২. সৃজন [১৯৬৩–১৯৮০]

২. সৃজন (১৯৬৩–১৯৮০)

৪.

ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের হ্যাঁম্পটনে অবস্থিত নাসার ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার (এল.আর.সি.)-এ আমি কাজ শুরু করলাম। অ্যাডভান্সড অ্যারোস্পেস টেকনোলজির জন্য এটা ছিল প্রাথমিকভাবে একটা আর-অ্যান্ড-ডি সেন্টার। এল.আর.সি.-তে আমার বর্ণবহুল স্মৃতিমালার একটা হচ্ছে একখণ্ড ভাস্কর্য, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একজন রথী দুটো ঘোড়াকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, একটায় ফুটে উঠছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর অন্যটায় প্রযুক্তিগত উন্নতি, তাতে রূপকার্থে প্রকাশ পাচ্ছে গবেষণা ও উন্নয়নের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ।

এল.আর.সি. থেকে আমি গেলাম মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের গ্রিনবেল্টে গরার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার (জি.এস.এফ.সি.)-এ। এই সেন্টারটি নির্মাণ করা হয় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান নাসার অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক উপগ্রহ, সমস্ত মহাশূন্য অভিযানের জন্য নাসার ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে এই কেন্দ্র। আমার সফরের শেষ দিকে আমি গিয়েছিলাম ভার্জিনিয়ার পূর্ব উপকূলীয় ওয়ালপস আইল্যান্ডে অবস্থিত ওয়ালপস ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে। এই জায়গাটি ছিল নাসার রকেট কর্মসূচির ঘাঁটি। এখানে আমি দেখতে পেলাম রিসেপশন লবিতে একটা তৈলচিত্র ঝোলান আছে। পশ্চাৎ ভূমিতে কয়েকটা উড়ন্ত রকেটসহ একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের দৃশ্য ছিল তাতে। এই থিম নিয়ে আঁকা তৈলচিত্র কোনো ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে অতি সাধারণ ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু ছবিটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার কারণ রকেট উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে যে দিক থেকে সে দিককার সৈন্যরা কেউ শ্বেতাঙ্গ ছিল না, তাদের চেহারা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার জাতিগুলোর মতো আর তেমনি কালচে চামড়ার। একদিন আমার কৌতূহল চরম মাত্রায় পৌঁছাল, আমাকে টেনে নিয়ে গেল তৈলচিত্রটার কাছে। দেখা গেল ছবিটায় টিপু সুলতানের বাহিনী যুদ্ধ করছে বৃটিশদের সঙ্গে। একটা প্রকৃত ঘটনা, যা টিপুর নিজের দেশ ভুলে গেছে তা প্রকাশিত হচ্ছে এই তৈলচিত্রে আর দুনিয়ার আরেকপ্রান্তে তা স্মরণ করা হচ্ছে। রকেট যুদ্ধের নায়ক হিসাবে একজন ভারতাঁকে যে মহিমান্বিত করেছে নাসা তাতে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম।

আমেরিকানদের সম্পর্কে ধারণার সারসংক্ষেপ করা যায় বেনজামিন ফ্রাংকলিনের একটা কথায়, সেই সব বস্তু যা নির্দেশকে আঘাত করে! আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে দুনিয়ার এই অংশের লোকজন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে। তার মোকাবেলা করে। তারা দুঃখভোগের চেয়ে বরং সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে।

আমার মা একবার পবিত্র কিতাব থেকে একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করার পর, আদমকে সেজদা করতে বললেন ফেরেশতাদের। সবাই আদমের সামনে সেজদা করল, কিন্তু ইবলিস, বা শয়তান, তা করল না। তুমি কেন সেজদা করলে না? আল্লাহ প্রশ্ন করলেন। আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন আর আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে। তাতে করে আমি কি আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই? শয়তান তর্ক করল। আল্লাহ বললেন, বেহেশত থেকে দূর হয়ে যা! তোর উদ্ধত অহংকারের জায়গা নয় এটা। শয়তান আল্লাহর কথা মেনে নিল, তবে আদমের জন্যও একই ভাগ্য বরণের অভিশম্পাত দেওয়ার আগে নয়। একটা নিষিদ্ধ ফল খেয়ে নির্দেশ লংঘনকারীতে পরিণত হলেন আদম, সুতরাং অবিলম্বে অভিশম্পাত লেগে গেল। আল্লাহ বললেন, এই স্থান থেকে দূর হও, আর তোমার বংশধররা যেন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মধ্যে জীবনযাপন করে।

ভারতীয় সংগঠনগুলোর জীবনকে যা কঠিন করে তুলেছে তা হলো এই উদ্ধত অহংকার। এ কারণে আমরা আমাদের কনিষ্ঠদের কথা, অধীনস্তদের কথা বা নিম্নবর্গের মানুষদের কথা শুনি না। যদি কোনো ব্যক্তির ওপর তুমি পীড়ন চালাও, তাহলে তার কাছ থেকে ভালো কিছুর ফলাফল তুমি আশা করতে পার না। তুমি তাকে নির্যাতন করলেও সে সৃষ্টিশীল ব্যক্তি হয়ে উঠবে তা আশা করা যায় না। বলিষ্ঠতা ও রূঢ়তা, শক্তিশালী নেতৃত্ব ও দুর্বলের ওপর নির্মম নিপীড়ন, শৃঙ্খলা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদির মধ্যে যে রেখা আছে তা ভালো কথা, কিন্তু সে রেখা টানতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে আজ হিরো ও জিরোর মধ্যে লক্ষণীয় রেখা টানা হয়েছে। এর একদিকে রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকশ হিরো আর অন্যদিকে নয়শ পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ। এ পরিস্থিতি বদলাতে হবে।

নাসা থেকে আমার ফিরে আসার পর পরই, ভারতের প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করা হলো ২১ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে। রকেটটার নাম ছিল নাইক-অ্যাপাচি, তৈরি করা হয়েছিল নাসায়। রকেটটা অ্যাসেম্বল করা হয়েছিল গির্জা ভবনে, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। রকেটটা পরিবহনের জন্য একমাত্র সুলভ যে ইকুইপমেন্ট পাওয়া গেল সেটা ছিল একটা ট্রাক এবং একটা হস্তচালিত হাইড্রলিক ক্রেন। অ্যাসেম্বল করা রকেটটা গির্জা ভবন থেকে উৎক্ষেপণ মঞ্চে তুলতে হয়েছিল ট্রাকের সাহায্যে। ক্রেন দিয়ে যখন রকেটটা উত্তোলন করা হয়েছে এবং লঞ্চারে স্থাপন করার উপক্রম করা হয়েছে, তখনই সেটা কাত হতে শুরু করল, ক্রেনের হাইড্রলিক সিস্টেমে একটা ছিদ্র হবার ইঙ্গিত দিল। উৎক্ষেপণ সময় সন্ধ্যা ৬টার একেবারে কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম, কাজেই ক্রেন মেরামতের কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। সৌভাগ্যবশত ছিদ্রটা তত বড়োও ছিল না আর রকেটটা হাত লাগিয়ে তুলে ফেলতে আমরা সক্ষম হলাম, আমাদের সম্মিলিত পেশীশক্তি ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত লঞ্চারের ওপর সেটা স্থাপন করলাম।

নাইক-অ্যাপাচি উৎক্ষেপণে আমি ছিলাম রকেট একীভবন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে। আমার দুজন সহকর্মী যারা এই উৎক্ষেপণে অত্যন্ত সক্রিয় ও কঠিন ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন ডি ঈশ্বরদাস ও আর আরাভামুন। রকেট অ্যাসেম্বলি ও উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঈশ্বরদাস। আরাভামুনকে আমরা ডাকতাম ডান বলে, তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাডার, টেলিমেট্রি ও গ্রাউন্ড সাপোর্টের। উৎক্ষেপণটা হয়েছিল মসৃণ আর সমস্যামুক্ত। আমরা অসাধারণ ফ্লাইট ডাটা পেয়েছিলাম আর ফিরে এসেছিলাম গৌরব ও সংসাধনের অনুভূতি নিয়ে।

.

পরের সন্ধ্যায় আমরা আয়েশ করছি ডিনার টেবিলে, ঠিক তখনই খবর পেলাম টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাসে নিহত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। আমরা আতঙ্কিত হলাম। কেনেডির শাসনামলটা ছিল আমেরিকায় অসাধারণ একটা যুগ। ১৯৬২ সালের মিসাইল সংকটে কেনেডির তৎপরতার বিষয় খুব আগ্রহ নিয়ে আমি পড়তাম। কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইল সাইট নির্মাণ করেছিল, যেখান থেকে আমেরিকান শহরগুলোর ওপর হামলা চালানো সম্ভব হতো। তিনি একটা ব্লকেড বা ক্যায়ারেন্টিন আরোপ করলেন, কিউবায় কোনো আক্রমণাত্মক মিসাইল স্থাপনে বাধা দিলেন। আমেরিকা আরও হুমকি দিল যে, কিউবা থেকে পশ্চিমা যে কোনো দেশের ওপর সোভিয়েত পারমাণবিক হামলা হলে সে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর পাল্টা হামলা চালাবে। চৌদ্দ দিনের টান টান নাটকের পর সংকট নিরসন করলেন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট খুশ্চেভ, তিনি কিউবার স্থাপনা অপসারণ ও মিসাইলগুলো রাশিয়ায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন।

পরদিন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা ছিল আমাদের। ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তিনি নতুন এক ফ্রন্টিয়ার সৃষ্টি করছিলেন। এক নতুন প্রজন্ম, ৩০ ও ৪০-এর দশকের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী, সবাই স্পন্দিত হচ্ছিল অভূতপূর্ব এক গতিশীলতায়। ইনকাঁপারে আমাদের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা ছিল আমাদের ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নয়, আমাদের সামর্থ্যের ওপর অধ্যাপক সারাভাইয়ের বিশ্বাস। নাইক-অ্যাপাচির সফল উৎক্ষেপণের পর, একটা ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল নির্মাণের যে স্বপ্ন, তার ছিল সেই স্বপ্ন তিনি আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন।

অধ্যাপক সারাভাইয়ের আশাবাদ ছিল অত্যন্ত সংক্রামক। থুম্বায় তার আগমণের নির্দিষ্ট খবর লোকজনকে যেন বৈদ্যুতিন করে তুলত আর সমস্ত গবেষণাগার, ওয়ার্কশপ ও ডিজাইন অফিস গুঞ্জন করতে থাকত অবিরাম কর্মতৎপরতায়। লোকেরা দৃশ্যত চব্বিশ ঘন্টা কাজ করত। কারণ তারা অধ্যাপক সারাভাইকে নতুন কিছু দেখাতে চাইত স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এমনকিছু যা আগে আর কখনও করা হয়নি আমাদের দেশে-তা হোক একটা নতুন ডিজাইন কিংবা ফেব্রিকেশনের একটা নতুন পদ্ধতি অথবা এমনকি অদ্ভুত কোনো প্রশাসনিক প্রসিডিওর। অধ্যাপক সারাভাই প্রায়ই একক কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলকে একাধারে নানাবিধ কাজ দিতেন। প্রথম দিকে মনে হতো ওসব কাজ পরস্পরের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন, পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যেত ওগুলো পরস্পরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক সারাভাই যখন স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (এসএলভি) সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, প্রায় এক নিঃশ্বাসে, সামরিক বিমানের জন্য রকেট-অ্যাসিস্টেড টেক-অফ সিস্টেম (আরএটিও) বিষয়ে আমি যেন পড়াশোনা করি। এই মহান দ্রষ্টার মনে ছাড়া এ দুটো বিষয়ের স্পষ্ট কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি জানতাম যে আমাকে সতর্ক থাকতে হবে আর আমার উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে এবং আগে বা পরে চ্যালেঞ্জিং কোনো কাজ করার সুযোগ আমার গবেষণাগারে প্রবেশ করবে।

অধ্যাপক সারাভাই তরুণদের অভিনব ভাবনা বের করে আনার ও তা তাদের মনে আঁকার চেষ্টা করতেন। তার এমন জ্ঞান ও বিচারবোধ ছিল যা দিয়ে তিনি কোনো ভালো কিছু হয়ে থাকলে উপলব্ধি করতে পারতেন। তবে এটাও জানতেন কখন থামতে হবে। আমার মতে, তিনি ছিলন একজন আদর্শ নিরীক্ষক ও উদ্ভাবক। আমাদের সামনে যখন কাজের বিকল্প কোর্স থাকত, যার ফলাফল সম্পর্কে আগেই কিছু বলা ছিল শক্ত, তখন তার সামাধান বের করে দিতেন অধ্যাপক সারাভাই। ১৯৬৩ সালে ইনকসপারে এই ছিল পরিস্থিতি। একদল তরুণ, অনভিজ্ঞ, কিন্তু উদ্যমী ও উৎসাহী ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আর নির্দিষ্টভাবে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ। এটা ছিল আস্থার দ্বারা নেতৃত্বের এক বিশাল উদাহরণ।

.

রকেট উৎক্ষেপণ এলাকাটি পরে বিকশিত হলো থুম্বা ইকুয়ারিয়াল রকেট লঞ্চ স্টেশন (টিইআরএলএস) নামে। ফ্রান্স, ইউএসএ ও ইউএসএসআর-এর সক্রিয় সহযোগিতায় টিইআরএলএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির নেতা, অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই চ্যালেঞ্জের পূর্ণ সংশ্লেষ উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা এড়িয়ে যাননি। ইনকসপার যে দিন গঠন করা হয় ঠিক সেদিন থেকে তিনি সচেতন ছিলেন একটা অখণ্ড জাতীয় মহাকাশ কর্মসূচি আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। সেই সঙ্গে রকেট তৈরির সাজসরঞ্জাম ও উৎক্ষেপণ স্থাপনার উন্নয়ন।

এই ব্যাপারটা মনে রেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নভিত্তিক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আহমেদাবাদে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি এবং স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করা হয় সেগুলো ছিল রকেট ফুয়েল, প্রপালসন সিস্টেম, অ্যারোনটিকস, অ্যারোস্পেস ম্যাটেরিয়াল, অ্যাডভান্সড ফেব্রিকেশন টেকনিক, রকেট মটর ইট্রুমেন্টেশন, কন্ট্রোল অ্যান্ড গাইডেন্স সিস্টেম, টেলিমেট্রি, ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং মহাশূন্যে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। ঘটনা পরম্পরায় বছরজুড়ে এই গবেষণাগার সৃষ্টি করেছে বিপুলসংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী।

ভারতীয় অ্যারোস্পেস কর্মসূচির সত্যিকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল রোহিনী সাউন্ডিং রকেট (আরএসআর) প্রোগ্রাম থেকে। একটা ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটা সাউন্ডিং রকেটকে স্বতন্ত্র করে কোন বিষয়টা? প্রকৃতপক্ষে এগুলো তিনটি আলাদা ধরনের রকেট। সাউন্ডিং রকেট সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর নিকটবর্তী পরিবেশ অনুসন্ধানের কাজে, অ্যাটমসফিয়ারের ওপরের অঞ্চলসহ। উচ্চতার একটা সীমা পর্যন্ত এগুলো বিভিন্ন প্রকার বৈজ্ঞানিক পেলোড নিয়ে যেতে পারে, তবে পেলোডের নিজ অক্ষে ঘুর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় চূড়ান্ত গতি প্রয়োগ করতে পারে না। অন্যদিকে লঞ্চ ভেহিকল এমনভাবে নকশা করা হয় যা কৃত্রিম উপগ্রহ বা প্রযুক্তিগত পেলোডকে নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের বেগসহ ইনজেক্ট করতে পারে। একটা লঞ্চ ভেহিকলের শেষ স্তর প্রয়োজনীয় বেগ দিয়ে থাকে কৃত্রিম উপগ্রহে নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের জন্য। এটা একটা জটিল কার্যক্রম যাতে প্রয়োজন হয় গাইডেন্স ও কন্ট্রোল সিস্টেম। একটা ক্ষেপণাস্ত্র, একই পরিবারের সদস্য হলেও, আরও বেশি জটিল পদ্ধতির অন্তর্গত। বিশাল টার্মিনাল ভেলোসিটি ও অনবোর্ড গাইডেন্স অ্যান্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে এতে আরও যোগ করতে হয় লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার সামর্থ্য। লক্ষ্যবস্তু যখন থাকে দ্রুতগতিতে ধাবমান আর কৌশলে অভিযান চালানোয় পারদর্শী, তখন ক্ষেপণাস্ত্রেও যোগ করতে হয় টার্গেট-ট্র্যাকিং ফাংশন।

আরএসআর কর্মসূচি ছিল ভারতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সাউন্ডিং রকেট উন্নয়ন ও ফেব্রিকেশন। এই কর্মসূচির অধীনে অপারেশনাল সাউন্ডিং রকেটের একটা পরিবার প্রস্তুত করা হয়েছিল। এসব রকেটের ছিল বিস্তৃত রেঞ্জিং সামর্থ্য, আর আজ পর্যন্ত কয়েক শ রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক গবেষণা কাজে।

আমার এখনও মনে আছে, প্রথম রোহিনী রকেটটিতে সংযোজিত ছিল ৩২ কেজি ওজনের একটা একক প্রপালসন মোটর। এটা ৭ কেজি পেলোড উত্তোলন করেছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উঁচুতে। এরপর পর আরও একটা রকেট ছোঁড়া হয়, তাতে ১০০ কেজি পেলোড় উৎক্ষেপণ করা হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার উঁচুতে।

.

বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় রকেটের উন্নয়ন কার্যক্রমকে দেখা যেতে পারে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দেখা টিপু সুলতানের স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন। টিপু সুলতান যখন নিহত হন, তখন বৃটিশরা ১৭৯৯ সালে তুরুখানাহালীর যুদ্ধে ৭০০ রকেট ও ৯০০ রকেটের সাবসিস্টেম দখল করেছিল। টিপুর সৈন্যবাহিনীতে ছিল ২৭টি ব্রিগেড, এদের বলা হতো কুশুন, আর প্রতিটা ব্রিগেড়ে ছিল রকেট নিক্ষেপকারীদের নিয়ে একটি করে কোম্পানি, এদের বলা হতো জুর্ক। উইলিয়াম কনগ্রিভ এই রকেটগুলো ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়। বৃটিশরা সেখানে এইসব রকেট নিয়ে যে গবেষণা চালায় আজকের দিনে তাকে আমরা রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং বলি। সেই সময় অবশ্যই কোনো গ্যাট, আইপিআর অ্যাক্ট, অথবা পেটেন্ট ব্যবস্থা ছিল না। টিপু সুলতানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রকেট বিজ্ঞানেরও মৃত্যু ঘটে– অন্তত ১৫০ বছরের জন্য।

ইতোমধ্যে বিদেশে রকেট প্রযুক্তি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। রাশিয়ায় কন্সতান্তিন সিওলকোভস্কি (১৯০৩), যুক্তরাষ্ট্রে রবার্ট গড়ার্ড (১৯১৪) এবং জার্মানিতে হেরমান ওবার্থ (১৯২৩) রকেটবিজ্ঞানকে পৌঁছে দেন নতুন মাত্রায়। নাৎসি জার্মানিতে ভের্নার ফন ব্রাউন-এর গ্রুপ V-2 নামে নিকটপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন করে এবং মিত্রবাহিনীর ওপর অগ্নিবর্ষণ শুরু করে দেয়। যুদ্ধের পর ইউএসএ ও ইউএসএসআর উভয়েই জার্মান রকেট প্রযুক্তি হস্তগত করে আর আটক করে রকেট ইঞ্জিনিয়ারদের। এদের দিয়ে তারা মিসাইল ও ওয়ারহেড উৎপাদনের মাধ্যমে শুরু করে তাদের ভয়াবহ অস্ত্র-প্রতিযোগিতা।

ভারতে রকেট বিজ্ঞান, পুনর্জন্ম লাভ করেছে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রযুক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির কল্যাণে। অধ্যাপক সারাভাই এই স্বপ্নকে মূর্ত করে তোলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। অসংখ্য ব্যক্তি একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে মহাকাশ গবেষণার এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যে রাষ্ট্রে অসংখ্য মানুষ খাদ্য-সংকটে ভোগে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নেহরু বা অধ্যাপক সারাভাই তাদের লক্ষ্য থেকে পিছপা হননি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার ও ভারতীয়রা যদি বিশ্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাদের বাস্তবজীবনের সমস্যায় প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। আমাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল না।

.

৫.

অধ্যাপক সারাভাই প্রায়ই থুম্বায় আসতেন। প্রতিবারই তিনি পুরো দলের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতেন খোলামেলাভাবে। তিনি কখনও নির্দেশ দিতেন না। বরং মুক্ত মত বিনিময়ের ভেতর দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন সামনের দিকে, এতে অনেক সমস্যার সমাধান আমরাই বের করতে পারতাম, এবং তা খুব সহজেই। ফলপ্রসূ নেতৃত্বের প্রধান গুণের সমস্যার সম্মিলিত বোঝাপড়ার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করতেন। একবার তিনি আমাকে বলেছিলেন, দেখ, আমার কাজ হলো সিদ্ধান্ত নেওয়া; কিন্তু আমার দলের সদস্যরা আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে কিনা সেটাও বিবেচনা করা সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আসলে অধ্যাপক সারাভাই ধারাবাহিকভাবে কতকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা ছিল অনেকের জন্য লাইফ-মিশন। আমরা আমাদের নিজেদের রকেট তৈরি করব। নিজেদের স্যাটেলাইট তৈরি করব। আর এসব করা হবে একটার পর একটা নয়, একই সঙ্গে। একটা বহুমাত্রিক ধারায়। সাউন্ডিং রকেটের জন্য পোলোড উৎপাদনে, একটা নির্দিষ্ট পেলোড নিয়ে রকেটে তা সংযুক্ত করার পরিবর্তে, আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম বিভিন্ন অবস্থানে এবং বিভিন্ন সংগঠনে কর্মরত পেলোড বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। আমি এমনকি এও বলতে পারি যে, সাউন্ডিং রকেট কর্মসূচির সবচেয়ে অসাধারণ সাফল্য ছিল দেশব্যাপী, মিউঁচুয়াল ট্রাস্ট গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ।

আমার বৈধ কর্তৃত্ব খাটানোর চেয়ে লোকজনকে আমি বুঝিয়ে কাজ করাতাম বুঝতে পেরে অধ্যাপক সারাভাই আমাকে পেলোড বিজ্ঞানীদের আনুষঙ্গিক সহায়তা দানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভারতের প্রায় সব ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি জড়িত ছিল সাউন্ডিং রকেট কর্মসূচিতে, প্রত্যেকের ছিল নিজ নিজ দায়িত্ব, নিজের বিষয় এবং নিজের পেলোড। এসব পেলোড এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে করে ফ্লাইট কন্ডিশনে এগুলো যথাযথভাবে কাজ করে। নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য রকেটে যুক্ত করা হতো এক্স-রে পেলোড; অ্যাটমসফিয়ারে ওপরের স্তরে গ্যাস কম্পজিশন বিশ্লেষণের জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাস স্পেক্ট্রমিটারে যুক্ত পেলোড; হাওয়ার অবস্থা, প্রবাহ ও গতি বুঝতে সোডিয়াম পেলোড। অ্যাটমসফিয়ারের বিভিন্ন স্তর আবিষ্কার করার জন্য আয়োনসফেরিক পেলোডও আমাদের ছিল। টিআইএফআর, ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি (এনপিএল) ও ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল)-এর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তো মিলিতভাবে আমাকে কাজ করতে হয়েছিলই, তাছাড়াও আমি একত্রে কাজ করেছিলাম ইউএসএ, ইউএসএসআর, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানের পেলোড বিজ্ঞানীদের সঙ্গে।

.

আমি প্রায় সময় কাহলিল জিবরানের রচনা পড়ি। আর সবসময় তার লেখায় আবিষ্কার করি জ্ঞানের কথা। ভালোবাসা ছাড়া যে রুটি তৈরি করা হয় সে রুটি তিক্ত রুটি, যা একজন মানুষের ক্ষুধা অর্ধেক মেটাতে পারে। যারা হৃদয় ঢেলে কাজ করতে পারে না তারা সাফল্য অর্জন করে আধাআধি যার থেকে সৃষ্টি হয় তিক্ততা। তুমি যদি একজন লেখক হও অথচ মনের গোপন বাসনা থাকে একজন ডাক্তার বা আইনজ্ঞ হবার, তাহলে তোমার লেখা পাঠকদের পড়ার ক্ষুধা মেটাবে অর্ধেকটা, পুরোপুরি নয়। তুমি যদি শিক্ষক হও যে কিনা ব্যবসায়ী হতে চাও, তাহলে তোমার পাঠদান তোমার ছাত্রদের জ্ঞানের তৃষ্ণা পুরোপুরি নিবারণ করতে পারবে না। তুমি যদি এমন একজন বিজ্ঞানী হও যে বিজ্ঞানকে অপছন্দ করে, তাহলে তোমার কাজ অর্ধেক প্রয়োজন মেটাবে তোমার মিশনের। ব্যক্তিগত সুখহীনতা ও ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতা নতুন নয়। কিন্তু অধ্যাপক ওড়া ও সুধাকরের উদাহরণ যখন সামনে আসে তখন অন্যরকম ভাবনা আসাটাই স্বাভাবিক। নিজেদের কাজের মধ্যে তারা যোগ করেছিলেন তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আর হয়তো তাদের হৃদয়ের স্ফটিক-স্বচ্ছস্বপ্ন। নিজেদের কাজের সঙ্গে তারা এতটাই আবেগপ্রবণভাবে যুক্ত ছিলেন যে, তাদের চেষ্টায় কোনো সাফল্য না এলে তারা ভীষণ বেদনার্ত হতেন।

অধ্যাপক ওড়া ছিলেন জাপানের ইন্সটিটিউট অব স্পেস অ্যান্ড অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্সেস (আইএসএএস)-এর এক্স-রে পেলোড বিজ্ঞানী। উঁচু ব্যক্তিত্ব আর উজ্জ্বল দ্যুতিময় চোখের মানুষ হিসাবে তাকে আমার মনে আছে। কাজের প্রতি তার উৎসর্গকৃত মনোভাব ছিল দৃষ্টান্তমূলক। আইএসএএস থেকে তিনি এক্সরে পেলোড সৃর্জন আনতেন, অধ্যাপক ইউআর রাও-এর তৈরি এক্স-রে পেলোডসহ ওই পেলোড় আমার দল রোহিনী রকেটের নাকের ডগায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য প্রকৌশলগত কাজকর্ম করত। ভূ-পৃষ্ট থেকে ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় সেই নাকের ডগা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ইলেকট্রনিক টাইমারের সাহায্যে পাইরোস বিস্ফোরণে। এভাবে মহাশূন্যে এক্স-রে সেন্সর স্থাপন করা হতো চাহিদা অনুযায়ী নক্ষত্রমন্ডলী থেকে নির্গত বস্তুর তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। অধ্যাপক ওডা ও অধ্যাপক রাও একত্রে ছিলেন মেধা ও আত্মত্যাগের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত, সচরাচর দেখা যায় না। একদিন আমি যখন আমার টাইমার ডিভাইস নিয়ে অধ্যাপক ওভার পেলোডের জন্য একীভবনের কাজ করছিলাম, তখন তিনি, জাপান থেকে আনা টাইমার ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার কাছে ওগুলো মনে হলো দুর্বল, কিন্তু অধ্যাপক ও অনড় হয়ে রইলেন তার জায়গায় যে ভারতীয় টাইমারের বদলে জাপানী টাইমার ব্যবহার করতে হবে। আমি তার পরামর্শ মেনে নিয়ে টাইমার বদল করলাম। রকেট চমৎকারভাবে আকাশে উঠল আর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছাল। কিন্তু টেলিমেট্রি সিগনাল থেকে জানা গেল, টাইমার যথাযথভাবে কাজ না করায় মিশন ব্যর্থ হয়েছে। অধ্যাপক ওড়া এতটাই বিষণ্ণ হয়েছিলেন যে তার চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। আমি হতবাক হয়ে পড়েছিলাম অধ্যাপক ওড়ার এই আবেগপূর্ণতা দেখে। তিনি স্পষ্টত হৃদয়-মন সঁপে দিয়েছিলেন তার কাজে।

পেলোড প্রিপারেশন ল্যাবরেটরিতে সুধাকর ছিল আমার সহকর্মী। উৎক্ষেপণপূর্ব শিডিউলের অংশ অনুযায়ী আমরা বিপদজনক সোডিয়াম ও থামাইট মিশ্রণ পূর্ণ করছিলাম ও দূরনিয়ন্ত্রণ উপায়ে চাপ প্রয়োগ করছিলাম। চিরাচরিতভাবে থুম্বার দিনটা ছিল গরম ও আর্দ্র। এ ধরনের ছয়টি অপারেশনের পর সুধাকর ও আমি মিশ্রণ যথাযথ পূর্ণ হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পেলোড রুমে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ তার কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম পড়ল সোডিয়ামে। ফলাফল, কী হচ্ছে আমরা বুঝে ওঠার আগেই, প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে কামরাটা কেঁপে উঠল। পরবর্তী কয়েক মুহূর্ত একেবারে অসাড় অবস্থাতেই কাটল। আমি বুঝতে পারিনি কী করতে হবে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, আর পানি দিয়ে সোডিয়ামের আগুন নেভান যেত না। এই অবস্থার মধ্যেও সুধাকর কিন্তু চেতনা হারায়নি। খালি হাতেই সে জানলার কাঁচ ভেঙে ফেলল আর আক্ষরিক অর্থেই আমাকে জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়ল। আমি কৃতজ্ঞতায় সুধাকরের হাত স্পর্শ করলাম। তার হাত থেকে তখন রক্ত ঝরছিল, যন্ত্রণার মধ্যেও সে হাসছিল। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কারণে সুধাকরকে কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।

.

টিইআরএলএসে আমি জড়িত ছিলাম রকেট তৈরির তৎপরতা, পেলোড অ্যাসেম্বলি, টেস্টিং এবং ক্রমোন্নতি ইত্যাদি ছাড়াও পেলোড হাউজিং ও জেটিসনেবল নোজ কোন-এর মতো সাবসিস্টেম নির্মাণের কাজেও। স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে নোজ কোন নিয়ে আমার কাজ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কম্পোজিট ম্যাটারিয়ালের ক্ষেত্রে।

এটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে যে সব ধনুক পাওয়া গেছে তা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, ভারতীয়রা কাঠ, পেশীতন্তু ও শিং দিয়ে তৈরি কম্পোজিট (যৌগিক) ধনুক ব্যবহার করত একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে ওই ধরনের ধনুক তৈরির আরও অন্তত ৫০০ বছর আগে। কম্পোজিটের বহুমুখ-কর্মশক্তি সম্পন্নতা আমাকে চমৎকৃত করেছিল। এই দিক থেকে যে এতে থাকে অত্যন্ত আকাঙ্খিত গঠনগত, থার্মাল, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক সমৃদ্ধি। মানুষের তৈরি এই বস্তুতে আমি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে তাড়াহুড়ো করে এক রাতের মধ্যে এ বিষয়ে সবকিছু জানতে চেয়েছিলাম। এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব লেখা আমি পড়তাম যা পাওয়া যেত হাতের কাছে। আমি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম গ্লাস ও কার্বন ফাইবার রিইনফোর্সড পাস্টিক (এফআরপি) কম্পোজিট সম্পর্কে।

একটা এফআরপি কম্পোজিট বিন্যাস্ত করা হয় ম্যাট্রিকসে ইনঅর্গানিক ফাইবার বুননের মাধ্যমে এতে এফআরপি কম্পোজিট জমাট হয় এবং অংশগুলোকে একটা আকার দেয়। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী টিইআরএলএসকে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস সায়েন্স কক্ষ্যনিটির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে থুম্বায় আসেন। এ উপলক্ষ্যে তিনি আমাদের গবেষণাগারে দেশের প্রথম ফিলামেন্ট উইন্ডিং মেশিন প্রদান করেন। এই ঘটনা আমার দলকে বিপুল পরিতৃপ্তি এনে দিল, যে দলে ছিলেন সিআর সত্য, পিএন সুব্রামানিয়ান ও এমএন সত্যনারায়ণ। নন ম্যাগনেটিক পেলোড হাউজিং বানাতে আমরা তৈরি করলাম হাই-স্ট্রেংথ গ্লাস ক্লোথ লেমিনেট এবং টু-স্টেজ সাউন্ডিং রকেটে সেগুলো মহাকাশে পাঠালাম। এ ছাড়া ৩৬০ এমএম ডায়ামিটারের মোটর কেসিংও আমরা পরীক্ষা করলাম। ধীরগতিতে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে, দুটো ভারতীয় রকেট জন্ম নিল থুম্বায়। নভঃদেব ইন্দ্রের দরবারের দুই পৌরাণিক নর্তকী রোহিনী ও মেনকার নামে রকেট দুটোর নামকরণ করা হয়েছিল। ভারতীয় পেলোড মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য ফরাসি রকেটের প্রয়োজন ছিল না আর। ইনকসপারে অধ্যাপক সারাভাই যে আস্থা ও কমিটমেন্টের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই পরিবেশ না হলে কি এসব করা যেত? তিনি প্রতিটা ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি সমস্যা সমাধানে প্রত্যেককে সরাসরি অংশ নেওয়ার মনোভাব তৈরি করে দিয়েছিলেন। দলের সদস্যদের অংশগ্রহণে সমাধান হতো নির্ভেজাল আর বাস্তবায়নের দিকে সামগ্রিক কমিটমেন্টের ফল লাভের জন্য সমগ্র দলের আস্থা অর্জন করত তা।

অধ্যাপক সারাভাই নিজের হতাশা কখনও লুকানোর চেষ্টা করতেন না। তিনি সৎ ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে। কোনো কোনো সময় আমি দেখতাম, ব্যাপার যতটা ইতিবাচক নয় তার চেয়ে বেশি ইতিবাচক করে তুলতেন তিনি, তারপর আমাদের উৎফুল্ল করে তুলতেন প্রত্যয় উৎপাদনের তার প্রায় জাদুকরি শক্তিতে। আমরা ড্রয়িং বোর্ডে থাকলে, তিনি উন্নত বিশ্ব থেকে কাউকে নিয়ে আসতেন টেকনিক্যাল সহযোগিতার জন্য। আমাদের সামর্থ্য প্রসারিত করতে আমাদের সবার প্রতি ওটাই ছিল তার চ্যালেঞ্জের ধারা।

একই সময়ে, আমরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয় অর্জনে ব্যর্থ হলেও, যেটুকু আমরা অর্জন করতাম তারও প্রশংসা করতেন তিনি। প্রথম রোহিনী-৭৫ রকেট যখন ১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর টিইআরএলএস থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল, সেই সময় আমরা প্রায় সবাই তার বশীভূত ছিলাম।

পরের বছর প্রথম দিকে অধ্যাপক সারাভাই জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন দিল্লিতে। এতদিনে আমি অধ্যাপক সারাভাইয়ের কর্ম পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি সবসময় উদ্যম আর আশাবাদিতায় পরিপূর্ণ ছিলেন। মনের ওই রকম একটা অবস্থায় অনুপ্রেরণার আকস্মিক ঝলক ছিল প্রায় স্বাভাবিক। দিল্লিতে পৌঁছে আমি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য যোগাযোগ করলাম অধ্যাপক সারাভাইয়ের সেক্রেটারির সঙ্গে, আমাকে বলা হলো রাত সাড়ে তিনটার সময় হোটেল অশোকায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। দিল্লি খানিকটা অপরিচিত জায়গা। আমার মতো লোকের জন্য এখানকার আবহাওয়াও তেমন অনুকূল নয়, আমি অভ্যস্ত দক্ষিণ ভারতের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায়, সুতরাং ডিনার শেষ করে হোটেলের লাউঞ্জে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আমি সবসময় একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, সেটা এই চেতনায় যে খোদার সঙ্গে আমি কাজের একটা অংশীদারীত্ব রক্ষা করি। আমি সচেতন ছিলাম যে আমার যা ক্ষমতা আছে ভালো কাজের জন্য তার চেয়ে আরও বেশি সামর্থ্য আমার প্রয়োজন, আর একমাত্র খোদাই আমার প্রয়োজনীয় সাহায্য আমাকে দিতে পারেন। নিজের সামথ্যের একটা প্রকৃত হিসেব আমি করেছিলাম, তারপর ৫০ শতাংশ তা উন্নীত করি, আর নিজেকে সঁপে দিই খোদার হাতে। এই অংশীদারীত্বে আমার প্রয়োজনীয় সব শক্তি আমি পেয়েছি, এবং প্রকৃতই তার প্রবাহ অনুভব করেছি নিজের মধ্যে। আজ আমি নিশ্চিত করতে পারি যে এই শক্তির আকারেই খোদার রাজ্য বিরাজমান রয়েছে। তোমার মধ্যে, তোমার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করতে আর তোমার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করতে।

বিভিন্ন ধরন ও স্তরের অভিজ্ঞতা আছে যা এই অভ্যন্তরীণ ক্ষমতায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কখনও কখনও, যখন আমরা প্রস্তুত থাকি, তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ আমরা অনুভব করি অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞান দিয়ে। এটা আসতে পারে অন্য আরেক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে, একটা শব্দ থেকে, একটা প্রশ্ন থেকে, একটা ইঙ্গিত বা এমনকি একটা দৃষ্টিপাত থেকে। অনেক সময় এটা আসতে পারে একটা বইয়ের ভেতর দিয়ে, একটা আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে, একটা বাগবৈশিষ্ট্যের ভেতর দিয়ে, এমনকি কবিতার একটা লাইন অথবা ছবির একটা দৃশ্য থেকেও। সামান্যতম সতর্কতা ছাড়াই, নতুন কিছু ঢুকে পড়ে তোমার জীবনে আর শুরু করতে একটা গোপন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, একটা সিদ্ধান্ত যে তুমি সম্পূর্ণ অসচেতন থাকবে হয়তো।

অভিজাত লাউঞ্জের চারদিকে আমি তাকালাম। কেউ একজন একটা বই ফেলে রেখে গিয়েছিল কাছের একটা সোফার ওপর। যেন সেই ঠান্ডা রাত্রির ক্ষুদ্র ঘন্টাগুলো কিছুটা উষ্ণ চিন্তায় পূর্ণ করতে আমি বইটা তুলে নিলাম এবং পৃষ্ঠা ওল্টাতে শুরু করলাম। আমি অবশ্যই বইটার কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টেছিলাম, কিন্তু আজ আর তার কিছু মনে করতে পারি না।

বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত একটা জনপ্রিয় বই ছিল সেটা। আমি বইটা আসলে পড়ছিলাম না। শুধু প্যারাগ্রাফগুলোর ওপর নজর বুলিয়ে যাচ্ছিলাম আর পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ বইটার একটা প্যাসেজের ওপর আমার চোখ পড়ল, অংশটা ছিল জর্জ বার্নার্ড শ-এর রচনা থেকে একটা উদ্ধৃতি। ঐ উদ্ধৃতির মর্মকথা ছিল এই যে, বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা নিজেদের মানিয়ে নেয় দুনিয়ার সঙ্গে। কেবল মুষ্টিমেয় কিছু বিচারবুদ্ধিহীন মানুষ নিজেদের সঙ্গে দুনিয়াকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দুনিয়ার সমস্ত অগ্রগতি নির্ভর করে এই বিচারবুদ্ধিহীন লোকজন ও তাদের উদ্ভাবনামূলক কিন্তু প্রায়ই অনিশ্চিত কাজকর্মের ওপর। বার্নার্ড শ-এর প্যাসেজ থেকে বইটা আমি পড়তে শুরু করেছিলাম। বইটির লেখক শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে উদ্ভাবনা প্রক্রিয়া ও ধারণা যেসব নির্দিষ্ট মিথে বোনা তা বর্ণনা করেছেন। আমি কৌশলগত পরিকল্পনার মিথ সম্পর্কে পড়ি। সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে কৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা বিস্ময় নয় ধরনের ফলাফল প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেয়। লেখকের মতামত ছিল যে একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের পক্ষে অনিশ্চয়তা নিয়ে জীবনযাপন করতে শেখাটা অত্যাবশ্যকীয়।

হোটেলের লবিতে রাত একটার সময় দুই ঘন্টা পরের একটা সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করাটা নিশ্চয়ই যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব ছিল না, আমার জন্যও না অধ্যাপক সারাভাইয়ের জন্যও না। তবে অধ্যাপক সারাভাই সবসময়ই এ ধরনের কান্ড করে থাকতেন। দেশে তিনি মহাকাশ গবেষণা চালাচ্ছিলেন একটা। তার স্টাফ ছিল কম, কাজ করতে হতো বেশি-তারপরও সাফল্যপূর্ণ আচরণ ছিল তার মধ্যে।

হঠাৎ করে আরেকটা লোকের ব্যাপারে আমি সচেতন হলাম, যিনি এসে আমার বিপরীত দিকে একটা সোফায় বসলেন। ভদ্রলোক বেশ বলিষ্ঠ চেহারার, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি এবং অত্যন্ত পরিপাটি। পোশাক পরিচ্ছদে সবসময়ই আমি অগোছালো, কিন্তু এই ভদ্রোলোকের পোশাকে দেখা যাচ্ছে আভিজাত্য। তাকে যথেষ্ট সতর্ক দেখা যাচ্ছিল।

লোকটার মধ্যে একটা অদ্ভুত চুম্বকীয় শক্তি ছিল যা আমার উদ্ভাবন বিষয়ক ভাবনার ট্রেনকে লাইনচ্যুত করে দিল। এবং বইটাতে আমি আবার মনোযোগ দেওয়ার আগেই অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ডাক পড়ল। যেখান থেকে বইটা নিয়েছিলাম কাছের সেই সোফার ওপর বইটা রেখে দিলাম। আমার বিপরীত দিকের সোফার ওপর বসা লোকটিকেও যখন অধ্যাপক সারাভাইয়ের কামরায় ডাকা হলো তখন আমি অবাক হলাম। কে এই লোক? আমার উত্তর পেতে বেশি দেরি হলো না। আমরা আসন গ্রহণ করার আগেই অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোকটি ছিলেন বিমান বাহিনীর সদর দপ্তরের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ভি এস নারায়ণন।

অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দুজনের জন্য কফির অর্ডার দিলেন এবং সামরিক বিমানের জন্য একটা রকেট-অ্যাসিস্টেড টেক-অফ সিস্টেম (আর এটিও) তৈরির পরিকল্পনা আমাদের সামনে মেলে ধরলেন। এটা আমাদের যুদ্ধ বিমানগুলোকে হিমালয়ের ক্ষুদ্র রানওয়ে থেকে টেক-অফ করতে সাহায্য করবে। অল্প কথার মধ্যে গরম কফি পরিবেশন করা হয়েছিল। অধ্যাপক সারাভাইয়ের স্বভাবসুলভ আচরণের সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল না। কিন্তু আমরা কফি শেষ করা মাত্রই অধ্যাপক সারাভাই উঠে দাঁড়ালেন এবং তার সঙ্গে আমাদের যেতে বললেন দিল্লি নগরীর প্রান্তে অবস্থিত তিলপাত রেঞ্জে। আমরা লৰি অতিক্রম করে যাবার সময় আমি কৌতূহলবশত এক নজর তাকালাম সেই সোফাটার দিকে যেটার ওপর বইটা রেখে গিয়েছিলাম। বইটা তখন আর সেখানে ছিল না।

রেঞ্জে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘন্টা গাড়ি চালাতে হলো। অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দেখালেন একটা রাশিয়ান আরএটিও। রাশিয়া থেকে এই পদ্ধতির মোটর যদি আমি আপনাদের পাইয়ে দিই, তাহলে কি আপনারা আঠারো মাসে এটা করতে পারবেন? অধ্যাপক সারাভাই আমাদের কাছে জানতে চাইলেন। হ্যাঁ, আমরা পারব। গ্রুপ ক্যাপ্টেন ভিএস নারায়ণন ও আমি প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলাম। অধ্যাপক সারাভাইয়ের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, তাতে প্রতিফলিত হচ্ছিল আমাদের আবিষ্টতা।

হোটেল অশোকায় আমাদের ফিরিয়ে আনার পর অধ্যাপক সারাভাই ব্রেকফাস্ট মিটিং-এ চলে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। সেই সন্ধ্যায় আমার নেতৃত্বে ভারতীয় সামরিক বিমানের শর্ট রানওয়েতে উডডয়নের জন্য একটা যন্ত্র তৈরির খবর প্রচার করা হলো। অসংখ্য আবেগে আমার মন পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সুখ, কৃতজ্ঞতা, পরিপূর্ণতার এক অনুভূতি এবং উনবিংশ শতাব্দীর স্বল্পপরিচিত একজন কবির লেখা একটা কবিতার এই লাইনগুলো আমার মনে ভেসে উঠছিল:

For all your days prepare
And meet them ever alike
When you are the anvil, bear
When you are the hammer, strike.

আরএটিও মোটর বিমানে যুক্ত করা হয়েছিল টেক-অফ রানের সময় নির্দিষ্ট অপারেটিং কন্ডিশনে অতিরিক্ত ধাক্কা প্রক্ষেপণের জন্য এবং সেই কন্ডিশনগুলো ছিল যেমন আংশিকভাবে বোমা-ধ্বস্ত রানওয়ে, হাই অ্যাল্টিচিউড এয়ারফিল্ড, অতিরিক্ত লোড, অথবা অত্যন্ত চড়া পরিবেষ্টক তাপমাত্রা। এয়ার ফোর্সের এস২২ ও এইচএফ ২৪ বিমানের জন্য বেশ কিছু আরএটিও অত্যন্ত প্রয়োজন হয়েছিল।

তিলপাত রেঞ্জে যে রাশিয়ান আরএটিও মোটর আমাদের দেখান হয়েছিল সেটা সমর্থ ছিল মোট ২৪৫০০ কেজি-সেকেন্ড ঘাতসহ ৩০০০ কেজি ধাক্কা উৎপাদনে। সেটার ওজন ছিল ২২০ কেজি এবং ইস্পাতের তৈরি একটা ডাবল বেজ প্রোপেল্যান্ট ছিল সেটার। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও), এইচএএল, ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার) এবং বিমান বাহিনীর সদরদপ্তরের সহযোগিতায় নির্মাণ কাজ করা হয়েছিল স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে।

হাতের কাছে পাওয়া সুযোগসুবিধাগুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর, আমি একটা ফাইবারগ্লাস মোটর কেসিং পছন্দ করলাম। একটা কম্পোজিট প্রোপেল্যান্টের অনুকুলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। এর সুবিধা ছিল, এটা সর্বোচ্চ ধাক্কা প্রয়োগ করতে পারে এবং পুরোপুরিভাবে এটা ব্যবহারের জন্য দীর্ঘসময় ধরে জ্বলতে পারে। আমি এছাড়াও অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আরএটিও নিয়ে কাজ করার সময় দুটো অসাধারণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া সাধিত হয়েছিল। প্রথমটি হলো দেশের মহাশূন্যে গবেষণার দশ বছরের একটা প্রোফাইল প্রকাশ, প্রস্তুত করেছিলেন অধ্যাপক সারাভাই। এই প্রোফাইল শুধুমাত্র একজন শীর্ষব্যক্তি তার দলের কাজকর্ম তুলে ধরার জন্য তৈরি করেছিলেন তা নয়, এটা ছিল মুক্ত আলোচনার এক থিম পেপার, পরবর্তী সময়ে যা রূপান্তরিত হতো একটা কর্মসূচিতে। বস্তুত, আমার কাছে এটা ছিল এক ব্যক্তির রোমান্টিক ইশতেহার, নিজের দেশের মহাশূন্য গবেষণা কর্মসূচিকে যিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন।

ইনকসপারে যে আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল প্রধান পরিকল্পনাটি। এতে আরও যুক্ত ছিল টেলিভিশন ও উন্নয়নমূলক শিক্ষা, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থার রিমোট সেন্সিং ইত্যাদির জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার। এর সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছিল স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকলের উন্নয়ন ও উৎক্ষেপণ।

আগের বছরগুলোয় যেমন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সক্রিয়ভাবে পাওয়া গিয়েছিল, এবারের পরিকল্পনায় স্পষ্টত তা শিথিল হয়ে গেল। এবার আমাদের পুরোপুরি আত্মনির্ভর হতে হলো। পৃথিবীর নিচু কক্ষপথে হালকা ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য একটা এসএলভি তৈরির বিষয় পরিকল্পনায় আলোচিত হয়েছিল। এর অর্থ ছিল, ভারতে তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহকে গবেষণাগারের মডেল থেকে মহাশূন্যে স্থাপনযোগ্য প্রকৃত আকারে উন্নীত করা এবং অ্যাপোজি, বুস্টার মোটর, মোমেন্টাম হুইল ও সোলার প্যানেল ডেভলপমেন্ট মেকানিজমের মতো বিস্তৃত রেঞ্জের স্পেসক্র্যাফট সাবসিস্টেমের উন্নতিসাধন।

দ্বিতীয় কাজ ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা মিসাইল প্যানেল গঠন করা। নারায়ণন আর আমি সদস্য হিসাবে তাতে অন্তর্ভূক্ত হই। আমাদের নিজেদের দেশে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির আইডিয়া ছিল উত্তেজনাকর, এবং আমরা বিভিন্ন অগ্রসর দেশের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পর্যালোচনা করে ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করলাম।

.

ট্যাকটিক্যাল মিসাইল ও স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের মধ্যে পার্থক্য প্রায় সময়ই বেশ মজার। সাধারণভাবে, স্ট্রাটেজিক বলতে বোঝায় যে এই ক্ষেপণাস্ত্র হাজার হাজার কিলোমিটার উড়তে পারবে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে দূরত্বের বদলে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার বেলায় এই টার্ম ব্যবহৃত হয়। স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল হলো সেসব মিসাইল যা শত্রুর একেবারে হৃৎপিন্ডে আঘাত করতে সক্ষম। ট্যাকটিক্যাল অস্ত্র সেগুলো যা প্রভাব খাটায় যুদ্ধে, আর সে যুদ্ধ হতে পারে স্থলভাগে, সমুদ্রে অথবা আকাশে, অথবা এই তিন ক্ষেত্রেই। এই শ্রেণিকরণ আজকের দিনে নির্বোধ বলে প্রতীয়মান হতে পারে, যেমন একটা উদাহরণ ইউএস এয়ার ফোর্সের ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য টমাহক ব্যবহৃত হয় ট্যাকটিক্যাল শ্রেণিতে যার পাল্লা প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার। সেইসব দিনে স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল সমার্থক ছিল ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইআরবিএম)-এর এবং এর পাল্লা ছিল ১৫০০ নটিক্যাল মাইল বা ২৭৮০ কিলোমিটার এবং আরও সমার্থক ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম)-এর যার পাল্লা ছিল আরও বেশি।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন নারায়ণনের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল গাইডেড মিসাইলের। রাশিয়ান মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের উচ্চাভিলাষের অনুরাগী ছিলেন তিনি। ওখানে যখন এটা করা যেতে পারে, তখন এখানে করা যাবে না কেন? মহাশূন্য গবেষণা যেখানে ইতোমধ্যে মিসাইল প্রযুক্তির ভূমি প্রস্তুত করে দিয়েছে। নারায়ণন আমাকে খোঁচা দিতেন।

১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের দুটো যুদ্ধের তিক্ত শিক্ষা ভারতীয় নেতৃত্বকে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কৌশলগত অবস্থানসমূহ রক্ষার জন্য ইউএসএসআর থেকে বিপুল পরিমাণ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এসএএম) আনতে হয়েছিল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন নারায়ণন দেশে এই মিসাইল তৈরির ব্যাপারে প্রচণ্ড আবেদন করেছিলেন।

মিসাইল প্যানেল নিয়ে যখন আমরা কাজ করছিলাম আরএটিও মোটরের ওপর, তখন নারায়ণন ও আমি ছাত্র ও শিক্ষকের ভূমিকা পালন করছিলাম যেখানে দরকার সেখানেই নিজেদের বদল করে। তিনি রকেট বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী ছিলেন এবং আমি খুব কৌতূহলী ছিলাম এয়ারবোর্ন উইপন সিস্টেম সম্পর্কে। নারায়ণনের মেধা প্রয়োগের শক্তি ও গভীরতা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে সূর্য ওঠারও আগে তিলপাত রেঞ্জে আমাদের সফরের সেই প্রথম দিনটি থেকে নারায়ণন ব্যস্ত ছিলেন তার আরএটিও মোটর নিয়ে। চাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সবকিছু তিনি জোগাড় করে রেখেছিলেন। ৭৫ লাখ রূপি তহবিল গঠন করে ফেলেছিলেন এবং আরও খরচখরচার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতিও তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। আপনার যা লাগবে সেটার নাম শুধু আমাকে বলবেন, আমি আপনাকে জিনিসটা এনে দেব, কিন্তু সময় চাইবেন না, তিনি বলেন। সময়ে সময়ে আমি তার অধৈর্য দেখে হাসতাম, আর তাকে পড়ে শোনাতাম টি. এস. এলিয়টের Hollow Men শীর্ষক কবিতার এই লাইনগুলো:

Between the conception
And the creation
Between the emotion
And the response
Falls the Shadow.

প্রতিরক্ষা R&D সেই সময়ে প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল ছিল আমদানিকৃত সরঞ্জামের ওপর। দৃশ্যত দেশীয় কোনো কিছুই সহজলভ্য ছিল না। আমরা একটা কেনাকাটার তালিকা ও আমদানি পরিকল্পনা তৈরি করলাম। কিন্তু এটা আমাকে নিরানন্দ করে তুলল। বিকল্প কিছু কি ছিল না? এই জাতি কি ধ্রুড্রাইভার-প্রযুক্তিতেই পড়ে থাকবে মুখ থুবড়ে? ভারতের মতো একটা গরীব দেশের এ ধরনের উন্নয়নের সামর্থ্য আছে?

একদিন অনেক দেরিতেও অফিসে কাজ করার সময় একজন তরুণ সহকর্মী জয় চন্দ্র বাবুকে দেখলাম বাড়িতে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে বাবু আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তার সম্পর্কে একটা মাত্র বিষয় যা জানতাম তা হলো, তার মনোভাব অত্যন্ত ইতিবাচক আর স্পষ্ট। আমি তাকে আমার অফিসের ভেতর ডেকে নিয়ে আমার একটা চিন্তা প্রকাশ করলাম। তোমার কোনো পরামর্শ আছে? আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। বাবু কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল, তারপর বলল পরবর্তী সন্ধ্যায় আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে তাকে কিছু হোমওয়ার্ক করতে দেওয়া হোক।

পরের সন্ধ্যায় নির্ধারিত সময়ের আগেই বাবু আমার কাছে এল। প্রতিজ্ঞায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার মুখ। আমরা এটা করতে পারব, স্যার! আরএটিও সিস্টেম প্রস্তুত করতে পারব আমদানি করা জিনিস ছাড়াই। একমাত্র বাধা হচ্ছে। সাবকন্ট্রাক্টিং আর প্রকিওরমেন্ট সম্পর্কে সংগঠনের অস্থিতিস্থাপক মনোভাব। কিন্তু আমাদানি এড়াতে হলে এ দুটোর সাহায্য নিতেই হবে। সে আমাকে সাতটা পয়েন্ট দিল। পুরো সংগঠনের পরিবর্তে একজন ব্যক্তির কাছ থেকে আর্থিক অনুমোদন, পদমর্যাদা যাই হোক এ কাজে সংশ্লিষ্ট প্রতিটা কর্মীর জন্য বিমান ভ্রমণ, কেবল একজনের কাছে জবাবদিহিতা, এয়ার-কার্গোর মাধ্যমে মালামাল উত্তোলন, প্রাইভেট সেক্টরে সাব-কন্ট্রাক্ট, কারিগরি প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজের আদেশ, এবং অভিযানমূলক ব্যয়ের প্রসিডিওর।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দাবি অশ্রুতপূর্ব, তবু তার প্রস্তাবে কিছু যুক্তি দেখতে পেলাম আমি। আরএটিও প্রকল্প ছিল একটা নতুন খেলা, সুতরাং নতুন নিয়ম যদি এ খেলায় প্রযুক্ত হয় তাতে ভুল কিছু নেই। আমি একটা পুরো রাত ধরে বাবুর পরামর্শের এপিঠ-ওপিঠ ভেবে দেখলাম এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টা অধ্যাপক সারাভাইয়ের কাছে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। অধ্যাপক সারাভাই দ্বিতীয়বার ভাবলেন না। প্রস্তাব অনুমোদন করলেন।

বাবু উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবসায় বিচারবুদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরেছিল। বিদ্যমান কর্ম প্যারামিটারের মধ্যে সবকিছু দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিতে হলে তোমাকে নিয়োগ করতে হবে অধিক লোকবল, অধিক উপাদান, অধিক অর্থ। তুমি তা না করতে পারলে তোমার প্যারামিটার বদলাও! বাবুর মধ্যে ছিল সহজাত ব্যবসায়ী মানুষ, ফলে আমাদের সঙ্গে বেশিদিন সে থাকেনি। আইএসআরও ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল নাইজেরিয়ায়। আর্থিক বিষয়ে বাবুর সাধারণ জ্ঞানের কথা আমি কখনও ভুলতে পারব না।

আরএটিও মোটর কেসিংয়ের জন্য ফিলামেন্ট ফাইবার গ্লাস/এপোক্সি ব্যবহার করে একটা কম্পোজিট স্ট্রাকচারের জন্য আমরা একটা পন্থা অবলম্বন করেছিলাম। একটা হাই এনার্জি কম্পোজিট প্রোপেল্যান্ট এবং একটা ইভেন্ট-বেজড ইগনিশন ও জেটিসনিং সিস্টেমও আমরা তৈরি করেছিলাম যথাসময়ে। এয়ার ক্র্যাফট থেকে জেট একপাশে সরিয়ে দেবার জন্য একটা ক্যান্টেড নোজলের নকশা করা হয়েছিল। প্রকল্প শুরুর দ্বাদশ মাসে আমরা আরএটিওর প্রথম স্ট্যাটিক পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হলাম। পরবর্তী চার মাসের মধ্যে আমরা আরও ৬৪টি পরীক্ষা চালাই। অথচ প্রকল্পে আমরা কাজ করছিলাম মাত্র ২০ জন প্রকৌশলী!

.

৬.

ভবিষ্যতের স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (এসএলভি) এই সময়েই পরিকল্পিত হয়েছিল। মহাশূন্য প্রযুক্তির অপরিসীম আর্থসামাজিক কল্যাণের বিষয়টি বুঝতে পেরে অধ্যাপক সারাভাই ১৯৬৯ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাদের নিজেদের স্যাটেলাইট নির্মাণ ও উৎক্ষেপণে দেশীয় সামর্থ্য অর্জনের কাজটি পুরো দমে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল ও বড়ো আকৃতির রকেট উৎক্ষেপণের জন্য একটি সম্ভাব্য জায়গার সন্ধানে আকাশ থেকে পূর্ব উপকূল পর্যবেক্ষণে ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

অধ্যাপক সারাভাই পূর্ব উপকূলের দিকে মনোযোগ স্থির করেছিলেন তার কারণ, পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘূর্ণনের পুরো সুবিধা যাতে নিতে পারে লঞ্চ ভেহিকল। তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করলেন মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তরে শ্রীহরিকোটা দ্বীপ, আর এভাবেই জন্ম নিল এসএইচএআর রকেট লঞ্চ স্টেশন। কাস্তে আকৃতির দ্বীপটি চওডায় ছিল সর্বোচ্চ ৮ কিলোমিটার আর অবস্থান ছিল উপকূল বরাবর। মাদ্রাজ নগরীর সমান সেটা বড়ো ছিল। এর পশ্চিম প্রান্তভাগে সৃষ্টি হয়েছিল বাকিংহাম ক্যানাল ও পুলিক্যাট লেক।

১৯৬৮ সালে আমরা গঠন করলাম ইন্ডিয়ান রকেট সোসাইটি। এর কিছুদিন পরেই, ইনকসপারকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমী (আইএনএসএ)-এর অধীনে একটা অ্যাডভাইসরি বডি হিসাবে পুনর্গঠিত করা হলো। অন্যদিকে দেশে মহাকাশ গবেষণা পরিচালনার জন্য ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি (ডিএই)-এর অধীনে সৃষ্টি করা হলো ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (আইএসআরও)।

এ সময় অধ্যাপক সারাভাই একটা ভারতীয় এসএলভির জন্য তার স্বপ্ন পূরণ করতে একটা দল গড়ে ফেলেন। প্রকল্পের নেতা হতে পারায় নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করতে পারি। অধ্যাপক সারাভাই এসএলভির চতুর্থ পর্যায়ের নকশা তৈরির অতিরিক্ত দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেন। অন্য তিনটি পর্যায়ের নকশা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ড, ভিআর গোয়ারিকর, এমআর কুরুপ এবং এই মুথুনায়াগামের ওপর।

এমন একটি বিশাল কাজে আমাদের কজন মাত্র কর্মীকে লাগানোর ভাবনা এসেছিল কীভাবে অধ্যাপক সারাভাইয়ের মাথায়? একটা কারণ হতে পারে আমাদের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাদীক্ষা। ড, গোয়ারিকর অনন্যসাধারণ কাজ করছিলেন। কম্পোজিট প্রোপেল্যান্টের ক্ষেত্রে। এমআর কুরুপ একটা চমৎকার গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রোপেল্যান্ট, প্রপালসন ও পাইরোটেকনিকের জন্য। হাই এনার্জি প্রোপেল্যান্টের ক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন মুথুনায়াগাম। চতুর্থ স্তরটা ছিল একটা কম্পোজিট স্ট্রাকচার আর তাতে প্রয়োজন হয়েছিল ফেব্রিকেশন টেকনোলজির ব্যাপক নব-উদ্ভাবন। হয়তো এ জন্যই আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।

চতুর্থ স্তরটার ভিত্তি স্থাপন করলাম আমি দুটো পাথরের ওপর নিশ্চিন্ত অবলম্বন। আমি সবসময় ভুলভ্রান্তিকে গ্রহণ করতাম শিক্ষাপ্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে। নিখুঁতভাবে কাজ করার জন্য আমি দুঃসাহসিক হতেও পছন্দ করি। আমার দলের সবার উদ্যোগগুলোর প্রতি সবার মনোযোগও শেখার অংশ হিসাবে আমি সমর্থন করি। সে তারা সফল হোক, বা ব্যর্থ।

আমার দলে প্রতিটা ক্ষুদ্র পদক্ষেপেই অগ্রগতির বিষয়টা স্বীকতি পেত আর নতুন শক্তি তাতে সন্নিবেশ করা হতো। চতুর্থ স্তর নির্মাণে আমার সহযোগী কর্মীদের আমি প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবরাহ করতাম। কিন্তু দরকারি উৎসের জন্য পুরোপুরি কাজে লাগতে পারছি কিনা তাতে আমার সন্দেহ ছিল। যে ভাবে আমি সময় ম্যানেজ করছিলাম তাতে কোনো ভুল থেকে যাচ্ছে কিনা, তা আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলল। এ পর্যায়ে অধ্যাপক সারাভাই আমাদের কাজের জায়গায় একজন ফরাসি ভিজিটরকে আনলেন, যিনি আমার কাছে সমস্যাগুলো তুলে ধরবেন। এই ভদ্রলোক ছিলেন ফ্রান্সে আমাদের সহযোগী CNES (Centre Nationale de Etudes Spatiales)-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক কুরিয়েন। ওই সংস্থাটি তখন তৈরি করছিল ডায়মন্ট লঞ্চ ভেহিকল। অধ্যাপক কুরিয়েন ছিলেন আগাগোড়া পেশাদার। অধ্যাপক সারাভাই ও অধ্যাপক কুরিয়েন এক সঙ্গে মিলে আমাকে একটা লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করেছিলেন। যে সব উপায় অবলম্বন করে আমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব তা নিয়ে আলোচনা করার সময় তারা আমাকে ব্যর্থতার সম্ভাবনা সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। অধ্যাপক কুরিয়েনের সহযোগিতামূলক শলাপরামর্শের ভেতর দিয়ে চতুর্থ স্তরের সমস্যাগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। অধ্যাপক সারাভাইয়ের তাড়নায় অধ্যাপক কুরিয়েন তার নিজের ডায়মন্ট কর্মসূচির সাফল্য বার বার ব্যাখ্যা করে শোনাতেন আমাদের।

অধ্যাপক কুরিয়েন ছোটোখাটো কাজ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বড়ো সাফল্য অর্জনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অধ্যাপক সারাভাইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমাদের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা দেখে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে, আমরা ডায়মন্টের চতুর্থ স্টেজ নির্মাণ করতে পারব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। এতে অধ্যাপক সারাভাইয়ের মুখে কী রকম হাসি ফুটেছিল, আমার তা মনে পড়ে।

আসল ব্যাপারটা হলো, ডায়মন্ট ও এসএলভির এয়ারফ্রেম ছিল খাপ খাওয়ানোর অসাধ্য। ডায়ামিটার ছিল একেবারেই আলাদা আর পারস্পরিক বদলের জন্য বেশ কিছু আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করব। আমার সহকর্মীরা সমাধান দিতে পারে কি না জানার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি সতর্কতার সঙ্গে সহকর্মীদের রুটিন পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম, যদি তাতে তাদের অবিরাম পরীক্ষানিরীক্ষার আকাক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাই। এমনকি সামান্যতম সম্ভাবনাও যদি দেখতাম কারো মধ্যে, তাহলে তাকে প্রশ্ন করতে ও তার উত্তর শুনতে আরম্ভ করলাম। আমার কিছু বন্ধু আমাকে সতর্ক করে দিল একটা ব্যাপারে যেটাকে তারা আখ্যায়িত করেছিল আমার সাদাসিধে ভাব হিসাবে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডিজাইনে ব্যক্তিগত পরামর্শ ও সহকর্মীদের হাতে-লেখা নোট দেওয়া আমি প্রায় নিয়মিত বিষয়ে পরিণত করেছিলাম। তাতে পাঁচ বা দশ দিনের মধ্যে নিচ্ছিদ্র ফলো-আপ অ্যাকশনের অনুরোধ থাকত।

এই পদ্ধতি চমৎকারভাবে কাজে দিয়েছিল। অধ্যাপক কুরিয়েন প্রমাণ পেলেন, ইউরোপে আমাদের প্রতিপক্ষরা তিন বছরে যা অর্জন করেছে, আমরা তা অর্জন করেছি মাত্র এক বছরের মধ্যে। আমাদের প্লাস পয়েন্ট হিসাবে তিনি ধরেছিলেন যে, আমরা প্রত্যেকেই কাজ করেছি ওপর-নিচের সবাই মিলেমিশে। আমার হিসেবটা ছিল, প্রত্যেক সপ্তাহে অন্তত একবার দল বৈঠকে বসবে। যদিও এতে সময় ও শক্তি খরচ হতো, তা সত্ত্বেও এটা আমি অপরিহার্য বিবেচনা করতাম।

একজন নেতা কতটা ভালো? তার জনগণের এবং তাদের অঙ্গীকার ও পূর্ণ অংশীদার হিসাবে প্রকল্পে অংশগ্রহণের চেয়ে বেশি ভালো নয়! যেটুকু ছোটোখাটো সাফল্য অর্জিত হয়েছিল তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমি তাদের এক সঙ্গে পেয়েছিলাম। ফলাফল, অভিজ্ঞতা, ক্ষুদ্র সাফল্য, আর এ ধরনের বিষয়গুলো এতে আমার সময় ও শক্তি খরচ মূল্যবান বলেই আমি মনে করতাম। এটা ছিল অঙ্গীকার ও টিমওয়ার্কের চেতনার সামান্য মূল্য। আমার ছোটো দলটার মধ্যেই আমি নেতা খুঁজে পেয়েছিলাম, আর জেনেছিলাম যে সকল পর্যায়েই নেতা আছে।

আমরা SLV-IV স্টেজটি ডায়মন্ট এয়ারফ্রেমের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় রদবদল করলাম। ২৫০ কেজি, ৪০০ এমএম ডায়ামিটার স্টেজ থেকে ৬০০ কেজি, ৬৫০ এমএম ডায়ামিটার স্টেজে সেটা রূপান্তরিত করলাম। দুবছরের চেষ্টার পর যখন সেটা আমরা CNES-এর কাছে হস্তান্তর করতে উদ্যত, ঠিক তখনই ফরাসিরা হঠাৎ করে তাদের ডায়মন্ট বিসি কর্মসূচি বাতিল করে দিল। তারা আমাদের বলল যে, আমাদের স্টেজ ফোর তাদের আর প্রয়োজন নেই। ঘটনাটা ছিল বিশাল আঘাত, দেরাদুনে যেমনটা আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম বিমান বাহিনীতে ঢুকতে, আর ব্যাঙ্গালোরে নন্দী প্রকল্প বিলুপ্ত হয়েছিল এডিইতে, সে সব যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠল।

আমি স্টেজ ফোর নির্মাণে বিশাল আশা রেখেছিলাম, সেই সঙ্গে ছিল আপ্রাণ চেষ্টা, যাতে করে এটা উড়তে পারে একটা ডায়মন্ট রকেটে। এসএলভির অন্য তিনটে স্টেজ ছিল অন্ততপক্ষে পাঁচ বছর দূরে। যাহোক, ডায়মন্ট বিসির স্টেজ ফোরের হতাশা শিকেয় তুলে রাখতে আমার বেশি সময় লাগেনি। আমি অন্তত এ প্রকল্পের কাজটা আগাগোড়া উপভোগ করেছিলাম। ডায়মন্ট বিসি স্টেজের কারণে আমার মধ্যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, যথা সময়ে তা পূরণ করল আরএটিও।

আরএটিও প্রকল্প যখন চলছিল, তখন ধীরে ধীরে আকার নিতে শুরু করেছিল এসএলভি প্রকল্প। একটা লঞ্চ ভেহিকলের সকল প্রধান পদ্ধতির সক্ষমতা ততদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গুম্বায়। বসন্ত গোয়ারিকর, এমআর কুরুপ ও মুথুনায়াগাম তাদের অনন্যসাধারণ প্রচেষ্টায় প্রস্তুত করেছিলেন টিইআরএলএস।

অধ্যাপক সারাভাই দলগঠন শিল্পে হয়ে উঠেছিলেন একটা উদাহরণ। একবারের ঘটনায় তাকে একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল এক ব্যক্তিকে যাচাই করে নিতে হয়েছিল, এসএলভির টেলিকমান্ড সিস্টেম তৈরির জন্য। এ কাজে দুজন ব্যক্তি ছিলেন যোগ্যতাসম্পন্ন। একজন ইউআর রাও, অন্যজন অপেক্ষাকৃত অপরিচিত একজন এক্সপেরিমেন্টার জি মাধবন নায়ার। এই মাধবন নায়ারের আত্মোৎসর্গ ও সক্ষমতায় আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হলেও, আমার মনে হয়নি তার সুযোগের মাত্রা খুব ভালো। অধ্যাপক সারাভাইয়ের নিয়মিত পরিদর্শনের সময় একদিন মাধবন নায়ার অতিশয় সাহসিকতার সঙ্গে প্রদর্শন করলেন তার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য টেলিকমান্ড সিস্টেম। অধ্যাপক সারাভাই একজন প্রতিষ্ঠিত এক্সপার্টের বদলে একজন তরুণ এক্সপেরিমেন্টারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে বেশি সময় নেননি। মাধবন নায়ার তার নেতার প্রত্যাশা শুধু যে পূরণ করেছিলেন তাই নয়, ছাড়িয়েও গিয়েছিলেন তা। পরে তিনি পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি)-এর প্রকল্প পরিচালক হয়েছিলেন।

এসএলভি ও মিসাইলকে বলা যেতে পারে জ্যেঠতুত ভাই: ধারণায় ও উদ্দেশ্যে আলাদা হলেও এরা এসেছে রকেট বিজ্ঞানের একই রক্ত থেকে। হায়দারাবাদে অবস্থিত ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরি (ডিআরডিএল)-এ ডিআরডিও কর্তৃক একটা বিপুল মিসাইল উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। এই সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিসাইল প্যানেলের বৈঠক আর গ্রুপ ক্যাপ্টেন নারায়ণনের সঙ্গে আমার মিথস্ক্রিয়াও সমান মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল।

১৯৬৮ সালে অধ্যাপক সারাভাই তার একটা রুটিন ভিজিটে থুম্বায় এসেছিলেন। তাকে তখন দেখান হচ্ছিল নোজ-কোন জেটসনিং মেকানিজমের পরিচালন ক্রিয়া। সবসময়ের মতো সেবারও আমাদের কাজের ফলাফল নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। অধ্যাপক সারাভাইকে আমরা অনুরোধ করলাম, একটা টাইমার সার্কিটের ভেতর দিয়ে রীতিমাফিক পাইরো সিস্টেম চালু করতে। অধ্যাপক সারাভাই মৃদু হাসলেন, এবং বোতামে চাপ দিলেন। আমরা আতংকিত হয়ে দেখলাম, কিছুই ঘটেনি। একেবারে নির্বাক হয়ে গেলাম আমরা। আমি তাকালাম প্রমোদ কালের দিকে, টাইমার সার্কিটটার নকশা ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন তিনিই। এক মুহূর্তের মধ্যে মনে মনে আমার এই ব্যর্থতার একটা বিশ্লেষণ করে ফেললাম। আমরা অধ্যাপক সারাভাইকে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার অনুরোধ জানালাম, তারপর টাইমার ডিভাইসটা সরিয়ে পাইরোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ দিয়ে দিলাম। অধ্যাপক সারাভাই আবার চাপ দিলেন বোতামে। পাইরো বিস্কুরিত হলো আর নোজ-কোন উৎক্ষিপ্ত হলো। অধ্যাপক সারাভাই আমাকে ও কালেকে অভিনন্দন জানালেন; কিন্তু অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল তার মন রয়েছে অন্য কোথাও। আমরা অনুমান করতে পারলাম না তিনি কী ভাবছেন। তবে অনিশ্চয়তা বেশিক্ষণ থাকল না। অধ্যাপক সারাভাইয়ের সেক্রেটারি টেলিফোনে আমাকে জানালেন, জরুরি আলোচনার জন্য ডিনারের পর অধ্যাপক সারাভাই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।

অধ্যাপক সারাভাই অবস্থান করছিলেন কোভালাম প্যালেস হোটেলে, ত্রিবান্দ্রামে এলে সবসময় এই হোটেলেই তিনি থাকতেন। এখন তার কাছ থেকে তলব পেয়ে আমি খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম। অধ্যাপক সারাভাই তার রীতিমাফিক উষ্ণতা সহযোগে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র, বিভিন্ন প্রকার সুযোগসুবিধা যেমন লঞ্চ প্যাড, ব্লক হাউজ, রাডার, টেলিমেট্রি ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বললেন। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণায় যেসব বস্তু আজ মঞ্জুরি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। তারপর তিনি সেই সকালের ঘটনা প্রসঙ্গে কথা তুললেন। ঠিক এ ভয়টাই আমি পেয়েছিলাম। যাহোক অধ্যাপক সারাভাই কিন্তু এটা উপসংহার করলেন না যে, তার লোকদের দক্ষতার অভাব এবং অপর্যাপ্ত জ্ঞানের কারণে পাইরো টাইমার সার্কিটে ব্যর্থতা ঘটেছে, কিংবা ডাইরেকশন স্টেজে তাদের ত্রুটিপূর্ণ বোঝাপড়ার জন্য এটা ঘটেছে। এসব কথার পরিবর্তে তিনি আমাকে বললেন, এই কাজটাতে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ ছিল না বলে কি আমরা তেমন। একটা কৌতূহলী ছিলাম না? তিনি আমাকে এও ভেবে দেখতে বললেন যে, যে সম্পর্কে সচেতন নই এমন কোনো সমস্যার দ্বারা কি আমার কাজ প্রভাবান্বিত হচ্ছে? তিনি শেষ পর্যন্ত মূল বিষয়ে আঙুল নির্দেশ করলেন। আমাদের সকল রকেট স্টেজ আর রকেট সিস্টেমের ইন্টিগ্রেশন পরিচালনার একটা একক আচ্ছাদনের অভাব আছে আমাদের। ইলেকট্রিক্যাল আর মেকানিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের কাজ চলছে একটা বিশাল পার্থক্যের মধ্যে সময় আর স্থান উভয় ক্ষেত্রেই। এ দুটোর পার্থক্য খুঁচিয়ে একত্রিত করার কোনো চেষ্টা নেই। অধ্যাপক সারাভাই পরবর্তী ঘন্টা খরচ করলেন আমাদের কাজ পুনঃনির্ধারণ করে এবং একেবারে ভোরের দিকে একটা রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

ভুলভ্রান্তি ব্যক্তি মানুষের বা সংগঠনের অর্জনগুলোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বা অর্জন বিলম্ব করতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক সারাভাইয়ের মতো দ্রষ্টা সেই ভুলভ্রান্তিকেই নতুন আইডিয়া বাস্তবায়নের সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে পারেন। তিনি টাইমার সার্কিটের ভুল সম্পর্কে বিশেষ করে উদ্বিগ্ন ছিলেন না, এ জন্যে নূ্যনতম দোষারোপও করেননি। এ ব্যাপারে তার মতামত ছিল যে, ভুলভ্রান্তি অপরিহার্য, তবে তা সংশোধন করে নেওয়া যায়। আমি পরবর্তীকালে অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম যে, ভুল প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা হলো সেগুলো আগেই উপলব্ধি করা। কিন্তু এ যাত্রা, ভাগ্যের এক অদ্ভুত ঘূর্ণনে, টাইমার সার্কিটের ভুল থেকে জন্ম নিল একটা রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরি।

মিসাইল প্যানেলের প্রতিটা বৈঠকের পর অধ্যাপক সারাভাইকে ব্রিফ করা আমার একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুরূপ এক বৈঠকে উপস্থিতির পর আমি ত্রিবান্দ্রামে ফিরছিলাম। ঠিক ওই দিনই এসএলভি ডিজাইন পর্যালোচনা করার জন্য অধ্যাপক সারাভাই সফর করছিলেন থুম্বা। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ থেকে টেলিফোনে আমি তার সঙ্গে কথা বললাম প্যানেল মিটিঙে উত্থাপিত মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে। তিনি আমাকে নিদের্শ দিলেন দিল্লি ফ্লাইট থেকে অবতরণের পর আমি যেন ত্রিবান্দ্রাম বিমান বন্দরে অপেক্ষা করি, এবং ওই রাতেই তার বোম্বাই চলে যাওয়ার আগে সেখানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি যখন ত্রিবান্দ্রামে পৌঁছলাম তখন সেখানে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। বিমানের ল্যাডার অপারেটর কুট্টি ভাঙা গলায় আমাকে জানাল, অধ্যাপক সারাভাই আর নেই। কয়েক ঘন্টা আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম; এটা ঘটেছিল আমাদের আলাপের পর ঘন্টাখানেকের মধ্যে। এটা ছিল আমার জন্য প্রচণ্ড এক আঘাত আর ভারতীয় বিজ্ঞান ক্ষেত্রে বিশাল ক্ষতি। সেই রাতটা কেটে গিয়েছিল শেষকৃত্যের জন্য অধ্যাপক সারাভাইয়ের মরদেহ বিমানযোগে আহমেদাবাদে নিয়ে যাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করতে।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় ২২ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তারা গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। অধ্যাপক সারাভাই শুধু একজন মহান বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বড়ো একজন নেতাও। আমার এখনও মনে পড়ে ১৯৭০ সালের জুনে তিনি এসএলভি-৩ ডিজাইন প্রকল্পের পাক্ষিক অগ্রগতি পর্যালোচনা করছেন। ১নং ও ৪ নং স্টেজের বিষয়গুলো উপস্থাপনার আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম তিনটি উপস্থাপনা মসৃণভাবে সম্পন্ন হলো। আমার পালা সব শেষে। আমি আমার দলের পাঁচ সদস্যকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, যারা বিভিন্ন দিক থেকে ডিজাইনে তাদের অবদান রেখেছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দৃঢ়তা ও আস্থার সঙ্গে তারা নিজ নিজ কাজের অংশ উপস্থাপন করলেন। এই উপস্থাপনাগুলোর ওপর বিস্তারিত আলোচনা হলো এবং উপসংহার করা হলো যে, সন্তোষজনক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

হঠাৎ করে একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী, যিনি অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনার প্রকল্পের বিষয়গুলো উপস্থাপন করলেন আপনার দলের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ কাজের ভিত্তিতে। কিন্তু প্রকল্পের জন্য আপনি কী করেছেন? সেই প্রথম আমি অধ্যাপক সারাভাইকে বাস্তবিকই বিরক্ত হতে দেখলাম। তিনি তার সহকর্মীকে বললেন, প্রকল্প ব্যবস্থাপনাটা কী নিয়ে সেটা আপনার জানা উচিৎ। আমরা একটা অসাধারণ উদাহরণ প্রত্যক্ষ করেছি। টিম ওয়ার্কের এটা এক অভূতপূর্ব প্রদর্শনী। আমি প্রকল্প নেতাকে সবসময় লোকজনের ইন্টিগ্রেটর হিসাবে বিবেচনা করি, আর কালাম হচ্ছে ঠিক সেটাই। আমি অধ্যাপক সারাভাইকে ভারতীয় বিজ্ঞানের মহাত্মা গান্ধী বলে মনে করি। তার দলে সঞ্চালন করছেন নেতৃত্বের গুণাবলী আর আইডিয়া ও উদাহরণ দিয়ে তাদের অনুপ্রাণিত করছেন।

অধ্যাপক এমজিকে মেননকে চালিকাশক্তির প্রধান হিসাবে রেখে একটা মধ্যবর্তী ব্যবস্থার পর, সতীশ ধাওয়ানকে আইএসআরও প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। থুম্বায় পুরো কমপ্লেক্স, যার মধ্যে ছিল টিইআরএলএস, স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টার (এসএসটিসি), আরপিপি, রকেট ফেব্রিকেশন ফ্যাসিলিটি (আরএফএফ) এবং প্রোপেল্যান্ট ফুয়েল কমপ্লেক্স, ইত্যাদি সবগুলোর একত্রীকরণ ঘটেছিল একটা অখন্ড স্পেস সেন্টার গড়ে তুলতে এবং এর নামকরণ করা হয়েছিল বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার (ভিএসএসসি), সেই মানুষটার স্মরণে যার কল্যাণে সম্ভব হয়েছিল এটা। প্রখ্যাত ধাতুবিদ ড. ব্রহ্ম প্রকাশ ভিএসএসসির প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন।

উত্তর প্রদেশের বেরেলি এয়ার ফোর্স স্টেশনে ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর আরএটিও সিস্টেম পরীক্ষা করা হয়েছিল সফল ভাবে, এতে একটা সুখোই-১৬ জেট বিমান ১২০০ মিটার রান করার পর শূন্যে ভেসে ওঠে, সাধারণভাবে যেটার শূন্যে উঠতে ২ কিলোমিটার রান করতে হয়। পরীক্ষার সময় আমরা ৬৬তম আরএটিও মোটর ব্যবহার করেছিলাম। এই প্রদর্শন প্রত্যক্ষ করেছিলেন এয়ার মার্শাল শিবদেব সিং এবং ড. বিডি নাগ চৌধুরী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর তৎকালীন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। এই চেষ্টা থেকে প্রায় ৪ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানো গিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট সায়েন্টিস্টের স্বপ্নদর্শন শেষ পর্যন্ত ফল দিল।

ভারতে মহাকাশ গবেষণা সংগঠিত করার দায়িত্ব নেওয়ার আগে এবং ইনকসপারের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে অধ্যাপক সারাভাই সাফল্যের সঙ্গে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন যে, শিল্প থেকে দূরে অবস্থান নিয়ে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বিজ্ঞান গবেষণা টিকে থাকতে পারবে না। অধ্যাপক সারাভাই যে সব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সেগুলো হচ্ছে সারাভাই কেমিক্যালস, সারাভাই গ্লাস, সারাভাই গেইগি লিমিটেড, সারাভাই মার্ক লিমিটেড এবং দ্য সারাভাই ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ। তেল বীজ থেকে তেল বের করার কাজে এবং কসমেটিকস ও সিনথেটিক ডিটারজেন্ট তৈরিতে তার স্তক অয়েল মিলস অগ্রপথিকের কাজ করেছিল। বড়ো আকারে পেনিসিলিন প্রস্তুত করতে তিনি চালু করেছিলেন স্ট্যান্ডার্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, সেই সময়ে প্রচুর অর্থব্যয় করে বিদেশ থেকে পেনিসিলিন আমদানি করা হতো। এখন আরএটিওর স্বদেশীকরণের ফলে তার মিশনে যোগ হয়েছিল নতুন এক যাত্রা। সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে স্বনির্ভরতা এবং কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করা। এসব আমার মনে পড়ে গিয়েছিল আরএটিও সিস্টেমের সফল ট্রায়ালের দিনে। ট্রায়ালের খরচাদিসহ পুরো প্রকল্পে আমাদের ব্যয় হয়েছিল ২৫ লাখ রুপিরও কম। ভারতীয় আরএটিও প্রতিটা উৎপাদন করা যেত ১৭০০০ রুপি খরচ করে, অন্যদিকে আমদানি করা প্রতিটা আরএটিওর জন্য খরচ হতো ৩৩০০০ রুপি। বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে এসএলভির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলল। সমগ্র সাবসিস্টেম ডিজাইন করা হয়েছিল, প্রযুক্তি চিহ্নিত করা হয়েছিল, প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, কর্মকেন্দ্র নির্বাচন করা হয়েছিল, জনশক্তি চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং শিডিউল নির্ধারণ করা হয়েছিল। একমাত্র সমস্যা ছিল এই মেগা প্রজেক্ট কার্যকর ভাবে চালানোর জন্য একটা ব্যবস্থাপনা অবকাঠামোর অভাব এবং কর্মতৎপরতা সমন্বয়ের অভাব।

অধ্যাপক ধাওয়ান ড. ব্রহ্ম প্রকাশের সঙ্গে পরামর্শ করে এই কাজের জন্য আমাকে ঠিক করলেন। আমাকে এসএলভি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হলো, আমাকে সরাসরি রিপোর্ট করতে হতো ভিএসএসসির পরিচালকের কাছে। আমার প্রথম কাজ ছিল একটা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রস্তুত করা। আমি অবাক হয়েছিলাম গোয়ারিকর, মুগুনায়াগাম এবং কুরুপের মতো প্রতিভাবানরা থাকতে আমাকে কেন এই কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। ঈশ্বরদাস, আরাভামুড়ান এবং এসসি গুপ্তের মতো সংগঠক থাকতে আমি ভালো করতে পারতাম কীভাবে? ডক্টর ব্ৰহ্ম প্রকাশের কাছে আমার এই সন্দেহের কথা প্রকাশ করলাম। তিনি আমাকে বললেন অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা না করে তাদের সামর্থ্য সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিতে।

ডক্টর ব্রহ্ম প্রকাশ আমাকে উপদেশ দিলেন অধস্তনদের কর্মকুশলতার যত্ন নিতে এবং অংশগ্রহণরত কর্মকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে অতিমাত্রায় দক্ষতা সন্ধানের ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করে দিলেন। প্রত্যেকেই কাজ করবে এসএলভির তাদের অংশ তৈরি করার জন্য; আপনার সমস্যাটা হতে যাচ্ছে অন্যদের ওপর আপনার নির্ভরতা। আপনাকে প্রচুর ধৈর্য ও সহনশীলতা দেখাতে হবে, তিনি বললেন। এতে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আমার বাবা যা পড়ে শোনাতেন পবিত্র কুরআন থেকে আমরা আপনার আগে কোনো নবীকে পাঠাইনি যিনি খাবার গ্রহণ করতেন না বা বাজারচত্বরে হেঁটে বেড়াতেন না। আমরা আপনাকে পরীক্ষা করি একটার পর অন্য উপায়ে। আপনি কি ধৈর্যশীল হবেন না?

এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রায়ই যা ঘটে সেই দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম। যারা দলকে পরিচালনা করে প্রায়শ তারা দুটো বিষয়ের একটি অনুসরণ করে : কারো কারো কাছে কাজ হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি প্রেষণা; অন্যদের কাছে তাদের কর্মীরাই সকল আগ্রহের বিষয়। আবার আরও অনেকে আছে যারা হয় এই দুই বিষয়ের মধ্যে পড়েছে, নয়তো এর বাইরে। যারা কাজ কিংবা কর্মী কারো প্রতিই আগ্রহী ছিল না তাদের এড়িয়ে চলা ছিল আমার কাজ। যে কোনো একটা চরমপন্থা গ্রহণ করা থেকে লোকদের ঠেকাতে আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম! আর কাজ ও কর্মী যাতে চলতে পারে একত্রে সে অবস্থা চালু করতেও আমার দৃঢ়তা ছিল।

এসএলভি প্রকল্পের প্রাথমিক বিষয় ছিল ডিজাইন, উন্নয়ন ও একটা স্ট্যান্ডার্ড এসএলভি সিস্টেম পরিচালনা, এসএলভি-৩, পৃথিবীর চারদিকে ৪০০ কিলোমিটার সার্কুলার অরবিটে ৪০ কেজি ওজনের একটা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের স্বতন্ত্র অভিযান সম্পন্ন করার সামর্থ্য।

প্রথম পদেক্ষপ হিসাবে, প্রাথমিক প্রকল্প বিষয়গুলোকে আমি কয়েকটি প্রধান কাজে বিভক্ত করি। ওই ধরনের একটা কাজ ছিল, ভেহিকলের চতুর্থ স্টেজের জন্য একটা রকেট মোটর সিস্টেম তৈরি করা। এ কাজ সম্পূর্ণ করার পথে জটিল সমস্যা ছিল: ৪.৬ টনের একটা প্রোপেল্যান্ট আর একটা হাই ম্যাস রেসিও অ্যাপোজি রকেট মোটর সিস্টেম তৈরি করা। আরেকটা কাজ ছিল ভেহিকল কন্ট্রোল এবং গাইডেন্স। তিন ধরনের কন্ট্রোল সিস্টেম সংশ্লিষ্ট ছিল এই কাজে অ্যারোডাইনামিক সারফেস কন্ট্রোল, থ্রাস্ট ভেক্টর কন্ট্রোল এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্টেজের জন্য রিঅ্যাকশন কন্ট্রোল। আর চতুর্থ স্টেজের জন্য স্পিন-আপ মেকানিজম। অপ্রতিরোধী পরিমাপের মাধ্যমে কন্ট্রোল সিস্টেম ও গাইডেন্সের জন্য অপ্রতিরোধী রেফারেন্সও ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়াও আরেকটা প্রধান কাজ ছিল এসএইচএআরে উৎক্ষেপণ সুবিধাদি বাড়ানো। ৬৪ মাসের মধ্যে একটা অল লাইন উডডয়ন পরীক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল ১৯৭৩ সালের মার্চে।

.

গৃহীত সিদ্ধান্ত, অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ও প্রকল্প রিপোর্টের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে ভিএসএসসির পরিচালক কর্তৃক আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতা ও বাজেটে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্বাহী দায়িত্ব নিয়েছিলাম আমি মধ্যে। ড. ব্রহ্ম প্রকাশ বিশেষ ক্ষেত্রগুলো যেমন রকেট মোটর, ম্যাটারিয়াল ও ফেব্রিকেশন, কন্ট্রোল ও গাইডেন্স, ইলেকট্রনিক্স, এবং মিশন ও লঞ্চিং-এ আমাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য চারটি প্রকল্প উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেছিলেন। আমি প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের গাইডেন্সের ব্যাপারে আশ্বস্ত ছিলাম, যেমন ডিএস রানে, মুথুনায়াগাম, টিএস প্রহ্লাদ, এআর আচার্য, এসসি গুপ্ত এবং সিএল আম্বা রাও তাদের কয়েকজন।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-আমরা আপনার কাছে বাণী প্রেরণ করেছি। আপনাকে তাদের বিষয়ে জানানোর জন্য যারা আপনার আগে গত হয়েছে এবং সাবধান ন্যায়পরায়ণ মানুষেরা। এই সব চরম জ্ঞানী মানুষদের জ্ঞান ভাগ করে নিতে চাইতাম আমি। জ্যোতির ওপর জ্যোতি আল্লাহ তার জ্যোতিতে পথ দেখান যাকে তিনি ইচ্ছা করেন। সকল বস্তুর জ্ঞান আছে তার।

প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমরা তিনটে গ্রুপ তৈরি করলাম। একটা কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা গ্রুপ, একটা ইন্টিগ্রেশন ও উড্ডয়ন পরীক্ষা গ্রুপ এবং একটা সাবসিস্টেমস ডেভলপমেন্ট গ্রুপ। প্রথম গ্রুপের দায়িত্ব হলো এসএলভি ৩ এর সামগ্রিক নির্বাহী অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, সেই সঙ্গে প্রশাসন, পরিকল্পনা ও ক্রমোন্নয়ন, সাবসিস্টেম স্পেসিফিকেশন, ম্যাটারিয়াল, ফেব্রিকেশন, কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স এবং কন্ট্রোল। ইন্টিগ্রেশন ও উড্ডয়ন পরীক্ষা গ্রুপের দায়িত্ব হলো এসএলভি-৩ এর ফ্লাইট টেস্টিং ও ইন্টিগ্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি সরবরাহ। তাদের আরও কাজ হলো মেকানিক্যাল ও অ্যারোডাইনামিক ইন্টারফেস সমস্যাসহ ভেহিকল বিশ্লেষণ। সাবসিস্টেমস ডেভলপমেন্ট গ্রুপকে দেওয়া হয়েছিল ভিএসএসসির বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং এসব বিভাগের প্রতিভাবানদের মধ্যে একটা যৌক্রিয়া সৃষ্টির দ্বারা বিভিন্ন সাবসিস্টেম উন্নয়নে যাবতীয় প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানের নিশ্চয়তা বিধান করা।

আমি এসএলভি-৩ এর জন্য ২৭৫ জন প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী চেয়েছিলাম, কিন্তু পেলাম মাত্র ৫০ জনকে। যৌথ প্রচেষ্টা না চালানো হলে সমস্ত প্রকল্পটা অচল হয়েই পড়ে থাকত। কয়েকজন তরুণ প্রকৌশলী যেমন এমএসআর দেব, জি মাধবন নায়ার, এস শ্রীনিবাসন, ইউএস সিং, সুন্দররাজন, আবদুল মজিদ, বেদ প্রকাশ স্যান্ডলাস, নাম্বুদিরি, শশী কুমার ও শিবাথানু পিল্লাই নিজেদের নিয়ম তৈরি করে নিয়েছিল প্রকল্পের দল হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য। এতে করে তারা স্বতন্ত্র ফলাফল সৃষ্টি করতে পেরেছিল। তারা এক সঙ্গে তাদের সাফল্য সেলিব্রেট করত। কঠিন কাজের পর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে এ ব্যাপারটা তাদের সাহায্য করত।

এসএলভি-৩ প্রকল্প দলের প্রতিটা সদস্য ছিল নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। অতঃপর এটা স্বাভাবিক যে তারা প্রত্যেকেই নিজের স্বাতন্ত্রকে মর্যাদা দিত। ওই ধরনের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কাজ বের করে নিতে দল নেতাকে নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় মনোভঙ্গির মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রাখতে হয়েছিল। সক্রিয় মনোভাব সদস্যদের কাজে অত্যন্ত নিয়মিত ভিত্তিতে কার্যকর আগ্রহ দেখায়। নিষিক্রয় মনোভাব দলের সদস্যদের প্রতি আস্থা দেখায় আর তাদের ভূমিকা নিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দেয়। নেতা যখন সক্রিয় মনোভাবকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়, তখন তাকে দেখা হয় উদ্বিগ্ন ও হস্তক্ষেপকারি হিসাবে। যদি সে নিষিক্রয় মনোভাবের দিকে যায়, তাহলে তাকে দায়িত্বহীনতার দোষারোপ করা হয়। কিংবা বলা হয় অনাগ্রহী। আজ, এসএলভি-৩ দলের সদস্যরা পরিণত হয়ে উঠেছেন দেশের সবচেয়ে মর্যাদাশীল কয়েকটি কর্মসূচির নেতৃত্ব দিতে। এমএস আর দেব অগমেন্টেড স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (এএসএলভি) প্রকল্পের প্রধান, পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি) প্রকল্পের প্রধান মাধবন নায়ার এবং ডিআরডিও সদর দপ্তরে প্রধান নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন স্যান্ডলাস ও শিবাথানু পিল্লাই। পাথরের মতো দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর ধারাবাহিক কঠোর কাজের ভেতর দিয়ে তারা উঠে এসেছেন আজকের অবস্থানে। এ দলটা বাস্তবিকই ছিল একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভাবানদের দল।

.

৭.

এসএলভি-৩ প্রকল্প পরিচালনার নেতৃত্ব গ্রহণ করে আমি নিজের সময়ের জরুরি ও দ্বন্দময় চাহিদার মুখোমুখি হলাম কমিটির কাজের জন্য, উপাদান সংগ্রহ, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, পর্যালোচনা, সারাংশ বিবৃতি, আর বিস্তৃত বিষয়ে জ্ঞাত থাকার প্রয়োজনীয়তার জন্য।

যেখানে আমি থাকতাম তার চারপাশে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটাহাঁটির ভেতর দিয়ে আমার দিন শুরু হতো। মর্নিং ওয়াকের সময় সাধারণ একটা শিডিউল আমি প্রস্তুত করে নিতাম, আর ওই দিনেই শেষ করতে চাই এমন দুটো বা তিনটে বিষয়ের ওপর জোর দিতাম, অন্তত একটা বিষয় যা দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে।

অফিসে পৌঁছানোর পর আমার প্রথম কাজ হয় টেবিল পরিষ্কার করা। পরবর্তী দশ মিনিটের মধ্যে সমস্ত কাগজপত্র বাছাই করে দ্রুত সেগুলো বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে ফেলি। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার গুলো এক দিকে, একটু কম জরুরিগুলো আরেকদিকে, পেন্ডিং রাখার গুলো অন্য দিকে, আর সব আমাকে পড়তে হতো। এরপর সবচেয়ে জরুরি কাগজপত্রগুলো আমার সামনে রেখে বাকি আর সবগুলো চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলি।

এখন এসএলভি-৩ প্রকল্পের কথায় ফিরে আসি, এর নকশা করার সময় ২৫০টি সাব-অ্যাসেম্বলি আর ৪৪টি বড়ো সাবসিস্টেম সম্পন্ন করা হয়েছিল।

জিনিসপত্রের তালিকায় গঠনকর উপাদানের পরিমাণ ১০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাত থেকে দশ বছর সময়কালের এই জটিল কর্মসূচির স্থিতিশীলভাবে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জনের জন্য একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন কৌশল অত্যাবশক হয়ে পড়েছিল। তার দিক থেকে অধ্যাপক ধাওয়ান একটা পরিষ্কার অবস্থান নিয়েছিলেন যে, ভিএসএসসি ও এসএইচএআর-এর সকল জনশক্তি ও তহবিল পরিচালিত হতে হবে আমাদের প্রতি। আর আমাদের দিক থেকে আমরা ব্যবস্থাপনার একটা মৌল ধরনের বিবর্ধন ঘটিয়েছিলাম যাতে করে তিন শয়েরও বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রডাক্টিভ ইন্টারফেসিং অর্জন করা যায়। লক্ষ্য ছিল যে, তাদের সঙ্গে আমাদের মিথস্ক্রিয়া অবশ্যই পৌঁছাতে হবে তাদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতায়নে। তিনটে বিষয় আমি তুলে ধরেছিলাম আমার সহকর্মীদের কাছে ডিজাইন ক্যাপাবিলিটির গুরুত্ব, লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন এবং বাধাবিপত্তি প্রতিরোধ করার শক্তি। এখন, এসএলভি-৩ প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার চিত্রটি তুলে ধরার আগে আমি এসএলভি-৩ সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

একটা লঞ্চ ভেহিকল সম্পর্কে গুরুত্বারোপমূলকভাবে কিছু বর্ণনা করা বাস্তবিক চিত্তাকর্ষক। প্রধান যান্ত্রিক কাঠামোটাকে মানবদেহ হিসাবে কল্পনা করা যেতে পারে, সহযোগী ইলেকট্রনিকসহ কন্ট্রোল ও গাইডেন্স সিস্টেম ধরা যেতে পারে মস্তিষ্ক। পেশীতন্ত্র গঠিত হয় প্রোপেল্যান্ট থেকে। কীভাবে এগুলো তৈরি করা হয়? উপাদান আর কলাকৌশল কীসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট?

একটা লঞ্চ ভেহিকল তৈরি করতে বিপুল সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের উপাদান প্রয়োজন হয়। ধাতব ও অধাতব উভয় প্রকার, এর সঙ্গে যোগ হয় কম্পোজিট ও সিরামিক। ধাতুর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার স্টেইনলেস স্টিল, অ লুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, টিটানিয়াম, কপার, বেরিলিয়াম, টাংস্টেন, ও মলিবডেনামের সঙ্কর ব্যবহৃত হয়। কমবাইনকৃত উপাদান হতে পারে ধাতব, জৈব অথবা অজৈব। আমরা বিপুল পরিমাণে গ্লাস ফাইবার, রিইনফোর্সড প্লস্টিক-এর যৌগ ব্যবহার করে থাকি এবং Keviar-এ প্রবেশের চতর উনাক্ত করে দিই, এ জিনিসটা হচ্ছে। পলিমাইড ও কার্বন-কার্বন যৌগ। সিরামিক হচ্ছে বিশেষ ধরনের আগুনে পোড়া মাটি যা ব্যবহার করা হয় মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সপারেন্ট এনক্লোজারে। আমরা সিরামিক ব্যবহারের কথা বিবেচনা করেছিলাম, কিন্তু সে সময় প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে ও চিন্তা বাদ দিতে হয়েছিল।

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভেতর দিয়ে এসব উপাদান রূপান্তরিত হয় হার্ডওয়ারে। বস্তুত, সকল প্রকৌশল বিদ্যার মধ্যে, যেগুলো সরাসরি রকেট বিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে সবচেয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। একটা জটিল পদ্ধতির লিকুইড ইঞ্জিন হোক বা সামান্য একটা কবজা হোক, এর যে কোনোটি তৈরির জন্য দরকার হবে একজন সুদক্ষ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং নিখুঁত সব যন্ত্রপাতি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যেমন অল্প মাত্রার সঙ্করযুক্ত মরিচারোধক ইস্পাতের জন্য ওয়েল্ডিং টেকনিক, ইলেকট্রফর্মিং টেকনিক, এবং অতি নিখুঁত প্রসেস টুলিং নিজেরাই তৈরি করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি যেমন ২৫৪ লিটার ভার্টিক্যাল মিক্সার এবং খাজ কাটা যন্ত্র তৈরি করব যা দরকার হবে আমার তৃতীয় ও চতুর্থ স্টেজে। আমাদের অনেক সাবসিস্টেম ছিল অত্যন্ত বিশাল ও জটিল। তাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের ব্যাপার ছিল। কোনো দ্বিধা না করে প্রাইভেট সেক্টরের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমরা জোগাড়যন্ত্র করে নিয়েছিলাম এবং তাতে করে তৈরি হয়েছিল এমন একটা কন্ট্রাক্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান পরে যা সরকার পরিচালিত অসংখ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবসা সংগঠনের পক্ষে নীলনকশা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।

এসএলভির জীবন্ত হয়ে ওঠার কথা বলতে গেলে এর সেই অংশগুলোর কথা বলতে হবে যার সাহায্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এতে ছিল জটিল বৈদ্যুতিক সার্কট্রি, এর ফলে যান্ত্রিক কাঠামো সচল হয়ে ওঠে। এই বিপুল তৎপরতা, সাদামাটা বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ থেকে শুরু করে গাইডেন্স ও কন্ট্রোল সিস্টেমের পাশাপাশি জটিল ইট্রুমেন্টেশন পর্যন্ত সবকিছু, অ্যারোস্পেস গবেষণায় সম্মিলিতভাবে Avionics নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এভিওনিক সিস্টেমে উন্নয়ন। প্রচেষ্টা ভিএসএসসিতে আগেই প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল ডিজিটাল ইলেকট্রনিক, মাইক্রোওয়েভ রাডার ও ট্রান্সপোন্ডার এবং ইনার্শিয়াল উপাদান ও পদ্ধতিতে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উড্ডয়নরত অবস্থায় এসএলভির কী অবস্থা দাঁড়ায় তা জানা। এসএলভির কারণে নতুন এক কর্মকুশলতা সৃষ্টি হয়েছিল ফিজিক্যাল প্যারামিটারের পরিমাপের জন্য বিভিন্ন প্রকার ট্রান্সডিউসার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন চাপ, ধাক্কা, কম্পন, তুরণ ইত্যাদি। ভেহিকলের ফিজিক্যাল প্যারামিটারকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিবর্তিত করে ট্রান্সডিউসার। একটা অনবোর্ড টেলিমেট্টি সিস্টেম এসব সংকেত প্রক্রিয়া করে এবং রেডিও সংকেতের আকারে তা প্রেরণ করে ভূ-কেন্দ্রে। এই পদ্ধতি যদি ডিজাইন অনুযায়ী ঠিকমতো কাজ করে তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার বিশেষ কিছু থাকে না। কিন্তু কিছু যদি ভুল হয়ে যায়, তাহলে অপ্রত্যাশিত কোনো চলন থেকে থামাতে ভেহিকলকে অবশ্যই ধ্বংস করে ফেলতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রকেট ধ্বংস করে ফেলার জন্য একটা স্পেশাল কমান্ড সিস্টেম তৈরি করতে হয়েছিল, আর এসএলভির দরত ও অবস্থান ঠিক রাখতে তৈরি করতে হয়েছিল একটা ইন্টারফোরোমিটার সিস্টেম, রাডার সিস্টেমের একটা যুক্ত উপায় হিসাবে। এসএলভি প্রকল্পের জন্য দেশীয় পর্যায়ে সেকুয়েলার উৎপাদন করা হয়েছিল, এর সাহায্যে সময় বেধে দেওয়া হতো বিভিন্ন ঘটনাক্রমের যেমন ইগনিশন, স্টেজ সেপারেশন, ভেহিকল অ্যান্টিটিউড প্রোগ্রামার যা রকেট পরিচালনার তথ্য জমা করে রাখে এবং পূর্বনির্ধারিত পথে রকেটকে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অটো-পাইলট ইলেকট্রনিকস!

পুরো সিস্টেমকে চালানোর শক্তি ছাড়া লঞ্চ ডেহিকল ভূ-পৃষ্ঠেই থেকে যায়। সাধারণভাবে একটা প্রোপেল্যান্ট হচ্ছে একটা দহনযোগ্য বস্তু যা থেকে তাপ উৎপন্ন হয় এবং রকেট ইঞ্জিনে সরবরাহ করে অতিক্ষুদ্র নিক্ষেপণ কণিকা। একই সঙ্গে এটা হলো শক্তির উৎস আর বর্ধনশীল শক্তির ক্রিয়াশীল বস্তু। যেহেতু রকেট ইঞ্জিনে পার্থক্য অনেক বেশি নিষ্পত্তিমূলক, তাই প্রোপেল্যান্ট পরিভাষাটি প্রাথমিকভাবে ব্যবহৃত হয় কেমিক্যালের বর্ণনা দিতে, রকেট যে কেমিক্যাল বহন করে সামনে চালনামূলক কাজে।

প্রোপেল্যান্টকে সলিড বা লিকুইড হিসাবে শ্রেণিভাগ করাটাই রীতি। আমরা সলিড প্রোপেল্যান্টের ওপর মনোযোগ ঘনীভূত করেছিলাম। একটা সলিড প্রোপেল্যান্ট গঠন করতে তিনটি উপাদান অত্যাবশ্যক ও অক্সিডাইজার, জ্বালানি এবং অ্যাডিটিভ। সলিড প্রোপেল্যান্ট পরে আরও দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায় ৪ কম্পোজিট এবং ডাল বেজ। আগেরটা গঠিতহয় অজৈব বস্তু (যেমন অ্যামোনিয়াম পারক্লোরেট) বা অক্সিডাইজারের জৈব জ্বালানির (যেমন সিনথেটিক রাবার) একটা পন্থায়। ডাবল বেজ প্রোপেল্যান্ট সেইসব দিনে ছিল দূরের স্বপ্ন, কিন্তু তবুও এ নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস করেছিলাম আমরা।

.

এই পর্যাপ্ততা আর দেশীয় উৎপাদন ঘটেছিল ক্রমাগত ভাবে, আর সবসময় যে যন্ত্রণা ছাড়া তা নয়। আমরা ছিলাম একদল প্রায়-প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী। আমাদের টিউটর বিহীন অধ্যবসায়, প্রতিভা, চরিত্র, আর আত্মনিবেদন এসএলভি তৈরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছিল। সমস্যা দেখা দিত নিয়মিতই, আর তা প্রায়ই ঘটতো। একটা সমস্যার পর দেখা মিলত আরেকটার। আমার দলের সদস্যরা কখনও আমার ধৈর্য নিঃশেষিত হতে দেননি। আমার মনে পড়ে একবার নাইট শিফটের কাজ শেষ করার পর লিখেছিলাম:

Beautiful hands are those that do
Work that is earnest and brave and true
Moment by moment
The long day through.

আমাদের এসএলভির কাজের প্রায় সমান্তরালে, ডিআরডিও নিজেকে প্রস্তুত করছিল একটা দেশীয় সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল নির্মাণের জন্য। আরএটিও প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়েছিল, কারণ যে বিমানটার জন্য এর ডিজাইন করা হয়েছিল তা সেকেলে হয়ে পড়েছিল। নতুন এয়ারক্র্যাফটের জন্য আরএটিও দরকার ছিল প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, নারায়ণনের ওপর ডিআরডিও যুক্তিসঙ্গত ভাবে মিসাইল নির্মাতা দলের নেতৃত্বভার অর্পণ করতে চাইল। আইএসআরওতে আমরা যেমন করতাম তেমন না করে তারা প্রযুক্তি উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে বরং ওয়ান-টু-ওয়ান প্রতিস্থাপনার দর্শন পছন্দ করেছিল। একটা পরীক্ষিত মিসাইলের সমস্ত ডিজাইন প্যারামিটারের যাবতীয় জ্ঞান আহরণের জন্য এবং সংস্থার চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় অবকাঠাম স্থাপনের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল রাশিয়াউদ্ভাবিত সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল এসএ-২। ভাবা হয়েছিল যে একবার ওয়ানটু-ওয়ান স্বদেশীকরণ প্রতিষ্ঠিত হলে, গাইডেড মিসাইলের আধুনিকতম ক্ষেত্রটির পরবর্তী অগ্রগতিতে ঘটবে প্রাকৃতিক ফল আউট। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল, এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ডেভিল এবং প্রথম তিন বছরের জন্য প্রায় ৫ কোটি রূপির তহবিল ধার্য করা হয়।

নারায়ণন ততদিনে পদোন্নতি পেয়ে এয়ার কমোডর হয়েছেন। তাকে ডিআরডি এলের পরিচালক নিযুক্ত করা হলো। এই বিশাল কাজের দায়িত্ব নেবার জন্য হায়দারাবাদের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শহরতলীতে অবস্থিত আনকোরা এই গবেষণাগারটি সচল করলেন তিনি। সমাধি আর প্রাচীন দালানকোঠার ছাপযুক্ত ভূদৃশ্যে শুরু হলো নতুন জীবনের প্রতিধ্বনি। নারায়ণন ছিলেন বিপুল শক্তিসম্পন্ন সদা উদ্দীপিত একজন মানুষ। তিনি নিজের চারপাশে জড়ো করলেন উদ্যমী মানুষদের শক্তিশালী একটা দলকে, এই বেসামরিক গবেষণাগারে তুলে আনলেন অনেক সার্ভিস অফিসারকে। এসএলভির কাজে পুরোপুরি নিমগ্ন হয়ে পড়ায় মিসাইল প্যানেলের বৈঠকগুলোয় আমার অংশগ্রহণ ক্রমে হ্রাস পেয়েছিল, পরে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাহোক, নারায়ণন ও তার ডেভিল-এর গল্প আসতে শুরু করেছিল ত্রিবান্দ্রামে। একটা নজিরবিহীন স্কেলের রূপান্তর ঘটছিল সেখানে।

আরএটিও প্রকল্পে নারায়ণনের সঙ্গে আমার কাজের সময় আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, তিনি একজন কঠিন কর্মবীর। এমন একজন যিনি নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব আর কর্তৃত্ব পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিলেন। আমি বিস্ময়ে ভাবতাম, তার মতো ব্যবস্থাপকরা যারা মূল্যকে পাত্তা না দিয়ে ফলাফল পাওয়ার দিকেই লক্ষ্যস্থির করে, তারা দীর্ঘ যাত্রায় অসহযোগিতা আর নীরব বিদ্রোহের মুখোমুখি হয় কিনা।

১৯৭৫ সালের নববর্ষের দিনে নারায়ণনের নেতৃত্বে কাজ করার সুযোগ এলো। অধ্যাপক এমজিকে মেনন, সেই সময় তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছিলেন আর ডিআরডিওর প্রধান ছিলেন, ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশের সভাপতিত্বে একটা রিভিউ কমিটি গঠন করলেন ডেভিল প্রকল্পের কাজের মূল্যায়ন করার জন্য। আমাকে ওই দলে রাখা হয়েছিল রকেট স্পেশালিস্ট হিসাবে অ্যারোডাইনামিকসের ক্ষেত্রগুলোয়, গঠনে ও মিসাইলের প্রপালসনে সাধিত অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য ছিলেন বিআর সোমাশেখর এবং উইং কমান্ডার পি কামারাজু। কমিটির সদস্যদের মধ্যে আরও ছিলেন ড, আরপি শেনয় এবং অধ্যাপক আইজি শর্মা, ইলেকট্রনিক সিস্টেমে যে কাজ করা হয়েছিল তার পর্যালোচনার দায়িত্ব ছিল তাদের।

১৯৭৫ সালের ১ ও ২ জানুয়ারিতে আমরা মিলিত হলাম ডিআরডিএলে। প্রায় ছয় সপ্তাহ পর দ্বিতীয় সেশনটি অনুষ্ঠিত হলো। আমরা পরিদর্শন করলাম বিভিন্ন ডেভলপমেন্ট ওয়ার্ক সেন্টার আর সেখানকার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। আমি ভীষণভাবে আলোড়িত হলাম এভি রঙ্গ রাওয়ের ভবিষ্যৎ দর্শনে, উইং কমান্ডার আর গোপালস্বামীর গতিশীলতায়, ড, আই অচ্যুত রাওয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খতায়, জি গণেশনের কর্মপ্রচেষ্টায়, এস কৃষ্ণনের চিন্তার স্বচ্ছতায় আর বালকৃষ্ণনের সমগ্রতার প্রতি সুক্ষ দৃষ্টিতে। ভীষণ জটিলতার মুখেও জেসি ভট্টাচার্য ও লেফটেন্যান্ট কর্ণেল স্বামীনাথনের শান্ত থাকার বিষয়টি ছিল চমকপ্রদ। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ভিজে সুন্দরমের গভীর উদ্দীপনা ও আবেদন ছিল দৃষ্টি-আকর্ষক। তারা ছিলেন একদল অতিশয় বুদ্ধিমান ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষ, সার্ভিস অফিসার ও বেসামরিক বিজ্ঞানীদের একটা মিশ্রণ-তারা নিজেদের প্রশিক্ষিত করেছিলেন একটা ভারতীয় মিসাইল উৎক্ষেপণের নিজস্ব আগ্রহ থেকে।

১৯৭৫-এর মার্চে ত্রিবান্দ্রামে আমাদের উপসংহারমূলক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। আমরা অনুভব করলাম যে প্রকল্প সম্পাদনের অগ্রগতি হার্ডওয়ার ফেব্রিকেশনের বিচারে যথেষ্ট, মিসাইল সাবসিস্টেমের ওয়ান-টু-ওয়ান প্রতিস্থাপনার দর্শন রূপায়িত করতে, কেবল লিকুইড রকেট ক্ষেত্র বাদ দিয়ে, ওখানে সাফল্য অর্জনের জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন ছিল। কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে মতামত দিল যে, হার্ডওয়ার ফেব্রিকেশন ও গ্রাউন্ড ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স ডিজাইন ও নির্মাণে সিস্টেম অ্যানালিসিসের দুটো লক্ষ্যই ডিআরডিএল পূরণ করেছে।

আমরা লক্ষ করলাম, ওয়ান-টু-ওয়ান প্রতিস্থাপনা দর্শন ডিজাইন ডাটা সঞ্চালনের ওপর অধিকতর মর্যাদা দখল করে আছে। অনেক ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজনীয় অ্যানালাইসিসের ওপর পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারেনি, যে অনুশীলনটা আমরা অনুসরণ করতাম ভিএসএসসিতে। তখনও পর্যন্ত চালানো সিস্টেম অ্যানালাইসিস অনুশীলন ছিল কেবলমাত্র প্রাথমিক প্রকৃতির। মোট কথা, ফলাফল দাঁড়িয়েছিল অভূতপূর্ব, কিন্তু আমাদের তখনও আরও অনেক দীর্ঘ পথ যেতে হবে। আমার মনে পড়েছিল স্কুলের একটা কবিতা:

Dont worry and fret, fainthearted,
The chances have just begun,
For the best jobs havent been started,
The best work hasnt been done.

ডেভিলকে আরও এগিয়ে নেবার জন্য সরকারের কাছে জোর সুপারিশ করল কমিটি। আমাদের সেই সুপারিশ গ্রহণ করা হলো আর প্রকল্প এগিয়ে চলল।

এদিকে ভিএসএসসিতে আকার নিচ্ছিল এসএলভি। ডিআরডিএলের বিপরীতে আমরা এগোচ্ছিলাম খুবই ধীর গতিতে। নেতাকে অনুসরণ করার বদলে আমার দল কয়েকটি ব্যক্তিগত পথে এগিয়ে যাচ্ছিল সাফল্যের দিকে। আমাদের কর্মপদ্ধতির প্রান ছিল যোগাযোগ, বিশেষভাবে নির্দিষ্ট পার্শ্বিক লক্ষ্যে, দলগুলোর মধ্যে আর দলের মধ্যে। এক দিক থেকে, এই দানবীয় প্রকল্প ম্যানেজ করার জন্য আমার মন্ত্র ছিল যোগাযোগ। আমার দলের সদস্যদের কাছ থেকে সর্বোত্তম কাজ বের করে নিতে আমি প্রায়ই তাদের সঙ্গে কথা বলতাম সংস্থার বিষয় ও লক্ষ্য সম্পর্কে, এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিটি সদস্যের নির্দিষ্ট অবদানের গুরুত্বের কথা তুলে ধরতাম। একই সঙ্গে আমার অধীনস্থদের গঠনমূলক আইডিয়াগুলোও গ্রহণের চেষ্টা করতাম আমি। সেই সময়ে আমার ডাইরির কোনো খানে লিখেছিলাম:

If you want to leave your footprints
On the sands of time
Do not drag your feet.

অধিকাংশ সময় যোগাযোগ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত আলাপচারিতায়। আসলে দুটো বিষয়ই আলাদা। আমি ছিলাম (এখনও আছি) ভীষণ আলাপচারী মানুষ, কিন্তু নিজেকে মনে করি একজন ভালো যোগযোগকারী। হাস্যকৌতুকে ভরা আলাপচারিতা বেশির ভাগ সময় এড়িয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, অন্যদিকে যোগাযোগের অর্থ হলো কেবলমাত্র তথ্য বিনিময়। এটা বোঝা খুব জরুরি যে, যোগযোগ হচ্ছে দুই পক্ষের ঘটনা যার লক্ষ্য নির্দিষ্ট তথ্য আদান-প্রদান।

এসএলভিতে কাজ করার সময়, আমি যোগাযোগের বিষয়টিকে ব্যবহার করতাম সমঝোতা চালু করার জন্য এবং সমস্যা নিরসনে সহকর্মীদের সঙ্গে ঐকমত্যে আসার জন্য। স্পেস সায়েন্স কাউন্সিল (এসএসসি)-এর একটা রিভিউ মিটিঙে. প্রকিউরমেন্টের বিলম্বে হতাশ হয়ে, আমি একেবারে অভিযোগের তোড়ে ফেটে পড়লাম উদাসীনতা ও ভিএসএসসির কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্ট ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। আমি বললাম যে অ্যাকাউন্টের কর্মীদের কাজের ধারা বদলাতে হবে, এবং প্রকল্প দলে তাদের প্রতিনিধি দাবি করলাম। ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশ আমার আচরণে একেবারে হতেচকিত হয়ে পড়লেন। তিনি সিগারেট রেখে মিটিং থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সারা রাত অনুতাপে আমি কাতর হলাম, আমার কর্কশ কথায় যন্ত্রণা পেয়েছেন ড, ব্রহ্ম প্রকাশ। যাহোক আমি পরাস্ত হবার আগেই পন্থা-পদ্ধতির মধ্যে ঢুকে পড়া কুঁড়েমির বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্থিরচিত্ত ছিলাম। একটা বাস্তব প্রশ্ন করলাম আমি নিজেকে: কেউ কি এইসব নির্বোধ আমলাদের সঙ্গে বসবাস করতে পারে? উত্তর হচ্ছে-একটা বড়ো না। তারপর নিজেকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলাম: ড, ব্রহ্ম প্রকাশকে বেশি আঘাত করবে কি আমার এখনকার কর্কশ কথাগুলো, নাকি পরবর্তী পর্যায়ে এসএলভির কবর? আমার হৃদয় ও মন সম্মত বুঝতে পেরে আমি সাহায্যের জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করলাম। আমার জন্য সৌভাগ্য, ড. ব্রহ্ম প্রকাশ পরবর্তী সকালে প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করলেন।

যে ব্যক্তি একটা দলের নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব নিয়েছে সে নিজের কাজে সফল হতে পারে আপন অধিকারে যদি সে হয় যথেষ্ট পরিমাণে স্বাধীন, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগত স্বাধীনতা জোরদার করতে একজন মানুষ কি করতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমি যে দুটো কৌশল ব্যবহার করি তা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার অসুবিধে নেই। প্রথম কৌশল হচ্ছে, আপনার শিক্ষা ও দক্ষতা তৈরি করা। জ্ঞান হচ্ছে এক অধিগম্য সম্পদ, যা প্রায় সবসময়ই আমার কাজের ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে গুরুতুপূর্ণ হাতিয়ার। যত বেশি হাল-নাগাদ জ্ঞান আপনি সঞ্চয় করতে পারবেন তত বেশি আপনি স্বাধীন হবেন। জ্ঞান কারো কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায় না। একজন নেতা তার দলকে পরিচালনার জন্য কেবল তখনই স্বাধীন হতে পারে যখন সে তার চারপাশে ঘটা সবকিছুর প্রতি নজর রাখে সঠিক সময়ে। নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে, এক দিক থেকে, অবিরাম শিক্ষার মধ্যে জড়িত থাকা। অনেক দেশে পেশাদার লোকদের জন্য প্রতি সপ্তাহে কয়েক রাত কলেজে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সফল দলনেতা হতে হলে, কর্মদিবসের কানে তালা লাগান হৈ হট্টগোলের পর নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে নতুন একটা দিনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

দ্বিতীয় কৌশল হচ্ছে, ব্যক্তিগত দায়িত্বের আকাঙ্ক্ষা জাগানো নিজের মধ্যে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সার্বভৌম উপায় হচ্ছে সেই শক্তিগুলোকে দৃঢ়প্রত্যয়ী করে। তোলা যেগুলো আপনাকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করে তোলে। সক্রিয় হোন! দায়িত্বশীল হোন! আপনার বিশ্বাসের জন্য কাজ করুন। যদি না করেন, তাহলে তার অর্থ হবে আপনার। ভাগ্যকে আপনি অন্যদের কাছে সমর্পণ করছেন। প্রাচীন গ্রীস সম্পর্কে ঐতিহাসিক এডিথ হ্যাঁমিলটন লিখেছেন ও তাদের সবচেয়ে আকাঙ্খিত স্বাধীনতা যখন দায়িত্বশীলতা থেকে মুক্তি অর্জন, তখন এথেন্স স্বাধীন হবার জন্য অবরুদ্ধ এবং কদাপি স্বাধীন হবে না আর। সত্যটা হলো এই যে অনেক কাজ আছে যা আমরা ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই করতে পারি আমাদের স্বাধীনতার পরিধি বাড়ানোর জন্য। আমাদের পীড়ন করার হুমকি দেয় যে শক্তিগুলো, তার বিরুদ্ধে আমরা লড়তে পারি। যোগ্যতা আর অবস্থা যা ব্যক্তি স্বাধীনতা চালনা করে তার সাহায্যে নিজেদের আমরা শক্তিশালী করতে পারি। সে রকম করলে তার অর্থ দাঁড়ায়, আমরা একটা অধিক দৃঢ় সংগঠন সৃষ্টিতে সাহায্য করছি, যা অপরিমেয় লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ।

এসএলভি উন্নয়নের সময় অধ্যাপক ধাওয়ান প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট সমস্ত দলের মধ্যে অগ্রগতি পর্যালোচনার পদ্ধতি চালু করেছিলেন। অধ্যাপক ধাওয়ান ছিলেন মিশন প্রাপ্ত একজন মানুষ। কাজ যাতে কোনো বাধাবিঘ্নের মধ্যে না পড়ে মসৃণভাবে এগিয়ে চলে তার জন্য কোথাও তিনি ফাঁক রাখেননি। ভিএসএসসিতে অধ্যাপক ধাওয়ানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রিভিউ মিটিংগুলো বড়ো ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা হতো। তিনি ছিলেন আইএসআরও জাহাজের এক সত্যিকারের কাপ্তান একজন কমান্ডার, নাবিক, হাউজকিপার, একের মধ্যে সবকিছু। তথাপি, যা করতেন তার চেয়ে বেশি জানার ভান করতেন না তিনি। তার বদলে যখন কোনো কিছু সন্দেহজনক মনে হতো তখন তিনি তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন। আমি তাকে স্মরণ করি এমন এক নেতা হিসাবে যার কাছে নেতৃত্ব ছিল একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা। কোনো ইস্যুতে একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে তিনি সহজে আর মত বদলাতেন না। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অনেক চিন্তাভাবনা করতেন।

অধ্যাপক ধাওয়ানের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটানোর সুবিধা পেয়েছিলাম আমি। তিনি শ্রোতাকে বিমোহিত করে রাখতে পারতেন তার যুক্তিপূর্ণ ধীশক্তির কারণে, যার সাহায্যে তিনি যে কোনো বিষয় বিশ্লেষণ করতে পারতেন। শিক্ষার দিক থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির বহরটি ছিল একেবারে অগতানুগতিক গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে বি. এসসি., ইংরেজি সাহিত্যে এম, এ., মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি. ই., অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এম, এস, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) থেকে অ্যারোনটিকস ও গণিতে পিএইচ. ডি.।

তার সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ছিল অতিশয় উদ্দীপক আর তা আমাকে ও আমার দলের সদস্যদেরকে মানসিকভাবে বলিয়ান করে তুলত। তার মধ্যে আমি পূর্ণ আশাবাদ খুঁজে পেয়েছিলাম। যদিও নিজেকে সবসময় তিনি বিচার করতেন নির্দয়ভাবে, কখনও ক্ষমা করতেন না, কিন্তু অন্যদের কিছু ভুল হলে তাদের ওপর কঠোর হতেন না। অধ্যাপক ধাওয়ান স্পষ্ট করে তার বিচার ঘোষণা করতেন, তারপর অপরাধী পক্ষকে ক্ষমা করে দিতেন।

১৯৭৫ সালে, আইএসআরও পরিণত হলো সরকারি সংস্থায়। একটা আইএসআরও কাউন্সিল গঠিত হলো বিভিন্ন কর্মকেন্দ্রের পরিচালক ও ডিপার্টমেন্ট অব স্পেস (ডিওএস)-এর সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে।

এই পরিবর্তনের ফলে টিএন সেশনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটল, তিনি ছিলেন ডিওএসের যুগ্মসচিব। তখনও পর্যন্ত আমলাদের ব্যাপারে আমার ছিল এক রকম রক্ষণবাদিতার মনোভাব। সুতরাং টিএন সেশনকে প্রথম যখন এসএলভি৩ এর ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের মিটিঙে অংশ নিতে দেখলাম তখন আমি খুব একটা স্বস্তি বোধ করিনি। কিন্তু শীঘ্রই তার ব্যাপারে আমার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটল। তার কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও প্রচণ্ড বিশ্লেষণী সামর্থ্য দিয়ে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীদের মনে।

এসএলভি প্রকল্পের প্রথম তিনটে বছর ছিল বিজ্ঞানের অসংখ্য অজানা রহস্যের উন্মোচনের কাল। যেহেতু মানুষ, সুতরাং অজ্ঞতা সবসময়ই লেগে আছে। আমাদের সঙ্গে, এবং থাকবেও সর্বদা। এ ব্যাপারে আমার সচেতনতায় নতুন যা যোগ হয়েছিল তা হলো; এর অতল মাত্রায় আমার জেগে ওঠা। আমার প্রান্ত ধারণা ছিল যে, বিজ্ঞানের কাজ হলো সবকিছু ব্যাখ্যা করা, আর অব্যাখ্যাত প্রপঞ্চ ছিল আমার বাবা ও লক্ষ্মণা শাস্ত্রীর মতো মানুষদের এলাকা। এ বিষয় নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করা থেকে আমি সবসময় বিরত থাকতাম, আমার ভয় ছিল যে এতে করে তাদের সংগঠিত দৃষ্টিভঙ্গির নেতৃত্ব হুমকিতে পড়তে পারে।

ক্রমশ আমি সচেতন হয়ে উঠলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদির মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য সম্পর্কে। বিজ্ঞান হচ্ছে ওপেন-এন্ডেড আর আবিষ্কারমূলক। উন্নয়ন হচ্ছে একটা আঁটো ফাস। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে অনুজ্ঞামূলক আর নিত্যকার ব্যাপার। কিন্তু প্রতিটা ভুল থেকে ক্রমোন্নতি সাধন করা যায়। স্রষ্টা সম্ভবত প্রকৌশলীদের সৃষ্টি করেছেন বিজ্ঞানীরা যাতে আরও বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারে সেই কারণে। প্রতিবারই বিজ্ঞানীরা সব ক্ষেত্রে আগাগোড়াগবেষণা সম্পন্ন করে পূর্ণ সমাধান বের করে, প্রকৌশলীরা তাদের দেখায় আরও জ্যোতিষ্ক, আরও সম্ভাবনা। আমি আমার দলকে সাবধান করে। দিয়েছিলাম যেন তারা বিজ্ঞানীতে পরিণত না হয়। বিজ্ঞান হচ্ছে এক প্যাসন প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনার জগতে এক অনন্ত যাত্রা। আমাদের সময় ও তহবিল সীমিত। আমাদের এসএলভি নির্মাণ নির্ভর করছে আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতার ওপর। আমার পছন্দ কর্মযোগ্য বিদ্যমান সমাধান যা হতে পারে সর্বোত্তম সুযোগ। নির্দিষ্ট সময়-নির্ধারিত প্রকল্পে নতুন কোনো কিছু করতে গেলে তাতে সমস্যা সৃষ্টি হবেই। আমার মতে, একজন প্রকল্প নেতাকে যতদূর সম্ভব বেশিরভাগ পদ্ধতিতে প্রমাণিত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে এবং নিরীক্ষা চালাতে হবে কেবলমাত্র বহুবিধ উৎস থেকে।

.

৮.

প্রকল্প এমনভাবে গঠন করা হয়েছিল যে প্রধান টেকনোলজি সেন্টারগুলো, ভিএসএসসি এবং এসএইচএআর, উভয় স্থানেই পরিচালনা করতে পারে প্রোপেল্যান্ট প্রডাকশন, রকেট মোটর টেস্টিং ও যে কোনো বড়ো ডায়ামিটার সম্পন্ন রকেট উৎক্ষেপণ। এসএলভি-৩ প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী হিসাবে আমরা নিজেদের জন্য তিনটে মাইলস্টোন নির্ধারণ করেছিলাম: ১৯৭৫ সালের মধ্যে সাউন্ডিং রকেটের মাধ্যমে সকল সাবসিস্টেমের ডেভলপমেন্ট ও ফ্লাইট কোয়ালিফিকেশন; ১৯৭৬ সালের মধ্যে সাব-অর্বিটাল ফ্লাইট; এবং ১৯৭৮ সালের মধ্যে চূড়ান্ত অর্বিটাল ফ্লাইট। ইতোমধ্যে কাজের গতি ও ছন্দ বেড়ে গিয়েছিল আর উত্তেজনায় ভরপুর হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। যেখানেই আমি গেছি, সেখানেই আমাদের দল চিত্তাকর্ষক কিছু

কিছু আমাকে দেখিয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো বিপুল পরিমাণ কাজ করা হচ্ছে এবং গ্রাউন্ড-লেভেল টেকনিশিয়ানদের হাতে এ ধরনের কাজের নমুনা আগে কখনও ছিল না। আমি লক্ষ করলাম, কর্মকুশলতার নতুন মাত্রা সৃষ্টি হচ্ছে আমার দলের সদস্যদের মধ্যে।

কর্মকুশলতার মাত্রা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নিয়ে যায় সৃষ্টির দিকে। ব্যক্তির জ্ঞান আর দক্ষতার মতো উপযুক্ততাও ছাড়িয়ে যায় তা। কোনো ব্যক্তি যা অবশ্যই জানবে আর নিজের কাজ সুচারুভাবে করতে সমর্থ হবে তার চেয়েও কর্মকুশলতার মাত্রা ব্যাপক ও গভীর। এতে থাকে মনোভাব, মূল্যবোধ ও চারিত্র লক্ষণ। এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে মানব ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন স্তরে। আচরণগত স্তরে আমরা দক্ষতা পর্যবেক্ষণ ও জ্ঞান পরিমাপ করতে পারি। মধ্যবর্তী স্তরে দেখা যায় সামাজিক ভূমিকা এবং ভাবমূর্তির মাত্রা। উদ্দেশ্য ও লক্ষণ নিহিত থাকে একেবারে ভেতরের স্তরে। আমরা যদি ওইসব কর্মকুশলতার মাত্রা শনাক্ত করতে পারি, তাহলে সেগুলো একটা নীলনকশার মতো একত্র সন্নিবিষ্ট করে আমাদের চিন্তা ও কাজে ব্যবহার করতে পারি।

এসএলভি-৩ তখনও ছিল ভবিষ্যতের মধ্যে। কিন্তু এর সাবসিস্টেম ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে আমরা কয়েকটি সূক্ষ সিস্টেম পরীক্ষার জন্য সাউন্ডিং রকেট কেন্টর উৎক্ষেপণ করি। এই রকেটটির সঙ্গে সংযোজন করা হয়েছিল এসএলভির একটা তাপ নিরোধক আবরণ, রেট জাইরো ইউনিট, আর ভেহিকল অ্যাটিচিউড প্রোগ্রামার। ব্যাপক পাল্লার বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনটে পদ্ধতি কম্পোজিট ম্যাটারিয়াল, কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং ও সফটওয়ার, আমাদের দেশে এগুলোর কোনোটাই এর আগে এ উদ্দেশ্যে চেষ্টা করে দেখা হয়নি। পরীক্ষা সফল হলো পুরোপুরি। এর আগে পর্যন্ত ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচি সাউন্ডিং রকেটের বাইরে যেতে পারেনি আর জ্ঞাত ব্যক্তিরাও আবহাওয়া বিষয়ক যন্ত্রপাতির চেয়ে সিরিয়াস কিছু পাঠানোর কথা ভাবতে পারেনি। প্রথমবারের মতো আমরা জাতির প্রত্যয়কে অনুপ্রাণিত করলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালের ২৪ জুলাই তারিখে পার্লামেন্টকে বললেন, প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তি, সাবসিস্টেম ও হার্ডওয়ার ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল নির্মাণের জন্য উন্নয়ন ও নির্মাণের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলেছে। কিছু সংখ্যক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিযুক্ত আছে বিভিন্ন অংশ নির্মাণে। ভারতের প্রথম অর্বিটাল ফ্লাইট শুরু হবে ১৯৭৮ সালে।

.

সৃষ্টির যে কোনো ক্রিয়ার মতো, এসএলভি-৩ সৃষ্টিতেও ছিল বেদনা। একদিন, যখন আমি ও আমার দল পুরোপুরি ব্যস্ত ছিলাম ফাস্ট স্টেজ মোটর পরীক্ষার প্রস্তুতিতে, তখন পরিবারের একটা মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছাল আমার কাছে। আমার ভগ্নিপতি ও বিজ্ঞ পরামর্শদাতা জনাব আহমেদ জালালুদ্দিন আর নেই। কয়েক মিনিট আমি পাথরের মতো দমে গেলাম, আমি ভাবতে পারছিলাম না, কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। যখন আরও একবার আমার চারপাশে তাকালাম আর কাজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করলাম, তখন আবিষ্কার করলাম আমি অসংলগ্ন কথা বলছি আর তখনই আমি উপলব্ধি করলাম যে, জালালুদ্দিনের সঙ্গে আমার নিজেরও একটা অংশ মারা গেছে। আমার শৈশব স্মৃতির একটা দৃশ্য পুনরায় ভেসে উঠল চোখের সামনে রামেশ্বরম মন্দিরের চারপাশে সন্ধ্যা বেলায় হাঁটাহাঁটি, চন্দ্রালোকে চিকচিক করতে থাকা বালি আর ঢেউয়ের নাচ, অমাবস্যার আকাশ থেকে তারার দৃষ্টিপাত, জালালুদ্দিন আমাকে দেখাচ্ছে দূর সমুদ্রে ডুবে গেছে। দিকচক্রবাল, আমার বই কেনার জন্য সে টাকা জোগাড় করছে, আর আমাকে বিদায় জানাচ্ছে সান্তা ক্রুজ বিমানবন্দরে। আবিষ্কার করলাম, স্থান ও কালের এক ঘূর্ণীচক্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমার পিতার বয়স ততদিনে একশ বছর পেরিয়েছে, তার বয়সের অর্ধেক বয়সি জামাইয়ের খাঁটিয়া তাকে বহন করতে হলো; আমার বোন জোহরা, তার চার বছরের পুত্রের পিতাকে হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। এসব চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে এসেছিল মুহূর্তে, সহ্য করা ভয়ানক ছিল আমার জন্য। আমি ঠেশ দিয়েছিলাম অ্যাসেম্বলি জিগের ওপর, নিজেকে সামলে নিয়ে কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছিলাম ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ড. এস শ্রীনিবাসনকে, আমার অনুপস্থিতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য।

সারারাত বিভিন্ন জেলা বাসে ভ্রমণ করে পরদিন আমি রামেশ্বরম পৌঁছালাম। এই সময়ের মধ্যে জালালুদ্দিনের সঙ্গে শেষ হয়ে যাওয়া স্মৃতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমি অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি বাড়িতে পৌঁছালাম, দুঃখ আবার আমাকে ধরাশায়ী করে ফেলল। জোহরা বা আমার ভাগ্নে মেহবুবকে বলার মতো কোনো কথা আমার ছিল না, দুজনেই তারা কাঁদছিল। আমার চোখে জল ছিল না ফেলার মতো। আমরা বেদনাহতভাবেই জালালুদ্দিনকে কবর দিয়েছিলাম।

আমার পিতা দীর্ঘ সময় আমার হাত ধরে রেখেছিলেন। তার চোখেও জল ছিল না। তুমি কি দেখতে পাও না, আবুল, প্রভু কেমন দীর্ঘ করেছেন ছায়া? যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তা তিনি স্থির করে দিতে পারতেন। কিন্তু সূর্যকে তিনি ছায়ার পথপ্রদর্শক করেছেন, ধীরে ধীরে ছায়া হ্রাস করেন তিনি। তিনিই তোমার জন্য রাতকে আবরণ করেছেন, নিদ্রাকে বিশ্রাম। জালালুদ্দিন এক দীর্ঘ নিদ্রায় নিদ্রিত হয়েছে। স্বপ্নহীন নিদ্রা, অচেতনতার মধ্যে তার সমস্ত সত্ত্বার পরিপূর্ণ বিশ্রাম। আল্লাহ যা নির্ধারণ করেন তা ব্যতীত আর কিছুই আমাদের ঘটবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আল্লাহর প্রতি তোমার আস্থা রাখো। তিনি ধীরে ধীরে চোখের পাতা বন্ধ করলেন এবং ধ্যানমগ্নের মতো হয়ে পড়লেন।

মৃত্যু কখনও আমাকে শংকিত করেনি। যাই হোক না কেন, একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু জালালুদ্দিন হয়তো একটু আগেই চলে গেছে, বেশ একটু আগেই। আমি বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ থাকতে পারলাম না। আমি অনুভব করলাম আমার ভেতরের সত্ত্বা এক ধরনের উদ্বিগ্নতায় ডুবে যাচ্ছে, অনুভব করলাম আমার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। অনেকদিন ধরে, থুম্বায়, একরকম তুচ্ছতা আমি অনুভব করছিলাম যার সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না। যা করছিলাম তার সবকিছু সম্পর্কেই।

অধ্যাপক ধাওয়ানের সঙ্গে এ নিয়ে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আমার এসএলভি-৩ প্রকল্পের অগ্রগতিই আমার জন্যে সান্ত্বনা বয়ে আনবে। বিভ্রান্তি প্রথমে ঢিলে হয়ে যাবে, তারপর কেটে যাবে একেবারেই। তিনি আমার মনোযোগ টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রযুক্তির বিস্ময় ও এর অর্জনগুলোর দিকে।

ক্রমান্বয়ে ড্রয়িং বোর্ড থেকে উত্থিত হতে থাকল হার্ডওয়ার। শশী কুমার ফেব্রিকেশন ওয়ার্ক সেন্টারের একটা খুব কার্যকর নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। একটা গঠনকর ড্রয়িং পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই যা পাওয়া যেত তা দিয়েই তিনি ফেব্রিকেশন শুরু করে দিতেন। চারটে রকেট মোটর তৈরির পেছনে নাম্বুদিরি ও পিল্লাই তাদের দিনরাতের পুরোটা সময় খরচ করছিলেন প্রপালসন গবেষণাগারে। এমএসআর দেব ও স্যান্ডলাস পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন ভেহিকলের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক ইন্টিগ্রেশনের। মাধবন নায়ার ও মূর্তি পরীক্ষা করতেন ভিএসএসসি ইলেকট্রনিক্স ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট পদ্ধতি এবং সেগুলো যেখানে সম্ভব সেখানে ফ্লাইট সাবসিস্টেমে প্রয়োগ করতেন। ইউএস সিং নিয়ে এসেছিলেন প্রথম লঞ্চ গ্রাউন্ড সিস্টেম, তার সঙ্গে টেলিমেট্রি, টেলিকমান্ড ও রাডার। ফ্লাইট ট্রায়ালের জন্য এসএইচএআরের একটা বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনাও তিনি তৈরি করেছিলেন। ড, সুন্দররাজন নিবিড়ভাবে মনিটর করতেন মিশনের বিষয়গুলো এবং সিস্টেম আপডেট করে রাখতেন। ড. শ্রীনিবাসন, একজন লঞ্চ ভেহিকল ডিজাইনার, এসএলভির ডেপুটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে তিনি আমার সকল সৌজন্যমূলক ও সম্পূরক ক্রিয়াকলাপ খারিজ করে দিয়েছিলেন। আমি যা এড়িয়ে যেতাম তিনি তা লক্ষ করতেন, আমি যেসব পয়েন্ট শুনতে ব্যর্থ হতাম তিনি সেগুলো শুনতে পেতেন, আর যে সম্ভাবনা আমার নজর এড়িয়ে যেত সে সম্ভাবনা তিনি তুলে ধরতেন।

প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও কর্মকেন্দ্রের মধ্যে নিয়মিত ও দক্ষ ইন্টারফেসিং প্রতিষ্ঠা করা। এই কঠিন বিষয়টা আমরা শিখেছিলাম। যথাযথ সমন্বয়ের অনুপস্থিতিতে কঠিন কাজ অবজ্ঞা করা যেতে পারে।

সেই সময়টাতে আইএসআরওর ওয়াইএস রাজনকে আমার বন্ধু হিসাবে পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটেছিল। রাজন ছিলেন (এবং আছেন) এক সর্বজনীন বন্ধু। টার্নার, ফিটার, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভার থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, কন্ট্রাক্টর, আমলা প্রমুখ সবার বন্ধু ছিলেন তিনি। আজ যখন সংবাদ মাধ্যম আমাকে জনতার ঢালাইকর হিসাবে আখ্যায়িত করে, তখন আমি এই স্বীকৃতি উৎসর্গ করি রাজনকে। বিভিন্ন কর্মকেন্দ্রের সঙ্গে তার নিবিড় মিথস্ক্রিয়া এসএলভিতে এমন এক ঐকতান সৃষ্টি করেছিল যে ব্যক্তি প্রচেষ্টার সুতোয় বোনা হয়েছিল বিশাল শক্তির এক বিপুল বস্ত্র।

.

১৯৭৬ সালে আমার পিতা ইন্তেকাল করলেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার আরও একটা কারণ ছিল জালালুদ্দিনের মতো। তিনি বেঁচে থাকার আকাক্ষা হারিয়ে ফেলেছিলেন, যেন জালালুদ্দিনকে তার দিব্যজগতে ফিরে যেতে দেখে তিনিও সেখানে ফিরে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিলেন।

আমি যখনই বাবার শরীর খারাপের কথা জানতে পারতাম তখনই শহর থেকে একজন ভালো ডাক্তার নিয়ে যেতাম রামেশ্বরমে। বাবা আমার অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগের কারণে ভর্ৎসনা করতেন আর ডাক্তারের পেছনে অর্থব্যয় সম্পর্কে বক্তৃতা শোনাতেন। তোমার আসাটাই আমার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট, ডাক্তার এনে তার ফি বাবদ অত টাকা খরচ করার দরকার কি? তিনি বলতেন। এবার তার অবস্থা চলে গিয়েছিল যে কোনো ডাক্তারের সামর্থ্যের বাইরে। আমার বাবা জয়নুলাবদিন, রামেশ্বরম দ্বীপে যিনি জীবন কাটিয়েছেন ১০২ বছর, তিনি পরলোক গমন করেন আর পেছনে রেখে যান পনেরোজন নাতিনাতনি, একজন প্রতি। তিনি একটা দৃষ্টান্তমূলক জীবনযাপন করেছিলেন। তাকে কবর দেবার পর রাতের বেলা একা বসে আমি একটি কবিতার কথা স্মরণ করলাম, অডেন তার বন্ধু ইয়েটস্-এর মৃত্যুতে সে কবিতা লিখেছিলেন, আর অনুভব করলাম যেন সে। কবিতা লেখা হয়েছে আমার বাবার জন্যই:

Earth, receive an honoured guest:
William Yeats is laid to rest :
…….
In the prison of his days
Teach the free man how to praise.

প্রকৃতির নিয়মে এটা ছিল মাত্র আরেকজন বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যু। সর্বসাধারণের কোনো শোকসভা আয়োজন করা হয়নি, কোনো পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়নি, কোনো সংবাদপত্র তার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করেনি। তিনি কোনো রাজনীতিক, পন্ডিত বা ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাদাসিধে ও স্বচ্ছ মানুষ। আমার বাবা অবলম্বন করেছিলেন সর্বোচ্চ মূল্যবোধ, সততা। তার জীবন তাদের বেড়ে ওঠায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, যারা ছিল সদাশয়, দেবোপম, বিজ্ঞ ও মহৎ।

আমার বাবা সবসময় আমাকে মনে করিয়ে দিতেন কিংবদন্তির আবু বেন আদহামের কথা। আবু বেন আদহাম একরাতে শান্তির এক গভীর স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখতে পেল একজন ফেরেশতা সোনার একটা গ্রন্থে সেই ব্যক্তিদের নাম লিখছে যারা স্রষ্টাকে ভালোবাসে। আবু জানতে চাইল তালিকায় তার নাম আছে কিনা। ফেরেশতা নেতিবাচক উত্তর দিল। হতাশ হলেও তখনও উষ্ণু আবু বলল, সহগামী লোকদের ভালোবাসি এই হিসাবে আমার নাম লেখ। ফেরেশতা লিখল তার নাম, এবং অদৃশ্য হয়ে গেল। পরের রাতে আবারও সবকিছু আলোকিত করে ফেরেশতা এল। তারপর সেসব লোকের নামের তালিকা দেখাল যাদের প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা বর্ষিত হয়েছে। তালিকার প্রথমেই ছিল আবুর নাম।

আমি দীর্ঘ সময় মায়ের সঙ্গে বসে থাকলাম, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারলাম না। ভাঙা গলায় তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন যখন আমি থুম্বায় ফিরে যাবার জন্য তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তিনি জানতেন যে, তার স্বামীর বাড়ি তিনি ছেড়ে যাবেন না, যে বাড়ির জামিনদার ছিলেন তিনি, আর আমিও তার সঙ্গে এখানে বসবাস করব না। আমাদের দুজনকেই যার যার নিয়তি অনুযায়ী ভিন্ন স্থানে জীবনযাপন করতে হবে। এসএলভি কি আমার ওপর অতিমাত্রায় চেপে বসেছিল? মায়ের কথা শোনার জন্য কিছু সময়ের জন্য কি আমার নিজের ব্যাপার ভুলে যেতে পারতাম না? অল্প কিছুদিন পর তিনি যখন পরলোকগমন করলেন, কেবল তখনই এটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম।

সএলভি-৩ অ্যাপোজি রকেট উন্নত করা হয়েছিল ডায়মন্টের একটা কমন আপার স্টেজ হিসাবে। ফ্রান্সে এই রকেটটির পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের শিডিউল ছিল। কিন্তু বেশ কয়েকটি জট-পাকান সমস্যার কারণে তাতে বিঘ্ন ঘটল। সমস্যাগুলো বের করতে আমাকে দ্রুত ছুটতে হলো ফ্রান্সে। আমি দেশ ছাড়ার আগে, শেষ বিকেলে, আমাকে জানান হলো যে আমার মা ইন্তেকাল করেছেন। নাগার কয়েলের প্রথম যে বাসটা পেলাম সেটাই ধরলাম। সেখান থেকে ট্রেনে পুরো একটা রাত খরচ করলাম। রামেশ্বরমে পৌঁছানোর জন্য, আর সেখানে পরদিন সকালে পৌঁছে দাফনের শেষ অংশে যোগ দিতে সক্ষম হলাম। যে দুজন মানুষ আমাকে গঠন করেছিলেন তারা দুজনেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন তাদের দিব্যজগতে। পরলোকগতরা তাদের যাত্রার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বাকি আমাদের সবার যাত্রা চলতে থাকবে উৎকণ্ঠিত পথে আর জীবনও চলতে থাকবে। যে মসজিদে বাবা আমাকে প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ে যেতেন সেখানে আমি প্রার্থনা করলাম। আমি স্রষ্টাকে বললাম যে, আমার মা পৃথিবীতে বেশিদিন জীবন যাপন করতে পারতেন না তার স্বামীর যত্ন ও ভালোবাসা ছাড়া, অতঃপর আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার। আমি স্রষ্টার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম। আমি যে কাজের ডিজাইন করেছিলাম সে কাজ তারা সম্পূর্ণ করেছে বিপুল যত্ন, আত্মোত্সর্গ এবং সততা সহকারে এবং তারা আমার কাছেই ফিরে এসেছে। তাদের সম্পূর্ণতার দিনে তুমি কেন সন্তাপ করছ? তোমার প্রতি অর্পিত দায়িত্বের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত কর, আর তোমার কাজের ভেতর দিয়ে আমার গৌরব ছড়িয়ে দাও! এই কথাগুলো কেউ বলেনি, কিন্তু আমি তা পরিষ্কার শুনতে পেলাম। মৃত্যুর পর দেহ ছেড়ে যাওয়া আত্মা সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত প্রেরণাদায়ক বাণীতে আমার মন পূর্ণ হয়ে উঠল: তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তান শুধুমাত্র পরীক্ষা, পক্ষান্তরে আল্লাহ! তিনিই অনন্ত পুরস্কার। আমি মসজিদ থেকে মনের শান্তি নিয়ে বেরিয়ে এলাম এবং এগিয়ে চললাম রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। আমার সবসময় মনে পড়ে, যখনই আজান হতো তখনই আমাদের বাড়িটা একটা ছোটো মসজিদে রূপান্তরিত হতো। আমার বাবা ও আমার মা নেতৃত্ব দিতেন, আর তাদের সন্তান ও নাতিনাতনিরা তাদের অনুসরণ করত।

পরদিন সকালে আমি ফিরে এসেছিলাম থুম্বায়, শারীরিক ভাবে ক্লান্ত, আবেগের দিক থেকে ভগ্ন, কিন্তু বিদেশের মাটিতে একটা ভারতীয় রকেট মোটর ওডানোর আমাদের উচ্চাকাঙ্খ পরিপূর্ণ করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী।

এসএলভি-৩ অ্যাপোজি মোটরের সফল পরীক্ষার পর ফান্স থেকে আমি ফিরে এলে ড. ব্ৰহ্ম প্রকাশ আমাকে একদিন ভের্নার ফন ব্রাউনের আগমন সম্পর্কে জানালেন। রকেট বিজ্ঞানে কর্মরত প্রত্যেকেই ফন ব্রাউন সম্পর্কে জানতেন। তিনি মারাত্মক V-2 ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করেছিলেন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লন্ডনকে বিধ্বস্ত করেছিল। যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন ফন ব্রাউন। তার প্রতিভার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ফন ব্রাউনকে নাসার রকেটবিজ্ঞান কর্মসূচিতে শীর্ষপদে বসান হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষে কর্মরত ফন ব্রাউন যুগান্তকারী জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেন, যেটা ছিল ৩০০০ কি.মি. পাল্লার প্রথম আইআরবিএম। উ, ব্রহ্ম প্রকাশ যখন মাদ্রাজে ফন ব্রাউনকে গ্রহণ করে থুম্বায় এস্কর্ট করে নিয়ে যাবার জন্য বললেন আমাকে, আমি তখন স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম।

V-2 মিসাইল (জার্মান শব্দ Vergeitungswaffe-এর সংক্ষেপ) ছিল রকেট ও মিসাইলের ইতিহাসে বিশালতম একক অর্জন। ১৯২০-এর দশকে ভিএফআর (সসাসাইটি ফর স্পেস ফ্লাইট)-এ ফন ব্রাউন ও তার দলের প্রচেষ্টায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছিল। বেসামরিক প্রচেষ্টা হিসাবে যা আরম্ভ হয়েছিল, শীঘ্রই তা পরিণত হলো সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডে, এবং ফন ব্রাউন পরিণত হলেন কুমেডর্ফে অবস্থিত জার্মান মিসাইল ল্যাবরেটরির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। প্রথম V-2 মিসাইল পরীক্ষা করা হয় ১৯৪২ সালের জুন মাসে। ওই পরীক্ষা ছিল অসফল। মিসাইলটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালের ১৬ অগাস্ট এটা পরিণত হয় শব্দের গতি ছাড়িয়ে যাওয়া প্রথম মিসাইলে। ফন ব্রাউনের তত্ত্বাবধানে, জার্মানির নর্ডহাউসেনের কাছে বিশাল ভূগর্ভস্থ উৎপাদন ইউনিটে, ১৯৪৪ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি v-2 মিসাইল নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই মানুষটার সঙ্গে আমি ভ্রমণ করব একজন বিজ্ঞানী, একজন ডিজাইনার, একজন প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ার, একজন প্রশাসক, একজন টেকনোলজি ম্যানেজার সবকিছু। আমি বেশি আর কী চাইতে পারতাম? আমরা একটা অ্যাভ্র বিমানে চড়ে প্রায় ৯০ মিনিট আকাশভ্রমণ শেষে মাদ্রাজ থেকে ত্রিবান্দ্রামে পৌঁছলাম। ফন ব্রাউন আমাদের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন এবং আমার বর্ণনা শুনলেন যেন তিনি। রকেট বিজ্ঞানের একজন ছাত্র। আমি কখনই আশা করিনি যে, আধুনিক রকেট বিজ্ঞানের জনক অতটা বিনয়ী হবেন, অতটা গ্রহণশীল আর প্রেরণাদায়ক হবেন। পুরো বিমান ভ্রমণের সময়টায় তার আচরণে আমি স্বস্তি অনুভব করলাম। এটা কল্পনা করা কঠিন ছিল যে মিসাইল সিস্টেমের এক মহাপন্ডিতের সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম।

তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন যে এসএলভি-৩-এর ডায়ামিটার LD অনুপাতের দৈর্ঘ্য, যা ডিজাইন করা হয়েছিল ২২ পর্যন্ত, তা ছিল উচ্চতর পাশে এবং তিনি আমাকে সাবধান করে দিলেন অ্যারো-ইলাস্টিক সমস্যা সম্পর্কে, উড্ডয়ন কালে যা অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে।

তার কর্মজীবনের প্রধান অংশটা জার্মানিতে খরচ করার পর, আমেরিকায় তিনি কেমন বোধ করছিলেন? এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম ফন ব্রাউনকে, এপোলো মিশনে স্যাটার্ন রকেট তৈরির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যিনি পরিণত হয়েছিলেন কাল্ট ফিগারে। এপোলো মিশন মানুষকে চাদে নিয়ে গিয়েছিল। আমেরিকা একটা বিশাল সম্ভাবনার দেশ, কিন্তু অ-আমেরিকান সবকিছুর প্রতি তারা সন্দেহ নিয়ে তাকায়। তারা সবসময় একটা NIHANot Invented HereHকমপ্লেক্সে ভোগে এবং বিদেশি প্রযুক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করে। রকেট বিজ্ঞান নিয়ে যদি তুমি কিছু করতে চাও তাহলে তা নিজেই কর, ফন ব্রাউন আমাকে পরামর্শ দিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, এসএলভি-তে একেবারে বিশুদ্ধ ভারতীয় ডিজাইন এবং তুমি হয়তো তোমার নিজের সমস্যায় জড়াচ্ছ। কিন্তু তুমি সবসময় মনে রাখবে যে আমরা শুধু সাফল্যের ওপরেই গড়ি না, আমরা ব্যর্থতার ওপরেও গড়ি।

রকেট নির্মাণে অপরিহার্য কঠোর কাজ ও অঙ্গীকারের বিষয়ে তিনি হাসলেন আর চোখে দুষ্টুমির ভাব নিয়ে বললেন, কঠোর কাজই শুধু যথেষ্ট নয় রকেট বিজ্ঞানে। এটা কোনো খেলা নয় যেখানে কঠোর কাজ তোমাকে সম্মান এনে দেবে। এখানে, তোমার শুধু লক্ষ্য থাকলেই চলবে না, যত দ্রুত সম্ভব লক্ষ্য অর্জনের কৌশলও থাকতে হবে। পূর্ণ অঙ্গীকার ঠিক কঠোর কাজ নয়; এটা হচ্ছে পূর্ণ সংশ্লিষ্টতা। পাথরের দেওয়াল নির্মাণ হচ্ছে একটা হাড়ভাঙা কাজ। কিছু লোক আছে যারা সারা জীবন পাথরের দেওয়াল বানায়। আর তারা যখন মারা যায়, তখন দেখা যায় মাইলের পর মাইল দেওয়াল, ওই লোকেরা কি কঠোর কাজ করেছিল তার নীরব সাক্ষী।

তিনি বলতেই থাকলেন, কিন্তু অন্য মানুষও আছে, একটা পাথর আরেকটার ওপর স্থাপন করার সময় যাদের মনে থাকে একটা দৃশ্য, একটা লক্ষ্য। এটা হতে পারে একটা চত্বর, যেখানে পাথরের দেওয়ালের ওপর উঠেছে গোলাপ এবং গ্রীষ্মের অলস দিনের জন্য বাইরে পাতা হয়েছে চেয়ার। কিংবা পাথরের দেয়াল হয়তো, পরিবেষ্টন করতে পারে একটা আপেল বাগান অথবা একটা বাউন্ডারির চিহ্ন। যখন তারা কাজ শেষ করে, তখন একটা দেওয়ালের চেয়েও বেশি কিছু পায় তারা। এটা সেই লক্ষ্য যা পার্থক্য তৈরি করে। রকেট বিজ্ঞানকে তোমার পেশা কর না, কিংবা জীবিকা-এটাকে বানাও তোমার ধর্ম, তোমার মিশন।

ফন ব্রাউনের মধ্যে আমি অধ্যাপক বিক্রম সারাভাইয়ের কিছু দেখলাম ভাবতেই আমার আনন্দ হয়েছিল।

.

পরিবারে তিনটি মৃত্যুর পর নিজের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা দরকার হলো আমার মনের কাছে। আমার সম্পূর্ণ সত্ত্বাটাকে এসএলভি সৃষ্টিতে নিমগ্ন রাখতে চেয়েছিলাম আমি। যে পথ আমাকে অনুসরণ করতে হবে সেই পথ যেন আবিষ্কার করেছি বলে আমার মনে হলো। আর সে পথ হলো আমার জন্য আল্লাহর মিশন এবং তার পৃথিবীতে আমার উদ্দেশ্য। এই সময়কালে আমি যেন যন্ত্রচালিত হয়ে গিয়েছিলাম সন্ধ্যাবেলায় ব্যাডমিন্টন খেলতাম, ছুটির দিনগুলো উদযাপন করতাম না, পরিবারের সঙ্গে বা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, এমনকি এসএলভি পরিমন্ডলের বাইরে কারো সঙ্গে বন্ধুত্বও ছিল না।

তোমার মিশন সফল করতে হলে, তোমাকে সব চিন্তা বাদ দিয়ে অবশ্যই একাগ্রচিত্ততার সঙ্গে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে তোমার লক্ষ্যের দিকে। আমার মতো ব্যক্তিদের প্রায়শই কর্মাসক্ত বলে অভিহিত করা হয়। এই টার্ম নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কারণ এটা থেকে প্যাথলজিক্যাল অবস্থা বা অসুস্থতা বোঝান হয়। দুনিয়ায় অন্য আর কোনো কিছুর চেয়ে যা আমার অধিক কাঙ্খিত এবং যা আমাকে আনন্দিত করে তা যদি আমি করি, তাহলে সে কাজ কখনই বিপথগামিতা হতে পারে না। আমি যখন কাজ করি তখন বাইবেলের ছাব্বিশতম চরণ আমার মনে আসে: আমাকে পরীক্ষা কর, হে প্রভু, আর প্রমাণিত কর।

যারা নিজের পেশার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে চায় তাদের ক্ষেত্রে টোটাল কমিটমেন্ট একটা বড়ো রকমের কোয়ালিটি। আমার সঙ্গে এমন অনেকে ছিলেন যারা ৪০ ঘণ্টায় এক সপ্তাহ হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু অন্য অনেককে চিনতাম যারা কাজ করতেন সপ্তাহে ৬০, ৮০ এমনকি ২০০ ঘণ্টা পর্যন্ত। কারণ তারা কাজের মধ্যে প্রাণের উত্তেজনা ও পুরস্কার খুঁজে পেয়েছিলেন। সমস্ত সফল নারীপুরুষের মধ্যে একটা সাধারণ বিষয় এই টোটাল কমিটমেন্ট। একজন উদ্যমী ও একজন বিভ্রান্ত মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতাকে তাদের মন যেভাবে ব্যবহার করে তার মধ্যে পার্থক্য। মানুষের প্রতিবন্ধকতা দরকার, কারণ সাফল্য উপভোগের জন্য এর প্রয়োজন। আমাদের সবার মধ্যেই এক ধরনের সুপার-ইন্টেলিজেন্স আছে। একে সঞ্চারিত করা উচিৎ যাতে আমরা পরীক্ষা করতে সমর্থ হই আমাদের গভীর ভাবনা, আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাস।

তোমার এজন্য আরও প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য আর সীমাহীন শক্তি! শীর্ষে উঠতে হলে। শক্তি লাগবে, সে এভারেস্ট পর্বতের শীর্ষই হোক আর তোমার ক্যারিয়ারের শীর্ষই হোক। লোকেরা বিভিন্ন প্রকার শক্তির মজুত নিয়ে জন্মায় এবং যারা ক্লান্ত হয় প্রথমে আর সহজেই নিঃশেষিত হয় তারা প্রথম দিকেই নিজ নিজ জীবন ভালোভাবে পুনর্গঠিত করতে পারে।

১৯৭৯ সালে ছয় সদস্যের একটি দল স্ট্যাটিক টেস্ট ও মূল্যায়নের জন্য একটা জটিল সেকেন্ড স্টেজ কন্ট্রোল সিস্টেমের ফ্লাইট ভার্সন প্রস্তুত করছিল। টি১৫ মিনিটে (পরীক্ষার আগের ১৫ মিনিট) দল মনোযোগী ছিল কাউন্টডাউন মোডে। বারোটা ভালভের একটা চেকআউটের সময় সাড়া দিল না। দলের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ করে রেড ফিউমিং নাইট্রিক এসিড (আরএফএনএ) পূর্ণ অক্সিডাইজারের ট্যাংক বিস্ফোরিত হলো, তাতে এসিড দগ্ধ হলো দলের সদস্যরা। তাদের ভোগান্তি দেখাটা ছিল এক নির্মম অভিজ্ঞতা। কুরুপ ও আমি দ্রুত ছুটে গেলাম ত্রিবান্দ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আর আমাদের ছয় সহকর্মীকে ভর্তি করে নেবার আকুতি জানালাম; ওই সময়ে হাসপাতালে কোনো বেড খালি ছিল না।

এসিড দগ্ধদের একজন ছিলেন শিবরামকৃষ্ণন নায়ার। তার শরীরের অনেকগুলো স্থান পুড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে আমরা একটা বেডের ব্যবস্থা করছিলাম যখন, তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। আমি তার বেডের পাশে রাত জেগে বসে থাকলাম। রাত প্রায় ৩টার দিকে জ্ঞান ফিরে পেলেন শিবরামকৃষ্ণন। তখন তিনি প্রথমেই দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন দুর্ঘটনার কারণে যে ভুলত্রুটি হয়েছে তা তিনি ঠিক করে দেবেন নির্ধারিত সময়ের ভেতরেই। ভয়ংকর যন্ত্রণার মধ্যেও তার সততা ও আশাবাদ আমাকে গভীর আলোড়িত করল।

শিবরামকৃষ্ণনের মতো লোকেরা জন্ম থেকেই আলাদা। এই ঘটনা আমার দলের প্রতি আমার আস্থা ভীষণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল, যে দল সাফল্যে ও ব্যর্থতায় দাঁড়িয়ে থাকবে পাথরের মতো।

.

আমি অনেক জায়গায় প্রবাহ শব্দটা ব্যবহার করেছি এর আসল অর্থটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা না করে। এই প্রবাহ জিনিসটা কী? আর এই আনন্দ? আমি এসবকে বলতে পারতাম জাদুর মুহূর্ত। প্রবাহ হচ্ছে একটা সেনসেশন, যখন আমরা সামগ্রিক সত্ত্বা দিয়ে কোনো কিছু করি তখন এর স্পর্শ পাই। প্রবাহের সময়, অভ্যন্তরীণ একটা যুক্তি অনুযায়ী ক্রিয়া অনুসরণ করে ক্রিয়াকে, কর্মীর কোনো অংশে সচেতন হস্তক্ষেপের যার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। কোনো তাড়া নেই: কারোর মনোযোগের ওপর কোনো চাহিদা নেই, অতীত ও ভবিষ্যৎ উধাও হয়ে যায়, ব্যক্তি ও সক্রিয়তার মধ্যে পার্থক্যও তাই করে। আমরা সবাই এসএলভি প্রবাহের মধ্যে জড়ো হয়েছিলাম। যদিও আমরা কঠোর পরিশ্রম করছিলাম, তবুও আমরা অত্যন্ত রিলাক্স, উদ্যমী ও তাজা ছিলাম। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল? কে সৃষ্টি করেছিল এই প্রবাহ?? হয়তো এটা ছিল আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যের অর্থপূর্ণ সংগঠন। আমরা বিস্তৃত লক্ষ্য চিহ্নিত করতাম, তারপর কাজ করতাম বিভিন্ন বিকল্প থেকে লক্ষ্য পূরণের। সমস্যা সমাধানে একটা সৃজনশীল পরিবর্তন আসত, তা আমাদের স্থাপন করত প্রবাহের মধ্যে।

এসএলভি-৩ হার্ডওয়ারের উত্থানের যখন শুরু হয়, তখন আমাদের একাগ্রচিত্ততার সামর্থ্য বেড়ে গিয়েছিল লক্ষ্যণীয়ভাবে। আমি বিপুল আত্মবিশ্বাস অনুভব করতাম, নিজের ও এসএলভি-৩ প্রকল্পের প্রতি। প্রবাহ হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত সক্রিয়তার একটা বাই-প্রডাক্ট। প্রথম চাহিদা হলো, যতটা পার কঠোর কাজ কর যা তোমার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আরেকটি বিষয় হলো বাধাবিঘ্নহীন সময়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আধঘন্টার কম সময়ের মধ্যে প্রবাহে ঢুকে পড়া কঠিন। আর বাধাবিঘ্ন থাকলে তো প্রায় অসম্ভব।

ফলপ্রসূভাবে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যেমন একটা অবস্থা আমরা সৃষ্টি করি, তেমনভাবে কী এক ধরনের কন্ডিশনিং ডিভাইস ব্যবহার করে আমরা প্রবাহের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারি? উত্তর হলো-হা, আর এর গুপ্তকথা হলো তুমি আগে যে প্রবাহের মধ্যে ছিলে সেই প্রবাহ বিশ্লেষণ করা। তুমি নিজেই শনাক্ত করতে পার সাধারণ বিভাজকগুলো। এই বিভাজকগুলো যদি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পার, তাহলে তুমি প্রবাহের জন্য মঞ্চ তৈরি করতে পারবে।

এই অবস্থার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার বহুবার। এসএলভি মিশনে প্রায় প্রতিদিন গবেষণাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা গেছে যখন আমি চোখ তুলে দেখেছি গবেষণাগার ফাঁকা, তখন বুঝতে পেরেছি কাজের সময় শেষ হয়েছে অনেক আগেই আর সবাই চলে গেছে। আবার অন্যান্য দিনে দেখেছি, আমার দলের সদস্যরা ও আমি কাজে এমনই আটকা পড়ে গেছি যে আমাদের মধ্যাহ্নভোজের সময় পেরিয়ে গেলেও কেউ বুঝতেই পারিনি আমরা ক্ষুধার্ত।

প্রকল্প যতই শেষের দিকে যাচ্ছিল ততই আমাদের এই অভিজ্ঞতা হচ্ছিল। আমি এও উপলব্ধি করেছিলাম যে, অফিস যেদিন আপাত শান্ত থাকে সেদিনও এই ঝোঁক থাকে প্রবলভাবে। এরকম প্রভাব ফ্রিকোয়েন্সিতে বর্ধিত হয়েছিল দারুণভাবে, এবং এসএলভি-৩ এর স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সত্য হলো ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝিতে।

আমরা এসএলভি-৩ এর প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের তারিখ নির্ধারণ করেছিলাম ১০ অগাস্ট ১৯৭৯। মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল একটা পুরোপুরি ইন্টিগ্রেটেড লঞ্চ ভেহিকল প্রস্তুত করা; স্টেজ মোটর, গাইডেন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ও ইলেকট্রনিক সাবসিস্টেমের মতো অন-বোর্ড সিস্টেমগুলোর মূল্যায়ন করা; আর গ্রাউন্ড সিস্টেম মূল্যায়ন করা, যেমন চেকআউট, ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি ও শ্রীহরিকোটা লঞ্চ কমপ্লেক্সে তৈরি লঞ্চ অপারেশনের রিয়াল-টাইম ডাটা ফ্যাসিলিটিজ। ২৩ মিটার লম্বা, ১৭ টন ওজনের ফোর-স্টেজ এসএলভি রকেট শেষ পর্যন্ত ০৭৫৮ ঘন্টায় চমৎকারভাবে উড্ডয়ন করল এবং অনতিবিলম্বে পূর্ব নির্ধারিত ট্রাজেক্টরিতে চলতে শুরু করল।

স্টেজ ১ কাজ করল নিখুঁতভাবে। এই স্টেজ থেকে দ্বিতীয় স্টেজে অতিক্রমণ ঘটল মসৃণভাবে। এসএলভি-৩–এর আকার নিয়ে আমাদের স্বপ্ন আকাশে উড়ছে দেখে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অকস্মাৎ জাদুমন্ত্র ভেঙে গেল। দ্বিতীয় স্টেজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই ফ্লাইটের অবসান ঘটল ৩১৭ সেকেন্ড পর এবং ভেহিকলের অবশিষ্ট অংশ, পেলোডযুক্ত আমার প্রিয় চতুর্থ স্টেজসহ, সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হলো, শ্রীহরিকোটা থেকে ৫৬০ কিলোমিটার দূরে।

এ ঘটনায় আমরা দারুণভাবে হতাশ হয়েছিলাম। ক্রোধ আর হতাশার অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভব করলাম আমি। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম, আমার পা এমনভাবে শক্ত হয়ে গেছে যে যন্ত্রণা করছে। সমস্যাটা আমার দেহে ছিল না। সমস্যাটা ছিল আমার মনে। আমার মনের মধ্যে কিছু একটা ঘটেছিল।

আমার হোভারক্র্যাফট নন্দীর অকালমৃত্যু, আরএটিও পরিত্যাগ, এসএলভি ডায়মন্ট ফোর্থ স্টেজের ব্যর্থতা। সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠল চোখের সামনে, যেন অনেকদিন আগে কবর দেওয়া কোনো ফিনিক্স পাখি আচমকা উঠে এল ছাই থেকে। বিগত বছরগুলোয় আমি কোনো রকমে এসব ব্যর্থ প্রচেষ্টা আত্মভূত করতে শিখেছিলাম, ওগুলো ভুলে নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নে মগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু এইবার আমার চরম নৈরাশ্যের মধ্যে সেইসব বাধাবিপত্তিগুলোর প্রত্যেকটি আবার জীবন্ত হতে দেখলাম।

এর কারণ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? ব্লক হাউজে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি একটা উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এ নিয়ে ভাবার বা উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করার মতো অবস্থা আমার ছিল না, তাই ওটা বাদ দিলাম। উৎক্ষেপণ পরিচালিত হয়েছিল খুব সকালে, সারা রাত কাউন্ট-ডাউনের পর। অধিকন্তু, তার আগের এক সপ্তাহ আমি ঘুমানোর সুযোগ পাইনি। আর তাই যেমন মানসিকভাবে ঠিক তেমনি শারীরিকভাবেও ক্লান্তিতে পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই সোজা নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম।

আমার কাঁধে কোমল একটা স্পর্শে আমি জেগে উঠলাম। তখন অপরাহ্ন পেরিয়ে গেছে, প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি। ড. ব্রহ্ম প্রকাশকে দেখতে পেলাম বসে আছেন আমার বিছানার পাশে। লাঞ্চ খেতে যাবেন না? তিনি জিজ্ঞেস করলেন। তার স্নেহপরায়ণতা ও উদ্বিগ্নতায় গভীরভাবে আলোড়িত হলাম। পরবর্তীতে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, ড. ব্রহ্ম প্রকাশ তার আগে আমার কামরায় আরও দুবার এসেছিলেন, কিন্তু আমাকে ঘুমন্ত দেখে চলে গিয়েছিলেন। কখন ঘুম থেকে জেগে তার সঙ্গে লাঞ্চ করব তারই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি সেই পুরো সময়টা। আমি ব্যথিত ছিলাম, কিন্তু এককভাবে নয়। ড. ব্রহ্ম প্রকাশের সঙ্গ আমাকে নতুন এক আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ করে তুলল। তিনি খাবার সময় হালকা কথাবার্তা বললেন, সতর্কতার সঙ্গে এসএলভি-৩ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন, কিন্তু কোমলভাবে তার কথাবার্তা আমাকে প্রবোধ দিচ্ছিল।

.

৯.

ড. ব্রহ্ম প্রকাশ এই প্রতিবন্ধকতার সময়টা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের নীতি প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। সাথীকে কেবল জীবন্ত অবস্থায় বাড়িতে পৌঁছে দাও। সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তিনি এসএলভি টিমের সবাইকে এক সঙ্গে জড়ো করে আমাকে দেখালেন, ব্যর্থতার দুঃখে শুধু আমি একাই কাতর নই। আপনার সব কমরেড দাঁড়িয়ে আছে আপনার পাশেই, তিনি বললেন। এটা আবেগপূর্ণ সমর্থন ও উৎসাহ জাগাল আমার মনে, সেই সঙ্গে পথনির্দেশনা।

উড্ডয়ন-পরবর্তী একটা পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হলো ১১ অগাস্ট ১৯৭৯ তারিখে। এতে সত্ত্বরজনেরও বেশি বিজ্ঞানী উপস্থিত হলেন। ব্যর্থতার বিস্তারিত টেকনিক্যাল দিকগুলো নির্ধারণ করা হয়েছিল এতে। পরে এসকে আথিখানের নেতৃত্বে পোস্টফ্লাইট অ্যানালাইসিস কমিটি ভেহিকলের কাজ না করার কারণগুলো নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছিল। সেকেন্ড স্টেজ কন্ট্রোল সিস্টেমের ব্যর্থতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে-এটা বোঝা গেল। দ্বিতীয় স্টেজ উড্ডয়নের সময় কোনো কন্ট্রোল ফোর্স না থাকায় ভেহিকল অ্যারোডাইনামিক ভাবে অস্থিত হয়ে পড়েছিল, এতে উচ্চতা ও গতি দুটোই হারাতে থাকে। এ কারণেই ভেহিকলটি সমুদ্রে পতিত হয়। অন্য স্টেজগুলো প্রজ্বলিত হওয়ার আগেই।

সেকেন্ড-স্টেজ ব্যর্থতার আরও ইন-ডেপথ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই পর্যায়ে জ্বালানি শক্তির জন্য অক্সিডাইজার হিসাবে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ রেড ফিউমিং নাইট্রিক এসিড (আরএফএনএ) নিঃসরণের ফলে কন্ট্রোল ফোর্স যখন প্রয়োজন হলো তখন কেবল জ্বালানি প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল, পরিণতিতে ফোর্স হলো শূন্য। অন্যদিকে আরএফএনএ নিঃসরণের কারণ শনাক্ত করা গেল যে, অক্সিডাইজার ট্যাংকে একটা সলেনয়েড ভালভ উন্মুক্ত ছিল, টি-৮ মিনিটে প্রথম কমান্ডের পর সংক্রমণের জন্য।

আইএসআরওর শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটা মিটিঙে অধ্যাপক ধাওয়ানের কাছে এই তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছিল আর তা গৃহীত হয়েছিল। ব্যর্থতা সামাল দিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে মিটিঙের সবারই সাধারণভাবে সন্তোষজনক মনোভাব ছিল। আমি কিন্তু তখনও নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছিলাম না আর অস্থিরতা অনুভব করছিলাম।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ধাওয়ানকে সম্ভাষণ করে বললাম, স্যার, যদিও আমার বন্ধুরা যান্ত্রিক দিক থেকে এই ব্যর্থতার বিচার করেছেন, তবু আরএফএনএ ছিদ্র কাউন্টডাউনের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপেক্ষা করার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। মিশন ডিরেক্টর হিসাবে, আমার উচিৎ ছিল উৎক্ষেপণ স্থগিত রাখা আর সম্ভব হলে ফ্লাইটটা রক্ষা করা। বিদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে মিশন ডিরেক্টরকে অপসারণ করা হতো। সুতরাং এসএলভি-৩ ব্যর্থতার দায়ভার আমি নিচ্ছি।

বেশ কিছু সময় হলের মধ্যে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল। অধ্যাপক ধাওয়ান তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কালামকে কক্ষপথে স্থাপন করতে যাচ্ছি!

তারপর মিটিং শেষ করার সংকেত দিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

.

বিজ্ঞানের অভীষ্ট বস্তু হচ্ছে পরমোল্লাস ও বিশাল হতাশার একটা সমন্বিতরূপ। এই রকম অনেক ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। জোহানেস কেপলারের তিন কক্ষ পথের সূত্র মহাকাশ গবেষণার ভিত্তি গড়েছিল। কিন্তু সূর্যের চারপাশে গ্রহসমূহের ঘূর্ণন সম্পর্কে তার প্রথম দুটো ধারণা সূত্রবদ্ধ করার পর তার তৃতীয় সূত্রটি ঘোষণা করতে সময় লেগেছিল ১৭ বছর। কতবার ব্যর্থতা আর হতাশার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে? রুশ গণিতবিদ কনস্তান্তিন সিওলকভস্কি মানুষের চাদে পদার্পণের ধারণা সম্প্রসারিত করেছিলেন, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়েছিল প্রায় চার দশক পর এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা। অধ্যাপক চন্দ্রশেখরকে তার আবিষ্কৃত চন্দ্রশেখর লিমিট-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় ৫০ বছর, ১৯৩০-এর দশকে ক্যামব্রিজে স্নাতক ছাত্র থাকাকালে তিনি এটা আবিষ্কার করেছিলেন। তার কাজ যদি সেই সময় স্বীকৃত হতো, তাহলে ব্ল্যাক হোল আবিষ্কারকে কয়েক দশক এগিয়ে নিতে পারত তা। কতবার ফন ব্রাউনকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল তার স্যাটার্ন লঞ্চ ভেহিকল মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দেবার আগে? এইসব চিন্তা আমাকে আবার পুরোদমে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল।

১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে অবসরে গেলেন ড. ব্রহ্ম প্রকাশ। ভিএসএসসিতে তিনি সবসময় ছিলেন আমার বিক্ষুব্ধ জলস্রোতে বিশ্বস্ত নোঙ্গর! দলীয় মনোবল বিষয়ে তার বিশ্বাস অনুপ্রাণিত করেছিল এসএলভি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদের, পরে এই ব্যবস্থাপনা প্যাটার্ন সারা দেশের বৈজ্ঞানিক প্রকল্পগুলোয় একটা ব্লু-প্রিন্টে পরিণত হয়েছিল। ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী পরামর্শক, যিনি আমাকে দিয়েছিলেন মূল্যবান পথের নির্দেশ।

অধ্যাপক সারাভাইয়ের কাছ থেকে আমি যে লক্ষণ পেয়েছিলাম তাতে ড. ব্রহ্ম প্রকাশ নতুন শক্তি জুগিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করতেও তিনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি আমাকে তাড়াহুড়োর বিরুদ্ধে সবসময় সাবধান করে দিতেন।

বড়ো বৈজ্ঞানিক প্রকল্প হচ্ছে পর্বতের মতো, সেখানে উঠতে হবে যত কম চেষ্টায় সম্ভব এবং কোনো রকম তাড়াহুড়ো না করে। তোমার নিজের প্রকৃতির বাস্তবতা নির্ধারণ করবে তোমার গতি। যদি তুমি অস্থির হও, গতি বাড়াও। যখন পীড়িত থাকবে, গতি কমাও। তোমাকে পর্বতে আরোহণ করতে হবে একটা সম্ভার অবস্থায়। তোমার প্রকল্পের প্রতিটা কাজ সমাপ্তির জন্য হয়ে অনন্য ঘটনা হয়ে উঠবে, তখন তুমি তা চমঙ্কারভাবে তা করতে পারবে, তিনি আমাকে বলেছিলেন।

ড. ব্রহ্ম প্রকাশের উপদেশ প্রতিধ্বনিত হয় ব্রহ্মাকে নিয়ে লেখা এমারসনের কবিতায়:

If the red slayer think he slays,
Or, if the slain think he is slain,
They know not well, the subtle ways
I keep, and pass, and turn again.

শুধু অজানা কোনো ভবিষ্যতের জন্য বেঁচে থাকা উপরিগত ব্যাপার। এটা হলো পার্শ্বস্থিত স্থান বাদ দিয়ে পাহাড় চূড়ায় ওঠা। পাহাড়ের পার্শ্বদেশই জীবনকে টিকিয়ে রাখে, চূড়া নয়। এখানেই সবকিছু জন্মায়, অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, টেকনোলজির দক্ষতা শেখা যায়। চূড়ার গুরুত্ত্ব হলো, সে পার্শ্বদেশকে স্থির রাখে। তাই আমি চুড়ার দিকে যাচ্ছিলাম, তবে পার্শ্বদেশের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। আমাকে যেতে হবে অনেক দূর, কিন্তু আমি তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম না। আমি যাচ্ছিলাম ছোটো ছোটো পা ফেলে ঠিক এক পা এক পা করে কিন্তু প্রতিটা পদক্ষেপেই চূড়ার দিকে।

.

প্রতিটা পর্যায়েই এসএলভি-৩ দল আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছিল কিছু অনন্যসাধারণ সাহসী মানুষের দ্বারা। সুধাকর ও শিবরামকৃষ্ণনের পাশাপাশি আরও ছিলেন শিবকামিনাথন। এসএলভি-৩ এর ইন্টিগ্রেশনের জন্য ত্রিবান্দ্রাম থেকে এসএইচএআরে সি-ব্যান্ড ট্রান্সপোন্ডার হচ্ছে একটা ডিভাইস যা রকেট সিস্টেমে যুক্ত করা হয় রাডার সংকেত দেওয়ার জন্য, উৎক্ষেপণস্থল থেকে চূড়ান্ত ইম্প্যাক্ট পয়েন্ট পর্যন্ত ভেহিকল ট্র্যাক করার পক্ষে যা যথেষ্ট শক্তিশালী। এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণ শিডিউল নির্ভরশীল ছিল। এই যন্ত্রের আগমন ও ইন্টিগ্রেশনের ওপর। যে বিমানে চড়ে শিবকামি আসছিল সেটা মাদ্রাজ বিমান বন্দরে অবতরণ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে স্কিড করল আর রানওয়েতে আছড়ে পড়ল। বিপুল ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল বিমানটি। এমারজেন্সি এগজিট দিয়ে সবাই লাফিয়ে নেমে গেল, নিজেদের বাঁচানোর জন্য তারা বেপরোয়া চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম শিবকামি, তার মালপত্র থেকে ট্রান্সপোন্ডারটা সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত সে বিমান ত্যাগ করল না। সর্বশেষ যে কজন ব্যক্তি ধোয়ার ভেতর থেকে অবশেষে বেরিয়ে এল, অন্যরা সবাই ছিল বিমানের ক্রু, তাদের একজন ছিল সে এবং ট্রান্সপোন্ডারটা বুকে চেপে ধরে রেখেছিল।

সেইসব দিনের আরও একটা ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেটা এসএলভি-৩ অ্যাসেম্বলি ভবনে অধ্যাপক ধাওয়ানের ভিজিটের সঙ্গে সম্পর্কিত। অধ্যাপক ধাওয়ান, মাধবন নায়ার ও আমি আলোচনা করছিলাম এসএলভি-৩ ইন্টিগ্রেশনের কিছু অপেক্ষাকৃত ভালো অবয়ব নিয়ে। ভেহিকলটা লঞ্চারের ওপর রাখা ছিল আনুভূমিক অবস্থায়। আমরা যখন চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর পরীক্ষা করছিলাম ইন্টিগ্রেটেড হার্ডওয়ারের দ্রুত সাধনযোগ্যতা, তখন আমি লক্ষ্য করলাম দুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নেভানোর জন্য বড়ো ওয়াটার পোর্ট রাখা হয়েছে। কোনো কারণে, লঞ্চারে এসএলভি-৩ এর দিকে মুখ করে রাখা পোর্টগুলো দেখে আমি অস্বস্তি অনুভব করলাম। আমি মাধবনকে পরামর্শ দিয়ে বললাম, পোর্টের মুখ ১৮০ ঘুরিয়ে রাখতে পারি আমরা বিপরীত দিকে। এতে করে হঠাৎ পানি বেরিয়ে রকেটের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা রোধ করা যাবে। মাধবন নায়ার পোর্টের মুখ রকেটের বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে রাখার কয়েক মিনিটের মধ্যে, আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে, প্রচণ্ড গতিতে পানির তোড় বেরিয়ে এল পোর্ট থেকে। ভেহিকল সেফটি অফিসার অগ্নিনির্বাপণ পদ্ধতির কাজ নিশ্চিত করেছিল, কিন্তু সে উপলব্ধি করতে পারেনি যে এতে রকেট ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এটা ছিল দূরদর্শিতার একটা শিক্ষা, নাকি আমরা রক্ষা পেয়েছিলাম ঐশ্বরিক মহিমায়?

১৯৮০ সালের ১৭ জুলাই দ্বিতীয় এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণের ৩০ ঘন্টা আগে, সব ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীতে পূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদপত্রগুলো। একটি কাগজে লেখা হলো, প্রকল্প পরিচালক নিখোঁজ, যোগাযোগের জন্য তাকে পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ সংবাদে বর্ণনা করা হয়েছিল প্রথম এসএলভি-৩ এর ইতিহাস, আর জ্বালানি সংকটের কারণে কীভাবে তৃতীয় স্টেজ প্রজ্বলিত হতে ব্যর্থ হয়েছিল আর সমুদ্রে নাক থুবড়ে পড়েছিল রকেট সেই কাহিনি। কোনো কোনো কাগজে এসএলভি-৩ এর সামরিক কাজে ব্যবহারের সম্ভাবনা হাইলাইট করা হলো। আমি জানতাম আগামীকালের উৎক্ষেপণে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ। বস্তুত, সাদামাটা কথায়, সমগ্র জাতির দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল আমাদের ওপর।

.

পরবর্তী দিনের প্রথম ভাগে, ১৮ জুলাই ১৯৮০-০৮০৩ ঘন্টায় ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল এসএলভি-৩ উৎক্ষিপ্ত হলো এসএইচআর থেকে। টেক অফের আগে ৬০০ সেকেন্ডে আমি দেখলাম কম্পিউটার ডাটা দিচ্ছে, রোহিনী স্যাটেলাইটকে (পেলোড হিসাবে বাহিত) কক্ষপথে প্রবেশ করাতে প্রয়োজন মতো বেগমাত্রা প্রয়োগ করছে স্টেজ ৪। পরবর্তী দুই মিনিটের মধ্যেই রোহিনী নিজ কক্ষপথে স্থাপিত হয়ে পৃথিবী পরিক্রমণ শুরু করল। কর্কশ আওয়াজের মধ্যে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলো আমি উচ্চারণ করলাম, মিশন ডিরেক্টর মনোযোগ আকর্ষণ করছি সমস্ত স্টেশনের। একটা জরুরি ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। মিশনের চাহিদামতো কাজ করেছে সমস্ত স্টেজ।

চতুর্থ স্টেজ অ্যাপোজি মোটর প্রয়োজন মতো বেগমাত্রা প্রয়োগ করেছে রোহিনী স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে স্থাপন করতে। আনন্দ ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল সবখানে। আমি যখন ব্লক হাউজ থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন আমার তরুণ সহকর্মীরা আমাকে তাদের কাঁধে তুলে নিল আর এগিয়ে চলল মিছিল করে।

গোটা জাতি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। যে সব রাষ্ট্র স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সামর্থ্য রাখে তাদের সংখ্যা খুবই কম, আর সেই নগন্যসংখ্যক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এখন ভারতের নামও অন্তর্ভুক্ত হলো। সংবাদপত্রগুলো এ ঘটনাকে শিরোনাম করে সংবাদ পরিবেশন করল। রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারিত হলো বিশেষ অনুষ্ঠান। ডেস্ক চাপড়ে অভিনন্দন জানাল পার্লামেন্ট। এটা ছিল একই সঙ্গে জাতীয় স্বপ্নের বাস্তবায়ন, আর আমাদের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের সূচনা। অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান, আইএসআরওর চেয়ারম্যান, তার রীতিমাফিক কথাবার্তার সতর্কতা হাওয়ায় ছুঁড়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন, মহাকাশে স্থান নেওয়ার বিষয়টি এখন আমাদের সাধ্যের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কেবল করে তার অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ছিল ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রত্যেকেই গর্বিত হয়েছিল এই একশভাগ দেশীয় প্রচেষ্টায়।

আমার অভিজ্ঞতা হলো মিশ্র অনুভূতির। সাফল্য অর্জনে আমি আনন্দিত ছিলাম, যা কৌশলে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিল গত দুই দশক ধরে; কিন্তু আমি ব্যথিত হয়েছিলাম, কারণ যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তারা কেউ আর বেঁচে ছিলেন না আমার আনন্দ ভাগ করে নেবার জন্য। আমার বাবা, আমার ভগ্নিপতি জালালুদ্দিন, এবং অধ্যাপক সারাভাই।

এসএলভি-৩ এর সফল উৎক্ষেপণের কৃতিত্ব প্রথমে ভারতের মহাকাশ কর্মসূচির মহানায়কদের, সুনির্দিষ্টভাবে অধ্যাপক সারাভাইয়ের; তারপর ভিএসএসসির কয়েকশ কর্মীবৃন্দের, এবং অধ্যাপক ধাওয়ান ও ড. ব্রহ্ম প্রকাশের।

সেই সন্ধ্যায় আমাদের রাতের খাবার খেতে দেরি হলো। ক্রমে ক্রমে শান্ত হয়ে এল উৎসবের আনন্দধ্বনি। আমি প্রায় শক্তিহীনভাবে বিছানায় গেলাম। খোলা জানলা দিয়ে আমি মেঘের ভেতর চাঁদ দেখতে পেলাম। শ্রীহরিকোটা দ্বীপে আজ সমুদ্রের বাতাস মনে হলো প্রতিফলন ঘটাচ্ছে প্রাণবন্ততা।

.

এসএলভি-৩ এর সাফল্যের এক মাসের মধ্যে আমি এক দিনের জন্য গেলাম বোম্বাইয়ে অবস্থিত নেহরু বিজ্ঞান কেন্দ্রে। সেখানে এসএলভি-৩ এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল আমাকে। সেখানে আমাকে দিল্লি থেকে ফোন করলেন অধ্যাপক ধাওয়ান। পরদিন সকালে তার সঙ্গে যোগ দিতে বললেন। প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের কথা ছিল। নেহরু কেন্দ্রে আমার আমন্ত্রণকারীরা আমাকে দিল্লির টিকেট জোগাড় করে দিলেন, কিন্তু আমার একটা ছোটো সমস্যা ছিল। সেটা পোশাকের। আমি অভ্যাসমতো একেবারে ক্যাজুয়াল পোশাক পরতাম আর স্লিপার। কোনোভাবেই অমন পোশাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায় না। এ সমস্যার কথা যখন বললাম অধ্যাপক ধাওয়ানকে, তিনি আমাকে পোশাক নিয়ে উৎকণ্ঠিত হতে নিষেধ করলেন। সাফল্যের সুন্দরতম পোশাকে আপনি আবৃত, তিনি সরস জবাব দিলেন।

অধ্যাপক ধাওয়ান ও আমি পার্লামেন্ট ভবন অ্যানেক্সে উপস্থিত হলাম পরদিন সকালে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক পার্লামেন্টারি প্যানেলের একটা মিটিং নির্ধারিত ছিল। কামরায় লোকসভা ও রাজ্যসভার প্রায় ৩০ জন সদস্য ছিলেন, আর সেখানে জ্বলছিল বিশাল এক ঝাড়বাতি। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক এমজিকে মেনন ও ড, নাগ চৌধুরী। শ্রীমতি গান্ধী এসএলভি-৩ এর সাফল্য সম্পর্কে সদস্যদের বললেন আর আমাদের অর্জনকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। অধ্যাপক ধাওয়ান দেশের মহাশূন্য গবেষণায় উৎসাহদানের জন্য সমবেতদের ধন্যবাদ জানালেন আর আই এসআরওর বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। অকস্মাৎ আমি দেখতে পেলাম শ্রীমতি গান্ধী আমাকে লক্ষ করে হাসি মুখে বলছেন, কালাম, আমরা আপনার কথা শুনতে চাই।

অধ্যাপক ধাওয়ান সমবেতদের উদ্দেশ্যে আগেই যেহেতু বক্তৃতা দিয়েছেন, তাই আমি অবাক হলাম এই অনুরোধে।

ইতস্তত করে আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এই সমাবেশে উপস্থিত হতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি একটা জিনিসই জানি যে আমাদের দেশে কীভাবে একটা রকেট নির্মাণ করতে হবে, যা দেশে তৈরি স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারবে, ঘন্টায় ২৫০০০ কিলোমিটার বেগমাত্রা প্রয়োগ করে। বজ্রধ্বনির মতো হাততালি পড়তে লাগল। এসএলভি-৩ এর মতো একটা প্রকল্পে কাজ করার আর আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক শক্তি প্রমাণের সুযোগ দেওয়ার জন্য সদস্যদের আমি ধন্যবাদ জানালাম আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল সমস্ত কক্ষ।

সাফল্যের সঙ্গে এসএলভি-৩ প্রকল্প সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর, ভিএসএসসির দরকার হয়ে পড়ল লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ ও সম্পদ পুনর্গঠনের। আমি প্রকল্পের কাজ থেকে অবসর চেয়েছিলাম। আমার দলের বেদ প্রকাশ স্যান্ডলাসকে এসএলভি-৩ কন্টিনুয়েশন প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক করা হলো। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল একই শ্রেণির অপারেশনাল স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল তৈরি করা। নির্দিষ্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সাহায্যে এসএলভি-৩ এর আরও উন্নতির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু সময়ের জন্য কাজ করা হচ্ছিল অগমেন্টেড স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (এএসএলভি নিয়ে। লক্ষ্য ছিল এসএলভি-৩ এর পেলোড বহনের ক্ষমতা ৪০ কেজি থেকে ১৫০ কেজিতে উন্নীত করা। আমার দলের এমএসআর দেবকে এএসএলভির প্রকল্প পরিচালক করা হলো। সান-সিনক্রোনাস অর্বিট (৯০০ কিলোমিটার)-এ পৌঁছাতে একটা পিএসএলভি তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল। জিও স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (জিএসএলভি) নিয়েও বিবেচনা করা হচ্ছিল, যদিও সেটা ছিল অনেক দূরের স্বপ্ন। আমাকে অ্যারোস্পেস ডাইনামিকস অ্যান্ড ডিজাইন গ্রুপের পরিচালক নিযুক্ত করা হলো, যাতে করে আমি লঞ্চ ভেহিকল গঠন করতে পারি আর প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে পারি।

ভিএসএসসির বিদ্যমান অবকাঠামো ভবিষ্যৎ লঞ্চ ভেহিকল সিস্টেমের আয়তন ও ওজনের পক্ষে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল উচ্চতর বিশেষায়িত স্থাপনা। ভিএসএসসির সম্প্রসারিত কর্মকান্ডের জন্য নতুন স্থান ঠিক করা হলো ভাটিয়ুরকাভু ও ভালিয়ামালায়। ড. শ্রীনিবাসন একটা বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করলেন এই স্থাপনাগুলোর। ইতোমধ্যে, শিবাথানু পিল্লাইয়ের সঙ্গে মিলে আমি একটা অ্যানালাইসিস করলাম এসএলভি-৩ ও এর থেকে জাত অন্যান্য নমুনার প্রয়োগ সম্পর্কে মিসাইল ব্যবহারের জন্য বিদ্যমান দুনিয়ার লঞ্চ ভেহিকলের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ ছিল সেটা। আমরা দেখলাম যে, এসএলভি-৩ সলিড রকেট সিস্টেম নিকট ও মধ্যম পাল্লার (৪০০০ কিলোমিটার) পেলোড ডেলিভারি ভেহিকলের জাতীয় চাহিদা পূরণ করবে। এসএলভি-৩ সাবসিস্টেমে ৩৬ টন প্রোপেল্যান্টের সঙ্গে ১.৮ মিটার ডায়ামিটারের একটা অতিরিক্ত সলিড বুস্টার জুড়ে দিতে পারলে আইসিবিএম-এর চাহিদাও (১০০০ কেজি পেলোডের জন্য ৫০০০ কিলোমিটার উর্ধ) পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এই প্রস্তাব কখনও বিবেচনা করা হয়নি। তা সত্ত্বেও এটা রি-এন্ট্রি এক্সপেরিমেন্ট (আরইএক্স) রূপদানের পথ করে দিয়েছিল, যার থেকে পরে সৃষ্টি হয় অগ্নি!

পরবর্তী এসএলভি-৩ ফ্লাইট, এসএলভি-৩-ডি, উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৮১ সালের ৩১ মে। দর্শকদের গ্যালারি থেকে এই ফ্লাইট আমি অবলোকন করলাম। এই প্রথমবার আমি কন্ট্রোল সেন্ট্রালের বাইরে বসে উৎক্ষেপণ প্রত্যক্ষ করলাম। একটা তিক্ত সত্যের মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছিল যে, সংবাদমাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় আমার ব্যাপারে আমার কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীর মনে ঈর্ষা জেগেছিল, যারা সবাই সমানভাবে অবদান রেখেছিলেন এসএলভি-৩ এর সাফল্যে। নতুন পরিবেশের শীতলতায় আমি কি আহত হয়েছিলাম? হয়তো হ্যাঁ, কিন্তু যা পরিবর্তন করতে পারব না তা গ্রহণ করতে আমার আপত্তি ছিল না।

অন্যদের লাভে ভাগ বসিয়ে আমি জীবনধারণ করি না। আমার প্রকৃতির মধ্যেই ও জিনিস নেই। নির্মম মুনাফাখখার আমি নই। এসএলভি-৩ জোর খাঁটিয়ে বা স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনের নিমিত্তে তৈরি হয়নি, বরং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে। তাহলে কেন এই তিক্ততা? এটা কি ভিএসএসসির শীর্ষ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য ছিল, নাকি এক সর্বজনীন বাস্তবতা? একজন বিজ্ঞানী হিসাবে, বাস্তবতার কারণ খুঁজে বের করার শিক্ষাই আমি পেয়েছিলাম। বিজ্ঞানে বাস্তবতা হলো তাই যার অস্তিত্ব আছে এবং যেহেতু এই তিক্ততা ছিল বাস্তব, সুতরাং এর কারণ আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু এই ধরনের কোনো কিছুর কী কারণ থাকে? আমার এসএলভি-পরবর্তী অভিজ্ঞতা কি আমাকে কোনো সংকটজনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল? হ্যাঁ আর না। হ্যাঁ, কারণ এসএলভি-৩ এর গৌরবের অধিকারী সবাই হয়নি। না, কারণ কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোনো পরিস্থিতি কেবল তখনই সংকটজনক বলে বিবেচনা করা যাবে, যখন তার সত্ত্বার প্রয়োজনীয়তা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে উঠবে এবং নিশ্চয়ই সে রকম ছিল না ঘটনা। বস্তুত দ্বন্দ্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মূল আইডিয়ার ওপর। অতীতের দিকে তাকিয়ে, আমি শুধু বলতে পারি পুনরারম্ভ আর বাস্তবায়নের বিশাল এক প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমি পূর্ণ সচেতন ছিলাম।

১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে এসএলভি-৩ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দেবার জন্য দেরাদুনে আমন্ত্রণ জানালেন হাই অ্যাল্টিচিউড ল্যাবরেটরির (এখন ডিফেন্স ইলেকট্রনিকস অ্যাপ্লিকেশনস ল্যাবরেটরি (ডিইএল)) ড, ভগীরথ রাও। প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী অধ্যাপক রাজা রামান্না সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন, তিনি ছিলেন তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা। তিনি পরমাণু শক্তি সঞ্চালনে ভারতের চেষ্টা ও শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন। যেহেতু এসএলভি-৩ এর সঙ্গে আমি ওতপ্রোত জড়িত ছিলাম, সুতরাং এ নিয়ে আমাকে বিস্তারিত বলতে হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। পরে, অধ্যাপক রাজা রামান্না একটা ব্যক্তিগত চা-চক্রে আমাকে আমন্ত্রণ জানান।

অধ্যাপক রামান্নার সঙ্গে সাক্ষাতে প্রথম যে ব্যাপারটা আমাকে চমকিত করেছিল, তা হলো আমার সাক্ষাৎ পাওয়ায় তার অনাবিল আনন্দ। তার কথাবার্তায় ছিল সহজ-স্বাভাবিকতা, বিলম্বহীন ও সহানুভূতিশীল বন্ধু ভাবাপন্নতা। এই সন্ধ্যায় আমার মনে ভেসে উঠেছিল অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি মনে হয় এইতো যেন গতকালের ব্যাপার। অধ্যাপক সারাভাইয়ের জগৎ ভেতরে ছিল সাদামাটা আর বাইরে ছিল সহজ। তার সঙ্গে আমরা যারা কাজ করেছি, সবাই পরিচালিত হয়েছি এক মন নিয়ে, সৃষ্টির একাগ্রচিত্ততায়। সারাভাইয়ের জগৎ ছিল আমাদের স্বপ্নের পরিমাপে গঠিত।

কিন্তু আমার জগতে সরলতা, বলতে আর কিছু ছিল না। এটা পরিণত হয়েছিল ভেতরে জটিল আর বাইরে প্রতিবন্ধক। রকেট বিজ্ঞানে ও দেশীয় রকেট তৈরির লক্ষ্য পূরণে আমার প্রচেষ্টা বাইরের বাধাবিপত্তিতে ব্যাহত হয়েছিল আর অভ্যন্তরীণ দোদুল্যমানতায় জটিল হয়েছিল। সামনে এগিয়ে যাবার জন্য আমার ইচ্ছার বিশেষ চেষ্টা প্রয়োজন ছিল আর তাতে আমি সচেতন ছিলাম। আমার অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সমন্বয় ইতোমধ্যেই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। আমার বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের সমন্বয় আমার মনে সর্বাগ্রে স্থান নিয়ে ছিল যখন আমি অধ্যাপক রামান্নার চায়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম।

তিনি আসল বিষয়ে আসতে বেশি সময় নিলেন না। ডিআরডিএলে নারায়ণন ও তার দলের বিপুল সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও ডেভিল ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ রাখা হয়েছিল। সামরিক রকেটের পুরো কর্মসূচি গুটিয়ে যাচ্ছিল অটল অনীহার নিচে। ডিআরডিওর প্রয়োজন তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কমান্ড নিতে পারবে এমন এক ব্যক্তি, এই কর্মসূচি কিছুদিন ধরে পড়ে ছিল ড্রয়িং বোর্ডের মধ্যেই। অধ্যাপক রামান্না আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ডিআরডিএলে যোগ দিতে এবং তাদের গাইডেড মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম (জিএমডিপি) রূপায়নের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে ইচ্ছুক কিনা। অধ্যাপক রামান্নার প্রস্তাবে আমি আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়লাম।

আমাদের রকেটবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োগের এমন সুযোগ আমি আর কবে পেতাম? অধ্যাপক রামান্না আমাকে যে রকম উচ্চমূল্য বলে গণ্য করেছিলেন তাতে আমি সম্মানিত বোধ করলাম। পোখারান পারমাণবিক পরীক্ষার পেছনে তিনি ছিলেন উজ্জীবনী শক্তি, এবং বহির্বিশ্বে প্রাযুক্তিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে তার অবদানের কথা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত হই। আমি যে তার কথা প্রত্যাখ্যান করতে পারব না, তা জানতাম। অধ্যাপক রামান্না আমাকে পরামর্শ দিলেন এ ব্যাপারে অধ্যাপক ধাওয়ানের সঙ্গে কথা বলতে, যাতে করে তিনি আইএসআরও থেকে ডিআরডিএলে আমাকে বদলির ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ অধ্যাপক ধাওয়ানের সঙ্গে আমি দেখা করলাম ১৪ জানুয়ারি ১৯৮১ তারিখে। তিনি ধৈর্যের সঙ্গে আমার কথা শুনলেন, তার সবকিছু সতর্কতার সঙ্গে মাপার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, যাতে করে কোনো পয়েন্ট মিস না করেন। তার অভিব্যক্তিতে লক্ষ্যণীয় আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আমার লোকের কাজের যে মুল্যায়ন তারা করেছে তাতে আমি খুশি। তিনি তারপর হাসলেন। অধ্যাপক ধাওয়ানের মতো হাসতে কাউকে দেখিনি কখনও-যেন এক কোমল শাদা মেঘদল-যেমন ইচ্ছা তেমন আকারে এর ছবি তুমি কল্পনা করতে পার।

আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম কীভাবে এগোব। আমি কি ওই পদের জন্য আনুষ্ঠানিক আবেদন জানাব, যাতে করে ডিআরডিএল নিয়োগপত্র পাঠাতে পারে? অধ্যাপক ধাওয়ানের কাছে আমি জানতে চাইলাম না। তাদের ওপর চাপ দেওয়ার দরকার নেই। নতুন দিল্লিতে আমার পরবর্তী সফরের সময় টপ-লেভেল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে কথা বলব। অধ্যাপক ধাওয়ান বললেন, আমি জানি আপনার একটা পা সবসময়ই ডিআরডিওতে দিয়ে রেখেছেন, এখন আপনার পুরো মধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র তাদের দিকে আপনাকে টেনে নিতে চাইছে।

অধ্যাপক ধাওয়ান যা বলছিলেন তার মধ্যে সত্যের উপাদান হয়তো ছিল, কিন্তু আমার হৃদয়খানা সবসময়ই ছিল আইএসআরওতে। তিনি কি তা সত্যিকারার্থেই বুঝতে পারেননি?

১৯৮১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস আনন্দময় বিস্ময় নিয়ে এল। ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অধ্যাপক ইউআর রাও-এর সচিব মহাদেবন দিল্লি থেকে ফোন করে জানালেন, আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ফোনটি এল অধ্যাপক ধাওয়ানের কাছ থেকে, তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আমি যেন গুরুর কাছ থেকে অভিনন্দন পাওয়ার পরম সুখ অনুভব করলাম। অন্যদিকে অধ্যাপক ধাওয়ান পদ্ম বিভূষণ পুরস্কার পাওয়ায় দারুণ উল্লাস হলো আমার, তাকে সর্বান্তকরণে আমি অভিনন্দন জানালাম। তারপর ড, ব্রহ্ম প্রকাশকে ফোন করে ধন্যবাদ দিলাম। ড. ব্রহ্ম প্রকাশ আমার এই আনুষ্ঠানিক ভদ্রতায় আমাকে ভর্ৎসনা করে বললেন, আমার অনুভূতি হচ্ছে যেন আমার সন্তান পুরস্কার পেয়েছে।

ড. ব্রহ্ম প্রকাশের স্নেহপরায়ণতা গভীর ভাবে আমাকে স্পর্শ করল, এতটা গভীর যে নিজের আবেগ আমি আর দমন করে রাখতে পারলাম না।

আমার ঘর আমি ভরিয়ে তুললাম বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের সুরে। সে সুর আমাকে নিয়ে গেল আরেক সময়ে, আরেক জগতে। আমি চলে গেছি রামেশ্বরমে আর মাকে জড়িয়ে ধরেছি। আমার বাবা সযত্নে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার চুলে। আমার প্রেরণাদাতা জালালুদ্দিন খবরটা ঘোষণা করছে মস্ক স্ট্রিটে জড়ো হওয়া লোকদের উদ্দেশ্যে। আমার বোন জোহরা আমার জন্য প্রস্তুত করছে বিশেষ মিষ্টান্ন। পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রী আমার কপালে এঁকে দিচ্ছেন তিলক। ফাদার সলোমন পবিত্র কুশ ধরে আমাকে আশীর্বাদ করছেন। আমি দেখতে পাই অধ্যাপক সারাভাই লক্ষ্য পূরণের তৃপ্তি নিয়ে হাসছেন। যার বীজ তিনি বপণ করেছিলেন কুড়ি বছর আগে, তা শেষ পর্যন্ত ডালপালা ছড়ান বৃক্ষে পরিণত হয়েছে আর সে বৃক্ষের ফল উপভোগ করছে ভারতের জনগণ।

আমার পদ্মভূষণ পুরস্কার প্রাপ্তি ভিএসএসসিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। অনেকে আমার আনন্দে শরিক হলো, অনেকে ভাবল আমাকে অসঙ্গতভাবে প্রত্যভিজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী ঈর্ষান্বিত হলো। কিছু মানুষ কেন জীবনের মহান মূল্য দেখতে ব্যর্থ হয়? জীবনে সুখ, তৃপ্তি ও সাফল্য নির্ভর করে সঠিক পছন্দের ওপর, বিজয়ী পছন্দের ওপর। জীবনে অনেক শক্তি আছে যা তোমার পক্ষে ও বিরুদ্ধে কাজ করছে। ক্ষতিকর শক্তি থেকে কল্যাণকামী শক্তিকে অবশ্যই পৃথক করতে হবে। আর এ দুয়ের মধ্যে সঠিকভাবে একটিকে বেছে নিতে হবে।

আমার ভেতরের একটা কণ্ঠস্বর বলল, অনেক দিন ধরে অনুভূত কিন্তু অবহেলিত পুনরারম্ভের সময় এসেছে। আমাকে প্লেট পরিষ্কার করে নতুন অংক কষতে হবে। আগের অংকগুলো কি সঠিকভাবে কষা হয়েছিল? জীবনে নিজস্ব অগ্রগতির মূল্যায়ন নিজে করা খুব কঠিন কাজ। এখানে ছাত্রকে নিজেই প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হয়েছে, নিজেই সে সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়েছে আর নিজের তৃপ্তির জন্য তার মূল্যায়ন করতে হয়েছে। বিচার এক পাশে থাক, আইএসআরওতে আঠার বছর কাটিয়ে এখন সেখান থেকে চলে যাবার সময় মনে ব্যথা জাগবে না তা অসম্ভব। আর আমার ব্যথাতুর বন্ধুদের ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল লিউইস ক্যারোলের কবিতার লাইনগুলোই সবচেয়ে উপযোগী:

You may charge me with murder
Or want of sense
(We are all of us weak at times):
But the slightest approach to a false pretence
Was never among my crimes!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *