মকবুল অনেক খবর রাখে, প্রত্যেক ঘরের খবর তার মুঠোর ভেতরে। একদিন সে বললো, আমাদের গ্রামে কমপক্ষে দশটা জারজ আছে। শুনে আমার ভয় লাগলো না, বরং মনে হলো ভাগ্য ভালো জারজ দেখে চেনা যায় না; চেনা গেলে খুব ভয়ঙ্কর হতো। তার মতে বুড়োগুলো কি কম শয়তান, এখন একেকটা দাড়ি রেখে মুরব্বি সেজেছে, টুপি মাথায় দিয়ে নামাজ পড়ে কপালের চামড়া তুলে ফেলছে, কিন্তু সেগুলো কি কম শয়তান ছিলো? সুবিধা পেলে এখনো কি কম শয়তানি করে যাত্রার সময় তারা কী। করে, আমরা জানি না? মকবুল একটি একটি করে জারজের নাম শোনাতে। থাকে-আবুল হাশেম, ইসমাইল মোল্লা…। নামগুলো সে তার দাদীর কাছে শুনেছে, তার দাদী গ্রামে কার সাথে কে শুয়েছে তার পঞ্চাশ বছরের সব খবর রাখে। মকবুল বলতে। থাকে, ওই যে জাহাজে যারা কাজ করে, যারা আসাম আর দিনাজপুর থাকে, বছর বছর বাড়ি আসে না, তাদের বউদের ছেলেমেয়ে হয় কেমনে? যারা সারারাত ইলিশ ধরে। পদ্মায়; তাদের বউগুলো কি একলা থাকে? আমি শুনি আর চোখের সামনে ভেঙে পড়া দেখতে থাকি; পদ্মার পার যেমন করে ভাঙে তেমন করে ভেঙে পড়তে থাকে-কী যেনো ভেঙে পড়তে থাকে, কী সব যেনো ভেঙে পড়তে থাকে, আমি বুঝে উঠতে পারি না; কিন্তু ভাঙনের দৃশ্যে আমার চোখ ভরে যায়।
রওশনদের বাড়ি আমি অনেক বছর যাই নি, যার সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম; তারপর সে শহরে চলে গিয়েছিলো শহরের ইস্কুলে বেশি ভালো করে পড়বে বলে, আবার ফিরে এসেছে; ফেরার পর আর দেখা হয় নি। রওশনের উচ্চশিক্ষা কি শেষ হয়ে গেলো? দূর থেকে রওশনকে মাঝেমাঝে দেখি আমি, যখন ইস্কুলে বা খেলার মাঠে যাই, দেখি রওশন নারকেল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে মাঠ দেখছে বা দেখছে আমাকে, বা পুকুরের পানি দেখছে, বা আকাশ দেখছে বা কিছুই দেখছে না, শুধু আমি দেখছি। তাকে। রওশন কী দেখতে পছন্দ করে, তা আমি জানি না; তবে দূর থেকে তাকে দেখে আমরা ধন্য হচ্ছি। গ্রামে রওশন ভিন্ন ছিলো; আমাদের বয়সের একমাত্র সে-ই শুধু। শহরে গেছে, আর ফিরে এসেছে শহর থেকে, এবং সে সালোয়ারকামিজ পরে, গলায় দোপাট্টা ঝুলিয়ে রাখে, শাড়ি পরে না। আর সে সুন্দর। তাকে দেখার জন্যে মকবুল মাঝেমাঝে এমনভাবে ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ছে, যাতে ঘুড়িটি গিয়ে ওদের নারকেল গাছে আটকায়। মকবুলের ঘুড়ি মকবুলের কথা শুনছে চমৎকারভাবে, উড়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছে রওশনদের নারকেল বা আমগাছে; মকবুল ঘুড়ি আনতে গিয়ে কখনো দেখতে পাচ্ছে রওশনকে, আর যতোক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না ততোক্ষণ সে কিছুতেই ঘুড়ি ছাড়াতে পারছে না। আমি ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছি না; কিন্তু দেখতে পাচ্ছি আমি ইস্কুলে যাওয়ার সময় রওশন আকাশ দেখার জন্যে এসে উপস্থিত হচ্ছে নারকেল গাছের গোড়ায়, ফেরার সময় সে পুকুরের জলে ঢেউ আর হাঁসের সাঁতার দেখার জন্যে এসে দাঁড়াচ্ছে বাঁধানো ঘাটে। ওই সময় আকাশ আর পুকুরের ঢেউ আর হাঁস ওর নিশ্চয়ই সুন্দর লাগছে সারাদিনের আকাশ আর জলের ঢেউ আর হাঁসের সাঁতার থেকে। কিন্তু। ওকে দেখার পর আমি আর হাঁটতে পারি না; কয়েক দিন আমি অনেক পথ ঘুরে ইস্কুলে গেছি, ঘুরে ফিরেছি, আর মাঠে যাই নি। তারপর খুব শূন্য লাগছে। শূন্য লাগার থেকে। অনেক ভালো সোজা পথে ইস্কুলে যাওয়া, ঠিক সময়ে মাঠে যাওয়া, আর কারো আকাশ আর পুকুরের জলের ঢেউ দেখাকে বিষাক্ত না করা।
শওকত এখন কোথায় কেমন কী করে জানি না, কিন্তু ওকে আমার মনে পড়ে; ও-ই আমাকে স্বপ্নের খুব কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। আমার;–সাধারণত স্বপ্ন দেখি না আমি, কিন্তু দেখলে রওশনকেই দেখি। আমার অন্য কোনো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু অন্য কিছুই আমি দেখি না, কয়েক মাস পর হঠাৎ স্বপ্ন দেখি, দেখি রওশন, এবং সে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে; আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি নারকেল গাছের নিচে, অগ্নিগিরির জ্বালামুখের ওপর, একলা পড়ে থাকি। শওকত, রওশনের ছোটোভাই, এক বিকেলে আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়, আমি যেতে চাই নি আর না গিয়েও পারি নি; আমরা বসার ঘরে ক্যারোম খেলতে থাকি। শরৎ শেষ হয়ে আসছে, হেমন্ত দেখা দিচ্ছে, বিকেলটি কোমলতায় ভরে গেছে, পৃথিবীতে এতো কোমল বিকেল হয়তো আর আসে নি; আমি এক সময় অনুভব করি পেছনের জানালা দিয়ে একটি হাত তার পাঁচটি কোমল আঙুল আমার চুলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ওই অনির্বচনীয় আঙুলগুলো তারপর স্থির হয়ে থাকে আমার মাথার। মাঝখানে, আমার শরীর জুড়ে কোমলতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে, আর আমি খুব ধীরে আমার বাঁ হাত উঠিয়ে আমার পাঁচটি আঙুল রাখি ওই অঙ্গুলিমালার ওপর, এবং পেছনের দিকে ফিরে তাকাই। রওশন হাত সরিয়ে নিয়ে শরতের চাঁদের মতো হাসে। এতো কাছে থেকে আগে কখনো আমি চাঁদ দেখি নি, আমার জানালার এতো কাছে এর আগে কখনো চাঁদ ওঠে নি। রওশন একটু পর ঘরে এসে ঢোকে; শওকত আর খেলবে না, রওশন আর আমি খেলতে থাকি। রওশন যখন স্ট্রাইক করে তার চুল ছড়িয়ে পড়ে, মাঝখানে একটি চাঁদ ভাসতে থাকে; রওশন যখন স্ট্রাইক করে, তার আঙুল ফুলের মতো দল মেলে। স্ট্রাইকার ফেরত নেয়ার সময় আমার আঙুলে লাগে রওশনের আঙুল, আর রওশনের আঙুলে লাগে আমার আঙুল; আমরা মুখে কথা না বলে আঙুল দিয়ে কথা বলতে থাকি। রওশনের প্রতিটি আঙুলের নিজস্ব কণ্ঠস্বর রয়েছে, তাদের গলা থেকে গলগল করে সোনা ঝরতে থাকে, আমি সেই সব স্বর শুনতে পাই; এর আগে আমি কখনো স্পর্শের স্বর শুনি নি। আমার মনে হতে থাকে এর আগে আমাকে কেউ ছোঁয় নি, আর আমিও কখনো কিছু ছুঁই নি, কাউকে ছুঁই নি।
আঙুল, আঙুলের রূপ, আঙুলের স্বর, আমার সন্ধ্যাটিকে এক কোটি দশ লাখ সুরে। ভরে দেয়; আমি যখন বেরিয়ে আসি চারপাশে মহাজগত ভরে কুয়াশায় গাছের পাতায় পাখির ডানায় আমি পাঁচটি আঙুলের স্বর শুনতে পাই। আমার রক্তে ওই স্বর ঢুকে যায়, চারপাশের বাতাসকে আশ্চর্যরকম মসৃণ পরিসুত মনে হয়, নিজেকে এতো হাল্কা লাগে। যে আমি হেঁটে বাড়ি না ফিরে মেঘলোকের ওপর দিয়ে নক্ষত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাড়ি ফিরি; তার আগে একবার নদীর দিকে যাই, মনে হতে থাকে পাঁচটি আঙুল নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে, আর জড়িয়ে আছে আমার পাঁচটি আঙুলের সাথে, মনে হতে থাকে পাঁচটি আঙুল এখনো আমার চুলের ভেতর পাঁচটি স্রোতের মতো ঢুকছে, ঢুকে স্থির হয়ে আছে, সেখান থেকে কোমলতা ছড়িয়ে পড়ছে আমার মাংসের ভেতর রক্তের ভেতর নদীর ভেতর। গাছপালার ভেতর কুয়াশার ভেতর। আমার আঙুলগুলোর দিকে তাকাই আমি, বারবার, দেখে মনে হয় ওগুলো অন্য রকম হয়ে গেছে, জন্মান্তর ঘটে গেছে ওগুলোর, সোনা হয়ে গেছে, ওগুলোর গায় কখনো আর ময়লা লাগবে না। ওইটুকু স্পর্শ নিয়েই আমি বিভোর হয়ে ছিলাম, আর কোনো স্পর্শ আমার জীবনে দরকার পড়বে বলে মনে হয় নি; যতোদিন বাঁচবো ততোদিন ওই স্পর্শ আমি আমার আঙুলে আমার রক্তে বয়ে বেড়াতে পারবো। তাই আমি মেঘের ওপর মেঘে বেড়াতে থাকি, একদিন দু-দিন তিনদিন চারদিন; রওশনের মুখ আমি ভুলে যাই, আঙুলগুলোকে ভুলে যাই, শুধু তার স্পর্শ বয়ে বেড়াতে থাকি। রওশনদের বাড়ির সামনের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার চোখ অন্ধ হয়ে আসতে থাকে, কিছু দেখতে পাই না আমি, শুধু স্পর্শ দেখতে পাই; এবং একদিন বিকেলে যখন আবার চোখে দেখতে পাই দেখি রওশন হাত তুলে ডাকছে আমাকে।
অনেক বছর ধরে যেনো আমি দুর্গম পথ হাঁটছি বা এখনো হাঁটতে শিখি নি, এমন করে আমি হাঁটতে থাকি রওশনদের সড়ক ধরে, রওশনদের বাড়িতে ঢোকার পথের। নারকেল গাছগুলোকে নতুন করে দেখি; রওশনদের বসার ঘরের পাশে একটি বাঁধানো কবর আছে, সেটিকে দেখি অনেকক্ষণ ধরে, এই প্রথম দেখছি বলে মনে হয়, এবং দেখতে পাই রওশন দাঁড়িয়ে আছে। রওশনের সাথে বসার ঘরে ঢুকি আমি, আমাকে বসতে বলে রওশন বেরিয়ে যায়; আমি জানালার পাশের চেয়ারটিতে বসে লক্ষ লক্ষ বছর কাটাতে থাকি, একসময় দেখি রওশন আমার পাশে দাঁড়ানো, এবং আমার বা হাতটি তার ডান হাতের মুঠোর ভেতর। আমি রওশনের মুখের দিকে তাকাই, জ্যো ৎস্নায় আমার চোখমুখ শীতল হয়ে ওঠে; এতো জ্যোৎস্না আমার মুখের ওপর আগে আর কখনো ঝরে পড়ে নি। আমি যদি অনেক আগেই অন্ধ না হয়ে যেতাম তাহলে ওই জ্যোৎস্নায় আমার দু-চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু জ্যোৎস্নার থেকে আরো অসামান্য ঘটনা রওশনের মুঠোতে আমার বা হাত;–আমি বুঝে উঠছি না আমার হাত নিয়ে আমি কী করবো, সেটিকে কি আমি অনন্তকাল ওই মুঠোতেই রেখে দেবো, ওই মুঠোতে থাকলেই কি সেটি সবচেয়ে শান্তি পাবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। রওশন আমাকে ধরেছে, রওশন আমাকে ছুঁয়েছে; আমি এখনো ধরি নি, আমি এখনো। দুই নি। রওশন আস্তে বলল, আমাকেও ধরো। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, রওশন তাকালো আমার মুখের দিকে; আমার আঙুলগুলো সজীব হয়ে উঠলো একটু একটু করে, অমনি কী যেনো রওশনের আঙুল থেকে আমার আঙুলে আর আমার আঙুল থেকে রওশনের আঙুলে বইতে শুরু করলো–তা বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুতের থেকে তীব্র ও আলোকময়; তা কার্তিকের কুয়াশা নয়, কার্তিকের কুয়াশার থেকে অনেক কোমল। অনেক কাতর। আমরা সারা বিকেল হাতে হাত রেখে জীবন যাপন করলাম, আমাদের মনে হলো আমাদের হাত দুটি পরস্পরের মুঠোতে থাকলেই শুধু বেঁচে থাকে। রওশন শুধু মাঝেমাঝে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো কেউ আসে কিনা কেউ উঁকি দেয় কিনা। সেই বিকেলে আমরা দুজন বদলে গেলাম, আমরা দুজন আবার জন্ম নিলাম।
আমি যখন চলে আসি তখনো মনে হচ্ছিলো রওশন আমার হাত ধরে আছে, আমি রওশনের হাত ধরে আছি; কিন্তু লেবুঝোঁপের পাশে এসেই আমার হাত আর বুক খুব শূন্য লাগতে শুরু করে, রওশনের হাত আরেকবার ধরার পিপাসা বুকে বোশেখের রোদের মতো কাঁপতে থাকে। রওশনের হাত একবার ধরার পর তারপর না ধরে থাকা কী কঠিন কী কষ্টকর তা আমি লেবুঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে মর্মেমর্মে অনুভব করি। আবার ফিরে যাবো, গিয়ে আরেকবার রওশনের হাত ধরবো? কেউ কি দেখে ফেলবে না? রওশন কি কিছু ভাববে? না, আমাকে ফিরে যেতে হবে, ওই হাত আরেকবার ছুঁতেই হবে, নইলে আমি বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাবো না। সন্ধ্যা নেমে গেছে, আমি আবার রওশনদের বসার ঘরের দিকে পা বাড়াই; রওশন দাঁড়িয়ে আছে বাঁধানো কবরের পাশের ডালিম গাছের নিচে। রওশনের হাতও কি রওশনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ডালিম গাছের নিচে? আমি কাছে যেতেই আমাদের হাত কখন যে পরস্পরকে ধরে ফেলে, তা আমরা কেউ জানতে পারি না। কোনো কথা বলি না আমরা, আমাদের কোনো কথা নেই, কথা আছে আমাদের হাতদের, তারা কথা বলতে থাকে, তাদের গলা থেকে সোনা ঝরতে থাকে। আমাদের হাতদের কথা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়, আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি। এক দুই তিন চার, কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি আর রওশন গৌণ হয়ে যাই, আমরা কেউ নই, আমাদের কোনো অস্তিত্ব নেই; অস্তিত্ব আছে শুধু দুজনের হাতের, রওশনের ডান হাতের আর আমার বাঁ হাতের। আমি গিয়ে রওশনদের বসার ঘরে বসলেই রওশনের ডান হাত আমার বাঁ হাতকে মুঠোতে তুলে নেয়, আমার ডান হাত রওশনের বা হাতকে মুঠোতে তুলে নেয়; আমরা চুপ করে থাকি, হাতেরা কথা বলে। হাতদের কথা বলায় আমরা কোনো বাধা দিই না, আমরা কথা বলে হাতদের কথা বলায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করি না; আমরা শুধু চাই ওরা ঝোঁপের আড়ালে বসে নিজেদের অন্তরঙ্গতম কথাগুলো বলুক; আর চাই তাতে যেনো আর কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। আমরা দুজন প্রহরীর ভূমিকা পালন করতে থাকি;–আমি জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি কেউ আসে কিনা, তাকায় কিনা; রওশন দরোজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কেউ আসে কিনা, কেউ তাকায় কিনা। হাতেরা যখন একে অন্যের সাথে কথা বলে তখন তারা বাইরের কিছু দেখতে পায় না, তাদের হয়ে দেখি আমি আর রওশন, আমাদের হাতেরা কথা বলে একে অন্যের সাথে।
পাহারা দেয়া, বুঝতে পারি আমরা, খুব কঠিন কাজ; পাহারা দিতে গিয়ে আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে ওঠে, ধারালো হয়ে ওঠে শান দেয়া ছুরিকার মতো; দূরে, কোথাও পাতা খসে পড়লে শুনতে পাই, ছায়া কেঁপে উঠলে দেখতে পাই,-অমনি আমাদের হাত সরে যায় পরস্পরের থেকে; যখন বুঝতে পারি ওটি পাতা খসার শব্দ ওটি ছায়া কাঁপার দৃশ্য, তখন আমাদের হাত আবার পরস্পরকে বুকে তুলে নেয়। রওশনের আব্বা মাঝেমাঝেই এদিক দিয়ে বাইরে যান, আবার ফিরে আসেন, তখন আমাদের হাত খুব দূরে সরে যায়রওশনের আম্মা কখনো উঠোনে আসেন, পুকুরের। দিকে যান, তখন আমাদের হাত সরে যায়; আর আছে শওকত, তার কাজ আসাযাওয়া, এই ঘরে ঢুকছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই আমাদের হাত এই ঠুচ্ছে পরস্পরকে আবার দূরে সরে যাচ্ছে একে অন্যের থেকে। দূরত্ব সম্পর্কে একটি অনুভূতি হয় আমাদের। আমরা বুঝতে পারি দু-ইঞ্চি দূরত্ব আর দু-কোটি মাইল দূরত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; আমাদের হাত যদি পরস্পরকে না ধরে থাকে তখন এক ইঞ্চি দূরত্ব আর এক কোটি মাইল দূরত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যখন আমরা না ছুঁয়ে থাকি তখন আমরা অনন্তের থেকেও বেশি দূরে। আমাদের চোখেরাও তখন সুন্দর ছাড়া আর কিছু দেখতে ভুলে গেছে, আমি রওশনের দিকে তাকাই, দেখি সুন্দর; রওশন আমার দিকে তাকায়, সেও দেখে সুন্দর; যদি সে সুন্দর না দেখতো তাহলে অমন করে এতোক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। এর আগে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আমি তাকিয়েছিলাম একটি ফুলের দিকে, দীর্ঘ কয়েক মিনিট তাকিয়ে ছিলাম, অতো সময় ধরে আর কোনো কিছুর দিকে আমি তাকাই নি; অতো সুন্দর ফুলের। দিকেও কয়েক মিনিটের বেশি আমি তাকিয়ে থাকতে পারি নি; কিন্তু রওশনের দিকে। মুখের দিকে আমি সারা বিকেল তাকিয়ে থাকতাম, যেমন রওশন তাকিয়ে থাকতো। আমার মুখের দিকে। রওশন তাকিয়ে থাকতে বলে আমার মুখটি তখন সুন্দর হয়ে উঠেছিলো।
সন্ধ্যা হলে চলে আসতাম আমি। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা নিষেধ ছিলো আমার; তবে কোনো কোনো দিন, প্রায় প্রত্যেক দিন, শওকত আর রওশন দুজনেই আমাকে থাকতে বলতো আরো কিছুক্ষণের জন্যে, ওদের সাথে পড়ার জন্যে, এবং আমি নিষেধ সত্ত্বেও ওদের সাথে, সপ্তাহে দু-এক দিন-বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, না থেকে পারতাম না। টেবিলে মুখোমুখি বসতাম রওশন ও আমি, ডান দিকে বসতো শওকত; তখন আমরা বেশ দূরে, আমাদের হাত ধরতে পারতো না পরস্পরকে, আমাদের মনে হতো আমরা দুই গ্রহে রয়েছি। রওশন এক বিস্ময়কর আবিষ্কারক, রওশনই তখন স্পর্শের নতুন রীতিটি বের করে। প্রথম সন্ধ্যায়ই, যখন আমি রওশনের থেকে লাখ লাখ আলোকবর্ষের দূরত্বে থাকার কষ্টে কাতর হয়ে উঠছি আর রওশন তা বুঝতে পেরে আরো কাতর হয়ে উঠছে, তখন আমার ডান পায়ের পাতার ওপর আমি অনুভব করি একপ কোমলতার লঘুতা, এবং সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি রওশনের চোখ দুটি কথা বলছে। আমার চোখ তার চোখের কথা সাথেসাথেই বুঝে ফেলে, আমি তখন আমার বাঁ পা রাখি রওশনের ডান পায়ের পাতার একরাশ কোমল মসৃণতার ওপর। আমাদের পা কথা বলতে থাকে। এর পর যে-সন্ধ্যায়ই আমি ওদের সাথে থেকেছি, আমার ডান পায়ের পাতার ওপর রওশন রাখতে তার বা পা, আর রওশনের ডান। পায়ের পাতার ওপর আমি রাখতাম আমার বাঁ পা। কথা বলতো আমাদের পায়েরা। পায়েরাও চমৎকার কথা বলতে পারে, পায়েরাও কোমল হতে হতে গন্ধরাজ হয়ে উঠতে পারে, আমাদের পা গন্ধরাজ হয়ে টেবিলের তলদেশকে সুগন্ধে ভরে দিতে, থাকে। আমাদের দুজনের পায়ের পাতা থেকে সুগন্ধ উঠছে, আমরা তাতে বিভোর হয়ে আছি, সে-গন্ধে আমাদের রক্ত পাগল হয়ে উঠছে মাতাল হয়ে উঠছে বুলবুলি হয়ে উঠছে প্রজাপতি হয়ে উঠছে পদ্ম হয়ে উঠছে চাঁদ হয়ে উঠছে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠছে। শওকত একদিন আমাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে টেবিলের নিচে আমাদের পায়েরা মাতাল হয়ে গেছে। কিন্তু সে তো আর টেবিলের নিচে অকারণে উঁকি দিতে পারে না! তাকে একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ বের করতে হয় টেবিলের নিচে উঁকি। দেয়ার জন্যে;–সে তার হাতের পেন্সিলটি নিচে ফেলে দিয়ে হ্যারিকেন নিয়ে টেবিলের নিচে পেন্সিল খুঁজতে থাকে, আমাদের পায়ের পাতা দূরে সরে যায়; আর তখন। টেবিলের ওপরের অন্ধকারে আমাদের হাত খুঁজে পায় একে অন্যকে, শান্তিতে ভরে যায় তাদের প্রতিটি আঙুল, আঙুলের মাংস, নখ, আঙুলের হৃদয়। শওকত হঠাৎ মাথা তোলে টেবিলের নিচে থেকে, আর অমনি আমাদের হাতেরা দূরে সরে যায়, যেনো তারা। কখনো কাছাকাছি আসে নি, আসার কোনো সাধ নেই তাদের; এবং তখন টেবিলের নিচে আমার ডান পায়ের ওপর এসে পড়ে একপ কোমলতার লঘুতা, আর আমার বা পায়ের পাতা গিয়ে পড়ে একস্তূপ কোমল মসৃণতার ওপর। শওকত বারবার পেন্সিল ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আর আমাদের পায়েরা একে অন্যের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে।
রওশন আর আমি বোবা নই, আমরা যে কোনো কথা বলি নি, তা নয়; অনেক কথাই আমরা বলেছি, কিন্তু আমাদের কোনো কথাই যেনো কোনো অর্থ প্রকাশ করতো না যতক্ষণ আমাদের হাত ধরতে পারতো না পরস্পরকে, আমাদের পায়ের পাতা স্পর্শ করতে না একে অন্যকে। রওশন আর আমি তখন ত্বক আর মাংসের অবর্ণনীয় সুখের। ভেতরে বাস করছি। রওশনের আঙুলগুলো ছিলো দীর্ঘ আর কোমল, যে-কোমলতা, মেঘের নয় পালকের নয় রেশমের নয় গোলাপের নয় বাতাসের নয় জলের নয়, যা শুধু। রওশনের; তার হাতের তালুতে কোমল মাংস, আমার আঙুল ওই দুগ্ধফেনার ভেতর ডুবে যায়; তার ত্বক কচুরি ফুলের পাপড়ির মতো মসৃণ; ওই কোমল মসৃণতা পেরিয়ে। রওশনের হাত থেকে আরেক কোমলতা সঞ্চারিত হয় আমার হাতে, যার কোনো পরিচয় আমি জানি না; হাত বেয়ে ত্বকের ওপর দিয়ে রক্তের ভেতর দিয়ে মাংসের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে, আর আমার শরীর অলৌকিক হয়ে ওঠে। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় আমার, মনে হয় চাঁদ গুড়োগুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার রক্তে; রওশনের মুখের দিকে তাকিয়েও তার চোখ ভরে মুখ ভরে ভুরুর ওপরে ঠোঁটের। মাঝখানে ঘুমের ঘোলাটে জ্যোৎস্না ছড়ানো দেখতে পাই।
তুমি কেমন আছো? আমি জানতে চাই, বা আমি জানতে চাই না, আমি শুধু জেগে থাকতে চাই। অবাক হয়ে আমি লক্ষ্য করি রওশনকে আমি তুমি বলছি, আমরা তো তুইই বলতাম একে অন্যকে।
ভা-লো, রওশন বলে, কী যে সুখ লাগে তোমাকে ছুঁলে! সেও প্রাণপণে চেষ্টা করে জেগে থাকার, বলে তোমার লাগে না? রওশনও তুমি বলছে আমাকে। আমরা তুই থেকে তুমি হয়ে উঠি।
ঘুম পায় আমার এতো ভালো লাগে, আমি বলি।
চিরকাল ছুঁয়ে থাকবো আমরা, তুমি আমি, রওশন বলে।
তারচেয়েও বেশি, আমি বলি, তারচেয়েও অনেক বেশি।
তুমি সুন্দর, রওশন বলে। আমি খুব বিব্রত বোধ করি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আমি সুন্দর, রওশন যা বলে তা কখনো মিথ্যা হতে পারে না।
না, তুমি সুন্দর, আমি বলি।
না, তুমি সুন্দর, রওশন আবার বলে; গানের মতো বলে রওশন, বলতে থাকে। রওশন, তুমি সুন্দর, এতো সুন্দর, কী যে সুন্দর।
রওশনের কথা শুনে আমার মেঘের ওপর ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, আমি ঘুমিয়েই পড়ি, বলি, না, তুমি সুন্দর, রওশন, শুধু তুমিই সুন্দর পৃথিবীতে।
আরো সুন্দর হয়ে ওঠে রওশন,-আমার ওষ্ঠ থেকেও তাহলে উচ্চারিত হচ্ছে চরম সত্য, রওশনের মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও অধিকার পেয়েছি চরম সত্য বলার;–রওশনের মুঠো আরো কোমল হয়ে ওঠে, ওই কোমল মুঠোর ভেতর আমার। আঙুলগুলো আমার হৃৎপিণ্ডের মতো কাঁপতে থাকে। রওশনের মুখের দিকে তাকাই। আমি, জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে থাকে আমার মুখমণ্ডল। মনে হয় শরতের পূর্ণিমা চাঁদের নিচে আমি নৌকো বেয়ে চলছি, বৈঠার শব্দ উঠছে; মনে হয় হেমন্তের পূর্ণ চাঁদের নিচে। পাকা আমন ধানের খেতের পাশে আমি নৌকো লাগিয়ে বসে আছি, শাদা কুয়াশা নেমে আসছে, আমার চুলে শিশির জমছে, কাশবন দুলছে, বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে, আর বহুদূরে আড়িয়ল বিলের উত্তরে জ্বলছে একটি আকাশপ্রদীপ। রওশনের শরীর থেকে জ্যোৎস্নার গন্ধ এসে লাগতে থাকে আমার নাকে, কুয়াশার গন্ধ এসে লাগতে থাকে আমার নাকে, ধানের গন্ধ এসে লাগতে থাকে নাকে; আমার শরীর কুয়াশার মতো। ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধানখেতের ওপর, আখখেতের ওপর, কাশবনে, নারকেল গাছের পাতায়, দূরের উঁচু উঁচু তালগাছগুলোর পাতায়। রওশন ঝুঁকে পড়ে আমার গ্রীবার ওপর, তার নাক লাগে আমার গ্রীবায়, তার গাল লাগে আমার গালে; আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে হাসে। আমি তখন আর কিছু দেখতে পাই না, চোখ বন্ধ করে ফেলি, এবং বন্ধ আর অন্ধ চোখে দেখতে পাই আকাশজোড়া লাল রঙ।
আমি আর নিজের শরীরের মধু আহরণ করি না, নিজের শরীরের চাক ভাঙি না, ভাঙতে ইচ্ছে করে না; বিস্মিত হই আমি-রওশনের হাতে হাত রাখার আগে নিজের। শরীরের মধুর স্বাদ আমি প্রাণভরে পান করেছি, কিন্তু এখন ইচ্ছে করে না, ঘেন্না লাগে, ওই কথা মনেই পড়ে না। আমি রওশনের হাতের মধু পান করেছি, অন্য কোনো মধু আর আমার কাছে মধুর লাগে না, একমাত্র মধু হচ্ছে রওশনের আঙুলের ছোঁয়া, রওশনের পায়ের পাতায় আমার পায়ের পাতার স্পর্শ, যা আমাকে মেঘের ওপরে। উড়ালের সুখ দেয়। একদিন আমাদের বিয়ে হবে, এমন ভাবনা আসে আমার মনে, তখন আমরা কী করবো? আমি ভাবতে চেষ্টা করি–তখন আমরা হাতে হাত রেখে সারাদিন বসে থাকবো, তখন আমরা হাতে হাত রেখে সারারাত জেগে থাকবো, রওশনের মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকবো, রওশন তাকিয়ে থাকবে আমার মুখের দিকে। আমরা আর কিছু করবো না। রওশনের শাড়ি থেকে আমার নাকে এসে গন্ধ লাগবে, আমরা হাঁটতে বেরোবো, তখন রওশনের শাড়ির পাড় বাতাসে উড়বে, আমার মুখে এসে পড়বে। আমরা পাশাপাশি শুয়ে থাকবো, রওশনের শরীরের ছোঁয়া লাগবে আমার শরীরে, রওশনের গালে আমি আমার আঙুল বুলোবো, রওশন আমার নাকের ওপর তার আঙুল রাখবে, আর আমরা সারারাত কথা বলবো। আমরা কি আর কিছু করবো? রওশন তখন ব্লাউজ পরবে, লাল ব্লাউজ পরবে, ব্লাউজের ওপর দিয়ে তার গলা দেখা যাবে, তার গ্রীবা দেখা যাবে। আমি কি কখনো তার ব্লাউজ খুলবো? না, না, না; আমি কখনো তার ব্লাউজ খুলব না, রওশন কী মনে করবে, রওশন আমাকে খুব। খারাপ মনে করবে; আমরা অতো খারাপ হবো না। বিয়ে হলে লোকেরা ন্যাংটো হয়ে শোয়, তারা খুব খারাপ কাজ করে, রওশন আর আমি কখনো ন্যাংটো হবো না, কোনো খারাপ কাজ করবো না; আমরা চুমো খাবো-রওশন আস্তে আমার গালে ঠোঁট ছোঁয়াবে, আমি আস্তে রওশনের গালে ঠোঁট ছোঁয়াবো, তাতেই আমাদের ঘুম এসে যাবে, আমরা পাশাপাশি ঘুমিয়ে পড়বো, জেগে উঠে দেখবো আমরা পাশাপাশি শুয়ে আছি, আমাদের একজনের হাতে আরেকজনের হাত। রওশন যদি কখনো ব্লাউজ পরতে গিয়ে পরতে না পারে, যদি আমার চোখের সামনে তার দুধ দুলে ওঠে? আমি চোখ বন্ধ করে ফেলবো, আমি অতো অসভ্য হতে পারবো না, আমরা কোনো অসভ্য কাজ করবো না, আমরা শুধু হাত ছুঁয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবো, আমরা শুধু ভালোবাসবো।
রওশন একটি চিঠি লিখেছে আমাকে, প্রথমে আমি বুঝতেই পারি নি ওটি কী; আমাকে সে চোখ বন্ধ করতে বলে, আমি চোখ বন্ধ করি, অমন সময় শওকত এসে ঢোকে, আর রওশন বলে ওঠে, চোখ খোলো, খোলো; আমি চোখ খুলে শওকতকে দেখে একটু বিব্রত হই, কিন্তু রওশন বলে, আমরা আজ চোখ খোলা চোখ বন্ধ করা। খেলছি। শওকতও চায় চোখ ভোলা চোখ বন্ধ করা খেলতে। রওশন শওকত ও আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলে, আমরা চোখ বন্ধ করি; আমি টের পাই রওশনের হাত ঢুকছে আমার বা পকেটে, রওশন কী যেনো রাখছে। শওকত চোখ বন্ধ রেখে অস্থির। হয়ে ওঠে, বলতে থাকে, চোখ তো বন্ধ করেছি, কিন্তু খেলা তো হচ্ছে না। যে-খেলাকে আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলা, যা খেলার জন্যে আমি সারাজীবন চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি, তা খেলাই মনে হচ্ছে না শওকতের! রওশন আমার পকেট থেকে হাত বের করে বলে, এবার বলো টেবিলের ওপর কী রেখেছি। শওকত বলে, পেন্সিল; আমি বলি, চাঁদ; তখন রওশন একবার আমার হাত ধরে, তার হাত থেকে আমার হাতে অলৌকিক শিখা সঞ্চারিত হয়, রওশন হাত ছেড়ে দিয়ে আমাদের চোখ খুলতে বলে। টেবিলে পেন্সিল দেখে খুব খুশি হয় শওকত, এবং পেন্সিল নিয়ে। বেরিয়ে যায়। রওশন আমার হাত ধরে বলে, বাড়ি গিয়ে দেখবে কী আছে, এখন কিন্তু দেখবে না। না, আমি দেখবো না; আমার পকেটে এখন রয়েছে চিরকালের চরম। বিস্ময়, কোনো অসম্ভব শূন্যোদ্যান বা পিরামিড বা তাজমহল; সবচেয়ে দামি মাণিক্য, পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় আমার পকেট সোনা হয়ে যাচ্ছে, মাণিক্য হয়ে যাচ্ছে, তা দেখার জন্যে আমি যুগযুগ অপেক্ষা করতে পারি। একটি অদ্ভুত কাজ করে রওশন আজ; সে তার দু-মুঠোতে আমার হাতটি পুজোর ফুলের মতো ধরে ওপরে উঠোতে থাকে, আমার হাত বিবশ হয়ে যায়, অঞ্জলিতে আমার হাত নিয়ে রওশন তার ঠোঁটে ছোঁয়ায়, ধীরেধীরে তার বুকের মাঝখানে কোমলভাবে ধরে রাখে। কোমলতা, কোমলতা, কোমলতা; আমার জগৎ কোমলতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, আমি বোধ করতে থাকি দুটি কোমল গোলাকার স্বর্গীয় গন্ধমের মাঝখানে স্থাপিত রয়েছে আমার হাত, স্থাপিত রয়েছি আমি; আমার পক্ষে ওই কোমলতা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, আমি ফেটে পড়তে থাকি, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাই, আমি গলে যাই, আমি ঝরনা হয়ে বইতে। থাকি। রওশন আমার হাত ছেড়ে দিলে আমি টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আবার আমি হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকি।
আমার বয়স পনেরো, রওশনেরও পনেরো; পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমি বেশি কিছু পড়তে পাই নি; রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়েছি চয়নিকায়, তাঁর গল্পও পড়েছি; শর ৎচন্দ্রের চারপাঁচটি উপন্যাস পড়েছি; ওগুলো পড়ে আমার বুক সুখে ভরে গিয়েছিলো; রওশনের চিঠি পড়ার পর মনে হতে থাকে এ-পর্যন্ত আমি যা কিছু পড়েছি তা খুবই তুচ্ছ, খুবই বানানো; রওশনের মতো কখনো কেউ কিছু লিখতে পারে নি। রওশনের। প্রতিটি শব্দ নতুন মনে হয় আমার, ওই সমস্ত শব্দ এর আগে কেউ কখনো ব্যবহার করে নি, রওশন আমার জন্যে নতুন শব্দ সৃষ্টি করেছে, এবং প্রতিটি শব্দকে মধু মেঘ অমৃত চাঁদ শিশির পাখির পালক ঘুঘুর ডাক কোকিলের গান রজনীগন্ধা শিউলি জ্যোৎস্না জলের শব্দে ভরে দিয়েছে। আমি রওশনের চিঠি পড়তে শুরু করি, একনিশ্বাসে পড়ে ফেলি; লাল লাইন টানা কাগজে মাত্র একপাতা লিখেছে রওশন, হাজার পাতা লিখলেও আমার পড়তে একনিশ্বাসের বেশি লাগতো না। বারবার আমি তার চিঠি পড়ি, একটু পরই আমার মুখস্থ হয়ে যায়; মায়ের ডাক শুনে আমি রওশনের চিঠির ভাষা বুকের ভেতরে আবৃত্তি করতে করতে ভাত খেতে নিচে নামি, খাওয়ার সময়ও বুকের ভেতর তার চিঠি আবৃত্তি করতে থাকি, আমার ভয় করতে থাকে মা হয়তো আমার বুকের আবৃত্তির শব্দ শুনে ফেলবে, খাওয়া শেষ করে টেবিলে ফিরে এসে আবার তার চিঠি মুখস্থ করি। আমি কোনো পবিত্রগ্রন্থের পাতা পড়ছি, যেনো এইমাত্র একটি নতুন পবিত্রগ্রন্থের পাতা আকাশ থেকে পড়েছে, এমন মনে হয় আমার; তার একটি অক্ষরও ভুল পড়া যাবে না, একটি শব্দও ভুল করা যাবে না, তাকে বুকের ভেতর এমনভাবে ধারণ করতে হবে যাতে জন্মেজন্মে অসংখ্য মৃত্যুর পরও কোনো ভুল না হয়। আমার হৃ ৎপিণ্ড রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার রক্তকণিকারা রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার ওষ্ঠজিভ রওশনের চিঠি মুখস্থ করে, আমার মাংস রওশনের চিঠি মুখস্থ করে; এবং তারা সবাই সম্মিলিতভাবে আমাকে ঘিরে ওই অলৌকিক শ্লোক আবৃত্তি করতে থাকে; ওই অলৌকিক ধ্বনিপুঞ্জে আমার সত্তা মুখর হয়ে ওঠে।
কয়েক মাসে আমরা কয়েক শো চিঠি লিখি, হয়তো চার শো বা পাঁচ শো হবে, বেশিও হতে পারে। প্রথম আমরা প্রতিদিন একটি করেই চিঠি লিখি, কিন্তু তিনচার দিন পর মনে হয় একটি চিঠিতে আমাদের প্রকাশ করা অসম্ভব। এটা রওশনই প্রথম বোধ করে। আমি বিকেলে যাই রওশনদের বাড়ি, গিয়ে আমার চেয়ারটিতে বসি; শওকত ঘর থেকে বেরোলেই রওশন কোমর থেকে চিঠি বের করে আমাকে দেয়, আমি পকেটে রাখি; আর আমি পকেট থেকে বের করে রওশনকে দিই, সে তার। কোমরে রেখে দেয়। একদিন ফিরে এসে দেখি রওশন তিনটি চিঠি লিখেছে। প্রথম চিঠিটি সে লেখে সকালবেলা, দুপুরেই তার বুকে অনেক কথা জমে যায়, সকাল থেকে দুপুরকে এক বছরের থেকে বেশি দীর্ঘ মনে হয়, তাই দুপুরে দ্বিতীয় চিঠিটি লেখে, এবং বিকেল হতে না হতেই আরেকটি চিঠি লেখে, কেননা দুপুর থেকে বিকেল আরেক বছরের থেকে বেশি দীর্ঘ। তখন থেকে আমরা দিনে দুটি তিনটি চিঠি লিখতে থাকি, লিখতে লিখতে আমাদের হাতের লেখা খুব সুন্দর হয়ে ওঠে। সম্বোধনের একটি অন্তরঙ্গ সূত্র বের করি আমরা, যা আমাদের কোনো ব্যাকরণবইতে নেই। রওশন আর আমি যখন একা, তখন আমরা বলি তুমি, যখন আমাদের পাশে কেউ থাকে, তখন বলি। তুই; আর আমাদের চিঠিতে তুমি ফিরে ফিরে আসে গানের মতো। প্রথম দিকে আমাদের চিঠি ছিলো হৃদয়ের, আমাদের হৃদয় গান গাইতো হাহাকার করতো চিঠি। ভরে, স্বপ্ন দেখতে অক্ষরে অক্ষরে; কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের মাংস কথা বলতে শুরু করে। প্রথম কয়েক দিন আমি আমার শরীরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, হয়ে উঠেছিলাম সম্পূর্ণ আত্মা বা হৃদয়, আমার যে একটি শরীর আছে এটাই ছিলো। আমার কাছে বিব্রতকর; কিন্তু রওশনই মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের দুজনেরই শরীর আছে। শুরু করে রওশনই, একটি চিঠির শেষে রওশন লেখে, তুমিই পান করবে আমার যৌবন সুধা। আমি একথা পড়ে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠি; এর একটি শব্দও বুঝতে পারি না; তুমি, পান, আমার, যৌবন, সুধা-প্রত্যেকটি শব্দকে আমার অচেনা মনে হয়, শব্দগুলো আমাকে মথিত করতে থাকে; আমি বুঝতে পারি না কাকে বলে পান করা, আর কাকে বলে যৌবন সুধা; আমি শুধু রক্তে পদ্মার গর্জন শুনতে পাই। হঠাৎ আমার চোখের সামনে রওশনের শরীরটি ভেসে ওঠে, তার শরীরটিকে একটি ধবধবে পানপাত্র বলে মনে হয়, আমি আর ভাবতে পারি না; আবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধবধবে পানপাত্র ও রওশনের শরীর, ওই পানপাত্র আর ওই শরীর পরিপূর্ণ হয়ে আছে সুধায়, যৌবন সুধায়, আমি দু-হাতে ধরে ওই ধবধবে পাত্র থেকে সুধা পান করছি-ভাবতেই আমার সমস্ত শরীর জুড়ে রাশিরাশি বজ্রপাত হতে থাকে। আমি একঝলকে রওশনকে সম্পূর্ণ নগ্ন দেখতে পাই।
তবে আমি অমন অসভ্য হবো না, আমরা অমন অসভ্য হবো না; আমরা শুধু হাতে হাত রাখার বেশি কখনো কাউকে ছোঁবো না। অসভ্যরাই অমন করে। বিয়ে করে। অসভ্য মানুষেরা কী করে? একটি বই পড়েছি আমি, খুব নোংরা বই, না অমন নোংরা কাজ আমরা কখনো করবো না। আমরা যখন বিয়ে করবো তখন কি রওশন ভোরবেলা গোসল করবে? রওশন যদি চায়, তাহলে ভোরবেলা গোসল করবে, আমিও করবো; দুজনে ঘুম থেকে উঠে একসাথে ঘাটে গিয়ে গোসল করবো, সাঁতার দিয়ে আমরা। মাঝপুকুরে চলে যাবো, শাড়িতে জড়িয়ে গেলে আমি রওশনকে জড়িয়ে ধরে সাঁতরে ঘাটে নিয়ে আসবো, আমাদের শরীর থেকে কুয়াশা উঠতে থাকবে, সাবানের গন্ধ। বেরোবে শরীর থেকে, রওশন তার শাড়িটা ঘাটে গোল স্কুপ করে রেখে আসবে, দূর থেকে ওটি দেখে আমার ভালো লাগবে; তার লাল পেড়ে শাড়ি যখন ডালিম গাছের নিচের তারে বাতাসে দুলবে, দেখে সুখে আমার বুক ভরে যাবে। কিন্তু আমরা ভোরবেলা গোসল করবো কেনো? সারারাত জেগে জেগে কথা বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে বলে? নাকি বিয়ে করলে ভোরবেলা গোসল করতে হয় বলে? না, ওই বইটায় যে-কথা লিখেছে, সে-জন্যে? আমরা অমন কাজ কখনো করবো না। কিন্তু রওশন যদি চায়? রওশন কি অতো খারাপ হবে? রওশনের সামনে আমি কখনো কাপড় খুলতেই পারবো না, আমার ভীষণ লজ্জা লাগবে; আমি কখনো রওশনকে উলঙ্গ দেখতে পারবো না। কিন্তু রওশন যে লিখেছে, তুমিই পান করবে আমার যৌবন সুধা, তা আমি পান করবো কীভাবে? কীভাবে রওশন আমাকে পান করতে দেবে তার যৌবন সুধা? যৌবন তো আসবে আমাদের দুজনেরই, এসে যাচ্ছে দুজনেরই, কিন্তু কোথায় জমছে কোথায় জমবে সুধাঃ রওশনের সুধা কোথায় জমবে? আমার হাতে আমি দুটি কোমল গন্ধমের ভয়ঙ্কর কোমলতা অনুভব করি, যেখানে একদিন রওশন স্থাপন করেছিলো আমার হাত, সুধা কি জমবে সেখানে? তাহলে তো রওশনের অনেক সুধা জমে গেছে, সুধা তার বুক হয়ে ফুলে উঠেছে। আমি কি পান করবো ওই সুধা, ওই সুধা পান করবো আমি? আমি আর ভাবতে পারি না, আমার রক্ত এলোমেলো হয়ে যায়।
কাদির ভাই আমাকে পছন্দ করছে না আজকাল, আমাকে দেখলে বিব্রত বোধ। করছে, আমাকেও একটু বিব্রত করতে চাইছে। আগে আমাকে দেখলেই দাঁড়িয়ে কথা বলতো, আমি যে প্রবেশিকায় ইস্কুলের জন্যে গৌরব নিয়ে আসবো, যা আমাদের ইস্কুল কখনো পায় নি, তা আমি এনে দেবো, এমন কথা বলতো; এখন কাদির ভাই আমার সাথে কথাই বলতে চায় না। বেশ মজা লাগছে আমার, তবে কাদির ভাইয়ের মজা। লাগছে না, আমি বুঝতে পারি; তার চামড়া আর চামড়ার নিচের মাংস জ্বলছে বলেই মনে হচ্ছে। কাদির ভাই দু-বার আইএ ফেল করে আমাদের পাশের ইস্কুলে পড়ায়; বিকেলে বাড়ি এসে পড়ায় রওশন আর শওকতকে। রওশনকে পড়ায় বলে সে গৌরব বোধ করে; আমাদের সাথে আগে যখন রওশনের কথা বলতে একটু গর্বই বোধ। করতো, একটু কেঁপে উঠতো। আমি যে আজকাল রওশনদের বাড়ি প্রত্যেক বিকেলে যাচ্ছি, এটা তার ভালো লাগছে না। সে জানে না এটা আমার আর রওশনের খুব ভালো লাগছে; আর এটা যে আমাদের খুব ভালো লাগছে জানলে তার আরো খারাপ লাগতো। আগে চারটার মধ্যেই তার পড়ানো শেষ হয়ে যেতো, এখন সাড়ে চারটা বাজলেও শেষ হতে চাচ্ছে না, কোনো কোনো দিন পাঁচটা বেজে যাচ্ছে।
আমি একদিন সাড়ে চারটার সময় পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকতেই রওশন চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে, স্যার, সাড়ে চারটা বাজে, মাহবুব এসেছে, আর পড়বো না। শওকতও তাই বলে
তোমার আরো অনেক পড়া বাকি আছে, কাদির ভাই একটি খাতা দেখতে দেখতে বলে।
সব খাতা তো আপনার দেখা হয়ে গেছে, রওশন বলে।
না, এখনো সব দেখা হয় নি, কাদির ভাই মন দিয়ে খাতা দেখতে থাকে, এবং আমাকে বলে, মাহবুব, তুমি আজকাল পড়াশোনা করো না মনে হয়।
আমি কোনো উত্তর দিই না, উত্তর দেয় রওশন; বলে, মাহবুবের পড়ার আর কিছুই নেই, সব তো মাহবুবের মুখস্থ।
তুমি মাহবুবের খবর রাখো কী করে? কাদির ভাই বলে।
আমি মাহবুবের সব খবর রাখি, রওশন বলে, আপনি জিজ্ঞেস করে দেখুন না, সব খবর বলে দেবো। বলে রওশন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমিও হাসি।
তবু কাদির ভাইয়ের খাতা দেখা শেষ করার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না; সন্ধ্যা হয়ে। গেলেও খাতা দেখতে থাকবে মনে হয়। রওশন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, এবং বলে, স্যার, সেদিন আপনি দুটি অংক ভুল করেছিলেন।
কাদির ভাই চমকে ওঠে, রওশন একটি খাতা বের করে।
স্যার, এ অংক দুটি ভুল হয়েছে। মাহবুব নিচে শুদ্ধ করে দিয়েছে। রওশন একবার আমার দিকে তাকিয়ে খাতাটি কাদির ভাইয়ের সামনে খুলে ধরে। কাদির ভাই খাতাটি ছিনিয়ে নিয়ে নিজের করা অংক দুটি পড়তে থাকে, পড়তে গিয়ে ভুল করে, আবার পড়ার চেষ্টা করে, নিচে আমার করা অংক দুটি পড়তে থাকে, শেষে নিজের করা। অংকের ভুল ধরতে পেরে বলতে থাকে, আইচ্ছা, ক্যামনে এই ভুলটা হইল, আইচ্ছা ক্যামনে এই ভুলটা হইল-বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। খুব বিপর্যস্ত হয়ে। পড়েছে কাদির ভাই; আমার দিকে তাকাতে পারছে না; প্রত্যেক দিন বেরোনোর সময়
সে একবার রওশনের দিকে তাকায়, আজ রওশনের দিকেও তাকাতে পারছে না। রওশন তাকে সালাম দেয়, কাদির ভাই কেঁপে কেঁপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সাথে শওকতও; আর অমনি আমাদের বুক থেকে কলকল করে হাসি বেরোয়, এবং আমাদের হাত একে অন্যকে ধরে সুখী হয়ে ওঠে। ওরা অনেকক্ষণ ধরে বড়ো কষ্টে ছিলো।
জানো, রওশন তার চোখ দুটি আমার দু-চোখের ভেতরে বল্লমের মতো ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, কাদির স্যার আজকাল তোমাকে একদম দেখতে পারছে না।
আমি যে খুব খারাপ ছেলে, লেখাপড়া করি না, তাই, আমি হেসে বলি, আর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি রওশনের চোখের দিকে, তার ঠোঁটের দিকে। রওশন কী চম। কারভাবে যে তার ঠোঁট নাড়ে, নিচের ঠোঁট ছোঁয়ায় ওপরের ঠোঁটের সাথে, আর দাঁত দিয়ে তার ঠোঁট কাটে!
তুমি খুব খারাপ ছেলে হলে আমি খুব খারাপ মেয়ে, রওশন হাসে, আর বলে, কাদির স্যারের আজ খুব শিক্ষা হলো।
এমনভাবে শিক্ষা না দিলেও পারতে, আমি বলি, গুরুজন তো।
না দিয়ে কী করি? প্রত্যেক দিন কাদির স্যার তোমার নিন্দা করে, রওশন বলে, তাই ঠিক করে রেখেছিলাম একদিন স্যারকে ভুল অংক দুটি দেখাবো। ভুল ইংরেজিটা তো বাকিই রইলো। রওশন হাসে, আর আমার দিকে চোখ দুটি স্থির করে বলে, তোমাকে কেউ নিন্দা করলে আমার একদম ভালো লাগে না, কান্না পায়। আমাকে কেউ নিন্দা করলে তোমার ভালো লাগে, বলো?
না, লাগে না, কোনো দিন লাগবে না, আমি বলি।
তোমাকে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন দেখি, রওশন বলে, আমাকে নিয়ে কি তুমি স্বপ্ন দেখো?
দেখি, দিনরাত স্বপ্ন দেখি, আমি বলি।
তুমি দূরে চলে যাচ্ছো ভাবলে আমার কান্না পায়, রওশন বলে; এবং আমার। দু-হাতের মুঠো তার মুঠোর ভেতরে নিয়ে তার দু-চোখের ওপর চেপে ধরে; রওশনের দীর্ঘশ্বাসে আমার হাত দুটি কোমল হয়ে ওঠে।
আমি শিউরে উঠে দেখি রওশনের চোখের জলে আর দীর্ঘশ্বাসে আমার আঙুল ভিজে গেছে। রওশনের মুখের দিকে তাকাই আমি; আগে কখনো যা দেখি নি সে-অসম্ভব। সুন্দরকে দেখতে পাই রওশনের চোখে। অশ্রু। শব্দটি আমি জানি; কিন্তু এর সৌন্দর্য আমি কখনো দেখি নি; রওশনের চোখের কোণায় যে-সৌন্দর্য টলমল করে, যা একটি বিন্দু কিন্তু যা মহাসাগরের থেকেও বিশাল, তা-ই অশ্রু। রওশন দুঃখ পাচ্ছে, ওই দুঃখে রওশন সুন্দর হয়ে উঠেছে, আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি তার মুখের দিকে, সুন্দর। দুঃখের দিকে। এতো দিন আমি রওশনের হাসি দেখেছি, তার ঝিলিকে আমার হৃদয় ভরে গেছে, রওশনকে সুন্দর লেগেছে; কিন্তু আজ দেখছি ভিন্ন সৌন্দর্য, যা অশ্রুতে সাজানো; এতো সুন্দর আর কখনো লাগে নি রওশনকে। দুঃখকে আমার সুন্দর মনে হয়, আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি না। এক সময় মনে হয় রওশন নিজেই একটি অশ্রুবিন্দু হয়ে গেছে, আমার পাশে টলমল করে কাঁপছে, এখনই গলে কাঠের পাটাতনের ওপর। মিশে যাবে, আমি তাকে কোথাও খুঁজে পাবে না।
আমি কখনো দূরে যাবো না, আমি বলি।
তুমি চলে যাবে, আমি জানি, তুমি চলে যাবে, রওশন বলে, আর কয়েক মাস মাত্র। তখন আমাকে ভুলে যাবে।
কখনো দূরে যাবো না, তোমাকে কখনো ভুলবো না, আমি বলি; আমার মুঠোতে রওশনের হাত কাঁপতে থাকে।
তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, বাঁচার ইচ্ছে হবে না, রওশন বলে, তুমিই আমার সব।
আমি রওশনের মুখের দিকে তাকাই, তার মুখটি আমি সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি না, সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখতে পাচ্ছি তার ঠোঁট কাঁপছে। আমরা দুজন একই বয়সের, কিন্তু এখন রওশন যেভাবে আমার মুঠো ধরে আছে, যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে, ঠোঁট কাঁপছে, তাতে রওশনকে মনে হচ্ছে নারী, নিজেকে মনে হচ্ছে পুরুষ। বাড়ি ফেরার সময় এ-অনুভূতি আমাকে আলোড়িত করে তোলে, মনে হতে থাকে আমি পুরুষ, আমি রওশনের সব, রওশন আমাকে ছাড়া বাচবে না। নিজেকে আমার কেন্দ্র মনে হয়; রওশন আমাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে, আমাকে কেন্দ্র করেই বেঁচে আছে। এখন থেকে আমি রওশনকে হাসাতে পারি, আমি চাইলে সে রৌদ্রের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠবে; আমি রওশনকে কাঁদাতে পারি, আমি চাইলে সে শ্রাবণের মতো কাঁদবে। নিজেকে পুরুষ ভেবে একটা বিস্ময়কর সুখ আমি বোধ করি। রওশনের চোখের জল আমার চোখে সুন্দর লেগেছে, তার আরো চোখের জল দেখতে আমার ইচ্ছে হয়, আগামীকালও তার চোখের জল আমার দেখতে ইচ্ছে হয়। কীভাবে দেখবো? আগামীকাল আমি রওশনদের বাড়ি যাবো না; রওশন নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা। করবে, অপেক্ষা করে করে কষ্টে রওশনের বুক ভরে যাবে, তার কান্না পাবে, তার চোখ জলে ভরে উঠবে। পরের দিন বিকেলে আমি যাবো, দেখবো রওশনের চোখে জল। কিন্তু আগামীকাল রওশনকে না দেখে থাকতে আমার কষ্ট হবে, তার হাত না। ছুঁলে আমার কষ্ট হবে; আগামীকাল আমি রওশনদের বাড়ি যাবো, পরে যখন রওশনের চোখের জল দেখতে ইচ্ছে হবে, তখন এক বিকেলে যাবো না; আমার কথা ভেবে ভেবে কষ্টে রওশনের বুক ভরে যাবে। রওশন, আমার জন্যে অপেক্ষা-করে–থাকা অশ্রুবিন্দু; রওশন, আমার জন্যে বুক-ভরে-ওঠা দীর্ঘশ্বাস; রওশন, আমার জন্যে টলমল-করা সুন্দর দুঃখ।
রওশন আমাকে সৃষ্টি করে চলছে; প্রত্যেক বিকেলে রওশনের সাথে দেখা হওয়ার পরই আমি বদলে যাচ্ছি একটু একটু করে; রওশন আমাকে যেমন দেখতে চায়, আমি তেমন হয়ে উঠছি; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষটি হয়ে উঠছি আমি, রওশন আমাকে তা-ই দেখতে চায় বলে। আমি যে পুরুষ, এটা আমার মনে আসে নি; রওশনই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার ভেতরে একটি সিংহকে জাগিয়ে দিয়েছে রওশন। আগে যখন আমরা তুই বলতাম, তখন সমান ছিলাম দুজনেই; কিন্তু তুমি বলার পর থেকে রওশনই একটু একটু করে আমাকে তার থেকে ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছে, আমাকে সিংহাসনে বসাচ্ছে, সে বসছে সিংহাসনের পাশে মেঝের ওপর। সিংহাসনে তার বসার। কোনো ইচ্ছে নেই, যেনো সে বসেও সুখ পাবে না; আমাকে বসাতে পারলেই বেশি সুখ পাবে। রওশন কথায় কথায় বলে, তুমি তো ছেলে, তুমি তো পুরুষ; তাই আমি সব। পারি, সব আমার পারা উচিত; রওশন চায় বলেই আমার পারা উচিত বলে আমার। মনে হয়। রওশনের কথায় আমি গর্ব বোধ করি। একদিন আমার হঠাৎ মনে হয় রওশন সব সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েই থাকে; আমি চেয়ারে বসে থাকি, রওশন দরোজার পাশে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, বসে না। রওশনের দাঁড়িয়ে থাকার একটি সুবিধা হচ্ছে আমরা যে হাত ধরে আছি সেটা কেউ দেখতে পায় না উঠোন থেকে; কিন্তু আমি অন্য চেয়ারে গিয়েও দেখেছি, রওশন দাঁড়িয়েই থাকে, খুব দরকার না হলে বসে না।
রওশন, তুমি বসো, আমি বলি।
না, তোমার পাশে আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগে, রওশন বলে।
শুনে আমার ভালো লাগে, এবং আমি জানতে চাই, কেনো?
রওশন হাসে আর হাসে, আমার আঙুল নিয়ে খেলে, আর বলে, তা বলবো না, তা বলবো না।
শুনে আমার আরো ভালো লাগে, অন্তত একজন আছে, তার নাম রওশন, যার। ভালো লাগে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
আমি বলি, রওশনকে একটু কষ্ট দেয়ার জন্যেই বলি, যদি না বলো, তাহলে আর আসবো না।
রওশনের চোখে অশ্রুর সৌন্দর্য দেখা দেয়, আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি।
রওশন বলে, তুমি পুরুষ, তাই এতো নিষ্ঠুর কথা বলতে পারলে, আমি কখনো বলতে পারবো না।
আমি পুরুষ, আমার মনে হতে থাকে, রওশনের থেকে আমার স্থান উঁচুতে; আমি নিষ্ঠুর হতে পারি, রওশন পারে না; নিষ্ঠুরতাকে গৌরবের বলে মনে হয় আমার। আমি পুরুষ, নিষ্ঠুর হবো; রওশন নারী, অশ্রু হবে।
রওশন আমার বুকের সিংহকে আরো জাগিয়ে দেয়; বলে, তোমাকে নিয়ে আমি কতো গর্ববোধ করি! তোমাকে নিয়ে আমার কতো স্বপ্ন!
শুনে আমার বুক স্ফীত হয়ে ওঠে, গর্বে আমি পুরুষ হয়ে উঠি। আমাকে নিয়ে রওশন গর্ব বোধ করে, এটা আমার গর্ব। আমি কি গর্ব বোধ করি রওশনকে নিয়ে? হ্যাঁ, আমিও একরকম গর্ববোধ করি রওশনকে নিয়ে, সেটা হচ্ছে রওশন আমাকে ভালোবাসে, আর কাউকে বাসে না; রওশন আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, আর কারো জন্যে করে না; আমার মাথায় একটি মুকুট আছে, রওশনকে আমার মুকুটের সবচেয়ে দামি মাণিক্য বলে মনে হয়। বন্ধুরা আজকাল আমাকে খুব বেশি ঈর্ষা করছে। আমি যে প্রথম হই, সবাই জানে খুব ভালো করবো প্রবেশিকায়, কোনো অংক আমার ভুল হয় না, ইংরেজি বাঙলা সব আমার মুখস্থ, ব্যাডমিন্টনও আমি খুব ভালো খেলি, এজন্যে ওরা ঈর্ষা করে না; ঈর্ষা করে এজন্যে যে রওশন, যে সবচেয়ে রূপসী বলে বিখ্যাত আমাদের গ্রামে, তার সাথে আমার বিকেলে দেখা হয়, ওরা বুঝতে পারে। রওশন আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। ওরা আমার কাছে জানতে চায় রওশন আসলেই কতোটা সুন্দর, দূর থেকে তাকে যতো সুন্দর মনে হয় রওশন কি ততোটা সুন্দর? ওরা যে-সুন্দরের কাছে কখনো যেতে পারে নি, যার কাছে একবার যেতে পারলে ওরা আর কিছু চাইতো না মনে হয়, তার কাছে আমি প্রতি বিকেলে যাই, এর জন্যে। আমাকে ওরা ঈর্ষা করছে, আমি এটা উপভোগ করি। রওশন যে আমাকে ভালোবাসে আর আমি যে ভালোবাসি রওশনকে, একথা আমি ওদের বলি না, কখনো বলবো না; কিন্তু ওদের ঈর্ষায় আমি গর্ববোধ করি, রওশন আমাকে এ-গর্বের অধিকার দিয়েছে। আর রওশন আমাকে দিয়েছে জয় করার অভিলাষ। রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে, তার গর্ব আমার রক্ষা করতে হবে; তাই আমি ওই বিকেলের সময়টুকু ছাড়া বই ছেড়ে উঠি না। রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ না করলে আমি এতো পড়তাম না, পড়ছি। আমি রওশনের জন্যে, সে যেনো আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করে, চিরকাল গর্ববোধ করে, তাই আমি পড়ি, পড়ে আমি সুখ পাই। আগেও আমি পড়েছি, কিন্তু এতো সুখ পাই। নি; পড়া আমার জন্যে আনন্দ হয়ে উঠেছে, রওশনের জন্যে; ফিরে ফিরে পড়া সুখ হয়ে উঠেছে আমার, রওশনের জন্যে, আমি প্রতিটি অক্ষরে রওশনের মুখ দেখতে পাই, প্রতিটি অক্ষরে দেখতে পাই রওশন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। রওশন আমাকে সৃষ্টি করে চলছে, রওশন আমাকে পুরুষ করে চলছে।
রওশন, একটি চিঠিতে লিখেছে, আমাকে তোমার কেমন লাগে, আমার মুখ তোমার কেমন লাগে, আমার ঠোঁট তোমার কেমন লাগে, আমার চুল তোমার কেমন। লাগে, আমার চিবুক তোমার কেমন লাগে, আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার আমার বুক তোমার কেমন লাগে? এটুকু পড়ে আমার চারপাশ দপ করে জ্বলে ওঠে, আমি আগুনের মধ্যে পড়ে যাই, জ্বলতে থাকি; আমার মেঘে মেঘে ঘর্ষণ চলতে থাকে, বিদ্যুতের ঝিলিকে আমার আকাশ ফালা ফালা হয়ে যায়। আমি ঘুমোতে পারি না, শুধু স্কুপ স্তূপ শুভ্রতা, রজনীগন্ধার পাহাড়, ঢেউ, খড়ের গম্বুজ দেখতে থাকি; রওশনের চিঠি পড়ি-আর আর আর আর আমার আমার আমার আমার আমার। পরের শব্দটিতে এসে কেঁপে উঠি আমি। আমি কী লিখবো এর উত্তরে? আমি কি লিখবো যা আমার স্বপ্ন তাকে আমার কেমন লাগে এ-অসম্ভব প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেবো? আমার লেখার শেষ নেই এর উত্তরে, আমি হাজার হাজার বছর ধরে এর উত্তর লিখতে পারি। কিন্তু কিছুই আমি লিখে উঠতে পারি না। আমি এই প্রথম কোনো উত্তর দিতে পারি না। আমার আমার আমার আমার ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি আমি, ঘুম থেকে উঠে চারদিকে আমি স্কুপ স্থূপ শুভ্রতা দেখতে থাকি।
বিকেলে রওশনদের বাড়ি যাই, রওশনের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। রওশন তার চিঠিগুলো আমার হাতে দেয়, আমি কোনো চিঠি দিতে পারি না।
আমারগুলো? রওশন অবাক আর আহত হয়ে বলে।
লিখতে পারি নি, আমি মাথা নিচু করে বলি। কেননা পারো নি?
রওশন খুব দুঃখ পায়, আর বলে, আমাকে তুমি শুধু কষ্ট দিতে ভালোবাসো।
না, তা নয়, আমি বলি, আমি বুঝতে পারি নি…।
রওশন দু-হাতে আমার মুখ ধরে বলে, আমি জানতে চাই, চাই, চাই, কেমন লাগে তোমার আমার মুখ, আমার চোখ, আমার…।
এমন সময় শওকত এসে ঢোকে, আমি মুক্তি পাই।
কালকে আমরা কান্দিপাড়া বেড়াতে যাচ্ছি, শওকত হাসতে হাসতে বলে, কালকে কিন্তু রওশন মাহবুবকে দেখতে পাবে না।
আমি যাবো না, রওশন বলে; আমার দিকে কোমলভাবে তাকায়।
কেনো যাবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।
আমার ইচ্ছে, রওশন বলে, কান্দিপাড়া কী আছে দেখার?
নদী আছে খাল আছে ইলিশ আছে, শওকত হাসে, কিন্তু মাহবুব নেই।
ঠিক আছে, রওশন বলে, তাহলে মনে করো সেজন্যেই আমি যাবো না।
রওশন চিবুকে আঙুল রেখে চুপ করে থাকে, যেনো সে আর কথা বলবে না; তার। চুপ করে থাকার ভঙ্গি দেখে তাকে আমার জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে হয়, তার চিবুকে আমার নাক ঘষার ইচ্ছে হয়। রওশন ব্যথা পাচ্ছে, কিন্তু আমার বুক সুখে ভরে ওঠে; রওশন। বেড়াতে যাবে না, আমার জন্যেই যাবে না, কান্দিপাড়া দেখার কিছু নেই আমি সেখানে। নেই বলে। রওশন যদি কথাটি খুব চুপেচুপে আমাকে বলতো, তাহলেই আমার রক্ত। মধু হয়ে উঠতো, বাঁশি বাজতে থাকতো আমার সমস্ত নদীর পারে আর কাশবনে, কিন্তু রওশন চুপেচুপে বলে নি, শওকতকে শুনিয়ে বলেছে, সারা পৃথিবীকে রওশন জানিয়ে দিয়েছে সে কান্দিপাড়া বেড়াতে যাবে না, কেননা সেখানে আমি নেই। আমার ইচ্ছে হচ্ছে বাইরে গিয়ে আমি বন্ধুদের ডেকে জানিয়ে দিই যে রওশন কান্দিপাড়া বেড়াতে যাবে না, কেননা সেখানে দেখার কিছু নেই, কেননা সেখানে আমি নেই। চঞ্চলভাবে ঘর থেকে আমার ছুটে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, কিন্তু আমি বেরোতে পারি না।
শওকত বেরিয়ে যেতেই রওশন আমার হাত ধরে। আমিও ধরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ছিলাম, ভেবেছিলাম আজ রওশনের হাত আমিই প্রথম ধরবো, অভিমানে রওশন হয়তো আমার হাত ধরবে না। বিষণ্ণ চাঁদের মতো তার মুখ আমার দিকে তুলে ধরে রওশন। বলে, আজ তোমাকে একটি শাস্তি পেতে হবে।
খুব কঠিন শাস্তি? আমি জানতে চাই।
তোমার জন্যে কঠিনই, রওশন বলে, খুব কঠিন। রওশন আমার দুটি হাতই তুলে নিয়েছে তার হাতে।–আমি তৈরি, আমি হাসি আর বলি, দাও, শাস্তি দাও, খুব কঠিন শাস্তি দিয়ো, তারপর ক্ষমা কোরো।
সন্ধ্যা হলেই, রওশন বলে, তুমি আজ বাড়ি যেতে পারবে না, আমার সাথে সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ তুমি থাকবে। সন্ধ্যার পরও আমি তোমাকে দেখতে চাই, তোমার মুখ দেখতে চাই, তোমার কথা শুনতে চাই। রওশন একটু থেমে বলে, আর সন্ধ্যার পরও তুমি আমাকে দেখো, আমি চাই।
রওশন আমার দিকে তাকিয়ে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকে, তার চোখ থেকে। মুখ থেকে আলো না শিশির না কী যে ঝরতে থাকে, আমি তা বুঝতে পারি না; আমার শুধু ইচ্ছে করে রওশনের চোখ আর মুখ থেকে যা ঝরে পড়ছে, যার নাম আমি কোনো দিন জানবো না, তার সবটুকু আমার হৃদয়ে চিরকালের জন্যে ধরে রাখতে। রওশনের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি, আমার রক্তমাংস সবুজ কোমল ঘাস হয়ে মাঠের পর মাঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শওকত ফিরে এলেই রওশন বলে, জানো, একটি সুসংবাদ আছে, সন্ধ্যার পরও মাহবুব আমাদের সাথে থাকবে। রওশন এমনভাবে বলে যেনো শওকত এ-সংবাদ শোনার জন্যে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আছে।
শওকত হেসে বলে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহবুব সারারাত থাকবে না।
তুমি বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো, রওশন রেগে ওঠে, তার রাগ থেকে বোঝা যায় সত্যিই কষ্ট পাবে একজন; তখন কী সুন্দর যে লাগে রওশনকে।