২. রণেশ ছবি আঁকে

রণেশ নীচের তলার ঘরে বসে ছবি আঁকে। বাঁ দিকের জানালা দিয়ে আলো আসে। জানালার পাশে একটু পোড়ো জমি। তার ওপাশে রাস্তা। জানালার ধারে একটা আতা গাছ আছে। আতা গাছ রণেশের খুব প্রিয়। ভারি সুন্দর এ গাছের পাতা। পৃথিবীর দৃশ্যমান যা কিছু সুন্দর তাই তার প্রিয়। সুন্দরের কোনো অভাব পৃথিবীতে মোটেই নেই। চারদিকে মনোযোগী চোখ ফেললে কত সুন্দরের দেখা পাওয়া যায়। রণেশের চোখে স্থায়ী এক রূপমুগ্ধতা আছে।

আজকাল সকালের দিকে জানালার ধারে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ছবি আঁকার সময় কেউ চেয়ে থাকলে রণেশের কাজ এগোতে চায় না, অস্বস্তি হয়। তাই প্রথম দিন অ্যাই পালা বলে ধমকে দিয়েছিল। ছেলেটা কয়েকদিন আসেনি। দিনসাতেক বাদে আবার ছেলেটার কৌতূহলী মুখ জানালার দেখে রণেশ অবাক হয়ে বলল, কি চাস বল তো!

ছবি দেখছি।

ছবি দেখতে ভালো লাগে?

হ্যাঁ।

আঁকতে পারিস?

না তো!

রণেশ সেদিন ছেলেটাকে তাড়াল না, শুধু বলল, জানালার পাল্লার ওদিকটায় সরে দাঁড়া, নইলে তোর ছায়া এসে ছবিতে পড়বে।

ছেলেটা সন্তর্পণে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছবি আঁকা দেখল।

আজকাল প্রায়ই আসে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। তারপর চলে যায়।

ছবি নিয়ে মস্ত জুয়া খেলেছিল রণেশ। চাকরি বা ব্যবসা না করে শুধু ছবি এঁকে সংসার চালানোর ঝুঁকি নিয়েছিল। বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও। কিছুদিন খুব কষ্ট গেছে। তবে তার ভাগ্য ভালো, সে নাম করল এবং বাজার পেল অত্যন্ত দ্রুত। কলকাতায় তার নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে, স্টুডিয়ো আছে। তবু কলকাতা থেকে একটু দূরে নিরুপদ্রবে নিরবচ্ছিন্ন ছবি আঁকার জন্য সে এখানে একটা বাড়ি কিনে নিয়েছে। এখানে সে বেশির ভাগ সময়েই একা থাকে, একজন কাজের লোক তার রান্নাবান্না সব করে দেয়। মাঝে মাঝে তার বউ-বাচ্চারা আসে এবং কয়েকদিন করে থেকে যায়।

রণেশ কয়েকদিন দেখার পর একদিন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, তোর নাম কি?

পিপুল ঘোষ।

কোন বাড়ির ছেলে তুই?

ওই রায় বাড়িতে থাকি। ওটা আমার মামাবাড়ি।

রায় বাড়ি? ওখানে তো খুব গন্ডগোল হয়েছিল কয়েকদিন আগে, তাই না?

হ্যাঁ।

তোর কে আছে?

শুধু বাবা, দাদু আর কাকিমা। মা নেই।

ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে?

 পারি না যে।

কাল একটা কিছু এঁকে নিয়ে আসিস তো, দেখব। একটা কথা বলে দিই, কোনো ছবি দেখে নকল করিস না কিন্তু। যত খারাপ হোক মন থেকে আঁকবি।

পরদিন পিপুল একটা সাদা পাতায় পেনসিলে আঁকা যে ছবিটা নিয়ে এল তা একটা উড়ন্ত কাকের ছবি। বেশ ভালোই এঁকেছে। রণেশ খুশি হয়ে বলে, ছবির নেশা দেখেই বুঝেছি তোর ভেতরে আর্ট আছে। ঘরে আয়। ওধারে চুপটি করে বসে আঁকা দেখ। শব্দ করিস না।

শব্দ করেনি পিপুল। ছবির রাজ্যে কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই। শুধু রূপের জগৎ খুলে যায় চোখের সামনে। নির্জন শব্দহীন ঘরে একটা বাচ্চা ছেলে যে খেলাধুলো দুষ্টুমি ভুলে চুপ করে বসে থাকতে পারে এটা একটা সুলক্ষণ।

রণেশ ছবি আঁকতে আঁকতে মাঝে মাঝে কফি বানিয়ে খায়, কখনো-বা পায়চারি করে, কখনো চোখ বুজে চুপ করে বসে থাকে। মাঝে মাঝে নিরবচ্ছিন্ন ছবি আঁকায় একটু-আধটু ফাঁক দিতে হয়।

এরকমই একটা ব্রেক নিয়ে আজ রণেশ ছেলেটার মুখোমুখি বসল। ছেলেটি বাচ্চা হলেও এই বয়সেই এর জীবন বেশ ঘটনাবহুল। সব মন দিয়ে শুনল রণেশ। ছেলেটা বড্ড গন্ডগোলে পড়েছে। বাবা হাসপাতালে, অস্তিত্ব অনিশ্চিত।

রণেশ জিজ্ঞেস করে, ইস্কুলে ভরতি হোসনি?

 উদাস মুখে পিপুল বলে, মামারা কী আর পড়াবে!

পড়াবে না কেন?

আমার এখানে থাকাটাই তো পছন্দ করছে না। তাড়াতে চাইছে।

আমি যদি তোর স্কুলের খরচ দিই?

তাহলে পড়ব।

আরও বলে দিই, যদি ও বাড়ি থেকে তোকে তাড়ায়, তাহলে আমার কাছে এসে থাকতে পারিস। এ বাড়িতে তো জায়গায় অভাব নেই।

পিপুল এ কথায় খুশি হল। বলল, আমাকে থাকতে দেবেন? চুরি করব বলে ভয় পাবেন না তো?

রণেশ হাসল, এ বাড়িতে চুরি করার মতো কিছুই থাকে না। একমাত্র রং, তুলি আর ক্যানভাস ছাড়া। আর তোকে চোর বলে মনে হয়নি আমার। ওসব ভাবিস কেন!

পিপুল অবশ্য থাকল না। রণেশ তার স্কুলে ভর্তির টাকা দিল আর বই-খাতার খরচ। ছবি আঁকার কিছু সরঞ্জম দিয়ে বলল, খবর্দার, ছবি আঁকতে গিয়ে পড়াশুনোয় ফাঁকি দিস না, তাহলে কিন্তু দুটোই যাবে।

পিপুলের জীবন এইভাবে শুরু হল, নানা গন্ডগোলে, কিন্তু থেমে রইল না। রণেশ ছবি আঁকে বলেই বাস্তব জগতের অনেক কিছু মাথায় রাখতে পারে না। কিন্তু পিপুলের মুখ দেখে সে ঠিক বুঝতে পারে কবে এর খাওয়া হয়নি, কবে এ মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে বা মারধর খেয়েছে।

মামাবাড়িতে পিপুলের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। দাদু আর দিদিমা তাকে আগলে রাখে বটে, কিন্তু তারা সব কিছু ঠেকাতে পারে না। মামারা নানাভাবে তাকে উৎখাত করতে চাইছে। বড় কারণ হল, এখনকার আইনে মামাবাড়িতে পিপুলের মায়েরও অংশ আছে। সুতরাং পিপুল যদি একদিন দাবি করে তাহলে বাড়ি আর সম্পত্তির অংশ তাকে দিতে হবে। তাছাড়া আছে তার মা আশালতার বেশ কিছু গয়না। আশালতা গলায় দড়ি দেওয়ার আগে সব গয়না তার মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে যায়। সে খবর মামা-মামিরা জানে। তক্কে তক্কে ছিল সবাই, সে সব গয়না ভাগজোখ করে নেবে। পিপুল মস্ত দাবিদার।

সে আসার পরে মামাবাড়িতে গন্ডগোল ঝগড়াঝাঁটি অনেক বেড়ে গেছে। সকলেরই লক্ষ্য হল দিদিমা আর দাদু। উপলক্ষ পিপুল। দাদু চুপচাপ মানুষ। দিদিমা কিছু বলিয়ে কইয়ে। কিন্তু মামা-মামিদের সমবেত ঝগড়ার সামনে দাঁড়াতে পারবে কেন? ভালোর মধ্যে শুধু পিপুলের গায়ে আর কেউ হাত তোলেনি।

প্রায় ছ-মাস বাদে এক সকালে পিপুলের বাবা হরিশচন্দ্র ঘোষের একটা হাতচিঠি নিয়ে একজন লোক এল। তাতে লেখা, পত্রপাঠ এই লোকটির সঙ্গে আমার ছেলেকে ফেরত পাঠাবেন। নইলে মামলা করব।

চিঠি নিয়ে আবার হইচই লাগল। মামা-মামিরা পিপুলকেই বিদায় করার পক্ষে। দিদিমার মত হল, হাতচিঠি পেয়েই অচেনা মানুষের হাতে নাতিকে ছেড়ে দিতে পারব না। তাতে যা হয় হোক।

কালীমামা লাফাতে লাগল, ছাড়বে না মানে? পরের ছেলে আটকে রেখে জেল খাটব নাকি সবাই?

জেল হলে আমার হবে, তোদের কী? পুলিশ এলে আমাকে ধরিয়ে দিস। এই বলে দিদিমা পিপুলকে কাছে টেনে ধরে রইল, পাছে ওকে কেড়ে নেয় ওরা।

হরিমামা কালীমামার মতো লাফালাফি করে না। সে মিটমিটে মানুষ। খুব মোলায়েম গলায় বলল, এখানেই বা ওকে কোন আদরে রেখেছি আমরা বলো! নিজের বাপের কাছে ওর তবু দাম আছে। যেমনই লোক হোক, ছেলেকে তো আর ফেলবে না।

যে লোকটা চিঠি নিয়ে এসেছে তাকে চেনে না পিপুল। তবে চেহারা দেখে মনে হয়, লোকটা সুবিধের নয়। রোগা, রগ-ওঠা চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখদুটো বেশ লাল। সে প্রথমটায় কথা বলছিল না, এবার এসব শুনে বলল, কাজটা খুব খারাপ করছেন আপনারা। হরিশচন্দ্রকে আপনারা মারধর করেছেন, তার জন্য খেসারত আছে। আবার ছেলেকে আটকে রাখছেন, এর জন্য দুনো খেসারত।

কালীমামা তিড়িং-বিড়িং করে উঠে বলল, কীসের খেসারত? হরিশচন্দ্র যা করেছে তাতে তার ফাঁসি হয়। আমাদের হাতে সে শুধু ঠ্যাঙানি খেয়ে বেঁচে গেছে। আর ছেলে? ছেলেকে তো সে-ই আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে গেছে। তৈরি ছেলে, চুরি-চামারিতে পাকা হাত। অতি শয়তান।

লোকটা বারান্দায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসা, বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে বলল, মারধর বাবদ পাঁচটি হাজার টাকা গুনে না দিলে হরিশচন্দ্র আপনাদের শ্রীঘর ঘোরাবে, এই বলে রাখলুম। এ তল্লাটের মেলা সাক্ষী জোগাড় হয়ে গেছে। পুলিশেও সব জানানো হয়েছে। তবে মোকদ্দমায় না গিয়ে আপসে হয়ে গেলে হরিশচন্দ্র ঝামেলা করবে না। ওই পাঁচটি হাজার টাকা আর ছেলের সঙ্গে ওর মায়ের গয়নাগুলোও দেবেন। না হোক বিশ ভরি সোনা, কম কথা তো নয়।

কালী আর হরি একথা শুনে এত চেঁচাতে লাগল যে, অন্য কেউ হলে ভয় খেত। এ লোকটা পোক্ত লোক। পাকা বাঁশের মতো পোক্ত। একটুও ঘাবড়াল না। বলল, আমার হাতে টাকাটা না দেন, হরিশচন্দ্রর হাতেই দেবেন। সে স্টেশনে লোকজন নিয়ে অপেক্ষা করছে।

তবে রে! বলে কালীপদ তখনই স্টেশনে যাওয়ার জন্য ছুটে বেরোতে যাচ্ছিল।

হরিপদ তাকে আটকাল। বলল, আর ও কাজ করতে যাসনি। এবার বিপদ হবে। বরং দল বেঁধে গিয়ে আপসে কথা বলে আসাই ভালো।

লোকটা মিটিমিটি হাসছিল। বলল, আমাকে আপনারা চেনেন না। আমি হলুম শ্রীপদ মন্ডল। শ্রীরামপুর শহরে যে কাউকে নামটা একবার বলে দেখবেন, কপালে হাত ঠেকাবে। এটা আমার এলাকা নয় বটে, কিন্তু এ জায়গাতেও আমার যাতায়াত আছে। রেসো, নন্দু, কোকা সব আমার বন্ধু-মানুষ। আপনারাও নাম শুনে থাকবেন।

নাম সবাই শুনেছে। রেসো, নন্দু আর কোকা এ অঞ্চলের ষন্ডাগুন্ডা। কালীপদর মুখখানা যেন কেমন হয়ে গেল। কথা ফুটল না মুখে। তবে রাগে কাঁপছিল।

লোকটা তার দিকে চেয়ে বলে, এবার সুবিধে হবে না আপনার!

লোকটা কালীপদর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসিটি বজায় রেখেই বলল, আপনার এখন জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।

কালীপদ হুংকার দিতে গিয়েছিল, হল না। গলাটা ফেঁসে গিয়ে মিয়োনো আওয়াজ বেরোল, তার মানে?

পুলিশে যদি কিছু না করে তাহলে আমি করব।

কী করবে?

ঘাড় নামিয়ে দেব। এই আপনার বাড়িতে বসেই বলে যাচ্ছি, টাকাপয়সা দিয়ে যদি মিটমাট না করেন, গয়না যদি ফেরত না দেন, তাহলে খুব বিপদ হয়ে যাবে।

কালীমামা ফের একটু তড়পানোর চেষ্টা করে বলল, মগের মুলুক পেয়েছ? বাড়ি বয়ে এসে চোখ রাঙানো, অ্যাঁ?

শ্রীপদ মন্ডল যে আত্মবিশ্বাসী লোক তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল এবার। মগজটি ঠাণ্ডা, মুখে একটা হাসির ভাব আছেই, কথাবার্তায় তেমন কিছু গরম নেই, গলাটি এবারও তুলল না। বলল, মশাই, আপনার তো কেবল তর্জন-গর্জনই দেখছি। আমি যা বলেছি সেটা একটু ঠাণ্ডা মাথায় বসে বিবেচনা করুন, তারপর আপনার যা ইচ্ছে করবেন। কিন্তু আমি যা বলি তা কাজেও করি, কখনো নড়চড় হয় না।

একথায় কালীমামার মুখে কুলুপ পড়ল। তার জায়গা নিল হরিমামা। বেশ মোলায়েম গলায় হরিমামা বলল, আমার দাদার মাথাটি কিছু গরম, নইলে লোক খুব খারাপ নন। তা হরিশচন্দ্র একটা দাঁও মারতে চাইছে তাহলে! বলি কাজটা কী তার উচিত হচ্ছে? শত হলেও জামাই মানুষ, একরকম আত্মীয়ই তো?

শ্রীপদ মন্ডল ঠাণ্ডা গলায় বলল, সেটা আপনারা মনে রাখলেই ভালো হয়। আত্মীয় বলেই যদি বিবেচনা হয়ে থাকে তাহলে আত্মীয়কে কেউ লোক জুটিয়ে হাটুরে কিল দিয়ে হাসপাতালে পাঠায় নাকি!

সে যা হয়ে গেছে, গেছেই। মানুষ তো ভুল করেই। তবে কিনা আমাদের বোনটাকে ওভাবে খুন করাটাও তো হরিশচন্দ্রের ঠিক কাজ হয়নি।

খুন বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন কি?

প্রমাণ করতে পারলে কী আর হাত গুটিয়ে বসে আছি রে ভাই! সে তো আর কাঁচা খুনী নয়। সব দিক বেঁধেছেঁদে কাজটি ফর্সা করেছে। সে বাবদে তো তার কাছ থেকে আমরা কানাকড়িটিও চাইনি। চেয়েছি, বলো?

এবার কী চাইতে ইচ্ছে করছে?

হরিপদ একটু হাসল। বলল, গয়নাগাটি আমাদের কাছে পাচার করবেটা কে? আমার বোনকে তো সে বাপের বাড়িতে আসতেও দিত না। ওই গয়না একটি একটি করে নিয়ে বন্ধক রেখে রোজ ফুর্তি করত। খুনটাও সেই গয়নার বাবদেই কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার।

তার মানে আপনারা উপুড়হস্ত হচ্ছেন না?

তোমার সঙ্গে কততে রফা করেছে হরিশচন্দ্র?

রফাটফা কীসের মশাই। সে আমার বন্ধু-লোক।

হরিপদ ফের হেসে বলে, এটা কলিকাল কিনা, ওসব শুনলে ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। হরিশচন্দ্র যদি পাঁচ হাজার পায়, তবে তুমি তা থেকে না হোক আড়াইটি হাজার নেবে। তাই না?

শ্রীপদ একটা হাই তুলে বলল, হরিশচন্দ্র তো স্টেশনেই বসে আছে। কথাবার্তা তার সঙ্গেই গিয়ে বলে আসুন না। জেনে আসুন কার কত বখরা।

বাপু হে, টাকাটা যদি দিই তাহলে গলা বাড়িয়ে নিজের দোষ কবুল করা হয়। আমরা ও ফাঁদে পা দিচ্ছি না। তুমি আসতে পার।

কাজটা বোধহয় ভালো করলেন না মশাই। বলে শ্রীপদ উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, হরিশচন্দ্রের ছেলেকে আমি সঙ্গে নিচ্ছি না। ওর দিদিমার বড়ো মায়া ওর ওপর। তবে আপনারা যদি পৌঁছে দেন কখনো, দেবেন।

এই বলে শ্রীপদ মন্ডল বেশ দুলকি চালে চলে গেল।

হরিপদর সাহস দেখে সবাই অবাক। সন্ত্রস্ত কালীমামা বারবার বলতে লাগল, কাজটা ঠিক হল না–কাজটা ঠিক হল না। লোকটা মোটেই সুবিধের নয়।

উত্তেজিত কালীমামার হঠাৎ নজর পড়ল পিপুলের দিকে। পিপুল তার দিদিমার গা ঘেঁষে তখনও দরদালানের বাইরের বারান্দামতো জায়গাটায় দাঁড়ানো। কালীমামা পিপুলের ওপর চোখ পড়তেই শক-খাওয়া লোকের মতো লাফিয়ে উঠে বলল, ওই ছোঁড়াই যত নষ্টের গোড়া! আর মায়েরও বলিহারি যাই, একটা অজ্ঞাতকুলশীলকে একেবারে ঘরদোরে বিছানা অবধি নিয়ে তুলেছে! অ্যাই ছোঁড়া, এখনই বার হ বাড়ি থেকে!

দিদিমা তাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। দিয়েই হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, তোকে যে এখন কোথায় রাখি দাদা। আমার মাথাটা বড় কেমন কেমন করছে।

বলতে বলতেই দিদিমা ঢলে পড়ল মেঝের ওপর। পিপুল তাড়াতাড়ি গিয়ে না ধরলে মেঝের ওপর পড়ে মাথাটা ফাটত।

ও দিদিমা! ও দিদিমা! বলে ডাকাডাকি করতে থাকে পিপুল।

দিদিমা একবার চোখ খুলে খুব ক্ষীণ গলায় বলে, বুকে ব্যথা হচ্ছে, তোর দাদুকে ডাক… পিপুল দিদিমাকে তুলে যে বিছানায় শোয়াবে ততখানি জোর তার শরীরে নেই। তবে বুদ্ধি করে সে মেঝের ওপর একটা মাদুর বিছিয়ে বালিশ পাতল। তারপর দিদিমাকে গড়িয়ে নিয়ে সে মাদুরের ওপর শোওয়াল।

পিপুল চেঁচামেচি করল না, ঘাবড়েও গেল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোলো। নীচে অবশ্য চেঁচামেচি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু দরদালানে খুব উত্তেজিত গলা পাওয়া যাচ্ছে কয়েকজনের। একটা লোক বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে গেছে, ব্যাপারটা সহজ নয়। পাড়ার লোকজনও কিছু জুটেছে, আরও আসছে।

দাদুকে সিঁড়ির গোড়ায় পেয়ে গেল পিপুল। কানে কানে খবরটা দিতেই দাদু ফ্যাকাশে মুখে উঠে এল ওপরে। দিদিমার নাড়ি ধরেই বলল, গতিক সুবিধের নয়। তুই শিয়রে বসে মাথায় হাওয়া দে।

এক ডোজ হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিদিমার মুখে ঢেলে দিয়ে দাদু বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনল।

তারপর দিদিমাকে নিয়ে পরদিন সকাল অবধি যমে-মানুষে টানাটানি। পিপুলের দিকে কেউ নজর দিল না তেমন।

শেষরাতে পিপুল ঘুমিয়েছিল একটু, যখন চোখ চাইল তখন তার চোখের কোণে জল। ঘুমের মধ্যেও সে কেঁদেছে। বুক বড়ো ভার। ইহজীবনে এই দিদিমার কাছেই সে আদরের মতো একটা জিনিস পেয়েছিল কয়েকদিন। সেই আদরের দিন কী তবে ফুরোল?

দিদিমা অবশ্য মরল না। সামলে উঠল।

দুপুর বেলা দিদিমা তাকে ডেকে চুপিচুপি বলল, আমার মনে হয় এ যাত্রা আর খাড়া হব না। ঋণ রেখে যেতে নেই। ভালো করে শোন। ওই যে উঁচু কাঠের আলমারি দেখছিস, ওর মাথায় রাজ্যের ডাঁই করা বাজে জিনিস আছে। পুরোনো কৌটো, ন্যাকড়ার পুঁটুলি এইসব। খুঁজলে দেখবি ওর মধ্যে একটা পুরোনো বড়ো কৌটো আছে–তার মধ্যে তোর মায়ের গয়না।

গয়না দিয়ে কী হয় তা পিপুল জানে না। গয়না দামি জিনিস হতে পারে, কিন্তু তার কোন কাজে লাগবে? সে বলল, আমার গয়না চাই না দিদিমা, তুমি ভালো হয়ে ওঠো।

চাই না বললেই তো হয় না। জিনিসটা তোর। তবে ও নিয়ে বিপদে পড়বি। তোর দাদুকে ডাক, তাকে বলছি।

দাদু কাছেই ছিল, ডেকে আনল পিপুল।

দিদিমা অবসন্ন শরীরের হাঁফধরা গলায় বলল, গয়নার খবর ওকে দিয়েছি। তুমি ওগুলো বেচে ওর একটা ব্যবস্থা করে দিও।

দাদু হতাশ গলায় বলে, কী ব্যবস্থা করতে বলছ?

গয়নাগুলো বিক্রি করে যা টাকা পাবে সেটা ওর নামে ডাকঘরে রাখলে কেমন হয়?

ও তো এখনও ছোটো। গার্জিয়ান ছাড়া টাকা তুলতে পারবে না।

তোমরা পুরুষমানুষ, ভেবে একটা কিছু বের করো। ওর কাছে গয়না থাকলে হয় মামারা কিংবা ওর বাবা কেড়ে নেবে।

সে তো বটেই। তুমি অত হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? মনটা শক্ত করো–বেঁচে উঠবে। ডাক্তার তেমন কোনো ভয় দেখায়নি।

ডাক্তাররা কী বোঝে আমার শরীরের ভিতরে কী হচ্ছে। যদি মরি তাহলে পিপুলের জন্য বড়ো অস্থির মন নিয়ে যাব। আমার মনটাকে একটু শান্ত করে দাও।

একটু ঘুমোও। আমারও নানা অশান্তিতে মাথা ভালো কাজ করছে না। তোমাকে সুস্থ করে তুলতে না পারলে আমার অবস্থা কী হবে একবার ভেবে দেখেছ?

দেখেছি। আমি গেলে এ সংসারে তুমি বড়ো বালাই। কিন্তু কী করব বল, ভগবানের ওপর তো আমাদের হাত নেই।

ওভাবে বোলো না, আমার বুকের জোর-বল চলে যায়। ডাক্তার তোমাকে বেশি কথা কইতে বারণ করেছে।

কথা কইতে হয় কী সাধে। এই শেষ কথা কটা না বলে নিলেই নয়–ঋণ রেখে মরা কী ভালো?

গয়না কত ভরি আছে?

সে কী আর জানি। কিছু গয়না জামাই ভেঙে খেয়েছে। বাকিগুলো রক্ষা করতে আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। যক্ষের মতো আগলে রেখেছি এতকাল। আর কী পারব? যার ধন তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে এইবেলা।

আর কথা বোলো না। তোমার হাঁফ ধরে যাচ্ছে। গয়নার বিলিব্যবস্থা করব, চিন্তা কোরো না।

ডাক্তারকে আর ডাকতে হবে না। তুমি নিজেই বরং একটু করে হোমিও ওষুধ দাও। যা হওয়ার তাতেই হবে।

আমারও কী বুদ্ধি কাজ করছে এখন? হোমিওপ্যাথি করতে স্থির বুদ্ধি চাই। আমার তো হাত কাঁপছে। ফোঁটা বা বড়ি ফেলতে পারছি না। ওষুধও ঠিক করতে পারছি না।

ওতেই হবে। তুমি যা দেবে তাতেই আমার কাজ হবে।

আচ্ছা, তাই হবে।

দিদিমা চোখ বুজল।

পিপুলের পৃথিবী দিদিমার সঙ্গেই যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারে, দিদিমা না বাঁচলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা বড়ো কঠিন হবে।

দিদিমা ঘুমোলে দাদু তাকে নিয়ে ছাদে এল। পায়চারি করতে করতে বলল, শুধু গয়না নয়, এ বাড়ি বা সম্পত্তিতেও তোর ভাগ আছে।

করুণ গলায় পিপুল বলে, ভাগ চাই না দাদু। এ বাড়িতে আমাকে কেউ দেখতে পারে না। আমি শ্রীরামপুরে ফিরে যাব।

দাদু মাথা নেড়ে বলে, সে যাস। তবু কথাগুলো তোকে বলে রাখলাম। দিদিমা তোকে বড়ো ভালোবাসে, এখনই যদি চলে যাস তবে বুড়ি বোধহয় হার্টফেল করবে। এখন কয়েকটা দিন কষ্ট করে থাক, তোর দিদিমা একটু সুস্থ হলে আমি নিজে গিয়ে তোকে শ্রীরামপুর স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসব।

এ প্রস্তাবে আপত্তি নেই পিপুলের। দিদিমা আর দাদুকে ছেড়ে যেতে তার যে খুব ইচ্ছে করছে তাও নয়। কিন্তু এ বাড়িতে তো থাকাও যায় না। বড়ো অশান্তি তাকে নিয়ে।

দিদিমা অবশ্য বেঁচে রইল। মরতে মরতেও শেষ অবধি মরল না। পরদিন সকাল বেলায় একটুক্ষণের জন্য উঠেও বসল এবং একটু দুধ খেল। ডাক্তার এসে দেখেটেখে বলল, হার্ট অ্যাটাক বলে ভেবেছিলাম। লক্ষণও তাই ছিল। তবে বোধহয় সিরিয়াস কিছু নয়। অল্পের ওপর দিয়ে ফাঁড়া কেটে গেছে।

দাদু একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বাঁচালে ডাক্তার। লক্ষণ দেখে আমার তো হাত পা হিম হয়ে গিয়েছিল।

ডাক্তার প্রেসারের যন্ত্র আর স্টেথস্কোপ গুছিয়ে ফেলে বলল, আপনাদের বাড়িতে কী একটা হাঙ্গামা হয়েছিল কাল। তাই না? ওরকম কিছু আবার হলে কিন্তু অ্যাটকটা রেকার করবে। কোনোরকম উত্তেজনা একদম বারণ।

আর ওরকম হবে বলে মনে হয় না।

 তবু সাবধানে রাখবেন।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর দাদু দিদিমাকে বলল, নীচে শুনে এলাম, কাল রাতে নাকি স্টেশনে গিয়ে হরিপদ আর পাড়ার মাতব্বররা হরিশচন্দ্রের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মিটমাট করে এসেছে।

দিল?

না দিয়ে উপায় কী? জামাই যা একখানা খুনে ঠ্যাঙাড়েকে পাঠিয়েছিল, ভয়ে সবাই জল! দুনিয়াটা হল শক্তের ভক্ত আর নরমের যম।

টাকাটা দিল কে?

কালীপদকেই দিতে হয়েছে। মারধরে সে-ই তো পান্ডা ছিল কিনা, তবে ভয়ে সে নিজে যায়নি। হরিপদ এসে নাকি বলেছে যে, জামাই আর তার দলবল সব স্টেশনেই মাইফেল বসিয়ে ফেলেছিল। সব নাকি মদে চুর। টাকা পেয়ে জামাই নাকি হরিপদর থুতনি নেড়ে চুম খেয়ে বলেছে, যাও তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। আমার ছেলেটাকেও তোমাদের দান করে দিলাম। তার অযত্ন কোরো না, তাহলে ফের হাঙ্গামায় পড়ে যাবে।

দিদিমা চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সবই আমার কপাল। তবু নাতিটাকে তো রাখতে পারব। সেটাই আমার ঢের।

দেখো কতদিন রাখতে পার! টাকাপয়সা দিয়ে আপোশরফার ফল ভালো হয় না। টাকায় টান পড়লে জামাই ফের আসবে। ব্ল্যাকমেল বোঝো? এ হচ্ছে সেই ব্ল্যাকমেল।

কালী তার পাপের শাস্তি পাচ্ছে। আমরা কী করব বল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *