২. সার্ভেরো ছোট দুর্গ

ছয়

ওদিকে কর্নেলিয়া কেমন আছে?

সার্ভেরো ছোট দুর্গ। কিন্তু তাতেও আর সব দুর্গের মত একটা কয়েদখানা রয়েছে। কয়েদখানা থাকে বাহির মহলে, পুরুষ অপরাধীদের আটকে রাখার জন্যে। কোন অভিজাত বংশের নারীকে সেখানে ঘণ্টাখানেকের জন্যেও আটকে রাখার কথা ভাবতে পারেন না দুর্গপ্রধান।

ম্যাজেন্টো অচেতন কর্নেলিয়া ও নিহত কোয়ামোদোকে একসঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

তার স্ত্রী ডেলভিনা, অর্থাৎ কোয়ামোদোর মা পুত্রশোকে কাতর। কর্নেলিয়ার দিকে নজরই দিলেন না তিনি। পুত্রের লাশ সামনে নিয়ে কেবলই আহাজারি করতে লাগলেন দুঃখিনী মা।

ওরে আমার সোনামানিক, ওরে আমার বাপধন, তুই আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেলি!

এদিকে, ম্যাজেন্টোর হাতে সময় নেই। তিনি কর্নেলিয়ার দিকে স্ত্রীর দৃষ্টি ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন।

ডিউক অর্লিয়াঁর চিঠিটা তিনি কোয়ামোদোর লাশের পাশে বসেই পড়ে নিয়েছিলেন।

ম্যাজেন্টোর মাথায় তার পর থেকে কেবল একটি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে।

স্পেন দেশটা কি তাহলে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে? আর যে পারছে সে এক একটা টুকরো দখল করে নিচ্ছে, এবং সেটা তার হয়ে যাচ্ছে?

এই লুটপাটের মেলায় ম্যাজেন্টো গরহাজির থাকবেন কেন? সামান্য গাফিলতি করলেই যেখানে তাকে ফাঁকিতে পড়তে হবে।

না, ফাঁকিতে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। বড় ছেলে জ্যাভেদোকে ডাকলেন তিনি।

এল সে। সংক্ষেপে তাকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিলেন ম্যাজেন্টো।

তোমার ভাই গোয়ার্তুমি করতে গিয়ে মারা পড়েছে, বললেন তিনি। ওর যে এরকম একটা কিছু হবে তা সবাই জানত। হাজারবার সাবধান করেছি, শোনেনি।

যাকগে, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ও যা-ই করুক না কেন ও এই পরিবারের ছেলে। গির্জায় নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে ওকে কবর দিয়ো।

আর এই যে মেয়েটিকে দেখছ এ হোসে ফার্ডিনান্ডের মেয়ে। আমাদের শত্রু, আলমাঞ্জা দুর্গের মালিক।

আমাকে এখুনি রিজেন্টের সাথে দেখা করতে রওনা হতে হবে। আমার হাতে সময় বড় কম।

তুমি ডাক্তার পিডুকে ডাকিয়ে এনে মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করো।

বুঝতেই পারছ, এই মেয়ে আমাদের হাতে থাকা মানে আলমাঞ্জার বিরুদ্ধে তুরুপের তাস হাতে থাকা। প্রয়োজনে দর কষাকষি করা যাবে।

এরপর ম্যাজেন্টো সসৈন্যে হৈ-হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়েন।

ডেলভিনা তখনও ছেলের জন্যে আহাজারি করে চলেছেন।

মাকে বিরক্ত করল না জ্যাভেদো। ডেকে পাঠাল হাউজকীপার ফ্রাউ জেসমিনাকে।

ফ্রাউ জেসমিনার বয়স চল্লিশের মত। ভারিক্কি চাল-চলন, এবাড়িতে তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। গৃহস্থালী কাজের জন্যে সবাই তার ওপরই ভরসা করে থাকে।

জ্যাভেদো মহিলাকে নিয়ে গেল যেখানে কর্নেলিয়া একটা কম্বলের ওপরে অব্যক্ত যাতনায় গড়াগড়ি করছে। অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয় তার। এই চেতনা ফিরে পাচ্ছে তো এই আবার হারাচ্ছে।

আল্লা, আমাকে বাঁচাও, যখনই জ্ঞান ফিরছে আর্তস্বরে ককিয়ে উঠছে। রীতিমত শোকাবহ পরিবেশ।

ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ওরা দুজনেই, জেসমিনা এ অবস্থা দেখেও বিচলিত হলো না। সে একবার কেবল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জ্যাভেদোর দিকে।

একে কি শুশ্রূষা করতে হবে? এটুকুই জানতে চাইল শুধু।

হ্যাঁ। সেবা-যত্ন দিয়ে সারিয়ে তুলতে হবে। সে সঙ্গে এটাও দেখতে হবে ইনি যেন বাইরে যেতে না পারেন বা বাইরের কোন লোক এঁর সঙ্গে দেখা করতে না পারে।

বেশ, বলে বেরিয়ে গেল জেসমিনা।

একটু পরে দুজন শক্তসমর্থ কাজের মেয়েকে নিয়ে ফিরে এল।

এঁকে আড়াইতলায় তুলে নিয়ে যাও, নির্দেশ দিল।

আড়াইতলায় দুখানা খালি কামরা আছে।

যাওয়ার আগে জ্যাভেদোকে বলে গেল, ডাক্তার পিডুকে এখুনি ডাকানো দরকার।

জ্যাভেদো মাথা নেড়ে সায় জানাল।

ডাকতে পাঠিয়ে দিয়েছি, বলল।

জেসমিনার ওপর কর্নেলিয়ার দায়িত্ব সঁপে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ও। মার ওপর যতখানি পারে না, তার চাইতে বেশি আস্থা রাখে সে জেসমিনার ওপরে। মা সহজেই ভেঙে পড়েন, কিন্তু ওদের এই হাউজকীপারটি নয়।

যাক, কর্নেলিয়ার ঝামেলাটা গেল। এখন কোয়ামোদোর সকারের ব্যবস্থা। সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

প্রথমে পাদ্রী আলফঞ্জোকে ডাকতে হবে। তারপর মুর্দাফরাসদের।

পাদ্রী দফায়-দফায় মোনাজাত করবেন, আর মুদাফরাসরা পেরেক ঠুকে-ঠুকে লাশটাকে কফিনবন্দী করবে।

সব রীতি মানতে গেলে অবশ্য ঝামেলা আরও রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম কাজটাই হলো শেরিফকে খবর দেয়া। দাঙ্গা-হাঙ্গামা কিংবা ডুয়েলে কেউ মার পড়লে শেরিফকে জানানো হয় এবং তাকে তদন্তের একটা সুযোগ দিতে হয়।

ওসব অবশ্য সাধারণ মানুষদের জন্যে। কেল্লাদারদের মত অভিজাতরা ওস পরোয়া করেন না।

প্রস্তুতিতে চলে গেল সারাটা দিন। পরদিন বিকেলে দাফন করা হলে কোয়ামোদোকে। এতবড় একটা শোকাবহ ঘটনা ঘটে গেল সার্ভেরোর দুর্গস্বামী অনুপস্থিতিতে।

জ্যাভেদো অবশ্য চমৎকার দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে গোটা ব্যাপারটা বাবার অভাব টের পেতে দেয়নি এতটুকু। কেউ বলতে পারবে না কোন কাজে সামান্যতম ক্রটি হয়েছে।

সার্ভেয়োর প্রতিবেশী বেলশাজার, কুরকোভা, ময়নিহান, ফৈজিয়ানা দুর্গপ্রধানরা যোগ দিয়েছেন শেষকৃত্যে।. এছাড়াও বেশ কজন ভদ্রস্থানীয় খামা মালিক আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।

অভ্যাগতদের মুখের চেহারায় শোকার্তভাব দেখা গেলেও মনে-মনে কি সবাই ভঁরা উদাসীন। কোয়ামোদোর আকস্মিক মৃত্যুতে অনেকে আবার আনন্দিতও বটে, বেঁচে থাকতে ছোঁড়াটা তো আর কম জ্বালায়নি তাদের।

দেশাচার অনুযায়ী এসব ভদ্রলোকদের বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল কোয়ামোদোর। সে সুযোগ না দিলে অভদ্রতা করা হত সার্ভেরো পরিবারের সঙ্গে। আর তার পরিণাম হয়তো গড়াত ডুয়েল কিংবা ভেনডেটা পর্যন্ত।

সুতরাং, কোয়ামাদো সবার বাসায় অবাধে যেত এবং অশান্তি ডেকে আনত। আলমাঞ্জায় ইদানীং যে অশান্তিটা সে শুরু করেছিল তেমনি ধরনেরই। তফাত শুধু এটুকুই, আলমাঞ্জার ঘটনাটার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। ওই বেয়াড়া ছোকরাটা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে কার যে কী সর্বনাশ করত আল্লাই জানেন।

যাহোক, আমন্ত্রিতরা সমাধিপ্রাঙ্গণে নীরবে দাঁড়িয়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠান দেখলেন। সবাই কবরে এক মুঠো করে মাটি ফেলে অনুষ্ঠানে অংশ নিলেন। তারপর জ্যাভেদো ও ডেলভিনার সঙ্গে চলে এলেন সার্ভেরোতে! এখন খানাপিনার আয়োজন থাকবে, এটাই নিয়ম।

খানাপিনা চলছে এসময় অপ্রত্যাশিত এক কাণ্ড করে বসলেন ডেলভিনা।

তুই ভেনডেটা ঘোষণা করছিস তো? সবাইকে শুনিয়ে জ্যাভেদোকে প্রশ্ন করলেন তিনি।

জ্যাভেদো হতবিহ্বল। গোলমালটা যে কোয়ামোদো শুরু করেছিল তাতে তো কারও দ্বিমত নেই। প্রত্যক্ষ প্রমাণও উপস্থিত রয়েছে তাদের দুর্গের মধ্যে। হোসে ফার্ডিনান্ডের মেয়ে এমুহূর্তে অসুস্থ অবস্থায় বন্দিনী।

হোসে ফার্ডিনান্ডের মেয়েকে অপহরণ করতে গিয়ে অন্যায় কাজ করেছে। কোয়ামোদো। সে যদি অপরাধ করতে গিয়ে মারা পড়ে তবে তার আত্মীয়-বন্ধুরা ভেনডেটা ঘোষণা করতে যাবে কেন?

ভেনডেটা ঘোষণা করবে যার উপর অন্যায় করা হয়েছে সে, অন্যায়কারী তো নয়।

জ্যাভেদো যা-ই ভাবুক না কেন, উসকে দেয়ার লোকের অভাব হলো না ভোজসভার টেবিলে।

অনেকেই কণ্ঠ মেলাল ডেলভিনার সঙ্গে। ওদের কি? আশপাশে ভেনডেটা চালু থাকলে ওরা একটা উত্তেজনার খোরাক পাবে, এটুকুই ওদের লাভ। দুটি পরিবারে বিবাদ লাগলে লাগুক না, ওদের গায়ে তো আঁচড়টিও পড়ছে না। দূর থেকে মজা লুটতে ক্ষতি কি?

ভেনডেটা চালু হলে আজ মরবে হোসে ফার্ডিনান্ড, তো কাল আবার ম্যাজেন্টো চলতে থাকবে পাল্টাপাল্টি খুন-খারাপি।

গৃহস্থ ঘরে ভেনডেটা শুরু হলে সম্ভাবনা থাকে একটা বংশ একদিন না একদিন নির্বংশ হয়ে যাবে; তখন বন্ধ হবে ভেনডেটা। কিন্তু দুর্গস্বামী কিংবা জমিদারদের ব্যাপারটা তা নয়। বংশগত ভেনডেটা একসময় চেপে বসে দুর্গের বা ভূখণ্ডের নতুন মালিকের ওপর। সম্পত্তির মত ভেনডেটাও হাতবদল হয়! সম্পদ ভোগ করব, অথচ রক্তের ঋণ শোধ করব না তা চলবে না।

কাজেই কুরকুণ্ডা, ময়নিহান, বেলশাজার, ফৈজিয়ানার ব্যারনরা তো উৎসাহিত হবেনই। শোকানুষ্ঠানের কথা ভুলে তারা সশব্দে টেবিল চাপড়াতে লাগলেন।

অবশ্যই ভেনডেটা ঘোষণা করা উচিত, চেঁচিয়ে উঠলেন কয়েকজন। মানী লোক ভাই হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে পারে?

জ্যাভেদো অন্যরকম ছেলে। সে ছোট ভাই কোয়ামোদোর মত বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল তো নয়ই, এমনকি বাবা ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোর মত স্বার্থান্বেষী, সংকীর্ণমনাও নয়। লোকে তার কাছ থেকে উদার, ন্যায়নিষ্ঠ, বীরোচিত আচরণ পেয়ে অভ্যস্ত। তার এ ধরনের চরিত্র অবশ্য ঘনিষ্ঠজনদের কাছে এক জটিল বহ। বাপ-ভাই কারও সাথেই ওর কণামাত্র মিল নেই।

ম্যাজেন্টো তাকে খানিকটা বিশ্বাস করেন, আর কোয়ামেদে কত অশদ্ধ

মায়ের আকস্মিক প্রশ্নটা বিচলিত করে তুলল জ্যাভেদোকে। ও বুঝতে পেরেছে মা আসলে প্রশ্ন করেননি, পরোক্ষভাবে ওকে ভেনডেটা ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছেন।

জ্যাভেদো বিব্রত বোধ করেছে অতিথিদের টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগাতে দেখে। মা একান্তে ওর কাছে কথাটা তুললে ও বুঝিয়ে বলতে পারত, হাজারটা যুক্তি দেখাতে পারত ভেনডেটার বিরুদ্ধে। কিন্ত এই লোক সমাবেশে মায়ের সঙ্গে তর্ক করা যায় না। তারপরও জবাব তো কিছু না কিছু দিতেই হবে।

ও ব্যাপারে তো আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, মা, শান্ত গলায় জবাব দিল ও। বাবা আগে ফিরুন, তিনি যা বলবেন তাই হবে।

মা সহ অভ্যাগতদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় যেন পানি ঢেলে দেয়া হলো। কমবয়সী যুবক, আবেগের বশে সায় দিয়ে বসবে তাঁদের কথায়-এমনটাই আশা করেছিলেন ব্যারন মহোদয়রা। তারা এবারে হতাশ হয়ে পড়লেন। ডেলভিনাও কি হতাশ হননি? তবে জ্যাভেদো বাবাকে ভক্তি করে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে খুশিও হলেন।

আমার ছেলে কেমন বাধ্য দেখো তোমরা, সবার দিকে চেয়ে নীরবে যেন তিনি ছেলের গুণকীর্তন করতে লাগলেন।

অতিথিরা একে একে বিদায় নিলেন। তবে যাওয়ার সময়ও রসাল আলোচনাটা জারি রাখলেন তারা।

বাপের মতামতের দাম অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে ভেনডেটার দায়িত্ব তো বুড়ো বাপের কাঁধে চাপালে চলবে না, যুবক ছেলেকেই দায়িত্বটা নিতে হবে। বরাবর তাই হয়ে এসেছে কিনা।

.

ওদিকে, কর্নেলিয়া যে বারবার জ্ঞান হারিয়েছে তা কোন দৈহিক আঘাতের কারণে নয়। লাগাতর আকস্মিক বিপদের ফলে তার মগজের ওপর সাঘাতিক চাপ পড়েছিল। ও সেটা সইতে পারেনি। পারবে কি করে, এধরনের পরিস্থিতিতে তো আগে কখনও পড়তে হয়নি তাকে।

একবার করে চাপ সামলে ওঠে, কিন্তু তার পরপরই আবার আরেকটা আঘাত আসে। মোট কথা চূড়ান্ত স্নায়বিক-মানসিক অবসাদে ভুগছে সে।

ডাক্তার পিড্রু অতি বিখ্যাত তেমন কেউ নন। তবে বয়স্ক, অভিজ্ঞ লোক। ভদ্রলোক এসে কর্নেলিয়ার পাশে বসতে না বসতেই কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ঘরে তারা ছাড়া তখন কেবল জেসমিনা। ডেলভিনা কোয়ামোদোর জন্যে কান্নাকাটি করছেন, আর জ্যাভেদো শালীনতাবোধবশত রোগীর ঘরে অনুপস্থিত।

ডাক্তারের চাঞ্চল্য দৃষ্টি এড়ায়নি জেসমিনার।

কি ব্যাপার, ডাক্তার সাহেব? প্রশ্ন করল সে।

একে আগে কোথায় যেন দেখেছি।

কর্নেলিয়ার পরিচয় তখনও জানে না জেসমিনা। জানা থাকলে জানিয়ে দিতে পারত ডাক্তারকে।

সিনর পিড্রু শুধু সার্ভেরোরই নন, আলমাঞ্জারও ডাক্তার। সত্যি বলতে কি, সার্ভেনরাকে ঘিরে যদি পঞ্চাশ মাইলের একটি বৃত্ত রচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, পিড্রু সালামাঙ্কা ছাড়া এ অঞ্চলে আর কোন উল্লেখযোগ্য ডাক্তার নেই। ডজন খানেক হাতুড়ে আছে অবশ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। বড় ঘরে তাদের ডাকও পড়ে। তবে ডাক এলে তাদের ঢুকতে হয় পেছনের দরজা দিয়ে। হ্যাঁ, চাকর বাকর, আর আশ্রিতদের চিকিৎসা করার জন্যে। মালিকপক্ষের অসুখ-বিসুখ হলে পিড্রুই ভরসা। তখন সিংহ দরজা খুলে দেয়া হয় তার বেতো ঘোড়াটির সামনে। বৃদ্ধ ডাক্তার তার বেতো ঘোড়াটি ছাড়া আর কোন বাহনকে বিশ্বাস করেন না কিনা।

কর্নেলিয়ার পরিচয় জানা থাকলে জেসমিনা হয়তো সত্যি কথাটা বলে দিত তার বদলে সে বলল, দেখে থাকলে আশ্চর্য কি! আপনি তো রোজই কত জায়গায় যাচ্ছেন-আসছেন।…এখন ওকে কিভাবে সারিয়ে তোলা যায় দয়া করে সে ব্যবস্থা করুন।

ডাক্তার যন্ত্রপাতি লাগিয়ে পরীক্ষা করছেন তখন রোগীকে।

ও সাতদিনের মধ্যেই সেরে উঠবে, দেখে-টেখে বললেন। কোন অসুখ নেই ওর। ওষুধ চলুক, সঙ্গে ভাল খাওয়া-দাওয়া, ব্যস-চিন্তা নেই।

.

সাত

হোসে ফার্ডিনান্ডের দশা এখন খাঁচাবন্দী সিংহের মত। কখনও খামোকা-খামোকা ছুটোছুটি করছেন, কখনও চেঁচামেচি করছেন, কখনওবা আবার গুম হয়ে বসে থাকছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পুরুষ মানুষ, শক্ত মন। নারীর মত অঝোরে খানিকটা কান্নাকাটি যদি করতে পারতেন, বুকটা হালকা হত। কিন্তু তা আর পারছেন কই?

মাঝে মাঝে তীব্র অনুশোচনায় পুড়ছেন তিনি। মেয়েকে তার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে চলে গেল, কিছুই করতে পারলেন না তিনি। করতে গেলে নিহত কিংবা বন্দী হতে পারতেন। এখন মনে হচ্ছে সে-ও ভাল হত। তার বদলে তিনি কিনা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এলেন? কেন তিনি আত্মদান করলেন না মেয়েকে উদ্ধার করতে গিয়ে? এই কলঙ্ক কি সারা জীবনেও ঘুচবে তার?

কখনও কখনও বিচার-বুদ্ধি তাকে মৃদু সান্ত্বনা দেয়।

মিথ্যে অনুশোচনা কোরো না। বেঁচে যখন আছ কর্নেলিয়াকে একদিন না একদিন উদ্ধার করতে পারবেই পারবে। তুমি গুলি খেয়ে মারা পড়লে লাভটা কি হত? কর্নেলিয়াকে উদ্ধার করার আশা যেমন ধূলিসাৎ হত, তেমনি অন্য কোন উত্তরাধিকার নেই বলে হাতছাড়া হয়ে যেত আলমাঞ্জা দুর্গ। সার্ভেরোর কেউ একজন জোর করে কর্নেলিয়াকে বিয়ে করে ভোগ-দখল করত আলমাঞ্জা দুর্গ। কাজেই, দুঃখ না করে মনটাকে শান্ত করো। জেনে রেখো, যা ঘটেছে এ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারত না।

এই সান্ত্বনা নিয়েই নিজেকে সামলে রেখেছেন হোসে ফার্ডিনান্ড। দুর্গরক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন যথাসম্ভব। চর মারফত রোজই খবর আসছে। মাদ্রিদ থেকে সৈন্য রওনা হয়েছে আলমাঞ্জা অভিমুখে। সেনাদলের নেতৃত্বে রয়েছেন সার্ভেরোর ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো, কেল্লাদার হিসেবে যাকে পাত্তাও দেন না হোসে ফার্ডিনান্ড।

সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আলমাঞ্জার। এমুহূর্তে আসন্ন বিপদের কথা মার্থায় রেখে স্বল্প সময়ের মধ্যে সেটিকে আরও জোরদার করা হয়েছে।

গুইশাম্পো এলেন আর দুর্গ জয় করে নিলেন ব্যাপারটা অত সহজ হবে না। গভীর পরিখা ঘিরে রেখেছে দুৰ্গটাকে। পরিখা পেরোবার একমাত্র উপায় লোহার ঝুলসেতু। তীরে দাঁড়িয়ে চাকা ঘোরাতে হয় ওটার। লোহার ভারী-ভারী শিকলে বাঁধা সেতুটা তখন ওপরে উঠে আসে।

রসদেরও অভাব নেই দুর্গে। ছয় মাসের খাবার মজুদ রয়েছে।

ম্যাজেন্টো কি দুর্গ অবরোধ করে ছয় মাস এখানে বসে থাকবেন? অসম্ভব। দাবার ছকে সামান্য বেড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন ম্যাজেন্টো। আসল খেলা চলবে ডিউক অর্লিয়াঁ ও রিজেন্ট ফ্রান্সিসের মধ্যে। ফ্রান্স থেকে এসে অর্নিয়া নিশ্চয়ই ছয় মাস হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন না। তিনি যে চাল চালবেন তার ওপরই নির্ভর করবে এ যুদ্ধের জয়-পরাজয়।

দুর্গপ্রাচীরের মাথায় দাঁড়িয়ে এ মুহূর্তে ফার্ডিনান্ড। দৃষ্টি তার সুদূর প্রসারিত। সামনে দুস্তর বালুকান্তার, তারই কোন এক জায়গায় শক্রশিবিরে বন্দী হয়ে আছে তার আদরের ধন কর্নেলিয়া। তাকে কি তিনি আর কোনদিন ফিরে পাবেন?

কর্নেলিয়া যদি তার কাছে থাকত তবে কোন কিছুকেই পরোয়া করতেন না ফার্ডিনান্ড। অবরুদ্ধ অবস্থাতেও হাসতে পারতেন তিনি। মনে মনে বিদ্রূপ করতেন ওই ম্যাজেন্টো গুইশাম্পোকে। কিন্তু হায়!

স্পেনের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে বলেই সমস্যাটা বেধেছে। তা নাহলে গুইশাম্পোর হাজারখানেক সৈনিকের বাহিনীকে মেরে তাড়াতে পারতেন ফার্ডিনান্ড। কিন্তু পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্পেনের রাজকীয় বাহিনীর দশ হাজার সৈনিক ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে রয়েছে গুইশারে। কাজেই, অর্লিয়াঁর কাছ থেকে যদ্দিন সাহায্য না আসছে সম্মুখ যুদ্ধ এড়াতে হবে ফার্ডিনান্ডকে।

অবরোধ কতদিন চলবে কে জানে। ততদিন সার্ভেনরাতে কি দশা হবে অসহায় কর্নেলিয়ার, এক বিধাতাই জানেন।

ভাবতে ভাবতে একসময় কপাল চাপড়াতে লাগলেন ফার্ডিনান্ড।

আর ঠিক সে মুহূর্তে তার কানে এল কার যেন সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর।

ব্যারন, আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে।

হোসে ফার্ডিনান্ড চেয়ে দেখেন কখন যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্লিয়াঁর সেই দূত, কর্নেলিয়াকে যে উদ্ধার করেছিল শত্রুদের কবল থেকে। শেষ অবধি কর্নেলিয়া আবারও অপহৃতা হয়েছে বটে, কিন্তু তার জন্যে এই অসমসাহসী যুবককে দায়ী করা যায় না। চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি সে। কিন্তু মারাত্মক আহত অবস্থায় বেচারা যুদ্ধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। কাজেই হোসে ফার্ডিনান্ড তার প্রতি বিরূপ তো ননই বরং কৃতজ্ঞ।

ফার্ডিনান্ডের কথায় মমতা ঝরে পড়ল।

আরে, আপনি উঠে এলেন কেন? বললেন ডাক্তার পিড্রু না আপনাকে এক সপ্তাহ নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন?

তা করেছেন, হাসিমুখে বলল সাভানা। কিন্তু তার পাঁচ দিন কেটে গেছে। দুটো দিন বিশ্রাম কম নিলে তেমন কোন ক্ষতি হবে না আমার তো বেশ সুস্থই মনে হচ্ছে নিজেকে।

যাক, অন্তত একটা সুসংবাদ শুনলাম আল্লাকে হাজারও শোকর আপনাকে সুস্থ করে তোলার জন্যে। আর আপনাকে ধন্যবাদ আমার অসহায় মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন বলে। আপনি যে সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তাতে আমার দৃষ্টিতে আপনি শার্লিমেনের নাইটদের চাইতে কোন অংশে কম নন।

আমার একটা প্রস্তাব ছিল, সামনাসামনি নিজের প্রশংসা শুনে বিব্রত বোধ করছে সাভানা।

নিশ্চয়ই, সোৎসাহে বলে উঠলেন ফার্ডিনান্ড। আপনার যে কোন প্রস্তাবই আমি মেনে নেব। শুধুমাত্র এখুনি এখান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তাবটা করবেন না। আপনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। তাছাড়া রিজেন্টের সেনাবাহিনী নিয়ে আলমাঞ্জার দিকেই আসছে ম্যাজেন্টো। রাস্তা-ঘাটে বিপদে পড়তে পারেন।

না, আমি চলে যাওয়ার কথা বলছি না। তবে একটু চলাফেরা করার অনুমতি চাইছি, বলল সাভানা। তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। রাখঢাক না করে বলেই ফেলি বরং। কৌশলে সিনোরিটা কর্নেলিয়াকে মুক্ত করে আনা যায় কিনা। একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।

কৌশলে মানে? থতমত খেয়ে গেলেন ফার্ডিনান্ড। লজ্জাও পেলেন। যে ভাবনাটা তার মাথায় আসা উচিত ছিল তা এসেছে কিনা ভিনদেশী এক যুবকের মাথায়।

ওর চেষ্টা সফল হোক বা না হোক, আন্তরিকতার যে পরিচয় পেলেন হোসে ফার্ডিনান্ড তাতেই যুবকের প্রতি তাঁর ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেল অনেকখানি।

আপনি তো জানেন, ডন পিড্রুই সার্ভেনরাতে কর্নেলিয়ার চিকিৎসা করছেন, সাভানা বলল।

তাই নাকি? আমি ওটা শুনিনি, আর কে চিকিৎসা করছে না করছে সে চিন্তা আমার মাথাতেও আসেনি। করতেই পারে। কেননা, গুইশাম্পোরা নিজেদের স্বার্থেই চাইবে কর্নেলিয়া বেঁচে থাকুক। আর সেজন্যে তাদের প্রয়োজন পড়বে ডাক্তার পিডুকে। এ অঞ্চলে সত্যিকার ডাক্তার তো ওই একজনই।

কথা তো ঠিকই। পিড্রু বলেছেন আমাকে, কারণ ম্যাজেন্টো এখন সার্ভেরোতে নেই বলেই তিনি দুজায়গায় একসঙ্গে আসা-যাওয়া করতে পারছেন। ব্যারন থাকলে নিশ্চয়ই চাইতেন না উনি কর্নেলিয়ার চিকিৎসাও করুন আবার আলমাঞ্জাতেও আসুন।

ব্যারনের বড় ছেলে জ্যাভেদো অবশ্য অন্যরকম মানুষ। তিনি সব এনেও কোন আপত্তি করেননি। তিনি বরং ডাক্তারকে বলেছেন, অসুস্থ লোকের চিকিৎসা করাই তো ডাক্তারদের কর্তব্য। যে-ই ডাকুক যেতে হবে। আগেকার আমলে যেমন নাইটরা ছিল। যে যেখানেই বিপদে পড়ুক না কেন নাইটরা ঠিক ছুটে যেত সাহায্য করতে।

সংশয় ফুটল ফার্ডিনাভের গলার সুরে।

জ্যাভেদো একথা বলেছে? গুইশাম্পো বংশে এমন ছেলেও জন্মেছে?

ডাক্তার নিজে আমাকে বলেছেন।

ও,… কিন্তু কি কৌশলের কথা যেন বলছিলেন তখন?

বুদ্ধিটা আজই আমার মাথায় এসেছে, ডাক্তার চলে যাওয়ার পর। উনি কদিন থাকছেন না এখানে। মাদ্রিদে যাচ্ছেন একটা চিকিৎসক সম্মেলনে যোগ দিতে। আজ এখান থেকেই রওনা হয়ে গেছেন, যেতে অন্তত পাঁচ-ছয় দিন তো লাগবেই। আসতেও ধরুন পাঁচ-ছয় দিন। উনি বললেন, এখানে আর কোন জরুরী রোগী নেই। সার্ভেয়োতে কর্নেলিয়া সুস্থ, এখানে আমিও চলেফিরে বেড়াচ্ছি। কাজেই, দুসপ্তাহ উনি না থাকলে রোগীদের কোন অসুবিধে হবে না।

উনি আলমাঞ্জা থেকেই মাদ্রিদ রওনা হয়ে গেলেন? অবশ্য ঠিকই আছে। ওঁর বাড়ি তো কুইলনে, উল্টো দিক হয়। খামোকা উল্টো দিকে বিশ মাইল যেতে যাবেন কোন দুঃখে!

উনিও সে কথাই বললেন। ভদ্রলোক সঙ্গে করে ভ্রমণের উপযোগী কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছিলেন। আমার ঘরে কাপড় পাল্টালেন। আর তার ক্লান্ত ঘোড়াটাকে রেখে গেছেন আপনার আস্তাবলে।

ঘোড়া রেখে গেছেন? তাহলে দুশো মাইল রাস্তা কি পায়ে হেঁটে পাড়ি দেবেন নাকি?

না, না, উনি আপনার আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে গেছেন। অবশ্য ডোনা অগাস্টাকে বলেই নিয়েছেন।

হোসে ফার্ডিনান্ড ক্রমেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছেন। ব্যাপারটা কি? পরপর এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা আগে কখনও ঘটেনি। যে ডাক্তার পিডুকে কুইলন থেকে আলমাঞ্জার মধ্যে ঘুরপাক খেতে দেখলেন সারাটা জীবন, তারই কিনা হঠাৎ করে মাদ্রিদ যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে গেল? এটা কিন্তু মস্তবড় ঘটনা।

এছাড়া আরও সন্দেহজনক ব্যাপার আছে। ভদ্রলোক বাসা থেকে পোশাক পাল্টে এলেন না, পাল্টালেন কিনা আলমাঞ্জায় এসে। বিদেশী সৈনিক সাভানার ঘরে তিনি তার পোশাক ছেড়ে গেলেন। অথচ ওই পোশাকটি পরেই বছরের পর বছর তিনি রোগী দেখে বেড়িয়েছেন মরুভূমি পাড়ি দিয়ে। ওটার কাপড়ের রং, বোতাম, এমনকি প্রত্যেকটা সেলাইয়ের ফোঁড় পর্যন্ত মুখস্থ এ অঞ্চলের প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ির লোকজনদের।

ভদ্রলোক তার প্রাণপ্রিয় বেততা ঘোড়াটিকে পর্যন্ত রেখে গেছেন। আর হোসে ফার্ডিনান্ডকে না বলে নিয়ে গেছেন তারই একটা তেজী ঘোড়া। ওটার পিঠে তিনি কতক্ষণ বসে থাকতে পারবেন এক বিধাতাই জানেন। ফার্ডিনান্ডের ঘোড়াগুলো সব কটাই মেজাজী, নতুন লোক সওয়ার হলে বড়জোর তিন মিনিট-তারপরই সোজা পপাত ধরণীতল।

আর ডোনা অগাস্টার ব্যাপারটিও কম রহস্যজনক নয়। তিনি কখনোই যা করেন না, আজ তাই করেছেন। স্বামীকে কিছুটি না জানিয়ে নিজ দায়িত্বে ঘোড়া দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার পিড্রুকে।

অনেকক্ষণ সাভানার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন হোসে ফার্ডিনান্ড। সাভানাকে কোন প্রশ্ন করার কথা তার মাথাতেই এল না।

শেষমেশ মুখ খুলতে হলো সাভানাকেই।

আমার সেই প্রস্তাবটা কি বলব এবার?

সংবিৎ ফিরে পেলেন যেন ফার্ডিনান্ড।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আমি এতক্ষণ আসলে ডাক্তার পিড্রুর কথাই ভাবছিলাম। ভদ্রলোক আমার ঘোড়া থেকে পড়ে ঘাড় ভেঙে মরেন কিনা আল্লা মালুম। তিনি হাড় জিরজিরে, বেতো ঘোড়ায় চড়ে অভ্যস্ত কিনা। তা কি বলছিলেন যেন?

ফার্ডিনান্ডকে পরিকল্পনাটা বোঝাতে দীর্ঘ সময় লাগল সাভানার। ফার্ডিনান্ড প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেন, তারপর আপত্তি করতে লাগলেন। কিন্তু শেষমেশ তার সমস্ত আপত্তি দূর হয়ে গেল সাভানার আত্মপ্রত্যয় দেখে।

কর্নেলিয়া আমার মেয়ে, বললেন তিনি, কিন্তু তারপরও এরকম একটা দুঃসাহসিক কাজে হাত দেয়ার কথা ভাবতে পারতাম না আমি। কাজটা দুঃসাহসিক, অথচ আপনাকে মন থেকে নিষেধও করতে পারছি না। বড় বেশি লোভ দেখাচ্ছেন আপনি। মেয়েকে ফিরে পাব, নিজের গায়ে টোকাটিও পড়বে না, এরচেয়ে বড় প্রলোভন আর কি হতে পারে? আপনি পারবেন। আপনি অন্য ধাতুতে গড়া। আমি ঝুঁকি নিই তখনই, যখন জয়লাভের সম্ভাবনা থাকে পঞ্চাশ পঞ্চাশ। আর আপনি তখনও ঝুঁকি নেন যখন পরাজয়ের সম্ভাবনাই একশো ভাগ। আমাদের মত লোকেদের নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়, আর আপনার মত লোককে নিয়ে লেখা হয় মহাকাব্য।

.

আট

ডাক্তার পিড্রুর আসা-যাওয়ার কোন ধরা-বাধা সময় নেই। কাজেই সন্ধ্যার পর তাকে সার্ভেনরাতে ঢুকতে দেখে অবাক হলো না কেউ। ঝুলসেতুর পাহারাদার সেলাম ঠুকল তাকে। ডাক্তারের বেতো ঘোড়া তার চেনা পথ ধরে খটমট শব্দ তুলে সেতু পেরোল। আস্তাবলটা বাঁ পাশে। আস্তাবল থেকে একটা সরু গলি বাগান ভেদ করে প্রাসাদে গিয়ে মিশেছে। ডাক্তারের ঘোড়া আস্তাবলের দিকে ঘুরল। আস্তাবলের সামনে এসে পৌঁছতে সহিসদের একজন এসে লাগাম ধরল। নেমে পড়লেন ডাক্তার।

সন্ধ্যা উতরে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই, প্রাসাদেও আলোর চিহ্ন দেখা গেল না। আস্তাবলের ভিতরে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। গলিপথটায় তাই ক্ষীণ আলোর আভাস। আবছা সেই আলোতে সহিস গিয়েলুমের মনে হলো, ডাক্তারকে আজ যেন অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। পরক্ষণে নিজেকে প্রবোধ দিল সে। ডাক্তার নিশ্চয়ই আজ উঁচু গোড়ালির জুতো পরেছেন। তাছাড়া আলো-আঁধারিতে সব কিছুকেই ছোট-বড় দেখাতে পারে। ধাঁধা লেগে যায় চোখে।

ব্যাগটা আপনি বইবেন কেন, আমার হাতে দিন, রোজকার মতন আজও বলল সহিস।

উঁহু, উঁহু, পিড্রুবেশী সাভানা জোরে-জোরে মাথা নাড়ল।

কোথায় কি প্রশ্ন হতে পারে, কি জবাব দিতে হবে, কোন প্রশ্নের জবাব না দিলেও চলবে-এসব কথা গত কদিন ধরে পাখিপড়া করে শিখিয়েছেন তাকে ডাক্তার পিড্রু। সাভানাও এমুহূর্তে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে তার নির্দেশ।

বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল, সাভানা। বুকের ভেতরটা শিরশির করছে। অবশ্য সেটা প্রাণের ভয়ে নয়, পরিকল্পনাটা যদি ব্যর্থ হয়ে যায় সেই ভয়ে। নিজেকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না সাভানা, সে মারা গেলে ফ্রান্সের খুব বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে না। তার মত লাখ-লাখ সৈন্য তৈরি রয়েছে মাতৃভূমির সেবা করার জন্যে।

একজন কমে গেলে কি যায় আসে। আর জীবনের ওপরও যে খুব দরদ আছে তার এমনও নয়। বীরধর্মী লোক সে, দরদ থাকবেই বা কেন। যতক্ষণ বেঁচে থাকবে কাজ করে যাবে অন্যের ভালর জন্যে, যখন থাকবে না তখন একজনও যদি মুহূর্তের জন্যে তাকে স্মরণ করে, তবে শান্তি পাবে ওর আত্মা। এটাই সাভানার মনের কথা।

বিশাল কাঠের দরজা প্রাসাদের সামনে। অসংখ্য গজাল ঠোকা হয়েছে একেকটা পাল্লায়। দরজার বাইরে বন্দুক হাতে এক প্রহরী। সে সামরিক কায়দায় সালাম দিয়ে ঝুলন্ত দড়িতে টান দিল। ভেতরে বড়সড় এক ঘণ্টার সঙ্গে বাঁধা সে দড়ি। ঢং-ঢং শব্দে.বেজে উঠল ঘণ্টা।

প্রহরী ভেতরেও আছে। সে সামান্য একটুখানি খুলে দিল দরজার একটা পাল্লা। ডাক্তার কোনরকমে শরীরটা গলিয়ে দিলেন ভেতরে। তারপর আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

স্বল্পালোকিত একটা চাতাল। তেমন চওড়াও নয়, তার ওপাশে ওপরে ওঠার সিঁড়ি, আর দুধারে দুটো মাঝারি আকারের দরজা। দরজা দুটো এখন বন্ধ।

প্রহরী গিয়ে ডানের দরজায় খটখট শব্দ করল। এক ভৃত্য সাড়া দিতে বেরিয়ে এল। ডাক্তারের হাত থেকে ব্যাগটা নিতে হাত বাড়াল সে। সাভানা জানে, ডাক্তার পিড্রু সব সময় মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেন ব্যাগ তিনি নিজেই বইবেন।

সাভানাও তাই করল। এবং ভূত্যও বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে তাকে পেছনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

সিঁড়ি সংলগ্ন বারান্দার দুপাশে সারি সারি দরজা। সব কটা দরজাতেই পর্দা ঝুলছে। তাছাড়া বেশিরভাগ ঘরই অন্ধকার। বোঝা যায়, ভেতরে মানুষ-জন নেই। ____ অবশ্য লোকজনও কম। এমুহূর্তে এখানে রয়েছে কেবল জ্যাভেদো _____ শেষ মাথায় সরু একটা সিঁড়ি। পাঁচ-ছয় ধাপ উঠতেই পাশাপাশি দুটো কামরা ____ । কামরা দুটো অথচ দরজা একটি। অর্থাৎ ওপাশের ঘরে যেতে হলে দুপাশের কামরার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ওদিকের ঘরটায় নিচে বাগান। বাগানের ওপাশে বিশ ফুট উঁচু দুর্গের দেয়ার। সান্ত্রী পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে।

দুর্গবাসী রোগীদের রাখা হয় আড়াইতলায় এই ছোট ঘর দুটোয়। কঠিন, সংক্রামক রোগ তো প্রায়ই দেখা দেয়। এখন অবশ্য সেরকম কোন রোগ নেই গুইশাম্পো পরিবারে। তাই বন্দিনী কর্নেলিয়াকে না হয়েছে এখানে। রোশর ঘব হিসেবে তো বটেই, কয়েদখানা হিসেবেও মন্দ নয় এ ঘর দুটি গাড়ির ভেতরে, অথচ বিচ্ছিন্ন। তার ওপর নিরাপদ পেছনের ঘরের লোককে বেরোতে হলে সামনের ঘর ব্যবহার করতে হবে। সেখানে সর্বক্ষণ কেউ না কেউ তো থাকেই। যখন না থাকে তখন দরজায় তালা মারা থাকে।

ঘরে এমুহূর্তে একজন মহিলা রয়েছে। মুখের চেহারা, পোশাক-আশাক দেখে অনুমান করল সাভানা, এ নিশ্চয়ই হাউজকীপার জেসমিনা। ডাক্তার পিড্রু তাকে বলেছেন, জেসমিনা অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ, কর্মঠ মহিলা। গৃহকত্রী স্বয়ং ডেলভিনাও সমঝে চলেন তাকে।

জেসমিনা শুভ সন্ধ্যা জানাল ডাক্তারকে। তারপর বলল, রোগী তো ভালই আছে। আজ না এলেও তো হত, ডাক্তার।

আসলাম, শুভ সন্ধ্যা জানিয়ে বলল সাভানা। কথা তিনটের ফাঁকে খুকখুক করে একটুখানি কেশে নিল। গলার আওয়াজের দিকে যাতে হঠাৎই মনোযোগ আকৃষ্ট না হয় জেসমিনার।

ডাক্তারের কাশি কান এড়ায়নি জেসমিনার।

দেখলেন তো, বলল সে। এ অঞ্চলের সন্ধেবেলার হাওয়াটা স্বাস্থ্যের পক্ষে কত ক্ষতিকর। কথাটা আপনার কাছেই বহুবার শুনেছি। অথচ আপনি নিজেই কিনা বেরিয়ে পড়েছেন। এখন অসুখ না বাধালেই হয়।

হুঁ, বলে আরেকটু কেশে নিল সাভানা।

আপনি রোগীকে দেখুন, আমি করি ব্যবস্থা করি। তালাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিন। নিয়ম যখন আছে মেনে চলাই ভাল।

খুকখুক করে কেশে সায় জানাল সাভানা।

আড়াইতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল জেসমিনা। সাভানা দরজার বাইরের তালাটা খুলে ভেতর দিকে লাগাল। তারপর কর্নেলিয়া যে ঘরে আছে সে ঘরের দরজায় করাঘাত করল।

দুমিনিট বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল ডাক্তারবেশী সাভানা। কর্নেলিয়াকে সুযোগ দিল বেশবাস সামলে নেবার। এবার আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে, পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল।

কুশল বিনিময়ের পর কর্নেলিয়া মৃদু স্বরে বলল, এই রাত্রিবেলা কষ্ট করে না এলেও পারতেন। আমি তো এখন ভালই আছি!

সাভানা সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে এল। দাঁড়াল এসে কর্নেলিয়ার বিছানার পাশে।

আজও পরীক্ষা করবেন? বিরক্তি চেপে, মুখে চেষ্টাকৃত হাসি ফুটিয়ে বলল কর্নেলিয়া। যে নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ মনে করছে তার কাছে ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা অনাবশ্যক মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

না, মৃদু স্বরে বলল সাভানা। শুনুন, এখন যে কথাগুলো বলব তা শুনে উত্তেজিত হবেন না, নিজেকে শান্ত রাখবেন। তাতে আপনারও মঙ্গল আমারও মঙ্গল। আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। ডাক্তারের ছদ্মবেশে এখানে এসেছি। আপনার বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আমাকে আপনি চেনেন। কোয়ামোদো যেদিন আপনাকে অপহরণ করে সেদিন বাতে ট্রিটন হিলের গুহায় আমাদের দেখা হয়েছিল–

কর্নেলিয়া এসব কথা শোনার পরে সতর্কবাণী ভুলে উত্তেজিত হয়ে উঠল। আধশোয়া অবস্থায় ছিল বালিশে হেলান দিয়ে, তড়াক করে সিধে হয়ে বসল। তারপর সাভানার একটা হাত চেপে ধরল দুহাতে।

আপনি? আপনি এসেছেন?

ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে কর্নেলিয়ার দুগাল বেয়ে।

আপনি শান্ত হোন, বারবার একই কথা বলতে লাগল সাভানা।

ঠিক এ সময় করাঘাত। বাইরের দরজায়। জেসমিনা কফি নিয়ে এসে জোরে-জোরে করাঘাত করছে।

শিগগির চোখ মুছে ফেলুন, ত্রস্ত কণ্ঠে বলল সাভানা। দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকুন।

সাভানা এবার দরজা খুলল এ ঘরের। তারপর ধীরেসুস্থে বাইরের কামরার তালা খুলে দিল। জেসমিনা একাই এসেছে। হাতে ছোট একটা ট্রে, তাতে ধূমায়িত কফির পট ও পেয়ালা। সঙ্গে অল্প কিছু কেকজাতীয় শুকনো খাবার। জেসমিনার নিজের হাতে তৈরি। বাজার-হাট এখান থেকে এতটাই দূরে, বিস্কে উপকূলের গৃহস্থরা সেখান থেকে কেক-মিষ্টি কিনে আনার কথা ভাবতেই পারেন না।

রোগী দেখা হলো?

না, বলে খুকখুক করে কাশল সাভানা। আপনি শিগগিরি কাশির ওষুধ খেয়ে নিন। নইলে আপনি তো ভুগবেনই, আপনার রোগীরাও ভুগবে। ডাক্তার নিজেই যদি নিউমোনিয়ায় পড়ে।

সাভানা এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যাতে মোমবাতির আলো ওর মুখে না পড়ে। এ অবস্থাতেই দরজায় তালা দিয়ে জেসমিনাকে ভেতরের ঘরে আসতে ইশারা করল।

কফিটা এখানে খেয়ে নিলেও পারতেন, বলল জেসমিনা।

না, না, বলে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ল সাভানা।

জেসমিনা নিঃশঙ্কচিত্তে প্রবেশ করল তার পিছু পিছু। সাভানা ট্রে-টা ওর হাত থেকে নিয়ে চেয়ারের ওপর রাখল। এবং পরক্ষণে দুহাত দিয়ে সবলে টিপে ধরল মহিলার কণ্ঠনালী। আচমকা আক্রমণে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল জেসমিনার, হাঁ হয়ে গেল মুখ। সেই সুযোগে নিজের রুমালটা দলামোচা পাকিয়ে তার মুখের ভেতর ভরে দিল সাভানা। বিছানার চাদরটা ছিঁড়ে দুটুকরো করে ফেলল ও। একটা টুকরো দিয়ে জেসমিনার দুহাত এবং অন্য টুকরোটা দিয়ে দুপা বেঁধে ফেলতেও দেরি হলো না। মুখটাও বেঁধে দিল রুমাল দিয়ে।

সাভানা কর্নেলিয়াকে জরুরী কণ্ঠে নির্দেশ দিল, জেসমিনার পোশাক নিজে পরে তার পোশাক জেসমিনাকে পরিয়ে দিতে।

আমি ততক্ষণে ও ঘরে গিয়ে কফিটা খেয়ে নিই, বলল সাভানা। কফির জন্যে ধন্যবাদ, ফ্রাউ জেসমিনা। মাপ করবেন, আপনাকে খামোকা কষ্ট দিতে হলো। জানেনই তো, খারাপের সংস্পর্শে থাকলে অনেক সময় ভালকেও বিপদে পড়তে হয়।

সাভানা ট্রেটা নিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে বসল। ওদিকে প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে উঠে চটপট সাভানার নির্দেশমত কাজ করে চলল কর্নেলিয়া। এ মুহূর্তে কোনরকম জড়তা দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। হাজার হলেও হোসে ফার্ডিনান্ডের মেয়ে তো সে।

দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে এ ঘরে চলে এল কর্নেলিয়া।

সাভানা এবার ভেতরের ঘরে গিয়ে জেসমিনাকে তুলে দিল বিছানায়। তারপর আবারও ক্ষমা চেয়ে বলল, দয়া করে ধৈর্য ধরে শুয়ে থাকুন। এটুকু কষ্ট আপনাকে না দিয়ে উপায় ছিল না। তবে এটা তেমন কিছু নয়। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন আপনি। .

জেসমিনাবেশী কর্নেলিয়াকে নিয়ে সাভানা ঘর ত্যাগ করে, বাইরের দরজায় তালা লাগাল। কর্নেলিয়াকে একটি উপদেশ দিয়ে রেখেছে সে। জোরে হাঁটবেন। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেন না। আর বললেও হুকুমের সুরে। মনে থাকে যেন, এবাড়িতে আপনি ডেলভিনা আর জ্যাভেদো ছাড়া আর কাউকে সমীহ করে কথা বলেন না।

সিঁড়ি দিয়ে নামলে বারান্দা, বারান্দার শেষ মাথায় আবার সিঁড়ি-দরজা বন্ধ সে সিঁড়ির। দরজায় করাঘাত করতে প্রহরী বাইরে থেকে খুলে দিল। চাতাল পেরোলে আরেকজন প্রহরী।

ফ্রাউ জেসমিনা আমার সঙ্গে চাতালে যাচ্ছেন, এখুনি ফিরে আসবেন। অনুচ্চ স্বরে বলল সাভানা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল ছদ্মবেশী কর্নেলিয়া।

বাগানের ভেতর দিয়ে পথ চলে গেছে আস্তাবল পর্যন্ত। ম্লান আলোয় ঠিক মত নজর চলে না। এতে সুবিধেই হচ্ছে সাভানাদের।

আমি ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে ঝুলসেতু পর্যন্ত যাচ্ছি। একটা ঘোড়া দাও। জেসমিনাবেশী কর্নেলিয়া বলল।

কর্নেলিয়া হোসে ফার্ডিনান্ডের মেয়ে, ঘোড়ায় চড়ে অভ্যস্ত। সহিসরা চটপট ঘোড়া সাজিয়ে দিল। ডাক্তারের ঘোড়ায় চাপল সাভানা আর আস্তাবলের ঘোড়ায় কর্নেলিয়া। হাঁটার গতিতে ঝুলসেতুর উদ্দেশে পাশাপাশি চলেছে দুটি ঘোড়া। দেখে মনে হচ্ছে জরুরী কোন পরামর্শ চলছে ওদের মধ্যে।

.

নয়

সন্ধ্যা সাতটায় সার্ভেরোতে ডিনার। জ্যাভেদো সাধারণত ডিনারে হাজির থাকে না, বিরক্তি বোধ করে সে। বিশাল এক ঘরের এমাথা-ওমাথা টেবিল পাতা। অন্তত দুশোটা চেয়ার রয়েছে বসার জন্যে। পাঁচ-সাতটা বাদে বাকি সব চেয়ার খালি পড়ে থাকে প্রায় সারা বছর। শুধুমাত্র বড়দিনে, ঈস্টারে, দুর্গস্বামীর জন্মদিনে, সেন্ট অ্যান্ড্রজের তিরোধান দিবসে, রাজার জন্মদিনে মেহমানদের আগমন ঘটে থাকে।

এবার থেকে আর রাজার নয়, রিজেন্টের জন্মদিন পালন করা হবে দেখো, জ্যাভেদো সেদিন তার মাকে বলেছিল। বাবা ফিরে এসেই ঘোষণা দেবে।

ডিনারে প্রচুর সময় লেগে যায় বলে আসতে চায় না জ্যাভেদো। পাক্কা আড়াই ঘণ্টার ধাক্কা। একটার পর একটা ব্যঞ্জন আসছে। খাও আর না খাও প্লেটে করে মুখের সামনে সাজিয়ে দেবে। রাজকীয় ভোজ যাকে বলে।

জ্যাভেদোর একটা নিজস্ব পড়ার ঘর আছে। কাজের লোকেরা ওখানেই তার খাবারটা পৌঁছে দেয়। ফলে, একাকী শান্তি মত খেতে পারে সে।

কিন্তু ইদানীং দুর্গের পরিস্থিতি তো আর আগের মত নেই আকস্মিক মৃত্যু ঘটেছে কোয়ামাদোর, বাবা গেছেন রিজেন্টের সঙ্গে দেখা করতে। মা আর জেসমিনা একা বসে খাবে? তাই বাধ্য হয়েই ডিনার টেবিলে যোগ দিতে হচ্ছে জ্যাভেদোকে।

ডাইনিং হলে কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় প্রবেশ করল জ্যাভেদো। দুএক মিনিট আগে-পরে ঢোকেন ডেলভিনা। আর তার পেছন পেছন জেসমিনা। হাউজকীপার মহিলা রোজ খেতে বসার আগে তদারকিটা সেরে নেয়। সব খাবার রান্নাঘর থেকে দাসীরা আনল কিনা, ভুল করে রূপার বাসন-কোসনের বদলে পিউটারের বাসন দেয়া হয়েছে কিনা কর্তা-কত্রীর সামনে এসব আর কি।

আজ মা-ছেলে যথাসময়ে হাজির হয়েছেন ডাইনিং হলে, কিন্তু জেসমিনার দেখা নেই। গেল কোথায় সে? হলোটা কি তার?

ডেলভিনা অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যান, আজও গেলেন।

তুই কিছু বলিস না বলে জেসমিনার বড় বাড় বেড়েছে, বললেন তিনি, “তোর বাবা থাকলে এমন গাফিলতি করার সাহস পেত না। ভেনডেটার ডাক দিতে যে মালিক ভয় পায় তাকে কাজের লোকেরাও পাত্তা দেয় না।

জ্যাভেদো দুঃখ পেল, কিন্তু ক্ষুব্ধ হলো না। মনে মনে শুধু বলল, মা কাজের লোকেদের সামনে এভাবে না বললেও পারতেন।

জেসমিনা নিশ্চয়ই কোন কাজে আটকা পড়েছেন, অশেষে শান্ত কণ্ঠে বলল জ্যাভেদো। ডোনা কর্নেলিয়ার অসুখ হয়তো বেড়ে গেছে। ডাক্তার এসেছিলেন খবর পেয়েছি। তিনি হয়তো জেসমিনাকে কোন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। রোগীর ঘরে তুমি বরং কাউকে পাঠিয়ে দাও। সে জেসমিনাকে ডেকে আনুক। আর না হয় শুনে আসুক উনি কতক্ষণে আসতে পারবেন।

ডাক্তার থাকলে তাকেও ডাইনিং হলে আসতে বলবে, ডেলভিনা দাসীকে শিখিয়ে দিলেন।

ওর বলার দরকার কি, মৃদু স্বরে বলল জ্যাভেদো। তারপর দাসীকে বলল, উনি যদি এখনও থেকে থাকেন, তাহলে চট করে আমাকে এসে জানাবে। আমি গিয়ে তাকে ডেকে আনব।

অ্যাগনেস, অর্থাৎ কাজের মহিলাটি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে মা-বেটা, একটু পরে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল অ্যাগনেস। একা।

হুজুর, হুজুর, দরজায় তো তালা! হাঁপাচ্ছে অ্যাগনেস।

তালা? ভেতরে না বাইরে? জিজ্ঞেস করল জ্যাভেদো।

বাইরে। দরজায় ধাক্কা দিয়েছি কেউ সাড়া দেয়নি। সিনোরিটা কর্নেলিয়ার নাম ধরেও ডাকাডাকি করেছি।

জ্যাভেদো উঠে দাঁড়াল। মাকে বলল খাওয়া শুরু করতে, আর অ্যাগনেসকে পাঠাল জেসমিনা রান্নাবাড়িতে রয়েছে কিনা দেখার জন্যে।

জেসমিনা গেল কোথায়? এসময় তার ভোজঘরে থাকার কথা। দেরি হচ্ছে যখন, ধরে নেয়া হয়েছিল সে বন্দিনীর কামরায় আছে। কিন্তু সে ঘরে তো বাইরে থেকে তালা দেয়া। তাহলে?

অ্যাগনেস খবর আনল রান্নাবাড়ির আশপাশে জেসমিনাকে কেউ দেখেনি।

অগত্যা, তালা ভাঙার হুকুম দিতে বাধ্য হলো জ্যাভেদো।

প্রহরীরা নিচ থেকে উঠে এসেছে হাঁক-ডাক শুনে। তারা জানাল, চিন্তার কোন কারণ নেই। জেসমিনা খানিক আগে ডাক্তারের সঙ্গে বাইরে গেছে।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল জ্যাভেদো। একজন প্রহরীকে নির্দেশ দিল, তুমি আস্তাবল হয়ে ঝুলসেতুর দিকে যাও। জেসমিনাকে কাছে পিঠে পেয়ে যাবে। তাকে ডেকে আনে। ডাক্তারকে অতদূর থেকে ডেকে আনার দরকার নেই।

জ্যাভেদো ডাইনিং হলে ফিরে এসে খেতে বসল।

খাওয়া মাঝ পর্যায়ে, তখনও ফিরল না প্রহরী। অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল জ্যাভেদো। তার মন কুডাক ডাকছে। শেষ অবধি, মার কাছ থেকে অনুমতি নিল ও, নিজে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসবে।

বাবা দুর্গে নেই, কোন ঝামেলা যদি বেধে বসে, স্বগতোক্তির মত করে বলল জ্যাভেদো।

ডেলভিনা সুযোগ পেয়ে গেলেন টিপ্পনী কাটার।

ঝামেলা যে বাধবে সে আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, বললেন তিনি। আলমাঞ্জার ডাইনীটা যেদিন আমার ঘরে এসে ঢুকল। ফার্ডিনান্ড-গুইশাম্পো পরিবারে জীবনেও মিল হয়নি। আমার কোয়ামোদো বাপটা সেই মিল ঘটাতে গিয়ে অকালে প্রাণটা দিল। চোখ মুছলেন ডেলভিনা; তারপর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আরও বললেন, সেজন্যেই তো এত করে তোকে বলেছিলাম ভেনডেটা ঘোষণা কর। ফার্ডিনান্ড বুড়োটাকে শেষ করতে পারলে আমার প্রাণটা জুড়োত।

মার আহাজারি সহজে থামবে না, জ্যাভেদো তাই তড়িঘড়ি চলে এল নিজের ঘরে। জেসমিনার খোঁজে বেরোবে। ওর মত দায়িত্বশীলা একজন মহিলা রাত বিরেতে বুড়ো ডাক্তারের সঙ্গে বেড়াতে চলে গেছে ব্যাপারটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কিছু একটা ঘটেছে। শীঘি সেটা জানতে হবে, দেরি করা চলবে না।

জ্যাভেদো বিস্কে উপকূলের চোরাকারবারীদের কাছ থেকে একটা পিস্তল সংগ্রহ করেছে। নিজের ঘরে গিয়ে পকেটে ভরল সেটা। পিস্তলে হাত পাকাতে পারেনি তেমন একটা, তবু গুলি ছুঁড়লে শত্রু ঘায়েল হবেই না তেমন কথাই বা কে বলল। পিস্তলের সঙ্গে একটা তরোয়ালও নিল সে।

চটপট নিচে নেমে এসে আস্তাবলে ঢুকল জ্যাভেদো। ওর হুকুম পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ঘোড়া তৈরি করে দিল সহিস।

ফ্রাউ জেসমিনা বাইরে ঘোড়া নিয়ে গেছে? জিজ্ঞেস করল জ্যাভেদো।

জ্বী, হুজুর, জবাবে বলল সহিস। ছোট সাহেবের ঘোড়াটা তাকে সাজিয়ে দিয়েছি।

মনে মনে রাগ করলেও মুখে কিছু বলল না জ্যাভেদো; ছোট সাহেব, অর্থাৎ কোয়ামোদোর ঘোড়াটা ছিল আস্তাবলের সেরা ঘোড়া। কারও বদ মতলব থেকে থাকলে দ্রুতগামী ঘোড়াটা তা হাসিল করতে যারপরনাই সাহায্য করবে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, জেসমিনার কি কোন কুমতলব থাকতে পারে? নাহ, আপন মনে মাথা নাড়ল জ্যাভেদো। জেসমিনাকে আজ বিশ বছর ধরে দেখছে, তেমন মানুষই জেসমিনা নয়।

ঝুলসেতুর পাহারাদারও জানাল জেসমিনা ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে বেড়াতে গেছে, পাঁচ-দশ মিনিটের কথা বলে। হ্যাঁ, জেসমিনাই ওটা। কেননা, তার পরনে ছিল অতিপরিচিত সাদা-কালো চেক কাপড়ের সেই পোশাকটি। জ্যাভেদোর প্রশ্নের জবাবে প্রহরী আরও জানাল, আবছা আলোয় জেসমিনার চেহারা সে ভাল করে লক্ষ করেনি। এবং লক্ষ করার কোন প্রয়োজনও বোধ করেনি। জেসমিনাকে চেনার জন্যে তার সাদা-কালো পোশাকটিই কি যথেষ্ট নয়?

জ্যাভেদো আর দেরি না করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। সামনে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। ফিকে আলোয় বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে। কিন্তু মাঠের কোথাও ডাক্তার পিড্রু কিংবা জেসমিনার চিহ্ন মাত্র নেই।

ওরা গেল কোন দিকে?

পিড্রু সাহেব নিশ্চয়ই নিজের বাড়ির পথে গেছেন। এত রাতে কোন ডাক্তারই বাড়ির বাইরে থাকতে চাইবেন না। ডাক্তার থাকেন কুইলনে। সার্ভেরো থেকে পুরো বিশ মাইল। জ্যাভেদো ওঁর বাড়ি চেনে।

পিড্রু নিশ্চয়ই যাবেন নিজের বাড়িতে, কিন্তু তাই বলে জেসমিনা কেন? কি এত জরুরী কথা থাকতে পারে তাদের মধ্যে যে রাতের বেলা বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসতে হবে?

এর ভেতরে গুরুতর কোন গলদ না থেকেই পারে না।

এসময় হঠাৎ ক্ষীণ একটা শব্দ মনোযোগ আকর্ষণ করল জ্যাভেদোর। ঘোড়ার ডাক। এবং ঘোড়াটা বিপন্ন। কোন অবস্থায় পড়লে ঘোড়া কিভাবে ডাকে স্পেন দেশের যুবকদেরকে তা বলে দিতে হয় না। কেননা, ঘোড়ার পিঠেই মানুষ হয় তারা।

বোঝা গেছে। ডাক্তার কথা-বার্তা সেরে নিজের পথে চলে গেছেন। আর জেসমিনা, আনাড়ী ঘোড়সওয়ার, ফিরতিপথে ঘোড়া সমেত আছাড় খেয়ে পড়েছে কোন পার্থরে বা গর্তে বেধে। জেসমিনাও হয়তো চেঁচাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে না। ঘোড়াটার আর্তনাদের আবছা প্রতিধ্বনি বাতাসে ভেসে এসেছে।

জ্যাভেদো কালবিলম্ব না করে ঘোড়া ছোটাল শব্দ লক্ষ্য করে।

এতটা দূরে রাত্রিবেলা কোন দুঃখে আসতে গেল জেসমিনা? বয়স তো কম হলো না তার, এখনও এত ছেলেমানুষ রয়ে গেছে!

আর ডাক্তারই বা কেমনতরো মানুষ?

ঘোড়াটার কাছে পৌঁছতে বেশ কিছুক্ষণ লেগে গেল। কিসের কি, কোন পাথরেও টক্কর খায়নি কিংবা গর্তেও পড়ে যায়নি জানোয়ারটা। বিভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক ঘুরছে আর অসহায়ের মত চি-হি-হি ডাক ছাড়ছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, ডাক্তার কিংবা জেসমিনা কোথাও নেই। জেসমিনার কাণ্ড-কারখানা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না জ্যাভেদো। তবে সে যে এপথে এসেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ঘোড়াটা ডাক্তারের। জেসমিনা নিয়ে এসেছিল কোয়ামোদোর ঘোড়া। সে ঘোড়া জ্যাভেদো চেনে। এই ঘোড়াটা খোঁড়াচ্ছে, হাঁফাচ্ছে-মোট কথা করুণ দশা জানোয়ারটার। বোঝা যায়, ডাক্তার মাত্রাতিরিক্ত দ্রুতবেগে ছুটিয়েছিল অনভ্যস্ত ঘোড়াটিকে।

কিন্তু ডাক্তার তো কখনও ওভাবে ঘোড়া দাবড়ায় না। রহস্যটা কি? যে লোক এটার পিঠে চেপেছিল সে ডাক্তার পিড্রু তো? অবশ্য অন্য লোক ডাক্তারের অতি চেনা বেতো ঘোড়াটাকে পাবেই বা কিভাবে? ডাক্তার যে সার্ভেরো দুর্গে এসেছিল এতেও তো কোন সন্দেহ নেই।

তাহলে গোলটা বাধল কোথায়?

আসুন! আসুন! অকস্মাৎ একটা কণ্ঠস্বর দস্তুর মত চমকে দিল জ্যাভেদোকে। আমি আপনার অপেক্ষাতেই আছি!

তীরবেগে একটা ঘোড়া ছুটে আসছে। ঘোড়াটা কোয়ামোদোর; এক পলক দেখেই চিনেছে জ্যাভেদো। কিন্তু অশ্বারোহী মানুষটি কে? জেসমিনা নয়, ডাক্তারও নয়। এর হাতে তরোয়াল বাগিয়ে ধরা।

পিস্তল নয়, দ্বন্দ্বযুদ্ধে আসুন তরোয়াল নিয়ে। আপনি চান ডোনা কর্নেলিয়াকে, আর আমি চাই আপনার তেজী ঘোড়াটাকে কেড়ে নিতে। এক ঘোড়ায় চেপে দুজন মানুষের আলমাঞ্জা পর্যন্ত যাওয়াটা কষ্টের ব্যাপার। ডাক্তারের ঘোড়াটা কোন কম্মের নয়, পা ভেঙে বসে পড়ল!

কে আপনি? কর্নেলিয়ার কথা বলছেন কেন?

বলছি এইজন্যে যে, আমার পেছনে যাকে বসে থাকতে দেখছেন ইনিই কর্নেলিয়া। আপনি বোধহয় এঁকে জেসমিনা ভেবেছিলেন। জ্বী না, জেসমিনা আপনাদের বাড়িতেই আছেন, মুখ বাঁধা অবস্থায় তালা বন্ধ ঘরে।

.

দশ

কর্নেলিয়া ঘোড়া থেকে নেমে খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। আর আন্দালুসিয়ান ঘোড়া দুটি পরস্পর মুখোমুখি হয়ে খুর দাপিয়ে বালি ছিটাতে লাগল। ওরা জাত যোদ্ধা ঘোড়া। ওদের ইন্দ্রিয় ঠিক-ঠিক জানান দিয়েছে, সওয়ারীরা এখন যুদ্ধংদেহী মেজাজে রয়েছে।

জ্যাভেদো ক্রোধে রীতিমত ফুঁসছে। ডাক্তারের ছদ্মবেশে শত্রু হানা দিয়েছে দুর্গে, বিশ্বস্ত কর্মচারী জেসমিনাকে মুখ বেঁধে আটকে রেখে, তাদেরই ঘোড়ায় চাপিয়ে উদ্ধার করে এনেছে বন্দিনী কর্নেলিয়াকে-এরপরও মাথা ঠাণ্ডা রাখা যায়?

তরোয়ালেই ফয়সালা হয়ে যাক, ঘোষণা করল জ্যাভেদো।

আমিও তো তাই চাই, বলল সাভানা।

এবার দুটো ঘোড়া তেড়ে গেল পরম্পরকে লক্ষ্য করে। অসিযুদ্ধে যোদ্ধাদের উদ্দেশ্য থাকে, শত্রুকে পাশ কাটিয়ে ডানে-বায়ে সরে যাওয়া, এবং পাশ থেকে সুযোগ বুঝে শক্রর পাজরে কিংবা গলায় আঘাত হেনে তাকে কাবু করা। সাভানা ও জ্যাভেদো একই কায়দায় তরোয়াল চালাচ্ছে। এরফলে, শত্রুকে মোক্ষম আঘাত করতে পারছে না কেউ। তবে দুজনেরই শরীরের নানা জায়গায় আঁচড় কাটছে তরোয়াল, এবং রক্তও ঝরাচ্ছে।

পেশাদার সৈনিক সাভানা। প্যারিসের অভিজ্ঞ অস্ত্রশিক্ষকের কাছে তার তরোয়ালে হাতেখড়ি। সম্মুখযুদ্ধে বহুবার অবতীর্ণ হতে হয়েছে তাকে। দ্বন্দ্বযুদ্ধও কম করেনি। ফ্রান্সের চতুর্দশ লুইয়ের সেনাবাহিনী দুই যুগ ধরে সারা ইউরোপ চষে বেড়াচ্ছে। চার্লি সেন্ট সাভানা সে বাহিনীর কোন না কোন অংশের সঙ্গে রয়েছে প্রায় এক যুগ ধরে। রণক্ষেত্রে তাকে লড়তে হয়েছে কখনও জার্মান, কখনওবা ওলন্দাজ শত্রুর বিরুদ্ধে। বেঁচে যখন আছে, বোঝাই যায় জীবনে কখনও পরাজিত হয়নি সে।

অন্যদিকে জ্যাভেদো অবশ্যই সাহসী পুরুষ, জন্মেছেও বীর বংশে। অস্ত্রশিক্ষায় তার হাতেখড়ি হয়েছে সেই শৈশবেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভাল শিক্ষক পায়নি সে। ম্যাজেন্টোর উচিত ছিল তাকে ও কোয়ামোদোকে মাদ্রিদে অভিজ্ঞ অস্ত্রগুরুর কাছে পাঠানো। তা তিনি করেননি। এমনকি উন্নত অস্ত্রশিক্ষাদানে সক্ষম কোন শিক্ষককে.তিনি তার দুর্গেও আমন্ত্রণ করে আনেননি, যাতে করে তার ছেলেরা উপযুক্ত শিক্ষালাভ করতে পারে।, এর ফলে যা হওয়ার তাই হলো। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কাবু হয়ে গেল জ্যাভেদো। তার ডান কাঁধে এতটাই জোরে আঘাত লেগেছে, তরোয়ালটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল। বাঁ হাতে কাধ চেপে ধরে ঘোড়া ছোটানোর চেষ্টা করল সে দুর্গের দিকে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে লাগাম চেপে ধরল সাভানা।

আমি দুঃখিত, ঘোড়াটা আমার দরকার, বলল সে। আলমাঞ্জায় পৌঁছতে হলে আমাদের দুটো ঘোড়া চাই। আপনি বাড়ির কাছেই আছেন, প্রয়োজনে হেঁটেও চলে যেতে পারবেন। তাছাড়া ডাক্তারের ঘোড়াটা তো রয়েছেই। যত কষ্টই হোক ওটা আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে দেবে।

বেশ তো, নিয়ে যান ঘোড়া, বলে নেমে দাঁড়াল জ্যাভেদো। আর তার পরমুহূর্তে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল মাটিতে। ভয়ানক কাহিল হয়ে পড়েছে সে। সাধ্য নেই দাঁড়িয়ে থাকে।

ওকে পড়ে যেতে দেখে এক লাফে নিজের ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল সাভানা। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আহত প্রতিদ্বন্দ্বীর জখম পরখ করতে।

এহ হে, আঘাতটা তো বেশ গুরুতর, কর্নেলিয়ার দিকে চেয়ে অনুচ্চ স্বরে বলল ও।

আমার জন্যে চিন্তা করবেন না, বলে উঠল জ্যাভেদো। দুর্গ থেকে লোক এসে পড়বে আমার খোঁজে। আপনি সিনোরিটাকে নিয়ে এখুনি পালান। একটা কথা শুধু জেনে রাখবেন, সিনোরিটাকে বন্দী করে আনা কিংবা আটকে রাখার ব্যাপারে আমার কোন হাত ছিল না। জানেনই তো, আমি দুর্গের মালিক নই।

কথা বলতে বলতে থেমে গেল জ্যাভেদো। সাভানা ওর বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল, তারপর কর্নেলিয়াকে বলল, অজ্ঞান হয়ে গেছেন, কি করা যায়?

শত্রুর জন্যে এত চিন্তা? মনে মনে বলল কর্নেলিয়া।

সাভানা ওর মনের কথা বুঝতে পারল।

একে এভাবে ফেলে গেলে রক্তক্ষরণে মারা যেতে পারেন, বলল ও। কিন্তু একটা ব্যান্ডেজ যদি বেঁধে দিতে পারি এযাত্রা বোধহয় বেঁচে যাবেন।

উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে ডাক্তারের ওষুধের ব্যাগটা নামিয়ে আনল সাভানা। ব্যাগের ভেতর ব্যান্ডেজের কাপড় ছিল, শীঘি চলনসই একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়া গেল।

এখন কি করবেন? জিজ্ঞেস করল কর্নেলিয়া।

আপনি একটা ঘোড়া নিয়ে আলমাঞ্জায় চলে যান। আরেকটায় এঁকে তুলে আমি সার্ভেরোতে ফিরে যাই। দ্বন্দ্বযুদ্ধে মারা গেলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু মারা যখন যাননি, তখন একে তো এভাবে নেকড়ের পেটে যেতে দিতে পারি না!

নেকড়ে? এস্ত কণ্ঠে বলল কর্নেলিয়া।

হ্যাঁ, বলল সাভানা। দূরে-দূরে নেকড়ের পাল আছে, আমাদের গন্ধ শুঁকে অনুসরণ করছে। আপনি ভয় পেয়ে যাবেন বলে এতক্ষণ বলিনি, ওদের ডাকাডাকির শব্দ অস্পষ্টভাবে কানে এসেছে আমার। এসব অঞ্চলের নেকড়েরা অবশ্য রাশিয়ার নেকড়েদের মত অত হিংস্র নয়। কাউকে অজ্ঞান অবস্থায় পেলে নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলবে, কিন্তু আরোহীকে ঘোড়ার পিঠ থেকে টেনে নামাতে চেষ্টা করবে না।

মুখ শুকিয়ে গেল কর্নেলিয়ার।

আপনি আলমাঞ্জায় একাই চলে যান, নেকড়েরা আক্রমণ করার সাহস পাবে না, বলল সাভানা। আপনাকে আলমাঞ্জায় পৌঁছে দিতে পারলে ভাল হত, কি কি করব বলুন-বুঝতেই তো পারছেন!

আহত জ্যাভোনোকে রেখে সাভানা তার সঙ্গে যাবে না পরিষ্কার বুঝতে পারল কর্নেলিয়া।

আমিও এখানে থাকৰ আনার সঙ্গে, বলল দৃঢ়কণ্ঠে।

তা না হয় থাকলেন, বলল সাভানা কিন্তু কতক্ষণ? সার্ভেরো থেকে লোকজন যতক্ষণ না আসে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ওরা এলে কিন্তু দল বেধেই আসবে। কেননা, জেসমিন বেরিয়ে গেল ফিরল না, জাভেদে বেরোল সে. ও ফিরল না। ওরা ধরেই নেবে বাইরে অন্ধকারে ভয়ঙ্কর কোন শত্রু আছে, ওদের সাড়া পেলেই আমরা অবশ্য ঘোড়া ছোটাৰ। কিন্তু ওরাও যে ঘোড়া মানবে না তার নিশ্চয়তা কি? আপনার তো দীর্ঘক্ষণ ঘোড়ায় বসে থাকার অভ্যাস নেই টওরা ধাওয়া করলে তখন কি করবেন?

তা হলে কি একা যেতে বলছেন?

আমি যখন এঁকে ফেলে রেখে যেতে পারছি না তখন এছাড়া আর উপায় কি? আপনি চলে যান, আপনার জীবনের দাম অনেক!

আর আপনার জীবনের দাম বুঝি কিছু নয়?

দাম আছে, কিন্তু আপনারটার সাথে তুলনা চলে না। আর আমার জন্যে ভাববেন না। আমি একবার ঘোড়া ছোটালে সার্ভেয়োর প্রহরীরা আমার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। যে দুটো ঘোড়া দেখছেন দুটোই ভাল জাতের।

তা হোক, কিন্তু আমি আপনাকে একা ফেলে যাব না।

হতাশা বোধ করল সাভানা, দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বেশ। এর ফলে হয়তো আমার সমস্ত কষ্ট পানিতে যাবে।

তা কেন? আমাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, করে এনেছেন। আবার কি?

কিন্তু আপনি নিরাপদে আপনাদের দুর্গে পৌঁছতে পারলেন কিনা সেটা দেখাও তো আমার দায়িত্ব।

একটুক্ষণ চুপ করে রইল কর্নেলিয়া।

দেখুন, সেই প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত আপনি আমার জন্যে যা করেছেন, এতটা কেউ কারও জন্যে করে না। প্রাচীন যুগের নাইটদের চাইতে আপনার শৌর্য-সাহসিকতা কোন অংশে কম নয়। যাক সে কথা, আমি থাকছি, যাচ্ছি না।

থাকুন তবে, হার মেনে বলল সাভানা। একটু দাঁড়ান, আমি আসছি।

দ্রুত পায়ে হেঁটে আঁধারে মিশে গেল সে। খানিক পরে ডাক্তারের বেতো ঘোড়াটিকে নিয়ে ফিরে এল। জানোয়ারটা যথারীতি ঝিমাচ্ছিল।

এটাকে দিয়ে কি হবে? বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল কর্নেলিয়া। এটা তো নিজেই চলতে পারছে না। এর পিঠে ওঁকে চাপিয়ে দিলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এই ভদ্রলোক শেষে ওর পেটের তলায় চাপা পড়ে মরবেন।

দেখুন না কি করি, বলল সাভানা। তারপর খোঁড়া ঘোড়াটার লাগাম খুলে ফেলল। লাগামের এক প্রান্ত বাধল ঘোড়ার পেছনের পায়ে এবং আরেক প্রান্ত বাধল জ্যাভেদোর বেল্টের সঙ্গে। আহত অচেতন জ্যাভেদোকে ফেলে বেশিদূর যেতে পারবে না এখন ঘোড়াটা।

ব্যাপারটা বুঝলাম না, বলল কর্নেলিয়া।

জ্যাভেদো যেহেতু মাটিতে পড়ে আছেন, অন্ধকারে দূর থেকে তাকে দেখা যাবে না। কিন্তু ঘোড়াটা দাঁড়িয়েই থাকবে, শোবে না। সার্ভেয়োর লোক এলে তারা ঠিক দেখতে পাবে।

দশ মিনিটের মধ্যেই দূরাগত অস্পষ্ট কোলাহল শোনা গেল। এসে পড়েছে সার্ভেয়োর লোকেরা। ডেলভিনা ওদের পাঠিয়েছেন। প্রথমে জেসমিনা, তারপর জ্যাভেদো বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরল না; নিশ্চয়ই কোন বিপদ-আপদ হয়েছে ওদের-এই ভেবে।

আর চিন্তা নেই, বলে পিস্তল তুলে পরপর দুবার ফাঁকা আওয়াজ করল সাভানা। প্রহরীদের উদ্দেশে সঙ্কেত।

এবার? প্রশ্ন করল কর্নেলিয়া।

এবার সোজা আলমাঞ্জা, হাসি মুখে জানাল সাভানা। আপনাকে আর একা যেতে বলব না।

সত্যি তো? আর কোনদিনই বলবেন না তো? অন্ধকারে অস্ফুটে জানতে চাইল কর্নেলিয়া।

.

এগারো

রিজেন্টের সেনাবাহিনী নিয়ে কর্নেল গুইশাম্পো এসে পড়েছেন। আর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আলমাঞ্জা পাহাড়ের নিচে তাবু ফেলবেন তিনি। সাভানাদের কপাল নিতান্তই ভাল, তাবু পড়ার আগেই দুর্গে প্রবেশ করতে পেরেছে তারা। বলাবাহুল্য, এ অবস্থায় হারানো মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারলেন না হেসে ফার্ডিনান্ড।

আলমাঞ্জা অবরোধ শুরু হলো পরদিন থেকে। দুর্গপ্রাচীর থেকে মাঝে মধ্যে কামান গর্জাচ্ছে। নিচের ছাউনিতে শত্রুসেনারাও কিছু কিছু হতাহত হচ্ছে।

কর্নেল গুইশাম্পো চাইছেন গোপন পথে, পাকদণ্ডী বেয়ে দুর্গে উঠে আসতে। দুর্গ জয় করতে চান না তিনি, দুর্গবাসীদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চান। এ ধরনের কাজের ভার সাধারণত নিম্নপদস্থ কোন সৈনিককে দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু গুইশাম্পোর মাথায় কি পোকা ঢুকেছে কে জানে, তিনি নিজেই হানাদার দলটার নেতৃত্ব দিতে চাইলেন।

এর ফলাফল হলো গুরুতর। আলমাঞ্জার এক অখ্যাত প্রহরীর তরোয়াল তাঁর প্রাণ কেড়ে নিল। তার সঙ্গী-সাথীরা খানিক লড়াই চালানোর পর পিছু হটে গেল।

পরদিন গুইশাম্পোর লাশ দেখে হোসে ফার্ডিনান্ড হতভম্ব হয়ে গেলেন। এ যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিবেশী দুর্গপ্রধান ম্যাজেন্টো গুইশাম্পো!

হোসে ফার্ডিনান্ড অবরোধকারীদের কাছে দূত পাঠিয়ে ম্যাজেন্টোর মৃত্যু সংবাদ জানালেন। ফলে, সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলো।

খবর পেয়ে সার্ভেরো থেকে ডেলভিনা, জ্যাভেদো ও জেসমিনা এলেন। মৃতদেহ সসম্মানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তারা।

জেসমিনা এক ফাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল কর্নেলিয়াকে।

কেমন ছাড়া পেয়ে গেলাম দেখলে? তোমার নাইট হাত-মুখ বেঁধেও আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, মজার গলায় বলল।

শোধ-বোধ, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল কর্নেলিয়া। তোমাদের কোয়ামোদোও আমার হাত-মুখ বেঁধে রেখেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারেনি। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা কোন পক্ষই আর রাগ পুষে রাখব না, কেমন?

রাগ পুষে রাখবে না জ্যাভেদোও। বাবা রিজেন্টের দলে যোগ দেন সেটা কোনদিনই চায়নি ও। আলমাঞ্জা থেকে বিদায় নেয়ার সময় সাভানার হাত ধরে অনুরোধ করে গেল সে: শিগগিরিই আলমাঞ্জার ওপর থেকে অবরোধ উঠে যাবে। পিছু হটবে রিজেন্টের সেনা। তখন তোমাকে বন্ধু হিসেবে পাব তো? তুমি আমাকে নেকড়ের মুখে ফেলে রেখে যেতে রাজি হওনি কর্নেলিয়া আমাকে বলেছে। তোমার মত মহৎ প্রতিবেশী কজনের ভাগ্যে জোটে বলো?

আমি আবার প্রতিবেশী হলাম কখন? সবিস্ময়ে বলল সাভানা। আমি তো বিদেশী মানুষ। অর্লিয়াঁর ডাক এলেই দেশে ফিরে যাব।

আহা, যেতে দিলে তো! ঝঙ্কার দিয়ে উঠল কর্নেলিয়া। ডিউক অর্লিয়াঁকে বাবা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন। লিখে দিয়েছেন, শিভালিয়ার সেন্ট সাভানাকে এখন এদেশ থেকে ছাড়া হবে না।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *