পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের এই জেফ্রির পয়েন্টে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। সেই সঙ্গে নেমেছে গাঢ় কুয়াশা। এখন শুক্লপক্ষ। আকাশে পূর্ণ চাঁদের মায়াবী আলো। অন্ধকার আর কুয়াশার স্তরগুলো ভেদ করে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সেই আলো এসে পড়েছে দক্ষিণ আন্দামানের এই সৃষ্টিছাড়া ভূখণ্ডে।
তিনদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় হাজার বছরের আদিম অরণ্য, অন্যদিকে যতদূর চোখ যায় ধু-ধু দিগন্ত অবধি সমুদ্র–অফুরান বঙ্গোপসাগর। অন্ধকার আর কুয়াশা মাখানো জ্যোৎস্না চারপাশের চরাচরকে অপার কোনও রহস্যে যেন মুড়ে রেখেছে। সমুদ্রকে ঝাঁকি দিতে দিতে উঠে আসছে জোরালো হাওয়া। তুমুল ঢেউ এসে ভেঙে পড়ছে সোনালি বালির বিচে। একটানা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শাঁই শাঁই। সমুদ্রের দিকটা ছাড়া বাকি সব কিছু একেবারে নিঝুম। অনন্ত নৈঃশব্দ্য বনভূমি, পাহাড় আর উপত্যকা পাষাণভারের মতো চেপে বসেছে।
এখানে নতুন উপনিবেশের পত্তন হবে। গড়ে উঠবে বাংলার ছিন্নমূল মানুষদের নতুন বাসভূমি। কয়েক ঘণ্টা আগে সেই বিকেল বেলায় দেড়শো উদ্বাস্তু পরিবারের শ’ পাঁচেক প্রথম দলটা এসে গেছে। সাড়ে চারদিন জাহাজে আর এ পোর্ট ব্লেয়ারে কাটিয়ে লরিতে চেপে চড়াই-উতরাই ভেঙে ঝাঁকানি খেতে খেতে যখন তারা পৌঁছল হাড়মজ্জা প্রায় ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সন্ধে নামতে না নামতেই তাদের খাইয়ে ব্যারাকের মতো লম্বা ঘরগুলোতে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল বিভাসরা। এখন তারা গভীর ঘুমের আরকে ডুবে আছে।
কিছুক্ষণ আগেও পূনর্বাসন দপ্তরের কর্মীদের কথাবার্তা ভেসে আসছিল। তাদেরও আর সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিন হইহই করে খাটাখাটুনির পর ওরাও অপার ক্লান্তিতে বিছানায় শরীর ঢেলে দিয়েছে।
বিশ্বজিৎ রাহার মাঝারি ধরনের ঘরটিতে টেবলের ওপর ঝুঁকে লিখে চলেছে বিনয়। টেবলের এক কোণে একটা ঝকঝকে কাচের বড় লণ্ঠন জ্বলছে আরও একটা লণ্ঠনও রয়েছে। সেটা ঝুলছে সিলিং থেকে। দুই লণ্ঠনের উজ্জ্বল আলোয় ঘর ভরে গেছে।
এই ঘরের দুটো তক্তপোশে পুনর্বাসন দপ্তরের একজন কর্মী বিছানা পেতে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। একটা বিছানায় মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে ক্রাইম স্টোরি পড়ছেন বিশ্বজিৎ। তিনি ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। অন্য বিছানাটা ফাঁকা। লেখা শেষ হলে বিনয়ও সেখানে শুয়ে পড়বে।
ঘরের চার কোনায় চারটে পেতলের সরায় মশা-মারার তেজি ধূপ পুড়ছে। এই বিজন অরণ্যে লক্ষ কোটি মশা আর বাড়িয়া পোকা দিবারাত্রি ঝাঁক বেঁধে টহল দিয়ে বেড়ায়। রাত্তিরে তাদের উদ্যমটা শতগুণ বেড়ে যায়। তারা টের পেয়েছে জেফ্রি পয়েন্টে নতুন মানুষ এসেছে। মানুষ মানেই তো টাটকা সুস্বাদু রক্ত।
বিনয়ের টেবলের সামনের বড় জানালাটা খোলা। ওরা ঘরে এসে ঢুকতেই বাড়িয়া পোকা আর মশাদের দঙ্গলগুলো ঢুকে আসছিল কিন্তু ধূপের উগ্র ঝাঁঝে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু যাদের এনার্জি বেশি, ভেতরে এসে হাত-পা-শুঁড়-ডানা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দমবন্ধ হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঘরের এধারে ওধারে মরা পোকা আর মশাদের ডাঁই।
পরশু দুপুরে বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে যাবেন। তার হাতে ‘নতুন ভারত’-এর জন্য অন্তত দুটো প্রতিবেদন তৈরি করে দিতেই হবে। আজ রাত্তিরে একটা লেখা শেষ না করলেই নয়। সেই সঙ্গে লিখতে হবে তিনটে চিঠি! বাকি প্রতিবেদনটা কাল এক ফাঁকে লিখে ফেলবে। বিশ্বজিৎ সেগুলো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্লেনে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন।
এক সময় প্রথম রিপোর্টটা শেষ হল। খিদিরপুর ডক থেকে হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে নিয়ে এস এস ‘মহারাজা’ জাহাজে রওনা হওয়ার পর থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছনো পর্যন্ত অনুপুঙ্খ বিবরণ গুছিয়ে লিখেছে বিনয়। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় আতঙ্কে উদ্বাস্তুদের দিশেহারা হয়ে যাওয়া, তাদের মৃত্যুভয়, তাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে ভরসা দিয়ে শান্ত করা, উত্তাল সমুদ্রে ভয়াবহ সাইক্লোনের মুখে পড়া–কোনও তে দিতে কিছুই বাদ যায়নি।
লেখাটা বেশ বড়ই হল। পুরো এগারো পাতা। আগাগোড়া সেটা পড়ে দু-চারটে শব্দ পালটে, তিন-চারটে প্যারা কেটে নতুন করে লিখল বিনয়। মনে হল রিপোর্টটা ভালোই দাঁড়িয়েছে। আন্দামানের প্রথম প্রতিবেদনটা যে ‘নতুন ভারত’-এর পাঠকদের উৎসুক করে তুলবে তা নিয়ে বিনয়ের সংশয় নেই। ভেতরে ভেতরে তৃপ্তিই বোধ করল সে। একটা লাগসই হেডিং দিতে হবে। খানিকক্ষণ ভেবে প্রথম পাতার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লিখে ফেলল ‘উত্তাল কালাপানি পেরিয়ে উদ্বাস্তুদের আন্দামান যাত্রা’। তারপর কাগজগুলো গুছিয়ে পিন দিয়ে গেঁথে টেবলের এক পাশে রাখল।
ঘাড় গুঁজে একটানা কলম চালিয়েছে। একটু ক্লান্তই লাগছিল বিনয়ের। পিঠটা পেছন দিকে হেলিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সে। সন্ধের পর থেকে যেমনটা দেখেছিল তার কোনও হেরফের নেই। ঘোলাটে চাঁদের আলো, কুয়াশা আর অন্ধকারে দক্ষিণ র্তিা কানে আন্দামানের পাহাড় অরণ্য জুড়ে সেই অন্তহীন নিশুতি। কিছুক্ষণ যাচ্ছে না। আগেও সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া দিচ্ছিল। হঠাৎ হাওয়ার তেজ পড়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের লক্ষ কোটি ঢেউ বাতাসের ধাক্কায় পাড়ে এসে বিপুল গর্জনে অবিরল ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। এখন সেই আওয়াজ থেমে গেছে। কোনও এক অদৃশ্য ম্যাজিসিয়ান জাদুকাঠি ছুঁইয়ে আচমকা যেন জেফ্রি পয়েন্টের সব শব্দ থামিয়ে দিয়েছে।
এই রাত্রিবেলা আদিম প্রকৃতির নিস্তব্ধ খাঁজের ভেতর বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন গা ছম ছম করে।
কয়েক মিনিট বাইরে তাকিয়ে থাকার পর সুটকেস থেকে চিঠির কাগজ খামটাম বার করে নিল বিনয়। আপাতত তিনটে চিঠি লিখতে হবে। একটা ‘নতুন ভারত’-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়িকে, একটা আনন্দকে, একটা সুধাকে। চকিতে মনে পড়ে গেল, কলকাতা থেকে জাহাজে ওঠার আগে ঝুমা কতবার যে বলেছে আন্দামানে পৌঁছেই বিনয় যেন তাকে চিঠি লেখে। বিনয় নিজেও জানিয়েছিল, লিখবে, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই লিখবে।
ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর তার জীবন জুড়ে যে ধু-ধু শূন্যতা নেমে এসেছিল সেই কটা ধীরে ধীরে ভরিয়ে তুলেছিল ঝুমা। রাজদিয়ায় তাকে নিয়ে দুই কিশোরীর মধ্যে যে মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা কতকাল চলত, কে জানে। কলকাতায় আসার পর যখন তারা পূর্ণ যুবতী তখনও সেই যুদ্ধের অবসান হয়নি।
ঝুমা এক পরমাশ্চর্য মেয়ে। যেন কোনও মায়া কাননের পরি। কী যে তীব্র সম্মোহন তার। এস্রাজে ছড় টানার মতো তার হাসি, তার কণ্ঠস্বরে হালকা ঝংকার, নিটোল ফুলদানির মতো গ্রীবা বাঁকিয়ে আধবোজা চঞ্চল চোখে তাকানো, তার সারা শরীর থেকে উঠে আসা উগ্র সুগন্ধ বিনয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলত। শত আলোকবর্ষ দূরের পূর্ব বাংলার ছোট্ট শহর রাজদিয়ায় এক বিজন দুপুরে কিশোরী ঝুমা তাদের বাড়ির চিলেকোঠায় একটি চুম্বনে সেদিনের বিনয়ের স্নায়ুতে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। বিনয়ের হাত ধরে জীবনের অজানা রহস্যের অনেকগুলো দরজা পার করে যৌবনের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে সে। তার কাছে গেলে সারা। শরীর ঝিম ঝিম করত। প্রবল আকর্ষণে সমস্ত শিকড় ছিঁড়ে ঝুমা বিনয়কে ছিনিয়ে নিতে চাইত।
অন্যদিকে ছিল ঝিনুক। চিরদুঃখী মেয়েটার শান্ত করুণ মুখ, বিষাদ মাখানো চোখের তাকানো, তার নিঝুম বসে থাকা, তার সংগোপন যাতনা–সব মিলিয়ে এমন এক শক্তি ছিল যা দিয়ে বিনয়কে নিজের কাছে ধরে রেখেছে। ঝুমা তার সমস্ত মাদকতা দিয়েও তাকে পুরোপুরি কেড়ে নিতে পারেনি।
কিন্তু ঝিনুক নিখোঁজ হওয়ার পর উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা এবং মহানগরের চারপাশে পঁচিশ-তিরিশ মাইল দূর অবধি ঘুরে ঘুরেও যখন তার সন্ধান পাওয়া গেল না, ভেঙেচুরে একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল বিনয়। সেই সময় অফুরান মমতায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ঝুমা। যে মেয়ে পুরুষের রক্তে তুফান তোলে, জাদুকরির মতো আঙুলের ডগায় তুলে তাকে নাচায়, তুড়ি মেরে মেরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মাতিয়ে দিতে পারে, এ যেন সেই ঝুমা নয়। কী প্রগাঢ় মায়া এই ঝুমার, কী অনন্ত সহানুভূতি।
ঝিনুক জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর এক সময় বিনয়ের মনে হয়েছিল আকাশ খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে। ঝিনুককে ছাড়া কীভাবে দিন কাটবে ভাবতেও পারছিল না। সে যে কী নিদারুণ ক্লেশ, কী যে অসহ্য দাহ! কিন্তু জীবন তো এক জায়গায় থেমে থাকে না; তার ভাঁজে ভাঁজে কত যে ইন্দ্রজাল লুকনো আছে, আগে তা কি সে জানত? ঝিনুক তার হাড়েমজ্জায় যে দগদগে রক্তাক্ত ক্ষত রেখে গিয়েছিল, ঝুমা তার ওপর স্নিগ্ধ প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। তখন পাগল পাগল, অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। তাকে সেখান থেকে তুলে এনে কত যত্নে ঝুমা যে সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলেছে। ক্রমশ বিনয়ের মনে হয়েছে স্বেচ্ছায় যে মেয়েটি হারিয়ে গেছে তার জন্য বাকি দীর্ঘ জীবনটা শুধু স্মৃতি, হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাটানো যায় না। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে ঝুমার হাতে সঁপে দিয়েছে সে।
কিন্তু কে জানত, আন্দামানে ‘রস’ আইল্যান্ডে ঝিনুকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে? না, তাকে ভোলা যায়নি। বুকের ভেতর যে গোপন ক্ষতটা মনে হয়েছিল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ফের সেটা সময়ের স্তর ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। বিনয় টের পেয়েছে, নতুন করে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। ঝিনুকের জন্য সেই পুরনো আবেগ আর তীব্র ব্যাকুলতা তাকে উথালপাতাল করে দিয়েছে। আরও একবার সে টের পেয়েছে তার শ্বাসপ্রশ্বাসে মেয়েটা জড়িয়ে আছে। আমৃত্যু জড়িয়েই থাকবে।
ঝিনুককে দেখার পর ঝুমা বহু-বহু দূরে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এ এক আশ্চর্য খেলা। যতদিন ঝিনুককে পাওয়া যায়নি, সেই শূন্য স্থানে চলে এসেছিল ঝুমা। কিন্তু এখন? বিনয়ের অজান্তে কেউ যেন তাকে নিঃশব্দে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।
এরপর ঝুমাকে চিঠি লেখা কি ঠিক হবে? বিনয় মনস্থির করে ফেলল লিখবে না। লেখাটা মহা অন্যায়। এক ধরনের পাপই হবে। সে যেন নিয়তিতাড়িত এক মানুষ। ঝিনুকই তার নিয়তি। তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোনও নারীর কথা এই মুহূর্তে সে ভাবতে পারছে না। ঝুমা খুবই কষ্ট পাবে, ভেঙেও পড়বে কিন্তু সম্পর্কটা খুব সম্ভব রাখা যাবে না। ঝুমাকে সে কি ভালোবাসেনি? বেসেছে। দুঃখের দিনে সংকটের সময় সে যখন চুরমার হয়ে যাচ্ছিল, ঝুমা পাশে থেকে তাকে ধসে পড়তে দেয়নি। অবিরল শুশ্রূষায় সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে। এটা তো ঠিক মনপ্রাণ ঢেলে মেয়েটা তাকে ভালোবেসেছে। কিন্তু যে ’রস’ আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর বিনয়ের মনে হয়েছে জীবনের প্রথম নারীটি তার বত্রিশ নাড়ি ধরে টান দিয়েছে। ঝিনুকের সঙ্গে কাল একটি কথাও হয়নি। চলুঙ্গা জাহাজের আপার ডেকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। জাহাজটা সুরে, আরও দূরে, ধীরে ধীরে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তারপর অন্য একটা দ্বীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই যে দেখা হয়েছিল তারপর থেকে ঝিনুক ঝুমার কাছ থেকে প্রবল টানে উপড়ে নিয়ে গেছে তাকে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিনয়। তারপর প্রথম চিঠিটা লেখে প্রসাদ লাহিড়িকে। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি। সে নিরাপদে আন্দামানে পৌঁছেছে, উদ্বাস্তু পরিবারগুলির সঙ্গে কাল চলে এসেছে জেফ্রি পয়েন্টে; গভীর অরণ্যের মধ্যে এখানেই রিফিউজি সেটলমেন্ট গড়ে উঠবে। দুটো প্রতিবেদন আপাতত সে পাঠাচ্ছে। এরপর দুদিন পর পর পাঠাতে থাকবে। ‘নতুন ভারত’-এর কপি এয়ারমেলে যদি বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানায় পাঠানো হয় সে পেয়ে যাবে। ঠিকানা লিখে দিল: C/o বিশ্বজিৎ রাহা, মেরিন জেটির কাছে। পোর্ট ব্লেয়ার। আন্দামান। প্রণাম জানিয়ে চিঠি শেষ করল বিনয়।
পরের চিঠিটা সে লিখল আনন্দকে। এটাও ছোট চিঠি। নির্বিঘ্নে পৌঁছবার খবর দিয়ে বিনয় জানাল, সে ভালোই আছে। তার জন্য কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করে। বাড়ির কে কেমন আছে, ইত্যাদি জানিয়ে আনন্দ যেন মাঝে মাঝে চিঠি লেখে। বিনয়ও লিখবে। বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানা জানিয়ে সেখানেই যোগাযোগ করতে লিখল। তার চিঠিতে ঝুমার নামটা পর্যন্ত নেই।
বিনয় জানে, কলকাতায় আনন্দর কাছে চিঠি পৌঁছানোমাত্র খবর পেয়ে যাবে ঝুমা। তাকে না লিখে তার মামাকে লিখেছে, এতে ভীষণ ভেঙে পড়বে মেয়েটা। কিন্তু কিছু করার নেই বিনয়ের। চকিতের জন্য তার খেয়াল হল, অনন্তকাল সে আন্দামানে পড়ে থাকবে না। একমাস কি দু’মাস পর তাকে কলকাতায় ফিরে যেতেই হবে। তখন কি ঝুমা তার কাছে ছুটে আসবে না? তার ব্যাকুলতার সামনে দাঁড়িয়ে কী জবাব দেবে সে? না–এখন আর সেসব ভাবতে পারছে না বিনয়।
ঝুমার চিন্তাটা মাথা থেকে এক রকম জোর করেই বার করে দিয়ে শেষ চিঠিটা লিখতে শুরু করল বিনয়।
‘প্রিয় ছোটদি,
এখন অনেক রাত। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে অনেক দূরে আজ বিকেলে আমরা এমন একটা সৃষ্টিছাড়া জায়গায় এসে পৌঁছেছি, কলকাতায় বসে তুই তা কল্পনাই করতে পারবি না। তিনদিকে গভীর অরণ্য, একদিকে সমুদ্র। এই এলাকাতেই কাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের উপনিবেশ তৈরির কাজ শুরু হবে। মনে হচ্ছে পশ্চিম। আফ্রিকার সুগভীর অরণ্যে ঘেরা আদিকালের এক অজানা, রহস্যময় পৃথিবীতে এসে পড়েছি। যতদূর চোখ যায়, এলাকাটা এত নির্জন, এমনই নিঝুম যে গা ছম ছম করে। এখানে বেশ কিছুদিন আমাকে থাকতে হবে। আমার ধারণা, এমন সব ঘটনা আর অভিজ্ঞতা হবে, আগে আর কখনও তা হয়নি।
সে যাক, তোরা কেমন আছিস? তুই তো সেই ছেলেমানুষ বয়স থেকেই ছিচকাঁদুনে; একটুতেই কেঁদে কেটে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভাসিয়ে। দিস। আমার জন্য ভেবে ভেবে মোটেও শরীর খারাপ করবি না। তোর ঠাকুরঘরে যে শ’খানেক দেবদেবী রয়েছে তাদের নামে দিব্যি করে বলছি, আমি ভালো আছি। আমার বিপদের কোনও ভয় নেই। যেসব অফিসার এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সেটলমেন্ট গড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা সব সময় আমার দিকে লক্ষ রাখছেন। আদরযত্নের লেশমাত্র ত্রুটি নেই।
একজনের জন্য আমি ভীষণ দুর্ভাবনায় আছি। তিনি হেমদাদু। কলকাতায় থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের অনেক খবর পাওয়া যায়। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে পৃথিবী নামে গ্রহটির সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক যেন ছিঁড়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে, সেখানকার হাল আরও খারাপ হয়ে গেছে কি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বর্ডার থেকে নিত্য দাস এর মধ্যে কি হেমদাদুর চিঠিপত্র দিয়ে গেছে? যদি দাদুর চিঠি আসে, খামে ভরে নিচের ঠিকানায় অবশ্যই পাঠিয়ে দিবি…..
এই পর্যন্ত লেখার পর হঠাৎ ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে, ভেসে ওঠে। এই মেয়েটার প্রতি যার অনন্ত সহানুভূতি, সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও একমাত্র সে-ই তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিল। লাঞ্ছনায়, গ্লানিতে, অসম্মানে চিরদুঃখী ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, খুবই কষ্ট পেয়েছিল সুধা।
তার এই ছোটদির কাছে সেই জ্ঞানবুদ্ধি হবার বয়স থেকে কখনও কিছু লুকোয়নি বিনয়। তার জীবনের ভালোমন্দ, সংকট বা আনন্দের মুহূর্তগুলো অকপটে মেলে ধরেছে।
কিন্তু না, ঝিনুকের কথা এখন কিছুতেই লিখতে পারবে না। আপাতত তা গোপনই রাখবে। তার কারণও রয়েছে। ঝিনুকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে মাত্র। কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়নি। সে রয়েছে মধ্য আন্দামানে, আর বিনু দক্ষিণ আন্দামানের জেফ্রি পয়েন্টে। দূরত্ব আর কতটুকু? বড়জোর ষাট কি সত্তর মাইল। সে তো মাইলের হিসেবে। কিন্তু এই দুর্গম দ্বীপপুঞ্জে যাতায়াত এমনই দুরূহ যে এক মাসের মধ্যে সেখানে যাওয়া অসম্ভব। এর থেকে লক্ষ কোটি মাইল দূরের নক্ষত্রলোকে পৌঁছনো অনেক সহজ।
সবার আগে মধ্য আন্দামানে গিয়ে ঝিনুককে খুঁজে বার করতে হবে। নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে কতটা দুঃখ, কতখানি ক্লেশ, কতখানি অভিমান মনের গোপন কুঠুরিতে সে জমিয়ে রেখেছে। প্রথমে তা জানতে হবে। সামনাসামনি তাকে দেখে ঝিনুকের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, ঘৃণায় ক্রোধে তাকে ফিরিয়ে দেবে কি না কিছুই জানা নেই।
বিনয়ের ধারণা, বিনয়ের বিশ্বাস ঝিনুক তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু মাঝখানের কয়েক মাসে সে যদি পুরোপুরি বদলে গিয়ে থাকে? যদি সে তাকে ফিরিয়ে দেয়? বুকের ভেতরটা হঠাৎই ভীষণ উতলা হয়ে ওঠে বিনয়ের।
খানিকক্ষণ পর মন কিছুটা শান্ত হলে সে ফের লেখা শুরু করে।
জানিস ছোটদি, আন্দামানে আসার পর এমন একটা ঘটনা ঘটেছে তার পরিণাম সুখকর হবে, নাকি অনন্ত বেদনাদায়ক, বুঝতে পারছি না। ঘটনাটি আমাকে প্রবল সংশয়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে এই চিঠিতে আর কিছু লিখছি না। তেমন বুঝলে পরে সমস্ত জানাব। দ্বারিকদাদু, জেঠিমা, হিরণদা আর তুই আমার ভালোবাসা এবং প্রণাম নিস। ইতি তোদের বিনু।
নিচে বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানা দিয়ে লিখল, এখানে উত্তর দিলে আমি পেয়ে যাব।
আগাগোড়া চিঠিটা একবার পড়ল বিনয়। আচমকা খেয়াল হল, ঝিনুকের ব্যাপারটা গোপন রাখবে ঠিক করেও নিজের অজান্তেই তার সম্বন্ধে একটু ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছে। লাইনগুলো কেটে দেবে কি? পরক্ষণে ভাবল, লেখা যখন হয়েই গেছে–থাক।
তিনটে চিঠি তিনটে খামে পুরে মুখ আঠা দিয়ে আটকে আনন্দ, প্রসাদ এবং সুধার পুরো নাম ঠিকানা লেখা যখন শেষ হয়েছে সেই সময় দূর থেকে অনেকগুলো ড্রাম বাজানোর একটানা তীব্র আওয়াজ ভেসে এল। কারা যেন উন্মাদের মতো বাজিয়ে চলেছে।
আদিম বনভূমির অন্তরাত্মা ভেদ করে শব্দপুঞ্জ উঠে আসছে। মধ্যরাতের নিরেট স্তব্ধতা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যাচ্ছে।
অজানা ভয়াবহ কোনও আশঙ্কায় পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে যায় বিনয়ের।
এদিকে বাইরে তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেছে। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সারাদিন অসুরের মতো খেটে কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ড্রামের শব্দে তাদের চোখ থেকে লহমায় ঘুম ছুটে গেছে। বিছানা থেকে উঠে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে যে যার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে।
জানালার বাইরে বিহুলের মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। দেখতে পেল কতকগুলো ছায়ামূর্তি ক্ষিপ্র হাতে একের পর এক মশাল জ্বালাচ্ছে। বেশ কয়েকজনের হাতে লম্বা লম্বা টর্চ। ওদের মধ্যে থেকে কয়েকজন সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, জারোয়া–জারোয়া–হোঁশিয়ার।
নতুন সেটেলমেন্টের এধারের অংশটুকু আলোয় ভরে গেছে। এখন বাইরের লোকগুলোকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ বণিক, চেইনম্যান ধনপত সিং, তার চারজন বর্মি সহকারী, বিভাস, নিরঞ্জন এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অন্য সব বাঙালি এবং অবাঙালি কর্মীরা, যাদের মধ্যে বেশ ক’জন পুরানো দাগি আসামি। এরা ব্রিটিশ আমলে যাবজ্জীবন কালাপানি’র সাজা নিয়ে আন্দামানে জেল খাটতে এসেছিল।
ওদিকে পাশের খাটে সচকিত হয়ে উঠে বসেছেন বিশ্বজিৎ। হাতের বইটা একধারে রেখে মশারি তুলে নেমে এলেন। বললেন, চলুন, দেখা যাক কী হল–