শিবানী
কাশীতে বাড়ি করায় বিপদ আছে। পরিচিত, অপরিচিত, অর্ধ-পরিচিত, পরিচিতের পরিচিত, অপরিচিতের পরিচিত, অর্ধ-পরিচিতের পরিচিত, যিনিই সদলবলে তীর্থ করতে আসেন তিনিই দিব্য সপ্রতিভভাবে গাড়ি থেকে স্থাবর ও অস্থাবর পোঁটলা-পুঁটলি নামিয়ে গাড়োয়ানকে বিদায় করতে করতে হতভম্ব দাশরথিবাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘দেখুন, এটা কি দাশরথিবাবুর বাড়ি?’
দাশরথিবাবু প্রশ্নকর্তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ঘোমটা-দেওয়া পুঁটলিগুলির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়েন। বলেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এইটেই দাশরথি বাবুর ছত্র। আমিই দাশরথি।’
প্রশ্নকর্তা বিনয়াবনত হয়ে একটি নমস্কার করেন। তারপর পোঁটলাপুঁটলির দিকে ফিরে উচ্চকন্ঠে বলেন, ‘প্রণাম করো। প্রণাম করো। ইনিই সেই প্রসিদ্ধ জজ দাশরথিবাবু।’
দাশরথিবাবু এরপর কেমন করে এতগুলি ভক্তকে তাড়িয়ে দেন? অন্দরে গিয়ে গিন্নিকে ডাকেন, ‘ওগো যাদুমণি।’
যাদুমণিকে খুলে বলতে হয় না। তিনি সম্বোধনের সুর থেকে আন্দাজ করেন যে বাড়িতে অভ্যাগত এসেছে। অর্ধেক জীবন কোথায় রাউজান, কোথায় হাতিয়া, কোথায় জাজপুর, কোথায় জামুই এইসব দুর্গম জায়গায় কাটল, একটিও অভ্যাগত এল না। এখন কাশীতে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে এসে সঞ্চিত অর্থটুকু খুঁটতে খুঁটতে নিঃশেষ করে দিল। হায়, এমন দিন গেছে যেদিন তাঁরা মাছ খেতে পাননি, সপ্তাহে দু-দিন হাটে মাছ পাওয়া যায়। মাছ না-খেয়ে-মিষ্টি না-খেয়ে বছরের পর বছর যা বাঁচালেন কাশীতে বাড়ি করে পরকে পাঁচরকম খাইয়ে তার অবশিষ্ট থাকল না।
সাধে কী যাদুমণির দাঁত দিয়ে বিষ ক্ষরিত হয়? দাঁতও আব্রুহীন, অধরের অবগুন্ঠন মানে না। যাদুমণি ঝংকার দিয়ে লঙ্কামরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেন। দু-দিন বাদে অভ্যাগতের তীর্থদর্শন ফুরিয়ে যায়, পোঁটলাপুঁটলি বাড়ি ছেড়ে গাড়িতে ওঠে।
তবু দাশরথিবাবুর ছত্রে লোকাভাব ঘটে না। তাঁরও পুণ্য হয়, লোকেরও ধর্মের জন্যে অর্থ দিতে হয় না।
এই ধারায় জীবনপ্রবাহ বইছিল কাশীতে। এদিকে দাশরথিবাবুর দেশে মুর্শিদাবাদে তাঁর ভ্রাতষ্পুত্রী শিবানী মাসে আধ ইঞ্চি করে বাড়তে বাড়তে চোদ্দো বছর বয়সে লম্বায় চওড়ায় চৌকস হয়ে উঠছিল। শিবানীর বাড় দেখে তার বাবা মৃগেন্দ্রবাবুর ব্লাড প্রেশার যাচ্ছিল বেড়ে। ভাইয়ের প্রাণ বাঁচাবার জন্য দাশরথিবাবু শিবানীকে আনিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রাখলেন। উদ্দেশ্য এই যে, কাশীতে যখন এত বাঙালির আসা, যাওয়া, শিবানীকে দেখে তাদের কারুর পছন্দ হতে সময় লাগবে না। যাদুমণি দেওরের ওপর প্রসন্ন ছিলেন না, কারণ দেওর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়ার অনুগত না-হয়ে নিজের স্ত্রীর অনুগত। তবু শিবানীকে পাত্রস্থ করবার দায়িত্ব নিলেন শুধু অতিথিদের ওপর যে খরচটা হচ্ছে সেই খরচটাকে সার্থক বলে মনে করতে। অপব্যয় নয়, প্রয়োজনীয় ব্যয়, দেওরের হিতার্থে। ভাই হয়ে ভাইয়ের এমন উপকার কলিযুগে আর কে, কোথায় করেছে? কার ভাইঝিকে দেখবার জন্যে দেশসুদ্ধ মানুষ কাশীতে এসে অতিথি হচ্ছে? কে এই ভ্রাতৃবৎসল কলির দাশরথি এবং কে তাঁর সীতা?
অতিথিদেরও এতে মুখ রক্ষা হল। তাঁরা আশ্রয়ের যাচক হয়ে আসেননি, তাঁরা মেয়ে দেখতে এসেছেন, মেয়ে দেখে অনুগৃহীত করতে। গাম্ভীর্যের ভান করে শিবানীকে যাচাই করেন, বিস্ময়ের ভান করে মন্তব্য করেন, ‘বাস্তবিক আজকালকার বাজারে এমন পাত্রী দেখা যায় না।’ কথা দিয়ে যান বাড়ি পৌঁছেই চিঠি লিখে দিনক্ষণ স্থির করবেন। তারপর তাগাদা দিলেও চিঠি লেখেন না। তবু দাশরথিবাবু অভ্যাগতকে বিশ্বাস করেন, তাঁরা যখন গাড়ি থেকে গোষ্ঠীসমেত নামেন ও দু-চার কথার পর বলেন, ‘দাশরথিবাবু, আপনার সেই প্রসিদ্ধ ভাইঝিটিকে দেখতে কাশীতে এলুম’ তখন দাশরথিবাবু অন্দরে প্রবেশ করে গৃহিণীকে ডাক দেন, ‘ওগো যাদুমণি।’
যাদুমণি বিদুষী না হলেও নারী, ইনটুইশন তাঁর জন্মগত ও মর্মগত। তিনি সবই বোঝেন, তবু মনকে প্রবোধ দেন এই বলে, ‘জীবনে যত মাছ হল না খাওয়া তাদের দাম মিছে জমাতে যাওয়া। টাকা জমিয়ে কী হবে? সঙ্গে যাবে?’
পাড়ায় থাকতেন এক সিভিল সার্জনের স্ত্রী—অবসরপ্রাপ্ত। (স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত নন, সিভিল সার্জন স্বয়ং অবসরপ্রাপ্ত) মহিলাটি মহিলা মহলের মোড়ল। শিবানীকে কেউ পছন্দ করছে না শুনে দু-চারটে টোটকা বাতলে দিলেন। বলেন, ‘বিজ্ঞানের অসাধ্য কী আছে? আর বিজ্ঞান খাটে না কোন বিষয়ে? মেয়ে-দেখানো কাজটি বৈজ্ঞানিকভাবে করে দেখুন, ফল অবশ্য পাবেন।’ তিনি ফি দাবি করেন না, পাড়ার মহিলারা তাঁকে ধরাধরি করে নিজ নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁর নির্দেশমতো দর্শনীয়া কন্যার প্রসাধন করেন। (টীকা—‘ধরাধরি করা’ এখানে দ্ব্যর্থবাচক।)
‘ও শাড়ি পরালেই হয়েছে! মরি মরি কী রুচি! খোঁপাটা অমন কুকুরের ল্যাজের মতো হল কেন শুনতে পারি? ব্রোচটা ওখানে বসবে না, বিশ্রী বেমানান দেখায়।’
সিভিল সার্জনের স্ত্রীর টোটকা অনুসারে দ্রৌপদীর মতো প্রতিদিন দু-বেলা শাড়ি বদলাতে বদলাতে শিবানী একটি পুতুলের মতো অসাড় হয়ে উঠল। তার মাথার চুলও ক্রমাগত খোলা হচ্ছে, বাঁধা হচ্ছে, তৈলাক্ত হচ্ছে, ধৌত হচ্ছে। তার হাত-পায়ের নখ ঘসা হয়, কাটা হয়, পালিশ করা হয়, রঙিন করা হয়। তবু ফল পাওয়া যায় না। গাঙ্গুলি গৃহিনী বলেন, ‘সবুরে মেওয়া ফলে। বিজ্ঞান তো ভোজবাজি নয় যে দেখতে দেখতে বীজ থেকে গাছ গজিয়ে সেই গাছে আম ফলবে।’
বেনারসি শাড়িতে ফল হয় না, সুতরাং কাশ্মীরি শাড়ি পরো। কাশ্মীরিতে ফল হয় না, অতএব বোম্বাই শাড়ি পরো। তাতেও ফল হয় না, মাদ্রাজি শাড়ি পরো।
কে এক অর্বাচীন টিপ্পনী করলেন, ‘তার মানে একশোটা গুলি মারলে একটা লেগে যাবে। তাহলে বিজ্ঞান আর কী হল।’
গাঙ্গুলি-গৃহিণী সিডিশনের গন্ধ পেয়ে জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘হয়েছে! হয়েছে! মা-মাসিমার চেয়ে তুমি বেশি জানো দেখছি! তবে তুমিই সবাইকে পরামর্শ দাও। আমরা তাহলে এখান থেকে উঠি।’
বলা যত সহজ ওঠা তত সহজ নয়। গাঙ্গুলি গৃহিণী রথের পথে পুরীর জগন্নাথ মূর্তির মতো দুলতে থাকলেন, কেউ তাঁকে তুলে নিয়ে এগিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ করল না।
বোঝা গেল তাঁর প্রতিপত্তি—বিজ্ঞানের প্রতিপত্তি—অস্তমিত হয়েছে। যার পরামর্শে ফল হয় না, তাকে মোড়ল বলে মানতে কেউ প্রস্তুত নয়।
শিবানীকে দেখে যাদের অনুমান হয় যে ওর বয়স উনিশ-কুড়ি তারা মুর্খ। তার দেহে এখনও লাবণ্যের বন্যা আসেনি। তার সর্বাঙ্গ ভরে উঠে ঢল ঢল করেনি ও দু-কূল ছাপাতে উদ্যত হয়নি। সে হচ্ছে সেই জাতীয় লতা যার বৃদ্ধি দ্রুত ও ঘন হলেও যে পুষ্পিতা হবার কোনো লক্ষণ দেখায় না।
প্রৌঢ়রা একটি রাঙা টুকটুকে বউমা পেলে খুশি হন, তাঁদের পক্ষে শিবানী যথেষ্ট কমনীয় নয়, কচি নয়। আর যুবকরা চান শ্রীসম্পন্না বয়ঃপ্রাপ্তা তরুণী বধূ, শিবানীকে তাঁরা ছ-সেরা বেগুনের মতো একটা অপরূপ পদার্থ জ্ঞান করেন। তার রং ময়লা। কালো মানুষদের দেশে সেটা তার এক মস্ত অপরাধ। কিন্তু সেজন্যে সে নিজে চিন্তিত নয়, চিন্তিত তার বাবা মৃগেন্দ্র, মা সৌদামিনী, তার জ্যাঠামশাই দাশরথি। কেবল তার জ্যাঠাইমা যাদুমণি বলেন, ‘পাঁচটা ছেলেমেয়ের মধ্যে সব কটাই ধলা হবে এ তোমার ইংরেজের দেশে হয় কিনা বলতে পারিনে, কিন্তু কালা-ধলা দুই না-থাকলে ভগবানের সৃষ্টি একাকার হয়ে যেত।’ একথা যখন তাঁর মুখে তাঁর স্মরণে তখন তাঁর দাঁতের কথা।
চিন্তা করতে, উদ্বিগ্ন হতে, বিরক্ত হতে শিবানী জানে না। তাকে যে যা করতে বলে সে তাই করে, তবু খাটুনির চাপে তার বাড় থামে না। ওজন কমাবার জন্যে তার ভোজন কমানো হয়, কিন্তু শরীর তার যেন মনসা সিজের ঝাড়। পড়াশুনো সে তার সাধ্যমতো করেছে। মেয়ে ইশকুলে ক্লাসে-ওঠা বাড়িতে সিঁড়ি-ওঠার চেয়ে সোজা, দেশে ফোর্থ ক্লাস অবধি উঠেছিল। তারপর কাশীতে এসে দু-বেলা সাজতে ও সাজ খুলতে ব্যাপৃত থাকায় ইশকুলে হাজিরা দেবার সময় নেই বলে ভরতি হয়নি। দাশরথিবাবুর একমাত্র দুহিতা—যিনি প্রকৃতপক্ষে বিধবা হলেও কলেজে কুমারী বলে আখ্যাতা —তাঁরই কাছে শিবানী মুখে মুখে ইংরেজি কথোপকথন শিখছে। তাকে গান শেখানোর জন্যে সপ্তাহে তিন দিন একজন আসেন—ওস্তাদ নন, কারণ ওস্তাদের ধৈর্যের সীমা আছে, যদিও অন্যের ধৈর্যের সীমা সম্বন্ধে ওস্তাদ হচ্ছেন নাস্তিক।
এই যার মোটামুটি পরিচয় সে যে সোমের মতো পাত্রের উপযুক্ত নয় তা কি দাশরথিবাবুরা জানতেন না? জানতেন। তবে সম্বন্ধ করলেন কেন? কারণ দাশরথিবাবুর এক ছেলে বিলেত ঘুরে এসেছে, আর এক ছেলে বিলেতে সাত বছর থেকে Accountancy শিখছে, মেয়েকেও তিনি বিলেত পাঠাবার কল্পনা করেছেন—যদি সে সরকারি স্কলারশিপ পায়। কাজেই দাশরথিবাবুর ভাইঝিকে যে বিয়ে করবে তার স্ত্রীভাগ্য যাই হোক শ্যালক ও শ্যালিকাভাগ্য গৌরবময়। শ্যালক ও শ্যালিকা সম্পদই তার যৌতুক। আর স্ত্রীও তো কাঁচামাল, তাকে দিয়ে যা বানাবে সে তাই বনবে। নিজের হাতে গড়ে নাও। কোনো আফশোস থাকবে না। সেই তো গার্হস্থ্য স্বরাজ। আজকাল ঘরে ঘরে এত দাম্পত্য অশান্তি কেন? লোকে পরের হাতে তৈরি মেয়ে বিয়ে করে বলে। সব ল্যাঙ্কেশায়ারের কলে প্রস্তুত।
কাজেই সোমকে শিবানীর বর করতে দাশরথিবাবুদের দ্বিধা ছিল না, তাঁরা মনে মনে বলছিলেন, উপযুক্ত নয়? তবে উপযুক্ত করে নাও। শত শত ভদ্রলোক যাকে দেখে না-পছন্দ করলেন সোম যে তাকে পছন্দ করবে এতটা ভরসা তাঁদের ছিল না। তবে ওসব ভদ্রলোক আসলে হচ্ছেন কশাই, ওঁরা দাশরথিবাবুকে প্রকারান্তরে জিজ্ঞাসা করে ছিলেন, পণ কত দেবেন। দাশরথিবাবু প্রকারান্তরে বলেছিলেন, এক পয়সাও না। এমন সব শ্যালক-শ্যালিকা থাকতে পণ? দাশরথিবাবু ক্রমশ বুঝলেন যে পণ অনুসারে পছন্দ। তবু তাঁর মতো মানী ব্যক্তি পণের কড়ি নিয়ে দরদস্তুর করবেন এ কি কখনো সম্ভব? আর কৃপণও তিনি কম নয়। সবদিক থেকে খতিয়ে দেখলে সোমের মতো পাত্রই তাঁর আশার স্থল। জাহ্নবীবাবুও দাশরথিবাবুর কথা ঠেলবেন না, যদি তাঁর ছেলের দিক থেকে কোনো আপত্তি না থাকে।
দাশরথিবাবু মনে মনে একটা প্রকান্ড বক্তৃতা মুসাবিদা করলেন, যেন জুরির প্রতি জজের চার্জ। বাবা কল্যাণ, তোমরা নব্য তরুণ, তোমরা ভাবী ভারত, তোমরা পণ নিতে পারো না। কী চাও তোমরা? রূপ? দেহের রূপ যে দেহের চেয়েও নশ্বর। বিদ্যা? দুজনের মধ্যে একজন বিদ্বানই যথেষ্ট, নইলে বিরোধ অনিবার্য। ডিগ্রি? হায়রে দেশ! ডিগ্রির মোহ এখনও মুছল না! ভেবে দেখ কল্যাণ, পৃথিবীতে শাশ্বত যদি কিছু থাকে সে হচ্ছে বনেদিয়ানা। আমরা বনেদি বংশ, কুলীন। আমাদের এভল্যুশনের জন্যে বহু শতাব্দী লেগেছে। এ বাড়ির মেয়ে কেবলমাত্র জন্মস্বত্বে এত বাঞ্ছনীয় যে চন্দনকাঠের বাক্সের মতো রঙিন প্রলেপের অপেক্ষা রাখে না। বাজারের মেয়ে হলে accomplishments-এর আবশ্যক থাকত। তোমরা গৃহশ্রী চাও না নটী চাও?
সোম দাশরথিবাবুর পরিচয় পেয়ে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ওপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই তিনি একেবারে গলে গেলেন। বললেন, ‘থাক, থাক, হয়েছে, হয়েছে।’ নিজের বিলেতফেরত ছেলেও তাঁকে সকলের সাক্ষাতে এমন মর্যাদা দেয়নি। স্টেশন থেকে বাড়ি পর্যন্ত তাঁর বাকস্ফূর্তি হল না—উত্তেজনায়। তারপর হাঁক দিলেন, ‘ওগো যাদুমণি।’ যাদুমণি বেরিয়ে আসতেই সোম তাঁকে একটি ভূমিষ্ঠ প্রণাম ঠুকে দিল। তিনিও হতবাক। সোম এদিকে একধার থেকে প্রণাম করতে লেগেছে। বাড়িতে দুই-তিনজন অভ্যাগত ছিলেন, তাঁরাও বাদ গেলেন না। দাশরথিবাবুর বিধবা মেয়ে কুমারী কাননবালা মিত্র চোখে চশমা এঁটে ওই পথ দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন, যেন সোমকে দেখতেই পাচ্ছিলেন না—সোম তাঁর পায়ের কাছে ঢিপ করে প্রণাম করলে, তিনি প্রথমে চকিত ও পরে এমন বিনম্রভাবে নমস্কার করলেন যে, পাঠক ওখানে উপস্থিত থাকলে পাঠকের মনে হত মিস মিত্র ওই নমস্কারের মহড়া দিয়ে আসছিলেন পরশু থেকে তাঁর শোবার ঘরের আয়নার সম্মুখে।
কৌতূহলী হয়ে শিবানী সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিল, পাছে সোমের ভক্তির আবেগ সাগরলহরীর মতো সেই সামান্য বালিকার চরণে চূর্ণ হয় এই আশঙ্কায় যাদুমণি বিশ্রী একটা নিষেধ বাক্যের দ্বারা সেই বালিকাকে স্বস্থানে স্তম্ভীভূত করে দিলেন। দেখেশুনে সোমও তার ভালোছেলেমির বেগ সংবরণ করল।
কে একটি চাকর এসে তাকে পাখা করতে লাগল। যাদুমণি বললেন, ‘বোসো, বাবা বোসো।’ দাশরথি বললেন, ‘তোমাকে দেখেছিলুম মুনশিগঞ্জে, তখন তুমি চার পাঁচ বছরের।’ যাদুমণি আপত্তি করে বললেন, ‘না, না, আমার রবি তখন কোলে, আর এ ছেলে তখন হামাগুড়ি দিচ্ছিল।’ দাশরথিবাবু বললেন, ‘সে কী করে হয়?’ স্বামী স্ত্রীতে এই নিয়ে ঘোরতর বচসা উপস্থিত। দুজনেই স্মৃতি-সমুদ্র মন্থন করে কার, কখন চোখ উঠেছিল, হাম হয়েছিল, কাকে কোনখানে কাঁকড়াবিছেতে কামড়েছিল, ভূতে পেয়েছিল, কে কোন বার গলায় মাছের কাঁটা আটকে প্রায় পটল তুলেছিল—এই সকল অলিখিত তথ্য উদ্ধার করতে থাকলেন।
বাড়ির বুড়ি ঝি—বুড়ি ঝিদের নাম যা হয়ে থাকে তাই অর্থাৎ মোক্ষদা—তর্কের মোড় ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক মায়ের মতো দেখতে—তেমনি চোখ, তেমনি ভুরু, তোমার—’
যাদুমণি বললেন, ‘তুই ভারি মনে রেখেছিস মোক্ষদা। অবিকল বাপের মতো মুখ, যেন ঠাকুরপো নিজেই এসেছেন এত কাল পরে। হাঁ বাছা, তোমার বাবার খবর দিলে না যে? ভালো আছেন তো? তোমার নতুন মাকে আমি দেখিনি। বেশ ভালো ব্যবহার করেন তো? নতুন ভাইবোন ক-টি?’
দাশরথি বললেন, ‘আহা, এক সঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে কেন?’ এই বলে তিনি নিজেই আর একটি প্রশ্ন জুড়ে দিলেন। ‘ওহে, লণ্ডনে ধূর্জটির সঙ্গে তোমার দেখাসাক্ষাৎ হত?’
সোম ধূর্জটির নাম শুনেছিল, কিন্তু চেহারা দেখেনি। বলল, ‘লণ্ডনের মতো বিরাট শহরে পাঁচ-শো বাঙালি ছাত্র কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, সকলের সঙ্গে সকলের দেখা হওয়া অসম্ভব। তাঁর ঠিকানাই জানতুম না।’
কর্তা-গিন্নি দু-জনেই ক্ষুণ্ণ হলেন। আশা করেছিলেন যে-খবর চিঠিতে পাবার নয়, সে-খবর দূতের মুখে পাবেন।
যাদুমণি দাশরথিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাঁ গা, রবি কোথায় পড়ত, গেলাস না বাটি কী তার নাম?’
মিস মিত্র ফিক করে হেসে বাপের হয়ে উত্তর দিলেন, ‘ও মা, গ্লাসগো তোমার মনে থাকে না।’
যাদুমণি বললেন, ‘এই তো তুই নিজমুখে বললি গ্লাস গো। আমিও বলেছি গ্লাস—তবে আমি মুখখু মানুষ, আমি গ্লাস না বলে গেলাস বলেছি। এই তো?’
‘ওগো না গো, দাশরথি বুঝিয়ে বললেন, ‘গ্লাস নয়, গ্লাসগো।’
যাদুমণি আগুন হয়ে বললেন, ‘তামাশা করবার আর সময় খুঁজে পেলে না। গ্লাস নয় গো, গ্লাসগো, চুলো নয় গো, চুলো গো।’
দাশরথিবাবু পলায়ন করলেন। কাননবালা সোমকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, ‘কত বার চেষ্টা করলুম, all in vain. তোতাকে কৃষ্ণ নাম শেখালে সে শেখে, কিন্তু to teach Mother English!’
মা কী বুঝলেন তিনিই জানেন, মুখ ভেঙিয়ে বললেন, ‘বুঝেছি লো বুঝেছি। আমারই ঘরে বসে আমারই খেয়ে আমার নিন্দে। আমার শিল আমার নোড়া আমার ভাঙে দাঁতের গোড়া।’
মোক্ষদা বলল, ‘হাঁ রে খুকী, তুই কী বলছিস ইঙ্গিরিজিতে? মায়ের দাঁত ভাঙবি?’
‘তুই বের হ এখান থেকে হারামজাদি,’ বলে যাদুমণি মোক্ষদার গায়ে যেন বিষ দাঁত বসিয়ে দিলেন। কাননবালার পিছু পিছু মোক্ষদাও দৌড় দিল।
বাকি থাকল সোম। যাদুমণি তাকে ব্যথার ব্যথী করলেন। লেখাপড়া যে তিনি জানেন না সেটা কি তাঁর দোষ? দশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে, বারো বছর বয়সে তিনি মা—এক এক করে পাঁচটি সন্তান হারিয়ে তিনি যখন বিশের কোটায় পা দিলেন তখন যমরাজ তাঁকে দয়া করলেন, তাঁকে তিনটি সন্তান ভিক্ষা দিলেন। তারপর সেই সন্তান তিনটিকে মানুষ করতে করতে আটাশ বছর অতীত হল, অতীতের স্মৃতি নিয়ে দুদন্ড কাটাবেন তার অবসর পেলেন না। মেয়েটিই সকলের বড়ো, তার কপাল পুড়ল বিয়ের মাস ছয় না যেতে। শ্বশুর-শাশুড়ি গরিব, নিজেরাই খেতে পান না, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এল। ওর বাপ বললেন, একটিমাত্র মেয়ে, তার বিষণ্ণ মুখ দেখতে পারিনে, যাক ও ইশকুলে, যে ক্লাসে পড়ছিল সেই ক্লাসে পড়ুক, ইশকুলের খাতায় যে-নাম লেখা ছিল সেই নাম বহাল থাকুক। পড়াশুনোয় মেয়ের খুব মন, কিন্তু মাঝখানে হল পেটের ব্যারাম। ভুগতে ভুগতে বেচারির চারটি বছর নষ্ট। এই বার এম-এ দেবে। —যাদুমণি সগর্বে ভ্রূ বিস্তার করলেন। ততক্ষণে ভুলে গেছলেন যে মেয়ে তাঁর মূর্খতা নিয়ে পরিহাস করেছে।
সোম বলল, ‘ধূর্জটিবাবু ও রবিবাবুর সঙ্গে বিলেতে পরিচয় হল না বলে আমি দুঃখিত।’
‘রবি তো দেশে ফিরেছে। দুই ভাই এক সঙ্গে ওদেশে যায়, রবি ছোটো। আর সেই রবিই কি না পাঁচ বছরের মধ্যে পড়া শেষ করে বরোদায় কাজ পেয়ে গেল।’ যাদুমণি সোমকে জিজ্ঞাসু দেখে যোগ করলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার।’
‘আর ধুর্জটিবাবু?’
‘ওকথা তুমি ওঁকে জিজ্ঞাসা কোরো, বাবা। আমার এখনও দোরস্ত হল না। পাস করলে কোম্পানির হিসাব পরীক্ষা করবে, না কী করবে। এদিকে তো বাপের পেনশনটা সেই একলা গ্রাস করল। সে আর এইসব’—এদিক-ওদিক চেয়ে চুপি চুপি—‘কুটুম্বুরা।’
সোমও গলার সুর নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা সব কুটুম্বু বুঝি?’
চোখ টিপে যাদুমণি চুপি চুপি বললেন, ‘বুঝতে পারলে না? কাশী বেড়াতে এসে ছত্রে খাবার ফন্দি এঁটেছে। কুটুম্ব নয়, কুটুম্বুর কুটুম্বু, তার কুটুম্বু। তাও নয়, কোথায় ওঁর নাম শুনেছে, এসে বলেছে আপনি আমার মামলা ডিসমিস করেছিলেন তেইশ বছর আগে আরামবাগে।’
সোম ফিসফিস করে বলল, ‘ভাগিয়ে দেন না কেন?’
‘ওরে বাপ রে। কাশীধামের পুণ্য যেটুকু হচ্ছে এই বুড়ো বয়সে সেটুকুও হবে না।’ যাদুমণি অঙ্গভঙ্গিসহকারে উক্তিটাকে সচিত্র করলেন।
সোম আসবে এই খবর পেয়ে শিবানীকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল, অন্যের কাছে পরীক্ষা দেওয়ার তার দরকার ছিল না। সোমের পৌঁছোনোর পর আবার সাজ সাজ রব উঠল। ধূর্জটির স্ত্রী এই বাড়িতেই থাকেন, রবির স্ত্রী বরোদায়। ধূর্জটি তিন বছর আগে একবার দেশে এসে স্ত্রীকে দেখা দিয়ে গেছল, ফলে তাঁর একটি খোকা হয়, সেই খোকাটিকে বুকে করে তাঁর বিরহবেদনার উপশম হচ্ছিল। শিবানীকে সাজানোর ভার তাঁরই ওপরে পড়েছে।
কাননবালার কলেজ থাকায় তিনি এ বিষয়ে দায়িত্ববিরহিত। তিনি এসব বোঝেনও না, বুঝতে চানও না। ভালো ছেলেরা যেমন টেরি কাটে না, সাবান মাখে না, শৌখিন পোশাক পরে না। কাননবালারও তেমনি কেশ আলুথালু, বসন এলোমেলো, ধরন অগোছালো।
আবার সাজ সাজ রব উঠল। এবার এসেছে বিলেতফেরতা পাত্র, পাড়ার পরোপকারিণীদের দ্বারে ডাকাডাকি করতে হল না; তাঁরা সাজ সাজ রবাহূত হয়ে নিজেরাই সেজেগুজে সমুপস্থিত হলেন। গাঙ্গুলিগিন্নি সেবারকার অপমানের কথা ধর্তব্য মনে করলেন না, তবে এবার মাদুরের উপর আসন না-নিয়ে, একখানা প্রশস্ত মজবুত চেয়ারে আসীন হলেন, যদি আবার অপমানিত হন, তবে গাত্রোত্থানের জন্য পরমুখাপেক্ষী হবেন না। এবার শিবানীর সংকট এত বিষম যে তাঁকে উপেক্ষা করবে কি সকলে তাঁকেই সংকটের তারিণী ভেবে স্তুতি করতে শুরু করে দিল।
সোম ঘুণাক্ষরে জানত না যে এত বড়ো একটা আয়োজন চলেছে শুধু তারই মনোহরণের জন্যে। সে আরাম করে সারা দুপুর জুড়ে নিদ্রা দিল। কে একটি ছোটো ছেলে তার শোবার ঘরে ঢুকে ছোটাছুটি করে তাকে যখন জাগিয়ে তুলল তখন পাঁচটা বাজে। চোখ-মুখ ধুয়ে সে বসবার ঘরে গিয়ে দেখে দাশরথিবাবু সপার্ষদে তার প্রতীক্ষা করছেন। ‘এই যে, কল্যাণ। বসো, কেমন ঘুম হল। এতক্ষণ তোমার কথা এঁদের বলছিলুম। একেবারে মনে হয় না যে বিলেত থেকে ফিরেছ। কী ভক্তি, কী বিনয়, কী স্বদেশপ্রীতি—আমি তো ভয়ে ভয়ে ছিলুম প্যান্ট-কোট পরা সাহেবকে কী খাইয়ে কোথায় বসিয়ে আদর আপ্যায়ন করব!’
সমাগত অবসরপ্রাপ্তগণ নাকের উপর চশমা চড়িয়ে সোমকে পর্যবেক্ষণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। দু-বছর বিলেতে থেকে তার গায়ের রং যতটা ফর্সা হয়েছিল এই কয় দিনেই প্রায় ততটা ময়লা হয়েছে। তার চামড়ার নীচে যে বিদেশি প্রভাব উহ্য ছিল টেলিস্কোপ বা মাইক্রোস্কোপেও তার পাত্তা পাওয়া যায় না, চশমা তো ছার। কাপড় চোপড় বাঙালির মতো দেখে তাঁরা চশমা খুলে রাখলেন। কতকটা হতাশ সুরে বললেন, ‘না, আদৌ মনে হয় না যে বিলেত প্রত্যাগত।’
তবু তাঁরা সে-দেশ সম্বন্ধে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে চললেন। সোম সাধ্যানুসারে উত্তর দিতে থাকল। তার অন্য দিকে হুঁশ ছিল না। হঠাৎ এক সময় পর্দা সরিয়ে দুই-তিন জন মহিলা একটি বালিকাকে ঘরের ভিতর জোরে ঠেলে দিলেন। পর্দা ছেড়ে দিলেন। বালিকাটি দুই হাতে একটি ট্রে ধরে তিরের মতো সোজা সোমের দিকে এগিয়ে এল। সোম যদি হঠাৎ উঠে তার হাত থেকে ট্রে-টি তুলে নিয়ে নিকটবর্তী টিপয়ের উপর না রাখত, তবে টাল সামলাতে না পেরে সে হয়তো সোমের গায়ে চা ঢেলে দিত।
সোমকে একটি সরল চাহনি অর্পণ করে সে নতমুখে দাঁড়িয়ে কী যেন স্মরণ করতে চেষ্টা করল। যেন তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই-এই করতে হবে, শেখানো কর্তব্য ভড়কে গিয়ে ভুলে গেছে। সোম যে হঠাৎ তার হাত থেকে ট্রে-টি কেড়ে নেবে এমন সম্ভাবনার জন্যে তাকে কেউ প্রস্তুত করে দেয়নি। সে যে ভূমিকায় অভিনয়ের তালিম পেয়েছিল তাতে কেউ ট্রে ছিনিয়ে নিলে ধন্যবাদ দিতে হয় এটুকুরও উল্লেখ ছিল না।
তাকে তদবস্থ দেখে কারুর করুণা উপজাত হওয়া দূরে থাকুক সোম ছাড়া সকলের কোপ উদ্রিক্ত হল, অভিনেতা পার্ট ভুলে গেলে অডিয়েন্সের যা হয়। দাশরথিবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘নমস্কার করো।’ মেয়েটি বার-এক চোখ মিট মিট করে শশব্যস্তভাবে নমস্কার করল। তখন সোম তার দশা হৃদয়ংগম করে তার ওপর থেকে সকলের মনোযোগ ছাড়িয়ে নিল। বৃদ্ধ কুঞ্জমোহনবাবুর কাছে ট্রেশুদ্ধ টিপয়টি স্থাপন করে করজোড়ে বলল, ‘আগে বয়ঃ প্রাচীন।’
কুঞ্জবাবুর মঙ্গোলীয় নয়নযুগল বিনা নেশায় ঢুলু ঢুলু। তিনি যুগপৎ বিস্মিত ও সন্মিত হলেন। কিছু না বলে একটি রসগোল্লা তুলে নিয়ে টপ করে মুখে ফেলে দিলেন। দুই ঠোঁট একত্র হয়ে ‘আঁপপ’ বলে একটা শব্দ সৃষ্টি করল। তারপর গন্ডদ্বয়ের স্ফীতি প্রশমিত হল ও চোখের কোণ থেকে খানিকটা জল ঝরে গেল। তখন দাদা বললেন, ‘বেশ বানিয়েছে তো। একটা মুখে দিয়ে দ্যাখ না, দাশরথি।’ অতঃপর সুসজ্জিতা অন্য কয়েকটি মেয়ে ঘরে যতগুলি ভদ্রলোক ছিলেন ততগুলি থালা হাতে করে প্রবেশ করলেন ও সকলের হর্ষ বর্ধন করলেন।
সোম এতক্ষণে টের পেয়েছিল যে এইসব সজ্জন তাকে পরীক্ষা করতে আসেননি, এসেছেন পরীক্ষাধীনার পক্ষীয় হয়ে পরীক্ষককে তোষামোদ করতে। কিন্তু কোনটি পরীক্ষাধীনা? একটি না সব ক-টি? কেউ তো কারুর চেয়ে কম সাজেনি। যেন সকলের জীবনে আজ পার্বণ। হয়তো প্রত্যেকেই ভাবছে সোম কী মনে করে তাকেই পছন্দ করবে। বলবে, দেখতে এসেছিলুম বটে শিবানীকে কিন্তু পছন্দ হল আমার (জ্যোৎস্নার মনে মনে) জ্যোৎস্নাকে, (লিলির মনে মনে) লিলিকে, (শান্তিলতিকার মনে মনে) শান্তিলতিকাকে।
কিন্তু মরীচিকার মতো ওই সকল মায়াললনা কোথায় মিলিয়ে গেল। সোম দেখল, সেই সর্বপ্রথম মেয়েটি। (সেইটি শিবানী বুঝি) তখনও তেমনি নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে—নিশ্চল প্রতিমার মতো। সুরূপা নয়, বেশভূষা তার অঙ্গের সঙ্গে অসমঞ্জস, যেন তার নিজের নিত্যকার নয়। কেবল দীঘল ঘন চুল এলায়িত হয়ে তার মধ্যে যা কিছু লাবণ্য যোজনা করেছে। মেয়েটির মুখ ভাব বড়ো সরল। মনে হয় এ মেয়ে রূপকথা শুনে তার প্রত্যেকটি কথা বিশ্বাস করে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি ঋজু, সরল। মনে হয় এ মেয়ে আরামকেদারায় বই হাতে করে ললিতা নয়, খাটতে অভ্যস্ত।
সোম নরম সুরে বলল, ‘বসুন।’
মেয়েটি সত্যিই বসল। হুকুম যে। হুকুমের অবাধ্য হতে জানে না। ওদিকে দাশরথিবাবুরা মেয়েটার স্পর্ধা দেখে রুষ্ট হলেন। কিন্তু পালটা হুকুম করলেন না।
ভদ্রতার খাতিরে সোম দুটো একটা প্রশ্ন করল। দাশরথিবাবু বললেন, ‘অতবার ওকে ‘আপনি’ আপনি’ বলছ কেন বাবা। ও তোমার অনেক ছোটো।’—
কাঙ্গালীবাবু বললেন, ‘সব দিক দিয়ে।’
সরোজিনীবাবু বললেন, ‘লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামি ছাত্রের সঙ্গে আমাদের ওই পল্লিবালিকার তুলনা হয়! তবে ইনি যদি ওকে নিজগুণে গ্রহণ করেন—যদি ওর নির্গুণতা গ্রাহ্য না করেন তবে দুই জেলা জজের পারিবারিক সংযোগ বড়োই হৃদয়গ্রাহী হবে।’
চাটুভাষণ সমানে চলল।
পরদিন যাদুমণি প্রসঙ্গটা তুললেন। বললেন, ‘কেমন লাগল, বাছা, শিবানীকে?’
সোম গত রাত্রে ভেবে রেখেছিল এর উত্তর। মেয়েটি এমন অবোধ যে ওকে প্রবঞ্চনা করা নিতান্ত সহজ এবং সেইজন্যে সর্বথা পরিহার্য। ওকে বিয়ে না করলেই চুকে যায়, কিন্তু বিয়ে করতে সোমের অনিচ্ছা ছিল না। বরঞ্চ ওর প্রতি সোমের প্রগাঢ় মমতা বোধ হচ্ছিল। কে জানে কার হাতে পড়বে, শাশুড়ি দেবে ছ্যাঁকা, ননদ করবে চিলেকোঠায় বন্দি, স্বামীটি গোপালের মতো সুবোধ, প্রতিবাদ করবে না। ওর মতো অবোধ মেয়েরাই তো অত্যাচারকে আমন্ত্রণ করে।
বলল, ‘ভালোই লেগেছে। তবে—’
‘তবে?’
‘তবে আমার একটি ব্রত আছে।’
‘ও মা পুরুষ মানুষের কী ব্রত!’ যাদুমণি তাঁর কন্যা কাননবালার দিকে তাকিয়ে সোমের দিকে ফিরে তাকালেন।
কাননবালা উৎকর্ণভাবে ছিলেন : বাক্য প্রক্ষেপ করলেন না।
সোম বলল, ‘আমার ব্রত এই যে যার সঙ্গে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হবে তার সঙ্গে আগে একবার আমি নির্জনে কথা বলতে চাইব। কথাবার্তার পরে স্থির করব তাকে বিয়ে করব কি না।’
‘কী বললে!’ যাদুমণি যেন হালুম হালুম করতে লাগলেন বাঘিনীর মতো। ‘কী বললে তুমি। নির্জনে কথাবার্তার পর বিয়ে করবে কি না ভেবে দেখবে। ওগো শুনছ! খুকীর বাবা। ডাক দেখি খুকী তোর বাবাকে।’ যাদুমণি গজরাতে থাকলেন।
দাশরথিবাবু এক পায়ের একপাটি চটি বৈঠকখানায় ফেলে এলেন। ঊর্ধ্বশ্বাসে বললেন, ‘কী হয়েছে? কী? কী?’
যাদুমণি ততক্ষণে স্মৃতির সঙ্গে কল্পনা মিশিয়েছেন এবং সেই মিশ্র সামগ্রীকে সোমের ওপর আরোপ করে আরও কুপিত হয়েছেন। বললেন, ‘তোমার বন্ধুর ছেলে বলছেন তোমার ভাইঝির সঙ্গে আগে নির্জনে কথা বলবেন, কী আর-কী করবেন, পরে বিয়ে করবেন, কী আর-কী করবেন। ভাইঝি, না বাইজি—কী দেখতে আসা হয়েছে কাশীতে?’
দাশরথিবাবু লজ্জিত, অপদস্থ, অপমানিত সোমকে ইঙ্গিতে বললেন, ‘এসো আমার সঙ্গে!’ বৈঠকখানায় পাশে বসিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিষম বদরাগী মানুষের পাল্লায় পড়েছিলে। আমি জানি উনি তিলকে বাড়িয়ে তাল করেছেন। আমাকে বলো তো আসল কথাটা।’
তখনও সোমের হৃৎকম্প হচ্ছিল। অপমানে তার বাকরোধ হয়েছিল। সে দুই হাতে মুখ ঢাকল। এই সময় কাননবালা এসে দাশরথিবাবুর কাছে আসন নিলেন।
‘বলো বাবা, বলো। আমাকে তোমার বাবার মতো মনে করতে পারো।’
তবু সোম নির্বাক।
কাননবালা সোমের পক্ষ নিয়ে বললেন, ‘বিলেতফেরতা আধুনিক যুবকদের এ বাড়িতে আসতে বলবার সময় মা-র মুখে gag দেওয়া উচিত, যেমন দুষ্টু কুকুরের মুখে।’
‘কী হয়েছে, তুই বল না খুকী।’
খুকী বললেন, ‘হয়েছে যা তারজন্যে এই ভদ্রলোকের কাছে আমাদের মাফ চাওয়া উচিত। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাসবশত যদি ইনি বলেই থাকেন যে শিবানীকে বিয়ে করবেন কি না স্থির করবার আগে একবার ওর সঙ্গে নির্জনে আলাপ করতে চান—যা ওদেশের একটা অতি নির্দোষ রীতি—তবে অন্যায় কিছু বলেননি। যে-কোনো মডার্ন যুবক তাই বলে থাকতেন ও যে-কোনো মডার্ন মেয়ে তাই প্রত্যাশা করে থাকত।’
দাশরথিবাবু শেষ পর্যন্ত শুনলেন কিনা সন্দেহ। একমনে ও দুই হাতের দশ আঙুলে দাড়ি বুরুষ করতে লাগলেন। যৌবনে ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন। ভাব গেছে, প্রভাব আছে ও পরিপুষ্ট হয়ে আননভূমিতে কানন রচনা করেছে।
বহুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘যে সমাজে বাস করতে হচ্ছে সে সমাজের রীতি মান্য করতে হয়। নইলে তোর আমি পুনরায় বিয়ে দিইনি কেন?’
সোম আড়চোখে কাননবালার মুখে তাকিয়ে দেখল তিনি শরম-সিন্দূর বদনে কী যেন ধ্যান করছেন। নিশ্চয়ই তাঁর লোকান্তরিত স্বামীর মর্ত্যরূপ নয়।
‘আমার স্ত্রীর কথায়,’ দাশরথিবাবু বলতে লাগলেন, ‘তুমি কিছু মনে কোরো না, কল্যাণ। এদেশে যা সম্ভব নয় তা ওদেশ থেকে ফিরে সম্ভব করতে চাও তো আর-এক পুরুষ অপেক্ষা করো। আমরা সেকেলে মানুষ, আমাদের উপর অধীত বিদ্যার প্রয়োগ না করে আমাদেরকে শান্তিতে মরতে দাও।’
সোম সাহসের সহিত বলল, ‘কিন্তু মেয়েগুলি যে আপনাদের হাতে।’
‘সেইজন্যেই তো বলছি আর-এক পুরুষ অপেক্ষা করো, তোমাদের নিজের নিজের মেয়ে হোক।’
‘কিন্তু,’ সোম উষ্মার সহিত বলল, ‘আমি যা সম্ভব করতে চাই তা এমন কিছু নয়, একটু বাক্যালাপের নিভৃত অবকাশ।’
‘না, না,’ দাশরথিবাবু দাড়ি নাড়লেন। ‘তুমি যে শুধু বাক্যালাপই করছ একথা পরে পাড়ার লোক বিশ্বাস করবে না।’
‘আপনার ভাইঝির মুখে শুনেও বিশ্বাস করবে না?’
‘না হে, না। ওদের মধ্যে যারা দুর্মুখ তারা ও-মেয়ের যাতে অন্যত্র বিয়ে না হয় সেই চেষ্টা করবে, বেনামি চিঠি লিখে পাত্র ভাঙিয়ে নেবে। ওদেরও তো বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে। এক যদি তুমি কথা দাও যে শিবানীকে পরে বিয়ে করবে তবে লোকনিন্দা আমরা সামলে নিতে পারব, যদিও এত বড়ো বনেদি বংশের পক্ষে ওটা যেন বনস্পতির পরগাছা—বনস্পতিরই মতো দীর্ঘজীবী। আরও তো ছোটো ছোটো ভাইঝি আছে, ওদেরও একদিন বিয়ে দিতে হবে। না, হবে না?’
কাননবালার পান্ডুর মুখ যেন এই কথাটি বলতে চাইছিল যে, ওইসব আগত অনাগত শিশুদের বিয়ে হবে না বলে আমারও ভালো করে বিয়ে হল না।
সোম বলল, ‘কথা আমি দিতে পারব না নিভৃতে কথা বলার আগে।’ আপনাকে অহেতুক লোকনিন্দাভাজন করতেও আমার রুচি হবে না। অতএব বিদায়।’
‘সে কী হে! তুমি এখনি উঠবে! হ্যাঁ!’
‘যা অসম্ভব তার জন্যে আমি আর-এক পুরুষ কেন আর-এক ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে পারবো না।’
‘সে কী হে! অ্যাঁ!’
‘যেতে হবে আমাকে সম্ভবের সন্ধানে—কুস্তোড় কলিয়ারি, নান্দিয়ারি, নান্দিয়ার পাড়া, লালমণির হাট, ভূসাওল, কোলাবা। একশো সাতচল্লিশটা ঠিকানার খোঁজ করতে হবে। সম্ভবকে এক জায়গায় বসে থাকলে চলে?’
দাশরথিবাবু বুদ্ধি ধার করবার জন্যে অন্দরে উঠে গেলেন। ডাকলেন, ‘ও যাদুমণি।’ স্বামী-স্ত্রীতে যতক্ষণ ধরে বুদ্ধি দেওয়া-নেওয়া চলল—ততক্ষণ বৈঠকখানায় সোম ও কাননবালা ছাড়া আর কেউ ছিল না।
কাননবালা সোমের দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘বাস্তবিক, লোকনিন্দাকে এতটা ভয় করা অনুচিত।’
সোম কাননবালার দিকে বিশেষ করে তাকিয়ে বলল, ‘লোকনিন্দার ভয়টা গৌণ। ভয় মুখ্যত আমাকে।’
কাননবালা ঘাবড়ে গেলেন। সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘কেন, আপনি কি বাঘ না ভালুক যে আপনাকে ভয় করতে হবে? এই তো আমি নিভৃত বাক্যালাপ করছি নির্ভয়ে।’
কপট গাম্ভীর্যের সহিত সোম বলল, ‘সাবধান, মিস মিত্র। একাকিনী নারীর পক্ষে পুরুষ হচ্ছে বাঘ-ভালুকের চেয়ে ভয়াবহ। কারণ বাঘ যদি আঁচড় দেয় তবে সে আঁচড় একদিন শুকোতে পারে। কিন্তু আমি যদি হাতখানি ধরে একটু নেড়ে দিই তবে সে ব্যথার চিকিৎসা নেই।’
নার্ভাস হাসি হেসে মিস মিত্র বললেন, ‘মডার্ন ইয়ংম্যানদের অহংকার দেখে এমন হাসি পায়। যেন আমরা কাচের পুতুল যে নাড়া পেলে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাব।’
সোম তেমনি গম্ভীরভাবে বলল, ‘একবার নাড়া দিয়ে দেখব নাকি?’
‘বেশ তো। দেখুন না।’ কাননবালা মুচকি হেসে চোখ নামালেন।
সোমের সহসা স্মরণ হল যে, না, আগুন নিয়ে খেলা আর নয়। যথেষ্ট বার প্রেম করা হয়েছে। এবার করতে হবে বিয়ে।
দাশরথিবাবু যেন আবৃত্তি করতে করতে ঘরে ঢুকলেন। ‘তোমার কথাই রইল, কল্যাণ। শিবানী ও তুমি এই ঘরে বসে নির্জনে কথাবার্তা কইবে, আর তিন পাশের তিন ঘরে থাকব আমি, খুকীর মা ও খুকী।’
সোম বিরক্তি দমন করে ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ‘তিন দিকের দরজা বন্ধ থাকবে, না খোলা থাকবে?’
‘খোলা থাকবে।’
‘তাহলে আর নির্জন কী হল?’
‘না, না, বন্ধ থাকবে।’
‘কোন দিক থেকে বন্ধ থাকবে—বাইরের দিক থেকে না ভিতরের দিক থেকে?’
দাশরথিবাবু বললেন, ‘তাই তো! তাই তো! ওগো যাদুমণি।’ আবার অন্দরে চললেন।
ইত্যবসরে কাননবালা বললেন, ‘মডার্ন ইয়ংম্যানদের ধরন হচ্ছে মেঘের মতো যত গর্জায় তত বর্ষায় না।’
সোম চুপ করে থাকল।
তিনি বললেন, ‘নাড়া দেব, নাড়া দেব। কই নাড়া? কেবল words, words, words.’
সোম আত্মসংবরণ করে সহাস্যে বললে, ‘মনে হয় সুপক্ক অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন।’
তিনি সকরুণ স্বরে বললেন, ‘আপনারা সকলেই সমান হৃদয়হীন। পরের হৃদয় সম্বন্ধে সমান উদাসীন।’
সোমের মধ্যেকার খেলোয়াড় ওই চ্যালেঞ্জ শুনে বলল, ‘শিবানীর হৃদয়ের প্রতি উদাসীন থেকে অন্যায় করব না বলেই তো তাঁর সঙ্গে প্রাইভেট ইন্টারভিউ প্রার্থনা করছি। তবে কোন অপরাধে আমাকে হৃদয়হীন বললেন?’
কাননবালা এর উত্তর দিতে না পেরে অপ্রতিভ বোধ করলেন। আরক্ত মুখমন্ডল অবনত করে অস্পষ্টভাবে বললেন, ‘আমি শিবানীকে লক্ষ করে বলিনি।’
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বেচারিকে আর নির্যাতন করে কী হবে! তাঁর দুঃখ দূর করা সোমের অসাধ্য। রোমান্সের ওপর তার অশ্রদ্ধা ধরে গেছল। ওর পরিণাম ভয়াবহ না হোক দুর্বহ। অথচ রোমান্সের সাহায্য ব্যতিরেকে এত বেশি বয়সের নারীকে বিবাহ করতেও প্রবৃত্তি হয় না।
সোম নীরব রইল। আর খেলা নয়।
পাঠ মুখস্থ করতে করতে দাশরথিবাবুর পুনঃপ্রবেশ। তিনি বললেন, ‘বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে।’
‘বাইরে থেকে যে বন্ধ থাকবে সারাক্ষণ তার স্থিরতা কী!’
‘তুমি তো ভারি সন্দেহী লোক হে!’
‘কে সন্দেহী লোক তা নিয়ে তর্ক করতে চাইনে।’ সোম উঠে দাঁড়াল। ‘আচ্ছা, আসি।’
‘অ্যাঁ!’ দাশরথিবাবু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললেন, ‘অ্যাঁ! বসো, বসো। আমার কথাটার সবটা শোনো আগে। তুমি বলছ, স্থিরতা কী? আমি বলছি, আমি প্রতিশ্রুতি দিলুম।’
‘আপনি তো দিলেন, আপনার স্ত্রী?’
‘আমার স্ত্রী পতিপ্রাণা।’
সোম মনে মনে বলল, ‘আর আপনার কন্যাটিও ভাবী ভগ্নীপতি-প্রাণা।’ মুখে বলল, ‘আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলুম।’
তাই হল। শিবানীকে সোমের সঙ্গে রেখে তিন দিকে তিন দরজার আড়ালে পাহারা দিলেন কেবল ওঁরা তিন জন না, ওঁদের বউমা, ওঁদের দাসী মোক্ষদা এবং আরও অনেকে। সোমকে শুনিয়ে শুনিয়ে দরজাগুলো সশব্দে বন্ধ হল। ক্রমশ গোলমাল থেমে এল। কিছুক্ষণ ফিসফিসানি চলল। তারপর সব চুপ। সকলে কান পেতে রইল সোম-শিবানী সংবাদ শুনতে।
সোম বলল, ‘শিবানী’। তার পর পাঁচ মিনিট স্তব্ধ থেকে ওঁদের উৎকর্ণতাকে ক্ষুরধার করল।
সোম বলল, ‘শিবানী, একটি দরজা খোলা আছে, চলো আমরা পালাই।’
ওঁরা কাশলেন। কাশীর কাশি, মহাকাশি।
সোম বলল, ‘ওঁরা সবাই ওই তিন ঘরে বন্ধ, কে আমাদের আটকাবে? এই যে, ধরো আমার হাত। ধরলে তো? চলো।’
কপাটের খিল খসিয়ে টান মেরে হুড়মুড় করে ওঁরা এসে সোমের ঘাড়ে পড়লেন। সে-দুষ্ট তখনও তেমনিভাবে যথাস্থানে উপবিষ্ট। শিবানীও তার থেকে তেমনি দূরে।
প্রথমে মুখ ফুটল যাদুমণির। তিনি বিনা গৌরচন্দ্রিকায় বললেন, ‘ছোটোলোকের ব্যাটা, বেজন্মা।’
দাশরথি ইশকুলে একটিমাত্র গালাগালি শিখেছিলেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ওই ছিল তাঁর সম্বল। এমনি তাঁর একনিষ্ঠতা। বললেন ‘Donkey, monkey, robber.’
মিস মিত্র আমতা আমতা করে বললেন, ‘হৃদয়হীন, উদাসীন।’
বউমা শিবানীকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন! মোক্ষদা বলল, ‘ছুঁচ হয়ে ঢোকে, ফাল হয়ে বেরোয়। কাল যখন এসে পেরণাম করল আমি ভাবনু সোনার চাঁদ ছেলে। ওমা, এর পেটে এত ছিল। আগুনমুখো, ড্যাকরা।’
সোম এসবের জন্যে একরকম প্রস্তুত হয়েই ছিল। বলল, ‘প্রতিশ্রুতি এমনি করে রাখতে হয়।’
দাশরথিবাবু ধমক দিয়ে বললেন, ‘যাও, যাও, সাধুপুরুষ। প্রতিশ্রুতির যোগ্য বটে।’
যাদুমণি তাড়া দিয়ে বললেন, ‘ভাগ, ভাগ, আমার বাড়ির থেকে। নইলে—’
‘নইলে?’
‘নইলে পুলিশ ডাকব।’
‘তবে তাই ডাকুন। আমি সহজে গা তুলছিনে।’ এই বলে সোম একটা চুরুট ধরাল। এই লোকগুলির ওপর তার ভক্তির লেশমাত্র অবশিষ্ট ছিল না।
ঘরে পুলিশ ডাকলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। দাশরথিবাবু গিন্নিকে বললেন, মেজাজ ঠাণ্ডা করতে। সোমকে বললেন, ‘ভদ্রলোকের ছেলে মানে মানে বিদায় হও।’
সোম বলল, ‘অপমানের কী বাকি রেখেছেন? কেন চোরের মতো সরে পড়ব? ডাকুন পুলিশ, একটা এজাহার লেখাই, পাড়ার লোক ভিড় করুক, একটা বক্তৃতা দিই। বলি সবাইকে ডেকে নির্জন ঘরে কী করেছি—’
‘কী করেছ।’ দশরথিবাবু আঁতকে উঠলেন।
‘কী করেছি তা আপনার ভাইঝিকে জিজ্ঞাসা করুন।’
দাশরথিবাবু মেঝের উপর ধপ করে বসে পড়লেন। মোক্ষদা পাখা নিয়ে ছুটে এল। মিস মিত্র চিৎকার করে ‘স্মেলিং সল্ট’ হেঁকে এঘর-ওঘর করতে থাকলেন। যাদুমণি এক ঘটি জল এনে স্বামীর মাথায় উজাড় করলেন। মোক্ষদাকে বললেন, ‘তুই আমার হাতে পাখাটা দিয়ে যা, আরও জল নিয়ে আয়।’
দাশরথিবাবু অনেক কষ্টে বললেন, ‘আজ আমি আত্মঘাতী হব, তোমরা কেউ বাধা দিয়ো না। গিন্নি, তুমি এতদিনে বিধবা হলে। বাড়িতে থান কাপড় আছে তো? দেখো বৈধব্যের কোনো উপকরণের কমতি হলে বাজারে রাম দুশমন সিংকে পাঠাতে ভুলো না।’
সোম পায়ের উপর পা রেখে নির্বিকারভাবে চুরুট ফুঁকতে থাকল। যেন ফোটোর জন্যে pose করেছে।