সঞ্জুর ঘর থেকে ছরতা দিয়ে সুপারি কাটার মতো কুট কুট শব্দ হচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে শব্দটা শুনছেন। কুট কুট কুটুর কুটুর। এর মানে কী? সঞ্জু সুপারি কাটবে কেন? মজার ব্যাপার তো!
রাত এগারোটা বাজে। ঘণ্টা দুএকের জন্যে বৃষ্টি থেমেছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। আজ রাতের ঘুমটা আরামের হবে। গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে শুতে হবে। মাথার কাছের জানালাটা খোলা থাকবে। খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট আসবে—আসুক। একটু আধটু বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় লাগলে কিছু হবে না। গত কয়েক রাত খুব গরম গেছে। আজ রাতটা আরামে যাবে। ঘুমুতে যাবার আগে ফরহাদ উদ্দিন ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্যে এসেছেন। টুকটাক কিছু কথা বলবেন। হালকা গলায় জিজ্ঞেস করবেন–তোর মামার বাসায় শেষ পর্যন্ত তুই গেলি না, সবাই অপেক্ষা করে ছিল। অভিযোগ না, এমি কথার কথা। ঘুমুতে যাবার আগে কঠিন কথা বলা একেবারেই ঠিক না। এতে ঘুমের অসুবিধা হয়। বদহজম হয়। বদহজম মানেই দুঃস্বপ্ন দেখা।
কঠিন কথা বলতে হয় দিনে। সন্ধ্যার পর থেকে হালকা কথাবার্তা। টিভিতে নাটক ফাটক দেখা। ছবিওয়ালা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টানো। পরিবারের লোকজন নিয়ে সামান্য হাসাহাসি।
ফরহাদ উদ্দিন সঞ্জুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না মন স্থির করতে পারছেন না। কেন জানি ঘুম আসছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কনকের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। সে বাসায় নেই। রাহেলা তাকে নিয়ে কোথায় জানি বেড়াতে গেছে। কোথায় গেছে, কেন গেছে সবই তাকে বলা হয়েছে কিন্তু তিনি এখন মনে করতে পারছেন না। হয়তো শোনার সময় ঠিকমতো শুনেন নি।
ফরহাদ উদ্দিন ছেলের ঘরের দরজায় হাত রেখে সামান্য চাপ দিলেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কি-না তার পরীক্ষা। তিনি ঠিক করে রেখেছেন ভেতর থেকে ছিটকিনি দেয়া থাকলে তিনি আর ঢুকবেন না। সকালবেলা সঞ্জুর সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসে যাবার আগে ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে বলবেন—কাল রাতে তোর ঘরে কুটকুট শব্দ হচ্ছিল। ব্যাপার কী রে? সুপারি কাটছিলি না-কি? বিটল নাট কাটিং?
সঞ্জুর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না। চাপ পড়তেই দরজা ফাঁক হলো। ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় আলো এসে পড়ল। সঞ্জু গম্ভীর গলায় বলল, কে? ফরহাদ উদ্দিন বললেন, কী করছিস? সঞ্জু জবাব দিল না, তবে কুট কুট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। ফরহাদ উদ্দিন ঘরে ঢুকে পড়লেন।
সঞ্জু খাটে পা তুলে বসে আছে। তার হাতে চকলেটের টিন। কুট কুট শব্দ টিন থেকে আসছে। মনে হয় টিনটা বাঁকা হাতের চাপ লেগে শব্দ হচ্ছে। সঞ্জুর ঘর খুব গোছানো। এই বয়সের ছেলের ঘর গোছানো থাকে না। জিনিসপত্র এলোমেলো ছড়ানো থাকে। সঞ্জু তাদের মতো না। সুন্দর করে সাজানো ঘর দেখতে ভালো লাগে। ফরহাদ উদ্দিন আনন্দ নিয়ে চারদিকে তাকালেন। সঞ্জুর পড়ার টেবিলের সামনের দেয়ালে আইনস্টাইনের বড় একটা পোস্টার। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল নিয়ে বিজ্ঞানী বসে আছেন। আউলা ঝাউলা চোখ।
আইনস্টাইনের ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন ফরহাদ উদ্দিন। হাসি মুখে বললেন—তোর খবর কী?
ভালো। সুপারি কাটার মতো কুট কুট শব্দ হচ্ছিল। ভাবলাম দেখি ঘটনা কী?
ফরহাদ উদ্দিন এগিয়ে এলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। সঞ্জু বলল, কিছু বলবে?
আলাদা রিকশা নিয়ে তুই কোথায় চলে গেলি। তোর মামার বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছিল। আমার নিজেরও শরীর খারাপ হয়ে গেল। ঐটা অবশ্যি কিছু না।
সঞ্জু বলল, মানুষের বাড়িতে বেড়াতে আমার ভালো লাগে না।
ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমারও ভালো লাগে না। তারপরেও সামাজিকতা রক্ষা করতে হয়। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। ম্যান ইজ এ সোশ্যাল এনিমেল। সঞ্জু শোন, আগামীকাল তোকে অবশ্যি নিয়ে যেতে বলেছে।
বাবা, আমি যাব না।
এত করে বলছে, পাঁচ দশ মিনিট থেকে চলে আসবি। আমি অবশ্যি বলেছি ও কোথাও যেতে চায় না। তোর মামি শুনছে না।
না শুনলে কিছু করার নেই।
ফরহাদ উদ্দিন লক্ষ করলেন সঞ্জুর কপালের রগ ফুলে উঠেছে। তার মন সামান্য খারাপ হলো—সঞ্জুকে রাগিয়ে দিয়েছেন। কাজটা ঠিক হয় নি। তিনি হালকা গলায় বললেন—যেতে ইচ্ছা না করলে আমি বুঝিয়ে বলব। সমস্যা হবে না। সবারই সুবিধা-অসুবিধা আছে!
সঞ্জু বলল, বাবা তুমি শুয়ে পড়। আমি একটা জরুরি কাজ করছি।
ফরহাদ উদ্দিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোর মামার বাড়ি যাওয়া নিয়ে তুই দুশ্চিন্তা করিস না। আমি বুঝিয়ে বলব। তোর মামি অবশ্যি বলছিল, হাসনাত সাহেবের কথা শুনলেই তুই যেতে রাজি হয়ে যাবি।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেবটা কে?
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, আমি তো জানি না কে? তুই চিনিস না?
না।
তাহলে মনে হয় ওরা কোনো গণ্ডগোল করেছে। অন্য কোনো নাম হবে। কিংবা আমি শুনতে ভুল করেছি। তোর মামি হয়তো বলেছে এক নমি, আমি শুনেছি অন্য নাম। এমন সমস্যার মধ্যে পড়েছি, বুঝলি সঞ্চু! মাথা বেশির ভাগ সময়ই আউলা হয়ে থাকে। মানুষের নাম মনে রাখা নিয়েই বেশি সমস্যা হচ্ছে। কোনো একদিন দেখব তোর নামই মনে নেই। সঞ্জুর বদলে তোকে ডাকছি ভঞ্জু। হা হা হা। ডাক্তার দেখাতে হবে।
সঞ্জু এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরহাদ উদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার মতো হাসি দিলেন।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেবের কথা তোমাকে কে বলল?
তোর মামি বলেছে। তোর মামির নাম দুলি। দুলালী থেকে দুলি। আশ্চর্য কাণ্ড, বুঝলি সঞ্জু! আমি দুলিকেও চিনতে পারি নি। শুরুতে ভাব করেছিলাম চিনেছি। দুলি আবার খুব চালাক মেয়ে, সে ধরে ফেলল। আমি বিরাট লজ্জার মধ্যে পড়েছি।
সঞ্জু বলল, হাসনাত সাহেব নিয়ে মামির সঙ্গে তোমার এগজেক্ট কী কথা হয়েছে?
তেমন কোনো কথা না। তোর মামি বলল, হাসনাত নামটা শুনলেই সঞ্জু আসবে।
এটা এমন কী মহিমান্বিত নাম যে শুনলেই আমি দৌড়ে চলে যাব?
রেগে যাচ্ছিস কেন? বোঝাই যাচ্ছে একটা কিছু ভুল হয়েছে। ভুলটা তোর মামি করে নি। আমি করেছি। তোকে তো বলেছি আমার ব্রেইন কাজ করছে না।
সঞ্জু বলল, হাসনাত নামের কাউকে আমি চিনি না।
না চিনলে তো ফুরিয়েই গেল। তুই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রাত আছে। আরামে ঘুমাবি।
তিনি সঞ্জুর ঘর থেকে বের হলেন। নিজেই দরজা টেনে দিলেন। বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন—কুটুর কুটুর শব্দটা আবার শুরু হয় কি-না তার পরীক্ষা। শব্দ শুরু হচ্ছে না তার সামান্য খারাপ লাগছে, সঞ্জুর ঘরে আরো কিছুক্ষণ বসলেই হতো। গল্পই করা হলো না। একটা জরুরি বিষয় নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করা দরকার ছিল। অফিসের ব্যাপার। চাকরি করতে আর ভালো লাগছে না। তার আরো দুই বছর চাকরি আছে। ইচ্ছা করলে শারীরিক কারণে তিনি আর্লি রিটায়ারমেন্টে যেতে পারেন। পেনশন অতি সামান্যই পাবেন, সেটা একটা সমস্যা। তবে খুব বড় সমস্যা না। ঢাকা শহরে এখন তার নিজের বাড়ি আছে। দোতলার কিছু কাজ বাকি আছে। কাজটা শেষ ক দোতলা ভাড়া দিয়ে দেবেন। এর মধ্যে পাস করে সঞ্জু চাকরি শুরু করবে। চাকরির বাজার যদিও খুব খারাপ তবুও ব্যবস্থা একটা হবে। সালু-মামা কোনো কোনো ব্যবস্থা করে ফেলবেন। ছেলের সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা বলতে পারলে ভালো লাগত। ছেলে বড় হলে বন্ধুর মতো হয়ে যায়। বিলেত আমেরিকায় বাপ-বেটা এক টেবিলে মদ খেয়ে হাসাহাসি করে। বাংলাদেশে এটা সম্ভব না; তবে গল্পগুজব করা, হাসাহাসি করা খুবই সম্ভব।
টানা বারান্দার শেষ মাথায় বেতের একটা চেয়ার রাখা। কে যেন চেয়ারে এসে বসল। তার তিন মেয়ের কোনো একজন কি? কোন মেয়ে? বড় মেয়ে? তারা তিনজন সব সময় এক সঙ্গে থাকে। একজন যদি বারান্দায় এসে বসে বাকি দুজন কিছুক্ষণের মধ্যে এসে উপস্থিত হবে। মেয়ে তিনটা ছোটবেলায় তিন রকম ছিল। যতই তাদের বয়স হচ্ছে ততই তার এক রকম হয়ে যাচ্ছে। স্বভাব এক রকম হবার পেছনে যুক্তি আছে শুধু স্বভাব না, এদের চেহারাও এখন কাছাকাছি চলে আসছে। তিনজনেরই গোল মুখ, ফোলা ফোলা গাল। তিনজনই উঁচু গলায় সামান্য ক্যানক্যানা স্বরে কথা বলে। যখন শাড়ি পরে তিনজনই একসঙ্গে শাড়ি পরে। যখন সালোলায়ার কামিজ পরে তখনও তিনজনই সালোয়ার কামিজ পরে।
ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি মনে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েকে একা পাওয়া গেছে, টুকটাক দুএকটা কথা মেয়ের সঙ্গে বলা যাবে। তিন বোন এক সঙ্গে থাকলে তিনি কথা বলতে পারেন না। তিনজনের দিকে একসঙ্গে তাকানো যায় না বলেই হয়তো এ সমস্যাটা হয়।
ফরহাদ উদ্দিন দূর থেকেই বললেন, কে?
বাবা আমি সেতু।
করছিস কী তুই?
বসে আছি।
বসে আছিস কেন?
কী আশ্চর্য কথা! বসে থাকতে পারব না?
ফরহাদ উদ্দিন সামান্য হকচকিয়ে গেলেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন বুঝতে পারছেন না। এটি তার বড় মেয়ে না মেজো মেয়ে। তাঁর তিন মেয়ের খুবই কাছাকাছি নাম–মিতু, সেতু, নীতু। ছোটটার নাম নীতু এটা ঠিক আছে। এখানে তার গণ্ডগোল হয় না, কিন্তু বড় আর মেজোর নামে বেশ কিছুদিন ধরেই গণ্ডগোল হচ্ছে। সেতু কার নাম? বড়টার না মেজোটার? তিনি নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে পারেন না–তুই বড় মেয়ে না মেজো মেয়ে?
সেতু চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। বারান্দায় একটাই চেয়ার। দুটো চেয়ার থাকলে ফরহাদ উদ্দিন আরেকটা চেয়ারে বসতেন। তার অবশ্যি দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ লাগছে না। মেয়ে সামান্য বেয়াদবি করছে—বাবাকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে পা দোলাচ্ছে। যাই হোক এটা এমন কোনো বড় বেয়াদবি না। খুব প্রিয়জনদের সঙ্গে বেয়াদবি করা যায়।
তুই একা কেন? তোর বাকি দুই বোন কোথায়? থ্রি মাস্কেটিয়াস! টিভি দেখছে না-কি?
সেতু বিরক্ত মুখে বলল, কী যে প্রশ্ন তুমি করো বাবা। রাতে খাবার সময় তো তোমাকে বললাম—মা নীতু, মিতু আপা আর কনককে নিয়ে ছোট খালার বাসায় গিয়েছে। ওদের বাসার সামনের রাস্তায় পানি জমে গেছে। আজ রাতে আর ফিরবে না।
আরে তাই তো!
তোমার ভুলোমন ভুলোমন ভাবটা দূর করো তো বাবা। বিরক্তি লাগে।
ফরহাদ উদ্দিন মেয়ের কথা বলার ভঙ্গিতে খুবই আনন্দ পেলেন। আনন্দটা বেশি হচ্ছে কারণ মেয়ের কথা থেকে তিনি ধরে ফেলেছেন এই মেয়ে হলো সেতু, তার মেজো মেয়ে। একটু আগেই সে বলেছে—মা নীতু, মিতু আপা আর কনককে নিয়ে ছোট খালার বাড়িতে গিয়েছে। মিতু আপা বলছে, কাজেই মিতু সবচে বড় বোন।
প্রথম মিতু, তারপর সেতু, সবচে শেষে নীতু। কে বড় কে মেজো কে ছোট মনে রাখার জন্য ভালো কোনো বুদ্ধি বের করা দরকার। কী বুদ্ধি করা যায়? সব মেয়ের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে একটা শব্দ বানাতে হবে। শব্দটা মনে রাখলেই কার পরে কে বোঝা যাবে। মিতুর M, সেতুর S, নীতুর N। শব্দটা হলো MSN. সহজ বুদ্ধি। এই বুদ্ধি খাঁটিয়ে তিনি ছোটবেলায় অনেক কিছু মনে রাখতেন।
সবাই গেছে তুই যাস নি কেন?
আমি কেন যাই নি সেটাও বাবা আমি তোমাকে বলেছি।
কখন বললি?
ভাত খাবার সময় বলেছি।
ভুলে গেছি। আরেকবার বল।
এক কথা একশবার বলতে ভালো লাগে না। তুমি কোনো ব্রেইন টনিক ফনিক খেয়ে ব্রেইনটা ঠিক কর তো।
রেগে আছিস কেন? বাড়ির বড় মেয়েকে হতে হবে শান্ত ধীর স্থির। অন্যরা রাগ করলেও বাড়ির বড় মেয়ে রাগ করবে না।
বাবা আমি সেতু। আমি বড় মেয়ে না।
ও আচ্ছা তাই তো। অন্ধকারে বসে আছিস বুঝতে পারি নি। MSN, তুই মাঝখানের s.
কী বলছ তুমি?
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হাসলেন। পারিবারিক সমস্যাটা MSN দিয়ে কাভার করা যাচ্ছে।
MSN টা কী?
আছে একটা ব্যাপার। বলা যাবে না।
সেতু বলল, না বললে নাই। বাবা যাও শুয়ে পড়ো। রাত বারোটা বাজে, এখনো হাঁটাহাঁটি করছো কেন?
তুইও শুয়ে পড়।
আমার ঘুম আসছে না।
তিন বোন একসঙ্গে থেকে থেকে এমন অভ্যাস করেছিস একা থাকলে ঘুম আসবে না। বিয়ের পর তো তোরা মহা বিপদে পড়বি। সবচে ভালো হতো কি জানিস? কোনো একটা ফ্যামিলির তিন ভাই-এর সঙ্গে তোদের তিনজনের বিয়ে দিয়ে দেয়া।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেললেন। হাসতে গিয়ে তার মনে পড়ল কেন সেতু তার ছোট খালার বাড়িতে যায় নি। সেতুর বিয়ের ফাইনাল কথা হচ্ছে। বিয়ের ফাইনাল কথায় কনে উপস্থিত থাকে না। উপস্থিত থাকা শোভন না। ছেলে দেশের বাইরে মালয়েশিয়া কিংবা জাপানে কোথায় যেন কাজ করে। বিয়েটা সেতুর পছন্দ না। তার আপত্তি হচ্ছে বড় বোনকে বাদ দিয়ে মেজো বোনের বিয়ে আগে কেন হবে? তারচেয়েও বড় আপত্তি হলো সেতুর পছন্দের একজন ছেলে আছে। কয়েকদিন তাকে এ বাড়িতে দেখেছেন। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলেন রিকশায় করে সেতু আর ঐ ছেলে যাচ্ছে। সেতু খুব হাত টাত নেড়ে গল্প করছে আর ছেলেটা মাথা নিচু করে বসে আছে। তাকে দেখতে পেলে দুজনই লজ্জা পাবে বলে তিনি দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। ছেলেটার নাম কী? নাম তিনি শুনেছেন কিন্তু মনে করতে পারছেন না। সেতুকে সেই ছেলের নাম জিজ্ঞেস করা একেবারেই উচিত হবে না। কায়দা করে অবশ্যি জিজ্ঞেস করা যায়। তিনি বলতে পারেন সেতু শোন, তোর কাছে মাঝে মাঝে একটা রোগা ছেলেকে আসতে দেখতাম। শ্যামলা রং, চশমা পরা। ছেলেটার নাম কী যেন? এখন জিজ্ঞেস করবেন?
ফরহাদ উদ্দিন নাম জিজ্ঞেস করবেন কী করবেন না এই নিয়ে কিছুটা ভাবলেন। যখন পুরোপুরি ঠিক করলেন জিজ্ঞেস করবেন তখন খাবার ঘর থেকে টেলিফোন বাজতে থাকল। সেতু চলে গেল টেলিফোন ধরতে। বাড়িতে টেলিফোন নতুন এসেছে। টেলিফোনে রিং হলেই সবাই খুব আগ্রহ বোধ করে। শুধু তিনি নিজে শংকিত বোধ করেন। টেলিফোন বাজলেই তার মনে হয় অফিস থেকে জরুরি কল আসছে। এক্স কর্নেল হাবীবুর রহমান কোনো একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছেন না। ফাইলটা ফরহাদ উদ্দিনের টেবিলে থাকার কথা।
সেতু ফিরে আসছে। নিশ্চয়ই রং নাম্বার। পরিচিত কারোর টেলিফোন এলে সেতু এত সহজে ছাড়ত না। তার তিন মেয়েই টেলিফোনে কথা বলতে খুব পছন্দ করে। কোনো একজনের টেলিফোন এলে বাকি দুইজনও টেলিফোন সেটের আশে পাশে থাকে। একজন কথা বলে, বাকি দুজন নিচু গলায় সারাক্ষণ হাসে।
সেতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন।
ফরহাদ উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, আমার টেলিফোন! বলিস কী? এত রাতে কে টেলিফোন করবে?
দেখ কে করেছে?
তুই জিজ্ঞেস করিস নি?
না।
ছেলে না মেয়ে? আমার অফিসের কেউ না তো?
তুমি টেলিফোনটা ধরলেই তো জানবে ছেলে না মেয়ে কথা বলে। কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন?
পরিচিত কাউকে টেলিফোন নাম্বার দেইনি তো এইজন্যই অবাক হয়েছি। দিব কীভাবে, আমি নিজেই বাসার টেলিফোন নাম্বার জানি না। একটা কাগজে লিখে মানিব্যাগে রেখেছিলাম। সেই কাগজটাও হারিয়ে ফেলেছি।
বাবা টেলিফোনট গিয়ে ধরো। প্লিজ। আর ধরতে না চাইলে আমি বলে আসি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ।
আমি তো ঘুমাই নাই। মিথ্যা বলাটা ঠিক হবে না। মিথ্যা বললে আয়ু যে কমে এটা জানিস?
না।
তুই যতক্ষণ মিথ্যা বলবি ততক্ষণ আয়ু কমবে। কেউ সারা দিনে পাচ মিনিট মিথ্যা কথা বললে তার আয়ু থেকে পাঁচ মিনিট মাইনাস করা হয়। মিথ্যাবাদী লোক কখনো দীর্ঘজীবী হয় না।
ফরহাদ উদ্দিন টেলিফোন ধরতে গেলেন। রাত বাজে বারোটা একুশ। এত রাতে কে তাকে টেলিফোন করবে।
হ্যালো
দুলাভাই স্লামালাইকুম। আমি ইস্তিয়াক। আপনি জেগে আছেন এইজন্যেই কথা বলতে চাইলাম। আপনার শরীর এখন কেমন?
ভালো
দুলির কাছে শুনলাম আপনার শরীর খুবই খারাপ করেছিল–তারপরেও আপনি একা একা হয়েছেন, কাজটা ঠিক করেননি
এখন ভালো আছি।
আপনাকে একা ছেড়ে দিয়েও দুলি ঠিক করে নি। আমি ওর উপরও রাগ করেছি। কাল আসছে ত দুলাভাই?
হা আসব
সন্ধ্যার পর থেকে আমি থাকব। কোনো কাজ রাখব না। আপনি সঞ্জুকে নিয়ে আসবেন। আমার মা ওকে খুবই দেখতে চাচ্ছেন। অসুস্থ মানুষ, মাথায় বিকার উঠে গেছে। সারাক্ষণ সঞ্জু সঞ্জু করছেন। সঞ্জু বাসায় আছে তো?
হা বাসায় আছে।
ও যেন বাসা থেকে কোথাও না যায়। আসলে ওর সঙ্গেই আমার কথা বলা দরকার। আমি চাচ্ছি কথা বলার সময় আপনিও সামনে থাকেন। দুলাভাই আপনি এখনই সঞ্জুকে বলে দিন।
আমি বলে দেব। তবে ইয়ে ইস্তিয়াক শোন—-ও তোমাদের এখানে যেতে চাচ্ছে না। লাজুক টাইপের তো? কোথাও যেতে চায় না। তারপরেও আমি বলব। লাজুক হোক যাই হোক, মানুষকে সামাজিকতা রক্ষা করতে হবে। মানুষ হলো সামাজিক জীব। ম্যান ইজ এ সোশ্যাল এনিমেল। ঠিক না?
হ্যা ঠিক।
তাই বলে জোর করে কিছু করানোও ঠিক না। এতেও মনের উপর চাপ পড়ে। মনের উপর চাপ পড়লে তার ফল খুবই অশুভ হয়। এই জন্যে আমার নীতি হলো কারো মনের উপর চাপ না দেয়া। বুঝলে ইস্তিয়াক, সঞ্জু আসতে না চাইলে আমি তার উপর জোর করব না। তবে আমি নিজে চলে যাব। মা’র সঙ্গেও দেখা করে আসব। অনেক দিন তাকে দেখতে যাই নি এটা খুবই অন্যায় হয়েছে। দেখা হলে আমি পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব।
ইস্তিয়াক বলল, দুলাভাই আপনি সঞ্জুকে একটু টেলিফোনটা ধরতে বলুন আমি বলে দিচ্ছি।
ফরহাদ উদ্দিন বললেন, ও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ও রাত জাগে না। সকাল সকাল ঘুমায়। এইটা তার একটা ভালো অভ্যাস। মেয়েগুলির স্বভাব আবার সম্পূর্ণ উল্টা। যত রাত জাগবে তত তাদের চোখ থেকে ঘুম চলে যাবে।
ইস্তিয়াক বলল, সঞ্জু একটা সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ওর সঙ্গে এই জন্যেই কথা বলাটা আমার জরুরি।
হাসনাত নামের কাউকে নিয়ে সমস্যা? দুলি এই নামটা বলেছিল।
হা।
ফরহাদ উদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, তুমি কোথাও বিরাট একটা ভুল করছ। সঞ্জু হাসনাত নামে কাউকে চিনেই না।
ও খুব ভালো করেই চিনে। যাই হোক আপনি ওকে টেলিফোন ধরতে বলুন।
ফরহাদ উদ্দিন টেলিফোন রেখে বারান্দায় এলেন।
বারান্দায় সেতু এখনো আগের জায়গায় বসে আছে। তার সামনে সঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই নিচু গলায় কথা বলছে। কোনো হাসির কথা হচ্ছে। সঞ্জু হঠাৎ হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠছে। বাবাকে দেখে সঞ্জু হাসি থামিয়ে তাকাল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন—রাত অনেক হয়েছে, ঘুমুতে যা। তার ইচ্ছা না সঞ্জু তার মামার সঙ্গে কথা বলুক। কথা বললেই মেজাজ খারাপ হবে। রাতের ঘুমের সমস্যা হবে। তিনি সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে বললেন—তুই তো রাত জাগিস না। আজ জেগে আছিস কেন?
সেতু বলল, বাবা তুমি আমাদের ঘুমের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এই নিয়ে তিনবার ঘুমের কথা বললে। তোমার ঘুম পেলে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। কাজের মেয়েটা মনে হয় জেগে আছে। হয়তো চা বানাচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিনের ছেলেমেয়েদের চায়ের অভ্যাস আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের চা খেতে ইচ্ছা করে। একবার রাত তিনটার সময় খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙেছে। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন বাসার সব বাতি জ্বলছে। খাবার ঘরের টেবিলে তিন মেয়ে তাদের মা-কে নিয়ে গল্প করছে। ওদের সঙ্গে সও আছে। সবার হাতেই চায়ের কাপ। খুবই আনন্দময় পরিবেশ। পরিবারের সবাই এক সঙ্গে বসে আনন্দ করছে দেখতেই ভালো লাগে। আনন্দের উৎসবে পরিবারের এক আধজন সদস্য বাদ পড়ছে এটা কোনো বিষয় না। একজন দুজন বাদ পড়তেই পারে।
ফরহাদ উদ্দিন রান্নাঘরের দিকে এগুলেন। ইস্তিয়াক টেলিফোন ধরে বসে আছে। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ঠিক না হলেও কিছু করার নেই। মানুষ সব সময় ঠিক কাজ করতে পারে না। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হয়ে যায়।
যা ভাবছিলেন তাই। চুলায় চায়ের কেতলি। অপরিচিত মাঝ বয়েসী একটা মেয়ে চায়ের কাপ ধুচ্ছে। ফরহাদ উদ্দিনকে দেখে সে মাথায় কাপড় দিল। ফরহাদ উদ্দিন অপরিচিত বুয়াকে দেখে অবাক হলেন না। এ বাড়িতে প্রায়ই বুয়া বদল হয়। একদিনে তিনবার বুয়া বদলের ঘটনাও ঘটেছে। সকালে ছিল একজন। তার চাকরি চলে গেল দুপুরের আগে আগে। বিকেলে নতুন একজন এলো। রাতে ভাত খাবার সময় দেখা গেল অন্য আরেকজন।
ফরহাদ উদ্দিন ঘোমটা পর বুয়াকে বললেন, আমাকে এক কাপ চা দিও
বুয়া মাথা নাড়ল।
চিনি দিও না, আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। চিনি খাওয়া নিষেধ। আমাকে দিবে হালকা লিকারের চা।
জ্বি আচ্ছা।
শুধু সকালবেলা দুধ চা দিবে। সেখানেও চিনি দেয়ার দরকার নেই। কনডেন্সড মিল্কে যতটুকু চিনি থাকে তাতেই আমার চলে।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি কি রান্নাঘরে ঘুমাবে নাকি?
বুয়া জবাব দিল না। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল। ফরহাদ উদ্দিন বললেন, রান্নাঘরে ঘুমালে অবশ্যই গ্যাসের চুলার চাবি ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাবে। চাবি সামান্য খোলা থাকলেও গ্যাস লিক করে। রান্নাঘর ভর্তি হয়ে যায় গ্যাসে। একসিডেন্ট হয়। পত্রিকা খুললেই এরকম একটা দু’টা একসিডেন্টের খবর পাওয়া যায়। বুঝতে পারছ কি বলছি?
জ্বি।
ফরহাদ উদ্দিন কথা বলার আর কিছু পাচ্ছেন না। আরো কিছুক্ষণ কথা বললে হতো। আরো কিছু সময় পার হতো। এর মধ্যে ইস্তিয়াক নিশ্চয়ই টেলিফোন রেখে দেবে। পুলিশের লোকের এত ধৈর্য থাকবে না যে দশ মিনিট টেলিফোন কানে নিয়ে বসে থাকবে। ইস্তিয়াকের সঙ্গে এখন আর তাঁর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি যা করবেন তা হলো টেলিফোনের কানেকশন খুলে রাখবেন।
বুয়া তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
মইমনসিং।
মৈমনসিংহ তো বিরাট জায়গা। মৈমনসিং-এর কোথায়?
ফুলপুর।
ঢাকা থেকে যাতায়াত ব্যবস্থা কী? বাস?
জ্বি।
মৈমনসিং-এর অনেক জায়গায় গিয়েছি। ফুলপুরে যাওয়া হয় নি। দেখি একবার যাব।
বারান্দায় চটির ফটফট শব্দ শোনা যাচ্ছে। ব্যস্ত পায়ে কে যেন আসছে। সেতু আসছে। তিন মেয়ে উপস্থিত থাকলে কে আসছে তার জন্যে আগে ভাগে বলে দেয়া মুশকিল হতে। তিন মেয়েই একই ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটে।
বাবা, তুমি রান্নাঘরে কী করছ?
চা দিতে বললাম।
চায়ের কথা বলতে এতক্ষণ লাগে। রান্নাঘর থেকে বের হও তো।
ফরহাদ উদ্দিন রান্নাঘর থেকে বের হলেন। সেতু তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে আছে। ফরহাদ উদ্দিন খাবার ঘরে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার কানে নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন, হ্যালো। ও পাশ থেকে কেউ জবাব দিল না। শোঁ শোঁ শব্দ হতে থাকল। ইস্তিয়াক টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে। ফরহাদ উদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। টেলিফোন লাইন খুলে দিয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। সবচে ভালো হয় বৃষ্টি নামা’র পর ঘুমুতে গেলে।
বাবা, তোমার ঘটনাটা কী বলো তো? রাত একটার সময় কাকে টেলিফোন করছ?
কাউকে না।
কাউকে না মানে কী? তুমি তো কানের কাছে টেলিফোন ধরে আছ।
ফরহাদ উদ্দিন লজ্জিত মুখে টেলিফোন রাখলেন।
এই নাও তোমার চা। হঠাৎ তোমার চা খাবার ইচ্ছা কেন হলো এটাও তো বুঝছি না। তুমি তো চা খাও না।
সকালে এক কাপ খাই।
ফরহাদ উদ্দিন চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে রেখে দিলেন। রাতদুপুরে চা খাবার কোনো মানে হয় না। ঘুমটা নষ্ট হবে। সেতু এগিয়ে এসে বাবার কপালে হাত রেখে বলল, জ্বর তো নেই। তোমার কপালে হাত দিয়ে মনে হচ্ছে উল্টো আমারই জ্বর। এত ঠাণ্ডা তোমার গা। বাবা যাও, শুয়ে থাক আর ঘুরঘুর করবে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে?
না।
ও আমি তো ভুলেই গেছি এখন তো আবার কনক তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে তোমার ভালো লাগে না।
কী যে তুই বলিস!
ঠিকই বলি। তুমি কনককে গোপনে চিড়িয়াখানা দেখিয়ে নিয়ে এসেছ।
ঐ বেচারি কখনো চিড়িয়াখানায় যায় নি। আর তোরা তো চিড়িয়াখানা পছন্দ করিস না। চিড়িয়াখানায় গেলে পশুদের গন্ধে তোদের বমি আসে।
কনককে তুমি এত পছন্দ কর কেন বাবা?
দুঃখি মেয়ে। এই জন্যে।
মা’র ধারণা কমক দেখতে অনেকটা আমাদের সৎমার মতো। বাবা এটা কি সত্যি?
ফরহাদ উদ্দিন জবাব দিলেন না। এই ভাবে তিনি আগে চিন্তা করেন নি। মেয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি। পারুলের মুখ লম্বাটে ছিল। কনকের মুখও লম্বাটে।
বাবা।
হু।
তোমার স্বভাবের মধ্যে গোপন করার একটা ব্যাপার আছে। এটা ভালো না।
আমি কী গোপন করলাম?
অনেক কিছুই গোপন কর। এতে মা খুব কষ্ট পায়। মা হয়তো আমাদের সৎ মা’র মতো না। কিন্তু মা খুবই ভালো মেয়ে। তাকে কষ্ট দিও না। যাও ঘুমুতে যাও।
তিনি বাধ্য ছেলের মতো ঘুমুতে গেলেন। দরজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নামল। গভীর রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করাতেও আনন্দ। তবে আজ আনন্দটা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। বড় একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা চেপে বসেছে মাথায়। নাম নিয়ে কি সমস্যা? আচ্ছা ইংরেজি শব্দটা যে তৈরি করেছেন সেটা কি SMN না-কি MS? এটা তো দেখি আরেক যন্ত্রণা হলো।
সঞ্জু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে এর মানে কী? সে কী ঝামেলায় জড়াবে। পলিটিক্স যারা করে তারা ঝামেলায় জড়ায়, বিজনেস ম্যানেরা ঝামেলায় জড়ায়। সঞ্জু এর কোনটাতেই নেই। রাত নটা বেজে গেছে সঞ্জু বাসায় ফিরে নি এরকম কখনো হয় নি। এই ছেলে কী ঝামেলায় পড়বে। সমস্যাটা কী? ইস্তিয়াকের কাছ থেকে জেনে নেয়া ভালো ছিল।
তার মাথা দপদপ করছে। সমস্যার পুরো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ঘুম আসবে না। ঘুমের সমস্যা তার নেই, তবে মাঝে মাঝে খুব ছোট ছোট জিনিস তাকে যন্ত্রণা দেয়। কেউ তাকে একটা ধাঁধা জিঞ্জেস করল তিনি উত্তর বের করতে না পেয়ে রাতে বিছানায় জেগে বসে থাকলেন। ধাঁধা জিজ্ঞেস করত পারুল। মশারি খাটাতে খাটাতে জিজ্ঞেস করল, এই বলো তো দেখি—
কুটুর মুটুর শব্দ হয়
আসলে তা শব্দ নয়।
জিনিসটা কী?
জানি না তো জিনিসটা কী?
চিন্তা করে বের কর। কুটুর মুটুরের মধ্যেই উত্তরটা আছে।
এটা খুবই কঠিন ধাঁধা, এটা পারব না।
চেষ্টা না করেই বলছ পারব না—চেষ্টা কর। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাব।
তখন তাঁর আর ঘুম আসে না। মাখার ভেতর ধাঁধা চলতে থাকে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকেন। তার পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমায় পারুল।
জেগে রাত পার করার এই অভ্যাস সঞ্জুরও আছে। ছোট বয়স থেকেই আছে। মা’র মৃত্যুর পর তিনি সঞ্জুকে নিয়ে ঘুমুতেন। সঞ্জুর আলাদা বিছানা হলো সঞ্জু ক্লাস ফাইভে উঠার পর। তখন হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তিনি লক্ষ করেছেন সঞ্জু তার গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে আছে। যেন পাথরের মূর্তি। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সময়ও মানুষের শরর সামান্য নড়াচড়া করে সঞ্জুর তাও হচ্ছে না। সে মশারির একটা কোনার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।
সঞ্জু কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
বাথরুমে যাবি?
না।
পানি খাবি?
না।
ঘুম আসছে না?
আসছে।
আসছে তাহলে জেগে বসে আছিস কেন?
জানি না।
কোনো কিছু নিয়ে মন খারাপ?
না।
স্কুলে মাস্টার বকেছে?
না।
শুয়ে থাক, পিঠ চুলকে দেই।
আচ্ছা।
তিনি অনেকক্ষণ পিঠ চুলকে দেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এক সময় নিশ্চিত হয়ে যান সঞ্জু ঘুমুচ্ছে। তখন কোমল গলায় বলেন, সঞ্জু ঘুমাচ্ছিস?
সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে বলে, হু।
ঘুমের মধ্যে কথা বলছিস কীভাবে?
আমি ঘুমের মধ্যে কথা বলতে পারি।
ফরহাদ উদ্দিন আনন্দে হেসে ফেলেন। শিশুদের সঙ্গে জীবনযাপন করা খুব আনন্দের ব্যাপার। না এখানে ভুল করা হলো, মানুষের সঙ্গে জীবনযাপন করাই আনন্দের। সঞ্জুর সঙ্গে এখন গিয়ে টুকটাক গল্প করতে পারলে তার আনন্দই হবে। আগের দিনের মতো বিছানায় নিজের পাশে নিয়ে ঘুমুতে পারলে আরো আনন্দ হবে। সঞ্জু খালি গায়ে শুয়ে থাকল, তিনি পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন—সঞ্জু একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব দেখি উত্তর দিতে পারিস কি-না—-
কুটুর মুটুর শব্দ হয়।
আসলে তা শব্দ নয়।
ধাঁধাটা তোর মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। আমি জবাব দিতে পারি নি। তোর তো বুদ্ধি আমার চেয়ে অনেক বেশি, তুই হয়তো পারবি। আচ্ছা আয় এক কাজ করি দুজনে মিলে ভেবে ভেবে বের করি উত্তরটা কী? বুঝলি সঞ্জু, তোর মা মোটামুটি অদ্ভুত মেয়ে ছিল ধাঁধা ধরত কিন্তু ধাঁধার উত্তর দিত না। আমরা কী করি? একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, উত্তর না পারলে নিজেরা বলে দেই। তোর মা এই কাজটা কখনো করত না। কত ধাঁধা যে জিজ্ঞেস করেছে একটারও উত্তর দিয়ে যায় নি। সবগুলি এখন মনেও নেই। ও আচ্ছা আরেকটা মনে পড়েছে—
আকাশে জন্মে কন্যা
পাতালে মরে
হাত দিয়া ধরতে গেলে
ছটর ফটর করে।
কি পারবি? সহজ না, কঠিন আছে। তোর মা যে সব ধাঁধা জিজ্ঞেস করত সবই কঠিন।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। শহরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। রাত গম্ভীর হলেই শুধু শোনা যায়। জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া আসছে। শরীরটা মনে হয় খারাপ করছে। জ্বর সত্যি সত্যি আসছে। জ্বর না এলে এত ঠাণ্ডা লাগার কথা না। গায়ে চাদর আছে তারপরেও শরীর কাঁপছে। ইস্তিয়াকদের ওখানে কাল মনে হয় যাওয়া হবে না। জ্বর নিয়ে তো কেউ আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় না। দুলি বেচারি বাইম মাছ রান্না করে বসে থাকবে। কিছু করার নেই। অসুস্থ অবস্থায় অতি সুখাদ্যের কথা ভাবলেও বমি বমি ভাব হয়।
বারান্দায় কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে। সঞ্জু কি হাঁটছে? তাকে ডেকে ঘরে নিয়ে এলে কেমন হয়? অসুস্থ বাবার পাশে খানিকক্ষণ বসল। এতে ক্ষতি তো কিছু নেই। বরং কথায় কথায় জিজ্ঞেস করা যেতে পারে সে কোনো সমস্যায় পড়েছে কিনা। প্রেম বিষয়ক কোনো সমস্যা না তো? তবে ইস্তিয়াকের গলার স্বরে মনে হচ্ছিল জরুরি কিছু। ফরহাদ উদ্দিন উঠে বসলেন। খাটে হেলান দিয়ে অন্ধকারে বসে রইলেন। সঞ্জুর মায়ের একটা ধাঁধারও তিনি সমাধান বের করতে পারেন নি। এখন আর চেষ্টা করে লাভ নেই। সমাধান বের করলেও সেই সমাধান তাকে জানাতে পারবেন না। তবু উত্তরটা জানা থাকল। কন্যা বাস করে আকাশে, তার মৃত্যু হয় পাতালে। হতি দিয়ে ধরলে সে ছটর ফটর করে। কী হতে পারে? বৃষ্টি কি হতে পারে? বৃষ্টির জন্ম আকাশে, তার মৃত্যু মাটিতে কিন্তু হাত দিয়ে ধরলে সে তো ছটর ফটর করে না।