যাচ্ছিস কোথায়?
স্টেশানে।
কেন? কেউ আসবেন বুঝি? কিন্তু এখন তো কোনো ট্রেন নেই। এই অসময়ে?
সাইকেল থেকে নেমে পড়ল ঝিঁঝি। লেডিস সাইকেল থেকে। মনোয়া-মিলনেও অধিকাংশর-ই বাহন সাইকেল। আমেরিকায় যেমন গাড়ি। শহরে পা।
ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিল। নাকটা তেলেতেলে। একটুতেই ঘেমে ওঠে নাক। মাথায় একটা তালপাতার টোকা। মাথার দু-পাশ দিয়ে কোমর-সমান চুল নেমে এসেছে। সদ্যস্নাতা। এই ছোটো, প্রায় গ্রাম-সদৃশ ‘মনোয়া-মিলন’ জায়গাটাতে এখনও মেয়েদের মধ্যে চুল-কাটার মহামারিটা এসে পৌঁছোয়নি। রোদে চকচক করছে কোমর-সমান চুল। সুগন্ধি তেলের বাস উড়ছে বাতাসে। এখন চৈত্রমাস।
গতবছর পৌষমেলাতে মণিমাসিদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে গেছিল ঝিঁঝি। তখন-ই কিনে নিয়ে এসেছিল টোকাটা। এদিকে তালগাছ নেই-ই বলতে গেলে। টোকা বানাতে কেউ জানেও না। তাই স্থানীয় মানুষেরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখে টোকাটাকে।
এখনও তো গরম পড়েনি। এরইমধ্যে মাথায় টোকা চড়িয়েছিস যে? তা ছাড়া, তুই তো টেকোও নোস।
শিরীষ, উত্তর পাক আর নাই-ই পাক, প্রশ্নই করে চলল ঝিঁঝিকে লাগাতার।
শিরীষ অমন-ই ছটফটে। অধৈর্য। আয়নাতে নিজের মুখ দেখা ওর স্বভাব নয়। ওর চেহারা এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন অন্য চোখে বা অন্য মনে পড়ল কী পড়ল না, তা নিয়েও কোনোদিন কোনো মাথাব্যথা ছিল না ওর। ও নিজের ছন্দে, নিজের লয়ে, নিজের তালে চলে। কে কী বলল ওকে, কে কী ভাবল; তা নিয়ে ওর কোনোদিনও কোনো মাথাব্যথা নেই। নদীর মতো ওর চলা। কারো ডাকে বা কারো মানাতে কান দেওয়া বা থেমে যাওয়া ওর চরিত্রে আদৌ নেই।
জল খাবি? তোর কালো মুখটা তেতে বেগুনি হয়ে গেছে।
নাঃ। সবাই তো তোর মতো ফর্সা নয়। ফর্সা মানে জানিস? ফর্সা মানে, রংহীনতা। আমি কালো। বেশ ভালো।
ঝিঁঝি সাইকেলে উঠবে বলে দু-হ্যাণ্ডেলে দু-হাত রেখে ডান প্যাডলে পা রাখবে বলে ডান পা-টি তুলল।
কী রে! উত্তর দিলি না তো আমার কথার। কেউ কি আসবেন? স্টেশনে যাচ্ছিস যে!
এই সময়ে কি কোনো ট্রেন আসে?
ঝিঁঝি বলল উলটে; শিরীষের প্রশ্নর উত্তর না দিয়ে।
না, তা নয়। তবে ঝিঁঝি ব্যানার্জি যদি স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ায় তবে, শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস পর্যন্ত অ্যাটেনশানে দাঁড়িয়ে যাবে। ঝিঁঝি-হল্ট। এই লাইনের একটা স্টেশনের নাম একসময়ে ছিল ‘আণ্ডা-হল্ট’। তা কি জানিস? মনোয়া-মিলনের নামও না-হয় হয়ে যাবে “ঝিঁঝি-হল্ট”।
কেন?
প্রশ্ন করার সঙ্গে-সঙ্গেই ঝিঁঝির দু-টি ভ্রূ, ভঙ্গিভরে বেঁকে উঠে ধনুকের মতো হয়ে গেল। শিরীষের দু-চোখ টায়ে টায়ে রেখে ও বলল, একথার মানে?
মানে আবার কী? তুই তো একজন ভি. আই. পি.। তাই বললাম।
তুই সবসময়ে ওরকম বাঁকা বাঁকা কথা বলবি না তো। তুই আমার সঙ্গে একেবারে কথা না বললেই খুশি হব।
তোকে খুশি অথবা দুঃখী করতে আমার বয়েই গেছে! কেন যাচ্ছিস তা যখন বলবিই না তাহলে চল আমিও তোর সঙ্গে যাই। ব্যাপারটা ‘ইনভেট্টিগেট’ করে আসি। ইনভেট্টিগেট’ শব্দটাও ও জগাদার মতো করেই উচ্চারণ করল।
ইচ্ছে করেই।
ঝিঁঝি সাইকেলে উঠে, প্যাডল করা শুরু করল এবং তার কিছু বলার আগেই সামনের সেগুন গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে-রাখা ওর সাইকেলটা টেনে নিয়েই তাতে চড়ে বসল শিরীষ। তারপর ঝিঁঝির পাশে পাশে ধীরে ধীরে প্যাডল করতে করতে বলল, তুই তো জানিস-ই; ঝিঁঝি’স উইশ ইজ আ কম্যাণ্ড টু মি!
ঝিঁঝি বলল, ইনকুইজিটিভনেস ভালো, সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর ব্যাপার। কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের ইনকুইজিটিভনেসটা ভালো নয়। সেটা একটা রোগ। পারভার্শান। বুঝেছিস?
হবে হয়তো। কিন্তু কী করা যাবে। মানুষ তো আর নাট-বল্ট নয় যে, হুবহু একইরকম হবে। আমি ওইরকম-ই। বল না, কেন যাচ্ছিস স্টেশনে? অসময়ে?
তুই সত্যিই অসহ্য।
তোর ব্যাপারটাও অসহ্য।
শোন তাহলে। যাচ্ছি, পেঁপে পাওয়া যায় কি না প্ল্যাটফর্মে, তাই খোঁজ করতে, ন্যান্সিমণির কাছে। তুই কি এরপরও পিছু পিছু আসবি ‘ইনভেট্টিগেট’ করতে?
পেঁপে? হায় আল্লা। আমি তো পৃথিবীর সব সেরা সুন্দরীর জন্যেও এমন হন্যে হয়ে কোথাও যেতাম না। আর তুই পেঁপে…। সত্যি! কী অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স!
জানার পরও পিছু ছাড়লি না! তোর স্বভাবটাও তোর কালু কুকুরের-ই মতো হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। সবসময়েই যাকে দেখবি তার-ই পিছু পিছু যাওয়া চাই।
তা কী করব? তুই যে, আমার মালকিন! তা ছাড়া পেঁপে’ বলেই কি তাচ্ছিল্য করা যায়? পেঁপে থেকে কী বেরোয়, তা কে বলতে পারে?
মানে?
মানে, কেঁচো খুঁড়তে সাপের-ই মতো ব্যাপার আর কী! তা হঠাৎ পেঁপের এমন ডিম্যাণ্ড? পলাশ গঞ্জুর বাড়ির উঠোনের গাছেই তো পেতিস। পেঁপেগাছ, মনোয়া-মিলনের কার বাড়িতে নেই? সব বাড়িতেই আছে। শুধু আমাদের বাড়ি ছাড়া। আমাদের বাড়িটা অবশ্য বাড়ির মধ্যেও গণ্যও নয়। দাঁড়কাকের বাসা।
পেঁপেগাছ আমাদের বাড়িতেই নেই। তা ছাড়া, মা সব জায়গাতে লোক পাঠিয়ে খোঁজও করেছিলেন। প্রত্যেকেই সব পেঁপে আজ পাঠিয়ে দিয়েছে চাঁদোয়া-টোড়ির হাটে। আজ সেখানে লালুপ্রসাদ যাদবের মিটিং। পেঁপে তো পেঁপে, শালপাতা পর্যন্ত হয়তো খেতে চাইবে লোকে এই দু-দিন। অতলোকের সারাদিনের খাবার জোটানো কী সহজ কথা!
তা, তোদের বাড়িতে কোন লালুপ্রসাদ আসছেন যে, পেঁপের জন্যে হন্যে হয়ে এই চৈতি রোদে ছুটোছুটি করছিস? তা ছাড়া, প্ল্যাটফর্মের ন্যান্সিমণির কাছেও যে, পাবি তার-ই বা গ্যারান্টি কী? সেও তো প্রতিসপ্তাহে-ই ওইদিনে টোড়ির হাটেই যায়।
জানি। তবু, একটা চান্স নিলাম। এও জানি যে, তার স্টেশান থাকার কথা নয়। সত্যি! একটা দাদা বা ভাই থাকলেও হত। মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তানকে যে, কতরকম হ্যাঁপাই সামলাতে হয়!
তুই বলছিস আমাকে! হাঃ, আরনট উই ইন দ্যা সেম বোট মাদাম?
চার্চের কাছে পৌঁছে ডান দিকে মোড় ঘুরেই শুধোল শিরীষ, তোর এই মহতী মেহনতির পেঁপেটা পাবেন অথবা খাবেন কোন ইতরজনে?
কে যে খাবেন তা ঠিক জানি না। তবে, আমাদের বাড়িতে কালকে কলকাতা থেকে দু তিনজন অতিথি আসছেন। অতিথি। অচেনা। মানে, এখনও অচেনা। তাঁদের মধ্যে একজনের কী না কী রোগ আছে নাকি। সকালে পাকা পেঁপে, দুপুরে কাঁচা পেঁপে সেদ্ধ, বিকেলে পেঁপের হালুয়া, রাতে কাঁচা পেঁপের স্যুপ ছাড়া যে, ক-দিন থাকবেন, সে ক-দিন কিছুই নাকি খাবেন না।
ভদ্রলোকের নামটা কী? পেঁপেদু? তিনি মনোয়া-মিলনে’ না এসে, কলকাতায় বড়োবাজারের ফলপট্টিতেই তো যেতে পারতেন। কষ্ট কম হত। তাঁরও, তোরও। তা, যাঁরা আসছেন, তাঁরা কারা?
কারা, বললাম-ই তো তা জানি না। মানে, সঠিক জানি না। তবে আভাসে ইঙ্গিতে বুঝছি…কিন্তু তোকে বলাটা কি ঠিক হবে? তুই তো মনোয়া-মিলনের গেজেট। একনাম্বারের গসিপ-মঙ্গার।
সাইকেলের স্পিড কমে গেল দু-জনেরই। সামনে দিয়ে একটা কালো বনবেড়াল একদৌড়ে রাস্তা পেরোল। ডানদিকের ঝটি-জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকের শাল-জঙ্গলে ঢুকে গেল।
দাঁড়িয়ে যাবি নাকি একটু?
প্যাডল করা থামিয়ে ঝিঁঝি বলল।
দুস। বলেই শিরীষ বলল, ঠিক আছে। তুই যখন বলছিস, দাঁড়াই। তবে আমার ওসব সুপারস্টিশান নেই। এদিকে এরকম কুসংস্কার আর এমন-ই ভাব দেখাস, ইংরিজি ফুটোস যে; মনে হয়, মেমসাহেব।
কালো বেড়াল যে, অশুভ সে তো সাহেব-মেমসাহেবদের-ই সুপারস্টিশান!
পারি না আর তোদের মতো না-ঘরকা না-ঘাটকাদের নিয়ে।
ত্রিশ সেকেণ্ড পর আবার সাইকেলে উঠেই শিরীষ স্টেশনের আউটার-সিগনালের দিকে চেয়ে বলল, পেঁপেদু সম্পর্কিত সেনটেন্সটা তো কমপ্লিট-ই করলি না।
মা আমার বিয়ের সম্বন্ধ করছেন। কী বুঝলি? বলেওছেন আমাকে। ঘণ্টেমামা এসে পৌঁছোচ্ছেন আজ রাতেই ডালটনগঞ্জ থেকে সেইজন্যেই। তিনিই ওই চক্রান্তের চক্র। কাল ঘণ্টেমামা ঝাণ্ডকে নিয়ে স্টেশনে আসবেন। রামু শেঠ-এর ভটভাটিয়াও ভাড়া করে রেখেছেন মা অগ্রিম, অতিথিদের মালপত্র স্টেশন থেকে আনার জন্যে।
শিরীষের গলাটা হঠাৎ শুকিয়ে গেল কথা শুনেই। রোদটা হঠাৎ যেন, ঠাণ্ডা মেরে গেল। গায়ে যেন জ্বর এল। ডাঙায়-তোলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগল যেন, ভেতরটা। একটু সামলে নিয়ে, সুস্থিত গলাতে শুধোল ঝিঁঝিকে, পাত্রও আসছে নাকি?
জানি না। আসতেও পারে। মা বলেননি কিছু। আজকাল কি আর শিক্ষিত পরিবারে একে অন্যকে না দেখে কেউ বিয়ে করে? যাদের সময় আছে, সুযোগ আছে; তাদের কোর্টশিপও হয়। তবে আমার…
তোর কী?
আমার তো কোনো চয়েস নেই। চয়েস, যে আসছে; শুধু তার-ই, ইউনিল্যাটারাল। অবশ্য যদি আসে আদৌ।
কেন? নেই কেন? চয়েস?
কথাটা বলতে গিয়ে শিরীষের গলাতে থুতু আটকে গেল।
মায়ের কথা শুনেই বুঝে গেছি যে, নেই।
কী করে? বুঝলি কী করে?
আমাদের কি টাকা আছে? আজকাল প্রত্যেক মেয়েকে হয় স্বাবলম্বী হতে হবে, স্বচ্ছল; নয় তার বাবার প্রচুর টাকা থাকতে হবে। নইলে…
তাহলে তুইও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠ।
বোকা বোকা কথা বলিস না।
ওই চেয়ে দেখ। দেখেছিস তো। ন্যান্সিমণি নেই। ফাঁকা। শুনসান সব। এসময়ে কোনোদিন-ই থাকে না। ট্রেন-ই যে, নেই কোনো।
শিরীষ বলল, তোকে বলেইছিলাম।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, যাক গে। তুই আর খামোকা পেঁপে নিয়ে চিন্তা করিস না। যতদিন তোর শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা থাকবেন ততদিন পেঁপের চিন্তা আমার। একটু পরেই আমি খিলাড়িতে কিংবা লাতেহার চলে যাচ্ছি। একবস্তা কাঁচা ও পাকা পেঁপে জোগাড় করে এনে আজ রাতেই কাকিমাকে জিম্মা দিয়ে আসবখন। কাকিমাকে টেনশান করতে মানা করিস, বুঝলি, কি, না? তোর শ্বশুরবাড়ির লোক বলে কথা!
ভালো হবে না বলছি শিরীষ। শ্বশুরবাড়ি! কোথায় কী? কী ধরনের প্রাণী সব নামবে ট্রেন থেকে, ডাইনোসর না ম্যামথ তা-ই জানা নেই।
বা রে। তুই-ই তো বললি। নইলে, আমি কি জানতাম!
যদি স্বাবলম্বী হতাম তবে এই লজ্জাকর ব্যাপারটার সম্মুখীন আদৌ হতাম না। কিন্তু বিহারের এই দেহাতে কোন চাকরিটা পাব বল? আমার বাজার-দরটা কী? সাধারণ, অতিসাধারণ মেয়ে আমি। তা ছাড়া মাকে ছেড়ে যাওয়াও যাবে না কোথাও। কতরকমের প্রবলেম! এবং প্রত্যেকটাই রিয়াল।
কেন? তোর ফিচার্স? তোর গানের গলা? সেগুলো বুঝি কিছুই নয়? তোর বুদ্ধি, সেটাও বুঝি ফালতু? তোর সেন্স অফ হিউমার? তারপরে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, বাজারে তো সাজানো থাকে অনেক জিনিস। সকলের চোখে কি সব পড়ে? হিরে ফেলে কাঁচ নেওয়ার মানুষ-ইতো বেশি। তা ছাড়া, তোর মতো ভালোমানুষ… গুণী, সকলেই হতে পারে ইচ্ছে এবং চেষ্টা থাকলেই। কিন্তু ভালোমানুষ চেষ্টা করে হওয়া যায় না।
রাখ তো। জানি রে জানি, আমি বাঁশবনে শেয়াল-রানি। তাও শুধু তোর-ই কাছে। এমনই একটা ‘পান্ডব বর্জিত’ জায়গা যে, তুই ছাড়া হাতের কাছে দ্বিতীয় কোনো বাঙালি ছেলেও নেই। সত্যি! কী অবস্থা আমার!
একটা বড়শ্বাস ফেলে বলল ঝিঁঝি।
চল, শিরীষ বলল, কোয়ানটিটি কোনো ব্যাপার-ই নয়, আসল হচ্ছে ‘কোয়ালিটি। জুলিয়েটের শুধু রোমিও-ই ছিল।
চল এবারে, ফিরবি তো?
না তো কী?
চল তবে। ঘোরা সাইকেল।
বলেই বলল, ঝিঁঝি, চা খাবি নাকি একটু? ভাঁড়ের চা?
চা? তা খেতে পারি। একটু অবাক হয়ে বলল, ঝিঁঝি।
তবে, আয় চলে যায়।
ঝাঁটি-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শিরীষ বলল, ওই দেখ, সাপ যায়।
কই সাপ? কী সাপ? দেখিনি তো।
তুই দেখতে পাবি না। ওটা প্রতীকী সাপ। সাসানডিরি’ বইটা কি পড়েছিস তুই? তোকে দিয়েছিলাম যে, আনন্দ’-পাবলিশার্স-এর।
হুঁ।
বলেই, ঝিঁঝি অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
তারপর বলল, সেই চাটান মুণ্ডা আর মুঙ্গরীর গল্প। সোনালি সাপ? দাবানল? কেন মনে করালি বইটার কথা? মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
“সুইটেষ্ট টেলস আর দোজ হুইচ টেল অফ স্যাডেস্ট থিঙ্গস।”
শিরীষ বলল।
তুই এখানে দাঁড়া। আসছি। বলেই, শিরীষ মাটির সমতার প্ল্যাটফর্মে নেমে গিয়ে লাইন পেরিয়ে চায়ের স্টলে গিয়ে চা দিতে বলে এল।
দোকানদারের খিদমদগার ছোটোছেলেটি চা নিয়ে আসবে মাটির কুলহার-এ করে। চায়ের গন্ধের চেয়ে মাটির ভাঁড়ের গন্ধটাই বেশি ভালো লাগে ঝিঁঝির। “মনোয়া-মিলন’ স্টেশনে এলেই চা খেতে ইচ্ছে করে ওর শুধু এইজন্যেই। এই ভাঁড়ের চা-এর গন্ধ নাকে গেলেই মনে হয় ট্রেনে করে দূরে কোথায় চলে গেছে-ছেলেবেলার মতো–ফ্রক পরে বসে আছে ছোট্টমেয়ে-ট্রেনের জানলার ধারে-’চায়ে গরম। চায়ে গরম!’ করে হেঁকে যাচ্ছে চা-ওয়ালা নিঝুম রাতে-কামরার মধ্যে নিভুনিভু আলো-কামরা-ভরা-ঘুম–কেবল ও-ই বসে আছে। একা জেগে-পৃথিবীর শেষ কোথায় তা দেখার জন্যে। পৃথিবীটা কত রহস্যময়, কত সুন্দর, কত ছোটো, কত রঙিন কল্পনার ছিল সেই বয়েসে। এইসব স্বাদ-গন্ধ পৃথিবী থেকে বড়ো দ্রুত লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ভাবলেও কষ্ট হয়।
তবু এখনও এই বদলে-যাওয়া পৃথিবীকেও খুব-ই ভালোবাসে ঝিঁঝি। শিরীষও সেই পৃথিবীর-ই বাসিন্দা। তবে, শিরীষকে যে, ওর ভীষণ-ই ভালো লাগে, সে-কথা একমুহূর্তের জন্যেও জানতে দেয় না, দেয়নি ঝিঁঝি। ও ওইরকম-ই। মন যা বলে, সবসময়ে তার উলটোটাই বলে মুখ। মনে-মনে ভাবে, যার বোঝার সে বুঝে নেবে। ওর বয়েই গেল!
সাইকেল দুটো একটা শালগাছের কান্ডে হেলান দিয়ে একটি বড়ো কালো পাথরের ওপরে বসল ওরা দু-জনে পাশাপাশি।
শিরীষকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
ঝিঁঝি বলল, কী ভাবছিস? তোর দিল্লি যাওয়ার কী হল? ম্যানেজমেন্ট না, কী পড়তে যাবি বললি?
হিল্লি-দিল্লি গিয়ে কী হবে? এইখানেই থেকে জায়গাটার জন্যে কিছু করতে পারলে তবু হত। দিল্লি গেলেই কি ল্যাজ গজাবে?
সকলের তো ল্যাজ গজায় না। ল্যাজ গজাতে হলে বানর প্রজাতির প্রাণী হয়।
শিরীষ চুপ করে গেল।
একটু পরে ঝিঁঝি বলল, কী ভাবছিস রে? তুই এমন হঠাৎ হঠাৎ চুপ মেরে যাস কেন?
ভাবছি, তোর বর কেমন হবে।
হোক-ই আগে। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।
তোর যদি পছন্দ না হয়?
আমার পছন্দ-অপছন্দর প্রশ্ন তো ওঠে না। বলেইছি তো তোকে। চয়েসটা একতরফের-ই। তার বা তাদের যদি আমাকে পছন্দ না হয় তবে স্টেশনের মাস্টারবাবু থেকে ঝাণ্ডু গঞ্জ পর্যন্ত সকলেই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে। বলবে, ইমতেহানমে ফেল কর গ্যয়ি। উনকি ডাল গলা নেহি। আর তুইও বলবি… ছেড়ে দিবি কি? তখন?
চুপ কর। আমার কথা থাক।
চায়ের সঙ্গে ঝাল বিস্কিট খাবি? লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া? লেড়ো?
কী ব্যাপার, খুব যে, বড়োলোক হয়েছিস দেখছি।
‘শেষ’-এ একটা কবিতা ছাপা হয়েছিল। কাল-ই টাকা এসেছে মানি-অর্ডারে। অনেক টাকা দেয় রে ওরা। তবে, কবিতা লিখে বড়োলোক হওয়া যায় না। যাবে না কোনোদিন-ই। গদ্য লিখতে হবে। গদ্য। গোদা গোদা বই। কলেজস্ট্রিট পাড়ার কোনো কোনো প্রকাশকের ভাষায়, মোটা মাল। প্রথম বইটা যদি লেগে যায়, তবে আর দেখতে হবে না। বড়োলোক হয়ে যাব। রিয়্যাল-রিচ। কোনো বড়োকাগজে একটা চাকরি যদি হয়ে যায়। তখন রিয়্যাল রিচ-প্লাস রিয়্যাল আঁতেলও হয়ে যাব। ওভারনাইট আই উইল থিঙ্ক বিগ। তখন লেখা ছাপাবার জন্যে কত উঠতি কবি-সাহিত্যিক তেল দেবে আমাকেই। দ্যা টেবল উইল বি টার্নড। কত খাতির, প্রতিপত্তি, ঘুস-ঘাস। হাঃ হাঃ।
ছেলেটি চা দিয়ে গিয়েই দৌড়ে বিস্কুট আনতে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়ে ঝিঁঝি বলল, আমার যদি অনেক টাকা থাকত, তবে তোকে আমি বলতাম, শুধুই লিখে যা। তোকে আর কিছুই করতে হবে না। না, টাকা রোজগারের জন্যে নয়, কোথাও ছাপাবার জন্যেও নয়, শুধু নিজের আনন্দের জন্যেই লিখে যা। তা ছাড়া, তুই তো কবি, কবিতাই লিখবি। গোদা-গোদা গদ্য লেখার তোর দরকার-ই বা কী? কবিতা হচ্ছে আতর। আর গদ্য পারফিউম। কবিতার বিন্দুতে সিন্ধু।
হাঃ। এসব ডায়ালগ সিনেমাতে শোনা যায়, হিন্দি, বাংলা, তামিল, মারাঠি। জীবনে এমন হয় না রে। কবিতা লেখা আর বালুবেলায় নাম লেখা একই কথা।
কারো কারো জীবনে হয়তো ঘটেও, ঘটতেও পারে। এত হতাশ হোস কেন?
হাঃ ‘অমি কেবলি স্বপন করেছি বপন বাতাসে/দিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে হুতাশে।
কার লেখা?
লেখা নয়, গান।
কার?
কার হতে পারে?
একমাত্র যার হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ?
ইয়েস।
কার গাওয়া গান?
একমাত্র যার হতে পারে।
কার হতে পারে?
হেঁয়ালি করিস না। হেঁয়ালি নয়। কিছু কিছু রবীন্দ্রসংগীত আছে, যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যেই বোধ হয় সেই দাড়িঅলা ভদ্রলোক লিখে গেছিলেন।
ঠিক-ই বলেছিস।
যদি তোর মতো করে কোনো হান্টারওয়ালি, বা মিলিয়নিয়রকা বেটি এমন অফার, মানে শুধুই খেতে পরতে দিয়ে কবিতা লেখার; দেয়ও কোনোদিন, সত্যি সত্যি, তবেও হয়তো আমি তা নিতে পারব না।
কারণ?
কারণ, শুধু শুধু লিখে আবর্জনার স্তূপ বাড়িয়ে কী হবে? যে-কোনো ‘গুণ’-এর জিনিস-ই সম্পূর্ণতা পায় না অন্যের স্বীকৃতি না পেলে। লেখাই বল, গান-ই বল, ছবি আঁকাই বল। দশ জনে, হাজার জনে, যদি তা না-ই পড়ল, না-ই শুনল, না-ই ভালো বলল; তাহলে উৎসাহটা আসবে কী করে! কবিতা গান, ছবি আঁকা এসব-ই হচ্ছে ‘ইয়ো-ইয়ো’-র মতো, বুঝলি। যা কিছুই আছে তা নৈবেদ্যর-ই মতো পাঠক কী শ্রোতা কী দর্শকদের দিকে তোর সব ছুঁড়ে দিতে হবে। তাঁরা তার গতিজাড্য বাড়িয়ে দিয়ে তোকে আবার ফিরিয়ে দেবেন। যদি অবশ্য তাঁদের তা ভালো লাগে। এমনিভাবেই দেওয়া-নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়ার একটা অদৃশ্য বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে; হয়। এবং তা না হলে কী লেখা, কী গান গাওয়া, কী ছবি আঁকা, সব-ই নিরর্থক। মিছিমিছি।
‘গতিজাড্য’ শব্দটার মানে কী? কখনো তো শুনিনি আগে।
শুনিসনি? মানে হচ্ছে, মোমেন্টাম।
দেখ, সাহিত্যের ছাত্রী আমি। আর আমিই…
দেখ কোনোক্রমে বি.কম. পাশ শিরীষ সেন তোকে বাংলা শেখাচ্ছে। তোকে ‘বাংলা পড়াতেপারলে অবশ্য আরও খুশি হতাম।
বলেই, শিরীষ হেসে উঠল। ঝিঁঝিও হেসে উঠল জোরে।
হাসির তোড়ে চা চলকে পড়ল ঝিঁঝির কামিজ-এ।
ঝিঁঝি বলল, কী হবে। খুব বকুনি খেতে হবে মায়ের কাছে। আছে তো মোটে এক জোড়াই ভদ্রস্থ সালোয়ার-কামিজ। তার-ই একটা গেল।
তাহলে আজ ভালোটা পরে এলি কেন মিছিমিছি?
বাঃ তোর সঙ্গে দেখা হবে তা তো জানতাম-ই! তুই আমার শিশুকালের খেলার সাথি– যদি আমার ‘বিদাইয়া’ হয়ে যায় সত্যি সত্যিই?
বলছিস? ‘বাবুল মোরা নইহার ছুটহি যায়!’
ইয়ার্কি নয়। আজ তো একটা বিশেষ দিন আমার জীবনের।
তোর জীবনের?
শিরীষ একটু অবাক হয়ে শুধোল। আজ? কেন? আজ কেন?
হ্যাঁ।
কেন?
আমার স্বাধীনতার ইতিহাসের শেষদিন।
এত বাজেকথা বলিস-না তুই।
শিরীষ বলল।
তারপর বলল, দেখিস, তোর বর তোকে কত আদরে-গোবরে রাখবে। বিয়ে তো একটা আনন্দের-ই ব্যাপার। বিশেষ করে মেয়েদের জীবনে। বিয়ে তো একটা উৎসব। পরমোৎসব।
হুঁ। যদি হয়…
তোর বরের নাম কী রে?
আঃ। ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আবারও তুই ‘বর বর’ করছিস?
কী বলব তাহলে?
পরীক্ষাতেই বসলাম না, আর।
নাম কী? গোরু-ছাগলেরও নাম থাকে আর তোর বরের, মানে হবু-বরের কোনো নাম নেই?
নীলোৎপল। শুনেছি।
বাবা! একে উৎপল, তায় নীল। তা, তিনি করেন কী?
ব্যবসা।
বাঃ
বাঃ কেন? ঠাট্টা করছিস?
ঠাট্টা নয় রে কেবলি। বাঙালির ছেলে ব্যবসা করলেই, সে পাত্র হিসেবে খারাপ বলে চিরদিন-ইবিবেচিত হয়েছে। অথচ বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী। আমি এমন চারটে কেস জানি যেখানে পাত্র ব্যবসাদার বলে, বাবা-মা তার সঙ্গে বিয়ে দেননি মেয়ের। অথচ চাকরিজীবী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কয়েক বছর পর-ই দেখা গেছে যে, জামাই সেই বাতিল-করা ছেলের-ই কর্মচারী হিসেবে কাজ করে দিন গুজরান করছে। বাঙালি জাত কখনোই, জীবনের কোনোক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে পারেনি। অবশ্য বাংলাদেশের বাঙালিরা ব্যতিক্রম। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা পরের চাকরি করেছে। যেকোনো চাকরি। ফিক্সড-ডিপোজিটে টাকা রেখেছে। ঘরে বসে বাবা-ঠাকুরদার উপার্জনের সঞ্চয়ের নিরাপদ কলসির জল গড়িয়ে খেয়েছে। তাই তো আজ বাঙালির এই অবস্থা! জামাই যে ব্যবসায়ী, তা জেনে সত্যিই প্রীত হলাম। দাঁড়া। দাঁড়া। একটিপ নস্যি দিয়ে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করি।
জ্যাঠার মতো কথা বলিস না। যেন তোর-ই জামাই! এতবেশি কথা বলিস-না তুই!
ঝিঁঝি চায়ের ভাঁড়টা রেললাইনের পাশের ঝাঁটি-জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে উঠে বিরক্তির সঙ্গে বলল, নস্যি নিস কেন রে? আমার দু-চোখের বিষ। তোকে কোনো মেয়েই জীবনে চুমু খাবে না।
হাঃ নস্যি না নিলেই যেন চুমুর বন্যা হয়ে যেত! কী করব বল? মাসে চার-পাঁচ টাকার নস্যিতে চলে যায়। আমার মতো হা-ভাতের পক্ষে এর চেয়ে সস্তা আর কোনো নেশাই নেই। তা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে।
কী কারণ?
ভালো গদ্য-লেখক হতে হলে নস্যি নিতে হয়।
তার মানে?
হ্যাঁ রে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় নিতেন। তারাপদ রায়ও নেন।
হাতছানি দিয়ে শিরীষ ডাকল চায়ের ছেলেটিকে। সে এসে পয়সা নিয়ে গেল। একটা সিকি দিল বকশিশ। বলল, লে রে ছোটুয়া।
ছোটুয়া সেলাম করে চলে গেল, ঝিঁঝি বলল, বাবাঃ কবিতার টাকা পেয়েই তুই এত দরাজ-দিল! আর উপন্যাস লিখলে না কী করতিস?
তা ঠিক। তবে এও যে, যাদের দরাজ-দিল তাদের টাকা দেন না বিধাতা। টাকা দেন শুধুই চিন্ধুদের। সিকিটা আসলে দিলাম সেলামটা পাবার জন্যেই। আমি তো মাত্র সিকি-ই দিলাম! যারা লক্ষ কোটি দেয়; সে শালারাও সকলেই কিন্তু ওই সেলাম পাবার জন্যই দেয়।
হয়তো।
অন্যমনস্ক গলায় বলল ঝিঁঝি।
ওরা ফেরার পথ ধরল।
একটু এগিয়ে গিয়ে শিরীষ বলল, কীসের ব্যবসা করে রে তোর বর?
আবারও ‘বর বর’ করছিস!
সরি! নীলোৎপল। নীলোৎপল কী?
নীলোৎপল দাস।
ও। তোদের মতো ব্রাহ্মণ নয়?
ব্রাহ্মণ্য তো একটা টাকা। সবসেরা ব্রাহ্মণ্য। ব্রাহ্মণ নয় মানে কী?
তা, বললি না, কীসের ব্যবসা?
বিড়ির ব্যবসা।
লজ্জামাখা গলায় বলল, ঝিঁঝি।
বলিস কী রে!
উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল শিরীষ।
ঝিঁঝি আরও লজ্জা পেল। মাথা নীচু করল।
শিরীষ বলল, তাহলে তো মালটি-মিলিয়নিয়র! বিড়ির ব্যবসা যে, কী প্রফিটেবল ব্যবসা তুই জানিস না। তবে ক্যাপিটালও লাগে অনেক।
ঝিঁঝির অপ্রতিভ ভাবটা কেটে গেল। অবাক গলায় বলল, তুই এত জানলি কী করে রে?
বাঃ। আমি কলকাতার এক অডিট ফার্মে কাজ করতে গেছিলাম-না? অডিট-ক্লার্ক ছিলাম। সেখান থেকেই অডিটে পাঠিয়েছিল। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে ছিল আশুতোষ পাধা অ্যাণ্ড কোম্পানি। বহরমপুরের ধুলিয়ানে ‘বিনোদিনী’ বিড়ি। আরও কত বিড়ি কোম্পানি। বিনোদিনী বিড়ির অডিটর অবশ্য ছিলেন সেন কোম্পানি। বিড়ির ব্যবসা শুনে যদি কেউ ভাবে ছোটোব্যবসা, তবে বলতে হয়, সে ব্যবসা-জগতের কিছুমাত্রই জানে না।
ঝিঁঝি বলল, শুনেছি, আগে নাকি চাতরা লাতেহার ডালটনগঞ্জ এসব জায়গাতে কেন্দুপাতার জঙ্গল নিতেন ওঁরা। সেইসময়েই তো ঘন্টেমামা ওঁদের কোম্পানিতে কাজ নেন।
ওঁরা মানে?
মানে ওই নীলোৎপলের পরিবারের মানুষেরা। বাবা, কাকারা।
তাই?
হ্যাঁ। সেইসূত্রেই সম্ভবত জলটা অথবা বলটা যাই বলিস এতদূর এগিয়েছে। আর ঘণ্টেমামাকে তো জানিস-ই। বাড়িয়েই সব কিছু বলেন! আমি তো লজ্জায়, ভয়ে, কুণ্ঠায় একদম সিঁটিয়ে আছি। ওঁদের নাকি ‘উঠতি ঘর’। তাই ভালো পরিবারের পড়তি ঘর থেকে মেয়ে খুঁজছিলেন।
শিরীষ হাসল। হেসে বলল, এবার ওঠ। তোর বিয়ে তো আমার কী?
বলে, সাইকেলটা উঠিয়ে দিল। ঝিঁঝিও। তারপর দু-জনে আস্তে আস্তে প্যাডল করতে করতে ফেরার পথ ধরল।
আসবার সময়ে খুবজোরে প্যাডল করেই এসেছিল। এখন ফেরার সময়ে খুব আস্তে আস্তে ফিরছে। জীবনের যেকোনো গন্তব্যে পৌঁছোনো ও ফিরে আসার বেলায়-ই অমন হয়, লক্ষ করেছে শিরীষ। অন্তত ওর বেলাতে হয়। যাওয়ার সময় পথ দীর্ঘ বলেও মনে হয়, আর ফেরার সময় হ্রস্ব।
হাসছিলি কেন তুই? ঝিঁঝি শুধোল।
আসলে ওইসব কথার পেছনে একটা ফিউডাল মনোবৃত্তি কাজ করে, তাই। মেয়ের সঙ্গে ‘উঠতি ঘর’ ‘পড়তি ঘর’ এর কী সম্পর্ক? মেয়ে-মেয়ে, ছেলে-ছেলে।
কেন? ও-কথা বলছিস কেন? তা ছাড়া, মেয়েরা এখনও তো এদেশে ‘সুলক্ষণা’ গাই বলেই গণ্য হয়। এবং হয়তো আরও বহুদিন হবেও।
একটি নিশ্বাস ফেলে বলল ঝিঁঝি।
একথা বলছি কারণ, উদ্দেশ্যটা সরল। পড়তি ঘরের মেয়ে মাথা নীচু করে থাকবে। অথচ সুদিনের সময়ে সে স্বাচ্ছল্যের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। জন্মাবধি হা-ভাতে নয়। টাকা থাকলেই তো আর হয় না। সচ্ছল, রুচিশীল জীবনযাত্রা, বড়োলোকও একটা আর্ট বিশেষ। শিখতে হয়; শিক্ষানবিশি লাগে। পড়তি ঘরের মেয়েরা ‘বড়োলোকি’ কাকে বলে তা জানে-শোনে। দু-জন সমান বড়োলোকের ঘরের মধ্যে বিয়ে হলে দু-পক্ষের মধ্যেই সামান্য টকরা টকরিতেই ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ ভাব জাগতে পারে। পড়তি ঘরের মেয়ের তো সে সামর্থ্য বা হিম্মত হবে না কখনো। তাই ‘উঠতি ঘরের পক্ষে পড়তি ঘরের মেয়েকে বউ করে আনাই সুবিধে। মাথা নীচু করে সে তাদের সব অত্যাচার মেনে নেবে।
বাবাঃ। তুই কত কী ভাবিস। ভেবে রেখেছিস রে শিরীষ!
ভেবে রাখিনি। এখন ভাবছি। আমার ঝিঁঝির বিয়ে বলে কথা।
‘আমার ঝিঁঝি’ মানে?
হঠাৎ যেন, ঝিনিঝিনি তুলে বলল ঝিঁঝি।
অন্তত তাই মনে হল শিরীষের।
বলেই, ঝিঁঝি গম্ভীর হয়ে গেল। প্যাডল-করা থামিয়ে মুখ ঘোরাল শিরীষের দিকে, ডানদিকে। সাইকেলের সামনের চাকা বাঁ-দিকে গড়িয়ে যেতে লাগল।
ঝিঁঝির মুখের দিকে চেয়ে অপ্রতিভ হয়ে গেল শিরীষ। রোদটা আবারও যেন হঠাৎ ঠাণ্ডা মেরে গেল। ঝিঁঝিকে ও বোঝে না একটুও। শিরীষের খুবই ইচ্ছা করছিল যে, স্টেশন থেকে বেরিয়েই ওকে বলে, বিকেলে ঝিরিনালার দহর কাছে একবার আসতে। ওর অনেক কথা বলার ছিল ঝিঁঝিকে। বলা হল না। হয়তো বলা হবে না আর কোনোদিনও। গত পাঁচ বছর ধরেই বলি-বলি করেও বলা হয়ে ওঠেনি যেসব কথা।
সরি। আমার অন্যায় হয়েছে।
আর কোনোদিনও এই কথা বলবি না। দু-কান খুলে শুনে রাখ শিরীষ যে, আমি কারোর ই নই। তোরও নই, কোনো নীলোৎপল বা রক্তোৎপল বা শ্বেততাৎপলেরও নই। তুই জানিস তো আমার দিদিমা পাগল ছিলেন। এক ন্যাকারেকে খুন করেছিলেন বঁটি দিয়ে। কেন করেছিলেন, সে-কথা তো ভবানীপুরের সকলেই জানে। আমার মনে হয় আমার মধ্যে দিদিমার জিন এসেছে। ঘণ্টেমামা আর মা এইসব করছেন বটে কিন্তু আমার মনে হয় না কোনো পুরুষের-ই ঘর করতে পারব আমি। আমি বনের হরিণী। আমার ইচ্ছে হলে আমি কিছুদিন কারো কাছে থাকতেও পারি কিন্তু ইচ্ছে ফুরোলেই ফিরে আসব। আবারও হয়তো নতুন কারো কাছে গিয়ে থাকতে পারি। তাও কিছুদিন, যতদিন ভালো লাগে; কিন্তু যে কেউই আমাকে বলবে ‘আমার ঝিঁঝি’ তার কপালে অশেষ দুঃখ।
প্যাডল-করা থামিয়ে দিয়েছিল শিরীষ। ওর বাড়ি, বাড়ি না বলে ডেরা’ বলাই ভালো; দেখা যাচ্ছে। ওর কালু কুকুর, বেঁটে-নাটা, ল্যাজ-কাটা; ধুলোর মধ্যে শুয়েছিল। শিরীষকে আসতে দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই ল্যাজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে এল। বড়ো শিমুলের ডাল থেকে পাগলা কোকিলটা ডেকে উঠল জোরে জোরে। হরিহরলালের বাড়ির পেছনের জঙ্গলের অন্য শিমুল থেকে তার দোসর সাড়া দিল।
এই চৈত্রমাস এলেই বড়ো ভয় করে শিরীষের। শিরীষ যে শিরীষ-ই!
ভয় করে ঝিঁঝিরও! ওর মাথার মধ্যের পাগলামির বীজগুলো কিলবিল করে তখন। ওর শিকড় আলগা হয়ে যেতে থাকে। সংসার, সমাজ, ঘর, সব কিছুর মায়া কাটতে থাকে, ছানার জল কাটার মতন। মনোয়া-মিলন, মহুয়া-মিলন, চাঁদোয়াটোরি, হেহেগাড়া, রিচুঘুটা, চাহাল চুঙুরুর বন তাকে হাতছানি দেয়, হাতছানি দেয় দূরের করণপুরার টাঁড়, কাটকামচারীর জঙ্গল, আরণ্যক’-এ পড়া নাড়া বইহার, লবটুলিয়া, রাজা দোবরু পান্না, রাজকুমারী কুন্তী। এসব জঙ্গলের অধিকাংশই সে, কোনোদিন চোখে দেখেনি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এর সরস্বতী কুন্ড বা রাজু পাঁড়েকেও যেমন দেখেনি। কিন্তু এরা সকলেই তাকে হাতছানি দেয়। বিশেষ করে, শুক্লপক্ষর তৃতীয়া থেকে বাসন্তী পূর্ণিমা অবধি। আবারও শুক্লপক্ষর তৃতীয়া থেকে বৈশাখী পূর্ণিমা অবধি।
এমন-ই ঘটে ও ঋতুমতী হওয়ার পর থেকেই। দু-দু-বার সে, জঙ্গলে পালিয়ে গেছিল। তখন বাবা বেঁচে ছিলেন। অর্থবল, জনবল সব-ই ছিল। এখন যদি পালিয়ে যায়, মা কেঁদেকেটে সারা হবেন। কোনো গ্রামের মাহাতো বা পঞ্চায়েতের নেতা তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে খাদে ছুঁড়ে দেবে মৃতদেহ। এখন মেয়েদের বড়ই বিপদ। ঘরে থাকাই বিপজ্জনক, তার বনে-পাহাড়ে! তবুও ভাবছিল ঝিঁঝি, সময় হয়েছে। সেই নীল-রঙা পাখি দু টি কি জোড়ে আসবে এবারে? চাট্টি নদীর দহর পাশের জঙ্গলে একদিন যেতে হবে চাঁদের রাতে। যদি না আসে? ভাবতেও ভয় করে।
ওই পাগলা কোকিল দুটোই যেন, ওর মাথাতে পাগলাঘণ্টি বাজিয়ে দিল।
শিরীষ বলল, আচ্ছা, তাহলে ভালো থাকিস।
ঝিঁঝি উত্তর দিল না কথার। স্থিরদৃষ্টিতে চোখ তুলে ধরল একবার শিরীষের চোখের দিকে, প্রদীপ তোলার মতো করে।
শিরীষের মনে হল, ঝিঁঝির চোখ দুটি অপ্রকৃতিস্থ।
তোর কি জ্বর-টর হল?
উত্তর দিল না ঝিঁঝি।
বাড়ি যা। সাবধানে যা। স্বগতোক্তির মতো ফিসফিসে গলায় বলল শিরীষ।
ঝিঁঝির ঠোঁটে একটা হাসি ফুটি-ফুটি করেও নিভে গেল।
ও হাসলে ওর ঠোঁটের দু-পাশের চামড়াতে সামান্য ভাঁজ পড়ে। টোল নয়; ভাঁজ। ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, সুন্দরীদের কারো কারো মুখে যেমন পড়ে। ইংরিজি সিনেমাতে দেখেছে ও।
তারপরে ও হ্যাঁণ্ডেল থেকে ডান হাতটা তুলল একটু। এক লহমার জন্যে। তারপরেই আর কথা না বলে, ধীরে প্যাডল করতে করতে চলে গেল। ডাইনে এক মোড়ের পরে বাঁয়ে এক মোড়। তারপরেও অনেক দূরে ডানহাতি বাড়ি, নাম ‘মহুয়া। সাদা শ্বেতপাথরের ফলকের ওপরে লেখা আছে নীল রঙে। বাড়ির পেছনেই জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে গড়িয়ে গেছে পাহাড়তলিতে। সেখানে পৌঁছে পাহাড়ের পায়ে পায়ে এগিয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে। ঢেউয়ের পরে ঢেউ তুলে মিশে গেছে পালামৌর, ডাকসাইটে সব বন-পাহাড়ের সঙ্গে চাহাল-চুঙরু, বাগেচম্পা, বাড়েষাঁর; আরও কত নাম না জানা, অদেখা গা-ছমছম প্রত্যন্ত প্রদেশে।
যতক্ষণ-না ঝিঁঝি মোড়ের মাথায় মিলিয়ে গেল, ততক্ষণ সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়েই রইল শিরীষ। ঝিঁঝিকে যখন আর দেখা গেল না, তখন দরজা ঠেলে খুলে উঠোনে ঢুকল।
শিরীষদের বাড়ির নাম নেই। বাইরের রং-চটা ফাটা-ফুটো কালো শালকাঠের দরজার ওপরে সাদা চকখড়ি দিয়ে শিরীষ লিখে রেখেছে ‘দাঁড়কাকের বাসা।
ঝিঁঝি বলে, এমন অ্যাপ্রোপিয়েট নাম ‘মনোয়া-মিলনে’-র আর কোনো বাড়ির-ই নেই।
মধ্যে উঠোন, দুইধারে ঘর। উঠোনের-ই একপাশে কুয়ো। লাটাখাম্বা লাগানো। কুয়োর উলটোদিকে একটা লক্ষ্ণৌ ল্যাংড়া আমের গাছ। শিরীষের মা শখ করে লাগিয়েছিলেন। তাতে বসে, একজোড়া দাঁড়কাক ডাকছে। কর্কশ নয়; আশ্চর্য কোমল স্বরে। টেনে টেনে। অমন ডাক কখনো শোনেনি আগে কাকেদের গলাতে।
হুসস হুসস করে কাক দুটোকে তাড়াতে যাবে, এমন সময়ে…উঠোনের এককোণে যে, একটা সজনে গাছ ছিল, অনেক দিনের পুরোনো; আশ্চর্য। সেই গাছটিতেই কোথা থেকে একটা হলুদ-বসন্ত পাখি উড়ে এসে বসল। প্রজাপতি উড়ছিল নাচতে নাচতে। হলুদ আর লাল। পাগলা কোকিলটাও আবার ডেকে উঠল। কোকিলের ডাকটা শিরীষের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বিধে গেল। হঠাৎ।
বড়ো বিপন্ন বোধ করল শিরীষ। ওর এই বিপন্নতার কথা ও একাই জানে।
তারপর-ই ডাকল, বুড়ি-মাই। চান করতে যাই। খাবার গরম করো। ঘরের ভেতর থেকে নীচুগ্রামের এক অক্ষরের একটি সংক্ষিপ্ত এবং দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে এল।
শিরীষের ভয় করে প্রায়-ই যে, একদিন বুড়ি-মাইকে ডেকে আর সাড়া পাবে না।
যেকোনো দিন।
সুনীতি রুক্ষকণ্ঠে বললেন, খালি হাতে এলি, তো করলি কী এতক্ষণ? গেছিলি কোথায়?
স্টেশনে গেছিলাম না! তোমাকে বলেই তো গেলাম।
তা, পেঁপে কোথায়?
সেখানেও তো পেলাম না পেঁপে।
এদিকে ঝাণ্ডু বলছে, হানিফ আজ এবং আগামীকালও পাঁঠাই কাটবে না এখানে। ও নাকি চাঁদোয়া গেছে। ওখানেই থাকবে দু-দিন। হাটিয়ার হোটেলওয়ালার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে যে, দু দিন শুধু হোটেলের খিদমদগারিই সে করবে। লালু যাদবের মিটিং। তার মানে, মাংস পাওয়া যাবে না। তুই বরং বিকেলে রায়বাবুর কাছে একবার যা ঝিঁঝি। যদি কাল সকালে একটা বড়ো মুরগি আর এক ডজন ডিম উনি দেন।
ওঁর কাছে যেতে আমার ভালো লাগে না মা।
কেন?
ওঁর চোখের চাউনিটা ভালো লাগে না।
ওঁর চোখ-ই ওরকম। আমার দিকেও অমন করেই তাকান। যারা সহায়-সম্বলহীন, বিশেষ করে মেয়ে, তাদের সকলের-ই দিকে সব পুরুষ-ই ওরকম করেই তাকান। ওঁর কি সাহস হবে কখনো সেনবাবুর বউ-মেয়ে বা মগনলালবাবুর বাড়ির মেয়েদের দিকে অমন চোখে। তাকাবার! ওসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে আমাদের অনুযোগ করে লাভ নেই। তাও তো শুধু তাকিয়েছেন-ই আজ অবধি। আর কোনোরকম অসভ্যতা তো করেননি!
করেই দেখুন-না একবার।
করলেও, তুই কিছুই করতে পারবি না। কী কলকাতা বা পাটনাতে, আর কী এখানে, সমস্ত সমাজ, সমস্ত আইন, সমস্ত পুলিশ ওঁদের-ই দিকে। বঙ্কিমবাবু ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ সেই কবে লিখে গেছেন, না? ‘আইন। সে তো তামাশা মাত্র। বড়োলোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে। সে-কথা এদেশে আজও তেমন-ই সত্যি! যদি তোর একটা ফয়সালা করে দিতে পারি, তুই যদি কখনো গাড়ি করে গিয়ে নামিস রায়বাবুর পোলট্রিতে, দেখবি তাঁর চোখের দৃষ্টি কত নরম, কত ভদ্র হয়ে গেছে। আসলে, খুব কম পুরুষের-ই মুখ আছে, ওদের শুধুই মুখোশ।
ঝিঁঝি বলল, আমাদের ধার তো ওঁর কাছে কম নেই। সেই যখন মণি মাসিমারা এসেছিলেন গত শীতে, তখন থেকেই বাকি পড়ে আছে। তা তো আজ অবধিও শোধ দেওয়া হয়নি। আজ কতদিন হয়ে গেল ওঁর পোলট্রির সামনে দিয়েই যেতে পারি না। লজ্জায় এবং ভয়েও। ওদিকে গেলে, পেছনের হাঁটাপথ দিয়েই যাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সাইকেল চালিয়ে বা হেঁটেও। যদি ওই টাকাটা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম তবেও না হয় কথা ছিল। তুমি বরং ঝাণ্ডকে পাঠাও, বস্তির-ই কারো বাড়ি থেকে যদি জোগাড় করে নিয়ে আসতে পারে একটা মুরগি।
সুনীতি বললেন, রোজ-ই তো ভাবি দিয়ে দেব কিন্তু এদিক ঢাকতে ওদিক উদলা হয়ে যায়। টাকাটা হয়তো দিয়েও দিতে পারতাম কিন্তু ওঁরা ক-জন যে আসবেন তা কে জানে! ওঁরা চলে গেলেই রায়বাবুর ধার শোধ করে দেব। এ ক-দিন তো বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, কম্বলের ওয়াড় কেচে কেচে তোর আমার হাতে ব্যথা হয়ে গেছে। ঝাণ্ড একা লোক আর কত করবে? তুই একটু যা-না বস্তিতে। তুই নিজে গেলে যা হবে, ঝাণ্ডু গেলে কি তাই হবে?
হবে। বড়লোক হলে অন্য কথা ছিল। ঝাণ্ডুও যে, দাম দিয়ে কিনবে আমিও সেই দাম দিয়েই কিনব। বরং ঝাণ্ডু গেলেই ভালো হবে। তা ছাড়া, একটা কথা বলব মা! তোমার এত ভাবনা-চিন্তা কীসের? তাদের মোরগ-আণ্ডা বা বিরিয়ানি খাওয়াতেই যে, হবে তার মানে কী? আমরা রোজ যা খাই, তাই খাওয়াবে। ভান করার দরকার কী আছে জানি না। তাঁরা তো জানেন-ই যে, আমরা গরিব। তাঁদের কাছে বড়োলোক সাজবার প্রয়োজনটাই বা কী? তাঁরা যদি মানুষ ভালো হন তো…
হুঃ। মানুষ ভালো! ভালোমানুষ আর কোথায় আছে? বেতলাতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফাণ্ড এবং ভারত সরকার মিলে বছরে কত কোটি টাকাই না-জানি খরচ করছেন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাঘেদের গুষ্টিকে বাঁচাতে। আর মানুষের মধ্যেও যে, ভালোমানুষ’ বলে একটি বিশেষ প্রজাতি ছিল, সেই প্রজাতিটিও যে পুরোপুরিই নির্মূল, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, সকলের-ই চোখের সামনে এই স্বাধীন-হওয়া ভারতবর্ষে, তা নিয়ে তো কই, কারোর-ই কোনো মাথাব্যথা নেই! যাঁরা আসছেন, তাঁরা যে, ভালো মানুষ হবেন-ই; এমন ভরসা আমার অন্তত নেই।
একটা স্কুল করলে কেমন হয়? সেই স্কুলে আমরা ছেলে-মেয়েদের চরিত্র গঠন করব। নতুন ভারতবর্ষের নতুন প্রজন্মকে ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা দেব। শিক্ষা আর জীবিকা যে, এক নয়, বড়োলোক হওয়াই যে, শিক্ষার বা জীবনের একমাত্র গন্তব্য নয়; এইসব শেখাব তাদের আমাদের স্কুলের মাধ্যমে। তা ছাড়া আমাদের মেয়ে-মায়ের সাচ্ছল্য ও সম্মানের জীবিকাও হবে একটা। করবে?
ভালোই বলেছিস!
কেন? ও-কথা বলছ কেন?
চরিত্র গঠন-টঠনের কথা বললে লোকে হাসবে এখন। এখন প্রত্যেক মানুষের-ই জীবনের একটাই গন্তব্য। ভালো-থাকা, ভালো-খাওয়া, ভালো-পরা, ফ্ল্যাট, গাড়ি টি.ভি., ভি.সি.আর.। যাঁদের এসব আছে তাঁরাই চরিত্রবান। মনুষ্যত্ব আর এইসব ভ্রান্তি; জঞ্জাল সব জড়িয়ে-মড়িয়ে গেছে। এই না?
সুনীতি একটি ফুলদানি পরিষ্কার করতে করতে বলেন, কোনটা আগে আর কোনটা পরে এ-জ্ঞান তোর কোনোদিনও ছিল না। হবেও না। আমি মরছি কালকের ভাবনা ভেবে। কোথায় পেঁপে, কোথায় দুধ, কোথায় দই, কোথায় ডিম-মুরগি; আর তুই পড়লি তোর স্বপ্নের স্কুল নিয়ে। কত যে, আকাশ-কুসুম’ দেখতে পারিস তুই! সত্যি!
মা, আমাদের রোজগারের একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত হলে কোনো স্বপ্নই আর আকাশ-কুসুম থাকবে না। সত্যি হয়ে উঠবে মা। একটু আগেই শিরীষ একটি গানের কথা বলছিল;
আমি কেবল-ই স্বপন করেছি বপন বাতাসেদিনশেষে দেখি ছাই হল সব হুতাশে হুতাশে।
নিশ্চয়ই রবীন্দ্রসংগীত?
এমন আর কে লিখেছেন বাংলাতে? না লিখবেন? অনেক কবিই তো এলেন গেলেন।
বলেই বলল, তবে শোনো। ইস, কী অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। তবু তোমার পেঁপের প্রবলেম সলভ হয়ে গেছে।
কী করে? একটাও তো আনতে পারলি না।
শিরীষ বলেছে, আজ রাতের মধ্যেই একবস্তা কাঁচা-পাকা পেঁপে তোমার পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
তাই?
ইয়েস।
ছেলেটা ভালো।
সুনীতি বললেন।
কেন? পেঁপে-জোগানদার বলে?
না, তা নয়। পেঁপে ব্যতিরেকেই ভালো। কিন্তু নৈবেদ্যটা তো আমার প্রাপ্য নয়।
তবে? কার প্রাপ্য?
তুই ভালো করেই জানিস, কার? কিন্তু বেচারা কি জানে যে, সেই পেঁপের বস্তাতে করেই সে তার স্বপ্ন-মরণের বীজও বয়ে আনবে? তারমধ্যেই তার ক্কচিৎ-কল্পনার মৃত্যু নিহিত আছে?
জানে।
জানে?
হ্যাঁ। আমিই ওকে বলেছি।
কী বলেছিস?
একটা সম্ভাবনার কথা! মানে…
এমন করেই বললি যে, সম্ভাবনা’ শব্দটাকে শোনাল যেন ‘সদ্ভাবনা’।
ঝিঁঝি হেসে উঠল। বলল, ডায়াসেশানে পড়ে এত ভালো বাংলা তুমি শিখলে কী করে মা?
ভাষাটা ভালোবাসার জিনিস। মাতৃভাষা বলে কথা! যে-মানুষ তার মাতৃভাষা ভালো করে জানে না, তার মতো অশিক্ষিত আর হয় না।
শিরীষের স্বপ্ন প্রসঙ্গে একটা কথা বলব মা। শুধু ওর স্বপ্ন কেন, কারো স্বপ্ন নিয়েই বোধ। হয় হাসি-তামাশা করা উচিত নয়। যারা স্বপ্ন দেখতে পারে এখনও, তারা নিশ্চয়ই অন্য এক নির্মল, অকলুষিত গ্রহের জীব। স্বপ্নই তো জীবন; জীবনের পাথেয়। তা ছাড়া, আরও একটা কথা মা! আমি শিরীষের স্বপ্নের অতীত কেউ নই। স্বপ্ন দেখার অধিকার প্রত্যেক মানুষের-ই জন্মগত অধিকার। কারো স্বপ্ন থেকেই কারোকে বঞ্চিত করার অধিকার অন্য কারোর-ই নেই।
কিছুক্ষণ উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকল ঝিঁঝি।
ঝিরিঝিরি করে একটা হাওয়া বইছিল। সামান্য ভাপ আছে হাওয়াটাতে। বইছিল শুকনো পাতা উড়িয়ে উড়িয়ে।
হাওয়াতে মহুয়ার গন্ধ।
বাইরে থেকে ভেতরে মুখ ফিরিয়েই হঠাৎ বলল ঝিঁঝি, তা ছাড়া, মা! আরও একটা কথা। কার স্বপ্ন যে, কখন সত্যি হয়ে ওঠে, বাস্তব; তা কি আমরা কেউ-ই জানি?
সুনীতি মেয়ের মুখে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন।
তারপর বললেন, স্বগতোক্তির-ই মতো, সে-কথা ঠিক’।
সুনীতিকে উদবিগ্ন দেখাল একটু।
ঝাণ্ডু ধামা করে নানা আনাজ নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। বস্তিতে গিয়েছিল। যার কাছে যা পেয়েছে তাই কুড়িয়ে-বাড়িয়ে এনেছে।
গুছিয়ে রাখ বাবা ভাঁড়ারে।
সুনীতি বললেন।
বাজারের রকম দেখে মনে হচ্ছে যেন, আমরা কলকাতাতেই আছি। ডান-বাম-উত্তর দক্ষিণ-ঈশান-নৈঋতের কোনো নচ্ছার দলের ডাকা ‘বনধ’-এর আগের দিন। তাইনা?
ঝিঁঝি বলল।
কলকাতার কথা ছাড়ো। পৃথিবীর ইতিহাসে কলকাতার ‘বনধ’-এর নজির আর কোথাও নেই।
তারপর দু-জনেই চুপচাপ রইল কিছুক্ষণ।
ঝিঁঝি বলল, আমার বড়ো ভয় করছে।
কেন? ভয় কীসের? তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি কিছুই করতে বলব না। তা ছাড়া, বিয়ে যে, করতে হবেই তার-ই বা কী মানে আছে? দিনকাল পালটে গেছে। তবে এও ঠিক যে, এখন তোর যা সবচেয়ে বেশি দরকার তা হচ্ছে অবলম্বন। সাচ্ছল্য, একজন পুরুষের অনেক দোষ-ই ঢেকে দেয়। দেখি, নীলোৎপল ছেলেটিকে কেমন লাগে। তুইও দেখ।
অন্য কথা বলো মা। ওই শোনো, কোকিল ডাকছে। আমার কিন্তু বছরের এই সময়টা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। এই বসন্ত, শেষ-বসন্ত, চৈত্র। চৈত্র-শেষ। একেবারে পাগল পাগল করে মনটা।
শরীরের মধ্যে রিকিঝিকি করে না? আমার তো করত তোর মতো বয়সে।
দু-চোখে হাসির ঝিলিক তুলে কিন্তু না হেসে সুনীতি বললেন।
ঝিঁঝি জোরে হেসে উঠল। সুনীতিকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি মা! তুমি না! রিকিঝিকি! কীসব যে-বলো!
ঠিক-ই বলি। লজ্জা পাওয়ার কী আছে? মনের মতো শরীরও তো বিধাতার এক আশ্চর্য দান। শরীরের কথাও শুনতে হয় বই কী! তাতে লজ্জা কীসের? শরীর তো মনের চেয়ে একটুও কম পবিত্র নয়!
সত্যি মা! তুমি তুমি-ই। তোমার মতো রিয়্যাল মর্ডান মা যদি, সব মেয়ে পেত। আমার কত কিছুই নেই, যা অন্যদের আছে। আবার আমার তুমি আছ যে, যা অন্য কারুর-ই নেই।
অনেক হয়েছে, এবারে কাঁচের আলমারিটা খুলে কাঁচের গেলাসগুলো বের করে ধুয়ে-মুছে রাখ। জাপানিজ টি-সেটটা একবার অবশ্য পরিষ্কার করে রেখেছিলাম ক-দিন আগে। তবু, সাবধানে আর একবার ধুতে হবে। তোর বাবা জাপান থেকে নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। কত জিনিস-ইযে এনেছিলেন। কলকাতার বাড়ি বিক্রি হবার সময়ে সবকিছু কারা যে নিয়ে গেল। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সকলেই হাতে হাতে লোপাট করে দিল। কী করব! মহুয়া-মিলনের মতো জংলি জায়গাতে এই নির্বাসিত জীবনে অবশ্য ওইসব জিনিস মানাতও না। একদিক দিয়ে, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুনীতি যেন, কোন দূরের ভোরে চলে গেলেন। যেন, অনেক দূর থেকে বললেন, কত মানুষ-ই না ছিল তখন আমাদের ঘিরে! আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, অনাহূত, রবাহূত কত লোক-ই যে, আসত আর তোর বাবার পয়সাতে হুইস্কি-বিয়ার-জিন ভদকা সব খেত। তারা যে, কোথায় গেল। সেসব সুখের পায়রারা।
ঝাণ্ডু বলে, ফসলি বটের।‘
ঝিঁঝি বলল, সত্যি। ভাবলেও অবাক লাগে। মানুষের দুর্দিন এলেই শুধু বোঝা যায় যে, পৃথিবীটা কত স্বার্থপর, কত নীচ, কত কৃতগ্ন।
সুনীতি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ঝিঁঝি বলল, ছাড়ো তো পুরোনো কথা। স্মৃতিতে, যা-কিছু সুন্দর শুধু সেই সবকিছুই রেখো; আর যা সুন্দর নয়, তা ভুলে যেয়ো। সুন্দর ‘স্মৃতি’ মানুষকে সুন্দর করে, প্রসন্ন করে। আসলে কী জানো মা, একদিন যদি আমরা আবারও বোলোক হই, আবারও আমাদের চারপাশে অমন মানুষেরা ভিড় জমাবে। বাড়ির সামনে লাইন পড়বে গাড়ির, যেমন পড়ত আগে, বাবার আমলে। দেখো, তখন আমরা নিজেরাই ভুলে যাব তাদের সব কৃতঘ্নতার কথা। আসলে, তুমি ও বাবা নিজেরা ভালো বলেই মন্দ লোকদেরও দূরে সরিয়ে রাখতে পারোনি, পারবে না।
পারব, পারব। আমি আর ভালো নেই। সেইসব ইতর খল স্বার্থপর মানুষদের কৃতঘ্নতা আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। দেখিস তুই।
জানো, শিরীষ একটা কথা প্রায়-ই বলে। বলে, টাকার বিনিময়ে শেষপর্যন্ত পাওয়ার মতো কোনো কিছুই পাওয়া যায় না, এই জীবনে। ভালোবাসা, প্রীতি, প্রেম, মান, যশ কিছুই নয়। টাকা, একটা ফালতু ব্যাপার। ভালোবাসা-প্রেম-প্রীতি কিনতে পারা যায়, শুধু ভালোবাসা প্রেম-প্রীতি দিয়েই। আর স্থায়ী মান যশ পাওয়া যেতে পারে শুধু ‘গুণপনা’ দিয়েই। হয়তো টাকা বা ক্ষমতা ভাঙিয়েও সেসব পেয়ে থাকেন কেউ-কেউ। কিন্তু সেইসব থাকার নয়। থাকেও না। টাকা আর ক্ষমতা ফুরোলেই সেই মান-যশও উবে যায়।
বাঃ। শিরীষ বলে বুঝি এই কথা?
সুনীতি বললেন।
ঠিক-ই বলে। ছেলেটা খুব-ই বুদ্ধিমান। এবং স্বভাবটাও মিষ্টি। কিন্তু পুরুষের মস্ত গুণ যে, তার সাচ্ছল্যও। বড়োলোক হতে বলছি না, কিন্তু গরিব থাকতেও বলব না। যে যাই বলুক, এখন পঞ্চাশ-এক-শো বছর আমাদের এই গরিব দেশে এই বোধটা থেকেই যাবে। আমরা অশেষ গুণী হলেও, স্বাবলম্বী হলেও, পুরুষের সংজ্ঞা আমাদের মনে শাল-শিমুলের-ই মতো ঋজু, সটান হয়ে বেঁচে থাকবে আর আমরা নরম, লাজুক, নাজুক স্বর্ণলতার মতো তাদের জড়িয়েই খুশি থাকব। আমি জানি না, তোরা, উইমেনস লিব-এ বিশ্বাসী আধুনিক মেয়েরা কী বলবি! কিন্তু আমার এই মত। এখনও এই মত।
ঝিঁঝি কথা বলল না কোনো। জানলা দিয়ে বাইরের টাঁড়, জঙ্গল আর পাহাড়ের দিকে চেয়ে রইল।
একটা কোকিল ডাকছিল, পাগলের মতো, বাড়ির হাতার মধ্যের অশোক গাছে বসে।
ঝিঁঝি জানে না যে, এইটাই সেই পাগলা কোকিলের দোসর। যে-কোকিলটা শিরীষের বাড়ির পাশের শিমুলগাছের লাল ফুলের মধ্যে কালো শরীর লুকিয়ে রেখে একটু আগেই শিহর তুলে-তুলে ডাকছিল তার-ই দোসর এসে ডাকছে এখন ঝিঁঝিদের বাড়িতে।
ঘটনাটা কাকতালীয়। কিন্তু ঝিঁঝি জানে না। হয়তো জানে না শিরীষও।
এক-ই কম্পার্টমেন্টে সকলেই ফিরল ওরা একসঙ্গে। ঘণ্টেমামা উঠেছিলেন ডালটনগঞ্জ থেকে। জগামামা, মাধামামা এবং বানোয়ারিচাচার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, পেঁপে সংগ্রহ করে টোরী থেকে ট্রেনে উঠতেই। ওঁরা আসছিলেন লাতেহার থেকে। মামামা, তাঁর বন্ধু। বানোয়ারিলাল, ঘন্টেমামা, জগামামা এবং শিরীষ।
সত্যি সত্যিই দু-টুকরি পেঁপে, কাঁচা ও পাকা এবং অধিকন্তু এক টুকরি কাঁচাকলা যে, জোগাড় হবে এতটা ভাবেনি শিরীষ। হয়ে গেল, ঝিঁঝির কপালে।
পুরো পথটাই মাধামামা চুপচাপ-ই ছিলেন।
আরও চুপচাপ বানোয়ারিলাল চাচা। তাতেই সন্দেহ হল, ভইষালোটনের ভইষ ভালো ‘কেচাইন’ করেছে।
অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন শুধু ঘণ্টেমামাই। অধিকাংশ মানুষ-ই নিজের গলার স্বরকে বড়োই ভালোবাসেন। তাঁকে অবশ্য বাঁচালের পর্যায়েরই ফেলা চলে। তবে উলটোপালটাও কথা একটাও বলেননি। ঝিঁঝির সম্ভাব্য বিয়ে-সম্পর্কিত একটি কথাও তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল না দেখে বাঁচালের বাকসংযম’ শীর্ষক একটা প্রবন্ধ লিখবে কোনোদিন এমন-ই স্থির করল শিরীষ মনে মনে।
অথচ শিরীষ নিজেই মাধামামার দু-বছরের বড়োদাদা জগামামাকে প্রায় বলেই ফেলেছিল কথাটা পেঁপের এক্সপ্লানেশান না দিতে পেরে।
লাতেহার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-এ দাঁড়িয়ে যদিও শিরীষ ঘটনার বিবরণ শোনাচ্ছিল কিন্তু লক্ষ করল যে, মাধামামা তাঁর ‘অ্যাডভেঞ্চার’ ঘণ্টেমামার কাছে বেমালুম চেপে গেলেন। লাতেহার থেকে মনোয়া-মিলনের পথে ট্রেনের মধ্যে কথোপকথন মাধামামা এবং ঘণ্টেমামার মধ্যে এইরকমে হলঃ
মাডেমড্যেই কোটায় কোটায় উপে ডান মটাই?
আমি কী কঞ্জুর যে, উপে যাব। যেখানেই থাকি, সেখানেই রুহ-খসস আত্মরের মতো গন্ধ উড়িয়ে থাকি। আমি উড়ি। উপি না।
খপর-পর ঠব বালোটো? ফাস্টোকেলাস।
আপনি আজকাল কি রেতের বেলাও ওকালতি করছেন? কী কেস? রেপ নাকি?
আরে না, না। ট্রেটপাসিং এবং আর্মস অ্যাক্ট-এর কেস।
সে কী মহায়। সঙ্গে যে, দু-গাছি বন্দুকও দেকচি। ডাকাতি করতে গেসলেন নাকি সদলবলে?
প্রায় ঠেরকম-ই। টবে ঠিরিঠ নয়। ঠিরিঠ অন্য কাডে গেটিল।
কী কাজে গেচিলে শিরীষ?
ঝিঁঝিদের বাড়ির একটা কাজে।
শিরীষ বলল।
তুমি কি বাবা আজকাল টিকটিকি হয়েচ? ঝিঁঝি ধরে খাবার ইচ্ছে হয়েছে বুজি?
এইসময়ে, হঠাৎ-ই ‘ওয়াইল্ডলাইফ বিশেষজ্ঞ’ মাধামামা তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা বা অধীত-বিদ্যাচাপতে না পেরে বলে উঠলেন, করকম ঝিঁঝি হয় তা কি জান ঘণ্টেদা? সব ঝিঁঝি তো সব টিকটিকির খাদ্য নয়।
আঃ! কী হট্টেটা কী? এটো আড হাইপটেটিকাল ব্যাপাড় নয়। টিটি নামে ডে। রক্তমাংটেরও একজন আটেন রিয়াল।
মাধামামা বললেন, রিয়্যাল ঝিঁঝির গায়ে রক্তমাংস থাকে না, তোমায় তা কে বলল?
ড্যাক মাডা! অনেক ডালিয়েটিস আড। এবাডে ক্যামা ডে। আনরিয়্যাল টিটির কটা ঠাক একন।
থাক তাহলে।
শিকার কি হল আজ মাধাবাবু?
মাধাদা তাঁর বাল্যবন্ধু বানোয়ারিলালের দিকে চেয়ে, তারপর জগাদার দিকেও একঝলক। চেয়ে নিয়েই বললেন, হয়নি কিছুই। তবে, হতে পারত।
কী হতে পারত?
অনেক কিছুই হটে পারট। হাটি, বাঘ, গন্ডার, কী লয় টাই বলো-না?
ফুঃ। পালামৌর টাঁড়ে গন্ডার আসবে কোত্বেকে? তবে এ-অঞ্চলের মনিষ্যির মধ্যে খোঁজ করলে দু-এক গাছি পেলিও পেতি পারো। সারাজীবন বিড়িপাতার ঠিকেদারের হয়ে জঙ্গলে জঙ্গলেই তো কাটালাম আর মাল চিনি না আমি বিশ্বেশ্বর? তোমরা আমায় ভাবোটা কী হে? জঙ্গলের ব্যাপারে খাপ খুলতে এসো না আমার কাছে।
কথাটা জগাদা-মাধাদা ভুলেই গেছিলেন। মানে, ঘণ্টেমামার ব্যাকগ্রাউণ্ড। চকিতে কথা ঘুরিয়ে নিলেন। বুদ্ধিমান তো দু-জনেই। তবে মাধাদার বুদ্ধি একটু বেশি বলেই মাঝে-মাঝে উথলানো-দুধের মতো উপচে পড়তে চায়।
লাতেহার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে অবশ্য মাধাদা দুর্ঘটনাটা কী করে ঘটল তা সবিস্তারে আগেই বলেছিলেন শিরীষকে। আগে ব্যাপারটা মিস-রিপোর্টেড হয়েছিল। মোষ নয়; হাতি। ঘণ্টেমামা ডালটনগঞ্জ থেকে আসছেন তাই ব্যাপারটা জানেন না। ব্যাপারটা, জগামামার ভাষায় বলতে গেলে, ইনভেট্টিগেট’ করার মতোই ব্যাপার!
মাধামামা আবারও ‘ফিনসে’ শুরু করলেন ঘন্টেমামার বেনিফিটের জন্যে।
ওখানে, মানে যেখানে শিকারে গেছিলেন, একটি তালাও ছিল। মানে পুকুর, তাতে একঝাঁক বত্তক ঘুরে ঘুরে চরে যাচ্ছিল। বড়ো বড়ো হাঁস। খুব বড়ো বড়ো হাঁস।
কী হাঁস?
শুধোল শিরীষ-ই। কারণ, এত ডিটেইলস-এ তখন বলেননি মাধামামা।
গুলি মার, গুলি মার। হাঁস; হাঁস। এক-একটার ওজন হবে দেড় কেজি। কম সে কম। মানে, পালক-ফালক ছাড়িয়ে।
মামামা বলেছিলেন।
তারপর?
তারপর আমি আর বানোয়ারি ঘাসের মধ্যে লেপার্ড-ক্রলিং করতে করতে আস্তে আস্তে এগোলাম। উঃ। বহুতদিন এমন ‘র্যাফিং’ করিনি। বুয়েচিস। তাপ্পর অকুস্তলে পৌঁচে ছুপকি মেরে শুয়ে থেকে ভালো করে নিশানা নিলাম। নিশানা নিতে নিতে বড়ই দেরি হয়ে গেল কারণ আমরা দুজনে দুটি চোট’-এ দু-ডজন হাঁস মারবার মওকাতে ছিলুম। শেষমেশ, যখন এক লাইনে হবে, হবে। মানে যখন তাদের গলার সঙ্গে মাথার সঙ্গে, গলা আর মাথায় ঘেঁটি আর ঘেঁটিতে এক লাইন হবে, তখন-ই ঠিক ঘোড়া দাবব! আর হাঁসগুলোও এমনি টেটিয়াল, একবার লাইন হয় তো সঙ্গে-সঙ্গেই ভেঙে যায়। একমুহূর্ত সমান তো পরক্ষণেই হিজিবিজি। এরই মধ্যে হতভাগা, ইডিয়ট, শর্ট-সাইটেড বানোয়ারি শালা হঠাৎ ফিসফিস করে বললে, মাধারে! ওয়াইল্ড অ্যালিপ্যান্ট।
যেই না বলা, আমি অমনি ডানধারে চেয়েই দেখি, প্রায় আমার বুকের ওপর-ই পা উঠিয়ে দেবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মিস্টার গণেশ। বাপরে বাপ। সে কী দৃশ্য! মিস্টার ডানবার বাণ্ডার চাক্ষুষ করলেও তাঁর ভিরমি লেগে যেত! উরিব্বাস। ইয়া ইয়া দুইকান আর একটি ইয়াব্বড়ো দাঁত দেখিয়ে হাতি চেয়ে আছেন নাতি-কষাবার অভিপ্পায়ে।
উত্তেজিত হয়ে শিরীষ বলেছিল, তারপর?
তারপর আর কী, মাধামামা বললেন, আমি ভাবলুম যাঃ শালা! সারাজীবনে তো কিছুই করলুম না, সব বাঙালিই যা হেলাফেলায় করে, সেই একটা চাকরি পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনদিনের বেশি করতে পারলুম না, ছেলেবেলা থেকে ‘জন টেইলর’, পপাণ্ডোরো’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’, বব রুয়ার্ক’ এমনি কত বাঘ-সিংহী মানুষের লেখা পড়েছি, স্বপ্নে কত শত হাতি-সিংহ মেরিচি…
ঘণ্টেমামা বললেন, মাধা গো! দাদা স্বপ্নে আর কী কী মেরেচ তা আবার বলতে যেয়োনি যেন। মেরে থাকলেও কাউকে বোলোনি। জানো তো, সাপকে মারলে সে-সাপ জ্যান্ত হয়ে উটে কামড়ে দেয়। সাপ মেরেই তাকে পুড়িয়ে দিতে হয়।
সাপের কথা হচ্ছে না।
অ।
গেরাম-গঞ্জ জঙ্গল-টাঁড়ের লোকজন সব। মুখের আগল নেই। কথাবার্তা খারাপ দিকে ঘুরে যাচ্ছিল বলে ঘণ্টেমামা নিজেই ব্রেকটা মারলেন। তাই তো নিয়ম। যে-অ্যাকসিলারেটর দাবায় সে-ই তো ব্রেক মারে।
ভুলেই গেছিলাম। বলো, হাতির কথা হচ্চিল।
ঘণ্টেমামা বললেন।
হ্যাঁ। তা ভাবলাম, ছেলেবেলার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে এতদিনে। এ নির্ঘাত পটলার মায়ের-ইদান…
পটলার মা-টি আবার কে?
সে, ছেল একজন।
ছেল তো বুজলাম, কিন্তু তিনি কে?
কেন? আমার কি কেউ-ই থাকতে পারে না?
দেকো দিকি! আমি কি তাই বলিচি?
সে ছেলো, আমাদের মনোয়ামিলনের প্রতিবেশী। কিছুদিন আগেও এয়েছেল। দাদাকে জিজ্ঞেস করো না, বিশ্বেস না হয়তো। সে আমার জন্যি কত পুণ্যিপুকুর ব্রত করেচেল গো। সে বলেচেল, তুমি যা চাবে, তাই পাবে। ভাবলুম, এতদিন ধরে হাতি চেয়েচি আজ এই নাদু-হাতিকে মেরে কোলবালিশ করে নে ঘুমুব। “ঘুঘুর-সই ঘুগুর-সই’ করে খেলব। কিন্তু হা হতোস্মি। বানোয়ারি আমার বাঁ কানের মধ্যে, ইয়ারফুল অফ অ্যাজিটেটেড, ওয়ার্ম হুইসপার ঢেলে বলল; ‘হোয়াট টু ডু? গুরু?’
আমি বললুম, টু শুট। হোয়াট এলস?
তাপ্পর বানোয়ারি বলল, ওয়ান-টু–’
আমি বললুম, থিরি-ই-ই-ই…।
তাপ্পর?
ঘণ্টেমামা প্রবল উত্তেজনার বশে বিড়িতে হাত পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও টান না লাগিয়েই শুধোলেন।
তাপ্পর আর কী? থিরির সঙ্গে রি-রি-রি করে ছররাদানাগুলো হাতির পায়ে যেয়ে বিঁধল। মানে, সেঁদোল আর কী। আর সঙ্গে সঙ্গে হাতিও পা তুলল। ভাবলুম, অ্যাই মারল বুজি, গোদা পায়ে নাতি। নয়তো পা-টি খুঁড়িতে চাপিয়ে দিয়ে দিল সাধের ভুড়ি ফাঁসিয়ে। মাধামামা বললেন।
কিন্তু না। দুর্ঘটনা কিছু ঘটল না। পটলার মায়েই বাঁচিয়ে দিল।
কিন্তু…
বানোয়ারিলাল বলল।
কী, কী? ঘন্টেমামা আবারও উত্তেজিত হয়ে শুধোল।
হাতি ছেড়ে দিল আমাদের নিজগুণে। অথবা পটলার মায়ের গুণে। কিন্তু প্যায়দাতে ধরল।
প্যায়দা?
ইয়েস।
কার প্যায়দা? পটলার মায়ের?
কী ইয়ার্কি করচ?
তবে কার?
কার আবার? রাজার। রাজার পোষা হাতি য্যা! ঘাস খাচ্ছিল। তার পেছনে পেছনে মাহুত আর রাজার খাস প্যায়দাও চেলো। আমরা ঘাসের মধ্যে শুয়েছিনু তাই তেনারা আমাদের দেকতে পায়নি।
এই অবধি শুনেই ঘণ্টেমামা হিহিহি-হিহিহি-হিহিহি করে কেবল-ই হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। দমবন্ধ হয়ে মারাই যান আর কী! বানোয়ারি তড়িঘড়ি ওয়াটারবটল-এর জল থেবড়ে থেবড়ে মুখে-মাথায় দিতে থাকলে তবে অনেকক্ষণ পরে ঘণ্টেমামা শান্ত হলেন। বললেন কেলো, কী কেলো! ফিরে গিয়ে প্রসাদ সাহেবকে বলে ডালটনগঞ্জের রোটারিতে এই হাতি শিকারের গল্প শোনাবার আসর বসাতে হবে একদিন। তুমি কি আসবে মাধা? তোমার বন্ধু বানোয়ারিলালকে নিয়ে? যদি আসো তো নেক্সট মিটিং এর আগে তোমাদের অফিসিয়ালি ইনভাইট করবেন তাহলে ওঁরা।
জগাদা বললেন, ঘণ্টেদা, এনাফ ইজ এনাফ। ইউ উইল হিট দ্যা সিলিং।
এইটেই এক পরমাশ্চর্য! জগাদা যখন ইংরিজি বলেন তখন অমন ‘ট-ট’ করেন না। করলে, অবশ্য ওকালতি হত না। ওকালতিতে তো, কথার’-ই খেলা!
মনোয়া-মিলনের জমির সমান প্ল্যাটফর্মে ওরা সকলেই নামল। ট্রেনটা চলে গেল। গার্ড সাহেবের শেষ কামরার আলো আর ট্রেনের পেছনের লাল বাতিটা হারিয়ে গেল খিলাড়ির দিকে।
যেকোনো ট্রেন চলে গেলেই শিরীষের বুকের মধ্যেটা হু হু করে ওঠে। লাইনের দুটো কালো দাগ পড়ে থাকে স্মৃতি বুকে করে। কত মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, আশা-নিরাশা বুকে করে দুলতে দুলতে ট্রেন চলে যায়, দূরে; বহুদূরে।
শিরীষ বলল, ঘণ্টেমামা আপনি আমার সাইকেলটা নিয়ে যান। সাইকেলটা রাখা আছে মাস্টারবাবুর ঘরের বাইরের বারান্দাতে। কাল একসময়ে গিয়ে আমি বরং নিয়ে আসব। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবেন।
শিরীষের যেন মনে হল যে, ঝাণু দাঁড়িয়ে আছে ঝুপরি আতাগাছটার তলাতে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখল শিরীষ, শুধু ঝাণ্ডুই নয় আরও দু-জনে আছে। ঝাণ্ডুর বস্তির লোক। মুখ চেনে, নাম জানে না শিরীষ।
ঘণ্টেমামা, শিরীষের প্রস্তাবে “হ্যাঁ” বা “না” কিছুই বললেন না। হয়তো বিবেচনা করে দেখছেন। ঝাণ্ডু বোধ হয় আগামীকাল রাতের মহড়া দিচ্ছে। ভালোই হল। টুকরি তিনটি তারা কাঁধে তুলে নিতে শিরীষ আর ঘণ্টেমামা হেঁটে রওনা হলেন। ততক্ষণে জগাদারা সকলেই যার যার সাইকেলে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। মাধাদা আর বানোয়ারিবাবুও বন্দুক কাঁধে লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ঘণ্টেমামা দাঁড়িয়ে পড়ে, হাওয়া আড়াল করে একটা বিড়ি ধরালেন।
বললেন শিরীষকে, চললে নাকি?
না।
শিরীষ বলল।
সকলেই শুধোয়, বিড়ি কেন খাই? ভদ্রলোক তো বিড়ি খায় না। তা আমি বলি…
ঘণ্টেমামার বিড়ি খাওয়ার এক্সপ্লানেশন শিরীষের কানে গেল না।
এখন শুক্লপক্ষ। সপ্তমী কী অষ্টমী হবে। কিছুদিন বাদেই দোলপূর্ণিমা। চৈতি রাতের হাওয়া ছেড়েছে গাছগাছালি, ঝোঁপঝাড়, ঘাসে-পাতায় বনমর্মর তুলে। মহুয়া ফোঁটার সময় এখনও হয়নি। তবু অনেক গাছে অসময়েই ফুল এসেছে। কখনো-কখনো হাওয়ার দমকে সেই গন্ধ এসে উদাস করে দিয়ে যায়। করৌঞ্জ, নিম, ইউক্যালিপ্টাস, কাঁঠালের মুচি, আমের মুকুল সবকিছুর-ই গন্ধে মাখামাখি হয়ে যায় এখন হাওয়া।
রাহেলাওলা, লিটপিটিয়া, সফেদিয়া, পিলাবিবি, জীরহুল ইত্যাদির ফুলে গন্ধ নেই। কিন্তু তাদের গায়ে আছে। নারীর গায়ের গন্ধর মত। হালকা হয়ে ভাসে। উগ্র নয়; কিন্তু আলাদা আলাদা। ঝিঁঝির গায়ের গন্ধর কথা মনে পড়ে গেল শিরীষের। যদিও ওর নিরাবরণ শরীরের গন্ধ কখনো নেয়নি নাক। এ-জীবনে তা নেওয়া হবেও না। জানে।
এইরকম রাতে পাথরের, পাহাড়ের শালফুলের ঊষর টাঁড়ের গন্ধ, সাপের গায়ের গন্ধ, খরগোশের গায়ের গন্ধ, বনহরিণীর তলপেটের গন্ধ, চিরচিরি আর চাট্টি নদীর জলের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে মনকে উদাস করে দেয়। সকলের মনকে দেয় কি না জানে না ও। তবে শিরীষের মনকে দেয়।
পরবে-তেওহারে যখন প্রদীপ ভাসায় মেয়েরা, হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে; পাতার দোনার মধ্যে ফুল, মিষ্টি, আগরবাতির গন্ধ আর রেড়ির তেলপোড়ার গন্ধ বুকে নিয়ে অবিন্যস্ত এলোমেলো, আগে-পিছে জলবাহিত হয়ে বয়ে-যাওয়া প্রদীপেরা যখন নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে আবারও অন্য কোনো অদৃশ্য বাঁকের দিকে বয়ে যায়, তখন শিরীষের জন্যে, তার মঙ্গলকামনায় প্রদীপ ভাসানোর জন্যে সুবেশা সুগন্ধি হাসিমুখের তরুণী এই পৃথিবীতে একজনও যে নেই, সে-কথা হঠাৎ-মনে হওয়ায় এক তীব্র দুঃখ, তীক্ষ্ণ, উত্তপ্ত ছুরির মতো শিরীষের বুককে বিদ্ধ করে দিয়ে চলে যায়।
সব-ক্ষততে রক্ত ঝরে না।
যে ক্ষততে ঝরে না, তা আরও বেশি বেদনাদায়ক।
নীলোৎপলের জন্যেও একটি প্রদীপ ভাসাবে, ভাবে শিরীষ। মাঝরাতে এসে ভাসিয়ে যাবে চাট্টি নদীতে কোনোদিন। ঝিঁঝির যে, রক্ষক হবে, বাহক হবে; ধারক, যে-বুকে নিয়ে আদর করবে ঝিঁঝিকে, তার-ই মঙ্গালাকাঙ্ক্ষাতেই ভাসাবে ওই প্রদীপ। ভাসাবে সেই শিরীষ, যে, সেই ভাগ্যবান নীলোৎপলের পেঁপে এবং কাঁচকলার বাহক। কী যেন বলে? ট্রান্সফারড এপিথেট? হাঃ। ইডিয়ট। ‘দাঁড়কাক-এর বাসা’-র বাসিন্দা আর একটা দাঁড়কাক; শিরীষ!
ছেলেটি তো খুবই ভালো শুনলাম।
স্বগতোক্তির মতো বলল শিরীষ। ঘণ্টেমামাকে শুনিয়ে।
ঘণ্টেমামা বিড়িতে সুখটান লাগাচ্ছিলেন। হঠাৎ এই প্রশ্নে চমকে উঠে বললেন, কে? কার কথা বলছ হে?
নীলোৎপল।
তোমাকে কে বলল, নাম?
ঝিঁঝি-ই বলেছে। যাদের জন্যে পেঁপে খুঁজে বেড়ালাম দিনভর তাদের নামটা জানাটাও কি অপরাধ?
না, না, তা কেন? তবে এ-কথা ঠিক-ই যে, নীলোৎপলের মতো ছেলে এই মনোয়া মিলনের মতো টাঁড়ে-জঙ্গলে কোথায় পাওয়া যাবে! নীলোৎপল সম্বন্ধে আর কী বলব। লক্ষে এমন একটি ছেলে মেলে। অমন স্বামীর জন্যেই মেয়েরা যুগে যুগে শিবের মাথাতে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে এয়েছে। যেমন চেহারা, তেমন-ই গুণপনা, যেমন বোলোক, তেমন-ই স্বভাব চরিত্তির।
একেবারে কপিবুক যে।
শিরীষ বলল।
বলেই, মনে হল ঘণ্টেমামা ভাবতে পারেন যে, ওর অভিব্যক্তির মধ্যে একটু ঈর্ষার দানা আছে। কিন্তু তার মৃতা মায়ের দিব্যি, বাক্যটাতে কোনো দ্বেষ, শ্লেষ বা ঈর্ষা আদৌ ছিল না।
মুখ দিয়ে পানের পিক ছিটকে যাওয়ার মতোই বেরিয়ে গেছিল বাক্যটা। আচমকাই।
ঘণ্টেমামা দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, মানে? কপিবুক তো ক্রিকেট হয়, ড্রাইভিং-এ হয়; ছেলেও হয় নাকি?
হবে না কেন? ছেলে হয়, মেয়ে হয়, বাঁদর হয়, কচ্ছপ হয়। যা-কিছু পার্ফেক্ট তাই কপিবুক।
অ।
ঘণ্টেমামা শিরীষের অফার করা সাইকেলে চড়লেন না। তাই শিরীষ তাঁর পাশে পাশে সাইকেল নিয়ে হাঁটতে লাগল। নির্জন পথে সাইকেলের চেনে ‘ঝিরঝির’ শব্দ উঠতে লাগল ওরা কথা বন্ধ করলেই।
হাঁটতে হাঁটতে শিরীষের মাথার মধ্যে ঘোরটা বাড়তে লাগল। এমন-ই হয়! শিরীষের বোধ হয় মাথার গোলমাল আছে। হয়তো পিতৃপুরুষের কারো ছিল। কার ‘জিন’ যে, কাকে কখন কুটুস করে কামড়ে দেয়, তা কে বলতে পারে?
জগাদা-মাধাদাদের এক জ্যাঠতুতো দাদা রাঁচির কাঁকে রোডের মানসিক রোগীদের হাসপাতালে তিনবছর ছিলেন। তাঁকে যখন আনতে গেলেন ওঁরা, শিরীষও সঙ্গে গেছিল। বিল-টিল মিটিয়ে, সই-সাবুদ করে, দাদাকে নিয়ে ওরা যখন ট্যাক্সি করে রওয়ানা হয়েছে তখন জগাদা শুধোলেন, টোমারটো ডেকি কিছুই হয়নি ডাডা। মিটিমিটি টিন টিনটে বটর টোমাকে ওরা একানে আটকে রেকে ডিলো! চিন্তা করা যায়? কী অন্যায়! বললাটো দেকি!
দাদা বললেন উত্তরে, তাঁর নিজের কপালে দুই জোর চাপড় মেরে; কী করব বল জগা! সব-ই শালা আমার পোঁদের-ই দোষ।
সর্পদ্রংষ্টের মতো জগাদা বললেন, ডাইভার! ডাইভার গাড়ি ঘুমাও। ঘুমাও আব্বি ঘুমাও। যাঁহাঠে আয়াঠা হুয়াই লওটাকে চালো ফিন।
এতদিন পরে সেই কথা মনে পড়ে গিয়ে, এই আঁকাবাঁকা শুক্লপক্ষের এখনও চাঁদ-না-ওঠা রাতের মিষ্টি-গন্ধ ধুলোর পথে হাঁটতে হাঁটতে খুব হাসি পেল শিরীষের।
দেখতে দেখতে ‘দাঁড়কাকের বাসা’ এসে গেল।
শিরীষ বলল, ঝাণ্ডু, তুমি তাহলে মামাবাবুকে নিয়ে এগোও।
ঝাণ্ডু বলল, ঠিক্কে হ্যায়।
একটা টর্চ দেব কি মামাবাবু? চাঁদ তো এখনও জোর হয়নি।
কী বলচ কী শিরীষ? কেন্দুপাতার জঙ্গলে সারাটা জীবন কাটালাম আর আমার লাগবে টর্চ? অমাবস্যার অন্ধকারেও আমি দেখতে পাই।
শিরীষ বলল, বাঃ। তাহলে তো চমৎকার! আমি তাহলে…
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি আরাম করো। কাল সকালে এসো, পারলে একবার। আরও যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, ঝাণু ছাড়া এসব করার তো কেউ নেইও। যাঁরা আসবেন তাঁরা সব খুব-ই মান্যি-গণ্যি লোক বুয়েচ।
কাল তো সোমবার। আমার তো কাজে যেতে হবে। তবে যদি মনে করেন যে, প্রয়োজন। আছে তবে কাকিমাকে জিজ্ঞেস করে বলবেন। রাতে স্টেশানে যাবই। মালপত্র যদি বেশি থাকে, ঝাণ্ডুরা যদি সব বইতে না পারে? নামাতেও তো হবে। এক মিনিট তো মাত্র স্টপেজ।
ঝাণ্ডু বলল, উও বাত ঠিক হ্যায়। ভটভটিয়া নেহি না মিলা বাবু। সবহি চলা গ্যায়া লালু বাবুকো মিটিংমে। চান্দোয়াটোড়ি।
ও বাবা। তবে তো দরকার হবেই। আমি মাল-টাল বইতে পারব না। আমার আবার স্পণ্ডিলাইটিস আচে। যাদের কাজ, তাদের-ই সাজে।
শিরীষ কথাটার মধ্যে একটু অপমানের গন্ধ পেল। কিন্তু ভাবল যে, ওকে যদি মাল বইতেই হয় তবে ও তো ঘন্টেমামার জন্যে বইবে না, ঝিঁঝির জন্যেই বইবে। মনে মনে ক্ষমা করে দিল ও ঘণ্টেমামাকে।
চললাম তাহলে।
শিরীষ বলল।
আচ্ছা। মানে আপাতত। কাল এসো। রিসেপশান কমিটি গড়তে হবে একটা।
ওঁরা এগোলেন।
ওর গলার শব্দ শুনে বুড়ি-মাই লণ্ঠন হাতে ভেতর থেকে এগিয়ে এল। ফুটো-ফাটা দরজার মধ্যে দিয়ে উঠোন থেকে আসা সেই আলো দেখা গেল। শিরীষের কুকুর কালু, ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। ল্যাজের এক ধাক্কায় দরজার পাল্লা খুলে বুড়িমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েই ও এক লাফে পেছনের দু-পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে সামনের দু-পা শিরীষের দু-ঊরুর ওপর রেখে ওর কোমরে মুখ ঘষতে লাগল।
শিরীষ ভাবল, কুকুরের ভালোবাসার মতো পবিত্র, নির্ভেজাল, আনকম্পলিকেটেড ভালোবাসা কোনো মানুষের কাছ থেকে অন্য কোনো মানুষ কোনোদিন-ই পায়নি। পাবেও না। হয়তো।
এমনি সময়ে বাইরে একটা শব্দ হল। বাইরে না গিয়েও শিরীষ বুঝল যে, ঘণ্টেমামা অন্ধকারে পথের পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। ভালোই চোট পেয়েছেন নিশ্চয়ই।
শিরীষের মুখে এক শীতল নিষ্ঠুর হাসি উঠল, যা একেবারেই ওর চরিত্রানুগ নয়। কিন্তু ও বাইরে না গিয়ে সারমেয়র গলকম্বলে আদরের হাত বোলাতে লাগল। ‘জঙ্গলের পোকা’ যদি জঙ্গলে পথে পড়ে গিয়েও থাকেন অন্ধকারে, তবে শিরীষের কিছুই করার নেই। অন্ধকারেও দেখতে পায় শুধুমাত্র শ্বাপদেরাই। দ্বিপদ, শ্বাপদ হতে চাইলে বা হওয়ার দাবি করলে, কিছু ঝামেলা তো তাকে পোয়াতেই হবে!
শিরীষের কিছুই করার নেই। শেঠ চিরাঞ্জিলালের গদিতে একটা নতুন ছেলে এসেছে রাজস্থানের ঝুনঝুন থেকে। ছেলেটা বেজায় মোটা। সেটা দোষের নয়। কিন্তু ছেলেটা ভীষণ-ই কুটিল চরিত্রের। ওইরকম চেহারা কিন্তু গলার স্বর মেয়েদের মতো। নাম পুরুষোত্তম। তার বাবা-মায়ের রসবোধ আছে। নরাধম নাম দিলেও যার প্রতি, যথেষ্ট দয়া দেখানো হত তার-ই নাম পুরুষোত্তম।
ছেলেটা ব্যাঙ্কের কাজ-ই দেখে মুখ্যত। রোজ যায় চাঁদোয়াটোড়িতে। বিল্টি ছড়ায়। বিল ডিসকাউন্টিং-এর ব্যাপার-স্যাপার দেখে। যেহেতু শেঠ-এর পরিচিত পরিবারের ছেলে এবং নিজের জাতের, তাই শেঠ প্রথম দিন থেকেই তাকে বিশ্বাস করে অনেক-ই দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন।
পুনমচাঁদজির বয়েস হচ্ছে। তা ছাড়া, তিনি এখানে না থাকলে এখানের দুর্গ সামলাবে কে? মাড়োয়ারি কোম্পানির চিফ-অ্যাকাউন্ট্যান্ট সবসময়ে মাড়োয়ারিই হয়। তা তার ডিগ্রি থাকুক আর নাই থাকুক।
শিরীষের মনে হয় যে, ছেলেটা ভালো পরিবারের নয়। তার চোখের দৃষ্টিটাও ভালো নয়। প্রায়-ই সে নিজের কাজ ছেড়ে শিরীষের টেবিলে এসে বসে। আর কোনো কারণে নয়, পুনমচাঁদজির ‘কন্যার’ বিশেষ করে গুঞ্জনের দেখা পাওয়ার জন্যে।
পুনমচাঁদজির চোখে যে পড়েনি ব্যাপারটা তাও নয়, কিন্তু তাঁর চোখে যেন, আশার ঝিলিক দেখতে পায় শিরীষ একধরনের। যদি মেয়েটার একটা হিল্লে হয়ে যায়। হয়তো ভাবেন। শিরীষ ভাবে, অমন সুন্দর ফিগায়ের দুবলা পাতলা মেয়েটাকে এই অসুরটা বিয়ে করবে? পদ্মবনে হস্তীযথা! কিন্তু ভালো মাল-কড়ি না পেলে বিয়ে করবে যে, এমন ভালোমানুষ বলে তাকে মনে হয় না।
এই কথা ভেবেই দুঃখ হয় শিরীষের। গুঞ্জন চলিতার্থে গরিব হতে পারে, অশিক্ষিত হতে পারে কিন্তু বেশ সুন্দরী ও সপ্রতিভ মেয়ে। সুন্দর ব্যবহার। তা ছাড়া স্কুল-কলেজে না পড়লেই যে অশিক্ষিত হবেই এমন কোনো মানেও নেই। এক ধরনের শিক্ষা, সহজাতও হয়, সহবতও। যখন হাসে, তখন শিরীষের মনে হয় যেন ওর অদেখা আলোয়ারের বুঝি ভোর হল। গুঞ্জনদের দেশ রাজস্থানের ‘আলোয়ারে’। “আলোয়ার’ রাজস্থানের মধ্যের একটি করদ রাজ্য ছিল। যেখানে পুনমচাঁদজির বাড়ি। আর ‘সুন্দরী’ মানে, যৌবনের সৌন্দর্য নয়। যৌবনে কুশ্রী কুকুরিও সুন্দরী। সেই আলগা সৌন্দর্য যৌবন অপগত হলেই ঝরে যায়। এ-সৌন্দর্য থেকে যাওয়ার সৌন্দর্য।
ওই পুরুষোত্তম নামক নরাধমটার চোখের দৃষ্টিতে প্রেম নেই, শুধুই কাম। অমন কামুক চোখ, ওইরকম কুদৃশ্য পুরুষ শরীর, আগে কখনোই দেখেনি শিরীষ। কষ্ট-কল্পনাতেও আনেনি কোনোদিনও। ওই পেটমোটা, মেয়েলি-গলার ঝুনঝুনবাসী নরাধম শিরীষের মনের মধ্যে এক আশ্চর্য অথচ ব্যাখ্যাহীন কষ্টর জন্ম দিয়েছে।
অথচ গুঞ্জন ওর কেউ-ই নয়। তার প্রতি ওর কোনো দুর্বলতা থাকার প্রশ্নই ওঠে না। পুরুষোত্তম অথবা নরাধমও ওর কেউ নয়। তবুও কেন যে, কষ্ট পায় ও, ভেবে পায় না। ঠিক কষ্ট নয়, চিন্তা। একধরনের দুশ্চিন্তা হয় গুঞ্জনের জন্যে।
অথচ গুঞ্জনের বাবা পুনমচাঁদজি আনন্দিত।
বড়ো আশ্চর্য জায়গা এই পৃথিবী।
মাঝে মাঝেই মানুষ হয়ে জন্মেছে বলে, নিজস্বার্থ ছাড়াও সম্পূর্ণ অনাত্মীয় দূর-জনের জন্যেও ও উদবিগ্ন হয়। বুঝতে পারে যে, মানুষ হয়ে জন্মানো বড়ো কষ্টের। এর চেয়ে বদরুদ্দিন মিয়ার বকরি বা জুগনু ধোবির গাধা হয়ে জন্মানোও অনেক সুখের ছিল হয়তো।
গদিঘরের দেওয়াল-ঘড়িতে দেখল চারটে প্রায় বাজে। আজ একটু তাড়াতাড়িই উঠবে। কারণ, ভেবেছিল; জগাদা-মাধাদাদের সঙ্গে একবার দেখা করে তারপর-ই যাবে স্টেশনে।
ঝিঁঝিদের বাড়িতে সকালে ইচ্ছে করেই যায়নি। কাল ঘণ্টেমামার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই ঝিঁঝির ওপরে কেমন যেন, এক অভিমান জন্মেছে ওর। বাবুটি না-হয় একেবারে নীল পদ্মই। তা বলে, ও কি শাপলা বা ঘেঁটুফুল হওয়ার যোগ্যতাও রাখে না? তবে স্টেশনে ঠিক-ই যাবে। শুষ্ক-কর্তব্য যা করার, তা করে দেবে।
একথাও অস্বীকার করতে পারে না যে, নীলোৎপল নামক রূপবান এবং সর্বগুণসম্পন্ন পুরুষটিকে একবার চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছেটাও বড়োই প্রবল হয়েছে। তার-ই সঙ্গে মিস্টার পেঁপেদুকেও দেখবে। কতরকম চিড়িয়া’ই যে, খোদার দুনিয়াতে থাকে।
খিদেও পেয়েছে। সকালে কাঁটায় কাঁটায় ন-টাতে এসে হাজিরা দেয়। বারোটায় সাইকেল নিয়ে বাড়ি যায় খেতে। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফিরে আসে একটাতে। থাকে, টানা ছ-টা পর্যন্ত। কোনো কোনোদিন বেশিও থাকতে হয়। ন-টা-দশটাও বেজে যায় কোনো কোনোদিন, গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীতের রাতেও। মোদ্দা কথা, রোজকার কাজ রোজ শেষ করে দিয়ে যেতে হয়। ওর কাজের পর পুনমচাঁদজি আর লাডসারিয়া বসে এক-নম্বর দু-নম্বরের হিসাব পাকা করেন। মাড়োয়ারিরা হিসেব-কিতেবে একেবারে পাকা। চুরি যদি থাকে, যা থাকে; তা খাতার বাইরেই থাকে। খাতাতে কোনো খুঁত-ই থাকে না তাঁদের।
পুনমচাঁদজিকে বলে উঠল, শিরীষ। সাইকেলটা বারান্দার লোহার দরজাতে লাগানো চেনের তালা খুলে টেনে নিয়ে যখন নামল পথে তখন দেখল নরাধম, থুড়ি, পুরুষোত্তম আসছে গলদঘর্ম হয়ে। তার পেটটা এতই মোটা যে, সেটা পাইলট-কারের মতো তার সামনে সামনে চলে। দশ পা চললেই হাঁস-ফাঁস করে।
সে ‘বাসা’-তেই খায়। মাড়োয়ারি সব ব্যবসাদারদের-ই ‘বাসা’ থাকে, বা ‘মেস’। পুরি, সবজি, চাল, খাঁটি ঘি, কাড়হি, দহি, আচার আর পাঁপর। খাবারের মধ্যে এই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও তাঁদের কাছ থেকে শেখার আছে অনেক। এমন মিতাহারী বাঙালিরা কেউ-ই নন। অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠে গভীর রাত অবধি পরিশ্রমও এদের মতো বাঙালিদের মধ্যে খুব কম মানুষ-ই করেন। শিরীষ এদের গুণগুলোই দেখার চেষ্টা করে, যাতে নিজের উন্নতি হয়। দোষগুলো সযত্নে পরিহার করার চেষ্টা করে।
কিন্তু নরাধম বেজায় খায়। এমন পেটুক মাড়োয়ারি শিরীষ আর দেখেনি যদিও, মাড়োয়ারি ফার্মে কাজ করে বলে অগণ্য মাড়োয়ারিকে কাছ থেকে দেখেছে। ছেলেটার হাঁটা, চলা, কথা বলা, খাওয়া সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের জংলামি আছে। যা, এই জঙ্গুলে জায়গাতেও চোখে লাগে।
নরাধম বলল, আজ ইতনা জলদি চল দিয়ে হেঁ আপ? কাম খতম হো গ্যয়া ক্যা?
শিরীষের মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
বলল, তুম আপনা কাম সামহালো পুত্তমবাবু। তুম কওন হো, যো হামে পুছতা হ্যায়?
গলার আওয়াজে নরাধম একটু ঘাবড়ে গেল। বলল, আপকি টেবলমে আভ্যি ম্যায় যাকর বৈঠকে কামতো করনে শকতা হ্যায়-না?
তখন শিরীষ বুঝল ওর আসল উদ্দেশ্য। দিনের ঠিক এই সময়টাতেই গুঞ্জন সিঁড়িতে বসে চুল আঁচড়ায়। পাকা বেলের মতো দু-টি আঁটসাঁট বুক থেকে শাড়ি খসে যায় তখন।
আশ্চর্য! দৃশ্যটা কখনো তেমন করে লক্ষ করেনি শিরীষ। মনে কোনো কু-ভাবনাও ছিল না। অথচ অনবধানে দেখে প্রায়-ই। দেখে, মানে চোখে যাই পড়ে, তার সব-ই কেউ দেখে । আজ নরাধম লোলুপ চোখে গুঞ্জনকে দেখবে বলেই হঠাৎ, ওই দৃশ্যটা কেন যে, ওর কল্পনাতে এমন তাৎপর্যময় হয়ে উঠল তা নিজেই ঠিক বুঝল না। কথাটা মনে হওয়াতেই ও খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। এবং একটু লজ্জিতও।
বলল, টেবল তো হামরা বাপকা নেহি হ্যায়।
নরাধম মেয়েলি গলায় বলল, যা, কুর্সিপর বৈঠত কুর্সি উসিকা না হ্যায় জি?
শিরীষ বুঝল, কথাটা দ্ব্যর্থক। ওর মুখটা বিকৃত হয়ে গেল।
মুখে বলল, জি হাঁ।
বলেই, প্রয়োজনের অনেক বেশি জোরে সাইকেলের প্যাডলে চাপ দিল। এবং শেঠ চিরাঞ্জিলালের গদি থেকে যতদূরে পারে চলে যাবে মনস্থ করে খুব জোরে সাইকেল ছোটাল। জ্যা-মুক্ত তিরের মতো কিছু পথ দ্রুত এসে তারপর খুব-ই আস্তে প্যাডল করতে করতে শিরীষ ভাবছিল যে, ঠিক এই সময়টাতে গুঞ্জন চুল বাঁধছে বসে। গুঞ্জনদের উঠোনের পাশের বারোমেসে ঝুমকো জবা গাছটার ডালে ডালে নানারকম মৌটুসি পাখির মেলা বসে। এখন তারা ফিস ফিস করে কথা বলে আর টুসকি দিয়ে দিয়ে চমকে বেড়ায় ফুলে ফুলে। পশ্চিমের আলো নরম হয়ে এসে পড়ে আমলকী গাছের ডাল-পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গুঞ্জনদের বাড়ির পুবের বারান্দায়। একসঙ্গে অনেকগুলো তিতির ডাকতে থাকে অদূরের রেলইয়ার্ডের পাশের খোওয়াই-এর পুটুসের ঝাড় থেকে। দিনের এই সময়টাতে পেটি-ক্যাশ বই লিখতে লিখতে আর ভাউচার বানাতে বানাতে হঠাৎ-ই রোজ-ই মনটা বড়ো উদাস হয়ে ওঠে ওর। বুঝতে পারে যে, এই কাজ তার আসল কাজ নয়। ও ওর সময়, ওর জীবন নষ্ট করছে। কিন্তু কী করবে, কী করা উচিত তা ভালো করে ভাববার আগেই গদিতে সন্ধের বাতি জ্বলে ওঠে। ধূপধুনো দিয়ে লক্ষ্মীজি আর গণেশজির কাছে উঠে দিয়ে জুতো খুলে মাথা নোয়ান পুনমচাঁদজি, লাডসারিয়াজি এবং নরাধম থাকলে, নরাধমও। বিড়বিড় করে কীসব বলেন। শেঠ নিজে যদি থাকেন সেই সময়ে তবে শেঠও এমন করেন নিজের আলাদা ঘরে বসে। আরও একটি সমৃদ্ধির, স্বর্ণমুদ্রার রাতকে, আবাহন জানিয়ে লক্ষ্মীজিকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসেন ওঁরা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লাডসারিয়াজির সেই কাশিটা আরম্ভ হয়। এইরকম কাশি কোনো বাঙালিকে কাশতে দেখেনি কখনো। কী যে, কষ্ট পান ভদ্রলোক! সারাবছর গলাতে একটি মাফলার জড়ানো থাকে। গলার কাছে একটা লাম্প মতো হয়েছে। কখনো-কখনো মনে হয়, কাশতে কাশতে অজ্ঞান-ই হয়ে যাবেন কিন্তু তার-ই মধ্যে কুঁজো হয়ে বসে গেঁহু, বাজরা, চাল তেলের পুরচা কাটতে থাকেন। ওঁর কণ্ঠস্বরও ভেঙে গেছে। রুক্ষ, কর্কশ স্বর। লাল লাল চোখ দু-খানি। কাশির-ই দমকে লাল হয়ে থাকে সবসময়–মাঝে মাঝেই বদ্যিনাথধামের কোনো কবিরাজের দেওয়া ছাগলাদ্যর মতো গুলি খান। তারপর একটু চাঙ্গা হলেই আবার কাজে লেগে যান। ওঁর পরিবারে কেউ নেই। স্ত্রী গত হয়েছেন। একছেলে, সে ঔরঙ্গাবাদে এক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এখনও বিয়ে করেনি। লাডসারিয়াজি এখানে বাসা’-তেই থাকেন। ছেলেও সেখানের বাসাতে। এই মানুষটি খুব-ই ধার্মিক প্রকৃতির। ছেলের বিয়ে দিয়ে টাকা নেওয়ার কথা নাকি তিনি চিন্তাও করতে পারেন না। শিরীষ ভাবে, গুঞ্জনের সঙ্গে কেন ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন না উনি। ভাবে, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এসব ওঁদের সমাজের এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারও।