২. সন্ধ্যার অন্ধকার

সন্ধ্যার অন্ধকার নামার কিছু আগে দেবেন্দ্রনারায়ণ বৈঠক ঘরে ঢুকলেন। তার ভেতরে প্রবল অস্থিরতা। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘরে ঢুকে দেখেন তার আগেই আর সকলে চলে এসেছেন। ভুজঙ্গ দেব এরইমধ্যে দু’জন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। একজনের নাম দিবাকর চাটুজ্জে, অন্যজন গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে। দেবেন্দ্রনারায়ণ এদের চেনেন। বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ হিসেবে চারদিকে এদের নাম ডাক রয়েছে। অন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যেও এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশ। ধর্মীয় এবং সামাজিক নানান বিষয়ে এদের মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকঘরে সকলেই এতক্ষণ দেবেন্দ্রনারায়ণের আসার অপেক্ষা করছিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ আসতেই আলোচনা শুরু হলো।

বিভূতিনাথ সাহা পুরো পরিস্থিতি আবার ব্যখ্যা করলেন। ভুজঙ্গ দেব বললেন, ব্রাহ্মণ ঠাকুরেরা এখানে রয়েছেন, এই কালব্যাধির ব্যাপারে কী করণীয় তারাই ভালো বলতে পারবেন।

দিবাকর চাটুজ্জে প্রাণতোষ বৈদ্যকে ইঙ্গিত করে বললেন, এখানে উনিও রয়েছেন, চিকিৎসাবিদ্যে জানেন, উনি কিছু বলুন।

প্রাণতোষ বৈদ্য লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, আমায় শুধু শুধু লজ্জা দিচ্ছেন। এই ব্যাধি ছোঁয়াচে, এ সকলেই জানে। এর কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার। হয়নি এ কথাও সকলের জানা। একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে যায়…।

প্রাণতোষ বৈদ্য কথা শেষ করার আগেই ভুজঙ্গ দেব বললেন, আবারো সেই একই কথা, চিকিৎসা, চিকিৎসা। শোনোনি, এ রোগ ভগবান দিয়েছেন। বুঝলাম আর সকল রোগও ভগবানই দেন। কিন্তু সে সকল রোগের ওষুধ পত্তরও তো রয়েছে, না কি? কিন্তু এ রোগের ওষুধ-পত্তর নেই কেন, আঁ?

ভুজঙ্গ দেব মুহূর্তের জন্য চারপাশের সকলের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ওষুধ-পত্তর নেই, চিকিৎসা নেই, তার ওপর এ রোগ বানের জলের মতোন ছড়ায়। এ রোগ কি আর সকল রোগের মতোন সাধারণ? এ রোগ সাধারণ কোনো রোগ নয়, এ এক কালব্যাধি। এ ভগবানের শাস্তি। এর থেকে মুক্তি একমাত্র ভগবানের কাছেই। অন্য কোনো ব্যবস্থা দিয়ে এর কিছু হবে না। ভগবান বরং রুষ্ট হবেন। ভগবানের খুশি মতোন যদি উপায় কিছু থাকে, তবে সে কথা বলো, আমরা শুনি।

ভুজঙ্গ দেব থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। অনেকক্ষণ বাদে কথা বললেন বিষ্ণুনারায়ণ। তিনি বললেন, সে তো আমরা বুঝেছি ভুজঙ্গ বাবু। এখন কথা হচ্ছে, একটা চেষ্টা তো করতে হবে, এ ব্যাধি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে, এর ছোঁয়াচ থেকে দূরে থাকতে।

বিষ্ণুনারায়ণ খানিক থামলেন। তিনি একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। শ্বাসের কষ্ট হয়। একটু সময় নিয়ে বিষ্ণুনারায়ণ দৃঢ় এবং গম্ভীর গলায় বললেন, তাছাড়া এই বিশাল বিষ্ণুপুরের জমিদার আমি। এর হাজার হাজার প্রজার ভালো-মন্দ দেখা আমার কর্তব্য। তাদের বিপদে-আপদে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে আমি তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।

দিবাকর চাটুজ্জে মাথা নেড়ে বিগলিত গলায় বললেন, অতিউত্তম বলেছেন কর্তামশাই। আজকাল ক’জন এমন করে অন্যের কথা ভাবে বলুন? এ তো আর সত্যযুগ নয়, এ কলিযুগ। ঘোর কলিযুগ। এ সময় সকলে কেবল নিজের স্বার্থ, লাভ-লোকসান দেখে। অন্যের কথা ভাবার সময় কই?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, সে তো আমরা সকলেই জানি, জমিদারবাবুর মতোন এমন মানুষ আর হয় না। তবে কথা হলো গিয়ে, মা শীতলা যাতে রুষ্ট না হন, সেদিকটাতেও খেয়াল রাখতে হবে। এতে যেন কোনোক্রমেই ভুল না হয়…।

এতক্ষণে যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল দেবেন্দ্রনারায়ণের, তিনি কঠিন গলায় বললেন, ভুজঙ্গ বাবু, আপনার কথা আমরা সকলেই বেশ বুঝতে পেরেছি। সকলেরই এ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা রয়েছে। আগে সকলকে কথা বলতে দিন। ধর্মনাশ হয় এমন কিছু কেউ করবে না। আর প্রাণতোষ তো বললই, এর কোনো চিকিৎসা নেই। তো চিকিৎসা, ওষুধ-পত্তরই যদি না থাকে, তাহলে ভগবানের ইচ্ছের বিপক্ষে গিয়ে কাউকে সারিয়ে তোলার উপায়ও তো নেই। আপনি শুধু শুধু উদ্বিগ্ন হবেন না।

ভুজঙ্গ দেব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাকে থামালেন বিভূতিনাথ। তিনি বললেন, ভুজঙ্গ বাবু, এখন সমস্যা আসলে একটিই, সেটি হলো নিতাই আর সেই ছেলে। ওদের একটা ব্যবস্থা করা। শুনেছি এই রোগে তেমন কেউ বাঁচে না। আর ভগবানের কৃপায় যদি কেউ বাঁচেও, তার নাকি অঙ্গহানী নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এখন ওই ছেলের গা-ভর্তি অত বড় বড় গুটিবসন্ত। সে ক’দিনে মরে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এতদিন কি সে ওই জঙ্গলেই থাকবে? তার ওপর তার শরীর থেকে তো ওই রোগ নিতাইকেও ধরবে। নিতাইও ক’দিন বাঁচে, কে জানে! এতদিনে যদি ওদের থেকেও ও রোগ আরো ছড়ায়?

এতক্ষণে কথা বললেন দীপেন্দ্রনারায়ণ। তিনি বললেন, কী করে ছড়াবে? ওরা তো আর লোকালয়ে ঢোকেনি। আর কারো সাথে মেশেওনি। তাছাড়া মেজদা তো ওদের নদীপথ ধরেই বারোহাটির জঙ্গলে পাঠিয়েছে।

বিভূতিনাথ সাহা সরু চোখে দীপেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে আছেন। দীপেন্দ্রনারায়ণের সেই চুপচুপে তেলের গন্ধেই যেন তার নাক খানিক কুঁচকানো। তিনি সতর্ক গলায় বললেন, দেবেন্দ্রবাবুর বিচক্ষণতা নিয়ে কথা নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে এ রোগ বহুভাবেই ছড়াতে পারে। আজ যারা ওদের নিয়ে গেল, তাদের কেউ কেউও কোনো না কোনোভাবে ছোঁয়াচে হতে পারে। অত সতর্ক থেকে কি সবসময় সবকিছু করা যায়? তারপর ওরা যতদিন ওখানে থাকবে, ওদের তো আর উপোষ করে মেরে ফেলতে পারবেন না। পারবেন? ওদের আহার পৌঁছাতে হবে। জল পৌঁছাতে হবে। এসব কি আর সবসময় নিয়ম মেনে হয় দীপেন্দ্রবাবু? একটু অসতর্কতায় যদি সামান্য অঘটনও ঘটে যায়, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছেন?

এই কথায় সভাকক্ষ আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। জ্যেষ্ঠপুত্র অবনিন্দ্রনারায়ণ এতক্ষণ কোনো কথাই বলেননি। সকালে বীণাবালার শিখিয়ে দেওয়া সেই ছোট্ট কথাখানা তিনি তোতা পাখির মতোন আওড়েছিলেন। কিন্তু সেই কথার ভাবার্থ এবং ভয়ানক তাৎপর্য ধরতে তার বেশ সময় লেগেছিল। এরপর থেকে তিনি কথাবার্তায় সতর্ক হয়ে গেছেন। বীণাবালা আরো কত কী যে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অবনীন্দ্রনারায়ণ সেসবের কিছুই আর বলেননি। মধ্যাহ্নে তিনি যখন মহলের অন্দরে গেলেন, তখন গিয়ে একটি অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করলেন। তিনি মহলে পৌঁছানোর পূর্বেই বীণাবালার কাছে বৈঠকের সকল ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পৌঁছে গেছে। বীণাবালা তাকে চেপে ধরেছিলেন যে কেন তিনি তার শিখিয়ে দেয়া আর সকল কথা বলেননি? অবনীন্দ্রনারায়ণ এই বলে কাটিয়ে দিলেন যে তিনি সকল কথা গুছিয়ে মনে রাখতে পারেননি। ভুলে গিয়েছিলেন।

এখন এই মুহূর্তে অবনীন্দ্রনারায়ণ খুব চিন্তা-ভাবনা করে বললেন, দু’দুটো মানুষ কবে মরবে, আমরা বসে বসে তার জন্য অপেক্ষা করব?

বিভূতিনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবনীবাবু ভালো কথা বলেছেন। তারা কবে মরবে, সে অবধি তো আর আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। এতে বিপদের আশঙ্কা আরো বাড়বে।

দিবাকর চাটুজ্জে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, হুম। এটি একখানা কথা বটে! কিন্তু কথা হচ্ছে কবে মরবে সেটা তো আর আমরা জানি না। আর আগেভাগে মৃত্যুর কোনো ব্যবস্থাও কি সম্ভব?

অবনীন্দ্রনারায়ণ এই কথায় ভীষণরকম আঁৎকে উঠলেন। তিনি মোটেই আগেভাগে নিতাই আর সেই ছেলের মৃত্যুর কথা বলেননি। তিনি বরং তাদের সুস্থ করে তোলা যায় কিনা, সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন। সবাই জানছে, অথচ দু’দুটো মানুষ গহীন জঙ্গলে এক পুরনো বাড়িতে দিনের পর দিন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যাবে, এ কেমন কথা! অবণীন্দ্রনারায়ণ এটি মেনে নিতে পারছিলেন

বলেই অমন কথা বলেছেন। কিন্তু এরা সকলে মিলে তার কথার অন্য অর্থ করছে। অবনীন্দ্রনারায়ণ সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, আমি সে কথা বলিনি, আমি বলেছি অমন দু’দুটো জ্যান্ত মানুষের মৃত্যুর জন্য আমরা অপেক্ষা করব? এ কেমন কথা? আমরা ওদের বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করব না?

ভুজঙ্গ দেব আবারও মুখ খুললেন, আপনিও সেই একই কথা বলছেন অবনীবাবু? আর কত বলব যে এ কোনো রোগ নয়, এ সাক্ষাৎ ভগবানের শাস্তি। এ থেকে কাউকে ছিনিয়ে আনার চেষ্টাও পাপ। বরং এদের বিনা ঝঞ্ঝাটে মরতে দেওয়া উচিত।

এতক্ষণে চুপচাপ থাকা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের দিকে তাকিয়ে বললেন, জমিদারকর্তা যদি ধৃষ্টতা না নেন, তাহলে একখানা কথা বলতে চাইছি।

বিষ্ণুনারায়ণ বললেন, আপনাদের উপরেই তো ভরসা। আপনারা কথা বলবেন বলেই তো এখানে এই অসময়ে এমন করে বসা।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে শান্ত গলায় বললেন, সকলের কথাই তো শুনলাম। ভুজঙ্গ বাবু যা বলেছেন, ভুল কিছু বলেননি। বিভিন্ন অঞ্চলে এ রোগ বানের জলের মতোই ছড়াচ্ছে। কারো নিস্তার নেই। এ সাক্ষাৎ ভগবানের অভিশাপ। নানারকমের ভয়াবহ খবরও আসছে। সেইসকল খবর শুনলে ভয়ে শিড়দাঁড়া পর্যন্ত কাঁপে। এখন কথা হচ্ছে এর থেকে নিস্তার কী?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, নিস্তার আর কী? সকাল-সন্ধ্যা প্রতি ঘরে ঘরে মা শীতলার নাম করে জল ছিটানো। আর ঘটিভর্তি জল ঘরের দরজায় রেখে দেওয়া।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে আবারও শান্ত গলায় বললেন, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এখন যারা রয়েছে, তাদের ব্যবস্থা কী হবে? ওই ছেলেটি অতরাতে একা। একখানা নৌকোয় কী করে এলো? আর এই ব্যাধির সকলকিছু জানা সত্ত্বেও নিতাই-ই বা তাকে কেন তীরে নিয়ে এলো, এ কথা কি কেউ ভেবেছেন? এমন। তো নয় যে নিতাই এ কালব্যাধির কথা জানে না। সে খুব ভালো করেই জানে। এমনকি কারো চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো গুটিবসন্তের রোগী যাতে গঙ্গাবতীর তীরে নৌকা না ভিড়তে পারে, সেজন্য গঙ্গাবতীর তীরজুড়ে পেয়াদা পাঠিয়ে দেবেন্দ্রবাবু পাহারা অবধি বসিয়েছেন, সে কথাও নিতাইর অজানা নয়। তাহলে? তাহলে কেন সে এই এতবড় ভুল করল?

এই কথায় সভাকক্ষখানি যেন মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধতা ভাঙলেন ভুজঙ্গ দেব, তিনি বললেন, তাই তো মশাই। এ কথা তো ভেবে দেখিনি!

ঘরের সবকয় জোড়া চোখ উৎকণ্ঠিত চোখে গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জের দিকে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘসময় নিয়ে গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, এই ব্যাধি নিয়ে নানান কথা উড়ে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মানুষ নানান কথা ছড়াচ্ছে। তবে তার সকলই যে সত্য, এমন নয়। আবার সকলি মিথ্যে এমনও নয়। মাসখানেক আগে আমি বৈকুণ্ঠপুর নামে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। সে গাঁও যদি আপনারা দেখতেন! রাস্তা-ঘাটে এখানে সেখানে মানুষ মরে পরে রয়েছে! কে কার সকার করবে? আমি যখন গেলাম ততদিনে গুটিবসন্ত পুরো গা শ্মশান বানিয়ে রেখে গেছে। হাতে গোনা কিছু মানুষ কী করে কী করে যেন বেঁচে রয়েছে। তাদের একজনের মুখে ভয়ঙ্কর এক ঘটনা শুনলাম।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে থেমে কাশি দিয়ে গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করলেন। তারপর আবার বললেন, আপনারাও তো অনেকেই শুনেছেন, এই রোগ মানুষের বেশ ধরে আসে। তবে কোন গাঁয়ে ঢুকতে হলে সেই গায়ের কারো না কারো সাহায্য দরকার হয়। যতক্ষণ না অবধি কেউ তাকে সে সুযোগ করে দিচ্ছে, ততক্ষণ অবধি সে নানান বেশ ধরে এখানে-সেখানে অপেক্ষা করে আর সুযোগ খোঁজে। এমন কথা শোনেননি?

ভুজঙ্গ দেব বললেন, শুনিনি আবার? আরো কত কথা যে শুনেছি। তিনি তার জামার লম্বা হাতা গুটিয়ে দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখুন, সে সকল কথা মনে হলে, এখনও ভয়ে গায়ের নোম অবধি দাঁড়িয়ে যায়।

সবাই চুপচাপ রুদ্ধশ্বাসে গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জের কথা শুনছিলেন। গৌরাঙ্গ বাড় জ্জে বললেন, তো বৈকুণ্ঠপুরেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। সন্ধ্যার পুজোর সময় এক বাড়ির গোয়াল ঘরের পেছনে বৃদ্ধার বেশ ধরে দাঁড়িয়েছিল কেউ একজন। অমন অন্ধকারে একজন থুথুড়ে বৃদ্ধাকে অমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই গৃহস্ত বাড়ির বউ তাকে ডেকে বলেছিল, ও মাসি, ওখানে দাঁড়িয়ে এই ভরসন্ধ্যায় কী করছ গো? আসো আসো, ঘরে আসো। এসে একটু জিরিয়ে যাও। সে সেই বৃদ্ধাকে ঘরে নিয়ে গেল। বৃদ্ধা নাকি অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেছে। সে সকাল হলেই চলে যাবে। রাতে সেই বৃদ্ধা কিছু খেল না। বাইরের ঘরে তাকে ঘুমাতেও দেয়া হলো। কিন্তু ভোর হতে তাকে আর দেখা গেল না। যা দেখা গেল, তা হলো সেই গৃহস্ত ঘরের সকলেরই গা-ভর্তি লাল লাল দাগ। সকলের শরীরে জ্বর, চোখ টকটকে লাল। দু’দিনের মাথায় তাদের শরীর বড়বড় গুটিতে ছেয়ে গেল। তার দুদিনের মধ্যে পুরো গ্রাম। মাসখানেক যেতে না যেতে সেই গ্রাম হয়ে গেল শ্মশান!

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে থামলেও কেউ কোনো কথা বললেন না। এখানে সকলেই যে ধর্মকর্ম করেন এমন না। স্বয়ং বিষ্ণুনারায়ণ নিজে ধর্মকর্ম মানলেও তেমন একটা পালন করেন না। কিন্তু এই ঘটনায় তারও কোথায় যেন তীব্র ভয়ের চোরাস্রোত বয়ে গেল। তিনিই প্রথম কথা বললেন। খানিকটা সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, আপনি কি অমন কিছু সন্দেহ করছেন?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে সাথে সাথে জবাব দিলেন না। দীর্ঘসময় নিয়ে তারপর তিনি বললেন, সন্দেহের কিছু কি আছে জমিদার বাবু? অতরাতে ওখানে ওই ছেলে একা নাওয়ে কী করেই বা এলো? আর সবকিছু জেনেশুনেও নিতাই কেনই বা তাকে নিয়ে এলো?

মানসিকভাবে অস্থির এবং প্রচণ্ডরকম বিচলিত হয়ে থাকা দেবেন্দ্রনারায়ণ এতক্ষণেও গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জের এই দীর্ঘ ভূমিকার কারণ ধরতে পারছিলেন না। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে হঠাৎ করেই দেবেন্দ্রনারায়ণের মনে হলো তিনি সম্ভবত বুঝতে পারছেন সামনে কী হতে যাচ্ছে! নৌকোর ওই ছেলেটিকে অতিপ্রাকৃত কোনো অশুভ শক্তিরূপে চিহ্নিত করার প্রবল চেষ্টা চলছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ আবিষ্কার করলেন, হঠাৎ করেই ছেলেটির জন্য তিনি প্রচণ্ডরকম বিচলিত বোধ করছেন। তিনি বেপরোয়া গলায় বললেন, তাহলে আপনি বলতে চাইছেন যে গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ওই ছেলেটি মানুষের বেশ ধরে আসা কালব্যাধি?

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, সে আপনারা দশজন মিলে ভাবুন। এখানে আপনারা সকলে রয়েছেন। আমি কেবল আমার কথা বললাম। একটু চিন্তা ভাবনা করলেই বিষয়টি আপনাদের কাছেও পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।

ভুজঙ্গ দেব ভীত গলায় বললেন, আমার আর কোনো সন্দেহ নেই। আমি বাড়ুজ্জে মশাইয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ওই ছেলে সাক্ষাৎ মনুষ্যশিশুর বেশে কালব্যাধি। হা ভগবান! মা শীতলা, রক্ষা কর মা, রক্ষা কর।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকা বিভূতিনাথ সাহা এবার কথা বললেন, বাড়ুজ্জে মশাই যা বললেন, তা নতুন কিছু নয়। উনি জানা কথাই বললেন। বরং আমরা যে ছোট জিনিসটাকে ভাবতে পারিনি, ধরতে পারিনি। এড়িয়ে গিয়েছিলাম, উনি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কী বলুন জমিদার বাবু?

বিষ্ণুনারায়ণ বিষয়টিকে এভাবে ভাবেননি। তবে পরিস্থিতি যে এখন পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে চলে গেছে, এটি তিনি বুঝতে পারছেন। প্রজারা এই কথা শুনলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে। তাদের সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। জীবন মরণের প্রশ্ন যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে শক্তি প্রয়োগে দমন বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা কোনোভাবেই কার্যকর নয়। পরিস্থিতি তখন আরো খারাপ হবে। এখন এই ব্রাহ্মণদের কাছ থেকেই কোনো গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত পেতে হবে। যা নিয়ে সকলেই নিশ্চিন্ত এবং সন্তুষ্ট থাকবে। তাছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্তই মন্দির থেকে এলে, ধর্ম থেকে এলে সকলে তা নিশ্চিন্তে, নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। ফলে ব্রাহ্মণরা যা বলবেন, তা সকলের কাছেই অন্যকিছুর চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য হবে।

বিষ্ণুনারায়ণ চিন্তিত গলায় বললেন, দেবেন্দ্র কিছু বলবে? তোমার কী মনে হয়, ওই ছেলে কী করে ওখানে এলো? নিতাই কেনই বা ওকে তীরে আনল? তারপর আবার তার নাওয়েও গেল?

দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন, তিনি যে-ই হন, এই মুহূর্তে পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এই ছেলেটি যে মোটেই অমন অতিপ্রাকৃত কিছু নয়, তা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে! তার জামার আস্তিনে এখনও নৌকোয় ছেলেটির শিয়রের পাশে পাওয়া সেই চিরকুটখানি সযত্নে রাখা রয়েছে। ওই চিরকুটখানিই ছেলেটির বাস্তব অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ছেলেটির এক বিস্ময়কর পরিচয়ের দলিল! কিন্তু এই মুহূর্তে সেই পরিচয় প্রকাশে তিনি অক্ষম। তিনি নিজেও রয়েছেন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায়। এই ধাঁধার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ জানেন, তার হাতে সময় খুব অল্প। আবার এখানে, এই মুহূর্তে তিনি যা-ই বলুন না কেন, তাতে পরিস্থিতির কিছুই পাল্টাবে না। বরং নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। তবে যে করেই হোক নিতাইর সাথে তাকে অন্তত আর একবার হলেও কথা বলতে হবে। বলতেই হবে। খুব জরুরি কিছু কথা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ তারপরও শেষ চেষ্টাটা করলেন, তিনি বললেন, না, তবে নিতাই মাঝরাতে তার নাওয়ের সাথে অমন একখানা নাও দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল। ওর নিদ্রামতো লেগেছিল। নাওখানার ধাক্কা খেয়ে নিদ্রা ছুটে গেল। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল প্রদীপের আলোয় ছেলেটা ঘুমুচ্ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে মাথা কাজ করছিল না। আর ওর ভাবনায়ও ছিল না, কোনো গুটিবসন্তের রোগী এতরাতে ওভাবে ওই নাওয়ে থাকতে পারে। তার ওপর অমন একটা ছোট ছেলে। সবকিছু মিলিয়ে নিতাই একটা ঘোরের বশেই নাওয়ে গিয়েছিল। গিয়ে ছেলেটার গায়ের চাদর সরাতেই চোখে পড়ল ওই ভয়ানক অবস্থা!

দেবেন্দ্রনারায়ণ একটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, আমার মনে হয় ছেলেটি অমন কিছু। সে মানুষের বেশে অমন কালব্যাধি, এ আমার মনে হয় না। তাছাড়া নিতাই বোকাসোকা মানুষ। ও কাঁচা ঘুম ভেঙে সবকিছু দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল। অতকিছু ভেবে সে কাজটা করেনি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ থামলেও ঘরের কেউ কোনো কথা বলল না। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝতে পারছেন তার কথা কারো মনে ধরেনি। এটিই যে ঘটবে তাও তিনি জানতেন, কিন্তু তারপরও শেষ চেষ্টাটা তিনি করে দেখলেন। যদিও তাতে কারো কিছু পরিবর্তন হলো না। দেবেন্দ্রনারায়ণ স্পষ্ট বুঝতে পারছেন এই সভাকক্ষেই আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিতাই আর ওই ছেলেটির কোনো ভয়ংকর পরণতির সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকবে না।

কথা বললেন ভুজঙ্গ দেব, নিতাইয়ের যা হয়েছিল, ওই সময় অন্যদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। ওই ব্যাধি মানুষের বেশ ধরে আসতে পারে বলেই। মানুষকেও মুহূর্তেই বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে দেবেন্দ্রবাবু।

বিভূতিনাথ সাহা গম্ভীর গলায় বললেন, বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলা করার বোধ করি আর উপায় নেই। এখন জমিদারবাবুর উপর আমাদের সকলের জীবন মরণের সিদ্ধান্ত। তিনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন।

বিষ্ণুনারায়ণ খানিক সময় নিয়ে ধীর গলায় বললেন, বিষয়টি অতি জটিল। কিন্তু এর সমাধানও জরুরি। ওই শিশুর বিষয়ে প্রজারা কি কিছু জানে? বা কতটুকু জানে?

দীপেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ঘটনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর নানান ডালপালাও বিস্তৃত হয়েছে। সময় যত গড়াবে, অবস্থা ততই খারাপ হতে থাকবে।

বিষ্ণুনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, আমায় মার্জনা করুন, আপনাদের আশঙ্কা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না বাড়ুজ্জে মশাই। কিন্তু তারপরও পাপী মন ওসব মেনে নিতেও সায় দেয় না। তবে দু’টো জীবনের জন্য আমি আমার সকল প্রজাদের জীবনের ঝুঁকিও নিতে পারি না। তাদের আতঙ্কিত করে রাখতে পারি। না। আপনারা বলুন, কী করলে এই আতঙ্ক দূর হবে। প্রজারা শান্ত হবে! ওই ছেলে আর নিতাইয়ের শরীর থেকে ওই কালব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কাও আর থাকবে না।

জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ থামলেও ঘরজুড়ে কী এক রুদ্ধশ্বাস স্তব্ধতা বিরাজ করছিল! দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বলল না। দিবাকর চাটুজ্জে এবং গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে দীর্ঘসময় নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বললেন। আলাপ-আলোচনা সারলেন। তারপর গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে ধীর, শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বললেন, জীবন্ত অগ্নিদাহ, জমিদার বাবু।

বিষ্ণুনারায়ণ উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, জীবন্ত অগ্নিদাহ!

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে বললেন, আজ্ঞে, জীবন্ত অগ্নিদাহ। ভগবান ব্রহ্মা সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। ভগবান বিষ্ণু সৃষ্ট সকল কিছু লালন পালন রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। আর এই সকল শুভ সৃষ্টির জন্য ক্ষতিকর, অনিষ্টকর, এমন সকল কিছু ধ্বংস করছেন ভগবান মহাদেব শিব।

তিনি একটু থেমে ঘরের সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে তারপর আবার বললেন, এখন এই জমিদারির এত এত প্রজা, এত এত প্রাণ, এইসকল কিছু রক্ষায়, ওই অনিষ্টকর ব্যাধির বেশে আসা মনুষ্যশিশু আর ছোঁয়াচে বহন করা নিতাই’র অগ্নিদাহর মাধ্যমে বিনাশের চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কোনো পথ নেই জমিদার কর্তা। ওই শিশু এই সকল সৃষ্টির অনিষ্টকারী। অগ্নিদাহই এদের বিনাশের একমাত্র উপায়। শুভ রক্ষায় অশুভর বিনাশ।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে থামতেই দিবাকর চাটুজ্জে বললেন, কর্তা মশাই, এ ঘটনা আরো বহু অঞ্চলেই ঘটেছে। এমন অগ্নিদাহের ফলে সে সকল অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ রক্ষা পেয়েছে কর্তা।

গৌরাঙ্গ বাড়ুজ্জে সামান্য থেমে গম্ভীর গলায় ঋগবেদ থেকে শ্লোক আওড়ালেন, আগ্নিমিলে পুরোহিতম যজ্ঞস্য দেবামৃতভিজম হতারাম রত্নাধাতমম।

এতক্ষণ ধরে ভগবানের শাস্তি বলে কোনো ধরনের ব্যবস্থার বিপক্ষে থাকা ভুজঙ্গ দেবও যেন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন এই অগ্নিদাহের ভেতরে খুব শক্তিশালীভাবেই ভগবানের শুভসৃষ্টি রক্ষায় অশুভ অসুর বিনাশের বিষয় রয়েছে। তাই তিনিও মুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, বাড়ুজ্জে মশাই, আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনার মতোন মানুষদের সংস্পর্শে থাকলে পুণ্যি হয়। আপনি আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন।

খানিক থেমে ভুজঙ্গ দেব কক্ষের সকলের দিকে তাকিয়ে সমর্থনের ভঙ্গিতে বললেন, অগ্নি পবিত্র, অগ্নিই শক্তি। অগ্নিতে আহুতি দিলে ভগবান আমাদের সকল অনিষ্ট হতে রক্ষা করবেন।

দিবাকর চাটুজ্জে বললেন, ভুজঙ্গ বাবু যথার্থই বলেছেন। এই কালব্যাধি মনুষ্যবেশি ওই শিশু। যে নিতাইকেও আক্রান্ত করেছে। এখন ভগবানের এই হাজার হাজার শুভ সৃষ্টি, এত এত মনুষ্য প্রাণ রক্ষায় এদের অগ্নিদাহের মাধ্যমে বিনাশ ব্যতিত উৎকৃষ্ট আর কোনো উপায় নেই।

দিবাকর চাটুজ্জে থামতে পুরো ঘরজুড়ে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না। দীর্ঘ নিস্তব্ধতা শেষে কথা বললেন জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ। তিনি নিষ্কম্প এবং কঠোর গলায় বিভূতিনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিভূতিবাবু, আপনার কী মত?

বিভূতিনাথ সাহা একটু সময় নিয়ে আড়চোখে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে ধীরে সুস্থে বললেন, জানি না কার কী মত! তবে এই মুহূর্তে এই কালব্যাধির আতঙ্ক থেকে মুক্তি এবং বিষ্ণুপুরের হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষায় এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো উপায় আমার জানা নেই।

জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ ঘরের সকলের দিকে এক এক করে তাকালেন। তারপর দেবেন্দ্রনারায়ণের উদ্দেশ্যে স্থির চোখ রেখে বললেন, আশা করি তোমারও কোনো দ্বিমত নেই দেবেন্দ্র!

দেবেন্দ্রনারায়ণ কোনো কথা বললেন না। বিষ্ণুনারায়ণ এক এক করে তার বাকি পুত্রদের দিকেও তাকালেন। তারপর বললেন, এই জমিদারিতে আমরা কয়েক পুরুষ ধরে বহাল রয়েছি। প্রজাদের ভালোমন্দ দেখতে কখনো কেউ অবহেলা করেনি। প্রয়োজনে জলের চেয়েও কোমল হয়েছি। প্রয়োজনে পাথরের চেয়ে কঠোর হতেও দ্বিধা করিনি। আজ কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। বিষ্ণুপুর জমিদারির সকল প্রজাদের জীবন-মরণের প্রশ্নে এই সিদ্ধান্ত। এখানে প্রাজ্ঞ ব্রাহ্মণ ঠাকুরেরাও রয়েছেন। সকল কিছু বিচার-বিবেচনা করে আমার মনে। হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত সকলের জন্যই মঙ্গলময়।

তিনি খানিক থামলেন। তারপর আবার বললেন, তাছাড়া ওই ছেলে সম্পর্কে ইতিমধ্যেই প্রজাদের মধ্যে নানান গুজব, কল্পকথা, ভীতিকর নানান ঘটনা ছড়িয়েছে। এখন শুধুমাত্র এই একটি উপায়ই পারে এই সকল কিছু বন্ধ করে তাদের ভয় ভীতি দূর করতে।

বিষ্ণুনারায়ণ বৈঠক শেষ করলেন। শেষ করার আগে বললেন, এই কাজে বিলম্ব অনিষ্টকর। আগামীকাল প্রত্যুষেই বারোহাটির সেই গভীর জঙ্গল অভিমুখে যাত্রা করো। সন্ধ্যার পরে দাহের ব্যবস্থা করো। ধর্মীয় আচারের জন্য ব্রাহ্মণ ঠাকুরেরা তো রয়েছেনই। আর দেবেন্দ্র, এই অগ্নিদাহের সকল দায়-দায়িত্ব তোমার উপরই ন্যস্ত করছি।

অবনীন্দ্রনারায়ণ পুরো ঘটনায় প্রবলভাবে হতচকিত হয়ে গেছেন। এটি যে আসলেই একটি সিদ্ধান্ত সেটি বুঝতে তার দীর্ঘসময় লেগেছে। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তার পিতা জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ এই নৃশংস কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। হতবুদ্ধ অবনীন্দ্রনারায়ণ এলোমেলো পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন। একে একে সকলেই প্রস্থান করলেন। কেবল বসে রইলেন একদিন আগেও বিষ্ণুপুরের মহাপরাক্রমশালী জমিদারপুত্র, হবু জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ। যার একক সিদ্ধান্তে বিষ্ণুপুর জমিদারির অধিকাংশ কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হতো। মাত্র একদিনের ব্যবধানেই তিনি আবিষ্কার করলেন ক্ষমতার কত অজস্র ভিত্তি থাকে। সেই সকল ভিত্তি মিলেই ক্ষমতা পরিপূর্ণ হয়। কার্যকর হয়। এই কোনো একটি ভিত্তির অভাবও পুরো ক্ষমতাকে মুহূর্তেই করে ফেলতে পারে দুর্বল, অকার্যকর এবং অক্ষম।

দেবেন্দ্রনারায়ণের নিজেকে হঠাৎ খুব একা, অসহায় এবং একইসাথে বোকা মনে হতে লাগল। এই সময় তিনি একটি অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করলেন, নৌকোর সেই ছেলেটির আশু পরিণতির কথা ভেবে তার বুকের ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার হঠাৎ মনে হলো, এই ছেলেটিকে এই ভয়ানক পরিণতি থেকে বাঁচাতেই হবে। যে করেই হোক বাঁচাতেই হবে।

সেই ভোরের আবছা আলোয় গঙ্গাবতীর তীরে দাঁড়িয়ে চিরকুটে লেখা শব্দ ক’টি পড়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ বজ্রাহত হয়েছিলেন। সেই আবছা আলোর ভোরের সমগ্র আকাশ যেন তার মাথায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল। চিরকুটের সেই শব্দ ক’টি পাঠমাত্র হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রতি প্রবল আক্রোশে তারা সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। ওই ছেলেটির অস্তিত্ব জগতের সকল কিছু থেকে মুছে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ ক্লান্তিকর, ঘটনাবহুল একটা দিনের শেষে এসে সেই ছেলেটি যেন ক্রমশই তার বুকের ভেতর কোথায় একটু একটু করে জায়গা করে নিয়েছে। সময় যত গড়িয়েছে, সেই ছেলেটির প্রতি একধরনের প্রবল মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে চলেছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ।

তার চোখে ভাসছে সেই চিরকুটে হেমাঙ্গিনী দেবীর লেখা সেই একটি মাত্র বাক্য,

শ্রী দেবেন্দ্রনারায়ণ,

কালব্যাধিতে আক্রান্ত এই ছেলের শরীরে আমার মতন কূলটা এক বাঈজীর রক্ত যেমন বইছে, তেমনি বইছে বিষ্ণুপুরের বিশাল জমিদার বংশের রক্তও।

ইতি
হেমাঙ্গিনী দেবী

*

দেবেন্দ্রনারায়ণ বৈঠকঘর থেকে বেরিয়েছেন সন্ধ্যারও অনেক পরে। দীর্ঘসময় তিনি নিঃশব্দে একা বসেছিলেন। তার মাথার ভেতর অজস্র প্রশ্ন, অজস্র হিসেব নিকেশ। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে জট পাকিয়ে আছে। কোনো একটিকে তিনি অন্যটি থেকে আলাদা করতে পারছিলেন না। এই ভয়াবহ দুঃসময়ে তার কী করণীয়, অনেক ভেবেও দেবেন্দ্রনারায়ণ তা ঠিক করতে পারছিলেন না। বৈঠকঘর থেকে তিনি বের হলেন ভয়াবহ বিধ্বস্ত এক অবস্থা নিয়ে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত দেবেন্দ্রনারায়ণের চোখ টকটকে লাল। তার কপালের ডানপাশের শিরাটা দপদপ করে কাঁপছে। তিনি উঠান পেরিয়ে তার অট্টালিকায় ঢুকলেন। দরজার আড়ালে অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল। দেবেন্দ্রনারায়ণ গমগমে মেঘের শব্দে ডাকলেন, কে ওখানে?

অন্ধকার থেকে মাঝারি গড়নের একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো, আজ্ঞে, আমি রতন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ যেন চিনতে পারলেন না, বললেন, কোন রতন?

ছায়মূর্তি বলল, আজ্ঞে, আমি রতনকান্তি দাস। আপনার কন্যাদের গান শেখাই। আমাকে আপনি পশ্চিম তল্লাট থেকে নিয়ে এসেছিলেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা এতরাতে এখানে কী?

রতন বলল, আজ্ঞে, আজ আসতে একটু বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। তাই ভাবলাম যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছে তা পুষিয়ে দিই। তাই একটু বিলম্ব হলো।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ও! তুমি তো দেখি মস্ত কর্মনিষ্ঠ, সাধু ছেলে।

রতনকান্তি কথা বলল না। সে আবছা অন্ধকারে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দেবেন্দ্রনারায়ণ বলল, তা গান শিখিয়ে কত পাও? পেট চলছে?

রতনকান্তি মাথা নিচু রেখেই বলল, আজ্ঞে, বেশ ভালোই চলছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ভালো চললেই ভালো। চারধারে শুধু খারাপ আর খারাপ। ভালো কিছু শুনলে শান্তি পাই।

রতনকান্তি কথা বলল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা ওদের গানের কী। অবস্থা?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে, ভালো।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোমার দুনিয়াতে কি খারাপ বলতে কিছু নেই হে? সকলি দেখি ভালোয় পরিপূর্ণ! তা বেশ তো!

রতনকান্তি এবারও কোনো কথা বলল না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এই গান বাজনা ছাড়া আর কিছু পারো?

রতনকান্তি মাথা নিচু করে বলল, জি, পারি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কী পারো?

রতনকান্তি বলল, ঘোড়া দৌড়াতে পারি। জুড়ি গাড়ি হাঁকাতে পারি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক অবাক হলেন, এসব কোথায় শিখেছ?

রতনকান্তি বলল, নানান জায়গায় ঘুরেছি। একবার এক সার্কাসের দলেও ভিড়েছিলাম। সেখানে গান গাইতাম। বাদ্য বাজাতাম। ওরা তো নানারকম খেলাধুলা, কসরত দেখায়। সেইসব কসরতের সাথে ঘোড়ার পিঠে চড়ারও অনেক রকম কসরত ছিল। ঘোড়ায় চড়ায় আমার খুব আগ্রহ হলো। শখ করে একটু একটু চেষ্টা করলাম। একটা সময় গিয়ে দেখি আর সকলের চেয়ে আমিই ভালো পারি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তোমার তো দেখি আসলেই সবকিছু ভালোয় পরিপূর্ণ। কেবল পেটে দুটো আহারই যা জুটত না। কিন্তু দিন শেষে ওই। আহারটাই আসল, বুঝলে? আহার বাদে বাকি সকল মিথ্যে। পেটে দু’টো ভাত না পড়লে মুখে গান আসে না, শরীরে বল আসে না। কসরত আসবে কোথা হতে?

রতনকান্তি এই কথার কোনো উত্তর করল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, তা তুমি থাকো কোথায়? আসো কোত্থেকে?

রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে, বিরামপুরে আমার এক দূর-সম্পর্কের মেসো থাকেন, ওনার একখানা বাড়তি ঘর রয়েছে। আমি সেখানেই থাকি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ সামান্য সময়ের জন্য কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, বিরামপুর! সে তো পায়ে হাঁটার জন্য বিস্তর পথ। অতদূর থেকে রোজ রোজ এতটা পথ পায়ে হেঁটে আসার কী দরকার? এক কাজ করো, কোচোয়ানদের যে থাকার ঘরটা রয়েছে, তাতে উঠে পড়ো। আজ থেকেই উঠে যাও। এত রাতে আর অতটা পথ হেঁটে যাওয়ার দরকার নেই। কাল ভোরে গিয়ে নিজের মালামাল কিছু থাকলে নিয়ে এসো।

একটু থেমে কী যেন ভাবলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তারপর বললেন, এখন থেকে এখানেই থাকলে, গান শেখালে। আবার কোনো একটা কোচোয়ানদের কাজেও লেগে গেলে। মন্দ কী! আয় রোজগারও খানিক বাড়ল। তাছাড়া সবসময় শুনে এসেছি গাড়োয়ানরাই কেবল গায়ক হয়। নানান রকম গান বাধে। কোচোয়ানদের কথা তো কখনো শুনি না। তো গাড়োয়ানরা যদি সব বিশাল গায়ক হতে পারে, কোচোয়ানরা কেন পারবে না? তোমাকে দিয়েই না হয় শুরু হোক হে রতনকান্তি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ সচরাচর করেন না, এই মুহূর্তে তাই করলেন। যেন খুব হাসির কোনো কথা বলে ফেলেছেন, এই ভঙ্গিতে হা হা হা করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তারপর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে গেলেন। এলোমেলো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল রতনকান্তি। সে কিছুই বুঝল না। আজ দেবেন্দ্রনারায়ণকে কেমন অস্বভাবিক লাগছে তার কাছে। এই এতদিন সে এ বাড়িতে আসে, কোনো দিন তাকে ডেকে একটি কথাও বলেননি যে মানুষটি। দেখা হলে চিনতেও পারেননি। আজ সেই মানুষটিই এত কথা বলছে দেখে রতনকান্তি ভারি অবাক হলো এবং পা ফেলে চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মনে পড়ল, দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে আজ থেকেই কোচোয়ানদের ঘরে থাকতে বলেছেন। হেলাফেলা করে বলুন আর মজা করেই বলুন, তিনি এ অঞ্চলের হবু জমিদার। তার প্রতিটি কথা সমান মূল্যবান। কিন্তু তিনি কি কথাটি সত্যিকার অর্থেই বলেছেন, না কি মজা করে বলেছেন, এই নিয়ে হঠাৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল রতনকান্তি। এমনিতেই আজ মানুষটিকে তার কাছে সুস্থ এবং স্বাভাবিক মনে হয়নি, তার উপর এমন অদ্ভুত সব কথা বললেন!

রতনকান্তি তার দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে পারল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ যদি কাল ভোরেই আবার ভুলে যান এই এখনকার এতসব কথা! তখন কী হবে? সে কি তবে বাড়ি ফিরে যাবে? না কি কোচোয়ানদের ঘরে যাবে? কিন্তু কোঁচোয়ানদের ঘরে গেলে তারা তাকে সে ঘরে থাকতে দেবে কেন? সে নিজে গিয়ে বললেই তো আর তারা মেনে নেবে না। এই বাড়ির কাউকে বলতে হবে। কিন্তু কে বলবে? এই নিয়ে রতনকান্তি ভালো সমস্যায় পড়ে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না কী করবে? উপরে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে গিয়ে আবার পরিষ্কার জেনে আসবে? কিন্তু সেই সাহসও তার হলো না। দ্বিধান্বিত রতনকান্তি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।

.

তপতী বসে আছে দেবেন্দ্রনারায়ণের শোবার ঘরের পালঙ্কে। তাকে যত্ন করেই সাজানো হয়েছে। রেণুকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজে উপস্থিত থেকে দাসীদের দিয়ে তপতীকে স্নান করিয়েছেন। তারপর নিজের একখানা ভালো শাড়ি এনে তপতীকে পরিয়েছেন। নিজের গহনা পরিয়েছেন। সুগন্ধি মেখে দিয়েছেন শরীরে। সবশেষে তিনি তপতীকে জিজ্ঞেস করেছেন তপতী কুমারী কিনা! তপতী মাথা নেড়ে জানিয়েছে সে কুমারী। রেণুকা তপতীকে বুঝিয়ে বলেছেন, দেবেন্দ্রনারায়ণের মতো বিশাল মানুষ তাকে পছন্দ করেছেন, এ তপতীর মতো দাসীর পূর্বজন্মে করা কোনো পুণ্যের ফল। তারপরও তপতীর যদি কোনো মনোকষ্ট থেকে থাকে, সে জন্য রেণুকা সত্যিকার অর্থেই দুঃখিত। কিন্তু এ মুহূর্তে তপতীর মনোকষ্ট লাঘবে রেণুকার সামর্থ্যের মধ্যে করার তেমন কিছুই নেই। তিনি সর্বোচ্চ যেটি করতে পারেন, তা হচ্ছে তাকে মূল্যবান কিছু স্বর্ণালঙ্কার দিতে পারেন। তপতী অবশ্য কোনো বিষয়েই কোনো কথা বলেনি। সে চুপচাপ সব শুনেছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খাবার ঘরে খাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘসময় নিয়ে আহার গ্রহণ করেন। আজ যেন তার সময় লাগছে আরো বেশি। তিনি নিচ থেকে এসে ঘরে ঢুকে কারো সাথে কোনো প্রকার বাক্যালাপ করেননি। কাপড় ছেড়েই স্নানঘরে ঢুকেছেন। স্নানঘর থেকে বের হয়েছেন দীর্ঘসময় পর। তারপরই খাবার ঘরে ঢুকেছেন। খাবার ঘরে ঢোকার আগে তিনি অবশ্য রেণুকাকে বলে গেছেন যে, রেণুকা’র তাকে খাবার দিতে আসার প্রয়োজন নেই, সে যেন পালঙ্কের পাশে অমন করেই বসে থাকে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ তার শয়নকক্ষে যখন প্রবেশ করলেন, তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর না হলেও প্রথম প্রহর প্রায় অতিক্রান্ত। রেণুকা বসে আছেন একখানা উঁচু জলচৌকির উপর। তার মুখমণ্ডল অবনত। দেবেন্দ্রনারায়ণের পায়ের আওয়াজ পেয়ে রেণুকা চোখ তুলে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। তবে ভালো করে লক্ষ করলে খানিক বিচলিতভাব ধরা পড়ে। দেবেন্দ্রনারায়ণ তা লক্ষ করলেন কিনা বোঝা গেল না। তিনি কোমল গলায় ডাকলেন, রেণুকা।

রেণুকা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আমি রাত্রি যাপনের পূর্বে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করি। এ বিষয়ে তুমি দীর্ঘদিন থেকেই অবগত। কিন্তু আজ শয্যাপাশে তেমন কোনো আয়োজনই চোখে পড়ছে না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ কথা শেষ করবার আগেই রেণুকা উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে হাত ইশারায় থামালেন। বললেন, প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা আজ আমার নেশার জন্য মদ্যপানের প্রয়োজন নেই। শয্যায় যে অল্পবয়স্কা মেয়েটি রয়েছে, কক্ষে প্রবেশ করবার সাথে সাথেই তার রূপের ছটায় আমি নেশাসক্ত হয়ে পড়েছি।

রেণুকা কথা বললেন না। তিনি দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আজ শয্যার ওই কিশোরিই আমার মদ্য। আমি তাকে সারা রাত্রি ধরে একটু একটু পান করব। তোমার ওই রূপবতী কিশোরী দাসী ব্যতীত জগতের আর কোনো নেশাদ্রব্যের আজ আমাকে মাতাল করবার ক্ষমতা। নেই।

রেণুকা এবারও কোনো কথা বললেন না। তিনি তার নিজেকে নিয়ে। দ্বিধান্বিত। তিনি জানেন না তার কী হয়েছে! তার ভেতরে কী চলছে সেটি তিনি নিজেই ধরতে পারছেন না। নিজের আচরণে তিনি নিজেই খানিক বিভ্রান্ত। এই রেণুকা যেন তিনি নন। এই রেণুকাকে যেন তিনি চেনেন না, জানেন না। কখনো এর সাথে তার কোনো সম্পর্কও ছিল না। এই রেণুকা যেন অন্য কেউ, অচেনা কেউ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ তার পায়ের চটি জুতো খুলে শয্যায় উঠলেন। তারপর দু’খানা বালিশে পিঠের নিচে হেলান দিয়ে বসলেন। তার একদম গা ঘেঁষে বসে আছে তপতী। দীর্ঘ ঘোমটায় তপতীর মুখের অনেকাংশই ঢেকে আছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। আবছা আলোর ঘরখানা প্রবল ঝড়ের আগের স্তব্ধ প্রকৃতির মতোই শান্ত হলেও রুদ্ধশ্বাস ক্ষণ গণনার মতোই চাপা উত্তেজনারও। এই তিনজন মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো শব্দ নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ তার শরীরের উর্ধাঙ্গের বস্ত্র খুলে পালঙ্কের পাশে রাখলেন। তারপর রেণুকার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই শাড়ি পেঁচানো কাপড়ের স্তূপ দেখে আমার নেশা হবে? এসব জঞ্জাল এর শরীর থেকে সরাও।

তপতীর শরীরের বস্ত্র উন্মোচন করতে হবে রেণুকাকে! অন্যসময় হলে রেণুকা কী করতেন তা রেণুকা জানেন না, তবে এই মুহূর্তে রেণুকার কাছে যেন কোনো কিছুই আর অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তিনি ধীর পায়ে উঠে এসে তপতীর শরীর থেকে শাড়িখানা খুলে নিলেন। শাড়িবিহীন শরীরের তপতী যেন প্রবল জড়তায় নিজের ভেতর গুটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। সে তার বাহু দিয়ে প্রাণপণে তার স্ফিত বক্ষযুগল আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার খানিক গম্ভীর গলায় বললেন, এ মেয়ের শরীর তো বয়সের তুলনায় বেশ বাড়ন্ত।

তিনি বা হাত প্রসারিত করে তপতীর ফর্সা সুডৌল বাহু শক্ত করে ধরলেন। তারপর বললেন, তুমিও কাছে এসো রেণুকা। একে ধরে দেখ, এর শরীর তোমার শরীরের চেয়েও কোমল আর আরামদায়ক।

রেণুকা কিছু বললেন না, তবে উঠে এসে তপতীর অন্য পাশে বসলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আমি এর বক্ষযুগল দেখতে চাই। তুমি এর বক্ষ উন্মোচিত করো।

রেণুকা পাথরের মূর্তির মতোন নিঃশব্দে তপতীর উধ্বাঙ্গের অন্তর্বাস খুলতে উদ্যত হলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ বললেন, এই কক্ষে আজ আলো এত কম কেন রেণুকা? তীব্র কামের আঁধার এই স্তনযুগল আমি এমন ম্লান আলোয় মন ভরে দেখতে পাবো? আমি আজ এর শরীরে নেশাগ্রস্ত হতে চাই রেণু। তুমি আগে আরো ঝলমলে আলোর ব্যবস্থা কর।

রেণুকা উঠে গিয়ে কক্ষের বিভিন্ন প্রান্তে আরো আলো জ্বেলে দিলেন। সেই আলোয় পুরো কক্ষ ঝলমল করে উঠল। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, এবার একে পূর্ণরূপে বিবস্ত্র করো রেণু। দেখি এর শরীরে কত নেশা লুকিয়ে আছে। আমাকে সে কতটা মাতাল করতে পারে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক থেমে তপতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ আমার পরাজয়ের দিন। এই দিনে তুমি আমায় নেশাগ্রস্ত করতে পারলে তুমি যা চাইবে আমি তোমায় তাই দেব তপতী। আজ নেশাগ্রস্ত হওয়া আমার বড় প্রয়োজন। তুমি আমায় তোমার শরীর পান করাও। আমি তোমার শরীর পান করে নেশাগ্রস্ত হতে চাই।

তপতী কোনো কথা বলল না। সে মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে বসে আছে। রেণুকা উঠে গিয়ে তপতীর উর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্র অবমুক্ত করলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘোর লাগা চোখে তপতীর পরিপুষ্ট বক্ষযুগলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কক্ষের ঝলমলে আলোয় তপতীর ধবধবে ফর্সা বক্ষযুগল যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। রেণুকা হাত ধরে তপতীকে দাঁড় করালেন। তিনি এখন তপতীকে পুরোপুরি বিবস্ত্র করবেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ সম্মোহিতের মতোন তাকিয়ে আছেন তপতীর দিকে। বড় বড় মোমের আলোয় তপতীকে লাগছে দেবী প্রতিমার মতোন। তপতীর ধবধবে শরীরের পেছনে জ্বলছে বিশাল বিশাল দু’খানা মোমবাতি। মোমবাতির আগুনের শিখারা যেন তপতীর এমন গনগনে রূপের আঁচে ক্রমশই আরো প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ তপতীর শরীরের আড়ালের মোমবাতির ওই গনগনে আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রেণুকা তপতীর শরীরের শেষ বস্ত্রটিও খুলে ফেললেন। মোমবাতির অদ্ভুত আলোয় খানিক আগের কিশোরী এক মেয়ে মুহূর্তেই যেন নগ্ন রূপবতী কামে পরিপূর্ণা এক নারী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ মোমবাতির দীপ্তিমান আলোর শিখা থেকে চকিতে চোখ ফিরিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নগ্ন নারীমূর্তিটির দিকে তাকালেন। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ ত্রস্ত পায়ে বিছানা থেকে নামলেন। পালঙ্কের পাশ থেকে তার উর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্রখানা তুলে নিয়ে গায়ে চড়ালেন। তারপর রেণুকার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট, কঠিন এবং গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার দাসী অতসীবালাকে ডাকো। ডেকে বল নিচ থেকে যেন সে খগেনকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ডেকে আনে।

এতক্ষণ ধরে প্রস্তরমূর্তি হয়ে থাকা রেণুকা ভীষণ অবাক হলেন। তিনি হতভম্ব চোখে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটিকে বোঝা বোধ করি এই জগতের কারো পক্ষেই কখনো সম্ভব নয়। কী করবেন এখন তিনি? শাস্তির নতুন কোনো উপায়? নতুন কোনো নির্মমতা?

রেণুকা অতসীবালাকে বললেন খগেনকে ডেকে আনতে। খগেন দেবেন্দ্রনারায়ণের অন্দরমহলের ভৃত্য। গঙ্গামহলের বাইরে তার তেমন কোনো কাজ নেই। সে বয়স্ক মানুষ। খানিক কাশির ব্যামো রয়েছে। দিনের বেলা সেটি তেমন বিপর্যয় না ঘটালেও রাত্রি বাড়তেই সেই কাশিও বাড়তে থাকে সমান তালে। বারান্দায় কাশির শব্দ পেতেই দেবেন্দ্রনারায়ণ উঁচু গলায় বললেন, নিচে জুড়িগাড়ি প্রস্তুত কর খগেন। আমি এক্ষুনি নামছি।

খগেন বাইরে থেকেই বলল, আজ্ঞে, কর্তা। কিন্তু এত রাতে কোচোয়ানরা তো কেউ নেই। গাড়িও নেই। একখানা যা রয়েছে তার অবস্থাও তেমন ভালো না কর্তা। এই রাতে ও গাড়িতে কোথাও যাওয়া ভীষণ বিপদের। আর কোচোয়ান একজন যেও আছে, সে ভোর থেকে পেটের পীড়ায় ভুগছে। আর বাকিরা সকলেই বারোহাটিতে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ উত্তেজিত গলায় বললেন, বড়দা’র গাড়িখানা জুড়তে বল।

খগেন বলল, বড় মা খুব ভোরে বেরোবেন। তিনি ব্রজগোপালকে সূর্য ওঠার আগেই গাড়ি প্রস্তুত রাখতে বলেছেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ মুহূর্তের জন্য বিচলিত হয়ে পড়লেন। কনিষ্ঠ দীপেন্দ্রনারায়ণের গাড়ি গিয়েছে ব্রাহ্মণদের পৌঁছে দিতে। সারাদিনই নানান কাজে ঘোড়াগুলোর উপরও বিস্তর পরিশ্রম গিয়েছে। এতক্ষণে ফিরে আসলেও ওই ঘোড়া নিয়ে এক্ষুনি আবার এতখানি পথ যাওয়া যাবে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, গাড়ি যেখানা রয়েছে সেখানাতেই ঘোড়া জুড়ে দে। আমি আসছি।

খগেন দরোজার বাইরে থেকেই আতঙ্কিত গলায় বলল, কিন্তু কর্তা, ওই গাড়ি চালাবে কে? কোচোয়ানতো…।

খগেন কথা শেষ করতে পারল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ ধমকে উঠলেন, তুই বড় বেশি কথা বলিস খগেন। যা বলেছি তাই কর। গাড়ি আমি স্বয়ং চালিয়ে যাব।

খগেন যেন আঁৎকে উঠল, এই অন্ধকারে ওই গাড়ি আপনি চালিয়ে যাবেন! কসুর নেবেন না কর্তা, এ বড় ঝুঁকির কাজ। ও গাড়ির অবস্থা আসলেই ভালো নয়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, যা বলেছি তাই কর। হাতে নষ্ট করার মতন এক মুহূর্ত সময়ও নেই খগেন।

খগেন চলে যেতেই রেণুকা দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন, আপনার কী হয়েছে? এই এত রাতে এমন করে কই যাচ্ছেন?

দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি দেরাজ খুলে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নিলেন। জুতো গলালেন পায়ে। তারপর হঠাৎ তার শয্যার উপরে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তপতীর দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, এই মেয়ে এখানে এমন ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? একে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করো, এক্ষুণি।

রেণুকা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তবে চোখের ইশারায় তিনি তপতীকে চলে যেতে বললেন। তপতী চলে যেতেই তিনি বললেন, কী হয়েছে আপনার? আপনি একা, এইরাতে এমন পাগলের মতোন ছুটে কোথায় যাচ্ছেন! আপনি জানেন না, চারধারে আপনার কত শত্রু! কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

দেবেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, বারোহাটি।

রেণুকা বিস্মিত গলায় বললেন, এই এতরাতে বারোহাটি! এতরাতে বারোহাটির বাগান বাড়িতে কী?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, বারোহাটির বাগান বাড়িতে না, বারোহাটির গভীর জঙ্গলে।

রেণুকা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে আর সে সুযোগ দিলেন না। তিনি তড়তড় করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। যে করেই হোক, ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তাকে বারোহাটির গভীর জঙ্গলে পৌঁছাতেই হবে। ঝোঁকের মাথায় তিনি একা যাত্রা করতে চাইলেও তিনি জানেন কতবড় ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন। তিনি দক্ষ ঘোড়সওয়ার নন, তার ওপর জুড়িগাড়ি চালানো সহজ কোনো কাজ নয়। এই অন্ধকারে সেটি তার জন্য নিশ্চিত দুর্ঘটনা ডেকে আনার সমান। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

তিনি অন্ধকারে পা বাড়ালেন।

*

হরিহরণ বণিক তোক ভালো।

বছর পঞ্চাশেকের পলকা গড়নের পক্ককেশ বৃদ্ধ হরিহরণের ধারণা তার পূর্বপুরুষ বিশাল ব্যবসায়ী ছিল। সিন্দাবাদের মতোন জাহাজে করে তারা সাগর পাড়ি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে যেত। কপালের ফেরে সে এখন পান, চুন, খর-পাতার ব্যবসায়ী। এইসব সদাই পাতি নিয়ে সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। মাঝে-মধ্যে লোকজনকে এ সকল কথা বলেও সে। সেদিন যেমন বেনুচন্দের বাজারে কেউ একজন তাকে পান-সুপুরির দামে কম দিলো। বেয়াড়া হরিহরণ রুখে দাঁড়াল। তার সামনে গিয়ে চেঁচাতে শুরু করল। সেই চেঁচামেচিতে একটা ছোটখাট ভিড় মতো লেগে গেল। ভিড়ে কেউ একজন হরিহরণকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো।

হরিহরণ বেশির ভাগ সময় শান্ত-শিষ্ট মানুষ। তবে মাঝে-মধ্যেই সে খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো আচরণ করে। সেদিন সে তাই করল। উন্মত্ত হরিহরণ পাগলের মতো দু’হাতে মুঠি মুঠি ধুলো উড়াতে লাগল বাতাসে। তারপর চিৎকার করে বলতে লাগল, আমায় ঠকাচ্ছ আঁ? আমায় বেশ ঠকাচ্ছ? তোমরা তো সব ঠগের দেশের মানুষ। চোর-ডাকাত-বদমাশের দল। ঠকাবে না তো কী করবে আঁ? হরিহরণ বণিকের কলিজাখানা তোমাদের মতোন নয়। হরিহরণ বণিকের পূর্বপুরুষ বিরাট ব্যবসায়ী ছিল, বড় জাহাজে করে মালসামানা বেচা-কেনা করত। কত বিদেশ বিভুঁই যে তারা ঘুরেছে। এই ক’খানা পান-সুপুরিতে তাকে ঠকিয়ে আর কী হবে! তাকে যদি তোমরা জানতে, তো তার পায়ে এসে পেন্নাম। ঠুকতে!

হরিহরণ কি শেষ বয়সে এসে বদ্ধ পাগল হয়ে যাচ্ছে? এই নিয়েও সেই বাজারে কথা উঠল। তবে লোকে তার সম্পর্কে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তও। তার নানান রহস্যময় কর্মকাণ্ডে তারা তাকে কিছুটা ভয়ও পায়। কিঞ্চিৎ ভয়মিশ্রিত সমীহও করে। তবে সে আর কতক্ষণ? সুযোগ পেলে হাসিঠাট্টা করতেও ছাড়ে না। সেদিন দামে কম দিয়েছিল যে লোকটা, সে চুপিচুপি এসে তাকে আবার পয়সা ফেরত দিয়ে গেল। হরিহরণ অবশ্য কিছু বলল না। সে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। যেন ধ্যানী পাখি সারস।

হরিহরণ বণিকের পরিচয় নিয়েও মানুষের মধ্যে নানান গল্পকথা প্রচলিত আছে। তারা অনেকের মুখে অনেক গল্পই শুনেছে। তবে সব মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে, তা অনেকটা এমন যে, বহুবছর আগে জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের বাবা, তৎকালীন জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটির জঙ্গলে গিয়েছিলেন বাঘ শিকারে। শিকার থেকে বজরাযোগে ফেরার পথে গঙ্গাবতীর তীরে বছর তের চৌদ্দ বছরের এক কিশোরকে বসে থাকতে দেখেন তিনি। কিশোরটি নদীর ধারে বসে কাঁদছে। যোগেন্দ্রনারায়ণ কিশোরটিকে বজরায় তুলে আনলেন। তার পরিচয় জানতে চাইলেন। কিন্তু কিশোরটি তার পরিচয় বলল না। শুধু যে পরিচয় দিলো না, তা-ই নয়। কিশোরটি আর কারো সাথেই কোনো কথা বলল না। সে কেবল শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকত আর কাঁদত।

যোগেন্দ্রনারায়ণ কিশোরটিকে ভৃত্যদের কাছে দিয়ে দিলেন। ভৃত্যরা তাকে কিছুদিন গঙ্গামহলে রাখলেও তারপর তারা তাকে বিষ্ণুপুরের কোনো এক বাজারে ছেড়ে দিল। এরপরও হরিহরণ মাঝে-মধ্যেই গঙ্গামহলে যেত। তারপর একসময় যাওয়া বন্ধ করে দিলো। তার কোনো খোঁজ জানে না কেউই। এরপর আবার কিশোরটিকে প্রায়ই বিষ্ণুপুরের এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। ততদিনে সে কথা বলা শুরু করেছে। তবে মানুষের কাছে তার কথাবার্তাকে মনে হয় পাগলের প্রলাপ। হরিহরণ একঘেয়ে গলায় সেই এক কথাই বলে, আমার পূর্বপুরুষ বিরাট ব্যবসায়ী ছিল, বড় জাহাজে করে মালসামানা বেচা-কেনা করত। কত বিদেশ বিভুঁই যে তারা ঘুরেছে মশাই, সে যদি আপনারা জানতেন! সাধে কি আর আমাদের নাম হয়েছে বণিক!

হরিহরণ আরো অনেক কিছুই বলে। কিন্তু সে সকল কথা লোকজন শোনে না। আর শুনলেও আমলে নেয় না। সেই কিশোর হরিহরণ তার জীবনের বাদবাকি সময় কাটিয়েছে একা। আপনমনে। আপন খেয়ালে। সে মানুষের সাথে যতটা না মেশে, তার চেয়ে অধিক মেশে বৃক্ষ, নদী, পশুপাখির সাথে। সে আপনমনে কথা বলে, খায়। লোকালয় থেকে দূরে ছোট্ট কুঁড়েঘরে ঘুমায়।

মাঝেমধ্যে দীর্ঘসময়ের জন্য সে তার ছোট্ট ডিঙ্গি নাওখানা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আড়ালে-আবডালে লোকজন এই নিয়েও আগে ফিসফাস করত। তবে এখন আর করে না। ধরে নেয়, হরিহরণ আর পাগল, উভয়ের সুখই মনে মনে। হরিহরণ কারো ক্ষতি তো করছে না! সে থাকে নিজের খেয়ালে। তা থাকুক না! তবে বারোহাটি জঙ্গলের আরো পুবে, যেখানে গঙ্গাবতী নদী জঙ্গলটাকে বা দিকে রেখে ডানে বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে আরো গভীর আর চওড়া হয়েছে, সে দিকটাতেও হরিহরণ মাঝেমধ্যে যায়। ওই ছোট ডিঙ্গি নাওখানা নিয়েই যায়। তার ভয়-ডর বলতে কিছু নেই।

আজও হরিহরণের মন-মেজাজ খারাপ। দিনদিন সে ভেতরে ভেতরে কেমন যেন ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে! আজকাল তার ভারি ইচ্ছে, লোকজন তাকে হরিহরণ বণিক ডাকুক। আর ক’দিনই বা সে বাঁচবে। তা লোকজন তাকে ডাকেও। তবে বণিক না, লোকজন তাকে ডাকে বন্নিক। আজ যেমন জমিদার বাড়ির পেয়াদা রঘু তাকে দেখেই দূর থেকে সজোরে হাঁক দিল, কী খবর হরিহর বন্নিক? এই অবেলায় কই যাও?

হরিহরণের মেজাজটা হুট করে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মেজাজ কদাচিৎ খারাপ হয়। আজ সেই কদাচিৎ খারাপের একদিন। লোকজন তাকে হরিহরণ বন্নিক’ ডাকে, এই নিয়ে তার বিস্তর আপত্তি। কিন্তু সে জানে, তার আপত্তি শোনার লোক নেই। লোকজনের তার আপত্তি শুনতে বয়েই গেছে!

এই জগতে অর্থকড়ি নেই, এমন মানুষের কথা কেউ শোনে না। হরিহরণের কথাও কেউ শোনে না। তাকে নিয়ে বড়জোর হাসি ঠাট্টা করা যায়। তা আজকাল লোকজন তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেও। সেসব সে চুপচাপ মেনেও নেয়। কিন্তু রঘু আজ যা করেছে, তা সে মেনে নিতে পারল না। রঘু। তাকে বন্নিক তো বলেছেই, উপরন্তু তার নামখানাও বিকৃত করেছে! হরিহরণ থেকে ণ’ ঘেঁটে দিয়ে সে তাকে বলেছে হরিহর।

হরিহরণ রঘুকে একটা উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। হরিহরণ গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে পান, পাতা, খয়ের বিক্রি করে সারাদিনের খাটাখাটনি শেষে বাড়ি ফিরছিল। এই সময় রঘুর ঘোড়ার গাড়ি পড়ল তার সামনে। কোচোয়ান গাড়ির গতি কমিয়ে তার দিকেই আসছিল। রঘু তখন দূর থেকেই হাঁক ছেড়ে তাকে ওই কথা বলল।

.

হরিহরণ শান্ত-শিষ্ট মানুষ। সে সহজে রাগে না। কিন্তু আজ রঘু যখন তাকে হরিহর বন্নিক বলে ডাকল, তখন মুহূর্তেই তার মাথার তালু উত্তপ্ত হয়ে উঠল। সে মুখ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই মুহূর্তে রঘু বলল, মেজোকর্তা জরুরি খবর পাঠিয়েছে।

হরিহরণ সাথে সাথে জবাব দিলো না। সে রঘুকে সেই ছোট হতে চেনে। জমিদার বাড়ি খাস পেয়াদা হলেও রঘুকে সে তুই তুকারিই করে। এই নিয়ে অবশ্য কেউ তাকে কিছু বলে না। তার ভেতর পাগল ভাব প্রবল। হয়তো এ কারণেই অনেক কিছুই লোকজন এড়িয়ে যায়। হরিহরণ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রঘুর মতলব বোঝার চেষ্টা করল। রঘু ঘোড়ার গাড়িতে একা। সাথে কেউ নেই। পাইক-পেয়াদাদের জমিদার বাড়ির ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করার কথা না। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো ব্যাপার আছে। হরিহরণ মুখে কোনো জবাব না দিলেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রঘুর দিকে তাকিয়ে রইল। রঘু ছোট্ট লাফে গাড়ি থেকে নেমে বলল, মেজোকর্তা বলেছিল অপলা মাসীকে দিয়ে তোমায় খবর দিতে, কিন্তু দেখো কী ভাগ্য, তোমার সাথে পথেই দেখা হয়ে গেল।

হরিহরণ বলল, কী বিষয়?

রঘু সংক্ষেপে গভীর রাতে গঙ্গাবতীতে গুটিবসন্তে-আক্রান্ত ছেলেটিকে পাওয়ার ঘটনা খুলে বলল। বলল নিতাই আর সেই ছেলেকে নিয়ে আপাতত দেবেন্দ্রনারায়ণের সিদ্ধান্তের কথাও। তারপর বলল, এখন নিতাই আর সেই ছেলেকে নিয়ে জগাই নাও বেয়ে বারোহাটির জঙ্গলে যাচ্ছে। এতক্ষণে পৌঁছেও গেছে কিনা কে জানে! আমাদেরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাতে হবে।

হরিহরণ বলল, মেজোকর্তা কি আসবেন?

রঘু বলল, মেজোকর্তা তো সে বিষয়ে কিছু বলেননি।

হরিহরণ বলল, আমি বাড়ি থেকে আসছি। তুই বাদবাকি যোগাড়যন্তর কর।

রঘু বলল, সন্ধ্যার অন্ধকারে ওই জঙ্গলে যেতে তোমার ভয় করবে না। বন্নিক? আমার তো এখনই ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

হরিহরণ বণিক এই কথার কোনো জবাব দিল না। সে বলল, মশাল জ্বালাস বেশি করে। আজ অমাবস্যার রাত্তির, জঙ্গলে আজ ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

রঘু কিছু একটা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু বলতে গিয়ে তার হঠাৎ মনে হলো সে জমিদার বাড়ির পেয়াদা। দেবেন্দ্রনারায়ণের খাস লোক। হরিহরণের মতোন লোকের সামনে তার এমন জড়সড় হয়ে থাকা সাজে না। তাছাড়া হরিহরণ এমনিতেই তাকে তুই তুকারি করে কথা বলে। এমন ভীতুর মতোন আচরণ করলে সে আরও পেয়ে বসবে। রঘু আর কথা বাড়াল। সে গাড়িতে চড়ে বসল।

হরিহরণ বণিক দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে।

.

হরিহরণ বণিকের বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা পথে ক্রোশ দুই পুবে বারোহাটি বাগান বাড়ি। তবে হরিহরণ বারোহাটি বাগান বাড়ির দিকে খুব একটা যায় না। মাঝে-মধ্যে অবশ্য দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে ডাকেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের কদাচিৎ পান খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। পানের সাথে কাঁচা সুপুরি। কাঁচা সুপুরিতে এক ধরনের নেশা হয় দেবেন্দ্রনারায়ণের। এই নেশাটা তেমন গভীর কিছু নয়। কেমন একটা ঘোর লাগা ব্যাপার। চোখ বন্ধ করে থাকতে তখন বেশ ভালো লাগে। মনে হয় অন্য কোনো জগত। তাই ভালো রসালো কাঁচা-সুপুরির জন্য তিনি হরিহরণকে ডাকেন। আর এ অঞ্চলে হরিহরণের কাছেই সবচেয়ে ভালো কাঁচা-সুপুরি পাওয়া যায়, এ কথা সকলেই জানে।

হরিহরণ এই কাঁচা-সুপুরি সংগ্রহ করে বারোহাটি জঙ্গলের গভীর থেকে। যদিও বারোহাটির বাগান বাড়ির অবস্থান এই জঙ্গলের একদম কোল ঘেঁষে। বাগান বাড়ির পরেই মূল গহীন জঙ্গল। তারপরও হরিহরণ এ পথে জঙ্গলে প্রবেশ করে না। সে তার বাড়ি থেকে সোজা উত্তরে চলে যায়। উত্তরে যেখানে গঙ্গাবতী নদী পুরো বিষ্ণুপুর ঘুরে এসে বারোহাটির জঙ্গলে ঢুকেছে, হরিহরণ সেই পথে জঙ্গলে ঢোকে। সে তার সেই ডিঙ্গি নাওখানা বেয়ে ধীরে-সুস্থে জঙ্গলে প্রবেশ করে। বারোহাটির জঙ্গল বিচিত্র এক জায়গা। এখানে হরেক রকম বৃক্ষ, লতাপাতার সমাহার। ফলবান নানান বৃক্ষরা যেমন এখানে রয়েছে, তেমনি রয়েছে গভীর ঘন দুর্ভেদ্য বেত ও বাঁশের ঝাড়। সুপুরির ঘন বন।

এককালে এই জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘের বেশ আনাগোনা ছিল বলে শোনা যায়। আজকাল অবশ্য প্রাণীটির সেই পূর্বেকার প্রবল দাপুটে ভাব আর নেই। তবে সংখ্যায় কমে গেলেও লোকে বলে মাঝেমধ্যেই প্রাণীটির দেখা পাওয়া। যায়। কিন্তু সেটি লোকের ওই মুখের কথা অবধিই। বাস্তবে তার প্রমাণ নেই। বললেই চলে। এ যেন বাঘ না থাকলেও বাঘের ভয় রয়ে যাওয়ার অবস্থা।

অবশ্য বহু বছর আগে রাতের অন্ধকারে বাঘ সদৃশ প্রাণী বারোহাটির লোকালয়ে ঢুকে গরু, মহিষ, ছাগল থেকে শুরু করে আস্ত মানুষ অবধি ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। ফলে এই জঙ্গলে প্রবেশ নিয়ে সকলের ভেতরেই তীব্র ভীতি কাজ করে। তার ওপর জঙ্গলের কিছুদূর যেতেই বহু প্রাচীন ভাঙা মন্দির, ছোটখাট নানান স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেও দেখা যায়। এই সকল ধ্বংসাবশেষ নিয়েও মানুষের মধ্যে নানান গল্প ও রহস্যময় কাহিনী প্রচলিত। যদিও অনেকেরই ধারণা এককালে হয়তো এখানে কোনো না কোনো বসতি ছিল। হয়তো গুটিবসন্ত বা ওলা ওঠার মতোন ভয়ানক কোনো মহামারির কবলে পরে সে সকল বসতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তবে ব্যাখ্যা যতই থাকুক, বারোহাটির জঙ্গল নিয়ে ভয়-ভীতি তাতে কিছু কমেনি। বরং দিনে দিনে তা নানান কারণে আরো বেড়েছে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ যখন বারোহাটির জঙ্গল ঘেঁষে এই বাগানবাড়ি তৈরি করেন, তখন অনেকেই তাকে নিষেধ করেছিলেন। অবশ্য দেবেন্দ্রনারায়ণ তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি। তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, দু’চারখানা বাঘ শিকার না করতে পারলে এতবড় জমিদারি তল্লাট থেকে কী লাভ! আর বাগানবাড়ির অন্দরে বসে বাঈজীর নৃত্য, হাতে মদের পেয়ালার সাথে যদি বাঘের হুঙ্কারও জুটে যায়, তবে মন্দ কী!

অবশ্য বারোহাটি বাগান বাড়ির কাজ শুরু হবার পরপরই দেবেন্দ্রনারায়ণ কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। ফলে তার ইচ্ছে অনুযায়ী অনেক কিছুই করা সম্ভব হয়নি এই বাড়ির। তিনি লোক মারফত তার নানান ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দের কথা জানাতেন। সনাতন মিস্ত্রির পিতা রামচরণ কারিগর সেই মতে বাড়ির দেখাশোনা করতেন। আর সকল কারিগরদের উপর রামচরণ কারিগরের প্রভাব ছিল প্রবল। ফলে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে আসা নানান নির্দেশনার কথা সে-ই অন্যান্য কারিগরদের নিকট পৌঁছে দিত। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তার এই রোগের কারণে বাগানবাড়ির নির্মাণকাজ দীর্ঘসময় ধরে স্বচক্ষে তদারকি করতে পারেননি। নির্মাণকার্য যখন প্রায় শেষের দিকে তখন তিনি প্রথম বারোহাটির বাগান বাড়ি পরিদর্শনে আসেন। সেদিন বারোহাটি বাগানবাড়ি পরিণত হয়েছিল এক থমথমে আতঙ্কিত শ্মশানে!

দেবেন্দ্রনারায়ণ বাড়ি দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন যে, এই বাড়ির কিছুই আসলে তার ইচ্ছেমতো হয়নি। তিনি মাটির নিচে একখানা পাতাল ঘর চেয়েছিলেন, বাড়ির নিচতলার একখানা ঘরের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে সেই ঘরের নিচেই পাতাল ঘরের নির্মাণকাজ তখনো চলছিল। কিন্তু এই অবস্থা দেখে দেবেন্দ্রনারায়ণ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই অর্ধসমাপ্ত ভূগর্ভস্থ ঘরের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তার কিছুই পছন্দ হলো না। তার ইচ্ছে বা ভাবনামতো কিছুই হয়নি, উল্টো তিনি যে নির্দেশনা পাঠিয়েছিলেন অনেকক্ষেত্রেই ঘটেছে তার ব্যতিক্রম। হতভম্ব এবং ক্ষিপ্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ মুহূর্তের মধ্যে এক উন্মত্ত মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। উন্মত্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই মুহূর্তে রামচরণ কারিগরের দুই হাত কেটে নেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ সে যাত্রা রামচরণ কারিগরের উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি নানানভাবে দেবেন্দ্রনারায়ণকে শান্ত করেন। তবে তিনি ঘোষণা করেন যে, এরপর থেকে রামচরণ কারিগর আর কখনো কোথাও কারিগর হিসেবে কাজ করতে পারবে না। এটাই তার শাস্তি।

সেই থেকে রামচরণ কারিগর তার বাড়ি থেকে বের হয় না। কোথাও যায় না। বৃদ্ধ রামচরণ কারিগরের পুরো পরিবারের জীবিকার ভার পরে তার দশ বছর বয়সের পুত্র সন্তানের ওপর। পুত্র সন্তানের নাম সনাতন। সেই দশ বছর বয়সের ছোট্ট সনাতন আজ সুদক্ষ সনাতন মিস্ত্রি। বারোহাটির এই বাগানবাড়ির নানান কাজে তাকে ছুটে আসতে হয়। সময়ে-অসময়ে প্রস্তুত থাকতে হয়, এই বুঝি জমিদার তরফ থেকে তার ডাক এলো!

হরিহরণ বণিকের সাথে কোনো এক অদ্ভুত কারণে দেবেন্দ্রনারায়ণের একটা যোগাযোগ রয়েছে। বাইরে থেকে সেই যোগাযোগ দেখতে পাওয়া না গেলেও অনুভব করা যায়। হরিহরণকে নিয়ে আড়ালে-আবডালে নানান। রহস্যময় কথা প্রচলিত আছে। সে নাকি প্রায়ই বারোহাটির গহীন জঙ্গলের ভেতর একা একা ঘোরাফেরা করে। শুধু যে একা একা ঘোরাফেরাই করে তা-ই নয়। সে জঙ্গলের গভীর থেকে নানান ফল-মূল নিয়ে আসে। সেগুলো লোকালয়ে বিক্রি করে। বারোহাটির জঙ্গল থেকে হরিহরণের আনা কাঁচা-সুপুরি দেবেন্দ্রনারায়ণের ভীষণ পছন্দ।

.

ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বারোহাটি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নয় দশজনের একটি দল। দলটার সামনে মশাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হরিহরণ বণিক। হরিহরণ বণিকের পেছনে অনেকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে নিতাই। নিতাইয়ের হাতে ঘোড়ার লাগাম। পেছনে শীর্ণকায় রোগা একটি ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে গুটিবসন্ত আক্রান্ত শিশুটিকে কাপড়ে জড়িয়ে আড়াআড়ি শুইয়ে রাখা হয়েছে। লম্বা কাপড়ে তার আপাদমস্তক মুড়ে রাখা হয়েছে। নৌকা থেকে নামার আগে রঘুর কথা মতোন নিতাই ছেলেটার মুখও ঢেকে দিয়েছে। নিতাই ছাড়া এখন অবধি আর কেউই ছেলেটাকে দেখতে পায়নি। অবশ্য দেখার কোনো প্রকার ইচ্ছেও কারো নেই। সকলেই গুটিবসন্তের তীব্র আতঙ্কে তটস্থ। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে, ঘোড়ার ওপর আড়াআড়ি করে রাখা হয়েছে লম্বাকায় একখানা কাপড়ের পুঁটলি। ঘোড়ার হাঁটার তালে-তালে প্রতি পদক্ষেপেই কাপড়ের পুঁটলিখানাও ছন্দে-ছন্দে দুলছে।

নিতাই আর ছেলেটাকে বহন করা ঘোড়ার পরে আরো বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে রঘু আর জগাই। তাদের পেছনে জনাপাঁচেক লোক। দলটির প্রায় প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে বহনযোগ্য কিছু না কিছু। কারো হাতে জ্বলন্ত মশাল, কারো হাতে ধারালো বর্শা। দেবেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশ অনুযায়ী খাবার আর অন্যান্য জিনিসপত্রও বয়ে নিচ্ছে কেউ কেউ।

এই মশালের আলোতেও হনহন করে হেঁটে চলছে হরিহরণ। যেন হাতের তালুর মতোই চেনা এই পথ। দেবেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশ মতো রঘু জঙ্গলের ভেতরের সেই পুরনো পরিত্যক্ত বাড়িখানার কথা বলেছে হরিহরণকে। হরিহরণ অবশ্য পুরোটা শোনার আগেই হাত-ইশারায় জানিয়ে দিয়েছে, ওই বাড়ি সে চেনে। হরিহরণ বাড়ি থেকে রঘু আর অন্যান্য ভৃত্য পেয়াদাদের সাথে আসেনি। সে এসেছে একা। প্রতিবার যেই পথে আসে, সেই পথেই। তার ডিঙি নাওখানা বেয়ে সে গঙ্গাবতী ধরে এসেছে। যেখানে নিতাই আর গুটিবসন্ত আক্রান্ত ছেলেটাকে নিয়ে নৌকোতে অপেক্ষা করছিল জগাই, ঠিক সেখানে এসেই নিজের ডিঙি নাও ভিড়িয়েছে হরিহরণ। তারপর জঙ্গলের ভেতরে এই পদযাত্রা।

চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অজস্র পোকা মাকড়ের কান ফাটানো চিৎকার। নাম না জানা নানান প্রাণীর লোমহর্ষক ডাক। এর মধ্যে শুরু হয়েছে টিপটিপ বৃষ্টি। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর ভূতুড়ে পরিবেশ। তার ওপর সাথে দু’জন গুটিবসন্তের রোগী। প্রতি পদক্ষেপেই যেন কোনো অজানা ভয়ের হাতছানি।

তবে হরিহরণ বণিক হেঁটে যাচ্ছে নির্ভার। এ যেন তার বাড়ির উঠোন। এখানে অজানা কিছু নেই, ভয়ের কিছু নেই। শুধু এই জঙ্গলই নয়, এই জঙ্গলের আশপাশজুড়ে যে বিস্তৃত গঙ্গাবতী রয়েছে, তাও যেন হরিহরণের নখদর্পণে। যে সকল জায়গায় বিষ্ণুপুরের মানুষ দিনের আলোয় দলবল বেঁধেও যেতে ভয় পায়, হরিহরণ সে সকল জায়গায় যায় নিঃশঙ্কোচে একা। বারোহাটির জঙ্গলের খানিকটা পূর্ব-দক্ষিণে গেলে গঙ্গাবতীর কিছুটা গভীরে ছোট একখানা চরের মতোন জায়গা রয়েছে। ওই জায়গার নাম বজরাডুবির চর। বজরাডুবির চর নিয়ে নোকমুখে নানান গল্প প্রচলিত। তাতে ভয়ঙ্কর সব গল্প রয়েছে। এককালে ওখান দিয়ে বিশাল বিশাল বজরা যাতায়াত করত। কিন্তু গভীর রাতে ওই বজরাডুবির চরের কাছ দিয়ে কোনো বজরা গেলে সে বজরা নাকি ডুবে যেত। দিনকয়েক যেতেই আশেপাশের জায়গা জুড়ে ভেসে উঠত মরা লাশ। গভীর রাতে সেই সকল লাশেদের কান্নাও না কি শুনেছে দূর দিয়ে যাওয়া অন্য সকল বজরার মাঝি-মল্লারা।

আজকাল অবশ্য আর কোনো বজরা ও পথে যায় না। এমনকি কোনো মানুষও না। তবে হরিহরণ বণিক মাঝে মধ্যেই সেই চরে যায়। কেন যায়, তা একমাত্র সে-ই জানে। সে ইচ্ছে হলেই যায়। তার কোনো পিছুটান নেই, কোনো ভয় নেই, দ্বিধা নেই। একাকী হরিহরণ তার ডিঙি নাও বেয়ে আপনমনে চলে যায়।

হরিহরণ বণিক এখনও এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে মশাল হাতে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে যাচ্ছে। শুধু যে হেঁটে যাচ্ছে তা-ই নয়। সে খানিক গুনগুন করে গানও গাইছে। পেছনের দলটি তাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছে। ক্রোশখানিক পথ পেরিয়ে হরিহরণ বণিক সামান্য বা দিকে ঘুরল। এই দিকটায় জঙ্গল আরো ঘন। মশালের আলোর কারণেই বোধহয় হাজার হাজার পোকামাকড় মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরছে। নিতাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেশ। সারাদিনে খানা-খাদ্য নেই। তার ওপর প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিক ধকল। সে এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। হরিহরণ একবার পেছনে ফিরে তাকাল। একই তালে পা ফেলে হেঁটে আসা মানুষগুলোকে দেখে তার মনে হলো এটা বাস্তব নয়, স্বপ্নের কোনো দৃশ্য। আবছা আলোয় একদল মানুষ যেন সম্মোহিতের মতোন হেঁটে চলছে অজানা গন্তব্যে। তাদের চোখ মুখজুড়ে তীব্র আতঙ্ক! প্রতি পদক্ষেপেই যেন সেই আতঙ্ক আরো গাঢ় হচ্ছে। হরিহরণ ঘাড় ঘুরিয়ে আবার হাঁটা ধরবে, ঠিক এই মুহূর্তে ঘটল ঘটনাটা। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারেও একটি সাদা ছায়ামূর্তি যেন মুহূর্তের জন্য চোখে পড়ল তার। হরিহরণ ভালো করে তাকাতেই সেই আবছা ছায়ামূর্তি চোখের পলকে উধাও! হরিহরণ ক্ষণিকের জন্য পা ফেলতে ভুলে গেল, ওখানে কি আসলেই কিছু ছিল? না কি সে ভুল কিছু দেখেছে? দৃষ্টিবিভ্রম?

হরিহরণ একবার ভাবল, সে থেমে দেখবে ঘটনা কী? কিন্তু পর মুহূর্তেই তার মনে হলো, এ হবে চূড়ান্ত বোকামি। তার সাথে এই এতগুলো মানুষ। এরা সকলেই তীব্র আতঙ্ক নিয়ে এই গহীন জঙ্গলে পথ হাঁটছে। এই মুহূর্তে হরিহরণ বণিক যদি তার এই ছায়ামূর্তি দর্শনের কথা বলে, তাহলে নিশ্চিত করেই মানুষগুলো ভয়াবহ আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যাবে!

হরিহরণ বণিক কিছুই করল না। সে যেমন হাঁটছিল তেমনই হাঁটতে থাকল। হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। কী দেখতে কী দেখে ফেলেছে! এই ঘুটঘুঁটে অমাবস্যার রাতে, এমন গহীন জঙ্গলে, এমন হতেই পারে। হরিহরণ বণিক লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল। আর কিছুক্ষণ পরেই সেই পুরনো ভাঙা বাড়ি। সেখানে পৌঁছে গভীর রাত নামার আগেই নিতাই আর গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ছেলেটাকে রেখে আসতে হবে। তারপর আবার ফিরতে হবে বারোহাটিতে। তবে কোনো এক অদ্ভুত কারণে হরিহরণের মন বলছে ওই ভাঙা বাড়িতে আজ রাতেই কোনো অঘটন ঘটবে।

কিন্তু সে জানে না, সেই অঘটনটি কী?

.

দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটির বাগানবাড়িতে পৌঁছালেন মধ্যরাতে। শেষ অবধি তিনি একা আসেননি। তার সাথে এসেছে রতনকান্তি। দেবেন্দ্রনারায়ণ কোনো এক অব্যক্ত কারণে রেণুকার দাসী তপতীকে নগ্নাবস্থায় পেয়েও স্পর্শ করেননি। বরং হঠাৎ করেই কী এক রহস্যময় তীব্র উত্তেজনা নিয়ে তিনি অন্দর থেকে বের হয়েছিলেন। বিকল্প কোনো উপায় ছিল না বলে তিনি নিজে নিজেই সেই ভাঙা জুড়িগাড়িখানা চালিয়ে এই গভীর রাতে এতটা পথ একা আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি যে আদৌ সম্ভব নয়, তা তিনি ভেবে দেখেননি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেবেন্দ্রনারায়ণ অবাক হয়ে দেখলেন, রতনকান্তি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, রতনকান্তি খানিক আগেই তাকে বলেছিল সে সার্কাসে ঘোড়ায় চড়ার নানান কসরত দেখাত। এমনকি সে জুড়িগাড়ি চালনায়ও দক্ষ। দেবেন্দ্রনারায়ণ আর মুহূর্তকাল দেরি করেননি। তিনি রতনকান্তিকে বললেন, আমার সাথে চলো, বারোহাটি যেতে হবে।

রতনকান্তি কোনো প্রশ্ন করেনি। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের পেছন পেছন জুড়িগাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ হাস্যমুখে বললেন, তা কি হে রতনকান্তি, জুড়িগাড়ি চালনায় তোমার দক্ষতা কতটা, তা পরীক্ষা করে দেখবার প্রয়োজন আছে না? জমিদার বাড়িতে কোচোয়ানের চাকরি নেবে, আর পরীক্ষা দেবে না, তা কী করে হয়?

রতনকান্তি অবশ্য কোনো কথা বলেনি। সে মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে বসেছে এবং গাড়ির সেই মৃদু লণ্ঠনের আলোয়ও সে যথাসম্ভব দ্রুত গাড়ি ছুটিয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ শেষ অবধি মুগ্ধ দৃষ্টি তুলে তাকিয়েছিলেন ঘাড় অবধি লম্বা চুলের এই আপাত লাজুক, আড়ষ্ট, বিনয়ী যুবকের দিকে।

মধ্যরাতে বারোহাটির বাগানবাড়িতে পৌঁছেই দেবেন্দ্রনারায়ণ গতরাতে হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরে ঢুকলেন। দীর্ঘ সময় তিনি ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা পায়চারি করলেন। জানালা খুলে কিছুক্ষণ। তাকিয়ে রইলেন বাইরে। সেখানে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে জানালা গলে বাইরে বের হওয়া লণ্ঠনের আলো পড়ে আছে তেরছাভাবে। জানালা থেকে সরে এসে দেবেন্দ্রনারায়ণ পশ্চিম দিকের দেয়ালের সাথে লাগানো ভারী সেগুন কাঠের আলমারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর আলমারি খুলে পানীয়ের বোতল বের করে ছিপি খুললেন। খুব ধীরে ঢকঢক করে খানিক তরল ঢাললেন গলায়। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘসময় নিয়ে তিনি তরলটুকু গিললেন। তারপর দরজা খুলে বের হয়ে দাসী অপলাকে ডাকলেন। এই মাঝরাতে দেবেন্দ্রনারায়ণকে হঠাৎ এখানে দেখে অপলা রীতিমতো চমকে গেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, রামচরণ কারিগরের কোনো খবর আছে?

অপলা এতটাই হকচকিয়ে গিয়েছে যে, সে সঙ্গে সঙ্গে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা ধরতে পারল না। অবাক গলায় বলল, কোন রামচরণ?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সনাতনের বাবা, রামচরণ কারিগর।

অপলা বলল, অ, সে তো বাড়ির বারই হয় না কতকাল। তার ওপর শুনেছি তার অবস্থাও বিশেষ ভালো না। আজ যায়, কাল যায় অবস্থা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে আনার ব্যবস্থা করো। আমি খানিক বেরুচ্ছি, তবে ভোর নাগাদ আবার এখানে ফিরব। ফিরে যেন তাকে এ বাড়িতে দেখতে পাই।

অপলা হতভম্ব হয়ে গেছে। এই এত রাতে দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার কোথায় যাবেন! আর বৃদ্ধ মুমূর্ষ রামচরণ কারিগরকেই বা এত জরুরি কী দরকার?

অপলা জানে, তার এত সব প্রশ্নের কোনোটিরই উত্তর সে পাবে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ যেখানেই যাক, সে ফিরে আসার আগেই রামচরণ কারিগরকে এখানে উপস্থিত করতে হবে। এটিই এখন তার একমাত্র কর্তব্য।

দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তিকে রেখে সেই গভীর রাতে বারোহাটির বাগানবাড়ি থেকে বের হলেন একা। তার এক হাতে ধারালো বর্শা, আরেক হাতে জ্বলন্ত মশাল। একাকী দেবেন্দ্রনারায়ণ দ্রুত পায়ে বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন বারোহাটির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলের ভেতর কিছু দূর গিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের হঠাৎ মনে হলো, তার আরো কিছুটা মদ্যপান করা উচিত ছিল। কারণ, এখন যে কাজটি তিনি করতে যাচ্ছেন, সুস্থ-মস্তিস্কে সেই কাজটি করার মতোন যথেষ্ট মানসিক শক্তি তার রয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজেই নিশ্চিত নন!

.

রঘু আর জগাইয়ের কাজ শেষ। তারা দেবেন্দ্রনারায়ণের নির্দেশ মতোই নিতাই আর ছেলেটার থাকার ব্যবস্থা করেছে। ঘরের বাইরে চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধূপ জ্বালিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। কয়েকদিনের খাবার, জল রেখে এসেছে। কাজ শেষে এবার সকলেই ভালোয় ভালোয় বারোহাটি বাগানবাড়িতে ফিরে আসার জন্য উদগ্রীব। জগাই এসে হরিহরণকে বলল, এবার চলো। আমার হাত-পা, মাথা আর চলছে না। কখন যে ধুম করে পরে। যাব সে কথাও ঠিক করে বলতে পারছি না। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরটা বনবন করে ঘুরছে।

রঘু বলল, জগাই ঠিক কথাই বলেছে। কারোরই আর এখানে এক মুহূর্ত থাকার ইচ্ছে নেই। চলো, এ জায়গা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি, ততই বাঁচি।

হরিহরণ কোনো কথা বলল না। তবে সে আবারো মশাল হাতে দলটার সামনে সামনে হেঁটে চলল। এখানে কী ঘটেছে না ঘটেছে তা নিয়ে হরিহরণের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার মাথায় কাঁটা হয়ে বিধে আছে আসার পথের সেই ঘটনা। এক মুহূর্তের ঘটনা হলেও বিষয়টি হরিহরণ মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। যদিও ভুল দেখেছে ভেবে নিয়ে বিষয়টি সে মাথা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বারংবার। কিন্তু যতই সময় গড়িয়েছে বিষয়টি ততই তার মাথায় আরো বেশি গেড়ে বসেছে। সে কিছুতেই বিষয়টি ভুলতে পারছে না। একমনে দলটা হরিহরণের পেছন পেছন হেঁটে চলেছে। এই আতঙ্কময় অন্ধকারের জঙ্গল থেকে বের হতে পারলে যেন সকলেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবে। যেন মুক্তির স্বাদ পাবে। সকলের বুকের ভেতর এখন এই একই তেষ্টা। একই ইচ্ছা।

হরিহরণের মাথায় অবশ্য অন্য চিন্তা। সেই একপলক দেখা আবছায়া এক মূর্তি। হরিহরণ একমনে হাঁটছে তো হাঁটছেই। কোথাও যেন তার কোনো দৃষ্টি নেই। সে ডুবে রয়েছে এক গভীর চিন্তায়। তবে ঠিক সেই জায়গাটিতে এসে হরিহরণ আচমকা থমকে দাঁড়াল। তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল রঘু আর জগাইসহ পুরো দলটাই। হরিহরণ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ বলল, রঘু, এখান থেকে তোরা পথ চিনে যেতে পারবি না?

রঘু ভীত কণ্ঠে বলল, আঁ? কেন, তুমি যাবে না?

হরিহরণ বলল, আমাকে আবার ওই ভাঙা বাড়িটাতে যেতে হবে। দেখছিস না, পায়ের জুতো জোড়া দিব্যি রেখে চলে এসেছি।

জগাই পেছন থেকে বলল, রেখে এসেছ বেশ করেছ। ও ছিঁড়ে জুতো না হলেও চলবে। আমি তোমায় একজোড়া নতুন জুতো বানিয়ে দিবক্ষণ।

হরিহরণ বলল, না, না। ও জুতো আমার লাগবেই। ও জোড়া আমার বংশের চিহ্ন। ভারি প্রাচীন আর বনেদি জুতো। ও জোড়া না হলে আমার চলবে না।

অন্য সময় হলে হরিহরণের বংশ নিয়ে এর মধ্যেই জগাই আর রঘু ঠাট্টা তামাশা শুরু করে দিত। কিন্তু এখন কেউই তা করল না। জগাই এগিয়ে এসে বলল, কাল দিনে এসে নিয়ে যেও। এখন আর ও মুখো হয়ো না।

হরিহরণ বণিক এতটুকু টলল না। সে বলল, না রে জগাই। সে আমি পারব না। ওই জুতো রেখে আমি কিছুতেই যেতে পারব না। ও আমাদের বংশের চিহ্ন। একদিন আমরা কত বড় বংশ ছিলাম, জানিস? আমার পূর্বপুরুষ সিন্দাবাদের মতোন করে জাহাজে চড়ে দেশ-বিদেশে বাণিজ্যে যেত।

হরিহরণের এই গল্প বিষ্ণুপুরের প্রায় সকলেই জানে। ফলে হরিহরণ এই কথা বলতে শুরু করলে সকলেই তাকে থামিয়ে দেয়, অথবা সরে পড়ে। কিন্তু আজ কেউই তা করল না। বরং সকলেই যেন প্রবল আগ্রহ নিয়ে হরিহরণের গল্প শুনতে লাগল। তবে হরিহরণ আজ আর তার গল্প বাড়ালো না। সে বলল, তোরা যা, এখান থেকে খানিক ডানে গিয়ে সোজা পশ্চিমে হাঁটবি। নদীর দিকে আর যাওয়ার দরকার নেই। সোজা হাঁটলেই বারোহাটি পৌঁছে যাবি।

জগাই আর রঘু তবুও দাঁড়িয়ে রইল। নানান কায়দা-কানুন, অনুনয়-বিনয় করে তারা হরিহরণকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু হরিহরণের সিদ্ধান্ত তাতে পাল্টাল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শেষ অবধি জগাই রেগে গিয়ে বলল, কী আমার দুঃসাহসী হরিহর বণিকরে! ও না গেলে আমাদের যেন বাঘ-ভলুকে গিলে খাবে। চল, চল রঘু। দেখি এই জঙ্গলে কী এমন বাঘ-ভল্লুক লুকিয়ে আছে!

জগাইয়ের কথা শুনে রঘু তেমন ভরসা পেল না। কিন্তু সে খেয়াল করল, তার পেছন থেকে সারি বেঁধে ভূত-পেয়াদারা জগাইয়ের পিছু নিয়েছে। ভীত রঘু বার দুয়েক সামনে পিছনে তাকাল। তারপর আর কোনো উপায় না দেখে সে নিজেও ত্রস্ত পায়ে জগাইয়ের দলটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।

.

হরিহরণ বণিক অনেকক্ষণ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। জগাইয়ের দলটার মশালের আলো দূরে না যাওয়া অবধি সে তার জায়গা থেকে নড়ল না। আলোটা দূরে যেতেই হরিহরণ পেছনে ঘুরে তাকাল। এতক্ষণ ধরে হেঁটে আসা পথে আবার খানিক পিছু হেঁটে গেলেই সে তার জুতো জোড়া পেয়ে যাবে। এই কিছুক্ষণ আগেই হরিহরণ তার জুতো জোড়া সবার অলক্ষ্যে ওখানে ঝোঁপের আড়ালে ছুঁড়ে দিয়েছিল। সে খানিক পিছু হেঁটে গিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে জুতো জোড়া কুড়িয়ে নিল। তারপর খানিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখন রাত কত হবে সে জানে না। ভোর হতে কত বাকি তা-ও না। তবে জঙ্গলে সহসা ভোর হয় না। ভোরের আলো গাছপালা ভেদ করে এই গভীর জঙ্গল আলোকিত করতে খানিক সময় নেয়।

হরিহরণ ধীর পায়ে তার জায়গা থেকে নড়ল। তারপর ঠিক সেই জায়গাটিতে ফিরে এলো, যেই জায়গাটিতে সে মুহূর্তের জন্য হলেও একটি ছায়ামূর্তির মতোন কিছু দেখেছিল। অবশ্য ঘন ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা জায়গাটিতে ঠিক কী দেখেছিল, সে সম্পর্কে হরিহরণ বণিক এখন আর নিশ্চিত নয়। এমনও হতে পারে যে দমকা হাওয়ায় কোনো লতা বা বৃক্ষের পাতার হঠাৎ নড়ে ওঠা দেখে সে ভুল ভেবেছিল। মশালের আলোয় সেই কম্পমান পাতাকেই সে ভেবে বসেছিল চলমান কিছু! কিন্তু তারপরও হরিহরণের সংশয় যেন কাটছেই না। সে কিছুক্ষণের মধ্যে মশালের আলোতে আশেপাশের পুরোটা জায়গা চষে ফেলল। গাছপালা, ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে শুরু করে গাছের শাখা অবধি। কিন্তু কিছুই মিলল না। ক্লান্ত হরিহরণ বিফল মনোরথেই ধীর পায়ে নদীর পথ ধরল। শেষ রাত বলেই কিনা কে জানে, চারপাশের পশুপাখির ডাক তেমন একটা নেই। হয়তো ভোরের আগমনী বার্তা টের পেয়েই নিশাচর প্রাণীগুলো ঘা ঢাকা দিতে শুরু করেছে।

হরিহরণ একমনে কতক্ষণ হেঁটেছে সে জানে না। মশালের আগুনও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ক্লান্তিতে তার শরীরও ভেঙে পড়ছে। চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম। চোখের পাতা খুলে রাখতেও তীব্র কষ্ট হচ্ছে। ক্লান্ত হরিহরণ নদীর পাড়ে এসে থামল। ঘুমঘুম চোখেই সে তার ডিঙি নৌকোতে উঠল। নৌকার বাঁধন খুলে বা পায়ের মৃদু ধাক্কায় সে নৌকাখানাকে জলে ভাসাল। পাটাতানের উপর থেকে বৈঠা তুলতে গিয়ে হরিহরণ বণিক হতভম্ব হয়ে গেল! তার সামনে নৌকার ঠিক গলুইয়ের ওপর ও কে? চিরকালের ভয়ডরহীন, দুঃসাহসী হরিহরণ বণিক যেন মুহূর্তের মধ্যে বরফের মতোন জমে গেল! তার নৌকার গলুইয়ে তুমুল কম্পন তুলে এক দীর্ঘ নারী মূর্তি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছে। হতভম্ব, ভীত, দ্বিধান্বিত হরিহরণ বণিকের হঠাৎ মনে হলো, প্রবল ক্লান্তি আর নিদ্রাহীনতায় সে চোখে ভুল দেখছে না তো!

হাত বাড়িয়ে গঙ্গাবতীর বুক থেকে খানিক জল তুলে হরিহরণ বণিক তার মুখে ছিটাল। তারপর আঁজলা তুলে জল নিয়ে চোখে ঝটকা দিলো বারকয়েক। তারপর আবার তাকাল। নৌকার গলুইয়ে নারী মূর্তিটি তখনও তেমনি দাঁড়িয়ে। নদীর এই ভোলা জায়গায়, অন্ধকার খানিকটা ফিকে, সেই ফিকে অন্ধকারে নারী মূর্তিটি তাকিয়ে রয়েছে সরাসরি হরিহরণ বণিকের দিকে। হরিহরণ বণিক এতক্ষণে বুঝল, সে ভুল কিছু দেখছে না। সে যা দেখছে তা পুরোপুরি সত্যি। তার চোখের সামনের ওই নারী মূর্তিটি সত্যিই সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। নারীমূর্তিটিকে সে চেনে।

এই নারীমূর্তির নাম হেমাঙ্গীনি দেবী!

*

দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটি জঙ্গলের গভীরে নিতাই আর গুটিবসন্ত-আক্রান্ত ছেলেটার আশ্রয়স্থল ভাঙা বাড়িটিতে পৌঁছালেন প্রায় শেষ রাতে। নিতাই আর ছেলেটাকে এখানে রেখে বারোহাটিতে ফিরে যাওয়া জগাইয়ের দলটার সাথে তার দেখা হয়নি। অবশ্য দেবেন্দ্রনারায়ণ নিজেও চাননি, তার সাথে কারো দেখা হোক। তিনি আসতে চেয়েছিলেন একা-নিভৃতে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বসে আছেন একটি দেয়ালের দিকে মুখ করে। দেয়ালটি এই বাড়ির আর সকল ঘরের দেয়ালের চেয়ে খানিকটা অক্ষত। তবে এই দেয়ালের শরীরজুড়েও এখানে সেখানে নানান জায়গায় পলেস্তরা খসে গেছে। জীর্ণ দেয়ালের মাঝখানে বিশাল ভাঙা জানালা। দেবেন্দ্রনারায়ণ বসে আছেন সেই ভাঙা জানালার দিকে মুখ করে। জানালার ওপর একখানা মশাল জ্বলছে। ওপাশে বড়সড় একটি ঘর। এই ভাঙা জানালাটি ছাড়া ঘরের আর সকল দরজা জানালা বাইরে থেকে বন্ধ। মেঝেজুড়ে শুকনো খড়-পাতা বিছানো। খড় পাতার ওপর মাদুর পাতা হয়েছে। ঘরে দু’জন মানুষ, নিতাই আর ছেলেটা। ছেলেটা ও প্রান্তের দেয়াল ঘেঁষে নিস্পন্দন শুয়ে আছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে জীবিত না মৃত! জানালার ওপাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসে আছে নিতাই। খানিক আগেই ওই ভাঙা জানালায় গলা বাড়িয়ে তাকে ডেকে তুলেছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। নিতাইয়ের চোখ টকটকে লাল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ জানালার বাইরে থেকেই বললেন, তুই আমার সাথে মিথ্যে বলেছিস নিতাই?

নিতাই মিনমিনে গলায় বলল, আপনার সাথে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ কত্তা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কী লাভ সে তুই জানিস। ও ছেলেকে তোর কাছে কে দিয়ে গেছে সে কথা তুই আমার কাছে লুকিয়েছিস। বলেছিস তুই জানিস না। কিন্তু তুই-ই আমায় বল, একটা ছেলে অত রাতে ওইভাবে নৌকায় ভেসে ভেসে একদম তোর নৌকার গায়ে এসে জুড়ে গেল, হ্যাঁ? আর সে কথা তুই আমায় বিশ্বাস করতে বলিস? তুই ঘুম ভেঙে উঠে তা-ই দেখলি?

নিতাই এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, আপনার কাছে মিথ্যে বলব না কত্তা। আমার তো বাঁচার আর কোনো পথ নেই। শরীরজুড়ে কেমন ব্যথা হচ্ছে, সারাশরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। ওই কালব্যাধি বুঝি ধরল আমায়!

কান্নার দমকে নিতাইয়ের কথা আটকে আসছিল। সে কান্না থামিয়ে বলল, আমি মাঝ নদীতে জাল ফেলে শুয়েছিলাম কত্তা। চোখে কখন ঘুম নেমে এসেছিল, টেরও পাইনি। রাতে আমার নাওয়ের সাথে হঠাৎ একখানা নাও এসে ভিড়ল। তারপর দু’জন লোক আমায় ডেকে তুলল। আমি নাওয়ের বাইরে এসে দেখি একখানা না, নাও দু’খানা। লোকগুলো যে নাওয়ে ছিল, সেইখানা বড়। আর তার সাথে ছোট আরো একখানা নাও। তারা আমায় বলল, তারা রাইপুর থেকে এসেছে। জমিদার বাড়ির জন্য তত্ত্ব নিয়ে এসেছে। ওই ছোট নাওখানাতেই রয়েছে জমিদার বাড়ির তত্ত্ব। আমি বললাম, জমিদার বাড়ি তো এখান থেকে বহু দূর। তাদের একজন বলল, তাদের নৌকোর মাঝি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর ছোট নাওখানাতে কোনো মাঝিই নেই। ওখানা তারা বড় নাওয়ের সাথে বেঁধে নিয়ে এসেছিল। এখন তাদের মাঝির অবস্থা দেখে তারা ভয় পাচ্ছে। মাঝির লক্ষণ দেখে ভালো মনে হচ্ছে না। চোখ লাল, বার কয়েক বমি করেছে, গায়ে জ্বর আর কেমন যেন ফুসকুরির মতোও উঠেছে।

নিতাই খানিক থামল। দেবেন্দ্রনারায়ণ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন নিতাইয়ের দিকে। যেন তিনি নিতাইয়ের অন্তর্জগতে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো সত্য পাঠ করবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু জ্বরাগ্রস্ত, ভীত, ক্লান্ত নিতাইয়ের ভেতর যেন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে যেন কেবল ঘোরের ভেতর এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে। সে আবার বলতে শুরু করল, ওই লোকের কথা শুনে আমি ভয় খেয়ে গেলাম কত্তা, এ যে সাক্ষাৎ গুটিবসন্তের লক্ষণ! তাদের মাঝির তাহলে গুটিবসন্ত উঠেছে! এখন উপায়? তারা বলল যে এই রোগী নিয়ে তারা বিষ্ণুপুরের আর ভেতরে ঢুকতে চায় না। জমিদার বাড়িতে তো নয়-ই। এ রোগ ছোঁয়াচে। তাছাড়া তারাও জানে, জমিদার বাড়ির পেয়াদারা নদীর তীরজুড়ে পাহারা দিতে ঘুরে বেড়ায়। গুটিবসন্তের কোনো রোগী দেখলেই আর রক্ষা নেই। তাই তারা এখান থেকেই ফিরে যেতে চায়। কিন্তু ফিরে গেলে তত্ত্ব কিভাবে পৌঁছাবে?

নিতাই আবার খানিক থামল। ঘটি থেকে খানিক জল ঢেলে ঢকঢক করে খেল। তারপর বলল, তারা আমায় বলল, আমি যদি তাদের সঙ্গে থাকা ওই ছোট নাওখানা মাঝ নদী থেকে নদীর তীরে নিয়ে যাই, তারপর জমিদার বাড়ির কোনো পেয়াদাকে একটু ডেকে তার কাছে পৌঁছে দেই, তো তাদের ভারি উপকার হয়! আমি রাজি হইনি কত্তা। আমার কেমন ভয় করছিল। আমি বললাম, আমি এ কাজ পারব না। তোমাদের আমি চিনি না, জানি না। তোমরা কার কাছ থেকে এসেছ, সে-ও জানি না। এ আমি পারব না। তারা তখন বলল রাইপুর থেকে এ তত্ত্ব পাঠিয়েছে হেমাঙ্গিনী দেবী। তারপর তারা আপনার নাম করে বলল, মেজোকত্তা দেবেন্দ্রনারায়ণের জন্য এ বিশেষ উপহার। নাওয়ের ভেতর খুব দামি জিনিস রয়েছে। আমি তাও রাজি হলাম না। তখন তারা আমার হাতে একগাদা টাকা গুঁজে দিল কত্তা। টাকা গুঁজে দিয়ে বলল…।

নিতাই যেন ঘুমে ঢলে পড়ছিল। তবে এই পর্যায়ে এসে সে টকটকে লাল চোখ তুলে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে চাইল। তারপর ভীত কণ্ঠে বলল, আমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ওই ছোট নাওখানার ভেতরে নাকি জমিদার বাড়ির কে রয়েছে! তাকে জরুরি জমিদার বাড়িতে পৌঁছাতে পারলে জমিদার বাড়ি থেকেও নাকি বকশিশ মিলবে! না হলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার গম্ভীর এবং কঠিন গলায় বললেন, তোকে কেউ বলেনি, কোনো অবস্থায়ই ওইরকম কোনো নৌকো তীরে ভেড়ানো নিষেধ? গঙ্গাবতীর সকল জেলে-মাঝিদেরও এ কথা বলা হয়েছে, তোকে বলা হয়নি?

নিতাই জড়ানো গলায় বলল, আমি লোভে পড়েছিলাম কত্তা। টাকার লোভ। অতগুলো টাকা দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না। তাছাড়া, ও নায়ে। জমিদার বাড়ির ছেলে ছিল, ওরা আমার হাতে একখানা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল ওই কাগজে না কি ওই ছেলের কথা লেখাও রয়েছে…।

নিতাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই দেবেন্দ্রনারায়ণ তার নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে নিতাইকে চুপ করতে ইশারা দিলেন। তারপর কণ্ঠ নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, এ কথা আর কেউ জানে নিতাই?

নিতাই ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, কোন কথা?

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, ওরা যে বলেছে, এই ছেলে জমিদার বাড়ির। এ কথা আর কাউকে বলেছিস? আর ওই চিঠির কথা?

নিতাই ভয়ার্ত গলায় বলল, না কত্তা। কেউ জানে না। আমি নাওখানা তীরে এনে বাঁধলাম। তারপর ভেতরে কী আছে দেখতে নাওয়ের ভেতরে ঢুকলাম। প্রথমে কিছুই বুঝিনি। ছোট একটি ছেলে চাদর গায়ে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু তারা মাথা অবধি ঢাকা। আমি তার গায়ে হাত দিয়ে চাদর সরালাম। লণ্ঠনের আলোয় আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি, কিন্তু যতক্ষণে বুঝলাম, ততক্ষণে ওই ছেলেকে আমি ছুঁয়ে দিয়েছি কত্তা, আমি…।

নিতাই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর বলল, তখন কী করব, কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। একবার ভাবলাম নাওখানা নদীতে ভাসিয়ে দিই। পরক্ষণেই ভাবলাম, তাতে যদি আরো বড় কোনো বিপদ হয়! নাওয়ের ভেতরের ছেলেটি যদি সত্যি সত্যিই জমিদার বাড়ির কেউ হয়! চিঠিখানাতেও তো না কি তা-ই লেখা আছে! তখন মাথায় বুদ্ধি এলো যে, চিঠিখানা নাওয়ের ভেতর রেখে নাওখানা এই তীরে বাঁধা রেখেই আমি আমার নাও নিয়ে আবার মাঝ নদীতে চলে যাব। পেয়াদাদের কারো না কারো চোখে ওই ছোট নাওখানা পড়বেই। তখন আমার আর কোনো দোষ থাকবে না। কে না কে রেখে গেছে! আর চিঠিখানা পড়লে তো ছেলেটার কথা সকলেই জানবে! তখন ছেলেটাকে আবার আগের মতো ঢেকেঢুকে রেখে, চিঠিখানা ঘটির সাথে বেঁধে নাও থেকে যেই বের হয়েছি, অমনি দেখি পেয়াদা রঘু নাওয়ের বাইরে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে!

নিতাই কথা শেষে একদম চুপ হয়ে রইল। দেবেন্দ্রনারায়ণও। অনেকক্ষণ। ওপাশের দেয়ালের কাছ থেকে ছেলেটা হঠাৎ নড়ে উঠল। তারপর খানিক ঘুরল। মশালের উজ্জ্বল আলোয় ছেলেটার ঘুমন্ত মুখ দেখে দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের ভেতর কোথায় যেন তীব্র জলোচ্ছ্বাসের মতোন কেঁপে উঠল। ভেসে গেল জানা-অজানা, যুক্তি-অযুক্তির কতকিছু! দেবেন্দ্রনারায়ণের আবারও মনে হল ওই ছেলেটিকে তার বাঁচাতেই হবে। যে করেই হোক বাঁচাতেই হবে। কিন্তু এই ছেলেটিকে বাঁচানো বড় অসম্ভব। এমন ভয়াবহ কালব্যাধি থেকে কেউ বাঁচে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময় চোখ বন্ধ করে রইলেন। ধ্যানী ঋষির মতোন। দীর্ঘ সময়।

সেই শেষ রাতে, বারোহাটির গভীর জঙ্গলের ওই ভাঙা বাড়িতে মুদ্রিত চোখের ধ্যানী দেবেন্দ্রনারায়ণে হঠাৎ মনে হলো এই ছেলেটি বেঁচে যাবে। এই কালব্যাধি এই ছেলেটির জীবন হরণ করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবে। এই ছেলেটি বেঁচে যাবে। কিন্তু এই রাতের শেষে যেই ভোরের আলো ফুটবে তাতে বিষ্ণুপুরের সকল মানুষের জন্য নিতাই আর ওই ছেলেটির জীবন্ত অগ্নিদাহ অবধারিত। গত সন্ধ্যায় গঙ্গামহলে সেই সিদ্ধান্তই হয়েছে। এই কালব্যাধি গুটিবসন্ত ছেলেটিকে শেষ অবধি রেখে যাবে কিনা, সেটির উত্তর সময়ের কাছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এই রাত শেষের ভোরের আলোয় যে দিনের শুরু হতে যাচ্ছে, সে দিনের আলোয় দেবেন্দ্রনারায়ণ কী করে সকলের চক্ষু ফাঁকি দিয়ে এই ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন?

এতক্ষণে বিষ্ণুপুরের সকলেই অবগত যে বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদের মতানুযায়ী কালব্যাধি গুটিবসন্ত থেকে বিষ্ণুপুরকে রক্ষার একমাত্র উপায় এখন এই দু’জনের জীবন্ত অগ্নিদাহ এবং আজকের দিন সেই জীবন্ত অগ্নিদাহের দিন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজা খুলে ঘরটাতে প্রবেশ করলেন। নিতাই ততক্ষণে জড়সড় হয়ে ঢলে পড়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বড় বড় পা ফেলে দেয়ালের শেষপ্রান্তে গেলেন। তারপর সকল ভয়, সকল দ্বিধা, সকল জড়তাকে অগ্রাহ্য করে তিনি কাপড়ে মোড়ানো ছেলেটিকে ছুঁয়ে দিলেন! দেবেন্দ্রনারায়ণ দুই হাতে ছেলেটিকে কাঁধে তুলে নিলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়ির খানিকটা দূরে সরে এসে ছেলেটিকে একটি গাছের তলায় শুইয়ে রাখলেন তিনি। তারপর আবার ফিরে গেলেন বাড়ির ভেতর। বাইরে থেকে দরজাখানা বন্ধ করলেন। ভাঙা জানালার উপর থেকে জ্বলন্ত মশালখানি তুলে নিলেন। তারপর মুহূর্তকাল তাকিয়ে রইলেন ঘুমন্ত নিতাইয়ের মুখের দিকে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বিড়বিড় করে যেন কিছু বললেন। তারপর গনগন করে জ্বলতে থাকা মশালখানি ছুঁড়ে দিলেন ঘরের ভেতর।

ঘরের ভেতরের শুকনো খড়-পাতায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। দেবেন্দ্রনারায়ণ জানালার কাছ থেকে সরে এলেন। একখানা শক্ত কাঠের পাল্লা তুলে নিয়ে জানালাটা ঢেকে দিলেন। ঢেকে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণ দেখলেন নিতাই উঠে বসেছে। সে জগতের সকল শূন্যতা চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে। সেই চোখে কোনো ভয় নেই, কোনো অসহায়ত্ব নেই, কোনো বাঁচার আকুতি নেই। কিছু নেই। শূন্য, নিঃসীম একজোড়া চোখ। নিতাই একবারের জন্যও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল না। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল না। তার পরনের ধুতিতে আগুনের শিখারা ছোবল মারতে শুরু করল, কিন্তু নিতাই ঠিক ওভাবেই তাকিয়ে রইল।

শূন্য, নিঃসীম, নির্ভয়।

.

দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটির বাগানবাড়িতে ফিরলেন ভোরের আলোয়। যেন একটা দিন, একটা দীর্ঘজীবনের মতোন দীর্ঘসময় নিয়ে পার হলো। দেবেন্দ্রনারায়ণ বারোহাটির বাগান বাড়িতে ঢুকে কারো সাথে কথা বললেন না। কেবল অপলাকে ডেকে দূর থেকেই জানতে চাইলেন রামচরণ কারিগর এসেছে কীনা?

অপলা জানাল, রামচরণ কারিগর তার ঘরের সামনে জলচৌকিতে বসে রয়েছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন কেউ যেন এই দিকে আর না আসে। তিনি রামচরণ কারিগরের সামনে গিয়ে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, এই বাড়ি করার সময় আমি ছিলাম না। তুমি তোমার ইচ্ছেমতো বাড়ি বানিয়েছ! আমি এটাকে বাগানবাড়ি বানাতে বলেছিলাম। তুমি একে বানিয়েছ দুর্গ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক থেমে আবার বললেন, এতদিন বাদে আমি তোমায় এক বিশেষ কারণে ডেকেছি। দরজা জানালা ছাড়া এই বাড়ি থেকে বের হবার আর কোনো উপায় আছে কিনা সেটি জানতে।

রামচরণ কারিগর সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলো না। খুক খুক করে খানিক কাশি দিলো। তারপর কাশি থামিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আপনি দুর্গ বানাতে বলেননি, সে কথা যেমন সত্য, আবার এই বাড়ির মাটির নিচে পাতাল ঘরও বানাতে বলেছিলেন সে কথাও সত্য। সেই শুনে আমি ভাবলাম উপরতলা থেকে নামবার ক’খানা গোপন পথও থাকুক। এই বাড়ির তিনখানা ঘরে গোপন দরজা রয়েছে, ও পথেও বের হওয়া যায়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ চমকালেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, তুমি যে পাতাল ঘরখানা বানিয়েছিলে, ওখানা আবার ঘর হলো নাকি! ও নিয়ে আর কথা বলো না। আমার মেজাজ আবার বিগড়ে যাবে। তো যে তিনখানা ঘরে গোপন দরজা রেখেছিলে, এই ঘর তার একখানা?

রামচরণ কারিগর আগের মতই নিচু এবং ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, সে বছর কুড়ি আগের কথা। আজকাল কিছুই তেমন ঠাহর করতে পারি না। মনেও থাকে না সব।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, দরজাগুলো কোথায় আছে সে কথা তো মনে। আছে?

রামচরণ কারিগর এবারও সাথে সাথে জবাব দিলো না। যেন ধ্যানে ডুবে রইল। দীর্ঘসময় পরে সে ধীরে মাথা তুলল। তারপর বলল, এ ঘরে যদি একখানা মোটে আলমারি থেকে থাকে। আর সেখানা দেয়ালজুড়ে হয় তাহলে ওই আলমারি সরানোর ব্যবস্থা আছে। ওখানা সরালেই ওই গুপ্তদরজা।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বলল, এ কথা তুমি ছাড়া আর কে জানত?

রামচরণ করিগর অনেকক্ষণ ভেবে বলল, এ খবর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না মেজো কর্তা। কেউ না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কেউ না?

রামচরণ কারিগর বলল, না, কেউ না।

দেবেন্দ্রনারায়ণ কী যেন ভাবলেন! তারপর আবার বললেন, কিন্তু এ কথা তুমি আমায়ও জানাওনি। আমায় জানানো তোমার কর্তব্য ছিল।

রামচরণ কারিগর এবার খানিক শক্ত হলো। সে বলল, আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছি, কিন্তু সে সুযোগ তো আপনি আমায় দেননি। সেই মাটির নিচের পাতাল ঘরখানা দেখেই আপনি যেমন অগ্নিশর্মা হলেন। ঘরখানার কাজ প্রায় শেষও হয়ে এসেছিল, কিন্তু আপনি তখনই তার নির্মাণ বন্ধ করে দিয়ে তেমনই ফেলে রাখলেন। তখন আর কোনো সাহসে বলি? তাছাড়া আপনি তখন আমার মুখ অবধি দেখতে চাননি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, কিন্তু তোমার পুত্র সনাতনকে দিয়ে হলেও তুমি আমায় এ খবর জানাতে পারতে।

রামচরণ কারিগর কী যেন বলতে গিয়েও আবার থেমে গেল। সে ধীরে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার যেন আবছা মনে পড়ছে সে কাউকে দিয়ে এই খবর দেবেন্দ্রনারায়ণকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কাকে দিয়ে তা তার স্পষ্ট মনে পড়ছে না। একেক সময় একেকজনের কথা মনে পড়ছে। তবে স্পষ্ট করে কারো কথাই ধরতে পারছে না রামচরণ কারিগর। কিন্তু যার কাছে সে খবরটি পাঠিয়েছিল, সে তাহলে দেবেন্দ্রনারায়ণকে এই খবর পৌঁছায়নি? কিন্তু কেন?

বৃদ্ধ, অসুস্থ রামচরণ কারিগর ভাবনার গভীরে ডুবে গেল। কিন্তু কিছুতেই সেই মানুষটির পরিচয় সে মনে করতে পারল না। নানান মানুষ, নানান নাম, নানান মুখ এসে একে এক ভিড় করছে তার চিন্তায়। কিন্তু এর থেকে কোনো একটি চিন্তাকে সে আলাদা করতে পারছে না। কোনো একটি মানুষকে সে আলাদা করতে পারছে না। বৃদ্ধরামচরণ কারিগর তার মাথার ভেতর অজস্র এলোমেলো ভাবনা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন।

দেবেন্দ্রনারায়ণ আর একটি কথাও বাড়ালেন না। তিনি চুপচাপ ঘরে ঢুকলেন। আলমারির আশেপাশে খুঁজতেই লোহার একটি আংটা মতো দেখতে পেলেন। সেটি ধরে টান দিতেই আপাতদৃষ্টিতে দেয়ালের সাথে সাঁটা মনে হওয়া আলমারিটা বা দিকে সরে গেল। সেখানে উঁকি দিল সরু একখানা দরজা। দরজাখানা দিয়ে একখানা সিঁড়ি সোজা নেমে গেছে নিচে। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন, এই দরজার কথা তিনি নিজে না জানলেও হেমাঙ্গীনি দেবী কী করে জানল?

.

তারপরের দু’দিন দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘর থেকে বের হলেন না। কারো সাথে দেখা দিলেন না। তার ধারণা তিনি ছেলেটিকে ছুঁয়ে দিয়ে যে কাণ্ডটি করেছেন, তাতে গুটিবসন্তে-আক্রান্ত হওয়া তার জন্য অবশ্যম্ভাবী। এ কারণেই তিনি আর গঙ্গামহলেও ফিরে গেলেন না। তিনি যেন অপেক্ষা করতে লাগলেন। গুটিবসন্তের। কিন্তু দু’দিনেও তার কিছু হলো না।

বরং সেই রাতের পরদিন ভোর থেকেই খবর রটে গেল, মশালের আগুন থেকে আগুন লেগে বারোহাটি জঙ্গলের সেই বাড়িটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সাথে জীবন্ত ভস্মিভূত হয়ে গেছে নিতাই আর সেই ছেলেটিও। বিষ্ণুপুরের মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সকলেই এতে ভগবানের অপার দাক্ষিণ্য খুঁজে পেল। বিশেষ ইঙ্গিত খুঁজে পেল। এবং গুটিবসন্ত নিয়ে ভয় কেটে গেল বিষ্ণুপুরবাসীর। এ যেন সাক্ষাৎ ভগবান নিজে নেমে এসে তাদের শাপমুক্তি ঘটালেন। না হলে ব্রাহ্মণরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ঠিক তা-ই এমন অলৌকিক উপায়ে কী করে ঘটল!

অবশেষে ভগবান তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন দেখালেন!

.

বিষ্ণুপুরবাসী গুটিবসন্ত আতঙ্ক কাটিয়ে আবার ফিরে গেল স্বাভাবিক জীবনে। সবকিছু স্বাভাবিক, নিস্তরঙ্গ। কিন্তু এই ঘটনার তিনদিনের মাথায় ঘটল আসল ঘটনা। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলো জগাই। সাথে থেকে। থেকে বমি। পরদিন তার সারা শরীরজুড়ে ছোট ছোট ফুসকুড়ি। ওই দিন দুপুর থেকে রান্না ঘরে কাজ করা দুজন দাসীরও জ্বর উঠল। তারপর বমি আর গা-ভর্তি দাগ। লক্ষণ পুরোপুরি জগাইয়ের মতোন। আরো দু’দিনে বিষ্ণুপুরজুড়ে গুটিবসন্তের ছড়িয়ে পড়ার খবর আসতে লাগল। জগাই মারা গেল পঞ্চম দিনে।

জগাই মারা যাওয়ার দিন-দুপুরে দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘ নিদ্রা গিয়েছিলেন। শরীরজুড়ে কেমন আলসেমি লাগছিল। তিনি এ ক’দিন ঘর থেকে বের হননি। অপলা তার খাবার দিয়ে যেত দরজার বাইরে। তবে সেখানে খাবার থাকত প্রায়। দু’জনের। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই খাবার নিয়ে আসতেন ঘরে। তারপর খেতেন। খাওয়া শেষে বাকি খাবার নিয়ে প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে দেবেন্দ্রনারায়ণ নেমে যেতেন আলমারির পেছনের সেই লুকানো পথে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই মাটির নিচের গুহাপথ। এই পথ চলে গেছে বারোহাটি বাগানবাড়ির সীমানাপ্রাচীরের বাইরে। তিনি সেই পথে হেঁটে বারোহাটির জঙ্গলের ভেতর অবধি গিয়ে গুহা থেকে বের হতেন। তারপর হেঁটে চলে যেতেন জঙ্গলের আরো গভীরে। সেখানে। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা পুরনো পরিত্যক্ত ভাঙা এক উর্দু দোতলা মন্দির। সেই মন্দিরের দোতলার একটি কক্ষে তখনও শ্বাস নিচ্ছে ছেলেটি।

দেবেন্দ্রনারায়ণ রাতের আঁধারে রোজ একবার গিয়ে শিশুটিকে খাবার খাইয়ে আসেন। তারপর বাড়তি খাবার আর জল রেখে আসেন ছেলেটির শয্যাপাশে। মাঝে একদিন তার হঠাৎ মনে হলো, কোনো একদিন যদি তিনি যেতে না পারেন, বা কোনো বিপদে পড়ে যান? তখন ছেলেটির কী হবে? সেদিনই তিনি লুকিয়ে ছেলেটির জন্য একখানা বালিশ, আর কিছু চাদর নিয়ে গেলেন। শুকনো খড়-পাতার ওপর সেই চাদরগুলো বিছিয়ে বিছানা করে তার ওপর ছেলেটিকে শুইয়ে রেখে এলেন। সাথে রেখে এলেন যতটা সম্ভব অতিরিক্ত খাবার আর জলও।

আজ দীর্ঘ নিদ্রা থেকে উঠতে গিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তার সারা শরীরজুড়ে অবসাদ। খানিক ব্যথাও। তিনি উঠে আহার গ্রহণ করতে গিয়ে দেখলেন তার মুখের ভেতর রাজ্যের বিস্বাদ। তিনি তেমন আহার গ্রহণ করতে পারলেন না। কিন্তু প্রতিরাতের মতো আজও সেই গোপন পথ ধরে জঙ্গলের গভীরে পরিত্যক্ত মন্দিরটাতে গেলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু আজ তিনি বহুকষ্টে বস্তাভর্তি অনেক খাবার নিয়ে নিলেন। হালকা কিন্তু পরিমাণে বেশি এমন শুকনো খাবার। তারপর ফিরে এলেন গভীর রাতে। শরীরজুড়ে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে ফিরে এসেই বিছানায় এলিয়ে পড়লেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। তার ঘুম ভাঙল ভোররাতে। সারা শরীরজুড়ে তীব্র ব্যথা আর জ্বর। জ্বরের ঘোরে দেবেন্দ্রনারায়ণ আবোল-তাবোল বকতে লাগলেন। দিনের আলোয় দেবেন্দ্রনারায়ণ দেখলেন তার শরীরজুড়ে অজস্র ফোঁটা ফোঁটা দাগ। সেই দাগ দেখে দেবেন্দ্রনারায়ণ অবাক হলেন না, মৃদু হাসলেন। তারপর তিনি আর সেই গোপন পথ ধরে যেতে পারলেন না। সেঁটে রইলেন বিছানায়।

অপলা দাসী মাঝে-মধ্যে এসে তার খবর নেয়। দেবেন্দ্রনারায়ণ তার কাছেই শুনেছেন বিষ্ণুপুরে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে গুটিবসন্ত। শ্মশান। ঘাটগুলিতে মড়া নিয়ে গিয়ে পোড়ানোর লোক পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টির ফোঁটার মতো রোজ মানুষ মরছে ঘরে ঘরে। কালব্যাধি গুটিবসন্ত অবশেষে যেন তার সর্বগ্রাসী রূপ উন্মোচন করেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণের জ্ঞান রইল না টানা কয়েকদিন।

এই সময়ে বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলের সিংহ দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো অনির্দিষ্টকালের জন্য। এ বাড়িতে কারো প্রবেশ যেমন নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ করা হলো কারো বহির্গমনও। এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিষ্ণুপুর জমিদারির বড়পুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণ। তবে সকলেই জানেন, তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে তার স্ত্রী বীণাবালা। দেবেন্দ্রনারায়ণের অসুস্থতার খবর শুনেও মহল থেকে বের হবার ব্যাপারে তার স্ত্রী রেণুকাকে যেন অঘোষিত এক নিষেধাজ্ঞায় বন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে। পুরো পরিস্থিতি হঠাৎ করেই এমন আমূল বদলে যাবার কারণ অবশ্য জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ।

দেবেন্দ্রনারায়ণ যেই গভীর রাতে বারোহাটির জঙ্গলে গিয়েছিলেন, তার পরদিনই অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন বিষ্ণুনারায়ণ। সে রাতেই বুকের বাঁ পাশে প্রবল ব্যথা অনুভব করেন। সাথে তুমুল বমি। এরপর আর কিছুই মনে নেই বিষ্ণুনারায়ণের। চেতনা ফিরে দেখেন শরীরের ডান দিকটা নড়াতে পারছেন না। বা দিকটাতেও তেমন সাড়া নেই। বিষ্ণুনারায়ণ বলতে গেলে পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্তই হয়ে পড়েছেন। তার বাকশক্তিও অনেকাংশেই রোহিত হয়ে পড়েছে। ফলে অবধারিতভাবেই গঙ্গামহলের সকল শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল তার জ্যেষ্ঠপুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকার অন্দরমহল। সেখান থেকেই। আসতে থাকল সকল নির্দেশ, নির্দেশনা। অবনীন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকার অন্দরমহল থেকেই ক্রমশই বিস্তৃত হতে থাকল এক নারীর প্রবল প্রভাব। সেই নারীর নাম বীণাবালা। অবনীন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী। এই মহাবিপর্যয়ের কালেও সময় যেন তার সবটুকু ঢেলে সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিল বীণাবালাকে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত বিষ্ণুনারায়ণ মারা গেলেন এর পনের দিনের মাথায়।

দেবেন্দ্রনারায়ণ তখনও মৃতপ্রায় শুয়ে রয়েছেন বারোহাটি বাগানবাড়ির অন্ধকার কুঠুরিতে। এখানে সেখানে রোজ অগণিত মানুষ মরছে। এ এক মহা দুর্যোগের কাল। সেই দুর্যোগ মুহূর্তে বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যু যেন আরো একটি সুযোগ করে দিল বীণাবালার সামনে। বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যুর দু’দিন না যেতেই দু’য়েকজন গণ্যমান্য লোক আর বামুন পুরুত ডেকে অবনীন্দ্রনারায়ণকে বিষ্ণুপুরের জমিদার ঘোষণা করা হলো।

বিষ্ণুনারায়ণের কনিষ্ঠপুত্র দীপেন্দ্রনারায়ণ তখন সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সাথে শ্বশুরালয়ে। তার শ্বশুরালয় বজরা নৌকায় দীর্ঘদিনের পথ। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে খবর দেয়াও সম্ভব হলো না। কিন্তু মাত্র কুড়ি দিনের মাথায় বিষ্ণুপুর নামক বহুবছরের পুরনো এক জমিদারির চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেল। এ যেন। বিষ্ণুপুর নয়। এ যেন বিষ্ণুপুর নামের অন্য কোনো জমিদারি।

বীণাবালা রোজ একবার করে দেবেন্দ্রনারায়ণের অট্টালিকায় যান। দেবেন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী রেণুকার সাথে খোশগল্প করার চেষ্টা করেন। রেণুকার সন্তানদের খোঁজ-খবর নেন। কোথাও তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চান। কিন্তু রেণুকা জানেন, তারা আসলে এখানে একপ্রকার বন্দি জীবনযাপন করছেন। এ থেকে মুক্তির উপায় এই মুহূর্তে তাদের জানা নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণ কেমন আছেন, সে খবরও তারা জানেন না। কারণ এই। গঙ্গামহল এখনও আবদ্ধ এক মহল। এর সিংহদরজা এখনও ভোলা হয়নি। পাছে গুটিবসন্ত কোনো মানুষের বেশ ধরে গঙ্গামহলে ঢুকে পড়ে!

রেণুকা জানেন না, দেবেন্দ্রনারায়ণ বেঁচে আছেন না মরে গেছেন। তবে রেণুকার দৃঢ় বিশ্বাস, তাদের এই অবস্থায় রেখে দেবেন্দ্রনারায়ণ চলে যেতে পারেন না। সে মৃত্যু যত ভয়ংকরই হোক না কেন! দেবেন্দ্রনারায়ণ ফিরবেন, এই বাড়িতে অবশ্যই ফিরবেন। রেণুকা দিনরাত ঠাকুরঘরে বসে থাকেন, আর তার প্রার্থনাশক্তির সবটুকু দিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের ফিরে আসার প্রার্থনা করেন।

*

নাওয়ের গলুইয়ে পলায়নপর হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখে হরিহরণ ভীষণ চমকে গেল। এতরাতে হোমঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? হেমাঙ্গিনী দেবী যে বারোহাটির বাগানবাড়ি থেকে পালিয়েছে, এ খবর তখন পুরো বিষ্ণুপুর ছড়িয়েছে। হেমাঙ্গিনী দেবী কী কারণে পালিয়েছে, তা কেউ স্পষ্ট না জানলেও সকলেই ধারণা করতে পেরেছে যে এর পেছনে রয়েছে সুগভীর কোনো বৃত্তান্ত। যদিও দেবেন্দ্রনারায়ণ এবং হেমাঙ্গিনী দেবীর সম্পর্কের ইতিহাস সবসময়ই রহস্যময় কিন্তু এবার যেন তা রহস্যময়তার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেল।

হরিহরণ বুঝতে পারছে, হেমাঙ্গিনী দেবীকে এই মুহূর্তে বিষ্ণুপুর নিয়ে যাওয়া মানে ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে উপাদেয় আহার তুলে দেয়া। তাই সে হেমাঙ্গিনী দেবীকে লুকিয়ে রাখার উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিল। উপযুক্ত জায়গার কথা ভাবতেই হরিহরণের মাথায় এসেছে বজরাডুবির চরের কথা। বজরাডুবির চরে সে ডাল-লতা-পাতা দিয়ে ছোট একখানা কুঁড়েঘরও তুলেছে। আপাতত হেমাঙ্গিনী দেবীকে সেখানে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে।

কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবীকে হরিহরণ কেন রক্ষা করবে? বরং হেমাঙ্গিনী দেবীকে সে যদি দেবেন্দ্রনারায়ণের হাতে তুলে দেয় তাহলেই তার মঙ্গল। কারণ এই মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে হেমাঙ্গিনী দেবীর চেয়ে আরাধ্য আর কিছুই নেই। বিধ্বস্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ এই সময়ে হেমাঙ্গিনী দেবীকে পেলে কী করবেন কে জানে! তবে হরিহরণকে যে পুরষ্কৃত করবেন, এটা নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে হরিহরণের জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেবেন্দ্রনারায়ণের হাতে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু হরিহরণ তা করল না।

নিয়তি এক অদ্ভুত সমীকরণের সামনে ফেলে দিল ক্রমশই জটিল হয়ে ওঠা সেই সুদীর্ঘ দিনের শেষ অংশকে। যে অংশে হরিহরণ এবং হেমাঙ্গিনী দেবী মুখোমুখি হয়েছিল অপ্রকাশিত এক গল্পের। যে গল্পের রহস্য হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ফিসফিসানি হয়েই এতদিন ডুবেছিল বিষ্ণুপুরের মানুষের কাছে। বিষ্ণুপুর জমিদারির অন্দরমহলের বাইরে যে গল্প কখনোই পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। তবে সেই গল্পের কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র এই হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণ বণিক। যারা দুজনই অবিচ্ছেদ্যভাবে গেঁথে রয়েছে এক বীভৎস অতীতের সুতীক্ষ্ণ ফলায়।

নাওয়ের গলুইয়ে বিধ্বস্ত হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখে হরিহরণ চমকে গেলেও মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, পালিয়েছিস কেন?

হেমাঙ্গিনী দেবী অন্ধকারে খানিক ডুব মেরে রইল। তারপর ধীরে মাথা তুলে বলল, কে পালায় না বলতো?

হরিহরণ বলল, মানে?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, মানে কিছু না।

হরিহরণ অন্ধকারেই হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা দিনে দিনে যত বড় হয়েছে, ততই দুর্বোধ্য হয়েছে। কিংবা হরিহরণের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে। হরিহরণ বহুকাল হেমাঙ্গিনী দেবীকে বুঝতে পারে না। অবশ্য বুঝতেও চায়নি। একটা সময় এই জগতের সকল কিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হওয়া শুরু করেছে।

কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলেনি। তারপর হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা সকলেই পালাচ্ছি হরি কাকা। তুমি? তুমিও কি পালাচ্ছ না?

হরিহরণ কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। আসলেই তো, সে-ও তো পালাচ্ছে। পালাচ্ছে না? পালাচ্ছেই তো। সে পালাচ্ছে তার নিজের কাছ থেকে। নিজের অতীত থেকে। স্মৃতি থেকে। এমনকি বর্তমান থেকেও।

হেমাঙ্গিনী দেবী এবার অন্ধকারে শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, আমরা সকলেই পালাচ্ছি হরি কাকা। এই জগত পালানোরই জগত। এখানে দিন-রাত লুকোচুরি খেলা চলে। এই খেলায় সকলকেই পালাতে হয়। আগে আর পরে। অন্যের কাছ থেকে হোক বা নিজের কাছ থেকে, মানুষকে তার জীবনভরই পালাতে হয়।

হেমাঙ্গিনী দেবী খানিক থামল। তারপর আবার বলল, কেউ অন্যের কাছ থেকে পালায়। কেউ নিজের কাছ থেকে পালায়। নিজের ছায়ার কাছ থেকেও পালায়। কেউ বর্তমান থেকে, কেউ অতীত থেকে। কিন্তু পালাতেই থাকে। এখানে পালানো ছাড়া আর কী উপায় হরি কাকা? আর কোনো উপায় নেই।

হরিহরণ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। সে বৈঠা ছেড়ে দিয়ে স্থির বসে। রইল। নাওখানা আটকে রইল নদীর পাড়ে জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসা মস্ত এক বৃক্ষের শেকড়ের সাথে। নাওয়ের দুই প্রান্তে দুইজন মানুষ। একজন হরিহরণ। বয়সের আগেই যে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। বছর পঞ্চাশের হরিহরণের মাথাভর্তি শুভ্র চুল। আর নাওয়ের অন্য প্রান্তে বসে আছে বয়সের ছাপ না পড়া হেমাঙ্গিনী। কত হবে হেমাঙ্গিনীর বয়স? হরিহরণ হিসেব করে দেখল, হেমাঙ্গিনী যখন জন্মায়, তখন তার বয়স আঠারো-কুড়ি। যদিও তাকে সেই বয়সেও দেখতে মনে হতো কিশোর। টিনটিনে শরীরে যেন বাচ্চাদের মুখ বসানেনা। তারপর কত সময় গেল। তার মানে হেমাঙ্গিনীর বয়স এখন কত? ত্রিশ, একত্রিশ না বত্রিশ? যাই হোক, হেমাঙ্গিনীকে দেখে অবশ্য তা বোঝার উপায় নেই। রোজ রোজ যেন হেমাঙ্গিনীর বয়স কমছে।

অন্ধকারে হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী দীর্ঘসময় চুপ করে বসে রইল নৌকার দুই প্রান্তে। হয়তো দু’জনের চোখের ভেতরই তখন ফেলে আসা অতীতের গল্প। যে গল্পে এই দুটি মানুষ রক্তের সম্পর্কে বাঁধা। সেই রক্ত আভিজাত্যের, বংশের, মর্যাদার। কিন্তু সেই আভিজাত্য, বংশ, সম্পর্ক, রক্ত সকলই ডুবে গেছে এক দুঃসহ বিভীষিকাময় অতীতে।

হরিহরণ আজ বংশ পরিচয়হীন উভ্রান্ত এক মানুষ। আর হেমাঙ্গিনী? কে সে? গণিকা? বাঈজী? কিংবা রক্ষিতা? যা-ই হোক, তার পরিচয়জুড়ে অমাবস্যার রাতের মতোন গাঢ় অন্ধকার কলঙ্ক। যদিও শেষ অবধি তার নাম হেমাঙ্গিনী বাঈ না হয়ে, হয়ে রইল হেমাঙ্গিনী দেবীই। কিন্তু সে তো বাঈ-ই, তবে তার নামের সাথে দেবী কেন? না কি সে দেবী হয়েও আসলে বাঈ? কিংবা বাঈ হয়েও দেবী? এ কেমন হিসেব? কার হিসেব? অদৃষ্টের? কিন্তু হরিহরণ জানে না, অদৃষ্টের হিসেব এত অদ্ভুত কেন?

হরিহরণ তখনও জানে না, হেমাঙ্গিনী দেবী কেন পালিয়েছে! সারাদিনের ঘটনায় নানান কথাবার্তা তার কানে এসেছে। কিন্তু সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তারপরও যতটুকু শুনেছে, তাতে সে বুঝেছে, দেবেন্দ্রনারায়ণ ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্রতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন হেমাঙ্গিনী দেবীর জন্য। সুতরাং হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে তার পালাতে হবে। হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে হরিহরণের যাওয়ার জায়গা কেবল বজরাডুবির চর।

বজরাডুবির চর নামটা মাথায় আসতেই হরিহরণের বুকের ভেতরটা ক্ষোভে, ক্রোধে, বিষাদে একাকার হয়ে উঠল। সেই অন্ধকারের হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হরিহরণ। কিন্তু তার চোখ না দেখছে। আবছা হেমাঙ্গিনী দেবীকে, না দেখছে গঙ্গাবতীর বুকজুড়ে জমে থাকা অন্ধকারকে।

হরিহরণের দৃষ্টিতে তখন ভেসে উঠছে ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগের এমনই এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার রাতের দৃশ্য। সেই রাতে হরিহরণ তার পরিবারের সাথে যাচ্ছিল প্রমোদ-ভ্রমণে। হরিহরণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা শশীচরণ বণিক বিশাল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী চন্দ্রাবতী প্রথমবারের মতোন গর্ভধারণ করেছে। এই সংবাদ শুনে শশীচরণ বণিক বজরাযোগে দীর্ঘ প্রমোদ ভ্রমণের ঘোষণা দিয়েছেন। চারখানা মস্ত বজরার বিশাল বহর। এই বহরে শশীচরণের পিতা-মাতা, কাছের আত্মীয়-স্বজন আর তাদের দাস-দাসীরাও রয়েছে। এক বজরায় রয়েছেন তারা। অন্য বজরায় রয়েছেন শশীচরণ, তার স্ত্রী চন্দ্রাবতী, ছোটভাই হরিহরণ আর তাদের দাস-দাসী। বহরের বাকি বজরা দুটোতে পাইক-পেয়াদা, পাঁচক পাঁচিকা, অতিরিক্ত দাস-দাসী, দূরের আত্মীয়-পরিজন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অচেনা পথে, বিদেশ বিভূঁইয়ে দু’হাত ভরে খরচ করার মতো অঢেল সোনা-দানা, নগদ অর্থও।

হরিহরণের মনে আছে, সে রাতে শশীচরণ বণিক খানিক বেশিই মাতাল হয়েছিলেন। মাঝিদের সর্দার এসে মাতাল শশীচরণের সামনে দাঁড়াল, তারপর মাথা নুইয়ে বলল, আজ্ঞে কর্তা, সামনে বজরাডুবির চর। ও জায়গাখানা ভালো না। আপনি যদি আজ্ঞা দিতেন তো ভোরের আলো ফুটলে না হয় আমরা ও জায়গা পেরোতাম।

মাতাল শশীচরণ বললেন, আঁ? বজরাডুবির চর? ওখানে কি বজরা ডোবে? তা বজরা কী করে ডোবে হে? এমনি এমনি ডোবে? না নৃত্য করতে করতে সলিল সমাধি ঘটে? হা হা হা। বজরা ডোবা তো কখনো দেখিনি। এ শশীচরণ বণিকের বজরা। এ ডোবা চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরও যদি ডোবে, তা সে একখানা দেখার মতো দৃশ্য হবে’খন। চল, চল। গিয়ে দেখি, বজরা কী করে ডোবে!

মাঝি সর্দার আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শশীচরণ বণিক তাকে হাত তুলে বেরিয়ে যেতে বলছেন। এ জায়গা তখন সকল বজরাই এড়িয়ে চলে। খুব জরুরি প্রয়োজনে কেউ গেলেও তারা বজরার আলো যতটা সম্ভব নিভিয়ে চুপিসারে যায়। কিন্তু শশীচরণ বললেন তিনি দেখবেন কী এমন আছে এখানে। সুতরাং সকল বজরার লণ্ঠন যেন জ্বেলে দেওয়া হয়।

ঝলমলে আলোর মিছিল নিয়ে শশীচরণ বণিকের বিশাল বজরা বহর এগিয়ে চলল। শশীচরণ বণিক তখন মদের বোতল হাতে বজরার উন্মুক্ত ছাদে দাঁড়িয়ে আপন মনে প্রলাপ বকছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে সাপের মতোন কিলবিল করতে করতে সরু লম্বা ক’খানা ছিপনৌকা চোখের পলকে বেরিয়ে এলো। মাতাল শশীচরণ বণিক কিছু না বুঝলেও মাঝিরা সমস্বরে চিৎকার জুড়ে দিলো, হুঁশিয়ার, সাবধান… ডাকাত পড়েছে, ডাকাত। হুশিয়ার, সাবধান…।

বজরার পাইক-পেয়াদারা অস্ত্র হাতে প্রস্তুতই ছিল। কিন্তু ওই সরু নৌকাগুলো থেকে পিলপিল করে নামল ধারালো অস্ত্রধারী ছায়ামূর্তিরা। তাদের সামনে মুহূর্তও টিকতে পারল না শশীচরণের পেয়াদারা। তারা ধরাশায়ী হলো

অতি সহজে। ততক্ষণে অন্য বজরাগুলোতেও আক্রমণ হয়েছে। ভয়াবহ চিৎকার আর চেঁচামেচিতে রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে গেল। কিন্তু শশীচরণের নেশা আর ভাঙল না। তিনি একখানা লাঠি টেনে নিয়ে লাফ দিয়ে বজরার পাটাতনে নামলেন। চিৎকার করে বলতে থাকলেন, কেউ আমার চন্দ্রাবতীর কাছে যাবি না। খবরদার কেউ না। আমার চন্দ্রাবতীর কাছে কেউ যাবি না। গেলে আমি তার…।

শশীচরণ বণিক তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পেছন থেকে কেউ একজন তার পিঠে আমূল বর্শা বিদ্ধ। করেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বজরার পাটাতন। কিশোর হরিহরণ দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিল বজরার আরো ভেতরে। সেখানে সুসজ্জিত এক কক্ষ। কক্ষে শশীচরণের গর্ভবতী স্ত্রী চন্দ্রাবতী আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। হরিহরণ তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। সে চন্দ্রবাতাঁকে কক্ষের খোলা জানালার কাছে টেনে নিয়ে গেল। চন্দ্রাবতী জানালার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর কম্পিত গলায় বলল, উনি কোথায়? উনি? তোমার দাদা? তোমার দাদা কোথায়?

হরিহরণ সেই কথারও কোনো জবাব দিলো না। সে বিশাল জানালার ভেতর চন্দ্রাবতীর মাথা চেপে ধরল। চন্দ্রাবতীর শরীর তখন আতঙ্কে অবশ। সে জানালার বাইরে মাথা গলিয়েও আতঙ্কিত গলায় বলতে লাগল তোমার দাদা কোথায়? তোমার দাদা?

হরিহরণ তাকে আর একটা শব্দও বলার সুযোগ দিলো না। আতঙ্কিত, হতবিহ্বল চন্দ্রাবতীর শরীরটাকে সে সজোরে ঠেলে দিল বাইরে। চন্দ্রাবতী চিৎকার করে উঠল। ঝুপ করে কেবল শব্দ হলো বাইরে। চন্দ্রাবতীর শরীর জলে পড়ার শব্দ। তার খানিক বাদে সেই জানালা গলে হরিহরণও লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু সেই রাতের অন্ধকারে গঙ্গাবতীর থই থই জলের ভেতর চন্দ্রাবতাঁকে আর খুঁজে পেল না হরিহরণ। হরিহরণ জানে না, সে কী ভেবেছিল? সে কি চন্দ্রাবতাঁকে নিয়ে সাঁতরে গিয়ে তীরে কোথাও লুকাতে চেয়েছিল? কিন্তু হরিহরণ তো জানতই না যে, চন্দ্রাবতী সাঁতার জানে কিনা!

সেই রাতে ওই জলের ভেতর হরিহরণ কতক্ষণ সাঁতার কেটেছিল তা তার মনে নেই। তবে সে চোখের সামনে বজরাগুলোকে ডুবিয়ে দিতে দেখেছিল। সারা শরীর অবশ হয়ে আসছিল হরিহরণের। একটুকরো কাঠ আঁকড়ে ধরার কথা অবধি তার মনে আছে। তারপর আর কিছুই মনে নেই। হরিহরণের জ্ঞান ফিরেছিল পরদিন ভোরে। সে পড়েছিল বারোহটির জঙ্গলের গা ঘেঁষে গঙ্গাবতীর তীরে। সেই তীরে হরিহরণ বসে রইল দিনের পর দিন। প্রথম দু’দিন সে কিছুই খায়নি। তারপর খিদে পেলে জঙ্গল থেকে এটা-সেটা খেত। তারপর আবার ঠায় বসে থাকত গঙ্গাবতীর দিকে তাকিয়ে। এই করে দিনের পর দিন কেটে গেল। মাঝেমধ্যে একটু একটু করে বারোহাটির জঙ্গলের ভেতর ঢুকতেও থাকল। তখনও এখানে-সেখানে বাঘের আনাগোনা দেখা যায়। তবে হরিহরণের ভাগ্যে হয়তো বাঘের আহার হওয়া ছিল না। সে দিব্যি বারোহাটির জঙ্গলটাকে চিনে নিতে লাগল নিজের হাতের তালুর মতোন। আর ধীরে ধীরে সেই বিভীষিকাময় রাতের দুঃসহ স্মৃতির গভীর বেদনারা খানিকটা করে ফিকে হতে লাগল।

ক’মাস গিয়েছে হরিহরণ জানে না। এক মেঘলা বিকেলে হরিহরণের বুকের ভেতর আবার কান্নার ঝড় উঠল। জঙ্গলের গা ঘেঁষে গঙ্গাবতীর তীরজুড়ে চাতালের মতোন জায়গাটিতে সে বসে রইল সারাদিন। কাঁদল, ভাবল, ঘুমাল। আবার কাঁদল। আবার জাগল। এই সময়ে সে দেখল বিশাল এক বজরা যাচ্ছে বারোহাটি জঙ্গলের একদম গা ঘেঁষে। সেই বজরার ছাদে শামিয়ানার নিচে জমিদার মতোন কেউ একজন বসে আছেন। হরিহরণ চিৎকার করে কাউকে ডাকল না। উঠে দাঁড়ালোও না। ইশারাও করল না কোনো। সে যেমন বসে ছিল তেমনই বসে রইল। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বজরাটি তীরে ভিড়ল। বজরা থেকে একজন পেয়াদা নেমে এসে হরিহরণকে নিয়ে গেল বজরায়।

বজরায় বসা ছিলেন বিষ্ণুপুরের তৎকালীন জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ। বর্তমান জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের পিতা তিনি। শরীরজুড়ে বয়সের ছাপ থাকলেও যোগেন্দ্রনারায়ণ তখনও শক্তসমর্থ মানুষ। তিনি হরিহরণকে নানান কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু হরিহরণ তার একটি কথারও উত্তর দিলো না। সে পুরোটা সময় তাকিয়ে রইল জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণের পেছনে বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী দুই পেয়াদার দিকে। তার স্পষ্ট মনে আছে, সেই ভয়ংকর রাতে এই দুই অস্ত্রধারীও ছিল তাদের বজরায়। এমনকি তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা শশীচরণ বণিককে পেছন থেকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করেছে এদের একজনই। সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় হরিহরণের হঠাৎ মনে হলো, এ সকল কিছুর মূলেই কি তবে এই বৃদ্ধ জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ? তিনিই কি তবে দিনের পর দিন তার লোকবল দিয়ে বজরাডুবিতে বজরা ডোবান, আর ধন-সম্পদ, সোনা-দানা লুট করেন?

হরিহরণের ভাবনা যে সত্যি ছিল, তা প্রমাণ হলো আরো পরে। হরিহরণ প্রবল অক্ষম আক্রোশে নিজের ভেতর গুটিয়ে গেল। সে কারো সাথে কথা বলল না। নানান চেষ্টা সত্ত্বেও না। সে ঝিম মেরে বসে রইল একা, নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ। যেন এই জগত সংসারের কোনো কিছুর প্রতিই তার আর কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই, কৌতূহল নেই।

হরিহরণের এই ঝিম দশা কাটল গঙ্গামহলে পৌঁছে। গঙ্গামহলের ভৃত্যদের সাথে তাকে রাখা হলো কিছুদিন। এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে হরিহরণ আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। গঙ্গামহলের মন্দির থেকে ধবধবে সাদা থান পরিহিতা এক রমণী বের হয়ে আসছেন। সেই রমণীর মুখ দেখে হরিহরণ পাথরের মূর্তির ন্যায় জমে গেল। চন্দ্রাবতী! তার বৌদি চন্দ্রাবতী এখানে?

সে দৌড়ে চন্দ্রাবতীর কাছে গেল। চন্দ্রাবতী অবশ্য তেমন চমকালো না। সে কেমন নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল হরিহরণের দিকে। হরিহরণ তাকে বার কয় ডাকল। চন্দ্রাবতী অনেকক্ষণ জবাব দিলো না। তারপর সে হরিহরণের সাথে কথা বলল। তবে এই চন্দ্রাবতী যেন কেমন থম মেরে যাওয়া অন্য এক মানুষ। হরিহরণ চন্দ্রাবতাঁকে টেনে আড়ালে নিয়ে গেল। চন্দ্রাবতী ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল সেই বিভীষিকময় রাতের ঘটনা।

জলে ভেসে যেতে থাকা একখানা কাঠের বাক্সের চামড়ার হাতলের ভেতর সে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর কী করে যেন ভেসে এসেছিল চরে। পরদিন ভোরে তাকে দেখতে পায় আক্রমণকারীরা। প্রায় বিবসনা চন্দ্রাবতীর খানিক স্কিত উদর। দিনের আলোর অন্য এক আবহে চন্দ্রাবতাঁকে দেখে তারা খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল। কী করবে তারা চন্দ্রাবতাঁকে নিয়ে? চন্দ্রাবতী তখন হাঁটু ভাঁজ করে দুহাতে তার ঈষৎ স্ফিত উদর আড়াল করে বসে আছে। দু’জন অস্ত্রধারী তার কাছে যেতেই চন্দ্রাবতী হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। তারপর জড়ানো গলায় বলতে থাকল, আমায় মেরো না। আমার সব নিয়ে নাও। কিন্তু আমায় মেরো না। আমার গর্ভে আমার সন্তান। আমায় মেরো না।

কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা তাকে নিয়ে আসল গঙ্গামহলে। জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ গম্ভীর মুখে সব শুনলেন। তারপর কী মনে করে বললেন, একে গঙ্গামহলেই থাকতে দাও।

খুবই অদ্ভুত ঘটনা। কিন্তু তারপর থেকে গত তিনটি মাস এখানেই রয়েছে চন্দ্রাবতী। তার উদর আরো স্ফিত হয়েছে। হরিহরণ পুরো ঘটনা শুনে স্থানুর মতোন দাঁড়িয়ে থেকেছিল সেদিন। যেন নড়তেও ভুলে গিয়েছিল। চন্দ্রাবতী চলে গেলেও হরিহরণ দাঁড়িয়েই থাকল। কী করবে সে? হরিহরণ জানে, কিছুই করার নেই তার। এর কিছুদিন বাদে হরিহরণকে গঙ্গামহল থেকে বাইরে বেণুচন্দের বাজারে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু হরিহরণ নানা উপায়ে চন্দ্রাবতীর খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করেছে। মাস কয় পরে হরিহরণ একদিন জানল, চন্দ্রাবতী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। সেই কন্যা সন্তানের নাম রাখা হয়েছে হেমাঙ্গিনী। হেমাঙ্গিনী দেবী! হরিহরণের অকাল প্রয়াত জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শশীচরণের একমাত্র মেয়ে হেমাঙ্গিনী দেবী।

এ অদৃষ্টের খেলা নয়তো কী?

.

হরিহরণ এরপরও নানা কাজে মাঝেমধ্যেই গঙ্গামহলে আসত। তাকে সকলেই চেনে। দাস-দাসী, পাইক-পেয়াদা সকলেই। ফলে এই বাড়িতে হরিহরণের সহজ যাতায়াতই ছিল। সে সুযোগ পেলেই চন্দ্রাবতীর সাথে দেখা করত। হেমাঙ্গিনীর সাথে কথা বলত। এই নিয়ে অবশ্য কারো কোনো আগ্রহই ছিল না। চন্দ্রাবতী তখন গঙ্গামহলের অভ্যন্তরের আরো অনেক আশ্রিত আত্মীয় অনাত্মীয় মানুষের মতোই। দাসী-বাদীর মতো না হলেও খুব যে সম্মানের কোনো জীবন তার ছিল, তাও নয়। তার খবরও কেউ রাখে না। সুতরাং হরিহরণ তার সাথে কী কথা বলে তা নিয়েও কেউ ভাবে না। দিন যেতে লাগল। সেই সাথে চন্দ্রাবতীও যেন কেমন হয়ে যেত থাকল। সে খায় না, ঘুমায় না। সারাদিন বিড়বিড় করে কী সব বলে। হেমাঙ্গিনী দেবী রোজ একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। শুধু বেড়েই উঠছে না, সে পুষ্পসম সুরভিত হচ্ছে। তার সৌরভে আশেপাশের নানান ভ্রমর গুনগুন করতে শুরু করল। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী ততদিনে বুঝে গেছে এ জগতে তার আপন বলতে ওই ক্রমশই পাগল হয়ে যেতে থাকা এক মা। আর মাঝেমধ্যেই লুকিয়ে চুরিয়ে তার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসা হরি কাকা।

হেমাঙ্গিনীর যখন আট বছর বয়স, তখন মারা যান জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ। তার মৃত্যুর কয়েক দিনে বিশাল আয়োজন হয় গঙ্গামহলে। অজস্র লোকে লোকারণ্য সেই বাড়িতে হরিহরণ আট বছরের হেমাঙ্গিনীকে নিয়ে নিভৃতে বসল। তাদের পাশে তখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ধউন্মাদ চন্দ্রাবতী। হরিহরণ হেমাঙ্গিনী দেবীর নিকট তার আসল পরিচয় উন্মোচিত করল। সেই বিভীষিকাময় রাতের পুরো ঘটনা সবিস্তারে খুলে বলল। এক নতুন পরিচয়ের উন্মোচনে আট বছরের হেমাঙ্গিনী দেবী যেন মুহূর্তেই বড় হয়ে গেল। বয়সে, চিন্তায় এবং খানিকটা প্রতিশোধ-স্পৃহায়ও।

.

হরিহরণ নাওয়ের ডগায় বসে যেন চোখের সামনে এই পুরো ঘটনা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে সেই সময় থেকেই তার হঠাৎ হঠাৎ-ই কেমন লাগত। জগতের সকল কিছুর প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা। রাতে ঘুমাতে পারত না। কেবল দুঃস্বপ্ন দেখত বজরা ডুবির চরের সেই ঘটনা। সেই রাত, বারোহটির জঙ্গল, আরো কত কিছু। তারপর নিজের অজান্তেই যেন হরিহরণ আবার বারোহাটির জঙ্গল আর বজরাডুবির চরে যেতে লাগল। একখানা ছোট্ট নাও। সেই নাও বেয়ে সে আপন মনে চলে যেত বারোহাটি জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরে।

সময় গিয়েছে। দিনে-দিনে বজরাডুবির চর নিয়ে চারদিকে সত্যি-মিথ্যে, বাস্তব অবাস্তব, অতিপ্রাকৃত নানান ঘটনা রটে গিয়েছিল। ফলে সকল ধরনের বজরা, নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল ওই পথে। নির্জন-পরিত্যক্ত এক ভূতুড়ে, লোমহর্ষক জায়গায় পরিণত হলো বজরাডুবির চর। কিন্তু হরিহরণের যে কী হলো, তার কেবল মনে হতো ওখানটাতে গেলেই সে যেন কিছু স্বস্তি পায়। তার ডিঙি নাওখানা নিয়ে সে ওখানে গিয়ে দিনের পর দিন ঠায় বসে থাকে। একখানা কুঁড়েঘরও তুলে ফেলল। তার কেবল মনে হতে থাকে, এই বুঝি শশীদা জলের ভেতর থেকে উঠে কাপড়ের জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলবেন, হ্যাঁরে হরি, এত বেলা হলো, এখনো কিছু খাসনি? এখানে বসে আছিস? চল চল, তোর বৌদি খাবার নিয়ে বসে রয়েছে। আবার বকবে।

কিংবা বাবা-মা, জ্যাঠা-জ্যাঠাইমা কেউ না কেউ একজন ওই জলের ভেতর থেকে ঠিকই উঠে আসবে। ঠিকই।

হরিহরণের কী যে কান্না পেত! বারকয়েক সে ভেবেছিল, আবার কী নিজ দেশে ফিরে যাবে! কিন্তু কে আছে সেখানে তার! আর কেউই তো নেই! হরিহরণ আর কারো সাথে কথা বলত না। কিন্তু ওই বজরাডুবির চরে সে একা। একা বসে থাকত, কাঁদত, কথা বলত। নিজের সাথে, বাবার সাথে, মায়ের সাথে, শশীদার সাথে। ফেরার সময়ে সে বারোহাটির জঙ্গলের ভেতর থেকে এটা-সেটা নিয়ে ফিরত। সেগুলো হাট-বাজারে বিক্রি করত। ততদিনে ধীরে ধীরে গঙ্গামহলেও যাওয়া কমে গেল তার। বারোহাটির জঙ্গলের দিকেই একখানা ঘর তুলে থাকতে লাগল হরিহরণ। এদিকে তেমন কেউ আসে না। বড্ড চুপচাপ আর নিরিবিলি জায়গা। হরিহরণ দিনরাত নিজের ভেতর ডুবে থাকত। আর ইচ্ছে হলেই চলে যেত বজরাডুবির চরে।

এই সময় ঘটল ভয়াবহ এক ঘটনা। বারোহাটির জঙ্গল থেকে একটি বাঘ চলে এলো লোকালয়ে। প্রায় রাতেই সেই বাঘ হানা দেয় এখানে-সেখানে। দু দু’জন মানুষ আস্ত গিলে খেল! জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর ততদিনে জমিদার হয়েছেন তার একমাত্র সন্তান বিষ্ণুনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণের স্ত্রী গত হওয়ার পর বিষ্ণুনারায়ণ আর দার পরিগ্রহ করেননি। তার তিন সন্তানই তার চোখের মণি। কিন্তু মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ কারো কথা শোনেন না। তিনি দাপুটে, খামখয়ালি, দুঃসাহসী জমিদারপুত্র।

তেইশ-চব্বিশ বছরের দেবেন্দ্রনারায়ণ একদিন ঘোষণা দিলেন, তিনি ওই বাঘ শিকারে বারোহাটির জঙ্গলে যাবেন এবং একা। তাকে নানাভাবে নিরস্ত করার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু তিনি কারো কোনো কথা শুনলেন না। এক ভোরে তিনি গঙ্গামহল থেকে উধাও হয়ে গেলেন। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পাইক-পেয়াদা পাঠালেন দেবেন্দ্রনারায়ণের খোঁজে। কিন্তু দুই দিনেও তার কোনো খোঁজ মিলল না। বিচলিত বিষ্ণুনারায়ণ আরো বড় দল নিয়ে নিজেই হানা দিলেন বারোহাটির জঙ্গলে। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণের কোনো খোঁজ মিলল না। শোকবিহ্বল বিষ্ণুনারায়ণ বিফল মনোরথে গঙ্গামহলে। ফিরলেন।

সপ্তাহখানেক বাদে হরিহরণ বণিক মৃতপ্রায় দেবেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে বারোহাটির জঙ্গলের কাছে তার ছোট্ট ঘরে ফিরল। খবর পাঠানো হলো জমিদার বিষ্ণুনারায়ণকে। পুত্রের আশা প্রায় ছেড়ে দেয়া বিষ্ণুনারায়ণ উন্মাদের মতো। ছুটে এলেন। শুরু হলো দেবেন্দ্রনারায়ণের চিকিৎসা, সেবা শুশ্রূষা। দেবেন্দ্রনারায়ণের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লেগেছিল। হরিহরণ দেবেন্দ্রনারায়ণকে আহত অবস্থায় পেয়েছিল বারোহাটির জঙ্গলের গভীরে। আহত দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রকাণ্ড এক বৃক্ষের ডালে আটকে ছিলেন। তিনি যে। সত্যি-সত্যিই বাঘের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটি তার শরীরের অসংখ্য ক্ষত দেখেই বুঝতে পেরেছিল হরিহরণ। তবে দুই বাঘের যুদ্ধে যে হারজিত হয়নি কারো, যুদ্ধ যে অমিমাংসিত ছিল, সেটিও বুঝে গিয়েছিল হরিহরণ। সেই থেকে হরিহরণের সাথে দেবেন্দ্রনারায়ণের একটি অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যেই সম্পর্ক সবসময়ই ছিল খানিকটা আড়ালের-আবডালের।

হরিহরণ অবশ্য জানে না, সে কেন দেবেন্দ্রনারায়ণকে উদ্ধার করেছিল। তার ভেতরে বিষ্ণুপুরের জমিদার বংশের প্রতি যে তীব্র বিদ্বেষ, যে সুতীব্র ঘৃণা রয়েছে তারপরও সে কেন দেবেন্দ্রনারায়ণের ত্রাতা হয়েছিল তা হরিহরণ আজ। অবধিও ভেবে পায়নি। হতে পারে দেবেন্দ্রনারায়ণের এমন অমিত দুঃসাহস হরিহরণের ভেতরে তার প্রতি এক ধরনের অবচেতন সমীহ তৈরি করেছিল।

দেবেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য এই ঘটনার পর খানিকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। তার সার্বক্ষণিক সেবা শুশ্রূষার জন্য তখন অনেক দাস-দাসী নিয়োজিত। তবে হেমাঙ্গিনী দেবীকেও মাঝে-মধ্যে যেতে হতো দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলে। এই যাওয়া-আসা চলতেই থাকল। সময় হেমাঙ্গিনী দেবীকে যেমন ক্রমশই বালিকা থেকে কিশোরী করে তুলল, তেমনি করে তুলল পুরুষের প্রেম ও কামের উপলক্ষও। দেবেন্দ্রনারায়ণ আর হেমাঙ্গিনী দেবীও সময়ের এই ক্রমবর্ধমান আবর্তে পরস্পরের প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণে আকর্ষিত হতে লাগল। প্রথম প্রথম বিষয়টি আড়ালে থাকলেও ধীরে ধীরে তা প্রকাশিত হতে লাগল জমিদার পরিবারের অন্দরে। জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ তার মেজোপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণকে বিবাহের কথা বললেও দেবেন্দ্রনারায়ণ তাতে সহসাই সাড়া দিলেন না। এরইমধ্যে দেবেন্দ্রনারায়ণ একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বারোহাটির জঙ্গলের সঙ্গেই গড়ে তুলবেন এক বিশাল বাগানবাড়ি।

বাগানবাড়ি তৈরী হলো অবশ্য আরো পরে। সেই বাগানবাড়ির জন্য দাস দাসী ভৃত্যের ব্যবস্থা করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে স্থায়ী নিবাস হলো অসুস্থ চন্দ্রাবতী এবং তার কন্যা হেমাঙ্গিনী দেবীরও।

.

জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ বারোহাটির এই বাগানবাড়ির বিষয়ে নিজ থেকে কোনো আগ্রহ না দেখালেও তিনি নানান মানুষের মাধ্যমে, বিশেষ করে নায়েব গোপীনাথ সরকারের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রেখেছেন। দ্রুত সময় কেটে যেতে লাগল। গঙ্গামহলের চেয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের বেশিরভাগ সময়ই তখন কাটতে লাগল বারোহাটির বাগানবাড়িতে। তুমুল আনন্দ বিনোদনের উৎস এই। বাগানবাড়ি। দেবেন্দ্রনারায়ণ বিলাসী মানুষ। তার ওপর অনিন্দ্য সুন্দরী। হেমাঙ্গিনী দেবী তখন পূর্ণ যুবতী। সেই হেমাঙ্গিনী দেবী যেমন অসীম কামের আঁধার, তেমনি প্রেমেরও। দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে কী ভেবেছিলেন তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। তবে বারোহাটি বাগানবাড়িতে হেমাঙ্গিনী দেবী আশ্রিতের মতোন নয়, থাকতে লাগল অনেকাংশে কত্রীর মতোই। সময় যেতে লাগল দ্রুতগতিতে। হেমাঙ্গিনী কিশোরী থেকে যুবতী হলো। দেবেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে নানান কানাঘুষা চলতে লাগল।

এই কানাঘুষা জমিদার বিষ্ণুনারায়ণের কানে পৌঁছালেও তিনি প্রথম প্রথম তাতে খুব একটা কর্ণপাত করেননি। এই বয়সে সকল জমিদার পুত্রদেরই নারী সম্ভোগের একটু-আধটু অভ্যাস থাকে। দেবেন্দ্রনারায়ণের অবশ্য খানিক বেশিই রয়েছে। তবে এ নিয়ে বিচলিত হবার কিছু নেই। দেবেন্দ্রনারায়ণের নৃত্য-গীত প্রীতির কথাও তিনি জানেন। তিনি শুনেছেন হেমাঙ্গিনী নামের মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, ভালো নৃত্য-গীত জানে। সুতরাং দেবেন্দ্রনারায়ণ যে তাকে খানিক আলাদা করেই দেখবে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। বিষ্ণুনারায়ণ অবাক হলেন না। তিনি নিশ্চিন্ত রইলেন। তবে তিনি অবাক হলেন এরও বহুদিন পরে।

এক রথযাত্রায় দেবেন্দ্রনারায়ণ সামনের দূর্গাপুজায় গঙ্গামহলে বিশাল পুজা আয়োজনের ঘোষণা দিলেন। সেখানে নৃত্য-গীতের আয়োজন হবে। সেই নৃত্য গীতে দূর-দূরান্ত থেকে শিল্পী-নর্তকীরা আসবে। উৎসবে আর সকল শিল্পী নর্তকীর সঙ্গে হেমাঙ্গিনী দেবীও নাচল-গাইল। বিষ্ণুনারায়ণ যেন সেই প্রথম নিজের চোখে হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখলেন। তিনি প্রবল বিস্ময় নিয়ে সতের আঠারো বছরের সেই হেমাঙ্গিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়ে এতদিন এই গঙ্গামহলের অন্দরে আর বারোহাটির বাগানবাড়িতে বেড়ে উঠেছে, এ যেন তার বিশ্বাস হতে চাইছিল না। বিস্মিত বিষ্ণুনারায়ণ হতভম্ব চোখে দেখলেন উপস্থিত সকল দর্শকের চোখ যেন চুম্বকের মতোন সেঁটে আছে হেমাঙ্গিনী দেবীর দেহে। স্বল্পবসনা না হলেও নৃত্যের পোশাকে হেমাঙ্গিনী দেবী যেন সমবেত পুরুষ দর্শকদের কামাতুর চোখে সাক্ষাৎ রম্ভা বা ঊর্বশী।

সদা স্থির, শান্ত বিষ্ণুনারায়ণ অনুষ্ঠানস্থল থেকে উঠে গেলেন। তার পরদিন বিষ্ণুনারায়ণ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এই অনুষ্ঠান আরো দিনকয়েক চলার কথা থাকলেও তার অসুস্থতার কারণে সমাপ্ত হলো।

দীর্ঘদিন ধরেই হাঁপানিসহ নানান ধরনের জটিল অসুখে ভুগছিলেন বিষ্ণুনারায়ণ। প্রাণতোষ বৈদ্য সেবার বিষ্ণুনারায়ণকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল বিষ্ণুনারায়ণের দীর্ঘমেয়াদে উৎকৃষ্ট চিকিৎসা দরকার। বিষ্ণুনারায়ণের ইচ্ছে দক্ষিণ বলেশ্বর থেকে বিখ্যাত চিকিৎসক ধনঞ্জয় গুপ্তকে যেন নিয়ে আসা হয় তার চিকিৎসার জন্য। ধনঞ্জয় গুপ্তকে আনার জন্য দেবেন্দ্রনারায়ণকে দক্ষিণ বলেশ্বর পাঠালেন বিষ্ণুনারায়ণ। বজরাযোগে দক্ষিণ বলেশ্বর দীর্ঘ নদীপথ। দেবেন্দ্রনারায়ণ সেই পথে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ফিরলেন দিন কুড়ি বাদে। কিন্তু গঙ্গামহলে ফিরে দেবেন্দ্রনারায়ণ বজ্রাহত হয়ে গেলেন। এই কুড়ি দিনেই বিষ্ণুপুরে যেন ঘটে গেছে কয়েক যুগের ঘটনা। বিষ্ণুনারায়ণ এর মধ্যেই আরো অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাইপুর শহরে। তিনি এখনও ফেরেননি। বিষ্ণুনারায়ণের সঙ্গে গঙ্গামহলের কয়েকজন দাস-দাসী গিয়েছে। সঙ্গে তিনি নিয়ে গেছেন হেমাঙ্গিনী দেবীকেও। হেমাঙ্গিনী দেবী বিষ্ণুনারায়ণের সঙ্গে রাইপুরে যাওয়ার দিন-সাতেকের মাথায় তার মাতা চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হয়েছে। এই খবর হেমাঙ্গিনী দেবীকে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। কারণ রাইপুর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে হাওয়া বদলের জন্য বিষ্ণুনারায়ণ আবার গিয়েছেন পূবের সমুদ্রশহর বিনয়পুরে। সেখানকার বিস্তারিত খবর বিষ্ণুপুরের কারো কাছেই নেই।

দেবেন্দ্রনারায়ণ হতচকিত হয়ে রইলেন। তবে তার হতচকিত হবার আরো বাকি ছিল। মাস দুই পরে সুস্থ শরীরের বিষ্ণুনারায়ণ ফিরলেও তার সাথে হেমাঙ্গিনী দেবী আর ফিরে এলো না। বিষ্ণুনারায়ণ স্পষ্ট ঘোষণা করলেন, হেমাঙ্গিনী দেবীর মতোন নর্তকীর আর গঙ্গামহলে বা বিষ্ণুপুরে জায়গা হবে না। তিনি শীঘ্রই দেবেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে দিবেন। হেমাঙ্গিনী দেবী নষ্টা চরিত্রের কুলটা নারী। সে রাইপুরে নানান পুরুষের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। সদাশয় বিষ্ণুনারায়ণ সেখানে তাকে একখানা বাড়ি ক্রয় করে দিয়েছেন। সে সেখানে। তার নাচ-গান আর রূপের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এখন থেকে ওভাবেই সে তার নিজের পথ নিজে দেখবে। তিনি চান না হেমাঙ্গিনী দেবী আর বিষ্ণুপুরে ফিরে আসুক।

দেবেন্দ্রনারায়ণ যেন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় পড়ে গেলেন। তার ভেতরের প্রবল বিদ্রোহী সত্তা জেগে উঠলেও তিনি তাৎক্ষণিক তার করণীয় বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হেমাঙ্গিনী দেবী তাকে অনেকবার বিবাহের কথা বলেছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তাতে সাড়া দেননি। তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিয়ের ব্যাপারে কখনোই মনোস্থির করে উঠতে পারেননি। কোথায় যেন তার প্রবল এক অনীহা ছিল। তবে স্পষ্টতই হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রতি তার একধরনের প্রবল আসক্তিও ছিল।

ক্রোধন্মোত্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীকে আনতে রাইপুর গেলেও হেমাঙ্গিনী তার সাথে দেখা দিলো না। হতবিহ্বল দেবেন্দ্রনারায়ণ এর কারণও খুঁজে পেলেন না। তবে কি হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিবাহ করতে চাননি বলেই হেমাঙ্গিনী দেবী তার উপর অভিমানবশত প্রতিশোধ নিচ্ছে! হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িজুড়ে তখন রাইপুরের বিখ্যাত সব মানুষদের আনাগোনা। এতদিনকার পোষা হেমাঙ্গিনী দেবীর এমন অবাধ্যতা এবং আর সকলের হয়ে ওঠা দেবেন্দ্রনারায়ণ মেনে নিতে পারলেন না। তিনি বলপূর্বক হেমাঙ্গিনী দেবীকে আবার বারোহাটির বাগানবাড়িতে নিয়ে আসলেন। এতে দেবেন্দ্রনারায়ণের দু’টি প্রতিশোধ নেয়া হলো। এক, তার পিতার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করা হলো। দুই, তার প্রবল পৌরুষের যে ক্ষমতা,–ও হেমাঙ্গিনী দেবীকে দেখানো হলো। আহত বাঘের মতোন উন্মত্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ যেন হেমাঙ্গিনী দেবীর অহমকে প্রবল আঘাতে ভেঙে ফেলতে চাইলেন।

এক মাস হেমাঙ্গিনী দেবীকে বারোহাটির বাগানবাড়িতে আটকে রাখলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু এই একমাসেও হেমাঙ্গিনী দেবী তাকে কিছুই বলেনি। হেমাঙ্গিনীর প্রতি যে সদাশয় দেবেন্দ্রনারায়ণকে এতদিন দেখা গিয়েছিল, এই দেবেন্দ্রনারায়ণ যেন তার ঠিক উল্টোটি। বন্য, ক্রুদ্ধ, উন্মত্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীর সাথে আর দশজন রক্ষিতা নর্তকীর মতোই আচরণ করলেন। প্রথমদিকে গুটিয়ে থাকলেও শেষের দিকে এসে হেমাঙ্গিনী দেবী সহজ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝতে পেরেছিলেন এই হেমাঙ্গিনী দেবী আর সেই হেমাঙ্গিনী দেবী যেন এক মানুষ নয়। কোথাও যেন কোনো বড় ধরনের ওলটপালট ঘটে গেছে।

মাসখানেক পরে হেমাঙ্গিনী দেবীকে রাইপুরে পাঠিয়ে দিলেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। এর পরপরই বিয়েও করে ফেললেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। আর রাইপুরেই স্থায়ী নিবাস হলো হেমাঙ্গিনী দেবীর। দিনে দিনে সে হয়ে উঠল রাইপুরের বিখ্যাত বাঈজী হেমাঙ্গিনী দেবী।

.

হরিহরণ অন্ধকারে তাকিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার সামনে অন্ধকারে নৌকার গলুইয়ে বসা তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা শশীচরণ বণিকের কন্যা হেমাঙ্গিনী দেবী। বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শশীচরণ বণিকের কন্যা হেমাঙ্গিনী দেবী আজ রাইপুরের বিখ্যাত বাঈজী!

হরিহরণের সঙ্গে এরপর থেকে হেমাঙ্গিনী দেবীর যোগাযোগ একদমই কমে গিয়েছিল। কিন্তু হরিহরণ জানত দেবেন্দ্রনারায়ণ এরপরও ইচ্ছে হলেই হেমাঙ্গিনী দেবীকে বারোহাটির বাগানবাড়িতে ডেকেছেন। হেমাঙ্গিনীও এসেছে। অতীতের সকল ঘটনাই তারা যেন ভুলে গিয়েছে। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে আর দশজন বাঈজীর মতোই ইচ্ছেমতো ডেকে আনলেও কোথায় যেন খানিকটা সমীহই করতেন। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী যেন পেশাদার বাঈজীর মতোই দেবেন্দ্রনারায়ণের মনোরঞ্জনের সকল রকম চেষ্টা করত। সেখানে অতীতের কোনো স্মৃতি, কোনো চিহ্নই যেন আর রইল না।

হরিহরণ এ সকল কথা মনে করতে চায় না। তার মন বলে, এই জীবন, এই বাস্তবতা এ সকলই একটি ঘোর মাত্র। এই ঘোর কোনো একদিন কেটে যাবে। সে কোনো একদিন আবার সেই ঝলমলে আনন্দময় জীবন ফিরে পাবে। বাবা-মা, শশীচরণ, চন্দ্রাবতী, পরিবার-পরিজন সব। সেই আগের জীবন। কিন্তু হরিহরণের মস্তিস্ক জানে এ সকলই বাস্তব। সে আসলে এই বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইছে। পালাতে চাইছে নিজের কাছ থেকে, বর্তমানের কাছ থেকে। আসলেই তো, হেমাঙ্গিনী দেবী তো ঠিকই বলেছে, এ জগতে সকলেই পালায়। এখানে জীবনভর চলে পালিয়ে যাবার খেলা, লুকোচুরি খেলা।

জঙ্গলের ভেতর থেকে নাম না জানা কোনো নিশাচর পাখির ডানা ঝাঁপটানির শব্দে হরিহরণ যেন ফিরে এলো বাস্তবে। তবুও অন্ধকারে গঙ্গাবতীর বুকে তারা দীর্ঘসময় চুপ করে বসে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। এ যেন থেকেও না থাকার এক জগত। এখানে যেন কেউ জানে না, কে কোথায়। শরীর কোথায়, মন কোথায়, অতীত কিংবা বর্তমান কোথায়! এ এক অদ্ভুত জগত। নিরবতা ভাঙল হেমাঙ্গিনী দেবী, সে বলল, হরি কাকা, অত রাতে জঙ্গলের ভেতর দলবল বেঁধে তোমরা সব কই যাচ্ছিলে?

হরিহরণ সময় নিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবীকে দিনের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। বিরামপুরের কাছে গঙ্গাবতী নদীতে মাঝি নিতাইয়ের গুটিবসন্ত-আক্রান্ত বালককে খুঁজে পাওয়া থেকে শুরু করে জমিদার বাড়ি থেকে ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে জীবন্ত অগ্নিদাহের সিদ্ধান্তের কথা, সবই খুলে বলল সে। হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ জলে ভাসা নাওয়ে প্রবল কম্পন তুলে ছুটে এলো হরিহরণের কাছে। তারপর দিশেহারা গলায় বলল, হরি কাকা, হরি কাকা, ও আমার ছেলে, ও আমার। ছেলে গো হরি কাকা। ওকে তুমি কই রেখে এলে!

হতচকিত হরিহরণ অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। হেমাঙ্গিনী দেবীর একটি ছেলে রয়েছে, এ কথা সকলেই জানে। সেই যে তেরো-চৌদ্দ বছর আগে বিষ্ণুনারায়ণ তাকে রাইপুরে রেখে এলেন, তখন থেকেই হেমাঙ্গিনীর রাইপুরের বাড়িতে নানান লোকজনের যাতায়াত। সে সময় দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনী দেবীকে একবার জোর করে বারোহাটিতে এনে মাসখানেক রাখলেও এরপর দীর্ঘদিন সে আর বারোহাটিতে আসেনি। তবে বারোহাটির বাগানবাড়িতে সেই। মাসখানেক থেকে যাওয়ার পর দেবেন্দ্রনারায়ণ বা বিষ্ণুপুরের কারো সাথে বলতে গেলে আর কোনো সম্পর্কই রইল না হেমাঙ্গিনী দেবীর। তবে বারোহাটি থেকে যাওয়ার আট-ন’মাস পরে হেমাঙ্গিনী দেবী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম। দিয়েছিল। এই খবর তখনও বিষ্ণুপুরে পৌঁছায়নি। ততদিনে হেমাঙ্গিনী। বহুপুরুষের শয্যাসঙ্গিনী। সুতরাং তার সন্তান হলেও সেই সন্তানের পিতৃপরিচয় কী- তা নিয়ে কেউ কোনো আগ্রহ দেখাল না। বরং ভদ্রসমাজ যতটা সম্ভব। ঘটনা এড়িয়ে গেল। কেউই চায় না, কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে পড়ক। শেষে কার না কার ঘাড়ে দোষ চাপে, এই আশঙ্কায় বরং ওই সময়ে সকলেই হেমাঙ্গিনী দেবীর রাইপুরের বাড়ি এড়িয়ে চলল। হেমাঙ্গিনী দেবীও অবশ্য এই নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করল না। সে যতটা পারল তার সন্তানকে আড়াল করে রেখেছিল জনমানুষ থেকে।

অল্পদিনেই রাইপুরের সকলেই হেমাঙ্গিনী দেবীর সন্তানের কথা ভুলেই গেল। এ সন্তানকে হেমাঙ্গিনী দেবী জনসম্মুখে আনত না। ফলে সে আড়ালেই রয়ে গেল। দেবেন্দ্রনারায়ণ খেয়ালি মানুষ। তার ওপর হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রতি তার প্রবল আক্রোশ। সেই আক্রোশ সে মিটিয়েছিল তাকে বারোহাটিতে তুলে এনে। তারপর থেকে দিব্যি হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা সে ভুলে গেল। হেমাঙ্গিনীও তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখল না। এরও বছর পাঁচেক বাদে একদিন দেবেন্দ্রনারায়ণের কী খেয়াল উঠল। তিনি তখন হেমাঙ্গিনী দেবীকে আবার ডেকে পাঠালেন। হেমাঙ্গিনী তখন রাইপুরের বিখ্যাত পেশাদার বাঈজী। সে এলো। সেই প্রথম দেবেন্দ্রনারায়ণ হেমাঙ্গিনীর সাথে আসা অন্য নর্তকীদের কাছ থেকে জানলেন যে হেমাঙ্গিনীর একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। কিন্তু সেই সন্তানের বয়স, বা পিতৃপরিচয় নিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের বিন্দুমাত্র আগ্রহ রইল না। কারণ ততদিনে হেমাঙ্গিনী দেবীর প্রতি তার সেই অতীতের প্রবল আসক্তি আর নেই। হেমাঙ্গিনীর প্রতি সমীহ থাকলেও তার মতো একজন মেয়ে-মানুষের সন্তানের পিতা নিয়ে আগ্রহ দেখানোর কারণও খুঁজে পাননি দেবেন্দ্রনারায়ণ। কিংবা খেয়ালি দেবেন্দ্রনারায়ণের মাথায় এই নিয়ে কোনো বিশেষ হিসেব-নিকেশও কাজ করেনি।

হরিহরণ দীর্ঘসময় চুপ করে বসে রইল। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, ও ছেলে তোর, তা বিষ্ণুপুরের কি কেউ জানে?

হেমাঙ্গিনী দেবী সাথে সাথেই জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। তারপর বলল, জানে।

হরিহরণ বলল, কে জানে?

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, বড়বাবুর স্ত্রী।

হরিহরণ এবার সত্যি সত্যি অবাক হলো, বড় বাবুর স্ত্রী মানে? দেবেন্দ্রনারায়ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা অবনীন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বীণাবালা?

হেমাঙ্গিনী অন্ধকারেই হা-সূচক মাথা নাড়াল। তারপর স্মিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।

হরিহরণ বলল, তোর কী হয়েছে হেমাঙ্গিনী? আমায় খুলে বল। স্পষ্ট করে বল।

হেমাঙ্গিনী আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সেও ঠাণ্ডা গলায় বলল, এই জমিদার বাড়ির সাথে আমার কিছু হিসেব আছে হরি কাকা। তোমারো ছিল। কিন্তু তুমি পালানো মানুষ। পালানো মানুষ হিসেব ভয় পায়। তারা হিসেব ছেড়ে পালায়। তুমিও পালাচ্ছ।

হরিহরণ বলল, তত্ত্বকথা ছাড় হেমাঙ্গিনী। এখন তত্ত্বকথার সময় নয়। আসল কথা বল। তুই কী খেলা শুরু করেছিস? আমায় বল।

হেমাঙ্গিনী দেবী বলল, সব বলব হরি কাকা। সব বলব। তার আগে আমার ছেলেকে বাঁচাও হরি কাকা। জঙ্গলের ভেতর ওই বাড়িতে আমায় নিয়ে চলো।

হরিহরণের হঠাৎ মনে হলো, আসলেই তো, আগে ছেলেটার কী হাল সেটি দেখা জরুরি। আর এখন এই শেষ রাতে ওখানে আর কারো থাকার কথাও না। হরিহরণ আর কথা বাড়াল না। সে হেমাঙ্গিনী দেবীর হাত ধরে টেনে নাও থেকে নামল। তারপর আবার ঢুকল বারোহাটির জঙ্গলে। হরিহরণ এবার আরো সংক্ষিপ্ত পথ ধরল। কিন্তু গভীর জঙ্গলে সেই ভাঙা বাড়ির সামনে এসে হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণ থমকে গেল। বাড়ির সামনে দেবেন্দ্রনারায়ণ সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছেন!

হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবীও নিশ্ৰুপ, নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল আড়ালে। দেবেন্দ্রনারায়ণ বাড়ির ভেতর ঢুকলেন। তারপর দীর্ঘসময় পর বাড়ির ভেতর থেকে বের হলেন। হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী দেখল দেবেন্দ্রনারায়ণের কাঁধে কাপড়ে মোড়ানো ছেলেটি। মশালের আলোয় তার পা দু’খানা দুলছে। হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী বিস্ফারিত চোখে দেখল, দেবেন্দ্রনারায়ণ ছেলেটিকে একটি বৃক্ষের সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে রাখলেন। তারপর আবার ঢুকে গেলেন বাড়িটিতে। তার কিছুক্ষণ বাদে দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। ততক্ষণে দাউদাউ আগুনে জ্বলতে শুরু করেছে বাড়িটি। দেবেন্দ্রনারায়ণ একবারের জন্যও পিছু ফিরে তাকালেন না। তিনি ছেলেটিকে ফের কাঁধে তুলে নিলেন। তারপর ঢুকে গেলেন জঙ্গলে।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল হরিহরণ আর হেমাঙ্গিনী দেবী। তবে তারা দুজনই নিশ্চিন্ত হলো যে, আর যাই হোক ছেলেটিকে নিয়ে চিন্তিত হবার আর কিছু নেই। কালব্যাধি গুটিবসন্ত তার প্রাণঘাতী হতে পারে, তবে মনুষ্য-আঘাতের শঙ্কা থেকে সে আপাতত মুক্ত।

তবে হরিহরণ এখনও গোলক ধাঁধায়। তার মনে এখনও অসংখ্য প্রশ্নের ঝড়। কিন্তু সে এই মুহূর্তে হেমাঙ্গিনী দেবীকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। তবে হরিহরণ স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছে বিষ্ণুপুরের অন্দরমহলে কোনো ভয়াবহ বিষবৃক্ষ শেকড় গেড়েছিল, যার ডালপালা ক্রমশই বিস্তৃত হয়েছে। হেমাঙ্গিনী দেবীও সেই বিষবৃক্ষের কোথাও না কোথাও জল ঢালছে। চিন্তিত হরিহরণ আর কোনো কথা বলল না। এই মুহূর্তে যা দরকার তা হলো হেমাঙ্গিনী দেবীর একটি আশ্রয়। নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয়। হরিহরণ তাকে নিয়ে গেল বজরাডুবির চরে।

1 Comment
Collapse Comments

সুবোধ ঘোষের “জুত গৃহ” ছোট গল্প পেতে চাই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *