সকালে স্নান করতে যাবার আগে, একটু অলস ভাবে আয়নার সামনে দাঁড়ানো, বা জানালার কাছে, আইভির হাতে দশ-পনেরো মিনিট সময় থাকে। প্রাতরাশ বিজিতের সঙ্গেই সকলের হয়ে যায়। আইভিও বাইরে লাঞ্চ খায়। আইভি এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের হঠাৎ ঝাপটায়, পরদার শব্দে চমকে ওঠা ভয়ের রেশটা, আভার বুক থেকে আস্তে আস্তে কমছে। আইভি নিজেকে দেখছে না। ও অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছে। আভা ভাবছে, আইভিকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি না। পরশুর আগের রাত্রের ঝগড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। এখন পরিস্থিতি আলাদা। আগে হলে, যখন বিজিতের সঙ্গে আইভির প্রেম পর্ব চলেছিল, আর বিয়ের পরেও যখন দেখা হত, তখন সহজেই হেসে জিজ্ঞেস করতে পারত, কী নিয়ে দুজনের হঠাৎ ঝগড়া হল? আবার মিটলই বা কী করে?
না, আভা জিজ্ঞেস করতে পারছে না। আইভি এখনও আয়নার সামনে একভাবেই দাঁড়িয়ে, অন্যমনস্ক হয়ে মাথার চুলে বিলি কাটছে। ন’টার ভোঁ বাজলেই দৌড়ে বাথরুমে ঢুকবে। পিসিমা এখন বাইরের ঘরে। আলি বাজারে গিয়েছে। ওর ঘর দরজা পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে। সাকিনা রাত্রের বাসনপত্র মেজে পরিষ্কার করে, নীচে গিয়েছে নিজেদের রান্নার জোগাড়ে। তারপরে আসবে জামাকাপড় কাঁচতে। ইংরেজি খবরের কাগজটা আভার হাতে ধরা, কিছুটা অংশ গায়ের ওপরে। কোনও খবরের দিকেই ওর নজর ছিল না। কেবল পার্সোনাল কলামটা দেখেছিল। দেখার কারণ, ওকে উদ্দেশ করে, কেউ কিছু লিখেছে কি না। লিখলে, অবিশ্যিই ধরে নিতে হবে, সে আভাকে খুঁজে বের করতে চায়। আর, সেই খোঁজার উদ্দেশ্য কখনওই সৎ হবে না। একমাত্র দাদা, বউদি, দিদি, মা, আর ছোট বোন ছাড়া। অবিশ্যি ওর বন্ধু কিছু কম নেই। কিন্তু সেই বন্ধুরা কে ওর প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী এখন আর ও তা বুঝতে পারে না। কয়েলস করপোরেশনের সুকুমার দাশ ওর সত্যি বন্ধু। বন্ধুত্বটা মঞ্জুর মারফত হয়েছিল। বিয়ের অনেক আগেই মঞ্জু ওর বন্ধু ছিল। সুকুমার মঞ্জুর বর। ওদের সঙ্গে আভার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু ওর জীবনের সেই ভয়ংকর দিনগুলোতে, ওরা কেউ যোগাযোগ করেনি। যারা করেছিল, আর ওকে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছিল, তাদের কারোকেই ও বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ, পরামর্শগুলো আদৌ ওর উপকারে লাগবার মতো ছিল না। অকারণ কতগুলো ডেসপারেট চ্যালেঞ্জের দিকে ওকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়েছিল। যার পরিণতি হত আরও খারাপ। এমনকী, আদালত অবমাননার দায়ে ওকে শাস্তি পেতে হত।
ন’টার ভোঁ বেজে ওঠার শব্দ ভেসে এল। আইভি চকিত হল, সরে এল আয়নার কাছ থেকে। পা বাড়াল ওয়াড্রবের দিকে। আর ঠিক এই মুহূর্তেই বুম বুম বোমা ফাটার মতো কলিং বেল বেজে উঠল। আভার বুকে শব্দটা বোমার মতোই বাজে। আইভি ওয়াড্রবের পাল্লা খুলল। আলি? কিন্তু আলির তো দু বার কলিং বেল বাজাবার কথা। টু টাং টু টাং, চার বার শব্দ হবার কথা। পিসিমার পায়ের শব্দ বাইরের ঘরে শোনা গেল। আভা খবরের কাগজটা সরিয়ে রেখে, ববের গায়ে হাত রাখল। তাকাল বাইরের ঘরের দরজার দিকে। পিসিমা দমকা বাতাসের মতো ঘরে এলেন। তাঁর চোখে তীব্র উৎকণ্ঠা, ফিসফিস করে বললেন, ‘আভা তুই ববকে নিয়ে এ ঘরের বাথরুমের পেছনের দরজা খুলে, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যা। নীচের বাথরুমের দরজায় তিন বার টোকা দিবি। মিসেস কাপুর বা কেউ দরজা খুলে দেবেন। যদি এক বার…।’
তার কথা শেষ হবার আগেই আবার কলিং বেল বুম বুম বেজে উঠল। আভা ইতিমধ্যে ববকে কোলে নিয়ে বাথরুমে ছুটে চলে গিয়েছে। পিসিমা বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আইভি, তুমি বাথরুমের পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে।
তারপরের ঘটনা এই রকম, যা আভা পিসিমার কাছে শুনেছিল: দরজা খোলবার আগেই আবার ঘন ঘন দু বার কলিং বেল বেজে উঠেছিল। পিসিমা দরজা খুলে দিলেন। তার আগেই তিনি দরজার গ্লাস হোল দিয়ে দেখে নিয়েছিলেন, বিজিতের বর্ণিত সেই রকম একটি লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। পিসিমা দরজা খুলে দিতেই, লোকটি ঘরের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু সে একলা ছিল না। পিছনেই আর এক জন দাঁড়িয়ে ছিল। তার উদ্যত হাতে রুমাল ঢাকা যে বস্তুটি ছিল, সেটি যে একটি মারণাস্ত্র, দেখা মাত্রই পিসিমা তা বুঝলেন। তাঁর চোখে দারুণ উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা, বুকের মধ্যে কাঁপছে। যে লোকটা ঘরের মধ্যে পা বাড়িয়ে দিল, সে রোগা লম্বা, তামাটে মুখে অনেক রেখার হিজিবিজি দাগ। নীল রঙের টেরিউলের স্যুট পরা। ছোট চোখের দৃষ্টি শক্ত। আর বাইরের লোকটার চেহারা বেঁটে, চওড়া, ভাবলেশহীন মুখ। ট্রাউজার আর হাওয়াই শার্ট গায়ে। পায়ে স্যান্ডেল। রোগা লম্বা লোকটি পিসিমাকে মোটা নিচু স্বরে বাংলায় বলল, কোনও রকম চেঁচামেচি করবার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাদের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি, এসেছি শুধু আভাকে খুঁজতে। আপনার ভাইঝি আভা মজুমদারকে। দরজাটা খোলাই থাকবে, আমার বন্ধু দরজায় থাকবে।
‘কিন্তু আভা তো এখানে নেই?’ পিসিমা কয়েক পা পেছিয়ে গিয়ে বললেন। লোকটি আরও ভিতরে ঢুকে এল। পিসিমার দিকে কঠিন সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, আছে কি না, সেটা আমি নিজের চোখেই দেখতে চাই। আমি ডাকাত নই, আপনাদের কোনও জিনিসে হাত দেব না। কিন্তু দয়া করে চেঁচামেচি করবেন না। আইভি কোথায়?
ঘরের ভেতরে আছে। পিসিমা আরও কয়েক পা পেছিয়ে গেলেন।
এ সময়েই আইভি ওর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি আইভির আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এল। ‘গুড মর্নিং। ভয় পাবার কিছু নেই আপনাদের। আমি আভাকে খুঁজতে এসেছি। আর তাও নিজের চোখেই খুঁজে দেখতে চাই। আপনারা আমার সঙ্গে থাকুন। সেটাই ভাল হবে। এ ঘরটাই আগে দেখা যাক।’ সে আইভির ঘরের দরজার দিকে যাবার আগে, পিসিমাকে সেই ঘরে ঢুকতে ইশারা করল।
পিসিমা বাইরের দরজার সামনে, হাতে রুমাল ঢাকা লোকটার দিকে এক বার দেখে, বিজিতের শোবার ঘরে ঢুকলেন। আইভির হাতে তোয়ালে ছিল। ও সেটাই ওর নাইটির ওপরে জড়িয়ে ঘরের ভিতরে একপাশে সরে দাঁড়াল। লোকটি ঘরে ঢুকে বাজপাখির মতো চোখে চারিদিকে এক বার চোখ বুলিয়ে নিল। ওয়াড্রব বা আলমারির পিছনে লুকোবার মতো জায়গা ছিল না। সে খাটের ওপর চোখ বুলিয়ে, ঝটিতি নিচু হয়ে খাটের তলা দেখল। তারপরে দক্ষিণে এগিয়ে গেল। ব্যালকনিতে যাবার দরজা খোলাই ছিল। দ্রুত পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখল। ফিরে এল। পিসিমা তখন আইভির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। লোকটি ফিরে এসে, বাথরুমের ভেজানো দরজা জুতো দিয়ে ঠেলে খুলল। বাথরুমের পুবের ছোট জানালা খোলা ছিল। সে ভিতরে ঢুকে দেখল। পিছনের দরজাটা চটপট খুলে, লোহার স্পাইরাল সিঁড়িটা দেখল। নীচের দিকে, এবং বাড়ির পিছনের অংশটা দেখতে একটু সময় নিল। দরজা বন্ধ করে ফিরে এল, জিজ্ঞেস করল, বাইরের ঘরের ওপাশে বোধ হয় এ রকম শোবার ঘর আর বাথরুম আছে।
আছে। পিসিমা বললেন।
লোকটি আইভির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এ ঘরেই থাকুন। আপনি আমাকে পাশের ঘরটা দেখাবেন চলুন। পিসিমাকে বলল।
পিসিমা এক বার আইভির দিকে সন্ত্রস্ত চোখে তাকালেন। লোকটি তাড়াতাড়ি বলল, কোনও ভয় নেই, আসুন। দেরি করবেন না।
পিসিমা বাইরের ঘরে গেলেন। লোকটা পিছনে। বলে উঠল, পরদার আড়ালে কী আছে, ডান দিকে?
খাবার ঘর, রান্নাঘর। পিসিমা দাঁড়িয়ে বললেন।
লোকটি বাইরের দরজার দিকে, নিজের সঙ্গীর দিকে এক বার দেখে নিল, চলুন, আগে ওটা দেখে আসি৷
পিসিমা ডাইনিং স্পেসের দিকে গিয়ে পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। লোকটিও ঢুকল। খাবার টেবিলের নীচে, ফ্রিজের পাশে ও পিছনে ভাল করে দেখে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। উত্তর দিকে জানালা খোলা ছিল। গ্যাস সিলিন্ডার, উনোন, রান্নার বাসনপত্র, মিটসেফ, তরকারি কাটার টেবিল, সব কিছুর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে এল, পাশের শোবার ঘরে যাব। পিসিমা তাঁর নিজের ঘরে ঢুকলেন। লোকটি একই রকমভাবে, খুব দ্রুত, ঘর, ব্যালকনি, বাথরুম, সবই প্রায় তন্ন তন্ন করে দেখে, বাইরের ঘরে ফিরে এল। পিসিমা প্রথম ভয়ের ধাক্কা অনেকটা সামলে উঠেছিলেন। তিনিও বাইরের ঘরে এলেন। আইভি ওর ঘরের দরজায় একটা পাল্লা দিয়ে শরীরকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। ওর চোখে। এখনও আতঙ্ক, অথচ একটা তীক্ষ্ণ কৌতূহলও রয়েছে। লোকটি হল ঘরের চারদিকে, শিকারে বাজের মতো চোখ বুলিয়ে, পিসিমার দিকে তাকাল। একই রকম মোটা নিচু স্বরে দ্রুত বলল, আমি কলিং বেল পুশ করবার পরে, দরজা খুলতে আপনারা সময় নিয়েছিলেন প্রায় এক মিনিটের ওপর। আভা তার মধ্যেই বাথরুমের পেছনের দরজা দিয়ে নীচে চলে গেছে কি না, সে সন্দেহটা থেকেই গেল। নীচে মোটর পার্টসের ডিলার মিঃ কাপুর থাকেন। তাঁর দরজায় গিয়ে আমি হামলা করতে চাই না। অবিশ্যি। সেখানে গেলেও, খবরটা কোনও রকমেই কাগজে প্রচার হবে না। তবু আমি তা করতে চাই না। সত্যি কথাটা আপনাদের মুখ থেকেই শুনতে চাই। তার চোখ এক বার আইভিকেও ছুঁয়ে এল।
সত্যি কথা তো আমি আগেই বলেছি। পিসিমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলেও যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললেন, আভা এখানে আসেনি। আভা অনেক দিনই আমাদের এখানে আসে না।
লোকটির ছোট চোখের দৃষ্টি কঠিন, মুখ শক্ত, অনেক দিনের সঙ্গে আর এখনকার অবস্থার অনেক তফাত। আমার কাছে যা খবর ছিল, তা একেবারে বাজে বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। যাই হোক, আমি আপাতত যাচ্ছি। কলকাতার মতো শহরে আভাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন হবে না। সে দরজার দিকে পা বাড়াল।
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’ পিসিমা বলে উঠলেন। লোকটি ফিরে দাঁড়িয়ে, কোনও রকম ভণিতা না করেই বলল, ‘কেন আভাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, এই কথা জিজ্ঞেস করবেন তো? সরি, সে কথা বলতে পারব না। আর একটা কথা। আমার এভাবে আপনাদের বাড়িতে ঢোকা নিয়ে, কী ব্যবস্থা আপনারা নেবেন, সেটা আপনারাই ভেবে দেখবেন। আমি আমার কথা রেখেছি, আপনাদের ওপর কোনও জুলুম করিনি।’ সে পিছন ফিরে সোজা দরজার দিকে চলে গেল।
পিসিমাও দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। লোকটা দরজা টেনে বন্ধ করতে গিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। দরজাটা খোলা রেখে সিঁড়িতে পা বাড়াল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার আগে নেমে গেল। পিসিমা দরজার কাছে গিয়ে, বাইরে মুখ বাড়ালেন। দেখলেন, আলি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে, বাজারের থলি হাতে উঠে আসছে। তার অবাক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি লোক দুটির দিকে। তারা আলির দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখল না। সিঁড়ির বাঁ দিকে দ্রুত নেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য। আবার তাদের নীচের বারান্দায় দেখা গেল। রোগা লম্বা লোকটি কাপুরদের দরজার দিকে এক বার দেখল। এক বার যেন থমকে দাঁড়াবার উপক্রম করল। পিসিমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। কিন্তু লোকটা দাঁড়াল না। সঙ্গীকে নিয়ে দ্রুত বারান্দার বাইরে চলে গেল। আলি দরজার কাছে উঠে এসে পিসিমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সাহেবরা কি আমাদের কুঠিতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ। পিসিমা দরজার কাছ থেকে সরে, পিছন ফিরলেন। দেখলেন, আইভি একটা সোফায় এলিয়ে পড়ে আছে। তোয়ালে কোলের ওপর। দু হাতে মুখ চাপা দেওয়া। বুক দ্রুত ওঠা-নামা করছে। পিসিমা। কাছে গিয়ে ডাকলেন, আইভি।
আইভি মুখ থেকে হাত সরাল। ওর চোখে আতঙ্ক, কিন্তু জলে ভেজা। প্রায় চুপিচুপি স্বরে বলল, মা, লোকটা খুনি! ও যখন আমার ঘরের খাটের নীচে উপুড় হয়ে দেখছিল, তখন ওর কোটের ফাঁক দিয়ে, কাঁধের সঙ্গে ফিতেয় ঝোলানো রিভলবার আমি দেখতে পেয়েছি।’
বাইরে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল, তার হাতেও রুমাল চাপা দেওয়া পিস্তল ছিল। পিসিমা অনেকটা ধাতস্থ স্বরে বললেন, ‘কী ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।’
আলির চোখে অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা। ও দরজাটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু কিছু না বলে, পিসিমা আর আইভিকে দেখে, ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। পিসিমা বললেন, ওরা ডাকাতি করতে আসেনি, কিন্তু দিনে-দুপুরে রিভলবার নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকা, সাংঘাতিক! আভাকে কি ওরা খুন করতে চায় নাকি? তা হলে তো আমাদের বিপদে পড়তে হবে।
‘আমিও সেটাই ভাবছি৷’ পিসিমা একটা সোফায় বসলেন। তাঁর চোখে উদ্বেগ, কপালে চিন্তার গাঢ় রেখা, লোকটা কেবল খবর রাখে না, আভা যে কাপুরদের কাছে গেছে, সেটাও আন্দাজ করেছে। তার মানে, আবার যখন তখনই আসতে পারে। ওরা নীচের বারান্দায় যখন নামল, আমি ভাবলাম, কাপুরদের ঘরে হয়তো ঢুকবে। ঢোকেনি। মিসেস কাপুরকে আমি বলে রেখেছিলাম, কোনও কারণে আভাকে ওঁদের বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য থাকতে দিতে হতে পারে। ও বাথরুমের পেছনের দরজায় তিন বার নক করা শুনলে, উনি যেন দরজা খুলে দেন। ওঁরাও নিশ্চয় ব্যাপারটা নীচে থেকে লক্ষ করেছেন। আভাকে এখনই ওপরে ডেকে নিয়ে আসা ঠিক হবে না। ওরা আশেপাশেই কোথাও ওত পেতে আছে।
আইভি উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, তা তো নিশ্চয়ই আছে। আমি কী করব, বুঝতে পারছি না। এদিকে অফিসে বেরোতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তোমাকে ওরা কিছু করবে না। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে অফিসে বেরিয়ে যাও। পিসিমা বললেন, অফিসে গিয়ে, বিজিতকে টেলিফোন করে সব জানাও। এদিকে কী করা যায়, আমি দেখছি। অবিশ্যি কী করার আছে, জানি না। আভার কপালে যা আছে, তাই হবে।
আইভি তোয়ালে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোখে মুখে এখনও উৎকণ্ঠা, বলল, ‘জানি আমাকে কিছু করবে না, করলে তা এখানেই করত। তবু আমার ভয় করছে। মনে হচ্ছে, একলা বাথরুমে গিয়ে চান করতে পারব না।’
আমি তো আছি। তোমার ভয় নেই। পিসিমা বললেন, বরং দেরি না করে, তোমার বেরিয়ে পড়াই উচিত। বিজিতকে খবরটা পৌঁছানো জরুরি।
আইভি একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, তাই যাই। পি
সিমা খানিকক্ষণ বসে রইলেন। তারপরে উঠে, ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে আগে গেলেন রান্নাঘরে। আলি টেবিলের ওপর, থলি থেকে বাজার বের করে রাখছিল। আনাজপাতি, মাংস, ডিম আর কিছু মশলার প্যাকেট। জিজ্ঞেস করলেন, আলি, যে লোক দুটোকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখলে, এদের আগে কখনও দেখেছ?
আলি একটু ভেবে মাথা নেড়ে বলল, না তো মাজি। কেন, সাহেবরা কি চেনা লোক নয়?
পিসিমা বললেন, ‘না।’
‘তবে সাহেবরা কী জন্যে এসেছিল?’ আলি অবাক মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
পিসিমা বললেন, ওরা বিজিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু ওদের তো জানা উচিত, বিজিত এ সময়ে বাড়ি থাকে না, অফিসে থাকে। তুমি রাস্তায় যখন বেরোবে, একটু খেয়াল রেখো তো, এদের আশেপাশে কোথাও দেখতে পাও কি না?
জরুর দেখব। আনজান তোক কুঠিতে আসা ঠিক নয়। আমি তো কিছু মালুমই করতে পারিনি। আলির দৃষ্টিতে আর গলার স্বরে এখনও বিস্ময়, ওদের অন্দরে ঢুকতে দিলেন কেন?
পিসিমা বললেন, ভদ্রলোক এলে, তাকে দরজা থেকে বিদায় করা যায় না। তা ছাড়া, দু-একটা কথাও বলে গেল। যাই হোক, তুমি ডালটা চাপিয়ে দাও। রান্নাটা আজ তোমাকেই করতে হবে, আমি একটু ব্যস্ত আছি।
আলির চোখে বিস্মিত জিজ্ঞাসা, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। আসলে সে অনুমান করতে পারছিল, কিছু একটা ঘটেছে, যা তাকে জানানো হচ্ছিল না। সে বলল, ঠিক আছে।
পিসিমা আলির মনোভাব বুঝতে পারছিলেন। বুঝেও, ওকে কিছু বলার উপায় ছিল না। এবং, অতঃপর আলির মনে প্রশ্ন জাগবে, আভা আর তার ছেলে কোথায়। কারণ, সে আশা করবে, আভা রান্নার কাজে সাহায্য করতে আসবে। আভা আসার পর থেকে, রোজই পিসিমাকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘরে আসে। কিছু না হোক, ববের কান্নাও সে শুনতে পাবে না। তখন সে আরও বেশি কৌতূহলিত হয়ে উঠবে। উঠলেও কিছু করার নেই। আলি যদি মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করেই, তবে জবাব দেওয়া যাবে, আভা একটু বাইরে গিয়েছে। আভা যে এ বাড়িতে এসে লুকিয়ে আছে, তা সে জানে না। না জানলেও, তার মনে নিশ্চয়ই কোনও রকম সন্দেহ বিধে আছে। আত্মীয় বাড়িতে, থাকবার জন্য কেউ বেড়াতে এলে, এক কাপড়ে, ছেলে কোলে আসে না। সব কিছুরই একটা স্বাভাবিক রীতি পদ্ধতি আছে। আভার জীবনের বিগত কয়েক মাসের ঘটনা আলির জার্নবার কথা না। কারণ সে কোনও ভাষাই পড়তে পারে না, খবরের কাগজ পড়ারও কোনও প্রশ্ন নেই। হতে পারে আলি ধরে নিয়েছে, আভা নিজের বাড়িতে ঝগড়া করে চলে এসেছে। আভা তার অচেনা না। আগে অনেক বারই দেখেছে। তা ছাড়া আলিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু আছে বলে মনে হয় না। সাকিনাকে বিয়ে করার আগে থেকে, প্রায় দশ বছর ধরে, বিশ্বস্ততার সঙ্গেই কাজ করছে।
পিসিমা বসবার ঘরে এলেন। আইভির ঘরের দরজা খোলা। ও স্নান করে বেরিয়েছে। জামাকাপড় পরে তৈরি হচ্ছে। তিনি আইভির ঘরেই ঢুকলেন। শায়া আর ব্রা ওর গায়ে। ফ্যান খুলে দিয়ে মাথার চুল মুছছে। ঘাড়ে গলায় বুকে পাউডার ছড়ানো। পিসিমা বললেন, আমি এদিকের ব্যালকনিতে এক বার যাচ্ছি।
পিসিমা অনুমতি নেবার জন্যে কথাটা বললেন না। বা জবাবের প্রত্যাশাও তাঁর নেই। আইভি পাছে নতুন কোনও দুর্ঘটনার কথা ভেবে ভয় পায়, সেজন্যই বললেন। আইভির চোখে মুখে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ চেপে আছে। পাখার নীচে খাটে বসে চুল মুছতে মুছতে এক বার শাশুড়িকে দেখল। নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, অফিসের গাড়িতে আজ আমার যাওয়া হবে না। পিসিমা ব্যালকনিতে এলেন। রেলিং নেই, কোমর অবধি দেওয়াল। মাঝখানে থাম। থামের দু পাশে, খড়খড়ি পাল্লা দেওয়া দুটো বড় জানালা। জানালার ওপরটা আর্চ করা ভিতর থেকে ছিটকিনি এঁটে বন্ধ করা। একটা ছোট গোল টেবিল ঘিরে, গোটা কয়েক লোহার ফ্রেমের সঙ্গে প্লাস্টিকের ফিতে বোনা চেয়ার। পিসিমা একটা জানলার খড়খড়ি আস্তে ফাঁক করলেন। ফাল্গুনের রৌদ্রালোকিত রাস্তা। পাড়ার চেনা লোকেরাই কয়েকজন যাতায়াত করছে। কেউ ব্যস্ত, কারোর গতি নিতান্তই মন্থর। কালো বোরখা ঢাকা একটি স্ত্রীলোক ট্রাম রাস্তার দিকে চলেছে স্যান্ডেলে খচখচ শব্দ তুলে। গলির আরও ভিতরের বাসিন্দা, বৃদ্ধা ভোটিয়া মহিলাটি বাজারের থলি হাতে ফিরছেন। উলটো দিকের বাড়িটা অনেক দিনের পুরনো, অনেকটা এ বাড়ির পুব দিকে মিলারদের বাড়ির মতোই। কিন্তু এখন অনেক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গেটের বদলে যাওয়া আসার ছোট দরজাটা সবসময়েই প্রায় বন্ধ থাকে। বাড়িটার মালিক এখন একজন মুসলমান। এ পাড়ার ভিতরে অধিকাংশ বাড়িই পুরনো। পুরনো আমলের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর পাঁচমিশেলি খ্রিস্টানদের পাড়া। বাড়িগুলোর ভিতরে ভিতরে পায়রার খোপের মতো অনেক জাতির বাস। চিনা, তিব্বতি, ভোটিয়া, নেপালি, গোয়ানিজ। মুসলমানও আছে, কিন্তু তারা প্রায় সকলের ছোঁয়া। বাঁচিয়ে চলে। হিন্দু বাঙালির সংখ্যা খুব কম। অবিশ্যি আজকাল বাঙালিদেরও এ পাড়ার পুরনো বাড়িগুলোর দিকে চোখ পড়েছে, বিশেষ করে নেবার জন্যে। জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে বাঁ দিকের রাস্তার খানিকটা পর্যন্ত দেখা যায়। পিসিমার এটা বৃথা আশা, সেই লোক দুটোকে তিনি দেখতে পাবেন। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, নোক দুটো কাছে পিঠেই কোথাও আছে। লক্ষ রাখছে এ বাড়ির দিকে। এমন হতে পারে, ওরা এ পাড়ার মধ্যেই কোনও বাড়িতে ঢুকে বসে আছে? অসম্ভব না। ভিতরে অসংখ্য চোরা গলি। গোটা কয়েক ছোটখাটো চিনা আর তিব্বতি কিচেন আছে। মেয়েরাই কিচেনগুলো চালায়। খদ্দেরও ভালই জোটে। অনেক পরিবারই রান্না করে না, ওই সব কিচেনেই খায়। বিজিতও মাঝে মাঝে মুখ বদলাবার জন্য ওই কিচেনগুলো থেকে খাবার আনে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের নেশা আর জুয়ার আড্ডা আছে। পিসিমা শুনেছেন, দেখেননি কোনও দিন। তবু, কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায়, এ সব পাড়ায় গোলমাল হাঙ্গামা কম। কারণ, রাজনৈতিক দলাদলি, মারামারি, বোমবাজি, এ সব পাড়ায় নেই। তথাকথিত সমাজবিরোধী গুণ্ডারাও এ সব পাড়ায় হামলা করে না। করে কোনও লাভ নেই, প্রাপ্তির আশা কম। তবু মাঝে মধ্যে হাঙ্গামা হয়। সে সব হাঙ্গামা জুয়া আর মেয়েঘটিত। কিছু বেপরোয়া বাজে লোক সবখানেই থাকে। অনেক মেয়ে পুরুষই চাকরি বাকরি করে। আবার কিছু অলস পুরুষ, আর বাজে মেয়েরাও আছে। যে সব মেয়েরা নানাভাবে দেহ বিক্রি করে। তবে নিজেদের এলাকার বাইরে, কলকাতার হোটেল বার রেস্তোরাঁর পাড়া বা ঘোড়দৌড়ের মাঠেই তাদের গতিবিধি, রোজগারের ঠাঁই আর ধান্দা।
অচেনা লোকের পক্ষে এ পাড়ায় ঢুকে, অলিগলিতে ঘোরাফেরা করা অসুবিধাজনক। কিচেনে ঢুকে খেতে পারে। জুয়ার আড্ডায় ঢুকতে পারবে না। অবিশ্যি নেশার আড্ডাগুলিতে ঢুকতে পারে। কিন্তু সেই লোক দুটোর পক্ষে জুয়া আর নেশা করে সময় কাটাবার উপায় নেই। তাদের কাজ, এ বাড়ির ওপরে লক্ষ রাখা। তবে, ওদের চেনাশোনা কেউ এ পাড়ায় নেই, এটা ধরে নেওয়া চলে না। ওরা। কোথাও আস্তানা নিতেও পারে। লোকটা তো পরিষ্কারই বলল, আভা এ বাড়িতে এসেছে, এ খবর তারা জানে। এমন ভাবে জানে, যা ওরা অবিশ্বাস করতে পারে না। সন্দেহ নেই, ঠিক খবরই ওরা পেয়েছে। অথচ পাঁচ দিন আগে, রাত্রি ন’টা নাগাদ আভা যখন ববকে নিয়ে এসেছিল, তখন ও যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছিল। আভার বিশ্বাস ছিল, ওর এ বাড়িতে আসার খবর কেউ জানতে পারবে না। বরং ওর। ভয় আর দুশ্চিন্তা ছিল, এ বাড়িতে ও আশ্রয় পাবে কি না। আভা সকলের সামনে প্রায় কেঁদে পড়েছিল, বলেছিল, আমাকে আর ববকে তোমরা বাঁচতে দাও। আমাদের দুজনকে মেরে ফেলবার চেষ্টা করা। হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, আমি অন্য কোথাও চলে যাবার চেষ্টা করব। এখন আমি আমার এক বন্ধুর। বাড়ি থেকে আসছি। ওদের স্বামী স্ত্রীর ভাবভঙ্গি আমার ভাল লাগেনি। বিশেষ করে বাড়ির বুড়ো কর্তাটি আমার ও বাড়িতে আশ্রয় নেওয়াটা মোটেই পছন্দ করেনি। ওদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কারণ, আমার বন্ধু নীলিমা বলেছিল, ওরা যদি তোর পেছনে লেগে থাকে, এ কলকাতা শহরে তুই। কোথায় লুকিয়ে বাঁচবি? ওরা কলকাতার নামকরা ফ্যামিলি, বড়লোক আর ওদের অসম্ভব পাওয়ার। পুলিশ, গভর্নমেন্ট থেকে শুরু করে এমন কোনও উঁচু মহল নেই, যেখানে ওদের ক্ষমতা খাটবে না। সবখানেই ওরা কলকাটি নাড়তে পারে। ওরা যদি জানতে পারে, আমরা তোকে শেলটার দিয়েছি, তা হলে আমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। নীলিমা একেবারে ভুল বলেছে, তা না। কিন্তু দু দিন থেকেই আমার মনে হল, ভয়ের থেকেও ওদের ভাবভঙ্গি যেন অন্য রকম। সন্দেহ হচ্ছিল, ওরাই হয়তো জানিয়ে দেবে, আমি ওদের বাড়ি আছি। সেই জন্য ওদের না বলে, পালিয়ে এসেছি। জামাকাপড়ের একটা ব্যাগ ছিল, সেটাও আনতে পারিনি। আমার কাছে এই হাতব্যাগে সামান্য কয়েকটা টাকা ছাড়া কিছু নেই। অনেক দিন এ বাড়িতে আমার যাওয়া-আসা নেই, জানি না, তোমরা আমাকে কী ভাবে নেবে। কিন্তু ভেবে দেখলাম, এটাই আমার একমাত্র সুযোগ, এ বাড়ির সঙ্গে আমার অনেক দিন যোগাযোগ নেই। ওরা সন্দেহও করতে পারবে না।
আভা কথাগুলো একেবারে মিথ্যে বলেনি। এ বাড়ির সঙ্গে আভা বা ওর মা ভাই বোনেরা ইচ্ছা করেই যোগাযোগ রাখত না। আভার কথা আলাদা। ও স্যার জে সি মজুমদারের একমাত্র পুত্রবধূ। অগাধ ঐশ্বর্য আর বিলাসবহুল জীবনে, ওর চলাফেরা মেলামেশার সমাজই ছিল আলাদা। সারা দেশকে চমকে দেওয়া সেই অভাবনীয় দুর্ঘটনা মাত্র কিছুকাল আগের। যার পরিণামে ও এখন ছেলেকে নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিজিত আভাকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিল। পিসিমাও বিজিতের মুখ থেকে কথাটা শুনতে চেয়েছিলেন, এবং রাজি হয়েছিলেন। আইভিও রাজি হয়েছিল। রাজি হওয়ার পিছনে একটা বড় যুক্তি ও বিশ্বাস ছিল, আভার এ বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কথাটা কারোর চিন্তায় আসবে না। কিন্তু আভা আসার পরের দিনই সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। বিজিত অফিসে যাওয়ার সময়েই সেই লোকটিকে এ বাড়ির দিকে লক্ষ করতে দেখেছিল। যে লোকটা আজ একটু আগেই ঘরের ভিতরে ঢুকেছিল। কী করে, কার কাছ থেকে ওরা সংবাদ পেয়েছে সে রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব না। আভার পক্ষেও অসম্ভব।
লোকটার চেহারা মনে করে, পিসিমার বুকের মধ্যে আবার কেঁপে উঠল। কী ভয়ংকর বেপরোয়া, দুঃসাহসী, অথচ কথাবার্তা শান্ত, আর ভাবভঙ্গি নির্বিকার। আইভি লোকটার কোটের ভিতরে রিভলভার দেখতে পেয়েছে। দরজায় দাঁড়ানো লোকটার হাতেও রিভলভার ছিল। অসম্ভব! পিসিমা মনে মনে বলে উঠলেন, আভাকে এ বাড়িতে রাখা অসম্ভব। রাখার কোনও প্রশ্নই নেই। ওরা নিজেরাই আবার আসবে। হয় তো আজই, একটু পরেই আবার আসবে। লোকটা তো পরিষ্কার বলেই গেল, হয়তো বাথরুমের পিছনের দরজা দিয়ে, আভা নীচে কাউরদের ঘরে চলে গিয়েছে। কী ভয়ংকর। একেবারে অব্যর্থ অনুমান। ওরা নিশ্চয়ই আবার আসবে। আর নীচের ভাড়াটে কাউরদের ঘরেই হয়তো ঢুকবে। লোকটা তো বলেই গেল, মিঃ কাপুর ব্যাপারটা প্রচার করতে চাইলেও, কোনও খবরের কাগজে তা বেরোবে না।
পিসিমার অস্থিরতা বাড়তে লাগল। তিনি দেখলেন, সাকিনা ভোলা উনোনটা ঘরের বাইরে এনে, খুঁটে ভেঙে ভেঙে ঢোকাচ্ছে। উনোন জ্বালিয়ে, রান্না চাপাবে। সাকিনা আর আলি এ বাড়ির কোনও খাবার মুখে নেয় না। শুয়োরের মাংসই তার একমাত্র কারণ। সেটা ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে। ওটা ওদের কাছে নিষিদ্ধ খাদ্য। আলি তো হ্যাম বা ককটেল সসেজ স্পর্শই করতে চায় না। এ সময়েই বাঁ দিক থেকে সেই চেনা হর্নের শব্দটা বেজে উঠল। অনেকটা, সা রে গা, রে গা মা’র মতো হর্ন বাজতে বাজতে, একেবারে এ বাড়িতে ঢুকে এল লাকসারি নীল রঙের ভ্যানটা। আইভি ছুটে এল ব্যালকনিতে। এখনও ওর গায়ে শায়া আর ব্রা। চুল আঁচড়ানো শেষ। মুখের প্রসাধন বাকি। ভাঁজ খোলা শাড়ি গলায়। জড়ানো। পিসিমা জানালার কাছ থেকে সরে গেলেন। আইভি ছিটকিনি নামিয়ে জানালার পাল্লা খুলে, মুখ বাড়াল। ড্রাইভারকে বাংলায় বলল, আমি একটু আটকে গেছি, আধ ঘণ্টা দেরি হবে। ট্যাকসি নিয়ে চলে যাব।
ইতিমধ্যে গাড়ির জানালা দিয়ে দু-তিনটি মেয়ের জিজ্ঞাসু কৌতূহলিত মুখ বেরিয়ে এল। তাকাল ওপরের দিকে। তাদেরই মধ্যে একজনের উদ্দেশে আইভি ইংরেজিতে বলল, ন্যানসি বসকে বোলো, আমার আধ ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরি হবে। হঠাৎ একটু আটকে গেছি।
ভ্যানের জানালা দিয়ে একটি মেয়ে হাত ইশারা করল। ড্রাইভার ইতিমধ্যে ভ্যানটা ব্যাক করতে আরম্ভ করেছে। রোজই তাই করে। আইভিকে তুলে নিয়ে, ব্যাক করে আবার ট্রাম রাস্তার দিকে চলে যায়। ভ্যান অদৃশ্য হবার আগেই আইভি ছুটে ঘরের মধ্যে চলে গেল। পিসিমা খোলা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভ্যানের ভিতর পাঁচ-ছ’জন মেয়ে আর পুরুষ। এখনও কয়েকজন ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। ভ্যানটা ট্রাম রাস্তার দিকে চলে গেল। সাকিনা উনোনটা তুলে নিয়ে সরে গিয়েছিল। আবার এগিয়ে এসে উনোন রেখে বসল। মুখ তুলে তাকাল জানালার দিকে। পিসিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ওর চোখে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা। কারণটা আইভির অফিসের গাড়িতে না যাওয়া। ও বোধ হয় সেই লোক দুটোকে ওপরে উঠতে দেখেনি। কিছুই জানে না। আলির কাছ থেকে শুনতে পাবে।
পিসিমা এ বার জানালায় মুখ বাড়িয়ে, রাস্তার ডাইনে বাঁয়ে, যতটা দেখা যায়, দেখলেন। না, লোক। দুটোকে দেখা যাচ্ছে না। না যাক, কিন্তু ওরা কাছে পিঠে আছে। এবং ওরা আবার আসবেই। এটা তাঁর বদ্ধমূল ধারণা। তাঁর বা এ বাড়ির কারোর কোনও ক্ষতিই ওরা করবে না। সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত। অথচ চোখের সামনে আভা আর ববকে ওরা মেরে ফেলবে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ভয়ে। বুকটা শুকিয়ে যাচ্ছে, অস্থির হয়ে পড়ছেন। এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। তিনি জানালার পাল্লা টেনে বন্ধ করে দিয়ে, ঘরের মধ্যে ফিরে এলেন। আইভির শাড়ি জামা পরা শেষ। এখন লিপস্টিক বোলাচ্ছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এর পরে আই শ্যাডো লাগানো আছে।
আমি বাথরুমের পেছন দিয়ে এক বার নীচে যাচ্ছি। পিসিমা বললেন, ‘আমাদের জন্যে কাপুরদের কোনও রকম বিপদে পড়তে হয়, সেটা ঠিক নয়। আভাকেও কথাটা বলা দরকার। আমার ধারণা, ওরা নির্ঘাত আবার আসবে।’
আইভির হাতটা ঠোঁটের ওপর লিপস্টিক সহ থেমে গেল। আতঙ্কিত চোখে পিসিমার দিকে তাকাল। প্রায় চুপিচুপি স্বরে উচ্চারণ করল, আবার আসবে? তা হলে?
‘তা হলে কী হবে, জানি না। তুমি বেরিয়ে পড়ো। আভা ওপরে উঠে আসতে পারে, তার আগেই ওকে আমার কথাটা বলা দরকার। বাথরুমের দরজাটা আমি এক দিক থেকে বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছি।’ পিসিমা বাথরুমের ভিতরে ঢুকে গেলেন। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে, লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেন। কাপুরদের বাথরুমের দরজায় তিন বার ঠুকঠুক শব্দ করলেন।
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। মিসেস কাপুর। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। খাড়া নাক, বড় চোখ, লম্বা মুখ, মাথার সামনের চুলে কিছু পাক ধরেছে। কিন্তু সব মিলিয়ে দেখতে মোটেই সুশ্রী না। খুব সাধারণ কাপড়ের সালোয়ার কামিজ পরে আছে। চোখে উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা, হিন্দিতে বলল, আসুন।
পিসিমা বাথরুমে ঢুকতেই, মিসেস কাপুর দরজা বন্ধ করে দিল। পিসিমা অন্য দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মিঃ কাপুর একটা চেয়ারে বসে ছিল। দোহারা লম্বা চেহারা। মাঝারি ফরসা। মোটা ভুরুর নীচে তীক্ষ্ণ চোখের কোণে ভাঁজ। মাথার চুল কাঁচা-পাকা। টিয়া ঠোঁটের মতো নাকের নীচে গোঁফ জোড়া কুচকুচে কালো। ট্রাউজারের ওপর শার্টের গলায় নেকটাই বাঁধা। পিসিমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। আভা মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে ববকে কোলে নিয়ে বসে ছিল। ও আগেই উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখ সাদা, চোখের কোলে যেন হঠাৎ কেউ গাঢ় কালি লেপে দিয়েছে। চোখে উদভ্রান্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। কাপুরদের এক মেয়ে কাছেই দাঁড়িয়ে। বয়স বছর কুড়ি।
মিঃ কাপুর ইংরেজিতে বলল, ওরা চলে গেছে, আমি দেখেছি। মিসেস মজুমদারের (আভা) কাছে আমি কিছু কথাও ইতিমধ্যে শুনেছি।
কিন্তু ওরা আবার যে কোনও মুহূর্তেই আসতে পারে।পিসিমা ইংরেজিতে বললেন, ‘হয়তো এক্ষুনি আসতে পারে। আমাকে বলেই গেছে, ওদের ধারণা, আভা বাথরুমের পিছনের দরজা দিয়ে নীচে আপনাদের এখানে পালিয়ে এসেছে। আমি নিশ্চিত ওরা আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। ওদের কাছে রিভলবার আছে।‘
মিঃ কাপুরের গোঁফ আর ধূসর চুলের নীচে মোটা ভুরু জোড়া কুঁকড়ে উঠে, মুখটার আদল যেন বদলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার মুখ হা হয়ে রইল। স্ত্রী আর কন্যার দিকে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাল। পিসিমা থামলেন না, দ্রুত সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিলেন। শুনতে শুনতে মিঃ কাপুর মুখ বন্ধ করে ঢোক গিলল। কিন্তু তার উৎকণ্ঠিত মুখে গভীর চিন্তার ছায়া পড়ল। কপালের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠল। বোঝা গেল, ভয় পেলেও, সে সমূহ বিপদ থেকে নিষ্কৃতির কথা কিছু ভাবছে।
মিসেস কাপুর ইংরেজি বোঝে না। কিন্তু ‘রিভলবার’ কথাটা বুঝেছে, এবং ভয়ফ্যাকাশে মুখে সকলের দিকে দেখছে। কেবল মেয়েটিই ইংরেজিতে বলে উঠল, কী ভয়ংকর। তা হলে এখন কী হবে?
আভা ইতিমধ্যে সরে গিয়ে দেওয়াল চেপে দাঁড়িয়েছে। কাপুরদের বসবার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। কিন্তু শোবার ঘরগুলোর আসবাবপত্র সামান্য। দুটো নেয়ারের খাঁটিয়া, তার ওপরে বেডকভারের নীচে ময়লা তোশকের উঁকি, এলোমেলো ছড়ানো বালিশ। এদিকে ওদিকে বিক্ষিপ্ত কয়েকটা চেয়ার। সামান্য দামের একটা ড্রেসিং টেবল। একটাই মাত্র স্টিলের বড় আলমারি এ ঘরে আছে। অন্য শোবার ঘরটাও প্রায় একই রকম।
মিঃ কাপুর মোটা খসখসে স্বরে বলল, খবরের কাগজে যখন ঘটনাটা পড়েছিলাম, তখন জানতাম না, মিসেস মজুমদার আপনার ভাইঝি। এখন জানলাম। ওর দুর্দশার খবর পড়ে, খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু কোর্টের রায়ের পরে, ভেবেছিলাম, ওখানেই সব শেষ হয়ে গেল। এখন দেখছি, মোটেই তা নয়। ঘটনা আবার অন্য দিকে মোড় নিয়েছে, আর সেটা আরও মারাত্মক। তবে মিসেস মজুমদার যে বললেন, ‘গত পাঁচ দিন আগে তিনি যখন তাঁর বন্ধুর বাড়ি থেকে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন তা বোধ হয় ঠিক নয়। ওঁকে নিশ্চয়ই কেউ অনুসরণ করেছিল।‘
‘সেটা আমি ঠিক জানিনে।‘ আভা শুকনো ভাঙা স্বরে ইংরেজিতে বলল, ‘আমি একটা ট্রামে উঠে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম এসপ্লানেডের ট্রামেই উঠেছি। কিন্তু এলিয়টের মোড়ে এসে দেখলাম, ট্রামটা হাওড়ার। সেখানে নেমে আমি রিকশায় করে এ বাড়িতে এসেছিলাম।‘
মিঃ কাপুর ঘাড় ফিরিয়ে এক বার দক্ষিণের বন্ধ দরজার দিকে দেখল। বলল, যাই হোক, এটা নিয়ে এখন গবেষণা করে কোনও লাভ নেই। হয়তো আপনার বন্ধু নীলিমাই এ রকম একটা আন্দাজ দিয়েছে, আপনি অতঃপর এ বাড়িতেই আসতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে মিসেস দত্ত। সে পিসিমার দিকে তাকাল, এ বাড়ি থেকে, সামনের গেট দিয়ে ছাড়া বেরোবার কোনও রাস্তা নেই। আর ওরা নিশ্চয় সে দিকেই কোথাও অপেক্ষা করছে।
ঠিক তাই। পিসিমা বললেন, ‘আমার ধারণা, আপনি বেরিয়ে গেলেই, ওরা আবার আসবে। ওরা আপনাকে এড়াতে চাইছে–মানে এ রকম হতে পারে। আর আপনি না বেরোলে, ওরা আপনার সামনেই আসবে, ওদের কোনও ভয়ডর নেই।’
মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকাল, বুঝেছি। আমি কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, আপনার ছেলেকে ডেকে একটা কথা বলব। কথাটা হল, আপনাদের বাড়ির পেছন দিকে, মিলারদের বাড়ির পাঁচিলের একটা জায়গা অনেকটা ধসে ভেঙে পড়েছে। দু-এক বার বাচ্চা ছেলেদের আমি ও দিক দিয়ে অনায়াসে ঢুকতে দেখেছি। ওখান দিয়ে চোরও আসতে পারে, সেই ভেবেই আমি মেরামতের কথা বলব ভেবেছিলাম। এখন মিসেস মজুমদার একমাত্র সেখান দিয়েই, মিলারদের বাড়িতে চলে যেতে পারেন। ও বাড়িতে, পেছনের এক কামরায়, আমার চেনা একজন থাকে, সূরয সিং আর তার বউ। তবে হাবিবের কাজের লোকেরা দেখে ফেলতে পারে আবার নাও পারে, কারণ পেছনের দিকটা থেকে, মিলারদের দিকটা সামান্যই দেখা যায়।
আমি এখুনি যাচ্ছি। আভা ববকে বুকে চেপে বাথরুমের দরজার দিকে পা বাড়াল।
মিঃ কাপুর হাত তুলে আভাকে থামালেন, এক মিনিট। আমার মনে হয় এর পরে ওরা এ বাড়ি তল্লাশ করে মিসেস মজুমদারের পাত্তা না পেয়ে, হতাশ হবে। তবে একেবারে আশা নাও ছাড়তে পারে। তার মধ্যে আমরা ভাববার অবকাশ পাব, মিসেস মজুমদারকে কোথায় সরানো যায়। আমার মেয়েরা বীণা আর লীনা প্রায় রোজই সুরযের বাড়িতে যায়। বীণা এখনই মিলারদের বাড়িতে চলে যাক। সে তার মেয়ের দিকে ফিরে বলল, কিন্তু খুব সাবধান, তোমার আচরণে যেন মোটেই বোঝা না যায়, তুমি ভয় পেয়েছ। একদম ব্যস্ত হয়ো না, ধীরে সুস্থে চলে যাও। লোক দুটো তোমাকে দেখলেও যেন সন্দেহ করতে না পারে। তুমি না গেলে সূরয সিং বা তার স্ত্রী মিসেস মজুমদারকে দেখে, এলোমেলো কিছু ভেবে, হইচই করে উঠতে পারে। পারবে তো?
বড় মেয়ে বীণা যে সামনে দাঁড়িয়েছিল, যার গায়ে ছিল লুঙির ওপরে ঢোলা গোল গলা চাইনিজ জামা, সে ঘাড় কাত করে জানাল, পারবে। জিজ্ঞেস করল, এখনই যাব কি?
হ্যাঁ, তুমিই আগে যাও। মিঃ কাপুর বলল, খুব সাবধান, আর একদম স্বাভাবিক ভাবে যাবে। সূর্য সিং বোধ হয় বেরিয়ে গেছে, তার স্ত্রীকে বলবে, মিসেস মজুমদার আমাদের পরিচিত। ওঁর স্বামীর সঙ্গে ভারী বিচ্ছিরি ঝগড়া হয়েছে, (পিসিমা আর আভার দিকে তাকিয়ে, হাসবার চেষ্টা করে, চোখ টিপল।) তাই উনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু ওঁর স্বামী যে কোনও সময়ই আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন, তা হলে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে। কারণ ওঁর স্বামী ভারী বদমেজাজি। (আবার আভার দিকে তাকিয়ে-চোখ টিপল)। বলবে, আমরাই পাঠিয়েছি। পরে আমি গিয়ে দেখা করব। এ কথা বললেই যথেষ্ট। ঠিক আছে?
বীণা ঘাড় ঝাঁকাল এবং বাইরের দরজার দিকে পা বাড়াল। মিঃ কাপুর মিসেস কাপুরকে তার মাতৃভাষায় বলল, ‘তুমি গিয়ে বীণাকে দরজা খুলে দাও। তার আগে, জানলার খড়খড়ি তুলে বাইরে এক বার দেখে নিয়ো।’
মা আর মেয়ে বাইরের ঘরে চলে গেল। পিসিমা বললেন, ‘মিঃ কাপুর, আপনি বাঁচালেন। কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব।’
ধন্যবাদের কিছু নেই।মিঃ কাপুর আভার দিকে তাকিয়ে, হাতের ঘড়ি দেখে বলল, ‘মিসেস কাপুর দরজা বন্ধ করে ফিরে এলেই আপনি বেরিয়ে যাবেন। একটু সাবধান থাকবেন, যেন হাবিবের গ্যারেজের লোকদের চোখে ফাঁকি দিতে পারেন। পাঁচিলটা এতটাই ভেঙে গেছে, টপকে যেতে আপনার একটুও কষ্ট হবে না।’
পিসিমার উৎকণ্ঠিত চোখে একরকমের বিস্ময় মুগ্ধতা। আভা যেন মঞ্চ থেকে উইংসের দিকে। তাকিয়ে আছে। বাইরের ঘরে যাবার দরজার দিকে ওর আতঙ্কিত দৃষ্টিটা এমনিই উৎসুক। মিসেস কাউর প্রবেশ করলেই ওর প্রস্থান। কেবল হাতব্যাগটার কথা সে মুহূর্তে মনে পড়ছে। ব্যাগে কুড়ি-বাইশটা টাকা ছাড়াও, একটা চেক বই আর ডট পেন, একটা হিরের আংটি, মুক্তোর দুটো কানের টব রয়েছে। ব্যাঙ্কে টাকা আছে সামান্যই। দেড়-দুশোর বেশি না। হাতব্যাগটা ঢোকানো আছে পিসিমার ঘরের টেবিলের দেরাজে।
মিসেস কাপুর এসে ঘরে ঢুকলেন। বব এ সময়েই কেঁদে উঠে, আভার বুকে মুখ ঘষতে লাগল। আভা ববের মুখ তুলে, ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে, বাথরুমে ঢুকে গেল। মিঃ কাপুর পিসিমাকেও সেদিকে যেতে ইশারা করল, পিসিমা বাথরুমে ঢুকলেন। পিছনে মিঃ কাপুর। আভা বাথরুমের পিছনের দরজা খুলে, ছোট চত্বর পেরিয়ে, ডান দিকে ভাঙা পাঁচিলের কাছে চলে গেল। পিসিমা বেরিয়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। মিঃ কাপুর খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে, আভাকে দেখছে।
আভা পিছন ফিরে এক বার তাকাল। বব ওর গাল চুষছে। ববের খিদে পেয়েছে। মিঃ কাপুর হাত তুলে, বিদায় জানাবার ভঙ্গি করল। আভা পাঁচিল টপকাতে গিয়ে ঝটিতি সরে এল। ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে মিলারদের বাড়ির পেছনে যাবার সরু ফালিতে দুজন লোক কিছু বলতে বলতে বেরিয়ে আসছে। সেই শব্দ মিলিয়ে যাবার পরে, ও আবার উঁকি দিল। গলা বাড়িয়ে ডান দিকে তাকাল। একটা গাড়ির বনেট খোলা হাঁ মুখের ওপর একজন ঝুঁকে আছে। আর একজন নীচে, দুচাকার মাঝখানে নোংরা পলিথিনের ওপর শুয়ে কিছু করছে। এক পাশে একটা খাঁটিয়া। খাঁটিয়ায় বসে একজন কাচের গেলাসে চা খাচ্ছে। তার মুখ পিছনে ফেরানো, কিছু দেখছে। গেটটা আড়ালে। আভা ববকে বাঁ হাতে ধরে, ডান হাতে শাড়ি খানিকটা তুলে ধরল। ভাঙা পাঁচিল টপকে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল না, ওকে কেউ লক্ষ করছে, কি না। সোজা পিছন দিকে চলে গেল।….
তারপরই যা ঘটল, তা এ রকম: পিসিমা যা ভেবেছিলেন, প্রায় ঠিক তাই। তবে একটু অন্য রকম। তিনি ওপরে গিয়ে দেখলেন, আইভি বেরিয়ে গিয়েছে। যাবার আগে আলিকে বলে গিয়েছে। ‘মা বাথরুমে গেছেন। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।’ বুদ্ধিমতীর মতো কথাই সে বলে গিয়েছিল। পিসিমা বাথরুমের দরজা খুলে আইভির ঘরে ঢুকলেন। সেখান থেকে গেলেন ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে রান্নাঘরে। আলি তখন স্টোভ জ্বেলে, ডাল চাপিয়ে দিয়েছে। টেবিলে রাখা আনাজপাতি ছুরি দিয়ে কাটছে। তাঁকে দেখে আলি আইভির কথা জানাল, এবং মাংসের কী তৈরি হবে জানতে চাইল। পিসিমা বললেন, ‘আলু দিয়ে প্লেন মাংসের ঝোল।‘
তারপরই আলি জিজ্ঞেস করল, আভা দিদি আর বব কোথায় গেল? আমি কোনও কামরায় তাদের দেখতে পাইনি।
ওরা একটু বেরিয়েছে। পিসিমা আলির অনুসন্ধিৎসু চোখের দিকে তাকিয়ে, একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আলি, অচেনা কোনও লোক যদি তোমাকে আভা দিদির কথা জিজ্ঞেস করে, তুমি সাফ বলে দেবে, সে এ বাড়িতে আসেইনি।’
আলির চোখে বিস্মিত জিজ্ঞাসা। পিসিমা বললেন, ‘আভা দিদির এখানে আসার কথা আমরা কারোকে জানাতে চাই না। তার ঘরে খুবই অশান্তি চলছে, সে এখানে এসে লুকিয়ে আছে। আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ?’
আলির কালো মুখে, কয়েক দিনের আকাটা খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি। খাটো শক্ত চেহারা। আধ ময়লা পায়জামার ওপরে, বিজিতেরই পুরনো, কিন্তু মোটামুটি ভাল একটা নীল হাফ শার্ট। সে বড় দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আভা দিদির ঘরে যে কিছু একটা হয়েছে, সেটা আমি পয়লা দিন দেখেই বুঝেছিলাম। আমি কারোকেই ও কথা বলব না। ববের জন্মের আগে আমি আভা দিদিকে এ বাড়িতে লাস্ট টাইম দেখেছি। ওনার বড় ছেলে জোজোকে কোথায় রেখে এসেছেন? জোজো দেখতে ববের থেকে খুবসুরত, আমার কাছে খুব আসত।
পিসিমা জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলেন। তাঁর চোখে মুখে অন্যমনস্কতা নেমে এল। এবং মুহূর্ত পরেই একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জোজোকে ওর স্বামীর কাছেই রেখে এসেছে।‘
আলি কিছু বলবার আগে, স্টোভে চাপানো ডালের পাত্রের দিকে তাকাল। তখনই কলিং বেল বেজে উঠল, টুং টাং। আলিই তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে, বাইরে যেতে বলে গেল, ডালে একটু পানি দিতে হবে।
পিসিমার বুক কাঁপছে। প্লাস্টিকের বালতিতে মুখ ঢাকা রান্নার জল। তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকের মগে জল তুলে, ডালের পাত্রে ঢেলে দিলেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে, ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়ালেন। পরদা খুব মোটা না। ঝাপসা ছবি দেখলেন, আলি দরজা খুলে দিল। সেই নীল স্যুট পরা লোকটি একেবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। আলি হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি একেবারে অন্দরে চলে এলেন?
সে আলিকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে, সোজা হলঘরের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে এল। লোকটার মোটা নিচুস্বর স্পষ্ট শোনা গেল, আভা কোথায়?
পিসিমা খোলা দরজায় অন্য লোকটিকে দেখতে পেলেন না। আলি লোকটার পিছনে পিছনে এগিয়ে এল, কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আভা দিদি তো এখানে নেই।
পিসিমা তখনই পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এলেন। লোকটি পিসিমার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ভেরি সরি, আমাকে আবার আসতে হল। আমি আর এক বার আপনার ঘরগুলো দেখব।‘
আলি ভুরু কুঁচকে অবাক চোখে পিসিমার দিকে তাকাল। পিসিমার চোখে এখন আতঙ্কের অভিব্যক্তি তেমন তীব্র না। বরং এ বার যেন খানিকটা বিরক্ত অসহায় অবাক স্বরে বললেন, ‘আমি তো আপনার মতলব, কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা ভদ্রলোকের বাড়ি, পুরুষ কেউ নেই, এ সময় আপনি বাড়ির মধ্যে ঢুকে যা খুশি করবেন, এটা কী রকম কথা!’
‘যা খুশি কিছুই করিনি, আপনি ভালই জানেন।’ লোকটার রেখা-হিজিবিজি মুখ আর ঈগল চোখ কঠিন হয়ে উঠল। গলার স্বর শানিত, আমি মিঃ কাপুরের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢোকবার আগে, আর এক বার দেখে নিতে চাই, আভা ওপরে কোনও ঘরে আছে কি না। হয়তো সে নীচে থেকে এর মধ্যে ওপরে উঠে এসে থাকতে পারে। আপনি কেবল আপনার এই আলিকে বুঝিয়ে দিন, আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা। করলে, ব্যাপারটা খুবই খারাপ হবে। আর ও যেন নীচে যাবার চেষ্টা না করে। সেখানে আমার লোক আছে।’ কথাগুলো খুব দ্রুত বলেই সে আগে ডাইনিং স্পেসের পরদা সরিয়ে ভিতরে চলে গেল।
আলি পিসিমার দিকে অবাক চোখে তাকাল। পিসিমা তাকে চোখের ইশারায় নিরস্ত করলেন। লোকটা পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এসেই, আগে পিসিমার ঘরে ঢুকল। এ বার সে পিসিমাকে সঙ্গে ডাকল না। বাথরুমের এবং পরে দক্ষিণের ব্যালকনির দরজা খোলার ও বন্ধ করার শব্দ শোনা গেল। এক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে এসে, সোজা ঢুকে গেল আইভির ঘরে। সেই একই রকম দরজা খোলা বন্ধের শব্দ ভেসে এল। আবার বেরিয়ে এল। পিসিমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ বারও মিস করলাম।‘
‘আপনি কি ভেবেছিলেন, আমি মিথ্যে কথা বলেছি?’ পিসিমা এ বার একটু সাহসের সঙ্গে জোর দিয়ে বললেন।
লোকটি আলিকে এক বার দেখে বলল, ‘কে মিথ্যে বলেছে, সেটা ঠিক ধরতে পারছি না। তবে আমাদের খবরটা পাকা বলেই মনে করি।’
এই তো পাকা খবরের নমুনা। পিসিমা বললেন, ‘কে আপনাদের এ পাকা খবরটা দিয়েছে, জানতে পারি?’
লোকটির ঈগল চোখে কিঞ্চিৎ সংশয়ের ছায়া, সেটা আপনাকে বলতে পারব না। তবে, আমার খবর পাকা বলেই এখনও মনে করি। জানি না, আবার এখানে আমাকে আসতে হবে কি না।বলেই সে জুতোর রবারের সোলে শব্দ না করে, দ্রুত বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে গেল।
আলি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিসিমা জানেন, লোকটা নীচে মিঃ কাপুরের ঘরে গিয়ে এখন ঢুকবে। নিশ্চিন্ত হবার জন্যেই, তিনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। মুখ বাড়িয়ে সিঁড়ির নীচে দেখলেন। সেই ট্রাউজার আর হাওয়াই শার্ট গায়ে দেওয়া লোকটা মিঃ কাপুরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। উদ্যত ডান হাতের ওপর রুমাল চাপা দেওয়া। তার মুখ রাস্তার দিকে। হাতটা সে দিক থেকে আড়াল করা। কিন্তু হঠাৎ সে মুখ ফিরিয়ে সিঁড়ির ওপর দিকে তাকাল। পিসিমার সঙ্গে চোখাচোখি হল। ভাবলেশহীন চোখ। নির্বিকার মুখ ফিরিয়ে কাপুরদের দরজার বাইরের দিকে তাকাল। পিসিমা বুঝতে পারছেন না, মিঃ কাপুর বেরিয়ে গিয়েছেন কি না। বোধ হয় সে অবকাশ পাননি। তিনি দরজার বাইরে গিয়ে ওপরে দাঁড়ালেন। এখন তিনি অনেকটা সাহস ফিরে পেয়েছেন।
কাপুরদের দরজায় দাঁড়ানো লোকটা আবার পিসিমার দিকে মুখ তুলে এক বার দেখল। আলি দরজার কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি কাপুর সাহেবের ফ্ল্যাটে ঢুকেছে?
পিসিমা আস্তে ঘাড় ঝাঁকালেন। তিন মিনিটের আগেই লোকটি কাপুরদের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। চকিতে এক বার মুখ তুলে সিঁড়ির ওপরে পিসিমাকে দেখল। নিচু স্বরে কিছু বলে, কপালে হাত ঠেকিয়ে, সঙ্গীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। মিঃ কাপুর দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। পিসিমা অবাক হয়ে শুনলেন তাঁদের বাড়ির চত্বর একটা গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট করার শব্দ। গাড়িটা বেরিয়ে গেল। মিঃ কাপুর আরও এগিয়ে গেল। তার পিছনে মিসেস কাপুর আর ছোট মেয়ে লীনা। মিঃ কাপুর সামনের বারান্দা থেকে পিসিমার চোখের আড়ালে চলে গেল। পিসিমা মুখ ফিরিয়ে আলিকে বললেন, ‘তুমি রান্নাঘরে যাও, আমি মিঃ কাপুরের সঙ্গে দেখা করে আসছি।‘ বলেই সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলেন।
মিসেস কাপুরের আর লীনার মুখ ফ্যাকাশে। চোখে আতঙ্ক। মিসেস কাপুর হিন্দিতে বলে উঠলেন, ওরা নিশ্চয়ই ডাকাত!
কিন্তু ওরা আমাদের ঘরের একটা জিনিসেও হাত দেয়নি। লীনা ইংরেজিতে বলল, আর ও বাবার সঙ্গে খুব ভদ্রলোকের মতো ইংরেজিতে কথা বলছিল। তবে ওর চোখ দুটো সাংঘাতিক!
পিসিমা ঘাড় ঝাঁকিয়ে, গেটের দিকে তাকালেন। মিঃ কাপুর ট্রাম রাস্তার দিকে দেখে কয়েক সেকেন্ড পরেই ফিরে এল। সাকিনার উনোন গনগন করে জ্বলছে। সে দিকে ওর খেয়াল নেই। হা করে, ভুরু কুঁচকে, অবাক চোখ মেলে এদিকে তাকিয়ে আছে। মিঃ কাপুর ফিরে এসে বলল, ওরা গাড়ি নিয়ে ট্রাম রাস্তার ডান দিকে চলে গেল। মিলারদের বাড়ির দিকে তাকায়নি। আসুন মিসেস দত্ত, দু মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলি।
চলুন। পিসিমা সকলের সঙ্গে কাপুরদের বসবার ঘরে ঢুকলেন।
মিঃ কাপুর বলল, দরজাটা খোলাই থাক। বসুন মিসেস দত্ত।
কাপুরদের বাইরের হলঘরটা দু ভাগে সাজানো। সামনের দিকে সোফা সেট, সেন্টার টেবিল। মাঝখানে কাঠের পাটাতনের ওপর কিছু টব। সব টবেই নানা জাতীয় ক্যাকটাস, আর কয়েক রকম পাতাবাহারের গাছ। তার ওপারে কিছু বইয়ের র্যাক মেঝে জুড়ে বসবার ফোমের গদি পাতা। তারপরে একটা কাঠের চায়নিজ পার্টিশন। পার্টিশনের আড়ালে, ডাইনিং টেবিল কিছুটা দেখা যায়। মিঃ কাপুরের মুখোমুখি পিসিমা একটা সোফায় বসলেন। মিসেস কাপুর আর লীনা দাঁড়িয়ে রইল। মিঃ কাপুর বলল, লোকটা কথাবার্তায় খুবইন কিন্তু আমার কোনও সন্দেহ নেই, ও একটা পেশাদার অপরাধী। আপনারা চলে যাবার পরে, আমি আমার স্ত্রী আর মেয়েকে কিছু নির্দেশ দিয়ে বেরোবার উদ্যোগ করছিলাম। তখনই শুনলাম, একটা গাড়ি গেট পেরিয়ে গিয়ে, ব্যাক করে আমাদের চত্বরে ঢুকল। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমরা ভেতরের ঘরেই চুপচাপ ছিলাম। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পরে কলিং বেল বাজল। আমি দরজা খুলতেই লম্বা রোগা নীল স্যুট পরা একটা লোক বেশ বেপরোয়া ভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল, আর পরিষ্কার বলল, আমি ডাকাত নই, আপনার কোনও জিনিসে হাত দেব না। কেবল একজনকে নিজের চোখে আপনার ঘরগুলোর মধ্যে খুঁজব। দয়া করে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আর আমি আমার কাজে বাধা দেওয়া একেবারে পছন্দ করি না। আপনি আমার সঙ্গেই থাকুন।
জানি জানি, এ সবই আমার জানা। পিসিমা বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, তারপরে বলুন, নতুন কোনও কথা হল কি না। আপনার এখানে আসবার আগে লোকটা আর এক বার ওপরে সব ঘর খুঁজে দেখে এসেছে।
মিঃ কাপুর বাধা পেয়ে একটু থামল। তারপরে বলল, যাই হোক, প্রত্যেকটা ঘর আর বাথরুমই সে তন্নতন্ন করে দেখল। বুঝতেই পারছেন, আমার রাগও হচ্ছিল। আমি জানতাম, লোকটা সশস্ত্র। আমি বললাম, এটা এক ধরনের জবরদস্তি অপরাধ, আমি এখুনি পুলিশকে জানাব। শুনে জবাব দিল, সে অধিকার আপনার আছে, আপনি এর পর যা খুশি তাই করতে পারেন। আমার কিছু বলবার নেই। বরং আপনাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না, আপনি আমাকে বাধা দেননি। তবু আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, সে কাকে খুঁজতে এসেছিল। জবাব দিল সেটা আপনি ওপরের মিসেস দত্তর কাছ থেকে জানতে পারবেন। বলেই ঘরের বাইরে চলে গেল, আর সেখান থেকে বলল, আপনাকে এ ভাবে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি জানি না, আবার আপনার কাছে আমাকে আসতে হবে কি না। এই ছিল লোকটার শেষ কথা।
বাকি সবই আমি দেখেছি। পিসিমা বললেন, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? থানায় খবর দেবেন?
মিঃ কাপুর টিয়া নাক যেন কেঁপে উঠল। মোটা ভুরু জোড়া কুঁচকে গেল। চোখে নিবিড় চিন্তার ছায়া। হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না। পিসিমাও চুপ করে মিঃ কাপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রায় দু মিনিট ভেবে মিঃ কাপুর বলল, পুলিশকে জানানো উচিত। তা নইলে ওরা আমাদের সন্দেহ করবে, আমরা চুপচাপ থেকে, কিছু চেপে যেতে চাইছি। যা স্বাভাবিক, সেটাই করা দরকার। আপনারও কি তাই মনে হয় না?
হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। পিসিমা সম্মত হয়ে বললেন, বাড়িতে এ রকম ঘটনা ঘটলে, লোকে পুলিশকেই আগে জানায়। বিজিতের মতামতটা জানতে পারলে ভাল হত। লোকটার বেপরোয়া ভাবভঙ্গি দেখে মনেই হয় না, পুলিশকে ও রেয়াৎ করে। এমনকী লোকটা আমাকে এ কথাও বলেছে, মিঃ কাপুর যদি খবরটা প্রচার করতে চান, তবে খবরের কাগজের সাহায্য উনি পাবেন না। এত বড় কথা বলল কেমন করে, বুঝতে পারি না।
মিঃ কাপুর মাথা ঝাঁকিয়ে, চিন্তিত স্বরে বলল, এর একটাই অর্থ, ওদের ঘাঁটি খুব শক্ত। খবরের কাগজের কথা আমি ভাবিনি। খুব একটা হইচই করাটা বোধ হয় মিসেস মজুমদারের পক্ষে এক রকমের বিপদই টেনে আনতে পারে। তবে, সাধারণভাবে, ব্যাপারটা থানায় জানানো একটা নিয়মের বিষয়, যাতে ওরাও ভাবে, আমরা শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসাবে আমাদের করণীয় কাজ করেছি। আমি অফিসে গিয়ে, আপনার ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারি।
হ্যাঁ, সেটাই ভাল। পিসিমা বললেন, খবর অবিশ্যি বিজিত তার মধ্যেই আইভির কাছে। টেলিফোনে পেয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে আলোচনা হলে, বিজিতও একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে। তবে পিসিমা থেমে গেলেন। মিসেস কাপুর আর লীনার দিকে এক বার দেখলেন।
মিঃ কাপুর জিজ্ঞাসু চোখে পিসিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। পিসিমা একটু চিন্তিত আর বিব্রত হেসে বললেন, মিঃ কাপুর আপনাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই–মানে, সত্যি কথা বলতে কী, আভার সঙ্গে আমাদের তেমন একটা যোগাযোগ নেই অনেক দিনই। হঠাৎ ও এসে আমাদের আশ্রয়ে উঠেছে। ওর পেছনে যারা লেগে আছে, আপনিও অনুমান করতে পারছেন, তারা কত শক্তিশালী। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে, কতটা ঝুঁকি আমরা নিতে পারি?
মিঃ কাপুর অনুসন্ধিৎসু চোখে পিসিমার মুখের দিকে দেখল। এক মুহূর্তের জন্য যেন তার মুখে ঈষৎ রক্তের ছটা দেখা দিল। তারপরে আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তা এক রকম ঠিক বলেছেন। ঠিকই আছে, আমি এখন উঠি, এবারে বেরোনো দরকার। যত দূর মনে হয়, ওরা মিলারদের বাড়ির ব্যাপারটা জানতে পারেনি। তবে ওরা আবার আসতে পারে, এ রকম শাসিয়ে গেছে। আমি আমার স্ত্রী আর মেয়েদের সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি। আপাতত, লোকটাকে আমরা যা বলেছি, মিসেস মজুমদারকে আমরা আশ্রয় দিইনি, তার দায়িত্বটা থাকছেই। সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হ্যাঁ, তা তো থাকছেই। পিসিমাও উঠে দাঁড়ালেন, আমাদের জন্য আপনাকেও বিপাকে পড়তে। হল। আমার খুবই খারাপ লাগছে।
মিঃ কাপুর ঘাড় ঝাঁকিয়ে, একটু হাসল, এটা তো আপনার ইচ্ছায় ঘটেনি। মিসেস মজুমদারও বোধ হয় এ রকম ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কী আর করা যাবে।
তা ঠিক। পিসিমা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, আভা অবিশ্যি জানত, ওর পেছনে লোক ঘুরছে। যাই হোক, এটাকে এখন ভাগ্যের ব্যাপার বলেই মেনে নিতে হবে।
মিঃ কাপুর ঘাড় ঝাঁকাল, ঠিক তাই।
পিসিমা মিসেস কাপুর আর লীনার দিকে তাকিয়ে, ঘাড় কাত করে বিদায়ের ভঙ্গি করলেন। বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
আভা সকালের ঘটনাগুলো সবই শুনল মিঃ কাপুরের কাছ থেকে। রাত্রি এখন প্রায় আটটা। মিলারদের বাড়ির একেবারে পিছনে, দেড়খানা ঘর। প্রধান বাড়িটা থেকে বিচ্ছিন্ন! দেখলেই বোঝা যায়, চাকর-নোকর থাকবার জন্য এ ঘর তৈরি হয়েছিল। বারান্দা বা সে রকম কিছু নেই। ঘরের বাইরে সামান্য খোলা জমির সঙ্গেই ঘরের মেঝে সমান। একটু বড় ঘরটার একটি মাত্তর দরজা, আর একটি জানালা। যার সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা বাড়িটা। পাশের ঘরে কোনও দরজা নেই। পরে কোনও সময়ে একটা জানালা করা হয়েছে। ঘরের বাইরে দিয়ে, বাঁ দিকে গেলে টিনের শেড দেওয়া একটা ফালি ঘর। ওটাই বাথরুম। একটা বালতি বসাবার মতো, নিচু জলের কল। জল যাবার একমাত্র রাস্তা, পাইখানার প্যান, দিনের বেলাও ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। বাতাস চলাচলের সুযোগ তেমন নেই। মার্চের প্রায় মাঝামাঝি সময়েও, অতএব পাখা চালাবার প্রয়োজন হয়। আভা সকালে যখন ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকছিল, পিছন ফিরে এক বারও তাকায়নি। দাঁতে দাঁত চেপে, অথচ না দৌড়ে, একেবারে পিছনের আড়ালে এসে পৌঁছেছিল। পিছনে, সূরয সিং-এর ঘরটাই সামনে। কিন্তু আভার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না, সেটাই সূরয সিং-এর ঘর কি না। দোতলার পিছন দিকেও ঘর ছিল। একটা ঘরের দরজার পরদা ঝুলছিল। ভিতরে মেয়ে পুরুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। পিছন দিকের ঘর বলতে, কোনটা সূরয সিং-এর ঘর, বুঝতে পারেনি। ভয়ে বিভ্রান্তিতে এ পাশে ও পাশে তাকাচ্ছিল। সৌভাগ্য, সেই মুহূর্তেই বীণা এসে পড়েছিল। ও আভার হাত ধরে, সূরয সিং-এর ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ঘরে ঢুকেই বাঁ দিকে একটা ডাবল বেডের পুরনো খাট। অগোছালো ময়লা বিছানা। সেই বিছানার ওপরে, একজন স্ত্রীলোক হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে, গুনগুন করে গান করছিল। বেঁটে, মাংসল কিন্তু শক্ত চেহারার স্ত্রীলোকটির রং ফরসা। বয়স ত্রিশ বত্রিশের মধ্যে। ছোট কপাল, বোঁচা নাক, মাঝারি চোখ, গোল মুখ। তার শাড়ি গোটানো ছিল প্রায় হাঁটুর কাছে। বুকের আঁচল বিছানায় লোটানো। অন্তর্বাসহীন জামাটার বোম দু-একটা খোলা। বুক দুটো দেখাচ্ছিল, দুটো বিরাট মাংসল পিণ্ডের মতো। ঘরের মধ্যে হিং-রসুন-পেঁয়াজ মেশানো একটা গন্ধ।
স্ত্রীলোকটি বীণাকেই প্রথম দেখতে পেয়েছিল। গান না থামিয়েই, হেসে বীণাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই আভাকে দেখে, লাফ দিয়ে উঠে বসেছিল। গান থামিয়ে, ভূত দেখার মতো, ববকে কোলে আভার দিকে তাকিয়েছিল। চোখে বুদ্ধির দীপ্তি নেই, অথচ একটা খরতা আছে। চমকানো চোখে ছিল একটা ভয় মেশানো সন্দেহ আর জিজ্ঞাসা।
বীণা আভাকে ধরে, খাটের পাশ দিয়ে, আরও ভিতরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সূরয সিং-এর স্ত্রীকে ও আন্টি বলে সম্বোধন করেছিল, এবং রোহী পাঞ্জাবি ভাষায় যা বলেছিল, আভা তা বুঝতে পেরেছিল। বীণা বলেছিল, মালতী আন্টি, ইনি আমার বাবার এক বিশেষ পরিচিত বন্ধুর স্ত্রী। কিন্তু বাবার সেই বন্ধুটি খুবই বদ মেজাজের। ঝগড়া হলে তিনি মেজাজের মাথায় যা খুশি তাই করে ফেলতে পারেন। ঝগড়া হতেই ইনি বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। কিন্তু পাছে ওঁর স্বামী আমাদের বাড়িতে এসে কোনও রকম হুজ্জোত করেন, তাই বাবা ওঁকে তোমার এখানে পাঠিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ?
মালতী প্রকৃতই অবুঝের মতো ঘাড় নেড়েছিল। খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল। বীণা হেসে, আভাকে একই ভাষায় বলেছিল, আপনি বসুন।
বব আবার তখন কান্না শুরু করেছিল। ওই সময়ে ওর একটু খাবার দরকার। বুকের দুধ খাবার অভ্যাস ছিল না। ববের কান্না থামাবার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘বসছি।’
বীণা মালতীকে আবার বিষয়টি বুঝিয়ে বলেছিল। মালতী বীণার কথা শুনতে শুনতে আভার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে দেখছিল। আস্তে আস্তে তার চোখের ভয় আর সন্দেহ অপসারিত হয়েছিল। কিন্তু আভাকে কোনও রকম অভ্যর্থনা করার মতো ভদ্রতা বা হাসি তার মুখে ফোটেনি। বরং একটু দ্বিধার সঙ্গে বলেছিল, তোমার চাচা থাকলে ভাল হত।
বাবা এখনই বেরিয়ে গিয়ে চাচার সঙ্গে দেখা করে সব কথা বলবে। বীণা বলেছিল, ও বেলা বাড়ি ফিরে, বাবা তোমাদের এখানে আসবে। তোমার কোনও ভয় নেই।
মালতী আভাকে দেখতে দেখতেই বলেছিল, ভয়ের কথা ভাবছি না। এ কত দিন থাকবে?
‘কত দিন কী বলছ?’ বীণা হেসে উঠেছিল, হয় তো আজই রাত্রের দিকে ইনি চলে যাবেন। বড় জোর একটা রাত্তির থাকতে পারেন। সে রকম হলে সূরয চাচা রাত্রিটা আমাদের বাড়িতেই কাটাবেন। তবে মনে হয়, তার দরকার হবে না।
মালতীর চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তি আর ভরসা দেখা দিয়েছিল। এমনকী সে হেসে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের একটা যৌন আর্তির কথাও বিদ্রুপের সুরে বলেছিল। যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, স্বামীদের মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই, অন্য গরম বেড়ে যায়। আর বউ তখন ছিনালি করে, পুরো মজা লুটে নেয়। বীণার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। ও চকিত সলজ্জ চোখে এক বার আভার দিকে দেখেছিল। আভার আতঙ্কিত ফ্যাকাশে মুখে একটা অপমানের লজ্জিত গ্লানি ফুটেছিল। কিন্তু মালতী একটু সহজ হয়েছিল। আভাকে বলেছিল, বসছ না কেন? বোসো।
হ্যাঁ, আপনি বসুন। বীণা আভাকে ইংরেজিতে বলেছিল।
আভা চোখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখছিল। খাটের বাইরে ঘরে জায়গা কম। আয়নার পাল্লা দেওয়া একটা স্টিলের আলমারি এক ধারে। তার গায়ে একটা আলনা। আলনার নীচে দু জোড়া পুরুষের জুতো, আর দু জোড়া বোধ হয় মালতীর স্যান্ডেল। তার পাশেই মেঝের ওপর পড়ে ছিল ট্রাউজার শার্ট গেঞ্জি আর জাঙিয়া। নিশ্চয়ই কাঁচবার জন্যে। খাটের বাইরে দু দিকে দু-আড়াই ফুটের মতো জায়গা। আর কোনও আসবাব ছিল না। খাটের নীচেয় অনেক কিছু ঠাসা ছিল। মাথার ওপরে ছোট একটা ফ্যান। ঘুরছিল না। দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে একটি নগ্ন মেয়ের ছবি ঝুলছিল। পাশের ঘরে স্টোভ আর রান্নার বাসনপত্র কিছু দেখা যাচ্ছিল।
আভার ভিতরে তখনও আতঙ্কের কম্পন ছিল। একেবারে নিশ্চিত হওয়ার কোনও প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু ঘরটার মধ্যে ঢুকে, ঘরের চেহারা, মালতীকে দেখে, আর তার কথা শুনে, মনের মধ্যে একটা বিমর্ষতাও নেমে এসেছিল আসছিল। ববের খুঁতখুঁত কান্না আর খিদেটাও ভুলতে পারছিল না। তবু ও ববকে নিয়ে ময়লা অগোছালো বিছানা পাতা খাটের এক ধারে বসেছিল। বীণা ওর পাশে বসেছিল। তখনই মালতী আভাকে দেখিয়ে বীণাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এ কোন দেশি? বাঙালি না?
হ্যাঁ। বীণা মাথা ঝাঁকিয়েছিল, তবে আমাদের কথা উনি বুঝতে পারেন৷’ ও জিজ্ঞাসু চোখে আভার দিকে তাকিয়েছিল।
আভা মাথা ঝাঁকিয়ে, ইংরেজিতে বলেছিল, হ্যাঁ, পারি।
যাক, আমি ভাবলাম, সারা দিন বুঝি একটা বোবার সঙ্গে আমাকে কাটাতে হবে। মালতী আরও সহজভাবে হেসে, নিজের ভাষায় বলেছিল। আভাকে বলেছিল, আমি ইংরেজি বুলি বুঝি না, বলতেও পারি না। তুমি ছেলেটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছ না কেন?
আভা রোহী পাঞ্জাবি ভাষা বুঝতে পারে, বলতে পারে না। হিন্দিতে বলেছিল, ও জন্মের পর থেকে কখনওই বুকের দুধ খেতে শেখেনি।
আজকালকার মাগিদের এ সব মেমসাহেবিপনা আমার একদম ভাল লাগে না। মালতীর বিরক্তিসূচক কথার মানে করলে, এ রকমই শুনিয়েছিল, বাচ্চা বুকের দুধ খেলে, পাছে বুক ঝুলে যায়, সেইজন্যই বুকের দুধ খেতে দেওয়া হয় না।
আভা চকিতের জন্য বীণার দিকে তাকিয়েছিল। বীণাও তাকিয়েছিল। ওর কুমারী মুখে রক্তের ছটা লেগেছিল। আভার মনের এমন অবস্থা ছিল না, কৈফিয়ত দিয়ে ব্যাখ্যা করবে, ববকে চেষ্টা করেও বুকের দুধ খাওয়ানো অভ্যাস করা যায়নি। কেবল বলেছিল, ও খেতে চায় না।
মালতী আভার বুকের দিকে তাকিয়েছিল। নিটোল, ঈষৎ নম্র বুকের জামার ভিতরে, ব্রার স্ট্র্যাপ খোলা ছিল। মালতী ওর কথা যথার্থ বিশ্বাস করেনি। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত, বিশেষ চোখে যেন মেপে দেখে নিয়েছিল। আভা বীণাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে কি ফোঁটানো জল পাওয়া যাবে? তা হলে একটু চিনি মিশিয়ে ছেলেকে খাওয়াতাম। অথবা গ্লুকোজ। ওর খিদে পেয়েছে।
বীণা মালতীকে জিজ্ঞেস করেছিল, ফোঁটানো জল আছে কি না। এবং চিনি। গ্লুকোজের কথা উচ্চারণ করেনি। ববের খিদে পাবার কথা বলেছিল। মালতী মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘ফোঁটানো জল আমাদের থাকে না। সোরাইয়ে খাবার জল আছে। বাচ্চাদের খাবার মতো কোনও খাবার আমার ঘরে নেই। কথাটা বলবার সময় তার গোল মুখে চকিতেই একটা হতাশ বিষণ্ণতা জেগে উঠেছিল, তবে তোমার চাচা একটা জিনিস খায়। সেটা ও খেতে পারবে কি না দেখতে পারো।’ বলে সে পাশের ছোট ঘরে ঢুকে, একটা মোটা কাচের বেঁটে বোতল হাতে করে এনেছিল।
আভা সেটা দেখে স্বস্তি পেয়েছিল।
বড় ছোটসকলেরই ওটা গরম জলে গুলে খাওয়া চলে। বলেছিল, হ্যাঁ, ওটাই একটু পাতলা করে খাওয়ানো যাবে।
আমি অবিশ্যি মাঝেমধ্যে এমনিই খাই, বেশ ভাল লাগে। মালতী হেসে বলেছিল, আর বোতলের ঢাকনা খুলে, পাউডার জাতীয় খাদ্য খানিকটা হাতে ঢেলে মুখে পুরেছিল।
বীণা হেসে উঠেছিল, আভার মুখে পর্যন্ত রক্তের ঈষৎ ছটা লেগে গিয়েছিল। মালতী কত দিন কলকাতায় এসেছে, ওর কোনও ধারণা ছিল না। অশিক্ষিত হতে পারে, কিন্তু তার গ্রাম্য ধরনের সরলতা ভাল লেগেছিল। ও বীণাকে বলেছিল, আমি তা হলে ববের জন্য একটু খাবার তৈরি করি।
আপনি বসুন, আমি করে দিচ্ছি। বীণা উঠে দাঁড়িয়েছিল, নতুন জায়গায় আপনার অসুবিধে হবে।
মালতীর মুখ থেকে পাউডার জাতীয় খাদ্য খানিকটা ঠোঁটের ওপর এসে পড়েছিল। জিভটা একটু জড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা কী বলছ?
বলছিলাম, বাচ্চার জন্য খাবারটা আমিই তৈরি করে দিচ্ছি। বীণা বলেছিল, তোমার ঘরে ওঁর অসুবিধে হবে।
মালতীর ভুরু কুঁচকে উঠেছিল। ঢোক গিলে বলেছিল, আমার বাচ্ছা নেই বলে কি আমি এটা করতে পারব না? কী ভেবেছে আমাকে? একটু পাতলা করে বানাতে হবে, এই তো? আমি বানিয়ে দিচ্ছি। সে পাশের ঘরে গিয়েছিল।
বীণা আভার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিল। আভা বলেছিল, ঠিক আছে। ফোঁটাবার আর খাবার পাত্র একটু পরিষ্কার থাকলেই হবে। পাখাটা কি খোলা যাবে?
‘নিশ্চয়!’ বীণা দরজার কাছে গিয়ে, সুইচ টিপে দিয়েছিল।