২. সপ্তগ্রাম
বংশবাটীর কিছু দক্ষিণে আদি সপ্তগ্রাম। বঙ্গসংস্কৃতির মধ্যযুগে তা ‘স্বর্ণনগরী’। তার সে আদিমরূপ আজ চিন্তার বাইরে। বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গলে’ দেখছি চাঁদ সদাগর সপ্তডিঙা ভাসিয়ে চলেছেন সমুদ্রে—বিপুল বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে। পথে পড়ল সপ্তগ্রাম। দেখতে পেলেন :
“অভিনব সুরপুরী দেখি সব সারি সারি
প্রতি ঘরে কনকের ঝারা,
নানা রত্ন অবিশাল জ্যোতির্ময় কাচ ঢাল
রাজমুক্তা প্রবালের ধারা।।”
নামকরণের সূত্রটি পাওয়া যাবে পৌরাণিক ইতিহাসে—
কিংবদন্তি অনুসারে বহু বহুযুগ পূর্বে কান্যকুব্জে ছিলেন এক নৃপতি। নাম প্রিয়বন্ত অথবা প্রিয়ব্রত। তাঁর ছিল সাত-সাতজন জোয়ান ছেলে। তাদের নাম : অগ্নিত্র, মেধাতিথি, বপুষ্মান, জ্যোতিষ্মান, দ্যুতুমান, সবন ও ভব্য। রাজার ছেলে, কিন্তু মতিগতি রাজসিক নয়, সাত্ত্বিক। সাতভাই একযোগে একদিন গৃহত্যাগ করল। ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম’– মন্ত্র তাদের, রাজসুখে বাঁধা পড়তে চায় না। দেশ-বিদেশ ঘুরতে ঘুরতে তারা এসে থামল ভাগীরথীর কিনারে। গঙ্গা-যমুনার কিনারে সাতটি স্থানে তপস্যায় বসল তারা। সেই তপস্যাস্থলে গড়ে উঠল সাত-সাতটি গ্রাম : বাঁশবেড়িয়া, বাসুদেবপুর, কৃষ্ণপুর, খামারপাড়া, দেবানন্দপুর, শিবপুর আর ত্রিশবিঘা। এই সাতটি গ্রাম নিয়েই হল সপ্তগ্রাম। পাশেই ত্রিবেণী—ভাগীরথী, সরস্বতী আর যমুনার মুক্তবেণী সঙ্গম। এ কাহিনীরও উল্লেখ আছে বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গলে’–
“বহিত্র চাপায়ে কূলে চাঁদ অধিকারী বলে
দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম
তথা সপ্তঋষিস্থান সর্বদেব অধিষ্ঠান
শোক দুঃখ সর্বগুণধাম।।
জ্যোতি হইয়া এক মূর্তি ঋষিমুনি সেরে তথি
জপ-তপ করে নিরন্তর।
গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি
অধিষ্ঠান উমা-মহেশ্বর।”
মাধবাচার্যের ‘চণ্ডীমঙ্গল’, মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’, মহারাজ লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ধোয়ী রচিত ‘পবনদূতম্’ কাব্যে এবং ‘চৈতন্য চরিতামৃতে’ আছে সপ্তগ্রামের বর্ণনা। আগেই বলেছি, গ্রীক ঐতিহাসিক বর্ণিত গঙ্গারিডি রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীরূপে সপ্তগ্রাম চিহ্নিত।
চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মিশর দেশীয় ভূপর্যটক ইবন বতুতা (1304-68) এসেছিলেন এখানে। আফ্রিকা ছাড়েন 1325-এ, ঘরে ফিরে যান আঠাশ বছর পরে। বাংলার মসনদে তখন সুলতান ফকরউদ্দীন। দিল্লীতে তখন দাস-বংশের গিয়াসুদ্দীন বলবন। ইবন বতুতা প্রসঙ্গক্রমে সপ্তগ্রামের অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। এমনকি বাজার দরও—”সপ্তগ্রামে একটা রূপোর দিরামে পাওয়া যায় পঁচিশ রিখল চাউল।” হিসেবটা বুঝিয়ে বলি। তখন মুদ্রা হিসাবে চালু ছিল রূপোর দিনার—আজকের একটাকার মতো। আট দিহরামে এক দিনার। আর ‘পঁচিশ রিখল’ মানে প্রার বিশ কিলোগ্রাম! দুগ্ধবতী একটি গাভীর দাম আজকের তিন টাকা। ‘পরমা সুন্দরী ক্রীতদাসীর দাম একটা সোনার দিরাম।’ অর্থাৎ দশ টাকা! শোনা কথা নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—”ঐ দামে আমি স্বয়ং একটি সুন্দরী বালিকাকে ক্রয় করেছিলাম। তার নাম লালুয়া।” -লিখে গেছেন ইবন বতুতা।
এক বৃদ্ধ বাঙালী মুসলমান নাকি বলেছিলেন, ‘সংসারে তিন তিনটি খাওয়াইয়া, মুই নিজে, এক বিবি, আউর এক কমবক্ত নোকর। সম্বৎসরে খাওনের খরচ হল গিয়ে পুরো এক দিনার!
ইবন বতুতা এ প্রসঙ্গে শেষ উপসংহারে বলেছেন, গোটা হিন্দুস্থানে শুধু নয়, গোটা দুনিয়ায় তখন বাংলাদেশের মতো সস্তার বাজার আর ছিল না।
হায়রে কবে কেটে গেছে ইবনবতুর কাল!
আরও জানাচ্ছেন, ফলের বাজারে মিলত—আম, জাম, আঙুর, ডালিম, নারকেল। আহারান্তে পান-চর্বণের রেওয়াজ ছিল। দিন-আনি দিন-খাই চিবাতো পান সুপারি, সৌখীন ব্যক্তিদের জন্য করঙ্কবাহিকা হাজির করত রূপার রেকাবীতে ভিন্ন ভিন্ন খোপে : পান, গুবাক, চুন, অন্যান্য মশলা ও কর্পূর। অর্থাৎ পূর্বযুগে নৈষধচরিতে যে বর্ণনা পাই তা তখনো টিকে আছে। ঘরানা ঘরের মেয়েরা পথ চলত দোলায় চেপে; সেটা পাল্কির বিকল্প। ঢাকা থাকত রেশমের পর্দায়। রেশম আসত ঢাকা অঞ্চল থেকে। দেশে সতীদাহ প্রথা ছিল, তবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে নাকি পুড়িয়ে মারা হত না।
আর একটি সূত্রে দেখছি—সাল তারিখ নিয়ে কিছু ভ্রান্তি আছে কিনা জানি না—ইবন বতুতার সপ্তগ্রাম দর্শনের প্রায় পঞ্চাশবছর আগে যখন রুকনউদ্দীন কৈকাউস্ শাহ্ গৌড়াধিপতি, তখন উলুগ-ই-আজম জাফর খাঁ বাহরাম ইংগীন সপ্তগ্রাম অধিকার করেছিলেন। তখন নাকি সেটাই ছিল গৌড়মণ্ডলের শ্রেষ্ঠ নগরী। তার পূর্বে সপ্তগ্রাম ছিল হিন্দু রাজার অধিকারে। কোন রাজার হাত থেকে জাফর খাঁ এই অধিকার ছিনিয়ে নেন তাঁর নাম জানা যায় না। কবি কৃষ্ণরামের ‘ষষ্ঠীমঙ্গল’ কাব্যে অনুমান করা যায় তাঁর নাম শত্রুজিৎ। ঐ জাফর খাঁ একটি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ইনি নাকি 1295 থেকে 1313 খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সপ্তগ্রামে অধিপতি ছিলেন, তাঁর মৃত্যুও হয় ওখানে। সরস্বতী ও ভাগীরথীর সঙ্গমে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, সেখানেই তাঁর সমাধি। বিতর্কিত বিষয়টি হল এই যে, অনেকের মতে ইনিই হচ্ছেন সাধক দরাফ খাঁ, যাঁর নামে সংস্কৃতে রচিত একটি গঙ্গাস্তোত্র পাওয়া যায়।
দু-আড়াইশ বছর পরের কথা। সুলতান হুসেন শাহ্-র (1493-1519) আমলে সপ্তগ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়—‘হুসেনাবাদ’। নামটি স্থায়ী হয়নি। হুসেন শাহকে নিশ্চয় চিনতে পারছ। তিনি বস্তুত বাঙলাদেশের স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। চৈতন্যদেবের প্রায় সমসাময়িক। তাঁর আমলে অনেক হিন্দু রাজপুরুষ উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। উজির ছিলেন পুরন্দর খাঁ (গোপীনাথ বসু), এছাড়া দবীর খাস (রূপ গোস্বামী), সাকর মল্লিক (সনাতন গোস্বামী), চিকিৎসক মুকুন্দ দাস। একদিকে যেমন রাজধানী গৌড়ে নির্মাণ করেছেন ছোট-সোনা মসজিদ, অন্যদিকে তাঁরই আদেশে ও অর্থানুকূল্যে মালাধর বসু বঙ্গানুবাদ করেন শ্রীমদ্ভগবৎগীতার। প্রতি জেলায় মসজিদসহ হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তগ্রামে তিনি একটি টাঁকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রধান কর্মাধ্যক্ষও একজন হিন্দু। সপ্তগ্রাম-টাঁকশালে মুদ্রিত হুসেন শাহ, শের শাহ্ প্রভৃতির নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে।
সম্ভবত হুসেন শাহ্রে আমলেও সপ্তগ্রামে পর্তুগীজ প্রভাব পড়েনি। দু-চারটি নৌকায় পর্তুগীজ ব্যবসায়ী হয়তো এসেছে; কিন্তু বড়জাতের অভিযান ঘটেনি। পূর্ণেন্দু পত্রী অবশ্য লিখেছেন, “1533–বাংলা দেশে তখন হোসেন শাহী রাজত্ব। পাঁচটা জাহাজ আর দুশো লোক নিয়ে অ্যাফোনসো ডি মেলো বাংলাদেশে এসে হাজির। উদ্দেশ্যে বাণিজ্য।”[১] মনে হয় তথ্যটায় কোথাও কিছু ভ্রান্তি আছে। পর্তুগীজদের এই নাটকীয় আবির্ভাব যদি 1533 খ্রীষ্টাব্দেই ঘটে থাকে তবে তা হুসেনশাহী জমানায় নয়, কারণ হুসেন ফৌত হয়েছেন 1519 খ্রীষ্টাব্দে। সম্ভবত তখন মামুদ শাহ্ গৌড়েশ্বর।
[১ ‘পুরনো কলকাতার কথাচিত্র’, পূর্ণেন্দু পত্রী, দে’জ পাবলিশিং, ফেব্রুয়ারি 1982, পূঃ 68.]
সুলতান মামুদকে তারা নানান মূল্যবান উপঢৌকনে নজরানা দিল। কিন্তু ফল হল উল্টো। কোতোয়াল সনাক্ত করল সেগুলি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপহৃত দ্রব্য! হার্মাদদের অপকীর্তি। ফলে সুলতান মামুদ ডি মেলোকে তার সাঙ্গোপাঙ্গ সমেত কয়েদ করলেন। দুঃসংবাদ পৌঁছালো কেন্দ্রীয় দফতরে, গোয়ায়। গোয়ায় পর্তুগীজ গভর্নর তখন নান্ ডি কুনহা। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে পাঠিয়ে দিলেন আর এক নৌ-সেনাপতিকে, আন্তোনিয় ডি সিলভা মেজেসকে। মেজেস ঘাঁটি গাড়লেন চট্টগ্রামে। সেখান থেকে তদ্বির-তদারক চলতে থাকে। সুলতান নির্বিকার! বন্দীদের মুক্ত করার কোন গরজ নেই। মেজেস লুট করল চট্টগ্রাম। তাতেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না। তখন মেজেস্-এর সেনানায়ক দিয়ানো রিবেলো সসৈন্য অবরোধ করল সপ্তগ্রাম বন্দর। ভাগীরথী দিয়ে নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সবাই আশা করেছিল এইবার সুলতান মামুদ সবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বেন ঐ পর্তুগীজ বোম্বেটেগুলোর উপর। বাস্তবে তা হল না। বরং সুলতান মামুদ ওদের ডেকে এনে সন্ধি করলেন।
কারণ ছিল। সেটা 1536; দিল্লীর মসনদে তখন বাবর-তনয় হুমায়ুন। তাঁর সঙ্গে সুলতান মামুদের সদ্ভাব আছে। কিন্তু বিহারে কে এক ভূঁইফোড় তরুণ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাজারে গুজব সে কৈশোরে ডাকাতি করত। সাসারামে সামান্য এক সুবেদার হাসানের ত্যাজ্যপুত্র—নাম ফরিদ। লোকটা এই কিছুদিন আগেও বিহারের এক সুলতান—বাহার খাঁ লোহানীর কিল্লায় গৃহশিক্ষকের নোকরি করত—তাঁর নাবালক পুত্র জালাল খাঁর ‘আতালিখ’ অর্থাৎ গৃহশিক্ষক। তবে লোকটার যেমন দেহের ক্ষমতা তেমনি দুর্জয় সাহস। কোন এক বিজন বনে তাকে নাকি বাঘে আক্রমণ করে, আর লোকটা তরোয়ালের এক কোপে বাঘটাকে দুখণ্ড করে ফেলে। সুলতান লোহানী তাঁর পুত্রের গৃহশিক্ষককে একটা নয়া খেতাব দেন : শের খান্!
জবর কিসমৎ লোকটার, আশমান ফুঁড়ে কিমতী-হুরী নেমে এসে ধরা দিল শের খাঁর হাতে। কাশীর কাছে চুনার কিল্লার অধিপতি তাজ খাঁকে বুঝি তারই যুবকপুত্র হত্যা করেছিল কিল্লার দখল নিতে। সদ্যবিধবা লাদ মালিকা তার এক বিশ্বস্ত অনুচরকে পাঠিয়ে দিল যুবক বীর শের খাঁর কাছে—সপত্নীপুত্রের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার আর্জি সমেত। শের সসৈন্য চুনারে এসে উদ্ধার করলেন লাদ মালিকাকে। কৃতজ্ঞ মেয়েটি উদ্ধারকারীর হাতে কিলাসমেত তুলে দিলেন কিল্লাদারনিকে!
সেই ভুঁইফোড় লোকটা নাকি হুমায়ুনকে হিন্দুস্থান থেকে তাড়াতে চায়! বোঝ দুঃসাহস! আর সে-কাজের আগে দখল নিতে চায় বঙ্গাল-মুলুক্! হুসেন শাহ তাই সে-সময়ে—সেই 1536 খ্রীষ্টাব্দে—আশঙ্কা করছিল পশ্চিমদিক থেকে শের খাঁর আক্রমণ। পর্তুগীজদের সে আল্লাতালার আশীর্বাদ বলে মনে করল। হাতে হাতে মেলালো।
শের খাঁ এ যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। পর্তুগীজদের সহায়তা সত্ত্বেও শের খাঁ-কে রুখতে পারল না মামুদ। তার অন্যতম হেতু—শের তালিয়াগাড়ির (আধুনিক সাহেবগঞ্জ) প্রচলিত পথে আদৌ আসেনি; শের জানত—সে পথে সুলতান হুসেন তার সৈন্য সমাবেশ করেছে। বনজঙ্গল ভেদ করে সে বাংলায় এল এক ঘুর পথে। সেই অতর্কিত আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে গেল গৌড়াধিপতি মামুদশাহ্-র বাহিনী। বহু উপঢৌকন দিয়ে সুলতান মামুদ শের খাঁর বশ্যতা মেনে নিল।
.
কিন্তু ভারতেতিহাস আমাদের আলোচ্য নয়,আমরা আলোচনা করছি সপ্তগ্রামের ইতিহাস। হুমায়ুন হিন্দুস্থান থেকে বিতারিত, শের খাঁ এখন দিল্লীশ্বর শের শাহ শুর। তা হোক পর্তুগীজের। ঐ সুযোগে সুলতান মামুদের ছত্রছায়ায় সপ্তগ্রামে জাঁকিয়ে বসেছে।
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাঠান রাজত্বের অবসান; দিল্লীশ্বর হয়েছেন আকবর। সম্রাট আকবরের আমল (1556-1605 )। গৌড়ে তখন সুলেমান কররানির সুলতানি। তাঁকে চিনতে না পারলেও তাঁর সেনাপতিটি তোমাদের অচেনা নয় : কালাপাহাড়! নঞর্থক ভাস্কর্যকীর্তিতে সে সারা পূর্বভারতে কুখ্যাত!
সুলেমান কররানি সেবার ভূরিশ্রেষ্ঠরাজ রুদ্রনারায়ণের রাজ্যটি দখল করার মতলব ভাঁজছে। রুদ্রনারায়ণ সাহায্য চাইলেন তদানীন্তন কলিঙ্গরাজ মুকুন্দদেবের। এবং পেলেন। রুদ্রনারায়ণের জ্ঞাতিভ্রাতা প্রখ্যাত বীর রাজীবলোচন রায় ভূরিশ্রেষ্ঠ এবং কলিঙ্গের সম্মিলিত বাহিনীর সৈনাপত্য গ্রহণ করেন। 1565 খ্রীষ্টাব্দে রাজীবলোচন মুসলমান সুবেদারের হাত থেকে সপ্তগ্রামকে পুনরুদ্ধার করেন। সপ্তগ্রামকে পুনর্বার অধিকারে আনার সঙ্কল্প নিয়ে সুলেমান কররানি ও তাঁর সেনাপতি কালাপাহাড় উপর্যুপরি চারবার সপ্তগ্রাম আক্রমণ করেন এবং চারবারই ব্যর্থ হন। পরিশেষে রুদ্রনারায়ণকে প্রচুর উপঢৌকন প্রেরণ করে সন্ধিস্থাপন করেন
সপ্তগ্রাম দীর্ঘদিন পরে আবার হয়ে গেল হিন্দুরাজার শাসনে একটি বন্দর।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি—অতঃপর সুলেমান কররানি কলিঙ্গরাজ মুকুন্দদেবকে উচিত শিক্ষা দিতে তাঁর সেনাপতি কালাপাহাড়কে প্রেরণ করলেন উড়িষ্যা বিজয়ে। “ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে দুর্ভাগ্য পুনরুক্তিদোষে ক্লান্তিকর এবারেও তাই ঘটল। এই চরম দুঃসময়ে মুকুন্দদেবের অমাত্যবর্গ সুযোগ বুঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল। নিরুপায় কলিঙ্গরাজ কোণার্কের সূর্যমূর্তিটি পুরীর মন্দিরে স্থানান্তরিত করে (সম্ভবত আজও তা সেখানে আছে) স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। সে যুদ্ধে বুকের রক্ত দিয়ে মুকুন্দদেব তাঁর অমাত্যবর্গের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যান। আর কালাপাহাড়ের অপকীর্তি মহাকালের শিলালেখে চিরস্থায়ী হয়ে রইল উড়িষ্যার নানান দেবদেউলে। এই মুকুন্দদেবই উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন হিন্দুরাজা।”[১]
[১. ‘কারুতীর্থ কলিঙ্গ’, নারায়ণ সান্যাল, ভারতী বুক স্টল, 1987- পূঃ 119.]
হয়তো ভুল বলেছি। এ কাহিনী এ গ্রন্থে প্রাসঙ্গিক। আমাকে এর পরের দশকে পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধটিও তো বর্ণনা করতে হবে—গৌড়দেশের শেষ স্বাধীন মুসলমান নবাবের সেই মর্মন্তুদ কাহিনীটি। ইতিহাস যে নিজের পুনরাবৃত্তি এই সূত্রে তা জানানো গেল।
ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সপ্তগ্রামের ভাগ্যে ঘটল দু-জাতের যুগান্তর। একটি ভৌগোলিক, একটি সাংস্কৃতিক।
ভৌগোলিক পরিবর্তনের হেতু সরস্বতী নদীর মহামৃত্যু।
ষোড়শ শতকের ষষ্ঠ দশকে বিদেশী পর্যটক সীজার ফ্রেডরিকের বর্ণনায়—
“A good tides rowing before you come Satgan, you shall have a place which is called Buttor, and from thence upwards the Ships doe not goe, because that upwards the River is very shallow, and little water.
ভাষা বা বানান যাই হোক, ক্যাপিটাল অক্ষরের ব্যবহারে যতই যথেচ্ছাচার থাক, বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না—সরস্বতী তিলতিল করে মরে যাচ্ছে। এতকাল ঐ সরস্বতীর খাতেই প্রবাহিত ছিল ভাগীরথীর মূলধারা। দেশের বাণিজ্যের রাজপথ ছিল সেটাই। সপ্তগ্রাম এতদিন ছিল প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ বন্দর—তাম্রলিপ্ত, চট্টগ্রামের প্রতিদ্বন্দ্বী। খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সরস্বতীতীরের অনেকগুলি বন্দর ছিল সমৃদ্ধশালী : শিয়াখালা, সিঙ্গুর, জনাই, চণ্ডীতলা, বেগমপুর, ঝাঁপড়দহ, মাকড়দহ, আন্দুল, হরিপাল প্রভৃতি। সরস্বতী নদী মজে যাওয়ার পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠল গঙ্গাতীরবর্তী হুগলী বন্দর। সে-কথা যথাস্থানে
ঐতিহাসিক তথা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন : বৈষ্ণব প্রভাব।
চৈতন্য-মহাপ্রভুর আদেশে নিত্যানন্দ প্রভু সংসার জীবন প্রবেশ করেছিলেন। তিনি তাঁর শেষ জীবন অতিবাহিত করেন এই সপ্তগ্রামে।
গড়ে উঠল দ্বাদশ গোপালের অন্যতম শ্রীমৎ উদ্ধারণ দত্তের শ্রীপাটে প্রতিষ্ঠিত গৌর-নিতাই বিগ্রহমন্দির। শ্রীকর দত্তের পুত্র উদ্ধারণ ছিলেন প্রভু নিত্যানন্দের প্রিয় শিষ্য। পৈত্রিক বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে তিনি সুলতান হুসেন শাহর কাছ থেকে একটি জমিদারী ক্রয় করেন। কাটোয়ার কিছু উত্তরে। নিজ নাম অনুসারে তার নামকরণ করেন ‘উদ্ধারণপুর’। তিনি নিজেই করেন, অথবা উদ্ধারকামী ভক্তবৃন্দ এ নামটি দেন তা জানা যায় না। প্রভু নিত্যানন্দ ঐ জনপদে শেষজীবন অতিবাহিত করেন। শোনা যায়, নিত্যানন্দের বিবাহে উদ্ধারণ দশসহস্র সিক্কা টাকা ব্যয় করেন।
দ্বিতীয়ত সপ্তগ্রামের আর এক গৌরব, রঘুনাথ দাস গোস্বামী।
চৈতন্যচরিতামৃত’ বলছেন :
হিরণ্য গোবর্ধন নাম দুই সহোদর।
সপ্তগ্রামে বার লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর।।
হিরণ্য ও তাঁর ভ্রাতা গোবর্ধন মজুমদারের জমিদারীর আয় ছিল বার্ষিক বার লক্ষ টাকা। রঘুনাথ ঐ গোবর্ধনের একমাত্র পুত্র। ধর্মানুরাগী পুত্রকে সংসারী করার অভিপ্রায়ে গোবর্ধন সপ্তদশবর্ষীয় কিশোরের সঙ্গে একটি সুন্দরী বালিকার বিবাহ দিলেন। কিন্তু তবু বেঁধে রাখা গেল না। রাহুলমাতা বা বিষ্ণুপ্রিয়ার নামটা অন্তত মনে রেখেছে ইতিহাস, রঘুনাথজায়ার নামটাও মুছে গেছে!
বিবাহের অনতিকাল পরেই রঘুনাথ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বলরাম আচার্যের শিষ্য। দীর্ঘ ষোলো বৎসর নীলাচলে মহাপ্রভুর সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর চলে যান শ্রীবৃন্দাবনে। রূপ ও সনাতন গোস্বামীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন। বৃন্দাবনে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড উদ্ধার। বহু গ্রন্থও রচনা করেন। শ্রীবৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীর অন্তর্গত এই পরমবৈষ্ণব সপ্তগ্রামের মানুষ। তাঁর স্মৃতিতে প্রতি বৎসর অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশী তিথিতে আজও সেখানে একটি বৈষ্ণব মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পাদ। একজন ইংরাজ বণিক এলেন সাতগায়। নাম রাল্ফ কিচ। তিনি এসেছিলেন স্থলপথে, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে। প্রায় আট বছর ধরে ভ্রমণ করেন ভারতবর্ষ, ব্রহ্মদেশ, শ্যামদেশ (1583-91)। বিলাতে ফিরে গিয়ে তিনি এই পূর্বরাজ্যের এক সোনালী স্বপ্নের ছবি প্রকাশ করেন তাঁর ভ্রমণ-বৃত্তান্তে। সমসাময়িক বিলাতি পত্রিকায় সমালোচনায় বলা হল, “He thrilled London in 1591 with the magnificient possibilities of Eastern commerce.
সন্ধ্যেবেলার আলোকসজ্জার প্রসঙ্গে যদি সকালবেলাকার পলতে পাকানোর কাহিনী লিপিবদ্ধ করতে হয়, তাহলে 1600 খ্রীষ্টাব্দে রানী এলিজাবেথ যে ইংরেজ কোম্পানিকে সান্ধ্য আলোকসজ্জার ‘চার্টার দিলেন, তার সলতেটি পাকিয়েছিলেন ঐ রালফ্ কিচ।
.
উনবিংশ শতাব্দী : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বেণের মেয়ে’তে এঁকেছেন সপ্তগ্রামের সম্পদের চিত্র। সমকালীন সপ্তগ্রামের নয়, অতীতের। বঙ্কিমচন্দ্র উনবিংশ শতাব্দীতে ‘কপালকুণ্ডলা’য় সপ্তগ্রামের পতন সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন তা যথার্থ:
“পূর্বকালে সপ্তগ্রাম সম্বৃদ্ধিশালী নগর ছিল। এককালে যবদ্বীপ হইতে রোমক পর্যন্ত সর্বদেশের বণিকেরা বাণিজ্যার্থ এই মহানগরে মিলিত হইত। কিন্তু বঙ্গীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে (অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে) সপ্তগ্রামে প্রাচীন সমৃদ্ধির লাঘব জন্মিয়াছিল। ইহার কারণ এই যে, তন্নগরের প্রান্তভাগ প্রক্ষালিত করিয়া যে স্রোতবতী বাহিত হইত, এক্ষণে তাহা সংকীর্ণশরীরা হইয়া আসিতেছিল। সুতরাং বৃহদাকার জলযান সকল আর নগর পর্যন্ত আসিতে পারিত না। এ কারণ বাণিজ্য বাহুল্য ক্রমে লুপ্ত হইতে লাগিল। বাণিজ্য-গৌরব নগরের বাণিজ্যনাশ হইলে সকলই যায়। সপ্তগ্রামের সকলই গেল। বঙ্গীয় একাদশ শতাব্দীতে হুগলী নতুন সৌষ্ঠবে তাহার প্রতিযোগী হইয়া উঠিতে ছিল। তথায় পর্তুগীজেরা বাণিজ্য আরম্ভ করিয়া সপ্তগ্রামের ধনলক্ষ্মীকে আকর্ষিতা করিতেছিলেন।”
বিংশ শতাব্দী : ইস্টার্ন রেলওয়ে টাইম-টেব্ল্ খুঁজলে ছোট-হরফে আদি সপ্তগ্রাম নামটি দেখতে পাবে। কোন কোন লোকাল ট্রেন ওখানে আজও দাঁড়ায় যে!