২. মুনশিজির-তালিম

মুনশিজির-তালিম

হালের মুরুব্বি আর এক জামানার দোস্তকে দু-মাসের বেতন কবুল করে মিলল চাপরাশ। হলাম ‘ডিপটি সাহেব’-এর আর্দালি। নিজেকে এই বলে তসল্লি দিলাম; হোক না আমদানি কম আখেরে সব পুষিয়ে যাবে। কয়েক হপ্তা পর নজর করলাম কোনও আমদানিই হচ্ছে না। আসলে হুজুরের কাম-কাজগুলো খুবই মামুলি। বেদম হয়ে আবার ধরে পড়লাম শুনতা ক্যা-কে।

“আরে! পাঁচকড়ি তুই আর লায়েক হলি না, এই রকম একটা মামুলি কারণে আমার কাছে ছুটে এলি। ডিপটি সাহেবের হাতে আছে ‘সরাসরি’ (Sursuree) দপ্তর যেখানে দুই তরফ মামলা লড়ে আর এক তরফ হারে। এটা তো দস্তুর যে যারা মামলা জিতবে তারা খরচ করবে। বেশক, হুজুরের আর্দালি নিজের আর সেই সঙ্গে মুহুরির অজুরাটা পেয়ে থাকে। তবেই না তার দুগুণা কামাই হবে। প্রত্যেক দিন তার উপরি চার থেকে আট আনা। কোনও মতে যদি তুই ডিক্রিদার আর মুহুরির মাঝে বেনামদার হয়ে উঠতে পারিস তখন তো কেল্লা ফতে। পুরো মামলা তোর হাতের মুঠোয়। যারা ডিক্রি পাবে তখন তাদের তুই চাপ দিতে পারবি তোর দিকটাও দেখার জন্য।”

আমি বললাম, “শুনেছি সাহেব খুব হুঁশিয়ার; আমার কারবার তার নজরে পড়লে তো দফা গয়া; কী অজুহাতে ডিক্রিদারের কাছে অজুরা চাইব?”

“আরে! পাঁচকড়ি, আমার কথা শোন। তোর সাহেবও বাকিদের মতোই নালায়েক। সেই মুরোদ নেই যে গোলমাল ধরবে। ডিক্রিদারেরা নিজেদের গরজেই মুখ খুলবে না। লোকজনকে এতবার ঘর-বার করতে হয় যে তোর মতো একটা আর্দালি কিছুক্ষণ হাজির না থাকলেও কারও নজরে পড়বে না। নিজের হকটা তুই জোর গলায় চাইবি। দেখবি কোনও গড়বড় হবে না আর যা আমদানি হবে সেখানে আমার হিস্‌সাটা ভুলিস না আবার!”

পর দিন মামলার ফয়সালা হতে না হতেই আমি ফুড়ুৎ করে কামরার বাইরে চলে এলাম। হাতটা বাড়িয়ে দিলাম ডিক্রিদারের সামনে। সেও কোনও সওয়াল না করে গুঁজে দিল একটা টাকা। তারপর ফিসফিস করে বলতে বসল, মুনশিও যেন ভাগ পায়। হারামের কামাই, তার আবার ভাগ! কোনও গড়বড় যাতে না হয় তাই একবার আওড়ে নিলাম আলহুমদৌল্লা (alhumduloollah)!! দাড়ি চুমড়াতে চুমড়াতে আবার গম্ভীর মুখে ঢুকে পড়লাম কামরায়। এরপর আমার তজরবা কম বেশি এক। ফারাকটা শুধু ছিল আমদানিতে।

কয়েকদিন পর মুনশি আমাকে তলব করল তার কামরায়। জানতে চাইল কোনও আমদানি হয়েছে কি না। জবাব দিলাম, আল্লার কসম, একটা কানাকড়িও কেউ ঠেকায়নি। দোস্ত, তুমি কী ভাব ডিক্রিদারের পিছু পিছু তোমার যাওয়াটা আমার নজরে পড়েনি। কোনও ফয়দা ছাড়াই কি তুমি আসা-যাওয়া কর? খোদার কিরা মুনশিজি, ঝুটমুট কিছু গালিগালাজ ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। আমি কোন শরাফত যে জমিদার আমাকে কিছু ঠেকাবে? মুনশি এবার বলতে বসল, সাবেক কাল থেকে এই দস্তুর জারি, মামলায় যার জিত হাসিল হবে সে আমলাকে কিছু বখশিশ ঠেকাবেই। মুনশিজির নাম করে আমি যেন তা আদায় করি। যা আদায় হবে তার চার ভাগের এক ভাগ পাবো আমি আর বাকি চাপরাশিরা তিন ভাগ যাবে মুনশি আর তার দোস্তদের জেবে। তুরন্ত আমি মুনশির কথায় রাজি হয়ে গেলাম। এবার মুনশি বসল আমায় তালিম দিতে। কী কী করতে হবে। সেই তালিমের কথাই এবার আমি আপনাদের সামনে খোলসা করব।

“ধরা যাক একটা কোনও হুকুম জারি হল আর সেরেস্তার কাছে চাওয়া হল কৈফিয়ত। সবাই ধরেই নেবে কাজটা হতে কমসে কম এক সপ্তাহ লাগবে। ফরিয়াদির যদি খুব তাড়া থাকে আর সাহেব জানতে চান কৈফিয়ত কেন লেখা হল না, তখন তোমার কাজ হবে সেই নালিশনামাটা নিয়ে ফরিয়াদির কাছে জানতে চাওয়া, তাড়াতাড়ি লিখিয়ে আনলে কত ঠেকাবে সে? বজ্জাতটা দেখবে খুশি হয়ে এক টাকা কবুল করেছে। তুমি সেটা ট্যাঁকে গুঁজে সটান হাজির হবে মহাফেজখানায়। বলবে সাহেব জানিয়েছেন, এখুনি এখুনি হুকুমটা লেখা না হলে সবাইকে জরিমানা করা হবে। মামলা খতম। আমরা সবাই বুঝে নেবো নিজের নিজের হিস্‌সা। আর যদি দেখ যে বজ্জাতটা কিছু ঠেকাতে নারাজ, তখন জানতে চাইবে কৈফিয়ত কেন লেখা হয়নি। জবাব মিলবে, আরও বড় বড় সব সাহেবরা জরুরি কাগজ তলব করেছেন; তাই মহাফেজ দপ্তরের বিনীত আর্জি, আরও কিছুটা সময় তাদের মঞ্জুর করা হোক। হয়রান মামলাবাজ দেখবে যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ জুতোর সুকতলা খোয়ানোর চেয়ে এক টাকায় রফা করাটা অনেক ভাল।

“আর একটা চালু রেওয়াজ হল জমিদারের আর্জি দপ্তরে জমাবন্দি হলে এক টাকা দস্তুরি কবুল করা। এই টাকাটা পায় মহাফেজ দপ্তর আর কানুনগোরা। শুনতে তোমার খারাপই লাগবে পাঁচকড়ি, যে এতে তোমার-আমার কোনও ভাগ নেই। তবে চোখ-কান যেন তোমার খোলা থাকে। যেই শুনবে জমিদার হুজুরকে নালিশ করছে, জমাবন্দি দিলেও তা নথিভুক্ত হচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করবে দরাদরি করে একটা রফা করে নিতে। গিয়ে চোটপাট শুরু করবে মহাফেজ দপ্তরে আর কানুনগোর উপর। ভাব করবে এটা করছ তুমি হুজুরের হুকুম মতো। জমিদার তোমাকে যা ঠেকানোর ঠেকাবে আর আমরা ভালমানুষের ছেলে আপসে ভাগ করে নেব।”

আমি নানা ইশারা-ইঙ্গিত মোতাবেক কাজ করে গেছি। তাতে কামাইও মন্দ হয়নি। বেশক ভাগাভাগির বেশিটাই গেছে আমার পেটে। তবে আমার নজর ছিল কী করে প্রথম সুযোগেই এই নোকরি পালটানো যায়। আমি চাইছিলাম এমন কোনও দপ্তরে যেতে যার মরতবা আর ইজ্জত বেশি।

১. কৈফিয়ত: জবাব, কারণ দর্শানো

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *