শ্রাবণ মাসের দিকে স্কুলের কাজ ভয়ানক বাড়িল।
এই সময় একজন নতুন মাস্টার স্কুলে নেওয়া হইল—বেশি বয়স নয়, ত্রিশের মধ্যে। লোকটি কবিতা লেখে, বড় বড় কথা বলে, অবস্থাও বোধ হয় ভালো। কারণ সাধারণ স্কুলমাস্টারদের অপেক্ষা ভালো সাজগোজ করিয়া স্কুলে আসে, বেশির ভাগ আপনমনে বসিয়া থাকে, কাহারও সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। ফট-ফট করিয়া ইংরেজি বলে যখন-তখন। নাম—রামেন্দুভূষণ দত্তগুপ্ত, বাড়ি—নৈহাটীর কাছে কী একটা জায়গায়।
যদুবাবু চায়ের দোকানে বলিলেন, ওহে, এ নবাবটি কে এল হে? নরলোকের সঙ্গে বাক্যালাপ করে না যে!
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, করার উপযুক্ত মনে করলেই করবে।
নারাণবাবু চুপ করিয়া ছিলেন। যদুবাবু বলিলেন, কী দাদা? চুপ করে আছেন যে?
—কী বলি বল? কী রকম লোক, কিছু জানি নে তো?
—কী রকম বলে মনে হয়? বেজায় গুমুরে?
—তা হতে পারে। তবে ছেলেমানুষ, শাইও হতে পারে।
—শাই, না ছাই! কারও সঙ্গে কথা বলে না, টিচারস-রুমে একলাটি বসে কী যেন ভাবে!
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, লোকটা কবি, তাই বোধ হয় আপনমনে ভাবে—
যদুবাবু কাহারও প্রশংসা সহ্য করিতে পারেন না, তিনি বলিলেন, হ্যাঁঃ কবি—একেবারে রবি ঠাকুর! ডেঁপো কোথাকার!
সেদিন টিফিনের পর কিছুক্ষণ ক্লাসে নূতন শিক্ষক নাই। দশ মিনিট কাটিয়া গেল, তখনও তাঁহার দেখা নাই।
হেডমাস্টার কটমট দৃষ্টিতে ক্লাসের শূন্য চেয়ারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, কার ক্লাস?
মনিটার দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, নিউ টিচার স্যার!
হেডমাস্টার চলিয়া গেলেন।
অনেকক্ষণ পরে নতুন মাস্টার আসিয়া বসিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মথুরা চাকর আসিয়া একটা স্লিপ দিল তাঁহার হাতে, হেডমাস্টার আপিসে ডাকিয়াছেন।
নতুন মাস্টার উঠিয়া আপিসে গেলেন।
—আমাকে ডেকেছেন স্যার?
—হ্যাঁ। আপনি ক্লাসে ছিলেন না?
—আমি ক্লাস থেকেই আসছি।
—দশ মিনিট পর্যন্ত আপনি ক্লাসে ছিলেন না।
—আমি দুঃখিত। চা খেতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল।
—কোথায় চা খেতে গিয়েছিলেন? আমায় না বলে বাইরে যাবেন না।
—কেন স্যার?
হেডমাস্টার ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া নতুন মাস্টারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আমার স্কুলের নিয়ম।
নতুম মাস্টার কিছু না বলিয়া ক্লাসে গিয়া পড়াইতে লাগিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার হেডমাস্টারের আপিসে আসিয়া বলিলেন, স্যার, একটা কথা—
—কী?
—আমি স্কুলের একজন টিচার, ছাত্র নই—হেডমাস্টারের কাছে অনুমতি নিয়ে স্কুলের ফটকের বাইরে যেতে হয় ছাত্রদের, টিচারদের নয়। আমার দেরি হয়েছিল ফিরতে, সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনাকে না বলে যাওয়ার জন্যে আপনি অনুযোগ করলেন, এটা ঠিক করেছেন বলে মনে করি না।
হেডমাস্টারের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে নতুন টিচার গটগট করিয়া ক্লাসে চলিয়া গেলেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্লার্কওয়েল তো অবাক, তাঁহার অধীনস্থ কোনো মাস্টার যে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া এ কথা বলিতে পারে, তাহা তাঁহার কল্পনার অতীত। তিনি তখনই মিঃ আলমকে ডাকিলেন।
—ইয়েস স্যার!
—নতুন টিচার বেশ ভালো পড়ায়?
—জানি না স্যার। বলেন তো দৃষ্টি রাখি।
—রাখো।
—কী রকম একটু অসামাজিক ধরনের—শুনলাম নাকি, কবি। বাংলা কবিতা পড় তোমরা—পড়েছ কী রকম কবিতা লেখে?
মিঃ আলম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত কড়িকাঠের দিকে উঠাইয়া থিয়েটারি ভঙ্গি করিলেন। তারপর সুর নিচু করিয়া বলিলেন, কিসের কবি! বাংলাদেশে সবাই কবিতা লেখে আজকাল। কবি!
—তুমি বাংলা কবিতা পড় মিঃ আলম?
—পড়ি বইকি স্যার!
আলমের এ কথা সত্য নয়, বাংলা সাহিত্যের কোনো খবর কোনোদিনও তিনি রাখেন না।
.
মিঃ আলমের সঙ্গে একদিন নতুন মাস্টারের ঠোকাঠুকি বাধিল।
ব্যাপারটা খুব সামান্য বিষয় অবলম্বন করিয়া। ক্লাসে কী একটা পরীক্ষার কাগজে নতুন মাস্টার নম্বর দিয়া ছেলেদের নিকট ফেরত দিয়াছেন। মিঃ আলম সে ক্লাসে পড়াইতে গিয়া সামনের বেঞ্চির উপর একটি ছেলের পরীক্ষার খাতা দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কিসের খাতা রে?
ছেলেটি বলিল, এবারকার উইকলি এক্সারসাইজের খাতা স্যার, নতুন স্যার দেখে ফেরত দিয়েছেন।
—কী সাবজেক্ট?
—হিস্ট্রি।
—দেখি খাতাখানা!
মিঃ আলম খাতাখানা লইয়া উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া বলিলেন, নম্বর দেওয়া সুবিধে হয় নি।
—কেন স্যার?
—এর নাম কি মার্ক দেওয়া! এ আনাড়ির মার্ক দেওয়া! এই খাতায় তুমি ষাট নম্বর কখনও পাও না—আমার হাতে চল্লিশের বেশি নম্বর উঠত না।
নতুন টিচারের কাছে ছেলেরা অন্যভাবে ঘুরাইয়া বলিল, স্যার, আপনার হাতে বড় নম্বর ওঠে!
—কেন রে?
—স্যার, ওই সতীশকে ষাট দিয়েচেন, ও চল্লিশের বেশি পায় না!
—কে বলেছে তোকে?
—মিঃ আলম বলে গেলেন স্যার।
—কী বললেন?
—বললেন, এ আনাড়ির মার্ক দেওয়া হয়েছে।
নতুন টিচার তখনই গিয়া হেডমাস্টারের আপিসে মিঃ আলমকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন। হেডমাস্টার নাই, ক্লাসে পড়াইতে গিয়াছেন। বলিলেন, আপনার সঙ্গে একটা কথা—এক মিনিট—
—কী বলুন?
—আপনি কি ফোর্থ ক্লাসে আমার খাতা দেখা সম্বন্ধে কিছু বলেছিলেন?
—কেন বলুন তো?
—না, তাই বলছি। ছেলেরা বলছিল, আপনি খাতা দেখে বলেছেন যে খাতা ভালো দেখা হয় নি!
—হ্যাঁ—তা—না—সে কথা ঠিক না—তবে হ্যাঁ, একটু বেশি নম্বর বলেই আমার মনে হল কিনা—
—খুব ভালো কথা। আপনি অভিজ্ঞ টিচার, আমার ভুল ধরবার সম্পূর্ণ অধিকারী। আমায় দয়া করে যদি খাতা দেখাটা সম্বন্ধে একটু বলে-টলে দেন—আমার অনেক ভুল সংশোধন হতে পারে। আমরা আনাড়ি কিনা আবার এ বিষয়ে!
আলমের মুখ লাল হইয়া উঠিল। বলিলেন, তা আমার যা মনে হয়েছে, তাই বলেছি। আপনার নম্বর দেওয়াটা একটু বেশি বলেই মনে হয়েছিল।
—আমি মোটেই তার প্রতিবাদ করছি না। আমি কেবল বলতে চাই, ক্লাসে ছেলেদের সামনে মন্তব্য না করে আমাকে আড়ালে ডেকে বললেই ভালো হত।
ন্যায্য কথা। এ কথার উপর কোনো কথা চলে না। মিঃ আলমের চুপ করিয়া থাকা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে হেডমাস্টারকে একা পাইয়া মিঃ আলম সাতখানা করিয়া তাঁহার কাছে লাগাইলেন, নতুন টিচারকে খাতা দেখতে দেবেন না স্যার!
—নতুন টিচারকে? কেন মিঃ আলম?
—উনি খাতা মনোযোগ দিয়ে দেখেন না।
—দেখেছিলে নাকি কোনো খাতা?
—হ্যাঁ স্যার। ফোর্থ ক্লাসের সতীশকে উনি ষাট নম্বর দিয়েছেন যে খাতায়, তাতে চল্লিশের বেশি নম্বর ওঠে না। ভুল কাটেনও নি সব জায়গায়।
এই কথাটার মধ্যে মুশকিল আছে। সব ভুল নিখুঁতভাবে কাটিয়া কোনো মাস্টারই খাতা দেখেন না—স্বয়ং মিঃ আলমও না। এখানে মিঃ আলম নতুন টিচারের উপর বেশ এক চাল চালিলেন। হেডমাস্টার খাতা চাহিয়া পাঠাইয়া সত্যই দেখিলেন, প্রত্যেক পাতায় এক-আধটা ভুল রহিয়া গিয়াছে, যাহা কাটা হয় নাই। নতুন মাস্টারের ডাক পড়িল ছুটির পর।
হেডমাস্টার বলিলেন, ফোর্থ ক্লাসের হিস্ট্রির খাতা দেখেছিলেন আপনি?
—হ্যাঁ স্যার।
—খাতা ভালো করে দেখেন নি তো! সব ভুলে লাল দাগ দেন নি!
—বেশির ভাগ দিয়েছি স্যার। দু-একটা ছুটে গিয়েছে হয়তো।
—না, আমার স্কুলে ওভাবে কাজ করলে চলবে না। খাতা সব আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। আবার দেখতে হবে।
—যে আজ্ঞে স্যার।
পরদিন নতুন মাস্টার সারকুলার-বই দেখিয়া বাহির করিলেন—মিঃ আলম ফার্স্ট ক্লাসের ইংরাজি গ্রামার ও রচনার খাতা দেখিয়াছেন। তিনখানি খাতা চাহিয়া লইয়া দেখিতে দেখিতে বাহির করিলেন, মিঃ আলম গড়ে প্রত্যেক পাতায় অন্তত তিনটি করিয়া ভুলের নীচে লাল দাগ দেন নাই।
নতুন টিচার খাতা কয়খানি হাতে করিয়া হেডমাস্টারের কাছে না গিয়া মিঃ আলমের কাছে গেলেন। খাতা দেখাইয়া বলিলেন, আপনার খাতা দেখা যদি আদর্শ হিসেবে নিতে হয়, তা হলে প্রত্যেক খাতায় আমার তিনটি ভুলে লাল দাগ না দিয়ে রাখা উচিত ছিল। দেখুন খাতা ক’খানা!
মিঃ আলম উল্টাইয়া খাতাগুলি দেখিলেন। যুক্তি অকাট্য। গড়ে তিনটি করিয়া ভুলে লাল দাগ দেওয়া হয় নাই—খাঁটি কথা।
মিঃ আলমের মুখ লাল হইয়া উঠিল অপমানে, কিন্তু কোনো কথা বলিলেন না।
নতুন টিচার বলিলেন, আপনি বললেন কিনা হেডমাস্টারের কাছে আমার বড্ড ভুল থাকে খাতায়, তাই দেখালুম—ভুল সকলেরই থাকে। ওগুলো ওভারলুক করতে হয়। সব কথায় হেডমাস্টারের কাছে—
মিঃ আলম রাগিয়া বলিলেন, আপনি কী করে জানলেন, আমি হেডমাস্টারের কাছে বলেছি?
—মনের অগোচরে পাপ নেই। আপনি জানেন, আপনি বলেছেন কিনা—বলিয়াই নতুন টিচার বেশ কায়দার সহিত ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
এ ব্যাপার কী করিয়া যেন অন্য টিচারেরা জানিতে পারিলেন, টিচারদের বসিবার ঘরে টিফিনের সময় এ কথা লইয়া বেশ গুলজার হইল। মিঃ আলমের অপমানে সকলেই খুশি।
যদুবাবু বলিলেন, বেশ হয়েছে অন্ত্যজটার। থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে নতুন টিচার। কী ওর নাম, রামেন্দুবাবু বুঝি?
নারাণবাবু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার একটা গুণ, পরের কথায় বড় একটা থাকেন না। বলিলেন, বাদ দাও ভায়া ও-কথা।
যদুবাবু বলিলেন, বাদ দেব কেন? আপনি তো দাদা, দেবতুল্য লোক। তা বলে দুষ্ট লোকও তো আছে পৃথিবীতে। তাদের শাস্তি হওয়াই ভালো।
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, জানেন দাদা, একটা কথা বলি। ওই আলমটা সবার নামে হেডমাস্টারের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়—এ কথা আপনি অস্বীকার করতে পারেন? অমন হিংসুক লোক আর দুটি দেখি নি, এই আপনাকে বলে দিচ্ছি।
জ্যোতির্বিনোদ নিচু ক্লাসের পণ্ডিত—বড় বড় ক্লাসে যাঁহারা পড়ান, তাঁহাদের সমীহ করিয়া চলেন, তিনি কাহারও বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা হইলে বিশেষ যোগ দেন না। তিনি বলেন, আমি চুনোপুঁটি, আপনারা সকলেই রুই-কাতলা—আমার কোনো কথায় থাকা সাজে না। তিনিও আজ বলিলেন, একটা ভালো বলতে হয় রামেন্দুবাবুকে—তিনি ওই খাতা নিয়ে হেডমাস্টারের কাছে না গিয়ে মিঃ আলমের কাছে গিয়েছেন!
যদুবাবু কাহারও ভালো দেখিতে পারেন না। তিনি বলিলেন, আরে সেটা কিছু নয় হে ভায়া, হেডমাস্টারের কাছে যেতে সাহস কি হয় সবারই!
নারাণবাবু বলিলেন, তা নয়। অতখানি যে করতে পারে, সাহেবের কাছে যাওয়ার সাহস তার খুবই আছে। লোকটি ভদ্রলোক।
যদুবাবু বলিলেন, তবে একটি গুমুরে। যাক সব গুণ মানুষের থাকে না। এ কাজটা করে যা শিক্ষা দিয়েছে আলমকে, ভারি খুশি হয়েছি—হ্যা-হ্যা, কী বল ক্ষেত্র-ভায়া?
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, স্পিরিট আছে ভদ্রলোকের!
—ডেকে নিয়ে এস না। ওই তো ওদিকের ছাদে বসে থাকে একলাটি। টিফিনে টিচারদের ঘরে কোনোদিন তো আসে না।
নারাণবাবু বলিলেন, বসে বসে বই পড়ে লাইব্রেরি থেকে নিয়ে। সেদিন বঙ্কিমের বই পড়ছিল। পকেটে একদিন শেলির কবিতা ছিল। তোমরা ওকে গুমুরে ভাব, ও তা-নয়। কবি কিনা, একটু আনমনে ভাবতে ভালোবাসে।
—যাও না ক্ষেত্র-ভায়া, ডেকে নিয়ে এস না!
—আমি পারব না দাদা, কিছু যদি বলে বসে! তার চেয়ে চলুন, আজ চায়ের দোকানের আড্ডায় নিয়ে যাওয়া যাক ওকে। আলাপ-সালাপ করা যাক।
ছুটির পর গেটের বাহিরে মাস্টারের দল নতুন মাস্টারের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, কারণ এ ঘনিষ্ঠতা হেডমাস্টার বা মিঃ আলমের চোখের আড়ালে হওয়াই ভালো। মিঃ আলম বা হেডমাস্টারের নেকনজরে যে ব্যক্তি নাই, তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিতে যাওয়ার বিপদ আছে।
নতুন টিচার চোখে চশমা লাগাইয়া ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে নব্য কবির স্টাইলে আকাশপানে মুখ করিয়া যেই গেটের বাহিরে পা দিয়াছেন, অমনি যদুবাবু এদিক-ওদিক চাহিয়া বলিলেন, এই যে শুনছেন, রামেন্দুবাবু—এই যে—
রামেন্দুবাবু হঠাৎ যেন চমকিয়া উঠিয়া পিছনে ফিরিয়া বিস্ময়ের সঙ্গে বলিলেন, আমাকে বলছেন?
যেন তিনি ইহা প্রত্যাশা করেন নাই, তাঁহাকে কেহ ডাকিবে!
যদুবাবু বলিলেন, আমরাই ডাকছি, আসুন, একটু চা খেয়ে আসি!
—ও! আচ্ছা—তা চলুন!
সকলেই খুব আগ্রহান্বিত। নতুন টিচারের সঙ্গে এতদিন আলাপ ভালো করিয়া হয়ই নাই, অনেকের সঙ্গে একটা কথাও হয় নাই। আজ ভালো করিয়া আলাপ করা যাইবে। লোকটার অদ্যকার কার্যে তাহার সম্বন্ধে মাস্টারদের কৌতূহলের অন্ত নাই। আলমকে যে অপমান করিয়া ছাড়িয়াছে, সে সকলের বন্ধু।
চায়ের দোকানে গিয়া প্রতিদিনের মত মজলিশ জমিল। স্কুল-মাস্টারদের অবশ্য যতটা হওয়া সম্ভব, তাহার বেশি ইঁহাদের ক্ষমতা নাই। নতুন টিচারকে খাতির করিয়া দুইখানা টোস্ট দেওয়া হইল, বাকি সবাই একখানা করিয়া টোস্ট লইলেন। পরস্পর একটা মানসিক বোঝাপড়া হইল যে, নতুন টিচারের খাবারের বিলটা সকলে মিলিয়া চাঁদা করিয়া দিবেন।
নারাণবাবু আলাপের ভূমিকাস্বরূপ প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন, মশায়ের বাড়ি কোথায়?
—আমার বাড়ি ছিল গিয়ে নদে জেলায় সুবর্ণপুর। এখন কলকাতায় আছি অনেক দিন।
—কলকাতায় কোথায় থাকেন?
—মেসে।
—ও।
যদুবাবু একটু ঘনিষ্ঠতা করার জন্য বলিলেন, অনেক দিন কলকাতায় আর কী আছ ভায়া, তোমার বয়েসটা কী আর এমন, আমাদের চেয়ে কত ছোট—
নতুন টিচার এ ঘনিষ্ঠতায় বিশেষ ধরা দিলেন না। খুব ভদ্রতার সঙ্গে বিনীতভাবে জানাইলেন, তাঁহার বয়স খুব কম নয়, প্রায় চৌত্রিশ পার হইতে চলিল। ‘দাদা’ কথাটার ব্যবহার একবারও করিলেন না। বেশ একটু ভদ্র ও বিনীত ব্যবধান বজায় রাখিয়া চলিলেন কথাবার্তায় ও চালচলনে।
একথা ওকথার পর যদুবাবু হঠাৎ বলিলেন, আজ আমরা খুব খুশি হয়েছি, বেশ শিক্ষা দিয়েছেন (মাখামাখি করিবার সাহস তাঁহার উবিয়া গিয়াছিল) ওই ব্যাটাকে—
নতুন টিচার ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, কার কথা বলছেন?
—আরে, ওই যে ওই আলমটাকে—ও ব্যাটা হেডমাস্টারের কাছে প্রত্যেক বিষয়ে লাগাবে। আমাদের উস্তন-কুস্তন করে মেরেচে মশাই! উঃ, ও একেবারে অন্ত্যজ—ওর যা অপমান করেচেন আজ! দেখুন তো, আপনার নামে কিনা লাগাতে—
নতুন টিচারের মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। তিনি বিরস কণ্ঠে বলিলেন, ও আলোচনা নাই বা করলেন এখন। মিঃ আলমের ভুল হতে পারে। ভুল সবারই হয়। আমি তাঁর ভুল পয়েন্ট-আউট করেছি মাত্র। আদারওয়াইজ হি ইজ এ ভেরি গুড টিচার—ভেরি অনেস্ট অ্যান্ড সিনসিয়ার টিচার। যাক ওসব কথা।
কঠিন ভদ্র সুরের গাম্ভীর্যে চায়ের দোকানের হালকা আবহাওয়া যেন থমথম করিয়া উঠিল।
যদুবাবু আর মাখামাখি করিবার সাহস পাইলেন না। অন্য কথা উঠিল। নতুন টিচার বিশেষ কোনো কথা বলিলেন না। মজলিশ জমিল না, যতটা আশা করা গিয়াছিল।
চায়ের মজলিশ শেষ হইলে নতুন টিচার বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন। সকলের পয়সা তিনি নিজেই দিয়া গেলেন।
যদুবাবু বলিলেন, গভীর জলের মাছ, দেখলে তো?
ক্ষেত্রবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হুঁ।
—বেশ চালবাজ!
—তা একটু আছে বইকি।
নারাণবাবু বলিলেন, তোমরা কারুর ভালো দেখ না—ওই তোমাদের দোষ। এ চালবাজ, ও গভীর জলের মাছ—এই সব তোমাদের কথা!
জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, না না, ভদ্রলোক ভালোই। আমি তো দেখচি বেশ উদার লোক।
যদুবাবু বলিলেন, ওই তো ভায়া, ওই জন্যেই তো বলচি গভীর জলের মাছ। আমাদের পয়সাটি পর্যন্ত নিজে দিয়ে গেল, যেন কত ভদ্রতা! অথচ—
নারাণবাবু বলিলেন, অথচ কী? তুমি সব জিনিসের মধ্যে একটা ‘অথচ’ না বের করে ছাড়বে না ভায়া!
—অথচ মনের কথাটা প্রকাশ করলে না।
—অথচ নয়, অর্থাৎ তোমার মত পেটপাতলা নয়।
—আপনি তো দাদা আমার সবই দোষ দেখেন!
—রাগ কোরো না ভায়া। আমি তো ও-ছোকরার কোনো দোষই দেখলাম না। বসে বসে মিঃ আলমের নামে কুৎসা গাইলেই কি ভালো লোক হত?
নারাণবাবুকে সকলেই তাঁহার বয়সের জন্য একটু সমীহ করিয়া চলে। যদুবাবু ইহা লইয়া নারাণবাবুর সঙ্গে আর তর্ক করিলেন না।
মোটের উপর সেদিন চায়ের মজলিশ হইতে বাহির হইয়া সকলেই অসন্তোষ লইয়া বাড়ি ফিরিলেন।
.
মাসের শেষে ছেলেদের প্রোগ্রেস রিপোর্ট ইত্যাদি লেখার ভিড় পড়িয়া গেল। হেডমাস্টারের কড়া হুকুম আছে, মাসের শেষদিন কোনো টিচার ছুটির পর বাড়ি যাইতে পারিবে না—বসিয়া বসিয়া সব প্রোগ্রেস রিপোর্ট লিখিয়া হেডমাস্টারের সই করাইয়া বিভিন্ন ক্লাসের মার্কের খাতায় ছেলেদের মার্ক জমা করিয়া, ক্লাসের হাজিরা-বহিতে ছেলেদের গর-হাজিরা বাহির করিয়া তবে যাইতে পারিবে।
এই সব কেরানির কাজ সাঙ্গ করিয়া বাড়ি ফিরিতে রাত সাড়ে সাতটা বাজিয়া যায়।
স্কুলের প্রথানুযায়ী মাস্টারদের এদিন জলখাবার দেওয়া হয় স্কুলের খরচে। যদুবাবু ছুটির পর সাহেবের কাছে জলখাবারের টাকা আনিতে গেলেন—বরাবর তিনিই যান ও কোনো দোকান হইতে খাবার কিনিয়া আনেন।
বরাদ্দ আছে সাড়ে পাঁচ টাকা। সাহেব যদুবাবুর হাতে সাতটি টাকা দিয়া বলিলেন, আজ ভালো করে খাও সকলে—লাড্ডু রসগোল্লা বেশি করে নিয়ে এস।
যদুবাবু প্রথমে একটি রেস্টুরেন্টে গিয়া দুই পেয়ালা চা খাইলেন, তারপর ছয় টাকার খাবার কিনিলেন এক দোকান হইতে। বাকি একটি টাকা তাঁহার উপরি-পাওনা। অন্যবার আট আনা পয়সা উপরি-পাওনা হয় অর্থাৎ পাঁচ টাকার খাবার কিনিয়া আট আনা পকেটস্থ করেন।
স্কুলে আসিতে প্রায় সন্ধ্যা হইল।
মাস্টারেরা অধীর আগ্রহে জলখাবারের প্রত্যাশায় বসিয়া আছেন। একজন বলিলেন, এত দেরি কেন যদুবাবু?
—আরে, গরম গরম ভাজিয়ে আনচি। আমার কাছে বাবা ফাঁকি দিতে পারবে না কোনো দোকানদার। বসে থেকে তৈরি করিয়ে ষোল আনা দাঁড়ি ধরে ওজন করিয়ে তবে—
অন্যান্য মাস্টারদের অগাধ বিশ্বাস যদুবাবুর উপরে। সকলেই বলেন, যদুবাবুর মত কিনতে-কাটতে কেউ পারে না—পাকা লোক একেবারে যাকে বলে।
টিচারদের ঘরে বেঞ্চির উপর ছোট ছোট পাতা পাতিয়া খাবার পরিবেশন করা হইল। যদুবাবু এখানে খাইবেন না, তিনি বাড়ি লইয়া যাইবেন। জ্যোতির্বিনোদ মশায় ঘিয়ে-ভাজা জিনিস খাইবেন না, তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, তাঁহার জন্য শুধু সন্দেশ-রসগোল্লা আনা হইয়াছে। নতুন টিচার বেঞ্চির এক পাশে খাইতে বসিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে বড় সাধারণত কাহারও মেশামেশি নাই। তিনি নিঃশব্দে ঘাড় গুঁজিয়া খাইতেছিলেন। যদুবাবু সামনে গিয়া বলিলেন, আর দু-একখানা লুচি দেব?
—না না, আর দেবেন না।
—একটা রসগোল্লা?
অন্যান্য টিচার সকলেই বিভিন্ন বেঞ্চি হইতে নতুন টিচারকে খাওয়ার জন্য, দুই-একটা অতিরিক্ত মিষ্টি লওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন।
মিঃ আলম ভোজসভায় প্রতিবার উপস্থিত থাকেন; কিন্তু স্বীয় পদের আভিজাত্য বজায় রাখিবার জন্য সাধারণ মাস্টারদের সঙ্গে খাইতে বসেন না। মাস্টারেরা বরং খোশামোদ করিয়া প্রতিবার ভোজসভাতেই তাঁহাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করিত। মিঃ আলম হাসিমুখে প্রত্যাখ্যান করিতেন।
আজ তাঁহার প্রাপ্য সেই আপ্যায়ন নতুন টিচারের উপর গিয়া পড়িতে দেখিয়া মিঃ আলম মনে মনে ক্ষুণ্ণ হইলেন, বিস্মিত হইলেন, নতুন টিচারের উপর হিংসায় মন পরিপূর্ণ হইল।
নতুন টিচার বলিলেন, মিঃ আলম, আপনি খেলেন না? আসুন!
মিঃ আলম গম্ভীরমুখে উত্তর দিলেন, না, আপনারা খান। আমি এখন খাই নে।
নতুন টিচার আর কোনো কথা বলিলেন না।
মাসে এই একদিন করিয়া স্কুলের খরচে খাওয়া—এমন বেশি কিছু খাওয়া নয়, হয়তো খান-পাঁচ-ছয় লুচি, দুইটি রসগোল্লা, একটু তরকারি, এক মুঠা বোঁদে। এই খাওয়াটুকুর জন্য মাস্টারেরা মাসের শেষ দিনটির প্রতীক্ষায় থাকেন, সেদিন সারা দিনটা খাটিবার পর সন্ধ্যায় সকলে বসিয়া একটু খাওয়াদাওয়া—
পরদিন মিঃ আলম হেডমাস্টারকে গিয়া বলিলেন, স্যার, একটা কথা—মাসের শেষে মাস্টারদের পিছনে পাঁচ টাকা ছ’ টাকা মিথ্যে খরচ, ও বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। ধরুন, কমিটি থেকে আপত্তি তুলতে পারে। মাস্টারদের ডিউটি তারা করবে, তার জন্যে খাওয়ানো কেন স্কুলের খরচে? আমি তো ভালো বুঝছি নে স্যার!
কমিটির নামে হেডমাস্টার একটু ভয় পাইয়া গেলেন। তবুও বলিলেন, তা খায় খাকগে, খাটতেও হয় তো।
মিঃ আলম জানিত, কমিটির নামে সাহেব একটু ভয় পায়। সে গিয়া কমিটির একজন মেম্বারকে কথাটা লাগাইল। কমিটির মীটিংয়ে অমূল্যবাবু সাহেবকে প্রশ্ন করিলেন, আচ্ছা, শুনলাম আপনি টিচারদের জলখাবার খেতে দেন মাসের শেষে, সে কার পয়সায়?
—স্কুলের খরচে।
—কেন?
—মাস্টারদের খাটুনি বেশি হয়—প্রোগ্রেস রিপোর্ট লেখা, রেজিস্টার ঠিক করা—
—এ তো তাঁদের ডিউটি। এর জন্যে জলখাবার দেওয়া কেন?
ক্লার্কওয়েল তর্ক করিয়া তখনকার মত নিজের কাজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিলেন বটে, কিন্তু পরের মাস হইতে মাস্টারদের জলযোগ বন্ধ হইয়া গেল।
.
ক্ষেত্রবাবু সেদিন স্কুল হইতে বাড়ি ফিরিয়া দেখিলেন, স্ত্রী বিছানায় শুইয়া আছে, ভয়ানক জ্বর। এঁটো বাসন রান্নাঘরের একপাশে জড়ো হইয়া আছে—ওবেলাকার এঁটো পরিষ্কার করা হয় নাই, ছেলেমেয়েগুলো ঘরময় দাপাদাপি করিয়া বেড়াইতেছে, চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। ক্ষেত্রবাবুর মাথা ঘুরিয়া গেল। সারাদিন পরে আসিয়া এ সব কি সহ্য হয়? স্ত্রীর ব্যবস্থামত ঠিকাঝিকে আজ মাস-তিনেক হইল ছাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। স্ত্রীই বলিয়াছিল, কেন মিছিমিছি ঝির পেছনে আড়াই টাকা তিন টাকা খরচ—আজ একটু নুন দাও মা, আজ খিদে পেয়েছে জলখাবার দাও মা, আজ মাখবার একটু তেল দাও মা—এই সব ঝক্কি রোজ লেগেই আছে। দাও ছাড়িয়ে, কাজকর্ম সব করব আমি। হাসিয়া বলিয়াছিল, কিন্তু মাসে মাসে আড়াইটে করে টাকা আমায় দিয়ো গো, ফাঁকি দিয়ো না যেন!
কিন্তু শরীর খারাপ, মন খাটিতে চাহিলে কী হইবে, তিন মাসের মধ্যে এই তিনবার অসুখে পড়িল। ডাক্তার ও ওষুধ খরচে ঠিকা-ঝিয়ের ডবল খরচ হইয়া গেল।
ক্ষেত্রবাবু নিজে বড় মেয়েটির সাহায্যে রান্নাঘর পরিষ্কার করিলেন। মেয়েকে বলিলেন, বাসন মাজতে পারবি হাবি?
হাবি মাত্র সাত বছরের মেয়ে। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হুঁ, খু-উ-ব।
—যা দিকি, আমি কলতলায় দিয়ে আসচি।
ঘরের ভিতর হইতে, নিভাননী চিঁ-চিঁ করিয়া বলিল, ও পারবে না—একটা ঠিকে-ঝি দেখে নিয়ে এস। ওই সদগোপ-বাবুদের পাশের গলিতে মুংলির মা বুড়ি থাকে, খোঁজ করে দেখগে।
ক্ষেত্রবাবু ধমক দিয়া বলিলেন, তুমি চুপ করে শুয়ে থাক। আমি বুঝছি। কেন ও পারবে না? শিখতে হবে না কাজ? কানু কোথায় রে?
হাবি বলিল, না বাবা, আমি পারব। দাদা খেলা করতে গিয়েচে।
—সুজি কোথায় আছে? ঘি?
নিভাননীর ধমক খাইয়া রাগ হইয়াছিল। সে কথা বলিল না।
—আঃ, বলি—সুজিটা কোথায়? সারাদিন খেটে খিদেতে মরছি, যা হয় কিছু খাব তো?
নিভাননী পূর্ববৎ চিঁ-চিঁ করিতে করিতে বলিল, আমার কী দরকার কথায়? যা বোঝ করো তুমি।
হাবি বলিল, আমি জানি বাবা, আমি দিচ্চি।
তখন নিভাননী মেয়েকে ডাকিয়া বলিয়া দিল, সুজি করিবার দরকার নাই, ও-বেলার রুটি করা আছে শিকেয় হাঁড়িতে। নিয়ে খেতে বল। চা করে দিতে পারবি?
হাবি ‘না’ বলিতে জানে না। ঘাড় লম্বা করিয়া বললি, হুঁ—উ—উ—
সে চায়ের কাপ ইত্যাদি লইয়া রান্নাঘরের দিকে যাইতে যাইতে বলিল, মা, উনুনে আঁচ দিয়ে দেবে কে?
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, তোমাকে ওসব করতে হবে না। হয়েছে, থাক, আর আমার চায়ে দরকার নেই, তারপর চা করতে গিয়ে জামায় আগুন লেগে মরুক—
নিভাননী বলিল, আহা মুখের কী মিষ্টি বাক্যি!
ক্ষেত্রবাবু এক গ্লাস জল ঢকঢক করিয়া খাইয়া ফেলিলেন। তারপর হাবির সাহায্যে রুটি বাহির করিয়া গুড় দিয়া এক-আধখানা নিজে খাইলেন, বাকি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করিয়া দিয়া টুইশানিতে বাহির হইলেন।
হাবি বলিল, বাবা, মা বলছে রাত্রে কী খাবে? একখানা পাউরুটি কিনে এনো—
ক্ষেত্রবাবু কথা কানে তুলিলেন না। ছাত্রের বাড়ি গিয়া মনে পড়িল, স্ত্রীর অসুখের জন্য একবার বেলেঘাটায় রামসদয় ডাক্তারের ওখানে যাইতে হইবে। খানিকটা আলাপ-পরিচয় আছে; স্কুল-মাস্টার বলিয়া ভিজিটটা কম লইয়া থাকে তাঁহার কাছে।
ছেলের বাপ আসিয়া কাছে বসিয়া ছেলের পড়ার তদারক করিতে লাগিল। ফলে ক্ষেত্রবাবু যে একটু সকাল সকাল বিদায় লইবেন, তাহার উপায় রহিল না। অভিভাবকের মনস্তুষ্টির দরুন বরং একটু বেশি সময় থাকিতে হইল। রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় ছাত্রের বাড়ি হইতে পদব্রজে বেলেঘাটা চলিলেন। ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিয়া কাজ শেষ করিতে সাড়ে দশটা বাজিয়া গেল, কাজেই আসিবার পথে ছয়টি পয়সা বাসভাড়া দিয়া ফিরিতে হইল।
বাসায় ফিরিয়া দেখেন, ছেলেমেয়েরা অঘোরে ঘুমাইতেছে। স্ত্রীর আবার জ্বর আসিয়াছিল সন্ধ্যার পরেই, সে বিছানায় পড়িয়া এপাশ-ওপাশ করিতেছে।
ভীষণ ক্ষুধা পাইয়াছে। কিন্তু এত রাত্রে কী খাইবেন? ভাত চড়াইবার ধৈর্য থাকে না আর এখন।
নিভাননী জ্বরে বেহুঁশ, তবুও সে জিজ্ঞাসা করিল, পাউরুটি এনেচ?
ঐ যাঃ! পাউরুটি কিনিতে ভুলিয়া গিয়াছেন, অত কি ছাই মনে থাকে? বলিলেন, না, আনতে মনে নেই।
নিভাননী উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিল, তবে কী খাবে এখন? দুটো চিঁড়ে কিনে আন না হয়—
ক্ষেত্রবাবু বিরক্তির সহিত বলিলেন, হ্যাঁঃ, এখন এগারোটা বাজে, আমার জন্যে চিঁড়ের দোকান খুলে রেখেছে তারা!
—দেখই না গো, মোড়ের দোকানটা অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
ক্ষেত্রবাবু সে কথার কোনো উত্তর না দিয়া কলসি হইতে এক গ্লাস জল গড়াইয়া ঢকঢক করিয়া খাইয়া আলো নিভাইয়া শুইয়া পড়িলেন, অর্থাৎ সমস্ত অসুবিধা ও অনাহারের দায়িত্বটা রুগ্ন স্ত্রীর ঘাড়ে চাপাইয়া দিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে।
নিভাননী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিল।
.
পরদিন সকালে ডাক্তার আসিয়া বলিল, রোগ বাঁকা পথ ধরিয়াছে। বাড়িতে ভালো চিকিৎসা হইবে না, হাসপাতালে পাঠাইতে পারিলে ভালো হয়। ক্ষেত্রবাবুর প্রাণ উড়িয়া গেল। হাসপাতালে স্ত্রীকে পাঠাইলে ছেলেমেয়েদের বাড়িতে দেখাশোনা করে কে? হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থাই বা তিনি কখন করেন।
ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরিয়া একটা চিঠি লিখাইয়া লইলেন ক্যাম্বেল হাসপাতালের এক ডাক্তারের নামে। খাইতে গেলে ক্যাম্বেল হাসপাতালে গিয়া কাজ মিটাইয়া আবার ঠিক সময়ে স্কুল যাইতে পারেন না। সুতরাং হাবিকে তাহার ভাইবোনের জন্য রান্না করিতে বলিয়া, না খাইয়াই বাহির হইলেন। ক্লার্কওয়েল সাহেবের স্কুলে পাঁচ মিনিট লেট হইবার জো নাই।
হাসাপাতালে গিয়া শুনিলেন, ডাক্তারবাবু দশটার আগে আসেন না। বসিয়া বসিয়া সাড়ে দশটার সময় ডাক্তারের মোটর আসিয়া গেটে ঢুকিল। ক্ষেত্রবাবুর হাত হইতে চিঠি পড়িয়া বলিলেন, আচ্ছা, আপনি ও-বেলা আমার সঙ্গে একবার দেখা করবেন, এই ছ’টার সময়। এ-বেলা বলতে পারচি নে।
ক্ষেত্রবাবু প্রমাদ গণিলেন। ছয়টা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করিবেন তো বাসায় যাইবেন কখন, ছেলে পড়াইতেই বা যাইবেন কখন?
স্কুলের কাজ শেষ হইয়া আসিয়াছে, বেলা চারিটা বাজে, এমন সময় সাহেবের ঘরে ডাক পড়িল।
ক্ষেত্রবাবু সাহেবের টেবিলের সামনে দাঁড়াইতেই সাহেব বলিলেন, ক্ষেত্রবাবু, দুটো ক্লাসের প্রশ্নপত্র লিথো করতে হবে—আপনি ছুটি হলে কাজটা করে বাড়ি যাবেন।
হেডমাস্টারের কথার উপর কথা চলে না, অগত্যা তাহাই করিতে হইল। ছুটির পর মাস্টারদের মধ্যে দুই-একজন বলিলেন, চলুন ক্ষেত্রবাবু, চা খেয়ে আসি।
—মনে সুখ নেই, চা খাব কী, চলুন—
সেখানে গিয়া মাস্টারের দল প্রস্তাব করিলেন, স্কুলে একদিন ফিস্ট করা হোক। হেডপণ্ডিত চা না খাইলেও এখানে উপস্থিত থাকেন রোজ। তিনি ফর্দ করিলেন, প্রত্যেক মাস্টারকে এক টাকা করিয়া চাঁদা দিতে হইবে। তাহা হইলে একদিন পোলাও রাঁধিয়া সবাই আমোদ করিয়া খাওয়া যায়। যদুবাবু বলিলেন, এক টাকা বড় বেশি হইয়া পড়ে—বারো আনার মধ্যে যাহা হয় হউক।
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, মনে সুখ নেই দাদা, এখন ওসব থাক।
যদুবাবু বলিলেন, কেন, কী হয়েছে?
—বাড়িতে বড় অসুখ। হাসপাতালে পাঠাতে হচ্চে কাল।
সকলেই নানারূপ ব্যগ্র প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। দুই-একজন ক্ষেত্রবাবুর বাড়ি পর্যন্ত গিয়া দেখিতে চাহিলেন। ফিস্ট খাইবার প্রস্তাব আপাতত মুলতুবী রহিল। সকলেই কম মাহিনায় সংসার চালান, এক পরিবারের মত মনে করেন পরস্পরকে, একজনের দুঃখ সবাই বোঝেন বলিয়াই চায়ের এ মজলিশের বন্ধুদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন ঘনিষ্ঠ ও নির্ভেজাল।
ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে নারাণবাবু হাসপাতাল পর্যন্ত গেলেন। ক্ষেত্রবাবু বলিয়াছিলেন, আপনি বুড়োমানুষ, এতটা আর যাবেন না হেঁটে।
—বুড়োমানুষ বলে কি মানুষ নই? ও কী ভায়া, চল, গিয়ে দেখে আসি।
দুজনে গিয়া ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিয়া হাসপাতালের সব ব্যবস্থা করিয়া ফেলিলেন এবং পরদিনই নিভাননীকে হাসপাতালে আনা হইল।
.
নারাণবাবু রোজ বিকালে টুইশানিতে যাইবার আগে দুইটি কমলালেবু, কোনোদিন বা এক গুচ্ছ আঙুর লইয়া নিভাননীকে দেখিয়া যান। স্কুলে পরদিন বলেন, ও ক্ষেত্র-ভায়া, বউমা কাল বলছিলেন, তুমি হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছ, তোমার কে এক শালি আছেন, তাঁকে এনে দু’দিন রাখ না—
—আপনাকে বললে বুঝি?
—হ্যাঁ, কাল উনি বলছিলেন। তোমার কষ্ট হচ্ছে। কবে যে সেরে উঠব, কবে যে বাড়ি যাব—বলছিলেন বউমা।
—ওই রকম বলে। শালিকে আনা কী সহজ দাদা? নিয়ে এস খরচ করে, দিয়ে এস খরচ করে—খাওয়াও লুচি-পরোটা। সে কি আমাদের সাধ্যি?
নারাণবাবুকে নিভাননী ‘দাদা’ বলিয়া ডাকে। আড়ালে ‘বটঠাকুর’ বলিয়া ডাকে স্বামীর কাছে। নারাণবাবু কত রকম মজার গল্প করেন তাহার কাছে, রোগীর মনে আনন্দ দিতে চান। একদিন নিভাননী বলিল, দাদা, আমি ভালো হলে আপনাকে ছোট বোনের বাড়ি একদিন খেতে হবে।
নারাণবাবু শশব্যস্ত হইয়া বলেন, নিশ্চয় বউমা, নিশ্চয়, এর আর কথা কী?
—আপনি কী খেতে ভালোবাসেন দাদা?
—আমি? আমার—বউমা—বুড়ো হয়েছি—যা হয় সব ভালো লাগে। একলা থাকি, রেঁধে খাই—
—কতদিন আছেন একা?
—তা আজ সাতাশ বছর বউমা।
—একা আছেন?
—তা থাকতে হয় বইকি বউমা। নিজেই রাঁধি—এই বয়সে কি রান্না করতে ইচ্ছে করে? বেশি কিছু রাঁধি না, যা হয় একটা তরকারি করি।
—আপনি মাছ খান?
—তা খাই বউমা। ও বোষ্টমদের ঢঙ নেই আমার। পুরুষ মানুষ, মাছ-মাংস কেন খাব না? ও বোষ্টমদের মেয়েলিপনার ঢঙ দেখলে আমি হাড়ে চটি।
—আমি আপনাকে ইলিশমাছের দই-মাছ রেঁধে খাওয়াব। আমি দিদিমার কাছে রাঁধতে শিখেছি, জানেন?
পিতৃসম স্নেহময় বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলিবার সময় নিভাননীর কণ্ঠে আপনিই যেন আবদারের সুর আসিয়া পড়ে। তাহার বালিকা-বয়সে যে বাবা স্বর্গে গিয়াছেন, যাঁহার কথা ভালো মনে পড়ে না—এই প্রাণখোলা সরল বৃদ্ধের মধ্যে নিভাননী তাঁহাকেই যেন আবার দেখিতে পায়, নিজের কণ্ঠে কখন যে কন্যার মত আবদার-অভিমানের সুর আসিয়া পড়ে সে বুঝিতেও পারে না।
নারাণবাবু বসিয়া বসিয়া সুখ-দুঃখের কথা বলেন। নারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আজ ত্রিশ বছর আসেন নাই—স্নেহ-ভালোবাসার পাট উঠিয়া গিয়াছে। এমন দরদী শ্রোতা পাইয়া তাঁহারও মনের উৎসমুখ খুলিয়া যায়। প্রথম জীবনের চাকুরির কথা বলেন। বহুকাল-পরলোকগতা পত্নীর সম্বন্ধে বলেন, অনুকূলবাবুর কথাও পাড়েন। নিভাননী সহানুভূতি জানায়, একমনে শুনিতে শুনিতে কখন তাহার চোখ ছলছল করিয়া উঠে।
ক্ষেত্রবাবু সবদিন আসিতে পারেন না। টুইশানি, বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের দেখাশানো এসব সারিয়া রোজ হাসপাতালে আসা চলে না। নারাণবাবু আসেন বলিয়া হয়তো তেমন দরকারও হয় না।
সেদিন নারাণবাবু টুইশানি সারিয়া বউবাজারের মোড় হইতে একটা বেদানা ও দুইটি কমলালেবু কিনিলেন। অনেকদিন কিছু হাতে করিয়া যাইতে পারেন নাই। আজ টুইশানির মাহিনা পাইয়াছেন। হাসপাতালের হলে দেখিলেন, হলের কোণে নিভাননীর সে বিছানাটা খালি, লোহার খাটটা হাড়পাঁজরা বাহির করা পড়িয়া আছে।
নারাণবাবু ভাবিলেন, তাঁহার ভুল হইয়াছে। কোন ঘরে আসিতে কোন ঘরে আসিয়াছেন, বৃদ্ধ বয়সে মনে থাকে না। বাহির হইতে গিয়া বারান্দায় জলের না কিসের ড্রামটি চোখে পড়িল। না, এই ড্রাম রহিয়াছে—এই তো ঘর। আবার তিনি ঘরে ঢুকিলেন।
পাশের বিছানার এক রোগী বলিল, আপনি কাকে খুঁজছেন বলুন তো? ও, সেই বউটির আপনি কেউ—আহা, আপনি জানেন না! ও তো আজ দুপুরে হয়ে গিয়েছে। বউটির স্বামী এল, আরও কে কে এল—নিয়ে গেল, প্রায় তখন তিনটে। আহা, আমরা সবাই—কথা কইতে কইতে পাশ ফিরল আর অমনি হয়ে গেল। হার্টে কিছু ছিল না। আহা, আপনি কে হতেন ওঁর—ইত্যাদি।
নারাণবাবু কিছু না বলিয়া ফলগুলি হাতে করিয়া বাহিরে আসিলেন।
আজ ক্ষেত্রবাবুকে কি স্কুলে দেখেন নাই? না বোধ হয়। এখন মনে পড়িল, সারাদিন স্কুলে ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে দেখা হয় নাই বটে। আজ হাসপাতালে আসিবেন বলিয়া টুইশানিতে গিয়াছিলেন ছুটির পরেই, সুতরাং চায়ের দোকানেও যান নাই। নতুবা ক্ষেত্রবাবুর অনুপস্থিতি চোখে পড়িত।
নিজের ছোট ঘরের নিঃসঙ্গ শয্যায় শুইয়া বৃদ্ধ কত রাত পর্যন্ত ঘুমাইতে পারিলেন না।
.
স্কুলের দুর্দশা উপস্থিত হইল এপ্রিল মাস হইতে। এপ্রিল মাসে মাস্টারদের বেতন ঠিক সময় দেওয়ার উপায় রহিল না; কারণ এবার জানুয়ারি মাসে আশানুরূপ ছেলে ভর্তি হয় নাই, বরং অনেক ছেলে ট্রান্সফার লইয়া চলিয়া গিয়াছে। এ স্কুলে ছেলেদের মাহিনা অন্য স্কুল হইতে বেশি, এই সব দুঃসময়ে লোক বেশি মাহিনা দিতে আর চায় না। পূর্বে ভাবা গিয়াছিল, সাহেব-মেমের স্কুলে পড়াইবে বলিয়া পাড়ার বড়লোকেরা ছেলে এখানেই ভর্তি করিবে; কিন্তু গত ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল তেমন ভালো না হওয়ায় এ স্কুলে পড়াইতে অনেকেই দ্বিধা বোধ করিল। ফলে ছেলে অনেক কমিয়া গিয়াছে এবার।
মাস্টাররা সাতাশে এপ্রিল মার্চ মাসের মাহিনার কিছু অংশ মাত্র পাইল। গরমের ছুটির পূর্বে মে মাসে মার্চ মাসের প্রাপ্ত বেতনের বাকি অংশ শোধ করিয়া দেওয়া হইল। দেড় মাস গরমের ছুটি, গরিব শিক্ষকেরা বাড়ি গিয়া খায় কী? হেডমাস্টারের কাছে দরবার করিয়া ফল হইল না। সকলে বলিল, সাহেব-মেম ঠিক ওদের পুরো ছুটির মাইনে নিয়ে যাচ্ছে, আমাদেরই বিপদ।
শোনা গেল, সাহেব দিল্লি না কোথায় যেন বেড়াইতে যাইতেছে।
স্কুলের কেরানি হরিচরণ নাগ কিন্তু বলিল, কথা ঠিক নয়—সাহেব এখনও মার্চ মাসের মাহিনা শোধ করিয়া লয় নাই। মেম এপ্রিল মাস পর্যন্ত মাহিনা লইয়াছে বটে।
সাহেবের নিকট যাইয়া মাহিনা পাইবার জন্য বেশি পীড়াপীড়ি করিলে সাহেব বলিলেন, মাই ডোর ইজ ওপন—যাঁদের না পোষায় চলে যেতে পারেন। আমার স্কুলে কষ্ট করে যারা থাকতে না পারবে, তাদের দিয়ে এখানে কাজ হবে না। আমাদের অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে এখনও যেতে হবে—স্বার্থত্যাগ চাই তার জন্যে। সামনের বছর থেকে স্কুল ভালো হয়ে যাবে, এই বছরটা তোমরা আমার সঙ্গে সহযোগিতা করো।
ক্লার্কওয়েল সাহেবের ব্যক্তিত্ব বলিয়া জিনিস ছিল, অন্তত গরিব টিচারদের কাছে। কারণ ব্যক্তিত্ব জিনিসটা ভীষণ রিলেটিভ, আমার গুরুদেবের ব্যক্তিত্ব তোমার কাছে হয়তো কিছুই নয়, কিন্তু আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ; তোমার জমিদার-মনিবের ব্যক্তিত্ব যতই গুরু হউক, আমার নিকটে তাহা নিতান্তই লঘু। সুতরাং মাস্টারের দল শুধুহাতে গরমের ছুটিতে দেশে চলিয়া গেল।
.
যদুবাবু পড়িয়া গেলেন মুশকিলে। কলিকাতা ছাড়িয়া কোথাও একটা যাইবার স্থান নাই, অথচ ইচ্ছা করে কোথাও যাইতে। কতদিন কলিকাতার বাহিরে যাওয়া ঘটে নাই, হাতও এদিকে খালি। তাঁহার ছাত্রেরা দেশে যাইতেছে, নবদ্বীপের কাছে পূর্বস্থলী নামে গ্রাম, বেশ নাকি ভালো জায়গা। কিন্তু যদুবাবু তো একা নহেন, স্ত্রীকে বাসায় রাখিয়া যাওয়া সম্ভব নয়।
পৈতৃক গ্রামে যাইতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সেখানে ঘরবাড়ি নাই। জমিজমা শরিক কিনিয়া লইয়াছে আজ বহুদিন। তবুও যদুবাবু বলিলেন, বেড়াবাড়ি যাবে?
যদুবাবুর স্ত্রী বিবাহ হইয়া কিছুদিন যশোর জেলার এই ক্ষুদ্র গ্রামে শ্বশুরঘর করিয়াছিল, ম্যালেরিয়া ধরিয়া মাস দুই ভোগে। তাহার পর হইতেই স্বামীর সঙ্গে বর্ধমান ও পরে কলিকাতায়। সে বেড়াবাড়ি যাইবার প্রস্তাবে বিস্মিত হইয়া কহিল, বেড়াবাড়ি! সেখানে কেমন করে যাবে গো? বাড়িঘর কোথায় সেখানে?
—চলো না, অবনীদের বাড়িতে গিয়া উঠি। সেও তো কলকাতায় এসে আমার বাসাতে থেকে গিয়েছে দু-একবার।
—না বাপু, পরের ঘরকন্নার মধ্যে যাওয়া, সে বড় ঝঞ্ঝাট। হাতে তোমার টাকাই বা কই?
যদুবাবুর মতলব একটু অন্য রকম। হাতে প্রায় কিছুই নাই, স্ত্রীকে পাড়াগাঁয়ে জ্ঞাতিদের বাড়ি গছাইয়া রাখিয়া আসিয়া দিনকতক তিনি একটু হালকা হইবেন। এগারো টাকা করিয়া বাসাভাড়া আর টানিতে পারেন না। ওই থার্ড মাস্টার শ্রীশ রায় মেসে থাকে, আড়াই টাকা সীট, রেন্ট, খোরাকি খরচ দশ টাকা, সাড়ে বারো টাকার মধ্যে সব শেষ।
যদুবাবু স্ত্রীকে বলিয়া-কহিয়া রাজি করাইলেন। কিন্তু যাইবার দিন বাড়িওয়ালা গোলমাল বাধাইল।
—আজ পাঁচ মাসের বাড়িভাড়া পাওনা মশাই, পাঁচ এগারোং পঞ্চান্ন টাকা—দশ টাকা মাত্র ঠেকিয়েছেন এ মাসে আর মাত্র পাঁচ টাকা ঠেকিয়ে চলে যাচ্ছেন? বাক্স-পেঁটরা-বিছানা সবই নিয়ে চললেন, রইল এখানে কী তবে? ওই একটা জারুল কাঠের সিন্দুক আর এখানে ভাঙা তক্তপোশ, আর তো দেখছি কয়লাভাঙা হাতুড়িটা আর মরচে-ধরা গোটা দুই কাচ-ভাঙা হ্যারিকেন। আপনি যদি আর না আসেন মশাই তো এতে আমার চল্লিশ টাকা আদায় হবে কিসে বুঝিয়ে দিয়ে তবে যান। আমি পাড়ার লোক ডাকি, তারা বলুক, আমার যদি অন্যায় হয়ে থাকে মশাই, আমায় দশ ঘা জুতো মারুক। আপনি ভদ্রলোকের ছেলে, বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলাম, ইস্কুলে মাস্টারি করেন, ছেলেদের লেখাপড়া শেখান, তা এই যদি আপনার ধরন হয়—না মশাই, আমি তা পারব না। মাপ করবেন। আপনি যেতে হয়, জিনিসপত্র রেখে যান, নইলে আমার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে যান।
—কী হয়েছে, কী হয়েছে?—বলিয়া কলিকাতার হুজুগপ্রিয় কৌতূহলী লোক ভিড় পাকাইয়া তুলিল। কেহ হইল বাড়িওয়ালার দিকে, কেহ হইল যদুবাবুর দিকে—উভয় দলে মারামারি হইবার উপক্রম হইল। যদুবাবুর স্ত্রী চট করিয়া উপরে গিয়া বাড়িওয়ালার মায়ের কাছে কাঁদিয়া পড়িলেন—মা, আপনি বলে দিন। টাকা আমরা ফেলে রাখব না—পালাবও না। স্কুল খুললেই টাকা শোধ দেব।
দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া বাড়িওয়ালার মা ডাকিল, ও বদে, বলি শোন, ওপরে আয়।
ব্যাপারটা মিটিল। স্ত্রী ও বাক্স-বিছানাসমেত যদুবাবু মুক্তি পাইলেন; কিন্তু আর তিনি কোনোদিন এ বাসা তো দূরের কথা, এ পাড়ার ত্রিসীমানাও মাড়ান নাই।
বেড়াবাড়ি বগুলা স্টেশনে নামিয়া সাত ক্রোশ গরুর গাড়িতে যাইতে হয়। দুপুর ঘুরিয়া গেল সেখানে পৌঁছিতে। শরিক অবনী মুখুজ্জে আহারাদি সারিয়া দিবানিদ্রা দিতেছিলেন, বাহিরে শোরগোল শুনিয়া আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তিনি খুব সন্তুষ্ট হইলেন না। মুখে বলিলেন, কে, যদুদা? সঙ্গে কে? বউদি? বেশ, বেশ—তা এতকাল পরে মনে পড়েছে যে! না, ভালো না, বাড়ির সবার অসুখ ব্যায়রাম। আপনার বউমা তো কাল জ্বর থেকে উঠেছে—ছেলে দুটোর এমন পাঁচড়া যে পঙ্গু হয়ে বসে থাকে—ও পুঁটি—ওগো—এই বউদিদি এসেছেন, নামিয়ে নাও—
রাত্রে যদুবাবু দেখিলেন, থাকিবার ভীষণ কষ্ট। ইহাদের দুইটি মাত্র ঘর আর এক ভাঙা পূজার দালান, তার একখানায় কাঠকুটা রহিয়াছে। একটি ঘরে ভদ্রতা করিয়া আজিকার জন্য থাকিবার জায়গা দিয়াছে বটে, কিন্তু বেশিদিনের জন্য এ ব্যবস্থা সম্ভব নয়, কারণ অবনীর তিনটি বড় মেয়ে, দুইটি ছেলে, স্ত্রী ও এক বিধবা দিদিকে লইয়া পাশের ওই একখানি মাত্র ঘরে কতদিন থাকিতে পারিবে?
দুই দিন গেল, এক সপ্তাহ গেল। গরমে বড় কষ্ট হয়—সেকেলে কোঠার ছোট ছোট জানালা, হাওয়া চলে না।
অবনীদের সংসারে প্রথম দুই দিন এক হাঁড়িতেই খাওয়া চলিয়াছিল, তারপর যদুবাবুর আলাদা রান্না হয়। জিনিসপত্র সস্তা, এক সের করিয়া দুধ যোগান করা হইয়াছে—বেশ খাঁটি দুধ। যদুবাবুর স্ত্রী বলে, এমন দুধ, যাই বল, শহরে বেশি পয়সা দিলেও মিলবে না।
কিন্তু দিন-পনেরো পরে থাকিবার বড় অসুবিধা হইতে লাগিল। অবনী একদিন ঘুরাইয়া কথাটা বলিয়াই ফেলিল। অর্থাৎ দেশ তো দেখা হইয়াছে, এবার যাইবার কী ব্যবস্থা, ভাবখানা এই রকম।
রাত্রে যদুবাবু স্ত্রীকে নিম্নকণ্ঠে বলিলেন, অবনী তো বলছিল, আর ক’দিন আছ দাদা? তা কী করি বল তো? এই গরমে কলকাতায়—
স্ত্রী বলিল, চল এখান থেকে বাপু। নানান অসুবিধে। মন টেঁকে না। বাবাঃ, যে জঙ্গল! ঘরদোরগুলো ভালো না, ছাদ যেমন—একটু বিষ্টি হলেই জল পড়বে। আর ওরাও আর তেমন ভালো ব্যবহার করছে না। আজ ঘাটে বড়দিদি কাকে বলছিল—আমাদের বাড়িতে আর শরিকের ভাগ নেই, যে যেখানে আছে হুট করে এলেই তো হল না! এই রকম কী কথা! আমাদের যাওয়াই ভালো। যে মশা, রাত্তিরে ঘুম হয় না মশার ডাকে।
যদুবাবুর তাহা ইচ্ছা নয়। স্ত্রীকে এবার শরিকের ঘাড়ে কিছুদিন চাপাইয়া যাইবেন, এই মতলব লইয়াই এখানে আসিয়াছেন। তিনি কিছু বলিলেন না।
আর দুই-তিন দিন পরে যদুবাবু ফিরিবেন মনস্থ করিলেন।
অবনীকে বলিলেন, তোমার বউদিদি রইল এ মাসটা, দিদির সঙ্গে শোবে। আমার কলকাতায় না গেলে নয়, আমি পরশু নাগাদ যাই।
গ্রামের কাপালীপাড়া হইতে সিধু কাপালী আসিয়া বলিল, দাদাঠাকুর, এ গাঁয়ে একটা পাঠশালা খুলে বসুন। পঁচিশ-ত্রিশটা ছেলে দেব—চার আনা আট আনা করে রেট। আপনার বাড়ি বসে যা হয়! কলকাতা ছেড়ে দিয়ে এখানেই থেকে যান না কেন?
যদুবাবু হাসিয়া বলিলেন, কলকাতার স্কুলে পঁচাত্তর টাকা মাইনে পাই—সত্তর ছিল, ছেড়ে দেব বলে ভয় দেখিয়েছিলাম, অমনি সেক্রেটারি পাঁচ টাকা বাড়িয়ে বলল—যদুবাবু, আপনার মত টিচার আর কোথায় পাব, আপনি থাকুন। প্রাইভেট টুইশানিতে তাও ধরো পাই—পনেরো আর পঁচিশ সকালে—বিকেলে পনেরো আর কুড়ি। এই ছেড়ে আসব পাঠশালা খুলে চার আনা আট আনা নিয়ে ছেলে পড়াতে? তুমি হাসালে সিদ্ধেশ্বর!
অবনী সেখানে উপস্থিত ছিল। যদুদাদা যে স্কুলে এত মাহিনা পান, এই সে প্রথম শুনিল। কিন্তু কই, তেমন তো আসবাব বাসনপত্র কিছুই নাই! বউদিদি মোটে চারখানা শাড়ি আনিয়াছেন। দাদার দুইটি মলিন পিরান, গায়ে ভালো গেঞ্জি একটাও দেখা যায় না। বিছানা তো যা আনিয়াছেন, তাহা দেখিয়া একদিন অবনীর স্ত্রী বলিয়াছিল—বটঠাকুরের যা বিছানাপত্র, ওই বিছানায় কী করে ওরা শোয় কলকাতা শহরে, তা ভেবে পাই নে। আমরা যে অজ-পাড়াগেঁয়ে—আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত ও-বিছানায় শোবে না।
গ্রামের সকলে ধরিয়াছিল, এতকাল পরে দেশে এসেছ, গাঁয়ের ব্রাহ্মণ কটিকে ভালো করে একদিন মা-বাপের তিথিতে খাইয়ে দাও। কিছুই তো করলে না গাঁয়ে—
যদুবাবু তাহাতে কর্ণপাত করেন না।
অথচ তিনি এত রোজগার করেন নিজের মুখেই তো বললেন। কী জানি কী ব্যাপার শহরের লোকের! বেশ মোটা পয়সা হাতে নিয়ে এসেছে দাদা, অথচ খরচপত্র বিষয়ে কঞ্জুস—
কথাটা অবনী স্ত্রীকে বলিল।
স্ত্রী বলিল, কী জানি বাপু, দিদির গায়ে তো একরত্তি সোনা নেই—শাঁখা আর কাঁচের চুড়ি এই তো দেখছি, তা কেমন করে বলব বল? হতে পারে।
—তুমি জান না, ওসব কলকাতার লোক, পাড়াগাঁয়ে আসবার সময়ে সব খুলে রেখে এসেছে। চুরি যাবার ভয় বড্ড ওদের।
ভাবিয়া-চিন্তিয়া পরদিন অবনী যদুবাবুর কাছে দুপুরের পর কথাটা পাড়িল : দাদা, একটা কথা ছিল—
—কী হে?
—নানা রকমে বড় জড়িয়ে পড়েছি, মেয়েটা বড় হয়ে উঠেছে, বিয়ে না দিলে আর নয়। বড়দা সেই সোনাঙ্গতির মোকদ্দমা করে আড়ালে বিল বিক্রি করে ফেললেন, জানেন তো সব। সেই নিজে মারাও গেলেন, আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে গেলেন। পয়সা অভাবে ছেলেটাকে পড়াতে পারছি না। তা আমি বলচি কী, ছেলেটাকে আপনার বাসায় রেখে যদি দুটো দুটো খেতে দেন আর আপনার স্কুলে ফ্রী করে নেন দয়া করে, তবে গরিবের ছেলের লেখাপড়াটা হয়। আপনিও তো ওর জ্যাঠামশায়—
যদুবাবু বুঝিলেন, মাহিনা সম্বন্ধে ও-রকম বলা উচিত হয় নাই তখন। পাড়াগাঁয়ের গতিক ভুলিয়া গিয়াছেন বহুদিন না আসার দরুন। এসব জায়গার লোকে সর্বদা সুবিধা খুঁজিয়া বেড়াইতেছে, চাহিতে-চিন্তিতে ইহাদের দ্বিধা নাই, লজ্জা নাই। কী বিপদেই ফেলিল এখন!
মুখে বলিলেন, তা আর বেশি কথা কী! সুঁটো থাকবে, এ ভালো কথাই তো! তবে এখন স্কুলে ভর্তি করার সময় নয়, সামনের জানুয়ারি মাসে নিয়ে যাব ওকে।
অবনী পল্লীগ্রামের লোক, পাইয়া বসিল। বলিল, তা কেন দাদা, বউদিদির সঙ্গেই যাক না। বাসায় থাকুক, সকালে বিকেলে আপনার কাছে একটু-আধটু পড়লেও ওর যথেষ্ট বিদ্যে হবে পেটে। বংশের মধ্যে আপনি এল-এ পাস করেছেন—আমাদের বংশের চুড়ো আপনি। আমরা সব মুখ্যু-সুখ্যু। দেখুন, যদি আপনার দয়ায় একটু-আধটু ইংরিজি পেটে যায় ওর, পরে করে খেতে পারবে।
যদুবাবু কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিলেন, তা—তা হবে। বেশ—বেশ।
স্ত্রীকে রাত্রে কথাটা বলিলেন। স্ত্রী বলিল, কে, ওই সুঁটো? ওই দেখতে পিলেরোগা পেটমোটা, ও আধসের চালের ভাত খায়! সেদিন একটা কাঁটাল একলা খেলে। ওর পেছনে, যা মাইনে পাও, সব যাবে। তা তুমি কিছু বলেচ নাকি?
—বলেচি বলেচি! কী আর করি! তোমাকে নিয়ে যাবার সময় এখন ছিনে-জোঁকের মত ধরে না বসে! ওসব লোককে বিশ্বাস নেই রে বাবা!
—কেন, বাহাদুরি করতে গিয়েছিলে যে বড়! এখন সামলাও ঠ্যালা!
যদুবাবুকে আরও বেশি মুশকিলে পড়িতে হইল। যেদিন তিনি যাইবেন, সেদিন অবনী আসিয়া কুড়ি টাকা ধার চাহিয়া বসিল। না দিলে চলিবে না, সামনের মাসে সে বউদিদির হাতে কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করিয়া দিবে। এখন না দিলে জমিদারের নালিশের দায়ে আমন ধানের জমা বিক্রয় হইয়া যাইবে। সে (অবনী) তাঁহাকে বড় দাদার মত দেখে, তিনি না দিলে এ বিপদের সময় সে কোথায় দাঁড়ায়, কাহার কাছে বা হাত পাতে?
অবনী একেবারে যদুবাবুর পা জড়াইয়া ধরিল। দিতেই হইবে, যদুবাবুর বউমা পর্যন্ত নাকি বটঠাকুরের কাছে আসিবার জন্য তৈয়ারি হইয়া আছে টাকার জন্য।
যদুবাবু প্রমাদ গণিলেন। এমন বিপদে পড়িবেন জানিলে তিনি সাধু কাপালীকে কি ও কথা বলেন? বলিলেন, তা একটা কথা, টাকাকড়ি ভায়া এখানে কিছু রাখি নি তো! সব ব্যাঙ্কে। তোমার বউদিদি বললে, পাড়াগাঁয়ে যাচ্ছ—সোনাদানা টাকাকড়ি সব এখানে রেখে দাও। হাতে কেবল যাবার ভাড়াটা রেখেছি ভায়া।
—আজই যাবেন?
—হ্যাঁ, এখুনি খাওয়া হলেই বেরুব। আজই দশটার গাড়িতে—
যদুবাবু মনে মনে বলিলেন, যাও বা থাকতাম আজকের এ বেলাটা হয়তো, আর এক দণ্ডও এখানে থাকি! এখন বেরুতে পারলে হয় এখান থেকে!
কিন্তু অবনী মুখুজ্জে অভাবগ্রস্ত পাড়াগাঁয়ের লোক, তাহাকে তিনি চেনেন নাই কিংবা চিনিয়াও ভুলিয়া গিয়াছিলেন।
অবনী বলিল, বেশ দাদা, চলুন আমিও আপনার সঙ্গে কলকাতা যাই তবে। না হয় যাতায়াতে সাত সিকে পয়সা খরচ হয়ে গেল, টাকাটা এনে জমিদারের দায় থেকে তো বেঁচে যাব এখন! সাত সিকে খরচ বলে এখন কী করব, না হয় গুনগার গেল!
যদুবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, তুমি কেন গাড়িভাড়া করে যেতে যাবে? আমি গিয়েই মনিঅর্ডার করে পাঠাব। তা ছাড়া আজ—আজ আমি, কি বলে—একটু হালিশহরে নামব কিনা। আমার বড় শালির বাড়ি। তারা কি গেলেই আজ ছাড়বে? এক-আধ-দিন রাখবেই। তুমি মিছিমিছি পয়সা খরচ করবে, অথচ সেই দেরি হয়েই যাবে।
অবনী বলিল, ভালোই তো চলুন না হয় বউদিদির বোনের বাড়ি দেখেই আসি। গাঁয়ে থাকি পড়ে, কুটুমবাড়ির ভালোটা মন্দটা না হয় খেয়েই আসি দুদিন।
কোথায় যাইবে অবনী তাঁহার সঙ্গে! তিনি এখন শ্রীশের মেসে গিয়া উঠিবেন। যদুবাবু কী যে বলেন, উপস্থিত বুদ্ধিতে আর কুলায় না। আকাশ-পাতাল ভাবাও যায় না সামনে দাঁড়াইয়া। বলিলেন, বেশ, বেশ, এ তো খুব ভালো কথা, তোমার মত কুটুম্ব যাবে আমার শালির বাড়ি। তবে একটা কথাও ভাবছি আবার, যদি কলকাতায় গিয়ে আমাদের স্কুলের হেডমাস্টারের দেখা না পাই!
—হেডমাস্টার! কেন দাদা?
যদুবাবু এতক্ষণে ভাবিয়া বলিবার একটা রাস্তা খুঁজিয়া পাইয়াছেন। বলিলেন, হেডমাস্টারের কাছে ব্যাঙ্কের বইখানা রয়েছে কিনা! হেডমাস্টার না থাকলে টাকা তুলব কী করে!
—কারও কাছে চাইলে আপনি দুদিনের জন্যে ধার পেয়ে যাবেন দাদা। আপনার কত বন্ধুবান্ধব সেখানে! এ দায় উদ্ধার করতেই হবে আপনাকে! দিন একটা উপায় করে!
—অবিশ্যি তা পেতাম। কিন্তু আমার যে বন্ধুবান্ধব এখন গরমের সময় কেউ নেই কলকাতায়, দার্জিলিং কি সিমলে পাহাড়ে গিয়েছে গরমের সময়। কলকাতার বড়লোক উকিল ব্যারিস্টার সব—গরমের সময় সব পাহাড়ে চলে যাবে, এ কি তুমি-আমি!
—তাই তো দাদা, তবে আমার কী উপায় হবে?—অবনী মুখুজ্জে প্রায় কাঁদো-কাঁদো হইয়া পড়িল।
যদু বলিলেন, কিছু ভেবো না ভায়া। আমি যাচ্ছি কলকাতায়—গিয়ে একটা যা হয় হিল্লে লাগিয়ে দেব। কেন তুমি পয়সা খরচ করে অনর্থক যাবে আমার সঙ্গে? আমি চেষ্টা করে দেখে মনিঅর্ডার করে দেব হাতে পেলেই। আচ্ছা চলি, দুটো খেয়ে নিই—আর দেরি করা চলে না।
যদুবাবু ঝড়ের বেগে সে স্থান ত্যাগ করিলেন। মনে মনে বলিলেন, উঃ, কী ছিনেজোঁক রে বাবা! কিছুতেই বাগ মানে না, এত করে ভেবে-ভেবে বলি! ভাগ্যিস মনে এল হেডমাস্টারের কাছে ব্যাঙ্কের খাতার ওই ফন্দিটা!
টিনের সুটকেস হাতে ঝুলাইয়া যদুবাবু তাড়াতাড়ি দুইটি খাইয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন, পাছে অবনী তাহার মত বদলাইয়া ফেলে! কী ঝঞ্ঝাট, এখন মেসে বসাইয়া উহাকে ফ্রেন্ডচার্জ দিয়া খাওয়াও, থিয়েটার বায়োস্কোপ দেখাও—কোথায় ব্যাঙ্ক, আর কোথায় বা টাকা!
.
যদুবাবু শ্রীশ রায়ের মেসে আসিয়া উঠিবার পরে অবনী মুখুজ্জের পর পর তিন-চারিখানা তাগাদার চিঠি পাইলেন। তিনি উত্তর লিখিয়া দিলেন, হেডমাস্টার অনুপস্থিত—টাকা ধারের কোনো উপায় হইল না, সেজন্য তিনি খুব দুঃখিত। তবুও চেষ্টায় আছেন। যদুবাবুর স্ত্রী বেচারির খোঁটা খাইতে খাইতে প্রাণ যাইতেছে। সে বেচারি লিখিল, পরের বাড়ি এমন করিয়া ফেলিয়া রাখা কি তাঁহার উচিত হইতেছে? কবে তিনি আসিয়া লইয়া যাইবেন? আর সে এক দণ্ডও এখানে থাকিতে চায় না!
যদুবাবু স্ত্রীর পত্রের কোনো উত্তর দিলেন না।
যদুবাবুরও খুব দোষ দেওয়া যায় না। স্কুল খুলিবার পর প্রত্যেক মাস্টার মাত্র পনেরো টাকা করিয়া পাইলেন ছুটির মাসের দরুন। তাহার মধ্যে মেসখরচ করিয়া আর হাতে কিছু থাকে না। এদিকে পুরাতন বাড়িওয়ালা স্কুলে আসিয়া তাগাদা দিয়া গায়ের ছাল ছিঁড়িয়া খাইবার উপক্রম করিতেছে। হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করিবার ভয় দেখাইয়া গিয়াছে, কেমন ভদ্রলোক সে দেখিয়া লইবে!
চায়ের দোকানের মজলিশে বসিয়া মাস্টারের দল পয়সাকড়ির টানাটানির কথা রোজই আলোচনা করে। কারণ অবস্থা সকলেরই একরূপ। জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, সামান্য ত্রিশটে টাকা, তাও দু’ মাস বাকি। সাহেবের কাছে বলতে গেলাম, সাহেব আজ দু’টাকা দিলে মোটে।
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমাদেরও তো তাই, সংসার অচল।
যদুবাবু বলিলেন, আমার দুর্দশা তো দেখতেই পাচ্ছ। দু’ বেলা শাসিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেত্রভায়া, তোমার ছেলেমেয়ে কোথায় এখন?
—রেখেছিলাম আমার শাশুড়ির কাছে দু মাস। এখন আবার এনেছি।
নারাণবাবু বলিলেন, আহা, বউমার কথা ভাবলে কী কষ্ট যে পাই মনে। লক্ষ্মীস্বরূপিণী ছিলেন। আমি যেন তাঁর বাবা, তিনি মেয়ে—এমন ব্যবহার করতেন আমার সঙ্গে।
উপস্থিত সকলেই ক্ষেত্রবাবুর স্ত্রী-বিয়োগের কথা স্মরণ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিলেন।
ক্ষেত্রবাবু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। তাহার নিগূঢ় কারণও ছিল। এই গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি বর্ধমানে তাঁহার জাঠতুতো ভাইয়ের কাছে গিয়াছিলেন। জাঠতুতো ভাই বর্ধমানে রেলে কাজ করেন। বউদিদি সেখানে তাঁহার জন্য একটি পাত্রী ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন। পাত্রীপক্ষ এজন্য তাঁহাকে অনুরোধও করিয়া গিয়াছে। তিনি এখনও মত দেন নাই বটে, কিন্তু এ শনিবার হঠাৎ তাঁহার মন বর্ধমানে যাইতে চাহিতেছে কেন!
চায়ের দোকান হইতে বাহির হইয়া টুইশানিতে যাইবার পূর্বে ক্ষেত্রবাবু ওয়েলেসলি স্কোয়ারে একটু বসিলেন। বেঞ্চিখানাতে আর একজন কে বসিয়া ছিল, তিনি বসিতেই সে উঠিয়া গেল। ক্ষেত্রবাবু একটু অন্যমনস্ক! পুনরায় বিবাহ করিবার অবশ্য তাঁহার ইচ্ছা নাই। করিবেনও না। তবে আর একটা কথাও ভাবিয়া দেখিতে হইবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিশেষ কষ্ট। সেই কোন সকালে তিনি স্কুলে চলিয়া আসিয়াছেন। বড় মেয়েটার উপরে সব ভার—তার বয়স এই মাত্র সাড়ে সাত। সে-ই রান্নাবান্না, ছোট ভাই-বোনদের খাওয়ানো-মাখানোর ঝুঁকি ঘাড়ে লইয়া গৃহিণী সাজিয়া বসিয়া আছে। কিন্তু আজ যদি একটা শক্ত অসুখবিসুখ হয় কাহারও—কে দেখাশোনা করিবে তাহাদের? এ সব ভাবিয়া দেখিবার জিনিস।
.
স্কুলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হইয়া আসিতেছে। গ্রীষ্মের ছুটির পর দুই মাস চলিয়া গিয়াছে, অথচ ছুটির মাহিনা এখনও সম্পূর্ণ শোধ হয় নাই। সাহেবকে বার বার বলিয়াও কোনো ফল হয় না। সাহেবের এক কথা, এ বছর কষ্ট সহ্য করিতে হইবে। যাহার না পোষায়, সে চলিয়া যাইতে পারে।
একদিন সাহেবের সারকুলার-অনুযায়ী ছুটির পর সাহেবের আপিসে শিক্ষকদের হাজির হইতে হইল। সাহেব বলিলেন, আজ একটা বিশেষ জরুরি মীটিং করা দরকার। থার্ড ক্লাসে গণিতের ফল আদৌ ভালো হইতেছে না, এ বিষয়ে শিক্ষকদের লইয়া পরামর্শ করা নিতান্ত আবশ্যক।
মীটিং চলিল। হতভাগ্য টিচারের দল খালিপেটে শ্রান্তদেহে পাঁচটা পর্যন্ত নানারূপ কৌশল উদ্ভাবন করিতে ব্যস্ত রহিল—থার্ড ক্লাসে কী করিয়া অ্যালজেব্রা ভালোরূপে শিখানো যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোনো বৈদেশিক শক্তি যুদ্ধ ঘোষণা করিলে ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী এতদপেক্ষা অধিক আগ্রহ ও উদ্যোগ দেখাইতে পারিতেন না তাঁহার ক্যাবিনেট মীটিংয়ে!
পাঁচটা বাজিয়া গেল। তখনও প্রস্তাবের অন্ত নাই। থার্ড ক্লাসের গণিত শিক্ষার ভারপ্রাপ্ত টিচার হতভাগ্য শেখরবাবু ম্লানমুখে বসিয়া শুনিয়া যাইতেছেন, কারণ এ অবস্থার জন্য তিনিই ধর্মত দায়ী। তাঁহার দপ্তরেই এ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। উক্ত ক্লাসের গত দুইটি সাপ্তাহিক পরীক্ষায় গণিতের ফল আদৌ আশাপ্রদ হয় নাই।
সাড়ে পাঁচটার সময় হেডমাস্টার উঠিয়া ধীরে ধীরে গণিতশিক্ষার প্রকৃষ্ট উপায় সম্বন্ধে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ পাঠ শুরু করিলেন—খাতার বহর দেখিয়া মনে হইল, সাড়ে ছয়টার কমে সে প্রবন্ধ শেষ হইবে না।
হঠাৎ নতুন টিচার দাঁড়াইয়া বলিলেন, স্যার, আমার একটা কথা বলবার আছে।
হেডমাস্টার প্রবন্ধ পাঠ করিতেছিলেন, থামিয়া মুখ তুলিয়া বিস্মিতভাবে নতুন টিচারের দিকে চাহিয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ইয়েস?
—স্যার, ছ’টা বাজে, মাস্টারেরা সকলেই ক্ষুধার্ত। আজ এই পর্যন্ত থাকলে ভালো হয়।
নতুন টিচারের সাহস দেখিয়া সবাই বিস্মিত ও স্তম্ভিত।
হেডমাস্টার বলিলেন, জান মাস্টার, আমি আমার বক্তব্যের মধ্যে কোনো বাধাসৃষ্টি পছন্দ করি না?
—স্যার, আমায় ক্ষমা করবেন। স্পষ্ট কথা বলবার সময় এসেছে। আপনার এ রকম মীটিং মাস্টারদের পক্ষে বড় কষ্টদায়ক হয়। এতে স্কুলের কাজ হয় না।
—স্কুলের কাজ কি তোমার কাছে আমায় শিখতে হবে?
—আপনিই ভেবে দেখুন, এতে স্কুলের কী ভালো হচ্ছে? ছাত্র ছেড়ে গিয়েছে, রিজার্ভ ফান্ড নেই, মাইনে পাই না আমরা নিয়মমত। অথচ আপনি এই সব শিক্ষককে নিয়ে আলোচনাসভার প্রহসন করচেন! আপনিই ভেবে দেখুন, এতে কী উপকার হয়? এই সব টিচার মুখ ফুটে বলতে পারেন না; কিন্তু চারটের পর আপনি এঁদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করতে পারেন কি?
এবার হেডমাস্টারের পালা বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইবার। একজন সামান্য বেতনের টিচারের কাছে তিনি এ ধরনের সোজা ও স্পষ্ট কথা প্রত্যাশা করেন নাই। বলিলেন, আমি কতদিন হেডমাস্টারি করছি, তা তোমার জানা আছে?
—তা আমার জানবার দরকার নেই স্যার। কিন্তু আপনার এই শাসনপ্রণালী যে আদৌ ফলপ্রদ নয়, তা আপনাকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়াতে আপনি আমায় শত্রু ভাববেন না। আমি বন্ধুভাবেই এ কথা বলছি। আপনাকে সদুপদেশ দেওয়ার লোক নেই।
মাস্টারেরা সকলে কাঠের মত বসিয়া আছেন। এমন একটা ব্যাপার তাঁহারা কখনও এ স্কুলে ঘটিতে পারে বলিয়া কল্পনাও করেন নাই। দুই-চারিজন সপ্রশংস দৃষ্টিতে নতুন টিচারের দিকে চাহিয়া রহিলেন। নতুন টিচার যে এমন চোস্ত ইংরেজি বলিতে পারদর্শী—এ তথ্য আজই তাঁহারা অবগত হইলেন।
হেডমাস্টারের মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন, তুমি কি বলতে চাও আমি স্কুল চালাতে জানি নে?
নতুন টিচার কী একটা উত্তর দিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে নারাণবাবু নতুন টিচারকে বলিলেন, ভায়া, ছেড়ে দাও! আর তর্ক-বিতর্ক করো না! সাহেব যা বলছেন, ওনার ওপর আর কথা বলো না!
আশ্চর্যের বিষয়, সেই সভাতেই সাহেবের সামনে দুই-তিনজন টিচার, তাঁহাদের মধ্যে ক্ষেত্রবাবু ও শ্রীশবাবু আছেন—নারাণবাবুর মধ্যস্থতা করিতে যাওয়ায় স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করিলেন।
পিছন হইতে হেডমৌলবী বলিল, আহা, বলতে দ্যান ওনাকে নারাণবাবু, বাধা দেবেন না।
আলম বেঞ্চির কোণে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন, মুখে কথাটি নাই।
নতুন টিচার বলিলেন, স্যার, আপনি ভেটারান হেডমাস্টার, স্কুল চালাতে জানেন না, তাই কি বলছি? কিন্তু আপনি স্কুলের বাজেট দেখে ব্যয়সঙ্কোচের ব্যবস্থা করুন, দু’মাসের মাইনে পান নি যে সব মাস্টার, তাঁদের নিয়ে ছ’টা পর্যন্ত মীটিং করা চলে কি স্যার?
নারাণবাবু বলিলেন, থাম ভায়া, থাম!
দুই-তিনজন টিচার একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, নারাণদা, ওঁকে বলতে দিন।
হেডমাস্টার দেখিলেন, সভার সমবেত মত তাঁহারই বিরুদ্ধে—নতুন টিচারের সপক্ষে।
তাঁহার নিজের স্কুলে বসিয়া এই তাঁহার প্রথম পরাজয়।
একটা দুর্বল কথা তিনি হঠাৎ বলিয়া বসিলেন। বলিলেন, কেন, চারটের পর আমি মাস্টারদের জন্যে জলখাবারের ব্যবস্থা তো করে দিই! আজ যদি তোমাদের খিদে পেয়ে থাকে, আমাকে আগে জানালেই আমি ব্যবস্থা করতাম!
সকলেই বুঝিল, হেডমাস্টারের এ উক্তি দুর্বলতাজ্ঞাপক।
নতুন টিচার বলিলেন, সামান্য দু-চারখানা লুচি জলখাবারের কথা ধরি নি স্যার! সে যাঁরা খেতে চান, তাঁরা খেতে পারেন। আমার বলবার উদ্দেশ্য, মাস্টারদের ওপর নানা দিক থেকে অন্যায় হচ্ছে—আপনি এর প্রতিকার করুন।
হেডমাস্টার যে আদৌ দমেন নাই, ইহা দেখাইবার জন্য মুখখানাতে গর্বসূচক হাসি আনিয়া সকলের দিকে একবার চাহিয়া লইয়া বলিলেন, শীগগির তোমরা আমার মতলব জানতে পারবে স্কুলের উন্নতি সম্বন্ধে।—বলিয়াই চশমাটি খুলিয়া ধীরভাবে মুছিয়া ফেলিতে ফেলিতে কৃত্রিম উৎসাহের সঙ্গে বলিলেন, আচ্ছা, এখন আমরা আমাদের প্রবন্ধ পাঠ আরম্ভ করি—কোন পর্যন্ত পড়েছিলাম তখন? দেখি—
এমন ভাব দেখাইবার চেষ্টা করিলেন, যেন নতুন টিচারের মন্তব্য তিনি গায়েই মাখেন নাই। ও-রকম বহু অর্বাচীনের উক্তি তিনি বহুবার শুনিয়াছেন, কিন্তু ওসব শুনিতে গেলে তাঁহার চলে না।
সাড়ে ছয়টার সময় প্রবন্ধ শেষ হইল। ইতিমধ্যে যদুবাবু কখন খাবারের টাকা লইয়া গিয়াছিলেন, কেহ লক্ষ করে নাই—তিন টুকরি লুচি কচুরি আলুর দম কখন আসিয়া পৌঁছিয়া গিয়াছে!
হেডমাস্টার নিজে দাঁড়াইয়া শিক্ষকদের খাওয়ার তদারক করিলেন।
নতুন টিচারের মর্যাদা যথেষ্ট বাড়িয়া গেল স্কুলে এই দিনটির পর হইতে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্লার্কওয়েল যার সামনে হঠাৎ নরম হইয়া সরু-সুতা কাটিতে লাগিলেন, তাঁর ক্ষমতা আছে বৈকি।
মিঃ আলম হেডমাস্টারকে বলিলেন, স্যার, আপনার মুখের ওপর তর্ক করে, আপনি তাই সহ্য করলেন কাল? বলুন, আজই পড়ানোর ভুল ধরে রিপোর্ট করে দিচ্ছি, দিন ওর চাকরি খেয়ে!
—নতুন টিচার অত ভালো ইংরেজি বলে, আমি জানতাম না মিঃ আলম। আমি ওর ক্লাস-ওয়ার্ক আগেও দেখেচি। তাকে খারাপ বলা যায় না ঠিক।
—স্যার, আমার কাল রাগ হচ্ছিল ওর বেয়াদবি দেখে। আর দেখলেন, মাস্টারেরা প্রায় অনেকেই ওকে সাপোর্ট করলে!
—সেটা নিয়ে আমিও ভেবেছি। মাস্টারেরা মাইনে ঠিকমত পায় না বলে অসন্তুষ্ট। অসন্তুষ্ট লোক দিয়ে কাজ হয় না। স্কুলের বাজেটটা সামনের বছর থেকে ব্যালান্স না করাতে পারলে আর এরা সন্তুষ্ট হচ্ছে না।
—স্যার, কাল কোন কোন টিচার ওকে সার্পোট করেছিল, তাদের নাম আমি লিখে রেখেচি।
—নামগুলো দিয়ো আমার কাছে।
—বলেন তো ওদের ক্লাস-ওয়ার্ক দেখি আজ থেকে। রিপোর্ট করি।
একদিন মিঃ আলম চুপি চুপি সাহেবের কাছে আসিয়া বলিল, স্যার, মাস্টারেরা নতুন টিচারকে নিয়ে দল পাকাচ্ছে!
—কে কে?
—স্যার, ক্ষেত্রবাবু, যদুবাবু, শ্রীশবাবু, জ্যোতির্বিনোদ, দত্ত, বোস—কেবল নারাণবাবু নয়।
—নারাণবাবু ইজ অ্যান ওলড লয়্যালিস্ট।
—স্যার, নতুন টিচারকে নিয়ে দল পাকায়—মোড়েই ওই চায়ের দোকানে রোজ ছুটির পর ওদের মীটিং হয়। নতুন টিচার ওদের দলপতি।
—তোমাকে কে বললে?
—ক্লার্ক সুবল দে আমায় সব কথা বলে। ও ওদের দলে যোগ দিয়ে শুনে এসে আমায় বলেছে। আমাদের স্কুলের সম্বন্ধে ইউনিভার্সিটিতে নাকি ওরা জানাবে। নতুন টিচারের কে আত্মীয় আছে ইউনিভার্সিটিতে!
—দেখ মিঃ আলম, যে যা পরে করুক। আর ও-সব স্পাইগিরি আমি পছন্দ করি নে। এটা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, এর মধ্যে ও-সব দলাদলি, ডার্টি পলিটিকস,—আই হেট! আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছেলেদের শিক্ষা, স্কুলকে ভালো করব। গড ইজ অন মাই সাইড—
—আমার মনে হয়, ওই নতুন টিচারকে না তাড়ালে স্কুলে দলাদলি আরও বাড়বে। ও-ই ভাঙবে স্কুলটাকে। ও লোক সুবিধের নয়।
কিন্তু এ রিপোর্টে ফল উলটা হইল। সাহেবের কাছে মাস দুইয়ের মধ্যে নতুন টিচারের প্রতিপত্তি বাড়িয়া গেল। মাস্টারেরা সব নতুন টিচারকে লিডার বানাইয়াছে, তাহাদের অভাব অভিযোগের কথা নতুন টিচারের মুখে ব্যক্ত হয় হেডমাস্টারের কাছে। আজ ইহাকে দুই টাকা আগাম দিতে হইবে, কাল ‘টিচার্স এড ফান্ড’ হইতে উহাকে পাঁচ টাকা ধার দিতে হইবে—নতুন টিচারকে মুখপাত্র করিয়া সবাই পাঠাইয়া দেয়।
সাহেব বলেন, কী, রামেন্দুবাবু?
—স্যার, আজ যদুবাবুকে কিছু আগাম দিতে হবে।
—কেন? ও-মাসে দেওয়া হয়েছে সাত টাকা।
—ওঁর বড় ঠেকা। দেনা হয়েছে—
—বড় অবিবেচক লোক ওই যদুবাবু। আমি শুনেছি, ও রেস খেলে।
—না স্যার। রেস খেলার পয়সা কোথায় পাবেন? মেসে থাকেন এখানে—
মিঃ আলমের কানে কথাটা উঠিল। আজকাল নতুন টিচার সাহেবের কাছে মাস্টারদের জন্য সুপারিশ করে এবং তাহাতে ফলও হয়। আলম একদিন সুবল দে কেরানিকে বাহিরে একটা চায়ের দোকানে লইয়া গেলেন। বলিলেন, সুবল, এসব হচ্ছে কী?
—কী বলুন, স্যার?
—সাহেব নাকি ওই নতুন টিচারের কথা খুব শুনছেন!
—তাই মনে হয় স্যার। সেদিন জ্যোতির্বিনোদকে দু’ দিন ছুটি দিলেন ওঁর সুপারিশে।
—কেন, কেন?
—জ্যোতির্বিনোদের ভাগ্নীর বিয়ে।
—জ্যোতির্বিনোদের ক্যাজুয়াল লিভের হিসেবটা চেক করে কাল আমায় জানিও তো! বুঝলে?
—বেশ, স্যার।
—স্কুলে যা-তা হচ্চে, না?
কেরানি চুপ করিয়া রহিল। কেরানি মানুষ, বড় টিচারের সামনে যা-তা বলিয়া কি শেষে বিপদে পড়িবে? মিঃ আলম বলিলেন, তোমার কি মনে হয়?
—স্যার, আমরা চুনোপুঁটির দল, আমাদের কিছু না বলাই ভালো।
—নতুন টিচার বড় বাড়িয়েচে, না?
—হুঁ। তবে একটা কথা—
—কী?
—স্যার, নতুন টিচার রামেন্দুবাবু কিন্তু লোকের অসুবিধে বা উপকার এই ধরনের ছাড়া অন্য কথা নিয়ে সাহেবের কাছে যায় না।
—তুমি কি করে জানলে?
—আমি জানি স্যার। সেই জন্যেই মাস্টারবাবুরা ওর খুব বাধ্য হয়ে পড়েছেন।
—থাক। তোমায় আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুমি কাল জ্যোতির্বিনোদের ক্যাজুয়াল লিভটা চেক করে আমায় জানাবে, কেমন তো?
—হ্যাঁ স্যার, তা করে দেব। বলেন তো আজই দিই।
—কালই দেবে।
পরদিন হিসাব করিয়া ধরা পড়িল, জ্যোতির্বিনোদের তিন দিন ছুটি বেশি লওয়া হইয়া গিয়াছে এ বছর। মিঃ আলম সাহেবের কাছে রিপোর্ট করিলেন। জ্যোতির্বিনোদের তিন দিনের বেতন কাটা গেল। মিঃ আলম হাসিয়া নিজের দলের মাস্টারদের বলিলেন, লিডার হলেই হল না! সব দিকে দৃষ্টি রেখে তবে লিডার হতে হয়। স্কুলটাকে এবার উচ্ছন্ন দেবে আর কি! সাহেবেরও আজকাল হয়েচে যেমন!
.
হেডপণ্ডিত ছুটিপ্রার্থী হইয়া সাহেবের টেবিলের সামনে দাঁড়াইয়াছেন।
সাহেব মুখ তুলিয়া বলিলেন, হোয়াট পাণ্ডিট?
—স্যার, কাল তালনবমী, টিচারেরা ও ছেলেরা ছুটি চাচ্ছে।
—টালনব—হোয়াট ইজ দ্যাট পাণ্ডিট? নেভার হার্ড দি নেম!
—স্যার, মস্ত বড় পরব হিন্দুর। দুর্গাপুজোর নীচেই—মস্ত পরব।
সাহেব চিন্তা করিয়া বলিলেন, না পণ্ডিত, এ বছর একশো দিন ছাড়িয়েছে। ইনসপেক্টর আপিসে গোলমাল করবে। কী তুমি বলছ—টাল—কী?
—তালনবমী।
—ফানি নেম! যাই হোক, এতে ছুটি দেওয়া চলে না।
হেডপণ্ডিত মাস্টারদের শেখানো ইংরেজি আওড়াইয়া বলিলেন, নেকসট টু দুর্গাপূজা সার—গ্রেট—গ্রেট—ইয়ে—
‘ফেস্টিভ্যাল’ কথাটা ভুলিয়া গিয়াছেন, অত বড় কথা মনে আনিতে পারিলেন না।
সাহেব হাসিয়া বলিলেন, ইয়েস, আন্ডারস্ট্যান্ড—ইউ মিন ফেস্টিভ্যাল—আমি বুঝেছি। হবে না। ক্লাসে পড়াওগে যাও।
সকলেই জানিল, ছুটি হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। কিন্তু ঠিক শেষ ঘণ্টায় মথুরা চাপরাসীকে সারকুলার-বই লইয়া ক্লাসে ক্লাসে ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতে দেখা গেল। তালনবমীর ছুটি হইয়া গিয়াছে।
মনে সকলেরই খুব স্ফূর্তি। জ্যোতির্বিনোদের ঘরে ছাদের উপর অনেকে আড্ডা দিতে গেলেন। জ্যোতির্বিনোদ বলিলেন, বাব্বা, কাল সেই পাগল বউটার কী কাণ্ড রাত্রে!
হেডপণ্ডিত বলিলেন, কী হয়েছিল?
—আরে, কখনও কাঁদে কখনও হাসে! রাত্রে ছাদে কতক্ষণ বসে রইল! ওর দুই দেওর এসে শেষে ধরে নিয়ে গেল। মারলেও যা!
নারাণবাবু বলিলেন, বড় কষ্ট হয় মেয়েটার জন্যে। ওর অদৃষ্টটাই খারাপ।
যে বাড়ির বধূর কথা বলা হইতেছে, বাড়িটা বেশ বড়লোকের, স্কুলের পশ্চিম দিকে, গত ছয় মাসের মধ্যে বাড়িটাতে অনেকগুলি বিবাহ হইয়াছিল খুব জাঁকজমকের সঙ্গে। সেই হিড়িকে এই মেয়েটিও বধূরূপে ও-বাড়িতে ঢোকে, কারণ তাহার পূর্বে মাস্টারেরা আর কোনোদিন উহাকে দেখেন নাই ও-বাড়িতে। কিন্তু বিবাহের মাসখানেক পর হইতেই বধূটি কেন যে পাগল হইয়া গিয়াছে, তাহা ইঁহারা কী করিয়াই বা জানিবেন! তবে বধূটি যে আগে ভালো ছিল, এ ব্যাপার ইঁহারা স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন।
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, হ্যাঁ হে, সেই পার্শী মেয়েটাকে আর তো দেখা যায় না ও-বাড়িতে!
শ্রীশবাবু বলিলেন, ও-বাড়িতে অন্য ভাড়াটে এসে গিয়েছে। তারা চলে গিয়েছে।
—কি করে জানলে?
—এই দিন-পনরো থেকে দেখছি, ছাদে বাঙালি মেয়ে গিন্নি পুরুষমানুষ ঘোরে।
পার্শী মেয়েটিকে ইঁহারা সকলেই প্রায় দুই বছর ধরিয়া দেখিয়া আসিতেছিলেন। তাহার আগে বছর পাঁচেক ও-বাড়িতে অন্য ভাড়াটে দেখিয়াছিলেন। মেয়েটি ছাদের লোহার চৌবাচ্চার ছায়ায় বসিয়া একমনে পিঠের উপর বেণী ফেলিয়া বসিয়া পড়িত—যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী প্রতিমা। কোনো স্কুল বা কলেজের ছাত্রী হইবে। দুপুরে বা বিকালে শতরঞ্জির উপর একরাশ বই ছড়াইয়া পড়িত—কী একাগ্র মনে পড়িত!
তাহাকে লইয়া মাস্টারদের কত জল্পনা-কল্পনা!
—আচ্ছা, ও কি স্কুলের ছাত্রী?
—কিন্তু ওর বয়েস হিসেবে কলেজের বলেই মনে হয়।
—খুব বড়লোক, না?
—এমন আর কী! ফ্ল্যাট নিয়ে তো থাকে। ওদের চাল খুব বেশি—পার্শী জাতটার—
—বিয়ে হয়েছে বলে মনে হয়?
এই রকম কত কথা! সে তরুণী পার্শী ছাত্রীটি বিবাহিতা হইলেই বা কাহার কী, না হইলেই বা তাহাতে মাস্টারদের কী লাভ! তবুও আলোচনা করিয়া সুখ।
অধিকাংশ মাস্টার এ স্কুলে বহুদিন ধরিয়া আছেন—দশ, তেরো, আঠারো, বিশ বছর। এই উঁচু তেতলার ছাদ হইতে চারিপাশের বাড়িগুলিতে কত উত্থান পতন পরিবর্তন দেখিলেন। অনেকে বাড়ি যাইতে পান না পয়সার অভাবে, যেমন জ্যোতির্বিনোদ কি নারাণবাবু, কিংবা মেস-পালিত শ্রীশবাবু—গৃহস্থবাড়ির মা, বোন, মেয়ে, ইহাদের চলচ্চিত্র মাত্র এত উঁচু হইতে দেখিতে পান এবং দেখিয়া কখনও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন নিজেদের নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভাবিয়া, কখনও আনন্দ পান, কখনও পরের দুঃখে দুঃখিত হন, উদ্বিগ্ন হন। এই চলিতেছে বহুদিন ধরিয়া।
এ এক অদ্ভুত জীবনানুভূতি—দূর হইয়াও নিকট, পর হইয়াও আপন, অথচ যে দূর সে দূরই, যে পর সে পরই। অনেক কুশ্রী ঘটনাও প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। ওই লাল বাড়িটাতে নয় বৎসর আগে এক মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে পলাইয়া গিয়াছিল, এদিকের ওই বাড়িটাতে প্রৌঢ়া গৃহিণীকে প্রত্যেকদিন—থাক, সে সব কথায় দরকার নাই।
কত দুঃখের কাহিনীও এই সঙ্গে মনে পড়ে। ওই পুবদিকের হলদে দোতলা বাড়িটাতে আজ প্রায় সাত-আট বছর আগে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে আত্মহত্যা করে। এতদিন পরেও সে কথা টিফিনের ছুটির সময় মাঝে মাঝে উঠে। বেকার স্বামী, পরিবার প্রতিপালন করিতে না পারিয়া স্ত্রীর সঙ্গে মিলিয়া বেকার-জীবনের অবসান করে।
সে সব দিনে ক্লার্কওয়েল সাহেব ছিল না। ছিলেন সুধীর মজুমদার হেডমাস্টার। অনুকূলবাবুর পরের কথা।
হেডপণ্ডিত বলেন, অনেকদিন হয়ে গেল এ স্কুলে যদু ভায়া, কী বল? সেই বউবাজার স্কুল ভেঙে এখানে আসি—মনে পড়ে সে-কথা? হেডমাস্টারের নাম কী ছিল যেন—শশিপদ কী যেন? আমার আজকাল ভুল হয়ে যায়, নাম মনে আনতে পারি নে।
যদুবাবু বলেন, শশিপদ রায়চৌধুরী। বউবাজার থেকে তারপর রানী ভবানীতে গিয়েছিলেন, মনে নেই?
—আমরা তো স্কুল ভেঙে চলে এলুম। শশিবাবুর আর কোনো খোঁজ রাখি নে। এ স্কুলে তখন অনুকূলবাবু হেডমাস্টার। ওঃ, অমন লোক আর হয় না। আমাদের নারাণদাদা সেই আমলের লোক, না দাদা?
নারাণবাবু বলেন, আমি তারও কত আগের। তুমি আর যদু এসেচ এই আঠারো বছর, আমি তারও বারো বছর আগে থেকে এখানে। অনুকূলবাবুতে আমাতে মিলে স্কুল গড়ি।
ক্ষেত্রবাবু বলেন, আপনারা গড়লেন স্কুল, এখন কোথা থেকে মিঃ আলম আর সাহেব এসে নবাবী করচে দেখ!
নারাণবাবু বলেন, আমি কিছু নই, অনুকূলবাবু গড়েন স্কুল। তাঁর মত ক্ষমতা যার তার থাকে না। অনুকূলবাবুর মত লোক হচ্ছে এই সাহেব। সত্যিকার ডিউটিফুল হেডমাস্টার হিসেবে সাহেব অনুকূলবাবুর জুড়িদার। লেখাপড়া শেখে সবাই, কিন্তু অন্যকে শেখানো সবাই পারে না। যে পারে, তাকে বলে টিচার। তুমি আমি টিচার নই—টিচার ছিলেন অনুকূলবাবু, টিচার হল এই সাহেব।
হেডপণ্ডিত বলেন, না, দাদা, আপনি টিচার নিশ্চয়ই। আমরা না হতে পারি—
নারাণবাবু বলেন, অত সহজে টিচার হয় না। এই শুনবে তবে অনুকূলবাবুর দু-একটা ঘটনা? একবার একটা ছেলে এল, তার বাবা বর্মায় ডাক্তারি করে, দু’পয়সা পায়। ছেলেটাকে আমাদের স্কুলে দিয়ে গেল বাংলা শিখবে বলে। বর্মী ভাষা জানে, বাংলা ভালো শেখে নি। পয়সাওলা লোকের ছেলে, বদমাইশও খুব। স্কুল পালায়, বাবা মোটা টাকা পাঠায়—সেই টাকায় থিয়েটার দেখে, হোটেলে খায়, পড়াশুনোয় মন দেয় না।
—এখানে থাকে কোথায়?
—থাকে তার আত্মীয়-বাড়ি। সেই ছেলের জন্যে অনুকূলবাবুকে রাতের পর রাত বসে ভাবতে দেখেচি। আমায় বললেন—নারাণ, মারধোর বা বকুনিতে ওকে ভালো করা যাবে না। উপায় ভাবচি। তারপর ভেবে করলেন কী, রোজ সেই ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বার হতেন আর মুখে মুখে গল্প করতেন পাপের দুর্দশা, অধঃপতনের ফল—এই সব সম্বন্ধে। গল্প নিজেই বসে বসে বানাতেন রাত্রে। আমায় আবার শোনাতেন পয়েন্টগুলো। সেই ছেলে ক্রমে শুধরে উঠল, ম্যাট্রিক পাস করে বেরুল। তার বাবা এসে অনুকূলবাবুকে একটা সোনার ঘড়ি দেয় ছেলে পাস করলে। অনুকূলবাবু ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমায় এ কেন দিচ্ছেন? আমার একার চেষ্টায় ও পাস করে নি, আমার স্কুলের অন্যান্য মাস্টারের কৃতিত্ব না থাকলে আমি একা কী করতে পারতাম? তা ছাড়া, আমি কর্তব্য পালন করেছি, ভগবানের কাছে আপনার ছেলের জন্যে আমি দায়ী ছিলাম, কারণ আমার স্কুলে তাকে ভর্তি করেছিলেন। সে দায়িত্ব পালন করেচি, তার জন্যে কোনো পুরস্কারের কথা ওঠে না।—আজকাল ক’জন শিক্ষক তাঁদের ছাত্রের সম্বন্ধে একথা ভাবেন বলুন দিকি? আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন তিনি। আমাদের সাহেবকে দেখি, অনেকটা সেইরকম ভাব ওঁর মধ্যে।
ক্ষেত্রবাবু ব্যঙ্গ করিয়া বলিলেন, দাদা, এতক্ষণ অনুকূলবাবুর কথা বলছিলেন, বেশ লাগছিল। আবার তাঁর সঙ্গে সাহেবের নাম করতে যান কেন?
নারাণবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, কেন করি, তোমরা জান না—আই নো এ রিয়াল টিচার হোয়েন দেয়ার ইজ ওয়ান—আমার কথা শোন ভায়া, সাহেবকে তোমরা অনেকেই চেন নি।
শিক্ষকের দল পরস্পরের কাছে বিদায় গ্রহণ করিলেন; কারণ সকলেরই টুইশানির সময় হইয়াছে।
.
পূজার ছুটির মাসখানেক দেরি। স্কুলের অবস্থা খুবই খারাপ। হেডমাস্টার সারকুলার দিলেন যে, যে মাস্টারের নিতান্ত দরকার, তাহারা আসিয়া জানাইলে কিছু কিছু টাকা দেওয়া হইবে, বাকি শিক্ষকদের ছুটির পর স্কুল খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে মাহিনা লওয়ার জন্য।
স্কুলে শিক্ষকদের মধ্যে হট্টগোল পড়িয়া গেল।
যদুবাবু বলিলেন, এ সারকুলারের মানে কী হে ক্ষেত্র-ভায়া? আমাদের মধ্যে কে তালেবর আছে, যার টাকার দরকার নেই?
ক্ষেত্রবাবু সেসব কিছু জানেন না, তবে তাঁহার নিজের টাকার দরকার এটুকু জানেন।
শ্রীশবাবু বলিলেন, তোমার যেমন দরকার, গরিব মাস্টার—পুজোর সময় শুধুহাতে বাড়ি যেতে হবে সারা বছর খেটে—সকলেরই দরকার। রামেন্দুবাবুকে সকলে বলা যাক।
কিন্তু শোনা গেল, টাকা আদৌ নাই। আশামত আদায় হয় নাই। যা আদায় হইয়াছে, বাড়িভাড়া আর কর্পোরেশন-ট্যাক্স দিতেই হইবে, যাহা কিছু উদ্বৃত্ত থাকিবে নিতান্ত অভাবগ্রস্ত শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করিয়া দেওয়া হইবে।
সেদিন টিচারদের ঘরে হঠাৎ মিঃ আলমের আগমনে সকলে বিস্মিত হইল। মাস্টারদের বসিবার ঘরে মিঃ আলম বড় একটা আসেন না।
মিঃ আলমকে দেখিয়া মাস্টারেরা সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। যে বসিয়াছিল সে উঠিয়া দাঁড়াইল, যে শুইয়াছিল সে সোজা হইয়া বসিল।
মিঃ আলম হাসিমুখে চারদিকে চাহিয়া বলিলেন, বসুন, বসুন।
তারপর ধীরে ধীরে নিজের আগমনের উদ্দেশ্য পাড়িলেন। হেডমাস্টারের এই যে সারকুলার, এ নিতান্ত জুলুমবাজি। কাহার টাকার জন্য কে এখানে খাটিতে আসিয়াছে?
সকলে এ উহার মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। মিঃ আলম সাহেবের বিশ্বাসী লেফটেন্যান্ট, তাঁহার মুখে এ কী কথা? সাহেবের স্পাই হিসাবেও মিঃ আলম প্রসিদ্ধ। কে কী কথা বলিবে তাঁহার সামনে?
মিঃ আলম বলিলেন, না, সাহেবকে দিয়ে এ স্কুলের আর উন্নতি নেই। আমি আপনাদের কো-অপারেশন চাই। আমার সঙ্গে মিলে সবাই সাহেবের বিরুদ্ধে সেক্রেটারির কাছে আর প্রেসিডেন্টের কাছে চলুন। স্কুলের যা আয়, তাতে মাস্টারদের বেশ চলে যায়। সাহেব আর মেম পুষতে সাড়ে চারশো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। এ স্কুলের হাতি পোষার ক্ষমতা নেই। আসুন, আমরা ম্যানেজিং কমিটিকে জানাই।
যদুবাবু প্রথমে কথা বলিলেন। তাঁহার ভাব বা আদর্শ বলিয়া জিনিস নাই কোনো কালে, সুবিধা বা স্বার্থ লইয়া কারবার। তিনি বলিলেন, ঠিক বলেছেন মিঃ আলম। আমিও তা ভেবেচি।
মিঃ আলম বলিলেন, আর কে কে আমাকে সাহায্য করতে রাজি।
জ্যোতির্বিনোদের রাগ ছিল হেডমাস্টারের উপর, বলিলেন, আমি করব।
যদুবাবু বলিলেন, আমিও।
ক্ষেত্রবাবু বলিলেন, আমিও।
শ্রীশবাবুও সাহায্য করিতে রাজি।
কেবল নতুন টিচার ও নারাণবাবু চুপ করিয়া রহিলেন।
মিঃ আলম বলিলেন, কী রামেন্দুবাবু, আপনি কী বলেন?
নতুন টিচার বলিলেন, আমি দু’ বছর প্রায় হল এ স্কুলে এসেছি, যা বুঝেছি এ স্কুলের উন্নতি নেই। স্কুলের বাজেট যিনি দেখেছেন, তিনিই এ কথা বলবেন। মিঃ আলম যা বলেছেন, তা খুবই ঠিক।
—তা হলে আপনি আমাকে সাহায্য করুন!
—কী জন্যে সাহায্য চান?
—টু রিমুভ দি প্রেজেন্ট হেডমাস্টার! আশি টাকার হেডমাস্টার রাখলে স্কুল চলে যায়, মেমের কী দরকার? ওতে ছেলে বাড়চে না যখন, তখন হাতি পোষা কেন? আমরা অনাহারে আছি, আর সাহেব মেম সাড়ে চারশো টাকা নিয়ে যাচ্ছে!
—ঠিক কথা।
—তবে আপনি কী করবেন?
—আমি এতে নেই।
—কেন?
—প্রকাশ্যভাবে প্রতিবাদ করি বলে গোপনে শত্রুতা করতে পারব না, মাপ করবেন মিঃ আলম। তবে আমি নিউট্রাল থাকব, কারও দিকে হব না—এ কথা আপনাকে দিতে পারি।
—বেশ, তাই থাকুন। নারাণবাবু?
—আমি বুড়ো মানুষ, আমায় নিয়ে কেন টানাটানি করেন মিঃ আলম? আপনি জানেন, আমি নির্বিরোধী লোক। আমায় আর এর মধ্যে জড়াবেন না।
—অন্য সব টিচারের মুখের দিকে চেয়ে রাজি হোন নারাণবাবু। আপনি হেডমাস্টার হোন, খুব খুশি হব সবাই। এঁদের মধ্যে কেউ নেই, যিনি তাতে অমত করবেন। কিংবা রামেন্দুবাবু হেডমাস্টার হোন—কারও আপত্তি হবে না।
সকলে সমস্বরে এ প্রস্তাব সমর্থন করিলেন।
এই দিনটির পরে মিঃ আলমের চক্রান্ত রোজই চলিতে লাগিল। মাস্টারদের মধ্যে স্বার্থান্বেষী, প্রিন্সিপল-বিহীন যাঁহারা (যেমন যদুবাবু), মিঃ আলমের দলে যোগ দিয়াছেন; ক্ষেত্রবাবু ও শ্রীশবাবু মনে মনে মিঃ আলমের দলে আছেন, মুখে কিছু বলেন না। কেবল নারাণবাবু ও নতুন টিচার রামেন্দু দত্ত নিরপেক্ষ, কোনো দলেই নাই।
ইঁহাদের মিটিং প্রতি দিন ছুটির পর তেতলার ঘরে হয়—নতুন টিচার ও নারাণবাবু সেখানে থাকেন না।
এই অবস্থার মধ্যে আসিল পূজার ছুটির সপ্তাহ। শনিবারে ছুটি হইবে। ছেলেরা ক্লাসে ক্লাসে ছুটির দিন শিক্ষকদের জলযোগের ব্যবস্থা করিতেছে। শিক্ষকদের মধ্যে কেহ কেহ গোপনে তাহাদের উসকাইয়া না দিতেছেন এমন নয়।
—কী রে, পড়াশুনা কিছুই হয় নি কেন? গ্রামার মুখস্থ ছিল, টাস্ক ছিল, কিছু করিস নি? খাওয়াতে ব্যস্ত আছিস বুঝি? কি ফর্দ করলি এবার?
ফর্দ শুনিয়া যদুবাবু উদাসীন ভাবে বলিলেন, এ আর তেমন কী হল—এবার থার্ড ক্লাসে যা করবে, শুনে এলুম—
ক্লাসের চাঁই বালকেরা সাগ্রহ কলরব করিয়া বলিয়া উঠিল, কী স্যার—কী স্যার—?
—আইসক্রিম, লুচি, আলুর দম, হরি ময়রার কড়াপাকের সন্দেশ—
—স্যার, আমরাও করব আইসক্রিম।
—হরি ময়রার সন্দেশ স্যার কোথায় পাওয়া যায়?
—সে আমি তোদের এনে দেব, ভাবনা কী! পয়সা দিস আমার হাতে।
—কালই দেব চাঁদা তুলে।
—স্যার, আপনার হাতে আমরা দশ টাকা দেব, আপনি যাতে থার্ড ক্লাসের চেয়ে ভালো হয়, তা কিন্তু করবেন।
থার্ড ক্লাসে গিয়া যদুবাবু বলিলেন, ওঃ, ছুটির টাস্কটা সবাই লিখে নে, ভুলে গিয়েচি একেবারে। তোদের এবার কী বন্দোবস্ত হচ্চে রে? কিন্তু এবার ফোর্থ ক্লাসে যা হচ্ছে, তার কাছে তোরা পারবি নে।
শ্রীশবাবু ও জ্যোতির্বিনোদ অন্য অন্য ক্লাসে উসকাইলেন। প্রতি বৎসর ক্লাসে ক্লাসে টেক্কা দিবার চেষ্টা করে।
ছুটির পর হেডমাস্টারের ঘরে নতুন টিচার গিয়া টেবিলের সামনে দাঁড়াইলেন।
—স্যার, আপনার সঙ্গে গোপনীয় কথা আছে—কখন আসব?
—ওঃ, মিঃ দত্ত! তুমি সন্ধ্যার পর এসো—আজ আর টুইশানিতে যাব না।
—বেশ।
ছুটির পর প্রায় দেড় ঘণ্টা মাস্টারেরা থাকিয়া ছেলেদের সেকেন্ড টার্মিনাল পরীক্ষার ফল লিপিবদ্ধ করিলেন, প্রোগ্রেস-রিপোর্ট লিখিলেন, বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সিজিল-মিজিল করিলেন—বড় একটা ছুটির আগে অনেক কাজ। অথচ সকলেই জানে, ছুটির মাহিনা কেহ পাইবেন না। এই শারদীয় পূজার সময়ে সকলকে শুধুহাতে বাড়ি যাইতে হইবে—উপায় নাই। ইহা যে স্বার্থত্যাগ-প্রণোদিত ব্যাপার তাহা নহে, নিরুপায়ে পড়িয়া মার খাওয়া মাত্র। এ চাকরি ছাড়িলে কোন স্কুলে হঠাৎ চাকরি মিলিতেছে?
সন্ধ্যার পর নতুন টিচার হেডমাস্টারের নিজের বসিবার ঘরের দরজায় কড়া নাড়িলেন।
—হ্যাঁ এস। কাম ইন—
নতুন টিচার ঢুকিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।
—বোস মিঃ দত্ত, বোস। এক পেয়ালা চা?
—না, ধন্যবাদ। এই খেয়ে আসছি। মিস সিবসন কোথায়?
—উনি আজকাল পড়াতে বেরোন। ভালো টুইশানি পেয়েছেন—পঞ্চকোটের রাজকুমারীকে এক ঘণ্টা ইংরিজি পড়াতে—
—ও!
—কী কথা বলবে বলছিলে?
নতুন টিচার পকেট হইতে একটা কাগজ বাহির করিলেন। গলা ঝাড়িয়া বলিলেন, স্যার, আপনি এবার কি কিছু দেবেন না আমাদের মাইনে?
—তোমায় তো সব দেখিয়েছি মিঃ দত্ত। স্কুলের আর্থিক অবস্থা তুমি আর মিঃ আলম জান, আর জানে নারাণবাবু। বেশি লোককে বলে কোনো লাভ নেই। স্কুলকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করছি প্রাণপণে। বাড়িওলা নালিশ করবে শাসিয়েছিল—তাকে পাঁচশো টাকা দিতে হয়েছে। মিস সিবসনকে দেড়শো টাকা দিতে হবে, উনি দার্জিলিং যাচ্ছেন। কিন্তু তার মধ্যে মোটে পঁচাত্তর দিতে পারছি। আমি এক পয়সা নিচ্ছি নে। এ আমাদের স্ট্রাগলের বছর, এ বছর যদি সামলে উঠি—সামনের বছরে হয়তো সুদিন আসবে। সকলকেই স্বার্থত্যাগ করতে হবে, কষ্ট স্বীকার করতে হবে এ বছরটাতে। বুঝলে না?
—হ্যাঁ স্যার।
—তুমি কিছু চাও? কত দরকার বল?
—না স্যার। আমি একরকম ম্যানেজ করে নেব। ধন্যবাদ স্যার। এই ক’জনকে কিছু কিছু দিতেই হবে, যে করে হোক ম্যানেজ করুন।
নতুন টিচার হাতের কাগজ দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, ক্ষেত্রবাবু কুড়ি টাকা, জ্যোতির্বিনোদ পনেরো টাকা, শ্রীশবাবু আঠারো টাকা, হেডপণ্ডিত দশ টাকা, যদুবাবু কুড়ি—
সাহেব কুইনাইন সেবনের পরের অবস্থার মত মুখখানা করিয়া বলিলেন, ও, দিজ আর দি ট্রাবল-মেকারস—
—না স্যার, এঁদের না হলে চলবে না। এঁদের অবস্থা সত্যিই খারাপ—প্রত্যেকেরই বিশেষ দরকার আছে। জ্যোতির্বিনোদের বাড়ি পৈতৃক পুজো, তাঁকে বাড়ি যেতে হবে, ভাড়া চাই। ক্ষেত্রবাবুর আবশ্যক আমি ঠিক জানি নে, তবে তাঁরও দরকার জরুরী। হেডপণ্ডিত পুজো করতে যাবেন দক্ষিণে শিষ্যবাড়ি। কাপড়চোপড় নেই, কিনবেন। যদুবাবু—
—দি কানিং ওল্ড ফক্স—
—যদুবাবুর স্ত্রী আজ তিন-চার মাস পড়ে আছেন জ্ঞাতির বাড়ি, তাঁদের সেখান থেকে না আনলে নয়—তাঁরা চিঠি লিখছেন কড়া কড়া। ট্রেনভাড়া খরচ চাই—
সাহেব হাসিয়া বলিলেন, তোমার কাছে সবাই বলে, তোমাকে ধরেছে আমাকে বলতে। বুঝলাম।
—হ্যাঁ, স্যার।
—টাকা আমি যে করে হয় ম্যানেজ করব, তুমি যখন বলছ। তুমি নিজের জন্যে কিছু নেবে না?
—না স্যার। আমার দুটো টুইশানির টাকা পাব—একরকম করে চালিয়ে নেব এখন। এখনও তো কত মাস্টারকে কিছু দেওয়া হচ্ছে না। শুধু এই ক’জনের নিতান্ত জরুরী দরকার, তাই—
—বেশ, কাল ওদের ব’লো, টাকা দিয়ে দেব যে করেই হোক।
—আর একটা কথা স্যার, যদি জানুয়ারি মাসে সুবিধে হয়, জ্যোতির্বিনোদের কিছু মাইনে বাড়িয়ে দিতে হবে। বড় গরিব।
—কেন, ওকে আমরা যা দিই, ওর বিদ্যাবুদ্ধির পক্ষে তা যথেষ্ট নয় কি?
—না স্যার। ওর প্রতি অবিচার করবেন না। গরিব বড়—
—কিন্তু বড় ফাঁকিবাজ, ক্লাসে কিছু করে না। আরও দু-চারজন আছে ফাঁকিবাজ। তুমি ভাব, আমি তাদের চিনি নে? স্কুলের অবস্থা ভালো না বলে কিছু বলি নে। আচ্ছা, তোমার কথা মনে রইল, জানুয়ারি মাসে বেশি ছেলে ভর্তি হলে থার্ড পণ্ডিতের কেস আমি বিবেচনা করব।
নতুন টিচার বিদায় লইলেন।
.
যদুবাবু সত্যই বিপদে পড়িয়াছেন।
গত গ্রীষ্মের ছুটিতে স্ত্রীকে সেই যে গ্রামে শরিকের বাড়ি রাখিয়া আসিয়াছিলেন, অর্থাভাবে তাহাকে আনিতে পারেন নাই। অবনী মুখুজ্জেকে টাকা ধার দিবেন বলিয়াছিলেন, সে অদ্য তিন মাস ধরিয়া তাগাদার উপর তাগাদা দিয়া আসিয়াছে—নানা ছলছুতো, সত্য-মিথ্যা নানারূপ স্তোকবাক্যে তাহাকে কতদিন ঠেকাইয়া রাখিয়াছেন। যদুবাবুর স্ত্রী লিখিল, তুমি অবনী ঠাকুরপোকে টাকা দিবার কথা নাকি বলিয়া গিয়াছিলে, সে একদফা নিজে, একদফা তাহার দিদি ও স্ত্রীর দ্বারা আমার গায়ের ছাল খুলিয়া ফেলিতেছে, তোমার কাছে টাকা ধারের সুপারিশ করিতে। তুমি কোথা হইতে টাকা দিবে জানি না। তবে এমন বলিলেই বা কেন, তাহাও ভাবিয়া পাই না। যদি টাকা দিতে না পার, তবে আমাকে এখান হইতে সত্বর লইয়া যাইবে। ইহাদের খোঁটা ও গঞ্জনা আর আমার সহ্য হয় না!
যদুবাবু স্ত্রীকে স্তোকবাক্য দিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন, সে আজ দেড় মাসের কথা। তারপর স্ত্রীর যত চিঠি আসিয়াছে, তাহার কোনো উত্তর দেন নাই।
দিবেনই বা কী করিয়া, স্কুলে দুই মাস খাটিয়া এক মাসের মাহিনা পাওয়া যায়—মাসের ঊনত্রিশ তারিখে গত মাসের মাহিনা যদি হইল, তবে মাস্টারেরা ভাগ্য প্রসন্ন বিবেচনা করেন। মেসের দেনা ঠিকমত দেওয়া যায় না—টুইশানি ছিল, তাই চলে। স্ত্রীকে ইহার মধ্যে আনেন কোথায়, বাসা করিবার খরচ জুটাইবেন কোথা হইতে, বলিলেই তো হইল না।
শনিবার পূজার ছুটি হইবে, আজ বৃহস্পতিবার। যদুবাবু টুইশানি করিয়া ফিরিবার পথে ভাবিতেছিলেন, ছুটিতে কি বেড়াবাড়ি যাইবেন? রামেন্দুবাবুকে ধরিয়াছেন, হেডমাস্টারকে বলিয়া-কহিয়া অন্তত কুড়ি টাকা যাহাতে পাওয়া যায়। রামেন্দুবাবুর কথা আজকাল সাহেব বড় শোনে।
কিন্তু তা যেন হইল। এই সামান্য টাকা হাতে সেখানে গিয়া কী করিবেন? স্ত্রীকে আনিয়া কোথায়ই বা রাখেন? অর্থকষ্টের বাজারে বাসা করিবেনই বা কোন সাহসে, হাওয়ায় ভর করিয়া দাঁড়াইয়া এত ঝুঁকি লওয়া চলে না।
আকাশ-পাতাল ভাবিতে ভাবিতে যদুবাবু মেসের দরজায় ঢুকিতেই মেসের একটি লোক বলিয়া উঠিল—একটি ভদ্রলোক আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন অনেকক্ষণ থেকে। শ্রীশদা এখনও ছেলে পড়িয়ে ফেরেন নি, আপনাদের ঘরে আমি বসিয়ে রেখেছি আপনার সীটে।
যদুবাবু বিস্মিত হইয়া বলিলেন, আমার জন্যে? কোথা থেকে?
—তা তো জিগ্যেস করি নি। দেখুন না গিয়ে, আপনার সীটেই বসে আছেন। বললেন—এখানে খাব। আমি আবার ঠাকুরকে বলে দিলাম, যদুবাবুর ফ্রেন্ড খাবে। নইলে রান্নাবান্না হয়ে যাবে, আপনি যখন ফিরবেন।
যদুবাবু দুরু-দুরু বক্ষে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া নিজের ঘরে ঢুকিতেই সম্মুখের সীট হইতে অবনী মুখুজ্জে দাঁত বাহির করিয়া একগাল হৃদ্যতার হাসি হাসিয়া বলিল, আসুন দাদা—এই যে! প্রণাম। ওঃ, কতক্ষণ থেকে বসে আছি!
যদুবাবুর হৃদস্পন্দন যেন এক সেকেন্ডের জন্য থামিয়া গেল। চক্ষে অন্ধকার দেখিলেন। তখনই কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিলেন, আরে, অবনী যে! এস এস ভায়া। তার পর, সব ভালো? তোমার বউদিদি ভালো তো?
—হেঁ হেঁ দাদা, সব একরকম আপনার আশীর্বাদে—
—বেশ বেশ।
—তারপর দাদা এলাম, বলি, যাই দাদার কাছে। জঙ্গলে পড়ে থাকি, দুদিন মুখ বদলানো হবে, আর শহরে দেখে-শুনে আসিগে যাই থিয়েটার-বায়োস্কোপ। দিন পনেরো কাটিয়ে আসি পুজোর মহড়াটা। ম্যালেরিয়ায় শরীর জ্বরজ্বর, একটু গায়ে লাগুক—দাদা যখন আছেন।
যদুবাবু পুনরায় কাষ্ঠহাসি হাসিলেন, তা বেশ তো বেশ! তবে—
—তারপর আপনার কাছে বলতে লজ্জা নেই দাদা—ধার করে গাড়ির ভাড়াটি কোনোক্রমে যোগাড় করে তবে আসা। হাতে কানা-কড়িটি নেই। বাড়িতে আপনার বউমার, ছেলেপুলের পরনে কাপড় নেই কারও—বছরকার দিন, পুজো আসচে। নিজেরও—দাদা, এই দেখুন না, সাতপুরনো ধুতি, তাই পরে তবে—। বলি, যাই দাদার কাছে, একটা হিল্লে হয়েই যাবে। আপাতত গোটা কুড়ি টাকা নিয়ে কাপড়গুলো তো কিনে রাখি! এর পর বাজার আক্রা হয়ে যাবে কিনা!
যদুবাবুর কপাল ঘামিয়া উঠিয়াছে। তাঁহার রুদ্ধ কণ্ঠ হইতে কী একটা কথা অস্ফুটভাবে উচ্চারিত হইল, ভালো বোঝা গেল না। অবনী তাহাকেই সম্মতিসূচক বাণী ধরিয়া লইয়া বলিল, না, কালই সকালে টাকাটা নিয়ে বাজার করে নিয়ে আসি। আর আপনি না দিলেই বা যাচ্ছি কোথায় বলুন! আপনার ওপর জোর খাটে বলেই তো আসা! না হয় বকবেন, না হয় মারবেন—কিন্তু ছোট ভাইয়ের আবদার না রেখে তো পারবেন না—হেঁ হেঁ—
যদুবাবু বেচারি সারাদিন খাটিয়াছেন, সেই কোন সকালে দুইটি খাইয়া বাহির হইয়াছিলেন। রাত দশটা, এখন কোথায় খাইয়া ঘুমাইবেন, এ উপসর্গ কোথা হইতে আসিয়া জুটিল বল তো!
পাড়াগাঁয়ের দূরসম্পর্কের জ্ঞাতি, দেখাশুনা ঘটিত কালেভদ্রে, এখন মাখামাখি করিতে গিয়া মুশকিলেই পড়িয়া গেলেন। পাড়াগাঁয়ের লোকের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করিতে নাই—ইহারা হাত পাতিয়াই আছে। পাড়াগাঁয়ের লোকের এ স্বভাব তিনি জানিতেন না যে তাহা নয়, কিন্তু বহুদিন কলিকাতায় থাকার দরুন ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাই আজ এ দুর্দশা। বলিলেন, চল, এস—খাবে।
যদুবাবুর ঘরে সাতটি সীট—অর্থাৎ মেঝেতে ঢালা বিছানা পাতিয়া পাশাপাশি সাতটি ক্লান্ত প্রাণী শয়ন করে। তাহার মধ্যে অবনীকে গুঁজিয়া কোনো রকমে শোওয়া চলিল। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের লোক, সকলের সম্মুখে অভাব-অভিযোগের কথা উচ্চৈঃস্বরে ব্যক্ত করিতে লাগিল। আর এত বকিতেও পারে! ‘হাঁ হাঁ’ দিতে দিতে যদুবাবুর মুখ-ব্যথা হইয়া গেল।
সকালে উঠিয়া অবনীর জন্য চা ও খাবার আনাইয়া দিয়া যদুবাবু মেসের বাজার করিতে বাহির হইলেন, কারণ বাজার জিনিসটা তিনি করেন ভালোই, এবং ইহা হইতে দুই-চারি আনা লাভও রাখিতে জানেন নিজের জন্য।
স্কুলে বাহির হইতে যাইবেন, অবনী জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, কখন আসচেন?
—কাল যে সময় এসেছিলাম, রাত হবে।
অবনী সকলের সামনেই বলিয়া বসিল, তা হলে দাদা, কাপড়ের টাকাটা আমায় দিয়ে যান, আজই কাপড়গুলো কিনে রাখি! আর ওবেলা ভাবছি বায়োস্কোপ দেখব, তার দরুনও কিছু দিন, আমার ট্যাঁক যাকে বলে গড়ের মাঠ কিনা! হ্যা—হ্যা—
যদুবাবু তিন-চারজন মেস-বন্ধুর সামনে কী বলিবেন! বলিলেন, আমি এসে দেব এখন, এখন তো—
ইহাতে অবনী চেঁচাইয়া আবদারের সুরে বলিয়া উঠিল, না দাদা, তা হবে না। আপনি দিয়েই যান—
যদুবাবু ফাঁপরে পড়িলেন। টাকা দিবেন কোথা হইতে? কুড়ি টাকা স্কুল হইতে লইবার সুপারিশ ধরিয়াছেন—হয়তো শনিবারের আগে সেই একমাত্র সম্বল কুড়িটি টাকাও হাতে পাওয়া যাইবে না। টুইশানির টাকা হয়তো ও-বেলা মিলিবে। অবশ্য টাকা হাতে আসিলে অবনীকে তিনি দিবেন না নিশ্চয়ই, তাঁহার নিজের খরচ নাই? বলিলেন, এস বাইরে আমার সঙ্গে।
পথে গিয়া বলিলেন, অমন করে সকলের সামনে বলতে আছে, ছিঃ! টাকা হাতে থাকলে তোমায় দিতাম না?
অবনী অনুযোগের সুরে বলিল, বা রে! আপনাকে তো কাল রাত থেকে বলছি। সত্যি দাদা, হাতে কিছুই নেই, চা-জলখাবারের পয়সাটি পর্যন্ত নেই। শুধু আপনার ভরসায় এখানে আসা—
—এই রাখ দু আনা পয়সা—চা-খাবার খেয়ো। আমি স্কুল থেকে ফিরি, তারপর বলব। চললাম, বেলা হয়ে যাচ্ছে—
স্কুলে বসিয়া যদুবাবু আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলেন। যখন আসিয়া পড়িয়াছে অবনী, তখন হঠাৎ এক-আধ দিনে চলিয়া যাইবে না। উহার স্বভাবই ওই, টাকা না লইয়া যাইবে না। দুই বেলা আট আনা ফ্রেন্ড-চার্জ দিয়া উহাকে বসাইয়া খাওয়াইতে গেলে যদুবাবু স্কুল হইতে যে কয়টি টাকা পাইবেন, তাহা উহার পিছনেই ব্যয় হইয়া যাইবে! আর কেনই বা উহাকে তিনি এখানে জামাই-আদরে বসাইয়া খাওয়াইতে যাইবেন, কে অবনী? কিসের খাতির তাহার সঙ্গে?
আচ্ছা, যদি মেসে না ফিরিয়া তিনি পলাইয়া দুই দিন অন্যত্র গিয়া থাকেন, তবে কেমন হয়? মেসে শ্রীশকে দিয়া বলিয়া পাঠাইয়া দেন যদি—বিশেষ কাজে তিনি অন্যত্র যাইতেছেন, এখন দিন-বারো মেসে ফিরিবেন না, কেমন হয়। হইবে আর কী, অবনী সেই দশ দিন বসিয়া বসিয়া দিব্য খাইবে এখন তাঁহার খরচে।
সামনের শনিবার ছুটি। একদিন আগে কি ছুটি লইবেন?
সাত-পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে টুইশান-শেষে যদুবাবু মেসে গিয়া দেখিলেন, অবনী নাই। চলিয়া গেল নাকি?
পাশের ঘরের সতীশবাবু বলিলেন, যদুবাবু, আসুন। আপনার ছোট ভাই সিনেমা দেখতে গিয়েছে, এখুনি আসবে। ছ’টার শোতে গিয়েছে।
—সিনেমা! আমার ছোট ভাই?
সতীশবাবু যদুবাবুর কথার সুরে বিস্মিত হইয়া বলিলেন, হ্যাঁ, যিনি কাল এসেছিলেন। আমায় বললেন, দাদার স্কুল থেকে আসতে দেরি হচ্ছে। বায়োস্কোপ দেখতে যাবার ইচ্ছে ছিল। তা বোধ হয় হল না। আমি বললাম—কেন হল না? উনি বললেন, টাকা নেই সঙ্গে, দাদার কাছে চাবি। মনে করে নিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি বললাম—তা আর কী! যদুবাবুর ফিরতে রাত হবে দশটা। আপনার কত দরকার, নিয়ে যান। পরস্পর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এসব—মেস-মেটের ভাই, আপনার কাছে নেই বলে কি আর অভাব ঘটবে?
—কত নিয়ে গেল?
—দু’ টাকা বললেন দরকার। আর দু’ টাকা নিয়েচেন বুঝি আপনার পিসিমার জন্যে, কী ওষুধ কিনতে হবে—দোকান বন্ধ হলে আজ আর পাওয়া যাবে না—কাল সকালেই বুঝি উনি চলে যাবেন। তা থাক, তার জন্যে কী, এখন দেবার তাড়া নেই। মাইনে পেলে শনিবার দেবেন, এখন কাজটা তো হয়ে গেল।
যদুবাবু অতিকষ্টে রাগ সামলাইয়া ঘরে ঢুকিলেন এবং একটু পরেই অবনী সিনেমা হইতে ফিরিয়া ঘরে ঢুকিল। দাঁত বাহির করিয়া বলিল, এই যে দাদা, দেখে এলাম সিনেমা। থাকি গাঁয়ে পড়ে, ওসব দেখা অদৃষ্টে ঘটেই না তো! সতীশবাবুর কাছ থেকে গোটাচারেক টাকা নিয়ে গেলাম। কুড়ি টাকার মধ্যে চার টাকা সতীশবাবুকে আর ষোলটা টাকা দেবেন আমায়!
যদুবাবু দেখিলেন, অবনী ধরিয়াই লইয়াছে—কুড়ি টাকা তাহার হাতের মুঠার মধ্যে আসিয়া গিয়াছে। কুড়ি টাকা তো দূরের কথা, এই বহু-কষ্টার্জিত টাকার মধ্যে চার টাকা এভাবে বাজে ব্যয় হওয়াই কি কম কষ্টকর? এ চার টাকা দিতেই হইবে ভদ্রতার খাতিরে। যদুবাবুর বহু ভাগ্য যে, সে কুড়ি টাকা ধার করে নাই!
এমন মুশকিলে তিনি জীবনে কখনও পড়েন নাই। কেন মিছামিছি শরিক-জ্ঞাতিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করিতে গিয়াছিলেন! এখন তাহার ধাক্কা সামলাইতে প্রাণ যে যায়! যদুবাবুর ইচ্ছা হইল, তিনি হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিয়া হাত-পা ছোঁড়েন, অবনীকে ধরিয়া দুমদাম করিয়া কিল মারেন, কিংবা একদিকে ছুটিয়া বাহির হইয়া যান। কিন্তু মেসের ভদ্রলোকদের মধ্যে কিছুই করিবার জো নাই। তিনি শান্তমুখে তামাক সাজিতে বসিয়া গেলেন।
অবনী উৎসাহের সঙ্গে সিনেমায় কী দেখিয়া আসিয়াছে, তাহার গল্প সবিস্তারে আরম্ভ করিল। গল্প তাহার আর শেষ হয় না। যদুবাবু বলিলেন, চল, খেয়ে আসি।
অবনী হাসিয়া বলিল, আজ এখনও হয় নি। আজ যে আপনাদের মেসে ফিস্ট। আমি খোঁজ নিয়ে এলাম রান্নাঘরে, এখনও দেরি আছে।
সর্বনাশ! আট আনা ফ্রেন্ডচার্জ আজ ফিস্টের দিনে! এ ভূতভোজন করাইয়া লাভ কী তাঁহার রক্ত-জল-করা পয়সায়!
অবনী পরের দিনও নড়িতে চাহিল তো না-ই, টাকার তাগাদা করিয়া যদুবাবুকে উদ্ব্যস্ত করিয়া তুলিল। রাত দশটায় ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, অবনী কাহার কাছে খবর পাইয়াছে, আগামী কাল শনিবার স্কুল বন্ধ হইবে, সুতরাং ওৎ পাতিয়া বসিয়া ছিল, বলিল, দাদা, কাল মাইনে পাবেন দু’মাসের, না? কাল চলুন, আপনার সঙ্গেই স্কুলে যাই—টাকা ষোলটা দিয়ে দিন, তিনটের গাড়িতে বাড়ি যাই। যদুবাবুর ভয়ানক রাগ হইল, কিন্তু এখানে স্পষ্ট কথা বলিতে গেলেই অবনী ঝগড়া বাধাইবে, তাহাও বুঝিলেন। পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত লোক, কাণ্ডজ্ঞানহীন কেলেঙ্কারি একটা না বাধাইয়া ছাড়িবে না।
পরদিন ক্লাসের ছেলেরা খাওয়াইল। অবনী গিয়া জুটিল যদুবাবুর সঙ্গে।
যদুবাবু কুড়িটি টাকা বেতন পাইলেন—তাও রামেন্দুবাবুর সুপারিশে। ছুটির সারকুলার বাহির হইয়া গেল। সকলে কে কোথায় যাইবেন, পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন। মাস্টারেরা চায়ের দোকানে গিয়া মজলিশ করিবে ঠিক ছিল, কিন্তু সাহেব তাহাদের লইয়া পাঁচটা পর্যন্ত মীটিং করিলেন।
মীটিংয়ের কার্যতালিকা নিম্নলিখিতরূপ :—
(১) ছুটির পরেই বার্ষিক পরীক্ষা—কী ভাবে পড়াইলে ছেলেরা বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারে।
(২) দেখা গিয়াছে, তৃতীয় শ্রেণীর ছেলেরা ইংরেজি ব্যাকরণে বড় কাঁচা। এই সময়ের মধ্যে কী প্রণালীতে শিক্ষা দিলে তাহারা উক্ত বিষয়ে পারদর্শী হইয়া উঠিতে পারে।
(৩) টেস্ট পরীক্ষার প্রশ্নপত্রগুলি পড়া ও তৎসম্বন্ধে আলোচনা।
(৪) সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় শ্রুতিলিখন থাকিবে কিনা। থাকিলে তাহাতে কত নম্বর থাকিতে পারে।
মিঃ আলম ক্ষেত্রবাবুর প্রশ্নপত্রের দুই স্থানে দুইটি ভুল বাহির করিলেন। পাঠ্যতালিকার বাহিরে সেই দুইটি প্রশ্ন করা হইয়াছে—এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় ওই দুইটি বিষয় নাই। সাহেবের আদেশে পাঠ্য-তালিকা দেখা হইল, ভুলই বটে। ক্ষেত্রবাবু অপ্রতিভ হইলেন।
ধরা পড়িল, যদুবাবু ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাসের প্রশ্ন এখনও তৈয়ারি করেন নাই। মিঃ আলম ধরিয়া দিলেন।
সাহেব বলিলেন, কী যদুবাবু?
যদুবাবু মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, অত্যন্ত দুঃখিত স্যার। এখুনি করে দিচ্ছি—
—মিঃ আলম ধরে না দিলে কী মুশকিলেই পড়তে হত!
—স্যার, বড় ব্যস্ত ছিলাম। মন ভালো ছিল না।
—সে সব কথা আমি জানি না। কর্তব্য-কাজে অবহেলা করে যে তার স্থান নেই আমার স্কুলে। মাই গেট ইজ—
—এবার মাপ করুন স্যার, আর কখনও এমন হবে না।
দোতলা হইতে নামিতেই অবনীর সহিত দেখা। সে সিঁড়ির নীচে তাঁহারই অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। দাঁত বাহির করিয়া বলিল, মাইনে পেলেন দাদা?
যদুবাবুর বড় রাগ হইল—একে সাহেবের কাছে অপমান, অপরের সুপারিশে মাত্র কুড়ি টাকা প্রাপ্তি, তার উপর এইসব হাঙ্গামা সহ্য হয়?
যদুবাবু বলিলেন, না।
—মাইনে পান নি? পেয়েছেন দাদা!
—না, পাই নি। কেউই পায় নি।
অবনী একগাল হাসিয়া বলিল, দাদার যেমন কথা! দু’মাসের মাইনে একসঙ্গে পেলেন বুঝি?
যদুবাবু বলিলেন, সত্যিই পাই নি। তুমি মাস্টারমশায়দের জিগ্যেস করে দেখ না?
—এক মাসের মাইনে দেবে না পুজোর সময়—তা কি কখনও হয়?
—এ স্কুলে এমনি নিয়ম। সাহেবের স্কুল, পুজোটুজো মানে না।
অবনী কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, তবে আমার টাকা দেবেন বললেন যে ও-বেলা?
—কোথা থেকে দেব বল? স্কুলের মাইনে যখন হল না, টাকা পাব কোথায়?
অবনী কথাটা উড়াইয়া দিবার মত তাচ্ছিল্যের সুরে বলিল, আপনার আবার টাকার ভাবনা! না হয় ডাকঘর থেকে তুলে কিছু দিন দাদা, এখনও সময় যায় নি—
যদুবাবু অবনীর মুখের দিকে চাহিয়া নীরস কণ্ঠে কহিলেন, ডাকঘরে এক পয়সাও নেই আমার। দিতে পারব না।
অবনী আরও কিছুক্ষণ কাকুতি-মিনতি করিল, রাগ করিল, ঝগড়া করিল, যদুবাবুকে কৃপণ বলিল, তাঁহার স্ত্রীকে এতদিন বাড়িতে জায়গা দিয়া রাখিয়াছে সে খোঁটাও দিতে ছাড়িল না। যদুবাবুর এক কথা—তিনি টাকা দিতে পারিবেন না।
তিনি মাত্র কুড়ি টাকা মাহিনা পাইয়াছেন, তাহা হইতে কিছু দেওয়ার উপায় নাই।
অবনীর হৃদ্যতা আগেই উবিয়া গিয়াছিল, সে বলিল, তা হলে টাকা দেবেন না আপনি?
কথা যেন ছুঁড়িয়া মারিতেছে!
যদুবাবু বলিলেন, না।
—বেশ। কিন্তু আপনাকে চিনে রাখলাম, বিপদে-আপদে লাগবে না কি আর কখনও? আচ্ছা, চলি।
কিছু দূর গিয়া তখনই আসিয়া বলল, হ্যাঁ, বউদিদিকে ওখানে রাখার আর সুবিধে হচ্ছে না। কালই গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসবেন, বলে দিচ্ছি। এত অসুবিধে করে পরের বউকে জায়গা দেবার ভারি তো লাভ! সব চিনি, এক কড়ার উপকারে কেউ লাগে না। কেবল মুখে লম্বা লম্বা কথা—
অবনী চলিয়া গেল। যদুবাবু স্কুলের বাহিরে আসিলেন ভাবিতে ভাবিতে। ক্ষেত্রবাবু পিছন হইতে আসিয়া বলিলেন, চল হে যদুদা, একটু চা খাই সবাই মিলে।
—আর চা খাব কী, মন বড় খারাপ।
—কী হল? তুমি তবুও কুড়ি টাকা পেলে। আমাদের তো এক পয়সাও না।
—না হে, তোমার বউদিদি রয়েছে বেড়াবাড়ি—সেই পাড়াগাঁ। তাকে এবার না আনলেই নয়। কিন্তু এনে কোথায় বা রাখি?
—এখন না-ই বা আনলে দাদা। নিজের বাড়িতেই তো রয়েছেন। থাকুন না। এখন পুজোর সময়, দেশে পুজো দেখুন না। গাঁয়ে পুজো হয় তো?
যদুবাবু গর্বের সহিত বলিলেন, আমার বাড়িতেই পুজো। শরিকী পুজো। আর বেড়াবাড়ির জমিদার তো আমরা। মস্ত বাড়ি, আমার অংশেই এখনও (যদুবাবু মনে মনে গণনা করিলেন) পাঁচখানা ঘর, ওপর নীচে। বাড়িতেই পুকুর, বাঁধা ঘাট। আমার স্ত্রী সেখানেই রয়েছে, আসতে চায় না, বলে—বেশ আছি। হয়েছে কী ভায়া, নামে তালপুকুর, ঘটি ডোবে না। আছে সবই, এখনও দেশে গেলে লোকজন ছুটে দেখা করতে আসে, বলে—বড়বাবু, বিদেশে পড়ে থাকেন কেন? দেশে আসুন, আপনার ভাবনা কী? কিন্তু ম্যালেরিয়া বড্ড। তেমন আয়ও নেই পুরনো আমলের মত। নামটাই আছে। নইলে কি আর বত্রিশ টাকা সাত আনায় পড়ে থাকি এই স্কুলে, রামোঃ!
যদুবাবু ওয়েলেসলি স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসিয়া মনে মনে বহু আলোচনা করিলেন। স্ত্রীকে এখন কলিকাতায় আনা অসম্ভব।
কুড়ি টাকা মাত্র সম্বলে বাসা করিয়া এক মাসও চালাইতে পারিবেন না। বেড়াবাড়ি এখন গেলে অবনী দস্তুরমত অপমান করিবে তাঁহাকে। সুতরাং তিনি কলিকাতায় মেসেই থাকিবেন, স্ত্রী কাঁদাকাটা করিলে কী হইবে?
যদুবাবুর স্ত্রী পূজার মধ্যে স্বামীকে পাঁচ-ছয়খানা লম্বা লম্বা পত্র লিখিল। সে সেখানে টিকিতে পারিতেছে না, অবনীর দিদির ও স্ত্রীর খোঁটা এবং দুর্ব্যবহারে তাহার জীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে, সেখানে আর থাকিতে হইলে সে গলায় দড়ি দিবে, ইত্যাদি।
যদুবাবু লিখিলেন, তিনি এখন রামপুরহাটের জমিদারের বাড়িতে টুইশানি পাইয়াছেন, ছুটি লইয়া এখন দেশে যাইবার কোনো উপায় নাই। তাহারা তাঁহাকে বড় ভালোবাসে, ছাড়িতে চায় না।
সবৈব মিথ্যা।