বক্তৃতা : দুই
সামাজিক আসঞ্জন এবং সরকার
সামাজিক আসনের মৌলিক প্রক্রিয়া, যা এখনও দেখা যায় অধিকাংশ আদিম জাতির মধ্যে, তা সরকার নামক বস্তুটির সাহায্য ব্যক্তি-মনস্তত্ত্বের পরিসর জুড়ে ক্রিয়াশীল ছিল। নিঃসন্দেহে, গোষ্ঠীগত রীতি-প্রথার প্রচলন ছিল, যা সকলকেই মানতে হতো, কিন্তু এটাও ধরে নেওয়া যায় যে, এইসব রীতিনীতি অমান্য করার প্রবৃত্তি ও প্রবণতা ছিল না অথবা তা বলবৎ করার জন্য কোন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশবাহিনীর প্রয়োজন দেখা দেয়নি। পুরাতন প্রস্তর যুগে, নেতৃত্বের পরিমন্ডলে এমন একটা পরিস্থিতি ছিল, যাকে আমরা বর্তমান কালের নৈরাজ্যতন্ত্র রূপে বর্ণনা করতে পারি। কিন্তু আধুনিক সমাজ-সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নৈরাজ্য থেকে তা পৃথক ধরনের ছিল, এর কারণ হল-সেই যুগে সামাজিক প্রবৃত্তিসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যক্তির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতো। নতুন প্রস্তর যুগের মানুষরা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের; তাদের সরকার ছিল, বলপূর্বক আনুগত্য ও বৃহত্তর সহযোগিতা আদায়ে সক্ষম নেতৃত্ব ছিল। তাদের কাজ দেখেও এটা স্পষ্ট বোঝা যায়; ক্ষুদ্রগোষ্ঠীভিত্তিক আসঞ্জনের ফলে হয়তো কোন বিশালাকার প্রস্ত রমূর্তি তারা সৃষ্টি করতে পারেনি, কিন্তু অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি পিরামিড তারাই গড়ে তুলেছিল। সামাজিক ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর সম্প্রসারণ মূলত যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ঘটেছিল। যদি দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বেধে যেত, তাহলে নতুন এলাকা দখলকারী বিজয়ী গোষ্ঠী তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে সমর্থ হতো। যুদ্ধে দুই ততোধিক গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতার সুবিধাও থাকতো। যদি সমঝোতা-উৎপাদক বিপদের সম্ভাবনা বজায় থাকতো, তাহলে যথাসময়ে সেই সমঝোতা একতাবদ্ধ মিশ্রণের রূপ নিত। যখন কোন একটি দলের সদস্যসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটাতো, যার ফলে পারস্পরিক জানা-চেনার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দিত, তখন যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোন নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন দেখা দিত এবং ধাপে ধাপে এই প্রক্রিয়া নিশ্চিতভাবেই বিকশিত হতো এমনভাবে, যা দেখে একজন আধুনিক মানুষ সেটিকে সরকার রূপে চিনে নিতে সক্ষম হয়। যখনই সরকারের উদ্ভব ঘটলো, তখনই অন্যদের তুলনায় কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে এল অধিকতর ক্ষমতা, এবং মোটামুটিভাবে বলতে গেলে-এই ক্ষমতা নির্ভর করতে তাদের শাসনাধীন দলটির আয়তনের উপর। সেই কারণে ক্ষমতার প্রতি ভালবাসা থেকেই জন্ম নিত শাসকের বিজয়-আকাঙ্ক্ষা। এই ধরনের উদ্দেশ্যে তখনই ব্যাপকভাবে রূপায়িত ও বলবৎ হতো, যখন পরাজিতদের ধ্বংস না করে ক্রীতদাসে পরিণত করা হতো। এইভাবে খুবই প্রাথমিক স্তরে সামাজিক সহযোগিতার অনুকূলে আদিম প্রবৃত্তির সক্রিয় অস্তিত্ব সত্ত্বেও বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিকাশ এমনভাবে অব্যাহত ছিল যে আদেশ অমান্যকারীদের সরকার কর্তৃক শাস্তিপ্রদানের ক্ষমতার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে তার প্রকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন ইজিপ্টের আদিমতম পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক গোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে আমরা এমন এক রাজার সাক্ষাৎ পাই, পুরোহিততন্ত্রের দ্বারা আরোপিত কিছু সীমাবদ্ধতা ছাড়া বিশাল এলাকা জুড়ে যার ক্ষমতা ছিল অসীম, এবং আমরা এও দেখি- ক্রীতদাসসুলভ এক বিশালসংখ্যক মানুষকে সেই রাজা যথেচ্ছভাবে পিরামিডের মতো সরকারি উদ্যোগে নিয়োজিত করতে পারতেন। এরকমই এক সমাজ- সম্প্রদায়ে সামাজিক স্তরের একেবারে চূড়ায় এক অতি ক্ষুদ্রাংশ-রাজা-অভিজাততন্ত্র, যাজক-সামাজিক আসঞ্জনের অনুকূলে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো; আর অবশিষ্ট সকলের কাজ ছিল-শুধুই তা মান্য করা। কোন সন্দেহ নেই-জনসাধারণের বিশাল অংশই ছিল অসুখী; এক্সোডাসের প্রথম অধ্যায়গুলোতে তাদের অবস্থার প্রতিচ্ছবি মেলে। কিন্তু প্রথাগতভাবে বহির্শক্রদের কাছ থেকে যতদিন পর্যন্ত কোন ভয়ের কারণ ঘটেনি, ততদিন এই ব্যাপক দুঃখকষ্ট-বিধ্বস্ত অবস্থার কারণে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ব্যাহত হয়নি, এবং এর ফলে ক্ষমতার অধিকারীদের তরফে জীবনকে উপভোগ করার ক্ষেত্রেও কোন প্রতিবন্ধকতা আসেনি। এই ধরনের অবস্থা দীর্ঘকাল ধরে বজায় ছিল সেই অঞ্চলে, যাকে আমরা বলি মধ্য প্রাচ্য। এই স্থিতাবস্থার জন্য তারা নির্ভর করেছিল ধর্ম ও রাজার অলৌকিকত্বের উপর । অবাধ্যতাকে মনে করা হতো এক ধরনের অধার্মিকতা এবং বিদ্রোহ মানেই ছিল দেবতার ক্রোধবর্ষণকে ডেকে আনা। যতদিন পর্যন্ত উচ্চতর সামাজিক লোকবৃত্ত অকৃত্রিমভাবে এটা বিশ্বাস করতো, ততদিন বাকিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা যেত, ঠিক বর্তমানে আমরা যেভাবে পশুদের বশে রাখি।
এটা খুবই কৌতূহলের বিষয় যে, সামরিক বিজয়ের সূত্রে প্রায়শই বিজিতদের মধ্যে জন্ম নিত অকৃত্রিম প্রভুভক্তি। রোমক বিজয়াভিযানের সমকালে এধরনের ঘটনা দেখা গিয়েছিল। পঞ্চম শতাব্দীতে যখন রোম আর বশ্যতাকে বাধ্যতামূলক করে রাখতে পারল না, তখনও গল ছিল সম্পূর্ণভাবেই সম্রাটের প্রতি অনুগত। প্রাচীনতার ঐতিহ্যবাহী সব বড় রাষ্ট্রই সামরিক শক্তির উপরেই তাদের অস্তিত্ব অর্পণ করেছিল, কিন্তু এই রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশই দীর্ঘস্থায়িত্ব লাভ করলে, সংযুক্তিকরণের সময়ে অনেক আঞ্চলিক সহিংস প্রতিরোধ সত্ত্বেও, সামগ্রিকভাবে এক ধরনের আসঞ্জনের পরিবেশ সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছিল। মধ্যযুগে আধুনিক রাষ্ট্রের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একই ঘটনা ঘটেছিল । জাতি নামে চিহ্নিত পরিমন্ডলের কোন কোন অংশের শাসকের সামরিক বিজয়ের সূত্রে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং স্পেন সকলেই ঐক্য অর্জন করেছিল।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ইজিপ্ট ছাড়া সব রাষ্ট্রই স্থায়িত্ব-হানির আশঙ্কায় ভুগতো, ব্যাপকতর অর্থে এর কারণগুলো ছিল কৌশলগত। যে যুগে ঘোড়ার চেয়ে দ্রুততর অন্য কোন মাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল না, তখন অতি দূরবর্তী, বিদ্রোহপ্রবণ প্রাদেশিক শাসক বা তাদের প্রতিনিধিদের উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে দুরূহ ছিল এবং এই বিদ্রোহী প্রান্তিক শাসকরা মাঝে মাঝে সমগ্র সাম্রাজ্য জয় করে নিতে সফল হতো এবং কখনও তার একটি অংশের স্বাধীন, সার্বভৌম শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতো। আলেকজান্ডার, অ্যাটিলা এবং চেঙ্গিস খানের ছিল সুবিশাল সাম্রাজ্য-তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, এবং এসব ক্ষেত্রে, বড় মাপের বিজেতার মান সম্মানের উপরে সাম্রাজ্যের ঐক্য নির্ভর করতো। এরকম বিভিন্ন ঘরানার সাম্রাজ্যের কোন মনস্তাত্ত্বিক ঐক্যবোধ ছিল না, ছিল শুধু ক্ষমতার ঐক্য। রোমের ভূমিকা ছিল কিছুটা ভাল, গ্রিক-রোমান সভ্যতা ছিল এমন একটা পর্যায় যেখানে ব্যক্তির জন্য থাকতো কিছুটা মূল্যবোধের শিক্ষা-দীক্ষা, যা অবস্থানগতভাবে ছিল সীমান্ত-বহির্ভূত গোষ্ঠীগত বর্বরতার পুরোপুরি বিপরীত বিন্দুতে। আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত, আগাপাশতলা বরাবর সমাজের উচ্চতর অংশের কিছু সাধারণ ভাবাবেগ-অনুপ্রাণিত ঐক্যবোধ ব্যতিরেকে কোন বিশাল সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ রাখা খুবই দুরূহ ছিল, এবং বর্তমান সময়ের তুলনায় সেই যুগে এধরনের সাধারণ ভাবাবেগ উৎসারণ সম্পর্কিত উপলব্ধির মাত্রাও ছিল খুবই সীমিত। সেই কারণে সামাজিক আসঞ্জনের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটি তখনও ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তার প্রয়োজনীয়তা একটি ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাচীন গোষ্ঠী ও সমাজজীবনে বিশাল সৈন্যবাহিনীর সম্ভাব্যতার মতো বিশাল আয়তনের প্রধান সুবিধার বিষয়টির ভারসাম্য নির্ধারিত হতে একটি অসুবিধাজনক দিকের মাধ্যমে এবং সেটি হলো-সাম্রাজ্যের এক অংশ থেকে অন্য প্রান্তে সৈন্যবাহিনীকে স্থানান্তর করতে দীর্ঘ সময় লাগতো, এবং এছাড়াও অসামরিক সরকার সামরিক আগ্রাসন প্রতিরোধের উপায় আবিষ্কার করতে পারেনি। আধুনিক যুগেও অন্তত কিছুটা স্তর পর্যন্ত এই অবস্থা দেখা গিয়েছিল। প্রধানত, গতিশীলতার অভাবেই ইংল্যান্ড, স্পেন এবং পর্তুগালকে হারাতে হয়েছিল পশ্চিম গোলার্ধে তাদের অধিকার, কিন্তু বাষ্প ইঞ্জিন ও টেলিগ্রাফ আবিষ্কারের ফলে, আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে উঠলো বিশাল অঞ্চল ধরে রাখা, এবং সর্বজনীন শিক্ষা প্রচলনের পর থেকে বিশালসংখ্যক মানুষের মধ্যে কম-বেশি কৃত্রিম আনুগত্যবোধ সঞ্চারিত করা সহজ হয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি শুধুমাত্র বিশাল গোষ্ঠীভিত্তিক আসঞ্জনের মনস্তত্ত্বকেই সাবলীল করে তোলেনি, তা অর্থনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড়সড়ো গোষ্ঠীকে অপরিহার্যও করে তুলেছে। বিশালায়তন উৎপাদনভিত্তিক সুবিধার বিষয়টি একটি মামুলি অজুহাত, যা আমি বিস্তৃত করতে চাই না। যেমন-আমরা সকলেই জানি, পশ্চিম ইউরোপের জাতিসমূহের অভ্যন্তরীণ নিকট-ঐক্যের কারণস্বরূপ এই বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নীলনদ, সেই প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র ইজিপ্টের আসঞ্জন-প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে, যদিও শুধুমাত্র উচ্চ-নীল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক কোন সরকার নিম্ন-নীল অঞ্চলের উর্বরতা ধ্বংস করতে পারতো। এক্ষেত্রে কোন উন্নত প্রযুক্তির অংশগ্রহণ ছিল না, কিন্তু টেনেসি উপত্যকা প্রকল্প এবং প্রস্তাবিত সেন্ট লরেন্স জলপথ ছিল নদীসমূহের একই আসনমূলক ফলশ্রুতির বিজ্ঞানভিত্তিক সম্প্রসারণমাত্র। কেন্দ্রীয় শক্তি পর্ষদগুলো ব্যাপক অঞ্চলে বিদ্যুৎ বণ্টন করার কাজ করতো ও এভাবেই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং ক্ষুদ্রায়ত অঞ্চলের তুলনায়। বৃহত্তর অঞ্চলে এগুলো অধিকতর লাভজনকও হয়ে উঠেছিল। আণবিক শক্তির ব্যবহারকে যদি বৃহদায়তন ভিত্তিতে বাস্তবায়িত (যা অসম্ভব নয়) করে তোলা যায়, তাহলে তার দ্বারা বন্টনের এলাকাকে বিপুলতর লাভজনক রূপে সম্প্রসারিত করা যাবে, বড় বড় সংস্থার পরিচালন-গোষ্ঠী এইসব আধুনিক অগ্রগতির মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাত্রাকে বৃদ্ধি করতে সমর্থ হবে, এবং একই সঙ্গে ক্ষুদ্রতর সংস্থার তুলনায় মুষ্টিমেয় বৃহত্তর সংস্থাগুলোকে অধিকতর উৎপাদনমুখী হয়ে উঠবে। এই গ্রহের সামগ্রিক নীতি-নিয়মটা এরকমই যে, কী অর্থনৈতিক, কী রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই আয়তনগত সুবিধার কোন দৃশ্যমান সীমারেখা নেই ।
আমি এখন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মোটামুটিভাবে একই সরকার-পরিচালিত উন্নয়ন ধারার একটি ভিন্নতর সমীক্ষা প্রসঙ্গে আসব। শুধুমাত্র সরকারের আওতাধীন অঞ্চলের আয়তনেই নয়, বরং ব্যক্তিজীবনে সরকারি হস্তক্ষেপের গভীরতাবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও, সমগ্র ইতিহাস জুড়েই দেখা যায় সমাজ-সদস্যদের জীবনের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের ভিন্নময়তা ও বৈচিত্র্যময়তা। সভ্যতা’ অভিধায় আমরা যা চিহ্নিত করে থাকি, তার সূত্রপাত ঘটেছিল সুসংগঠিত রূপের সাম্রাজ্য ব্যবস্থা থেকে, যার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল-ইজিপ্ট, ব্যাবিলন এবং নিনেভা; আজটেক ও ইনকা সাম্রাজ্যও অনিবার্যভাবেই ছিল একই ধরনের। এই ধরনের সাম্রাজ্যে, প্রথমদিকে উচ্চবর্ণের মানুষদের ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যক্তিউদ্যোগ, কিন্তু ভিন্নদেশ জয়ের সুবাদে আনীত বিশালসংখ্যক দাসজনসাধারণের কোন উদ্যোগ বা উদ্যমই ছিল না। যাজকতন্ত্রও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করতে সমর্থ ছিল। একমাত্র ধর্মভিত্তিক পটভূমি ছাড়া রাজা চরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং তার প্রজাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য করতে পারতেন। রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও যাজকতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, এই দুইয়ের সম্মিলনে গড়ে উঠেছিল স্থিতিশীল সমাজ। এরকমই একটি দৃষ্টান্ত ইজিপ্ট যা আমাদের জানাশোনার পরিধিতে সর্বাধিক স্থিতিশীলতারই দৃষ্টান্ত বিশেষ। এই স্থিতি অর্জিত হয়েছিল কঠোরতার বিনিময়ে এবং এই প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলো একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত এতটাই গতানুগতিক হয়ে পড়েছিল যে, তারা আর বিদেশী আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারত না। পারস্য তাদের গ্রাস করে ফেলেছিল এবং অবশেষে পারস্যও গ্রীকদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। গ্রিকজাতি একটা নতুন ধরনের সভ্যতার উন্নয়ন ঘটিয়েছিল যা প্রচলিত হয়েছিল ফিনিসিয়দের উদ্যোগে বাণিজ্য ও সমুদ্র শক্তির ওপর গঠিত নগর-রাষ্ট্রপর্যায়। নাগরিকদের প্রতি প্রদত্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরিখে গ্রিসের নগরগুলোর মধ্যে ছিল পারস্পরিক বৈসাদৃশ্য; অধিকাংশ নগরের ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিমাণেই স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু স্পার্টা নগরীতে এই স্বাধীনতার পরিমাণ ছিল ন্যূনতম। তাদের অধিকাংশকেই থাকতে হতো স্বৈরাচারীদের প্রভাবে এবং দীর্ঘকাল ব্যাপী বজায় থাকত বিদ্রোহ-প্রভাবিত স্বেচ্ছাচারমূলক শাসন। নগররাষ্ট্রে বিদ্রোহ-বিপ্লবের বিষয়টি ছিল খুবই সহজ। কোন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিলাষী রাজনৈতিক কারণে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিদের সেই সরকারি অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে মাত্র কয়েক মাইল অতিক্রম করতে হতো এবং সেইসব ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য সর্বদা কিছু শত্রুপক্ষীয় রাষ্ট্র প্রস্তুত থাকতো। গ্রিসদেশের মহান অতীত কালব্যাপী বজায় ছিল একটি নির্দিষ্ট স্তরভিত্তিক নৈরাজ্য, আধুনিক মননে যা অসহনীয় রূপেই বিবেচিত হবে। কিন্তু একটি গ্রিক নগরের নাগরিকবৃন্দ, এমনকী যারা সরকারের বিরুদ্ধাচারী হিসেবে পরিচিত ছিল, সকলেই এক ধরনের আদিম আনুগত্যের মনস্তত্ত্ব পোষণ করতো, তারা তাদের নিজেদের নগরকে একধরনের মুক্তিহীন অথচ চরম আবেগপূর্ণ আনুগত্য দিয়ে ভালবাসতো। আমি মনে করি-ব্যক্তিগত কৃতিত্বে গ্রিকদের মহান ঐতিহ্যের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অযোগ্যতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। কেননা ব্যক্তিগত আবেগের শক্তিই ছিল ব্যক্তিগত কৃতিত্ব ও গ্রিক-ঐক্য অর্জনে ব্যর্থতার উৎস। এই কারণে গ্রিসকে প্রথমে ম্যাসিডোনিয়া এবং পরে রোমের প্রভাবাধীনে পড়তে হয়েছিল।
সম্প্রসারণশীল অবস্থায় রোমক সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যক্তিগত ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রসার ঘটিয়েছিল, কিন্তু অগস্টাস সরকারের পরে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ, আরও নিয়ন্ত্রণ জারি হল, এবং সবশেষে নিছক মাত্রাধিক করধার্যের কারণে বিশাল রোমক সাম্রাজ্যের বৃহত্তর রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন ঘটেছিল। তবে, অবশিষ্ট যা রইলো-সেখানেও নিয়ন্ত্রণ কমলো না। জাস্টিনিয়ানের ইতালি ও আফ্রিকা পুনর্বিজয়ের অন্যান্য কারণের চেয়ে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল-এই ধরনের অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! যারা প্রথমে বিশাল সেনাবাহিনীকে গথ ও ভ্যান্ডালদের তরফ থেকে প্রেরিত রক্ষক হিসাবে স্বাগত জানিয়েছিল, এই সেনাবাহিনীর পিছু পিছু আসা কর-সংগ্রাহকদের দেখা তারাই তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেছিল ।
সুসভ্য পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করার রোমের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল-সম্ভবত অতি দূরবর্তী ও বিদেশী বৈশিষ্ট্যের জন্য সে এমনকী সমৃদ্ধ নাগরিকদের জন্যও কোন প্রবৃত্তিগত সুখের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তার শেষ শতকগুলোতে সেখানে দেখা গিয়েছিল সামগ্রিক হতাশা ও উদ্যমহীনতা। মানুষ মনে করতো-এই ধরাধামে নশ্বর জীবনের দেওয়ার মতো কিছু নেই, এবং মানুষের এই লালিত ধারণা আগামী দিনের মানুষের ভাবনাকে কেন্দ্রীভূত করতে খ্রিস্টধর্মকে সাহায্য করেছিল।
রোম রাহুগ্রস্ত হওয়ার পরে পাশ্চাত্যে দেখা গিয়েছিল এক পূর্ণাঙ্গ রূপান্তর। ব্যবসা-বাণিজ্যচক্র প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, মহান রোমের পথ সংস্কারের অযোগ্য হয়ে উঠলো, খুদে রাজারা পরস্পর নিজেদের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহে মেতে রইলো এবং তাদের নাগালে থাকা ছোটখাটো অঞ্চল জুড়ে তাদের শাসন অব্যাহত রইলো, সেই সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে উদ্ভত জার্মান-ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত অভিজাততন্ত্রের অরাজকতা ও পুরাতন রোমক ঐতিহাবিষ্ট মানুষদের পুঞ্জীভূত বিতৃষ্ণার সঙ্গে। পশ্চিম খ্রিস্ট-সাম্রাজ্য থেকে ব্যাপক দাসপ্রথা প্রায়-অবলুপ্ত হল কিন্তু তার পরিবর্তে এল দায়বদ্ধ কৃষকবৃত্তি। সুবিশাল নৌ-পরিবহনের মাধ্যমে আফ্রিকা থেকে রোমে আনীত শস্য-সহায়তার পরিবর্তে খুবই সীমিত বিরল বহির্যোগাযোগের সুবিধাবলম্বী ছোট ছোট সম্প্রদায়গুলো তাদের নিজেদের জমির উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল হয়ে সাধ্যমতো বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া শুরু করলো। জীবনযাপন খুবই কঠিন ও রূঢ় হয়ে দাঁড়ালো, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তা আর রোম সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলোর মতো অবসাদ ও হতাশায় পরিপূর্ণ ছিল না। সমগ্র অন্ধকার যুগ ও মধ্যযুগ ধরে আইনহীন বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছিল, যার ফলে সর্বস্তরের চিন্তাশীল মানুষের আইনী অনুশাসনের পুজো করতে শুরু করেছিলেন। কালক্রমে উদ্দমতা-প্রসূত বিশৃঙ্খলা থেকেই জন্ম নিল এক ধরনের শৃঙ্খলা, যা এক দল মহান মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলো এক নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে।
পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবেই ক্রমবর্ধমান; প্রথমত, এর প্রধান কারণ ছিল-বারুদের আবিষ্কার । ঠিক যেমন নৈরাজ্যবাদের গোড়ার দিনগুলোতে সবচেয়ে চিন্তাশীল মানুষ আইনের পুজো করতো, সেরকমই ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রশক্তির সময় পর্বে স্বাধীনতার আবাহন এক ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রূপে দেখা দিয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা প্রসারের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে দেখা গিয়েছিল। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সাফল্য এবং এটা শৃঙ্খল বজায় রাখার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল এবং নিম্নতম সামাজিক স্তরের নয় এমন নাগরিকদের কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্বাধীনতা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও এটা ঘটেছিল। অবশ্য, স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগের বিষয়টির অন্তর্নিহিত শক্তি অনেকাংশেই হারিয়ে গিয়েছিল সংস্কারকদের মধ্যে থেকে এবং এই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল সাম্যের প্রতি ভালবাসা যা আবার ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত হয়েছিল উচ্চমান্যতার ঐতিহ্যবাহী দাবি ব্যতিরেকেই নতুন শিল্প-উদ্যোক্তাদের বদান্যতা ও ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার সূত্রে অন্তত প্রায় সকলকেই এটুকু বোঝানো সম্ভব হয়েছিল যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের সন্তোষবিধানকারী পরিস্থিতির তুলনায় একটা দৃঢ়তর সামাজিক ব্যবস্থার আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
এক ধরনের নতুন যাজকতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত প্রধান ইজিপ্টের স্বর্গীয় রাজকীয় ব্যবস্থার বিপরীত রূপান্তরমাত্র নয়-ঠিক এরকম একটা অবস্থা উদ্ভূত হয়েছিল এই বিশ্বের এক বৃহত্তর অংশে। যদিও এখনও পর্যন্ত এই প্রবণতা প্রাচ্যের মতো পাশ্চাত্যে এতদূর প্রসারিত হয়নি, তবুও তা এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যা ইংল্যান্ড ও আমেরিকা দুটি দেশেরই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীকে বিস্মিত করেছে। রাষ্ট্র বা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বিন্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে, এর ফলে এমন বিপদের সম্ভাবনাও রয়েছে, যা দেখা গিয়েছিল প্রাচীন রোমে-এবং তা হল, সতেজ জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর এক ধরনের অবসাদ ও অদৃষ্টবাদ। আমি অবিরাম এই ধরনের বয়ানে চিঠি পাই, আমি দেখছি যে, পৃথিবীর অবস্থা খুবই খারাপ স্তরে পৌঁছেছে, কিন্তু একজন সাদামাটা বিনয়ী মানুষ এর জন্য কী করতে পারে? জীবন ও ধনসম্পদ যেন কয়েকজন মানুষের একচেটিয়া অনুগ্রহ-বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে-একমাত্র তারাই শান্তি বা যুদ্ধ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকারী। যে কোন বৃহদায়তন ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়ে থাকে এমন বিশেষ কিছু মানুষের দ্বারা, যারা রাষ্ট্র অথবা বিশাল সংস্থাগুলোতে শাসন চালায়। এমনকী যেখানে নামমাত্র গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানেও নীতিনির্ধারণে একজন নাগরিকের ভূমিকা হল অত্যন্ত নগণ্য। এই অবস্থায় কি গণমুখী কাজকর্ম ভুলে গিয়ে সময় সভ্যতার শর্তসাপেক্ষে সর্বাধিক আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে যাওয়া অধিকতর বাঞ্ছনীয় নয়?’ এধরনের চিঠিপত্রের উত্তর দেওয়া আমার কাছে খুবই দুরূহ মনে হয় এবং আমি এ ব্যাপারেও সুনিশ্চিত-যে মানসিক পরিমন্ডল এধরনের চিঠি লিখতে তাদের প্রাণিত করে, তা স্বাস্থ্যকর সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। নিছক আয়তনের ফলশ্রুতিতে সরকারের সঙ্গে শাসিতের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলে, এবং এই ভাবে এমনকী গণতন্ত্রে নিজস্ব ঢঙের এক স্বাধীন জীবনচর্যার প্রবণতা দেখা যায়। আমি জানতে চাই না কোন উপায়ে সম্পূর্ণভাবে অশুভ প্রবণতার নিরাময় সম্ভব, কিন্তু আমি মনে করি, এর অস্তিত্বকে চিহ্নিত করা এবং এর মাত্রাকে হ্রাস করার জন্য পথের অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরস্পরের চেনাজানায় এরকম ক্ষুদ্র গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদের প্রতি আনুগত্যের মতো সামাজিক আসঞ্জনের প্রবৃত্তিগত প্রক্রিয়াটি আধুনিক পৃথিবীতে বিশাল রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ধরনের চেয়ে বাস্তবিকই বহুলাংশে পৃথক, এবং এমনকী আদিম ঐতিহ্যের আনুগত্যের অবশিষ্টাংশও বিপদসংকুল পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। একজন ইংরেজ অথবা একজন স্কটল্যান্ডের মানুষ ব্রিটেনের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য পালন করতে পারে : তার জানা থাকতে পারে, শেক্সপিয়র তাদের দেশ সম্পর্কে কী বলেছেন; সে জানে-এটা হল একটা দ্বীপ, যার সীমানা সম্পূর্ণভাবেই প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক। সে ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত, অন্তত এই দেশের গৌরবময় পর্বের সবটুকুই তার জানা, এবং সে এ-ও জানে-মহাদেশের মানুষেরা বিদেশী ভাষায় কথা বলে। কিন্তু যদি ব্রিটেনের মতো আনুগত্যের স্থানে পশ্চিমী সংঘকে প্রতিস্থাপিত করতে হয় তাহলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে এমন এক ধরনের সচেতনতার প্রয়োজন দেখা দেবে, যা জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে এক ধরনের ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করবে; কারণ, এছাড়াও এই উদ্দেশ্যের পরিপূরক আর মাত্র একটিই মনস্তাত্ত্বিকতার কথা ভাবা যায় এবং তা হ’ল বহির্শক্র থেকে ভীতিজনিত মানসিকতা। কিন্তু, ভয় হল একটা নেতিবাচক মানসিকতা, যা বিজয়ের মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। যখন এটাকে একজন গ্রিকের তার স্বদেশ-নগরীর প্রতি ভালবাসার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই বন্ধন কতই না ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এবং তাৎক্ষণিক ও বর্ধমান বিপদের অনুপস্থিতিতে যে আনুগত্য নিছক সাধারণ নর-নারীর প্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর ভর রেখে অবস্থান করে।
তার অস্তিত্বের একেবারে গোড়ার দিনগুলো থেকে সরকারের দুটি কার্যধারা রয়েছে, একটি নেতিবাচক ও একটি ইতিবাচক। এই নেতিবাচক কাজের মধ্যে রয়েছে বে-সরকারি হিংসা দমন, জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা, ফৌজদারি আইন-প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ। এসব ছাড়াও, এর একটা ইতিবাচক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তা হল অধিকাংশ নাগরিকের পক্ষে উপযোগী ও জরুরি অভিলাষসমূহের রূপায়ণ-প্রক্রিয়ার ত্বরান্বিতকরণ। অধিকাংশ সময়েই সরকারের ইতিবাচক কার্যাবলি যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে : যদি কোন শত্রুকে পরাজিত করা যায় এবং তার এলাকা দখল করা যায়, তাহলে বিজয়ী জাতির প্রত্যেকেই কম-বেশি লাভবান হয়। কিন্তু, বর্তমানে সরকারের ইতিবাচক কার্যাবলি বহুধাবিস্তৃত। সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে হয়-শিক্ষা যা শুধুমাত্র পণ্ডিতসুলভ চর্চা দিয়ে নয়, বরং সুনির্দিষ্ট আনুগত্য ও বিশ্বাস-সঞ্চারক উপরকরণ দিয়ে গড়ে উঠবে। এগুলো হল সেইসব উপকরণ, যা রাষ্ট্রের কাছে কাম্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তত সীমিত পর্যায়েও যা কিছু ধর্মীয় সংস্থার কাছেও অভীলিত। এরপরেও রয়েছে সুবিশাল শিল্পোৎপাদন উদ্যোগ। এমনকী, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যথাসম্ভব রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সীমিত রাখার পক্ষপাতী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেরও উপরোক্ত ধরনের উদ্যোগে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অতি দ্রুতগতিতে বেড়েই চলেছে এবং শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রেও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, রাষ্ট্র পরিচালিত ক্ষেত্রে ও বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ক্ষেত্রের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। উভয় ক্ষেত্রেই, প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছায় না হলেও এমন একটা সরকার রয়েছে, যার সঙ্গে তার নিয়ন্ত্রকদের রয়েছে যথেষ্ট দূরত্ব। একমাত্র রাষ্ট্র অথবা বেসরকারি সংস্থার সদস্যরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ সচেতনতাকে উজ্জীবিত করতে পারে এবং নিছক প্রয়োজনীয় উপকরণের মতো যন্ত্রকে মান্য করার মতোই সরকারের তরফ থেকে, যারা তাদের অনুকূলে কম-বেশি কাজ করে, তাদের মান্য করার একটা অনিবার্য প্রবণতা রয়েছে। মসৃণ সহযোগিতার ইচ্ছায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সংস্থার আয়তন বর্ধিত করার প্রবণতা থাকে এবং সেকারণে স্ব-উদ্যোগ রয়েছে, এমন মানুষদের সংখ্যা কমানোরও প্রবণতা থাকে। আমাদের বর্তমান দৃষ্টিকোণ থেকে, সবচেয়ে খারাপ বিষয় হল-ব্রিটেনের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এমন একটা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে যেখানে যাদের মধ্যে অতি সামান্য পরিমাণে উদ্যোগ রয়েছে, তারা চিরকাল জনপালন কৃত্যকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে আর এই জনপালনের মধ্যে রয়েছে শুধু ‘ভেটো ও পরিকল্পনা-শূন্যতার ক্ষমতা, এবং যা এইভাবে শুধুমাত্র নিষিদ্ধকরণের অনুকূলে এক ধরনের চিরন্তন নেতিবাচক মনস্তত্ত্বের ভিত গড়ে তুলেছে। এরকম একটা ব্যবস্থায় উৎসাহ পর্যবসিত হয় হতাশায়; যারা অধিকতর আশাবাদী পরিবেশে উৎসাহী হয়ে উঠতে পারতো, তারাও অবসন্ন ও অসার হয়ে যেতে পারে এবং এরকম সম্ভাবনাও নেই যে, রাষ্ট্রের ইতিবাচক কাজগুলো উদ্দীপনা ও দক্ষতা সহকারে সম্পন্ন হবে। এরকম সম্ভাবনাও রয়েছে যে, অর্থনৈতিক পতঙ্গবিজ্ঞান বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে মুনাফা নিয়ে আসবে, কিন্তু এর জন্য এক উল্লেখযোগ্য অংশ পতঙ্গবিজ্ঞানীর বেতন মঞ্জুর করতে হবে এবং বর্তমানে সরকারের অভিমত হল-পতঙ্গবিজ্ঞানীদের নিয়োগ করার মতো উদ্যোগী নীতিকে খুব ধীরে রূপায়িত করা হবে। বলা নিপ্রয়োজন-এটা এমনই মানুষদের একটা অভিমত যারা একটি বিশেষ ধরনের অভ্যাস রপ্ত করেছেন। এই অভ্যাসের সুবাদে একদল আগে তারা অবশ্য বিচারও করেন না যে, ওটা আদৌ কোন ক্ষতিকর বস্তু কিনা। যে পটভূমিতে দূর-নিয়ন্ত্রণী ব্যবস্থা রয়েছে এবং বিশালতর সংগঠনের যেখানে আরও অনেক বেশি দূর নিয়ন্ত্রণী ব্যবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে, সেক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষতিকর প্রবণতাকে এড়িয়ে চলা খুবই দুরূহ।
পরবর্তী একটি বক্তৃতায় আমি বিশ্লেষণ করবো, বৃহদায়তন সংগঠনের সুনিশ্চিত সুবিধাকে না হারিয়ে এই অশুভ প্রবণতার সমাধানে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এরকমও হতে পারে যে, বর্তমানে কেন্দ্রীভূত করার দিকে প্রবণতা এতটাই শক্তিশালী যে, তাকে প্রতিরোধ করা অসাধ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা কোন বিপর্যয় বয়ে আনে-যে রকম বিপর্যয়ের সূত্র ধরে নৈরাজ্য ও দারিদ্র্যের সমস্ত রকম অনিবার্য ফল সহ পঞ্চম শতাব্দীতে সমগ্র ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছিল-যতক্ষণ পর্যন্ত না জীবনের স্বাদসঞ্চারী ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মাত্রা মানুষ আবার অর্জন করতে পারে। আমি আশা করি, ঘটনা আসলে এরকমটা নয়, কিন্তু যদি বিপদের গুরুত্ব না উপলব্ধি করা হয় এবং তার মোকাবিলা করতে যদি না কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এরকম ঘটনা ঘটবেই।
ঐতিহাসিক পর্বে সংগঠিত সামাজিক আসন-সম্পর্কিত পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত চালচিত্রে, আমরা একটি দ্বি-স্তর আন্দোলনকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি ।
একদিকে রয়েছে একটা সময়ভিত্তিক অগ্রগতি, যা আসলে এক ঢিলেঢালা ও আদিম ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা থেকে বৃহত্তর এলাকাভিত্তিক ও বৃহত্তর সংখ্যক ব্যক্তি মানুষের জীবনের সুবিন্যাসমূলক সুশৃঙ্খল সরকারে ক্রমশ উত্তরণ। অগ্রগতির এই পর্বের-এক নির্দিষ্ট স্তরে, যেখানে সম্পদ ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্প্রতি দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য, কিন্তু আদিমতর যুগের প্রাণশক্তি ও উদ্যম এখনও অন্তর্হিত হয়নি, সেক্ষেত্রে সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠিতে বড় ধরনের কৃতিত্বের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যখন নতুন সভ্যতা গতানুগতিকতায় পর্যবসিত হয়, যখন সরকার সব ক্ষমতা হাতের মুঠোয় কেন্দ্রীভূত করার সময় পায়, যখন লোকাঁচার, ঐতিহ্য এবং আইনের সুবাদে বিধিনিয়ম এমনভাবে প্রচলিত হয়েছে যাতে উদ্যোগ স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সংশ্লিষ্ট সমাজ এক অচল অবস্থায় প্রবেশ করে। মানুষ তাদের পূর্বসূরীর শোষণকে প্রশংসা করে, কিন্তু নিজেদের সেই সমাবস্থায় নিয়ে যেতে পারে না; শিল্পকলা হয়ে পড়ে গতানুগতিক; এবং কর্তৃত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বিজ্ঞান গতিরুদ্ধ হয়ে যায়।
কঠোর রাজ্য-অনুসৃত এই ধরনের অগ্রগতি দেখা যায় চীন ও ভারতে, মেসোপটেমিয়া ও ইজিপ্টে, এবং গ্রিক-রোমক পৃথিবীতে। সাধারণত এর অবসান ঘটে বিদেশী অভিযানের সূত্রেঃ পুরনো শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পুরনো নিয়মনীতি রয়েছে, কিন্তু যখন কোন নতুন ধরনের শত্রুর উদয় হয়, তখন বয়োজ্যেষ্ঠ সমাজের পক্ষে সুরক্ষা প্রদানকারী নতুন নিয়মনীতিতে অভিযোজিত হয়ে উঠতে পারে না। যদি-যা প্রায়শই ঘটে থাকে-বিজিতদের চেয়ে বিজেতারা কম সভ্য হয়, সেক্ষেত্রে সম্ভবত বিশাল সাম্রাজ্যশাসন করা বা বিস্তৃতর অঞ্চল জুড়ে বাণিজ্য ব্যবস্থা সংরক্ষণ করার মতো দক্ষতা তাদের থাকে না। এর অনিবার্য ফল-জনসংখ্যা, সরকারি সংস্থার আয়তন ও সরকারি নিয়ন্ত্রণের কঠোরতার হ্রাস। কালক্রমে, নতুনতর কম-বেশি নৈরাজ্যবাদী অবস্থায় সজীবতা ফিরে আসে, এবং এক নতুন পরিক্রমার সূচনা হয়।
কিন্তু, এ ধরনের পর্যাবৃত্ত অগ্রগতি ছাড়াও আরও একটি আছে। প্রতিটি পর্যায়ের শীর্ষে, কোন পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় কোন রাষ্ট্র-শাসিত অঞ্চলের আয়তন বৃহত্তর হয়ে থাকে, এবং ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণের মাত্রা পূর্ববর্তী যে কোন আমলের চেয়ে অনেক বেশি কঠোরতর হয়ে থাকে। রোমক সাম্রাজ্য ব্যাবিলনীয় ও ইজিষ্পীয় সাম্রাজ্যের চেয়ে বড় ছিল, এবং বর্তমানের সাম্রাজ্য, রোম সাম্রাজ্যের চেয়ে বৃহত্তর। অতীত ইতিহাসে কখনও এমন কোন বড় রাষ্ট্র দেখা যায়নি, যা তার নাগরিকদের সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, অথবা এমনকী পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মতো সামগ্রিকভাবে শাসন করে চলেছে।
যেহেতু, এই পৃথিবীর রয়েছে সুনির্দিষ্ট আয়তন, নিয়ন্ত্রিত না হলে এই প্রবণতার সূত্র ধরে গড়ে উঠবে এক অখণ্ড বিশ্বরাষ্ট্র। কিন্তু, যেহেতু তখন কোন বহির্শক্রর অস্তিত্ব থাকবে না, তাই ভীতির মাধ্যমে আসঞ্জন উন্নয়নেরও প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, সে কারণে পুরনো মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া আর যথেষ্ট বলে গণ্য হবে না। বিশ্বরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে কোন দেশপ্রেমের সুযোগ থাকবে না; ঘৃণা ও ভয়ের সক্রিয় উপাদান ব্যতিরেকেই আত্মস্বার্থ ও বদান্যতা থেকে চালিকাশক্তিকে খুঁজে নিতে হবে। এই ধরনের সমাজ কি টিকে থাকতে পারে? যদি টিকে থাকে, তাহলে তা কি প্রগতির চাকাকে সচল রাখতে সমর্থ হবে? এসব খুবই দুরূহ প্রশ্ন । এর উত্তরের জন্য কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, যা পরবর্তী বক্তৃতাসমূহে আলোচিত হবে।
আমি অতীত ইতিহাসের এক ধরনের দ্বি-স্তর অগ্রগতির কথা বলেছি, কিন্তু আমরা আবিষ্কার করতে পারি, এমন ঐতিহাসিক অগ্রগতি সংক্রান্ত নিয়মের নির্দিষ্টতা ও অনিবার্যতাকে আমি বিবেচনা করি না। নতুন জ্ঞান ঘটনাক্রমকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় চালিত করতে পারে, উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা-আবিষ্কারের ফলাফলের উল্লেখ করা যায়। আগে থেকে অনুমান করা যায় না, এরকম ঘটনার ওপরেও নতুন প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে : আমি ভাবতে পারি না কিভাবে জুলিয়াস সিজারের সমকালীন একজন রোমান ক্যাথলিক চার্চের মতো ভীবষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে, কেউ-ই, এমনকী মার্ক্সও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাবনা দেখতে পাননি, এইসব কারণের জন্য, মানবজাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে কোন ভাবিষ্যদ্বাণীকেই বিবেচনাযোগ্য প্রকল্পিত ধারণারূপে বিশ্লেষণ করা উচিত।
আমি মনে করি, যেহেতু সমস্ত সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণীই অসংগতিপূর্ণ সেকারণে কিছু অবাঞ্ছিত সম্ভাবনা থেকেই যায়, তাই এই বিষয়টি মনে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। একদিকে, যে কোন সভ্য দেশেই দীর্ঘস্থায়ী ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শিল্পক্ষেত্রের পতন ডেকে আনতে পারে,যার ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্রশিল্পের নৈরাজ্যবাদী উত্থান ঘটতে পারে-রোমের পতনের পরে পশ্চিম ইউরোপে সেরকমটি ঘটেছিল। এর ফলে ঘটতে পারে ব্যাপক জনসংখ্যা হ্রাসের ঘটনা, এবং অন্তত কিছু দিনের জন্যও, সভ্য জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য রূপে যেসব কার্যাবলিকে আমরা গণ্য করি, তার অধিকাংশই অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু, এরকম আশা করাটাই সম্ভবত যুক্তিযুক্ত-যা ঘটেছিল মধ্যযুগে-পর্যাপ্ত অথচ ন্যূনতম সামাজিক আসন-প্রক্রিয়ার যথাসময়ে প্রত্যাবর্তন ঘটবে এবং হারানো জমি ক্রমশ উদ্ধার করা যাবে।
তবে আরও একটি বিপদ রয়েছে, যা সম্ভবত উপলব্ধি করা প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তি সরকারি নিয়ন্ত্রণের আরও কাঠোরতা সম্ভব করে তুলেছে এবং চরম শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই সম্ভাবনার পরিপূর্ণ অপব্যবহার করা হয়েছে। এরকম হতে পারে-যুদ্ধের চাপে অথবা ভয়ে, অথবা কোন চরম শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কর্তৃক বিজয় অভিযানের ফলে, পৃথিবীর যেসব অংশে ব্যক্তিস্বাধীনতার ছিটেফোঁটাও টিকে আছে, সেইসব অঞ্চলের সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে, এবং এমনকী এই সব এলাকায় স্বাধীনতা ক্রমশ আরও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। এরকম মনে করার বিশেষ কারণ নেই-এর ফলে ব্যবস্থা অস্থায়ী হবে, কিন্তু তা প্রায় নিশ্চল ও প্রগতিবিমুখ হবেই এবং এর সঙ্গে প্রাচীন অশুভ উপসর্গাদির প্রাদুর্ভাব ঘটবেঃ দাসপ্রথা, গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা, অধিকাংশ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের অবস্থা। আমার মতে, এটা এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এবং এর বিরুদ্ধে সর্তক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে, পূর্বের তুলনায় বর্তমান সময়ে ব্যক্তির মূল্যের ওপর গুরুত্বদান অনেক বেশি জরুরি।
আরও একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, যা পরিহার করা উচিত। যে বিষয়ের স্বপক্ষে আমি ওকালতি করে চলেছি তার ভিত্তিতে আমি মনে করি এটা সত্য যে, মানুষের যা সহজাত, বিগত শত-সহস্র বৎসর ধরে তার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু যা সহজাত তা আধুনিক মানুষের মানসিক কাঠামোর এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশমাত্র। আমি তা বলতে চাইছি-আমি কাউকে এমন সিদ্ধান্তে আসতে বলছি না যে, যুদ্ধহীন পৃথিবীতে আবশ্যিকভাবেই এসে যাবে প্রবৃত্তিজাত হতাশা। ১৮১৪ সাল থেকে সুইডেন কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, বলা যায় প্রায় চার প্রজন্মের মোট সময়সীমা। কিন্তু আমি মনে করি না, কেউ বলবে যে, এই অনাক্রম্যতার ফলস্বরূপ সুইডেনের মানুষেরা তাদের প্রবৃত্তিগত জীবনে খুবই কষ্টভোগ করেছে। মানবজাতি যদি যুদ্ধবিলোপে সফল হয়, তাহলে রোমাঞ্চ সুখ ও ঝুঁকি গ্রহণের আরও নির্গম-পথ খুঁজে বার করা কঠিন হবে না। পুরনো নির্গম-পথগুলো, এক সময় যা জৈব উদ্দেশ্যেই সাধন করতো, সেগুলো আর কার্যকরী নয়, এবং সে কারণে নতুন নির্গম-পথ খুবই জরুরি। কিন্তু মানব-প্রকৃতিতে এমন কিছু নেই যা ধারাবাহিক আঙ্গিকতার স্বপক্ষে মৌনসম্মতিদানে তাকে বাধ্য করতে পারে। শুধুমাত্র প্রত্যাঘাত অথবা ভুল-বোঝাবুঝি হলে আমাদের স্বল্প-সুশৃঙ্খল প্রবৃত্তিগুলো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। যখন এই ভ্রান্তিকে এড়িয়ে যাওয়া যায়, তখন একটি ভাল সামাজিক ব্যবস্থায় সংযোগ স্থাপনের সমস্যাটির সমাধান হতে পারে বুদ্ধি ও সদিচ্ছার সাহায্যে।