২. সিরাজ চরিত-কথা

সিরাজ চরিত-কথা

সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্র সম্বন্ধে প্রায়-সমসাময়িক সব ঐতিহাসিক ও পর্যবেক্ষকদের মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায়। যে-সব তথ্যের ওপর নির্ভর করে এ-সব বক্তব্য, বর্তমান অধ্যায়ে সেগুলি আমরা বিশদভাবে আলোচনা করেছি। সিরাজ চরিত্রের সমর্থন আমাদের উদ্দেশ্য নয় এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। শুধু যে-সব তথ্যের ভিত্তিতে সিরাজচরিত্র বর্ণনা করা হয়, তার সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রায়-সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাসে এবং ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকদের লেখায় এটা পরিষ্কার যে তরুণ যুবক হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা এমনই নিষ্ঠুর, দুর্বিনীত, নির্দয় এবং দুশ্চরিত্র ছিলেন যে সবাই তাঁর নবাব হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাঁর ভীতিপ্রদ স্বভাবের জন্য শুধু সাধারণ মানুষই নয়, এমনকী উচ্চবর্গের শাসকশ্রেণীও তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল। ফারসি ঐতিহাসিকদের মধ্যে সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন খান সিরাজের দুশ্চরিত্রের নিন্দায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। সিরাজ সম্বন্ধে তিনি নানা কটূক্তি করেছেন—‘অজ্ঞ অর্বাচীন যুবক’, ‘যে পাপপুণ্যের বা ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য করে না’, ‘দয়ামায়াহীন উদ্ধত ব্যবহার’, ‘রূঢ়ভাষী ও হৃদয়হীন’, ‘অহংকার ও অজ্ঞতায় যার মাথা বিগড়েছে’, ‘যৌবন, ক্ষমতা ও আধিপত্যের নেশায় যে আত্মহারা’, ইত্যাদি। রিয়াজে-র গ্রন্থকার গোলাম হোসেন সলিমও সিরাজ চরিত্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে সিরাজ ‘বদমেজাজি ও রূঢ়ভাষী’ ছিলেন এবং তিনি ‘সব অভিজাত ব্যক্তি ও সেনাপতিদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেন।’

শুধু ফারসি ঐতিহাসিকরা নন, তদানীন্তন প্রায় সব ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরাও সিরাজদ্দৌল্লার ব্যক্তিগত চরিত্রের অনুরূপ চিত্র দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ (Jean Law)। তিনি সিরাজের ‘জঘন্যতম চরিত্র’ এবং ‘লম্পট ও নিষ্ঠুর স্বভাবের’ উল্লেখ করেছেন। ইংরেজ কুঠিয়াল লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনও (Luke Scrafton) লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘সর্বদাই লাম্পট্য ও অতিরিক্ত মদ্যপানে ডুবে থাকেন, তাঁর ইয়ার দোস্তরাও অতি নিকৃষ্ট স্তরের মানুষ’। সিরাজ সম্বন্ধে তিনি এটাও বলেছেন যে, তাঁর ‘কথাবার্তা, আচরণ বদমেজাজি ও হিংস্র ধরনের এবং তিনি ছিলেন নির্দয়, লোভী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী।’ সমসাময়িক অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় আখ্যানেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়।

সুতরাং তরুণ যুবক হিসেবে, বিশেষ করে নবাব হওয়ার আগে, সিরাজদ্দৌল্লা যে নির্দয়, নিষ্ঠুর ও অসচ্চরিত্র ছিলেন তা তাঁর অন্ধ সমর্থকও অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ এ চিত্রটাই প্রায় সব ফারসি ইতিহাস ও ইউরোপীয়দের লেখায় দেখা যায়। তবে বিষয়টি বিচার-বিবেচনার আগে তাঁর ছোটবেলা থেকে নবাব হওয়া পর্যন্ত তাঁর জীবনটার প্রতি দৃষ্টিপাত করা দরকার। মির্জা মহম্মদ সিরাজদ্দৌল্লা ছিলেন নবাব আলিবর্দির তৃতীয় কন্যা আমিনা বেগম ও আলিবর্দির ভাই হাজি আহমেদের পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদের ঔরসে জাত পুত্র অর্থাৎ নবাব আলিবর্দির নাতি। আলিবর্দির প্রথম কন্যা মেহের উন্নিসার (ঘসেটি বেগম) বিয়ে হয়েছিল হাজি আহমেদের বড় ছেলে নওয়াজিস মহম্মদের সঙ্গে। দ্বিতীয় কন্যার স্বামী ছিলেন আলিবর্দির আরেক ভাইপো পুর্ণিয়ার নবাব সৈয়দ আহমেদ।

১৭৩৩ সালে আলিবর্দি বিহারের ছোট নবাব (deputy governor) পদে নিযুক্ত হওয়ার ক’দিন আগে সিরাজের জন্ম হয়। তাঁর জন্মের পরেই আলিবর্দি এত উচ্চপদে নিযুক্ত হওয়ায় তিনি তাঁর মাতামহের বিশেষ স্নেহ ও আদরের পাত্র হয়ে ওঠেন। গোলাম হোসেন খান লিখেছেন যে ‘আলিবর্দি তাঁর বাড়িতেই সিরাজের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।’ মুজাফ্‌ফরনামা,-র লেখক করম আলি জানাচ্ছেন:

আলিবর্দি সিরাজের জন্ম থেকেই তাঁর প্রতি এমন স্নেহান্ধ ছিলেন যে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে কাছছাড়া করতেন না। তিনি তাঁকে রাষ্ট্রনীতি, শাসনকার্য ও শাসক-অভিজাত জীবনের নানা গুণাবলী শেখাতেন। সিরাজের প্রতি তাঁর স্নেহ এমনই অন্ধ ছিল যে সিরাজের সমস্ত অপকীর্তিকে তিনি যেন দেখেননি বা শোনেননি এমন ভাব করতেন।… সিরাজের চিন্তা ছাড়া তাঁর একটি মুহূর্তও কাটত না।

বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্রয়ের ফল ভাল হয় না। মাতামহের অত্যধিক আদরযত্ন, অপরিসীম স্নেহ ও মনোযোগ বালক সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রকে নষ্ট করেছিল। সে ক্রমেই হয়ে উঠল এক অসংযত স্বভাবের দুর্বিনীত যুবক। তার ওপর সিরাজের অন্ধ অনুগত চাটুকারেরও অভাব ছিল না। তারা তাঁর সব খামখেয়ালিতে সায় দিয়ে ও মিথ্যা স্তবস্তুতি করে তাঁর অহমিকায় ইন্ধন জোগাত। তাই প্রথম যৌবনে সিরাজ নানা স্বেচ্ছাচারিতা করেও বৃদ্ধ আলিবর্দির সমর্থন ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হননি। বরঞ্চ আলিবর্দি নানাভাবে তাঁকে তোষণ করার চেষ্টা করতেন।

নবাব আলিবর্দি তাঁর প্রিয় দৌহিত্রকে অল্পবয়সেই ঢাকার রাজকীয় নৌবাহিনীর অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করেন। এমনকী সামরিক অভিযানের সময়েও বৃদ্ধ নবাব সিরাজকে তাঁর সান্নিধ্যে রাখতেন। ১৭৪০-৪১ সালে উড়িষ্যা অভিযানেও সিরাজকে তিনি সঙ্গে নেন। ১৭৪৬ সালে মির্জা ইরেজ খানের কন্যার সঙ্গে খুব ধূমধাম করে তিনি সিরাজের বিয়ে দেন। এই অনুষ্ঠানের বিলাসবহুল আড়ম্বর ছিল দেখার মতো। ১৭৪৮ সালে সিরাজের পিতা জৈনুদ্দিন আহমেদ নিহত হলে আলিবর্দি সিরাজকে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করেন। অবশ্য রাজা জানকীরাম হন তাঁর সহকারী। নামে সহকারী হলেও আসলে জানকীরামই শাসনকার্য চালাতেন। ১৭৪৯ সালের ডিসেম্বরে আলিবর্দি মারাঠাদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে মেদিনীপুর অভিযান করেন এবং সিরাজকে বালেশ্বরে পাঠান সেখান থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করার জন্য। ইতিমধ্যে মেহদি নিসার নামে নবাবের এক বিতাড়িত ও বিক্ষুব্ধ সেনাপতির প্ররোচনায় সিরাজ জানকীরামকে তাড়িয়ে বিহারের স্বাধীন নবাব হওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা অবশ্য বিফল হয় এবং শীঘ্রই জানকীরামের সঙ্গে তাঁর মিটমাট হয়ে যায়। বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি বরাবরের মতো এবারও তাঁর প্রিয় নাতিকে ক্ষমা করে দেন। ১৭৫২-এর মে মাসে তিনি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করলেন। তাঁর মৃত্যুর (৯ বা ১০ই এপ্রিল ১৭৫৬) পর সিরাজদ্দৌল্লা ১৫ই এপ্রিল ১৭৫৬-তে রাজ্যভার গ্রহণ করেন।

ওপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে তরুণ নবাব রাজকার্যে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন না। যুদ্ধাভিযান ও শাসনকার্য দুই বিষয়েই অত্যন্ত নবীন বয়স থেকে মাতামহের সান্নিধ্য ও শিক্ষায় তাঁর বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা সিরাজ-চরিত্রকে মহান বলার কোনও চেষ্টাই করব না, তবে তাঁকে যতটা খারাপ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়, তা কতখানি সত্যনির্ভর তার বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করব শুধু। সিরাজদ্দৌল্লা সত্যিসত্যিই ‘ভিলেন’ জাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কি না তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানা একান্ত প্রয়োজন। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে, বেশির ভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশির প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ওইসব ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তা ছাড়া, আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, ফারসি ইতিহাসগুলির বেশির ভাগই লেখা হয়েছিল, ওইসব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’ বা ‘মনিবদের’ আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ বা ‘দুর্বৃত্ত’ প্রতিপন্ন করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশি ষড়যন্ত্রের চক্রান্ত করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই যারা সিরাজকে উচ্ছৃঙ্খল, স্বেচ্ছাচারী, নির্দয় ও চরিত্রহীন বলে চিত্রায়িত করেছে, সেই সব সূত্রের যথার্থ বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন।

প্রথমেই সিয়র-প্রণেতা গোলাম হোসেন খানের ব্যাপারটাই দেখা যাক। ইনি ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক এবং সিরাজ চরিত্রের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। প্রথমে তিনি নবাব আলিবর্দির হাজি বা বাড়ির সরকার ছিলেন। পরে ১৭৪৯ সালে সিংহাসনের জন্য সিরাজদ্দৌল্লার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৭৫৬-এর অক্টোবরে সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধে শওকত জঙ্গ নিহত হওয়া পর্যন্ত তিনি পুর্ণিয়াতে ছিলেন। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন গোঁড়া ইংরেজ-ভক্ত এবং সিরাজ-বিরোধী। করম আলির ভাষায়, ‘ইংরেজদের বন্ধু’ হিসেবে ‘তাদের জন্য ওকালতি করায়’ তিনি সিরাজদ্দৌল্লার চাকরি খুইয়েছিলেন, কিন্তু পরে ‘মীরকাশিমের রাজত্বকালে ইংরেজদের মিত্র হিসেবে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক ও অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন।’১০ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব আর তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন—‘এই জাতির (ইংরেজ)… শক্তি, সাহস ও মনোবলের কোনও তুলনা হয় না’ বা ‘এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী।’

অন্যদিকে প্রাক্-পলাশি ঘটনাবলীর বর্ণনায় সিরাজের প্রতি গোলাম হোসেনের বিরূপ মনোভাব অত্যন্ত পরিষ্কার। বিন্দুমাত্র বিচার বিশ্লেষণ না করেই তিনি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন মন্তব্য করেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে বিবাদ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আমরা সবিশেষ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি যে সিরাজের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।১১ অবশ্য সিরাজের বিরুদ্ধে গোলাম হোসেনের আক্রোশ সম্পূর্ণ অমূলক নয়। তাঁর ইংরেজ-প্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নবাব তাঁকে সপরিবারে বাংলা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।১২ গোলাম হোসেনই শওকত জঙ্গকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করার আগে কিছুটা সময় নিতে এবং বর্ষার পর ইংরেজদের সঙ্গে জোট বেঁধে এ-ব্যাপারে অগ্রসর হতে কারণ শোনা যাচ্ছে যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযান করতে চায়।’১৩

শুধু তাই নয়, সিরাজদ্দৌল্লাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে তিনি অযৌক্তিকভাবে এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য সিরাজই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। তিনি লিখেছেন যে ‘নবাব কারও পরামর্শ গ্রহণ করতেন না কিংবা কারও মতামতও জানতে চাইতেন না। তা না হলে তাঁর ছোটখাটো মন্ত্রী এবং সেনাপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে অতি অল্প কথায় এ বিরোধের [ইংরেজদের সঙ্গে] নিষ্পত্তি করা যেত, যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই হত না’।১৪ কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, গোলাম হোসেন নিজেই পরে তাঁর ওপরের বক্তব্যের ঠিক উল্টোটাই লিখেছেন যে নবাব তাঁর সভাসদদের সঙ্গে কী করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করেন এবং বিশদ আলাপ আলোচনার পর দরবারের প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মতামত অনুযায়ী তাঁর কর্মপন্থা স্থির করেন।১৫ তা ছাড়া গোলাম হোসেনের বক্তব্য, কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব ইংরেজদের বাংলা থেকে বহিষ্কার করা স্থির করেই কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন।১৬ এটা যে সম্পূর্ণ অসত্য তা শুধু নয়, এতে নবাবের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে তাঁর ইংরেজ-প্রীতি এবং সিরাজ-বিরোধী মনোভাবের আরও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যখন তিনি আলিনগরের চুক্তি ভেঙে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখেন:১৭

এই জাতি [ইংরেজ] কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না। সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না।… অবশ্য এ-বিষয়ে আমার কাছে সঠিক কোনও তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব [শর্ত অনুযায়ী] টাকাপয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারণ দেরি করছিলেন।

এই উক্তি থেকে স্পষ্টতই লেখকের পক্ষপাতিত্ব বোঝা যায়। সিরাজের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ এত তীব্র ছিল যে নবাবের কাছ থেকে দয়ালু ব্যবহার পেয়েও সিরাজের নিন্দা করতে তাঁর এতটুকু বাধেনি। গোলাম হোসেনের ঘনিষ্ঠ পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরেও সিরাজদ্দৌল্লা মোহনলালকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন গোলাম হোসেন ও তাঁর পরিবারের কোনও অনিষ্ট হয়, তাঁদের যেন যথেষ্ট অর্থ সাহায্য ও অনুমতিপত্র দেওয়া হয়, তাঁরা যাতে ‘নির্বিঘ্নে এবং নিরাপদে’ চলে যেতে পারেন।১৮ কিন্তু কৃতজ্ঞতা দূরে থাকুক, গোলাম হোসেন সিরাজের এই সদয় ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাননি। সিরাজের বদান্যতায় বেনারস পৌঁছে তিনি তাঁর মামা ও ভাইদের সঙ্গে (তাঁদেরও কোনও ক্ষতি সিরাজ করেননি) সঙ্গে মিলিত হন। এ-প্রসঙ্গে তিনি পরে লেখেন যে তাঁরা ‘নবাবের মতো অত্যাচারীর হাত থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্তি’ পেয়েছিলেন।১৯ তিনি এমন অভিযোগও করেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠকে ‘সুন্নত’ (circumcision) করার ভয়ও দেখিয়েছিলেন।২০ এটা অত্যন্ত গুরুতর অপবাদ অথচ আশ্চর্যের কথা, সমসাময়িক কোনও ফারসি গ্রন্থে বা কোনও ইউরোপীয় বিবরণে এরকম কিছুর উল্লেখ বা ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

গোলাম হোসেন সলিমের রিয়াজ-উস্‌-সলাতিন প্রকাশিত হয় ১৭৮৬ সালে এবং এটি রচিত হয় তাঁর ইংরেজ ‘মনিব’ জর্জ উডনির (George Udni) নির্দেশে, যিনি ‘এই অধম ব্যক্তিকে’ ওই গ্রন্থ রচনা করতে ‘আদেশ’ দেন। সিয়রে-র গ্রন্থকারের মতো এই লেখকও ইংরেজদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এবং এজন্য সিরাজ তাঁকে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করেছিলেন।২১ ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন:২২

তারা [ইংরেজরা] কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে এমনই বদ্ধপরিকর যে নিজেদের প্রাণসংশয় করেও তাতে অবিচল থাকে। মিথ্যাবাদীকে তারা সমাজে বরদাস্ত করে না। তারা উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তা তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারটাই তাদের কাছে অজানা।

করম আলির মুজাফ্‌ফরনামা ১৭৭২ সালের পরে লেখা এবং বহু ভুলভ্রান্তিতে ভরা ও ইংরেজদের অনুকূলে সমান পক্ষপাতদুষ্ট। তিনি ঘোড়াঘাটের ফৌজদার ছিলেন কিন্তু সেখানে না থেকে বেশির ভাগ সময়ই পুর্ণিয়াতে কাটাতেন। শওকত জঙ্গের পতনের পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ঘোড়াঘাটের ফৌজদারি থেকে বিচ্যুত হন। সিরাজ তাঁকে পাটনাতে নির্বাসিত করেন। ইংরেজদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব ও তাদের চাটুকারিতা তাঁর নিম্নোক্ত মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ‘আল্লার ইচ্ছা যে ফরাসিরা [ইংরেজদের দ্বারা] বাংলা থেকে বিতাড়িত হোক।’২৩ এ ধরনের বক্তব্য বিচার করলে করম আলির বিবরণের যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যায়।

ইউরোপীয়দের মধ্যে জঁ ল’ ১৭৬৩ সালে তাঁর স্মৃতিকথা (Memoir) লেখেন। নিজের হতাশা ও বাংলা বিজয়ে ইংরেজদের কূটনৈতিক চালের মোকাবিলা করতে নিজের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি সমস্ত ঘটনার জন্য প্রধানত সিরাজদ্দৌল্লাকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়ন করার পর যখন সিরাজ মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন, জাঁ ল’ তখন তিক্তসুরে মন্তব্য করেন, ‘স্বৈরাচারী [নবাব] এখন [যুদ্ধে] জয়ী হয়ে ফিরে এসেছেন।’২৪ তিনি সিরাজ সম্বন্ধে এমনও লেখেন যে ‘এই মাথা গরম তরুণের রাজ্যশাসন করার কোনও ক্ষমতা নেই।’২৫ তাঁর বক্তব্য, ‘শওকত জঙ্গকে লোকে যতটা ভালবাসে, সিরাজকে ততটাই ঘৃণা করে’, ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতি। গোলাম হোসেন খানও এমন কথা বলার মতো অতটা বাড়াবাড়ি করেননি।২৬ সিরাজের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট বোঝা যায় যখন তিনি লেখেন, ‘সিরাজকে পদচ্যুত করার জন্য [পুর্ণিয়াতে] একটি যড়যন্ত্র হয়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়ায় তা সফল হতে পারেনি।’২৭ তাঁর বলার ভঙ্গিতে বোঝা যায় তিনি এতে স্পষ্টতই নিরাশ হয়েছিলেন। হয়তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি এমন কথা পর্যন্ত বলেছেন যে ‘ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করুক এটাই তিনি বিশেষ করে চান।’২৮ এইসব বক্তব্য থেকে সিরাজের প্রতি জাঁ ল’-র বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তা ছাড়া ল’-র বিবরণে অনেক ভুলভ্রান্তি ও বিকৃতি দেখা যায়। সিরাজ ‘ইউরোপীয়দের প্রবল ঘৃণা করতেন’—তাঁর এই মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।২৯ সিরাজ চন্দননগরের ফরাসি কুঠির প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানিয়েছিলেন যে, আহমদ শাহ আবদালির বাংলা আক্রমণের আশঙ্কায় তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি (আলিনগরের সন্ধি, ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) করতে হল। কিন্তু এ-ঘটনাকে বিকৃত করে জাঁ ল’ লিখেছেন যে ‘এটা নিজের [সিরাজের] কাপুরুষতাকে ঢাকা দেওয়ার অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।’৩০ অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ দরবারের চক্রান্তে তাঁকে সাহায্য না করার জন্য তিনি মোহনলালকে ‘পাজি, বদমায়েস’ আখ্যা দিচ্ছেন অথচ একই সঙ্গে স্বীকার করেছেন যে ‘একমাত্র মোহনলালই জগৎশেঠদের সঙ্গে পাল্লা দেবার সামর্থ্য রাখেন’ এবং আরও বলছেন যে ‘আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি [মোহনলাল] এই সংকটপূর্ণ সময়ে কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ।’৩১ সর্বোপরি, তাঁর মন্তব্য, মীরজাফর ‘সাহসী ও অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি’ সত্যি তো নয়ই, বরঞ্চ ফারসি ঐতিহাসিকদের বিবরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।

এভাবে ব্যাখ্যা করে দেখা যায় লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের বক্তব্যও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। সিরাজদ্দৌল্লা ‘কলকাতায়, ইংরেজদের আক্রমণ করে অত্যন্ত অবিচার ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছেন’ বলে তাঁর যে উক্তি তা সিরাজ-বিরোধী মনোভাবেরই পরিচায়ক এবং এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।৩২ স্ক্র্যাফ্‌টন যেহেতু পলাশি চক্রান্তের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন এবং মুর্শিদাবাদে এই ষড়যন্ত্রের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম, তাই এটা স্বাভাবিক যে তিনি নবাবকে ‘ভিলেন’ প্রতিপন্ন করে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন।

যাই হোক, আমাদের আলোচ্য আকরগ্রন্থ ও সূত্রগুলিতে ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেলেও তরুণ বয়সে সিরাজদ্দৌল্লা যে নিষ্ঠুর, অত্যাচারী ও বেপরোয়া মানুষ ছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এই চরিত্র কি নবাব হওয়ার আগের? এবং এই প্রসঙ্গে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সংঘাতের বা পলাশি যুদ্ধের আগেকার ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গেলে নবাব হওয়ার আগেকার সিরাজ চরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ বিচার করা কি সত্যিই প্রয়োজনীয় বা প্রাসঙ্গিক? কেউ যদি তর্কের খাতিরে বলেন যে তা প্রয়োজন, তা হলে মনে রাখা দরকার বাংলার প্রায় সব নবাবই নির্মম, অত্যাচারী ও দুশ্চরিত্র ছিলেন। মুর্শিদকুলি খানের নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীন স্বভাব প্রবাদস্বরূপ ছিল। সুজাউদ্দিন ও সরফরাজ দু’জনেই দুশ্চরিত্র ও নির্দয় ছিলেন। মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার সব নবাবই স্বৈরাচারী ছিলেন। তা যদি হয়, তা হলে শুধু সিরাজের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ কেন? সেটা ইংরেজ বিজয়কে যৌক্তিক সমর্থন দেওয়ার জন্যই কি?

এখানে এটা পরিষ্কার করে বলা দরকার যে নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সম্বন্ধে এখানে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে না। জরুরি প্রশ্ন হল: নবাব হওয়ার পরেও কি তাঁর স্বভাবচরিত্র ও ব্যবহার একইরকম ছিল? লক্ষণীয় ব্যাপার হল সিরাজচরিত্রের ‘অন্ধকার দিক’ সব বিবরণেই তাঁর নবাব হওয়ার আগেকার ঘটনা সম্বন্ধে। নবাব হওয়ার পর সিরাজচরিত্রের নিন্দাসূচক কোনও প্রত্যক্ষ তথ্য বা নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই যে আলিবর্দির মৃত্যুর পরে মসনদে বসার পর সিরাজের স্বভাবচরিত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল।

এটা নাটকীয় মনে হলেও এমন পরিবর্তন যে সম্ভব এবং অনেকে তা আশা করেছিল সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং জাঁ ল’। তিনি স্পষ্ট বলছেন যে সিরাজের যে-চরিত্র তিনি এঁকেছেন, তা হল ‘আলিবর্দি খানের মত্যর আগের’। তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ: ‘সব লোক খুশি মনে বলে যে তিনি [সিরাজদ্দৌল্লা] একদিন [নবাব হওয়ার পরে?] ভাল লোক হয়ে যাবেন।’ তাঁর নিজেরও এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ ছিল যেজন্য তিনি লিখছেন: ‘[ঢাকার] তরুণ নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান৩৩ সিরাজের চেয়ে কম বদলোক ছিলেন না কিন্তু পরে তিনি সবার চোখের মণি হয়ে ওঠেন।’৩৪

আলিবর্দির মৃত্যুর পরে সিরাজদ্দৌল্লা রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর ব্যবহার ও আচার আচরণ কেমন ছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রথমে, তিনি নবাব হয়েই যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হলেন, সেগুলির তিনি কীভাবে সম্মুখীন হলেন? বিশেষত তাঁর দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও মসনদের দাবিদার ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা তিনি কীভাবে করলেন? তাঁর সুবিদিত বেপরোয়া স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি কি অদূরদর্শিতা বা অপরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন? এ সবেরই উত্তর না, এ ধরনের কিছুই তিনি করেননি। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সমঝোতা করতে তিনি এমন কূটনৈতিক চাল দিয়েছিলেন যে, তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎ-জঙ্গী-র লেখক ইউসুফ আলি খান তার তারিফ না করে পারেননি৷ উক্ত লেখক এই মর্মে লিখেছেন যে, বহুলোক যারা আগে ঘসেটি বেগমকে সমর্থন করত, তারা সিরাজের ‘আপোসমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে’ বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।৩৫ শওকত জঙ্গ অবশ্য আরও অনেক শক্তিশালী ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নিজের তখত্ বজায় রাখতে সিরাজ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হন ও তাঁকে পর্যুদস্ত করেন।

কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসের (William Watts) ভাষা প্রয়োগ করে বলা যায় যে সিরাজ ছিলেন ‘ঐশ্বৰ্য্য ও শক্তির গর্বে মত্ত’ এক যুবক। কিন্তু তাঁর পনেরো মাস রাজত্বকালে তাঁর অপরিণত বুদ্ধি, পাগলামি বা নির্দয় ব্যবহারের কোনও নজির নেই। কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তাঁর আচরণ ও তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কে প্রথমে তিনি অস্ত্রধারণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে কূটনৈতিক চালের আশ্রয় নেন। পরে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হলে কূটনীতির সঙ্গে কাশিমবাজারে ইংরেজ কুঠির বিরুদ্ধে অভিযান করে শক্তি প্রদর্শন করেন। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন ও তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই তাদের সঙ্গে ব্যবহারে বা সম্পর্কে সিরাজ কখনও বদমেজাজ বা চরম নিষ্ঠুরতা দেখাননি। তবে নবাব হিসেবে তিনি ইউরোপীয় সমেত সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন যে তিনিই ‘মনিব’ এবং কারও ঔদ্ধত্য তিনি সহ্য করবেন না। ওয়াটস বলছেন, নবাব হিসেবে তাঁর প্রত্যাশা ও দাবি যে, সবাই তাঁর আজ্ঞা বা আদেশ যথারীতি পালন করবে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যে তরুণের বিরুদ্ধে ‘উগ্রমেজাজ ও চরম নিষ্ঠুরতার’ অভিযোগ প্রায় সব বিবরণেই দেখা যায়, কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির পতনের পর নবাব হিসেবে তিনি ইংরেজদের প্রতি ব্যবহারে ‘বদান্যতা ও মানবিকতার’ পরিচয় দিয়েছিলেন।৩৬ ইংরেজদের সম্পূর্ণ অসহায় পেয়েও কোনও লুঠতরাজ, হত্যা বা নিষ্ঠুরতার আশ্রয় কিন্তু সিরাজ নেননি।

লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো ব্যক্তির কাছ থেকেও এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নবাব হওয়ার পরে সিরাজচরিত্রে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। যদিও স্ক্র্যাফ্‌টন প্রথমে সিরাজকে ‘অতিরিক্ত পানাসক্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন, পরে অবশ্য তিনি নিজেই তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংযোজন করেন যে, আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় কোরাণ ছুঁয়ে সিরাজ শপথ করেন যে তিনি ‘জীবনে আর কোনওদিন মদ্যস্পর্শ করবেন না’ এবং সেই শপথ তিনি ‘অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।’৩৭ এটা খুবই অর্থবহ কারণ যে-যুবক অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিল সে যে এত সহজে দীর্ঘদিনের বদ-অভ্যাস পরিত্যাগ করতে পারল এবং মৃত্যুপথযাত্রী মাতামহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আজীবন রক্ষা করেছে, তার পক্ষে ইচ্ছে করলে নিজের স্বভাবচরিত্র সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারা অত্যাশ্চর্য কিছু নয়। এই কারণে মনে হয় নবাব হওয়ার আগে সিরাজের চরিত্র যেমনই থাকুক না কেন, রাজ্যভার গ্রহণ করার পর তাঁর চরিত্রে পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।

এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার, যেটা আমরা আগেও বলার চেষ্টা করেছি, যে সিরাজচরিত্রের (নবাব হওয়ার আগে বা পরে) দোষগুণ বিচার করা মোটেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য, এ-বিষয়ে যে-সব ঐতিহাসিক তথ্য ও সূত্রের ওপর নির্ভর করা হয়, সেগুলির পক্ষপাতদুষ্ট ধারণা, তাদের স্ববিরোধ ও উদ্দেশ্যমূলক বিকৃতি দৃষ্টিগোচরে আনা এবং সেগুলির বিচার-বিশ্লেষণ করা। আমাদের প্রচেষ্টা, যে তথ্যগুলির ওপর ভিত্তি করে সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখানো হয়, এবং ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত, মুর্শিদাবাদ দরবারের শক্তিশালী গোষ্ঠীর মধ্যে নবাবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও বিরূপতা এবং শেষ পর্যন্ত পলাশির পরিণতি (ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য মূলত সিরাজকেই দায়ী করা হয়), সে-সব তথ্যগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা কতদূর তা যাচাই করা। যে বক্তব্যের ওপর আমরা জোর দিয়েছি, তা হল নবাব হওয়ার আগে সিরাজচরিত্র যতই দাম্ভিক, অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল হোক না কেন, নবাবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর সে স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। দয়ামায়াহীন উগ্র স্বভাব বা পাগলামির কোনও লক্ষণ কিন্তু তখনকার আচরণে পাওয়া যায় না। নবাব হিসেবে সিরাজদ্দৌল্লা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধীদল এমনকী ইউরোপীয়দের প্রতিও কোনও নির্মম অত্যাচার করেননি বা উগ্র মেজাজ দেখাননি। অবশ্য নবাবি ক্ষমতা পেয়ে কিছুটা উদ্ধত ও মেজাজি ভাব তাঁর মধ্যে দেখা গেছে। অর্থাৎ সিরাজের দোষত্রুটি ছিল ঠিকই। প্রধান দোষ, দৃঢ় সিদ্ধান্তের অভাব, অস্থিরমতি ও সংকট মুহূর্তে দিশাহারা অবস্থা। তবে মনে রাখা দরকার, তখনও তিনি মাত্র ২৩-২৪ বছরের যুবক। যথেষ্ট পরিণতবুদ্ধি নন এবং তার ওপর ক্ষমতা ও পদগর্বে গরীয়ান। বিভিন্ন শত্রুকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাওয়াটাই তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছিল। তারা যাতে একজোট হয়ে তাঁর বিরোধিতা করতে না পারে সেই অত্যাবশ্যক সাবধানতা তিনি অবলম্বন করেননি। এই অক্ষমতা ও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত স্থির সংকল্পের অভাব তাঁর পতন ডেকে এনেছিল।

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৯, ১০১, ১২১-২২, ১৮৭-৮৯, ২২০।

২. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩।

৩. Jean Law’s Memoir, Hill, vol. 3, p. 162.

৪. Luke Scrafton, Reflections, pp. 53, 55, 103.

৫. K. K. Datta, Sirajuddaullah, p.1.

৬. সিয়র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৮৩; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৪৩(খ), কে. কে. দত্ত-র সিরাজদ্দৌল্লা-তে উদ্ধৃত।

৭. ঐ, পৃ. ১-২।

৮. ঐ, পৃ. ৩-৪।

৯. অধুনা অনেক লেখাতেও সিরাজদ্দৌল্লাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেমন রজতকান্ত রায়, পলাশীর ষড়যন্ত্র ‘Colonial Penetration’ in Indian Historical Review, 12 (July 1985-Jan. 1986); পিটার মার্শাল (East Indian Fortunes; Bengal: the British Bridgehead)। অবশ্য মার্শাল সিরাজকে ঠিক ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখাননি এবং তিনি সিরাজের প্রতি রজতকান্ত রায়ের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল। তবে তিনিও সিরাজের কিছুটা দোষ ধরেছেন যখন বলছেন যে (অযৌক্তিকভাবে) ‘সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ফলেই কোম্পানির সঙ্গে নবাবের সম্পর্কে ধস [avalanche] নামে।’ East Indian Fortunes, p. 256.

১০. J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, PP. 10-11, 70-71,91.

১১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৬৩ এবং এই বইয়ের ৪র্থ অধ্যায়।

১২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫৫; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs , p. 64.

১৩. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৪।

১৪. ঐ, পৃ. ১৮৮।

১৫. ঐ, পৃ. ১৮৮-৮৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬৩-৬৪।

১৬.সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২১।

১৭. ঐ, পৃ. ২২৯।

১৮. ঐ, পৃ. ২১৫।

১৯. ঐ, পৃ. ২১৭।

২০. ঐ, পৃ. ২২৫।

২১. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৪, পাদটীকা ২।

২২. ঐ, পৃ. ৪১৪।

২৩. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ১০, ৬০, ৭০, ৭৩।

২৪. Hill, Bengal, III, p. 172.

২৫. ঐ, পৃ. ১৭৩।

২৬. ঐ।

২৭. ঐ, পৃ. ১৭৪।

২৮. ঐ, পৃ. ১৭৭।

২৯. ঐ, পৃ. ১৭৮।

৩০. ঐ, পৃ. ১৮৩।

৩১. ঐ, পৃ. ১৯০।

৩২. Luke Scrafton, Reflections, p. 102. এ-প্রসঙ্গে এই বইয়ের পঞ্চম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

৩৩. হাজি আহমেদের পুত্র, ঘসেটি বেগমের স্বামী, ঢাকার নবাব।

৩৪. Jean Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.

৩৫. ইউসুফ আলি খান, তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮।

৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 57.

৩৭. Luke Scrafton, Reflections, p. 55.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *