২. মনীষীদের দৃষ্টিতে ও ব্যবহারে গীতা

মনীষীদের দৃষ্টিতে ও ব্যবহারে গীতা

গীতা ও রামমোহন

রামমোহন রায়ের নাম বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণ পর্বের সঙ্গে যুক্ত। অক্লান্তকর্মী এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। আপাতত আমরা তাঁর একটি বিশেষ সামাজিক কর্মকেই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করব-সতীদাহ প্রথা নিবারণে রামমোহনের ভূমিকা। বিধবাবিবাহকে আইনানুগ করার ক্ষেত্রে পুণ্যশ্লোক পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকার সঙ্গেই সতীদাহ প্রথা নিবারণে রামমোহনের ভূমিকা স্মর্তব্য, তুলনীয়। বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন :

he utilized the upanishads and the Bhagavad Gita to derive support for his reformist ideas.

রামমোহনের গীতা নির্ভরতা প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত করে বলা হল :

Roy was able to score victory over the Suttee-advocates were based mainly on the teachings of the Bhagavad Gita.

আমরা জানি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গীতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির মত বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবীরা গীতা পাঠ করতেন, গোপনীয়তা রক্ষায় কিংবা মাতৃভূমির দাসত্বের শৃঙ্খল মোচনকল্পে অঙ্গীকারবদ্ধ হতেন গীতা হাতে নিয়ে, এমনকি জীবনপণ সংগ্রামের বাক্য উচ্চারণ করতেন গীতাকে সাক্ষী মেনে। আর যাঁরা অহিংস উপায়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পরিচালিত করেছিলেন তাঁদেরও অনেকেই গীতা থেকে প্রেরণা নিয়েছেন, বিশেষত গীতার কর্মযোগ থেকে। ঋষি অরবিন্দ, বালগঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধী, বিনোবা ভাবে, এ্যানি বেসান্ত, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী এবং অন্যান্যরা গীতাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিতেন, গীতার আদর্শকে এঁরা জীবনের আদর্শ করে নিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে গীতার গ্রহণযোগ্যতা পরিলক্ষিত হল রামমোহনের মাধ্যমে।

অন্য এক বিশ্লেষকের মন্তব্য প্রসঙ্গত স্মর্তব্য : ইনি মন্তব্য করেছেন রামমোহনের সুবাদেই আধুনিক ভারতীয় রাজনীতিতে গীতার প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে।

এক্ষেত্রে রাজনীতি বলতে সামাজিক প্রসঙ্গকে বুঝতে হবে। একটি ক্ষেত্রে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি তথা ভূমিকা গ্রহণে আমরা ঐক্যের সন্ধান পাই। এদেশের মানুষ প্রাচীন সংস্কারে লালিত, যুক্তির তুলনায় বিশ্বাসের গুরুত্ব এ দেশের মানুষের মজ্জাগত। ধর্মীয় বিশ্বাসকে এদেশের মানুষ সবার উপরে স্থান দেন। যুক্তিরও ওপরে। তাই যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগরকে বিধবাবিবাহ আইনকে আইনানুগ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শাস্ত্রীয় অনুমোদনের সন্ধান করতে হয়েছিল। তিনি লাভও করেছিলেন। পরাশরসংহিতা থেকে বহু অভিলষিত শ্লোকটির সন্ধান পেয়ে একেই অমোঘ অস্ত্র করে সমগ্র যুক্তিহীন সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। রামমোহনও সতীদাহ প্রথা নিবারণে সহায়তা নিলেন ভাগবতগীতার। ভারতবাসীর অন্তরে গীতার স্থান। ভারতীয় হিন্দু গীতাকে সর্বোত্তম সম্মান দিয়ে থাকে। সেই কারণেই সতীদাহ প্রথার মত অমানবিক প্রথা রদে গীতার সহায়তা নিলেন। এক্ষেত্রে তিনি চরম বাস্তববাদীর ভূমিকা পালন করেছিলেন স্বীকার করতে হয়।

গীতার পাঁচটি অধ্যায় থেকে রামমোহন তাঁর শাস্ত্রীয় যুক্তির রসদ সংগ্রহ করলেন। লক্ষণীয় এইসব শ্লোকগুলির ইংরেজি অনুবাদ স্বয়ং রামমোহনের করা। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ যেটি রামমোহন-কৃত সেটি হল এইরকম—

i. ‘O Arjuna, rites performed for the sake of fruition are degraded far below works done without desire, which lead to the aquisition of the knowledge of God. Therefore perform thy works without desire of fruition, with the view of acquiring divine knowledge. Those who perform works for the sake of fruition are most debased.’

ii. তৃতীয় অধ্যায়ের ৯ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদটি এইরকম—Works performed, except for the sake of God, only entangle the soul. Therefore, O Arjuna, for sake desire, perfrom works with the view to please God.

iii. পঞ্চম অধ্যায়ের ১২ সংখ্যক শ্লোকের অনুবাদ—The person who performs works without desire of fruition, directing his mind to God, obtains eternal rest. And the person who is devoted to fruition and performs works with desire he is indeed inextricably involved.

iv. দ্বাদশ অধ্যায় অর্থাৎ ভক্তিযোগের ১০ম ও ১১শ সংখ্যক শ্লোকদ্বয়ের অনুবাদ—If you are unable to acquire by degrees divine knowledge, be diligent in performing works with a view to please Me, that by such works you may acquire a better state. If you are unable even to perform rites solely for my sake, then controlling your senses, endeavour to perform rites without the desire of fruition.

v. গীতার শেষ অর্থাৎ অষ্টাদশ অধ্যায়ের ৬ষ্ঠ শ্লোক—It is my firm opinion that works are to be performed forsaking their consequences and the prospect of their fruits.

উদ্ধৃত অনুবাদগুলির সারমর্ম হল—

ক. কোনো ফলের আশা না করে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।

খ. যে কাজই করা হোক, তা করতে হবে একমাত্র ঈশ্বরের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য।

গ. যে ব্যক্তি আসক্তিপূর্ণ হয়ে কাজ করে, সেঅধিকতর বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে।

ঘ. আসক্তিশূন্য হয়ে কাজ করলে ভগবৎ জ্ঞান অর্জিত হয়।

ঙ. পরিণতির কথা না ভেবেই কাজ করে যেতে হবে।

এটা ঠিক যে, রামমোহন সতীদাহ প্রথা রদের ক্ষেত্রে দার্শনিক বিতর্কের অবতারণা করেছিলেন উপনিষদকে আশ্রয় করে কিন্তু তৎসহ তিনি সহায়তা নিয়েছিলেন গীতোক্ত উপদেশের। রামমোহনের অভিযোগ ছিল বল- প্রয়োগে সতীদাহ আসলে নারীহত্যা। গীতার উল্লেখে রামমোহন প্রমাণে সচেষ্ট হলেন যে, লোকাচারের তুলনায় আধ্যাত্মিকতার স্থান উচ্চে। রামমোহন গীতার শ্লোকের উল্লেখে ব্যাখ্যা করলেন বৈদিক আচার আধ্যাত্মিকতার পথের অন্তরায়। সতীদাহ প্রথায় বিশ্বাসীদের প্রসঙ্গত রাজা রামমোহন স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, হিন্দুদের কাছে পবিত্রতম গ্রন্থই হল গীতা, গীতা সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য। বিরুদ্ধবাদীরাও স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, ফলের আশায় সম্পাদিত কাজের তুলনায় বাসনাহীন কাজই শ্রেয়ঃ। কর্ম এবং কর্মযোগের পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন রামমোহন। কর্মকান্ডের সুবাদে একজনের স্বর্গবাস সীমাবদ্ধ কালের জন্য।

লোকাচার পালনকারীদের তাদের পুরস্কারপ্রাপ্তির শেষে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। ফলে পুরস্কারের লোভে কৃত কর্মাদির কারণে মানুষকে বারংবার স্বর্গ-মর্ত্য করতে হয়।

রামমোহন জানালেন, পুরুষের মত নারীরও আধ্যাত্মিকতার জগতে উত্তরণ ঘটে। বিধবারা পবিত্র জীবন যাপন করে, আসক্তিহীন ভাবে কর্ম সম্পাদন করে তাদের মানসিক পবিত্রতাকে ত্রুটি মুক্ত করতে পারে এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম।

সতী হওয়ার পেছনে দুটি বাসনা ক্রিয়াশীল থাকে। এক স্বর্গলাভ, দুই প্রয়াত পতির সঙ্গে পুনর্মিলন। দুটির সঙ্গেই বাসনা বা আসক্তির সম্পর্ক যুক্ত। অতএব গীতার প্রেক্ষিতে সতী হওয়া অর্থহীন প্রয়াস মাত্র।

গবেষক যথার্থই মন্তব্য করেছেন :

The Bhagavad Gita provided the strongest support to Rammohan Roy when he argued the case for suttee abolition to convince the orthodox scholars of the Hindu community.

সত্য পি আগরওয়াল আরও মন্তব্য করেছেন :

Utilizing this basic teaching of the Bhagavad Gita, Rammohon Roy was able to point out how the Suttee-advocates had imposed false values on the society by declaring a Suttee to be spirituality superior to a widow.

গীতা : শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে

ভক্তিযোগে সব পাওয়া যায়। আমি মার কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম :

মা, যোগীরা যোগ করে যা জেনেছে, জ্ঞানীরা বিচার করে যা জেনেছে—আমায় জানিয়ে দাও—আমায় দেখিয়ে দাও।

মা আমায় সব দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্যাকুল হয়ে তাঁর কাছে কাঁদলে তিনি সব জানিয়ে দেন। বেদ, বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্র—এসব শাস্ত্রে কি আছে; সব তিনি আমায় জানিয়ে দিয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত; ৪র্থ ভাগ; নবম পুনর্মুদ্রণ, ১৩৮৩, পৃ-১৮০

আমরা জানি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তথাকথিত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, প্রথাবদ্ধ শিক্ষা তাঁর হয় নি। অথচ অনায়াসে অবলীলাক্রমে তিনি সাধক, পন্ডিত, জ্ঞানীদের সঙ্গে শাস্ত্রের বিভিন্ন দুরূহ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, ভক্ত-শিষ্যদের সদা-সর্বদা নানা উপদেশাদিতেও তাঁর বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তির সন্ধান মেলে। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, এসব দুরূহ বেদ-বেদান্ত, পুরাণ, তন্ত্রাদির অন্দরমহলের কথা তাঁর মত প্রায় নিরক্ষর মানুষটি জানলেন কী করে? এ ব্যাপারে ঠাকুরের বক্তব্য, সব তিনি জেনেছেন তাঁর পরমারাধ্যা মায়ের কাছে। শিশুর প্রথম শিক্ষা হয় তাঁর জননীর কাছে, গর্ভধারিণীর কাছে, ঠাকুরের শাস্ত্রীয় শিক্ষা হয়েছিল জগজ্জননীর কাছে—মা ভবতারিণীর কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ—একখানি পুস্তকও সঙ্গে থাকবে না। যেমন, শুকদেব—তাঁর সব মুখে। ঠাকুরের ক্ষেত্রেও ত সেই একই বক্তব্য। কথামৃতকার সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শুকদেবাদির নাম করিয়া ঠাকুর কি নিজের অবস্থা ইঙ্গিত করিয়া বুঝাইতেছেন?’

ঠাকুর রামকৃষ্ণের গীতার প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থা। তাঁর বহু উপদেশই গীতার শ্লোকাশ্রিত। গীতাকে ঠাকুর কী দৃষ্টিতে দেখতেন আগে দেখে নেওয়া যাক—‘গীতা সব শাস্ত্রের সার’। ঠাকুর বললেন, ‘সন্ন্যাসীর কাছে আর কিছু না থাকে, গীতা একখানি ছোট থাকবে।’ ঠাকুর কর্মযোগের ব্যাখ্যা করেছেন বারংবার। পরামর্শ দিয়েছেন কর্মযোগকে আশ্রয় করার। কিন্তু তাই বলে গীতায় কথিত জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ সম্পর্কেও ঠাকুর নীরবতা অবলম্বন করেন নি। কর্মযোগের তুলনায় জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ কম শোনা গেছে তাঁর কন্ঠে। এ সত্য স্বীকার করে নিয়ে প্রথমে তিনি জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ নিয়ে কী বলেছেন একটু দেখে নেব।

ক. ভক্তিযোগ জ্ঞানযোগ সবই পথ। যে পথ দিয়েই যাও তাঁকে পাবে। ভক্তির পথ সহজ পথ। জ্ঞান বিচারের পথ কঠিন পথ . . . .।

—কথামৃত। ৩য় ভাগ। ১৩৮১। পৃ-৮২

খ. জ্ঞানচর্চা ছাড়—ভক্তি নাও—ভক্তিই সার!

গ. জ্ঞান সদর মহল পর্যন্ত যেতে পারে। ভক্তি অন্দরমহলে যায়।

—কথামৃত। ৩য় ভাগ। ১৩৮১। পৃ-১২০

ঘ. ভক্তিযোগে সব পাওয়া যায়। আমি মার কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম :

মা যোগীরা যোগ করে যা জেনেছে, জ্ঞানীরা বিচার করে যা জেনেছে—আমায় জানিয়ে দাও—আমায় দেখিয়ে দাও। মা আমায় সব দেখিয়ে দিয়েছেন।

—রামকৃষ্ণ কথামৃত । ৪র্থ ভাগ। নবম পুনর্মুদ্রণ, ১৩৮৩, পৃ-১৮০

ঙ. কলিযুগে ভক্তিযোগ, ভগবানের নাম গুণগান আর প্রার্থনা। ভক্তিযোগই যুগধর্ম।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-৫১

চ. . . . . ওকে বিচারপথ বলে—জ্ঞানযোগ বলে। ও পথেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-২১৬

ছ. ভক্তিপথেও তাঁকে পাওয়া যায়।যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে একবার ভক্তি হয়, যদি তাঁর নামগুণগান করতে ভাল লাগে, তাহলে ইন্দ্রিয়সংযম আর চেষ্টা করে করতে হয় না।

এখানে জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ সম্পর্কে ঠাকুরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে করা কয়েকটি মন্তব্য উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সাতটি মন্তব্যের অনেকগুলিতেই ভক্তিপথেরই জয়জয়কার। এমন কথাও বলেছেন ঠাকুর, কলিযুগে ভক্তিপথই একমাত্র অবলম্বন। আরও বলেছেন, জ্ঞানচর্চার তুলনায় ভক্তিপথ সহজতর। শুধু তাই নয় অন্দরমহলে প্রবেশের ক্ষেত্রেও ভক্তিপথ অনেকখানি সহায়ক। স্পষ্টতই বোঝা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ জ্ঞানপথের তুলনায় ভক্তিযোগকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ঠাকুর নিজে ভক্তিমার্গের পথিক ছিলেন। এ সত্য সকলেরই জানা। কিন্তু লক্ষণীয় শিষ্য-ভক্তদের কাছে উপদেশ দানকালে তিনি বারংবার নিষ্কাম কর্মের প্রসঙ্গ তুলেছেন। নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে ঠাকুরের উক্তিগুলি প্রথমে জেনে নেওয়া যাক—

ক. কর্মকান্ড হচ্ছে আদিকান্ড। সত্ত্বগুণ (ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য, দয়া এইসব) না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-১২৬

খ. তবে কর্ম একেবারে ত্যাগ করার যো নাই। তোমার প্রকৃতিতে তোমায় কর্ম করাবে। তা তুমি ইচ্ছা কর আর নাই কর। তাই বলেছে অনাসক্ত হয়ে কর্ম কর। অনাসক্ত হয়ে কর্ম করো;— কিন্তু, কর্মের ফল আকাঙক্ষা করবে না।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-১২৭

গ. কর্ম ছাড়বার যো নেই। আমি চিন্তা করছি, আমি ধ্যান করছি, এও কর্ম।

—কথামৃত। ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-১২৭

ঘ. কর্ম চাই, তবে দর্শন হয়। . . . . কর্ম না করলে ভক্তিলাভ হয় না, ঈশ্বর দর্শন হয় না। ধ্যান, জপ এই সব কর্ম। তাঁর নাম গুণকীর্তনও কর্ম— আবার দান, যজ্ঞ এ সবও কর্ম।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-১৭০

ঙ. সকলেরই কর্ম করতে হবে।

—কথামৃত । ১ম ভাগ। ১৩৮২। পৃ-২৪৪

চ. সংসার কর্মভূমি। এখানে কর্ম করতে আসা। যেমন দেশে বাড়ী, কলকাতায় গিয়ে কর্ম করে।

—কথামৃত। ২য় ভাগ। ১৩৮২। পৃ-৩৭

ছ. নিষ্কাম কর্ম করা বড় কঠিন! তাই ভক্তিপথ আশ্রয় করতে বলেছে।

—কথামৃত। ২য় ভাগ। ১৩৮২। পৃ-১৭১

জ. গীতার কথা। কাটবার যো নাই। তবে আর একটি কথা আছে। শ্রীকৃষ্ণে ফল সমর্পণ বলেছে; শ্রীকৃষ্ণে ভক্তি বলে নাই।

—কথামৃত। ২য় ভাগ। ১৯৮২। পৃ-১৮৯

ঝ. তুমি যে সব কর্ম করছো, এসব সৎকর্ম। যদি ‘আমি কর্তা’ এই অহংকার ত্যাগ করে নিষ্কামভাবে করতে পারো, তাহলে খুব ভাল। এই নিষ্কাম কর্ম করতে করতে ঈশ্বরেতে ভালবাসা আসে। এইরূপ নিষ্কাম কর্ম করতে করতে ঈশ্বরলাভ হয়।

—কথামৃত। ৩য় ভাগ। ১৩৮১। পৃ-১৫

ঞ. নিষ্কামভাবে কর্ম করতে পারলে চিত্তশুদ্ধি হবে, ঈশ্বরের উপর তোমার ভালবাসা আসবে। ভালোবাসা এলেই তাঁকে লাভ করতে পারবে। জগতের উপকার মানুষে করে না। তিনিই করছেন . . . . যে লোক কামনাশূন্য হয়ে কর্ম করবে সেনিজের মঙ্গল করবে।

—কথামৃত। ৩য় ভাগ। ১৩৮১। পৃ-১৫

ট. কর্ম সকলেই করে—তাঁর নাম গুণগান করা এও কর্ম—সোhহংবাদীদের ‘আমিই সেই’ এই চিন্তাও কর্ম— নি:শ্বাস ফেলা এও কর্ম। কর্মত্যাগ করবার যো নাই। তাই কর্ম করবে,—কিন্তু ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করবে।

—কথামৃত। ৩য় ভাগ। ১৩৮১। পৃ-২০

ঠ. তিনি এমন প্রকৃতি তোমায় দিয়েছেন যে, তোমায় সংসারের কাজই করতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন—তুমি যুদ্ধ করবে না, কি বলছো?—তুমি ইচ্ছা করলেই যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হতে পারবে না, তোমার প্রকৃতিতে তোমায় যুদ্ধ করাবে।

—কথামৃত। ৪র্থ ভাগ। ১৩৮৩। পৃ-২৫

ড. কোনরকম করে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়ে থাকা। দুই পথ আছে—কর্মযোগ ও মনোযোগ। যারা আশ্রমে আছে, তাদের যোগ কর্মের দ্বারা। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস। . . . . দন্ডধারণ, ভিক্ষা করা, তীর্থ যাত্রা, পূজা, জপ এসব কর্মের দ্বারা তাঁর সঙ্গে যোগ হয়। আর যে কর্মই কর, ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে কামনাশূন্য হয়ে করতে পারলে তাঁর সঙ্গে যোগ হয়।

—কথামৃত । ৪র্থ ভাগ। ১৩৮৩। পৃ-১৮০

ঢ. কর্মযোগ বড় কঠিন। নিষ্কাম না করতে পারলে বন্ধনের কারণ হয়।

—কথামৃত। ৪র্থ ভাগ। ১৩৮৩। পৃ-১৮৮

এখানে কর্মযোগ সংক্রান্ত মোট তেরোটি মন্তব্য উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, সবক’টি মন্তব্যই ঠাকুরের। অনেকগুলিতেই বক্তব্য বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। এই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে এই কারণে যে, ঠাকুর ব্যক্তিবিশেষকে ত আর এইসব বক্তব্য বলেন, নি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে উপদেশ দান করতে গিয়ে এগুলি বলা। ফলতঃ সেই নিরিখে বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি দোষ ধরা পড়ে না। আমরা গীতার বক্তব্যের সঙ্গে ঠাকুরের বক্তব্যের মিল ও গরমিলের সন্ধান করার আগে সূত্রাকারে নিষ্কাম কর্ম সম্পর্কিত তাঁর ধারণাগুলিকে উল্লেখ করতে চাই—

i. নিষ্কাম কর্ম হল অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন।

ii. এটি অত্যন্ত দুরূহ, দুরূহ বলেই ঠাকুর ভক্তিপথকে আশ্রয় করার পক্ষপাতী।

iii. কর্ম সম্পাদন বাধ্যতামূলক এই সংসারে। একজন ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক যাই হোক না কেন, কর্ম করতে বাধ্য।

iv. আমরা কর্ম বলতে সীমিত অর্থে নির্বাচিত কিছু কর্মকেই বুঝে থাকি, কিন্তু ঠাকুর স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন নি:শ্বাস ত্যাগ, ঈশ্বরের নামগান করা, চিন্তা করা, ধ্যান করা এসবও কর্ম, আবার ভিক্ষা, তীর্থযাত্রা, দান, পূজা, যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান এসবও কর্ম।

v. কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হবে।

vi. আমাদের প্রকৃতিই আমাদের কর্মে সক্রিয় রেখেছে।

vii. কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে ভক্তিলাভ, ঈশ্বরে ভালবাসা আর ঈশ্বরে ভালবাসা থেকে ঈশ্বরদর্শন, ঈশ্বরলাভ সুনিশ্চিত হয়।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন :

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্মঃ সর্বঃ প্রকৃতিজৈগুণৈ:।। ৩/৫

কারো পক্ষেই মূহূর্তের জন্য নিষ্কর্মা হয়ে থাকা সম্ভব নয়, কেননা প্রকৃতিগত ভাবেই সকলে কর্ম করতে বাধ্য। ঠাকুরও ত’ ঠিক এই কথাই বলেছেন। বলেছেন প্রকৃতিগত ভাবেই আমরা কর্মব্যস্ত। ঠাকুর বারংবার ফলের কামনা ত্যাগ করে কর্ম সম্পাদনের কথা বলেছেন, গীতাতে বলা হয়েছে—

কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়।

এই হল বিখ্যাত নিষ্কাম কর্মতত্ত্ব। এখানে দুটি নির্দেশ স্পষ্ট—

i. কর্ম আমাদের জীবনের অনিবার্য নিয়ম, বলা যায়,

ii. Law of life নিষ্কাম হয়ে সম্পন্ন করা আবশ্যক। যখন ঠাকুর কর্মের নিদর্শন রূপে উল্লেখ করেন নি:শ্বাস ত্যাগ, চিন্তা করা, ধ্যান করার মত বিষয়গুলি, তখন বুঝতে বাকি থাকে না কেন গীতায় বলা হয়েছে এক মূহূর্তের জন্যও কারো পক্ষে নিষ্কর্মা জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। গীতার ৮ম শ্লোকে কথিত হয়েছে—

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ। শরীর যাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যে দ কর্মণঃ।।

নিয়ত কর্ম কর, বলা হয়েছে কর্ম অকর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ, অকর্মে শরীর যাত্রাও নির্বাহ হয় না। স্বভাব বা প্রকৃতির বশীভূত অশন, বসন, শয়ন, শ্বাস, প্রশ্বাস ব্যতিরেকে শরীর যাত্রা নির্বাহ হয় না, অতএব প্রকৃতিই আমাদের সক্রিয় রেখেছে—ঠাকুরের একথা এখানে স্বীকৃত।

মানুষ প্রকৃতিতে ভয়ঙ্কর রূপে বৈষয়িক। প্রতিটি ক্রিয়ার যেমন প্রতিক্রিয়া আছে, তেমনি মানুষ প্রতিটি কার্যের বিনিময়ে পরিণামে তার প্রত্যাশামত ফললাভে উৎসুক থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায় যে, পরীক্ষার্থী কঠিন পরিশ্রম করে পাঠ প্রস্তুত করল, রাত্রি জাগরণের ক্লেশ স্বীকার করল, নানা বিনোদন-প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল, সেকি চাইবে না তার পরিশ্রম অনুযায়ী সুফলের অধিকারী হতে? বস্তুতঃ প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ উপযুক্ত প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে মূলধন করেই কর্মে প্রবিষ্ট হয়। এইজন্যই ঠাকুর বলেছেন, নিষ্কাম হয়ে কর্ম সম্পাদন দুরূহ।

এখন প্রশ্ন, কেন নিষ্কাম হয়ে কর্ম সাধন :

কর্মের ফলই সুখ—যে অনুষ্ঠেয় কর্ম মুনিরাই করে সেতজ্জনিত সুখলাভও করে। যে কামনা বা স্পৃহার অধীন হইয়া কর্ম করে, সেসুখ লাভ করে না—কামনা ও স্পৃহা অননুষ্ঠেয় কর্মের, সুতরাং পাপের ও দুঃখের কারণ হইয়া থাকে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা ; বঙ্কিম রচনাবলী / ২য় খন্ড / সাহিত্য সংসদ, ১৩৭৬ / পৃ-৭৪২

আমরা এই বক্তব্যের সমর্থনে উদ্ধার করতে পারি ৭০ সংখ্যক শ্লোকটি—

আপূর্য্যমাণমচল প্রতিষ্ঠং

সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।

তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে

স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।। ২/৭০

পূর্যমাণ স্থিরপ্রতিষ্ঠ যে সমুদ্র সেখানে প্রবেশ করে নদীগুলি, তেমনি ভোগসকল যাতে প্রবেশ করে, তিনি লাভ করেন শান্তি, অপরপক্ষে যিনি ভোগসকলের কামনা করেন, তিনি পান না।

সমুদ্র কখনও জলের অন্বেষণ করে না, নদীগুলি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে নিজ নিজ জলভান্ডারসহ সমুদ্রে প্রবেশ করে সমুদ্রকে সমৃদ্ধ করে, পূর্ণতা দান করে। অনুরূপ ভাবে যিনি ইন্দ্রিয়সকল বশ করেছেন, ভোগ সব আপনা থেকেই তাঁকে আশ্রয় করে, এজন্য তিনি শান্তি লাভ করেন। বিপরীতক্রমে ইন্দ্রিয়তাড়িত যে কামনার বশীভূত কদাচ শান্তি লাভ করে না। এজন্যই কামনা পরিত্যাগকে কর্মফলজনিত সুখলাভের উপায় স্বরূপ বিবেচনা করা হয়েছে।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-গীতা বহির্ভূত দুটি বিষয়কে অবলম্বন করেছেন লক্ষিত হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার ব্যাপারে তিনি দুটি পথের কথা বলেছেন—একস্থানে কর্মযোগ আর মনোযোগ। গীতায় জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের কথা বলা হলেও মনোযোগের কথা বলা হয় নি। এটি সম্পূর্ণ ঠাকুরের নিজস্ব সংযোজন। বলা যায়, তিনি বলতে চেয়েছেন ঈশ্বরের প্রতি নিবিষ্টচিত্ততার কথা। ঈশ্বরে নিবিষ্টচিত্ততাই মানুষকে জ্ঞান, ভক্তি অথবা কর্মযোগে ব্রতী করে। যতই সেএর যে কোনো একটি পথ ধরে অগ্রসর হয়, ততই তার ঈশ্বর সম্পর্কিত নিবিষ্টতাও বৃদ্ধি পায়। নিরাসক্ত ভাবে কর্ম সম্পাদন যে অতীব কঠিন, ঠাকুর তা জানতেন, তাই সংসারী ভক্তদের তিনি তুলনামূলক ভাবে সহজতর ভক্তিমার্গের কথা বলেছেন, কিন্তু ভুলেও জ্ঞানমার্গ অনুসরণের কথা তাঁর মুখে শোনা যায় নি, কেননা জ্ঞানমার্গের পথ ছিল তাঁর অপছন্দ। দ্বিবিধ কারণে, এ পথে সাধক ভক্ত সদরমহল পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠিটি পান না। দ্বিতীয়ত, জ্ঞান বিচারের পথ কঠিন পথ, এ পথের পথিক প্রায়শই লক্ষ্যকে বিস্মৃত হয়ে উপলক্ষ্যেই মজে পড়েন।

বঙ্কিমের দৃষ্টিতে গীতা

বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকা রচনা করেছিলেন ১২৯৩ সালে। বঙ্কিম বলেছেন তিনি তাঁর টীকা রচনায় যেসব পূর্বসূরীদের রচনার সহায়তা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা হলেন—আনন্দগিরি-টীকা সম্বলিত শঙ্করভাষ্য, শ্রীধরস্বামী-কৃত টীকা, রামানুজ ভাষ্য, মধুসূদন সরস্বতী-কৃত টীকা, বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর টীকা। বঙ্কিম তাঁর টীকা রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের দেশের যেমন শিক্ষিত সম্প্রদায় শৈশব থেকেই পাশ্চাত্য চিন্তাপ্রণালীর অনুবর্তী, যাঁদের কাছে ভারতবর্ষীয় চিন্তাপ্রণালী অপরিচিত, তাঁদের পাশ্চাত্য ভাবের সাহায্যে গীতার মর্ম বোঝান। গীতা সম্পর্কে পাশ্চাত্য শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে যেসব সংশয় বাসা বেঁধে আছে, সেগুলির নিরসন ঘটানোও এই টীকা রচনার অন্য এক উদ্দেশ্য।

বঙ্কিম গীতার টীকা রচনায় তাঁর দীনতা স্বীকার করে বলেছেন :

আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তি গীতার মর্মার্থ জানিতে বা বোঝাইতে যে অক্ষম, তাহা আমি মুক্তকন্ঠে স্বীকার করি।

বঙ্কিমের গীতার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অপরিসীম। ‘ধর্মতত্ত্বে’ বঙ্কিম বলেছেন :

যদি কেহ মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া ধর্মের সম্পূর্ণ অবয়ব হৃদয়ে ধ্যান, এবং মনুষ্যলোকে প্রচারিত করিতে পারিয়া থাকেন, তবে সেশ্রীমদ্ভগবদগীতাকার। ভগবদগীতার উক্তি ঈশ্বরাবতার শ্রীকৃষ্ণের উক্তি কি কোন মনুষ্যপ্রণীত, তাহা জানি না। কিন্তু যদি কোথাও ধর্মের সম্পূর্ণ প্রকৃতি ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হইয়া থাকে, তবে সেশ্রীমদ্ভগবদগীতায়।

বঙ্কিম অন্যত্রও গীতার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের কথা ঘোষণা করেছেন :

যাহা আর কোথাও নাই, তাহাও ইহাতে আছে, জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সামঞ্জস্য আছে। এই সামঞ্জস্য আছে বলিয়াই ইহাকে সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মগ্রন্থ বলা যাইতে পারে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গীতার অনন্যতার কারণ স্বরূপ বঙ্কিম আত্মার অবিনাশিতা এবং জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে উল্লেখ করেছেন। গীতা সম্পর্কে বঙ্কিমের যতই শ্রদ্ধাবোধ থাক, গীতা সম্পর্কে আলোচনায় তিনি যে দুটি প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন তাতে তাঁর যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রতিফলনই লক্ষিত হয়—

ক. ‘যুদ্ধক্ষেত্রে উভয় সেনার সম্মুখে রথ স্থাপিত করিয়া, কৃষ্ণার্জুনে যথার্থ এইরূপ কথোপকথন যে হইয়াছিল, তাহাতে বিশেষ সন্দেহ। দুই পক্ষের সেনা ব্যূহিত হইয়া পরস্পরকে প্রহার করিতে উদ্যত, সেই সময় যে এক পক্ষের সেনাপতি উভয় সৈন্যের মধ্যে রথ স্থাপন করিয়া অষ্টাদশ অধ্যায় যোগধর্ম শ্রবণ করিবেন, এ কথাটা বড় সম্ভবপর বলিয়াও বোধ হয় না।’

খ. ‘গীতায় ভগবৎ প্রচারিত ধর্ম সঙ্কলিত হইয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু গীতাগ্রন্থখানি ভগবৎ প্রণীত নহে, অন্য ব্যক্তি ইহার প্রণেতা …. অনেক কথা যে গ্রন্থকারের নিজের মত, তিনি ভগবানের মুখ হইতে বাহির করিতেছেন, ইহা সম্ভব।’

বঙ্কিম সহজবোধ্য কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন, যিনি শ্রীমদ্ভগবতের প্রণেতা তিনি কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথন কালে অকুস্থলে উপস্থিত থেকে স্বকর্ণে শুনে সেখানে বসেই সব লিখেছিলেন অথবা পরবর্তীতে স্মৃতিধরের মত স্মরণে রেখেছিলেন এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।

যদিও বঙ্কিম শ্রীমদ্ভগবদগীতার টীকা প্রণয়নে প্রয়াসী হয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষণীয়, তিনি গীতার জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগের তুলনায় আদ্যন্ত কর্মযোগ নিয়েই আলোচনা করেছেন। বঙ্কিমের ভগবদগীতার টীকার আলোচনা প্রসঙ্গে স্বভাবতঃই ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের বক্তব্যও এসে যাবে কেননা গীতার বিভিন্ন বক্তব্য সেখানে আলোচিত হয়েছে গুরু-শিষ্যের কথোপকথনের আঙ্গিকে।

‘ধর্মতত্ত্বে’র অষ্টাদশ অধ্যায়ে ভগবদগীতার ভক্তিযোগ আলোচনা প্রসঙ্গে গুরু বলেছেন :

সোজা পথ একটা ভিন্ন পাঁচটা থাকে না বটে, কিন্তু সকলে, সকল সময়ে সোজা পথে যাইতে পারে না। পাহাড়ের চূড়ায় উঠিবার যে সোজা পথ, দুই একজন বলবানে তাহাতে আরোহণ করিতে পারে। সাধারণের জন্য ঘুরান ফিরান পথই বিহিত। এই সংসারে নানাবিধ লোক, তাহাদের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি। কেহ সংসারী, কাহারও সংসার হয় নাই, হইয়াছিল ত’ সেত্যাগ করিয়াছে। যে সংসারী, তাহার পক্ষে কর্ম, যে অসংসারী তাহার পক্ষে সন্ন্যাস। যে জ্ঞানী, অথচ সংসারী, তাহার পক্ষে জ্ঞান ও বিজ্ঞানযোগই প্রশস্ত, যে জ্ঞানী অথচ সংসারী নয়, অর্থাৎ যোগী, তাহার পক্ষে ধ্যানযোগই প্রশস্ত। …………. যাহাতে সকলেরই পক্ষে ধর্ম সোজা হয়, ইহাই তাঁহার উদ্দেশ্য।

শিষ্য ভেবেছে, তাহলে ভক্তিই সকল সাধনের অন্তর্গত। গুরু উত্তরে বলেছেন :

কিন্তু ভক্তির অনুশীলন চাই। তাই বিবিধ সাধন, বিবিধ অনুশীলন পদ্ধতি।

এখানে লক্ষণীয়, গুরু সংসারীদের জন্য কর্মযোগ এবং জ্ঞানী অথচ সংসারীদের জন্য জ্ঞান ও বিজ্ঞানযোগ প্রশস্ত বলেছেন। গুরু ভক্তিযোগের পরিবর্তে ধ্যানযোগের কথা বলেছেন এবং তাও তা যোগীদের জন্যই প্রশস্ত।

পাশ্চাত্য ধারণার সঙ্গে গীতার তত্ত্বের সাযুজ্যের সন্ধান করতে গিয়ে বঙ্কিম বললেন :

মনুষ্যজীবনে যাহা কিছু আছে, পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা তাহা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন, Thought, Action and Feeling ……. আমরা নিজেই মনুষ্যজীবন আলোচনা করিয়া দেখিলে জানিব যে, তাহাতে এই তিন ভিন্ন আর কিছুই নাই। এই তিনকেই ঈশ্বর-মুখ করা যাইতে পারে, তিনিই ঈশ্বরার্পিত হইলে ঈশ্বরসমীপে লইয়া যাইতে পারে। Thought ঈশ্বরমুখ হইলে জ্ঞানযোগ, Action ঈশ্বরমুখ হইলে কর্মযোগ, Feeling ঈশ্বরমুখ হইলে ভক্তিযোগ।

তাহলে Action ঈশ্বরমুখ হলে তাকেই বলা হবে কর্মযোগ। এবারে বঙ্কিম কর্মযোগ সম্পর্কে তাঁর যে ধারণার কথা ব্যক্ত করেছেন তার পরিচয় নেওয়া যাক। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যাক, বঙ্কিম কর্মযোগকেই ভক্তিযোগ বলে মনে করেন আর বঙ্কিমের দৃষ্টিতে সর্বোত্তম হল ভক্তিযোগ, সকলের উপরে তার স্থান। তাই বিস্তারিতভাবে কর্মযোগের আলোচনা করে, প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিম ভক্তিযোগের অদ্বিতীয়ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। বঙ্কিমের ভাষায় :

কর্ম ঈশ্বরে অর্পণ করিবে অর্থাৎ কর্ম তাঁহার, আমি তাঁহার ভৃত্যস্বরূপ কর্ম করিতেছি, এইরূপ বুদ্ধিতে কর্ম করিবে, তাহা হইলেই কর্মযোগ সিদ্ধ হইবে।

এইভাবেই কৃষ্ণে কর্মার্পণ সম্ভব। বঙ্কিম পরামর্শ দিয়েছেন, কার্যকারিণী ও শারীরিক বৃত্তি সকলকে ঈশ্বরমুখী করা চাই। এই প্রেক্ষিতেই কর্মযোগ ভক্তিযোগ। ভক্তির সঙ্গে তিনি কর্মের ঐক্য এবং সামঞ্জস্য দুইই লক্ষ্য করেছেন। তাঁর মতে :

এই অপূর্ব তত্ত্ব অপূর্ব ধর্ম কেবল গীতাতেই আছে। এইরূপ স্পষ্ট ধর্মব্যাখ্যা আর কখন কোন দেশে হয় নাই।১০

বেদেও কর্মের কথা আছে কিন্তু বেদোক্ত কর্ম এবং গীতায় কথিত কর্মযোগ এক ত’ নয়ই বরং বিপরীতমুখীন। বেদে কর্ম বলতে বোঝানো হয়েছে আপনার মঙ্গল কামনায় দেবতার প্রসাদার্থ যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানাদি। বঙ্কিমের স্পষ্ট উক্তি :

বৈদিক কর্ম বা কাম্য কর্মের অনুষ্ঠান ধর্ম নহে। অথচ কর্ম করিতেই হইবে। তবে কি কর্ম করিতে হইবে? যাহা কাম্য নহে, তাহাই নিষ্কাম। যাহা নিষ্কাম ধর্ম বলিয়া পরিচিত।১১

বঙ্কিম গীতোক্ত কর্মের উৎকর্ষে চমৎকৃত। গীতানুসরণে বঙ্কিমের পরামর্শ :

তোমার কর্মেই অধিকার, কদাচ কর্মফলে যেন না হয়। কর্মের ফলার্থী হইও না, কর্মত্যাগেও প্রবৃত্তি না হউক।১২

‘যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত ধনঞ্জয়’ শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বঙ্কিম বললেন :

কর্ম করিবে, কিন্তু কর্ম সিদ্ধ হউক, অসিদ্ধ হউক, সমান জ্ঞান করিবে। তোমার যতদূর কর্তব্য, তাহা তুমি করিবে। তাতে তোমার কর্ম সিদ্ধ হয় আর নাই হয়, তুল্য জ্ঞান করিবে। এই যে সিদ্ধ সিদ্ধিকে সমান জ্ঞান করা, ইহাকেই ভগবান যোগ বলিতেছেন। এইরূপ যোগস্থ হইয়া, কর্ম আসক্তিশূন্য হইয়া কর্মের যে অনুষ্ঠান করা, তাহাই নিষ্কাম কর্মানুষ্ঠান।১৩

তাহলে কোন কর্ম সম্পাদন করা কর্তব্য? ‘ঈশ্বরার্থ ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম,’ অন্য কর্ম বন্ধন মাত্র। ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের জন্য কর্তব্য হল সমস্ত বৃত্তিগুলিকে ঈশ্বরমুখী করা, নতুবা সকল কর্ম ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম হবে না। এইভাবেই বঙ্কিম কর্ম ও ভক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন। কর্মের সঙ্গে ভক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিষ্কাম কর্মকেই বঙ্কিম ভক্তির নামান্তর বলে মান্যতা দিয়েছেন। নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হলেও বঙ্কিম দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করেন কর্ম করলেই তার ফলভোগ অবশ্যম্ভাবী। তিনি আরও বিশ্বাস করেন, ইহজন্মেই আমরা সকল কর্মের ফল ভোগ করি। তাঁর ভাষায় :

সকল প্রকার কর্মের ফল ইহজন্মেই এইরূপ পাওয়া গিয়া থাকে।১৪

বঙ্কিম কর্মযোগের ব্যাখ্যায় বললেন :

জীবন্মুক্তি লাভ যে কর্মে সম্ভব তাই হল কর্মযোগ। এমন কি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী যাঁরা নন, তাঁরাও কর্মযোগের দ্বারা মুক্তিলাভে সক্ষম।১৫

বঙ্কিম কর্মযোগকে নানাভাবে দেখেছেন, জীবন্মুক্তি লাভের উপায়স্বরূপ হল কর্মযোগ এ যেমন একটি ধারণা, অন্যদিকে আবার বললেন :

কাম্যাদি কর্মাত্মক যে উপাসনা, তাহার সাধারণ নাম কর্ম। এই কাজ করিলে তাহার এই ফল, অতএব কাজ করিতে হইবে—এইরূপ ধর্মার্জনের যে পদ্ধতি, তাহারই নাম কর্ম।১৬

বঙ্কিম গীতার শ্লোক উদ্ধার করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ ক্ষণমাত্র কর্ম না করে থাকতে পারে না স্বভাব, প্রকৃতির বশীভূত হয়ে কতকগুলি কাজ মানুষকে অনিবার্যভাবেই করতে হয় যেমন, আসন, বসন, শয়ন, শ্বাস, প্রশ্বাস ইত্যাদি। গীতানুসরণে বঙ্কিম স্মরণ করেছেন, অকর্ম থেকে কর্মই শ্রেষ্ঠ। অকর্মে শরীরযাত্রা নির্বাহ হয় না। কর্মকে কেন্দ্র করে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা হয়। যেমন, কর্ম কেন করব, উত্তর হল কর্মই আমাদের জীবনের নিয়ম, Law of life। কর্ম না করে ক্ষণকাল থাকা যায় না তাই। কর্ম ব্যতিরেকে শরীরযাত্রা নির্বাহ হয় না, তাই আমাদের কর্মনির্ভরতা। বঙ্কিম কর্মকে দুটি শ্রেণীতে বিভাজন করেছেন—সৎকর্ম ও অসৎকর্ম। তৃতীয় আর এক শ্রেণীর কর্মের কোনো বিশেষ পক্ষ নেই। সৎকর্ম যেমন পরোপকার, অসৎকর্মের নিদর্শন পরদার গমন আর শয়ন ভোজন ইত্যাদি সদসতের ঊর্ধ্বে। বঙ্কিম কর্মের আরো একটি নতুন বিভাজন করেছেন— অনুষ্ঠেয় এবং অননুষ্ঠেয়। তৃতীয় আরও একটি বিভাজন করেছেন লেখক—সকাম ও নিষ্কাম কর্ম। বঙ্কিমচন্দ্রের গীতানুরক্তির পরিচয় ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি, কিন্তু তাই বলে তিনি তাঁর যুক্তিবোধ বিসর্জন দেননি। স্পষ্টতই বলেছেন :

গীতায় যাহা কিছু আছে, তাহাই যে ভগবদুক্তি, এমন কথা বিশ্বাস করা উচিত নহে। …… কৃষ্ণ-কথিত ধর্ম অন্য কতৃক সঙ্কলিত হইয়াছে। যিনি সঙ্কলন করিয়াছেন, তাঁহার নিজের মতামত অবশ্য ছিল। তিনি যে নিজ সঙ্কলিত গ্রন্থে কোথাও নিজের মত জানান নাই, ইহা সম্ভব নহে।১৭

দৃষ্টান্তস্বরূপ লেখক কর্মযোগের দশম থেকে ষোড়শ এই সাতটি শ্লোকের উল্লেখ করেছেন। বঙ্কিমের মতে এই সাতটি শ্লোক অনৈসর্গিক কথায় ভরা, সমস্তই অবৈজ্ঞানিক। বঙ্কিম ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, কৃষ্ণোক্ত নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে এই সাতটি শ্লোকের বিরোধ। এজন্যই বঙ্কিমের সিদ্ধান্ত :

…. ইহা ভগবদুক্তি নহে, সঙ্কলনকর্তার মত—ইহাই আমার বিশ্বাস।১৮

বঙ্কিমের মতে এই সাতটি শ্লোক বৈজ্ঞানিক অসত্যে কলঙ্কিত। কর্মযোগের প্রসঙ্গে লেখক গীতায় স্বধর্ম বিরোধিতার প্রমাণ দাখিল করেছেন। একবার বলা হল মানুষ কর্ম ব্যতিরেকে টিঁকতে পারে না ক্ষণমাত্র, আবার অন্যত্র বলা হল—

যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।

আত্মন্যেব চ সস্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে।।

যে মানুষের আত্মাতেই রতি, যিনি আত্মতৃপ্ত, আত্মাতেই যিনি সন্তুষ্ট, তাঁর কাজ নেই।

বঙ্কিম নিষ্কাম কর্মের তত্ত্বকে পুরোপুরি সমর্থন জানিয়েছেন, কিন্তু সেইসঙ্গে বলেছেন :

সকাম কর্ম অভ্যস্ত না হইলে, নিষ্কাম কর্ম সম্ভবে না।১৯

বঙ্কিম প্রাসঙ্গিক ভাবেই কর্ম, বিকর্ম এবং অকর্মের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এই তিনের স্বাতন্ত্র্য ব্যাখ্যা করেছেন। কর্ম হল বিহিত কর্ম বা যথার্থ কর্ম। বিকর্ম হল অবিহিত কর্ম। আর অকর্ম হল কর্মশূন্যতা। নিষ্কাম কর্মের তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য ঈশ্বরের নিষ্কাম কর্মিত্ব অনুধাবন করা জরুরী। বঙ্কিমের মতে, ঈশ্বর কর্ম করেন কিন্তু কর্ম করেও তিনি অকর্তা। কারণ তিনি অব্যয়। তাই তিনি কর্মফলের অধীন হন না, শুধু তাই নয়, তাঁর সুখ-দুঃখের হ্রাস-বৃদ্ধিও নেই। ফলের অধীন তিনি নন, তাই তিনি নিষ্কামকর্মী এবং তাঁর কৃতকর্মও নিষ্কাম।

স্বদেশহিতৈষীর দৃষ্টান্তে বঙ্কিম নিষ্কাম ও সকাম কর্মের পার্থক্য দেখিয়েছেন। স্বদেশহিতৈষী যখন নিছকই স্বদেশের হিতকামনা করে কর্ম করেন তখন তা নিষ্কাম কর্মের নিদর্শন। কিন্তু যদি তিনি নিজের জন্য মান সম্ভ্রম উন্নতি প্রভৃতির বাসনায় স্বদেশের ইষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হন, তবে তিনি সকামকর্মা।

বঙ্কিম কথিত অনুশীলন ধর্মের মর্মস্থলে আছে সকল বৃত্তির ঈশ্বরে সমর্পণের কথা। বঙ্কিম দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করেন এতদ্ব্যতীত মনুষ্যত্ব নেই। আসলে নিষ্কাম কর্মকে উপজীব্য করেই বঙ্কিমের অনুশীলন ধর্মের আত্মপ্রকাশ। সকল বৃত্তির ঈশ্বরে সমর্পণকেই বঙ্কিম প্রকৃত ‘কৃষ্ণার্পণ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই হল প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম, এরই নামান্তর তাঁর মতে চিত্তশুদ্ধি। নিষ্কাম কর্ম ব্যতিরেকে মানুষের স্থায়ী সুখ লাভের বিকল্প কোনো পথ নেই।

বঙ্কিম জ্ঞান ও কর্ম উভয়ের সংযোগের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেছেন, বলেছেন কর্মেই হয় জ্ঞানের সাধন। অর্থাৎ কর্মের দ্বারাই জ্ঞানলাভ ঘটে। জ্ঞানযোগ আহরণেচ্ছু যে তাকে কর্মকেই আশ্রয় করতে হয়। বঙ্কিম দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন কর্মযোগ ব্যতিরেকে চিত্তশুদ্ধি সম্ভব নয়।

‘ধর্মতত্ত্বে’ গুরু পরামর্শ দিয়েছেন মুক্তির কারণ দ্বিবিধ—কর্মযোগ এবং কর্মত্যাগ। দুইয়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্টতর হল কর্মযোগ। কর্ম রেখেও কর্মত্যাগের ফললাভ সম্ভব। অতএব সেইরূপ প্রয়াস করাই সমীচীন।

জন্মান্তরবাদীরা মানেন এ জন্মে কৃতকর্মের ফলভোগ জন্মান্তরে করতে হয়। বঙ্কিম জানিয়েছেন, যাঁরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী নন, তাঁরাও কিন্তু কর্মযোগের মাধ্যমে মুক্তিলাভে সক্ষম। এই প্রেক্ষিতেই বঙ্কিম কর্মযোগের নবতর সংজ্ঞা দান করেন :

যেরূপ অনুষ্ঠানের দ্বারা তাহা (জীবন্মুক্তি) লাভ করা যাইতে পারে, তাহাই কর্মযোগ।২০

বঙ্কিম কর্মযোগ সম্পর্কে যেসব ধ্যানধারণার কথা ব্যক্ত করেছেন সেগুলিকে সূত্রাকারে বর্ণনা করলে দাঁড়ায়—

ক. বেদোক্ত যজ্ঞ কর্ম নয়।

খ. কর্মেই অধিকার, ফলে নয়।

গ. স্বাভাবিক গুণে সকলকেই কর্মরত থাকতে হয়।

ঘ. অসৎকর্ম আমাদের জীবন নির্বাহের নিয়ম নয়।

ঙ. সৎকর্ম মনুষ্যত্বের প্রধান উপাদান।

চ. কর্মসিদ্ধি এবং কর্মের অসিদ্ধিকে তুল্য জ্ঞান করা চাই।

ছ. ঈশ্বরার্থ কর্ম করা চাই।

জ. কামনাযুক্ত হয়ে কর্ম করলে দুঃখ পেতে হয়।

ঝ. কর্মশূন্যতা থেকে কর্ম শ্রেষ্ঠ।

ঞ. কর্মযোগীর কর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য সর্বভূতের হিতসাধন।

ট. সকলেরই কর্ম করা কর্তব্য।

ঠ. ভারতবর্ষের অধঃপতনের কারণ—কর্মবিমুখতা। এজন্য বঙ্কিম দায়ী করেছেন জ্ঞানমার্গাবলম্বীদের। কেননা জ্ঞানমার্গাবলম্বীরা কর্মে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন।

ড. শ্রীকৃষ্ণ গীতায় যেমন কর্মের মহিমা কীর্তন করেছেন, একইভাবে গুণকীর্তন করেছেন মহাভারতেরও।

ঢ. কর্ম থেকেই জ্ঞানে আরোহণ করতে হয়।

ণ. সকাম কর্মে অভ্যস্ত না হলে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন সম্ভব নয়।

ত. ইন্দ্রিয়ে ও বিষয়ে যে সংযোগ সংঘটন, তাই কর্ম।

থ. আদর্শ মানুষ, আদর্শ কর্মী।

দ. ঈশ্বরই সকল কর্মের ফলবিধাতা।

ধ. নিষ্কাম কর্মের জন্য আবশ্যক ঈশ্বরে অভেদ জ্ঞান, জ্ঞান ও তপের সাহায্যে চরিত্রের বিশুদ্ধিকরণ।

ন. সকলের পক্ষে নিষ্কামকর্মী হওয়া সম্ভব নয়।

কর্মযোগের পর আমরা জ্ঞানযোগের আলোচনায় ব্রতী হব। অবশ্যই বঙ্কিমের অনুসরণে।

‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে গুরু বলেছেন :

জ্ঞান ভিন্ন ঈশ্বরকে জানা যায় না। ঈশ্বরের বিধিপূর্বক উপাসনা করা যায় না।২১

গুরু আরও জানিয়েছেন, মূর্খের ঈশ্বরোপাসনা নেই। তবে স্বীকার করেছেন জ্ঞান পুস্তকপাঠ ভিন্ন অন্য প্রকারেও উপার্জিত হতে পারে। এর দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের নারীসমাজ। প্রাচীনারা নানাভাবেই জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেতেন। এঁরা লেখাপড়া না জেনেও জ্ঞানী হতেন। গুরু বলেছেন, জ্ঞানই ধর্ম, জ্ঞানেই নি:শ্রেয়স। উপনিষদ জ্ঞানবাদীদের কীর্তি। দর্শনের মধ্যে কেবল পূর্বমীমাংসা কর্মবাদী, আর সবই জ্ঞানবাদী। জ্ঞানবাদীরা মায়া নামে ঈশ্বরের যে শক্তির কল্পনা করেছেন, সেই মায়াকেই জগৎসৃষ্টির কারণ রূপে অভিহিত করা হয়। আর এই মায়ার কারণেই আমরা ঈশ্বরকে জানতে পারি না। আত্মার অনশ্বরতা জ্ঞানের বিষয়। জ্ঞানলাভ সম্ভব কর্মের দ্বারা। কর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমেই জ্ঞানলাভ করতে হয়। কর্মযোগ ভিন্ন চিত্তশুদ্ধি সম্ভব নয় যেমন, তেমনি চিত্তশুদ্ধি ব্যতিরেকে জ্ঞানযোগে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞানের দ্বারাই সংশয় ছেদন সম্ভব। গুরুর অভিমত এইরূপ :

জ্ঞানার্জনী বৃত্তিগুলি যখন ভক্তির অধীন হইয়া ঈশ্বরমুখী হইবে, তখনই এই গীতোক্ত জ্ঞানে পৌঁছিবে। অনুশীলন ধর্মেই যেমন কর্মযোগ, অনুশীলন ধর্মেই তেমনি জ্ঞানযোগ।২২

অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই অনুশীলন ধর্মের অনিবার্যতা। বঙ্কিমের অভিমত ‘Thought’ ঈশ্বরমুখী হলে হয় জ্ঞানযোগ। জ্ঞান কিন্তু সকলের আয়ত্ত নয়। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লিখিত হয়েছে। শিষ্যের বকলমে বঙ্কিম এই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন :

জ্ঞানে ঈশ্বরকে জানিতে পারি বটে, কিন্তু জ্ঞানে কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায়? জানিলেই কি পাওয়া যায়?২৩

সবশেষে ভক্তিযোগ প্রসঙ্গ।

‘ধর্মতত্ত্বে’ বলা হয়েছে :

ভক্তি, প্রীতি, দয়া মনুষ্যবৃত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তন্মধ্যে ভক্তিই সর্বশ্রেষ্ঠ।২৪

‘ধর্মতত্ত্বে’র একাদশ অধ্যায়ে ‘ঈশ্বরে ভক্তি’ শিরোনামায় গুরু ভক্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন এই বলে :

যখন মানুষের সকল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরমুখী বা ঈশ্বরানুবর্তিনী হয়, সেই অবস্থাই ভক্তি।

শুধু সংজ্ঞা দানই নয়, তৎসহ তার সম্প্রসারিত ব্যাখ্যাও উপস্থাপিত হয়েছে :

……. যখন জ্ঞানার্জনী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরানুসন্ধান করে, কার্যকারিণী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরে অর্পিত হয়, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরের সৌন্দর্যই উপভোগ করে, এবং শারীরিকী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরের কার্যসাধনে বা ঈশ্বরের আজ্ঞা পালনে নিযুক্ত হয়, সেই অবস্থাকেই ভক্তি বলে। যাহার জ্ঞান ঈশ্বরে, কর্ম ঈশ্বরে, আনন্দ ঈশ্বরে এবং শরীরার্পণ ঈশ্বরে তাহারই ঈশ্বরে ভক্তি হইয়াছে।২৫

‘ধর্মতত্ত্বে’ গুরু বারংবার ভক্তির কথা বলেছেন। যেমন :

যে অবস্থায় মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরানুবর্তী হয়, তাহাই ভক্তি। ওই ব্যক্তির শারীরিক বল বেশী থাক, অল্প থাক, যতটুকু আছে, তাহা যদি ঈশ্বরানুবর্তী হয়, অর্থাৎ ঈশ্বরানুমত কার্যে প্রযুক্ত হয়—আর অন্য বৃত্তিগুলিও সেইরূপ হয়, তবে তাহার ঈশ্বরে ভক্তি হইয়াছে।২৬

গুরু এমন কথাও বলেছেন :

জীবন লইয়া কি করিব এ প্রশ্নের এই উত্তর পাইয়াছি। ইহাই যথার্থ উত্তর, আর সকল উত্তর অযথার্থ।২৭

প্রশ্ন হল উত্তরটি কি? উত্তর হল ঈশ্বরানুবর্তিতা। ভক্তি সকল বৃত্তির ঈশ্বরানুবর্তিতা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। আর এই ভক্তি ব্যতিরেকে মনুষ্যত্ব অর্থহীন।

‘ধর্মতত্ত্বে’ ভক্তিবাদের উদ্ভব রহস্য ভেদ করা হয়েছে। জ্ঞানবাদের সীমাবদ্ধতার কারণেই ভক্তিবাদের উদ্ভব। জ্ঞানে ঈশ্বরকে জানা যায় বটে কিন্তু ঈশ্বরকে জানা আর ঈশ্বরকে লাভ করা এক নয়। ভক্তি ঈশ্বরকে পেতে সহায়তা করে। তাই জ্ঞানযোগের ঊর্ধ্বেই ভক্তিযোগের অবস্থান।

গুরু ঈশ্বরপ্রাপ্তির একটিই মাত্র পথ এবং তা যে ভক্তি তা প্রতিপন্ন করতে বলেছেন :

যে শরীরী, তাহাকে কোন অনুরাগে না পাইলে না পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু যিনি অশরীরী তিনি কেবল অন্তঃকরণের দ্বারাই প্রাপ্য। অতএব তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থাকিলেই আমরা তাঁহাকে পাইব। সেই প্রকারের অনুরাগের নাম ভক্তি।২৮

গুরু স্বীকার করেছেন যে, গীতায় জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি তিনেরই কথা আছে, তিনেরই প্রশংসা আছে, তিনেরই সামঞ্জস্য আছে, কিন্তু একথাও গুরু সোচ্চার কন্ঠে ঘোষণা করেছেন :

কিন্তু সেই সামঞ্জস্যের প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, এই তিনের চরমাবস্থা যাহা, তাহা ভক্তি। এইজন্য গীতা প্রকৃতপক্ষে ভক্তিশাস্ত্র।২৯

একথা স্বীকার করেছেন গুরু যে জ্ঞান ও কর্মযোগ বুঝলে তবেই জানা যাবে ‘গীতা ভক্তিশাস্ত্র’।৩০

বঙ্কিম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কর্মযোগই ভক্তিযোগ, নিষ্কাম কর্মই নামান্তরে ভক্তি।

ধর্মতত্ত্বের সপ্তদশ অধ্যায়ে গুরু ঘোষণা করেছেন :

গীতোক্ত ধর্মে, জ্ঞান, কর্ম, ধ্যান সন্ন্যাসভক্তি ব্যতীত কিছুই সম্পূর্ণ নহে। ভক্তিই সর্বসাধারণের সার।৩১

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ব্যাখ্যাকালে বঙ্কিম বলেছেন :

Feeling ঈশ্বরমুখী হইলে ভক্তিযোগ।

গীতা এবং ভাগবত দুটিই ভক্তিপ্রধান গ্রন্থ বলে বঙ্কিমের অভিমত। দেবর্ষি নারদ ব্যাসদেবকে উপদেশ দেন তিনি যেন ধর্মের প্রধান অবলম্বন ভক্তি জগতে প্রচার করেন। ব্যাসদেব অনুভব করেন ভক্তিই জীবনের চরম উদ্দেশ্য, শুধু তাই নয় পরিত্রাণ লাভেরও একমাত্র উপায়। বঙ্কিম এঁদের পরামর্শ ও উপদেশের কথা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছেন কেননা তিনিও ভক্তিমার্গের প্রতি ছিলেন আস্থাশীল।

গীতা পাঠ
 দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর

আক্ষরিক অর্থেই যাঁরা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, তাঁরা বহুক্ষেত্রেই আংশিক বা খন্ডিত পরিচিতির ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে সীমাবদ্ধ থাকেন, কিংবা বলা যায়, খন্ডিত পরিচয় এঁদের সামগ্রিক পরিচয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এর দৃষ্টান্ত পুণ্যশ্লোক পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, এর দৃষ্টান্ত শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তালিকাতেই আমরা অনায়াসে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটিকেও সন্নিবিষ্ট করতে পারি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটি উচ্চারিত হলেই আমরা মূলতঃ তাঁর দুটি পরিচয়কে স্মরণ করি—তিনি রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’-এর কবি। এইসঙ্গে বড়জোর মনে করি যে তিনি ছিলেন দার্শনিক। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় এইটুকুতেই শেষ হবার নয়।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পরই ছিল যাঁর সর্বোচ্চ স্থান, তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জন্ম ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই মার্চ। মৃত্যু ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারী। তখন তাঁর বয়স ৮৫ বৎসর। হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলেজীয় শিক্ষাশেষে স্বাধীনভাবে তিনি গৃহে জ্ঞানানুশীলনে ব্রতী হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতার দ্বারাই গৃহে স্বাধীনভাবে শিক্ষার্জনের প্রেরণা পেয়ে থাকবেন। মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ অনুবাদ করেন (১৮৬০)। নানা পত্র পত্রিকায় তাঁর জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হত—যেমন জ্ঞানাঙ্কুর, প্রবাসী, বঙ্গদর্শন, ভারতী, বালক, মানসী, সাধনা, সাহিত্য, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা।

১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনাতেই ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর (১৮৮৪-১৯০৯)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৮৬৪ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন। আদি ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি পদে বৃত হন ১৮৯৯ সালে।

তিনি আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবক। নতুন নিয়মে জ্যামিতি লিখেছেন। বাংলায় শর্ট হ্যান্ড লিখন পদ্ধতিরও তিনিই প্রথম প্রবর্তক। তাঁর ‘রেখাক্ষর বর্ণমালা’র প্রকাশকাল ১৩১৯ বঙ্গাব্দ। হিন্দুমেলার সম্পাদক ছিলেন ১৮৭০ থেকে ১৮৭৩।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেকগুলি গ্রন্থেরও রচয়িতা। এগুলির মধ্যে উল্লেখ্য, ভ্রাতৃভাব (১৮৬৩), তত্ত্ববিদ্যা (১ম খন্ড ১৮৬৬, ২য় খন্ড ১৮৬৭, ৩য় খন্ড ১৮৬৮, ৪র্থ খন্ড ১৮৬৯), সাধনা—প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৮৯২), অদ্বৈত মতের প্রথম ও দ্বিতীয় সমালোচনা (১৩০৪), আর্যধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মের পরস্পর ঘাত প্রতিঘাত ও সংঘাত (১৩০৬), ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মসাধন (১৩০৬), নানা চিন্তা (১৩২৭), প্রবন্ধমালা (১৩২৭), চিন্তামণি (১৩২৯), উপসর্গের অবিচার (১৯৭৯) ইত্যাদি। গণিত ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। বংশী সংগ্রহে ছিল তাঁর উৎসাহ। সত্যব্রত, ঋষিকল্প এই মানুষটি ছিলেন আপাদমস্তক তত্ত্বজ্ঞানী। তিনি ছিলেন স্বাদেশিক। সঙ্গীত রচয়িতা। গদ্য রচনাতেও আমরা তাঁর নৈপুণ্যের স্বাক্ষর লক্ষ করি। হয়ত তাঁকে গদ্যশিল্পীর মর্যাদা দেওয়া যাবে না, কিন্তু দুরূহ বিষয় নিয়ে গদ্য রচনাতে দ্বিজেন্দ্রনাথ যে সাবলীলত্বের পরিচয় দিয়েছেন, স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন সেজন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবী করতে পারেন।

এবারে আমরা তাঁর গীতা সম্পর্কিত আলোচনা গ্রন্থের প্রসঙ্গে আসব। আদিতে এই গ্রন্থের নাম ছিল নাকি ‘গীতা পাঠের ভূমিকা’, পরে এর পরিবর্তিত নামকরণ হয় ‘গীতা – পাঠ’। প্রথম প্রকাশকাল ১৩২২ (১৯১৫), প্রকাশস্থল—এলাহাবাদ। শান্তিনিকেতনের নিভৃত আশ্রমে সমবেত শ্রোতৃমন্ডলীর কাছে সর্বমোট একবিংশতিটি অধিবেশনে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতা সম্পর্কিত যে তত্ত্বনির্ভর বক্তৃতা দান করেন, আলোচ্য গ্রন্থটি সেই আলোচনা তথা বক্তৃতামালার সংকলন। লেখক তাঁর আলোচনাকে কোনো অধ্যায় কিংবা পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করেন নি। কেবল অধিবেশনের সংখ্যাটি উল্লিখিত হয়েছে। অর্থাৎ ২১টি অধিবেশনে ২১টি বক্তৃতায় লেখক তাঁর গীতা সম্পর্কিত তাত্ত্বিক আলোচনা শেষ করেন। স্বভাবতঃই প্রথম অধিবেশনে ‘ভূমিকা’ করা হয়েছিল সামগ্রিক আলোচনার। এর জের টানা হয়েছিল দ্বিতীয় অধিবেশনেও। তৃতীয় অধিবেশন থেকে ‘ব্যাখ্যান’ সন্নিবিষ্ট হয়েছিল। একটি উপসংহারও লেখক উপহার দিয়েছেন।

আলোচ্য গ্রন্থটি নানা কারণেই একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াসরূপে গণ্য হবার দাবি রাখে। দ্বিজেন্দ্রনাথ মামুলিভাবে গীতার আলোচনা করেন নি, কিংবা অন্য অনেক গীতা-আলোচকদের মত গীতার শ্লোক ধরে ধরে অথবা অধ্যায়-ভিত্তিক আলোচনার পথে পা বাড়াননি। এককথায় তিনি গীতার Spirit তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তব্যে। বলাবাহুল্য, এজন্য তাঁকে পুরোদস্তুর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে হয়েছে, নির্ভর করেছেন দার্শনিক প্রত্যয়ে।

যদি প্রশ্ন করা হয় লেখক এই গ্রন্থ রচনায় কোনো পদ্ধতি বা Methodology অনুসরণ করেছেন কিনা, তবে এককথায় বলতে হবে তিনি তুলনামূলক পদ্ধতি বা Comparative Methodology-র ওপর নির্ভর করেছেন। এই তুলনামূলক পদ্ধতি দু’বিচারেই অনুসৃত হয়েছে। একদিকে বেন্থাম, কাণ্ট তথা প্রতীচ্য দর্শন, অন্যদিকে বেদান্ত সাংখ্য, যোগ, উপনিষদ, গীতা এবং মহাভারতের তত্ত্বাংশের আলোচনায় যেমন ব্রতী হয়েছেন, তেমনি প্রাচ্য দর্শনের তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন। একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল লেখক দার্শনিক আলোচনায় বিজ্ঞানকেও অচ্ছুৎ করে রাখেন নি। ডারউইন প্রমুখের তত্ত্বকেও প্রসঙ্গক্রমে হাজির করেছেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ জানতেন, তিনি যে তাত্ত্বিক আলোচনার অবতারণা করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে তা বোধগম্য নাও হতে পারে। অনেকের কাছেই তা বিষয়বস্তুর কারণে দুরূহ বলে প্রতিভাত হতে পারে। সেইজন্য তিনি খুব বেশি জোর দিয়েছেন দৃষ্টান্তের ওপর। বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনাকে ফলপ্রসূ করতে তিনি ‘Example is better than precept’ নীতিকে আশ্রয় করেছেন। দৃষ্টান্তগুলি গৃহীত হয়েছে পরিচিত জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে। ফলতঃ দুরূহ তাত্ত্বিক আলোচনাও সাধারণের কাছে অনেকটাই পরিস্ফুট হয়েছে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক আলোচনাতে ইতিহাসচেতনাকেও সঙ্গী করে নিয়েছেন। আসলে তাত্ত্বিক আলোচনার প্রেক্ষাপট নির্দিষ্ট করার তাগিদেই তাঁর ইতিহাসের শরণাপন্ন হওয়া। দু’একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না :

আমাদের দেশে প্রথমে ছিল স্বরাজ্য; তাহার পরে আসিল মুসলমান রাজ্য; তাহার পর আসিল এক্ষণকার ঐংরাজ্য। (পৃ-৬৮)

কিংবা,

বেদের আমলে আমাদের দেশ ঋষিপ্রধান ছিল; মনুর আমলে ব্রাহ্মণপ্রধান ছিল; ব্যাসের আমলে ক্ষত্রিয়- প্রধান ছিল; শ্রীমন্ত সদাগরদিগের প্রাদুর্ভাবকালে বৈশ্যপ্রধান ছিল; এবং সম্প্রতি শূদ্রপ্রধান বা দাসত্বপ্রধান হইয়া দাঁড়াইয়াছে। (পৃ-৬৮)

ডারউইনের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করতে গিয়ে লেখক বললেন :

ডারুইন কেবল জীবদিগের বহিক্ষেত্রের জীবন-সংগ্রামের প্রতিই ষোল আনা মাত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়াছিলেন . . ., কিন্তু মানুষের অন্তর্জগতের পর্যালোচনা স্বতন্ত্র।

লেখকের মতে :

ডারুইনের হস্তের সাধনী যন্ত্র ছিল প্রত্যক্ষ অনুমান এবং বাহ্য পরীক্ষা; আমাদের হস্তের সাধনী যন্ত্র স্বানুভূতি, মহচ্চরিতের আলোচনা এবং আত্মপরীক্ষা। (পৃ-৪০-৪১)

বেন্থাম ও কাণ্টের তত্ত্ব সম্পর্কেও লেখক আলোকপাত করেছেন এবং তাঁদের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করেছেন :

কাণ্ট বলেন যে, অন্তরের অহেতুকী আজ্ঞা পালন করাই Categorical Imperative-এর কথা শোনাই ধর্ম সাধনের একমাত্র পথ।

অথচ অন্তরের অহেতুকী আজ্ঞার সঙ্গে কোনো কার্যপ্রবর্তনী শক্তিকে সংযুক্ত না করলে সব ব্যাপারই অর্থহীন হয়ে পড়ে।

লেখকের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত :

অন্তরের অহেতুকী আজ্ঞার সঙ্গে কার্যপ্রবর্তনী শক্তি না থাকিলে তাহাতে কোনো ফল দর্শিতে পারে না। নিয়মের প্রতি ভক্তির পরিবর্তে অন্তর্যামী পুরুষের প্রতি ভক্তির ওপর দ্বিজেন্দ্রনাথ গুরুত্ব দিয়েছেন।

গীতা সম্পর্কে লেখকের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অসীম। তাঁর মন্তব্য থেকেই এটি বোঝা যায় :

আমার কুটীরে বিনা-তৈলে একটি দীপ জ্বলিতেছে—ভগবদগীতা। . . . . পশ্চিমের সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান একত্র পুঞ্জীভূত হইয়া যত না আলোকচ্ছটা দিগ-দিগন্তরে বিস্তার করিতেছে—আমাদের ঐ ক্ষুদ্র দীপের অপরাজিত শিখা সেসমস্তেরই উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া স্বর্গীয় মহিমায় দীপ্তি পাইতেছে। (পৃ-১; প্রথম অধিবেশনে প্রদত্ত ভূমিকা)

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ চৈতন্য জীবনকথা তথা তাঁর দিব্যোন্মাদ অবস্থার বিবরণ দানের প্রয়াসকে দুঃসাহসিক এবং অক্ষম প্রয়াস বলে দীনতা প্রকাশ করেছিলেন—

আমি অতি ক্ষুদ্র জীব পক্ষী রাঙা টুনী

সেযৈছে তৃষ্ণায় পিয়ে সমুদ্রের পানি।

দ্বিজেন্দ্রনাথও তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা ও তত্ত্বানুসন্ধানে নিরন্তর লব্ধ অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে জানিয়েছেন :

. . . . আমার সাধ্যই বা কতটুকু—আর যাহা আমি বিবৃত করিলাম তাহাই বা কতটুকু? সবই সমুদ্রে অর্ঘদান! তত্ত্বানুসন্ধানে আমি যতই অগ্রসর হইতেছি ততই দেখিতেছি যে, সকলই অকূল অপার; অনির্বচনীয় এবং আশ্চর্য হইতেও আশ্চর্য।

এবারে আমরা গীতা-সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রসঙ্গে আসব। আমরা জানি গীতা তিনটি স্তম্ভের উপর অধিষ্ঠিত— কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ। প্রায় সব ব্যাখ্যাতারাই যে কোনো একটি যোগের পক্ষাবলম্বন করে গীতায় মূলতঃ সেই যোগের প্রাধান্য প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন। কেউ কেউ আবার গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তুলনামূলক ভাবে দ্বিজেন্দ্রনাথ কর্মযোগের কথাই বিস্তারিত ভাবে বলেছেন, যদিও জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগের বিষয়টিও অনুল্লিখিত থাকেনি।

নৈষ্কর্ম্যকে আমাদের প্রাচীন তত্ত্বজ্ঞানীরা জীবনের আদর্শ বলে মানেন নি, তারই দৃষ্টান্ত গীতা। লেখক বলেছেন :

যেমন কাঁটা দিয়া কাঁটা বাহির করা যায়, তেমনি কর্ম দ্বারাই কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করা যায়।(পৃ-৮; প্রথম অধিবেশন; ভূমিকা)

দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় লেখক ভোজরাজ-কৃত পতঞ্জল ভাষ্যে উল্লিখিত ‘প্রণিধানে’র প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। প্রণিধানের অর্থ হল বিশেষ প্রকার ভক্তি, বিশিষ্টরূপে উপাসনা এবং ‘তাঁহাতে সমস্ত কর্মের সমর্পণ’ (‘বিষয়সুখাদিকং ফলমিচ্ছন সর্ব্ব: ক্রিয়াস্তস্মিন পরমগুরৌ অর্পয়তীতি প্রণিধানম’) বিষয়সুখ ফলের ইচ্ছা না করে সমস্ত কর্ম সেই পরম গুরুর চরণে প্রণিহিত করার কথা বলা হয়েছে। গীতার কর্মযোগের বক্তব্যের অনুরণন এক্ষেত্রে লভ্য। লেখক কাপিল দর্শনের সাধনাঙ্গকে জ্ঞানযোগ বলে মেনেছেন, পাতঞ্জল দর্শনের নিম্ন সোপানের সাধনাঙ্গ তাঁর মতে কর্মযোগ, আর পাতঞ্জল দর্শনের উচ্চ সোপানের সাধনাঙ্গ হল ভক্তিযোগ। লেখক বলেন :

ভগবদগীতাতে জ্ঞানযোগ হইতে কর্মযোগে এবং কর্মযোগ হইতে ভক্তিযোগে কেমন করিয়া উত্তীর্ণ হইতে হয় তাহার সর্বাপেক্ষা সুগম পথ যেমন অকৃত্রিম সরল মাধুর্যের সহিত বিশদরূপে প্রদর্শিত হইয়াছে, এমন আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। (পৃ-১৪; দ্বিতীয় অধিবেশন; ভূমিকা)

লেখকের দৃষ্টিতে অর্জুন ক্ষত্রিয়ধর্মের আধ্যাত্মিক অবতার, আর শ্রীকৃষ্ণ ক্ষত্রিয়ধর্মের আধিদৈবিক অবতার। এক সংকটাপন্ন সময়ে সঙ্কটাপন্ন কাজে প্রবৃত্ত হতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন। অর্জুনকে বলা হল ‘নিস্ত্রৈগুণ্য’ হতে, অর্জুন যেন তার অন্তরস্থিত সত্ত্বগুণকে রজস্তমোগুণের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হতে না দেয়। উপদেশ প্রদত্ত হল, ‘অব্যাকুলিত এবং অনাসক্ত চিত্তে ক্ষত্রিয়ধর্ম সাধনে প্রবৃত্ত হও।’ শুধু উপদেশ দান নয়, কৃষ্ণ তাঁর প্রদত্ত উপদেশ কিরূপে অর্জুন পালন করতে সক্ষম হবে সেপথও বাতলে দিলেন :

আমাকে তুমি কায়মনোবাক্যে আশ্রয় কর—আমাতে কর্ম সমর্পণ কর, তাহা হইলে তুমি সহজে সিদ্ধিলাভে কৃতকার্য হইবে। (পৃ-৭৩; নবম অধিবেশন; ব্যাখ্যান)

সংসারযাত্রা নির্বাহের তিনটি পথ—জ্ঞানের পথ, কর্মের পথ এবং ভক্তির পথ। দ্বিজেন্দ্রনাথের মতে আরো একটি পথ আছে তা হল ‘ঐ তিন পথের ত্রিবেণী সঙ্গম’। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই শেষোক্ত পথে চালিত করতে সাংখ্যে উল্লিখিত জ্ঞানের পথে যাত্রা শুরু করার পরামর্শ দিলেন। তিনি অর্জুনকে সাংখ্য শাস্ত্রের সারকথা যেটি ‘আত্মা অজর অমর এবং অপরিবর্তনীয়’—এই ধ্রুব সত্যটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে সাধনের পাঁচটি সোপান উত্তরোত্তর উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি এবং প্রজ্ঞা। গীতার প্রথম উপক্রমে বলা হয়েছে বিশুদ্ধ জ্ঞানের কথা। শ্রদ্ধাই সাধনের প্রথম সোপান। আত্মার ধ্রুব অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন আবশ্যক এটাই হল সাধনের প্রথম শর্ত। দ্বিতীয় সোপান বীর্য, জ্ঞানের কথাকে কাজে ফলাতে গেলে বীরত্বের প্রয়োজন। তৃতীয় সোপান স্মৃতি-নিষ্কাম কর্মের সাধন অভ্যাসের ফলে সাধকের স্মরণে দৃঢ়রূপে মুদ্রিত হয়, তখন আত্মাতে এক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রাদুর্ভাব ঘটে। আত্মশক্তির প্রাদুর্ভাব সাধনের তৃতীয় সোপান। চতুর্থ পর্যায় হল সমাধি বা একাগ্রতা। আত্মশক্তি সুপরিস্ফুট হলে সাধকের মন লক্ষ বিষয়ে স্থিরীকৃত হয়, লক্ষ বিষয়ে মনের যে স্থৈর্য, এটাই সাধনার চতুর্থ পর্যায়, পঞ্চম পর্যায়ে পাই প্রজ্ঞা, জ্ঞাতব্য বিষয়ের সম্যক জ্ঞান। লেখক বলেছেন বিস্তারিতভাবে এই শেষ পর্যায়ের প্রসঙ্গে :

. . . . আত্মশক্তি সহকারে মন লক্ষ্য বস্তুতে তদগত ভাবে নিবিষ্ট হইলে সেই লক্ষ্য বস্তুতে জ্ঞানাগ্নি প্রবেশ করিয়া লক্ষ্য বস্তুকে জ্ঞানময় করিয়া তোলে। এইরূপ অবস্থায় সাধকের পরম পরিশুদ্ধ জ্ঞান সকল বস্তুর ভিতরে প্রবেশ করিয়া সর্বভূতে পরমাত্মাকে দর্শন করে এবং পরমাত্মাতে সর্বজগৎ দর্শন করে। ইহারই নাম যোগ; ইহাই সাধনের পঞ্চম পইটা। (পৃ-২১; তৃতীয় অধিবেশন, ব্যাখ্যান)

লক্ষণীয় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সাংখ্যের উপদেশ প্রথমে দিয়েছেন, তারপরে দিয়েছেন যোগের উপদেশ।

লেখক বিস্তারিতভাবে ত্রিগুণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছেন, কারণ ত্রিগুণ পদার্থমধ্যে আমাদের দেশীয় তত্ত্বজ্ঞানের সারকথাগুলি রয়ে গেছে, এগুলি না জানলে গীতার তাৎপর্য যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ বারংবার ঘোষণা করেছেন গীতাশাস্ত্রের পরামর্শের কথা—তা হল যোগস্থ হয়ে কর্ম কর, পরমাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর মঙ্গলকাজে যুক্ত হতে বলা হয়েছে। ফলের আশায় যারা কর্ম করে, তারা কৃপার পাত্র, কিন্তু যাঁরা বুদ্ধিযোগে যুক্ত, তাঁরাই সুকৃত ও দুষ্কৃত দুইয়ের থেকেই রেহাই পান। যোগ আসলে কর্মনৈপুণ্যেরই আর এক নাম মাত্র। গীতায় যে নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে তা জ্ঞানী এবং ভক্ত উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, উভয়েরই অবশ্যকর্তব্য।

কৃষ্ণ অর্জুনকে জ্ঞানী হতে বলেছেন, কর্মী হতে বলেছেন, আবার ভক্ত হতেও বলেছেন। এককথায় কৃষ্ণ অর্জুনকে জীবন্মুক্ত হবার কথা বলেছেন। ‘জীবন্মুক্তি’ ব্যাপারটা কী? গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের অষ্টচত্বারিংশ শ্লোক এবং তৃতীয় অধ্যায়ের সার্ধ-ঊনবিংশ শ্লোকের উল্লেখে তা জানিয়েছেন লেখক—যোগস্থ হয়ে কর্ম করতে হবে, অনাসক্ত হয়ে কর্ম করতে হবে, সিদ্ধি-অসিদ্ধির মধ্যস্থলে সমভাবে দন্ডায়মান থেকে কর্ম করতে হবে।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বোপরি অধ্যাত্ম জগতের মানুষ, তিনি ছিলেন ভক্ত যদিও তাঁর ভক্তি ভাবনা নিছক হৃদয়োচ্ছ্বাস মাত্র ছিল না, তা ছিল শাস্ত্রানুসারী ও যুক্তিনিষ্ঠ। সেইজন্য তিনি শেষ পর্যন্ত না বলে পারেন নি— ‘শিবের অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে যেমন যজ্ঞ নিষ্ফল হয়, তেমনি ভক্তিযোগের সাহচর্য ব্যতিরেকে জ্ঞানযোগই বা কি, কর্মযোগই বা কি, দুই-ই নিষ্ফল হয়।’ প্রসঙ্গত লেখক গীতাশাস্ত্রের সার উপদেশ বলে অভিহিত করেছেন—

ক. পরাৎপর পরম সত্যে—পরমাত্মাতে—জ্ঞানের যোগ সাধন করার কথা বলা হয়েছে। এটি হল জ্ঞানযোগের উপদেশ।

খ. ইন্দ্রিয় সংযম করে ধর্মানুমোদিত কর্তব্যের পথে মনের যোগসাধন করা চাই। এটি হল কর্মযোগের উপদেশ।

গ. সর্বান্তঃকরণের সঙ্গে ঈশ্বরেতে প্রীতি স্থাপন করা চাই। এটি হল ভক্তিযোগের উপদেশ।

লেখকের উপলব্ধিতে ভক্তিযোগের উপদেশ কেবল গীতাতেই লভ্য নয়, ‘সর্বদেশের সর্ব শাস্ত্রেরই প্রধানতম উপদেশ।’ লেখক তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে দুটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। এক বাইবেলের নববিধান থেকে। দুই পাতঞ্জল দর্শনের ভোজরাজ-কৃত টীকা থেকে। ঈশা মহাপ্রভুকে জিজ্ঞাসা করলেন, which is the great commandment in the law?

উত্তর হল, Thou shalt love the Lord thy God with all thy heart, and with all thy soul, and with all thy mind. This is the first and great commandment.

ঈশ্বর-প্রণিধানাদ বা সূত্রের টীকায় বলা হয়েছে : ঈশ্বর-প্রনিধানং তত্র ভক্তিবিশেষঃ বিশিষ্ট মুপাসনং; সর্বক্রিয়ানামপি তত্রার্পণং বিষয় সুখাদিকং ফলং অনিচ্ছন সর্বা: ক্রিয়াস্তস্মিন গুরৌ অর্পয়তীতি।—ঈশ্বরের ভক্তি বিশিষ্ট রকমের উপাসনা। বিষয়সুখাদি ফলের প্রত্যাশা না করে পরম গুরু পরমেশ্বরেতে সমস্ত কর্মের সমর্পণ।

লেখকের কাছে শ্রীকৃষ্ণ জীবাত্মার প্রিয়তম পরমাত্মা। তিনি জীবাত্মার পরম সহায় এবং পরম সুহৃদ। গীতার মুখ্যতম সার উপদেশ শেষ অধ্যায়ে বর্ণিত—

সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।

অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।। ১৮। ৬৬

কৃষ্ণ যে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন অর্জুনকে, লেখকের ইঙ্গিত, আমরাও যেন সেই আশ্বাসবাণীকে আশ্রয় করে শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হই।

বালগঙ্গাধর তিলকের ‘গীতা রহস্য’

বালগঙ্গাধর তিলক প্রণীত ‘গীতা রহস্য বা কর্মযোগ শাস্ত্রে’র প্রকাশকাল ১৯২৪। গীতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেশি-বিদেশি নানা পন্ডিত ও গবেষকগণ সুদীর্ঘকাল ধরেই করে আসছেন। এ ধারা এখনও অব্যাহত। কিন্তু বালগঙ্গাধর তিলক প্রণীত গ্রন্থটি সঙ্গত কারণেই দেশে-বিদেশে সমভাবে আদৃত এবং বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত হয়। রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ করেন ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। প্রশ্ন, হল তিলক কেন বহুচর্চিত এই বিষয়ের আলোচনায় নিযুক্ত হলেন? যোল বৎসর বয়সে তিলক তাঁর পিতৃদেবকে রোগশয্যায় গীতার ভাষ্য বিবৃতি নামীয় মহারাষ্ট্রীয় টীকা শোনাবার ভার পেয়েছিলেন। সঙ্গত কারণেই সেদিনের সেই কিশোর গীতার ভাবার্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হন নি।

না হলেও গীতা সম্পর্কে তাঁর মনে একটি সংস্কার দৃঢ়ীভূত হয়। ক্রমে তিলক সংস্কৃত ও ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি লাভ করার পর গীতার সংস্কৃত ভাষ্য, অন্যান্য টীকা এবং মারাঠী ও ইংরেজিতে লিখিত নানা পন্ডিতের আলোচনা পাঠ করার সুযোগ পান। তিলকের মনে একটি প্রশ্ন জাগে। প্রশ্নটি এই—যে অর্জুন নিজের আত্মীয়-প্রিয়জনদের সঙ্গে যুদ্ধ করা অন্যায়, অধর্ম বলে মনে করলেন, সেই তাঁকেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত করার জন্য যে গীতা কথিত হল শ্রীকৃষ্ণের বকলমে, সেখানে ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা বা ভক্তি দ্বারা মোক্ষপ্রাপ্তির বিধির—শুধু মোক্ষমার্গের বিচার কেন করা হল? তিলক গীতার কোনো টীকাতেই এই সংশয়ের উপযুক্ত জবাব পেলেন না। শেষে গীতার প্রচলিত সমস্ত টীকাভাষ্য সরিয়ে রেখে কেবল গীতারই স্বতন্ত্র বিচার করে বহুবার তা পাঠ করেন। শেষ পর্যন্ত তিলকের সংশয় তিরোহিত হল। তিনি অনুধাবন করলেন—গীতা-নিবৃত্তি প্রধান নয় কোন মতেই, তা কর্মপ্রধান।

তিলকের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, গীতাতে ‘যোগ’ শব্দটি ‘কর্মযোগ’ অর্থেই প্রযুক্ত। তিনি মহাভারত, বেদান্তসূত্র, উপনিষদ এবং বেদান্তশাস্ত্র বিষয়ক অন্যান্য সংস্কৃত ও ইংরেজি গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেন এবং তাঁর পূর্বমতই দৃঢ় হল। গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় প্রবৃত্তিপ্রধান—তিনি নি:সন্দিগ্ধ হলেন। অতঃপর তিলক সিদ্ধান্ত করলেন প্রাচীন টীকাকারদের স্থিরীকৃত তাৎপর্য কেন তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি, সকল টীকাকারদের মত সংগ্রহপূর্বক, তাঁদের ব্যাখ্যার অপূর্ণতার কারণ নির্দেশপূর্বক, সর্বোপরি অন্য ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে গীতা ধর্মের তুলনা লিপিবদ্ধ করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিলক তাঁর প্রস্তাবিত গ্রন্থের খসড়া প্রস্তুত করেন মান্ডালের জেলে। সহজেই অনুমেয় যে, তিনি প্রাসঙ্গিক গ্রন্থাদি সব এখানে পান নি। এই প্রতিকূলতার মধ্যেও কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না, শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রস্তাবিত গ্রন্থটির পান্ডুলিপি প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হল।

১.১। তিলক তাঁর গীতা রহস্যের নামকরণ করেছেন ‘কর্মযোগ শাস্ত্র’। কেন এরূপ নামকরণ? মনু প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রে বর্ণাশ্রম বিহিত আচরণ ও সেগুলির নিয়ম বিস্তারিতভাবে নির্দিষ্ট থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এসব হল আচার সংগ্রহ পুস্তক মাত্র। যেসব বিধি-নিষেধ কিংবা নিয়মের কথা বর্ণিত হয়েছে, সেগুলির কারণ বা মূলতত্ত্ব অনুল্লিখিত থেকে গেছে। স্মৃতিগ্রন্থগুলি কারণ ব্যাখ্যায় নীরবতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু তিলক বিশ্বাস করতেন মানুষ যেহেতু জ্ঞানবান প্রাণী, তাই নিছক কিছু বিধি বিধান পাঠ করে বা জেনেই সেকখনও সন্তষ্ট হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। তার আগ্রহ বিধি-নিষেধ ও নিয়মের যুক্তি বা মূলতত্ত্বে। সেতার মননশীলতা দিয়ে এগুলি বিচার করতে চায়। এইজন্যই এমন এক শাস্ত্রের প্রয়োজন যেখানে কার্যাকার্য ব্যবস্থিতি হয় তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে। গীতার অপূর্বতা কিংবা অনন্যতা এখানেই যে কর্মাকর্ম শাস্ত্রের সমস্ত তাৎপর্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই তিলক তাঁর গ্রন্থের নামকরণ করেছেন ‘কর্মযোগ শাস্ত্র’।

১.২। বঙ্কিম ও তিলক : গীতার ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে—

গীতার প্রসঙ্গে বঙ্কিম ও তিলকের দৃষ্টিভঙ্গিগত সাযুজ্য আমাদের চমৎকৃত করে। বঙ্কিমই প্রথম কোনো আধুনিক ভারতীয় ভাষায় (Modern Indian Language, বাংলা) পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য পাশ্চাত্য প্রথা অবলম্বনপূর্বক, পাশ্চাত্য ভাবের সহায়তায় গীতার মর্ম বোঝানোর উদ্দেশ্যে গীতার আধুনিক টীকা রচনায় মনোনিবেশ করেন। বঙ্কিম বিশ্বাস করতেন হিন্দুধর্ম সকল ধর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর এই ধর্মের সমগ্র প্রকৃতি ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হয়েছে শ্রীমদ্ভগবদগীতায়। অন্যদিকে তিলকের মতে সংক্ষেপে অথচ নি:সন্দিগ্ধ রূপে আধুনিক হিন্দুধর্মের তত্ত্ব বোঝাবার জন্য গীতার তুল্য গ্রন্থ আর মিলবে না।

বঙ্কিমের মতে গীতায় যে কর্মযোগের বিষয় উপস্থাপিত, তাতে ‘কর্মযোগীর কর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য সর্বভূতের হিতসাধন—সর্বভূতে সমদৃষ্টি, সর্বভূতে আত্মজ্ঞান এবং সর্বভূতের হিতসাধন।’

তিলকও গীতার প্রতিপাদ্য বলে যে নীতিশাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন, সেখানেও সর্বভূতে আত্মজ্ঞানের ভিত্তিতে সর্বভূতে সমদৃষ্টি অক্ষুণ্ণ রেখে সর্বভূতের হিতসাধনের কথাই বলা হয়েছে।

বঙ্কিম ও তিলক উভয়েই ভগবদগীতার মধ্যেই হিন্দুর জীবনদর্শন, নীতিশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের সম্পূর্ণ রূপ খুঁজে পেয়েছেন।

তবে বঙ্কিম যেখানে গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৯শ শ্লোক পর্যন্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিলক সেখানে সমগ্র গীতার অনুবাদ ও আলোচনা সম্পন্ন করেন। আর একটি কথা, তিলক ও বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গিগত সাযুজ্য দেখা গেলেও তিলক কখনই বঙ্কিমের গীতার ব্যাখ্যা পড়েন নি, কেননা তা সম্ভব ছিল না।

১.৩। শঙ্করাচার্য ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে গীতা—

গীতার প্রথম ভাষ্য রচনার কৃতিত্ব শঙ্করাচার্যের নয়। তাঁর বহু পূর্ব থেকেই গীতার নানা ভাষ্য চলিত ছিল। এইসব ভাষ্যে জ্ঞান ও কর্ম একটি পুরুষের দ্বারা এককালেই অনুষ্ঠেয়, এমন সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। শঙ্করাচার্য তাঁর পূর্ববর্তীকালে প্রচলিত এইসব ভাষ্যগুলির যুক্তি ও সিদ্ধান্তগুলি দূরীকরণের অভিপ্রায়েই তাঁর নিজস্ব ভাষ্য রচনা করেন। শঙ্করাচার্যের মতে গীতা শাস্ত্রের প্রয়োজন—সহেতুক সংসারের অত্যন্ত উপরতি বা নিবৃত্তি লক্ষণ পরম নি:শ্রেয়স। এরও উদ্ভব হল সর্বকর্ম সংন্যাসপূর্বক আত্মজ্ঞাননিষ্ঠারূপ ধর্ম। শঙ্করাচার্য তাঁর সিদ্ধান্তের অনুকূলে উদ্ধৃত করেছেন অনুগীতার ‘জ্ঞানং সংন্যাসলক্ষণম’ শ্লোকটি। তৎসহ গীতায় উদ্ধৃত ‘সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ শ্লোকটি। শঙ্করাচার্যের মতে গীতার সার কথা মিলবে যে শ্লোকটিতে সেটি হল—

মৎকর্মকৃন্মৎপরমো মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ।

নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মামেতি পান্ডব।। ১১। ৫৫

—হে পান্ডব, সমস্ত কর্ম আমার অর্থাৎ পরমেশ্বরের যে এবংবিধ বুদ্ধিতে কর্ম সম্পাদন করে, যে নাকি মৎপরায়ণ ও সঙ্গবিরহিত, যে সমস্ত প্রাণী সম্পর্কে নির্বৈর, সেই ভক্ত আমার সঙ্গে মিলিত হয়, এই শ্লোকে একমাত্র যা নি:শ্রেয়স, মোক্ষলাভের জন্য অনুষ্ঠেয়, তারই উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে। কর্মে যারা নিষ্ঠাবান, কর্মেই যাদের অধিকার তারা যদি কতৃত্বের অভিমান ত্যাগপূর্বক ঈশ্বরের জন্যই কর্ম করছি এইরূপ ধারণা নিয়ে কর্মের অনুষ্ঠানাদি করে, সেক্ষেত্রে কর্মের মাধ্যমেই তাদের চিত্তশুদ্ধি ঘটে, এবং কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠা প্রাপ্তির হেতুভূত বলে পরতন্ত্রভাবে মোক্ষের উপায়স্বরূপ হয়। শঙ্করাচার্য মোক্ষলাভের পক্ষে জ্ঞান ও কর্মনিষ্ঠার মুখ্য ও গৌণ দ্বিবিধ উপযোগিতা নিয়েই আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতা হল তত্ত্বসিদ্ধান্তে সাংখ্য ও বেদান্তের সঙ্গে ঈশ্বরবাদকে যুক্ত করে, প্রয়োগের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও ভক্তিমার্গকে মিলিয়ে যে উদার ও ব্যাপক সমন্বয়ের ভিত্তিতে গীতায় কর্মযোগশাস্ত্র উপস্থাপিত, আচার্য শঙ্করের ভাষ্যে সেই ঐতিহাসিক তাৎপর্য ধরা পড়েনি। গীতার প্রধান প্রতিপাদ্য যে প্রবৃত্তিপর কর্মযোগশাস্ত্র, আচার্য শঙ্করের দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে নি। শঙ্করাচার্যের মূল অভিপ্রায় ছিল শ্রুতি-স্মৃতি-বিহিত বৈদিক ধর্মের সংরক্ষণ। তাঁর প্রধান কীর্তি নিবৃত্তিপর বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের পুনঃ প্রবর্তন। শঙ্করাচার্যের বক্তব্য হল সবই অনিত্য তা সেআমি, তুমি কিংবা মানুষের দৃষ্টিগোচর দৃশ্যমান যে জগৎ, সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থসমূহ, কোন কিছুই সত্য নয়। একই শুদ্ধ ও নিত্য পরব্রহ্মে ইত্যাদি যা ভেবে থাকি, তার মায়াতে মানুষের ইন্দ্রিয় সমক্ষে নান্যত্ব অবভাসিত। মানুষের আত্মাও পরব্রহ্মরূপই। আত্মা ও পরব্রহ্মের একতার পূর্ণজ্ঞান না হলে মোক্ষলাভ অসম্ভব। একেই বলা হয় অদ্বৈতবাদ। শুদ্ধ, বুদ্ধ, নিত্য ও মুক্ত পরব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোনো কিছুরই সত্যতা নেই, স্বতন্ত্র ও সত্য বস্তু নেই। আমরা যে বৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ করি তা নিছকই মানবীয় দৃষ্টির ভ্রম। এমনকি মায়াও সত্য নয়, তাও মিথ্যা। শঙ্করাচার্যের মতে শেষ পর্যন্ত সব কাজ ছেড়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলে তবেই মোক্ষলাভ সম্ভব। কর্ম ও জ্ঞান পরস্পরবিরোধী, অনেকটা আলো ও অন্ধকারের মত। সকল বাসনা ও কর্ম পরিত্যাগ না করলে ব্রহ্মজ্ঞান পূর্ণতা পায় না। সকল কর্ম ত্যাগ করে জ্ঞানেতে মগ্ন থাকার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তটির পরিচিতি নিবৃত্তিমার্গ বা জ্ঞাননিষ্ঠা। শঙ্করাচার্যের মতে কর্মই জ্ঞানলাভের গৌণ সাধন এবং সকল কর্ম সন্ন্যাস পূর্বক জ্ঞানেই মোক্ষলাভ।

শঙ্কর সম্প্রদায়ের পরে বিশিষ্টাদ্বৈত সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করলেন শ্রীরামানুজাচার্য। এঁদের মতে মায়া ও মিথ্যাত্ববাদ এবং অদ্বৈত সিদ্ধান্ত দুটির কোনটিই সত্য নয়। জীব, জগৎ ও ঈশ্বর এই তিন সম্পর্কিত তত্ত্ব ভিন্ন হলেও প্রথম দুটি অর্থাৎ জীব ও জগৎ একই ঈশ্বরের শরীর। চিৎ ও অচিৎ বিশিষ্ট ঈশ্বর এক, সূক্ষ্ম চিৎ অচিৎ থেকেই পরবর্তীতে স্থূল চিৎ-অচিৎ উদ্ভূত। জ্ঞান-কর্ম-ভক্তি এ তিনটিই গীতাতে বর্ণিত। তত্ত্বজ্ঞান দৃষ্টিতে বিশিষ্টাদ্বৈত এবং আচার দৃষ্টিতে বাসুদেব ভক্তি হল গীতার সার। রামানুজাচার্যের মতে কর্মনিষ্ঠা স্বতন্ত্র বস্তু কিছু নয়, তা জ্ঞাননিষ্ঠারই উৎপাদক। অর্থাৎ শঙ্কর সম্প্রদায় থেকে এঁর যে স্বাতন্ত্র্য তা হল অদ্বৈত জ্ঞানের স্থলে বিশিষ্টাদ্বৈত এবং সন্ন্যাসের স্থলে ভক্তিকে প্রভেদ করা। রামানুজাচার্যও শেষ কর্তব্যরূপে ভক্তিকেই স্বীকার করে গেছেন। রামানুজাচার্যের পরে শ্রীমধ্বাচার্যের প্রসঙ্গ। ইনি দ্বৈতী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। এঁর মতে গীতায় নিষ্কাম কর্মের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিষ্কাম কর্মসাধন মার্গ মাত্র, ভক্তিই সব, ভক্তিই চরম নিষ্ঠা। ভক্তি যদি সিদ্ধ হয়, তবে কর্ম কিছু করা বা না করায় যায় আসে না।

বৈষ্ণবপন্থী শ্রীবল্লভাচার্য শুদ্ধাদ্বৈত মতের প্রবর্তক। এই মত বিশিষ্টাদ্বৈত অথবা দ্বৈতমত এ দুটি থেকেই স্বতন্ত্র। বল্লভাচার্য শঙ্করাচার্যের মত কখনই স্বীকার করেন নি যে, জীব ও ব্রহ্ম এক। তিনি বলেন, জীব ঈশ্বরের অংশ মাত্র। বল্লভাচার্য বলেন, মায়াময় এই জগৎ মিথ্যা নয়। এঁর মতে মায়াও ঈশ্বর-বিভক্ত এক শক্তি মাত্র। বল্লভাচার্য বলেছেন, মায়াগ্রস্ত জীবের মোক্ষজ্ঞান তখনই সম্ভব যখন সেলাভ করে ঈশ্বরের অনুগ্রহ। অর্থাৎ মোক্ষের মুখ্য সাধন হল ভগবদ্ভক্তি।

এবারে আসি নিম্বাকাচার্যের প্রসঙ্গে। নিম্বাকাচার্য জীব, জগৎ ও ঈশ্বর এই তিন যে ভিন্ন তা স্বীকার করতেন সেইসঙ্গে বিশ্বাস করতেন জীব ও জগতের অস্তিত্ব স্বতন্ত্র নয়, এরা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অবলম্বন করে বিদ্যমান। মূল পরমেশ্বরের মধ্যেই জীব ও জগতের সূক্ষ্মতত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত। রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত থেকে এঁর মত স্বতন্ত্র, বলাই বাহুল্য। নিম্বাকাচার্যের মতকে দ্বৈতাদ্বৈতী বলা চলে।

১.৪। তিলকের গীতা ভাষ্যের বিশেষত্ব :

তিলকের গীতা ভাষ্যের বিশেষত্বগুলিকে আমরা সূত্রাকারে উপস্থাপন করতে পারি—

ক. গীতার কর্মযোগের ওপর প্রথম গুরুত্ব আরোপ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। কিন্তু তিলকের বিশেষত্ব এইখানে যে, তিনিই প্রথম কর্মযোগ শাস্ত্র রূপে গীতার বিচারে প্রয়াসী হন এবং কর্মযোগ শাস্ত্র রূপে গীতাকে প্রতিপন্নও করেন।

খ. তিলক যে ভাষ্য রচনা করেছেন তা সর্বসাধারণের জন্য নয়। তাঁর উদ্দিষ্ট পাঠকসমাজ হলেন বিদগ্ধ, মননশীল পন্ডিতেরা।

গ. তিলকের ভাষ্যে যুক্তি ও শ্রদ্ধাবোধের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।

ঘ. তিলক তাঁর অভিলষিত লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রগুলির বিচার করেছেন শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে, অন্যদিকে য়ুরোপের দর্শন ও নীতিশাস্ত্রসমূহের বিচার করেছেন পাশ্চাত্য দেশীয় তর্কশাস্ত্রে গৃহীত পদ্ধতিতে।

ঙ. তিলকের সবিশেষ কৃতিত্ব, তিনি ভগবান শঙ্করাচার্যের মত খন্ডন করেছেন। প্রমাণ করেছেন গীতায় শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। তিলক শাস্ত্রীয় বিচারপদ্ধতিকেই অবলম্বন করেছেন এবং উপক্রম, উপসংহার, অভ্যাস, অপূর্বতা, ফল, অর্থবাদ ও উপপত্তি এই সাতটি বিষয়কে উপায়স্বরূপ গ্রহণ করেছেন।

চ. তিলকের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে ধর্মাধর্ম বিচারে নীতিশাস্ত্রের উপযোগিতা। বিবেকানন্দ নীতিতত্ত্বের ভিত্তির সন্ধান পেয়েছিলেন গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের অন্তর্গত ২৮সংখ্যক শ্লোকে। বিবেকানন্দ মনে করতেন বেদান্তের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্য হল গীতা। আর তিলক নীতিশাস্ত্রের বিচার করেছেন বেদান্তের অধ্যাত্ম জ্ঞানের নিরিখে। তিনি দেখালেন পাশ্চাত্যের নীতিশাস্ত্রের আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক তত্ত্বসমূহের অসম্পূর্ণতা। তিনি প্রমাণ করেছেন, গীতার কর্মযোগ শাস্ত্র আসলে ব্যবহারিক বেদান্ত।

ছ. গীতার কর্মযোগকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে কিরূপে প্রয়োগ করা যায় তিলক তারই নিদর্শন স্থাপন করেছেন তাঁর ভাষ্যে। তাঁর ভাষায় ‘প্রবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্ম’। কেবল মনুষ্য জাতিই মাত্র নয়, সর্বভূত তথা মনুষ্যলোক ভিন্ন অন্যান্য লোককেও ধারণ, পোষণ, রক্ষণ ও পালন করতে হবে। এইভাবে তিলক ‘লোক সংগ্রহে’র উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লোক সংগ্রহের জন্যও কর্ম ছাড়া নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।

জ. তিলক গীতার কর্মযোগের সঙ্গে পাশ্চাত্য আধিভৌতিক কর্মমার্গের পার্থক্য সম্পর্কে আলোকপাত করে গীতার কর্মযোগের স্বাতন্ত্র্যকে পরিস্ফুট করেছেন।

ঝ. লেখক প্রতিপন্ন করেছেন যে, বর্তমান গীতা এবং বর্তমান মহাভারত রচয়িতা একজনই।

ঞ. গীতার অনুবাদ এবং গীতা রহস্য পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।

ট. তিলকের মতে কর্মই গীতার মধ্যবিন্দু মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই বলে তিনি জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগকে এড়িয়ে যান নি। বরং দেখিয়েছেন যে জ্ঞান কর্মেই পরিণতি প্রাপ্ত হয়। এদিক দিয়ে দেখলে বলা যায়, তিলক জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন।

তিলক বলেছেন :

. . . . যদিও আমার এই মত মান্য নহে যে, সাংসারিক কর্মকে গৌণ অথবা ত্যাজ্য ধরিয়া ব্রহ্মজ্ঞান ও ভক্তি প্রভৃতি শুধু নিবৃত্তিপ্রধান মোক্ষমার্গেরই নিরূপণ গীতাতে আছে; তথাপি আমি এমন বলি না যে, মোক্ষপ্রাপ্তির মার্গের আলোচনা ভগবদগীতাতে মোটেই নাই। আমিও এই গ্রন্থে স্পষ্ট দেখাইয়াছি যে, গীতাশাস্ত্র অনুসারে এই জগতে প্রত্যেক মনুষ্যের প্রথম কর্তব্যই এই যে, সেপরমেশ্বরের শুদ্ধ স্বরূপের জ্ঞান প্রাপ্ত হইয়া, উহা দ্বারা নিজের বুদ্ধিকে যতদূর পারে ততদূর নির্মল ও পবিত্র করিয়া লইবে। . . . যুদ্ধের আরম্ভে অর্জুন এই কর্তব্যমোহে বাঁধা পড়িয়াছিলেন যে যুদ্ধ করা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হইলই বা, কিন্তু কুলক্ষয় আদি ঘোর পাতক হইলে যে যুদ্ধ মোক্ষপ্রাপ্তিরূপ আত্মকল্যাণের নাশ করিবে, সেই যুদ্ধ করা উচিত বা অনুচিত। অতএব আমার এই অভিপ্রায় যে, ঐ মোহ দূর করিবার জন্য শুদ্ধ বেদান্তের ভিত্তিতে কর্ম— অকর্মের এবং সঙ্গে সঙ্গেই মোক্ষের উপায়সমূহেরও পূর্ণ বিচার করিয়া এই প্রকার স্থির করা হইয়াছে যে, এক তো কর্ম কখনও দূরই হয় না এবং দ্বিতীয় উহা ছাড়াও উচিত নহে, এবং যাহা দ্বারা কর্ম করিলেও কোন পাপ লাগে না এবং অন্তে উহা দ্বারাই মোক্ষও লাভ হয়, গীতাতে সেই যুক্তিরহ—জ্ঞানমূলক, ভক্তিপ্রধান কর্মযোগেরই—প্রতিপাদন করা হইয়াছে।

তিলক আরও বলেছেন :

গীতা উপদেশের রহস্য যদি উদঘাটন করিতে হয় তবে এই তাহার উপক্রম উপসংহার ও পরিণাম ফল আলোচনা করা আবশ্যক। ভক্তির দ্বারা কিরূপে মোক্ষলাভ হয়, কিংবা ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা অথবা পাতঞ্জল যোগের দ্বারা কিরূপে তাহা লাভ করা যায়, ইত্যাদি নিবৃত্তিপর মার্গ কিম্বা কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসধর্ম সম্বন্ধীয় প্রশ্নসমূহের কেবলমাত্র আলোচনা করিয়া কোন লাভ নাই।

প্রথম প্রকরণেই উপযুক্ত দৃষ্টান্তের উল্লেখে তিলক প্রতিপন্ন করেছেন, গীতার মূল বিষয় প্রবৃত্তি ধর্মের জ্ঞান—

ক. তস্মাদযুধ্যস্ব ভারত (গীতা. ২.১৮) (অতএব অর্জুন তুমি যুদ্ধ কর)

খ. তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ (গীতা. ২.৩৭) (তুমি যুদ্ধ করার নিশ্চিত সঙ্কল্প নিয়ে উত্থান কর)

গ. তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর (গীতা. ৩.১৮) (অতএব তুমি আসক্তি ছেড়ে নিজ কর্তব্যকর্ম সম্পাদন কর)

ঘ. কুরু কর্মৈব তস্মাত্ত্ব (গীতা. ৪.১৫) (অতএব তুমি কর্মই কর)

ঙ. মামনুস্মর যুধ্য চ (গীতা. ৮.৭) (আমাকে স্মরণ কর ও যুদ্ধ কর)

চ. জ্ঞাত্বা শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম কর্তুমিহার্হসি (গীতা. ১৬.২৪) (শাস্ত্রে যা বলেছে তা বুঝে সেই অনুসারে এই লোকে তোমার কর্ম করা উচিত)

জ. এতান্যপি তু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত ফলানি চ।

কর্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম।। (গীতা. ১৮.৬) (অতএব এইসকল কর্মও আসক্তি না রেখে ফলত্যাগপূর্বক করতে থাকা চাই / পার্থ, এই হচ্ছে আমার নিশ্চিত অভিমত)

অষ্টাদশ অধ্যায়ের একেবারে শেষের দিকে অর্জুন জানিয়েছেন যে, শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদে তাঁর মোহ বিনষ্ট হয়েছে, স্মৃতি ফিরে এসেছে। নি:সন্দিগ্ধ হয়েছেন। বলেছেন, ‘করিষ্যে বচনং তব’, তোমার কথামতই কাজ করব অর্থাৎ যুদ্ধ করব।

সংক্ষেপে যদি গীতার বিষয়কে উল্লেখ করতে হয় তাহলে বলতে হবে আপন আত্মীয়-পরিজনকে শত্রুজ্ঞানে যে অর্জুন যুদ্ধে তাদের বধ করতে অনীহা দেখিয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণের উপযুক্ত উপদেশে তিনি সেই অনীহামুক্ত হয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবার অঙ্গীকার করলেন। এইভাবেই শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য ফলবতী হয়েছে। তিলক এভাবেই গীতার উপক্রম ও উপসংহারের মধ্যে সঙ্গতি লক্ষ্য করেছেন।

কর্মযোগের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপের প্রেক্ষাপটটিও বিশ্লেষণের দাবী রাখে। শুধু গীতার ওপর নির্ভরতাই এর একমাত্র কারণ নয়। গীতায় ভক্তিবাদ বর্তমান কিন্তু এ সত্য অনস্বীকার্য যে গীতার কর্মযোগ হল নৈতিক বা ethical, আর এর মূলে রয়েছে জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির সমন্বয়। গীতার কর্মযোগের আদর্শটা কী? আদর্শ হল সর্বভূতে যে ঈশ্বর বিরাজমান, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সর্বভূতের হিতসাধন কর্তব্য, অবশ্যই তা করতে হবে নিরাসক্ত ভাবে। অতীব দুঃখের বিষয়, এই আদর্শ থেকে পরবর্তীকালে আমাদের সমাজ, দেশ বিচ্যুত হয়। পরবর্তীকালে লক্ষ্য করা গেল ধর্মের ভক্তিপ্রধান হয়ে ওঠা। উচ্চারিত হল ভক্তিতেই মুক্তি। মানুষ ভক্তিপথকে অবলম্বন করে পরিহার করল কর্মের পথ এবং জ্ঞানচর্চার পথ। হিন্দুসমাজ প্রবলভাবে তামসিকতার শিকার হয়ে উঠল। এ যাবৎকাল যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমো গুণের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয়ে এসেছিল তা আর রইল না। জ্ঞান ও কর্মের গৌণতা প্রাপ্তির কারণে জীবনচর্যায় অবজ্ঞাত হল সত্ত্ব ও রজো গুণের সম্যক বিকাশ। ধর্ম যখন আধ্যাত্মিকতা বর্জিত হয়, জ্ঞান ও কর্মসাধনায় যখন ছেদ পড়ে, আত্মপ্রকাশ করে অনিবার্যভাবে তামসিক ভাবোন্মত্ততা, পরিণামে হিন্দু সমাজের চরম অধঃপতন লক্ষিত হল। আধ্যাত্মিকতা অপসৃত হল। তামসিকতাকেই মানুষ সাত্ত্বিকতার লক্ষণ বলে আঁকড়ে ধরল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই তামসিকতার মূলে আঘাত হানা সম্ভব হল আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার দুর্দমনীয় প্রভাবে।

আরও একটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ্য। সাংখ্য, বেদান্ত, বৌদ্ধদর্শনের মত মোক্ষপ্রধান তথা নিবৃত্তিসাধনার শাস্ত্রগুলি ক্রমাগত সংসার ও জীবনকে দুঃখময়, মায়াময়, প্রপঞ্চময় ঘোষণা করে মানুষকে একান্তভাবে জীবন বিমুখ, অদৃষ্টবাদী করে তুলেছিল। মানুষ এমনকি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ব্যাপারেও চরম ঔদাসীন্য দেখিয়েছে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজন উপলব্ধি করলেন এদেশে কোনো সমাজসংস্কার মূলক আন্দোলনই ফলবতী হতে পারে না যদি এদেশীয় মানুষদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো না যায়। তাই হিন্দুধর্ম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হল। নবযুগের চিন্তানায়করা সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন কর্মবিমুখ জাতিকে সর্বতোভাবে কর্মনিষ্ঠ করে তুলতে হবে। বিবেকানন্দ রজোগুণের চর্চার ওপর গুরুত্ব দিলেন। তিনি হাঁক দিয়ে বীর্য অবলম্বনের কথা বললেন। দৌর্বল্য পরিহারের পরামর্শ দিলেন। রামমোহন ধর্মের সংস্কারসাধনে ব্রতী হয়ে বেদান্তকে আশ্রয় করলেন। কারণ বিশ্বজনীন ধর্মের উদার আদর্শের সন্ধান তিনি লাভ করেছিলেন বেদান্তেই। বিবেকানন্দও বেদান্তের আধ্যাত্মিক আদর্শকেই ভারতীয় জীবনের পক্ষে উপযোগী মনে করেছিলেন। একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট করা আবশ্যক। আমাদের দেশের চিন্তানায়করা অন্ধভাবে ইউরোপের রাজসিক কর্মোন্মাদনায় নিজেদের ভাসিয়ে দেন নি। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন পাশ্চাত্য আদর্শে দীক্ষিত হলে দেখা দেবে সংযমের অভাব। মানুষ হয়ে উঠবে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। তাই রজোগুণকে সংযত করতে নিয়ন্ত্রণ করতে সাত্ত্বিকতার সাধনার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হল। অবলম্বিত হল গীতা, কারণ গীতায় যে কর্মযোগ উপস্থাপিত তাই প্রকৃতপক্ষে সাত্ত্বিক কর্মের আদর্শ।

বালগঙ্গাধর তিলক নিজ বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে গীতার যেসব Internal evidence দাখিল করেছেন সেগুলির প্রসঙ্গে আসা যাক।

তিলকের মতে ‘যোগী’ এবং ‘কর্মযোগী’ এই দুই শব্দ গীতায় সমানার্থক। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নিজের উপদেশকে ‘যোগ’ নামে অভিহিত করেছেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে স্বয়ং অর্জুন এবং গীতার শেষে উপসংহারে সঞ্জয়ও গীতোক্ত উপদেশের নাম দিয়েছেন ‘যোগ’। যোগশাস্ত্রই গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়। তিলকের বিশ্বাস, যোগমার্গের প্রবর্তক, সমস্ত যোগের সাক্ষাৎ ঈশ্বর যিনি সেই শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং কর্মযোগ প্রতিপাদনের দায়িত্ব নিয়ে সর্বলোকের কল্যাণে অর্জুনকে তার রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন। যোগশাস্ত্রের তাত্ত্বিক আলোচনা ভগবদগীতাতেই কেবল স্থান পেয়েছে, অন্যত্র নয়।

কর্ম ব্যতিরেকে আমরা কেউই অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারি না। কিন্তু কর্ম কেমন করে সম্পাদন করতে হবে, গীতা তাও বলে দিয়েছে। কর্মেই শুধু আমাদের অধিকার, ফললাভ করা বা না করা আমাদের অধিকারভুক্ত নয়।

কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।। ২/৪৭

তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোকে বলা হয়েছে—

কর্মেন্দ্রিয়ৈ: কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে।।

কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা অনাসক্ত বুদ্ধিতে কর্মযোগের আরম্ভকারী যে তারই যোগ্যতাবিশেষ, সেই শ্রেষ্ঠ। এখানেও নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করার যোগের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, আর একেই বলা হয়েছে ‘কর্মযোগ’। এই একই অধ্যায়ের ৮ম শ্লোকে বলা হল—

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্মণঃ।।

নিজের ধর্ম অনুযায়ী নিয়মিত কর্ম কর, কর্ম না করা অপেক্ষা কর্ম করাই অধিক উত্তম। যদি তুমি কর্ম না কর, তোমার শরীর নির্বাহ পর্যন্ত হবে না। ২২ সংখ্যক শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন—

ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং ত্রিষ্ণু লোকেষু কিঞ্চন।

নানাবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি।। ২২

পার্থকে কৃষ্ণ বলছেন যে ত্রিভুবনে তাঁর কোনো কর্তব্যই অবশিষ্ট নেই, কোনো অপ্রাপ্ত বস্তু পাওয়ারও বাকি নেই, তবু তিনি কর্মরতই আছেন। চতুর্থ অধ্যায়ের বিংশ শ্লোকে দেখি—

ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ।

কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোহপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ।। ২০

কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে যিনি সদাতৃপ্ত ও নিরাশ্রয়, তিনি কর্মের মধ্যে ডুবে থেকেও কিছুই করেন নি। পঞ্চম অধ্যায়ের সপ্তম শ্লোকে বলা হল—

যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ।

সর্বভূতাত্মভূতাত্মা কুবন্নপি ন লিপ্যতে।। ৭

যিনি যোগযুক্ত, যাঁর অন্তঃকরণ শুদ্ধ, যিনি নিজের মন ও ইন্দ্রিয়সকল জয় করেছেন, সকল প্রাণীর আত্মাই যাঁর আত্মা হয়ে গেছে, তিনি সমস্ত কাজ করলেও অলিপ্ত থাকেন। সর্বভূতে সমদৃষ্টিসম্পন্ন হলে কর্ম করেও কর্মের দ্বারা কেউ বদ্ধ হয় না। দ্বাদশ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে সমস্ত কর্মফল ত্যাগের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে—

সর্বকর্মফলত্যাগং ততঃ কুরু যতাত্মবান।। ১১

অষ্টাদশ অধ্যায়ের নবম শ্লোকে সাত্ত্বিকের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলা হল—

কার্যমিত্যেব যৎ কর্ম নিয়তং ক্রিয়তে।

কেবল কর্তব্যজ্ঞানে যে কর্ম সম্পাদন তাই হল সাত্ত্বিকতা আর যিনি তা সম্পাদন করেন তিনি হলেন সাত্ত্বিক। এই অষ্টাদশ অধ্যায়েরই ৫৭সংখ্যক শ্লোকে কৃষ্ণ বললেন—

চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ।

বুদ্ধিযোগমুপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব।। ৫৭

মনের দ্বারা সব কাজ আমাতে সমর্পিত করে বুদ্ধিযোগের আশ্রয়ে সর্বদা আমাতে চিত্ত রাখ। অর্থাৎ সেই সকল কাজ কৃষ্ণে সমর্পণের কথা ব্যক্ত হয়েছে। সর্বোপরি কাজ করার কথাও অনুক্ত থাকেনি। গীতার কুত্রাপি মোক্ষলাভের জন্য কর্মত্যাগের পরামর্শ প্রদত্ত হয়নি। কর্ম অনুষ্ঠানকারীরা দুটি ভাগে বিভক্ত—

ক. ফলের আশা রেখে যারা সংসারযাত্রা নির্বাহ করে।

খ. নিষ্কাম বুদ্ধিতে নিছক কর্তব্যজ্ঞানে যারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করে।

তিলকের মতে প্রথমোক্তরা স্বর্গপ্রাপ্তিরূপ অনিত্য ফললাভের অধিকারী। দ্বিতীয়োক্তরা নিত্য মোক্ষ ফললাভের অধিকারী। আমরা সাধারণতঃ বন্ধনকে কর্মের ধর্ম বা গুণ বলে মানি। আসলে বন্ধন হল মনের ধর্ম। ব্যবহারিক কর্মে আমাদের আসক্তি জন্মে, ইন্দ্রিয়নিগ্রহের মাধ্যমে তাকে হ্রাস করতে পারলে কর্ম শুদ্ধ অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে সম্পন্ন করলে ‘সাম্যবুদ্ধিরূপ আত্মজ্ঞান দেহান্দ্রিয়াদি মধ্যে প্রবিষ্ট হয় এবং পরিশেষে পূর্ণ সিদ্ধিলাভ ঘটে’। ‘যথাশক্তি ও যথাধিকার নিষ্কাম কর্ম করতে থাকলে কর্মবন্ধন মোচন হয় চিত্তশুদ্ধির দ্বারা শেষে পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব হয়।’

তিলক গীতা শাস্ত্রের উদ্ভবের কারণানুসন্ধান করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ‘কোন কর্মের ভয়ঙ্কর পরিণাম চক্ষের সম্মুখে দেখা গেলেও, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহা কেন করিবে, ইহা বলিবার জন্যই গীতা শাস্ত্রের সৃষ্টি; ইহাই গীতার বৈশিষ্ট্য।’

প্রচলিত ধারণায় কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় এবং জ্ঞানের দ্বারা মুক্ত হয়। এই যুক্তিতে জ্ঞানী ব্যক্তির কর্মসম্পাদন অর্থহীন হয়ে পড়ে। তিলক উপযুক্ত দৃষ্টান্তের সাহায্যে কর্মের দ্বারা লব্ধ জ্ঞানের উপকারিতা বুঝিয়েছেন :

চতুর্দিক জলময় হইলে যেরূপ জলের জন্য কূপের দিকে কেহ ছুটিয়া যায় না, সেইরূপ কর্মের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় সেই জ্ঞান হইলে জ্ঞানী পুরুষকে কর্মের কোন অপেক্ষা রাখিতে হয় না . . . . ।

মোটের ওপর সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা কর্মযোগই গীতায় শ্রেষ্ঠ বলে নির্ধারিত। সন্ন্যাসমার্গের তুলনায় কর্মযোগের গুরুত্ব এখানে স্পষ্ট।

তিলক উপনিষদ, মহাভারত প্রভৃতি থেকেও উপযুক্ত শ্লোকের দৃষ্টান্তে কর্ম সম্পাদনের স্বপক্ষে বলেছেন। ঈশোপনিষদের শ্লোকে বলা হয়েছে—

কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমা:

এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে।। ঈশ-২

কর্মরত থেকে শত বৎসর পর্যন্ত জীবিত থাকার ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। বনপর্বে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—

অকর্মণা বৈ ভূতানাং বৃত্তি: স্যান্ন হি কাচন (বন. ৩২.৮)

কর্ম ব্যতীত প্রাণীমাত্রের জীবনা যাত্রা নির্বাহ হয় না। সাধুদের পরিত্রাণের জন্য, দৃষ্কৃতিদের বিনাশসাধনের জন্য ঈশ্বর অবতাররূপে যে যুগে যুগে অবতীর্ণ হন, প্রকারান্তরে সেও ত কাজই। ধর্ম সংস্থাপনকে কী কাজ-বহির্ভূত বলা যাবে? তিলক গীতার উৎকর্ষ প্রমাণের জন্য পাশ্চাত্য দেশের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ টেনেছেন। তাঁর মতে ‘গীতার কর্মযোগ যেখানে সাত্ত্বিক, এবং পাশ্চাত্য কর্মযোগ সেখান রাজসিক . . .।’ ব্যাখ্যাও করেছেন তিলক :

পাশ্চাত্য কর্মযোগী সুখেচ্ছু বা দুঃখনিবারণেচ্ছু হয়—যাহাই বল না কেন কিন্তু সে‘ইচ্ছু’ অর্থাৎ ‘সকাম’ নিশ্চয়ই, এবং গীতার কর্মযোগী সর্বদা ফল সম্বন্ধে নিষ্কাম হইয়া থাকেন।’

পার্থক্যকে বিস্তারিত করেছেন তিলক :

গীতার স্থিতপ্রজ্ঞের মনে, আমার কর্মের দ্বারা আমি লোককল্যাণ করিতেছি এই অভিমানবুদ্ধি থাকেই না, বরং সাম্যবুদ্ধি তাঁহার দেহ স্বভাবই হইয়া পড়ায়, সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থানুসারে কেবল কর্তব্য বলিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি যে যে কাজ করেন সেসমস্ত স্বভাবত লোককল্যাণকর হইয়া থাকে; এবং আধুনিক পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্রজ্ঞ সংসারকে সুখময় মনে করিয়া এই সংসারসুখ প্রাপ্তির জন্য সমস্ত লোককে লোককল্যাণকর কর্ম করিতে বলেন।

তিলক নানা ভাবেই গীতার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণে প্রয়াস করেছেন। শাস্ত্র সমুদ্রমন্থন করেছেন, গীতার থেকেও সম্ভাব্য সকল সূত্রের সন্ধান করেছেন। পরিশেষে তিলক এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন যে শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুন এবং সঞ্জয় তিনজনের মতে ‘যোগ’ অর্থাৎ কর্মযোগই গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়।’ কেননা শ্রীকৃষ্ণ যে যোগ প্রতিপাদন করেছিলেন তা যেমন কর্মযোগ, অর্জুনও প্রথমে একে ‘যোগ’ (সাম্যযোগ) বলেছেন। সঞ্জয়ও শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের সংবাদকে ‘যোগ বলেছেন।

তুলনামূলক পদ্ধতি অনুসরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তিলকের গীতা রহস্য। বলা যায়, Comparative Religion-এরও বিরল আদর্শ স্থানীয় নিদর্শন। সমগ্র গ্রন্থমধ্যেই তিলকের সেই অনুসন্ধিৎসা, মননশীলতা ও বহুপঠনশীলতার স্বাক্ষর বিদ্যমান। আমরা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করব গীতা ও মহাভারতের শ্লোক বা শ্লোকার্ধের সাযুজ্য নিরূপণ, ব্রহ্মসূত্রের বিভিন্ন সূত্রে ভগবদগীতার ছায়াপাত, গীতা ও বৌদ্ধ গ্রন্থ, গীতা ও বাইবেল প্রভৃতির মধ্যেকার তুলনা। শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুবাদ ও টিপ্পনীতেও তিলকের বিরল মনীষার পরিচয় লভ্য।

ভক্তিযোগ

অশ্বিনীকুমার দত্ত

অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন শিক্ষাব্রতী। সেইসঙ্গে তাঁর অন্য পরিচয় তিনি একজন সারস্বত সাধক ও দেশপ্রেমিকও। ১২৯৪ বঙ্গাব্দে বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে অশ্বিনীকুমার দত্ত ভক্তিযোগ বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতা করেন। বর্তমান গ্রন্থটি সেই বক্তৃতাগুলির সারমর্ম। আলোচ্য গ্রন্থে লেখক ভক্তির মূল তত্ত্ব, লক্ষণ নির্দেশ, ভক্তির পরিপন্থী ও তন্নিবারণের উপায়, অধিকারীভেদে ভক্তির প্রকারভেদ, ভক্তিপথের সহায়, ভক্তির ক্রম ও উৎকর্ষ ইত্যাদি বিষয়- সমূহ বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন। লেখক বলেছেন :

ভগবৎ পদে যে একান্ত রতি তাহারই নাম ভক্তি।

লেখক একেই বলেছেন রাগাত্মিকা ভক্তি, অহৈতুকি ভক্তি বা মুখ্যাভক্তি। ভাবের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত বৈধী ভক্তি সাধন করতে হয়। ভাব হলেই রাগ হয়। রাগ হলেই রাগাত্মিকা ভক্তির আবির্ভাব হয়।

লেখক বলেছেন গৌণী ভক্তি ত্রিবিধ— সাত্ত্বিকী, তামসী ও রাজসী। তামসী থেকে রাজসী, রাজসী থেকে সাত্ত্বিকী ভক্তির উদয় হয়। পরে সাত্ত্বিকী ভক্তি মুখ্যাভক্তিতে পরিণত হয়।

যিনি পরোপকার সাধন করেন, কেবল স্বর্গ কামনা করেন ও ভগবানকে ডাকেন তিনি সাত্ত্বিক ভক্ত। ডাকাতরা যে কালীপূজা করে ডাকাতি করতে বের হতো তা হল তামস ভক্তি। পুত্র, যশঃ, ধন, মান, ঐশ্বর্য কামনা করে যে ভগবানকে ডাকে, কিংবা যে অনিষ্ট করেছে প্রতিশোধে তার অনিষ্ট হোক ইচ্ছা করে যে ভগবানকে ডাকে সেরাজস ভক্ত। তিন প্রকার ভক্তিই সকাম ভক্তি। মুখ্যাভক্তিই কেবল নিষ্কাম। অর্থার্থী কিরূপে মুখ্যাভক্তি লাভ করেন, লেখকের মতে ভক্ত ধ্রুব তার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।

ভক্তিযোগ জাতি, কুল কিংবা বয়সের অপেক্ষা রাখে না। প্রচলিত ধারণায় পরিণত বয়স হল ভক্তি সাধনার প্রকৃষ্ট সময়। লেখকের মতে এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে :

ভক্তিসাধন বাল্য বয়সেই আরম্ভ করা কর্তব্য।

লেখক বলেছেন, ধর্ম বিনা বিদ্যা অকর্মণ্য, ধন অকর্মণ্য। ভক্তিরাজ্যে বর্ণভেদ জাতিভেদ স্থান পায় না। ‘যিনি সংসারের সমস্ত কার্যের মধ্যে তাঁহাকে পাইয়া থাকেন তিনিই তাঁহার ভক্ত।’

যতদূর সম্ভব দুঃসঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হবে। লেখক মনে করেন কুসংসর্গের মত ভক্তিবিরোধী আর কিছুই নেই। কেননা এর থেকেই সমস্ত পাপের উদ্ভব। কুসংসর্গ কাম, ক্রোধ, মোহ, স্মৃতিভ্রংশ, বুদ্ধিনাশও সর্বনাশের কারণ। বিষয়ের ধ্যান করতে করতে তাতে আসক্তি জন্মে তাই বিষয়ের ধ্যান করা ঠিক নয়, ঠিক নয় বিষয়ীর সংসর্গও।

ধ্যায়তো বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গস্তেযূ পজায়তে। সঙ্গাত সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোভিজায়তে।।

বাসনা চরিতার্থ হওয়ার পথে বাধা পেলেই ক্রোধের উদয় হয়। ক্রোধ থেকেই মোহের উৎপত্তি। ক্রোধ হলেই চিত্ত অন্ধকারাবৃত হয়ে পড়ে, চিত্ত অন্ধকারাবৃত হলেই স্মৃতিবিভ্রম উপস্থিত হয়, যা কিছু জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল তা আর মনে পড়ে না, সমস্ত বিপর্যস্ত হয়ে যায়। স্মৃতিবিভ্রম হলেই বুদ্ধিনাশ, সদসৎ বিচারের ক্ষমতা তখন আর থাকে না, বুদ্ধিনাশেই সর্বনাশ—

ক্রোধাদ্ভবতি সক্ষ্মোহঃ সক্ষ্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।

স্মৃতি ভ্রংশাদ্বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।। ২/৬৩

লেখক কামজনিত দশটি দোষের উল্লেখ করেছেন। এগুলি হলো মৃগয়া, তাস-পাশা খেলা, দিবানিদ্রা, পরের দোষকীর্তন, স্ত্রীসঙ্গ, সুরাপান, নৃত্যগীত বাদ্য ও বৃথা ভ্রমণ। ক্রোধজনিত আটটি দোষ উল্লিখিত হয়েছে; যথা— খলতা, হঠকারিতা, পরের অনিষ্ট চিন্তা ও আচরণ, অন্যের গুণ সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা, পরের গুণ থেকে দোষ বের করা, যা দেওয়া উচিত তা না দেওয়া, দত্ত পদার্থ অপহরণ করা, কঠোর ও কটু বাক্য উচ্চারণ এবং নিষ্ঠুর আচরণ। লেখক মনে করেন লোভশূন্য হয়ে বিষয় ভোগ করলে তবেই শান্তি মেলে।

অপূর্বমাণমচলপ্রতিষ্ঠং

সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্বৎ।

তদ্বৎ কামা যৎ প্রবিশন্তি সর্বে

স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।

চারদিকের নদনদী থেকে ক্রমাগত জল এসে সমুদ্রে পড়ে অথচ তাতে সমুদ্রের বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। সেই- মত যিনি কামনার বিষয় উপভোগ করছেন অথচ বিন্দুমাত্র কাম দ্বারা বিচলিত হচ্ছেন না, তিনি শান্তি লাভ করে থাকেন। ভোগ-কামনাশীল ব্যক্তি কখনোই শান্তি পান না। যেদিক থেকে লোভের উৎপত্তি হবে সেদিক থেকেই মনকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে—

যতোযতো নিশ্চলতি মনশ্চঞল মস্থিরং।

ততস্ততো নিষম্যৈ তদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ।।

যেদিকে চঞ্চল অস্থির মন ধাবিত হবে, সেদিক থেকেই একে সংযত করে বশে আনতে হবে। লোভ দমনের এর থেকে উৎকৃষ্ট পথ আর নেই। প্রচলিত ধারণায় মোহ চলে গেলে সংসারের কাজ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এ- কথা ঠিক নয়। লেখক গীতার কথা তুললেন এই প্রসঙ্গে—

সক্তা: কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।

কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম।। ৩/২৫

হে অর্জুন, অজ্ঞানী ব্যক্তি যেমন মোহাদ্ভিভূত হয়ে কর্ম করে, জ্ঞানী ব্যক্তি কিন্তু মোহমুক্ত হয়ে লোকসমাজের রক্ষা ও উন্নতির জন্য তেমনি কর্ম করেন। সংযত বাক্য না হলে ভক্ত হওয়া যায় না। গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তের লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে এইভাবে—

তুল্যনিন্দাস্তুতিমৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ।

অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান মে প্রিয়ো নরঃ।। ১২/১৯

লেখক সমস্ত বহির্মুখীন ইন্দ্রিয়গুলিকে অন্তর্মুখীন করে মনেতে যোজনা করার পরামর্শ দিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন—

যদা সংহরতে চায়ং কুর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।

ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।। ২/৫৮

কচ্ছপ যেমন আপনার অঙ্গগুলি বাইরে থেকে ভেতরে গুটিয়ে নেয় তেমনি যখন কেউ ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে ভেতরে টেনে নেয় তখন তার জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়। লেখক ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলিকে অন্তর্মুখীন করে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ। লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।। ৫/১০

যে ব্যক্তি বিষয়াসক্তি বিহীন হয়ে ব্রহ্মতে অর্পণ করে সবকিছু কর্ম করেন, পদ্মপত্রে যেমন জল দাঁড়াতে পারে না তেমনি তাঁর হৃদয়ে পাপ প্রবেশ করতে পারে না। গীতায় অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন—

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।

যম পস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্বতত দর্পণম।। ৯/২৭

কার্য, আহার, যজ্ঞ, দান, তপস্যা যা কিছুই করনা কেন সব শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করতে হবে। যে ব্যক্তি কর্ম, বাক্য, চিন্তা সবকিছুই ভগবানকে অর্পণ করতে চেষ্টা করে তার প্রাণ পবিত্র ও ভক্তিপূর্ণ হবেই। বঙ্কিমচন্দ্র অশ্বিনীকুমারের ‘ভক্তিযোগ’ পাঠ করে আপ্লুত হয়েছিলেন, বলেছিলেন :

আমার বিশ্বাস যে, এরূপ উৎকৃষ্ট গ্রন্থ আমি বাঙ্গালা ভাষায় সম্প্রতি দেখি নাই অথবা বাঙ্গালা ভাষায় অল্পই দেখিয়াছি।

আমরা গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নলিখিত ভাবে নির্দেশ করতে পারি—

ক. কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য এ গ্রন্থ লিখিত হয়নি।

খ. রিপু দমন পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন কাজ। লেখক এই গ্রন্থে কিরূপে রিপু দমন করা সম্ভব তার পথ নির্দেশ করেছেন।

গ. ভক্তির লোমহর্ষক ও অশ্রু নি:সারণকারী গল্প লেখক বলেছেন।

ঘ. ভক্তিকথা সহজ প্রণালীতে বলেছেন।

ঙ. লেখকের বহু পঠনশীলতার পরিচয় মেলে। তিনি শাস্ত্রসিন্ধু মন্থন করেছেন। কেবল মানুষের সমস্যার কথা বলেন নি। সেগুলির সমাধানের পথও বাতলেছেন।

চ. গ্রন্থের ভাষা সহজ এবং সরল। নিজের বক্তব্য পরিস্ফুট করতে দৃষ্টান্তের সাহায্য নিয়েছেন।

হঠাৎ করে গ্রন্থের নাম দেখে মনে হবে বুঝিবা লেখক শ্রীমদ্ভভাগবদ গীতার ভক্তিযোগকে আশ্রয় করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন। তা কিন্তু নয়। শ্রীমদ্ভভাগবদ থেকে কিছু কিছু শ্লোকের উল্লেখ এবং সেগুলির ব্যাখ্যা করলেও ভক্তিযোগ লেখকের নিজের পরিকল্পনাপ্রসূত। বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে গ্রন্থটি রচিত হওয়ায় অন্যবিধ মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

দি গীতা—এ সিনথেটিক ইণ্টারপ্রিটেশনব্রজেন্দ্রনাথ শীল

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আনুকূল্যে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের ইংরেজিতে লেখা ‘The Gita—A Synthetic Interpretation’ প্রকাশিত হয় কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ থেকে, ১৯৬৪তে (Reprint)। মাত্র ১৮ পৃষ্ঠার পুস্তিকা এটি।

আপাতভাবে এটি একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা বলে মনে হলেও দার্শনিকপ্রবর ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পান্ডিত্য, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণনৈপুণ্য, সর্বোপরি যুক্তির পারম্পর্য রক্ষায় যে মনোযোগ লক্ষিত হয় এককথায় তা অতুলনীয়। লেখক নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্ত দৃষ্টিতে গীতার ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্ব থেকে মনগড়া কোনো সিন্ধান্তের দ্বারা তিনি চালিত হন নি। একেবারে ভূমিকায় লেখক খুব সঙ্গতভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন—

i. ‘Each commentator accepts those passages of the Gita which support his own preconceived dogma (Siddhanta) and distorts the meaning of the conflicting passages to harmonise them with his dogma’—এখানে ‘distort’ শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষ করার। নিজের সিদ্ধান্তের আনুকূল্য করে, এমন শ্লোকই গীতার ব্যাখ্যাতারা বেছে নেন, অপরদিকে তাঁদের সিদ্ধান্তের বিপরীত অর্থজ্ঞাপক শ্লোকগুলির অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করেন, নিজের সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে। জ্ঞানচর্চায় এই পদ্ধতি যে সঠিক নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ii. ‘On the other hand, if one studies the Gita independently, one is hopelessly puzzled at first by internal contradictions of a serious character, as well as by irrelevancies and meaningless repetition’—কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে গীতা পড়েন, তবে প্রথমেই তিনি আশাতীতভাবে বিভ্রান্তির শিকার হবেন, কারণ গীতায় মিলবে স্ববিরোধিতা যা প্রকৃতিতে খুবইগুরুত্বপূর্ণ, তাছাড়া অপ্রাসঙ্গিকতা এবং অর্থহীন পুনরুক্তিরও সন্ধান মিলবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গীতার ব্যাখ্যাতাদের দেখা গেছে ভক্তিগদগদ চিত্তে যেন ঈশ্বর মুখনি:সৃত পবিত্র বাণীর ব্যাখ্যা করছেন। তাই তাঁরা গীতার কোনো ত্রুটি লক্ষ করেন নি, পাছে ঈশ্বরের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। অথবা ঈশ্বরের ভ্রম ধরার ‘দুঃসাহস’ তাঁরা দেখান নি, দেখাতে চান নি। কিন্তু আচার্য শীল জ্ঞানপথের পথিক, তিনি জ্ঞান সাধনাকে ভক্তি ভাবনায় আচ্ছন্ন করে ফেলেন নি। যুক্তিতর্কের পথকেই তিনি অবলম্বন করেছেন অত্যন্ত আভিজাত্যের সঙ্গে। বক্তব্য তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ, অপ্রাসঙ্গিকতাকে পরিহার করে গেছেন, এমনকি অন্য অনেকের মত কথায় কথায় দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা থেকেও বিরত থেকেছেন। আচার্য শীল দাবী করেছেন, তাঁর পুস্তিকা

. . . . is not only a systhesis, synthetic interpretation, of the varied contents of the Gita, but also a synthesis of the various schools of interpretation themselves.

গীতার বিভিন্ন উপাদনগুলিরই বিচিত্রমুখীন ব্যাখ্যা করেন নি লেখক, সেইসঙ্গে তিনি যে দাবী করেছেন বিভিন্ন ব্যাখ্যাতাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যাগুলিরও এটি ‘Synthesis’-এ পরিণত হয়েছে, তা একেবারে যথার্থ।

গীতাকে লেখক তিনটি বিভাগে বিন্যস্ত করেছেন—

ক. Chapter I – VI

খ. Chapter VII – XII

গ. Chapter XIII – XVIII

লেখকের মতে প্রথম বিভাগটির সূচনা (খ) কর্মযোগ দিয়ে কিন্তু তা সম্প্রসারিত হয়েছে (ক) জ্ঞানযোগে ও (গ) ভক্তিযোগে।

দ্বিতীয় বিভাগের সূচনা (ক) ভক্তিযোগে কিন্তু তারপর তার অভিমুখ দেখা গেছে (খ) জ্ঞানযোগে (গ) কর্মযোগে।

তৃতীয় বিভাগের সূচনা (ক) জ্ঞানযোগে, তারপর তার পরিণতি ঘটেছে (খ) কর্মযোগে এবং (গ) ভক্তিযোগে।

লেখক জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ ও ভক্তিযোগকে তিনটি বিভাগেই পেয়েছেন। আরও উল্লেখ্য, প্রতিটি বিভাগের সূচনা হয়েছে কখনও কর্মযোগ দিয়ে, কখনও ভক্তিযোগ দিয়ে, আবার কখনও জ্ঞানযোগ দিয়ে। সূচনা যা দিয়েই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তিনটি যোগেরই সমন্বয় ঘটেছে। কি রকম? জ্ঞানযোগকে ‘ক’, কর্মযোগকে ‘খ’ এবং ভক্তিযোগকে ‘গ’ রূপে চিহ্নিত করলে পাওয়া যাবে নিম্নলিখিত ভাবে—

প্রথম বিভাগ2.jpgখ ক + গ

দ্বিতীয় বিভাগ3.jpgগ ক + খ

তৃতীয় বিভাগ4.jpgক খ + গ

লেখক সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, প্রত্যেককে অনিবার্যভাবে প্রতিটি পর্যায় অতিক্রম করতে হবে না—It is not intended that every one necessarily should pass through all the three sets of courses. আসলে তিনটি পথ নিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ সাধনক্রম (পাঠক্রম) রচিত হয়েছে (complete syllabus). But it is a moot point whether any single individual may choose to go through the three courses successively.

ক. এবারে আমরা পৃথক পৃথক ভাবে লেখকের অনুসরণে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের আলোচনার প্রয়াস পাব। গীতায় কর্মযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভাবে উপস্থাপিত। লেখকও তাঁর পুস্তিকায় কর্মযোগ সম্পর্কে তুলনামূলক ভাবে বিস্তৃততর আলোচনা সংঘটিত করেছেন। প্রথমেই তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, যতই কর্মযোগে গুরুত্ব আরোপিত হোক, on the synthetic view knowledge and devotion are implied in works and works can not form any discipline without Knowledge and Devotion.

কর্মযোগে নিছক কর্মই থাকে না, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে জ্ঞান এবং ভক্তিও। কর্মযোগে প্রথমাবস্থায় যতই কর্মে গুরুত্ব আরোপিত হোক, পরবর্তী পর্যায়ে আমরা তাতে জ্ঞানকে যুক্ত করে নিই। লেখকের মতে :

Thus, we have synthesis of Works and Knowledge.

লেখক জানালেন :

here the knowledge element becomes explicit, works are for the time being subordinated to Knowledge and Devotion remains implicit.

পরবর্তী পর্যায়ে আমরা কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় দেখি। (‘Synthesis of all the three Works, Knowledge and Dovotion, when the Devotion element becomes explicit, পরিণামে all the element become synthetized by way of works in and through the Self or become centred in Brahma’.

ব্রজেন্দ্রনাথের মতে গীতায় অর্জুন চালিত হয়েছিলেন ‘Sentiment of Compassion’ দ্বারা, সেকারণেই তার যুদ্ধবিমুখতা দেখা গিয়েছিল। লেখকের মতে এটি ছিল Conventional Code of Works, কিন্তু গীতা অন্য পথের কথা বলে, লেখকের মতে তা হল :

the Gita teaching takes up the progressive Synthesis of Works and Knowledge at this transitional point.

‘কর্মযোগ’ লেখকের মতে আসলে Synthesis of Works with Buddhi (Jnana, Knowledge), Works synthetized with Knowledge (Jnana samanvita karma), কর্ম যখন ‘যোগে’র সঙ্গে harmonized হয় তখনই তা কর্মযোগে রূপান্তরিত হয়।

গীতায় দেখি অর্জুন ভীত, কারণ কর্মের সঙ্গে যে পাপ যুক্ত। কৃষ্ণও তা মেনে নিয়েছেন, তিনিও কাজকেই পাপের উৎস বলেছেন। তাঁর এক্ষেত্রে পরামর্শ :

Works must be conquered by the central of the senses (indriyani yamana) and by Knowledge of the self that transcends the understanding (Buddhed param buddhva).

ইন্দ্রিয়সংযমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন আর বলেছেন নিজেকে জানার কথা। কৃষ্ণ কর্ম ও অকর্ম কি তাও ব্যাখ্যা করেছেন। লেখকের মতে কৃষ্ণ শিক্ষা দিয়েছেন, action in inaction এবং inaction in action-এর।

কৃষ্ণ আরও বলেছেন :

All these forms of Works lead ultimately to Liberation . . . . all works are fulfilled in and through sacrifice (Jnana yajna) and it is the fire of sacrifice that burns up the bondage of works. It is in the vessel of Knowledge that one can cross the ocean of Samsara (world).

জ্ঞানের তরণী চড়েই সংসার-সমুদ্র অতিক্রম করতে হয়। কর্মসঞ্জাত যে বন্ধন তা পুড়ে খাক হয় যজ্ঞাগ্নিতে।

ব্রজেন্দ্রনাথ বললেন :

Works in the end are fulfilled in Knowledge and we shall find that the Knowledge of the self (atma-jnana) is also fulfilled in works (Chapter V) and even one who delights in the soul (atmarati) works with the spontaneity of Nature, though he is free from law (vidhi). . . . one who is united (yuktatma) who experiences union with Brahma yoga or Brahma nirvana as the consummate state on the path of the Synthesis of Works and Knowledge.

চমৎকার ভাবে লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, কর্ম চরিতার্থতা লাভ করে জ্ঞানে, অন্যদিকে আত্মজ্ঞান চরিতার্থতা পায় কর্মে (পঞ্চম অধ্যায়)। যে বা যিনি আত্মরতিতে সন্তুষ্ট, তিনিও প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বের সঙ্গে কর্মরত হন। যদিও তিনি বিধিমুক্ত। যিনি নাকি যুক্তাত্মা, যিনি ব্রহ্মযোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিনিও কর্ম ও জ্ঞানের সমন্বয় পথের পথিক।

খ. এবারে জ্ঞানের প্রসঙ্গ : Knowledge and Works are implied in Devotion on the Synthetic view, only there is emphasis on Devotion for certain temperaments. But Knowledge of the God (Devata), the object of Devotion, is necessary for Devotion. So we pass on from Devotion to Knowledge-Knowledge of the Supreme self or the Lord of all creation. . . this knowledge Synthetized with Devotion, cognizes the object of Devotion in form of the concrete or manifest Universe-first Prakriti (the Universe) and their Vibhutis (special mainifestation) and finally Visvarupas (The manifest Universal). This leads to Synthesis of Deovotion and Knowledge.

লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, ভক্তির জন্য চাই দেবতা সম্পর্কিত জ্ঞান এবং ভক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কিত ধারণা। এভাবে অগ্রসর হতে হয় ভক্তি থেকে জ্ঞানে, এ জ্ঞান হল সকল সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা তাঁর সম্পর্কিত জ্ঞান।

In the next stadium Works are added by way of Synthesis to this unification of Knowledge and Deovotion. এটাই হল ভক্তির ‘Synthetic view’.

গ. এবারে ভক্তির প্রসঙ্গ : Devotion necessarily implies Knowledge. This Knowledge is directed towards the discrimination of the Kshetra (body or organism) from the Kshetrajna (knower of the Kshetra, the Universal Soul) and not towards the discrimination of Purusha from Prakriti, as in the Sankhya.

ভক্তি জ্ঞান ছাড়া হবার নয়। তবে সাংখ্যের মত প্রকৃতি থেকে পুরুষের পার্থক্য সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা এখানে বলা হয়নি, বলা হয়েছে ক্ষেত্রজ থেকে ক্ষেত্রের পার্থক্য সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা।

Now comes Knowledge-the highest Knowledge (Jnanam, Jnana muttamam). This knowledge proceeds by analysis of the qualities or mods (guna) and by discrimination of that which transcends all qualities (gunanattya gunanativartata). This knowledge leads to the condition of that which transcends all qualities. জ্ঞান তিন পুরুষের জ্ঞানের দিকে চালিত করে—এই তিন পুরুষ হল যথাক্রমে, ক্ষর, অক্ষর এবং পুরুষোত্তম।

Knowledge thus leads to the Knowledge of the three Purushas, Kshara, Akshara and Purushottama, the Perishable the Imperishable and the Transcendent one.

যিনি পুরুষোত্তমকে জেনেছেন তিনি সবকিছুই জেনেছেন। এদিক দিয়ে দেখলে জ্ঞান ত’ ভক্তিরই তুল্য। The knower of Purushottama is Knower of everything and this knowledge is equivalent to worship in all modes and forms. He is knower who knows or understands this. Now after this emphasis on the discipline of Knowledge so far begins Synthesis with Works, first by discrimination of various forms of works meaning ethical activities not Works as enjoined in the Vedas.

Briefly Devotion is added to Knowledge and Works for the one who is identified with Brahma attains supreme Devotion. By Devotion he knows, then he enters into Me truly and then allows by My Grace the eternal station. This is the Synthesis of Devotion with Knowledge

ভক্তি যুক্ত হয় জ্ঞানের সঙ্গে এবং কাজ করা বলতে সেই কাজকেই বোঝায় যা ব্রহ্মর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ভক্তির দ্বারাই ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে। অতএব ভক্তি ও জ্ঞান সমন্বিত। এভাবেই ব্রজেন্দ্রনাথ জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির মধ্যেকার সমন্বয় রূপটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

রবীন্দ্র দৃষ্টিতে ও ব্যবহারে গীতা

রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ — প্রীতি আমাদের সকলেরই জানা, কিন্তু যা জানা ছিল না দীর্ঘ কালাবধি, তা হল তাঁর গীতা— প্রীতি। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নীহাররঞ্জন রায়ের সুবাদে আমরা বহুকাল পর্যন্ত জেনে এসেছি রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশাল আয়োজনে গীতা উল্লিখিত হয়েছে মাত্র কয়েকবারই সংখ্যার বিচারে পুরো দশবারও নয়— ন্যূনাধিক ছয় বার— ‘It is important to remember . . . . that while Bankim Chandra and, later, men like Tilak and Aurobindo, Gandhi and ‘Raja’ Gopalachari, . . . went to the Gita for their ideological sustenance and emotional for his, . . . I cannot help pointing but in this connection that Tagore’s voluminous writings do not contain more than half-a-dozen references to the Gita.’

কিন্তু নীহারবাবু প্রদত্ত এই সংখ্যাতত্ত্বের হিসেব যে যথার্থ নয়, তা প্রমাণিত হল পম্পা মজুমদার রচিত ‘রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস’ গ্রন্থটি প্রকাশের ফলে (১৯৭২)। পম্পা দেবীর প্রাসঙ্গিক মন্তব্যটি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য—‘উপনিষদ তাঁর মনকে গভীরভাবে অধিকার করে থাকলেও গীতার ভাবধারার প্রতি তাঁর হৃদয়ের আকর্ষণ কম ছিল না। তাঁর সারা জীবনের সাহিত্যে অন্তত ঊননব্বইবার যে তিনি গীতার শ্লোককে নানাভাবে স্মরণ করেছিলেন . . . . তার অভ্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।’

পম্পা দেবী অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেই অভ্রান্ত প্রমাণ দাখিল করেছেন, যাকে আমরা বলি পাথুরে প্রমাণ, আর এইভাবেই তিনি প্রমাণে সক্ষম হলেন যে কবি উপনিষদের মত গীতা-প্রেমীও ছিলেন। আপাতত সেই প্রমাণের প্রসঙ্গে না গিয়ে কবি কেমন করে গীতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, আমরা তা সংক্ষেপে জেনে নিই।

যে কোনো ভারতীয় বিশেষত হিন্দু মাত্রের কাছেই গীতা একটি অত্যন্ত পরিচিত গ্রন্থ। আমাদের দেশের অধিকাংশ চিন্তাশীল মানুষই গীতার দ্বারা প্রভাবিত। কী ধার্মিক ব্যক্তি, কী দার্শনিক, কী সংসারী সকল শ্রেণীর মানুষই গীতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কত অসংখ্য অনুবাদ ও ব্যাখ্যা যে এই একটিমাত্র গ্রন্থের এ যাবৎ হয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। শুধু এদেশেই নয়, বিদেশেও পন্ডিত, গবেষক, তাত্ত্বিকরা এই গ্রন্থ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, রচনা করেছেন গ্রন্থ আলোচনাদি। কৃষ্ণকে এদেশের মানুষ যেমন ঈশ্বরের অবতার বলে বিশ্বাস করেন, তেমনি মননশীল শিক্ষিত জনের কাছে তিনি যত না দেবত্বের অধিকারী তদপেক্ষা কূটনীতিজ্ঞ রাজনীতিবিদ রূপে বিবেচিত হন। তাই কি আমাদের দেশের স্বাধীনতা পূর্বকালীন তামাম প্রথম শ্রেণীর খ্যাতকীর্তি রাজনীতিজ্ঞরা বিশেষভাবে গীতায় অনুরক্ত হয়েছিলেন? কে নয়? ঋষি অরবিন্দ থেকে বালগঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধী, বিনোবা ভাবে, চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এঁরা সকলেই গীতার ভাষ্য রচনায় কিংবা অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যাঁরা ভারতীয়ত্বের সন্ধান করেন, তাঁরাও গীতাকেই মুখ্যতঃ আশ্রয় করেন, কারণ গীতা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংহত রূপ বলে বিবেচনা করা হয় সঙ্গত কারণেই।

পারিবারিক দিক দিয়ে ঠাকুর পরিবারে গীতাচর্চার রেওয়াজ ছিল। রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ভগবদগীতা বিষয়ক বক্তৃতা এবং শ্লোকসংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

১৩১১ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস. সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীমদভগবদগীতার অনুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ এটি সম্পাদনা করেছিলেন। কবির সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বালগঙ্গাধর তিলক প্রণীত ‘গীতা রহস্য’-এর অনুবাদ করেছিলেন বাংলায় (১৯২৪)।

কবির উপনয়ন হয় যখন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১১ বছর ৯মাস। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সুবাদে কবির গীতার সঙ্গে পরিচয় ঘটল, অবশ্য সম্পূর্ণ গীতা নয়, মহর্ষি নির্বাচিত তাঁর কয়েকটি প্রিয় শ্লোকের। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে এর উল্লেখ করেছেন :

ভগবদগীতায় পিতার মনের মতো শ্লোকগুলি চিহ্নিত করা ছিল। সেইগুলি বাংলা অনুবাদ সমেত আমাকে কপি করিতে দিয়াছিলেন।

নানা সময়ে নানা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতা সম্পর্কিত ধারণার কথা বলেছেন। আমরা সেইসব মন্তব্যের কিছু পরিচয় নেব, কারণ তা থেকেই গীতা সম্পর্কে কবির ধারণা, মানসিকতা বোঝা যাবে—

ক. একটি অর্ধসমাপ্ত রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখে শেষ করার দায়বদ্ধতার উল্লেখে কবি মন্তব্য করেছেন : ‘লিখে যে কী ফল হবে তা অন্তর্যামীই জানেন।’ এরপরই গীতার উল্লেখে কবি বললেন :

ভগবদগীতায় আছে, কর্মেই আমাদের অধিকার আছে, ফলে অধিকার নেই—অর্থাৎ, ফল পাব কি না পাব সেকথা না ভেবে কাজ করতে হবে। ফল পাব না মনে করেই আমাদের দেশে কাজ করতে হয়।

এই মন্তব্যে কবি যে গীতার আদর্শের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন তা বলা যাবে না। কারণ স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের ফলের আশা অব্যক্ত থাকে নি, কিন্তু সেই আশাপূরণ কদাচিৎ হয় এই প্রেক্ষিতেই তাঁর হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য, গীতার শ্লোকের অনুসরণে। তাই ‘কবিকে দেশের হিতসাধনের প্রসঙ্গে গীতার নিষ্কাম কর্মবাদের আদর্শটি স্মরণ করতে দেখা গেছে’ —এবংবিধ মন্তব্য আক্ষরিক অর্থে গ্রহণযোগ্য নয়।

খ. অত্যন্ত সিরিয়াস আলোচনা করেছেন কবি মহাভারত এবং তার অপরিহার্য অঙ্গস্বরূপ গীতার ‘আতস-কাচের একপিঠে যেমন প্রাপ্ত সূর্যালোক এবং আর একপিঠে যেমন তাহারই সংহত দীপ্তিরশ্মি, মহাভারতেও তেমনি একদিকে ব্যাপক জনশ্রুতিরাশি আর একদিকে তাহারই সমস্তটির একটি সংহত জ্যোতি—সেই জ্যোতিটিই ভগবদগীতা। জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির যে সমন্বয় যোগ তাহাই সমস্ত ভারত ইতিহাসের চরমতত্ত্ব। . . . . ভারতবর্ষ একদিন আপনার সমস্ত ইতিহাসের একটি চরমতত্ত্বকে দেখিয়াছিল। মানুষের ইতিহাসের জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম অনেক সময়ে স্বতন্ত্রভাবে, এমনকি পরস্পর বিরুদ্ধভাবে আপনার পথে চলে; সেই বিরোধের বিপ্লব ভারতবর্ষে খুব করিয়া ঘটিয়াছে বলিয়াই এক জায়গায় তাহার সমন্বয়টিকে স্পষ্ট করিয়া সেদেখিতে পাইয়াছে। মানুষের সকল চেষ্টাই কোনখানে আসিয়া অবিরোধে মিলিতে পারে মহাভারত সকল পথের চৌমাথায় সেই চরম লক্ষ্যের আলোকটি জ্বালাইয়া ধরিয়াছে। তাহাই গীতা। . . . . মহাভারতের এই গীতার মধ্যে লজিকের ঐক্যতত্ত্ব সম্পূর্ণ না থাকিতেও পারে, কিন্তু তাহার মধ্যে বৃহৎ একটি জাতীয় জীবনের অনিবর্চনীয় ঐক্যতত্ত্ব আছে।’

ভারতবর্ষে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে আদর্শ মূর্ত হয়েছে বলে দাবী করা হয়, রবীন্দ্রনাথ এখানে গীতার উল্লেখে তার প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। গীতায় কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় কবি লক্ষ্য করেছেন।

গ. গীতায় ফললাভের আশা পরিত্যাগ করে শুধু কাজ করার যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ তার কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং কর্ম কখন বন্ধনস্বরূপ হয়ে ওঠে একাধিক দৃষ্টান্তের উল্লেখে তার ব্যাখ্যা করেছেন :

শক্তির রূপ আর মুক্তির রূপ অনবচ্ছিন্ন এক। এতেই শান্তি, এতেই সৌন্দর্য। জীবনের মধ্যে এই মিলনটিই তো খুঁজি—চির বহমান নদীধারায় আর হওয়ার চিরগম্ভীর মহাসমুদ্রের মিলন। এই আত্ম-পরিতৃপ্ত মিলনটিকে লক্ষ্য করেই গীতা বলেছেন, ‘কর্ম করো, ফল চেয়ো না’। এই চাওয়ার রাহুটাই কর্মের পাত্র থেকে তার অমৃত ঢেলে নেবার জন্যে লালায়িত। ভিতরকার সহজ হওয়াটি সার্থক হয় বাইরেকার সহজ কর্মে। অন্তরের সেই সার্থকতার চেয়ে বাইরের স্বার্থ প্রবল হয়ে উঠলেই কর্ম হয় বন্ধন: সেই বন্ধনেই জড়িত যত হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, নিজেকে ও অন্যকে প্রবঞ্চনা। . . . .বাহ্য ফলের দ্বারা নয়, আপন অন্তর্নিহিত সত্যের দ্বারাই কর্ম সার্থক হোক, তাতেই হোক মুক্তি।

রবীন্দ্রনাথ কর্ম কখন বন্ধন হয়ে দেখা দেয়, কখন তা অগৌরবের, বিপরীতক্রমে কর্ম করেও কেমন করে কর্ম থেকে নিত্য মুক্তিলাভ সম্ভব তার একাধিক দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন। বলেছেন গুজরাটের কাঠিয়াবাড়ে গোয়ালা গরুকে ভালবাসে প্রাণাধিক। এই ভালবাসাই দুধের ব্যবসায়ে তার ফলকামনাকে তুচ্ছ করে দিয়েছে। বলেছেন, যে পরিবারে ভৃত্য পরিবারেরই একজন সদস্যের মত মর্যাদা পায়, দরদ লাভ করে ষোল আনা দাসত্ব থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে দাদা, খুড়ো কিংবা জ্যাঠার কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়, ভৃত্যের কাছে তখন মনিবগৃহের কাজ পরের কাজ না হয়ে নিজের কাজ হয়ে ওঠে। তখন তার কাজের ফলকামনাটা যায় ঘুচে। ফলকামনা ঘোচাবার এমনতর বাস্তব দৃষ্টান্তের উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কাউকেই করতে দেখা যায় নি। অথচ গীতার এই নিষ্কাম তত্ত্বের কত ব্যাখ্যাই না কতজনে করেছেন নিছক তত্ত্বগতভাবে।

ঘ. ‘গীতায় আছে, কর্মের বিশুদ্ধ মুক্তরূপ হচ্ছে তার নিষ্কাম রূপ। অর্থাৎ ত্যাগের দ্বারা নয়, বৈরাগ্যের দ্বারাই কর্মের বন্ধন চলে যায়।’ দৃষ্টান্তের উল্লেখে কবি বললেন, ‘ফুলের মধ্যে যে আনন্দ সেপ্রধানত ফলের প্রত্যাশার আনন্দ এটা অত্যন্ত মোটা কথা।’

ঙ. ‘ভগবদগীতা আজও পুরাতন হয় নি, হয়তো কোনোকালেই পুরাতন হবে না।’

সাহিত্যের স্বরূপ, সাহিত্যের মাত্রা, ১৩৪০

চ. ‘ভগবদ গীতার মাহাত্ম্য কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে না।’ প্রাচীন সাহিত্য, কাদম্বরী চিত্র।

ছ. ‘শ্রীকৃষ্ণ কর্মকে মনুষ্যের শ্রেষ্ঠ পথ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন।’ . . . . কর্মেই মনুষ্যের কতৃশক্তি বা আধ্যাত্মিতার বলবৃদ্ধি হয়।’

সমাজ, পরিশিষ্ট; আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবুর মত, ১২৯৮

জ. স্বধর্মে জগতে খুব মহৎ লোকেরও নিধন হয়েছে, কিন্তু সেনিধন বাইরের, স্বধর্ম ভিতরের দিক থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছে। আর এও দেখা গেছে, পরধর্মে খুব ক্ষুদ্র লোকেও হঠাৎ বড়ো হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার নিধন ভিতরের থেকে।

পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারী; সেপ্টেম্বর ২৪, ১৯২৪

রবীন্দ্রনাথের গীতার যে কয়টি শ্লোক খুব প্রিয় ছিল সেগুলির অন্যতম—

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।। ৩/৩৫

—এই শ্লোকেরই ব্যাখ্যা দেখি পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারীতে যেখানে কবি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন স্বধর্মে যে নিধনতা বাইরের, কেননা স্বধর্ম ভিতরের থেকে বাঁচায় কিন্তু পরধর্মে যে নিধন তা ভিতরের।

বারংবার তাঁর নানা লেখায় এই শ্লোকের বক্তব্য প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। ‘ভারতবর্ষ’ চীনেম্যানের চিঠিতে কবি বললেন, ‘আত্মানং বিদ্ধি’, আপনাকে জানো— ইহাই মুক্তির উপায়। ‘পরধর্মো ভয়াবহঃ’, পরের অনুকরণেই বিনাশ’। স্পষ্টতই এখানে বিদেশী অনুকরণের বিরুদ্ধে কবির সতর্ক বাণীকে সোচ্চার দেখা গেছে। ‘চতুরঙ্গে’ শচীশের জবানীতে বলানো হয়েছে :

আর সব জিনিস পরের হাত হইতে লওয়া যায়, কিন্তু ধর্ম যদি নিজের না হয় তবে মারে, বাঁচায় না। আমার ভগবান অন্যের হাতের মুষ্টি ভিক্ষা নহেন, যদি তাঁকে পাই তো আমিই তাঁকে পাইব, নাহলে নিধনং শ্রেয়ঃ।

গীতার বিতর্কিত বিষয়গুলি হল যজ্ঞ

যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোএন্যত্র লোকোএয়ং কর্মবন্ধনঃ

তদর্থং কর্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।। ৩/৯

—এখানে যজ্ঞের জন্য, ঈশ্বরার্থে অনুষ্ঠিত কর্মের কথা বলা হয়েছে। কেননা অন্য কর্মে মানুষ বদ্ধ হয়। তাই গীতার পরামর্শ আসক্তি মুক্ত হয়ে যজ্ঞার্থ কর্ম সম্পাদনের। যজ্ঞের প্রসঙ্গ আরও অনেকগুলি শ্লোকেই পাই—

সহযজ্ঞা: প্রজা: সৃষ্টা পুরোবাচ প্রজাপতি:।

অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোএস্ত্বিষ্টকামধুক।। ১০

—সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মা যজ্ঞের সঙ্গে ব্রাহ্মণাদি ত্রিবর্ণ সৃষ্টি করে বলেন, এই যজ্ঞ দ্বারা তোমরা সদা সমৃদ্ধ হও, এই যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্টদানে কামধেনুর মত হবে। আরও বলা হয়েছে—

ইষ্টান ভোগান হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতা:।

তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙক্তে স্তেন এব সঃ।। ১২

—যজ্ঞের ফলে সন্তুষ্ট হয়ে তবে দেবতারা তোমাদের বাঞ্ছিত ভোগ্যবস্তু প্রদান করবেন। কিন্তু যদি দেবতাদের প্রদত্ত বস্তু তাঁদের নিবেদন না করে, ভোগকারী নিশ্চিতভাবে চোর। শঙ্করাচার্য থেকে শ্রীধর গোস্বামী প্রমুখ ‘যজ্ঞ’ বলতে বুঝেছেন ঈশ্বরকে। আবার প্রচলিত অর্থে দেবতাদের আরাধনার অঙ্গস্বরূপ হল এই যাগ, যজ্ঞ, হোম ইত্যাদি যাতে আহুতি প্রদত্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ এর কোনটিই গ্রহণ করেন নি। বারংবার যজ্ঞের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর রচনায় কখনও ইংরেজীতে কখনও বা বাংলায় :

. . . the meaning of sacrifice, which in former days consisted in external ritualism entailing bloodshed. The same thing we find in the Gita in which the meaning of the word yajna has been translated into a higher significance than it had into crude form.’

The Religion of Man; Chapter V : The prophet

এই ‘higher significance’ ব্যাখ্যাত হয়েছে অন্যত্র—‘যেখানে তার সাধনা সকলের জন্যে সেইখানেই মানুষের আকাঙ্খা কৃতার্থ হয়। এই সাধনাকেই গীতা যজ্ঞ বলেছেন; এই যজ্ঞের দ্বারাই লোকরক্ষা।’ আরও বললেন :

গীতায় যজ্ঞকেও সাধনাক্ষেত্রে স্থান দিয়াছে। কিন্তু গীতায় যজ্ঞ ব্যাপার এমন একটি বড়ো ভাব পাইয়াছে যাহাতে তাহার সংকীর্ণতা ঘুচিয়া সেএকটি বিশ্বের সামগ্রী হইয়া উঠিয়াছে। যে সকল ক্রিয়াকলাপে মানুষ আত্মশক্তির দ্বারা বিশ্বশক্তিকে উদবোধিত করিয়া তোলে তাহাই মানুষের যজ্ঞ।১০

রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞ বা Sacrifice-কে প্রচলিত অর্থে যে মানেননি তার প্রমাণ অন্যত্রও মিলবে। A vision of India’s History-তে (১৯২৩) বলেছেন :

Krishna undoubtedly takes his stand against the traditional cult of Sacrificial ceremonies . . . .

রবীন্দ্রনাথ নানা উপলক্ষে তাঁর নানা রচনায় গীতার যেসব শ্লোক সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন এবারে সেইরকম কিছু শ্লোকের উল্লেখ করা গেল—

ক. অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যাণি ভারত।

অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।। ২/২৮

খ. নেহাভিক্রমনাশোএস্তি প্রত্যবায়ো না বিদ্যতে।

স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।। ২/৪০

গ. ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন।

নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান।। ২/৪৫

ঘ. দুঃখেষ্বনুদবিগ্নমনা: সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।

বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।। ২/৫৬

ঙ. ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীনির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।। ৩/৩০

চ. অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।

কথমেতদ বীজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি।। ৪/৪

ছ. যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।

মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যা: পার্থ সর্বশঃ।। ৪/১১

জ. রসোএহপ্সুম কৌন্তেয় প্রভাস্মি শশিসূর্যয়ো:।

প্রণবঃ সর্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।। ৭/৮

ঝ. যদ যদ বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জিতমেব বা।

তত্তদেবাগচ্ছ ত্বং মম তেজোএংশসম্ভবম।। ১০/৪১

আর উদ্ধৃতির সংখ্যাবৃদ্ধি নিষ্প্রয়োজন। বরং আমরা গীতার কোন অধ্যায়ের কোন শ্লোকের সম্পূর্ণ বা আংশিক উল্লেখ কবি করেছেন তার একটি তালিকা প্রণয়ন করে দিতে পারি—

২। ২০, ২। ২৩, ২। ২৮, ২। ২৯, ২। ৪০, ২। ৪২, ২। ৪৩, ২। ৪৪, ২। ৪৫, ২। ৪৭, ২। ৫৩, ২। ৫৬, ২। ৭১

৩। ৯, ৩। ২০, ৩। ২৫, ৩। ৩০, ৩। ৩৫, ৩। ৪২

৪। ২, ৪। ৪, ৪। ৫, ৪। ৮, ৪। ১১, ৪। ৩৩

৬। ৫, ৬। ২২, ৬। ২৯, ৬। ৩০

৭। ৮

৯। ২৬, ৯। ২৭

১০। ৪১

১১। ২০, ১১। ৩০, ১১। ৩৩, ১১। ৪০, ১১। ৪৪

১২। ১৫,

১৩। ১৪, ১৩। ১৫, ১৩। ১৭

এই তালিকা থেকে যে চিত্রটি স্পষ্ট তা হল গীতার ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে কবি ১০টি অধ্যায় গ্রহণ করেছেন, বাদ দিয়েছেন ৮টি অধ্যায়। সর্বাধিক শ্লোক কবি গ্রহণ করেছেন দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে, গৃহীত শ্লোকের সংখ্যা ১৩। ৬টি করে শ্লোক নিয়েছেন ৩য় ও ৬ষ্ঠ অধ্যায় থেকে। ৫টি শ্লোক নিয়েছেন ১১শ অধ্যায় থেকে। ৪টি শ্লোক নিয়েছেন ৬ষ্ঠ অধ্যায় থেকে। ৩টি শ্লোক গৃহীত হয়েছে ১৩শ অধ্যায় থেকে, ৭ম, ১০ম এবং ১২শ অধ্যায় থেকে একটি করে শ্লোক গৃহীত হয়েছে।

সর্বাধিক প্রয়োগ বা উল্লেখের নিরিখে যে শ্লোকটির উল্লেখ করতে হয়, সেটি হল গীতার ২য় অধ্যায়ভুক্ত ৪৭ সংখ্যক শ্লোকটি—কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন ইত্যাদি। কবি এটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উল্লেখ করেছেন ৩১ বার। কখনও প্রবন্ধে, কখনও চিঠিপত্রে, কখনও বা উপন্যাসে।

প্রয়োগের নিরিখে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত শ্লোকটি হল ৩য় অধ্যায়ভুক্ত ৩৫ সংখ্যক শ্লোকটি—শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ইত্যাদি। এটির ব্যবহার দেখি ১৪বার। ব্যবহৃত হয়েছে উপন্যাসে, চিঠিপত্রে কিংবা প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যেসব রচনায় বা গ্রন্থে গীতার প্রসঙ্গ এনেছেন ইতিমধ্যেই তার কিছুটা আভাস মিলেছে। এবারে তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা গেল—

উপন্যাস—চার অধ্যায় (১৯৩৪), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), চতুরঙ্গ (১৯১৬), দুই বোন (১৯৩৩)

ছোট গল্প—গল্পগুচ্ছ (১৩৩২),

নাটক—বাঁশরি (১৯৩৩), মুক্তির উপায় (১৩৪৫)

কাব্য—রোগশয্যায় (১৯৪০)

প্রবন্ধ—খৃষ্ট (১৯১০), শান্তিনিকেতন (১৩১৫), সঞ্চয় (১৩১৮), কালান্তর (?), ইতিহাস (১৮৯৯), সমূহ (১৯০৩), বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯১৪), সমাধান (প্রবাসী, ১৯২৩), বিশ্বভারতী (১৯২৪), সমাজ (১৮৯১), ভারতবর্ষ (নববর্ষ, ১৩০৯), আত্মশক্তি (১৯০৫), সাহিত্যের পথে (১৯২৪), The Religion of Man (১৯৩১),A vision of India’s History (১৯২৩), পথে ও পথের প্রান্তে (১৯২৭), ছন্দ (১৯৩৩), মানুষের ধর্ম (১৯৩৩), ধর্ম (১৯০৮), ভারতবর্ষ (১৯০২)

চিঠিপত্র, ডায়েরী—পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারী (১৯২৫), ছিন্নপত্রাবলী (১৮৯৪), স্মৃতি (১৯০৮), জাভা-যাত্রীর পত্র (১৯২৭)

শুধু কতবার গীতার প্রসঙ্গ কবি এনেছেন সেই সংখ্যার নিরিখেই নয়, সেইসঙ্গে তাঁর সাহিত্যের প্রায় সর্ব স্তরেই গীতার প্রসঙ্গ আনায় বোঝা যায় কবি কতখানি গীতা-প্রেমী ছিলেন, বোঝা যায় গীতার তিনি উপনিষদের মতই অত্যন্ত মনোযোগী পাঠক ছিলেন, তা না হলে দশ দশটি অধ্যায় থেকে তাঁকে গীতার শ্লোক উদ্ধার করতে দেখা যেতনা।

এবারে আমরা রবীন্দ্রনাথের গীতাচর্চার বৈশিষ্ট্য :

ক. রবীন্দ্রনাথ গীতা রীতিমত পাঠ করেছেন, গীতার আবেদন, তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণরূপে অবহিত ছিলেন, গীতার মাহাত্ম্য তিনি মুক্তকন্ঠে স্বীকারও করে নিয়েছেন, তবে লক্ষণীয়, গীতা নিয়ে কোনো একটি সম্পূর্ণ বা সামগ্রিক আলোচনায় তিনি যান নি। নানা স্থানে নানা উপলক্ষে গীতার বক্তব্যের উল্লেখ করেছেন মাত্র। কখনও সরাসরি শ্লোকের উদ্ধৃতি দিয়ে কখনও বা তার বক্তব্যের উল্লেখে অথবা শ্লোকের অনুবাদে।

খ. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে তিনি গীতাকে দেখেন নি, কিছুটা দেখেছেন দার্শনিকতা দিয়ে, বেশিটা দেখেছেন গীতার ব্যবহারিক জীবনের প্রেক্ষিতে কার্যকরী আবেদনের নিরিখে। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথ গীতার প্রতি যে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার জন্য অনেকখানি দায়ী গীতার আবেদনের সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের মেলবন্ধন।

গ. গীতায় কার ওপর গুরুত্ব অধিক দেওয়া হয়েছে এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন কর্মযোগে গুরুত্ব অধিক, কেউ বা জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগের প্রাধান্যকে মেনেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন গীতার জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিযোগের সমন্বয়ী আবেদনে। এই সমন্বয় যোগই ভারত-ইতিহাসের চরমতত্ত্ব বলে কবির দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। এজন্য গীতার মর্মবাণী ভারতেরই মর্মবাণী বলে কবির প্রতীতী জন্মেছিল, ‘গীতার জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের মধ্যে যে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য-স্থাপনের চেষ্টা দেখি তাহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষের,’ কিংবা কবির মন্তব্য, ‘গীতা প্রাচীনের সেই সমন্বয়তত্ত্বকে উজ্জ্বল করে’, অথবা ‘জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির যে সমন্বয় যোগ তাহাই সমস্ত ভারত-ইতিহাসের চরম তত্ত্ব’— মন্তব্যগুলি স্মর্তব্য।

ঘ. অধিকাংশ গীতা ব্যাখ্যাতা গীতাকে একান্তভাবে হিন্দুয়ানির দৃষ্টিতে দেখেছেন, দেখাতে চেয়েছেন, এঁদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ অবতারশ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ গীতার ব্যাখ্যায় ভারতীয়ত্বকে প্রেক্ষিত করেছেন। সংকীর্ণ হিন্দুয়ানিকে প্রশ্রয় দেন নি, শুধু তাই নয়, বারেকের জন্যও শ্রীকৃষ্ণের অবতারত্ব স্বীকার করেন নি। নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্ত বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টি কখনই তাঁর ধর্মীয় ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয় নি।

ঙ. রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন গীতার বাণী মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অনুসৃত হোক, তার ব্যবহারিক জীবনকে গীতা নিয়ন্ত্রণ করুক, তৎপরিবর্তে ধর্মীয় ভাবালুতায় গীতাকে ধর্মগ্রন্থ জ্ঞানে দেবতার স্থানে রেখে ভক্তি নিবেদন তাঁর না-পছন্দ ছিল। ‘মুক্তির উপায়’ নাটকে (১৯৪৮) ‘হৈমকে’ দিয়ে তাই তিনি ব্যঙ্গোক্তি করিয়েছেন :

দক্ষিণা পেলেই গুরু তালপাতার উপর গীতার শ্লোক লিখে সেগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দেন। গীতা-ধোওয়া জলে ঐ বোতলগুলো ভরা। তিন সন্ধ্যে স্নান করে তিন চুমুক করে খান। ওঁর বিশ্বাস, ওঁর রক্তে গীতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। (১ম দৃশ্য)

চ. গীতার বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মাথা ঘামান নি। পূর্বসূরীদের মন্তব্য কিংবা মূল্যায়নও তাঁর আলোচনায় আসেনি। অথবা গীতার সঙ্গে কোরাণ, বাইবেল প্রমুখ ধর্মগ্রন্থের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি উদ্বুদ্ধ হন নি। তৎপরিবর্তে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি তাঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টির আলোক ফেলেছিলেন।A vision of India’s History-তে (১৯৬২) তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকের মত যুক্তিতর্কের নিরিখে প্রতিপন্ন করেছেন যে এখন আমরা যে গীতার (Text) সঙ্গে পরিচিত, সেটিই তার একমাত্র রূপ নয়, গীতার একটি আদি রূপ ছিল, বর্তমান রূপটি পরিবর্তিত। গীতার Archetype-এর উদ্ভবকাল তিনি বিশ্লেষণ করেছেন :

There was a period of struggle between the cult of ritualism supported by the Brahmins, and the religion of love . . . . In the fact that Krishna, a Kshatriya, was not only at the head of the vaishnava cult, but the object of its worship, that in his teaching, as inculcated in the Bhagavad Gita, there are hints of detraction against vedic verses, we find a proof that this cult was developed by the Kshatriyas …. The ideal which was supported by the kshatriya opponents of the priesthood, is represented by the Bhagabad Gita. It was spoken to the kshatriya hero Arjuna, by the Kshatriya prophet Krishna. The doctrine of Yoga . . . . the doctrine of the disinterested concentration of life . . . . had its tradition, according to Krishna, along the line of the Rajarshis, the kingly prophets.

—অর্থাৎ গীতার উপদেষ্টা কোনো ব্রাহ্মণ নন ক্ষত্রিয় রাজটি, আর এর প্রেক্ষিতটি হল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের বিরোধ। কবির অনুমান বৌদ্ধ উপদেশে ভারতবর্ষে যখন কর্মবিমুখতার প্রাবল্য, এদেশের মানুষকে যখন নিষ্ক্রিয়তা পেয়ে বসেছিল, অহিংসাধর্মের সাত্ত্বিকতাকে নেতিবাচকতা গ্রাস করেছিল তখনই যুগের প্রয়োজনে, কালের প্রয়োজনে গীতার আত্মপ্রকাশ।

দ্বিতীয় যে বিষয়টিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বাধীন চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছেন তা হল গীতার বাণীগুলি পূর্বতন কোনো মনস্বী-কল্পিত, কথিত; পরবর্তীতে কোনো সংকলয়িতা এগুলিকে সংকলিত ও ব্যাখ্যা করেছেন : কোনো একজন মনস্বী পূর্বতন গুরুর উপদেশকে কর্মোৎসাহকর ভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এইভাবে গীতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-কথিত, প্রচলিত এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন।

ছ. রবীন্দ্রনাথ গীতার সামগ্রিক আবেদনের প্রেক্ষিতে দুটি বিভাগে একে বিভক্ত করার পক্ষপাতী—নিত্য অংশ এবং ক্ষণিক প্রয়োজনসাধক। বলাবাহুল্য, প্রথমটির প্রতিই ছিল কবির পক্ষপাতিত্ব সঙ্গত কারণে। কারণ বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রয়োজন মিটে গেলে সেই ক্ষণিক প্রয়োজনের সুরটি অচল হয়ে পড়ে, তার গ্রহণ যোগ্যতা আর থাকে না। কিন্তু নিত্য অংশের গ্রহণযোগ্যতা সর্বকালের, সর্বদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের কাছেই।

জ. ‘স্বধর্ম’-এর নবতর ভাষ্য রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষের ব্যক্তিগত স্বভাব তথা মানসিকতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বর্ণাশ্রম – স্বীকৃত স্বধর্মকে অস্বীকার করেছেন। বস্তুত ধর্মাচরণের সঙ্গে জীবিকার সম্পর্কে কবির কোনো অন্তরের সমর্থন ছিল না।

ঝ. যতই কেন রবীন্দ্রনাথ গীতার সমন্বয়বাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন, কিন্তু ব্যবহারের নিরিখে, সংখ্যাধিক্যের বিচারে কর্মবাদের প্রতিই ছিল কবির পক্ষপাতিত্ব। ৩১ বার তিনি এটির ব্যবহার করেছেন। কবির এই তত্ত্ব বা ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’ শ্লোকটির প্রতি দুর্বলতার কারণ ব্যবহারিক জীবনে এটির গ্রহণযোগ্যতা। পত্নীকে লেখা চিঠিতেও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সন্ততিদের শিক্ষাদানের কর্তব্য পালন করতে হবে নিস্পৃহভাবে, কোনো ফলের দিকে না তাকিয়ে।

ঞ. রবীন্দ্রনাথ যতই না কেন গীতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, তবু এর সীমাবদ্ধতাও তাঁর সচেতন দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায় নি। বলেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে থমকিয়ে রেখে সমস্ত গীতাকে আবৃত্তি করা সাহিত্যের আদর্শ অনুসারে নি:সন্দেহেই অপরাধ। আরও বলেছেন :

কুরুক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে এই যে খানিকটা দার্শনিকভাবে আলোচনা একে কাব্যের দিক থেকে অসঙ্গত বলা যেতে পারে; এমনও বলা যেতে পারে যে, মূল মহাভারতে এটা ছিল না।

গীতায় উপস্থাপিত স্ববিরোধী উক্তিও কবির নজর এড়ায় নি, এমনকি এতে নিত্য অংশের সঙ্গে ক্ষণিক প্রয়োজনের বিরোধ তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। যেমন যুদ্ধবিমুখ অর্জুনকে কৃষ্ণ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে উৎসাহিত করেছেন, আবার সেই কৃষ্ণই বলছেন স্থৈর্য ও নিষ্কামতার আদর্শে দীক্ষিত হতে। কখনও কৃষ্ণ আত্মশরণ মন্ত্রে দীক্ষিত হতে বলছেন, আবার পরবর্তীতে তিনি আত্মনির্ভরতা পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন। গীতার ছন্দ ব্যবহারেও ত্রুটি লক্ষ্য করেছিলেন কবি। চতুর্থ অধ্যায়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্লোকদ্বয়ের ছন্দের তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘অপরং ভবতো জন্মে’র পরিবর্তে ছন্দের প্রয়োজনে ব্যবহার করা উচিত ছিল ‘অপারং ভাবতো জন্ম’।

স্বামীজীর বাণী ও রচনায় গীতা প্রসঙ্গ

স্বামীজীর কম্বুকন্ঠের ঘোষণা, গীতা উপনিষদের ভাষ্য। উপনিষদ ভারতের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।

তিনি আরও বলেছেন : সকল উপনিষদের সারভাগ গীতায় নিহিত।

অন্যত্র বললেন :

যিনি স্বয়ং বেদের প্রকাশ সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারাই বেদের একমাত্র টীকা—একমাত্র প্রামাণিক টীকা— গীতা চিরকালের মত রচিত হইয়াছে।

অর্জুন কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেন, যদি কৃষ্ণ জ্ঞানকে কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন তবে তিনি কেন কর্মের উপদেশদানে সক্রিয়, উত্তরে শ্রীকৃষ্ণের জবানীতে বলা হয়েছে :

অতি প্রাচীনকাল হইতে দুইটি সাধন পথ প্রচলিত আছে। জ্ঞানানুরাগী দার্শনিকগণ জ্ঞানযোগের এবং নিষ্কামকর্মীগণ কর্মযোগের কথা বলেন।

এখানে লক্ষণীয় ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। বিবেকানন্দ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, গীতার সূচনায় যে শ্লোকটি পাই তার অসীম তাৎপর্যের কথা :

হে ভারত (অর্জুন), ওঠ, হৃদয়ের এই দুর্বলতা ত্যাগ কর, ত্যাগ কর এই নির্বীর্যতা। উঠিয়া দাঁড়াও, সংগ্রাম কর।

প্রেক্ষিতের উল্লেখে কৃষ্ণ দ্বিধাহীন কন্ঠে জানিয়েছেন, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবন এক বিরামহীন সংগ্রাম। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, অনেক সময়েই আমরা আমাদের দুর্বলতা ও কাপুরুষতাকে ক্ষমা ও ত্যাগ বলে চালিয়ে যেতে অভ্যস্ত। কিন্তু স্বামীজীর এক্ষেত্রেও সতর্ক বাণীর সোচ্চার প্রকাশ দেখি :

. . . ভিক্ষুকের ত্যাগে কোন কৃতিত্ব নেই। আঘাত করতে সমর্থ কোন মানুষ যদি সহিয়া যায় তবে তাহাতে কৃতিত্ব আছে; যাহার কিছু আছে, সেযদি ত্যাগ করে, তবে তাহাতে মহত্ত্ব আছে।

বস্তুত, আমরা নিজেদের সাহসী বলে মনে করে নিজেদের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করি, মনকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করে থাকি। নিছক আলস্য ও ভীরুতার কারণে কতই না সংগ্রাম করা থেকে বিরত থেকেছি।

কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে অর্জুন তাঁর প্রতিপক্ষের দলে তাঁর শ্রদ্ধাস্পদ ও প্রীতিভাজনদের দেখে যুদ্ধ করায় তাঁর অনীহার কথা জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে হৃদয়দৌর্বল্য ত্যাগ করে সংগ্রামরত হবার পরামর্শ দিলেন। কারণ কৃষ্ণ, যিনি স্বামীজীর মতে ‘পরমাত্মা’ এবং ‘ভগবান’ তিনি অর্জুনের যুক্তির প্রকৃত রূপ ধরে ফেললেন, তা হল তাঁর আন্তরদৌর্বল্য। অর্জুন আত্মসম্মোহনের শিকার তখন। আত্মস্বরূপে দন্ডায়মান হওয়ার অবস্থা তাঁর ছিল না। অর্জুনের আন্তর দুর্বলতা কৃষ্ণের কাছে ধরা পড়ে গেল। কর্তব্য আর মায়ার দ্বন্দ্বে অর্জুন তখন অস্থিরমতি, ঘোষণা করলেন শ্রীকৃষ্ণ, ‘ত্যাগ কর নির্বীর্যতা’। আবেগের অধীন অর্জুনকে কৃষ্ণ কর্তব্যপরায়ণ করে তুলতে চাইলেন। তবে কি গীতার সূচনাজ্ঞাপক এই শ্লোকটিই তামাম গীতার Key statement?

কর্মযোগ এবং কর্মযোগ প্রসঙ্গ নিয়ে স্বামীজী দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। বস্তুতঃ স্বামী বিবেকানন্দ কর্মযোগের যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, কর্মযোগ সংক্রান্ত সকল বিষয়ের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তাতে তাঁকে আমরা অন্যভাবে পাই। বোঝা যায়, তিনি ছিলেন কর্মযোগ পন্থায় বিশ্বাসী।

দেখা যাক, প্রথমে স্বামীজী ‘কর্ম’ বলতে কী বুঝেছেন :

মানুষ প্রকৃতির দাস এবং চিরকালই সেএইরূপ থাকিবে। আমরা ইহাকে ‘কর্ম’ বলি। কর্ম একটি নিয়ম; ইহা সর্বত্র প্রযোজ্য।

অন্যত্র তিনি বললেন :

আত্মার অভ্যন্তরস্থ অগ্নিকে বাহির করিবার জন্য, উহার নিজ শক্তি ও জ্ঞান প্রকাশের জন্য যে কোনো মানসিক বা দৈহিক আঘাত প্রদত্ত হয়, তাহাই কর্ম।

এখানে স্বামীজী কর্মের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা ব্যাপকার্থে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন স্বামীজী :

. . . আমরা সর্বদাই কর্ম করিতেছি। আমি কথা বলিতেছি—ইহা কর্ম। তোমরা শুনিতেছ—তাহাও কর্ম। আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলিতেছি—ইহা কর্ম, বেড়াইতেছি—কর্ম, কথা কহিতেছি—কর্ম, শারীরিক বা মানসিক যাহা কিছু আমরা করি, সর্ব কর্ম।

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বললেন—

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ।

কার্যতে হ্যবশঃ কর্ম সর্বঃ প্রকৃতিজৈগুণৈ:।। ৩/৫

কৃষ্ণ বললেন, কারো পক্ষেই ক্ষণমাত্র কর্ম না করে থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতি-উৎপন্ন গুণ তার বশীভূত প্রত্যেককেই কর্ম করায়। স্বামীজীর ভাষ্যে ‘মানুষ প্রকৃতির দাস’, তাই নিষ্কর্মার জীবন অঙ্গীকার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

গীতায় যা উল্লিখিত হয় নি, স্বামীজী কর্মসংশ্লিষ্ট সেইসব প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। কোনো কিছুই তিনি এড়িয়ে যান নি। যেমন তিনি পরামর্শ দিয়ে বললেন :

যখন কেহ অতি ছোট ছোট সাধারণ কার্য করিতেছে, তখন দেখ—সেকিভাবে করিতেছে; এইভাবেই মহৎ লোকের প্রকৃত চরিত্র জানিতে পারিবে। বড় বড় ঘটনা উপলক্ষে অতি সামান্য লোকও মহত্ত্বে উন্নীত হয়।

তথাকথিত বৃহৎ কাজে তাৎক্ষণিকতা থাকে, থাকে সাময়িক আবেগ যা কখনই চিরস্থায়ী নয়। তাই এমনতর আবেগের বশবর্তী হয়ে হঠাৎ করে সম্পাদিত তথাকথিত বৃহৎ কর্মের প্রেক্ষিতে একজনের চরিত্রের যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব তথাকথিত ক্ষুদ্র তুচ্ছ কাজের প্রেক্ষিতে, কেননা এগুলি মানুষ নিছক আবেগের বশবর্তী হয়ে সম্পাদন করে না।

রবীন্দ্রনাথের ‘বাজে কথা’ প্রবন্ধটির কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসে। তুলনাটা হয়ত খুব জুৎসই হল না, কিন্তু স্পিরিটের দিক থেকে যেন স্বামীজীর বক্তব্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোথায় একটা মিল পাওয়া যায়। ‘অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। কারণ, মানুষ ব্যয় করে বাঁধা নিয়ম-অনুসারে, অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে।’

স্বামীজী ছোট তুচ্ছ কাজের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত পরিচয় জানার কথা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে তুচ্ছ কথার মাধ্যমে যথার্থ মানুষকে চেনার বিষয়ে জানিয়েছেন।

স্বামীজী এরপর একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। নিয়তিবাদের দেশে স্বামীজী নিয়তিবাদের মূলেই কুঠারাঘাত করেছেন :

আমাদের বর্তমান অবস্থা যদি আমাদের পূর্ব কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে ইহাই নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হইবে যে, ভবিষ্যতে আমরা যাহা হইতে ইচ্ছা করি, আমাদের বর্তমান কর্ম দ্বারাই তাহা হইতে পারি।১০

মানুষের বর্তমানের মত ভবিষ্যৎও তার নিজের কৃৎ কর্মের উপরেই একান্তভাবে নির্ভরশীল। মানুষের ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে কর্মশক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন স্বামীজী :

আমরা যাহা হইতে ইচ্ছা করি, তাহা হইবার শক্তিও আমাদের আছে।

স্বামীজী গীতার অনুসরণে মানুষমাত্রই কর্মব্যস্ত এ সত্য স্বীকার করেছেন, কিন্তু গীতায় যা অনুক্ত আছে সেই প্রসঙ্গের উত্থাপন করে বললেন :

তীব্র কর্মশীলতার প্রয়োজন; সর্বদাই আমাদের কর্ম করিতে হইবে, আমরা এক মিনিটও কর্ম না করিয়া থাকিতে পারি না। তবে বিশ্রাম কোথায়?১১

অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বামীজী এই প্রশ্নের সমাধান করেছেন, বলেছেন :

আদর্শ পুরুষ তিনিই, যিনি গভীরতম নির্জনতা ও নিস্তব্ধতার মধ্যে তীব্র কর্মী এবং প্রবল কর্মশীলতার মধ্যে মরুভূমির নিস্তব্ধতা ও নি:সঙ্গতা অনুভব করেন।১২

বুঝতে অসুবিধা হয় না, স্বামীজী কর্মযোগের আদর্শ প্রসঙ্গে বলেছেন এবং গুরুত্ব দিয়েছেন আত্মসংযমে। গীতায় কথিত হয়েছে, কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়। কর্মণ্যেবোধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাবে স্বামীজী প্রশ্নের অবতারণা করেছেন ফলের কথা না ভেবে মানুষের পক্ষে কি প্রথম থেকেই কাজ করা সম্ভব? কেননা আমাদের স্বার্থপরতা প্রকৃতিগত। তাই স্বামীজীর এই প্রসঙ্গে পরামর্শ :

প্রথম প্রথম আমাদের অভিসন্ধি সর্বদাই স্বার্থপূর্ণ, কিন্তু অধ্যবসায় প্রভাবে ক্রমশঃ এই স্বার্থপরতা কমিয়া যাইবে। অবশেষে এমন সময় আসিবে, যখন আমরা সত্যই নি:স্বার্থ কর্ম করিতে সমর্থ হইব। তখন আমাদের আশা হইবে যে, জীবনের পথে ক্রমশঃ অগ্রসর হইতে হইতে কোন না কোন সময়ে এমন একদিন আসিবে, যখন আমরা সম্পূর্ণ নি:স্বার্থ হইতে পারিব।১৩

অর্থাৎ গীতার উপদেশ নিছক অবাস্তব কোনো পরামর্শ নয়, মানুষ অধ্যবসায়ের সহায়তায় এই উপদেশকে জীবনে মূর্ত করতে পারে। নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন সম্ভব। গীতার ব্যাখ্যায় স্বামীজীকে যত না দার্শনিক রূপে পাই, তদপেক্ষা অনেক বেশি করে পাই সমাজবিজ্ঞানী রূপে। এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা তাঁর সেই সমাজ তাত্ত্বিকের ভূমিকাটিরই পরিচয় লাভ করেছি। কিন্তু যখন তিনি মন্তব্য করেন :

সকল ব্যাপারেই চরম বিপরীত প্রান্ত দুইটি দেখিতে একই প্রকার; কিংবা মন্তব্য করেন, ‘চূড়ান্ত অস্তি’ ও ‘চূড়ান্ত নাস্তি’ সকল সময়েই সদৃশ, তখন স্বামীজীর দার্শনিক সত্তার উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষ করি। এরূপ মন্তব্যের প্রসঙ্গ যুদ্ধ-বিমুখ অর্জুনকে কৃষ্ণের ভর্ৎসনা ও তিরস্কার। অর্জুনকে কৃষ্ণ বললেন, কাপুরুষ এবং কপট। এই প্রেক্ষিতেই তাঁর দার্শনিকসুলভ মন্তব্য। বিজ্ঞানের দৃষ্টান্তে নিজ বক্তব্যকে স্পষ্ট করলেন তিনি :

আলোক-কম্পন যখন অতি মৃদু, তখন উহা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না, অতি দ্রুত কম্পনও আমরা দেখিতে পাই না। . . . . অতি নিম্নগ্রামের শব্দ শোনা যায় না, অতি উচ্চগ্রামের শব্দও শোনা যায় না।১৪

‘প্রতিকার’ ও ‘অপ্রতিকারে’ প্রভেদও এইরূপ। স্বামীজী প্রতিকার ও অপ্রতিকারের Dichotomy দিলেন শুধু তাই নয়, এ ডাইকোটমির বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন প্রয়োজনবোধ থেকেই :

একজন কোন অন্যায়ের প্রতিকার করে না, কারণ সেদুর্বল, অলস ও প্রতিকারে অক্ষম; প্রতিকারের ইচ্ছা নাই বলিয়া প্রতিকার করে না, তাহা নয়। আর একজন জানে ইচ্ছা করিলে সেদুর্নিবার আঘাত হানিতে পারে, তথাপি সেশুধু যে আঘাত করে না—তাহা নয় বরং শত্রুকে আশীর্বাদ করে। যে ব্যক্তি দুর্বলতাবশতঃ ‘প্রতিকার’ করে না, সেপাপ করিতেছে।১৫

তাই সর্বাগ্রে বুঝে নেওয়া আবশ্যক, প্রতিকার করার শক্তি আমাদের আদৌ আছে কি না। অর্জুনকে কৃষ্ণ কেন ভর্ৎসনা করেছিলেন সেউত্তর এখানে মিলবে। বিপক্ষে প্রবল সৈন্যসমূহ সজ্জিত দেখে তিনি ভীত নন, প্রিয়জনদের উপস্থিতিই তাঁর যুদ্ধবৈরাগ্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ‘স্নেহ ভালোবাসা’ বশতঃ অর্জুন দেশের তথা রাজার করণীয় কর্তব্য বিস্মৃত হয়েছিলেন।

স্বামীজী বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর মন্তব্য করেছেন :

কর্মযোগী জানেন অপ্রতিকারই সর্বোচ্চ আদর্শ—তিনি আরও জানেন যে, উহাই শক্তির উচ্চতম বিকাশ এবং অন্যায়ের প্রতিকার কেবল অপ্রতিকাররূপ শ্রেষ্ঠ শক্তিলাভের সোপান মাত্র।১৬

সাংখ্যদর্শনে উল্লিখিত হয়েছে প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি উপাদান দ্বারা গঠিত। কর্মশূন্যতায় তমো গুণের লক্ষণ প্রকাশ পায়। অন্যদিকে কর্মশীলতা লভ্য রজোগুণে। সত্ত্ব হল রজঃ ও তমের সাম্যাবস্থা। তমোগুণের প্রভাবেই আমাদের আলস্যপরায়ণতা, রজোগুণের প্রভাবেই কর্মশীলতা আর কর্মশীলতা ও আলস্যপরায়ণতার এই সাম্যাবস্থার পশ্চাতে কার্যকরী ভূমিকা সত্ত্বের।

বিবেকানন্দের উপদেশ :

আলস্য সর্বতোভাবে ত্যাগ কর, মানসিক ও শারীরিক সর্ববিধ অসদভাবের প্রতিরোধ করা চাই।১৭

দুটি উপদেশ বিশেষভাবে লক্ষ করার। স্বামীজী যে কতখানি বাস্তববাদী ছিলেন তারই প্রমাণ এ দুটি উপদেশ। এক, প্রভুত্বলাভের বাসনা কিংবা অন্য যে কিছু বাসনা আছে সব পূরণ করে নেওয়া ভাল। বাসনা অচরিতার্থ থাকলে আত্মসমর্পণের ও বৈরাগ্যের ভাব লাভ অসম্ভব। বাসনা পূর্ণ হলে মানুষ উপলব্ধি করে এগুলি তুচ্ছ, ক্ষুদ্র। দুই, প্রত্যেকের নিজস্ব আদর্শ বর্তমান, সেসেই আদর্শ দ্বারা চালিত হয়। কোনো আদর্শই অবজ্ঞা অবহেলার নয়। একের আদর্শ দিয়ে অন্যের বিচার অযৌক্তিক, অযথার্থ। আমাদের কর্তব্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজস্ব সর্বোচ্চ আদর্শ অনুসারে চলার চেষ্টায় উৎসাহিত করা। ঐ আদর্শ সত্যের যত নিকটবর্তী হয় সেজন্য চেষ্টা করা।১৮

গীতায় নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কর্মের উল্লেখ ব্যতিরেকে, বিশেষতঃ গৃহস্থ অথবা সাংসারিক মানুষের মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগবে কী কর্ম, কী কর্তব্য, কী করণীয়? কর্মযোগের এক অংশ যে গৃহস্থের কর্তব্য ও কাজকর্ম সম্পর্কিত, স্বামীজী সেসম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি নিছক তাত্ত্বিক আলোচনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন ‘মহানির্বাণ-তন্ত্র’ থেকে। দৃষ্টান্তগুলি নিম্নরূপ—

ক. গৃহস্থের প্রধান কর্তব্য জীবিকার্জন, অবশ্যই সদুপায়ে।

খ. স্মরণ রাখতে হবে তার জীবন ঈশ্বরসেবার জন্য, দরিদ্র অভাবীদের সেবার জন্য উৎসর্গীকৃত।

গ. মাতা ও পিতাকে প্রত্যক্ষ দেবতাজ্ঞানে সেবা করবে। কোনো প্রকার ঔদ্ধত্য, পরিহাস, চঞ্চলতা অথবা ক্রোধ এঁদের সামনে প্রকাশ করা চলবে না।

ঘ. ভার্যার প্রতি উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করবে। পরস্ত্রী সংসর্গ করবে না। স্ত্রীলোকের সামনে অশিষ্ট বাক্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে।

ঙ. পুত্রকন্যাকে যথাযথভাবে পালন করবে, ষোড়শ বৎসর পর্যন্ত তাদের নানাবিধ সদগুণ ও বিদ্যা শিক্ষা দেবে। কন্যাকেও উপযুক্তভাবে পালন করতে হবে, যত্নপূর্বক শিক্ষাদান করা আবশ্যক। বিদ্বান বরের হাতে কন্যাকে সমর্পণ করবে।

চ. ভ্রাতা-ভগিনী, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভাগ্নে, জ্ঞাতি, বন্ধু এমনকি ভৃত্যদেরও প্রতিপালন করবে।

ছ. গৃহী ব্যক্তি অতিরিক্ত নিদ্রা, আলস্য, কেশবিন্যাস কিংবা অশন-বসনে আসক্তি ত্যাগ করবে।

জ. শত্রুর নিকট শৌর্য প্রদর্শন করবে। বীর্যপ্রকাশের দ্বারা তাদের শাসন করবে। কিন্তু আত্মীয়-বন্ধুদের কাছে শান্ত ও নিরীহ ভাব অবলম্বন করবে।

ঝ. অসৎ ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকবে, অন্যদিকে সম্মানীয়কে সম্মান প্রদর্শন করবে।

ঞ. উপযুক্ত বিবেচনার পর বন্ধুত্ব স্থাপন করবে, বন্ধু নির্বাচন সঠিক হওয়া কাম্য।

ট. গৃহস্থ তিনটি বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করবে—নিজ যশ, পৌরুষ প্রসঙ্গ, অপরের কথিত গুপ্ত কথা ও অপরকে দেয় তার সাহায্য।

ঠ. অসৎসঙ্গ, মিথ্যাবাক্য, হিংসা, শত্রুতা ত্যাগ করবে।

ড. অবস্থা ও সময় অনুসারে কর্ম করবে।

ঢ. সত্য, মৃদু, প্রিয় ও হিতকর বাক্য বলবে।

ণ. সাধারণের ব্যবহার্থে জলাশয় খনন, বৃক্ষরোপণ, পথিমধ্যে বিশ্রামগৃহ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ অত্যন্ত পুণ্যের কাজ, এসবের দ্বারা ত্রিভুবন জয়ের পথ সুগম হয়।

কর্মযোগের তত্ত্বকে সম্যকরূপে বোঝার জন্য প্রয়োজন কর্তব্য কি তা জানা। কিন্তু সমস্যা হল ব্যক্তিনিরপেক্ষ ভাবে কর্তব্যের সংজ্ঞাদান প্রায় অসম্ভব। বাস্তববাদী স্বামীজী তাই কর্তব্যের বর্গীকরণ করেছেন উদ্দেশ্যের নিরিখে— অধ্যাত্মভাবের দিক থেকে কতকগুলি কার্য আমাদের উন্নত ও মহান করে, কতকগুলি কার্য আমাদের অবনতি ডেকে আনে, আমাদের পশুভাবাপন্ন করে তোলে। স্বামীজী একটি সংস্কৃত শ্লোকের ব্যবহারে মানুষকে (সম্প্রদায়, কাল, দেশ, নির্বিশেষে) কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সচেতন করিয়ে দিয়েছেন—

পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম।

স্বামীজীর পরামর্শ :

যে সমাজে আমরা জন্মগ্রহণ করিয়াছি, সেই সমাজের আদর্শ ও কর্মধারা অনুসারে এমন কাজ করা, যাহা দ্বারা আমাদের জীবন উন্নত ও মহৎ হয়।১৯

গীতায় যে আমাদের অবিরত কর্ম করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, স্বামীজী তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তেমনি গীতায় অনাসক্ত ভাবে কর্ম সম্পাদনের কথাও বলা হয়েছে। স্বামীজী এই ‘অনাসক্ত’ ব্যাপারটি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অনাসক্তি কী, অনাসক্তি কেন, কীরূপে অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব, এর উদ্দেশ্য— সবই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে।

গীতায় কথিত হয়েছে, আমরা যদি কর্মে আসক্ত না হই, তবে কর্ম আমাদের বন্ধন হয়ে উঠবে না। স্বামীজীর পরামর্শ :

অনাসক্ত হও, সব ব্যাপার চলিতে থাকুক, মস্তিষ্ক—কেন্দ্রগুলি কর্ম করুক। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু একটি তরঙ্গও যেন মনকে পরাভূত না করিতে পারে। তুমি যেন সংসারে বিদেশী পথিক, যেন দুদিনের জন্য আসিয়াছ—এইভাবে কর্ম করিয়া যাও। নিরন্তর কর্ম কর, কিন্তু নিজেকে বন্ধনে ফেলিও না; বন্ধন বড় ভয়ানক। এই জগৎ আমাদের বাসভূমি নয়।২০

স্বামীজী সাংখ্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সমুদয় প্রকৃতি আত্মার জন্য, আত্মা প্রকৃতির জন্য নয়। বস্তুত, আত্মার শিক্ষার জন্যই প্রয়োজন প্রকৃতির। নতুবা প্রকৃতি অর্থহীন। আত্মা যাতে জ্ঞানলাভ করতে পারে, জ্ঞানের দ্বারা আত্মা যেন নিজেকে মুক্ত করতে পারে—এই সচেতনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই সচেতনতা থাকলে মানুষ কখনই প্রকৃতি-আসক্ত হবে না। দুঃখের বিষয় আমরা প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলি। আর ভাবি আত্মা প্রকৃতিরই জন্য। প্রকৃতিকে আমি ভাবতে থাকলে তার প্রতি আসক্তি জন্মে।

গীতায় ৩য় সর্গের ২২-২৪ শ্লোকগুলিতে কৃষ্ণ বলেছেন, তিনি এক মুহূর্ত কর্ম থেকে বিরত থাকেন না, কারণ, বিরত থাকলে জগৎ ধ্বংস হবে। কর্ম করে কৃষ্ণের কোনো লাভ নেই, কেননা তিনিই জগতের একমাত্র প্রভু, তাহলে তিনি কর্ম করেন কেন? বলেছেন জগৎকে যেহেতু ভালোবাসেন তাই। স্বামীজীর মন্তব্য :

ঈশ্বর ভালোবাসেন বলিয়াই তিনি অনাসক্ত। প্রকৃত ভালবাসা আমাদিগকেও অনাসক্ত করে।২১

আসক্তি মানেই পার্থিব বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, প্রাকৃতিক আকর্ষণ। এ আকর্ষণ আসলে ‘কতকগুলি জড় বিন্দুর সহিত আরও কতকগুলি জড় বিন্দুর ভৌতিক আকর্ষণ মাত্র—কিছু যেন দুইটি বস্তুকে ক্রমাগত নিকটে আকর্ষণ করিতেছে।’২২ এই অনাসক্তি লাভই হল জীবনের সাধনা। অনাসক্তির কারণেই প্রকৃত প্রেমের লক্ষ্যস্থলে উপনীত হওয়া সম্ভব আর সেই উপনীত হওয়ার মাধ্যমেই ঘটে মুক্তি।

অনাসক্তি প্রসঙ্গে স্বামীজী পরামর্শ দিয়েছেন অন্যত্রও :

আমরা যদি কর্মের ফল চাই তবে শুভই হউক আর অশুভই হউক, উহার ফল ভোগ করিতে হইবেই। কিন্তু যদি আমরা আমাদের নিজেদের জন্য কর্ম না করিয়া ঈশ্বরের মহিমার জন্যই করি, তাহা হইলে ফল নিজের ভাবনা নিজেই ভাবিবে।২৩

প্রকৃতি-আসক্তি থেকে মুক্ত থাকা একটি পথ যেমন, তেমনি সর্বপ্রকার কর্মাদি ঈশ্বরের মহিমার জন্য সম্পাদন করেও অনাসক্তি লাভ সম্ভব।

তৃতীয় একটি পথেরও সন্ধান দিলেন স্বামীজী :

শিশুসন্তানদিগকে কিছু দিলে তোমরা কি তাহাদের নিকট হইতে কিছু প্রতিদান চাও? তাহাদের জন্য কাজ করাই তোমার কর্তব্য—ঐখানেই উহার শেষ। . . . . যদি সর্বদা দাতার ভাব অবলম্বন করিতে পারো, প্রত্যুপকারের কোন আশা না রাখিয়া জগৎকে শুধু দিয়া যাইতে পারো, তবেই সেই কর্ম হইতে তোমার কোন বন্ধন বা আসক্তি আসিবে না। যখন আমরা কিছু প্রত্যাশা করি, তখনই আসক্তি আসে।২৪

স্বামীজী নানা দিক দিয়ে আসক্তির উদ্ভবের কারণগুলি সম্পর্কে ভেবেছেন এবং আসক্তি নির্মূল করার দাওয়াই বাতলেছেন সাংসারিকতায় আসক্ত মানুষদের জন্য। যেমন তিনি বললেন :

আমার উপর কেহ নির্ভর করে এবং আমি কাহারও উপকার করিতে পারি, এরূপ চিন্তা করাই অত্যন্ত দুর্বলতা। এই বিশ্বাস হইতেই আমাদের সর্বপ্রকার আসক্তি জন্মায় এবং এই আসক্তি হইতেই সকল দুঃখের উদ্ভব। আমাদের মনকে জানানো উচিত যে, এই বিশ্বজগতে কেহই আমাদের উপর নির্ভর করে না, একজন গরীবও আমাদের দানের উপর নির্ভর করে না, কেহই আমাদের দয়ার উপর নির্ভর করে না, একটি প্রাণীও আমাদের সাহায্যের উপর নির্ভর করে না। প্রকৃতিই সকলকে সাহায্য করিতেছে। আমরা কোটি কোটি মানুষ না থাকিলেও এইরূপ সাহায্য চলিবে। তোমার আমার জন্য প্রকৃতির গতি বন্ধ থাকিবে না।২৫

‘স্বামী-শিষ্য-সংবাদে’ স্বামীজী শিষ্যের উদ্দেশে কর্মবন্ধন মোচনের পথ নির্দেশ করেছেন :

কর্মের ফলে যদি তোর দৃষ্টি না থাকে এবং সকল প্রকার কামনা-বাসনার পারে যাবার যদি তোর একান্ত অনুরাগ থাকে, তাহলে ঐসব সৎকাজ তোর কর্মবন্ধন মোচনেই সহায়তা করবে।২৬

Man is the architect of his own fate. স্বামীজীর ভাষায় :

আমরাই আমাদের অদৃষ্টের নির্মাতা।

গীতার অনুসরণে স্বামীজী বললেন :

তিনি কাহারও দন্ডবিধান করেন না, কাহাকেও পুরস্কার দেন না।

নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভু:।

অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ।। ৫/১৫

ঈশ্বর পরম করুণাময়। সকলেই সর্ব অবস্থায় সব দেশে ও কালে তাঁর দয়ালাভের অধিকারী। কিন্তু ‘উহার ব্যবহার কীরূপ করিব, তাহা আমাদের উপর নির্ভর করিতেছে। আমরা যে কষ্ট পাই সেজন্য ঈশ্বর নন, আমরাই দায়ী। আমাদের কর্মফলেই আমাদের ভোগান্তি। তাই আমাদের দোষের জন্য অন্যকে দায়ী করা উচিত নয়, সমুদয় দায়িত্ব আমাদেরই। সবকিছুই কৃতকর্মের ফল। এ যেমন সত্য, তেমনিই সত্য :

আমার দ্বারাই এই দুঃখকষ্ট দূরীভূত হইবে। আমি যাহা সৃষ্টি করিয়াছি, আমিই তাহা ধ্বংস করিতে পারি।২৭

মোদ্দা কথা, কর্মের কারণেই দুঃখভোগ আবার উপযুক্ত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমেই সেই দুঃখভোগের বিনাশ সম্ভব। প্রকারান্তরে কর্মকেই গুরুত্ব দিয়েছেন স্বামীজী।

স্বামীজী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বেদান্ত দর্শনের সবকিছুই ধ্যানলব্ধ নয় যেমন, তেমনি তার প্রাপ্তিস্থান কখনই তপোবন মাত্র নয়। স্বামীজীর ভাষায়, ‘ইহার সর্বোৎকৃষ্ট অংশগুলি সাংসারিক কার্যে বিশেষ ব্যস্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই চিন্তিত ও প্রকাশিত।’ এক্ষেত্রে স্বামীজীর যুক্তিটিও অকাট্য :

লক্ষ লক্ষ প্রজার শাসক সার্বভৌম রাজা অপেক্ষা অধিকতর কর্মব্যস্ত মানুষ আর কল্পনা করা যায় না; রাজারা শুধু রাজকার্যে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁরা চিন্তাশীলতামুক্ত ছিলেন এমন ভাবাটা ঠিক নয়।

অনেক সময়েই তাঁদের গভীর চিন্তাশীল রূপে দেখা মিলত। গীতায় তীব্র কর্মশীলতার পরিচয় লভ্য, তৎসহ যুক্ত হয়েছে শান্তভাব। স্বামীজী একেই বলেছেন : কর্ম রহস্য। ‘কর্ম রহস্যে’র ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। শান্ত মনে, ক্ষমাসুন্দর চিত্তের অধিকারীই সর্বাধিক কাজে সক্ষম, এমন মানুষের পক্ষেই সমুদয় শক্তি সৎকার্যে নিয়োগ করা সম্ভব—

‘মন যখন খুব শান্ত ও স্থির থাকে, কেবল তখনই আমাদের সমুদয় শক্তিটুকু সৎকার্যে নিয়োজিত হইয়া থাকে। যদি তোমরা জগতে বড় বড় কর্মকুশল ব্যক্তির জীবনী পাঠ কর, দেখিবে তাঁহারা অদ্ভুত শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। কিছুই তাঁহাদের চিত্তের সমতা নষ্ট করিতে পারিত না।’

স্বামীজীর সিদ্ধান্ত, কেবল শান্ত ক্ষমাশীল স্থিরচিত্ত ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা বেশী কাজ করিয়া থাকেন।২৮

দি মেসেজ অফ দি ভাগবত গীতালালা লাজপত রায়

The Message of the Bhagavad Gita : প্রকাশকাল ১৮৯৪, প্রকাশস্থল বোম্বাই। গ্রন্থটির প্রকাশ – উদ্দেশ্য ব্যাখ্যাত হয়েছে পাবলিশার্স নোটে। বলা হয়েছে :

The Publisher feels specially gratified to present to the public Lalagi’s ‘Message of the Bhagavad Gita’ at the present critical moment of India’s history, when Indians need a Message of Karma the most–that interpretation of the world famous Gita by one who has woven the very spirit of the work into his life. The doctrine of Karma expounded in the Bhagavad Gita and so ably and vigorously interpreted by our Great Patriot, all Indians need act up to.

লাজপত রায় মূলতঃ কর্মযোগের কথা বলতেই গীতার আলোচনায় প্রয়াসী। ভারতবর্ষের তৎকালীন পরিবেশের প্রেক্ষিতে এই আলোচনা ছিল জরুরী। লালা লাজপতের এই আলোচনাটি একটি সাময়িক পত্রে প্রথম প্রকাশিত হয় গ্রন্থ প্রকাশের ১৩ বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৮১ সালে।

লাজপত গীতাকে বলেছেন ‘The Lord’s Song’। কৃষ্ণ তাঁর কাছে লর্ড, ভগবান। অতএব ভগবান-কথিত বাণী, উপদেশ অকাট্য। গীতা সকল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যেমন ও Orthodox Heterodox, reformed or unreformed, the Brahmos, the Aryas, Sanatanists, Vedantists, Ramanujas, Vallabhacharis, the vaishnavas, Nanakapanthis, Dadupanthis, Kabirpanthis, Gulabdasis-এর থেকেই লালা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, গীতার বক্তব্যে এমন কিছু আছে যার ফলে তাকে কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষেই অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। গীতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লালা বললেন— Vedas are a sealed book to a vast majority, the Gita is open and intelligible to a large number.

গীতার আবেদন যেমন বুদ্ধির কাছে, তেমনি এর আবেদন আবেগের কাছেও। গীতা একই সঙ্গে অনেকগুলি বিপরীত কোটির বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ—

It is rigid and elastic at the same time. It broadens the vision and expands the outlook without requiring a serious outrage on the affection. It is invigorating as well as chastening. It stimulates one’s energies and subdues one’s passions. It is a constant and everrecurring exhortation in favour of right action without attachment to its results. It shows the way to the balancing of the mind, assigning their proper places to the activities of the body and the yearning of the soul. It is a most audacious as well as a most successful attempt to reconcile the different schools of religious thoughts that prevailed in ancient India at the time of its composition.

সত্যি কথা বলতে কি গীতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এমন আবেগপূর্ণ এবং ঐশ্বর্যমন্ডিত বিশ্লেষণ আর কেউ করেননি।

গীতার গ্রহণযোগ্যতা সর্বাধিক এই কারণে যে, সেমুশকিল আসানের ভূমিকা পালন করে। নানা স্ববিরোধিতা ও বৈপরীত্যের মধ্যেও গীতার ভূমিকা সমন্বয় সাধকের। লাজপত রায় বললেন :

Here we are in the world of conflict and struggle and strife, more often surrounded by sin and sorrow than by virtue and happiness, more dejected by the pettiness; and no meanness encompassing us, thou held up by the broadness of soul and the sympathy of heart which we only now and then experience; more depressed by the inconsistencies of life, the selfishness, the narrowness, the ugliness, and the utter depravity of human nature the elevated by that much sought after and much talked of harmony, that is said to prevail in the world and by that disinterested love, beauty of character and nobility of behaviour, which occasionally given an angelic appearance to the son of man. In short in the world thou seems to be more to dishearten and depress, than to encourage and sustain,’

অর্জুন কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করলেন। কে এই অর্জুন? তিনি কারো ভাই, তিনি কারো শিষ্য, কারো বা বন্ধু—এ ত গেল একদিককার পরিচয়, অন্যদিকে তিনি যোদ্ধা, দ্রৌপদীর স্বামী, যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতা। মাতা কিংবা পত্নীর অপমানকারীর বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াবেন না?

As a Sishya (a disciple), as a brother, as a friend, and as a man, it was a sin for him to attempt the lives of those who stood in the opposite rank, as a Prince, and as a warrior, even as a brother of Yudhisthira, husband of Draupadi, son of Kunti, it was his duty to fight for the deliverance of his notion; to restore to his brother what was lawfully and by right his and to teach a lesson to those who had viciously and out of pureill insulted his wife and his mother. To neglect this duty was as much a sin.

Mrs. Annie Besant প্রশ্ন তুলেছেন :

To break familyties was a sin, to have the people in cruel bondage was a sin, where was the right way?

লাজপত রায় মনে করেছেন, হত্যা যত পাপই হোক, কিন্তু যে নাকি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছে, সেইমত শিক্ষা পেয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে তার যুদ্ধবিমুখতা অত্যন্ত দূষণীয়। কৃষ্ণ যদি অর্জুনকে প্রশ্রয় দিতেন, তাঁর ক্লীবত্বকে মেনে নিতেন, তবে তাঁর কলঙ্ক রটত, তিনি কর্তব্যভ্রষ্ট হতেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে ছাড় দিতে হতো :

fraud, dishonesty, deceit, wrongful unsurpation of other people’s rights to go unpunished.

কৃষ্ণ কিভাবে তাঁর যুক্তির জাল বিস্তার করলেন, অর্জুনকে দিয়ে তাঁর কৃত কর্তব্য সম্পাদন করতে সম্মত করালেন সেবিষয় নিয়েই গীতা। লালা তাই মনে করেন। অর্জুনের যে সমস্যা, সেসমস্যা ত’ আমাদের সকলেরও। প্রাচ্যেও এই সমস্যা, পাশ্চাত্যের মানুষেরও একই সমস্যা—

Hence the value of the eternal message conveyed for all and for all ages by the Lord’s song, the Bhagavad Gita.

লালা বলেছেন, গীতায় নতুন কিছুই নেই, ‘The Lord taught and said nothing that was not already there or what was quite new and original.’ তাহলে গীতার এত জনপ্রিয়তা কেন? তারও কারণানুসন্ধান করেছেন তিনি। লালার মতে :

. . . . the story of the Gita is so natural and human, that it directly and irresistibly appeals to the innermost core of every seeker after truth.

কৃষ্ণের উক্তি স্বাভাবিক, মানবিক, বাগ্মিতাপূর্ণ, জ্ঞানগর্ভ এবং ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ :

Natural beginning with the human and ending with the Divine, winding up with the detailed account of the ways and means of reacting the Divine or to make the dialogue a complete whole–a masterpeace endowed with the eloquence of wisdom and good sense, with the convincingness of sound reason and logic and reassuring with the assurance of experience and practical knowledge.

একদিকে জীবনদর্শনে সমৃদ্ধ অন্যদিকে তা প্রকাশে আন্তরিকতা সর্বোপরি তা চিত্তাকর্ষক, শ্রোতার ভীতি দূরকারী—it speaks to you in deepest philosophy of life :

The language of love and regard demanding from you the fullest shraddha and confidence in the Lord, inspiring awe but removing all causes of fear.

কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন, জীবন কি, মৃত্যুই বা কি? What is Life and Death? The great riddle of existence and non-existence —অবস্থান এবং অনবস্থানজনিত জটিল রহস্যকে অনিন্দ্যসুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

it combines splendid prose with sublime poetry. মনে রাখতে হবে গীতার সূচনায় কোনো question of theology, religion পাই না, পাই অর্জুনের যুদ্ধবিমুখতার প্রসঙ্গ।

গীতায় পুনরুক্তি বা স্ববিরোধিতা লালা অস্বীকার করেন নি, কিন্তু এগুলিকে তিনি গীতার ত্রুটি বলেও মেনে নিতে পারেন নি। বরং এগুলিকে very essence of such a dialogue, quite natural বলে অভিহিত করেছেন। এক্ষেত্রে যুক্তি এবং নিরাসক্ত দৃষ্টির পরিবর্তে তাঁর পক্ষপাতিত্ব তথা একদেশদর্শিতার ছাপ স্পষ্ট। গীতার আদিতে সংশয় প্রকাশ করেছেন লেখক — perhaps its original purity has been tampered …. যা যত জনপ্রিয় হয়, বহুল ব্যবহৃত হয়, ততই তার বিকৃতি ঘটে, শুদ্ধতা নষ্ট হয়।

গীতায় অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদের কথা স্বীকার করা হয়েছে। অদ্বৈতবাদের প্রচারক শঙ্করাচার্য, রামানুজ আবার দ্বৈতবাদের সমর্থক। অবশ্য লাজপত রায় মনে করেছেন গীতায় দ্বৈততত্ত্বের প্রতি ঝোঁকটাই বেশি।

the collective weight of the whole poem favours the Dvaitavad is more than it does the Advaitavad.

গীতায় সাংখ্য ও যোগের প্রসঙ্গেও বিতর্ক আসীন। সাংখ্যরা মনে করেন জ্ঞানই সর্বোচ্চ। Gita establishes the superiority of Jnana over all other ways of knowing and realising the supreme soul.

অন্যদিকে যোগমতে কর্মই সব—lord has given the foremost place to Yoga and action.

গীতায় কর্মযোগের প্রাধান্যের স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে লাজপত রায় মনে করেছেন :

If the language of the book is any guide to its subject, surely the latter position seems to be the correct one. তাছাড়াও All the chapters of Gita end by giving a name Sankhya Yoga, Karma Yoga, the Sanyasa Yoga – ‘যোগ’ শব্দটি প্রতিটি অধ্যায়েই ব্যবহৃত।

লাজপত রায় বলছেন :

One’s individual Dharma is the supreme law of his life, is the spring by which all its movements must be regulated. It is the rudder of the ship, the compass, the guiding star and the supreme determining entity.

স্বধর্মই সব। তার ওপরে কোনকিছুকে স্থান দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। স্বধর্মাচরণেই সর্বশক্তি নিয়োজিত হওয়া আবশ্যক।

Everything else must be subordinated to it, put under its guidance and control as existing for it and for the furtherance of its ends. One’s dharma cannot be anything but righteous. Hence anything which is necessary to be done in the performance of Dharma cannot be sinful.

ধর্মাচরণে কৃত কোনকিছুই পাপ বলে গণ্য হয় না।

A Raja commits no sin in punishing thieves, robbers, dacoits and murderers.

রাজধর্ম হলো দুষ্টের দমন, দুর্বৃত্তের শাস্তিবিধান। এ যেমন পাপকর্ম নয় কোনমতেই, A patriot warrior commits no sin in killing the enemies of his country in fair fight, তেমনি স্বদেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধা যদি নিজ দেশের স্বার্থে শত্রু বিনাশ করে তা কখনই পাপকর্ম নয়।

. . . . after weighing all the pros and cons and scanning it carefully in the light of your conscience and the teaching of the Shastras, you conclude that you cannot do your duty without running the risk of doing what otherwise appears to you to be sinful, your path is clear, you must do the former at any risk and at any cost.

তবে সকল কর্মই সম্পাদন করতে হবে বিবেকের অনুশাসন মেনে, শাস্ত্রীয় শিক্ষা মেনে। লালাজী বললেন :

. . . the central sun of the whole system of the Gita is the truth that every one must do his own duty, be true to his own Dharma.

গীতার কেন্দ্রীয় বাণী তথা উপদেশ হলো প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্ম নিষ্ঠাসহ সম্পাদন কর। কৃষ্ণ যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে কেমন করে যুদ্ধে অনিচ্ছুক অর্জুনকে যুদ্ধ করতে সম্মত করালেন, অর্জুনের সকল সংশয় দূরীভূত হলো গ্রন্থের শেষাংশে তাই আলোচিত হয়েছে। লাজপত রায় চেয়েছেন কৃষ্ণের জ্ঞান ও অর্জুনের সাহসিকতার সমন্বয় ঘটুক, ঘটলে একটি জাতির উন্নতি অনিবার্য, সাফল্য সুনিশ্চিত। জ্ঞান এবং সাহসিকতা দুইয়েরই প্রয়োজন। এককে বাদ দিলে অন্যটি অসম্পূর্ণ।

Efficiency can best be secured by a combination of both. This is the corollary to the Bhagavad Gita; disinterested performance of one’s duty without attachment to its fruits, at any cost and any risk, being be. . . . this is the message for the descendants, successors and countrymen of Krishna and Arjuna, swayed as they are at present, by the forces of ignorance, superstition. Chicken hartedness and falseeding of Dharma and Karma. In unswearing loyalty to the truth — at any cost and under any circumstances lies the salvation of the present-day Indians.

ইংরেজ শাসনাধীন দুর্গত পীড়িত ভারতবাসী কিরূপে পরিত্রাণ লাভ করবে তারই ইঙ্গিত প্রদত্ত হয়েছে। যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, এবং তা করতে হলে একই সঙ্গে প্রয়োজন জ্ঞান ও সাহসিকতার। কাজ করতে হবে ফলের আশা না করেই নিরাসক্ত ভাবে। স্বার্থ-প্রণোদিত হয়ে কর্ম করলে চলবে না। অজ্ঞতা, সংস্কার কিংবা দুর্বল-চিত্ততা পরিহার করতে হবে। সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। ধর্ম এবং কর্ম সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা বিসর্জন দিতে হবে।

লালা লাজপত রায় এক বিশেষ উদ্দেশ্যে গীতার বাণী আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন দেশের মানুষকে সচেতন করা যে তারা শ্রীকৃষ্ণ-অর্জুনের বংশধর, তাদেরই মহান উত্তরাধিকারী। তাই জ্ঞান ও সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হবে। স্পষ্টভাবে ইংরেজ-বিরোধিতার কথা না বললেও আভাসে স্পষ্ট দেশের স্বার্থে পরাধীনতার গ্লানি মোচনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা বা মোকাবিলা করা অন্যায় নয়। কৃষ্ণকে লেখক ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছেন। লেখক কোন তত্ত্বসন্ধিৎসু হয়ে গীতার আলোচনায় প্রবৃত্ত হন নি। মূলতঃ গীতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন, কোন পরিবেশে গীতা রচিত—এ সবেরই ওপর জোর দিয়েছেন লেখক। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ কিংবা ভক্তিযোগ নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করা থেকে বিরত থেকেছেন। লালার আহ্বান ধর্মাচরণ। কর্মকেই তিনি ধর্ম বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর সতর্কীকরণ দেশবাসী যেন ভ্রান্ত ধারণার শিকার না হন কারণ সেক্ষেত্রে তাদের মন ও শক্তি দুই-ই অবশ হয়ে পড়বে।

গীতা ও মহাত্মা গান্ধী

গান্ধীজীর জীবনে যদি কোনো একটি গ্রন্থের সর্বাধিক প্রভাবের কথা বলতে হয় তবে সেগ্রন্থটির নাম গীতা। গান্ধীজী গীতাকে কোন দৃষ্টিতে দেখতেন সর্বাগ্রে আমরা সেই পরিচয় গ্রহণ করব। তারপর গীতার কোন বাণী, আদর্শ অথবা বৈশিষ্ট্য গান্ধীজীকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই প্রসঙ্গে আসব।

শৈশব থেকেই গান্ধীজীর ভাবনা, এই মোহময় জীবনে তাঁকে সার্থকভাবে পরিচালনার জন্য বিশেষ এক শাস্ত্রের প্রয়োজন। বেদ শিক্ষা করতেই লেগে যাবে সুদীর্ঘ ১৫/১৬ বৎসর, তাই বেদ শিক্ষায় মনোযোগী হলেন না তিনি। ঝুঁকলেন গীতার দিকে। গীতা গান্ধীজীর কাছে বাইবেল বা কোরাণ ছিল না কেবল, তা ছিল তাঁর কাছে জননী-স্বরূপা। শৈশবে তাঁর মাতৃ- বিয়োগ হয়। চিরন্তনী জননী গীতা সেই স্থান পূরণ করেন। গান্ধীজীর মতে গীতা অপরিবর্তনীয়, সকল ব্যর্থতার ঊর্ধ্বে। অকপটে জানিয়েছেন, যখনই তিনি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন আশ্রয় নিয়েছেন গীতার।

গীতার সঙ্গে গান্ধীজীর প্রথম পরিচয় ১৮৮৯ সালে, তখন তিনি ইংলন্ডে অবস্থান করছেন। গান্ধীজীর কাছে গীতা ‘a great religious poem.’ বলেছেন, যতই গীতার সাগরে একজন ডুব দেবে, ততই সেবিরল মণিমাণিক্যের সন্ধান লাভ করবে—The deeper you dive into it, the riches the meaning you get। গীতা গান্ধীজীর জীবনের মুসকিল আসান। যখনই তিনি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, সংশয়ের শিকার হয়েছেন, কর্তব্য নির্ধারণে দোলাচলতার শিকার হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে শরণ নিয়েছেন গীতার এবং সমাধানমূলক শ্লোকের সন্ধান পেয়ে সঙ্কটমুক্ত হয়েছেন :

When doubts haunt me, when disappointment stares me, and I immediately begin to smile in the midst of overwhelming sorrow, I turn to the Bhagavat Gita and find a verse to comfort me.

গীতা পৃথিবীর সবরকম শাস্ত্রের চাবিকাঠি স্বরূপ। গীতা সর্বপ্রকার গভীর রহস্যভেদে অদ্বিতীয় পারঙ্গম :

Gita has become for me the key to the Scriptures of the world. It unrevels for me the deepest mysteries to be found in them.

গান্ধীজী গীতার সঙ্গে তাঁর আরও একটি প্রিয় গ্রন্থের কথা বলেছেন, সেটি হল তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’। I find the greatest consolation in the Bhagavad Gita and Tulsidasi Ramayan। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রগুলির প্রতি তিনি সমভাবে শ্রদ্ধাশীল, তা সত্ত্বেও তুলসীদাসের রামচরিত মানস কিংবা ভাগবদগীতা তাঁকে যতটা টানে, ঐ ধর্মপুস্তকগুলি তাঁকে তেমনভাবে আকৃষ্ট করে না।

I have no hesitation in regarding the Korana as revered as I have none in regarding the Bible, the Zend Avesta, the Granth Sahib and any other clean scripture as revealed . . . . I frankly confess that the Koran and the Bible and the other scriptures of the world do not move me as do the Gita of Krishna and the Ramayan of Tulsidas.

গান্ধীজীর মতে :

The Gita has become for us a spirited reference book.

তিনি বলেন :

I have not been able to see any difference between the Sermon on the Mount and the Bhagwad Gita. What the Sermon describes in graphic manner, the Bhagwad Gita reduces to a scientific formula.

গান্ধীজী পড়েছিলেন যে, গীতার ৭০০টি শ্লোকে আমাদের সমস্ত উপনিষদ ও শাস্ত্র উপস্থাপিত। তাই তিনি সঠিকভাবে গীতা পাঠের জন্য সংস্কৃত শিক্ষা করলেন এবং সেই অধীত জ্ঞানে গীতা পাঠ করে তাঁর অনন্যসাধারণ অনুভব হল :

. . . . the Gita, I had read somewhere, gave within the compass of its 700 verses the quintessence of all the shastras and the Upanishads. That decided me. I learnt Sanskrit to enable me to read the Gita. Today the Gita is not only my Bible or my Koran it is more than that — it is my mother.

গীতা গান্ধীজীর কাছে ‘eternal mother’, ‘has never changed’, she has never failed’.

এবারে আসা যাক গীতার মর্মবাণীর প্রসঙ্গে, গান্ধীজী যার দ্বারা উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। প্রথমেই তিনি অকপটে জানালেন যে, গীতাকে তিনি কোনমতেই ঐতিহাসিক কাজ বলে বিবেচনা করেন না, গান্ধীজীর মনে হয়েছে বাহ্যিক যুদ্ধ প্রসঙ্গে মানবের চিত্তে যে অহর্নিশি দ্বন্দ্ব চলেছে সেই প্রসঙ্গেই এই গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। এ অনুভূতি গান্ধীজীর হয়েছিল ১৯৮৮-৮৯ সালেই :

I felt that it was not an historical work but that under the guise of physical warfare, it described the duel that perpetually went on in the hearts of mankind, and that physical warfare was brought in merely to make the description of the internal duel more alluring.

বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করেন নি যে, গীতা যুদ্ধের মত নৃশংস ব্যাপারে মানুষকে প্ররোচিত করেছে। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন গীতার উদ্দেশ্য মানুষকে স্বধর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করা। কৃষ্ণ অর্জুনকে তার নিজের ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন মাত্র। গান্ধীজীও মহাভারত তথা গীতাকে যুদ্ধের অপরিহার্যতা প্রচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখেন নি। বরং যুদ্ধের ব্যর্থতা প্রতিপন্ন করা হয়েছে এর মাধ্যমে বলেই গান্ধীজীর ঐকান্তিক বিশ্বাস :

The author of the Mahabharata has not established the necessity of physical warfare; on the contrary he has proved its futility. He has made the victors shed tears of sorrow and repentance, and has left them nothing but a legacy of miseries.

গান্ধীজী তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে উল্লেখ করেছেন গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের। এখানেও physical warfare- এর পরিবর্তে একজন নির্দোষ খাঁটি মানুষ রচনার ওপরেই সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গান্ধীজীর মতে, গীতার কৃষ্ণ হলেন Perfect ও যথার্থ জ্ঞানের প্রতিভূ। গীতার মূল আলোচ্য বিষয় হল Self-realisation বা আত্মোপলব্ধি। অবশ্য শুধু গীতা কেন সকল শাস্ত্রেরই মূল আলোচ্য বিষয় এটিই। গীতার স্বাতন্ত্র্য হল—আত্মোপলব্ধি করার পথনির্দেশ।

The self-realisation is the subject of the Gita, as it is of all scriptures. . . . . The object of the Gita appears to me to be that of showing the most excellent way to attain self-realisation.

প্রশ্ন হল কেন এই self-realisation?

Man is not at peace with himself till he has become like unto God. The endeavour to reach this state is the supreme, the only ambition worth having. And this is self-realisation.১০

গান্ধীজীর মতে, উপনিষদের মধ্যে যে অভাব আছে, তার পূরণ হয়েছে গীতায়। মহাত্মাজী বিশ্বাস করতেন আসলে গীতার আকারে এটি একখানি উপনিষদই। মহাত্মাজী গীতার অনুবাদে তাঁর বক্তব্য পৃথকভাবে বলার অবকাশ পাননি, যেটুকু বলার বলেছেন টিপ্পনীতে, খুবই সংক্ষেপে। বরং সেতুলনায় তিনি ‘গীতা-বোধে’ অনেক কথা খোলাখুলি বলেছেন; গীতা-বোধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণ অর্জুনের উদ্দেশে বলেছেন, দেহ মরে, আত্মার কিন্তু মৃত্যু নাই। বলেছেন, দেহের নাশ হয় কিন্তু দেহীর নাশ কদাপি হয় না। মানুষের ধর্মের কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণ বলেছেন :

ফলের অভিলাষ ত্যাগ করিয়া কর্তব্য পালন কর।১১

গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে গান্ধীজী কর্মযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অর্জুন কৃষ্ণকে জানিয়েছেন, কর্ম অপেক্ষা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। সেক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ কেন অকারণে অর্জুনকে ঘোর কর্মে নামাতে চাইছেন। উত্তরে কৃষ্ণ জানিয়েছেন, কর্ম ব্যতিরেকে জ্ঞান আসে না। দ্বিতীয়ত, কর্ম ছাড়া হয়ে কেউ এক দন্ডও থাকতে অপারগ। তৃতীয়ত, অলসের মত চুপ করে বসে থাকার তুলনায় কর্ম শ্রেষ্ঠ। বলেছেন, মূঢ় জীব মাত্রই শ্রমজীবী, কেউই শুয়ে থেকে খেতে পায় না। মূঢ় জীবই যদি এরূপ হয়, তবে মানুষের ভূমিকা যে এক্ষেত্রে অধিকতর সত্য তা বলাই বাহুল্য।

গান্ধীজীর পরামর্শ :

প্রতিদিন কর্তব্যকর্ম করে যাও। কিন্তু রাগ-দ্বেষ যেন না থাকে। যেন কাজে আসক্তি না থাকে। অনাসক্ত হয়ে কাজ করার পরামর্শ দিলেন কৃষ্ণ। তাঁর বক্তব্য যিনি অনাসক্ত হয়ে কর্ম করবেন, তবেই ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার লাভ ঘটবে। কৃষ্ণ জানিয়েছেন, তিনি ২৪ ঘণ্টাই অক্লান্তভাবে কর্মরত, সেই কারণে মানুষও কম-বেশি তেমনই করে চলেছে। বলেছেন, ‘আমি যদি আলস্য করি, তবে জগতের কি অবস্থা হয়? সূর্য, চন্দ্র, তারা ইত্যাদি যদি স্থির হইয়া যায়, তবে জগতের বিনাশ হয়, একথা তুমি বুঝিতে পার।১২

দেবতার সঙ্গে মানুষের পার্থক্য কোথায়? না, দেবতার যেখানে আসক্তি নেই, মানুষের সেখানে আসক্তি রয়েছে। তারা স্বার্থের বশে কাজ করে। তাই অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উপদেশ :

যাহাতে লোকে ধর্মভ্রষ্ট না হয়, যাহাতে ধীরে ধীরে অনাসক্ত হইতে শিখে সেজন্য তোমারও আসক্তি ত্যাগ করিয়া কর্ম করা উচিত।১৩

গান্ধীজী তৃতীয় অধ্যায়টিকে গীতা বোঝবার চাবিকাঠি বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর লব্ধ জ্ঞান হল ‘জীবন সেবার জন্য, ভোগের জন্য নয়।’

গীতা-বোধের চতুর্থ অধ্যায়ে গান্ধীজী বলেছেন যে, কর্মে কামনা আছে, সেসবই অকরণীয় কর্ম। তাঁর মতে যারা নাকি কামনা ও সংকল্প ত্যাগ করে কর্তব্যকর্ম করে যায় তারা নিজেদের জ্ঞানরূপ অগ্নিতে কর্মকে পুড়িয়ে ছাই করেছে। আর বলেছেন, আসক্তিহীন কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি সদা সন্তুষ্ট থাকেন। অর্থাৎ জ্ঞানকে তিনি অগ্রাহ্য করেন নি। জ্ঞানের সহায়তা ব্যতিরেকে এটি সম্ভবপর হত না। গান্ধীজী সবিস্তারে জ্ঞানের ব্যাপারটিকে বুঝিয়েছেন। বলেছেন, তিনি জ্ঞান বলতে কোনো অক্ষরজ্ঞানকে বোঝাতে চাননি। বলেছেন, শ্রদ্ধায় যার আরম্ভ অনুভূতিতে যার পরিসমাপ্তি—এই প্রকার জ্ঞান হলে তবেই মানুষ সমস্ত জীবকে নিজের মধ্যে দেখে ও নিজেকে দেখে ঈশ্বরের মধ্যে। সকলই তার কাছে তখন প্রত্যক্ষ ঈশ্বরময় বলে বোধ হয়। গান্ধীজীর দৃঢ় প্রত্যয় এবংবিধ জ্ঞানের সাহায্যে পাপীও উদ্ধার হতে পারে। এই যে জ্ঞান, এর সাহায্যেই মানুষ কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভের হদিস পায়। অর্থাৎ জ্ঞান ব্যতিরেকে কর্ম নয়।

অর্জুন কিছুটা বিমূঢ়। কখনও মনে হচ্ছে তার, কৃষ্ণ জ্ঞানকেই বড় বলে প্রতিপন্ন করছেন, আবার কখনও মনে হচ্ছে কর্মই ভাল। উত্তরে কৃষ্ণ জানালেন জ্ঞান ও কর্ম দুইই ভাল। সন্ন্যাস মানে জ্ঞান আর কর্মযোগ মানে নিষ্কাম কর্ম। গান্ধীজীর পছন্দ ছিল অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন। তিনি বলেছেন জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। উভয়েই সম্পর্কযুক্ত। নবম অধ্যায়ে গান্ধীজী মন্তব্য করলেন :

গান্ধীজীর দৃঢ় প্রত্যয়, গীতার যোগী জ্ঞান ও ভক্তিময় থাকিয়া অনাসক্ত হইয়া কর্ম করে।

প্রভুতে আসক্তি বা ভক্তি না হইলে কর্মফলে অনাসক্তি অসম্ভব।

দ্বাদশ অধ্যায়ে আবার তাঁকে বলতে শোনা গেল :

ভক্তি ছাড়া জ্ঞান ও কর্ম শুষ্ক, বন্ধনরূপ হওয়ারও সম্ভাবনা আছে।

গান্ধীজী শেষ পর্যন্ত ভক্তির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে :

যে ভক্তিপূর্বক আমার ভজনা করে তাহার কদাপি নাশ হয় না, সেধর্মাত্মা হয় ও শান্তিলাভ করে। . . . যে ভক্তি করে, সেই ফল পায়। তুমি অসার সংসারে জন্মিয়াছ, আমাকে ভক্তি করিয়া তুমি তরিয়া যাও। তোমার মন আমাতে গাঁথিয়া ফেল, আমার ভক্ত হও। আমার জন্যই যজ্ঞ কর, আমাকেই নমস্কার কর। এমনি করিয়া যদি তুমি আমাতে পরায়ণ হইয়া তোমার আত্মা আমাতে হোম করিয়া শূন্যবৎ হইয়া যাও, তবে তুমি আমাকেই পাইবে।১৪

অনাসক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদনের পরামর্শ প্রদত্ত হয়েছে গীতায়, গান্ধীজীর মতে :

প্রভুতে আসক্তি বা ভক্তি না হইলে কর্মফলে অনাসক্তি অসম্ভব। তাঁর আরও অভিমত, ভক্তিই রাজযোগ ও সহজ মার্গ।

গীতায় যে অনাসক্তির কথা বলা হয়েছে, তার প্রতি গান্ধীজীর ছিল পূর্ণ সমর্থন। কিন্তু তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে অনাসক্তির জন্য প্রয়োজন নিয়মিত অভ্যাসের, সর্বোপরি ঈশ্বরের অনুকম্পা। গীতায় কথিত হয়েছে, যত বড় পাপীই হোক, জ্ঞানরূপী নৌকার দ্বারা সকল পাপ উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব (৪র্থ অধ্যায়, ৩৬নং শ্লোক)। গান্ধীজী এর সঙ্গে যোগ করেছেন জ্ঞানলাভের তিনটি শর্ত—প্রণিপাত, পরিশ্রম ও সেবা। নম্রতা, পুনঃপুনঃ জিজ্ঞাসা এবং সেবা এ তিনের সহায়তা আবশ্যক। যতক্ষণ কোনো বিষয় বোধগম্য না হয়, গুরুর কাছে নম্রতাপূর্বক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হয়। সেবা ব্যতিরেকে নম্রতা খোশামুদিতে পরিণত হতে পারে—গান্ধীজীর সতর্কবাণী।

গান্ধীজী অকপটে জানিয়েছেন, গীতার অনেক শ্লোক কাল্পনিক আদর্শ অবলম্বনকারী। এমনকি সেই আদর্শের হুবহু নমুনা বাস্তব জগতে অলভ্য। তবে সেইসঙ্গে তিনি স্বীকার করেছেন রেখা-গণিতে যেমন কাল্পনিক আদর্শের আবশ্যকতা আছে, ধর্ম-ব্যবহারেও তেমনি ঐরূপ আদর্শের আবশ্যকতা রয়েছে। গীতায় বলা হয়েছে—

শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম।। ১৮/৪৭

পরধর্ম সহজ ও আচরণীয় হলেও তুলনামূলক ভাবে বিগুণ স্বধর্ম সর্বপ্রকারে শ্রেষ্ঠ। স্বভাব অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনকারী মানুষের পাপ হয় না জগতে। গান্ধীজী বললেন, এই প্রেক্ষিতে যে গীতার শিক্ষার মধ্য বিন্দুই হল কর্মফল ত্যাগ। স্বধর্ম ব্যতিরেকে উত্তম কর্তব্য অনুসন্ধানে ফলত্যাগের স্থান থাকে না। কারণ স্বধর্মই শ্রেষ্ঠ। সব ধর্মের ফল এতে মেলে।

গীতার মুখ্য শিক্ষা কী? গান্ধীজীর ভাষায় :

. . . .it is anasakti — selfless action. তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, যদি কেউ অনাসক্ত হয়, তবে তাকে নিষ্ঠার সঙ্গে অহিংসার পাঠ নিতে হবে—He who would be anasakta (selfless) has necessarily to practise non-violence in order to attain the state of selflessness.

অতএব তাঁর মতে :

Ahimsa is, therefore, a necessary preliminary; it is included in anasakti.১৪

অনাসক্তির সঙ্গে অহিংসাকে যুক্ত করে একমাত্র গান্ধীজীই দেখেছেন, আর কেউ তা দেখেননি, বলেনওনি।

I interpret the Gita to mean that, if its central theme is anasakti it also teaches ahimsa, whilst we are in the flesh and tread the solid earth, we have to practise ahimsa.১৫

গান্ধীজী চরকা কাটার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি তিনি লাভ করেছিলেন ভাগবদগীতা থেকে। তাঁর ভাষায় :

my belief is derived largely from the Bhagavad Gita.’ ‘Divine song-এ বলা হয়েছে—

Work is more excellent than idleness

The body’s life proceeds not, lacking work.

there is a task of holiness to do,

Unlike world-binding toil, which bindeth not

The faithful soul; such earthly duty do

Free from desire, and thou salt well perform

Thy heavenly purpose, spoke prajapati

In the beginning, when all men were made,

And, with mankind, the sacrifice—‘Do this’!

Work ! sacrifice ! In crease and multiply

With sacrifice ! This shall be Kamadhuk,

Your cow of plenty, giving back her milk

Of all abundance. Worship the God thereby;

The god shall yield ye grace . . . .

গান্ধীজী বিশ্বাস করেন এই ‘Divine song’-এ যে কাজের কথা বলা হয়েছে তা একান্তভাবেই শারীরিক। তিনি আরও বিশ্বাস করেন—Such work — such sacrifice can only be spinning. তিনি স্বীকার করেছেন ‘Divine song’-এর রচয়িতার মনে চরকার কথা ছিল না। রচয়িতা একটি আচরণগত সূত্রের উল্লেখ করেছেন মাত্র। কিন্তু গান্ধীজীর মনে হয়েছে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে :

I can only think of spinning as the fittest and most acceptable sacrificial body labour. I cannot imagine anything nobler that the poor must do and thus identify ourselves with them and through them with all mankind. I cannot imagine better worship of God than that in His name. I should labour for the poor even as they do. The spinning-wheel spells a more equitable distribution of the riches of the earth.১৬

অতএব গান্ধীজীর প্রচারিত চরকায় সূতা কাটা এবং রাজনীতিতে যে অহিংস মতাদর্শের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, এ দুটিরই সূত্রের সন্ধান তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর একান্ত প্রিয়, আত্মার আত্মীয় গীতা থেকেই। সেই কারণেই এই দুটি বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস দেখা দিয়েছিল দৃঢ়তার সঙ্গে।

শ্রীঅরবিন্দের এসেজ অন দি গীতা

শ্রীঅরবিন্দের ‘Essays on the Gita’ (১৯৫০) গীতা আলোচনায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটিকে ‘গ্রন্থ’ না বলে মহাগ্রন্থ বলা চলে। দুটি খন্ডে বিভক্ত এই মহাগ্রন্থের প্রথম পর্যায়ে স্থান পেয়েছে ২৪টি রচনা, আর দ্বিতীয় পর্যায়েও স্থান পেয়েছে ২৪টি রচনা। গীতার আনুষঙ্গিক সকল বিষয় নিয়েই অত্যন্ত সুগভীর আলোচনা করেছেন লেখক—গীতার কাছে আমাদের চাহিদা, গীতার শিক্ষাদাতা, মানব শিক্ষার্থী, কুরুক্ষেত্র, মানুষ এবং জীবনযুদ্ধ, আর্য যোদ্ধার ধর্ম, সাংখ্য এবং যোগ, সাংখ্য যোগ ও বেদান্ত, কর্ম এবং যজ্ঞ, স্বর্গীয় কর্মের নিয়ম, অবতারবাদের সম্ভাবনা ও উদ্দেশ্য, অবতার বাদের প্রক্রিয়া, স্বর্গীয় জন্ম ও স্বর্গীয় কর্ম, সাম্য, কর্মযোগের সারাৎসার, ভক্তি ও জ্ঞানের সমন্বয়, গোপনীয়ের গোপনীয়, স্বর্গীয় সত্য ও পথ, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, গীতার সর্বোচ্চ বক্তব্য, পথ ও ভক্ত, তিন পুরুষ, দেব-অসুর, গুণ-বিশ্বাস-কর্ম, গুণ-মন ও কর্ম, স্বভাব ও স্বধর্ম, সর্বোচ্চ গোপনীয়তায় উদ্দেশে, গোপনীয়তম, গীতার বাণী ইত্যাদি। এই সুদীর্ঘ তালিকা প্রমাণ করে অরবিন্দ গীতার আলোচনায় কোন কিছু বাকি রাখেন নি। বস্তুতপক্ষে এবংবিধ গীতার অনুপুঙ্খ আলোচনার জন্য যে পান্ডিত্য, যে জ্ঞান, যে মননশীলতা, যে বিচারবোধ, দার্শনিক জ্ঞান প্রয়োজন বলাবাহুল্য, অরবিন্দের তা ছিল, আর ছিল বলেই তাঁর আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।

আমরা মূলতঃ আলোচনা করব অরবিন্দ গীতার জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং কর্মযোগকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং কোনটির প্রতি তাঁর অধিক আস্থা ও নির্ভরতা দেখা গেছে। কিন্তু সেই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে গীতা সম্পর্কিত অরবিন্দের সাধারণ ধারণা কিরূপ ছিল তার কিছু পরিচয় আমরা নিয়ে নেব।

‘The Divine Teather’ অধ্যায়ে লেখক গীতার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, অন্য পাঁচটা ধর্মগ্রন্থের তুলনায় গীতার যে একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে লেখক সেবিষয়ে জানিয়েছেন :

The peculiarity of the Gita among the great religious books of the world is that it does not stand apart as a work by itself, the fruit of the spiritual life of a creative personality like Christ, Mahomed or Buddha or of an epoch of pure spiritual searching like the Veda and upanishads, but is given as an episode in an epic history of nations and their wars and men and their deeds and arises out of a critical moment in the soul of one of its leading personages face to face with the crowning action of his life, a work terrible, violent and sanguinary, at the point when he must either recoil from it altogether or carry it through to its inexorable completion.

গীতা কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ রচনা নয়, যীশু খ্রিস্ট, মহম্মদ, বুদ্ধের মত কারো আধ্যাত্মিক জীবনসঞ্জাত নয়, নয় বেদ-উপনিষদ গোত্রীয় রচনা যেখানে নাকি আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা প্রকাশিত হয়েছে।

গীতা পরবর্তীকালের রচনা এবং সংযোজন :

the Gita is a later composition inserted into the mass of the Mahabharata by its author in order to invest its teaching, with the authority and popularity of the great national epic.

মহাভারতে গীতাকে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যও অপ্রকটিত থাকেনি; মহাভারতের জনপ্রিয়তার আধারে পরিবেশন করা হয়েছে কোনো তাৎক্ষণিক কারণে নয়, পরন্তু অনেক ভাবনা চিন্তার পরেই। গীতাকে যেন প্রচলিত সাধারণ আধ্যাত্মিক দর্শন বা নৈতিক শাস্ত্ররূপে না দেখা হয়, লেখক সেই বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন :

The teaching of the Gita must therefore be regarded not merely in the light of a general spiritual philosophy or ethical doctrine, but as bearing upon a practical crisis, in the applications of ethics and spirituality to human life.

জীবনে নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা প্রয়োগে যে সমস্যা দেখা দেয় সেই প্রেক্ষিতেই, বাস্তব সমস্যার নিরিখেই গীতা আলোচ্য। আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে গীতার তিনটি বিষয় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ—

i) the divine personality of the teacher

ii) his characteristic relations with his disciple

iii) the occasion of his teaching

শিক্ষাদাতার অলৌকিক ব্যক্তিত্ব, শিষ্যের সঙ্গে তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং শিক্ষাকালের উপলক্ষ্য। ঋষি অরবিন্দ এ তিনটি বিষয়ের জবাবও দিয়েছেন :

i) the teacher is God himself, descended into humanity.

ii) The disciple . . . . the representative man of his age, closest friend and chosen instrument of the Avatar.

iii) the occasion is the violent crisis of that work and struggle at the moment when the anguish and moral difficulty and blind violence of its apparent movements forces itself with the shock of a visible revelation in the mind of its representative man and raises the whole question of the meaning of God in the world . .

মহাভারতের ঐতিহাসিক মর্যাদা লেখকের দ্বারা স্বীকৃত, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের গুরুত্বও একইভাবে স্বীকৃত হয়েছে :

The epic is to a great extent dealing with historical characters and in the war of Kurukshetra with a historical occurrence imprinted firmly on the memory of the race.

কৃষ্ণ লেখকের মতে :

The figure of Krishna becomes, as it were, the symbol of the divine dealings with humanity.

অরবিন্দ কম্বুকন্ঠে ঘোষণা করেছেন :

the Gita is not a book of practical ethics, but of the spiritual life.

অরবিন্দ গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন, জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিনের মধ্যে :

the Gita preserves a perfectly equal balance, emphasising new knowledge, new works, new devotion, but for the purpose of the immediate trend of the thought, not with any absolute separate preferences of one over the others. He is whom all three meet and become one. He is the supreme Being, the Purushottam.

এখানে লক্ষণীয় ‘not with any absolute separate preference of one over the others’, অবিমিশ্রভাবে গীতায় যে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ অথবা ভক্তিযোগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি সেবিষয়ে লেখক অকপটে জানিয়েছেন।

আধুনিক কালে ভক্তিযোগ কিংবা জ্ঞানযোগকে নস্যাৎ করে কর্মযোগকে প্রাধান্য দেওয়ার এক ধরনের মানসিকতা লেখক লক্ষ করেছেন :

But at the present day, since in fact the modern mind began to recognise and deal at all with the Gita, the tendency is to subordinate its elements of knowledge and devotion, to take advantage of its continual insistence on action and to find in it a scripture of the Karmayoga, a Light leading us on the path of action, a Gospel of Works.

অরবিন্দ মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে কর্মযোগ গীতায় বর্তমান, সেকর্ম হল আধ্যাত্মিক কর্ম, কোনো সাধারণ কর্ম নয়, প্রাত্যহিক জীবন-সম্পৃক্ত নয় :

Undoubtedly, the Gita is a Gospel of works, but of works which culminate in Knowledge, that is, in spiritual realisation and quietude, and of works motivated by devotion, that is a conscious surrender of one’s whole self first into the hands and then into the being of the supreme, and not at all of works as they are understood by the modern mind, not at all an action dictated by egoistic and altruistic, by personal, social, humanitarian motives, principles, ideas.

পাছে গীতায় উল্লিখিত কর্মকে সীমিত অর্থে পাঠক ধরেন, এ কর্ম বলতে যে কোনো সামাজিক অথবা ব্যক্তিগত নয়, দেবতার উদ্দেশেই তা সংগঠিত, নিবেদিত এবং এ কর্ম নি:স্বার্থভাবে অহংবোধশূন্য হয়ে সম্পাদন করতে হয় সেবিষয়ে সচেতন করে দিয়েছেন :

That which the Gita teaches is not a human, but a divine action; not the performance of social duties, but the abandonment of all other standards of duty or conduct for a selfless performance of the divine will working through our nature; not social service, but the action of the Best, the God possessed, the Master-men done impersonally for the sake of the world and as a sacrifice to Him who stands behind man and Nature.

গীতায় কথিত কাজের উদ্দেশ্য কী? গীতায় কর্মহীনতার তুলনায় কর্মকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নি:সন্দেহে, তাই বলে আধ্যাত্মিকতাকে বিসর্জন দেওয়া হয়নি :

although the Gita prefers action to inaction, it does not rule out the renunciation of works, but accepts it as one of the ways to the Divine.১০

অরবিন্দ আরো বলেছেন :

. . . . in action the effort of the human individual must be to get back to his true spiritual personality and to make all his works flow from the power of its supernatural shakti, to develop action through the soul and the inmost intrinsic beings, not through the mental idea and vital desire, and to turn all his acts into a pure outflowing of the will of the supreme . . . .১১

কর্ম সম্পাদনে মানসিক ভাবনা কিংবা জৈবিক আকাঙ্ক্ষা থাকবে না, সকল কাজই হবে স্বতঃস্ফূর্ত, বিধাতার ইচ্ছাপ্রসূত।

অরবিন্দ সেইসঙ্গে সতর্কীকরণ করেছেন, যেন কর্ম সম্পাদনের মূলে কোনো অজ্ঞতা, অহংবোধ, বিকৃতি না থাকে, মিশ্র না হয়, মোটের উপর কোনভাবেই যেন নিম্ন শ্রেণীর ব্যক্তিত্বের কাজ না হয় :

. . . . there is also this lower nature of the three gunas whose character is the character of the ignorance and whose action is the action of the ignorance, mixed, confused, perverted; it is the action of the lower personality of the ego, of the natural and not of the spiritual individual.১২

প্রশ্ন, কেমন করে আমরা lower personality থেকে উত্তরণ ঘটাব? অরবিন্দ পরামর্শ দিয়েছেন সাত্ত্বিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে, ঊর্ধ্বে উঠতে হবে রাজসিক ও তামসিকতার।

অপকর্মা সম্পর্কে অরবিন্দ বিস্তৃতভাবে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, এরা কখনই সর্বোত্তমের কাছে যেতে পারে না, সর্বোত্তমকে লাভ করতে পারে না। কেননা এদের দেবতা হল এদের অহং, এরা মায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন, মায়ার দ্বারাই চালিত :

The evil doer cannot attain to the Supreme because he is forever trying to satisfy the idol ego on the lowest scale of human nature; his real God is this ego. His mind and will, hurried away in the activities of the Maya . . . .১৩

এইসব অপকর্মারা কেবল অহং আর আকাঙ্ক্ষার দ্বারা চালিত, এরা শুধু এদের অহংবোধ আর আকাঙ্ক্ষাকেই তৃপ্ত করতে ব্যস্ত। তাই অরবিন্দ পরামর্শ দিলেন :

‘Right thinker’ এবং ‘right doer’ হবার। সাত্ত্বিক মানুষও ইচ্ছা দ্বেষের শিকার হন এবং ‘moves within the circle of the forms of Nature and has not the highest, not the transcendental and integral knowledge.

তাই সাত্ত্বিক গুণের অধিকারীকেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। যখন রাজসিক ও তামসিক গুণগুলি অন্তর্হিত হয় তখন মানুষ আর তার ব্যক্তিগত ভাল লাগা কিংবা খুশীর জন্য সচেতন থাকে না। এমনকি ব্যক্তিগত দুঃখ-যন্ত্রণা, পীড়া তাকে পীড়িত করে না। এই অবস্থায় মানুষ কখনও বলে না যে সেপুণ্যবান কিংবা পাপী। তখন মানুষ তার উচ্চ আধ্যাত্মিক প্রকৃতি অনুসারে কাজ করে, কাজ করে সকলের ভালর জন্য। এজন্য কর্মযোগীর কর্তব্য আত্মজ্ঞান লাভের, সমতাবোধের অধিকারী হওয়া, প্রয়োজন জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ের :

. . . . the Gita now lays down another and greater necessity for the Karmoyogin who has unified his Yoga of works with the Yoga of knowledge.

শুধু তাই নয় :

Not knowledge and works alone are demanded of him now, but Bhakti also, devotion to the Divine, love and adoration and the soul’s desire of the Highest.

অর্থাৎ কর্মযোগ, ভক্তিযোগ ও জ্ঞানযোগের সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত হয়েছে। অন্যত্রও অরবিন্দ বললেন :

it is bhakti with knowledge, which the Gita demands from the disciple . . .

আমাদের বিস্মরণ যেন না হয় যে :

Life is not for the sake of life alone, but for God, and the living soul of man is an eternal portion of the God head.’

আমরা যেন মনে রাখি :

Action is for self-finding, for self-fulfilment, for self-realisation..১৪

তবে একটা কথা বলা জরুরী, অরবিন্দ ভক্তি, কর্ম ও জ্ঞানযোগের সমন্বয়ের কথা বললেও কর্মযোগ নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভক্তি-কর্ম-জ্ঞানযোগের সমন্বয় নিয়ে সেকরম আলোচনা করেন নি।

ভাগবত গীতাচক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি

চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারি ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতাসংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, চিন্তাশীল, মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহচর, মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল। এমন এক ব্যক্তি ভাগবত গীতা নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৬৩।

রাজা গোপালাচারি মনে করতেন :

The Gita is one of the most authoritative sources of Hindu doctrine and ethics, and is accepted as such by Hindus of all denominations.

মূলতঃ তিনি ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞাতার্থেই গীতার আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় :

A study of even selections from it, strengthened by earnest meditation, will enable young men and women to understand the religion of our fathers, which is the background of all the noble philosophy, art, literature and civilization that we have inherited.

রাজা গোপালাচারি যেহেতু ছাত্রছাত্রীদের কাছে গীতাকে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন তাই কোনো তাত্ত্বিক আলোচনা করে তাঁর রচনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুভার করে তোলেন নি। এমনকি তিনি গীতার আনুপূর্বিক আলোচনাতেও যান নি, যান নি যে তার প্রমাণ তাঁর আলোচনায় গীতার সাতশত শ্লোকের মধ্যে মাত্র ২২৬টি শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে। লেখক তাঁর আলোচনার উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে স্পষ্টভাবে জানাতে ভোলেন নি যে :

This book does not purpose to give any new interpretation of the Bhagavad Gita. Let the reader not expect to find in the following pages any old interpretation controverted, any newly invented explanation. This little book aims at a simplified presentation of the Gita content, and at bringing it within a small compass so as to enable the modern student to understand in the midst of his other studies . . . . ideas that lighted the path of life for our forefathers and to which is given the new Sanatan Dharma or Hinduism.

গীতার অনন্যতা সম্পর্কে আলোকপাত করে লেখক বললেন :

In spite of its undoubted conservatism, in no other religion is there greatest elasticity, freedom of thought, or scientific respect for truth.

Preface এবং Introductory ছাড়া মোট ১৫টি অধ্যায় পাই গ্রন্থে—

1. The Soul

2. Karma

3. God and Nature

4. Right Action

5. The Practice of Mind — Control

6. Meditation

7. Inherited Propensities

8. Hope for all

9. Godlessness

10. Ideals — Austerities — Food.

11. Surrender and Grace

12. The oneness of Existence

13. Advaita and Gita Discipline

14. Seeing God

15. Conclusion

লেখক তাঁর প্রতিটি বিষয়ের আলোচনায় গীতার যে সব অধ্যায়ের ওপর নির্ভর করেছেন সেগুলি হল যথাক্রমে ১ম (২য় ও ১৩শ অধ্যায়), ২য় (১৩শ ও ১৫শ অধ্যায়), ৩য় (৭ম, ৯ম ও ১৫শ অধ্যায়), ৪র্থ (২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ১৮শ অধ্যায়), ৫ম (২য়, ৩য়, ১৬শ ও ১৮শ অধ্যায়), ৬ষ্ঠ (২য়, ৫ম, ৬ষ্ঠ, ১২শ ও ১৫শ অধ্যায়), ৭ম (৩য়, ১৩শ, ১৪শ ও ১৮শ অধ্যায়), ৮ম (৪র্থ, ৭ম, ৯ম অধ্যায়), ৯ম (১৬শ অধ্যায়), ১০ম (১৭শ অধ্যায়), ১১শ (৯ম, ১০ম, ১২শ, ১৪শ ও ১৮শ অধ্যায়), ১২শ (৫ম, ৬ষ্ঠ, ১৮শ অধ্যায়), ১৪শ (১১শ অধ্যায়)।

আলোচনায় যেসব শ্লোক উদ্ধার করা হয়েছে, গ্রন্থে তার Index বা সূচিও দেওয়া হয়েছে। এবারে আমরা লেখক কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ সম্পর্কে কি বলেছেন দেখে নিতে পারি।

The Gita emphasises that the activities of the world must go on . . . . We should liberate our activities from the bondage of selfish purpose. Work should be done in a spirit of duty done and results should not be permitted to agitate the mind. This unselfish and detatched attitude can and should be cultivated even while we are engaged in life’s activities. ‘কর্মণ্যে—বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’—গীতার এই উপদেশের কথাই এখানে লেখক বলেছেন। এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ।

He who perceives inaction in action and action is inaction, has among men attained real Knowledge

আসলে চতুর্থ অধ্যায়ের অষ্টাদশ শ্লোকের কথা এখানে বলা হয়েছে—সর্ববিধ কাজে নিরাসক্তির ভাবটিকে বজায় রাখতে হয়—‘All prescribed actions attain this complete fulfilment only in true Knowledge: Jnana manifests itself in the cultivation of a detatched attitude in all work.’

লেখক ‘জ্ঞান’ অর্থে ইংরেজি ‘Knowledge’ শব্দটির ব্যবহার করলেও অনুভব করেছেন এ ব্যবহার যথাযথ নয়, জ্ঞান তারও বেশি কিছু :

Jnana is not fully expressed by ‘Knowledge’ or ‘Wisdom’. It involves a complete transformation of oneself in accordance with the truth that is seen. Such transformation resulting from and at the same time leads to progressive realisation of one’s unity with the rest of the world and of the whole world with God.

এবারে ভক্তিযোগ প্রসঙ্গ— ‘Even keeping Him in mind, let us engage ourselves in all activities and dedicate all our work to God as service and worship done unto Him. Ultimately it is His Grace alone that can save, by giving us power of self-control, knowledge and peace, and protecting us from temptation, doubt, weakness and confusion. This aspect of Hindu faith is known as the ‘Bhakti’ path of salvation. It is, however, not an alternative to, but a complement of, the practice of an unselfish and detatched attitude in the performance of the duties that fall to one’s lot.’

এখানে লক্ষ্য করার, ঈশ্বরকে মনে রেখে সকল কাজ করার কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে সকল কাজ ঈশ্বরকে উৎসর্গ করার কথা এবং কাজকেই ঈশ্বরের আরাধনা এবং ঈশ্বরের কাজ বলে গণ্য করতে হবে। ঈশ্বরের অনুকম্পাতেই আমরা লাভ করতে পারি আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি, জ্ঞান, শান্তি এবং সর্বোপরি সংশয়, প্রলোভন, দ্বন্দ্ব থেকে তা আমাদের রক্ষা করে। হিন্দু বিশ্বাসমতে এই হল ভক্তি। এক্ষেত্রেও কর্মের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং নিষ্কামভাবে কর্ম করার কথা বলা হয়েছে। রাজাগোপালাচারির কৃতিত্ব হল তিনি অহেতুক কোনো বিষয়কে জটিল করে তোলেন নি। তাঁর বক্তব্য প্রাঞ্জল, ভাষাও অনুধাবনযোগ। দৃষ্টান্তের অবতারণা করার প্রলোভন লেখক সংবরণ করেছেন। বক্তব্যে পুনরাবৃত্তিকে এড়িয়ে চলা হয়েছে।

লেখক একটি পরামর্শ দিয়েছেন, সেটি বেশ অভিনব। বলেছেন, সনাতন ধর্মগ্রন্থ রূপে গীতা অধ্যয়নকালে যুদ্ধবৃত্তান্ত বিস্মৃত হতে হবে :

We should forget the battle scene when we study the Gita as a scripture of Sanatan Dharma.

অথচ অধিকাংশ ব্যাখ্যাদানকারী যুদ্ধ-দৃশ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন, বিশেষত কর্মযোগের প্রেক্ষিতে। এমনকি কেউ কেউ তো আবার এই যুদ্ধ-দৃশ্যকে রূপক রূপেও মনে করেছেন। অনেকেই গীতার সমন্বয়বাদের ওপরগুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থের লেখক প্রথমে সেপথে যান নি, তিনিও সমন্বয়ের কথা বলেছেন তবে তা গীতার পূর্ববর্তীকালে প্রদত্ত ধর্মাদর্শের প্রসঙ্গে :

It contents itself with a synthesis of the older teaching

শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনিও গীতার সমন্বয়বাদী চরিত্রকেই স্বীকার করে নিয়েছেন—কর্ম, জ্ঞান কিংবা ভক্তি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সব মিলিয়েই গীতায় সমন্বয়ী সুর প্রকট হয়ে উঠেছে :

Each of those aspects of Joga may be emphasised and given a separate name, such as Sankhya Yoga, Karma Yoga, Jnana Yoga, Sannyasa Yoga, Adhyatma Yoga or Bhakti Yoga. But in practice, they are all mutually connected and inseparable, and so, all are combined in the Gita and brought together in one organic synthesis.১০

শ্রীমদভগবদ গীতা

রাজশেখর বসু

মননশীল লেখক বলতে যা বোঝায় রাজশেখর বসু ছিলেন তাই। রাজশেখর বসুর দ্বিবিধ সত্তা—একদিকে সৃজনশীল সাহিত্য রচনায় তাঁর কিংবদন্তী লেখকের ভূমিকা পালন, অন্যদিকে তিনিই রচনা করে গেছেন জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ-নিবন্ধ। রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ করেছেন, অনুবাদ করেছেন সেইসঙ্গে শ্রীমদভগবদ গীতা (শ্রাবণ ১৩৬৮)।

রাজশেখর বসু গীতা আলোচনায় হুহুঙ্কার পান্ডিত্য দেখান নি। গীতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল ও প্রয়োজনের বিষয়টি মাথায় রেখেই তাঁর গ্রন্থ প্রণয়ন। কিঞ্চিদধিক ১৬ পৃষ্ঠার ভূমিকা, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ব্যাপী সকল অধ্যায়ের অন্তর্গত মূল শ্লোক, সেগুলির অন্বয় ও অন্বয়-অনুগামী অনুবাদ প্রদত্ত হয়েছে। লেখক ভারতবর্ষের সর্বাধিক পরিচিত এই ধর্মগ্রন্থের অনুবাদে কখনই উচ্ছ্বাস বা ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেন নি। বরং তুলনামূলক ভাবে অনেকখানি সংযমী হয়ে তাঁর ঈপ্সিত কর্তব্য পালন করেছেন।

ভূমিকাটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও বক্তব্যই সেখানে উপস্থাপিত। তত্ত্বের কচকচি অনুপস্থিত, দর্শনের কূট বিতর্ক এড়িয়ে গিয়েছেন লেখক, অথচ সার কথাটি দিব্যি বলে দিয়েছেন।

সচরাচর গীতার ব্যাখ্যাতারা ভক্তিগদগদ চিত্তে গীতার ব্যাখ্যায় মনোযোগী হয়েছেন এবং বারংবার সোচ্চার কন্ঠে এর অদ্বিতীয়ত্ব ঘোষণা করেছেন। ব্যাখ্যাতারা গীতার ব্যাখ্যায় কোনো বিরূপ সমালোচনা করেন নি, যেটুকু বিরূপতা দেখিয়েছেন তা অন্য ব্যাখ্যাতাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যা কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। রাজশেখর বসু যদিও স্বীকার করেছেন :

বহু পূর্বে বহু প্রাচীন সংস্কারের মধ্যে রচিত হলেও গীতায় সর্বকালের উপযোগী শ্রেষ্ঠ সাধনা পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

কিন্তু সেইসঙ্গে তিনি এই বিরূপ সমালোচনা করতেও বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেন নি যে—

১. গীতার অনেক অংশ দুর্বোধ্য।

২. ‘গীতায় বহু প্রসঙ্গ আছে যা অনেক আধুনিক পাঠকের ধারণার বিরোধী। জন্মান্তরবাদ, দেহ থেকে উৎক্রান্ত সূক্ষ্মশরীর (১৫। ৮), দেবযান, পিতৃযান (৯। ২৫) প্রভৃতি, শ্রীকৃষ্ণের ব্রহ্মত্ব, এমনকি তাঁর ঐতিহাসিকত্ব অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হতে পারে।’

৩. স্বধর্মের প্রাচীন অর্থ ধরার বিরোধিতা করেছেন, তাতে গীতার বক্তব্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। পূর্বে শিক্ষার ধারা ছিল বর্ণ বা বংশগত তখন অপর বর্ণের নির্দিষ্ট ধর্ম তার অপরিচিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে বর্ণগত ধর্ম লোপ পেয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে লেখক গীতার অধ্যাত্মতত্ত্বে মনোযোগী ছিলেন না, গীতাকে তিনি ব্যবহারিক বিদ্যারূপে দেখেছেন এবং পাঠককেও তা দেখাবার প্রয়াস করেছেন।

দর্শন বিদ্যার একটি অঙ্গ হল তত্ত্বজ্ঞান, অপর অঙ্গ হল ঐ তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োগ। লেখকের মতে বেদান্ত কিংবা সাংখ্যসূত্র গ্রন্থ যেখানে মুখ্যত তত্ত্বমূলক, সেখানে গীতায় বিস্তর দার্শনিক তত্ত্ব থাকলেও ‘মুখ্যত ব্যবহারিক বিদ্যাই কথিত হয়েছে’।

গীতাকার যে তাঁর সময়ের প্রচলিত সাংখ্যদর্শনের তত্ত্বসমূহকে ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছিলেন লেখকের দৃষ্টিকে তা এড়িয়ে যায়নি কিন্তু বেশি করে যা তাঁর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছে তা হল :

ঐ সকল তত্ত্ব অনুসারে জীবনযাত্রার পদ্ধতি নির্ধারণ।

লেখক জটিলতাকে প্রশ্রয় না দিলেও, দুরূহতাকে এড়িয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে অবহেলা করেন নি। করেন নি যে তার প্রমাণ, সাংখ্য, যোগ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে গীতায় উপস্থাপিত এই বিষয়গুলির স্বাতন্ত্র্য লেখক লক্ষ করেছেন। প্রচলিত সাংখ্যে ব্রহ্ম বর্জিত হয়েছেন, কিন্তু গীতোক্ত সাংখ্যে ব্রহ্মই কেন্দ্রস্বরূপ। গীতায় ‘যোগ’ শব্দ যে সংকীর্ণ অর্থে প্রযুক্ত হয় নি, লেখক তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, গীতায় ‘যোগ’ ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত। যেমন ‘সমত্বই যোগ’ (২। ৪৮), ‘কর্মে কৌশল যোগ’ (২। ৫০)। লেখক ‘বুদ্ধিযোগ’, ‘সাংখ্যযোগ’ ও ‘ভক্তিযোগ’-এর প্রসঙ্গ এনে জানিয়েছেন :

১. আমি যখন ফলাফল সম্বন্ধে নিরপেক্ষ থেকে একাগ্রচিত্তে বুদ্ধি প্রয়োগ করি, তখন আমি ‘বুদ্ধিযোগ’ অবলম্বন করি।’

২. ‘যখন ঐ প্রকারে সাংখ্য সন্ন্যাসীগণের মত অনুসারে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করি, তখন ‘সাংখ্যযোগ’ অবলম্বন করি।’

৩. ‘যখন মাথা না ঘামিয়ে কেবল শ্রদ্ধা প্রয়োগ করে কোনও আপ্তবাক্য উপলব্ধি করে তদনুসারে কর্ম করি, তখন ‘ভক্তিযোগ’ অবলম্বন করি।’

লেখক সবিস্তারে আলোচনা করেছেন কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ প্রসঙ্গ।

লেখক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন গীতায় বিধেয় কর্মের কোনো বিস্তৃত তালিকা দেওয়া হয় নি। প্রসঙ্গক্রমে কোন কর্মের তুলনায় অন্য কর্ম ভাল তাই উল্লিখিত হয়েছে। সাধারণভাবে এমন কিছু কর্ম আছে যা ইচ্ছা করে ছাড়া যায় না। আবার এমন কিছু কর্ম আছে যেগুলি ইচ্ছাধীন। বিহিত কর্ম যেমন আছে, তেমনিই আছে বিকর্ম বা কুকর্ম। গীতা অনুসারে সব কাজ নির্বিচারে করা চলে না। বুদ্ধিযোগ দ্বারা যাচাই করা আবশ্যক। যা সমাজ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় তেমন কর্মই বিহিত কর্ম। বিহিত কর্মমাত্রই চোখ কান বুজে তা করা যাবে না। গীতায় এসবের সাধন পদ্ধতি নিরূপিত হয়েছে। আসক্তিহীন কর্মের কথাই গীতাতে বলা হয়েছে। নিষ্কাম কর্মই গীতার মূল বক্তব্য।

লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন যে, নিষ্কাম কর্ম মানে লক্ষ্যহীন কর্ম নয়। নিষ্কামের অর্থ ব্যক্তিগত স্বার্থবিহীন। লেখক যেভাবে নিষ্কাম কর্মের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তেমনটি অন্যত্র দেখা যায়নি। প্রচলিত ধারণা ও ব্যাখ্যায় নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে কর্ম সম্পাদনকারীর স্বার্থ কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট থাকবে না। লেখক এই ভ্রান্ত ধারণার নিরসন ঘটিয়েছেন, বলেছেন :

নিজেকে সুস্থ রাখাও নিষ্কাম কর্ম, কারণ প্রত্যেকের স্বাস্থ্য নিয়েই বহুজনের স্বাস্থ্য।

আরও বলেছেন :

আমি যদি যথাসাধ্য সমাজ রক্ষার অনুকূল কর্ম করি এবং তার ফলে স্বয়ং উপকৃত হই তাও নিষ্কাম কর্ম।১০

কর্মযোগের লক্ষণ বলতে লেখক গীতানুসারে যেগুলির উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল—

করণীয় কর্মে বুদ্ধি প্রযুক্ত হবে, একাগ্রচিত্ত হয়ে কর্ম সম্পাদন করতে হবে, কৌশলে অর্থাৎ বিশিষ্ট উপায়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করতে হবে এবং সর্বোপরি আসক্তি ত্যাগ করে সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমভাবাপন্ন হয়ে সুকৃত দুষ্কৃতের হিসাব না করে নিষ্কামভাবে সম্পন্ন করতে হবে। কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের পার্থক্য নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন এবং তাঁর ধারণায় গীতায় জ্ঞানযোগী সন্ন্যাসীর তুলনায় কর্মযোগীর শ্রেষ্ঠত্বই স্বীকৃত। কেন?

কর্মযোগী বহু কাজে ব্যাপৃত থাকেন। তিনি আসক্তি ত্যাগ করলেও কর্মত্যাগী নন। জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার রয়েছে। সাধারণ লোকের সামনে সহজসাধ্য হিতকর আদর্শ তিনি নিজের আচরণ দ্বারা স্থাপন করেন। তিনি কেবল নিজেরই উন্নতি করেন না, পরন্তু যোগপরায়ণ হয়ে সর্বকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে লোকসেবাও করেন। তাঁর অনুষ্ঠান কেবল মানসিক ব্যাপার মাত্র নয়, মন দ্বারা ইন্দ্রিয়ের প্রভাব সংযত করে অনাসক্ত হয়ে কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন।

জ্ঞানযোগী যেখানে অ-সামাজিক সন্ন্যাসী, কর্মযোগী সেক্ষেত্রে সামাজিক, গৃহী।

গীতায় কথিত হয়েছে, সন্ন্যাসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্তমযোগতঃ, যোগযুক্তো মুনিব্রাহ্মন চিরেণাধিগচ্ছতি।’ ৫। ৬ তবে বিস্মৃত হলে চলবে না যে যিনি কর্মযোগী তিনি জ্ঞানযোগীও।

লেখক যজ্ঞ, হঠযোগ, যজ্ঞ ও নিষ্কাম কর্ম, ধর্ম ও স্বধর্ম, গীতার দার্শনিক মত এসব নিয়েও আলোকপাত করেছেন। মহাভারতের কৃষ্ণের সঙ্গে গীতার কৃষ্ণের সঙ্গতি লক্ষ্য করেছেন, গীতাকার মহাভারতের সাধারণ ধারারই অনুসারী বলে মেনে নিয়েছেন। তবে কৃষ্ণের ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে লেখক কোনো আলোচনা করেন নি। গীতায় আমরা যে কৃষ্ণকে পাই তিনি লেখকের মতে :

ধর্মসংস্থাপক নরদেহধারী পুরুষোত্তম রূপে চিত্রিত . . . ।

গীতায় ভক্তিবাদ প্রসঙ্গে লেখকের বক্তব্য, গীতায় বারংবার ভক্তি শ্রদ্ধার অবতারণা হয়েছে। তাঁর মতে, ‘যিনি জ্ঞান চান শ্রদ্ধা তাঁর সহায়, এবং জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধাও বৃদ্ধি পাবে। যাঁর জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা নেই, তিনি শ্রদ্ধার দ্বারাই নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারবেন’।১১

উপসংহারে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, যোগী কে? আত্মোন্নতির জন্য সর্বতোভাবে যে সাধনা Spiritual, moral এবং physical culture, বঙ্কিম যাকে বলেছেন অনুশীলন, যিনি এই সাধনা করেন গীতায় তাঁকেই যোগী বলা হয়েছে। এই যোগ সাধনার উপায় হল ইন্দ্রিয়সংযম, আসক্তি ত্যাগ ও শ্রীকৃষ্ণে অবিচলিত ভক্তি।

গীতোক্ত সাধনার প্রধান উপায় বলে লেখক মেনে নিয়েছেন কর্মযোগকে। আবার এও মেনেছেন যে। সমস্ত কর্ম জ্ঞানেই পূর্ণতা লাভ করে, এমনকি ভক্তির পরেও বুদ্ধির দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হয়—

তেষাং সতত যুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম, দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে। ১০/১০

লেখকের একটি ক্ষেত্রে স্ববিরোধী বক্তব্যের সন্ধান লভ্য। একবার বলেছেন :

ক. গীতা সর্বসাধারণের জন্য রচিত হয়নি (পৃ-১)

খ. ‘আপামর সাধারণকে গীতা মুখস্থ করিয়ে কোনও লাভ নেই।’ (পৃ-ভূমিকা ১)

আবার অন্যত্র বলেছেন, ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’ (২। ৪৪)—ধর্মের অতি অল্পও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। সাধারণ লোকের গীতা অধ্যয়নের এই সার্থকতা। (ভূমিকা-পৃ-নং)

অনুবাদ সম্পর্কে দু-একটি প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ জরুরী। লেখক প্রচলিত অন্বয় না করে বাংলা শব্দবিন্যাস প্রণালীতে গীতার শ্লোকগুলির অন্বয় করেছেন।

মূলে যে শব্দ পাদপূরণের জন্য কিংবা অনুবাদে অনাবশ্যক, অন্বয়ে বিরাম চিহ্নের মধ্যে তা দিয়েছেন। মূলে যা উহ্য, অন্বয়ে বা অনুবাদে তা তৃতীয় ব্রাকেটের মধ্যে লেখক দিয়েছেন।

মূল শ্লোকের শব্দ যথাসম্ভব অনুবাদে বজায় রাখা হয়েছে। অনুবাদের বাক্য প্রায়ই অন্বয়ানুযায়ী করা হয়েছে।

লেখক অনুবাদে অনেক স্বচ্ছতা রক্ষা করেছেন, অনুবাদ হয়েছে সাবলীল। সাধারণ পাঠকের বোধগম্য। তাঁর ব্যাখ্যাও হয়েছে প্রাঞ্জল। গীতার সার ব্যাখ্যাতেও তিনি যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা চালিত হয়েছেন তাও সবিশেষ প্রশংসনীয়।

ভগবদগীতাগিরীন্দ্রশেখর বসু

গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘ভগবদগীতা’র প্রকাশকাল ১৯৪৮, বাংলা ১৬ই আশ্বিন, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ। অসংখ্য গীতার অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও গিরীন্দ্রশেখর বসু পুনরায় গীতার ব্যাখ্যায় মনোযোগী হয়েছিলেন কেন, তার ব্যাখ্যা লেখক নিজেই দিয়েছেন, ‘গীতাকার ঠিক কি বলিয়াছেন আমরা তাহাই জানিতে চাই।’

এই বক্তব্যে স্পষ্ট, এ যাবৎকাল যেসব গীতার ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, লেখক সেগুলিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি, তাঁর অসন্তোষের কারণ তিনি অপ্রকাশিত রাখেন নি :

গদ্যে পদ্যে গীতার অসংখ্য ব্যাখ্যা দেখা যায়, তাহাদের প্রায় প্রত্যেকটির মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা বা গোঁড়ামির ছাপ বর্তমান, অর্থাৎ গীতার টীকাকার যে মার্গের উপাসক, ব্যাখ্যায় তিনি সেই মার্গকেই প্রাধান্য দিয়া থাকেন। ভক্তিমার্গের সাধক হইলে তিনি ভক্তিমার্গকে অথবা জ্ঞানমার্গের সাধক হইলে জ্ঞানমার্গকেই প্রাধান্য দিয়াছেন। যদিও সকলে নিজ নিজ সম্প্রদায়গত শ্রেষ্ঠত্ব স্পষ্টভাবে নিজেদের ব্যাখ্যাতে প্রতিপন্ন করেন নাই তথাপি তাঁহাদের লেখার মধ্যে অল্পাধিক সাম্প্রদায়িকতার পক্ষপাতিতা থাকিয়া গিয়াছে। যুক্তিবাদীর পক্ষে এরূপ ব্যাখ্যা বিশেষ আদরণীয় হইতে পারে না। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সাম্প্রদায়িকতা বর্জিত ব্যাখ্যাই সত্য- সন্ধিৎসুর আদর্শ।

অতএব লেখকের গীতার আলোচনায় ব্রতী হওয়ার একটি কারণ স্পষ্ট হল—সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়ে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে সত্যসন্ধিৎসুর আদর্শ নিয়ে গীতার আলোচনায় মনোযোগী হয়েছেন তিনি। এবারে দ্বিতীয় কারণটি কী দেখা যাক :

মনোবিদ্যার দিক হইতে আমি গীতার আলোচনায় নিযুক্ত হই। গীতায় এমন অনেক তথ্য আছে যাহা মনোবিদের দৃষ্টিতে মূল্যবান।

লেখক নিজে একজন প্রতিষ্ঠিত মনোবিদ, স্বভাবতই তিনি যখন মনোবিদ্যার দিক থেকে গীতার আলোচনায় প্রয়াসী হন, তখন সেআলোচনার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বস্তুত, এই প্রথম মনোবিদ্যার আলোকে গীতার ব্যাখ্যা সম্পাদিত হল। ইতঃপূর্বে নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই গীতার ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কিন্তু মনোবিদ্যার আলোকে গীতার ব্যাখ্যা অভিনব এবং এই ধরনের প্রয়াস এই প্রথম বলে স্বীকার করতে হয়।

যে দুটি কারণ এখানে উল্লিখিত হয়েছে, তা থেকেই স্বতঃ প্রমাণিত হয় যে, লেখক অন্যান্য অনেকের মতো ধর্মভাব প্রণোদিত হয়ে গীতার ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হবেন না, গীতার ব্যাখ্যায় তাঁর সম্বল যুক্তিবাদ। যুক্তিবাদকে আশ্রয় করলে ব্যাখ্যা সাধ্যমত যে নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক হবে তা বলাই বাহুল্য।

আমরা এবারে গিরীন্দ্রশেখরের গ্রন্থটির অন্যান্য প্রসঙ্গের আলোচনায় আসতে পারি। লেখক গীতার সর্বত্র একটা সঙ্গতির অবিচ্ছিন্ন ধারার সন্ধান করেছেন। তাঁর মতে :

এই সঙ্গতিই যেন গীতার প্রাণ।

গীতার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যেও সঙ্গতি বিদ্যমান—লেখকের চোখকে তা এড়িয়ে যায় নি।

গীতার কোনো কোনো শ্লোক লেখকের কাছে ‘কষ্টকল্পনা’ বলে মনে হয়েছে। এগুলির অর্থ দুরূহ, যুক্তিনিষ্ঠ নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি ৮ম অধ্যায়ের ২৪ ও ২৫ শ্লোক দুটির কথা বলেছেন। লেখক গীতার ব্যাখ্যায় সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। যে সব শ্লোকের একাধিক ব্যাখ্যা মেলে, সেই শ্লোকের অপেক্ষাকৃত সহজ ও সাধারণের বোধগম্য ব্যাখ্যাই গ্রহণ করেছেন। যখন কোনো শ্লোকের কোনো প্রচলিত ব্যাখ্যা অন্যান্য শ্লোকের বিরোধী মনে হয়েছে তাঁর, তিনি সেটিকে বর্জন করেছেন। এমনকি যে ব্যাখ্যাতে সঙ্গতির অভাব, সেগুলিকেও তিনি বর্জন করেছেন। লেখক যেহেতু যুক্তিবাদী, তাই কোনো অবস্থাতেই তিনি কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যাকে স্বীকার করেন নি।

গ্রন্থশেষে শ্লোকের যথাযথ অনুবাদ ও মূল সংস্কৃত শ্লোক বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছে। শ্লোক ও অনুবাদ পৃথক পৃথক ভাবে উপস্থাপিত।

গ্রন্থারম্ভে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মুখবন্ধ, অবতরণিকা, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে গীতার অবতারণা কেন’, ‘মহাভারতে গীতা’ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত অলোচনাগুলি।

গীতার ব্যাখ্যা পাঠক যাতে অবিচ্ছিন্নভাবে পড়তে পারেন, সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। ব্যাখ্যার পরে মূল শ্লোক উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় শ্লোকের অনুবাদে কখন কখন শ্লোকাতিরিক্ত শব্দকে যুক্ত করা হয়েছে। শ্লোকের পৌর্বাপর্ব ক্ষেত্রবিশেষে রক্ষিত হয় নি। ব্যাখ্যায় শ্লোকের যে অর্থ, তা কখনই অনুবাদকে অতিক্রম করেনি।

নিয়ম করে প্রতিটি শ্লোকের অন্বয় লেখক দেন নি, কেবল যেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাখ্যার সঙ্গে তাঁর মতের অমিল ঘটেছে, সেখানেই শ্লোকের অন্বয় উপস্থাপিত।

পরিশিষ্টে গীতার বিভিন্ন মার্গ, সৃষ্টিতত্ত্ব, পুনর্জন্ম, সত্ত্ব, রজঃ তম, ইত্যাদি বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে।

‘যুদ্ধক্ষেত্রে গীতার অবতারণা কেন’-তে লেখক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনায় ব্রতী হয়েছেন। পাশ্চাত্যে বহি:প্রকৃতির উপর প্রভুত্বের শিক্ষা দেওয়া হয় যেখানে, সেখানে প্রাচ্যে নিজের উপর প্রভুত্বের চেষ্টার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশ্চাত্যে আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি সম্ভব নয় বলা হলেও প্রাচ্যের আদর্শে আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি সম্ভব।

লেখক যতই নিজেকে যুক্তিবাদী প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হন, কিন্তু তিনিই যখন বলেন :

গীতা শাস্ত্রের সামান্যমাত্র বুঝিয়াও তুমি মহৎ ভয় হইতে উদ্ধার পাইতে পার। . . . . গীতার মর্ম উপলব্ধি করিলে তোমাকে কোন কষ্ট স্পর্শ করিতে পারিবে না। স্বপ্ন উপলব্ধিতেও অনেক লাভ।

তখন বোঝা যায়, লেখকও কখনও কখনও যুক্তির পথ ত্যাগ করে বিশ্বাসের পথ অবলম্বন করে বসেছেন। লেখক যুদ্ধক্ষেত্রে গীতার অবতারণার যৌক্তিকতা প্রতিপাদন করেছেন :

. . . . যুদ্ধের মত দুঃখের ব্যাপার আর কিছুই নাই। এমত অবস্থায় পড়িয়াও যদি দুঃখনিবৃত্তি সম্ভব হয়, তবে সর্বাবস্থাতেই তাহা সম্ভব। এইজন্যই গীতাকার যুদ্ধের অবতারণা করিয়াছেন।

গীতার ৩। ৪১ শ্লোকে জ্ঞান ও বিজ্ঞান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। লেখক জ্ঞানের শংকর প্রদত্ত ব্যাখ্যার উল্লেখ করেছেন, বিজ্ঞানের অর্থও উল্লিখিত হয়েছে, কিন্তু লেখক এ সত্ত্বেও নিজে পৃথক অর্থ প্রদান করেছেন :

আমার মতে প্রত্যক্ষ ও অনুভবসিদ্ধ প্রতীতিকে জ্ঞান বলা হইয়াছে এবং সেই জ্ঞান যখন যুক্তি, তর্ক, বুদ্ধি, বিচার ইত্যাদির দ্বারা পরিপুষ্টি লাভ করে তখন তাহা বিশেষ জ্ঞানে বা বিজ্ঞানে পরিণত হয়।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ‘স্বধর্মাচরণে গুরুত্ব দিয়েছেন, বলেছেন—

‘শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।। ৩/৩৫

লেখক এই ‘স্বধর্ম’ নিয়েও নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর বক্তব্য :

শ্রীকৃষ্ণের উপদেশমত চলিলে মেথরের উন্নতি চিরকালের জন্য বন্ধ থাকিবে।

আমরা ‘স্বধর্ম’ বলতে সমাজনির্দিষ্ট ধর্মকেই বুঝে এসেছি, লেখক নূতন একটি ব্যাখ্যা দিলেন :

স্বধর্ম স্বভাব নিয়ত কর্ম।

অর্থাৎ যে কাজ নিজ প্রবৃত্তির বিরোধী নয় এবং যা নাকি সমাজ দ্বারা অনুমোদিত তাই স্বধর্ম। তাঁর মতে নিজ প্রবৃত্তিগত যে কোনো বর্ণের কর্মই স্বধর্ম। এই প্রেক্ষিতেই শ্রীকৃষ্ণ যেসব ক্ষেত্রেই স্বভাবধর্মকে বংশগত বলেন নি, প্রমাণিত হয়।

অবতরণিকায় লেখক যে ‘শর্বিলকের আখ্যান’ উপস্থিত করেছেন, যেখানে শর্বিলক কুলধর্ম মেনে নরহত্যায় লিপ্ত তা কখনই গীতানুমোদিত নয় বলে লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন। অর্জুনের সঙ্গে শর্বিলকের তুলনা টেনেছেন লেখক, স্বীকার করেছেন দুজনের প্রকৃতিতেই স্বভাবজ নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান কিন্তু।

‘যুদ্ধ সমাজসম্মত বলিয়া অর্জুনের পক্ষে তাহা স্বধর্ম হইয়াছে এবং শর্বিলকের হত্যাকার্য সমাজবিরুদ্ধ বলিয়া তাহা পাপ।’

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের কর্মযোগ ব্যাখ্যায় লেখক একাধিক প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্তের অবতারণা করে গীতার মর্মার্থকে স্পষ্ট করেছেন। আমরা কাজ করি কিন্তু কর্মে আমাদের প্রবৃত্ত করে প্রকৃতি। আত্মা কর্মে নির্লিপ্ত থাকে। কিন্তু মায়া- বশেই আমরা মনে করি যে, আমি বা আমরা কাজ করছি। এই বিষয়টিকেই লেখক ঘড়ির সাহায্যে পরিস্ফুট করেছেন :

ঘড়ির যদি চৈতন্য থাকিত এবং সেযদি মনে করিত আমি ইচ্ছামত আমার ছোট কাঁটাটাকে আস্তে চালাইতেছি এবং বড়টাকে জোরে চালাইতেছি, পাঁচটার দাগে ছোট কাঁটাকে রাখিয়া বড় কাঁটাকে বারটার কাছে লইয়া গিয়া বিবেচনা করিয়া দেখিতেছি বাজিব কি না, পরে ইচ্ছামত পাঁচটা বাজিলাম, ইচ্ছা করিলে নাও বাজিতে পারিতাম বা ছোট কাঁটাকে চারিটার দাগে আনিয়া পাঁচটা না বাজিয়া চারিটা বাজিতে পারিতাম, তবে ঘড়ির অবস্থা অনেকটা আমাদের মত হইত।

লেখক গীতায় সামাজিক আদর্শকে বড়ো করে দেখানো হয়েছে বলে মনে করেছেন। আর সেকারণে শ্রীকৃষ্ণ যে অর্জুনকে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন তা নিজেকে ভগবান বলে মনে করে দেন নি :

তিনি প্রধান এজন্য শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, প্রজারা তাঁহারই আদর্শে চলিবে ইহা বলাই উদ্দেশ্য।

তৃতীয় অধ্যায়ের ৮ম ও ৯ম শ্লোকদ্বয়ের অর্থে লেখক সঙ্গতির অভাব লক্ষ করেছেন। ৮ম শ্লোকে ব্যক্তিগত শারীরিক কর্মের উল্লেখ পাই, কিন্তু ৯ম শ্লোকে উল্লিখিত হয়েছে সমষ্টিগত যজ্ঞের প্রসঙ্গ। লেখক তিলকের ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছেন :

যজ্ঞের জন্য যে কর্ম কৃত হয়, তাহার অতিরিক্ত অন্য কর্মের দ্বারা এই লোক আবদ্ধ আছে। তদর্থ অর্থাৎ যজ্ঞার্থ কৃতকর্মও তুমি আসক্তি বা ফলাশা ছাড়িয়া করিতে থাক।

লেখক প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি এইরূপ—যজ্ঞার্থ কর্মে যদি বন্ধনই না থাকে তবে তদর্থ অর্থাৎ যজ্ঞার্থ কর্ম মুক্ত সঙ্গ হইয়া কর এ কথার কোন সার্থকতা থাকে না। লেখক কৃত ৯ম শ্লোকের অন্বয়টি এইরূপ—যজ্ঞার্থাৎ কর্মণঃ অয়ং লোকঃ কর্মবন্ধনঃ কৌন্তেয় তদর্থং মুক্তসঙ্গঃ কর্ম সমাচর। লেখক ‘কর্ম’ শব্দটির অর্থ ব্যাপকার্থে গ্রহণ করেছেন—যা কিছু করা যায় তাই কর্ম। এই নিরিখে তিনি কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের বিশেষ পার্থক্য দেখেন নি। তাঁর বিবেচনায়, ‘কর্মযোগে যে বুদ্ধি বিকশিত হয় তাহাই জ্ঞানযোগ।’

লেখক যাচাই করে নিয়েছেন সবকিছু। গড্ডলিকা স্রোতে গা ভাসাতে চান নি। আর সেই কারণেই তাঁর পূর্বসূরীর প্রদত্ত ব্যাখ্যার সঙ্গে লেখক প্রদত্ত ব্যাখ্যার ব্যবধান তৈরি হয়েছে। লেখকের স্বাধীন চিন্তাভাবনার পরিচয় পাই নানা ক্ষেত্রেই।

চতুর্থ অধ্যায়ের ৭ম ও ৮ম শ্লোকদ্বয়ে বলা হয়েছে যখনই পাপের প্রাদুর্ভাব হয় তখনই তা নিবারণ কল্পে ভগবান নিজেকে সৃষ্টি করেন। লেখক এখানে ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁর বক্তব্য :

ভগবান কোন বিশেষ যুগে জন্মগ্রহণ করেন না, . . . যে মনুষ্য যখন ধর্ম সংস্থাপনের চেষ্টা করে সেই তখন ভগবানের অবতার।১০

চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক বিভিন্ন শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জানালেন দ্রব্যময় যজ্ঞের তুলনায় জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেয়, কারণ, জ্ঞানেতেই সর্ব অখিল কর্মের অবসান। আরও বললেন, জ্ঞান ভেলার সাহায্যে পাপ থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। পৃথিবীতে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছুই নেই। পাপ, পুণ্য, কর্ম, বিকর্ম, অকর্ম ইত্যাদি বিচারের আবশ্যকতা থাকে না যদি কেউ জ্ঞানলাভ করে। জ্ঞানাগ্নি সমুদয় কর্মকে দগ্ধ করে। জ্ঞান বুদ্ধি বা কর্মযোগ লভ্য। জ্ঞানে সকল প্রকার সংশয় ছিন্ন হয়, কর্ম বন্ধন করতে পারে না আত্মজ্ঞানীকে। ১৩। ২৪ শ্লোকে তিন সাধনার কথা পাই—জ্ঞান, ধ্যান ও কর্মযোগের কথা লভ্য। কেউ ধ্যানের সাহায্যে নিজের মধ্যে আত্মার দ্বারা আত্মাকে দর্শন করেন, কেউ জ্ঞানমার্গের দ্বারা আত্মাকে দেখেন, আবার কেউ কর্মযোগের দ্বারা আত্মার দর্শন পান। কৃষ্ণের মতে এই তিন মার্গের মধ্যে কর্মযোগই সুসাধ্য ও শীঘ্র ফলপ্রদ।

লেখক দ্বাদশ অধ্যায়টিকে উপদেশের সার বলে বর্ণনা করেছেন :

সকল প্রকার সাধকের পক্ষে রাজবিদ্যার অন্তর্গত কর্মযোগ আশ্রয় করা শ্রেয় এবং পরমাত্মার উপলব্ধি একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।১১

গীতা প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণন

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৯৪৮ সালে প্রথম তাঁর ভাগবৎগীতা প্রকাশ করেন গ্রেট ব্রিটেন থেকে। তিনি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীকে। দীর্ঘ ৭৮ পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকায় লেখক তেরটি পরিচ্ছেদে গীতার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভূমিকায় লেখক ভাগবৎগীতার গুরুত্ব, এর রচনাকাল, গীতার মুখ্য আলোচকবৃন্দ, বাস্তবতা, মায়াবাদ, ব্যক্তিসত্তা, যোগশাস্ত্র, জ্ঞান, জ্ঞান-মার্গ, কর্ম-মার্গ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

লেখক বিশ্বাস করেন যে, জীবনের চরম পরিণতি বোঝার জন্য গীতা এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান :

The Bhagavad Gita is a valuable aid for the understanding of the supreme ends of life.

লেখক যথার্থই বলেছেন, প্রতিটি শাস্ত্রের দুটি দিক—একটি তার তাৎক্ষণিক দিক, যা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় অপরটি শাশ্বত, অক্ষয়, যা কখনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। শেষেরটিই সর্বকালে সর্বদেশে প্রযোজ্য। গীতার গ্রহণযোগ্যতার কারণ নির্দেশ করে লেখক বলেছেন, আপাতধর্মীয় চেতনার বিভিন্নতা এবং বৈপরীত্যের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের বিরল নজিরস্বরূপ হল গীতা, গীতা ধর্মীয় ভাবনার মূলকে গুরুত্ব দেওয়ায় তা না প্রাচীন না আধুনিক, পরন্তু শাশ্বতের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়ে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মানবজাতির গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

রাধাকৃষ্ণন গীতার ইংরেজি অনুবাদে প্রয়াসী কিন্তু তিনি সচেতন যে গীতার কোনো অনুবাদই মূলের আভিজাত্য ও গাম্ভীর্য রক্ষায় সক্ষম নয়। যে কোনো অনুবাদের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য, তার ওপর গীতার মত গ্রন্থ হলে ত কথাই নেই, রাধাকৃষ্ণনের অকপট স্বীকারোক্তি :

Its melody and magic of phrase are difficult to recapture in another medium.

তাই তিনি কিংবা অন্য অনুবাদকদের একটিই উদ্দেশ্য—মূলের চিন্তাভাবনাকে তুলে ধরা, তার বেশি কিছু নয়। কোনো অনুবাদকের পক্ষেই গীতার ‘Spirit’-কে যথাযথভাবে উপস্থাপন সম্ভব নয়।

বহু শতাব্দী ধরে গীতা কোটি কোটি হিন্দুকে পরম আশ্রয় দিয়ে এসেছে কারণ গীতা এমন এক মহান গ্রন্থ যেখানে আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিটি বিশেষ শক্তপোক্ত, কোনো অবৈজ্ঞানিক ধারণা কিংবা স্বেচ্ছাচারী কল্পনাশক্তিকে তা প্রশ্রয় দেয় নি :

The great book which sets forth in precise and penetrating words the essential principles of a spiritual religion which are not contingent on ill-founded facts, unscientific dogmas or arbitrary fancis.

যদিও গীতা শ্রীকৃষ্ণ কথিত বলে প্রচলিত, তথাপি লেখক তা ব্যক্তিবিশেষের রচনা বা চিন্তাপ্রসূত বলে মনে করেন না, মনে করেন না বিশেষ দর্শনে আস্থাশীল ব্যক্তিদের মননসঞ্জাত বলে, বরং এটি মানবজাতির ধর্মীয় জীবন-সম্পৃক্ত পরম্পরা-উদ্ভূত বলেই তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় :

It is set forth as a tradition which has emerged from the religious life of mankind.

গীতা হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্র, এই হল গীতার সাধারণ পরিচিতি। কিন্তু এই ব্যাপারেও লেখকের নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে, তা হল গীতা কখনই বিশেষ কোনো হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, তা গোষ্ঠী, সম্প্রদায় নির্বিশেষে তামাম হিন্দুদের, সামগ্রিকভাবে হিন্দুদের, নিছক হিন্দু ধর্ম নয়, সাধারণভাবে তা ধর্মের মর্যাদাসম্পন্ন যেহেতু তা বিশ্বজনীনতাকে অঙ্গীকার করেছে, বিশেষ সময় কিংবা স্থানের সীমাবদ্ধতাকে তা অতিক্রম করে গেছে :

It represents not any sect of Hinduism but Hinduism as a whole, not merely Hinduism but religion as such, in its Universality, without limit of time or space, . . .

রাধাকৃষ্ণণ গীতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে উল্লেখ করেছেন তাঁর ভূমিকায়—

ক. অস্তিত্বের অর্থ ও গুরুত্ব এতে ব্যাখ্যাত হয়েছে।

খ. একই সঙ্গে ভাগবত গীতা বাস্তবতার বিজ্ঞান এবং বাস্তবতা – সম্পৃক্ত সংযোগের শিল্প।

গ. বভিন্ন চিন্তা ভাবনার সামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থাপন।

‘The teacher refines and reconciles the different currents of thought, the vedic cult of sacrifices, the Upanishad teaching of the transcendent Brahman, the Bhagavata theism and tender piety, the Sankhya dualism and the yoga meditation.’

সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন গীতার প্রেক্ষাপটটি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে দার্শনিক মতবাদের ভিন্নতার বিষয়েও স্বভাবতই উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব হ্রাস পেল ভারতবর্ষে, একে একে আত্মপ্রকাশ করল বিভিন্ন গোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক তথা দার্শনিক মতবাদ যেমন—অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ এমনকি শুদ্ধাদ্বৈতবাদ। বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত ব্যাখ্যাতারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে গীতার ব্যাখ্যায় অবতীর্ণ হলেন। স্বভাবতঃই এঁরা নিজস্ব গোষ্ঠীর মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেন এবং অন্য মতগুলিকে বাতিল করতে প্রয়াসী হলেন। কিন্তু গীতা এমন একটি শাশ্বত সত্যকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে, যা থেকে অন্যান্য সত্যগুলি আত্মপ্রকাশ করেছে :

The Gita suggests that the one eternal truth which we are seeking, from which all other truth derives, cannot be shut up in a single formula.

এখানে লক্ষ করার, লেখক ‘many other truth’ না বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন : ‘all other truth’-এর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গ।

গীতার ভাষ্য রচনা অনেককাল থেকে করে আসা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত আমাদের প্রাপ্ত প্রাচীনতম ভাষ্যটি হল শঙ্করাচার্যের। শঙ্করাচার্যের পূর্ব থেকেই ভাষ্য রচিত হয়েছে, কিন্তু সেসব ভাষ্য আমাদের করায়ত্ত হয়নি। রাধাকৃষ্ণন তুলনামূলকভাবে বিস্তৃত পরিসরেই শঙ্করাচার্যের ভাষ্যের উল্লেখ করেছেন। শঙ্করাচার্যগুরুত্ব দিয়েছেন Wisdom বা জ্ঞানের ওপর, কর্মের ওপর নয়। তাঁর মতে জ্ঞান ও কর্ম পরস্পর বিরোধী যেমন আলো ও অন্ধকার পরস্পর বিরোধী। জ্ঞানের উদয় হলে, জ্ঞান করায়ত্ত হলে, অহংবোধ বিলুপ্ত হয়, লাভ হয় যথার্থ আনন্দ স্বর্গসুখ। তিনি ‘জ্ঞানকর্ম সমুচ্চয় তত্ত্ব’ বাতিল করেছেন। অবিদ্যায় আচ্ছন্ন যারা তাদের কাছেই এই অবাস্তব সংসারের গ্রহণযোগ্যতা। কর্ম অসার ও অর্থহীন।

‘Works are vain and bind us firmly to this unreal cosmic process (Samsara) the endless chain of cause and effect.’

গীতার উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, শঙ্করাচার্যের মতে :

Complete suppression of the world—‘The aim of the Gita, according to Sankara, is the complete suppression of the world of becoming in which all action occurs, . . .

শুধু শঙ্করাচার্যই নন, রাধাকৃষ্ণণ রামানুজ, মধ্ব, নিম্বার্ক, বল্লভ এঁদের মতাদর্শেরও উল্লেখ করেছেন। পৃথিবীর অবাস্তবতা তত্ত্ব নাকচ করলেন রামানুজ। গীতার্থ সংগ্রহে যমুনাচার্য যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন রামানুজ তারই অনুবর্তী। তাঁর মতে একমাত্র ভগবান হলেন বিষ্ণু। তিনি তাঁর দৈব সম্মান অন্য কারো সঙ্গে ভাগ করে নেন না। রামানুজের মতে, গীতায় সবই অভিব্যক্ত জ্ঞান, ভক্তি এবং কর্ম, কিন্তু গীতায়গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভক্তির ওপর। মানুষের আত্মার গোপনতম স্থানে ঈশ্বরের অবস্থান, কিন্তু উপযুক্ত জ্ঞানার্জন ব্যতিরেকে ঈশ্বরের অবস্থান জানা যায় না। সর্বন্তঃকরণে ঈশ্বর আরাধনার মাধ্যমেই একমাত্র সেই জ্ঞান অর্জিত হয়।

মধ্ব গীতায় যে পথের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মেনেছেন, তা হল ভক্তি। এদিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে রামানুজের সাযুজ্য। তবে তাঁর ‘গীতা ভাষ্য’ এবং ‘গীতা তাৎপর্যে’ তিনি প্রয়াস করেছেন গীতা থেকে দ্বৈতবাদের দর্শনে উপনীত হতে। রাধাকৃষ্ণান মধ্বের প্রয়াসকে স্ববিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক বিচারে আত্মার সঙ্গে সর্বশক্তিমানের অভিন্নতা দেখানো হয়েছে, অন্যদিকে আবার দুইয়ের মধ্যেকার পার্থক্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

নিম্বার্ক দ্বৈতাদ্বৈত তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাঁর মতে জীব, জগৎ এবং ঈশ্বর একে অন্যের থেকে পৃথক। তথাপি জীবের অস্তিত্ব ও কর্মধারা এবং জগৎ ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিকেই নিম্বার্কের মুখ্য তত্ত্ব বলে অভিহিত করতে হয়।

বল্লভ শুদ্ধাদ্বৈত মতবাদের পৃষ্ঠপোষক। ভ্রান্ত ধারণামুক্ত জীব এবং সর্বশক্তিমান ব্রহ্ম এক। আত্মা ঈশ্বরের খন্ডিত অংশ, অগ্নিকণার অনুরূপ। ঈশ্বরের অনুকম্পা ব্যতিরেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, যা নাকি মুক্তির জন্য কাম্য তা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। মুক্তির জন্য ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। তাঁর মতে ভক্তি হল প্রেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সত্য।

একই গীতা, অথচ বিভিন্ন ব্যাখ্যাতার ব্যাখ্যায় ভিন্নতা দেখা গেছে। ব্যাখ্যাতা যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গীতার ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হয়েছেন তাতেই রয়ে গেছে এর কারণ। রাধাকৃষ্ণণ চমৎকার মন্তব্য করেছেন :

The Hindu tradition believes that the different views are complementary. মতের ভিন্নতা থাকলেও, আসলে সেগুলি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। তাই কোন মতটিই পরিত্যাজ্য নয়।

‘From the view-point of the body, I am thy servant, from the view-point of the ego, I am a portion of Thee; from the view-point of the self I am Thyself. This is my conviction.’ ভাগবত গীতায় যে উপদেশ প্রদত্ত হয়েছে সেই প্রেক্ষিতে শ্রীকৃষ্ণ একজন ঐতিহাসিক চরিত্র কিনা সেবিবেচনা অনাবশ্যক। যদিও রাধাকৃষ্ণণ মনে করেন তাঁর ঐতিহাসিকতার স্বপক্ষে নানা প্রমাণ বিদ্যমান (ample evidence in favour of the historicity of Krishna)। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক এবং অবতাররূপে উপস্থাপিত, যদিও এই মহাকাব্যেই ইঙ্গিত লভ্য যে তাঁর অধিকার ও ক্ষমতা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। যাই হোক মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়, এখানে তাঁকে আমরা অর্জুনের মিত্ররূপে পাই। রাধাকৃষ্ণন পাণিনির উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে, বসুদেব ও অর্জুন আরাধ্য বলে উল্লিখিত। কৃষ্ণ ছিলেন যদু বংশোদ্ভূত। মথুরার নিকটবর্তী স্থানে তাঁর ছিল নিবাস। এই মথুরার সঙ্গে কৃষ্ণের নাম যুক্ত ঐতিহাসিক, পরম্পরাগত ভাবে এবং পৌরাণিকতার সুবাদে। কৃষ্ণ যে তত্ত্ব বা উপদেশ দিয়েছেন, তা তিনি লাভ করেছিলেন ঘোর অঙ্গীরসের কাছ থেকে। কৃষ্ণ সূর্যপূজার শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং তিনি সূর্যের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে পড়েন।

ভাগবত ধর্মে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীভগবন রূপে পরিচিত। তিনি যে তত্ত্ব শিক্ষা দেন তাই ভাগবত ধর্ম। গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন, তিনি নতুন কিছু বলছেন না, ইতঃপূর্বে তিনি বিবাশ্বনকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তারই পুনরাবৃত্তি করছেন মাত্র। বিবাশ্বন তাঁর লব্ধ উপদেশ মনুকে দান করেন, মনু আবার তা দান করেন ইক্ষ্বাকুকে।

নারায়ণ্যীয় বা ভাগবত ধর্মে কথিত হয়েছে, এই ধর্মের পাঠ তিনি ইতঃপূর্বেই ভাগবত গীতায় দিয়েছেন। পুনরায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়ে যখন অর্জুন যুদ্ধ করতে অসম্মত হন, তখনও তাঁকে এই উপদেশ দেন। রাধাকৃষ্ণণের মতে এই ধর্ম হল একেশ্বরবাদ বা একান্তিকা This is the religion of monotheism (ekantika).

প্রশ্ন হল, মানুষ কিরূপে পরিপূর্ণতায় বা পরাকাষ্ঠায় উপনীত হবে? চরমোৎকর্ষ কীরূপে আয়ত্ত করবে? আমরা জানি এই জগৎ যে স্থানু হয়ে নেই তার মূলে রয়েছে কর্ম। মানবিক পর্যায়ে কর্মশীলতার মূলে সক্রিয় থাকে বাসনা, আকর্ষণ, কাম। বাসনার মূল কারণ হল অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা। রাধাকৃষ্ণনের ভাষায় :

The roots of desire lie in the ignorant belief in the individual’s self-sufficiency, in the atribution of reality and permanence to it.১০

যে পর্যন্ত অবিদ্যার উপস্থিতি, সেপর্যন্ত মানুষের ক্লেদাক্ত জীবনচক্র থেকে রেহাই নেই। বাসনার মূলোচ্ছেদ বাসনার দ্বারা সম্ভব নয়। কর্মের নিরাময় কর্মের দ্বারা অসম্ভব। যা নাকি শাশ্বত, চিরন্তন, তাকে কখনই ক্ষণস্থায়ী কোনো কিছুর মাধ্যমে লাভ করা যায় না। প্রশ্ন উঠবে, বাসনারও ত ভাল মন্দ আছে। রাবণ চেয়েছিলেন মর্ত্যলোকের সুবিধার্থে স্বর্গ পর্যন্ত সিঁড়ি প্রস্তুত করিয়ে দেবেন। আমরা হাসপাতাল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় স্থাপন করার বাসনা করি। এসব হল ভাল বাসনার নিদর্শন। আবার অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করা, শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করা বা তার নিধনের বাসনা অবশ্যই মন্দের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হল ভাল-মন্দে কী আসে যায়? বাসনা মাত্রেই বন্ধন :

It makes little difference whether the chains which bind us are made of gold or of iron.

এখন এই বাসনা থেকে মুক্ত হতে হবে, মুক্ত হতে হবে অবিদ্যা থেকে, অজ্ঞানতা থেকে। অবিদ্যা (অজ্ঞানতা)— অজ্ঞান বাসনা—অজ্ঞান কর্ম। অবিদ্যা—কাম—কর্ম থেকে মুক্ত হতে আশ্রয় করতে হবে বিদ্যা বা জ্ঞানকে—

‘Vidya or wisdom is the means of liberation from the chain of avidya—Kama—Karma.’ না, এই জ্ঞান প্রচলিত অর্থের শিক্ষা বা শিক্ষাসঞ্জাত নয়, এ হল আধ্যাত্মিক অন্ধত্ব। এজন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক দীপের প্রজ্বলন। প্রয়োজন পঞ্চেন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ :

The fire of passion and the tumult of desire must be suppressed. The mind, inconstant and unstable, must be steadied so as to reflect the wisdom from above. We must control the senses possess the faith which no intellectual doubts disturb and train the understanding (buddhi).১১

জ্ঞান হল প্রত্যক্ষ অজ্ঞতা। প্রতিকূলতার অবসান হলেই জ্ঞানলাভ সম্ভব। তাই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালাভের ক্ষেত্রে যা বাধাস্বরূপ, তার দূরীকরণ প্রয়োজন।

অদ্বৈত বেদান্ত বলেন জ্ঞান সর্বদাই উপস্থিত। একে অর্জন করা যায় না। কেবল এটি আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকে মাত্র। বাস্তবতা ধরা পড়ে না কারণ—‘Our casual apprehensions, backed by our wishes and prejudices . . .’ আলো এবং অন্ধকার যেমন পরস্পর পরস্পরের বিপরীত কোটিতে অবস্থান করে, জ্ঞান ও অজ্ঞানতার অবস্থানও তদনুরূপ। যে মুহূর্তে জ্ঞানের উদয় হয়, সেই মুহূর্তে অজ্ঞানতার মৃত্যু হয়। এভাবে অশুভের একেবারে মূল থেকে বিনাশ ঘটে। মুক্ত বা স্বাধীন আত্মা অনায়াসে পৃথিবীকে অতিক্রম করে। কোনো কিছুই সৃষ্টি করার নয়, কোনো কিছুই জয় করার নয়। কর্ম তখন আর বন্ধন নয়। জ্ঞানের উন্মেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সর্বোত্তমের মধ্যে অবস্থান করি। এ কোনো বিমূর্ত ভাবনা মাত্র নয় রাধাকৃষ্ণনের মতে :

It is that by which thou shalt see all existences without exception in the Self, then in Me.১২

আমরা লক্ষ্যে বা চরমোৎকর্ষে উপনীত হতে পারি তিনটি পৃথক পথে—জ্ঞানের সাহায্যে, ভক্তির সাহায্যে এবং কর্মের সাহায্যে। ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ কেউ বা চিন্তাশীল, কেউ আবার আবেগপ্রবণ, আবার কেউ ক্রিয়াশীল। আপাতভাবে এই তিনের মধ্যে পার্থক্য আছে মনে হলেও শেষ পর্যন্ত জ্ঞান-ভক্তি-কর্মের সমন্বয় সাধিত হয়। কারণ ঈশ্বর স্বয়ং সৎ, চিৎ ও আনন্দ। তাই যাঁরা জ্ঞানবাদী, তাঁদের কাছে ঈশ্বর হলেন শাশ্বত আলোক, স্বচ্ছ, স্পষ্ট, মধ্যাহ্নকালীন সূর্যসম। যাঁরা ন্যায়পরায়ণতার জন্য সংগ্রামশীল, ঈশ্বর তাঁদের কাছে নিরপেক্ষ এবং শাশ্বত ন্যায়পরায়ণ। অপরপক্ষে যাঁরা আবেগপ্রবণ, তাঁদের কাছে ঈশ্বর চিরন্তন প্রেম, সৌন্দর্য এবং পবিত্রতার প্রতীক।

জ্ঞান বলতে knowledge নয়, wisdom-এর কথা বলা হয়েছে, যাকে আমরা আধ্যাত্মিক জ্ঞান বলতে পারি। বৈষয়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রয়োজন যে জ্ঞানের, স্বভাবতই আধ্যাত্মিক জ্ঞান থেকে তা পৃথক। ক্ষমতা কিংবা খ্যাতির তাড়নায় যে জ্ঞানার্জন, তা আমাদের বহুদূর নিয়ে যেতে পারে না। তাই সন্ধানরত হতে হবে সত্যের জন্য। অর্জুন তাঁর চর্মচক্ষে সত্যকে দেখতে পাননি, তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল স্বর্গীয় দৃষ্টিশক্তির।

‘ভজ’ ধাতু থেকে এসেছে ‘ভক্তি’ শব্দটি। অর্থ হল ভজনা করা বা সেবা করা। কার সেবা? না ঈশ্বরের। এই সেবা শর্তসাপেক্ষ নয়, নি:শর্ত। নারদের মতে ভক্তি হল ঈশ্বরের প্রতি তীব্র অনুরক্তি। শান্ডিল্যের মতে, ঈশ্বরের জন্য তীব্র আকাঙ্খা। ভোজ বলেন, বিনা ফলের প্রত্যাশায় ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা, শিক্ষকেরও শিক্ষক যিনি তাঁর উদ্দেশে সকল কর্ম সমর্পণ। ভক্তি হল এমন এক অভিজ্ঞতা যা নাকি সর্বপ্রকারের ইচ্ছা আকাঙ্খাকে বাতিল করে, অন্তরকে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসায় পূর্ণ করে তোলে। ভক্ত বা সেবক তার সমগ্র সত্তাকে ঈশ্বরের দিকে চালিত করে। আরাধনা হল ধর্মের সার। আরাধনার মাধ্যমে আরাধ্য এবং অর্চনাকারীর মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মধ্যেকার পার্থক্য হল ভক্তিধর্মের সত্তা তত্ত্বীয় ভিত্তি।

রাধাকৃষ্ণনের মতে ভাগবত গীতায় আমরা যে ঈশ্বরকে পাই, তিনি ততটা দার্শনিক অনুমানের ঈশ্বর নন, যতটা তিনি সেই অভিলষিত ঈশ্বর যাঁকে মন প্রাণ কামনা করে, যিনি ব্যক্তিগত আস্থাকে, ভালবাসাকে উদ্দীপিত করেন, উদ্দীপিত করেন শ্রদ্ধাবোধ তথা বিশ্বস্ত আত্মসমর্পণে :

The Eternal one is viewed in the Bhagavad Gita not so much as the God of philosophical speculation as the God of grace such as the heart and the soul need and seek, who inspires personal trust and love, reverence and loyal self-surrender.১৩

শান্ডিল্য বলেন, ভক্তি আমাদের আধ্যাত্মিক শান্তি দেয় এবং তা জ্ঞান ব্যতিরেকেই, যেমনটি দেখা যায় গোয়ালাদের ক্ষেত্রে। ভক্তের মধ্যে থাকে এক ধরনের দীনতা। ঈপ্সিতের উপস্থিতিতে ভক্ত অনুভব করে সেকিছুই না। বলা হয় প্রকৃতিতে ভক্তি অনেকখানি নারীসুলভ। যেসব বৈশিষ্ট্য ভক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেগুলি হল প্রেম, কোমলতা, ক্ষমা, নিষ্ঠা, অনুরক্তি। এসব বৈশিষ্ট্যগুলির অধিক পরিমাণে উপস্থিতি লক্ষিত হয় নারীতে। নারী আশা করে, দুর্ভোগ ভোগ করে এবং লাভ করে। সব মানুষের মধ্যেই নারীসুলভ গুণগুলি বিদ্যমান, কম অথবা বেশি, ভাগবতে বলা হয়েছে মেয়েরা দেবী কাত্যায়নীর কাছে প্রার্থনা জানায় যেন কৃষ্ণকে তারা স্বামী রূপে লাভ করে। নারী তার আস্থাভাজনকে বিশ্বাস তথা সর্বস্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। বিনিময়ে অন্য কোনো চাহিদা থাকে না, চাহিদা শুধু একটিরই—ভালবাসার। ভালবাসা সেপেতে চায়, ভালবাসা সেদিতে চায়। ঈশ্বরের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্কের প্রেক্ষিতে তারা অনেকটা নারীসুলভ। ঈশ্বরই একমাত্র পুরুষ, অন্য সকলে ব্রহ্ম থেকে পরবর্তী অধস্তন সব নারীর সদৃশ।

আত্মা যখন ঈশ্বরে সমর্পিত হয়, ঈশ্বর সকল জ্ঞান এবং ত্রুটি গ্রহণ করে আমাদের সব ধরনের অসম্পূর্ণতাকে দূরে নিক্ষেপ করেন। তাঁর শাশ্বত জ্যোতিতে সব রূপান্তরিত করেন। ভক্তি তাই নিছক নি:সঙ্গ একাকীর একক ঈশ্বরের কাছে গমন মাত্র নয়, পৃথিবী থেকে আত্মার বিচ্ছিন্ন হওয়া অন্যদিকে তা ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।

ভক্তি জ্ঞানের পথে চালিত করে। রামানুজ বলেন, এ হল স্মৃতি সান্ত্বনা। এমনকি প্রপত্তিও হল জ্ঞানের একটি রূপ। ভক্ত নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে এবং ঈশ্বরের মধ্যে উপলব্ধি করে নিজেকে। প্রহ্লাদের মতে, মানুষের চরম পরিণতি হল ঈশ্বরে সর্বাতিশারী ভক্তি এবং সর্বত্র ঈশ্বরের উপস্থিতিকে অনুভব করা।

বিশ্বাস হল ভক্তির ভিত্তি। ভক্তির সঙ্গে দেবারাধনায় অন্তর পবিত্র হয়। শুধু তাই নয়, মনকে উন্নততর চেতনার দিকে যেতে প্রস্তুত করে। আমাদের চেতনার মান থেকে ঈশ্বরের প্রকৃতি কখনই উচ্চতর হতে পারে না—

The nature of God cannot be higher than the level of our consciousness.১৪

গীতার সূচনা হয়েছে একটি সমস্যা নিয়ে। স্থান কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গন। দু’দিকে দু’পক্ষের সুসজ্জিত সৈন্যবাহিনী। একদিকে কৌরবপক্ষীয় অন্যদিকে পান্ডবপক্ষীয়। অর্জুন হঠাৎ ঘোষণা করলেন তিনি যুদ্ধ করবেন না, এই বলে অস্ত্র ত্যাগ করলেন। কারণ তাঁর পরমাত্মীয়রা, পিতামহ, অস্ত্রগুরু এবং অন্যান্যরা শত্রুপক্ষীয়, এদের হত্যা করতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। এই যে একটু ওজুহাত খাড়া করে অর্জুনের কর্তব্যকর্ম সম্পাদনে অনীহা, এই প্রেক্ষিতে গীতার আত্মপ্রকাশ। অর্জুনের মত পরিবর্তনের জন্যই গীতা কথিত হয়েছিল। স্বভাবতঃই গীতায় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে কোনটি শ্রেয়; কর্ম না বৈরাগ্যসাধন? গীতায় যে উত্তর প্রদত্ত হয়েছে তা হল কর্মই শ্রেয়; অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাঁর উপদেশবাণী শুনে মত পরিবর্তন করলেন, জানালেন তাঁর মধ্যে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূরীভূত। তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত বলে জানালেন। এর থেকেই গীতায় কর্মের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলা হয়। শিক্ষক একবারের জন্যও এই পৃথিবীকে প্রপঞ্চ বলে সমস্যার সমাধান করেন নি, কর্মকে ফাঁদ বা প্রলোভনও বলেন নি। বরং তিনি পৃথিবীতে মানুষকে পূর্ণ কর্মময় জীবন যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন, সুপারিশ করেছেন। গীতা তাই এককথায় কর্ম সম্পাদনের নির্দেশক। গীতা একজন সামাজিক মানুষের কি করা উচিত সেই পরামর্শ দেয় নি, পরামর্শ দিয়েছে ব্যক্তিবিশেষকে তার আধ্যাত্মিক ভবিষ্যতের নিরিখে। সাংখ্যে কর্ম বর্জনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সৃষ্ট জীব কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ এবং একমাত্র জ্ঞানের সহায়তায় তারা রক্ষা পায়। যে কোনো কর্মই তা ভাল অথবা মন্দ যাই হোক, তা স্বাভাবিকভাবে ফল প্রসব করে যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে বন্ধনে আবদ্ধ করে মুক্তির পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। এজন্য প্রত্যেকেরই কর্ম বর্জন করা কর্তব্য। শঙ্করাচার্য জ্ঞানমার্গের অনুসারী ছিলেন, তিনি বলেন, অর্জুন ছিলেন ‘মাধ্যম অধিকারী’, তাই তাঁর পক্ষে বর্জন ছিল সাংঘাতিক ব্যাপার তাই তাঁকে কর্মের উপদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ভাগবত ধর্মে যে বক্তব্য উপস্থাপিত গীতায় তাকেই গ্রহণ করা হয়েছে, উদ্দেশ্য আমাদের সহায়তা করা দু’ভাবে—সম্পূর্ণ মুক্তিলাভে এবং পৃথিবীতে কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে। ব্যাস শুককে বলেছেন, ব্রাহ্মণদের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পদ্ধতি হল জ্ঞানলাভের মাধ্যমে মুক্তিলাভ এবং কর্ম সম্পাদন।

গীতার শিক্ষক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, আমাদের পক্ষে কর্মজীবন থেকে সরে থাকা অসম্ভব। আরও দেখি, কর্মের বন্ধনক্ষমতা কর্মের প্রকৃতি-নির্ভর নয়, নির্ভর কর্ম সম্পাদনের অভিপ্রায় বা আকাঙ্ক্ষার ওপর যা কর্ম সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে।

স্বার্থত্যাগের অর্থ হল বাসনার অনুপস্থিতি। যে পর্যন্ত কর্ম ভ্রান্ত হেতুবাক্য, নির্ভর, তা ব্যক্তিবিশেষের আত্মাকে বন্ধনদশার শিকার করে। যদি আমাদের জীবন অজ্ঞতা, নির্ভর হয়, তবে চরিত্র যতই মহৎ হোক তবু বন্ধনের শিকার হতে হবে। গীতা কখনই কর্ম থেকে দূরে সরে থাকার কথা বলে নি, বলেছে আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা ত্যাগের কথা। সৎ ও ন্যায়ের জন্য যে যুদ্ধ, অর্জুন তাতে অংশগ্রহণে তাঁর অনীহার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি পরিস্থিতির একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন এবং অহিংসার চরমতম অবস্থাকে উপস্থাপিত করেছেন। কখনই অর্জুন যুদ্ধের ভাল, মন্দ ঠিক-বেঠিক নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন নি। এমন নয় যে তিনি চিরকেলে যুদ্ধবিমুখ। বহু যুদ্ধেই তিনি অংশ নিয়েছেন। বহু শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যেহেতু তাঁকে ধ্বংস করতে হবে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন গুরুজনদের, তাতেই তাঁর অনীহা। অর্থাৎ যুদ্ধের ভয়ঙ্করতা, বলপ্রয়োগজনিত কুফল নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ তোলেন নি তিনি—অনীহা তাঁর আপনজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্রপ্রয়োগে, যাঁরা এখন তাঁর শত্রুপক্ষীয়। রাধাকৃষ্ণন মন্তব্য করেছেন, যুদ্ধে বিরত থাকা অর্জুনের কোনো আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের নিদর্শন নয়, তা তাঁর অজ্ঞতা এবং দুর্বলতার পরিচায়ক।১৫

আসলে কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন মন্দ উদ্দেশ্য অথবা আবেগমুক্ত হবার। বলেছিলেন তাঁকে ক্রোধশূন্য হতে অথবা যদি নৈকট্যের বন্ধন থেকে থাকে তা থেকে মুক্ত হতে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা নিশ্চয়ই সংগ্রাম করব, কিন্তু যদি আমরা ঘৃণার দ্বারা চালিত হই তবে সেক্ষেত্রে আমাদের আধ্যাত্মিক পরাজয় ঘটবে। কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দিয়েছেন একজন চরমোৎকর্ষে উপনীত হতে পারে নিজের কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে, কিন্তু সেই কর্ম সম্পাদন করতে হবে সর্বান্তঃকরণে, কোনোপ্রকার আকর্ষণ ব্যতিরেকে, আকর্ষণ হল ফলের; কর্ম সম্পাদন করতে হবে নিষ্ঠা সহকারে। রাধাকষ্ণন প্রথমত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন—

If we act in the spirit of the Gita with detachment and dedication, and have love even for our enemy, we will help to rid the world of wars.১৬

অর্থাৎ গীতায় যুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়ার কথা যে কেউ কেউ বলেন, তা যথার্থ নয়, রাধাকৃষ্ণন সেই ইঙ্গিতটিই এখানে দিয়েছেন।

রাধাকৃষ্ণনের মতে ভাগবত গীতা যত না দার্শনিক গ্রন্থ, তদপেক্ষা অনেক বেশি এটি ধর্মীয় গ্রন্থ, তাঁর ভাষায় (religious classic)। তবে গীতায় যে বাণী প্রদত্ত হয়েছে, যা নাকি ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তা নির্ভরশীল জীবন- দর্শনের ওপর।

রাধাকৃষ্ণনের মতে গীতা রচিত হয়ে থাকবে খ্রিষ্টপূর্ব কালে। গীতার রচনাকাল তাঁর মতে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চাশ শতাব্দীতে। অবশ্য গীতার text পরবর্তীতে নানা রূপান্তরকে অঙ্গীকার করে নিয়েছে। গীতার রচয়িতা সম্পর্কে লেখক কিছু বলেন নি। বলেছেন বিষয়টি অজানা—

We do not know the name of the author of the Gita.

স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রাচীনকালের সব গ্রন্থেরই রচয়িতার নাম অজ্ঞাত। তবে গীতার ক্ষেত্রে রচয়িতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে মহর্ষি ব্যাসকে। ইনিই মহাভারতের সংকলয়িতা।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রারম্ভে কৃষ্ণ যে সারথির ভূমিকা পালন করেছেন আর অর্জুনকে যুদ্ধরত করার জন্য কৃষ্ণের উপদেশামৃত দান লেখক এটিকে রূপকাশ্রয়ী বলে মনে করেছেন :

Every individual is a pupil, an aspirant for perfection, a seeker of god and if he seeks earnestly for perfection, with faith, God the goal becomes God the guide. It is of little moment, so far as the validity of the teaching is concerned, whether the author is a figure of history or the very God descended into man, for the realities of spirit are the same now as they were thousands of years ago and differences of race and nationality do not affect then. The essential thing is truth or significance.১৭

রাধাকৃষ্ণন এই সত্যের সন্ধান করেছেন গীতা থেকে।

শ্রীমদ্ভগবদগীতাঅনিলবরণ রায়

অনিলবরণ রায় (১৮৯০) অধ্যাপক, স্বাধীনতাসংগ্রামী, কিন্তু তাঁর সেসব পরিচয়কে ছাড়িয়ে গিয়েছে ভক্ত ও অধ্যাত্মজগতের মানুষ হিসাবে তাঁর পরিচিতি। শ্রীঅরবিন্দের একনিষ্ঠ শিষ্য ও ভক্ত তিনি। দীর্ঘদিন পন্ডিচেরীতে অধ্যাত্মসাধনায় যুক্ত ছিলেন। এরপর ১৯৬৩ সালে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং শ্রীঅরবিন্দের আদর্শে দেশবিভাগ দূর করে অখন্ড ভারত গঠনের সাধনায় লিপ্ত থাকেন। ১৯৭৪ সালে এই সাধক মানুষটির প্রয়াণ ঘটে।

বহু গ্রন্থের রচয়িতা অনিলবরণ রায়। শ্রীঅবরিন্দের ব্যাখ্যাবলম্বনে তিনি ইংরেজি, বাংলা ও ফরাসী ভাষায় গীতা সম্পাদনা করেন। এছাড়া শ্রীমা এবং শ্রীঅরবিন্দের আদর্শকে কেন্দ্র করে রচনা করেন ‘পুরুষোত্তম শ্রীঅরবিন্দ’, ‘যোগে দীক্ষা’, ‘শ্রীঅরবিন্দ ও বর্তমান জগৎ’, ‘Mother India’, ‘Songs from the soul’, ‘Sri Aurobindo and the New Age’ ইত্যাদি।

অনিলবরণ রায় দুটি খন্ডে ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ (২০০০) রচনা করেন, অবশ্যই শ্রীঅরবিন্দের ব্যাখ্যা শিরোধার্য করেছেন লেখক। অরবিন্দ মন্তব্য করেছেন :

গীতার সহস্র ব্যাখ্যা হইলেও এমন সময় কখনও আসিবে না যখন নূতন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হইবে না। এমন জগৎশ্রেষ্ঠ মহামন্ডিত বা গভীর জ্ঞানী গীতার ব্যাখ্যা করিতে পারেন না যে তাঁহার ব্যাখ্যা হৃদয়ঙ্গম হইলে বলিতে পারি, হইয়াছে, ইহার পরে আর গীতার ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন, সমস্ত অর্থ বোঝা গেল।

অতএব অনিলবরণও অন্যান্য অনেকের মত শ্রীমদ্ভগবদগীতার ব্যাখ্যায় প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে এই গ্রন্থের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া আবশ্যক।

দর্শনশাস্ত্রে লেখকের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যুৎপত্তি ছিল। গীতার ব্যাখ্যায় তাঁর সেই ব্যুৎপত্তির পরিচয় যেমন মিলেছে, তেমনি তাঁর গৃহীত কাজটিতে ভিন্নতর মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

অনিলবরণ শ্রীঅরবিন্দের ব্যাখ্যাবলম্বনে শ্রীমদ্ভগবদগীতার বিস্তৃত ভাষ্য ষোল খন্ডে রচনা করেন। তাঁর ব্যাখ্যা এবং উপস্থাপনটি এমনই যে প্রতিটি খন্ডই স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে হবে।

অনিলবরণের বৈশিষ্ট্য হল তাঁর ভাষ্য আধুনিক মনন উপযোগী। বলা চলে যুগোপযোগী। আধুনিককালের নানা প্রসঙ্গ তাঁর আলোচনায় এসেছে।

প্রসঙ্গত লেখক নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন সত্য, তবু মূলতঃ অধ্যাত্মতত্ত্ব ও যোগসাধনাই আলোচিত হয়েছে। লেখক দাবী করেছেন আলোচ্য গ্রন্থ নিছক গীতার ব্যাখ্যা মাত্র নয়, এটি মানবজাতির সমগ্র অধ্যাত্ম সাধনার ব্যাখ্যা। লেখকের কৃতিত্ব তিনি পান্ডিত্যের সঙ্গে দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করে দেন নি, অধ্যাত্মপথের পথিককে যথাসম্ভব পথনির্দেশ দিয়েছেন। বস্তুতপক্ষে গীতা পাঠকে অবলম্বন করে লেখক সকল দিক থেকে অধ্যাত্মতত্ত্বেরও বিস্তৃত আলোচনা সন্নিবিষ্ট করেছেন। গীতাকে সূত্র ধরে প্রাচীন ও আধুনিক সকল দার্শনিক মতের এবং প্রাচীন ও আধুনিক সকল অধ্যাত্মসাধনার পরিচয় উপস্থিত করেছেন লেখক।

অনিলবরণ তাই বলে প্রাচীন ও আধুনিক, কিংবা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিভিন্ন মতের সংকলন প্রস্তুত করেন নি, এই সবের মধ্যে সমন্বয়েরও প্রয়াস করেছেন। তাঁর লক্ষ এক দর্শনশাস্ত্র ও এক অধ্যাত্মসাধনাকে পরিস্ফুট করা এবং সেলক্ষে তিনি সার্থকভাবেই উপনীত হতে পেরেছেন।

গীতোক্ত প্রায় প্রতিটি শব্দেরই লেখক বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে নিছক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাতেই লেখক তাঁর বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, প্রয়োজনে ক্ষেত্রবিশেষে নিজের বক্তব্যকে যুগোপযোগী করে প্রকাশ করেছেন। যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণার্জুন’ সংবাদ প্রসঙ্গে লেখক ভারতের প্রাচীন কালের শিক্ষাপদ্ধতির প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন :

বর্তমান শিক্ষালয়সমূহে ছাত্র যতটা শিখিতে ব্যস্ত নহে, গুরু তাহা অপেক্ষা শিখাইতে ব্যস্ত। ছাত্র কি শিখিতে চায়, গুরুর সেদিকে লক্ষ্য নাই, ছাত্রকে কী শিখিতে হইবে গুরুই তাহা ঠিক করেন, গুরুর উপরওয়ালারা ও গবর্ণমেণ্ট সেই শিক্ষার কোর্স, syllabus, নির্দ্ধারণ করিয়া দেন। ভারতের শিক্ষা পদ্ধতি এইরূপ ছিল না। ছাত্রকে জোর করিয়া কিছু শিখান হইত না। ছাত্রকে এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে রাখা হইত, যেখানে ছাত্রের মনে শিখিবার প্রবৃত্তি আপনা হইতেই জাগিয়া উঠিত, ছাত্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া গুরুকে নানা প্রশ্ন করিত, গুরুশিষ্যের সেইসব প্রশ্নকে অবলম্বন করিয়া তাহার সন্দেহ দূর করিয়া দিতেন।

লেখকের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এখানে পাই।

‘কুলধর্মা: সনাতনা:’র ব্যাখ্যায় লেখক বিস্তারিতভাবে কুলের প্রসঙ্গ টেনেছেন :

প্রাচীন ভারতে কুলের উপরেই ছিল সমাজের প্রতিষ্ঠা। কুল অর্থাৎ class, family, এক পূর্বপুরুষের বংশধরগণকে লইয়া একটি কুল হইত, যেমন কুরুর বংশধরগণই কুরুকুল। . . প্রত্যেক কুলের ছিল বিশিষ্ট জীবনের ধারা। তাহারই অনুসরণ করিয়া প্রত্যেক কুল স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হইয়া উঠিত। কুলের প্রকৃতিগত বংশগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিকাশসাধনের নিমিত্ত যে সকল নৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক রীতিনীতি উপযোগী বলিয়া উপলব্ধি হইত, তাহাই হইত কুলের ধর্ম। এই সকল রীতিনীতি কেবল মনগড়া আইন কানুন ছিল না, অথবা বাহির হইতে কোন বিজাতীয় শক্তি এই আইনকানুন বাঁধিয়া দিত না, কুলের জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই ধর্মও ভিতর হইতে বিকশিত হইয়া উঠিত, . . .

ক্ষেত্রবিশেষে লেখক বিরল মৌলিকত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। কমবেশি যাঁরাই গীতার ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁরাই গীতার যে শ্লোকটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন, সেটি হল ‘কর্মর্ণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’। ফলে তোমার কোনো অধিকার নেই, কেবল কর্মেই অধিকার, কিন্তু লেখক একেবারে বিপরীত কথা বলেছেন :

এইটি গীতার মহাবাক্য ত নহেই, বস্তুতঃ ইহা গীতার শিক্ষাও নহে। যাহারা অজ্ঞানী তাহাদের জন্যই গীতা জোর করিয়া বলিয়াছে যে, কর্মে তাহাদের অধিকার আছে নতুবা তাহারা কর্মে উৎসাহ হারাইয়া প্রকৃতির অধর্ম গুণ তমোগুণের কবলে পতিত হইয়া বিনষ্ট হইবে। কর্মে মানুষের অধিকার আছে এক কথা এক স্তরে সত্য, আবার কর্মে অধিকার নাই, প্রকৃতির গুণ সকলের দ্বারাই সমস্ত কর্ম সম্পাদিত হইতেছে একথা আর এক স্তরের সত্য, যাঁহারা ঊর্ধ্বের স্তরে উঠিয়াছেন, সমগ্র জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, কৃৎস্নবিৎ, তাঁহারা এই ভেদ বুঝিবেন।

লেখক গীতাকে সকল দর্শনশাস্ত্রের সার রূপে দেখেছেন। গীতা তাঁর মতে ‘যোগশাস্ত্র’, যেহেতু প্রাচীন ভারতে বিকশিত সব অধ্যাত্মসাধনার বিকাশ সেসবের সার সমন্বয় করা হয়েছে গীতাতে। তাছাড়া লেখক গীতাকে সমন্বয়মূলক শাস্ত্ররূপে দেখেছেন, যে সমন্বয়ের প্রথম সন্ধান মেলে বেদে। উপনিষদের সমন্বয় ভাবনাকে ভিত্তি করেই গীতার আত্ম-প্রকাশ, যেখানে নাকি তৎকাল প্রচলিত সব চিন্তাধারা ও সাধনপদ্ধতির যুগোপযোগী সমন্বয় সাধিত হয়েছে।

লেখকের চোখে গীতার মাহাত্ম্য ধরা পড়েছে সেইখানে, যেখানে অত্যুচ্চ অধ্যাত্ম জীবনের মধ্যেও গীতা কর্মকে স্থান দিয়েছে। লেখকের ভাষায় :

যে-সকল দার্শনিক মতবাদ অধ্যাত্মজীবনের জন্য কর্মত্যাগের উপদেশ দেয়, গীতা . . . . তাহাদের ত্রুটি সংশোধন করিয়াছে। গুণত্রয়ের বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে হইবে, কিন্তু কর্মত্যাগ করিতে হইবে না।

লেখক গীতাকে অবিমিশ্র কর্মযোগ বলে ভাবেন নি, তাঁর মনে হয়েছিল :

গীতা কর্মকে জ্ঞানের সাধন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে, ‘সর্ব্বা কর্ম্মাখিলং পার্থজ্ঞানে পরিসমাপ্যতে, . . .

লেখক মনে করেছেন :

গীতা কর্মযোগ বটে কিন্তু জ্ঞানযোগেই সেই কর্মযোগের পরিণতি এবং উভয়েই ভক্তিযোগের মধ্যে আসিয়া পরিপূর্ণ সার্থকতা লাভ করিয়াছে।

গীতা কর্মকে জ্ঞানের সাধন বলে গ্রহণ করেছে, আবার সকল কর্ম সকল জ্ঞানের পরিণতি করেছে পূর্ণ ভগবদভক্তিতে।

গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের কথা লেখক বারংবার বলেছেন :

গীতা জ্ঞান ও কর্মের যে সমন্বয় সাধন করিয়াছে, এবং ভক্তি ও ভগবানে আত্মসমর্পণের মধ্যে তাহাদের পূর্ণ সার্থকতা দেখাইয়াছে—গীতার এই নিগূঢ় সমন্বয়ের মর্ম বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ ও সাম্প্রদায়িক ভাষ্যের দ্বারা চাপা পড়িয়া গিয়াছে। কেহ জ্ঞানের উপরে, কেহ ভক্তির উপরেই বিশেষ ঝোঁক দিয়াছে, এবং সকলেই শেষ পর্যন্ত কর্মত্যাগ, সংসারত্যাগকেই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য করিয়াছে। . . . . বস্তুতঃ ইহাই গীতার প্রকৃত শিক্ষা নহে। গীতা এই সকল মতবাদ ও সাধন পন্থার সারবস্তু গ্রহণ করিয়াছে, এবং এই সবকেই ছাড়াইয়া উঠিয়া ইহাদের মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় সাধন করিয়াছে।

লেখক অর্জুনকে দেখেছেন ‘কর্মী’-রূপে, যিনি বিশ্বতত্ত্বের দার্শনিক ব্যাখ্যা শ্রবণের জন্য কৃষ্ণের শরণাপন্ন হন নি, তিনি কর্ম সম্পাদন করবেন কিন্তু তা কোন নীতি ও কোন ধর্ম অনুসারে এটাই তাঁর জিজ্ঞাসা। অর্জুন চেয়েছেন কর্মের একটা নির্দিষ্ট মানদন্ড বা standard, শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন অথচ কর্ম করতেও বলছেন, অর্জুন তাই বিভ্রান্ত। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের৪৯ সংখ্যক শ্লোকটির কথা যেখানে বুদ্ধি বা জ্ঞানকে কর্মের তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।

লেখক মনে করেছেন বাস্তবিক অর্থে জ্ঞান ও কর্মে বিরোধ নেই, দুই-ই যোগের অঙ্গ। কর্ম ও জ্ঞান এ দুটি উপায় মিলিত হয়েই মোক্ষলাভের কারণ হয়। এই ধরনের মতের পূর্ব পরিচিতি ছিল ‘জ্ঞান কর্ম সমুচ্চয়বাদ’ নামে।

আচার্য শঙ্কর তাঁর ভাষ্যে বলেছেন, জ্ঞান ও কর্ম সমুচ্চয় মোক্ষলাভের উপযোগী নয়। পরস্পর বিরোধ নিবন্ধন একই পুরুষের দ্বারা এককালে জ্ঞান ও কর্মের অনুষ্ঠান সম্ভবপর নহে।

আচার্য শঙ্কর কেবল জ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষলাভ ঘটে, বলে মনে করেছেন। কিন্তু লেখকের প্রতীতি, গীতা ঐ মত সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করে নি। জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে।

গীতার প্রথম ছয় অধ্যায়ের লক্ষ উদার বৈদান্তিক ভিত্তির ওপর সাংখ্য ও যোগ এই দুটি পথের সমন্বয় সাধন। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৃষ্ণ এই সমন্বয়ের সূত্রপাত করেছেন—কর্মের সঙ্গে বুদ্ধিযোগের সমন্বয় সাধন করা হয়েছে।

গীতায় যোগ অর্থে কর্মযোগকেই নির্দিষ্টভাবে মেনে নেওয়া হয়নি। গীতায় সাংখ্যও একপ্রকার যোগ, জ্ঞানযোগ। লেখক মনে করেন, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ মূল নীতি ও লক্ষে অভিন্ন, ভিন্নতা শুধু তাদের আরম্ভে ও প্রণালীতে। গীতায় কর্মমধ্যে জ্ঞান ও ভক্তি নিহিত আছে। কি রকম?

জ্ঞানের দ্বারা আমরা যে সত্য উপলব্ধি করি, তাহাই জীবনের কার্যে পরিণত করিতে হইবে এবং তাহার প্রেরণা হইবে ব্যক্তিগত বাসনা কামনা নহে, তাহার প্রেরণা হইবে ভগবানে ভক্তি। যাঁহাকে আমরা পরম বস্তু, পরম সত্য বলিয়া জ্ঞানের দ্বারা উপলব্ধি করিব তাঁহার নিকটে আমাদের দেহ, প্রাণ, মন, আমাদের চিন্তা, ভাব, কর্ম, আমাদের সমুদয় জীবন ভক্তিভরে নি:শেষে উৎসর্গ করিব—ইহাই গীতার যোগ। ইহার মধ্যে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি এই তিনেরই মিলন ও সামঞ্জস্য হইয়াছে।১০

কর্মমাত্রেই বন্ধন—এ ধারণা অমূলক। কেননা মুক্ত ব্যক্তিরও কর্ম আছে। গীতার শিক্ষা লেখকের মতে :

বিশ্ববিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া কর্মত্যাগের বৃথা চেষ্টা না করিয়া যাহাতে কর্মবন্ধনের কারণ না হয় সেই সাধনা করা।১১

লেখকের মতে গীতার অনন্যতা এইখানে, তা নিছক দার্শনিক তত্ত্বালোচনার গ্রন্থমাত্র নয়, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে কেমন করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মানবজীবনের বাস্তব সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব গীতা সেব্যাপারে পথ নির্দেশ করেছে : লেখক আচার্য শংকরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে তাঁর মহত্ত্বপূর্ণ স্থান। হিন্দুর পক্ষে এক মহা সঙ্কটের সময় তাঁর আবির্ভাব। বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে লোকে ভারতের অধ্যাত্মসাধনার মূল উৎস বেদ উপনিষদে আস্থা হারিয়ে ফেলছিল। আচার্য শঙ্কর অসাধারণ প্রতিভা ও কর্মশক্তি নিয়ে সেই শ্রদ্ধা আবার ফিরিয়ে আনেন। হিন্দুসমাজ নানা মত, নানা সম্প্রদায়ে শতধাবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, আচার্য শঙ্কর তাদের মধ্যে সমন্বয় এবং সামঞ্জস্য সাধন করেন।

বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করিয়া ভারতের বহুলোক জাতিভ্রষ্ট এবং হিন্দুসমাজচ্যুত হইয়া পড়িয়াছিল, শঙ্কর আবার তাহাদিগের জন্য হিন্দু সমাজের দার উন্মুক্ত করিয়া দেন . . . আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে এক সংস্কৃতির সূত্রে বাঁধিবার যে ব্যবস্থা করিয়াছিলেন তাহা আলেকজান্ডার বা চেনগীজ খাঁ কর্তৃক জগৎ জয় অপেক্ষাও বিস্ময়কর ও অধিকতর মহত্ত্বপূর্ণ। শঙ্কর ভারতীয় অধ্যাত্মসংস্কৃতিকে রক্ষা করিয়াছেন, একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না; কিন্তু তাহার পূর্ণতর বিকাশের পথে তিনি দূরতিক্রম্য বাধার সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন, ইহাও অস্বীকার করিবার উপায় নাই।১২

আজ পর্যন্ত আধ্যাত্মিকতা বলতে আমরা বুঝি গেরুয়া পরিধান, দন্ড কমন্ডলু গ্রহণ। লেখক মনে করেছেন, সামগ্রিকভাবে ভারতবাসীর কর্মবিমুখতার মূলে রয়েছে একদিকে বৌদ্ধ প্রভাব অন্যদিকে আচার্য শঙ্করের প্রভাব। শঙ্কর প্রবর্তিত মায়াবাদ ভারতবাসীকে চরম অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সংসারত্যাগ, কর্মত্যাগকেই ভারতবাসী মানবজীবনের পরম আদর্শরূপে গ্রহণ করে বসে। এই প্রেক্ষিতেই গীতার কর্মযোগের গুরুত্ব।

গীতা ইন্দ্রিয়সংযমের ওপর জোর দিয়েছে। কর্মযোগের কথা বললেও নির্বিচারে সব কর্মকে বলা হয় নি। কর্মযোগের মূল তত্ত্ব হচ্ছে কর্মে ও কর্মফলে অনাসক্তি। মাধবাচার্য এবং অন্যান্য প্রাচীন ব্যাখ্যাতাগণ কর্মযোগ বলতে বর্ণাশ্রমোচিত কর্ম বুঝিয়েছিলেন। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গীতার কর্মযোগের শিক্ষা গভীর ও সেইসঙ্গে উদার। সকল দেশ ও সকল কালের তা উপযোগী। সংসারের প্রয়োজনীয় যে কোনো কর্ম অনাসক্তভাবে সম্পাদন করাই হল কর্মযোগ। এখানে প্রশ্ন উঠবে ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে কর্ম সম্পাদন কিরূপে সম্ভব? লেখক মধুসূদন সরস্বতী প্রদত্ত দৃষ্টান্তের অবতারণা করেছেন। ফলের কামনায় লোকে আমগাছ লাগায়। কিন্তু ছায়া ও মুকুলের সুগন্ধ কামনা না করেও পায়। গীতা কামনাত্যাগকে জীবনের লক্ষ করতে বলেনি। আমরা এবারে অনিলবাবুর কয়েকটি অভিমত উদ্ধার করব—

ক. ‘বস্তুতঃ গীতায় কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগে এরূপ ভেদ করা হয় নাই। গীতার মতে শেষ পর্যন্ত কর্মযোগই হয় জ্ঞানযোগ, জ্ঞানযোগও হয় কর্মযোগ, পূর্ণ জ্ঞানের সহিত সকল কর্ম ভগবানের উদ্দেশে যজ্ঞরূপে অর্পণ করাই কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের চরম স্বরূপ।’১৩

খ. গীতার মতে জ্ঞান ও কর্ম পরস্পর সাপেক্ষ, গীতা নিষ্কাম কর্মের শিক্ষা দিয়াছে, তাহা জ্ঞানের বিরোধী নহে, জ্ঞানের দ্বারা শুদ্ধ হইয়াই কর্ম নিষ্কাম হয়, আবার নিষ্কাম কর্মের ভিতর দিয়াই জ্ঞান পূর্ণ হইয়া উঠে। এইভাবে যুগপৎ জ্ঞান ও কর্মের সাহায্যেই মানুষ পরম সিদ্ধিলাভ করে।’১৪

লক্ষণীয়, লেখক গীতায় কথিত কর্ম ও জ্ঞানের পৃথক কোনো শ্রেণীবিভাগ করেন নি। দুইকে পরস্পর সাপেক্ষ বলে মনে করেছেন।

গ. ‘গীতার মতে কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ বিরোধী নহে, একের পূর্ণতাতেই অন্যের পূর্ণতা, গীতার যে পূর্ণ-যোগ তাহা একাধারে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ।’১৫

ঘ. ‘. . . . কর্ম ও জ্ঞানের সমন্বয় করাই এখানে গীতার লক্ষ্য—প্রচলিত মতে যোগ বলিতে কর্মযোগ বুঝাইলেও, গীতা যে যোগ শিক্ষা দিয়াছে তাহাতে সাংখ্যযোগের জ্ঞানযোগ এবং যোগীদের কর্মযোগ এই দুইটিরই সমন্বয় হইয়াছে, জ্ঞান ও কর্ম পরস্পরের সহায় হইয়া পরস্পরকে সিদ্ধ করিয়া তুলিবে।’১৬

অনিলবরণ গীতার সমন্বয়ী ভাবনাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন, স্বীকারও করে নিয়েছেন। বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিষয় কিংবা পথ হিসাবে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তি আপাতভাবে যতই কেন পৃথক পৃথক মনে হোক, আসলে তিনটির একটিও অবিমিশ্র একক নয়। একের মধ্যে অন্যের সহাবস্থান। তাই কর্মযোগ শুধু কর্মযোগই নয় তা জ্ঞানযোগও। কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ব্যতীত অসম্পূর্ণ। আরও কিছুটা এগিয়ে অনিলবরণ বললেন :

গীতোক্ত পন্থা হইতেছে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির পূর্ণ সমন্বয়। গীতা কোথাও বলিয়াছে কর্মের দ্বারাই পূর্ণতম সিদ্ধি লাভ করা যায় (৩। ২০), কোথাও বলিয়াছে জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ, কারণ জ্ঞানী ভগবানের আত্মাস্বরূপ (৭। ১৮), আবার কোথাও বলিয়াছে ভক্তই শ্রেষ্ঠ যোগী (৬। ৪৭)। গীতার কোনো একটি অংশের উপর ঝোঁক দিয়া অন্যান্য অংশকে উপেক্ষা করিয়া আমরা বলিতে পারি না যে, গীতার মতে কর্মই শ্রেষ্ঠ, কিংবা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ, কিংবা ভক্তিই শ্রেষ্ঠ। . . . . শঙ্করাদির মতে গীতার যোগ হইতেছে জ্ঞানযোগ, রামানুজ প্রভৃতি বৈষ্ণবাচার্যগণের মতে গীতার যোগ ভক্তিযোগ, আবার গীতার আধুনিক ব্যাখ্যাকারগণের মতে গীতার যোগ হইতেছে প্রধানতঃ কর্মযোগ। কিন্তু গীতা এইভাবে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক মত স্থাপনের জন্য রচিত হয় নাই, গীতার মধ্যে সকল মত, সকল পন্থার অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হইয়াছে। গীতা কখনও কর্মকে, কখনও জ্ঞানকে, কখনও ভক্তিকে শ্রেষ্ঠ বলিয়াছে, তাহার কারণ সম্যকভাবে যে কোনোটিরই অনুসরণ করা হউক, তাহার মধ্যে অপর দুইটি নিহিত থাকিবেই। যিনি সমগ্র জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, সর্ববিদ, তিনি সর্বভূতের মধ্যে প্রেমময় ভগবানকে দেখিবেন, সর্বভাবে তাঁহার যোগ ও ভজনা করিবেন। কর্মের দ্বারা পূর্ণসিদ্ধি তখনই লাভ করা যায়, যখন পূর্ণজ্ঞান ও ভক্তির সহিত কর্ম ভগবানে সমর্পিত হয়। ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা ভগবানের নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারাই আমরা ভগবানের সাধর্ম্য লাভ করি, কিন্তু এইরূপ সমগ্র আত্মসমর্পণের জন্য সমগ্র জ্ঞানের প্রয়োজন।’১৭

শ্রীমদভাগবদগীতাস্বামী বীরেশ্বরানন্দ

শ্রীমদভাগবদগীতার অনুবাদক স্বামী বীরেশ্বরানন্দ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রেসিডেণ্ট। মা সারদার কাছে দীক্ষিত বীরেশ্বরানন্দ ১৯১৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে যোগ দেন। বীরেশ্বরানন্দজী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অধিকাংশ প্রত্যক্ষ শিষ্যদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। অদ্বৈত আশ্রমের তিনি ছিলেন ম্যানেজার। পরে ১৯২৭ সালে তিনি আশ্রমের প্রেসিডেণ্ট পদে বৃত হন। ১৯৩৮ সালে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহকারী সম্পাদক পদে বৃত হন। ১৯৬১ সালে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদে উন্নীত হন।

একজন বিশিষ্ট সন্ন্যাসী হওয়া ছাড়াও বীরেশ্বরানন্দজী ছিলেন একজন স্বীকৃত পন্ডিত ভাগবদগীতা ও শ্রীধর আচার্য কৃত সংস্কৃত মন্তব্যের অনুবাদ ব্যতীত ব্রহ্মসূত্র নিয়ে তাঁর পান্ডিত্যপূর্ণ কাজটিও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। সুদীর্ঘ ৮৮ বছরব্যাপী মঠ ও মিশনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন স্বামীজী।

স্বামীজী গীতার সমন্বয়ী চরিত্রের সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। নানা মত, নানা বিশ্বাসের উপস্থিতি দেখা যাবে গীতায়, আপাতভাবে নানা বৈপরীত্য ভাবনার সমাবেশ লক্ষিত হবে। অনেকে সেই কারণে বিভ্রান্তও হন—কোনটি গ্রাহ্য আর কোনটিই বা অগ্রাহ্য; দর্শনের বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটেছে, দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের উপস্থিতি কিংবা জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সাংখ্য অথবা বেদান্ত, ব্যক্তি ভগবান, নৈর্ব্যক্তিক ভগবান এ সবেরই সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।

লেখক ধর্মীয় ও মননের ক্ষেত্রে এই বিভিন্নতার কারণানুসন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন :

The Indo-Aryans were never dominated by rigidity of thought of any time in any sphere of their national life. This freedom thought helped them to evolve a synthetic outlook a spirit of seeing unity behind variety. This synthetic outlook is predominantly noticeable in the field of religion.

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী সত্যের আবিষ্কার হল, ‘That which exists is one, sages call it by various names.’ যা কিছু অবস্থান করে, যা কিছু বিদ্যমান প্রকৃতপক্ষে তা এক, ভিন্ন ভিন্ন নামে মুনিরা তাকে ডাকেন, এইমাত্র। ভারতবাসীর মগ্ন চৈতন্যেও এই সত্য অনুপ্রবিষ্ট। হিন্দুরা এরই প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মকে স্বীকার করে নিয়েছে, স্বীকার করে নিয়েছে দর্শন পদ্ধতির বিভিন্নতাকেও, এমনকি আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির বিভিন্নতাও তাই স্বীকৃত। বস্তুতঃ, ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির; নিজ নিজ মানসিকতা উপযোগী ধর্মীয় বিশ্বাস তথা দার্শনিক পদ্ধতি স্বীকার করে নেওয়াই কাম্য নতুবা মানসিকতা কিংবা বোধবুদ্ধির প্রতিকূল পথ অবলম্বন করলে সমস্ত প্রয়াস, সাধনা ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্মুখীন হয়। গীতায় আমরা এই সংস্কৃতির প্রতিফলন লক্ষ্য করি— In keeping with this spirit is the message of Sri Krishna in the ‘Bhagavad Gita’.

বীরেশ্বরানন্দজী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

If man is to progress spiritually, he must have religious ideas suited to him.

প্রসঙ্গত কৃষ্ণের বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

By whatsoever way men worship Me, even so do I accept them (for) in all ways, o Partha, men walk in my path.

গীতা মীমাংসকদের ধ্যানধারণার সমালোচক। গীতা বিশ্বাস করে না যে আনুষ্ঠানিকতা, আচারসর্বস্বতার মাধ্যমে মুক্তিলাভ সম্ভব। উপনিষদের দ্বারা প্রভাবিত গীতা ঘোষণা করে যে, একমাত্র জ্ঞানই মুক্তির পথে চালিত করে, নিছক আচার-অনুষ্ঠানাদির আয়োজনে তা সম্ভব নয়।

আলোচকের মতে ধর্ম এবং যজ্ঞ সম্পর্কে গীতায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ধর্ম নিছক আচার-সর্বস্ব মাত্র নয় যেমনটি বেদে কথিত হয়েছে। বরং জন্মসূত্রে এবং সমাজে যে স্থান অধিকার করা হয়েছে সেই নিরিখে আমাদের যা কিছু করণীয় তাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আলোচকের মতে এই দৃষ্টিতে ধর্মের এমন কোনো সংজ্ঞা হয় না যা নাকি বিশ্বজনীনভাবে সকল পরিস্থিতিতে সকলের দ্বারা গ্রাহ্য। ব্যক্তির পার্থক্যের সঙ্গে, এমনকি একই ব্যক্তির পরিবেশ-পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তার মধ্যে ব্যবধান ঘটে যায়। ঘটে যেতে বাধ্য। লক্ষ্য একটাই থাকবে :

The only criterion to fix it is to see whether a particular action takes a person God ward or not.

নির্দিষ্ট একটি কাজ সেটির সম্পাদনকারীকে ঈশ্বরাভিমুখী করল কি না সেটাই বিবেচ্য। যদি তা ইতিবাচক হয় তবে তা ধর্ম, যদি তা না হয় তবে তা অধর্ম।

আলোচক জন্মান্তরে বিশ্বাসী, তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে, মানুষ পূর্বজন্মের সংস্কার নিয়েই পরবর্তীতে জন্মগ্রহণ করে। কর্ম সম্পাদনে এই সংস্কারেরও ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রকৃতি-নির্দিষ্ট কর্মগুলি সম্পাদন করাই আমাদের কর্তব্য। লেখকের মতে Performance of one’s duties is the only way to salvation. এরপর যজ্ঞের প্রসঙ্গ। লেখক যজ্ঞের প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। দান, বাসনার নিবৃত্তিসাধন, ইন্দ্রিয়সংযম, মন্ত্রোচ্চারণ, ঈশ্বরের নামকীর্তন এসবই যজ্ঞের অন্তর্গত। গীতার অনুসরণে লেখক মন্তব্য করেছেন নি:স্বার্থভাবে মানুষ যাই করুক না কেন, তাই যজ্ঞ বলে বিবেচিত হবে :

In fact, according to the Gita, sacrifice include all acts whatsoever, done unselfishly;

প্রচলিত অর্থে যজ্ঞ হল দেবতার উদ্দেশে পূত অগ্নিতে কোন কিছুর আহুতি দান। কিন্তু লেখক বিশ্বাস করেন :

Any act done without selfishness can be regarded as an offering, and therefore all such acts are sacrifice.

যজ্ঞের যে বৈদিক ধারণা তার পরিবর্তিত রূপের প্রতি লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বৈদিক ধারণায় যজ্ঞানুষ্ঠান আচারানুষ্ঠান মাত্র, কিন্তু পরিবর্তিত অর্থে ‘action other than that done for a sacrifice’. প্রসঙ্গত লেখকের মন্তব্যটি স্মর্তব্য :

Knowledge sacrifice is superior to material sacrifices.

এই প্রেক্ষিতেই কৃষ্ণ অর্জুনকে কাজ করার জন্য বলেছেন : ধর্ম-কর্মের পর কর্তব্যের প্রসঙ্গ। কর্ম আমাদের ব্যক্তিগত বাসনা, আকাঙ্ক্ষা, অহংবোধ চরিতার্থ করে। অর্জুন যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলেন, তাঁর যুদ্ধ করার সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা ছিল যুদ্ধজয়ের খ্যাতি অর্জন, বিজয়ী রূপে স্বীকৃতি লাভ এবং সর্বোপরি একটি রাজত্ব করায়ত্ত করার অভিপ্রায়। আপাতভাবে সকলেই সন্তষ্ট হয় যদি সেতার কাজটি সন্তোষজনক ভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সুচারুভাবে হয়ত কোন কাজ সম্পন্ন করা হল, তাতে কি আধ্যাত্মিকভাবে অগ্রগতি ঘটা সম্ভব? কেননা বাসনা যুক্ত থাকলে ত’ মুক্তিলাভ ঘটবে না। বাসনাই বন্ধনের কারণ। তাই কর্তব্য হল ফললাভের আশা না করে কাজ করা—‘So the only duty we have is to work in a non-attached way and not to get ourselves identified with the work.’

স্বভাবতঃই এরপরই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কীরূপে বাসনামুক্ত হয়ে ফললাভের কোনো আশা না করে কাজ করা সম্ভব? গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকের আশ্রয় নিয়ে লেখক জ্ঞান ও কর্মের সহায়তা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। একাগ্রচিত্তে মনঃসংযোগ সহকারে যাঁরা ধ্যান করতে সক্ষম, তাঁরা জ্ঞানের পথ অবলম্বন করবেন, আর কর্মী মানুষদের কর্তব্য হল অহংমুক্ত হয়ে কর্মের পথ অবলম্বন। তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকে কৃষ্ণ বলেছেন—

জ্ঞানযোগেণ সাংখ্যানাং কর্মযোগেণ যোগিনাম।।

সাংখ্যদের জন্য জ্ঞানের পথ আর যোগীদের জন্য কর্মপথ নির্দেশিত হয়েছে।

শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানপথের সমর্থকদের সঙ্গে কর্মপথের সমর্থকদের দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কপিল সাংখ্য ও বৈদান্তিকেরা মীমাংসকদের প্রতি খড়গহস্ত। শেষ পথের সমর্থকরা যেখানে কর্ম সম্পাদনের ওপর জোর দেন, পূর্ববর্তী পথের সমর্থকরা সেখানে জোর দেন কর্মত্যাগের উপর, কেননা তা অশুভ। বলা হয় কর্মের সঙ্গে যোগ অজ্ঞানতার, সকল কর্মই ত্রুটিপূর্ণ যেমন অগ্নিমাত্রই তা ধূম্রজালকে সঙ্গী করে। তাই কর্মের মাধ্যমে মুক্তির পথে যাত্রার প্রয়াস ব্যর্থ, অর্থহীন। মুক্তিলাভের জন্য চিত্তকে বাসনামুক্ত করতে হয়, ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করতে হয়। কিন্তু কর্মপথে এর বিপরীতটাই দেখি। আমাদের মন এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে অধিকতর বৈষয়িক করে তোলে। বীরেশ্বরানন্দজীর মতে শ্রীকৃষ্ণ তাই মধ্যপন্থী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন :

Sri krishna, however, prescribes a middle path. He says that work should not be given up, but should be performed without attachment and desire for the fruit. Renunciation and performance of action both lead to liberation, for they are not different, but one.

জ্ঞান ও কর্মের পথকে এক করলেও লেখক শেষ পর্যন্ত কর্মের দিকেই ঝুঁকেছেন। তাঁর যুক্তি হল :

Of the two, however, performance is superior, because it is easier and therefore suited for the vast majority, while renunciation of action is different to attain.

মুষ্টিমেয় মানুষই জ্ঞানের পথ অবলম্বনের যোগ্য, অধিকারী। অধিকাংশই এই পথ অবলম্বনের যোগ্য নয়।

আমাদের কর্মীজীবনের লক্ষ্য হল ‘নৈষ্ক্রমণ্যকে’ আয়ত্ত করা। এটি আয়ত্ত করতে নিছক বহিরঙ্গভাবে কর্ম ত্যাগ করলেই কিংবা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর চিন্তা করলেই হয় না। এরূপ চিন্তাও কর্ম পর্যায়ভুক্ত এবং বন্ধনক্ষমতা সম্পন্ন। বন্ধনের দুটি প্রধান উপাদান হল বাসনা এবং অনুরক্তি। সম্পূর্ণরূপে কর্ম ত্যাগ করাও একদিকে অসম্ভব। কৃষ্ণ তাই অর্জুনকে পরামর্শ দিলেন যোগে মগ্ন হয়ে সৈনিকের কর্তব্যকর্ম পালনে। যোগমগ্ন ব্যক্তি কর্ম সম্পাদনের সময়ে নিজেকে বিশেষ কর্মের সম্পাদনকারী বলে ভাবেন না, ফলতঃ :

work then loses its binding effect and becomes equal to no-work.১০

এমন ব্যক্তিকে ভাল-মন্দ, কিংবা আনন্দ-দুঃখ পীড়িত করে না। সকল অবস্থাতেই তিনি একইরূপ থাকেন। এই যে অবস্থা এরই নাম ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ অবস্থা। অহংবোধমুক্ত হয়ে কর্ম সম্পাদনের অভ্যাস চালিয়ে যেতে হয়।

আলোচক এই প্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্তে এসেছেন, গীতার জ্ঞান ও কর্ম একে অন্যের প্রতিকূলতা করেনি, দুই পৃথক বলেও উপস্থাপিত হয় নি :

Knowledge and action are harmonized thereby, and the statement that knowledge (Sankhya) and action (yoga) are not different, but one, is justified by this explanation.১১

দুই পথেই একই রূপ পরিণতি প্রাপ্তি ঘটে কোনো পার্থক্য থাকে না :

The result attained is also identical, for that which is gained by knowledge, viz, everlasting peace, is also attained by the man of selfless action.১২

গীতার বাণীতেও কথিত হয়েছে—

যুক্তঃ কর্মফলং ত্যা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম। অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে।। ৫/১২

বীরেশ্বরানন্দজীর মতে গীতায় জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে। কোনো বিশেষ একটি যোগকে প্রশ্রয় অথবা সমর্থন করা হয় নি। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি বলেন :

The Gita thus asks us to perform our duties disinterestedly, combining the subjective attitude of the man of knowledge with outward action, that is to say, having an attitude of mind towards the performance of duties which is similar to that of a man of self-realization with respect to the normal functions of the body like seeing, hearing, smelling, eating and sleeping (i.e., being free from the idea of agency), knowledge and action are harmonized thereby, and the statement that knowledge (Samkhya) and action (yoga) are not different, but one, is justified by this explanation.১৩

দুটি ক্ষেত্রেরই লব্ধ পরিণাম এক, অভিন্ন, তা হল ‘everlasting peace’ চিরস্থায়ী শান্তি। ‘জ্ঞানযোগে’ও শেষ পর্যন্ত লাভ হয় শান্তি, কর্মযোগেও তাই। বীরেশ্বরানন্দজী একদিকে জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগের সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন যেমন, দুটি ক্ষেত্রের লব্ধ পরিণামের অভিন্নতাকেও প্রত্যক্ষ করেছেন, অন্যদিকে কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগের মধ্যেও এক ধরনের সমন্বয়ের সন্ধান পেয়েছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে ভক্তিযোগের কিছু স্বাতন্ত্র্য আছে। ফললাভের আশা ব্যতিরেকেই যে কর্ম সম্পাদন, সেক্ষেত্রে কর্ম সম্পাদনকারীর ঈশ্বরে বিশ্বাস সর্বদা প্রয়োজনীয় নয়। কর্ম সম্পাদনকারীর এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দের কোনো দেবতাকে (personal god) বিশ্বাস করলেই চলে, এই বিশ্বাসে আসক্তিহীনতায় পৌঁছানো সহজতর হয়। এক্ষেত্রে কর্মসম্পাদনকারী কর্মসম্পাদনকেই ঈশ্বর আরাধনা বলে গণ্য করেন, শুধু তাই নয়, সম্পাদিত বা অনুষ্ঠিত কর্ম নি:সৃত ফলকেও ঐ দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করেন। এ পথ তাই তুলনামূলকভাবে সহজতর :

Thus there is a much easier path suited to those who possess some faith and devotion.

বীরেশ্বরানন্দজী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন অষ্টাদশ অধ্যায়ের৪৬ সংখ্যক শ্লোকটির কথা, যেখানে বলা হয়েছে—

যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্বমিদং ততম। স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ।। ৪৬

স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দ্বাদশ অধ্যায়ের দশম শ্লোকটির কথা—

অভ্যাসেহপ্যসমর্থোএসি মৎকর্মপরমো ভব। মদর্থমপি কর্মাণি কুর্বন সিদ্ধিমবাপ্সসি।। ১০

আরও বললেন পঞ্চম অধ্যায়ের দশম শ্লোকের কথা—

ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যা করোতি যঃ। লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।। ১০

স্মরণ করিয়েছেন অষ্টাদশ অধ্যায়ের৭৩ সংখ্যক শ্লোকটির কথাও—

নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত। স্থিতোএস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।। ৭৩

বীরেশ্বরানন্দজীর মন্তব্য :

Worshipping Him through one’s own duties by performing work for the Lord, and by dedicating it to Him, one attains liberation.

তিনি আরও বললেন :

Here we have a beautiful synthesis of action and devotion . . . .১৪

বীরেশ্বরানন্দজী গীতায় জ্ঞান ও কর্ম কিংবা ভক্তি ও কর্মের সমন্বয় ব্যতীত সাংখ্যের দ্বৈতবাদের সঙ্গে উপনিষদের অদ্বৈতবাদের সমন্বয়ও লক্ষ্য করেছেন। ঈশ্বরের তুলনায় বড় কিছু আর হয় না। সূক্তকে আশ্রয় করে যেমন মুক্ত থাকে, তেমনি দৃষ্টিগ্রাহ্য এই বিশ্বপ্রকৃতিও ঈশ্বরকে আশ্রয় করে আছে। প্রকৃতি হল বিশ্বের জননী, অপরদিকে ঈশ্বর হলেন পিতা। প্রকৃতির আশ্রয়েই ঈশ্বরের জন্ম, ঈশ্বরের আত্মপ্রকাশ। প্রকৃতি তাই অবিমিশ্র বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তা ঈশ্বরেই অবস্থিত। গীতায় আমরা ব্যক্তি সত্তার বহুত্বকে লাভ করি, যেগুলি আবার ঈশ্বরেরই অংশ। যথার্থ অথবা আপাত বাস্তব যাই হোক না কেন, একমাত্র সর্বোচ্চ ক্ষমতা হল পুরুষের। প্রকৃতির ক্রিয়াকর্মাদির দ্রষ্টা, সমর্থক এবং তার সর্ববিধ কর্মাদির অনুমোদক। প্রকৃতির প্রভু। অতএব প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন অথবা স্বতন্ত্র কিছু নয়। প্রকৃতির মাধ্যমেই সৃষ্টির কারণরূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে পুরুষের। একমাত্র বাস্তব হল এই সর্বোত্তম ঈশ্বর, এঁকে সঠিক ভাবে জেনে তবেই তাঁর মধ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব। মুক্তি তাই প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যেকার পার্থক্যমাত্র নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে তার মেলবন্ধনও। এভাবেই দ্বৈত-অদ্বৈতের সমন্বয় ব্যাখ্যাত হয়েছে।

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, বীরেশ্বরানন্দজী অন্যান্যদের মত তিনটি নয়, চারটি পক্ষের উল্লেখ করেছেন জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তৎসহ ধ্যান বা তপস্যা :

The Gita, though it recognizes the efficacy of each path each of these paths to lead the soul to freedom; yet recommends and harmonizes combination of all four paths. . . . the path of selfless action combined in the first place with knowledge; for the aspirant has to perform work externally, . . . He is to work established in Yoga, with an even mind, and this equanimity is not possible till one’s mind is free from the distractions of the senses and desires. The senses have to be controlled if one is to practise selfless action efficiently.

কিন্তু এই মানসিক অবস্থা কোনমতেই লাভ করা সম্ভব নয় ধ্যানযোগ ছাড়া। ঈশ্বরের ধ্যানের কথা বলা হয়েছে :

Thus with action are combined knowledge, meditation and devotion. Similarly, devotion, in its paths, is combined with the other three.

ঈশ্বরের প্রকৃতি ও তাঁর গরিমা উভয় সম্পর্কেই ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়, কেননা ভক্তিযোগে উপনীত হওয়া তারপরই সম্ভব। বলা হয়েছে ঈশ্বরের উদ্দেশেই সকল কর্ম ত্যাগ করতে হবে। এমনকি কর্মের মাধ্যমেই ঈশ্বরারাধনা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাই Devotion are combined knowledge, action and meditation. জ্ঞানের পথে ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তির মুক্ত সত্তার মধ্যেকার পার্থক্যই প্রধান। বস্তু বাস্তব এই ধারণা ত্যাগ করা চাই। ব্যক্তি- সত্তাই একমাত্র সত্য বাকি সব ভ্রম সৃষ্টিকারী। কর্ম করতে হবে, কখনই তা ত্যাগ করা যাবে না। কিন্তু কর্ম সম্পাদন করতে হবে ফলাফলের দিকে নজর না রেখেই। কর্ম আমাদের উন্নয়ন ঘটায়, উন্নীত করে ‘তম’ থেকে ‘রজে’র পর্যায়ে, তা থেকে ‘সত্ত্বে’। এটা সম্ভব তখনই যখনই সম্পূর্ণ জ্ঞান হয়।

‘Thus with knowledge are combined meditation, action and devotion, though knowledge is the main note in this symphony.’১৫

গীতার দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক জীবন জৈবিক সম্পূর্ণতা (organic whole), ‘and recommends a harmonious blending of the four yogas, which would result in an all round development of the human personality.’১৬

গীতা-প্রবচনবিনোবা ভাবে

বিনোবা ভাবে রচিত ‘গীতা-প্রবচন গ্রন্থটি মূল মারাঠি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন বীরেন্দ্রনাথ গুহ ১৯৫৫ সালে। গ্রন্থটি অষ্টাদশ অধ্যায়ে সমাপ্ত। তিনি অনুবাদে হিন্দীর সহায়তা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে লেখক বলছেন :

অধিকাংশ সময় আমি গীতার আবহাওয়ায় থাকি। গীতা আমার প্রাণতত্ত্ব।

বিনোবার মতে :

সমগ্র মহাভারতের নবনীত মন্থন করিয়া ব্যাসদেব ভগবদ গীতায় রাখিয়া দিয়াছেন। তাঁর আরও অভিমত, গীতা ব্যাসদেবের মুখ্য শিক্ষা ও তাঁহার চিন্তার সার সঞ্চয়। . . . . গীতা উপনিষদের উপনিষদ। সকল উপনিষদ দোহন করিয়া গীতারূপী এই দুগ্ধ ভগবান অর্জুনকে নিমিত্ত করিয়া পৃথিবীকে দিয়াছেন। জীবন- বিকাশের পক্ষে আবশ্যক প্রায় সমস্ত বিচার গীতায় স্থান পাইয়াছে। . . . . গীতা হিন্দুধর্মের মুখ্য গ্রন্থ।

বিনোবা বিশ্বাস করেন :

অর্জুনকে উত্তেজিত করার জন্য ক্লৈব্যের আরোপ স্বয়ং কৃষ্ণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার সেই শর ব্যর্থ গেল বলিয়া অপর বিষয় অবলম্বন করিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা তাঁহাকে করিতে হইয়াছিল। অতএব ক্লৈব্য নিরসন রূপ সহজ তাৎপর্য . . . গীতার নয়, ইহা সুনিশ্চিত।

. . . . গীতার উপক্রম ও উপসংহারে মিলাইয়া দেখিলে মোহ নিরসনই যে গীতার ফলিত ইহা স্পষ্ট বুঝা যায়। কেবল গীতাই নহে, সারা মহাভারতের ইহাই উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক গীতার শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ভগবান জীবনের সিদ্ধান্তসমূহের নির্দেশ করিয়াছেন, কিন্তু কেবল সিদ্ধান্ত নির্দেশ করিলে কাজ পূর্ণ হয় না। গীতায় বর্ণিত এইসব সিদ্ধান্ত উপনিষদ ও স্মৃতিসমূহে পূর্ব হইতেই ছিল। গীতা এইসব পুনরায় উপস্থিত করিয়াছে—এখানে গীতার অপূর্বতা নহে, এই সকল সিদ্ধান্ত কিভাবে আচরণ করা যায় সেই পথ গীতা দেখাইয়াছে, আর এইখানেই গীতার অপূর্বতা।’

কর্মযোগের কথা মূলতঃ আলোচিত হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে, কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়েই কর্মযোগের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত। বিনোবার মতে লোকে কর্ম করে কেন—দ্বিবিধ কারণে নিজের কর্মের ফল ভোগ করা, তাতে তার অধিকার। দ্বিতীয়ত, এর বিপরীতটি হল এই ফল ভোগ করতেই যদি না পেলাম তবে কর্ম করা কেন? এর সঙ্গে বিনোবা তৃতীয় এক ভাব বা বৃত্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন :

কর্ম অবশ্যই করবে, কিন্তু ফলে তোমার অধিকার একথা মনে করো না। কর্ম যে করে ফলে অবশ্যই তার অধিকার আছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় সেই অধিকার তুমি ছেড়ে দাও।

রজোগুণের মতে, নিতে হলে ফলসমেত নেব। তমোগুণের মতে, ছাড়তে হলে কর্মসহ ছাড়ব। গীতার পরামর্শ অনুযায়ী :

এই দুইয়ের ঊর্ধ্বে উঠিয়া তুমি শুদ্ধসত্ত্ব গুণী হও—অর্থাৎ কর্ম কর, কিন্তু ফল ছাড়। আর ফল ছাড়িয়া কর্ম কর। আগে বা পাছে ফলের আশা রাখিও না।

বিনোবা যোগ করেছেন, গীতায় শুধু নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়নি, সেইসঙ্গে উত্তমরূপে ও দক্ষতাসহ কর্ম সম্পাদনের কথাও বলা হয়েছে :

সকাম পুরুষের কর্ম অপেক্ষা নিষ্কাম পুরুষের কর্ম অধিকতর ভাল হওয়া চাই।

বিনোবার ব্যাখ্যা, ফলাসক্ত ব্যক্তির সময় ও শক্তি ফলের স্বপ্ন ও চিন্তায় ব্যয়িত হয়, কিন্তু নিষ্কাম কর্মের মানুষের সেই অপব্যয় হয় না। সমস্ত শক্তি ও সময় তার কর্মেই নিয়োজিত হয়। ফলে তার কর্ম উৎকৃষ্ট না হয়ে পারে না। তিনি আরও বলেন :

কর্মফল হইতে গীতা যখন মানুষের দৃষ্টি সরাইয়া দেয় তখন গীতা ঐ উপায়ে তাহার কর্মতন্ময়তা শতগুণে বাড়াইয়া দেয়। ফল-নিরপেক্ষ লোকের কর্ম-বিষয়ক তন্ময়তা সমাধির তুল্য। . . . নিষ্কাম কর্ম নিজেই এক মহান ফল।

নিষ্কাম কর্মের দৃষ্টান্তস্বরূপ বিনোবা ‘পুন্ডলীকে’র ফল ত্যাগের কথা বলেছেন। বিনোবার মতে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের অন্তিম অষ্টাদশ শ্লোক, যেখানে স্থিতপ্রজ্ঞের গম্ভীর ও উদাত্ত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, সেখানেই সমগ্র গীতার আঠার অধ্যায়ের সার মেলে।

তৃতীয় অধ্যায়ে নিষ্কাম কর্মের গুণাবলী আলোচিত হয়েছে। সেগুলি হল—

ক. এতে শরীরযাত্রা নির্বাহ হয়, দেহ ও বুদ্ধি সতেজ থাকে। সমাজেরও কল্যাণ হয়। এ ছাড়াও চিত্তশুদ্ধিরূপ মহান ফললাভ ঘটে।

খ. সমাজ আদর্শ লাভ করে। কর্মেই কর্মযোগীর আনন্দ। তাই সেসতত কর্ম করে। তার ফলে সমাজে ছল- চাতুরী বাড়তে পায় না। কর্মযোগী স্বয়ং তৃপ্ত থাকে।

গ. কর্মযোগী নিবিষ্ট কর্ম করে ঈশ্বরে অর্পণ করে।

গীতায় ‘কর্ম’ শব্দটি কোন তাৎপর্যে ব্যবহৃত, ব্যাখ্যাত হয়েছে চতুর্থ অধ্যায়ে। বিনোবার মতে গীতায় কর্ম শব্দে স্বধর্মাচরণকে বোঝানো হয়েছে, নির্বিচারে সব কর্মকে নয়।

বিনোবা বলেন : অহিংস-অসহযোগে যেমন অসহযোগ অপেক্ষা ‘অহিংস’ বিশেষণেরই গুরুত্ব, তেমনি ‘নিষ্কাম-কর্ম’ শব্দবন্ধে কর্ম অপেক্ষা নিষ্কামেই গুরুত্ব অধিক দেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে কর্মের সঙ্গে মনের মিলন হওয়া চাই। কর্মের সঙ্গে মনের যে সহযোগ, গীতায় তাকেই বলা হয়েছে ‘বিকর্ম’। কর্মে বিকর্ম জুড়লে হয় অকর্ম। কর্মে বিকর্ম জুড়লে ক্লান্তি থাকে না। মন তখন ধ্রুবের মত শান্ত স্থির ও তেজোময় হয়ে ওঠে। মাতার সন্তানকে প্রহার হল বিকর্মের নিদর্শন। মায়ের প্রহার নিষ্কাম। ঐ কাজে তাঁর স্বার্থ নেই।

বিকর্মের দরুন, চিত্তশুদ্ধি হেতু কর্মের কর্মত্ব উঠিয়া যায়।১০

কিন্তু মাতা যখন সন্তানকে প্রহার করেন, তখন সত্যিই কী তাঁর কোনো স্বার্থ থাকে না, সন্তানের কুমতি দূর হোক, সন্তানের মন্দ আচরণ সংশোধিত হোক, সন্তান ঈপ্সিত পথে চলুক, এ কামনা কি যুক্ত থাকে না? সন্তান অন্যায় কর্মে যুক্ত থাকলে সেই সুবাদে মারও যে কলঙ্কিত হবার সম্ভাবনা। তাই সেই সম্ভাবনাকে তিরোহিত করতেও তাঁকে শাসন করতে হয়। অতএব মাতৃ শাসন একেবারে স্বার্থশূন্য নয়।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক বলেছেন :

গীতা-গ্রন্থ সর্বসাধারণ ব্যবহারিক লোকের জন্য তিলকের একথা আমি ঠিক মনে করি। ভগবদ গীতা সমস্ত সংসারের জন্য। . . . . ব্যবহার কিরূপে শুদ্ধ করা যায় তারই জন্য গীতা। তুমি যখনই কোন আচরণ কর তখনই গীতা আসিয়া যায়। কিন্তু গীতা সেখানেই তোমাকে রাখিতে চাহে না। তোমার হাত ধরিয়া গীতা তোমাকে অন্তিম গন্তব্যে লইয়া যাইবে।১১

নবম অধ্যায়ে লেখক কর্মযোগ ও ভক্তিযোগের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর মতে নবম অধ্যায়ে কর্মযোগ ও ভক্তিযোগের মধুর মিলন ঘটেছে। কর্মযোগের অর্থ :

কর্ম করিবে ও ফল ত্যাগ করিবে। এইভাবে কর্ম করিবে যে ফলের বাসনা চিত্ত স্পর্শ না করে। তাহা যেন আখরোটের গাছ বসানো। আখরোট গাছে পঁচিশ বৎসরে ফল ধরে। যে লাগায় তার ভাগ্যে ফল খাওয়া ঘটে না। . . . . কর্মযোগ মাত্রেই গাছ লাগানো, আর ফলের প্রত্যাশা না রাখা।

ভক্তিযোগ মানে কী?

ভাবপূর্বক ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হইয়া যাওয়া। কর্ম ত’ করিতে হইবেই, কিন্তু ফল ত্যাগ করা নয়। তাহা ঈশ্বরে অর্পণ করিতে হইবে। ফল ত্যাগ কর বলিতে ফলের নিষেধ বোঝায়। অর্পণে তাহা নাই। ফল ত্যাগের অর্থ এই নয় যে কেহই ফল লইবে না। কেহ না কেহ তাহা নিশ্চয়ই লইবে। কেন না কেহ তাহা নিশ্চয়ই পাইবে। যাহা করিতেছি তাহা পরমেশ্বরের কাজ এই ভাবনা হইতে যে কাজই করি না কেন তাহা সামান্য হইলেও পবিত্র হইয়া যায়। ইহা অনুভবসিদ্ধ কথা।

অর্থাৎ এক্ষেত্রে তিনি কয়েকটি নূতন বক্তব্যের সংযোজন ঘটিয়েছেন। কর্ম মাত্রেরই ফল হয়। যিনি কর্ম সম্পাদন করেন, তিনি তার ফলভোগী না হলেও অন্যে হয়। নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে লেখক ভক্তি-ভাবনাকেও যুক্ত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম কখনই ভগবৎ-চিন্তা বিমুক্ত নয়। পরমেশ্বরের কাজ—এই চিন্তাতেই কাজ করা। বিনোবা কোনো কোনো অধ্যায়ের নূতন নামকরণও করেছেন। যেমন সপ্তম অধ্যায়কে বলেছেন ‘প্রপত্তি যোগ’। এ হল ঈশ্বরের শরণ নেওয়ার প্রেরণাদায়ী যোগ। অষ্টম অধ্যায়কে বলেছেন ‘সাতত্য যোগ’। বলেছেন :

আমি আমার উপযোগী নাম দিতেছি। সাতত্য যোগ মানে অন্তিম দিন পর্যন্ত নিজ সাধনা সতত চালু রাখা।

নামকরণের মধ্য দিয়ে লেখকের নূতন ধ্যানধারণার পরিচয় লভ্য।

ভক্তি (সপ্তম অধ্যায়) প্রসঙ্গে বিনোবার বক্তব্য :

ভগবানের স্মরণকারী পাগল জীব বিশ্ববন্দ্য হইয়া থাকে।১২ নিমিত্ত যাহাই হোক, ভক্তিমন্দিরে যাও ত’। প্রথমে যদি কামনা লইয়াও যাও, ত’ পরে নিষ্কাম হইয়া যাইবে।১৩

বিনোবা বলেছেন : যে কোন সাধনের পক্ষে ভক্তি আবশ্যক। ভক্তি এক সার্বভৌম সাধন।১৪

‘সেই পরমেশ্বরকে বুঝিবার এক মহান সাধন, এক মহান বিকর্ম নির্দেশ করার জন্য সপ্তম অধ্যায়ে গীতা ভক্তিরূপ ভবন খুলিয়া দিয়াছে।’ চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত যজ্ঞ, দান, জপতপ, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি বহু বিকর্মের কথা বলা হয়। এইসব সাধনাকে বিনোবা সোডা, সাবান, রিঠার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

‘কিন্তু ভক্তি হইতেছে জল। সোডা, সাবান, রিঠা পরিষ্কার করে, কিন্তু জল ছাড়া এ সকলের চলে না। জল বিনা উহারা কে কাজে আসিবে? কিন্তু সোডা, সাবান, রিঠা না হইলেও কেবল জলই পরিষ্কার করিতে পারে।১৫

শেষ পর্যন্ত লেখক ভক্তির উপরেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মূলতঃ ভক্তিভাবনার দ্বারা চালিত হয়েই তাঁকে গীতার ব্যাখ্যা করতে দেখা গেছে যদিও গ্রন্থের বৃহদংশে নিষ্কাম কর্মের আলোচনা স্থান পেয়েছে।

জ্ঞানের প্রসঙ্গে বিনোবা বলেন :

এক সময়ে জ্ঞানের উপর আমার অধিক ভর ছিল। কিন্তু এখন আমার অনুভব হইয়াছে যে, কেবল জ্ঞান দ্বারা আমার কাজ চলিবে না। যদিও স্থূল ময়লা জ্ঞানে পুড়িয়া ছাই হয়। কিন্তু সূক্ষ্ম ময়লা দূর করার শক্তি জ্ঞানে নাই। স্বাবলম্বন, বিচার, বিবেক, অভ্যাস, বৈরাগ্য—এ সকল সাধনের আশ্রয় লওয়া সত্ত্বেও মনের সূক্ষ্ম ময়লা মুছিয়া ফেলা যাইবে না। ভক্তির জল ছাড়া এই ময়লা ধোয়া যায় না। এই শক্তি ভক্তি-জলে আছে। . . . . পরমাত্মাতে আশ্রয় লওয়া ব্যতীত চিত্তের ময়লা নষ্ট হইবার নয়।১৬

অর্থাৎ জ্ঞানের ওপরে ভক্তিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে বলা হল :

. . . আমি বলিতে চাই যে, এই মাটির পুতুলে শুদ্ধ জ্ঞান হওয়া কঠিন। এই দেহ পিঞ্জরে উৎপন্ন জ্ঞান সেযতই শুদ্ধরূপ হোক না কেন, তবুও কিছুটা অপূর্ণ ত থাকিবেই। দেহে উৎপন্ন জ্ঞানের শক্তি সীমাবদ্ধ হইবেই। জ্ঞানের উদয় হইলে সকল ময়লা ভস্ম করিয়া ফেলার শক্তি জ্ঞানে আছে। কিন্তু এই বিকারী দেহস্থিত যে জ্ঞান তার তেজ কম। তাই তাহা দ্বারা সূক্ষ্ম ময়লা দূর করা যায় না। ভক্তির আশ্রয় লওয়া ছাড়া সূক্ষ্ম ময়লা সাফ করার উপায় নাই। তাই ভক্তিতে মানুষ অধিক সুরক্ষিত।১৭

শুধু কর্মযোগ নয়, বিনোবা জোর দিয়েছেন ‘স্বধর্মাচরণরূপ কর্মযোগে’। বলেছেন :

উত্তমরূপে করিয়া তার ফল ত্যাগ করিবে একথা বলিতে সহজ, শুনিতে সহজ কিন্তু আচরণ করা কঠিন।

বিনোবা সাধারণ মানুষকে গীতার আদর্শ বোঝাতে রচনা করেন গীতা-প্রবচন। মূলতঃ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে করা তাঁর আলোচনা। গীতার শ্লোক ধরে ধরে আলোচনা বা ব্যাখ্যা করার কোনো অবকাশ ছিল না তাঁর। স্বভাবতই দার্শনিকতা কিংবা তাত্ত্বিকতাকে সম্ভবমত এড়িয়ে গিয়েছেন। গীতার আদর্শকে বোধগম্য করাতে প্রচুর পরিমাণে দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। সেসব দৃষ্টান্ত পরিচিত অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে সংগৃহীত। বিনোবা তাঁর আলোচনার পূর্বসূরী রূপে একমাত্র তিলকের উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষে বিনোবার রচনার বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা সংক্ষেপে নির্দেশ করব। গ্রন্থটি মূলে মারাঠি ভাষায় রচিত। তা থেকে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গ্রন্থটি অনূদিত হয়। তাঁর—

১. লেখনশৈলী লৌকিক, শাস্ত্রীয় নয়।

২. আলোচনা পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট।

৩. গ্রন্থে সকল জ্ঞানোপযোগী পরমার্থের সহজ সুগম বিচার রয়েছে।

৪. গীতায় প্রাকৃতিক, নৈতিক ও সাধনিক তিন প্রকারের বিবেচনা রয়েছে। প্রাকৃতিক বিচারে না গিয়ে লেখক মুখ্যত নৈতিক ও সাধনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন।

ভারতের বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থটির অনুবাদ হয়েছে। এতেই গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নি:সংশয়ে প্রমাণিত বলা চলে। বিনোবা কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির আলোচনা করেছেন। তুলনামূলকভাবে কর্মের আলোচনাই সর্বাধিক, তারপরে ভক্তির, সব থেকে কম আলোচনা জ্ঞানের। তিনের আলোচনা করলেও সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন ভক্তিকে, এমনকি কর্ম ও জ্ঞানযোগও ভক্তিশূন্য নয়।

. . . .কর্মে যে ভক্তি মিলাইতে হয় তাহা আমরা এ পর্যন্ত দেখিয়াছি। কিন্তু তাহাতে জ্ঞানের পর্বও আবশ্যক। তাহা ছাড়া গীতার সন্তোষ নাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই তিন বস্তু ভিন্ন ভিন্ন। বলার প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করি এই মাত্র। কর্ম মানেই ভক্তি। ভক্তি কিছু আলাদা আনিয়া মিশাইতে হয় না। জ্ঞানের সম্বন্ধেও সেই কথা। এই জ্ঞান লাভের উপায়? গীতা বলে, সর্বত্র পুরুষদর্শন দ্বারা এ জ্ঞান মেলে।১৮

গীতার আদর্শ, উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিনোবার স্পষ্ট মূল্যায়ন :

গীতা চাহে আমাদের প্রত্যেক কৃতি ভক্তিময় হোক। . . . . সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কিছু কর্ম করি সেসবই ভগবানের পূজার নিমিত্ত করা চাই। নাইতে, খাইতে, ঝাড়ু দিতে তাঁহাকে স্মরণ করা চাই। . . . . আমাদের সমস্ত কর্মপূজা কর্ম হওয়া চাই। . . . . সকল কর্ম প্রভু-পূজা হইয়া যাক এদিকে গীতার পরম আগ্রহ।১৯

সমস্ত জীবন হরিময় হোক, পূজা রূপ হোক, গীতার ইহা ব্যাকুল আগ্রহ।২০ আমা হইতে আমিত্ব ধুইয়া ফেলিয়া আমি আমার জীবন হরিময় করিব, জীবন ভক্তিময় বানাইব একথাই গীতা বারবার বলিতেছে। সেব্য পরমাত্মা, আমি সেবক, আর সাধন রূপ এই সৃষ্টি।২১

ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তাস্বামী রঙ্গনাথানন্দ

স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ত্রয়োদশ অধ্যক্ষ। পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের কমপক্ষে ৫০টি দেশ ভ্রমণ করে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও বেদান্তের বাণী প্রচার করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় সংহতি পুরস্কার এবং ১৯৯৯-এ গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ১৭ বৎসর বয়সে তিনি রামকৃষ্ণ সঙ্গে যোগদান করেন। আধুনিক চিন্তাধারার ও চাহিদার আলোকে তিন খন্ডে তিনি গীতাভাষ্য রচনা করেন। গ্রন্থের নাম ‘Universal Message of the Bhagavad Gita’। প্রথম খন্ডটির প্রকাশকাল ২০০০। এই গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় ২০০৫-এ। অনুবাদ করেন ড. শশাঙ্কভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রঙ্গনাথানন্দজীর গীতাভাষ্যটি বাস্তবিকই অভিনব। আধুনিক চিন্তাধারার আলোকে গীতা ব্যাখ্যাত হয়েছে। গীতা নিছক ধর্মগ্রন্থ মাত্র নয়, কিংবা এ মহাগ্রন্থ বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গী হবার উপযুক্ত নয়। স্বামীজী গীতার শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগগত দিকটির ওপরেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশবিদেশের নানা মনীষীর বক্তব্য, তাঁদের চিন্তাভাবনা, সেইসঙ্গে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে গীতার ভাষ্য রচিত হওয়ায় এটিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। লেখকের মতে, ফলিত বেদান্তের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল গীতা। গীতার উদ্দেশ্য হল :

নর-নারীর অন্তরস্থ শাশ্বত আধ্যাত্মিক সত্যটিকে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা।

লেখক গীতার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বললেন :

ভারতবর্ষে আজ আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ সঠিক লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন যথার্থ একটি দর্শনের, যাতে আমরা এদেশের বিপুল পুরুষ-শক্তি ও স্ত্রী-শক্তি জাগরণ ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি। গীতায় আমরা সেই দর্শন ও সেই আধ্যাত্মিকতারই সন্ধান পাই।

গীতার সার্বজনীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক বললেন :

গীতার বাণী সর্বজনীন; তাই সেটির পৃথিবীর যে কোনো জায়গার যে কোনো মানুষের সম্বন্ধে প্রযোজ্য, যাতে সেই মানুষ তার অন্তর্নিহিত পূর্ণাঙ্গ মানবীয় সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারে।

গীতার শিক্ষা সম্পর্কে লেখকের অভিমত হল :

প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির, অভ্যুদয় ও নি:শ্রেয়স-এর মিলনই হলো গীতার মহৎ শিক্ষা।

লেখকের মতে গীতা হল বিজ্ঞান, এর লক্ষ্য হলো ‘আধ্যাত্মিক মুক্তি’।

গীতা শুধু একটি প্রাচীন গ্রন্থ নয়, তা আধুনিকও। বিশেষত আমরা যে সময়ে বাস করছি তার পক্ষে সবদিক দিয়েই গীতা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ প্রাসঙ্গিকতা সর্বকালীন। গীতার তৃতীয় অধ্যায় কর্মযোগের তাৎপর্য লেখকের কাছে ধরা দিয়েছে এইভাবে :

মানুষ কীভাবে বন্ধনমুক্ত হতে পারে, যে মুক্তিতে আছে মানুষের জন্মগত অধিকার, আর তা প্রত্যেকের অন্তরে অধিষ্ঠিত, কেবল সেজানে না কীভাবে এর বিকাশ ঘটাতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সহায়তা করছেন, আমাদের অন্তরে সদা বিদ্যমান এই মুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে। এই হলো কর্মযোগ নামক তৃতীয় অধ্যায়ের মহান বাণী।

‘কর্মদর্শন’কে লেখক ‘সর্বজনীন দর্শন’ বলে মনে করেছেন। কারণ অসংখ্য মানুষ কর্মযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েও কর্মদর্শন অনুসরণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতিলাভে সমর্থ হবে। বিশ্বের কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত সব মানুষকেই শ্রীকৃষ্ণ এই মহতী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’

সমগ্র প্রকৃতি হল মায়া আর পরমেশ্বর হলেন মায়ার অধীশ্বর। শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন মায়ার পারে, মায়ার প্রভুরূপে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে নিয়ে আমি ও আমার ভাব থেকে মুক্ত হয়ে, উদ্দেশ্যশূন্য হয়ে জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হয়ে সমস্ত কর্ম শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করতে হবে—গীতার এটিই হলো কর্মযোগ অধ্যায়ের মূল বাণী।

প্রকৃতিই আমাদের সব কাজে প্রেরণা দেয়। প্রকৃতির বিভিন্ন গুণ, সত্ত্ব, রজঃ এবং তম, তারাই সব কাজ করে, কিন্তু আমরা অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে ভেবে বসি সব আমিই করছি।

গীতায় কর্মযোগে লোকসংগ্রহের ওপর গুরুত্ব প্রদত্ত হয়েছে। এখানে ‘লোক’ হল পৃথিবীর সব মানুষ, সংগ্রহ শব্দটির অর্থ হল ‘কল্যাণ’। কর্মজগতে গভীর আধ্যাত্মিকতাসম্পন্ন হওয়া যায়, যদি লোকসংগ্রহ প্রেরণার উৎসে থাকে। আমরা সবাই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার প্রসঙ্গ রয়েছে একাদশ শ্লোকেও একই অধ্যায়ে। তাহলে দাঁড়াল এই সমগ্র জগতের হিতকামনায় কঠিন পরিশ্রম করব। লোকের সেবা করব, সাহায্য করব। ব্যক্তিগত সাফল্যের সঙ্গে লোকের সাফল্যের কথাও মনে রাখতে হবে। এভাবেই সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়।

লেখক লোকসংগ্রহের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন—কর্ম বনাম অকর্ম—এ বিষয়টি গীতায় আলোচিত হয়েছে। নৈষ্কর্ম বা কর্মহীনতার শিকার হয়েছে ভারতবাসী। কেন কাজ করব—এই চিন্তার প্রেক্ষিতে আলস্য আমাদের আচ্ছন্ন করেছে। বৈদান্তিক গ্রন্থে ‘নৈষ্কর্ম সিদ্ধি’র কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে অকর্মের পথে শ্রেয়ঃ প্রাপ্তির কথা। লেখক সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন এই বলে যে নৈষ্কর্মের তাৎপর্য যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে জাতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। বিশেষ এক আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ায় কর্মকে অকর্মে পরিণত করা চাই। তাতেই নৈষ্কর্মের ফললাভ ঘটবে কর্মের মাধ্যমে। নিছক কর্মত্যাগের দ্বারা পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব। তাই প্রথমে কর্ম করতে হবে, পরে আসবে নৈষ্কর্ম্য। নৈষ্কর্ম্যের আনন্দ করায়ত্ত হবে কর্মপ্রচেষ্টায় সমস্ত শক্তি উজাড় করে দেওয়ার মাধ্যমে। কর্মতত্ত্ব তাই নিগূঢ় জ্ঞানের বিষয়। জ্ঞানযোগ নিয়ে পৃথক কোনো আলোচনা করেন নি স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী, তবে চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচনায় গীতার বিভিন্ন শ্লোককে অবলম্বন করে জ্ঞানযোগের বিস্তারিত আলোচনা করতে তাঁকে দেখা গেছে। ১০নং শ্লোকের ‘জ্ঞানতপসা’ শব্দটির ওপর তিনি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য তপস্যার মাধ্যমে তাকে শুদ্ধ করে নেবার কথা। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন :

জ্ঞান সরাসরি তোমার কাছে আসে না। জ্ঞান এমন জিনিস নয় যে গিলে ফেললেই হলো। এর জন্য তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।১০

প্রসঙ্গত লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ক্রোধ, কামলোলুপতা, ঘৃণা এবং ভয়—এ সবের আবেগকে জ্ঞানের আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শ্রেষ্ঠ তপস্যাই হল জ্ঞান তপস্যা।

গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের অন্তর্গত ১৮শ শ্লোকটিকে লেখক সমগ্র গীতার মধ্যে ‘একটি অতি উচ্চ মার্গের চিন্তা’১১ বলে মন্তব্য করেও এটিতে পরস্পর বিরোধীমন্তব্যের সমাবেশ লক্ষ্য করেছেন,১২ তবে দৈনন্দিন জীবনের যুক্তি বিচারে এই পারস্পরিক বিরোধের অবসান রয়েছে বলেও দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা জানিয়েছেন, বলেছেন কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দেখার অধিকারী যিনি তিনিই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।

১৯শ শ্লোকে যে ‘জ্ঞানাগ্নি’র কথা বলা হয়েছে, লেখক তার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জ্ঞানের আগুন বলতে তিনি ‘আত্মজ্ঞানের, আমিই আত্মা, আমিই শুদ্ধ আত্মা’ এই বোধের আগুনকে নির্দেশ করেছেন,১৩ যে আগুনে সর্ব কর্ম পুড়ে শেষ হয়ে যায়।

২৭নং শ্লোকে যজ্ঞের উল্লেখ পাই—‘আত্মসংযমযোগাগ্নেই’, গীতার যজ্ঞ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়েছে, যজ্ঞের অনেকগুলি বিকল্পের সন্ধান লভ্য গীতাতে, কিন্তু শেষে (৩৩ সংখ্যক শ্লোক) জ্ঞান যজ্ঞকেই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছেন—

শ্রেয়ান দ্রব্যময়াদ যজ্ঞাজ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ। সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে।। ৪/৩৩

জ্ঞানযজ্ঞ বলতে এখানে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের যজ্ঞকে বোঝানো হয়েছে যাতে ইন্দ্রিয়জ উদ্দীপনাসমূহ আহুতি প্রদত্ত হয়। লেখক দু’রকম অগ্নির কথা বলেছেন প্রাসঙ্গিক ভাবে—জঠরাগ্নি এবং জ্ঞানাগ্নি। পশুর জঠরাগ্নি থাকলেও একমাত্র মানুষই জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলনের অধিকারী। কালে সমস্ত কর্ম জ্ঞানে লয়প্রাপ্ত হয়। সবই হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক জ্ঞান। লেখক বলেছেন :

তোমার যাত্রা কর্ম দিয়ে শুরু হলেও, তার সমাপ্তি ঘটবে উচ্চে, জ্ঞানে।১৪

যদি প্রশ্ন করা হয় জীবনের লক্ষ্য কী, তবে তার উত্তর হল ব্রহ্মজ্ঞান। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ব্রহ্মজ্ঞান অর্জিত হবে কিরূপে? আচার্যের কাছে উপনীত হয়ে তাঁকে প্রণিপাতের দ্বারা, বারংবার প্রশ্নের দ্বারা, সেবার দ্বারা। ৩৪নং শ্লোকে কৃষ্ণ একথাই বলেছেন। একমাত্র জ্ঞানই পারে সাধককে আধ্যাত্মিক মুক্তির বিধান দিতে।

সত্য জ্ঞানে মোহ সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। সত্যের জ্ঞান হলে অনুভূত হয় ‘সমস্ত জগৎ অবস্থান করছে তোমার, তথা অনন্ত আত্মার মধ্যে।’১৫ জ্ঞানাগ্নি সকল কর্মকে দগ্ধ করে ভস্মে পরিণত করে। অবশিষ্ট থাকে কেবল জ্ঞানই। জ্ঞানাগ্নি সমস্ত অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতাকে ভস্মসাৎ করে।

লেখক তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা এখানে দিয়েছেন। বলেছেন :

যখন জ্ঞানাগ্নি প্রজ্বলিত করবে, তখন তুমি তোমার সমস্ত মানসিক যন্ত্রণা ও চাপ সম্বন্ধে সমুচিত ব্যবস্থা নিতে পারবে। . . . কোন মন্দ ভাবনা থাকবে না, কারণ ঐ অগ্নি সবই নষ্ট করে দেবে।১৬

৩৮নং শ্লোকে বলা হয়েছে :

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মত চিত্তশুদ্ধিকর বস্তু আর ইহজগতে নেই।

লেখকের মতে :

মানব-তন্ত্রের বাকি বিষয়গুলিকে শুদ্ধ করতে পারার উপকরণ হলো একমাত্র জ্ঞান।১৭

প্রজ্বলিত জ্ঞানাগ্নি থাকার সুবাদে মানুষ প্রচুর চাপ ও যন্ত্রণা সহ্য করতে সক্ষম হয়। এরই অভাবে মানুষ বিহ্বল হয়।

গীতায় বলা হয়েছে ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং’। শ্রদ্ধা থাকলে তবেই জ্ঞানলাভ ঘটে। লেখক শ্রদ্ধার অর্থ করেছেন :

নিজের ওপর বিশ্বাস, বিশ্বের অর্থপূর্ণতার ওপর বিশ্বাস।১৮

শঙ্করাচার্য অবশ্য শ্রদ্ধা বলতে আস্তিক্য বুদ্ধিকে বুঝেছিলেন।

ভক্তিযোগ : গীতার দ্বাদশ অধ্যায়টি ভক্তিযোগ নামে চিহ্নিত, কিন্তু বিস্মৃত হলে চলবে না গীতার পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতেও শ্রীকৃষ্ণ ভক্তির পথ অবলম্বন করে ঈশ্বর আরাধনার কথা বলেছেন। অর্জুন জানতে চেয়েছিলেন যোগীশ্রেষ্ঠ কে, শ্রীকৃষ্ণ২ নং শ্লোকে সেই উত্তর দিলেন—

ময্যাবেশ্য মনো যে মাং নিত্যযুক্তা উপাসতে। শ্রদ্ধয়া পরয়োপেতাস্তে মে যুক্ততমা মতা:।। ১২/২

যাঁরা শ্রীকৃষ্ণে মন নিবিষ্ট করে পরম শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসে নিরন্তর তাঁর ভাবনায় লিপ্ত, তাঁরাই শ্রেষ্ঠ যোগী। সাধন পথ হিসাবে জ্ঞান ও ভক্তি দুইয়েরই উপযোগিতা, তবে দুইয়ে কিছু পার্থক্যও বিদ্যমান। জ্ঞানপথ সকলের জন্য নয়, কিন্তু ভক্তির পথ সকলের, তা বিশ্বজনীন। দেহাভিমানীদের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মের লক্ষ্যে উপনীত হওয়া খুবই কঠিন। নির্গুণ , নিরাকার, অবিনাশী ব্রহ্মর চিন্তার তুলনায় সগুণ ঈশ্বরের চিন্তা সহজতর। দ্বাদশ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণের বক্তব্যই হল আমিত্ববোধ তথা দেহাত্মবোধ সম্পন্ন যাঁরা তাঁদের কাছে জ্ঞানপথ কঠিন, তুলনায় ভক্তিপথ সোজা তাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ভক্তিপথের পথিক। ভক্তিপথে ঈশ্বরের আরাধনা করে আমরা জানতে পারি শরীরের মৃত্যু থাকলেও আত্মার মৃত্যু নেই। স্বরূপত আমরা জন্ম-মৃত্যুহীন। আর সেই উপলব্ধিই আমাদের সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত করে। ভক্তির অনুশীলনে ধাপে ধাপে এই আধ্যাত্মিক চেতনা তথা অধ্যাত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটে।১৯ অব্যাহতভাবে ঈশ্বরে মন স্থির করা সম্ভব না হলে অভ্যাসের দ্বারা ঈশ্বরকে পেতে চেষ্টা করা যেতে পারে। ভক্ত যে কাজই করবেন তা ঈশ্বরের জন্য—এটাই হল যথার্থ ভক্তের ভাব। সব কাজ ঈশ্বরের উদ্দেশে সমর্পণ করতে হবে।

বিভিন্ন সাধনপদ্ধতির কথা বলা হল গীতায়। বলা হয় অভ্যাসের চেয়ে জ্ঞান বড়। জ্ঞানের চাইতে ধ্যান আরো বড়, ধ্যানের মাধ্যমেই কর্মফল ত্যাগের মানসিকতা তৈরী হয়, ভক্ত তখন ভগবানের চরণে সব কর্মফল সঁপে দেন। তাহলে সাধন ক্রমটি হল এইরকম : অভ্যাস জ্ঞান ধ্যান কর্মফল ত্যাগ। সর্বোচ্চ লক্ষ্যই হল এই কর্মফল ত্যাগ। ঈশ্বরের ভক্ত জানেন তিনি তাঁর হাতের যন্ত্র মাত্র। ভক্ত যিনি তিনি হবেন সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, সুখ-দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সদাসন্তুষ্ট, সমাহিতচিত্ত, আত্মসংযত, দৃঢ় প্রত্যয়, যিনি জগৎকে উদ্বিগ্ন করেন না, আবার জগতের কোন কিছুতে উদ্বিগ্ন হন না, ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত, তিনি হবেন কর্মকুশল, পরিশ্রমী, সম্পূর্ণ অনাসক্ত, শুভাশুভ পরিত্যাগী, ভক্তিমান, বন্ধু ও শত্রু সকলের প্রতিই সমভাবাপন্ন, সম্মান কিংবা অসম্মান, উষ্ণতা ও শৈত্যে, সুখ অথবা দুঃখে অবিচলিত, প্রশংসা অথবা নিন্দায় যিনি অবিচল, সংযতবাক, যাঁর নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই, সব যাঁর স্থির। রঙ্গনাথানন্দজী জোর দিয়েছেন গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে অভিব্যক্ত ‘ধর্ম্যস’ এবং ‘অমৃতম’-এর উপর। ধর্ম্যস হল সামাজিক স্থিতি রক্ষার্থে অনুষ্ঠিত কর্ম, যা মানুষকে সুখী হতে সহায়তা করে, সমাজকে উন্নতিশীল করে। অপরদিকে ‘অমৃতম’ হল নিজের ভিতর নিহিত আত্মাকে উপলব্ধি করা। এভাবেই একই সঙ্গে সামাজিক উন্নতিবিধান এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথনির্দেশ মিলবে ভক্তিযোগ থেকে। মূলতঃ ‘প্রবৃত্তির মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটানো এবং নিবৃত্তির সাহায্যে নি:শ্রেয়স লাভ’,২০ এটিই হবে ভক্তের মূল লক্ষ্য।

শ্রীমদ্ভগবদগীতা : অনুবাদ ও ব্যাখ্যাস্বামী লোকেশ্বরানন্দ

গ্রন্থটির প্রকাশকাল ২০০৩। লোকেশ্বরানন্দজীর মতে গীতা ‘সর্বশাস্ত্রময়ী’। কারণ এতে আছে, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগ। তাঁর মতে সর্ব শাস্ত্রের সার হল গীতা। একটি উপমার আশ্রয় নিয়ে বলেছেন তিনি— উপনিষদ যদি হয় গাভী, তবে সেই গাভীর সার হল তার দুধ বা ক্ষীর। গীতা হল সেই ক্ষীর।

লোকেশ্বরানন্দজী কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তুলনামূলক ভাবে ভক্তিযোগের আলোচনা সেই পরিমাণে পাই না। পাই না যে তার কারণ গীতার নবম অধ্যায় রাজযোগের আলোচনার পরই গ্রন্থটি শেষ হয়ে গেছে, কারণ লেখকের জীবনাবসান। ভক্তিযোগের বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পান নি লেখক।

লেখকের পরামর্শ, নিষ্কামভাবে কাজ করতে হবে, ফলের আকাঙ্খা না করেই। কেননা নিষ্কাম কর্মের ফল হল চিত্তশুদ্ধি। চিত্তশুদ্ধি হলে জ্ঞান স্বতঃই প্রকাশ পায়।

তাঁর বক্তব্য হল সব অবস্থাতেই এমনভাবে কাজ করা সম্ভব যা নাকি আমাদের জ্ঞানের পথে এগিয়ে দেয়। আরও বলেছেন তিনি যে, সাধারণ মানুষ কর্মের দাস। সেই অর্থে পরাধীন। গীতাতেও বলা হয়েছে, আমরা মুহূর্তের জন্যও কাজ না করে থাকতে পারি না। প্রকৃতিই আমাদের কাজে বাধ্য করে। কাজ যখন করতেই হবে, তখন তা এমন কৌশলে করা দরকার যাতে আমরা কর্মবন্ধনে না জড়িয়ে পড়ি। অর্থাৎ কাজ যেন আমাদের না পেয়ে বসে। লেখক বলেছেন যে, গীতা আমাদের কাজের সেই কৌশল বলে দিয়েছে ফলে কাজ বন্ধনের কারণ না হয়ে বরং মুক্তির সহায়ক হয়েছে।

জ্ঞানযোগ হল নিবৃত্তি মার্গ, অপরপক্ষে কর্মযোগ হল প্রবৃত্তি মার্গ। জ্ঞান ও কর্ম দুই যোগেই ঈশ্বরলাভ সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে দুইয়ে তফাৎ আছে মনে হলেও, দুটি পথেরই মূল লক্ষ্য কিন্তু একটিই। সেটি হল চিত্তশুদ্ধি। যে জ্ঞানের অধিকারী সেজ্ঞান বিচার করে, উদ্দেশ্য চিত্তশুদ্ধি। সেসহায়তা নেয় গুরুবাক্যের ও শাস্ত্রবাক্যের। নিবৃত্তির পথের পথিক সহায়তা নেয় বিবেক, বৈরাগ্য, সংযম ও অভ্যাসের। সেবিচার করে নিত্য অনিত্যের। নিত্য হল আত্মা, অনিত্য হল অনাত্মা।

যারা প্রবৃত্তি মার্গের পথিক তারা অভ্যাস করে কর্মযোগের। এরা ঈশ্বরের জন্য কাজ করে, কাজ করে লোক- কল্যাণের জন্য। এরাও কিন্তু চিত্তশুদ্ধি লাভ করে। আমাদের মলিনতা হল ‘আমি’ ও ‘আমার’ বোধ। এই মলিনতা দূর হলে চিত্তশুদ্ধি ঘটে, চিত্তশুদ্ধিতে জ্ঞান স্বতঃই প্রকাশিত হয়। লেখক যথার্থই বলেছেন, জ্ঞানযোগের যা লক্ষ্য নিষ্কাম কর্মেরও সেই একই লক্ষ্য। লক্ষ্য হল চিত্তশুদ্ধি এবং আত্মজ্ঞান লাভ।

কর্মযোগের সঙ্গে কি জ্ঞানযোগের বিরোধ রয়েছে? লেখক এই প্রসঙ্গটির আলোচনা করে একটি সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ‘জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাম’—সাংখ্য অর্থাৎ যাঁরা চিন্তাশীল, তারা তর্কবিচারের পথ অবলম্বন করেন, যাঁদের মধ্যে সংযমের ভাব আছে, শুদ্ধ আধার যাঁদের, তাঁরাই জ্ঞানপথের অধিকারী। লেখক বলেছেন, তার অর্থ এই নয় :

যে জ্ঞানবিচার করে সেকর্ম করে না। আর যে নিষ্কাম কর্ম করে সেজ্ঞানবিচার করে না। যার যেদিকে ঝোঁক বেশী সেসেই পথ বেছে নেয়। অপরপক্ষে ‘কর্মযোগেন যোগিনাম’ যারা ততটা বিচারশীল নয়, যাদের উৎসাহ আছে, উদ্যম আছে, ভাল স্বাস্থ্য আছে, তাদের জন্য নিষ্কাম কর্মযোগ।

কর্মের দ্বারাই কর্মকে জয় করার কথা বলেছেন লেখক। কোন কর্মে চিত্তশুদ্ধি? যে কর্ম ঈশ্বরের উদ্দেশে করা হয় কিংবা লোককল্যাণের উদ্দেশ্যে করা হয়। চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন লেখক। ব্যাপারটিকে তিনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মত, কর্ম করে চিত্তশুদ্ধি হলে আত্মজ্ঞান হয়, আত্মজ্ঞান হলে কর্ম খসে পড়ে যায়। প্রচলিত ধারণায় কর্ম বন্ধনের কারণ, কিন্তু তা যথার্থ নয়। বন্ধনের কারণ হল অহঙ্কার ও আসক্তি। কর্মত্যাগের জন্য কি চেষ্টা করতে হয়? না। কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলেই জ্ঞানলাভ হয়। তখন নৈষ্কর্ম অবস্থা আপনা আপনিই তৈরি হয়।

গীতাতে বলা হয়েছে, প্রকৃতির অধীন যেহেতু তাই আমরা কেউই নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারি না। আমরা কেউই জিতেন্দ্রিয় নই। বাসনা থাকা পর্যন্ত আমরা কেউই চুপ করে থাকতে পারি না। লেখক এই প্রেক্ষিতেই কর্মযোগের ব্যাখ্যা করে বললেন :

সুতরাং কর্ম যখন করতেই হবে, তখন এমন কাজ করব যা বন্ধনের কারণ না হয়ে মুক্তির কারণ হয়। অর্থাৎ নিষ্কামভাবে কর্ম করা। একেই কর্মযোগ বলে।’

লেখক একটি অত্যন্ত জরুরী কথা বলেছেন :

জ্ঞানলাভ না হওয়া পর্যন্ত কর্মত্যাগ করা যায় না।

লেখক গীতার সমন্বয় ভাবকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁর মতে প্রকৃত কর্মযোগীর লক্ষণ হল জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন। গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৩০ সংখ্যক শ্লোকটির প্রেক্ষিতেই লেখকের এই অভিমত—

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।

নিরাশীর্নির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।। ৩/৩০

লেখকের মূল্যায়ন :

. . . কর্মযোগই ভক্তিযোগ। আবার যিনি সম্পূর্ণরূপে ‘আমি’ ‘আমার’ বোধ ত্যাগ করে আত্মাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনিই পরম জ্ঞানী। সুতরাং কর্মযোগই জ্ঞানযোগ।

নিষ্কাম কর্মকে আত্মজ্ঞান লাভের বিজ্ঞানসম্মত উপায় বলে লেখক মনে করেন।

এবারে জ্ঞানযোগের প্রসঙ্গ। কর্মযোগের লক্ষ্য হল জ্ঞান। জ্ঞানের দ্বারাই মুক্তিলাভ সম্ভব। তাই আমাদের সকলেরই লক্ষ্য হল জ্ঞানলাভ। কিন্তু এই জ্ঞানলাভ সম্ভব কিরূপে? না কর্মের দ্বারা। কী কর্ম? না নিষ্কাম কর্ম। জ্ঞান আমাদের স্বরূপ। জ্ঞান কি বাইরে অবস্থান করে? চেষ্টা করে তাকে সংগ্রহ করতে হয়। লেখক শঙ্করাচার্যের কথা এনেছেন—‘আত্মা তু সততং প্রাপ্তোসি অপ্রাপ্তবৎ ভবতি অবিদ্যয়া। তন্নাশে প্রাপ্তবৎ ভাতি স্বকন্ঠাভরণম যথা।—অর্থ হল আমার গলার হারটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। ঠাৎ দেখলাম সেটা আমার গলাতেই আছে। হারটি বরাবরই আমার গলায় ছিল। কিন্তু আমি জানতাম না। ঠিক তেমনি জ্ঞান আমার ভেতরেই আছে। চিত্তের অশুদ্ধি, মলিনতাই জ্ঞানকে ঢেকে রেখেছে। মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে।১০

জ্ঞান অবিনাশী। এর কোনো ক্ষয় নেই। জ্ঞান অপরিবর্তনীয়। জ্ঞান স্বয়ং প্রকাশ। এ হল সত্য, নিত্য ও সনাতন। জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। জ্ঞানের মধ্যে আবার শ্রেষ্ঠ হল ব্রহ্মজ্ঞান। গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৯ সংখ্যক শ্লোকে জ্ঞানকে বলা হয়েছে অগ্নি—জ্ঞানাগ্নি দগ্ধ কর্মাণং তমাহুঃ পন্ডিতং বুধা:, ‘ইমং যোগং’ বলতে জ্ঞানমিশ্র কর্মযোগকে বোঝানো হয়েছে। লেখক এখানে কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির সমন্বয় লক্ষ্য করেছেন।১১

সাধন প্রণালী নানাবিধ—দ্রব্যযজ্ঞ, তপোযজ্ঞ, যোগযজ্ঞ ইত্যাদি। অন্যান্য যজ্ঞের তুলনায় জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল যজ্ঞ। বৈদিক যাগযজ্ঞ গৌণ হয়ে পড়ল জ্ঞানমার্গের প্রভাবে। আত্মসংযম যোগ অভ্যাস করলে আত্মজ্ঞান লাভ হয়। নিষ্কামভাবে কাজ করলে সব কাজই শেষে জ্ঞানে পর্যবসিত হয়। ভারতবর্ষ জ্ঞানের উপাসনা করে। আমাদের দেবদেবীরা সকলে জ্ঞানের প্রতীক। জ্ঞান ব্যতিরেকে মুক্তি- লাভ অসম্ভব। কর্মযোগ কিংবা জ্ঞানযোগ যে পথ ধরেই মানুষ অগ্রসর হোক, শেষ পর্যন্ত জ্ঞানলাভ করতেই হয়।

গ্রন্থে মূল শ্লোক, তারপর অন্বয়, এরপর শ্লোকের সরলার্থ এবং শেষে শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রদত্ত হয়েছে। লেখকের ভাষা প্রাঞ্জল, সাবলীল এবং জটিলতামুক্ত। শ্লোকের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে প্রায়শই নানান অভিজ্ঞতা, কিংবা রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী, গিরিশচন্দ্রের জীবনী থেকে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হয়েছে। গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে ‘রাজযোগে’।

গীতায় ঈশ্বরবাদ

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

গীতায় ঈশ্বরবাদ (১৩১২) গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলি ‘সাহিত্য’ মাসিক পত্রিকায় প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত। ‘বেদান্ত ও গীতা’ নতুন অধ্যায়। গীতার কাল সম্বন্ধে লেখক কিছু বলেন নি। এমনকি গীতা মূল মহাভারতের অপরিহার্য অংশ কিনা সেআলোচনাও অনুপস্থিত।

ভূমিকায় লেখক গীতার যে বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করেছেন তা হল—

ক. গীতা সর্ব ধর্মের সার

খ. গীতার সার্বভৌমতা—কর্মী, জ্ঞানী, যোগী, ভক্ত—সকলের কাছেই গীতা তুল্য উপাদেয়।

গ. লেখকের মতে গীতা সম্বন্ধে চরম কথা এখনও বলা হয়নি, হয়ত কখন হবেও না।

ঘ. গীতার প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করতে হলে তর্ক-যুক্তির আশ্রয় নেওয়া হবে অনুচিত। শ্রদ্ধাসহকারে গীতার অর্থ মনন করতে হবে, নিবিষ্ট হয়ে এর মর্ম উপলব্ধি করতে হবে। অন্যভাবে নয়।

গ্রন্থটি একবিংশ অধ্যায়ে সমাপ্ত। তিনটি পরিশিষ্ট ক, খ, গ নামে শেষে সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

লেখক মূলতঃ তুলনামূলক পদ্ধতির অনুসরণ করেছেন। ন্যায়দর্শন, বৈশেষিকদর্শন, মীমাংসাদর্শন, সাংখ্যদর্শন, পাতঞ্জলদর্শন, বেদান্তদর্শনের মত মুখ্যদর্শনের সঙ্গে গীতার তুলনা করেছেন। সঙ্গতভাবেই লেখক মীমাংসাদর্শন, সাংখ্যদর্শন, পাতঞ্জলদর্শন, বেদান্তদর্শনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করেছেন। এছাড়াও তিনি অদ্বৈতমত, বিশিষ্টাদ্বৈতমত, জগৎ সত্য না মিথ্যা, জীব ও ব্রহ্ম, ব্রহ্মের স্বরূপ, ব্রহ্মের সাধন, ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়, ব্রহ্ম প্রাপ্তিরফল ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করেছেন।

লেখক মনে করেন গীতার রচনাকালে ষড়দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য অপরিজ্ঞাত ছিল না। তা না হলে গীতায় ষড়দর্শনের মূল প্রতিপাদ্যের প্রতিফলন ঘটত না। প্রত্যেক দর্শনের ভিত্তি হল দুঃখবাদ আর সমাপ্তি দুঃখ-নাশে। গীতাতেও দুঃখবাদকে সমর্থন করা হয়েছে। এখানেও দুঃখনাশের উপায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু দর্শনে কথিত উপায়ের সঙ্গে গীতোক্ত উপায়ের পার্থক্য বিদ্যমান। এই প্রভেদের মূল সূত্র হল ঈশ্বরবাদ। দুঃখহানির উদ্দেশ্যে যেসব উপায়ের কথা বলা হয়েছে সেসবক’টিরই কেন্দ্রস্থলে রয়েছেন ঈশ্বর। লেখক এই পার্থক্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক মীমাংসাদর্শনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দানপ্রসঙ্গে কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ডের প্রসঙ্গ এনেছেন। বেদের দুটি ভাগ—কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ড। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ ভাগ নিয়ে কর্মকান্ড, আরণ্যক আর উপনিষদ নিয়ে জ্ঞানকান্ড।

কর্মই বেদের প্রতিপাদ্য। মীমাংসা দর্শন অন্ততঃ তাই বলে। আরও বলে যে, জ্ঞানকান্ড নিরর্থক। কিন্তু জ্ঞানবাদীরা আবার কর্মকান্ডের বিরোধী। এঁরা বলেন, কর্মের দ্বারা কখনই শ্রেয়োলাভ হয় না। ‘ন কর্মণা ন প্রজয়া ধনেন, ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’—অমরত্ব লাভের উপায় কর্ম নয়, সন্তান নয়, ধন নয়, কেবল ত্যাগের দ্বারাই অমরত্ব লাভ সম্ভব। জ্ঞানবাদীদের মতে কর্মের ফল চিরস্থায়ী নয়। ভোগের দ্বারা কর্মক্ষয় হলে কর্মীর পতন অনিবার্য। কর্মের আর একটি দোষ—কর্ম বন্ধের কারণ—কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া চ প্রমুচ্যতে—জীব কর্মের দ্বারা বদ্ধ হয়, জ্ঞান দ্বারা মুক্ত হয়। পাপ-পুণ্য যে কর্মই জীব করুক না কেন, তার ফলভোগ তাকে করতে হয়—অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতং কর্ম শুভাশুভম। জ্ঞানবাদীরা তাই বলেন, কর্মের সন্ন্যাস করা উচিত অর্থাৎ সর্ববিধ কর্মত্যাগই কর্তব্য।

পঞ্চম অধ্যায়ে মীমাংসাদর্শনের সঙ্গে গীতার তুলনা প্রসঙ্গে লেখক স্বীকার করেছেন যে, গীতাতেও কর্মাসক্তির নিন্দা করা হয়েছে। কর্মবাদী মীমাংসকদের নিন্দা করে গীতায় বলা হয়েছে—

কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম।

ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।। ২/৪৩

কামাত্মা, স্বর্গপরায়ণ, ভোগ ও ঐশ্বর্যসাধক ক্রিয়াবহুল কর্মকান্ডে অনুরক্ত (এদের সংসারে আসতে হয়)।

ঈশ্বরের উদ্দেশে কৃত কর্ম ব্যতীত অন্য কর্ম বন্ধনের কারণ—‘অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে।।’ (গীতা ৫। ১২) গীতা সকাম যজ্ঞের বিরোধিতা করলেও যজ্ঞমাত্রেরই বিরোধিতা করেনি, বরং স্থানে স্থানে যজ্ঞের প্রশংসাই এতে করা হয়েছে। বলা হয়েছে—

যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম।

নায়ং লোকেহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোএন্যঃ কুরুসত্তম।। গীতা ৪/৩১

যজ্ঞহীন ব্যক্তি যে, তার না আছে ইহলোক, না আছে পরলোক। যাঁরা যজ্ঞের শেষ ভোজন করেন, তাঁরা সনাতন ব্রহ্ম লাভ করেন। দেবতারা বর্ষণের মাধ্যমে, উত্তাপ দানের মাধ্যমে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ থেকে জগতের যেমন হিত সাধন করেন, মানুষও দেবতাদের কৃত উপকারের সবটা না হলেও কিছুটা প্রত্যুপকার করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন যজ্ঞানুষ্ঠানের। যজ্ঞানুষ্ঠানে যে ফল উৎপন্ন হয়, তাতে দেবলোকের পুষ্টিসাধন হয়।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে কর্ম ও কর্মযোগের দীর্ঘ আলোচনা। গীতার বিভিন্ন শ্লোক অবলম্বনে লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন—

ক. মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত রেখে, কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মযোগের অনুষ্ঠান করেন যিনি, সেই অনাসক্ত কর্মী প্রশংসার্হ। (৩। ৭)

খ. কর্মাসক্তির মত অকর্মাসক্তিও দূষণীয়। (২। ৪৭)

গ. অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ (৩। ৮)

নিয়তং কুরু কর্ম ত্বং কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ।

ঘ. অনাসক্ত চিত্তে কর্তব্যবুদ্ধির প্রেরণায় যিনি কর্মে যুক্ত হন তাকে কর্মবন্ধনের শিকার হতে হয় না। (৬। ১)

অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ।। (গীতা ৬/১)

হীরেনবাবু মনে করেন, গীতায় কর্ম ও অকর্ম, কর্মানুষ্ঠান ও কর্মসন্ন্যাস এ দুইয়ের মধ্যে অদ্ভুত সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছে।

ঙ. ফলাকাঙক্ষা বর্জন—‘কর্মণ্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’ (গীতা ২/৪৭)

চ. কতৃত্বাভিমান ত্যাগ—

নান্যং গুণেভ্যঃ কর্তারং যদা দ্রষ্টানুপশ্যতি। গুণেভ্যশ্চ পরং বেত্তি মদ্ভাবং সোএধি গচ্ছতি।। (গীতা ১৪/১৯)

অল্পবুদ্ধিসম্পন্নরা আত্মাকে কর্তা মনে করে। কিন্তু প্রকৃতিই যথার্থ কর্তা। নিজেকে দ্রষ্টামাত্র মনে করতে হয়।

ছ. ঈশ্বরে সমস্ত কর্ম সমর্পণ। সমস্ত কর্মের ফল ঈশ্বরে অর্পণ করতে হয়। তাঁরই উদ্দেশে তাঁরই কার্য করছি— এই মানসিকতার দ্বারা জগতের হিতের জন্য কর্মের অনুষ্ঠান করতে হয়।

ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্ম চেতসা।

নিরাশীনির্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।। (গীতা ৩/৩০)

জ. অষ্টম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে জ্ঞানযোগ—সাংখ্যদর্শনের মতে জ্ঞানের ফলেই মুক্তিলাভ সম্ভব। গীতাও জ্ঞানের বিরোধী নয়, বরং জ্ঞানের প্রশংসাই লভ্য গীতাতে—

ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। (গীতা ৪/৩৮)

জ্ঞানের সমান পবিত্র আর কিছু নেই।

ঝ. নিখিল কর্মের পরিসমাপ্তি জ্ঞানে—

সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে। (গীতা ৪/৩৩) সর্বং জ্ঞান প্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি। (গীতা ৪/৩৬)

জ্ঞানরূপ ভেলার সাহায্যে পাপসমুদ্রে উত্তীর্ণ হওয়া যায়।

ঞ. প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন কাঠকে ভস্মীভূত করে, তেমনি জ্ঞানরূপ অগ্নি সমুদয় কর্মরাশিকে ভস্মীভূত করে—

জ্ঞানাগ্নি: সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা। (গীতা ৪/৩৭)

ট. জ্ঞানং লব্ধা পরাং শান্তিমচিরেণাধি গচ্ছতি। (গীতা ৪/৩৯)

জ্ঞানলাভে অচিরে পরম শান্তিলাভ ঘটে।

এখন প্রশ্ন হল গীতায় যে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে সেটা কি জ্ঞান? Knowledge না Wisdom? গীতায় বলা হয়েছে তত্ত্বজ্ঞানের কথা, যার অপর নাম পরাবিদ্যা। যে বিদ্যার দ্বারা অক্ষয় পুরুষকে লাভ করা যায় তাই হল পরাবিদ্যা। তত্ত্বজ্ঞান—তৎ এর জ্ঞান। তৎ তিনি, ‘ওঁ তৎসৎ’। সেই সচ্চিদানন্দ ভগবান। লেখকের মতে গীতা একেই জ্ঞান বলেছে। যে জ্ঞানের দ্বারা জীব সমস্ত প্রাণীকে প্রথমত আপনাতে এবং পরিশেষে ঈশ্বরে দর্শন করে—

যেন ভূতান্যশেষেণ দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি। (গীতা ৪/৩৫)

লেখক এর থেকেই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, তত্ত্বজ্ঞানীর পক্ষে ভগবদ্ভক্ত না হয়ে উপায় নেই। জ্ঞানীকে ভক্ত হতেই হয়। জ্ঞানী জ্ঞানযজ্ঞ দ্বারা ভগবানের উপাসনায় প্রবৃত্ত—

জ্ঞানযজ্ঞেন চাপ্যন্তে যজন্তো মামুপাসতে। ৯/১৫

গীতায় চার শ্রেণীর ভক্ত উল্লিখিত—আর্ত, মর্মার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী। তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়া হয়েছে জ্ঞানীকে, যিনি নাকি শ্রেষ্ঠ ভক্ত—

চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনা: সুকৃতিনোএর্জুন।

আর্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে।

প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোএত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।

উদারা: সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব সেমতম।

আস্থিতঃস হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম।। (গীতা ৭/১৬-১৮)

আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু এবং জ্ঞানী—এঁদের মধ্যে জ্ঞানীই সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ জ্ঞানীর কাছে ভগবানই প্রিয়তম বস্তু। সেজন্য ভগবানও জ্ঞানীর প্রতি প্রীতিমান। লেখক মনে করেছেন জ্ঞানী ভগবানের যেন আত্মা, কারণ তিনি ভগবানকেই পরম গতি জ্ঞানে একাগ্রচিত্তে তাঁকেই আশ্রয় করেছেন।

ভক্তিযোগ :

ক. শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে ভগবানে চিত্ত সংযুক্ত করে তাঁকে ভজনা করতে হবে—

শ্রদ্ধাবান ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ।। (৬/৪৭)

খ. সকলের মধ্যে যে ঈশ্বরকে দেখে, সকলকে ঈশ্বরে দেখেন যিনি—

যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি। (৬/৩০-৩১)

গ. মন্মনা ভব মদ ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।

মামেবৈষ্যসি যুত্ত্বৈবমআত্মানং মৎপরায়ণঃ।। (গীতা ৯/৩৪)

—ঈশ্বরে মন অর্পণ করার কথা বলা হয়েছে, তাঁকে যজনের ও ভজনের কথাও বলা হয়েছে, বলা হয়েছে প্রণাম করতে, তাঁকে সার বলে গ্রহণ করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

ঘ. তীব্র ভক্তিসহকারে ভগবানে চিত্ত অর্পণ করা চাই—

তীব্রেণ ভক্তিযোগেন মনো ময্যর্পিতং স্থিরম।। ভাগবত (৩/২৫/৪৪)

ঙ. বলা হয়েছে, ভক্তিযোগ অপেক্ষা ব্রহ্মসিদ্ধির আর কোনো শুভ পন্থা নেই—

ন যুজ্যমানয়া ভক্ত্যা ভগবত্য খিলাত্মনি।

সদৃশোহস্তি শিবপন্থা যোগানাং ব্রহ্মসিদ্ধয়ে।। ভাগবত (৩/২৫/১৯)

লেখক গীতার সমন্বয়ী চরিত্রে বিশ্বাসী ‘. . . . এই সমন্বয়বাদ গীতার নিজস্ব—শাস্ত্রের অন্যত্র এমন উজ্জ্বল- ভাবে ইহার উপদেশ দৃষ্ট হয় না।’ পরিশিষ্ট ‘খ’ (গীতার ত্রিবেণী) গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী যেমন প্রয়াগে ত্রিধারায় মিলিত তেমনি :

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে গীত-ধারা উৎসারিত করেন, ঐ গীতার পুণ্য নীরে অবগাহন করলে দেখা যায়—উহাও এক নবতর, কল্যাণতর ত্রিবেণী। কারণ, ঐ ত্রিবেণীতে তদানীং প্রচলিত কর্মমার্গ, জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গ অভূতপূর্ব সমন্বয়ে সমন্বিত হইয়া পতিতপাবনী ধারায় জগৎকে প্লাবিত করিয়া শ্রীভগবানের অভিমুখে প্রধাবিত হইয়াছে।

প্রাচীন যুগে ঋষিরা ছিলেন কর্মবাদের সমর্থক—কর্মই বেদের মুখ্য প্রতিপাদ্য। কিন্তু যাঁরা জ্ঞানবাদের সমর্থক তাঁরা এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, কর্মের ফল কেবল অচিরস্থায়ীই নয়, তা বন্ধেরও কারণ— কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ। অতএব প্রকৃত শ্রেয়োলাভের উপায় কখনই কর্ম হতে পারে না, জ্ঞান জ্ঞানাৎ মুক্তি:। লেখকের মতে, গীতা এক্ষেত্রে সমন্বয় করলেন। বলা হল অকৌশলে কর্ম করলে কর্ম বন্ধের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি এমনভাবে কর্ম সম্পাদিত হয়-কর্মও কৃত হল, অথচ কর্মজনিত বন্ধন ঘটল না। যোগঃ কর্মসু কৌশলম। লেখকের মতে, গীতায় ভগবান তিনটি সোপান অতিক্রমের কথা বলেছেন, তবেই কর্মযোগে উপনীত হওয়া সম্ভব—ফলাকাঙ্খা বর্জন, কতৃত্বাভিমান ত্যাগ এবং ঈশ্বরে সমস্ত সমর্পণ। অজ্ঞ মানুষই মনে করে জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ বুঝিবা পৃথক। কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তি তা করেন না, তিনি জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগকে অভিন্ন দেখেন। গীতায় জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগ দুটিকেই মোক্ষ কারক বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, গীতার অনুমোদিত কর্মযোগে উপনীত হতে হলে সাধককে শুধু কর্মী হলেই চলে না, জ্ঞানীও হতে হয়। প্রশ্ন, সাধক যদি জ্ঞানী না হন, তবে কতৃত্বাভিমান ত্যাগ করবেন কীরূপে? এজন্যই জ্ঞানীকে তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। এই জ্ঞানের দ্বারাই তিনি সমস্ত জীবকে প্রথমতঃ আপনাতে এবং পরিশেষে ঈশ্বরে দর্শন করেন।

এখন প্রশ্ন হল গীতোক্ত কর্মযোগে ভক্তির স্থান আছে কি? লেখক লক্ষ্য করেছেন যে, এই স্থান রয়েছে সর্ব কর্মের ঈশ্বরে সমর্পণে—

ব্রহ্মণ্যাধয় কর্মাণি সঙ্গং ত্যা করোতি যঃ।

লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।। (গীতা ৫/১০)

ভক্ত না হলে তিনি কেমন করে সমস্ত কর্ম ভগবানে অর্পণ করবেন—

সর্বকর্মাণ্যপি সদা কুর্বাণো মদ্ব্য আশ্রয়ঃ।

মৎ প্রসাদাদ বাপ্নোতি শাশ্বতং পদম ব্যয়ম।। (গীতা ১৮/৫৬)

জ্ঞান ও ভক্তির ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে গীতার শ্লোক উদ্ধার করলেন লেখক :

‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (৪। ৩৮), বলা হয়েছে, কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলা হয়েছে—‘সর্বং জ্ঞান প্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি।। (৪। ৩৬), সেই জ্ঞানের চরম ভক্তি—‘নিষ্ঠা জ্ঞানস্য যা পরা’ (গীতা ১৮। ৫০)। জ্ঞানের লক্ষণ বলতে গিয়েও গীতায় বলা হয়েছে—‘ময়ি চানন্য যোগেণ ভক্তির ব্যপ্তিচারিণী’ (১৩। ১০)। জ্ঞান কি না অচ্যুতা ভক্তি। ভক্তশ্রেষ্ঠ কে না যিনি জ্ঞানী—

সর্বভূতেষু যঃ পশ্যেদ ভগবদ ভাবমাত্মনঃ। (১১/২/৪৫)

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত এক ভক্তির্বিশিষ্যতে। (গীতা ৭/১৭)

সব ভক্তের মধ্যে জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ কারণ তিনিই কেবল ভগবানে একান্ত ভক্তিযুক্ত। এরূপ জ্ঞানী তাই যেন ভগবানের আত্মা। ভগবান তাঁর খুবই প্রিয়—

উদারা: সর্ব এবৈতে জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মতম।

আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম।। (গীতা ৭/১৮)

জ্ঞানসিদ্ধ পাঠক ভক্তির দ্বারা ভগবানকে অবগত হন। স্বরূপতঃ ভগবানকে জেনে অনন্তর ভগবানে প্রবেশ করেন—

ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ। ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম।। (গীতা ১৮। ৫৫)

গীতায় বারবার ভক্তির কথা বলা হয়েছে, ভক্তির প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্জুনকেও কৃষ্ণ উপদেশ দিয়েছেন—

মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদযাজী মাং নমস্কুরু।

মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োএসি মে।। (গীতা ১৮। ৬৪। ৬৫)

আমাতে মন অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমাকে নমস্কার কর। তাহলে আমাকে পাবে, তুমি আমার প্রিয়, সত্য প্রতিজ্ঞা করে এই কথা বলছি।

লেখকের বক্তব্য কিন্তু ভগবদ্ভক্ত যিনি, তিনি শুধু ভক্তিমান হন না, জ্ঞানীও হন, কর্মীও হন—

মৎকর্মকৃন্মৎ পরমো মদভক্তঃ সঙ্গ বর্জিতঃ। নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মামতি পান্ডব।। (১১/৫৫)

যে আমার কর্ম করে, আমি যার পরম, যে আমার ভক্ত, যে অনাসক্ত, যে সর্বভূতে বৈরহীন, সেআমাকে পায়। অনেকেই গীতায় কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তিকে সম্পর্কশূন্য মনে করেন, মনে করেন বিশেষ একটি যোগকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন :

. . . . কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি—কোন মার্গই যথেষ্ট নয়। পরমাত্মার যে চিদ ভাব—জীবের বিজ্ঞানময় কোশের সাহায্যে যে ভাবের আংশিক প্রকাশ হয়,—জ্ঞানযোগ দ্বারা তাহার সম্পূর্ণ বিকাশসাধন করিতে হইবে, পরমাত্মার যে আনন্দ ভাব জীবের আনন্দময় কোশের সাহায্যে যে ভাবের আংশিক প্রকাশ হয়—ভক্তিযোগ দ্বারা তাহার সম্পূর্ণ বিকাশসাধন করিতে হইবে, এবং পরমাত্মার যে সৎ-ভাব হিরন্ময় কোশের সাহায্যে যাহার আংশিক প্রকাশ হয়,—কর্মযোগের দ্বারা তাহার সম্পূর্ণ বিকাশসাধন করিতে হইবে। অর্থাৎ জীবকে একাধারে বীর, পীর ও ধীর (Hero, Saint and Sage) হইতে হইবে। . . . . যুগপৎ কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির উপদেশ দিয়া গীতা দেখাইয়াছেন যে, জীবের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য কেবল কর্ম, কেবল জ্ঞান, কেবল ভক্তি পর্যাপ্ত নয়। জীবকে ব্রহ্মে বিকশিত করিতে হইলে ঐ মার্গত্রয়কেই সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিতে হইবে, . . . .।

এ ভিউ অফ দি গীতা

মোরারজী দেশাই

A view of the Gita’-র লেখক ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই। এটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৭৪। গুজরাট বিদ্যাপীঠের আচার্য রূপে তিনি ১৯৭৩ সালে গুজরাটি ভাষায় গীতা নিয়ে যে ছয়টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতারই সংকলন বর্তমান গ্রন্থটি।

ভূমিকায় লেখক বলেছেন :

I have reached the conclusion that the Bhagavad Gita teaches a common religion for all mankind, which can be equally applicable and useful for all countries, societies and times. One gets full help from the Bhagavad Gita in making one’s life pure, fully active, humane and serene. (page – 2)

গান্ধীবাদী এই নেতার গীতার প্রতি আসক্তি ১৯২৫-২৬ সাল থেকেই। ১৯৩৪ সালে সমস্ত গীতাই ছিল তাঁর কন্ঠস্থ। প্রতিদিন এক বা একাধিকবার তিনি গীতা আবৃত্তি করতেন। লেখক জানিয়েছেন তাঁর ব্যক্তি জীবনে গীতার বাণী প্রয়োগের কথা এবং তার পরিণাম :

As I began to apply the teaching of the Gita to the questions of my life, my doubts began to get resolved. Today my faith in the teachings of the Gita is absolute and all doubts have disappeared. (page – 4)

গীতায় তিনটি যোগের কথা থাকলেও লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন কর্মযোগই প্রাধান্য পেয়েছে :

There is a complete educidation of the three paths in the Gita. It is however, my view that the Gita considers the path of action as the most suitable path for pursuing truth or God for Arjuna or for an ordinary being. (page – 5)

লেখক মনে করেন কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ কিংবা ভক্তিযোগ এই তিনের যে কোনো একটির সাহায্যেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো সম্ভব— পথ ভিন্ন হলেও তিনেরই লক্ষ্য এক এবং অভিন্ন— ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভ-ঈশ্বরোপলব্ধি। লেখক মানুষের এই তিনটি পথের একটিকে আশ্রয় করার ব্যাপারটিকে চমৎকার ভাবে বুঝিয়েছেন বাস্তব দৃষ্টান্তের সাহায্যে :

If any person has to go from one town to another, he can go by rail, aeroplane or by any other mode of travelling or on foot, whatever is suitable to him, he utilises. The different modes of travel used will require different amount of time for travel. Some will take more time, some will take less. There can be also easier or more difficult travel in the different modes of travelling. But the place where the person has to reach will be the same whatever may be the mode of travelling. (page-18)

কর্মযোগের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখক বললেন :

the service of the creation is the service of God, and as one serves the people, the people serve him. Therefore one gives and receives, but one does not merely receive and enjoy. (page-50)

একতরফা কোনো কিছুই হয় না। আমি অন্যের কাজে লাগলে, অন্যেও আমার কাজে লাগবে। মানুষ কেবল গ্রহণ করেনা, করবে না বিনিময়ে তাকেও কিছু দিতে হয়। দেবতার বিরামহীন সক্রিয়তা বোঝাতে লেখক প্রকৃতির কর্ম তৎপরতাকে নির্দেশ করেছেন :

the movements of nature including the sun, the moon, the earth and the universe which go on moving constantly without any exception. (page-53)

এমন কী জ্ঞানীদেরও কর্মরত হতে হয় :

even men of knowledge have to fulfil their nature and act according to it and that it will not be profitable to slap it by forcible restraint.

স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক :

A forcible abstention from action does not lead to good result, (page – 54)

অন্য পথের আকর্ষণে গৃহীত পথ ত্যাগ কখনই বাঞ্ছনীয় নয় :

one should not try to go on changing one’s path of action, being attracted or lured by another path, but one must stick to one’s path of action after having chosen it. (page – 56)

জ্ঞানযোগ সকলের জন্য নয়, তবে তা কাদের জন্য?

Jnana yoga … is only for those who have got complete disillusionment about the world and are detatched from it thoroughly. Such people give up all worldly ties, resort to solitude and give all their time, attention and energy to meditation on God. This desire replaces all other desires pursuly this paths with absolute dedication, they get the knowledge of God or Brahma. Then they serve people by giving them benefit of their knowledge and when they finish the enjoyment of their past Karmas or action they attain Moksha or freedom. (page-17)

সকল কাজই জীবকে বন্ধনে আবদ্ধ করে যদি সেই কাজের সঙ্গে বাসনা যুক্ত থাকে। কিন্তু যদি সব কিছুই ঈশ্বরে সমর্পিত হয় তবেই মুক্তি লাভ। কি ভাবে সেটা সম্ভব?

with the knowledge that the doer is the God and not oneself

অহং ধ্বংস হলে তবেই একজনের পক্ষে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ সম্ভব। আর এই সমর্পণের মাধ্যমেই মানুষের ঘটে বন্ধন মুক্তি। ভক্তিযোগের মূল কথাই হল :

a person sees God living every where with a spirit of equanimity and nothing else, he gets free from his ego and is not moved by anything, with the result that he gets Moksha (Salvation). (page-129)

.

গীতা ও রামমোহন :

১.  The social role of Gita, page – 4

২.  The social role of Gita, page – 4

৩.  Eric. J. Sharpe. The Universal Gita ; Nestern images of the Bhagavad Gita, A Bicentenary survey. La Salle, open court, 1985, page – 14

৪.  The social role of Gita, Satya P. Agarwal (1993), page – 46

৫.  The social role of Gita, Satya P. Agarwal (1993), page – 46

বঙ্কিমের দৃষ্টিতে গীতা :

১. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭৩৪

২. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬৭৬

৩. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৬

৪. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬৯৩

৫. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬৯৩

৬. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬৩৫

৭. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬৩৫

৮. শ্রীমদ্ভগবদগীতা, পৃ – ৭২৪, (২য় খন্ড; বঙ্কিম রচনাবলী)

৯. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৯

১০. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৯

১১. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৭

১২. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৮

১৩. ধর্মতত্ত্ব ; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৬২৮

১৪. শ্রীমদ্ভগবদগীতা; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭২৫

১৫. শ্রীমদ্ভগবদগীতা; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭২৫

১৬. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদগীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা, ৪র্থ অধ্যায়, ১ম খন্ড, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৫, পৃ – ৪৬৭

১৭. শ্রীমদ্ভগবদগীতা; বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭২৮

১৮. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭৫২

১৯. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; পৃ – ৭৬০

২০. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; শ্রীমদ্ভগবদগীতা; পৃ – ৭২৫

২১. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬১২

২২. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদগীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা, ৪র্থ অধ্যায়, ১ম খন্ড, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৫, পৃ – ৩৯৪

২৩. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬৩০

২৪. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২৩

২৫. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬১৫

২৬. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২১

২৭. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২২

২৮. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২৪

২৯. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২৬

৩০. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬২৭

৩১. বঙ্কিম রচনাবলী; ২য় খন্ড; ধর্মতত্ত্ব ; পৃ – ৬৩৩

গীতা রহস্য :

১.  গীতা রহস্য বাল গঙ্গাধর তিলক; প্রস্তাবনা , বঙ্গানুবাদ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৪, পৃ – ১৫

২.  গীতা রহস্য; বিষয়-প্রবেশ, বঙ্গানুবাদ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৪, পৃ – ৫৩

৩. ঐ ঐ ঐ

৪.  ঐ ঐ পৃ-৪৪৯

৫.  ঐ ঐ পৃ-২৮০

৬.  গীতা রহস্য; উপসংহার, পৃ-৪৫০

৭.  গীতা রহস্য; উপসংহার, পৃ – ৪৫০

ভক্তিযোগ / অশ্বিনীকুমার দত্ত :

১. ভক্তিযোগ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, ১২৯৪, পৃ – ৬

২. ঐ ঐ ঐ পৃ – ১৫

৩. ঐ ঐ ঐ পৃ – ২৬

দি গীতা—এ সিনথেটিক ইন্টারপ্রিটেশন:

১. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল : The Gita A Synthetic Interpretation, পৃ – ১৮

২. ঐ পৃ – ১৭

৩. ঐ পৃ – ৮

৪. ঐ পৃ – ৮

৫. ঐ পৃ – ৯

৬. ঐ পৃ – ১০

৭. ঐ পৃ – ১১

রবীন্দ্র দৃষ্টিতে ও ব্যবহারে গীতা :

১.  ‘An Artist in life’, 1967, part one; Influences, p-45

২.  পম্পা মজুমদার : রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস; ভগবদগীতা; প্রথম দে’জ সংস্করণ, ২০০৭, পৃ – ১৪১

৩.  ছিন্ন পত্রাবলী; পত্র সংখ্যা ১৬৯, রবীন্দ্র রচনাবলী; ১১শ খন্ড, পত্রটি লিখিত হবার তারিখ : ২৫ অক্টোবর, ১৮৯৪

৪.  পম্পা মজুমদার : রবীন্দ্র সংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস, ভগবদগীতা; পৃ – ১৪৩; ১ম দে’জ সংস্করণ, ২০০৭

৫.  পরিচয় : ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা; ১৩শ খন্ড; ১৩২২ বঙ্গাব্দে রচিত; পৃ – ১৫৭

৬.  জাভা-যাত্রীর পত্র, পত্র সংখ্যা ৫; জুলাই ২৮, ১৯২৭, ১০ খন্ড; পৃ – ৬১৭

৭. ঐ ঐ পৃ – ৫৭৯

৮.  পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি; ১০ম খন্ড; পৃ – ৫৮৯

৯.  জাভা-যাত্রীর পত্র, পত্র সংখ্যা ১, শ্রাবণ, ১৩৩৪

১০. ‘ইতিহাস’, ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা; ১৩১৯

স্বামীজীর বাণী ও রচনায় গীতা প্রসঙ্গ :

১. স্বামীজীর বাণী ও রচনা ; ৮ম খন্ড, পৃ – ৪১৭

২. ঐ ঐ পৃ – ৪৩৮

৩. ঐ ঐ পৃ – ৪৩০

৪. ঐ ঐ পৃ – ৪৩০

৫. ঐ ঐ পৃ – ৪২১

৬. ঐ ১ম খন্ড, পৃ – ৪৫

৭. ঐ ঐ পৃ – ৫৭৯

৮. ঐ ঐ পৃ – ৪৫

৯. বাজে কথা, বিচিত্র প্রবন্ধ; চতুর্দশ খন্ড; পৃ – ৭৩৫

১০. স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ১ম খন্ড; পৃ – ৪৭

১১. ঐ ঐ পৃ – ৫০

১২. ঐ ঐ পৃ – ৫১

১৩. ঐ ঐ পৃ – ৫১

১৪. ঐ ঐ পৃ – ৫৫

১৫. ঐ ঐ পৃ – ৫৫

১৬. ঐ ঐ পৃ – ৫৫

১৭. স্বামীজীর বাণী ও রচনা ; ১ম খন্ড, পৃ – ৫৬

১৮. ঐ ঐ পৃ – ৫৭ – ৫৮

১৯. ঐ ঐ পৃ – ৮৬

২০. ঐ ঐ পৃ – ৭৭ -৭৮

২১. ঐ ঐ পৃ – ৮০

২২. ঐ ঐ পৃ – ৮০

২৩. ঐ ৮ম খন্ড, পৃ – ৩১৪

২৪. ঐ ১ম খন্ড, পৃ : ৮০ – ৮১

২৫. ঐ ঐ পৃ : ১১৬ – ১১৭

২৬. ঐ ৯ম খন্ড, পৃ – ১২৭

২৭. ঐ ২য় খন্ড, পৃ – ১৩৫

২৮. ঐ ঐ পৃ : ২২০ – ২২১

লালা লাজপৎ রায়ের : দি মেসেজ অফ দি ভগবত গীতা

১. লালা লাজপৎ রায় : The Message of the Bhagavad Gita, পৃ – ৬ -৭

২. ঐ ঐ পৃ – ১৫

৩. ঐ ঐ পৃ – ১৬

৪. ঐ ঐ পৃ – ১৭

৫. ঐ ঐ পৃ -২৩

৬. ঐ ঐ পৃ – ২৯

৭. ঐ ঐ পৃ – ২৯

৮. ঐ ঐ পৃ – ৩০-৩১

৯. ঐ ঐ পৃ – ৬৭

গীতা ও মহাত্মা গান্ধী :

১.  Sir Edwin Arnold-কৃত-গীতার অনুবাদ পাঠের মাধ্যমে, যে অনুবাদটির পরিচিতি ‘The Song Celestial’

২.  Gita the mother, M.K. Gandhi, Edited by Jag Parvesh Chander, Introduction, p-5

৩.  Ibid p-5

৪.  ‘Gita the mother’, Introduction; p-4

৫.  Ibid p-4

৬.  Ibid p-4

৭.  Ibid ; Chap – I p-14

৮.  Ibid ; Chap – I p-14

৯.  Ibid; Chap – I p-15

১০.  Ibid; Chap – I p-15

১১. গীতা – বোধ, গান্ধী রচনা সম্ভার; ৪র্থ খন্ড; দ্বিতীয় মুদ্রণ; ১৩৭৬, পৃ – ৭২

১২. তৃতীয় অধ্যায়, কর্মযোগ, গান্ধী রচনা সম্ভার; ৪র্থ খন্ড; দ্বিতীয় মুদ্রণ, পৃ – ৭২

১৩. ঐ ঐ ঐ ঐ ঐ পৃ – ৭২

১৪. গীতা – বোধ, নবম অধ্যায়; গান্ধী রচনা সম্ভার; ৪র্থ খন্ড; ১৯৬৯; পৃ – ৯৫

১৫.  Gita the Mother by M. K. Gandhi; Edited by Jag Parvesh Chander, 4th Chapter, p-151

১৬.  Ibid p-151

শ্রী অরবিন্দের এসেজ অন দি গীতা :

১.  The Divine Teacher; Essays on the Gita; Book- I; (1950), p-11

২.  The Divine Teacher ; Essays on the Gita ; Book- I ; (1950), p-11

৩.  The Divine Teacher ; Essays on the Gita ; Book- I ; (1950), p-11

৪.  Ibid p-16

৫.  Essays on the Gita ; Sri Aurabinda ; Part – I, The Divine Teacher, p-14

৬.  Essays on the Gita ; Sri Aurabinda ; Part – I, The core of the teaching, 1950; p-28

৭.  Ibid p-28

৮.  Ibid p-28

৯.  Ibid p-29

১০.  Ibid p-30

১১.  Essays on the Gita ; Part – I, Book two, 1950, The Synthesis of Devotion and Knowledge, p-247

১২.  Ibid p-247

১৩.  Ibid p-248

১৪.  Essays on the Gita ; Part – II ; The Message of the Gita; 1950, p-510

ভাগবত গীতা / চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি :

১. চক্রবর্তী, রাজাগোপালাচারি, ভাগবত গীতা; Introductory; p-11

২. ঐ ঐ ঐ p-13

৩. ঐ, chapter IV, Right Action; p-41

৪. ঐ ঐ ঐ p-42

৫. ঐ ঐ ঐ p-43

৬. ঐ ঐ ঐ p-45

৭. ঐ ঐ ঐ p-97-98

৮. ঐ ঐ ঐ p-12

৯. ঐ ঐ ঐ p-13

১০. ঐ চতুর্থ অধ্যায়, পৃ – ১২৪

শ্রীমদভগবদ গীতা / রাজশেখর বসু :

১. ভূমিকা ; ১/.

২. ঐ ; পৃ – ১/.

৩. ঐ ; পৃ – ১

৪. ঐ ; পৃ – ১/.

৫. ঐ ; পৃ – গ

৬. ঐ ; পৃ – য

৭. ঐ ; পৃ – য

৮. ঐ ; পৃ – য – 1.

৯. ঐ ; পৃ – 1.

১০. ঐ ; পৃ – v.

১১. ঐ ; পৃ – v.

ভগবদগীতা / গিরীন্দ্রশেখর বসু :

১. গিরীন্দ্রশেখর বসু : ভগবদগীতা; ১৯৪৮, পৃ – ১৩

২. তদেব পৃ – ৯৯ – ১০০

৩. তদেব পৃ – ৯৪

৪. তদেব পৃ – ৯৪

৫. তদেব পৃ – ৯৬

৬. তদেব পৃ – ৮৮

৭. তদেব পৃ – ৮৫

৮. তদেব পৃ – ৭৯

৯. তদেব পৃ – ৭৭

১০. তদেব পৃ – ১০৮

১১. তদেব পৃ – ২৬২

গীতা প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণন :

১.  Preface, p-7

২.  Introductory Essay; p-11

৩.  ,, p-12

৪.  ,, p-12

৫.  ,, p-13-14

৬.  ,, p-16

৭.  Preface : The Bhagavad Gita; p-16-17

৮.  ,, ,, p-17

৯.  ,, ,, p-20

১০.  Introductory Essay; The Bhagavad Gita; p-52

১১.  ,, ,, p-53

১২.  ,, ,, p-61

১৩.  ,, ,, p-64

১৪.  ,, ,, p-68

১৫.  ,, ,, p-69

১৬.  ,, ,, p-68

১৭.  ,, ,, p-37

শ্রীমদ্ভগবদগীতা / অনিলবরণ রায় :

১. অনিলবরণ রায়, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, প্রথম অধ্যায়, পৃ – ৬৭

২. তদেব পৃ – ৫০

৩. তদেব, তৃতীয় অধ্যায় পৃ – ৩০৪

৪. তদেব, দ্বিতীয় অধ্যায় পৃ – ১৫২

৫. তদেব পৃ – ১৪৭

৬. তদেব পৃ – ১৪৭

৭. তদেব পৃ – ১৪৭

৮. তদেব পৃ – ২০৫

৯. তদেব, তৃতীয় অধ্যায় পৃ – ২১০

১০. তদেব পৃ – ২১৬-২১৭

১১. তদেব পৃ – ২২০

১২. তদেব পৃ – ২৮৭

১৩. তদেব, চতুর্থ অধ্যায় পৃ – ৪৩৯

১৪. তদেব পৃ – ৪৫৭

১৫. তদেব পৃ – ৪৫৯

১৬. তদেব পৃ – ৪৭২

১৭. তদেব পৃ – ৩৯৩

শ্রীমদভাগবদগীতা / স্বামী বীরেশ্বরানন্দ :

১.  Preface; Srimad Bhagavad Gita : p-x

২.  ,, ,, p-x

৩.  ,, ,, p-x

৪.  ,, ,, p-xiii

৫.  ,, ,, p-xiii

৬.  ,, ,, p-xiii

৭.  ,, ,, p-xiv

৮.  ,, ,, p-xiv-xv

৯.  ,, ,, p-xv

১০.  ,, ,, p-xv

১১.  ,, ,, p-xvi

১২.  ,, ,, p-xvi

১৩.  ,, ,, p-xvi

১৪.  ,, ,, p-xvii

১৫.  ,, ,, p-xxvi

১৬.  ,, ,, p-xxvi-xxvii

গীতা – প্রবচন / বিনোবা ভাবে :

১. গীতা – প্রবচন : বিনোবা ভাবে; (বঙ্গানুবাদ বীরেন্দ্রনাথ গুহ), প্রকাশকাল ১৯৫৫, পৃ – ১

২. ঐ পৃ – ২

৩. ঐ পৃ – ৪

৪. ঐ পৃ – ৮

৫. ঐ পৃ – ১৭

৬. ঐ পৃ – ১৮

৭. ঐ পৃ – ১৯

৮. ঐ পৃ – ২৩

৯. ঐ পৃ – ৩৯

১০. ঐ পৃ – ৩৯

১১. ঐ পৃ – ৬০ – ৬১

১২. ঐ পৃ – ৮৩

১৩. ঐ পৃ – ৮২

১৪. ঐ পৃ – ৭৭

১৫. ঐ পৃ – ৭৭

১৬. ঐ পৃ – ১৫০

১৭. ঐ পৃ – ১৫০

১৮. ঐ পৃ – ২০৫

১৯. ঐ পৃ – ২০৪

২০. ঐ পৃ – ২০৫

২১. ঐ পৃ – ২০৫

ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা / স্বামী রঙ্গনাথানন্দ :

১. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা; ভূমিকা, পৃ – ১

২. ঐ ঐ পৃ – ৫

৩. ঐ ঐ পৃ – ৫

৪. ঐ ঐ পৃ – ২৩

৫. ঐ ঐ পৃ – ৬৬

৬. ঐ ঐ পৃ – ৩০১

৭. ঐ ঐ পৃ – ২৯৯

৮. ঐ ঐ পৃ – ২৯৭

৯. ঐ ঐ পৃ – ২৮৮

১০. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা, ৪র্থ অধ্যায়, ১ম খন্ড, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৫, পৃ – ৩৯৪

১১. ঐ ঐ পৃ – ৪৩০

১২. ঐ ঐ পৃ – ৪৩৫

১৩. ঐ ঐ পৃ – ৪৩৫

১৪. ঐ ঐ পৃ – ৪৩৮

১৫. ঐ ঐ পৃ – ৪৬৩

১৬. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা, ৪র্থ অধ্যায়, ১ম খন্ড, ৩য় মুদ্রণ, ১৪১৫, পৃ – ৪৬৭

১৭. ঐ ঐ পৃ – ৪৭৪

১৮. ঐ ঐ পৃ – ৪৭৪

১৯. ঐ ঐ পৃ – ৪৮৫

২০. স্বামী রঙ্গনাথানন্দ; ভগবদ গীতা ও বিশ্বজনীন বার্তা, ৪র্থ অধ্যায়, ৩য় খন্ড, ১৪১৬, ইংরাজী ২০০৯, পৃ – ৬

শ্রীমদ্ভগবদগীতা : অনুবাদ ও ব্যাখ্যা : স্বামী লোকেশ্বরানন্দ :

১. স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, শ্রীমদ্ভগবদগীতা; পৃ – দ

২. ঐ ঐ পৃ – ধ

৩. ঐ ঐ পৃ – ৮৫

৪. ঐ ঐ পৃ – ৮৬

৫. ঐ ঐ পৃ – ৮৬

৬. ঐ তৃতীয় অধ্যায়, পৃ – ৮৭

৭. ঐ ঐ পৃ – ৮৮

৮. ঐ ঐ পৃ – ৯০

৯. ঐ ঐ পৃ – ১১০

১০. ঐ চতুর্থ অধ্যায়, পৃ – ১২৪

১১. ঐ ঐ পৃ – ১২৪

গীতায় ঈশ্বরবাদ / হীরেন্দ্রনাথ দত্ত :

১. হীরেন্দ্রনাথ দত্ত : গীতায় ঈশ্বরবাদ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৩৬৫, পৃ – ৩৯

২. তদেব পৃ – ৩৭২, পরিশিষ্ট ‘খ’

৩. তদেব পৃ – ৩৭২

৪. তদেব পৃ – ৩৮২-৮৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *