১১. মোগল দুর্গের দিন
ল্যান্ডরোভার গাড়ির অ্যাডভেঞ্চার আর হয় না। প্লেনেই পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে আসতে হয় দুজনকে। তাহেরের সবচেয়ে বড় ভাই আরিফুর রহমান তখন ইসলামাবাদে চাকরি করছেন প্ল্যানিং কমিশনে। তার বাড়িতেই উঠলেন দুজন। লুৎফাকে ইসলামাবাদ রেখে তাহের চলে যান রাওয়ালপিন্ডি এবং পেশওয়ারের মাঝামাঝি টু কমান্ডো ব্যাটালিয়ান আটক ফোর্টে, এখানেই তার নতুন পোস্টিং। কিছুদিন পর চলে এলেন লুৎফাও।
শের শাহর তৈরি গ্রান্ড ট্রাংক রোডের ঠিক উপরে মোগল সম্রাট আকবরের তৈরি আটক দুর্গ। অবাক হয়ে এই প্রকাও দুর্গটিকে দেখেন লুৎফা। দুর্গের চারপাশে গভীর পাথুরে খাদ, খাদের কিনারা ঘেষে দুর্গের আকাশচুম্বী দুর্ভেদ্য দেয়াল। পেটানো লোহার ভীষণ মজবুত দুর্গের বিশাল প্রধান ফটক। ফটকের দরজার পাল্লায় অসংখ্য সুচালো লোহার স্পাইক, সামনের দেয়ালে বড় বড় ছিদ্র, যে ছিদ্র দিয়ে মোগল সৈনিকেরা দুর্গ আক্রমনকারী শক্রদের ওপর গরম পানি, বোল্ডার নিক্ষেপ করতেন। দুর্গের ভেতর অনেক গোপন, ভুগর্ভস্থ কক্ষ। এখন সেখানে থাকে টু কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের গোলা বারুদ। দুর্গ থেকে একটু দূরেই বেগম কি সরাই বা রানীর পান্থশালা। সরাইয়ের সামনে বয়ে যাচ্ছে সিন্ধু নদ। মোগল রানীরা সখীদের নিয়ে জলকেলী করতে আসত এখানে। এখন এই সরাইয়ের পাশের মাঠে চলে টু কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের পিটি প্যারেড। সরাই থেকে খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে গ্রান্ড ট্রাংক রোড। এই ঢালের উপরেই টু কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের অফিসার্স মেস।
একদিকে ব্যাচেলার অফিসার্স কোয়ার্টার, কিছু দূরেই ম্যারিড অফিসার্স কোয়ার্টার। মারিঙ অফিসার্স কোয়ার্টারে জায়গা না থাকাতে ব্যাচেলার কোয়ার্টারে দুটো রুম নিয়ে উঠেন তাহের, লুৎফা। মেজর তাহের তখন টু কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার।
রাতে তাহেরের আটক ফোটে যোগদানের উপলক্ষে ডিনারের আয়োজন। ইউনিটের সব অফিসার সেখানে উপস্থিত। স্যুট টাই পড়া কেতাদুরস্ত অফিসাররা চারদিকে। কাটা চামুচ দিয়ে খাওয়া, ইংরেজি কথা, আশপাশে মুহুর্মুহু স্যালুট, স্যার স্যার সম্বোধন এ সবই নতুন লুৎফার কাছে। তাহের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন স্ত্রী লুৎফাকে। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্নেল সোলেমান খান তাহেরের বস। হাসিখুসি, সদালাপী মানুষ। তাকে ভালো লাগে ক্ষার। অন্যানা জুনিয়র আফিসারদের সঙ্গেও পরিচয় হয়, ক্যাপ্টেন পারভেজ, ক্যাপ্টেন ইকবাল, ক্যাপ্টেন সাঈদ, ক্যাপ্টেন আনোয়ার এমনি আরও অনেকে। এদের মধ্যে শুধু ক্যাপ্টেন আনোয়ার বাঙালি। তাকে ডাকেন তাহের : হাই আনোয়ার, কি খবর তোমার?
একজন বাঙালির দেখা পেয়ে মনে স্বস্তি আসে লুৎফার। তাহের ক্যাপ্টেন আনোয়ারাকে বলেন : এখন তো আমরা তোমাদের ব্যাচেলার কোয়ার্টারেই আছি, বোয়াই ডোন্ট ইউ কাম আন্ড হ্যাভ ডিনার এভরি ডে উইথ আস। বাংলায় কথা বলতে পেরে তোমার ভাবীর একটু ভালো লাগবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে নতুন জীবন শুরু তাদের। তাহের বলেন। লুৎফা, চাকরি আমি করে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার মিশন চলবে। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে যে কাজটা শুরু করেছিলাম সে অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করতে হবে। ওয়েস্ট পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অনেক বাঙালি অফিসার আছে, ওদেরকেও একটু ইন্সপায়ার করা দরকার।
ক্যাপ্টেন আনোয়ার মাঝে মাঝে খেতে আসেন তাহের আর লুৎফার সঙ্গে। খেতে খেতে তাহের আনোয়ারকে বলেন : তুমি কমান্ডোতে যোগ দিয়েছ দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। বাঙালি কমান্ডো তো আর নাই। মনে রেখে দেশ স্বাধীন করতে হবে, তোমাদের দরকার।
রাজনীতির সঙ্গে আনোয়ারের কোনো সক্রিয় যোগাযোগ নেই আর তাহেরের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কেও কোনো ধারনা নেই তার। সিনিয়র অফিসারের মুখে এধরনের কথা শুনে ক্যাপ্টেন আনোয়ার অবাক। আমতা আমতা করে বলেন, কিন্তু স্যার পাকিস্তান তো একটা স্বাধীন দেশ।
ধমক দিয়ে উঠেন তাহেরঃ ইউ স্টুপিড, ড্যাম উইথ ইওর পাকিস্তান। ভুলে যেও না যে তুমি একজন বাঙালি। সুতরাং বুঝতেই পারছ কোন দেশ স্বাধীন করার কথা বলছি। পাকিস্তানের সাথে থেকে আমাদের কিছু হবে না। উই মাস্ট হ্যাভ আওয়ার ইনডপেন্ডেন্স। আর্মির ভেতরেই কি লেভেলে ডিসক্রিমিনেশন টের পাও না? এক ব্রিগেডিয়ার সেদিন বলছিল, এই সব ছোটে ছোটে কালে কালে মাছলি খাওয়া বাঙালি আবার যুদ্ধ করবে কি? আর্মিতে নাকি বাঙালিদের রিক্রুট করারই দরকার নাই। যুদ্ধ কাকে বলে ও বেটাদের দেখিয়ে দিতে হবে, বুঝলে আনোয়ার?
ইতোমধ্যে ম্যারেড অফিসার্স কোয়ার্টার খালি হলে তাহের, লুকা, সেখানে গিয়ে উঠেন। লুৎফা শুরু করেন তার সংসার সাজানো। তাহের বাড়ির বাজার ঘাট, কেনাকাটার ভার লুৎফার ওপর ছেড়ে দিয়ে চলে যান অফিসে। তাকে সাহায্য করবার জন্য হাজির থাকে ব্যাটম্যান, হাবিলদার। কিন্তু এদের সামলাতেই হিমশিম খান লুৎফা। তার সামান্য উর্দু জ্ঞান নিয়ে হাবিলদারদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাহেরকে বলেন, বাঙালি ব্যাটম্যান পাওয়া যায় না?
তাহেরঃ আমার তো এই ব্যাটম্যানের ধারণাটাই খুব বাজে মনে হয়। স্রেফ ক্রীতদাস। সুযোগ পেলে এই সিস্টেমটাই আমি উঠিয়ে দিতাম। যাহোক, তোমার জন্য বাঙালি ব্যাটম্যান যোগাড় করে দিচ্ছি।
কোন কোনো দিন বেগম কি সরাইয়ের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদের পাড় ঘেষে গল্প করতে করতে হাঁটেন তাহের, লুৎফা লুৎফা তখন গর্ভবতী। আসন্ন সন্তান নিয়ে কল্পনার জাল বোনেন দুজন। তাবে যথারীতি তাহেরের গল্পে ঘুরে ফিরে আসে রাজনীতি আর দেশের কথা তাহের বলেন : দেশে ট্রান্সফার নেওয়ার চেষ্টা করছি। এখানে থেকে তো, আমার সময় নষ্ট। আমি তো ব্রিগেডিয়ার, মেজর জেনারেল হবার জন্য আর্মিতে চুকিনি। দেশের কমিউনিস্ট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এখানে বসে সেটা তো ডিফিকাল্ট। একটা সোসালিস্ট রেত্যুলেশন ঘটাতেই হবে বাংলাদেশে। সেটা হতে হবে একটা পার্টির প্রতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা পার্টির সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার আমার। লুৎফা, তোমাকে কিন্তু প্রিপিয়ার্ড থাকতে হবে। আমি যে কোনো সময় একটা ড্রাস্টিক ডিসিশন নিয়ে ফেলতে পারি। চাকরি ছেড়ে দিতে পারি।
লুৎফা চোখ তুলে তাহেরের কথা শুনতে শুনতে চাপা শ্বাস নেন। এই লোকটির সঙ্গে যখন জীবন বাধা পড়েছে তখন তাকে প্রস্তুত হতেই হবে অনাগত ঘটনাপ্রবাহের জন্য।
তাহের বলেন : আমি চাই তুমিও আমার সঙ্গে একটিভলি যুক্ত থাক, আমার কাজের পার্ট হও। রেভুলেশনের ব্যাপারে আমার ভাবনাগুলো নিয়ে আরও কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।
লুৎফাঃ আমার কি আর তোমার মতো অত পড়াশোনা আছে?
তাহের : তাতে কি? পরাশোনা করবে। এক কাজ করো, আমি যখন অফিসে তুমি তো বাসাতেই আছ সারাদিন আর তোমার তো এখন বিশ্রাম নেবারই সময়। তুমি বরং টাইমটা পড়াশোনা করে ইউটিলাইজ করো। আমি তোমাকে একটা করে এসাইনমেন্ট দিয়ে যাবে, রাতে এসে সেটা নিয়ে কথা বলব, কি বলো?
রাজি হয় লুৎফা।
তাহের বলেন : মার্ক্সবাদের বেসিক কনসেপ্টগুলো তো তোমার জানা আছে?
লুৎফাঃ ঐ অ আ ক খ পর্যন্ত।
তাহের : ওতেই চলবে। তোমাকে আজকে লেনিনের সোসালিজম অ্যান্ড ওয়ার বইটা দেব। পড়তে শুরু করো। আমি সোসালিস্ট রেভুলেশনের জন্য কেন আর্মস স্ট্রাগলের কথা বলছি সেটা ব্যাখ্যা করব।
লুৎফা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেন। বলেন : আর পেটের ভেতরে যেটা আছে, এটার কি হবে?
তাহের হেসে বলেন : ওটাও হবে লিটল কমরেড। চলো উঠি আজকে।
বেগম কি সরাইয়ের সামনে দিয়ে হেঁটে দুজন ফেরে কোয়ার্টারে। সিন্ধু নদ থেকে আসা হাওয়ায় লুৎফার আঁচল উড়ে। পিঠের পিছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে লুৎফাকে জড়িয়ে রাখেন তাহের। একটা অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে লুৎফার। তবু মনে হয় এ লোকটি পাশে থাকলে তিনি যেন নিরাপদ।
তাহেরদের পাশের কোয়ার্টারে থাকেন ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ। ফুর্তিবাজ মানুষ, নতুন বিয়ে করেছেন। স্ত্রী ইংরেজি সাহিত্যের তুখোর ছাত্রী। ক্যাপ্টেন পারভেজের স্ত্রী মাঝে মাঝে সঙ্গ দেন লুৎফাকে। এদিক ওদিক বেড়াতে নিয়ে যান, শহরে একসাথে যান কেনাকাটা করতে। ভাঙ্গা উর্দু, ভাঙ্গা ইংরেজিতে আলাপ চালিয়ে যান লুৎফা। একদিন লুৎফা তাহেরকে বলেন : এখানে যখন আছি তখন উর্দটা একটু ভালোভাবে শিখে নিলে তো হয়।
তাহের বলেন : কোনো দরকার নাই। নতুন একটা ভাষা যদি ভালো করে শিখতেই হয় তাহলে ইংরেজিটা শেখ, উর্দু শিখতে যাবে কেন?
ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ ছুটির দিনে প্রায়ই সস্ত্রীক তাহেরদের বাসায় এসে স্যালুট ঠুকে বলেন : স্যার চলে এলাম অসময়ে। চলেন দু ডিল কার্ড খেলি। ক্যাপ্টেন আনোয়ার আর সাঈদকে ডেকে আনি।
তাহের পারভেজের বস কিন্তু তাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই। তাহের জুনিয়র ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে কার্ড খেলতে বসে যান। লুৎফা আর পারভেজ মোশারফের স্ত্রী ঢোকেন রান্নাঘরে, স্পেশাল মাংসের রেজালা রান্না করতে। আজ খাওয়া হবে একসাথে। রাজনীতি নিয়ে পারভেজের তেমন আগ্রহ নেই। নানা ঠাট্টা ইয়ার্কি করে তিনি মাতিয়ে রাখেন সবাইকে।
বহু বছর পর রাজনীতিতে, অনুৎসাহী, ফুর্তিবাজ এই ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফই হয়ে উঠে পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান কুশীলব। তিনি হন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে আঁতাত করে পরে আবার বুশের বিরুদ্ধেই বই লিখে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হন পারভেজ। শেষে নিজের দেশের রাজনীতির নানা পাকচক্রে পড়ে হন নাস্তানাবুদ। টেলিভিশনের পর্দায় বিপর্যস্ত জেনারেল মোশাররফকে পদত্যাগের ভাষণ দিতে দেখে লুৎফার মনে পড়ে অনেক বছর আগের সেই চপল তরুণ অফিসারটির মুখ। দেখতে দেখতে লুৎফা ভাবেন, জীবন কাকে কোথায় নিয়ে যে ঠেকায়!
আটক ফোর্টে তাহেরের পশ্চিম পাকিস্তানি বস কর্নেল সোলেমান তাহেরকে পছন্দ করেন। বস হলেও অফিসের বাইরে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন তিনি। প্রায়ই চলে আসেন নুঙ্কার বাড়িতে। লুৎফা মাছ খেতে পছন্দ করে কিন্তু আশপাশে মাছ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কর্নেল সোলেমান তাই বাইশ মাইল দূরের নওশেরা লেকে গিয়ে মাছ শিকার করে বাড়িতে এনে ভেজে খাওয়ান তাহের আর লুৎফাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তাহের তার ক্ষোভ কর্নেল সোলেমানের সঙ্গে খোলামেলাভাবেই আলাপ করেন। কর্নেল সোলেমান বলেন, আই এগ্রি ইউথ ইউ তাহের। বাট দি ওয়ে ইওর লিডার মুজিব ইজ মুভিং ইজ ডেঞ্জারাস। ইন দ্যাট কেস পাকিস্তান উইল নট রিমেইন ইউনাইনেট এনি মোর।
তাহের : প্রবাবলি দ্যাট ইজ হোয়াট দি বাঙালি ওয়ান্ট।
কর্নেল সোলেমান : ওয়েল, উই উইল সি।
মাঝে মাঝে ইসলামাবাদে বড় ভাই আরিফুর রহমানের ওখানে চলে যান তাহের। পশ্চিম পাকিস্তানে দুই বাঙালি একত্রিত হলে আলাপের প্রসঙ্গ দাঁড়ায় একটাই, পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন বৈষম্য। আরিফ প্ল্যনিং কমিশনে আছেন বলে অনেক ভেতরের খবর দিতে পারেন।
আরিফ বলেন : দেখছি তো ইস্ট পাকিস্তানের কোনো প্রজেক্ট হলে সেটা পাস করতে কেমন তালবাহানা করে এরা, তারপর পাস হলেও টাকাটা পাঠায় এমন দেরিতে যে ওটা কাজে লাগানোরও তখন আর সময় থাকে না। অথচ ওয়েসের ব্যাপার হলে সবকিছু ঝটপট। তোমাকে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। চীন একটা লোন দিয়েছিল ছয় কোটি মার্কিন ডলারের। সেখান থেকে মাত্র এক লক্ষ পঁচিশ হাজার ডলার খরচ করা হয়েছে পূর্ব পকিস্তানের ওয়াটার আর পাওয়ার সেক্টরে, বাকি পাঁচ কোটিরও বেশি ডলার খরচ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙালিদের খুশি করার জন্য আইয়ুব খান ঢাকাকে সেকেন্ড ক্যাপিটাল ঘোষণা করেছে। কিন্তু জানো ইসলামাবাদকে ক্যাপিটেল করতে যেখানে ওরা খরচ করেছে তিন হাজার মিলিয়ন টাকা সেখানে ঢাকায় খরচ করেছে মাত্রেই শ মিলিয়ন।
তাহের যোগ করেন : দেখেন না, কোন টপপোস্টে তো বাঙালি নাই। আর্মির কথা বাদ দিলাম, একজন বাঙালি সচিবও তো নাই। গভর্নমেন্টের একটা কোনো প্রতিষ্ঠানেরও হেড অফিস ঢাকায় নাই, সব ওয়েস্ট পাকিস্তানে। কোনো বাঙালি কোনোদিন অর্থমন্ত্রী হলো না, স্টেট ব্যাংকের গভর্নর হলো না। এক ব্রিগেডিয়ার সেদিন আমাদের এক আর্মি ডিনারে বলে, বাঙালিরা তো গাদ্দার, এদের জন্মই হয়েছে গোলামি করার জন্য। বাঙালিদের পাক্কা মুসলমান করার দায়িত্ব নাকি পশ্চিম পাকিস্তানিদের।
আরিফ বলেনঃ এক পাঞ্জাবি জয়েন্ট সেক্রেটারি সেদিন এক মিটিংয়ে বলে, বাঙালিদের এত হায়ার স্টাডির দরকার কি, ওদের মাদ্রাসা পর্যন্ত পড়লেই চলে। চুপচাপ হজম করতে হলে এসব কথা।
কথা কেড়ে নিয়ে তাহের বলেন : আরিফ ভাই, এসব বাঙালি বেশিদিন সহ্য করবে না। একটা কিছু দফারফা হবে দেখবেন খুব শীঘ্র।
তাহেরের ভেতরে সবসময় যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে লুৎফা তা টের পান।
তাহের বলেন : ট্রান্সফারের একটা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বাঙালি অফিসারদের ওরা আর ইস্ট পাকিস্তানে ট্রান্সফার করছে না। ওখানে অবস্থা খুব সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। আনোয়ার লিখেছে, শেখ মুজিব সারাদেশ ঘুরে ঘুরে মোবিলাইজ করছেন মানুষকে। ঘটনা যে কোনোদিকে যাচ্ছে বলা মুশকিল।
অফিস থেকে ফিরে তাহের বসেন রেডিও নিয়ে, নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা স্টেশনের খবর শোনেন, অধীর গ্রহে শোনেন পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের খবর। চাপা উত্তেজনার একটা উপজাত ব্যাপার হিসেবে তাহেরের ড্রিংক করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। একটু আধটু ড্রিংক তাহের সব সময়েই করেন। কিন্তু ঐ সময়টাতে মাত্রাটা বেশ বেড়ে যায়। চিন্তিত হয়ে পড়েন লুক। নিষেধ করেন কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। লুৎফা শেষে ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে বলেন; ভাই আপনাকে তো বেশ স্নেহ করে, আপনি একটু বলেন তো ড্রিংকটা কমাতে।
আনোয়ার একদিন সুযোগমতো অনেক সাহস সঞ্চয় করে আলাপ তোলেন : স্যার ড্রিংকটা একটু কমালে ভালো হতো না? বলেই তিনি ঘামতে শুরু করেন।
তাহের বলেন : তুমি দিনে কয় কাপ চা খাও?
আনোয়ার : দশ কাপের মতো হবে।
তাহেরঃ কেন?
আনোয়ার : একটু ফ্রেশ হবার জন্য, স্যার।
তাহের : তুমি যেমন ফ্রেশ হবার জন্য চা খাও আমিও তেমন ফ্রেশ হবার জন্য মদ খাই। মদ খেয়ে আমি তো মাতলামি করি না, বউকে পিটাই না। তাছাড়া মদ আমাকে খায় না আমি মদকে খাই। বুঝলে ইডিয়ট।
রাইট স্যার : তাড়াতাড়ি বলেন আনোয়ার।
তাহের : নিশ্চয় তোমার ভাবী বলেছে আমাকে এসব বলতে? নাহ, আমার বউটা ভেতো বাঙালিই রয়ে গেল। আচ্ছা ও যখন এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে গেছে ড্রিংক কমিয়ে দেব কিন্তু ছাড়তে পারব না পুরোপুরি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের নানা ডকুমেন্টারি তখন দেখানো হয় পাকিস্তান আর্মিদের। আমেরিকান সেনাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রস্তুতি সেসব ডকুমেন্টারির বিষয়। একদিন তাহের আর আনোয়ার ওরকম একটা ডকুমেন্টারি দেখছেন। ছবিতে দেখানো হচ্ছে আমেরিকান সৈন্যরা বাঁশের সাহায্য নিয়ে বিশেষ কায়দায় একটা খুব উঁচু দেয়াল পার হচ্ছে। তাহের হঠাৎ বেশ উত্তেজিত হয়ে পাশে বসা আনোয়ারকে বলেন, দারুণ, আমরাও তো ট্রাই করে দেখতে পারি।
আনোয়ার বলেন : কিন্তু খুব রিক্ষি হবে স্যার।
ক্ষেপে যান তাহের : মাই ব্লাডি ফুট। ৱিস্কি শব্দটা কমান্ডোদের অভিধানে আছে নাকি? এই রোববারই আমি আটক ফোর্টের দেয়াল ওভাবে পার হবো। রেপেলিং করার জায়গায় ওটা করব আমি।
আনোয়ার চমকে ওঠেন : কিন্তু আমেরিকানরা যে দেয়ালটা পার হচ্ছে ওটা স্যার ম্যাক্সিমাম বিশত্রিশ ফুট উঁচু হবে। আর আটক ফোর্টের ওয়াল তো এক শ বিশ ফুট। আপনি কি ঠাট্টা করছেন স্যার?
তাহের : শাট আপ! এটা কোনো ঠাট্টার ব্যাপার না। আই এম গোয়িং টু ডু ইট। এ বেটাদের দেখিয়ে দেব বাঙালি অফিসাররা কি করতে পারে।
পরদিন ইউনিটে টি ব্রেকের সময় তাহের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান সবাইকে। ইউনিটের চিফ কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সোলেমান আপত্তি করেন ব্যাপারটায়। অন্য অফিসাররাও ব্যাপারটাকে একটা পাগলামি মনে করেন। কিন্তু তাহের তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। কর্নেল সোলেমান তাহেরকে স্নেহ করেন। শেষে কর্নেল সোলেমান রাজি হন এবং সবাইকে পরের রোববার রেপলিং এরিয়ায় আসতে অর্ডার দেন। সব অফিসার বলাবলি করতে থাকে, ছুটির দিনটাই মাটি।
অফিসে ফিরে আনোয়ার তাহেরকে জিজ্ঞাসা করে : কিন্তু স্যার অত উঁচু বাঁশ পাবেন কোথায়?
তাহের : কেন ছোট ছোট বাঁশের টুকরা জোড়া দিয়ে।
আনোয়ার : কিন্তু স্যার জোড়া দেওয়া জিনিস কি আর আস্ত বাঁশের মতো শক্ত হবে?
তাহের : সেটা আমি ম্যানেজ করব।
রোববার সকাল। সব অফিসার আটক ফোর্টের রেপেলিং করার জায়গায় হাজির। দুর্গের দেয়ালের একটা জায়গা একটু বাঁক খেয়ে খাড়া কোনাকুনি গোল হয়ে উপরে উঠে গেছে। একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দিয়ে একশ বিশ ফুট উঁচু একটা বাঁশ তৈরি করেছেন তাহের। তাহের দুই হাতে বাঁশের উপরের কোণাটি ধরেন এবং দশ জন বেশ তাগরা সিপাই বাঁশটাকে খাড়া দেয়ালের কোনাকুনি বরাবর ঠেলে একটু একটু করে উপরে উঠাতে থাকেন। তাহের দুই পা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে অনেকটা হাঁটার ভঙ্গিতে দেয়াল বেয়ে উঠছেন। পঞ্চাশ ষাট ফুটের মতো উঠে গেছেন তাহের। নিচে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছেন সব অফিসার। বুক ধড়ফড় করছে আনোয়ারের। বাঁশটা বেশ দুলছে, যে কোনো মুহূর্তে একটা মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে। নিচে দাঁড়ানো অফিসারদের মধ্যে আতঙ্ক। কিন্তু তাহের দেয়াল বেয়ে উঠতে উঠতে যে সিপাইরা বাশটা ঠেলছে তাদের বলছেন, দ্যাটস রাইট, ক্যারি অন। হ্যাঁ এভাবেই বাঁশটাকে একটু একটু করে ঠেলতে থাকো।
সবাই নিরব। একসময় সবার বিস্মিত চোখের সামনে তাহের আটক ফোর্টের এক শ বিশ ফুট দেয়ালের উপর গিয়ে দাঁড়ান। উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নিচে কর্নেল সোলেমানকে বলেন, স্যার এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি আরেকজনকে পাঠান।
কর্নেল সোলেমান চারদিকে তাকান কিন্তু না কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। কর্নেল সোলেমান অন্যদের বলেন, তাহের যদি এটা পারে তোমাদেরও পারা উচিত। কিন্তু সবাই নিরুত্তর।
তাহের এবার পাকিস্তানি অফিসারদের হেয় করার মোক্ষম সুযোগটা নেন। তিনি বলেন : অল রাইট। একজন বাঙালি অফিসার যখন এটা পেয়েছে আমার ধারণা আরেকজন বাঙালি অফিসার তা পারবে। আনোয়ার এবার তুমি চলে আস।
ক্যাপ্টেন আনোয়ার একটু দ্বিধান্বিত থাকলেও তাহেরের ডাকের পর তার আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তিনি সোজা গিয়ে ঐ বাঁশটাকে ধরেন। মনের সব সাহস সঞ্চয় করে শুরু করেন উপরে উঠা। উপর থেকে তাহের চিৎকার করে আনোয়ারকে উৎসাহ দিতে থাকেন : ব্রাভো, এই তো আর একটু, কুইক।
আনোয়ার প্রায় আশি ফুটের মতো উঠেও যান। কিন্তু তখন হঠাৎ বাঁশটা দুলতে শুরু করে এবং ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করতে থাকে। বাশটা প্রায় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলে তাহের তাড়াতাড়ি আনোয়ারকে নেমে আসতে বলেন। নেমে যান আনোয়ার।
নিচে নামলে তাহের আনোয়ারকে বলেন : ব্লভি হেল কমান্ডো, তোমার মতো একটা ভীতু অপদার্থের কমান্ডোতে যোগ দেয়াই উচিত হয়নি। নাউ পুশ অফ।
আনোয়ার মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলে, পেছন থেকে ডাক দেন তাহের : কাম অন, ইটস অল রাইট। আমি তোমার বিপদটা টের পাচ্ছিলাম। একবার ইউজের কারণে বাশটা তো উইক হয়ে গিয়েছে, তাছাড়া ক্ষেত্র ওয়েটও তো আমার চেয়ে বেশি। বাদ দাও চলো এবার বারে গিয়ে নাএকটু ভিজিয়ে আসি।
তাহের যখন ক্যান্টনমেন্টের রেপলিং স্কায়ারে আর বারে তার বুকের ভেতর চেপে থাকা উত্তেজনার প্রশমন ঘটাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের অগ্নিগিরিতে তখন শুরু হয়ে গেছে লাভা উদ্গীরণ।
১২. ব্যারিকেড, বেয়োনেট, বেড়াজাল
গণআন্দোলনের তোড়ে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছেন ১৯৭০ এর ৫ অক্টোবর। প্রায় এক যুগের সামরিক শাসনের পর দেশে প্রথম নির্বাচন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে গড় পড়তা বাঙালির চেয়ে মাথায় উঁচু শেখ মুজিব তার তর্জনি তুলে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের। স্বপ্ন দেখাচ্ছেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তির।
হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসে প্রবল বন্যা হলো পূর্ব পাকিস্তানে। বাতিল করা হলো নির্বাচনের তারিখ। ইয়াহিয়া খান ভোটের নতুন তারিখ দিলেন ৭ ডিসেম্বর। কিন্তু প্রকৃতির পুতুল খেলার জায়গা যেন এই বাংলাদেশ, তখনও পূর্ব পাকিস্তান। কিছুদিনের মধ্যেই আবার নেমে এলো ভয়ংকর এক দুর্যোগ। ১২ নভেম্বর উপকুল অঞ্চলে ঘটে গেল এদেশের স্মরণকালের ভয়াবহতম প্রলয়ংকরী সাইক্লোন, মারা গেল দু লাখেরও বেশি মানুষ। কিন্তু এই অভাবনীয় ঘটনায় পাকিস্তান সরকার রইলেন নীরব, শীতল। কোনো সরকারি কর্মকর্তা উপদ্রুত এলাকায় গেলেন না, তৎক্ষণাৎ কোনো ত্রাণ পৌঁছালো না সেখানে। শুধু চীন থেকে ফেরার পথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বল্প সময়ের যাত্রা বিরতি করলেন ঢাকায়। একটি হেলিকপ্টারে করে তিনি উড়ে গেলেন পটুয়াখালীর এক উপদ্রত চরে। ইয়াহিয়া খানকে দেখানোর জন্যে কিছু লাশ টেনে এনে হেলিপ্যাডের কাছে রাখা হলো যাতে তাকে খুব বেশি দূর হেঁটে লাশ দেখতে যেতে না হয়। ইয়াহিয়া খান হেলিকপ্টার থেকে নামলে সাইক্লোনে বেঁচে যাওয়া অসংখ্য অভুক্ত মানুষ ঘিরে ধরেন তাকে, তারা খাবার চান, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ঘর্মাক্ত কলেবরে উর্দুতে তাদের নানা রকম উপদেশ দেন এবং বলেন, কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। মনের ভেতর ফুর্তি রাখতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে এবং ভাতের বদলে রুটি খেতে হবে তাহলে শক্তি অনেক বাড়বে।
এই বলে তিনি আবার হেলিকপ্টারে উঠে চলে যান। ইয়াহিয়া চলে গেলে চরবাসী একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করে। এই ব্যাটা কেডা?
বিদেশি মিডিয়াতে এই ঘূর্ণিঝড়ের খবর প্রচারিত হলে সাহায্য আসতে থাকে নানা দেশ থেকে। সরকারের এই সীমাহীন অবজ্ঞায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্রতর। নির্বাচন প্রাক্কালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের এই দুর্বলতাকে লুফে নেন শেখ মুজিব। তিনি তার চৌকস নির্বাচনী বক্তৃতায় স্কুলে আনেন এই নগ্ন অবহেলার কথা। বলেন, … পশ্চিম পাকিস্তানে আজ বাম্পার গম উৎপন্ন হয়েছে কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ঘূর্ণিঝড় বিদ্ধস্থ অঞ্চলে খাদ্য বোঝাই প্রথম জাহাজটি এসেছে বিদেশ থেকে। আমাদের পয়সায় ঐশ্চিম পাকিস্তানে লাখ লাখ সৈন্য পোষা হলেও আজ দাফনের কাজ করছে বিদেশিরা। পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড়ের কলের মালিকেরা প্রধান বাজার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করলেও মৃতদেহের কাফনের জন্য এক টুকরো কাপড়ও পাঠায়নি তারা।…
শেখ মুজিবের বক্তৃতা বাঙালির মনের আগুন উস্কে দেয় আরও। এবার আর নির্বাচনের দিন পরিবর্তন হয় না। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। বদলে যায় পূর্ব পাকিস্তানের নিত্যকার দিনের চেহারা। ভোট সেদিন। কত যুগ ধরে যেন বাঙালিরা অপেক্ষা করছে এই দিনটির জন্য। ভোটকে ঘিরে অভূতপূর্ব উৎসাহ উদ্দীপনা চারদিকে। ঐদিন ঢাকায় হাট বাজার, দোকান পাট, অফিস সব বন্ধ। কর্ম চঞ্চল সদরঘাট সেদিন নিস্তব্ধ, জনাকীর্ণ নবাবপুর রোড, মতিঝিল সেদিন খাঁ খাঁ করছে। সব কাজকর্ম ফেলে ডোর বেলা থেকে সবাই লাইন দিয়েছে ভোট কেন্দ্রে। একই অবস্থা প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। সেখানে কেবলই নৌকার ছড়াছড়ি। কাগজের নৌকা, কাপড়ের নৌকা, কাঠের নৌকা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জামায় পিন দিয়ে আঁটা নৌকার ছবি। নৌকা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের প্রতীক।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, এমনি সব ইসলামী দল, এছাড়াও মোজাফফর আর ওয়ালীর ন্যাপ ভাসানী বর্জন করেছেন নির্বাচন।
ক্যান্টনমেন্টে উদ্বিগ্ন পায়চারী করেন তাহের। লুৎফাকে বলেন : আনোয়ার লিখেছে, আওয়ামী লীগ অ্যাবস্যালুট মেজরিটি পেয়ে যেতে পারে। অথচ এখানকার আর্মি অফিসারদের কোনো ধারণাই নাই কি হচ্ছে বাংলাদেশে। এরা মনে করছে আওয়ামী লীগ বড়জোর ৩০/৪০টা সিট পাবে। আমাদের ইন্টেলিজেন্স থেকেও এমন রিপোর্টই দেওয়া হয়েছে।
বাঙালিদের জন্য প্রত্যাশিত আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য অপ্রত্যাশিত এক ফলাফলই ঘটে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিই পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ১৪৪টির মধ্যে ৮৮টি। সংসদে আওয়ামী লীগেরই দাঁড়ায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগড়িষ্ঠতা।
সারারাত ধরে রেডিওতে নির্বাচনের ফলাফল অনুসরণ করেন তাহের। নিথুম, উত্তেজিত তাহের সকালে লুৎফাকে বলেন : খুবই ড্রামাটিক একটা সিচুয়েশন তৈরি হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগকেই পাকিস্তানের গভর্নমেন্ট ফর্ম করতে হবে। কিন্তু ওয়েস্ট পাকিস্তানিরা তো এটা হতে দেবে না কিছুতেই। এরা কোনোদিন বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেবে না।
অভূতপূর্ব এই জয়ের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানান শেখ মুজিব। বলেন। এই ভোটের মাধ্যমে জনগণ ৬ দফার প্রতি তাদের ম্যান্ডেট ঘোষণা করেছে। এবার চাই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন। বিজয়োল্লাস পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে, প্রান্তরে, পথে ঘাটে।
অপ্রস্তুত প্রেসিডেন্ট ইয়হিয়া খান। কিন্তু নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে উপায় নেই তার। ঘোষণা দিলেন ১৯৭১ এর ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসবে ঢাকায়। কিন্তু বাগরা বাধালেন ভুট্টো! বললেন ছয় দফা তিনি মানেন না।
ঘটনাপ্রবাহের প্রতিটি মুহূর্ত অনুসরণ করছেন তাহের। তাঁর উত্তেজনা ভাগাভাগি করছেন লুৎফার সঙ্গে। তাহের বলেন : ভুট্টো কি বলে জানো? বলে, ছয় দফার মধ্য দিয়ে আওয়মীলীগ নিজেদের মতো করে একটা সংবিধান অলরেডি বানিয়ে রেখেছে, শুধু সেটাকে সাপোর্ট করার জন্য আমি ঢাকায় যাবো না। ভুট্টো বলছে পশ্চিম পাকিস্তানে আমি মেজরিটি। সুতরাং মুজিব যদি ছয় দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে থাকেন আমি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছি ছয় দফা না মানার। তাছাড়া ছয় দফা মানিলে পাকিস্তানের ইউনিটি বলে আর কিছু থাকবে না। বুঝলে লুৎফা ওরা আছে ওদের ইউনিটি নিয়ে। বাঙালিদের সেন্টিমেন্ট কিছুই বুঝতে পারছে না। আমার মনে হয় না ভুট্টো সংসদে যাবে। সে তো বলেই দিয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ ঢাকায় গেলে তার ঠাং ভেঙ্গে দেওয়া হবে। আমি একটা সিভিল ওয়ার সেন্স করছি।
দৃশ্যপটের প্রধান চরিত্র তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। গাড়ির ড্রাইভিং সিট এখন তার দখলে। তার ওপর নির্ভর করছে গাড়ি চলবে কোনো দিগন্তে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানিকটা তোয়াজ করবার চেষ্টা করেন শেখ মুজিবকে। তাকে বলেন, পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী। ভুট্টোও সমঝোতার চেষ্টা চালান। তিনি এসে নতুন থিওরি দেন, বলেন যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো মেজরিটি এবং পূর্বে শেখ মুজিব, ফলে দুই পাকিস্তানে দুটি সরকার হোক, হোক দুজন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, হাম ইধার, তুম উধার। মুজিব প্রত্যাখ্যান করেন সে প্রস্তাব! বলেন ছয় দফা থেকে সরে আসবার কোনো উপায় তার নেই।
এদিকে ঘনিয়ে আসছে লুৎফার প্রসবকাল। সেটা নিয়েও একটা ভাবনা তাহেরের। লুৎফাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তিনি। ডাক্তার বলেন, লুৎফা সুস্থ আছেন, কোনো সমস্যা নেই। তবু ভয় করে সুত্যকার। তাহের সাহস দেন : ভয় করো না লুৎফা। এটা একটা ন্যাচারাল প্রসেস। তোমার ডেলিভারিটা এখানে করাবে নাকি দেশ পাঠিয়ে দেবো তাই ভাবছি। দেশের অবস্থাটা যে কোনোদিকে যায় বুঝতে পাচ্ছি না।
লুৎফা : এই অবস্থায় দেশে যাব? ইলেকশন নিয়ে আর্মির ভিতরে কেমন রিয়াকশন দেখছ?
তাহের : আরে এদের তো ধারণা শেখ মুজিব হচ্ছে গাদ্দার, বিশ্বাসঘাতক। সে পাকিস্তান ভাঙতে চায়। আর তাকে পেছন থেকে সাপোর্ট করছে ইন্ডিয়া। বহু পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের ধারণা আওয়ামী লীগ লোকের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ভোট কিনেছে আর এই টাকা দিয়েছে ইন্ডিয়া। এদের আরেকটা ইন্টারেস্টিং ধারণ হচ্ছে ইস্ট পাকিস্তানের সব স্কুল কলেজের টিচাররা যেহেতু মেইনলি হিন্দু, এরাই সব বাঙালি ছেলে-মেয়েদের মনে অনেকদিন ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিষ ঢেলে আসছে। আসলে কি জানো এতদিন যে লাঠি ওরা আমদের ওপর ঘুরিয়েছে সে লাঠি বাঙালিদের হাতে চলে যাচ্ছে, সেটা এরা কিছুতেই মানতে পারছে না।
ঘটনা গড়াতে থাকে দ্রুত। শেখ মুজিবের অনড় অবস্থান দেখে নাটকের পশ্চিম পাকিস্তানি কুশীলবরা ধরেন ভিন্ন পথ। ভুট্টো একদিন ইয়াহিয়া খানকে তার গ্রামের বাড়ি লারকানায় দাওয়াত দেন পাখি শিকার করতে। লোকে বলে ইয়াহিয়ার নেশা তিনটি ব্যাপারে, মদ, নারী আর পাখি। ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট হাউজের জন্য তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে এনেছেন টিয়া, বিশেষভাবে লেক তৈরি করে ছেড়ে দিয়েছেন অসংখ্য সারস। ফলে এ আর আশ্চর্যের কি যে ভুট্টোর ডাকে তিনি যাবেন পাখি শিকারে। কিন্তু দেশের এই ঘোর সংকট কালে পাখির মতো এমন নিরীহ ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠা রহস্যজনক। সে রহস্য উনোচিত হয় অনেক পরে। জানা যায় শিকারের ছলে লারকানায় বস্তুত চলেছে এক গোপন বৈঠক। ভুট্টো ছাড়াও সে বৈঠকে যোগ দিয়েছেন বেশ কজন সিনিয়র আর্মি অফিসার। ছোটে ছোটে কালে কালে মাছলি খাওয়া বাঙালিদের হাতে কিছুতেই ক্ষমতা দেওয়া যাবে না, সে বৈঠকে এ বিষয়ে একমত হন তারা। লারকানা থেকে ফিরে ইয়াহিয়ার সুর যায় পাল্টে। তিনি ঘোষণা করেন সংসদের অধিবেশন বাতিল।
এ ঘোষণায় বাঙালিদের ক্ষোভ আক্রোশ এবার পৌঁছায় একেবারে তুঙ্গে। শত শত মানুষ নেমে পড়েন রাস্তায়। জঙ্গি মিছিল করেন তাঁরা, তাদের হাতে লাঠি, লোহার রড, হকিস্টিক। পাকিস্তানের পতাকা পোড়ন, পোড়ান কায়েদে আযমের ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এক নতুন পতাকা উড়িয়ে দেন একাত্তরের ২ মার্চ। ঢাকা জেলের সেল ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় শত শত কয়েদি। শেখ মুজিব হরতাল ডাকেন মার্চের দুই আর তিন তারিখ ঘোষণা দেন সাতই মার্চ তিনি রেসকোর্সে বক্তৃতা দেবেন। মারমুখো জনতার ওপর গুলি করে সৈন্যরা, মারা যান বেশ কয়জন। কাফু জারি হয় রাতে। কিন্তু কার্টু ভেঙ্গেই ঢাকায় বেরিয়ে পড়ে অনেক মিছিল। টানটান উত্তেজনা চারদিকে।
তাহের লুৎফাকে বলেন, জানি না সাতই মার্চ শেখ মুজিব কি বলবেন কিন্তু ঘটনা এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে তাতে শেখ মুজিবের উচিত এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেওয়া।
ইয়াহিয়া খান বেতারে ভাষণ দেন ৬ মার্চ। সংসদের অধিবেশনের নতুন তারিখ দেন তিনি। বলেন : এবার অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিবকে দোষারোপ করেন। বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে তিনি প্রস্তুত। ইঙ্গিত দেন প্রয়োজনে মিলিটারি অ্যাকশনে যাবেন তিনি। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতেও বসনো হয় ভারী অস্ত্র। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় সেনা টহল।
সাতই মার্চ অভূতপূর্ব লক সমাগম হয় রেসকোর্সে। লাঠি হাতে লাখ লাখ মানুষ। সাত লাখ, আট লাখ কিংবা দশ লাখ। সে সভায় একজনই শুধু বক্তা, শেখ মুজিব। লক্ষ লক্ষ মানুষ অপেক্ষা করছেন তার নির্দেশের জন্য। রেসকোর্সে আসবার আগে ধানমণ্ডির বাসায় আওয়ালী লীগ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ মিটিং করেন মুজিব। বক্তৃতায় কি বলবেন, সে ব্যাপারে তারা নানারকম পরামর্শ দেন মুজিবকে। এক ফাঁকে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা তাকে নিয়ে যান শোবার ঘরে। বলেন : রওনা দেওয়ার আগে দশ মিনিট বিশ্রাম করো।
শেখ মুজিব শুয়ে পড়েন বিছানায়। পাশে বসে তার চুলে হাত বুলান বেগম ফজিলাতুন্নেসা। বলেন : লোকজন যে পরামর্শই দিক, তোমার মনে যা আছে, তুমি তাই বলবা। খালি একটা জিনিস মনে রাইখ, তোমার সামনে লাখ লাখ মানুষ লাঠি হাতে কিন্তু ঐ মানুষগুলার পিছনে কিন্তু বন্দুক।
শেখ মুজিব যথাসময়ে রেসকোর্সে হাজির হয়ে উঠে যান মঞ্চে। তারপর শুরু করেন : আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে …।
মাত্র ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ দেন শেখ মুজিব। তার সুবিদিত কণ্ঠ নৈপুণ্য আর উপস্থাপনায় এই ঐতিহসিক ভাষণ হয়ে যায় এ দেশের মানুষের যৌথ স্মৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি তার ভাষণে পুরো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবি করেন, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেন, পুলিশের গুলিতে যে প্রাণহানি হয়েছে তার তদন্ধের দাবি করেন এবং বলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এই শর্তগুলো মেনে নেওয়া হলে বিবেচনা করে দেখবেন ২৫ মার্চের ঘোষিত এসেম্বলিতে বসবেন কি বসবেন না? শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, আজ থেকে কোর্ট কাছারী, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। রেডিও টিভিতে বাঙালিদের আন্দোলনের খবর দিলে সব কর্মচারীদের রেডিও টিভিতে যেতে নিষেধ করে দেন তিনি। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে বলেন।
লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে তাক করা একটি তর্জনির দিকে। শেখ মুজিবের তর্জনি। ঐ তর্জনিই তখন সংবিধান। ঐ তর্জনি যা বলবে তাই করতে প্রস্তুত প্রতিটি মানুষ। শেখ মুজিব তার ফরিদপুরের আঞ্চলিক বয়ানে বলেন, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না, মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব..। শেখ মুজিব ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বললেন, বললেন যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে। সবশেষে বললেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
শেখ মুজিব যখন এই বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন বিমানে করে ঢাকায় নামছেন ইয়াহিয়ার পাঠানো পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান। তার সঙ্গে আছেন জেনারেল রাও ফরমান আলীও। বিমান যখন বেশ নিচু দিয়ে যাচ্ছে তখন তারা দেখতে পেলেন রেসকোর্সের ঐ বিশাল জনসমুদ্র। টিক্কা খান ভুরু কুঁচকালেন। রাও ফরমান আলী অনেকদিন ধরেই আছেন ঢাকায়, তিনি টিক্কা খানের দিকে ঘুরে বলেন, পড় ড্যাম, দিস ইজ হোয়াট ইজ গোয়িং অন ইন ঢাকা। থিংস আর গেটিং কমপ্লিকেটেড।
বুঝি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফজিলাতুন্নেসার শেষ কথাগুলো মনে রেখেছিলেন শেখ মুজিব। সাতই মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না, বললেন স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা। বেশ কৌশলে একটা মাঝামাঝি পথ নিলেন শেখ মুজিব। তিনি তার আন্দোলনকে যেমন আইনের আওতার মধ্যে রাখলেন আবার চরমপন্থীদেরও নিরাশ করলেন না। পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা না করায় অনেকে হতাশ হলো, তবে সাধারণভাবে শেখ মুজিবের এই বক্তৃতা সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিল এক উত্তেজনার কাঁপন। শেখ মুজিবের ভাষণ রেডিওতে সরাসরি প্রচারের অনুমতি দিল না পাকিস্তান প্রশাসন। কিন্তু ঢাকা রেডিওর কর্মচারীরা কৌশলে পরদিন তার ভাষণ প্রচারে করে দেন রেডিওতে। পূর্ব পাকিস্তান অদ্ভুত তখন চলতে থাকে শেখ মুজিবেরই নির্দেশে। ছয় দফা ক্রমশ পরিণত হয় এক দফায়। সে দফা স্বাধীনতার।
দুদিন পর ৯ মার্চ মাওলানা ভাসানীও বক্তৃতা দিয়ে সমর্থন করেন শেখ মুজিবের দাবি। তিনি বলেন : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলি, অনেক হয়েছে আর না। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লা কুম দ্বিনকুম ওয়াল ইয়া দিন–তোমার ধর্ম তোমার আমার ধর্ম আমার এই নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা স্বীকার করো।
পাকিস্তান সরকারের বুঝতে বাকি থাকে না যে পুরো পরিস্থিতি তাদের হাতের মুঠোর বাইরে চলে গেছে। সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে শেখ মুজিবের সাথে আলাপ করতে ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন ১৫ মার্চ। তার সামনে পেছনে মেশিনগানবাহী ট্রাকের প্রহরা, সঙ্গে একাধিক পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল। মিটিং চলে শেখ মুজিবের সঙ্গে। একজন বেসামরিক মানুষকে ঘিরে আলাপে বসেছেন উর্দি পড়া যুদ্ধবাজরা। পাকিস্তান কাঠামো না ভেঙ্গেই একটা সমাধানের পথ তখনও খুঁজছেন শেখ মুজিব। কিছুদিন পর ভুট্টোও এসে যোগ দেন সে মিটিংয়ে। ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে সামনে পিছনে মেশিনগানের প্রহরা নিয়ে ভুট্টো যখন যাচ্ছেন শেখ মুজিবের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটলের কর্মচারীরা তখন কালো ব্যাজ পরে কাজ করছেন।
আটক ফোর্টে প্রতিদিন তাহের নিয়মমাফিক অফিস করছেন, প্যারেড করছেন, কমান্ড দিচ্ছেন কিন্তু তার মন পড়ে আছে ঢাকায়। রাতে ভাত খেতে খেতে লুৎফাকে বলেন : আমি কমফার্ম যে এরা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না। শেখ মুজিব শুধু শুধু ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে মিটিং করছেন।
লুৎফা: একটা মীমাংসা তো হতেও পারে।
তাহের : কোন মীমাংসা হবে না লুৎফা। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি একটা সিভিল ওয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। শেখ মুজিব একজন গ্রেট ন্যাশনালিস্ট লিডার। কিন্তু এরকম একটা যুদ্ধ বেধে গেলে তিনি সেটাকে কিভাবে ট্যাকল করবেন বুঝতে পারছি না। উনি তো হো চি মিনের মতো একটা আর্মস স্ট্রাগল লিড করতে পারবেন না, উনার পার্টি তো সেভাবে প্রিপেয়ার্ড না।
ঢাকার পথে পথে তখন উত্তপ্ত জনতা। দেশের নানা অঞ্চলে রাইফেল, বোয়োনেট উঁচিয়ে চলাচল শুরু করেছে আর্মির ট্রাক, জীপ। ইতোমধ্যে রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম, জয়দেবপুরে জনতার সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ। জনতা পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে বাধা সৃষ্টি করছে সেসব গাড়ি চলাচলের। গুলি চালাচ্ছে আর্মি। চারদিক থেকে আসছে মৃত্যুর খবর। খুলনার শিল্পী সাধন প্রকার গাইলেন, ব্যারিকেড়, বেয়োনেট বেড়াজাল, পাকে পাকে তড়পায় সমকাল…। সেই কবে জিন্নাহ যে বলেছিলেন পাকিস্তান টিকে থাকবার জন্যই এসেছে, সে কথার ভিত তখন নড়বড়ে।
১৩. তোমরা প্রস্তুত হও
ইতোমধ্যে তাহেরকে পাঠানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা ইনফেন্ট্রি স্কুলে সিনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্স করতে। ঢাকার ঘটনাবলির ওপর সতর্ক চোখ রাখছেন তিনি। আনোয়ারকে লিখলেন, ভুট্টো এখানে বলে গেছে পাকিস্তানে তিনটি দল আছে, আওয়ামী লীগ, পি পি পি এবং আমি। আর্মিকে যে ইনভলব করা হচ্ছে তা খুবই স্পষ্ট। আমরা এখান থেকে টের পাচ্ছি পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে আর্মি ডেপ্লয় করা হচ্ছে, আর্মস যাচ্ছে। এখানকার বাঙালি অফিসারদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ছুটি দেওয়া হচ্ছে না। আমি দেখতে পারছি একটা যুদ্ধ অনিবার্য। তোমরা সবাই প্রস্তুত হও। সাঈদ, বেলাল, বাহার সবাইকে বলে প্রিপেয়ার্ড থাকতে। তোমাদের ট্রেনিং আছে, যুদ্ধ বাধলে সবাইকেই বখানে যোগ দিতে হবে। মনে রেখো, এটা হবে একটা ন্যাশনালিস্ট ওয়ার কিন্তু এটাকে একটা সোসালিস্ট ওয়ারের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের দায়িত্ব আছে। যুদ্ধের ট্রেন্ডটা কোনোদিকে যাচ্ছে লক্ষ রাখতে হবে। আমি সময় সুযোগ মতো যোগ দেবো সেই যুদ্ধে।
তাহের লুৎফাকে বলেন : এরা খুব শীঘ্রই একটা মিলিটারি অ্যাকশনে যাবে। যুদ্ধ একটা বাধবে। কিন্তু বাঙালিদের তো তেমন মিলিটারি এক্সপার্টিজ নাই। সিনিয়র আর্মি অফিসাররাও তেমন সেখানে নাই। আমাকে খুব দ্রুত সেখানে যেতে হবে। যদিও এটা হবে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ কিছু যুদ্ধটাকে যদি দীর্ঘায়িত করা যায় তাহলে এটাকে একটা সোসালিস্ট আর্মস স্ট্রাগলের দিকে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ভিয়েতনামের মতো। কিন্তু যুদ্ধটাকে সাসটেইন করতে হবে। এরা তো ডেফিনিটলি আমাকে ছুটি দেবে না। আমাকে পালাতে হবে।
লুৎফা : সেসব তো বুঝলাম কিন্তু আমার কি হবে?
তাহের : সেটাই তো ভাবছি। তোমার এমন অ্যাডভান্স স্টেজ তোমাকে নিয়ে তো পালাতে পারব না। তুমি বরং এখনই ঢাকায় চলে যাও। আমি ব্যবস্থা করছি।
লুৎফা বলেনঃ কিন্তু রাস্তায় যদি কিছু হয়?
তাহের বলেন : কিছু হবে না। ডাক্তার তো বললেন তোমার সব কিছু নরমাল আছে। জানো চীনা মেয়েরা মাঠে কাজ করতে করতে পেইন উঠলে চলে যায় ঘরে। সেখানে বাচ্চাটা হয়ে যাবার কিছু দিন পরই আবার ফিরে যায় মাঠে কাজ করতে।
লুৎফা : আমি তো আর চীনা মেয়ে না।
তাহের : ভয় করো না, লুৎফা। আমি প্লেনে উঠিয়ে দেবো, ওরা প্লেনে স্পেশাল কেয়ার নেবে। আর ওখানে তো কেউ তোমাকে রিসিভ করবেই। খুব দ্রুতই সব ব্যবস্থা করতে হবে। কখন যে কি শুরু হয়ে যায় বলা মুশকিল।
লুৎফা ঢাকা যাবার প্রস্তুতি নেন। কাপড় চোপড় যখন গোছাচ্ছেন তখন সুটকেস থেকে তুলে রাখেন লন্ডন থেকে কেনা প্রিয় কার্ডিগেন দুটো। তাহেরকে বলেন, এ দুটো তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসো। এখন যদি নিয়ে যাই, সব কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যাবে আমার কাছ থেকে। এতো পছন্দ আমার কার্ডিগেন দুটো!
লুৎফাকে প্লেনে উঠিয়ে দেন তাহের। ইসলামাবাদ থেকে লুৎফা ঢাকায় আসেন ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে। উঠেন তার ফুফাতো বোন হালিমা আর স্বামী জুনারুল ইসলামের বাড়ি। ঢাকায় তখন অচল অবস্থা চারদিকে। গাড়ি, ট্রেন ঠিকমতো চলছে না কিছুই। প্রতিদিন বিক্ষোভ মিছিল। কয়দিন পর ট্রেনে চেপে লুৎফা রওনা দেন ঈশ্বরগঞ্জে বাবার কাছে। অস্বাভাবিক ধীর গতিতে চলে ট্রেন। ঢাকা থেকে সকালে রওনা দিলেও পথে পথে মিটিং, মিছিল-পুলিশের চেকআপ মিলিয়ে ঈশ্বরগঞ্জে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয় সন্ধ্যা। ঈশ্বরগঞ্জে পৌঁছে দেখেন সেখানেও তুমুল উত্তেজনা। এসেম্বলি নিয়ে ইয়াহিয়া খানের তাল বাহানা, শেখ মুজিবের বক্তৃতা সব মিলিয়ে চারদিকে আলোড়ন। লুৎফার বাবা, ভাইরা মিলে সারাদিন আলাপ করছেন মুজিব আর ইয়াহিয়ার মিটিং নিয়ে। গ্রামের ছেলেদের হাতে লাঠি।
১৪. পাখির ডিম
ঢাকায় যখন ভুট্টো, ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের মিটিং হচ্ছে তখন এম ভি সোয়াত নামে একটি জাহার্জ সন্তর্পণে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঢুকছে চট্টগ্রাম বন্দরে, করাচি বন্দর থেকে ছেড়ে আসা সে জাহাজ বোঝাই অস্ত্র সন্ত্র, গোলবারুদ। সে সময়ই রাতের অন্ধকারে ঢাকা এয়ারপোর্টে পি আই এ প্লেনের ঘন ঘন ফ্লাইটে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেসামরিক পোশাকে দলে দলে নামছে পাঞ্জাবি সৈন্য, এসে পৌঁছেছে পাকিস্তানের চৌকস এস এস জি কমান্ডো গ্রুপ। ঢাকার নানা স্ট্রেটেজিক পয়েন্টে বসানো হয়েছে ভারী কামান আর মেশিন গান। মিটিং চলছে গণভবনে, তার ভেতরে বাইরে, মোতায়েন করা হয়েছে ট্যাংকের বহর।
বাতাসে ঝড়ের আভাস। জাতিসংঘের প্রধান উথান্ট ঢাকায় জাতিসংঘ অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। ২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবসে ঢাকায় কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে না। উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। কোনো কোনো বিদেশি দূতাবাসে পাকিস্তানের পতাকা উড়ানো হলেও উত্তেজিত জনতা সেটি নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করেছে। ঐদিন শেখ। মুজিব তার মাজদা গাড়িতে কালো পতাকা নয়, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে গণভবনে গেলেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিটিং করতে। ২৫ মার্চ সংসদের অধিবেশন বসবার কথা। সংসদ বসবার আগেই শেখ মুজিবের দাবি অনুযায়ী মার্শাল ল প্রত্যাহার আইনসম্মত হবে কিনা মিটিংয়ে এসষ কূট তর্ক করেন ইয়াহিয়, ভুট্টো। কোনো মীমাংসা ছাড়াই স্থগিত হয় মিটিং। পরবর্তী মিটিং কবে হবে সে কথা টেলিফোনে জানানো হবে বললেন ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি জেনারেল পীরজাদা। শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা অপেক্ষা করতে থাকেন সেই টেলিফোন কলের জন্য।
সেদিন রাতে ইয়াহিয়া হুইস্কির গ্লাস নিয়ে বসেন তার জেনারেলদের সঙ্গে, সাথে একমাত্র বেসামরিক মানুষ ভুট্টো। সিন্ধের বিশাল জমিদারের ছেলে, অক্সফোর্ডে পড়া চৌকস জুলফিকার আলী ভুট্টো, মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে যিনি হয়েছিলেন আইয়ুব খানের মন্ত্রী। পাকিস্তানের জেনারেলদের সঙ্গে তার উঠাবসা বহুদিনের। ভুট্টো শেখ মুজিবকে কোনো গুরুত্বই দিতেন না কখনো। পরবর্তীতে তিনি যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন ইতালির সাংবাদিক ওরিয়েনা ফ্যালাচিকে স্পষ্টই বলেছেন, শেখ মুজিব অযোগ্য, বিভ্রান্ত, অশিষ্ট, বোধহীন। তিনি শুধু জানেন কি করে গলাবাজী করা যায় … আমি তাকে কোনোদিনও গুরুত্ব দেইনি… আমি বুঝিনা কি করে বিশ্ব তাকে গুরুত্ব দিতে পারে…? রাজনীতিবিদ সম্পর্কে তার ধারণার কথা বলতে গিয়ে ভুট্টো ওরিয়েনা ফ্যালাচিকে বলেন, আপনি কি কখনো পাখিকে তার বাসায় ডিমের উপর তা দিতে দেখেছেন? হালকা আঙ্গুল দিয়ে পাখির নিচের সেই ডিমগুলো একটি একটি করে সরিয়ে আনার যোগ্যতা থাকতে হবে একজন রাজনীতিবিদের। যাতে পাখিটি কিছুতেই টের না পায়।
সেইসব রাতে পাখির নিচের সেই ডিমগুলো নিঃশব্দে সরানোর ব্যবস্থা করছিলেন ভুট্টো এবং সেই জেনারেলরা। তারা ঠিক করেছিলেন পলিটিক্যাল সলিউশন যখন হলো না অনিবার্যভাবেই একটা মিলিটারি সলিউশনে যেতে হবে। বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রচণ্ড সামরিক অ্যাকশন নিতে হবে। জেনারেল টিক্কা খান খুব সফলতার সঙ্গে বেলুচদের এমন বিদ্রোহ শায়েস্তা করেছেন, ইন্দোনেশিয়ার আর্মিরাও খুব দ্রুত মিলিটারি অ্যাকশনে খুবই সফলভাবে দমিয়ে দিয়েছে সে দেশের বিদ্রোহীদের। বাঙালিদের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহকেও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল রাও ফরমান আলীকে বলেন, কুস হো রাহা হ্যায়, তৈয়ারি মৈয়ারি কারো।
টিক্কা খান, রাও ফরমান আলী, হামিদ, খাদিম, বাঘা এইসব জেনারেল মিলে তৈরি করেন অপারেশনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা, নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট। সিদ্ধান্ত হয় শেখ মুজিব এবং তার অনুগামীদের দ্রুত বন্দি করে, শেল, মর্টারসহ সবরকম ভারী অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বাঙালিদের ওপর, তাদের ভড়কে দিতে হবে। তাহলেই সম্বিত আসবে বাঙালিদের। টিক্কা খান বলেন পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে তার বড়জোর বাহাত্তর ঘণ্টা সময় লাগবে।
১৫. সে রাতে চাঁদ দেখেনি কেউ
২৫ মার্চ রাতে একটি গাড়ি এসে থামে ঢাকা এয়ারপোর্টে, সাধারণ একটি গাড়ি। সে গাড়ি থেকে নামেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি অন্ধকারে এগিয়ে যান রানওয়ের দিকে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি এরোপ্লেন। গুটিকয় সঙ্গী নিয়ে তিনি উঠে পড়েন প্লেনে। কিছুক্ষণ পর প্লেনটি উড়ে যায় করাচির পথে। যাবার আগে তিনি সবুজ সংকেত দিয়ে যান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কে। তবে বলেন রাত ১২ টার আগে যেন অ্যাকশন শুরু না হয়। ততক্ষণে তিনি পৌঁছে যাবেন করাচি। এর আগে জানাজানি হয়ে গেলে ভারত আক্রমণ করে বসতে পারে ইয়াহিয়ার বিমান।
এসময়ে টারম্যাকে দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকারে নিভৃতে প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগের এই দৃশ্য দেখেন বিমানবাহিনীর এক বাঙালি অফিসার এ কে খন্দকার। বিস্মিত হন, আঁচ করেন সমূহ বিপদের। অফিসে ফিরে টেলিফোন তুলে নেন হাতে, দ্রুত এ খবর পাঠাতে হবে সংশ্লিষ্ট কাউকে। টারম্যাকে দাঁড়ানো এ কে খন্দকার জানেন না অচিরেই তাকে দায়িত্ব নিতে হবে একটি মুক্তিযুদ্ধের সহঅধিনায়কত্বের।
রাত বাড়ে। শহরের কোলাহল কমে আসে ক্রমশ, বন্ধ হয় দোকানের ঝাঁপি, একটি একটি করে নিভে আসতে থাকে ঘরের বাতি, রাস্তার উপর বেরিকেডগুলো অবশ্য পড়ে থাকে অবিচল। শহর জুড়ে অজানা আশঙ্কা।
ঠিক মধ্যরাতে হঠাৎ বিকট শব্দে ট্যাঙ্ক, ভারী মর্টার, শেল, মেশিন গান নিয়ে রাজপথে নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নানা দলে বিভক্ত হয়ে পথে পথে ফেলে রাখা বেড়িকেডগুলো সরিয়ে এগুতে থাকে তারা। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট।
একদল এগিয়ে যায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের হেডকোয়ার্টার পিলখানায় আর রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। সেখানে শত শত ঘুমন্ত, অপ্রস্তুত বাঙালি পুলিশ আর সৈনিকদের অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করে তারা।
একদল যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মর্টার শেলের আঘাতে তারা গুঁড়িয়ে দেয় ছাত্রদের আবাসিক হল, শিক্ষকদের আবাস। নিহত হয় অসংখ্য ছাত্র শিক্ষক। হল থেকে ধরে এনে গুলি করা হয় ছাত্রদের।
অন্যদল আগুন ধরিয়ে দেয় পুরান ঢাকার শাখারীপট্টিসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা, ঢাকার আসে পাশের নানা বস্তি।
রাতের অন্ধকারে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, মর্টার, শেলের আঘাতে পুলিশ, রাইফেলসের সদস্য, ছাত্র, পথের সাধারণ মানুষ মিলিয়ে শত শত লোককে হত্যা করতে করতে শহর দাপিয়ে বেড়ায় পাক আর্মি। আগুনে পুড়িয়ে দেয় পত্রিকার অফিস। আগুনের লেলিহান শিখা, গুলি আর আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হতে থাকে ঢাকার রাত। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় গণহত্যার উৎসব।
চকিতে একটা ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে পাক সেনারা স্তব্ধ করে দিতে চায় বাঙালিদের। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে তুলনাহীন ভীতির সঞ্চার করে প্রতিষ্ঠা করতে চায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য। জেনারেল টিক্কা খান এগুতে থাকেন নির্মম এবং সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে আয় বাহাত্তর ঘন্টায় পাকিস্তানি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে।
রাত দেড়টার দিকে পাক কমান্ডো বাহিনী গুলি করতে করতে শেখ মুজিবের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢোকে। ঐ দিন রাতে এমন একটি আক্রমণের আশঙ্কা করে তাজউদ্দীনসহ অন্য নেতারা শেখ মুজিবকে আত্মগোপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি তা শোনেননি। শেখ মুজিব মনে করেছিলেন তাঁকে গ্রেফতার করতে না পারলে পাকবাহিনী আরও নির্মম হয়ে উঠবে বাঙালিদের ওপর। পাকবাহিনী বন্দি করে মুজিবকে। তাঁকে বন্দি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের করাচিতে। শেখ মুজিবের ধারণা ভুল প্রমাণ করে নির্মমতার শেষ নয় বরং হয় শুরু।
দীর্ঘদিন ধরে সুচারুভাবে প্রস্তুত করা একটি অভিযান নেমে আসে অপ্রস্তুত এক জাতির ওপর। সেদিন ঢাকার আকাশে চাঁদ উঠেছিল। কিন্তু শহরে একজন মানুষও ছিল না সে চাঁদের দিকে তাকাবার। লেখক আব্দুল হক অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ছাদে উঠেছিলেন। কিন্তু চাঁদ দেখতে নয়, কোথা থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে সেটা বুঝবার জন্য। তিনি দেখলেন অন্ধকার রাত্রির আকাশ লাল টকটকে হয়ে আছে আগুনের রঙে। দেখলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন জ্বলছে, জ্বলছে রেল স্টেশনের দিকে কিছু এবং জ্বলছে হাইকোর্টের দিকে আরও কিছু। বহু দূরে মিরপুরের দিকেও লাল আকাশ। কালো আকাশ চিরে মাঝে মাঝে রক্তবর্ণ গুলি শূন্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। পুলিশ লাইনের দিক থেকে দলে দলে নারী পুরুষ ছেলে মেয়ে ছুটে পালাচ্ছে। তার মনে হলো কোনো কোনো গুলি বুঝি তার বাড়িতে এসে লাগবে। ঘরে ফিরে দেখলেন ছেলে মঞ্জু কান্নাকাটি করছে। তাকে কিছুক্ষণ রাখলেন বাথরুমে, সেখানে গুলি লাগবে না এই ভরসায়, কিছুক্ষণ পর শুইয়ে দিলেন বিছানার নিচে। আশপাশের সমস্ত বাড়ি অন্ধকার কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলেন সবাই জেগে অন্ধকারে বসে আছে। পুরনো ঢাকার নানা মহল্লায় সে রাতে হাজার হাজার আতঙ্কিত মানুষ একসঙ্গে আজান দিয়ে উঠে, যেন রোজ কেয়ামত উপস্থিত। এই অভূতপূর্ব রাত এরপর এই জনপদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে প্রবাহিত হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক ড. নুরুল উলা থাকতেন ফুলার রোডের পুরনো এসেমব্লি হলের উল্টোদিকে অধ্যাপকদের জন্য বরাদ্দ ফ্লাটে। তার জানালা থেকে জগন্নাথ হল ছাত্রাবাসের একটি বিরাট মাঠ সরাসরি চোখে পড়ে। ২৫ মার্চের নিঘুম রাত কাটিয়ে পরদিন নিজের বাড়ির জানালা থেকে ঐ খেলার মাঠে তিনি দেখলেন বীভৎসতর দৃশ্য। দেখলেন হলের ভেতর থেকে ছাত্রদের ধরে এনে লাইন করে দাঁড় করানো হচ্ছে সেই মাঠে, তারপর তাদের উপর গুলি চালানো হচ্ছে খুব কাছ থেকে। দেখলেন ছাত্রগুলোর পেছন থেকে উঠছে ধূলি, বুঝতে পারলেন যে, কিছু গুলি শরীর ভেদ করে মাটিতে ঠেকছে এবং সে থেকেই ধূলি উড়ছে। কোনো কোনো ছাত্র গুলি করবার আগে হাত জোর করে মাফ চাইছে, তাকে গুলি করা হচ্ছে আরও কাছ থেকে। এভাবে এক একটি ছোট দলে ছাত্রদের আনা হচ্ছে আর হত্যা করা হচ্ছে। মাঠের উপর পড়ে থাকা লাশের সংখ্যা তার চোখের সামনে একটু একটু করে বাড়ছে। ড. নুরুল উলার কাছে ছিল জাপানের তৈরি ভারী একটি পোর্টেবল মুভি ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় তিনি অত্যন্ত গোপনীয়তায় তাঁর জানালা থেকে তুললেন সেই বীভৎস দৃশ্য। তার সেই ক্যামেরা ফুটেজ হয়ে গেল বাংলাদেশের গণহত্যার প্রথম ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল।
ঢাকার এই বীভৎস ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচবার আশায় শত শত মানুষ তখন পিছু হঠতে হঠতে পালিয়ে আশ্রয় নেয় বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরায়। পাকবাহিনীর লক্ষ্য তখন হয়ে দাঁড়ায় টাকার অদূরের জিঞ্জিরা। এক রাতে তারা হত্যা করে জিঞ্জিরার কয়েক শত মানুষ। বহু বছর পরে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ স্মৃতি লিখে সবাইকে শিহরিত করবেন কবি নির্মলেন্দু গুণ।
কিন্তু একাত্তরে তাদের এই ধ্বংসযজ্ঞের খবর যেন সারা পৃথিবীর কাছে না পৌঁছায় সেটা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সমস্ত বিদেশি সাংবাদিকদের আটকে রাখে পাকবাহিনী। ২৬ মার্চ সবাইকে সেনা প্রহরায় বিমানে উঠিয়ে বের করে দেওয়া হয় দেশ থেকে। কিন্তু ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সায়মন ড্রিং সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকেন হোটেলে। হোটেলের রান্নাঘরে বাবুর্চিদের সহায়তায় তিনি লুকিয়ে থাকেন দুদিন। চুপিসারে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়ান বিধ্বস্ত ঢাকায়। যে রিপোর্ট তিনি লেখেন তা কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে ব্যাংকক হয়ে নানা কৌশলে পাঠিয়ে দেন টেলিগ্রাফে। বিশ্ববাসী জানে এক মৃতনগরীর ইতিবৃত্ত। করাচি মর্নিং নিউজের সাংবাদিক এ্যন্থনী ম্যাসকারানহাসও ব্রিটেনের ‘সানডে টাইমস’এ তুলে ধরেন ঢাকার লোমহর্ষক কাহিনী। শুধু জিঞ্জিরা, কালুরঘাট, পিলখানা নয় গণহত্যার খবর জেনে যায় লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, সিডনির মানুষেরাও। ঢাকার পর পাকবাহিনী ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে দেশের অন্যান্য শহর আর গ্রামে। হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠা একটি জনপদকে তছনছ করে দেবার জন্য যেন পাহাড় থেকে নেমে এসেছে হিংস্র দানব।
১৬. নাম জয়া
আতঙ্কিত ঈশ্বরগঞ্জের মানুষরা খোঁজ পায় দানব এগিয়ে আসছে তাদের দিকেও। ঢাকা ছেড়ে ইতোমধ্যে পাকিস্তান আর্মিরা চলে এসেছে কাছের শহর ময়মনসিংহে। খবর রটে যায় তরুণদের ধরে ধরে গুলি করছে তারা। শহরের মানুষ ধ্বশ্বাসে পালায় গ্রামের দিকে। মিলিটারির তাড়া খেয়ে ময়মনসিংহ থেকে লুৎকার বাবার পরিচিত ছয়টি পরিবারের অসংখ্য সদস্য এসে উপস্থিত হয় তাদের ঈশ্বরগঞ্জের বাড়িতে। এত মানুষের স্থান সংকুলান হয় না বাড়িতে। সীমাহীন বিপর্যস্ত অবস্থা। এরই মধ্যে একদিন প্রসব বেদনা উঠে লুৎফার। যুদ্ধের ঐ ডামাডোলের মধ্যে, সর্বব্যাপী উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের ভেতর গ্রামীণ ধাত্রীর হাতে জন্ম নেয় লুকা, তাহেরের প্রথম সন্তান। সেদিন এপ্রিলের ছয় তারিখ। অক্সফোর্ডের ফুরফুরে রাতে যেমনটি বলেছিলেন তাহের, ঠিক তাই ঘটে, জন্ম হয় একটি মেয়ের। তাহেরের কথা মতোই লুৎফা মেয়ের নাম রাখেন জয়া।
কিন্তু উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায় লুৎফার বাবা ডা. খোরশেদুদীনের, তিনি বলেন; এ জায়গাটা আর মোটেও নিরাপদ না, যে কোনো দিন মিলিটারি চলে আসতে পারে ঈশ্বরগঞ্জ। আমাদের আরও ভেতরে চলে যেতে হবে। আর মা লুৎফা তুমি বরং তোমার শ্বশুরবাড়ি কাজলাতেই চলে যাও।
রেল চলাচল অনিশ্চিত, ঈশ্বরগঞ্জের স্টেশন মাস্টার তাহেরের চাচা মুন্সেফউদ্দীন তালুকদার একদিন রেল ইন্সপেকশনের স্পেশাল ছাদ খোলা চার চাকার ট্রলিতে উঠিয়ে দেন লুৎফাকে। সদ্যোজাত মেয়ে জয়াকে শাড়িতে ঢেকে আতঙ্কিত লুৎফা ঐ অদ্ভুত যানে চড়ে রওনা দেন শ্যামগঞ্জের পথে। শ্যামগঞ্জে পৌঁছালে তাকে পালকিতে করে নিয়ে যাওয়ায় কাজলায়।
শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে লুৎফা দেখেন সেখানেও এলাহী কাণ্ড। ময়মনসিংহ শহরের নানা মানুষ মিলিটারির তাড়া খেয়ে এসে উঠেছে কাজলাতেও। বিশেষ করে নানা জেলা থেকে আসা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে ফিরে যেতে না পেরে যে যেদিকে পেরেছে ঢুকে গেছে প্রত্যন্ত গ্রামে। এতসব ছেলে মেয়ে কাউকেই চেনেন না লুৎফা, চেনেন না বাড়ির অন্য কেউ। রাজশাহীর মেয়ে লতা কেবলই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। জানে না কি হয়েছে রাজশাহীতে থাকা তার বাবা মার, জানে না আর কোনো দিন দেখা হবে কিনা তাদের সঙ্গে।
আশরাফুন্নেসা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কাজলায় জড়ো হওয়া আগন্ত্রক ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তাদের জন্য রান্না আর খাওয়ার আয়োজন করছেন তিনি, বাবস্থা করছেন রাতের ঘুমাবার। তাহেরদের বাড়িতে যে কয়জনের জায়গা হয়েছে তারা বয়ে গেছে সেখানে বাকিদের গ্রামের অন্যদের বাড়িতে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন তিনি। এক বিছানায় একসঙ্গে আড়াআড়ি করে শুচ্ছে চার, পাঁচজন। একফাঁকে আদর করে যাচ্ছেন জয়াকে, মুফাঁকে দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় নির্দেশ।
যথারীতি এই ব্যস্ততার মধ্যেও চালু রয়েছে আশরাফুন্নেসার উদ্ভাবনী ভাবনা। একদিন তিনি ছেলেমেয়েদের ডেকে বললেন : গ্রামে তো কখনো এতগুলো শিক্ষিত ছেলে মেয়ে এক সঙ্গে আসে না। এ সুযোগটাকে কাজে লাগানো দরকার। যুদ্ধ কতদিন চলে কে জানে। তোমরা যতদিন গ্রামে আছ প্রত্যেকে অন্তত দুইজন করে ছেলে বা বুড়ারে পড়াশোনা শিখাও।
নানা জায়গা থেকে পালিয়ে আসা ছেলেমেয়ের উৎসাহের সঙ্গে লেগে পড়ে গ্রামের নিরক্ষরদের পড়ানোর কাজে। এত লোকজনের ভিড়ে খানিকটা উৎসবের আমেজ আসে যেন কাজলায়। যদিও সবার মধ্যেই নিরন্তর চাপা উদ্বিগ্নতা, ত্রাস। এই বুঝি দানবের পদধ্বনি শোনা যায় গ্রামের প্রান্তে।
যুগ্ধতাড়িত মানুষের ভিড়ে ছোট জয়াকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সহসা অন্যমনস্ক হয়ে যান লুৎফা। তার চোখে চকিতে ভেসে ওঠে অক্সফোর্ডের সবুজ পার্ক, ডেফোডিল ফুলের বাহার। অচেনা গাছের ছায়ায় বসে তাহেরের সঙ্গে কাটানো বিকেল। জয়ার জন্মের খবর লিখে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েছেন সুঙ্কা কিন্তু এই যুদ্ধের ডামাডোলে কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সে চিঠি কে জানে?
১৭. রাতের পায়চারী
তাহের তখন কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে। ঢাকার রাজপথে সৈন্য নেমে গেছে, শুরু হয়ে গেছে হত্যাযজ্ঞ, চালু হয়ে গেছে অপারেশন সার্চ লাইট। এ খবর তাহের পেয়েছেন ২৫ মার্চ গভীর রাতেই। উত্তেজনায় বেরিয়ে গেছেন ঘর থেকে। পায়চারী করেছেন ক্যান্টনমেন্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। একা একা। অন্ধকার ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড গ্রাউন্ডে নিঃসঙ্গ পায়চারী করতে করতে তাহের সিদ্ধান্ত নেন যত দ্রুত সম্ভব তাকে পৌঁছাতে হবে বাংলাদেশে। প্রতিহত করতে হবে এই আক্রমণ, ঘুরিয়ে দিতে হবে যুদ্ধের গতিপথ, যার প্রস্তুতি তিনি নিয়েছেন দীর্ঘদিন।
পরদিন সকালেই সতর্কতার সঙ্গে তিনি কথা বলেন কোয়েটায় অবস্থানকারী গুটিকয় বাঙালি-অফিসারদের সঙ্গে। তাদের বলেন, বাংলাদেশে একটা ফুল ফ্লেজেড ওয়ার শুরু হয়ে যাবে অচিরেই, সেখানে ট্রেইন বাঙালি আর্মি অফিসার দরকার। আমাদের ওখানে জয়েন করা উচিত খুব শীঘ্রই।
বাঙালি অফিসাররা তখন ভীতসন্ত্রস্ত। একজন বলেনঃ কিন্তু কিভাবে স্যার?
তাহের : পালাতে হবে। আমি পালাবো এজ আর্মি এজ পসিবল। তোমরা থাকবে আমার সঙ্গে?
দু-একজন জুনিয়র অফিসার উৎসাহিত হন কিন্তু দ্বিধান্বিত থাকেন। একজন বলেন : আমরা কয়জন পালালে ওয়েস্ট পাকিস্তানের সব বাঙালি অফিসারদের মধ্যে বিপদ নেমে আসবে। সেটা কি ঠিক হবে?
তাহের : বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়াই এখন সবচেয়ে ঠিক কাজ এবং আমাদের কর্তব্য। তাতে যে কনসেকুয়েশই হোক না কেন, আমাদের তা মাথা পেতে নিতে হবে। আমি প্রিপারেশন নিচ্ছি পালিয়ে যাবার, তোমরা যারা ইন্টারেস্টেড তার যোগাযোগ করবে আমার সাথে।
যে সিনিয়র ট্যাকটিক্যাল কোর্সটি করবার জনা তাহেরকে কোয়েটায় পাঠনো হয়েছিল সেটি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাহের খোঁজ পান কোয়েটা থেকে এক ডিভিশন আর খারিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে আরেক ডিভিশন সৈন্য প্লেনে করে পাঠানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। এও খোঁজ পান সেসব ডিভিশনে যে বাঙালি অফিসার রয়েছে তাদের নেওয়া হয়নি।
কোয়েটার কোর্স বন্ধ হবার পর তাহের যখন নিজ ইউনিট খারিয়াতে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন ট্রেনিং স্কুলের পশ্চিম পাকিস্তানি কমান্ডার মেজর জেনারেল বি এম মোস্তফা তাহেরকে ডেকে পাঠান। জেনারেল মোস্তফা তাহেরকে বলেন, তুমি আপাতত তোমার ইউনিটে ফিরে যেতে পারবে না, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমাকে কোয়েটাতেই থাকতে হবে।
শংকিত হয়ে পড়েন তাহের। ভাবেন, তার পালাবার পরিকল্পনা কাঁস হলো কি? তাহেরকে নজরবন্দি করে রাখা হয় কোয়েটায়।
১৮. মাইনর বনাম মেজর আর নির্জন চা বাগান
ওদিকে পাকবাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বেপেরোয়া গোলাগুলি আর ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়াতে হতচকিত বাংলাদেশের আপামর মানুষ। এ আর বুঝতে কারো বাকি নেই যে, এদেশের মানুষ সহসা একটা বর্বরোচিত যুদ্ধের পাকচক্রে পড়ে গেছে। ঠিক অপ্রত্যাশিত না হলে অনেকটাই অপ্রস্তুত।
অপ্রস্তুত রাজনৈতিক নেতাকর্মী সশস্ত্রবাহিনীর বাঙালিরাও। রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের সে সময় নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এরকম একটা সর্বাত্মক যুদ্ধের স্পষ্ট, সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের। পাকবাহিনীর ঐ আচমকা আক্রমণের শুরুর সময়টা বাঙালিরা তাই অনেকটাই দিকভ্রান্ত, অগোছালো। অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব বন্দি, আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা আত্মগোপনে।
প্রাথমিক প্রতিরোধের খানিকটা চেষ্টা চালান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা। ঢাকার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস আর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক আর পুলিশরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চেষ্টা করেন পাকবাহিনীর আক্রমণাকে প্রতিরোধ করার। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন সেখানকার ইপিআরের সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট বাঙালি ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। পরিস্থিতির অবনতি দেখে তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমান আর চিফ ট্রেইনার লে কর্নেল এম আর চৌধুরীকে অনুরোধ করেছিলেন আগে থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে রাজি হননি মেজর জিয়া এবং কর্নেল চৌধুরী। ফলে ঢাকার মতো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টেও পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন অসংখ্য বাঙালি সেনা, নিহত হন কর্নেল চৌধুরীও।
নিহত হতেন মেজর জিয়াও। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন চরিত্র হবেন বলে নিয়তি যেন বাঁচিয়ে রাখে তাকে। মেজর জিয়া বেঁচে যান কারণ তিনি তখন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে। তার অধিনায়ক পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াকে আদেশ দিয়েছিলেন এমভি সোয়াত থেকে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র নামাতে। তিনি সে কাজেই যাচ্ছিলেন। আগ্রাবাদের কাছে এসে তিনি পাকিস্তানিদের আক্রমণের খবর পান। শেষ মুহূর্তে পক্ষ ত্যাগ করে মেজর জিয়া যোগ দেন বাঙালিদের সঙ্গে।
এসময় এক কাকতালীয় ঘটনা বদলে দেয় এই দোদুল্যমান মেজরের জীবন। চট্টগ্রামের কাছে কালুরঘাটে তখন একটি ছোট্ট রেডিও রিলে সেন্টার দখল করে রেখেছেন বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দীপ, আবদুল্লাহ আল ফারুক প্রমুখ। বেতার কর্মীরা। তারা এই রেডিও স্টেশনের নাম দিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র! ২৫ মার্চের ভয়াবহ রাত কাটাবার পরদিন ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা এম এ হান্নানের কাছে ইপিয়ারের ওয়ারলেস মারফত এসে পৌঁছায় শেখ মুজিবের একটি বার্তা, যা তিনি আগের রাতে বন্দি হবার পূর্ব মুহূর্তে পাঠিয়ে গেছেন। সে বার্তায় শেখ মুজিব ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সারাবিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশসমূহের কাছ থেকে প্রার্থনা করেছেন সাহায্য।
এসময় বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ খানিকটা ঠাট্টা করেই মেজর জিয়াকে বলেন, আমরা তো সব মাইনর আপনি মেজর হিসেবে নিজের কণ্ঠে কিছু প্রচার করলে ভালো হবে।
প্রস্তাবটি গুরুত্বের সাথে নেন মেজর জিয়া। ২৭ মার্চ প্রথমে নিজের নামে পরে শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি। বলেন, আই মেজর জিয়া, প্রভিন্সিয়াল কমান্ডার ইন চিফ অফ দি বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি, হেয়ার বাই প্রক্লেইম, অন বিহাফ অফ শেখ মুজিবর রহমান, দি ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ বাংলাদেশ …।
তারপর থেকে মেজর জিয়ার ঐ ভাষণ এবং তার বাংলা তর্জমা লাগাতার প্রচারিত হতে থাকে কালুর ঘাট রিলে স্টেশন থেকে। একাত্তরের ঐ দিকচিহ্নহীন দিনে যারা বেতারে মেজর জিয়ার ঐ ঘোষণা শুনেছেন তাঁরা উদ্দীপিত হন। বিশেষ করে একজন সেনা কর্মকর্তার মুখে এই ঘোষণা শুনে সবার স্বস্তি জাগে এই ভেবে যে বাঙালিরা শুধু পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে না, লড়াই করছে কোথাও। মেজর জিয়ার ঐ ঘোষণা এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্য নদীতে নোঙ্গর করা এক জাপানি জাহাজে ধরা পড়ে, সেখান থেকে চলে যায় রেডিও অস্ট্রেলিয়ায়। রেডিও অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যমে সারা পৃথিবী শুনতে পায় মেজর জিয়ার সেই ঘোষণা।
আর এই ঘোষণার মাধ্যমে সে সময় অপরিচিত জনৈক মেজর জিয়ার জীবনও জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কঠিন পাকচক্রে। কালুরঘাট বেতারের সেই সন্ত্রস্ত অথচ সাহসী বেতারকর্মীরা তখন এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেননি যে এই ঘোষণাটির প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে। তাদের জানবার কথা নয় যে এই ঘোষণা মাত্র দুই দশকের মধ্যে হয়ে উঠবে বাংলাদেশের মানুষকে দ্বিখণ্ডিত করার অন্যতম হাতিয়ার। কে ঘোষণা দিয়েছেন আগে শেখ মুজিব না মেজর জিয়া এই তুই বিতর্কে নিজেদের হিনভিন্ন করবে একটি জাতি।
চট্টগ্রামে যখন ঐ স্বাধীনতা ঘোষণার নাটক চলছে তখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সামরিক বাহিনীর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে প্রতিরোধ। জয়দেবপুর, কুমিল্লা, যশোর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি আর্মি অফিসাররা যার যার সাধ্যমতো বিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন লড়াই। দেশের নানা এলাকায় ছড়িয়ে থাকা সিনিয়র বাঙালি আমি অফিসাররা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এপর্যায়ে সব সামরিক অফিসারদের একটি সভায় মিলিত হওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। শেষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানের নির্জন বাঙলোতে বসে সেই ঐতিহাসিক সভা।
দুরে চা বাগানের কুলিদের পূজার ঢাকের শব্দ আসে, দুটি পাতা আর একটি কুড়ির উপর দিয়ে বয়ে যায় রাতের বাতাস, নাম না জানা পাখি ডাকে। আর বাঙলোর ভেতরে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাঙালি সেক্টর কমান্ডাররা। এটি স্পষ্ট হয় যে বাঙালিদের অবস্থা খুবই নাজুক। দেশের নানা অঞ্চল দ্রুত চলে যাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে বাঙালি সেনাদের দখলে যে অস্ত্র আছে এ দিয়ে পাকিস্তানি শক্তিশালী কাহিনীর সাথে টিকে থাকা অসম্ভব। তাদের দরকার আরও অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। কিন্তু কোথা থেকে আসবে সেই অস্ত্র? স্বভাবতই প্রথম বিবেচনায় আসে প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু ভারতের সাথে যোগাযযাগটা হবে কি করে? ভারত তাদের অস্ত্র দেবে কিনা সেটি একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের সরকারের কোনো প্রতিনিধিকে? কিন্তু কোথায় বাংলাদেশের সরকার, কে তার প্রতিনিধি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের অভাবনীয় ভয়াবহতায় হতবিহ্বল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। শেখ মুজিব কি ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধ বিষয়ে কোনো কথা বলে গিয়েছিলেন?
সে খবর স্পষ্ট করে জানেন না তেলিয়াপাড়ার চা বাগানে বসা বাঙালি এই সামরিক অফিসাররা। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা অব্যহত রেখে তারা আপাতত সিদ্ধান্ত নেন একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী গঠনের, সর্বসম্মতিক্রমে যার নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ আর্মির অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বাঙালি অফিসার কর্নেল ওসমানীকে।
দূরে তখনও শোনা যায় চা শ্রমিকদের পূজার ঢাকের শব্দ।
১৯. ছায়া যুদ্ধ থেকে যুদ্ধের ছায়ায়
বাড়ির পাশের মাঠে তাহেরের নেতৃত্বে আশরাফুন্নেসার সব ছেলেমেয়েরা যে ছায়া যুদ্ধের খেলা খেলেছে, সে যুদ্ধ এখন সশরীরে উপস্থিত তাদের সামনে। তারা সবাই প্রস্তুত। আসল যুদ্ধ মাঠের মাঝখানে যাবার জন্য তারা উদগ্রীব।
ইয়াহিয়া খান যখন সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন তখন ছাত্রলীগের একটি অংশ সিদ্ধান্ত নেয় আরও জঙ্গি হয়ে উঠবার। তাদের নেতা সিরাজুল আলম খান। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, শহর শহরে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্কিত করে তুলবে ইয়াহিয়া সরকারকে। ডাক পড়ে আনোয়ারের। বোমা পারদর্শী হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে আনোয়ারের মান ডাক। ছাত্রলীগের জঙ্গি কয়েকজন সদস্য নিয়ে আনোয়ার তৈরি করে ফেলেন সূর্যসেন স্কোয়াড। মলোটভ ককটেল বানিয়ে শহরের নানা জায়গায় তা ফাটিয়ে সরকারকে আতঙ্কিত এবং বিভ্রান্ত করে তোলেন তারা।
মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আনোয়ার যখন ছাত্রলীগের সঙ্গে মিলে বোমা বানাচ্ছেন তখন আরেক ভাই সাঈদ যোগ দিয়েছেন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পাটি নামের এক জঙ্গি দলে। এই দল তখন বোমবার্ড দি হেডকোয়ার্টার–মাও সে তুং এর এই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকায় এসেম্বলি হল বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুজিব এবং ইয়াহিয়া আলোচনা শেষে যেদিনই এসেম্বলিতে বসবেন সেদিনই কয়েকজন সুইসাইড স্কোয়াডের কর্মীদেরকে দিয়ে বোমা ফাটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে সংসদ। সাঈদ তখন ঐ সুইসাইড স্কোয়াড গঠনে ব্যস্ত। সংসদ ভবনে রেকির কাজ চালান তিনি। সংসদ ভবনের দারোয়ান, গার্ড, মালি এদের সাথে নানাভাবে ভাব জমিয়ে ভবনের খুটিনাটি জেনে নেন তিনি। কোথায় কোথায় বিস্ফোরকগুলো বসাতে হবে, সংসদ ভবনে কে কোথায় কিভাবে যাতায়াত করে, সুইসাইড স্কোয়াডের ছেলেরা কোথায় অবস্থান নেবে ইত্যাদি ব্যাপারগুলো সমন্বয় করায় তখন ব্যস্ত সাঈদ। তার সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যদের ট্রেনিং দেবার নাও সাঈদ ডাকেন আনোয়ারকে। সূর্যসেন স্কোয়াডের পাশাপাশি সাঈদের সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যদেরও ট্রেনিং দেন আনোয়ার। ধানমণ্ডির এক বাসা ভাড়া করে মজুদ করা হয় বোমা বানানোর সব বিস্ফোরক। এইসব কর্মকাণ্ডে তাদের যাবতীয় সহায়তায় আছেন তাদের পুরনো বামপন্থী বন্ধু বেবী ভাই, দুই হাত কব্জি থেকে কাটা এই মানুষটির তৎপরতা বামপন্থী বন্ধু মহলে সুবিদিত। তারই সূত্রে তাদের পরিচয় ঘটে আরেক কৌতূহলোদ্দীপক মানুষ মিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে। পেশায় কন্ট্রাকটার, বিশাল ধনবান এই মানুষটি ঢাকা শহরের গুটিকয় মার্সিডিস বেঞ্চের মালিকের মধ্যে একজন। মার্সিডিজ এর পেছনে ক্যারাভ্যান লাগিয়ে তিনি চলে যান আউটিং এ। এমন ব্যাপার নেহাতই অভিনব তখন ঢাকায়। তবে বিশাল অর্থ সম্পত্তির মালিক হয়েও মিন্টু ভাই এর গোপন কাজ হচ্ছে বামপন্থী জঙ্গি দলগুলোকে সহায়তা করা। ধানমন্ত্রি বাসা ভাড়া, বিস্ফোরক কেনার পয়সা সব দেন তিনি। আনোয়ার খোঁজ পান জয়পুরহাটের খঞ্জনপুরে পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভের আড়াই হাজার পাউন্ড জিলেনাইট প্লাস্টিক বিস্ফোরক মজুদ আছে। মিন্টু ভাই, বেবী ভাইয়ের সহায়তায় ঐ জিলেনাইটগুলো দখল করার পরিকল্পনা করেন আনোয়ার। খঞ্জনপুরে যাবার তারিখ ঠিক করা হয় ২৫ মার্চ।
কিন্তু সবার সব হিসাব এলোমেলো করে সেদিনই বদলে যায় বাংলাদেশের ইতিহাস। সে রাতে পাকবাহিনীর সেই তাণ্ডব যখন শুরু হয়েছে আনোয়ার তখন তার সূর্যসেন স্কোয়াডের আরও কয়েকজন ছেলেদের নিয়ে ফজলুল হক হলে। তাদের সঙ্গে কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড। সারারাত তারা শোনেন প্রচণ্ড গোলাগুলি, লাগাতার বিস্ফোরণ আর থেমে থেমে মানুষের আর্তচিৎকার। আনোয়ার তার সঙ্গীদের নিয়ে গ্রেনেড হাতে অবস্থান নেন হলের ছাদে। নির্ঘুম কাটে তাদের সারারাত। ভোরের দিকে পরিস্থিতি বোঝার জন্যে হল থেকে বের হলে দেখেন চারপাশে ভূতুড়ে পরিবেশ, আশপাশে মানুষ জনের কোনো চিহ্ন নেই। আবার হলে ফিরে আসেন আনোয়ার। দূর থেকে শহীদুল্লাহ হলে প্রচণ্ড শব্দে কামানের গোলা এসে পড়তে দেখেন তারা। কিছুক্ষণ পর এক দল পাক সেনা তাদের হলে ঢুকবার চেষ্টা করে। ফজলুল হক হলের উর্দুভাষী দারোয়ান মিলিটারিদের নানা কথা বলে বোঝাতে সক্ষম হয় যে হলের ভেতর কেউ নেই। চলে যায় পাক সেনারা, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে যেন বেঁচে যান আনোয়ার আর তার সঙ্গীরা।
সে-রাতে সাঈদ ধানমণ্ডির সেই বাসায় বিস্ফোরক পাহারা দিচ্ছেন। মাঝ রাতে গোলাগুলির শব্দে, মানুষের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় তার বাইরে এসে দেখবার চেষ্টা করেন। কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। আকাশে শুধু কামানের গোলার আলোর হলকা। ধানমণ্ডির ঐ বাড়ির মালিক পাকিস্তানপন্থী। তিনি এসে সাঈদকে হুমকি দেন সকালের মধ্যে সব বিস্ফোরক সরিয়ে না ফেললে তাকে পাক আর্মির কাছে তিনি ধরিয়ে দেবেন। নিরাপত্তার স্বার্থে নিজের কাছে সবসময় একটি পিস্তল রাখেন সাঈদ। ক্ষেপে গিয়ে সে পিস্তুল সাঈদ বাড়িওয়ালার মাথায় ঠেকিয়ে বলেন, আর একটা কথা বলবি তো খুলি উড়াইয়া দিমু। অনিশ্চিয়তায় সাঈদ সারারাত জেগে ভোরের অপেক্ষা করতে থাকেন। সাঈদও টের পান তাদের এসেম্বলি উড়িয়ে দেবার হিসাবে কোথাও গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
সকালে কারফিউ শিথিল হলে আনোয়ার রওনা দেন সাঈদের কাছে। দেখেন রাস্তায় পড়ে আছে লাশ, রাস্তার দুপাশে আগুনে পোড়া ঘরবাড়ি। ধ্বংসের চিহ্ন চারদিকে। কিছু দূর পর পর আর্মির ট্রাক। শহরের ঐ ভীতিকর রাস্তা পেরিয়ে আনোয়ার পৌঁছান সাঈদের কাছে। তারা সিদ্ধান্ত নেন চলে যাবেন বুড়িগঙ্গার ওপারে, ঠিক করেন তাদের বানানো বোমা এবং বোমার সরঞ্জামগুলোও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ধানমণ্ডির বিস্ফোরকগুলো নদী পার করবার জন্য এগিয়ে আসেন মিন্টু ভাই। তিনি তার মার্সিডিজের বনেটে বিস্ফোরকগুলো নিয়ে চলে যান সেনা টহলের মাঝ দিয়েই। এক সৈনিক তাকে গাড়ি থামাতে বললে উর্দুতে ধমক দেন তিনি। বিলাস বহুল গাড়ি আর অভিজাত হুমকিতে ভঙকে যায় সেই সৈনিক, ছেড়ে দেয়। গাড়ি। একই ভাবে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে শহরের ভেতরেই চালের বস্তা আর লেপের ভেতর দিয়ে কিছু মজুত অস্ত্র আনোয়ারের কাছে পাচার করেন বেবী ভাই। বেবী ভাইয়ের রিকশা থামালে তিনিও পাক সেনাদের ভড়কে দেন নাটকীয়ভাবে তার কাটা দুই হাতের গল্প বলে।
বুড়িগঙ্গা পাড় হয়ে ওপারে চলে যান আনোয়ার আর সাঈদ। বুড়িগঙ্গার বুকে সেদিন অভূতপূর্ব দৃশ্য। মানুষ স্রোতের মতো নদী পার হচ্ছে। দলে দলে মানুষ পালাচ্ছে ঢাকা ছেড়ে। কেরানিগঞ্জে এক পরিচিতের বাড়িতে গুলি, বন্দুক আর বিস্ফোরকগুলো রেখে আনোয়ার এবং সাইদ রওনা দেন ময়মনসিংহের পথে। টাঙ্গাইল হয়ে পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে বেশ কদিন ধরে যাত্রার পর তাঁরা পৌঁছান শ্যামগঞ্জের কাজলায়।
আরেক ভাই বেলাল তখন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে। ৭১-এর মার্চে অন্যান্য জায়গার মতো নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজেও নানারকম প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছে। সে প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে যুক্ত বেলাল। ২৫ মার্চ রাত্রে পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠলে তোলারাম কলেজের ছাত্ররা একটা বিশাল রেলের বগি নিয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রোডের মাঝে ফেলে ব্যারিকেড দেয়। সেই বগি সরানোতে আছে বেলালেরও হাত ঐ রেল বগির কারণে সে রাতে পাকিস্তান আমি ঢুকতে পারেনি নারায়ণগঞ্জে। এর আগে ছাত্ররা নারায়ণগঞ্জের রাইফেল ক্লাব। ভেঙ্গে সেখানকার সব রাইফেলগুলোও নিয়ে নেয় নিজেদের দখলে। তবে ২৫ মার্চ ঠেকাতে পারলেও পরদিন পাকিস্তানি আর্মি ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢোকে নারায়ণগঞ্জে। তারা ফায়ার করতে করতে, পথে পথে অগণিত মানুষকে হত্যা করতে করতে এগিয়ে যায়। ভয় পেয়ে পিছু হটে যায় সবাই পিছু হটেন বেলালও। নানা ঘোরা পথে নারায়ণগঞ্জ থেকে বেরিয়ে তিনি চলে যান কাছের গ্রাম নিতাইগঞ্জে। দুদিন গ্রামে লুকিয়ে থাকার পর অবস্থা বুঝবার জন্য বেলাল নিতাইগঞ্জ থেকে একটি সাইকেল নিয়ে রওনা দেন ঢাকার দিকে।
প্ৰথমে যান মোহাম্মদপুরে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামীমের বাসায়। দেখেন বিরান বাড়ি, আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে। শোনেন বিহারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িটি। মেরে ফেলেছে ওদের বাবা সলিমুল্লাহ সাহেবকেও। বহু বছর পর শামীমের দুই ভাই সাদী আর শিবলী যখন স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গীত আর নাচে নাম কুড়াচ্ছেন তখন বেলালের চোখে থেকে থেকে ভেসে ওঠে সেই পোড়া বাড়ি। বাড়িটার কাছেই তাকে দেখে এক বিহারী চিৎকার করে বলে, ইধার ছে ভাগ যা, আভি ইধার ছে ভাগ যা। বেলাল দ্রুত সাইকেল নিয়ে রওনা দেন খেজুরবাগানে তার আরেক বন্ধু কাশেমের বাড়ি। কিন্তু সেখানেও চারদিকে শুনসান। বাড়ির সিঁড়িতে রক্ত, ঘরের ভেতরে কেউ নেই। বন্ধু কাশেমকে খুঁজে পান না বেলাল। যেন অচেনা এক দৈত্যপুরীতে সাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছে এক উদ্ভ্রান্ত যুবক। জন মানব নেই, আছে রক্ত, আছে আগুন।
ঐ মৃত প্রেতনগরীর ভয়ঙ্কর রুপ দেখে দ্রুত আবার নারায়ণগঞ্জে ফিরে যান বেলাল। ঠিক করেন চলে যাবেন ময়মনসিংহ। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকেন। দূর পাল্লার কোনো যানবাহন চলছে না। হঠাৎ ময়মনসিংহের একটি বাস পাওয়া যায়। বাসে উঠে পড়েন বেলাল। মধুপুরের কাছে আসতেই পাকিস্তানিরা বাস থামায়। বাস থামিয়ে চেক করা তখন মিলিটারিদের নৈমিত্তিক কাজ। কাউকে সন্দেহ হলে সেখানেই গুলি করে হত্যা করে তারা। বেলালদের বাস থেকেও সবাইকে নামানো হয়, লাইন করে দাঁড়ায় সবাই। বেলালের দিকে তাকিয়ে সুবেদার বলে, আপ কিধার যাতা হায়? ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দুতে বেলাল জানান তিনি ময়মনসিংহ যাচ্ছেন। বুক শুকিয়ে আসে তার। বাঁচার তাগিদ শুভবুদ্ধির যোগান দেয় মানুষকে। হঠাৎ বেলাল সুবেদারকে বলেন, মেরা ভাই পাকিস্তান আর্মিকা মেজর হ্যায়। সুবেদার জানতে চায় কোথাকার মেজর? বেলাল বলেন, বেলুচ রেজিমেন্ট কা মেজর।
বেলাল তার ভাই মেজর তাহেরের পরিচয় দেন। এতে কাজ হয়। সুবেদার বেলালকে বেশ মর্যাদা দিতে থাকে। সে তাকে বাসে উঠে যেতে বলে এবং কোথাও কেউ আটকালে তার ভাই যে পাকিস্থান আর্মির মেজর সে কথা যেন বলে সেটি স্মরণ করিয়ে দেয়। সারা পথ আতঙ্কে থাকে বেলাল। আতঙ্ক তখন ছায়ার মতো ঢেকে রেখেছে বাংলাদেশের মানচিত্র। একসময় ময়মনসিংহ নামে বেলাল। দেখে চারদিকে নিস্তব্ধ। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহ শহরে ঘটে গেছে বীভৎস এক হত্যালীলা। বাঙালিরা হত্যা করেছে অসংখা বিহারীদের। বিহারীদের নিরাপত্তা দিতে এসে পাকবাহিনী পুরো ময়মনসিংহ শহর দখল করে নিয়েছে এবং নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে বাঙালিদের। অবস্থা তখন এমন যে কোনো ছোট বিহারী শিশু যদি কোনো বাঙালির দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে পাক আর্মিকে বলে, উও লোক মেরা বাপকো মারা হ্যায়। ব্যাস্ সাথে সাথে ঐ জায়গাতেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলছে পাকিস্তান আর্মি। ভীতির চাদর মোড়ানো ময়মনসিংহ শহর সন্তর্পণে পাড়ি দিয়ে বেলালও একসময় পৌঁছে যায় শ্যামগঞ্জের কাজলায়। এভাবেই মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে আশরাফুন্নেসার ছেলেরা এক এক করে পৌঁছায় কাজলায়।
ইতোমধ্যেই কাজলার বাড়ি ভরে গেছে নানা প্রান্ত থেকে পালিয়ে আসা ছেলেমেয়েদের ভিড়ে। সেই ভিড়ে নিজের ছেলেদেরও দেখে স্বস্তি আসে আশরাফুন্নেসার।
বাহার নেত্রকোণা থেকে সবার আগেই চলে এসেছিল কাজলায়। নেত্রকোণা কলেজ থেকে সেবার ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছেন তিনি। কাছেই মধুপুরের ইপিআর এর সৈনারা এর মধ্যেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে এবং বাহার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পেয়ে গেছেন রাইফেল। চোরাগোপ্তা প্রতিরোধে ইতোমধ্যেই অংশ নিতে শুরু করেছেন তিনি। ভাইদের মধ্যে তখন কেবল বাহারের হাতেই অস্ত্র। সবচেয়ে সুদর্শন, সাহসী বাহার তখন বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া তরুণীদের মুগ্ধ চোখের সামনে রাইফেল কাঁধে নিয়ে প্রতিদিন সকালে চলে যান অপারেশনে, সন্ধ্যায় ফেরেন বীরের মতো। ঘরে ফিরে নানা বীরোচিত কাণ্ড করে নজর কাড়েন সবার। একদিন বাহার উঠানের মাঝখানের কুয়াটিতে খালি হাতে, দু হাত আর দুপায়ে দুদিকের দেয়ালে ভর রেখে নেমে যান নিচে আবার উঠে আসেন উপরে। কুয়ার মুখের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা হাততালি দিয়ে ওঠে। পিঠেপিঠে ভাই বেলাল বলে; মার্কেট তো পুরাটা তুই দখল করলি, আমাদের আর কোনো চান্স নাই।
তাহের তখনও কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে নজরবন্দি হয়ে আছেন। তাদের বড় ভাই আরিফও তখন ইসলামাবাদে আর ইউসুফ চাকরিসূত্রে সৌদি আরব। এরা সবাই অচিরেই এসে যোগ দেবেন ইতিহাসের এই যজ্ঞে। আর তাহের হয়ে উঠবেন এর অন্যতম এক কুশীলব।
২০. একটি ডাকোটা বিমান, একজন অনন্য মানুষ
তেলিয়াপাড়ার চা বাগানে বাঙালি আর্মি অফিসাররা যখন যুদ্ধের সামরিক দিকটি পর্যালোচনা করছেন তখন শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে এর রাজনৈতিক দিকটি সামাল দেবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ। খানিকটা অন্তর্মুখী, প্রচারবিমুখ এই মানুষটি পাকিস্তান বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে দীর্ঘদিন ছিলেন শেখ মুজিবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী। জুলফিকার আলী ভুট্টো একবার তার এক সহচরকে বলেছিলেন, আলোচনার টেবিলে শেখ মুজিবের পেছনে ফাঁইল হাতে যে নটরিয়াস লোকটি চুপচাপ বসে থাকে তাকে কাবু করা খুব শক্ত, দিস তাজউদ্দীন … আই টেল ইউ, উইল বি এ বিগ প্রবলেম, হি ইজ ভেরি থরো।
২৫ মার্চের সন্ধ্যাতেও তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন ঢাকার শহরতলীতে কোথাও লুকিয়ে থাকতে যাতে সময়মতো আবার তারা মিলিত হতে পারেন। ২৫ মার্চ মাঝ রাত থেকে প্রবল গোলাগুলি শুরু হলে তাজউদ্দীন আর শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাননি। পরদিন পাকিস্তানিদের তাণ্ডবের মধ্যে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতার সঙ্গেও আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি তার। এরপর তরুণ সহকর্মী পরবর্তীকালের আইনজীবী আমিরুল ইসলামকে নিয়ে তাজউদ্দীন রওনা দেন ভারতের পথে। পায়ে হেঁটে, নৌকায়, গাড়িতে, কখনো ঘোড়ায় চড়ে খাল, বিল, নদী পেরিয়ে চাকা, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা হয়ে দুজনে পৌঁছান পশ্চিমবঙ্গে।
ভারত সরকারের সীমান্তরক্ষী বাঙালি কর্মকর্তা গোলক মজুমদার একদিন গুনলেন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা কুষ্টিয়ার মেহেরপুর এলাকায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন তিনি সম্ভবত শেখ মুজিবর রহমান স্বয়ং! গোলক মজুমদার কলকাতা থেকে সারাদিন জার্নি করে নদিয়া জেলার টুঙ্গি সীমান্তে এসে পৌঁছলেন এই নেতাকে দেখবার জন্যে। গিয়ে দেখলেন সেখানে শেখ মুজিব নেই বরং তার সাথে দেখা হলো ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরা, ক্লান্ত মুখের চার পাঁচ দিনের দাড়ি গোঁফ, রবারের ছেড়া চটি পায়ে দুজন লোক। জানতে পারলেন এদের একজনের নাম তাজুউদ্দীন আহমেদ অন্যজন আমিরুল ইসলাম।
গোলক মজুমদারের সহায়তাতেই তাজউদ্দীন দেখা করেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজউদ্দিন সামরিক সাহায্য চান, চান গোলা বারুদ অস্ত্রশস্ত্র, চান দীর্ঘমেয়াদী একটি যুদ্ধের জন্য সাধারণ বাঙালিদের সামরিক প্রশিক্ষণ এবং সীমান্ত পার হয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য ভারতে নিরাপদ আশ্রয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও বাংলাদেশের কোনো সরকার নেই তবু তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় দেন।
ভারত সরকার নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল। তাদের দরকার ছিল বাংলাদেশের কোনো যোগ্য প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ। ইন্দিরা সবকটির ব্যাপারে বাংলাদেশকে পূর্ণ সহায়তা দেবেন বলে জানান। পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের সঙ্গে কাশ্মীরসহ অনান্য সমস্যাসমেত ভারতের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। ভৌগোলিক রাজনৈতিক স্বার্থ আর মানবিক দিক বিবেচনা করে ভারত তাই অনায়াসেই দাঁড়ায় বাংলাদেশের পাশে।
তাজউদ্দীন ইন্দিরার কাছে সবুজ সংকেত পেয়ে দ্রুত ফিরে আসেন কলকাতায়। ফিরেই দুটি কাজ করা খুব জরুরি মনে করলেন তিনি, এক, দেশের মানুষের উদ্দেশে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে একটা ভাষণ দেওয়া এবং শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে একটা অস্থায়ী সরকার গঠন করা। কলকাতায় ফিরে তার সঙ্গে দেখা হয় অর্থনীতিবিদ রেহমান সোহান এবং আনিসুর রহমানের সঙ্গে।
তাঁদের কাছ থেকেও শুনতে পান ঢাকার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা, জানতে পারেন ড. কামাল হোসেনের গ্রেফতারের খবর। আমিরুল ইসলাম এবং রেহমান সোবহানের সহায়তায় তাজউদ্দীন একটি বক্তৃতা তৈরি করেন, যেখানে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে দেশবাসীকে নানা রকম নির্দেশ দেন। শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হতে থাকে সেই বক্তৃতা।
কিন্তু তাজউদ্দীন তখনও জানেন না তার সহকর্মীরা কে কোথায় আছেন। প্রাথমিক কাজের জন্য ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে একটি ছোট ভাকোটা বিমান দেন। কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে ঐ ছোট বিমানে চড়ে তাজউদ্দীন বেড়িয়ে পড়েন অন্য নেতাদের খোঁজে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত বরাবর আকাশ পথে খুঁজতে বেরোন তার সতীর্থদের। খুব নিচু দিয়ে চলে বিমান। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেটের সীমান্তের কাছে মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা, শিলচর প্রভৃতি ভারতীয় এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত রানওয়েগুলোতে নামে সেই বিমান। তাজউদ্দীন খোঁজ করেন বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সেখানে এসেছেন কিনা। তিনি পেয়ে যান মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, ওসমানী প্রমুখ নেতাদের। বিমানে চড়ে আকাশে আকাশে ঘুরে যুদ্ধ আক্রান্ত একটি দেশের সরকার গঠন করবার চেষ্টা করতে থাকেন শেখ মুজিবের পেছনে সবসময় ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নটোরিয়াস লোকটি।
বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়ো করে তাজউদ্দীন কলকাতায় মিটিং ডাকেন। কলকাতার লর্ড সিনহা রোডের সেই মিটিংয়ে তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আলাপের বিষয়টিকে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে জানান। অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া পান তিনি।
তরুণ নেতা শেখ মণি বলে উঠেন, আপনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিলেন কেন? আপনাকে কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে? এটা কি মন্ত্রী মন্ত্রী খেলার সময়?
অপ্রস্তুত হন তাজউদ্দীন। তবে একেবারে অবাক নন। তাজউদ্দীন বেশ জানেন শেখ মণি প্রভাবশালী তরুণ নেতা, শেখ মুজিবের আত্মীয়, প্রিয়ভাজন। তিনি এও খোঁজ পেয়েছেন যে, শেখ মণি তার সহযোগী তরুণ ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ ভারতে এসে তাজউদ্দীনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করে স্বতন্ত্রভাবে মুজিববাহিনী নামে এক সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলবার উদ্যোগ নিয়েছেন। শেখ মণি আরও বলেন, এখন যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে এবং একটা বিপ্লবী পরিষদ তৈরি করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ রকম নির্দেশই দিয়ে গেছেন আমাকে।
বিরক্ত, মর্মহত হলেন তাজউদ্দীন কি শান্তকণ্ঠে ঐ ক্রান্তিকালে ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনার স্বার্থে একটি আইনগত সরকার প্রতিষ্ঠার শুরুত্বের কথা বললেন এবং সে প্রেক্ষিতে ইন্দিরার সাথে তার আলাপের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করলেন। এ নিয়ে আলাপ চলল দীর্ঘক্ষণ এবং বৈঠকে শেষ পর্যনত অধিকাংশ নেতাই তাজউদ্দীনের বক্তব্যকে মেনে নিলেন। মানলেন না শুধু একজন, শেখ মণি।
অসন্তুষ্ট মণিকে পেছনে রেখে কলকাতা থেকে সেই ছোট ডাকোটা বিমানে চড়েই এবার তাজউদ্দীন চলে গেলেন আগরতলায়। আগরতলায় গিয়ে তাজউদ্দীন খুঁজে পেলেন মিজান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রমুখ নেতাদের। মিটিং এ বসলেন তাদের নিয়েও। অন্যান্য নেতারা ইন্দিরার সঙ্গে তাজউদ্দীনের আলাপটিকে স্বাগত জানালেও এখানেও ব্যতিক্রম একজন। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা যিনি সব সময় আচকান এবং টুপি পড়ে থাকেন।
তাঁর প্রতিবাদটি নাটকীয়। মিটিংয়ের মাঝখানে তিনি হঠাৎ বলে উঠেন, আমাকে তোমরা সবাই মক্কায় পাঠিয়ে দাও, আমি সেখানেই মারা যাবো। আমি মারা গেলে আমার লাশ তোমরা পাঠিয়ে দিও বাংলাদেশে। সবাই অবাক। বোঝার চেষ্টা করছেন কি ব্যাপার। কিন্তু খন্দকার মোশতাক তেমন কিছুই বলেন না। পরে তিনি তার এক ঘনিষ্ঠ জনের মাধ্যমে জানান যে, তিনি তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব ঘোষণায় ক্ষুদ্ধ। কারণ তিনি মনে করেন সিনিয়র হিসাবে প্রধানমন্ত্রি হওয়া উচিত তারই। এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আবার। বাংলাদেশের নতুন মন্ত্রিসভায় তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে এই শর্তে খন্দকার মোশতাক তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি হন।
লক্ষ রাখা দরকার বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠার সেই ভ্ৰণাবস্থায় বিভক্তির বীজ বপন করলেন দুজন মানুষ–শেখ মণি এবং খন্দকার মোশতাক। এর তাৎপর্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে ভবিষ্যত বাংলাদেশে।
তাজউদ্দীন এগিয়ে চললেন তার পরিকল্পনা নিয়ে। সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলাদেশ নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ এবং স্বাধীনতার সনদ পাঠ অনুষ্ঠান তিনি করবেন বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে কোনো জায়গায়। বাংলাদেশে প্রায় সব অঞ্চলই তখন চলে গেছে পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণে। শেষ পর্যন্ত খুঁজে সীমান্তের কাছাকাছি কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামটিকে নির্বাচন করা হলো অনুষ্ঠানের স্থান হিসেবে। সিদ্ধান্ত হলো ১৭ এপ্রিল হবে অনুষ্ঠান। গোপনীয়তার সাথে শপথ অনুষ্ঠানের খুটিনাটি প্রস্তুতি নিতে থাকলেন তাজউদ্দীন, আমিরুল ইসলাম প্রমুখেরা। শেষ মুহূর্তে হঠাৎ আৰিকৃত হলো যদিও কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কিন্তু তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন, ফলে তার কোনো সামরিক পোশাক নেই। কিন্তু শপথের অনুষ্ঠানে যুদ্ধের সর্বাধিনায়কের একটা সামরিক পোশ থাকবে না তা কেমন করে হয়? ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে ঘেঁজ করা হলো। কিন্তু কর্নেল ওসমানী শুকনো মানুষ তার মাপ মতো কোনো ভারতীয় অফিসারের পোশাক পাওয়া গেলো না। শেষে অনেক রাতে কাপড় কিনে দর্জি ডেকে কর্নেল ওসমানীর সামরিক পোশাক বানানো হলো।
সূর্য উঠবার আগেই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সব সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হলো বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে। কয়েকটা সাধারণ চৌকি একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। মঞ্চে তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আমহেদ, এম মনসুর আলী, এইচ এম কামরুজ্জামন, কর্নেল ওসমানী। সবার পরনে সাদা পাঞ্জাবি শুধু একজন ছাড়া, যিনি যথারীতি পরে আছেন কালো আচকান আর টুপি। তাড়াতাড়ি করে অনুষ্ঠান শুরু করা হলো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অফ অনার প্রদান করার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী পাঠ করলেন স্বাধীনতার সনদ। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমেদ ভাষণ দিলেন উপস্থিত সাংবাদিক এবং জনগণের উদ্দেশে। তাজউদ্দীন তাৎক্ষণিকভাবে বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করলেন এবং ঐ এলাকাটিকে অস্থায়ীভাবে ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে। আমবাগানের সে অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও জড়ো হয়েছেন পার্শ্ববর্তী গ্রামের শত শত লোক। চারদিকে আওয়াজ ওঠে জয় বাংলা, বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো শ্লোগান। দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে দুপুরের মধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ সবাই ঐ জায়গা ত্যাগ করলেন। বৈদ্যনাথতলার আমবাগানের আম গাছে সেদিন কোনো আম নেই। আমবিহীন ঐ গাছ গুলো সাক্ষী হয়ে রইল একটি নতুন দেশের প্রথম সরকার ঘোষণার ঐতিহাসিক মুহূর্তটির।