০২.
মৃদুলা এবং টুকুন এক ঘরে শোয়।
দুজনের জন্যে দুটা আলাদা খাট। রাতে মৃদুলা এই ঘরেই শোয়। তবে ঘুম ভাঙ্গলেই মায়ের ঘরে চলে যায়। তাদের ঘর এবং মার ঘরের মাঝখানে একটা দরজা। দরজা সব সময় খোলা থাকে।
মুনা এদের ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে চান। কখনো তা সম্ভব হয় না। এক একবার ঘরে ঢুকলে তাঁর কান্না পায়। দুজনে মিলে ঘরটা কি যে করে রাখে! মৃদুলা এম্নিতে খুব শান্ত এবং লক্ষী মেয়ে হলেও ঘর নোংরা করায় তার দক্ষতা অসাধারণ। সে যা করে তা হচ্ছে শান্ত মুখে কাগজ ছেঁড়া। কাগজ ছেঁড়ার সময় সে গুন গুন করে গান গায়। গানের কথা এবং সুর দুইই বিচিত্র। গানের সুরে সে নিজেই সবচে মুগ্ধ হয়। মাথা দুলিয়ে হাসে। মুনাকে রোজ কয়েকবার ঝাঁট দিয়ে কাগজ সরাতে হয়। টুকুন কাগজ ছিঁড়ে না, ছবি আঁকে। ছবি আঁকে দেয়ালে। দেয়াল ভর্তি ছবি। এক সপ্তাহ আগে তাদের ঘর নতুন করে ডিসটেম্পার করা হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে দেয়ালে আর কোন ছবি আঁকা যাবে না।
মুনা তাদের ঘরে মশারি খাটাতে এসে দেখেন ডিসটেম্পার করা দেয়ালে ছবি আঁকা হয়েছে। কাকের ছবি। শুধু ছবি না, ছবির নিচে কবিতা।
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,
দুই ধারে বসে কাক ঢালু তার পাড়ি।
মুনা মশারি খাটালেন। মৃদুলার গালে চুমু খেলেন। টুকুন বড় হয়েছে বলে এখন চুমু খেতে দেয় না। তবু তিনি জোর করেই চুমু খেলেন। তিনি মশারি খুঁজতে খুঁজতে, বললেন, বাতি নিভিয়ে দেব, টুকুন?
টুকুন বলল, দাও।
ভয় করবে না তো?
না।
মুনা বাতি নিভিয়ে দিয়ে ছেলের বিছানার পাশে বসলেন। নরম গলায় বললেন, দেয়ালে ছবি তুমি একেঁছ?
হ্যাঁ। সুন্দর হয়েছে না মা?
ছেলেকে কঠিন ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। বেচারা ঘুমুতে যাচ্ছে, ঘুমুক। ঘুমের আগে বকা দিয়ে মন খারাপ করিয়ে দিতে চান না। সকাল বেলা দিলেই হবে। তিনি বললেন, ছবিটা ভালই হয়েছে।
কবিতা কেমন হয়েছে, মা?
কবিতা ভাল হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন কবিতা?
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে।
টুকুন উৎসাহে উঠে বসল, মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আসলে কি হয়েছে জান মা, আমি তো কবিতা পড়ছিলাম, তখন কাক এসে বলল, কি পড়ছ টুকুন?
আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছি, এখন বিরক্ত করবেন না।
তুমি তাকে আপনি করে বল?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, তারপর উনি কি বললেন? ..
উনি বললেন, তোমাদের রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কি কোন কবিতা লিখেছেন?
আমি বললাম, লিখেছেন। উনি তো বিশ্বকবি। বিশ্বকবিকে সবকিছু নিয়ে কবিতা লিখতে হয়। উনি তখন বললেন, দেখি আমাদের নিয়ে যেটা লিখেছেন সেটা একটু পড়তো। তখন আমি বানিয়ে বানিয়ে এই কবিতাটা বললাম।
উনি খুশি হলেন?
খুব খুশি। হাসতে হাসতে বললেন, বাহ, খুব সুন্দর লিখেছে, বৈশাখ মাসে কাক গাছে বসে থাকে। বিশ্বকবি বলেই এত সুন্দর লিখতে পেরেছেন। গ্রাম কবি, দেশ কবি হলে পারতেন না। অতি উচ্চমানের কবিতা হয়েছে।
মুনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন, কি করা যায় এই ছেলেকে নিয়ে?
টুকুন বলল, মা, উনি এত খুশি হলেন যে আমাকে বললেন, টুকুন, একটা কাজ কর তো –দেয়ালে আমার একটা ছবি এঁকে তার নিচে কবিতাটা লিখে রাখ। আমি বললাম, মা রাগ করবে। দেয়ালে নতুন করে ডিসটেম্পার করা হয়েছে। তখন উনি বললেন, না, তোমার মা রাগ করবেন না। উনাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের উপর রাগ করা ভাল না। মা, তুমি কি রাগ করেছ?
না।
বাবাকে তুমি কি বুঝিয়ে বলতে পারবে?
দেখি চেষ্টা করে পারি কিনা। তুমি এখন ঘুমাও।
.
ঘুমুতে যাবার সময় মুনা কাক এবং কাকের কবিতার কথা বললেন। চিন্তিত গলায় বললেন, ছেলেটাকে নিয়ে কি করা যায় বল তো? মাথা থেকে কাক কি করে দূর করা যায়?
রশিদ সাহেব বললেন, গরমের ছুটি হোক, ওকে নিয়ে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে আসি। ওর এই কাক নিশ্চয়ই এত দূর যাবে না। কিছুদিন পার হলে ভুলে যাবে।
মুনা বললেন, তোমার কি মনে হয় কোন ডাক্তার-টাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার?
রশিদ সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আরে দূর। এটা তো কোন অসুখ না যে ডাক্তার চিকিৎসা করবে। ছেলেমানুষি খেয়াল। দুদিন পর কেটে যাবে। আচ্ছা, কোন কাক কি সত্যি ওর জানালায় বসে?
মুনা বিরক্ত হয়ে বললেন, শেষ পর্যন্ত তোমারও বিশ্বাস হয়ে গেল? কাক তো। সব সময়ই বসে। জানালায় বসে, রেলিং-এ বসে।
ও পড়শোনা কেমন করছে?
ভালই করছে। ক্লাস টেস্ট হয়েছে। অংকে একশতে পেয়েছে একশ।
তাহলে মনে হয় চিন্তার কিছু নেই।
চিন্তা তো আমি করছি না। সারাদিন কাক কাক করে এই জন্যে বিরক্তি লাগে।
রশিদ সাহেব লেখা নিয়ে বসলেন। তিনি ব্যাংকে কাজ করেন, তবে সেই সঙ্গে লেখালেখিও করেন। তাঁর সব লেখাই বাচ্চাদের জন্যে। এখন একটি মজার বই লিখছেন –নাম একি কান্ড! খুব মজার একটা বই।