২. শান্তিপুর

২. শান্তিপুর

ভাগীরথীর পুব-পারে এই গ্রামটি অতি প্রাচীন—প্রায় হাজার বছর আগেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈষ্ণবদের একটি শ্রীপাট। ‘শান্ত’ নামের জনৈক মুনি এখানে বাস করতেন কি না তার কোন হক-হদিস নেই। তোমরা বলতে পার : তাহলে ‘শান্তিপুর’ নামটা হল কী করে?

আমি প্রতিপ্রশ্ন করব—ঐ রবিবাউল তাঁর ‘শ্রীপাটে’র নাম ‘শান্তিনিকেতন’ রেখেছিলেন কেন গো?

অদ্বৈত আচার্যের (জন্ম : 1434) আমল থেকে শান্তিপুরের খ্যাতি। শ্রীহট্টের লাউড় পরগণার রাজা দিব্যসিংহের সভাপণ্ডিত ছিলেন কুবের আচার্য। তাঁরই পুত্র কমলাক্ষ—মাত্ৰ দ্বাদশ বৎসর বয়সে এসে ভর্তি হলেন শান্তিপুরের অন্তঃপাতী পূর্ণবাটী গ্রামের শান্ত বেদান্তবাগীশের গুরুকুলে। তাঁর কাছেই বেদচতুষ্টয় আয়ত্ত করে হলেন ‘বেদ-পঞ্চানন’। দীক্ষা গ্রহণ করলেন মাধবেন্দ্র পুরীর কাছে। উপাধী লাভ করে কমলাক্ষ হলেন অদ্বৈতাচার্য। দীর্ঘজীবী তিনি—অনুমান একশ পঁচিশ বৎসর ধরাধামে ছিলেন। চৈতন্যদেবের জন্মসময়ে তিনি পঞ্চাশোর্ধ। অদ্বৈতাচার্য নাকি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় সেই 1486-খ্রীষ্টাব্দের দোলপূর্ণিমারাত্রে অনুভব করেন যে, নিমাই জন্মগ্রহণ করেছেন আপামর জনসাধারণকে ত্রাণ করতে। তিনিই প্রথম বৈদিক মন্ত্র সহযোগে সচন্দন তুলসীপত্র সমেত নিমাই পণ্ডিতকে ভগবানরূপে প্ৰণাম করেন—স্বীকৃতি দেন। পুরীর রথযাত্রায় লক্ষ লক্ষ যাত্রীর মধ্যে তিনি শ্রীচৈতন্যের অবতারত্ব ঘোষণা করেন। শান্তিপুরের ‘মদনগোপাল’ মূর্তির তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। লোকাচার অপেক্ষা ভক্তিবাদে বিশ্বাসী। তাঁর পুত্র অচ্যুতানন্দ বাল্যকাল থেকেই মহাপ্রভুর সঙ্গী, পরে ভক্ত। আচাৰ্য অদ্বৈতের জীবনী পাওয়া যাবে ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’ গ্রন্থে—রচনা ঈশান নাগর; শৈশব থেকেই তিনি অদ্বৈতাচার্যের গৃহে প্রতিপালিত। ইনি লাউরিয়া কৃষ্ণদাস নামে খ্যাত।

অদ্বৈত প্ৰতিষ্ঠিত ‘মদনমোহন’ মন্দিরের সন্ধান পাইনি; কিন্তু শান্তিপুরে অন্তত তিনটি প্রাচীন মন্দির এখনো দেখতে পাওয়া যায়। শ্যামচাঁদ, গোকুলচাঁদ এবং জলেশ্বর মন্দির। শ্যামচাঁদের বিশাল মন্দিরটি নির্মাণ করেন স্থানীয় তন্তুবায়বংশজাত রামগোপাল খাঁ চৌধুরী। নির্মাণ সমাপ্ত হয় 1726 খ্রীষ্টাব্দে—অন্যূন দুই লক্ষ তঙ্কা ব্যয়ে! মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় স্বয়ং নদীয়াধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। মন্দির-প্রবেশের জন্য পাশাপাশি তিনটি অশ্বখুরাকৃতি খিলান—ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর। দুটি কাদের মধ্যবর্তী অংশে (স্প্যান্ড্রিল অংশে) যে নক্‌শা তাও মুগলরীতির—প্রতিটি খিলানে এক জোড়া পদ্ম-নক্শা ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

গোকুলচাদের মন্দিরটি আমাদের কাহিনীর কালে সদ্যসমাপ্ত—প্রতিষ্ঠা : 1740 খ্রীষ্টাব্দে।

জলেশ্বর মন্দিরটি নির্মাণ করেন নদীয়া-মহারাজ রামকৃষ্ণের জননী প্রায় সমকালেই। এ মন্দিরে পোড়ামাটির নক্শায় যে কারুকার্য তা ভুবনেশ্বরের মুক্তেশ্বর মন্দিরের অলঙ্করণের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে!

শান্তিপুরে পরবর্তী যুগে যাঁরা বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নামও এইসঙ্গে লিপিবদ্ধ করে যাই। শ্রীরাম গোস্বামী, চন্দ্রশেখর বাচস্পতি এবং রামনাথ তর্করত্ন। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে আবির্ভূত হন আশানন্দ মুখোপাধ্যায়। তাঁর একটি স্মৃতিস্তম্ভ হালে—1932 সালে—নির্মিত হয়েছে। তিনি ছিলেন অসাধারণ বীর ও ক্ষমতাশালী। এক রাত্রে মুখুজ্জেমশাই কোন ধনী গৃহস্থের বাটীতে অতিথিরূপে বাস করছিলেন। স্থানীয় ডাকাতদলের দুর্ভাগ্য, তারা সেই রাত্রেই ঐ বাড়িতে ডাকাতি করতে আসে। আশানন্দ নিদ্রাভঙ্গ হয়ে মুশকিলে পড়লেন—তিনি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। অপরপক্ষে ডাকাতদলের হাতে নানান মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। ঢেঁকিশালে ছিল একটি প্রকাণ্ড ঢেঁকি। উপড়ে নিয়ে তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে একলাই সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। কয়জন ডাকাত হতাহত হয়েছিল তা ইতিহাসে লেখা নেই, কিন্তু তরোয়াল বা বল্লমের ধার যে ঢেঁকির ভারের কাছে ভোতা হয়ে গিয়েছিল এ তথ্যটা স্বীকৃত। রবি-বাউলের পুরাতন ভৃত্যটি নাকি ছিল ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’; আশানন্দ হয়ে গেলেন : ‘শক্তির ঢেঁকি’।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়িও শান্তিপুরে।

শান্তিপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাঘ-আঁচড়ায় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত বাগদেবীর মন্দিরটি বর্তমানে নিশ্চিহ্ন, তার চেয়েও করুণ অবস্থা ব্রহ্মশাসন গ্রামে চাঁদ রায় প্রতিষ্ঠিত অতিবৃহৎ মন্দির : চাঁদরায়ের শিবমন্দির। তাতেও ছিল অপূর্ব পোড়ামাটির কাজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *