পরের দিন সকালে মংকুর সঙ্গে দেখা হল তিনসুকিয়ার ফেমাস সিনেমা হল করোনেশনের সামনে৷ জায়গাটা জিএনবি রোডের ওপর, খুবই জনবহুল রাস্তা৷ রিকশা, টেম্পো, আর গাড়িঘোড়ার আওয়াজে কান পাতা দায়৷ সেখানে একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছি, আর ভাবছি মনুষ্যচরিত্র কত জটিল, এমন সময় ডানদিকের কাঁধে একটা টোকা পেয়ে দেখি মংকু৷ তবে ও একা নয়, সঙ্গে আরেকজন৷
লোকটা যে মংকুরই জাতভাই সেটা আর বলে দিতে হয় না৷ মঙ্গোলীয় চোখমুখ, গাঁট্টাগোঁট্টা শরীর, হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হবে না৷ পোশাকে-আশাকে বোঝা যায় মোটামুটি পয়সাওয়ালা লোক৷ কিন্তু ছটফটে চোখ আর ছোট করে কাটা কদমছাঁট চুলে একটা সতর্ক ও ধূর্ত মানুষের অবয়ব স্পষ্ট৷
লোকটাকে দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম৷ মংকুকে আমি এখানে আসতে বলেছিলাম বটে, কিন্তু সঙ্গে অন্য কাউকে আনতে তো বলিনি? এ আবার কোন উটকো আপদ?
মংকুই আমাকে ইশারা করে বলল সাইডে আসতে৷ পান দোকানটার পেছনে একটা বটগাছের নীচে নির্জন জায়গায় দাঁড়ালাম আমরা তিনজন৷ মংকুর সঙ্গে আসা লোকটা একটা বিড়ি ধরাল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বিড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘চলে?’’
বিড়ি-সিগারেট ছেড়েছি প্রায় বছর পাঁচেক৷ তবুও সম্পর্ক তৈরির খাতিরে একটা বিড়ি টেনে নিলাম৷ আর তারপর মংকুর এগিয়ে দেওয়া আগুনে বিড়িটা জ্বালিয়ে একটা টান দিয়েই বুঝলাম যে মস্ত বড় ভুল করেছি৷ এই কড়া তামাকের ধক সহ্য করার ক্ষমতা আমার কলজের নেই৷
‘‘আমার নাম পরাগ বসুমাতারি৷ এখানকার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সরকারি গাইড৷’’ বিড়িতে একটা লম্বা টান মেরে বলল লোকটা৷ তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সরু চাউনিতে আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘‘মংকু আমাকে বলল, আপনি নাকি কাল কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলেন?’’
কথাটা মংকু আর আমার মধ্যে থাকার কথা৷ ব্যাটা সেটা চাউর করে দিয়েছে বলে ওর দিকে একটা কড়া চাউনি দিলাম৷
লোকটা ভকভক করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘‘মংকু কথাটা আমাকে বলেছে বলে ওর ওপর খাপ্পা হওয়ার কোনো দরকার নেই সাহেব৷ সম্পর্কে ও আমার জ্ঞাতিভাই হয়, তার ওপর জিগরি দোস্তও বটে৷ ব্যাটা কোনো কথাই আমার কাছে লুকোয় না৷ আপনি কবে এসেছেন, কেন এসেছেন, জঙ্গলে গিয়ে কী করেন, মানে মোটমাট আপনার ব্যাপারে সবই আমার জানা৷ পরশু আপনি মাগুরি বিলের পাশে একটা রেয়ার সাদাপেট হেরনের ছবি তুলতে গিয়ে সাপের কামড় খেতে খেতে বেঁচে গেছেন, ঠিক কি না?’’
কথাটা নির্জলা সত্যি৷ ইচ্ছে করছিল মংকুর কানের গোড়ায় গুছিয়ে একটা থাপ্পড় কষাই৷ শালা মিরজাফর! শুয়োরের বাচ্চাটা সব কথা উগরে দিয়েছে এর কাছে৷
‘‘ফলে কাল আপনি কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলেন, এইরকম একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আমার কাছে ও লুকোবে সেটা তো হতে পারে না৷’’
হাতে ধরা বিড়িটায় সন্তর্পণে আরেকটা টান দিয়ে বললাম, ‘‘হুঁ, গেছিলাম৷ তো?’’
লোকটার চাউনি একটু কড়া হয়ে উঠল, ‘‘তার প্রমাণ দিতে পারেন?’’
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা৷ কেন রে ভাই, আমি কোথায় কোন মন্দিরে গেছিলাম তার প্রমাণ তোকে কেন দিতে যাব? তুই লোকটা প্রমাণ চাওয়ারই বা কে?
আমার প্রশ্নটা শুনে পরাগ থমকাল খানিক৷ তারপর হাতের বিড়িটা মাটিতে ফেলে চটি পরা পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল, ‘‘কারণ আমার মনে হয় আপনি মিথ্যে বলছেন৷’’
আমিও বিড়িটা ফেলে বুটের ডগা দিয়ে পিষে দিয়ে বললাম, ‘‘তাতে আমার ছেঁড়া যায়৷’’
কুতকুতে চোখ দুটো মেলে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল পরাগ বসুমাতারি৷ বোধহয় আমার মনের কথাটা আঁচ করতে পারল৷ সুরটা সামান্য নরম করে বলল, ‘‘রাগ করবেন না দাদা৷ আপনি যদি কাউরীবুড়ির মন্দিরের ব্যাপারে আপনার মতলবটা একটু খুলে বলেন, তাহলে হয়তো আপনার কাজে লাগলেও লাগতে পারি৷’’
‘‘সে তো বুঝলাম৷ কিন্তু আমার কাজে লেগে আপনার স্বার্থ?’’ সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম৷
‘‘স্বার্থ আছে বই কি৷ নইলে আর এখানে ছুটে আসব কেন?’’
‘‘কী চাই? টাকা?’’ আদানপ্রদানের জায়গাটা প্রথমেই খোলসা হয়ে যাওয়া ভালো৷
টাকার কথা শুনে লোকটা থমকাল খানিক৷ ফের সেই কুতকুতে চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে৷ তারপর গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘‘টাকার ব্যাপারটা তো আছেই৷ তা ছাড়াও অন্য আরেকটা কারণও আছে৷’’
‘‘কী সেটা?’’
লোকটা আরেকটা বিড়ি ধরাল৷ একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল ওকে৷ বিড়িতে একটা লম্বা টান মেরে খানিকটা আত্মমগ্ন ভাবে বলল, ‘‘সেটা বলার আগে এই কাউরীবুড়ির মন্দির নিয়ে একটু ভেঙে বলতে হয় যে!’’
পাশে একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি পাতা ছিল৷ সেখানে বেশ জুত করে বসলাম৷ তারপর মনের ভাব লুকিয়ে একটু হেসে পরাগকে বললাম, ‘‘এসব কথা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয় ভায়া? এসো, এখানে বসো তো৷ চা খাবে?’’ মনে হল আপনি-র বদলে তুমি বললে হয়তো ব্যাপারটা আরও সহজে ম্যানেজ করা যাবে৷
সামনে দিয়ে মস্ত বড় কেটলি হাতে এক চাওয়ালা যাচ্ছিল৷ তাকে পাকড়াও করে তিন কাপ চা কেনা হল৷ একটা বড় ভাঁড়ে চা নিয়ে শ্রীমান মংকুকুমার উলটোদিকে পড়ে থাকা একটা বড় পাথরের ওপর অধিষ্ঠিত হলেন৷
চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিল পরাগ, দু’হাতে চেপে ধরে খানিকটা ওম নিল৷ তারপর একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘‘আপনি কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছিলেন শুনেই আমি কেন দৌড়ে এসেছি সেটা কি বুঝতে পারছেন?’’
নেতিবাচক মাথা নাড়লাম৷ এখনও অবধি কিছুই বুঝিনি৷
‘‘এই মন্দির আমাদের, মানে দেওরিদের কাছে একটা রহস্যবিশেষ বুঝলেন? আমাদের সমাজের বাইরে কেউ এর নাম জানে না৷ দেওরিদের মধ্যেও যারা জানে তাদের সংখ্যাও এক হাতেই গোনা যায়৷ তবে তারাও এর নামই শুনেছে, কেউ দেখেনি৷ আমরা বিশ্বাস করি যে কাউরীবুড়ির থানে যে যায়, সে আর বেঁচে ফেরে না৷’’
বেঁচে না ফেরার ব্যাপারটা কালকের সেই ভদ্রমহিলাও বলছিলেন বটে৷ আর দেওরি নামে যে এখানে একটা ট্রাইব আছে সেটা আগেই জানতাম৷ কিন্তু দেওরিদের সঙ্গে এই কাউরীবুড়ির মন্দিরের কী সম্পর্ক?
চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, ‘‘কেসটা কী খুলে বলো তো ভায়া৷ আমি তো কিছুই বুঝছি না৷ কে এই কাউরীবুড়ি? তাঁর মন্দিরে যাওয়া নিয়ে এত বিধিনিষেধ কীসের? আর সেখানে কেউ গেলে বেঁচে ফেরে নাই বা কেন?’’
আমার দিকে আড়চোখে তাকাল পরাগ৷ এতক্ষণে ওর আত্মভোলা ভাবটা কেটে গিয়ে সেই ধূর্ত ভাবটা ফিরে আসছিল৷ মিচকে হেসে বলল, ‘‘দেখুন, এসব হচ্ছে গিয়ে আমাদের জাতের গোপন কথা৷ এসব কথা এদিক-ওদিক বলে বেড়ানো আমাদের জন্য একেবারে নিষেধ, বুঝলেন?’’
বুঝলাম৷ গাড়ি লাইনে আসছে, না বুঝে উপায় কী?
‘‘একে আপনি বাইরের লোক, তার ওপর কাউরীবুড়ির মন্দিরেও গিয়ে একটা মস্ত বড় অপরাধ করে বসে আছেন৷ তার ওপর আপনার যে কী মতিগতি সেসব কিছুই জানি না৷ আপনাকে এতসব বলাটা কি ঠিক হবে?’’
বুঝলাম, মংকু দেখে দেখে ঠিক লোককেই এনেছে আমার কাছে৷ পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে লোকটার জামার বুকপকেটে গুঁজে দিলাম৷
তাতে কাজ হল৷ শ্রীমান পরাগ বসুমাতারি তাঁর শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী বিতরণ শুরু করলেন৷
‘‘আমরা দেওরিরা হচ্ছি এই উজনি আসামের অনেক পুরোনো জনজাতি৷ দেওরি কথাটা এসেছে দেব বা দেও থেকে৷ এককালে ঈশ্বরভক্ত জাতি হিসেবে পুরো অহোমে আমাদের বিপুল খ্যাতি ছিল৷ দেবী কেশাইখাতি-র নাম শুনেছেন তো?’’
মাথা নেড়ে জানালাম যে শুনেছি তো বটেই৷ ভারতবর্ষে পূজিত সবচেয়ে ভয়ংকরী দেবীদের মধ্যে ইনি অন্যতমা৷ সুটিয়া রাজত্বের সময় নিত্য নরবলি হত দেবী কেশাইখাতি-র মন্দিরে৷ সেই থেকে দেবীর নাম কেশাইখাতি বা কেচাইখাতি৷ অর্থাৎ যে দেবী কাঁচা খান!
‘‘কাউরীবুড়ি হচ্ছেন কেশাইখাতি-র মতোই আমাদের এক অত্যন্ত ভয়ংকর দেবী৷
এঁর ব্যাপারে বিশদে বলার আগে আমাদের দেওরিদের আরেকটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো৷ সেটা হচ্ছে যে আমাদের মধ্যে তিনটি প্রধান উপজাতি বা গোষ্ঠী আছে৷ তাদের নাম হচ্ছে দিবংগোঁয়্যা, বড়গোঁয়্যা আর তেঙাপোনিয়া৷’’
এই তিনটে নাম রিসেন্টলি কোথায় শুনেছি না? স্মৃতির মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ করে বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে গেল৷ মংকুই বলেছিল বটে!
‘‘কিন্তু এককালে এই তিনটে ছাড়াও আমাদের দেওরিদের আরও একটি উপজাতি ছিল৷’’
‘‘তাই নাকি? কী নাম তাদের?’’
‘‘পাতরগোঁয়্যা৷’’
‘‘ভেরি ইন্টারেস্টিং তো৷ তা ছিল বলছ কেন?’’
‘‘কারণ এখন আর তারা নেই বলে৷’’
পৃথিবীর ইতিহাসে বিলুপ্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া জনজাতির উদাহরণ বিরল নয়৷ ফলে তাতে বিশেষ আমল দিলাম না৷
‘‘হুম৷ তা এই পাতরগোঁয়্যা না কী একটা বললে, তাদের আজ কোনো চিহ্ন নেই কেন?’’
‘‘সে এক খুব পুরোনো গল্প৷’’ বেঞ্চিতে পা দুটো তুলে বেশ জুত করে বসল পরাগ, ‘‘আর সেটাই আপনাকে বিশদে বলার৷
আমাদের কিংবদন্তি অনুযায়ী, আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরি নাকি ওদের দেবীর পুজোয় খুব বড়সড় একটা ভুল করে৷ তখন দেবী কঠিন অভিশাপ দেন যে একমাত্র বড়দেওরির পরিবার ছাড়া এই গোষ্ঠীর সবাই সবংশে নিহত হবে৷ আর বড়দেওরির বংশের সবাইকে বংশানুক্রমে অনন্তকাল ধরে দেবীর পুজো করে যেতে হবে৷’’
‘‘ইন্টারেস্টিং! কী এমন অপরাধ শুনি?’’
‘‘সেটা কেউ জানতে পারেনি৷ তবে সাংঘাতিক কিছু হবে৷ নইলে এত বড় অভিশাপ কেউ দেয়? দেবদেবীর পুজোয় ছোটখাটো কত ধরনের খুঁতই তো হয়ে থাকে৷’’
‘‘হুম৷ তা পাতরগোঁয়্যাদের সেই দেবীই কি কাউরীবুড়ি?’’
মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বলে পরাগ৷
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘তারপর আবার কী৷ একদিনের মধ্যে পাতরগোঁয়্যারা দেবীর রোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷’’
কথাটা শুনে থমকে গেলাম৷ লোকটা বলছেটা কী? একটা গোটা উপজাতি একদিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? তাও কোনো এক পাথুরে মূর্তির অভিশাপে? এরকম হয় নাকি?
‘‘কীভাবে নিশ্চিহ্ন হল শুনি? যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে? ঝড়-ঝঞ্ঝা? অথবা আগুন? নাকি বন্যা?’’
এইবার প্রথমবার একটু অস্বস্তি দেখলাম পরাগের মুখে৷ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘সেটা ভারী অদ্ভুত কাহিনি দাদা৷ আমাদের দেওরিদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এই কাহিনি চলে আসছে৷ এটা শুনলে বুঝবেন কেন কেউ কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার সাহস করে না৷
আজকাল আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই যে কে দিবংগোঁয়্যা আর কেই বা তেঙাপোনিয়া৷ সবাই মিলেমিশে গেছে৷ কিন্তু অনেক আগে সেটা বোঝা যেত৷ তখন চারটে গোষ্ঠী আলাদা আলাদা গ্রামে থাকত৷ এক গোষ্ঠীর লোকজনের পক্ষে অন্য গোষ্ঠীর গ্রামে ইচ্ছেমতো ঢোকা-বেরোনোর ওপর একটা অলিখিত কড়াকড়ির ব্যাপার ছিল৷’’
‘‘তা তোমাদের এই গ্রামগুলো ছিল কোথায়?’’
‘‘এই এখানেই৷ সদিয়া আর তিনসুকিয়া মিলিয়ে৷ যেমন ধরুন আমি জাতিতে দিবংগোঁয়্যা৷ আমাদের আদি গ্রাম ছিল ডুমডুমা বলে একটা জায়গায়৷ এখান থেকে আধঘণ্টার রাস্তা৷’’
‘‘আর পাতরগোঁয়্যাদের?’’
‘‘পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামটা ছিল অন্যদের থেকে একটু দূরে, মাগুরি বিলের ধারে৷ জঙ্গলের মধ্যে যে শুখানালাটা আপনি দেখেছিলেন, তার ওপারে৷
পাতরগোঁয়্যারা চিরকালই অন্যদের থেকে একটু তফাতে থাকতে পছন্দ করত, সবার সঙ্গে চট করে মিশত-টিশত না৷ ওদের আচার-আচরণ, বেশভূষা, এসবও ছিল অন্যদের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা৷’’
‘‘তাতে বাকিরা, মানে অন্য তিন জাতের লোকজন ওদের নিয়ে কিছু বলত না?’’
‘‘প্রশ্নই ওঠে না! ঘাঁটানো তো দূরে, বাকিরা বরং ওদের একটু ভয়ই পেত৷’’
‘‘কেন? ভয় পেত কেন?’’
‘‘তার দুটো কারণ৷ আপনি তো জানেনই, আমরা এমনিতে পুজো-আচ্চা, ঝাড়ফুঁক, এসবে খুবই বিশ্বাস করি৷ আমাদের বড়দেওরিরাও প্রত্যেকেই তুকতাক ইত্যাদিতে খুব পারদর্শী৷ কিন্তু পাতরগোঁয়্যাদের তুকতাক বা তন্তরমন্তর ছিল বাকিদের থেকে অনেক উঁচু দরের৷ সাধারণ বিষকাটান, বাটিচালা, ধুলাপড়া, বাণমারা এসব ছোটখাটো বিদ্যা তো ছেড়েই দিন৷ বিভিন্ন ঘরোয়া অশান্তির উপশম, সাপে কাটার ওষুধ, বিভিন্ন জটিল মেয়েলি রোগের চিকিৎসা, এসবেও এদের খ্যাতি ছিল সাংঘাতিক৷ আর মারণবিদ্যায় তো কথাই নেই৷ যদি পাতরগোঁয়্যাদের কেউ অন্য জাতের কারও ওপর রুষ্ট হত, তবে আমরা ধরেই নিতাম যে সে আর বেশিদিন বেঁচে নেই৷’’
‘‘এটা তো হল গিয়ে প্রথম কারণ৷ তবে দ্বিতীয়টা?’’
‘‘বলছি সাহেব৷ সেটাই হচ্ছে আসল৷’’
‘‘কী সেটা?’’ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আড়চোখে দেখলাম মংকুও উৎকর্ণ হয়ে শুনছে৷
একটু সময় নিল পরাগ৷ চোখ কুঁচকে কী যেন একটা ভাবছিল ও৷ তারপর বলল, ‘‘এককালে আমাদের মধ্যে নরবলির প্রচলন ছিল জানেন তো?’’
‘‘জানি৷ সুটিয়া রাজাদের রাজত্বের সময় দেবী কেচাইখাতির কাছে রেগুলার নরবলি হত৷ বলির মানুষ সাপ্লাই আসত মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে থেকে বা যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া অন্য উপজাতির লোকদের থেকে৷ কি, ঠিক বলেছি তো?’’
‘‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন৷ শুধু জেনে রাখুন যে সেই বলি দেওয়ার অধিকার ছিল একমাত্র পাতরগোঁয়্যাদের৷ আর কারও নয়৷’’
চুপ করে রইলাম৷ এই তথ্যটা জানা ছিল না৷
‘‘আমাদের প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, সেইজন্য পাতরগোঁয়্যারা অন্য জাতের লোকজনকে একটু নীচু নজরে দেখত৷ অন্য জাতের লোকেরাও নাকি পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে বিশেষ একটা যেত-টেত না৷ গেলেও চেষ্টা করত বেলা থাকতে থাকতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের গ্রামে ফিরে আসা যায়৷’’
ব্যাপারটা উত্তরোত্তর জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল৷ এসব উপজাতিদের মধ্যে অনেক গল্পগাছা, কিংবদন্তি, লোককাহিনি ইত্যাদি প্রচলিত আছে জানি৷ কিন্তু এটা তাদের মধ্যে একেবারে অন্যরকম৷
‘‘তবে আরও একটা ব্যাপারে ওরা আমাদের থেকে একদম আলাদা ছিল৷’’
‘‘যেমন?’’
‘‘বড়দেওরি মানে পুরুষ, চিরকাল আমরা এই দেখে এসেছি৷ কিন্তু ওদের সমাজ চালাত মেয়েরা৷ মেয়েরাই ওদের বড়দেওরি হতেন৷ একজন বড়দেওরি মরে গেলে তাঁর বড় মেয়ে পরের বড়দেওরি হতেন, এইভাবে চলত৷’’
শোনামাত্র নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল আমার৷ কালকেই এই কথাটা শুনেছি না? কিন্তু সেটা ওকে বুঝতে দিলাম না৷
‘‘সে তো বুঝলাম৷ কিন্তু তুমি আসল গল্পটাই বললে না যে৷ পাতরগোঁয়্যারা সবাই একদিনের মধ্যে উধাও হয়ে গেল কী করে?’’
ফের খানিকক্ষণ চুপ করে রইল পরাগ৷ তারপর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘ওদের দেবী যে রুষ্ট হয়ে খুব সাংঘাতিক একটা অভিশাপ দিয়েছেন সে খবর আমরা অন্যভাবে পেয়েছিলাম বটে৷ কিন্তু সেই রাতে কেউ আর ভয়ে ওদের গ্রামের রাস্তা মাড়ায়নি৷’’
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘সে রাতটা ছিল কার্তিক মাসের চতুর্দশী, রাত পেরোলেই অমাবস্যা৷ পরের দিন সকালে বাকি তিনটে গোষ্ঠীর গাঁওবুড়ো আর পারিয়া-রা বাছা বাছা কয়েকজন সাহসী পুরুষ সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামের উদ্দেশে৷ হাজার হোক, ওরাও দেওরি, বালিয়াবাবা আর তাম্রেশ্বরীর লোক বলে কথা৷ কী হল না হল সেটা তো একবার দেখে আসতে হয়, না কি?’’
‘‘তারপর?’’ আমার গা বেয়ে নিজের অজান্তেই একটা শিরশিরানি ভাব উঠে আসছিল৷
‘‘আগেই বলেছি, পাতরগোঁয়্যাদের বসবাস ছিল অন্যদের থেকে বেশ একটু দূরে৷ তার ওপর পুরো গ্রামটাই ছিল বাঁশের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা৷ সামনে মস্ত বড় একটা শালকাঠের দরজা৷ বাইরের লোকজন ওখানে গিয়ে আওয়াজ দিলে দরজাটা খুলে যেত৷
সেই অমাবস্যার দিন, গাঁওবুড়োরা যখন ওদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছোয় তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধে নামছে৷ গিয়ে দ্যাখে চারিদিকে সব কিছু নিঝুম৷ অত বড় গ্রাম থেকে শুধু একটা আওয়াজই ভেসে আসছে, একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ৷ এ ছাড়া চারিদিক একেবারে শুনশান৷
লোকজন গিয়ে প্রথমে দরজায় ঠক ঠক করে৷ তারপর তাতে কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে হাঁকডাকও করে কিছুক্ষণ৷ তাতেও কাজ না হওয়ায় শেষমেশ জোয়ান মদ্দরা মিলে দরজাটা একটু জোরে ধাক্কা মারে, আর দরজাটা নিজে নিজেই হাট হয়ে খুলে যায়৷’’
তারপর কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ্য৷ আমি আর মংকু একেবারে চুপ৷
‘‘ভেতরের দৃশ্য দেখে সবাই খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকে৷ তারপর দুদ্দাড় করে যে যেদিকে পারে ছুটে পালায়৷’’
‘‘কেন?’’ প্রশ্ন করার সময় বুঝতে পারছিলাম যে আমার হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করছে৷
‘‘কারণ ওরা দ্যাখে যে গ্রামের মধ্যে কোথাও কোনো মানুষের চিহ্নমাত্র নেই৷ এমনকি সামনেই যে দেওথান, সেটাও ফাঁকা৷ দেওথানের সামনে একটা গাছ থেকে ঝুলছে সেই অভিশপ্ত বড়দেওরির দেহ, আর তার বাচ্চা মেয়েটা মায়ের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে৷ ব্যস, এই ছাড়া মানুষজন বলতে কেউ নেই, কোত্থাও নেই, কিচ্ছু নেই৷ তার বদলে সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে শুধু ওরা৷’’
‘‘কারা?’’
বোধহয় নিজের অজান্তেই গলাটা নীচু হয়ে গেল পরাগের, ‘‘কাক৷ গোটা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে আছে অগুনতি কাক৷ তাদের সবার চোখ লাল, সবার ঠোঁটে রক্ত৷’’
* * * *
বিকেলে নিজের ঘরের আরামকেদারায় বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলাম৷ ঘটনা যেভাবে জট পাকিয়ে উঠেছে সেটা একবার ঠান্ডা মাথায় বুঝে নেওয়া দরকার৷
গত কালকের অভিজ্ঞতা আর আজকে শোনা গল্পটা মেলাতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না৷ পরাগের বক্তব্য অনুযায়ী, শুখানালার ওপারেই ছিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম৷ মানে এখন যেখানে কাউরীবুড়ির মন্দির৷ সেই মন্দিরের প্রধান সেবায়েত ছিলেন মহিলারা৷ বংশানুক্রমে নয়, মাতৃ-অনুক্রমে৷ পরাগের বয়ান অনুসারে, কাউরীবুড়ির অভিশাপে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম ছারখার হয়ে যায়, শুধু দেবীর অভিশাপ পূরণ করার জন্যই বড়দেওরির কন্যাটি বেঁচে থাকে৷
ওদিকে কাউরীবুড়ির মন্দিরের মহিলাটি বলেছিলেন একমাত্র তাঁদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া অন্য কারও সেখানে যাওয়া নিষেধ৷ হতেই পারে যে ইনিই সেই পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির উত্তরসূরি৷ তিনি এখনও তাঁদের পারিবারিক অভিশাপের উত্তরাধিকার বহন করে চলছেন৷ আর সেই থেকে দেওরিদের বাকি উপজাতিরা কাউরীবুড়ির থানকে যমের মতো ডরায়, সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে৷
তবে যেটা আমাকে ভাবাচ্ছিল সবচেয়ে বেশি, সেটা হচ্ছে কাক৷ আজ অবধি কাকেদের আমি অত অদ্ভুত আচরণ করতে দেখিনি, যা কাল দেখলাম৷ কাউরীবুড়ির মন্দিরে অত কাক কী করছিল? তাদের অমন ভয়ংকর চাউনি কেন?
অত বছর আগে পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে ওরা অত কাক দেখেছিল কেন? কী হয়েছিল পাতরগোঁয়্যাদের? কীভাবে উধাও হয়ে গেল ওরা?
হয়তো চিন্তায় অত্যধিক মগ্ন হয়ে থাকার কারণেই খেয়াল করিনি যে মাধুরী কখন ঘরে ঢুকে পড়েছে৷ তাই ও যখন জিজ্ঞেস করল, ‘‘কী বিড়বিড় করছেন?’’ আমি তখনও ধাতস্থ হইনি৷ আনমনে ওর দিকে চেয়ে পালটা প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘‘কাউরীবুড়ির মন্দিরে গেছ কখনও?’’
প্রশ্নটা শুনে হেসেই ফেলল মাধুরী, ‘‘ধুত, কী যে বলেন! কাকের আবার মন্দির হয় নাকি?’’
কথাটা মাথায় সেঁধোতে একটু সময় নিল, ‘‘কাকের মন্দির কখন বললাম? বললাম যে কাউরীবুড়ির…’’
‘‘ওই হল৷ অসমিয়া ভাষায় কাউরী মানে কাক৷’’
কথাটা শুনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সোজা হয়ে বসলাম৷ কাউরী মানে কাক? তার মানে কাউরীবুড়ি আসলে কাকেদের দেবী? মাই গুডনেস!
পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে নিলাম৷ এখন আমার কাজ অন্য৷ কাউরীবুড়ি রহস্য নিয়ে না হয় পরে ভাবা যাবে৷
সোজা হয়ে বসে মাধুরীকে সামনের চেয়ারে বসতে বললাম৷ তারপর প্রশ্ন করলাম, ‘‘এবার বলো তো তোমার সঙ্গে অনির্বাণের কেসটা কী?’’
প্রশ্নটা শুনে মাধুরী খানিকক্ষণ শাড়ির আঁচলটা আঙুলে জড়াল৷ তারপর অস্ফুটে বলল, ‘‘কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না৷’’
‘‘টেনশন নেওয়ার কিছু নেই৷ একদম ঠান্ডা মাথায় পরপর বলে যাও৷ কোনো ডিটেইলস বাদ দেবে না৷’’
‘‘না না…টেনশনের ব্যাপার নয়৷ আসলে ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত যে আমার নিজের পক্ষেও সেটা বিশ্বাস করা খুব মুশকিল৷’’
‘‘কীরকম?’’
প্রশ্নটার সরাসরি কোনো জবাব দিল না মাধুরী৷ তার বদলে উলটে আমাকে একটা প্রশ্ন করে বসল, ‘‘আচ্ছা দাদা, একটা কথা বলুন, আপনি তো আমার থেকে বয়সে বড়৷ তার ওপর কলকাতার মতো বড় শহরে থাকেন৷ সেখানকার জীবন নিশ্চয়ই আমাদের এই তিনসুকিয়ার থেকে অনেক জটিল?’’
ম্লান হাসলাম, ‘‘সে আর বলতে? বড় শহরের জীবন শুধু জটিল নয়, মাকড়সার জালের মতো৷ সেখানে একবার যদি কেউ আটকে পড়ে, তবে তার আর নিস্তার নেই৷’’
‘‘অনেক রকমের সাংসারিক অশান্তিও দেখেছেন নিশ্চয়ই?’’
‘‘তা দেখেছি বই কি! আমার কাছে ওষুধ নিতে বা কোষ্ঠীবিচার করাতে তো কম লোক আসেন না৷ তাঁদের কাছে যেসব গল্প শুনি, লিখতে পারলে একটা মহাভারত হয়ে যেত৷’’
চুপ করে গেল মাধুরী৷ ফের সেই অন্যমনস্ক ভাব৷ দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছে৷ কপালে ভ্রূকুটি, চোখে চিন্তিত দৃষ্টি৷ যেন কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে৷
‘‘কী হল মাধুরী? কিছু ভাবছ?’’
আমার এই কথায় সাড় ফিরে এল মাধুরীর মধ্যে৷ যেন অতল চিন্তার সমুদ্র সাঁতরে পারে এসে পৌঁছোল সে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেই গন্ধটা ফের নাকে এল আমার৷
ভিজে কাঠ পোড়ার গন্ধ৷ কটু, ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷
‘‘আমি…আমি…বুঝতে পারছি না কীভাবে বলব৷ মানে বিষয়টা যেমন অদ্ভুত, তেমনই…তেমনই নোংরা…আর আর…’’
নড়েচড়ে বসলাম৷
‘‘কাউকে বলে বোঝানো যাবে না দাদা৷ যাকে বলব সেই বলবে হয় আমি পাগল…নইলে আমি…আমি…ইচ্ছে করে খুব খারাপ কিছু ভাবছি…আমি একটা অত্যন্ত নোংরা মনের মেয়ে৷’’
‘‘সেইজন্যই কি নিজের মা-বাবাকেও কিছু বলোনি এই নিয়ে?’’
মাথা নাড়ল মাধুরী৷
‘‘হুম৷ তুমি এক কাজ করো৷ শুধু ঘটনাগুলো আমাকে পরপর বলে যাও৷ খারাপ না ভালো, সে বিচারের ভার নাহয় আমি নিলাম৷’’
আরও খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুলল মাধুরী৷
‘‘আমাদের বিয়ের গল্প তো শুনেইছেন৷ অনির্বাণের সঙ্গে আমার আলাপ আমার এক বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টিতে৷ আমাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় ভালোবাসায় গড়াতে দেরি হয়নি বেশি৷
মা-বাবা যখন আমার জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করেন, আমিই বলি অনির্বাণের কথা৷ ছেলে হিসেবে অনি খুব ভালো৷ দেখতে ভালো, পড়াশোনায় ভালো৷ ভালো চাকরি করে৷ মা-বাবার না করার কোনো কারণ ছিল না৷
বিয়ের আগেও আমি ওদের বাড়ি বারকতক গেছি৷ অনির দিদির সঙ্গে আমার তখনই আলাপ৷ অনিই শিখিয়েছিল ওর দিদিকে দিভাই বলে ডাকতে৷
দিভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল ওদের মামাবাড়ির দিকের কোনো এক দূরসম্পর্কের রিলেটিভের সঙ্গে৷ জানি না জানেন কি না, অনির মা ছিলেন এখানকার লোক, মানে আসামিজ৷ অনির বাবা কলকাতা থেকে চাকরিসূত্রে এখানে চলে আসেন সত্তরের শেষাশেষি৷ শেষে অনির মাকে বিয়ে করে এখানেই থিতু হন৷ উনি মারাও যান এখানেই৷’’
‘‘কবে?’’
‘‘অনি যে বছর ক্লাস টেনের বোর্ড এক্সাম দেয়, সেই বছর৷ দু’হাজার চার৷’’
‘‘আর অনির মা?’’
‘‘তিনি মারা যান তার তিন বছর পর৷ অনি তখন ফার্স্ট ইয়ারে৷’’
‘‘হুম৷ আর ওর দিদি? তিনি তখন কোথায় ছিলেন?’’
‘‘দিভাইয়ের হাজব্যান্ডও সেই বছরেই মারা যান৷ অনি একা আছে দেখে দিভাই এ বাড়ি চলে আসেন৷ সে যাই হোক৷ এবার আসল কথায় আসি৷
ফুলশয্যার পরের দিন সকালে স্নান-টান করে আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছি, এমন সময় দিভাই এসে আমার হাতে একটা পাথরের মূর্তি দিয়ে বললেন, ‘এইটে নিজের শোওয়ার ঘরে রাখিস মাধু৷ আমার মায়ের দেওয়া জিনিস৷ তোর ভালো হবে৷’
তাকিয়ে দেখি একটা কোনো দেবীমূর্তি, সাইজে আড়াই-তিন ইঞ্চির বেশি হবে না৷ সারা গায়ে তেল আর সিঁদুর লেপা বলে ভালো করে বোঝাও যাচ্ছে না৷ আমি কিছু না ভেবে আলমারির পাশে একটা তাকে তুলে রাখলাম৷
পরের দিন ছিল চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি৷ আমাদের হানিমুন কাটাতে ভুটান যাওয়ার কথা৷ গোছগাছ করে বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেল৷ দিভাইও বেরিয়ে গেলেন গুয়াহাটি যাবেন বলে, ওখানে নাকি কীসব অফিশিয়াল কাজকম্ম আছে৷
আমরা ভুটান থেকে ফিরলাম ছ’দিন বাদে, তারিখটা এখনও মনে আছে, বিশে ফেব্রুয়ারি৷ দিভাই তার আগের দিনই গুয়াহাটি থেকে ফিরেছেন৷ আমি পরের দিন সকাল সকাল বাপের বাড়ি চলে আসি৷ কারণ দু’দিন বাদে ছিল শিবরাত্রি৷ ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর প্রথম শিবরাত্রিটা বাড়িতেই কাটিয়ে পরের দিনই আমি সদিয়ার বাড়ি চলে যাব৷ তারপর ওখানে দিনকয়েক কাটিয়ে অনির সঙ্গে ডিব্রুগড়ে ব্যাক করব৷
সে যাই হোক৷ এ বাড়িতে এসে দুপুর নাগাদ স্নান করে আয়নার সামনে বসেছি৷ সিঁদুরটা পরতে যাব, এমন সময়ে মনে হল…’’
বলে থমকে গেল মাধুরী৷ আমি তাড়া দিলাম, ‘‘কী হল, থামলে কেন? বলো!’’
আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল মাধুরী৷ তারপর বলল, ‘‘মনে হল, কে যেন আমার কানে কানে বলছে, ‘ও সিঁদুর পরিসনি মেয়ে৷ ও সিঁদুরে অভিশাপ আছে৷ ও সিঁদুর বড় অলুক্ষুণে’৷’’
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলাম৷ মেয়েটা স্কিজোফ্রেনিক নাকি?
আমার মনের কথাটা বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারল মাধুরী৷ প্রশ্ন করল, ‘‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি৷ তাই তো মা-বাবাকে এসবের কিছুই বলিনি৷’’
‘‘দ্যাখো, এসব কথা যে চট করে বিশ্বাস করা মুশকিল সে তো বোঝোই৷ হতে পারে তোমার অবচেতনে হয়তো কোনো জটিল চিন্তা কাজ করছিল, তাই হয়তো নিজে নিজেই…’’
‘‘তাই বলে তিনদিন? পরপর তিনদিন? ঠিক সিঁদুর পরার সময়টাতেই?’’
থমকে গেলাম৷ ‘‘তিনদিন ধরে তুমি একই কথা শুনলে?’’
‘‘একদম দাদা৷ স্পষ্ট শুনলাম৷ ঠিক সিঁদুরটা পরতে যাব, তখনই৷’’
‘‘হুম৷ তারপর?’’
‘‘তারপর শিবরাত্রির দিন সারাদিন উপোস করে রাত্রিবেলায় সামান্য ফল আর সাবুদানা খেয়ে উপোস ভাঙলাম৷ শরীরটা প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিল, তাই ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হয়নি বিশেষ৷’’
বলে থমকে গেল মেয়েটা৷
‘‘বলো, তারপর কী হল?’’
‘‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, জানেন?’’
‘‘কী স্বপ্ন?’’
‘‘দেখলাম যে আমি যেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছি৷ আমার পেছনে কারা যেন চিৎকার করে আমাকে বারণ করছে সেখানে যেতে৷ কিন্তু আমি কিছুতেই তাদের বারণ শুনছি না৷ আমি এগিয়ে চলেছি সেই জঙ্গলের মধ্যে৷ এগিয়ে চলেছি বলা ভুল, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের আরও ভেতরে…আর…আর…’’
‘‘আর কী?’’
‘‘আর আমার চারিপাশে গাছের ডালে বসে আছে অসংখ্য কাক৷ তাদের লাল লাল চোখ৷ আর তারা একদৃষ্টে চেয়ে আছে আমার দিকেই৷’’
সোজা হয়ে উঠে বসলাম৷ কী বলছে কী মেয়েটা?
মাধুরী বোধহয় আমার চমকে ওঠাটা খেয়াল করেনি৷ সে বলে যেতে লাগল, ‘‘পরের দিন সকালে উঠে দেখি মাথা টিপটিপ করছে৷ কিন্তু সেদিনই আমার সদিয়া ফেরার কথা৷ তাই জোর করেই স্নান করলাম৷ আয়নার সামনে বসে ফের সিঁদুর পরতে গেছি, এমন সময় আবার সেই ডাক৷ এবার আরও জোরে৷ একজন নয়, অনেকজন মিলে৷ ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর নখ দিয়ে আঁচড় কাটলে যেমন একটা অসহ্য শব্দ হয়, ঠিক সেরকম সুরে কারা যেন চিৎকার করে আমাকে বলছে, ‘ও সিঁদুর পরিসনি মেয়ে, ও সিঁদুর সর্বনেশে, অলুক্ষুণে’৷’’
‘‘আর ইউ শিওর?’’ আমার গলাটা একটু কেঁপে গেল নাকি?
‘‘একদম দাদা৷ ভুল হওয়ার কোনো জো-ই নেই৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা ব্যাপার ঘটল৷ আমার মনে হল ডান হাতের আঙুলগুলো যেন অসাড় হয়ে এসেছে, বুঝলেন? মানে মনে হল অনেক চেষ্টা করেও আমি কবজি থেকে বাকিটা আর নাড়াতে পারছি না, কে বা কেউ যেন আমার হাতটা সজোরে টেনে ধরে রেখেছে৷ ব্যাপারটা ভাবুন একটু৷ ভরা দুপুর, চারিদিকে রোদে ঝলমল, পাশের ঘরে মা রান্না করছেন, বাইরে বাবা কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন৷ আর এসবের মাঝখানে আমি আমার ড্রেসিং টেবিলের সামনে একদম স্থির বসে৷ একদম নড়তে পারছি না, চিৎকার করতে পারছি না, কানে কোনো শব্দ আসছে না, এমনকি নিঃশ্বাসও নিতে পারছি না৷ আমার মনে হচ্ছে যেন আমার চারিপাশের সবকিছু একদম স্থির হয়ে গেছে৷ দেওয়ালে টাঙানো ফটোর মতো৷’’
একটানে এতটা বলে হাঁপাতে লাগল মাধুরী৷ আমি উঠে গিয়ে একগ্লাস জল এগিয়ে দিলাম ওর দিকে৷ খেয়াল করলাম আমার নিজের হাতও অল্পস্বল্প কাঁপছে৷
‘‘তারপর?’’
‘‘ওইভাবেই ছিলাম বেশ কিছু মুহূর্ত৷ তারপর কিছুক্ষণ পর মনে হল হাতে যেন একটু সাড় পাচ্ছি৷ তখন অনেকখানি মনের জোর একসঙ্গে করে সিঁদুরটা পরে নিয়ে টলতে টলতে উঠে এলাম ওখান থেকে৷ আয়নার সামনে আর এক মুহূর্ত বসে থাকতে আমার ভয় করছিল, ভীষণ ভয় করছিল৷’’
এবার এক গ্লাস জল আমি খেলাম৷ গলাটা শুকিয়ে আসছিল আমার৷
‘‘তারপর বাকিটা বোধহয় আমি জানি৷ খেয়েদেয়ে ওঠার পর তোমার খুব জ্বর আসে, তাই না?’’
উত্তেজিত হয়ে উঠছিল মাধুরী৷ এই প্রথম লক্ষ করলাম যে উত্তেজিত হলে ওর কপাল আর গাল লাল হয়ে ওঠে, নাকের পাটা ফুলে যায়৷ আশ্বিনের ঠান্ডাতেও হিরের কুচির মতো অল্প অল্প ঘাম জমছিল ওর কপালে৷
‘‘দাঁতে কুটোটি কেটেছি কি কাটিনি, ধুম জ্বর এল আমার৷ মনে হল আমাকে কে যেন একগলা বরফঠান্ডা জলে চুবিয়ে রেখেছে৷ খাওয়ার টেবিল থেকেই ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি৷ তারপর আমার আর কিছু মনে নেই৷’’
আরামকেদারায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করলাম একবার৷ তারপর চোখ খুলতেই ক্ষণিকের জন্য মনে হল একবার যেন দেখলাম যে মেয়েটার মাথার সিঁথিটা ফাঁকা, হাতে কোনো সধবার চিহ্ন নেই, আর যে শাড়িটা পরে আছে সেটার রং সাদা!
আবার চোখ বন্ধ করলাম৷ সারাদিনের মানসিক পরিশ্রমের পর বোধহয় আমার স্নায়ু বোধহয় এবার জবাব দিতে শুরু করেছে৷ নইলে এরকম ভুলভাল দৃশ্য দেখব কেন?
ঠিক তখনই ফের সেই গন্ধটা নাকে এল৷ ভিজে কাঠ পোড়ার ভ্যাপসা শ্বাসরুদ্ধকর গন্ধটা৷
মাধুরীকে ভিতরে বসতে বলে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম৷ আমার চোখের সামনে তখন দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার রাত্রি৷ মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ, সামান্য মেঘ জমেছে ঈশান কোণে৷ কাকুর বাড়ির সামনের কুয়োতলাটা পেরোলেই একটা ছোট বাগান৷ সেখান থেকে শিউলির মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল৷ বাড়ির সীমানা ঘেঁষে সুপুরিগাছের সারি৷ এখানকার লোকজন খুব পান খায় দেখেছি, আর সঙ্গে কাঁচা সুপুরি৷ একবার সে জিনিস শখ করে খেতে গিয়ে প্রায় উলটে পড়ে যাচ্ছিলাম, বাবা রে! সে কী সাংঘাতিক জিনিস! এরা খায় কী করে?
এসব আবোলতাবোল ভাবছি, এমন সময় আনমনে কুয়োতলার দিকে তাকাতেই আমার মনে হল সামনের কুয়োতলা দিয়ে স্যাঁৎ করে কে একটা যেন বাড়ির ভেতরে চলে গেল৷ শুধুমাত্র সাদা কাপড়টা নজরে এল আমার, আর খানিকটা উড়ন্ত চুল৷ আমি ‘কে, কে ওখানে’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম৷
আমার ডাক শুনে মাধুরী বাইরে বেরিয়ে এল৷ প্রশ্ন করল, ‘‘কোথায় কে?’’
‘‘ওই যে’’, বলে আমি কুয়োতলার দিকে আঙুল দেখালাম, ‘‘মনে হল ওখান দিয়ে কে যেন বাড়ির ভিতরে চলে গেল৷’’
ইতিমধ্যে কাকু আর কাকিমাও বেরিয়ে এসেছিলেন৷ দুজন কাজের লোক ভেতরে ব্যস্ত ছিল৷ তারাও কাজ ছেড়ে বেরিয়ে এল৷ আমার কথা শুনে বাড়ির আনাচকানাচ তন্নতন্ন করে খোঁজা হল৷ কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না৷
চোখের ভুলই হবে হয়তো৷ আমি আর ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাঁটালাম না৷ মাধুরী আর আমি ভেতরে এসে বসলাম৷
‘‘তারপর? পরের দিন সকালে হঠাৎ করে তোমার জ্বর সেরে যায়, তাই তো?’’ আলোচনাটা যেখানে এসে থেমে গেছিল, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করলাম৷
‘‘সেদিন সারারাত ধরে বীভৎস সব স্বপ্ন দেখি, জানেন? প্রতিটা স্বপ্ন এত জ্যান্ত যে আমার এখনও মনে আছে৷ কখনও দেখছি আমাকে ঘিরে মুখে বিচিত্র উল্কি আঁকা উলঙ্গ মানুষের দল, অদ্ভুতভাবে নাচছে৷ আবার কখনও দেখছি আমার সামনে একটা মস্ত বড় হাড়িকাঠ, সেখানে নরবলি হচ্ছে, আর সেই বলির রক্ত আমার দু’পায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে কেউ৷ আবার একবার দেখলাম দুপুরবেলা খাঁ খাঁ করা শ্মশানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, চারিদিকে কোত্থাও কিচ্ছু নেই৷ আর আমার মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে কাকেদের দল৷ মানে সব মিলিয়ে ভয়ংকর আর ভীষণ ভয় ধরানো এক-একটা স্বপ্ন৷’’
আমার মাথাটা টিপটিপ করতে লাগল৷ জ্বর আসবে নাকি?
‘‘ভোরের দিকে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল৷ একটা খুব কষ্টের স্বপ্ন দেখলাম, জানেন? দেখলাম কে যেন আমার পা দুটো বেঁধে জলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আর আমি ক্রমেই ছটফট করছি, প্রাণপণে বাঁচতে চাইছি৷ এমন সময় কী করে জানি আমার পা থেকে সেই বাঁধন খুলে গেল, আর আমি প্রাণপণে সাঁতার কেটে ওপরে উঠতে শুরু করলাম৷ উঠতে উঠতে ঠিক যেই আমার মাথাটা জলের ওপর ভেসে উঠল, ঠিক সেই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ দেখি আমার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে সপসপ করছে৷ বিছানার পাশে একটা মোড়ায় বসে মা জলপট্টি দিচ্ছিলেন বোধহয়৷ তিনি সেখানে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ তাঁর হাতদুটো আমার কাঁধে৷ আর আমার সমস্ত জ্বরজারি, শরীর খারাপ, সবই ম্যাজিকের মতো উধাও৷’’
একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম মাধুরীর দিকে৷ মনোবিজ্ঞান নিয়ে এককালে একটু-আধটু জানতে হয়েছিল আমাকে৷ স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে ফ্রয়েড বা ইয়ুং সাহেবের বিস্তারিত গবেষণাও পড়া আছে আমার৷ কিন্তু আমার মন বলছিল সেসব তত্ত্ব দিয়ে এই স্বপ্নগুলো বোঝার চেষ্টা করাটা বৃথা৷ এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে৷
মাধুরীকে বললাম যে ওর কাহিনির বাকিটা কাল শুনব৷ আজ আর শরীর দিচ্ছে না৷ আজ রাতে যে খাব না, সেটা ও যেন কাকিমাকে বলে দেয়৷
মাধুরী চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘আর একটা কথা মনে পড়ে গেল৷’’
‘‘কী?’’
‘‘স্বপ্নের মধ্যে যখন জলের ওপরে উঠে আসছি তখন মনে হল ওই জলের মধ্যেই আমার শরীর ঘিরে যেন আলোর বন্যা বইছে, সেই আলোয় জলের অতলে বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে৷ নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, যে জিনিসটা দিয়ে আমার পা দুটো এতক্ষণ বাঁধা ছিল, সেটা খুলে ধীরে ধীরে নীচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে৷ আর সেটা কোনো দড়ি নয়৷’’
‘‘তাহলে? কী সেটা?’’
‘‘ওটা একটা লতা৷ আর তার মাথাটা ছোবল দিতে ওঠা সাপের ফণার মতো৷’’
* * * *
পরের দিন সকালে উঠে শুনি মংকু আসেনি কোন একটা কাজের অজুহাতে৷ আমারও সেদিন আর অন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল না৷ ভাবলাম আজ একটু তিনসুকিয়া শহরটা ঘুরে দেখি৷
বেরিয়েছিলাম কাকুর সাইকেলটা সঙ্গে নিয়ে৷ সবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের মোড়টা ঘুরেছি, ছেলেটার মুখোমুখি পড়ে গেলাম একেবারে৷
অথচ সদানন্দকাকুর বাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি না মারলে হয়তো ছেলেটাকে লক্ষই করতাম না, পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম৷ কারণ প্রথমত ছোকরাকে দেখতে আহামরি কিছু না৷ পরে আছে সাধারণ জামাকাপড়৷ চুল উশকোখুশকো, গালে অনেকদিনের না-কামানো দাড়ি৷ অমন লোক তিনসুকিয়ার রাস্তায় হাজার একটা দেখেছি৷
ছেলেটাকে দেখে সাইকেলের ব্রেক কষলাম জোরে৷ ও বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারার কারণটা কী জানতে হচ্ছে তো৷
সাইকেল থামাতেই ছেলেটা আমার দিকে একঝলক চাইল৷ লক্ষ করলাম যে ছোকরা এখানকার লোক বটে, মুখ-চোখ সেইরকমই৷ আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে ছোকরা উলটোদিকে দিল সোজা দৌড়!
দ্রুত সাইকেলে করে ধাওয়া করেও লাভ হল না৷ একটু এগিয়ে গলির শেষ৷ সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে দেখি তার টিকিটির চিহ্ন অবধি নেই৷ সে কোথায় মিলিয়ে গেল কে জানে!
আমিও আর ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাঁটালাম না৷ হাজার হোক লোক্যাল ছেলে৷ বেশি জানতে গিয়ে যদি কোনো বিপদ হয়? আমি আর মাথা ঘামালাম না, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷
এতালা-বেতালা চালাতে চালাতে দেখি বেংপুখুরির রাস্তা ধরে, দুর্গাবাড়ির পাশ কাটিয়ে তিনসুকিয়া উইমেনস কলেজের কাছে এসে পৌঁছেছি৷ তখন কলেজ শুরু হওয়ার সময়, ছাত্রীরা সবে আসা শুরু করেছে৷ গেটের উলটোদিকে রাস্তার ওপারে সাইকেলের জটলা৷ সেই সাইকেল-তমালরাজির পাশে রয়েছে সদ্য গোঁফ ওঠা ছেলেদের দল৷
সাইকেলটা একবার দাঁড় করালাম আমি৷ আচ্ছা, আজ যদি মাধুরী এই কলেজে এখন পড়তে আসত, আমি কি তাহলে এইভাবেই এইসব ছেলেদের দলে দাঁড়িয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম? অপেক্ষা করতাম মাধুরীকে একবার দেখার জন্য?
ভাবনাটা মাথার মধ্যে আসতেই আমি থমকে গেলাম৷ ছি ছি ছি, মাধুরীকে নিয়ে এসব কী ভাবছি আমি! এরকম একটা নোংরা চিন্তা আমার মাথায় এল কী করে? মাধুরী আমার বোনের মতো না? কাকু-কাকিমা আমাকে ভালোবেসে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের বাড়িতে, তাঁদের একমাত্র কন্যার বিপদে আমার সাহায্য চেয়েছেন, আর আমি তাকে নিয়ে এইসব উলটোপালটা ভাবছি? ছি ছি ছি! আমি কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি?
কলেজের গেটের ঠিক উলটোদিকে একটা পানের দোকান ছিল৷ তার সামনে একটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি পাতা৷ ধীরেসুস্থে সেখানে সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে দোকানিকে একটা গোল্ড ফ্লেক দিতে বললাম৷ তারপর দোকানের পাশে ঝুলতে থাকা নারকেলের জ্বলন্ত দড়ি থেকে সেটা ধরিয়ে একটা বুক খালি করা গভীর টান দিলাম৷
তামাক পোড়া ধোঁয়াটা পাক খেতে খেতে আমার বুকের গভীর অন্ধকারে সেঁধিয়ে যেতে থাকল৷ নিকোটিনের প্রথম ধাক্কাটা মগজে পৌঁছোতেই স্নায়ুগুলো সামান্য সজাগ হয়ে উঠল বটে, কিন্তু মাথার জটটা ছাড়ল না৷
সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম৷ কলেজ শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, মেয়েরা সব ভেতরে চলে গেছে৷ সাইকেল আরোহী ছেলেদের দলও এখন ঘরে ফেরার তালে৷ মাথার ওপর আশ্বিনের মিঠে রোদ চড়চড় করছে৷ যদিও আকাশের অর্ধেকটা মেঘে ঢাকা৷ দিন দুয়েকের মধ্যে বৃষ্টি নামবে মনে হয়৷
ভাবলাম একবার নদীর দিকটায় যাই৷ ঠান্ডা হাওয়া খেয়ে যদি মাথার জটটা একটু ছাড়ে৷ সেইমতো রাঙ্গাগড়া রোডটা ধরলাম৷
তখন তিনসুকিয়ার রাস্তার অবস্থা ছিল খুব করুণ৷ কোনোমতে খানাখন্দ পেরিয়ে সবে নতুনমাটি টি ফ্যাক্টরির কাছে পৌঁছেছি, এমন সময় মনে হল পেছন থেকে কে যেন নাম ধরে ডাকছে না?
সাইকেলটা সাইড করলাম৷ অচেনা-অজানা জায়গায় কে নাম ধরে ডাকে ভাই?
তাকিয়ে দেখি পরাগ বসুমাতারি৷ রাস্তার ওপার থেকে আমার দিকে প্রবল বেগে হাত নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে৷ আমাকে দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে এল আমার কাছে, ‘‘কী আশ্চর্য! আপনি এখানে? আমি তো আপনার খোঁজে আপনার বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম৷’’
‘‘কী ব্যাপারে?’’
পরাগ গলাটা নামিয়ে বলল ওই কাউরীবুড়ির মন্দিরের ব্যাপারে ও আমাকে একজনের সঙ্গে দেখা করাতে চায়৷ তাতে আমার উপকার হলেও হতে পারে৷
‘‘কে সেই লোক?’’
‘‘আমার বড় ঠাকুর্দা৷’’
জানা গেল পরাগের বড় ঠাকুর্দা, অর্থাৎ ঠাকুর্দার দাদার বয়েস প্রায় নব্বইয়ের কাছাকাছি৷ বুড়োর নাকি টুকটাক হাতুড়ে বিদ্যায় খ্যাতি আছে কিছু৷ এখনও গ্রামে-গঞ্জে লোকজন কাছে আসে জড়িবুটি নিতে৷ তা ছাড়া পুজোপার্বণের দিন দেখে দেওয়া, জলপড়া, বাটি চালানো, ভূত ছাড়ানোর মন্তর, এসবেও বুড়োর হাতযশ খুব৷
কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার লাভ?
পরাগ জানাল যে ওর বড় ঠাকুর্দা হচ্ছেন দেওরিদের লোককথা বা উপকথার জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া বিশেষ৷ ওদের সমাজের হেন গল্প নেই, হেন প্রথা নেই, হেন কাহিনি নেই যা উনি জানেন না৷ কালকে রাতে পরাগ গিয়ে ওঁকে জানিয়েছে আমার কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার কাহিনি৷ তাতে নাকি তিনি ভীষণ উত্তেজিত৷ আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছেন৷ সদানন্দকাকুকেও উনি ভালোভাবেই চেনেন৷ আজ সকালে নিজেই রওনা দিয়ে দিচ্ছিলেন প্রায়৷ অনেক কষ্টে ওঁকে থামিয়ে আমার খোঁজে বেরোচ্ছিল পরাগ৷ ভাগ্যক্রমে আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে যায় ও৷
পরাগের সঙ্গে যেতে কোনো আপত্তি ছিল না আমার৷ কৌতূহলও হচ্ছিল বিস্তর৷
জঙ্গল কেটে বানানো মেঠো রাস্তা পেরিয়ে পরাগের সঙ্গে ওদের গ্রামে পৌঁছোতে সময় লাগল মিনিট বিশেক৷ গ্রাম বললে অবশ্য যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার সঙ্গে মিল সামান্যই৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছোট পাড়া বললেই ঠিক হয়৷ সব একতলা পাকা বাড়ি৷ মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি, এখানে বলে ঢেউটিন৷ পাড়ার পুরুষেরা বোধহয় কাজের ধান্দায় বেরিয়েছে সব৷ আমাকে দেখে বউ-ঝিরা উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতেই পরাগের ধমক খেয়ে অন্দরে লুকোল৷ বুঝলাম পরাগের বেশ প্রতাপ আছে মহল্লায়৷
পরাগের বাড়িটা গ্রামের একদম শেষে৷ দেখে বোঝাই যায় এরা হল গিয়ে গ্রামের সবচেয়ে সম্পন্ন গৃহস্থ৷ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বানানো একতলা বাড়ি৷ সামনেটায় খানিকটা ছড়ানো জমি৷ তাতে শাকসবজি চাষ করা হয়েছে৷ চোখের আন্দাজে বুঝলাম যে বাড়ির পেছনের দিকেও বেশ বড় গোছের একটা বাগান-টাগান আছে৷
আমাকে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে বারান্দায় একটা চাটাই পেতে বসতে দেওয়া হল৷ ভেতর থেকে ভারী কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা জল এল, সঙ্গে কিছু স্থানীয় মিষ্টি গোছের জিনিস৷ সেসব খেতে খেতেই দেখি পরাগ হাত ধরে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে বাইরে নিয়ে আসছে৷
বড় ঠাকুর্দা এসে বসলেন আমার সামনে৷ আমি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলাম৷ উনিও কাশতে কাশতে দু’হাত তুলে প্রতি-নমস্কার করলেন৷ হাতের মুঠোয় বেতের লাঠিটি ধরা৷
বুড়োবাবু দেখলাম খিলাড়ি লোক৷ দুম করে প্রসঙ্গটায় ঢুকলেন না৷ আমি কলকাতার লোক শুনে প্রথমে খানিকক্ষণ বাঙালিদের সুখ্যাতি করলেন৷ সুভাষচন্দ্র বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে যে আজ দেশের এই হাল হত না সে কথাটা জোর দিয়ে বললেন৷ কলকাতার এখনকার হালচাল জিজ্ঞেস করলেন কিছু৷ ট্রাম জিনিসটা কী করে ওই ভিড় রাস্তায় চলে সে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন৷ মিঠুন চক্রবর্তীর অভিনয় নিয়ে কিছু উচ্চাঙ্গের আলোচনা হল৷ ততক্ষণে স্টিলের গ্লাসে চা এসে গেছে৷ চায়ের কাপে একটা চুমুক দিলেন প্রথমে৷ তারপরেই বলিরেখাঙ্কিত মুখখানি তুলে, সরু চোখদুটো আরও সরু করে প্রশ্ন করলেন—
‘‘তারপর বাবু, আমার নাতি যা বলছে সেটা ঠিক নাকি, অ্যাঁ?’’
বুড়োকে আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল৷ হাসিমুখে বললাম, ‘‘হ্যাঁ, একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক৷’’
‘‘কিন্তু বাবু, আপনি যে সত্যি বলছেন, সেটা বুঝব কী করে?’’
গতকাল পরাগকে যে কড়া জবাবটা দিয়েছিলাম সেটা মুখে এসে গেছিল৷ কিন্তু ওই যে বললাম, বুড়ো লোকটাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল আমার৷ তা ছাড়া বুড়োর এত কৌতূহল কেন সেটাও তো জানা দরকার৷ বলা যায় না, যে কাজে এসেছি সেটার জন্য লোকটা হয়তো অযাচিতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল৷ বলা তো যায় না!
হাসিমুখে বললাম, ‘‘প্রমাণ তো সেরকম কিছু নেই দাদু৷ একটা ছবি তুলতে গেছিলাম, তাতেই সেই ভদ্রমহিলা তো এমন হাঁইমাই করে উঠলেন যে…’’
‘‘মহিলা? কোন মহিলা?’’ বুড়োর দৃষ্টি আর স্বর দুটোই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল৷ পরাগ বারান্দার একটা থামে হেলান দিয়ে বসেছিল৷ সেও দেখলাম উঠে বসেছে, চোখে বিস্মিত দৃষ্টি, ‘‘মহিলা? কই, কাল তো কোনো মহিলার কথা বলেননি আমাকে!’’
‘‘কাল আর তোমাকে কিছু বলার সময় পেলাম কোথায়? শুধু তো শুনলাম৷’’
বুড়ো একটু কাছে ঘনিয়ে এল৷ পরাগকে বলল বারান্দা থেকে ভেতরে যাওয়ার সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে একবার চারপাশটা ঘুরে দেখে আসতে, কেউ আছে কি না৷ তারপর আমাকে চাপাস্বরে বললেন, ‘‘কীভাবে কোথা থেকে ওখানে গেলেন, কী কী হল সেটা একবার আমাকে আগাগোড়া খুলে বলুন তো বাবু৷’’
পুরো ঘটনাটাই বললাম ওঁকে৷ কিচ্ছু বাদ দিলাম না৷ আমার ওখানে যাওয়া, ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হওয়া, এমনকি পুজোপদ্ধতিটাও৷
কথা শেষ হওয়ার পর দেখি বুড়োর মুখ উত্তেজনায় থমথম করছে৷ পরাগ ভেতর থেকে বুড়োর জন্য হুঁকো মতন কী একটা এনে দিল৷ বুড়ো সেটাতে গুড়ুক গুড়ুক টান দিল দুবার৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘জানি না বাবু আপনার বাপ-দাদারা কী কী পুণ্যি করে গেছেন৷ নইলে আজ অবধি কাউরীবুড়ির মন্দিরে কেউ যেতে পেরেছে অথবা গেলে ফিরতে পেরেছে বলে শুনিনি৷ আমার জানাশোনার মধ্যে আপনিই একমাত্র লোক৷’’
‘‘সে কথা তো পরাগও বলছিল বটে৷ কিন্তু কেন বলুন তো?’’
‘‘সে বড় ভয়ংকর জায়গা বাবু৷ মরণ না ডাকলে ওখানে কেউ যায় না৷ আমরা বলি নরকের দরজা৷’’
‘‘নরক? নরক কেন?’’
‘‘সে অনেক কথা বাবু৷ পরাগ আপনাকে যেটুকু জানে শুধু সেটুকুই বলেছে৷ ওর বাইরেও ওই মন্দির ঘিরে যে কত কিছু আছে সেসব আপনার ধারণার বাইরে৷’’
‘‘যেমন?’’
‘‘আপনি কী ভাবছেন, ওই লতা যেমন-তেমন সাধারণ লতা? আপনি তুলে নিয়ে অন্য কোথাও পুঁতবেন আর ও শাকপাতার মতো তরতরিয়ে বেড়ে উঠে ফুল ফোটানো শুরু করবে? সেটি হবার নয় গো বাবু৷’’
সেই মহিলার শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল৷ কাউরীবুড়ির কাছে বলি দেওয়া প্রাণীর রক্ত ছাড়া ও ফুল বাঁচে না৷
‘‘শুনুন বাবু, ও ফুল বড় সাংঘাতিক জিনিস৷ ও এ দুনিয়ার ফুলই নয়, সাক্ষাৎ পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷ ওর মোহে একবার যে পড়েছে তার আর বাঁচার কোনো পথ নেই, তার মহাসর্বনাশ অনিবার্য৷ আমাদের পূর্বপুরুষেরা বলতেন যে কেউ যদি অম্বুবাচীর দিনে গভীর রাতে কাউরীবুড়ির পুজো করে ওই ফুলের রস খায়, তাহলে তার নাকি শয়তানের ক্ষমতা জন্মায়৷ তখন সে মরা মানুষ বাঁচাতে পারে, বাঁজা মেয়েমানুষের পেটে বাচ্চা এনে দিতে পারে, জীয়ন্ত মদ্দাকে ভেড়া বানিয়ে দিতে পারে৷’’
‘‘এসব কে বলেছে আপনাকে?’’
‘‘আমাদের পূর্বপুরুষের থেকে শোনা কথা গো বাবু৷ অবশ্য তারাও কেউ ওই ফুল চক্ষে দেখেনি, শুধু নামই শুনেছে৷’’
‘‘কিন্তু একটা কথা বলুন দাদু, সেক্ষেত্রে তো পাতরগোঁয়্যাদের গোষ্ঠীর সব্বারই অলৌকিক ক্ষমতা থাকার কথা, তাই না?’’
‘‘না বাবু, ওদের সবাই যে গোলকপুষ্পের লতা ইচ্ছেমতো হাতের কাছে পেত তা তো নয়৷ এই লতার চাষ হত খুব গোপনে, বুঝলেন কি না৷’’ বুড়ো আরও খানিকটা ঝুঁকে এল আমার দিকে, যেন কোনো একটা গোপন খবর দিচ্ছে, ‘‘একমাত্র বড়দেওরি আর তাদের পরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ জানতই না এই ফুলের পরিচর্যা কী করে করতে হয়৷’’
‘‘আর তাদের যদি বিয়ে হয়ে যেত অন্য গোষ্ঠীর কোনো ফ্যামিলিতে? তারা জেনে যেত না?’’ প্রশ্ন করি আমি৷
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বুড়ো, ‘‘না বাবু, সেটা হত না৷ কারণ ওদের জন্য নিয়ম ছিল আলাদা৷ বড়দেওরি পরিবারের মেয়েদের বিয়ে হত ওদের সমাজের মধ্যেই৷’’
‘‘কেন? ওদের জন্য অন্য নিয়ম কেন?’’
‘‘কারণ, বড়দেওরির রক্ত যাতে বিশুদ্ধ থাকে৷ অন্য জাতের রক্ত ওরা ভেজাল মনে করত কি না! বড়দেওরির গর্ভে সন্তান এনে দেওয়া কি সাধারণ মানুষের কম্ম?’’
‘‘তাহলে?’’
‘‘ওদের সমাজে একটি সুলক্ষণযুক্ত যুবককে ছোট থেকে এই উদ্দেশ্যেই বড় করে তোলা হত৷ তাকে বলা হত দেওধারী, মানে দেবতাকে ধারণ করেন যিনি৷ তাঁর থেকে পরবর্তী বড়দেওরির জন্ম হবে, সে যে মস্ত পুণ্যের কাজ৷ মহা ধুমধাম করে তাঁর সঙ্গে বড়দেওরির বিয়ে হত৷ তারপর বড়দেওরির গর্ভাধানের খবর এলে তো কথাই নেই! পাতরগোঁয়্যাদের গ্রাম জুড়ে উৎসব৷ বলিদানই চলত প্রায় হপ্তাখানেক ধরে৷ সেসব প্রসাদ পুরো গ্রামে বাঁটোয়ারা হত৷’’
‘‘বাপ রে! তাহলে সন্তান জন্মালে কী করত ওরা?’’
‘‘সেদিন তো আনন্দে পাগল হয়ে যেত ওরা৷ আরও বড় মোচ্ছব হত৷ দেওরিদের বাকি গোষ্ঠীদের সব্বাইকে নেমন্তন্ন করে পাত পেড়ে খাওয়ানো হত, সঙ্গে দেদার মদ৷ সেদিন বড়দেওরির থানে যার যা ইচ্ছে নজরানা দিয়ে যেত৷ সে বড় পুণ্যের দিন৷’’
‘‘সেসব নজরানা কি বড়দেওরিই পেতেন? তাঁর স্বামী কিছু পেতেন না?’’
‘‘হা হা হা…ভাগ? পেতেন বই কি! সেদিনই সে হতভাগা ছেলের ভাগে বেঁচে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট হয়ে যেত কি না৷’’
‘‘মা…মা…মানে? বেঁচে থাকার মেয়াদ নির্দিষ্ট হয়ে যেত মানে?’’ আমি তুতলে যাই৷
‘‘কারণ বড়দেওরির সন্তান, যে কিনা সবসময় মেয়েই হত, তার এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনেই বড়দেওরির হতভাগ্য স্বামীটিকে কাউরীবুড়ির সামনে বলি দেওয়া হত৷’’
কথাটা শুনে বাক্যহারা হয়ে গেলাম৷ এর মানে? সন্তান জন্মানোর পরেই প্রধানা পুরোহিতের স্বামীকে কাউরীবুড়ির সামনে বলি দেওয়া হত? কেন?
বুড়ো বোধহয় আমার মনের কথাটা আঁচ করে নিল৷ ধীরে ধীরে বলতে লাগল, ‘‘কারণ মেয়ে জন্মানোর পরেই বড়দেওরিকে বিধবা হতে হত৷ এটাই ছিল ওদের প্রথা৷’’
আমি চুপ৷
‘‘সেই মেয়ের যেদিন এক বছর বয়েস হত, সেদিনই সাজিয়ে-গুছিয়ে তাকে আর তার হতভাগ্য বাবাকে নিয়ে যাওয়া হত কাউরীবুড়ির মন্দিরে৷ সেদিন ওদের গ্রামে মস্ত উৎসব৷ তারপর মহাধুমধাম করে পুজোর পর সেই ছেলেটিকে কাউরীবুড়ির সামনে বলি দেওয়া হত৷ বলির রক্তে স্নান করানো হত বাচ্চা মেয়েটিকে৷ সেটাই তার দীক্ষা, সেইদিনই সে যোগ্য বলে বিবেচিত হত পরের বড়দেওরি হওয়ার জন্য৷’’
হা ঈশ্বর, বাবার রক্তে এক বছরের মেয়ের স্নানদীক্ষা?
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ৷ আমার আর কথা বলার ইচ্ছে ছিল না একদমই৷ মনটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে ছিল৷ চটকা ভাঙল পরাগের কথা শুনে, ‘‘তাহলে কী ভাবলেন বাবু?’’
‘‘কী ভাবব বলো? কীসের ব্যাপারে?’’
‘‘ওই গোলকপুষ্পের লতা তুলে আনার ব্যাপারে?’’
বুড়োর গল্প শুনে একটা বিষণ্ণ ভাব মনের মধ্যে ছেয়ে থাকাতে কথাটা মাথায় ঢুকতে একটু সময় নিল৷ অবাক হয়ে বললাম, ‘‘সে কী? এই যে বললাম ওই মহিলা বলেছেন ও লতা নাকি বলির রক্ত ছাড়া বাঁচে না, ও লতা তুলে কোনো লাভ নেই!’’
‘‘ধুস, কী যে বলেন দাদা’’, নার্ভাস হাসল পরাগ, ‘‘আপনারা হলেন গিয়ে লেখাপড়া জানা শহুরে লোক, সমাজের মাথা৷ এখন আপনারাও যদি এইসবে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তাহলে আর আমরা যাই কোথায় বলুন তো? শুনুন দাদা’’, এই বলে আরও কাছে ঘেঁষে এল পরাগ, ‘‘বলছি কী, একবার যখন আপনি ওখানে যেতে পেরেছেন, আমার মনে হয় আরেকবারও পারবেন৷ কি, পারবেন না?’’
আমি চুপ করে রইলাম, পরাগ যেন সাহস দেওয়ার জন্যই বলতে লাগল আমাকে, ‘‘আর এবার নাহয় আমিও যাব আপনার সঙ্গে৷ এই এলাকার যাবতীয় খোঁজখবর আমার নখদর্পণে, বুঝলেন কি না৷ আমার ওই জঙ্গলের ব্যাপারে জানাশোনা, আর আপনার সাহস, এই দুটো মিলিয়ে আমরা একটা সামান্য লতা মাটি থেকে খুঁড়ে তুলে আনতে পারব না?’’
কথাটা শুনে বিস্মিত হলাম৷ আমার ধারণা ছিল এই উপজাতিদের মধ্যে কুসংস্কার জিনিসটা খুব প্রবল৷ এসব থেকে তারা শতহস্ত দূরে থাকতে চায়৷ কিন্তু এই পরাগ তো দেখছি একেবারে তার অ্যান্টিথিসিস৷ ইচ্ছে করে বাঘের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে!
বুড়োর দিকে তাকালাম৷ তিনি চোখ বন্ধ করে গুড়ুক গুড়ুক করে তামুক ফুঁকছেন৷ কথাগুলো তাঁর কানে যাচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না৷
‘‘শুনুন দাদা, কাল বাদে পরশু অমাবস্যা৷ জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে যাওয়ার এর থেকে ভালো দিন আর হয় না৷’’
আশ্বিন মাসের অমাবস্যা? মানে মহালয়া?
‘‘কিন্তু…কিন্তু…কেন? একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না পরাগ’’, যে কথাটা মনের মধ্যে ঘূর্ণির মতো অনেকক্ষণ ধরে পাক খাচ্ছিল, সেইটে এবার সরাসরি আছড়ে পড়ল লোকটার ওপর, ‘‘তোমার এই বিষয়ে এত ইন্টারেস্ট কীসের? তোমাদের সমাজের এত গোপন বিষয়, যে কথা আমার জানার কথাই নয়, সে কথা নিজে এসে আমাকে জানিয়েছ৷ এখানে নিয়ে এসেছ তোমার বড় ঠাকুর্দার সঙ্গে কথা বলাতে৷ এখন বলছ ওই গোলকপুষ্পের লতা তুলে আনার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে চাও… সত্যি করে বলো তো পরাগ, তুমি চাইছটা কী?’’
পরাগ বসুমাতারি একবার আড়চোখে তার বড় ঠাকুর্দার দিকে চাইল৷ আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম বুড়ো একমনে তামুক টেনেই যাচ্ছে৷ উঠোনে বোনা সুপুরি গাছের ছায়া দুলছিল বুড়োর ভাঙা গালে৷ কেন জানি না ক্ষণিকের জন্য মনে হল চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে লোকটার৷
গলাখাঁকারি দিল পরাগ, ‘‘দেখুন দাদা, আমি এ যুগের লোক৷ ওসব ফালতু পুরোনো গালগল্পে বিশ্বাস করি না বিশেষ৷ আমি বুঝি টাকা, বুঝলেন দাদা, টাকা, মানে হার্ড ক্যাশ,’’ এই বলে ডান হাতটা আমার সামনে একটু এগিয়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে টাকা গোনার ইঙ্গিত করল পরাগ৷ ‘‘টাকা ছাড়া আমি আর কিচ্ছু বুঝি না দাদা৷’’ চোখের কোনা দিয়ে অল্প হাসল পরাগ৷
তখন নব্বই দশকের মাঝামাঝি৷ উদার অর্থনীতির খোলা হাওয়া আমাদের ঘরের অন্দরমহলের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে৷ চোখের সামনে দেখছি পারিবারিক মূল্যবোধ এক এক করে ভেঙে পড়ছে, শিক্ষাদীক্ষার বদলে দামি হয়ে উঠতে শুরু করেছে টাকার ঝনঝনানি৷ ভাবলাম পরাগও বুঝি তারই শিকার৷ সংস্কারহীনতার ঘোমটার আড়ালে লোভের খ্যামটা নাচতে চাইছে৷
আমি মনস্থির করে নিলাম৷ আমিও তো এসেছিলাম টাকার খোঁজেই, না কি? এখন একই পথের পথিক অন্য কাউকে ছিছিক্কার করলে চলবে? আমি করলে লীলা, আর পরাগ করলেই বিলা?
মনের থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম৷ ওকে বলে দিলাম যে পরশু রাতের এক্সপিডিশনের জন্য আমি রেডি৷ বাকি কথাবার্তা নাহয় পরশু সকালেই হবে৷
ফিরে আসার সময় খেয়াল করলাম যে কোথাও একটা অস্বস্তি হচ্ছে৷ কী যেন একটা হিসেব মিলছে না৷ কাল বাদে পরশু আমার অভিযানের শেষ পর্যায়ের কাজ শুরু হবে, এবার হয় এসপার নয় ওসপার৷ এই সময় আমার উত্তেজনা আর উৎসাহের তুঙ্গে থাকার কথা, তাই না? কিন্তু তার বদলে নিজেকে এত ক্লান্ত লাগছে কেন?
মাথার ভেতর এতোলবেতোল ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে নিতে দিলাম৷ খানিকটা ভাবার পর মনে হল এর কারণ মাধুরী নয় তো? হতেই তো পারে যে আমার অবচেতনে আমার সাফল্যের চাইতে ওর অমঙ্গলের আশঙ্কাটাই আমার কাছে বড় হয়ে উঠছে? ওর সিঁদুর পরার সময় কানের কাছে শোনা অশরীরী ডাক, ঘুমের মধ্যে দেখা ভয়ংকর স্বপ্নগুলো, সবই খুব অস্বাভাবিক লাগছিল আমার কাছে৷
মাধুরীর স্বপ্নের সঙ্গে আমার কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার ঘটনার এত মিল হয় কী করে?
আবার মনে পড়ে গেল সেই কাকেদের দল, গাছের ডালে ডালে তাদের নিঃশব্দে উড়ে আসা৷ শীতল খুনে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাদের তাকিয়ে থাকা৷
অত কাক কেন? তাদের চোখ অত লাল লাল কেন?
পরাগের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পথে নিজের অজান্তেই আবার সেই প্রশ্নটা আমার মাথায় ধাক্কা দিতে শুরু করল৷ কী হয়েছিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে? ওরা সবাই উধাও হয়ে গেল কী করে? ওখানে অত কাক কী করছিল?
আমি আমার মনস্থির করে ফেললাম৷ এ রহস্যের সমাধান আমার একার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কুলোবে না৷
এখন যেমন এত মোবাইল ফোনের রমরমা, তখন সেরকম ছিল না৷ রাস্তার পাশের পানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে একটা ফোন বুথের খোঁজ পাওয়া গেল৷ সেখান থেকে শিলিগুড়িতে একটা এসটিডি কল করলাম৷
কাকার সঙ্গে আমাকে এখনই যোগাযোগ করতে হবে৷
* * * *