২. যদু বড়াল লেনে

তারাপদকে সঙ্গে করে কিকিরা রবিবার বেলা ন’টা নাগাদ যদু বড়াল লেনে হাজির।

শরৎকালের আকাশ। ঝকঝকে রোদ মাঝে-মাঝে সামান্য চাপা পড়ছে, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল মাঝে-মাঝে। তুলোর আঁশের মতন বৃষ্টি এই এল, এই গেল। আবার রোদ।

গলিটা পুরনো তো বটেই–কিন্তু সরু নয়, মোটামুটি চওড়া। গাড়ি ঘোড়া আসা-যাওয়া করতে কোনো অসুবিধে হয় না। বাড়িগুলোও দোতলা-তেতলা। কোনো-কোনোটা জীর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আবার কোনোটা বেশ পাকাঁপোক্ত। ওরই মধ্যে একটা বাড়ি নতুন করে সারিয়ে রংচঙ করা হচ্ছিল।

গলির মধ্যে রোদও ছিল, ছায়াও ছিল। রাস্তা সামান্য ভিজে ভিজে। দু-চারটে মামুলি দোকান। লন্ড্রি, চায়ের, মুদিখানার, তেলেভাজার দোকানও রয়েছে একটা।

কিকিরা ঠিকানা মতন বাড়িটার সামনে এসে রিকশা ছেড়ে দিলেন। বগলা যা বলেছিল, মোটামুটি ঠিক। উঁচু পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি। অবশ্য পাঁচিলের দশ আনাই ভেঙে পড়েছে। ইট একেবারে শ্যাওলাধরা। বাড়ি ঢোকার মুখে এক ভাঙা ফটক। ফটকটা বন্ধ হয় না। ভোলাই থাকে ফটকের একপাশে থামের ওপর কোনোকালে আলোর ব্যবস্থা ছিল, এখন নিতান্তই একটা লোহার বাঁকানো পাইপ খাড়া হয়ে আছে।

ফটক দিয়ে ঢুকতেই খানিকটা মাঠ। একেবারে জংলা চেহারা। নিম আর কুলগাছ। একপাশে ফুলগাছের ঝোঁপ। শিউলিগাছ, করবী। মাঠে জলকাদা, ঘাস। ডান দিকে দারোয়ানের ঘর ছিল আগে। এখন ভাঙা ঝুপড়ি।

গজ চল্লিশ হয়ত হবে না, মাঠটুকু পেরিয়েই দোতলা বাড়ি। বাড়ি সেকেলে। চেহারাতেই সেটা বোঝা যায়। কাঠের খড়খড়ি, লোহার নকশাদারি রেলিং, বড়বড় থাম, কাঁচের শার্সি। বাড়ির নানান জায়গায় ভাঙা-চোরা। বাইরে থেকে বেশ বিবর্ণ দেখায়। মাঠের একপাশে একটা ভাঙা টালির শেড। জায়গাটা নোংরা হয়ে রয়েছে।

তারাপদকে নিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বিশ-ত্রিশ পা এগোতে-না-এগোতেই কার গলা শোনা গেল।

 “এ বাবু?”

কিকিরা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাকালেন।

বাড়ির চওড়া থামের আড়াল থেকে একটা লোক এগিয়ে আসছিল। কুস্তিগিরের মতন চেহারা। পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, খাটো বহরের। গায়ে হাক্কাটা গেঞ্জি। গেঞ্জিটা রং করা। মাথা প্রায় ন্যাড়া।

কাছে এলে বোঝা গেল, নোকটা পালোয়ানই বটে। বুকের ছাতি, পায়ের গোছ, হাতের পেশী দেখার মতনই। সেইসঙ্গে তার পইতেটাও। গলা থেকে পেট পর্যন্ত লম্বা। লোকটার কপালে চন্দন, কানের লতিতে চন্দন।

কাছে এসে লোকটা বলল, “কাঁহা যাইয়ে গা?”

কিকিরা বললেন, “বাবুসে ভেট করনা হ্যায়।”

“কোন বাবু?”

“বড়া বাবু! লোচনবাবু!” বুদ্ধি করেই বললেন কিকিরা।

 “কেয়া নাম আপনোগা?”

কিকিরা বললেন, “কিকিরা!”

“কেয়া?”

“কি-কিরা!”

“কিক্কিরিয়া!” বলে লোকটা কেমন সন্দেহের চোখে দেখল কিকিরাদের। তারপর বলল, “ঠাহের যাইয়ে।”

কিকিরাদের দাঁড়াতে বলে লোকটা বাড়ির দিকে চলে গেল।

কিকিরা রঙ্গ করে বললেন, “কোন বাবু?” বলেই কৌতূহল হল। “এবাড়িতে আর ক’জন বাবু থাকে হে?”

এতক্ষণ পরে কুকুরের ডাক শোনা গেল। মনে হল, কুকুর এখন কাছাকাছি কোথাও নেই। হয়ত বাড়ির পেছন দিকে, বা দোতলায়।

কিকিরার সাজপোশাক যথারীতি খানিকটা বিচিত্র। আলখাল্লা ধরনের জামা, সরু প্যান্ট। মানুষটি যেমন রোগা তেমনই লম্বা। এই পোশাকে তাঁকে আরও লম্বা দেখায়। মাথায় একরাশ চুল, বড়বড়, প্রায় কাঁধ ছুঁয়েছে। কিকিরার হাতে বেতের লাঠি ছিল। পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ। পায়ে চটি।

তারাপদ বলল, “কিকিরা, এই বাড়ি দেখে তো মনে হচ্ছে–ভেরি ওল্ড। কুইন ভিক্টোরিয়া আমলের নাকি?”

কিকিরা বললেন, “হতে পারে। অন্তত জর্জ দ্য ফিফথের আমলের তো হবেই।” বলে চারপাশ দেখিয়ে বললেন, “বাড়িটার সামনে কত জায়গা দেখেছ! পুরনো দিনের বাড়ি না হলে কলকাতা শহরে এত জায়গা ফেলে কেউ বাড়ি করে। এখন এই জমিরই কী দাম! লোচন দত্তরা ধনী লোক ছিল হে। ধনী আর বনেদি। আমার মনে হচ্ছে, একসময় এবাড়িতে নিজেদের ঘোড়া আর গাড়িও থাকত! ওই শেডটা বোধ হয় ঘোড়ার আস্তাবল ছিল এক সময়। “

“কী করে বুঝলেন?”

“এরকম আমি দেখেছি। তা ছাড়া একটা ভাঙা চাকা পড়ে আছে একপাশে।”

আরও দু-চারটে কথা শেষ না হতে-না-হতেই পালোয়ান ফিরে এল।

 “আইয়ে।”

 কিকিরা পা বাড়ালেন। সামনে পালোয়ানজি।

হাঁটতে হাঁটতে কিকিরা হঠাৎ বললেন, “এ পালহানজি! দেশ গাঁও কাঁহা। তুমহারা?”

“ছাপরা জিলা!… লাটোয়া গাঁও।”

“আচ্ছা! কলকাত্তামে নয়া মালুম!”

কিকিরা দু-চার কথা আরও জেনে নিলেন। পালোয়ানের নাম, হরিপ্রসাদ। আগে সেজানবাজারে থাকত। লখিয়াবাবুর বাড়িতে দারোয়ান ছিল।

সিঁড়ি কয়েক ধাপ। তারপর ঢাকা বারান্দা। বারান্দার গায়ে-গায়ে তিন-চারটে ঘর।

পালোয়ান হরিপ্রসাদ কিকিরাদের নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসাল।

 কিকিরারা কাঠের চেয়ারে বসলেন।

ঘরটা বড়। জানলা-দরজাও বেশ বড় বড়। কড়ি কাঠ থেকে লোহার রড ঝুলছে। রডের সঙ্গে পাখা লাগানো। গুটি দুই বাতি ঝুলছিল উঁচু থেকে। ঘরে আসবাবপত্র বলতে এক জোড়া কাঠের আলমারি। রাজ্যের জঞ্জাল জমিয়ে রাখলে যেমন হয়–আলমারির মধ্যেটা সেইরকম দেখাচ্ছিল। পাল্লার কাঁচ অর্ধেক ভাঙা। গোটা কয়েক কাঠের চেয়ার, আর তক্তপোশের ওপর পাতা ময়লা ফরাস ছাড়া অন্য কিছু বড় একটা দেখা যায় না। একটা ক্যারাম বোর্ড একপাশে রাখা। টিনের একটা কৌটোও রয়েছে বোর্ডের পাশে। দেওয়ালে এক মস্ত বড় ছবি। বোধ হয় দত্ত বাড়ির কোনো প্রাচীন কতার। দেওয়ালে এক কাগজ সাঁটা রয়েছে। সাদা কাগজের ওপর রং দিয়ে লেখা ক্যারাম প্রতিযোগিতা। গোটা দুয়েক ঘেঁড়া-ফাটা ক্যালেন্ডার। ঘরের চেহারা থেকে বেশ বোঝা যায়–এটা ঝড়তি-পড়তি ঘর। মামুলি লোকজনদেরই বসানো হয়।

লোচন দত্ত ঘরে এল। প্রথম নজরেই আন্দাজ হয় বয়েস বেশি নয় লোচনের।

কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানালেন।

লোচন দত্তর পরনে দামি চেককাটা লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়া। এক হাতে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই, অন্য হাতে চাবির গোছা। মনে হল, চাবির গোছা ছাড়া তিনি কোথাও নড়েন না।

লোচনের চেহারা দেখে কিকিরার ধারণা হল ওর বয়েস বছর পঁয়তাল্লিশ। স্বাস্থ্য মজবুত। গায়ের রং তামাটে। মুখটা চৌকোনো ধাঁচের, শক্ত। দুটো চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। বড় বড় চোখ। খানিকটা রুক্ষ। চতুর বলেও মনে হচ্ছিল। মাথার চুল কোঁকড়ানো, মাঝখানে সিঁথি। গোঁফ রয়েছে। গলায় সোনার সরু হার।

ঘরে ঢুকে লোচন দত্ত একবার পাখার দিকে তাকাল। “আহা, পাখাটা খুলে দিয়ে যায়নি। যত্ত সব গাধা আহাম্মক।” বলতে বলতে নিজেই পাখার সুইচে হাত দিল।

পাখা চলতে শুরু করল।

লোচন এবার একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “আপনারা?”

কিকিরা বললেন, “আপনার কাছে এসেছি।”

“কী ব্যাপারে?”

“খবরের কাগজে আপনি একটা নোটিস দিয়েছিলেন।”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল।”

 “অন্য কেউ এসেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে?”

“দুজন। দু’দিনে দু’জন। দুজনের কাউকেই আমার পছন্দ হয়নি। একজন বোধ হয়–একসময় হোটেলে কাজ করত। সিকিউরিটির কাজ।”

“আমরা আপনার সঙ্গে ওই নোটিসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”

লোচন চাবির গোছাটা কোলের ওপর রাখল। দেখল কিকিরাকে। মনে হল না, খুশি হয়েছে।

“মিশাইয়ের নাম?”

“কিরকিশোর রায়।” বলে কিকিরা তারাপদকে দেখালেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর সরল গলায় বললেন, “লোকে আমাকে কিকিরা বলেই জানে।”

“কী? কিকিরা?” লোচন অবাক।

“কিঙ্কর-এর কি, কিশোর-এর কি, আর রায়-এর রা।” কিকিরা মজা-মজা মুখ করে হাসলেন।“আজকাল সবাই ঘোটর ভক্ত। ফ্যান্টাসটিক-কে বলে “ফ্যান্টা’, ওয়ান্ডারফুল-কে “ওয়ান্ডা। নামের বেলাতেও তাই। ডিপি, বিবি, কেজি। বড় নাম বারবার বলতে কষ্ট হয়।”

“আচ্ছা-আচ্ছা! তা মশাইয়ের কী করা হয়? কিকিরা অমায়িক মুখ করে হাসলেন। “আমার পেশা বলে কিছু নেই। একসময় ম্যাজিক দেখাতাম। লোকে বলত, “কিকিরা দ্য ওয়ান্ডার’। এখন আর ওসব বিদ্যে জাহির করি না। একটা বই লিখছি প্রাচীন ভারতের ইন্দ্রজাল বিদ্যা। …সেকালে নানা শাস্ত্রে কাব্যে…”

কিকিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে লোচন বিরক্ত হয়ে বলল, “না না, প্রাচীন ইন্দ্রজাল- টিন্দ্রজাল আমি ছাপব না।” বলে বেশ কঠিনভাবে কিকিরার দিকে তাকাল। “আপনি বললেন, কাগজ দেখে এসেছেন। এখন বলছেন ইন্দ্রজাল…! আশ্চর্য ব্যাপার মশাই। আমি ইন্দ্রজাল দেখার জন্যে গাঁটের পয়সা খরচ করে কাগজে নোটিস ছাপিনি।”

কিকিরা হাসি-হাসি মুখেই বললেন, “আজ্ঞে না। আমি বই ছাপাবার জন্যে আপনার কাছে আসিনি! আমি জানি, আপনি ছাপাখানার ব্যবসা করেন।”

“হ্যাঁ। আমাদের সত্তর বছরের ব্যবসা। দত্ত অ্যান্ড সন্স।”

“বিখ্যাত ছাপাখানা। ফেমাস! ধর্মতলায় আপনাদের বিরাট প্রেস। আপনারা বিশাল বিশাল কাজ করতেন। সরকারি, বেসরকারি। একবার সি আর দাশের স্পিচ ছেপেছিলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অভিভাষণ…”

লোচন কেমন অবাক হয়ে গেল। হ্যাঁ করে কিকিরাকে দেখছিল। ও

তারাপদ মনে-মনে হাসছিল। কিকিরা অতি চতুর। আসার আগে লোচন দত্তর কাজ কারবারের খোঁজ করে নিয়েছেন তবে। অবশ্য যত না খোঁজ করছেন তার চেয়ে বেশি গুল-গাপ্পা ঝাড়ছেন লোচন দত্তর কাছে। সি আর দাশ, শ্যামাপ্রসাদ-বোধ হয় বাজে কথা।

লোচন বলল, “সি আর দাশের কথা আপনি জানলেন কেমন করে?”

“আপনি জানেন না?” কিকিরা যেন কতই অবাক।

 “আমার বাবা জানতে পারতেন। আমি কেমন করে জানব। ..তবে হ্যাঁ আমাদের প্রেসের অফিসঘরে কয়েকটা সার্টিফিকেট টাঙানো আছে। বড় বড় কাজকারবার যখন করেছি, সার্টিফিকেট পেয়েছি। দু-একটা ফোটোও আছে। নেতাজি একবার আমাদের প্রেসে এসেছিলেন। ইয়ে–কী নাম যে, অ্যাক্টর-ওই যে, আহা কী যেন নামটা..”

“শিশিরকুমার!”

“না না, শিশির ভাদুড়ী নন, মিত্তির, মিত্তির।”

“নরেশ মিত্তির।”

“তাঁরও ফোটো আছে। জ্যাঠামশাইয়ের বন্ধু ছিলেন।”

কিকিরা আড়চোখে তারাপদকে দেখলেন।

লোচন বলল, ছাপাখানার কথা থাক। ছাপাখানার জন্যে আমি কাউকে ডাকিনি।”

“জানি স্যার। আপনি মোহনবাবু সম্পর্কে খোঁজ-খবর চান।”

“হ্যাঁ।”

“আমি আদতে ম্যাজিশিয়ান হলেও মাঝেসাঝে এই ধরনের খোঁজখবর রাখার কাজও করি।”

“গোয়েন্দা?”

“না স্যার। আসল গোয়েন্দা নই।”

“তবে?”

“পাতি গোয়েন্দা।” কিকিরা হাসলেন মজার মুখ করে। “আপনি আমায় ওয়ার্থলেস মনে করবেন না। আমি কাপালিক ধরেছি, রাজবাড়ির কাজও করেছি। সত্যি বলতে কি, আপনি আমায় একটু লোভ দেখিয়ে টেনে এনেছেন।”

“লোভ?” লোচন সিগারেটের প্যাকেটটা খুলতে-খুলতে বলল।

 “তিরিশ হাজার টাকার লোভ!”

“ও!”

“মোহন দত্তকে, মানে জাল মোহন দত্তকে আমি খুঁজে বের করতে চাই।”

লোচন সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে যেন বিদ্রূপ করে হাসল। “আপনি জাল মোহনকে খুঁজে বের করবেন! বলেন কী মশাই! আপনি তো বললেন পাতি গোয়েন্দা। আমি ভাবছি একটা আসল গোয়েন্দা ভাড়া করব।”

কিকিরা হাসিমুখেই জবাব দিলেন, “তা করতে পারেন। শাঁটুলদাকেই করুন।”

“শাঁটুল! কে শাঁটুল?”

“শার্লকদাকে আমি শাঁটুলদা বলি!”

লোচন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাত-মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “না না, ওসব শটুল-মাটুল আমার চাই না।”

কিকিরা হঠাৎ হাত বাড়ালেন। “স্যার, একবার আপনার দেশলাইটা দেবেন?”

“দেশলাই!”

“মানে, আমি একটা বিড়ি ধরাব।”

“বিড়ি!”

“চুরুট!”

 লোচন যেন বিরক্ত হয়েই দেশলাইটা ছুঁড়ে দিল।

কিকিরা ততক্ষণে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়েছেন। চুরুট বের করছেন। দেশলাইটা এসে তাঁর পায়ের কাছে পড়ল। তারাপদ কুড়িয়ে নিল দেশলাই।

কিকিরা কোটের পকেট থেকে হাত বের করলেন। দেশলাই দিল তারাপদ। চুরুট ধরিয়ে কিকিরা বললেন, “কাগজে যা ছেপেছেন তাতে তো বলেছিলেন–যে-কোনো লোকই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। বিশেষ করে কাউকে তো আসতে বলেননি। তা হলে এই খোঁড়া পা নিয়ে আসতাম না। কাজটা ঠিক করেননি, দত্তবাবু! কথায় কাজে মিল থাকা দরকার! …তা ঠিক আছে। চলি। এই নিন আপনার দেশলাই!” বলে কিকিরা উঠে দাঁড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা এগিয়ে ছুঁড়ে দিলেন দেশলাই।

লোচন দেশলাইয়ের বাক্সটা লোফার জন্যে হাত বাড়াল। কোথায় দেশলাই! পায়ের কাছে ঠং করে কী যেন একটা পড়ল।

নিচু হয়ে একটু খোঁজাখুঁজি করে লোচন জিনিসটা তুলে নিল। তুলে নিয়েই। অবাক। চকচক করছে। সোনা নাকি? “কী এটা?”

“সোনার মেডেল…!”

“মে-ডে-ল?”

“আরও দেখবেন! এই দেখুন আমার ডান হাত। ফাঁকা। দেখছেন? ভাল করেই দেখুন স্যার! …নিন, আরও একটা মেডেল।” এবারের জিনিসটা লোচনের কোলে গিয়ে পড়ল। “আরও চাই? আচ্ছা–এই নিন আরও একটা। এটা স্বয়ং গভর্নর সাহেব দিয়েছিলেন। ছ’আনা সোনা আছে–গিনি গোল্ড!”

লোচন রীতিমতন ঘাবড়ে গিয়েছিল। বলল, “থাক থাক…।”

“না স্যার, কিকিরা হল জেনুইন। ফাঁকিবাজি পাবেন না। আরও কিছু শো করব? দেখবেন? দিন না আপনার চাবির গোছাটা। হাওয়া করে দেব।”

লোচন তার চাবির গোছা মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলল। “না না, চাবির গোছ থাক। আপনি…”

“আমি কিকিরা দ্য গ্রেট। ম্যাগনিফিসিয়ান্ট ম্যাজিশিয়ান। ডাক ডিটেকটিভ–মানে পাতি গোয়েন্দা।”

লোচন বেশ বিমূঢ়।

কিকিরা বললেন, “দিন দত্তমশাই, মেডেলগুলো ফেরত দিন। …তারাপদ, ওগুলো নিয়ে নাও।”

তারাপদ এগিয়ে গিয়ে মেডেলগুলো নিয়ে নিল।

“তা হলে চলি সার!”

লোচন থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনারা কি সত্যিই জাল মোহনকে ধরে দেওয়ার জন্যে এসেছেন?”

“ভদ্রলোকের এক কথা। কাগজ দেখে এসেছি। কাজ করতে পারলে তিরিশ হাজার টাকা, নয়ত তিরিশ পয়সাও নয়।”

লোচন যেন কী ভাবল। “পারবেন?”

“চেষ্টা করব।”

“বসুন।”

 কিকিরা বসলেন, ইশারায় বসতে বললেন তারাপদকে।

লোচন খানিকক্ষণ যেন কিছু ভাবল। তারপর বলল, “মোহন আমার ছোট ভাই। সহোদর ভাই নয়। জ্যাঠামশাই ওকে পোষ্য নিয়েছিলেন। মানে জ্যাঠার ছেলেমেয়ে ছিল না। আমরা জন্মের বছর দশ পরে পরে এক বন্ধুর ছেলেকে পোষ্য নেন। বন্ধু মারা যান। …তা মোহন আমার ভাই-ই। আমরা দুটি ভাই ছিলাম। মোহন আজ পাঁচ বছর হল মারা গিয়েছে। নাইনটিন এইট্টি ফাইভে। “

“অগস্ট মাসে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“সে সব কথা পরে। এখন যা বলছি শুনুন। …আজ মাস দেড়-দুই হল একটা লোক আমার ছোট ভাই মোহন সেজে নানা জায়গায় ঝঞ্ঝাট করে বেড়াচ্ছে।”

“আপনি তাকে চোখে দেখেছেন? মানে, যে-লোকটি ঝঞ্ঝাট করে বেড়াচ্ছে, তাকে দেখেছেন?”

“না, আমি দেখিনি।”

“তা হলে?”

 লোচন অন্যমনস্কভাবে আরও একটা সিগারেট ধরাল। বলল, “আমি খবর পাচ্ছি।”

“কোত্থেকে খবর পাচ্ছেন?”

“এর-ওর কাছ থেকে।”

“যেমন? নাম বলুন? ঠিকানা?”

ধোঁয়া গিলে লোচন বলল, “মাস দেড়েক আগে একদিন আমার এক আত্মীয়, সম্পর্কে মাসতুতো দাদা, রাত্তিরে ফোন করে প্রথম খবরটা দিল।”

লোচনের কথা শেষ হয়নি, আচমকা এক ছোকরা ঘরে ঢুকল। ঘন মেরুন। রঙের গেঞ্জি গায়ে–স্পোর্টস গেঞ্জি, পরনে সাদা প্যান্ট। চোখে বাহারি গগলস। হাতে একটা লম্বা মতন বাক্স। বাজনার। বলল, “জামাইবাবু, দিদি আপনাকে ডাকছে। ফোন এসেছে। তাড়াতাড়ি যান।” বলে ডোকরা। কিকিরাদের দেখল কৌতূহলের সঙ্গে, তারপর চলে গেল।

লোচন নিজেই বলল, “আমার ছোট শ্যালক, জ্যোতি। ভাল গিটার বাজায়। কোথাও চলল। বাজাতে বোধ হয়। ..আপনারা বসুন। আমি আসছি।”

লোচন চলে গেল।