২. হিমঘর

হিমঘর

হিমঘরে শুয়ে আছে যমুনা। চোখের সামনে মৃতদেহ দেখেও নূপুরের মনে হতে থাকে এ সত্য নয়। এ ঘটেনি। যমুনা আছে, বেঁচে আছে। কোথাও আছে। এই মৃতদেহ, এই হিমঘর—সবকিছু ঘটছে হয়তো অন্য কোথাও, স্বপ্নে অথবা অন্য কোনও জগতে। এই পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে হয়তো সম্পর্ক নেই কোনও। ‘নূপুর তুই এলি, শেষ পর্যন্ত এলি! আয় কাছে আয়, আয় আরও কাছে’— নূপুর অনুভব করতে থাকে যমুনার স্পর্শ। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টানা, ভালোবাসায় মমতায় স্নেহে জড়িয়ে রাখা। কতকাল এই স্পর্শ সে পায়নি। কে করে আর তাকে ওভাবে আলিঙ্গণ, যমুনার মতো! জগতটা তারপরও হঠাৎ চরকির মতো ঘুরে ওঠে। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়। আবারও ঘোরে। আবারও শান্ত হয়। একটি মুত্যুকেই শত শত মৃত্যুর মতো মনে হয় তার। যেন সে অন্ধকারে কোনও শহরের এক ক্যাটাকম্বের মধ্য দিয়ে হাঁটছে, দু’ধারে লক্ষ লক্ষ মানুষের মাথার খুলি আর হাড় থরে থরে সাজানো। নূপুর হাঁটছে মাঝখানের সরু অন্ধকার পথে, কোথাও কেউ বাতি হাতে তার জন্য দাঁড়িয়ে নেই।

হিমঘরে যমুনার শরীর ওভাবেই পড়ে থাকে, যেভাবে পড়ে ছিল। নূপুর ফিরে আসে যমুনার বেহালার বাড়িতে। কলকাতায় যমুনার সঙ্গে দেখা করতে নূপুর যখন আগে এসেছিল, তখন যাদবপুরের দিকে কোথাও থাকতো যমুনা। বেহালার এই বাড়িতে যমুনা কতবার আসতে বলেছে তাকে। এলো ঠিকই। যমুনার শুধু দেখা হল না যে এলো। কুড়ি বছর যমুনা কলকাতায় থেকেছে। কুড়ি বছরে কুড়িবারেরও বেশি নূপুর পাশের দেশ বাংলাদেশে এসেছে। ঢাকায় বা ময়মনসিংহে অলস অবসর কাটিয়েছে, কিন্তু যমুনার সঙ্গে একবার শুধু দেখা করতে এসেছে। ফোনে যতবারই কথা হয়েছে, যমুনা বলেছে ‘টিকিট পাঠাচ্ছি চলে আয়, দু’বোনে ক’টা দিন কাটাই চল, খুব ভালো লাগবে এখানে দেখবি, তোকে অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবো, পাহাড় ভালো লাগে না তোর?’ এরকম প্রশ্নের উত্তরে নূপুর ‘না গো, জয়ের পেটটা খারাপ বা জ্বর হয়েছে বা জয়ের ইস্কুল আছে, তাড়াতাড়ি নিউইয়র্কে ফিরতে হবে’,অথবা ‘সময়ই তো পাচ্ছি না, অথবা তোমার সঙ্গে তো ফোনে বা নেটে কথাই হয়’, বা ‘এই গরমে কোথাও আর জার্নি করতে ইচ্ছে করছে না, এবার বাদ দাও, সামনের বছর ঠিক ঠিক যাবো। আর তুমি তো যাবেই নিউইয়র্ক তখন তো দেখা হবেই’ বলেছে। যমুনার আবেগের জলে ঝাঁকা ঝাঁকা ছাই ঢেলে দিয়েছে। অপরাধবোধ আজ নূপুরকে স্তব্ধ করে রাখে। সেই স্তব্ধতাকে আলতো করে স্পর্শ করে নির্মলা।

—কী, এত কী ভাবছো?

নূপুর বিষণ্ণ মাথা নাড়ে। নাহ কিছু না।

তাকায় সে নির্মলার দিকে। কত হবে বয়স! সম্ভবত চল্লিশের কাছাকাছি। পিঠে দুলছে লম্বা ঘন চুল। ফর্সা মুখ। পরনে কালো পাড় সাদা শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ। লম্বায় নূপুরের চেয়ে ছ’ইঞ্চি মতো ছোট। নূপুর আর যমুনা দুজনই পাঁচ ফুট সাড়ে আট। দু’জনই ছিপছিপে, দুজনকেই চোখে পড়ে, তবে যমুনাকে বেশি পড়ে। সে কী আজ থেকে!

নির্মলা বলে, ‘আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট কি আমারও কম হচ্ছে!’

নূপুর জানে না যারা যমুনাকে শৈশব, কৈশোর আর যৌবন জুড়ে দেখেনি, তাদের কষ্ট আদৌ কোনও কষ্ট, অথবা গভীর কোনও কষ্ট কি না!

নূপুরের সঙ্গে দেখা করতে যমুনার কয়েকজন বন্ধু আর সহকর্মী আসে বাড়িতে। ড্রইংরুমে বসে চা খেতে খেতে ওরা যমুনার কথাই বলে। যমুনা কেমন ছিল, কী ছিল, কেন হঠাৎ এমন হল, ভালো মানুষগুলোই কেন এভাবে আগে চলে যায়। ওদের কণ্ঠস্বরে উথলে উঠতে থাকে যমুনাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস আর যমুনার না থাকার বেদনা। চারদিকের পরিবেশ নতুন, মানুষগুলো নতুন, ভাষা এক হলেও উচ্চারণ ভিন্ন। নূপুর শোনেই বেশি। ওদের কিছু মামুলি প্রশ্নের উত্তর মলিন মুখে দেয়। নূপুরের কথা সবাই যমুনার মুখে শুনেছে। নূপুরকে দেখার ইচ্ছে ছিল সবার। আলাপের সুযোগটা কেউ ছাড়তে চায়নি। নূপুরের কষ্টে সান্ত্বনা দিতেও আসা। ‘নূপুর একেবারে দিদির মতো দেখতে, দিদি যে কী ভালোবাসতো বোনকে!’ ‘ক’দিন আগে এলেই দেখাটা হতে পারতো, কী যে খুশী হত যমুনা!’ ‘আহ, কষ্টটা যে কী ভীষণ!’ এসব বলে কয়েকজন। ধীরে ধীরে ভিড় কমতে থাকে। নূপুর বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজা জানালা বই পত্র, চেয়ার টেবিল, বিছানা বালিশের দিকে। বাড়িটাতে কিছুদিন আগেই একটা মানুষ ছিল, মানুষটা নেই। মানুষটা কখনও আর ফিরে আসবে না। কখনও আর যাপন করবে না জীবন আগের মতো।

নির্মলা রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে নূপুরকে ডাকে। নূপুর চা টা খায়। ভাত তরকারি খেতে তার ইচ্ছে করে না। স্মৃতি জাপটে ধরে। পুরোনো দিনগুলো আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। উদাস হতে থাকে নূপুর। ঘুমহীন সারারাত। নির্মলার প্রশ্নের উত্তরে হু হা ছাড়া আর কিছু বলে না। যে শাড়ি পরে এসেছিল, সেই শাড়ি পরেই শুয়ে থাকে। মুখ হাত ধোয়া, বাড়িটা ঘুরে দেখা, নির্মলার সঙ্গে গল্প করা, কিছুই তার করতে ইচ্ছে করে না। নির্মলা বাধা দেয় না। একেক জনের শোক করা একেক রকম। খাবো না, ঘুমোবো না, কথা বলবো না, এই আচরণ নির্মলার নয়। নির্মলা প্রতিদিন ভোরে যমুনার ছবিতে তাজা ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। দোতলার বারান্দায় বসে আগে যেমন গান গাইতো, তেমন বসে এখনও গান গায়। পাশে যমুনার চেয়ারটা যেমন ছিল, থাকে। স্নান করে এরপর নির্মলা আপিস চলে যায়। সন্ধেবলায় ফিরে বাচ্চাদের পড়াতে বসে। চণ্ডিতলা থেকে পঞ্চাশ ষাটটা পাঁচ ছ’ বছর বয়সী গরিব বাচ্চা মেয়ে আসে বাড়িতে, নির্মলা ওদের বাংলা ইংরেজি অংক বিজ্ঞান পড়ায়। পড়ানো হয়ে গেলে সবার হাতে রুটি বিস্কুট কলা ডিম এসব দিয়ে দেয়। এ কাজটি যমুনাই শুরু করেছিল। শেষদিকে নির্মলার ওপর দায়িত্ব পড়েছে। যমুনা বলেছিল তার অনুপস্থিতিতেও যেন এই বাচ্চা পড়ানোর কাজটা চলতে থাকে বাড়িতে। নূপুর জিজ্ঞেস করেছিল নির্মলাকে, ‘সিস্টারহুডই তো দায়িত্ব নিয়েছে গরিব বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর। তবে আর বাড়িতে একই কাজ করার দরকার কী!’ নির্মলার উত্তর, ‘কয়েক লক্ষ ইস্কুল খুললেও কয়েক কোটি গরিব থেকে যায় যারা পড়াশোনা করার সুযোগ পায়না’। যমুনার সব আদেশ উপদেশ নির্মলা মাথা পেতে বরণ করেছে। বাড়িতে মেয়ে পড়ানোর কাজটা ছাড়েনি এই দুর্যোগেও। অবশ্য যমুনার চলে যাওয়া আর নূপুরের আসা, — এ দুটো কারণে অফিসে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে নির্মলাকে।

পরদিন সকালে বিছানা ছেড়ে নূপুর বাড়িটা খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে দেখে। হলুদ দোতলা বাড়ি। ওপর তলায় তিনটে শোবার ঘর। দক্ষিণে বারান্দা। নিচ তলায় ড্রইং রুম, রান্নাঘর, খাবার ঘর, সামনে পেছনে দুটো বারান্দা। সামনের বারান্দা পেরোলে ফুল ফলের বাগান। আর পেছনের বারান্দা পেরোলে শাক সবজির বাগান। ফুল ফল আর শাক সবজির বাগান দেখে নূপুরের বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। যেন এ বাগান কলকাতার কোনও বাড়ির বাগান নয়, এ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়ির বাগান। ঠিক এভাবেই তার মা বাগান করতো। ঠিক এই ফুলফল গাছগুলো, ঠিক এই সবজি শাক ছিল তাদের বাগানে। নূপুর আনমনে হাঁটে। ভোরের হাওয়া তার আঁচল উড়িয়ে নেয়, তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় বারবার। এ কি ব্রহ্মপুত্রের হঠাৎ হাওয়া! ভোরগুলো দেখতে খুব সুন্দর। নূপুর কতদিন ভোর দেখে না। চোখ বুজলেই সে যেন শুনতে পেল, পেছন থেকে বলছে যমুনা, ‘কতদিন পর এলি নূপুর। কী যে ভালো লাগছে তুই এসেছিস। গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানটা আজও করা হয়নি, তুই এলে করবো ভেবেছিলাম। আজ আমরা মুড়িভাজা আর চা খেতে খেতে অনেক গল্প করবো, কেমন? আজ অফিস যাবো না। তুই এসেছিস, তোকে নিয়ে সারাদিন। তোকে নিয়ে সারারাত’। নূপুর উঠে আসে সবজি বাগান থেকে রান্নাঘরের রেফ্রিজারেটরের দিকে। তেষ্টা পাচ্ছে তার। জল চাই। লক্ষ্য করে স্নাত, স্নিগ্ধ নির্মলা, সাদা শাড়ি কালো পাড়, কপালে কালো টিপ, মুখে স্মিত হাসি, দরজা জানালা যত আছে সব খুলে দিয়ে উঠোনে চলে গেল, ফিরে এলো আঁচল ভরে ফুল নিয়ে। রান্নাঘরের পাশে ছোট একটা পুজোর ঘরে ঢুকলো। নূপুর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে নির্মলার পুজোর ঘর, ছোট ছোট কাসার বাটি গেলাস, জবা ফুল, বেল ফুল। ছোট ছোট মূর্তি, পাশে যমুনার একটি ছবি। মূর্তিগুলোর সামনে তাজা ফুল, যমুনার ছবির সামনেও। ছবির কপালে চন্দন আর সিঁদুরের ফোঁটা। দু’হাত জড়ো করে নির্মলা মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই পুজো করাটা কিছুক্ষণ দেখে নূপুর উঠোনে গিয়ে আবার আগের মতো হাঁটে। ধর্ম টর্ম কোনওদিন মানেনি যমুনা আর তার বাড়িতেই কিনা দেব দেবীর ভিড়! নিজের গুণগান গাওয়াও সে পছন্দ করতো না, আর কি না তার বাড়িতেই তাকে পুজো করা হচ্ছে! নূপুর ঠিক বুঝে পায় না, এসব কবে হল, কী করে হল। এ বাড়ি কী করে চলবে, এ বাড়িতে ধর্মকর্ম চলবে কী চলবে না, সেই সিদ্ধান্ত কি অন্য কেউ নিত, যমুনা নিত না? যমুনা কি শেষদিকে নিজের বিশ্বাস থেকে তবে সরে গিয়েছিল?

শিউলি ফুলের গন্ধে সারা পাড়া মনে হয় মাতাল হবে। নূপুর শিউলি কুড়োয়। সেই ছোটবেলায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়িটার সামনে সবুজ মাঠটা শিউলি পড়ে সাদা হয়ে থাকতো, নূপুর আর যমুনা ভোরবেলা শিউলি কুড়োতো। শিউলি কুড়োনোর সময়ই গানের শব্দ ভেসে আসে। সূর অনুসরণ করে দোতলায় উঠে বারান্দায় বসা নির্মলার গাওয়া গানটা শুনতে থাকে। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়া, চারদিকের সবুজ আর নির্মলার ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে..’! নূপুর পাশের চেয়ারটায় বসে. যমুনার চেয়ারটায়।

গান শেষ হলে নূপুর মুগ্ধ কণ্ঠে বলে, ‘বাহ তুমি তো খুব ভালো গান গাও’।

—’একসময় শিখতাম। সেই ছোটবেলায়’।

মুখে নির্মলার মিষ্টি হাসি।

—’চর্চাটা রেখেছো’।

—’তা রেখেছি। যমুনাদির অনুরোধে গাইতে গাইতে এখন গাওয়াটা রিচুয়ালের মত দাঁড়িয়ে গেছে। যেন না গাইলে দিন শুরু হবে না। প্রায় দু’বছর এই বারান্দায় বসে সকাল সন্ধায় গাইছি। যমুনাদি ঠিক এখানে বসতো। আজ তুমি বসে আছো। তোমাদের দুজনে দেখতে এত মিল’!

—’বল কী! আমরা তো জানি কোনও মিল নেই’।

—’আমি তো মিল দেখছি’।

—’আমি আর বুবু জানতাম কোনও মিলই নেই। বাইরের লোকেরা কেন মিল পায় ঠিক বুঝি না। যাই হোক…বুবু গান তো সেই ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসতো। রবীন্দ্রসঙ্গীত। গাইতোও তো’।

—’আমি গাইলে গুন গুন করতো, কিন্তু গাইতো না’।

—’আর একটা গান গাও তো শুনি’।

—’কোনটা গাইবো বলো। তোমার ভালো লাগার একটা গান বলো।

—’ওই যে ওই গানটা গাও না। যমুনা’দির মানে বুবুর খুব পছন্দের গানটা। ‘আমি কান পেতে রই’। শান্তিদেব ঘোষের গলায় গানটা অদ্ভুত সুন্দর লাগতো। কোনও মিউজক ছাড়া গানটা। বুবু গাইতো’।

—’এটা যে কত গেয়ে শুনিয়েছি যমুনাদিকে’।

নির্মলা গাইতে শুরু করে গান। এই গান নূপুরকে আবার ব্রহ্মপুত্রের জলে সাঁতার কাটায়। গান গাইতে গাইতেই নির্মলা নূপুরের একখানা হাত হাতে নেয়। দুজনই গানের মসৃণ সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে যায় যমুনার কাছে, অন্তত এরকম মনে হয় যে পৌঁছে গেছে। মানুষ কত দূরে চলে যায়, তবু মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় দূরত্বেই বুঝি আছে।

গান শেষ হলে হাত দুটো শিথিল হয়ে আসে। নূপুর জিজ্ঞেস করে — ‘তোমার কাছে সুই সুতো আছে?’

—’কেন গো?’

—’শিউলি ফুলের মালা গাঁথবো’।

নির্মলা হেসে বলে, ‘আমার কাছে দাও, আমি গেঁথে দিচ্ছি। যমুনাও ঠিক এভাবে শিউলি ফুলের মালা গাঁথতে বলতো। তোমাদের দু’জনে মিল নেই তো কাদের মিল আছে বল?’

—’তোমার সঙ্গে মিলতো না?’ নূপুর জিজ্ঞেস করে।

নির্মলা হাসতে হাসতে বলে, ‘পাগল হয়েছো? নিজের দিদিকে চেনোনা? আমি আর তোমার দিদি দু’জন দু’মেরুর মানুষ’।

—’দু মেরুর হয়ে কী করে এতকাল একসঙ্গে থেকেছো? ঝগড়া হতো না?’

—’মোটেও না। কারণ আমরা জানতাম আমরা দু মেরুর। কেউ কাউকে কনভার্ট করার চেষ্টা করিনি’।

—’কমন গ্রাউণ্ডস কী? কিছু তো থাকতেই হয়, তাই না?’

—’আছে নিশ্চয়ই কিছু। অথবা না থাকলেও হয়তো চলে। বিশ্বাসে আদর্শে মেলে এমন লোকদের সঙ্গে দেখেছি যমুনা তুমুল ঝগড়া করছে, কিন্তু আমার সঙ্গে করছে না’।

—’সম্ভবত তুমি খুব মানিয়ে চলতে’।

নির্মলা বলে, ‘মানিয়ে চলা যদি আমার চরিত্র, তবে সে একেবারে ইনবিল্ট। এ তোমার দিদির জন্য আমি তৈরি করিনি’।

নির্মলা উঠে গিয়ে সুই সুতো নিয়ে শিউলির মালা গাঁথতে থাকে। এভাবে সে যমুনার জন্যও মালা গাঁথতো। নূপুর জিজ্ঞেস করে,

—’বুবু তোমাকে সব কথা বলতো?’

—’জানিনা সব বলতো কি না। তবে অনেক কিছুই বলতো। কেন বলো তো?’

—’না। এমনি। কতদিন চেনো বুবুকে?’

—’প্রায় ষোলো বছর’।

—’অনেক দিন’।

—’হ্যাঁ অনেক দিন’।

—’আচ্ছা তুমি বুবুকে যমুনা বলে ডাকতে নাকি যমুনাদি?’

—’কখনও যমুনা, কখনও যমুনাদি। কখনও নদী। কখনও যা ইচ্ছে’।

—’তুমি তো বয়সে বুবুর চেয়ে ছোট অনেক’।

—’তাতে কী! বয়স হল তুচ্ছ সুতো, ইচ্ছে করলে ডিঙোনো যায়। ভালোবাসায় বয়স কী গো?’

নূপুরের ঠোঁটে একটু হাসির ঝিলিক। তার ভালো লাগছে দেখতে একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার দিদিকে ভাবছে, তার জন্য কাঁদছে, তাকে ভালোবাসছে। এরকমও তো হতে পারতো যে নূপুর খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখতে পেলো যমুনার খুব নিঃসঙ্গ জীবন ছিল, কেউ ছিল না ভালোবাসার, কেউ ছিল না পাশে বসার, দুটো কথা বলার, হাতে একটু হাত রাখার। যমুনা মরে পড়ে আছে, শরীর পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। পুলিশের জমাদার এসে কোথাও শরীরটা ফেলে দিয়ে আসছে। ভালোবাসা খুব চমৎকার জিনিস। চোখ বুজলেও নিশ্চিন্তে চোখ বোজা যায়। কেউ একজন রইলো আমার, এই অনুভূতিটা, নূপুর জানে, না থাকাটা কী রকম শ্বাসরুদ্ধকর।

 নিজের শরীরটা যেমন ঝকঝকে, বাড়িঘর উঠোন বারান্দাও তেমন ঝকঝকে করে রাখছে নির্মলা। অবচেতনে তারও বোধহয় নূপুরের মতো বিশ্বাস হয়, যমুনা আছে, কোথাও না কোথাও আছে, হয়তো গেছে ঘরের বাইরে, ফিরে আসবে, ঠিক এক্ষুণি ফিরে না এলেও ফিরে আসবে। নির্মলাকে নিয়ে বোধহয় বেশ সুখে ছিল যমুনা, নূপুর ভাবে। কেউ একজন কাছে আছে, যে ভালোবাসে, এর চেয়ে বড় আর কী আছে একটা জীবনে? কাছে তো কত কেউ থাকে। নূপুরের কাছে দীর্ঘকাল তো শওকত ছিল! তার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো। যে ভালোবাসে না, তার সঙ্গে এক বাড়িতে এক ঘরে বছরের পর বছর কাটানোর মতো ভয়ংকর আর কিছুই নয়।

—’অনেকদিন কথা হয়নি আমাদের’।

 পায়রার ওড়াওড়ির দিকে, গাছের পাতার নাচের দিকে নূপুর তাকিয়ে থাকে উদাস। শিউলি ফুলের মালাটা নূপুরের হাতে দিয়ে নির্মলা বলে, —’আমার মনে হয় একটু অভিমানও ছিল তোমার ওপর। অনেকদিন জিজ্ঞেস করেছি, নূপুরের সঙ্গে কথা হয়েছে? বলতো, নাহ, ও ব্যস্ত মানুষ। ওর কি আমার সঙ্গে কথা বলার সময় হবে! একবার ফোন করলেই তো পারো, না হয় ব্যস্ত, তাতে কী, তোমার সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলার সময় হবে না? একটা মানুষ কি চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে! তোমার চেয়ে ব্যস্ত লোক তো আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। নূপুর তোমার চেয়েও বেশি ব্যস্ত? —আমি বলেছি। কিন্তু যমুনা’দি কি আমার কথা কখনও শুনেছে! নিজে যা ভালো বুঝেছে, করেছে। আমার ওই কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, চিকি, আমার ডাক নাম চিকি, ভয়ে করি না, যদি বলে দু’মিনিট সময় হবে না’।

—আসলে আমাদের বেশিরভাগ কথা শেষদিকে ইমেইলেই হত। আর বছর পাঁচ আগে আমার জীবনে ওরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর..। জানো তো নিশ্চয়ই। জীবনটা ভীষণ পাল্টে গেছে।

নূপুরের একটা হাত নির্মলা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে একটুখানি উষ্ণতা ছড়িয়ে বলে,— জানি।

—কী জানি বুবুর পুরোনো নম্বরগুলো পাল্টে গিয়েছিল কি! ফোন করেছিলাম কি এর মধ্যে? হয়তো পাইনি।

—যমুনাদি তো পুরোনো নম্বর পাল্টায়নি। আগের নম্বরই সব ছিল, এখনও আছে। ল্যান্ড, মোবাইল।

—ও। তাহলে জানিনা কেন।

অপরাধবোধের একটা কালো চাদর আচমকা নূপুরকে আপাদমস্তক ঢেকে দেয়। বড় একা বোধ করে সে। শিউলির সুঘ্রাণটুকু শুধু থাকে সঙ্গে।

যমুনা অফিসের কাজে আমেরিকায় বেশ কয়েকবার গেছে। যতবারই গেছে, নূপুরের সঙ্গে দেখা না করে আসেনি।

—তুমি তো একবার গেছ ত্রিবান্দ্রামে। সোলার পাওয়ার প্রজেক্টের জন্য কাজ করতো যমুনাদি। ওখানে তো সোলার পাওয়ারের ওপর একটা পিএইচডিও করছিল।

—বাহ তুমি তো দেখি সব জানো।

—সব জানি না। যতটুকু বলতো ততটুকু। সব বলতো কি?

—’আচ্ছা, কেরালায় একটা ক্রিশ্চান লোক, অদ্ভুত একটা নাম ছিল, সোজো ভারুগিজ, ওকে তো বোধহয় বিয়ে করেছিল বুবু। একবার বলেছিল, এ দেশের সিটিজেন না হওয়ার কারণে নাকি কী সব অসুবিধে হচ্ছে, তাই বিয়ে করে যদি সিটিজেনশিপ নিতে হয়, তাই নেবে। বুবুর সিটিজেনশিপটা বোধহয় ওই বিয়ের কারণে। জানি না, আমার মনে হয়েছিল, বিয়েটা অনেকটা কনট্রাক্ট ম্যারেজের মতো। সেই কবেকার কথা! তখন তপু ছোট। আর জয়ের তো জন্মই হয়নি’।

বিয়ের পর আমেরিকা থেকে শওকত আর নূপুর যখন বাংলাদেশে প্রথম বেড়াতে এল, নূপুরের একটাই দাবি ছিল তখন, সে ভারতে তার বুবুকে আর তপুকে দেখতে যাবে। শওকত আপত্তি করেনি, নিজেই টিকিট করে দিয়েছিল, বিমান বন্দরে পৌঁছেও দিয়েছিল। ত্রিবান্দ্রামে একা একা চলে গিয়েছিল নূপুর। ক’টা দিন নূপুরকে রানীর আদরে রেখেছিল যমুনা।

নির্মলা হেসে বলে—’হ্যাঁ তা ঠিক। ভালই করেছিল। সিটিজেনশিপটা তাড়াতাড়ি করে নিয়েছিল বলে অত ভালো চাকরি করতে পেরেছে। কলকাতায় তো অগ্নি পাওয়ার যমুনাদির হাতেই গড়ে উঠেছে’।

—’তাই বুঝি?’

—’বলেনি তোমাকে?’

নূপুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হয়তো বলেছিল, ঠিক মনে নেই।

দুজনই ওঠে। দুজনেরই চায়ের তেষ্টা পায়। চা নিয়ে দুজনই যমুনার শোবার ঘরে ঢোকে। বড় খাট। সাদা চাদর বিছানো, বালিশের কভারগুলোও সাদা, সুন্দর। হালকা নীল সুতোর কাজ করা। ঘরে অনেকগুলো বড় কাঠের আলমারি। খাটের পাশে ছোট টেবিল। টেবিলে উঁচু হয়ে আছে বই। বসার ঘরের বইয়ের তাকগুলোয় রাশি রাশি বই। এত বই কখন পড়তো যমুনা! নির্মলা শোবার ঘরের আলমারিগুলো খুলে দেখায় নূপুরকে।

 ‘যমুনাদির কাপড়চোপড় সব এখানে। সব সময় তো শাড়িই পরতো। শাড়িই বেশি। তাছাড়াও কত যে তার রাজ্যির টুকিটাকি জিনিস আছে, অত আমি বুঝিও না। কোনও শাড়ি পছন্দ হলে তুমি পরতে পারো’। নূপুর ম্লান হেসেছে। যমুনার শাড়ি কত পরেছে নূপুর। ঢাকায়, ত্রিবান্দ্রামে, কলকাতায় সবখানেই। কখনও মনে হয়নি অন্যের শাড়ি। কোনওদিন কোনও অনুমতি নেয়নি পরতে গিয়ে। যমুনার জিনিসপত্রে নূপুরের অধিকার সেই শেশব থেকেই ছিল। জিনিসপত্র পড়ে থাকে, মানুষ চলে যায়। নূপুরের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, যে, যমুনা সত্যি সত্যি চলে গেছে।

 নূপুর যমুনার বিছানাতেই শুয়েছিল কাল। চায়ে চুমুক দিয়ে বিছানায় বসে, পিঠের পিছনে বালিশ দিয়ে, হেলান দিয়ে দেয়ালে, নূপুর বলে, ‘তোমার ঘরটা কোথায়, পাশেরটা?’

—’এই ঘরটাই আমাদের দুজনের শোবার ঘর’।

—’তোমরা এক বিছানায় শুতে?’

নির্মলা জোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে —’তাহলে কি দু’বিছানায় শোবো?’

নির্মলার নির্মল হাসি ঝিলমিল করে।

—’না, আসলে বুবু তো অন্য কারও সঙ্গে শুতে পারতো না’।

—’কে বললো শুতে পারতো না। বেশ পারতো!’

নূপুর বলতে গিয়েও বলেনি যে তপু যখন ছোট, যমুনা তপুকে নিয়েও শোয়নি। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টায় সে। কারণ নির্মলার অমন হাসি নূপুরকে এক শরীর অস্বস্তি দেয়।

—’বুবু ওই ত্রিবান্দ্রামের লোকটার কথা আমাকে খুব বেশি বলতো না। হঠাৎ করে শুনি সম্পর্কটা নেই’।

নির্মলা বললো, ‘বিস্কুট খাবে? একেবারে খালি পেটে চা খাচ্ছো, একেবারে দিদির মতো। তুমিও দুধ চিনি কিছু নাও না চায়ে। যমুনা ঠিক এরকম। আমার চায়ের সঙ্গে বিস্কুট না হলে চলে না। যমুনাদিকে কখনো দেখিনি বিস্কুট খেতে’।

 —ত্রিবান্দ্রামের ওই সোজোর কথা বলতো তোমাকে কিছু?

নূপুরের মনে পড়ে সেই দিনগুলো। সোজো ছুটে এসেছিল যমুনার বোন এসেছে শুনে! কত কোথাও যে ঘুরে বেড়িয়েছে তিনজন। যমুনা আর সোজোর মধ্যে সম্পর্কটা নূপুর যতটুকু বুঝেছিল, বন্ধুত্বের। দু’জনে ফিজিক্সের পিএইচডি। বড় কোম্পানীতে ছিল, সোলার এনার্জি নিয়ে গবেষণা করছিল দুজন।

—’বিয়েটা কেন করেছিল, আদৌ করেছিল কি না, কে জানে! নাকি প্রেম করতো, প্রেমের বিয়ে?’

 নির্মলা চায়ের খালি কাপ দুটো তুলে নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এসে বলে—’করেছিল বলেই তো জানতাম। পুরোনা জিনিস ঘাঁটার দরকারটা কী! এ দেশের কোথায় ছিল না ছিল কী করেছে না করেছে এ নিয়ে আমাকে ডিটেইলস কিছু বলেনি। সোজার কথা অত হত না। বলতো, খুব স্ট্রাগল করেছি। কাউকে যদি বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তবে তো তা স্ট্রাগলের মধ্যেই পড়ে’।

নূপুর বলে—’দুজনে কিন্তু চমৎকার বন্ধু ছিল। ওরকমই তো দেখেছি। এক সপ্তাহ ছিলাম। সোজো কিন্তু বুবুর সঙ্গে সারাদিন কাটাতো কিন্তু রাতে থাকতো না। প্রেম ট্রেম করলে নিশ্চয়ই থাকতো’।

অনেকক্ষণ দুজনই চুপচাপ। নির্মলা বলে—’চান টান করো, কিছু ব্রেকফাস্ট করবে তো’।

এক টান টান যুবতী টানা টানা চোখ বাড়িতে ঢুকে বাসন মাজা আর ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজ করতে শুরু করে। উঁকি মেরে বারবার দেখে নূপুরকে। নির্মলাকে জিজ্ঞেস করে, ‘যমুনাদির বোন বুঝি?’

নির্মলা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো লুচি আর বেগুনভাজা নিয়ে।

—বিছানায়?

—আমরা তো ব্রেকফাস্ট খাটে বসেই করতাম।

—ও। কী খেতো বুবু?

—কোনোদিন লুচি আলুর দম, কোনোদিন পরিজ, কোনোদিন রুটি বেগুনভাজা, কোনোদিন কর্নফ্লেক্স, কোনোদিন কিছুই না।

—কোনোদিন কিছুই না?

— কিছুই-না-টাই আসলে বেশি চলতো।

—তুমি বানাতে ব্রেকফাস্ট?

—কোনওদিন আমি। কোনওদিন যমুনা। তবে আমিই বেশির ভাগ করতাম। আমার রান্নার বেশ প্রশংসা করতো।

—তারপর?

—তারপর তো হুড়মুড় করে উঠে যমুনা চলে যেত অফিসে। আর আমি রান্নাবান্না সেরে, ভাত খেয়ে তারপর অফিসের দিকে রওনা হই। যমুনা নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে যেত। আমি ট্যাক্সিতে, কখনও অটোতে, বাসে।

—কেন ড্রাইভার তো তোমাকেও অফিসে পৌঁছে দিতে পারতো?

নির্মলা হেসে বলে, ড্রাইভার ছিল না। অবশ্য অনেক আগে ছিল একটা। একটা পাঁড় মদ্যপ। আমার ভয় হত। আমিই যমুনাকে বলে বলে ড্রাইভার ছাড়িয়েছি। যমুনা তাই নিজেই চালাতো। আর আমার অফিস তো খুব বেশী দূরে নয়। মাত্র পনেরো মিনিটের পথ।

—তুমি গাড়ি চালাও না?

—না গো। শেখা হয়নি। সন্ধেবেলা বাইরে বেরোলে যমুনাই চালায়। চালাতো।

—খুব যেতে বাইরে?

—অনেকটা আমার কারণেই যেতে হত। কোথাও ভালো গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে, আমি যাবোই। ভালো নাটক হচ্ছে, যাবো। অবশ্য যমুনা ঘরে বসে বই টই পড়তেই পছন্দ করতো বেশি।

নূপুর হাসে। আবার ভেতরে কষ্টও হয়। নিজের বোন কী ছিল কেমন ছিল তা শুনতে হচ্ছে অচেনা এক মানুষের কাছে।

 লুচি আর বেগুনভাজা বেশ সুস্বাদু। খেতে খেতে নূপুর জিজ্ঞেস করে, ‘বাংলাদেশে কেন যেত না তোমার যমুনাদি, কিছু বলতো ?’

—’তেমন কিছু বলতো না। বলতো, ও দেশে তার কেউ নেই। তুমি আছো, কিন্তু তুমি তো আর দেশে ছিলে না।

—আর কিছু বলতো না, যেমন ধরো তপুর বাবার কথা?

—তপুর বাবার সঙ্গে যে বিয়ে হয়নি বলেছে।

—আর কিছু বলেনি?

—আর কী বলবে?

—তপু ওর বাবার কথা জানতে চায়?

নির্মলা ভুরু কুঁচকে বলে, বাবা? হঠাৎ বাবা এল কোত্থেকে?

—কেন, আসতে পারে না বুঝি? নূপুর বলে।

— তপু ছোটবেলায় জানতে চেয়েছে কী না সে জানিনা। আমি যদ্দিন থেকে আছি, শুনিনি। যমুনা একবার বলেছিল, ছোটবেলা থেকে বাবা বাবা বলে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে না দিলে ওদের কোনও কৌতূহল জন্মায় না বাবা জিনিসটাকে দেখার জন্য।

—যমুনাদি কিছু বলতো না তোমাকে? ধরো, তপুর বাবা যে বেঁচে নেই, সে কথা?

—বেঁচে নেই বুঝি?

 নির্মলা উঠে চলে গেল হঠাৎ। কাজ করছে মেয়েটির সঙ্গে কী কী সব রান্না বান্না কাটা বাটা নিয়ে কথা বলে ফিরে এলো। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, তপু কোনোদিন ওর বাবার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। বাবা কে ছিল, কেমন ছিল, বাবাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে এমন আবদার কখনো করতে শুনিনি।

—হ্যাঁ, সে তো বলেছোই। মাথা আসলে বাড়িতে খারাপ না করলেও ইস্কুল টিস্কুলের বন্ধুরাই তো খারাপ করতে পারে। প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করতে পারে, আমাদের তো বাবা আছে, তোমার বাবা নেই কেন!

নির্মলা কোনও উত্তর দেয়না।

নূপুর ভাবতে থাকে, তপু কী করে মনে রাখবে তার বাবাকে। তপুর তখন দেড় বছর বয়স যখন সে তার বাবাকে শেষ দেখেছে। মনে থাকলেও কোনও টান থাকার কথা নয়। ইস্কুলে আর বাড়িতে এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলে হয়তো বাবা বলে কিছুর অস্তিত্বও আর শেষ অবধি থাকে না।

 যমুনা আর পাশার আশ্চর্য প্রেমের দিনগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখতো নূপুর। কিন্তু প্রেম সত্যিই মরিচিকার মতো। এই আছে মনে হচ্ছে, আসলে কিন্তু নেই। নূপুরকে বাচ্চা দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যমুনা। বাবা মা নূপুরকে যেতে দিতে চায়নি। অবিবাহিত মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে, আবার নির্লজ্জের মতো প্রসবও করেছে, আবার আত্মীয় স্বজনকে ডাকাডাকিও করছে বাচ্চা দেখতে! নূপুর যেদিন ঢাকায় বোনের কাছে যাবে বলে আবদার করেছিল, ‘এ কেমন মেয়ে গর্ভে ধরেছিলাম’ — মা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল। বাড়িসুদ্ধ লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করে যমুনার মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল নূপুর। যদিও বাবা মা রাগ দেখাতো, হেন অপমানজনক কথা নেই যে বলতো না, কিন্তু তারপরও নূপুর ভালো করেই জানতো ওরা দুজনই চায় যমুনার প্রয়োজনে নূপুর যমুনার কাছে যাক। যমুনা সমাজের নিয়ম-না-মানা-মেয়ে, মেধাবী-বুদ্ধিমতী-মেয়ে, এ মেয়ে নিয়ে সমাজে মুখ দেখানো যেত না, কিন্তু এ মেয়ে নিয়ে ভেতরে ভেতরে গর্ব করা যেত। গর্ব করতো ওরা, অবশ্য কিছুই বুঝতে দিত না যমুনাকে। বাবা মা’র ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করেছিল, অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেই পাত্রকে শীঘ্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল যমুনা। যমুনার বাবা মা’ও জানে যে এ ছাড়া যমুনার আর করার কিছু ছিল না। সে ঠিক কাজটিই করেছিল। একটা অত্যাচারী পাষণ্ডকে ত্যাগ না করে উপায় ছিল না। এরপর বাবা মা যা চেয়েছিল, তা হল দেখেশুনে একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ের পিঁড়িতে বসা। কিন্তু কোনও পিঁড়িতে বসতে যমুনা আর রাজি ছিল না। বলতো ‘আমি যে গদির চেয়ারটায় বসে আছি, সে চেয়ারটাতেই বসে থাকবো, চেয়ার ছেড়ে গিয়ে নিচু পিঁড়িতে আমাকে আর বসতে বলো না। অত নিচে নামতে আমি আর পারবো না’। নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে ভাঙা, তারপর যার সঙ্গে ইচ্ছে করে তার সঙ্গে থাকা, শেষ অবদি চূড়ান্ত অন্যায় করলো, এরই হয়তো বাকি ছিল, সন্তান জন্ম দিল অবিবাহিত মেয়ে। পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করো, কিন্তু শরীর নিয়ে এসব চলবে না, এই হল যমুনার আত্মীয় স্বজনের বক্তব্য। যমুনার বক্তব্য ছিল, ‘এ আমার শরীর, আমি আমার শরীর নিয়ে কী করবো না করবো সে আমি বুঝবো। এ শরীরের ওপর অধিকার আমার, অন্য কারওর নয়’। পাশা ছিল তপুর বাবা, কিন্তু পাশা যমুনার স্বামী ছিল না। এই সত্য নূপুরকে গুটিয়ে রাখতো ভয়ে, বিভ্রান্তিতে। যমুনা তাকে কত কিছু যে বলতো, বলতো, ‘মেয়েরা কারও সম্পত্তি নয়, পুরুষের সম্পত্তি নয়, সমাজের সম্পত্তি নয়। আমি কার সঙ্গে শোবো— সে সিদ্ধান্ত আমার পরিবার নেবে, আমার প্রতিবেশি নেবে, সমাজের একশ একটা বদমাশ লোক নেবে, নাকি আমি নেব? আমি নেব। আমি প্রেগনেন্ট হব কি না, কটা বাচ্চা হবে আমার, ছেলে নেব না মেয়ে নেব, সে সিদ্ধান্ত আমি নেব, অন্য কেউ নয়’। নূপুর মন দিয়ে শুনতো যমুনার কথা। কিছু বুঝতো, কিছু আবার বুঝতো না। কত আর তখন বয়স ছিল নূপুরের!

‘আমার একার ওভামে হবে না, ঠিক আছে স্পার্ম নিয়েছি। কিন্তু যে লোকের স্পার্ম নিলাম, তার অধিকার কী কারণে আমার বাচ্চার ওপর আমার চেয়েও বেশি হবে? আমি ন’মাস কষ্ট করে পেটে রেখে যে বাচ্চাটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হওয়ালাম, সে বাচ্চা কেন হঠাৎ করে তার বাচ্চা বনে যাবে? আমার বাচ্চা আমার নামের টাইটেল পাবে, অন্য কারোর নয়’।

যমুনা আবার নূপুরকে বুঝিয়ে বলে, ‘ভাবিস না যেন যে পাশা বাচ্চার ওপর অধিকার দাবি করছে। সেটা করছে না। আমি চাইছি, এ বাচ্চা আমার বাচ্চা বলে পরিচিত হোক। কারও অত নাক গলানোর দরকার নেই বাচ্চার বাবা কে, এ নিয়ে। বাচ্চার বাবাকে যদি বিয়ে করতাম, যদি মনে করতাম বাচ্চার বাবা মা দুজনে বাচ্চাকে বড় করবো, মানুষ করবো, তাহলে কথা ছিল। পাশাকে অনেক আগেই বলে রেখেছি, যে, আমি একটা বাচ্চা নেব, সেই বাচ্চার ওপর পাশার কোনওরকম দাবি বা কিছু থাকবে না। বোঝাতে পারলাম তোকে?’ যমুনা জিজ্ঞেস করতো। নূপুর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতো।

নামটা নূপুরই রেখেছিল, তপু। কী কারণে তপু নামটা নূপুরের পছন্দ হয়েছিল, এখন আর মনে নেই। তপন বা তপু নামের কোনও একটা ছেলেকে কি তার ভালো লাগতো? হয়তো লাগতো। নূপুরকে শুধু ডাক নাম নয়, ভালো নামও রাখতে বলেছিল যমুনা। তপুর ভালো নাম তপস্যা চৌধুরী। যমুনা নূপুরের দেওয়া নামই পছন্দ করেছিল।

যমুনার কলাবাগানের ফ্ল্যাটটা তখন নূপুরের বাড়িঘর হয়ে উঠেছিল। ময়মনসিংহ থেকে প্রায়ই চলে আসতো। দু’তিন মাস পর এমন হয়েছিল যমুনার কাছেই থেকে গিয়েছিল নূপুর। খুব প্রয়োজন না হলে ময়মনসিংহে যেত না। তপুকে নূপুরের কাছে রেখেই যমুনা আপিসে যেত। তপুকে খাওয়ানো, স্নান করানো, গল্প শোনানো, ঘুম পাড়ানো, যা কিছু করার, নূপুরই করতো। নূপুর ছিল বিরাট এক ভরসা যমুনার জন্য। কী নিশ্চিন্তে তপুকে লালন পালনের দায়িত্ব নূপুরকে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতো যমুনা! অনেকটা মা’র কাছে বাচ্চা রাখার মতো।

তপু জন্মাবার পর আগের মতো না হলেও পাশা আসতো যমুনার ফ্ল্যাটে। নূপুর লক্ষ্য করেছে পাশার সঙ্গে তখন প্রায়ই ঝগড়া হচ্ছে যমুনার। যমুনা পাশাকে বলতো তপুকে যেন কোলে না নেয়। বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তপুকে জোর করে কোলে নিত। নূপুর বলতো, ‘এমন করো কেন বুবু, পাশা ভাই তো তপুর বাবা। বাবাকে তো এভাবে বঞ্চিত করা উচিত নয়’।

‘যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না’। যমুনা জোরে ধমক দিত নূপুরকে।

‘কী জানি না?’ জিজ্ঞেস করলে যমুনা বলেছে, ‘ও যেন কেমন করে কোলে নেয় তপুকে, দেখলে মনে হয় ওর হাত থেকে পড়ে যাবে তপু। বাচ্চা যে জীবনে কোনোদিন কোলে নেয়নি, তা তো নয়। নিয়েছে। তবে তপুর বেলায় এত হেলাফেলা কেন!’

 নূপুর লক্ষ করেছে যে যমুনা পাশার জন্য পাগল ছিল, সেই যমুনাই ধীরে ধীরে চাইছে না যমুনার ফ্ল্যাটে অত ঘন ঘন পাশা আসুক, বা রাত কাটাক। সন্ধেটা কাটাতো প্রায়ই। কিন্তু একসময় মনে হতে যমুনা ওই সন্ধেটাও চায়নি। চেয়েছে আপিস থেকে ফিরে পাশাকে নিয়ে নয়, নূপুর আর তপুকে নিয়ে সময় কাটাতে।

নূপুর জানতো না যে পাশা শুধু প্রেম করতে চেয়েছিল যমুনার সঙ্গে, কিন্তু বাচ্চা জাতীয় কোনও জিনিস সে চায়নি। যমুনার বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই পাশা চেঁচামেচি করছিল। নূপুর জানতো না যে পাশা বলতো, —’পেটের জিনিসটা দূর করো যমুনা। পরে প্রব্লেম হবে’। নূপুর জানতো না যে যমুনা পাশাকে বলতো, —’অশিক্ষিতের মতো কথা বলো না। পেটের জিনিস মানেটা কি? দূর করো মানে? বলো, অ্যাবরসন করো’। পাশা বলতো, আদর করে বলতো, ধমক দিয়ে বলতো, —’অ্যাবরসন করো’।

—’না, আমি অ্যাবরসন করবো না। কেন করবো অ্যাবরসন?’

—’বিয়ে হয়নি। জারজ সন্তান। এসব। সমাজটাকে তো চেন’।

—’চিনি। খুব ভালো চিনি। তুমি পুরুষ হয়ে কত আর চেন! সমাজটাকে বেশি চেনা যায় মেয়ে হলে। তুমি তো আর মেয়ে নও। সমাজটা কী, তা আমাকে বলো না। তোমার চেয়ে বেশ ভালো জানি। আর জেনেই আমি এই বাচ্চাটা উইদাউট ওয়েডলক নিচ্ছি, সো কল্ড জারজ বাচ্চা, জেনেশুনেই নিচ্ছি’।

—’দুনিয়াসুদ্ধ তো বলে বেড়াবে এ বাচ্চার বাবা আমি’।

—’সে নিয়ে ভয় পাওয়ার তোমার দরকার নেই। আমি কোথাও বলবোনা তোমার কথা। এ আমার বাচ্চা। এটা যে মানবে, সে মানবে। যে মানবে না, তাকে জোর করে মানাতে যাবো না আমি। হ্যাঁ এ বাচ্চা তৈরিতে তোমার অবদান আছে। কিন্তু যেহেতু তুমি ম্যারেড, তুমি চাও না এক্সপোজড হতে। তুমি দুনিয়াকে দেখাতে চাও তুমি একটা ফেইথফুল হাজবেণ্ড। বাট ইউ আর এ প্রমিসক্যুয়াস ম্যান। ইউ চিট অন ইওর ওয়াইফ। তুমি মেয়েদের এক্সপ্লয়েট করো। আমার একটা বাচ্চার শখ ছিল, আমি নিচ্ছি। তোমার সঙ্গে সম্পর্কটা থাকার কারণে এটি হতে পেরেছে। তোমার বাচ্চার শখ নেই। তোমার অলরেডি দুটো বাচ্চা আছে। সুতরাং তুমি চেয়েছো একে অ্যাবরসন করাতে। আমি করবো না অ্যাবরসন। এ বাচ্চার ওপর তোমার অধিকার নেই। আমি একে বড় করবো, মানুষ করবো। আমাকে বিরক্ত করো না। আমি তোমার মিসট্রস নই। এ বাচ্চা তোমার নয়। এ বাচ্চা আমার। লীভ মি এলোন’।

পাশা ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিতে দিতে বলেছে, ‘তুমি আসলে একটা মান্ধাতার আমলে বাস করছো। মেয়েদের রাইটস-এর কথা বলো, অ্যাবরসন রাইটস যে মেয়েরা বিদেশে কত আন্দোলন করে পেয়েছে, তা জানো? বেশ একেবারে নারীবাদীর ভাব দেখাও। নারীবাদের কিছুই জানো না’।

যমুনা বলেছে, —’দেখ, আমি কিন্তু অ্যাবরসনের বিপক্ষের মানুষ নই। মেয়েদের যখন ইচ্ছে তখন অ্যাবরসন করার অধিকারের ভীষণ পক্ষে। আবার যখন ইচ্ছে তখন অ্যাবরসন না করার অধিকারের পক্ষেও’।

যমুনা জেদ করেছে অথবা ইচ্ছে করেছে অথবা শখ করেছে, বাচ্চা সে নিয়েছে। পাশার বাধা যমুনার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে কোনও সাহায্য তো করেইনি, বরং সিদ্ধান্তে যমুনাকে আরও অটল করেছে। এই শিশু না জন্মালে কারও কোনও ক্ষতি হত না, মানব প্রজাতির টিকে থাকায় কোনও ব্যাঘাত ঘটতো না। পৃথিবীতে অগুনতি শিশু আছে। লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিবছর শুধু খেতে না পেয়েই মরে যাচ্ছে। যমুনা কোনও একটা শিশুর দায়িত্ব নিতে পারতো। কিন্তু তারপরও অবিবাহিত অবস্থায় বাচ্চা সে নিয়েছে। আত্মীয়দের প্রায় সবার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে হলেও নিয়েছে। এ কি কেবলই জেদের কারণে নাকি ‘মেয়েদের শরীর নিয়ে মেয়েরা কী করবে, তার সিদ্ধান্ত মেয়েরাই নেবে’এই মতকে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার কারণেই যা করার সে করেছে!

নূপুর প্রায় দেড় বছর ছিল যমুনার বাড়িতে। একাই তখন ছিল সে যমুনার মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন। নূপুর ছাড়া তপুকে যমুনার পরিবারের আর কেউ দেখেনি। কারও দেখতে ইচ্ছেও হয়নি। নাইম ঢাকা শহরেই ছিল। নাইমের বাড়িতে প্রয়োজনে যেত সে। নাইম জানতো যমুনার বাচ্চা হয়েছে, নূপুরই বলেছিল। শুধু ছি ছিই করেছে। নাইমের বউও ছি ছি করেছে। দু’জনের এই ছি ছি শুনতে শুনতে নূপুর ওদের চৌহদ্দি থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালায়। যমুনার বাড়িতে ফিরে সে প্রাণ ফিরে পায়। এ বাড়িতে তার অধিকার তার বাবার বাড়িতে তার যত অধিকার তার চেয়েও বেশি। এ বাড়িতে সে তার বন্ধু বা বান্ধবীকে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, আপ্যায়ণ করতে পারে। এ বাড়ি থেকে যখন খুশি যেখানে খুশি যেতে পারে, কাউকে কোনও কৈফিয়ত দিতে হয় না। বাবার বাড়িতে এসবের অনেক কিছু সম্ভব নয়।

নূপুর টের পেত দিন দিন পাশার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে যমুনার। যমুনা উতলা হচ্ছে না পাশা এলে। বরং যখন সন্ধেটা কাটাচ্ছে দুজন, ঘরে বা বারান্দায়, গলার স্বর দুজনেরই চড়া হচ্ছে। চিৎকার বাড়ছে দিনদিন। একদিন নূপুর শুনতে পেলো যমুনা বলছে,—’জন্মের আগেও ছিল রাগ, জন্ম নেওয়ার পরও তোমার রাগ মেয়েটার ওপর, এ জন্মালো কেন। দেখতে তোমার মতো হল কেন। তপুকে তুমি পারলে মেরে ফেলবে। তোমার কাছে তপুর জীবনের চেয়েও, আমার জীবনের চেয়েও বড় তোমার সংসার, তোমার চাকরি, তোমার সমাজ, তোমার বিচ্ছিরি হিপোক্রেট দুনিয়া। লীভ মি এলোন পাশা। আই ডোন্ট লাভ ইউ এনিমোর’।

পাশা মেজাজ খারাপ করে চলে যেতো। কিন্তু দুদিন পর আবার আসতো।

যমুনার শোবার ঘরের দেয়ালে বড় একটা বাঁধানো ছবি, নূপুরের কোলে তপু। সেই তপু যাকে জন্মের পর আদর দিয়ে আহ্লাদ দিয়ে বড় করছিল নূপুর। তপুর বয়স তখন এক। ঘটা করে জন্মদিনের উৎসব হয়েছিল। জন্মদিনে যমুনা বিশ্বাস করে না। উৎসব নূপুরের ইচ্ছেয় হয়েছিল। নূপুর আর যমুনার কাছের ক’জন বন্ধু এসেছিল। আত্মীয়দের কেউ ছিল না। বেশির ভাগ বন্ধুই জানতো, পাশা তপুর বাবা, এবং পাশার সঙ্গে হয় গোপনে যমুনার বিয়ে হয়ে গেছে, অথবা না হয়ে থাকলে যে কোনও একদিন হয়ে যাবে। শহরের আনাচে কানাচে বিবাহিত পুরুষগুলোর গোপন কিছু স্ত্রী থাকাটা যে অস্বাভাবিক কিছু নয়, তা ভদ্রলোক-অভদ্রলোক সবাই জানে। জন্মদিনের উৎসবে নূপুরের সঙ্গে তপুর প্রচুর ছবি তুলেছিল যমুনা। ছবিগুলো নূপুরের কাছেই থাকার কথা। কোথায় সেই অ্যালবাম! কে জানে কোথায়! যমুনা তো সব ফেলে দেশ ছেড়েছিল। নূপুর অনেক কিছু সঙ্গে নিয়েছিল, কিন্তু ছবির অ্যালবাম নেয়নি। ছবির অ্যালবাম তাহলে যমুনাই নিয়েছিল। আগে কখনও যমুনার বাড়িতে নূপুর দেখেনি এই ছবি। যমুনা যদি এই ছবিটিকে না রাখতো বাঁধিয়ে, তাহলে হয়তো মনেও পড়তো না সেই জন্মদিনের উৎসবের কথা। সেদিন জন্মদিনে, নূপুরের মনে আছে, সারাদিন পর রাত বারোটা পার করে পাশা একেসছিল, খালি হাতে। খালি হাতে বলে যমুনা অসন্তুষ্ট হয়নি, হয়েছিল নূপুর। ‘পাশা ভাই, সারাদিন আপনার এখানে আসার সময় হল না। বার্থডে পার্টি তো শেষ। আপনার জন্য আমরা সবাই ওয়েট করলাম। তপুকে উইশ করবেন না?’

পাশা গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘যমুনা কোথায়? নেই নাকি?’

—’থাকবে না কেন? ঘুমিয়েছে বোধহয়। খালি হাতে এসেছেন? তপুর জন্য কোনও গিফট নেই?’

পাশা যমুনার শোবার ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কথা বলতে থাকে। কী বলতে থাকে কে জানে। তপুর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে নূপুর তপুকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

 ছবিটির দিকে তন্ময় তাকিয়ে থাকতে থাকতে নূপুর ভাবে, এই তপুকেই সে হাঁটতে শিখিয়েছিল, কথা বলতে শিখিয়েছিল। তপু তখন তার মা’র চেয়েও বেশি আপন নূপুরের। নূপুরকেই আঁকড়ে থাকতো। নূপুরের সঙ্গেই ঘুমোতো। যমুনা বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে ঘুমোতে পারতো না। মাঝে মাঝে নূপুরের মনে হত, বুঝি যমুনার নয়, তপু তারই মেয়ে, তারই গর্ভজাত সন্তান। চোখ ভিজে ওঠে নূপুরের। টুপ টুপ করে সুখের সেই সব স্মৃতি আর চোখের জল ঝরতে থাকে।

যখন এ ঘরে প্রথম ঢুকেছিল নূপুর, আরও একটি ছবির দিকে চোখ গেছে। নূপুর আর যমুনা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আছে। দু’জন হেসে গড়িয়ে পড়ছে. সেইসব কৈশোরের আর যৌবনের ছবিও এঘরে বা ওঘরে বাঁধানো, দেয়ালে ঝুলছে নয়তো টেবিলে দাঁড় করানো।

 নির্মলা পেছনে এসে দাঁড়ায়, ভারী গলায় বলে, ‘শোনো নূপুর, গণদর্পণের লোক এসেছে। যমুনা’দির ডেডবডিটা ওরা নেবে। তোমার সঙ্গে কথা বলবে, যাও ওরা নিচে বসে আছে’।

—’হুঁ। যাচ্ছি’।

যাচ্ছি বলেও আর যায় না নূপুর। স্মৃতির দোলনায় ভয়ানক দুলতে থাকে। ভুলে যায় নিচে কেউ বসে আছে, তাকে যেতে হবে কথা বলতে। কথা সব নির্মলাই বলতে পারতো। কোনও হয়তো দরকারই ছিল না নূপুরের কোনও সিদ্ধান্তের। কিন্তু তপু তাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছে। ঠিক যেমন যমুনা দায়িত্ব দিয়েছিল নূপুরকে, তপুর জন্য যা কিছু করার করতে। আজ তপু তাকে দায়িত্ব দিল যমুনার জন্য যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিতে। ছাব্বিশ বছর পর আবার সেই দায়িত্ব কাঁধে। নূপুরের ভালো লাগে দায়িত্ব নিতে। তাকে কখনই কারও দায়িত্ব নিতে হয়নি। চেয়েছিল নিতে, কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি কোনো দায়িত্ব। নিজের ছেলের দায়িত্ব অন্যরাই নিয়েছে, তারই নেওয়া হয়নি। নূপুর বোঝে না, নূপুর বুদ্ধিহীন, নূপুর নষ্ট করে ফেলবে, এসবই শুনে এসেছিল জয় জন্মাবার পর।

জয় আর তপুকে যখন জীবনে একবার কী দু’বার একসঙ্গে পেয়েছিল, নূপুর লক্ষ্য করেছে, জয়ের জন্য নয়, তপুর জন্যই তাকে উতলা হতে। জয় চিরকালই ছিল তার বাবার ছেলে। নূপুরকে মা বলে ডাকতো। ওর বেশি কিছু জয় থেকে সে আশাও হয়তো কোনোদিন করেনি।

নির্মলা আবার ডাকে নূপুরকে। ‘নূপুর, ব্রজ অপেক্ষা করছে। ওদের সঙ্গে জরুরি কথাগুলো সেরে এসো। চানও করলে না। যে শাড়ি পরে দেশ থেকে এসেছো, সে শাড়ি পরেই রয়েছো এখনো’।

নূপুর এবার নিজেকে যমুনার শোবার ঘর থেকে উঠিয়ে নিচের তলায় নামিয়ে ব্রজ’র সামনে বসায়। বসায় বটে কিন্তু মন তখনও যমুনার কলাবাগানের বাড়িতে। যমুনা আর নূপুর বিছানায় মুখোমুখি শুয়ে আছে, দুজনের মাঝখানে বসে তপু খেলছে। যমুনা বলছে, ‘তোর আর ময়মনসিংহে থাকতে হবে না। এখানে আমার সঙ্গেই থাক। দু’বোনে থাকবো বাকি জীবন। তুই এই শহরে একটা ভালো চাকরি করবি। এই ফ্ল্যাট ছোট মনে হলে একটা বড় ফ্ল্যাট নেবো। আর যদি বিয়ে টিয়ে করিস, তাহলে এক কাজ করবো, একটা বাড়িই কিনে ফেলবো, নিচতলায় আমি, দোতলায় তুই, তোর সংসার। খাবো একসঙ্গে। এক টেবিলে বসে, গল্প করতে করতে, গান শুনতে শুনতে, নাটক দেখতে দেখতে। ঘুরে বেড়াবো একসঙ্গে। এই ছোট গাড়িটা বিক্রি করে বড় একটা গাড়ি কিনবো। ছুটি ছাটায় প্রায়ই চলে যাবো দূরে কোথাও। আর তুই যদি ভালো কোনও ছেলেকে বিয়ে করিস, ওকে দিব্যি ছোট ভাই বানিয়ে নেব। আমাদের ভাই বোনের সুখের সংসার। তুই সংসারটা ভালো বুঝিস। তোর হাতেই সংসার খরচের টাকা পয়সা দিয়ে দেব। তোর পয়সা তুই জমাবি ব্যাংকে। তোর কোনও টাকা খরচ করার দরকার নেই। যদি এমন হয়, আমার খুব প্রয়োজন পড়ছে টাকা পয়সার, মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য একটা প্রাইভেট স্পেসশিপ কিনবো, তখন তোর কাছে ধার নেব, কেমন? আমরা সারা দেশটা ঘুরবো, পাশের দেশগুলো দেখবো, পাহাড় সমুদ্র দেখবো, দূরের দেশগুলোতেও সাহস করে চলে যাবো। জীবন তো একটাই রে, নূপুর’।

নূপুরের কী যে ভালো লাগতো যমুনাকে শুনতে। মেঘেয় ভেসে বেড়ানোর মতো একটা সুখ হতো।

ব্রজ বলল, ‘কী এত ভাবছেন, বলুন। আপনি যমুনা চৌধুরীর বোন। আপনার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি ছিলেন না কিন্তু আমরা অরগানগুলো নিয়ে নিয়েছি। নির্মলাদি বললেন, আপনি আসার পর বাকিটা হবে। এখন বডিটা আজই নিয়ে যাবো ভাবছি’।

 নূপুরের মলিন কণ্ঠস্বর। বললো—মেডিকেলে তো?

—হ্যাঁ

—যমুনাদি কবে মরণোত্তর দেহ দিয়ে গেছে?

অন্যমনস্ক নূপুর অবান্তর প্রশ্ন করে। ব্রজ বোঝে। নির্মলাও।

—’বছর পাঁচেক আগে। বডিটা দরকার। আমাদের গণদর্পণে যারা বডি দিয়ে যান, আমরা কখনও তাদের বডি এতদিন ফেলে রাখি না’।

ব্রজ পাঁচ বছর আগের চুক্তিপত্রটি এগিয়ে দেয় নূপুরের দিকে। যমুনার সই। সইটাতে আঙুল বুলোয় নূপুর। বুলোতে থাকে।

ব্রজ বলে—’আপনার জন্য নিশ্চয়ই শকিং। দিদিরা তো অনেকটা মায়ের মতো’।

— ‘আসলে আমি তো আমার দিদিটাকে একটু ভালো করে দেখিনি। একটু দেখবো, একটু স্পর্শ করবো..। এই তো শেষ দেখা, মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর আর তো কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবো না’।

কণ্ঠস্বরটা ভেঙে আসে। তারপরও স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে নূপুর।

ব্রজ আর তার সঙ্গের ছেলে মাথা নোয়ায়। টানটান মেয়েটা একটা ট্রেতে চার বাটি মিস্টি আর চার গ্লাস জল দিয়ে যায়। সবাই অপেক্ষা করছিল নূপুর একটু সামলে উঠে বলবে, ‘ঠিক আছে আজ শেষ দেখা দেখে নিই, আজ বিকেলেই নিয়ে যান’।

পার্ক স্ট্রিটের পিস হেভেনে রাখা হয়েছে যমুনার দেহ। ব্রজ বললো, ‘রাখার খরচও তো অনেক, আর তাছাড়া..’

নূপুর থামিয়ে দেয় ব্রজকে, ‘জানি খরচ অনেক। আমাকে প্লিজ খরচের কথা বলবেন না। খরচ বাঁচানোর জন্য আমার দিদিকে আমি দূর করে দেব, তা হতে পারে না’।

নির্মলা মূর্তির মতো বসে থাকে পাশে। গম্ভীর মুখ। নূপুর অপ্রস্তুত বোধ করে। চিকন স্বরে বলে, ‘আসলে আমি তপুর সঙ্গে আবার কথা বলতে চাই। ও যদি আসতে চায়। দেখি আজ আবার বলবো। ওর তো মা। কাছে থাকুক এই সময়টায়। ও যদিও আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছে, তারপরও…। আমি চাই তপু আসুক। তপু আসার পর মেডিকেলে নেওয়া হোক বডি।’

নির্মলা বলে, ‘ওর নাকি হারভার্ডে এখন কী সব এক্সাম চলছে’।

—’তাই নাকি? আমাকে বলেনি। বলেছে, মায়ের মৃত মুখ সে দেখতে চায় না। মৃত মুখের কোনও স্মৃতি সে চায় না। যেমন মাকে দেখেছে, সদা হাসিখুশি, প্রাণময়, উচ্ছ্বল। তেমন মাকেই রাখতে চায় স্মৃতিতে’।

ব্রজ আর নির্মলা দুজনই বললো যে তারা তপুর এই অনুভূতিটাকেই ভালো বুঝতে পারছে।

সামনে ব্রজ আর ব্রজ’র সঙ্গের লোক আর পাশে নির্মলা থাকা সত্ত্বেও নূপুর সেই অতীতে সাঁতরায়। ছোট্ট সেই তপু এখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছে। বিখ্যাত পদার্থবিদ লোরেন্স ক্রস-এর সঙ্গে বই লিখছে একসঙ্গে। পিএইচডি শেষ করে হারভার্ডেই শিক্ষকতার চাকরিতে ঢুকবে, এরকমই ঠিক হয়ে আছে। তপুর জন্য গর্ব হতে থাকে নূপুরের। তপুর জন্ম নিয়ে ছি ছি করা লোকগুলো আজ কোথায়, আর তপু কোথায়! সংসারে আর কেউ এত পড়াশোনা করেনি। যমুনা করেছিল, এখন যমুনাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে তপু।

নূপুর কোনওদিন যায়নি হারভার্ডে। যতদিন ছিল আমেরিকায়, নিউইয়র্কের এল্মহার্স অ্যাভেন্যূতে ছিল। যে ভাড়া বাড়িতে উঠেছিল, সেই বাড়িতেই টানা উনিশ বছর কাটিয়েছে। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়েছে, বাড়িতে আরশোলা আর ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে, তারপরও ছাড়েনি। না ছাড়াটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অতগুলো বছর এল্মহার্স্ট অ্যাভেন্যু আর জ্যাকসন হাইটসেই বিচরণ করেছে। যমুনাকে ঈর্ষা করতো নূপুর। মুখে কোনোদিন না বললেও মনে মনে ঠিক জানে সে ঈর্ষা করতো যমুনাকে। যমুনার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পেছনে এই ঈর্ষাই হয়তো কাজ করেছিল। নাকি রাগ! নাকি অভিমান। নূপুর ঠিক জানে না। নাকি সবকিছু মিলিয়ে কিছু একটা! তপু আমেরিকায় পড়াশোনা করছে, জানার পরও সে তপুর সঙ্গে না গেছে দেখা করতে, না বলেছে তপুকে আসতে তার কাছে।

 জাঁকজমক করে বিয়ে হওয়া নূপুরের সংসার ছিল অশান্তির সংসার। যে সন্তানকে জগত ভুলে বড় করেছে, সেই জয় কলেজেই ঢুকতে পারেনি। ড্রাগ অ্যাডিকশান পনেরো বছর বয়স থেকেই। নূপুর বুঝতে পারেনি। যমুনা যখন শেষবার আমেরিকায় গেছে নূপুরের সঙ্গে দেখা করতে, লক্ষ্য করেছে জয় সারাদিন ঘুমোচ্ছে। রাতে ঢুলুঢুলু চোখ, জোরে হাসছে, কথা বলতে গেলে শব্দগুলো জড়িয়ে যায়, কথায় কোনও অর্থ নেই, যুক্তি নেই। নূপুর জয়কে মুখে তুলে খাওয়াতে চাইছে। বাবা খাও, আমার সোনাটা, জাদুটা, হিরেটা। জয় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে নূপুরকে। যমুনা জয়কে এরকম অবস্থায় কখনও দেখেনি। ছিল প্রাণময় হাসিখুশি ছেলে। তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

যমুনা জানতো না সেই জয় এর মধ্যে ভয়ংকর পাল্টে গেছে। দু’দিন লক্ষ্য করেছে, তৃতীয় দিন নূপুরকে জিজ্ঞেস করেছে, —জয় কি নেশা করে?

নূপুর ভুরু কুঁচকে নাক কুঁচকে ঠোঁট কুঁচকে যমুনার দিকে তাকায়, তিক্ত কণ্ঠস্বর। —’কী বলছো?’

‘জিজ্ঞেস করছি, জয় কি কোনও নেশা টেশা করে’?

—নেশা?

—হ্যাঁ নেশা।

-নেশা মানেটা কি?

যমুনা রাগী স্বরে বলে, —’অত না বোঝার ভান করিস না। নেশা মানে নেশা। গাঁজা ভাঙ চরশ এসবের নাম শুনিস নি? জয় কি ড্রাগস নেয়? মানে খায় কোনও ঘুমের ওষুধ টষুধ? ইনজেকশন নেয়?’

নূপুরের গা জ্বলে রাগে। বলে, —না। আমার ছেলে ভালো ছেলে। তুমি জয় সম্পর্কে বাজে কথা কেন বলছো আমি বুঝতে পারছি না।

—জয়ের ভালোর জন্য বলছি। মনে হচ্ছে জয় নেশাগ্রস্ত।

—আশ্চর্য। এই বাচ্চা ছেলে নেশা করবে কেন! আমি ভাবতাম জয়কে তুমি বোধহয় ভালোবাসো। তুমি যে ওকে দুচোখে দেখতে পাওনা তা জানতাম না।

—আমার কথার অদ্ভুত অর্থ করিস না। জয়কে দেখে আমার ভালো লাগছে না। ড্রাগ অ্যাডিক্ট-এর মতো লাগছে জয়কে।

নূপুর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। যমুনা নূপুরের পিঠে আদর করে দিতে থাকে। যমুনার হাত পিঠ থেকে সরিয়ে দেয় নূপুর। বলে —’বুবু তুমি চিরকালই আমাকে হিংসে করেছো। জয়কেও তোমার সহ্য হচ্ছে না। তোমার স্বামী নেই, সংসার নেই, ছেলে নেই। তুমি আমার বিয়ে আর সংসার হোক, কোনওদিন চাওনি। ঢাকায় যেমন তোমার বাড়িতে চাকরের কাজ করতাম, চেয়েছিলে সারাজীবন তেমন চাকর হয়েই থাকি তোমার। আমি বুঝি কেন তুমি জয়কে সহ্য করতে পারছো না। বলছো জয় নেশা করে। ও মদ খাবে? আমার ছেলে জয় মদ খাবে? যাও ওর ঘরে গিয়ে দেখ, দেখ মদ খায় কিনা। সোনার টুকরো ছেলে সারাটা রাত পড়াশোনা করে। দিনে একটু খানি ঘুমোয়। আর এখন তো ইস্কুলে ছুটি চলছে। ওর এত পড়াশোনা করা তোমার সহ্য হচ্ছে না। ভাবছো ও না আবার তপুর চেয়ে ভালও স্টুডেন্ট হয়ে যায়। সব বুঝি আমি বুবু’।

—’সব যখন বুঝিস, তখন এটাও নিশ্চয়ই বুঝিস যে নেশা করতে হলে সব সময় মদের দরকার হয় না। ড্রাগের নেশাও নেশা। মদ ছাড়াও নানারকম পদার্থ আছে নেশা করার। অত যখন আমার কুমতলব, তোকে হিংসে করি, তোর সুখের সংসার সহ্য করতে পারছি না, আমার ছেলে নেই বলে তোর ছেলেকে হিংসে করে বদনাম করছি, তখন এটাও নিশ্চয়ই বুঝিস ড্রাগের নেশা খুব ভয়ংকর নেশা। এই নেশা ছাড়াতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ডাক্তারের কাছে যা, আমার অনুরোধ’।

—’তুমি কি করে জানো ও ড্রাগের নেশা করছে। ড্রাগের নেশা তুমি করেছা?’

—’আমি করিনি। আমি শুনেছি। পড়েছি। দেখেছি। নিজের জীবনে না ঘটলেও নলেজ থাকে মানুষের’।

—’ডাক্তারের কাছে যেতে হলে তুমি যাও। তোমার মাথায় গণ্ডগোল আছে বুবু। তুমি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও’।

—’সে না হয় দেখাবো’।

—’তুমি আমেরিকায় আমাকে দেখার নাম করে তুমি আমার ছেলের বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলতে এসেছো। এত নোংরা মন তোমার! ছিছি’।

—’আমাকে ছিছি করার ঢের সময় পাবি নূপুর। জয়কে এখনই যদি না নিয়ে যাস, যদি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা না করিস, পরে আফসোস করতে হবে। তুই না যেতে পারিস, আমি আছি এখানে, আমি হেল্প করি। আমি নিয়ে যাই। রিহ্যাবে দিতে হলে আমি দিই। তোর কিছু করতে হবে না’।

নূপুর চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তুমি আর অশান্তি ডেকে এনো না এই সংসারে’।

দুজনের চিৎকার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যমুনার এক কথা, ‘ছেলেকে ডাক্তার দেখা’ নূপুরের কথা, ‘তুমি আমার চিরজীবনের শত্রু। আমার ভালো তুমি কোনওদিন চাওনি। আমাকে তোমার বাড়িতে তোমার মেয়ের দেখাশোনার জন্য রেখেছিলে। আমি জাস্ট একটা বেবি সিটারের বা গভরনেসের কাজ করতাম। আমাকে বোন বলে মানোনি। তোমার কাছে ওভাবে থাকলে আমার বিয়েটাও হয়তো হত না। চিরকাল আমাকে ইউজ করেছো। নিজের মেয়ের মতো তোমার মেয়েকে লালন পালন করেছিলাম। তার এই প্রতিদান তুমি দিলে? আমার ছেলের বিরুদ্ধে লেগেছো তুমি!’ নূপুর চেঁচিয়ে কাঁদে। হাত পা কাঁপে রাগে আর আবেগে।

চেঁচিয়ে নূপুর এও বলে, যমুনা যেন অন্য কোথাও চলে যায়। আজই। যে কোনও কোথাও। কোনো হোটেলে বা অন্য কারও বাড়িতে। সে চায় না তার সংসারে কোনও বাইরের লোক নাক গলাক।

যমুনা শুয়ে শুয়ে ভাবে আজ সে বাইরের লোক। কিন্তু তার ওপর ছুঁড়ে দেওয়া অপমান, অপবাদ কিছুই তার চোখে জল আনে না, জল আনে জয়ের করুণ অবস্থা। আধচেতন মন। বিক্ষিপ্ত ভাবনা। যমুনার স্পষ্ট ধারণা জয় ভালো নেই, জয়ের চিকিৎসা দরকার।

ফোনে সে কথা বলে নিউ ইয়র্কের ডাক্তারদের সঙ্গে। ড্রাগের নেশা ছাড়ানোর বিশেষজ্ঞদের কাছে। অন্তত তিনজন বিশেষজ্ঞ যমুনাকে উপদেশ দেয়, রোগী নিয়ে চেম্বারে যেতে।

যমুনা নূপুরকে বলে, —’আমি ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। জয়কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। তোর যাওয়ার দরকার নেই। আমিই ওকে নিয়ে যাবো’।

নূপুর জোরে হেসে ওঠে। —’তুমি পাগল হয়ে গেছো বুবু। তুমি ডাক্তার দেখাও। যে ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছো, তাকেই দেখাও’।

নূপুর শওকতের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। আজ শওকত যমুনার চেয়েও বেশি আপন। শওকতও সে চোখে তাকায় যমুনার দিকে, যে চোখে নূপুর তাকায়। অবজ্ঞা আর ঘৃণা নূপুরের চোখে যতটা তার চেয়েও দ্বিগুণ শওকতের চোখে।

—’আপনি আমার ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার দেখানোর প্ল্যান করছেন কেন? আমার ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিতে হলে আমি নিয়ে যাবো। ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হলে আমি করবো। আপনার তো এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই! আপনি বেড়াতে এসেছেন নিউইয়র্কে, বেড়িয়ে চলে যান। কোথায় কার সঙ্গে নাকি দেখা করবেন, দেখা করুন। ব্রডওয়ের নাটক নাকি দেখবেন, দেখুন। বই কিনবেন বলেছিলেন, বই কিনুন। আমার ছেলেকে প্লিজ ছাড়ুন। ছেলের বাবা মা আছে, তারা ছেলের ভালো চায়। বাবা আর মা’র মতো শুভাকাংক্ষী তো আর কেউ হয় না। তাই না? আপনি মাঝে মাঝে ভুলে যান যে আপনি ওর মা নন, আপনি খালা’।

যমুনা সোফায় ধপাশ করে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি খালা, আমার এত নাক গলানো তোমরা কেউ চাইছো না, আমি বুঝতে পারছি। শুধু বুঝতে পারছি না, তোমরা কেন চোখ বন্ধ করে আছো। জয় ইস্কুলে যাচ্ছে না। কিছু একটা খেয়ে বা কিছু একটা পান করে, বা কিছু একটা ইনজেক্ট করে ও ঘুমোচ্ছে, বাকিটা সময় আচ্ছন্নতার মধ্যে থাকছে। না দেখার ভান করোনা। কবে থেকে এমন হচ্ছে। কবে ও ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে। আমাকে তোমরা কিছু জানাওনি’।

—’কিছু হলে তো জানাবো। জোর করে কেন ভাবতে চাইছেন যে কিছু একটা হয়েছে’?

জয়ের ঘরে ঢুকে যমুনা জিজ্ঞেস করে, তুমি ইস্কুলে যাওনা কেন?

—’ইচ্ছে করে না’। জয়ের সোজা উত্তর।

—ছুটি চলছে?

—নট রিয়েলি।

—তুমি কি কোনও ড্রাগ ইউজ করো? ঠিক করে বলোতা।

—ইউ আর এ ফাকিং ইডিয়ট, অ্যান ওল্ড রিটার্ড। হোয়াই ডোন্ট ইউ জাস্ট লীভ মি এণ্ড মাই পেরেন্টস এলোন! উই ডোন্ট নীড ইউ। লিসেন লেডি, উই একচুয়ালি হেইট ইউ। ইউ আন্ডারস্ট্যাণ্ড ইংলিশ? ইফ আই টেইক ড্রাগস, আই টেইক ড্রাগস। ইটস নট ইওর ফাকিং বিজনেস।

যমুনা হাঁ হয়ে গেছে জয়ের কথা শুনে। চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের ছেলে এভাবে কথা বলে, বলতে পারে! আসলে যমুনার আস্থা বেশি ছিল জয়ের ওপর। নূপুর আর শওকতের ওপর যা ছিল তার চেয়েও বেশি। জয়ের সঙ্গে কিছু হলেও সখ্য ছিল যমুনার। ভালোবাসা তো আকাশ থেকে পড়েনি। খুব ছোট যখন জয়, তখন জয়কে অনেক গল্প শোনাতে হত। ভুতের গল্প যমুনা কখনও শোনায়নি। শোনাতো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গল্প, বিগ ব্যাং, বিবর্তন। খুব মন দিয়ে শুনতো জয়। প্রশ্ন করতো।

যমুনার খুব ন্যাওটা ছিল তখন। জয়ের যখন পাঁচ ছ বছর বয়স, ওই অতটুকুন ছেলেকে যত মিউজিয়াম আছে যমুনা নিয়ে গিয়েছিল। মেট্রোপলিটান, গুগেনহাইম, মডার্ন। শহরের বইয়ের দোকান ঘুরে ঘুরে রাজ্যির বই কিনে দিয়েছে, নূপুর দেখে বলেছে, এত বই রাখার জায়গাই তো নেই। আর ও তো এসব বড়দের বই পড়তে পারবে না।

যমুনা বলেছে, ‘বড় হলে পড়বে। এখন ক্লাসিকসগুলো সব রইলো হাতের কাছে। তপুকে যত বড়দের বই গিফট করেছিলাম, সব এখন বড় হয়ে পড়ছে। জয়ও পড়বে’।

—’মিউজিয়ামের কী বোঝে ও? এতক্ষণ বাইরে, নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছিল ওর’।

যমুনা বলেছে, ‘তুই শুধু এর পেটে খাবার ঢোকাতে পারলেই খুশি। মিউজিয়ামের কী বোঝে মানে? বাচ্চারা যা দেখে, যা শোনে, তা-ই মাথায় ঢুকে যায়। আমাদের মাথাতে অত ভালো কিন্তু ঢোকে না’।

জয় তার মা’র সঙ্গে নয়, বেশি ঘেঁষে থাকতো যমুনার সঙ্গে। যমুনা যতদিন ছিল, ছায়ার মতো জয় ছিল। তারপর জয়কে আরও দেখেছে, কিন্তু লক্ষ্য করতো জয় আগের মতো অত ঘেঁষছে না কাছে। ছেলেরা বড় হলে এরকমই হয়, ভেবে নিয়েছিল।

 সেই যে দু’শ ক্লাসিকস কেনা হয়েছিল, সেই বইগুলো ঘরে জায়গা নেই বলে নূপুর খাটের তলায় কিছুদিন রেখেছিল, ঘরে ছারপোকা পাওয়া যাওয়ার পর বইগুলো সব ফেলে দিয়েছিল। যমুনা বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো, ‘আর বোলো না, এত ছারপোকা, সব গারবেজ করে দিতে হল’। যমুনার মন খারাপ হয় শুনে।

জয়, যমুনার মনে হয়, মনে রাখেনি যে যমুনার সঙ্গে তার একসময় খুব ভাব ছিল। খুব বেশি সময় কাটানো হয়নি জয়ের সঙ্গে। তবু যতটকু সময়ই কাটিয়েছে — জয় খুব বুদ্ধিমান ছেলে, জয় বড় হলে বিরাট কিছু হবে এই বিশ্বাস নিয়ে তপুর চেয়েও বেশি জয়কে নিয়ে মেতেছে যমুনা। তপুকে সম্ভবত জয়ের মনেও এখন নেই। জয়ের চেয়ে সাত বছরের বড় তপু। না, তপু এভাবে কোনওদিন কথা বলেনি। এভাবে কথা বলতে তপু জানে না। এই শব্দগুলো কখনও উচ্চারণ হয় না বাড়িতে।

এত অপমান সয়েও যমুনা থাকে নূপুরের বাড়িতে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, ব্রডওয়ের নাটক দেখা, বই কেনা—সব কিছু বাতিল করে জয়কে নিয়ে পড়ে থাকে। তার সোজা কথা, ড্রাগের নেশা এখনই ছাড়াতে হবে, কোকেন, হিরোইন, হোয়াটএভার, এখন না ছাড়ালে পরে আর ছাড়ানো যাবে না, যে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।

জয়ের ঘরের ড্রয়ার খুলে যমুনা দেখেছে, অচেনা সব বড়ি। পাউডার। জয় বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। কিছু এনে সে নূপুর আর শওকতকে দেখিয়েছেও, জিজ্ঞেস করেছে, এগুলো কী?

দুজনেরই বক্তব্য এগুলো এণ্টিবায়োটিক, প্যারাসিটামল। জ্বর টর হয়। ইনফেকশন দাঁতে, হাতে ইত্যাদিতে লেগেই আছে, সে কারণে। ‘কে দিয়েছে ওকে এসব ওষুধ? ও কি নিজে নিজে ডাক্তার দেখিয়েছিল? নিজেই ওষুধ কিনেছে?’ জয়-এর কেন এত ইনফেকশন হচ্ছে! যমুনা কোনও ইনফেকশন জয়ের শরীরে দেখেনি। ও নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। জয়-এর ব্যবহার তার ত্রিবান্দ্রাম অফিসের এক কলিগের মতো। ঠিক এভাবে টলতো, সম্পূর্ণ চেতন কখনও ছিল না, কাকে কী বলছে, কেন বলছে, ঠিক বুঝতে পারতো বলেও মনে হয়নি। পরে ধরা পড়লো মাদকসেবনের কারণে এমন হচ্ছে। ছুটি দেওয়া হল, ডাক্তারের কাছে যাও, না যাবে না। দিব্যি নাকি আছে। শেষ অবধি যখন অচেতন অবস্থা ধেই ধেই করে বাড়তে থাকলে ধরে বেঁধে অফিসের লোকেরাই রিহ্যাবে রেখে এল। জয় টলছে দেখলে সুধীরনাথের টলোমলো পায়ের কথা মনে পড়ে যমুনার।

একসময় ঘুম থেকে উঠে টলোমলো পায়ে জয় যখন টয়লেটে যাচ্ছে, যমুনা জিজ্ঞেস করেছে, ‘তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার, জয়। তোমার সময় হবে?’

জয় টয়লেটে অনেকক্ষণ কাটালো, দূর থেকে যমুনা অস্থির হচ্ছিল ক্রমশ। টয়লেটে অতক্ষণ কী করছে ও। প্রায় আধঘণ্টা পার হওয়ার পর টোকা দিল যমুনা দরজায়। টেনশনে ঘামছিল সে। নূপুর রান্নাঘরে। শওকত বাড়ির বাইরে। ‘জয়, এতক্ষণ কী করছো বাথরুমে? তুমি তো গোসল করছো না। করছো টা কী শুনি। আমি বাথরুমে যাবো, দরজা খোল’।

দরজা তার পরেও খোলে না জয়। আরও মিনিট কুড়ি পেরোলে দরজা যখন খোলে, জয়ের সারা মুখ ঘামছে, আর হাঁফাচ্ছে। যেন শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। জয়কে একটা টাওয়েল দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। সারা গা কাঁপছে তখন তার।

 যমুনা জয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘জয়, তুমি যদি এসব ছাড়তে না পারো, আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি। তোমাকে তো বাঁচতে হবে, তাইনা? তোমাকে তো বাঁচতে হবে’। যমুনার চোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে। হাতের পিঠে মুছতে মুছতে জল, যমুনা বলে, ‘তুমি যদি একা একা এসব ছাড়তে না পারো, তাহলে ছাড়ানোর জন্য সাহায্য করা হবে, তুমি সাহায্যটা প্লিজ নাও’। না, সাহায্য সে নেবে না। কারণ এই জীবনকে সে ভালোবাসে না। সবাইকে ঘৃণা করে সে। নিজেকেও। অবশমতো হতে থাকে শরীর। বার বার বলতে থাকে, ‘আই হেইট এভরিবডি’। জয়ের কাছে বসেই ছিল যমুনা। নূপুর ডেকে নিয়ে যায়। ‘সারারাত লেখাপড়া করে ছেলে, দিনের বেলায় একটু ঘুমোয়, এই ঘুমটাকেও আর নষ্ট করো না’। যমুনাকে বের করে জয়ের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় নূপুর।

‘ওকে একটু দয়া করে একা থাকতে দাও। জ্বরে ভুগছে। কিছু খেতে চাইছে না’। যমুনা লক্ষ্য করেছে নানারকম খাবার রান্না করে জয়ের মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে নূপুর, কিন্তু সব কিছুই ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে জয়। বাইরের রেস্টুরেন্টের খাবার যা যা পছন্দ করে, সবই আনিয়ে দেখছে খায় কি না। না খেলে ফেলে দিচ্ছে সব, কিন্তু একবারও নূপুরের সন্দেহ হচ্ছে না যে জয় স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।

যমুনা ছেড়ে দেয় না। ছলে বলে কৌশলে জয়কে রিহ্যাবে নেওয়ার বুদ্ধি অঁটতে থাকে। আত্মীয়দের বলে কোনও ফল হয়নি, শেষ অবধি ডাক্তারের পরামর্শে ৯১১ এ ফোন করে। ঘরে অল্প বয়সী ছেলে, আচার ব্যবহার কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়, মনে হচ্ছে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ড্রয়ারেও পাওয়া গেছে কিছু। সম্ভবত ড্রাগসই। এত ঘুমোচ্ছে কেন, ওভারডোজ হচ্ছে কি না। বাড়ির কেউ নিরাপদ বোধ করছে না..

কেউ নিরাপদ বোধ করছে না, এই বাক্যটির দরকার ছিল। না হলে ৯১১ নাক গলাবে না। ৯১১ র লোক গিয়েছিল বাড়িতে। যমুনা চেষ্টা করেছে নূপুর আর শওকতকে বোঝাতে। নিয়ে যাক জয়কে, ডাক্তার দেখুক। যদি কোনও অসুখবিসুখ না থাকে, তা হলে তো ভালোই। আর যদি থাকে, তাহলে এই সুযোগে চিকিৎসাটা হয়ে যাবে।

—’বুবু, তুমি আমার সর্বনাশ করছো, একটা সুস্থ ছেলেকে রোগী বানাচ্ছো, ড্রাগ এডিক্ট-এর অপবাদ দিচ্ছ। ওর ভবিষ্যত নষ্ট করছো। তোমাকে আমি ক্ষমা করবো না কোনোদিন। তুমি আমার বোন, ভাবতে আমার লজ্জা হচ্ছে। আজ থেকে তুমি আমার কেউ নও। তুমি চলে যাও এ বাড়ি থেকে। আজই। আমার সংসার নষ্ট করতে, আমার ছেলের সর্বনাশ করতে তুমি আর এসো না। তুমি তো খুনী। ঠিক না? খুন তো করেছিল পাশাকে। তুমি ছেলেদের সহ্য করতে পারছো না। আমার ছেলেকে খুন করতে চাইছো। আমার ছেলে কী ক্ষতি করেছিল তোমার?’

৯১১ এর লোকদের ঢুকতেই দেয়নি নূপুর আর শওকত জয়ের ঘরে। বলে দিয়েছে, জয় অত্যন্ত ভালো ছেলে, পড়াশোনা করছে মন দিয়ে। ওদের বাড়িতে একটা পাগল মাথার মহিলা দেশ থেকে এসেছে, সে-ই জঘন্য সব কাণ্ড করেছে, ৯১১ এ কল করেছে। সবকিছুর জন্য পুলিশের কাছে নূপুর অত্যন্ত ভদ্রভাবে ক্ষমা চেয়ে নেয়। পুলিশ চলে যায়।

যমুনা শান্ত করতে চেয়েছিল নূপুরকে, জড়িয়ে ধরে। যমুনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে নূপুর। ধাক্কা খেয়ে যমুনা উল্টে পড়েছে। তারপরও অসন্তুষ্ট না হয়ে, রাগ না করে নূপুরকে আদর করতে চেয়েছে পিঠে হাত বুলিয়ে। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই একটু শান্ত হ। আমার ওপর দায়িত্ব-দে। এইভাবে আমাকে ভুল বুঝিস না। তোরাই আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। যা বলছি জয়ের ভালোর জন্য বলছি’।

শওকতকে কোনওদিন এত ভয়ংকর হতে দেখেনি যমুনা। বাড়ির দরজা জানালা কাঁপে এমন জোরে সে চেঁচায়। ‘আমার ছেলের ভালো আপনাকে বুঝতে হবে না। দয়া করে আমার ছেলের ভালো মন্দ আমাকে বুঝতে দিন। আমি ওর বাবা, বুঝলেন আমি ওর বাবা। আপনি জয়কে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন না। উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। জয়কে জন্মের পর থেকে আপনি মানুষ করেছেন নাকি আমি করেছি? আপনি ওর বাড়িঘর খাওয়া দাওয়া কাপড় চোপড় ফোন কমপিউটার-এর খরচ দিয়েছেন নাকি আমি দিয়েছি? এখানে এখন আত্মীয়তা দেখাতে এসেছেন। এই ফ্ল্যাট আমার। আমি বলছি এক্ষুনি আপনি সুটকেস প্যাক করুন। আপনি চলে যান। আমার ছেলের জন্য আপনি ৯১১ ডেকেছেন। কতবড় সাহস আপনার। আমার ফ্ল্যাটে বসে আপনি আমাকে কত বড় অপমান করছেন’।

নূপুর শওকতের সুরে সুর মিলিয়েছিল।

এরপর আর থাকা সম্ভব হয়নি যমুনার। দ্রুত সে সুটকেস গুছিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়।

কাছাকাছি কোথাও একটা হোটেলে ওঠে। কাছাকাছিই। কারণ যদি জয়ের জন্য তাকে দরকার হয়। যমুনা পারতো টিকিটের তারিখ এগিয়ে আনতে। কলকাতায় চলে যেতে। যায়নি। তারিখ এগিয়ে তো আনেইনি, বরং আরও কয়েকদিন বাড়িয়েছে থাকা। আরও দুসপ্তাহ যমুনা কাটায় হোটেলে। একটিই কারণ, একদিন নূপুরের ফোন আসবে, বলবে শিগরি এস, জয় যেন কেমন করছে।

জয় কেমন করছে, এই ভয়টা যমুনার সাংঘাতিক। অনেকবার মনে করেছে নূপুরের কাছে যাবে, আবার তাকে বোঝায়। জয়ের ওভারডোজ যদি ঘটতে থাকে, ও হয়তো চোখ আর খুলবে না কোনওদিন। নূপুর আর শওকত সম্পূর্ণ অজ্ঞানতা থেকে বলছে, যা বলছে। ওদের অজ্ঞানতা, মূর্খতাকে মূল্য দিয়ে অভিমান করে দূরে বসে থাকা কি ঠিক হচ্ছে! যমুনার যদি নেশাগ্রস্ততা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকতো তাহলে নিজেও হয়তো সে বুঝতো না কী ঘটছে। নূপুরের মতো মাথা ঘুরছে, শরীরটা খারাপ, ইনফেকশান হয়েছে, পেটে কোনও খাবার সইছে না, বদহজম হচ্ছে, এসব বলতো। নূপুর আর শওকতকে খুব দোষ যমুনা দিতেও পারে না। শুধু জয়কে বাঁচানোর তাগিদ সে এত কিছুর পরও অনুভব করে। চরম নির্লজ্জের মতো নূপুরকে সে ফোনও করেছে। নূপুর ফোন ধরেনি। তারপর থেকে সে এসএমএস করে চলেছে, জয়ের নেশা ছাড়ানোর জন্য কী কী করতে হবে, তার উপদেশ। নূপুর যেন উপদেশ মানে। যমুনার প্রয়োজন না থাকলে না থাকুক, যাবে না সে। কিন্তু কয়েকজন ডাক্তারের নাম ঠিকানা সে এসএমএস করে দেয়। দু সপ্তাহে একবারও কোনো ফোন ব্যাক করেনি, কোনও এসএমএসের উত্তরও দেয়নি নূপুর। যমুনার বিশ্বাস নূপুর নিজের ভুল বুঝতে পারবে একদিন। ততদিনে যেন দেরি না হয়ে যায়।

 দু সপ্তাহ পর কলকাতা ফিরে এসে যমুনা জয়কে নিয়েই দুশ্চিন্তা করতে থাকে। ফোন করে দেখেছে, নূপুর ধরছে না। ইমেইল করে দেখেছে, ইমেইলের উত্তর দিচ্ছে না। জয়ের ওই করুণ অবস্থা দেখে তার মনে হয়েছে, জয় সবাইকে আকুল আবেদন জানাচ্ছে ওকে বাঁচাতে। বাইরের মানুষ বোঝে এ ড্রাগের আসক্তি, শুধু নিজের বাবা মা-ই বোঝে না। হয়তো বোঝে, কিন্তু বাস্তবকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চায়। অথবা একটা চমৎকার জগত তৈরি করে নিয়েছে মনে মনে, সেই জগতেই বাস করছে বলে বিশ্বাস করছে। নূপুরকে কয়েকটা ইমেইল পাঠিয়ে দেয় যমুনা। কারণ কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে পরে নূপুরই কেঁদে কেঁদে বলবে, ‘বুবু তুমি কেন আমাকে তখন আরও ভালো করে বুঝিয়ে বললে না, ছেলেটা তো বাঁচতো। আমাকে কেন মারলে না, কেন জোর করে তুমি নিয়ে গেলে না ডাক্তারের কাছে। আমরা না হয় বুঝতে পারছিলাম না, আমরা বোকা, আমরা গাধার মত কাজ করি পয়সার জন্য, দুনিয়ার খবর কিছু রাখি না, ড্রাগস কাকে বলে, দেখতে কেমন, খায় কেন, খেলে কী হয়, কিচ্ছু জানিনা। তুমি তো জানতে। জেনেও কেন যে করেই হোক জয়কে বাঁচালে না? তুমি তো দেখতে পাচ্ছিলে। আমরা না হয় অন্ধ ছিলাম’। দোষ থেকে বাঁচার জন্য নয়, যা করে যমুনা অন্তর থেকেই করে। জয়কে বাঁচাবার জন্য করে, জয় মরছে বা মরে যাবে এরকম কোনো আভাস নেই, কিন্তু ভেতরে যে ভয়ংকর একটা আশংকা বাসা বেঁধেছে, সেই আশংকা থেকে করে। যে আশংকা তপুর বেলাতেও ছিল। পাশা তপুকে মেরে ফেলতে চাইছিল, একটা বউ বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার করা লোকের গোপন কোনও ঔরসজাত সন্তান আছে কোথাও, এই ঘটনা প্রথম প্রথম পাশা মেনে নিলেও পরে আর পারছিল না, তখন যমুনারও সময় ছিল না পাশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার। যমুনা পাশার ওই বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থা, ভয় আর আশংকায় দিন রাত আচ্ছন্ন হয়ে থাকা, —এসবের সামনে দাঁড়াতে পারছিল না। যমুনা লক্ষ করছিল তপুকে পাশা আর সহ্য করতে পারছে না। তপুর দিকে ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে থাকতো, কোলে নিয়ে খেলার ছলে ওপর দিকে ছুঁড়ে দিত, ধরতো কিন্তু যেন না ধরলে কী ঘটে, তাও একটু পরখ করতে চাইতো।

যমুনার অনুপস্থিতিতে ঘন ঘন যমুনার ফ্ল্যাটে এসে পাশার বসে থাকা যমুনার ভালো লাগতো না। ভাবতো তপুকে ভালোবেসে হয়তো আসে, যত হোক নিজের সন্তান তো। কিন্তু ফুলি কথায় কথায় পাশার ওই তপুকে নিয়ে ছোঁড়াছুঁড়ির অস্বস্তিতর ঘটনার বর্ণনা করার পর গা ঠাণ্ডা হয়ে যায় যমুনার। তবে কি পাশা তপুকে ভালোবেসে নয়, না-ভালোবেসে আসে! তপুর জন্ম হওয়াটা পাশা পছন্দ করেনি। কিন্তু যমুনা ভেবেছে, জন্ম হওয়া তো কত বাবা কত মা-ই চায় না, কিন্তু একসময় ধীরে ধীরে ভালবাসা জন্ম নেয়।

 পাশার কাছে ফ্ল্যাটের যে চাবিটা থাকে সেটা প্যান্টের পকেট থেকে যমুনা একদিন নিয়ে নিল। পাশা পরে চাবি যখন খুঁজে পাচ্ছেনা, যমুনাই বললো ‘আমি আসলে চাই না তুমি খালি বাড়িতে যাও। আমি অফিস থেকে ফিরলেই না হয় এসো। তোমারও তো অফিস আছে’।

—’মানে?’

—’মানে আবার কী। না বোঝার তো কিছু নেই। আমি চাই না আমি যখন নেই, তুমি আমার ফ্ল্যাটে যাও। তোমার যাওয়াটা ঠিক ভালো দেখায় না। ঘরে অল্পবয়সী কাজের মেয়ে। আজকাল কত রকমের ঘটনা ঘটে’।

—’তার মানে তুমি কি বলতে চাও ফুলিকে আমি রেপ করবো?’

—’সেটা তো বলিনি’।

—’সেটা বলনি, তো কেন বললে আজকাল কত রকমের ঘটনা ঘটে’।

—’নূপুর ঘরে থাকলে ঠিক আছে’।

—’কেন ঠিক থাকবে, আজ ফুলিকে নিয়ে বলেছো, কাল নূপুরকে নিয়ে বলবে’।

—’এসব ইম্পর্টেন্ট কথা নয়’।

—’তবে ইম্পর্টেন্ট কথা কী শুনি! ছোটলোকের মত তো কথা বলেই যাচ্ছো। ছিঃ’।

—’তপুকে খুব ভালোবাসো বুঝি?’

—’বাসিই তো। ওর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে, ফাঁক পেলেই চলে আসি’।

—তা’ই বুঝি। ওর জন্মটাই তো চাওনি। অ্যাবরশনের কথা কত বার বলেছো। তপুকে ভালোবেসে তপুকে স্পর্শ করেছা, কোনোদিন দেখিনি। তপু দেখতে তোমার মত হয়েছে, এ যেন তুমি আরও সইতে পারছো না। তোমার বোধহয় ইচ্ছে করে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে ওর মুখটা কেটে কেটে একটু পাল্টে দিতে, যেন তোমার মেয়ে হিসেবে কোনওদিন ওকে কেউ করতে না পারে, তাই না?’

—’যমুনা তুমি জানোনা তুমি কী বলছো। তপু জন্ম নেওয়ার পর থেকে তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছো না। সারাক্ষণই আমাকে শত্রু বলে মনে করছো। আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, তাই না? তুমি একটা আস্ত স্বার্থপর। আমার আজকাল পাগল পাগল লাগে। সংসার ওদিকে। এদিকে তুমি, তপু। আমি কোনদিকে যাই বলো’।

—’তুমি ওদিকে যাও। ওদিকে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি আর আমি বিয়ে করিনি। তপু অফিসিয়ালি আমার মেয়ে, তোমার সঙ্গে বেসরকারি আত্মীয়তা আছে, সরকারি আত্মীয়তা নেই। তুমি নিশ্চিন্তে সংসার করো’।

সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেত যমুনার। পাশা তপুকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করছে, ফুলির ঘাড়ে সবটা দোষ চাপিয়ে সে দিব্যি ভালোমানুষ বনতে চাইছে, তা বুঝতে যমুনার অনেকদিন সময় লেগেছে। মানুষকে হঠাৎ করে অবিশ্বাস করতে অসুবিধে হয় যমুনার। বিশেষ করে যে মানুষ দীর্ঘদিন পাশে ছিল, দীর্ঘদিন যে মানুষ শুধু মানুষ নয় সবচেয়ে কাছের মানুষ, প্রেমিক ছিল।

তপুকে বাঁচাতে যা কিছু করার প্রয়োজন ছিল, যমুনা করেছে। একবারও তার অনুতাপ হয়নি পৃথিবীতে পাশা বলে কেউ নেই বলে। যমুনা ঠিক নিশ্চিত নয় পাশা কী কারণে অতটা উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, সে কি আসলেই নিজের সংসারের কথা ভেবে যে ওর বউ বাচ্চা বড় হয়ে যদি জানতে পায় যে পাশা অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে শুয়ে একটা বাচ্চা করেছে অন্য বাড়িতে, তাহলে আত্মীয় স্বজনের সামনে আর মুখ দেখাতে পারবে না? এতই যদি মুখ দেখানো নিয়ে সমস্যা পাশার, পাশা কি করে তবে বছরের পর বছর প্রেম করতো যমুনার সঙ্গে! ওভাবে প্রায় স্বামী স্ত্রীর মতো বাস করতো! রাতে হয়তো ঘুমোতে যেত বাড়িতে, কিন্তু অফিসের বাইরে যেটুকু সময় বাঁচে, তার বেশির ভাগ সময়ই তো যমুনাকে নিয়ে কাটাতো। হঠাৎ করে এত বড় পূত-পবিত্র হওয়ার বাসনা কেন পাশার! পাশাও তো সমাজের চোখ রাঙানো, কানাঘুষা, গুঞ্জন এসবকে তুচ্ছ করেছিল!

যমুনার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। নাকি যমুনা দূরে সরে যাচ্ছিল বলে! তপুর জন্ম নেওয়ার পর পাশাকে হয়তো ধীরে ধীরে জীবন থেকেই সরিয়ে দেবে, এই আশংকায় কি পাশা তপুকে নিশ্চিহ্ন করে যমুনাকে আগের মতো ফিরে পেতে চেয়েছিল! আজও যমুনা জানে না। যমুনার অনুতাপ হয় না পাশা নেই বলে, কিন্তু পাশার জন্য তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে। যমুনা করুণার সাগর হতে পারে, আবার হতে পারে কঠিন পাথর। মাঝে মাঝে মনে হয়, নিজেকে সে এখনও আবিষ্কার করছে। এখনও সে একটু একটু করে নিজেকে চিনছে। তপুকে বাঁচাতে সে পাশাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে মুহূর্তে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। নূপুর ময়মনসিংহে তখন। তপুকে নিয়ে ফুলি থাকে ঘরে। সেদিন যদি দুপুরবেলা হঠাৎ ঘরে না ফিরতো যমুনা, তপুকে বাঁচাতে পারতো না। যমুনা গভীর ভাবেই বিশ্বাস করে পারতো না বাঁচাতে। এর মধ্যে হয়তো কিন্তু নেই। সেদিন সকালে নূপুর ময়মনসিংহ থেকে জরুরি টেলিফোন করে যমুনার অফিসে, এক্ষুণি তাকে কোনও এক সার্টিফিকেটের কোনো একটা নাম্বার আর কোনও একটা তারিখ জানাতে হবে। সেগুলো নিতেই যমুনার ঘরে আসা, আর ঘরে এসেই দেখা, বাড়ি ঘর ওলোট পালোট। ফুলি বাথরুমে, তপু বারান্দায় একা, কাঁদছে চিৎকার করে। তপুকে কোলে তুলে নিয়ে দেখে মুখ নীল হয়ে আছে, মাথায় আঘাতের চিহ্ন, সারা গায়ে নখের দাগ, গলায় পাঁচ আঙুলের বসে যাওয়া রক্ত জমা লাল দাগ। যমুনা ফুলিকে ডাকতে ডাকতে দেখে ও ভেতরে বসে আছে বাথরুমের। দরজা ধাক্কাতে থাকলে একসময় খোলে ফুলি দরজা কিন্তু সারা মুখে আতংক। দৌড়ে সে অন্য ঘর থেকে নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে দৌড়ে যায়, পেছন থেকে খপ করে ধরে ফুলিকে পেছনে টেনে আনে যমুনা। এক ঝটকায় ব্যাগটা হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

‘আমি কিছূ জানি না, যা করার পাশা ভাই করেছে’। বলে ফুলি কাঁদতে থাকে জোরে। এমন জোরে কাঁদলে যে কারও ধারণা হবে ফুলিকে পেটানো হচ্ছে।

তখনও বোঝেনি যমুনা পাশা কী করেছে। তার ধারণা হয় পাশা ফুলির সঙ্গে কোনও যৌন সম্পর্কের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তপুর এই হাল কে করেছে! খাট থেকে ফেলে দিয়েছিল! দাঁতে নখে তপুকে ছিঁড়েছে, কিছু একটা ঘটেছে, সেটা কী ঘটেছে! ফুলিকে টেনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে যমুনা জিজ্ঞেস করছে, কাঁপছে তার শরীর, উত্তেজনায়, রাগে। তপুর মুখে জলের বোতলটা ধরতে ধরতেই ফুলি হাওয়া।

ফুলি হাওয়া হয়েছে কিন্তু ব্যাগ নিয়ে নয়। ব্যাগে দশ হাজার টাকা। কোথায় পেয়েছে ফুলি টাকা? যমুনার নিজের কোনও টাকা পয়সা চুরি হয়নি। তবে ফুলির হাতে টাকাটা এল কী করে! তখনও যমুনা সবচেয়ে মন্দ যা হতে পারে, সেই আশংকাটি করেছে, ফুলির সঙ্গে, একটা ষোলো সতেরো বছরের কিশোরীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক পাশা টাকা দিয়ে কিনেছে। সন্ধেয় যমুনার সঙ্গে, রাতে নিজের বাড়িতে নিজের বউ-এর সঙ্গে আর দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারের সময় বা ফাঁক পেলে তপুকে দেখার নাম করে ফুলির সঙ্গে। তখনও যমুনা জানে না যে এ আসলে তপুকে মেরে ফেলার ঘুষ। তখনও যমুনা মন্দটাই ভাবছে, চূড়ান্ত মন্দটা ভাবতে পারেনি।

ফোন করে যমুনা পাশার অফিসে, —’তুমি আজ এসেছিলে আমার ফ্ল্যাটে’?

‘সকালে অফিসে আসার পথে একবার ঢুঁ দিয়ে এলাম। ফুলি ঠিকমত তপুকে দেখছে কি না..’

‘ফুলির ব্যাগে টাকা কেন?’

‘টাকা?’

‘হ্যাঁ টাকা..’

‘তুমি কি ওর সঙ্গে.’.

‘কী ওর সঙ্গে?’

‘ওর সঙ্গে শুচ্ছ?’

‘হা হা হা হা। যমুনা তুমি পাগল হয়ে গেছ। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ। তোমাকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না। আর আমি তোমার কাজের লোকের সঙ্গে শোবো, তাও আবার টাকা দিয়ে? দশ টাকা দিয়ে বাইরে ভারজিন পাওয়া যায়, ফর ইওর ইনফরমেশন। দশ হাজার টাকা লাগে না, ইডিয়েট’।

হ্যাঁ ঠিকই। যমুনা পাগল হয়ে গেছে। যমুনা একটা ইডিয়েট। ফুলির মতো একটা মোটা সোটা কালো মেয়েকে যে মেয়েকে অসুন্দর বা কুৎসিত বলে বিবেচনা করে পুরুষেরা, তাকে দশ হাজার টাকা দিয়ে শোবে পাশা, যেখানে মাগনা শুতে পারছে যমুনার মতো সুন্দরীর সঙ্গে!

—’তাহলে টাকা কোথায় পেল ফুলি?’

—’তা আমি কী করে বলবো! বোধহয় দেশ থেকে এনেছে’।

—’যার দশ হাজার টাকা আছে সে অন্য বাড়িতে কাজ করে না। সে দশ হাজার টাকা ফুরোলে পরে অন্যের বাড়ি কাজ করে’।

—’একবার আমাকে বলছিলও যেন যে ওর বাবার নাকি কী একটা জমি ছিল, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি হয়েছে। চল্লিশ হাজার টাকা ওর মা নিয়েছে, ও নিয়েছে দশ। বলেছিল ও নাকি ব্যাংকে রাখতে চায় টাকা’।

—’কই আমাকে তো বলেনি? তোমাকে বললো কেন?’

—’এটার মধ্যেও তুমি সন্দেহ খুঁজে পাচ্ছো’।

—’আসলে কী জানো পাশা, পাচ্ছি’।

—’সে তোমার প্রব্লেম’।

—’শুধু আমার নয়। এ তোমারও প্রব্লেম। কিছু একটা হচ্ছে আমি যা জানি না। আমার অজান্তে কিছু একটা হচ্ছে’।

যমুনা ফোন রেখে দৌড়োয় ক্লিনিকে। তপুর সারা শরীর পরীক্ষা করে ডাক্তার বলেন, ‘ওকে টরচার করা হয়েছে’। শরীরে বেশ কিছু ইনজুরি। ওর শ্বাস রোধ করারও সম্ভবত চেষ্টা হয়েছে। গলায় দাগ পাওয়া যাচ্ছে আঙুলের। শরীরের অনেক জায়গায় নখের আঁচড়। অনেক জায়গায় রক্ত জমে গেছে। ওকে কি মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল ! ডাক্তার বলেছেন, মেরে ফেলার কিনা বলা যাচ্ছে না, তবে বেবি মিসহ্যাণ্ডলড। কাজের লোকের কেয়ারে বাচ্চা থাকলে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। মনিবের ওপর রাগ কাজের লোক শোধ নেয় বাচ্চাকে টরচার করে’।

—’কীরকম হাত বা আঙুলের দাগ, মেয়ের নাকি ছেলের’।

—’কার হাতে আপনার মেয়েকে রেখে যান। কাজের মেয়ে তো?’

—’হ্যাঁ’।

—’তাহলে মেয়ের’।

—’তা কেন হবে। বাইরে থেকে কোনও ছেলে এসে হয়তো ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে, হয়তো কাজের মেয়েই বাধা দিয়েছে’।

—’হতে পারে। কিন্তু কে এমন একটা ছোট বাচ্চাকে মারতে আসবে? আপনার কী অনেক শত্রু নাকি?’

—’খুব বেশি শত্রুর কী দরকার নাকি? একজন হলেই তো হয়’। যমুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তারের চেম্বারে বসে। ডাক্তার মুচকি হাসেন। যমুনার মুখে একটা তেতো হাসি।

—’আপনার কি মনে হয় বাইরের কেউ করেছে? তাহলে থানায় ডায়রি করুন। আর কাজের লোকের কাছে মেয়েকে একা রেখে যাওয়াটা একদমই রিকমেণ্ড করছি না। কিছু মলম লাগান, কিছু সিরাপ খাওয়ান বাচ্চাকে’।

যমুনা অফিস থেকে ছুটি নেয়। ফুলি কোথায় গেছে কিছুই জানে না সে। নূপুরকে ঘটনা জানায় ফোনে, দ্রুত চলে আসতে বলে। নূপুর দুদিন পর ফেরে। ওই দুদিন যমুনা তপুকে ছেড়ে এক মুহূর্ত কোথাও নড়েনি। ওই দুদিনেই অনেক কিছু ঘটে যায়।

যমুনার ফুলিকে দরকার। গহীন গ্রামের মেয়ে, ঢাকা শহরে কোনোদিন আসেনি। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে কোথায়।

পাশা এলে যমুনা পাশাকে প্রশ্ন করে।

—’ফুলি কোথায়?’

—’সে আমি কী জানি’।

—’তুমি নিশ্চয়ই জানো। টাকা দিয়েছো’।

—’মানে?

—’তুমি ফুলিকে দশ হাজার টাকা দিয়েছো। তোমার সেক্স যদি এখানে ইস্যু না হয়, তাহলে তপুকে কিছু একটা করার জন্য টাকা দিয়েছো’।

—’তুমি পাগল হয়ে গেছ যমুনা। তপু আমার মেয়ে’।

—’তোমার মেয়ে, সে জানি। কত কত বাবা তাদের পাঁচ বছর তিন বছর এমন কী দু’তিন মাসের বাচ্চাকে রেপ করছে। দেখ না খবরের কাগজে?’

—’তোমার জিভটা টেনে বার করে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে’।

—’আমার কিন্তু তোমাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

পাশাকে মেরে ফেলতে যমুনা তখনও হয়তো প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত তখন নেয়, যখন পাশা যমুনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তপুকে খাট থেকে উঠিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়। তপুর মাথা মেঝেয় পড়েনি। মেঝেয় তোশক ছিল ফুলির, ওখানে লেগে বেঁচেছে। কিন্তু কাচের আলমারিতে ধাক্কা খায় শরীর। যমুনা দ্রুত তপুকে কোলে তুলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে। কিছুক্ষণ তপুর জ্ঞান ছিল না। তপুকে বাঁচাতে হাতে টাকা নেই, পয়সা নেই, পায়ে জুতো নেই যমুনা দৌড়োয়। বেবিট্যাক্সি নেয়।

হয় তপু বেঁচে থাকবে, নয় পাশা। যমুনা তখন উন্মাদ। তপুর উড়ুর ভেতর ঢুকে গেছে কাচ। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেই রক্ত বন্ধ করতে যমুনা চেপে ধরেছে নিজের আঁচল দিয়ে। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে পৌঁছে বেবি ট্যাক্সিওয়ালাকে শুধু বললো, ‘আমার বাসায় গিয়ে কাল ভাড়াটা নিয়ে নিও’।

টাকা লাগবে না আপা, আপনার বাচ্চাটারে বাঁচান।

আহ, এই গরিব বেবিট্যাক্সিওয়ালারও বাচ্চার জন্য মায়া আছে। শুধু বোধহয় পাশারই নেই। যমুনা চেনা দুজন ডাক্তারদের হাতে বাচ্চাকে সঁপে দিয়ে ছোটে কলাবাগানের দিকে। ফ্ল্যাটে গিয়ে তার টাকা আনতে হবে। প্রাইভেট হাতপাতালে আগে টাকা দিতে হয়। না দিলে চিকিৎসাই শুরু করবে না। চেনা বলে হয়তো কিছুটা খাতির করবে, কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী, টাকা হাতে থাকা ভালো। বেবিট্যাক্সি দাড় করিয়ে রেখে সে ফ্ল্যাটে ঢোকে। দরজা হাঁ খোলা। ফুলিকে কয়েকবার ডাকে। হঠাৎ খেয়াল হয় ফুলি পালিয়েছে। ফুলির ব্যাগ আছে, ব্যাগে টাকা নেই। ঘরে পাশা নেই। তাহলে ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে সেও পালিয়েছে। কোনও প্রমাণ আর রইলো না সে যে ফুলিকে টাকা দিয়েছে। যমুনার খুব ইচ্ছে করে ফুলিকে পেতে। ফুলিই সমস্ত জানে কী ঘটেছে। ‘সব পাশা ভাই করেছে যা করেছে’, ফুলি বলেছিল কেঁদে কেঁদে। কী করেছিল পাশা, ফুলি আর বলেনি। ভয়ে পালিয়েছে। একবার ফুলির সঙ্গে কথা বলা দরকার যমুনার। তার মাথা ঘোরে। ঘুরতে থাকে। নিজের টাকার ব্যাগখানা নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যায় যমুনা। ঘেন্নায় রাগে বার বার সে থুতু ফেলে। এই পাশা লোকটির সঙ্গে সে কতগুলো বছর কাটিয়েছে। কত কত দিন তাকে সে রেঁধে খাইয়েছে। পাশার কাপড় চোপড় কেচে ইস্ত্রি করে দিয়েছে। কত কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেছে। কতগুলো বছর সে পাশাকে বলেছে সে ভালোবাসে পাশাকে। জল উপচে ওঠে চোখে। চোয়াল শক্ত হয় যমুনার। দাঁতে দাঁত ঘসে। চোখের সামনে ঘটেছে, তারপরও তার অবিশ্বাস্য লাগে দৃশ্যটি, পাশা আজ তপুকে ছুড়ে মেরেছে মেঝেয়, যেন ও মরে যায়। বয়স ওর এক বছর ছ’মাস মোটে। হাসপাতালে তপুকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে ডাক্তাররা। পাশা আজ তপুকে আঘাত করার জন্য ছুড়ে ফেলেনি। যা করেছে মেরে ফেলার জন্য করেছে। মেরে ফেলার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। যমুনার আর কোনও সুবিধে হয় না এটুকু বুঝতে যে ফুলিকে টাকাটা পাশাই দিয়েছিল যেন মেরে ফেলে তপুকে। আজ যদি তপু প্রাণে বেঁচে যায় তবে পাশার হাত থেকে বাঁচবে কী করে। পাশা তপুকে বাঁচতে দেবে না। পালিয়ে যমুনা যাবে কোথায়!

 তপুকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রেখেছে। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। শরীরে বিঁধে থাকা কাঁচ তোলা হয়েছে। ক্ষতের ড্রেসিং চলছে। শরীরে বিঁধে থাকা কিছু কিছু ক্ষতে আবার ইনফেকশন ধরেছে। মাথায় ব্যাণ্ডেজ। ইঞ্জেকশান চলছে। হাসপাতালে দু’দিন রাখতে হবে। ফ্ল্যাটে থাকার চেয়ে তপুর হাসপাতালে থাকাই এখন নিরাপদ। একটা আয়া রাখে যমুনা তপুর দেখাশোনা করার জন্য। অনেক রাতে বেরোয় সে। ঘরে পৌঁছে দেখে পাশা। পাশা শুয়ে আছে বিছানায়। অন্য দিন এভাবে শুয়ে থাকা পাশাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতো যমুনা। পাশা ঘুরে যমুনাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে চুমু খেতো। উতল প্রেমে দুজন মেঘের ওপর ভাসার মতো ভাসতো আর রেইনবো ছুঁতো। আহ সেই রেইনবো রেইনবো খেলা। আজ অন্য খেলা খেলবে যমুনা।

ইলেকট্রিকের তার ছিল রান্নাঘরে। নিয়ে আসে। পাশা আজ তপুকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটাবার পরও যমুনার ফ্ল্যাটে এসেছে, এর কী কারণ! তার ভয় নেই! এত নির্লজ্জ লোক যমুনা আর দেখেনি জীবনে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, ঘুমিয়ে আছে কী, নাকি যমুনার সারেণ্ডারের অপেক্ষা করছে। দুজনে ঝগড়া হওয়ার পর পাশার অভ্যেস উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা। আর অপেক্ষা করা যমুনা একটু একটু করে পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। তার মানে যুদ্ধ নয়, ভালোবাসি চল, আপোস করি চল। পাশা কি ভেবেছে জীবনভর আপোস চলে? কিছু কিছু বিষয়ের সঙ্গে তো আপোস করা যায় না।

পেছনে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবে?

—’না। তপু কোথায়?’

—’হাসপাতালে। কী হয়েছিল তোমার। হঠাৎ করে তপুকে ফেলে দিলে কেন?’

—’আমি চাদর টান দিয়েছি, আমি তো দেখিনি তপুকে ওখানে শুইয়ে রেখেছা’।

—’ও তাই বলো, দেখোনি!’

—’তাই তো। ভালো আছে তো তপু? কোন হাসপাতালে বল। দেখতে যাবো’।

—’যেও। আমিই নিয়ে যাবো’।

—’ভেবো না। সেরে যাবে। মাথায় তো চোট লাগেনি’।

—’হ্যাঁ ডাক্তারও বলেছে, বেশি চোট লাগেনি। তারপরও আজ হাসপাতালে থাকুক। কাল সকালে নিয়ে আসবো’।

—দেরি কোরো না।

—’ফ্ল্যাটের চাবি তো তোমার কাছে ছিল না। পেলে কোথায়?’ হেসে জিজ্ঞেস করে যমুনা।

পাশাও হাসতে হাসতে বলে—’জাদু জাদু!’

পেছনে হাত বুলোতে বুলতে পাশার দুটো হাত সে ইলেকট্রিক তার দিয়ে বেঁধে ফেলে।

পাশা ওই উপুড় হয়ে শুয়ে থেকেই বলে,

—’বাঁধছো কেন? লাগছে তো’।

শক্ত করে বেঁধে এরপর পা দুটোও তারে বেঁধে ফেলে।

—’কী হচ্ছে কী!’

বেশ কয়েকবার পাশা তার নিজের হাত পা বেঁধেছে সঙ্গম করতে গিয়ে। পাশার শখ। এতে নাকি সে সুখ পায় বেশি।

যমুনা পাশার নিতম্বে হাত বুলোতে বুলোতে হাতখানা প্যান্টের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। পাশার গলা থেকে আদুরে শব্দ বেরোতে থাকে। পেছন থেকেই সে তার পায়ের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে পুরুষাঙ্গটির ওপর হাত বুলোয়। পাশা উল্টে শুতে যায়। যমুনা থামিয়ে দেয়। হাতটা অণ্ডকোষে বুলোয়। এবার চেপে ধরে সমস্ত শক্তিতে যমুনা। আর্তচিৎকার করে কুঁচকে কুঁকড়ে যেতে থাকে পাশা। দু’হাতে চাপতে থাকে যমুনা। যমুনা গান চালিয়ে দিয়েছিল, এবার শুধু এক হাত বাড়িয়ে গানের শব্দটা বাড়িয়ে দেয়, যেন পাশার আর্তচিৎকার বাইরের কেউ শুনতে না পায়। পাশা গোঙাতে থাকে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। এবার উঠে এসে পাশার মুখ হাঁ করিয়ে যমুনা হুইস্কি ঢালতে থাকে মুখে। প্রায় আধ বোতল র’ হুইস্কি সে গেলায় পাশাকে দিয়ে। এরপর দু’চাক পাউরুটির মধ্যে ইদুর মারার ওষুধ পুরে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। দিয়ে বড় শক্ত টেপ লাগিয়ে দেয় মুখে। ছটফট করে চূড়ান্ত পাশা। না পারে ছিঁড়তে হাতের তার, না পারে পায়ের।

শরীর প্রায় নিথর হয়ে পড়ে যখন রইল, হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল যমুনা। না মরেনি তখনও। শরীরটাকে টেনে গেটের ওপারে ছেড়ে দিয়ে আসে, বড় রাস্তা থেকে একটা রিক্সা বা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে নাও। পাশা সামনের দিকে টলতে টলতে হাঁটতে থাকে। মাতাল বলে কেউ কেউ গালিও দেয়। যমুনা চেয়েছে তার ত্রিসীমানার বাইরে গিয়ে মরুক।

পরদিন তপুকে হাসপাতালে দেখে যখন বাড়ি ফেরে দুপুরে, দেখে নূপুর এসেছে। নূপুরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো অনেকক্ষণ যমুনা। তারপর সব বললো সে নূপুরকে। সব। কত যে ধকল গেছে তার ওপর, নূপুরকে সব বলতে পেরে সে যেন মুক্তি পেল সেদিন। যমুনা নূপুরের জন্য ব্যাংকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে নূপুর ময়মনসিংহে গিয়েছিল কলেজের কিছু সার্টিফিকেট তুলতে, ঢাকায় ফিরেই দেখে সব ওলোটপালোট। জগত বদলে গেছে।

নূপুর চুপ হয়ে শুনে বললো, বুবু, তুমি তপুকে নিয়ে আজই কোথাও চলে যাও।

—কোথায় যাবো?

—দূরে কোথাও।

—দূরে কোথাও মানে?

—আমার খুব ভয় হচ্ছে। তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে ওরা।

—কারা?

—পাশার আত্মীয়রা।

—পাশা তো মরেনি। বোধহয় ও মরেনি।

—কী করে জানো ও মরেনি?

—হাঁটছিল তো। হাসপাতালে পৌঁছে যেতে পারলে তো মরবে না।

—’রাস্তায় কোথাও হয়তো মরে রয়েছে। এক মুহূর্ত দেরি করো না। আমার ভয় হচ্ছে। সারাজীবন জেলে কাটাতে হবে, বা মৃত্যু দণ্ড হবে। তপুর জন্য বাঁচো। নিজের জন্য বাঁচো। পাশার মতো পাষণ্ড একটা লোকের জন্য নিজের জীবনটাকে নষ্ট করো না’।

নূপুরের উপদেশ যমুনা শুনেছিল। পরদিনই ভিসা, পরদিনই টিকিট। পরদিনই দিল্লি। নতুন একটা অদ্ভুত জীবন শুরু হয় তখন যমুনার।

পরদিন কলাবাগানের বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। নূপুর জানিয়ে দিয়েছে পাশা টাশার খবর কিছু সে জানে না। কিছুদিন গেলে যতটুকু জানতে পেরেছে, তা হল, পাশা নাকি শাহবাগের রাস্তার ধারে পড়েছিল। পুলিশ তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে তখনও সে কাতরাচ্ছিল। ডাক্তারদের স্ট্রাইক ছিল। তিনঘণ্টা ইমারজেন্সিতে চিকিৎসাহীন অবস্থায় শুয়ে থাকার পর মারা গেছে পাশা। ‘তক্ষুনি যদি স্যালাইন ট্যালাইন দেওয়া হত, বাঁচতো’— নূপুরের এক পরিচিত ডাক্তার এরকমই বলেছে। সেই ডাক্তার ঢাকা মেডিক্যালে চাকরি করে, যে মেডিক্যালে পাশাকে নেওয়া হয়েছিল। পাশার আত্মীয়রা চায়নি কোনও পোস্ট মর্টেম করাতে। পোস্ট মর্টেম হয়নি। নূপুর স্বস্তির শ্বাস ফেলে। পুলিশ তিনদিন যমুনার খোঁজে কলাবাগানে এসেছিল। নূপুরকে যমুনা ভেবে নানা রকম প্রশ্ন করে চলে গেছে। পাশার পরিবার থেকে চায়নি কেউ পাশার প্রেমিকা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে। পাশা সরকারি অফিসের মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ার। স্ত্রী শিক্ষিকা। দুই পুত্র সন্তানের পিতা। সমাজে মান ইজ্জত আছে। মদ খেয়ে শিক্ষিত ভদ্রলোক তার ওপর আবার সরকারি বড় অফিসার রাস্তায় পড়ে থাকতো বা গোপনে কারও সঙ্গে প্রেম করতো বা কারও বাড়িতে শুতে যেত এসব জানাজানি হলে আর রক্ষে নেই। যে গেছে সে আর ফিরে আসবে না। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোলে মুশকিল। কেঁচো খোঁড়ারই দরকার নেই। মৃত্যুকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক মুত্যু বানিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নূপুর ভাবতে থাকে তপুকে বাঁচানোর জন্য যে উপদেশ নূপুর যমুনাকে দিয়েছিল, যমুনা শুনেছিল। কিন্তু জয়কে বাঁচাতে যে উপদেশ দিয়েছিল যমুনা, তা নূপুর শোনেনি। জয়কে তাই বাঁচাতেও পারেনি নূপুর। যমুনা ছিল একটা নতুন দেশে একটা অসুস্থ বাচ্চা কোলে নিয়ে আসা কাউকে চেনে না, কাউকে জানে না একটা অসহায় মেয়ে। কতই আর বয়স ছিল যমুনার! সে যখন বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে লড়ছে নতুন মাটিতে, নূপুর তার প্রেমিক প্রবর শওকতকে ধুমধাম করে বিয়ে করেছে। আত্মীয় স্বজনের দোয়া আর আশীর্বাদ নিয়ে নতুন দম্পতি পাড়ি দিয়েছে আমেরিকায়। নূপুরকে নতুন মাটিতে একা সংগ্রাম করতে হয়নি। কোথায় কলাবাগান! কোথায় দু’বোনের এক বাড়িতে বাকি জীবন হেসে খেলে ভালোবেসে যাপন করার স্বপ্ন! আচমকা এক ভূমিকম্প এসে দু’দিকে দু’বোনকে ছুড়ে ফেলে দিল। শুরু করলো দুটো নতুন জীবন, দু’বোন দুদিকে।

 নির্মলা ডাকে, নূপুর তুমি চা’টাও খাওনি! ও তো জল হয়ে গেছে।’ তাই তো! অনেকক্ষণ চা দিয়ে গেছে নির্মলা। নূপুর বসেই আছে নিচতলার সোফায়। ব্রজরা অনেকক্ষণ চলে গেছে। নূপুরের কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনি, কিছু পান করতে বা খেতে ইচ্ছে করেনি। এবার তাড়া দেয় নির্মলা, ‘চান করে এসো। খাবে’।

নূপুর বলে, ‘তুমি খেয়ে নাও, আমার এখন ক্ষিধে নেই’।

নূপুরের সারা শরীরে অবসাদ। সোফায় শুয়ে থাকে। হাত গুটিয়ে। পা গুটিয়ে। খুব শীত বোধ হয় নূপুরের। যেন যমুনার মতো সেও হিমঘরে শুয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *