২. ব্যাগের ভিতর পাণ্ডুলিপি

অকুর বেরিয়ে গিয়েছে। তাপস ব্যাগের ভিতর থেকে পাণ্ডুলিপিটা বের করেও আবার ঢুকিয়ে রাখল। বাইরে রোদ উঠেছে। নদীতে ছোট ঢেউ, ভাটার টানের স্রোতে রোদের ঝলক। ওপারে ধু ধু চর। রোদ লেগে বালি চিকচিক করছে। চরের ওপারে গ্রাম। গাছপালার আড়ালে ঘর দেখা যায়। মানুষ। চোখে পড়ে না। তাপসের দু চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। ও ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল। ভেজা কাপড়টা মেলে দিয়েছে, ঘরের দেওয়ালে দুটো পেরেকের সঙ্গে। ধোয়া কাপড়ের সঙ্গে ধোয়া জামা গায়ে। মেঝেটা ঠাণ্ডা।

কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই তাপস আবার উঠে বসল। মনে হচ্ছিল, গভীর ঘুমে চোখ জুড়ে আসছে। বসে থাকতে পারছে না। অথচ ঘুম আসছে না। শুয়ে থাকতেও পারছে না। মাথার নীচে ব্যাগের ভিতর থেকে পাণ্ডুলিপিটা যেন ওকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। ক্লান্তি জড়তা ঘুম সবই যেন শরীর থেকে ঘুচে যাচ্ছে। ও ব্যাগের ভিতর থেকে কাপড়ে মোড়া পাণ্ডুলিপিটা বের করল। খাতা কলম সবই তুলে সামনে রাখল। আস্তে আস্তে কাপড়ের ভাঁজ খুলল। ঘরে তেমন বাতাস আসছে না। দক্ষিণ দিকে কোনও দরজা জানালা নেই। পশ্চিমের দরজা দিয়ে যে হাওয়া আসছে তা ঘরের শেষ কোণ অবধি পৌঁছোচ্ছে না। তবুও পাণ্ডুলিপিটাকে কাপড় দিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে রাখল। কালো অক্ষরে সংস্কৃত গদ্য রচনা। অক্ষরগুলো পেঁপের বিচির মতো মাপ, স্পষ্ট, হাতের লেখায় পরিচর্যার ছাপ। তাপস একাধিক বার এই পাণ্ডুলিপি পড়েছে। এইভাবে শুরু হয়েছে :

সপ্তত্রিংশদধিক সপ্তদশতম শাকে চৈত্রে মাসি কৃষ্ণপক্ষে অষ্টম্যাংতিথৌ ॥

প্রবলৎ বিধানানুসারেণ গ্রন্থারম্ভঃ গৃহনির্মাণাদি শুভ কৰ্মণাং বিঘ্নবিনাশায় মঙ্গলাচরণং বিধিয়েম; অদ্যাগহম আত্মজীবন বৃত্তানি রচয়িতুম যতে ॥ মমতু নাস্তি কাপি বিঘশঙ্কা ॥ ততঃ মঙ্গলাচরণপ্রবৃত্তেঃ হেতুর্নাস্তি ॥ যতঃ মে বিঘ্নবিঘ্নচিন্তা সমানা ॥ পাপপুণ্যয়োঃ কমোপি ভেদম নাহম গণয়ামি ॥ অতএব প্রায়শ্চিত্তং ব্যর্থ প্রতীয়তে ॥ ঈশ্বরঃ মানবজন্ম কারণং তৎপরিণামশ্চ ধর্মাধর্মেী জ্ঞানাজ্ঞানে স্বৰ্গনরকে সর্বমিদং বিজ্ঞজননাং পরিকল্পনামাত্রম ইতি–

তাপস থামল। সেই যুগের একজন মানুষ সমস্ত প্রচলিত বিশ্বাসকে কীভাবে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন, প্রথমেই তিনি তা ঘোষণা করেছেন। এই রচনার বাংলা ওর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে। তবু, খাতা সামনে টেনে নিয়ে হাতে কলম তুলে ও শেষ বারের জন্য আর এক বার ভাবল। বাংলা অনুবাদের চিন্তায় প্রথমেই ওর মনে এসেছিল বঙ্কিমি গদ্য। তারপরে ভেবেছিল, সেকালের সংবাদপত্রের বাংলা রচনার কথা। কোনওটাই পছন্দ হয়নি। মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের কথ্য ভাষায় রচনা, রামমোহন, রাজীবলোচন থেকে হুতোম পর্যন্ত ওর মস্তিষ্কে পাক খেয়েছে। কিন্তু সে সব কোনও ভাষাই ওকে আকর্ষণ করেনি। অথচ একেবারে হালের কথ্য বাংলা সাহিত্যের ভাষাও এই অনুবাদের ক্ষেত্রে যেন বেমানান মনে হয়েছে। ও স্থির করেছে, সহজ সরল সাধুভাষায় অনুবাদই ঠিক। লেখক নিজে কোথাও পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেবার চেষ্টা করেননি। অথচ তাঁর সংস্কৃত ভাষার মধ্যে, যাকে বলে ক্লাসিকের ছোঁয়া, তাই রয়েছে। সহজ সরল নির্ভুল ভাষা তাঁর আয়ত্তে ছিল। পণ্ডিত-মূর্খের অপটুতার ছাপ কোথাও নেই। যা সে যুগে, কিংবা তাঁর যুগে অধিকাংশ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পুরোহিত জ্যোতিষ আর বৈদ্যদের মধ্যে ছিল।

তাপস সহজ বাংলা ভাষার সঙ্গে ক্রিয়াপদগুলো সাধুভাষায় ব্যবহারের কথা ভেবেছে। প্রয়োজনে শকাব্দ এবং কিছু কিছু কথা ওকে বন্ধনীর মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। লেখা শুরু করার মুহূর্তে ও এক বার গঙ্গার দিকে তাকাল। কিন্তু গঙ্গাকে দেখছে না। কল্পনায় একটি পুরুষকে ও যেন এক বার দেখে নিতে চাইল। ইন্দ্রনীল পাথরের মতো যাঁর গায়ের রং–অর্থাৎ (সম্ভবত) উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘদেহী, দীর্ঘ কেশ, উন্নত নাসা, মধ্যমাকৃতি, কালো চোখ, গোঁফদাড়িহীন মুখ। এই সব বর্ণনাগুলো রচয়িতার নিজের লেখার মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে।

তাপস লিখতে আরম্ভ করল:

সতরশ সাঁইত্রিশ শকাব্দ (১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) চৈত্র মাস কৃষ্ণপক্ষ অষ্টম তিথি।

প্রচলিত বিধান অনুসারে গ্রন্থরচনা আরম্ভ গৃহ নির্মাণাদি শুভকাজে বিঘ্নের বিনাশের কারণে মঙ্গলাচরণ করা বিধি। আজ আমি আত্মজীবনী বৃত্তান্ত শুরু করিতেছি। (কিন্তু) আমার কোনও বিঘ্নের আশঙ্কা নাই! অতএব মঙ্গলাচরণেরও কোনও হেতু নাই। আমার বিঘ্ন অবিঘ্ন ভাবনা সকলই সমান। পাপ পুণ্যে কোনও ভেদ গণি না। অতএব প্রায়শ্চিত্ত অর্থহীন (ব্যর্থ)। ঈশ্বর, মানুষের জন্মের কারণ, পরিণাম ধর্মাধর্ম জ্ঞান-অজ্ঞান স্বর্গ-নরক সমস্তই বিজ্ঞ ব্যক্তিদের কল্পনামাত্র–অর্থাৎ মিথ্যা। এই মিথ্যা লইয়া জগতে বাঁচিয়া থাকিতে চাহে। কারণ অন্যথায় বাঁচিবার কোনও উপায় খুঁজিয়া পায় না। সকলই মানুষের অবস্থা বিশেষের দ্বারা বিচার করা হয়। সে ঈশ্বর হউক, জ্ঞান ধর্ম পাপ পুণ্য হউক, স্বর্গ নরক হউক, মানুষের জন্মের পরিণাম, অতীত ভবিষ্যৎ, যাহা কিছু ভাবনা, করণীয় কাজ, সকলই মানুষের প্রয়োজনে চালিত হইতেছে। মূলত এ সকলই ভিত্তিহীন। নিজেকে বিজ্ঞ জ্ঞানী প্রমাণ করিতে হইলে, তাহারা শাস্ত্রের বিধান উল্লেখ করে। শাস্ত্রের স্রষ্টারা এক রকম নিরুপায়। তাহারাও জানে, মানুষের জীবন হইতে শাস্ত্র বড় নহে। তথাপি, মানুষের জীবনকে একটি নির্ধারিত পথে চালিত করার জন্য তাহারা শাস্ত্রের সৃষ্টি করিয়াছে। অথচ শাস্ত্রের নির্ধারিত পথে মানুষের বাস্তব জীবন চালিত হয় না। উভয়ের মধ্যে গভীর অসঙ্গতি রহিয়াছে। সেই অসঙ্গতিকে সঙ্গত প্রমাণ করিবার জন্য নানা কূট তর্কজালে আরও অজস্র অসঙ্গতি সৃষ্টি করা হইয়াছে। যথা, প্রাচীন নৈয়ায়িক বলিতেছে, নাস্তিক ব্যক্তির শাস্ত্র রচনা যদি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হয়, তবে তাহা তাহার পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলস্বরূপ গণ্য করিতে হইবে। নাস্তিকের পূর্বজন্মই বা কী, পরজন্মই বা কী। নাস্তিক জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না। নাস্তিকের শাস্ত্র আস্তিকের নিকট কী রূপেই বা উৎকৃষ্ট প্রমাণ হইতে পারে। বাস্তবে, ক্ষেত্রবিশেষে নাস্তিকের প্রিয়তা প্রভাব অস্বীকার করার উপায় থাকে না। অতএব নাস্তিকের শাস্ত্রকে উৎকৃষ্ট বলিতে হয়। যুক্তি সিদ্ধান্তে পূর্বজন্মের সুকৃতির কথা বলিতে হয়। ইহাও মিথ্যাচারিতা।

অসহায় মানুষ বাঁচিবার জন্য সমাজ সংসারের মঙ্গলের জন্য কিছু অবলম্বন করিতে চাহে। শাস্ত্রের অনুশাসন সেই অবলম্বন। কিন্তু অনুশাসন প্রকৃতপক্ষে ভাগ্য নিয়ন্তা নিয়তির রূপ লইয়াছে। শাস্ত্ৰশাসনবিধির সঙ্গে জীবনযাপনের প্রত্যক্ষ অসঙ্গতি লক্ষ করা সত্ত্বেও মানুষ সেই নিয়তি নির্দিষ্ট বন্দিদশায় জীবন কাটাইতেছে। বহুকালের বিশ্বাস, অপরিসীম সারল্য, গভীর অজ্ঞতা, সমাজের ভয় তাহার মনে এক অলৌকিক ও সম্মোহিত ভাবের সৃষ্টি করিয়াছে। পরিত্রাণের কোনও উপায় দেখিতে পায় না। শাস্ত্রকারেরা প্রয়োজন বোধে শাস্ত্রকে ঢালিয়া সাজায়। ইহা তাহাদের ব্যবসায়ের স্বার্থের কারণ। সে ইহাকে মুক্তির উপায় বলে। মানুষ আরও কঠিন পাশে বন্দি হয়।

শাস্ত্রানুশাসন নিয়তির স্থান লইলেই তাহা নিমিত্ত মাত্র। শাস্ত্রকার স্বয়ং নিয়তির অধীন। নিয়তি এক ভিন্ন শক্তি। ইহা বিশ্বাস করিলে মানিতে হয়, নিয়তি অলক্ষ্যে থাকিয়া, মানুষকে তাহার ক্রীড়নকরূপে চালিত করিতেছে। তাহার শক্তি অমোঘ। মানুষ জন্ম লইতেছে। নিয়তি তাহাকে চালনা করিতেছে। হায়! মানুষ কী অসহায়! এই বোধ মনে আসিলে, অন্তরে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ক্রোধ জাগিয়া ওঠে। সংসার ও জীবনের প্রতি বৈরাগ্য ও বীতশ্রদ্ধ হইয়া হতমান জীবনযাপনের পরিবর্তে নিয়তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা শ্রেয়। পুরাণে দুর্বাসা মুনির কথা যাহা বলা হইয়াছে, তাহা কত দূর সত্য, আমি জানি না। কিন্তু নিয়তির বিরুদ্ধে তাঁহার সংগ্রামকে আমি শ্রদ্ধা করি। মানুষ হইয়া জন্মাইলাম, অথচ আমি অপরের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। ইহা যেন জীবন্তে নিজেরই মৃত্যুশোকের মতো নিদারুণ। তবে জন্মিলাম কেন। জীবজগতের নিয়মানুসারে যদি জন্ম হইল, তবে মানুষ হইয়া জন্মাইলাম কেন। পশু হইয়া জন্মাইলে এই সব চিন্তা আসিত না। ভাবিলে অন্তর অস্থির হইয়া ওঠে। ক্রীড়নক জীবনের অসহায়তার কী বিড়ম্বনা। কী কষ্ট, কী যন্ত্রণা। ইহাকে মাথা নত করিয়া মানিয়া লইবার পরিবর্তে আমার অন্তরে তীব্র বিক্ষোভ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়। পাপ পুণ্য প্রায়শ্চিত্ত বোধ, জ্ঞান বিবেক এ সকলই তবে বৃথা। তাহা হইলে কী চোখে জগৎকে দেখিব। আমি জগতের কাছে অবাঞ্ছিত অথবা জগৎ আমার কাছে অবাঞ্ছিত, কোনটি সত্য। বোধ হয় উভয়ই সত্য। ভাবিলে ভয়ংকর মনে হইবে। জীবন সংসার ভয়ংকর ব্যতীত আর কী। সেই ভয়ংকরতার মধ্যেই আমি আমার জীবনকে দেখিয়াছি।

অতএব, অদ্য জীবন বৃত্তান্ত রচনা করিতে বসিয়া মঙ্গলাচরণের কোনও প্রয়োজন দেখি না। শাস্ত্রে বলে অষ্টমে নিধন স্থান। ভাল কথা। অষ্টম তিথিকেই সেইজন্য উপযুক্ত ভাবিয়া শুরু করিতেছি। ষোল শ চুরানব্বই শকাব্দে (১৭৭২ খ্রিস্টাব্দ) ফাঙ্কুনি শুক্লা সপ্তমীতে জন্মিয়াছিলাম। (তিথিকেই বিশেষভাবে গণ্য করা হত।) অতঃপরেই রাশি লগ্ন ইত্যাদির বিষয় অনিবার্য হইয়া ওঠে। কিন্তু আমি সেসব বিবরণ হইতে বিরত থাকিতেছি। কারণ জ্যোতিষী শাস্ত্রে আমার জন্মলগ্নে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান বিবেচনায় যাহা কিছু লিখিত হইয়াছিল, জীবনের একটা সময়ে আসিয়া সকলই মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে। পুরুষানুক্রমে বংশপরিচয়ও লিখিতে চাহি না। কেবল নিজের নামটি উল্লেখ করিব। শুনিয়াছি আমার রাশ্যাশ্রিত (অন্নপ্রাশনের দিন) নাম ছিল রমাকান্ত। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে সেই সময়ে যে রাশিতে। রকারাদি নাম নির্বাচিত হওয়া উচিত, সেই রাশিতে নাকি আমার জন্ম হয় নাই। একদা এই সব বিষয়ে বিশ্বাস ছিল। এখন নাই। অতএব কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। পিতামহ আমার নাম রাখিয়াছিলেন। বৈদূৰ্য্যকান্তি। কুলগ্রন্থে শ্রোত্রিয়বংশ বা বন্দ্যঘটি রাঢ়ী মহাকুলীন। এ সব বিবরণও আমার কাছে এখন অর্থহীন। কুল মেল জাতি পাতি সবই বিসর্জন দিয়াছি। আমার জাত পাত কিছুই নাই।

বৈদূর্য্যমণির বিষয়ে দ্রৌপদীর গাত্রবর্ণের কথা মনে পড়ে। বৈদূৰ্য্যমণি (ক্যাটসআই) দেখিয়াছি। সর্পদংশনের আশঙ্কায় জ্যোতিষের বিধানে আমাকে সোনার আংটিতে বৈদূর্য্যমণি ধারণ করিতে হইয়াছিল। তখন আমার বয়স একুশ। এখন নিতান্তই হাস্যকর বোধ হয়। ঘন দূর্বাঘাসে শিশির বিন্দুর। মতো ইহার রং। কাহারও গায়ের বর্ণ কি এ রূপ হইতে পারে। এই বর্ণের কথা শুনিয়া দ্রৌপদীর রূপ কল্পনা করিতে চেষ্টা করিতাম। কিন্তু আমার গায়ের রং কালো অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল। বৈদূৰ্য্যকান্তি রায় (নবাবি উপাধি) বা বন্দ্য না। নাম হইতে শুরু করিয়া জীবনের সব কিছুতেই অমিল। পরিবারের জ্যেষ্ঠরা আমাকে বেদো নামে সম্বোধন করিত। বৈদূৰ্য্যকান্তি রায় (নবাবি উপাধি) বা বন্দ্য বা বেদো নাম। ভুলিয়াছি। আমি এখন কেবল রমাকান্ত হইয়াছি। রাশ্যাশিত নাম (অন্নপ্রাশনে রাশি নাম) রাখিতে নাই, ইহাতে সন্তানের অমঙ্গল। বলিয়াছি, আমার মঙ্গলামঙ্গলে বিশ্বাস নাই। বরং অমঙ্গলকেই প্রত্যক্ষ করিতেছি। অতএব রমাকান্ত নামেই বা আর অধিক কী অমঙ্গল হইবে। কিন্তু আপাতত জীবন বৃত্তান্তের রচনায় আমি শৈশবকাল হইতে শুরু করিতে চাহি না। তিন বৎসর পূর্বে, সেই ভয়ংকর দিনটি হইতে শুরু করিব। অদ্য এইখানে ইতি।

.

মনে হইল আমি স্বপ্নের মধ্যে বহু ঢাকের বাদ্যাদি শুনিতেছি। তাহার সঙ্গে কাঁসরের শব্দ। এত ঢাক একসঙ্গে বাজিতেছে, যেন ভূমি ও আকাশ কাঁপিতেছে। ঢাক কাঁসরে জগঝম্পের মধ্যে বহু লোকের উল্লসিত চিৎকার। কতক্ষণ এই রকম শুনিলাম, হিসাব নাই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন ডুবিয়া গেল। কতক্ষণ ঘুমাইলাম জানি না। আবার সেই ঢাকের প্রলয় শব্দ শুনিতে পাইলাম। মনে হইল মানুষের কোলাহলে কানের পরদা ফাটিয়া যাইবে। স্পষ্টই শুনিতে পাইলাম, বহুকণ্ঠে ধ্বনিত হইতেছে, জয় জগত্তারিণীর জয়। জয় মা মনসার জয়। জয় বিষহরির জয়।

এই সব জয়ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের গ্রামের জগত্তারিণীর মন্দির দেখিতে পাইলাম। মনসাকেই আমাদের গ্রামে জগত্তারিণী বলা হয়। দেখিলাম শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন মনসা পূজা উপলক্ষে ঝম্পন (ঝাপান) হইতেছে। মন্দিরের সামনে হাড়িকাঠের সামনে বিস্তর রক্ত। মনসা পূজা উপলক্ষে বলি হইয়া থাকে। দেখিলাম, বলি শেষ হইয়া গিয়াছে। হাড়িকাঠের সামনে ছাড়াও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রক্তের ছড়া। মন্দিরের একটু দূরেই দুই-তিনটি বাঁশের মঞ্চ তৈরি হইয়াছে। আমাদের গ্রামের এবং আশেপাশের অন্য গ্রামের যত মাল গুণিন ওঝা তাহাদের বিস্তর সাপের ঝাঁপি লইয়া উপস্থিত হইয়াছে। ঝাঁপি হইতে নানা রকমের বিষধর সাপ বাহির করিয়া তাহারা নানা রকম খেলা দেখাইতেছে। মঞ্চের ওপর উঠিয়া বিশেষ বিশেষ গুণিন মাল ওঝারা মাথায় দুধ গোখরার পাগড়ি বাঁধিতেছে। কালনাগিনীকে বলয় করিতেছে। শঙ্খচূড়, কালি গোখরা, খরিশ গোখরা, অতি ভয়ংকর সব বিষাক্ত সাপ দিয়া গলায় কোমরে জড়াইতেছে। দু হাতেও তাহাদের নানা রকম সাপ ফণা তুলিয়া রহিয়াছে। স্ত্রীলোকগণ যেরূপ সারা গায়ে মাথায় নানা অলংকার জড়ায়, তাহারা সেই রূপ সাপের দ্বারা সাজিতেছে।

বহু ঢাকের শব্দে ফোঁস ফোঁস শুনা যাইতেছে না। মঞ্চ ঘিরিয়া শত শত নরনারী বালক বালিকা। কেবল মাল ওঝাদের হুংকার মাঝে মাঝে ঢাকের শব্দ ছাপাইয়া উঠিতেছে। কার কত প্রকার সাপ আছে, কে কেমন সাজিতে পারে, ইহা প্রদর্শনের পর সাপ লইয়া মঞ্চে মঞ্চে ছোঁড়াছুড়ি খেলা চলিতে লাগিল। ইহাতে কোন সাপ হঠাৎ মঞ্চ হইতে নীচে পড়িয়া যাইতেছে। তৎক্ষণাৎ মালবৈদ্য ওঝাদের শিষ্যরা ছুটিয়া গিয়া ধরিয়া আনিতেছে। কেহ সাপের মুখে চুম্বন করিতেছে। কেহ বা শিথিল সাপকে আঘাত করিয়া তাহার ফণা উজ্জীবিত করিয়া তুলিয়া সেই ফণা মুখের মধ্যে প্রবেশ করাইতেছে ও বাহির করিতেছে। ইহা দেখিয়া যুবতী বধূদের চোখে দ্যুতি ফুটিয়া উঠিতেছে। সলজ্জ হাসিতে পরস্পরের গায়ে লুটাইয়া পড়িতেছে। পুরুষেরাও হাসিতেছে, এবং কেহ কেহ বলিয়া উঠিতেছে, তরুণী ভার্যার বৃদ্ধ স্বামীরা চাহিয়া দেখ। কোনও কোনও বৃদ্ধ বলিয়া উঠিতেছে, আমার ফণা যথেষ্ট শক্ত আছে, সূক্ষ্ম ছিদ্রেও প্রবেশ করিতে পারে।

অতঃপর সকলেই এমন সব অশ্লীল কথাবার্তা আরম্ভ করিল, গৃহস্থ রমণীরা হাসিতে হাসিতে দ্রুত গৃহে গমন করিল। কিন্তু হাড়ি ডোম বাগদি, মাল ওঝাদের স্ত্রীগণ স্থান ত্যাগ করিল না। বরং নির্লজ্জ উল্লাসে হাসিতে হাসিতে পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিয়া অতি কদর্য আচরণ করিতে লাগল। তাহারা এমন সব অশ্লীল কথা বিনিময় করিতে লাগিল, পুরুষদেরও অতিক্রম করিয়া গেল। হাড়ি ডোম স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সুরা পান করিয়া আসিয়াছে, ইহা সকলেই জানে। সকলে মহানন্দে তাহা শুনিতে ও দেখিতে লাগিল। কিন্তু মাল ওঝাদের সাপ লইয়া খেলা দেখিতে দেখিতে আমার শরীরে বড় অস্বস্তি বোধ হইল।

পূর্বে এ রূপ হইত না। একুশ বৎসর বয়সে সর্পদংশনের ভয়ে যখন হইতে আমাকে বৈদূর্য্যমণি ধারণ করিতে হইয়াছিল, তখন হইতে সাপ দেখিলেই আমার শরীরে এক প্রকার অস্বস্তি হইত। জ্যোতিষীতে তখন আমার বিশ্বাস এমন বদ্ধমূল ছিল, সময়ে রজুতেও সর্পভ্রম হইত। আমি গলায় শব্দ করিয়া নড়িয়া চড়িয়া উঠিলাম। তৎক্ষণাৎ সেই স্বপ্ন দূর হইয়া গেল। একটা তন্দ্রার ঘোরে আবিষ্ট হইয়া রহিলাম। আমি অস্পষ্ট স্বর শুনিতে পাইলাম, কী মহাপাতক। ইহার জ্ঞান ফিরিয়া আসিতেছে।

পুরুষের কণ্ঠস্বর, অস্পষ্ট হইলেও শুনিতে পাইলাম। কে বলিল, কেন বলিল, কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। তার ঘোরের মধ্যেই স্বপ্নবৎ বহু লোকের নানা কথাবার্তা আমার কানে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। বুঝিতে পারিতেছি না, আমি কোথায়, কী অবস্থায় আছি। এখনও কি সেই জগত্তারিণীর ঝাপানের কোলাহল শুনিতেছি! কিন্তু তাহা বোধ হইতেছে না। এ কোলাহল অন্য রকম। ইহা সমবেত কোলাহল নহে। অথচ চারিপাশে নানা লোকের নানা কথা শুনা যাইতেছে। এক বার মনে হইল, বাড়ির মধ্যে কোনও শুভ যাগ কর্ম হইতেছে। অতিথি নিমন্ত্রিতের দল নানা কথা ও হাস্য পরিহাস করিতেছে। ইহা মনে হইবার কারণ, স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বরও আমার কানে আসিতেছে। শুনিতেছি, অথচ সম্যকরূপে কিছুই বোধগম্য হইতেছে না। সমস্তই একটা তন্দ্রার ঘোরে শুনিতেছি। এই সময়ে কেহ যেন আমার ঠোঁট ফাঁক করিয়া ধরিল এবং মুখের মধ্যে কোনও কাদার মতো কটু অম্ল জল ঢালিয়া দিল। আমি তাহা গিলিতে পারিলাম না। থুৎকারে বাহিরে ঠেলিয়া দিলাম। অনুভব করিলাম আমার ঠোঁটের কষ ও চিবুক দিয়া তাহা গড়াইয়া পড়িল। এইবার আরও স্পষ্ট পুরুষের স্বর শুনিতে পাইলাম, কী মহাপাপ, দেখ ইহার পূর্ণজ্ঞান ফিরিয়া আসিয়াছে।

কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত মনে হইল। কিন্তু যথার্থ চিনিতে পারিলাম না। আবার আমার ঠোঁট ফাঁক করিয়া সেই কটু অম্ল পদার্থ দেওয়া হইল। এই বার বুঝিলাম অম্ল ও কটু স্বাদের দধি আমার মুখে দেওয়া হইতেছে। আমি আবার থুৎকারে তাহা মুখের বাহিরে ফেলিয়া দিলাম।

আমার নিজের স্খলিত বিরক্ত স্বর শুনিতে পাইলাম। মুখ মুছিবার জন্য হাত তুলিতে চেষ্টা করিলাম। হাত উঠিল। মুখের উপর আসিয়া পড়িল। কিন্তু আর নাড়িতে পারিলাম না। এই সময়ে অন্য এক পুরুষের স্বর শুনিতে পাইলাম, কী দুর্ভাগ্য। জানি না কী ঘটিবে।

ইহার জবাবে পূর্বের স্বর শুনিতে পাইলাম, যাহা ঘটিবার তাহাই ঘটিবে। যে যেমন ভাগ্য লইয়া জন্মাইয়াছে, তাহা খণ্ডন করা যায় না। বয়স বেশি হইলে জলে নামাইয়া দিতাম। ইহাকে তাহা করা সম্ভব নহে। এই সব কথা শুনিয়া আমার তন্দ্রাবিষ্ট ঘোর ক্রমে দূর হইয়া গেল। কথাগুলির অর্থ যেন আমার কাছে স্পষ্ট বোধ হইল। আমার জাগ্রত চেতনার মধ্যে এক অশুভ ভয়ংকর সংকেত পাইলাম। বিশেষ করিয়া বয়স বেশি হইলে জলে নামাইয়া দিবার কথায়, ভয়ংকর সংকেতটি স্পষ্ট হইয়া উঠিল। চোখ না মেলিয়াও নির্ঘাত বুঝিলাম আমি গঙ্গাযাত্রীর ঘাটে শায়িত রহিয়াছি। বৈদ্যেরা নিশ্চিত নিদান দেওয়ায়, আমাকে গঙ্গার ঘাটে লইয়া আসা হইয়াছে। সম্ভবত ইহা ত্রিবেণীর ঘাট। যে সমস্ত কোলাহল শুনিতেছি, তাহা আনার্থী এবং মাঝিমাল্লাদের। হরিধ্বনিও কানে আসিল। নিকটের শ্মশানের চিত্র আমার চোখের সামনে জাগিয়া উঠিল। নানা গন্ধের মধ্যে মৃতদেহের দগ্ধ গন্ধও এখন স্পষ্ট পাইতেছি। অভিজ্ঞতা নতুন নহে। আমার পিতামহকে এই ঘাটেই অন্তর্জলি যাত্রার জন্য লইয়া আসিয়াছিলাম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি পাঁচ দিন বাঁচিয়া ছিলেন। আমার চার জ্যাঠাইমার মধ্যে এক জনকে এই ঘাটে আনিয়াছিলাম। তাঁহাকে অন্তর্জলি করিতে হয় নাই। মাত্র দুই দিন বাঁচিয়া প্রচুর গঙ্গাজল পান করিতে করিতে মরিয়াছিলেন। তাঁহার মুখেও অম্ল কটু দই দেওয়া হইয়াছিল। জ্যাঠামশাই অনেক আগেই মারা গিয়াছিলেন। তখন আমার বারো বছর (১৭৮৪ খ্রিঃ) বয়স। তাঁহাকে ত্রিবেণীতে আনা হয় নাই। সপ্তগ্রামে ছোট গঙ্গার তীরে (মূলত সরস্বতী নদী) তাঁহার জন্য একটি চালাঘর করা হইয়াছিল। ইহার কারণ পরে বুঝিয়াছিলাম। আমার জ্যাঠামহাশয়ের চার পত্নীর মধ্যে, প্রথমা তাঁহার সঙ্গে সহমরণে চিতারোহণ করিয়াছিলেন। পাছে কোম্পানির সাহেবরা আসিয়া বাধা দেয়, সেই জন্যই সাতগাঁয়ে দাহ করার ব্যবস্থা হইয়াছিল। জ্যাঠাইমার সেই লাল চেলি পরা, সধবা মূর্তি এখনও আমার চোখে ভাসে। ইহাও মনে আছে, তাঁহাকে সহমরণে যাইতে কেহ কোনওরূপ উদ্বুদ্ধ করে নাই। তিনি স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় আরোহণ করিয়াছিলেন। জ্যাঠাইমার ‘সতী’ হইবার সংবাদ গোটা পরগনায় রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছিল। সেই সহমরণ দেখিবার জন্য দোল দুর্গোৎসব ঝাপানের অপেক্ষাও বেশি লোক সমাগম হইয়াছিল।

আমি পরেও দুইটি সহমরণ দেখিয়াছি। তাহা ছিল হত্যারই সামিল। যে বিধবা জ্যাঠাইমাকে এই গঙ্গাযাত্রীর ঘাটে আনা হইয়াছিল, তিনি গঙ্গাজল আর অম্ল দই খাইয়া সজ্ঞানে মরিয়াছিলেন। মনে আছে, তিনি মুখে গঙ্গা জল ও কটু দই নিতে পারিতেছিলেন না। জোর করিয়াই তাঁহাকে কর্দমাক্ত গঙ্গাজল ও কটু দই দেওয়া হইয়াছিল। আজ আমার মুখেও অম্ল কটু দই দিবার চেষ্টা হইতেছে। যাহারা কথা বলিতেছে, কণ্ঠস্বর শুনিয়া তাহাদের চিনিতে পারিতেছি। আমার কনিষ্ঠ ভাই শ্যামকান্তি এবং জ্ঞাতি খুড়া ভবতারণ বন্দ্য ভট্টাচার্য। আর কোনও সন্দেহ নাই আমি গঙ্গাযাত্রীর ঘরে শায়িত রহিয়াছি। মাঝিমাল্লাদের হাঁকডাক, স্নানার্থীদের কলকোলাহল, শ্মশানযাত্রীদের হরিধ্বনি, ত্রিবেণীর এই সবই আমার পরিচিত। এখন আমাকে মারিবার চেষ্টা হইতেছে। জ্ঞাতি খুড়া ভবতারণ, নিতান্ত আমার বয়সের কথা ভাবিয়া গঙ্গার জলে নামাইতে পারিতেছে না। শ্যামকান্তির স্বর অশুভ ভয়ে আক্রান্ত। আমার চারিপাশে অনেকের ফিসফাস শুনিতেছি। যেন প্রেতাত্মারা বায়ুর সঙ্গে কথা বলিতেছে। বুঝিতেছি, কেবল জ্ঞাতি খুড়া ও আমার কনিষ্ঠ ভাই আসে নাই। আত্মীয়বর্গের আরও কেহ কেহ আসিয়াছে। তাহারা ভৌতিক স্বরে নানা কথা আলোচনা করিতেছে। তাহাদের কথা আমি স্পষ্ট কিছুই শুনিতে পাইতেছি না। কিন্তু না শুনিতে পাইলেও, কী আলোচনা হইতেছে তাহার মর্মার্থ আমি জানি।

আমার বাঁচিয়া থাকা তাহাদের কাছে কোনও প্রকারেই প্রার্থিত নহে। আমার গঙ্গাপ্রাপ্তি সম্পর্কে তাহারা নিশ্চিত ছিল। প্রত্যক্ষ না জানিলেও ইহা নিশ্চিত, বৈদ্য আমার নিদান (অনিবার্য মৃত্যু) ঘোষণা করিয়াছিল। সেই কারণেই সুদূর গ্রাম হইতে আমাকে নৌকাযোগে এখানে আনা হইয়াছে। আমি নিজেই জানি না, কত দিন আমি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম। আজ কিছুক্ষণ আগেই যে প্রথম তন্দ্রাঘোরে স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, তাহা নহে। ইতিপূর্বেও দুই চারিবার এরূপ চকিত স্বপ্নের ক্ষীণ রেখা আমার ঘুমন্ত অবস্থায় দেখিয়াছি। কিন্তু তাহা ছিল নিঃশব্দ অথচ জীবন্ত চিত্রের মতো। কিছু শুনিতে পাই নাই। কোনও অনুভূতিও ছিল না। এখন আমার শরীরে অনুভূতি ফিরিয়া আসিতেছে। কথা শুনিতে পাইতেছি। জিভে স্বাদ পাইতেছি। হাত নাড়িতে পারিতেছি। ডান হাত এখন আমার মুখের ওপর রহিয়াছে, যাহাতে কিছু মুখে দিতে গেলে বাধা দিতে পারি। এমনকী ইহাও অনুভব করিতেছি, আমার হাতে অনধিক এক সপ্তাহকালের গোঁফ দাড়ির স্পর্শ।

ইহাই আমারই দুর্ভাগ্য অথবা ভাই জ্ঞাতি খুড়া ও অন্যান্য আত্মীয়বর্গ পুরুষদেরই দুর্ভাগ্য। বৈদ্যের নিদান ব্যর্থ হইয়াছে। আমার দুর্ভাগ্য, এখন পরিপূর্ণ মাত্রায় বাঁচিয়া রহিয়াছি। আমাকে লইয়া যাহারা গঙ্গাযাত্রায় আসিয়াছে তাদেরও দুর্ভাগ্য। তাহারা আমার মৃত্যু কামনা করিতেছে। তাহাদের পক্ষে ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু জীবাত্মার কী মহিমা, আমার বাঁচিতে ইচ্ছা করিতেছে। আমার নিশ্চিত অনুমান, আমাকে যাহারা লইয়া আসিয়াছে, তাহারা এক অশুভ আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের অবস্থায় পড়িলে আমার মনের অবস্থা কি তাহাদের মতোই হইত না! আমি জানি, এখন তাহাদের আলোচনার বিষয় একটি। আমাকে রাখিবে অথবা মারিবে। এই সময়েই আমি একজন পুরুষকে ফুপাইয়া কাঁদিয়া উঠিতে শুনিলাম। বলিতে শুনিলাম, হে বাবাঠাকুরেরা, এমন কাজ করিও না। ইহাতে আমার ব্রহ্মশাপ লাগিবে।..

.

তাপস পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে, খাতা থেকে মুখ তুলল। দেখল অকুর ফিরে এসেছে। তাপসের নিজেরও খেয়াল ছিল না ও কখন গায়ের জামা খুলে ফেলেছে। ও উপুড় হয়ে গভীর মগ্নতায় পাণ্ডুলিপির প্রতিটি লাইন অনুবাদ করছিল। গভীর মগ্নতার মধ্যে একটা উত্তেজনাও রয়েছে। ও খালি গায়েই ঘামছে। অথচ পশ্চিমের পাল্লাহীন খোলা দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে হাওয়া আসছে। ও অকুরকে দেখে সোজা হয়ে বসল। বাইরে তাকিয়ে দেখল চারদিকে এখনও ঝা ঝা রোদ। ঘোর দুপুরবেলা দুটো-আড়াইটার বেশি না। অথচ ও জানত অকুর বিকালের আগে ফিরবে না। অকুর নিজেও তা-ই বলে গিয়েছিল।

অকুরকে দু কাঁধে ঝোলাঝুলি নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে তাপস সোজা হয়ে বসল। দীর্ঘকাল টেবিল চেয়ারে বসে লেখার অভ্যাস। সোজা হয়ে বসতে গিয়ে, ওর কোমর টনটন করে উঠল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখনই ফিরে এলে? বলেছিলে ফিরতে ফিরতে বেলা পড়ে বিকেল হয়ে যাবে?

হ্যাঁ, তাই ত বলেছিলুম গো দাদাবাবু। অকুর ক্লান্ত ঝুঁকে পড়ে নিজের কোণটিতে যেতে যেতে বলল, তা পরে বাইরে যেয়ে মনে হল, তুমি বাবু ভদ্দরলোকের ঘরের ছেলে। আমার মতন এক বেলা খেয়ে থাকবে কেমন করে। তাই ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এলুম। ভিখ মাগার কাজটা তেমন হল না। বাজার থেকে এ দোকান ও দোকান ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে চলে এলুম। আল কুমড়ো এনেচি, ভাতে ভাত ফুটতে সময় লাগবে না। সে কথা বলতে বলতে ঘাড়ের ঝোলা নামাল। কপালের গঙ্গা মাটির ফোঁটাটা ঘামে নাক অবধি গড়িয়ে এসেছে।

দুপুরবেলা খাওয়ার কথাটা তাপসেরও খেয়াল ছিল না। এখনও ওর মন পাণ্ডুলিপির মধ্যে ডুবে আছে। বলল, আমার জন্য তোমার ফিরে আসার দরকার ছিল না। তোমার সঙ্গে তোমার মতোই থাকব। তুমি যদি সারা দিনে এক বার খেয়ে থাকতে পারো, আমিও পারব। আমার জন্য তোমার দুপুরে রান্না না করলেও চলবে।

তা কি হয় বাবা। অকুরের গোঁফ দাড়ির ফাঁকে তার দাঁতহীন লাল মাড়ির হাসি দেখা গেল, বাবু ভদ্দরনোকের ছেলে নয় বাদ দিলুম। তোমার বয়সটা দেখতে হবে তা জোয়ান ছেলে, এ বয়সে কি এক বেলা খেয়ে থাকা যায়? ভিখ মাগতে যেয়ে, আমিও দোকান থেকে চেয়ে চিন্তে যা পাই, এক মুঠো চিড়ে মুড়ি গুড় চিবিয়ে জল খাই। বুড়ো হলেও পেট মানে না। তোমার মতন বয়সে আমি কি এক বেলা খেয়ে থেকেচি? সে তাপসের দিকে এগিয়ে এসে একটা ঠোঙা বাড়িয়ে দিল, বলল, নাও তোমার পয়সা দিয়েই মুড়ি মুড়কি মিশিয়ে কিনে এনেচি। চিবোও। আমি উনোন জ্বেলে ভাত বসিয়ে দিচ্ছি।

তাপস বৃদ্ধ অকুরের মুখের দিকে এক বার তাকিয়ে দেখল। অবাস্তব কথা সে বলেনি। এই ভাঙা গঙ্গাযাত্রীর ঘরের নিভৃত জীবনে, ভিক্ষে করে জীবনধারণ করলেও সংসার ও মানুষ সম্পর্কে তার বাস্তব চিন্তা-ভাবনা নষ্ট হয়নি। তাপস ঠোঙাটা হাতে নিতেই, মুড়ি মুড়কির গন্ধে ওর খিদে পেয়ে গেল। অকুরের দিকে তাকিয়ে হেসে ঠোঙা থেকে মুড়ি মুড়কি নিয়ে মুখে দিল। অকুর বলল, দেখ, যার যেমন জীবন। আমি গেচি ভিখ মাগতে আর তুমি এক মনে নেকাপড়া করচ। এটাই বুইতে পারলুম না ঘর ছেড়ে এ ঘাটে এসে কেন বাবা নেকাপড়া নিয়ে বসে।

তাপস হাসতে হাসতে আরও কয়েক মুঠো মুড়ি-মুড়কি মুখে পুরল। অকুরেরও কোনও জবাবের প্রত্যাশা নেই। সে নিজের জায়গায় সরে গিয়ে, ঝোলা থেকে কলাপাতা বের করে বলল, তোমার জন্যে কলাপাতা নিয়ে এসেছি। আমার বাসনপত্তরে তোমাকে খেতে দিতে পারব না। যা বল কও বাবা, পিবিত্তি বলে একটা কথা আছে। যদি বল, কাল তোমার জন্যে একটা আলাদা মাটির হাঁড়ি কিনে নিয়ে আসব।

কোনও দরকার নেই অকুরদা। তাপস এই প্রথম অকুরকে একটা নামে সম্বোধন করল, তোমার হাঁড়ি থালা বাসনে খেতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তোমার তো সবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

অকুর মালসায় চাল ঢালতে ঢালতে বলল, ‘তা হোক বাবা, তুমি আমি এক নই। পেথমে ত ভেবেচিলুম আমাকে তুমি মারতে এসেচ। তা যখন আসনি, আমার সঙ্গে থাকবে বলচ, আমাকে আমার মতন সব করতে হবে। কলসি গড়িয়ে চালের মালসায় জল নিয়ে আবার বলল, তা ছাড়া, বিকেল লাগাদ আমি একবার কাটকুটো পাতা ঝোরা কুড়তে যাব। আজ দু বেলা রাঁধব। রাতের ভাত তোমার জন্যে জল দিয়ে রেখে আমি সকালে বেরিয়ে যাব। তেল এনিচি। আলু প্যাঁজ কুমড়ো ভেজে রেখে। যাব। দুপুরে যখন খিদে পাবে, তাই খাবে।’ সে কলসি থেকে একটা টিনের কৌটায় জল ঢেলে গঙ্গার। দিকে খোলা দরজার কাছে গেল। দু হাত ধুয়ে, গোঁফ দাড়ি ভিজিয়ে চোখে মুখে জল দিল। তার পর ফিরে এসে, মালসার চালে হাত দিল। মুখ না ফিরিয়েই বলল, তোমার মোমবাতি এনিচি, দেশলাই এনিচি, সিরগেটও এনিচি। সব দিচ্ছি। ভাতটা আগে বসিয়ে দিই। তোমার যখন সময় হবে তখন হিসেব দেব। এখন নেকাপড়া করতে চাও তো কর।

তাপস অকুরকে যতই দেখছিল, ওর কথা শুনছিল, ততই অবাক হচ্ছিল। তার কথায় কাজে কোনও ত্রুটি নেই। বাড়াবাড়ি নেই। আপাতদৃষ্টিতে সে যেন নির্লিপ্ত, অথচ বাস্তববোধের কোনও অভাব নেই। একদা সে গরিব কৃষক ছিল। যখন তার কাজের ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়েছিল, তখন সে ছেলেদের একটা বোঝা মাত্র। তারা তাকে খেতে দিতে পারেনি। কিন্তু বাঁচতে বড় সাধ, মরতে কেউ চায় না। সেই কারণে সে সংসারের বাইরে, ভিক্ষে করে বেঁচে আছে। তার কোনও অভিযোগ নেই। সে ছেলেদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি। সমাজ সংসারের বিরুদ্ধেও এখনও পর্যন্ত কোনও অভিযোগ করেনি। অথচ সংসারের বোধ বুদ্ধি হারায়নি। জীবনকে সে এইভাবে মেনে নিল কেমন করে। তাপসের অভিজ্ঞতায়। এমন চরিত্র দরিদ্র কৃষকের সঙ্গে মেলে না। সে সংসার অভিজ্ঞ, অথচ সংসারের বাইরে সে যেন একাকী এক দার্শনিক। সে নিজেকে নিতান্ত ভিখিরি ভাবে না, তাকে দেখেও একটা ছন্নছাড়া ধুলামলিন ভিখিরি। মনে হয় না। স্থান কাল পাত্র এবং নিজের সম্পর্কে সে অবহিত। এক রাত্রের পরে এই দুপুরে লোকটিকে ওর আরও ভাল লাগল। এই বহিষ্কৃত জীবনে, অকুরের প্রতি ও কৃতজ্ঞবোধ করল। তার কথায় ওর ক্ষণিকের অন্যমনস্ক মন আবার পাণ্ডুলিপির দিকে ফিরে গেল।

.

বিকাল আসন্ন। অকুর কাটকুটোর সন্ধানে বেরিয়েছে। ভাদ্রের দীর্ঘদিন। আসন্ন বিকালেও মনে হচ্ছে ঘোর দুপুর। তাপস নিজের কাজে ডুবে গিয়েছে।…

রুদ্ধ কান্নার সঙ্গে পুরুষের এই উৎকণ্ঠিত স্বর শুনিবা মাত্র তাহাকে চিনিতে পারিলাম। এই স্বর দু বাগদির। অর্থাৎ দুর্যোধন বাগদির। স্বর চিনিবামাত্র, আমার অজ্ঞান হওয়ার পূর্ব মুহূর্তের কথা মনে পড়িয়া গেল। দু আমার পাইক সর্দার। তাহার সঙ্গে আমার এক প্রকার সখ্যতা ছিল। আমার পশ্চিমের। বড় পুষ্করিণীর ধারে বাগানে একটি আখড়া করিয়াছিলাম। সেখানে প্রায় অপরাহেই তাহার সঙ্গে আমি মল্লক্রীড়া (কুস্তি) করিতাম। দু আমারই বয়সি হইবে। বংশপরম্পরায় উহারা নবাব সরকারের অধীনে। যুদ্ধ করিত। তিন পুরুষ আগেই তাহাদের যুদ্ধবৃত্তির যুগ শেষ হইয়াছে। দুই একমাত্র আমার অধীনে চাকরি করিত। উহার বাপ জ্যাঠারা আমাদের ভূমিতে কৃষিবৃত্তি করিত। দুয়া ছাড়াও আমার আরও কয়েকজন পাইক ছিল। তাহারাও সকলেই বাগদি। ভিন্ন পরগনায় রাজস্ব আদায়ের সময় তাহারা আমার সঙ্গে যাইত। সরকারে জমা দিবার সময়ও যাইত।

অবকাশ সময়ে ঘরে স্ত্রীলোকদের বা বাইরের বাড়িতে বয়স্যগণের সঙ্গে কেবল পাশা সটকা (?) খেলিতে আমার ভাল লাগিত না। শরীর চর্চার দিকে আমার ঝোঁক ছিল। দুঃখের বিষয় পরিবারের বা জ্ঞাতিবর্গের যুবকদের মধ্যে শরীর চর্চার কোনও উৎসাহ ছিল না। দুর সেই উৎসাহ ছিল। তাহার রায়বেশ খেলা দেখিবার মতো ছিল। আমিও তাহার সঙ্গে খেলিতাম। তবে আমাদের উভয়েরই বয়স চল্লিশ হইয়াছিল। অল্প বয়সের উদ্দামতা তেমন ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝেই বাগানের মল্লভূমিতে যাইতাম। যেদিন লড়াই হইত না, সেই দিন দুযা কেবল আমার শরীর দলন মর্দন করিত। এ কথা নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি, মেদবর্জিত শরীরে আমি বিশ বছরের যুবকের মতো শক্তিশালী বোধ করিতাম।

দুযাও বয়স অনুপাতে অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছিল। দৈর্ঘ্যে সে আমার অপেক্ষা কিঞ্চিৎ কম হইলেও, প্রস্থে ভীমের মতো চওড়া ছিল। রং ভ্রমরের মতো কালো উজ্জ্বল। চল্লিশ বছর বয়সে আমাকে সকলে যেমন তরুণ দেখিত, দুকেও সেই রকম দেখিত। শরীর চর্চার বিষয়টি আমার পিতামহর কাছ হইতে পাইয়াছিলাম। তিনি নিজে কৈশোর ও যৌবনে ব্যায়ামাদি করিতেন। আমার পিতার সে উৎসাহ কখনও দেখি নাই। পিতামহ যৌবনে বুকে আছড়াইয়া কাঁচা বেল ভাঙিতে পারিতেন। দু হাতে সরষে চটকাইয়া তেল নিষ্কাশন করিতে পারিতেন। রায়বেশেও তিনি দক্ষ ছিলেন। এ সব অধিকাংশই শুনিয়াছি। বালক বয়সে পিতামহ খেলাচ্ছলে কিছু দেখাইতেন। বলিতেন, দেশের আগের অবস্থা থাকিলে মুরশিদাবাদে রাখিয়া দক্ষ বীরদের কাছে তিনি আমাকে ব্যায়াম শিক্ষা করিতে দিতেন। অবশ্য এ কথাও ঠিক, আমার বারো বছর বয়সে আমি যখন পারসি শিখিবার জন্য দুই বছর মুরশিদাবাদে ছিলাম, তখনই আমার শরীর চর্চা শুরু হইয়াছিল। আমার পিতামহ (নাম নেই) মুরশিদাবাদের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করিতেন। আমার পিতাও কিছুকাল করিয়াছিলেন। সেখানে আমি এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে থাকিতাম। মদমে যাইয়া পারসি শিখিবার কোনও প্রশ্ন ছিল না। একজন পারসি ও আরবি ভাষার পণ্ডিত সৈয়দ ধার্মিক মুসলমানের কাছে লেখাপড়া শিখিতাম। নবাবের আত্মীয়বর্গ বিশিষ্ট মুসলমান পরিবারের সন্তানরা যেখানে মল্লক্রীড়া করিত, পিতামহ আমাকে সেইখানে যাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। আমার পিতার ইহাতে তেমন সম্মতি ছিল না। রাজস্ব বিভাগে কিছু কাজকম্ম চালাইবার মতো শিক্ষা পাইলেই যথেষ্ট। পিতার আর কোনও উৎসাহ ছিল না। ত্রিবেণীতে ইতিপূর্বেই সংস্কৃত শিক্ষা করিয়াছিলাম। যদিচ তাহাতে আমি তৃপ্ত ছিলাম না। পরে আমি নতুন করিয়া সংস্কৃত শিখিয়াছিলাম।

সে সব পরের কথা। মুরশিদাবাদে যে ব্রাহ্মণের গৃহে থাকিতাম তিনি আমার পিতামহের অনুগ্রহভাজন ছিলেন। তাহারও ইচ্ছা ছিল না আমি মল্লভূমে যাই। পারসি শিক্ষকের গৃহ হইতে ফিরিয়া স্নান না করিয়া আমি তাহার গৃহে প্রবেশ করিতাম না। মল্লক্রীড়া সারিয়া ফিরিবার পরে, দুই বার স্নান করিলে, তিনি হয়তো মনে মনে অধিক সুখী হইতেন। মুরশিদাবাদ নগরে যে সব সুবিধা ছিল, গ্রামে তাহা ছিল না। বলিয়াছি, আমাদের গ্রামের বাড়িতে কাহারও শরীর চর্চায় উৎসাহ ছিল না। অতএব দুকে লইয়া আমিই পশ্চিমের বাগানে একটি চালাঘর করিয়া, তাহার মধ্যে মাটি কাটিয়া মল্লভূমি প্রস্তুত করিয়াছিলাম।

দুয়া প্রথমে আপত্তি করিয়াছিল। মল্লক্রীড়া করিতে গেলে, ব্রাহ্মণের গায়ে তাহার পায়ের স্পর্শ লাগিবে, ইহা পাপ। তখন আমার পিতামহই বিধান দিয়াছিলেন দুয়া ক্রীড়ার শুরুতে আমার পদধূলি লইবে। ক্রীড়ার শেষেও পদধূলি লইবে এবং আমার পাদোদক পান করিবে। সেই হইতে দুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য রকম গড়িয়া উঠিয়াছিল। শুরুতে, অল্প বয়সে অবকাশ পাইলেই দুয়া আর আমি মল্লঘরে যাইতাম। বয়সের ও পারিবারিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মল্লক্রীড়া বা অন্যান্য ক্রীড়াও কমিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া কেহ সম্যক উপলব্ধি করিতে পারিবে না, শরীর চর্চায় এক বার অভ্যস্ত হইলে, তাহা অনেকটা নেশার মতো পাইয়া বসে। কিছুদিন মল্লক্রীড়া বন্ধ থাকিলেই শরীর যেন নিস্তেজ বোধ হয়। মনে স্ফুর্তি থাকে না। সেই জন্য চল্লিশ বছর বয়সেও অবকাশ পাইলেই আমি আর দু পশ্চিমের বাগানের ক্রীড়াভূমিতে যাইতাম। এইরূপ নহে যে, উহা দুইজনের একটি নিভৃত ক্ষেত্র ছিল। বিশেষ করিয়া অন্যান্য পাইক ও অল্পবয়সি কুতূহলী বালকেরা সেখানে উপস্থিত থাকিত। সময়ে যুব বা বয়োজ্যেষ্ঠরাও নিতান্ত কৌতুকবশত উপস্থিত হইত।

যে মুহূর্তে আমি রুদ্ধ কান্না ও কথা শুনিয়া দুকে চিনিতে পারিলাম সেই মুহূর্তেই জ্ঞান হারাইবার পূর্বের কথা আমার মনে পড়িয়া গেল। তখনও জানি না কতক্ষণ বা কয়দিন আমার জ্ঞান ছিল না। শেষ মনে ছিল। আমি আর দু পশ্চিমের বাগানে মল্লঘরে গিয়াছিলাম। নিয়মিত যা হইত তাহাই হইয়াছিল। আশ্বিনের অপরাহু, তখনও শরতের নীল আকাশে রৌদ্র ছিল। দু আর আমি কাপড় খুলিয়া লেঙ্গুটি পরিয়াছিলাম। দু দণ্ডবত হইয়া আমাকে প্রণাম করিয়াছিল এবং মনে মনে ঠোঁট নাড়িয়া কী সব বলিয়াছিল। প্রণাম করিয়া ঠোঁট নাড়িয়া কিছু বলা নতুন নহে। আমি জিজ্ঞাসা করিলে সে হাসিত, বলিত কর্তাদাদা উহা শুনিয়া আপনার কাজ নাই। কিন্তু আমি জানিতাম সে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে বলিত আমার সঙ্গে ক্রীড়া করিয়া তাহার যেন কোনও পাপ না লাগে। সম্ভবত সে ঈশ্বরের কাছে আরও প্রার্থনা করিত ক্রীড়া যুদ্ধে যেন আমার কোনওরূপ কষ্ট না হয়।

আমি ইহা পছন্দ করিতাম না। দুর মনে যদি এই রকম দ্বিধা ও ভয় থাকে তবে লড়াই ভাল হইত না। লক্ষ করিবার বিষয় ছিল সে সর্বদাই আমার নিকট পরাজয় মানিয়া লইতে চেষ্টা করিত। নিজের পরাজয়ে সে সুখী হইত। আমি বিরক্ত হইতাম। তাহাকে উত্তেজিত করিবার জন্য নানা প্রকার গালি দিতাম। তাহার শক্তি ও বীর্য সম্পর্কে কটুক্তি করিতাম, অশ্লীল কথা বলিতাম। এমনকী তাহার স্ত্রীর নাম লইয়া বিদ্রূপ করিতাম। দুর স্ত্রী আমার অন্তঃপুরে থাকিয়া কাজ করিত। বাড়ির খিড়কি পুকুরের নিকটে, তাহার জন্য আমি আলাদা ঘর করিয়া দিয়াছিলাম। ক্রীড়ায় তাহাকে উত্তেজিত করার জন্য, আমি অনেক সময় তাহাকে অন্যায় আঘাত করিতাম। একেবারেই যে এ সবের কোনও ফল হইত না, এমন নহে। এক এক দিন দু এমন রুদ্ররূপ ধারণ করিত, মনে হইত আমাকে লইয়া সে গেণ্ডুয়া খেলিতেছে। দেখিতাম তাহার মধ্যে তখন সেই পূর্বপুরুষ যোদ্ধাদের ভয়াল রক্ত উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে। তাহার ঘর্মাক্ত কালো বিশাল শরীর ও রক্তচক্ষু দেখিয়া একটা ক্ষিপ্ত বরাহের মতন মনে হইত।

দুযার পক্ষে একটা বিষয় বোঝা সম্ভব ছিল না। ক্রীড়াতে ক্রোধ ত্যাগ করিতে হয়। কিন্তু তাহার প্রকৃতি ছিল অন্য রকম। নিজে পর্যদস্ত হইবার জন্য আমাকে সমস্ত রকম সুযোগ দিত। অন্যথায় ক্ষিপ্ত হইয়া লড়িত। সে রুদ্র হইয়া উঠিলে তাহাকে সামলানো অসম্ভব ছিল না। কারণ তখন সে কেবল বলপ্রয়োগের চেষ্টা করিত। ক্রীড়া কৌশল ভুলিয়া যাইত। আমি কৌশলের আশ্রয় লইতাম। তথাপিও তাহাকে যথার্থ সামলানো কঠিন হইয়া পড়িত। ক্রীড়ার শেষে যখন এই সব কথা বলিতাম, সে সকাতর লজ্জায় আমার পায়ে মুখ খুঁজিয়া থাকিত।

যখন রুদ্ধ কান্না ও কথা শুনিয়া তাহাকে চিনিতে পারিলাম মনে পড়িল, ক্রীড়া শুরু হইবার পূর্বে সে আমাকে প্রণাম করিল। ঠোঁট নাড়িয়া প্রার্থনা করিল। ক্রীড়ার পূর্বেই একটি পাথর বাটিতে কাঁচা দুগ্ধ এক কোণে রাখা থাকিত। আমি আমার গলার সোনার হারের সহিত মৃত্যুঞ্জয় মাদুলি ডান হাতের বৈদূর্য্যমণি ও একটি অন্য আংটি খুলিয়া সেই পাথরবাটিতে রাখিয়া দিতাম। ক্রীড়ার শেষে আবার সেগুলি ধারণ করিয়া স্নান সারিয়া কাপড় বদলাইতে অন্দরে যাইতাম। আমি প্রস্তুত হইবার পরে, দুযাও প্রস্তুত হইল। প্রথমে সে আমার গায়ে মল্লভূমির মাটি ছড়াইয়া খানিকক্ষণ দলন মর্দন করিল। ইতিমধ্যেই কুতূহলী কয়েকটি বালক আসিয়া জুটিয়াছে। ক্রীড়া শুরু হইল। দুইজন পাইক ও জ্ঞাতি খুড়া ভবতারণ ভট্টাচার্যও আসিল। যে ভবতারণ খুড়া এখন এখানে উপস্থিত রহিয়াছে, যাহার কণ্ঠস্বর আমি আগেই শুনিয়াছি।

দুযা তাহার অভ্যাস মতো বারে বারেই পরাজয় মানিতে লাগিল। আমি হাসিতে হাসিতে তাহাকে বিদ্রূপ করিয়া নানা কথায় উত্তেজিত করিতে চেষ্টা করিলাম। সেও জবাবে কেবল হাসিতে লাগিল। দু-একবার আক্রমণ করিয়া আমাকে পর্যুদস্তও করিল। আমিও তাহাকে আক্রমণ করিতে শুরু করিলাম। এইরূপ ক্রীড়া চলিতে চলিতে সহসা কী হইল বুঝিলাম না, বুকে একটা প্রচণ্ড আঘাত পাইলাম। আমার শরীরের দৈর্ঘ্যের জন্য যেমন কিছু সুবিধা ছিল, তেমনি দুর দৈর্ঘ্য কম হইলেও সে তাহার পাথরের মতো মাথার দ্বারা প্রায়ই আমাকে ষাঁড়ের মতো উঁষা মারত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাহা পেটে, পিঠে ও কোমরেই মারিত। বুকে লাগিলেও, আমি সামলাইয়া লইতাম। এইদিন কী হইল বুঝিলাম না, বুকে সহসা আঘাত পাইয়া তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করিলাম। দু তাহা বুঝিতে পারে নাই। আমি অন্য কোনও কৌশল অবলম্বন করিবার চেষ্টা করিতেছি সম্ভবত এই ভাবিয়া, আবার আমার উপরে ঝাপাইয়া পড়িল। আমি পড়িয়া গেলাম, জ্ঞান হারাইলাম। কেবল একটি স্বর শুনিতে পাইলাম, কর্তা দাদার মুখের কষে রক্ত পড়িতেছে। তারপরে এই প্রথম জ্ঞান ফিরিয়া পাইলাম।

জ্ঞান ফিরিয়া পাইয়া যাহা শুনিলাম, তাহা মর্মান্তিক। আমার নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়াই, গঙ্গাযাত্রা করিয়া, এই ঘরে লইয়া আসিয়াছে। আমার চোখের সামনে গ্রামের বৈদ্য মুরলীধর গুপ্ত কবিরাজের মূর্তি ভাসিয়া উঠিল। কপালে চন্দনের ফোঁটা, টাক মাথায় পাগড়ির মতো এক খণ্ড কাপড় জড়ানো। গলায় পৈতা গায়ে জড়ানো সাদা মোটা কার্পাস বস্ত্র। পাড়হীন ধুতিও সেই রকম। আমি তাঁহাকে বৈদ্য খুড়া বলিয়া ডাকিতাম। আমার প্রপিতামহের আমলে, এই বৈদ্য পরিবারকে গ্রামে বাসস্থানের ভিটা ও জমি দেওয়া হইয়াছিল। এই বৈদ্যবংশই বংশপরম্পরা গ্রামের মানুষদের ও আমাদের বাড়ির চিকিৎসা করিয়া আসিতেছেন। আমি স্পষ্ট দেখিতেছি, মুরলীধর বৈদ্য খুড়া আমার চিকিৎসার জন্য আসিয়াছেন। ওষুধ দেওয়া ছাড়াও তিনি নানা প্রকার ঝাড়ফুক মন্ত্র পড়িয়া থাকেন। যখন তিনি আর কোনও আশা দেখেন নাই, তখনই নিদান দিয়াছেন। নিদান দেওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু।

অতঃপর বিধান অনুসারে, আমাকে গঙ্গাযাত্রীর ঘরে লইয়া আসিয়াছে। কখন আনিয়াছে, কবে আনিয়াছে, কিছুই জানি না। ভবতারণ খুড়া, ভাই শ্যামকান্তি এবং দুয়া আসিয়াছে, ইহা জানিতে পারিয়াছি। দু যখন আসিয়াছে, তখন নিশ্চয়ই ভিন্ন নৌকায় তাহার সঙ্গে পাইকরাও কেহ কেহ আসিয়া থাকিবে। আমাকে লইয়া যে নৌকা আসিয়াছে সেই নৌকায় দুযারা আসিতে পারে না। যাহারাই আসিয়া থাকুক, যখন বা যে দিনই আসিয়া থাকুক, সকলেই আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করিতেছিল। কিন্তু কী দুর্দৈব, তাহাদের নিরাশ করিয়া আমি বাঁচিয়া উঠিতেছি। সেই কারণেই শ্যামকান্তি অতি অমঙ্গল ভয়ে দুই বার বলিয়া উঠিয়াছে, কী মহাপাতক। কী মহাপাপ। ইহার জ্ঞান ফিরিয়া আসিতেছে। ভবতারণ খুড়া আমার পূর্ণ জ্ঞান ফিরিয়া আসিবার পূর্বেই জলে ডুবাইয়া মারিবার প্রস্তাব করিয়াছে। জ্ঞান যাহাতে আর না ফিরিয়া আসে, তাহার জন্য অকটু দধি গিলাইয়া বুকের পাঁজরায় ও হৃদয়ে শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করিয়া মারিবার চেষ্টা পাইয়াছে। এমনকী নদীর কাদা মিশানো জলও ঢালিয়াছে, যাহাতে গলনালী বন্ধ হইয়া যায়।

জ্ঞান ফিরিয়া না আসিলে কিছু করিবার ছিল না। দুর্দৈব উহাদের নহে, আমারও। জ্ঞান ফিরিয়া আসাতে, আমি বাধা না দিয়া পারিতেছি না। আমি হাত পর্যন্ত তুলিতে পারিয়াছি। অনুভব করিতেছি অত্যন্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও জ্ঞান ফিরিয়া পাইবার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা শক্তিও অনুভব করিতেছি। ইহা যেন এক অলৌকিক শক্তি আমার মধ্যে জাগিয়া উঠিতেছে। ইহা বাঁচিয়া উঠিবার ইচ্ছাশক্তি। স্বাভাবিক মৃত্যু অথবা হত্যা যে কোনও শক্তিকে বাধা দিবার সংকল্পও যেন শরীরে ও মনে প্রবল হইতেছে। অথচ আমি জানি, আমার বাঁচিয়া ওঠাও এক অতি নিদারুণ সংকটের সৃষ্টি করিতে যাইতেছে। সেই সংকটের জন্যই, এখন আমাকে ঘিরিয়া সবাই ফিসফাস করিয়া নিজেদের মধ্যে কিংকর্তব্য বিষয়ে আলোচনা করিতেছে। মনে হইতেছে আমি যেন প্রেতলোকে, প্রেতগণের দ্বারা বেষ্টিত হইয়া আছি।

দুযার কান্না কথা শুনিবামাত্র, তাহাকে যেমন চিনিতে পারিলাম, জ্ঞান হারাইবার পূর্বের কথা মনে পড়িল, তেমনি ইহাও নিশ্চিত বুঝিলাম আমার মৃত্যু ঘটানোর সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে। দু যে ব্রহ্মশাপের কথা বলিল, তাহার কারণও আমি এখন বুঝিতে পারিতেছি। তাহার চরিত্র ও মন ভাল জানি। সে নিশ্চয়ই নিজেকে আমার মৃত্যুর কারণ বলিয়া ভাবিতেছিল। এখন আমার মৃত্যু ঘটানোর সিদ্ধান্তের কথা শুনিয়া সে কাঁদিয়াবারণ করিতেছে। ব্রহ্মশাপ বলিতে, সে আমার দ্বারা তাহার প্রতি শাপের কথা বলিতেছে।

আমার মুখের মধ্যে এখনও অম্ল কটু দধির স্বাদ। তার সঙ্গে দাতে ও জিভে গঙ্গামাটি ও বালি। গলাও শুকাইয়া গিয়াছে। আমি পানীয় জল চাহিলাম। চাহিলাম, কিন্তু নিজেই বুঝিতে পারিলাম, আমি স্পষ্ট কথা উচ্চারণ করিতে পারিতেছি না। স্থলিত বিকৃত স্বর বাহির হইল। মুখের কাছে যে হাত রাখিয়াছিলাম তাহা নাড়িবার চেষ্টা করিলাম। আবার জল চাহিলাম। কাহারও কোনও সাড়া পাইলাম না। মুখের কাছ হইতে হাত সরাইয়া পাশে ছড়াইয়া দিলাম। শক্ত বাঁধানো মেঝে আমার হাতে ঠেকিল। আমি শরীরের অন্যান্য অংশ নাড়িবার চেষ্টা করিলাম। অনুভব করিলাম দুর্বল হইলেও আমার সমস্ত শরীরে চেতনা রহিয়াছে। এ সকলই ভয়ে করিতেছি। যাহাতে সকলে বুঝিতে পারে আমার কেবল জ্ঞান ফিরিয়া আসে নাই। আমি সুস্থাবস্থায় বাঁচিয়া রহিয়াছি। আমি পা দুইটি নাড়িতে পারিলাম। কোমরের অংশ তুলিবার ব্যর্থ চেষ্টা করিলেও একেবারে নিশ্চল জড়বৎ নহে। বাঁ হাতও ছড়াইয়া দিলাম। চোখ মেলিয়া তাকাইবার চেষ্টা করিলাম। পারিলাম না। চোখের পাতা বড় বেশি ভারী বোধ হইল।

আমি স্পষ্ট বুঝিতেছি এখন আমার শুশ্রূষার দরকার। এখনও আমার চারিপাশে সকলেই বাতাসের শব্দে কথাবার্তা কহিতেছে। একটু মিষ্ট পানীয় জল পান করিতে পারিলে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ পাইলে অনেক সুস্থ বোধ করিতে পারি। কিন্তু কোনও আশা দেখিতেছি না। মরি নাই। মৃত্যুর দশাও আমার মধ্যে নাই। সে তাহার গ্রাস হইতে আমাকে মুক্তি দিয়াছে। না দিলে কিছুই জানিতে পারিতাম না। অথচ মৃত্যু আমাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। তাহারা এখনও আমার মৃত্যু কামনা করিতেছে, প্রত্যাশা করিতেছে হয় তো এই ভাবেই আমার মৃত্যু হইবে।

এইভাবে সময় কাটিতে থাকিলে হয় তো মরিতেই হইবে। আমি অধিক শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করিলাম। আমি আবার হাত তুলিয়া মুখের উপর আনিলাম। চোখের উপর হাত চাপিয়া ধরিলাম। যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়া স্পষ্ট উচ্চারণ করিলাম, জল দাও। জবাব না পাইয়া কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া আমি বাঁ হাত মাটিতে রাখিয়া উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিলাম। পারিলাম না। এই সময় কাহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম, অমঙ্গল পাপ যাহাই হউক এ রকম অবস্থা চলিতে পারে না। যাহা হয় করো।

কাহার স্বর। অতি পরিচিত, যেন আমারই বুকের ভিতর হইতে আমারই গলা দিয়া বাহির হইল। ক্ষণ পরেই চিনিতে পারিলাম, কণ্ঠস্বর আমার জ্যেষ্ঠপুত্র বিদ্যুৎকান্তির। চিনিতে পারিবামাত্র আমার অন্তর জুড়িয়া যেন বিশাল মেঘের মতো ভারী ব্যথা ঘনাইয়া আসিল। মেঘ গলিয়া হৃদয় ভাসাইয়া চোখের কূল ছাপাইয়া বহিতে লাগিল। আমার হৃদয় যে এত দুর্বল, আগে জানিতাম না। অবস্থা বিপাকে কী না হয়। ইতিমধ্যে আমার আশপাশে যাহাদের চিনিতে পারিয়াছি, তাহারা আমাকে কোনও দিন কঁদিতে দেখে নাই। আজ এই অবস্থায় জ্যেষ্ঠ পুত্রের উপস্থিতি জানিতে পারিবামাত্র ভাবাবেগে আমার বুক মথিত করিয়া চোখে জল আসিল।

বিদ্যুৎকান্তিকে নাটু বলিয়া ডাকা হয়। তাহার স্বর কিছু রুক্ষ শুনাইলেও ভীতির ভাব বর্তমান। তবু তাহার গলার স্বর শুনিয়া আমার পিতৃহৃদয় হাহাকার করিয়া উঠিল। নাটু শান্ত প্রকৃতির। সে আমাকে সম্ভ্রম করে, কিঞ্চিৎ ভয়ও পায়। সচরাচর আমার সামনে আসিতে চাহে না। কিন্তু আমি মনে মনে তাহাকে ভালবাসি। সে সংস্কৃত ভালই শিখিয়াছে। আমি নিজে তাহাকে পারসি শিখাইয়াছি। তাহাকে বিষয়কৰ্ম বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহার মনোগত বাসনা সে কলিকাতায় যাইতে চাহে। আমার তাহা ইচ্ছা নহে। সে কলিকাতায় সাহেবদের পালকির পিছনে পিছনে দৌড়াইয়া বেড়াইবে। কোম্পানির কাজ করিবে, তাহাতে আমার বিশেষ আপত্তি। কলিকাতা ও সাহেবদের প্রতি পিতামহ আমার মনে একটা বিরাগ জন্মাইয়া দিয়াছিলেন।

সে কথা পরে বলা যাইবে। ভবতারণ ভট্ট খুড়ার স্বর শুনিতে পাইলাম, তোমরা যেরূপ বলিবে, তাহাই হইবে। শ্যামকান্তির শঙ্কিত স্বর শুনিলাম, আমার বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পাইতে বসিয়াছে। কে জানিত এমন সর্বনাশ ঘটিবে। কী মহাপাপ!

আমার বাঁচিয়া ওঠা সর্বনাশের কারণ। মহাপাপও। আমার প্রত্যাশা নাটু ইহার প্রতিবাদ করুক। কিন্তু তাহা সম্ভব নহে। আমার বাঁচিয়া ওঠা তাহার নিকটও অত্যন্ত অমঙ্গলের বিষয়। ভবতারণ খুড়ো, শ্যামকান্তি সকলই আমাকে বিশেষ সমীহ করে। শ্যামকান্তির সংসার পৃথক হইলেও সে সর্বদাই বৈষয়িক কাজেকর্মে আমার পরামর্শ গ্রহণ করে। ভবতারণ খুড়া এক রকমের মূর্খ পণ্ডিত। গ্রামে। গ্রামান্তরে পূজা-পার্বণে পৌরোহিত্য ও সামান্য যজমানি করে। আমাদের জ্ঞাতিবর্গের মধ্যে পড়িলেও উহাদের পরিবারে সংখ্যাধিক্যে বিষয়কর্মে বিমুখীনতায়, যাবতীয় সম্পত্তি বহু ভাগে বিভক্ত হইয়া হতদরিদ্র অবস্থা হইয়াছে। প্রয়োজন পড়িলেই সে আমার দ্বারস্থ হয়। এখন তাহাদের কথা শুনিয়া মনে হইতেছে, আমার বাঁচা মরা সব ইহাদের হাতে।

আমি দুযার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম, বাবাঠাকুরেরা কর্তাদাদাকে একটু জল দিন। আমি মূর্খ মানুষ, শাস্ত্ৰ বুঝি না। বিচার পরে যাহা হয় করিবেন। উনি জল চাহিতেছেন, জল দিন।

দুযার কথা শুনিয়া তাহাকে আমার আলিঙ্গন করিতে ইচ্ছা হইল। আমার অবস্থা সে-ই একমাত্র অনুভব করিতেছে। সে শুনিয়াছে, আমি জল চাহিতেছি। অপরেরা সে কথায় কর্ণপাত করিতেছে না। মনে দ্বিধা দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও তাহারা এখনও আমার মৃত্যুই কামনা করিতেছে। দুর কথায় প্রথম জ্ঞান লাভ করিতেছি। শাস্ত্র হইতে জীবন বড়। তাহার কথা শুনিয়া আমার শক্তি বাড়িল। আমি বাঁচিয়া রহিয়াছি, বাঁচিয়া উঠিব। ইহার আর অন্যথা হইবার উপায় নাই। মল্লযুদ্ধে বুকে যে সহসা আঘাত পাইয়া অচেতন হইয়াছিলাম, এখন সেই ব্যথা অনুভব করিতেছি না। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক ভাবে বহিতেছে। কেবল দুর্বল বোধ করিতেছি। মুখের কটু স্বাদে শুকনো গলায় ভাল করিয়া কথা বলিতে পারিতেছি না। যদি পারিতাম, তবে আমার স্বাভাবিক গম্ভীর স্বরে সবাইকে ডাকিয়া আদেশ করিতাম। সকলের সব তর্কবিতর্ক কথাবার্তা অবাধ্যতা আস্ফালন বন্ধ হইয়া যাইত। কিন্তু আমি তো এখন ইহাদের কাছে আর বৈদূর্যকান্তি বন্দ্য নহি। বাঁচিয়া থাকিয়াও শবতুল্য।

আমি আবার সমস্ত শরীরকে আন্দোলিত করিতে চেষ্টা পাইলাম। অধিকতর স্পষ্ট স্বরে বলিলাম, জল দাও। চোখ জলে ভরিয়া ওঠায়, হাত দিয়া ঘষিলাম। অশ্রুতে ভিজিয়া আমার চোখ কিঞ্চিৎ ধুইয়া গিয়াছে। কয়েক বার ঘষিয়া চোখের পাতা হালকা মনে হইল। আমি চোখ মেলিয়া চাহিলাম। অতি উজ্জ্বল আলোতে দৃষ্টি যেন ঝলসাইয়া গেল। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ হইয়া গেল। কিন্তু নিরস্ত না থাকিয়া আমি আবার চোখের পাতা খুলিবার চেষ্টা করিলাম। আবার চোখ খুলিয়া গেল। অতি উজ্জ্বল আলো সহিতে পারিলাম না। কয়েক বার এইরূপ করিয়া বুঝিতে পারিলাম, রৌদ্রালোকিত দিনের আলো ছড়াইয়া রহিয়াছে। তারপর দৃষ্টি মেলিয়া, প্রথমে চোখে পড়িল আমার মাথার উপরে কড়িবরগার ছাদ। চিনিতে ভুল হইল না। ইহা আমার পরিচিত গঙ্গাযাত্রীর ঘর। দৃষ্টি ফিরাইতেই রৌদ্রচকিত গঙ্গা দেখিতে পাইলাম। চোখে সহিল না। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরাইলাম। প্রথমেই নাটুকে দেখিতে পাইলাম। সে আমার মুখের দিকে ভীত আতঙ্কিত চোখে তাকাইয়া রহিয়াছে। আমি উচ্চারণ করিলাম, জল।

নাটু দ্রুত সরিয়া গেল। আমি আবার চোখ বুজিলাম। নাটুর স্বর শুনিলাম, বাবা জল নিন। নাটুর স্বর আমার শক্তিকে আরও উদ্দীপ্ত করিল। কিন্তু মনে একটু সন্দেহও হইল। সে আমাকে পরিষ্কার পানীয় জল দিবে তো। আমি চোখ মেলিয়া তাকাইলাম। দেখিলাম নাটুর হাতে কাঁসার ঘটি। সে আমার দিকে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে। এই বার আমি শ্যামকান্তি ও একটু দূরে দুযার মুখও দেখিতে পাইলাম। সকলের চোখেই ভয়, দ্বিধা, সংশয়। তথাপি আমি দুয়ার মুখের দিকে কয়েক নিমেষ বেশি দৃষ্টিপাত করিলাম। নাটুর হাতের ঘটি হইতে জল গ্রহণ করিবার আগে দুযার মুখের অভিব্যক্তি ভাল করিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিলাম। সে কোনও ইঙ্গিত করে কি না, বুঝিতে চেষ্টা করিলাম। নাটু আমার মুখে সাবধানে জল দিল। আহ! প্রকৃতই মিষ্ট পানীয় জল। আমি কয়েক বার ঠোঁট ফাঁক করিয়া জল গ্রহণ করিলাম। গলা ভিজিয়া প্রাণটা জুড়াইল। চোখ বুজিলাম।

মরিতে মরিতে বাঁচিলাম। নিজের শক্তিতে বাঁচিয়াছি। অলৌকিক বলিয়া কিছু নাই। কিন্তু এইক্ষণে বাঁচিয়া উঠিবার শক্তিকে যেন অলৌকিক বোধ হইতেছে। নাটুর হাতে জল পাইয়া ভাবাবেগে আমার অন্দর অশান্ত হইয়া উঠিতেছে। বুক ফাটিয়া চোখে জল আসিবার উপক্রম করিতেছে। কিন্তু আমি নিজেকে শক্ত শান্ত রাখিলাম। কঁদিবার দিন শেষ হইল, অথবা বাকি জীবিতকাল কেবল কঁদিবার জন্যই রহিল। এখন আর কঁদিব না। বাঁচিলাম, কিন্তু জানি, দুর্দৈব যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে। জানি না বাঁচিয়া থাকিবার জন্য পরে অনুতাপ করিতে হইবে কি না। কিন্তু মৃত্যু কী, আর মৃত্যুকে প্রতিরোধ করিয়া বাঁচিয়া ওঠা কী, তাহা অনুভব করিলাম। বাঁচিয়া থাকিয়া বুঝিতেছি মৃত্যুর পরে আর কিছু নাই। আত্মা পরমাত্মা পুনর্জন্ম বাঁচিয়া থাকিবার কাছে সকলই মিথ্যা। সে সব কথা এক বারও মনে উদিত হইল না। কেবল ইহাই জানিলাম, আমি নিঃশেষে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইব। জগৎ সংসার যেমন চলিতেছে তেমনি চলিবে। অথচ মৃত্যু অনিবার্য, ইহা জানি। সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। তখন সে কী রূপ ধরিয়া আসিবে জানি না।

জন্ম মুহূর্ত হইতে মৃত্যু সঙ্গী হইয়া আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করিতেছে। কালগতি এই অনিবার্যতাকে জীবের উপর আরোপ করিয়াছে। ইহা তাহার লীলা। সেই লীলায় মানুষ জন্মিতেছে মরিতেছে, কোনওটাই তাহার হাতে নাই। প্রশ্ন থাকিতে পারে, জবাব নাই। তথাপি জীবিত থাকিয়া কেহ মরিতে চাহে না। জীবের ধর্ম সে বাঁচিয়া থাকিতে চাহে। যে চাহে না, সে জীবন্তেই মরিয়াছে। বাঁচিবার অনুভূতি আকাঙ্ক্ষা শেষ হইয়াছে।

বাঁচিলাম কিন্তু পূর্বের জীবন আর ফিরিয়া পাইব না। এতকাল নিয়তির অমোঘ নির্দেশকে এক দৃষ্টিতে দেখিতাম। এখন অন্ধের মতো ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া রহিয়াছি। জানি না, সে কোন পথে আমাকে চালিত করিবে। যাহারা সর্বনাশের কথা বলিতেছিল তাহাদের চিন্তা একরূপ। আমিও এক। ভয়ংকর সর্বনাশের মুখোমুখি হইতেছি। এখনও তাহার স্বরূপ দেখিতে পাইতেছি না। আপাতত বাঁচিয়া উঠিলাম, নিধনের হাত হইতে রক্ষা পাইলাম, ইহাই পরম প্রাপ্য মনে হইতেছে।

অতঃপর পরিস্থিতির পরিবর্তন হইল। আমাকে গরম দুধ পান করিতে দিল, মিষ্ট জল দিল। আমাকে ঘিরিয়া সকলে বসিল। আমি শায়িত অবস্থায় সকলের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম। সকলেই নীরবে আমার মুখের দিকে দেখিতেছে। সকলেরই মুখ শুষ্ক শীর্ণ, চোখে শঙ্কা ও ভয়। সকলের চোখেই জল। বিশেষ করিয়া দুয়া ও আরও দুই পাইক এবং তালুকের আদায় উশুলের হিসাবদারী। পরমেশ ভট্টাচার্য কাঁদিয়াআকুল হইতেছে। কিছু অপরিচিত মুখও দেখিতেছি। তাহারা আমার সম্পর্কে বলাবলি করিতেছে, ইহার কী দুর্ভাগ্য। গঙ্গাযাত্রা করিয়া বাঁচিয়া উঠিল। কেহ বলিতেছে, একমাত্র ভরসা, ইহার বয়স অল্প, এখনও যুবক।

নাটু আমার নিকটে বসিয়াছে। তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া আমি ক্ষীণস্বরে বলিলাম, ভয় নাই, আমার দ্বারা তোমাদের কোনও অমঙ্গল হইবে না। নাটু দুই হাতে মুখ চাপিয়া কাঁদিয়া উঠিল। তাহার। বয়স সতেরো। আমি হাত বাড়াইয়া তাহাকে স্পর্শ করিব ভাবিলাম। কিন্তু করিলাম না। শ্যামকান্তি কাঁদিয়াবলিল, আমরা বাড়ি ফিরিয়া কী বলিব। কী করিয়া সকলের সামনে গিয়া দাঁড়াইব।

ইহা এক প্রকার শোকের কথা বটে। কিন্তু মৃত্যুশোক নহে। ইহা দুর্দৈব দুঃখজনক ঘটনা। সকলেই কান্নাকাটি করিবে, বুক চাপড়াইবে। জীবনযাপনের আদৌ কোনও পরিবর্তন হইবে না। পরিবর্তন যেখানে ঘটিবার তাহা বিষয়-সম্পত্তিজনিত। শ্রাদ্ধাদি বা পারলৌকিক কোনও কাজ করিতে হইবে না। তবে, পরিবর্তন একেবারে না হইবে এমন নহে। সে কথা এখন ভাবিতে পারিতেছি না। বাড়ির কথা মনে হইলেই প্রাণটা আকুলিবিকুলি করিয়া উঠিতেছে। অথচ ইহা নিরর্থক।