মূলে কোনও ব্যাপারই নেই–মূলে হয়তো ছিল, আসলে কিছুই ঘটেনি, তবু ওদের বিশ্বাস করানো গেল না। ওদের হাসিটা যেন হাসি না, কেমন একটা ভয় ধরিয়ে দেবার মতো অদ্ভুত শব্দ, যা ঠিক যেন মেয়েদের গলা থেকে বেরোয় না। সন্ধে হয়ে গিয়েছে, রাস্তার আলোও জ্বলছে, এখন কোথায় যাব। হাসিটা কি এখনও শোনা যাচ্ছে, ওরকম শোনাল কেন হাসিটা, মেয়েরা খিলখিল করে হাসলে তো শুনতে খুবই ভাল লাগে, ঠিক যেন–ঠিক যেন কী? যেন জলতরঙ্গের বাজনার মতো, কবিতায় বা আজকাল গল্পে উপন্যাসেও অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখে, অনেক সময় গদ্যকেই কবিতা বলে মনে হয়, মানে একটা সেনটেনসকে কয়েক টুকরো করে ভেঙে ভেঙে সাজালেই কবিতা হয়ে যায়, তাতে যেমন মেয়েদের খিলখিল হাসির কথা লেখে, যেমন ঝরনার মতো ঝরনার মতো? ঝরনার শব্দ কি খিলখিল হাসির মতো, বা খিলখিল হাসি কি ঝরনার মতো হতে পারে। ঝরনার শব্দ তো খুব জোর –অনেকটা খলখল হাসির মতো মনে হয়। সেটা বোধ হয় জলপ্রপাতের শব্দ। জলপ্রপাত আর ঝরনা বোধ হয় আলাদা, যেমন উশ্রী বা হুডরু–ওগুলোকে নিশ্চয় ঝরনা বলে না, মিনি জলপ্রপাতকে বোধ হয় ঝরনা বলে, তা হলে খলখল খিলখিল শোনাতে পারে, অথবা কবিতার ভাষায় রিনিরিনি ঠিনিঠিনি। হাসি-কথাটা মনে পড়ে গেল, আমি একবার একটা কবিতায় এরকম কথা লিখেছিলাম, ঘরে বাজে রিনিরিনি হাসি/বাহিরে গরম ধুলা ওড়ে/আঁধি, সবুজ শাড়ি সরিয়ে, বুকের পুকুরে জল দোলে/ঘরে বাজে ঠিনিঠিনি হাসি।
নিখিল বলেছিল, এ সব শালা তোদের বজ্জাতি, এই তোদের কবি শালাদের কথা বলছি। ঘরে রিনিরিনি ঠিনিঠিনি হাসি, বাইরে শালা আঁধি, আবার ওদিকে ওটা কী? সবুজ শাড়ি সরানো, বুকের পুকুরে জল দোলে? তার চেয়ে লেখ না, গাড়ি চলে, ঠোঙা ফাটে, বাদামের খোসা ওড়ে, রাইটার্স বিল্ডিং-এর মাথায় হাঁস প্যাঁক প্যাঁক!
নিখিলের কথা ওইরকম। ও আবার সব পার্টি করে তো, ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের, যাকে বলে লড়াকু–সেইরকম কর্মী, সাহিত্য কবিতা ও সব ওর কাছে কিছু না, বিশেষ করে আমার কবিতা নাকি অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া কবিদের মতো, যদিও আমিও তখন নিখিলদের পার্টিতেই ছিলাম, প্রায় সক্রিয় কর্মী বলতে যা বোঝায় অনেকটা তা-ই, তারপরে অনেক ভেবেচিন্তে আমার মনে হয়েছিল, ও পার্টি সংশোধনবাদী, তাই আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। তখন ওদের পার্টির যে সাহিত্য পত্রিকা, সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প ইত্যাদির পত্রিকা, সেই পত্রিকাতেই আমার কয়েকটা কবিতা ছাপানো হয়েছিল। নিখিলদের পার্টি–মানে সেই সংশোধনবাদী পার্টি, যে-পার্টি ছেড়ে আমি চলে এসেছি এবং পার্টি বা রাজনীতির বাইরে বা রাজনীতির চিন্তা-ভাবনার বাইরে থাকা সম্ভব নয়, কেন না, আমরা কে-ই বা তা আছি, যদি বা আমরা ওই সব, কী বলে নিরপেক্ষ টিরপেক্ষ অনেক কথা শুনতে পাই, যেটা একেবারেই বাজে কথা, কারণ, আমি নিশ্চয়ই একটা মেয়ে হাতি না যে, দুটো মদ্দা হাতি খুঁড়ে দাঁতে লড়ালড়ি করছে, কে আমাকে পাবে এবং আমি একটি নিরপেক্ষ মাদি, মদ্দাদের দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময় ওদিকে চেয়েও দেখছি না, কেবল কচি কচি লতাপাতা খাচ্ছি, তারপরে একটা মদ্দা মরল বা মার খেয়ে ভাগল, আর একটা বীরের মতো মাদিটার কাছে এগিয়ে এল, আর নিরপেক্ষ মাদিটা তখন জয়ী যোদ্ধার গায়ে সোহাগ করে শুড় বুলিয়ে আদর করতে লাগল, কিংবা এরকম অনেক জানোয়ারের নাম করা যায়, বাঁদর, কুকুর, (এ সব কথা ভাবলে এত রাগ হয় আমার, ভীষণ খারাপ খারাপ কথা বলতে ইচ্ছা করে) যাদের জগতে, মাদিদের নিরপেক্ষতা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। মানুষের বেলায় তা ঘটতে পারে নাকি। মাদি-ই যখন মানুষের জগতে মানবী, তারাও কি জানোয়ার জগতের এই নিয়মটা মেনে নিতে পারবে। আমার তো মনে হয়, তাদের কেউ এ কথা বললে, মারতে আসবে। অন্তত বাইরের দিক থেকে তো বটেই, মানে লোক দেখানো যাকে বলে, তবে আমার মনে হয়, মানুষেরা, মেয়ে বা পুরুষ তারা আবার মন বলে একটা জিনিসের দাবি করে, জানোয়ারদের যেটা. নেই, কেনো, তাদের ব্যাপারগুলো সবই প্রবৃত্তিজাত, তথাপি আমার কেমন একটা সন্দেহ, মানুষের জগতেও মদ্দা-মাদির খেলাটা আছে, যা দেখলে খুব দুঃখ পাই, মনে বড় কষ্ট লাগে। প্রকৃতি আর প্রবৃত্তি ব্যাপারটা কেমন যেন তেওঁটে গোছের, ঝানু, এমন গাছ থাকে, খুব জোর না লড়লে এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায় না।
যাই হোক রাজনীতি ইত্যাদিতে ও সব মাদির মতো নিরপেক্ষতা আমি বিশ্বাস করি না, মনে মনে আপনা থেকেই কেমন যেন একটা সাপোর্ট এসে যায়, আর অন্য দিকে একটা বিরোধী ভাবনা জেগে ওঠে, তা আমি কোনও দলে থাকি বা না থাকি, কাজ করি বা না করি। সোনার পাথরবাটিরও হয়তো একটা মানে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু রাজনীতির চিন্তায় নিরপেক্ষ, যারা বলে, তাদের ছাগলাদ্য ঘৃত খাওয়া উচিত, অবিশ্যি ছাগলাদ্য ঘৃত কাকে বলে জানি না, নামটার জন্যই এরকম বলতে ইচ্ছে করল। আর এই বলার জন্য, এই নিরপেক্ষ-টিরপেক্ষ একটা মিথ্যা কথা, এই কথা নিয়ে একবার আমি ডিবেটে নাম দিয়েছিলাম, বিচারে দেখা গিয়েছিল আমি বা আমরা কয়েকজন জিতেছিলাম, তবু কফি হাউসে বিভাস আমাকে দুটো থাপ্পড় দিয়েছিল।
বিভাস আমার বিপক্ষে ছিল, আর আমি তখন একলা ছিলাম, আমার টেবিলেই ও বসেছিল, আবার এক প্রস্থ তর্ক করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত রেগে গিয়ে ঠাসঠাস করে আমার গালে দুটো চড় বসিয়ে দিয়েছিল। অথচ ও আমার বন্ধু ছিল, কলেজের বন্ধু, ভাবতেই পারিনি ও আমাকে হঠাৎ ওরকম চড়িয়ে দিতে পারে। এত অবাক হয়েছিলাম, মনে মনে কষ্টও পেয়েছিলাম, কথাই বলতে পারিনি। অবিশ্যি বিভাসকে সেদিন মার খেতে হত, কয়েকজন উঠে এসেছিল অন্য টেবিল থেকে, যারা আমার ঠিক বন্ধু না, কিন্তু আমিই তাদের বারণ করেছিলাম, কারণ একটা মারামারি লেগে গেলে সেটা আরও খারাপ হত। তখন হয়তো একটা চেয়ার আমার মাথায় পড়ত, তার চেয়ে বিভাসকে ক্ষমা করাই ভাল মনে করেছিলাম। এখন বিভাস অবিশ্যি একটা পার্টিতে কাজ করে, একটা বামপন্থী পার্টিতে। এখন তো সবাই বলে তারা বামপন্থী। কয়েকটা পার্টি ছাড়া, কেন না তারা নিজেদের বামপন্থী বললে যে লোকে কিছু বলবে, তা না, তাদের নিজেদেরই লজ্জা করবে, তারা নিজেরাই নিজেদের দক্ষিণপন্থী বলে। বাকি সবই বামপন্থী, এবং কেন বলে, এ বিষয়ে বোধ হয় আমার বাবা বেশি বোঝেন, আমি বুঝি না।
তাই, ক্রমেই যখন আমার মনে হল, আমি যে পার্টিতে আছি এই পার্টির নীতি, আদর্শ আর কৌশলের মধ্যে দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদ কাজ করছে, আমি তার সমালোচনা শুরু করেছিলাম। তার জন্য আমাকে যে সব সমালোচনা শুনতে হয়েছিল, আর গালাগালি খিস্তি, আমি কোনওদিন তা ভাবতে পারিনি। যে-নিখিলের কথা বলছিলাম, আমার এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, কেন না, ওকে আমার সত্যি একটা লড়াকু কর্মী বলে মনে হত, ও ভদ্রলোকদের মতো কথা বলতে জানত না, ভীষণ সাহসী বলে মনে হত, মাকর্সবাদ, লেলিনবাদ, সুভাষবাদ, ও সব কোনও বাদই ও পড়াশোনা করেনি, কিন্তু শ্রমিক ফ্রন্টে খুব লড়াই করত, এখনও করে ওদের পার্টির হয়ে, দারুণ বক্তৃতা দিতে পারে, হিন্দিতেও পারে। ওকে যখন আমি মার্কসের নাম করে সংশোধনবাদ বোঝাতে চেয়েছিলাম, ও মুখটাকে সাংঘাতিক করে, মানে রেগে গিয়ে, বুড়ো আঙুলটা দেখিয়ে একটা খারাপ খিস্তি দিয়ে বলেছিল, তুই মার্কসের ইয়ে (মানে সেই কথাটা, কেশ বা রোমাবলি জাতীয়) বুঝিস। শালা পার্টির কুচ্ছো করছিস, তোর থেকে বোঝদার লোক আর পার্টিতে নেই, না? ও সব দিয়ে নিখিলকে পগানো যাবে না। ও সব সওয়াল নিখিল ভালই জানে।
নিখিলের বাবা একজন উকিল, আর নিখিল তো মোটামুটি শ্রমিক নেতা গোছের লোক, সে জন্য ওর কথায়, ওর বাবা যে লোয়ার কোর্টে আছে, সেখানে পার্টির কোনও কেস হলে ওর বাবাকেই দেওয়া হয়, অবিশ্যি টাকা দিতে হয়। কিন্তু আমি সেজন্য ভাবছি না, নিখিলের সওয়াল কথাটা শুনে ভেবেছিলাম। ওর বাবা উকিল বলেই বোধ হয় সব সওয়াল ওর জানা আছে। অথচ আমি ওকে, কী বলে–পগানো, মানে–পগানো মানে, বোধ হয় জয় করা, তা কেন করতে যাব আর কুচ্ছোই বা গাইতে যাব কেন। আমার বিষয়ে তখন পার্টিতে কথা চলছিল, আমি নাকি পার্টির শত্রুতা করছি, তারপরে যখন–উহ, চমকে উঠেছিলাম হাসিটা শুনে, ভাবলাম খুকু, পরিমলের বোন আর বউদি, তিনজনেই এখনও আমার পিছনে পিছনে হাসতে হাসতে আসছে নাকি।
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, না। দুটি মেয়ে, আমার পিছনে পিছনেই হাঁটছে, আমার দিকে ওদের কোনও লক্ষই নেই, ফ্রক-পরা দুটো মেয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে, করতে করতেই হেসে উঠেছিল, এবং ওরা আমার থেকেও তাড়াতাড়ি হাঁটছে, হাত ধরাধরি করে, আমাকে প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, যার থেকে অনুমান হয় কাছেরই কোনও বাড়ি থেকে ওরা বেরিয়েছে। আমার কাছ দিয়ে চলে যাবার সময় একবার ওদের দিকে তাকালাম, আমি ওদের বয়স অনুমান করতে পারি না, ওরা বোধ হয় কিশোরী, কেন না, ওদের শরীরের দিকে আপনা থেকেই আমার চোখ পড়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কী, এরকম মেয়েদের বালিকা না কিশোরী বলে আমি ঠিক জানি না, তবে যে-দুই মন বই পড়েছিলাম পরীক্ষার জন্য, তাতে নওল কিশোরী বলে যে বর্ণনা দেওয়া আছে তার সঙ্গে যেন অনেকটা মেলে, এবং এদের আমার খুব পবিত্র ভাবতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ফ্রক-পরা অথচ ভারী ভারী পায়ের গোছা, বড় বড় মেয়েদের মতো ভারী আর চওড়া কোমর সব মিলিয়ে আর এই ফ্রকের জন্যই বোধ হয়, আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে ওঠে, ভয় ভয় করে। ধৃতিধৃতিকে আমার মনে আছে, ধৃতির সেই ঘটনা, সেই জন্যই বোধ হয় আমার মনের মধ্যে এদের নিয়ে একটা ভয় জমে আছে।
মেয়ে দুটো আবার হেসে উঠল, আবার আমার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল, আমার কানে যেন খুকুদের তিনজনের হাসিটাই বেজে উঠল, যে-হাসিটার কথা ভাবতে গিয়ে আমার মনে হল, ঠিক যেন মিষ্টি বা খুশি গলায় হেসে ওঠা খিলখিল শব্দ না। অন্যরকম, সেই কী বলে, একটা, একটা অমঙ্গল, অশুভ কিছুর সংকেতের মতো যেন ওদের হাসিটা মনে হয়েছিল, যে কারণে আমার কেমন ভয় করছিল; দিগার–দিগন্তর চোখ আর হাসি দেখেও আমার ঠিক এই রকম মনে হয়েছিল। ওরা কেউ-ই হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করেনি, হয়তো কেন, করেনি, কিন্তু হাসিটা ওরকম শোনাচ্ছিল কেন। ম্যাকবেথ-এর সেই ডাইনিদের হাসির কথা আমার মনে পড়ছে, শুনেছি গোসাপের ডাক নাকি অনেকটা খিলখিল হাসির মতো শোনায়, আর একবার রেবতীদার (সেই সংশোধনবাদী পার্টির কৃষক নেতা, উত্তর বাংলার লোক, সেখানে এক সময়ে কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন করেছেন, এখন কলকাতাতেই থাকেন, তবে মাঝে মাঝে গ্রামে সভা করতে যান, কলকাতার কৃষক আপিসে বসেন) সঙ্গে কৃষকদের একটা সম্মেলনে গ্রামে গিয়ে পৌষ মাসের সন্ধের ধান কাটা মাঠে ঠিক এইরকম খিলখিল হাসি শুনেছিলাম। অনেক দূরে যেন কেউ খিলখিল করে হাসতে হাসতে দূরে ছুটে চলে গিয়েছিল। এক বার না, অনেক বার। সেই হাসিটা শুনে আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল, শিউরোনো যাকে বলে। আমি, রেবতীদা এবং আরও কয়েকজন কৃষক তখন এমনি একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। আমি রেবতীদার দিকে এবং কৃষকদের দিকে তাকিয়েছিলাম। একজন কৃষক হেসে বলেছিল, ভয় পাবেন না, ও শেয়ালে ডাকছে।
শেয়াল। শেয়ালের ডাক জীবনে অনেক শুনেছি, কিন্তু ওরকম ডাক তো কখনও শুনিনি, বরং ডাকাডাকিতে ওরা রিয়াল ঐক্যবদ্ধ, সকলেই একসঙ্গেই হুক্কা হুয়া করে। কিন্তু ওরকম খিলখিল জীবনে শুনিনি, তা-ই কৃষকটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। রেবতীদার কোনও ভ্রূক্ষেপ ছিল না, উনি তখন অন্য কথা বলছিলেন–মানে আন্দোলনেরই কথা, ওঁর মতো লোকের বাজে ব্যাপারে মনোযোগ থাকবার কথা নয়, কিন্তু হাসিটা যেন তখনও আমার মাথার মধ্যে চক্র দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করেছিলাম, শেয়াল কি এ রকম করে ডাকে?
কৃষকটির মুখ সন্ধের অন্ধকারে আমি ভাল দেখতে পাচ্ছিলাম না, মনে হচ্ছিল তার খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়িওয়ালা মুখে কেমন একটা অদ্ভুত হাসি, যাকে অনেকটা রহস্যময় বলা যায়। মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ডাকে, এক এক সময় ডাকে। কামবায়ু কাকে বলে জানেন তো?
কথাটা খট করে কানে লেগেছিল, কামবায়ুকলকাতায় কেউ বললে অবাক হতাম, আর মনে হয় শুনতে খুব খারাপ লাগত, কৃষকটি এমনভাবে বলেছিল, যেন জ্বর বা পেটের অসুখের মতো কোনও কথা বলেছে, কিন্তু ও কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবার মানে কী। আমি কথাটা জানতাম, তবু এক কথায় স্বীকার করতে যেন কেমন লাগছিল। কৃষকটি অবিশ্যি আমার জবাবের আশা করছিল না, বলেছিল, কামবায়ু চাগলে ওরকম ডাকে।
এমন সরল আর নিরীহভাবে বলেছিল, কিছু মনে করবার ছিল না, তবু ওরকম উক্তিতে আমি যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে নিশ্চয়ই কৃষকটি ঠাট্টা করেনি। তারপরে কথাটা যতই ভেবেছিলাম, সেই শব্দটা ততই যেন আমার গায়ে কাঁটা দেবার মতো শিহরন তুলছিল। সময়ে হুক্কাহুয়াও খিলখিল হয়ে যায়। খুকুদের নিশ্চয়ই সেরকম কোনও বায়ু চাগেনি, যদি বা ওরা এমন ঢলে ঢলে হাসছিল, আর ওদের চোখ-মুখে এমন ভাব দেখা যাচ্ছিল, কেমন যেন খারাপ খারাপ মতো। তা ছাড়া খুকু বলেছিল, যান এখন লিপির সঙ্গে ফুর্তি করুন গে… মানে কী, কী ফুর্তি করব। এই ফুর্তি কথাটার পরেই ওদের হাসির সঙ্গে যেন সেই মাঠের কামবায়ুর হাসিটা মিলে যাচ্ছে, এবং সেই হাসিটাও আমার কাছে অমঙ্গল আর অশুভ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু লিপি, লিপিটা কোথায় গেল, ও কি…
.
এই, এই নীরে-দা, এদিকে শোন।
কে! আমি কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি এখন। ভাল করে চেয়ে দেখলাম, ঠিকই যাচ্ছি, আমি বাড়ির দিকেই যাচ্ছি, কারণ, রাস্তাটাকে অন্ধকারে ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা হাজরাদের প্রকাণ্ড বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি। এই রকম গলির মধ্যে এত বড় সেকালের থামওয়ালা বাড়িটা যেন একটা ছোট উঠোনে একটা বুড়ো হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হাজরাদের বাড়িটা চুপচাপ, রাত্রে ভাল করে আলো জ্বলে না, সেজন্য কেমন ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে, কারণ লোকজন খুব কম। কেবল বাড়িতে ঢোকবার দরজার সামনে একটা মাত্র টিমটিমে লালচে আলো আছে, যেটা প্রায়ই পাড়ার ছোট আর বড় বড় ছেলেদের হাতের টিপ ঠিক করতেই নষ্ট হয়ে যায়। হাজরাদের বাড়ির উলটো দিকে রাস্তার ধারে রকওয়ালা বাড়িটার রকে আমাদের ছেলেরাই বসে, মানে আমি এখন যে-পার্টির সঙ্গে আছি। সংশোধনবাদী দলটা ছাড়ার পরে। অবিশ্যি, আমার গায়ের মধ্যে কী রকম করে উঠল যেন, এ পার্টিকেও আজকাল আমার কেমন যেন সুবিধাবাদী বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সে কথা আমি দু-একজনকে বলেছি এবং আলোচনাও করেছি, তবে খুব সাবধানে, কেন না, আগের পার্টি ছাড়ার জন্য যা শাস্তি আমাকে পেতে হয়েছে তার দাগ এখনও আমার গা থেকে শুকোয়নি, কিন্তু আমি কী-ই বা করতে পারি। যাই হোক, এ বিষয়ে আমি কী করব এখনও ঠিক করে উঠতে পারছি না, পার্টির দৌলতেই অস্থায়ী চাকরিটা পেয়েছি, চালিয়ে যাচ্ছি, চলছে, চলবে বলেও মনে হয়, অথবা, বাংলায় থার্ড ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও একটা কলেজে চাকরিও পেয়ে যেতে পারি, সেটাও পার্টির কল্যাণেই, সেরকম একটা আশা পেয়েছি, আর আশাটা তুচ্ছ করবার মতো না, কারণ, একটা ফার্স্ট ক্লাসকে টপকেই হয়তো পেয়ে যাব। কিন্তু, আমাকে কে ডাকল। আমি রকের দিকে তাকালাম। নিশ্চয়ই আমার চেনা, কারণ এটা এখন আমাদের পার্টির ছেলেদের রক, মানে, এ রকটা এখন তাদের দখলে, যারা আমাদের পার্টির ছেলে। অবিশ্যি, আমি আগে হলে কখনও ভাবতেই পারতাম না, এরা কী করে পার্টিতে এল বা পার্টির কাজকর্মে এদের ডাক পড়ে, কারণ এদের আমি রাজনীতি করার মতো ছেলে বলে আগে কখনও ভাবতে পারতাম না, বিশ্বাসও করতে পারতাম না। যেমন দিগা-দিগন্ত, আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমি জানি ওকেও কোনও কোনও পার্টি ডেকেছে বা ডাকে, কিন্তু ও সেই কী বলে, অনেকটা ফ্রি লালার সাংবাদিকদের মতো। ও কোনও পলিটিকাল পার্টির সঙ্গে নেই, যাদের সঙ্গে বোমা ছোঁড়াছুড়ি করে, ছুরি মারামারি করে, তারাও কোনও পলেটিকাল পার্টি না, ওদের আলাদা ব্যাপার, আলাদা এরিয়া। তবে কখনও কখনও লেগে যায়, একসঙ্গে অনেকে মিলে সুতো কাটাকাটি খেলতে গেলে যা হয়। কখন কার সঙ্গে প্যাঁচ লেগে গেল, তারপরে চেহারা বদলে যায়। তবে দিগদিগন্ত, এ ব্যাপারে খুব হুঁশিয়ার। ও কোনও দলে নেই, ও ওর নিজের দলের মস্তান। নিজের দলকে পরিচালনা করতে পারে ভাল, বেশ শক্ত হাতেই করে। কখন কীভাবে কোথায় হাতে পায়ে ধরতে হবে, দুটো ভাল মিষ্টি কথা বলে মানিয়ে নিতে হবে তাও জানে। এগুলোকে যদি গুণ বলতে হয়, তা হলে দিগদিগন্ত গুণী।
তবে রাজনীতি বিষয়ে ওকে যেরকম ভাবা যায়, ঠিক তা না, ও একটা নিরপেক্ষ মাদি হাতি না, কিন্তু বলতে গেলে ওকেই একরকমের নিরপেক্ষ বলা যায়। ছিনতাই, বোমা, ব্যবসাদারদের রক্ষক–মানে যাদের সত্যিকারের উপকারী মস্তান-মস্তান ছাড়া চোরা ব্যবসায়ীর চলে না, আরও অনেক সরকারি আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ছাড়াও তাদের কারবার চলে না, তবে একটা মস্তান দল চাই-ই, এবং ওয়াগন ভাঙা, ট্রাক লুঠ, এ সব ছাড়াও কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের হয়ে মারামারি না করলেও যখন যে দলের দরকার, বিচার বিবেচনা করে, তাদের জন্যও কাজ করে, সেই হিসাবে দিগা ফ্রি লান্সার।
কিন্তু এরা, ওই যে অন্ধকার রকে বসে থাকা ছেলেরা, যারা আমাদের পার্টিরই ছেলে, বলতে গেলে ওই রকটা এখন আমাদের পার্টির নামেই চলে, এরা কী করে পার্টিতে মানে রাজনৈতিক দলে আসতে পারে, আমি বুঝতে পারি না। অবিশ্যি আজকাল সব পার্টিতেই এ ধরনের ছেলেরা আছে, যারা পার্টির তত্ত্ব, নীতি, কৌশল বা আদর্শ বিষয়ে কিছুই জানে না, কখনও কিছু পড়াশোনাও করেনি, কেবল জাতের লড়াইয়ের মতো খেপে আছে, যে কারণে আমার সেই গানের কলিটা প্রায়ই মনে পড়ে যায়, জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া। এরা ঠিক দিগা–মানে দিগন্ত না, ও তো কোনও রাজনৈতিক দলের না, ও হচ্ছে চাকু মারা, পেটো ছোঁড়া মস্তান, ছিনতাই লুঠ নিয়েই আছে, দরকার হলে, যাকে ওরা মালকড়ি বলে, পেলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়েও কাজ করে। আর এরা সব রকম ব্যাপারেই আছে। এদের কারোকে কারোকে কখনও দিগার দলেও কাজ করতে দেখা যায়, বা অন্য কারো দলে, কেউ ভাল ছুরি চালায়, অথবা ব্লেড–এক একজন এক এক ধরনের অস্ত্র চালাতে একম্পার্ট, পেটো মানে বোমার তো কোনও কথাই নেই। এরা কেন পার্টিতে আসে, পার্টিই বা কেন এদের আসতে দেয়, আমি বুঝি না। এতে পার্টির যে একটা ইমেজ, যেরকম ভাবে পার্টির আদর্শ আর নীতির কথা বলা হয়, সব যেন কেমন একটা, যাকে বলে খচ–মানে, অশ্বেতর পশুটার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমি আবার একটু ন্যাকা আছি, একেবারে অশ্বেতর। যেন খচ্চর বললে কেউ শুনতে পেত। মানুষ মনে মনে যা বলে, যা ভাবে, বিশেষ করে খারাপ খারাপ কথা আর কাজের বিষয়ে, নেহাত আইনটাইনগুলো তাদের ভিতরে ঢুকতে পারে না, দেখতে পায় না, শুনতে পায় না, তা হলেই বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরের টিকি খাড়া সব ছুঁচোগুলোকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিত। অথচ সেই টিকি খাড়া ছুঁচোগুলোই দেখ গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর সত্যি বলতে কী, স্বয়ং বিচারকের মন-ই তখন কীসে বিচরণ করছে, তা জানে শুধু তার মস্তিষ্ক, শরীর আর মন।
যাই হোক, এই সব ছেলেরা, যাদের আগে অন্য রকম ভাবা হত, যারা মেয়েদের দেখে টিটকারি দেয়, শিস দেয়, হিপ পকেটে ছুরি রাখে, যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও জায়গা থেকে হাত গলিয়ে বোমা বের করতে পারে, লুঠপাট রাহাজানি ছিনতাই কোনও কিছুতেই বাদ নেই, তারা কী করে পার্টির ছেলে হয় বুঝতে পারি না। তবে একটা কথা কী, এরা পাড়ার সব ভদ্রলোকের ছেলে, লেখাপড়াও করেছে, কারো হয়তো লেখাপড়া করতে ভাল লাগেনি, কেউ করেও বেকার। বেকারই বা বলা যায় কেমন করে, বলতে গেলে এরা একটা কিছু তো করেই, এক ধরনের যাকে বলে পেশাজীবী, তা-ই। কিন্তু এদের লুমপেন প্রলেতারিয়েত যাদের বলে, তাও বলা যাবে না। এরা ডাক্তার উকিল ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলেও আমার মতো অস্থায়ী কেরানি হবার কথা ছিল। আর যাই হোক, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক পরিবারের ছেলে সব।
এরা সবাই একরকম না, কারও কারোকে আমার খুব ভাল লাগে, সাদামাটা সহজ সাহসী, অনেকটা টগবগে ফুটন্ত, মনে হয় বীর হবার যোগ্য। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আমার মতোই মিথ্যে কথা শুনতে শুনতে, বাবা মায়ের কাছ থেকে, মাস্টারমশাই প্রফেসরদের কাছ থেকে, নেতা আর যারা প্রফেটের মতো কথা বলে (যাদের ধ্যান-ধারণাগুলো অনেকটা ঘোড়া আর গাধা মেশানো বাচ্চার মতো আবার ন্যাকামো, খচ্চরই বলা যাক না), তা সে সাহিত্যেই হোক বা কোনও দর্শনতত্ত্বের বক্তিমেতেই হোক, যাদের নানা বেশ আর রোলে–মানে ভূমিকায় দেখা যায়, নেতা বা বাবাজি, সেই সব প্রফেটের কাছ থেকে মিথ্যা কথা শুনতে শুনতে এদের সব বিশ্বাস ওঁয়ারাই খেয়ে বসে আছেন। হ্যাঁন হোগা, ত্যান হোগা, জটি বুড়ি কা উকুন মারেগা, কার্যকালে ভোঁ ভাঁ, বেঁচে থাক রক। যদি বলা যায়, একটা বিশাল অবিশ্বাসীর দল, ওমর খৈয়ামের সেই কথাটার মতো, সে কোন এক মরুর বুকে, অবিশ্বাসী থাকত সুখে–সেইরকম। কেউ কিছুই হব না, অথচ বলা হয়েছিল তা-ই যে, সামনে হাজার পাওয়ারের বাত্তি, এবং বালবটা হয়ত সত্যি ছিল। কিন্তু কারেন্ট নেই, কেবল অন্ধকার, কেবল বাঁচবার জন্য বাঁচা, অতএব ধ্বনি প্রতিধ্বনি, সব ঝুটা হ্যায়, ক্ষমা দাও কর্তারা, বুঝেছি কী করতে হবে।
আমিই কি বিশ্বাস করি নাকি। নিজেকে মনে মনে শালা বলা যায় না, নিজেকে ওটা বলার কোনও মানেই হয় না, শয়তান তো বলা যায়। বিশ্বাস কি আমারও আছে নাকি, কিন্তু সত্যি বলছি, ভগবানের থুড়ি, আমি ওসবে বিশ্বাস করি না অথচ কীসের বা কার দিব্যি গেলে বলব বুঝতে পারছি না, আমি বিশ্বাস করতে চেয়েছি, এখনও চাই। হ্যাঁন বা ত্যান কোনও কেউকেটা, মস্ত বড় একজন কেউ হওয়ার বিশ্বাসের কথা বলছি না, কিন্তু নিজেরই খুব অবাক লাগে, এমনকী শুধু এই কারণেই নিজেকে গালাগাল দিতে ইচ্ছা করে, আমার এখনও মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, মনে হয়, সুন্দর মহৎ ভাল কিছু হবে, এবং এই বিশ্বাসটা আমাকে বাবা মা টিচারস প্রফেসর নেতা বা পার্টি দেয়নি। অনেক মানুষকে দেখে বা বই পড়ে, একটা সাংঘাতিক মারাত্মক আর সুন্দরের ব্যাপারে বিশ্বাস, ঠিক যেন চোরের মতো আমার ভিতরে চোর চোর খেলে বেড়াচ্ছে।
তা না হলে, আগের পার্টি, যাদের নীতি আদর্শই কৌশল সবই আমার সংশোধনবাদী বলে মনে হয়েছিল, যে-পার্টি থেকে আমি চলে এসেছি, থাকলে এতদিনে আমার অনেক উন্নতি হত, সেখানেই থাকলাম না কেন। আর একই কারণে, এখন আমি যে-পার্টির সঙ্গে আছি, সেই পার্টি সম্পর্কেও একই কথা মনে হচ্ছে। এ মনে হওয়াটা যে কী ভয়ঙ্কর বিশ্রী আর ভয়াবহ, তা জেনেও মনটাকে আমি সামলে রাখতে পারছি না, যেন চোরের মতোই কেউ আমার ভিতরে খুব সাবধানে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, আর অবিশ্বাসের সুখ, যেসুখ ভিতরে বেশ সোনা ফলিয়ে রাখছে, সোনার শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইছে, অথবা সেটাকে একটা লোহার ডাণ্ডাও বলা যায়। চোরটাকে পিটিয়ে মারতে চাইছে। বিশ্বাসটাই তো চোর, অবিশ্বাসটাই দারোগা, চোগা চাপকান পরে গলাবাজি আর ডাণ্ডাবাজি করছে। আমি তা চাই না, চোরকে কে-ই বা চায়। এ চোর আমার দরকার নেই, এ চোরটাই তো আমার এখনকার চাকরিটার কথা সবসময়ে মনে করিয়ে রাখে, অস্থায়ী চাকরিটা গেলেই ফাস্ট ক্লাসকে ডিঙিয়ে কলেজে চাকরি পেয়ে যাব, এ ভাবনাটাকে সবসময়ে বিধিয়ে রাখে। তার থেকে পুরোপুরি অবিশ্বাসী হওয়া ভাল, তাতে অনেক সুবিধা, মারধোর খেতে হবে না, গালাগাল শুনতে হবে না।
আমি এত প্যাঁচ পয়জার জানি, এত বদমাইশি জানি, সুযোগ সন্ধান-টন্ধান করতে পারি, ভালমানুষ সেজে থাকতে পারি, যার একটা বড় কারণ, আসলে আমি কাওয়ার্ড কাপুরুষ, আমার বিশ্বাসের দাম কী। যত বারই আমি বিশ্বাসের কথা বলতে গিয়েছি, ততবারই মারমানে রিয়্যালি প্যাঁদানি–আবার সেই খারাপ কথা, অর্থাৎ প্রহার সহ্য করতে হয়েছে। তবু, সেই যে বলে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী, আমার অবস্থাটা সেইরকম। অবিশ্বাসের যে সব ধর্ম, তার বুলি আর নামাবলী সবাই জানে চেনে, সেই ধর্মের কাছে বিশ্বাসটাই চোর, কখনওই বিধর্মী হওয়া চলবে না। তথাপি, মাইনা, এ ধরনের দিব্যি গালতে চাই না, তথাপি বিশ্বাস আমার মধ্যে এরকম আন্ডারগ্রাউন্ড সাসপেন্সকে জিইয়ে রাখছে। জানি না কখন ধরা পড়ে যাব, এই এক চিন্তা, অথচ সে ঠিক তার কাজ করে যাচ্ছে। বলতে গেলে, এক এক সময় রাগই হয়, এমনকী একটা কষ্টও, তবু সত্যি, একটা বিশ্বাস, বিশ্বাস করতে চাওয়ার ইচ্ছা পা টিপে টিপে বেড়াচ্ছে। এই সব ছেলে, অবিশ্বাসী, সমস্ত কিছুতেই, যাদের কথা বলতে গিয়ে ওমর খৈয়ামের কবিতার সুখের কথা বললাম, সে-সুখ কী আমি জানি না, তবে এদের সেরকম কোনও সুখ নেই, রাগ আছে, অবিশ্বাসের রাগ, ঘৃণা, এদের কারও কারোকে আমার ভাল লাগে, কিন্তু সবাইকেই আমি এক একটি বাঘের মতো ভয় পাই। মদ খাক, সিগারেট খাক (কর্তাদের মধ্যে কে-ই বা না খাচ্ছে, ভজাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই), খিস্তি খেউড় করুক, মেয়েদের পেছনে লাগুক–অবিশ্যি সব মেয়েই যে পেছনে লাগাকে পেছনে লাগা মনে করে তা বলছি না, না লাগলেই বরং তাদের মনে কষ্ট হয়, আর তারাও সমানে ছেলেদের পেছনে লাগে (খুকু), ওরা যেন ছুরি ব্লেড চালিয়ে না দেয়। পার্টিই যখন ওদের নিতে পেরেছে, জানি না, সেটা আবার মুক্তির কৌশল কি না বা সংঘের কূটনীতি যাকে বলে, অথবা, অন্যান্য পার্টিতে আছে বলেই একটা পালটা ফোর্স অন্য পার্টিও রাখবে, খুবই স্বাভাবিক, তখন আমার কী করার আছে। এদের বাঘের মতো ভয় পাই, কিন্তু কারও কারোকে ভালও লাগে, কেন না, কেমন যেন মনে হয়, অবিশ্বাসের মধ্যে একটা দুঃখ আর কষ্টও আছে।
আমি ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওদের ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, এখানে আলো নেই, আলোটা ওরাই নষ্ট করে দিয়েছে, যাতে ওদের গায়ে না পড়ে। ওরা সব দলা পাকিয়ে রয়েছে, আর তার মধ্য থেকেই একজনের গলা শোনা গেল, কোথায় যাচ্ছেন নীরেদা?
নীরে-দা। তারপরে আর একটা ন বসাতে অসুবিধা কী জানি না, যেমন অনেক কিছুই জানি না, বললাম, বাড়িতে।
গলা শোনা গেল, বাড়িতে?
ছায়াগুলো যেন সব নড়ে চড়ে উঠল, আরও কাছে এগিয়ে এল, একটা নিচু গলা শোনা গেল, নির্ঘাত মাল টেনে এসেছে। তারপরে অন্য গলা, বাড়ি যাচ্ছেন কী, আপনাকে তো পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমার বুকটা আবার ধক করে উঠল, জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
হাসি, আর আমাকে উদ্দেশ করেই একটা খারাপ কথা, মানে খিস্তি। জিজ্ঞাসা, কেন মানে? সবাই তো জানে দাদা, আর আমাদের কাছে ছাপিয়ে লাভ কী।
তার মানে, এরাও সেই কথা বলছে, এরাও সেই ব্যাপারটা শুনেছে, আর মনে হচ্ছে, বিশ্বাসও করেছে, কিন্তু আমি সহজে কথাটার মধ্যে যেতে চাই না। চারদিকের সমস্ত ব্যাপারেই আমি যেমন দিশেহারা আর বিভ্রান্ত বোধ করি, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি বোধ করছি। কারওরই কি মাথার ঠিক নেই, না কি সবাই একই অবস্থার মধ্যে আছে, একটা সাদা সোজা সরল কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছে না। আমি বললাম, না, মানে, তোমরা কী বলছ, আমি ঠিক
আর বাতেলা দেবেন না দাদা। আপনার মতো লেখাপড়া শিখিনি, তা বলে ও সব ভড়কিবাজি আমরাও জানি।
কথাগুলো শোনার পরে হিস হিস খিস খিস স্বরে অনেকের হাসি শোনা গেল। ওদের চোখগুলো, দাঁতগুলো, দূরের অস্পষ্ট আলোয় ঝকঝক করছে। ঠিক মনে হচ্ছে, আমি যেন কোনও অন্ধকার জঙ্গলে একদল নেকড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝারি গলিটা দিয়ে প্রায়ই অনেকে চলে যাচ্ছে, আমি খুব সচেতন থাকবার চেষ্টা করছি, পুলিশ কি না, যদিও এখনও আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না, তারা আমাকে খুঁজছে। এরকম মিছিমিছি, আদপে যেখানে কোনও ব্যাপারই নেই, তার জন্য আমাকে খুঁজবে কেন। কিন্তু এরা বলছে, আমি বাকতাল্লা দিচ্ছি, ভড়কিবাজি করছি, তার মানে এরাও আমাকে বিশ্বাস করছে না। সত্যি, আমি আর এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা পরিমলকে দেখেছ?
একজনের গলা শোনা গেল, তা কী করে জানব, পরিদা এখন হয়তো তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কোথাও হাওয়া খেতে গেছে।
পরিমল সম্পর্কেও এরা এরকম কথা বলে, কোনওদিন শুনিনি, অন্তত আমার সামনে। আজই শুনলাম। পরিমলও তো আমাদের পার্টিরই লোক, এখন আমি যে-পার্টিতে আছি। এদের সঙ্গে আর কোনও কথা বলে লাভ নেই, বুঝতে পারলাম, কিন্তু চলে যাবার আগেই শুনতে পেলাম, যেখান থেকে এলেন সেখানেই কেটে পড়ুন, এদিক ঘোরাফেরা করবেন না।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কেন বলো তো?
আপনার ভালর জন্যই বললাম।
হঠাৎ দুটো-তিনটে গলায় একধরনের শব্দ হল, হাতের মুঠোর ফুটো দিয়ে ফুঁ দিয়ে এক ধরনের শব্দ, মানে আমাকে প্যাঁক দিচ্ছে। মনে মনে এরা এত দিন আমাকে কী বলত বা ভাবত জানি না, কিন্তু এখন এদের ব্যবহার দেখে আমি যেন হকচকিয়ে যাচ্ছি, আর মনে মনে কষ্টও পাচ্ছি। মনে মনে আমিও বাঁকা হেসে, অনেককে ওরকম দিয়ে থাকি, সত্যি সত্যি না, মনে মনে, এবং এ কথাও সত্যি, ছুরি ব্লেডও চালিয়ে থাকি মনে মনে। তা বলে ওরা আমাকেও প্যাঁ–মানে প্যাঁক দেবে। এর আগে একটা খারাপ খিস্তি করেছে। যাক, এদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না, তা ছাড়া চোখ আর দাঁত ঝলকানো নেকড়ের দলকে আমার কেমন যেন ভয়ও করছে। শুধু ওদের বা এই মুহূর্তের ভয় না, কেমন যেন একটা অশুভ অমঙ্গলের মতো, দিগদিগন্তের মুখ আর হাসি দেখে, খুকুদের হাসি শুনে যে রকম মনে হয়েছিল। আমি ওদের সামনে থেকে সরবার জন্য পা বাড়ালাম, তখনই শুনতে পেলাম, ওকে কোথায় রেখে এলেন?
আমার গায়ের মধ্যে কী রকম করে উঠল, অনেকটা শিউরে ওঠার মতো। কথা কোনদিকে ঘুরছে। আমি বুঝতে পারছি। জিজ্ঞেস করলাম, কাকে বলো তো?
ন্যাকামি!
মজাকি।
দুটো শব্দেই বোঝা গেল, ওদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে, আর সত্যি বলতে কী, হঠাৎ আমার মনে হল, ওরা যথেষ্ট ধৈর্য আর খাতির দেখিয়েছে। অনেক চেপে-চুপে, আসল কথাটা এখনও কেউ মুখ ফুটে বলেনি। তারপরেই একজন আমার সামনে উঠে এল, নির্মল ওর নাম, একবার একজন পুলিশ অফিসারকে মেরেছিল, সেই থেকে ওর ওপর আমার একটা আলাদা আকর্ষণ। কেন না, পুলিশকে মারতে দেখলেই, আমি মনে করি, চমৎকার, দারুণ, এটা একটা বীরের কাজ। ও আমার সামনে উঠে এসে বলল, আমাদের সঙ্গে আর পাট্টিবাজি করতে হবে না দাদা, সবাই জানে আপনি লিপিকে নিয়ে কাট মেরেছেন। সেই জন্যই বলছিলাম, বেশি পেঁয়াজি করবেন না, কেটে পড়ুন, পুলিশ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আমি কেমন যেন আবেগ বোধ করলাম, ভয়ের সঙ্গে আবেগ। আমি নির্মলের একটা হাত চেপে ধরলাম, বললাম, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করো, আমি লিপিকে নিয়ে কোথাও যাইনি, আমি জানি না ও কোথায় গেছে।
রকের ছায়াদের মধ্যে হাসি আর খিস্তি। নির্মল ঝটকা দিয়ে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল। মনে হল, ওর চোখগুলো যেন ধক ধক করে জ্বলছে। যেন গর্জন করে উঠল, আমাদের গুল মারছেন কেন, আমরা কি পুলিশ না লিপির বাবা-মা। মেয়েটাকে নিয়ে কাটলেন, এখন বলছেন, কাটেননি। লিপি এমনি এমনি চিঠি লিখে রেখে গেছে?
কার একটা গলা শোনা গেল, দাদাদের জিনিস বলে আমরা শালা কোনওদিন একটাও আওয়াজ দিইনি মাইরি, এখন শালা দিনকে রাত!
আমার যেন বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। এরা কি বলতে চায় আমি মিথ্যা কথা বলছি। আমি তো মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না, কেবল মনে হচ্ছে, চারদিক থেকে একটা কিছু যেন আমাকে ক্রমেই ঘিরে ধরতে আসছে। বললাম, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করো–
এবার ছায়াগুলো সব একসঙ্গে, এক সুরে, একই রকমের স্বরে শব্দ করে উঠল, অনেকটা যেন উলু দেওয়ার মতো, আর তারপরেই খলখল করে হেসে উঠল। আবার আমার বুকের মধ্যে কী রকম করে উঠল এই হাসি আর শব্দ শুনে। কার গলা যেন শোনা গেল, গোলাম হোসসেন, এই ভাগ্য নিয়ে আমি বাংলা বিহার উড়্যিার ভাগ্য বিধাতা।..
আবার হাসি শোনা গেল, এবং কথাটা কেন বলল, না বুঝলেও বলার ধরন আর স্বরটা আমার বেশ ভাল লাগল, অনেকটা যেন পাকা অভিনেতার মতোই। আবার একটা গলা শোনা গেল, যেন পার্টির বক্তৃতা হচ্ছে।
.
কথাটা বলার সময়েই অরূপকে আমি দেখতে পেলাম–অরূপ, এক সময়ে আমার মতে যাকে বলে অসাধারণ ছেলে ছিল। কত আর বয়স হবে, বছর কুড়ি, ছাত্রও খারাপ ছিল না, আর খুব রোখা ছেলে, ইস্কুলে থাকতেই খুব–খুব–মানে, খুব মিলিটান্ট টাইপের ছেলে ছিল। আমার এখনও মনে আছে, তখন সেই খাদ্য আন্দোলন চলছিল, চারদিকে খুবই গোলমাল, কনটিয়াস–মানে লাগাতার ধর্মঘট চলছে, এবং আমি সেই সময়ে আগের পার্টিতে ছিলাম, অরূপও ছিল–ছিল অর্থে, সেই পার্টির ছাত্রদলে, বলতে গেলে ও তখন ছেলেমানুষ। কলকাতার পথে পথে কেন্দ্রীয় রিজারভ পুলিশ ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের এলাকা থেকে দূরে, ট্রাম রাস্তার ওপরেই, সি আর পি আমাদের তাড়া করছিল। কারণ ওদের ওপরই কয়েকটা ইট পড়েছিল। হঠাৎ অরূপ ট্রাম লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিল, হাফ প্যান্ট পরা একটা ছেলে, বুক খোলা শার্ট, কপালের ওপর চুলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, চোখ দুটো দপদপ করে জ্বলছে। হঠাৎ ও ট্রাম লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বুকের জামা দু হাতে ফাঁক করে ধরে চিৎকার করে বলেছিল, মারো, মারো।
ওরকম অদ্ভুত ভয়ংকর নাটকীয় ব্যাপার আমি আর কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যারা দৌড়চ্ছিল, মানে আমিও, আমরা দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, আর দেখেছিলাম, অরূপের কাছ থেকে কুড়ি হাত দূরে, উদ্যত রাইফেলটা ঠিক অরূপের বুক লক্ষ্য করে রয়েছে। খাড়া নাক, লাল চোখ, খাকি উনিফর্ম পরা একটি জোয়ান ছেলে অরূপের দিকে যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, অনেকটা কী বলব, ঠিক যেন সিনেমার শীত-জমাট ছবির মতো, ফ্রিজ যাকে বলে। কয়েক সেকেন্ড, উদ্যত রাইফেলের মুজ-এর ওপর থেকে চোখটা তুলে ছোকরা রাইফেলধারী রাগে আর বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিল, ভাগো জলদি।
বলতে বলতে তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল, ট্রিগারের ওপরে তার আঙুল, আমার চোখের সামনে এক বার চকিতে ভেসে উঠেছিল, অরূপ রক্তাক্ত অবস্থায় ট্রাম লাইনের ওপরে পড়ে আছে, কিন্তু আমি তার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম, নহি, তুম মারো, ভুখমে মরেগা, এয়সা ভি মরেগা।
ঘটনাটা এমনই নাটকীয়, সি আর পি-র অন্যান্য রাইফেলধারীরাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা দেখেছিল, এবং অরূপের বুক লক্ষ্য করে উদ্যত রাইফেলধারী জোয়ান ছেলেটাকে, দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করতে দেখেছিলাম, ট্রিগারের ওপরে তার আঙুল এক বার যেন নড়ে উঠেছিল, মনে হচ্ছিল, ছেলেমানুষ পুলিশটা যেন আগের তুলনায় আরও খেপে উঠেছে। আসলে, তখন বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারি, তার প্রতি ওপরওয়ালার নির্দেশ আর কর্তব্য এবং অরূপের ওরকম হঠাৎ বুক খুলে সামনে দাঁড়িয়ে পড়া, এই দুয়ের মধ্যে একটা ভয়ংকর ধাক্কাধাক্কি চলছিল, সমস্ত শক্তি একত্র করেও সে ট্রিগার টিপতে পারছিল না। অথচ নির্দেশ আর কর্তব্য তাকে ভীষণ ভাবে উত্তেজিত এবং তাড়না করছিল, সে আবার চিৎকার করে উঠেছিল, আভি ভাগো, নহি তো মরোগে।
কিন্তু সেই ক্ষেত্রে গুলি করাই তার প্রতি নির্দেশ। অরূপ তেমনিভাবেই বুক ফুলিয়ে থেকে চিৎকার করে জবাব দিয়েছিল, নেই ভাগেগা। তারপরেও কয়েকটা সেকেন্ড একেবারে চুপচাপ কেটেছিল, পুলিশটি আস্তে আস্তে রাইফেল নামিয়ে নিয়েছিল, আর সেই মুহূর্তে আমার নানারকম অদ্ভুত কথা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, একটা সশস্ত্র পুলিশ ধাওয়া করে ছুটে এসে একজন নিরস্ত্র, মরতে চাওয়া ছেলের বুকে গুলি করতে পারল না, যেন একটা ছোটখাটো বিপ্লব হয়ে গেল, কিন্তু অরূপ কেন ওরকম ভাবে দাঁড়িয়েছিল। ও তো ভুখা মরবার ছেলে না, কারণ ওদের অবস্থা খুব খারাপ না। গরিব মোটেই বলা চলে না, অথচ এমনভাবে কথাটা বলেছিল, না খেয়ে মরবে, না হয় এমনি মরবে, যেন ও সত্যি সত্যি না খেয়ে মরার চেয়ে পুলিশের গুলিতে মরাটাই ভাল মনে করেছিল, যা ওর জীবনে সত্যি না–অর্থাৎ না খেয়ে মরা। ওর বাবা ইলেকট্রিক ওয়ার্কসের কন্ট্রাক্টর, ব্যবসা ভালই, গাড়িটা সেকেলে থ্যাবড়া ধরনের পুরনো, আর প্রায়ই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই থাকে, তবু গাড়ি আছে, বাড়িটাও নিজেদের, ওর দুই দিদিকেই দেখতে বেশ সুন্দর–অবিশ্যি অবস্থার কথা বলতে গিয়ে সুন্দর দিদিদের কথা বলার কোনও মানে হয় না, তবু কেমন মনে হচ্ছিল। অরূপকে তখন আমার একটা লড়িয়ে মজদুরের মতো মনে হচ্ছিল। হয়তো লড়িয়ে মজদুর না, অথচ না খেয়ে মরার কথাটা ও ওরকমভাবে কেন বলেছিল। যাই হোক, তাড়া খেয়ে আমরা সরে গিয়েছিলাম, পুলিশটা অরূপকে সেই অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে, রাইফেলটা নামিয়ে, এক বার কেবল সাবধান করে দিয়েছিল, ভাগ যাও–তারপর তাদের গাড়ির কাছে ফিরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, অরূপকে অন্তত অ্যারেস্ট করবেই, তাও করেনি, ও ফিরে এসেছিল, আর আমাদের মনে হয়েছিল, একটি খাঁটি বিপ্লবী বীর ফিরে এল, সবাই ওর সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুশি হয়েছিলাম, পার্টি অফিসেও ওকে সেদিন খুব খাতির করেছিল সবাই। নিখিল অরূপের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল, একে বলে সাচ্চা লড়াকু।
নিখিল অরূপের এক দিদিকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছে, প্রেম অনেক আগের থেকেই চলছিল, যদি বা এ সব ব্যাপারের সঙ্গে নিখিলের বিয়ের কোনও ব্যাপার নেই, এবং অরূপ নিজেই আর আগের পার্টিতে নেই। কী করে আর কেন এ পার্টিতে এল, আমি এখন যে-পার্টিতে আছি, তাও ঠিক জানি না।
সেই ঘটনার পরে, অনেকদিন ভেবে ভেবে, আমি অরূপকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে ও কেন ওরকম বলেছিল। আমার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, মানে?
আমি বলেছিলাম, না, মানে, তুমি তো আর সত্যি পেটে ভুখা নও, তবু কেন বলেছিলে, ভুখা মরার চেয়ে এভাবেই মরব।
অরূপ আমার ওপর রেগে গিয়েছিল, আমি যেন একটা শত্ৰু, এমনিভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল, বলেছিল, তাতে আপনার কী।
সেটা কোনও কথা না, আমার সত্যি খুব জানতে ইচ্ছা করছিল, ওর তখন কী মনে হয়েছিল। ওর সাহস আর কাজ দেখে এমনই, যাকে বলে চমৎকৃত হয়েছিলাম, শুধু সেই একটা কী রকম খটকা থেকে গিয়েছিল। বলেছিলাম, আমার কিছু না, একটা খুব কিয়োরিসিটি
অরূপ রেগে চেঁচিয়ে উঠেছিল, আপনাকে আমি সে কথা বলতে চাই না, আপনি একটা রিঅ্যাকশনারি লোক। এ কথা জিজ্ঞেস করবার মানে কী।
ভাবছিলাম ও কেন আমাকে এরকম ভুল ভাবছে, আমি তো মুগ্ধ–মানে সেই ব্যাপারে। কিন্তু কেন যে ও কথাটা আমার মাথায় ঢুকেছিল। অরূপের কাছে আমি রিঅ্যাকশনারি হয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমাদের এলাকার পার্টির সবাই আমার ওপর রেগে গিয়েছিল, নিখিল বলেছিল, ঘরে বসে কবিতা লিখলে ও সব বোঝা যায় না, বিপ্লব মুখের কথা না।
আমি অপরাধীর মতো চুপ করে ছিলাম। খুব দুঃখ হয়েছিল এই ভেবে, আমাকে কেউ বোঝে না। এখন এই অরূপের বিষয়ে নিখিল কী ভাবে, কে জানে। অরূপ আর ওদের পার্টিতে নেই, এবং অরূপ আর সেই অরূপ নেই, এখন আর ও খালি হাতে, বুক চিতিয়ে রাইফেলের সামনে দাঁড়ায় না–পারবে কি না, সে কথা আমি জানি না, যদিও পুলিশের সঙ্গে গোলমাল হলে এখনও বোমা ছুঁড়তে পারে। আমার কেমন মনে হয়, অরূপ নিজেই জানত না, সেই সময়ে, সেই দিন ট্রামলাইনের ওপর দাঁড়ানোর তাৎপর্যটা কী, ও কী করতে যাচ্ছিল, এবং ওর মরতে চাওয়ার সঙ্গে, একজন সশস্ত্র পুলিশের কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করার গুরুত্বটা কী, কেউ বুঝেছিল বলে মনে হয় না। এখন ভাবলে আমি যেন কেমন অভিভূত হয়ে যাই। অবিশ্যি, আমি বলতে চাই না, ওটা একটা হিংসা আর অহিংসা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, যদি বা ব্যাপারটাকে সেদিক দিয়েও একটা ব্যাখ্যা করা যায়। একজন নিরস্ত্র সাহসী অহিংস মৃত্যুভাবনাহীনের সামনে হিংস্র রাইফেল মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। আমি ভাবতে পারি না, নিরস্ত্র আর অহিংস হলেই তার বুকে রাইফেলের গুলি বেঁধে না, তথাপি সেই ঘটনার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য যা-ই হোক, আমার ধারণা, অরূপের সেই বয়সে, জীবন বা মৃত্যু সম্পর্কে যাকে বলে, বিশেষ কোনও উপলব্ধি, কোনওটাই ছিল না, আর ভুখা শব্দের দ্বারাই প্রমাণ হয় রাজনৈতিক বোধ বা গভীর কোনও উপলব্ধি থেকে, ওরকম করেনি। ওটা এক ধরনের সব সময়ে শোনা আর পরিবেশঘটিত ব্যাপার। একটা অবুঝ রোমান্টিক মনের ব্যাপার।
.
কিন্তু আমার আর এ সব ভেবে কোনও লাভ নেই। অরূপ আজকাল অন্যরকম হয়ে গিয়েছে, এই রকের ছেলে, যদি বা রকটা পার্টিরই। কলেজে টলেজে যায় কেন, তা ও নিজেই জানে না। অবিশ্যি কলেজে যাবার কারণ-টারণগুলো এখন আমিও আর বুঝি না। সেখানে কী হয়, কেন হয়, তার ভবিষ্যৎ-ই বা কী, আমার মাথায় ঢোকে না। রকের কাছ থেকে চলে যাবার সময়ে আমার মনের মধ্যে একটা কষ্ট হতে লাগল। পিছন থেকে ওরা হাতের মুঠোর ফুটোতে ফুঁ দিয়ে শব্দ করতে লাগল, কেউ কেউ অন্য রকম, অথবা হাসতে লাগল, নির্মলের গলা শোনা গেল, পার্টি অফিসে যাবেন, আপনার বুজরুকি বেরিয়ে যাবে।
আরও যে সব কথা শোনা গেল, তাতে অবিশ্যি কান যে কেন গরম হয় তাও জানি না, খুব খারাপ খারাপ কথা, আমাকে আর লিপিকে নিয়ে। তাতেও আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না, আমার কষ্ট হচ্ছে ওরা আমাকে বিশ্বাস করল না, ওরা দিগা-দিগন্ত বা খুকু বা পরিমলের বোন বউদির মতো মেয়ে না, তবু। তার মানে, আমি ওদের অবিশ্বাসের কারণ যেমন বুঝতে পারলাম না, ওরা আমাকে বুঝতে পারল না, আমরা কেউ কারোকে বুঝতে পারছি না। তারপরেও পার্টির অফিস, প্রিয়তোষদা–আমাদের এলাকার পার্টি নেতা, এবং আরও অন্যান্য সবাই আছে, অসময়ে যাদের আমি আমার লোক মনে করতে পারি, আপন মানুষ, যারা নিজেদের বোঝে অর্থাৎ নিজেদের সঙ্গে মনের জানাজানি আছে বলে ভাবি, তারাও হয়তো এরকম ভাববে। নির্মল তো বলেই দিল, পার্টি অফিসে গেলেই আমার বুজরুকি বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এরকম কি ভাবা যায়, পার্টি আমাকে এ ব্যাপারে বুঝতে ভুল করবে, অবিশ্বাস করবে। অবিশ্যি, অনেকবারই মনে হয়েছে, একই পার্টির মধ্যে থেকে, আমরা নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন, (এটা ভাবা অন্যায়, কারণ এটা একটা প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা) পরস্পরের চিন্তা ভাবনা জীবন জীবিকা, সমস্ত কিছুর মধ্যেই বিচ্ছিন্নতা। তথাপি, আমি যা করিনি, পার্টিও কি ভাববে আমি তা করেছি। হয়তো এ পার্টির সঙ্গেও আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে, কারণ, ইতিমধ্যেই আমি বলে ফেলেছি, সংশোধনবাদেরই আর একটা রূপ, সুবিধাবাদ পার্টির মধ্যে বিশেষ ভাবেই আছে। সরাসরি সংশোধনবাদী এখনও বলিনি, এবং তাতেই হাওয়া খারাপ। তবু মনে হল, আমি কি একবার পার্টি অফিসে যাব, প্রিয়তোষদাকে সব বলব।
না, থাক। পরিমল যেখানেই যাক, ও নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ও ফিরে এলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার না হয় লিপির সঙ্গে প্রেম ছিল–ছি ছি, আমি এরকম কথা ভাবতে পারছি, ছিল! বলা উচিত, আছে, পরিমলের সঙ্গে তো নেই, এবং লিপি বাড়িতে যা-ই লিখে রেখে গিয়ে থাকুক, পার্টির ছেলে পরিমলের মুখ থেকে সব ব্যাপারটা শুনলে তো আর অবিশ্বাস করতে পারবে না। আমার এখন আর কোনও সন্দেহ নেই, পরিমল লিপির সঙ্গে দেখা করতে পারেনি, হঠাৎ কোনও জরুরি কাজে কোথাও চলে গিয়েছে, আমাকে বা লিপিকে কোনও সংবাদ দিয়ে যেতে পারেনি, আর–আর– আমার বুকের কাছে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, আর একটা ভয় এবং আতঙ্ক যেন ছুরি দিয়ে বুকের মধ্যে ফালা ফালা করে দিল–আরআরআর, লিপি যদি সেই বেলা একটা-দেড়টার সময় আমার খোঁজে বেরিয়ে গিয়ে থাকে, বেরিয়ে গিয়ে কোনও একটা বিপদ আপদে পড়ে থাকে। লিপির চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, লিপি, সেই–সেই আশ্চর্য গঠনের শরীর। যৌবন যাকে বলে, (ওর শরীরের যৌবনটা যেন ঘন তালে গেয়ে ওঠা সুরের মতো। সুরের মতো, তালের মতো বাজে, আহ্, আমি এখন লিপিকে একেবারে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পাচ্ছি। আর ওর একটু মোটা ভাবের লাল ঠোঁটে চুমো খেতে খেতে নিশ্বাসের মধ্যে একটা গন্ধ পাচ্ছি, যে-গন্ধটার নাম, আমি মনে করি, লিপিগন্ধ-আহ, এখন আমি কী সব ভাবছি, আমি একটা কী, যেন সেই কামবায়ু শেয়ালের মতো, ছি, যেন লিপির নিশ্বাসের গন্ধটা কোনও কেমিক্যাল কোম্পানির লিপি সেন্ট) ওর সেই ঝিলিক দিয়ে ওঠা চোখ আর হাসি, যা যেখানে সেখানে সব সময়েই, মনটাকে যেন কেমন করে দেয়, লিপিকে কি কেউ বা কোনও একটা দল, ভর দুপুরে ওদের গলির মোড় থেকে ট্যাকসিতে তুলে নিয়ে গিয়েছে।
ভাবতে পারছি না, না–যদি বা, কিছুই অসম্ভব না, কারণ মাস দুয়েক হল ফটিক খাস্তগীর রোড থেকে আশা আচার্য বলে মেয়েটাকে বাড়ি থেকেই তো টেনে নিয়ে গেল। অবিশ্যি বাড়ি থেকে এমনি এমনি টেনে নিয়ে যায়নি, আশা আচার্যের বাবা মা যেভাবে পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়েছিল, যেন একটি নিরীহ ভালমানুষ মেয়ে, বাড়িতে কাজ করছিল বা পড়াশুনো করছিল, আর কতকগুলো গুণ্ডা ডাকাত ঢুকে খুকিটিকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। শুনলেই হিড়িক দিতে ইচ্ছা করে। আমাদের পাড়ার আশেপাশে না হতে পারে, কাছেই তো আশা আচার্যদের বাড়ি। দিগদিগন্তের মুখেই শুনেছি অনেক কথা, শালা পাড়ার বাপ ছেলে রেয়াত নেই, যাকে পায়, তাকেই খেলা দেখায়। তা বলে এমনি যাবে, পালে একদিনও বাঘ পড়বে না? তারপরে পড়ল ছুঁড়ি ছোঁড়াদের পাল্লায়–তোর বন্ধুরে শালা, হেরো। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, আমার বন্ধু হেরো, সে আবার কে।
দিগা খুব চটে গিয়েছিল, বলেছিল, সশালা বাতেলাবাজ, খুব সুশিক্ষিত রাজনীতিয়ালা হয়েছ। হারু-হারাণ ঘোষকে তুমি চেনো না, একসঙ্গে ইস্কুলে পড়তে?
ওহ, সেই হারু, রোগা লিকলিকে, অস্পষ্টভাবে যেন চেহারাটা মনে পড়েছিল। ভীষণ অসভ্য ছিল, ক্লাসে আমাদের সামনেই এমন একটা কাণ্ড করত, মানে প্যান্টের বোতাম খুলে–যাকগে, কিন্তু তার কথা আমার মনেই ছিল না, মাঝখান থেকে দিগার গালাগাল খেয়েছিলাম। সেই হারুই, আশা আচার্যকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিল, কারণ হারুর সঙ্গে নাকি আশা প্রেম করেছিল, ওর বাবা মাও জানত, অনেক দিন দুজনে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করেছে। হারু চেয়েছিল, আশাকে বিয়ে করবে, আশা চায়নি, দিগার ভাষায়, খেলিয়ে চলে যাবে, খেলবে না, তা বললে কি হয়।তারপরে হারু ওর কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে করে আশাকে বাড়ি থেকে দিনের বেলা সকলের সামনে টেনে বের করে নিয়ে চলে গিয়েছিল। পুলিশ এসেছিল, পাড়ায় সকলের কাছে খোঁজখবর করেছিল, আশাকেও নাকি খুঁজেছিল, তারপরে আশার ব্যাপারে সব জানবার পরে আর মাথা ঘামায়নি, কেউ ঘামায়নি। এখন তো নাকি ফিরে এসেছে, অন্য ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, হারু কিছুই বলে না।
কিন্তু সে যাই হোক গিয়ে, লিপি আশা আচার্য না, লিপি-লিপি আমার–আমার প্রেমিকা, ফটিক খাস্তগীর রোডের আশা আচার্যের মতো ওর কোনও দুর্নাম নেই, লিপি কোথায় গেল? কোথায় গেল, কোথায় যেতে পারে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্যি কি ওকে ওরকম ভাবে, রাস্তা থেকে জোর করে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে। আশার কথা আমি ভাবতে চাই না। রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো একেবারে অবাস্তব না। এরকম ঘটনা কলকাতায় আগেও ঘটেছে, এখন আরও বেড়েছে, রোজই বাড়ছে। এক এক সময় মনে হয়, সবই বাড়ছে, লোকসংখ্যার মতো সবই বাড়ছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাকে নিয়ে যেন কী একটা খেলা হচ্ছে,যেন কে আড়াল থেকে মুখ টিপে টিপে হাসছে, আমাকে খেলাচ্ছে, আমি পাগলের মতো খেলছি। আমি ফেটালিস্ট নই, যাকে নিয়তিবাদী বলে, অথচ সমস্ত ঘটনাটা ভাবতে গেলে, আমি এর কিছুই ভেবে উঠতে পারছি না এবং আমার চারপাশে যেন কী একটা অশুভ আর অমঙ্গল ছায়ার মতো পায়ে পায়ে ঘিরে আসছে, অন্তত এখন পর্যন্ত সকলের কথা হাসি শুনে আর দেখে, আরও বেশি করে সে কথা মনে হচ্ছে। আমি সত্যি আর ভাবতে পারছি না। কোথাও একটু চুপ করে বসে বা শুয়ে ব্যাপারটা আমার বোধ হয় একটু ভাবা দরকার। ভেবে আমি কী উদ্ধার করতে পারব, জানি না, তবু একবার মাথা ঠাণ্ডা করে, একটু বোধ হয় ভাবা দরকার যে লিপির সঙ্গে কয়েকদিন ধরে আমার কী কী কথা হয়েছিল। লিপি কী বলেছিল, ওর কথার মধ্যে এমন কোনও কু পাওয়া যায় কি না, যাতে একটা কোনও ভুল ঘটে যেতে পারে, যার পরিণামে পালানোর প্ল্যান–উহ, অনেক বার, বহু বার লিপিকে আমি পালাবার প্ল্যানটা ছাড়তে বলেছিলাম। কী বিশ্রী ব্যাপার, আমার মতো একটা ছেলে পাড়ার একটা মেয়েকে নিয়ে কেন পালাবে। এটা তো একটা ডিগনিটির প্রশ্ন। কিন্তু কী করব, লিপি-লিপির যে তা-ই ইচ্ছা, এবং (আমি নিজেকে কুকুর ভাবতে চাই না, কিন্তু এই হচ্ছে মানুষ, চাই না, ভাবি না, অথচ করি, করে ফেলি, আর তা-ই নিজেকে, মানুষ হিসেবে, কুকুরের থেকে খারাপ খারাপ কিছু বলতে ইচ্ছা করছে) লিপিকে পেতে হলে আর আমার কোনও উপায় ছিল না।
নাহ, বাড়িই যাই, বাড়ি গিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু ভাবি, আমার বোধ হয় একটু ভাবা উচিত। সবসমস্ত ব্যাপারই, এরকম বিভ্রান্তি, অনিশ্চয়তা আর কনট্রাডিকশন অর্থাৎ এই বৈপরীত্য যাকে বলে, এ সব নিয়ে চলা যায় না।
.
আমাদের বাড়িটা অনেকটা ভূতের মতো চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের রেলিংঘেরা বারান্দা দিয়ে উঠে, (রেলিং ঘেরা আছে বলেই, এটা পাড়ার একটা রক হয়ে ওঠেনি, একটু অসুবিধা) সামনেই বড় দরজা, দরজা দিয়ে এগিয়ে গেলেই ডান দিকে বড় একটা বসবার ঘর, বাঁ দিকটা দেওয়াল ঢাকা, দেয়ালের ওপারে পাশের বাড়ি। বসবার ঘরটা পেরিয়ে গেলে ডান দিকে দোতলার সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। নীচে, সিঁড়ির পাশ থেকেই, পর পর দুটো ঘর, অন্য ভাড়াটেরা থাকে, আর এই ভাড়াটেদেরই ফ্রক পরা কিশোরী মেয়ে ধৃতির কথা, রাস্তায়, কিছুক্ষণ আগে আমার মনে পড়ছিল।
কিন্তু বাড়িটাকে এমন চুপচাপ অন্ধকার আর ভুতুড়ে দেখাচ্ছে কেন। বাড়িতে কেউ নেই নাকি। এ সময়ে বাবা তো বাইরের ঘরে বসেন, আর পাড়া বা কাছ পিঠ থেকেই ওঁর বন্ধুবান্ধবেরা আসেন, যাঁদের কথা আর তর্ক শুনলে মনে হয়, কেউ আদি বা নব কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার, অথবা চৌদ্দ পার্টির একেবারে টপমোস্ট লিডার–বাবা কমিটি ফমিটি না, তার চেয়ে অনেক উঁচু। জহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী থেকে অতুল্য ঘোষেরা কী ক্ষতি করে গিয়েছেন অথবা এখন অজয় মুখার্জি, জ্যোতি বোসেরা কী ক্ষতি সাধন করে চলেছেন, কে ভাল, কে মন্দ, এই নিয়ে তুমুল বাক (বাকতাল্লা) বিতণ্ডা, সেই সঙ্গে ভাবতে লজ্জা করে, কেন না, সকলের যথেষ্ট বায়ুর দোষ সব মিলিয়ে বেশ হই-চই। তারপর আজকাল ছেলেমেয়েদের চরিত্রহীনতা, তাদের পোশাক আশাকের সমালোচনা, বোমা আলুর থেকে সস্তা এবং তারপরে বাজার দর থেকে বাত পিত্ততে পৌঁছে সকলেরই খেয়াল হয়, কার কার মোদক বা মদের প্রয়োজন আছে এবং (শুনেছি তো অনেকবার কান খাড়া করে, সজনী দাস নাকি কার লেখা পড়ে, কান খাড়া সম্পর্কে লিখেছিলেন, উহাকে আমরা অন্য কিছু খাড়া বলে জানি, অপূর্ব। আমার অবিশ্যি সেরকম ব্যাপার কিছু না) গলার স্বর নামিয়ে পাড়া বা বেপাড়ার মেয়েদের বিষয় নিয়ে একটু রস রঙ্গ করে, ইতি, অদ্য রজনীর পালা এখানেই সমাপ্ত। কিন্তু আজ সাড়া শব্দ নেই, বারান্দার ওপরে, দরজার মাথায় আলো জ্বলছে না। ভিতরের গলিটা অন্ধকার। বাইরের ঘরের দরজাটা বন্ধ।
থাকুক, আমি এখন আমার ঘরে যেতে চাই। দোতলায় আমার ঘরে যাবার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই, গলির মধ্যে একটা গাড়ি ঢোকার শব্দ পেলাম। ওপরের বারান্দায় এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল আমার বোন, ছোট বোন, আর আমার দিকে চেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কেন, এরকম চমকে উঠল কেন, ও কি ঘরের মধ্যে কোনও অন্যায় কাজ করছিল, কারণ কিছুকাল ওর চাল-চলন আমার তেমন ভাল ঠেকছে না। আমি বাবা মাকে কিছুই বলিনি। এ বছরই প্রথম কলেজে ঢুকেছে, কয়েক মাস হল, আর কয়েক মাস আগেই ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরেছে, তাতে হঠাৎ একটু বড় হয়ে উঠলেও সুতপা-মানে আমার এই ছোটবোন খুকু (ওহ, আমার বোনের ডাক নামও খুকু) আমার কাছে ছোট-ই, এবং আমার থেকে বয়সেও বেশ ছোট। এই কয়েক মাসের মধ্যেই যেসব মেয়েদের সঙ্গে ওকে ঘুরে বেড়াতে দেখছি, আর যে সব ছেলেদের সঙ্গে, ব্যাপারটা মোটেই আমার ভাল লাগে না। সিনেমার পোকা হয়ে উঠেছে, বোধ হয় একদিনও বাদ যায় না। আমার সবথেকে আশ্চর্য লাগে, খুকু কলেজে কোনও রকম রাজনীতি করে না, কোনও ছাত্র গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেয়নি, যে-সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ঘোরে তারাও কেউ রাজনীতি করে না। আমি ভাবতে পারি না, এটা কেমন করে সম্ভব, আর এ ব্যাপারটাকে আমি মোটেই ভাল চোখে দেখি না, কারণ ওরা যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা মারে, সিনেমা দেখে, হুল্লোড়বাজি করে, তাতে ওরা যে লেখাপড়ায় সিরিয়াস তা মোটেই না। এ ধরনের গ্রুপটা, সব কিছুতেই আছে, আবার কোনও কিছুতেই নেই। ধর্মঘটে আছে, ঘেরাওয়ে আছে, কিন্তু কেন আছে, তার কোনও কারণ নেই, সবাই আছে তাই আছে, আছে আছে আছে, সব কিছুতেই আছে, ভাবলেই আমার কেমন খারাপ লাগে, ভয়ও করে। ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে কয়েকদিন আগে এক প্যাকেট সিগারেট, তার মধ্যে একটা খানিকটা খাওয়া অবস্থায় দেখেছি। হতে পারে, ফাজলামি করে বা দল বেঁধে এক আধদিন সিগারেট খেয়েছে, কিন্তু একটা বই দেখে আমার হাত কেঁপে গিয়েছিল। অন্য মেয়ের ড্রয়ারে ওরকম খারাপ খারাপ ছবির বই দেখলে কী রকম মনে হত জানি না, (ন্যাকামি, নিজের এই ভাঁড়ামিটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না) হয়তো ভালই লাগত। নিজের বোনের বইয়ের ভাঁজে এরকম বই দেখলে আপনা থেকেই যেন কেমন চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, মনে হয়, বাঘ হয়ে উঠেছি। এখন অবিশ্যি এরকম বই অনেক দেখি অনেকের কাছে, নিজের কাছে রাখার কথা ভাবতে পারি না। খুকুর বয়সে তো নয়ই।
খুকুকে তবু আমি কিছু বলিনি। কেন বলিনি বা বাবা মাকেও কেন জানাইনি, এ ব্যাপারে মনটাকে ঠিক যাচিয়ে দেখিনি। নীচের ভাড়াটেদের মেয়ে ধৃতি–মানে ফ্রক পরা কিশোরী, (ধৃতি খুকুর থেকে একটু বড়, এখন কলেজে পড়ে, বাড়িতে ফ্রক পরে, কলেজে সালোয়ার কামিজ পরে যায়) পবিত্র নওল কিশোরী ভাবনাটা যে আমাকে মিটিয়ে দিয়েছিল, তার কথা মনে পড়েই কি, খুকুকে আমি…যাক গিয়ে এখন এ সব আমি ভাবতে চাই না। জানি না, খুকু ঘরের মধ্যে কী করছিল, বেরিয়ে এসে ও আমার দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। অন্য কোনও কথা আমার মাথায় এল না, আমার ঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম, খুকু, আমাকে এক কাপ চা দিতে বল তো।
দোতলার এল টাইপ বারান্দার দক্ষিণেই বাবার ঘর। বাঁ দিকে পর পর তিনটে ঘর। বাবার ঘর আর বাকি ঘরগুলোর মাঝখানের সরু বারান্দা দিয়ে পিছনে রান্নাঘর আর বাথরুমে যাবার পথ। আমি কয়েক পা এগোতেই, শুনতে পেলাম, এই যে, এদিকে।
ফিরে তাকিয়ে দেখলুম, বাবা। বাবার ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল। কী করে টের পেলেন আমি এসেছি, বুঝতে পারলাম না। বাবার গলার স্বরটা এমন শোনাল, যেন খানিকটা গর্জনের মতো, আমার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। একহারা লম্বা ধাঁচের চেহারা, কানের ওপরে জুলফি চাঁছা, মাথার কাঁচাপাকা চুল ছোট ছোট করে কাটা, পরনে চেক লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি, এক হাতে একটা মাসিক পত্রিকা আর এক হাতে এইমাত্র খুলে নেওয়া মোটা ফ্রেমের চশমা বাবা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছেন, যেন আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবেন। পত্রিকা সুদ্ধ হাতটা তুলে সিঁড়ি দেখিয়ে, আগের থেকেও চড়া গলায় গর্জন করে উঠলেন, য়ু সোয়াইন, গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ।
রেগে গেলেই বাবা ইংরেজি বলেন এবং বলতেই থাকবেন। ইংরেজি ভাল না জানতে পারি, কিন্তু গালাগালগুলো ছাড়া, বাবার ইংরেজি, অফিসে বলা একধরনের কী বলব, স্মার্ট আর বোকাটে। তা হোক, বাবার কথা শুনেই আমার বুকের মধ্যে ধক ধক করে উঠল, মানে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছেন। বুঝতে পারছি, সেই একই ব্যাপার, সেই একই ঘটনা, বাড়িতে সবাই জেনেছে, আর সেই জন্যই নীচের তলাটা অন্ধকার, গোটা বাড়িটা চুপচাপ, কিন্তু তা হলে–মানে, বাবাও কথাটা বিশ্বাস করেছেন। দেখলাম রান্নাঘরের দিক থেকে মা এসে বাবার পাশে দাঁড়াল, খুকু গিয়ে মায়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। মা যেন আমাকে চিনতে পারছে না, একটা অচেনা চোর বা ডাকাতকে ধরাপড়া অবস্থায় সামনে দেখলে যেমন ঘৃণা করি, ভয় চোখে ফুটে ওঠে, মায়ের দৃষ্টি সেইরকম। তার মানে এ তল্লাটে, আশে পাশে, পাড়ার সবাই যা ভাবছে মাও তা-ই ভাবছে, বাবাও, খুকুও। কী করে এরকম একটা কথা সবাই ভাবতে পারছে, বুঝতে পারছি না, নিশ্চয়ই সকলের মাথা খারাপ হয়ে যায়নি বা সবাইকেই কেউ ম্যাজিকের মতো, যাকে বলে হিপনোটাইজ করে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোকদের কাছেই যা একটু আশা ছিল, তাও নেই। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, কেন?
বাবা একবার মায়ের দিকে তাকালেন, মা বাবার দিকে, তারপর আরও জোরে চিৎকার করে উঠলেন, য়ু ডেয়ার, আঁ? হোয়াই? য়ু আসক মি, ডেভিল, স্কাল্প ফিলান্ডারার?
বাবা এখনও হাতটা যেভাবে সিঁড়ির দিকে ট্রাফিক পুলিশের মতো তুলে আছেন, বুক টান করে, রাগে দপদপে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অনেকটা থিয়েটারের অভিনয়ের মতো লাগছে, কিন্তু আমার বুকের মধ্যে কেমন গুরগুর করে উঠছে। গালাগালগুলোর কোনও মানে করার মতো মনের অবস্থা আমার না, তবে এ সবের অর্থ কী, বাবা আমাকে এভাবে বেরিয়ে যেতে বলছেন, আমার একটা কথাও না শুনে! আমাকে একটুও বিশ্বাস নেই। আমি যদি কিছু অন্যায়ই করব, তা হলে এভাবে কখনও বাড়ি আসতে পারি। মুখ তুলে কথা বলবার চেষ্টা করতেই বাবা আবার চিৎকার করে উঠলেন, চুপ, দুশ্চরিত্র লম্পট। আই স্যে গেট আউট ফ্রম হিয়ার।
বলতে বলতে বাবা এক পা এগিয়ে এলেন। এ সময়ে, সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল, কিন্তু এবার গালাগালগুলো আমাকে সত্যি বড় কষ্ট দিল, আমি অপমানিত বোধ করলাম। বাবা আমাকে এইসব বলছেন, যা কোনওদিন বলেননি। কোনও কথা না জেনে শুনেই আমাকে এইসব বলছেন, আর মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে মাও আমাকে যেন মনে মনে এইসব গালাগালগুলোই দিচ্ছে। সত্যি, আমি যে কী বলব, ভেবে পাচ্ছি না, কী করব তাও মাথা মুণ্ডু ঠিক করতে পারছি না। আমাকে কি সত্যি বেরিয়ে যেতে হবে নাকি। আমি বললাম, কিন্তু শোনো
মা বলে উঠল, কেন কথা বাড়াচ্ছিস, যা বলছে তা-ই কর। বাড়িতে এখুনি পুলিশ আসবে।
আমি তবু বলবার চেষ্টা করলাম কিন্তু
বাবা এবার, যাকে বলে, প্রায় তেড়ে এলেন, আর গলার স্বরটা শোনাল অনেকটা নিচু গলায় গোঙানোর মতো, য়ু সানোফাবিচ।
মা তাড়াতাড়ি বাবার হাতটা ধরল, আর আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলল, একটা নোংরা মেয়েকে নিয়ে ভেগেছিস, কোন মুখ নিয়ে তুই এ
মায়ের কথা শেষ হল না, সিঁড়ি থেকে জুতোর শব্দটা বারান্দায় এসে থামল, দেখলাম একজন সাব ইন্সপেক্টর এসে দাঁড়াল। বেঁটে ফরসা, বড় বড় চোখ, মোটা ভুরু, সরু করে কাটা গোঁফ ইনস্পেক্টরের মুখ আমার চেনা। লোকাল থানার ইনস্পেক্টর, সারাদিন অনেকবারই আশেপাশে চক্কর মারে। তাকে দেখেই বাবা আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলেন, হিয়ার ইজ দ্য কালপ্রিট।
ইনস্পেক্টর আমার দিকে তাকাল। লোকটাকে কতদিন চলন্ত জিপে দেখেছি দূর থেকে। এখন কাছ থেকে মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তার চোখ দুটো ঝকঝকে, একটু লাল ভাব আর মুখটা এমন হাসি হাসি, যেন সে রহস্যের সন্ধান জানে অথবা তা ঠিক নয়, যেন মোটা ভুরু আর সরু গোঁফে একটা রহস্য–অর্থাৎ, মিষ্ট্রি লেগে আছে। ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি খবর নিতে নিতেই আসছি। একটু আগেই আমি খবর পেয়েছি, হি ইজ রোমিং ইন দিস এরিয়া।
এ লোকটাও ইংরেজি বলছে। কেন বলছে, তা আমি খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। আমাকে আপনি বলবে না তুমি বলবে, সেটা ঠিক করে উঠতে পারছে না বোধ হয়। রাসকেল। এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমি যুবক, বয়সও যথেষ্ট হয়েছে, আমাকে আপনি ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে। বাংলা বলতে বলতে, তারপরে হঠাৎ ইংরেজি, তার মানে, ওঁকে এই এলাকায়–অর্থাৎ ওঁকে কি একে বা ওকে বলবে, স্থির করতে পারছে না বলেই ইংরেজিতে ম্যানেজ করল। একজন সাব ইনস্পেক্টর হিসাবে অবিশ্যি যথেষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, সন্দেহ নেই। আবার বলল, এদিকে আসতেই, আমাকে পাড়ার দু-একজন বলল, বাড়িতে ঢুকেছে। শুনেই আমি আসছি।
বলতে বলতে ইনস্পেক্টর বাবার দিকে তাকাল। সিঁড়ির দরজার কাছে কেউ এসে দাঁড়াল, কে দাঁড়াল দেখতে পেলাম না, ছায়া দেখা গেল। লোকটার–মানে ইনস্পেক্টরের কর্তব্যজ্ঞান দেখে যথেষ্ট মোহিত হতে হয়, সে আমার খবর নিয়ে বেড়াচ্ছিল, আমাকে এ অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে, এবং যাকে বলে, ট্রেইল করতে করতে ক্রিমিনালকে হাতে নাতে ধরে ফেলেছে। বুন্ধু! কিছুই জানে না, গম গম করে কথা বলছে। কিন্তু, একেবারেই স্বস্তি বোধ করছি না, এদের সকলের মুখের দিকে চেয়ে, এদের ভাবভঙ্গি দেখে সেই অশুভ আর অমঙ্গলের ভাবটাই বেশি করে জেগে উঠছে। কোথায় একটু চুপচাপ সমস্ত ব্যাপারটা ভাবব বলে বাড়িতে এলাম। এখানে আরও বেশি গোলমাল। বাবা মাও যে– মা তো সোজা বলেই দিল, একটা নোংরা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে-ভেগেছি এই শব্দটাই মা বলেছে, এবং তারপরও কোন মুখ নিয়ে আমি এ বাড়িতে ঢুকেছি।
বাবা বলে উঠলেন, আমি কিছু জানি না, ও কেন বাড়িতে এসে ঢুকেছে।
ইনস্পেক্টর ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। বাবার কথার মানেটা যেন কৈফিয়ত দেবার মতো। ইনস্পেক্টর বলল, হয়তো কিছু ফেলে গেছে, নিতে এসেছে।
এর পরে যদি লোকটাকে আমি বলদের বাচ্চা বলি তা হলে আমার কী দোষ থাকতে পারে। বাবা বা বাড়ির আর সকলেই বা কি ভেবেছে আমার কথা শোনবার কোনও দরকার নেই, বাকি সবাই যা বুঝেছে সেটাই ঠিক, আর আমি কেবল মিথ্যা বলে যাচ্ছি। বাবাকে মাকে আমি বলদের বাচ্চা বলতে চাই না, কিন্তু এটা কী ধরনের বোঝাবুঝি, সবাই যা বলবে, অথচ আমি যা করিনি, তা-ই মেনে নিতে হবে। দুঃখ আর কষ্টের বদলে এখন আমার সত্যি সত্যি বেশ রাগ হয়ে যাচ্ছে, এরা যতই মুখ শক্ত করে আগুনের মতো চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকুক, যেন আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে দেবে, তবু আমার এখন বেশ রাগ হয়ে যাচ্ছে। এখানেও সেই একই ব্যাপার, যেহেতু সবাই বলছে, বেশির ভাগ লোকই বলছে, অর্থাৎ, পার্টিতে–আগের পার্টিতে যে রকম বিচার আমার ওপর হল, কেউ যখন মানছে, তখন আমিই ভুল। শুধু ভুল না, রিঅ্যাকশনারি, পার্টিবিরোধী, মতলববাজ, পার্টির ক্ষতি সাধন করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমিও শত্রুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে, দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদী বলেছি। সবাই বললেই হল, বেশির ভাগ বললেই হল, সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সবথেকে বড় কথা। যেন একটা অঙ্কের মতো সত্যি, যোগ বা বিয়োগ ফলের মতো। রাজনৈতিক বা যে কোনও ব্যাপারেই হোক, কোনও ক্ষেত্রে, কোনও কারণেই এর যেন ব্যতিক্রম হতে পারে না।
বাবা ইনস্পেক্টরের কথায় সায় দিয়ে বলে উঠলেন, সেটা আমারও মনে হয়েছিল, সেই জন্যই তো ঢোকা মাত্রই আমি গেট আউট করে দিচ্ছিলাম। আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, আই ওন্ট টলারেট দিজ থিংস, হি মে বি মাই সান।
ইনস্পেক্টরের গোঁফ একটু ছড়াল, এটা বোধ হয় হাসি, যদিও দাঁত দেখা গেল না বা কোনও শব্দ হল না। ঘাড় নাড়িয়ে বলল, এরকম বাবা আজকাল আর কজন আছে বলুন। নিজের ছেলের ক্রাইম ঢাকতেই চায় তারা।
বাবা খুব জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলে উঠলেন, নো নো নো, আই অ্যাম নট এ ম্যান অব দ্যাট টাইপ, তাতে আমার যা হয় হোক।
ইনস্পেক্টর বলল, আজকের যুগে এটা আশা করা যায় না। আমি তো মশাই মাঝে মাঝে অবাকই হই, বাবা মায়েরা কোথায় ছেলেমেয়েদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, তা না, উলটে আমাদেরই তেড়ে আসে। যেন পুলিশ বলে, আমাদেরই সব দোষ।
বাবা একরকম ভাবেই, ঘাড় নেড়ে, আরও যেন উৎসাহিত হয়ে বললেন, না না, আমি তা পারি না। আপনি যা বললেন, তা আমি জানি। দেশটা যে কোথায় নেমেছে, নেমে চলেছে, আই নো ইট ভেরি ওয়েল।
দুজনে যেন নাটক করছে, শেখানো বুলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে, উইথ অ্যাকশন কপচাচ্ছে। কী বলব, এদের কী বলা যায়, আমি বুঝতে পারছি না। এভাবে কথা বলে, এই সব বাদুড়ের বাচ্চারা বাদুড়ের বাচ্চা! কথাটা কেন আমার মনে হল, বুঝতে পারছি না, এরকম গালাগাল আমি কারো মুখে কোনওদিন শুনিনি–তথাপি, হ্যাঁ বাদুড়ের মতোই এরা দিনের আলোতে চোখ বুজে থাকে আর রাত্রের অন্ধকারে রপুটে বেড়ায়, এদের কী বলা যায়। আমার তো এই মুহূর্তে বাংলা দেশের কয়েকজন মুভি অভিনেতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, এদের ভাবভঙ্গি দেখে। আদর্শ পিতা, আদর্শ পুলিশ ইনস্পেক্টর, একজন অপরাধীর (সত্যি রেগে যাচ্ছি, একটা যা-তা কিছু বলে ফেলব) সামনে অধঃপতিত সমাজের বিষয় আলোচনা করছে, দুজন লোক নিজেদের আবিষ্কার করছে।
ইনস্পেক্টর একবার সিঁড়ির দরজার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল। তারপর বাবার দিকে চেয়ে বলল, হুম, মানে আমরা একটু ঘরের মধ্যে গেলে বোধ হয় ভাল হত।
বাবা বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই!
ইনস্পেক্টর আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। বাবা যেন সেই তাকানোর কারণ বুঝতে পেরেই আমার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে হুকুমের স্বরে ডেকে উঠলেন, কাম, কাম হিয়ার।
কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না। এই সব বাজে ঝামেলা থেকে আমার বেরিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। এরা যত খুশি আমাকে অপরাধী করে গালাগাল দিক, নিজেরা বড় বড় কথা বলুক, আমি কাছে থাকতে চাই না, শুনতেও চাই না। তবে ইনস্পেক্টর যখন ঘরের মধ্যে গিয়ে কথা বলতে চাইছে, মনে হয় লোকটার মধ্যে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বোধ হয়, আমার সঙ্গে একটু ব্যাপারটা বলাবলি করে, তলিয়ে ভাবতে চায়। তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, আমি কথাবার্তা বলতে চাই। দেখা যাক, কী বলে লোকটা। আমি, বাবা আর ইনস্পেক্টরের পিছনে, বাবার ঘরের দিকে এগোেলাম। মা আর খুকু বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। যেতে গিয়ে, সিঁড়ির মুখে, কয়েকজনের মধ্যে, ধৃতিকে দেখলাম। আশ্চর্য, আমার নিজেরই অবাক লাগল, ধৃতির মুখে কোনও রকম রাগ ভয় বা যাকে বলে অবাক হওয়া, সেরকম কিছুই নেই। হয়তো ও বারান্দায় এগিয়ে আসত, কিন্তু আমি জানি, খুকুর সঙ্গে ওর ঝগড়া আছে, অনেক দিন আমাদের ওপরে আসে না। মাও বোধ হয় ধূতির সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। মেয়েদের সব ব্যাপার আমি বুঝি না। খুকু কলেজে যাবার আগেও ধূতির সঙ্গে ওর মোটামুটি কথাবার্তা ছিল, এখন। একেবারে বন্ধ। ধৃতি একটা চিনা মেয়েদের মতো পায়জামার ওপরে লাল জ্যাকেট পরে রয়েছে, দেখতে ও বরাবরই সুন্দর, যদি বা ওকে আমি কোনওরকমেই ভাল মেয়ে বলতে পারি না, কেন না, ও আমার জীবনের একটা ধারণা বা বিশ্বাস একেবারে চুরমার করে দিয়েছে, অথচ দেখ, এখন ওকে কেমন নিষ্পাপ পবিত্র দেখাচ্ছে। টানা বড় চোখনা থাক, এখন এ সব ভাববার সময় না। এ লোকগুলোর সঙ্গে আগে আমি মিটিয়ে নিই। কিন্তু ধৃতির চোখে বা মুখে আর সকলের মতো ভাব নেই কেন বুঝতে পারছি না। এটা তো একটা অসম্ভব ব্যাপার, এরকম একটা পাজি জাঁহাবাজ সুন্দরী কিশোরী (কিশোরী! এখন আমারও বলতে ইচ্ছে করছে, মোসাই দ্যাখেননি তাই। কম করে উনিশ হবে।) আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমার অবস্থাটা ও বুঝতে পারছে। নিশ্চয়ই এর মধ্যেও ওর কোনও চালাকি আছে। আমাকে অন্য দিক থেকে খোঁচা মারার তালে আছে। আমি ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। আমার পিছনে পিছনে মা আর খুকুও ঢুকল।
বাবা ইনস্পেক্টরের দিকে তাকিয়ে, যেন একটা বিশেষ পরামর্শ দেবার মতো বলে উঠলেন, যা করবার আপনি তাড়াতাড়ি করুন। তা না হলে দেখবেন, হয়তো পার্টির লোকেরা এসে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে, একে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে।
ইনস্পেক্টরের ফরসা মোটা মুখে এবার সত্যি হাসি ফুটল, গোঁফ জোড়া ওড়া পাখির মেলে দেওয়া লম্বা পাখার মতো ঠোঁটের দু পাশে ছড়িয়ে পড়ল। বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর চালে মাথা নাড়ল। বলল, সেরকম কোনও ব্যাপার নেই বলেই মনে হয়। আপনার ছেলের কোনও পলেটিকাল পার্টির সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন আছে, আমরা খবর রাখি।
বাবা ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, পলেটিকাল পার্টি কী বলছেন মশাই, সে সব আজকাল আবার আছে নাকি। অল ব্লাডি মস্তান পার্টিজ।
মদন! বাবাকে আমার এ ছাড়া আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে, মায়ের আঁচলটা দিয়ে বাবাকে চাপা দিয়ে দিই, তারপর ঘরে বসে বসে উনি যত খুশি সমালোচনা করুন, কেন না, জানি তো, এ সব হুমকানি বাইরে গিয়ে ছাড়তে পারবেন না, ঘরেতেই সম্ভব। অবিশ্যি রকের নির্মল অরূপেরা যে-পার্টিতে থাকে তাদের মস্তান পার্টি বলা যায়, কিন্তু বাবা বলবেন কেন। মুখে যা-ই বলুন, তাঁর জীবনে তো কোথাও একটু এদিক-ওদিক হয়নি, কোথাও টোল খায়নি, আর যা-ই বলবেন, সবই ঘরের কোণে এসে।
ইনস্পেক্টর বলল, মে বি। কিন্তু আমি যতটা স্মেল করেছি, এর ব্যাপারে (আমার দিকে দেখিয়ে) সেরকম কিছু ঘটবে না। মনে হয়, পার্টি এর কাজেকর্মে বিশেষ খুশি না। তা না হলে কী হত, বলতে পারি না। হয়তো আপনি যা বলছেন, তা-ই ঘটত।
আশ্চর্য, এ সব খবরও এ লোকটা জানে। তার মানে, খবরের কাগজে ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে যতই সমালোচনা করুক, তারা ততটা অকর্মণ্য না। অবিশ্যি, এ খবর জানাটা খুব একটা বিরাট ব্যাপার কিছু না। আমার বিষয়ে কথাবার্তা এমন গোপনীয়, কেউ জানতে পারবে না। কিন্তু একজন ৭থানার ইনস্পেক্টর যখন এ সব কথা বলে, তখন মনে হয় পার্টিতে কে কী বলছে না বলছে এ সব খবর তাদের জানা। অথচ, আমি তো পার্টিকে–পার্টির বিষয়ে আমার যা বক্তব্য, জানাইনি। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেছি মাত্র। স্থানীয় পার্টির কর্তাদের কানে সে কথা যেতে পারে। তা নিয়ে পার্টিতে কোনও আলোচনা হয়নি–মানে, ফর্মাল কোনও আলোচনা বা সমালোচনা বা মিটিং ডেকে কোনওরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, কারণ পার্টি আমাকে এখনও ডেকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। মিটিং ডেকে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে তা আমি জানি, আর জিজ্ঞেস করাকরির আবহাওয়া আদপেই পার্টির মধ্যে আছে কি না সন্দেহ। এক কথায়, পার্টি থেকে বের করে দেবে, কর্তাদের মর্জির ওপরেই সব এবং এও জানি, ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হবে না, একটা, যাকে বলে–দীর্ঘস্থায়ী লড়াই লেগেই থাকবে। রাতারাতি আমি জনসাধারণের শত্রু, বিপ্লবের শত্রু এবং আরও ওই যে সব কী বলে, আজকাল সবাই সবাইকে বলে, যার সঙ্গেই যার ঝগড়া হোক, বাবা আর ছেলের সঙ্গে ঝগড়া হলে এ ওকে সি আই এর দালাল বলে, আমিও তা-ই হয়ে যাব। আগে আমি যে পার্টিতে ছিলাম, যাদের রাজনৈতিক প্রস্তাব কার্যকৌশলনীতি সবই আমার সংশোধনবাদী বলে বিশ্বাস, ছেড়ে আসার সময়ে তারাও আমার বিরুদ্ধে ও সব কথা বলেছিল, গালগাল দিয়েছিল, এমনকী আঁকাবাঁকা হাতের লেখায়, গুনতিতে প্রায় তিন চারটে পোস্টারও পড়েছিল, তার মধ্যে একটা আমাদের বাড়ির দেওয়ালে। কোনও মানে হয়, আমার জন্য আবার ও সব করা।
আসলে নিজেদের এলাকায়, সবাই সবাইয়ের চেনাশোনা, তাই ব্যাপারটা একটা পাড়াটে ঝগড়ার মতো, আর আজকাল তো দেওয়ালে লিখে সব বলার রেওয়াজ। কিরীটি ভঞ্জ লেনের ছেনো হালদার লোক ভাল না। বড়লোক, অহংকারী আর চরিত্রটা একশো বছর আগের ধনীদের মতে, এখনকার সময় আর যুগটাকে বোধ হয় বোঝেই না, কোনও ব্যাপারে এক পয়সা চাঁদা দেবে না। তার বিরুদ্ধে পোস্টার পড়েছিল, ছেনো হালদারকে পাড়া থেকে তাড়াও। আমাদের পার্টির ছেলেরাই পোস্টার দিয়েছিল, এখন আমি যে-পার্টিতে আছি, এবং প্রিয়তোষদাকে–স্থানীয় নেতাকে, ছেলেরা বলেছিল, পার্টির নামে পোস্টার দেবে। প্রিয়তোষদা খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, তা কিছুতেই হবে না–সেই জন্য কোনও সংস্থার নাম পোস্টারে ছিল না। এটা যদিও বা বোঝা যায়, রামকৃষ্ণ ঘটকের মুদিখানা, পাড়া থেকে হটিয়ে দাও বা ১৭ নং তিলক (আসলে ত্রিলোক) ঠাকুর লেনের বাড়িকে ঠাণ্ডা কর এই সব বেনামা পোস্টার দেখে কে কী বুঝবে। না বোঝবার কোনও কারণ নেই। পাড়া আর আশেপাশের লোকেরা সবই বুঝতে পারে, কারা কীসের জন্য এ সব পোস্টার দিচ্ছে। ঘটকের অপরাধ, কারও কারোকে হয়তো দোকান থেকে চিরদিনের ধারে মাল দেয়নি, সতেরো নম্বর ত্রিলোক ঠাকুর লেনের বাড়ির মেয়েরা যাদের সঙ্গে প্রেম করতে নারাজ, পোস্টারের হুমকি তাদেরই। তবে সেটা যথেষ্ট ভদ্র আর নিরীহ, পেটো ছুঁড়ে উড়িয়ে তো দেয়নি।
এ সব যাই হোক গিয়ে, এ লোকটা ইনস্পেক্টর পার্টিতে আমার কী পজিশন, তা জানল কী করে। অবিশ্যি, কাজে কর্মে পার্টি আমার ওপর খুশি নয়, কথাটা ঠিক না, বন্ধুদের কাছে আমার মন্তব্যে পার্টি খুশি না, যদি বা সেটা কাজকর্ম বলতেই বা কতক্ষণ লাগে। তথাপি এ সব হল পার্টির ব্যাপার, সেটা আমার সঙ্গে পার্টির বোঝাপড়া, এ লোকটা এ সব খবর বলছে কী করে।
ইনস্পেক্টর আবার বলল, তবে স্যার, আপনার ছেলের এমনি রেপুটেশন খারাপ না, (এ সময়ে একবার চোখের কোণ দিয়ে আমাকে দেখে নিল, আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করল, মাইরি?) সে খবর আমাদের কাছে আছে, পার্টির মস্তান বা সেরকমও কিছু না, বরং পলেটিকাল ফাইটার হিসেবে
ইমপসিবল। শব্দটা যে আমার গলা থেকেই বেরিয়েছে, এটা আমি নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না, কারণ কথাটা বলেই আমি একবার সকলের মুখের দিকে তাকালাম, যেন কে বলেছে, সেটা জানবার জন্য, আসলে যদি বা তা না, আমার এই আচমকা প্রতিবাদে কে কী মনে করল, বিশেষত বাবা, তার জন্যই তাকালাম। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, আমি একজন এম এ পাশ যুবক, বামপন্থী রাজনীতি করি, থানার একটা পুলিশ ইনস্পেক্টরের কাছ থেকে, আমি আমার চরিত্র বা রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশংসার সার্টিফিকেট চাই না, কোনও কথাও শুনতে চাই না। আমি ইনস্পেক্টরের মুখের। দিকে তাকালাম, মনে হল, লোকটা ঠোঁটের কোণ বাঁকিয়ে হাসছে, কারণ একদিকের গোঁফ একটু বেশি টানা দেখাচ্ছে, অথচ চোখ দুটো যেন একটু লাল হয়ে উঠেছে। আমি মোটেই গলা চড়িয়ে বা ফেঁজে কথা বলতে পারি না, তা-ই আবার নিরীহ ভাবেই বললাম, আমি–মানে, বলতে চাই, আপনার মুখ থেকে এ সব কথা আমি–মানে, শুনতে চাই না।
বাবাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এল, চিৎকার করে উঠলেন, য়ু, মাস্ট হিয়ার। একশো বার শুনতে হবে।
ওহ, বাবাকে নিয়ে সত্যি পারা যায় না। আমি বাবা হয়ে, বাবা ছেলে হলে দেখছি ভাল হত। এত অবুঝ মাথা গরম হলে বাবা হওয়া যায় কী করে। মনে মনে খুব রেগে থাকলেও আমি শান্ত আর বেশ গম্ভীর ভাবে বললাম, তা হলে বলতে চাও, আমার কোনও কথা বলবার অধিকার নেই?
বাবা একইভাবে চিৎকার করে বললেন, নো, য়ু হ্যাভ নো রাইট টু টক। অধিকার, আবার অধিকার বলা হচ্ছে।
এর মানে কী, আমি কোনও কথা বলতে পারব না। খুনিকেও তার স্বপক্ষে কথা বলতে দেওয়া হয়, আর আমি কোনও অপরাধ না করেও কিছুই বলতে পারব না। এরা সবাই ভাবল কী। আমি বাবাকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বললাম, দেখো বাবা, কথাটা একটু শোনো, আসলে কী
বাবার সেই এক কথা, নো, য়ু কিপ কোয়ায়েট। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলের নমুনা দেখাচ্ছ, না? একটা বাজে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে, আবার বাড়ি
আমি ঠোঁট আর দাঁত দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ না করে পারলাম না। বাবাকে দেখছি আর তুমি করে বলা চলবে না, আপনি করে বলতে হবে, কারণ রাগে আর দুঃখে আমার তা-ই বলতে ইচ্ছা করছে, এবং বললামও তা-ই। আমি ঠাণ্ডাভাবে বললাম, আপনি একটু শুনুন দয়া করে, ব্যাপারটা কী ঘটেছে–
বাবার গলা দিয়ে অবাক স্বর বেরিয়ে পড়ল, মানে?
মা রেগে বলে উঠল, তোমাকে ঠাট্টা করছে।
য়ু ডেয়ার?
আমি জানি না, বা ভাবতেও পারি না, বাবা আমার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলেন কি না, ইনস্পেক্টর চেয়ার ছেড়ে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। বাবার দিকে মাথা নেড়ে হাত তুলে বলল, আপনি স্যার একটু ধৈর্য ধরুন, আমি এর সঙ্গে কথা বলছি।
যেন এতক্ষণ ধরে আমি এদের কথা বলাচ্ছি, আর রাগিয়ে দিচ্ছি। কিছু বলতে দেবে না, বুঝতে চাইবে না, নিজেরাই সেই কী বলে, নিজেরাই গাইছে, নিজেরাই শুনছে। মা-ই বা কথাটা কী করে বলল। আমার রাগ আর দুঃখটা ঠাট্টা হয়ে গেল। ইনস্পেক্টর আমার দিকে ফিরে, যেন খুবই সদয়ভাবে অপরাধীটাকে বলল, আচ্ছা, তুমি বসো তো ভাই, আমাকে সব কথা বলো, একটুও না চেপে।
উল্লুক বুন্ধু ছুঁচো, আনকালচারড, ইললিটারেট! মনে মনে এই কথা বলেও এই মুহূর্তে আর কোনও গালাগাল মাথায় এল না।
এরকম একটা সস্তা ধারণা লোকটা করল কী করে যে, আমাকে একটু তুইয়ে বুইয়ে বললেই আমি ওর মনের মতো কথা বলতে আরম্ভ করব, তা সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, এবং যেটা আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম, ইংরেজিতে আওয়াজ দেওয়ার রকম দেখে, আমাকে তুমি বলবে কিনা, ভাবছিল। এখন সোজা তা-ই বলল। আমি রোখপাক করতে চাই না, বললাম, আপনি যদি আমাকে–মানে, তুমি না বলেন, তা হলে কী হয়।
ইনস্পেক্টর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, চোখ দুটো আর একটু লাল হল, চোখের পাতা কোঁচকাল, যেন আমার কথাটা সে ঠিক ধরতে পারেনি বা আমার মনের ভাবটা মুখ দেখে বুঝতে চাইছে। বাবা হুমকে উঠে বললেন, তা হলে সম্মান দেখানো হয়।
আপত্তিকর হলেও বাবার ভাষাটা এবার বেশ ভাল হয়েছে, মানে আমার কথার জবাবে বেশ লাগসই এবং যথেষ্ট ভদ্রলোকের মতো ইয়ে–অর্থাৎ ক্রুদ্ধ উক্তি। ইনস্পেক্টর ঠোঁট বাঁকিয়ে, হাসির ভঙ্গি করে বলল, আফটার অল আই অ্যাম ওলডার দ্যান ইউ।
তবে আর কী, ওলডার দ্যান মি যখন, তখন তুই বলে ডাকলেই হয়। মনে মনে খুবই উত্তেজিত হলেও, সেরকম ভাবে আমি কিছু বলতে চাই না। বললাম, আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনার থেকে বয়সে ছোট মন্ত্রী আছে, পুলিশের বড় অফিসার আছে। তাদের আপনি তুমি বলবেন তা বলে।
বাবা আগের মতোই হুমকে উঠলেন, আই সে য়ু শাট আপ।
ইনস্পেক্টরের ফরসা মুখটাও এবার চোখের মতোই খানিকটা লাল হয়ে উঠল। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, কেমন যেন চাপা গরগর স্বরে বলল; আই অ্যাম নট টকিং উইথ এ মিনিস্টার, অর এ বিগ অফিসার। আমি যার সঙ্গে কথা বলছি, তার বিরুদ্ধে কমপ্লেন হচ্ছে, আন্ডার এজেড একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, যাকে বলে নাবালিকা হরণ, ফোসলানো, আন্ডারস্ট্যান্ড?
কথাটা ঠিক, মানতেই হবে, আর যাকে বলে, আমার মুখের ওপর বেশ শক্তভাবে, যথার্থ কথাই লোকটা বলেছে। কোনও রাজনৈতিক অপরাধীকে না, যার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ আছে, তাকে আপনি আজ্ঞে করে কেউ বলবে না নিশ্চয়ই, যদি বা, সে অপরাধ আমি করিনি, তবু লোকটার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আমি কোনও জবাব দিতে পারলাম না, বলতে গেলে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে খানিকটা বোকার মতোই তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, ইনস্পেক্টরের মুখের লাল ভাবটা কেটে যাচ্ছে। গোঁফ ঠোঁটের দু পাশে ছড়াচ্ছে, হাসি ফুটছে। বলল, এ সব কথায় তো আসল কাজের কিছু এগোচ্ছে না, ডোন্ট ট্রাই টু বি মাচ স্মার্ট।
লোকটা যেন নিজের কবজায় গোটা দাবার ছকটা পেয়ে গেল, আর বেশ সন্তুষ্ট মেজাজে তরতর করে কথাগুলো বলল। আর কিছু বলবার আগেই সে আবার বলতে লাগল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ঘোষালের সঙ্গে, আই মিন মেয়ের বাবা মায়ের সঙ্গে, আমি কথাবার্তা বলে যা বুঝেছি, তাঁরা যদি মেয়েকে ইনট্যাকট পেয়ে যান, (তার মানে কী, মেয়ের শরীরের কোনও কোনও অংশ কি কেটে রাখা হবে নাকি!) আজ রাত্রের মধ্যেই, তা হলে ব্যাপারটা আর বেশি দূর গড়াবে না। তাঁরা অভিযোগ উইথড্র করে নেবেন। আমরাও চাইনা ব্যাপারটা কোর্টে যাক, এ নিয়ে বেশি হইচই হোক, তাতে মেয়েটার পক্ষে ক্ষতি। নাউ
কথা শেষ না করে সে আমার দিকে তাকাল। যেন যথেষ্ট বিবেচক আর বুদ্ধিমানের মতো, বেশ একটু অমায়িক হেসে, (এই জন্যই ওরা কারও কারোকে ক্যালানে বা খচ্চর জাতীয় কিছু বলে) আমার আরও কাছে এসে বলল, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এবার বলো তো ভাই, মেয়েটাকে তুমি কোথায় রেখে এসেছ। বলতে না চাও, আমাকে নিয়ে চলো সেখানে, মেয়েটিকে নিয়ে আসি।
ছেড়েই যাচ্ছে, ছেড়েই যাচ্ছে, মানে যাকে বলে সুতো ছেড়েই চলেছে, সেইরকম, দেখবার দরকার নেই, আশপাশ থেকে আর কোনও ঘুড়ি আসছে কি না। আমার খুবই অবাক লাগছে, এটা একটা প্রহসন–মানে, আমাকে নিয়ে একটা কেলোর কীর্তি হচ্ছে, নাকি একটা ষড়যন্ত্র। আমি, যাকে বলে, খানিকটা অসহায়ভাবে অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু আমি তো লিপিকে কোথাও নিয়ে যাইনি।
খুকু বলে উঠল, উহ, টপ দাদা।
মানে, আমার থেকে অনেক ছোট বোন খুকু আমাকে এরকম করে বলছে, যার মানে, আমি একটা নিদারুণ মিথ্যা কথা বলেছি। খুকুর স্বরে অবাক হওয়া আর হাসি, দুই-ই আছে। দেখলাম, ওর চোখ দুটোতেই সেই ভাব। ইনস্পেক্টর এতক্ষণে বেশ শব্দ করে হেসে উঠল, আর সেটা খুকুর দিকে চেয়েই। বাবার দিকে তাকাবার আগেই, আমার গালে বাদাম্ করে একটা থাপ্পড় পড়ল বাদাম্ মানে, থাপ্পড়ের শব্দ বাদাম হয় কি না কে জানে, কিন্তু আমার গালের চামড়াটা যেন ফেটে গেল, কানে কী রকম ভোঁ ভোঁ শব্দ হতে লাগল, কারণ থাপ্পড়টা সপাটে কান সুদ্ধ লেগেছে, এমনকী মনে হল, চোখেও ভাল দেখতে পাচ্ছি না, কেবল বাবার ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনতে পেলাম, লায়ার, মিথ্যুক, রাসকেল! ইনস্পেক্টরের গলা শুনতে পেলাম, থাক থাক, মার ধোর করবেন না।