২. ল্যাবে বসে হাই তুলতে তুলতে

ল্যাবে বসে হাই তুলতে তুলতে বেহুদ্দ বোর হচ্ছিল সুজন। জেনিভা থেকে দুদিন আগেই কলকাতা ফিরেছে ও, এখনও ভালোভাবে জেট ল্যাগ কাটেনি। তার মধ্যেই ল্যাবে ডিউটি দেওয়ার জন্য আসা।

যে কাজে গেছিল সুজন সেসব ভালোভাবে মিটে তার ওপর বেশ কিছু উপরি পাওনাও জুটেছে ওর। সার্নের ডেল্টা টিমের চিফ অ্যাডভাইজর প্রফেসর কাগুয়োচি স্বয়ং ওর পিঠ চাপড়ে বলেছেন পার্টিকল ফিজিক্সে সুজনের ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল। প্রফেসর কাগুয়োচি নোবেলজয়ী পদার্থবিদ, পার্টিকল ফিজিক্সে দুনিয়াজোড়া নাম। এহেন বিশ্ববিখ্যাত সায়েন্টিস্টের টিমে কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়ে সুজনের খুশি থাকারই কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে কোনো কারণে ওর মনমেজাজ বিতিকিচ্ছিরি রকমের টকে আছে।

খানিকক্ষণ দোনোমোনো করে চেয়ার থেকে ওঠার উদ্যোগ করছে, এমন সময় পিঠে একটা মোক্ষম চাপড় পড়ায় চমকে উঠল সুজন। তারপরেই ভেসে এল চড়া গলায় সুভাষিতানি, ‘কী খবর বে? শুনছি প্রফেসর কানামাছিকে নাকি একেবারে পকেটে পুরে ফেলেছিস? কনগ্র্যাটস ব্রো। প্রফেসর মুখার্জি তো বলাই শুরু করেছেন যে সুজন ইজ আওয়ার নেক্সট নোবেল লরিয়েট। তা একদিন খাইয়ে টাইয়ে দে। পরে সেলেব্রিটি হয়ে গেলে তো তোকে আর ধরা ছোঁওয়া যাবে না।’

প্রাণের বন্ধু দেবাদিত্য ওরফে দেবুকে দেখে সুজনের মুখে একটা আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠতে গিয়েও মিলিয়ে যায়। ম্লান মুখে বলে, ‘মন-মেজাজ ভালো নেই ব্রো। ফালতু বকে ঝাঁট জ্বালাস না প্লিজ।’

সুজন প্রেসিডেন্সির ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুটোতেই প্রথম পাঁচের মধ্যে র‌্যাঙ্ক ছিল ওর। হাওড়ার এক এঁদো গলিতে জন্মানো অসামান্য প্রতিভাবান ছেলেটিকে স্কুল কলেজের মাস্টারমশাইরা অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁরাই সুজনকে বটগাছের মতো আগলে আগলে রেখে রেখে এতদূর পৌঁছে দিয়েছেন।

দেবাদিত্য’র গল্পটা আবার একেবারে উল্টো, একমাত্র রেজাল্টের ব্যাপারটা ছাড়া। সাউথ কলকাতার এক নামী ব্যবসায়ীর ছেলে সে, বাপের টাকার লেখাজোখা নেই। তার ওপর টানা-টানা চোখ, টকটকে ফরসা গায়ের রঙ, টিকোলো নাক আর নিয়মিত জিমে যাওয়া স্বাস্থ্যের অধিকারী এই ছেলেটি রূপে একেবারে রাজপুত্র। শুধু রূপে কেন, শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে সে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে মারকাটারি রেজাল্ট করেছে। তার গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার্সের রেজাল্টও রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।

দেবাদিত্য আর সুজন দুজনে নেট কোয়ালিফাই করা জুনিয়র রিসার্চ ফেলো। বছর দুয়েক আগে দুজনে একই দিনে সল্টলেকের সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে জয়েন করে। দুজনেই এক্সপেরিমেন্টাল পার্টিকল ফিজিক্স নিয়ে গবেষণারত।

প্রাণের বন্ধুর মনটা কোনো কারণে সত্যিই খারাপ বুঝে দেবু একটা অন্য রাস্তা নেয়।

‘তা সামনে তো লং উইকেন্ড। কী করবি, কিছু ভেবেছিস?’

গোঁজ হয়ে বসে থাকে সুজন, উত্তর দেয় না। বোঝা যায় যে তার কোনো প্ল্যানই নেই।

‘শোন ভাই,’ আরও ঘন হয়ে আসে দেবু ‘যদি তোর অন্য কোনো এনগেজমেন্ট না থাকে, আমার সঙ্গে চেংমারি টি গার্ডেন যাবি?’

‘সেটা আবার কোথায়?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে সুজন, ‘নাম শুনিনি তো।’

‘আরে শিলিগুড়ি থেকে মালবাজার হয়ে জয়গাঁও যাওয়ার পথে পড়ে।’ হাত-পা নেড়ে বলতে থাকে দেবু, ‘মালবাজার থেকে নাগরাকাটা। সেখান থেকে চেংমারি টি গার্ডেন আধঘণ্টার রাস্তা। সব মিলিয়ে শিলিগুড়ি থেকে যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। আমার ছোটমামা হল ওই চা-বাগানের ম্যানেজার, বুঝলি। একটা ব্রিটিশ আমলের দুর্দান্ত আউটহাউস আছে, পুরো ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। জায়গাটা ভুটানের গা ঘেঁষে। অসম্ভব টেস্টি দেশি মুরগি পাওয়া যায়, সঙ্গে কড়া ভুটানি হুইস্কি, আর চারদিকের সিনিক বিউটি দেখলে মাইরি পাগলা হয়ে যাবি।’

‘বলছিস?’ উৎসাহিত দেখায় সুজনকে, ‘তা আমরা গেলে তোর মামার কাজেকর্মে কোনো অসুবিধা হবে না তো?’

‘আরে না-না!’ সুজনের কাঁধে ইয়াব্বড় চাপড় মেরে আশ্বাস দেয় দেবাদিত্য, ‘এখন তো চা পাতা তোলা বন্ধ আছে হপ্তাদুয়েকের জন্য। কাজ ফের শুরু হবে অক্টোবরের শেষে। মামা এখন ওখানে নেই, মালিকের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছে।

তার মধ্যেই ওখানে কী একটা ছোট বাওয়াল হয়েছে নাকি। আমাকে বলল, ‘চা বাগানের কুলিকামিনগুলো কী একটা নিয়ে একটু ভয়টয় পাচ্ছে। গিয়ে দেখে আয় তো বুবলা।’ ব্যস! আমিও প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। এমনিতেই ছোট বাগান, বেশি লোকলস্কর নেই, আর এখন তো ফাঁকা বললেই চলে। দিন তিন-চারেকের মামলা, যাব আর আসব।’

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুজন। তারপর চোরা চাউনিতে দেবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ফ্লাইটের খচ্চা তুই দিবি তো?’

দেবুর থাপ্পড়টা এড়াতে টেবিলের নীচে অনেকটা ডাক করতে হয় সুজনকে।

আট মাস আগে

জঙ্গলটা প্রায় আধাআধি সাফ হয়ে এসেছে। মেশিনচালিত বড় বড় চেইনস’গুলো এক একটা করে গাছ কাটছে, আর বুলডোজারগুলো সেসব গাছের গুঁড়ি টেনে নিয়ে গিয়ে জমা করছে জঙ্গলের একপাশে। এসব গুঁড়ি পরে কাঠ চেরাই কলে যাবে। তারপর সেখান থেকে কাঠের কারখানায়।

বাচ্চাদের দল পড়ে থাকা ডালপালা কাঠকুটো দু-হাতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, জ্বালানি হিসেবে ঘরে মজুত করবে বলে। পাশেই ডায়না নদীর কোল ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা কোমর সমান উঁচু ঘাসের জঙ্গল। ঘাস কাটার জন্য বড় বড় হেঁসো নিয়ে নেমে পড়েছে একদল লোক। একনজরেই বোঝা যায় যে তারা এখানকার লোক নয়। সাধারণ ঘেসুড়েদের থেকে তাদের হাবভাব একেবারেই আলাদা।

একটা ঘোড়ানিম গাছের নীচে চেয়ারে বসে অলস ভঙ্গিতে চারিদিকে এসবই নজরে রাখছিলেন মধ্য চল্লিশের একজন মানুষ। ভালো করে চেয়ে দেখলে বোঝা যায় যে তাঁর আপাত ঔদাসীন্যের আড়ালে একটা সতর্ক কাঠিন্য আছে। ছিপছিপে পেটাই চেহারা, সুগঠিত পেশি আর মুখে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভাব দেখে বোঝা যায় যে ইনি যে সে সামান্য লোক নন। যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন পেশাদার সেনাপ্রধান তাঁর সেনাদের গতিবিধি নজরে রাখেন, তিনিও সেভাবেই এই কর্মকাণ্ডটি পরিচালনা করছেন।

এমন সময়ে তাঁর পকেটে থাকা মোবাইল ফোন খড়খড় করে উঠল। মানুষটি মোবাইলটা বার করে স্ক্রিনটা একবার দেখতেই চেয়ার থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর মোবাইলটা আড়াল করে জঙ্গলের একটু ভেতর দিকে সরে গেলেন তিনি।

মিনিট পাঁচেক পর যখন তিনি ফিরে এলেন, তখন তাঁর চলাফেরা বদলে গেছে। একটু ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন ঘেসুড়েদের সর্দারের কাছে।

‘কিতনা দিন লাগেগা ইয়ে সব সাফ হোনে মে?’

‘অওর দস বারা দিন তো লাগেগা হুজুর।’

‘অওর পাঁচ দিনকে অন্দর ইয়ে কাম খতম করনা পড়েগা। উপর সে অর্ডার আয়া হ্যায়। ক্যায়সে করোগে?’

‘ইয়ে ক্যায়সে সম্ভব হোগা হুজুর? ইতনা বড়া জঙ্গল, অওর হাম সির্ফ পাঁচ লোগ…’

‘ম্যায়নে আপসে ইয়ে পুছা হুঁ কে ইয়ে কাম ক্যায়সে হোগা। ম্যায়নে ইয়ে নেহি পুছা কি ইয়ে কিঁউ নেহি হোগা, সমঝে?’ শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল।

সেই প্রশ্নের সামনে যেন একটু কুঁকড়েই গেল ঘেসোদের সর্দার।

এই লোকটাকে সে ভয় পায়, বিলক্ষণ ভয়। লোকটা মারে না, ধরে না, বকাবকি করে না, আজ অবধি কেউ লোকটাকে গলা তুলে কথা অবধি বলতে শোনেনি। তবুও লোকটার মধ্যে কী যেন একটা আছে, সামনে এসে দাঁড়ালে গা’টা এমনিতেই একটু শিরশির করে ওঠে।

‘অগর অওর দস লোগ মিল যাঁয়ে তো…’

‘মিল জায়েগা। অওর?’

‘প্যায়সা ভি থোড়া জ্যায়াদা চাহিয়ে হোগা।’

‘উসকে লিয়ে চিন্তা মত কীজিয়ে। কাম বরাবর হোনি চাহিয়ে।’

‘জি মালিক।’

লোকটি আদেশ দিয়ে চেয়ারের দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে একজন ঘেসুড়েকে দৌড়ে আসতে দেখে থমকে গেলেন তিনি। তিনি এবং ঘেসুড়েদের সর্দার দুজনেই।

দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করছিল অভিরাম। দৌড়ে আসা লোকটার ভাবভঙ্গিতে যে একটা উত্তেজনার ভাব ছিল সেটা নজর এড়ায়নি তার। লিডার গোছের লোকটাকেও সকাল থেকে নজরে রেখেছে সে। মালটার একটা আলাদা পার্সোনালিটি আছে, স্বীকার করতে বাধ্য সে।

স্থানীয় লোকজন এদিকে আস্তে আস্তে সরে পড়ছিল। সবারই বাড়ির কাজ আছে, তেল নুন লকড়ির লড়াই আছে, সারাদিন এখানে রঙ্গ দেখার জন্য পড়ে থাকলে চলবে? দু-একটা বাচ্চা অবশ্য এখানে থেকে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিল, পিঠে দু’ঘা করে পড়তে তারাও বাড়ির রাস্তা ধরেছে।

একটা ঝুরি নামানো বটের আড়ালে সট করে সরে গেলো অভিরাম।

এখানে হচ্ছেটা কী? সে হচ্ছে গিয়ে এই এলাকার অবিসংবাদী দাদা, সে অবধি জানে না এ কীসের প্রজেক্ট, কেমন প্রজেক্ট, কোথাকার প্রজেক্ট!

এমনকী তার গডফাদার পালবাবু অবধি ঠিকঠাক কিছু জানাননি তাকে। কথাবার্তায় অন্তত এটুকু বুঝেছে সে যে পালবাবুও এ ব্যাপারে তার মতোই অন্ধকারে।

অভিরাম বেসরা পালবাবু নয়। তার একটা উচ্চাশা আছে, পলিটিক্সে তার একটা কেরিয়ার আছে। এখানে কী হচ্ছে সেটা ঠিকঠাক না জানলে তার পেটের ভাত হজম হবে না যে!

জঙ্গল থেকে দৌড়ে আসা লোকটা হাত-পা নেড়ে অনেক কিছু বোঝাচ্ছিল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন লোককে। কিছুক্ষণ পর লিডার গোছের লোকটা বাকি ঘেসুড়েদের চলে যেতে বলল।

অভিরাম কাঁটা হয়ে রইল। ফিরে আসা ঘেসোদের দল তাকে দেখতে পেলেই চিত্তির!

বটের ঝুরির মধ্যে আরও ঘন হয়ে সেঁধিয়ে গেল সে।

জায়গাটা ফাঁকা হওয়ার পর লিডার গোছের লোকটা, ঘেসুড়েদের সর্দার, আর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা সেই ঘেসো, তিনজনে মিলে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

অভিরাম এদিক-ওদিক দেখে বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। তারপর সম্পূর্ণ অন্য একটা রাস্তা ধরল সে। এই এলাকার ছেলে অভিরাম, তার ওপর অবাধ্য দামাল ছেলে বলে ছোটবেলা থেকেই তার একটা কুখ্যাতি ছিল। এই জঙ্গলের প্রতিটি সুঁড়িপথ, প্রতিটি গোপন আস্তানা, প্রতিটি ঝোপঝাড় তার চেনা। এবং সে যদি খুব ভুল না হয়, যদি তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ভুল সংকেত না দিয়ে থাকে, তবে সে জানে যে ওরা কোথায় যাচ্ছে।

ওরা যাচ্ছে আটকোনার থানে। যেখানে ওদের যাওয়া বারণ। ভীষণভাবে বারণ।

*

চেংমারি টি গার্ডেনে যখন এসে পৌঁছয় সুজন আর দেবু, তখন প্রায় বিকেল। দেবুর মামার ইনোভাও সময়ের আগেই হাজির ছিল নিউ জলপাইগুড়ি রেলস্টেশনে। ড্রাইভার নেপালি, নাম বাজবাহাদুর থাপা। দেখা হতেই একগাল হেসে ‘হামকো বাজু বুলাইয়েগা সা’ব’ বলে ঝটপট ওদের লাগেজ ডিকিতে তুলে দেয় সে। ওরা যখন রওনা দিল তখন প্রায় এগারোটা।

করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে ওদলাবাড়ির রাস্তা ধরতেই ম্যাজিক! দুপাশে বিস্তীর্ণ চা বাগান। রাস্তার পাশে বড় বড় গাছেরা একে অন্যের ওপর ঝুঁকে তৈরি করেছে আশ্চর্য সুন্দর চাঁদোয়া। তারমধ্য দিয়ে দুপুরের রোদের মিষ্টি আলো পিচের রাস্তার ওপর পড়ে ঝিকিয়ে উঠছিল। দেবু এদিকটায় অনেকবার এসেছে, তবুও মুগ্ধ হয়ে দুপাশের দৃশ্য উপভোগ করছিল সে।

লাঞ্চটা ওরা সারল মালবাজারের টুরিস্ট লজের রেস্তোরাঁয়।

এখানেই দেবু প্রথমবারের জন্য লক্ষ করল লোকটাকে।

একই টেবিলে তাদের উল্টোদিকে বসে ছিল লোকটা। সাধারণ মধ্যবয়স্ক বাঙালি যেমন হয় তেমনই। বছর পঁয়ত্রিশ বয়েস, মাথায় অল্প চুল, হালকা একটা ভুঁড়ি। পরনে একটা হাফ-হাতা শার্ট, ঢলঢলে ট্রাউজার আর চপ্পল। একঝলক দেখলেই নির্বিবাদী নির্বিরোধী বাঙালি ভদ্রলোক ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়া অসম্ভব। তবে দেবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করল অন্য একটা জিনিস।

ভদ্রলোক ভাতে ডাল মেখে খাওয়া শুরুর আগে বিড়বিড় করে কী একটা বললেন, তারপর প্রথম গ্রাস মুখে দিলেন।

‘মন্ত্র বললেন নাকি?’ খেতে-খেতে প্রশ্নটা সেই ভদ্রলোকের দিকে ছুঁড়ে দেয় সুজন।

ভদ্রলোক চিবোতে-চিবোতে এদিকে তাকিয়ে একটু অল্প হাসলেন। তারপর গ্রাস শেষ হলে খানিকটা লজ্জিতভাবে বলেন ‘ওই আর কি। ছোটবেলার অভ্যেস, বাবা শিখিয়ে গেছিলেন। প্রথম গ্রাস মুখের দেওয়ার আগে…’

‘খাওয়ারও মন্ত্র হয়? ইন্টারেস্টিং! মন্ত্রটা কী জানতে পারি?’ প্রশ্ন করে সুজন।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন ভদ্রলোক, তারপর চাপা কিন্তু পরিষ্কার উচ্চারণে বলে ওঠেন, ‘ব্রহ্মার্পনং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম, ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।’

‘এটা…হজম হওয়ার মন্ত্র নয়তো?’ সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করে দেবু।

লোকটা ধীরস্বরে বলে, ‘না। হজমের মন্ত্র নয়। যে ব্রহ্ম থেকে এই মায়াময় বিশ্ব সৃষ্ট, যে ব্রহ্ম সর্বভূতে পরিব্যপ্ত, যে ব্রহ্ম আমাদের উৎপত্তি ও বিলয়ের কারণ স্বরূপ, তাঁকে স্মরণ করা। ধরে নিন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানো, থ্যাঙ্কস গিভিং-এর মতো।’

একটু সম্ভ্রমের সঙ্গে প্রশ্ন করে সুজন, ‘দাদা এখানকারই লোক নাকি?’

‘হ্যাঁ ভাই, চাকরিসূত্রে আপাতত এখানেই আছি। তুমি করেই বলছি, হ্যাঁ। দেখে মনে হচ্ছে তোমরা বয়েসে ছোটই হবে। কিছু মনে করলে না তো?’

‘আরে না-না, মনে করার প্রশ্নই নেই। আমরা আপনার ভাইয়ের বয়সিই হব। স্বচ্ছন্দে তুমি বলুন। তা দাদার কী করা হয়?’ খেতে-খেতে প্রশ্ন করে সুজন।

‘এই সামান্য শিক্ষকতা করি আর কি। নাগরাকাটার একটা স্কুলে বাংলা আর সংস্কৃত পড়াই।’

‘আচ্ছা! সংস্কৃতের টিচার। তাই আপনার উচ্চারণ এত ভালো।’ তারিফ করার ভঙ্গিতে মাথা দোলায় দেবু।

‘এ আর এমনকী? ওই বাপঠাকুরদা যেটুকু শিখিয়ে গেছিলেন, সেটুকুই ভাঙিয়ে যা চলছে। তা তোমরা এখানে কী মনে করে? ওই লাল ঝমেলা দেখতে?’

দেবু আর সুজন দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কই, দেবুর মামা তো লাল ঝামেলা নিয়ে কিছু বলেননি। আর লাল ঝামেলাটাই বা কী বস্তু?

খাওয়া শেষ করে নীচে নেমে দেবু আর সুজন একটা করে সিগারেট ধরায়, ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা স্টিলের ছোট ডিব্বা বার করে তার থেকে একটা পান বার করে মুখে দেন।

‘তোমরা চেংমারি টি গার্ডেন যাচ্ছ তো? ওরই উত্তরে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা বস্তি আছে। ওটারই নাম লাল ঝামেলা বস্তি। সেখানে এই চা বাগানের মদেশিয়া কুলি কামিনদের বাস।’

‘তা সেখানে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?’ প্রশ্ন করে সুজন। বরাবরই তার ঠান্ডা মাথা। দেবুর মামা বলে দেননি যে চেংমারি টি গার্ডেনে ঠিক কী বাওয়াল হয়েছে। আসার আগে ওঁর সঙ্গে সুজন একবার কথা বলেছিল বটে। তাতে বরং এটাই বোঝা গেছিল যে উনিও ঠিকঠাক জানেন না ব্যাপারটা কী। ইনি কি সেই নিয়েই কিছু বলছেন?

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘যাচ্ছ তো ওখানে। গিয়েই দেখবে না হয়। আজ চলি ভাই, আলাপ করে ভারি ভালো লাগল।’

লোকটা হঠাৎ করে কথা শেষ করে দিতে দুজনেই অবাক। তবুও ভদ্রতা করে দেবু, ‘আপনি তো ওদিকেই যাবেন। আপনাকে নামিয়ে দিই কোথাও?’

‘আরে না-না, তার দরকার হবে না।’ সহাস্যে বলে ওঠেন ভদ্রলোক, ‘মালবাজারে আমার কিছু কাজ আছে। সেগুলো সেরে তবেই ফিরব। তোমরা ওখানে থাকবে তো কিছুদিন? আশা করি দেখা হয়ে যাবে।’

নমস্কার করেন ভদ্রলোক, তারপর হাঁটা লাগান। দেবু অস্ফুটে বলে, ‘এই যাহ! লোকটার নামটাই জানা হল না।’

সুজন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল লোকটার যাওয়ার পথের দিকে। হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে যেতে এক টুসকিতে সেটা দূরে ফেলে দিয়ে দেবুর পিঠ চাপড়ে দেয় সে, ‘চ’-চ’! এখন না বেরোলে দেরি হয়ে যাবে। লোকটা তো কাছেপিঠেই থাকে বলল। দেখা হয়েও যেতে পারে। তখনই না হয় নাম-ধাম জেনে নেব সব।’

আট মাস আগে

প্রায় আধঘণ্টা হাঁটার পর তিনজনে যে জায়গাটায় এলেন সেটা জঙ্গলের একেবারেই নির্জন একটা অংশ। দেখলেই বোঝা যায় যে এখানে মানুষের হাঁটাচলা একেবারেই নেই। বড় হাঁসুয়া আর কাটারি দিয়ে ঝোপঝাড় আর গাছের ডালপালা কাটতে কাটতে কোনওমতে এখানে আসতে হয়েছে।

সতর্ক ছিলেন দলনেতা। এ অঞ্চলে সাপের উপদ্রব খুব। কেউটে আছে, কালাচ আছে। আছে চন্দ্রবোড়া, করাইত। আর রাজগোখরোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তো কথাই নেই।

উদ্দিষ্ট জায়গাটিতে এসে দাঁড়াতেই দলনেতা লোকটি খেয়াল করলেন যে জায়গাটা শুধু নির্জন তাই নয়, অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধও বটে। মানুষ কেন, কোনও জীবজন্তুর আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল না।

আর ঠিক তখনই ব্যাপারটা অনুভব করা শুরু করলেন তিনি।

তাঁর মাথার ভেতরে এক আশ্চর্য বোধ যেন ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। সমস্ত শরীর জুড়ে জেগে উঠছিল এক অব্যক্ত, অনৈচ্ছিক সতর্কতা। যেভাবে বর্ষার জল পেয়ে মাটির শরীর জুড়ে জেগে ওঠে বন্য ঘাসের দল, ঠিক সেভাবে এই বোধ সামুদ্রিক শ্যাওলার মতো চারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর সমগ্র সত্ত্বায়। যেন এক অশরীরী অনুভূতি তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দরজায় ফিসফিস করে বলছিল, ‘সময় এসেছে পথিক, তৈরি হও। তোমার পূর্বপুরুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সময় এসেছে। তৈরি হও, তৈরি হও, তৈরি হও…’

ভেতরে ভেতরে নিজের অজান্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন মানুষটি। এ যদি দৈবের নির্দেশ না হয় তাহলে দৈব জিনিসটা কী?

তিনি তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে নর্থ বেঙ্গলে এসে এই মিশন শেষ করার প্রস্তুতি নিয়েই ফেলেছিলেন। আজোবা’র ডায়েরি অনুযায়ী সময় শেষ হয়ে আসছিল দ্রুত। তার মধ্যে এই মিশন তাঁকে শেষ করতেই হত।

কিন্তু সেই একই জায়গায় যে অমন হাই প্রোফাইল, এক্সট্রিমলি হাই সিকিউরিটির একটা প্রোজেক্ট হবে, আর চাকরি ছাড়তে যাওয়ার দিনই এই প্রজেক্টের প্রজেক্ট ইন-চার্জ করে তাঁকেই পাঠানো হবে, এ কি তিনি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন?

নিজের অজান্তেই তাঁর ডান হাতটা বুকের বাঁদিকে উঠে এল। বুকের ধুকপুকুনিটা হাতুড়ির মতো ঘা মারছিল তাঁর বুকে।

জায়গাটির সামনে একবার দাঁড়ালেন তিনি। তারপর যেন কার অলঙ্ঘ্য নির্দেশে, নিজের অজান্তেই তাঁর মাথাটা উত্তর দিকে ঘুরে গেল।

ওই তো, পাহাড়ের শ্রেণি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিম দিকে ডায়না নদী, ওদিকে থেকেই এলেন তাঁরা। পেছন দিকে, অর্থাৎ দক্ষিণেও ডায়না নদীর বাঁক। আর ডানদিকে, মানে পূর্বদিকে…

ওই তো, ওই তো! একটা বট আর অশ্বত্থের মাঝখানে একটি পত্রহীন তালগাছ! ঠিক যেমনটি লেখা ছিল আজোবা’র ডায়েরিতে, যা দেখে নাকি চেনা যাবে সেই জায়গাটিকে!

এই তাহলে সেই অষ্টভুজক্ষেত্র?

সামনের দিকে তাকালেন তিনি। ছোট্ট একফালি জমি, একটুকরো রুমালের মতো পড়ে আছে জঙ্গলের মধ্যে। চোখের আন্দাজে মনে হল সাইজে দশ ফুট বাই বারো ফুট মতো হবে।

প্রথমেই নজরে পড়ে যে জমিটা আশ্চর্যজনক ভাবে ন্যাড়া। মানে একেবারে ন্যাড়া। গাছপালা দূরে থাক, একটা ঘাস অবধি গজায়নি। মনে হচ্ছে জঙ্গল বাড়তে বাড়তে এইখানে এসে কার আদেশে হঠাৎ করে থেমে গেছে! কে যেন সেই অলক্ষ্য লক্ষ্মণরেখায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করছে, ‘তফাত যাও। এখানে কোনও সবুজের প্রবেশ নিষিদ্ধ।’

যে ঘেসুড়েটি খোঁজ এনেছিল তার পায়ের কাছে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি দেশি কুকুর। তার ভাবভঙ্গিতে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। বারবার যে তার মালিকের প্যান্ট ধরে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। বার দুয়েক ধমক খাওয়ার পর মালিকের দু-পায়ের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে রইল সে।

চোখ সরু করে জায়গাটার আকার বোঝার চেষ্টা করলেন দলনেতা মানুষটি। আজোবা যা লিখে গেছিলেন সেই লক্ষণগুলি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি?

সন্ধানী চোখে একটু লক্ষ্য করতেই মানুষটি সেই জমিতে জন্মানো ঘাসেদের মধ্যে একটি প্যাটার্ন খুঁজে পেলেন। মনে হল কয়েকটি সরলরেখা জুড়ে গজানো ঘাসেরা যেন অন্যান্য ঘাসগুলোর থেকে আলাদা, একটু বেশি সবুজ, একটু বেশি বড়।

মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে সেই সরলরেখাগুলি গভীর অভিনিবেশ সহকারে দেখতে থাকলেন তিনি।

ওরা কি কিছু বলতে চায়?

কিছু পরে একটা জ্যামিতিক ডায়াগ্রামের আকার তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠল। এখন তিনি তাঁর চোখের সামনে এমন তিনটি ত্রিভুজের ছবি দেখতে পাচ্ছেন যারা পরস্পরকে পাঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে কেটেছে। তাতে ফুটে উঠেছে একটি অদ্ভুত নকশা।

একটি আটকোণবিশিষ্ট তারা।

শুধু তাই নয়। অ্যাডভান্সড ম্যাথসের ছাত্রের শিক্ষিত চোখে ধরা পড়ে গেল নকশার আসল প্যাটার্নটি।

এটা একটা অক্টাগ্রাম।

না না, শুধু অক্টাগ্রাম নয়, এটি একটি আইসোটক্সাল অক্টাগ্রাম। ঠিক যেরকমটি আঁকা ছিল আজোবা’র ডায়েরিতে।

হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল তাঁর। কোনওমতে নিজেকে সামলে পেছনে ফিরলেন, তারপর যে ঘেসুড়েটি জায়গাটার খোঁজ নিয়ে এসেছিল তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ইস জগহ কা পতা ক্যায়সে চলা?’

‘শেরু ভাগ গ্যয়া থা হুজুর,’ ভীতস্বরে নিবেদন করে ঘেসুড়েটি, ‘জঙ্গল মে এক নেউলা কো পিছা করতে করতে। উসি কো ঢুন্ডতে ঢুন্ডতে ইধর তক আ পঁহুছা।’

‘শেরু কওন?’

‘মেরা কুত্তা, হুজুর।’ পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ভীত কুকুরটিকে দেখায় সে।

‘হুম।’ বলে চুপ করে যান তিনি। তারপর কিছুক্ষণ বাদে বলেন, ‘আপলোগ চলে যাইয়ে। হাম থোড়ে দের বাদ আয়েঙ্গে।’

‘লেকিন হুজুর,’ আপত্তি জানায় ঘেসোদের সর্দার, ‘রাস্তা পতা নেহি চলেগা তো কেইসে আইয়েগা আপ?’

‘পতা চল জায়েগা, আপ সোচিয়ে মৎ। জ্যায়সে ম্যায়নে বোলা ওয়সাহি কীজিয়ে। পাঁচদিন কে অন্দর ইয়ে পুরা এরিয়া মুঝে সাফসুতরা চাহিয়ে। কাল সে এক্সট্রা দস নেহি, বিস লোগ মিল জায়েগা আপকো।’

লোকদুটো মাথা নেড়ে চলে গেলে গাঢ় নৈঃশব্দ নেমে এল জায়গাটা জুড়ে।

চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিলেন মানুষটি। কেউ কোথাও নেই জেনে নিশ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে সমগ্র ক্ষেত্রটিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন তিনি।

তিনপুরুষের অপেক্ষা বোধহয় এবার শেষ হতে চলেছে। তবে হাতে সময় আর বেশি নেই। আটচল্লিশ ঘণ্টা আছে, মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা। ক্যালেন্ডার তাই বলছে। তার আগেই আজোবা’র আদেশ অনুযায়ী কাজটা করে ফেলতে হবে ওঁকে। তবেই আজোবা, অর্থাৎ ঠাকুরদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবেন তিনি।

পাঁচ মিনিট বাদে ফেরার রাস্তা ধরলেন সেই মানুষটি যাঁকে এই গুরুত্বপূর্ণ মিশনের সর্বেসর্বা করে পাঠানো হয়েছে। তিনি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইংস-এর উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, মেজর রাহুল অশোকরাও মাত্রে।

খানিকক্ষণ বাদে একটু দূরের টিলা থেকে আরেকটা ছায়া সরে গেল। অভিরাম বেসরা’র মনে কু-ডাক ডাকছিল খুবই। এই লোকটার হাবভাব ভালো ঠেকছে না তার।

*

ঝামেলাটা যত ছোট মনে হয়েছিল তত ছোট নয়। দেবু’র মামা বৃথাই ভেবেছিলেন যে ওরা সামাল দিতে পারবে। বোধহয় তিনিও ব্যাপারটার গুরুত্ব ততটা বোঝেননি। অথবা তাঁকে সঠিক খবর দেওয়া হয়নি।

গত কয়েকদিন ধরেই চা বাগানের শ্রমিক কর্মচারীরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝেই শ্রমিকদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা তেমন বড় কিছু না। এককালে অবাধ্য শ্রমিকদের গুম করার অনেক উপায়ই জানতেন মালিকপক্ষের লোকজন। এখন সেসবের চল নেই বটে, কিন্তু তাতেও বিপদ কমেনি খুব একটা।

চা বাগানের মাঝে বৃষ্টির জল বয়ে যাওয়ার জন্য গভীর নালা কাটা থাকে, সেখানে মাঝে-মাঝেই আশ্রয় নেয় গর্ভিণী পাহাড়ি চিতা। তাদের হাতেও কম লোক মরে না। এছাড়া আশপাশের গাঁয়ের ছোকরা বা ছুকরির সঙ্গে ছুটকো আশনাই মহব্বত জমে উঠলে জোড়ে পালিয়ে যাওয়া তো আছেই। সেগুলো চেংমারি বা আশেপাশের চা বাগানের শ্রমিকদের গা-সওয়া।

কিন্তু এবার ব্যাপারটা আলাদা।

প্রথম ঘটনাটা ঘটে হপ্তাখানেক আগে। বুধন মাহাতোর বউ সেরালি গেছিল কেরোসিন আনতে। তখন একটু রাত হয়েছে। এসব কেনাকাটি সচরাচর বুধনেরই করার কথা। কিন্তু সেদিন সন্ধেতে মাদারিহাট থেকে তার শালা বাবুলাল এসেছিল দিদির সঙ্গে দেখা করতে। একটা দেশী বনমুরগি আর দ্রৌপদী সরেনের ভাঁটির দুইখাম্বা সরেস ধেনো। বুধনের পকেট থেকে পয়সা নিয়ে কেরোসিনের ডিব্বা হাতে সেরালি নিজেই হাঁটা দেয় বস্তির বাইরে মুদীর দোকানের দিকে।

ঘণ্টাখানেক পরেও সেরালি না ফেরায় শালা-জামাইবাবুর টনক নড়ে। মেয়েটা গেল কোথায়? প্রথমের বুধনের সন্দেহ হয় শালী পাশের বস্তির যোগেনের সঙ্গে পালিয়ে যায়নি তো? কিন্তু যদি পালাবারই হয় তবে সোনাদানা টাকাপয়সা আছে সেসব নিয়ে রাতে পালাতে পারত। কেরোসিনের ডিব্বা হাতে কেউ পালিয়েছে বলে আজ অবধি এ বস্তিতে কোনো খবর নেই।

দুদিন ধরে গরু-খোঁজা করা হয়। সেই সার্চ পার্টিতে যোগেন নিজেও ছিল। মায়ের নামে কিরে কেটে যোগেন বলে সেরালিকে সে নিজের বোনের মতো দেখত, অন্যকিছুর কথা ভাবতেই পারে না। তন্নতন্ন করে দু’দিন খোঁজার পর সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, থানার বড়বাবু অবধি গা করছেন না, তখন হারিয়ে গেল বস্তির সবচেয়ে পুরোনো লোক ঘনরাম মান্ডি।

ঘনরাম নিখোঁজ হওয়াতে বেশ শোরগোল পড়ে গেল চারিদিকে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চাপে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল পুলিশ।

স্থানীয় লোকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। উঠতি নেতা অভিরাম বেসরা এই মওকাটাই খুঁজছিল। বড়বাবুর থাপ্পড়ের এত বড় জবাব দেওয়ার সুযোগ পাবে সে? একদিন থানা ঘেরাও হল। অভিরাম চোঙা হাতে নতুন বড়বাবুর অপদার্থতার ব্যাপারে একখানি বেশ চোখা চোখা বাক্যবাণ সমৃদ্ধ জ্বালাময়ী ভাষণ পেশ করল।

অভিরাম এই এলাকার জনপ্রিয় লোক, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কনট্যাক্ট পয়েন্টও বটে। শাসক দলের হয়ে লাল ঝামেলা বস্তির ভোট সেই ম্যানেজ করে দেয়।

খবর পৌঁছল শিলিগুড়ি অবধি।

কিন্তু প্রশাসন নড়েচড়ে বসার আগেই ঘটে গেল আরেকটা অঘটন। ঘনরাম হারিয়ে যাওয়ার ঠিক পাঁচদিনের মাথায় হারিয়ে গেল অভিরাম বেসরা নিজে!

*

ডায়না নদীর অন্য পারে ছোট একটা কটেজ, নাম ‘সোনার বাংলা’। এমনিতে ট্যুরিস্টদের ভিড়ে কটেজটা সদাসর্বদাই জমজমাট হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গ তো বটেই, সীজন টাইমে সুদূর কলকাতা থেকেও শৌখিন পর্যটকের দল ভিড় জমান এখানে।

কিন্তু গত মাস তিনেক ধরে পুরো কটেজটা গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে বুক করে রাখা হয়েছে। সেখানে শুধু সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারদের আনাগোনা। শুধু তাই নয়, পুরো কটেজ জুড়ে উচ্চপর্যায়ের সিকিউরিটি মজুত চব্বিশ ঘণ্টাই। তাদের যেমন পাথরকোঁদা চাউনি, তেমন নির্মম ব্যবহার। এরিয়ার মধ্যে কোনও চ্যাংব্যাং দেখলেই মার ছাড়া কথা নেই।

 ‘বলি এখানে হচ্ছেটা কী দাদা? দু’দুটো লোক হারিয়ে গেল। সে নিয়ে পুলিশের কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কাল শিলিগুড়িতে পার্টি অফিসে ফোন করেছিলাম। পালবাবুও চুপ করে বসে থাকতে বলছেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

কটেজের মালিক দেবাশিস বারিকের সঙ্গে বসে আড্ডা জমাবার চেষ্টায় ছিল অভিরাম। যে কয়েকজন এই কটেজের মালিকের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা জমাতে পারে, অভিরাম তাদের মধ্যে একজন।

‘জানি না ভায়া।’ ব্যালেন্টাইনের ছয় নম্বর নিট পেগটা গলায় চালান করে দিয়ে বললেন দেবশিসদা, ‘তবে কয়েকদিন ধরে অফিসাররা খুব চিন্তিত। ঘন ঘন মিটিং হচ্ছে খুব। দিল্লি থেকে গভর্নমেন্টের উঁচু লেভেলের লোকজন আসছে। আর্মির বড় বড় অফিসারেরাও আসছে। ছোটখাটো কিছু নয় হে, বেশ বড় আকারের কিছু একটা ঝামেলা বেঁধেছে। সে তোমার আমার বোঝাবুঝির বাইরে।’

‘তোমার সঙ্গে ওদের কোনও আলোচনা হয় না এই নিয়ে?’ পরের পেগটা বানাতে বানাতে সতর্কভাবে জিগ্যেস করল অভিরাম।

‘আর আলোচনা’, চুকচুক করে দুঃখ প্রকাশ করলেন দেবাশিসদা, ‘সামান্য হাই হ্যালো’র বাইরে কথাই বলে না তো আলোচনা, হুঁ।’

‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো দাদা,’ একটু কাছ ঘেঁষে এল অভিরাম, ‘তোমার মনে হয় না, ওই যন্তরমন্তরের সঙ্গে এইসব লোক হারিয়ে যাওয়ার কোনও কানেকশন থাকতে পারে?’

‘জানি না ভায়া,’ নেশাগ্রস্তভাবে কথাগুলো বললেন দেবাশিসদা। মনে হচ্ছিল বহুদিন বাদে পরের পয়সায় দামি স্কচ খেয়ে সামান্য বেএখতিয়ার হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। সপ্তম পেগে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘শুধু এটুকু জানি যে এখানে নাকি কীসব সায়েন্সের পরীক্ষা-টরিক্ষা হচ্ছিল। সে নাকি হেবি সিক্রেট জিনিস। এত সিকিউরিটির তামঝাম সেই জন্যই। সেই যে যন্তরমন্তর থেকে লোকজন হাপিস হয়ে গেল, তারপর থেকেই তো বাবুদের এত ছটফটানি। এখন কে কোথায় সায়েন্সের কী গ্যাঁড়াকল করে রেখেছে সে আমি কী করে বলি বলো তো?’

‘তা এত খবর তুমি জানলে কী করে? এইমাত্র যে বললে তোমার সঙ্গে নাকি হাই হ্যালো ছাড়া কথাই বলে না?’

‘সে তো বলেই না। তবে যে লোকটাকে এরা কুক হিসেবে রেখেছে, সেইই একদিন মাল খেয়ে বলে ফেলেছিল আমাকে… খি খি খি… মাতালদের কাজকারবার তো জানোই…’ বলতে বলতেই অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।

মাতাল লোকটাকে ফেলে চলে আসছিল অভিরাম। কটেজের ভেতরের রাস্তা ওর চেনা। ঢোকার সময়েই ওর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ ডিজিটালি অ্যাক্টিভেটেড কার্ড, যেটা ওর চোখের মণির ছবির সঙ্গে লিঙ্ক করা আছে। এই কটেজের যে-কোনও সিকিউরিটি যে কোনও সময়ে সেটা দেখতে চাইতে পারে, এবং তার চোখে বিশেষ টর্চের আলো ফেলে সেটা আসল না নকল তা যাচাই করতে পারে। মিললে ভালো, না মিললে…

না মিললে যে কী সেটা অভিরাম নিজেও জানে না। তবে সেটা খুব যে সুখকর হবে না অন্তত সেটুকু ও খুব ভালো করেই বোঝে।

দেবাশিসদা’র ঘর থেকে কটেজের গেটটা একটু দূরে। মাঝখানে একটা ছোট ফোয়ারা মতো আছে। রাস্তাটা তার পাশ দিয়ে ঘুরে যায়। এখন অবশ্য ফোয়ারাটা বন্ধ।

শুনশান রাস্তা। কটেজের বাগান থেকে জুঁইফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। আকাশে আধখানা চাঁদ উঠেছে, দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া।

পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চিন্তাগ্রস্তভাবে হাঁটছিল অভিরাম। অনেক চিন্তাভাবনা করেও কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিল না সে।

কিসের সায়েন্সের পরীক্ষা হচ্ছিল যন্তরমন্তরে? তার এত গোপনীয়তা কীসের? কেন তাকে পালবাবু চুপ করে থাকতে বলছে? লোকগুলো হারিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও পুলিশ কেস হচ্ছে না কেন? যন্তরমন্তরে এত সিকিউরিটি কীসের জন্য? সেদিন ওই লিডার গোছের লোকটা জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে কী করছিল?

ফোয়ারার কাছাকাছি আসতেই একটা ভুক ভুক আওয়াজ শুনে থমকে গেল অভিরাম। সিকিউরিটির ওই বাঘাটে কুকুরগুলো নাকি? রটওয়েলার না কি যেন নাম, এক একটা কুকুর দিনে কিলোখানেক করে পাঁঠার মাংস খায়। কী ভয়ঙ্কর চাউনি ব্যাটাদের, দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়!

 এদিক ওদিক দেখে অভিরাম বুঝল আশেপাশে কেউ নেই। তাহলে তো আরও মুশকিল। কুকুরটা ছাড়া আছে নাকি? তাহলে তো আরও চিত্তির! ঘাড়ের ওপর একবার এসে পড়লে আর দেখতে হবে না! এক কামড়ে টুঁটি ছিঁড়ে নিতে পারে শালারা!

ফের সেই ভুকভুক আওয়াজ। কানটা খাড়া করল অভিরাম। আওয়াজটা ফোয়ারার ভেতর থেকে আসছে না?

একটু একটু করে এগিয়ে ফোয়ারার ভেতর উঁকি দিল অভিরাম।

প্রথমে কিছু নজরে পড়ল না ওর। কোনও কুকুর কেন, কোনও প্রাণীই নেই ওখানে। ফোয়ারার ঘন কালো জল জমে আছে নীচটায়। আর কিচ্ছু নেই।

আওয়াজটা তাহলে কে করল?

খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর অভিরামের মনে হল ফোয়ারার জলে যেন একটা সূক্ষ্ম কম্পন শুরু হয়েছে। তিরতির করে কাঁপছে জলের উপরিভাগ।

জলটা কাঁপছে কেন? ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল অভিরাম।

কম্পন বাড়তে থাকল ক্রমশ। এবার তার সঙ্গে জলের মধ্যে ছোট ঘূর্ণি তৈরি হতে লাগল। প্রথমে ধীরে, তারপর বেগ বাড়তে লাগল ঘূর্ণিগুলোর। ক্রমে বড় হতে হতে একে অন্যের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল ওরা।

নড়তে পারছিল না অভিরাম। কে যেন তার পা দুটোকে গেঁথে দিয়েছিল সেখানে।

হঠাৎ করেই যেন ঘূর্ণিগুলোর বেগ ধীর হয়ে আসতে থাকল। যেমন হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল, তেমনই হঠাৎ করে থেমে যেতে লাগল জলের ঘূর্ণনস্রোত।

আবার শান্ত হয়ে এল জলের উপরিভাগ।

এবার ধীরে ধীরে জলের মধ্যে কার যেন একটা অবয়ব ফুটে উঠতে লাগল।

মোহগ্রস্তের মতো সেদিকে তাকিয়েছিল অভিরাম। কার মুখ ও? সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে কে দাঁড়িয়ে আছে জলের অতলে? ও কার ছায়া?

একবার আকাশের দিকে তাকাল অভিরাম। নিশ্চিন্ত নির্মল আকাশ। কোথাও কোনও বাধাবন্ধ নেই। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কোথাও কোনও আলো নেই। কোথাও কোনও প্রাণ নেই।

মাথা নীচু করল অভিরাম। ঠিক তার সামনে সিংহের মতো কেশরওয়ালা একটি মস্ত বড় কুকুর দাঁড়িয়ে!

আর্তচিৎকার করার অবকাশও পেল অভিরাম। দুই থাবায় তাকে টেনে ধরে অতল জলের নীচে ঝাঁপ দিল সেই কালভৈরব।

*

কথা হচ্ছিল ডায়না নদীর পাড়ে একটা বড় পাথরের ওপর বসে। দেবু, সুজন আর সেই মালবাজার ট্যুরিস্ট লজে আলাপ হওয়া বাংলার টিচার। এতক্ষণে অবশ্য ভদ্রলোকের নাম জেনে গেছে ওরা।

‘আমাকে কৃষ্ণদা বলেই ডেকো ভাই,’ হাসতে হাসতে বলেছিলেন ভদ্রলোক, ‘এরাও তাইই বলে। আসল নাম একটা আছে বটে, তবে সেটা আমি নিজেও খুব একটা মনে রাখি না। ছোটবেলা থেকেই কেষ্ট, কেষ্টা শুনতে শুনতে এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে চট করে সেই নামে কেউ ডাকলে প্রথমে বুঝতেই পারি না আমাকে ডাকছে বলে।’

ওরা কেন এসেছে এখানে, সে-কথাটাও ভদ্রলোককে জানিয়েছে দু’জনে। যা অবস্থা তাতে একজন স্থানীয় মানুষকে পাশে রাখা ভালো।

আজ সকালেই দু’জনে বেরিয়েছিল ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করে দেখবে বলে। টি-গার্ডেন এখন প্রায় ফাঁকা, কাজকর্ম পুরোপুরি বন্ধ। শুধু কয়েকজন সিকিওরিটি গার্ড, আউট হাউসের কেয়ারটেকার আর বাজবাহাদুর ওরফে বাজু, এই ক’জনই রয়ে গেছে। শ্রমিকরা ডিউটিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। এই নিয়ে একটা চাপা থমথমে আবহাওয়া ছেয়ে আছে চারিপাশে।

খবরটা মোবাইলে মামাকে জানাতে দেরি করেনি দেবু। কিন্তু ট্যাক্স সংক্রান্ত একটা বড় ঝামেলা পেকে উঠেছে কলকাতায়। সেসব না সামলালে যা পেনাল্টি ধার্য হতে পারে তাতে চা বাগানটা উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। দেবুর মামা বলেছেন উনি দিন চার-পাঁচের আগে কলকাতা ছেড়ে নড়তে পারবেন না।

তবে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে ওপর মহল থেকে কলকাঠি নেড়ে স্থানীয় থানাকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। ওরা যেন যে করে হোক কয়েকটা দিন সামলে নেয়, বেশি ঝামেলায় না জড়ায়। বাকিটা তিনি এসে সামলে নেবেন।

ওরা থানাতেও গেছিল। বড়বাবু পাত্তাই দিলেন না। ‘দুঃখিত, এইসব সেনসিটিভ ইনফর্মেশন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারব না’—এই ছিল তাঁর উত্তর।

থানা থেকে তাড়াটাড়া খেয়ে দুজনে ডায়না নদীর দিকে আসছিল। নদীর ধারে দেখা হল ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনিই ব্যাপারটা ওদের কাছে খোলসা করলেন।

‘তারপর থেকেই লোকজন একেবারে ঘাবড়ে গেছে, বুঝলে।’ হাতে ধরা ছোট লাঠিটা দিয়ে মাটিতে আঁক কাটতে কাটতে চিন্তিত স্বরে বলছিলেন ভদ্রলোক, ‘পুলিশ যে কিছু করতে পারছে না তাই নয়। ইনফ্যাক্ট, তাদের কিছু করতেই দেওয়া হচ্ছে না এ বিষয়ে।’

কথাটা শুনে দু’জনেরই ভারি আশ্চর্য লাগে।

‘সে কী! পুলিশকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, মানে? তিন-তিন জন লোক হাপিশ হয়ে গেল, আর পুলিশকে কাজ করতে দিচ্ছে না? কে কাজ করতে দিচ্ছে না? আর কেনই বা দিচ্ছে না?’ প্রশ্নটা সুজনই করে।

প্রশ্নটা শুনে গম্ভীর হয়ে যান কৃষ্ণদা। তারপর নীচু গলায় বলেন, ‘এর পেছনে একটা মস্ত বড় রহস্য আছে হে। নদীর ওপারে ওই সাদা রঙের বিল্ডিংটা দেখেছ?’

দেখেছে দু’জনেই। এই নির্জন অঞ্চলে এমন একটা পাকা বাড়ি দেখে ওরা অবাকই হয়েছিল। ওদিকে ভুটানের পাহাড়, সামনে তিরতিরে পাহাড়ি নদী আর পিছনে নীল আকাশ, তার মধ্যে গম্ভীরভাবে জেগে আছে সাদা রঙের দোতলা বাড়িটি। তার পেছনে আবার মস্ত বড় একটা ফ্যাক্টরি, একই চৌহদ্দির মধ্যে।

ওরা একবার ভেবেছিল, গিয়ে দেখে আসবে ওটা কার বাড়ি, আর এমন অদ্ভুত জায়গায় অতটা জায়গা নিয়ে এমন পাকা বাড়ি বানাবার মানেটাই বা কী? তবে সেসব দেখতে গেলে বিস্তর রাস্তা ঠ্যাঙাতে হবে। তারপর একটা কাঠের পুল পেরিয়ে তবেই ওপারে যাওয়া যায়। অতটা গিয়ে লাভ হবে কি না তারও নিশ্চয়তা নেই। তাই আপাতত সেই ইচ্ছায় ইতি দিয়েছে দু’জনে।

‘গেলেই যে ওখানে ঢুকতে পেতে তার কোনো মানে নেই।’ ওদের প্ল্যানের কথা শুনে স্মিতহাস্যে বলেন ভদ্রলোক, ‘পণ্ডশ্রম হত।’

‘কেন বলুন তো?’ দেবুর বিস্মিত প্রশ্ন।

‘কারণ বাড়ির সামনে মিলিটারির কড়া পাহাড়া। তোমাদের কাউকে চৌহদ্দির মধ্যে আসতেই দিত না।’

‘মিলিটারি? এখানে?’ ভারি অবাক হয় দু’জনে, ‘কেন?’

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন ভদ্রলোক। তারপর বলেন, ‘কারণ যে ঝড়ের রাতে যন্তরমন্তর অন্ধকার হয়ে গেছিল, ঠিক সেই রাত থেকেই লোকজনের নিখোঁজ হওয়া শুরু।’

আট মাস আগে

গভীর রাত। জঙ্গলের মধ্যে এক বিশেষ জায়গায় দশ বাই বারো সাইজের জমির চার কোণে চারটে হ্যাজাক জ্বলছে।

হ্যাজাক বলা ভুল। এ এক বিশেষ মিলিটারি গ্রেড ল্যাম্প, নাম কন্ট্রোলুমিনো। এই প্রোগ্রামেবল ল্যাম্পে প্রোগ্রাম সেট করে দিলে এক নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই আলো ছড়ায়। তার বাইরে এই আলো প্রায় অদৃশ্য।

মেজর রাহুল মাত্রে হাঁটু গেড়ে বসে পুরো জায়গাটাকে একবার জরিপ করে নিলেন। মনে মনে ছকে নিলেন পরের কর্মপদ্ধতি। পুরোটা শেষ করতে ঘণ্টা তিনেকের বেশি লাগার কথা নয়।

পিঠের রুকস্যাকটা থেকে বেশ কয়েকটা আধুনিক যন্ত্রপাতি বার করলেন রাহুল। তার একটা হচ্ছে অ্যাডভান্সড সারফেস সোনার। মাটির নীচে দশ ফুটের মধ্যে কী কী লুকোনো আছে তার একটা মোটামুটি আইডিয়া দিতে পারে এই যন্ত্র। শুধু তাই নয়, সেসবের মোটামুটি থ্রি ডাইমেনশনাল ছবিও এঁকে দিতে পারে। বাকি যন্ত্রপাতিগুলো সবই ব্যাটারিচালিত অত্যাধুনিক খননযন্ত্র।

আর রয়েছে একটা পুরোনো ডায়েরি।

ডায়েরিটার গায়ে পরম মমতায় একবার হাত বুলিয়ে নিলেন রাহুল। এক নিরপরাধ সন্ন্যাসীর নিদারুণ মৃত্যুযন্ত্রণা মিশে আছে এই ডায়েরির পাতায় পাতায়। মিশে আছে বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর প্রতি এক মরণোন্মুখ বন্ধুর সুতীব্র ঘৃণার আখ্যান। মিশে আছে এক খুনে গুপ্তচরের অন্তর্বেদনা, অনুশোচনার তীব্র দহনজ্বালা।

আর মিশে আছে একটি হাজার বছরের পুরোনো কাহিনি। বড় অদ্ভুত, বড় অবিশ্বাস্য, বড় আশ্চর্য সেই গল্প।

এই ডায়েরিটা লেখার পরপরই পাগল হয়ে গেছিলেন আজোবা। সারাদিন চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকতেন। মুণ্ডিতমস্তক গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী দেখলেই ঠকঠক করে কাঁপতে থাকতেন প্রবল আতঙ্কে।

ডায়েরিটা পরম মমতায় নিজের বুকে তুলে নিলেন রাহুল। আজোবা যা করেছিলেন তার ক্ষমা নেই। গুপ্তচর দুনিয়াতে ডাবল ক্রসিং ঘৃণ্যতম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর সেই ডাবল এজেন্ট যখন নিজের নিরপরাধ বিশ্বস্ত বন্ধুকে মর্মান্তিক নরকযন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেয়, তখন?

স্বয়ং ঈশ্বরও সেই অপরাধ ক্ষমা করেন না।

তবুও, রতনলাল মাত্রে তাঁর ঠাকুরদা। পূর্বপুরুষের রক্তের ঋণ শোধ করার কিছু দায়িত্ব তো বর্তায় রাহুলের কাঁধে, বর্তায় না?

চটপট অ্যালুমিনিয়ামের ডান্ডার কয়েকটা টুকরো পরপর ফিট করে চারটে ফুট ছয়েকের ডান্ডা বানালেন রাহুল। জমিটার চারদিকে লাগিয়ে দিলেন সেগুলোকে। সারফেস সোনারের অপারেটিং মডিউলটা হাতে নিয়ে বসে কন্ট্রোল প্যানেলটা অন করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ডান্ডার মাথায় ফুটে উঠল একটি রক্তাভ লাল আলোর বিন্দু। আর প্রতিটি বিন্দু থেকে অন্য তিনটি ডান্ডার মাথা এবং পায়ের কাছে ছিটকে গেল দুটি করে উজ্জ্বল লেজার রশ্মির শিখা।

ধীরে ধীরে কন্ট্রোল প্যানেলের ভিজ্যুয়ালস অন করলেন রাহুল। মিনিট পাঁচেক চেয়ে থেকে সেটাকে নামিয়ে রাখলেন নীচে। তাঁর কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম।

আইসোটক্সাল অক্টাগ্রামের ছবিটা এখন স্পষ্ট। সেই ছবি বলছে যে মাটির প্রায় তিন ফুট নীচে, এই অক্টাগ্রামের প্রতিটি শীর্ষবিন্দুতে গাঁথা আছে একটি করে অবজেক্ট বা বস্তু। খুব সম্ভবত লাইফ ফিগার, উচ্চতা পাঁচ থেকে ছ’ইঞ্চির বেশি নয়। আর এই অক্টাগ্রামের ঠিক মাঝখানে রয়েছে আরেকটি লাইফ ফিগার, আগের আটটির থেকে সামান্য বড়।

ঠিক যেমন লেখা ছিল আজোবার ডায়েরিতে।

কাজের সময় মদ্যপান করা ঘোরতর অপছন্দ রাহুল মাত্রের। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকছিল না তাঁর। রুকস্যাকে হাত ঢুকিয়ে একটা বড় হুইস্কির বোতল বার করে আনলেন তিনি। গলায় ঢেলে নিলেন খানিকটা সোনালি আগুন।

তারপর কয়েকটা ব্যাটারি অপারেটেড মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে পড়লেন পরের পর্যায়ের কাজে।

*

‘মাসদুয়েক আগে হঠাৎ করেই গড়ে তোলা হয় এই দোতলা বাড়িটা। প্রথমে শোনা গেছিল, প্রবাসী কোনো বাঙালি বিজ্ঞানী বানাচ্ছেন। পরে আবার শোনা গেল, ওটা নাকি আসলে সরকারেরই একটা প্রোজেক্ট!

পুরো চৌহদ্দির মধ্যে একদিকে আছে ওই দোতলা বাড়িটা। অন্যদিকে ওই কারখানার মতো বিশাল ঘরটা। ওই কারখানার মধ্যে মধ্যে বিরাট বড় একটা মেশিন আছে। ওর নামেই স্থানীয় লোকেরা বাড়িটার নাম দিয়েছে যন্তরমন্তর।

বাড়ির ভেতরটা পুরোটাই এসি করা। পেছনদিকে জেনারেটর আছে, যন্তরমন্তরে কক্ষনো কারেন্ট যায় না।

বাড়িটা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সেখানে থাকতে আসেন এক প্রৌঢ় প্রফেসর। তাঁর নাম কেউ জানে না। সবাই ডাকে স্যার বলে। সবাই বলতে অবশ্য বাড়ির জনা চারেক গাঁট্টাগোট্টা কাজের লোক, আর দুজন অবাঙালি দারোয়ান। এরা সবাই বাইরের লোক। না তারা বাড়ির বাইরে আসে, না কারও সঙ্গে কথা বলে।’

এতটা বলে দেবুর দিকে ফেরেন কৃষ্ণদা, ‘তোমার মামা কখনও এটার কথা বলেননি তোমাদের?’

দেবু খানিকটা মাথা চুলকে নেয় প্রথমে। তারপর বলে, ‘আসলে মামার সঙ্গে এই বিষয়টা নিয়ে সেভাবে আলোচনা তো হয়নি। এখানে আসাটাও ঝট করেই। তাই…’

‘হুঁ।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন কৃষ্ণদা, তারপর ফের বলতে শুরু করেন।

‘যন্তরমন্তর নিয়ে লোকজনের কৌতূহলের আরও একটা বিষয় হল কড়া সিকিওরিটি। চারিদিকে বারোফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের ওপর বসানো কাঁটাতারের মধ্যে দিয়ে সবসময় চারশো চল্লিশ ভোল্টের ইলেক্ট্রিসিটি চলে। বাড়ির সর্বত্র ক্যামেরা বসানো। বাইরে থেকে আসা সব্বাইকে একটা ছোটো যন্ত্রে দশ আঙুলের ছাপ দিয়ে তবেই ভেতরে যেতে দেওয়া হত।

ফলে যন্তরমন্তর নিয়ে একটা ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। কেউ বলে ওখানে জাল নোট ছাপা হয়। কেউ বলে ওটা স্মাগলিঙের ডেন। অনেকের মতে ওটা গোপন অস্ত্র কারখানা। মোটমাট যন্তরমন্তর নিয়ে লোকজনের কৌতূহলের শেষ নেই। এরই মধ্যে একদিন ঘটে যায় একটা দুর্ঘটনা।’

‘ঝড়জলের রাতের ব্যাপারে কী একটা বলছিলেন না?’ প্রশ্ন করে সুজন।

‘বলছি।’ বলে ওদের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসেন ভদ্রলোক, ‘ওখান থেকেই তো কাহিনির শুরু।’

‘গল্পটা আমাকে বলেছিল ঘনরাম। সে ছিল ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী। আমিই তাকে বারণ করি এ কথা পাঁচকান করতে।

সেই রাতে প্রবল ঝড়জল হচ্ছিল। বস্তির কেউই বাইরে ছিল না, শুধু ঝন্টু মণ্ডলের ঠেক থেকে ফুল দুটো পাঁইট শেষ করে ফিরছিল ঘনরাম। যতই ঝড়জল হোক, ঝন্টু’র ঠেকে যেতে ভুল হয় না বুড়োর।

ফেরত আসার পর বোধহয় একটু জিরোতেই একটা ঝোপড়ার ভেতরে বসে হাঁপিয়ে নিচ্ছিল বুড়ো। তখনই নদীর ওপারে তার নজর গেলে ঘনরাম একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পায়।

হঠাৎ করে তার মনে হয়, যেন কোনো একটা দৈত্য বাড়িটাকে সজোরে চেপে ধরেছে। বাড়ির আলোগুলো ভয়ানকভাবে কাঁপছিল সেই রাতে। অন্ধকারের মধ্যেই ঘনরামের মনে হয়, বাড়িটা যেন অতি কষ্টে একবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। তখনই ও শোনে, ফ্যাক্টরির মতো ঘরটা থেকে একটা চাপা শোঁ-শোঁ আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে উঠছে। দোতলার ঘরের কাচের জানলার ওপাশে সে বেশ কিছু লোককে দৌড়োদৌড়ি করতেও দেখে।

হঠাৎ ঘনরামের নজরে পড়ে যে যন্তরমন্তরের আকাশ ঘিরে একটা অদ্ভুত নীল আলোর বলয়। সেটা নেমে আসার চেষ্টা করছে বাড়িটার ওপর! সেই সঙ্গে আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই শোঁ-শোঁ শব্দ। ঘনরামের মনে হয়, ধীর কিন্তু নিশ্চিত ভঙ্গিতে সেই অতি বিশাল কালো বৃত্তটি গিলে খেতে চাইছে বাড়িটাকে।

এরপর একনাগাড়ে প্রায় কুড়িটা বাজ পড়ে ওই জায়গায়। ঘনরাম এমনিতে বাজে খুব ভয় পায়, কিন্তু সেদিন কে যেন তার চোখ দুটো আটকে রেখেছিল বাড়িটার দিকে। শেষবার বজ্রপাতের সঙ্গে-সঙ্গে একটা হাহাকার তুলে সেই নীল বলয়টি যেন অন্ধকারের গুঁড়োর মতো মিশে যেতে থাকে দুপাশের জমাট অন্ধকারের মধ্যে।

সবকিছু থেমে গেলে ঘনরাম কাঁপতে কাঁপতে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। এসব কথা আমাকে ছাড়া কাউকে বলেনি সে।

 পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ও শোনে, যন্তরমন্তর থেকে যেন ভোজবাজির মতোই উধাও হয়ে গেছে বাড়ির লোকগুলো। সেদিন থেকেই যরন্তরমন্তরের দখল নেয় মিলিটারি। আর শুরু হয় লাল ঝামেলা বস্তি থেকে একের পর এক হারিয়ে যাওয়া।’

আট মাস আগে

রাহুল মাত্রের বাঁ-হাতের কব্জিতে বাঁধা মাল্টিফাংশনাল মিলিটারি রিস্ট ওয়াচের ডায়ালে তখন রাত দুটো।

তাঁর সামনে এখন আইসোটক্সাল অক্টাগ্রামটির আট কোণে আটটি গর্ত। প্রতিটি গর্তের সামনে আটটি ছোট ছোট মূর্তি রাখা। একটু আগেই তাদের তুলে আনা হয়েছে মাটির গর্ভ থেকে। প্রতিটি মূর্তির গায়ে মাটি কাদা লেগে।

মন দিয়ে মূর্তিগুলি দেখছিলেন রাহুল। ডায়েরির কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এই মূর্তিগুলির বয়েস হাজার বছরের কাছাকাছি। এগুলির পূজা করতেন এক অসামান্য শক্তিধর সাধক।

ধীরে ধীরে প্রতিটা মূর্তির নাম ডায়েরি থেকে পড়তে লাগলেন রাহুল। পূর্ব কোণের মূর্তিটি যাঁর, তাঁর নাম বজ্রাঙ্কুশী। পশ্চিমদিকের দেবীটির নাম বজ্রস্ফোটা। উত্তরে আছেন বজ্রঘন্টা, দক্ষিণে বজ্রপাশী।

অপ্রধান কোণগুলিতে অবশ্য দেবীদের না, দেবতাদের অধিষ্ঠান। নৈঋতকোণে আছেন নীলদণ্ড, বায়ুকোণে মহাবল। অগ্নিকোণের দেবতাটির নাম টক্কিরাজ, ঈশান কোণে অধিষ্ঠিত আছেন ত্রৈলোক্যবিজয়।

লোবসাং বলে গেছিলেন আট কোণে এই আটজন মহাবলশালী দেবদেবীর মূর্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল অষ্টভুজক্ষেত্রটির বীজকায়া।

আর ক্ষেত্রের মধ্যিখানে হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছেন যিনি?

তাঁকে তুলে আনতে গেলে প্রবেশ করতে হবে এই অষ্টভুজক্ষেত্রের মধ্যে। কিন্তু রাহুল জানেন যে, প্রাথমিক প্রক্রিয়া সমাপ্ত না করে এই অষ্টভুজক্ষেত্রে পা দেওয়া নিষেধ, প্রবলভাবে নিষেধ।

প্রথমে প্রতিটি দেবীমূর্তির জায়গায় দেবতাদের মূর্তিগুলি এনে রাখতে শুরু করলেন রাহুল, ঘড়ির কাঁটার উল্টো চলন ধরে বা অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ ভাবে। উত্তরদিক থেকে বজ্রঘণ্টাকে তুলে এনে রাখলেন উত্তর পূর্বে, বায়ুকোণে। বায়ুকোণ থেকে মহাবলের মূর্তি এনে রাখলেন পশ্চিমে, বজ্রস্ফোটার জায়গায়। শেষ অবধি ত্রৈলোক্য বিজয়ের মূর্তি উত্তরদিকে এনে রাখার সঙ্গে সঙ্গে প্রক্রিয়াটির প্রথম ধাপ শেষ হল।

উঠে দাঁড়ালেন রাহুল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল মাটিতে যেন অতি সামান্য একটা মৃদু কম্পন শুরু হয়েই থেমে গেল।

এরপর দ্বিতীয় প্রক্রিয়া।

এক এক করে প্রতিটি মূর্তি তুলে এনে ঠিক তার উল্টোদিকে রাখতে শুরু করলেন রাহুল। উত্তরদিক থেকে ত্রৈলোক্য বিজয়ের মূর্তি তুলে এনে রাখলেন দক্ষিণে। দক্ষিণের নীলদণ্ডের মূর্তি গেল উত্তরে। অগ্নিকোণের বজ্রপাশী গেলেন বায়ুকোণে, নৈঋতকোণের বজ্রস্ফোটা গেলন ঈশানে।

পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে করতে একটা কথাই মাথায় এল রাহুলের। তিনি যেটা করছেন সেটা আর কিছুই না, একটা প্যাটার্ন আনলক করা। পুরোটাই যেন একটা জটিল ধাঁধা সলভ করার পাসওয়ার্ড।

এইবার প্রতিটি মূর্তি মাটিতে খুঁড়ে রাখা গর্তের মধ্যে সযত্নে নামিয়ে দিলেন। তারপর মাটিচাপা দিলেন মূর্তিগুলিকে।

শেষ মূর্তিটিকে প্রোথিত করে ওঠার সময়েই রাহুল টের পেলেন যে সমগ্র অষ্টভুজক্ষেত্রটি জুড়ে একটা মৃদু কম্পন শুরু হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ক্ষেত্রটির বাইরের ভূমিতে কিন্তু কিছু টের পাওয়া যাচ্ছে না।

তারপর যেটা ঘটল সেটা আরও আশ্চর্যের, প্রায় ম্যাজিক!

রাহুলের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মাটির বুক চিরে, অক্টাগ্রামের প্রতিটি শীর্ষবিন্দুতে জেগে উঠল একটি করে নীল আলোর পিণ্ড। প্রতিটি পিণ্ড থেকে নির্গত হল একটি করে ঋজু আলোকরেখা। তারা এসে মিলিত হল অক্টাগ্রামটির ঠিক মধ্যবিন্দুতে।

মেজর রাহুল মাত্রে দেশের একজন প্রথম সারির কম্যান্ডো। মাথা ঠান্ডা বলে সুনাম আছে তাঁর। বহু কভার্ট অপারেশনে অংশ নিয়েছেন, বার তিনেক ফিরে এসেছেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে। তবুও তাঁর হাত-পা কাঁপছিল এই অনৈসর্গিক দৃশ্য দেখে!

মনের জোরে নিজেকে শক্ত করলেন তিনি। এখন দুর্বল হওয়ার সময় নয়, রক্তের ঋণ শোধ করার সময়।

এইবার শেষ ধাপ। মাটি খোঁড়ার পোর্টেবল আর্থ মুভার আর অটোমেটেড ক্লাচারটা নিয়ে ভেতরে পা রাখলেন তিনি। মনে হল পুরো ভূমিখণ্ডটি যেন গোঙাচ্ছে, পায়ের নীচে তার স্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করা যায়।

অক্টাগ্রামের মধ্যবিন্দু বরাবর যখন মাটি খুঁড়ছে ব্যাটারিচালিত যন্ত্রটা, রাহুল মাত্রে বুঝতে পারলেন যে কম্পন আরও বাড়ছে। মাটির বুক থেকে সহস্র মৌমাছির সমবেত গুঞ্জনের মতো একটা আর্তস্বর উঠে আসছিল।

খানিক পরেই মাটি খোঁড়া থেমে গেল। ওপরে উঠে এল অত্যাধুনিক খননযন্ত্রটির লম্বা পাইপ আর কাটিং হেড। তারপর অটোমেটেড ক্লাচারের দুটো দীর্ঘ দাঁড়া নেমে গেল গর্তের মধ্যে।

একটু পরে যে জিনিসটা উঠে এল সেটাকে দেখে ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন রাহুল মাত্রে।

পুরো মূর্তিটা একটা নীল স্ফটিকের তৈরি। গায়ে মাটি লেগে থাকা সত্ত্বেও নীলাভ আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছিল মূর্তিটির চারিপাশে। মোহগ্রস্তের মতো সেটি হাতে তুলে নিলেন রাহুল। তিনি জানেন এটি কার মূর্তি।

এঁর ব্যাপারে বিশদে লিখে গেছেন আজোবা। তবুও, মূর্তিটি দেখে বুকটা একবার ভয়ে কেঁপে উঠল অসমসাহসী কম্যান্ডোর।

ষড়ভুজ মহাকাল।

মূর্তিটির একটি মাথা, তিনটি চোখ এবং ছয়খানি হাত। মাথায় উত্তুঙ্গ জটাজূট, একটি সাপ ফিতের মতো সেটি বেঁধে রেখেছে। চুলের প্রান্ত হাওয়ায় উড়ছে আগুনের শিখার মতো। পরনে বাঘছাল, গলায় ঝুলছে নরমুণ্ডের মালা। বাহুতে ও পায়ে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো। মূর্তির ডানদিকের তিনটি হাতে রয়েছে নরমুণ্ডের জপমালা, ডমরু এবং কর্ত্রি। বাঁ-দিকের তিনটি হাতে শূল, বজ্রপাশ এবং নরকপাল। ডান হাতের কর্ত্রি এবং বাঁ-হাতের নরকপাল বুকের কাছে জড়ো করা। তিনটি রক্তাভ চোখে ফুটে উঠেছে মহাক্রোধবহ্নি।

নির্নিমেষে মূর্তিটির দিকে চেয়েছিলেন রাহুল। এমন ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর মূর্তি কমই দেখেছেন তিনি। যে অজানা শিল্পী এই অসামান্য শিল্পকর্মটি তৈরি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই দৈবী অনুগ্রহপ্রাপ্ত।

খানিকপরেই সচেতন হয়ে উঠলেন রাহুল। এইবার শেষ কাজ।

আজোবার ডায়েরি অনুযায়ী, যে পুঁথিটির অধিকার নিয়ে এই মহা অনর্থ, সেটি লোবসাং আই বি চীফের হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি বিশেষে কারণে।

আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে লোবসাং-এর এক পূর্বপুরুষ গুরু পদ্মসম্ভবের বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করেন। কী জাতীয় অনুগ্রহ সেটা পুঁথি পড়ে বোঝা দুষ্কর। তবে এইটুকু জানা যায় যে লোবসাং-এর পূর্বপুরুষের অনুরোধে পদ্মসম্ভব একটি জটিল ও দুরূহ তান্ত্রিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তিনি লিখে রেখে যান যে দেড় হাজার বছর পর নিয়তির বিধানে সেই পূর্বপুরুষের আত্মা মুক্তিলাভ করবে।

কিন্তু সেই মুক্তিলাভ করার পথে একটা বাধা আছে।

গুরু পদ্মসম্ভব তাঁর তন্ত্রক্রিয়াটি একটি বিশেষ স্থানে অবরুদ্ধ করে রেখে যান। তিনি তাঁর পুঁথিতে পূর্ব ভারতে হিমালয়ের পাদদেশের সেই বিশেষ স্থানটির ইঙ্গিতও দিয়ে গেছেন।

তিনি এও লিখেছেন যে দেড় হাজার বছর পর কোনও এক ঐশীশক্তির ক্ষমতাবলে ওই একই স্থানে তাঁর কৃত ক্রিয়াটি পুনরায় ঘটমান হবে। তখনই মুক্তিলাভ করবে লোবসাং-এর পূর্বপুরুষের আত্মা।

কিন্তু ক্রিয়াটির সূচনা করার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। সেইটি সম্পন্ন না করলে তন্ত্রক্রিয়াটি সচল হবে না। পদ্ধতিটিও তিনি বিশদে লিখে গেছেন।

তাঁর আদেশ অনুযায়ী ঠিক দেড় হাজার বছর পরে গিয়াৎসো পরিবারের কোনও উত্তরাধিকারীকে বা তার পরম বিশ্বস্ত কাউকে সেখানে গিয়ে তাঁর লিখিত পদ্ধতি অনুসারে ক্ষেত্রটি উন্মুক্ত করতে হবে। তবেই লোবসাং এর সেই পূর্বপুরুষের আত্মার মুক্তি ঘটবে।

আত্মার মুক্তি তিব্বতীদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। হাজার বছর ধরে লোবসাং-এর পরিবারের প্রতিটি পুরুষ জানে যে অমুক দিনে অমুক জায়গায় গিয়ে একটি বিশেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে, তবেই তাদের সেই আশীর্বাদধন্য পূর্বপুরুষের আত্মা নির্বাণপ্রাপ্ত হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রেখেছে সেই আদেশ, আর জানিয়ে গেছে তার উত্তরপুরুষদের। তার সঙ্গে তারা সযত্নে আগলে রেখেছে সেই পুঁথি।

লোবসাং-এর কোনও সন্তান না হওয়ায় সন্ন্যাস নেয় সে। তারপরেই গুরু রিন পো চে’র স্বহস্তে লেখা পুঁথিটি সে তুলে দেয় হিজ হোলিনেস দলাই লামা’র হাতে। দলাই লামা’র থেকে পরম বিশ্বস্ত আর কে আছে তিব্বতীদের কাছে? নিশ্চয়ই তিনি পূর্ণ করবেন সেই আরব্ধ কর্ম। লোবসাং-এর পরিবার আগে থেকেই দলাই লামা’র বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত ছিল। এরপর তার স্থান হয় দলাই লামার একদম ঘনিষ্ট বৃত্তের মধ্যে।

পরিস্থিতি পালটে যায় চীনের তিব্বত আক্রমণের পর। দলাই লামা’র সঙ্গে লোবসাংকেও পালিয়ে আসতে হয় ভারতে। লোবসাং সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে যে পরম মহিমান্বিত দলাই লামা, যাঁর আদেশ ছাড়া তিব্বতের আকাশে চন্দ্র সূর্য ওঠে না, তিব্বতের প্রতিটি আত্মা যাঁর আশীর্বাদ ছাড়া নিঃশ্বাস নেয় না, যাঁর অজানিতে তিব্বতের কোনও শুভাশুভ কর্ম সম্পন্ন হয় না, তিনিও সাধারণ মানুষের মতোই সমান অসহায়। প্রবল পরাক্রান্ত বিদেশি শক্তির সামনে তাঁর কোনও দৈবী বা ঐশী শক্তির কোনও জোরই খাটে না।

সেই থেকে অমূল্য পুঁথিটির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন লোবসাং। তিনি চেয়েছিলেন যে চীনের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে এমন এক শক্তির হাতে তাঁদের পরিবারের আরব্ধ কর্মের উত্তরাধিকার সঁপে যেতে।

তাঁর ধারণা হয়েছিল যে ভারতের নিরাপত্তা আই বি’র হাতেই সমর্পিত। তখনই তিনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন আই বি’র সঙ্গে। আর সেই কাজে তিনি সাহায্য নেন…

হাঁটু গেড়ে মাথা মূর্তিটিকে নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন রাহুল। হঠাৎ করেই যেন ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তিনি।

এসেছে, অবশেষে আজ এসেছে সেই সময়। লোবসাং গিয়াৎসো মারা যাওয়ার আগে তার বিশ্বাসঘাতক বন্ধু রতনলাল মাত্রে’র হাতেই সঁপে যান তার আরব্ধ কর্মের ভার। এর থেকে মধুর প্রতিশোধ বোধহয় আর হয় না।

সত্তর বছর। সত্তর বছর ধরে রতনলালের ছেলে অশোকরাও মাত্রে, আর অশোক রাওয়ের ছেলে রাহুল অশোকরাও মাত্রে এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্য ডে অফ রিডেম্পশন।

মূর্তিটি চিৎ করে মাটিতে শুইয়ে রাখলেন রাহুল। তার ওপর মেলে ধরলেন নিজের বাম বাহুখানি। তারপর পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বার করে অতি যত্নে নিজের বাঁ-হাতের কনুই থেকে কবজি বরাবর একটানে কেটে ফেললেন।

ফিনকি দিয়ে উঠল রক্তের ধারা। মনে হল যেন সেই রুধির স্রোত স্নান করিয়ে দিচ্ছে নীলাভ মহাকাল মূর্তি। এর সঙ্গে সঙ্গে কোন এক অজানা ভাষায় দ্রুতস্বরে মন্ত্র আউড়ে যেতে লাগলেন রাহুল।

মন্ত্রপাঠ শেষ হওয়ার পর ষড়ভুজ মহাকালের মূর্তিটা উলটো করে সযত্নে গর্তটার মধ্যে নামিয়ে দিলেন রাহুল মাত্রে। তারপর মাটি ফেলতে লাগলেন গর্তের মধ্যে।

গর্তের মধ্যে মাটি ফেলা শেষ হলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দুই হাত তুলে আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। দু-চোখের কোনায় চিক চিক করছিল অশ্রুবিন্দু।

আপনি শান্তি পেয়েছেন তো লোবসাং গিয়াৎসো? ক্ষমা করেছেন আমার ঠাকুরদাকে? যাকে আপনি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলেন, আপনার সেই বিশ্বাসঘাতক বন্ধু’র রক্তের উত্তরাধিকারী আজ আপনার পরিবারের আরব্ধ কর্ম সুসম্পন্ন করেছে। আজ আপনি তৃপ্ত তো?

সেই গহীন রাত্রির বুক চিরে, আকাশের নীল তারার আলোপথ ধরে যেন গহীন এক শান্তি নেমে এলো রাহুল মাত্রের বুকে। কে যেন গম্ভীর সুরে বলে উঠল, ‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু। অবেরা হোন্তু। অব্যাপজ্ঝা হোন্তু…’

ফেরার পথ ধরলেন রাহুল। রক্তের ঋণ রক্তেই শোধ।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *