক মাস আগে জাহানারাকে সেবাদাসী হিসেবে তরুণী এক গুজরাটী অভিজাত নারীকে পাঠিয়েছিলাম আমি, নাম নাসরীন। কর্মঠ হিসেবে জানি আমি এই নারীকে, তাই ভেবেছি আমার ভগিনীরও কাজে লাগবে। এখানে হারেমে নাসরীনের ফুপু আছে। যখনই ফুপুকে দেখতে আসে, আমার কাছেও আসে নাসরীন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ আগে আমাকে এমন একটা কথা জানিয়েছে যা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না–মুরাদ আর সেনাবাহিনী আগ্রা ত্যাগের খুব বেশিদিন আগের কথা না। নিকোলাস ব্যালান্টাইন, আমার ভগিনীর সাথে তার প্রাসাদে গিয়ে সাক্ষাৎ করে এসেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক একসাথে ছিল তারা আর নাসরীন যদিও শুনতে পায়নি যে কী কথা হয়েছে তাদের মাঝে, তবে এটুকু দেখেছে যে উভয়েই বেশ আন্তরিক ছিল।

বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলেন শাহজাহান। নিকোলাস ব্যালান্টাইন আর জাহানারাকে কী নিয়ে আলোচনা করতে হয়েছে? আর কেমন করেই বা তাঁর কন্যা এতটা অন্ধ হয়ে গেল যে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রাসাদে এক পুরুষকে ডেকে পাঠাল?

আপনি রেগে গেছেন, আব্বাজান। আমার উচিত হয়নি কথাটা বলা।

জাহানারা নিজে কি তোমাকে কিছু বলেছে নিকোলাসের সাথে সাক্ষাৎ করা নিয়ে?

না, আর তাই আরও অদ্ভুত ঠেকেছে ব্যাপারটা।

তুমি কেন তাকে জিজ্ঞেস করোনি?

এত সরাসরি প্রশ্নে মনে হল আশ্চর্য হয়ে গেল রোশনারা। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল মনমরা হয়ে পড়ল; তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানালো আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম মনে হতে পারে যে আমি অনধিকার চর্চা করছি। এছাড়া, তাকে প্রশ্ন করার মত পদমর্যাদা নেই আমার। সাম্রাজ্যের সম্মানীত শীর্ষস্থানীয় নারী জাহানারা আর আমি তার ছোট বোন মাত্র।

রোশনারার মন্তব্যে দুঃখের আভাস পেয়ে খানিক আগে অনুভব করা উল্লাস মুছে গেল শাহজাহানের মন থেকে। আমাকে বলার পেছনে কারণটা কী? আর এত দেরিই বা কেন করেছ?

প্রথম দিকে আমি কী করব তাই বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু এরপর থেকেই ভগিনীর খ্যাতি নিয়ে ভয় হতে লাগল–বিশেষ করে সে তো এখন আর হারেমেও থাকে না। নিজের গৃহস্থালী সাজিয়ে নিয়েছে। দরবারে রসাত্মক কাহিনী ছড়িয়ে পড়া খুবই সোজা। আমি নাসরীনকে জোর করে বলে দিয়েছি যেন আর কাউকে না জানায় আর সেই দিনে উপস্থিত অন্য পরিচারিকাদেরকেও শপথ করিয়েছি যেন গোপনই থাকে এ কথা। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে জানাব কারণ আপনি শুধু আমাদের পিতাই নন, জাহানারাকেও বোঝাতে পারবেন… এই ধরনের আচরণ তার অবস্থানের ক্ষতি করতে পারে…

ঠিক কাজটিই করেছ তুমি। যেমনটা তুমি নিজেই বলেছ। কুৎসা ছড়াতে সময় লাগে না আর পাখা গজাতেও তর সয় না। যাই হোক, এ নিয়ে আর ভাবতে হবে না তোমাকে।

শাহজাহান প্রস্থান করলে পর খানিক দাঁড়িয়ে রইল রোশনারা। পিতা যখন এত বড় বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা, এখন উপলব্ধি করতে পারল রোশনারা যে এই সময়ে জহানারার বিষয় তোলা উচিত হয়নি। কিন্তু তারপরেও পিতার প্রতিক্রিয়াতেও অবাক না হয়ে পারেনি রোশনারা। শাহজাহানকে মনে হল রোশনারা আর জাহানারা উভয়ের সম্পর্কেই সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু সে নিজেই বা কেন এত বিস্মিত হচ্ছে? পিতার চোখে কোনরকম ত্রুটি নেই জাহানারার। এমনকি সে নিজেও কোন ভুল করেনি…পিতাকে যাই জানিয়েছে, পুরোটুকুই নির্জলা সত্যি আর যদি জাহানারা নিজের পদমর্যাদা সত্ত্বেও এহেন বোকামি করতে পারে, তাহলে যে কোন শাস্তিও জাহানারার প্রাপ্যই বলতে হবে। নাসরীন তো ইতিমধ্যে এও জানিয়েছে যে নিকোলাস সবসময় পত্র লিখে জাহানারার কাছে, যদিও কোন চিঠি পড়ার সুযোগ করে উঠতে পারেনি নাসরীন–নিজের রত্নভাণ্ডারে তালাবদ্ধ করে রাখে চিঠিগুলোকে। যাই হোক, সবসময় চোখ রাখছে নাসরীন। হয়ত কোন একদিন নাসরীন যথেষ্ট প্রমাণ হাজির করতে পারবে যা দেখিয়ে পিতাকে জানানো যাবে যে জাহানারার উপর আরো মনোযোগ আর শিক্ষা দেয়া উচিত। পিতা হিসেবে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র-কন্যাদ্বয়ের কোন অপরাধে আমল দেন না শাহজাহান আর তাই জাহানারা আর দারা দুজনেই পিতার হৃদয়ে নিজেদের অবস্থান নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। ফলে দুজনেই মর্জিমতন আচরণ করে যেন কনিষ্ঠ ভাই-ভগিনীরা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু, ঠিক আছে অপেক্ষা করুক তারা…

*

এত হুট করে তোমাদের সবাইকে তলব করা হয়েছে, কেননা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে অনেক দেরি হয়ে যেত। নিজের সভাসদদের উপর চোখ বোলালেন শাহজাহান। নিদ্রাতুর চেহারা আর তাড়াহুড়োয় গায়ের উপর চাপানো পোশাক দেখেই বোঝা গেল যে মাত্রই বিছানা ছেড়ে এসেছে। এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যা এই মাত্র পড়লেন। অথচ দুটি পত্র সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে লেখা হলেও এসে পৌঁছেছে আধা ঘণ্টা আগেপরে। বহুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছেন যে সংবাদ পাবেন নিরাপদে অক্সাসের অপর পাড়ে পৌঁছে সমরকন্দের দিকে এগিয়ে চলেছে সেনাবাহিনী। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা কিছুই ঘটেনি। তার বদলে প্রতি চিঠি বয়ে এনেছে একের পর এক অজুহাত–নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তাই অপেক্ষা করছে সেনাবাহিনী… রসদবাহী জম্ভগুলোর খাবার কমে গিয়েছে, তাই তারা অপেক্ষা করছে যথেষ্ট মজুদের জন্য… বিদেশী ভাড়াটে সৈন্যরা অনভ্যস্ত খাবার আর পরিবেশে জ্বরের কবলে পড়েছে… অক্সাসের অপর পাড়ে উজবেকদের দেখা যাচ্ছে অপেক্ষা করছে যেন পার হতে গেলেই আক্রমণ করবে মোগলদের উপর তাই অন্যত্র দিয়ে পার হবার ভণিতা করতে হতে পারে সেনাবাহিনীকে।

ধৈর্য বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন সম্রাট, বিলম্বের কারণগুলো বোধগম্য বলে বোঝাতে চাইছেন নিজেকে আর সমরকন্দের দিকে অভিযান চালাবার জন্য অনুকূল আছে এখনো আবহাওয়া। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে সন্দেহ বাড়ছে যে তাঁর সাথে যেন কোন খেলা হচ্ছে। অশোক সিং নিজে কখনো এমনটা করবে না, কিন্তু ক্রমশই রাজপুত সেনাপতির লেখায় একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে সে তাই লিখছে যা মুরাদ তাকে লিখতে বলছে …

অশোক সিংয়ের বাক্যে একের পর এক সন্দেহসূচক শব্দ এমনকি অস্বস্তিরও আভাস পাচ্ছেন তিনি। প্রমাণ হয়ে গেছে ব্যাপারটা। নতুন ডাকে আসা প্রথম পত্রটি হাতে নিয়ে এখনো কাঁপছেন ম্রাট, জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন চিঠির বিষয়বস্তু :

জাহাপনা,
আপনার পুত্র আমাকে এই নির্দেশ দিয়েছে যেন আপনাকে জানিয়ে দিই যে মোগল সেনাবাহিনীর হাতে দক্ষিণে পিছু হটা ব্যতীত আর কোন পথ খোলা নেই। অক্সাস পার হওয়া এখনো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা নিজেদের সাম্প্রতিক সব বিভেদ ভুলে একত্রে জড়ো হওয়া শুরু করেছে আমাদের শত্রুরা। তাদের লক্ষ্য একটাই প্রথম সুযোগেই আমাদেরকে নির্মূল করা। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই উজবেক একদল অশ্বারোহী নদীর উধ্বভাগে বেশ কয়েক মাইল পার হয়ে এসে আক্রমণ করে আমাদের শিবিরের উপরে আর নির্বিচারে হত্যা করে প্রহরীদের। পরের দিন সকাল বেলা কাঁধ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় খুঁজে পাই মৃত প্রহরীদেরকে; মুখ থেকে ঠেলে বেরিয়ে ছিল জননেন্দ্রিয়। মনোবল হারিয়ে আমাদের সৈন্যরা অভিযোগ করছে যে অচেনা এই ভূমিতে যুদ্ধ করার মত অবস্থায় নেই তারা। এছাড়া আবহাওয়াও আমাদের প্রতিকূলে চলে গেছে প্রথম তুষারপাত হয়ে গেছে; রুক্ষ শীতের সাথে টিকে থাকার মত রসদ নেই সৈন্যদের। আমরা তাই আপনার পুত্রের নির্দেশে পিছিয়ে এসে বাঙ্কে আপনার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছি। ——-অশোক সিং।

শাহজাহান কথা বলা বন্ধ করতেই চারপাশে নেমে এলো ভারী নিস্তব্ধতা। কেউই তাঁর চোখের দিকে তাকাতে রাজি নয়। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তারা কী ভাবছে–যুদ্ধ করার মত কোন অবস্থাই নেই মুরাদের। আর ঠিকই ভাবছে তারা বিশেষ করে এইবার দ্বিতীয় পত্রটি লিখেছে মুরাদ নিজে।

এটার চেয়েও খারাপ সংবাদ আছে। তার থেকে বড় কথা এবারের পত্র লিখেছে আমার পুত্র যা ছাড়িয়ে গেছে অশোক সিংকেও। 

আববাজান,
এই পত্র যখন আপনি পড়ছেন ততক্ষণে আমি আর আপনার সেনাবাহিনী বাল্ক ছেড়ে হিন্দুস্তানের পথে রওনা হয়ে যাবো। শহর ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। অক্সাসের ওপরে উজবেকদের ঢেউয়ের মত আঁছড়ে পড়ার সংবাদ পেয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাবুল ফিরে যাবার, কেননা পরবর্তীতে যে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে তার ঝুঁকি এড়ানো যাবে তাহলে। আমি চাইনি আমাদের অসংখ্য সৈন্যের রক্তপাত ঘটুক আর আমার বিশ্বাস যে আমার সিদ্ধান্ত বুঝতে পেরে একমত হবেন আপনিও।
–আপনার দায়িত্ববোধ সম্পন্ন পুত্র মুরাদ।

দায়িত্ববোধ সম্পন্ন পুত্র! – নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না শাহজাহান।

আমার অবাধ্য হয়েছে সে। জানত যে তার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে তৎক্ষণাৎ সমরকন্দের পথে রওনা হওয়া। এর পরিবর্তে আবিষ্কার করেছে নিত্যনতুন অজুহাত আর হাত ফসকে গেছে নিশ্চিত বিজয়। আর এখন যতটুকু অর্জন করেছিল সেটাও টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বিনা যুদ্ধে। তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। কিন্তু জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে উত্তরে অশোক সিংকে কোন নির্দেশ পাঠাবো যে যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন কোন সেনাপ্রধান নিয়োগ দিচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর দায়িত্বে কে থাকবে? তোমাদের কী পরামর্শ? অপেক্ষা করলেন শাহজাহান। কিন্তু এবারেও কথা বলল না কেউই। তো কারো কিছু বলার নেই?

কিন্তু চারপাশে নিজের সভাসদদের দিকে তাকিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই সম্রাট উপলব্ধি করলেন এ অপরাধ যতটা মুরাদের ঠিক ততটাই তার। আওরঙ্গজেবকে শিক্ষা দিতে চেয়ে অনভিজ্ঞ এক তরুণকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বহু দিনের সাধনার লক্ষ্য সমরকন্দের দিকে। কিন্তু কখনো ভাবেন নি যে মুরাদ তাঁকে এতটা বাজেভাবে হতাশ করবে।

জাহাপনা, অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন একজন বর্ষীয়ান উপদেষ্টা।

এই বছর অভিযানে আর সফল হবার সম্ভাবনা নেই–অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে, শীঘ্রই উত্তরের মুখে বরফ পড়ে হিন্দুস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে আপনার সেনাবাহিনীকে। তাহলে কাবুলেই কেন তাদেরকে শীতকাল কাটানোর নির্দেশ দিচ্ছেন না? এরপর শুকনো দিন এলে আবারো উত্তরের দিকে এগিয়ে যাবে তারা সম্ভবত হিন্দুকূশের ভেতর দিয়ে ভিন্ন কোন রাস্তা ব্যবহার করতে হবে যেন চমকে যায় আমাদের শক্ররা।

খানিক চুপ করে থেকে মাথা নাড়লেন শাহজাহান।

ঠিক আছে, এটা সঠিক। একটা প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে সে কারণে হাল ছাড়ার কোন মানে হয় না। বিশেষ করে যখন এত বড় সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে ও সশস্ত্র করতে প্রচুর ব্যয় হয়েছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি যে সফল হবার পেছনে বহু যুক্তি আছে আমাদের। এছাড়া এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার মানে হল শত্রুর চোখেও হীন হয়ে যাওয়া। উজবেক বা পারস্য সকলেই ভাবতে উৎসাহী হবে যে নিজেদের দন্ত হারিয়ে ফেলেছে মোগল সেনাবাহিনী। চারপাশে প্রকৃতই নিদ্রাভেঙ্গে জেগে উঠেছে উপদেষ্টারা। বিড়বিড় করে সকলেই একমত হল সম্রাটের সাথে।

ভালো। আমি এখনই অশোক সিংকে সংবাদ পাঠিয়ে দিচ্ছি এই বলে যে, কাবুলেই শীতকাল কাটাবে সেনাবাহিনী। এছাড়া সেখানকার প্রশাসকের কাছেও প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠাচ্ছি তাদের জন্য যথাযথ আশ্রয় ও খাবারের সংস্থান করার।

আর নতুন সেনাপ্রধান, জাহাপনার সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। দ্রুতকণ্ঠে জানতে চাইল বর্ষীয়ান উপদেষ্টা।

গুজরাট থেকে শাহজাদা আওরঙ্গজেবকে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারে মনস্থির করেছি আমি। এ দায়িত্ব নিতে আগ্রহী ছিল সে। এখন তাহলে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া যাক যে সে এর যোগ্য আর আমার ভরসার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *