বৈশাখ যায় যায়। বৃষ্টি নামে না। বরগুইনির দু’পাড়ের কৃষকদের মনের বাম্প আকাশে কালো মেঘ হয়ে দেখা দিলো না। কালো মেঘের আঁচল চিরে নেমে এলো না সুশীতল বারিধারা।
তারা আল্লাহর আরশের উদ্দেশ্যে করুণ মিনতি জানালো। আসমানের আল্লাহ প্রার্থনায় সারা দিলো না। সারা জাহানের মালিক কৃপণের মতো আরশের সিংহাসনে গাঁট হয়ে বসে রইলেন। তার মনে লেশমাত্র করূণা নেই। আখেরী জমানা দুনিয়াটা দিনে দিনে বুড়া হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হায়া শরম আর ঈমান বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। সে জন্য দীন-দুনিয়ায় দো জাহানের মালিক তার সমস্ত মায়া সমস্ত মমতা মাটির খাঁক থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বুড়োবুড়িরা মন্তব্য করলো কেয়ামতের আর বেশী বাকী নেই। নয়তো বৈশাখের সতেরো তারিখে বিয়ে হয়ে গেছে গাজী কালুর, এখনো নামলো না বৃষ্টি?
তাদের ধারণা–পীর কুলের মধ্যমণি, ফকির কুলের শিরোমণি গাজীকালুর বিয়ে হয় বৈশাখের সতেরো তারিখে। বৌ করে রাজার ঝি চম্পাবতাঁকে ঘরে নিয়ে আসবেন। সতেরো তারিখেই সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করেন। কালো মেঘ ঢোলক বাজায়। বিজলী আলোক জ্বালায়। বিয়ের উৎসবে বঙ্গোপসাগর হতে উঠে আসা কালবৈশাখীর মৌসুমী ঝড় কেশর ফোলা সিংহের প্রমত্ত গর্জনে উড় মাটি চুর করে, এঁটেল মাটি ধুলো করে। সকলে বলে আমাদের গাজী পীর বিয়ে করতে যাচ্ছেন। রাজার দুলালী চম্পাবতীর তাবৎ শরীরে পাঁচটি ফুলের ভার। পঞ্চফুলের ওজন ফুলের মতো রাজকন্যার বিয়ের যোগাড়যন্তর শেষ-সমাপ্ত প্রায়। তখন ভেঙে গেলো বিয়ে। চম্পাবতীর চাঁপা বরণ গায়ের রঙ গাজীর মায়ের মনে ঈর্ষা জাগায়। ভাংচি দেয় মা। ভেঙে যায় বিয়ে। মাতৃভক্ত সন্তান মায়ের কথামতো চলে আসে। আবিয়েতা চম্পাবতী মনের দুঃখে কাঁদতে বসে। মনের জ্বালা আকাশে মেঘ হয়ে জমে… বৃষ্টি হয়ে গলে পড়ে। সারা জীবন কুমারী থাকার অনুক্ত বেদনা বৃষ্টির ধারায় ঝড়ে পড়ে। ফি বছর এমনি হয়। যতোদিন পৃথিবী থাকে এমনিই হবে। তা না হলে সৃষ্টি রক্ষা পাবে না। মানুষ কেমন করে চাষাবাদ করবে? একমাত্র কেয়ামতের দিন গাজী পীর রাজার কন্যা চম্পাবতাঁকে বিয়ে করতে পারবে, তার আগে নয়।
কবে চলে গেছে বৈশাখের সে সতেরো তারিখ। এবার অজন্মার বছর। তাই গাজী পীর আর বিয়ে করতে যান নি। গেলেও চুপি চুপি গেছেন। মাতৃভক্ত সন্তানের পৌনপুনিক কাপুরুষতার কথা সকলকে জানান দিতে হয়তো লজ্জাজনক মনে করেছেন পীর সাহেব। তাই অতো শান-শওকত করেন নি। কেউ একজন মন্তব্য করলো, এ অজন্মার বছরে, গাজী পীর অতো বড়ো পীর হয়েও বেফজুল হিসেব পত্তর করতে সাহস করেন নি।
বুড়ো-বুড়ীরা বৈশাখের শেষের দিকে সূর্যের হলুদ শিখায় কেয়ামতের নমুনা দেখতে পেলো। এবার আর তারা নিশ্চেষ্ট বসে থাকতে পারে না। খোদার দরবারে মোনাজাত করে। আরশের খোদা বান্দার দিকে মুখ তুলে চাও… তুমি না চাইলে তারা যে বাঁচবে না। বরগুইনির পাড়ের আদম সন্তানের কেউ নেই দয়াল প্রভু তুমি ছাড়া, তোমার রহমত ছাড়া তাদের কিছু সম্বল নেই। তারা লেখা পড়া জানে না চাকরী করে না, দূর-বিদেশ চিনে না, ব্যবসা কেমন করে করতে হয় জানে না। তারা আছে বাবা আদমের লাঙল নিয়ে বরগুইনির পলিমাটি আঁকড়ে। তুমি যদি তোমার রহমতের চোখ মেলে তাদের পানে না তাকাও, তারা যে মরে যাবে। ওগো আল্লাহ! অতো নিষ্ঠুর হয়োনা তুমি। দাও, দাও, মাটি ভিজিয়ে দাও। বৃষ্টি দাও। একশো মোল্লা মৌলানা দিয়ে ধূ ধূ করা বিলে খতম পড়ানো হলো। খতম পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাছুরকে দুধ খেতে দিলোনা গেরোস্ত। বুকের শিশুকে স্তন্য দিলো না জননী। আগে খতম শেষ হোক, আসমানে মেঘ উঠুক। কালো মেয়ের কালো যৌবনের মতো মেঘ। কিন্তু বিষ্টি হলো না। বিষ্টির আগমনী গান গেয়ে পাড়া পাড়া চাঁদা তুলে বেড়ালো জোয়ান-বুড়োঃ
“কালা মেঘা ধলা মেঘা তারা সোদর ভাই
এক লাচা ঝড় (বৃষ্টি) দে ভিজি পুড়ি যাই।”
শির্ণী-সালাত অনেক করা হলো। কিন্তু বৃষ্টি নামলো না। কেয়ামত–সাক্ষাৎ কেয়ামত। সূর্যের শিখা দিনে দিনে হলুদ হয়ে উঠছে। পৃথিবীতে আগুন উঠবে–আগুন ছুটবে পৃথিবীতে। আকাশের আগুনে বুকের আশা জ্বলে গেলো। এখনো আউশ ধান বোনে নি। সারা বছর পেটের দাবী, আধসের চালের সে মহাজনকে কি করে- যে বুঝ দেবে। সন্তান বউকে কি খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখবো। সমস্যা–মস্ত সমস্যা।
জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি বৃষ্টি নামলো। কালো জলবাহী মেঘ ভারে নত হয়ে মধুর চাকের মতো ঝুলে পড়লো। শুরু হলো বর্ষণ। রাত নেই, দিন নেই। বর্ষণ সে কি বর্ষণ! সাত-আট দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি। চোখ মেলবার উপায় নেই। চাষীরা লাঙল-জোয়াল কাঁধে ফেলে মাঠের দিকে ছুটলো। বৃষ্টির পানি পেয়ে পলিপড়া মাটি ফকফকে হয়ে আছে। লাঙলের ধারালো ফলার ঘায়ে নরম মাটির বুক চিরে ফেলে। ধান ছড়াবার সময় চলে গেছে। এখন অঙ্কুরিত ধান চাষ জমিতে ফেলে জালা করতে হবে। কচি ধানের চারা। যেগুলোকে তারা বলে জালা একগাছি দু’গাছি করে সারি সারি রোপণ করতে হবে। শত অভাব, দুঃখের মধ্যেও গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে
গানঃ
“দেশ মরি গেল দুর্ভিক্ষের আগুনে
তবু দেশের মানুষ জাগিল না কেনে।”
কেন যে দেশের মানুষ জাগে না হাসিমের জানার কথা নয়। কবিয়াল ফনি বড়ুয়া গান বেঁধেছিলেন। কবিয়ালের কথাই সত্য। দেশ দুর্ভিক্ষের আগুনে জ্বলে গেছে, পুড়ে গেছে। তার পরেও দেশের মানুষ জাগছে না কেন? ঝিলিক মেরে চোখের সামনে তেজেনদার চোখ দুটো ভেসে উঠলো। মৃত নিথর চোখের ছুরির ফলার মতো অন্তরের অতলস্পর্শী জিজ্ঞাসাটি হাসিমকে ডাক দিয়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে এসকল কথা মনে ঘুরে ঘুরে কেন যে পানির ভাষায় বেজে উঠে হাসিম তার হদিশ পায় না। হাত দুটো কাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে চুপ করে থাকে। দলা দলা কাদা তুলে নিয়ে আল বাঁধতে ভুলে যায় সে। কিছুই দেখতে পায় না। কেবল দেখে হাতির মতো বলশালী তেলীপাড়ার তেজেনের বাঁকানো দৃষ্টি হাজার হাজার ভগ্নাংশ হয়ে জীবনে জীবনে মিশে গেছে।
“এই বানিয়ার পুত, মাইনসে কয়; ‘হাত-পাঁচ গুণ্যা চাষ নগরে ব্যান্যা।‘ কি গরসদে, তোরে দি চাষের কাম ন অইবো।” (অই বেনের ছেলে কি করছিস, লোকে বলে সাত পাঁচ হিসাব করে বেনেরা চাষ করে না। তোকে দিয়ে চাষের কাজ হবেনা।)
আমজুর চীৎকারে চেতনা ফিরে আসে। হাঁ, সাত পাঁচ ভেবে স্বর্ণ বণিকেরা চাষ করে না। অপরকে দিয়ে করায়। চাষ করার দরকারটা কি? সোনাতে পেতল মিশিয়ে বেচে ডবল ডবল লাভ করে। দশ-বিশ গেরামের বউয়ের নাক-কানের সোনা তাদের লোহার সিন্দুকে আটক থাকে। মাসে মাসে সুদ বাড়ে। সুদ সুদ বিয়ায়। এসব স্বর্ণ বণিকদের লোহার সিন্দুকে চাষী গোরোস্তের প্রাণ-ভভামরা বন্দী হয়ে থাকে। তবু মুসলমান চাষীরা বেনেদের বাবু বলে ডাকে। একখানি জমি এক সন চাষ করার জন্য সারা বছর ভেট বেগাড় বয়ে বেড়ায়। দু’আনা সুদ কম দেবার জন্যে দশবার হাতে-পায়ে ধরে। আসল যারা বেনে বাবু, সে মুসলমান তার বাবা নয়-বাবার বাবা বেনে ছিলো বলে তাকে ‘বানিয়ার পুত’ বলে ডাকে। এ সমাজের মানুষের সংকীর্ণতা, অনুদারতা, মমতাহীনতা তার বুকে কাঁসার ঘন্টার মতো বাজে। না সে আর আল বাঁধবে না। প্যাক মাখা হাত দুখানি বিলের পানিতে ধুয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে আসে। তাকে চলে আসতে দেখে আমজুর ছেলেটি চীৎকার করে বললোঃ
“বা-জান, বানিয়ার পুত যায় গৈ।” (বাপজান, বেনের ছেলে চলে যাচ্ছে।)।
“যউকদে হালা মালাউনের বাইচ্চা, একবারে ধুতা বলদ, কন কামের নয়।” (যায় যাক শালা মালাউনের বাচ্চা। হিন্দুদের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক উক্তি।) একেবারে অলস বলদের মতো। কোন কাজে আসে না জবাব দিলো আমজু।
সেই-যে চলে এসেছে তারপরে হাসিম আর কারো মাঠের কাজে মজুর খাটতে যায় নি। আকাশ ফুটো হয়ে বৃষ্টি ঝরছে। বাইরে বেরোবার উপায় নেই। পাহাড়িয়া পথ-ঘাট পিছল হয়ে আছে ভয়ানক রকম। একবার যদি পাহাড়ের ধার বেয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যায়, এ জীবনে কোনোদিন উঠে বসে খেতে হবে না। তবু হাসিম পাহাড়ে যায় প্রতিদিন। ছড়িতে ঢল নেমেছে। হাঁসের মতো সাঁতার কেটে পেরোতে হয়। পাহাড়ে জীবনের রহস্যের সমাধান খুঁজে পায়। তাকে দেখে পাড়ার মানুষ হেসে ওঠে। মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। দিনমজুরী তিন বেলা খেয়ে আড়াই টাকা তিন টাকার নীচে না। হাসিম পাহাড় থেকে বাঁশ এনে দু’টাকার বেশি পায় না। তার বোকামীর জন্য লোকে হাসে। তার নির্বুদ্ধিতায় তারা আমোদ পায়, সে কথা হাসিম জানে। কিন্তু কেন, সে কথা বুঝিয়ে বলতে পারবে না; খুলে বলতে পারবে না। পাহাড় তাকে কষ্ট দেয় বটে, সে কষ্ট কিছুতেই মানসিক নির্যাতনের সমান নয়। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হৃদয়কে রক্তাক্ত করতে জানে না ধানী মৌনী নীলশৃঙ্গবিশিষ্ট পাহাড়।
বৃষ্টি অবিরাম ঝরছে। উপায় নেই চোখ মেলবার। হাসিমের সেদিন বাশ কাটার পাশ ছিলো না। ফরেস্টারের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ঘুরতি পথে আসছিলো। থমথমে গুমোট আকাশে বিরাম-বিহীন বিষ্টি। বনের ভেতর শ্বাপদের থাবার মতো সন্ধ্যা নামছিলো। তাড়াতাড়ি হাঁটছিলো হাসিম। চড়াই বেয়ে নামতে গিয়ে হাত দেড়েক লম্বা কাটা বাঁশের চোখা একটি ফালি তার পায়ের তলা দিয়ে সেঁধিয়ে পাতার ওপর দিয়ে বেরিয়ে আসে। উঃ করে বসে পড়ে! কাঁধ থেকে কাঁচা বাঁশের ভারটা সটকে পড়ে। চিরকি দিয়ে ছোটে রক্ত। ফিনকি দিয়ে প্রবাহিত হয়। টকটকে, লাল তাজা রক্ত। জীবনের জীবনী রস। হাসিমের মাথা ঘুরতে থাকে। এ দৃশ্য দেখতে পারে না চোখ দিয়ে। কোমরের গামছা খুললো। দু’হাতে শরীরের সমগ্র শক্তি জড়ো করে হেঁচকা টানে বিধে যাওয়া ফালিটি বের করে নিয়ে আসে। তারপর কিছু লতাপাতার রস চিপে গামছাতে কষে ক্ষতস্থান বেঁধে পাথুরে পথ রক্তে রাঙিয়ে চলে এসেছিলো। কেমন করে চলে এসেছিলো সে কথা হাসিম বলতে পারেনা। ঘরের কাছে এসে দেখে বরগুইনিতে কুলফাটা ঢল। আশ্চর্য জীবনীশক্তি, জীবনতৃষ্ণার তাগিদে সাঁতার কেটে এপাড়ে এসে ঢলে পরছিলো। তার পর আর জানে না। জ্ঞান ফিরেনি তিন দিন।
চার দিনের দিন জ্ঞান ফিরলো। নড়তে চড়তে পারে না। সারা শরীরে ধান দিলে খৈ ফোঁটার মতো বেতাপ জ্বর। জখমী পা-টা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। বেলা ভাটির দিকে জ্বর আসে। হাড় কাঁপানো জ্বর। সারারাত দুঃসহ যন্ত্রনায় কঁকায়। দিনের দিকে জ্বর ছেড়ে যায়। সুফিয়া অম্লান বদনে সেবা করে। পায়ের পট্টি বদলায়। গাছ গাছড়ার পাতা, মূল শেকড় পিষে ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগায়। সারাদিন বসে থাকে শয্যার পাশে। পায়ের ফুলাতে টোটকা ওষুধের প্রলেপ দেয়। মানকচু পাতা গরম করে সেঁক দেয়। বিষ্টি থামার নাম গন্ধ নেই। ঘরের শনের পচা চালের ফুটো দিয়ে জল ঝরছে। সমস্তটা আঙ্গিনা থিক থিকে কর্দমাক্ত হয়ে গেছে। ফাঁকা জয়গা কোথাও নেই। দু’চোখ বুজে বুক ভরা বেদনা আর শরীর ভরা ব্যথার গভীর আস্বাদ গ্রহন করে হাসিম। কলজে ধরে টান দেয় বেদনার শৃঙ্খল। এ সেই বেদনা শরীর থেকে আলাদা করে পাথরে ছেড়ে দিলে পাথর ক্ষয় করে ফেলবে। তেমনি গভীর, চোখা সর্বব্যাপ্ত বেদনা। চেতনার প্রতিভাসে আলোকিত হয় কতকিছু।
বাপের কথা মনে হয়। মার কথা। কাছের অতীত… দূরের অতীত আজ হাসিমের চেয়ে বড়ো বেশি দৃশ্যমান। স্মৃতির উৎস গভীর খুবই গভীর। প্রথম যে মানুষ তার জন্মের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে সংগ্রামী চেতনায় জন্ম নিয়েছিলো তার খবরও ধরে রেখেছে স্মৃতি।
হায় রে বাপ! গোকুল ধরের কনিষ্ঠ সন্তান। কোনদিন কী কুক্ষণে কাজী বাড়ির রহমত কাজীর মেয়ে জরিনাকে দেখে মজেছিলো! তার বাপের হিতাহিত, জাত বিচার ভুলিয়ে–দেয়া সুন্দরী নারী জরিনার একটি ছবি মনের ভিতরে খাড়া করতে চেষ্টা করে। জরিনা কি খুব সুন্দর ছিলো? তার চোখ দুটো কেমন ছিলো? সুন্দরী দেখেই কি তার বাপ পতঙ্গের মতো উড়ে এসেছিলো? শুধু কি সৌন্দর্য? নাকি আরো কিছু ছিলো? হয়তো ছিলো কিন্তু হাসিম কোনো দিন জরিনাকে দেখে নি।
বাঁশখালী থানার কালীপুর গ্রামে গোকুল ধরের কনিষ্ঠতম সন্তানের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। বিয়ে করলো না তার বাপ। ছিটকে বেরিয়ে এলো। প্রেমের তাগিদে বেরিয়ে আসা জনকের স্মৃতিতে মনটা তার ফলভারে নত নম্র গাছের মতো নুয়ে আসে। তার বাপ হরিমোহনের সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসার কাহিনী গ্রামে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে আছে। সে কথা হাসিমের চেতনায় লজ্জা, দুঃখ, ক্ষোভের সহযোগে স্তরে স্তরে সঞ্চিত আছে।
কাজী রহমতের তখন বড়ো টাকা-পয়সার টানাটানি। ঘুষ-ঘাস খেয়ে, গাঁয়ে মামলা-মোকদ্দমা লাগিয়ে শরাফতির ভড়ং বজায় রেখে কোনো রকমে চালাচ্ছিলো দিন। চরিত্রের বলিষ্ঠতা, প্রতিপত্তির ব্যঞ্জনা মরে গেছে সে কতোকাল আগে। যতো রকমে সম্ভব অন্যায় করেই যাচ্ছিলো রহমত। শাশুড়ীর বিছানায় জামাইকে শুইয়ে যে লোক ঠাট বজায় রাখে সে কাজী সাহেব শুনলো। শুনে জোড়া চোখে দপ্ দপ্ করে জ্বলেছিলো লোভলালসা। আগের দবদবা রবরবা থাকলে কাফেরের সন্তানকে কতল করে ফেলতো। পচা অভিজাত রহমত কাজী শুধু মনে মনে একটা ফন্দি এঁটে চুপচাপ রইলো। কাজী রহমতের ছোট চোখ আরো ছোট হয়ে যে অবর্ননীয় একটি ভাবের সঞ্চার হয়েছিলো, তাই কল্পনায় ভাসে। ধূর্ত শেয়ালের মতো চকচকে চোখবিশিষ্ট কাজী রহমতের ছবি চোখের সামনে জেগে উঠে। ছোটবেলায় কাজী রহমতের সে মুর্তি অনেকবার দেখেছে। শাদা শাদা খোঁচা খোঁচা আমের আটির কেশের মতো দাঁড়িগুলো। দুরভিসন্ধিতে কুটিল-কথা কইবার সময় কাঁপে।
যার এক কথায় মিথ্যা সত্য বনে যায়, সে কাজী রহমত সহচর কানা আফজালকে দিয়ে তার বাপ হরিমোহনকে ডাকিয়ে নিয়েছিলো। এসেছিলো তার বাপ। যদি না আসতো! আহা, যদি সে রাতে কাজী রহমতের বৈঠকখানায় না আসতো! হাসিম কিন্তু বিগত ঘটনার কথা ভাবছে। কাজী রহমত স্নিগ্ধ কণ্ঠে নাকি বলেছিলোঃ
“তয় বাজান মাইনসে নানান কথা কই বেড়ায়। আঁর খান্দানের ইজ্জত আছে। হেই কথা ভাবি চাইও। তারপরেও আঁই বেদীনরে মইয়া দিত পাইরতাম নয়। মুসলমান ত অইবা, বাকী কথা আফজালে কইবা।” [তারপর বাপজান, মানুষে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। আর আমার বংশেরও তো একটা ইজ্জত আছে। সে কথা ভেবে দেখো। তাছাড়াও কিন্তু আমি বেদীনকে (বিধর্মীকে) মেয়ে দিতে পারবো না। তুমি তো মুসলমান হবে, বাকী কথা আফজল বলবে।]
হরিমোহন প্রতিবাদ করে নি। হাঁ, ঠিক, কাজী সাহেবের বড়ো বংশ, বড়ো খানদান, বড়ো ইজ্জত। মুসলমান হলেও হরিমোহনকে মেয়ে বিয়ে দেবার পথে অনেক বাধা। বাদবাকী কথা কানা আফজল মর্তমান কলার ঝাড়টার কাছে নিয়ে কানে কানে বলেছিলো। সে কথায়ও রাজী হয়েছিলো তার বাপ। হায় রে প্রেম! তারপর একদিন চাঁদনী রাতে কানা আফজলের সাক্ষাতে আধসের পাকা সোনা আর দু’হাজার মহারাণীর ছবি আঁকা রূপোর টাকা মেয়ে জরীনার দাম স্বরূপ কাজী রহমতের হাতে তুলে দিয়েছিলো। গোপনে… অত্যন্ত গোপনে। গোপনও সময়ের পরিশেষে দল-পাপড়ি মেলে। সে কাজী রহমতই নেই, কাজী বাড়ির দবদবা রবরবা এখন ধুলোয় লুণ্ঠিত তাদের ঘাড়ে পা রেখে কানা আফজলেরা মাথা তুলছে। কানা আফজল এখন আলহাজ্ব আফজল আহমদ চৌধুরী। মান্যগণ্য ব্যক্তি, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। চেহারাতে চেকনাই লেগেছে। পোষাকে রুচি ফিরেছে। কিন্তু স্বভাবটা ঠিক আগের মতো আছে।
তারপরে একদিন বাগিচার হাটের বড়ো মসজিদে গিয়ে ইমাম সৈয়দ সাহেবের হাতে হাত রেখে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়েছিলো। দশ গ্রামের মুসলমান তাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠেছিলো। বাজী পুড়িয়ে ইসলামের জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছিলো। হিন্দু ধর্মের অসারতা নিয়ে জোড় বক্তৃতা দিয়েছিলো। গরু জবাই করে জেয়াফত দিয়েছিলো। ইচ্ছে ছিলো হিন্দুদের মাথা চির জীবনের জন্য হেঁট করে দেবে।
মৌলানা সাহ্বে শাদা ফ্যাড়ফ্যাড়ে দাড়ি নেড়ে নেড়ে হাজেরান মজলিশের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন উর্দু ভাষায়ঃ
“এসলাম জিন্দা হোতা হ্যয় হর কারবালা কি বাদ।” (প্রতি কারবালার পরেই ইসলাম ধর্ম নবজীবন পায়।)।
হরিমোহনের নতুন নামকরণ হলো মুহম্মদ ইসমাইল খান।
টাকা আর সোনা নেয়ার রাতে কাজী রহমত নিজের মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দেয়ার একটা তারিখও হরিমোহনকে দিয়েছিলো। নির্দিষ্ট তারিখেই পাশের গ্রামের শিকদার সাহেবের ছেলের সংগে জরীনার বিয়ে দিয়ে দিলো এবং সে দিনেই তার বাপের সংগে তার মা–মানে কাজী বাড়ির বাঁদির বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো। কি চেয়েছিলো? আর হয়ে গেলো কি? মুসলমান হলো, মুসলমানি নাম নিলো, তবু কেন হরি ব্যান্যা ডাকতো তার বাপকে। তার মা বাঁদী। আর বাপ বেনে।
তার পরিচয় মুসলমানের কাছে ব্যানার পুত, হিন্দুদের কাছে কি তা জানার অবকাশ হয় নি। কারণ তারাও নৃশংস কম নয়। বাপের প্রতি সমবেদনায় মনটা তার মেদুর হয়ে যায়। লোকটা সারা জীবন ধরে যে মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছে তার কি কোনো তুলনা আছে?
ফুলশয্যার রাতে গলায় বেনারসী শাড়ী দিয়ে, দড়ি পাকিয়ে ফাঁসি দিয়ে আত্নহত্যা করেছিলো জরীনা। সে অব্যক্ত বেদনার গুরুভারও তার বাপকে বইতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, কাজী বাড়ীর দাসী বিয়ে করে দাস হিসেবে জিন্দেগী কাটাতে হয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে হয়েছে। নির্মম নিষ্ঠুরতার আঘাতে প্রতি পলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া জীবন তার বাপের। বান্যা পুকুরের বটগাছে লটকানো তেজেনদার চোখের জিজ্ঞাসার ছুরি তার বাপের মর্মে আমুল বিঁধে গিয়েছিলো যেনো। একবার আহা করবার সুযোগও পায়নি। অতীতের ছায়ামূর্তিগুলো তার সামনে নির্দিষ্ট গতিপথে নিজের নিজের ভঙ্গীতে প্যারেড করে যেন চলে গেলো। সকলে মিলে তার জীবনের যে গতিপথ নির্দিষ্ট করেছে, সে পথেই তাকে আমরণ হাঁটতে হবে। নির্দিষ্ট গন্ডী ভেদ করে কোনদিন সে উদার আকাশের তলায় এসে দাঁড়াতে পারবে না। নিজের অস্তিত্বের চারপাশে দেয়ালের মতো নিরেট কঠিন বাধা অনুভব করে। হাজার আঘাতেও পথ দেবে না।
মনের গভীরে সঙ্গোপনে ক্ষীণ স্পষ্ট একটি আলোক শিখা জেগে ওঠে। এই চেতনাই তার হাতিয়ার। এরই আলোকে পথ দেখে দেখে অত্যাচার অবিচার সয়ে সয়ে সে এতো বড়ো হয়েছে। হাসিম স্পষ্ট দেখতে পায়, মানুষের নীচতা, ক্ষুদ্রতা আর ভণ্ডামীর সীমা কতদূর। নিজেকে সময় নির্যাতিত মানব জাতির প্রতীক বলে মনে হয়। চেতনার শিখা আরো প্রোজ্জ্বল, সন্ধানী রশ্মি আরো তীক্ষ্ণতর হয়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো শৃঙ্খলকে চোখের সামনে তুলে ধরে। নিজের অস্তিত্বের চার পাশের দেয়ালটাকে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। শরীর উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়, মাথায় ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ওঠে। সে চিৎকার করে ওঠে।
“এই দেয়াল আঁই ভাইঙ্গম”
এই দেয়াল ভাঙবো আমি।
উত্তেজনার মুহূর্তে জখমো পা’টাতে টান লেগে ব্যথিত হয়ে ওঠে সারা শরীর। মা গো! বলে বলে অস্ফুটে চীৎকার করে। পৃথিবীতে কোনো কিছু, কোনো বাদ্যযন্ত্র কোনো সুর সে যাতনাকে ধরতে পারবে না। সুফিয়া ছুটে আসে তাড়াতাড়ি। পায়ের পট্টি বদলায়। বাটা ঔষধের প্রলেপ লাগায়। হাসিম চুপচাপ মরার মতো নিঃশব্দে পড়ে থাকে।
দীর্ঘ আটদিন পরে বিষ্টি থামলো। আকাশে সোনার বরণ রোদ হেসেছে। বিকেল বেলা। উঠানের কাঁঠাল গাছটিতে দুটি চড়ুই পাখি কিচিরমিচির ডাকছে। হাসিম এক পায়ে ভর করে কোনো রকমে দাওয়ায় এসে মাদুরের উপর বসে। সূর্যের গালানো সোনা দু’চোখে পান করে মনের অলিগলি খুশিতে ভরে ওঠে। মনের ভেতর আলোর ঝরনা বয়ে যাচ্ছে… তার ভাষা নেই কোনো। প্রকৃতির সঙ্গে মনের এ সংযোগ কতো সহজ, কতো স্বাভাবিক। মনে মনে এর একটা অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করে। এই যে আকাশ, এই যে গাছপালা, এই যে সূর্য কেমন প্রিয় বন্ধুর মতো তার সমগ্র সত্তা নিবিড় মেহের আবরণে পরম মমতায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে আসছে জোহরা। তার সুগৌর ফর্সা মুখমন্ডলে শেষ বিকেলের ছটা লেগে অপরূপ দেখাচ্ছে। চুল বাঁধেনি। রুক্ষুচুলে এলোলামেলো জোহরার চেহারার মধ্যে বিষণ্ণ সৌন্দর্যের আমেজ। চোখ দুটো টলো টলো। মুখের ওপর থমকে আছে একটা কান্নার আবেগ। হাসিম ডাকে।
“আয় বইন, আয় বয়।” (এসো বোন, এসো, বসো।)
একখানা সিঁড়ি টেনে নিয়ে বসলো জোহরা। তার মুখে কোনো কথা নেই। রোগক্লিষ্ট যন্ত্রণাকাতর হাসিমও অনুভব করে জোহরা বড় দুঃখী। তার জোয়ান খসমটা মারা গেছে বিশ দিন আগে। চা বাগানে সাবের মতো অমন সুন্দর মানুষটা মাত্র এক সপ্তাহের জ্বরে মারা গেলো। মরার সময় নাকি জোহরাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলো। খলু মাতুব্বর ভাতিঝিকে যেতে দেয় নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসিম জোহরার কথা শুনছে। পাড়া-পড়শী তার শয্যার পাশে টুকরো টুকরো আলাপ করছে এ বিষয়ে। স্মরণে জেগে আছে সে সব। রাশি রাশি শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার তাপে চাপে হারিয়ে যায় নি। খলু মাতব্বর বলেছে, আইন মতে জোহরা কবীরকে কাজীর অফিসে গিয়ে তালাক দিয়েছে। সুতরং কবীর এখন বেগানা পুরুষ। শরীয়ত মতে বেগানা পুরুষের মরা মুখ দেখাও হারাম। হারামের জন্য জোহরা খসমকে দেখতে যেতে পারে নি।
আগে আরো দু’দুবার বিয়ে হয়েছে জোহরার। মাতব্বর মামলাবাজ, দাঙ্গাবাজ মানুষ। আগের দুখসমের মধ্যে একজনের জমি মামলা করে নিজের চাষে নিয়ে এসেছে এবং অন্য জনের নামে অলংকার ও খোর পোষের নালিশ করে সব কিছু আত্নসাৎ করেছে। তৃতীয়বার সাতবাড়িয়ার কবীরের সংগে জোহরার বিয়ে হয়েছিলো, গেলো ফাল্গুনের আগের ফাল্গুনে। জোহরার শ্বশুরের জমি নিয়ে মামলা মকদ্দমা চলছিলো। জোহরা অশান্তিতে আছে এ অজুহাতে নাইয়র এনে আর শ্বশুরবাড়ীতে যেতে দেয়নি। কাজীর অফিসে গিয়ে জোহরাকে দিয়ে কবীরকে তালাক দিতে বাধ্য করে তিন কানি জমি দখলের ফন্দি করেছে। তালাক দেওয়ার পরেও কবীরের প্রতি জোহরার টানের কথা মাতব্বর বিলক্ষণ জানতো। জমি জোহরার নামে। মেয়েমানুষের গতি কি বোঝা যায়! কথায় বলে বারো হাত কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকে। এখন কবির মরেছে। আপদ বিপদ চুকে বুকে গেছে। জমি নিজের চাষে নিয়ে আসার পথ নিষ্কটক। সে আনন্দে খলু মাতব্বর বগল বাজাচ্ছে।
“সুফিয়া বু কড়ে গেইয়েদে?” (সুফিয়া বুবু কেথায় গিয়েছে?) জিজ্ঞেস করে জোহরা।
“কডে জানি গেউয়ে বইন। কড়ে আর যাইব, সের আধসের চইল উধার চাইবার লায় গেইয়েদে আর কি। আঁরে ত আল্লায় নেয়মত দিয়ে” (কোথায় জানি গিয়েছে বোন। সের আধসের চাল ধারটার চাইতে গেছে। আল্লা তো আমাকে অমৃত দিয়েছে।)
জোহরা কথা কয় না। চুপ করে থাকে। চোখের দুটো টলোটলো মণিতে উদগত অশ্রু। হাসিম এলোমেলো বিস্রস্ত সৌন্দর্যের পানে চেয়ে থাকে। লজ্জা পায়। নড়ে বসতে চেষ্টা করে। পা-টা ব্যাথা জানায়।
“আঁরে এক দলা বিষ দিবানি হাসিম বাই?” (আমাকে এক দলা বিষ যোগাড় করে দেবে হাসিম ভাই?)
“বিষ কিয়ার লাই বইন?” (বিষ কিসের জন্য বোন?)।
“হেই কথা বুঝাইতে পাইরতাম নয়, আল্লায় আঁরে হেই মুখ ন দে।” (সে কথা বুঝিয়ে বলতে পারবো না, আল্লায় আমাকে সে মুখ দেয় নি।)।
“বইন, জগত সংসারে হক্কল জিনিস বিষ। হক্কল কিছু সহ্য গরন পড়িব। উতলা অইলে ত চইলতো নয়।” (বোন, জগৎ সংসারে সক্কল জিনিস বিষ। সব কিছু সহ্য করতে হবে। উতলা হলে চলবে না।)
কথাগুলো বলে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে হাসিম।
জোহরার অন্তরের বেদনার ঝড় হাসিমের সহানুভূতির ছোঁয়ায় ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে গণ্ডদেশে গড়িয়ে পড়ে। আস্তে আঁচলে মুখ মুছে ফেললো। তার চোখে পানির দীর্ঘায়ত ফোঁটাগুলো বড়ো দুঃখের। হাসিমের চোখে বড় সুন্দর লাগে।
“জোহরা বু আইজো ন আইল” (জোহরা বুবু আজো এলো না।) বলে ধীরে ধীরে পা ফেলে সচল বিষণ্ণ সৌন্দর্যের মূর্তির মতো কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে ঘনায়মান সন্ধার অন্ধকারের দিকে হারিয়ে গেলো।
সুফিয়া গিয়েছিলো খলু মাতব্বরের বাড়িতে আধসের চাল ধার চাইতে। পড়শীদের কারো চাল নেই। এতোদিন পর হাসিম বিছানা থেকে উঠে বসেছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শোকর। অসুস্থ, অভুক্ত স্বামী যদি কিছু খেতে চায় তা হলে সামনে কি বেড়ে দেবে? আট দিন একলাগা বৃষ্টির পরে পড়শীদের কারও ঘরে চাল থাকার কথা নয়। দু’এক জনের কাছে চাইবার পরে তার অনুমানের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছে। সকলে জোহরাদের মতো আঁচলে করে এনে পাতিলে ঢেলে রান্না করে জীবন চালায়।
উপায়ান্তর না দেখে খলু মাতব্বরের বাড়িতে গেলো। মাতব্বর চালাক মানুষ। বিষ্টির পর চালের দাম চড়বে জানে। সে জন্য ধানের কল থেকে চাল ছাঁটিয়ে এনেছে। চার পাঁচ ভার হবে। মাতব্বরের বড় বৌ, ছোট বৌ, দু’ছেলের বৌ সকলে পাটি বিছিয়ে চাল ঝাড়ছে, চালছে।
সুফিয়া বড় বিবির কাছে অত্যন্ত মিনতি করে বললো, “খালা, তোঁয়ারার জামাই ভাত খাইবার লায় সের আধাসের চইল উধারের লায় আস্যিদে। নদিনের পরে আজিয়া মোড়ে উঠি বস্যে, খালা আঁরে এক সের চইল দেও… আঁই ঝাড়ি চালি দিয়ম।” (খালা, তোমাদের জামাইয়ের ভাত খাওয়ার জন্য সের আধসের চাল ধার চাইবার জন্য এসেছি। ন’দিনের পরে আজ মোটে উঠে বসেছে। খালা, আমাকে সের আধসের চাল ধার দাও–আমি ঝেড়ে চেলে দেবো।)
বড়ো বিবির দয়ার শরীর রাজী হয়েছিলো। কিন্তু শুনতে পেলো মাতব্বর। গরু ঠেঙ্গানো লাঠিটা দিয়ে নিজের ছোট বৌ এবং দু’ছেলের বউয়ের সামনে বড়ো বিবিকে ঠেঙ্গিয়ে দিলো।
“মউগের ঝি, এই ভাবে আঁর গিরোস্থি ধ্বংস গরিবি, দরেয়াত ডোবাবি। (মাগের ঝি, তুই আমার গৃহস্থী ধ্বংস করবি, সমুদ্রে ডুবাবি) মাতব্বরের মুখ দিয়ে আরো নানা রকম অশ্লীল কথা বেরিয়ে আসে।
সুফিয়া তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসে। তাকে দেখে মাতব্বরের মুখে গালাগালির খৈ ফোটে।
“এই বান্যিয়ার পুতের বউ, আর তোরে ঘরের কাছে পিছে দেহিলে ঝুঁড়া কাডি লইয়ম।” (এই বেনের বউ, আবার তোকে ঘরের কাছে দেখলে খোঁপা কেটে নেবো৷)
ওদের অসম্ভব কিছু নেই। খোঁপাটিতে হাত দিয়ে অন্ধকারের ভেতর পা চালায়। বুকটা ভয়ে চিব ঢিব করে। পুকুর পাড় ছাড়িয়ে মাতব্বরের গরুর গোয়ালের কাছে এসে হাঁপায়। অন্ধকারের ভেতর একজনকে দেখে চমকে উঠে। মাতব্বরের ছোটো ছেলে লড়াই দেয়ার ষাঁড়টাকে বিল থেকে কলাই চুরি করে এনে ধুনে ধুনে খেতে দিচ্ছে। সুফিয়াকে দেখতে পেয়ে সে ফিসফিসিরে ডাকে। এমনি ডাক তাকে তার বাপ মাতব্বরও ডেকেছে অনেকদিন।
“খোদার কহর পড়ক তোর উয়র।” (খোদার অভিশাপ পড়ুক তোর উপর।) চীকার করে বলে।
গর্ভের ভারে হাঁটতে পারে না সুফিয়া। কিছু দূর দৌড়ে ফুঁপিয়ে উঠে। ছেলেটা চীকার করে গালাগাল করে। হঠাৎ অন্ধকারে কোত্থেকে মাতব্বরের আবির্ভাব হলো। উচ্চঃস্বরে বললোঃ
“মউগের ঝিয়ের ঠ্যাং ভাঙ্গি দে রইস্যা। মউগের ঝি চোর।” (মাগের ঝিয়ের ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দে রসিদ। মাগের ঝি চোর।)
.
কোনো রকমে সুফিয়া দু বন্য জন্তুর আওতার বাইরে চলে আসে। তার পরনের শাড়ি খুলে গিয়েছে। খুলে যাওয়া শাড়িটা পড়বার জন্যে কাজী রহমতের কবরের কাছে একবার দাঁড়ায়। কাপড় পড়তে ভুলে যায়। স্ফীত উদরের সঙ্গে কাপড়টা চেপে ধরে কাজী রহমতের কবরে তিনটি লাথি মেরে শোধ নিলো নীরবে। শব্দ করে বললোঃ
“আল্লা, জালেমের উয়র তোর গজব পড়ক। জালেমের বংশ নির্বংশ অউক।” (আল্লা, অত্যাচারীর উপর তোমার অভিশাপ পড়ক।)।
হরিমোহন মুসলমান হয়েছিলো। গোকুল পপাদ্দারের সোনায় ভর্তি লোহার আলমারীর ডালা তার জন্যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। গোকুল ছেলেকে ক্ষমা করেনি। ক্ষমা করতে পারেনি। এ অপমান হজম করে বেশি দিন বাঁচে নি। রয়ে গেলো গোকুলের বিধবা স্ত্রী, সম্পর্কে হাসিমের দাদী। পদে পদে মেনে চলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। কিন্তু এক জায়গায় বুড়ি দুর্বল, বড় অসহায়। তার কনিষ্ঠ সন্তান। হরিমোহন। আঁতের মধ্যে দশমাস দশদিন ছিলো। সে ছেলে বড় হলো, তারপর মুসলমান হয়ে গেলো। এ জন্য স্বামী তাকেও ক্ষমা করে নি। পেটে ধরেছিলো বলে যেন সমস্ত দোষ তারই। কাজী বাড়ির বাদীকে বিয়ে করলো, মারা গেলো। হায় রে সমাজ! হায় রে ধর্ম! মৃত সন্তানের মুখ বুড়ী দেখতে পারেনি। হিন্দু হোক, মুসলমান হোক তারই সন্তান, তারই গর্ভস্থ ভ্রুণ হতে জন্ম, হরিমোহনকে কি ভুলতে পেরেছে? আরো তিন ছেলে এবং এক গণ্ডা নাতি কি হরিমোহনের স্থান পূরণ করতে পেরেছে?
হাসিমের অসুখ-বিসুখ হলে বুড়ী দেখতে আসে। আসে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে– যাতে কেউ দেখতে না পায়। হোক না নিজের আঁত পচা ছেলের ছেলে। তবু তো মুসলমান; বিধর্মী। কিন্তু হাসিমের বিপদে আপদে থুখুরী মনখানা আনচান আঁকুপাঁকু করে কেন? কেন করে? স্বামীর গচ্ছিত মরণের সম্বল থেকে রূপোর টাকা দিয়ে যায় দু’চারটা করে। ছেলেরা নাতিরা প্রচণ্ডভাবে শাসিয়েছে। শ্মশানে বয়ে নেবে না বলে ভয় দেখিয়েছে। মরলে গোর দেবে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছে। বুড়ী ভয় পায়, শিউরে ওঠে। যদি তাকে শ্মশানে বয়ে নিয়ে না যায়, যদি তাকে কবর দেয়া হয় মুসলমানের মতো? তা হলে? তা হলে? অস্ফুটে উচ্চারণ করে।
“আঁরে ক্ষেমা গইয্য তেত্রিশ কোটি দেওতা। আঁর মনেত মায়া ছাড়া আর কিছু নাই।” (আমাকে ক্ষমা করো তেত্রিশ কোটি দেবতা। আমার মনে মায়া ছাড়া কিছু নেই।) তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্দেশ্যে হাত ঠেকিয়ে সভক্তি প্রণাম করে।
হাসিমের কথা চিন্তা না করার জন্যে সচেতন মনে বারবার সংকল্প করেছে। হাসিম তার কে? তার যে একটি ছেলে ছিলো, তার নাম হরিমোহন সে কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু, যুক্তি মানে না হৃদয়। রক্ত ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
হাসিমের পায়ে জখমের সংবাদ শোনা অবধি বুড়ীর মনটা বার বার কোণাকোণি হয়ে যাচ্ছে। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মনের কষ্টিপাথরে বিজলী রেখার মতো মুসলমান নাতির জন্যে বেদনা জ্বলে ওঠে। কতো গভীর সে বেদনা। রাতে ঘুমোতে পারে না। পথে বেরোতে পারে না। একে তো বিষ্টি, তদুপরি পথঘাট পিছল।
বিষ্টি বন্ধ হবার পরের দিনই সের দুই চালের একটা পুঁটুলি বেঁধে, স্বামীর দেওয়া সঞ্চয় থেকে ক’টি রূপোর টাকা থান কাপড়ের আঁচলে নিয়ে পথে নামলো। সন্ধ্যার অন্ধকারে লাঠি ঠক ঠক করে যখন হাসিমের ঘরের কুয়োটির সামনে এলো, দেখতে পেলো শাদা কাপড় পরা কে একজন এদিকে আসছে। তাড়াতাড়ি বুড়ী চালের পুঁটুলিটা পরনের থান কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে কেয়া ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কাঁটার আঘাত সমস্ত শরীরকে জর্জরিত করে। একটি নিশ্বাসও না ফেলে চুপ করে রইলো। আঁধর হাঁ, অধরই তো চলে গেলো। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। দেবতাকে ধন্যবাদ দেয়। অধর নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলে বুড়ী অনুচ্চকণ্ঠে হাসিমকে ডাকাডাকি করে। চড়াতে পারে না গলার স্বর। এ পাড়ার কেউ শুনলে আরো এক অনর্থ বাধবে। দাঁতহীন মুখ দিয়ে ঠিক মতো স্বর বেরোয় না। অনেক ডাকাডাকির পর সুফিয়া একখানা বাতি নিয়ে কুয়োর পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করেঃ
“হেইভা কন?” (সেটা কে?)।
“ওডি আগে তোল আঁরে কেঁড়ায় খাই ফেলাইল। উহ্ বাবারে মরি গেলাম রে।” (ওগো, আগে তো আমাকে কাঁটায় খেয়ে ফেললো। উঃ বাবা গো, মারা গেলাম।) ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসে।
বুড়ীকে পাড়ে টেনে তুলে কাপড়ের কাঁটা বাছতে বাছতে জিজ্ঞেস করে সুফিয়াঃ
“দাদী তুই ঝাড়ত ক্যা পইরলা?” (দাদী, তুমি ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেলে কেমন করে?)
“অধর, অধর গেলদে রাস্তাদি।” (অধর, অধর যে গেলো রাস্তা দিয়ে।) বুড়ী বিজ্ঞতার ভান করে মাড়ি দেখিয়ে হাসে।
সুফিয়ার আর বোঝার বাকি থাকে না। বুড়ীকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। চালের পুঁটুলিটা হাসিমের সামনে রাখে। ঘরের ভেতরে ঢুকে সর্ষের তেলের বোতলটা এনে উপুর করে বুড়ীর ছড়ে যাওয়া কুঁচকানো চামড়ায় লাগায়। যন্ত্রনায় উঁহু হু করে বুড়ী।
স্বল্পালোকিত বাতির স্লান শিখায় হাসিমের রোগা-পাণ্ডুর কষ্টক্লিন্ন মুখ দেখতে পেয়ে নিজের যন্ত্রনার কথা ভুলে যায়। করুণায়, সেহে, দুঃখে অন্তরের গহনতল পর্যন্ত আলোড়িত হয়। পাশে উবু হয়ে বসে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে।
“সোনা কন জাগাত জখম অইয়েদে?” (সোনা, কোন জায়গায় জখম হয়েছে?)
হাসিম জখমী পা দেখায়। বুড়ী সযত্নে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয়। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ছাড়ে। এ নিশ্বাসের ভেতর থেকে অনেক অগ্নিগিরির লাভা নিঃসরিত হয় নীরবে। নাতি দাদী দু’জনের কেউ কথা বলে না। দু’জনেই বেদনার নীরব স্রোতে অবগাহন করে। একজনের মুখে অন্যজন সান্তনার ভাষা খুঁজছে। বুড়ী হাসিমের বুকে মুখে কাঁধে সারা শরীরে হাত বুলোয়। বাম চোখে ছানি পড়েছে, ভালো দেখতে পায় না। তবু দৃষ্টির সবটুকু ধার উপুর করে হাসিমের মুখে কি দেখতে চায়। হরিমোহনের মুখের আদল?
আঁচলের গিঁঠটা খুলে গুণে গুণে দশটা রুপোর টাকা, দশখানা পাঁজরের মতো সন্তর্পনে হাসিমের হাতে তুলে দিলো। চেরাগ বাতির আলোকে টাকার বুকের মহারাণীর ছবিটা জ্বলে উঠলো চিক চিক করে। একদৃষ্টিতে হাতের টাকাগুলোর দিকে চেয়ে হাসিমের দু’চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু নির্গত হলো। শিশু যেমন একমুঠো জোছনা চেপে ধরে হাসিমও তেমনি টাকাগুলোকে চেপে ধরলো। এ টাকাতে কিসের স্পর্শ যেন এখনো লেগে আছে।
“নাতি, এহন যাই। অধর ঘরত গেলে গোলমাল লাগাইব।” (নাতি, এখন যাই। ঘরে গেলে আবার অধর একটা গোলমাল বাধিয়ে বসবে।)।
বাকী কথা শেষ না করে বুড়ী উঠে দাঁড়ায়। সুফিয়া হাতে লাঠিটা তুলে দিয়ে কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে আসে। খুবই সন্তর্পণে লাঠি ঠক ঠক করে পথ চলে। কেউ যদি দেখে ফেলে? আঁধারের ভেতর নদীর মতো শুশ্রূষার জল, পিপাসার বারি হয়ে আসে বুড়ী আঁধারেই চলে যায়। দিনের আলোতে দেখা নেই। অন্তরেও আঁধার নদী আছে। তারই স্রোতে ভেসে আসে সমাজের অনুশাসন ডিঙিয়ে রাতের বেলা নাতিকে দেখার জন্যে। হৃদয়ের এ লাবণ্যরেখার নদী কোনোদিন কি দিনের আলোর মুখ দেখবে? বুড়ী মনে মনে সে কথাই ভাবে।