২. বিষ খাও বাজার-সরকারের মেয়ে
পান্তাভাত খেতে ভালোবাসতেন রবি ঠাকুর। যদি সেই পান্তার স্বাদে যুক্ত হত বউদির আঙুলের স্পর্শ, ”অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না” (রবীন্দ্রনাথ)।
পান্তা-লঙ্কা-বউদি-এই বিরল ত্রহ্যস্পর্শ রবীন্দ্রের অন্তরজীবনে ক্রমশ তৈরি করেছিল অমোঘ সেই রসায়ন যা একদিন তরুণ কবিটিকে বউদির উদ্দেশে লিখিয়ে নিল সম্পূর্ণ সমর্পণের স্বীকারোক্তি-তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর ছ নম্বর সন্তান, আরও বিশদে পাঁচ নম্বর ছেলে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্র-সারদার চোদ্দো নম্বর সন্তান রবীন্দ্রের প্রিয়তম ‘নতুন দাদা’।
তাঁরই স্ত্রী, বাল্যের খেলার সাথি ‘নতুন বউঠাকরুণ’ কাদম্বরীর সঙ্গে বেপরোয়াভাবে প্রেমে পড়েছিলেন সদ্য বিলেতফেরত যুবক রবীন্দ্রনাথ। ‘‘He fell desperately in love with her’’, রবীন্দ্রের সঙ্গে কাদম্বরীর ক্রমশ বদলে-যাওয়া সম্পর্ক প্রসঙ্গে এ-কথা বলতে হাত কাঁপেনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের।
ছেলেবেলায় যে প্রিয় মেয়েটির আঙুলের ছোঁয়া পালটে দিত রবীন্দ্ররসনায় অন্নের স্বাদ-সৌরভ, সেই মেয়েরই চোখের দিকে তাকিয়ে বিলেতফেরত, তখনও-বিদেশিনী-আচ্ছন্ন যুবক রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হলেন এমনভাবে যে বউদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে রূপরেখায় এল হার্দিক পরিবর্তন। এ-মেয়ের চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দুলে উঠল রবীন্দ্রের যৌবন।
রবীন্দ্রনাথ আজীবন ভুলতে পারেননি তাঁর নতুন বউঠাকরুণের চোখ। ”তোমার দুখানি কালো আঁখি পরে বরষার কালো ছায়াখানি পড়ে”- দেওরের এ-লেখা বউদির চোখের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
কাদম্বরীর চোখ আর তাঁর কালো কোঁকড়ানো চুল- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে সেই আকর্ষণে যাঁরা সাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ- ”নতুন বৌঠানের চোখ দুটো এমনভাবে আমার মনের মধ্যে গাঁথা আছে যে মানুষের ছবি আঁকতে বসলে অনেক সময়েই তাঁর চোখ দুটো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে- কিছুতেই ভুলতে পারিনে। তাই ছবিতেও বোধহয় তাঁর চোখেরই আদল এসে যায়।”
রবীন্দ্রনাথের আঁকা মানুষের প্রতিকৃতির প্রায় সব চোখই এক রকম। চোখ আঁকলেই তিনি আঁকতেন তাঁর নতুন বউঠাকরুণের চোখ। ভুলতে পারেননি বউদির দৃষ্টিপাতের অমোঘ টান-
বড় বড় কাজল নয়ানে
অসংকোচে ছিল চেয়ে
নবকৈশোরের মেয়ে,
ছিল তারই কাছাকাছি বয়েস আমার।
এই ‘অসংকোচ’ মেয়ের টানেই রবি ঠাকুর ইস্কুল পালাতেন, সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রের বয়েস তখন বারো। কাদম্বরী চোদ্দো। বেঙ্গল অ্যাকাডেমি স্কুলের ছাত্র তখন রবি। প্রায়ই ইস্কুল যেত না। গেলেও, অমনস্ক রবি তাকিয়ে থাকত জানলা দিয়ে বাইরে। কার কথা ভাবত? এ-প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই দিয়ে গিয়েছেন :
”বাড়িতে আমি ছিলুম একমাত্র দেওর, বউদিদির আমসত্ত্ব পাহারা, তা ছাড়া আরও পাঁচ রকম খুচরো কাজের সাথি।”
বালক রবীন্দ্রনাথ বউদির সঙ্গে নানাবিধ খুচরো কাজের লোভ সামলাতে না পেরেই ইস্কুল কামাই করত। এ-কথা বিশ্বাস করাটা কি খুব শক্ত?
বালক রবির খেলার সাথি বলতে তেমন কেউই ছিল না ঠাকুরবাড়িতে। (রবীন্দ্রনাথের ভাইবোনের অভাব ছিল না। তবু ছোট্ট রবি একা। মহর্ষির নয়-নয় করে ছেলেমেয়ের সংখ্যা পনেরো। প্রথম সন্তান কন্যা। নামকরণের আগে মারা যায়। বাকিরা- দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ, সৌদামিনী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সুকুমারী, পুণ্যেন্দ্রনাথ, শরৎকুমারী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারী, সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বুধেন্দ্রনাথ।)
হঠাৎ-ই নরম সুন্দর খুনসুটিপ্রবণ সপ্রতিভ এবং বেশ ‘তৎপর’ একটি মেয়ে এল রবির জীবনে, যে মাত্র বছর দুয়েকের বড়। এর পরে কি ইস্কুলে যাওয়া যায় রোজ-রোজ? এ-প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-
”কখনো কখনো আমার উপর ভার পড়ত জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটবার। খুব সরু করে সুপুরি কাটতে পারতুম। আমার অন্য কোনো গুণ যে ছিল, সেকথা কিছুতেই বউঠাকরুণ মানতেন না, এমনকী চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার সুপুরিকাটা হাতের গুণ বাড়িয়ে বলতে মুখে বাধত না। তাতে সুপুরিকাটার কাজটা চলত খুব দৌড়বেগে।”
কিশোরী বউদিটি আলতো ফ্লার্টিং করত, করত প্রণয়ের ভান, দেওরটির সঙ্গে। কেমন ছিল সেই দুষ্টুমি এবং রসিকতার ধরন?
”বাড়িতে আমার দর্পহরণ করিবার জন্য যাঁহার প্রবল অধ্যবসায় ছিল- তিনি বিশেষ করিয়া আমাকে এই কথাটি বুঝাইয়া দিয়াছিলেন যে আমার ললাট এবং মুখশ্রী পৃথিবীর অন্য অনেকের সহিত তুলনায় কোনোমতে মধ্যম শ্রেণীর বলিয়া গণ্য হইতে পারে।”
এই হল সেই চতুর ফ্লার্টিং যার মাধ্যমে কিশোরী বউদিটি তার দেওরকে এক্কবারে পাত্তা-না-দেওয়া পাত্তা দিয়েছে।
”কী বিচ্ছিরি দেখতে তোমায় ঠাকুরপো”,রবীন্দ্রের মতো দেওরকে যে-বউদি এ-কথা বলতে পরে, সে আসলে বলতে চায় ঠিক উলটো কথা।
পনেরো বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করলেন শেক্সপিয়র-এর ‘ম্যাকবেথ’। এই নাটকেই আছে ‘হেকেটি’ ডাকিনির প্রসঙ্গ। শেক্সপিয়র-এর বানানে Heccat, ডাইনিদের প্রধানা, এক রহস্যময়ী, বশীকরণের ক্ষমতায় তুখোড়।
সতেরো বছরের বউদির আকর্ষণে ততদিন রহস্যময়তার আভাস পেয়েছেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ। এই রহস্যময়তার মধ্যে কোথাও কি ডাকিনি-ডাকের স্বাদ পেয়েছিলেন এই কবি, তাঁর রোম্যান্টিক জাগৃতির লগ্নে?
‘মালতী-পুঁথি’ নামের একটি খাতায় কবিতা লিখতেন ১৮৭৫-এর রবীন্দ্রনাথ। এবং এই খাতারই একটি পাতায় ‘বউঠাকরুণ’ না লিখে তিনবার লিখেছেন তিনি Hecate Thakroon !
কিন্তু ‘হেকেটি’ শুধু শেক্সপিয়র-এর ডাকিনি নয়, সে তো গ্রিক দেবীও বটে। প্রচ্ছন্ন, অন্তর্গূঢ় দেবী এই নারী, গ্রিক পুরাণে যার বাস পরিচিত আলোকবৃত্তের বাইরে, নিরন্তর নিরালোকে। শেক্সপিয়র গ্রিক দেবী হেকেটিকেই ধার করেছিলেন তাঁর নাটকের ডাকিনি হিসেবে।
হেকেটি যে অন্ধকারের দেবী, তাকে যে দেখা যায় না, বোঝা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় তার আকর্ষণ, এমন একটি ভাব বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাঁর বউদিটিও কি নয় সেই রকমই সংবৃত অন্তরালের এক নারী?
অন্তত রবীন্দ্র তাঁকে সেই ভাবেই ভাবতে ভালবাসেন, এক নিঃসঙ্গ অন্তরালবর্তিনী, ঠাকুরবাড়ির পরিচিত বৃত্তের বাইরে এক গোপনচারিণী, যার সঙ্গে সম্পর্কের সবটুকু বলা যায় না, বোঝাও যায় না। এই আকর্ষণের কতটুকু ন্যায়, কতটুকু অন্যায়, কে বলবে?
”শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি, হে সুন্দরী!” এই মোহিনীর রহস্য-আকর্ষণে ক্রমশ বাঁধা পড়লেন রবীন্দ্র- সেই তো তোমার ডাকার বাঁধন অলস ডোরে দিনে দিনে বাঁধল মোরে।
দেওর পড়তেই পারে বউদির প্রেমে। কিন্তু ধরণীর আর কোন দেওর এমন বেপরোয়া বলতে পেরেছে বউদিটির প্রতি প্রবল প্রবণতার কথা?
রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীকে ‘হেকেটি’ নামের ইশারায় ডাকতেনও। ক্রমে হেকেটি-ই হয়ে উঠল ঠাকুরবাড়িতে কাদম্বরীর ডাকনাম। অবশ্যই পুরুষমহলে।
মেয়েরা নিশ্চয় রবীন্দ্রের এই বউদি-প্রেমকে আড়-চোখ বা কিঞ্চিৎ ঈর্ষার চোখেই দেখতেন। তাই তাঁর কেউ কাদম্বরীকে ‘হেকেটি’ নামে ডাকতেন না।
অচিরে প্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থ। উৎসর্গে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-
শ্রীমতী ‘হে’-কে উপহার। কে এই ‘হে’? উত্তরে রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন :
হৃদয়ের বনে বনে সূর্যমুখী শত শত/এই মুখপানে চেয়ে ফুটিয়া উঠিছে যত।
বলাই বাহুল্য, এ হৃদয়বন দেওরের। কিন্তু যে-কথাটি বলা বাহুল্য নয় তা হল, ভগ্নহৃদয়ের ‘হে’ একই সঙ্গে ‘হেকেটি ঠাকরুণ’ এবং ‘হেমাঙ্গিনী ঠাকরুণ’!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন নায়ক অলীকবাবুর ভূমিকায়। তাঁর প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কাদম্বরী। নাটকে তাঁর নাম হেমাঙ্গিনী। সুতরাং ‘হে’ নামের আভাসিত আদর একই সঙ্গে হেকেটি ঠাকরুণ ও হেমাঙ্গিনী ঠাকরুণ কাদম্বরীর প্রতিই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখলেন নাটক। সেই নাটকের নায়িকা কাদম্বরী। নায়ক রবীন্দ্রনাথ। নাটকের কাদম্বরী লুকিয়ে-লুকিয়ে প্রেমপত্র লেখেন নাটকের রবীন্দ্রনাথকে।
একটি প্রেমপত্রের কিছু অংশ এখানে পড়তে মন্দ লাগবে না- ”স্বামিন! কি বলিলাম! আমি কি আপনাকে এখন এরূপ সম্বোধন করিতে পারি? কে বলে পারি না? অবশ্য পারি। সমাজ ইহার জন্য আমাকে তিরস্কার করিতে পারে, পিতামাতা আমাকে জন্মের মতো ত্যাগ করিতে পারেন, কিন্তু এরূপ মধুর সম্বোধন করিতে কেহই আমাকে বিরত করিতে পারিবে না। আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্র সূর্যকে সাক্ষী করিয়া মুক্তকণ্ঠে স্পষ্টাক্ষরে বলিব, তুমিই আমার স্বামী ; শতবার বলিব, সহস্রবার বলিব, লক্ষবার বলিব, আমিই তোমার স্ত্রী।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘হেমাঙ্গিনী’র আবির্ভাব ১৮৭৭ সালে। অলীকবাবু নাটকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায় কাদম্বরী কণ্ঠ মিলিয়ে গান গেয়েছিলেন।
গল্পের মূল বিষয় হেমাঙ্গিনী আর অলীকবাবুর প্রণয়। কাদম্বরীর সঙ্গে নাটকের চরিত্র হেমাঙ্গিনীর অনেক মিল। উভয়েরই প্রিয় লেখক বঙ্কিম। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পে এবং সেই গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘চারুলতা’-য় বউঠাকরুণটিরও প্রিয় লেখক বঙ্কিম। এবং গল্প এবং চলচ্চিত্রের বিষয়, বউদি-দেওরের প্রেম।
নষ্টনীড় গল্পের বউঠান যে কাদম্বরী এবং অমল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনও মানে হয় না। যে-কথাটা ইন্টারেস্টিং, তা হল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নায়িকা হেমাঙ্গিনী তাঁর স্ত্রী কাদম্বরীর মতোই বঙ্কিমের নায়িকাদের রূপ-গুণ রোম্যান্টিকতা নিজের মধ্যে কল্পনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় গল্পের এবং সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা ছবির বউদিটিও কিন্তু এই কাজটাই করেন আরও সূক্ষ্মভাবে। রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনে বউঠাকরুণ ও বঙ্কিম ওতপ্রোত। হেমাঙ্গিনী, কাদম্বরী বা নষ্টনীড়-এর বউঠান, প্রত্যেকেই শিখেছেন প্রণয়ের ছলাকলা বঙ্কিমের উপন্যাস থেকে। হেমাঙ্গিনী তো এইভাবেই, এই ছলাকলা শিখতে-শিখতে, প্রেমে পড়ছে অলীকবাবুর। আর কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কও কি এই নাটকের সূত্র ধরেই নতুন মোড় নিয়েছিল? আবারও উত্তর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ অকপটে :
তার পর একদিন
জানাশোনা হল বাধাহীন।
একদিন নিয়ে তার ডাকনাম
তারে ডাকিলাম।
একদিন ঘুচে গেল ভয়,
পরিহাসে পরিহাসে হল দোঁহে কথা বিনিময়।
কখনও গানে, কখনও কবিতায়, কখনও বা সূক্ষ্ম পরিহাসে, নীরব ইশারায় নতুন বউঠানকে প্রেম নিবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্র মনে করতেন চারপাশের লোকজন, সংসারের আর পাঁচজন, স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথও বোঝেন না বউদিটির সঙ্গে তাঁর আভাসবাহী বিনিময়ের কথা। তাঁরা কি সত্যিই বুঝতেন না? নাকি, বুঝেও বুঝতেন না?
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের বার্তা বাইরে বেরোত না চট করে। সে এক আশ্চর্য আবৃত পরিবহ। রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন হয়তো ছিল। রবীন্দ্রের লেখায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যদিও রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী কেউই কান পাততেন না। ক্রমশই আরও নিবিড় হল তাঁদের পারস্পরিকতা :
আমি যে তোমায় জানি সে তো কেউ জানে না
তুমি মোর পানে চাও সে তো কেউ মানে না।
মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কত জনে কত করে পরিহাস
পাছে সে না পারে সহিতে
নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়
কেহ কিছু নারে কহিতে।
রবীন্দ্র-কাদম্বরীর পারস্পরিক মুগ্ধতার কথা যে গোপন থাকতে পারেনি, প্রেমকে যে লুকিয়ে রাখা যায় না, সে-কথা কতভাবে রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়ে গিয়েছেন।
গোপন কথাটি রবে না গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।
না না না, রবে না গোপনে।।
ওই তিনটি ‘না’ ধ্বনি, কিং লিয়ার-এর প্রান্তিক দৃশ্যে পাঁচটি ‘নেভার’-এর মতো, উঠে এসেছে জীবন- অভিজ্ঞতার বহ্নিত কোরক থেকে।
কিন্তু আরও এক গোপন কথা আছে রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্কের হৃদয়পুরে। এই কথাটির গূঢ় আত্মীয়তা একটি প্রশ্নের সঙ্গে : কেন রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী পরস্পরের এত কাছে এসেছিলেন? কেন তাঁরা দেওর-বউদির সম্পর্ক পেরিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন প্রেমের সম্পর্কে?
উত্তরটি ছোট কিন্তু তাৎপর্যে প্রসারী। কাদম্বরীর আর কোনও বন্ধু ছিল না ঠাকুরবাড়িতে। স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রও ছিলেন তাঁর থেকে আলোকবর্ষ দূরের মানুষ। ভাসুর সত্যেন্দ্রনাথ প্রায় করুণার চোখেই দেখতেন কাদম্বরীকে।
তিনি এবং তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী চেয়েছিলেন তাঁদের বিশেষ বন্ধু ডা. সূর্যকুমার চক্রবর্তীর বিলেতফেরত মেয়ের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে হোক। জ্যোতিরিন্দ্রকে মেয়েও দেখিয়ে ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। সে-বিয়ে হল না বলেই জ্ঞানদানন্দিনীর অহংয়ে লেগেছিল আঘাত। তিনিও অনুকম্পার চোখে দেখতে শুরু করেন কাদম্বরীকে। এবং দৃষ্টির সেই ভঙ্গিটি আভাসে-ইঙ্গিতে ক্রমশই তিনি নিজেই ছড়িয়েছিটিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ি জুড়ে।
কন্যা ইন্দিরার ভাষায় মা জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন ‘জবরদস্ত’ মহিলা। কড়া বুলির চড়া মেজাজের অহঙ্কারী জ্ঞানদা বিলেত থেকে ফিরে যে কিঞ্চিৎ ছড়ি ঘোরাবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী?
কাদম্বরীর বিরুদ্ধে তাঁর কটাক্ষ, টিপ্পুনি, সমালোচনা প্রভাবিত করেছিল অন্যদের। একমাত্র রবীন্দ্রকে ছুঁতে পারেনি সেই সংক্রমণ।
কেন কাদম্বরীর প্রতি চাপা অনুকম্পা মার্জিত অবহেলা? এ-প্রশ্নের উত্তর নিহিত কাদম্বরীর পশ্চাৎপটে।
এই শ্যামল মেয়ের জন্ম ১৮৫৯ সালের ৫ জুলাই। অর্থাৎ ঠাকুরপো রবির থেকে ঠিক বছর দেড়েকের বড় ছিলেন কাদম্বরী।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচ নম্বর ছেলে জ্যোতিরিন্দ্রের সঙ্গে বিয়ের আগে ঠাকুরবাড়িতে কাদম্বরীর পরিচয় ছিল, বাজার সরকার শ্যামলালের তিন নম্বর মেয়ে।
শ্যামলালের পরিবার বরাবরই ঠাকুরবাড়ির দয়াদাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করেছে। শ্যামলালের বাবা জগন্মোহন গঙ্গোপাধায় থাকতেন কলকাতার হাড়কাটা গলিতে। সেখানকার বাড়িটাও ঠাকুরবাড়ির দান।
এই দান কীভাবে কোন পথে এসেছিল, তা জানা দরকার ঠাকুরবাড়িতে কাদম্বরীর অবস্থান উপলব্ধি করতে। দানের প্রেক্ষিতটি কাদম্বরীর বাপ-ঠাকুরদার পক্ষে খুব যে সম্মানজনক ছিল না তা বলাই বাহুল্য।
কাদম্বরীর ঠাকুরদা জগন্মোহন বিয়ে করেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামাত বোন শিরোমণিকে। দ্বারকানাথের মামা অর্থাৎ শিরোমণির বাবার নাম ছিল কেনারাম রায়চৌধুরী। শিরোমণির বাড়ি ছিল হাড়কাটা গলিতে। বাড়িটা বাপ কেনারামের কাছ থেকে তিনি পাননি। পেয়েছিলেন কাকিমা রামপ্রিয়ার কাছ থেকে। কে এই রামপ্রিয়া?
আগেই বলেছি, এখানে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, তিনি দ্বারকানাথের ঠাকুরদা নীলমণি ঠাকুরের ভাই গোবিন্দরামের বউ। রামপ্রিয়া কেন হাড়কাটা গলিতে একটা বাড়ি দিতে গেলেন শিরোমণিকে?
কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। শুধু সন্তানস্নেহে বাড়িই দেননি শিরোমণিকে, গরিব জগন্মোহনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন রামপ্রিয়া।
জগন্মোহন হাড়কাটা গলিতে স্ত্রী শিরোমণির বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন। ঠাকুরবাড়ির সূত্রে পাওয়া বাড়িতে বসবাসকারী জগন্মোহন সম্পর্কে কোনওদিনই ঠাকুরপরিবারের সদস্যরা উঁচু ধারণা পোষণ করেননি।
‘আমার বাল্যকথা’-য় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জগমোহন’ সম্পর্কে যে-কথা অত্যন্ত ‘সুভদ্র’ ভঙ্গিতে লিখেছেন, তা থেকেই বোঝা যায় এহেন মানুষের নাতনি কাদম্বরীকে ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হিসেবে তিনি কোন চোখে দেখবেন : ‘তখন ১১ মাঘের উৎসব খুব ধুমধামে সম্পন্ন হত। ঐ উপলক্ষ্যে একবার একদল মিলে পলতার বাগানে গিয়ে বড়ই আমোদ আহ্লাদ করা গিয়েছিল ; সেদিনের ব্যাপার আমার বেশ মনে পড়ে। ভোজের কর্মকর্তা ছিলেন জগমোহন গাঙ্গুলী। লোকটি বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ,-তাঁর ভুঁড়িটিও অতুলনীয়। এমন সৌখীন আমুদে অথচ কর্মিষ্ঠ মানুষ আমি কখনো দেখিনি। খাওয়া-পরা- ওঠা-বসা, প্রত্যেক কাজে তাঁর কারিগরি প্রকাশ পেত। রান্নাবান্না ঘরকন্না- পোষাক সাজসজ্জা, কারুকার্য, ছুতরের কামারের কাজ- সকল কর্মেই তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমরা ছেলের দল তাঁর বড় নেওটা ছিলুম- তাঁর ঘরে গিয়ে খেলা করতুম ;-তাঁর মুখের পান কি মিষ্টি লাগত। তাঁর ভুঁড়িটি আমাদের আদরের সামগ্রী ছিল আর তিনি সকালে যে নাকডাকানী গম্ভীর আওয়াজে দিগ্বিদিক প্রতিধ্বনিত করতেন আমরা ভোরে উঠে তাই শুনতে যেতুম। তিনি একপ্রকার আমাদের বাড়ির দ্বারপাল ছিলেন।”
ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্যের দূরত্ব থেকে রচিত এই লেখার মধ্যে কৌতুক, হাস্যরস, মজা এ সব যাই থাক, নেই ছুতোর-কামারের-কাজ-জানা ‘জগমোহন’-এর প্রতি কোনও রকম শ্রদ্ধা।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম আই সি এস, কি কোনওদিন ভুলতে পেরেছিলেন তাঁর বিদগ্ধ, সুদর্শন ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির দায়োয়ান ‘জগমোহন’-এর নাতনি, বাজারসরকার শ্যামলালের মেয়ে?
এমনকী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঘরোয়া’ নামের স্মৃতিগ্রন্থে যেভাবে জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা লিখেছেন, তাতেও ফুটে উঠেছে ঠাকুরবাড়ির সম্পদ-আভিজাত্য-কৌলীন্য থেকে এই নিম্নবিত্ত মানুষটির দূরত্ব : ”জগমোহন গাঙ্গুলী মশায়ের ছিল রান্না আর খাবার শখ। পাকা রাঁধিয়ে ছিলেন, কি বিলিতি, কি দেশী। গায়ে যেমন ছিল অগাধ শক্তি, খাইয়েও তেমনি। ভালো রান্না আর ভালো খাওয়া নিয়েই থাকতেন তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যা ইস্তিক। অনেকগুলি বাটি ছিল তাঁর, সকাল হলেই তিনি এবাড়ি ওবাড়ি ঘরে ঘরে একটা করে বাটি পাঠিয়ে দিতেন। যার ঘরে যা ভাল রান্না হত, একটা তরকারি ওই বাটিতে করে আসত। সব ঘর থেকে যখন সব তরকারি এল তখন খোঁজ নিতেন, দেখ তো মেথরদের বাড়িতে কী রান্না হয়েছে আজ। সেখানে হয়তো কোনোদিন হাঁসের ডিমের ঝোল, কোনোদিন মাছের ঝোল- তাই খানিকটা এল বাটিতে করে। এই সব নিয়ে তিনি রোজ মধ্যাহ্নভোজনে বসতেন।”
অবনীন্দ্রনাথের মেজাজ আর সত্যেন্দ্রনাথের মেজাজে আকাশপাতাল তফাত। এ-লেখাটির মধ্যে জগন্মোহনের প্রতি কোনও বক্রোক্তি নেই। কিন্তু তেমন শ্রদ্ধাও যে আছে বলব না। বরং ফুটে উঠেছে জগন্মোহনের লোভ ও চেয়েচিন্তে খাওয়ার নিম্নবিত্ত মনোভাব, এমনকী গরিব মেথরদের বাড়ি থেকেও।
একটি কথা কিন্তু খুবই জরুরি। কথাটা হল, জগন্মোহনের রান্নার হাত ছিল দারুণ। তবে ভালো ভালো রান্না করার অবস্থা তাঁর ছিল বলে মনে হয় না। তিনি পরের বাড়ির রান্নাই বেশি খেতেন। বাবার কাছ থেকেই সম্ভবত রান্না শিখেছিলেন শ্যামলাল। শ্যামলালের রান্নার প্রশংসা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরা।
তখন গাজিপুরে কিছুদিন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও স্ত্রী মৃণালিনী। সেই সময়ে ইন্দিরা কিছুদিন থাকেন কাকা-কাকিমার সঙ্গে। কাদম্বরীর বাবা শ্যামলালও ছিলেন ওখানে। এবং রান্নাবান্নাও করতেন। ইন্দিরা তাঁর ‘ভ্রমণস্মৃতি’ প্রবন্ধে শ্যামলালের রান্না নিয়ে লিখেছেন, ”গাজিপুরে জ্যোতিকাকামশাইয়ের শ্বশুর শ্যামলাল গাঙ্গুলীও ছিলেন। মনে আছে তিনি বেগুন মুলো ও বড়ি দিয়ে গুড় অম্বল রেঁধে রান্নাঘরের তাকে তুলে রেখে কাশী বেড়াতে যেতেন এবং ফিরে এসে খেতেন। ততদিনে অম্বল পুরনো হয়ে বেশ সুন্দরভাবে মজে থাকত। সত্যি কথা বলতে কী, সে রকম সুস্বাদু গুড় অম্বল তার পরে আর কখনো খাইনি।”
নিঃসন্দেহে বাপ-ঠাকুরদার রান্নার হাত পেয়েছিলেন কাদম্বরী। এবং সেই রান্না খেয়ে ভুলে ছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ।
১৮৭৩-এর ৬ ফেব্রুয়ারি পইতে হয় রবীন্দ্রনাথের। তেরো বছরের কাদম্বরী প্রিয় দেওরটির জন্য তিন দিন হবিষ্যান্ন রেঁধেছিলেন। সেই রান্নার স্বাদ রবীন্দ্রনাথ ভোলেননি কোনওদিন, ”মনে পড়ে বৌঠাকরুণ আমাদের দুই ভাইয়ের (রবীন্দ্রনাথের ঠিক ওপরের ভাই সোমেন্দ্রনাথেরও পইতে হয় একই দিনে) হবিষ্যান্ন রেঁধে দিতেন, তাতে পড়ত গাওয়া ঘি। ঐ তিন দিন তার স্বাদে, গন্ধে মুগ্ধ করে রেখেছিল লোভীদের।”
জ্যোতিরিন্দ্র কোনওদিন স্ত্রী কাদম্বরীর হাতের রান্না তেমনভাবে পছন্দ করেছিলেন বলে মনে হয় না। না করাটাই স্বাভাবিক।
ক্রমশ তিনি ঢলে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীর সাহেবিপনার দিকে।
জ্ঞানদানন্দিনী তখনকার দিনে একা বিলেত ঘুরে আসা মেয়ে। তাঁর হাবভাব চালচলন সবই ছিল পশ্চিমাস্য। তার পাশে কালো মেয়ে কাদম্বরীকে নেহাত আটপৌরে, বর্ণহীন মনে হওয়ারই কথা। এহেন স্ত্রীর রান্না মনে ধরবে কেন? বিশেষ করে জ্ঞানদানন্দিনীর উড স্ট্রিটের বাড়ির সাহেবি বৈভব এবং ‘স্বাদ’-আহ্লাদের পরে?
শ্যামলালও যে বেশিদিন ঠাকুরবাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শ্বশুর হিসেবে থাকতে পেরেছেন, তা-ও নয়। তাঁকে বিদায় করা হয়েছিল গাজিপুরের বাড়িতেই। কুড়ি টাকা মাসোহারায়। অথচ ঠাকুরবাড়িতেই তো তাঁর কেটেছিল অর্ধেক জীবন।
তাঁর মা শিরোমণি রবীন্দ্রনাথকে বিয়ের সময় বরণ করেছিলেন। শ্যামলালও তো এক অর্থে ঠাকুরবাড়িরই ছেলে। কিন্তু কোনও দিন তাঁকে জাতে উঠতে দেওয়া হয়নি। চিরদিনই তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোর বারবাড়ির সামান্য কর্মচারী।
আর কাদম্বরী? তাঁর জন্ম কোথায়? শ্যামলালদের হাড়কাটা গলির বাড়িতে? নাকি, ঠাকুরবাড়িতেই? কারণ হাড়কাটা গলির পাততাড়ি গুটিয়ে স্থায়িভাবে সেখানেই তো চলে আসেন কাদম্বরীর ঠাকুরদা জগন্মোহন।
ঠাকুরবাড়িতে কাদম্বরীর জন্ম হোক-না-হোক, তিনিও ছিলেন ঠাকুরপরিবারের মেয়ে! এবং এক হিসেবে দূর আত্মীয়ার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের- যে-আত্মীয়া তাঁর জীবনের প্রথম ন বছর কাটিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়ে হয়েও, বাজার সরকারের মেয়ে পরিচয়ে, বারবাড়িতে!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে বিয়ে করার পরেই তাঁর স্থান হয়েছিল অন্দরমহলে। নিতান্ত সামান্য অবস্থার মধ্যে যে বারবাড়িতে কেটেছিল কাদম্বরীর শৈশব সেখানে পৌঁছত না ঠাকুরবাড়ির বৈভব ও সংস্কৃতির কোনও শীর্ণ শাখাও। ফরমাশখাটা বাজার সরকারের শীর্ণ কালো মেয়েটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাও হয়নি, জ্যোতিদাদার সঙ্গে তার হঠাৎ বিয়ের আগে।
১৮৬৮-র ৫ জুলাই ন বছরের কাদম্বরীর বিয়ে হল উনিশ বছরের শিক্ষিত সুদর্শন যুবক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। এইবার শুরু হল বাজার সরকারের মেয়েকে মাজাঘষার পালা। কাদম্বরীর জন্য কেনা হল প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, ধারাপাত।
কাদম্বরী ঢুকে গেলেন ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। আর বাবা শ্যামলাল পড়ে রইলেন বারবাড়ির খাটাখাটুনি নিয়ে, স্বল্প মাসোহারায়।
শ্যামলালের খাটুনির দুটি পরিচয় দিচ্ছি এখানে। ১৮৭৪-এর ১৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরবাড়ির সামনের বাগানে গোল পাঁচিল দেওয়ার, বাগানের ভিতরে বেড়াবার পথ তৈরি করার এবং আস্তাবলের সামনে পাঁচিল দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে শ্যামলালের উপর। এই কাজের জন্য তাঁকে দেওয়া হয় ১০০ টাকা আগাম।
পাঁচিল দেওয়ার কাজ থেকে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদাদেবীর বিছানা ‘দুরস্ত’ করার দায়িত্ব, সবই পড়ত শ্যামলালের ঘাড়ে। কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির বউ হলেন বটে, শ্যামলাল কিন্তু ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারই থেকে গেলেন। বাজার সরকারের মেয়ে, এই পরিচয় থেকে কাদম্বরী সম্পূর্ণ মুক্তি পাননি কোনওদিনই।
স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর, ঠাকুরবাড়ির বেয়াই, এই সামাজিক পদেও কোনওদিন আরোহী হতে পারেননি বাজার সরকার শ্যামলাল। বাবা শ্যামলাল, মেয়ে কাদম্বরীর অবস্থান ঠাকুরবাড়িতে ঠিক কেমন ছিল তার একটি প্রমাণ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি।
জ্যোতিরিন্দ্রের সঙ্গে কাদম্বরীর বিয়ের ঠিক হয়েছে শুনে স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে ১৮৬৮-র ৮ জুন সত্যেন্দ্রনাথ লিখলেন, ”শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮ বৎসরের মেয়ে। আমি যদি নতুন (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ডাক নাম) হইতাম, তবে কখনোই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না।”
শ্যামলালকে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কী চোখে দেখতেন তার কিছু ধারণা হয় আর একটি চিঠি থেকে, ”শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার কখনোই মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে- কোনো অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।”
বোঝাই যায় বাজার সরকার শ্যামলালকে ভাল চোখে দেখতেন না সত্যেন্দ্রনাথ। মানুষ হিসেবে শ্যামলাল যে ভাল ছিলেন না, এমন ধারণাই পোষণ করতেন তিনি। শ্যামলাল ভাল মানুষ নয়। অতএব তার মেয়েটিও সুবিধের হবে না, এ-বিষয়ে কত্তাগিন্নি, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী এক মতই পোষণ করতেন।
এহেন ধারণার বশবর্তী হয়েই কাদম্বরীকে ‘জা’ হিসেবে কোনওদিনই মেনে নেননি জ্ঞানদানন্দিনী। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ কথা লিখতে দ্বিধা করেননি যে, কাদম্বরীর আত্মহননের একটি মূল কারণ তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মহলের ব্যবহার।
ক্রমশই যেন কাদম্বরী ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন অন্দরপুরে। এবং তাঁর প্রতি যাঁর বিরাগ ছিল সব থেকে বেশি তিনি ‘জবরদস্ত’ জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি কাদম্বরীকে ‘গরিবের মেয়ে’ এবং ‘বন্ধ্যা’ বলে যে খোঁটা দিতেন এমন ভাবাটা খুব ভুল হবে না।
রবীন্দ্রের সঙ্গে কাদম্বরীর ঘনিষ্ঠতাও তিনি নিশ্চয় ভালভাবে নেননি। পাছে কাদম্বরীর সঙ্গে ঘর করতে হয়, তিনি থাকতেন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। তারপর উড স্ট্রিটে। কাদম্বরীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রের স্ত্রী মৃণালিনীকে ‘মানুষ’ করার জন্য তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ফিরে আসেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে জ্ঞানদানন্দিনীই ধীরে ধীরে কাদম্বরীর কাছ থেকে সরিয়ে নেন। জ্যোতিরিন্দ্র সময় কাটাতেন বিলেতের আলোক প্রাপ্তা পশ্চিমাস্যা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গেই।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করলেন জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি প্রথমে থাকতেন ১০ উড স্ট্রিটে। এ বাড়িটাকেই বির্জিততলার বাড়ি বলা হত। সেখান থেকে উঠে যান ৫০ পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে।
কাদম্বরীকে অবহেলা করে বির্জিততলার বাড়িতেই বহু সময় কাটাতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। সেখানেই চলত গানবাজনা আড্ডা। ক্রমশ নিভে গেল ঠাকুরবাড়ির ছাদ-বারান্দার মজলিশ।
জ্ঞানদানন্দিনীর অভিজাত প্রভাবের মধ্যে ক্রমশই আটকে গেলেন জ্যোতিরিন্দ্র। বাড়ি ফিরতে ভুলে যেতেন। এমনকী কাদম্বরীর জন্মদিনেও।
জ্যোতিরিন্দ্র-কাদম্বরীর মধ্যে বিভেদরেখাটি ক্রমেই আরও স্পষ্ট হল। স্বামী-স্ত্রী হয়েও ওঁদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা বুঝতে কারও বাকি রইল না।
কাদম্বরীর সেই অপমান ও একাকিত্বের মধ্যে কেউ পাশে এসে দাঁড়াননি। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। ঠাকুরবাড়ির মার্জিত ব্যবহার, শিল্পিত জীবনের অন্তরালে এই ছিল আসল মুখ।
ঠাকুরবাড়ির মুখ ও মুখোশের পরিচয় পাওয়া যায় নীচের তলার অবস্থার মধ্যে।
সেই নীচ-তলার ঠাকুরবাড়ি নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই, ”ছেলেবেলা থেকে আমাদের বাড়িতে দেখেছি, নিঃসহায় অনাথা আশ্রয় পেয়েছে। প্রকাণ্ড বাড়িটি তাদের বসবাসে একেবারে পায়রার খোপের মতো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিবাসিনীদের অবস্থা তখন অতি শোচনীয় ছিল। তাদের অশিক্ষিত মন আত্মাবমাননাতে পূর্ণ হয়ে থাকত। তারা কখনো আত্মমর্যাদা অনুভব করতে পারেনি। তখনকার দিনে দেশের অন্যান্য মেয়েদের মতো অভ্যস্ত অজ্ঞানতা ও অন্ধকারের মধ্যে তার জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা পরস্পরে ঈর্ষা করেছে, নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির দ্বারা যত রকম কুচিন্তার প্রশ্রয় দিয়েছে। মানুষের জগতে তাদের স্থান কত তলায়, তা বোধ করিবার শক্তি তাদের ছিল না।…বাড়ির আবহাওয়া একেবারে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল।”
মনে রাখতে হবে শ্যামলাল এবং তাঁর মেয়ে কাদম্বরী ছিলেন এই বিষাক্ত নীচতলার বাসিন্দা।
গগনেন্দ্রনাথের কন্যা পূর্ণিমা চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনাতেও ঠাকুরবাড়ির নীচের তলার পরিচয় পাওয়া যায়। পূর্ণিমা জানাচ্ছেন, ”আরও চারজন সরকার ছিল, তারা যশোরের আত্মীয়। নাম ছিল, জ্যোতি, গুপি, পচা ও পুঁটে, চার ভাই। আমরা কাকা বলে ডাকতুম। জ্যোতিকাকা বাজার করত, গুপিকাকা দুধ দোহাত, পচাকাকা ও পুঁটেকাকা ফাই-ফরমাশ খাটত, ছেলেদের সঙ্গে খোশগল্প করত।”
কাদম্বরীর শৈশব কী অবস্থার মধ্যে, কেমন পারিবারিক অবহেলা ও অপমানের মধ্যে কেটেছিল, কিছুটা আন্দাজ করা যায় এই বর্ণনা থেকে।
কাদম্বরীর প্রতি ঠাকুরবাড়ির এই অবহেলা, চাপা ঘেন্নার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
পৃথিবীর আর কোনও রবীন্দ্রমাত্রার কবি শুধুমাত্র একটি মেয়ের প্রতি এতভাবে, এমন আভাসে-ইশারায় -দ্যোতনায় প্রেম নিবেদন করেননি, যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, বউদি কাদম্বরীকে।
বিয়েত্রিচের দান্তে, ডার্ক লেডির শেক্সপিয়র, ফ্যানি ব্রন-এর কিটস, মড গন-এর ইয়েটস, কেউ নন। জান দ্যুভাল-এর শার্ল বোদলেয়র? তিনিও নন। একটিমাত্র মেয়েকে আজীবন কবিতায় গানে, গল্পে, ছবিতে চিঠিপত্রে, স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রতুল্য প্রেমনিবেদনে আর কেউ নেই ধরাতলে।
যতদিন বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা, ততদিন থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। আর যতদিন থাকবেন রবীন্দ্রনাথ, ততদিন বেঁচে থাকবেন ঠাকুরবাড়ির বাজারসরকারের কালো মেয়ে। রবীন্দ্রের চিরন্তনী হয়ে।
এক অপমানিত, অবহেলিত আত্মীয়াকে ভালোবেসে তাঁকেই নিয়ে এমন অনন্য প্রণয়গীতি, কাব্য, সাহিত্য রচনার নজির এ-ভুবনে আর একটিও নেই।
বউঠাকরুণের আপন হাতের দোলা পৌঁছেছিল আরও অনেক প্রণয় ও বিচ্ছেদ অতিক্রান্ত রবীন্দ্রের প্রান্তিক জীবনেও।
১৮৬৮-র ৫ জুলাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বিয়ে হল কাদম্বরীর। দেবেন্দ্রনাথের আজ্ঞাতেই এই অসম বিয়ে।
দেবেন্দ্রনাথ এক রকম সামাজিক চাপে পড়েই বাজার সরকারের মেয়ের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সামাজিক চাপের মূল কারণ দুটি।
এক, দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম। তিনি শালগ্রামশিলা মানেন না। সুতরাং তাঁর ঘরে মেয়ে দেবে কোন ব্রাহ্মণ পরিবার? দুই, তিনি মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্কদুষ্ট পিরালি ব্রাহ্মণ। সে তো গোদের ওপর বিষফোঁড়া।
পিরালি ব্রাহ্মণ ব্যাপারটা যে ঠিক কী, আগে বলেছি। এখানে আরও একটু ব্যাখ্যা করলে মন্দ হয় না।
যশোর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগনার গুড়বংশজাত জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার ছেলে, কামদেব, জয়দেব, রতিদেব, শুকদেবের মধ্যে প্রথম দুজন পির আলি নামের এক মুসলমানের ফন্দিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এবং এঁদের কাছের মানুষ হিসেবে অন্য দুই ভাই পিরালি ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত ও ব্রাত্য হয়ে যান।
‘মুসলমানদুষ্ট’ ব্রাত্য ব্রাহ্মণ সেই থেকে পিরালি ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত।
দেবেন্দ্রনাথের পরিবারও এই সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ। তাই একঘরে করা হয়েছিল। এই জন্যেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও পিরালি ব্রাহ্মণ যশোরের অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনীকে বিয়ে করতে হয়, তাঁর পক্ষেও কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করা সম্ভব হয়নি।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচ জামাইয়ের মধ্যে চার জামাই এই কারণেই ঘরজামাই ছিলেন। নিজেদের বাড়িতে তাঁদের আর স্থান হয়নি এবং এই কারণেই দেবেন্দ্রনাথের ঘরে কোনও কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবার মেয়ে দিতে চাইত না।
শ্যামলালের মেয়েকে জ্যোতিরিন্দ্রের পাত্রী হিসেবে পাওয়া যেতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ”জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এইই ভাগ্য। একে তো পিরালি বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদিগের সঙ্গে বিবাহেতে যোগ দেয় না, তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্ম-অনুষ্ঠান জন্য পিরালিরা আমাদিগকে ভয় করে।”
যাই হোক, দেবেন্দ্রনাথের চাপে জ্যোতিরিন্দ্র যখন বিয়ে করলেন, তখন তিনি ১৯, কাদম্বরী ৯, রবীন্দ্রনাথ ৭। ন বছরের সেই বউদিটির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার অলীক অভিজ্ঞতাকে কোনওদিনই ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ : ”একদিন বাজল সানাই বারোয়াঁ সুরে। বাড়িতে এল নতুন বউ, কচি শ্যামল হাতে সরু সোনার চুড়ি। পলক ফেলতেই ফাঁক হয়ে গেল বেড়া, দেখা দিল চেনাশোনার বাহির সীমানা থেকে মায়াবী দেশের নতুন মানুষ। দূরে দূরে ঘুরে বেড়াই, সাহস হয় না কাছে আসতে।…হঠাৎ দূর পাহাড় থেকে বর্ষার জল নেমে সাবেক বাঁধের তলা খইয়ে দেয়, এবার তাই ঘটল।” বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিই তাঁর জীবনের প্রথম ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।
ভালোবাসায় পড়ল বালক রবি। ইস্কুল থেকে ফিরে ছোট্ট বউদিটিকে না দেখতে পেলে কী যে অভিমান এই বালকের, ”মাঝে মাঝে যখন আত্মীয়বাড়িতে যেতেন, ঘরের সামনে তাঁর চটি জুতোজোড়া দেখতে পেতুম না, তখন রাগ করে ঘরের থেকে একটা কোনও দামি জিনিস লুকিয়ে রেখে ঝগড়ার পত্তন করতুম। বলতে হত, ”তুমি গেলে তোমার ঘর সামলাবে কে? আমি কি চৌকিদার?”
তিনি রাগ দেখিয়ে বলতেন, ”তোমাকে আর ঘর সামলাতে হবে না, নিজের হাত সামলিও।”
এমন কথা শোনার লোভ, এই সব ছোট-ছোট মিষ্টি ফ্লার্টিং, গভীরতর প্রণয় ও বোঝাপড়ার এমত প্রাথমিক সঙ্কেত, এ সব কিছুর আকর্ষণ বালক রবীন্দ্রের পক্ষে ছিল দুর্নিবার।
বালকটির শরীর-মনের মধ্যে যে ক্রমিক জাগরণ ঘটছিল, তা উসকে দিয়েছিলেন দু-বছরের বড় কাদম্বরী। কাদম্বরীই রবীন্দ্রের জীবনে প্রথম নারী যিনি ঘটিয়েছিলেন সেই মুগ্ধ রসায়ন, যার থেকে রবীন্দ্রনাথ আজীবন বেরিয়ে আসতে পারেননি।
কাদম্বরীকে ছেড়ে থাকতে সত্যিই কষ্ট পেতেন রবীন্দ্রনাথ। একবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বেড়াতে গেলেন কাদম্বরী। দেওরটিকে সঙ্গে নিলেন না। বউদির বিরহে দেওরের কবিতা :
চলে গেল, আর কিছু নাহি কহিবার।
চলে গেল, আর কিছু নাহি গাহিবার।
শুধু গাহিতেছে আর শুধু বলিতেছে,
‘চলে গেল সকলেই, চলে গেল সকলেই গো,
বুক শুধু ভেঙে গেল, চলে গেল গো।’
আর রবীন্দ্রনাথ চোখের আড়াল হলে কেমন লাগত কাদম্বরীর, কতখানি কষ্ট পেতেন তিনি?
তাঁর তো কোনও লেখা নেই, চিঠি নেই যে দেওরের বিরহে তাঁর মনের কথা জানব। কিন্তু কাদম্বরীর সমস্ত জীবন এবং আত্মহনন-ই তো একটি গূঢ় পত্র, প্রিয় ঠাকুরপো রবীন্দ্রনাথের প্রতি।
১৮৮০ সালে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা উঠল। সেই বছরেই বিলেত থেকে ফিরেছেন তিনি। প্রিয় ঠাকুরপোকে ছেড়ে থাকার কষ্ট পেয়েছেন কাদম্বরী। আবার চলে যেতে হবে রবীন্দ্রকে? আবার বিচ্ছেদ? একাকিত্ব? ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলে আবার বেদনাময় বন্ধুহীন নির্বাসন? মনের কষ্টের কথা জানাবার একমাত্র মানুষটিকে আবার দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
রবীন্দ্রনাথ তখন উনিশ। কাদম্বরী একুশ। কিছুতেই প্রিয় রবিকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা আরও একবার সহ্য করার শক্তি খুঁজে পাননি কাদম্বরী। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন- সেটাই প্রথম চেষ্টা।
ততদিনে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে বারো বছরের বিবাহিত জীবনে ক্লান্ত, স্বপ্নচ্যুত, আর্ত কাদম্বরী। নিরাসক্ত স্বামী নিয়ে নিঃসন্তান জীবন কাটাতে কাটাতে বন্ধ্যাত্বের দায় মাথা পেতে নিয়েছেন তিনি।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ততদিনে জড়িয়ে পড়েছেন থিয়েটার পাড়ার নটীদের সঙ্গে। কারও নাম বিনোদিনী। কেউ বা গোলাপ সুন্দরী। কখনও বাড়ি ফেরেন, কখনও ফেরেন না।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল কাদম্বরীকেই দায়ী করে বন্ধ্যাত্বের জন্যও যেমন, তেমনই জ্যোতির নটী-প্রবণতার জন্যও।
দেওর রবিই তখন কাদম্বরীর একমাত্র সখা। এই তো সবে বিলেত থেকে ফিরেছে। আবার চলে যাবে ভালবাসার পুরুষ? রবিকে ছেড়ে তিনি থাকবেন কী করে ঠাকুরবাড়ির নির্মম পরিবেশে? বাঁচতে চাননি তিনি। তবু বাঁচতে হয়েছিল।
প্রাসঙ্গিকভাবেই এবার এমন একটি বিষয়ে ঢুকতে চলেছি যেখানে দেবদূতেও পা ফেলতে ভয় পাবেন। কারণ, ঠাকুর পরিবারকে sacrosanct বা প্রশ্নাতীতভাবে সব সন্দেহ, অভিযোগ, শাস্তির ঊর্ধ্বে অলঙ্ঘনীয়ভাবে ধর্মাশ্রিত-এইভাবেই ভাবতে ভারী আরাম পায় আমাদের মনপ্রাণ, এ-যুগেও।
কথাটা হল, কাদম্বরীকে আরও কয়েক বছর বাঁচতে হয়েছিল ‘বন্ধ্যা’ এবং অন্যান্য ‘আরও’ বদনাম ঘাড়ে নিয়ে। অহরহ তাঁকে শুনতে হত গঞ্জনা ঠাকুরবাড়ির ‘কুটনীতিজটিল শিথিলরসনা’ মেয়েমহলে।
সেই পুরুষশাসিত সমাজে নিঃসন্তান কাদম্বরীর ‘বাঁজা’-ব্রাত্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কীই বা উপায় ছিল? ঠাকুরবাড়িতে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ অনুভব করতে পেরেছিলেন এই ভালোবাসার মেয়েটির দহন। এবং তাঁর আত্মহত্যার পরে লিখেও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘আমি জানি, আত্মহত্যার কারণ জিজ্ঞেসা করলে কী সে কহিত, কী তাকে দহিত!’
কী বলতেন কাদম্বরী? কাছের মানুষ, বিপুল প্রতিভাবান দুর্বার দেওরটিকে মনের কথা কি তিনি কিছু-ই জানিয়ে যাননি?
কাদম্বরী জানতেন, রবীন্দ্রনাথ সত্যিই বেপরোয়াভাবেই তাঁর প্রেমে পড়েছেন। এবং কাদম্বরীও না সাড়া দিয়ে পারেননি। এতটাই ভাবতে পারি আমরা।
এই ভাবনার সঙ্গে মেশাতে হবে এই অনুভব যে, কাদম্বরী এ কথাও অসহায়ভাবে মানতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, এই প্রণয় শেষ হবে বিফল যন্ত্রণাতে, কোথাও পৌঁছবে না।
রবীন্দ্রের ধারণা ছিল নিশ্চয় অন্যরকম। একমাত্র তিনিই জানতেন কাদম্বরীর প্রতি তাঁর গভীর প্রণয় উত্তীর্ণ হবে কালজয়ী গানে-কবিতায়-গল্পে-ছবিতে।
কী ছিল কাদম্বরীর গভীর ব্যথা, যা জন্য তাঁর আত্মহনন? হয়তো জানতেন রবীন্দ্রনাথ- সেই কারণ, একাকিত্ব, অপমান, পারিবারিক পীড়ন, প্রণয়দহন।
প্রাচীনকালের পুরুষশাসন ও তঞ্চকতা থেকে বেরিয়ে এসে এ-যুগে আমরা কাদম্বরীকে অন্তত বেনিফিট অব দ্য ডাউট বা সন্দেহাবসরটুকু তো দিতে পারি।
কাদম্বরীর যে সন্তান হল না, তার সন্দেহাতীত দায় কি তাঁরই উপর বর্তাতে পারে, কোনও ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই?
এমন কোনও পরীক্ষার প্রমাণ ছাড়া সন্তানহীনতার দায়কে কি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করা খুব অন্যায় হবে?
তিরের মুখ ঘুরে যেতে পারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দিকেও, এমন সম্ভাবনাকে কি সত্যিই উড়িয়ে দেওয়া যায়?
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতা, আরও একটি ছোটগল্প ‘মানভঞ্জন’-এর গিরিবালা (যার স্বামী নটী লবঙ্গ-র প্রেমে পাগল), উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে’-র বিমলা, সবাই নিঃসন্তান।
এই সন্তানহীনতার দায়িত্ব সন্দেহাতীতভাবে তিন নারীর উপর চাপিয়ে দেননি রবীন্দ্রনাথ। বরং ভূপতি, নিখিলেশ এবং গোপীনাথ, যথাক্রমে চারুলতা, বিমলা, গিরিবালার স্বামীকে আভাসে-ইঙ্গিতে এমনভাবে গড়েছেন তিনি যে মনে হয়, তাঁরা বড় বেশি ‘ঠান্ডা’ তাঁদের দাম্পত্য জীবনে। অস্বাভাবিক শৈত্যে ভুগছেন। এবং সেই কারণেই ‘নষ্টনীড়’-এর অমল, ‘ঘরে বাইরে’-র সন্দীপ বিপ্রতীপ তাপে এমন লোভনীয়।
দাম্পত্য শৈত্য থেকে অন্য পুরুষের লোভনীয় উষ্ণতার ডাকেই ভাঙছে চারু এবং বিমলার বিয়ে। জ্যোতিরিন্দ্র-কাদম্বরী-রবীন্দ্র, এই ত্রিভুজ-সম্পর্কের জটিল প্রসঙ্গে এই দুই কাহিনির তাৎপর্য কম নয় কিন্তু। তুল্য তাৎপর্যের দেখা পাই আমরা ‘মানভঞ্জন’ গল্পে গোপীনাথের নটীমুগ্ধতার ইঙ্গিতে।
১৮৭৮-এ বিলেত যান সতেরো বছরের রবীন্দ্রনাথ। উনিশ বছরের বউদিটিকে পিছনে ফেলে তাঁর পরদেশে পাড়ি।
কাদম্বরীকে চিঠি লেখেননি রবীন্দ্রনাথ? লিখেছেন, অবশ্যই, সঙ্কেতধর্মী অনেক চিঠি। সেই সব চিঠিই ‘ভারতী’ পত্রিকায় য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রবিরহে ১৮৭৮ থেকে ১৮৮০ সাল কীভাবে কেটেছিল কাদম্বরীর? দেবেন্দ্রনাথের নবম সন্তান, রবীন্দ্রনাথের ন দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে ঊর্মিলাকে সর্বস্ব করে বিশ বছরের নিঃসন্তান কাদম্বরী কাটাচ্ছিলেন তাঁর একা জীবন।
ঊর্মিলার দিদি সরলাদেবী লিখেছেন, ”ঊর্মিলা ছিল নতুন মামীর আদুরে। তিনিই তাকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। তাঁর সঙ্গে সে বাইরের তেতলাতেই থাকত, আমাদের তিনজনের সঙ্গে বাড়ির ভিতরে নয়। নিঃসন্তান নতুন মামীরই মেয়ে যেন সে।”
১৮৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাদম্বরীর ছাদের ঘর থেকে লোহার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পড়ে গেল ঊর্মিলা। মাথায় আঘাত। তাকে বাঁচানো গেল না।
কাদম্বরীর সেই নিঃসঙ্গতাকে ঠাকুরবাড়ির একজনই উপলব্ধি করেছিলেন। সেই জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ- ”তাঁহার সমস্ত ঘরকন্না, তাঁহার সমস্ত কর্তব্যের অন্তঃস্তরের তলদেশে সুড়ঙ্গ খনন করিয়া সেই নিরালোকে নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে অশ্রুমালাসজ্জিত একটি গোপন শোকের মন্দির নির্মাণ করিয়া রাখিলেন, সেখানে তাঁহার স্বামী বা পৃথিবীর আর কাহারও কোনও অধিকার রহিল না।”
বউদির কথা বলতে গিয়ে অন্ধকারের গ্রিক দেবী রহস্যময়ী হেকেটির কথাই ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং প্রিয় জ্যোতিদাদাকেও তাঁর কটাক্ষ থেকে রেহাই দেননি।
রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফেরার পরেই বিরহের অবসানে যেন জোয়ার এল কাদম্বরীর নিঃসঙ্গ জীবনে। যে-কাদম্বরীকে ফেলে গিয়েছিলেন তিনি আর যাঁর কাছে দেড় বছর পর ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁরা যেন দুই আলাদা মেয়ে।
কাদম্বরী যেন রবীন্দ্রনাথের ফিরে আসার জন্যই পথ চেয়ে বসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ক্রমশই বুঝতে পারলেন, দেড় বছরে কত বদলে গিয়েছে তাঁর বউদিটি, ঠাকুরবাড়ির আর কারও মতোই নন তিনি, ব্যবহারে, সংলাপে, ভাবনায়। কাজে বা অবসরে, একেবারেই আলাদা।
রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর মনের কথা- ”যৌবনের আরম্ভ সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এলাম। সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিণে বাতাস, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে চারদিক থেকে প্রসারিত সহস্র বন্ধন।”
আর সেই বউদি? তাঁর কথা ইঙ্গিতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ : ”নাগপাশের দ্বারা জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে আছি।” এই বউদির উদ্দেশেই তো লেখা যায় :
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে।।
পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ান-
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।।
এই বউদিকেই তো উৎসর্গ করা যায় একের পর এক বই। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর উৎসর্গে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘তোমাকে দিলাম’। শৈশবসঙ্গীত’-এর উৎসর্গ -‘তোমাকেই দিলাম’। ‘ভানুসিংহের পদাবলী’-র উৎসর্গে চিরবিচ্ছেদের ব্যথা- ‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি। আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।’ ছ বছর পরে ‘মানসী’-ও দিলেন কাদম্বরীকেই- ‘সেই আনন্দ মুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি/সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।’ আরও পাঁচ বছর পরে ‘চৈতালী’-ও সেই প্রিয় বউদিকেই :
সুখাবেশে বসি লতামূলে
সারাবেলা অলস অঙ্গুলে
বৃথা কাজে যেন অন্যমনে
খেলাচ্ছলে লহ তুলি তুলি।
তব ওষ্ঠ দশনদংশনে
টুটে যাক পূর্ণফলগুলি।
শেষ দুটি লাইনের শরীরী সঙ্কেত কাদম্বরীর প্রতি! আট বছর পরে কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গে আবারও বউদিকেই স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ- ‘কোমল তব কমল করে, পরশ করো পরাণ-পরে,’।
প্রিয় নতুন বউঠান ছাড়া এতগুলি বই আর কাউকে উৎসর্গ করেননি তিনি। কোনও নতুন লেখা শেষ হলেই বা কোনও নতুন বই প্রকাশকালে বউদির কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের আজীবন।
কেন, সে-উত্তরও তিনিই দিয়েছেন : ”বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকে শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই, মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়বেই।”
বউদিকে নিয়ে এই ‘অবসেশন’, এই নতুন-বউঠাকরুণ -আবিষ্টতা কোনও দিনই কাটিয়ে উঠতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ।
বিলেত থেকে ফিরেই নতুন বউঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির ছাদে বাগান করলেন রবীন্দ্র। নাম দিলেন নন্দনকানন। কাদম্বরী তাঁর অসহায় একাকিত্ব এবং ঠাকুরবাড়ির নানা অপমান থেকে মুক্তির একটিই পথ খুঁজে পেলেন। সে-পথ তাঁর প্রিয় দেওর রবি। রবি ছাড়া আর কোনও পুরুষ ছিল না কাদম্বরীর জীবনে যিনি তাঁর মনের খোঁজ রাখতেন।
কাদম্বরী আর রবীন্দ্রনাথ বিকেল আর সন্ধে কাটাতেন ঠাকুরবাড়ির ছাদের নন্দনকাননে। নন্দনকাননেই কাদম্বরীর সঙ্গে আর গাঢ় হল রবীন্দ্রের সম্পর্ক।
”দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রূপোর রেকাবিতে বেলফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে এক গ্লাস বরফ দেওয়া জল, আর বাটিতে ছাঁচি পান। বউঠাকরুণ গা-ধুয়ে চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন।…সূর্যডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত আমার গান। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে। তার পর তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে।”
এহেন বউদিটি রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনটাকেই আচ্ছন্ন করেছিলেন। এবং সেই ‘অবসেশন’-এর কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন কোনওরকম আড়ালের আশ্রয়ে না গিয়ে, ”আমার যে গেছে সে আমাকে কতদিন হইতে জানিত, আমাকে কত প্রভাতে কত দ্বিপ্রহরে, কত সন্ধ্যাবেলায় সে দেখিয়াছে। কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি তার কাছে ছিলাম। সে আমাকে কত স্নেহ করিয়াছে, আমাকে কত শতসহস্র ঘটনার মধ্যে খুব কাছে থাকিয়া দেখিয়াছে। যে-আমাকে সে জানিত, সে সেই সতেরো বৎসরের খেলাধূলা, সতেরো বৎসরের সুখদুঃখ, সতেরো বৎসরের বসন্ত-বর্ষা। সে আমাকে যখন ডাকিত, তখন আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশই, আমার সতেরো বৎসর, তাহার সমস্ত খেলাধূলা লইয়া তাহাকে সাড়া দিত।”
সন্দেহ নেই, অনেক গানই ছিল নিশ্চয় বউদিটিকে নিয়ে লেখা, বউদিরই উদ্দেশে নিবেদিত, যাদের মর্মার্থ বুঝতেন শুধুই কাদম্বরী, যাদের ইশারা ছুঁয়ে যেত তাঁরই হৃদয়।
কাদম্বরীর মৃত্যুর অনেক বছর পরে বউদিকে গান শোনানোর স্মৃতিচারণায় কী গভীর বেদনা ও বিষাদ রবীন্দ্রনাথের: ”হে জগতের বিস্তৃত, আমার চিরস্মৃত, আগে তোমাকে যেমন গান শুনাইতাম, এখন তোমাকে তেমন শুনাতে পারি না কেন? এ সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে-চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে, তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পারো, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না! যেসব লেখা তুমি এত ভালোবাসিয়া শুনিতে, তোমার সঙ্গেই যাহাদের বিশেষ যোগ, একটু আড়াল হইয়াছে বলিয়াই তোমার সঙ্গে আর কি তাহাদের কোনও সম্বন্ধ নাই?”
মৃত বউদির কাছে এই আর্ত অসহায় প্রশ্ন এক ভুবনখ্যাত দেওরের! এই উদ্ধৃতি থেকে যা সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে আসে তা হল কাদম্বরীর প্রতি রবীন্দ্রের প্রবল প্যাশন।
তাড়না এবং যন্ত্রণা-এই উভয় অর্থেই ‘প্যাশন’ এখানে উপস্থিত, নির্ভুল উচ্চারণে। এ-কথা জানাতে এতটুকু আড়াল টানেননি রবি ঠাকুর, তাঁর পরিবারের রক্ষণশীলতা এবং শাসনের কথা ভেবেও, যে তিনি কাদম্বরীকে শোনবার জন্যই লিখেছেন ভালোবাসার গান, বসিয়েছেন সুর, তাঁরই জন্য গেয়েছেন প্রাণের কথা। কাদম্বরী পৃথিবীতে নেই, তবু তাঁরই জন্য এখনও তিনি গান বাঁধেন, সুর দেন, গান করেন এই আশায় যে কাদম্বরী যেখানেই থাকুন, সেই গান তাঁর কাছে পৌঁছয়।
রবীন্দ্রের প্রেমভাবনা ও প্রণয়লিখনের সঙ্গে যে কাদম্বরী ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন, সে-কথাও কত সহজে স্বীকৃত! প্রণয়সাহিত্যে এমন দুর্নিবার প্যাশন ও অবসেশন বিশেষ দেখা যায় না, দেখা যায় না এক নিকট আত্মীয়ার প্রতি এমন বেপরোয়া ভালোবাসা।
সতাতোবোন অগাস্টাকে ভালবাসার অপরাধে নির্বাসিত হয়েছিলেন কবি বায়রন। তাঁকে ভোগ করতে হয়েছিল সামাজিক শাস্তি। বোন ডরোথির সঙ্গে ওয়র্ডসওয়ার্থ-এর সম্পর্ক নিয়েও কেউ-কেউ কথা বলেছেন। শেলির সঙ্গে তাঁর শ্যালিকার সম্পর্ক নিয়েও নিন্দে রটেছিল। কিন্তু এই সব ‘ইনসেস্ট’-এর মধ্যে কোথায় সেই প্যাশন, সেই আচ্ছন্নতা, সেই শান্তায়ন, যা দেখা যায় রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্কে?
দেওরটি বিলেত থেকে ফিরে সত্যিই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বউদিকে, গানে-কাব্যে-প্রণয়ে-নিবেদনে। হঠাৎ জোয়ার এসেছিল কাদম্বরীর জীবনে। একের পর এক নাটকে রবীন্দ্রের নায়িকা হলেন তিনি। একটি নাটকে উর্বশী কাদম্বরী। আর মদন, দেওর রবীন্দ্র।
১৮৮১-র জুন। রবীন্দ্রনাথ কুড়ি। বাইশ ছুঁই-ছুঁই কাদম্বরী। ‘হেমাঙ্গিনী-হেকেটি’-র মিশ্র সঙ্কেতে ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রিয় বউদিকে উৎসর্গ করলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু লিখলেন ‘শ্রীমতী হে-কে’।
এই মিত প্রতিভাসে আশ্রিত থাকল গভীর প্রণয়। প্রিয় বউদির প্রতি এমন সাঙ্কেতিক অভীপ্সা অনেকের মাথার উপর দিয়ে গিয়েও যাঁর কাছে পৌঁছবার পৌঁছেছিল নিশ্চয়। এবং কিছুই কি বুঝতে পারেননি জ্যোতিরিন্দ্র?
১৮৮১-তে আরও একবার বিলেত পাঠানো হয় রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য। জাহাজ মাদ্রাজ পর্যন্ত যেতেই প্রিয় বউদির জন্য একরাশ মনকেমন নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন সোজা কাদম্বরীরই কাছে, চন্দননগরে এক বাগানবাড়িতে।
ঠিক গত বছরেই তাঁর দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার সম্ভাবনায় কাদম্বরীর আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় ভুলতে পারেননি। বিলেতের পথ থেকে হঠাৎ ফিরে আসার কারণ যে কাদম্বরী এ-কথা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সরাসরি জোড়াসাঁকোতে না উঠে সোজা চলে গেলেন বাগানবাড়িতে বউদির কাছে, সেটা ঠাকুরবাড়ি যে ভালোভাবে নেবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথ যদি অন্যায় করেও থাকেন, তাঁকে প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে অপরাধিনী অবশ্যই কাদম্বরী, এমন গুঞ্জন কি শোনা যায়নি?
দেবেন্দ্রনাথের কানেও তো কথাটা পৌঁছল যে রবি বিলেত না গিয়ে সামান্য অজুহাত দেখিয়ে ফিরে এসেছে। তিনি কি কিছুই বুঝতে পারেননি কী ঘটছে! তাঁর কি টনক নড়েনি তাড়াতাড়ি রবীন্দ্রনাথের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্য?
সে-বিয়ে যা-হোক তা-হোক হলেও চলবে। কিন্তু জল আরও গড়াবার আগে, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে, রবীন্দ্রের বিয়ের বড় প্রয়োজন যে!
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় বউঠাকরুণের কাছে। এবং ফিরে আসা বিফলে গেল না।
মাদ্রাজ থেকে হঠাৎ ফিরে এসে তেলেনিপাড়ায় বাঁড়ুজ্যেদের বাগানবাড়িতে নতুন বউঠানের সঙ্গে রোমান্সের কথা রানি চন্দ-কে জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ এই ভাষায়: ”গঙ্গা সাঁতরে তখন এপার-ওপার হতাম। নতুন বৌঠান দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠতেন। কত বেড়িয়েছি নতুন বৌঠান আর আমি জঙ্গলে, কত কুল পেড়ে খেয়েছি। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’,-এ-গান এখানেই সুর দিই। সুর দিয়েই নতুন বৌঠানকে শোনাতুম। খুব ভালোবাসতুম তাঁকে। তিনিও আমায় খুব ভালোবাসতেন।”
বোঝা যায় ইচ্ছে করেই প্রিয় মেয়েটির উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দূর সাঁতারে যেতেন তরুণ কবিটি। বউদি যে আকুল প্রতীক্ষায় তাঁরই ফিরে আসার জন্য, প্রণয়ের এই স্বাভাবিক নিষ্ঠুরতার ঊর্ধ্বে ছিলেন না বিশ বছরের দেওরটি।
আমাদের মনে পড়ে যায়, শেলির সাঁতারের কথা। মেরি শেলির কাছে জানতে পারি, জল থেকে সদ্য উঠে আসা নগ্ন শেলিকে দেখাত দেবদূতের মতো।
কেমন দেখাত দীর্ঘাঙ্গ, বলিষ্ঠ, লাবণ্যময় রবীন্দ্রনাথকে? কারও কাছে কখনও কি বলেননি কাদম্বরী?
বাঁড়ুজ্যেদের বাগান থেকে চন্দননগরেই আরও এক রোম্যান্টিক ঠিকানায় চলে যান রবীন্দ্রনাথ-মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি।
রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শোনা যাক বউদির সঙ্গে সেই রোমান্সের কথা : ”বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিতে মনের মতো সুর বসাইয়া বর্ষার রাগিণী গাহিতে গাহিতে বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন মধ্যাহ্ন খ্যাপার মতো কাটাইয়া দিতাম। কখনো বা সূর্যাস্তের সময় আমরা নৌকা লইয়া বাহির হইয়া পড়িতাম… তখন পশ্চিম আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হইয়া গিয়া পূর্ববনান্ত হইতে চাঁদ উঠিয়া আসিত। আমরা যখন বাগানের ভাগে ফিরিয়া নদীতীরের ছাদটার উপরে বিছানা করিয়া বসিতাম তখন জলে-স্থলে শুভ্র শান্তি, নদীতে নৌকা প্রায় নাই, তীরের বনরেখা অন্ধকারে নিবিড়। নদীর তরঙ্গহীন প্রবাহের উপর আলো ঝিকমিক করিতেছে।”
বউদি এবং তাঁর প্রণয়প্রচ্ছন্ন দেওর দুজনে একা এই পরিবেশে। সে কথা জানাচ্ছেন ইন্দ্রিয়ঘন রবীন্দ্রনাথ: ”সেই দুইজনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ, সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা, সেই দুজনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা, সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া, একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান-তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল।”
এরপর সেই মারাত্মক স্বীকারোক্তি রবীন্দ্রনাথের, যেভাবে একমাত্র তিনিই লিখতে পারেন: ”আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল, এক লেখা তুমি-আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।”
আমরা এবার প্রায় পৌঁছে গিয়েছি রবীন্দ্র-কাদম্বরী রোমান্সের শেষ পর্যায়ে।
মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন ওঁরা। উঠেছেন পাথুরিয়াঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের ১০ সদর স্ট্রিটের বাড়িটি ভাড়া করে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ-কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথ: এই অমোঘ ত্রয়ী জোড়াসাঁকোতে না ফিরে সদর স্ট্রিটে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তাঁর ‘অন্য’ জাগৃতির বিখ্যাত কবিতা- ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।
পরের বছর দুর্গাপুজোতে আবার রবীন্দ্র-কাদম্বরী। এবার দার্জিলিঙে। কিছুদিনের মধ্যেই, ১৮৮৩-র মে মাসে, প্রকাশিত হল ‘প্রভাতসঙ্গীত’। এবং ঠিক এক মাস পরেই ‘ভারতী’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ”সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুজলে সিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়া ছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আর আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।”
ভারতী পত্রিকায় এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরেই ঠাকুরপরিবারের অন্দরমহলে দেখা দিল অন্ধ বেগে ধেয়ে আসা ঈশানের পুঞ্জ মেঘ। চমকে উঠল অশনি সঙ্কেত। রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্ক নিয়ে শোনা যেতে লাগল চাপা গুঞ্জন।
তড়িঘড়ি করে বিয়ের ঠিক হল রবীন্দ্রনাথের। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য বউদের সঙ্গে কাদম্বরীও যেতে বাধ্য হলেন যশোরে প্রিতম পুরুষটির বউ খুঁজতে। সেই প্রগাঢ় মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেননি কাদম্বরী। কলকাতায় ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়ে গেল ১৮৮৩-র ৮ ডিসেম্বর। বিয়ের ভাঁড় খেলতে গিয়ে ভাঁড়গুলোকে ইচ্ছে করে উলটে দিলেন রবি ঠাকুর। ”এ কী করছিস রবি”। ছোট কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরীর আর্তস্বরের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ”সবই তো আজ থেকে ওলোটপালোট হয়ে গেল কাকিমা।”
১৮৮৪-র ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ছবি ও গান’-এর উৎসর্গে সদ্য বিবাহিত রবীন্দ্রননাথ কাদম্বরীকে যেন অনেক দূর থেকে জানালেন অন্তরের অর্পণ-”গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম। যাঁহার নয়নকিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।” প্রেম ও পূজা একাকার হয়ে গেল উৎসর্গে, যেমন রবীন্দ্রনাথের গানে বারবার।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেটে কাদম্বরী হঠাৎ পেলেন কিছু চিঠিপত্র যা থেকে তাঁর বুঝতে বাকি রইল না এক নটীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্কের কথা। এই অভিনেত্রী ভারী সুশ্রী। তাঁর প্রেমে অনেকেই পড়েছিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় তিনি যখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটক ‘অশ্রুমতী’ ও ‘সরোজিনী’-র নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নটীর নাম কি বিনোদিনী নয়? তিনি নিজেই লিখেছেন লিখেছেন, ”সরোজিনী নাটকের অভিনয় ভারি জমত। অভিনয় করতে-করতে আমরা একেবারে আত্মহারা হয়ে যেতাম।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তখন সত্যিই আত্মহারা অবস্থা। ১৮৮৩ সাল থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাড়ি ফেরার কোনও হদিস ছিল না কারও কাছেই।
১৮৮৪-র ১৯ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথের বিয়ের চার মাস পরে, আফিম খেলেন কাদম্বরী। মারা গেলেন ২১ এপ্রিল সন্ধেবেলা।
তাঁর আত্মহত্যার সমস্ত প্রমাণ এবং ‘সুইসাইড নোট’ লোপাট করলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাহান্ন টাকা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করলেন খবরের কাগজের।
কাদম্বরীর মৃত্যু সংবাদ কোনও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরেই জ্ঞানদানন্দিনী আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জাহাজে করে বেড়াতে চলে যান। ফিরে এসে জ্ঞানদানন্দিনীর কাছেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন জ্যোতিরিন্দ্র।
পরে ১৯১০ সালে রাঁচির মোরাবাদী পাহাড়টি কিনে সেখানে বাড়ি করেন তিনি। সেই পাহাড়ের তলায় তৈরি হল জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়ি।
রবীন্দ্রনাথ ভুলেও কোনওদিন জ্যোতিদাদার কাছে রাঁচিতে আসেননি।
অন্তরাল
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কাদম্বরীর মৃত্যুদিন ৮ বৈশাখ, শনিবার ১২৯১। প্রশান্ত পাল ‘রবিজীবনী’র দ্বিতীয় খণ্ডে প্রমাণ করেছেন, কাদম্বরী বেঁচে ছিলেন ৯ বৈশাখ রাত কিংবা ১০ বৈশাখ সকাল পর্যন্ত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই দু-দিন ধরে তাঁর চিকিৎসা চলে। চিকিৎসা করেছিলেন সাহেব ডাক্তার ডি বি স্মিথ।
ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবই-এ রবীন্দ্রের আত্মঘাতী নতুন বউঠানের চিকিৎসার হিসেব: ”ডাক্তারকে বাঙ্গাল ব্যাঙ্কের এক চেক খোদ হস্তে সোভারাম সিং ৪০০; নগদ ঔষধি ক্রয় ও দাইয়ের ঔষধ আনিতে ও ডাক্তার আনিতে ‘জাতাতের’ গাড়ি ভাড়া প্রভৃতির ব্যয় ইস্তক (৯ বৈশাখ) ১ বৌচর (ভাউচার) ২৫ টাকা ৬ আনা ৬ পয়সা; বধূ ঠাকুরানীর পীড়া উপলক্ষ্যে তেতালার ঘরে আলোর জন্য বাতি ক্রয় বৌচর ১ টাকা ৬ আনা; শ্রীমতী নতুন বধূ ঠাকুরানীর পীড়ার জন্য রাত্রে ডাক্তার নীল মাধব হালদার ও সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাবু মহাশয় এ-বাটীতে থাকায় উঁহাদের জল খাবার ও আহারের ব্যয় ১০ বৈশাখের ১ বৌচর ৩ টাকা ২ আনা ৩ পয়সা; এই সময়ে ডাক্তারবাবুদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে খাবার খরচ ৩৮ টাকা।”
মর্গে পাঠানো হয়নি কাদম্বরীর দেহ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই স্ক্যান্ডেল এড়াতে বসেছিল করোনার কোর্ট।
১৪ ও ৩১ বৈশাখের ক্যাশবই-তে তার খরচের হিসেব : ”নূতন বউঠাকুরানীর মৃত্যু হওয়ার দরুণ বাবু যদুনাথ মুখোপাধ্যায় দং কাঁউসেলের ফি ৫১ টাকা; করোনার ক্লার্কের গাড়িভাড়া ২ টাকা; উহা দিগের জন্য ব্রান্ডি, ৩ টাকা ১২ আনা ও ৫৮ টাকা ১২ আনা।”
করোনার রিপোর্ট লোপাট করা হয়। আজও পাওয়া যায়নি।
করোনার রিপোর্ট লুপ্ত করতে কত খরচ হয় তা আজও জানা যায়নি।
কাদম্বরীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিমতলা শ্মশানে ১১ বৈশাখ পণ্ডিত হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের তত্ত্বাবধানে। উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অরুণেন্দ্রনাথ, (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজো ছেলে, কাদম্বরীর ভাসুরপো), সোমেন্দ্রনাথ (রবীন্দ্রনাথের বড়ো ভাই, কাদম্বরীর দেওর) দ্বীপেন্দ্রনাথ (দ্বিজেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে)।
কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ? তিনি ছিলেন কোথায়?
কাঠ খাট ঘি চন্দন ধুনো-র খরচ ও হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিমতলায় যাওয়া-আসার গাড়ি ভাড়ার খরচ ১৩ টাকা ২ আনা ৯ পয়সা।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পঁয়তাল্লিশ বছর পরের ঘটনা। আটষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ, একাধিকবার প্ল্যানচেটে ডাকলেন প্রিয় বউদিকে।
প্রিয় ঠাকুরপোর ডাকে ফিরে এলেন তিনি ১৯২৯-এর ২৯ নভেম্বর রাত্রিবেলা। রবীন্দ্রবর্ণনায় সেই ফিরে আসার কথা :
তুমি নাম বলবে?
না।
আমি তোমার কথা শান্তিনিকেতনে অনেকবার ভেবেছিলুম। আমার শরীর ভাল ছিল না। তখন তোমায় ভেবেছি। তুমি জানতে?
জানি। আমি আসতে পারিনি। শেষ রাত্রে শিরশিরে হাওয়ায় তুমি যখন গায়ের কাপড়টা টেনে নিলে, আমি এসেছিলুম তখন। তুমি আমায় দেখলে ঠিক চিনবে। আমার ছায়াটা আজও আছে, প্রাণ আছে, দেহ নেই শুধু।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পরে ‘লিপিকা’র ‘প্রথম শোক’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ এইভাবে লিখেছেন তাঁর বাসনাকামনাস্বপ্ন ও যন্ত্রণার কথা, তাঁর অবচেতন মনের দহন থেকে উৎসারিত এই সাহসী উচ্চারণ, ”বনের ছায়াতে যে-পথটি ছিল সে আজ ঘাসে ঢাকা। সেই নির্জনে হঠাৎ পিছন থেকে কে বলে উঠল, আমাকে চিনতে পার না? আমি ফিরে তার মুখের দিকে তাকালেম। বললেম, মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছিনে। সে বললে, আমি তোমার সেই অনেক কালের সেই পঁচিশ বছর বয়েসের শোক। বললেম, সেদিনের তোমাকে শ্রাবণের মেঘের মতো কালো দেখেছি, আজ যে দেখি আশ্বিনের সোনার প্রতিমা। কোনো কথাটি না বলে সে একটু হাসলে; বুঝলেম সবটুকু রয়ে গেছে ঐ হাসিতে। বর্ষার মেঘ শরতের শিউলি ফুলের হাসি শিখে নিয়েছে। দেখলেম, সেদিনকার বসন্তের মালার একটি পাপড়িও খসেনি। আমি বললেম, আমার তো সব জীর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু তোমার গলায় আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবন আজও তো ম্লান হয়নি। আস্তে-আস্তে সেই মালাটি নিয়ে সে আমার গলায় পরিয়ে দিলে। বললে, মনে আছে? সেদিন বলেছিলে, তুমি সান্ত্বনা চাও না, তুমি শোককেই চাও। লজ্জিত হয়ে বললেন, বলেছিলেম, কিন্তু তারপরে অনেকদিন হয়ে গেল, তারপরে কখন ভুলে গেলেম। সে বললে, যে অন্তর্যামীর বর, তিনি তো ভোলেননি। আমি সেই অবধি ছায়াতলে গোপনে বসে আচি। আমাকে বরণ করে নাও।”
মধ্যজীবন থেকে জীবনপ্রান্তে উপনীত রবীন্দ্রনাথ। ভুলতে পারেননি তখনও বউঠানের চোখ, তাঁর কাঁচাকচি গা, ”উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ, গলায় পলার হারখানি/ একখানি সাদা শাড়ি কাঁচাকচি গায়ে/ কালো পাড় দেহ ঘিরে ঘুরিয়া পড়েছে তার পায়ে।”
বউঠানের শরীর ছোঁয়ার পুরস্কার, তা-ও ভুলে যাননি ভুবনখ্যাত দেওর :
একদিন বলেছিলে, ”জানি হাত দেখা”
হাতে তুলে নিয়ে হাত নতশিরে গণেছিল রেখা
বলেছিল, ”তোমার স্বভাব
প্রেমের লক্ষণে দীন।” দিউ নাই কোনই জবাব।
পরশের সত্য পুরস্কার
খণ্ডিয়া দিয়াছে দোষ মিথ্যা সে নিন্দার।
কোনওদিন ভুলতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর কোমল শ্যামল গ্রীবার আকর্ষণও, যেখানে আদর করার বাসনাটুকু এখানে ডাক দিয়েছে, ”পিছন হইতে দেখিনু কোমল গ্রীবা/ লোভন হয়েছে রেশম চিকন চুলে।”
সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘চারুলতা’-য় কতবার কতভাবে মাধবীর রেশম চিকন চুলে লোভনীয় কোমল গ্রীবাটিকে তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে সেই দৃশ্যে পিছন থেকে (যেমন হয়তো দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ) যেখানে মাধবী খাটের পাশে একা মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, কেন তুমি চলে গেলে ঠাকুরপো!