২
যাবার দিন ঠিক হয়ে গেল। রামলাল খুব সেকেলে নয়, বাড়ি থেকে বেরুবার সময় সে পুঁজিপুঁথি মানে না। রামলালের স্ত্রী অন্নপূর্ণা আত্মীয়ের বাসায় যেতে হলে যে সব জিনিস হাতে করে যেতে হয়, সেই সব গোছাতে লাগলেন। অন্নপূর্ণার আপন ভাই কেউ নেই—খুড়তুতো জ্যাঠতুতো সম্পর্কের ভাই হলেন শরৎকালী গাঙ্গুলী। সেখানে এদের কেউ কখনো যায়নি—তবে শরৎকালী গাঙ্গুলী এই বোনটিকে খুব ভালবাসেন, অবস্থা তত ভাল নয় বলে ভগ্নীপতিকে মাঝে মাঝে কিছু সাহায্যও করেন।
শ্যামলাল আজ দু’দিন ধরে স্কুলের ম্যাপ নিয়ে এসে নানা দাগ দিচ্ছে ও নোটখাতায় কি সব লিখে নিচ্ছে। খুব খুশী হয়েছে সে, কখনো জীবনে কোথাও বেরোয়নি—আজ হঠাৎ এতদূর চলে যাবে!
শ্যামলালের বন্ধু ওপাড়ার রতন হালদার এসে বললে—সে কি রে! তোরা নাকি চলে যাবি শুনলাম? কতদূর যাবি?
শ্যামলাল ম্যাপ দেখে পথঘাট ঠিক করচে আজ ক’দিন। বললে—চল, নদীর ধারে গিয়ে বসি—
—আগে বল কতদূরে যাবি?
—এক কথায় বললে হবে না, সেইজন্যেই তো নদীর ধারে গিয়ে বসে বলবো।
—অত ভণিতার দরকার কি বাপু? জায়গাটার নাম বলে ফেলো শুনি।
—নাম বললে তুই কি বুঝবি? জায়গাটার নাম ধুরুয়াডিহি, উড়িষ্যার গাংপুর স্টেট আছে, তারই মধ্যে। বড্ড পাহাড়-জঙ্গলের জায়গা বলে শুনেচি। স্টেশনের নামও ধুরুয়াডিহি।
—কোন দিকে?
—বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের স্টেশন। হাওড়া থেকে উঠতে হবে। আমি সব ঠিক করে রেখেচি ম্যাপ দেখে। চল তোকে সব বোঝাবো।
—অতদূর যাবি কেন? এদেশে ভাত নেই? ইস্কুলে মাস্টারি কর না?
—আমার কোনো অনিচ্ছা নেই। কিন্তু বাবার মত নেই।
—কেন?
—তিনি বলেন, ঐ করে আমার নিজের জীবনটা নষ্ট করেচি, তোমার জীবনটা আর নষ্ট করতে চাইনে।
—তাঁর ইচ্ছে? নষ্ট আর কি হল তাঁর জীবন! বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে টাকায় দশ সের বারো সের খাঁটি দুধ খেয়ে পাঁচ সিকে সের গাওয়া ঘি খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে গেলেন। হয়েচে তোমার আমার বিপদ। আমরা টাকায় পাঁচ পোয়া দুধ কিনবো, তাও জল। ঘি বলে পদার্থ নেই বাজারে। তেল নেই। মাছ মাংস আগুন দর। যে দেশে যাচ্ছ, সে দেশে জিনিস-পত্র সস্তা বলতে পারো?
—তা বলে মনে হয় না। ভারতবর্ষের কোথাও আর এখন জিনিস-পত্তর সস্তা থাকবে ভেবেচ? তবে ঊনিশ আর বিশ।
—তবে অতদূরে কেন?
—বাবা বলেন, আমার জন্যেই তিনি অতদূরে যাচ্ছেন। আমার জন্যে একটা কিছু করে দিতে চান সেখানে।
—তোর যাবার ইচ্ছে আছে?
—বাবা যা বলেন, যাতে উনি সন্তুষ্ট হন, সে-ই এখন আমার ইচ্ছে। এখন বুড়ো হয়ে পড়েচেন তো, কেবল মনে ভাবেন, আমার একটা কিছু করে দিয়ে যাবেন। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে আমার এক মামা ডাক্তারি করেন। আগে ছিলেন তিনি স্টেশনমাস্টার, চাকুরি ছেড়ে দিয়ে এখন ডাক্তারি করেন ওখানেই। বাবা তো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেচেন, তাই সেখানে গিয়ে বসতে চান। আসল উদ্দেশ্য আমার একটা কিছু সুবিধে করে দেওয়া।
—এক বনে দুই বাঘ চলবে। তোমার মামা ডাক্তার, তোমার বাবাকে নিয়ে গিয়ে নিজের পসারের ভাগ দেবেন!
—তা ভাই আমি বলতে পারি নে। সে বুঝবেন ওঁরা দুজন। তবে শরৎকালী মামা মাকে বড় ভালবাসেন এটা জানি। আর তিনিও বুড়ো হয়েচেন, বিদেশে একা বহুদিন আছেন, আপনার লোকজন কাছে রাখতে চান, এও একটা কারণ হতে পারে বোধ হয়।
দুই বন্ধু নদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে অনেকক্ষণ বসলো। কার্তিক মাসের বৈকালে নোনা গাঙের খালে জোয়ার এসেচে—নাটাকাঁটার বন ডুবে গিয়েচে, বেতবনের ডাঁটা ঝুঁকে আছে জলের ওপর। একটা হরিয়াল পাখী উড়ে এসে বসলো ডুমুরের ডালে। রতন বললে—আজ ভূতিদের বাড়ি সত্যনারাণের সিন্নি—সেখানে যাবি সন্দের পর তো?
—ও তো আমার বাঁধা কাজ। যেখানেই সত্যনারাণের সিন্নি হবে, আমাকে পুঁথি পড়তে হবেই।
—বেশ লাগে, না?
—বেশ জ্যোৎস্না ওঠে, নারকোল পাতা চিক চিক করে, শাঁক বাজে, মেয়েরা উলু দেয়—
—থাক ওসব কবিত্ব। আমি সেকথা বলিনি—ভূতিদের বাড়ি পুঁথি পড়তে ভাল লাগে, না?
—যাঃ, ভূতিদের বাড়ি কেন, সকলের বাড়িই ভাল লাগে—
—মিথ্যে কথা বলিসনে। তোকে আর ঢেকে-রেখে কথা বলতে হবে না। ভূতি কি বলেচে তোর যাবার কথা শুনে? সত্যি কথা বল!
—মন খারাপ করেচে।
—কবে তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
—রোজই হয়। চোখের জল ফেলেচে কাল।
—ফেললেই বা কি! তোমার বাবা ভূতির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবেন না।
—না দিলে আমার জোর নেই তো। তবে বাবা এখনো কিছু জানেন না।
—দ্যাখো, আমিও যাবো সত্যনারাণের সিন্নিতে।
কিছুক্ষণ পরে শ্যামলাল তার বন্ধুর সঙ্গে গ্রামের জীবনকৃষ্ণ চক্রবর্তীর বাড়ি সত্যনারাণের পুঁথি পড়তে গেল। চক্রবর্তী মশায়ের ছোট ভাই অঘোর চক্রবর্তী ওদের দেখে বললেন—এই যে! ওই ঘরে যাও। পুজোর জায়গা হয়েচে। হাত পা ধুয়ে নাও। এখনো পুরুতমশায় আসেনি—এসো বসো রতন, ওই শতরঞ্জিখানা বাইরের রোয়াকে পেতে নাও তো বাবা—
রতন বুঝলে তাকে ঘরের মধ্যে যেতে বারণ করা হল। শ্যামলাল ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলে ও অপ্রসন্ন মুখে অঘোর চক্রবর্তীর কথামত কোণ থেকে শতরঞ্জিখানা এনে রোয়াকে পেতে নিয়ে তার ওপরে বসতে যাচ্ছে, এমন সময় একটি গৌরাঙ্গী সুন্দরী ষোল-সতেরো বছরের মেয়ে এসে বললে—রতনদা, একবার পুরুতকাকার ওখানে যাও তো, এখনো কেন এলেন না—
—পুজোর যোগাড় হয়ে গিয়েচে?
—কোন কালে! তুমি যাও, একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলগে—
—তুই বুঝি উপোস করেছিস ভূতি?
—আহা, আমি কেন উপোস করতে যাবো? মা করেচে।
ভূতি কি একটা প্রশ্ন ওকে করতে গিয়েও যেন করতে পারলে না।
রতন চলে গেল। ভূতি ঘরের মধ্যে ঢুকতে গিয়ে সামনেই কুশাসনে উপবিষ্ট শ্যামলালকে দেখে অবাক হয়ে বললে—একি? ভূত নাকি?
শ্যামলাল ঘরের চারিদিকে একবার চট করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললে—বাঃ বাঃ, ভূত তো বটেই! তুই ব্যাকরণ পড়েচিস তো, ভূতের পেত্নী কি হয় বল তো?
—যাও—সত্যি বল না কখন এলে?
—তোর চোখের সামনে দিয়ে তো এলাম, টের পাসনি?
—মাইরি না। মিথ্যে বলচি? আমি রতনদাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম তুমি কেন আসতে দেরি করচো আজ—জিবের আগায় এসে গিয়েছিল, কিন্তু আটকে গেল।
—আটকালো কেন?
—ভূতি ঝংকার দিয়ে বললে—জানি নে। অত খবর দিতে পারবো না। আহা নেকু!
—মারবো তোর মুখে ঝাঁটা—
—মারো না দেখি—
—আচ্ছা মিথ্যে মিথ্যে ঝগড়া করে মরচিস কেন সন্দেবেলা? যা, পুজোর যোগাড় করে দিগে যা। খুড়ীমাকে ডাক দে—
—আচ্ছা শ্যামদা, তুমি সত্যি চলে যাচ্চ সেই কোথায়!
—যাচ্ছি তো।
—কেন যাচ্ছ অতদূরে?
—পেটের ধান্দায়—
—এখানে পেট চলে না? জ্যাঠামশায় এখানে কি করে চালাচ্ছেন?
—বাবা বলেন, এখানে রেখে তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করতে চাইনে। বাবার যা মত, তাই তো আমাকে করতে হবে।
এই সময়ে একটি প্রৌঢ়াকে হরিনামের ঝুলি হাতে বাইরের বারান্দা দিয়ে ঘরের দিকে আসতে দেখে ভূতি দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। প্রৌঢ়া ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে বললেন—বসে কে ওখানে?
শ্যামলাল বললে—আমি, পিসিমা।
—আর কেউ নেই? পুরুত কোথায়?
—আসেননি এখনো। আসুন বসুন পিসিমা, অনেকক্ষণ থেকে একা বসে ভাল লাগচে না।
—না, আমি বাইরে বসে ততক্ষণ একটু জপ সেরে নি।
প্রৌঢ়াকে এ গাঁয়ের সকলে ভয় করে চলে, বিশেষতঃ প্রণয়ভীরু তরুণ-তরুণীরা। কারণ রায়পিসি হলেন এ গাঁয়ের গেজেট। এর কথা ওর কানে সাতখানা করে লাগানো, খুঁজে খুঁজে লোকের দোষ বের করা, কুৎসা রটনা—বিশেষ করে কুমারী মেয়েদের বিয়েতে ভাংচি দেওয়া প্রভৃতি কাজে রায়পিসির জুড়ি মেলা ভার। পরের মন্দ দেখে এত খুশী বোধ হয় আর কেউ হয় না এ গাঁয়ে। এ হেন রায়পিসি ঘরে না ঢুকে বাইরে বসাতে শ্যামলাল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললে।
.
পুরুতঠাকুর কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন। শ্যামলাল পূজা-অন্তে পুঁথি পাঠ করলে। দিব্যি জ্যোৎস্না রাত। প্রসাদের বাটি বিলির ভার শ্যামলাল নিজে নিয়েচে, ইচ্ছে করে—কিছুক্ষণ দেরি করবার জন্যে। এই দঙ্গল বজায় থাকতে ভূতির সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? আপদ বিদেয় হয়েও কি হয়? একদল যায় তো আর একদল আসে।
কাজ মিটতে রাত দশটা বেজে গেল। ভূতির মা এসে বললেন—বাবা, তুমি একটু জল না খেয়ে যেও না যেন। অনেক খাটাখাটুনি করলে। এসো রান্নাঘরের পিঁড়েতে—
শ্যামলাল গিয়ে দেখলে ভূতি সেখানে একখানা বড় আঙট কলাপাতা ছিঁড়ে ওর জন্যেই বোধ হয় জায়গা করেচে। রান্নাঘরের মধ্যে কিন্তু অনেক লোক—তবে তারা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। রান্নাঘরের পিঁড়ের একপাশে ছোট্ট ডোলে ধান তোলা আছে, ডোলের তলায় আট-দশটা পাকা মিঠে কুমড়ো। এক আঁটি শোলা ডোলের চালে তোলা। ভূতির খুড়ীমা একবার বাইরে এসে শ্যামলালকে দেখে বললেন—এসো বাবা, বোসো। ভূতি পাতা ধুয়ে দিইচিস তো? আগে মুগের ডাল ভিজে আর ফলমূল নিয়ে আয় ওঘর থেকে—যা—
শ্যামলাল খেতে বসবার কিছুক্ষণ পরেই খুড়ীমা অন্যদিকে কোথায় কাজে গেলেন। ভূতি একখানা বগিথালা হাতে শ্যামলালের পাতের সামনে এসে যখন দাঁড়ালো তখন রান্নাঘরের পিঁড়ে জনশূন্য।
শ্যামলাল মুখ উঁচু করে চেয়ে বললে—ওতে কি?
—ডাল ভিজে। দেবো?
—দে।
—আর কি দেবো? তুমি তো কবি মানুষ, আদ্ধেক জিনিষ মুখে রোচে না।
—আর যা দিস, শশা আর শাঁকআলু দিস না, দুচক্ষে দেখতে পারিনে।
—তবে দাঁড়াও, লুচি আনি—
—শোন শোন, লুচি থাক। দে যা আছে থালাতে তাই দে।
—হঠাৎ এত ভক্তি ফলমূলের ওপর?
—ওরে দূর! এখুনি কে এসে পড়বে, দুটো কথা হবে না। বুঝিসনে কেন?
—না না, তোমার খাওয়া হবে না। দাঁড়াও।
—এই ভূতি! যাস না বলচি, খবরদার!
ভূতি হেসে ফেললে। থালা নামিয়ে সামনে বসে পড়ে নিম্নস্বরে বললে—রায়পিসি কিন্তু এখনো যায়নি। রান্নাঘরের মধ্যে বসে ছোট খুড়ীমার সঙ্গে কথা বলচে—
—বলিস কি!
—সত্যি বলচি। তা হোক, তুমি বসে খাও, অত ভয় করবার কি আছে? আমি লুচি আনি—
ভূতি থালায় করে গরম লুচি এনে খান-দশ-বারে শ্যামলালের পাতে দিয়ে বললে—রায়পিসি খেতে বসেচে ওদিকের চালায়—
শ্যামলাল বললে—বাঁচা গেল! খাওয়া ফেলে ও বুড়ী আর উঠচে না। তারপর শোন, আমার কথা মনে থাকবে?
ভূতি মুখভঙ্গি করে বললে—আহা। তা কি আর থাকবে?
—চিঠি দিবি?
—কি করে দেবো? তা বুঝি দেওয়া যায়?
—আমি যদি দিই?
—না, ওসব করতে যেও না। গাঁ জানো তো? এমনি তো কত রকম কথা উঠিয়েচে—
—আমার কথা মনে থাকবে তো?
—আহা কি কথার ছিরি! কেউ বুঝি আবার কারো কথা ভোলে?
—কেউ ভোলে কি না সে কথার দরকার কি? তুই ভুলবি নে তো?
—জানি নে। খেয়ে নাও ভাল করে। লুচি ফেললে চলবে না।
শ্যামলালের কবিপ্রাণ যেমনটা আশা করেছিল তেমন ধরনের কোনো মিষ্টি মোলায়েম নাটুকে ব্যাপার বা কথাবার্তা কিছু ঘটলো না। গল্পের বই-টইয়ে যেমন ধারাটি পড়া যায় তেমন হল কই?
খেয়ে চলে আসার সময় ভূতি ওর হাতে একটা সাজা পান দিয়ে কেবল হেসে ওর মুখের দিকে চাইলে। ছোট্ট করে বললে—এসো শ্যামদা—
—হুঁ।
—কবে যাচ্চ?
—পরশু সকালে।
—আসবে কবে?
—তা আর কি জানি!
—শীগগির এসো—
ব্যস, এই পর্যন্ত শেষ। শ্যামলাল অপ্রসন্ন মনে বাড়ির দিকে রওনা হল। কয়েক পা আসতে না আসতে পেছন থেকে রায়পিসি বলে উঠলেন—ও শ্যামা, একটু দাঁড়িয়ে যাও বাবা—আমায় নিয়ে যাও—
ভালো মুশকিল! শ্যামলাল যা পছন্দ করে না তাই। বাধ্য হয়ে দাঁড়াতেই হল।
রায়পিসি এগিয়ে এসে ওর পাশে পাশে চলতে লাগলেন। শ্যামলাল বললে—আপনার বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসবো পিসিমা?
—না বাবা, এই ঠাকুরবাড়ির পুকুর পর্যন্ত এগিয়ে দিলিই হবে। আজকাল আবার যা বাঘের ভয় হয়েচে—
—চলুন।
কিন্তু রায়পিসি কিছুক্ষণ পরেই প্রকাশ করলেন যে পরের কথা ছাড়া তিনি থাকেন না। প্রথমে তুললেন শ্যামলালের বাবার কথা।
—হ্যাঁরে শ্যামা, তোর বাবার চাকরিটা গেল কেন? আহা কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে এই বয়সে—দাঁড়াবার থল নেই! অতি কষ্টে চালাচ্ছিলেন দাদা—
শ্যামলাল অত্যন্ত চটে গেল। তার বাবাকে নিচু করে দিয়ে যে কোন কথাই হোক না কেন, তার ভাল লাগে না। তার বাবা গরীব, একথাও তার সহ্য হয় না। সে বললে—তা আর কি হবে বলুন!
—চাকরিটা গেল কেন? আচ্ছা দাদা তো অনেককাল থেকেই পণ্ডিতি করছিলেন, ভালই পড়াতেন শোনাতেন—
অর্থাৎ চাকরি থেকে কোন দোষে রামলাল বরখাস্ত হয়েছেন সেই সংবাদটাই রায়-পিসি জেনে নিতে চান এবং রায়পিসির ধারণা রামলাল অকৃতকার্যতার জন্যেই চাকরিটা হারিয়েচেন।
শ্যামলাল বললে—ষাট বছর বয়স হলে আর চাকরিতে রাখার নিয়ম নেই গবর্ণমেণ্টের।
—দাদার বয়েস ষাট বছর হয়েচে নাকি?
—তার দু’এক বছর বেশী ছাড়া কম নয়।
রায়পিসি কপট সহানুভূতির সুরে বললেন—আহা কি বিপদেই পড়ে গেলেন দাদা এই বয়সে—এই বাজারে এখন সংসার চালানোই যে দায়! দুবেলা ভাত জোটাই যে মুশকিল হয়ে পড়লো!
অর্থাৎ কোনো রকমে শ্যামলালের মুখ দিয়ে যদি বেরোয়, তাই তো পিসি, সত্যিই বড় কষ্ট হয়েচে সংসারের—তবে রায়পিসি সেই একখানা কথা সতেরোখানা করে পাড়ায় পাড়ায় রটনা করে বেড়াবেন।
—আহা, আর কি বলবো, কি কষ্টেই পড়েছে রামু পণ্ডিত! কোন বেলা হাঁড়ি চড়ে, কোন বেলা চড়ে না। কাল ছেলেটা কত দুঃখু করতে লাগল আমার কাছে, মধ্যে একদিন খাওয়াই হয় নি শুনলাম—তা হবে না? ধাড়ি অত বড় ছেলেটা কোন কাজ করে না, শুধু বসে বসে গিলবে—আর স্বভাব-চরিত্তির যা, সে আর—
এই পর্যন্ত বলে রায়পিসি হঠাৎ সুর নিচু করে ফেলবেন গলার, তারপর এদিক-ওদিক চেয়ে বলবেন—এ মিথ্যে কথা নয়, নিজের চোখে দেখা—ওই নিবারণ চক্কত্তির মেয়েটার সঙ্গে—সে-সব কেলেঙ্কারির কথা বাপু আর না বলাই ভাল—নিজের চোখে যদি না দেখতাম—যাক গে, ওসব পরের কথায় থাকিও নে, সে-সব কথায় দরকারও নেই—
কিন্তু শ্যামলাল টোপ গিলল না, কারণ তার বাবাকে ছোট করে দেওয়াতে সে গোড়া থেকেই চটে গিয়েচে। শ্যামলালকে না চিনে রায়পিসি চালে ভুল করে ফেলেচেন।
সে বললে—বাবা হোমিওপ্যাথিক জানেন, তাই করবেন।
—সে-সব বাবা এদেশে চলবে না। ও হুমানপ্যাথির জলে এদেশের লোকের বিশ্বাস তো ভারি!
—না, এদেশে নয়।
—ও, তবে কোথায়?
—আপনি কি বুঝতে পারবেন পিসি? সে অনেকদূর, পশ্চিমে।
—পশ্চিমে! গয়া কাশী নাকি?
—ওদিকে না। আপনি বুঝতে পারবেন না। সেখানে আমার এক মামা থাকেন, তাঁরই কাছে। আমিও যাবো বাবার সঙ্গে—
রায়পিসি যেন কিঞ্চিৎ দমে গেলেন। খানিক দূর পর্যন্ত কোন কথা না বলেই পাশাপাশি হেঁটে চললেন। পরে হঠাৎ শ্যামলালের দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—হ্যাঁরে, বলি নিবারণের মেয়েটার সঙ্গে কি তোর বিয়ের কোনো কথাবার্তা চলচে?
প্রশ্নের আকস্মিকতায় শ্যামলাল একটু চমকে গেলেও তখুনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললে—কে? ভূতি? রামোঃ! আমার আর কি খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই? তাছাড়া বিয়ে করে এখন আমি খেতে দেবো কি?
—তাহলে তোদের বিয়ের কথাবার্তা কিছু হয়নি? সর্বদা মেলামেশা করিস কিনা তাই বলচি—
—রামোঃ! অমন কানে-পুঁজপড়া মেয়ে আমার বিয়ে করবার দায় পড়ে গিয়েচে। যেমন কালো, তেমনি হুমদো—তেমনি ঝগড়াটে—
ইচ্ছে করেই শ্যামলাল ভূতির বিরুদ্ধে এই মিথ্যা বিশেষণগুলি প্রয়োগ করলে—এ ছাড়া আর কোন কৌশল হঠাৎ তার মাথায় এলো না। ওর গলার সুরে ভূতির প্রতি যদি এতটুকু অনুরাগ ধরা পড়ে যায়—এই হল শ্যামলালের আসল ভয়। রায়পিসিও রটনা করে বেড়াবার মস্ত বড় একটা বিষয় পাবে তা হলে। না, রায়পিসি যেন বেশ খানিকটা দমেই গেলেন। মনে মনে যেটা চাচ্ছিলেন তিনি, সেটা হল না। কথা দিয়ে কথা বের করবার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, এতটুকু পেলেও কাজ হত যে!
শ্যামলাল তাঁকে পুকুরের পাড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললে—তা হলে যাই, পিসিমা। দাঁড়ান, একটু পায়ের ধুলো দিন, দেশ থেকে চলে যাচ্চি, আপনাদের আশীর্বাদই ভরসা।
—এসো বাবা এসো, ধনেপুত্রে লক্ষ্মীশ্বর হও। বেঁচে থাকো। দাঁড়া—কাছে আয়—
রায়পিসি ওর চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেলেন।