২. স্মার্ট ফোন আসক্তি

২. স্মার্ট ফোন আসক্তি

প্রিয় ডিকেটটিভ শাহরিয়ার সাহেব।

আমার শুছেচ্ছা নিবেন। আমি ফারজানা বেগম, একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। আমি একটি বিষয়ে আপনার সাহায্য প্রার্থী।

আমার ১৪ বছরের ছেলে স্মার্টফোনে মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত। তার আসক্তি দূর করার জন্য আমি ইন্টারনেটে খোঁজখবর নিয়ে একটি স্মার্টফোন আসক্তি দূরীকরণ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু এই কেন্দ্রের কর্ম পদ্ধতি আমার কাছে নিষ্ঠুর এবং অমানবিক মনে হয়েছে। বিষয়টি আমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং যথাযথ দপ্তরকে অবহিত করেছিলাম। অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার তারা কেউ এই নিরাময় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। এবং এই নিরাময় কেন্দ্রটি তাদের নিষ্ঠুর এবং অমানবিক পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থোপার্জন করে যাচ্ছে।

আমার একান্ত অনুরোধ আপনি এই কেন্দ্র সম্পর্কে তদন্ত করে তাদের সম্পর্কে সত্য উদ্ঘাটন করুন।

আমার ছেলের স্মার্টফোন আসক্তি নিজ থেকেই অনেকাংশে দূর হয়েছে বলে তাকে এই কেন্দ্রের সাহায্য নিতে হয় নাই।

বিনীত

ফারজানা বেগম

ছোটাচ্চু ই-মেইলটি দুইবার পড়ল। দেশে মাদকাসক্তি দূর করার জন্য নানারকম কেন্দ্র আছে জানতো কিন্তু স্মার্টফোনের যন্ত্রণা থেকে বাচ্চাকাচ্চাদের রক্ষা করার জন্যও যে নিরাময় কেন্দ্র তৈরি শুরু হয়েছে এই ব্যাপারটা মনে হয় নতুন। ব্যাপারটা খারাপ না কিন্তু এই মহিলার ই-মেইল পড়ে মনে হচ্ছে কেন্দ্রগুলো বাড়াবাড়ি কিছু করছে! কে জানে মারধোর অত্যাচার করে কিনা।

ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ চিন্তা করল, সে ডিটেকটিভ কাজ মোটামুটি ছেড়ে দেবে ঠিক করেছে কিন্তু ডিটেকটিভ কাজ তাকে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। ছোটাচ্চু তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে দাদির ঘরে গেল, দূর থেকেই বাচ্চাদের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে!

ছোটাচ্চুকে দেখেই বাচ্চারা চিৎকার করতে থাকে, “ছোটাচ্চু! ছোটাচ্চু!”

ছোটাচ্চু তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, “কী হলো? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন? আমাকে আগে দেখিস নাই নাকি?”

একজন বলল, “দেখব না কেন? কিন্তু প্রত্যেকবার দেখলে চিৎকার দেওয়া হচ্ছে নিয়ম।”

“এই নিয়ম কে তৈরি করেছে?”

“আমরাই তৈরি করেছি।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তুমি এভাবে তোমার গাল চুলকাচ্ছে কেন? তোমার কী চুলকানি হয়েছে?”

আরেকজন বলল, “না! না! চুলকানি না। ছোটাচ্চু কিছু একটা চিন্তা করছে। ছোটাচ্চু যখন কিছু চিন্তা করে তখন এভাবে গাল চুলকায়।

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিই বলেছিস! আমি একটা জিনিস চিন্তা করছি।

“কী চিন্তা করছ ছোটাচ্চু? আমাদেরকে বলে দাও, আমরা তোমার চিন্তাটা সবাই মিলে করে দিই।”

আরেকজন বলল, “তুমি একলা একলা চিন্তা করলে সব আউলা-ঝাউলা করে ফেলবে। আমরা ঠিক ঠিক চিন্তা করে দেব।

ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে বসে বলল, “আমি ঠিক করেছিলাম ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দেব। কিন্তু ডিটেকটিভ কাজ আমাকে ছাড়ছে না। প্রত্যেক দিনই কিছু-না-কিছু কাজ চলে আসছে।”

ছোটাচ্চু এমনভাবে বলার চেষ্টা করল যে এসব কাজ চলে আসার জন্য সে খুব বিরক্ত কিন্তু তার মুখ থেকে বোঝা গেল মনে মনে ছোটাচ্চু বেশ খুশি।

শান্ত বলল, “কী কাজ বল ছোটাচ্চু। দেখি আমরা করে দিতে পারি কিনা।”

ছোটাচ্চু বলল, “একজন ভদ্রমহিলা আমাকে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে। তার ছেলে স্মার্টফোন এডিক্ট।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এডিক্ট মানে কী?”

শান্ত টুম্পার মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, “গাধা! তুই এডিক্ট মানেও জানিস না? এডিক্ট মানে হচ্ছে নেশা করা। মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হিরোইন এসব খেয়ে মানুষ এডিক্ট হয়।”

টুম্পা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একটু দূরে সরে গিয়ে বলল, “কিন্তু স্মার্টফোন খাবে কীভাবে? দাঁত ভেঙে যাবে না?”

শান্ত আরেকটা চাটি মারার জন্য উঠে যাচ্ছিল, টুনি তাকে রক্ষা করে বলল, “শান্ত ভাইয়া! কেন টুম্পাকে জ্বালাচ্ছ? সবাই তোমার মতো ড্রাগসের এক্সপার্ট না।” তারপর টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্মার্টফোন এডিক্ট মানে হচ্ছে যে দিন রাত স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকে। ফেসবুক করে, না হলে ইউটিউব করে।”

টুম্পা ভয়ে ভয়ে বলল, “কেন?”

প্রমি বলল, “এইটা মিলিওন ডলার প্রশ্ন। আমাদের শান্ত মনে হয় এই লাইনে যাচ্ছে। কয়দিন পরে শান্তকে জিজ্ঞেস করিস সে তখন বলে দেবে।” শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কক্ষনো না। নেভার। কভি নেহি।”

প্রমি মুচকি হেসে বলল, “দেখা যাবে!”

শান্ত বলল, “যারা এমনিতেই স্মার্ট তাদের স্মার্টফোন লাগে না। যারা একটু বোকা ধরনের তাদের স্মার্টফোন ছাড়া সময় কাটে না।”

টুনি বলল, “কিন্তু আমরা ছোটাচ্চু কথাটাই এখনো শুনতে পেলাম না। ছোটাচ্চু তুমি বল। এডিক্ট ছেলের মা কী লিখেছে?”

“লিখেছে সে তার ছেলেকে একটা স্মার্টফোন আসক্তি-নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে গেছে। সেখানে নাকি স্মার্টফোনের আসক্তি দূর করার জন্য টর্চার করে!”

শাহানা বলল, “টর্চার?”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “তাইতো লিখেছে। নিষ্ঠুর এবং অমানবিক কর্ম পদ্ধতি, সোজা বাংলায় টর্চার!”

টুম্পা বিড়বিড় করে বলল, “সোজা বাংলা না সোজা ইংরেজি?”

শান্ত একটা ধমক দিল, “তুই চুপ করবি?” তারপর ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে টর্চার করে ছোটাচ্চু?”

“সেইটা লিখে নাই।”

“মনে হয় শক্ত একটা স্মার্টফোন দিয়ে মাথায় বাড়ি দিতে দিতে রক্ত বের করে ফেলে!”

বাচ্চাদের কথাবার্তার জন্য দাদি তার টেলিভিশনে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। শান্তর কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী আজেবাজে কথা বলিস তুই শান্ত? একদিন একটা ভালো কথা বলতে পারিস না?”

স্মার্টফোন দিয়ে টর্চার করার আরেকটা ফিচলে বুদ্ধি শান্তর মাথায় এসেছিল কিন্তু দাদির ধমক খেয়ে সে আর সেটা বলার সাহস করল না।

টুনি বলল, “তোমাকে কী করতে হবে সেটা এখনো বল নাই ছোটাচ্চু।”

“তোরা আমাকে বলতে দিলে তো বলব? আমাকে তো কথাই বলতে দিচ্ছিস না।”

টুনি বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন সবার কথা বন্ধ। এখন ছোটাচ্চু কথা বলবে।”

সবাই চুপ করল। তখন ছোটাচ্চু বলল, “স্মার্টফোন এডিক্টর মা ব্যাপারটা পুলিশ র‍্যাব সবাইকে জানিয়েছে কিন্তু তারপরও এই নিরাময় কেন্দ্রকে কেউ ধরছে না। তারা ব্যবসা করে যাচ্ছে।

“কেউ তাদের ধরছে না কেন?”

“সেইটাই ভদ্রমহিলা বুঝতে পারছে না। আমাকে বলেছে আমি রহস্য উদ্ঘাটন করে দিতে পারব কি না।

টুনি বলল, “তুমি কী রাজি হয়েছ?”

“এখনো কিছু বলি নাই। রাজি হব কি না বুঝতে পারছি না ৷ ডিটেকটিভ কাজ করতে আর ইচ্ছা করে না।”

শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কতো টাকা দিবে বলেছে?”

ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “এখানে টাকার কথা কেন আসছে?”

শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী আশ্চর্য। টাকার কথা না আসলে কিসের কথা আসবে? আগে টাকার কথা তারপর অন্য কিছু!”

শাহানা বলল, “অনেক হয়েছে শান্ত, এখন চুপ কর।”

শান্ত গরম হয়ে বলল, “অনেক হয়েছে মানে কী? আমি তো কিছু বললামই না। ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ এজেন্সি ফেল মেরেছে কেন? কারণ–”

ছোটাচ্চু চোখ লাল করে বলল, “মোটেও ফেল মারে নাই। ঐ বদমাইশ সরফরাজ কাফী ষড়যন্ত্র করে আমার এজেন্সি দখল করেছে!”

“একই কথা। এর পিছনেও আছে টাকা! টাকা এবং টাকা! সবার প্রথমে তুমি জিজ্ঞেস করবে কত টাকা পাবে। তারপর ঠিক করবে তুমি কাজ নিবে কিনা। তোমার যদি লজ্জা লাগে আমাকে ই-মেইল এড্রেসটা দাও আমি একটা ই-মেইল পাঠাই ৷”

শাহানা বলল, “শান্ত, তুই বড় হয়ে কী করিস সেটা দেখার আমার খুব ইচ্ছা।”

শান্ত বুকে থাবা দিয়ে বলল, “সবচেয়ে কম বয়সে বিলিওনিয়ার হব, দেখে নিও।”

প্রমি বলল, “উঁহু। তুই সবচেয়ে কম বয়সে দুর্নীতির দায়ে জেলে যাবি ৷”

শান্ত বলল, “ভালো হবে না। ভালো হবে না কিন্তু।”

ছোটাচ্চু আর পারল না। সে উঠে তার গাল ঘষতে ঘষতে নিজের রুমের দিকে রওনা দিল। দাদি (কিংবা নানি) একটা হুংকার দিলেন, “তোরা চুপ করবি একটু? চুপ করবি?”

বাচ্চারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করল তারপর আবার চেঁচামেচি শুরু করে দিল।

.

ছোটাচ্চু পিছু পিছু টুনিও তার ঘরে চলে এসেছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তুমি কাজটা নিবে কিনা কখন ঠিক করবে?”

“বুঝতে পারছি না।”

“কিন্তু শুধু ই-মেইলে কয়েক লাইন পড়ে কি আর ঠিক করতে পারবে? তোমার ঐ ছেলের মায়ের সাথে কথা বলা দরকার না?

ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম।”

“আমার মনে হয় তুমি তার সাথে কথা বল। সবচেয়ে ভালো হয় যদি তাকে এই বাসায় আসতে বল। তাহলে ভালো করে কথা বলতে পারবে!”

আসলে এই বাসায় এসে কথা বললে বাচ্চারা সবাই জানালার নিচে উবু হয়ে বসে পুরো কথাবার্তা শুনতে পারবে! বাচ্চারা ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ কাজের গোপন কথাবার্তা শুনতে খুব পছন্দ করে।

.

তাই দুদিন পর সত্যিই দেখা গেল স্মার্টফোন এডিক্টের মা চলে এসেছে, বাইরের ঘরে বসে ছোটাচ্চু সাথে কথা বলছে এবং বাচ্চারা লুকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাবার্তা শুনছে।

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনি কীভাবে জানেন এডিকশান দূর করার জন্য নিষ্ঠুর কাজকর্ম করা হয়?”

“সিসি ক্যামেরায় দেখেছি।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “নিজে দেখেছেন?”

“হ্যাঁ। মনে হয় ভুলে দেখিয়ে ফেলেছে। এরকম বিষয় দেখানোর কথা না।”

“কী দেখেছেন?”

ভদ্রমহিলা নড়েচড়ে বসে বলল, “প্রথমে ছেলেটাকে একটা চেয়ারে বেল্ট দিয়ে বেঁধেছে যেন নড়তে চড়তে না পারে। শুধু একটা হাত খোলা। সেই হাতে একটা স্মার্টফোন দিয়েছে। নিশ্চয়ই তাকে বলেছে স্মার্টফোনটা দেখতে। সিসি ক্যামেরায় কথা শোনা যায় না, তাই অনুমান করছি। ছেলেটা যেই স্মার্টফোনটা তুলে দেখেছে ওমনি ইলেকট্রিক শক?”

“ইলেকট্রিক শক?”

“হ্যাঁ। কাছেই একটা প্যানেল সেখানে সুইচ নব এসব। সুইচটা চাপ দেয় সাথে সাথে ছেলেটা কেঁপে উঠে। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বাড়াতে থাকে। ছেলেটার রীতিমতো খিঁচুনি হতে থাকে। কোনো মায়া দয়া নেই!”

ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, “কী সর্বনাশ!”

“শেষের দিকে ছেলেটা আর স্মার্টফোনের দিকে তাকাতে চায় না তখন জোর করে তার চোখ খুলে চোখের সামনে স্মার্টফোনটা ধরে রেখে ইলেকট্রিক শক দেয়।” মহিলা মাথা নেড়ে বলল, “আমি শেষের দিকে দেখতে পারছিলাম না। ঘরে অন্য যারা ছিল সবারই একই অবস্থা!”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনি ওদের সাথে কথা বলেন নাই?”

“বলেছি।”

“তারা কী বলে?”

“তারা বলে এটা নাকি আসক্তি নিরাময়ের স্ট্যান্ডার্ড টেকনিক। তারা কোনো দোষ দেখে না। তারা বলে সারা পৃথিবীতে নাকি এভাবে এডিকশান দূর করা হয়। এভাবে বেশ কিছুদিন চালিয়ে গেলে স্মার্টফোন দেখলেই ছেলেটার মনে হবে সে ইলেকট্রিক শক খাচ্ছে। ভয়ের চোটে আর স্মার্টফোন ধরবে না।

ছোটাচ্চু মাথা নড়ল, বলল, “কী সর্বনাশ!”

ভদ্রমহিলা আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। যাওয়ার সময় একটা খাম টেবিলে রেখে বলল, “আমি জানি না আপনার ফি কত কিংবা কীভাবে ফি দিতে হয়। তাই এই খামে কিছু সম্মানি রেখে গেলাম আর কত দিতে হবে জানাবেন।

জানালার নিচে লুকিয়ে থাকা শান্ত হাতে কিল মেরে ফিসফিস করে বলল, “ইয়েস!”

কিন্তু ছোটাচ্চুর কথা শুনে তার পুরো উত্তেজনা দপ করে নিভে গেল। ছোটাচ্চু বলল, “না-না-না। আমি এসব কাজে মোটেও এডভান্স নিই না। যদি কাজ নিই, কাজ শেষ হওয়ার পর যদি পেমেন্ট করতে হয় তখন দেখা যাবে।’

ভদ্রমহিলা আরেকটু জোর করল কিন্তু ছোটাচ্চু রাজি হলো না। শান্তর যা মেজাজ খারাপ হলো সেটা বলার মতো না।

স্মার্টফোন এডিক্টের মা চলে যাবার পর শান্ত ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু তোমার কোনো আশা নাই। তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।”

প্রমি বলল, “ছোটাচ্চু তুমি শান্তর কথাকে কোনো গুরুত্ব দিও না। তুমি যেটা করেছ ঠিকই করেছ।”

মুনিয়া সবচেয়ে ছোট, সে রিনরিনে গলায় বলল, “টাকার পিছনে ছুটতে হয় না। টাকাই তোমার পিছনে ছুটবে!”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই এই দার্শনিকের কথা কোথা থেকে শিখেছিস?”

মুনিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “আমাদের স্যার বলেছে।”

“স্যার কী করে?”

“স্যারের বিশাল কোচিং সেন্টার আছে।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “এই জন্যই টাকা তার পিছু পিছু ছুটছে।”

শাহানা বলল, “টাকার কথা বাদ দাও ছোটাচ্চু। তুমি এই কাজটা নিবে কি না বল।”

একসাথে অন্য সবাই বলল, “নিতেই হবে ছোটাচ্চু। নিতেই হবে। ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “ভেবে দেখি।”

সবাই কিছু-না-কিছু বলছে শুধু টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ কিছু একটা ভাবতে থাকে। তার শুধু মনে হয় একটা প্যানেলে সুইচ আর নব, সেই সুইচ টিপে নব ঘুরিয়ে মানুষকে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার ব্যাপারটা সে জানি আগে কোথায় দেখেছে। কোথায় দেখেছিল সে মনে করতে পারছিল না। ভুরু কুঁচকে টুনি চিন্তা করতে থাকে। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল। সাথে সাথে সে খাওয়া শেষ করে ছোটাচ্চুর কাছে ছুটে গেল ৷ ছোটাচ্চু টুনিকে এত ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে টুনি?”

“তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

“কী কথা?”

“স্মার্টফোন এডিক্টদের জন্য যে জায়গাটা আছে সেখানে তোমার যেতে হবে।”

“আমার যেতে হবে?”

“হ্যাঁ। আমাকে নিয়ে যাবে।”

“তোকে?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“তুমি গিয়ে বলবে আমি স্মার্টফোনে এডিক্ট। তুমি আমাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছ।

“তুই এডিক্ট?” ছোটাচ্চু শব্দ করে হেসে ফেলল।

“আসলে তো না, আমি শুধু ভান করব। একটা স্মার্টফোন নিয়ে যাব সারাক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকব-ওরা বিশ্বাস করবে।”

“ঠিক আছে সেটা না হয় বিশ্বাস করানো গেল, কিন্তু তাতে লাভ কী?”

“আমাকে নিয়ে গেলেই তুমি টের পাবে। শুধু আমি যেটা বলব তুমি সেটা মেনে নেবে। “

ছোটাচ্চু একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে বলল, “কিন্তু যদি সত্যি সত্যি তোকে ইলেকট্রিক শক দিতে শুরু করে–”

“সেটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না ছোটাচ্চু। আমি সেটা দেখব।

এখন পর্যন্ত টুনি ছোটাচ্চুর ডিটেকটিভ কাজকর্মে বড় কিংবা ছোট কোনো অঘটনই ঘটায়নি। তাই তার কথা শুনলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। তারপরেও জেনে শুনে ইলেকট্রিক শক খেতে যাওয়াটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে ছোটাচ্চু বুঝতে পারল না।

ছোটাচ্চু ইতঃস্তত করছে টের পেয়ে টুনি অনুনয় করে বলল, “প্লিজ প্লিজ ছোটাচ্চু আমাকে নিয়ে যাও। আর কিছু যদি নাও হয় তুমি তদন্ত করার সুযোগ পাবে। প্লিজ প্লিজ ছোটাচ্চু! প্লিজ।”

ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত রাজি হলো।

.

তাই দুদিন পর ছোটাচ্চু স্মার্টফোন আসক্তি দূরীকরণ কেন্দ্রে টুনিকে নিয়ে হাজির হলো। বাইরে কোনো সাইনবোর্ড নেই, বিল্ডিংটাকে দেখেও কেমন জানি বাসা বাসা মনে হয়। লিফটে করে পাঁচ তলা গিয়ে এপার্টমেন্টটা খুঁজে বের করে কলিংবেলে চাপ দিল। কিছুক্ষণ পর একজন কম বয়সী মানুষ দরজা খুলে দিল, তাদেরকে ঢুকতে না দিয়ে মুখে প্রশ্ন ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

ছোটাচ্চু বলল, “এটা স্মার্টফোন আসক্তি দূরীকরণ কেন্দ্র না?”

“জী।”

“আমি আমার ভাতিঝিকে নিয়ে এসেছি। তার সিরিয়াস এডিকশান।”

বিষয়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য টুনি ছোটাচ্চুর স্মার্টফোনটার দিকে দৃষ্টি রেখে কান খাড়া করে রেখেছে।

মানুষটা টুনিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল, জিজ্ঞেস করল, “বয়স কত?”

“তেরো।”

“এত কম বয়সে স্মার্টফোন দেওয়া ঠিক হয় নাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “যাই হোক সেটা অন্য ব্যাপার। এখন আমি আপনাদের সার্ভিস নিতে এসেছি।”

মানুষ দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, “আসেন।”

ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে একটা করিডোর ধরে মানুষটার পিছু পিছু হেঁটে গেল। করিডোরের শেষ মাথায় একটা রুমের দরজা খুলে ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে মানুষটা বলল, “আরো একজন এডিক্ট এসেছে।”

ভিতর থেকে কেউ একজন কিছু একটা বলল, তখন মানুষটা দরজা থেকে সরে গিয়ে তাদের ঢোকার জায়গা করে দিল। ভিতরে খুবই সাদামাটা একটা টেবিলে কিছু কাগজপত্র। টেবিলের পিছনে একটা সাদামাটা চেয়ারে কমবয়সী একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার চোখে চশমা, গলায় একটা স্টেথিস্কোপ এবং পরনে সাদা এপ্রন। মানুষটা ভুরু কুচকে টুনিকে দেখল। টুনিও তাকে এক নজর দেখে আবার তার স্মার্টফোনে ফিরে গেল। মানুষটা বলল, “এই যে মেয়ে, তুমি কী এখন তোমার স্মার্টফোনটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখবে?”

টুনি হতাশার একটা ভঙ্গী করে স্মার্টফোনটা ছোটাচ্চুর হাতে দিল। মানুষটা ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “বসেন।” ছোটাচ্চু এবং টুনি বসল। মানুষটা বলল, “আমরা কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি?”

ছোটাচ্চু বলল, “ইন্টারনেটে আপনাদের ওয়েবসাইট দেখে আমরা আপনার সেন্টারে এসেছি। টুনিকে দেখিয়ে বলল, “আমার ভাতিঝি। আমরা টের পাইনি, তার সিরিয়াস সমস্যা–”

টুনি আপত্তি করে বলল, “মোটেও সিরিয়াস সমস্যা নয়। সবাই তো করে।”

ছোটাচ্চু কঠিন গলায় বলল, “তুই চুপ করবি? আমাকে কথা বলতে দে।”

টুনি ছোটাচ্চুর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলো। সেও অভিনয় করে ঠোঁট ওল্টালো, তারপর এদিক সেদিক দেখতে লাগল। ছোটাচ্চু একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “আপনাদের সার্ভিস নেওয়ার আগে আমার কয়েকটা বিষয় জানা দরকার। ঠিক কীভাবে আপনারা সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেন। কয়টা সেশন নিতে হয়, কতদিন লাগে। আপনাদের কত পার্সেন্ট ক্লায়েন্ট ভালো হয়, আবার রিলান্স করে কিনা। আপনাদের অরগানাইজেশন অনুমোদিত কিনা—”

মানুষটা হাসিহাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হলো সে ছোটাচ্চুর কথাগুলি শুনে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা টাইপ করা কাগজ বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিয়ে বলল, “আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমাদের এই ফর্মে আছে। ফর্মটা পড়ে সেটা ফিল-আপ করে আমাদের দেন।

ছোটাচ্চু জানতে চাইল, “এখনই ফিল-আপ করব?”

“হ্যাঁ, এখনই করেন। পাশে আমাদের ওয়েটিং রুম আছে সেখানে ডেস্ক আছে, ফর্ম ফিল-আপ করতে সুবিধা হবে। আপনারা অপেক্ষা করেন সময় হলে আমরা ডেকে নেব।“

ছোটাচ্চু উঠে দাঁড়াল, টুনিও উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী ব্যথা দেবেন?”

মানুষটা শব্দ করে হাসল, বলল, “ব্যথা বলতে কী বোঝাও তার ওপর নির্ভর করে!”

যখন দরজা খুলে বের হয়ে যাবে ঠিক তখন হঠাৎ করে মানুষটা বলল, “আচ্ছা, একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?”

ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে গেল। মানুষটা বলল, “আপনাকে কী আমি আগে কখনো দেখেছি?”

ছোটাচ্চু বলল, “দেখার কথা না। হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে গেলেও মনে থাকার কথা না। মনে হয় আমার চেহারার কোনো ক্রিমিনাল ধরা পড়েছে, পত্রপত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে সেটা আপনার মনে গেঁথে গেছে–”

ছোটাচ্চুর রসিকতা শুনে মানুষটা হা হা করে হাসার ভান করল, যদিও টুনি টের পেলো হাসিটা মোটেও আন্তরিক হাসি না!

টুনি আর ছোটাচ্চু পাশের ঘরে গিয়ে দেখল সেখানে বেশ কিছু মানুষ বসে আছে। কমবয়সী ছেলে এবং মেয়ে এবং তাদের পাশে বাবা কিংবা মা। ছেলে মেয়েগুলোর চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ, বাবা মায়ের মুখে একটুখানি হতাশার চিহ্ন এবং অনেকখানি ভয়ের চিহ্ন।

টুনিকে নিয়ে ছোটাচ্চু একটা খালি ডেস্কে বসে ফর্মটা ফিল-আপ করতে শুরু করল। অনেক বড় ফর্ম, অনেক কিছু লিখতে হয়। দুইজন মিলে বানিয়ে বানিয়ে সেগুলো লেখা শুরু করল। হঠাৎ দেওয়ালে ঝোলানো একটা টিভি স্ক্রিনে একটা ছবি ভেসে উঠল। ছবিটা কয়েকবার কেঁপে কেঁপে ওঠে স্থির হয়ে যায়। তারপর আবার চলতে শুরু করে। এটা সিসি টিভি, ভেতরের কোনো একটা ল্যাবরেটরির দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ছোটাচ্চুকে স্মার্টফোন এডিক্টের মা যেরকম বলেছিল ঠিক সেরকম। সেই ভদ্রমহিলা একটা ছেলের কথা বলেছিল, এখানে একটি চৌদ্দ পনেরো বছরের মেয়ে। মেয়েটাকে ডেন্টিস্টের চেয়ারের মতো একটা চেয়ারে বসিয়েছে, তারপর দুই হাত দুই পা চেয়ারের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেলেছে। মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হলো না, মুখে এক ধরনের তাচ্ছিল্যের হাসি। বুকের উপর দিয়ে আরেকটা বড় স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধেছে। তারপর শরীরের কয়েক জায়গায় মনিটর লাগিয়েছে। কপালের দুই পাশেও মনিটর লাগিয়েছে। সেই মনিটরের সিগন্যালগুলোও দেখা গেল।

কঠিন চেহারার একজন মহিলা একটা কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুঁকে পড়েছে। প্যানেলের পিছন থেকে মহিলাটি কয়েকটা বড় বড় তার বের করল। সেখান থেকে দুটো তার এনে মেয়েটার পায়ের গোড়ালির উপর লাগালো, অন্য দুটি দুই হাতের কব্জির কাছে। মেয়েটার সাথে যে মানুষটা এসেছে তাকে বাইরে যেতে বলা হলো, মানুষটা প্রথমে রাজি হলো না, একটু তর্কাতর্কি হলো তারপর একটু রাগারাগি হলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাইরে চলে যেতে হলো।

কঠিন চেহারার মহিলাটি মেয়েটার হাতে একটা স্মার্টফোন দিল। হাত বাঁধা থাকলেও স্মার্টফোনটা ধরা যায়, তারপর মেয়েটাকে কিছু একটা বলল। মেয়েটা মাথা নাড়ল। স্মার্টফোনটা চালু করে মেয়েটা সেটার দিকে তাকায়, এক হাতেই বেশ দক্ষভাবে সেটাকে টেপাটেপি করতে থাকে। টুনি তীক্ষ্ণ চোখে কঠিন চেহারার মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মহিলা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে কন্ট্রোল প্যানেলে একটা নব ঘোরালো তারপর একটা সুইচে চাপ দিল, সাথে সাথে মেয়েটার শরীর কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। সে একটু অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকালো, মহিলাকে কিছু একটা বলল। মহিলা মাথা নাড়ল, মেয়েটাকে কিছু একটা বলল, মেয়েটা খুবই অনিচ্ছার সাথে হাতের স্মার্টফোনটার দিকে তাকালো। তার মুখের সেই তাচ্ছিল্যের হাসিটা এখন নেই, মুখে একটা ভয়ের ছাপ। মহিলা আবার নবটা ঘুরিয়ে সুইচে চাপ দিল, সাথে সাথে মেয়েটার শরীর কেমন জানি ঝটকা দিয়ে উঠল, এবারে আগের থেকে বেশি। মনে হয় একটা আর্তচিৎকারও করল, কিন্তু সিসি টিভিতে কোনো শব্দ শোনা গেল না ৷

মেয়েটা এখন আর তার স্মার্টফোনের দিকে তাকাতে চাইছে না। জোরে জোরে মাথা নাড়ছে কিন্তু কঠিন চেহারার মহিলাটা জোর করল, মেয়েটা তখন তাকাল আর সাথে সাথেই ইলেকট্রিক শক। এবারে নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি একটা শক, মেয়েটার পুরো শরীর বাঁকা হয়ে যায়, এক ধরনের খিঁচুনি দিতে থাকে, খিঁচুনিটা থামতেই চায় না।

ছোটাচ্চু ভয়ের একটা চাপা শব্দ করে টুনির দিকে তাকাল, অবাক হয়ে দেখল টুনির মুখের একটা চাপা হাসি। ছোটাচ্চু অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী হলো? তুই হাসছিস কেন?”

টুনি ছোটাচ্চুর কানের কাছে মুখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “বুঝতে পারছ না? পুরোটা ভূয়া। একটিং।”

“একটিং?”

“হ্যাঁ।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“আগেই সন্দেহ করেছিলাম, এখন দেখে বুঝতে পারছি।”

“কীভাবে বুঝতে পেরেছিস?”

টুনি খুবই চাপা গলায় বলল, “যখন মহিলাটা সুইচে চাপ দেয় আর যখন মেয়েটা শক খায় সেই টাইম মিলাতে পারছে না। একটু আগে পরে হচ্ছে। তুমি দেখো।”

ছোটাচ্চু টুনির কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না কিন্তু এবারে একটু ভালো করে লক্ষ করল, দেখল সত্যি সত্যি মহিলাটা সুইচে চাপ দেওয়ার আগেই মেয়েটা হঠাৎ প্রচণ্ড শক খেয়ে ছটফট করা শুরু করেছে। এমনভাবে মেয়েটা যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে যে সেটা দেখে ঘরের সবাই আতংকে চিৎকার করে উঠে। কয়েকজন ভয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে, কয়েকজন দাঁড়িয়ে গিয়ে বলছে, “কী হচ্ছে এসব? কী হচ্ছে এখানে?”

শুধু টুনি পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ লক্ষ করল না, শুধু টুনি দেখল হঠাৎ হঠাৎ মেয়েটার মুখে একটা দুষ্টু হাসি খেলা করে উঠে। টুনিকে স্বীকার করতেই হলো মেয়েটা খুবই ভালো অভিনয় করছে।

এবারে মেয়েটা কিছুতেই স্মার্টফোনটা দেখতে চাইছে না–রীতিমতো জোর করে হাতে ফোনটা ধরিয়ে মহিলা ইলেকট্রিক শক দিতে এগিয়ে গেল। টুনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, মহিলাটি সুইচে চাপ দিয়েছে, মেয়েটার একটু দেরি হলো তারপর হাত থেকে স্মার্টফোন ছুঁড়ে দিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। দেখে ভয় লেগে যায়–অনবদ্য অভিনয়।

এবারে ঘরের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। সিসি টিভিটা বন্ধ হয়ে গেল এবং দরজা খুলে পাশের ঘরের সাদা গাউন পরা কম বয়সী মানুষটা উঁকি দিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

প্রায় সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করে, তাই কারো কথাই ভালো করে বোঝা গেল না। তখন একজন বয়স্ক মানুষ অন্য সবাইকে থামিয়ে বলল, “আমাকে বলতে দিন।”

সবাই থামল, তখন বয়স্ক মানুষটা বলল, “আমরা আপনাদের ট্রিটমেন্টের প্রসেস দেখে হতবাক। এটা ইনহিউম্যান, এটা ক্রিমিনাল-

সাদা গাউন পরা মানুষটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “দেখলে একটু অস্বস্তি হয় আসলে এমন কিছু ব্যাপার না। এটা খুবই কমন টেকনিক। ঠিক আছে এখন থেকে সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখব, আপনাদের দেখতে হবে না।

একজন বলল, “সিসি ক্যামেরা বন্ধ রাখলেই তো আর ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।”

আরেকজন বলল, “পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত। নিউজ মিডিয়াকে খবর দেওয়া উচিত!”

কম বয়সী মানুষটা একটুও বিচলিত হলো না, বলল, “মোস্ট ওয়েলকাম। খবর দিতে চাইলে খবর দেন। আপনাদের ইচ্ছা। এখন বলেন, নেক্সট কে ট্রিটমেন্ট নেবে?”

ছেলেমেয়েগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “আমি নেব না। মরে গেলেও নেব না ৷”

মানুষটা খুবই অবাক হলো। বলল, “কেউ নেবে না?”

“না।”

বয়স্ক মানুষটা বলল, “আমাদের তো আর মাথা খারাপ হয় নাই যে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের এভাবে টর্চার করব।”

“না?”

মানুষটা তবু আশা ছাড়ল না। বলল, “তাই বলে কেউ ট্রিটমেন্ট নিবে না?”

টুনি তখন উঠে দাঁড়াল, বলল, “আমি নেব।”

সবাই চমকে উঠল। সবচেয়ে বেশি চমকালো গাউন পরা কম বয়সী মানুষটা। আমতা আমতা করে বলল, “তু-তুমি নেবে?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”

“সত্যি? সত্যি তুমি নিতে চাও?”

“হ্যাঁ।”

ঘরের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, নিজের চোখে দেখার পরও কেউ এরকম একটা ভয়ংকর ব্যাপারের ভিতর দিয়ে যেতে চাইবে!

গাউন পরা মানুষটাও বিশ্বাস করল না। চোখ বড় বড় করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনিও তাকে দিতে চান?”

ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে বলল, “এতো করে যখন চাইছে–“

“কিন্তু কিন্তু –” মানুষটা কথা শেষ করতে পারল না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা এবারে ছোটাচ্চু দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু কেন চাইছে?”

টুনি এবারে কথা বলল, “তার কারণ পুরো ব্যাপারটা ভূয়া।” ঘরের সবাই চিৎকার করে উঠল, “ভূয়া?”

টুনি গাউন পরা মানুষটার দিকে তাকাল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “তাই না ডাক্তার আংকেল?”

মানুষটা একবার খাবি খেলো। ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো তারপর টুনির দিকে তাকালো, তারপর আবার ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো, তারপর বলল, “এই বারে আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি ডিটেকটিভ শাহরিয়ার। আর এই মেয়ে হচ্ছে আপনার এসিস্টেন্ট টুনি! আপনারা গাবড়া বাবাকে ধরেছিলেন।”

ঘরের মানুষজন এবারে ছোটাচ্চু আর টুনিকে ভালো করে দেখার জন্য এগিয়ে আসে–নিজেদের মাঝে কথা বলে। ছোটাচ্চু বলল, “আপনি কিন্তু আমার এসিস্টেন্টের প্রশ্নের উত্তর দেননি! বলেন, পুরো ব্যাপারটা কী আসলেই ভূয়া?

মানুষটা আমতা আমতা করে বলল, “আসলে, আসলে–এটা বলতে পারেন একটা সোস্যাল সার্ভিস। সিসি টিভির ভিডিওটা দেখে অনেকে স্মার্টফোন থেকে সরে আসে, সেই জন্য প্রফেশনাল এক্টর এক্ট্রেস দিয়ে—

ছোটাচ্চু বাক্যটা শেষ করল “একটা ভূয়া ভিডিও বানিয়ে রেখেছেন!”

“আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নাই। আমার উদ্দেশ্য মহৎ”

মধ্যবয়স্ক মানুষটা গর্জন করে বলল, “মহৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণা করা যায় না। ফাজলামো পেয়েছেন?”

ঘরের মাঝে কমবয়সী ছেলেমেয়েগুলো হুংকার দিয়ে বলল, “পুরো ল্যাব জ্বালিয়ে দিব। জ্বালিয়ে শেষ করে দেব।”

টুনি আস্তে আস্তে বলল, “আমার মনে হয় জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো ল্যাব নাই। কিছু নাই!”

গাউন পরা মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছ। নাই, কিছু নাই।”

যণ্ডা টাইপের একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, “তাহলে এই ঘর আর অফিসটাই ভাংচুর করে যাই।” সে যে আসলই ভাংচুর করার জন্য রেডি সেটা বোঝাবার জন্য একটা চেয়ার তুলে নেয়।

গাউন পরা মানুষটা এবারে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, “শাহরিয়ার সাহেব! প্লিজ এদেরকে একটু বোঝান আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নাই, আমি এখান থেকে কোনো টাকা কামাই করি না, জাস্ট একটু ফান–”

ছোটাচ্চু বলল, “প্রতারণা করে ফান হয় না। যাইহোক আপনি যান, আমি দেখছি।”

টুনি ভেবেছিল মানুষটা বুঝি শুধু ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। কিন্তু দেখল শুধু ঘর থেকে নয়, বাইরের দরজা খুলে খুবই তাড়াতাড়ি একেবারে বাসার বাইরে চলে গেল। একা নয়–একসাথে তার এসিটেন্টও! সহজে ফিরে আসবে বলে মনে হয় না!

ছোটাচ্চু তখন কথা বলে সবাইকে শান্ত করল, তাদেরকে বলল সে এসেছেই তদন্ত করার জন্য! তদন্ত করার কিছু নাই, পুরো ব্যাপারটাই একটা রসিকতার মতো। মানুষটা অন্তত একটা কথা সত্যি বলেছে, সে এখান থেকে কোনো টাকা কামাই করেনি। করার কথা না!

সবাই মোটামুটি শান্ত হলো, একটু হাসাহাসি হলো এবং তখন টুনি আর ছোটাচ্চুকে বেশ কিছু সেলফি তুলতে হলো।

.

ফিরে আসার সময় ছোটাচ্চু টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে অনুমান করেছিলি এটা ভূয়া হতে পারে? আমি তো বুঝতেই পারিনি!”

টুনি বলল, “মিলগ্রাম নামে একজন সাইকোলজিস্টের এরকম একটা বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট আছে, ভূয়া ইলেকট্রিক শক দেওয়ার এক্সপেরিমেন্ট।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “তুই সেটার কথা কেমন করে জানলি?”

“আম্মু একবার একটা বই এনেছিল। অনেক মজার মজার ছবি ছিল। সেখানে দেখেছিলাম।”

বাসায় এসে যখন সবাইকে ঘটনাটা বর্ণনা করা হলো তখন শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টান্টিক আইডিয়া!”

শাহানা অবাক হয়ে বলল, “কোনটা ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া?”

“এই যে স্মার্টফোন আসক্তি দূর করার সেন্টার। আমরা আমাদের বাসায় এটা খুলতে পারি। আমরা আগেই টাকা নিয়ে নেব। সার্ভিস না নিলে টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। শাহানা আপু ভূয়া শক দেওয়ার যন্ত্র বানিয়ে দেবে। ঝুমু খালা হবে ডাক্তার আমি শক খাওয়ার ভান করব।”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি পারবে শান্ত ভাইয়া?”

‘পারব না কেন? দেখাবো করে?

টুম্পা উৎসাহ নিয়ে বলল, “দেখাও শান্ত ভাইয়া!’

তখন শান্ত ইলেকট্রিক শক খাওয়ার যা একটা অভিনয় করে দেখাল সেটা আর বলার মতো নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *