এতদিনে চিত্রলেখা উঠিয়া পড়িয়া লাগে মেয়ে-ছেলেদের সুশিক্ষিত করিয়া তুলিতে। সদ্য দেখিয়া আসা সেজকাকীর ও তস্য ভগিনীর ছেলেমেয়েদের দৃষ্টান্ত তো আছেই, তাছাড়া আছে চিরদিনের স্বপ্নসাধ । শাশুড়ীর জ্বালায় যেটা সম্পূর্ণ বিকশিত হইতে পায় নাই।
গভীর রাত্রে রাত্রি জাগিয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে-না প্রেমালাপ নয়–তর্ক হইতেছিল।
–চিত্রলেখার স্বর স্বভাব-অনুযায়ী তীক্ষ্ণ অসহিষ্ণু, মণীন্দ্র গম্ভীর কিন্তু কতকটা যেন অসহায়। তর্কের বস্তু তাপসী। মণীন্দ্রর ধারণা–তাপসী ছেলেমানুষ হইলেও বিবাহ ব্যাপারটায় তার মনে হয়তো কিছুটা রেখাপাত করিয়াছে, সে রেখা সিঁথির সিঁদুর রেখার মত অত সহজে মুছিয়া ফেলা বোধ হয় সম্ভব নয়। চিত্রলেখার হিসাবে হয়তো ভুল আছে, মেয়েকে অতি আধুনিক করিয়া গড়িয়া তুলিয়া যথাসময়ে যথার্থ বিবাহের জন্য প্রস্তুত করিবার ইচ্ছাটা একটু যেন অসঙ্গত জেদের মত। কিন্তু চিত্রলেখার কথার উপর তেমন জোর দিয়া কথা বলার ক্ষমতা মণীন্দ্রর কই?
তাই দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বলেন–হয়তো শেষ পর্যন্ত সেই বিবাহটাকেই মেনে নিতে হবে। অবশ্য এখন নয়–যাক দু’চার বছর হয়তো ছেলেটা–
চিত্রলেখা এতক্ষণ নিজের খাটেই ছিল, কিন্তু এখন সঙ্গীন অবস্থায় অত দূর পাল্লা হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ কার্যকরী না হওয়ার আশঙ্কায় উঠয়া আসিয়া স্বামীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পড়িয়া স্বামীর বদলে বালিশের উপর একটি প্রবল চাপড়’ বসাইয়া তিক্ত তীক্ষ্ণ স্বরে বলে কী, সেই জোচ্চোরদের সঙ্গে আপস করে? তার চেয়ে মনে করব বেবি বিধবা, গোঁড়া হিন্দুঘরের বালবিধবা!
–ছি চিত্রা!
–ছি আবার কিসের? আমার কাছে এই সাফ কথা। তোমাদের সেই পুতুলখেলার বিয়ের বর যদি রাজপুত্তুরও হয়, সে বিয়ে আমি মানব না, মানব না, মানব না। তোমার মা’র স্বেচ্ছাচারিতার কাছে কিছুতেই হার মানব না।
–দেখ, মা’র হয়ে ওকালতি করতে চাইছি না আমি, কিন্তু ভেবে দেখ, বেবির মনের ওপর যদি এর কোন প্রভাব পড়ে থাকে–
–তোমার কথা শুনলে আমার সুইসাইড করতে ইচ্ছে করে। ওইটুকু একটা বাচ্ছা– দুধের শিশু বললেও হয়, দুনিয়ার কিছুই যে জানে না–তার বিষয়ে এসব কথা ভাবো কি করে তাই আশ্চর্য! ওর আবার মন, তার ওপর আবার প্রভাব! একটা চকোলেটের ভাগ নিয়ে অভীর সঙ্গে বাবলুর সঙ্গে খুনসুড়ি করে
–তা করুক। শুনতে পাই–পৃথিবীতে আমার শুভ জন্মদিনে আমার মা সারাদিন নাকি কেঁদেছিলেন একটি মাটির পুতুলের বিয়োগ-ব্যথায়।
–থাক থাক, প্রত্যেক বিষয়ে তোমার মা’র উদাহরণ শোনবার শখ আমার নেই। ওঁদের আমলের মত অকালপক্ক ছেলেমেয়ে এখনকার নয়। নিশ্চয় জেনো, সেই বাজে ব্যাপারটা বেবি মোটেই মনে করে নেই। এবং যাতে আর কখনো মনে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাকে।–যাক সে কথা, বেবির জন্যে যে টিউটরের কথা বলেছিলাম তার কি করছ? ম্যাথমেটিকসে কি যাচ্ছেতাই কাঁচা ও তার খেয়াল রাখ?
–খেয়াল! আমি আর কি রাখব? তুমিই তো কিন্তু কি যেন নাম ভদ্রলোকের হিমাংশু বুঝি, তা তিনি কি আর পড়াবেন না?
–আঃ, তোমার সঙ্গে কথা কওয়া একটা বিরক্তিকর ব্যাপার! সেদিন অত কথা বললাম, সব ভুলে গেছ! হিমাংশুবাবু ইংলিশটা ছাড়া আর কিছু ভালো করে দেখেন না। অবশ্য সেইটাই প্রধান তা জানি, কিন্তু কোন কিছুতেই কঁচা থাকবে তা চাই না আমি।
–বেশ তো, ওঁকে নয় বলে দেখব সপ্তাহে চারদিন না এসে যদি ছ’দিন অন্ততঃ আসেন। অবশ্য ‘পে’টা কিছু বাড়াতে হবে–
-না।
–না মানে?
–‘না’ মানে না। ওর আর কোন মানে নেই। ছোটলোকের মত যে একই টিউটর ইংলিশ দেখবে–ম্যাথমেটিকস্ দেখবে–হিস্ত্রী, জিওগ্রাফী, বেঙ্গলী, গ্রামার সবই দেখবে–এটা আমার জঘন্য লাগে। তাহলে বাবলু অভীরই বা আলাদা টিউটরের দরকার কি–সাধারণ কেরানী বাড়ীর মত একটা টিউটর এসে তিনজনকে ধরে সবগুলো সাবজেক্টের মিক্সচার খানিকটা গিলিয়ে দিয়ে গেলেই চমৎকার হয়!
–সে কথা হচ্ছে না। মণীন্দ্র হতাশ ভঙ্গীতে বলেন–ও বেচারা আর কখন সময় পাবে? সপ্তাহের মধ্যে তিনদিন তো তোমার গান-বাজনা-এস্রাজ আর ডান্সিং মাস্টারের নিষ্ঠুরতা–বাকি চারদিন তো হিমাংশুবাবুই আছেন। সপ্তাহটা তো রবারের নয় যে টেনেটুনে বাড়িয়ে নেবে।
–কেন, সকালে? রুটিন হিসেবে চললে অনায়াসেই এক ঘণ্টা করে সময় বের করা যায়! –সকালে? আহা!
–এই সব বাজে সেন্টিমেন্টের কোন মানে হয় না। আহা কিসের? এই তো শিক্ষার সময়। জগতে যা কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে সবগুলোই দেখতে হবে চেষ্টা করে। এত সুযোগ থাকতে
মণীন্দ্রনাথ মনে মনে বলেন–নিজের জীবনের সুযোগের অভাবই বোধ করি তোমাকে এমন জ্ঞানী করিয়া তুলিয়াছে! মুখে বলিতে সাহস পান না, শুধু ভাবিতে চেষ্টা করেন চিত্রলেখার ভাগ্যে সে সুযোগ ঘটিলে মণীন্দ্রর নিজের ভাগ্যে কি ঘটিত!
.
মেয়েকে সর্ববিদ্যা-পটিয়সী করিয়া তুলিবার দুরন্ত সাধনায় মেয়ের জীবনটা চিত্রলেখা দুঃসহ করিয়া তুলিয়াছে বলিয়া ভারি একটা ক্ষোভ ছিল মণীন্দ্রর, কিন্তু সহসা একদিন মেয়েরই এক নূতনতর আবদারে তাক লাগিয়া গেল তাঁহার। সপ্তাহের সব কয়টা দিনকে রবারের মত টানিয়া। টুনিয়া বাড়াইবার অপূর্ব কৌশল আয়ত্ত করিলেও, রবিবারের সকালটাকে উদার ঔদাসীন্যে বাদ দিয়া রাখিয়াছিল চিত্রলেখা। সেই দুর্লভ ক্ষণটুকুকেও কাজে লাগাইবার বায়না লইয়া বাবার দরবারে আসিয়া হাজির হইল বেবি।
মায়ের কাছে তাহার সব বিষয়েই কুণ্ঠা, বাবার কাছে নিশ্চিত প্রশ্রয়ের নিশ্চিন্ত। অতএব জগতের যাবতীয় শিক্ষণীয় বস্তু সম্বন্ধে মায়ের যতই উৎসাহ থাক, বেবি আসিয়া বাবাকেই ধরিয়া পড়িল–সে গাড়ী চালানো শিখিবে।
মেয়ের অভিনব ইচ্ছায় সস্নেহ হাসি হাসিয়া মণীন্দ্র কহিলেন–কেন বলো তো? অক্ষয় রিটায়ার করতে চায় নাকি?
তাপসী হাসিয়া বাবার চেয়ার ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া বলে–বাঃ, তা কেন? শিখে রাখা ভাল নয় বুঝি? মোটর-ড্রাইভিং শেখে না মানুষ?
বলা বাহুল্য, বাবার দরবারে আবেদন করিবার কালে একটু নির্জন অবসরের জন্য যতই চেষ্টা করুক বেচারা, অমিতাভ তাহার সঙ্গ ছাড়ে নাই। দিদির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিতান্ত অবজ্ঞাভরে বলিয়া উঠে–মানুষরা শেখে নিশ্চয়ই, দরকারও আছে শিখে রাখবার, মেয়েমানুষে শিখতে যাবে কি জন্যে?
–অভী, আবার? তীব্র নয়নে অগ্নি হানিয়া দিদি সরোষে বাবার কাছে অভিযোগ করে বাবা দেখছ? অভী আবার আমাকে মেয়েমানুষ’ বলে ঠাট্টা করছে।
অর্থাৎ বোঝা যায় ঠাট্টাটা পূর্ব-নিষিদ্ধ।
কিন্তু অমিতাভ কিছুমাত্র দমে না। সজোরে বলে–যে যা, তাকে তাই বললে ঠাট্টা হয় বুঝি? আমাকে ‘পুরুষমানুষ’ বলো না, কিছুই রাগ করব না আমি। যা সত্যি তা বলতে দোষের কি আছে?
তাপসী নিরুপায় আক্রোশে উত্তেজিত হইয়া বলে–কেন থাকবে না? কানাকে ‘কানা’ বললে দোষ হয় না? খোঁড়াকে ‘খোঁড়া’ বললে দোষ হয় না? গরীবকে–
অমিতাভর সহসা সশব্দ হাসিতে সব উদাহরণগুলা আর দাখিল করা সম্ভব হয় না তাপসীর পক্ষে।
মণীন্দ্রও অবশ্য মেয়ের যুক্তির মৌলিকত্বে হাসিয়া ফেলিয়াছেন, তবু দুর্বলের পক্ষগ্রহণ নীতির বশে ছেলের হাসির প্রতিবাদ করেন–বা রে অভী, হাসছ কেন তুমি? ঠিকই তো বলেছে বেবি। মেয়েদের ‘মেয়ে’ বললে তোমার মা চটেন না?
–মা তো সবতাতেই চটেন। মা’র কথা বাদ দাও…মা সম্বন্ধে এই নির্ভীক মন্তব্যটি উচ্চারণ করিয়া অমিতাভ নিতান্ত বিচক্ষণের মত বলে–আমি শুধু বলছি, দিদি এই বুদ্ধি নিয়ে গাড়ী চালালে প্রত্যেক দিনই তো অ্যাসিডেন্ট ঘটাবে!
–কেন রে শুনি? মেয়েদের গাড়ী চালাতে দেখিসনি কখনো? রোজ অ্যাসিডেন্ট করে তারা? তাপসী এবার নিজেই হাল ধরে।
–তারা তোর মত হাঁদা মেয়ে নয়। তোর পক্ষে ওই পিড়িং পিড়িং সেতার বাজানো, আর ‘চিঁ চিঁ’ করে গান শেখাই ভালো।
মণীন্দ্র সকৌতুক হাস্যে ছেলেমেয়েদের এই বাগবিতণ্ডা উপভোগ করিতেছিলেন। এবার হাসিয়া বলেন–ওঃ, তাহলে অভীবাবুর মতে গান-বাজনা শেখা হাঁদাদের উপযুক্ত কাজ! আমার তো তা ধারণা ছিল না!
অভী বেকায়দায় পড়িয়া ঈষৎ অপ্রতিভভাবে বলে–তা কেন? দিদির মত মেয়ে আর কি করবে
–সবই করবে। মণীন্দ্র সস্নেহ গাম্ভীর্যে বলেন–ইচ্ছে করলে চেষ্টা থাকলে সবাই সব করতে পারে, বুঝলে অভী? মেয়ে ছেলে বলে তফাৎ করবার কিছু নেই। হয়তো এমন হতে পারে বেবি তোমার চাইতে ভালো ড্রাইভিং শিখবে!
অমিতাভ একটা অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া দিদির দিকে দৃষ্টিপাত করে। অর্থাৎ ওই আনন্দেই থাকো ‘!
মণীন্দ্র মেয়ের দিকে তাকাইয়া বলেন–কিন্তু সপ্তাহে তো ওই একবেলা মাত্র ছুটি তোমার, সেটুকুও খরচ করে ফেলতে চাইছ?
বেবি সোৎসাহে বলে–ও তো ছুটির মতই মজা, ছুটির চেয়েও ভালো। মাকে বলে-টলে ঠিক করে দাও না বাবা!
–হ্যাঁ, ওই একটা দিক আছে বটে। দেখি তিনি কি বলেন!
অমিতাভ নিশ্চিন্ত স্বরে বলে–কি আবার বলবেন, মা তো ওই চান, খালি ফ্যাশন শিখুক মেয়েটি। হ্যাঁ, যদি আমি বলতাম–তাহলে ঠিক বলতেন—’এখন তোমার লেখাপড়ার সময়, এখন ওসব থাক।’–নিজের কণ্ঠস্বরে মায়ের কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য নকল করিয়া হাসিয়া ওঠে।
-কিন্তু শেখাচ্ছে কে? অক্ষয়? রাজী হবে তো? মানে সময় হবে তার?
বেবি আগ্রহ-চঞ্চল স্বরে বলিয়া ওঠে–খুব খুব। অক্ষয়কে তো বলে-টলে ঠিক করে রেখেছি। শুধু মা’র মত হলেই
মাঝপথে কথা থামিয়া যায় স্বয়ং মাতৃদেবীর আবির্ভাবে। কথা থামাইয়া বাবার চেয়ারটার সঙ্গে আর একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়ায় তাপসী, ভীত-চঞ্চল দৃষ্টি মেলিয়া।
–কি? কিসের পরামর্শ হচ্ছে তোমাদের?
–বিশেষ কিছু না। মণীন্দ্র নিতান্ত লঘুভাবে বলেন–বেবির শখ হয়েছে গাড়ী চালাতে শিখবে, তাই–
চিত্রলেখা শ্লেষ-মিশ্রিত একটু হাসির সঙ্গে বলেন–তবু ভালল! তোমার মেয়ের শখ বলে জিনিসটা আছে তাহলে! আমি তো জানি সবই আমার শখে করতে হয়!..শেখাচ্ছে কে? তুমি নাকি?
–আমি? তবেই হয়েছে। অক্ষয় আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। ওই অক্ষয়ই শেখাবে। অবশ্য অভীর মতে–
–থাক থাক, বালক-বৃদ্ধ সকলের মতামত শোনবার সময় আমার নেই। আমি বলতে এসেছিলাম–
কথার মাঝখানে একঝলক কাল-বৈশাখী ঝড়ের মত ছুটিয়া আসে সিদ্ধার্থ–দাদা, দিদি, তোমরা এখানে? ওদিকে দেখগে যাও কি মজা হচ্ছে! অক্ষয় একটা পাখী ধরেছে–একদম সবুজ। কি সুন্দর লাল লাল পা! একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে এখন কঞ্চি দিয়ে খাঁচা বানাচ্ছে। আমি ধরছিলাম–তোমরা দেখতে পাবে না বলে একবারটি শুধু–আসবে তো এসো!
অমিতাভ অবশ্য ‘একদম সবুজ’ পর্যন্তও দাঁড়াইয়া শুনিবার অপেক্ষা রাখে নাই। সংবাদদাতার সংবাদ-দানকার্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই ঘটনাস্থল-উদ্দেশে দৌড়াইয়াছে। বেবিও নিজেকে সামলাইতে পারে নাই। সিদ্ধার্থর সঙ্গে সঙ্গে সেও প্রায় ছুটিয়া বাহির হইয়া যায়।
অক্ষয় ওদের অনেক দিনের লোক। অধস্তন ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করা চিত্রলেখার অত্যন্ত অপছন্দকর হইলেও অক্ষয় সম্বন্ধে ছেলেমেয়েদের ঠিক আঁটিয়া উঠিতে পারে না–”অক্ষয়টি হচ্ছে এদের দুষ্টু বুদ্ধির যোগানদার”–এর বেশী আর কিছু বলা হয় না। স্বামীর ঘরে আসিয়া পর্যন্ত অক্ষয়কে দেখিতেছে সে। স্বামীরও পুরনো লোক বলিয়া কেমন যে একটা সমীহ ভাব, দেখিলে হাসিও পায়, গাও জ্বালা করে। গ্রাম্য মনোভাব আর কি!
চিত্রলেখার ভাগ্যের সবদিকেই যেন কাঁটা ঘেরা। পাগড়ীধারী ছ’ফুট পাঞ্জাবী ড্রাইভার সম্বলিত গাড়ীর চেহারা কেমন আভিজাত্যপূর্ণ!…সে জায়গায় আধময়লা ছিটের শার্ট পরা বেঁটে খাটো অক্ষয়!
ছি!
স্ত্রীর মুখের উপরকার নানা বর্ণের খেলা বোধ করি মণীন্দ্রর চোখে পড়ে না। হালকা সুরে বলেন-বেবি ভাবনায় পড়েছে তোমার পাছে আপত্তি হয়। আপত্তির আর কি আছে, এ্যা! ছেলেমানুষের শখ–ক’দিন আর টিকবে?
মেয়ের হইয়া ওকালতির প্রয়োজন খুব বেশী ছিল না অবশ্য। চিত্রলেখার আপত্তি হইবার কথা নয়। তবে প্রস্তাবটা অপরপক্ষ হইতে আসায় বেশী উৎসাহ প্রকাশ করা যায় না এই যা। নিজে যে বিশেষ কিছুই শিখিতে পায় নাই, এই একটা দারুণ ক্ষোভ মাঝে মাঝে নিজের সন্তানদের উপরও কেমন যেন ঈর্ষান্বিত করিয়া তোলে।
বেবি ছুটিয়া বাহির হইয়া যাইবার পর অন্য একটা কথার ছুতা ধরিয়া স্বামীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করিয়া উঠিয়া যায় এবং মেয়ের এই শখের প্রস্তাবের স্বপক্ষেই বা কতটুকু রায় দেওয়া যায় এবং বিপক্ষেই বা কি কি যুক্তি দেখানো চলে, মনে মনে তাহার হিসাব করিতে থাকে।
স্বামীর সংসারে আসিয়া পর্যন্ত ক্রমাগত লড়াই করিতে করিতে স্বভাবটাই কেমন যেন ‘রণং দেহি’ গোছের হইয়া গিয়াছে তাহার। বুড়ী এক শাশুড়ী, আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্বামীর হাতে পড়িয়া জীবনটাই মিথ্যা হইয়া গেল!
বাহির হইতে মণীন্দ্রকে যতই অনুগত আর পত্নীসব দেখাক, আসলে যে সেটা কত ভুয়ো, চিত্রলেখার মত এমন মর্মান্তিক করিয়া আর কে জানে?
অথচ অদৃশ্য বস্তুর সঙ্গে লড়াই চলে না। মণীন্দ্রর বাহিরের ভঙ্গীটা নিতান্তই আত্মসমর্পণের ভঙ্গী। তাই না এত জ্বালা চিত্রলেখার!
মেয়েকে ‘চৌকস’ করিয়া তুলিবার সাধটা নিজেরই নিতান্ত প্রবল বলিয়া মেয়ের সাধের স্বপক্ষেই রায় দিতে হয় চিত্রলেখাকে। অবশ্য অনেকগুলি শর্তাধীনে নিমরাজী ভাব দেখাইয়া।
সম্মতি দেওয়ার পর আর চুলের ডগা দেখিতে পাওয়া যায় না মেয়ের। মনে হয় যেন হাওয়ায় ভাসিতেছে।…যাক মন্দের ভালো! সবটাই তো বুড়ীর মত, একটা বিষয়েও তবু প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছে!
নির্দিষ্ট দিনে বেবি অভী গাড়ীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই অক্ষয় ভালোমানুষের মত পিছনদিকে উঠিয়া বসে। যেন তাহার আর কোনো কাজ নাই, হাত-পা ছড়াইয়া বসিয়া যাইবে।
–ও কি, তুমি ভেতরে বসলে যে? তাপসী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
–কেন, আজ তো তুমি চালাবে, আমার ছুটি!
–বাঃ, আমি তো সবে আজ থেকে শিখব! আমি বুঝি চালাতে পারি?
–ওঃ, তাই বুঝি! আমি ভাবছি বেবিদিদি আজ আমাকে ছুটি দিয়ে দিলে!
ইস্, ভারি তো কাজ, আমি খুব পারি। অমিতাভ সগর্বে চালকের আসনে উঠিয়া বসে এবং স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়া গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে–লাইসেন্স যে নেই, ওই তো হয়েছে মুশকিল!
–এই অভী, দুষ্টু ছেলে–যা ভেতরে বসগে যা, আজকে আমি শিখব। অক্ষয় এসো না লক্ষ্মীটি, এখুনি হয়তো মা’র মত বদলে যাবে!
–বা রে, আমি শিখব না বুঝি? অমিতাভ প্রায় দিদির মতই নাকিসুর তোলে- মেয়েদের তো ভারি দরকার, শুধু শখ! ছেলেদেরই তো5
–আরে তুমি আবার শিখবে কি, তোমার তো সব শেখাই আছে। অক্ষয় হাসিতে হাসিতে স্বস্থানে আসিয়া বসে। বলে–বেবিদিদি এসো।
আগে ‘বেবিই’ বলিত, আজকাল কি ভাবিয়া কে জানে ‘দিদিটা’ যোগ দিয়াছে। অমিতাভ অনিচ্ছামন্থর গতিতে পিছনের সীটে’ এবং তাপসী মহোৎসাহে সামনের ‘সীটে’ উঠিয়া বসে।
–আজ শুধু দেখে নাও মন দিয়ে, বুঝলে? কোন্ দিকে যাব?–কেন, রেস কোর্সে! অমিতাভ ফোড়ন দিয়া ওঠে-ওখানেই তো চক্কর দেওয়ার সুবিধে।
–তা কেন? তাপসী ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি জানায় তার চাইতে এমনি যেদিকে ইচ্ছে–
–হ্যা যেদিকে ইচ্ছে, অমিতাভ পুরুষোচিত তীব্রকণ্ঠে মন্তব্য করে–দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যেতে হবে নাকি? অক্ষয় তুমি দিদির কথা শুনো না, ওর যদি কোনো বুদ্ধি আছে!
–না, কোনো বুদ্ধি নেই, যত বুদ্ধি তোর মাথায় ভরা আছে! তাপসী ঝঙ্কার দিয়া ওঠে–কলকাতার সব কিছুই বুঝি আমরা দেখেছি! এই যে, কলকাতায় ক’টা কলেজ আছে। জানিস? দেখেছিস সব?
–কলেজ? আহা রে! কী একেবারে দ্রষ্টব্য জায়গা! তার চেয়ে বললি না কেন দিদি, কলকাতায় ক’টা গোয়াল আছে তাই দেখে বেড়াই!
তাপসীর কণ্ঠ আবার স্তিমিত হইয়া আসে–গোয়াল আর কলেজ এক হল? খুব তো বুদ্ধি! ম্যাট্রিক দেবার পর আমাকে বুঝি পড়তে হবে না?
–তাই এখন থেকে দরজা চিনে রাখবি? ভাইবোনের বাগবিতণ্ডার অবসরে গাড়ী অনেক দূর অগ্রসর হইতে থাকে।
-এই তো এসে গেল প্রেসিডেন্সী কলেজ! অক্ষয় মন্তব্য করে।
তাপসী চ্যালেঞ্জের সুরে বলে–আচ্ছা অভী, বল্ তো, প্রেসিডেন্সী কলেজে কত স্টুডেন্ট আছে?
–কত? ইঃ, কে না জানে! পাঁচশ’-বলা বাহুল্য দিদির কাছে খাটো হইবার ভয়ে ভাবনা চিন্তার অপেক্ষা না রাখিয়াই উত্তর দিয়া বসে অমিতাভ।
সঙ্গে সঙ্গে ফল ফলে, তাপসী যথেচ্ছ হাসিয়া ওঠে। খুব বলেছিস! আমি বলছি এক হাজার কিংবা দু’হাজার।–এই, এই অক্ষয়, থামাও তো গাড়ীটা, একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই তো দেখা যাবে কত ছেলে আসবে! দশটা বাজবে তো এখুনি!
–আজ আর দশটা বাজবে না বেবিদিদি! অক্ষয় ভাইবোনের তর্ককলহটা উপভোগ করিতে করিতে সহাস্যে বলে–আজ যে রবিবার!
রবিবার! রবিবার! ওঃ, তাই তো! এই প্রচণ্ড সত্যটা ভুলিয়া বসিয়াছিল তাপসী! কী আশ্চর্য!
–দিদি এবার পাগল হয়ে যাবে। অমিতাভ গম্ভীর মত ব্যক্ত করে–যা মাথার অবস্থা হচ্ছে দিন দিন! এখন ক্লাস নাইনে পড়েন, এখন থেকেই কলেজ কলেজ’! উনি আবার কলেজে পড়বার সময় হোস্টেলে থাকবেন, জানো অক্ষয়?
–হ্যাঁ, থাকব! বলেছি তোকে?
–বললি না সেদিন! সেই যেদিন তোর গানের মাস্টারমশাই এলেন না, বাগানে চলে। গেলাম আমরা! বললি না?
-হ্যাঁ, সে তো শুধু বলেছি, হোস্টেলে থাকলে বাড়ীর থেকে পড়া ভালো হয়। হয় না অক্ষয়? বাড়ীর মত তো গোলমাল নেই!
–কি করে জানব দিদি? সাবধানে মোড় ঘুরিতে ঘুরিতে অক্ষয় উত্তর দেয়– কলেজেও পড়িনি, হোস্টেলেও থাকি নি
–পড়লে না কেন? অমিতাভ গম্ভীরভাবে বলে–শিক্ষাই জীবনের মূলধন, বুঝলে? অনেক অনেক পাস করলেই উন্নতি করতে পারতে।
অক্ষয় ক্ষুণ্ণভাবে বলে কই আর পড়তে পেলাম ভাই-বাপ-ঠাকুর্দা কাকা সবাই মারা গেল–
তাপসী উৎসুক ভাবে বলে–সবাই মারা গেলে বুঝি পড়া যায় না? খুব মন খারাপ হয়ে যায়?
অক্ষয় হাসিয়া ফেলে–মন খারাপের জন্যে নয় রে দিদি, টাকা লাগে না?
-ওঃ, টাকা! ভারি যেন আশ্বস্তভাবে তাপসী বলে–অনেক অনেক টাকা থাকলে পড়া যায়। তাহলে?
–দিদি তুই থা! অমিতাভ বিরক্তসুরে বলে–এমন বোকার মত কথা বলিস আজকাল, কোনো যদি মানে থাকে! অক্ষয় তার চেয়ে চল বরানগরে। একদিন তোমার বাড়ী দেখিয়ে আনবে বলেছিলে যে–
–আমার বাড়ী? গরীবের বাড়ীর আর কি দেখবে অভীবাবু, তোমার মা শুনলে রাগ করবেন।
-মা তো সর শুনলেই রাগ করেন, ছেড়ে দাও মায়ের কথা। চলো তুমি। গাড়ী চলিতে থাকে।
তাপসী ম্লানমুখে চুপচাপ বসিয়া থাকিতে থাকিতে একসময় বলে–অভী, তুই এদিকে এসে বোস্, আমার ভাল লাগছে না।
ছেলেমানুষের কণ্ঠে এমন শ্রান্তির সুর কেন? অক্ষয় চকিতভাবে বলে–শরীর খারাপ লাগছে বেবিদিদি? বাড়ী ফিরবে?
-না-না, বাড়ী বিশ্রী।
‘বিশ্রী’ হইলেও একসময়ে ফিরিতেই হয় বাড়ীতে।
মণীন্দ্র সহাস্যমুখে বলেন–কী হল তোমাদের? কতটা এগোলো?
–ছাই এগোলো! অমিতাভ বলে–দিদির শুধু মুখেই ওস্তাদি, শিখতে পারলে তো! খোলা জায়গায় গিয়ে তবে তো শিখতে হয়, তা নয়–কি শখ, না কলকাতায় ক’টা কলেজ আছে দেখব!
মণীন্দ্রনাথ চমকিয়া বলেনক’টা কি আছে?
–কলেজ! দু’ বছর পরে কবে পাস করবেন তাই এখন থেকে কলেজ দেখে বেড়াবেন! মা যেমন শাড়ীর দোকান দেখে বেড়ান–কোনটা পছন্দ হয় না, তাই না বাবা?
বাবা কিন্তু কথার উত্তর দেন না, তীক্ষ্ণভাবে একবার স্ত্রীর মুখের পানে চাহিয়া গুম হইয়া বসিয়া থাকেন। কন্যার দর্শন মেলে না। কোথায় সে সরিয়া পড়িয়াছে পাত্তা পাওয়া যায় না।
অমিতাভ বাপের কাছে ঘেঁষিয়া বসিয়া হাসিতে হাসিতে দ্রুতভঙ্গীতে বলিয়া চলে– দিদিটা আজকাল কী বোকাই হয়েছে বাবা! আজ রবিবার তা খেয়াল নেই, কলেজের ছেলে গুনতে বসেছিলেন বাবু! আচ্ছা বাবা, প্রেসিডেন্সী কলেজে কত স্টুডেন্ট আছে? দিদি বলছে এক হাজার! এত ছেলে কোথায় ধরে বাবা?
.
দিন যায়।
এইভাবেই বারে বারে ছোট ভাইয়ের কাছে অপদস্থ হইতে থাকে তাপসী। ছেলেমানুষ অমিতাভ সত্যই অক্ষয়ের কাছে বসিয়া প্রায় হাত পাকাইয়া ফেলে, আর লাইসেন্স পাইবার বয়স আসিতে আরো কতদিন লাগিবে, সনিঃশ্বাসে তাহার হিসাব কষিতে থাকে।
অথচ তাপসী গাড়ীতে উঠিয়াই অনর্থক শুধু এলোমেলো ঘুরাইয়া মারে অক্ষয়কে। কলিকাতার প্রত্যেকটি রাস্তাঘাট, প্রতিটি স্কুল-কলেজ, পার্ক, সিনেমা দেখিয়া বেড়াইবার কি যে। এক বাজে খেয়াল চাপিয়াছে তাহার!
অমিতাভর সঙ্গে তর্কের বেলায় অবশ্য যুক্তি তারও আছে। কলিকাতায় বাস করিয়া যদি কলিকাতার সবকিছু না দেখা হইল তবে আর গাড়ী থাকিয়া লাভ কি? কিন্তু একই জায়গা বার বার দেখিবার স্বপক্ষে আর যুক্তি যোগায় না তার, ছোট ভাইয়ের জেরার মুখে কাঁদিয়া ভাসায়।
চিত্রলেখা এত খবর রাখেন না, রাখেন মণীন্দ্র এবং কেন জানি না মনে মনে শঙ্কিত হইতে থাকেন।
.
বৎসর ঘুরিতে দেরি লাগে না। মণীন্দ্র ভাবিয়া চিন্তিয়া একদিন প্রস্তাব তুলিলেন– এবারে গ্রীষ্মের ছুটিতে মায়ের কাছে কাশী যাওয়া যাক। ছেলেরা তোতা এক পায়ে খাড়া, তাপসী অধীর আগ্রহে চিত্রলেখার মুখপানে চাহিয়া অপেক্ষা করে মা কী রায় দেন, কিন্তু চিত্রলেখা যেন এক ঝটকায় সকলের উন্মুখ চিত্তকে তছনছ করিয়া দিলেন।
–আবার ‘সামার ভেকেশনে’ মা’র কাছে! বলতে লজ্জা করল না তোমার? মুখে আটকাল না? বেশ যেতে পারো, কিন্তু মনে জেনো তার আগে পটাসিয়াম সায়ানাইড খাব আমি। তারপর যা খুশী কোরো তোমরা।
অতএব কথাটা চাপা পড়িয়া যায়।
.
ঢিলে পায়জামা আর হাফশার্ট পরাইয়া মেয়েকে চিত্রলেখা ছেলেদের সঙ্গে সমানভাবে মানুষ করিতে থাকেন আর নিজের বুদ্ধিগৌরবে উত্তরোত্তর আত্মপ্রসাদ অনুভব করিতে থাকেন।
কাটিতে থাকে দিনরাত্রি। সূর্য আর চন্দ্র নিজের নিয়মে আবর্তিত হইতে থাকে। বয়স বাড়িতে থাকে পৃথিবীর–বাড়িতে থাকে মানুষের। রাত্রির যবনিকা দিনের পৃথিবীকে ঢাকিয়া দেয়– মৃত্যুর যবনিকা মানুষকে ঢাকে।
কিন্তু পৃথিবীর জীবনে ঘটে নূতন সূর্যোদয়, ঘটে ঋতুচক্রের আবর্তন। দীর্ঘ অবসরের সুযোগে ফিরিয়া দেখা দেয় ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে রঙের সমারোহ–প্রজাপতির পাখনায় নিত্যনূতন বৈচিত্র্য। ত্রুটিহীন প্রকৃতি দেবীর প্রতিটি কাজ সমাপ্তি-মধুর।
হায়, মানুষ এখানে হার মানিয়াছে। তার জীবনে অবসর নাই, তাই ত্রুটিবহুল জীবনে তার সব কিছুই অসমাপ্ত।
মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া মণীন্দ্রনাথ যত বেশী পীড়িত হইয়াছেন, তার শতাংশের একাংশও যদি কার্যকরী হইত, তবে হয়তো তাপসীর জীবনের ইতিহাস হইত অন্যরূপ। কিন্তু কিছুই করিতে পারিলেন না মণীন্দ্র, অনেক কিছু পরিকল্পনা মাথায় লইয়া হঠাৎ একদিন চির অন্ধকারের পথে পাড়ি দিলেন।
.
সংসার ত্যাগ করিয়া আসিয়া হেমপ্রভা কাশীবাসিনী হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এখানেও ধীরে ধীরে কেমন করিয়া যেন গড়িয়া উঠিতেছিল নূতন সংসার। সংসার ভিন্ন আর কি? মানুষই সংসার। যাহারা মুখাপেক্ষী, যাহারা আশ্রিত, তাহাদের জন্য নিজের স্বামী-পুত্রের সংসারের মতই খাঁটিতে হয়, চিন্তা করিতে হয়। হেমপ্রভাকে কেন্দ্র করিয়া এমন একটি আশ্রিতের সংসার গড়িয়া উঠিয়াছিল।
মা-বাপ-মরা যে ছেলে দু’টি স্কুলে যায় তাহাদের আহারের তদ্বির সারিয়া হেমপ্রভা সবে গঙ্গার ঘাটে স্নানে গিয়াছেন, রাঁধুনী বামুনঠাকরুণ ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া কহিল–মা চান হয়েছে? কলকেতা থেকে আপনাকে নিতে এসেছে!
–নিতে এসেছে? সে কি! কে?
–জানি না মা। নাম বললে লালবেহারী
–হ্যাঁ, কলকাতার বাড়ীর সরকার–কি বলছে সে? অজানা একটা আশঙ্কায় বুকটা থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে হেমপ্রভার।
–কিছু বলছে না–শুধু বলছে–”ঠাকুমাকে নিতে এসেছি”।
হেমপ্রভা আর প্রশ্ন করিতে সাহস করেন না। ধীরে ধীরে বাড়ী ফেরেন। বাহিরের ঘরে। লালবিহারী বসিয়া ছিল চুপচাপ। হেমপ্রভা আসিয়া দাঁড়াইতেই পায়ের উপর হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠে।
আপাততঃ সত্য খবর গোপন করিয়া মণীন্দ্রর সাংঘাতিক অসুখের ছুতায় হেমপ্রভাকে লইয়া যাইবার সংকল্পে মনে মনে কত কথা সাজাইয়া আসিয়াছিল, কিছুই বজায় রাখিতে পারে না, মেয়েমানুষের মত বিলাপ করিয়া কাঁদিতে থাকে।
নাঃ, সন্দেহের আর অবকাশ নাই। হেমপ্রভার জন্য চরম দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণ করিয়া গেল মণীন্দ্র। অপরাধের ভারে ভারাক্রান্ত হেমপ্রভা নিজেই তো নিজের জন্য নির্বাসন দণ্ড বাছিয়া লইয়াছিলেন, তবুও তৃপ্তি হইল না তাহার? আরো শাস্তির প্রয়োজন হইল?
কাঁদিলেন না, মূৰ্ছা গেলেন না, কাঠের মত বসিয়া রহিলেন হেমপ্রভা, দেওয়ালে পিঠ ঠেসাইয়া।
অনেকক্ষণ কঁদিয়া লালবিহারী নিজেই স্থির হইল। চোখ মুছিয়া বলিল–আমার সঙ্গে যেতে হবে যে ঠাকুমা!
–যেতে হবে? হেমপ্রভা চমকিয়া উঠেন, কার কাছে লালবিহারী?
–মা’র কাছে, খোকা-খুকীদের কাছে, আমাদের কাছে। আপনি না গেলে আমরা কোথায় দাঁড়াব ঠাকুমা!
হেমপ্রভা এক মিনিট চুপ থাকিয়া বলেন–বৌমা কি আমাকে নিয়ে যেতে তোমায় পাঠিয়েছে লালবিহারী?
লালবিহারী টেক গিলিয়া বলে–তার কি আর মাথার ঠিক আছে ঠাকুমা? পাঠিয়েছেন বৈকি, তিনিই তো খবর দেবার জন্যে
হেমপ্রভা ম্লান হাসির সঙ্গে বলেন–খবর দিতে বলেছে তা জানি। বলবে বৈকি, সকলের আগে আমারই তো এ খবর পাওয়া উচিত। কিন্তু যেতে আমি পারব না লালবিহারী। বৌমাকে এ মুখ দেখাতে পারব না আমি।
–কিন্তু ঠাকুমা, খোকা-খুকীদের–
–তাদের আর আমি কি করতে পারব লালবিহারী? হয়তো অনিষ্টই করে বসব! সত্য কথা এই চিত্রলেখা শুধু টেলিগ্রাম করিয়া দিবার হুকুম দিয়াছিলেন। লালবিহারী নিজের বুদ্ধি খাটাইয়া: সরাসরি চলিয়া আসিয়াছে।হেমপ্রভার স্থির মুখভাব দেখিয়া আর ভরসা থাকে না তাহার, তবু কাতরভাবে বলে–তাহলে একলা ফিরে যাব ঠাকুমা?
–একলাই তো সবাইকে ফিরতে হবে লালবিহারী!
হেমপ্রভা আর একবার ম্লান হাসেন।
আবার কিছুক্ষণ কাটে। একসময় বলেন–ওঠো লালবিহারী, স্নানটান করো, জল মুখে দাও। লালবিহারী আর একবার হাহাকার করিয়া ওঠে—ও অনুরোধ আর করবেন না ঠাকুমা।
হেমপ্রভা স্থিরস্বরে বলেন–করব বৈকি লালবিহারী, করতে তো হবেই। আমি নিজেই কি এখুনি স্নান-আহার করব না? আজ না পারি, কাল করব।–মণি যখন ‘মা’ বলে আমাকে এতটুকু দয়ামায়া করল না, আমি আবার কোন্ লজ্জায় অভিমান করব, শোক করব?
.
যে বিবাহ ব্যাপারটাকে লইয়া এত কাণ্ড, তাপসী ভিন্ন আরও যে একটি অংশীদার আছে তাহার, সেকথা ভুলিয়া থাকিলেই বা চলিবে কেন? বেচারা বুলুর দিকেও তো একবার চাহিতে হয়! অগাধ অর্থের মালিক হইলেও মাতৃপিতৃহীন অসহায় কিশোর যেদিন জীবনের একমাত্র নির্ভরস্থল পিতামহকে অকস্মাৎ হারাইয়া বসিল, সেদিন সেই অগাধ অর্থের পানে চাহিয়া যে সে কিছুমাত্র ভরসা বোধ করিল, এমন মনে করিবার কারণ নাই।
চারিদিকে চাহিয়া–একটা নিঃশ্বাসরোধকারী গুরুভার অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িল না তাহার!
স্বপ্নের মত কি যে একটা কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে সে ছবিও স্পষ্ট মনে পড়ে না। জানিয়া বুঝিয়া বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করিবার মত বয়স তো তাহার নয়ই, তাছাড়া সময়ও ছিল না। ব্যাপারটা যে সত্যই ‘বিবাহ’ এ বোধই কি জন্মিয়াছে ছাই!
বিবাহ এবং ঠাকুর্দার মৃত্যু–দুইটা অপ্রত্যাশিত বস্তু যেন তালগোল পাকাইয়া হঠাৎ হুড়মুড় শব্দে ঘাড়ে পড়িয়া গেল। নিঃশঙ্কে পথ চলিতে চলিতে যেন কোথা হইতে একটা পাহাড়ের চূড়া ঝড়ে উড়িয়া আসিয়া ঘাড়ের উপর ভাঙিয়া পড়িয়াছে!
অপ্রত্যাশিত এত বড় আঘাতটায় মূঢ় বিপর্যস্ত দিশাহারা হইলেও তবু কান্তি মখুজ্জের নাতি সে! দিশাহারা হইলেও কর্তব্যহারা হইল না। শ্রাদ্ধের আয়োজনে ত্রুটিমাত্র ঘটিল না, দানধ্যান, ব্রাহ্মণ-বিদায়, কাঙালী ভোজন উচিত মতই হইল। অর্থবল, লোকবল, অভাব কিছুরই ছিল না, শুধু ইচ্ছা প্রকাশের অপেক্ষা।
নিমন্ত্রণপত্র বিলি করিবার সময় পিসি রাজলক্ষ্মী একবার কথাটা পাড়িলেন। বিবাহ যখন হইয়াছেই, উড়াইয়া দিবার তো উপায় নাই, শ্বশুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া বৌ লইয়া আসুক বুলু। স্বামী-স্ত্রী ‘একঘাট’ করিতে হয় এ কথা আর কোন হিন্দুর সন্তান না জানে? কাজেই তাপসীদের দিক হইতে আপত্তি তুলিবার আর পথ কোথায়?
নিজের পিসি নয় কান্তি মুখুজ্জের দূর সম্পর্কের ভাগিনেয়ী। তবু বুলুর মা মারা যাওয়ার পর বুলুর ভার তিনিই লইয়াছিলেন এবং নিজের পিসির বাড়া হইয়াই চিরদিন এ সংসারে আছেন। কান্তি মুখুজ্জেও কন্যার আদরেই এতদিন আশ্রয় দিয়া আসিয়াছেন তাহাকে। কাজেই বাড়ীর ভিতরকার ব্যবস্থাপনা অথবা লোক-লৌকিকতার বিষয়ে উপদেশ পরামর্শের অধিকার তাঁহারই। বুলুকে নীরব থাকিতে দেখিয়া তিনি ঈষৎ জোরের সঙ্গে বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন।
–শোন বাবা, এখন থেকে সবই যখন তোকে মাথায় নিতে হবে তখন কোনো কিছুই তো এড়িয়ে গেলে চলবে না, শুনতে হবে বুঝতে হবে। বৌমাকে না আনলে তো চলবেই না, আনতেই হবে যে!
কিন্তু নিজের গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে যতই অবহিত হোক বুলু, তবু পিসিমার কথার না দিল উত্তর, না তুলিল মুখ। রাজলক্ষ্মী আর একবার বলেন–ওরা শুনছি কলকাতায় চলে গেছে। খুবই অভদ্রতা হয়েছে ওদের এটা, তবু আমাদের কর্তব্য আমাদের কাছে। আমি সরকার মশাইকে বলে সব ঠিক করিয়ে দিচ্ছি, কাল সকালের ট্রেনে তুমি চলে যাও সরকার মশাইয়ের সঙ্গে, বুঝলে? একটা দিন কলকাতার বাড়ীতে থেকে একেবারে পরশু বৌমাকে নিয়ে ফিরবে।
এতক্ষণে বুলু কথা বলে, বলে বেশ সজোরে মাথা নাড়িয়া-ও সব আমি পারব না–চিনি না, কিচ্ছু না।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–চিনতে তো হবে! নাকি হবে না? তোকে কিছুই বলতে কইতে হবে না বাপু, শুধু লোক-দেত্তা একবার গিয়ে দাঁড়াবি, যা বলবার সবই সরকার মশাই বলবেন।
–সরকার মশাই নিজেই যান না তবে!
–না রে বাপু, তা হয় না। এ সব সমাজ-সামাজিকতার ব্যাপার, যা নিয়ম তা করতেই হয়! তোমার দায় যখন
–হ্যাঁ দায়! ভারি একেবারে ইয়ে–আমাকে কেউ চেনে বুঝি?
–নাঃ, এ ছেলেটা অচেনার ভয়েই সারা হলো দেখছি! ওরে বাপু, এই সূত্রে চেনা-পরিচয় করে নেওয়াটাও তো হবে! হুট করে কাজটা হয়ে গেছে, মেয়ের মা-বাপ জানতে পারেনি, ব্যাপারটা তো একটু জগাখিচুড়ি মতনই হয়ে রয়েছে, পরিষ্কার করা দরকার নয় কি? অবিশ্যি নিন্দে আমি ওদের করবই–যতই হোক মেয়ের পিতামহী যখন নিজে বসে সম্প্রদান করেছেন, তখন মা-বাপের আর বলবার কি আছে? তাছাড়া হিঁদুর মেয়ের বিয়ে, ফিরিয়ে দিতে পারবি না তো? এদিকে এই এত বড় বিপদ ঘটে গেল, উদ্দিশ নেই, কিছু নেই, মেয়ে নিয়ে গট গট করে চলে গেলি! মেয়েই নয় তোদের মস্ত দামী বুঝলাম, কিন্তু আমাদের ছেলেই বুঝি ফেলনা?
বলা বাহুল্য রাজলক্ষ্মী দেবী যে উপযুক্ত শ্রোতা ভাবিয়াই বুলুকে এসব কথা শোনাইতে বসিয়াছেন তা নয়, বুলু উপলক্ষ্য মাত্র, নিজের মনের বিরক্তিটাই প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গীতে প্রকাশ করিতে থাকেন তিনি।
বকিতে বকিতে তিনি সরকার মশাইকে ডাকিতে পাঠাইবার উদ্যোগ করিতেই বুলু মরীয়া হইয়া বলে–পিসিমা, ও সব কিছু করতে-টরতে হবে না। সত্যিই নয় কিছু, শুধু শুধু–
পিসিমা সন্দিগ্ধভাবে বলেন–কি সত্যি নয়?
–ওই তো ওই সব সুকুমার লাবণ্যময় মুখ লজ্জায় লাল হইয়া ওঠে বুলুর।
তবু পিসিমা বুঝিয়া উঠিতে পারেন না। অথবা না বোঝার ভান করেন হয়তো। বলেন—’কি সব’–তাই খুলে বল না বাপু? না বললে বুঝব কি করে?
বুলু সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া ওঠেনাঃ, তুমি কিছু বুঝতে পারো না–সব বাজে কথা–বোঝো না বই কি!
–পারলাম না, রাজলক্ষ্মী হতাশ ভঙ্গীতে বলেন–না পারলে উপায় কি বল? ‘ওই সব’ ‘সেই সব’ বোঝ আমার কর্ম নয়।
–আঃ বাবারে! সেদিন যা সব কাণ্ড হল মোটেই কিছু সত্যি নয়, দাদু শুধু শুধু কেন যে আমাকে–সহসা দাদুর নাম মুখে আসিতেই অভিমানে বেদনায় নীল আকাশের মত উজ্জ্বল চোখ দু’টি আসন্নবর্ষণ মেঘের ছায়ায় গভীর কালো হইয়া আসে। এক ঝাঁপটা শীতল বাতাসের অপেক্ষা, ঝরিয়া পড়িতে বিলম্ব হইবে না।
‘দাদু’ ‘দাদু’! যে নাম তাহার অস্থিতে মজ্জায় শিরায় শোণিতে একাকার হইয়া মিশিয়া আছে সে নামের অধিকারী যে আজ ত্রিভুবনের কোনখানে নাই একথা বিশ্বাস করা কি সহজ! বিশ্বাস করিবার মত করিয়া তলাইয়া ভাবিতে বসাও তো সম্ভব নয়! দাদু নাই’ একথা মনে মনে উচ্চারণ করা মাত্রই যে মাথার মধ্যে কেমন একটা প্রবল আলোড়ন হয়, দুই চোখ ঝাঁপসা হইয়া। আসে! ছুটিয়া গিয়া ধরিয়া আনা যদি সম্ভব হইত! শোক কি দুঃখ তা বুঝিতে পারে না বুলু, মনে হয় রাগ। হা, রাগই হয় তার দাদুর উপর। বুলুকে এমন ভাসাইয়া দিয়া দিব্য কোথায় গিয়া বসিয়া রহিলেন–বুলু এখন করে কি?
শুধু কি বিষয়-সম্পত্তি, কোলিয়ারির হিসাবপত্র, অথবা বুলুর নিজের ভবিষ্যতের ভাবনা? আর একটা কি বিকেল কাণ্ডই না করিয়া গেলেন! সেটা যে ভালোমত করিয়া ভাবিতেও সাহস হয় না। তবু যাই হোক ঘটনাকে কিছু নয়–খেলা” গোছের ভাবিয়া লইয়া এই দিন আষ্টেকের মধ্যে ধাতস্থ হইতেছিল বেচারা, পিসিমা আবার নূতন করিয়া ফ্যাচাং তুলিলেন!
‘বুলুর বিবাহ হইয়া গিয়াছে!’
কথাটা শুনিলে বন্ধুরা বলিবে কি? কিন্তু বিবাহটাই কি সত্য? দাদুর মৃত্যুর মত এটাও যেন একটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কিছুতেই মনকে মানাইয়া লওয়া যায় না। অথচ একেবারে ভুলিয়া থাকাও কঠিন।
রাজলক্ষ্মীও বুলুর কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঁচলে চোখ মুছিয়া বলেন–সে কথা সত্যি, শেষটায় মামার যে কি জেদ হল! জানি না ভালো করলেন না মন্দ করলেন! তারাই বা কি রকম মানুষ কে জানে–এই তো যা ব্যবহার দেখালে! তবুও ধর্মসাক্ষী করে বিয়ে যখন হয়ে গেছে বাবা, সত্যি নয়’ একথা তুই বলতে পারিস না। আর তাও বলি– এখনই হাসির কথা হয়েছে, নইলে এন্ট্রেস পাস করে বিয়ে, আগের আমলে খুবই ছিল। …তুই যা বাবা, অমত করলে হবে না। সরকার মশাইয়ের হাতে একটা চিঠি দিয়ে দিই আমি, পাঠিয়ে দেবার কথা জোর দিয়ে বলে দিই। বলতে গেলে আধখানা বিয়ে হয়ে রয়েছে, বৌভাত ফুলশয্যা পর্যন্ত হয়নি-শ্রাদ্ধ শান্তি হয়ে গেলে ওটাও করে নিতে হবে যে!
–ধ্যেৎ! আমি কখনো পারব না! বলিয়া উঠিয়া পালায় বুলু।
.
শেষ পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী বেশ কিছু ভণিতা করিয়া একখানি চিঠি লিখিয়া সরকার মশায়ের হাতে পাঠাইয়া দেন এবং বৌ আসার আশা আর আশঙ্কায় ঘণ্টা গুনিতে বসেন।
কিন্তু আশার জয় হইল না, হইল আশঙ্কার। সরকার মশাই ফিরতি ট্রেনেই ফিরিয়া আসিলেন। বলা বাহুল্য একলা। আসিয়া নূতন কুটুম্ব সম্বন্ধে এমন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন, যেটা শ্রুতিমধুরও নয়, খুব বেশী সম্মানসূচকও নয়। কেবলমাত্র আশাভঙ্গের মনস্তাপে নয়–অপমানের জ্বালায় রাজলক্ষ্মী যা মুখে আসিল তাই বলিয়া গালি দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত একটা কটু দিব্যির সঙ্গে বলিয়া বসিলেন– থাকুক ওরা মেয়ে নিয়ে। দেখব কান্তি মুখুজ্জের নাতির আর বৌ জুটবে কিনা, বুলুর আমি আবার বিয়ে দেবই দেব।
নিজের পড়ার ঘরে বসিয়া সব কিছুই শুনিল বুলু, কিন্তু তাহাকে আর কেহ কিছু জ্বালাতন করিল না। নিজে হইতে তার আর বলিবার কি আছে? শুধু একবার মনে করিতে চেষ্টা করিল-সরকার মশাইয়ের পিছু পিছু আর একটা মানুষ ঢুকিলে লাগিত কেমন!
মানুষ না ছবি? দাদুর ঘরে একখানা বীণাবাদিনী সরস্বতীর ছবি আছে, ঠিক সেই ধরনের দেখিতে নয় কি? অবশ্য সেই অদ্ভুত রাত্রের কথা প্রায় কিছুই মনে পড়ে না, মনে করিতে গেলেই দিনের আলোয় দেখা একখানা ঝকঝকে জরিদার লাল শাড়ীমাত্র চোখের উপর ভাসিয়া ওঠে। ভাবিতে গেলে বল্লভজীর মন্দিরের ছায়াটাই শুধু চকিতের মত মনে পড়িয়া যায়।
খানিকটা:আলো আর খানিকটা অলৌকিকত্ব।
তাছাড়া আর কি?
.
শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটিয়া গেলে কলিকাতায় রওনা হইবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল বুলু, কিন্তু রাজলক্ষ্মী দেশের বাড়ী ছাড়িয়া যাইতে রাজী হইলেন না। কেন কি দরকার তার কলিকাতায়? বুলু নাকি হোস্টেলে থাকিয়া পড়াশোনার ব্যবস্থা করিতেছে, তবে? কিসের দায় রাজলক্ষ্মীর যে গোটাকতক ঝি-চাকর লইয়া সেই বৃহৎ বাড়ীখানা আগলাইয়া পড়িয়া থাকিবেন? কি ছাই আছে কলিকাতায়? এ তো তবু ভালো কিছু না হোক ‘বল্লভজী’র মন্দিরটায় দু’দণ্ড বসিলেও মনটা ভালো থাকিবে। রাণীগঞ্জে ফিরিবার প্রয়োজনও ফুরাইয়াছে। মামার সেবার জন্যই কতকটা, তাছাড়া কতকটা বুলুর জন্যও বটে, সর্বত্রই মামার সঙ্গে থাকিয়াছেন, আজ সব দিক দিয়াই মুক্তি।
মাতৃহীন শিশু এখন তো স্বাবলম্বী বীরপুরুষ হইয়া উঠিয়াছে–আর মামা নিজে তো দিব্যি নিজের পথ বাছিয়া সরিয়া পড়িলেন। অতএব রাজলক্ষ্মীরও এবার কর্তব্য ফুরাইয়াছে।
তবে হ্যাঁ, স্বাভাবিক নিয়মে যদি সংসারটা চলিত সে আলাদা কথা। পড়ুক না বুলু হোস্টেলে থাকিয়া, পড়ার যদি অসুবিধাই হয় তাহাতে রাজলক্ষ্মী কি আর বাধা দিবেন? এমন অবুঝ নন তিনি। ছেলে মূর্খ হইয়া কোলজোড়া করিয়া থাকুক এ সাধ তাহার নাই, কিন্তু বৌটিকে কাছে আনিয়া রাখিবার সাধ কি খুব বেশী অসঙ্গত? কত আদরে স্নেহে মমতায় সর্বদা কাছে কাছে রাখিয়া সকল বিষয়ে সুশিক্ষিত করিয়া তুলিতেন তাহাকে। তারপর যার সংসার তার হাতে। তুলিয়া দিয়া ছুটি লইতেন। বুলুর মা’র পরিত্যক্ত গৃহস্থালি কুড়াইয়া লইয়া কিসের আশায় আগলাইয়া বসিয়া আছেন এতদিন? বুলুর বৌয়ের হাতেই তুলিয়া দিবার সুদূর আশা লইয়া নয় কি?
বৌটি এখানে থাক–ছুটিছাটা পাইলেই বুলু এক-আধবার বাড়ী আসুক। হইলই বা ছেলেমানুষ, কিন্তু সত্যকার ভালোবাসিবার বন্ধুত্ব করিবার নিবিড় সখ্যতায় অন্তরঙ্গ হইবার বয়স তো এই। নব পরিণয়ের মাধুর্য উপভোগ করিবার অবকাশ তো এখনই লজ্জা সঙ্কোচ কুণ্ঠার আড়ালে।
বঞ্চিত নারীহৃদয়ের ঔৎসুক্য লইয়া-কল্পনায় অনেক মধুময় ছবি আঁকিতে বসেন রাজলক্ষ্মী এই কিশোর দম্পতিকে কেন্দ্র করিয়া, কিন্তু ছবি সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার ভাগ্য রাজলক্ষ্মীর নয়। বারে বারে তাই উজ্জ্বল রঙের তুলি বিবর্ণ হইয়া আসে। আর তাপসীর উপর রাগে ব্রহ্মার জুলিতে থাকে।
অবশ্য তাপসীর আর দোষ কি, দোষ তার বাপ-মার। ভারি পয়সা মণীন্দ্র বড়য্যের, তাই ধরাকে সরা দেখিতেছে! মুখে উচ্চারণ করিলে শুনিতে খারাপ, তা নয়তো বুলুর পয়সায় বুলু অমন দশটা মণি বাঁড়য্যেকে চাকর রাখিতে পারে। ছেলের শীঘ্রই আবার বিবাহ দিবার সংকল্পটা এ রকম সময় খুব প্রবল হইয়া ওঠে, কিন্তু তাপসীর মুখোনি মনে পড়িলেই যেন সংকল্প শিথিল হইয়া যায়।
সেকালের রাজপুত্রেরা যেমন বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিত-তাপসীকে তেমনি উদ্ধার করিয়া আনা যদি সম্ভব হইত বুলুর পক্ষে!
যাক, মনে মনে মানুষ কত কিই ভাবে, বাস্তবক্ষেত্রে তো দাম নাই সে সব কথার। যে কথার দাম আছে সেই কথাই কহিতে হয়।
বুলুর কলিকাতা যাইবার মুখে তাই রাজলক্ষ্মী তাহাকে ডাকিয়া সাবধান করিয়া দেন–দেখ বাপু, একটি কথা বলে রাখছি–কোনো ছলে কোনো উপলক্ষ্যে ওদের বাড়ীর ছায়াটি মাড়াবে না!
অন্যমনা বুলু ফস করিয়া প্রশ্ন করে, কাদের বাড়ী পিসিমা?
–কাদের আবার, তোর ওই গুণধর শ্বশুর মশাইয়ের! এখন তো অগ্রাহ্য করে মেয়ে নিয়ে চলে গেল, যেন কোনো সম্বন্ধই নেই! শেষে পস্তাতে হবে–তখন যে টুপ করে ওখানে থেকে যাওয়া-আসা করিয়ে জামাইটিকে বশ করে নেবেন তা হতে দিচ্ছি না!
–ধ্যেৎ! পিসিমার যত্ত সব ইয়ে! বশ আবার কি? যাচ্ছে কে?
রাজলক্ষ্মী মুচকি হাসিয়া বলেন–তা কি জানি, টুকটুকে বৌ হয়েছে, তোর যদি শ্বশুরবাড়ী যাবার মন হয়, তাই সাবধান করে দিচ্ছি। তোর পড়াশুনো শেষ হওয়াটা পর্যন্ত দেখব, খোশামোদ করে মেয়ে পৌঁছে দেয় তো ভালো কথা–নচেৎ আবার তোর বিয়ে দেব আমি। কি বলব- মামা নেই তাই, নইলে এখুনি ওদের নাকের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বৌ ঘরে তুলতাম, ওর মেম-ফ্যাশানী মা মেয়ে নিয়ে বসে বসে দেখত। মামা অসময়ে চলে গিয়ে–
রাজলক্ষ্মী আর একবার চোখ মুছিবার জন্যে কথা থামাইতেই বুলু তাড়াতাড়ি একটা প্রণাম ঠুকিয়া–’দেরি হয়ে যাচ্ছে পিসিমা’–বলিয়া ব্যস্ত হইয়া ওঠে। ওসব কথার আলোচনা তাহার পক্ষে অস্বস্তিকর।
কিন্তু রাজলক্ষ্মীর যেন আর অন্য চিন্তা নাই, অন্য কথা নাই। নিজে ভুলিতে পারেন না বলিয়াই বোধ করি অপর কাহাকেও ভুলিতে দেন না। অথচ ভুলিয়া যাওয়াই সব চাইতে ভালো ছিল না কি!
.
ট্রেন ছুটিতে থাকে। বুলুকে ঘুমাইবার পরামর্শ দিয়া, সরকার মশাই নিজে নাক ডাকাইতে শুরু করেন–আর খোলা জানলার বাহিরে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলিয়া বিনিদ্র বুলু বসিয়া থাকে। বসিয়া বসিয়া কি ভাবে কে জানে!
কৈশোর কাল–স্বপ্ন দেখিবার কাল। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন, নিজেকে রচনা করিবার দুরন্ত ইচ্ছার উদ্দাম স্বপ্ন–আবহমান কাল হইতে পৃথিবীর সমস্ত কিশোরচিত্ত যে বেদনাময় আনন্দের স্বপ্ন দেখিয়া আসিতেছে তাহার স্বপ্ন।
আসিবার সময় পিসিমা এমন একটা কথা বলিয়া বসিলেন–অদ্ভুত! এদিকে নিজেই তো ‘ধর্মসাক্ষীটাক্ষী’ কত কি বলিলেন! ফেরত দিবার উপায় নাই’ ‘বদলাইবার উপায় নাই’ কত সব কথা! এখন আবার উল্টোপাল্টা কথা শুরু করিয়াছেন!
ধ্যেৎ! দাদু যা করিয়া দিয়া গিয়াছেন–তাহার উপর বুঝি সদারি ফলাইতে আছে? আর এত ভাবনারই বা কি দরকার? বুলুর বুঝি লেখাপড়া নাই? কলিকাতার পড়া সাঙ্গ করিয়া বুলু বিলাত যাইবে না যেন!
কলিকাতায় আসিয়া কলেজে ভর্তি হইল বটে, কিন্তু প্রথমটা কিছুতেই মন বসাইতে পারিত না বুলু। তাহার সদ্য শোকাহত উদভ্রান্ত মনের অবস্থায় সহপাঠীদের হৈ-হুঁল্লোড়, অকারণ হাসি, অর্থহীন গল্প নিতান্ত বাজে আর বিশ্রী লাগিত। সকলের সঙ্গে মেলামেশা করার মত সপ্রতিভ নয় যে, কাজেই মনমরা ভাবে আপনার লেখাপড়া লইয়া একপাশে কাটাইয়া দিত।
কিন্তু বয়সটা যোলো আর জায়গাটা ছাত্রাবাস। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া একপাশে পড়িয়া থাকা বেশীদিন সম্ভব নয়। প্রবল বন্যার আকর্ষণে কে কতদিন অটল থাকিতে পারে? আসন্ন যৌবনের সোনার কাঠি ঘুমন্ত মনকে নাড়া দিয়া জাগাইয়া তোলে, চিত্ত শতদলের এক একটি দল বিকশিত হইতে থাকে, উন্মুখ হৃদয় বিরাট বিশ্বকে আপনার ভিতর গ্রহণ করিতে চায়। সকলকে ভালোবাসিতে ইচ্ছা হয়, সকলকে আপনার মনে হয়–অকপট সরলতায় ধীরে ধীরে ধরা দেয় বুলু।
দলের মধ্যে সুকুমার নামক ছেলেটিই চাই। সদাহাস্যময় কৌতুকপ্রিয় এই ছেলেটিকে প্রত্যেকেই ভালোবাসে, বলিতে গেলে বুলু তো তার প্রেমমুগ্ধ ভক্ত। কিন্তু সুকুমারই একদিন তাহার মাথা খাইয়া বসিল।
বুলু তখন ধরে অনুপস্থিত, কি একটুকরা কাগজ লইয়া হাসির বান ডাকিয়াছে ঘরে। উপলক্ষ্যটা যে বুলুসেটা একটু লক্ষ্য করিলেই বোঝা যায়।
বেশ কিছুক্ষণ হুল্লোড়ের পর রঙ্গমঞ্চে বুলুর অবির্ভাব ঘটে। সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা প্রচণ্ড হাসির রোল। বুলুও হাস্মুখে প্রশ্ন করে-কি হল হঠাৎ?
–আর কি হল! রমেন চশমার ভিতর হইতে চোখ পাকাইয়া বলে–কি বাবা ভালো ছেলে, ডুবে ডুবে জল খেতে শিখেছ! উঃ, আমরা ভাবি কি ইনোসেন্ট!
–তা হঠাৎ এমন কি প্রমাণ পেলে আমার বিরুদ্ধে? বুলু প্রশ্ন করে।
সুকুমার বাঁকা হাসির সঙ্গে বলে, আমরা কি জানতে পারি ‘তাপসী’ নাম্নী ভদ্রমহিলাটি কে?
–তাপসী?
আর কিছুই বলে না বুলু, কিন্তু চমকানিটা সুস্পষ্ট।
নিত্য নতুন ফন্দী আঁটিয়া আশেপাশে সকলকে ক্ষেপানো সুকুমারের একটা বিশেষ শখ। সহপাঠীদের তো বটেই, প্রফেসারদেরও ছাড়িয়া কথা কহে না সে। মাঝে মাঝে তাদের নাকালের এক শেষ করিয়া ছাড়ে। সুকুমার যখন বুলুর খাটের তলা হইতে একখানা লেটার প্যাডের পাতা কুড়াইয়া আনিয়া এত হাসাহাসি জুড়িয়া দিয়াছিল, রমেন দিলীপ পরেশ শিবনাথ প্রভৃতি সকলেই ভাবিয়াছিল এটা সুকুমারের নূতন কীর্তি। পরের হাতের লেখা নকল করিবার একটা বিশেষ ক্ষমতা সুকুমারের আছে কিনা।
কাগজখানার একটা পিঠ ভর্তি শুধু একই নাম লেখা–ইংরাজী, বাংলা, টানাহাতের মুক্তাক্ষর। আবার সবগুলির উপর হিজিবিজি আর বড় বড় করিয়া লেখা একটি নাম–তাপসী তাপসী–তাপসী!
কিন্তু বুলুর চমকানিটা যে নিতান্তই সন্দেহজনক।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তাপসী, যাঁর নামের জপমালা তৈরী হয়েছে। চিনতে পারেন হাতের লেখাটা? রমেন সোৎসাহে প্রশ্ন করে।
চিনিতে দেরি হয় না। একটা ফাউন্টেন পেন কিনিয়া আনিয়া নিবটার গুণাগুণ পরীক্ষার্থে বার বার এই নামটাই লিখিয়াছিল বুলু লেটার প্যাডের পাতা ভর্তি করিয়া–কাল কি পরশু ঠিক স্মরণ নাই।
বুলুর অবশ্য আগের চাইতে উন্নতি হইয়াছে, তাই ধাতস্থ হইতে দেরি লাগে না। লজ্জায় লাল হইয়া পড়িয়া অপ্রতিভও হয় না। কাগজখানার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই অবহেলাভরে বলিয়া ওঠে–ওঃ, এই! আমি ভাবলাম না জানি আমার বিরুদ্ধে কি ভয়ানক সব প্রমাণপত্র যোগাড় করেছিস! নতুন পেনটার নিবটা পরীক্ষা করতে আজেবাজে একটা নাম লিখছিলাম বটে কাল!
সুকুমার সন্দিগ্ধভাবে বলে–বলি হে বাপু, এত নাম থাকতে হঠাৎ এই নামটিই বা নির্বাচিত হল কেন?
–যা হোক কিছু–যে কোনো একটা নাম লিখলেই তোমরা তা থেকে সূত্র আবিষ্কার করতে বসতে, ওর আর কি! ধরোযদি ওর বদলে ক্ষ্যান্তকালী’ লিখতাম!
–তাই বা লিখবে কেন? পরেশ গম্ভীরভাবে বলে আমাদের আদরের প্রাণকেষ্টর নাম লিখতে পারতে!
প্রাণকেষ্ট হোস্টেলের চাকর।
পরেশের কথায় সকলেই আর এক দফা হাসিয়া ওঠে।
–প্রফেসর দিগ্বিজয় রায়ের নামটাই বা লিখতে বাধা কি ছিল? ওঁকে যখন অত পছন্দ করি আমরা! বুলু হাসিয়া প্রশ্ন করে।
বলা বাহুল্য উক্ত ভদ্রলোকটি ছাত্রমহলের দু’চক্ষের বিষ।
–ওই দেখ, সুকুমার তীক্ষ্ণস্বরে বলে–নিজের কথাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে ছোঁকরা! দিগ্বিজয়কে আমরা পছন্দ করি না বলেই ঠাট্টা করতে ওর নামটাই মনে পড়ল বুলুর! তার মানে-ঠাট্টাটা বাদ দিলে এই দাঁড়ায়, যাকে পছন্দ করি খাতার পাতায় তার নাম লিখি।
–চমৎকার! তুই আবার বলিস কিনা তুই অঙ্কে কাঁচা! বলিয়া গায়ের শার্টটা খুলিতে খুলিতে নিজের ঘরে চলিয়া যায় বুলু। কিন্তু এ ঘরে আর তাড়াতাড়ি আসে না, চুপচাপ বিছানায় বসিয়া থাকে। কি আশ্চর্য! এত নাম থাকিতে ও নামটাই বা লিখতে গেল কেন সে? নিজের জ্ঞাতসারেই লিখিয়াছিল কি? স্পষ্ট মনে পড়ে না, খেয়ালের মাথায় একবার লিখিয়া ফেলিয়া বার বার সেইটাই চালাইয়া গিয়াছে মাত্র।–ধ্যেৎ! কি মনে করিল ওরা কে জানে? সত্যই কিছু সন্দেহ করিবে না তো? কাগজখানা ছিঁড়িয়া ফেলিলেই ভালো ছিল!
.
কয়েকটা দিন কাটিয়াছে। সেদিনের কথা বুলুর তো মনে নাই বটেই আর কেহ যে মনে রাখিবে এমন সন্দেহ করিবার হেতু নাই। হঠাৎ সুকুমার একদিন কোথা হইতে যে কি পাকা দলিল যোগাড় করিয়া বসিল কে জানে-বুলু দেখিয়া অবাক হয়, তাহার দিকে যে তাকায় সে-ই হাসিতে শুরু করে।
ব্যাপার কি? বুলু কি রাতারাতি চিড়িয়াখানার নূতন আমদানি চীজ বনিয়া গেল নাকি? যত দূর মনে পড়ে সেদিনের মত বোস বোকামি তো আর একবারও করিয়া বসে নাই।
তবে?
সংক্রামক ব্যাধির মত এ হাসি যে ক্রমশই ছড়াইয়া পড়িতেছে।
নাঃ, আজ আর নিজে যাচিয়া ব্যাপার জানিতে যাইবে না বুলু। তাহার যেন আর মানমর্যাদা নাই! মনে মনে হঠাৎ ভারি একটা অভিমান হয়, বিশেষত সুকুমারের উপর। এত ভালোবাসে বুলু সুকুমারকে, অথচ সুকুমারই তাহাকে অপদস্থ করিবার জন্য নিত্য নূতন ফন্দী আবিষ্কার করিয়া বেড়ায়!
স্বভাবদোষে সুকুমার সকলকেই ক্ষেপাইয়া মারে বটে, কিন্তু আজকে বুলুর প্রতি আক্রমণটা যেন বড় প্রবল। কেন? ক্লাসসুদ্ধ ছেলেকে বলিয়া বেড়াইবার মত কি এমন অপকর্ম করিয়া রাখিয়াছে বেচারা?
যাকগে, কারণ জানিবার প্রয়োজন নাই। নিজের ঘরে আসিয়া সকালের পড়া খবরের কাগজখানা মুখের সামনে ধরিয়া মনে মনে রাগে ফুলিতে থাকে বুলু।
কিন্তু বুলুকে আজ আর ওরা স্বস্তিতে থাকিতে দিবে না। মিনিট কয়েক পরেই সদলবলে সুকুমারের আবির্ভাব। একটানে কাগজখানা টানিয়া লইয়া হৈ হৈ করিয়া ওঠে–কি বাবা যুধিষ্ঠির, কি হলো? এত বড় কাণ্ডটা বেমালুম চেপে যাচ্ছিলে? এখন যে হাটে হাঁড়ি ভাঙল তার কি! দুধে দাঁত না ভাঙতেই বিবাহ-পর্বটা সেরে বসে আছ বাবা!
উঃ! ধৈর্যের বাঁধ আর কতক্ষণ থাকে মানুষের? এত বড় আঘাতেও ভাঙিয়া পড়িবে না? ক্ষোভে অপমানে স্বর্গত দাদুর উপর দুরন্ত অভিমানে আপাদমস্তক আলোড়িত হইয়া এক ঝলক জল আসিয়া পড়ে চোখে।
হায়! এটা বাড়ী নয়, কিংবা পিসিমার স্নেহচ্ছায়া নয় যে চোখের জলের মূল্য থাকিবে। ফল ফলিল বিপরীত। একবাক্যে সকলে স্থির করিল বৌয়ের জন্য মন কেমন করিতেছে বুলুর।
বলা বাহুল্য কোথা হইতে সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আনিয়া সহপাঠীমহলে রাষ্ট্র করিয়া দিয়াছে সুকুমার-বুলু বিবাহিত।
অতঃপর অনেক প্রশ্ন বর্ষণ হইতে থাকে বুলুর উপর।
বুলুরা সত্যই বাঙালী অথবা খোট্টা? বিবাহ কি তাহার দুগ্ধপোষ্য অবস্থাতেই স্থির হইয়া গিয়াছিল? এ হেন শুভকর্মটি একেবারে সারিয়া লইয়া কলেজে ঢোকার কারণ কি বন্ধুবর্গকে নিমন্ত্রণে ফাঁকি দেওয়া? বৌ দেখিতে কেমন? বন্ধুদের একদিন দেখাইবে কিনা বুলু? এই সব অজস্র প্রশ্ন।
প্রশ্ন এবং পরিহাসের ভঙ্গীতে অবশ্য দুগ্ধপোয্যতা’র আভাস খুঁজিয়া পাওয়া শক্ত হয়। সহপাঠীদের মধ্যে দু-চার বছরের বড় ছেলের তো অভাব নাই।
বুলু কোন উত্তরই দেয় না, আর কাঁদিয়াও ফেলে না। ভারী মুখে চুপচাপ বসিয়া থাকে। বন্ধুদের উপর রাগ করিতেও যেন পথ থাকে না। সত্যই তো সে একটা খাপছাড়া সৃষ্টিছাড়া অভিশপ্ত জীব। জীবনের প্রারম্ভে যে অভিশাপ বর্ষণ করা হইয়াছে তাহার উপর, তাহার ফল ভুগিতে হইবে না? এই সভ্যজগতে সভ্যসমাজে এমন অসভ্য ব্যাপার কি কাহারও জীবনে ঘটে?
বন্ধুদের উপর অভিমানে কিছুদিন আর ভালোভাবে মেলামেশা করে না বুলু, আপনমনে নিজের পড়াশোনা লইয়াই থাকে। নিজেকে যেন সকলের চাইতে স্বতন্ত্র মনে হয়। ভালোও লাগে না। এই ছোট গণ্ডির মধ্যে সামান্য কয়খানা পাঠ্য-পুস্তক নাড়াচাড়া করিয়া দিন কাটানো, আর পরীক্ষার শেষে গোটাকয়েক নম্বর বেশী পাওয়ার মধ্যেই কি জীবনের সার্থকতা?
দূর-দূরান্তরের দেশ হইতে কে যেন হাতছানি দিয়া ডাকে–কোথায় সেই অগাধ সমুদ্র, তুষারকিরীট পর্বতমালা, বিচিত্র ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্মভূমি, সভ্যতা আর সৌন্দর্যের লীলানিকেতন–বিশাল পৃথিবী–বিরাট জগৎ–এতটুকু একটা ঘরের মধ্যে নিজেকে আটকাইয়া রাখিবার জন্যই কি মানুষের সৃষ্টি?
কিন্তু অপেক্ষা করিতে হইবে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই, বিশ্বের দরবারে যে এখনও নিতান্তই নাবালক সে।
ধীরে ধীরে আবার কিছুটা সহজ হইয়া আসে, আবার সহপাঠীদের আক্রমণের ফাঁদে ধরা দিতে হয়। সভা-সমিতি, শোভাযাত্রা, পিকেটিং, কর্তৃপক্ষের অনুশাসনের প্রতিবাদে ধর্মঘট–ছাত্রজীবনের বহুবিধ উত্তেজনার মধ্যে কাটিতে থাকে দিনগুলি। অতীতের দুঃস্বপ্ন আর তেমন অব্যবস্থিত করিয়া তুলিতে পারে না। ভীতিবিহ্বল কিশোরচিত্তে আসে যৌবনের দৃঢ়তা, অগাধ সমুদ্রের রহস্যময় আহ্বানে সাড়া দিবার সাহস খুঁজিয়া পায়, নূতন নূতন জ্ঞান আহরণের সংকল্পে সেই সমুদ্র পাড়ি দেয় বুলু।
.
অবলম্বনহীন রাজলক্ষ্মী রোষে ক্ষোভে স্বর্গগত মাতুল হইতে শুরু করিয়া বুলুর অবিবাহিতা বধু পর্যন্ত সকলকে গালি দেন, নিত্য দুইবেলা কাশীবাসের সংকল্প ঘোষণা করেন আর বাঘিনীর মত আগলাইয়া থাকেন বুলুর ঘর-বাড়ী বিষয়-সম্পত্তি। সাতসমুদ্র পার হইয়া বুলু যেদিন ঘরে ফিরিবে, সেইদিন তাহাকে সবকিছু বুঝাইয়া পড়াইয়া তবে তাহার ছুটি।
ইত্যবসরে বার-দুই সরকার মহাশয়কে লুকাইয়া মূল্যবান উপহারসহ বুলুর শ্বশুরবাড়ী লোক পাঠাইয়াছিলেন, বলা বাহুল্য ফলাফলটা সুবিধাজনক হয় নাই।
চিত্রলেখা তাহাদের তো উপহার-দ্রব্যসমেত পত্রপাঠ বিদায় করিয়াছে বটেই, কিন্তু না করিলেও যে শেষ পর্যন্ত বিশেষ শোভনীয় ব্যাপার ঘটিত এমন নয়। অসম্ভব কল্পনা হইলেও চিত্রলেখা যদি রাজলক্ষ্মীর স্নেহ-ক্ষুধার তৃপ্তি সাধনাৰ্থে: মেয়েকে পাঠাইতেই রাজী হইত, সালোয়ার-পাঞ্জাবি-পরা সাইকেল-চাপা বৌকে লইয়া রাজলক্ষ্মী তৃপ্ত হইতে পারিতেন কি?
আসল কথা, মিলের যেখানে একান্তই অভাব, সেখানে মিশ খাওয়াইবার চেষ্টাই প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। বিপজ্জনকও বটে। তাই না শূন্যমণ্ডলবাহী লক্ষ লক্ষ গ্রহ কেহ কাহারও নিকটবর্তী হইতে পারে না, সুদূর ব্যবধানে আপন আপন কেন্দ্রে পাক খাইয়া মরে!
চিত্রলেখা আর রাজলক্ষ্মী ভিন্ন গ্রহবাসী, ভুলক্রমে পরস্পরের কাছাকাছি আসিবার চেষ্টা করিতে গেলে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন মধুর পরিণতির সম্ভাবনা কোথায়?
কে জানে সাত সমুদ্র পার হইতে বুলু কোন্ ভিন্নমূর্তি লইয়া ফিরিবে? রাজলক্ষ্মীকে চিনিতে পারিবে তো?
.
ঢিলে পায়জামা আর হাফশার্ট পরা তাপসীকে রাখিয়া দীর্ঘদিনের জন্য বিদায় লইয়াছিলাম, যবনিকা উত্তোলন করিতেই দেখা গেল–আকাশপাতাল পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাপসীর। কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই যে তাহাকে ভাঙিয়া চুরিয়া নূতন ছাঁদে গড়িয়া রূপের উপর অপরূপত্ব দান করিয়াছেন তাহা নয়, প্রয়োগ-নৈপুণ্যের নিখুঁত কৌশলে সৃষ্টিকর্তার উপরও টেক্কা দিতে শিখিয়াছে সে। বাস্তবিক রূপচর্যাকে যদি শিল্পকলা হিসাবে ধরা যায় তো তাপসীকে ভালো শিল্পী বলা উচিত। সাজসজ্জায় অতিমাত্রায় আধুনিক হওয়াটাই যে সৌন্দর্যের মাপকাঠি এ বিশ্বাস তাহার নাই, তাই ফ্যাশনশাস্ত্র লঙ্ঘন করিয়া নিজেকে ইচ্ছামত ফুটাইয়া তুলিতে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না সে।
মেয়ের সঙ্গে তাই আর কোনকালেই বনিল না চিত্রলেখার।
নিজের তো সব পথ বন্ধ–বৈধব্যের বেশের উপর কতটাই আর পালিশ লাগানো যায়? অতএব মেয়ের উপর দিয়া মনের সাধ মিটানোর ইচ্ছাটা কি খুব বেশী অন্যায় চিত্রলেখার? কিন্তু মেয়ে যেন বুনো ঘোড়া। তা নয়তো দেশী বিলাতী সকল দোকান ঘুরিয়া চিত্রলেখা নিজে যে শাড়ী ব্লাউজ জুতা ম্যাচ করিয়া কিনিয়া আনিয়াছে, মানানসই সেই জুতাটাকে বাতিল করিয়া দিয়া একটা জরির চটি পরিয়া বেড়াইতেছে মেয়ে! তার উপর আবার কপালের উপর পিতামহীর আমলের একটা মুক্তার সিঁথি!
দেখিয়া গলায় দড়ি দিয়া মরিতে ইচ্ছা হয় কিনা!
বাছিয়া বাছিয়া আবার কেমন দিনটিতে এহেন কিম্ভুত সাজ করা! কিনা যেদিন কিরীটীর আসিবার কথা!
কত চেষ্টায় চিত্রলেখা এই ছেলেটিকে যোগাড় করিয়া আনিয়া মেয়ের চোখের সামনে ধরিয়া দিয়াছে–আর মেয়ের মোটে গ্রাহ্যই নাই! অথচ এমন একটি পাত্র গাঁথিয়া তুলিতে পারিলে যে কোনো মেয়ে ধন্য হইয়া যায়!
শুধুই কি বিদ্যায়? বুদ্ধিতে, সৌজন্যে, অর্থে, স্বাস্থ্যে অতুলনীয় বলিলেও অতিরঞ্জন হয় না। তার উপর রূপ–যেটা পুরুষের পক্ষে বাড়তি বলিলেও চলে। সে হিসাবে সৃষ্টিকর্তার একটি বেহিসাবী অপচয়ের নমুনা কিরীটী। এত রূপ, এত গুণ, এত টাকা কিরীটীর, তবু মেয়ের অন্ত পাওয়া ভার। কখনো মনে হয় বেশ সুরাহা-কিরীটীর আসার কথা থাকিলে মেয়ের যে উন্মুখ চাঞ্চল্য সে তো আর চিনিতে ভুল হয় না চিত্রলেখার, কিন্তু পরদিনই আবার সব গোলমাল হইয়া যায়, নিজের হিসাবের উপর আর আস্থা থাকে না। হতাশ চিত্রলেখা হাল ছাড়িয়া দিয়া নিজের মরণ কামনা করিতে বসে।
এই তো সেদিন কিরীটী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে মাত্র, আর নাকের উপর দিয়া গটগট করিয়া বাহির হইয়া গেল বেবি! ভদ্রতা রক্ষা হইল কিভাবে–না “এই যে মিস্টার মুখার্জি, ভালো তো? বসুন, মা আছেন।” ব্যস! যেন তোর মার চরণ-দর্শন-পিপাসাতেই এক গ্যালন পেট্রল পুড়াইয়া তোদের দরজায় আসিয়াছেন মিস্টার মুখার্জি! মূর্খ! মূর্খ! তাছাড়া আর কিছুই নয়! যেমন নির্বোধের বংশ! শেষ পর্যন্ত স্বর্গবাসী স্বামী আর কাশীবাসিনী শাশুড়ী ঠাকুরাণীর উপরেই সমস্ত ক্রোধটা গিয়া পড়ে।
আজও যে মেয়ের এই সৃষ্টিছাড়া সাজ, এ আর কিছুই নয়–কিরীটীর উপর অবহেলা দেখানো আর মায়ের সঙ্গে যুদ্ধ-ঘোষণা। ওই যে সকালবেলা ফোন করিয়া জানাইয়া রাখিয়াছে কিরীটী যে সন্ধ্যার ‘শো’র জন্য চারখানা টিকিট কিনিয়া রাখিয়াছে লাইট-হাউসের, তাই আগে হইতেই বিদ্রোহের সাজ! কত বুদ্ধিমান আর অমায়িক ছেলে! বেবিকে একলা লইয়া গেলেই কি আপত্তি করিত চিত্রলেখা? তা তো নয়–তবু সব সময় অমিতাভ, সিদ্ধার্থ সকলকে সঙ্গে নেয়। অথচ বাঙালীর ঘরের কূপমণ্ডুক ছেলেও নয়–ইয়োরোপ আমেরিকা জাপান সর্বত্র ঘুরিয়া আসিয়াছে। শিক্ষা সহবৎ বুদ্ধি বিবেচনায় অনিন্দ্য। হাজারেও একটা অমন ছেলে মেলে না। কিন্তু হতভাগা মেয়ে কিছুরই মর্যাদা দেয় না।
‘বলিব না’ প্রতিজ্ঞা করিয়াও শেষ অবধি থাকিতে পারে না চিত্রলেখা। মেয়েকে ডাকিয়া প্রশ্ন করে–এটা কি হয়েছে বেবি?
–কোন্টা মা? সরল সুরে প্রতিপ্রশ্ন করে তাপসী।
-এইটা, তোমার এই বিদঘুঁটে সাজটা! আবার তুমি ওই বিশ্রী গয়নাটা কপালের ওপর চড়িয়েছ? সিনেমা যাবার কথা রয়েছে না আজ?
–সিনেমা? কই?
–ন্যাকামি করিসনে বেবি, সকালবেলা ফোন করল না কিরীটী?
–ও হো হো, ভুলেই গেছলাম। যাকগে গেলেই হবে, কিন্তু সিঁথি পরলে ঢুকতে দেবে না, কি বলছ?
–বলছি আমার মাথা আর মুণ্ডু! ওই জঘন্য সাজটা সেজে যেতে লজ্জা করবে না তোর?
–কেন লজ্জা করবে? বাঃ, নানির এই সিঁথিটার দাম এখন কত জানো?
-জানি না, জানতে চাইও না। দামী হলেই সেটা বাহার হয় না সব সময়। তাহলে ওই ‘গিনি’র মালাটাই বা গলায় ঝুলিয়ে বেড়াও না কেন? ওরও তো অনেক দাম!
–ওটা আমার ভালো লাগে না তাই। ওর তো কোনো সৌন্দর্য নেই।
–আর এইটার খুব আছে, কেমন? আচ্ছা যতই সৌন্দর্য থাক, ওটা খুলে ফেল আজ, আর ওই জরির চটি!
–পাগল হয়েছ মা! কি একটু সিনেমা যাব তার জন্যে আবার নতুন করে এত কাণ্ড! যা আছি বেশ আছি।
–আচ্ছা বেবি, তুই কি আমায় পাগল করবি? এ রকম সেকেলেপনা দেখলে কিরীটী কি মনে করবে বল তো?
–পাগল তোমায় নতুন করে করতে হবে না মা, নিজেই তুমি যথেষ্ট পাগল আছ। জগতে এত লোক থাকতে মিস্টার মুখার্জি কি মনে করবেন ভেবে এত দুশ্চিন্তা কেন?
চিত্রলেখা মেয়ের ইচ্ছাকৃত ন্যাকামি আর বরদাস্ত করিতে পারে না, জ্বলিয়া উঠিয়া বলে দুশ্চিন্তা কেন তা তুমি বোঝ না? তুমি কি মনে কর তুমি ভিন্ন আর পাত্রী জুটবে না ওর? নেহাৎ নাকি অতি অমায়িক, অতি ভদ্র ছেলে, তাই এখনো পর্যন্ত তোমার খামখেয়ালীপনা সহ্য করছে! একবার যদি মন ঘুরে যায়–
তাপসী এইবার কিঞ্চিৎ গম্ভীর হইয়া পড়ে। ধীরস্বরে বলে কার কখন মন ঘুরে যাবে সেই ভয়ে কাতর হওয়া আমার পোয় না মা। বাংলাদেশে পাত্রীর অভাব নেই, ওঁর যে একটাও জুটবে না এমন বাজে কথা ভাবতেই বা যাব কেন? কিন্তু আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি? শুধু শুধু খানিকটা ভুল ধারণা নিয়ে থেকো না।
ভুল ধারণা! চিত্রলেখা করিবে ভুল ধারণা? মেয়েকে বরং সে বুঝিয়া উঠিতে অক্ষম হইয়া পড়ে মাঝে মাঝে, কিন্তু কিরীটীর বিষয়ে ভুল করিবার কিছু নাই। কাছাকাছি আসিলেই তাহার চোখে মুখে যে আলো জ্বলিয়া ওঠে সে আলো চিনিতে কি ভুল হয়? সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া কত নীলনয়না রূপসীর, বিদ্যাবতী তরুণীর মোহ এড়াইয়া সে যে চিত্রলেখার মেয়ের হৃদয়দ্বারে প্রার্থী হইয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এটাই কি সোজা বিস্ময়? হউক না তাহার সুন্দর মেয়ে, তবু বিদেশিনীদের রূপগুণ হাস্যলাস্য আকর্ষণী শক্তির কাছে কি? তাহাদের তুলনায় সত্যই কিছু আর চোখে পড়িবার মত নয় তাপসী। তবু কিরীটী যে বেবির প্রেমে পড়িয়াছে একথা চন্দ্র সূর্যের মতই সত্য। চিত্রলেখার ধারণা ভুল নয়।
হঠাৎ একটা কথা মনে হয়–তাপসীর এই যে অবহেলার ভাব, বোধ করি বা অভিমান, হয়তো কিরীটীর প্রেমে আজও সন্দেহ আছে তার, তাই মাঝে মাঝে নিজেকে সরাইয়া লয়। তাই মাকে বলিল, মিথ্যে খানিকটা ভুল ধারণা নিয়ে থেকো না। অর্থাৎ মিথ্যা আশা মনে পোষণ করিও না।
মেয়ের খামখেয়ালী ব্যবহারের খানিকটা হদিস আবিষ্কার করিয়া ফেলিয়া চিত্রলেখা বেশ খানিকটা ধাতস্থ হয়। প্রসন্ন কণ্ঠে বলে–ভুল ধারণা কিছুই নয় রে বাপু, কিরীটীর মন জানতে আর বাকী নেই আমার, এখন শুধু অপেক্ষায় আছে বোধ হয়–দেখি এদিক থেকে কোনো প্রস্তাব ওঠে কিনা। তা এইবার আমি—
প্রস্তাব তো চিত্রলেখা কবেই করিত, কেবলমাত্র মনমর্জি’ মেয়ের ভয়েই সাহস করে না। যা থাকে কপালে, এইবার একটা হেস্তনেস্ত করিয়া ছাড়িবে সে নির্ঘাত।
তাপসী আরো বেশী গম্ভীরমুখে বলে-দেখ মা, তোমায় বাপু বারণ করে দিচ্ছি, ওসব যা তা করতে যেও না। মানুষ কি পুতুল–যে একটাকে নিয়েই বার বার খেলা যায়?
–কি হল কথাটা? চিত্রলেখা তীক্ষ্ণ সুরে প্রশ্ন করে-তোমার এ কথার অর্থ?
–অর্থ-টর্থ জানিনে মা, শুধু তোমায় বলে রাখছি, আমার ওপর থেকে আশা ছাড়ো। আজ মিস্টার মুখার্জি পছন্দ করবেন না বলে আমি শাড়ী ছেড়ে স্কার্ট ধরব–অথবা কাল মিস্টার লাহিড়ী পছন্দ করছেন না ভেবে চা ছেড়ে কোকো ধরব–এসব আমাকে দিয়ে হবে না।
দুই চোখে অগ্নিবাণ হানিয়া চিত্রলেখা কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর ক্রুদ্ধ স্বরে বলে–তোমার মতলবটা আমাকে খুলে বলবে?
–আমার আবার মতলব কিসের! যেমন আছি তেমনি থাকব–ব্যস!
–ব্যস্? এ কি ছেলেখেলা পেয়েছ নাকি?
–অকারণ রাগ করছ কেন মা? নানির দেওয়া গয়নাগুলো আমার পরতে ভালো লাগে তাই। পরি, তোমার যদি খুব বিরক্তিকর লাগে, আর পরব না। কপাল হইতে সিঁথিটা খুলিয়া ফেলিতে উদ্যত হয় বেবি।
চিত্রলেখা বোধ করি কিছুটা অপ্রতিভ হয়, ঈষৎ নরম গলায় বলে–থাক থাক, ব্যস্ত হবার দরকার নেই, কিন্তু কথা হচ্ছে, কিরীটীর বিষয়ে একটা কিছু স্থির করে ফেলা উচিত নয় কি? সত্যি কিছু আর এভাবে অনিশ্চিতের আশায় দিন কাটিয়ে বসে থাকবার মত সস্তা ছেলে ও নয়, শুধু তোমাকে একটু বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছে বলেই এখনো তোমার এসব খামখেয়াল সহ্য করছে। কিন্তু জেনে রেখো সুযোগ বার বার আসে না। অবশ্য ওকেও যদি তোমার পছন্দ না হয় আলাদা কথা, কিন্তু তা না হলে বলব সেটা তোমার পক্ষে রীতিমত দুর্ভাগ্য।
–ভাগ্যটা তো আমার নেহাতই দুর্জন মা, নতুন করে আর কি বদলাবে তুমি?
যদিও তাপসী পরিহাসের ছলেই আপন ভাগ্যের নিন্দা করে, তবু মনে হয় ব্যঙ্গের আড়ালে কোথায় যেন রহিয়াছে হতাশার সুর।
চিত্রলেখার মাতৃহৃদয় কাঁপিয়া ওঠে। মুখরা হউক, রুক্ষমেজাজী হউক, তবু মা। এই যে আজ দশ-বারো বৎসর যাবৎ লড়িয়া আসিতেছে চিত্রলেখা-মেয়ের সেই পুতুল খেলার বিয়েটা নাকচ করিয়া ফেলিবার চেষ্টায়, সে কার জন্য? মেয়েটা সুখী হোক, সংসার করুক, জীবনকে উপভোগ করিবার পথ খুঁজিয়া পাক–এই না উদ্দেশ্য?
বিগলিত স্বরে বলে–ভাগ্য কেন খারাপ হবে? কখনই না। মানুষের অবিবেচনার ফলে যে দুর্ভাগ্য, সে দুর্ভাগ্যকে কেন স্বীকার করে নেব আমরা? আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি বেবি, এত লেখাপড়া শিখে তুমি এখনো এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছ?
তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে, সেটা খুব মিথ্যে নয় মা, তোমার মতন অত সংস্কারমুক্ত হতে পারিনি এখন, ভবিষ্যতে যদি পারি দেখা যাবে।
পূর্বতন সেই ‘বিবাহ’ নামক খেলাটার নাম আর স্পষ্ট করিয়া কেহই উল্লেখ করে না, শুধু কথার যুদ্ধ চলে। চিত্রলেখা মেয়ের বিদ্রুপে জ্বলিয়া উঠিয়া বলে–এই যদি তোমার উচ্চ আদর্শ হয়, তাহলে ও ছেলেটাকে টাঙিয়ে রেখে ফ্লার্ট করবার তো কোন মানে দেখি না!
–মা ছি!
চিত্রলেখা কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মনে মনে একটু যে কুণ্ঠিত হয় নাই তা নয়, কিন্তু সেটা প্রকাশ করাও সম্মানজনক নয়, তাই আরো জেদের সঙ্গে বলিয়া বসে নিশ্চয়ই তো, নিজের ব্যবহার নিজে বোঝবার মত বুদ্ধি তোমার হয়নি এটা বলবে না অবশ্যই! কিসের আশায় সে যখন তখন এসে দোরে ধর্না দেয়-রাশ রাশ টাকা খরচা করে? এতদিনে অনায়াসে জবাব দিতে পারতে তুমি–দেওয়া উচিত ছিল।
তাপসী বিরক্তি-গম্ভীরস্বরে বলে–কে কিসের আশায় কি করছে, তার জন্যে আমি দায়ী হতে যাব কি দুঃখে? আর জবাবের কথা যদি বলল, মিছিমিছি গায়ে পড়ে জবাব দিতে যাব কেন? প্রশ্ন যদি আসে, জবাব দিতে দেরি হবে না তা দেখো।
মেয়ের এ হেন কথা শুনিয়া চিত্রলেখা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এটা কিছু বিচিত্র নয়। দীর্ঘকাল যাবৎ যে আশাতরুর মূলে জলসিঞ্চন করিয়া অসিতেছে–মেয়ে যদি এক কথায় তার মূলে কুঠারাঘাত করিয়া বসে, মনের অবস্থা কেমন হয়?
তাপসীর সঙ্গে মুখোমুখি কোন কথাই কোনদিন হয় নাই এটা ঠিক, তবু চিত্ৰলেখার নিশ্চিত ধারণা ছিল–এতদিনে মেয়েটা নিজেকে কুমারী কন্যা বলিয়াই স্বীকার করিয়া লইয়াছে এবং মনে মনে ভবিষ্যতের রঙিন ছবি আঁকিতেছে, কিন্তু আজকের কথাবার্তাগুলো তো তেমন সুবিধাজনক নয়! শেষ পর্যন্ত এমনি গণ্ডমূর্খ হইল মেয়েটা? এত বড় জীবনটা কাটাইবার একটা অবলম্বনও কি প্রয়োজন হইবে না? বিধবা তবু স্বামীর স্মৃতি বুকে ধরিয়া–আচ্ছা বিধবা-বিয়েও তো হয়! এক যুগ আগেকার সেই ধূমকেতুর মত সর্বনেশে অপয়া ছেলেটা বাঁচিয়া আছে কিনা সন্দেহ। শোনা গিয়াছিল তিন কুলে নাকি কেহ নাই তাহার–তবে? এখনো কি আর টিকিয়া থাকা সম্ভব? টাকাকড়িগুলা পাঁচজনে ভুলাইয়া লইয়াছে, ছেলেটা হয়তো
সব চিন্তাগুলি মনের মধ্যে ভিড় করিয়া উঠিতেই দিশাহারা চিত্রলেখা ক্রুদ্ধ আর তীব্র প্রশ্ন করে–তুমি তাহলে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী হতে চাও, কেমন? তা হবে নাই বা কেন? তোমার নানি তো স্বেচ্ছাচারী হবার রাস্তা খুলেই দিয়ে গিয়েছেন। কারুর মুখাপেক্ষী তো নও! জমিদারির মালিক
নিতান্ত ক্রোধের বশেই এত বড় কটু কথাটা উচ্চারণ করে চিত্রলেখা। বস্তুত হেমপ্রভার দানপত্র অনুসারে তাপসীই সব কিছুর উত্তরাধিকারিণী হইলেও সেটা নিতান্তই অভিনয়ের মত–চিত্রলেখাই সব। তাছাড়া বুদ্ধি-বিবেচনা হইবার পর হইতেই তাপসী ক্রমাগতই এই ব্যাপারটার প্রতিবাদ করিয়া আসিতেছে, কিন্তু প্রতিকার এখনো কিছু হইয়া উঠে নাই। কিন্তু সেই কথা লইয়া যে এমন তীক্ষ্ণ খোঁচা মারিবে চিত্রলেখা, এইটাই ধারণা ছিল না তার।
মর্মাহত তাপসী কি একটা বলিতে যাইতেছিল, সেই সময় সিদ্ধার্থ আসিয়া সংবাদ দিল–মা, দিদি, মিস্টার মুখার্জি এসেছেন!
বেপরোয়া কিশোর তরুণ, তবু বলিবার ভঙ্গী দেখিয়া মনে হয় মিস্টার মুখার্জি সম্বন্ধে মনোভাবটা নেহাতই বিগলিত। দিদি অগ্রাহ্য অবহেলার ভাব দেখাইলে দিদিকে তিরস্কার করিতে ছাড়ে না।
শুধু অমিতাভকেই নিরপেক্ষ মনে হয়।
চিত্রলেখা হতাশভাবে দুই হাত উল্টাইয়া বলে–আর মিস্টার মুখার্জি।
সিদ্ধার্থ বিস্মিতভাবে বলে–কি হলো?
–কিছু নয়, তোমার দিদির সিনেমা যাওয়ার রুচি নেই।
সিদ্ধার্থ মা’র কথার উত্তরে বিরক্তভাবে বলে–বাঃ, মজা মন্দ নয়! দাদা বললে যাব না, দিদি এখন ওই বলছে, আমিই বুঝি বোকার মত যাব শুধু?
তাপসী মৃদু হাসিয়া বলে–কেন, অভীর কি হলো?
–কি আবার হবে, হয়েছে মান! মেয়েদের মত কারুর সঙ্গে যাবেন না বাবু, নিজের কি হাত-পা নেই? হাত-পা যেন আমারই নেই, তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে কিনা!
–নিশ্চয়ই আছে। তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে–ভদ্রতা রাখতে নিশ্চয় যাওয়া দরকার–কি বল সিদ্ধার্থবাবু? তাছাড়া মেয়েদের তো আবার নিজের হাত-পাও নেই, কারুর সঙ্গে যাওয়া ছাড়া উপায় কি? নিতান্ত স্বচ্ছন্দগতিতে সিদ্ধার্থর সঙ্গে নীচে নামিয়া যায় তাপসী। সন্দেহ নাই মিস্টার মুখার্জির উদ্দেশ্যেই।
চিত্রলেখা মেয়ের গমনপথের পানে যে দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকেন, তাহার সংজ্ঞা পাওয়া ভার। ক্রোধ? ক্ষোভ? ঘৃণা? অবিশ্বাস? না হতাশা?–মেয়েকে বুঝিতে না পারার হতাশা! বারান্দায় গিয়া উঁকিঝুঁকি মারিবার এনার্জি আর থাকে না চিত্রলেখার। বসিয়া বসিয়া এক সময় শুনিতে পান–মোটর বাহির হইয়া গেল। অমিতাভ যায় নাই, কণ্ঠস্বর পাওয়া যাইতেছে বাড়ীতে।
মিস্টার মুখার্জি বা কিরীটীকে যে অমিতাভ বিশেষ সুচক্ষে দেখে না, তা তাহার এড়াইয়া যাওয়ার ভঙ্গীতেই ধরা পড়ে। নিতান্তই অনুরোধে না পড়িলে কিরীটীর সঙ্গে কোথাও যাইতে চাহে না।
কিন্তু কেন?
.
ভালো লাগে না–ভালো লাগে না কিছুই ভালো লাগে না। ভালো লাগিবার সহস্র উপকরণ চারিদিকে থরে থরে সাজানো থাকা সত্ত্বেও যেন একটা ভালো না লাগা’র” তীক্ষ্ণ কাঁটা অহরহ বিধিয়া থাকে মনের ভিতর। কোনমতেই দূর করা যায় না সেই অদৃশ্য শত্রুকে। চলিতে, ফিরিতে, খাইতে, শুইতে এই কাটা যেন প্রতিনিয়ত স্মরণ করাইয়া দেয়–”তুমি অস্বাভাবিক, তুমি অদ্ভুত, তুমি সৃষ্টিছাড়া! সব কিছুতেই খুশী হইয়া উঠিবার অধিকারী তুমি নও, জন্মলগ্নের ক্রুর পরিহাসে সে যোগ্যতা তুমি হারাইয়াছ!”
খুশী হইতে গিয়াও তাই খুশী হইতে পারে না তাপসী, ঠিক অন্তরঙ্গ হইতে পারে না কাহারও কাছে। পারে না ঠিকমত সহজ হইতে। হাসিতে গিয়া থামিয়া পড়ে, ভালোবাসিতে গিয়া ফিরিয়া আসে। অনেক সময় তাই ব্যবহারটা তাহার সামঞ্জস্যহীন উল্টাপাল্টা, অন্যের কাছে দুর্বোধ্য।
অন্যের কথা দূরে থাক, চিত্রলেখা মা হইয়াও আজ পর্যন্ত চিনিতে পারিলেন না তাহাকে, পারিলেন না খুশী করিতে। বাজার উজাড় করিয়া উপহার সামগ্রী দিয়া নয়, হৃদয় উজাড় করিয়া ভালোবাসা দিয়াও নয়।
তাছাড়া কিরীটীর কথাই ধরো, তাপসীকে এতটুকু খুশী করিতে পাইলে যে বেচারা ধন্য হইয়া যায়, সে কথা তো আর এখন গোপন নাই! চেষ্টারও ত্রুটি রাখে নাই, কিন্তু পারিল কই! তাপসীর পায়ের কাছে প্রাণটা ঢালিয়া দিলে, বড় জোর আনন্দ-প্রকাশের প্রসাদ বিতরণ করিতে পারে তাপসী, খুশী হইতে পারে না।
কিরীটী হয়তো ভাবে নিজের ত্রুটি, কিন্তু তাপসী তো জানে ত্রুটি কার। ভালোবাসা পাইয়া খুশী হইবার, ধন্য করিয়া ধন্য হইবার সৌভাগ্য তাপসীর নয়। শিশু তাপসীকে খুঁটি করিয়া যাহারা ইচ্ছামত খেলা করিয়া গিয়াছে, তাহাদের উপর ক্রোধে ক্ষোভে মাঝে মাঝে যেন হাত পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে ইচ্ছা হয় তাপসীর। কিন্তু ইচ্ছাটা তো আর কার্যে পরিণত করা চলে না, তাই আগাগোড়া ব্যবহারই তাহার সঙ্গতিহীন দুর্বোধ্য। চিত্রলেখার মত যদি খেলাটাকে খেলার মতই ঝাড়িয়া ফেলিয়া সহজ হইতে পারিত তবে হয়তো বাঁচিয়া যাইত। কিন্তু পারিল কই? পারে না। বলিয়া কিরীটীর সঙ্গে পাশাপাশি বসিয়া সিনেমা দেখিতে দেখিতে মাথার যন্ত্রণায় এত বেশী কাতর হইতে হয় তাহাকে যে হল’-এর ভিতর বসিয়া থাকা অসম্ভব হয়।
অমিতাভ অবশ্য আসে নাই, দিদির এলোমেলো ব্যবহার সে বরদাস্ত করিতে পারে না, কিন্তু আজকের ব্যবহারে সিদ্ধার্থও কম চটে না। সেও আর এত ছেলেমানুষ নাই যে দিদির এসব যে। “টং ছাড়া আর কিছু নয়” এটুকু বুঝিতে অক্ষম হইবে? এমন ভাল ছবিখানা দেখিতে দেখিতে মাঝখানে হঠাৎ বাড়ী ফিরিবার বায়না লইলে কেই বা না চটে? তাই মনের রাগ মনে চাপিয়া গম্ভীরভাবে বলে–সে কি মিস্টার মুখার্জি, আপনি কেন যাবেন? বরং আমিই দিদিকে নিয়ে
কিরীটী ব্যস্ত হইয়া উত্তর দেয়–না-না, আরে তুমি বোস না, আমি ওঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আবার এসে জুটছি দেখ না! যাব আর আসব–
‘তা আর নয়’–সিদ্ধার্থ মনে মনে বলে–গিয়ে আবার আপনি এখুন আসবেন! তা হলে আর ভাবনা ছিল না–ড্রইংরুমে ঘণ্টাখানেক, সিঁড়ির সামনে আধঘণ্টা, গেটের ধারে কোন না। মিনিট কুড়ি! ততক্ষণে আর একটা শো শুরু হয়ে যাবে!
যাক, মনে মনে কি না বলে লোকে! ভদ্রতাটা বজায় রাখিতে বলিতে হয়–দেখুন দিকি কী অন্যায়! মাঝখান থেকে আপনারও দেখা হল না। দিদির এই এক রোগ–মাথাধরা! যখন-তখন মাথা ধরলেই হল!
দিদিটি ততক্ষণে ‘গটগট’ করিয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন। ব্যবহারে চক্ষুলজ্জার বালাই মাত্র নাই। অসময়ে মাথা ধরাইয়া অপরের ক্ষতির কারণ হইলে যে লোক-দেখানো কুণ্ঠার ভাবও দেখাইতে হয়, এটুকু সভ্যতার রীতিও মানিয়া চলিতে রাজী নয় যেন।
কিরীটী গাড়ীর দরজা খুলিয়া সরিয়া দাঁড়ানো পর্যন্ত একটি কথাও বলে না তাপসী। গাড়ীতে উঠিয়া জুৎ করিয়া বসার পর বলে–আপনি ছবিটা ছেড়ে না এলেও পারতেন, আমি কি আর এটুকু একলা যেতে পারতাম না?
–নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু আমার একটা কর্তব্য আছে অবশ্যই।
–কর্তব্য? ওঃ!
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না, মনে হয় যেন উত্তর খুঁজিতেছে, কিন্তু মিনিট কয়েক পর্যন্ত কিছুই বলে না, জনবহুল পথে সাবধানে গাড়ীটি চালাইয়া যায় মাত্র।
কিছুক্ষণ কাটে–তাপসীই হঠাৎ প্রশ্ন করে–অথবা ঠিক প্রশ্নও নয়–কথা। নীরবতাকে এড়াইবার জন্য অর্থহীন কথা একটা-বাবলু খুব চটে গেল, কি বলেন!
–কেন, চটে যাবে কেন? উত্তরটা দিয়া হয়তো একবার মুখ ফিরাইয়া পার্শ্ববর্তিনীর মুখটা দেখিয়া লয়, কিংবা তার মাথা ডিঙাইয়া রাস্তার ওদিকটা–ঠিক বোঝা যায় না।
–কেন? তাপসী অল্প একটু হাসে–অসময়ে এ রকম মাথা ধরলে ও ভারি চটে যায়।
–কেন, ওর তো এ রকম মাথাধরা দেখা অভ্যাস আছে!
–তাহলে দেখা যাদের অভ্যাস নেই, তাদেরই চটা উচিত, এই আপনার অভিমত?
–আমার কোন মতামত নেই। অসুখের ওপর তো হাত চলে না।
–আপনি খুব উদার! তীক্ষ্ণ শোনায় তাপসীর কণ্ঠস্বর–আর ধরুন যদি অসুখটা ইচ্ছাকৃত হয়? তাহলেও রাগ হবে না আপনার?
–তাতেও না। কিরীটীর স্বরে আকস্মিক বিস্ময়ের আভাস নাই, যেন জানা কথা, এইভাবেই। বলে–সেটা তো হবে আরও হাতের বাইরের ব্যাপার।
–ওঃ, কিছুতেই তাহলে যায় আসে না আপনার?
–এসব কথা এত তাড়াতাড়ি বলা শক্ত।
–থাক বলতে হবে না। উঃ, বাড়ী গিয়ে শুতে পেলে বাঁচি!
এবারও কিরীটী নিরুত্তর। উত্তর দেয় বাড়ীর দরজায় নামাইয়া দিয়া–আপনার কষ্টের কারণ হলাম বলে দুঃখিত। কি আর করা যাবে–পৃথিবীতে নির্বোধ লোক তো কিছু কিছু থাকবেই। যাক, শুয়ে পড়ুনগে তাড়াতাড়ি।
–মা শুতে দিলে তো!
তাপসীর চোখে যেন কৌতুকের আভাস, কিছু আগে যে রীতিমত বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছে বোঝা যায় না।
–মা শুতে দেবেন না! তার মানে?
–তার মানে, অসময়ে বাইরে থেকে এসে শুয়েছি দেখলে ডাক্তার না ডেকে ছাড়বেন না।
–তা ডাক্তার আপনার জন্যে ডাকাই উচিত।
–কেন? ব্রেনের চিকিৎসা করাতে?
–ধরুন তাই। সত্যি আপনি কেন যে এমন খাপছাড়া তাই ভাবি। বেশ থাকেন, হঠাৎ কি যে হয়!
–একেবারে সাধারণ হওয়াই কি ভালো?
–আমার তো তাই ভালো মনে হয়। আশপাশের লোকেরা একটু নির্ভয়ে পথ চলে।
–ভয় করবারই বা দরকার কি?
–কি জানি, হয়তো বোকামি!
–নিজেকে বোকা ভাবতেও বোধ হয় খুব ভালো লাগে আপনার?
–লাগে না? তবে বোকামি ধরা পড়লে স্বীকার করতে বাধে না। আচ্ছা চলি।
–যাচ্ছেন? ওঃ, নমস্কার। অবশ্য ফিরে যেতে যেতে ছবিটা ফুরিয়ে যাবে।
–ছবির জন্যেই মরে যাচ্ছি, এই আপনার মনে হয়?
–বাঃ, মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এত তাড়াতাড়ি পালাবার আর কি কারণ থাকতে পারে তবে?
–বেশ। করব না তাড়াতাড়ি, ছোট সাহেবকে ফিরিয়ে আনার টাইমে গেলেই হল।
হাতের ঘড়িটা একবার হাত উল্টাইয়া দেখিয়া লয় কিরীটী।
‘ছোট সাহেব’ অর্থে সিদ্ধার্থ।
–বাবলু রাস্তা হারিয়ে ফেলবে না নিশ্চয়!
–রাস্তা হারিয়ে কেউ ফেলে না, তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে তো?
–আছে বৈকি। আপনার কাছে তো আবার শুধু ওই একটা জিনিসই আছে। বিদ্রুপে তীক্ষ্ণ স্বর।
কিরীটী স্পষ্ট সোজাসুজি একবার চাহিয়া দেখে তাপসীর চোখের দিকে। কি চায় তাপসী? কোন উত্তর? কোন প্রশ্ন? কেন ওর স্বভাবে এমন অসঙ্গতি? এক মিনিট চুপ থাকিয়া বলে–এর উত্তর আছে আমার কাছে, কিন্তু আজ হয় না।
–কেন, ক্ষতি কি?
কিরীটী আবার কিছু বলিতে গিয়া থামিয়া যায়–অমিতাভও বেড়াইয়া ফিরিতেছে। বাঁকাচোখে দুইজনের দিকে একবার চাহিয়া টকটক করিয়া গাড়ীবারান্দার সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া যায়–কথা বলে না।
কিরীটীকে সে দেখিতে পারে না এটা অবশ্য এতদিনে ধরা পড়িয়াছে, কিন্তু এমন স্পষ্ট অবহেলা বড় একটা করে না।
–আচ্ছা ধন্যবাদ, চলি।
তাপসী নিজেও তো সর্বদা ভদ্রতার বিধি মানিয়া চলে না, তবু কি ভাইয়ের ব্যবহারে কুণ্ঠিত হইয়াছে? তা নয়তো অমন দুর্বল আর ফ্যাকাসে শোনায় কেন তার গলা?
–উত্তরটা কিন্তু শোনা হলো না আমার!
–না-হয় না হলে, ক্ষতি কি? সারা দুনিয়াটাই তো প্রশ্নে মুখর, উত্তর কোথায়?–নমস্কার। এবার সত্যই চলিয়া যায়।
.
–কি রে কি হলো? চলে এলি যে? মাথা ধরেছে নাকি? অন্ধকার ঘরে টুক করিয়া এতটুকু একটু শব্দ, পরক্ষণেই আলোর বন্যায় ভাসিয়া গেল সব। চিত্রলেখার উৎকণ্ঠিত প্রশ্নের বাকিটা যেন মেয়ের বিছানার কাছে আসিয়া আছাড় খাইল–কখন ফিরেছিস? মাথা ধরল কেন?
–মাথা ধরার আবার কেন কি? এমন কিছু তো নতুন নয় ব্যাপারটা! তাপসী উঠিয়া বসে।
–নয় তা তো বুঝলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ সিনেমা দেখতে গিয়ে–চিত্রলেখা মেয়ের কাছে বেশ একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া বসে–থাক না, উঠছিস কেন? বলছি–হঠাৎ এভাবে মাথা ধরা ইয়ে–কিরীটী কিছু বললে-টললে নাকি? এত মৃদু কণ্ঠস্বর চিত্রলেখার, যেন ফিসফিস করার মত শোনায়।
–বলবে আবার কি? আর মাথা ধরার সঙ্গেই বা সম্পর্ক কি তার? বিরক্তি গোপন না করিয়াই উত্তর দেয় তাপসী।
–না, মানে–তাই বলছি। ইয়ে–একটা কিছু না হলে–
–তুমি কি বলতে চাও, বলো তো স্পষ্ট করে! তীব্রস্বরে প্রশ্ন করে তাপসী।
মেয়ের স্বরের তীব্রতায় চিত্রলেখার যেন আত্মমর্যাদা ফিরিয়া আসে। স্বরের তীব্রতায় মেয়েকে কি আর হার মানাইতে পারে না সে? খুবই পারে, নেহাৎ মেয়ের উপর সহৃদয়তা দেখাইতে আসিয়াছে বলিয়াই না! কি জানি, কিরীটীর কোন ব্যবহারে মর্মাহত হইয়াই বিছানা লইয়াছে কিনা বেচারা! অবশ্য কিরীটী তেমন ছেলে নয়, কিন্তু মানুষের ধৈর্যেরও তো সীমা আছে একটা। নিজের মেয়ের মেজাজটিও তো জানিতে বাকি নাই তাহার। আর কিছু নয়–ওই যে সিঁথি-টিতি পরিয়া একটা কিম্ভুতকিমাকার বেশে সিনেমায় যাওয়া, সেই সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কোন মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকিবে। অথবা কি জানি হয়তো বা তাও নয়–বিবাহের প্রস্তাব! কিন্তু যাই হোক, আর নরম হইবে না চিত্রলেখা, তীব্রস্বরের টেক্কা দিয়া সেও বলে–কি বলতে চাই সেটুকু বোঝবার মত বুদ্ধি অবশ্যই আছে তোমার! এমন কচি খুকী নও! বলতে চাই কিরীটী আজ প্রোপোজ করেছে কিনা? নিজের আমলের ভাষাই ব্যবহার করে সে।
প্রোপোজ!
তাপসী হঠাৎ হাসিয়া ফেলে–ঠিক আন্দাজ করেছ দেখছি।
চিত্রলেখা ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে বলে–সত্যি বলছিস তো? কিভাবে মানে ঠিক কি বললে বল দিকি?
–বাবলুকে জিজ্ঞেস করো না, ছিলই তো কাছে!
যেন বাবলুকে সাক্ষী রাখিয়া মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছে কিরীটী! শোনো কথা!
–বাবলু তো এই এল, তার মুখেই শুনলাম যে তুমি আগে চলে এসেছ। ডিরেক্ট বাড়ীই চলে এসেছিলে, না ময়দানের দিকে একটু ঘুরে-টুরে
চিত্রলেখার কথার ছাঁদে যেন কেমন একটা স্কুল লোলুপতা–যেন কথার পাচে ফেলিয়া মেয়ের কাছ হইতে কী একটা গোপন তথ্য জানিয়া লইতে চায়।
–পাগলামি কোরো না বেশী! বিছানা হইতে নামিয়া পড়িয়া টেবিলের ধারে আসিয়া একটা বই টানিয়া লইয়া বসে তাপসী।
–হোপলেস! বিরক্ত হইয়া প্রস্থান করে চিত্রলেখা। হায়! চিত্রলেখার মত নির্লজ্জ কি আর কেউ আছে জগতে? এখনও সে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবিতে যায়, ভালো করিতে চেষ্টা করে? বাবলুকে প্রশ্ন করিবার রুচিও থাকে না, যা খুশি করুক সব।
মা চলিয়া যাইতেই ঘরের আলো নিভাইয়া দিয়া আবার শুইয়া পড়ে তাপসী। মাথা ধরাটা মিথ্যাই বা বলা চলে কি করিয়া? মাথার মধ্যে যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে।-সত্যিই বটে, কতদিন আর এভাবে চালানো যাইবে? নিজের মনের চেহারা স্পষ্ট করিয়া দেখিতে ভয় করে আজকাল। এই দুরন্ত আকর্ষণকে কতদিন আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে তাপসী? কোন মন্ত্রের জোরে? কোন্ দেবতার দোহাই দিয়া? সেই প্রচণ্ড আকর্ষণের সংস্রব ত্যাগ করিবার প্রবল সংকল্প প্রতিদিনই কত সহজে ভাঙিয়া পড়ে–অথচ–না না, কিছুতেই না, সে অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব!
চিত্রলেখার সহজ হিসাবের সঙ্গে তাপসীর হিসাব মেলানো সম্ভব নয়।