২. ভালোবাসা এক ধরনের ফাঁদ

সোমবার, ডিসেম্বর ৬, ১৯৯৩

ভালোবাসা হলো এক ধরনের ফাঁদ।

এটা যখন হাজির হয় তখন আমরা শুধু এর আলোটাই দেখতে পাই। এর ছায়াটা আমাদের চোখে পড়ে না।

 ‘আমাদের চারপাশে যেই জমিনটা আছে চলো আমরা সেখানে শুয়ে পড়ি। এ গ্রহের হৃদয়ের স্পন্দনটুকু শোনার চেষ্টা করি। সে বলল।

‘তাতে করে আমার কোর্টটা ময়লা হয়ে যাবে। আমার সাথে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। আমি বললাম।

 জলপাই বাগানের পাহাড়ি উপত্যকার ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম।

 বিলাবোয়ের গতকালের বৃষ্টির পর আজকের সকালের সূর্যতে আমি ঠিক মতো তাকাতে পারছিলাম না। চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে উঠছিল। দুই দিন আগেই যেহেতু আমি যারাগোজায় ফিরে যাব এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে এসেছিলাম ফলে আমার সাথে কোন সানগ্লাস কিংবা অন্য কিছুই সাথে করে নিয়ে আসি নি আমি।

আমার ছেলে বন্ধুটির শার্ট ধার করে পরে রাতে ঘুমিয়েছিলাম। বিলবাওতে হোটেলের কাছাকাছি একটা দোকান থেকে টি-শার্ট কিনেছি।

‘তুমি আমাকে প্রতিদিন একই পোশাকে দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যাবে। আমি মজা করার জন্য বললাম।

‘তুমি যে এখানে আছে তাতেই আমি খুশি। সে বলল।

সে আমাকে যখন মেডেলটা দিচ্ছিল তখন কিন্তু ভালোবাসার কোন কথা বলে নি। তাকে বেশ হাস্যজ্বল লাগছে। সকালের আলোতে নিজেকে ভিজিয়ে নিয়ে সে হাটছিল।

 ‘ঐ পারে গিয়ে তুমি কি করবে? আমি দিগন্তের ওপারে ইশারা করে বললাম।

 ‘পাহাড়ি উপত্যকার সেই পাশে আছে ফ্রান্স। সে মুচকি হেসে বলল।

‘আমি জানি। তুমিতো জানো ভূগোল আমার খুব ভালো করেই পড়া আছে।

আমি শুধু জানতে আগ্রহি কেন আমাদের সেখানে যেতে হচ্ছে।

সে একটু থেমে মুচকি হাসি দিল।

‘এখন তুমি তোমার কৌতূহলের ঘরটার প্রতি দৃষ্টি বুলাতে পার।

তুমি যদি মনে করো যে তুমি একজন আবাসন ব্যবসার এজেন্ট হবে তাহলে সেটা ভুলে যাও। কারণ আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই।’

 নাভারার কোনো গ্রামে কিংবা ফ্রান্সে যাওয়াতে তেমন কোন ফারাক নেই। আমি কেবল জারাগোযাতে আমার ছুটির দিনগুলো কাটাতে চাচ্ছিলাম না।

 তুমি দেখলে?

আমি শুনতে পেলাম আমার মস্তিষ্ক আমাকে বলছে।

তুমি তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বেশ সুখি হয়েছ। তুমি পাল্টে গেছ। যদিও তুমি সেটা বুঝতে পারছ না।

না আমি মোটেও পাল্টে যাই নি। আমি একটু হাল্কা হতে চেয়েছিলাম।

 ‘মাটির উপর ঐ পাথরগুলো দেখো।

পাথরগুলো একদম গোলাকার ছিল। কোন ছুচালো অংশ তার দেখা যাচ্ছিল না। সমুদ্রের নুড়ি পাথরের মতো সেগুলো লাগছিল। যদিও নাভাররার কোথাও কোনো দিন সমুদ্র দেখা যায় নি।

শ্রমিক,তীর্থযাত্রী আর অভিযাত্রীদের পায়ের ঘর্ষণে পাথরগুলো আরো বেশি মসৃণ হয়ে গেছে। পাথরগুলো পাল্টে গেছে সাথে সাথে ভ্রমণকারীরাও পাল্টে গেছে। সে বলল।

‘ভ্রমণই কি তোমাকে এসব শিখিয়েছে?

না। আমি এই সব প্রত্যাদেশের অলৌকিকতা থেকে শিখেছি।’

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘কোথাও না। চলো আজকের সকালটাকে, এই সূর্যটাকে আর এই উপত্যাকার সৌন্দর্যটুকুকে আমরা উপভোগ করি। সামনে আমাদের দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে হবে।’ কথাগুলো বলে সে একটু ইতস্তত করল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কি সেই মেডেলটা এখনো আছে?

 ‘অবশ্যই। আমি সেটাকে রেখে দিয়েছি। কথাটা বলে আমি দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম।

মেডেলের বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছিলাম না। আমি এমন কিছু বলতে চাচ্ছিলাম না যা আজকের এই সকালের অবারিত আনন্দ আর সুখি মুহূর্তটাকে নষ্ট করে দিতে পারে।

*

সামনে একটা গ্রাম পড়ল।

 মধ্যযুগীয় কোন শহরের মতো গ্রামটা একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় ছিল। আমি অনেক দূর থেকে গির্জার গম্বুজ আর ক্ষয়ে যাওয়া একটা প্রাসাদ দেখতে পেলাম।

 ‘চলো ঐ গ্রামটার দিকে যাই। আমি বললাম।

তাকে খুব নিশ্চিন্ত মনে হলো। সে যাওয়ার জন্য সম্মত হলো।

পথের মধ্যে ছোট্ট একটা ধর্মশালা দেখে আমি থেমে সেখানে যেতে চাইলাম। আমি কখনো প্রার্থনা করি নি। তবে গির্জার নিরবতা আমাকে সব সময়ই আকৃষ্ট করে।

নিজেকে দোষী মনে করো না। আমি নিজেকেই বলতে থাকলাম। সে যদি প্রেমে পড়ে থাকে তাহলে সেটা তার সমস্যা।

সে আমাকে মেডেলের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছিল। আমি জানতাম সে কেফের। সেই বিষয়টা নিয়ে আবারো কথা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে সে এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করবে যেটা আমি আসলে শুনতে চাই না।

 তবে সে যদি ভাবে আমাদের এ ভালোবাসাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া উচিত সেই মুহূর্তে আমরা কি করতে পারি?

হাস্যকর একটা বিষয়। আমি নিজের মনে ভাবলাম। ভালোবাসার চেয়ে গভীর কিছুই নেই। লোকগল্পগুলোতে রাজকুমারী বেঙকে চুমু খায় আর বেঙ রাজকুমারে পাল্টে যায়। আর সত্যিকারের জীবনে রাজকুমারী যখন রাজকুমারকে চুমু খায় তখন রাজকুমার বেঙ হয়ে যায়।

আরো আধঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার পর আমরা সেই ছোট্ট ধর্মশালায় গিয়ে পৌঁছলাম।

একজন বৃদ্ধলোক সামনেই বসেছিল। আমরা যাত্রা শুরু করার পর এই প্রথম কাউকে দেখতে পেলাম।

 ‘হ্যালো। আমার বন্ধুটি বৃদ্ধলোককে বলল।

‘তুমি কেমন আছ?

 ‘এই গ্রামের নাম কী?

 ‘সান মার্টিন দি আংস।’

‘আংস? আমি প্রশ্ন করে গির্জার ভেতর ঢুকতে চাইলাম।

“তুমি ভেতরে যেতে পারবে না। বৃদ্ধ লোকটি সতর্ক করে দিয়ে বলল।

 ‘এটা দুপুরেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি যদি ঢুকতেই চাও তাহলে আজকে চারটার দিকে আসো।

দরজা খোলাই ছিল। যথেষ্ট আলো থাকার পরেও আমি ভেতরটা তেমন ভালোভাবে দেখতে পারলাম না।

‘এক মিনিটের জন্য কি যেতে পারব না। আমি একটু প্রার্থনা করতে চেয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি খুবই দুঃখিত। এটা বন্ধ হয়ে গেছে।

আমার বন্ধু বুড়ো লোকটার সাথে আমার কথাগুলো শুনল। সে কিছু বলল না।

‘ঠিক আছে তাহলে চলো আমরা যাই। এখানে বৃথা তর্ক করে কোনো লাভ নেই। আমি বললাম।

সে তখনো শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘তুমি কি এই গির্জাটা দেখতে চাও নি? সে জিজ্ঞেস করল।

আমি বুঝতে পারলাম সে আমার সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে গ্রহণ করে নি।

সে ভেবেছিল আমি দুর্বল, ভীতু, আমি যা চাই তার জন্য সংগ্রাম করতে সক্ষম নই।’

‘গতকালের কথা কি তোমার মনে আছে?’ আমি বললাম। সে পানশালায় তুমি আমার কথাকে থামিয়ে দিয়েছিলে কারণ তুমি আমার সাথে তর্ক করতে চাও নি। আর এখন যখন আমি একই কাজ করলাম তুমি সেটা নিয়ে সমালোচনা শুরু করলে।

বুড়ো লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। সে হয়ত এটা দেখে খুশি হচ্ছিল যে এই জায়গাটায় যেখানে প্রতিটি সকাল, প্রতিটি মুহূর্ত একই রকম এক ঘেয়ে সেখানে নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

গির্জার দরজা খোলা আছে। সে বুড়ো লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল।

 ‘আপনি যদি কিছু টাকা পয়সা চান তাহলে আমরা সেটা দিতে পারি। বুঝতেই পারছেন আমার বান্ধবী গির্জার ভেতরটা দেখতে চাচ্ছে।

‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বলল।

“ঠিক আছে তাহলে আমরা যেভাবেই হোক ভেতরে যাব।’ সে আমার হাত ধরল, আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

 আমার বুকটা লাফিয়ে উঠছিল। বুড়ো লোকটা হয়ত পুলিশ ডাকতে পারে, চেঁচামেচি করতে পারে।

 ‘তুমি কেন এটা করছ?

কারণ তুমি গির্জাটা দেখতে চেয়েছিলে।

আমি খুব ঘাবরে গিয়েছিলাম। আমার চারপাশে কি হচ্ছে ভালোভাবে মনোযোগি দিতে পারছিলাম না।

 আমার আচরণ, বৃথা তর্ক আজকের চমৎকার সকালটাকে নষ্ট করে দিল।

 আমি মনোযোগ দিয়ে বাইরে কোন শব্দ হচ্ছে কিনা সেটা শোনার চেষ্টা করলাম।

 বুড়ো লোকটা গ্রামের পুলিশকে ডাকতে পারে। আমি ভাবলাম। এরা জোর করে গির্জায় ঢুকেছে। চোর! তারা নিয়ম ভেঙেছে।

বৃদ্ধ লোকটা বলেছিল যে গির্জাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুড়ে দেখার সময় শেষ। বুড়োটা খুবই দূর্বল অসহায়। আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিতে পারে নি। পুলিশ আমাদের উপর চড়াও হতে পারে কারণ আমরা অসহায় বুড়োকে বাধা দিয়েছি।

গির্জার ভেতর আমি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার বন্ধুকে বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে আমি আসলেই গির্জাটা দেখতে চেয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম, ঠিক আছে চল।

‘পিলার ভয় পেয়ো না। কোন নাটক করার চেষ্টা করো না।

বুড়োর সাথে আমার সমস্যাটা আমি কিছুতেই আমার বন্ধুর জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াক আমি কিছুতেই সেটা চাচ্ছিলাম না। আমি শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম। নাটক করার চেষ্টা করো না বলে তুমি কি বলতে চাইছ আমি সেটা বুঝতে পারি নি।

‘কিছু লোক সব সময় অন্যের সাথে যুদ্ধ করে থাকে। কখনো কখনো সে নিজের সাথেও সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এক ধরনের নাটক তারা তৈরি করে। নিজেদের সংকোচ আর দুঃশ্চিন্তা থেকে সেই নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখে।’ ‘আমি জানি অনেক লোকই সেরকম। বুঝতে পারছি তুমি কি বলতে চাইছ?

 “কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অংশ হলো তারা নিজেরা নাটকটা উপস্থাপন করতে পারে না। ফলে অন্য অভিনেতাদেরকে তারা এখানে জড়িয়ে ফেলে। ঐ বুড়ো লোকটাও এমন কিছু করতে চাইছিল। সেও কোনো কিছুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমাদের সাথে এমন একটা খেলা খেলতে চাইল। তাকে সেই সুযোগ দিলে আমরাই পরাজিত হতাম।

 আমার বন্ধুর ধারনাই ঠিক। কিন্তু গীর্জার ভেতর যা ঘটল তা নিয়ে আমি খুশি ছিলাম না।

 ঠিক আছে আমার প্রার্থনা শেষ। আমি যা চেয়েছিলাম সেটা করেছি। এখন চলো।

গির্জার ভেতরের অন্ধকার থেকে বের হয়ে বাইরের সূর্যের আলোতে আমি কিছুক্ষণ তাকাতেই পারলাম না। আলো আমার চোখে সয়ে এলে আমি বাইরে বুড়ো লোকটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না।

 ‘চলো দুপুরের খাবার খেতে যাই। সে গ্রামের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল।

*

আমি দু গ্লাস মদ খেলাম দুপুরের খাবারের সময়।

জীবনেও আমি এমনটা করি নি।

আমার বন্ধুটি ওয়েটারের সাথে কথা বলছিল। ওয়েটার তাকে জানাল যে সেখানে অনেকগুলো রোমান ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তাদের কথাবার্তা আমি শোনার চেষ্টা করলাম। আমার মন খারাপ ভাবটা তখনো দূর হয় নি।

রাজকুমার বেঙ হয়ে গেছে। তাতে কি?

আমি যা অর্জন করেছি তার জন্য আমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আমার জন্য উন্মুক্ত অনেক খোলা রাস্তা আমি পরিত্যাগ করে চলে এসেছি।

 ‘তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমার বন্ধু তার কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘হ্যাঁ আমি আসলেই একটু চিন্তা করছি। সেই বুড়োটা হয়ত পুলিশ ডাকতে গেছে। আমি মনে করি এটা খুবই ছোট একটা জায়গা। তারা সহজেই আমাদেরকে খুঁজে পাবে। এখানে দুপুরের খাবার খাওয়ার তোমার এই সাহসিকতা আমাদের ছুটিটাকেই না জানি ধ্বংস করে দেয়।

সে পানির গ্লাসটাকে একটু ঘুরালো। সে সত্যিই জানত যে এটা কোন সমস্যাই না।

‘এমন কিছুই ঘটতে যাচ্ছে না। বুড়ো লোকটা তার নিজের বাড়িতে চলে গেছে। সে এর মধ্যেই সব কিছু ভুলে গেছে। আমাকে বিশ্বাস করো। সে বলল।

গর্দভ আমি সে জন্য মোটেও দুঃশ্চিন্তা করছি না। আমি মনে মনে বললাম।

‘তোমার হৃদয়ের কথা আরো বেশি করে শোনার চেষ্টা করো।’ সে বলল।

 ‘হ্যাঁ আমি সেটাই শোনার চেষ্টা করছি। আর অনুভব করছি যে আমাদের হৃদয় বলছে এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়া উচিত। এই জায়গাটা আমার ভালো লাগছে না। আমি বললাম।

 ‘দিনের বেলা তোমার মদ খাওয়া উচিত হয় নি।

এই মুহূর্তেই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আমি কি ভাবছিলাম সেটা বলার এখনই সময়।

 ‘তুমি ভাবো যে তুমিই সব কিছু জানো। আমি বললাম। সব যাদুকরি মুহূর্তের বিষয়ে তোমার ধারণা আছে। অন্তরের ভেতরের শিশু… আমি জানি না এখানে তুমি আমার সাথে কি করছ?’

আমার কথা শুনে সে হাসল। আমি তোমার প্রশংসা করি। তোমার হৃদয়ের সাথে যে যুদ্ধ তুমি চালিয়ে যাচ্ছ আমি তারও প্রশংসা করি।

 ‘কোন যুদ্ধ?

 ‘কিছু মনে করো না। সে বলল।

কিন্তু আমি জানতাম সে কি বিষয় নিয়ে কথা বলছে।

‘ছেলেমানুষি করো না। আমি বললাম। তুমি যদি মনে করো তাহলে। আমরা এই নিয়ে কথা বলতে পারি। আমার অনুভূতি নিয়ে তুমি ভুল বুঝছ।

তার গ্লাস নিয়ে খেলা বন্ধ করে সে আমার দিকে তাকাল।

না আমি কোন ভুল করছি না। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না।

এ কথা শুনে আমি আবারো সংশয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম।

তারপরেও আমি তোমার ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করে যাব।’ সে বলতে থাকল।

‘জীবনে এমন কিছু আছে যার জন্য শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সংগ্রাম করতে হয়। তার কথা শুনে আমি বাকহারা হয়ে গেলাম।

তুমি আমার কাছে সেরকম মূল্যবান একজন। সে বলল।

আমি মুখ ঘুরিয়ে চারপাশটা ভালোভাবে দেখে ভান করলাম যে রেস্টুরেন্টের চারপাশের সাজসজ্জার বিষয়ে আমার আগ্রহ অনেক। একটা বেঙের অনুভূতি হচ্ছিল আমার। হঠাৎ করেই আমি যেন রাজকুমারী হয়ে গেছি।

‘আমার শক্ত কথার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি বললাম।

সে একটু হাসল। ওয়েটারকে ইশারা করে কাছে ডেকে বিল দিয়ে দিল।

 গাড়িতে ফেরার মুহূর্তে আমি আবারো বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। এটা হতে পারে সূর্যের জন্য। কিন্তু না এটা ছিল শরৎকাল। শরৎকালের সূর্যের ত্যাজ খুব দুর্বল থাকে। সেই বুড়ো লোকটাও হতে পারে। তবে কিছুক্ষণ আগেই সে চলে গিয়েছে।

এই সব কিছুই আমার কাছে নতুন ছিল। জীবন আমাদের কাছে খুব বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়েছে। আর আমাদেরকে অজানার দিকে যাওয়ার ইশারা করছে। এমনকি আমরা যদি নাও চাই কিংবা আমাদের যদি কোন প্রয়োজন নাও থাকে তবুও।

আমি চেষ্টা করছিলাম আমার চারপাশের দৃশ্যগুলোর প্রতি মনোযোগ দিতে।

কিন্তু জলাপাই বাগান, পাহাড়ের মাথার উপর সেই গ্রামটা, গির্জার প্রবেশমুখের বুড়োটা এই সব কিছু আমার কাছে খুব অপরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি কিছুতেই মন দিতে পারছিলাম না।

একদিন আগে আমি কি পরিমান মদ খেয়েছিলাম সেটা নিয়ে চিন্তা করলাম। আমার বন্ধু কি নিয়ে তখন গান করছিল সেটা নিয়েও ভাবলাম কিছুক্ষণ।

 ‘আচ্ছা তুমি গতকাল সেই গানটা কেন গেয়েছিলে?’ আমি বললাম।

‘তুমি কেন সেটা জানার জন্য এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছ? সে বলল।

‘আমি জানি না।

আমার সত্যিই একটা কারণ ছিল। আমি জানতাম সে যে গানটা গেয়েছিল সেটা ছিল এক ধরনের প্রলোভনমূলক সংগিত। সে আমার পরিচিত একটা গান গাইতে পারত। কিন্তু সে এমন একটা গান পছন্দ করল যেটা আমি এর আগে কখনোই শুনি নি।

এটা অবশ্যই একটা ফাঁদ। কোন রেডিওতে প্রচারিত হওয়া কিংবা কোন ক্লাবে গাওয়া কোন পরিচিত গান যদি সে গাইত তাহলে আমি তাকে নিয়ে ভাবতাম, বিলবাওকে নিয়ে চিন্তা করতাম, আমার জীবনের শরতের মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতাম যেগুলো বসন্তে পাল্টে গেছে।

সেও হয়ত তাই চিন্তা করছিল। সে খুব বিদ্বান, পন্ডিত আর অভিজ্ঞ ব্যক্তি।

সে জানে কীভাবে মেয়েদেরকে বসে আনতে হয়।

আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি নিজেকে বললাম। আমি একজন মদ্যপ। গত দুদিনে খুব বেশি মদ আমি খেয়েছি। সে সব ধরনের চালাকি জানে। সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’

 ‘হৃদয়ের সাথে তুমি যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছ আমি তার প্রশংসা করি।’ সে এই কথাটা আমাকে রেস্টুরেন্টে বলেছিল।

কিন্তু সে ছিল ভুল। কারণ আমার হৃদয়ের সাথে যুদ্ধ করে তাকে আমি অনেক আগেই হারিয়ে দিয়েছি। আমার সীমা আমি জানি। আমি জানি কতটুকু ব্যথা আমি সহ্য করতে পারব।

গাড়িতে ফেরার পথে আমি বললাম, কিছু একটা বল।

কি বলব?

যা কিছু ইচ্ছে হয়। আমার সাথে কথা বলো।

 সুতরাং সে কথা বলা শুরু করল। সে আমাকে বলল কুমারী মেরীর কি উদ্দেশ্য ছিল। আমি অবশ্য জানতাম না যে কেন সে হঠাৎ করে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে।

আমার অন্তরটা এর মধ্যেই শান্ত হয়ে এসেছে।

হা আমি আমার সীমা জানি। আমি জানি কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকতে হয়।

*

আমরা ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে রাতে এসে পৌঁছলাম।

কুয়াশা এত ঘন ছিল যে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমি কেবল ছোট্ট একটা মার্কেট, ল্যাম্বপোস্ট, পুরোনো কিছু বাড়ি দেখতে পেলাম।

 ‘এই কুয়াশা’! সে ব্যাখ্যা করল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন সে এত উত্তেজিত হয়ে আছে।

 ‘আমরা এখন সেন্ট সাভিনে’ সে ব্যাখ্যা করল।

এই নামে আমার কিছুই যায় আসে না। আমরা এখন ফ্রান্সে এটাই বড় কথা। ফ্রান্সে আছি এটা ভেবেই আমার খুব উত্তেজনা হচ্ছিল।

আমরা এই জায়গাটায় কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কারণ আমি তোমাকে যে বাড়িটা দেখাতে চাচ্ছি সেটা এখানে। সে হাসতে হাসতে বলল।

গাড়ি থামিয়ে আমরা যখন নেমে আসলাম তখন সে আমার হাতটা ধরল।

আমরা কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম।

 ‘অপ্রত্যাশিত ভাবেই এই জায়গাটা আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে আছে। সে বলল।

তুমিও? আমি ভাবলাম।

 ‘আমি প্রথম যখন এখানে আসি ভেবেছিলাম আমি হারিয়ে গেছি। কিন্তু আমি হারায় নি। আসলে আমি এটাকে আবার আবিষ্কার করলাম।

মাঝে মাঝে তুমি খুব হেয়ালিভরা কথা বলো। আমি বললাম।

 ‘এই জায়গাটাতেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার জীবনে তোমাকে ছাড়া চলবে না।’

আমি সামনে তাকালাম। তাকে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

 ‘চলো দেখি কারো সাহায্য নিয়ে আমাদের জন্য ঘর ভাড়া করা যায় কিনা। কারণ গ্রীষ্মের সময় এই গ্রামে মাত্র দুটো হোটেল খোলা থাকে। তারপর আমরা ভালো কোন হোটেলে রাতের খাবার খাব। এখানে পুলিশের কোনো ভয় নেই, ছুটে গাড়িতে যেতে হবে না, মদ পান করতে করতে যখন আমাদের জিহ্বা হাল্কা হয়ে আসবে তখন অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলব আমরা।’

 কথা শেষ হওয়া মাত্র আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম।

আমি এর মধ্যেই বেশ ভারমুক্ত হয়ে গেছি। গাড়িতে চড়ে যখন আসছিলাম তখন আমি অনেক কিছু নিয়েই ভাবছিলাম। পাহাড়ি উপত্যাকার উপরের অংশ যেটা ফ্রান্সকে স্পেন থেকে পৃথক করে রেখেছে সে অংশটা যখন আমরা পার হচ্ছিলাম তখন আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম তিনি যেন আমার অন্তরকে ভয় আর দুঃশ্চিন্তা মুক্ত রাখেন।

.

‘প্রার্থনা করি কুমারি মাতা আমাদেরকে এখানে রক্ষা করবে। সে বলল।

আমি চুপ থাকলাম।

 ‘কেন তুমি আমিন বললে না? সে জিজ্ঞেস করল।

কারণ আমি মনে করি না যে এটা বলা দরকার। একটা সময় ছিল যখন ধর্ম আমার জীবনের অংশ ছিল। কিন্তু সেই সময়টা এখন পার হয়ে গেছে।

সে ঘুড়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

‘আমি এখনো প্রার্থনা করি, তবে তাতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। আমি বললাম।

‘কেন?’

কারণ অনেক অনেক বিপদের মাঝে পরে খোদাকে ডেকেছি। তিনি আমার প্রার্থনা শোনে নি। কারণ আমার জীবনে অসংখ্যবার আমার হৃদয়ের সাথে আমি ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেটা বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ঈশ্বর যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়ে থাকেন তাহলে আমার এই অনুভূতিগুলোর তিনি দাম দিতেন।

‘ঈশ্বর হলেন ভালোবাসা। একমাত্র কুমারি মাতাই সেটা সবচেয়ে ভালো বোঝেন।

আমি হাসিতে ফেটে পড়লাম। যখন তার দিকে তাকালাম দেখলাম সে খুব সিরিয়াস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

কুমারি মাতাই সকল আত্মসমর্পণের রহস্য জানেন। তিনি আমাদেরকে দুঃখ থেকে মুক্ত করেন একই ভাবে যীশু আমাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত করে। সে বলল।

‘যিশু হলো ঈশ্বরের সন্তান। তারা বলে কুমারি মাতা যীশুকে পেটে ধারণ করেছিল। আমি এই কথাটা বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে আমি তার বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করি।’

আমার বন্ধু গাড়ির দরজা খুলে আমাদের ব্যাগগুলো বের করল।

আমি যখন আমার ব্যগটা নিতে গেলাম সে বলল, তোমার ব্যাগটা আমাকে নিতে দাও।

 দীর্ঘদিন আমার জন্য কেউ এমনটা করেনি। আমি ভাবলাম।

আমরা প্রথম বাড়িটাতে নক করলাম। বাড়ির মহিলা বলল যে তারা কোন ঘর ভাড়া দেন না।

দ্বিতীয় ঘরে নক করে সেখান থেকে কোন উত্তর পেলাম না।

তৃতীয় ঘরটাতে একজন দয়ালু বৃদ্ধ লোক আমাদেরকে অভিবাদন জানালেন। তিনি যে ঘরটা দেখালেন সেটাতে একটা মাত্র ডাবল বিছানা। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

 ‘আমাদেরকে বড় কোনো শহরের দিকে যেতে হবে। আমি বললাম।

 ‘আমরা একটা ঘর ঠিক পেয়ে যাব। তুমি কি অন্যের ক্ষমতার বিষয়ে কিছু জানো? এটা একটা গল্পের অংশ, প্রায় একশ বছর আগে একজন লেখক তার নাম হলো…’ সে বলার চেষ্টা করল।

‘লেখকের নাম বলতে হবে না। তাকে ভুলে যাও। তুমি গল্পটা বলো। আমি বাধা দিয়ে বললাম। আমরা তখন সেইন্ট সেভিনের রাস্তা দিয়ে হাটছি।

*

একজন লোক দীর্ঘদিন পর তার বন্ধুর কাছে গেল।

 ‘আমার বন্ধুকে কিছু টাকা দেওয়া উচিত, সে ভাবল।

কিন্তু বন্ধুকে সাহায্য করার আগেই সে জানতে পারল যে তার বন্ধু এখন অনেক ধনী হয়ে গেছে। বন্ধু তার কাছে অতীতে যে টাকা-পয়সা ধার করেছিল সেগুলো ফেরত দিতে চাইছে।

তারা অতীতে যে পানশালায় একত্রিত হতো সেখানে দেখা করল। বন্ধু সেই পানশালার সকলের জন্য পানীয় দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

পানশালার লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করল তার এই সফলতার মূল রহস্য কি?

বন্ধু বলল, “কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমি অন্য একজনের নির্দেশমত জীবন যাপন করেছি।’

 ‘সেই অন্য একজন কে?

‘অন্যজন হলো এমন একজন যে আমাকে শিখিয়েছে কি পছন্দ করা উচিত। সেই একজন আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে আমাদের হাতকে ব্যবহার করে প্রচুর টাকা অর্জন করা যায় যাতে করে আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাব তখন যেন না খেয়ে ক্ষুধায় মরতে হয়। ফলে আমরা এত বেশি টাকা উপার্জনের চিন্তা করলাম যে একসময় আবিষ্কার করলাম আমাদের দিন শেষ হয়ে গেছে। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

 ‘তাহলে আপনি? আপনি কে?’

‘আমি অন্য সকলের মতই যারা হৃদয়ের কথা শুনতে চায়। আমি এমন একজন মানুষ যে জীবনের রহস্যময়তা থেকে রসদ জোগাড় করে এবং তাদের কি করা উচিৎ তার উৎসাহ নেয়।’

কিন্তু জীবনেতো অনেক দুঃখবেদনা আছে। শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন বলল।

“জীবনে পরাজয়ও আছে। কেউ এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। ফলে জীবনের স্বপ্নের সগ্রামে কিছু যুদ্ধ পরিত্যাগ করে চলাটাই ভালো।

এই তাহলে সব?’ আরেকজন শ্রোতা বলল।

হ্যাঁ এই হলো সব রহস্য। আমি এটা জানার পরই আমি যেই মানুষটা হতে চেয়েছিলাম সেটা হয়ে গেলাম। আর অন্যজন আমার ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখল। কিন্তু সেই দ্বিতীয়জনকে আমি কখনো আমার ভেতর ঢুকতে দেয় নি। এমনকি সে আমাকে ভয় দেখিয়েছে, সতক করে দিয়েছে যে ভবিষ্যতের চিন্তা না করাটাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

দ্বিতীয় সেই লোকটাকে যখনই আমি আমার ভেতর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি তখন থেকেই আমার জীবনের যাদুকরি ক্ষমতা বেড়ে গেছে।

*

যদিও আমার বন্ধু অনেক কাল আগেই তার সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে ত্যাগ করেছে তারপরেও সে তেমন সৌভাগ্য লাভ করতে পারে নি। কারণ আজকের রাতে আমাদের থাকার জন্য সে একটা ঘর পর্যন্ত ব্যবস্থা করতে পারে নি।

 আমার বন্ধু যে গল্পটা বলল আমি জানি সেটা সে তার নিজের জন্য বলেনি বরং সে গল্পটা আমার জন্যই বলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে আমার ভয়, অনিরাপত্তাসহ আরো অনেক বিষয়ে কথা বলতে চায়, কারণ আগামীদিন হয়ত সেগুলোর অনুপস্থিতিতে আমি বিপদে পড়ব।

ঈশ্বর পাশা খেলার বোর্ডটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তিনি জানতেও চাইলেন না আমরা এই খেলাটা খেলতে চাই কি না।

তুমি যদি চলে যাও, কিংবা তোমার প্রেমিকা, বাসা, স্বপ্ন সব কিছু ছেড়েছুরে দাও কিংবা এই সব কিছুই সাথে করে রাখো তাতেও ঈশ্বরের কিছু যাবে আসবে না।

 ঈশ্বর তোমার পরিকল্পনা কিংবা তোমার প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে আগ্রহি না।

কোনো ভাবে তিনি পাশা খেলার মঞ্চ তৈরি করেছেন আর তোমাকে পছন্দ করেছেন খেলোয়াড় হিসেবে।

এর পর থেকেই বিজয়ী হওয়া কিংবা পরাজিত হওয়া হলো তোমার একমাত্র ললাট লিখন।

ঈশ্বর পাশা খেলার বোর্ডটা ছুঁড়ে মেরেছেন আর তার খাঁচা থেকে মুক্ত করেছেন ভালোবাসাকে।

যেহেতু ভালোবাসা এখন স্বাধীন তাই মুক্ত বাতাসের ইচ্ছে অনুযায়ি সে নিজেই সৃষ্টি করতে পারে কিংবা ধ্বংস করতে পারে।

 সেই মুহূর্ত থেকে বাতাস আমার বন্ধুর পক্ষেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু বাতাসও ঈশ্বরের মতো হেয়ালি আচরণ শুরু করল। আমার হৃদয়ের গভীরে হঠাৎ করেই আমি কিছু একটা নড়ন চড়নের টের পেলাম।

*

অবশেষে ভাগ্য চাইল যে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির গল্পটা সত্য হোক; আর মহাবিশ্বতো সব সময়ই যে স্বপ্ন দেখে তার পক্ষে ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে ফলে আমরা রাতে থাকার জন্য পৃথক বিছানার একটা ঘর পেয়ে গেলাম।

 ঘরে ঢুকে আমার প্রথম কাজ হলো গোসল করা, কাপড়গুলো ধুয়ে ফেলা, নতুন শার্টটা পরা।

এসব কিছু শেষ করার পর নিজেকে অনেকটা ভারমুক্ত আর নিরাপদ লাগল আমার কাছে।

 বাড়ির মালিক দম্পত্তির সাথে রাতের খাবার খেয়ে আমরা একটা মদের বোতল চাইলাম। কোট পরে দুটো গ্লাস ধার করে বাইরে বের হয়ে আসলাম।

 ‘চলো ঐ কুয়োটার পারে গিয়ে বসি। আমি বললাম।

আমরা সেখানে বসলাম। একটু মদ খেয়ে শীত আর আমাদের ভেতর স্বাভাবিক যে জড়তা তৈরি হয়েছিল সেটা দূর করার চেষ্টা করলাম।

‘মনে হচ্ছে সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তোমাকে পেয়ে বসেছে। তোমার ভেতর থেকে উৎফুল্ল ভাবটা এখন নেই। আমি মজা করে বললাম।

সে হাসল। আমরা জানতাম একটা ঘর আমরা খোঁজার চেষ্টা করলে পাবই। এই মহাবিশ্ব সব সময় আমাদের স্বপ্নকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আমাদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছে। সেগুলো যত হাস্যকরই হোক না কেন। আমাদের স্বপ্নগুলো একমাত্র আমাদেরই। সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কি রকম পরিশ্রম করতে হবে সেটাও শুধু আমরাই জানি।

রাস্তার হলুদ আলোতে কুয়াশাগুলো হলুদ হয়ে ঝুলে ছিল। এত ঘন কুয়াশার কারণে আমাদের থাকার বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল না।

আমি দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলাম। আমাদের আলোচনার বিষয়টা কিছুতেই আমি তারাতে পারছিলাম না।

 ‘ভালোবাসার বিষয়ে আমাদেরকে কথা বলতে হবে। আমি বললাম। তুমিতো জানো গত কয়েকটা দিন আমি এখানে কীভাবে কাটিয়েছি। বিষয়টা তুমিই শুরু করেছে। আমি এখন এক মুহূর্তও এটা নিয়ে চিন্তা না করে থাকতে পারছি না।

‘ভালোবাসায় পরা সত্যিকার অর্থেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সে বলল।

‘আমি এটা জানি। আমি উত্তরে বললাম। ইতোপূর্বে আমি প্রেমে পড়েছিলাম। এটা একধরনের মাদকতা। প্রথমে নিজেকে সপে দেয়ার মত একধরনের আনন্দ আসবে। তারপর দিন তুমি আরো বেশি কিছু চাইবে। যদিও তুমি আসক্ত হবে না কিন্তু সেই আনন্দটা তুমি বারবার চাইবে, তোমার মনে হবে তুমি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। প্রথম প্রথম যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে দুই মিনিট মনে রাখবে আর দুই ঘণ্টা ভুলে থাকবে।

 কিন্তু যখন তুমি এই লোকটার সাথে অভ্যস্ত হতে শুরু করবে আর তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে তখন দিনে দুই মিনিট তুমি তাকে ভুলে থাকবে আর দুই ঘণ্টা তাকে মনে রাখবে। একটা সময় যখন সে কাছে থাকবে না তুমি নিজের ভেতর এক ধরনের পাগলামি আসক্তি টের পাবে।

 ‘কি বিপদজনক ভাবে তুমি এটা ব্যাখ্যা করলে। সে বলল।

হ্যাঁ সে জন্য তাদেরকেই শুধু ভালোবাসা উচিত যারা সব সময় আমাদের কাছেই থাকবে। আমি বললাম।

 সে কুয়াশার উপর দিয়ে অনেক দূরে তাকাল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে সে এই বিষয়ে আর কথা বলতে চায়।

আমি এভাবেই শিখেছিলাম। এ ছাড়া আমার আর কোন বিকল্প পথ ছিল না।

আমি ভাবলাম ভালোবাসাবাসির এই বিষয়টা আপাতত বন্ধ হয়ে গেল। তার মনের পরিবর্তনের জন্য তার সাথে তিন দিন থাকাটাই যথেষ্ট।

আমি একটু কষ্ট পেলেও মনটা একটু হাল্কা হয়ে এসেছে।

আমি কি সত্যিই এটা চেয়েছিলাম? আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম।

কিন্তু আমি এর মধ্যেই ভালোবাসার ঝড়টা টের পাচ্ছিলাম।

আমি অনুভব করতে পারছিলাম আমার বাধে ফাটল ধরে যাচ্ছে।

আমরা কোন গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা না করেই মদ খেতে থাকলাম। যে বাড়িতে আমরা উঠেছি সে বাড়ির দম্পত্তিকে নিয়ে কথা বললাম। আমার বন্ধু এই শহরটা যে দরবেশের নামে হয়েছে তার বিষয়ে আমাকে বলল। সে এই শহরের চার্চগুলো নিয়ে আরো অনেক পৌরাণিক কাহিনি আমাকে বলল।

‘তোমাকে বেশ আনমনা আর চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে একটা মুহূর্তে এসে থেমে বলল।

হ্যাঁ আমার মনটা সত্যিই অস্থির হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল। আমি আশা করছিলাম এখানে কেউ একজন আমার সাথে থাকুক যে আমার হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে দিতে পারে। পরের দিন তাকে আমি হারিয়ে ফেলব এমন কোনো ভয় না পেয়েই আমি যার সাথে সময় কাটিয়ে দিতে পারব। সময় খুব ধীর গতিতে এগুচ্ছিল।

আমরা কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলাম। কারণ আমরা জানি আমাদের জীবনের জন্য পরের মুহূর্তগুলোতে কি কথা আমাদেরকে বলতে হবে।

কোনো কঠিন কথা কিংবা গুরুতর বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিলাম না।

*

আমরা সেখানে চুপচাপ বসেছিলাম। নিরবতাটাই যেন আমাদের জন্য একটা ইশারা ছিল।

 এই প্রথমবারের মতো আমাদের বলার মত কিছু ছিল না। বিষয়টা আমি লক্ষ্য করলাম যখন দেখলাম যে আমার বন্ধু আরেকটা মদের বোতল আনার জন্য উঠে দাঁড়াল।

আবার নিরবতা।

 কিছুক্ষণ পর তার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।

সে কুয়োটার দিকে আসছে যেখানে আমরা গত এক ঘণ্টা ধরে বসে মদ খেয়েছি আর শূন্য চোখে কুয়াশার দিকে তাকিয়েছিলাম।

এই প্রথমবারের মতো আমরা দুজন দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম।

আমাদের এই নিরবতাটা অন্যান্য সময়ের নিরবতার মতো ছিল না।

আজকের এই নিরবতা সে নিজেই কথা বলছিল।

নিরবতাটা এমন ছিল যেন সে বলছে যে আমাদের একে অপরকে আর কোনো কিছুই ব্যখ্যা করার দরকার নেই।

তার পায়ের শব্দটা থেমে গেল। সে আমার দিকে তাকাল। মনে হলো যেন সে কুয়োর পারে কুয়াশার মধ্যে রাস্তার বাতির আলোয় খুব সুন্দরী একজন তরুণীকে অবাক হয়ে দেখছে।

প্রাচীন ঘর বাড়ি, একাদশ শতাব্দীর গির্জা, আর নিরবতা

আমি যখন কথা বলার চিন্তা করলাম এর মধ্যে দ্বিতীয় মদের বোতলটা অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে।

‘আজকের সকালেই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি একজন বেশ ভালো মদ্যপায়ী। আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মদ খাচ্ছি। গত এক বছরেও আমি যেটুকু মদ খায় নি গত তিনদিনে তার চেয়ে বেশি মদ খেয়েছি।’

 সে কিছু না বলে আমার মাথার চুলগুলো নিয়ে একটু নাড়ানাড়ি করল। মাথাটাকে না টেনে নিয়ে আমি তার স্পর্শটা মেনে নিলাম।

 ‘আমি তোমাকে সর্বশেষ যখন দেখলাম তার পর থেকে তোমার জীবনের বিষয়ে আমাকে বলো। আমি বললাম।

বলার মতো তেমন কোন রহস্যময় কিছু নেই। আমার পথ সবসময় এখানেই ছিল।’

 তোমার পথ কোনটা?

কারো একজনের ভালোবাসা খুঁজে বেড়ানো।

সে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর বলল, ভালোবাসার পথ সত্যিই খুব জটিল। কথা শেষ করল।

‘কেননা সেই পথ দিয়েই আমরা স্বর্গে কিংবা নরকে যেতে পারি।

আমি নিশ্চিত ছিলাম না সে এই কথা বলে কি আমাদেরকে ইংগিত করছিল কি না।

সে আর কোনো উত্তর দিল না। সম্ভবত সে সমুদ্রের গভীর কোনো নিরবতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু মদ আমার জিহ্বাকে ক্রমশই আরো ভারি করে দিচ্ছে। আমাকে কথা বলতেই হবে।

‘তুমি বলেছিলে এই শহরের কিছু একটা তোমরা কার্যক্রমকে পাল্টে দিয়েছে।

“হ্যাঁ আমি সেটাই মনে করি। তবে আমি একদম নিশ্চিত না। আর সে জন্যই আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’

‘এটা কি সেই ধরনের কোনো কিছু?

‘না। এটা হলো এক রকমের আত্মসমর্পণ। যাতে করে সে আমাকে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে সাহায্য করবে।

কে সে?

‘কুমারি মাতা।’

কুমারি মাতা! আমার এটা জানা উচিত ছিল। আমি খুবই অবাক হলাম। তার এত কালের ভ্রমণ, তার শিক্ষা, নতুন নতুন সব দিগন্ত তাকে কিছুতেই তার শিশুকালের ক্যাথলিক বিশ্বাস থেকে মুক্ত করতে পারে নি।

 ‘আমি খুব অবাক হচ্ছি যে এত কাল পরেও তুমি সেই বিশ্বাসটা এখনো ধরে রেখেছ। আমি বললাম।

 ‘আমি এই বিশ্বাসটা ধরে রাখি নি। আমি এটাকে হারিয়ে ফেলেছি, আবার পুনরুদ্ধার করেছি।

 ‘কিন্তু এই কুমারিত্বে বিশ্বাস? অসম্ভব আর কল্পনাপ্রসূত বিষয়ে? তুমি কি জীবনে কখনো সেক্স করো নি?

ঠিক আছে শান্ত হও। শোনো আমি অনেক মেয়ে মানুষের প্রেমে পড়েছি।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তার এই কথাতে আমি একটু ঈর্ষা কাতর হয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার ভেতরের যুদ্ধটা সব কিছু স্বাভাবিক করে দিল।

‘কেন এই কুমারি মরিয়ম? সে কেন অন্য মেয়েদের মতো আমাদের কাছে একজন স্বাভাবিক নারী হয়ে আসে না?

সে বোতলের সবশেষ মদের ফোঁটা টুকু গলায় ঢেলে আমাকে বলল আমি তাকে অন্য কোথায় নিয়ে যাব কিনা?

আমি বললাম না।

 ‘আমি তোমার কাছে কি উত্তরটা চাইতে পারি। যখন আমরা কোন বিশেষ বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করি তখনই তুমি অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করো।

 ‘মেরি মাতা অত্যন্ত স্বাভাবিক মেয়ে ছিলেন। তার আরো অন্যান্য সন্তান ছিল। বাইবেল আমাদেরকে বলে যে যিশুর আরো দুইজন ভাই ছিল। মেরি মাতা আশীর্বাদের এক নতুন প্রজন্ম শুরু করতে চেয়েছিলেন।

তিনি নিজের ভাগ্যটাকে মেনে নিয়েছিলেন। ঈশ্বরকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছেন। আর তিনি পাল্টে গেছেন এক নতুন মহান মা মেরিতে। সে কথা শেষ করল।

আমার বন্ধু আসলে কি বলতে চাইছিল আমি তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

সে হলো ঈশ্বরের নারী রূপ।

 আমার বন্ধু প্রচণ্ড আবেগে আর বেশ শব্দ করেই তার কথাগুলো বলছে।

‘একজন দেবী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন আমার বন্ধু পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু সে কিছুই বলল না।

‘এই কুমারি মাতাই বা কে? আর দেবীটাই বা কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 ‘এটা ব্যাখ্যা করা এত সহজ না। সে গরগর করে একটু পরিষ্কার ভাষায় বলার চেষ্টা করল। আমার কাছে কিছু লিখিত কাগজ আছে। তুমি যদি চাও তাহলে সেটা পড়তে পারো।

 ‘আমি এখনই এটা পড়তে চাই না। আমি চাই তুমি এটা ব্যাখ্যা করো।

আমি বেশ দৃঢ় ভাবেই বললাম।

সে মদের বোতলটা ভালোভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। এর ভেতর এক ফোঁটা মদও ছিল না। আমরা দুজনেই ভুলে গেলাম কেন আমরা এখানে এসেছিলাম।

বলো। চুপ থেকো না। আমি আবারো তাগাদা দিলাম।

‘মেরি মাতার প্রতিক হলো পানি। যেমন আমাদের চারপাশ ঘিরে রাখা এই কুয়াশা। দেবি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য এই পানি ব্যবহার করেন।

 আমি তারপরেও বুঝতে পারছিলাম না আমার বন্ধু কি বলতে চাইছে।

 ‘আমি তোমাকে কোন ইতিহাস বলতে চাই না। তুমি যদি ইতিহাস জানতে চাও তাহলে আমার কাছে বই আছে। সেগুলো পড়তে পারো। কিন্তু তোমার জানা উচিৎ যে এই পবিত্র কুমারি মাতা মরিয়ম, পবিত্র আত্মা এই পৃথিবীর চেহারায় সব ধর্মের ভেতর দিয়েই আছেন। তিনি হয়ত বিস্মৃত হয়েছেন কিন্তু তার অনুসারীরা, তার এক শতাব্দি থেকে আরেক শতাব্দি এক সহস্রাব্দ থেকে আরেক সহস্রাব্দ, এমনকি বর্তমান পর্যন্ত নিজেদেরকে রক্ষা করে চলেছে।

“ঈশ্বরের একটা চেহারা আসলে নারীরই চেহারা।

আমি তার মুখটাকে ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম। তার চোখ দুটো চকমক করছিল। আমাদের চারপাশে ঘিরে রাখা কুয়াশার দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

‘পানি কেন ঈশ্বরের নারী রূপ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি জানি না। কিন্তু মেরি মাতা নিজেকে প্রকাশ করার জন্য পানিকেই বেছে নিয়েছিলেন। এটা হতে পারে পবিত্র কুমারি মাতা হলো জীবনের উৎস। আমরা পানি থেকেই উৎপত্তি লাভ করি, তারপর নয়টা মাস পানির মধ্যেই থাকি। পানি হলো নারীর শক্তির প্রতীক।

আমার বন্ধু কিছুক্ষণের জন্য থামল।

তারপর আবার বলা শুরু করল।

সমস্ত ধর্মে সমস্ত প্রথায় তিনি নিজেকে নানা রূপে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আমি একজন ক্যাথলিক হিসেবে তাকে কুমারি মরিয়ম হিসেবে চিনতে পেরেছি।

সে আমার হাত ধরল। আমরা পাঁচ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে সেইন্ট সেভিন শহরের বাইরে চলে আসলাম।

আমাদের চারপাশে অন্ধকার আর কুয়াশা ভালোভাবে জেকে বসল।

আমি ভাবতে শুরু করলাম যে আমি মায়ের গর্ভের ভেতর পানিতে হুটোপুটি খাচ্ছি। যেখানে সময় আর চিন্তার কোনো অস্তিত্ব নেই। সে যা কিছু আমাকে বলেছে সেটা শুধু মাত্র চেতনা তৈরি করার জন্য।

আমি সম্মেলনের সেই মহিলাটার কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। চিন্তা করলাম অল্প বয়স্ক সেই তরুণীটার কথা যে আমাকে বলেছিল পানি হলো দেবী মাতার প্রতীক।

*

“এখান থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে একটা জঙ্গল গুহা আছে। আমার বন্ধু আমাকে বলল।

 ‘সেই গুহার পাশে ১৮৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি একজন তরুণী বালিকা আরো দুটো শিশুর সাথে খড়ের আটি বাঁধছিল। কিশোরীটি খুবই পাতলা আর শ্বাসরোগী ছিল। দরিদ্ৰপরিবারে বাস করত। সেই শীতের কালে একদিন ছোট্ট একটা ঝর্ণা পার হওয়ার সময় মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছিল। এই জন্য যে যদি সে পানিতে পড়ে যায় তাহলে এই শীতে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে অসুস্থ হলে চলবে না। কারণ সে মেষবালিকা হিসেবে যা উপার্জন করে সেটা তার পরিবারের জন্য খুব দরকার।

একদিন সাদা পোশাক পরে হাতে দুটি সোনার গোলাপ ফুল নিয়ে একজন দেবি নারী তার সামনে আবির্ভূত হলো। নারীটি তখন ছোট্ট মেয়েটার সাথে এমন ভাবে আচরণ করল যেন মেয়েটা একজন রাজকুমারি। সেই নারী মূর্তিটি কিশোরীকে আরো বলল যে সে এই জায়গায় তার সাথে দেখা করার জন্য আবারো আসবে।’

‘কিশোরী মেয়েটার সাথে আরো যেই বাচ্চারা ছিল তারা গ্রামে এসে এই খবরটা সব জায়গায় ছড়িয়ে দিল। ফলে এই ঘটনার জন্য কিশোরী মেয়েটাকে কঠিন একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলো।

কিশোরীকে গ্রামের কর্তৃপক্ষ বন্দি করে পুরো ঘটনা জানতে চাইল। তারা মেয়েটাকে আরো বলল সে যেন ঐ অলৌকিক যাদুকরি নারীটাকে আবারো উপস্থিত হতে বলে তাকে ভালো কিছু দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

‘অল্প কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামের লোকজন মেয়েটার পরিবারকে এই বলে উপহাস করতে লাগল যে মেয়েটা একটা বানানো কিচ্ছা কাহিনি নিয়ে এসে তাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে।

‘কিশোরী মেয়েটার নাম ছিল বারনাদেত। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না আসলে সে কি দেখে ছিল। তার বাবা মা উদ্বিগ্ন হয়ে মেয়েটাকে গ্রামের পুরোহিতের কাছে নিয়ে গেল।

 ‘পুরোহিত বলল যে সেই অলৌকিক নারী যখন আবার আসবে তখন মেয়েটা যেন সেই নারীর নামটা জেনে নেয়।

 ‘বারনাদেতকে যেমনটা বলা হয়েছিল সে তেমনটাই করল। সে যখন অলৌকিক নারীকে নাম জিজ্ঞেস করল তখন সেই নারী উত্তরে কিছু না বলে কেবল মুচকি হাসল।

‘এইভাবে সেই অলৌকিক দেবী মূর্তি যতবারই বারনাদেতের কাছে এসেছে ততবারই কিছু না বলে চুপ থেকেছে। একদিন সেই দেবি নারী মূর্তি বারনাদেতকে বলল মাটিতে চুমু খেতে।

বারনাদাতকে যা বলা হলো সে তাই করল। মাটিতে চুমু খাওয়ার পর সেই নারী তাকে গুহার মধ্যে একটা ছোট্ট গর্ত করতে বলল। মেয়েটা তাই করল। তখন সেই গর্ত দিয়ে পানি উঠতে শুরু করল।

নারী মূর্তি তাকে গর্তের পানি খেতে বলল। মেয়েটা একবার দুইবার তিনবার হাত দিয়ে পানি তুলে খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কারণ পানিটা খুব নোংরা ছিল। অবশেষে সে পানিটা খেল।

 ‘মেয়েটা যেখানে গর্ত খুড়েছিল সেখান দিয়ে আরো পানি প্রবাহিত হতে থাকল। একজন এক চক্ষু অন্ধলোক সেই পানির গর্তের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখান থেকে পানি তুলে নিজের মুখ আর চোখের উপর ছিটিয়ে দিল। সাথে সাথে অন্ধ লোকটির চোখদুটো ভালো হয়ে গেল।

‘আরেকবার শুন্য ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা চলে যাওয়ার কারণে প্রচণ্ড শীতে এক মহিলার নতুন জন্ম নেওয়া শিশুটা মরে যাবার উপক্রম হলো। তখন সেই পানি থেকে শিশুটিকে পান করালে শিশুটি সাথে সাথে সুস্থ হয়ে গেল।

 ‘আস্তে আস্তে এই খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ সেই পানির কাছে আসতে থাকল।

বারনাদাত নামের সেই মেয়েটাও বারবার দেবি মূর্তিকে তার নাম জিজ্ঞেস করতে থাকল। কিন্তু দেবী মূর্তি নাম বলল না।

 ‘একদিন সেই দেবী মূর্তি বারনাদাঁতের দিকে তাকিয়ে বলল আমি হলাম নিষ্কলঙ্ক কুমারি নারীর অবয়ব।

মেয়েটা এতেই খুশি হয়ে গ্রামের সেই পুরোহিতের কাছে গিয়ে ঘটনাটা বলল।

‘এটা হতে পারে না। পুরোহিত বলল। কারণ কেউ একই সময়ে গাছ আর গাছের ফল হতে পারে না। তুমি সেখানে আবার যাও আর এই পবিত্র জল তার উপর ছিটিয়ে দাও।

যাই হোক পুরোহিত খুবই দুঃশ্চিন্তায় ছিল। কারণ তার মতে ঈশ্বরই প্রথম থেকে আছে। সেই ঈশ্বর তিনি একজন পুরুষ ছাড়া আর কেউ নন।

এতটুকু বলে সে দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকল।

বারনাদাত সেই পবিত্র জল দেবীমূর্তির উপর ছুঁড়ে মারল।

 ‘দেবী মূর্তি কিছু না বলে কেবল মিটিমিট হাসলেন।

জুলাইয়ের ষোল তারিখ সেই দেবী মূর্তি শেষবারের মতো মেয়েটার কাছে আসল। বারনাদাত বুঝতেও পারল না যে সেই নারী মূর্তি ঝর্ণার আশপাশে গ্রামের যে সমস্ত বাসিন্দারা বসবাস করত তাদের ভাগ্যটাকেই পাল্টে দিয়ে গেছে। সেই ঝর্ণা প্রবাহিত হতে থাকল, সাথে সাথে একের পর এক অলৌকিক ঘটনাও ঘটতে থাকল।

 ‘ঘটনাটা প্রথমে ফ্রান্স থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। সেই শহরটা আরো উন্নত হলো। চারপাশে ব্যবসা বাণিজ্যের রমরমা কারবার শুরু হলো।

বারনাদাত নামের সেই মেয়েটা মারা গেল। তাকে সেই ঝর্ণার একটু দূরে সমাহিত করা হলো। অবশ্য এটা জানা গেল না যে কীভাবে সে মারা গেল।

 ‘পানির সেই প্রবাহ আজো বয়ে যাচ্ছে আর রোগ মুক্তির ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে।

আমি কাছেই কিছু একটার শব্দ শুনতে পেলাম। খুব ভয় পেয়ে গেলাম আমি। কিন্তু আমার বন্ধুকে দেখে মনে হলো না যে সে কোন ভয় পেয়েছে। এই যে আমাদের চারপাশের এই কুয়াশা এর এখন জীবন আছে এর ভেতরে গল্প আছে।

আমার বন্ধু যা কিছু আমাকে বলেছে সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করছিলাম। আমি ভাবছিলাম কীভাবে সে এত কিছু মনে রেখেছে।

ঈশ্বরের নারী রূপটি নিয়ে আমি ভাবতে থাকলাম।

আমার পাশে যে পুরুষটি বসে আছে তার ভেতরের আত্মাটা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে পূর্ণ। সে এখন সংশয়ে আছে। কিছু কাল আগেও চিঠিতে সে আমাকে জানিয়েছিল যে সে ক্যাথলিক সেমিনারিতে ঢুকতে চাচ্ছে আর এখন সে ঈশ্বরের নারী অংশটাকে বিশ্বাস করছে।

আমার বন্ধুটি একদম চুপচাপ বসে ছিল। আমি তখনো অনুভব করছিলাম যে আমি সময় আর কাল অতিক্রম করে পৃথিবী মাতার গর্ভের ভেতর বসে আছি।

আমার বন্ধুটি কথা বলা শুরু করল।

 ‘সেই মেয়েটাকে নিয়ে এখানে দুটো বিষয় লক্ষ্য করা যায়। এক হলো মেয়েটা যেখানে বসবাস করত সেই জায়গাটাতে উদ্বাস্তু আর প্রাচীন লোকদের বসবাস ছিল। সেই দেবীই ছিল তাদের একমাত্র উৎসর্গের বিষয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই দেবীকে স্রষ্টার নারী রূপ হিসেবে তারা পুজো করে আসছিল, তার ভালোবাসা মাহাত্মকে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল।

‘দ্বিতীয়টি হলো এই মেয়েটার সাথে আরো বড় কিছু ঘটল। ভেটিকান সিটি থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লোকজন এসে দেখা করল। বারনাদাঁতের সাথে কি কথা হলো এটা কেউ বলতে পারে না। এটি রহস্যময় হয়েই থাকল।

কথা শেষ করে আমার বন্ধুটি কিছুক্ষণ চুপ থাকল।

 ‘এই সব কিছু নিয়ে তোমার পরিকল্পনা কি? তুমি কী করতে চাও? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি তারই অনুসারি। আমি তার মাধ্যমেই সব কিছু শিখেছি।’

তার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল তার সমস্ত জ্ঞানের উৎস হলো এই নারী।

‘তুমি কি তাকে দেখেছ?

‘হ্যাঁ।’

*

আমরা হোটেলে ফিরে আসার জন্য গির্জার পথ ধরে হাঁটা দিলাম।

আমি রাস্তার বাতির আলোতে কুয়োটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে কুয়োর দেয়ালের উপর মদের বোতল আর দুটো গ্লাস পড়ে আছে।

খুব মিষ্টি কোমল হৃদয়ের দুজন তরুণ তরুণি সেখানে বসেছিল। আমি ভাবলাম। চারপাশের নিরবতা তাদেরকে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তাদের হৃদয়ের সব কথা যখন বলা শেষ হয়ে গেল তখন তারা মহান রহস্য নিয়ে একে অপরে ভাগাভাগি শুরু করল।

.

আমি বুঝতে শুরু করলাম যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা মুখোমুখি হচ্ছি আমি। আমাকে এই রহস্যের সবটাই জানতেই হবে। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি জারাগোজায় আমার শিক্ষার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম।

আমার মনের মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে থাকলাম যাকে আমি সব সময় আমার জীবনে প্রত্যাশা করেছি।

 কিন্তু সব কিছুই কেমন সেইন্ট সেভিনের কুয়াশার রহস্যে অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছে।

 ‘তুমি কেন আমাকে বারনাদাঁতের এই গল্পটা বললে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি আসলে জানি না কেন বলেছি। সে আমার মুখের দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বলল। এটা হয়ত এই জন্য বলেছি যে তুমি আর আমি খুব দূরে নই। কিংবা কালকের পরের যে দিনটা আসছে সেই দিনটাও এক নিষ্কলঙ্ক কল্পনাপ্রসূত বিশ্বাস। অথবা আমি তোমাকে এটা এজন্য বলেছি যে আমি তোমাকে দেখাতে চেয়েছিলাম আমার জগত্তা ততটা নির্জন, একাকী আর ক্ষেপাটে না যতটা দেখে মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে আরো অনেকে আছে যারা এই পৃথিবীরই অংশ তারাও নিজেরা যা বলে সেটাই বিশ্বাস করে।

 ‘আমি কখনোই বলি নি যে তোমার জগত্তা খুব পাগলাটে। আমি বলতে চাই এখানে আমি আমার জীবনের খুবই কঠিন একটা সময় পার করছি। কারণ আমার নিজের পড়ালেখার বই আর কোর্সের দিকে আমাকে মনোযোগ দিয়ে সময়টা পার করতে হচ্ছে। যেটা আমাকে কিছুতেই এখান থেকে বের হতে সাহায্য করছে না। এটা আমি খুব ভালো বুঝে গেছি।

.

আমি বুঝলাম আমার বন্ধু এটা জেনে আস্বস্ত হলো যে আমি তাকে বুঝতে পেরেছি।

আমি আশা করছিলাম আমার বন্ধু দেবীদের বিষয়ে আমাকে আরো অনেক কিছু বলবে।

 কিন্তু সে তেমন কিছু না বলে আমার দিকে ঘুড়ে তাকাল। তারপর বলল, চলো ঘুমাতে যাই। আজকে আমরা প্রচুর মদ খেয়েছি।

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *