২ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার ১৯৭১
শরীফকে কর্নেল বলেছিল রুমী একদিন পরে ফিরবে। কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আমি কি বিশ্বাস করেছিলাম? শরীফের ফিরে আসার খবর পেয়ে পরশু বিকেল থেকে বাসায় আত্মীয়বন্ধুর ঢল নেমেছে। সবাই রুমীর জন্য হায় হায় করছে। হায় হায় করছে কেন? তবে কি রুমীর ছাড়া পাবার কোনো আশা নেই? গতকাল এগারোটায় আমি মঞ্জুরের সঙ্গে আবার এম.পি.এ. হোস্টেলে গিয়েছিলাম। রুমীর কিছু কাপড়-চোপড়ের একটা প্যাকেট করে সেটা তাকে দেবার এবং তার সঙ্গে দেখা করার প্রার্থনা জানিয়ে একটা দরখাস্ত লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়াই সার। কোনখানে কোন সুরাহা করতে পারলাম না। কেউ রুমীর সম্বন্ধে কোন হদিসই দিতে পারল না। কর্নেল হেজাজীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। তিনি নাকি নেই। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, সুবেদার গুল তারাও যেন বাতাসে হাওয়া হয়ে গেছে। এম.পি.এ. হোস্টেলটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে এরই অভ্যন্তরে দিবারাত্রি ঐসব নারকীয় অত্যাচার হয়ে চলেছে। এখানে কি সাউন্ড প্রুফ ঘর আছে? নইলে ৩১ তারিখে যখন এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত এখানে দুটো বাড়িতে যাওয়া আসা করেছি, কোথাও কোন চিকার, গোঙানি শুনি নি কেন? অথচ শরীফ, জামী, মাসুমের কাছে যা শুনেছি, তাতে তো ঐ সময়টাতে পেছনের দোতলা বাড়িটার ভেতরে বন্দীদের স্টেটমেন্ট নেয়া চলছিল। নিশ্চয় সাউন্ড প্রুফ ঘর আছে, নইলে একটুও চিৎকার শুনি নি কেন?
বাড়ি ফিরে এসে এই কথাটাই জামী আর মাসুমকে জিগ্যেস করলাম। জামী বলল, সাউন্ড প্রুফ ঘর নেই। তবে এম.পি.এ. হোস্টেলে আর পরের বাড়িটায় পেছন দিক দিয়ে অনেক ঘর আছে। নির্যাতন ঐ পেছনে হয়। সামনের দিকে কিছু অফিসরুম সাজানো আছে। রাতের গভীরে অবশ্য এই অফিসরুমগুলোতেও মারধর করার কাজ চালানো হয়।
বিকেলে মান্নান আর নূরজাহান এসেছে। মান্নান চাটগাঁ থেকে ফিরেছে কাল। নূরজাহানের দুভাই রসুল ও নাসের মঙ্গলবারেই ছাড়া পেয়েছে। ভীষণ মারের চোটে ওদের অবস্থা কাহিল। রসুলের বাঁ হাতের তর্জনী ভেঙে গেছে, পিঠে কোমরে ব্যথা। নাসেরেরও তাই।
আলতাফ মাহমুদের চার শালা আর ভাগনে আবুল বারাক গতকাল ছাড়া পেয়েছে। ওদের অবস্থাও খুব খারাপ। সবাইকেই যথেষ্ট রকম পিটিয়েছে, ওর মধ্যে বড় ভাই নুহেলের ঘাড়ে, পিঠে, কোমরে বেশি চোট লেগেছে, মেজ দীনুর দুই হাত পায়ের আঙুলের গিঁট, হাতের কবজি ভেঙেছে, প্রচণ্ড চড়েবাঁ কানের পর্দা ফেটে গেছে। আলভীর বেঁচে যাওয়াটা প্রায় অলৌকিক মনে হয়। বাসায় আলতাফ একবার তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল সে আলভী নয়, আবুল বারাক, আলতাফের বোনের ছেলে। এম.পি.এ. হোস্টেলের সেই ছোট্ট ঘরটাতে খানসেনারা আবার জিগ্যেস করছিল, আলভী কৌন হ্যায়। আলভী একবার বেখেয়ালে প্রায় হাম হ্যায় বলে দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস পাশেই লীনু তার জামার পেছন চেপে ধরে থামিয়ে দিতে পেরেছিল। খানসেনারা চলে যাবার পর লীনুদীনুরা আলভীকেমুখস্থকরিয়েছিল আমার নাম আবুল বারাক। বাবার নাম অমুক, মার নাম অমুকঅর্থাৎ আলতাফের বোন আর দুলাভাইয়ের নাম।
ওরা পাঁচজন বেঁচে ফিরেছে, আলতাফ মাহমুদ ফেরে নি।
নূরজাহান, মান্নান থাকতে থাকতেই দাদাভাই, মোর্তুজা ভাই এলেন। শরীফের ফেরার খবর পেয়ে এরা রোজ দুবেলা করে আসছেন। রুমীর জন্য আফসোসের শেষ নেই। মোর্তুজা ভাই বারবার দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বললেন, রুমীই ২৫ তারিখের অ্যাকশান করেছিল? যদি একটু জানতাম ভাবী! রুমীকে কিছুতেই ঢাকায় রাখতে দিতাম না। আপনারা তো আমাদের একদম জানতে দেন নি। আমরা যখনই ১৮ নম্বর, ৫নম্বর রোডের অ্যাকশানের কথা বলেছি, আপনারা শুধু চুপ করে শুনেছেন। এমন ভান করেছেন যেন কিছু জানেন না, আমাদের মুখ থেকেই প্রথম শুনছেন। দাদাভাই একরকম তিরস্কার করেই বললেন, রুমী মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করেছিল, আমাদের একটু বললে কি হত? আর না হয় নাই বলতেন, রাতের বেলা তো আমাদের বাড়িতে শুতে পাঠাতে পারতেন।
কি জবাব দেব এ কথার? দাদাভাই, মোর্তুজা ভাই নিজের নিজের বাড়ির ছেলেদের সামলে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন, দেখতাম। তার ওপর রুমিকে ওদের ঘাড়ে চাপাবার কথা চিন্তাই করতে পারতাম না।
বাঁকা ফিরেছে চাটগাঁ থেকে। বাঁকা, মঞ্জুর, মিকি, মোর্তুজা, দাদাভাই, ফকির, মিনিভাই–সবাই মিলে নানারকম চিন্তাভাবনা করছেন রুমীকে ছাড়ানোর ব্যাপারে কি উপায় করা যেতে পারে। সবারই কোন না কোন সামরিক অফিসারের সঙ্গে পরিচয়। বা খাতির আছে। সবাই নিজের নিজের মতো করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টায় আছেন।
লালু আর মা ৩০ তারিখে এ বাসায় এসেছিলেন, আর যেতে দিই নি। এখানেই রয়ে গেছেন। মাও তার নিজের মতো করে জায়নামাজের পাটিতে বসে আল্লাহর কাছে দেন। দরবার করছেন রুমীর জন্য।
এইসব ডামাডোলের মধ্যে জামীর জন্মদিন কখন এসে চলে গেছে, কারো খেয়ালই নেই। জামীর নিজেরই হয়তো খেয়াল নেই। আমার হঠাৎ মনে পড়ল সন্ধ্যার মুখে। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এসেছিলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে একসময় উঠলেন। উনি এমনিতেই কথা খুব কম বলেন। আর এখন তো বলার কিছুই নেই। ওকে বিদায় দিতে বাইরের গেট পর্যন্ত গেলাম! বাগানে চার পাঁচটা গোলাপ গাছে ফুল। ফুটে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে বোরহান বললেন, ভারি চমক্কার ফুল তো। বাগান একেবারে আলো করে ফুটে রয়েছে।
আমি বললাম, ফুলগুলোর এতটুকু লজ্জা বা হৃদয় বলে কিছুই নেই। সারাবছর এত খাটি, এত যত্ন করি ওদের জন্য। অথচ আমার এত বড় সর্বনাশেও ওদের কিছু যায় আসে না। কেমন নির্লজ্জের মতো ফুটে রয়েছে।
কেমন এক আক্রোশভরা চোখে চেয়ে রইলাম বনি প্রিন্স, এনা হার্কনেস, সিমোন আর পিসয়ের উজ্জ্বল, সুখী চেহারাগুলোর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়ল রুমী বনি প্রিন্সের একটা আধ-ফোটা কলি উপহার দিয়েছিল আমার জন্মদিনে। আহা,
আমার বনি প্রিন্স আজ কোথায়? কোন জালেমের হাতে শুকিয়ে ঝরছে?
এই ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল আজ জামীর জন্মদিন। আমার আরেকটা বনি প্রিন্স তো রয়েছে। রুমীর শোকে জামীকে ভুলতে বসেছি!
আমি বনি প্রিন্সের ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে জামীর খোঁজে বাড়ির ভেতর গেলাম। একতলায় নেই, দোতলায় নেই। ছাদে গিয়ে দেখি জামী খোলা ছাদের মেঝেতে বসে মাথা নিচু করে সেতার বাজাচ্ছে। কাছে গিয়ে দাড়ালাম। জামী টের পেল না। একটু নিচু হয়ে দেখলাম ও চোখ বুজে বাজাচ্ছে, চোখের পাতা ভেজা। বুকে ধাক্কা লাগল, জামী প্র্যাকটিস করার সময় রুমী তবলা বাজাত। সেই কথা মনে হয়ে কি জামীর চোখে পানি? নাকি ওর জন্মদিনে ওর ভাইয়ার কথা মনে করে চোখে পানি? বাড়ির সবাই ওর জন্মদিনের কথা ভুলে গেছে বলে অভিমানে ওর চোখে পানি?
আমারও চোখ ভরে পানি এল, ফুলটা আলতো করে জামীর গালে ছুঁইয়ে অস্ফুটে বললাম, মেনি মোর রিটার্নস।