২. যুবরাজ শেঠির বিবাহ

৫.

মহাসমারোহে যুবরাজ শেঠির বিবাহ হয়ে গেল রাজকন্যা উসার্টির সঙ্গে। শেঠির অনিচ্ছা যতই আন্তরিক হোক, দেশাচার, কুপ্রথা এবং পিতা তথা সম্রাটের আদেশের সমুখে নতি স্বীকার করতেই হল তাকে।

আর বিবাহের পরেই তোড়জোড় শুরু হল গোসেন অভিযানের। অনেকেই ভেবেছিল, উসার্টিও এ-অভিযানে যুবরাজের সঙ্গিনী হবেন। কিন্তু তারা যে কতখানি ভ্রান্ত, তা হৃদয়ঙ্গম করতে দেরি হল না তাদের। উসার্টি বললেন তার প্রথম কর্তব্য হল বৃদ্ধ পিতার শুশ্রূষা। ফারাওয়ের কাছ থেকে একদিনের জন্যও দূরে যাওয়ার কথা কল্পনা করতেই পারেন না তিনি।

“বৃদ্ধ পিতা?”-ব্যঙ্গ হাসি হাসলেন শেঠি, নিভৃত কক্ষে আমার কানে–“পিতা বলে নয়, ফারাও বলেই বৃদ্ধকে চোখে চোখে রাখা উসার্টির প্রয়োজন। কখন আছেন, কখন নেই, শেষ সময় কখন এসে পড়ে, আর সে-সময়ে কে তার মুখ থেকে কী আদেশ বার করিয়ে নেয়, ঠিক কী! চোখে চোখে রাখতে হবে বই কি!”

এ-কথাও অবশ্য খুবই ঠিক যে উসার্টিকে সঙ্গে না পাওয়াটা কিছুমাত্র ক্ষোভের কারণ হয়নি যুবরাজের পক্ষে। কোনোদিনই তিনি এই স্বার্থসর্বস্ব উচ্চাশিনী নারীকে সুনজরে দেখতে পারেননি। আজ বিবাহটা হয়ে গিয়েছে বলেই যে ওঁর সম্পর্কে যুবরাজের মনোভাব পালটে যাবে, এটা কে আশা করতে পারে?

তা সঙ্গে না যান, তিনি যে যুবরাজের একান্ত শুভার্থিনী, এর একটা প্রমাণ উসার্টি দিলেন যাত্রার প্রাক্কালে। যুবরাজকে পরিয়ে দিলেন যে-কোনো অস্ত্রের অভেদ্য একটি লৌহবর্ম। আর আমায়ও দিলেন সেইরকমই অন্য একটি–’জামার ভিতরে সর্বদা এটিকে পরে রাখবে”-কড়া নির্দেশ দিলেন আমাকে। আমি অবাক হয়ে বললাম–“আমাকে কেন যুবরানি?”

“তুমিই তো এখন যুবরাজের সারাক্ষণের সাথী!”–উত্তর দিলেন উসার্টি “আর লোকচরিত্র আমি যতটা বুঝি, যুবরাজের খুব অনুরক্তও তুমি। যাচ্ছ তোমরা গোসেনে। শত্ৰুপুরী আমাদের পক্ষে। সেখানে হঠাৎ যুবরাজের বিপন্ন হয়ে পড়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। ঐ হিব্রুরা ধর্মোন্মাদ, ধর্মের নামে ওরা যে-কোনো দুষ্কর্ম করতে পারে। তাই বলছি, যুবরাজ যদি আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হন, স্বভাবতই তাকে সাহায্য করার প্রথম দায়িত্ব পড়বে তোমার উপরে। তাই তোমার আত্মরক্ষার এই ব্যবস্থা করে দিলাম, ভাল কথা, শুধু কলমই চালিয়েছ সারা জীবন? না তরোয়াল চালাতেও জান?”

‘আমি গতযুদ্ধে সৈন্যদলে যোগ দিয়েছিলাম যুবরানি! হাতাহাতি লড়াইয়ে দুই-চারটা শত্রুকে নিপাতও করেছি।”

“বেশ, বেশ! তাহলে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। মনে রেখো, যুবরাজের ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বিপদের আশঙ্কা থাকবে ওখানে। বাইরে হিব্রুরা, ঘরে আমেনমেসিস।”

‘“আ-মে-ন মেসিস?”–আমি অবাক হয়ে গেলাম।

“শেঠি অপসারিত হলে সিংহাসনের দাবিদার তো সেই!” বললেন উসার্টি।

যথাকালে আমরা পৌঁছোলাম গোসেনে। একদল সৈন্য আছে সঙ্গে। আছেন রাজপুত্র আমেনমেসিস, আর আছি আমি, এই অধম লেখক। ছাউনি পড়ল শহরের বাইরে। এদিকে শেঠি, ওদিকে আমেনমেসিস হিব্রু মুরুব্বিদের ডেকে ডেকে আলাপ আলোচনা চালাতে থাকলেন তাদের সঙ্গে। কী তাদের অসন্তোষের কারণ? কী তাদের অসুবিধা গোসেনে? কী ধরনের অত্যাচার হয় তাদের উপরে?

প্রধান অভিযোগ অবশ্য এইটাই যে ইজরায়েলীদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, বহুদূরের সরকারী খামারে বেগার খাটবার জন্য। সেখানে জুলুম হয় তাদের উপরে, মার খেতে খেতে মরেও যায় অনেকে। এছাড়াও ছোটখাটো নালিশ আছে কিছু কিছু। সরকারী কর্মচারীরা বেগারের লোক সংগ্রহ করতে বা অন্য প্রয়োজনে যখনই আসে গোসেনে, যেখানে যা পারে উৎকোচ আদায় করে, আর সুযোগ পেলেই করে নারীদের সম্ভ্রমহানি। বস্তুত ফারাওয়ের লোক যখন আসে, তখন গোটা হিব্রু সমাজটাই তটস্থ হয়ে থাকে আতঙ্কে।

দুজনের তদন্তের ধারা দুই রকম, শেঠির আর আমেনমেসিসের। শেঠির আলাপ আলোচনা ধনী-দরিদ্র সকলেরই সঙ্গে। আমেনমেসিস এদিকে বাছাই করা কয়েকজন দলপতির বক্তব্যটা শুনে নিয়েই মনে করলেন যে তার কর্তব্য শেষ হয়েছে। শেঠি এসেই খোঁজ নিয়েছিলেন সেই পয়গম্বর মুসার। যিনি মেরাপিকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র কয়েকদিন আগে ফারাওয়ের দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন, আর তারস্বরে অভিশাপ দিয়ে এসেছিলেন ফারাওকে এবং মিশরের সমস্ত জনগণকে।

পয়গম্বর নেই গোসেনে। ট্যানিস থেকেই তিনি তার সহচরকে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন নিরুদ্দেশের পথে। হিব্রুরা বলে, তিনি বনে-কান্তারে বিচরণ করছেন জাহভের অন্বেষণ করে কৰে। কবে ফিরবেন, কেউ পারে না বলতে।

শেঠি কিন্তু মুসার অন্বেষণ করছিলেন অন্য প্রয়োজনে। ইজরায়েলীদের এই ধর্ম এবং এই দেবতা সম্বন্ধে অসীম কৌতূহল জেগেছে তার মনে। গোসেনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট সুবিধা আছে সে-কৌতূহল চরিতার্থ করার। না পাওয়া যদি যায় মুসাকে, নাই বা গেল। শেঠি ডেকে পাঠালেন হিব্রু ধর্মমন্দিরের অন্যতম যাজক কোহাটকে। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর কাছ থেকে পাঠ নিতে থাকলেন ইজরায়েলীদের ধর্ম, দেবতা এবং শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পর্কে। কোহাট লোকটি সৎ, ইহুদী হিসাবে গর্ব থাকলেও বিদ্বেষ নেই মিশরীদের উপরে। আন্তরিকতার সঙ্গেই তিনি যুবরাজের সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

তদন্ত এগুচ্ছে। সেদিন কত যে লোকের সঙ্গে কত কথা যে কইতে হয়েছে যুবরাজকে, তার লেখাজোখা নেই। শ্রান্ত বিরক্ত হয়ে দিনান্তে তিনি আমাকে নিয়ে রথে চড়ে বসলেন–“চল, গ্রামাঞ্চলে বেড়িয়ে আসি।” রাজপথ থেকে রথ মাঠে নেমে পড়ল। মাঠ শুধু নামেই মাঠ, আসলে এ একটা মরুভূমি বললেই চলে, চাষ-আবাদ এতে কিছুই হয় না। হয় না বলেই রথের গতিও অবাধ, অল্পক্ষণেই আমরা শহরসীমা ছাড়িয়ে চলে গেলাম।

ওদিকে সূর্যও ডুবে আসছে। আমি মাঝে মাঝে বলছি–“এইবার চলুন, ফেরা যাক যুবরাজ?”

যুবরাজ সেকথা কানেও তুলছেন না–“কেন? তোমার কি ভয় করছে নাকি?”

“না করবে কেন যুবরাজ?”–বললাম আমি–যুবরানি বলে দিয়েছিলেন গোসেন আমাদের পক্ষে শত্ৰুপুরী। সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ যে চড়াও হবে না আমাদের উপরে, একথা নিশ্চয় করে বলা যায় কি?”

যুবরাজ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই একটা অনুচ্চ আর্তনাদ কানে এল আমাদের। যেখান দিয়ে চলেছে আমাদের রথ, তার বাঁদিকে একটা উঁচু ডাঙা জমি, কী আছে সেখানে, রথ থেকে তা চোখে পড়ে না। আর্তনাদটা এসেছে সেইখান থেকে। এবং আর্তনাদটা রমণীকণ্ঠের বলেই মনে হল।

রথ থামাতে বললেন যুবরাজ। “দুনিয়ায় দুঃখের পার নেই মানুষের। দেখা যাক, এখানে আবার কার কী হল?

আগে আগে যুবরাজ, পিছনে পিছনে আমি, সেই উঁচু ডাঙায় উঠে পড়লাম হাঁচোড়-পাঁচোড় করে। এ যেন একটা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, যতদূর দৃষ্টি চলে, একটানা খড়-ভুঁই। সেই দুইয়ের ভিতর একটি স্ত্রীলোক বসে আছে এবং কাতরাচ্ছে তখনও। তার অতি নিকটেই মস্ত এক বোঝা খড় পড়ে আছে, দড়ি দিয়ে বাঁধা।

“কে গো তুমি?”-যুবরাজ এ-কথা বলতেই স্ত্রীলোকটি চমকে চোখ তুলে তাকাল, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টাও করল একটু।

“উঠো না, উঠো না”-নিষেধ করলেন যুবরাজ–“তোমার পা কেটে রক্ত পড়ছে দেখছি।”

যুবরাজ তার পায়ের দিকেই দৃষ্টিপাত করেছেন, আমি তাকিয়েছি তার মুখের দিকে। ফলে আমার মুখ থেকেই প্রথম বেরুলো অপরিসীম বিস্ময়ের স্বগত উক্তি “এ যে ইজরায়েলের চাঁদ সেই মেরাপি দেখছি।”

“মে-রা-পি?”-যুবরাজ এতক্ষণে চিনলেন তাকে, তারপরে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলেন–“মেরাপিই বটে। হবে নাই বা কেন? এই তো তোমার দেশ! কী বল?”

“নিশ্চয় যুবরাজ! এইটাই আমার দেশ বটে। তবে দাসজাতির দেশে-বিদেশে একই অবস্থা। ট্যানিসেও হিব্রুর উপরে মিশর সরকারের অত্যাচার অব্যাহত, গোসেনেও তাই। ঐ খড়ের বোঝাই তার প্রমাণ।

“কী প্রমাণ, বুঝলাম না ভদ্রে!”–বললেন যুবরাজ।

“যখন বিদেশে ফারাওয়ের বেগার খাটতে না যাই, তখনও দেশে বসেই খাঁটি তারই বেগার। ইট বানাই কাদা শুকিয়ে। তাতে মেশাতে হয় খড়ের কুচি। সেই খড়টা আগে সরকার থেকে দেওয়া হত। এখন আর হয় না। হুকুম হয়েছে, ‘যার যার প্রয়োজন মতো খড় নিজেরা কেটে নাও সরকারী জমি থেকে। সেই খড় কাটতেই আমি এসেছিলাম। কেটে বেঁধে বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় ঐ ধারালো পাথরটাতে পা কেটে গেল।”

যুবরাজ আর দেরি করলেন না। নিজের রেশমী জামা থেকে একটা ফালি ছিঁড়ে বার করলেন চোখের পলকে, আর তাই দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন মেরাপির পায়ের ক্ষতস্থানে। হাঁটতে গেলে হয়তো ব্যান্ডেজ খুলেও যেতে পারে, এই ভয়ে নিজের একটা পিনও আটকে দিলেন তাতে। পিনটি সোনার, তার উপর দিকটার চেহারা অনেকটা মুকুটের মতো।

একথা আমি বলতে চাই না যে মেরাপি নীরবে বসে যুবরাজের এই সেবা ও সাহায্য উদাসীনভাবে গ্রহণ করছিল। ঠিক উলটো বরং। সে বিধিমতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল যুবরাজকে নিরস্ত করবার। “একী যুবরাজ! আপনি কেন–আমি কী বলে আপনাকে আমার পা স্পর্শ করতে দেব–বাঁধা-ছাঁদার দরকার নেই– আমি এমনিই বেশ হাঁটতে পারব,” ইত্যাদি ইত্যাদি কত রকম কাকুতি যে বেরুচ্ছিল তার মুখ থেকে, তার ধারাবাহিক বিবরণ দেওয়াই শক্ত।

যা হোক, মেরাপির কোনো কথায় কান না দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করলেন যুবরাজ, এবং হেসে বললেন–“ওঠো এইবার, তাকিয়ে দেখ, মিশরের রাজমুকুট তোমার পায়ের তলায়।”

ইঙ্গিতটা ঐ পিনের সম্পর্কে, যার চেহারা অনেকটা মুকুটের মতো। কিন্তু মেরাপি আঁতকে উঠল ঐ রসিকতা শুনে, আকুলভাবে বলল–“যুবরাজ! যুবরাজ! আমায় অপরাধী করবেন না।”

ও কথায় কর্ণপাত না করে যুবরাজ বললেন–“তোমার বাড়ি কতদূর?”

বিষণ্ণভাবেই মেরাপি জবাব দিল–“তা অনেক দূর। সন্ধ্যাও হয়ে এল, বোঝাটাও ভারী, তবে হ্যাঁ, আমার দেরি দেখলে কাকা খুঁজতে আসতে পারেন, আর লাবানও–“

কে লাবান? যুবরাজের প্রশ্নটার উত্তরই দিল না মেরাপি। যুবরাজও উত্তরের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন না, হাত বাড়িয়ে দিলেন মেরাপির দিকে, “আমার হাত ধরে ধরে মাঠে নামতে হবে তোমায়। রথ আছে সেখানে, তাইতে করে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”

‘যুবরাজ! যুবরাজ!”সুরটা প্রতিবাদেরই, কিন্তু এমন ভাষা মেরাপি খুঁজে পেলো না, যা দিয়ে প্রতিবাদটি সম্যক প্রকাশ করা যায়।

“অ্যানা, তুমি ভাই বোঝাটা দেখ’-এই, বলেই যুবরাজ মেরাপিকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি অগত্যা, যুবরাজের বন্ধু যখন, বন্ধুত্বের দাম দিতে হবে তো! খড়ের বোঝা ঘাড়ে করে পিছু নিলাম তাদের। উঃ, ভারী তত কম নয়! মেরাপির মতো কোমলা অবলা কী করে বুইত এটা? বাড়ি তো নিকটেও নয় বলছে।

আগে আগে রথ চলে, পিছে চলি আমি। রথে দুই জনের বেশি ধরে না। সুতরাং আমাকেই পায়দলেই যেতে হবে। এবং বোঝা মাথায় নিয়েই। তবু এই লজ্জাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও এমন কথা আমার একবারও মনে হয়নি সেদিন যে, এর চেয়ে সেই মেম্ফিসে বসে আমার নকলনবিশ করাই শ্রেয় ছিল।

মাঠ ছেড়ে রথ একটা রাস্তায় উঠল ক্রমশ। পাকা রাস্তাও নয়, চওড়া রাস্তাও নয়। রথ চলবার মতো রাস্তা তো নয়ই। পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাচ্ছে ঘোড়ারা। সারথি তাদের মাথার উপরে চাবুক ঘোরাচ্ছে সাঁই সাঁই শব্দে, কিন্তু ঘোড়াদের পিঠে সে-চাবুক বসাতে পারছে না, কারণ সে তো জানে যে মানুষের উপরেই হোক আর জন্তুর উপরেই হোক, চাবুক হাঁকানোটা একদম পছন্দ করেন না যুবরাজ।

চাঁদ উঠেছে, বেশ বড়-সড় চাঁদ একটা। তা নইলে রথের ঘোড়ার মতো আমিও পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেয়ে মরতাম। মাটির দিকে নজর রেখে সাবধানে পথ চলছি, এমন সময় পুরুষ কণ্ঠে ক্রুদ্ধ তর্জন শোনা গেল–“মেরাপি! কী হয়েছে তোমার? ঐ অচেনা লোকটার সঙ্গে রথে বসে তুমি করছ কী?”

মেরাপি বলে উঠল–“হস্‌-স্‌-স্‌! চুপ! চুপ! এ-রথ মিশর যুবরাজের। এই যে যুবরাজ রথেই আছেন–

এক মুহূর্তে বিস্ময়ে হতবাক লোকটা। কিন্তু পরক্ষণেই গর্জে উঠল–“হোক যুবরাজ! আমার বাগদত্তার সঙ্গে একা রথে কেন তিনি? নাম তুমি এক্ষুনি?”

মেরাপি আবারও হস্স্স্ করে উঠল, তারপর বলল–“নামার উপায় থাকলে উঠতামই না। আমার পা ভয়ানক কেটে গিয়েছে। গাড়িতে করেই বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। তুমি বরং এক কাজ কর, ঐ খড়ের বোঝাটা তোমার মাথায় নাও। যুবরাজের বন্ধু ওটাকে বয়ে বয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন।”

লোকটা বোঝ তুলে নিল আমার মাথা থেকে। আর নিতে গিয়েই গজগজ করে উঠল–“এই কয়গাছি খড়? এতে আমার কাজ কতটুকু এগোবে?”

আমি কাঁধে মাথায় হাত বুলোত বুলোত বললাম–“তোমার কাজ এগিয়ে দেবার জন্যই কি মেরাপি খড় কাটতে গিয়েছিলেন?”

“কেন যাবে না?”–খেঁকিয়ে উঠল লোকটা। ও আমার বাগদত্তা না? বাগদান হয়ে গেলেই মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি হয়ে গেল। হ্যাঁ, বাগান আর বিয়েতে ফারাক কমই আমাদের সমাজে।”

নিজের পাড়ায় পৌঁছে যে-বাড়িটাতে নামতে চাইল মেরাপি, সেটা তার কাকার বাড়ি। কাকা জ্যাবেজই এখন তার অভিভাবক দাঁড়িয়েছে, নাথানের মৃত্যুর পরে। ভাইঝির ডাকাডাকি শুনে জ্যাবেজ বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। হিব্রুদের মধ্যে সে বেশ বর্ধিষ্ণুঃ লোক, আর কথাবার্তায় মনে হল বেশ চতুর ব্যবসায়ীও বটে। যুবরাজের পরিচয় পেয়ে সে বিস্ময় প্রকাশ করল, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল, আবার সঙ্গে সঙ্গেই নিবেদন করে রাখল যে সে ভেড়া বিক্রি করে থাকে, মিশরী পল্টনের রসদ হিসাবে ভেড়া নিশ্চয়ই দরকার হবে যুবরাজের, যদি অন্য স্থানে না কিনে জ্যাবেজের কাছ থেকে তা কেনা হয়, সে আগের চেয়েও অনেক বেশি কৃতজ্ঞ হবে।

মেরাপি ইতিমধ্যে রথ থেকে নেমেছে, মাটিতে বসে পায়ের তলা থেকে মুকুটাকার পিনটা খুলবার চেষ্টা করছে। যুবরাজ দেখতে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন–“ও তুমি করছ কী? পিন খুললে ব্যান্ডেজ খুলে যাবে, তাতে ঘা সারতে দেরি হবে। ওটা এখন তোমার কাছেই থাকুক।”

তখন কি আর যুবরাজ জানেন যে ঐ পিন নিয়ে মেরাপির ভাবী বর লাবান হুলুস্থুল কাণ্ড করবে একটা? সে আগে খড়ের বোঝাটা নিজের বাড়িতে রেখে এসেছে, তারপর মেরাপির খোঁজ নিতে এসেছে জ্যাবেজের বাড়িতে। এসে যখন পিনের বৃত্তান্ত শুনল, সে রেগে আগুন। তার ধারণা হয়ে গেল, ব্যান্ডেজ বাঁধা অছিলা মাত্র, ঐ সূত্রে যুবরাজ একটা উপহার গছিয়ে গিয়েছেন তার বাগদত্তাকে। এসব কথা পরদিন আমরা শুনলাম জ্যাবেজের প্রমুখাৎ, যখন সে ভেড়ার দাম নিতে মিশরী ছাউনিতে এল।

শাবানের রাগারাগির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে জ্যাবেজ সবিনয়ে বলল “লাবান অতি বাগী লোক, যুবরাজ। যতক্ষণ আপনি আপনার সৈন্যদের ভিতর আছেন, ততক্ষণ অবশ্য তার সাধ্য নেই আপনার কোনো ক্ষতি করবার। কিন্তু আপনি তো অরক্ষিত অবস্থাতেও ঘোরাফেরা করেন দেখছি। আমার পক্ষে অবশ্য আপনাকে উপদেশ দিতে যাওয়া ধৃষ্টতাই হবে শুধু। কিন্তু লাবানকে আপনি জানেন না, আমি জানি। আর শুধু লাবানই বা কেন, গোসেনের সব হিব্রুই মিশরীদের উপরে খাপ্পা, সুযোগ পেলে তারা আপনাকে খুনও করতে পারে।”

যুবরাজ হেসেই উড়িয়ে দিলেন জ্যাবেজের কথা, যদিও তার সদিচ্ছা ও সদুপদেশের জন্য ধন্যবাদ দিতেও ভুললেন না।

তদন্ত শেষ হয়েছে। আমেনমেসিস নিত্য তাগাদা দিচ্ছেন–“এইবার ট্যানিস ফিরে চল।” অবশেষে যুবরাজ একটা দিন ধার্য করে দিলেন ফিরে যাওয়ার। অর্ধেক সৈন্য নিয়ে আমেনমেসিস যাবেন সকালবেলায়, গিয়ে ছাউনি ফেলবেন গোসেন সীমান্তের গিরিমালার ওধারে। যুবরাজ নিজে বেরুবেন অপরাহে বাকি অর্ধেক সৈন্য নিয়ে, গিয়ে ছাউনিতে পৌঁছোবেন সন্ধ্যাবেলায়। এ-বন্দোবস্তের হেতু কী, কে তা জিজ্ঞাসা করবে যুবরাজকে? রাজা বা রাজপুত্র যদি নিজের খেয়াল খুশিমতো কাজ করতে না পারেন, তা হলে লাভ কী তাদের রাজা বা রাজপুত্র হয়ে?

যাত্রার আগের রাতে কিন্তু একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে গেল। অতি সহজেই বিয়োগান্ত হয়ে পড়তে পারত, যুবরাজের প্রাণ রক্ষা হল অল্পের জন্যই। সেই যাজক কোহাট! যিনি ইজরায়েলী ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে দুই-চার কথা যুবরাজকে শেখাচ্ছিলেন এই কয়েকদিন ধরে, তিনি নিমন্ত্রণ করলেন–“যাওয়ার আগে যুবরাজ আমাদের ধর্মমন্দির দেখে যান একটিবার। সান্ধ্য উপাসনার সময় এলে উপাসনার পদ্ধতিও লক্ষ্য করতে পারবেন বাইরে থেকে।”

বলা বাহুল্য, এসব ব্যাপারে যুবরাজের কৌতূহল অপরিসীম, তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। গোসেন ত্যাগের আগের সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে উপস্থিতও হলেন গিয়ে ইজরায়েলী ধর্মমন্দিরে।

অনর্থ ঘটল অপ্রত্যাশিতভাবে। কোহাট বলে রেখেছিলেন, একমাত্র গর্ভগৃহ অর্থাৎ জাহভের অধিষ্ঠান বেদী ছাড়া আর সব কিছুই সবাই দেখতে পারে, তাতে বাধানিষেধ কিছু নেই। এখন সেই অধিষ্ঠান বেদীই দৈবাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হয়ে গেল আমাদের।

একটা প্রায়ান্ধকার বারান্দা দিয়ে কোহাট আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ হোঁচট খেলেন যুবরাজ। পড়ে যেতে যেতে তিনি আঁকড়ে ধরলেন পাশের দেয়ালের গায়ে লম্বমান একটা পর্দা। তার টানে পর্দাটা পড়ল ছিঁড়ে। আমরা দেখতে পেলাম, ভিতরে একখানা ঘর, সেই ঘরও প্রায়ান্ধকার, আর সেই অন্ধকারের মধ্যে উপাসনারত অবস্থায় অনেকগুলি লোক।

পর্দা যখন ছিঁড়ে পড়ল, টু শব্দটি কোথাও নেই এক মুহূর্ত। কিন্তু সেই এক মুহূর্ত পরে সেই অন্ধকার ঘরে যেন শুরু হয়ে গেল একটা প্রেতনৃত্য। উপাসকেরা সবাই চিৎকার করছে, লাফাচ্ছে, “ধর্মের অপমান করেছে ঐ পামর, ওকে হত্যা কর” বলে শাসাচ্ছে।

কোহাট আগলে দাঁড়িয়েছেন যুবরাজকে, ক্রুদ্ধ উপাসকদের বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে পর্দাটা দৈবাই ছিঁড়ে পড়েছে, এটা ইচ্ছাকৃত ধর্মাবমাননা নয় মোটেই। নাঃ, কিছুতেই তাদের ক্রোধ শান্ত হয় না। তারা তারস্বরে চাঁচাচ্ছে–“হত্যা করব। রক্ত নেব! যুবরাজ বলে ক্ষমা করব না। ধর্মের অপমান করে কেউ নিস্তার পাবে না।”

সে বিপদে আমরা রক্ষা পেলাম শুধু জ্যাবেজের বেনিয়া বুদ্ধির দৌলতে। সে সবাইকে বলল–“অপমান যা হওয়ার, তা হয়েছে জাহভের। সাজা যদি ওর প্রাপ্য হয়, জাহতেই তা দেবেন। আমরা কেন নিজেদের মাথায় দায়িত্ব নিতে যাই? এস, আমরা সবাই মিলে একমনে নীরবে ভগবানকে ডাকি এই বলে যে বিধর্মী ঐ মিশরী যুবরাজ যদি ইচ্ছা করে ধর্মস্থান কলুষিত করে থাকেন, তাহলে জাহভের ক্রোধাগ্নি তাকে এক্ষুনি দগ্ধ করুক। আর যদি তার অপরাধটা অনিচ্ছাকৃত হয়ে থাকে, তবে তাকে যেন সে ক্রোধাগ্নি স্পর্শ না করে।

এটা মোটের উপর মনঃপূত হল অনেকেরই। জ্যাবেজ এক, দুই করে যাট পর্যন্ত শুনে যাবে জোরে জোরে। ষাট গুনবার পরেও যদি বজ্রাঘাতে যুবরাজ মারা না পড়েন, তবে বুঝতে হবে যে তিনি নির্দোষ, ছাড়া পাবেন তিনি।

সেই অনুসারেই হল ব্যবস্থা। ইজরায়েলী উপাসকেরা নীরবে বসে আছে অন্ধকারে, একমনে জাহভেকে ডাকছে–“দোষীর সাজা দাও, নির্দোষকে মুক্তি দাও, হে ভগবান!” আর ওদিকে জ্যাবেজ থেমে থেমে ধীরে ধীরে গুনে যাচ্ছে “এক, দুই, তিন, দশ, বারো—”

সে কী উত্তেজনা! জীবন-মৃত্যু নির্ভর করছে যে কিসের উপরে, তা আমরা বুঝতে পারছি না, সমস্ত ব্যাপারটাই লাগছে যেন অবাস্তব, আজগুবি, ভূতুড়ে । কী হবে? ষাট গোনা শেষ হওয়া মাত্রই কি বর্জ নেমে আসবে ছাদ ফুঁড়ে? ভাবতেও যে হাসি পায়। হাসি? কথাটা পরিপূর্ণ সত্য হল না। হাসি অবশ্য পায়, কিন্তু সেই সঙ্গেই কপাল দিয়ে ঘামও ঝরে।

যা হোক, গোনা শেষ হল জ্যাবেজের, বজ্র নেমে এল না, কোনো চাঞ্চলেরই লক্ষণ দেখা গেল না জাহভের অধিষ্ঠান বেদীতে। তখন কোহাট ঘোষণা করলেন, মিশরীরা দোষী নয়, তারা যেতে পারে নিরাপদে ফিরে।

পরদিন ভোরবেলাতেই আমেনমেসিস অর্ধ সৈন্য নিয়ে ট্যানিসের পথ ধরলেন। পূর্ব রাত্রিতে ধর্মমন্দিরে যা ঘটেছিল, তা বোধ হয় তখনও তার কর্ণগোচর হয়নি। অন্ততপক্ষে তিনি কোনো উত্তেজনার বা দুশ্চিন্তার ভাব দেখলেন না বিদায় বেলায়। দেখাবেনই বা কেন? অর্ধেক সৈন্য তো রইলই যুবরাজের সঙ্গে। ইজরায়েলীরা যদি কোনো বেয়াড়া ব্যবহার করে, তাদের দমন করবার মতো লোকবল তো যুবরাজের রইলই!

কিন্তু কী আশ্চর্য! আমেনমেসিস যাত্রা করবার দুই দণ্ড পরেই যুবরাজ হুকুম জারি করলেন–“অ্যানা, সুযোগ পেয়েছি তো নিরিবিলি পর্যটনের আনন্দ উপভোগ করে নিই একটু, বাকি সৈন্যও সব রওনা করে দাও। তুমি আর আমি একখানি রথ নিয়ে দুপুরের পর রওনা হব গায়ে হাওয়া লাগাতে লাগাতে।”

“বলেন কী যুবরাজ? মাত্র আমরা দুইজন? শত্ৰুপুরী, জানেন তো? যুবরানি বলেছিলেন শত্ৰুপুরী–” প্রতিবাদ না করে পারলাম না আমি।

‘হয় যদি শত্ৰুপুরী তো হোক না। যুবরানিরই দেওয়া লৌহবর্ম আমার গায়েও আছে, তোমার গায়েও আছে। তা সত্ত্বেও আমরা কি এই চাষার দলকে ভয় পাব নাকি? গোটা চারেক ভৃত্য সঙ্গে রাখতে পার। সীমান্তের পাহাড়ে রথ অনেক সময় টেনে তুলতে বা নামাতে হয়, আসার সময় দেখেছ তো?”

আদেশ অলঙ্ঘ্য। তবু আমি ওরই ভিতর কারচুপি করলাম একটু। চারজন ভৃত্য না নিয়ে নিলাম চারজন পাকা সৈনিক, তারা অবশ্য যাবে ভৃত্য পরিচয়েই। আর বিশ্বাসী একজন সৈন্যাধ্যক্ষকে বললাম, দুশো সৈনিক নিয়ে আপাতত সে শহরে কোথাও লুকিয়ে থাকুক, যুবরাজ রওনা হয়ে যাওয়ার পরে সে অনুসরণ করবে এরকম দূরত্ব বজায় রেখে, যাতে যুবরাজ জানতে না পারেন যে তারা রয়েছে পিছনে।

জানি না কোন দেবতার প্রেরণায় এই কাজ দুটি আমি করেছিলাম। তারই দরুন জীবনরক্ষা হল যুবরাজের। তারই দরুন এবং মেরাপির দরুন।

গোসেন সীমান্তে এক দুর্গম পার্বত্য প্রদেশ। তার ভিতর দিয়ে পথ অতি সরু ও বন্ধুর। অনেক জায়গাতেই দুই ধারে খাড়া পাহাড়। পথের প্রান্তে সে পথ আবার মোড় ঘুরেছে একটা। এমনিই মোড় যে তার ওদিকে কী হচ্ছে, তা এদিক থেকে ঠাহর পাওয়া যায় না। আমরা সেই মোড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছি যখন, দেখলাম যে পাহাড়ের উপর থেকে ছুটতে ছুটতে নেমে আসছে এক তরুণী। সে মেরাপি।

“যাবেন না, যাবেন না। মোড় ঘুরবেন না। ও পিঠেই শত্রু। হত্যা করবে আপনাকে।”

“কেন? হত্যা করবে কেন?”

“লাবান। তার হয়েছে ঈর্ষা। আর ইজরায়েলী ধর্মোন্মাদ কিছুসংখ্যক। কাল জাহভের বজ্রে আপনি যে দগ্ধ হননি, এতে তারা অখুশি। দেবতার ভুল তারা নিজেরা শুধরে দিতে চায়।”

মোড়ের ওধার থেকে গুপ্তঘাতকেরা ইতিমধ্যে মেরাপিকে দেখতে পেয়েছে গিরিসানুতে, তাকে কথা কইতেও শুনেছে আমাদের সঙ্গে। তাদের ষড়যন্ত্রের কথা যে আর গোপন নেই, তা বুঝতে পেরে অবিলম্বে আক্রমণ করাই তারা সাব্যস্ত করল। গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে গোটা চল্লিশ হিংস্র ইজরায়েলী মোড় ঘুরে এসে ধাবিত হল আমাদের দিকে। যুবরাজ আদেশ দিলেন–“রথ ঘোরাও সারথি।”

পথ অতি সংকীর্ণ, রথ ঘুরিয়ে উলটো মুখে চালানো সম্ভব হল না আর। তবে একটা উপকার হল ঘোরাতে গিয়ে, রথখানা আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল গিরিসংকট একেবারে রুদ্ধ করে, সেটা না টপকে আততায়ীরা আর পৌঁছোতে পারবে না আমাদের কাছে। ভৃত্যবেশে যে চারজন দক্ষ সৈনিক আমাদের সঙ্গে এসেছিল, তারা রথের তলা থেকেই লুক্কায়িত অস্ত্রশস্ত্র টেনে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে উঠল সেই রথের উপরে। তাদের সঙ্গে আগে বোঝাঁপড়া না করে শত্ৰুরা আর রথের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করতে পারছে না।

দলে অবশ্য জনা চল্লিশ ওরা। ভোলা জায়গায় আমাদের পেলে চারদিক থেকে বেড় দিয়ে ওরা নিমেষে আমাদের কচুকাটা করে ফেলতে পারত। সেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমরা রক্ষা পেয়ে গেছি মেরাপির কৃপায় । এখন উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা খুব অনায়াসসাধ্য নয় ওদের পক্ষে। কারণ গিরিপথ অতি সংকীর্ণ, পাশাপাশি চারজনের বেশি লোক সেখানে দাঁড়াতেই পারবে না, তা-লড়াই করা তো দূরের কথা।

সে-অসুবিধা যে কত মর্মান্তিক, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে আততায়ীরা। লোকবল তাদের কোনো উপকারেই আসছে না। এদিকে চার, ওদিকে চার, সমানে সমানে যুদ্ধ। তাও আমাদের সৈনিকেরা আবার পেশাদার সৈনিকইইজরায়েলীরা বলবান পুরুষ হলেও অস্ত্রধারণে অভ্যস্ত নয়। তার উপরেও বিবেচনা করতে হবে–আমাদের সৈনিকেরা আছে রথের উপরে, শত্রুরা আছে নীচে! হানাহানির ক্ষেত্রে নীচের লোকেরা যে অসুবিধায় পড়বে, তাতে সন্দেহ কী!

এদিকে রথ যে-মুহূর্তে আড়াআড়ি আটকে গেল গিরিপথে, আমি সারথিকে ছুটিয়ে দিয়েছি পিছন পানে–“দুশো সৈনিক আছে ওদিকে। রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাও, রুদ্ধশ্বাসে তাদের ছুটে আসতে বল।”

যুদ্ধ চলছে। চারজনের বিরুদ্ধে চারজন। ইজরায়েলীরা পড়ছে, হতাহত হয়ে। কিন্তু যতই দক্ষ সৈনিক হোক, আমাদের চারজনও রক্তমাংসের মানুষ তো। তারাও আহত হচ্ছে বই কি! অবশেষে ধরাশায়ী হল তাদের দুইজন। অমনি তাদের শূন্যস্থান দিয়ে লাফিয়ে ভিতরে এসে পড়ল দুটো ইজরায়েলী। তাদের বাধা দিতে এবার এগিয়ে গেলাম যুবরাজ আর আমি। আমার শত্রুকে আমি বধ করলাম অক্লেশে। যুবরাজও অক্লেশেই পারতেন তাঁর আততায়ীকে খতম করতে। কারণ উসার্টির লৌহবর্মের কল্যাণে আমাদের দেহ তত অস্ত্রের অভেদ্য!

পারতেন, কিন্তু পারলেন না অন্য কারণে। তার প্রতিপক্ষটা ছিল একটা দৈত্যকার প্রকাণ্ড মানুষ। অথচ যুবরাজ মোটামুটি বলবান পুরুষ হলেও কলেবরের দিক দিয়ে তাকে কৃশই বলা যায়। আততায়ী যখন লাফিয়ে পড়ল তার উপরে, তার দেহের ভারেই যুবরাজ মাটিতে পড়ে গেলেন, আর শত্রু দুই হাতে তার গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। ওদিকে আমাকে তখন নতুন এক শত্রু এসে আক্রমণ করেছে, আমি যে যুবরাজকে সাহায্য করতে আসব, এমন উপায় নেই।

আমার দ্বিতীয় শত্রুও যখন পড়ে গেল আমার পায়ের তলায়, আমি যুবরাজের দিকে চাইবার সময় পেলাম শুধু তখনই। চাইলাম ভয়ে ভয়ে। এই ভয় যে হয়ত যুবরাজকে মৃত অবস্থাতেই দেখতে পাব। এতক্ষণ কি আর তার দম আটকে যেতে বাকি আছে?

কিন্তু যা দেখলাম, তা দেখবার আশা করিনি। কল্পনা করতেই পারিনি, যুবরাজের দেহে প্রাণ আছে কিনা তখনও, তা অবশ্য হঠাৎ বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তিনি তখনও ধরাশায়ী, দৈত্যাকার শত্রুটা তখনও চেপে ধরে আছে তার গলা। কিন্তু সেই দৈত্যের মাথায় উপরে নেমে আসছে, নেমে এল এক বিশাল তরোয়াল। দুই হাতে উঁচু করে ধরে সেই তরোয়াল তার মাথায় বসিয়ে দিল এক কোমলা রমণী।

সে-রমণী মেরাপি।

আর ঐ যে অদূরে বহুকণ্ঠের জয়ধ্বনি শোনা যায়, ও আমাদেরই সেনার জয়ধ্বনি, পার্শ্ববর্তী সেই দুইশো মিশরীর।

.

৬.

যুবরাজ শেঠির গোসেন পরিদর্শনে মিশরের ইতিহাসটারই মোড় ঘুরিয়ে দিল। সেই সঙ্গে একটা সাময়িক বিপর্যয় এনে দিল তার ব্যক্তিগত জীবনেও।

প্রথমেই বলে রাখা যাক, মেরাপিকে যুবরাজ সঙ্গে আনতেই বাধ্য হয়েছেন। কারণ তাকে রক্ষা করতে গিয়েই সে হয়ে পড়েছে জাতির ও ধর্মের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী বিদ্রোহিনী, গোসেনে থাকলে তার ভাগ্যে অশেষ দুঃখ তো আছেই, এমন কি তার জীবন যাওয়ারও বাধা নেই কিছু। নিয়ে এসেছেন সাথে, তাকে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের প্রাসাদ উদ্যানের এক বিশ্রামভবনে, সেখানে নিজের কয়েকটি পরিচারিকা নিয়ে সে স্বতন্ত্রভাবে থাকে।

ইতিমধ্যে রাজসভায় গিয়ে যুবরাজ ও আমেনমেসিস দুজনেই প্রণিপাত জানিয়ে এসেছেন ফারাওকে, স্বতন্ত্রভাবে দুজনে দুটো বিবরণী দাখিল করেছেন গোসেন সম্পর্কে। ঐ বিবরণ সংগ্রহ করার জন্যই তো তাদের পাঠানো হয়েছিল গোসেনে।

সব সৈন্য আগেভাগে পাঠিয়ে দিয়ে একা পিছনে পিছনে আসছিলেন যুবরাজ, এবং সেই সুযোগ নিয়ে ইজরায়েলীরা চেষ্টা করেছিল যুবরাজকে হত্যা করতে, একথা শুনে ফারাও যুবরাজকে তিরস্কার করলেন না। কিন্তু আমাকে করলেন পুরস্কৃত। একটি রত্নহার আমায় খুলে দিলেন নিজের কণ্ঠ থেকে, আর আমাকে উপাধি দিলেন রাজবন্ধু। এ-পদবীর অধিকারীরা সর্বদা সর্বক্ষেত্রে দরবারে আসন পাওয়ার অধিকারী।

যুবরাজকে তিরস্কার করলেন না, উলটে প্রসন্ন হাস্যে অভিষিক্ত করলেন তাকে। “এই তত সিংহপুরুষের মতো কাজ! সাহস যার নেই, সে সিংহাসনে বসে করবে কী?” তা ছাড়াও তিনি বললেন—”ইজরায়েলীরা যে কত বড় নরাধম, তাদের এই সর্বশেষ আচরণেই তা প্রকাশ পেয়েছে। এবার আমি যদি তাদের ঝাড়েবংশে কোতল করি, কেউ নিন্দা করতে পারবে না আমায়। আশা করি, সেই রকম সুপারিশই করেছ তোমরা তোমাদের বিবরণীতে।”–এই শেষ কথাটা বলার সময়ে ফারাও, শেঠি ও আমেনমেসিস উভয়ের মুখের দিকেই চাইলেন।

আমেনমেসিস জবাব দিলেন ফারাওয়ের মুখের কথা মুখ থেকে না খসতেই। “নিশ্চয়, ফারাও, তাতেও কি আর সন্দেহ থাকতে পারে? পাঁচশো বছর ধরে ওরা পরম সুখে বাস করছে মিশরে। এসেছিল মুষ্টিমেয় দুই-একশো লোক, এখন ওরা লক্ষাধিক। এসেছিল ভিখারী বেশে, এখন ওরা জনে জনে বিত্তবান। আর আজ দেখুন কিনা, কী কৃতঘ্ন ওরা, বিনা কারণে ওরা হত্যা করতে গিয়েছিল মিশর-সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে। ইজরায়েলী বংশে বাতি দিতে কাউকে যেন আর না রাখেন ফারাও।”

কিন্তু শেঠি জবাব দিলেন অনেক পরে বিষঃ-দৃঢ় সুরে–“আমাকে হত্যার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেটা অল্প কয়েকজন ধর্মোন্মাদের কাজ। তার জন্য সমগ্র জাতিটাকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত হবে না। যারা দোষী ছিল, তারা অনেকেই হতাহত হয়েছে। কাজেই চরম দণ্ড বলতে গেলে হয়েই গিয়েছে তাদের। অন্য সব ইজরায়েলীকে খগের মুখে নিক্ষেপ করার কোনো যুক্তি আমি দেখতে পাইনি, করিনিও সে-রকম সুপারিশ।” ফারাও বিস্মিত, বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কী রকম সুপারিশ তাহলে করেছ তুমি? ওদের জনে জনে মিষ্টান্ন খাওয়াবার?”

“না, সম্রাট, অতটা নয়”–মৃদুস্বরে জবাব দিলেন শেঠি–“শুধু এইটুকু বলেছি যে যুগ যুগ ধরে ওদের পয়গম্বরেরা যে দাবি করে আসছেন, সেইটি মঞ্জুরও করা হোক কালবিলম্ব না করে। ওদের যেতে দেওয়া হোক মিশর ছেড়ে। যে দেশের মানুষ ওরা, যে দেশে যেতে চাইছে ওরা, চলে যাক সেই দেশেই। ওরা মিশরে থাকলে মিশরের কী লাভ? ফসল কেটে দেবে? ইট বানিয়ে দেবে? কেন, সে-সব কাজ কি মিশরীরা করতে জানে না নাকি? ওদের রেখে লাভ কারও হচ্ছে না, না আমাদের, না ওদের। ওরা শক্তি বৃদ্ধি করছে না মিশরের, মিশরকে দুর্বল করে ফেলছে দিন দিন।”

“এইসব তুমি লিখেছ তোমার বিবরণীতে?”–ফারাও যেন তখন ক্রুদ্ধ সিংহের মতে ফুঁসছেন।

“ফারাও পড়ে দেখবেন অবশ্য–“ শান্ত ভাবেই জবাব দিলেন শেঠি।

“পড়ে অবশ্যই দেখব। কিন্তু সত্যই যদি এইসব সুপারিশই তুমি করে থাক, তা হলে তা যে আমি গ্রহণ করব না, তা তুমি এখনই জেনে যেতে পার। কারও সুপারিশে লক্ষাধিক দাসকে মুক্তি দেব না কদাচ।”

“আমার মত আমি জানিয়েছি ফারাওকে। সে-মত অনুযায়ী কাজ করা না করা আপনার ইচ্ছা–“ বললেন শেঠি।

“অবশ্যই। কিন্তু ঐ কথা বলেই তুমি রেহাই পাবে না। তোমার এই বিবরণী প্রত্যাহার করে একটা নতুন বিবরণী তোমায় পেশ করতে হবে! উঁচু স্তরের রাজনীতি সম্পর্কে ফারাও এবং তাঁর উত্তরাধিকারীর মধ্যে দুই মত থাকবে, এটা বাঞ্ছনীয় নয়, এটা এদেশের প্রথাও নয়। তুমি এখন বিশ্রাম কর গিয়ে। ধীরভাবে চিন্তা করে কর্তব্য স্থির কর।”

শেঠি গম্ভীর, আমেনমেসিস উৎফুল্ল, উসার্টি ক্রুদ্ধ। এই অবস্থায় সভাভঙ্গ হল সেদিন। আমেনমেসিস উৎফুল্ল। তার কারণ, ফারাও এবং শেঠি দুজন জেদী লোক। এ-দুইজনের ভিতর যদি মতদ্বৈধ হয়, মতদ্বৈধ যদি কলহে পর্যবসিত হয়, তাহলে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে, এমন কি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিতও হতে পারেন শেঠি। আর শেঠি বঞ্চিত হওয়া মানেই তো আমেনমেসিসের ভাগ্যোদয়! সিংহাসনের পরবর্তী দাবিদার তো আমেনমেসিসই!

উসার্টি ক্রুদ্ধ তার কারণও ঐ একই। এ-ব্যাপারের পরিণাম যদি হয় শেঠির ভাগ্যবিপর্যয়, তাতে ক্ষতি তত উসার্টিরই। অর্ধ সিংহাসন হারাতে হবে তাকে। ফারাও পদে অধিষ্ঠিত হন যদি আমেনমেসিস, শেঠির স্ত্রীর তো আর কোনো অধিকার থাকবে না সিংহাসনের উপরে।

শেঠি দরবারে ছিলেন গম্ভীর, কিন্তু গৃহে ফিরতেই স্বাভাবিক সদানন্দ ভাবটি তার ফিরে এল। হালকা ভাবে কথাবার্তা কইতে লাগলেন আমার সঙ্গে, পুরোনো পুঁথিপত্র সম্পর্কে। আমি অবাক। ফারাওয়ের ক্রোধ কি শেঠির বিবেচনায় অগ্রাহ্য করার মতোই বস্তু? সিংহাসনের উত্তরাধিকার কি মূল্যহীন তার চোখে? প্রথম যেদিন আমি দেখেছিলাম শেঠিকে, সেদিনই তার ভিতরে আবিষ্কার করেছিলাম এক বৈরাগী রাজর্ষিকে! আজ আবার সেই আবিষ্কারই নতুন করে করলাম যেন। সুখে-দুঃখে সমজ্ঞানী এই স্থিতধী পুরুষ, সাধারণ স্তরের মানুষ ইনি নন।

আমাদের পুঁথিপত্রের আলোচনায় হঠাৎ কিন্তু, ছেদ পড়ে গেল অতি অপ্রত্যাশিতভাবে। ভিতর মহল থেকে মেরাপি এল এক আবেদন নিয়ে ‘যুবরাজের অনুমতি হলে আমি একটা বাজি ধরতে চাই।”

“বা-জি?”- স্থিতধী পুরুষ শেঠিও বিস্ময়ে হাঁ করে ফেললেন এককথায়।

“হাঁ, বাজি। এই বাজি আমি ধরব যে মিশরের শ্রেষ্ঠ দেবতা আমন-রা, তার নিজের মন্দিরে বসেও আমার কোনো অনিষ্ট করতে পারবেন না। উপরন্তু আমিই করব তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত।”

“তুমি?”-এবারও একটার বেশি শব্দ যোগালোনা শেঠির মুখে।

‘‘আমি, মানে-বাহ্যত আমনের সমুখে আমিই দাঁড়াব তার প্রতিপক্ষ হয়ে। কিন্তু আসলে আমার ভিতর দিয়ে কাজ করবেন আমার দেবতা, ভগবান জাহভে।”

“কী করে জানলে যে জাহভের আবেশ হবে তোমার উপরে?”

“আপনি তো অনুমতি দিয়েছিলেন যে আমার সঙ্গে কেউ সাক্ষাৎ করতে চাইলে তাকে দেখা দেওয়ার পক্ষে কোনো বাধা আমার নেই। আমার কাকা এসেছিলেন- জ্যাবেজ। তাকে দিয়েই ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা ঐ বার্তা পাঠিয়েছেন আমাকে। আমি তাদেরই কথার পুনরাবৃত্তি করছি-হয় আমি আমনের মূর্তি চূর্ণ করে ফেলব জাহভের শক্তিতে, নয় তো আমার জীবন বিসর্জন দেব আমনের বোষে।”

“বাজিটা কিছু অসম নয়, কী বল আনা?’-এতক্ষণে তার স্বাভাবিক নিরাসক্ত বাচন-ভঙ্গি ফিরে পেয়েছেন যুবরাজ–“একদিকে মূর্তি, অন্যদিকে প্রাণ।” তারপর মেপির দিকে ফিরে যুবরাজ তেমনি হালকা সুরেই বললেন–“তা তোমার পয়গম্বরদের আদেশ তুমি পালন করবে বই কি? আমন-রার আমিই প্রতিনিধি ও সেবাইত। আমি প্রধান পূজারীকে খবর দিচ্ছি–আজ রাত্রেই যাতে তোমাকে আমনের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়।”

মেরাপি চলে গেল তার বিশ্রামভবনে, পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, সারাদিন সে উপবাস থেকে জাহভের আরাধনা করেছিল সেদিন নিজেকে শুচিশুদ্ধ করে তুলবার জন্য। যাতে ভগবানের অধিষ্ঠানের যোগ্য আসন হয়ে উঠতে পারে তার হৃদয়।

রাত্রি দ্বিপ্রহরে এই বাজির অনুষ্ঠান হবে। কী জানি কাদের দ্বারা বাজির ব্যাপারটা প্রচার হয়ে পড়েছে শহরে। সারা শহর ভেঙে পড়েছে আমন মন্দিরে। অবশ্য মন্দিরের হাতার ভিতরে কেউ ঢুকতে পারছে না, মন্দিরের দ্বারে দ্বারে সশস্ত্র সান্ত্রী বসেছে আজ। জনতা ভিড় করেছে বাইরে বাইরে, একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সহস্র কণ্ঠের। আমনের স্তুতিবাদ, ইজরায়েলীদের উপরে অভিশাপ, স্পর্ধিত মেরাপির অকুণ্ঠ নিন্দাবাদে সবাই মুখর।

মন্দিরের গর্ভগৃহে আমন-রার অতিকায় পাষাণ মূর্তি, কুটিভয়াল মুখ তার, ভঙ্গি তার নিষ্করুণ।

বিগ্রহের সমুখে এবং দুই পাশে লম্বমান রেখায় দণ্ডায়মান প্রধান পূজারী রয় এবং তার সহকারী অন্য পূজারীবৃন্দ। একটু স্বতন্ত্রভাবে দৃপ্তশিরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধান জাদুকর ‘খারেব’ পদবীধারী কাই। তারও সঙ্গে জাদুবিদ সহকারী দশ-বিশজন।

বিগ্রহের ঠিক সমুখে, পূজারী জাদুকরদের থেকে দূরে এক ক্ষীণ রমণীকে দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অনুজ্জ্বল আলোকেও তার মুখ ও মূর্তি এক অতি রহস্যময় আভায় মণ্ডিত। বলা বাহুল্য, সে-রমণী মেরাপি ছাড়া আর কেউ নয়। যুবরাজ আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পাশের দিকের এক স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে। এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে আসল মূর্তিকে আর মেরাপিকে সমান ভাবে লক্ষ্য করা যায়।

যুবরাজকে আমনের প্রতিনিধি হিসাবে তো থাকতেই হবে উপস্থিত এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে। আর আমি? আমি উপস্থিত থাকবার সুযোগ পেয়েছি প্রতিনিধির সহকারী হিসাবে।

বাইরে যতই কলরব থাকুক, মন্দিরের ভিতর সব নিস্তব্ধ। যে যখন কথা কইছে, কানে কানে কইছে ফিসফিস করে। একটা নিদারুণ কিছু ঘটবে, এই প্রত্যাশায় সবাই অধীর। নেপথ্যে কোথাও একটা ঐকতান বাজছে নিচু পর্দায়। সে-তালে আনন্দের বদলে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে শ্রোতার প্রাণে।

অকস্মাৎ একটা প্রচণ্ড আওয়াজে চমকে উঠলাম আমরা। কী এ আওয়াজ? কোনো অনুমানে পৌঁছোবার আগেই একটা বিদ্যুৎ চমকে গেল মন্দিরের মধ্যে চকিতের জন্য। আর প্রধান পূজারী রয় মেরাপির সমুখে দাঁড়িয়ে গম্ভীর বিরস কণ্ঠে বললেন–“ইজরায়েল-দুহিতা! তুমি কী কথা বলবার জন্য এই রজনীতে দেবাদিদেব আমন-রার সাক্ষাৎপ্রার্থিনী হয়েছ?”

মেরাপি জবাব দিল ধীর কিন্তু দৃপ্ত কণ্ঠে–“এই কথা বলবার জন্য যে আমন রার দেবাদিদেব নন, আসলে কোনো দেৰতাই নন তিনি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র দেবতা, একমাত্র ভগবান হচ্ছেন প্রভু জাহভে, আমরা ইজরায়েলীরা যাঁর পূজা করি। এই পরম সত্য কথার প্রতিবাদ যদি করতে চান আমন-রা, তিনি তা করতে পারেন, আমাকে নিহত করে। আমি এই দাঁড়িয়ে আছি আমনের সমুখে, আমন পরিচয় দিন নিজের শক্তির।”

মেরাপি তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই বিকট আওয়াজটা গমগম করে বেজে উঠল সারা মন্দিরে। আমাদের মনে হল সারা মন্দিরটা যেন থরথর করে কাঁপছে। সবগুলো আলো হঠাৎ নিষ্প্রভ হয়ে গেল, প্রায়ান্ধকার মন্দিরে আমনের পাষাণ মূর্তি যেন দুলতে লাগল মৃদু মন্থর তালে, তার বাহু আর বক্ষে যেন সজীব মাংসপেশী সব ফুলে ফুলে উঠতে লাগল অদম্য আবেগে। পুরোহিতেরা সমস্বরে স্তোত্রগান শুরু করে দিল–“জাগো দেবতা আমন-রা, অবিশ্বাসীকে ধ্বংস কর, ধ্বংস কর, ধ্বংস কর।”

একি আমাদের দৃষ্টির বিভ্রম? সামনের পাষাণ বাহু দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হচ্ছে ক্রমশ, প্রসারিত হচ্ছে মেরাপির দিকে, মেরাপি তবু দাঁড়িয়ে আছে, দৃপ্তশিরে, মুখে তার অবজ্ঞার মৃদু হাসি। পাষাণ বাহু ক্রমে স্পর্শ করল মেরাপিকে, যেন তার কণ্ঠনলী চেপে ধরতে গেল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করে সে-বাহু নেমে এল মেরাপির বুকের কাছে। বুকে ছিল একটা সোনার পিন লাগানো, টেনে সেইটি ছিঁড়ে নিল পরিচ্ছদ থেকে ফেলে দিল মেরাপির পায়ের কাছে। তারপরে ধীরে ধীরে গুটিয়ে যেতে লাগল সে-হাত, ফিরে গেল চিরদিনের স্বাভাবিক দৈর্ঘে।

একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল পূজারী আর জাদুকরদের ভিতরে। তারা কোথায় আশা করেছিল, মেরাপির নিষ্প্রাণ দেহ কক্ষতলে লুণ্ঠিত হবে এক্ষুনি, তার বদলে এ কী? সামান্য একটা সোনার পিন ছিঁড়ে ফেলে দিতেই কি দেবাদিদেবের দৈবশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল?

ঐ যে মেরাপি নিচু হয়ে পিনটা তুলে নিল, আবার তা পরে নিল বুকে। আমরা চিনলাম, এ সেই যুবরাজের পিন, যা নিজের হাতে যুবরাজ এঁটে দিয়েছিলেন মেরাপির পায়ের ব্যান্ডেজে, গোসেনের তৃণভূমিতে।

পিন বুকে পরে মেরাপি এবার আমন-রার মূর্তির দিকে চাইল দৃপ্তনেত্রে। দৃপ্তকণ্ঠে বলল–“তোমার শক্তির পরিচয় তুমি দিয়েছ মিশরী দেবতা! এইবার আমি তাহলে আমার ভগবানকে প্রার্থনা জানাই, তার শক্তির পরিচয় দেবার জন্য?”

নীরব, অতগুলো মানুষ ভীত, স্তব্ধ। কী যেন আসন্ন সর্বনাশের ভয়ে অন্তরে অন্তরে কম্পমান। যুবরাজের মনের অবস্থা জানবার উপায় ছিল না, কিন্তু আমি, অ্যানা, আমি অকপটে স্বীকার করছি–আমারও মন ভয়-সংশয় থেকে মোটেই বিমুক্ত ছিল না সেই মুহূর্তে।

এদিকে মেরাপি নিষ্ক্রিয় নেই, নীরবও নেই। এলায়িত কৃষ্ণকবরী কটি ছাপিয়ে জানু পর্যন্ত ঝুলছে তার, পদ্মফুলের মতো মুখখানি ঈষৎ উন্নমিত করে তীক্ষ্ণ সতেজ কণ্ঠে সে আহ্বান জানাচ্ছে তার সেই রহস্যময় ভগবান জাহভেকে–“হে প্রভু! হে ইজরায়েলের ভগবান! তোমারই পয়গম্বরের নির্দেশে তোমার এই দীনা দাসী ভিক্ষা চাইছে–তোমার অপরিসীম বিভূতির এক কণা পরিচয় আজ তুমি দাও এই অবিশ্বাসীদের সমুখে। চূর্ণ করে দাও ওদের ঐ কুশ্রী পাষাণ বিগ্রহকে, তোমার রোষদৃষ্টির বজ্ৰানলে, হে ভগবান! এস প্রভু! আবির্ভূত হও জাহভে! সত্যকে প্রকাশ হতে দাও মিথ্যার জগতে!”

মেরাপির এই রোমাঞ্চকর প্রার্থনা তখনও সমাপ্ত হয়নি, দূরত বর্জনাদের মতো একটা শব্দ আমরা শুনতে পেলাম মন্দিরে দাঁড়িয়ে। এরকম শব্দ আগেও আমরা শুনেছি, শক্তি প্রকাশের পালা যখন আমনের ছিল। তারপর এল বিদ্যুৎস্ফুরণ, এও আমরা আগেই দেখেছি। চঞ্চল হওয়ার মতো কিছু নয় এসব। তবু চাঞ্চল্য আমাদের বেড়েই যাচ্ছে যে!

বজ্র! বিদ্যুৎ! এবার কী তাহলে?

আর কিছু নয়। কী যেন একটা ভারী কঠিন জিনিস গুড়ো হয়ে যাচ্ছে প্রলয় সংঘাতে, এমনি একটা গুরু গুরু শব্দ। সহসা আমাদের চোখের সমুখে গুড়ো হয়েই ছড়িয়ে পড়ল গ্রানাইট পাথরের অতিকায় আমন বিগ্রহ। শূন্য! আমনের সিংহাসন শূন্য! সমস্ত মন্দির টুকরো টুকরো পাথরে আকীর্ণ।

তখনও মন্দির আবছা অন্ধকার! যুবরাজকে কাছে দেখছি না। তাকে খুঁজবার জন্য এগিয়েছি, সমুখে পড়ল দুটি মানুষ। একটি পুরুষ, একটি নারী। কাই আর মেরাপি।

কাই মৃদুস্বরে বলছে–“আমি পরাজয় স্বীকার করছি। হে বিশ্বের শ্রেষ্ঠা জাদুকরী। জাদুর শক্তিতে বজ্রবিদ্যুৎ আমরা আখছার নামাই বটে, কিন্তু পাহাড় সমান পাষাণ বিগ্রহকে সত্যি সত্যি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো জাদু আমরা জানি না। আমাকে তোমার শিষ্য করে নাও, তোমার বিদ্যা আমাকে দাও। বিনিময়ে আমিও তোমাকে দেব, আমার যা কিছু বিদ্যা আছে। দুইজনের ভিতরে সন্ধি যদি হয়, তুমি আর আমি সারা পৃথিবী শাসন করতে পারব যৌথভাবে।”

মেরাপিকে বলতে শুনলাম–“তুমি ভুল করেছ খারেব কাই! আমি কোনো জাদুই জানি না। আমার ভিতর দিয়ে ভগবানের কোনো শক্তি যদি আত্মপ্রকাশ করে থাকে, ভগবানের ইচ্ছাতেই তা হয়েছে। ভগবানেরই মহিমা সেটা, আমার বা অন্য কারও কোনো কৃতিত্ব নয়।”

রুষ্টস্বরে কাই বলল–“আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছ তুমি? এরজন্য ঘোরতর অনুতাপ করতে হবে তোমায়।

“যা আমার নেই, তা আমার কাছে চাইলে আমি দেব কোথা থেকে? ওকে প্রত্যাখ্যান বল কী করে? অনুতাপ? জাহভের যদি সেই ইচ্ছা হয়, করব অনুতাপ!”

দুই দিন পরে দরবারে আবার ডাক পড়ল যুবরাজের। ফারাও বললেন “গোসেন পর্যটনের বিবরণী যা দিয়েছ, আগে থেকেই মৌখিক তোমার কাছে শুনেছিলাম যদিও, ভাল করে পড়লাম তবু। তুমি বলছ ইজরায়েলীরা যুগ যুগ ধরে অত্যাচারিত হচ্ছে মিশরে, তাদের এবারে নিজের দেশে যেতে দেওয়া উচিত। কেমন তো?”

“সম্রাট ঠিকই পড়েছেন আমার বিবরণী” বললেন যুবরাজ।

“এখন আমার বক্তব্য, আমি তোমার মতানুযায়ী কাজ করতে অক্ষম। আমি স্থির করেছি, ইহুদীদের আমি অসিমুখে শায়েস্তা করব। যুগ যুগ ধরে যারা মিশরে বাস করছে, মিশর ছাড়া অন্য কোনো দেশে তাদের থাকা উচিত নয়। আছে বলে যারা মনে করে, আমার চোখে তারা রাজদ্রোহী, দেশদ্রোহী। তারা দণ্ডনীয়, এই নীতি অনুসারেই ইহুদীদের এযাবৎ শাসন করা হয়েছে এদেশে, এখনও তাই হবে। এতে তোমার অনুমোদন আছে কিনা, বল।”

‘সম্রাট যখন আজ্ঞা করছেন, তখন বলি, নেই অনুমোদন।”

“তা হলে কাল যদি আমি মরে যাই, সিংহাসনে তুমি কর উপবেশন, তা হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই তুমি ইজরায়েলীদের দেশ ছেড়ে যেতে অনুমতি দেবে?”

“তা তো অবশ্যই ফারাও!”

“আমি তা হতে দিতে পারি না। যুগ যুগ ধরে যে প্রশাসন নীতি চলে আসছে মিশরে, একটা জাদুকরীর মোহে পড়ে তুমি তা উলটে দেবে, এ আমি হতে দিতে পারি না।”

“জাদুকরী?”–এতক্ষণে তীক্ষ্ণ প্রতিবাদের সুর ফুটে উঠল যুবরাজের কণ্ঠে।

“জাদুকরী নয়? আমি সেই জাদুকরীর কথাই বলছি, যে পরশু রাত্রে আমনের মূর্তি বিচূর্ণ করেছে রাজধানীর বুকের উপরে বসে। তোমার উপরে সে যে অত্যন্ত অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সে-প্রভাবের ফলে তোমার ব্যক্তিগত ক্ষতি যা হবার, তা তো হবেই, তা রোধ করার উপায় নেই আমার হাতে। কিন্তু মিশরেরও সর্বনাশ যাতে না হয় সে-প্রভাবের দরুন, তা আমি এক্ষুনি করছি। তোমায় আমি আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, তুমি তবু সতর্ক হওনি। অতএব তোমাকে আমি সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। আমার পরে ফারাও হবে আমেনমেসিস।”

.

৭.

প্রিয় পুত্রকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করলেন ফারাও মেনাটা। কেন করলেন? দৈবতাড়িত হয়েই করলেন বলতে হবে। মিশরের ভাগ্যে অশেষ দুর্গতি আছে বলেই তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন এইভাবে। শেঠির বদলে আমেনমেসিস। এ যেন যেচে শান্তির বদলে অশান্তি বরণ করে নেওয়া, প্রীতির বদলে হিংসা, অমৃতের বদলে নরকাগ্নি।

শেঠিকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরেই জ্ঞান হারালেন মেনাপ্টা। সে-জ্ঞান আর মৃত্যুর পূর্বে ফিরে আসেনি তাঁর। বেঁচে ছিলেন অবশ্য অজ্ঞান অবস্থায় পুরো একটা দিন, এবং সেই একদিন উসার্টির কর্মতৎপরতার বিরামও ছিল না অবশ্য, কিন্তু শেঠির নিজের উদাসীনতার দরুনই পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়ে গেল।

উসার্টি চেয়েছিলেন–সৈন্যবাহিনীর এবং অভিজাতবর্গের সাহায্য নিয়ে ফারাওয়ের আদেশ তিনি নাকচ করিয়ে দেবেন। সে-প্রয়াসে শেঠির অনুমোদন থাকত যদি, আমেনমেসিসকে বন্দি বা নির্বাসিত করা কঠিন হত না। কারণ জনসমাজের সর্বস্তরে শেঠির জনপ্রিয়তা অসাধারণ, তার একটি মাত্র ইঙ্গিতে আমেনমেসিস ফুৎকারে উড়ে যেত মিশরের সীমার বাইরে।

কিন্তু যুবরাজ নিস্পৃহ। “পিতৃআজ্ঞার বিরোধিতা করব না। রাজ্য সিংহাসন এমন কী জিনিস, যার জন্য বিবেকবিরুদ্ধ কাজ করব?” উসার্টির শত অনুনয় ব্যর্থ হল। ওদিকে ফারাও মেনাটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তাঁর শেষ ঘোষণা অনুযায়ী আমেনমেসিস উপবেশন করলেন মিশর সিংহাসনে। অনায়াসে, মসৃণভাবে। কোনো তরফ থেকে কোনো প্রতিবাদ উত্থিত হল না। অথচ শেঠি যদি উসার্টির পরামর্শে কর্ণপাত করতেন তা তিনি করলেন না। পিতার দেহান্ত হল যখন, তিনি ত্যাগ করে গেলেন ‘ট্যানিস রাজধানী। এখন থেকে তিনি বাস করবেন মেম্ফিস নগরে। সেখানে বিশাল প্রাসাদ ও জমিদারি আছে তার। এগুলি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। ফারাওয়ের ঘোষণায় সিংহাসন তিনি হারিয়েছেন বটে, কিন্তু সে-ঘোষণা, এ-সম্পত্তিকে স্পর্শ করতে পারেনি।

যুবরাজের সঙ্গে মেম্ফিস এসেছি আমি, অ্যানা। ফিরে এসেছি। এই মেক্ষিসেই জন্ম আমার, ট্যানিসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এইখানেই সুখে-দুঃখে আমার দিন কেটেছিল। আবার এখানে ফিরে এসে আমি সুখী হয়েছি। তবে আগের মতো দরিদ্র পল্লীতে এখন আর বাস করছি না আমি, করবার উপায় নেই। বাস করতে হচ্ছে যুবরাজের প্রাসাদ ভবনে, ভোজন করতে হচ্ছে যুবরাজেরই টেবিলে। তা বলে দুই বেলা রাজভোগই যে খাচ্ছি, তা নয়। কারণ যুবরাজ নিজেই স্বল্পাহারী, সাদাসিধে উপকরণেই তৃপ্তি সহকারে তার ভোজন সমাধা হয়।

যুবরাজের সঙ্গে আর এসেছে সেই মেরাপি, ইজরায়েলের চন্দ্রমা। যুবরাজের ইচ্ছায় বা অনুরোধে নয়, তার নিজেরই ইচ্ছাতে, যাওয়ার অন্য স্থান নেই বলেই সে এসেছে যুবরাজের সঙ্গে। অন্যস্থান নেই। কারণ গোসেন তার জন্মভূমি, তার আত্মীয়পরিজন জ্ঞাতিগোত্র সবাই রয়েছে যেখানে, সেটা আজ মেরাপির পক্ষে নিরাপদ নয় মোটেই। দুটো মারাত্মক অপরাধে তাকে অপরাধী বিবেচনা করছে ইজরায়েলীরা। প্রথমত, গোসেন সীমান্তের ইহুদীরা সেই চোরা আক্রমণ যখন চালিয়েছিল যুবরাজের উপরে, তখন মেরাপিই রক্ষা করেছিল তাকে। ইহুদীদের বিচারে নির্ভেজাল বিশ্বাসঘাতকতা ও জাতিদ্রোহিতা। দ্বিতীয়ত, লাবান যদিও তার বাগদত্ত স্বামী, মেরাপি ইদানীং তাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করেছে। কেন? সে-প্রশ্নের উত্তর সে দেয়নি।

ইজরায়েলী পয়গম্বরদের উপরে তার আস্থা ও শ্রদ্ধা পূর্ববৎই অটুট এখনো, তাদের আদেশও সে পালন করবে নতশিরে, যেমন করেছিল সেই আমন মন্দিরে বাজি ধরার সময়। কিন্তু তা বলে তাদের আদেশেও মেরাপি লাবানকে আর আত্মদান করবে না। কেন? এ-প্রশ্নের আর উত্তর নেই।

গোসেনে যখন যাবে না, মেক্ষিসেই অগত্যা তাকে আসতে হল। যুবরাজ শেঠি সিংহাসনে বসছেন না আর, তা ঠিক। কিন্তু ইজরায়েলীদের ক্রোধ থেকে মেরাপিকে রক্ষা করবার মতো ক্ষমতা তার এখনও যথেষ্টই আছে। এখানে তাঁর মেম্ফিসের প্রাসাদ একটা কেল্লার মতোই সুরক্ষিত, তার চৌহদ্দির ভিতরে শেঠিই একচ্ছত্র রাজা, সেখানে তার অনুমতি বিনা প্রবেশ করবে, এমন সাধ্য কারও নেই।

ট্যানিস থেকে যুবরাজের ভৃত্যবর্গও অনেকে এসেছে তার সঙ্গে, যদিও সেই দাড়িওয়ালা পাম্বাসা বুড়ো আসেনি। যুবরাজ ফারাও হচ্ছেন না শুনেই সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল তার, এখন শোনা যাচ্ছে সে ফারাও আমেনমেসিসের চাকরিতে ভর্তি হয়েছে। ঘুষখোর লোকের প্রভুভক্তি আর কত হবে?

মেম্ফিসে বসে সারা মিশরেরই খবর পাই আমরা। আমেনমেসিস বসেছেন সিংহাসনে। উসার্টি স্বামীর সঙ্গে আসেননি বটে, কিন্তু আমেনমেসিসকেও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না। শেঠিরই ট্যানিসের প্রাসাদে তিনি আছেন, নতুন ফারাওকে ভয়ও করেন না, ভক্তি দেখাবারও দরকার বোধ করেন না।

সব খবরই পাওয়া যায় এখানে বসে। আমেনমেসিস সিংহাসনে বসার অল্প কয়েকদিন পরেই ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা আবার এসেছিলেন তাঁর দরবারে। এসে যথারীতি দাবি জানিয়েছিলেন যে ইজরায়েলীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। যা আশা করা গিয়েছিল, আমেনমেসিস তাই বললেন–“কদাপি দেব না অনুমতি। কেন দেব? কয়েক শতাব্দী ধরে যারা মিশরে বাস করছে, তারা মিশরেরই অধিবাসী। মিশর ছেড়ে যাওয়ার অধিকার তাদের নেই।”

“যদি যেতে না দেন, মিশরের সর্বনাশ হবে ভগবানের ক্রোধে।”

“ভগবান কি আমাদেরও নেই?”

“না, তোমাদের আছে শত শত পুতুল দেবতা। তাদের মধ্যে যে ছিল সবার প্রধান, তাকে তত জাহভের রোষবজ্ৰ বিচূর্ণই করে ফেলেছে তার নিজের মন্দিরে। যা বলছি, তা শোন ফারাও। ইজরায়েলীদের আটকে রাখলে মিশর ধ্বংস হয়ে যাবে। অভিশাপের পরে অভিশাপ এমনভাবে নেমে আসতে থাকবে এদেশের উপরে, শ্মাশান হয়ে যাবে এই সোনার দেশ। ঘটবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঘটবে অনৈসর্গিক দুর্বিপাক, ক্ষুধার অন্ন পাবে না মিশরীরা, এক বিন্দু জলও পাবে না পান করবার জন্য।”

পান করবার জল পাবে না? ফারাও হেসে উঠলেন, হেসে উঠল তার সভাসদবর্গ। “এত বড় নীলনদ থাকতে?”

‘নীলনদে তখন জলস্রোত বইবে না, বইবে রক্তস্রোত।’ বললেন পয়গম্বরেরা। “দেখবে তোমরা?” দরবার গৃহের সমুখে একটা ফোয়ারায় জল উৎসারিত হচ্ছে, পয়গম্বরেরা হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন সেই জলে। অমনি, কী এ বিভীষিকা? সমস্ত ফোয়ারাটা লালে লাল হয়ে গেল চোখের পলকে। কেউ কেউ সেই লাল জল মুখে দিয়েও দেখল–ঠিক রক্তের মতো নোনতা বিস্বাদ। থু থু করে ফেলে দিল মুখ থেকে।

পয়গম্বরেরা বিদায় হয়ে গেলেন। ভয়ার্ত ফারাও ডেকে পাঠালেন শ্রেষ্ঠ মিশরী জাদুকর কাইকে। আমন মন্দিরের খারেব সে। মেরাপির সঙ্গে জাদুর বাজি লড়তে গিয়ে সে আসল বিগ্রহকে রক্ষা করতে পারেনি বটে, কিন্তু এবারে সে আশ্বাস দিল–“জলকে রক্ত করে দেওয়া এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ও আমরাও পারি। এই দেখুন—”

ফারাওকে অন্য একটা জলাশয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে কাই নিজের লাঠি দিয়ে আঘাত করল তার জলে, অমনি সে-জলও পরিণত হল রক্তে। ফারাও উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। তাই তো? আরও তত রয়েছে সব শক্তিমান জাদুকর! এরাও তো জলকে রক্ত বানিয়ে দিতে সক্ষম। তবে আর ভয় কী?

ভয় নেই? মূঢ় ফারাও! জলকে রক্ত বানাবার ফিকির কাইয়েরও জানা আছে বটে, কিন্তু রক্তকে আবার জলে পরিবর্তিত করার ক্ষমতা তার আছে কি? দরকার রক্তের নয়, দরকার তৃষ্ণার জলের। সেই জল যখন সবই রক্তে পরিণত হবে, কাইয়ের ইন্দ্রজালে তা আবার স্বরূপ ফিরে পাবে কি?

সে-প্রশ্নই ফারাও করলেন না কাইকে। মতিচ্ছন্ন না হলে এমন ভুল কেউ

এসব কত মেম্ফিসে বসেই শুনেছি আমরা।

ইতিমধ্যে আমাদের মেসি প্রাসাদে ঘটনাও ঘটেছে কিছু। শেঠি বিবাহ করেছেন মেরাপিকে। উসার্টি যখন ট্যানিস থেকে আসবেনই না এবং সিংহাসনহারা শেঠিকে যখন তার কোনো প্রয়োজনই নেই, তখন শেঠিই বা কতকাল আর নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করবেন?

মেরাপি রয়েছেন শেঠির অত্যন্ত কাছে। সৌন্দর্যে তিনি তো দেবী আইসিসেরই সমতুল। এদিকে শেঠির তিনি অনুরাগিনীও অতি মাত্র। এ-দুইয়ের বিবাহ হয়ে যাওয়া সর্বথা বাঞ্ছনীয়। এতে নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা ভুলতে পারবে দুটি মহৎ প্রাণ।

এই বিবাহের পরে যুবরাজের বজরা নিয়ে আমি চলে গেলাম থিবিসে। সেখানকার গ্রন্থাগারে আছে কতকগুলি মূল্যবান প্রাচীন পুঁথি, সেইগুলির এক একটা নকল করে আনবার উদ্দেশ্য নিয়ে।

কাজ শেষ করতে আমার প্রায় দুই মাস লেগে গেল। ওদিকে যুবরাজও আমায় ঘন ঘন তাগিদ পাঠাচ্ছেন, মেম্ফিসে ফিরে যাওয়ার জন্য। অবশেষে আমি একদিন বজরায় চড়ে বসলাম আমার পুঁথির বোঝা সঙ্গে নিয়ে।

আমি যাচ্ছি নদীর ভাটিতে। উজান বেয়ে আসছে আর একখান বজরা। পাশাপাশি আসতেই লক্ষ্য করলাম–সে বজরার আরোহী আমার পরিচিত, ট্যানিমের জনৈক ভদ্রলোক, ফারাওয়ের কর্মচারী। নৌকা থামিয়ে আমরা পরস্পরে আলাপ করে নিলাম কিছুক্ষণ। সেই সময়ই তিনি আমায় চুপি চুপি বললেন “যতটা সম্ভব, পানীয় জল বোঝাই করে নিন বজরাতে। ভাটিতে সারা নদী রক্ত নদী হয়ে গিয়েছে, জল পাবেন না একবিন্দুও।”

“সে কী মশাই?”–আমি আকাশ থেকে পড়লাম একেবারে।

“ইজরায়েলী পয়গম্বরদের অভিশাপের কথা শোনেননি। তারা সময় দিয়ে গিয়েছিল দুই চাঁদ। ঠিক দুই চাঁদ পরে সারা দেশে সব জল রক্ত হয়ে গিয়েছে। কাল সারাদিন এক ফোঁটা জল খেতে পাইনি। এই একটু আগে রক্তের রাজ্য পেরিয়ে এল আমার বজরা। দেখুন নৌকার গায়ে রক্ত, আমার নিজের পোশাকে রক্তের ছিট, মাল্লাদের বসনেও তাই।”

“কিন্তু নদীর এ-অংশে তে রক্তের চিহ্ন নেই। এর কারণ কী তাহলে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোককে।

“বলতে পারব না। তবে রক্তবন্যাটা ধীরে ধীরে এগুচ্ছে, বজরার গতির চেয়ে তার বেগ মন্থর। আর মজা দেখুন, রক্তটা এগুচ্ছে নদীস্রোতের উলটো মুখে, উজানে। কিসের জোরে এগুচ্ছে, তা বুঝি না।”

একটু থেমে তিনি আরও বললেন–“সারাপথ জেলেদের হাহাকার শুনতে শুনতে আসছি। জলের মাছ রক্তের ভিতর বাঁচাবে কেমন করে? সারা নদী মরা, পচা মাছে ভর্তি। দুর্গন্ধে বমি আসে।”

রাজকর্মচারীটি বজরা চালিয়ে দিলেন। আমি মাল্লাদের বললাম সমস্ত জলপাত্র জলে পূর্ণ করে নিতে। তারা আদেশ পালন করল বটে, কিন্তু যেভাবে আমার দিকে চাইতে লাগল, তাতে মনে হল যে আমাকে পাগল ঠাউরেছে তারা।

বজরা আমরাও চালিয়ে যাচ্ছি। অল্প দূরেই দেখা পেলাম সেই রক্ত নদীর। লাল রেখাটা এগুচ্ছে উজানের পানে, ধীরে হলেও নিশ্চিতভাবে এগুচ্ছে। হতবুদ্ধিকর দৃশ্য। এপাশে কালো জল, ওপাশে লাল রক্ত, মাঝখান দিয়ে সুচিহ্নিত একটি সীমারেখা। আর সেই সীমারেখা যেন চোখের সামনেই একটু একটু করে উজানে হটে যাচ্ছে। আর মাছগুলোর কী রুদ্ধশ্বাস দৌড়! রক্তের এলাকা পেরিয়ে নির্মল জলে পালাবার জন্য কী তাদের আকুলিবিকুলি!

মেম্ফিসে পৌঁছোলাম। এখানে আর এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সারা মেম্ফিসে সব জল রক্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যুবরাজ শেঠির প্রাসাদে সব জল আগের মতোই নির্মল, স্বাভাবিক। এ-রহস্যের কারণও জানতে পারলাম যুবরাজের মুখ থেকেই। জ্যাবেজ এসেছিল, মেরাপির কাকা। ইজারায়েলী পয়গম্বরদের আশীর্বাদ এনেছিল যুবরাজের জন্য। তারা বলে দিয়েছিলেন–“যুবরাজ! তুমি ইজরায়েলীদের উপরে ন্যায্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলে, সুপারিশ করেছিলে যে তাদের ফিরে যেতে দেওয়া হোক তাদের নিজের দেশে। সে-সুপারিশ যে অগ্রাহ্য হয়েছে, সেটা তোমার দোষ নয়। অগ্রাহ্য হওয়ার ফলে জাহভের কোপে তিলে তিলে ধ্বংস হবে মিশর, কিন্তু সে-ধ্বংসের গ্রাস থেকে তুমি যুবরাজ শেঠি, তুমি রেহাই পেতে থাকবে বরাবর।

জ্যাবেজ এই বার্তাই শুধু বহন করে আনেনি, শেঠি যাতে রেহাই পান, তার পাকা ব্যবস্থাও করে গিয়েছে। প্রাসাদের, খেত-খামারের চারিদিকে সে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছে মন্ত্রোচ্চারণ করে করে আর মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে। বলে গিয়েছে যে যুবরাজের অধিকৃত এলাকায় জাহভের কোনো অভিশাপ কোনো অশুভ প্রভাবই সঞ্চারিত হবে না কোনোদিন। প্রত্যক্ষ প্রমাণ, এ-প্রাসাদে জলের স্বাভাবিক অবস্থা।

জলের বিকৃতি সাত দিন স্থায়ী হল। পয়গম্বরেরা বলেও ছিলেন সাত দিনের কথা। তারপর কিছুদিন সব শান্ত, হঠাৎ ঐ পয়গম্বরেরা আবারও দেখা দিলেন : ফারাওয়ের দরবারে–“এখনও তুমি যেতে দাও ইজরায়েলীদের। তা নইলে নতুন এক অভিশাপ নেমে আসবে অচিরে। গতবারে টের পেয়েছ যে তেষ্টার জলের অভাবে কী কষ্ট হয় মানুষের। এবারে টের পাবে ক্ষিধের যন্ত্রণা। এখনও দাও অনুমতি।”

“দেব না!”–গর্জন করে উঠলেন ফারাও। কী যেন এক দুর্দান্ত জেদ চেপে গিয়েছে তার, ইজরায়েলীদের কিছুতেই ছাড়বেন না তিনি। কী করবে তারা? জাদুমন্ত্রের খেল দেখিয়ে রাজশক্তিকে পরাজিত করবে? তা যে করা যায় না।

হাতে হাতে তা ওদের দেখিয়ে দেবেন ফারাও আমেনমেসিস। তিনি কাইকে ডেকে কড়া আদেশ দিলেন–“তোমার সকল বিদ্যে ঝালিয়ে নাও এই সময়। রুখতেই হবে ইজরায়েলীদের জাদুর শক্তি।”

কাই তো প্রতিজ্ঞায় কল্পতরু একেবারে। দরাজ প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল, মিশরে কোনো উৎপাতই সে হতে দেবে না অতঃপর। তোড়জোড় শুরু করে দিল, নানা আধা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে। আমন মন্দিরে নতুন এক আমন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এর মধ্যে, আগের মতোই অতিকায়, আগের চাইতেও ভয়াল। সেই মূর্তির আশেপাশে, সেই মূর্তিকেই কেন্দ্র করে তার যা কিছু ক্রিয়াকলাপ।

দুটো মাস অপেক্ষা করলেন ইজরায়েলের পয়গম্বরেরা। তারপর মিশরের উপরে নেমে এল আকাশজোড়া পঙ্গপালের ঝাক। সূর্য ঢেকে ফেলল সেই পঙ্গপালের মেঘ, দিনদুপুরে সারা পৃথিবী অন্ধকার। মাটিতে যখন নেমে এল ঐ কাল পতঙ্গেরা, ক্ষেতের ফসল খেয়ে শেষ করল তারা, বড় বড় গাছকে করে ফেলল নিষ্পত্র, একটা শিষ রইল না কোনো ঘাসের ডগায়। জনগণ হাহাকার করতে লাগল, সারা বৎসরের খাদ্য তাদের পঙ্গপালের উদরে চলে গেল কয়েক দিনের মধ্যে।

কিন্তু আশ্চর্য দেখ, মেম্ফিস শহরে যুবরাজ শেঠির প্রাসাদ উদ্যানে একটি পঙ্গপাল নামেনি, তার কোনো শস্যক্ষেত্রে এক কণা শস্য খোয়া যায়নি পঙ্গপালের দরুন। জ্যাবেজ ঠিক বলেছিল, অভিশাপের আওতা থেকে শেঠিকে রেহাই দিয়েছেন ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা।

তারপর কিছুদিন যায়, এবার হল ব্যাংয়ের উৎপাত। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ব্যাং কোথা থেকে যে এল, কেউ তা বলতে পারে না। যেমন বীভৎস তাদের চেহারা, তেমনি বিকট তাদের আওয়াজ। সারা পৃথিবী জুড়ে যেন ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছে কোনো দুর্জয় শত্রুসেনা। পথঘাট মাঠ নদীকূল গিরিসানু বনপ্রান্তর, সর্বত্র তারা গ্যাঙোর-গ্যাং আওয়াজে যেন শুনিয়ে যাচ্ছে মিশরীয়দের–“তোরা অভিশপ্ত, তোরা অভিশপ্ত, তোরা অভিশপ্ত।”

কিন্তু আগেও যেমন, এবারেও তেমনি। মেসি নগরে শেঠির প্রাসাদে। শেঠির শস্যক্ষেত্রে নেই একটিও ব্যাং। শেঠির অধিকারের ঠিক ওপারে তারা চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাচ্ছে, কিন্তু এপারে তারা কেউ আসবে না।

ব্যাংয়ের পরে এল উকুন, তারও পরে হল এক মহামারী। অন্য কিছু ব্যাধি নয়, প্রত্যেকটা মানুষের সারা অঙ্গ ছেয়ে গেল দূষিত ক্ষতে। প্রাণহানি কারও হল না তাতে, কিন্তু জনে জনে কষ্ট পেল অশেষ। ঘা যতদিন না শুকলো, কোনো কাজ করতে পারল না কেউ হাত-পা নেড়ে ।

অবাক কাণ্ড! শেঠির প্রাসাদের বাইরে থাকে একদল রক্ষী, ভিতরে থাকে আর একদল । দুই দলের বাসগৃহের মধ্যে ব্যবধান মাত্র বিশ পা। সেই বাইরের রক্ষীরা আক্রান্ত হল মহামারীতে, ভিতরের রক্ষীরা পেল তা থেকে অব্যাহতি। তা নিয়ে দুই দলের কী কলহ আবার!

তার পরে এল পশুর মড়ক। যেখানে যত পশু আছে মিশরে, কী এক অজানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মরতে লাগল হাজারে হাজারে। রক্ষা পেয়ে গেল শুধু যুবরাজ শেঠির পশুবৃন্দ।

এই সময়ে প্রথমে বৃদ্ধ বোকেনঘোনসু, পরে খারেব কাই মেম্ফিস থেকে চলে এলেন, যুবরাজ শেঠির কাছে আশ্রয় নেবার জন্য। বোকেনঘোনসুকে সমাদরেই গ্রহণ করলেন যুবরাজ, কিন্তু কাইয়ের সম্বন্ধে তার যথেষ্ট আপত্তি দেখা গেল। আপত্তির কারণ অবশ্য মেরাপি। মেরাপি যেদিন আমন মন্দিরে বাজি ধরেছিল, সেদিন বিগ্রহ চুর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে কাই করে একটা সন্ধির প্রস্তাব মেরাপির কাছে। আর সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে সে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শাসায় মেপিকে। সে সব কথা তো যুবরাজ শুনেছেন।

কিন্তু কাই অনুনয় করছেন অতি সকাতরে–“অপদার্থ বলে ফারাও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। মিশরের উপরে এই অভিশাপ পরম্পরার একটাও আমি রুখতে পারিনি, এই আমার অপরাধ। কিন্তু আমি কী করব বলুন! স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ইজরায়েলের দেবতা জাহভে আমাদের দেবতা আমন অসিরিস আইসিসের চেয়ে বেশি শক্তি রাখেন। ফারাও তা কিছুতেই বুঝতে চান না। বিনা দোষে তাড়িয়ে দিলেন আমাকে। আমি তাই আপনার কাছে এলাম আশ্রয় নিতে। যুবরাজ শেঠি কি শরণার্থীকে বিমুখ করবেন?”

কোমল হৃদয় শেঠির। একটুখানি কাতরতা দেখেই গলে গেলেন। খাল কেটে কুমীর আনা হচ্ছে জেনেও আশ্রয় দিলেন কাইকে।

বলা হয়নি, শেঠির হৃদয় ঠিক এই সময়টাতে একটু বেশিই কোমল ছিল এক বিশেষ কারণে। ইজরায়েল চন্দ্রমা মেরাপি তার কয়েকদিন আগে একটি পুত্র উপহার দিয়েছেন শেঠিকে।

.

৮.

এর পরে সারা মিশরে নেমে এল নিবিড় অন্ধকার। দিবারাত্রি ভেদজ্ঞান হারিয়ে ফেলল মানুষে, আকাশে না দেখা দেয় সূর্য, না ওঠে একটা নক্ষত্র। ভয়ার্ত মিশরীরা তারস্বরে ডাকছে তাদের বহু দেবতার মধ্যে কাউকে না কাউকে, বাড়ি থেকে বেরুবার সাহসও নেই তাদের। তবে হ্যাঁ, সূর্যচন্দ্রহীন আকাশের নীচেও শেঠির বাড়িটা কী এক রহস্যময় আলোকে যেন উদ্ভাসিত।

কাই নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে নেই। বুকে বসে দাড়ি ওড়াচ্ছে শেঠির। গোপনে গোপনে সে ক্ষেপিয়ে তুলছে মেসিবাসীদের। এই যে নরকের অন্ধকারে আচ্ছন্ন সারা পৃথিবী, এর ভিতরেও সে অনায়াসে সারা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতি গৃহে ঢুকে মানুষকে বোঝাচ্ছে যে পরপর এই যে এতগুলি দৈবী উৎপাত ঘটে গেল মিশরের উপর দিয়ে, এর জন্য দায়ী আর কেউ নয়, যুবরাজ শেঠির আশ্রিতা ঐ ইহুদিনী জাদুকরী মেরাপি, ইজরায়েলরা যাকে ডাকে ইজরায়েলের চঁদ বলে। মনে নেই, ঐ মায়াবিনী ইহুদিনীই আমন মন্দিরে ঢুকে বিচূর্ণ করেছিল আমন-রার বিগ্রহ? ওর জাদুর কাছে আমরা সব শিশু মাত্র। এই যে অনন্ত অন্ধকারের রাজত্ব চলছে মিশরে, এর প্রতিকারের বিদ্যে মিশরের কোনো জাদুকরের নেই। এর অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র ঐ নারীই। তোমরা সবাই গিয়ে যুবরাজ শেঠিকে যদি বল

কী যে বলতে হবে যুবরাজকে, তা আর ধৈর্য ধারণ করে শুনল না মেসিবাসীরা। দল বেঁধে তারা বেরিয়ে পড়ল মশাল হাতে নিয়ে, শেঠির প্রাসাদের দ্বারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল–“এ আঁধারের অবসান করুন। আমরা পাগল হয়ে গেলাম এর দরুন।”

শেঠি স্তম্ভিত। “কে অবসান করবে এ-অন্ধকারের?’–প্রশ্ন করলেন অলিন্দে দাঁড়িয়ে। করবেন তিনি, যাঁর মন্ত্রবলে এতগুলো দৈবদুর্বিপাকের হাত থেকে আপনার প্রাসাদ অক্ষত দেহে বেরিয়ে এসেছে। জলের বদলে আমরা খেয়েছি রক্ত, আপনার প্রাসাদের বাসিন্দাদের জল রক্তে পরিণত হয়নি। লাখে লাখে ব্যাং ডেকেছে সারা মিশরে, আপনার জমিতে তারা ডাকেনি। পঙ্গপালে উজাড় করেছে আমাদের শস্যক্ষেত্র, আপনার একটি কণা ফসল খোয়া যায়নি। এসবই আপনার রানি মেরাপির মন্ত্রবলে হয়েছে, যাঁকে ইজরায়েলীরা ডাকে ইজরায়েলের চাঁদ বলে। সে-চাঁদ এবার আমাদের উপরে এক কণা করুণার জ্যোছনা বিতরণ করুন, অন্ধকারের কবল থেকে আমাদের রক্ষা করুন। ঐ দেখুন, সারা মেম্ফিস নিবিড় আঁধারে আচ্ছন্ন, কেবল এই আপনারই প্রাসাদটি আলোয় আলোয় ঝলমল করছে।”

‘যুবরানি মেরাপিকে দিয়ে তোমরা কী করতে চাও?”–জিজ্ঞাসা করলেন শেঠি।

“কী করলে অন্ধকার কাটবে, তিনিই তো ভাল জানেন”–বলল একজন।

“না, জানেন না তিনি”–দৃঢ়স্বরে জবাব দিলেন শেঠি।

তখন কাইয়ের শিক্ষামন্তত একজন বলল–“তিনি একবারটি আইসিস মন্দিরে চলুন। তিনিও চন্দ্রমা, আইসিসও চন্দ্রমা। আমাদের বিশ্বাস যে তিনিই দেহধারিণী আইসিস। মন্দিরে গিয়ে আইসিসের আসনে তিনি বসুন একবার, তাহলেই অন্ধকার কেটে যাবে বলে বিশ্বাস আমাদের।”

“কখনোই কাটবে না”–বললেন শেঠি। কিন্তু জনতা নাছোড়বান্দা। শেঠিকে সাধারণত তারা রাজার মতো সম্মান করে, কিন্তু এখন তারা কথা কইছে যেন বেশ একটু অসম্ভ্রমের সুরে। শেঠি সমস্যায় পড়লেন। রক্ষীসেনা তার আছে, কিন্তু সংখ্যায় তারা বড় জোর একশো হবে। ওদিকে সারা মেম্ফিস এসে একত্র হয়েছে তার দ্বারদেশে। ওরা যদি উগ্র হয়ে ওঠে, মেরাপিকে যদি জোর করেই নিয়ে যেতে চায় আইসিস মন্দিরে, ওদের তাড়িয়ে দেবার শক্তি সে রক্ষীসেনার হবে না। এই সমস্যার মুহূর্তে পরামর্শ চাইলেন তিনি বিজ্ঞ বৃদ্ধ বোকেনঘোর কাছে।

বোকেনঘোন্‌সু বললেন–“যুবরানির ক্ষতি কী হতে পারে আইসিস মন্দিরে গেলে? বরং না গেলে ঐ ক্রুদ্ধ জনতা অনেক কিছু ক্ষতি করতে পারবে তার, আপনার ও আমাদের সবাইয়ের। আমার বিবেচনায় ওঁর একবার যাওয়াই ভাল।”

মেরাপির নিজের ঘোরতর অনিচ্ছা–“আমি পৌত্তলিক নই, আইসিস নাম্নী কোনো দেবীর অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস নেই, আমি কেন যাব তার মন্দিরে তারই ভূমিকায় অভিনয় করতে? বিশেষত আমার শিশুপুত্রকে নিয়ে?”

কিন্তু শেঠির বিপদটা উপলব্ধি করলেন মেরাপি। তাই ঘোরতর অনিচ্ছাতেও তিনি রাজি হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। জনতা আনন্দরোলে দশ দিক কম্পিত করে সপুত্র মেরাপিকে নিয়ে চলল আইসিস মন্দিরে।

একে প্রচণ্ড ভিড়, তায় নিবিড় অন্ধকার। আমাকে আর বোকেনঘোন্‌সুকে সঙ্গে নিয়ে শেঠিও মেরাপির সঙ্গে সঙ্গেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু সিংহদ্বারের বাইরে পা দেওয়া মাত্রই অন্ধকারে দিভুল হয়ে গেল আমাদের। কাই যে জনতার বেষ্টনীতে ঘিরে কোথায় নিয়ে গেল মেরাপিকে, তা আর ঠাউরে উঠতেই পারলাম না আমরা। তাকে নিয়ে কী করেছিল জনতা, তা পরে আমরা মেরাপির মুখ থেকেই শুনেছিলাম।

আইসিসের মন্দিরে নিয়েই মেরাপিকে তুলল ওরা। কাই যে জাদুকর, আর মেরাপি যে তা নয়, তার প্রমাণ হাতে হাতেই পাওয়া গেল এইবার। মশালের আলোকে কাইয়ের চোখের দিকে একবার তাকিয়েই মেরাপি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ল। কাই তাকে পরিধান করতে বলল আইসিসের শাস্ত্রকথিত পরিচ্ছদ।

আমরা যখন অবশেষে মন্দিরে পৌঁছোলাম, সারি সারি মশালে মন্দিরের ভিতরটা আলোকিত। আইসিসের সিংহাসন থেকে দেবীর প্রস্তর বিগ্রহ অপসারিত হয়েছে, তার জায়গায় বসানো হয়েছে দেবীবেশিনী মেরাপিকে। শুধু তাই নয়, তার কোলে তার পুত্রও রয়েছে, আইসিসপুত্র হোরাসের বেশে সজ্জিত। এই অবস্থায় আইসিসবেশিনী মেরাপি কাইয়ের শিক্ষামতো উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে–“সৃষ্টি স্থিতি-সংহারকারিণী আমি আইসিস নিজস্ব দৈবীশক্তি বলে এই বিশ্বব্যাপী তমসাকে সংহরণ করে নিলাম। দিবালোক ফুটে উঠুক এইবার।”

আর কী বিস্ময়! কী বিস্ময়! সত্য সত্যই অন্ধকার কেটে যেতে লাগল মেরাপির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, জনতা উঠল জয়ধ্বনি করে–“জয় মাতা আইসিসের জয়।”

আমরা যখন সপুত্র মেরাপিকে রথে তুললাম, তখন তার জ্ঞান নেই।

আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া কিন্তু কোথায় এই অন্ধকারে আলো ফোঁটানোর ব্যাপার উপলক্ষ করে মেসিবাসীরা কৃতজ্ঞ হবে মেরাপির উপরে, তা না হয়ে তারা অনুযোগ করতে লাগল নানা রকম–“উনি যখন ইচ্ছা করলেই ইজরায়েলী অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন আমাদের, তখন আগের আগের অভিশাপগুলোকেও কেন আগে থেকে নিরস্ত করেননি? ওঁর নিজের প্রাসাদের জল রক্তে পরিণত হল না, আমাদের বাড়ির জল হল। ওঁর ক্ষেতখামারের ফল বা ফসল নষ্ট হল না, আমাদের ক্ষেতখামারের হল। ওঁর একটাও ঘোড়া বা ভেড়া মারা গেল না, আমাদের গেল। এরকম পক্ষপাত কোনো দেবীর মধ্যে থাকা উচিত নয়। দেবী হয়েও উনি দানবীর মতো আচরণ করেছেন।”

বলা বাহুল্য, এসব অনুযোগেরও উৎস কাই। আইসিসবেশিনী মেরাপির আদেশেই সেদিন অন্ধকার কেটে গিয়েছিল মেম্ফিস থেকে, মেম্ফিসবাসীদের এ ধারণা একদম ভ্রান্ত। বাস্তবিকপক্ষে সে-ব্যাপারটা কাই নিজেই ঘটিয়েছিল নিজেরই জাদুশক্তি বলে। জাদুকর হিসাবে তার শক্তি, তত সে সত্যি সত্যি হারায়নি। ইজরায়েলী পয়গম্বরদের বৃহত্তর শক্তির কাছে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে যদিও, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেলে এখনও কাই অনেক অঘটন ঘটাতে পারে।

মেরাপি যে অসাধারণ শক্তিমতী জাদুকরী, এ-বিশ্বাস এখনও দৃঢ় কাইয়ের অন্তরে। তার ধারণা, ইচ্ছা করলেই ইজরায়েলী জাদুর গূঢ় রহস্যের সন্ধান তাকে দিতে পারত মেরাপি! দেয়নি যে, সে শুধু কাইকে পদানত রাখবার জন্যই। বেশ, কাইও দেখে নেবে তাকে। মেসিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে সর্বনাশ করে ছাড়বে মেরাপির।

দুর্ভাগিনী মেরাপি! এদিকে শত্রু তার কাই ও মেম্ফিসবাসীরা, ওদিকে শত্রু ইজরায়েলের ভগবান। জাহভের অপার করুণা ছিল তার উপরে, আইসিস সেজে পৌত্তলিক ধর্মের মহিমা ঘোষণা করতে গিয়ে সে-করুণা সে হারিয়েছে। পয়গম্বরদের আদেশ প্রচারিত হয়েছে, আগের আগের সব অভিশাপ থেকে মেরাপির স্বামী নিষ্কৃতি পেয়েছে যদিও, আসন্ন যে অভিশাপ অচিরেই মিশরের উপরে নেমে আসতে যাচ্ছে, তা থেকে আর নিস্তার পাবে না, সে।

সে-অভিশাপ এল, নিষ্ঠুর, ভয়াবহ, সর্বনাশা। অভিশাপটা এই যে, মিশরের প্রতি গৃহের প্রথম সন্তানটি একই দিনে একই সময়ে একসঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হবে, বিনা ব্যাধিতে, বিনা দুর্ঘটনায়।

এল অভিশাপ। একই দিনে একই মুহূর্তে, একান্ত অকারণে মারা পড়ল মিশরের প্রতি গৃহের প্রথম সন্তান। সেই সঙ্গে মেরাপিরও প্রথম সন্তান অকস্মাৎ ঢলে পড়ল মরণের কোলে।

শেঠির হৃদয় ভেঙে গেল। মেরাপি হয়ে গেল পাগলের মতো।

কিন্তু শেঠির সন্তানই একমাত্র রাজবংশধর নয়, যাকে গ্রাস করেছিল ইজরায়েলী পয়গম্বরদের শেষ এবং সর্বনাশা অভিশাপ। ফারাও আমেনমেসিসেরও জ্যেষ্ঠ পুত্রকে হতে হয়েছে এই অভিশাপের বলি।

আর শুনতে আশ্চর্য লাগবে, সারা দেশের উপর সর্বধ্বংসী ইজরায়েলী অভিশাপের তাথৈ নৃত্য বারবার পর্যবেক্ষণ করেও পাষাণ হৃদয় বিন্দুমাত্র টলেনি, নিজের সন্তানকে অকস্মাৎ সেই অভিশাপের খড়গে বলিদান হতে দেখে সে একেবারে ভেঙে পড়ল নৈরাশ্যে। “কেন আমি শেঠির সুপারিশকে সমর্থন করিনি তখন? কেন সিংহাসনে বসবার পরে নিজের দেশে চলে যেতে দিইনি ইহুদীদের? তা হলে তো বারবার খণ্ডপ্রলয় নেমে আসতে পারত না মিশরের বুকে? ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত হত না মিশরী জনগণ?” এইসব হল এখন আমেনমেসিসের মুখের বুলি প্রতি মুহূর্তে।

মিশরী জনগণেরও বিপুল একটা অংশ এই মতই পোষণ করতে শুরু করল এবার। “ছেড়ে দাও ওদের। ওদের ধরে রাখতে গিয়ে সর্বনাশ হল মিশরের। যাক ওরা! নিজেদের মরুদেশে গিয়ে স্বর্গসুখ পায় যদি, তাই ওদের পেতে দাও।”

এবার যখন ইজরায়েলী পয়গম্বরেরা দরবারে এলেন, তাঁদের পুরোনো দাবি উত্থাপন করতে, তখন মন্ত্রী সভাসদবর্গের সঙ্গে পরামর্শ করে ফারাও বললেন “বেশ, আর আমি আপত্তি করব না তোমাদের প্রস্তাবে যেতে পার তোমরা মিশর ছেড়ে।”

উৎফুল্ল হয়ে পয়গম্বরেরা বললেন–“আমাদের ধনৈশ্বর্য সব নিয়ে তো?”

“কী আর এমন ধনৈশ্বর্য তোমরা সঞ্চয় করেছ এদেশে? তোমাদের কাছে তার মূল্য যতই হোক, মিশরীদের চোখে তা তুচ্ছ। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও তোমাদের শস্যভাণ্ডার, তোমাদের পশুপাল, তোমাদের আর আর যা কিছু আছে, সব। বিদায় হও তোমরা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি।”

পয়গম্বরেরা আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন–“আমরা বিশ দিনের মধ্যেই চলে যাচ্ছি মিশর ছেড়ে। এবার যে ফারাওয়ের সম্মতি আদায় হবে, তা আমরা আগে থেকেই জানতাম। তাই আমাদের জনগণকে আমরা প্রস্তুত থাকতেই বলেছি। তারা মোটঘাট বেঁধে তৈরিই আছে। তিন দিন পরে আর একটিও ইজরায়েলী থাকবে না মিশরে।”

পয়গম্বরেরা বিদায় হলেন। এই নতুন পরিণতির কথা ট্যানিসবাসীদের জানাবার জন্য বিশেষ করে এক দরবার আহ্বান করলেন আমেনমেসিস। অভিজাতবর্গের সঙ্গে এতে আমন্ত্রিত হয়ে এলেন সাধারণ নাগরিকদের প্রতিনিধিরাও। আমেনমেসিস প্রথমে সবাইয়ের সমুখে এক বিশদ বিবরণ খাড়া করলেন বিগত দ্বাদশ অভিসম্পাতের। মিশর যে এখন সর্বান্ত, রিক্ত, তার জীবনীশক্তি যে ধাপে ধাপে ক্ষয় হতে হতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে ঐ সব বিপর্যয়ের দরুন, এসব বুঝিয়ে দিলেন সবাইকে। খেদ করে বললেন–“কী বলব তোমাদের, আমি যেন চোখ মেলেই ঝাঁপ দিয়েছি আগুনে। কী এক দুর্বার শক্তি যেন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে—”দেব না, দেব না যেতে। হয়তো তা আমার স্বার্থবুদ্ধি, হয়তো তা আমার পূর্বজন্মের পাপের ফল। মেনাটা আমায় রাজ্য সিংহাসন দিয়ে গিয়েছিলেন শুধু এই উদ্দেশ্যেই যে আমি ইজরায়েলীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের দাবি কখনো মঞ্জুর করব না। হয়তো সেই মৃত ফারাওয়ের আজ্ঞাই আমাকে বাধ্য করেছে এই সর্বনাশা নীতির অনুসরণে।”

আত্মবিলাপ শেষ করে আমেনমেসিস এবার ভবিষ্যতের কথা তুললেন–“দশটা অভিশাপেই মিশর বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে একেবারে। এখনও যদি ইজরায়েলীদের সঙ্গে আমরা বিরোধ চালিয়ে যেতে থাকি, তা হলে ওরা হয়তো জাদুর বলে নীলনদটাই ভরাট করে দেবে বালি দিয়ে। অথবা হয়তো ভূমধ্যসাগরটাকে আকর্ষণ করে আনবে মিশরের বুকের উপরে! এই ভয়েই আমি এবার অনুমতি দিয়েছি যে ওরা যেথা ইচ্ছা চলে যেতে পারে এ দেশ ছেড়ে। আশা করি, এতে তোমাদের অনুমোদন আমি পাব।”

সমবেত মিশরীরা আর কী বলবে? পূর্ব ইতিহাস ফারাও যা বর্ণনা করলেন, তাও তাদের জানা, আবার ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথা তিনি যা আজ শোনালেন, তাও তাদের ধারণার বাইরে নয়। তারা সর্বসম্মতিক্রমেই ফারাওকে জানিয়ে দিল– তিনি যা ব্যবস্থা করেছেন, তাতে তাদের সবাইয়েরই সমর্থন আছে।

কিন্তু এর পরেই নতুন সুর বেজে উঠল সভাস্থলে। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মিশরের রাজকন্যা, যুবরানি উসার্টি। তিনি পুরোপুরি সমর্থন করতে পারলেন না আমেনমেসিসকে। তার বক্তব্য হল এই যে ইজরায়েলীরা যেতে চায় যখন, চলে যাক। ওরকম দুবৃত্ত জাতি দেশে না থাকে যদি, তাতেই দেশের মঙ্গল। কিন্তু তারা সমস্ত ধনৈশ্বর্য সঙ্গে নিয়ে যাবে, এ কেমন কথা? কয়েক শতাব্দী আগে যখন তাদের পূর্বপুরুষেরা নিজের দেশে খেতে না পেয়ে এদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন কি তারা সঙ্গে এনেছিল কোনো ধন বা ঐশ্বর্য? জীর্ণ চীর ছিল তাদের পরিধানে, উদর পূর্ণ ছিল শুধু হাওয়ায়। সেই তারা খেয়ে-পরে চকচকে হয়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে, বংশবৃদ্ধি করেছে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে, মালিক হয়েছে জমিজিরাত, ঘোড়াভেড়া, বাড়ির ও খামারের। কোথায় পেলো? দিয়েছে এই মিশর। থাকত যদি এদেশে শান্তিপ্রিয় নাগরিকের মতে, সে-সব অবশ্যই ভোগ করত। কিন্তু চলে যখন যাচ্ছে, তখন কী অধিকারে নিয়ে যাবে সে-সব? দশ দশটা অভিশাপে মিশরের অন্য সব জমি জ্বলে গিয়েছে, যায়নি কেবল গোসেনের জমি। মিশরের সব প্রদেশের পশুপাল হয়েছে নির্মূল, হয়নি কেবল গোসেনের। এখন তো মিশরীদের চাইতে ইজরায়েলীদের অবস্থা ভাল! এখন কী বলে ফারাও তাদের ঢালাও অনুমতি দিয়ে দিচ্ছেন–গোলার শস্য আর পালের পশু সব তারা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে পুরুষ পরম্পরায় ভোগ করবার জন্য? যাবে যারা, তারা সেই ভিখারীর বেশেই যাক, যে ভিখারীবেশে তারা এসেছিল মিশরে।

দৃপ্তস্বরে বক্তৃতার উপসংহার করলেন উসার্টি ––”মিশরে এখনো একটা বিশাল সৈন্যবাহিনী আছে। আছে দ্রুতগামী রথ, আছে অস্ত্রকুশল পদাতিক। ফারাও আজ্ঞা দিন, এই বাহিনী অচিরে ধাবিত হোক ইজরায়েলীদের আটক করবার জন্য। না, মানুষগুলোকে তারা আটকাবে না। আটকাবে পশুপালকে, আটকাবে গম, রাই, আর ধানের বস্তাকে। মিশরীদের নিজেদেরই এখন বড় অভাব ওসবের! ইজরায়েলীদের ওসব আমরা খয়রাত করতে পারব না এখন।”

দৈবাৎ সেদিন বোকেনঘোন উপস্থিত ছিলেন ট্যানিসে। নিজের কানে তিনি শুনলেন, প্রথমে ফারাওয়ের ভাষণ, তারপরে উসার্টির তর্জন। তারপর ঐ প্রায় দেড়শো বছরের বুড়ো হাড় নিয়ে তিনি ধাবিত হলেন মেম্ফিসে। মেম্ফিসে যুবরাজ শেঠির প্রাসাদে সেদিন দারুণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যুবরাজ ও আমি। রানি মেরাপি স্বপ্ন দেখেছেন একটা। আমাদের কাছে সেটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। যেন একটা বিশাল সেনাদল নিয়ে মিশরের দ্বিমুকুটধারী ফারাও তলিয়ে যাচ্ছেন উত্তাল সমুদ্রের জলে। মেরাপি রাত্রিশেষেই শেঠিকে বলেছেন স্বপ্নের কথা। শেঠি আবার বলেছেন আমাকে, সূর্যোদয়ের পরেই। তারপর শেঠি আর আমি বসে বসে ভাবছি শুধু। ফারাও তলিয়ে যাচ্ছেন সমুদ্রে। কেন? কোথায়? সমুদ্রযাত্রা করার কোন প্রয়োজন হঠাৎ ঘটল আমেনমেসিসের? ইজরায়েলীদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে বলে একটা গুজব ইদানীং শোনা যাচ্ছে বটে। কিন্তু তারা দেশে যাক, আর জাহান্নমে যাক, সেটা তাদের ব্যাপার। ফারাও বা তার সেনাবাহিনী কেন সমুদ্রে তলিয়ে যাবেন? দুটোর ভিতর সংশ্রব কোথায়?

সংশ্রবটা বুঝতে পারা গেল, বোকেনঘো9 ফিরে আসার পরে। আমেনমেসিস প্রথমে অনুমতি দিয়েছিলেন ইজরায়েলীরা তাদের ধনসম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে। পরে উসার্টির উত্তেজনায় তিনিই সসৈন্যে বেরিয়ে পড়েছেন, মিশরত্যাগী ইজরায়েলীদের কাছ থেকে তাদের পশু ও শস্য কেড়ে আনবার জন্য। যদি লোহিত সমুদ্রের এপারেই তিনি ধরে ফেলতে পারেন ইজরায়েলীদের, তাহলে তো ভালই। যদি তা না পারেন, সমুদ্রপারেও তিনি যাবেন সসৈন্যে। সেই যাওয়ার সময়

দেবী মেরাপি যা স্বপ্ন দেখেছেন, ফারাওর সৈন্য সমুদ্র পেরুবার সময় তা ঘটেও যেতে পারে বই কি! মেরাপি যে জাদুকরী, একথা শেঠিও বিশ্বাস করেন না, বোকেনঘোন্‌সুও না। কিন্তু জাদুকরী না হয়েও যে অনেক সময় তিনি নানা রকমের আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাও তো জানা আছে আমাদের। স্বপ্নের আকারে ভবিষ্যৎ যদি নিজেকে উদ্ঘাটন করে থাকে মেরাপির সমুখে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

বোকেনঘোন্‌সু বলছেন–“আপনার আর অপেক্ষা করা চলে না যুবরাজ! এক্ষুনি বেরুতে হবে। ফারাও যদি সমুদ্র পেরুবার চেষ্টায় থাকেন, তাহলে তাকে নিবৃত্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে আপনাকে।”

“আমার কী স্বার্থ?”–শেঠি একটা নিস্পৃহ ভাব দেখাবার চেষ্টা করছেন ‘আমি নিষেধই বা করব কেন, আর নিষেধ করলেই বা ফারাও তা শুনবেন কেন?”

“ফারাও না শুনতে পারেন, কারণ ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়েছে তার আর তার নিয়তির মধ্যেকার ব্যাপার। কিন্তু চেষ্টা আপনাকে করতেই হবে। ফারাওকে বাঁচাবার জন্য নয়, সৈন্যবাহিনীটাকে বাঁচাবার জন্য। কারণ ও সৈন্য মিশরের, যে মিশর দুদিন বাদে আপনারই হবে।”

.

৯.

মেরাপিকে সঙ্গে নেওয়া সমীচীন মনে হল না। কারণ এটা আমরা জানি যে বায়ুবেগে রথ চালিয়ে গেলেও আট দিনের কমে আমরা ফারাওয়ের নাগাল পাব না। এই আটদিন ধরে ধাবমান রথের ধাক্কা সহ্য করা কোমলাঙ্গী নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। ওকে সঙ্গে নিলেই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিতে হবে। আর তা নিতে গেলে সব চেষ্টা হবে ব্যর্থ। নিয়তি গ্রাস করবে মিশরী সেনাকে, আমরা কুম্ভীরকুণ্ডে পৌঁছোবার আগে।

কুম্ভীরকুণ্ড হচ্ছে লোহিত সমুদ্রের সেই বিশেষ অংশটা, যেখানে সমুদ্র শাখাটা সবচেয়ে সংকীর্ণ আর অগভীর। ইজরায়েলীরা সেইখান দিয়েই সমুদ্র পেরুবে, এই রকমই জনশ্রুতি শুনে এসেছেন বোকেনঘোষ্ণু। দেখে এসেছেন যে আমেনমেসিসও সসৈন্যে যাত্রা করলেন সেই কুম্ভীরকুণ্ডেরই পানে। কাজেই আমরাও যাব সেই কুণ্ড লক্ষ্য করেই।

মেরাপি কাতর হলেন খুবই। একমাত্র সন্তানকে হারাবার পরে তিনি যেন শেঠিকে পলকের জন্যও আর চোখের আড়াল করতে চান না। তবু বিষয়টার গুরুত্ব প্রণিধান করতে তার দেরি হল না, তিনি সাহস দেখিয়ে বললেন–“আমার জন্য চিন্তা করো না তোমরা। এ-প্রাসাদে আবার ভয় কী? অসুবিধাই বা কী? আমি খুবই সাবধানে থাকব। তোমরা কার্যসিদ্ধি করে সগৌরবে ফিরে এসো।”

মেরাপির কাছে বিদায় নিলাম। রক্ষীসৈন্যকে বিশেষ করে সতর্ক করা হল। সযতনে প্রাসাদ পাহারা দেবে তারা, রক্ষা করবে মেরাপিকে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেবে না প্রাসাদ সীমায়। প্রয়োজন হলে অবাঞ্ছিত প্রবেশার্থীকে হত্যাও করতে পারবে, তার জন্য দায়-দায়িত্ব সব যুবরাজ শেঠির।

বিদায় নিলাম আমরা। বায়ুবেগে ধাবিত হল অশ্ব। মাঝে মাঝেই ঘোড়া বদল করে নিচ্ছি। যে-কোনো শহরেই মেলে ঘোড়া। বিশেষত যুবরাজ শেঠির নাম করলে তো যে-কোনো গৃহস্থই ঘোড়া সরবরাহ করবে আহ্লাদ করে। তবে কথা এই, সব জায়গায় তেমন ভাল ঘোড়া পাওয়া তো সম্ভব নয় অল্প সময়ের মধ্যে। গতি মন্থর হলেই আমরা অধীর হয়ে উঠি।

অবশেষে আট দিন পরে আমরা পৌঁছোলাম। ঠিক কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে নয়, তীরে পৌঁছোবার উপায় নেই। সমুদ্রতীর জুড়ে ছাউনি ফেলেছে লক্ষাধিক ইজরায়েলী। তার পিছনে শিবির পড়েছে মিশরী সেনার। এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান রচনা করেছে এক আশ্চর্য বস্তু। আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত আলম্বিত ঘোর কৃষ্ণ একখানা নিচ্ছিদ্র বিশাল মেঘ। পথে আসতে আসতে এই ব্যাপারটার সম্পর্কে কিছু কিছু জনরব আমরা শুনেছি। শুনেছি যে দিনের বেলায় ইজরায়েলী চমূর আগে আগে চলে একটা আকাশচুম্বী স্তম্ভ, আগুনের মতো রং তার। কিন্তু সূর্যাস্তের পরে (সেই স্তম্ভ সমুখ থেকে চলে আসে ইজরায়েলীদের পিছনে, তখন এর রং হয় কালো, আর স্তম্ভের মতো আকাশপানে না উঠে এটা দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, ইজরায়েলী ছাউনিকে মিশরীদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে। তা দিনের বেলায় এর সেই অগ্নিস্তম্ভের মতো রূপ দেখবার সুযোগ অবশ্য হয়নি আমাদের, কিন্তু রাতের চেহারার যা বর্ণনা এর শুনেছিলাম, তা দেখলাম বর্ণে বর্ণে ঠিক।

ফারাও আমেনমেসিস তখন উজির, সভাসদ, সেনানীদের নিয়ে ভোজনে বসেছেন। আমরা শিবিদ্বারে পৌঁছোতেই সৈনিকেরা যথারীতি জিজ্ঞাসা করল “কে যায়?” আমি উত্তর দিলাম–“মিশর যুবরাজ শেঠি মেনাটা।” আশ্চর্য হয়ে গেলাম সৈনিকদের আচরণে। বাইরের লোক সৈন্য শিবিরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রহরীসেনার কর্তব্য হল উপরওলাদের কাছে এত্তেলা করা। কিন্তু এক্ষেত্রে সে-এত্তেলা এরা করল না কেউ। শেঠির নাম শোনামাত্র সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে তাকে পথ ছেড়ে দিল। আমরা প্রবেশ করলাম শিবিরে।

ফারাওয়ের ভোজসভার জাঁকজমক এই সঙ্গিন মুহূর্তেও কিছু কম নয়। বরং সমবেত অতিথিদের বেশ যেন উৎফুল্লই মনে হল। এতদিন মিশরী সেনা পশ্চাদ্ধাবনই করে এসেছে ইজরায়েলীদের, কিছুতেই তাদের নাগাল পায়নি। আজ কিন্তু ওদের সমুখে দুর্লঙ্ঘ্য সমুদ্র, রাত্রি অবসানে ধরা না পড়ে ওরা যাবে কোথায়? এতদিনকার মেহনত মিশরী সেনার, কাল শেষ হবে তার। ভাল করে খাওয়া দাওয়া করছেন আজ মিশরী নেতারা।

“কে আসে বিনা এত্তেলায়?”“ক্রুদ্ধ প্রশ্ন এল ভোজ-টেবিল থেকে।

আমি উত্তর দিলাম–“মিশর যুবরাজ শেঠি মেনাটা ও তাঁর সঙ্গে রাজসভাসদ বোকেনঘোনসু ও রাজবন্ধু লেখক অ্যানা। মহামানা হারওয়ের দর্শনপ্রার্থী।”

নিজেই এবার কথা কইলেন ফারাও–“সব পুরাতন বন্ধু? আসুন যুবরাজ শেঠি, সঙ্গীদের নিয়ে আসন গ্রহণ করুন, যোগ দিন এই আনন্দভোজ।”

“ফারাওকে ধন্যবাদ।”–জবাব দিলেন শেঠি, ফারাওয়ের মর্যাদার অনুযায়ী কোনো সম্মান তাকে না দেখিয়ে-কিন্তু আনন্দ করবার মতো সময় এটা কিনা, আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে ফারাও। ইজরায়েল-নন্দিনী মেরাপির কথা শুনে থাকবেন, তিনি কিছু কিছু অসাধারণ শক্তির অধিকারিণী। তিনি একটা স্বপ্ন দেখেছেন কয়েকদিন আগে। স্বপ্নটা এই যে ইজরায়েলীদের অনুসরণ করতে গিয়ে মিশরের ফারাও সসৈন্যে ডুবে মরেছেন অতল সমুদ্রে। এই স্বপ্নের বৃত্তান্ত শোনামাত্র আমি যাত্রা করেছি মেম্ফিস থেকে, দিবারাত্রি রথ চালিয়ে আট দিনে এসে পৌঁছেছি কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে। এখন আমার অনুরোধ, ফারাও কদাপি মিশরী সেনাকে সমুদ্র পেরুবার আদেশ দেবেন না, দেন যদি, মিশরের হয়তো তাতে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

ফারাও অট্টহাস্য করে উঠলেন–“পরামর্শটা দিচ্ছেন সেই মেরাপি, নয়? জাদুশক্তির বলে যিনি আমন দেবতার বিগ্রহ চূর্ণ করেছিলেন? পয়গম্বরদের অভিশাপে অভিশাপে মিশর যখন ধ্বংস হতে বসেছিল, যিনি তখন মেম্ফিসে নিজের বাসভবনটিকে নিরাপদ রেখেছিলেন জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। অথচ প্রতিবেশী মেসিবাসীদের নিরাপদে রাখবার জন্য একটি অঙ্গুলিও উত্তোলন করেননি। শুনুন সবাই, আমাদের চিরহিতৈষিণী সেই জাদুকরী আজ বলে পাঠাচ্ছেন মিশরী সেনা যেন সমুদ্র পেরুবার চেষ্টা না করে, অর্থাৎ পলাতক ইজরায়েলীদের যেন স্বচ্ছন্দে কুম্ভীরকুণ্ড অতিক্রম করে সিনাই মরুতে চলে যেতে দেয়। বাহবা পরামর্শ! এ পরামর্শও কি আমরা না নিয়ে পারি?”

কথা শেষ করে ফারাও অমেনমেসিস অট্টহাস্য করে উঠলেন, আর সভাসদ সেনানীদের একাংশও যোগ দিল সেই হাসির রোলে। শেঠি বুকের উপরে দুই হাত বেঁধে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছেন, এই উন্মত্ত পরিহাসে তিলমাত্র বিচলিত হবার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে নেই।

হাসির রোল কতকটা থামল যখন, তখন তিনি উচ্চকণ্ঠে অথচ শান্তভাবেই পুনরুক্তি করলেন–“আমি আবারও বলছি ফারাও, মিশরের মুখ চেয়ে আপনি এখনও নিবৃত্ত হোন, কদাপি সমুদ্র পেরুতে যাবেন না, ইজরায়েলীদের পিছনে পিছনে।”

“নিশ্চয় যাব’–হুঙ্কার করে উঠলেন আমেনমেসিস–“এবং তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। আমরা মরি যদি, মরবে তুমিও।”

“মরব একদিন নিশ্চয়ই, কিন্তু সমুদ্রে ডুবে মরব না”–বললেন শেঠি “ফারাও যদি আমার কথায় কোনোমতেই কর্ণপাত না করেন, তবে আর আমি কী করতে পারি? আমি বিদায় নিচ্ছি।”

আবার হুঙ্কার ফারাওয়ের–“কক্ষনো না। তোমাকে যেতেই হবে আমাদের সঙ্গে। ধর ওকে সেনানীরা!”

সম্রাটের আজ্ঞা, সেনানীরা যে যার আসন থেকে লাফিয়ে উঠল বৈকি! কিন্তু এ কী হল তাদের? কেউই যে সমুখে পা বাড়াতেই পারে না! এগুবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা তারা স্পষ্টতই করছে, কিন্তু শ্রীচরণ যেন আজ ঘোরতর বিদ্রোহী তাদের! একবার তাদের ব্যর্থ প্রয়াসের দিকে, আর একবার ফারাওয়ের হতবুদ্ধি ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গির দিকে তাকিয়ে শেঠি ধীর পদে অপসৃত হলেন ভোজঘর থেকে। চলে যাওয়ার আগে বুড়ো বোকেনঘোষ্ণু হেসে উঠলেন হঠাৎ, “এ-পর্যন্ত পাঁচ পাঁচটা ফারাওকে আমি দেখেছি মিশরের সিংহাসনে। এই কিন্তু প্রথম দেখলাম এমন এক ফারাওকে, যাঁর আজ্ঞা পালন করবার মতো সৈনিক মেলে না।”

ভোজসভায় যে বিতণ্ডা হয়েছিল ফারাও আর শেঠির মধ্যে, তা কি আর কানে যায়নি সৈনিকদের? শেঠিকে বেরিয়ে আসতে দেখে কেউ তারা হয়তো পথ ছেড়ে দিল অভিবাদন করে, কেউ বা হয়তো এগিয়ে এল, যেন কিছু বলবার মতলবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বলল না কেউ কিছুই, কিন্তু হাবেভাবে প্রত্যেকেই এটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে ইজরায়েলীদের অনুসরণ করে সমুদ্র পেরুনোর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয় তারা।

কয়েকদিন যাবৎ রাতেও বিশ্রাম করিনি আমরা, বসে বসে ঝিমিয়েছি ধাবমান রথের উপরে। আজ আর রথের ধাবন কুর্দনের কোনো প্রয়োজন নেই, রাত্রি প্রভাতে কী ঘটে এই কুম্ভীরকুণ্ডের তীরে, তাই দেখবার জন্য আমরা বসে রইলাম নিশ্চল রথে। সেনাশিবির থেকে বেশি দূরে আমরা যাইনি, যদিও এ-সম্ভাবনার কথা সারাক্ষণ আমাদের অন্তরে জাগরূক ছিল যে গভীর নিশীথে হয়তো ফারাওয়ের তরফ থেকে একটা চেষ্টা হবে আমাদের হত্যা করবার জন্যই।

সে-আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও আমরা নিকটেই আছি। কী ঘটে, তাই দেখবার জন্যই আছি।

রাত দুপুর। একটা ঝড় বইছে। ঝড়টা এল পুব দিক থেকে, এত প্রবল সে ঝড় যে রথের আড়ালে আমাদের শুয়ে পড়তে হল, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে না পেরে।

হঠাৎ সে ঝড় আবার থেমেও গেল। আর থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শোনা গেল নানারকম বিকট আওয়াজ, আর বহুকণ্ঠের চিৎকার। চিৎকার আসছে মিশরী শিবির থেকেও বটে, মেঘযবনিকার অন্তরালবর্তী ইজরায়েলী ছাউনি থেকেও বটে।

তারপর সারা পৃথিবী দুলে উঠল একবার, যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। যারা চিৎকার শুনে উঠে দাঁড়িয়েছিল, তারা সে-কম্পনে হুমড়ি খেয়ে মাঠিতে পড়ে গেল উপুড় হয়ে। আকাশে চাঁদ উঠছে তখন, সে চাঁদের রং রক্তের মতো রাঙা। সেই চাঁদের আলোতে আমরা দেখলাম, ফারাওর সমগ্র বাহিনী সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

যুবরাজ আমার হাতখানা আঁকড়ে ধরে আছেন। আমি নিজের মনেই বললাম “কোথায়? ওরা যায় কোথায়?”

যুবরাজ বললেন–যায় নিয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কী সে নিয়তি, তা কে বলবে এক্ষুনি?”

আর কোনো কথা কইলাম না কেউ। বড় ভয় করছে যেন!

রাত্রি প্রভাত হল অবশেষে। তখন যে ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল, মানুষের চোখ আগে কখনো দেখেনি তেমন।

মেঘপ্রাচীর অন্তর্ধান করেছে। প্রভাতী সূর্যালোকে আমরা স্পষ্ট দেখলাম, লোহিত সমুদ্রের অগাধ জল আপনাআপনি ভাগ হয়ে গিয়ে মাঝ বরাবর জাগিয়ে তুলেছে। একটা উঁচু জাঙ্গাল। ঐ ভূমিকম্পের দরুনই কি জাগল এটা? কে বলবে? এইটুকু শুধু আমার মনে হল যে ও পথ যমদ্বারে পৌঁছোবারই পথ।

প্রশস্ত সেই পথ বেয়ে কাতারে কাতারে চলে যাচ্ছে ইজরায়েলী জনগণ। ডাইনে জলপর্বত, বাঁয়ে জলপর্বত, মাঝখানে চলমান বিপুল জনপ্রবাহ। মিশরী সেনারা? তারাও চলেছে ইজরায়েলীদের ধরবার জন্য। ঠিক পিছনেই চলেছে তারা। সমস্ত মিশরী বাহিনী, ফারাও সমেত। না, সমস্ত নয়। বাহিনীর কিছু লোক গত রাত্রিতেই পালিয়ে এসেছিল শিবির থেকে, আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের আশেপাশে। এ-প্রলয়ের কালে শেঠির সান্নিধ্যই যে নিরাপদ, এই বিশ্বাসের বশেই এসেছে তারা।

দেখতে পাচ্ছি। সবই দেখতে পাচ্ছি। এইখান থেকেই স্বর্ণরথে সমাসীন ফারাওকে দেখতে পাচ্ছি আমরা, তার চারপাশে দেখতে পাচ্ছি তার রক্ষীসেনাকে, বিশৃঙ্খল, এলোমেলো তার পদক্ষেপ।

“এখন? এখন? কী হবে এখন?”–অধীর হয়ে বিড়বিড় করছেন শেঠি। আর তার জিজ্ঞাসার উত্তরেই যেন পৃথিবী দুলে উঠল দ্বিতীয়বার। আবার ভূমিকম্প? ভূমিকম্প বই কি! তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তাল জলোচ্ছ্বাস। পশ্চিমপানে সমুদ্রে উঠেছে এক তরঙ্গ সম্রাট, তার শীর্ষমুকুট যেন পিরামিড চূড়ার মতো উঁচুতে। ঈষৎ বাঁকানো ফেনায়িত ফণা তুলে সে-তরঙ্গ গড়াতে গড়াতে আসছে, আসছে, আসছে! ফারাও? কোথায় ফারাও? কোথায় তার দুই হাজার রথ, বিশ হাজার পদাতিক? তরঙ্গ দানবের জঠরে এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম তাদের, তার পরে জল! জল! জল ছাড়া কোথাও কিছু নেই। পূর্ব দিকের জলপাহাড় ভেঙে নেমেছে পশ্চিমে, পশ্চিম দিকের জলপাহাড় ভেঙে নেমেছে পুবে, দুইয়ে মিলে এক হয়ে গিয়েছে, অবিচ্ছিন্ন লোহিত সমুদ্র। সেই সমুদ্রেরই উপর দিয়ে আমি যেন দেখতে পেলাম মিশর অভিমুখে পলায়মান মহা-মহা দেবদেহ, আমন, অসিরিস, টা, আইসিস, মাট। অকারণে তারা পালাচ্ছে না, পিছনে পিছনে আগুনের চাবুক হাতে তাদের তাড়া করে নিয়ে আসছে এক মহান অগ্নিস্তম্ভ।

কিন্তু দূরে?

দূরে, লোহিত সমুদ্রের পূর্ব কুলে তখন ইজরায়েলী জনতা নিরাপদে এগিয়ে চলেছে সিনাই মরুর অভিমুখে।

কতক্ষণ আমরা তাকিয়ে থাকতাম সেদিকে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, তা কে জানে? কিন্তু হঠাৎ রূঢ় আঘাতে মোহভঙ্গ হল আমাদের। পিছন থেকে একটা নারীকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ আমরা শুনতে পেলাম, যুগপৎ যুবরাজ ও আমি দুজনেই শুনতে পেলাম এক অশরীরী হাহাকার–“বাঁচাও! প্রভু শেঠি! বাঁচাও আমাকে।”

চমকে পিছন ফিরলাম দুজনেই। কেউ কোথাও নেই। কিন্তু ও কণ্ঠস্বর তো আমাদের ভুল হবার উপায় নেই! ও-আর্তনাদ মেরাপির।

***

আট দিন পথেই কাটল আমাদের।

বায়ুবেগে ঘোড়া ছুটিয়েছি দিবারাত্রি। মেরাপি! মেরাপি! কী হল ইজরায়েল চন্দ্রমা মেরাপির? কেন আমরা দেখলাম তার অশরীরী ছায়ামূর্তি? কেন শুনলাম তার করুণ আর্তনাদ? পারব কি আমরা সময়মতো পৌঁছোতে? পারব কি তাকে রক্ষা করতে? বৃদ্ধ বোকেনঘোন্‌সু বলছেন–“ঐ পামর জাদুকর কাই-ই কিছু করেছে তার।”

বায়ুবেগে ছুটেছে আমাদের রথ। তবু আমরা দেখছি, জনরব ছুটছে আমাদেরও আগে আগে। যে কোনো জায়গায় ঘোড়া বদলাবার জন্য থামছি আমরা, দলে দলে মানুষ ঘিরে ধরছে আমাদের, সর্বত্রই একই প্রশ্ন সকলের মুখে–“ফারাও নাকি সসৈন্যে ডুবে গিয়েছেন লোহিত সমুদ্রে?”

“দেখলাম তো সেই রকমই”-উত্তর দিচ্ছি আমরা।

বায়ুবেগে রথ ছুটল দিবারাত্রি, আট দিন পুরো। অবশেষে মেম্ফিস। মেম্ফিসের সিংহদ্বার রুদ্ধ। আমরা সবলে পদাঘাত করলাম সেই দ্বারে। ভিতর থেকে প্রশ্ন করল প্রহরী–“কে তোমরা?”

“সপারিষদ ফারাও শেঠি” “অকম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন বৃদ্ধ বোকেনঘোন্‌সু।

“শেঠি ফারাও? ফারাও তো আমেনমেসিস!”

“ছিলেন আমেনমেসিসই ফারাও। তোমরা কিসের নেশায় বিভোর হয়ে আছ যে সারা মিশর যা শুনেছে, তোমরা তা শোননি? আমেনমেসিস লোহিত সমুদ্রের তলায়। আজকার ফারাও শেঠি মেনা। খোলো দ্বার! খোলো!”

ঘড়াং ঘড় শব্দে খুলে গেল বিশাল সিংহদ্বার। শেঠির সমুখে নতজানু রক্ষিবৃন্দ, মুখে তাদের জয়ধ্বনি–“জীবন! রক্ত! শক্তি! ফারাও! ফারাও। ফারাও!

সারা মেম্ফিসে প্রচণ্ড কোলাহল–“ও কীসের গোলমাল?”–প্রশ্ন করলেন শেঠি।

রক্ষী বলল–“এক ইজরায়েলী জাদুকরী নাকি ধরা পড়েছে, তাকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আমন মন্দিরের সমুখে। তারই কোলাহল।”

মারা হচ্ছে? হয়নি তাহলে এখনো? পারব কি আমরা? পারব কি সময় থাকতে আমন মন্দিরে পৌঁছাতে? বায়ুবেগে রথ ছুটেছে মেম্ফিসের রাজপথে। কতদূর? কতদূর আর আমন মন্দির?

বিরাট অগ্নিকুণ্ড আমন মন্দিরের সমুখে। জনতা আজ কাইয়ের আজ্ঞাবহ। কাই বুঝিয়েছে–পরপর ঐ যে দশটা অভিশাপে শ্মশান হয়ে গেল সোনার মিশর, সে-সব অভিশাপ আসলে এই জাদুকরী মেরাপিরই ইন্দ্রজাল। সব ইজরায়েলী ছেড়ে গিয়েছে মিশর, এ তবু যায়নি, নিশ্চয় ও রয়ে গিয়েছে মিশরের আরও কিছু অনিষ্ট করবার জন্য। এই বেলা পুড়িয়ে মার একে।”

জনতা মেরাপিকে বেষ্টন করে আছে। এইবার তাকে ধরে আগুনে ফেলে দেবার জন্য তৈরি হল। প্রাণভয়ে মেরাপি চেঁচিয়ে উঠল—“বাঁচাও! প্রভু শেঠি! বাঁচাও আমাকে?”

আর সে-আর্তনাদের রেশ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে না যেতে আমি আর বোকেনঘোন্‌সু হুঙ্কার করে উঠলাম–“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও! ফারাও!” সন্ত্রস্ত জনতা দুই ভাগ হয়ে গেল চকিতে, রাজরথ ঘর্ঘর শব্দে ছুটে এসে পড়ল আমন মন্দিরের সমুখে। লাফিয়ে নামলেন তা থেকে নবীন ফারাও শেঠি, মেরাপিকে বেষ্টন করলেন বাহুযুগলের আলিঙ্গনে।

“জীবন! রক্ত! শক্তি। ফারাও! ফারাও! ফারাও!”

কাই প্রশ্ন করেছিল-ফারাও তো আমেনমেসিস?

বোকেনঘোন্‌সু উত্তর দিয়েছেন–“আমেনমেসিসের সমাধি হয়েছে লোহিত সমুদ্রের অতল তলে। কিন্তু ফারাওয়ের আসন শূন্য থাকে না। নতুন ফারাও এই শেঠি মেনাটা তোমার সমুখে।”

এবার কাই নিঃশব্দে অপসৃত হওয়ার চেষ্টা করছে, শেঠির আদেশে জনতাই তাকে ধরে ফেলল। কী চপল এই জনতার চিত্ত! কাইয়ের প্ররোচনায় তারা মেরাপিকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে যাচ্ছিল, এখন শেঠির আদেশে তারাই কাইকে নিক্ষেপ করল অগিকুণ্ডে।

মেরাপিকে আমরা প্রাসাদে নিয়ে এলাম। কিন্তু তার স্নায়ুমণ্ডলীতে লেগেছিল প্রচণ্ড আঘাত, তিন দিনের দিন শেঠির কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল ইজরায়েল চন্দ্রমা।

শেঠির যখন অভিষেক হল মিশর সিংহাসনে, রানির আসনে উপবেশন করলে যিনি, তিনি উত্সাটি, মেরাপি নন। কিন্তু তাতে যে মেরাপির আত্মার ক্ষোভের কারণ হয়েছে কিছু, আমি অ্যানা তো তা মনে করি না। মেরাপি যা চেয়েছিলেন তা তিনি পেয়েছিলেন। সে-বস্তু মিশর সিংহাসনের অর্ধাংশ নয়, শেঠির হৃদয় সিংহাসনের উপরে পরিপূর্ণ অধিকার। তা তিনি পেয়েছিলেন। রাজ্যলাভের পরে ছয় বৎসর জীবিত ছিলেন শেঠি, এই ছয় বৎসরের ভিতর এক মুহূর্তের জন্যও মেরাপি ভিন্ন অপর কাউকে তিনি পত্নী বলে ভাবতে পারেননি।

ছয় বৎসর রাজত্ব করার পরে শেঠি যখন স্বর্গারোহণ করলেন, তখন তার কফিনের ভিতরে, তার বক্ষের উপরে, আমি রাজবন্ধু লেখক অ্যানা সাশ্রুনেত্রে স্থাপন করলাম একটা দ্বিখণ্ডিত স্ফটিক পেয়ালার দুটো অর্ধাংশ, আমাদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সেই আদি প্রতীক।

3 Comments
Collapse Comments

ঈশ্বরের মুখোশ উপন্যাসটা কি পাওয়া যাবে?

Bangla Library (Administrator) December 24, 2020 at 7:33 pm

নতুন লেখকেরা আপত্তি জানান বলে নতুন বই দেয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন অনেকে।

Shiva Trilgi by Amish Tripathi, Bangla অনুবাদ পাওয়া যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *