ডিটেকটিভ নোংরা পরির কংকাল প্রেমিক (ডিটেকটিভ উপন্যাস) – মলয় রায়চৌধুরী
১. পলাতকার উড়াল
তারিখটা আজও মনে আছে : পয়লা সেপ্টেম্বর ।
মেট্রো রেল স্টেশানের চত্বরে দাঁড়িয়ে, মোবাইলটা পকেটে আছে কিনা চেক করছি, একজন তরুণী খপ করে বাঁ হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ । খপ, এই শব্দটাই মাথায় এলো , অব্যর্থ শব্দ । ডেস্কটপের কি-বোর্ড পর্যন্ত শব্দটাকে নতুন মানে দিয়ে ফেলছে , স্পষ্ট অনুভব করছি । মুখে বললে অশ্লীল শোনাবে এই খপ শব্দটা ; কিন্তু হাত ধরার প্রক্রিয়ায় তো ওই আধ্যাত্মিক ইন্দ্রজাল লুকিয়ে ছিল । ইঁটের তলাকার ঘাসের মতন, রহস্যময় ।
‘চলুন পালাই’ কথাটার জন্যে নয় , বা, ডান হাতের কব্জিতে শক্ত মুঠোয় ধরার, ধরে থাকার কারণে , আমার মুখমন্ডলে যে ভাব ছড়িয়ে পড়েছিল, তা ভয়, ভীতি, অতিপরিচিত ভীতি, রক্তশূন্যতা, অথচ অজানা আশঙ্কা, বিপদের পূর্বাভাস না অন্য কিছু , তা স্মৃতিতে আর ফিরিয়ে আনতে পারছি না যদিও । ব্রহ্মাণ্ড নিশ্চই ভয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল । শব্দহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন, বাতাসের স্পর্শহীন, স্বাদবস্তুহীন পূঞ্জীভূত ভয় , সীমাহীন অন্ধকারে শূন্যবিন্দুতে ঘন হয়ে ওঠার ভয় । স্টেশানের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলুম সেই শূন্যবিন্দুতে । হঠাৎ । আচমকা, এক নিঃশব্দ হিমশীতল বিস্ফোরণ । পয়লা সেপ্টেম্বর ।
তরুণী ফোটোক্রোমেটিক চশমায় , কাচের নিচের দিকটা ফিকে বলে গভীর চোখ দুটোয় প্রশ্নময়তার ঝিলিক । মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল । আমার চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চ ছোট ; দামি ব্র্যান্ডেড ফেডেড জিনসের ওপর সিল্কের ঢিলেঢালা টপ । আমার চেয়ে এক পোঁচ কম ফর্সা , কানে ছোট-ছোট হীরের তারা, ডান হাতে পুরুষালি ঘড়ি, বিদেশি দামি ঘড়ি — ওই হাতেই লুকিয়ে ছিল খপ শব্দটা । পাতলা ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ্সটিক ছাপিয়ে শ্লেষের মৃদু হাসি, বলল, কী হল ? লেট আস রান অ্যাওয়ে, চলুন পালাই ।
বিন্যস্ত, মনস্হিতিকে শান্ত করতে , স্বাভাবিকভাবে, সময় লাগছিল । আমার প্রতিক্রিয়া উপভোগ করছিল স্মার্ট তরুণী । স্পষ্ট করে বলল, দেখুন, কত কাওয়ার্ড আপনি । নিজের কাওয়ার্ডাইসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না বুঝি ? প্রতিদিন তো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন আমায় । সারাদিনে বেশ কয়েকবার কাছাকাছি ঘোরাফেরা করেন , বুঝতে পারি কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন ; এখন কী হল !
সম্বিত ফিরে পেতে যতক্ষণ । আমাদের ডিপার্টমেন্টের মায়া পাল । কয়েক মাস হল এই বিভাগে জয়েন করেছে । অফিসে তো ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলে না , কনভেন্ট স্কুলের ইংরেজি । ওদের সেকশানে গেলে ফিরে-ফিরে চোখ চলে যেত তরুণীটির দিকে । চার্মিং । সুন্দরী না হয়েও আকর্ষণীয়া । হাঁটার, কথা কইবার ঢঙে গর্ব ছলকায় , সম্ভবত উচ্চশিক্ষায় ভালো ফলাফল করার, অঢেল মাইনে পাবার, গোমর , তখন ভাবতুম । মানুষের ভেতরের আলোর খবর সেসময়ে আমার জানা ছিল না । শুনেছিলুম, নানা চাকরি বদল করার অভ্যাস আছে তরুণীটির , একটি থেকে আরেকটিতে লাফিয়ে-লাফিয়ে বর্তমানে বছরখানেক আমাদের অফিসে । প্রতিষ্ঠান হিসাবে অফিস জিনিসটার আর গুরুত্ব নেই । চাকুরিজীবি নিজেই নিজের ব্র্যান্ড । তা সে যে সংস্হায় কাজ করছে সেটি যতই বিখ্যাত হোক ।
আমি জীবনে ওই একটি চাকরিই করেছি , এ ছাড়া কী করব জানি না বলে চাকরি করা শুরু করেছিলুম । বাপ-ঠাকুর্দা যা ছেড়ে গেছে তা যথেষ্ট । বিয়ে-করা, সংসার পাতা ইত্যাদি সম্পর্কে আমার কমিটমেন্ট ভীতি ছিল । আমি জানতুম যে আমি পলিগ্যামাস । একজন নারীর বাঁধনে নিজেকে আটকে ফেলার আশঙ্কায় প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা চিরকাল এড়িয়ে গেছি । আকর্ষিত হয়েছি, কিন্তু গড়াতে দিইনি বেশিদিন । কলগার্লদের তাই আমার ভালো লাগত ; কল গার্ল বলতে আমি আমাদের দেশের বেশ্যালয়ের বেশ্যাদের কথা বলছি না । আমাদের দেশের কথাটা এইজন্যে মনে এলো যে পৃথিবীতে আমাদের দেশের বেশ্যালয়গুলোর মতন ্রকম নংরা পরিবেশ বোধহয় আর কোনো দেশে নেই । শহরের সবচেয়ে উপেক্ষিত পাড়াটি তাদের জন্য বরাদ্দ ; ভারতবর্ষে ।
আমি নিজেকে বলতে শুনলুম, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, মানে আপনার কথার আড়ালে কী লুকিয়ে রেখেছেন, ডেসিফার করতে পারছি না । এমনিতেই আমার গলা শুকিয়ে জল বা কোল্ড ড্রিংক্সের চাহিদায় তখন । তার ওপর যারা আসপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে তারা যাতে কথপোকথন শুনতে না পায় তাই স্তিমিত কন্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল আমার বোকামি ।
কোনোই হেঁয়ালি করিনি আমি ; জাস্ট লেট আস গেট লস্ট । এবার বুঝতে পেরেছেন ? আমি বলছি, চলুন পালাই, আমাদের এই চেনাজানা ম্যাডনেসের বাইরে পালাই, এমন পরিবেশে যেখানে আধুনিক জগত অনুপস্হিত, যেখানে ভিড় একদম নেই, মানুষ দেখতে পাওয়া যায় না সচরাচর, চেঁচামেচি নেই , আওয়াজ নেই, মানুষের গ্ল্যান্ডের দুর্গন্ধ নেই । অ্যাম আই ক্লিয়ার নাও ? আমার হাতের কব্জি ধরে রেখেই বলছিল মায়া । মনে হয়নি কখনও, ও এরকম চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারে, ওকে দেখে কখনও মনে হয়নি যে ও মহানগরীর বিতৃষ্ণায় আক্রান্ত ।
আজ বুঝতে পারি, মহানগরীয় বিতৃষ্ণা নয়, অন্য এক অজানার সন্ধান করেছিল মায়া পাল, যা জানতে পারা আমার ক্ষমতা ওজ্ঞানের বাইরে । আজও জানি না তা কী ।
একজন তরুণী তার সঙ্গে কোথাও উধাও হয়ে যেতে বলছে । কলকাতা শহরে, সকাল নটায়, অফিস যাত্রার দৈনিক ব্যস্ততার মাঝে এরকম একটা অ্যাবসার্ড প্রস্তাব দিয়ে বসল । ঠাট্টা-ইয়ার্কি নাকি হিউমিলিয়েট করার উদ্দেশ্যে, তা স্পষ্ট করার জন্যে বললুম, অকারণে অপমান করবেন না প্লিজ, তরুণীরাই আমার দিকে তাকান, তাকিয়ে থাকেন, কেউ-কেউ কথা বলতে চান, কিন্তু আমি কখনই কাউকে ডিমিন করি না, আমি প্রেমে পড়া ব্যাপারটাও ঠিক অনুমোদন করি না , তা ঘটে বলে তো মনে হয় না ।
হাত ধরে রেখেই মায়া বলেছিল, স্ট্রেঞ্জ, গলার টোন থেকে ধরতে পারছেন না যে আমি সিরিয়াস ? আমি বলছি, চলুন, সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাই কোথাও ; আমরা পরস্পরের সঙ্গে সেরকম পরিচিত নই, সেটা একটা প্লাস পয়েন্ট । কিছুটা তো চিনি একজন আরেকজনকে । বিকেল পর্যন্ত আমরা পরস্পরের পরিচিত হয়ে উঠব । পালাতে হলে এভাবেই পালাতে হয় , হঠাৎ । হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়ে , এক পোশাকে, পরিচিত জগত থেকে ফ্রিক-আউট করে যাওয়া , বিকামিঙ আননোন, অ্যাননিমাস, ফরগটন । প্রেমে পড়ার কথা তো আসছে না । কী ? ভাবছেন, আমার মাথা খারাপ ? মেন্টাল কেস ? তাহলে এরকম চাকরি পেতাম নাকি ? কত স্মার্ট ক্যান্ডিডেট তো ছিল , তা থেকে মাত্র আমি সেলেক্ট হয়েছিলাম , আপনি তা জানেন নিশ্চই ? এই ধরণের চাকরি আমি চাইলেই পেতে পারি । ভাববার সময় নেবেন না । আমিও ঠিক এক্ষুনি ভাবলাম , পালানো যাক । কাউকে বলি, চলুন পালাই , আপনাকেই সামনে পেলুম । ভাবতে চেষ্টা করবেন না । অত্যধিন চিন্তা মানুষকে দুশ্চরিত্র করে । ও , আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না ? চশমা খুলে মায়া বলল, নিন, চলুন পালাই, আই অ্যাম ডেড সিরিয়াস ।
আমার মুখ দিয়ে আমতা-আমতা কন্ঠস্বরে বেরিয়েছিল, আমি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা হিসাবে গণিত সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি ।
ফরগেট ইট, বলেছিল মায়া, জানি আপনি গণিত বিশেষজ্ঞ । ওসব ভুলে যান । গণিত কাজে লাগে না , ইংরেজিরও প্রয়োজন নেই , এরকম জনহীন অঞ্চলে চলে যেতে চাই । তাড়াতাড়ি করুন । আমার কাছে এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড আছে ; আপনার কাছেও আছে নিশ্চই । চলুন, যতটা পারা যায় তুলে নিই , তারপর নিরুদ্দেশের পথে ওগুলোর আর প্রয়োজন হবে না ।
মায়ার পরিবারে কে-কে আছে জানি না , কখনও জানিনি, জানতে চাইনি । আমার তো মা-বাবা মারা যাবার পর কেউ নেই , কেউই নেই । বিশাল বাঙলোবাড়িতে আমি একা । দাদুর বাবার ঘর, দাদুর ঘর, বাবার ঘর, বাবা-মা মারা যাবার পর আর খুলিনি । মায়ের চব্বিশ ঘন্টা কাজের বই সেলিমা বেওয়াকেও ছাড়িয়ে দিয়েছি , কেননা একা একজন যুবতীর সঙ্গে, সে কাজের মেয়ে হলেও, একই বাড়িতে থাকা যায় না । বস্তুত কেউ নেই বলেই চাকরি করি । নয়তো চাকরি করার দরকার ছিল না । মায়া পালকে বললুম, আমি অসৎ, জোচ্চোর, বিশ্বাসঘাতক, দুশ্চরিত্র, ফেরেববাজ, বেপাড়ার যাত্রী কিনা তা তো আপনি জানেন না ।
তরুণী হাসির মৃদু ঝিলিক খেলালেন, ঠোঁট সামান্য খুলে, বললেন, অ্যাডাম আর ইভের গল্প জানেন ? তাদের নাভি ছিল না । আমাদেরও অতীত ঠিক এই মুহূর্ত থেকে আর নেই । আমরা এক্ষুনি স্বর্গোদ্যানে নেমেছি । আপনি অ্যাডাম, আপনি নিষ্পাপ । আমরা তাদের মতনই শাকাহারী । এসব কথা বলার জন্যে তো সারাজীবন পড়ে রইলো । এখন চলুন, যেদিকে পথ নিয়ে যায়, সেইদিকে ।
জানি না কে কাকে সন্মোহিত করেছিল । আমরা নিজেদের অ্যাকাউন্ট থেকে যত বেশি সম্ভব টাকা তুলে, দমদম বিমান বন্দরে পৌঁছে, প্রথম ফ্লাইটের খোঁজ করে, চেন্নাইয়ের বিমানে দুটো সিট পেলুম । টিকিট মায়াই কেটেছিল, মিসেস মায়া পাল আর নিরঞ্জন পালের নামে । বিমানে বসে, মায়া চুপচাপ, হয়তো নিজের ফেলে আসা অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার চেষ্টায় একাগ্র । মেয়েদের অতীত পুরুষদের চেয়ে ভিন্ন হয় বলে আমার অনুমান । আমি অপেক্ষা করছিলুম ওর কথার, কথা বলার, কেননা নুরুদ্দেশে যাবার আকস্মিক পরিকল্পনাটা ওরই , আমি তো তাতে সঙ্গদান করছি মাত্র । আমার দিকে না তাকিয়েই মায়া বলেছিল, আমরা সারা জীবন নিজেদের সম্পর্ক আপনি-আজ্ঞের পবিত্র গভীরতায় রাখব । তুমি-তুমি ওগো-হ্যাঁগোর ছেঁদো নোংরা রুটিনে বাঁধা পড়ব না
বলেছিলুম, পবিত্র ? এই ধরণের অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না প্লিজ ।
মায়া বলেছিল, ঠিক বলেছেন, এবার থেকে করব না ; এই রকম শব্দও তো অতীতকে ধরে রাখার ষড়যন্ত্র ।
মায়ার পাশে বসে একই ভাবনা ঘুরছিল আমার মগজে, যা বহুকাল থেকে বাসা বেঁধে আছে । তা এই যে, আমি একজন কুকুর । যে মালকিনির হাতে পড়েছি, সে যেরকম চেয়েছে, যেরকম গড়েছে, তা-ই হয়েছি : প্রেমের কুকুর, কাজের কুকুর, সেবার কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর , পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপির কুকুর, অনধের কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল, আজও তেমনই আছে । থাকবে । এখন টাইপ করতে বসেও জানি, লেজটা অমনই রয়েছে ।
কুকুরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমার । টাকা ফুরোলে তো ফিরতেই হবে আরামের শহুরে জীবনে । না ফেরা পর্যন্ত নিরঞ্জন পাল হয়েই থাকা যাক । মায়া হয়তো সংসারের বেড়ি-শেকল থেকে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি চাইছে । চেন্নাইতে নেমে, আমার প্রস্তাবমত, দুটো সস্তা ক্যারিব্যাগ, মোটা চাদর, ফোলাবার দুটো বালিশ, মশারি, দক্ষিণ ভারতীয় সস্তা শাড়ি, স্হানীয়দের মতৌ শাদা আর চাককাটা লুঙ্গি কিনে, স্টেশানের কাছে হোটেলে উঠলুম । মিসেস মায়া বণিক আর নিরঞ্জন বণিক নামে । মায়া কারণ বলেনি এই নতুন পদবির । আমি অনুমান করলুম, পেছনের যাবতীয় ছাপ মুছে ফেলতে চাইছে, প্রতিটি পদক্ষেপের, যাতে কেউ খুঁজে না পায় আমাদের । দক্ষিণ ভারতীয় সাপড়া, মানে ভাত সাম্বর রসম পাঁপড় পাতলা দই খেয়ে মায়া দিব্বি ঘুমোলো সারারাত । কোনো তরুণির পাশে শুয়ে ঘুমোনো , আমার মতন জার্মান শেপার্ড বা কুন হাউন্ডের পক্ষে অসম্ভব ছিল । জেগে রইলুম সারারাত । লক্ষ করলুম, মায়ার কানের হীরের টপ, আর হাতের মোটা চুড়িটা নেই । মায়ার পারফিউমের মায়াবিনী সুগন্ধের স্বপ্নিল পরিমণ্ডলে শুয়ে-শুয়ে সেদিন ভেবেছিলুম, এ কিরকম সম্পর্ক ! এ তো প্রেম নয়, কয়েক ঘন্টার জন্যে কেনা মেয়েমানুষের সঙ্গে শোয়া নয় ল সম্পূর্ণ অচেনা একজন মহিলার পাশে শুয়ে আছি , কেন তার কারণ নিজেই জানি না । মগজে ঘুরঘুর করছে ভাবনার ধোঁয়া ।
কে এই মহিলা ? কী চায় ? ধর্মের ঘেরাটোপে পাগল রমণী ?
পাল যখন তখন বৈষ্ণব নয় বলেই তো মনে হচ্ছে যে গোপন বৈরাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ? ফেডেড জিন্স পরে !
একজন প্রায় অচেনা পুরুষের পাশে শুয়ে নিশ্চিন্তে কী করে ঘুমোতে পারে একজন যুবতী , যে দেখতেও ভাল, এমনকি আকর্ষক ?
জীবন থেকে কিছু চাই ? চাইলে আমার তো তাতে কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয় ?
হয়তো আমার ভূমিকা ছকে রাখা আছে, ক্রমশ প্রকাশ্য । দেখাই যাক । একটা উদ্দেশ্য তো হল । বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য !
আমি একজন যধবতীর পাশে শুয়ে আছি , অথচ আমার শরীরে কোনো যৌন প্রতিক্রিয়া ঘটছে না । এর আগে কোনো যুবতীর সঙ্গে শোবার প্রস্তুতির পর্ব থেকেই আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আনন্দনৃত্য শুরু হয়েছে । উদ্দেশ্যহীন শুয়ে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি আগে ।
চেন্নাই স্টাশানে পোঁছে, প্রথম ট্রেন পাওয়া গেল নেল্লোরের, তার দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে উঠলুম । হোটেল মালিকও বলেছিল, হনিমুনের জন্য নেল্লোর হয়ে কডপ্পা জেলার ম্যাগনামপেট অঞ্চলে ব্যারাইট ব্যবারিটাস খনি-অঞ্চল ছাড়িয়ে কিছুটা দক্ষিণপূর্বে গেলে খুবই ভাল সময় কাটবে ; সেখান থেকে আরও দক্ষিণে ভেতরদিকে গেলে , কর্ণটক সীমান্তের কাছাকাছি, একেবারে আধুনিকতা-বর্জিত গ্রামসমাজে যাওয়া যায় , উপজাতিরা থাকে, এমন জনসমাজ যেখানে অভাব আছে কিন্তু সেখানের লোকেরা তাকেই জীবন মনে করে , দারিদ্র্যই তাদের বেঁধে রেখেছে পরস্পরের সঙ্গে । তবে যেতে-আসতে অনেক হ্যাপা ।
আমার দশ কিলোমিটার মর্নিংওয়াকের অভ্যাস আছে । মায়াকে জিগ্যেস করেছিলুম, যাবেন কি ওই অঞ্চলে ?
মায়া বলেছিল, ওরকম অঞ্চলই তো চাইছি । দেখছেন তো ক্রমশ আমরা ইশারায় কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি , কেননা সকলে আমার-আপনার ভাষা কাজ চালাবার মতন জানে । আমরাও এনাদের ভাষা একবর্ণ বুঝি না, তবুও বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ তো চলে যাচ্ছে , কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না ।
মায়া পালের কথা শুনছিলুম । যত শুনছিলুম, তত ওকে স্ট্রেঞ্জ মনে হচ্ছিল । ও তো, বুঝতে পারলুম, ব্যারাইট জিনিসটার নামই শোনেনি । বললুম, ব্যারাইট অনেকটা আপনার মতন, ঝিকমিক-ঝিকমিক ক্রিস্টাল দিয়ে গঠিত খনিজ, অনেক রকমের কাজে লাগে । শুনে, আমার মনে হল, ভালো লাগল মায়ার । ওর পাতলা ঠোঁটে হাসি খেলল । ওর বিভিন্ন মৃদু হাসিগুলোর মানে আমি বুঝতে আরম্ভ করেছি । নারীর স্টকে কত রকমের হাসি থাকে তার ইয়ত্তা নেই ।
নেল্লোরে নেমে ট্রেন পালটিয়ে কোদরু । নেল্লোরে যাবার পথে আমার মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড নিয়ে নিজের পার্সে ঢুকিয়ে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মায়া । শখের কালো চশমাটা দিয়ে দিল আমাদের সামনে বসে-থাকা ছেলেটিকে, যে মায়ার পার্স ছুঁড়ে ফেলা দেখে তখনও পর্যন্ত সম্বিত ফিরে পায়নি । নিজের কার্ডগুলোও এক-এক করে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল । আম কলা পাতিলেবু পেঁপের চাষের এলাকা আর ব্যারিটাইসের খনি অঞ্চল শুনে এই এলাকা চিহ্ণিত করেছিল মায়া । কোদরু থেকে ভাড়ার জিপগাড়িতে আধকাঁচা রাস্তার ধুলোর কুয়াশা ওড়াতে-ওড়াতে খনি অঞ্চল । প্যাংলা শ্রমিকদের আনাগোনা দেখে টের পাওয়া যাচ্ছিল যে খনি অঞ্চল এসে পড়ল । খনি ম্যানেজারকে আমাদের উদ্ভট হনিমুন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে, মিস্টার কৃষ্ণাইয়া ওনাদের রেস্ট হাউসে রাতটা কাটাতে দিলেন । এখানেও দুজনে পাশাপাশি শুলুম । তবে বিছানাটা বিশাল বলে আর ঘরে এসি থাকায় অসুবিধা হল না । রাজ্যের কেষ্টবিষ্টুরা এসে থাকেন বোধহয় , তাই বেশ সাজানো-গোছানো ।
আমি অতিপ্রয়োজনীয় ঘুমটা দিয়ে নিলুম । সকালে রেস্ট হাউসের দেয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে অজানা সাংসারিক জীবনের পথে রওনা দিলুম । ব্রেকফাস্টে যাতে ডিম আর দুধ দেয়া না হয় তা ওখানের খানসামাকে বলে দিয়েছিল মায়া । চা কেবল লিকার । ভাবলুম, বোধহয় শনি-মঙ্গলবার ধরণের কোনো স্ত্রী আচার । আমি তো নিজেই যা হোক ব্রেকফাস্ট খাই , ওটস, পরিজ, ব্রেড-স্যান্ড উইচ বা অফিসে পৌঁছে অর্ডার করি । এই অঞ্চলে রেস্টহাউসেই আমরা শাওয়ার বাথ করেছিলুম, একসঙ্গে নয়, প্রথমা মায়া তারপর আমি । যদিও আমার আশঙ্কা ছিল হয়তো মায়া সেরকম কোনো প্রস্তাব দিয়ে বসবে । রহস্যময়ী, অতএব কখন কোন রহস্যের ঘুর্ণিতে গিয়ে পড়ি , তার জন্যে নিজেকে সবকিছুর মুখোমুখি হবার জন্যে প্রস্তুত করে নিয়েছিলুম । মায়ার কার্যকলাপ দেখতে-দেখতে আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে ফেলছিলুম ।
খনি ম্যানেজার একজন শ্রমিককে দিলেন গাইড হিসাবে । প্রথমে খনির ম্যাটাডর গাড়িতে, ড্রাইভারের পাশে গাইড, আমরা ক্যারিয়ারে হেলান দিয়ে । গাইড প্রস্তাব দিয়েছিল যে আমরা দুজনে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসি । মায়াই ক্যারিয়ারে বসার আইডিয়া দিয়েছিল, চারিদিকের দৃশ্য দেখতে-দেখতে যাবে বলে । সূর্যের অবস্হান দেখে বুঝতে পারছিলুম যে আমরা দক্ষিণের দিকে কোথাও যাচ্ছি ।
ম্যাটাডর আমাদের যে জায়গায় নামাল, গাঈদের পরামর্শে সেখানকার রাস্তার ধারের এক নোংরা ঢাবায় বিরাট-বিরাট জংলি পাতায় মোটা চালের ভাত আর ভিষণ ঝাল সাম্বর খেলুম । মায়াকে বলেছিলুম, যে কোনো জায়গায় জল খাবার অভ্যাস আছে তো , নয়তো পেট খারাপ হতে পারে । জবাবে মায়া বলেছিল, হলে হবে, ইমিউন হতে হবে তো, নয়তো থাকব কী করে সারাজীবন !
ঘাইড কোথা থেকে একটা গোরুর গাড়ি ডেকে এনেছিল, যতক্ষণ আমরা খাচ্ছিলুম সেই ফাঁকে । দক্ষিণ ভারতীয় বলদ । ওপর দিকে শিঙ উঠে ভেতরে বেঁকে এসেছে , গায়ে-গতরে পশ্চিমবঙ্গের বলদগুলোর চেয়ে স্বাস্হ্যবান । অদ্ভুত লাগল । লোকগুলো প্যাংলাটে আর বলদগুলো ভারিভরকম । মায়া দুহাত এগিয়ে দিয়ে বলল আমাকে গাড়িটায় তুলে দিন । দিলুম । অচেনা একধরণের ঠান্ডা ওর দেহকে ঘিরে রেখেছে মনে হল । এরকম ঠান্ডা দেহের নারী শরীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না । পারফিউমের গন্ধ ছিল তখনও পর্যন্ত , নিশ্চই কোনো বিদেশি দামি পারফিউম লাগিয়েছিল বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে । গায়ে পারফিউম মেখে কেউ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশে যায় ? গাড়িতে উঠে মায়া বলেছিল, যাক, বলদগুলোকে অত্যধিক খাটায় না , ওদের স্বাস্হ্য ভালো ।
গাড়ির ওপর শুকনো পেঁপেপাতার গদিতে বসলুম আমরা , আর হেলতে-দুলতে চললুম, মায়ার অদেখা স্বপ্নভূমিতে । এখানকার সূর্য কলকাতার সেপ্টেম্বরের সূর্য নয় । মায়ার মুখে ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠছিল । মনে পড়ছিল না যে এত কাছ থেকে কোনো যুবতীকে এভাবে ঘামতে দেখেছি কিনা । আম কাঁঠাল লেবু পেঁপে আতা সজনেডাঁটা ইত্যাদি বাগানের পাশ দিয়ে সারারাত গোরুর গাড়ি করে অত্যন্ত ক্লান্ত দেহে ভোরবেলা পৌঁছোলুম এক গ্রামে , যেখানে শ্রমিকটি আমাদের আরেকজনের জিম্মায় দিয়ে চলে গেল । তাকে খি বুঝিয়েছিল জানি না, কেননা ভাষাটা ঠিকমতন ডেসিফার করতে পারছিলুম না । সে আমাদের ক্যারিব্যাগ দুটো মাথায় চাপিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল , আমরা পেছন-পেছন । ঘন্টাখানেক হেঁটে, একটা সরু ঝর্ণার পাশ দিয়ে , যে গ্রামে পোঁছোলুম, তার নাম লোকটি আকারে-ইঙ্গিতে জানিয়েছিল, অগ্রমগাগি, কর্ণাটকের সীমান্তের কাছাকাছি । মজুরি হিসাবে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে সে নিতে অস্বীকার করল । মায়ার নির্দেশমত আমরা হাত-ঘড়ি দুটো দিয়ে দিলুম , যদিও কী কাজে যা লাগাবে লোকটা কে জানে । হয়তো বেচে কিছু রোজগারপাতি হবে ।
লোকজন দেখতে পাচ্ছিলুম না । চারিদিকে গাছপালা, বনাঞ্চল বলা যায় । গ্রাম বলে তো মনে হল না । জঙ্গলে এনে ছেড়ে দিল নাকি, যখন ভাবছি, একজন চাষিমতন লোক একটা বছর তেরো-চোদ্দর ছেলেকে গাছের ডাল দিয়ে পেটাতে-পেটাতে এদিকেই আসছিল । দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরল মায়া , আর লোকটাকে বাংলাতেই যেভাবে বকুনি দেয়া শুরু করল তা বুঝতে কোনো ভাষাভাষিরই অসুবিধার কথা নয় । লোকটা তেলেগু ধরণের ভাষায় ছেলেটির অপরাধ, মনে হয়, ব্যাখ্যা করল, আর একেবারে অপরিচিত শহুরে দম্পতি দেখে অবাক প্রশ্ন তুলল ; অন্তত সেরকমটাই মনে হল । আমি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে আমরা এখানে থাকতে এসেছি । নিজামদের প্রভাব কিনা কে জানে, লোকটা বিস্মিত কন্ঠে যা বলল, হায়দ্রাবাদি হিন্দি মেশানো তেলেগুতে, যা পরে জেনেছি আঞ্চলিক ভাষা তুরপু, তা হল যে এই অঞ্চল আপনাদের মতো মানুষের বসবাসের অযোগ্য , এটা ঠিক গ্রাম নয়, এটা আউটার এরিয়া, আমরা অনেক দূরে-দূরে থাকি , কেউই এক জায়গায় থাকি না । এই জঙ্গলটা গড়ে ওঠার আগে আমরা এই জঙ্গলের জমিতেই থাকতুম , আম লেবু পেঁপে কলার খেতে কাজ করতে যেতুম , এখনও প্রায় সকলেই ফলের বাগানে কাজ করতে যায় , তার জন্যে দুবেলা অনেকটা হাঁটতে হয় । এখানে আলো নেই , জল ভরতে অনেকটা হাঁটতে হয় , স্কুল নেই, পঞ্চায়েত দপতর এতো দূরে যে নেই বললেই চলে , কোনো সরকারি লোক আসে না এখানে , লোকে দুবেলা খেতে পায় না , পায়খানা নেই, মাঠে যেতে হয়…
লোকটি বলতে প্রচুর সময় নিয়েছিল , প্রায় আধ ঘন্টা, আমি তার কথার একটা নির্যাস লিখলুম । যাহোক, মায়া তাকে থামিয়ে সর্বভারতীয় খিচুড়ি ভাষায় বলল যে আমরা এখানেই থাকব , তোমাদের সঙ্গে, তোমাদের মতনকরে থাকব ।
মায়ার কথাগুলো আমি আরেকটু বোধগম্য হিন্দি করে বললুম লোকটাকে । সঙ্গের ছেলেটি একবার আমাদের আর একবার ওর বাবার মুখ দেখছিল । আঁচ করলুম যে ছেলেটি বোধহয় তার বাবার চেয়ে ভালো হিন্দি বলতে পারত, যেভাবে সে মৃদু হাসছিল আর কিছুটা অবাক হচ্ছিল আমাদের কথোপকথন শুনে । আমরা ওদের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলুম ।
লোকটা বলতে-বলতে যাচ্ছিল, আমি আগে ব্যারাইট খনিতে কাজ করতুম, কিন্তু আমার স্ত্রীর ওই কাজ পছন্দ হচ্ছিল না বলে চলে এলুম, কেননা ওখানকার জল নষ্ট হয়ে গেছে খনির কারণে , শ্রমিকদের নানারকম রোগ হচ্ছে , আমার ছেলেটাও ওখানে কুসঙ্গে পড়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, শহরের ছেলেরা আজকাল যেমন হয় ; এখানে ফলমূল খেয়ে চলে যায় । পরে জেনেছি এখানকার তুরপুরা উপজাতি, তাই কারোর নজরে পড়ে না ; এরা ভোটাভুটি সম্পর্কেও আগ্রহী নয় । আরও পরে জেনেছিলুম যে এই অঞ্চলে মাটির তলায় আছে লোহা আর ম্যাঙ্গানিজ ।
আমরা লোকটির পেছন-পেছন তালপাতা পেঁপেপাতা আর গাছের ডালপালা ছাওয়া দরজাহীন একটা ঘরের কাছে পৌঁছোলে, আমাদের পথপ্রদর্শক তিন-চার বার হাঁক পেড়ে ডাকল কাউকে । কিছুক্ষণ পর যে লোকটি উদয় হল , তাকে দুর্বোধ্য বুলিতে বোঝাল আমাদের বক্তব্য । সেই লোকটা আরও রোগা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কতকাল স্নান করেনি কে জানে । তার কথা আমাদের দোভাষী, বাধ্য হয়ে দোভাষী বলতে হচ্ছে আমাদের পথপ্রদর্শককে, অনুবাদ করে বলল যে একটা ঝুপড়ি আছে , যার ছিল সে বহুকাল আগে হায়দ্রাবাদ কিংবা ব্যাগালুরু চলে গেছে বোউ-বাচ্চা নিয়ে, আমরা চাইলে সেখানে গিয়ে থাকতে পারি ল
শুনে, মায়ার মুখ আলোকিত হল । আমার বিমূঢ় মুখ দেখে মায়া বলেছিল, আমি তো আছি, আশঙ্কা কিসের ।
উত্তরে বলেছিলুম, আমার এতক্ষণ ভুল ধারণা ছিল যে আমি আছি বলে আপনার কোনো আশঙ্কা নেই । প্রতিক্রিয়ায় মায়া মৃদু হাসি খেলিয়েছিল ঠোঁটে । চোখ বুজলেই আমি মায়ার এই বিশেষ হাসি-মাখানো মুখ দেখতে পাই । কতদিন কতবার যে দেখেছি ওর এই অনুমোদনমূলক হাসি , আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে গেছে ছবিটা ।
আশ্চর্য ! জায়গাটায়, চালাঘরটায় থেকে গেলুম আমরা ! ক্রমশ রপ্ত হতে থাকল মূল ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা । কাঁচকলা পোড়া, কাঁঠালবিচি সিদ্ধ-চটকানো , আর কখনো=সখনো আম বা পাকা পেঁপে খেয়ে, কেবল দিনের বেলায় , কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন । অবশ্য যে ছেলেটিকে মায়া মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল , সে আমাদের ভারতীয় জীবনে সেটল হতে সাহায্য করেছিল । সে তালপাতার একটা চাটাই দিয়ে গেছে, যদিও তা অতিব্যবহারে চলনসই গোছের । সে আর তার বয়সী কয়েকটি ছেলে লেগেই থাকত আমাদের সঙ্গে । আমাদের সম্পর্কে তাদের কৌতূহল ; এত কাছ থেকে শহরের মানুষদের জীবনযাত্রা দেখেনি তারা । বহুবার প্রশ্ন করে তার নাম জেনেছে মায়া, সম্পূর্ণ নাম আমাদের পক্ষে উচ্চারখ করা কঠিন বলে মায়া ওকে বালু নাম দিয়েছে । সম্ভবত বালাজীর কোনো একটা নামের স্হানীয় রূপ । বালু কালো রঙের প্লাসটিকের ঘড়া আর প্লাসটিকেরই গেলাস দিয়ে গেছে জল ভরে রাখার আর খাবার জন্যে । ঘড়াটায় পুরো জল ভরা যায় না ; ওপর দিকটা সামান্য ফাটা । গেলাস চাপা দিয়েও কোনো লাভ নেই । প্রতিদিন জল না বদলালে মশা ব্রিড করবে , মায়াকে বলতে ও বলেছিল, এর সবাই তো খাচ্ছে, মশার ডিমসুদ্ধই খাচ্ছে হয়তো , আমরাও না হয় খাবো, ক্ষতি কী ।
কিছু দূরের বিশাল গভীর কুয়ো থেকে গ্রামের মহিলারা জল ভরে আনে দেখে মায়া নিজেই ঘড়া কাঁখে নিয়ে জল ভরে আনে । যতটুকু জল ও বইতে পারে ততটুকু, আমাদের তেষ্টা তাতেই মেটে । ব্লাউজহীন শাড়ি পরা আরম্ভ করেছে স্হানীয় মহিলাদের অনুকরণে । ব্লাউজহীন মায়াকে দেখে প্রথম-প্রথম আমার অস্বস্তি হতো ; তাকাতে লজ্জা করত । মায়াই একদিন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, সারা জীবন একসঙ্গে থাকতে হয়ে , ভুলে যাচ্ছেন কেন, তাকান তাকান তাকান তাকান, তাকিয়ে থাকুন ।
আমিও খালি গায়ে কেবল লুঙ্গি পরে থাকি । প্রথম দিন বিব্রত বোধ করেছিলুম , লুঙ্গি পরা আর খালি গায়ে থাকা, এই দুটিরই অভ্যাস ছিল না । মায়াকে দেখি আর নিজেকে কেমন দেখতে হয়েছে হয়ে যাচ্ছে অনুমান করি । গোঁফদাড়ি না কামিয়ে কেমন দেখাচ্ছে তা কালো ঘড়ার জলেতেও দেখার উপায় নেই । কোথাও প্রতিফলনের সুযোগ নেই । সত্যিই , নার্সিসিজম ঘটার কোনো সুযোগ নেই । তার মানে বহু মানুষ জীবনে মাত্র কয়েকবার আয়না দ্যাখে ; দ্যাখার প্রয়োজন বোধ করে না ।
মায়া কী করে চালাচ্ছে বিনা আয়নায় ? আজকালকার যুবতীরা নিজের প্রতিফলন দিনে বহুবার দেখেন । মায়া সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সেই মায়ার সঙ্গে যে অফিসে আসার আগে নিজেকে সুশ্রী করে তুলে আনতো । অফিসেও টয়লেটে গিয়ে চুলের বিন্যাস গুছিয়ে ঠোঁটে লিপ্সটিকের নবীকরণ করে নিতো । বাড়ি যাবার সময়ে আবার একবার রূপটান দিয়ে নিত ! নারীর অন্তরজগতে পরিবর্তনের দ্রুতি কি পুরুষদের থেকে ভিন্ন ? বা, হয়তো, মায়া পাল নিজেকে নিয়ে চলেছেন এমনই এক জগতে যার সঙ্গে তাঁর নিজেরই পরিচয় হয়নি ? ভাবতুম ।
এখানে রাতের বেলায় না খেলেও চলে, এই প্রথম জানলুম । অন্ধকারেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । প্রতিদিন স্নান না করেও থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । ঘরের দরজা বন্ধ না করেও ঘুমোনো যায়, এই প্রথম জানলুম । লুঙ্গি পরে, গায়ে জামা না পরে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । দাড়িগোঁফ না কামিয়ে থাকা যায়, এই প্রথম জানলুম । মাঠে বসে হাগা যায়, এই প্রথম জানলুম । অচেনা গাছের ডালে দাঁত ব্রাশ করা যায়, এই প্রথম জানলুম ।
মায়া কোথায় প্রাতঃকৃত্য সারতে যায় তা জানি না ; হয়তো অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে ।
একজন নাপিত আসে মাসে কখনও গ্রামে যারা চায় তাদের দাড়ি কামিয়ে গোঁফ ছেঁটে দিয়ে যায় । আমি আমার গোঁফদাড়িকে স্বাধীনতা দিয়েছি, যেভাবে ইচ্ছা বেড়ে উঠুক ।
তবে, মশারি টাঙানো থেকে মুক্ত হতে পারিনি । সন্ধা্যা হলেই মশারির ভেতরে ঢুকে বসে থাকি, মশা আর অজানা কীটের ভয়ে । মায়া বাধা দিয়েছিল । বোঝাতে চেয়েছিল ওকে যে ম্যালেরিয়া হলে যে উদ্দেশ্যে মায়া এসে্ছে তা পূরণ হবে না । অবশ্য কী যে ওর উদ্দেশ্য ছিল তা আজও জানি না ল মাটিতে চাটাই আর মোটা চাদর পেতে শুই । প্রায় সপ্তাহখানেক মেঝের উঁচুনিচু মাটির সঙ্গে খাপখাওয়াতে সময় লেগেছিল । ক্রমশ অমনভাবে শোয়ায় অভ্যাস করে ফেললুম । সহ্য হয়ে গেল ল
উটকো দুজন বাইরের মানুষ এসে তাদের সমাজে থেকে গেল, অঞ্চলের কারোর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখলুম না । শহরে হলে, ক্লাবের ছেলেরা, পার্টির লোকেরা, পাড়া-প্রতিবেশি সবাই অযথা নাক গলাতো । এখানে কেউ নামও জানতে চাইল না । আমরা কোন ভাষায় কথা বলি বা কোথা থেকে এসেছি , তাতে কারোর কোনো আগ্রহ নেই । ভারতবর্ষে মানুষের চরিত্র ছোটো-ছোটো দ্বীপের মতন পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ।
একদিন মায়া বলল, গারু, এখানে পুরুষদের গারু বলে ডাকে, কলকাতায় যেমন স্যার কিংবা বাবু বা দাদা, মায়া বলেছিল, গারু, আজকে আমার মেন্সটুরেশান শুরু হল, হয়তো সেকারণে মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, কিছু মনে করবেন না ।
ভালই হল, বলেছিলুম আমি, এখানে ক্যালেন্ডার বা মাস-তারিখ জানার কোনো ব্যাপার নেই ; আপনার মেন্স যেদিন হবে আমাকে অবশ্যই বলবেন, আমি সামনের কাঁঠাল গাছটায় খুরপি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখব , তাহলে মারা যাবার সময়ে আমি বা আপনি জানতে পারব, কতদিন একসঙ্গে ছিলুম । শারীরিক কষ্টের মধ্যেও জোরে হেসে উঠেছিল মায়া । হাসছিল ও, অথচ তার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল আমার অস্তিত্বে , রিন রিন রিন রিন রিন । কারোর হাসি যে গা-ময় লেগে থাকে, তার কথা যে মগজের ভেতরে বাজতে থাকে, তার দেহের গন্ধ মনের মধ্যে ফিকে ঢেউ তোলে, তা মায়ার সংস্পর্শে না এলে জানতে পারতুম না ।
কলকাতায় নিজেকে কখনও পরগাছা মনে হয়নি । এখানে, তিন দিনেই মনে হতে লাগল যে পুরুতদের মতন বা পার্টিকর্মীদের মতন অন্যের দানে পেট ভরাতে হচ্ছে । বেশ গ্লানিময় । এত পড়াশোনা করেছি, গণিতে প্রথম শ্রেণি থেকে প্রথম হয়েছি চিরকাল, এই প্রায়-জনহীন গ্রামে সেসব জ্ঞানের কিয়দংশও কাজে লাগছে না । মায়াকে বলতে, ও বলল, ওর অবস্হা আরও খারাপ, ও চিরকাল ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে, ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছে ।
ঘুরে-ঘুরে দেখেছি, আম লেবু পেঁপের গাছে তেলেগুতে সংখ্যা লেখা । গণিত আর ইংরেজি দুটোই সেক্ষেত্রে ফালতু বলেই মনে হল এই অঞ্চলে । তার চেয়ে, দুজনেই ঠিক করলুম, আমরাই শিখি । এই অঞ্চলের কীট পতঙ্গ আগাছা আচার ভাষা যা জানি না, তা-ই শেখার প্রয়াস করি ।
ওর বাবা ব্যারেটাইস খনিতে কাজ করার সময়ে বালো ওখানকার খনিশ্রমিকদের স্কুলে একবছর পড়েছে । বালুকে প্রস্তাব দেয়া হল যে সে আমাদের তেলেগু শেখাবে , যতটুকু ও জানে, অক্ষরজ্ঞান হলেই চলবে , প্রতিদানে আমি ওকে ইংরেজিতে এক দুই তিন চার শৈখাব , আর মায়া শেখাবে এ বি সি ডি । সমস্যা দেখা দিল শুরু করতে গিয়েই । ওর বা ওর পরিচিত কারোর বাড়িতে স্লেট-পেনসিল বা কাগজ কলম নেই । বালুই উপায় বাতলালো । আমাদের চালার বাইরে পেছনদিকে মাটির দেয়ালে কাঠ-কয়লা দিয়ে লেখা হবে আর ভিজে ন্যাকড়ায় তা পোঁছা হবে । ও উৎসাহিত, এইজন্যে যে ও দুটো জিনিস শিখবে আর আমরা দুজনে কেবল একটা । আমাদের ক্লাস নেয়া-দেয়া দেখাতে বালু নিজের মাকে এনেছিল । বালুর মা পরের দিন এসে কুমড়ো দিয়ে গিয়েছিল, যেটা দিয়ে কি করা হবে যাতে তা খাওয়া যায় ঠাহর করতে না পেরে মায়া শেষপর্যন্ত কুমড়ো-পোড়া বানিয়েছিল । গরম-গরম ভালই লেগেছিল খেতে , নুন-হীন । নুন খায় এ-অঞ্চলের লোকে, কিন্তু কুসংস্কারবশত নুন কেউ দিতে চায় না । আর চিনি তো খায়ই না এরা, পায়ই না তো খাবে কোথ্থেকে ! লঙ্কা হয় কারোর কারোর বাড়ির সামনের জমিটুকুতে– এনে দ্যায় বালু ; লঙ্কা দিয়েই স্বাদকে অভ্যস্ত করে নিয়েছিলুম আমরা ।
বালুর দেখাদেখি দশ-বারো দিনে আরও চারজন ছাত্র জুটে গেল আমাদের । ক্রমে গ্রামের, গ্রাম বলতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরত্বের সব আগ্রহী ছেলেমেয়ে চলে আসতে লাগল । যার যখন সময় । ওদের শেখার আর আমাদের শেখার তো কোনো নির্দিষ্ট স্কুলসময় বলে রুটিন ছিল না । তাদের মধ্যে থেকে আমরা একজন শিক্ষিকা পেলুম, সিরিদেবি, বোধহয় শ্রীদেবীর অপভ্রংশ, যে তেলেগুতে আমাদের এক দুই তিন চার শেখানো শুরু করল । তারা যে মায়াকেই বেশি পছন্দ করছে তার স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠছিল ছাত্রছাট্রিদের মুখে আর ব্যবহারে । মায়া ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারে , আমার কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকে । পড়াবার সময়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমাদের পা ব্যথা করতে পারে অনুমান করে সিরিদেবির বাবা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি দুটো টুল বানিয়ে দিয়ে গেছে একটা একটু নিচু,মায়ার জন্যে, আরেকটা আমার কোমরের উচ্চতায় , আমার জন্যে ।
মাঝে-মথভে পড়াবার দেয়ালটা মাটি দিয়ে লেপে নতুন করে দিয়ে যায় কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর মা । নয়তো মায়া নিজেই কোথাও থেকে গোবর এনে সারাদিন লেপার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখে । মায়া আমাদের চালার ভেতরটাও গোবরে লেপে ফেলেছে । কোথায় যে গোবর পায় তা জানি না ; এখনও তো গোরু বা মোষ নজরে পড়েনি । হয়তো গ্রামের লোকেরা নিয়ে আসে কোথাও থেকে । যখন এক মনে দেয়ালে গোবর লেপে মায়া, আমি ওকে দেখেছি আর অবাক হয়েছি । নিজেকে একেবারে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে মায়া ; দেকতে থাকলে মনে হয় ঠিক যেন রঙ করার আগের মাটির প্রতিমা যার চোখদুটো কেবল আঁকা হয়েছে । আমি নেজেকে কীরকম দেখতে হয়েছে অনুমান করতে পারি ; ক্রমশ মহিষাসুর হয়ে উঠছি , সবুজদেহ অসুর নয়, কয়লাদেহ ।
মায়া চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে তেলেগু সংখ্যা আনকেলু এক দুই তিন চার অর্থাৎ ওকাতি , রেন্ডু, মুন্ডু, নালগু, আইডু, আরু, এডডু, এনিমিডি , তোম্মিদি, পাডি মুখস্হ করত । স্বরবর্ণ বা আচ্ছেলু , ব্যঞ্জনবর্ণ বা হাল্লুলু মুখস্হ করত । আমি ওর সঙ্গীতময় কন্ঠস্বর শুনতুম আর মনে রাখতুম । আজও আমার কানে ওরই তেলেগু অক্ষর বাজছে , যখন এই লেখাটার জন্যে কি-বোর্ড টিপছি । অক্ষরগুলো গোলগোল , বাংলার চেয়ে বেশ কঠিন, ইংরেজির থেকে তো বটেই । মায়া আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে । আমার একটা অক্ষর রপ্ত করতে , এবং তার পরের অক্ষরে গিয়ে প্রথম অক্ষরে ফিরে আসতে তিন-চার দিন লাগছে ।
ও, মায়া, কুয়োতলায় গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় তারাও ওকে নানা কথা বলে , আমাদের সংসার গুছিয়ে ফেলেছি কিনা তারা জানতে চায় । মহিলারা জল তোলার সময়ে বাচ্চাকে মায়ার কোলে দিয়ে দেয় । ও ফিরে আসলে ওর গা থেকে শিশুদের গন্ধ বেরোয় । মায়া ফিরে এসে সেই দিনকার কোন বাচ্চা ওকে বেশি আদর করল তার গল্প শোনায় । মনে হয় জল ভরার অছিলায় বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আদর করতেই যায় ও । কোনো-কোনো যুবতী শিশু দেখলেই কোলে নিতে চায়, তার সঙ্গে তোতলা কথা বলতে চায়, মায়া সেই ধরণেরই এক যুবতী । মায়া যেন মায়াময় ।
আমি গল্প করার বিশেষ কাউকে পাই না, ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া । বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন দূরের এক-আধটা চালায় , কিন্তু কী গল্পই বা করব তাঁদের সঙ্গে । তাঁরা আমার কথা বুঝতে পারবেন না, আমি তাঁদের । অনেক সময়ে মনে হয় স্হানীয় পুরুষদের মতন আমিও কোনো ফলের বাগানে গিয়ে চাকরি নিই , অন্তত ভাঙা-ভাঙা কথা বলার লোক তো পাব । মায়াকে সেকথা জানালে ও রাজি হয় না । বলল, ওরা টাকা দেবে, তা নিয়ে কী করবেন ? নতুন সমস্যা দেখা দেবে । টাকা এলে তার সঙ্গে সংসার পাতার প্রক্রিয়াও এসে পড়বে , জীবনে চাই না, এরকম অপ্রয়োজনীয় বস্তু জড়ো হয়ে যেতে পারে , যদিও এখানকার কারোর সঙ্গে এখনও পরিচয় হয়নি যে অমনধারা জিনিস সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়েছে ।
শিক্ষকতার দরুণ গুরুদক্ষিণাও জুটতে লাগল , ইন কাইন্ড, এবং একদিন চালও পাওয়া গেল , লাল খোসাসহ, ব্রাউন রাইস, যা দেখে মায়া বলেছিল, কলকাতায় কত খুঁজেছিলাম প্রকৃত ব্রাউন রাইস , আর এখানে এটা গরিব গ্রামবাসীর খাদ্য ।
বললুম, দেখছেন তো ? অতীত কী ভাবে ঘাপটি মেরে থাকে ! শুনে, মায়া যেন কেমনতর উদাসীন হয়ে উঠল । বেফাঁস কথা বলায় আমিও বেশ অপ্রস্তুত হলুম ।
চাল-পোড়া তো খাওয়া যাবে না , তাই মায়া চাল দাতাকে অনুরোধ করেছিল যে আমাদের একমুঠো ভাত দিলেই চলবে , কাঁচকলা পোড়া বা কাঁঠালবিচি পোড়া দিয়ে খেয়ে নেয়া যাবে , লঙ্কার টাকনা দিয়ে । প্রায় প্রতিদিনই ভাত পেতে লাগলুম , যদিও কলকাতায় যা খেতুম তার চেয়ে অনেক কমই, কিন্তু কম খেয়ে আর রাতে না খেয়ে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল কম খাবার । আমি চাইতুম মায়া বেশি খাক, মায়া চাইত আমি বেশি খাই । আমি একদিন বলেই ফেললুম, প্রকৃত ভালোবাসা কাকে বলে জানি না , কেবল যৌনতাই জেনে এসেছি এতকাল, আপনি ভালোবাসতে শেখালেন ।
জবাবে মায়া বলেছিল, অতীতকে আনবেন না প্লিজ, আপনি কী ছিলেন, কী করেছিলেন, সব ভুলে যান, সমস্তকিছু মুছে ফেলুন , আমি কি কোনো স্মৃতিচারণ করেছি ?
স্মৃতিচারণ মায়া করেছিল, করে ফেলেছিল, কয়েকজন বিদেশী সাহিত্যিকদের জীবনবোধকে একদিন তীব্র আক্রমণ করে ; আমি তাদের বইটই তখনও পর্যন্ত পড়িনি । তাই মুখ বন্ধ রেখে মায়ার জীবনদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ উপভোগ করেছিলুম ।
ভাত পেয়ে, মায়া বলেছিল, ভাতও খাবো কিনা সে-চিন্তায় ছিলাম , কেননা ভাতের সঙ্গে তো অতীত জুড়ে রয়েছে । আপনি আমাকে ভালোবাসার চোখে দেখবেন তা আমি জানি , আমিও যে আপনাকে ভালোবাসছি, ভালবেসে ফেলেছি, তা অনুভব করছেন না ? আমার চোখের পানে সরাসরি তাকিয়ে মায়া যোগ করেছিল, বালুরা যে ঝর্ণার জলে স্নান করতে যায়, কালকে চলুন সেই ঝর্ণায় গিয়ে স্নান করি , আমাদের সত্যিই এবার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, নয়তো আচমকা কোনো রোগে দুজনের একজন আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি ।
আমি বলেছিলুম, কালকে নয়, যেদিন আপনার চতুর্থ মেন্সের দাগ কাঁঠালগাছে আঁকব, সেই স্নান ঝর্ণার জলে করবেন ।
—আপনি জানেন দেখছি , মধ্যবিত্ত সংস্কার অনুযায়ী স্নান করতে হয় ।
—হ্যাঁ, পর পর তিনবার আপনাকে স্নান করতে দেখলুম না, বলার সাহসও হয়নি ।
—আদিম মানবীরা কি স্নান করত ? বিদেশের প্রতিটি দেশের মহিলারা কি স্নান করেন ? এখানের মহিলারা করেন ? স্নান করাটা, দেখেছেন তো, এখানকার জনজীবনে উৎসবনির্ভর । দৈনন্দিন রুটিন নয় ।
—আরেকটা কথা বলি আপনাকে । একই মশারির ভেতর পাশাপাশি শুতে এখনও অস্বস্তি হয় আমার । কাঠ হয়ে শুয়ে থাকতে হয় । আমি বলেছিলুম মায়াকে ।
—আমি তো ওভাবে শুই না । আমি তো আপনাকে অ্যাডাম মনে করি আর নিজেকে ইভ , তাহলে স্পর্শ বাঁচাব কেন ? বলেছিল মায়া , অকপটে ।
—আমি কি আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি ? বলেছিলুম আমি ।
—এই নিন আপনার অস্বস্তি কাটিয়ে দিচ্ছি ; বলছেন ভালোবাসেন, ভালোবাসা তো সর্বগ্রাসী । বলতে-বলতে মায়া জড়িয়ে ধরল আমায় । বলল, এই কারণেই ঝর্ণার জলে গিয়ে স্নান করে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম । জানি, শহরের সুগন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে গেছি, আদিম মানবীর গন্ধ হয়তো ছেয়ে গেছে দেহে । জানি না এখানকার স্বাভাবিক দেহ-গন্ধে আপনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পেরেছেন কিনা ।
—আপনার হাত যতক্ষণ না ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণ জড়িয়ে থাকুন প্লিজ, বললুম আমি । আমিও জড়িয়ে ধরব কিনা নির্ণয় নিতে না পেরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলুম । এখানে এসে তো কেবল লুঙ্গি পরে থাকি , যা কাচা হয়নি এখনও । মায়াও একই কাপড় পরে আছে ।
বহুক্ষণ ওভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল মায়া । অথচ আমার যৌনতার উদ্রেক হল না । আমিই ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলুম এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে । বললুম, জানি, আপনার হাত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ; আমার অস্বস্তি কেটে গেছে । চলুন আমরা আমাদের আরামকেদারায় বসি । আরামকেদারা অর্থে কাঁঠালগাছের তলায় রাখা দুটো পাথর । গ্রামের লোকেরা ওদুটো আমাদের জন্যে এনে দেয়নি, ওগুলো আগেই ছিল ওখানে, হয়তো কাঁঠাল গাছে ওঠার জন্য কখনও এনেছিল কিশোর-যুবকেরা ।
পাথরের ওপর বসে মায়া শোনাত জীবনের সৌন্দর্যের গল্প । ও বলত, দেখছেন তো, জীবন মোটেই দরিদ্র, পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল , জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট , বর্বর নয় । শহরের সমস্তপ্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা ; তবু কত শান্তিতে রয়েছি ।
কাঠাল গাছে দাগ দেবার চার দিন পর আমরা ঝর্ণার জলে স্নান করতে গেলুম , অনেকটা হেঁটে, প্রায় তিন কিলোমিটার । আমাদের সঙ্গে তিনজন ছাত্র যোগ দিল । আমি ভালোভাবেই স্নান করলুম, গা থেকে নোংরা ঘষে-ঘষে তুললুম । চুলের জট ছাড়ালুম , আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে দাড়ির চুল ভালো করে ধুলুম । জলের আয়নায় নিজেকে প্রাগৈতিহাসিক মানব মনে হচ্ছিল । বহুদিন পর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেকে অপরিচিত মনে হচ্ছিল ।
মায়ার প্রায় পুরোটা সময় গেল ছাত্রদের দিকে নজর রাখতে । একজন ছাত্র, কার্তিকা, বলল, আজকে আকাশ এরকম মানে রাতে বৃষ্টি পড়বে, তখন বৃষ্টিতে নাচব ।
ছাত্রদের জল থেকে তুলে, তাদের নিয়ে আমি রওনা দিলুম আস্তানার দিকে, ছাত্রদের দুজনের চালা আমাদের চালা থেকে বেশ দূরে, আধঘন্টার বেশি হাঁটতে হবে ওদের । মায়াকে বললুম, আপনিও ভালোভাবে স্নান করে আসুন , আপনার চুল তো সাধুদের মতো হয়ে চলেছে , আমি এদের নিয়ে এগোচ্ছি । কিছুটা হাঁটার পর বালু মায়াগারু মায়াগারু বলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, আম্মা আম্মা । দেখলুম মায়া সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে স্নান করছে । অপূর্ব লাগল । ভয়ও হল , প্রচণ্ড ভয়, যদি কেউ ওকে লুকিয়ে দেখতে থাকে ! তাকিয়েছিলুম ওর দিকে । তক্ষুনি মনে হল উচিত কাজ করছি না । এর আগে ওকে নগ্ন দেখিনি । দৃশ্যটা চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে, আজও ।
মায়া ওদের আম্মা হয়ে উঠেছে কবে থেকে জানতুম না । বোধহয় কুয়োতলায় বাচ্চাদের আদর করার দৌলতে বা শিক্ষকতার কারণে ।
রাতে দুজনে দুজনকে নগ্ন পেলুম । একে আরেকজনের সামনে দাঁড়িয়ে, প্রায়ান্ধকারে, মশারির বাইরে । মায়া প্রশ্ন করল, ইতস্তত করছেন ? নিজেকে ফর্নিকেটর বা আমাকে ফ্ল্যাপার ভেবে গুটিয়ে রাখছেন না তো নিজেকে , মিস্টার মায়ালিঙ্গা ।
বললুম, আপনি এখানে সবায়ের আম্মা হয়ে গেছেন , কিশোর-কিশোরীদের, তাদের মা-বাবার সকলের আম্মা ; আমি নিরঞ্জন দত্ত থেকে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে মিলিয়ে যাচ্ছি মায়ায়, নাম থেকে নামে , নামহীনতায় । কিন্তু আমার আর আপনার মাঝে আমি আর কাউকে চাই না, তাই ইতস্তত করছি । আমি চাই কেবল আপনি আর আমি , আমাদের নিজস্ব ব্রহ্মাণ্ডে ; আপনিই তো বলেছিলেন, আমরা কোনো সংসার পাতাপাতি করব না । আমরা যদি যৌনকর্মে মিলিত হই তাহলে আমরা হয়তো একধাপ এগিয়ে যাব সংসার পাতার পথে। আমি আপনার অখণ্ড ভালোবাসা চাই । কারোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই না । আমি চাই না হঠাৎ কোনো শিশু এসে আমাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিক ।
মায়া বলেছিল, পিরিয়ডের প্রথম সাতদিন ও শেষ সাতদিন সেফ হয় । আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের তাপ অনুভব করুন আর তা স্মৃতিতে ধরে রাখুন । আপনি তো গণিত বিশেষজ্ঞ ; প্রকৃতি দেহের জন্যে গণিতের ছক তৈরি করে দিয়েছে । আমি আমার দেহের রসায়নের গণিত ও মিউকাস তৈরির কথা জানি , কী ভাবে তা ক্যালকুলেট করতে হয় জানি, কিন্তু নিজের দেহের তাপ তো নিজে অনুভব করতে পারব না । আপনি এই সময়ে প্রতিদিন আমাকে জড়িয়ে ধরবেন, যেদিন আমার শরীরের তাপ যৎসামান্য উনিশ-বিশ মনে হবে সেদিন জানাবেন । আমিও আপনার দেহের রসায়ন যাচাই করব । প্রকৃতি মনের তাপ আর দেহের তাপে পার্থক্য তৈরি করে রেখেছে । মনের তাপে আমরা কাছে আসব, আর দেহের তাপে যৌনক্রিয়া করব না । আমিও আপনার দেহের তাপ নজরে রাখব যাতে টের পাই যা আপনার দেহ অসুখের দিকে যাচ্ছে না । স্বাস্হ্য দেখে তো মনে হয় আপনার ইমিউন সিসটেম পর্যাপ্ত ।
জড়িয়ে ধরতে যাব, হাওয়ায় কেমন যেন বাঁশিতে তোলা উদারার আওয়াজ পেলুম , সম্ভবত ঝড়ের পূর্বাভাস , অদৃশ্য এক ধ্বনিকুহক ঝড়কে ডাকছে । সকালে কার্তিকা বলেছিল বৃষ্টি হবে, একজন বৃদ্ধও স্নান করতে যাবার পথে বলেছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি, কেননা আজকে ঝড় উঠতে পারে । দুজনে বাইরে উঁকি দিলুম । দেখলুম আকাশ অমাবস্যার রাতের মতন অন্ধকার কিন্তু গোলাপি আভায় ছেয়ে গেছে । বালু ওর মায়ের হাত ধরে দৌড়ে-দৌড়ে এদিকে আসছে দেখে আমরা দ্রুত কাপড় পরে নিলুম । বালুর মা হাত নেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তুরপু তেলেগুতে যা বলল তা আমরা বুঝতে না পারলেও, এটুকু বুঝলুম যে আমাদের মতো ওরাও ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কা করছে । বালুর কথায় স্পষ্ট হল যে এখানে থাকতে নিষেধ করছে ওর মা, ঝড় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ।
মায়া বলল, নিয়ে যাক না উড়িয়ে, হারিয়ে যাবার জন্যেই তো এসেছি ।
—পাগলামি করবেন না , এখনও সম্পূর্ণ ভালোবাসা পাইনি আপনার । মায়ার হাত ধরে টানতে-টানতে দৌড়োলুম বালুর মায়ের পেছনে, ঝর্ণার দিকে । প্রশ্ন করার সময় ছিল না । কিছুদূর গিয়ে মায়াকে কাঁধের ওপর তুলে নিলুম, কারণ ও খালি পায়ে দ্রুত দৌড়োতে পারছিল না । দৌড়োবার সময়ে দেখতে পেলুম, অন্ধকারে বহু ছায়া দৌড়োচ্ছে আমাদের সঙ্গে, পেছনে, সামনে, বাঁদিকে, ডানদিকে । কোথাব ছিল এত মানুষ, আগে তো এতজনকে একত্রে দেখিনি । ঝড় সবাইকে আতঙ্ক দিয়ে বেঁধে ফেলেছে । ঝর্ণার স্রোতকে পাশ কাটিয়ে সবাই উঠলুম পাহাড়ের ওপর । ছায়াদলের নেতা ঢুকে গেল পাহাড়ের কন্দরে । তাকে একে-একে অনুসরণ করল সবাই, আমরাও । অন্ধকার গুহা । কে কোথায় কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছিল না । কেবল চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল । মহিলারা স্বামীকে, ছেলেদের ডেকে একত্রিত করছেন হয়তো । ভেতরে ঢুকে, মায়াকে নামিয়ে, টের পেলুম আগে থাকতে অনেকে এসে বসে আছে । আমি মায়ার হাত শক্ত করে ধরে রইলুম । বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে , শোনা যাচ্ছে মেঘের আনন্দ-চিৎকার , আর থেকে-থেকে ভেতরে ছিটকে আসছে তার চিৎকারের আলো । এই প্রথম দেখলুম আলোও প্রতিধ্বনিত হয় ।
সবাই গুহার উবড়ো-খাবড়া দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে রইলুম সারা রাত । মায়া আমার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ঘুমোইনি । জেগে বসেছিলুম সারারাত । ঘুমোলে যদি জেগে উঠে হঠাৎ নিজেকে দেখি দাদুর বাঙলোবাড়িতে আমার বিছানায় একা শুয়ে আছি ! অতীতকে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য । ভাবছিলুম সত্যিই কি পরিচিত প্রথিবীতে আছি না কি স্বপ্নের দুনিয়ায় ।
সকালে একে-একে বাইরে বেরিয়ে দেখলুম যে ঝড় বয়ে চলে গেছে অঞ্চলের ওপর দিয়ে । পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যদিকটায় দেখতে পাচ্ছিলুম অজস্র কলা আর পেঁপেগাছ ফলসুদ্ধ ভেঙে পড়ে আছে । এত দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছিলুম কাঁচা আর আধপাকা পেঁপে আর কলার কাঁদি কাৎ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে চারিধারে । ক্ষুধার্ত ঝড় কলা আর পেঁপে খেতে-খেতে এসেছে , আমাদের ভয় দেখিয়ে, আরও ভেতরে ঢুকে গেছে ঝড়টা, ব্যারাইটের খনির দিকে । বোধহয় এটা ছিল বঙ্গোপসাগরে ওঠা এক সামুদ্রিক ঘূর্ণির ল্যাজের ঝাপটা ।
পাহায থেকে নামবার সময়ে চোখে পড়ল ঝর্ণার স্বাস্হ্যবতী হয়ে ওঠা কলকল নৃত্য । মায়া বলল, আমার হাত ধরে, আপনি ওভাবে হঠাৎ কাঁধে তুলে নিলেন আমায় ? ইন্সটিংক্টিভলি ? কাঁধে তুলে দৌড়োচ্ছিলেন যখন, আমি আপনার গলা জড়িয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম আপনার হৃৎপিণ্ড কত দ্রুত কাজ করে চলেছে. আমারই জন্যে , কী আশ্চর্য , তাই না ?
বলেছিলুম, কোনো চিন্তা মাথায় আসেনি তখন ; জাস্ট পৌঁছে যেতে চেয়েছিলুম পাহাড়ের ওপরে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ; আপনি যে আমার কাঁধে, আপনি যে আমার গলা জড়িয়ে ঝুলছেন, তা লক্ষ করার সম্বিত ছিল না তখন ।
যে যার চালার দিকে হাটতে লাগলুম । জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের এলাকায় পৌঁছে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রায় সবায়ের চালা , সম্পূর্ণ পড়ে না গিয়ে থাকলেও , ভেঙেচুরে হেলে আছে । জঙ্গলের সুউচ্চ গাছগুলো চালাগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি । আমাদের চালাটা কোনোমতে টিকে আছে । তবে ক্লাস নেবার দেয়ালকে খেয়ে ফেলেছে ঝড়ে , আর বেরিয়ে পড়েছে দেয়ালের পাঁজরা, শুকনো পেঁপে গাছের ও অন্যান্য গাছের ডালপালা, যার ওপর মাটি-গোবর লেপে গড়ে উঠেছিল দেয়ালের আস্তরণ বা ব্ল্যাকবোর্ড ।
গোরুছাগল কোথায় থাকে আমি খোঁজ নিইনি কখনও ; মায়া জানে । পরে ও বলেছিল, জন্তুগুলোর জন্যে পাথরে ঘেরা দেয়াল আছে , সেখানে ঢুকিয়ে গাঁছের গুঁড়ির গেট বন্ধ করে দেয়া হয় রাতের বেলায় । ফলে ঝড়ে জন্তুগুলো ডাকাডাকি করলেও বহাল তবিয়তে আছে ।
আমাদের ঘরের ভেতরেও জল ঢুকে গিয়েছিল । মশারি ভিজে চুপচুপে । ক্যারিব্যাগ দুটো চলে গিয়েছিল চালার বাইরে, বেশ দূরে । খুঁজে আনতে হল । মায়া বলেছিল , দেখেছেন তো ? প্রকৃতিও আমাদের দুজনার সঙ্গে রয়েছে । আধুনিকতার বিষ থেকে আমাদের ধুয়ে দিয়ে গেল । আমাদের ঘর এবার আমরা নিজেরাই মাটি লেপে নতুন করে তুলব । মেঝেটাও মসৃণ করে নেব যাতে আপনার পিঠে না ফোটে ।
আমি মনে-মনে ভেবেছিলুম, আধুনিকতার বিষ কি এড়ানো যায় ? যায় না, তার কারণ আমাদের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আধুনিকতা , মাদকের চেয়েও মহা আকর্ষক সেই নেশা । চলুন পালাই ডাকে সাড়া দিয়ে চলে তো এসেছি, তা কি মুক্ত করেছে আমাদের , আমাকে ? সদাসর্বদা আধুনিক বস্তুর অভাব বোধ করতে থাকি । মায়া না থাকলে এখানে এক ঘন্টাও টিকতে পারব না । মায়াই আমার জীবনদায়ী ওষুধ ।
পুরো প্রিন্টআউট পড়া শেষ হলে ইন্সপেক্টর রিমা খান সংশ্লিষ্ট সিডিটায় লিখে রাখল ‘পঠিত’ । এবার খুঁজে বের করতে হবে মায়া পালকে । মায়া পালই কি প্রেমিককে খুন করে উধাও হয়ে গেছে । ইনি কি সত্যিই কেউ , নাকি বানানো গল্প । কোথায় থাকেন ? বোঝা যাচ্ছে বেশ ধনী পরিবারের মেয়ে । উচ্চ-মধ্যবিত্ত বাঙালি এলাকায় নিবাস, নিঃসন্দেহে । বাবার নাম জানা গেলে সুবিধা হতো । কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত একজন তরুণীর ওইভাবে জোতদার-জমিদার পরিবারের যুবককে প্রেমিক হিসাবে বেছে নেয়াটা কিরকম যেন বিসদৃশ ঠেকল ইন্সপেক্টর রিমা খানের । ইংরেজি ভাষার সঙ্গে গণিত কি মেলে ? মেট্রো রেলস্টেশান মানে এখানে দমদমই বুঝতে হবে, কেননা প্রেমিক মশায়ের সিদিগুলো পাওয়া গেছে ওনার বাড়িতে, যার সবচেয়ে কাছের মেট্রো রেলস্টেশান আপাতত দমদম । মায়া পালকে কিন্তু দমদমের মিলিউয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না । রাজারহাটের নিউটাউনও তখনও পর্যন্ত জমে ওঠেনি । মায়া পাল ওই স্টেশানে কি ওনার প্রেমিককে ধরার জন্যেই গিয়েছিলেন ? এই প্রেমের গল্পটাও তো অবিশ্বাস্য । কোনো ভালবাসাবাসি নেই, তার ব্যাকগ্রাউন্ড গড়ে ওঠেনি, ব্যাস, তরুণি বলল, চলুন পালাই, আর তরুণ তার সঙ্গে পালালো !
সিডিটায় , চিন্তা করছিল রিমা, ক্রিয়াপদের কালসঙ্গতি নেই ; কখনও লেখা হয়েছে অতীতকাল প্রয়োগ করে, আবার কখনও বর্তমানকাল । কংকালটা নিশ্চই বাংলায় ভালো মার্কস পেতো না । কিংবা হয়তো ক্যারিড অ্যাওয়ে হয়ে লিখে গেছে ।
প্রিন্টআউটের মার্জিনে এই প্রশ্নগুলো, যেগুলো ওর মগজে উদয় হচ্ছে, লিখে রাখছে ইন্সপেক্টর রিমা খান ।
বাঁ আঙুলে ধরা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে নেভাল রিমা খান । ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিল । টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । কঠিন প্রেম, জটিল প্রেমিক, রহস্যময়ী প্রেমিকা —নিজেকে নিঃশব্দে শুনিয়ে বলল রিমা । মনের ভেতরে ‘আধুনিকতার বিষ’ কথাটা ভাসতে দিল কিছিক্ষণ । আধুনিকতা কী, সেটাই তো জানি না । কোলকাতার কোন লোকটা আধুনিক ? কোন পাড়াটা আধুনিক ? আধুনিকতা ছাড়াই তো বিষে-বিষে ছয়লাপ । এককালে ছিল ঠগিরা । আর এখন ? ঠগ বাছতে ভারত উজাড় ।
দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক ডিটেকটিভ সেমিনারে গিয়েছিল রিমা , তাতে যোগ দিতে লন্ডন থেকে শার্লক হোমসও এসেছিলেন । উনি বলেছিলেন, তোমাদের দেশ থেকে স্বাধীনতার পর চারশো বিলিয়ান ডলার চলে গেছে সুইস ব্যাঙ্কে , আমার কাছে প্রতিটি লোকের নাম, অ্যাকাউন্ট নম্বর আর ডলারের অ্যামাউন্ট আছে ; আমি তালিকাটা দিতে চেয়েছিলুম , কিন্তু তোমাদের দেশের সরকার নিতে রাজি হল না । আসলে কেই বা রাজি হবে ? যার হাতে দেবো , তারই তো লুকোনো টাকার পাহাড় রয়েছে সেখানে ।
মডার্ন ইন্ডিয়া ! নিজেকে নিজে বলেছিল ইন্সপেক্টার রিমা খান ।
২. প্রেমিক কংকালের আত্মক্ষত
পরের সিডিটার প্রিন্টআউট পড়ায় একাগ্র হল রিমা, যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায় :
নাম নিরঞ্জন পাল, বণিক, ব্যানার্জি, দত্তমজুমদার, মিত্র, লিঙ্গা, গারু, ওয়েডিং গিফ্ট , সাকার, লম্বুলোচ্চা ইত্যাদি । একাধিক ওরফেও পাওয়া গেছে । বয়স আনুমানিক এত বছর এত মাস এত দিন । উচ্চতা পাঁচ ফিট নয় ইঞ্চি । ওজন এত কিলো । মুখাকৃতি সম্ভবত ওভাল , চওড়া কপাল । চুল কাঁচা-পাকা । গায়ের রঙ ফর্সা । এই ডিস্কে টেক্সট ঢোকাবার সময়ে প্রথম দিন লাল টিশার্ট , ব্লু ফেডেড জিনস পরে আছি ।
কেন এসব লিখছি ? শেষতম মহিলা জানতে চেয়েছেন । মেয়েটির নাম বিদকুটে । আমি তাই ওকে ‘শেষনি’ বলে ডাকি । ও নিজেও চায় না যে আমি ওর নামটা এখানে রেকর্ড করি । কিন্তু আমি শেষনিকে বলিনি যে আমি সিডিতে তুলে রাখছি । ও শুধু জানে যে হার্ড ডিস্কে থাকছে । ও আমার কমপ্লিট লাইফ-স্টোরি চায় । আমি বাংলায় লিখছি বটে, কিন্তু অক্ষরগুলো থাকছে তেলেগু । ও বলেছে কাউকে দিয়ে বাংলা অক্ষরে কনভার্ট করে নেবে । নিক । কী কাজে লাগবে জানি না । নিরঞ্জনের শিক্ষা গণিতে স্নাতকোত্তর । আয়ের স্রোত বহুবিধ । দাদুর বাবার সোনাদান , দাদুর জমিজিরেত, বাবার সম্পত্তি, যা ভাগ্যিস বেদখল হয়নি ; কোমপানি ডিভিডেন্ড ; ফিক্স ডিপজিটস ; গভমেন্ট সিকিউরিটিজ । বাবা নামকরা ফৌজদারি উকিল ছিলেন । কত খুনি, জোচ্চোর, ডাকাত, ব্যাংক জালিয়াত, বাটপাড়, রাজনৈতিক গুণ্ডা , টাকা ছয়লাপকারীদের জেল থেকে বাঁচিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই । মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা ; ব্রাহ্মণ পরিবারের ।
আমি প্রথম চাকরি পাবার দিন বাবা মারা গেলেন। আঘাত সহ্য করতে না পেরে মা মারা গেলেন তিন মাস পর , একই তারিখে, স্ট্রঞ্জলি ; অথচ দুজনের যে খুব ভাব-ভালবাসা ছিল তা নায় । নারী-পুরুষের এরকম ব্যাখ্যার অতীত সমস্যাসংকুল সম্পর্ক যে সম্ভব, তা আমি নিজের জীবন থেকেই জানি ।
জীবনের বাঁকবদলগুলো, যতবার ঘটেছে বাঁকবদল, সব সব সব সব নারীকেন্দ্রিক ; নারীর ইচ্ছার, নির্দেশের, দেহের, আকর্ষণের, রহস্যের মোহে । স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভাল, সান্মানিক স্নাতকে খুব-ভাল , স্নাতকোত্তরে অত্যন্ত ভাল, তাদেরই কারণে , প্রভাবে, চাপে, আদরে । চাকরিতে যোগ নারীর জন্যে উন্নতি নারীর জন্যে, চাকরি ছাড়া নারীর জন্যে , ভাসমান জীবিকা নারীর জন্যে , অবসরে পৈতৃক বৈভবে পরগাছাবৃত্তি নারীর কারণে । কে জানে, হয়তো মৃত্যুও নারীর হাতেই হবে ।
জীবনে নারীদের আসা-যাওয়া, সেনসেক্স ওঠা-পড়ার মতন, না ঘটলে, আমার ব্যর্থতা, ব্যথা, পরাজয়, গ্লানি, অপরাধবোধ, এ-সবের জন্যে কাকেই বা দায়ি করতুম ! কাকেই বা দোষ দিতুম আমার অধঃপতনের জন্যে ? লোভি লম্পট মাগিবাজ প্রেমিক ফেরারি হয়ে ওঠার জন্যে ? হবার, নাকি হয়ে ওঠার ?
আসলে আমি একটা কুকুর । আগের সিডিতে লিখেছি, তবু রিপিট করছি শেষনির খাতিরে । যে-মালকিনির হাতে পড়েছি , সে য-রকম চেয়েছে, যে-রকম গড়েছে , তা-ই হয়েছি । সেবার কুকুর, কাজের কুকুর, প্রজননের কুকুর, গুপ্তচর কুকুর, ধাঙড় কুকুর, কুরিয়ার কুকুর, প্রেডাটার কুকুর, পাহারাদার কুকুর, মানসিক থেরাপি কুকুর, শোনার কুকুর, শোঁকার কুকুর, চাটার কুকুর, রক্ষক কুকুর, গাড়িটানার কুকুর, কোলের কুকুর, আদরের কুকুর, এই কুকুর, ওই কুকুর, সেই কুকুর ইত্যাদি । কিন্তু একমাত্র কুকুর যেটাকে আমি ভালবেসেছি, তা হল মালকিনিকে উন্মাদের মতন ভালবাসার কুকুর । কিন্তু আমার লেজটা জন্মের সময়ে যেমন আকাশমুখো ছিল , চিরকাল তেমনই থেকে গেছে । আজও, যখন আমার গা থেকে চুল ঝরে যাচ্ছে, চোখে ভাল দেখতে পাই না , ইন্দ্রিয়গুলো খর্ব হয়ে ক্ষয়ে চলেছে ।
ভাবি । যে-বয়সে আমার আসেপাশের লোকেরা ড্রইংরুমে নকল পিকাসো , নকল যামিনী রায় টাঙাতো, আমি টাঙাতুম আসল সিনেমা-সিন্দরীদের । এখনও সেরকমই কেউ একজন টাঙানো রয়েছে । যেমন-যেমন ফিল্মের নায়িকারা পালটেছে আমার দেয়ালের নায়িকাদের বদল ঘটেছে । আমার বয়সী লোকেরা ঘরের আলমারিতে রেখেছে রবীন্দ্ররচনাবলী । আমি রাখতুম হ্যাভলক এলিস , হেনরি মিলারদের । তবে, আমি সোনাগাছিতে যারা যায় তাদের ক্ষমা করি না । আমার কাছে নারীর অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন । এমনকি আমি কল গার্ল বরদাস্ত করি , কিন্তু সোনাগাছি বরদাস্ত করতে পারি না । জানি না লোকে কি করে সেখানে যায় ! গলিটা দিয়ে গিয়েছিলুম একবার ; বমি পেয়ে গিয়েছিল ।
দাদুর বাবা বাইজি নাচাতেন, এই বাড়িতেই । বারোটা ঘর আছে বাড়িটায় । ওনার কিউরিও ঘর দেখে সবাই স্তম্ভিত হয় । ওনার সময়ে অবশ্য ওটা কিউরিও ঘর ছিল না । বাবা ওনার ক্লায়েন্টদের দেখাবার উদ্দেশে ওটাকে কিউরিও ঘর বানিয়েছেন । বাইজিদের সঙ্গে যে-খাটে দাদুর বাবা শুতেন, সেই বিশাল পালঙ্ক আজও একইভাবে আছে । কল গার্লদের ওই ঘরে নিয়ে গেলে তাদের মুডই বদলে যেত । অনেকে আবার ডাক দেবার জন্যে অনুরোধ করত , এমনকি এও বলত যে কম টাকা দিলেও চলবে, রাতটা ওই ঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে চায় । আমার কলেজের বন্ধুবান্ধবরা স্তম্ভিত হয়ে যেত দাদুর বাবার ঘরের সংগ্রহ দেখে ; নিজের প্রেমিকাকে নিয়ে এসে ওই ঘরে রাত কাটিয়ে গেছে কলেজের বন্ধুরা । কত রকমের সংলাপের স্মৃতি ঘুরে বেড়ায় ঘরটায় , নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের তাপ থেকে চাগিয়ে ওঠা সংলাপ । ওই ঘরটা ইস্ট ইনডিয়া কোমপানির স্মৃতি । দাদুর ঘরটা রেনেসঁসের স্মৃতি ;মনীষীদের ছবি টাঙানো দেয়ালে-দেয়ালে । বাবার ঘর ? আধুনিক-অনাধুনিকের খিচুড়ি ; আলমারি জুড়ে আইনের মোটা-মোটা বই , গন্ধও আদালতের মতন । মায়ের ঘর দেখলে মনে হবে ভারতের সব দেবী-দেবতাদের সভা ; কোথা থেকে যে মা ওই সব ছবি এবং মূর্তি সংগ্রহ করতেন জানি না । রবি ভার্মা না থাকলে দেবী-দেবতার মুখ কি এত সুন্দর হতো !
আমার ঘর ? সিম্পল । আমি বেশি আসবাব পছন্দ করি না । অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া কিছুই নেই আমার ঘরে ।
একদা নারীর নৈকট্য ছাড়া আমার জীবন ছিল ঘটনাহীন । কে এই নিরঞ্জন ? নারী ছাড়া ! বেঁচে থাকার মানে , কারণ, মূল্য আর কী-ই বা হতে ওপারে ? আমার তো জানা নেই । পৃথিবী নামের ছোট্টো দ্বীপটায়, নারী ছাড়া আমি একা, নিঃসঙ্গ, অন্তরীণ । জীবনে নারী নেই ভাবলেই মনে হয় মরে যাবো, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি ; ফাঁকা, ফোঁপরা, খালি । জানতেই পারতুম না আহ্লাদ কি, আঘাত কি, বেদনা কি, হাহাকার কি ।
এতজন নারীর সান্নিধ্য সত্ত্বেও , কি স্বদেশে বা কি বিদেশে, আমি জীবনসূত্র পেয়েছিলুম একজনের কাছ থেকেই । সে লরেটোতে পড়া, ইংরেজিতে সান্মানিক স্নাতক । স্নাতকোত্তরে টি এস এলিয়ট বিশেষজ্ঞ । আমি তো গণিতে এম এস সি । সাহিটভ বা দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না ; আজও অবশ্য নেই । সে আমাকে টমাস হবস, জোসেফ কনরাড, অ্যান্টনি বারজেস, উইলিয়াম গোলডিং আরো কারা কারা যেন, প্রতিটি নাম মনেও নেই এতদিন পর , এনাদের লেখালিখির কথা শোনাতো । তার জীবনের অতীতসূত্র কেবল এই সাহিত্যদর্শনকে ঘৃণা । তার অতীত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানি না, সে বলতে চায়নি । বলত ওনারা জীবনের ভুল ব্যাখ্যা করে গেছেন । ওনারা নাকি বলে গেছেন একজন মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত, সে একাকী, কেউ নেই তার, যত বৈভব থাক নাকেন সে প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র , পঙ্কিল, কদর্য, অশ্লীল, জঘন্য, স্হূল, পাশবিক, অশিষ্ট ও বর্বর । সে বলত, জীবনের এই আশাহীন দৃষ্টিকোণ অসত্য । জানি না সে প্রমাণ করতে পেরেছিল কিনা যে ওই লোকগুলোর বক্তব্য ভুল না সঠিক । আমাকে সে নতুন মানুষ করে তুলছিল ; তার মাঝেই একদিন সে হঠাৎ বলে উঠল, ‘আচ্ছা চলি’ । আমি বাকি জীবনটা নানা নারীদের মাধ্যমে তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছি । পারিনি ।
তদন্তকারী পুলিস অফিসার রিমা খানের সামনে টেবিলের ওপর এক গোছা সিডির পাশে যে প্রিন্টআঊটটা পড়ে আছে, তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ । অনুবাদ-করা নয় , তেলেগু অক্ষরকে বাংলায় রুপান্তরণ ।
একটি সিডিতে ব্যাস ওইটুকুই লিখে গেছে লোকটা , যার অদ্ভুত মৃত্যু সম্পর্কে তদন্ত করছে রিমা , পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার , বর্তমানে চাকরি থেকে নিলম্বিত । এই কেস যিনি সর্বপ্রথম দদন্ত করেছিলেন, তিনি স্হানীয় থানার ওসি সুমন মিশ্র । এফ আই আর অনুযায়ী, বাঙলোবাড়ির পাশের মাঠে একটি পিকনিক দল শীতের আমেজে, সেবার শীত পুজোর পর-পরই এসে পড়েছিল , যখন হইচই করছে, কয়েকটা তিনচার বছরের ছেলেমেয়ে খেলতে-খেলতে বাঙলোবাড়ির দেয়াল পর্যন্ত চলে যায় বলের খোঁজে । তাদের পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করে । পিঁপড়ে কামড়ের অ্যালার্জি কম-বেশি কয়েকটা বাচ্চার হলেও, সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয় একটি মেয়ে ; বস্তুত সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় । তাৎক্ষণিক জ্বরে আক্রান্ত হয় মেয়েটি এবং সে অজ্ঞান হয়ে যায় । পিকনিকদলের সদস্যদের সাক্ষ্য অনুযায়ী , পিঁপড়ের ঝাঁক আসছিল বাঙলোবাড়ির ভেতর থেকে । দলের নেতা রবিরঞ্জন কর্মকার গিয়ে খবর দেন স্হানীয় থানায় এবং থানা ইনচার্জের জিপে চেপে ডাকতার ডেকে আনেন ।
থানাত ওসি সুমন মিশ্র ঘটনাস্হলে পোঁছে বাঙলোবাড়িটা তালা-বন্ধ পান , এক নজরে টের পাওয়া যায় কেউ থাকেনা বাড়িটায় , বহুদিন যাবত অব্যবহৃত পড়ে আছে । তিনি জিপে চেপে কাছাকাছি যে ডাকতার পেয়েছিলেন তাঁকে ডেকে আনেন । ডাকতার সযত্নে বাচ্চাটির শুশ্রুষা করেন । কোনো ফিস নেননি , বরং নিজেই ওষুধ দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে সুস্হ করেন ও জ্ঞান ফেরে তার । সাদা কাগজে কয়েকটা ওষুধ লিখে দেন কয়েকদিন খাবার জন্য ; তাড়াহুড়োয় নিজের প্রিন্টেড প্যাড আনতে পারেননি । সামান্য ঘটনা বলে ওসি বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । থানায় নতুন এসেছিলেন, তাই এলাকা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান ছিল না তাঁর । পিকনিকদলের আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের ঠিকানা ডিটেইলসে লিখে রাখা প্রয়োজন মনে করেননি । যে শিশুটি সর্বাধিক আক্রান্ত হয়েছিল তার বাবার নাম ও স্হানটুকু লেখা : দীপ্যমান গোস্বামী, সাকিন লেক টাউন । ভালোয়-ভালোয় ঘটনা মিটমাট হয়ে যাওয়ায় তখনকার মতন নিশ্চিন্ত ছিলেন ওসি ।
মাস ছয়েক পর, হঠাৎই, হাতে তেমন কাজ ছিল না, ওসি বাঙলোবাড়িটার হাল-হকিকাত জানার জন্য, সেখানে ক্রিমিনাল আড্ডা থাকতে পারে অনুমান করে, কেননা কিছুদিন যাবত তাঁর এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, একাই ঢুঁ মারেন । গেটের তালা একজন তালা-খুলিয়ে বিশেষজ্ঞ কন্সটেবলকে দিয়ে খুলিয়ে, ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান যে বাড়িটায় বহুকাল বসবাস করা হয়নি ; ঝোপ-ঝাড় উঁচু ঘাসে সামনের বাগান ছয়লাপ , এক-আধটা ফুলের গাছ দেখে টের পাওয়া যায় যে কখনও সাজানো বাগান ছিল । আগাছার জঙ্গলে পিঁপড়ে আর ছিল না । ওসির ধারণা হয় যে পিঁপড়েরা কলোনি সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকবে । বাঙলোবাড়িটার ফাটলেও গাছ গজিয়েছে । সিঁড়ি দিয়ে উঠে, পুলিস অফিসার হলেও, তাঁর গা ছমছম করে । সেদিনকার মতন অনুসন্ধান স্হগিত রেখে আবার কিছুদিন পর তিনি হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েল আর সইফুদ্দি তালাঅলাকে এনে প্রবেশের সদরের তালা খোলান, গোদরেজের ডুলিকেট ল্যাচকি নিজের কাছে রেখে, চাবিঅলাকে চলে যেতে বলে, ভেতরে ঢুকে সাজানো বাড়ির বৈভব দেখে অবাক হয়ে যান । বাড়িতে কেমন যেন অশরিরী গন্ধ রয়েছে মনে হয় তাঁর , পোড়োবাড়ির গন্ধ সচরাচর যেমন হয় তেমন সোঁদাটে নয়, কিছুটা ইংরেজ-রাজত্বের ফেলে যাওয়া গোরস্হানের মতন , স্বদেশে ফিরতে পারেনি বলে গোরা সায়েবের প্রেতাত্মা হাহাকার করে বেড়াচ্ছে । নিজের দৈনিক ডায়েরিতে এভাবেই বর্ণনা করে গেছেন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ।
বাড়িটার সবকটা ঘর খোলা থাকলেও একটা ঘর বাইরে থেকে তালা-বন্ধ ছিল , তার জানালাও ভেতর থেকে বন্ধ । হেড কন্সটেবল পীতাম্বর পোড়েলের কাঁধের ধাক্কায় খুলে যায় মরচেধরা তালাটা । বিশেষ আসবাবপত্র নেই ঘরটায় । ঘরের ভেতরের দৃশ্যে অবাক হয়ে যান ওসি সুমন মিশ্র । ঘরের দামি মেহগনি খাটে পুরু বিছানার ওপর অর্থেক ঝুলে আছে একজন মানুষের কংকাল , বিছানা থেকে কয়েক পা দূরে একটা প্রাণীর কংকাল । প্রাণীটাকে খুঁটিয়ে দেখার জন্যে উবু হয়ে বসলেন ওসি । প্রাণীটার চামড়া রয়ে গেছে দেহের কয়েকটা অংশে , কালো-সাদা, পোকা আর সময় সম্পূর্ণ খেয়ে নিশ্চিহ্ণ করতে পারেনি । মুখের আকৃতি , কাটা লেজের আর দেহের চামড়া থেকে ওসি অনুমান করলেন যে কংকালটি একটি কুকুরের । বাঙলোবাড়িটায় তালা দিয়ে ফিরলেন তিনি, এবং স্বতঃপণোদিত হয়ে পিঁপড়ের কামড়ের যে নথি ছিল, তা নিয়ে একটি ফাইল খুললেন, জনৈক ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ।
পরের দিন বাঙলোবাড়িটায় দুজন কন্সটেবলকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওসি সুমন মিশ্র । মানুষের আর কুকুরের কংকালের রহস্য , যদিও তাঁর জানা জরুরি ছিল না, তবে তাঁর মনে হয়েছিল যে এর পেছনে একটা অঘটনের কাহিনি নিশ্চই আছে , যার রহস্য ভেদ করা পুলিসের কাজ । কয়েকটা জিনিস তিনি সংগ্রহ করেছিলেন রহস্যময় বাঙলোবাড়ি থেকে : ( ১ ) বাথরুমে রাখা চটি ; ( ২ ) দ্রেসিংটেবিলের ওপর রাখা কয়েকগাছা চুলসহ একটা হেয়ারব্রাশ ; ( ৩ ) কমপিউটারবিহীন ও মনিটরবিহীন কিবোর্ড ; কমপিউটারটা না থাকায় সন্দেহের খচখচানি হল ওসির ; ( ৪ ) এক হাজারটি সিডি , ইংরেজিতে নম্বর দেয়া ; ( ৫ ) ব্রাউনরঙের খামে কোনো মহিলার দীর্ঘ চুলের আঁটি, সম্ভবত তাঁকে নেড়া করার সময়ে একটুখানি নেয়া । সিজ করার মতন আর তেমন কিছু পেলেন না ওসি ।
মিউনিসিপালিটির রেকর্ড থেকে বাঙলোবাড়ির মালিকের নাম পেয়েছিলেন ওসি, গুরুচরণ দত্তমজুমদার ; তিনি তো দেশ স্বাধীন হবার আগেই মারা গিয়েছিলেন, বোধহয় ইংরেজদের আমলেই, তখন মিউনিসিপালিটি ছিল না । তাঁর ছেলেও মারা গিয়েছিল । মিউনিসিপাল কর্পোরেশানের কাছে তাঁদের মৃত্যুর দিনক্ষণ দর্জ করা নেই । তাঁদের সময়ে অবশ্য ওটা নোটিফায়েড এরিয়া ছিল, মিউনিসিপালিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি । তাঁর উত্তরাধীকারী এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কী করে, লোকটা যখন ফৌজদারি উকিল ছিল । সাবইন্সপেক্টারকে পাঠিয়ে বার কাউনসিলের পুরানো রেকর্ড থেকে দত্তমজুমদার পদবির অ্যাডভোকেট পেয়েছিলেন ওসি, সুবীর দত্তমজুমদার । পরের প্রজন্মের উকিলরা জানে যে তিনি ব্রিফ নেবার অনেক ফিস নিতেন , বিচারপতিরা তাঁকে আইনী-জ্ঞানের কারণে সমীহ করতেন । রাশভারি দশাসই চেহারার লোক ছিলেন , বাজখাঁই গলা, রাগি মেজাজের, অথচ তাঁর পরিবারের বিষয়ে কেউ কিছুই বলতে পারল না ।
সাইবার কাফেতে গিয়ে কয়েকটা সিডি দেখার চেষ্টা করেছিলেন, কেননা পুলিস কমপিউটার সেন্টার তখনও স্হাপিত হয়নি এই রাজ্যে ; বিলেতি আর হিন্দি গানের আধিক্য দেখে কোনো ক্লু পাননি । চুলের দুটি গোছা, হেয়ার ব্রাশ আর ব্রাউন প্যাকেটে, তাঁর মতে, বাড়ির কোনো সদস্যের ; হয়তো ওই কংকাল মহিলার , যিনি হঅর্ট অ্যাটাক বা সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান ; কুকুরটা মণিবের দুঃখে মারা গেছে । নিজে থেকে পিঁপড়ের কেসকে কংকালের কেসে নিয়ে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়েন তিনি । ক্লোজ করার জন্যে ঊর্ধতন অফিসারদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা মত না দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ।
পরের ইনভেসটিগেটিং অফিসার রমেন বসু ফাইলটা নাড়াচাড়া করতেন আর চিন্তা করতেন কী করা যায় । বাঙলোবাড়ি সিল করে দেয়া হয়েছিল । মানুষের কংকাল যে অবস্হায় ছিল তেমনই পড়ে ছিল । তিনি বাড়তি সিজ করেছিলেন কুকুরের কংকাল আর তার ছাল । কুকুরের ছালসহ কংকালটি থানার মালখানায় এনে রেখেছিলেন । সিডিগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটা বাছাই করে দেখার চেষ্টা করে তিনি দেখেন সেগুলো খুলছে না , যেগুলো খুলছে সেগুলো বাংলা ইংরেজি হিন্দি গানের । তাঁর সন্দেহ হয় । তিনি পুলিস কমপিউটার সেন্টারে সাইবার বিশেষজ্ঞকে পাঠালে , বিশেষজ্ঞ জানান, যেগুলো খুলছিল না ওগুলো তেলেগু ভাষায় লেখা । সেসময়ে তেলেগু-জানা কাউকে পুলিসে না পেয়ে তিনি সিডিগুলো সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফ্যালেন । তবে কুকুরের কংকালটা তিনি সরকারি পশু ডাকতার কাকলি সোমকে দেখিয়ে একটা রিপোর্ট নিয়েছিলেন । কুকুরটা সম্ভবত পিট বুল প্রজাতির , ভয়ানক হিংস্র , কেবল মালিকের হুকুম শোনে , মাংস ছাড়া খায় না । বোধহয় না খেতে পেয়ে মরে গেছে । তার মালিকের মৃত্যুর পর তাকে খেতে দেবার কেউ ছিল না বাঙলোবাড়িটায় । চামড়াটা পোকায় খেয়ে ফেলেছে , আর বহুকাল পড়ে থাকার দরুণ চুল ঝরে গেছে । তিনি নেক্রপসি করেছিলেন কিন্তু ডিএনএ স্যামপেলের কেমিকাল অ্যানালিসিস করেননি । সেসময়ে ফরেনসিক ল্যাব ঠিকমতন গড়ে ওঠেনি ।
কোনো নির্ণয়ে পোঁছোতে না পেরে, মৃত্যুর কারণ অনিশ্চিত লিখে, রমেন বসুও ঝুলিয়ে রাখেন ফাইলটা । সেই থেকে কেসটা হাফ-খোলা হাফ-বন্ধ হয়ে পড়েছিল । এখন রিমার দায়িত্ব , নির্ণয়ে পৌঁছোবার ; ওকে কেসটা দেয়া হয়েছে দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার একমাত্র উপায় হিসাবে । দুর্নাম থেকে সুনামে ফেরত যাবার জন্যে রিমা খান অনেককে ধরাধরি করেছিকল ; কোনো কাজ হয়নি । অনেক ওপর পর্যন্ত গিয়েছিল ; মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে অত সহজে বদনাম থেকে মুক্ত করা যাবে না ; রিমাকে কিছু-একটা করে দেখাতে হবে যাতে মিডিয়ার চোখে ও নায়িকার পাবলিসিটি পায় । কেননা মিডিয়াই ওকে বদনাম করেছে । চ্যালেঞ্জ নিয়েছে রিমা ; এর শেষ দেখে তবে ছাড়বে ।
রিমার ধারণা কেসটার সমাধান করার জন্য বিল্ডার লবির চাপ আছে ; তারা অতখানি জমির লোভ সামলাতে পারছে না । কেস-ফাইল হঠাৎ ক্লোজ করে দিলে মিডিয়ার লোকেরা নতুন রসদ পেয়ে হইচই করবে । কেন্দ্রীয় নেতাদের টাকা গেঁড়িয়ে সুইসব্যাঙ্কে রাখার খবর শুনে আর পড়ে লোকে ক্লান্ত হয়ে গেছে ; দেশের মানুষ মেনে নিয়েছে যে এই সমস্ত জোচ্চর রাজনীতিকদের নিয়েই ভোটাভুটির গণতন্ত্র চলতে থাকবে এদেশে । পাবলিকের এখন নতুন মালখাদ্য চাই ।
রিমা একটা ফিলটার টিপ সিগারেট ধরালো । অন্য মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে লুকিয়ে ফোঁকে ; রিমার লুকোছাপা নেই, উচ্চমাধ্যমিকের সময় থেকে । মুখেরও আগল নেই, স্কুল থেকেই । পুলিসে ঢুকে অবশ্য সেই গুণগুলো কাজে দিয়েছে । পুরুষতান্ত্রিক পুলিসে সহকর্মীরা ভেবেছিল অশ্লীল শব্দ আর গালমন্দ প্রয়োগ করে ঘাবড়ে দেবে রিমাকে । অপরাধীরাও রিমার মুখনিঃসৃত এমসেবিসি বাণী থেকে নিস্তার পায় না ।
দীপ্যমান গোস্বামী । চাকরিতে থাকলে থাকার কর্মীদের পাওয়া যেত । রিমার জন্য ডিজি পবিত্র মুখোপাধ্যায় বরাদ্দ করেছেন সাব-ইন্সপেক্টার রজত মণ্ডলকে । তার জন্যেও কত ধরাধরি করতে হয়েছিল । ডিজি নিজের ডিসক্রিশানারি পাওয়ার প্রয়োগ করে রজতকে দিয়েছেন । রিমা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো-কোনো কর্মীর সাহায্য নেয় । কন্সটেবলরা, যারা ওর আন্ডারে কাজ করেছে, তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাজ করে দ্যায় । রিমা চিরকাল ওর অধস্তনদের বাঁচিয়েছে , ঊর্ধতনদের প্রকোপ থেকে ।
বাঙালিদের পিকনিকে যাবার অভ্যাসটাও মন্দ নয় । কবে থেকে পিকনিকের চল হয়েছে তা অনুমান করতে পারে রিমা । ইংরেজরা যাবার সময়ে তাদের বাতিল গোরস্তানের সঙ্গে দিয়ে গেছে এটা । বলিউডি গান সহযোগে বিয়ার বা পাউচমালের সঙ্গে মুর্গির টাকনা । সপরিবারে হলে অন্তাক্ষরী। অনেক রকমের এঁটো ফেলে গেছে ওরা । যারা পিকনিকে যায় তারাও নানা এঁটো ফেলে জায়গাটা নোংরা করে চলে যায়।
বিএসএনএল-এর ডিরেক্টরি তন্ন তন্ন খুঁজে কোনো দীপ্যমান গোস্বামীকে লেক টাউন অঞ্চলে পাওয়া গেল না । ইনটারনেটে বিএসএনএল-এর তালিকাতেও পেল না । মোবাইল হয়ে লোকে ল্যান্ডলাইন কাটিয়ে দিলেও, পুরানোতে হয়তো আছে ; কিন্তু ওয়েবসাইটে অবিরাম পরিবর্তন ঘটতে থাকায় পুরানো রেকর্ড নেই । কী করা যায় ?
রাজ্য নির্বাচন দপতরে একদিন গেল রিমা, উর্দি পরে । লেক টাউনের হালের লিস্টটায় পেয়ে গেল দুজন দীপ্যমান গোস্বামী । একজন কালিন্দীতে , অন্যজন বাইরে । রবিবার দেখে কালিন্দীতেও পুলিসের উর্দিতে গেল । বাড়িতে দীপ্যমান ছিলেন না । তাঁর স্ত্রী চৈতালি, গায়ের রঙ ময়লাটে, দুবেলা ভাত-খাওয়া ভরাট কাঠামো, প্রতিদিনের গৃহদেবতার পুজোর সন্দেশ আর জল দিয়ে ভয়ে-ভয়ে জানতে চাইলেন, কেন আসা । পুলিস দেখে কয়েকজন দরজায় উঁকিঝুঁকি মারছিল । দীপ্যমানের স্ত্রী দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন, রিমা বলল, আসতে দিন আসতে দিন, আমি আপনাদের পিকনিকে গিয়ে পিঁপড়ে কামড়ের ঘটনাটা জানতে চাই । দীপ্যমানের স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, আমার মেয়েকেই জংলি পিঁপড়ে কামড়ে ছিল, ওঃ, সে কি অঘটন, ভাগ্যিস সুমনবাবু একজন ডাকতার এনে তক্ষুনি ওষুধপথ্য করলেন , নয়তো কী যে হতো ভগবানই জানেন ।
সমবেত প্রতিবেশীরা ঘটনাটাকে নানাভাবে উপস্হাপন করছিলেন । কিছুক্ষণ পর দীপ্যমান গোস্বামী বাজার থেকে দুহাতে দুটি থলে ঝুলিয়ে ফিরলেন , এবং যথারীতি পুলিস দেখে ঘাবড়ে গেলেন । প্রতিবেশিরা তাঁকে রিমার আগমনের উদ্দেশ্য জানালে তিনি ফ্ল্যাটের অন্য ঘর থেকে একটা ফাইল নিয়ে এলেন । বললেন, সেই পিঁপড়ের কামড়ে আমার মেয়ে আজও মানসিকভাবে ভুগছে , কীটফোবিয়া হয়ে গেছে ওর , আমরা প্রতি মাসে পেস্ট কন্ট্রোলকে দিয়ে পুরি ফ্ল্যাট ডিসইনসেক্টিফাই করাই । দীপ্যামন গোস্বামী লোকটা ওর স্ত্রীর চেয়ে বেশ ফর্সা , বোধহয় প্রেম, নয়তো মোটা যৌতুক । গালদুটো মোদো-চকচকে , চুল কোঁকড়ানো, পায়জামা কুর্তায় , আজকালকার রঙিন চকরাবকরা পাঞ্জাবি ।
রিমা জানাল , আমি সেই ঘটনার সূত্রে আরেকটি ঘটনার তদন্ত করছি । ডাকতারের ক্লিনিকটা কোথায় আর তাঁর নাম-ঠিকানা জানেন কি ?
—না, তা তো আমরা জিগ্যেস করিনি তখন, এত বিপর্যস্ত ছিলাম আমরা । আমার মেয়েকে সবচে বেশি কামড়ে ছিল, কিন্তু কমবেশি অনেকের বাচ্চাকে কামড়েছিল ওই বিদকুটে বিষাক্ত পিঁপড়ে ।
—হ্যাঁ, আমার মেয়েকেও পিমড়ে কামড়েছিল , তবে অত জঘন্য ভাবে নয় ; বাড়ি ফিরে ডাকতার দেখিয়ে ওষুধ দিয়ে কয়েক দিনেই সেরে গিয়েছিল ।
—আমার দুই ছেলেকে কামড়েছিল বটে, তবে গোস্বামীদার মেয়ের মতন নয় ।
দীপ্যমান গোস্বামীকে রিমা অনুরোধ করা প্রেসক্রিপশানের জেরক্স নিল, মোবাইল নম্বর নিল দীপ্যমানসহ কয়েক জনের । ডাকতারদের হাতের লেখা এত নোংরা কেন যে হয় , নামের জায়গায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি । নয়তো ডাকতার সাহায্য করতে পারতেন ।
ডাকতারকে কী রকম দেখতে ? জানতে চাইল রিমা ।
দীপ্যমান : মহিলা ডাকতার যুবতী-যুবতী টাইপ । ঢ্যাঙা । কাঁধ পর্যন্ত চুল ; চুলে তেমন পাক ধরেনি যদিও । গায়ের রঙ এই ধরুন আমার চেয়ে এক পোঁচ ময়লা । ফিস দিতে চাইলেও নেননি ।
চৈতালি : কম বয়সী কী ? চাহারা তো একহারা । বোধহয় বিয়ে করেননি বলে কম বয়সী মনে হচ্ছিল , মানে সিঁদুর-টিঁদুর তো দেখিনি ; আজকাল অবশ্য ডাকতার-টাকতাররা শাঁখা-সিঁদুর পরেন না । তবে বেশি বয়স নয় ; আলগাচটুকে ।
দীপ্যমান : ডাকতার হলেও কিন্তু দামি জামদানি পরেছিলেন । চোখে রিমলেস চশমা । হাতে একগাছা সোনার বালা । অন্য হাতে চারচৌকো ঘড়ি । ফিস নিশ্চই অনেক, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিলেন না । বোথহয় বাচ্চার কষ্ট দেখে ।
—স্যার, খবরটা কি টিভিতে আসবে ? মানে টিভির লোক কি দীপ্যমানবাবুর বাড়ি আসবেন এই কেস তুলে ধরতে ? জিগ্যেস করল একজন যুবক ।
—না না, এখনই এটা নিউজ হবার মতন নয় । হলে দীপ্যমানবাবুকে ওরা অবশ্যই কভার করবে , বলে, রিমা উঠে দাঁড়াল, যোগ করল, পরে দরকার পড়লে যোগাযোগ করব । আর, ডাকতারের সঙ্গে যোগাযোগ হলে ঠিকানা-ফোন নম্বর নিয়ে নেবেন প্লিজ ।
বাইরে বারিয়ে রিমা দেখল ওর লাল-কালো সুজুকি হায়াবুসা মোটর সাইকেল ঘিরে ভিড় । স্টার্ট করে আধা-থ্রটল হুমকি দিতেই ভিড় সরে গেল । রিমা শুনতে পেল কেউ বলছে, আরে এ তো সেই বিখ্যাত নোংরা পরি, উরিব্বাস, কত চুপটি করে কথা বললে আমাদের সঙ্গে । টিভিতে দেখেছিলিস তো ওনাকে নিয়ে প্রোগ্রাম করেছিল ? জাঁদরেল অফিসার , চোর-ডাকাতরা ওনার ভয়ে হেগে ফ্যালে । মোটর সাইকেলটার ফোটো বেরিয়েছিল কাগজে । নোংরা পরি ওপর বসলে সাইকেলটার ডানা গজায় ।
আর পুরুষদের ওপর বসলে তাদের গায়ে কাঁটা গজায় , রিমা নিজেকে শোনালো, রে-ব্যান গগলস পরতে-পরতে ।
৩. ওয়েডিং গিফ্ট
ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে, তখন ভবানীপুরে থাকতুম, মিলিদের পাশের বাড়িতেই , কেননা বাবা এই বাঙলোবাড়িটায় থাকতে চাইতেন না । বলতেন, ওটা বাড়ি নাকি ? দাদুর বেলেল্লাপনার মিউজিয়াম । মিলির সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে চেনাজানা ছিল । এই চল, একদিন দুজনে মিলে লুকিয়ে চুমু খাই, বলতেও ও রাজি হয়ে গেল । বলেছিল, তুই এর আগে চুমু খাসনি তো কাউকে ? উচ্ছিষ্ট হয়ে যাসনি তো ? আজকালকার ছোঁড়ারা তো নিজে চুল আঁচড়াতে শিখলেই উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় । কত স্যামপেল যে দেখলুম আজ পজ্জন্ত ।
সত্যিই আগে কাউকে চুমু খাইনি । তুই খেয়েছিস কি খাসনি তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না । মিলির মোটা-মোটা গোল টুপটুপে ঠোঁট কাছ থেকে দেখলেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । আসলে যেকোনো মেয়েকেই চুমু খাবার ইচ্ছে হতো । ক্লাসের সহপাঠীরা প্রতিদিনই গল্প করত কেমন চুমু খেল, ফ্রকে হাত ঢুকিয়ে আনন্দ করল , বান্ধবীর হাত নিয়ে নিজের ট্রাউজারে রাখতে দিল ইত্যাদি ।
মিলির দেহ-কাঠামো দারুণ, যদিও মুখশ্রী তত ভালো ছিল না । ছোটো-ছোটো চোখের আর চ্যাপ্টা নাকের কারণে । স্কুলের সবাই জানত, ও নিজেও জানত যে ও সেক্সি । আমার আগে অনেক সহপাঠী লাইন মেরেছিল ওকে । আমি বলেছিলুম , না খাইনি, তাইতো খেতে চাইছি , কিরকম লাগে জানতে চাই । ও বলেছিল, আমিও খাইনি, প্রমিস, গড প্রমিস, কাউকে দেখে পছন্দ না হলে কেন চুমু খাব ! কেন বলতো ? চুমু খাওয়াটা তো আর খাওয়া নয়, প্রেম করা ।
আমিও জানি না কিরকম লাগে, কিন্তু কাউকে চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করে , ইচ্ছে করে কসসে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুমু খাই কোনো ছেলেকে । তবে সব ছেলে আমার পছন্দ নয় , তুই যেরকম খোলাখুলি বললি সেভাবে কেউ বলেনি । শুধু গন্দা-গন্দা মন্তব্য করে । মুখ দেখেই বলে দিতে পারি যে কোন ছেলের মুখ দিয়ে কিরকম গন্ধ বেরোয় । তোর তো প্রেমিক হবার সব গুণ আছে । কেন বলতো ? তুই বেশ খাবসুরাত । সত্যি । আমার বন্ধু দিপলি, তুই তো চিনিস ওকে, ও রোজ ওর প্রেমিকের গল্প করে , কত কি করে দুজনে ওরা ; আমারও খুব ইচ্ছে হয় । চল না , তুই আর আমি প্রেমিক-প্রেমিকা হই । বলেছিল মিলি ।
আমি জিগ্যেস করেছিলুম, দিপলির বয়ফ্রেন্ড কে রে ? তারপর বলেছিলুম , কোথায় গিয়ে চুমু খাব ?
ও বলেছিল, আপাতত চল না কোনো সিনেমায় যাই , অন্ধকার হলেই দুজনে চুমু খাবো , দিপলির মতন নানা ব্যাপার করব । দিপলির প্রেমিক নীতিদিদির বর ; নীতিদিদিটা নাকি একদম রেফরিজারেটার । কেন বলতো ? পাশ ফেরালে পাশ ফেরে , কাৎ করালে কাৎ হয়, চিৎ হতে বললে চিৎ হয়, উপুড় হতে বললে উপুড় হয়, নিজে থেকে কিছুই করে না । অমন ঠান্ডা প্রেমিকাকে কে-ই বা নেবে ? বল ! তুই তো লম্বা চওড়া জোয়ান ছেলে, সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে । তুই নির্ঘাৎ নীতিদিদির বরের চেয়ে ভালো প্রেমিক হবি । আরো কেন বলতো ? তোর বাবা কায়েত আর তোর মা বামুন , তার মানে তোর রক্তে প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছে বইছে । আজকে কোনো ফিলিম দেখতে চল । যেদিন আমার বাবা-মা দক্ষিণেশ্বরে যাবে , সেদিনকে তোকে বাড়িতে নিয়ে যাব । প্রেমিক হতে হলে কিন্তু সাহসী হতে হয় । কেন বলতো ? নানা বাধা বিপত্তি আসে, তাই ।
সিনেমা দেখতে গিয়েছিলুম মীনার হলে । কী ফিল্ম দেখাচ্ছিল কে জানে ; যতবার দুজনে কাছাকাছি হবার চেষ্টা করি অন্ধকারটা হঠাৎ সরে গিয়ে আলো হয়ে যায় । আলো হলে ওকে কাছ থেকে কত লোভনীয় মনে হচ্ছিল, অথচ কিছু করার উপায় নেই । আসলে সঠিক সিনেমা হল আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ফিল্ম বাছাই না করেই চলে গিয়েছিলুম।
মিলি বলল, এখানে চুমু খাওয়া কঠিন , বার-বার আলো হয়ে যাচ্ছে , তোর মুখের ওপর ফোকাস মারছে , শেষে কেউ দেখে ফেলবে, তার চেয়ে আমরা ধরাধরি খেলি । বলে, মিলি হঠাৎ আমার প্যান্টের ওপর হাত রাখল , বলল, বোতাম খোলো, বোতাম খোল, এবার থেকে বোতাম খুলে রাখবি । দিপলি বলেছে, প্রেমিকের বোতাম সদাসর্বদা খোলা থাকা দরকার । একেবারে উজবুক তুই, তোকেও আগ্রহ দেখাতে হবে তো । প্রেমিককে প্রেমিকার চেয়ে বেশি-বেশি আগ্রহ দেখাতে হয় ।
আমি বোতাম খুলতেই হাত চালিয়ে দিল মিলি । বলল, যাক বাবা, ভেতরে কিছু পরে আসিসনি ; তারপর প্রকৃত বিস্ময়ে ফিসফিস করল, ও, এরকম হয় বুঝি , এই ফুলে যাচ্ছে রে, গরমও হয়ে যাচ্ছে , ঠিকি যেমন দিপলি বলেছে । আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রে, বুক ঢিপ-ঢিপ করছে ; তোর কিছু হচ্ছে না ? মানে এখানে নয়, যেটা ধরে আছি, মনের মধ্যে কিছু ? কিংবা বুকে ? বাবা-মা কোনদিন যে দক্ষিণেশ্বর যাবে কে জানে !
আমি ওর হাত সরিয়ে বললুম, বার-বআর দিপলিদিপলি করিসনি , ওর নাম শুনলে তোর মুখের বদলে ওর মুখটাই ভাসবে চোখের সামনে ; এবার তোরটায় হাত দিতে দে । হাত চালিয়ে দিতে ন্যাকড়া-বাঁধা পেলুম । চাপা উত্তেজনায় বললুম, ও, নিজেরটা বেঁথে এনেছিস । কেন ? চাস না যে হাত দিই !
মিলি বলেছিল, ধ্যাৎ বোকা , এখুন ধ্যাড়ানি চলছে ; কালকে খুলব , তখন যত ইচ্ছে হাত দিস । দিপলি বলেছে ওর প্রেমিক মুখও দ্যায়, কিন্তু এখানে তো আর তুই মুখ দিতে পারবি না । বাবাকে বলব, যাও দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে্ এসো , যাতে এবার ক্লাসে প্রোমোশান পাই । বাবা আমার কথা ফেলে না ।
আমি বলেছিলুম, হোকগে থ্যাড়ানি, আমি এখনই হাত দেবো , টের পাচ্ছিস তো আমি ষাঁড়ের মতন হয়ে যাচ্ছি । মিলি ন্যাকড়া ঢিলে করতে হাত ঢোকালুম , কিরকম চটচটে । আমার হাতটা নিয়ে নিজের ফ্রকে পুঁছে মিলি বলেছিল, দেখলি তো ? কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে পারলি না । তুই কিন্তু সত্যিই ষাঁড় । বড়বাজারে গিসলুম একবার, তখন দেখেছিলুম একটা ষাঁড় ওই করছে। একদম গোলাপি । তুইও নিশ্চই গোলাপি । কেন বলতো ? তুই তোফর্সা । নীতিদিদির বরটাতো কালোকুচ্ছিত , তবে দিপলি বলেছে প্রেমে কালো-ফর্সা বলে কিছু হয় না । মিলন হলেই সব একাকার , বুকের ভেতর আলোয় আলো । এই তুই কবিতা জানিস ? কেন বলতো ? দিপলি বলছিল যে যখন শরীর গরম হতে থাকে তখন নীতিদিদির বর ওর কানে-কানে কবিতা শোনায়, গানও শোনায় । আমি তো কবিতাও জানি না আর গানের গলাও নেই কী করব বল !
—কবিতা ? কী যে বলিস ! আমি সাইন্সের ছাত্র , অঙ্কতে সবচে বেশি নম্বর পাই ক্লাসে । তবে নার্সারি রাইম জানি , ছোটোবেলায় শিখেছিলুম । বলেছিলুম ওকে ।
মিলি তাইতেই সন্তুষ্ট । ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলেছিল, তবে তা-ই শোনাস । ক্লাস এইটা আর ক্লাস নাইনে একবার করে ফেল করেছে মিলি । তাতে কি । কত মোটা-মোটা গোলাপি ওর ঠোঁট দুটো । বুকও ঢেউ খেলতে শুরু করেছে , আর আমার চেয়ে অনেক ফর্সা । জামা খুললে ঘরে বোধহয় আলো জ্বালতে হয় না । কথাটা ওকে বলতে মিলির খুব ভালো লাগল । বলল, তুই যা বললি তা নীতিদিদির বরের কবিতারচে অনেক-অনেক মিষ্টি । এই রকম কথা মাঝে-মাঝে বলিস । কেন বলতো ? যে কথার মানে হয় না অথচ শুনতে ভালো লাগে তা শোনার জন্যেই তো মানুষ বেঁচে থাকে ; মানুষ তো শুধু খাবার আর হাগবার জন্যে বেঁচে থাকে না ।
পরের দিন গেলুম ভবানী সিনেমায় । মিলি নিজে সিনেমার টিকিট কেটে রেখেছিল। দেয়ালে ঠেসান-দেয়া সিট পেয়েছিলুম । ভালই হল । আমি ফিসফিস করে বললুম, আজকে কিছু বাঁথিসনি তো ? মিলি আমার বাঁ-হাতর মধ্যমা আঙুলটা নিয়ে বলেছিল, এইতে রাখ, শুধু রাখবি, নাড়াবিনা কিন্তু, নাড়ালে কাল থেকে আসবো না ।
আমি আঙুলটা নাড়াতে-নাড়াতে বললুম, নাড়ালে কী হয় ?
মিলি আমার বোতাম-খোলা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে টিপে-টিপে ফোলাতে লাগল আর বলতে লাগল, এই হয়, এই হয়, এই হয়, এই হয়, হেই হয়, এই হয়, এটা আমার আমার আমার । আমি এত উত্তেজিত হয়েগিয়েছিলুম যে সামলাতে পারলুম না । রুমাল বের করে পুঁছতে হল । রুমালটা নিজের কাছে রেখে নিয়ে মিলি বলেছিল, এটা আমার ওয়েডিং গিফ্ট । রুমালটা বুকের মধ্যে গুঁজে মিলি বলল, চল এবার, ফিলিম দেখে কী হবে ? আমরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে গেলুম , ইনটারভালের আগেই । বাইরে বেরিয়ে মিলি রুমালটা শুঁকতে-শুঁকতে খুব জোরে হাসতে লাগল । হাসতে-হাসতে বলল, অদ্ভূত ব্যাপার এই প্রেম ; তুই এটা প্রেম ভাবছিস তো ? আমি কিন্তু ঠিক করে নিয়েছি তু-ই আমার প্রেমিক । কিন্তু আমার কিছু হবার আগেই তোর হয়ে গেল কেন ? তোর সঙ্গে ঘর বাঁথা যাবে না , এক্কেবারে প্রেমিক হবার অযোগ্য তুই । দিপলি বলেছে, দুজনের একসঙ্গে হওয়া মানে প্রেমিক-প্রেমিকার রাজযোটক । ঠিকুজি-কুষ্টি মেলাবার সময়ে আঁক কষে এটাই তো দ্যাখে , সেই বিয়ে সফল হয় ।
—তোর জন্যেই তো হল, বলেছিলুম ওকে ।
দিপলি বলেছিল, প্রথম দিনেই দেখে নিতে । তাই টেস্ট করলুম। তুই পাস । লেটার পাবি প্রেমে । বাব্বাঃ, কত স্টক তোর , প্রেমে টইটুম্বুর । আনন্দিত আননে বলেছিল মিলি ।
আমরা দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলুম , চিনেবাদাম খেলুম । চিনেবাদাম খেতে-খেতে মিলি বলেছিল, ফুচকা খেয়ে চুমু খাস , তার মতন আর মজা নেই । দিপলি আর নীতিদিদির বর প্রায়ই ফুচকা খেয়ে চুমু খায়, টকঝাল চুমু । নানা স্বাদের চুমু হয় । বড়-বড় কবি-মনীষিরা লেখে গেছেন । তুই সেসব পড়তে পারবি না , সংস্কৃততে লেখা ।
যাবার আগে আমি বললুম, কালকে আমার পালা, তুই কিছু করবি না । ও বলেছিল, ঠিক আছে , তুই যা করার করে নিবি , তারপর আমি আমার ওয়েডিং গিফ্ট নেবো । আমার তো আর অত তাড়াতাড়ি তোর মতন রসগোল্লার রস বেরোবে না । আমি নিজে-নিজেও নিজের মজা নিই , ক্লাসে অনেকেই নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । ছেলেরাও তো নিজে-নিজে আনন্দ নেয় । তুই নিস ? রোজ দুটো করে হাফ-বয়েল ডিম খাবি । কেন বলতো ? তাহলে রস অক্ষুন্ন থাকবে , দিপলি বলেছে । দেখিসনি, ফুচকায় রস থাকে বলে খেতে ভালো লাগে , মুখে ঢোকালি কি ফুচ ।
পরের দিন আমরা লাইটহাউসে গেলুম । মিলি বাড়ি থেকে চাইলেই পয়সা পেতো । আমি বাড়িতে হাতখরচ চাইলে খেতুম চড় । লাইটহাউসে আমরা চুমু খাবার সুযোগ পেয়ে গেলুম । উনটারভালে বাইরে বেরিয়ে ফুচকা খেয়ে আবার চুমু খেলুম । চুমু খেতে যে এত ভালো লাগে জানতুম না , ফুচকা অর নো ফুচকা । চুমুটা খাবার পর থেকে আমরা দুজনেই চুমু খাবার সুযোগ খুঁজতুম । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁটের গরম গন্ধ আমার ভালো লাগত । ওর ভাল লাগত ওয়েডিং গিফ্ট ; এই ওয়েডিং গিফ্ট খেলা খেলতে ওর ভালো লাগত । কত যে ওয়েডিং গিফ্ট ওকে দিয়েছি তার হিসেব নেই । তবে রুমালের বদলে কাপড়ের টুকরো ওই আনত ।
একদিন ওকে বললুম তোর বুকে হাত বোলাবো কী করে ? তোর বুক দেখতে খুব ইচ্ছে করে । ও বলল, শীতকাল তো আসছে , একটু অপেক্ষা কর , সামনে দিকে বোতামখোলা একটা সোয়েটার আছে আমার , সেইটে পরে বেরোব , ভেতরে পরব না কিছু । বড়দিনের দিন সেই দিনটা এলো । অমরা ছবিঘর সিনেমা হলে গিয়েছিলুম । মিলি ওর সোয়েটারে বোতাম খুলতেই ফিল্মের আলোয় ওর বুকের ঢেউ আরও গোলাপি হয়ে উঠেছিল , আর ওর বুকের ওপর দেখতে পাচ্ছিলুম নায়ক আর খলনায়কের মারামারির আলোছায়া । আমি ওর কাছ ঘেঁষে হাত বোলালুম , বললুম, মুখ দিতে ইচ্ছে করছে রে । মিলি বলল, পরশু বাড়িতে কেউ থাকবে না ; মা-বাবা যাবে দক্ষিণেশ্বরে , আমি বলে দিয়েছি পরীক্ষার পড়া আছে । তুই দুপুর বেলা চলে আসিস , সঙ্গে বইখাতা নিয়ে আসিস । কেন বলতো ? যদি অন্য কেউ হঠাৎ এসে পড়ে । ড্রইংরুমে বইখাতা খুলে রাখব । কেন বলতো ? কেউ এলে ভাববে তুই আমাকে পড়াচ্ছিস । সবাই জানে তুই ভাল ছাত্র , আর আমি ফেলটুস । পড়ে কি করব ? কেন বলতো ? সংসার তো তুই চালাবি , আমার শুধু তো সংসারের খাটনি থাকবে । কত প্রেম করব দুজনে , ওফ, ভাবলেই তোকে আলুপোস্ত করে ফেলতে ইচ্ছে করে ।
আমি স্কুলব্যাগ বইখাতা জিওমেট্রর বাক্স নিয়ে মিলিদের বাড়ি গিয়ে দেখি ও ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর বই-খাতা খুলে রেখেছে । আমার কাঁধ থেকে তাড়াতাড়ি স্কুলব্যাগ নিয়ে বই-খাতা পেনসিল বের করে রাখল , এমনভাবে যাতে মনে হয় ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি । বলল, দাঁড়া, আমার টাওয়েলটা নিয়ে আসি ; কেন বলতো ? তোর রসগোল্লার রসে যদি কার্পেট নোংরা হয়ে যায়, বড়রা ঠিক টের পেয়ে যাবে । তারপর জিগ্যেস করল, রবার এনেছিস ?
আমি বললুম, হ্যাঁ, জিওমেট্রি বক্সে আছে ।
—ওঃ মাগো, একে নিয়ে কী করব ! দুহাত ওপরে তুলে বিরক্তি প্রকাশ করল মিলি : ওই রবার নয় রে গাধা, প্রেম করার রবার , ওফ, যদি জানতুম তাহলে দিপলির কাছ থেকে নিয়ে নিতুম । নীতিদিদির বর নিজের পকেটে নিয়ে ঘোরে , জানিস ? কখন দরকার পড়ে, বলা তো যায় না । কোনো সুযোগ ছাড়ে না ওরা । আমার অবাক চেহারাখানা দেখে আরও বিরক্ত হল মিলি । বলল, প্রেম করার সময়ে ছেলেরা পরে, জানিস না ? কেন বলতো ? না পরলে রসগোল্লার রস ভেতরে পড়ে বাচ্চা ফুটিয়ে ফেলবে । আজকের পুরো সুযোগটা ডোবালি তুই । নাঃ, তোকে নিয়ে পারা যায় না , মোটেই প্রেমিক হবার যোগ্য নোস । হয় ভগবান, কাকে যে প্রেমিক বাছলুম ।
ও বারবার এত হাত নাড়িয়ে কথা বলছিল যে ওর ফ্রক ওপরে উঠে যাচ্ছিল ঞাঝে-মাঝে , আর তাইতে বুঝে গেলুম যে ফ্রকের তলায় কিছু পরে নেই । আমি সজোরে জড়িয়ে ধরে ওর মোটা-মোটা ঠোটে আমার ঠোঁট চেপে ধরে মিলির কথাবলা থামালুম। ও আমাকে টেনে বই-খাতার মধ্যে ফেলল, বলল, তুই আমার পায়ের দিকে মাথা কর , দিপলি বলেছে, রবার সঙ্গে না থাকলে এই উপায় করতে হয় । আমার আগে মিলি নিজেই আমার মাথার দিকে পা করে ফেলল আর আমায় বলল, ওখানে জিভ ঘসতে থাক , মুখ ঘসতে থাক । যখন বলব তখন থামবি ; আমার হয়ে গেলে আমি তোর শুরু করব ।
উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে মিলি বলল, তোর বুকের মধ্যে কী বাজছে বলতো ?
আমি জিগ্যাস করলুম, কী ?
ও আমাকে বলার আগেই গাল ঘসতে লেগে গিয়েছিলুম ; নেশা ধরা গন্ধ, চোখ বুজে গন্ধ নিতে-নিতে আমার উঠতি দাড়ি দিয়ে ঘসছিলুম । মিলি বলল, কবিতা বল না , যা জানিস, তা-ই বল, আর যা করছিস তা-ই কর, ভেতরে গিয়ে বল ; ওটাও কবিতা বোঝে ।
আমি টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর বলতে-বলতে কী যে করছিলুম, নিজেই জানি না, যতক্ষণ না মিলি থামতে বলল, ততক্ষণ । মিলি কেঁপে-কেঁপে জোরে জড়িয়ে ধরল । তারপর যা করল তা আজও মনে হয় আত্ম-আবিষ্কার । মুখে পুরে নিয়ে জিভ ব্যবহার করে রসগোল্লার রস বের করে ফেলল , আর গিলে নিল, স্পষ্ট টের পেলুম ।
—কী করছিস কি, পাগল না কি তুই, বললুম উঠে বসে ।
মিলি বলল, দিপলিও খায় , বেশ ভালো স্বাদ , মন ভরে গেল, সত্যি, আলোয় আলো হয়ে গেল মনটা । তুই এবার বই-খাতা গুটিয়ে, যা, কেটে পড় ; ভাগ্যিস কেউ আসেনি । এবার আমিই রবার যোগাড় করে রাখব , তোর দ্বারা কিসসু হবে না ।
আমি বললুম, এখনও তোর বুকটাই ভালো করে দেখা হল না আর তুই তাড়িয়ে দিচ্ছিস । মিলি ফ্রক ওপরে তুলে বলল, নে, যত পারিস দেখে নে শিগগির ; আশ মিটিয়ে নে । ফ্রক তোলার ফলে ওর মুখ ঠাকা পড়ে গিয়েছিল । আমি সেই সুযোগে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিলুম । ঢেউয়ের ওপর জিভের নৌকো বাইতে লাগলুম , ও বাধা দিল না ; বলল, ঠিক আছে, কর কর , বেশ ভাল্লাগছে । বলল, তোর ভেতর কোন বাজনা বাজছে বলতো ? পুজোর বাজনা : না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই , হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, ঠিক কি না ?
আমি দাঁত বসিয়ে দিতে, উঃ, জানোয়ার কোথাকার, সুযোগ পেয়েছিস কি নিজের রূপে এসে গেলি ।
তখনকার মতো আমার প্রথম প্রেমের সেখানেই ইতি ।
আমাদের দুজনকে বাবা কোথায় একসঙ্গে দেখে ফেলেছিলেন । আমরা নাকি খুব হাসাহাসি করছিলুম । ব্যাস, চড়, চড়ের পর চড়, আরও চড় । বাবার ধারণা যে বাইজি নাচাবার রক্ত আমার শরীরে ডাক দিতে লেগেছে । আমাকে ওই রক্তদোষ থেকে বাঁচাবার জন্যে বাবা এই বাগানবাড়িতে থাকাটা শ্রেয় মনে করলেন । আমার নারী-সঙ্গর সাহস, কেন কে জানে, ছিল না তখন । তা ঢুকল কলেজে ঢুকে , হস্টেলে থাকার সময়ে , বাবার চোখের আড়ালে ।
বাবা প্রেম ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না , সম্ভবত নিজে প্রেম করে বিয়ে করাটা সফল হয়নি বলে । স্কুলের দিনে মিলির সঙ্গে তারপর দেখা হলে ওয়েডিং গিফ্ট বলে ডাকত না । বলত, কী রে জারজ, বাপকে ভয় পাস, প্রেম করার মুরোদ নেই চললেন উনি বুকে হাত বোলাতে । তবে তোকে আমি ছাড়ব না, দেখে নিস । যদি আমার বিয়েও হয়ে যায়, আমি তোর বাচ্চাকে পেটে নেবোই নেবো । তুই পৃথিবীর যেখানেই থাকিস খুঁজে বের করব তোকে । তোর মতন কেউ আমার সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না , জানি আমি । তারপর রাস্তায় দাঁড়িয়েই কাঁদতে আরম্ভ করে দিয়েছিল ।
আমি বলেছিলুম, তুই কি উন্মাদ ?
ও বলেছিল, হ্যাঁ, আমি উন্মাদ ; তা না হলে কি করে এক কথায় রাজি হয়ে যেতুম ? তুই এত ভিতু ? এরকম ঢ্যাঙা ছেলে, চওড়া ছাতি, হিরি-হিরো চেহারা, আর সেই ছেলেটা কিনা নিজের বাবাকে ভয় পায় ! প্রেমকে ভয় পায় ! প্রেমের জন্যে মানুষ মরতে পর্যন্ত রাজি হয় আর তুই প্রেমিক হয়েও পালালি বাপের ঠ্যাঙানির ভয়ে ! তবে ছাড়ব না তোকে, এই বলে রাখলুম , দক্ষিণেশ্বরের দিব্বি ।
বাবাকে কেউ নিশ্চই খবর দিয়ে থাকবে । আমার এখন মনে হয় দিপলির সঙ্গে সব কথা বলাবলি করার ফলে নীতিদিদির বরের কানে গিয়ে থাকবে আমাদের প্রেম-কাহিনি । বাবা পাড়াটাই ছেড়ে দিলেন ।
আমরা তারপর দাদুর বাগানবাড়িতে চলে এলুম । একদিক থেকে ভালো হল । শহর থেকে দূরে বলে বাবার গাড়ি করে স্কুলে যাতায়াতের সুবিধে হয়ে গেল । তারপর কলেজে গিয়ে হস্টেলে ভর্তি হলুম । মিলির সঙ্গে প্রেমের নবীকরণের সুযোগ ছিল । কিন্তু আমার কেমন যেন গিল্ট ফিলিং হতে লাগল । কত আর ধোকা দেব বোকা মেয়েটাকে ! বোকা বলেই ওকে ভালো লাগত । ভয় ছিল যে শেষে পেটে বাচ্চা-ফাচ্চা এসে গেলে কেলেঙ্কারি , এমন ডাকাবুকো মেয়ে মিলি যে নিজে থেকেই হয়তো চেষ্টা করত যাতে পেটে বাচ্চা এসে যায় । বাবা জানতে পারলে চড় মেরে-মেরে আধমরা করে দিতেন ।
কলেজে ঢুকে সহপাঠীদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সহায়তায় কল গার্লদের জগতটার সঙ্গে পরিচয় হল ।
এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়া, এই অভিব্যক্তিটা এই বুড়ো বয়সে আমায় হন্ট করে । উন্মাদ ? হ্যাঁ, আজ জানি, আমি উন্মাদ ।
বাগানবাড়িটা নিয়ে দাদু আর দাদুর বাবার বনিবনা ছিল না । দাদুর বাবা নাকি বাইজিদের নিয়ে কেলো করতেন বাড়িটায় । দাদুর নামে করে দিয়ে যাননি । নোটিফায়েড এরিয়ে বলে দাদুও বিশেষ গা করেননি দাদুর বাবা মারা যাবার পর । দাদু মারা যেতে বাবাও মিউটেশানের জন্যে করেননি কিছু । আমিই বা কী করব সম্পত্তির মালিকানার ঝঞ্ঝাটে ঢুকে !
ইউরোপ যাবার আগে, উত্তর ইউরোপের কয়েকটা দেশের ভিসা পেয়েছিলুম , বাবা এত টাকা আমার জন্যে রেখে গিয়েছিলেন যে মন ভালো করার উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া অন্য পথ ছিল না । অন্ধ্র থেকে ফিরে এসে আমার মন ভেঙে পড়েছিল । দেশে থাকলে বাগানবাড়িতে, নতুবা বিদেশে, এভাবেই জীবন কাটাব ঠিক করেছিলুম ।
ওবেরয় গ্র্যান্ড থেকে বেরিয়ে , এয়ার কান্ডিশানের শীতটা দেহ থেকে ঝরিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে, ফুটপাতের রোদে গিয়ে দাঁড়াতেই , একজন মহিলা, কাঁধে চামড়ার সুদৃশ্য ব্যাগ, আমাকে আঁকড়ে ধরলেন । ছাড়ুন, ছাড়ুন, কী করছেন কি , এভাবে, কে আপনি ? বলে, ছাড়াতে, দেখি মিলি । দেখেই ভয় করে উঠল , বাবার ভয় নব< বাবা তো স্বর্গে , অন্য এক অচেনা ভয় , বিশ্বাসঘাতকরা হয়তো এরকম ভয়ে আচমকা আক্রান্ত হয় । বুকের ভেতরে বাবা তখন হৃৎপুণ্ডকে চড় মেরে চলেছেন ।
—জানি, তুই চিনতে পারবি না , মিলি কে চিনতিস কি , যখন স্কুলে পড়তিস ? আমি সেই মিলি । আজকেই, আজকেই বলি কেন, এই কিছুক্ষণ আগে আমার ডিভোর্স হয়ে গেল । কেন বলতো ? আমার বর ভালো চাকরি করে না , আমার রোজগার উড়িয়ে বেঁচে থাকতে চাইছিল বাঞ্চোতটা । মিলি বলল, সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে ।
—আমি তো পরশু ইউরোপ চলে যাচ্ছি । ভয়ে আমার মুখ দিয়ে পলায়নের অ্যালিবাই বেরোলো । টের পাচ্ছিলুম ঘেমে উঠছি ।
—তোর বাবা তো কবেই অক্কা পেয়েছেন , এখনও কিসের ভয়ে মরিস ? প্রথম প্রেমকে ভয় পাস ? নিজেকেই ভয় পাস তুই । কেন বলতো ? নিজেই নিজেকে জানিস না ।
—প্রেমকে ভয় ? মায়ার স্মৃতি উসকে উঠল । মিলি বুঝতে পারছিল আমি কোনো সংবেদন চেপে রাখতে চাইছি । বললুম, না রে, প্রেমকে ভয় পাই না আর , প্রেম বিপর্যস্ত করে দিয়ে চলে যায় । আমি তোকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলুম । তোর দুঃখ আর অসহায়তা আজ অনুভব করি ।
—চল না, তোর বাড়ি যাই , দুজনে দুঃখ ভাগাভাগি করব । চিনেবাদামের দুপুর আর ফুচকার রাতগুলোর গল্প করব । তুই তো সেই উত্তর চব্বিশ পরগণার কোথায় যেন থাকিস , বিশাল প্রাসাদ আছে তোদের, তা তো দেখাই হয়নি । নিয়ে চল না । ভয় নেই তোর চলে আসব , আমার নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাট আছে গল্ফগ্রীনের চার তলায় ; সেখানে তোকে নিয়ে যেতে পারতাম । আজকে নয় । কেন বলতো ? লোকেরা আজকে আমার মুখ দেখার জন্যে তৈরি হয়েই থাকবে , বিয়ে ভাঙনের আনন্দ নেবে । আমার হাত দুটো নিয়ে বলল মিলি ।
নিয়ে গেলুম ওকে । পথে দুবার ট্যাক্সি পাল্টালুম । নির্বাক দীর্ঘ পথে গায়ে গা লাগিয়ে মিলি আড়চোখে মাপজোক করছিল আমরা পরস্পরের কত আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছি ।
বাড়িতে ঢুকে দরজা বনধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই মিলি জড়িয়ে ধরল আমাকে । ফোঁপাতে লাগল । কারণ ঠাহর করতে পারলুম না । কাঁদবার রসায়ন আমার শরীরে ঘোর অনর্থ গড়া শুরু করেছিল ; তা চাপা দিতে আমিও জড়িয়ে ধরলুম মিলিকে যাতে ও আমার মুখের দিকে তাকাতে না পারে । ও আমার শঅর্ট টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল, ছিঁড়েও গেল বোতামগুলো । বলতে লাগল, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই, তোর বাচ্চা চাই…
আমার ভয় নাকি যৌনতা তা জানি না । একজন যুবতী জড়িয়ে ধরেছে আমায় , তার নরম বুক চেপে বসিয়ে দিয়েছে আমার বুকে, নিজের পোশাক নিজেই দ্রুত খুলে ফেলার প্রয়াস করছে । আমি চোখ বুজতেই মায়া ভেসে উঠল, মায়ার উলঙ্গ দেহ দেখতে পেলুম চোখের সামনে ।
মিলি বলল, আমি আজ তোকে খুন করে তবে যাব , খোল, খোল, খোল, খোল….জানি, তোর বুকের ভেতরে সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না, না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না , না না চাই, হ্যাঁ হ্যাঁ চাই না । আর আমার ভেতরেও সেই পুরানো বাজনাটা বাজছে চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই চাই…..
—কি করছিস কি , পরশু আমি চলে যাব রে , কি করবি তুই তারপর , এখনও তুই উন্মাদ থেকে গেছিস, ছাড়, ছাড়, ছাড় ।
—ওসব আমি বুঝব ; বললুম না তোকে । আজ তোকে খুন করে তবেই যাব , তোর খাবারে বিষ মেশাব , দে, তোর বাচ্চা দে…
নারী জড়িয়ে ধরলে আমার পক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণ যে আসম্ভব তা আমি জানি । বোধহয় মিলিও জানত । আমি ওকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে দাদুর বাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালুম , এই আশায় যে ঘরের আসবাব ওকে পাগলামি থেকে মুক্ত করবে । দাদুর বাবার ঘরে ওনার সময়ে শিকার করা স্টাফড বাঘ, হরিণ, মোষ, জংলি বিড়াল ইত্যাদি দিয়ে সাজানো ; দেয়ালে ওনার সঙ্গে ওনার স্ত্রী আর দাদুর তেলরঙে বিরাট ছবি , ওনার প্রিয় বাইজির তেলরঙে পোরট্রেট , দেয়ালে মোষের, হরিণের করোটি । মিলির কোনো পরিবর্তন হল না । পরিবর্তে , আমার গলা জড়িয়ে বলে উঠল, ওঃ, এই ঘরটায় তো কত অবৈধ ভালবাসাবসি হয়েছিল , না হয় আরেকটা হল । রসে রস মিশলে প্রেম আর অবৈধ থাকে না , বলে রাখলুম তোকে ।
সারা রাত পোশাকহীন আর অভূক্ত থেকে সকালে শাড়ি-ব্লাউজ পরতে-পরতে ও বলেছিল, রক্ত দেখে তোর সন্দেহ হয়নি ? তোকে মিথ্যা কথা বলেছিলুম , আমার বিয়েই হয়নি তো ডিভোর্স হবে কোথ্থেকে !
আমি স্তম্ভিত ।
রাতে ওর বুকে একটা দাগ দেখিয়ে বলেছিল মিলি, এই দ্যাখ, সেই তুই কামড়ে দিয়েছিলি, তোর দাঁতের বিষে ঘা হয়ে গিয়েছিল । আমি ওষুধ লাগাতে দিইনি, লাগাইনি, তোর স্মৃতিচিহ্ণ ধরে রেখেছি ।
আমার জীবনে আমি কোনো নারীকে বুঝে উঠতে পারিনি । হয়তো সেকারণেই আমি আকৃষ্ট হই, আজও । এই বার্ধক্যে ।
ও বলেছিল, তোর বাড়ি দেখে রাখলুম , যদি আমার আজকের উদ্দেশ্য সফল না হয়, তাহলে একদিন চুপচাপ এসে তোকে খুন করে যাব । এমনভাবে খুন করব যে কেউ বুঝতে পারবে না তুই কি করে মরলি ।
আমি ওকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে, ভাড়া দিয়ে দিতে চাইছিলুম । মিলি বলল, ট্যাক্সিঅলার সামনেই, তুই কি সেবার দাম দিচ্ছিস নাকি ? আমাকে পি পথবৌমা পেয়েছিস নাকি ? দেখি কি হয়, নয়তো সত্যইই তোকে জীবন দিয়ে দাম চোকাতে হবে । মনে রাখিস । ঠাট্টা করছি না, সিরিয়াসলি বলছি । ডায়েরিতে লিখে রাখ , পুলিস তোর লাশ পেয়ে আমার খোঁজে আসবে তাহলে ।
শেষনির কথামতন লিখতে-লিখতে বেশ লাগছে । সব-কিছুই মনে করতে পারছি , এত দিন পরও । মিলির মোটা-মোটা ঠোঁট, গোলাপি ভরাট বুক, বুকে কামড়ে দেবার দাগ, সোঁদা-সোঁদা গন্ধ । আর ওর প্রতিজ্ঞা যে, আমার বাচ্চাকে ও পেটে নেবেই নেবে , নয়তো খুন করবে আমাকে । আমি ওর স্মৃতিতে আমার শুক্রকীট ডক্টে অনিল পালেসকরের লিকুইড নাইট্রোজেনে ফ্রিজ করিয়ে রেখেছি ; চল্লিশ বছর রেখে দেবার কনট্র্যাক্ট । এখন তো কাগজে পড়ি ষাট-বাষট্টি বছরেও ফ্রোজ করা স্পার্ম থেকে বাচ্চা হয় । ডক্টর পালেসকর বলেছেন কোনো সমস্যা হবে না । আপনার নির্দেশ অনুযায়ী দাবিদার মহিলা যোগাযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় আইভিএফ করে দিতে পারব , আপনার স্পার্ম কাউন্ট অনেক বেশি ।
মিলি তুই কোথায় ? তুই কি সফল হয়েছিলি ? তুই কি কেওড়াতলার স্বর্গদ্বার দিয়ে উধাও হয়ে গেছিস ? কেই বা তোকে জানাবে তোকে নিবেদিত আমার স্পার্মের কথা , শীতঘুমে নিদ্রিত তোর সন্তান-সন্ততির অপেক্ষার কথা !
ওর, মানে মিলির, চামড়ার ব্যাগটা পড়ে রয়েছে ; মিলি বাড়িতে ঢুকেই যেখানে ওটা রেখেছিল । ব্যাগটায় একটা ছোরা দেখে আমার আরও ভয় হল যে সত্যিই মিলি ইনসেন নয়তো । বা, হয়তো, ওর প্রেম ইনসেন , ও নয় ।
আমারও বেশ লাগল হে কংকাল প্রেমিক, তোমার প্রথম প্রেমের গল্প পড়ে । ইন্সপেক্টার রিমা খান নিজেকে শুনিয়ে বলল , সিগারেটের ধোঁয়া হাওয়ায় উড়িয়ে । তবে তুমি নিজের ঠিকানাটা লিখলে না কেন ? কোথায় থাকতে ভবানীপুরে ? মিলিদের বাড়ির নম্বরটাই বা কি ? মিলির বাপের নাম কি ? দিপলি কে ? নীতিদিদির বর লোকটা কে ? শ্রাদ্ধ করতে বসে লোকে দাদু-দাদুর বাপের নাম বলতে পারে না । আর এখানে একজন, যে কিনা নিজের নাম বলছে না, অথচ গ্রেটগ্র্যান্ড ফাদারের কাহিনি শোনাচ্ছে ! প্রথম প্রেমের রহস্যময়ী প্রেমিকার কাহিনি শোনাচ্ছে , নিজেকে শোনাচ্ছে । হাউ অ্যাবসার্ড । মায়া পাল নামে সেই মহিলার কী হল তাহলে ? এটা কি ডাইভারসানারি ট্যাকটিকস ? কংকালটা বেশ ঘোড়েল ।
মিলি কি এসে খুন করে যাবে ? মনে তো হয় না । প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা বলে কথা, অপেক্ষা করেছে বছরের পর বছর পালিয়ে যাওয়া প্রেমিকের জন্য । কিন্তু মিলির চামড়ার ব্যাগটা তো সিজার লিস্টে নেই । ওটা কি হল ? কংকাল প্রেমিকের দাদুর বাবার কিউরিও ঘরটাও অব্যবহৃত । ওই ঘরটার তালা জংধরা ছিল ; অর্থাৎ কংকাল প্রেমিক নিজেও, সম্ভবত মিলি এপিসোডের পর খোলেনি । বেডরুমটা কংকাল প্রেমিক ব্যবহার করত না , স্টাডিতেই শুত , আর সেখানেই মরেছে । লোকটার স্টাডিতেও জমকালো পালঙ্ক । মহিলার চুলের গোছা পাওয়া গেছে , সেটা তাহলে মিলির নয় বলেই মনে হচ্ছে । তাহলে কার ?
যাহোক, দুটো সূত্র তো পাওয়া গেল । বেডরুমে হাতের ছাপ যা পাওয়া গেছে, তার দ্বিতীয় আর তৃতীয় স্যামপেলের একটা হয়তো মিলির ; অন্যটা কার সন্ধান করতে হবে । প্রথম আর দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা আঙুলের ছাপ স্টেট ক্রাইম ব্র্যাঞ্চ রেকর্ডস ব্যুরোয় সংরক্ষিত ছাপগুলোর সঙ্গে মিলিয়েছিলেন ; মেলেনি , কেননা রেকর্ডে কেবল ক্রিমিনালদের ছাপই রক্ষিত । কংকাল প্রেমিকের হত্যায় কোনো পেশাদার খুনির হাত আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না ।
শুক্রকীত সংরক্ষণ করার এই ডাকতারের নাম দেখেছি সংবাদপত্রে । অনেকের আইভিএফ করে বাচ্চার জন্ম দিয়েছেন । ইনি নিশ্চয় মুম্বাইয়ের সেই বিখ্যাত ডাকতার । নিজেই যাব । ডিজিকে অনুরোধ করব যাতায়াতের খরচ অনুমোদন আর মুম্বাইয়ের কমিশনারকে একটা চিঠি দিয়ে দিতে যাতে সরকারি অতিথি হয়ে থাকতে পারি ।
রিমা পড়তে-পড়তে ভাবছিল, কংকালটা বেশ লিখেছে , উপন্যাস টাইপের । ডিজিকে জিগ্যেস করতে হবে এই পুরো লেখাটা কোনো ডিটেকটিভ রাইটারকে দিয়ে নিরঞ্জন দত্ত নামে বই ছাপানো যায় কি না । কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ এই গল্পটা ঢোকাতে গেল কেন ? কংকালটা বোধ হয় ঠাহর করতে পারেনি যে তার প্রকৃত প্রেমিকা কে ! সত্যিই, দুজন তরুণি যদি একজন পুরুষকে ভালোবাসে , তাহলে কোন নিক্তি প্রবোগ করেই বা বুঝবে যে কাকে ও চায় । ধরা যাক আরও কয়েকজন তরুণী পুরুষটাকে প্রেম নিবেদন করে বসল , তখন লোকটা কি করবে ? মায়া আর মিলি এই দুজন একেবারে বিপরীত মেরুর মহিলা । এদের দুজনকেই যদি খুঁজে পাওয়া যায় , তাহলে বাঙলোবাড়িতে এনে কংকালটাকে দেখিয়ে জানতে চাইবে, চেনে কিনা ।
৪. নোংরা পরি
তেলেগু অক্ষরে লেখা বাংলা ন্যারেটিভ পড়া বজায় রাখল ইন্সপেক্টার রিমা খান । তেলেগু অক্ষরকে বাংলা করিয়ে প্রিন্টআউট নিয়েছে ।
সময়টা সেনসেক্স অমুক থেকে তমুক হাজারে যাবার মাঝামাঝি বেশ পেছলা এরকম কাদায় কিউতে দাঁড়িয়ে টাইমপাস করতে চোখ ব্যবহার করে, চারিপাশে তাকিয়ে তার সঙ্গে কাণ উৎকর্ণ রেখে ফালতু গল্পে নিজেকে সেসব টানাপোড়েনে জড়িয়ে রেখেছিলুম । ক্লান্তির আবছায়ায় মনে হচ্ছিল, অতীতে, ধূসর নয়, রঙ গন্ধ ছোঁয়ার স্মৃতিতে ভাসছিল ও, নিরঞ্জন, বয়স হওয়া সত্ত্বেও । ডাকতার ওকে বলেছে ভাবতে-ভাবতে অতীতের স্মৃতিকে খুঁচিয়ে তুলতে , যতটা স্পষ্টতা ওসকানো সম্ভব, পেছনে চলে যেতে, পেছনে পেছনে পেছনে পেছনে গিয়ে আবার এগিয়ে আসতে , এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে এগিয়ে, বিশেষ করে প্রতিযোগীতায় হেরে যাবার, মা-বাবার কাছে মার খাবার, চোট-জখমের, অপমানিত হবার, শয্যাশায়ী থাকার, অসুখের, প্রতারিত হবার, প্রতারণা করার, প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতার, যৌনতার, যৌন হুল্লোড়ের, যে-স্মৃতিগুলো ঘাঁটলে মগজ টাটকা থাকবে, বুড়িয়ে যাবার অবধারিত ভুলোপনাকে আটকে রাখবে, অ্যালঝিমারের ভয় থাকবে না । ডাকতার শেষনি ম্যাডাম বলেছেন যে গোপন স্বীকৃতি কমপিউটারে লুকিয়ে রাখুন , মাঝে-মাঝে পড়ুন, মেমারি এনজয় করুন , ফ্রেশ ফিল করবেন ।
মেয়েমানুষ, নারী, স্ত্রীলোক ছাড়া কোনও একরোখা উদ্দেশ্য ছিল না । হ্যাঁ, খাওয়া আর টাকা থাকাটাও জরুরি মনে হয়েছে । কত রকমের খাবার যে আছে জগতে । মানুষে-মানুষে প্রভেদ যে কত প্রয়োজন তা রকমারি খাবার দেখে, খেয়ে বুঝতে পেরেছি । মেয়েমানুষ, টাকা আর খাওয়া । কিন্তু একদিন একজন হঠাৎ বলে উঠল, ‘চলুন পালাই’ , আর ব্যাস, সব কিছু ওলোট-পালোট হয়ে গিয়েছিল ।
সেনসেক্সের অমুক হাজার থেকে স্মৃতিকে আঙুল করছে নিরঞ্জন, নিরু, মায়ালিঙ্গা, মায়াগারু, নিরঞ্জন পাল, নিরঞ্জন বণিক, নিরঞ্জন ব্যানার্জি, নির্জনাইয়া । এসব ওরফে আমার নিজের নেয়া নয় ; আমার ওপর চাপানো । আমার কিন্তু তা ভালো লেগেছে । ওরফেগুলোর জন্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারলুম । নয়তো কি-ই বা ছিলুম । কখনও ষাঁড়ের মতন দৌড়োতুম, কখনও ভাল্লুকের মতন গোটাতুম নিরঞ্জনকে । বাবার দেয়া নাম । বাবা । যিনি কথায়-কথায় চড় মারতেন । আমার কানে প্রতিটি চড়ের আওয়াজ দর্জ করা আছে । সব চড়ের ধ্বনি একই রকম নয় । চড়ের কারণ অনুযায়ী বাবা চড়কে শব্দদান করতেন । এবং অর্থ ।
অনেকে বলে ঠাস করে চড় । তারা জানেইনা চড় কাকে বলে । চড়ের আওয়াজ ঠাস হতে পারে না । পপটিটি চড়ের পৃথক অর্থ হয় । এখন চড়ের আশঙ্কা নেই । ভয় সুধু ভাইরাসের । হার্ড ডিস্কের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করার কারণ এই ভাইরাসই । কোথা থেকে কোন ভাইরাস চলে আসবে তার ঠিক নেই । সিডি থেকেই চলে আসবে হয়তো বা গান বা বাজনা থেকে । বাবার চড়ের চেয়েও অপ্রত্যাশিত ।
পড়তে শুরু করে পুলিসের ইনভেসটিগেটিং অফিসার ইন্সপেক্টার রিমা খানকে এই চিন্তাটা উত্তেজিত করেছে যে কেন কংকালটা লিখেছে বাংলা কিন্তু ব্যবহার করেছে তেলেগু অক্ষর । এটুকু পড়ে নোট নিল যে শেষনি ছদ্মনামের একজন ডাকতারের নির্দেশে, কংকালটা নিজের বার্ধক্যের নিরাময়ের উপায় হিসাবে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছে । শেষনি সত্যিই ডাকতার না নার্স না সেবিকা না সহায়িকা না প্রেমিকা তা কংকালের হেঁয়ালির কারণে বেশ কনফিউজিং । সতর্কভাবে কনফিউজ করার ব্যবস্হা করে রেখেছে কংকাল লোকটা । যাতে কেউ না সহজে পড়ে ফ্যালে, সেদিকেও কংকালটা খেয়াল রেখেছিল ।
কংকালটার বাপ ওকে ঠেঙিয়ে-ঠেঙিয়ে মেনটাল কেস করে দিয়েছিল কিনা তাও জানা দরকার । তার মানে কংকালটার যোগাযোগ ছিল কিছু লোকের সঙ্গে যাদের সবাইকে ও নিজের সম্পর্কে গোপন তথ্য জানতে দিতে চায়নি । কী সেই গোপনীয়তা ? শেষনি ছদ্মনামের কোনো ডাকতার খুঁজে পাওয়া যাবে না রেজিস্টার্ড ডাকতারদের তালিকা থেকে । কংকালটার বাড়িতে মেডিকাল ফাইল পাওয়া যায়নি । প্রেসক্রিপশান বা প্যাথলজিকাল রিপোর্ট থাকলেও ক্লু পাওয়া যেত । শেষনি হয়তো ডাকতার নয় ; কংকালের বুড়ো বয়সের প্রেমিকা হতে পারে । অনেক পুরুষ আছে যারা প্রেমিকা ছাড়া বাঁচতে পারে না । কংকালটাও বোধহয় সেই টাইপের লোক ছিল । শেষনি বলে জুটিয়েছিল কাউকে ।
ওই মহিলা, যার কয়েকগাছা চুল পাওয়া গেছে, তার হদিস এই সিডিগুলোর মথ্যে নিশ্চয় কোনোটায় থাকবে । বাথরুমের চটিটা এত বড় মাপের যে মনে হয় তা কোনো পুরুষের । কংকালের নিজেরও হতে পারে । কিন্তু কংকাল কি অমন রঙচঙে মেয়েলি চটি পরত ? কংকালটা গে নয় তো ? হয়তো কোনো গে পুরুষ ভুলে ফেলে গেছে ! সেই কি খুনি ? গে পুরুষদের প্রেমিক নিয়ে টানাটানি হয় বটে, তা থেকে খুনোখুনির সূত্রপাতও ঘটে ; বিদেশে তো অমন গে সংক্রান্ত খুনোখুনি প্রায়ই ঘটতে দেখা যায় । সুমন মিশ্র আর রমেন বসু চটিটার কেমিকাল অ্যানালিসিস করিয়ে নিতে পারেননি, তখন ফরেনসিক দপতরের সুযোগ-সুবিধা ছিল না তেমন । চুলের যে গোছা পাওয়া গেছে তার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে নেয়া যেতে পারে , যদি আরও কোনো জিনিসের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয় ভবিষ্যতে ।
প্রথম যিনি এই কেসটা নিয়েছিলেন সেই তদন্তকারী অফিসার সুমন মিশ্র নির্ণয় নিতে পারেননি যে এটা আত্মহত্যা না খুন না স্বাভাবিক মৃত্যু । উনি বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফাইলটা ক্লোজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ; সে প্রায় দশ বছর আগের কথা । ফাইলটা তখন ক্লোজ করতে চাননি তখনকার ডাইরেক্টার জেনারাল হরিশঙ্কর মুখার্জি । ওনার গভীর অভিজ্ঞতা ওনাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছিল যে এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয় ।
দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসার রমেনবাবু বছর দুয়েক পরে কেসটা নিয়ে বহু তথ্য একত্রিত করেছিলেন, উনিও পথ গুলিয়ে হাল ছেড়ে দেন । সেই থেকে ফাইলটা বলা যায় হাফ-খোলা-হাফ-বন্ধ হয়ে পড়ে আছে । বর্তমান ডায়রেক্টার জেনারাল পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেছেন যে চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড রিমার চাকরিতে বহাল হওয়া , আটকে থাকা পোস্টিং আর প্রোমোশান এই কেসটা সুরাহা করার পরই হবে । দ্বিতীয় তদন্তকারী ওসির সময়ে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটারিতে ডিএনএ স্যামপেল টেস্ট করার কেমিকাল নাকি ফুরিয়ে গিয়েছিল ; দুটো জেনেটিক অ্যানালাইজারের মধ্যে একটা খারাপ হয়ে পড়েছিল ; অ্যানালিস্টদের পদগুলোতে পোস্টিং হয়নি কারোর ।
ট্র্যান্সক্রিপ্ট-অনুবাদের গোছা পড়া বজায় রাখল রিমা । পুলিস কমপিউটার সেন্টারের সহায়তায় সবকটা সিডি ও তেলেগু থেকে বাংলা করেছে । কংকালের সংগ্রহের প্রতিটি সিডিই তার আত্মক্ষতর খতিয়ান নয় । প্রায় হাজার খানেক সিডির মাত্র কয়েকটায় আত্মক্ষত আছে । বাদবাকি সবকটাই পাশ্চাত্য গান, বাংলা গান, বলিউডি গান, হলিউডের ফিল্ম, নাচের ডিভিডি, আর কোনো কিছু রেকর্ড না-করা সিডি । প্রতিটি দেখে দেখে তেলেগু লেখা সিডিগুলো পৃথক করেছে রিমা । ২০০টা সিডি দেখার পর রিমার মনে হয়েছিল প্রেমিক কংকাল ১০১, ২০১, ৩০১, ৪০১, ৫০১, ৬০১ আর ৭০১ নম্বরের সিডিতে নিজের গল্প লিখে রেখেছে , যা কিনা একটা সিডিতেই এঁটেভ যেত । এক থেকে একহাজার পর্যন্ত সবুজ মার্কার দিয়ে মার্ক করেছিল কংকালটা , যাতে খুঁজতে অসুবিধা না হয় । সিডি তো রয়েছে , কিন্তু কমপিউটার আর মনিটর লোপাট বা ল্যাওপটপ থাকলে সেটি লোপাট । ল্যাপটপ ছিল না , ডেস্কটপই ছিল , কেননা কি-বোর্ড পড়ে আছে । বাড়িতে কোথাও মার্কার বা পেন-পেনসিল কিচ্ছু নেই । কেউ ওই ধরণের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলে থাকবে । কে সে ? মায়া পাল ? মিলি ? না অন্য কেউ ? কংকালটা ওর ফিকল্স ডিপজিট , গভমেন্ট সিকিউরিটি, শেয়ার সার্টিফিকেত ইত্যাদির কথা লিখেছে আরেকটা সিডিতে । তা সেগুলো গেল কোথায় ? ওগুলো যে-কেউ ভাঙাতে পারবে না, যদি না কংকালটা মরার আগে তার নামে ট্রান্সফার করে দিয়ে থাকে । খুনি জোর করে সই করিয়ে মেরে ফ্যালেনি তো ?
রিমার ক্লু খোঁজার চেষ্টা চলছে । প্রথম এবং দ্বিতীয় তদন্তকারী অফিসাররা ভেবেছিলেন সব কয়টা সিডিই হয় ফিল্ম নয় গান । সব কয়টা দেখার প্রয়োজন মনে করেননি । তাংছাড়া একটায় তেলেগু লেখা দেখে আশাহত হন দ্বিতীয় ওসি রমেনদা ।
রিমার চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান নির্ভর করছে এই রহস্য অনুসন্ধানের ওপর । লক আপে একজন আসামিকে মেরে ফেলার অভিযোগে ও সাসপেন্ডেড ; যদিও এনকোয়ারি কমিশন ওকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছে । চাকরিতে বহাল আর প্রোমোশান আটকে আছে । ওর নামই সংবাদপত্র আর টিভির সাংবাদিকরা দিয়েছে ডার্টি ফেয়ারি বা নোংরা পরি, আমেরিকার কোনো মারকুটে পুলিস অফিসারের নামের আদলে । সে নাকি বলত ‘মেক মাই ডে’ । সাংবাদিকরা সেরকম গল্পই ছড়িয়েছে রিমা খান সম্পর্কে ; রিমা খানের উক্তি হল ‘একে ববিটাইজ কর ‘। সাংবাদিকদের মতে , রিমা নাকি পুরুষ আসামিদের ভয় দেখায়, লিঙ্গের চারপাশের চুল নাপিত ডেকে কামিয়ে একজন কন্সটেবল ক্ষুর নিয়ে অপেক্ষা করে । অপরাধীকে চেয়ারে বেঁধে তার দুহাত আর দুপা দুদিকে টান-টান করে বেঁধে রাখা হয় । রিমা খানের চোখের সামনে । তাতেই কাজ হয়। ডাকসাইটে গুন্ডার কাছেও তার যৌনাঙ্গের চেয়ে পার্থিব-অপার্থিব দামি কোনো বস্তু নেই । মিডিয়াতে রসিয়ে-রসিয়ে রঙিন ছবি এঁকে তুলে ধরা হয়েছে ।
মা-বাবা বলেন, তোকে কেই বা বিয়ে করবে এবার ! সাংবাদিকরা জিগ্যেস করে, মেয়ে হয়ে নোংরা গালাগাল ইউজ করেন ? অপরাধীদের থানায় এনেই আপনি নাকি হুমকি দ্যান যে নপুংসক করে দেব তোকে । রিমার সোজাসাপটা উত্তর, কেন, মেয়েমানুষের জন্যে ভাষা আলাদা, শব্দভাঁড়ার পৃথক ? মেয়েরা পাদবে না, ঢেঁকুর তুলবে না, যৌনকর্মে প্যাসিভ থাকবে । যত্তো সব ব্লাডি রাসকেল বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষ ।
নোংরা পরি ! আর নাম পেলি না তোরা ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে রিমা । তবে প্রেমিক কংকালটার গল্প বেশ ইনটারেস্টিং মনে হচ্ছে । এককালে মেয়েদের নিয়ে জব্বর লীলে করেছে দেখছি ।
পড়া বজায় রাখল রিমা ।
নারীরা আমার ভাসমান জাহাজের অ্যাংকর । হ্যাঁ, অ্যাংকর কথাটা সঠিক । মেয়েমানুষ হল অ্যাংকর, নোঙর, যে স্হিরতা দেয় । চেতনার তরল কোলাহলের হইচই ঘিরে এক নারী-দেয়াল । কোনোপ্রকার আদর্শ ছাড়াই নোঙরের অধিযন্ত্র গড়ে তোলে এমন একটা মূল্যমান যাতে অজান্তেই সঙ্গতিপূর্ণভাবে একাগ্র হওয়া যায় । অমন একাগ্রতার দরুণ মগজটা আর মনের ওপর চড়াও হতে পারে না । অবিরাম দাসত্বকে লাগাতার উদ্ভাবনা দিয়ে মনোযোগের ঘেরাটোকে সতত উদ্দীপিত রাখার আর কি-ই বা উপায় আছে ? অন্তত আমি তো তা জানি না । বেঁচে থাকার তেজ খরচ করার জন্যে এর চেয়ে আরামপ্রদ আকর্ষণ আর নেই । দুঃখ কষ্ট যাতনা একাকীত্ব গ্লানি ইত্যাদির চেয়ে উন্নত কোনো আরাম আছে কি ? নেই ।
ওই আকর্ষণের ফলে যাবতীয় এনার্জি নেতিবাচক নির্গমপথের বদলে ইতিবাচক রাস্তায় চালিত করা গেছে । জীবনের ঝড় জঞ্জাল নোংরামির ঘূর্ণিপাকে উচ্চতর মহত্তর পরমোল্লাস । বোথহয় একেই বলে আধ্যাত্মিক প্রাপ্তি । মায়া এনে দিয়েছিল ।
এই সিডিটা এখানেই শেষ দেখছি , নিজেকে শুনিয়ে বলল রিমা । এরকম টুকরো-টুকরো লিখেছে কেন ? টাইমপাস না অন্য কিছু ? পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যায় ।
৫. খুনি কে ?
সন্ধ্যা ।
অন্ধকার ঘরে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে মগ্ন ইন্সপেকটর রিমা খান । চারটে সিগারেটই ছিল প্যাকেটে । শেষ হয়ে গেছে দেখে প্যাকেটটা দুমড়ে টেবিলের তলায় রাখা পেপার-বিনে ফেলে দিল ।
ঘরে ঢুকেই রিমার মা সিগারেটের ধোঁয়া খেয়ে কাশতে শুরু করলেন। কাশতে-কাশতেই বললেন, কতবার বলেছি তোকে এত সিগারেট খাসনি । টেনশানের চাকরি, ছেড়েদে না । কাশি থামলে বললেন, পুলিসের চাকরি শুনে কেই বা বিয়ে করবে তোকে ? পুলিসের লোকেই করতে পারে ; তাও জোটাতে পারলি না । বিয়ের বয়সও পার করতে চললি । আবার কোনো তেএঁটে কেস এনেছিস বোধহয় । তোর সাসপেনশানের হিল্লে হল না, আবার কেস । কতবার বললুম, যা, দিল্লিতে সেজো মামার সঙ্গে দেখা কর ; ওনার অনেক জানাশোনা আছে দিল্লিতে , কাউকে ধরে এখানে মুখ্যমন্ত্রীকে একটা যদি ফোন করাতে পারতিস তাহলে তোর বিপদের সুরাহা হতো ।
রিমা বলল, মা, ধরাধরি করে দেখে নিয়েছি । ডিজি একটা কেস দিয়েছেন, বলেছেন, স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশ হল যে আমি যদি এই প্যাঁচালো কেসটার সুরাহা করতে পারি, তাহলে তার পর দিনই আমার পোস্টিং আর প্রোমোশানের অর্ডার বেরিয়ে যাবে । আর সিগারেট ? কলেজগুলোয় গিয়ে দ্যাখো, বেশির ভাগ মেয়েই আজকাল গ্যাঁজা, যাকে ওরা বলে পাতা, দিব্বি ফোঁকে । দিনে গ্যাঁজা, রাতে ডিলডো ।
প্রকৃতই আঁৎকে উঠলেন রিমার মা সুনয়না খান ; আশঙ্কা-থমথমে কন্ঠে বললেন, আবার প্যাঁচালো কেস ? ওই প্যাঁচালো কেসের সমাধান করতে গিয়েই তুই লক আপে একজনকে ঠেঙিয়ে বিপদ ডেকে এনেছিস । আবার ? ডিলডো কী রে ? কেমন খেতে ? ডিলডো কোনো নতুন সিগারেট ?
মাকে পাশের স্টুলে বসিয়ে রিমা বলল, না, মা, সেরকম প্যাঁচালো নয় । এটা একজন লোকের রহস্য , যে পাঁচ বছরেরও বেশি আগে মরে ভুত হয়ে গেছে , এখন কংকাল হয়ে পড়ে আছে সে, তারই বিশাল বাড়িতে । কেউ তাকে খুন করেছিল, নাকি সে আত্মহত্যা করেছিল, নাকি তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল, তা আত , ইউরোপ থেকে আসে বলে দু-তিন হাজার টাকা দাম ।আমিও একটা কিনব , কখনও-কখনও ইচ্ছে করে খেলতে ।
—হ্যাঁ, কিনে নিস, মনটা হালকা হবে । যখন কিছুই ভালো লাগবে না তখন একটু খেলে নিলে কাজে মন লাগবে । বললেন রিমার মা ।
রিমা, সমান্তরাল চিন্তায় অভ্যস্ত, ভাবল, এই ডিলডো জিনিসটা মন্দ নয়, নানা রঙের, নানা কায়দার, সঙ্গীতময় ডিলডো, জেলি-দেয়া ডিলডো, ব্যাটারিতে কাঁপুনি-তোলা ডিলডো । বিয়ে না করে যৌবনটা কাটিয়ে দেয়া যায় ডিলডোদের সঙ্গে প্রেম করে । কোনো নটবরের দায়-দায়িত্ব নেই , হাগিজ পালটাবার হ্যাঙ্গাম নেই, প্লে স্কুলে গিয়ে লাইন দেবার ঝামেলা নেই , ডোনেশানের দুশ্চিন্তা নেই । ভাইব্রেটারের আনন্দ নাও , আর গাঢ় ঘুমে রাত কাবার ।
—ও আবার কেমন পুলিসি কেস ? অমন তো শুনিনি আগে , বললেন সুনয়না । উপদেশের ঢঙে যোগ করলেন, তোর সঙ্গে তো সেই বিদেশি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভের আলাপ হয়েছিল দিল্লির কোন সেমিনারে, তা তাকে তোর এই প্যাঁচালো কেসের বিষয়ে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারতিস । একদিন স্কাইপে কথা বলে দেখ ।
—সেটাই তো ধাঁধা , বলল রিমা । তারপর যোগ করল, এর আগে দুজন ডিটেকটিভ, মানে পুলিসেরই অফিসার, তুমি চেনো, সুমনদা আর রমেনদা, তদন্ত করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন । আমি সুযোগ পেয়েছি কিছু একটা করে দেখাবার, ছাড়ব কেন ! তুমি দেখে নিও, কয়েক সপ্তাহেই রহস্য ভেদ করব । দেখা তো বহু এদেশি-বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে হয়েছিল সেখানে, সে একখানা অভিজ্ঞতা বটে । ওই বিদেশি ডিটেকটিভের নাম এরকুল পয়েরো ; উনি বলছিলেন, ব্রিটিশ আমলে তোমাদের শহরেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ছিল ; এখন তোমাদের দেশে ডিটেকটিভের আর দরকার কোথায় ? প্রতিদিন তোমাদের রাজ্যে দু-দশটা খুন হয় , আর সেগুলো তোমাদের মন্ত্রীরা রাজনৈতিক খুন নাম দিয়ে চাপা দিয়ে দেন । উনি বলছিলেন, তোমাদের বাংলাভাষায় ডিটেকটিভরা উধাও হয়ে গেল কারণ রাজনীতিকরা গুন্ডা পোষে , খুন করায়, ডাকাতি করায়, ট্রেন লুট করায়, নারী পাচার করায় , আর তারাই আবার আইন বানায় ; তোমাদের দেশে আমলা-রাজনীতিক-অপরাধীদের এমন চক্র তৈরি হয়ে গেছে যে অপরাধীরা হিরোর সন্মান পাচ্ছে , নির্বাচন জিতে আইনসভায় যাচ্ছে ।
—আরেকজন বিদেশি ডিটেকটিভের সঙ্গে তো এই শহরেই দেখা হয়েছিল । তিনি আমেরিকার রেড ইনডিয়ান মহিলা, নাম এলা ক্লাহ । উনি আরও মারাত্মক কথা বলেছিলেন । উনি বলেছিলেন যে তোমাদের শহরটা পৃথিবীর পঙ্কিল শহরগুলোর অন্যতম, তোমাদের সরকারি হাসপাতালগুলো সমাজবিরোধীদের আখড়া । এখানে তো বিনা চিকিৎসায় রোজ কতজন মারা যায় তার ইয়ত্তা নেই , না খেতে পেয়ে মানুষ মরছে ; ডিটেকটিভ থাকাটা তোমাদের সমাজে বিলাসিতা , একটা-দুটো খুনে কী-ই বা এসে যায় এরকম সমাজে !
মায়ের শাঁখা-নোয়া পরা বাঁ হাত নিজের দু হাতে নিয়ে রিমা বলল, আমি শুনে-শুনে শুধু ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার ইয়েস ম্যাম ইয়েস ম্যাম করে গেলুম ।
—অসত্য বলেনি তো মা । তা তুই তোর কেসের কোনো সুলুক সন্ধান পেয়েছিস ? কেসটাই বা কেমনতরো, রিমার মা শুধোলেন ।
—দুপুর থেকে তা-ই তো চিন্তা করছি , বলল রিমা । যে লোকটা মরে গেছে তার কংকালই কেবল রয়েছে ; মেয়ে না পুরুষমানুষ তা জানি না , আর তার কুকুরের কংকাল রয়েছে আমাদের মালখানায় । আমার আগের অফিসাররা হাতের টিপছাপ সংগ্রহ করেছিলেন ঘরগুলো থেকে, তা পুলিসের ফাইলে রাখা কোনো অপরাধীর সঙ্গে মেলেনি । একগাদা কমপিউটার ডিস্ক পাওয়া গেছে, গানের, বাজনার, নাচের ; কয়েকটা তেলেগু ভাষায় ইজকুড়ি-বিজকুড়ি লেখা বলে আগের অফিসাররা আগ্রহ দেখাননি । ল্যাপটপ বা টেবিলটপ কমপিউটার পাওয়া যায়নি ।
রিমার মা বললেন, তুই কোনো ডাকতার দেখা ।
—ডাকতার আবার কী দেখাব , আমার কিছু হয়েছে নাকি ? শুধু ক্লান্ত, ব্যাস, রাগতস্বরে বলল রিমা ।
সুনয়না বললেন, পুলিস ইন্সপেক্টারবাবু, তোর অসুখের কথা বলিনি । বলছি যে কংকালটা কোনো ডাকতারকে দেখা , তারা তো জানবে যে ওটা মেয়ের না ছেলের, কেমন করে মরল, কবে মরল ।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল রিমা । বলে উঠল, আরে ঠিক বলেছ তো । কোন দিক দিয়ে এগোবো বুঝতেই পারছিলাম না । লোকটার লেখা পড়তে-পড়তে তাইতেই মশগুল হয়ে পড়েছিলাম ।
সুনয়না বললেন, যে-লোকটা মরেছে, মানে যার কংকাল, তারও তো কোনো ডাকতার ছিল , তারও অসুখ-বিসুখ করত নিশ্চয়ই । খোঁজখবর নে, দ্যাক গিয়ে আসেপাশে কোনো ডাকতার-টাকতার বা হাসপাতাল আছে কিনা । লোকটার আত্মীয়-স্বজন কেউ তো হবে ? অমন মানুষ হয় নাকি যার ভূভারতে কেউ নেই ?
রিমা বলল, চলি মা, তোমার কথামতন এগিয়ে দেখি । নিচে নেমে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা সোজা ঘটনাস্হলে পোঁছাল। দশ বছর আগে বাঙলোটার ধারে-কাছে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না । কেবল বাঙলোবাড়িটা ছিল , একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে । যেমন-যেমন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে, এলাকাটার নাম হয়ে গেছে কংকাল-বাঙলো পাড়া । পাড়ার লোকেদের কাহিনী অনুযায়ী , বাঙলোবাড়িটায় রাতে অনেকগুলো কংকালভুত ঘুরে বেড়ায় , তারা ঘুঙুর পরে নাচে, গান গায়, বাজনা বাজায় , মেয়ে কংকালগুলো হাসাহাসি করে ; তাই বাঙলোটার মাঠের কাছাকাছি ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিক্রি হয়নি , ভয়ে কেউ আসতে চায়নি । নতুন তৈরি বিল্ডিঙগুলোতে শ্যাওলা জমে কালচে হয়ে যাচ্ছে । এই বিল্ডাররাই চাইছে কেসটার তাড়াতাড়ি হিল্লে হোক , খুনি ধরা পড়ুক , বা রহস্যটার বিশ্বাসযোগ্য সমাধান হোক ।
রিমা এক নজরে বাঙলোবাড়িটা দেখে নিয়ে মোটরসাইকেলে থ্রটল ঘুরিয়ে প্রথম গেল গোবিন্দর সেলুনে , বিশ্বকর্মা হেয়ার কাটিং স্টুডিও, গোবিন্দ যে ফোটোগ্রাফার হতে চেয়েছিল , তার নিদর্শন । একটা চেয়ার খালি আছে , উঁকি মেরে দেখে ঢুকলো রিমা ; অন্য দুটো চেয়ারে দুজন ঘুমন্ত বৃদ্ধ চুল কাটাচ্ছেন । বুড়োরা বোধহয় সন্ধ্যাবেলা চুল কাটায় , নিজেকে বলল রিমা । ওর সমান্তরাল চিন্তা ওকে বলল, খগেনের কাছ থেকে খবর নেয়া যাক । খগেন গোবিন্দর ছেলে , দুটো নাপিত রেখে সেলুনটা চালাচ্ছে , বাস চাপা পড়ে গোবিন্দ মারা যাবার পর । ফাঁকা চেয়ারটায় গিয়ে বসতে বৃদ্ধ দুজন এক পলক দেখে নিয়ে নিজেদের নাপিততন্দ্রায় ফিরে গেলেন । ওপরের উঁচু তাকে রাখা মিউজিক সিসটেমে হিন্দি গান বাজছে ।
খগেনকে রিমা বলল, চেঁচিয়েই বলল, নে, বয়কাট করে দে , কানের ওপর চুল এসে গেছে, সুড়সুড়ি লাগে । আর তোর এই হিন্দি গান বন্ধ কর , কত ভালোভালো বাংলা গান আছে, সেসব বাজাতে পারিস না ?
মিউজিক সিসটেমের সুইচ অফ করে খগেন বলল, ওই দ্যাখো, তোমার ফোটো, মোবাইলে তুলেছিলুম, এনলার্জ করিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি । ছোটকুর কমপিউটার দোকানে গিয়ে মোবাইল থেকে তোমার রঙিন ফোটো বানিয়ে নিলুম । কেন জানো ? তুমিই আমার একমাত্তর মেয়ে খদ্দের । আর তোমার নাম তো পৃথিবীতে সক্কোলে জানে । গর্বভরে বলল খগেন প্রামাণিক । তারপর ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, চাকরিতে বহাল হলে ? যাও দুচারটাকা তোমার কাছ থেকে পেতুম, তাও তো বন্ধ ।
খগেন রিমার ইনফরমার বাহিনীর একজন । অনেকে চুল কাটতে আসে ওর সেলুনে , আর ও গল্প শুরু করে খবর আদায় করার মতলবে । কোনো একটা সূত্র পেলেই হল , রিমা তা অনুসরণ করে বেশ কয়েকটা আসামি ধরেছে ।
রিমা বলল, হ্যাঁ, একটা কেস বিশেষ করে আমাকেই দিয়েছেন ডিজি । জানিস তো, আমার থানায় কোনো কেস ঝুলে থাকত না । সমাধান করে তবে শ্বাস নিয়েছি । তুই ওই কংকাল-পাড়ার বাঙলোবাড়ির বিষয়ে জানিস কিছু ? এই যে রে , নতুন পাড়ার মাঠের ওপারে, কংকালবাঙলো পাড়ায় ?
—ও তো ভুতুড়ে বাড়ি গো । ওর ধারে-কাছে যায় না কেউ । চুল ছাঁটার বদলে কাঁচির বাজনা আর আঙুলের নাচ বেশি তুলছিল খগেন । ওই বাড়িটার গল্প নিয়ে নাকি হিন্দিতে ভুতবাংলা নামে একটা ফিলিম হয়েছিল , হিরো মামুদ মিউজিক আর ডি বর্মণ ; বাবার মুখে শুনেছিলুম । আমি তো জম্মে ও-মুখো হইনি ।
—ওই বাঙলোবাড়ি ভিষণ অপয়া , বলল জনৈক চুলকাটিয়ে বৃদ্ধ , ঝিমন্ত অবস্হাতেই । তারপর যোগ করল, আমিও মেশোমশায়ের কাছে শুনেছি ; রাতের বেলায় বাঙলোবাড়িটায় নীল আলো জ্বলত আর হিন্দি ফিলিমের গান বাজত , কখনও-কখীনও বিলিতি গান বাজতো । মেশোমশায় বলেছিলেন, ওই গান শোনার পরেই উনি কালা হয়ে যান ।
—ওটা হরিচরণ দত্ত নামে একজন জমিদারের বাগানবাড়ি ছিল, দিনাজপুর না মালদা কোথাকার জমিদার-জোতদার , অনেক জমিজমার মালিক ; সে বাইজি নাচাত বাড়িটায়, হিন্দুস্তানি বাইজিরা সারা রাত নাচত ওই বাড়িতে ; ওই বাড়ির ভেতরে গেলে মেয়েদের কিমারীত্ব সঙ্গে-সঙ্গে নষ্ট হয়ে যায় বলে শুনেছি । অন্য বৃদ্ধ, যাঁর চুল কাটানো হয়ে গিয়েছিল, জামা থেকে চুল ঝাড়তে-ঝাড়তে বলল।
—ওনার কি কেউ ছিল সন্তান ? জানতে চাইল রিমা । যে বহুবার ঢুকেছে বাড়িটায় আর এখনও যার কুমারীত্ব, পুরুষের বা লেসবিয়ানের দ্বারা ভাঙেনি; ওর নিজের মতে ইনট্যাক্ট — ম্যাস্টারবেশানে যদি কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে থাকে তাহলে কোনো তরুণীই কুমারী আর কোনো যুবকই কুমার থাকে বলে মনে হয় না । তেনশান কমাতে ও মাঝে-মধ্যে ম্যাস্টারবেট করে ।
আয়নার দিকে তাকিয়ে, নিজেকে চোখ দিয়ে আদর করতে-করতে আর চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে বৃদ্ধ বলল, তা জানি না, আমি তখন শহরের দক্ষিণে থাকতুম । মেসো ওনার বাড়িটা আমাকে লিখে দেবার পর গেল বছর এ-পাড়ায় এসেছি । তা তোমাকে তো চেনা-চেনা মনে হচ্ছে গো, কোথায় দেখেছি যেন ?
খগেন বলল, ইনি রিমা খান , বিখ্যাত পুলিস অফিসার , সাদা পোশাকে বলে চিনতে পারছেন না ; রিমাদি একবার উর্দি পরলে ওনার রোয়াব দেখে কে ? কোথায় দেখেছেন জানেন ? টিভিতে আর খবরের কাগজে , ওনার বিষয়ে রসালো সব গপ্পো বেরিয়েছিল গত বছর । টিভিতে চ্যাংড়ারা ওনার নাম দিয়েছিল….
—নোংরা পরি । খগেনের কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল রিমা ।
—ও, তুমিই সেই পুলিসনি ; তুমি তো বিখ্যাত মহিলা গো ; তা লোকটা কি সত্যই লক আপে মরেছিল , না আগেই মরে গিসলো ? যে বৃদ্ধর দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছিল খগেনের কর্মী রেজাউল, জানতে চাইল সেই বৃদ্ধ ।
—না, পিটিয়ে মেরে দিয়েছিলুম ; আর খভাতি জিনিসটা অন্যলোকে দেয় না স্যার , পাবলিকও দেয় না, ওটা আত্মআবিষ্কারের ব্যাপার , নিজেকে খুঁজে পাবার রহস্য , বুঝলেন দাদু । খ্যাতি জন্মায় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থেকে । নিজের ভেতরকার উদ্বেগ-উৎকন্ঠা , সাংসারিক দুশ্চিন্তা নয় , ঘাড় ঘুরিয়ে বলল রিমা ।
—আরে কি আবোল-তাবোল বকছ রিমাদি , পাবলিক ভাববে তুমিও থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাও । বলে উঠল রেজাউল । যার চুল কাটছিল, আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকে বলল, গুণ্ডাটা অন্য একটা লোককে খুন করে তাকে নিজেরই নাম দিয়ে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল , আর তারপর মরা লোকটার আত্মপরিচয় নিয়ে দিব্বি কুকম্মো করে বেড়াচ্ছিল । রিমাদিই তো ধরেছিলেন ব্যাটাকে ; এখন তার মুখ থেকে তার অপরাধ না জানতে পারলে ঘুণ্ডাটা তো সারাজীবন ওই মরা লোকটার নামে নিজেকে চালাত, খুন করেও পার পেয়ে যেত । টিভিঅলারা পাবলিককে বুঝিয়েছিল যে শ্মশানে যে গুণ্ডাটা পুড়েছে সেটাকে রিমাদিই মেরে ফেলেছিলেন ।
রিমা গম্ভীর কন্ঠে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, যে ক্রিমিনালরা জেরা করার সময়ে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের দু-ডিগ্রি ঠ্যাঙাই, যারা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের থার্ড ডিগ্রি ঠ্যাঙাই । যারা আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের ঠেঙিয়ে কথা আদায় করি না , আমার সাবইন্সপেক্টারের ওপর ছেড়ে দিই মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলার জন্যে । এক ডিগ্রি বলে কোনো ঠ্যাঙানি হয় না ।
—কি বলছ রিমাদি , দেখছ বয়স্ক লোক এখানে , বলল খগেন ।
রিমা মুচকি হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বলল, এতে লুকোবার কি আছে ! তুইওতো চুল কাটতে-কাটতে আমার বুকের খাঁজ দেখছিলি, আয়নায় তোর কিত্তি দেখা যাচ্ছিল রে । পুরুষরা যুবতীদের দেখার সময়ে সবচেয়ে প্রথমে বুকের দিকে তাকায় , সেটাই স্বাভাবিক, মাদার-সান ইন্সটিংকট, মানে মা-ছেলে সম্পর্কের চেতনা । যে-ক্রিমিনালরা বুকের দিকে তাকায় , বুঝতে হবে ব্যাটা ততো বজ্জাত নয় ; আর আমার বুক নকল নয়, সিলিকন-পোরা নয়; কোনো প্রেমিকও ছিল না কস্মিনকালে যে তার ছোঁয়ায় ফুলে উঠেছে আজকালকার খুকিগুলোর মতন ।
—একেই বলে মডার্ন মেয়ে , এক বৃদ্ধ আরেক বৃদ্ধকে বলল, পার্স থেকে টাকা বের করে । দুজন বৃদ্ধই সারা মুখে খাঁটি ওথলানো-বুক দেখার আনন্দ ফুটিয়ে বেরিয়ে গেল সেলুন থেকে । বাইরে বেরিয়ে একজন আরেকজনকে বলল, এবার থেকে কালো চশমা পরতে হবে বুঝলে । আমিও মেয়েদের দিকে তাকালেই সবচে আগে বুকের দিকে তাকাই । ছুঁচলো-ছুঁচলো বডিস পরে ঘোরে, দেখেছেন, কচি-কচি মেয়েরাও । চোখের এমন অভ্যাস হয়ে গেছে ইসকুলে পড়ার সময় থেকে যে মন না চাইলেও চোখ চেয়ে ফ্যালে ।
অন্য বৃদ্ধ বলল, আজগাল বাংলা ফিলিমেও তো নায়িকারা বুকের খাঁজ দেখিয়ে নাচে । যাদের ভগবানের দেয়া খাঁজ নেই তারা বিদেশে গিয়ে শল্যচিকিৎসা করিয়ে নকল খাঁজ বানিয়ে আনে । কীই বা করবে বলুন , প্রতিযোগীতার বাজার ; নজর কাড়তে হলে করতেই হবে । তবে এখনকার মেয়েদের খাঁজগুলো বেশ মিষ্টি । উদারীকরণের মিষ্টতা ।
রেজাউলের দিকে তাকিয়ে খগেন বলল, রিমাদিও ক্যারাটে জানেন , একাই যে-কোনো লোককে পেড়ে ফেলতে পারেন ।
—উঁহু উঁহু, বাধা দিয়ে বলল রিমা , ক্যারাটে নয়, আমি যেটা শিখেছি তার নাম এসক্রিমা , ফিলিপাইনসের আত্মরক্ষার টাকনিক । চিরুনি , কলম, খবরের কাগজ, চটি, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই আত্মরক্ষা করা যায় , আবার ধরেও ফেলা যায় আসামিকে, কোনো শারীরিক আঘাত না করে । সাবইন্সপেক্টার থাকার সময়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিল রাধিকা শেখের ন্যাশানাল স্কুল অব কমব্যাট আর্টে , মুম্বাইয়ের ওরলিতে । বোরখা-পরা মেয়েরাও শেখে, বোরখা না খুলেই আত্মরক্ষা আর আক্রমণের টেকনিক শেখে। রাধিকা ম্যাডাম নিজে বোরখা পরে ডিমন্সট্রেট করতেন । এসক্রিমা শিক্ষার স্লোগান ছিল, ‘সাপকে না মেরে তার বিষদাঁত খুলে নাও ‘।
—এসক্রিমা ! তুমি তো পেঁদিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দাও । হাঃ হাঃ । এবার বলো , কেসখানা কি ? রিমা চেয়ার থেকে নামলে টাকা নিয়ে পকেটে রেখে জিগ্যেস করল খগেন ।
—ওই বাঙলোবাড়িটায়, পাঁচ বছর আগে, যিনি সে-সময়ের থানা ইনচার্জ ছিলেন , তিনি ভিন্নসূত্রে সেখানে একটা কংকাল আবিষ্কার করেছিলেন । কংকালটা বিছানায় আধশোয়া হয়ে পড়েছিল আর তার পাশে মেঝের ওপর একটা কুকুরের কংকাল । মানুষের কংকালটা যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে , কুকুরের কংকালটা উনি মালখানায় রাখিয়ে দিয়েছিলেন । এখন আমাকে দাবিত্ব দেয়া হয়েছে কংকালটা খুন হয়েছিল নাকি আত্মহত্যা করেছিল তা অনুসন্ধান করে বের করতে । খুন হয়ে থাকলে খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে , আর আত্মহত্যা হলে যে দায়ি তাকে বের করতে হবে । তোকে একদিন নিয়ে যাব, বলল রিমা ।
—না না না না , শেষে মরি আর কি , আমার খুব ভুতের ভয় । আঁৎকে উঠে, হেঁচকি তুলে, খগেনের কন্ঠ থেকে দ্রুত কথাগুলো বেরোল । তারপর, রিমা, সাহায্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারে আশঙ্কায় বলল, এই কেসের জন্যে অন্য কি কাজে লাগতে পারি তা বলো ।
নিজের ভাবনা খগেনকে দিয়ে ভাবাবার উদ্দেশে রিমা ওকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা, কংকাল বললেই তোর মনে কোনো মানুষের ছবি তৈরি হয় কি ? মহিলা না পুরুষের ? আমি তো কেসটা নেয়া অব্দি কুকুরের কংকালের জায়গায় কুকুরটার একটুখানি , শাদা-কালো চামড়ার ছিল বলে, মনের মধ্যে কুকুরের ছবি তৈরি করে নিতে পারছি, কিন্তু কংকাল শুনলে, দেখার পরও, বুঝতে পারছি না, লোকটাকে কেমন দেখতে ছিল ।
রেজাউল জ্ঞানীর ঢঙে বলল, ঠিকই বলেছেন রিমাদি, কংকাল বললে মনে হয় কংকাল জিনিসটা আলাদা আর মানুষ জিনিসটা তার থেকে আলাদা । অথচ কুকুরের কংকাল আর কুকুর যেন একই ব্যাপার । তাই তো বলে, যে, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই ।
সেলুন থেকে বেরিয়ে, মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে রিমা বলল, যাই, মা কিছু আইডিয়া দিয়েছে, সেই দিক দিয়ে এগোই । তোরা থুথ্থুরে বুড়োরা চুল কাটাতে এলে তাদের কাছ থেকে বাঙলোবাড়ির খবর-টবর পেলে যোগাড় করে রাখিস ; আগামি সোমবার আসব ।’
তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, মাসিমা ! পুলিসের মা তো !
রেজাউল বলল, আপনার বাবাও পুলিসে ছিলেন , তাই উনিও কেসের ব্যাপার শুনে-শুনে খুনি ধরার ফাঁদগুলো জেনে ফেলেছেন ।
রিমার সুজুকি হায়াবুসা লাল-কালো মোটর সাইকেলের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে রেজাউল স্বগতোক্তি করল, মহিলা বটে একখানা , নিজের মাইয়ের কথা আমাদের খোলাখুলি বলছে , বুড়োগুনোও শুনছে তাতেও পরোয়া নেই, ওফ ।
শুনে, খগেন মুচকি হাসি দিয়ে, যে হাসির মানে, হেঃ হেঃ, আমি অনেক-কাল থেকে রিমাদির চুল কাটছি , কলেজে পড়ার সময় থেকে, রিমাদির বয়-কাট, সেই থেকে বিউটি পারলারে যায় না ।
রেজাউল ভুরু কুঁচকে বলল, তুই অমন হাসছিস যে ? ভুল বলেছি ? মাইয়ের সাইজ দেখেছিস ? টুসকি মারলে টন-টন শন্দ উঠবে । শুধু মাই ? রিমাদির রঙও কত ফর্সা অথচ ওনার মা অত ফর্সা নয় । রিমাদি বোধহয় নিজগুণে ফর্সা।
—আসলি জিনিস । খগেন সবজান্তার হাসি মুখময় ছড়িয়ে বলল, চুল কাটতে-কাটতে দেখে ফেলি, ওফ, ভেতরে পরেও না কিছু, গুঁড়ো-গুঁড়ো পাউডার লেগে থাকে ; ওই কাপসাইজের হয় না বোধহয় বাজারের বডিস !
পিনাকি, যে এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি, বলল, হবে না কেন, বিলেতে তো কতো বড়ো বড়ো মাই হয় , ইংরিজি ফিলিমগুলোয় দেখিসনি ? কি এক-একখানা বুক, প্রাণ জুড়িয়ে যায় । তারপর যোগ করল , এতক্ষণ তোদের মুখে রা ফোটেনি , যেই রিমা খান গেল ওমনি তোদের পোঁদে খই ফুটছে । রিমাদি তোদের দুজনের চেয়েও লম্বা , এমন একখানা লাথি দেবে না, যে বংশের সম্পত্তি ফেটে নকশালবাঁড়া বেরিয়ে যাবে । রিমাদি পুলিসে ঢুকতে গেল কেন কে জানে , অমন ভালো ফিগার, দেখতে-শুনতে ভাল, গলার স্বরও মিষ্টি, পাতলা ঠোঁট, ফিলিমে যেতে হলে যা-যা দরকার ।
রেজাউল বলল, ওনার সামনে ওনার বিষয়ে মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলে পোঁদের চামড়া খুলে নেবে । যে-সে পুলিস নয় চাঁদু, প্যাঁদাতে ওনার জুড়ি নেই ; যে এলাকায় ওনার পোস্টিং হয় , সেখানের গুণ্ডারা সে এলাকা থেকে পালায় ; নেতাদের কথাও শোনেন না । নেতার টিভি চ্যানেলেই তো ওনাকে নোংরা পরি নাম দিয়েছে । চ্যানেলটা নাকি ওনাকে সাবানের মডেল হতে বলেছিল । সাবানের মডেল হলে দারুণ হতো , ওফ, শাওয়ারের তলায় খালি গায়ে রিমাদি, পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ভাবতেও ভাল্লাগে শালা ।
বাঙলোবাড়িটার দু-কিলোমিটারের মধ্যে যে ডাকতাররা আছে , ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে-নিয়ে তাদের একটা তালিকা আড়াই দিনে তৈরি করল রিমা । ওষুধের দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে মোটর সাইকেলে ঘুরে-ঘুরে তাদের চেম্বারগুলো কোথায় তা টুকে রাখল নিজের ডায়রিতে । বাঙলোবাড়ি থেকে যে-সমস্ত সামগ্রী প্রথম ও দ্বিতীয় ইনভেসটিগেটিং অফিসাররা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, তা থেকে জানা যায়নি যে মৃত ব্যক্তির কোনো ডাকতার ছিল কিনা । ওষুধের শিশি বা বড়ির কভার বা প্রেসক্রিপশান কিছুই পাননি তাঁরা । যা জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, আর যা-যা পাওয়া উচিত ছিল অথচ পাওয়া যায়নি, রিমার অনুমান, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় । হয় আত্মহত্যা নতুবা হত্যা । কংকাল প্রেমিক যাকে শেষনি বলে উল্লেখ করেছে সে আদপে ডাকতার না নার্স না সহায়ক স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে না । কংকালটা সব ব্যাপারে এমন হেঁয়ালি করেছে যে মনে হয় খুন হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল ।
প্রশ্ন হল মোটিভ কী ? রিমা নিজেকে প্রশ্ন করল, মোটিভ কী ? কেউ খুন করে থাকলে সে কী জন্যে খুন করেছে ? বাড়িটা তো পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর যাবত যেমনকার তেমন । সম্পত্তির জন্যে হলে সবচেয়ে আগে তো খুনি অতবড় বাড়িটাই হাতাত— কংকাল প্রেমিককে বাগানে পুঁতে দিলেই ব্যাস নিশ্চিন্ত । বাড়ির ভেতরেও দামি আসবাব তছনছ করা হয়নি । দামি-দামি কিউরিওগুলোতেও হাত দেয়নি কেউ । সরানো হয়ে থাকতে পারে নিবেশের কাগজপত্রগুলো ; আবার কংকালটা নিজেই সেসব ভাঙিয়ে ফেলে থাকতে পারে মরবার আগে । বাড়ির মধ্যেকার সাজানো গোছানো জিনিসপত্র দেখে মনে হয় , লোকটা, মারা যাবার সময়ে যেমন ছিল, তেমনই পড়ে আছে । তাহলে ?
ডিজিকে অনুরোধ করে কালকেই একজন বিশেষজ্ঞ ডাকতারকে নিয়ে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করবে, ঠিক করল রিমা, বিশেষজ্ঞ ডাকতারের মতামত নিয়ে নিশ্চিত হবে যে ঠিক কী কারণে মারা গেল কংকালটা ।
অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল । রিমা বাঙলোবাড়িটায় পৌঁছে, মোটর সাইকেলের আলো বাড়িটার বাগানের দিকে ফোকাস করে ঢুকলো । বেশ কিছুক্ষণ বাগানের আগাছা সরিয়ে ঘুরে-ঘুরে মাটিতে দেখতে লাগল সূক্ষ্ম কিছু পাওয়া যায় কিনা, যা দিনের আলোয় পায়নি । কয়েকটা মরা পিঁপড়ে দেখতে পেয়ে খুঁটে-খুঁটে তুলে বারবার শুঁকলো , পকেট থেকে রুমাল বের করে মুড়ে রাখল তাতে । ওর মনে হল এগুলো কাঠপিঁপড়ে । মোটর সাইকেলে বসে একটা সিগারেট শেষ করার পর ফরেনসিক ল্যাবের পথা রওনা হল ।
ফরেনসিক অ্যানালিস্ট রুচিষ্মিতা ঘোষ তখনও ছিলেন ল্যাবে । টেবিলে রাখা কোনো জিনিস খুঁটিয়ে দেখছিলেন, সাদা চোখেই । রিমাকে দেখে বললেন , কি রিমা, কিছু পেলেন ? আপনি তো কেসটা নেয়া অব্দি হাওয়ায় ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বলে শুনেছি ; এখনও নাকি নিশ্চিত হতে পারেননি যে খুন না আত্মহত্যা ।
রিমা রুমালে-মোড়া পিঁপড়েগুলো টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিল , রুচিষ্মিতা উঁহু উঁহু করে একটা ছোট্টো কাচের পাত্র এগিয়ে দিলেন । রিমার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, সন্দেহটা কি ?
—গন্ধ থেকে মনে হল পেস্টিসাইড । এতকাল পরও পেস্টিসাইডের গন্ধ রয়ে গেছে , বেশ স্ট্রং কোনো কেমিকাল, কিংবা প্রায়ই পেস্টিসাইড ছড়ানো হচ্ছে । আমার তিনটি জিজ্ঞাস্য । প্রথম, পেস্টিসাইডটা কি ? দ্বিতীয়, কতদিন আগে ছড়ানো হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান । তৃতীয়, পিঁপড়েগুলো কোন জাতের ?
—দারুণ । প্রথম দুটির উত্তর আমি তৈরি করে রাখব । তৃতীয়টার জন্য আপনি রাজ্যের এনটোমলোজিস্টকে অনুরোধ করুন । তবে প্রথম দর্শনে পিঁপড়েগুলোকে ডরিলাস প্রজাতির মনে হচ্ছে । যাহোক, পথ খুঁজে পেয়েছেন দেখছি । পরশু বিকালে ফোন করবেন । জানতে পারি কি যে এখান থেকে কি ভাবে এগোবেন ?
—মোটিভ, মোটিভ । মোটিভটা পাচ্ছি না । একটা বাচ্চা মেয়েকে পিঁপড়ের ঝাঁক আক্রমণ করেছিল বাঙলোবাড়ির বাইরে , পাঁচ বছর আগে । বাঙলোর ভেতরে সেই পিঁপড়েগুলো যদি এখনও থেকে থাকে, তাদের গায়ে পেস্টিসাইডের গন্ধ থাকবে নাকি !
—না থাকবে না । গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্তে পাঁচ বছর আগের সেসব পিঁপড়েদের মৃতদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়াই স্বাভাবিক ।
—তার মানে, কেউ পেস্টিসাইড রেগুলারলি স্প্রে করাচ্ছে বা সম্প্রতি করিয়েছে ।
—কোনো কন্সটেবলকে লক্ষ রাখতে বলুন না, রাতের বেলায় ।
—আমার তো হিউমান রিসোর্স নেই । জানেন তো, নিলম্বিত, আই মিন সাসপেন্ডেড । একজন সাবইন্সপেক্টার পেয়েছি , তাকে আর কত খাটাব । দেখি আমার কয়েকজন প্রাইভেট শিষ্য আছে , তাদের বলে দেখব । আপনার কাছ থেকে স্প্রে করানোর ফ্রিকোয়েন্সি জানতে পারলে সুবিধা হবে ।
ল্যাবের টয়লেটে গিয়ে রিমা ঠোঁতের ওপর ফিকে গোলাপি লিপ্সটিক বোলালো । নিজেকে ও ভালোবাসে । আয়নায় মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে নানা দিক থেকে দেখে সন্তুষ্ট হল । অ্যাট্র্যাকটিভ লেডি, বলল আয়নার দিকে প্রতিফলিত নিজেকে, অ্যান্ড রুথলেস টু ।