বিবাহের কথা
(শ্বশুর বাড়ী)
একবার আমাদের গুরুঠাকুর এসেছিলেন। তাঁকে বাবামশায় জিজ্ঞেস করেছিলেন—কিরকম কন্যাদানে বেশি পুণ্য হয়। তিনি বললেন—সাত বছর বয়সে বিয়ে দিলে, অর্থাৎ গৌরীদানে। ঠিক সেই বয়সেই আমার বিয়ে হয়। কলকাতার ঠাকুরবাড়ী থেকে তখন যশোরে মেয়ে খুঁজতে পাঠাত, কারণ যশোরের মেয়েরা নাকি সুন্দরী হত। যে সব দাসীরা মনিবের পছন্দ ঠিক বুঝতে পারে, তাদের খেলনা দিয়ে তাঁরা মেয়ে দেখতে পাঠাতেন। আমাদের ওখানেও এইরকম দাসী গিয়েছিল।
আমার শাশুড়ীর (মহর্ষির স্ত্রী) রং খুব সাফ ছিল। তাঁর এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, আমার শ্বশুরমশায়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি দেশে এসে আমার শাশুড়ীকে (তিনি তখন ছয় বৎসরের মেয়ে) কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ী ছিলেন না—গঙ্গা নাইতে গিয়েছিলেন। বাড়ী এসে, মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছেন শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন। আমার দিদিশাশুড়ীও খুব সুন্দরী ছিলেন শুনেছি। তাঁকেও নাকি মনুবুড়ি বলে এক পুরনো দাসী পছন্দ করে এনেছিল।
আমাকে বোধ হয় দাসী পছন্দ করে’ গিয়েছিল। যখন আমার বিয়ের দিন সব ঠিক হয়ে গেল, তখন তাঁরা আমাকে আনতে সরকার চাকর দাসী ইত্যাদি পাঠালেন।
বিয়ের পর বাসী বিয়েতে আমাকে মেয়েপুরুষ মিলে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে নিতে এসেছিল। শ্বশুরবাড়ীর অন্দরমহলে যখন পালকি নামাল তখন বোধ হয় আমার শাশুড়ী আমাকে কোলে করে’ তুলে নিয়ে গেলেন। তাঁর ভারী মোটা শরীর ছিল, কিন্তু আমি খুব রোগা ও ছোট ছিলুম বলে’ কোলে করতে পেরেছিলেন। আমাকে নিয়ে পুতুলের মতো এক কোণে বসিয়ে রাখলেন। মাথায় এক গলা ঘোমটা, আর পায়ে গুজরী-পঞ্চম ইত্যাদি কত কি গয়না বিঁধছে। আমার পাশে একজন গুরুসম্পৰ্কীয়া বসে যৌতুকের টাকা কুড়োতে লাগলেন। আমি তো সমস্তক্ষণ কাঁদছিলুম। আমার শ্বশুর যখন যৌতুক করতে এলেন তখন একটু জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলুম। তিনি জিগ্যেস করলেন—কেন কাঁদছে? লোকে বললে—বাপের বাড়ী যাবার জন্যে। তাতে তিনি বললেন—বল পাঠিয়ে দেব। সকলে বলতে লাগলেন—দেখেছ কী সেয়ানা বউ! ঠিক তাকমাফিক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছে, যখন শ্বশুর যৌতুক করতে এসেছে। কিছুদিন পর্যন্ত লোকে আমাকে রোজই দেখতে আসত ও নানারকম ফরমাশ করত—উপর বাগে চাও তো মা ইত্যাদি। মেয়েরা কাপড় পর্যন্ত খুলে দেখত। আমি খুব লাজুক ছিলাম। সমবযসীদের সঙ্গে ভালভাবে কথা কইতুম না। ক্রমে ক্রমে সে ভাবটা কেটে গেল।
সেকালে আমাদের অন্দরমহলে এক ছেলে-মানুষ-করা পুরনো লোক ছাড়া কেউ আসতে পারত না। বিবাহিত লোকেরা ছাড়া কেউ রাতে বাড়ীর ভিতর আসতেন না, কিন্তু কখন কখন দিনে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে আসতেন। আমার পাঁচজন নন্দাইদের একজন ছাড়া সকলেই ঘরজামাই ছিলেন। নন্দাইরা প্রায় সকলেই কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরের ছেলে, হয়ত কলকাতায় পড়তে এসেছেন, সুন্দর চেহারা দেখে এঁরা ধরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমাদের পিরালী ঘরে বিয়ে করবার পরে তাঁদের নিজেদের বাড়ীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকত না। একজনের বাপ গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে তাঁর ছেলেকে শাপ দিয়েছিলেন শুনেছি।
আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবী আমাদের খুব যত্ন করতেন। বাপের বাড়ীর জন্য যখন কাঁদতুম তখন সান্ত্বনা দিতেন, চুল বেঁধে দিতেন—সে সব তখন কিছুই জানতাম না। ক্রমে ক্রমে যখন ওঁদের সঙ্গে মিশে গেলুম তখন অন্দরমহলে বেশ সুখেই ছিলুম। দাসীরা গঙ্গা নাইতে গেলে বলতুম ছোট ছোট নুড়ি কুড়িয়ে আনতে, তাই দিয়ে আমাদের ঘুঁটি খেলা হত। তাস খেলাও বোধহয় শিখেছিলুম, তাতেও খুব আনন্দ পেতুম।
অনেকদিন বাদে বাদে বাবামশায় (মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) আসতেন। আগেই বলেছি, তাঁকে ভয় করতুম, তাই বেশি কথা বলতুম না।
আমরা বউয়েরা প্রায় সকলেই শ্যামবর্ণ ছিলুম। শাশুড়ী ননদ সকলেই গৌরবর্ণ ছিলেন। প্রথম বিয়ের পর শাশুড়ী আমাদের রূপটান ইত্যাদি মাখিয়ে রং সাফ করবার চেষ্টা করতেন। তিনি সামনে বসে থাকতেন তক্তপোশের উপর, আর দাসীরা আমাদের ঐসব মাখাত। দিন কতক পরে যতদূর হবার হলে ছেড়ে দিতেন। আমরা মেয়েরা বউয়েরা সকলেই ঠিক তাঁর কথামত চলতুম। আমি বড্ড রোগা ছিলুম। একদিন কাদের বাড়ীর বউরা বেড়াতে এসেছে সেজেগুজে, তাদের বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখে মা বল্লেন, “এরা কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখ দেখি, আর তোরা সব যেন বৃষকাষ্ঠ!” তারপর আমাকে কিছুদিন নিজে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আমার একমাথা ঘোমটার ভিতর দিয়ে তার সেই সুন্দর চাঁপার কলির মত হাত দিয়ে ভাত খাওয়াতেন। আমার কেবল মনে হত মা কতক্ষণে উঠে যাবেন আর আমি দালানে গিয়ে বমি করব।
বিয়ের দুতিন বৎসর পরে বাবামশায় মাকে সুদ্ধ নিয়ে এসে কলকাতায় বাড়ী ভাড়া করে রইলেন। মা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্য পালকি পাঠালেন। কিন্তু শাশুড়ী ঠাকরুণ বল্লেন ভাড়া বাড়িতে বউ পাঠাবেন না। আমি তাঁর উপর তো কখন কিছু বলিনি, এই কথা শুনে লুকিয়ে ছাতের এক কোণে বসে কাঁদতে লাগলুম। দাসীদের ভয় করতুম, কেননা তার মায়ের কাছে লাগিয়ে দিয়ে বকুনি খাওয়াত। এমন সময় উনি মায়ের কাছে কি একটা কথা বলতে এলেন। বড়ঠাকুরঝিকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন—সে কোথা? বড় ঠাকুরঝি বল্লেন—তার মা তাকে আনতে পালকি পাঠিয়েছেন কিন্তু ভাড়া বাড়িতে মা পাঠাবেন না বলেছেন, তাই সে ছাতে বসে কাঁদছে। উনি এই কথা শুনে তখনি বাবামশায়ের কাছে চলে গেলেন। তিনি বাপের কাছে যত স্পষ্ট কথা বলতেন, এমন আর কোন ছেলে সাহস করত না। বাবামশায় যখন শুনলেন মা এই কারণে আমাকে যেতে দিচ্ছেন না তখন নিজেই বাড়ীর ভিতর চলে এলেন। এসে মাকে বল্লেন—সত্যেন্দ্রর বউয়ের মা তাঁকে নিতে পালকি পাঠিয়েছেন, তুমি নাকি ভাড়া বাড়ী বলে’ তাকে যেতে দাও নি? ভাড়াবাড়ী কেন, মা গাছতলায় থাকলেও মায়ের কাছে যাবে, এখনি পাঠিয়ে দাও।—একথা শুনে আমার খুব আহ্লাদ হল। মায়ের কাছে গিয়ে শুধু তাঁকে মা বলে ডাকতে এত আনন্দ হচ্ছিল যে একটা আলাদা ঘরে গিয়ে মা মা বলতে লাগলুম। সামনে বারবার বলতে লজ্জা করছিল।
আমাদের অসুখ বিসুখ করলে দাসীরা গিয়ে মাকে খবর দিলে তিনি বলতেন, যা দপ্তরখানায় খবর দে গে যা। সেখানকার কর্তা ছিলেন আমার মামাশ্বশুর। তিনি ডাক্তারকে খবর পাঠাতেন।
তখনকার ভাল ডাক্তারদের মধ্যে একজন ইংরেজ ও একজন বাঙালী ডাক্তার আমাদের পরিবারে বাঁধা ছিলেন। একবার মনে আছে একটা অসুখ হয়ে কোণে পড়ে আছি। ডাক্তার এসে আমাকে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দিলেন। মামা নিয়মিত খাইয়ে গেলেন। তারপর পড়েই আছি। আর কোন খোঁজ খবর নেই। আমার বড় ননদ তখন আঁতুড়ে, তা বাঁচিয়ে যতদূর সম্ভব আঁতুড় ঘরের কাছে গিয়েই বসলুম। তখন ভয়ানক খিদে পেয়েছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। বড় ঠাকুরঝির খাবার জন্যে একজন ঘিয়ে ভাজা চিঁড়ে দিয়ে গেল, তাতে বুঝি নাড়ী শুকোয়। তিনি তখন আমায় জিজ্ঞেস করলেন—খাবে? আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালুম। তখন এত শরীর অবসন্ন বোধ হচ্ছিল যে, লজ্জা করবার অবস্থা ছিল না। সেই চিঁড়ে খেয়ে যেন ধড়ে প্রাণ এল।
আমার শাশুড়ীর একটু স্থূল শরীর ছিল, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না। সংসারের ভাঁড়ারাদির কাজ বোধ হয় দপ্তরখানা থেকেই করা হত। দৈনিক বাজারে আমাদের কিছু করতে হত না। কেবল পৌষপার্বণে রাশীকৃত পিঠে গড়তে হত বলে লোক কম পড়লে মেয়েদের বউদের ডাক পড়ত। ঝাল কাসুন্দি বড় বড় তোলোহাঁড়িতে করা হত। কাঠি দিয়ে জল মাপা হত, তার আবার অনেক বিচার, একটুকুতেই অশুচি হত। ক্রিয়া-কর্মে আনন্দনাড়ু করবারও ধুম পড়ে যেত। আমার মনে পড়ে বাবামশায় যখন বাড়ী থাকতেন আমার শাশুড়ীকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন; এই ছিল তাঁর রাত্রের সাজ।
একবার জমিদারীর আয় কমে গিয়েছিল। তখন আমার শ্বশুর বলে পাঠালেন বউদের রাঁধতে শেখাও। রান্নাঘরের রান্না বড় সুবিধের হত না। দপ্তরখানা থেকে ঘি তেল এনে বামুনরা চুরি করত। কেবল বাবামশায় যখন বাড়ী থাকতেন মা রান্নাঘরে নিজে গিয়ে বসতেন। তখন তারা একটু ভয়ে থাকত। কৈলাস মুখুজ্জে বলে একজন খুব আমুদে সরকার ছিল। ছেলে বাবুদের সঙ্গে রঙ্গরস করত। সে বামুনদের চুরি ধরবার মতলবে এক-একদিন রান্নাঘরে খেত। তারা ফন্দি করে কাঁচাকাঠ উনুনে দিয়ে খুব ধোঁয়া বার করলে, যাতে মুখুজ্জে দেখতে না পায়। কিন্তু চোরাই মাল রাখবে কোথায়? তাই একজন বামুন নিজের পেটে চালাবার উপক্রম যেই করেছে অমনি কৈলাস চোখমুখ পুঁছে তাকে ক্যাঁক করে চেপে ধরেছে। আমরা রান্নাঘরের রান্না অল্পই খেতুম। তবে দুএক টাকা করে মাসহা্রা পেতুম, তাই দিয়ে কখন কখন সখ করে কিছু খাবার আনিয়ে আমোদ করে খেতুম। একাদশীর দিন দাসীরা পয়সা চাইত, দু এক পয়সা পেলেই খুশি হয়ে যেত। তাদের দিয়ে কখন কাঁচা আম কি জারক লেবু আনাতুম। মুখ ধুয়ে কাপড় ছেড়ে লেবু খেতে খেতে ছাতে পায়চারি করতুম। ছেলে বাবুদের মাসহারা বেশি ছিল।
মা বোধ হয় কৃপণতা করে বাজারের টাকা থেকে কিছু বাঁচাতেন কারণ কর্তামশায় প্রায় পাহাড়ে ভগবানের ধ্যান করে বেড়াতেন বলে কবে বাড়ী আসবেন তাই গুণে বলে দেবার জন্যে দৈবজ্ঞদের পয়সা দিতেন। এক আচার্যানী ও তার ছেলে আসত—তারা তাঁর কল্যাণের জন্য স্বস্তি স্বস্ত্যয়ন করতে বলত, সেজন্য মা মুক্তহস্তে ব্যয় করতেন। মা তাঁর জন্য শুয়ে শুয়ে কেবল ভাবতেন, তাই সংসারের কাজে বড় একটা মন দিতে পারতেন না। এতে অযথা অনেক ব্যয় হত বলে ছেলেরা দরোয়ানকে বলে আচার্যানীর আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু মা সে কথা টের পেয়ে কান্নাকাটি বকাবকি করাতে সে আবার এল।
এই সময়ে মায়ের খুড়ী, কাকার দ্বিতীয় পক্ষের বিধবা স্ত্রী মায়ের কাছে থাকতে এলেন। তিনি এসে মায়েব ও আমাদের খাওয়া-দাওয়া দেখাশুনো আর অসুখে সেবাশুশ্রূষা করতে লাগলেন; তিনি এসে সবদিকে সকলের সুবিধা হল। তাঁকে আমরা দিদিমা বলতুম। তাঁর ছেলেপিলে ছিল না, তাই ক্রমে আমাদের ওখানেই রয়ে গেলেন। তিনি প্রায় মায়েরই সমবয়সী ছিলেন ও তাঁর বেশ সঙ্গিনী হলেন।
আমরা তখন শুধু একখানা শাড়িই পরতুম—তার উপর শীতকালে সন্ধ্যাবেলায় হয়ত একটা দোলাই গায়ে দিতুম। বিয়ের আগে ছেলেরা বাইরেই থাকত, বিয়ে হলে সকলেরই একখানা আলাদা ঘর হত, সেখানে রাত্রে শুতে আসত। ওঁর এক বন্ধু ছিলেন মনোমোহন ঘোষ। ওঁর ইচ্ছে যে তিনি আমাকে দেখেন—কিন্তু আমারত বাইরে যাবার জো নেই, অন্য পুরুষেরও বাড়ীর ভিতরে আসবার নিয়ম নেই। তাই ওঁরা দু’জনে পরামর্শ করে একদিন বেশি রাত্রে সমান তালে পা ফেলে বাড়ীর ভিতরে এলেন। তার পরে উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে বিছানার এক পাশে আর তিনি ভোম্বলদাসের মত আর এক পাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই—। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমান তালে পা ফেলে উনি তাঁকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন।
মনোমোহনের সঙ্গে ওঁর খুব ভাব ছিল। তিনিই ওঁকে প্রথমে পরামর্শ দিলেন যে—ভিক্টোরিয়া ত আমাদের দেশের লোককে সিবিল সার্বিসে ঢোকবার অনুমতি দিয়ে গেছেন, কিন্তু কেউ এ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে যায়নি। চলনা দেখি আমাদের সিবিল সার্বিসে নেয় কিনা। তিনি ক্রমাগত এইভাবে লইয়ে লইয়ে ওঁর বিলেত যাবার মত করালেন। বাবামশায়ের ইচ্ছে ছিল যে সব ছেলেরাই বড় হয়ে জমিদারী দেখে। কিন্তু উনি অনেক বলা-কওয়ায় বিলেত যাবার অনুমতি দিলেন।
আমি প্রথম প্রথম লজ্জায় ওঁর সঙ্গে কথা বলতুম না। লজ্জা আমার অসাধারণরকমের ছিল। তখন উনি একবার বলেছিলেন যে—তুমি যদি কথা বলো ত যা চাও তাই দেব। তাতে আমি একটা ঘড়ি চেয়েছিলুম, উনিও দিয়েছিলেন। ওঁর বিলেত যাবার সময় অবশ্য সে অবস্থা কাটিয়ে উঠেছিলুম। আমার নাম জ্ঞানদা বলে উনি আমাকে ‘জ্ঞেনি’ বলে ডাকতেন।
একদিন ওঁর যাবার সময় সময় দিদিমার কাছে বসে আমার একটা গান লেখবার সখ হল। এই পর্যন্ত লেখা হয়েছিল—
“কেমনে বিদায় দেব থাকিতে জীবন
তুমি তো যাবে আনন্দে, সঙ্গীগণ লয়ে সঙ্গে”—
তারপরে আর এগোয় নি।
সেই কাগজটা আমি ঘরে ফেলে গিয়েছিলুম, দিদিমা আবার ওঁকে সেটা দেখালেন। তারপর উনি এই গানটা রচনা করে ফেল্লেন—
কেমনে বিদায় দিব থাকিতে জীবন—
কোন প্রাণে যাব চলি বিজন গহন।
কেমনে ছাড়িব তারে সদা প্রাণ চাহে যারে
কেমনে সহিব বল বিচ্ছেদ দহন।
শরীর যদিও যাবে— মন সদা হেথা রবে
যার ধন তারই কাছে রবে অনুক্ষণ।
দিবস ফুরায় যত, ছায়া যায় দূরে তত
কভু না ছাড়ায় তবু পাদপবন্ধন।
তাঁর গান লেখার খুব অভ্যাস ছিল, ব্রহ্মসঙ্গীত অনেক রচনা করেছিলেন।
ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দিকে ওঁর খুব ঝোঁক ছিল, এবং বোধ হয় সেইটেই জীবনের ব্রত করবার ইচ্ছে করেছিলেন। মনে আছে একবার বলেছিলেন—আমি যখন প্রচার করতে বেরব তখন ত রাত জাগতে হবে, বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। অবশ্য বিলেত যাওয়াতে সে সাধ পূর্ণ হল না। কিন্তু সেখান থেকেও ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করে পাঠাতেন; এক একটা নতুন গান পেয়ে মহর্ষি খুব সন্তুষ্ট হতেন।
আমাদের বাড়িতে তখন রোজ উপাসনা হত, রোজ সকালে আমাদের তৈরি হবার জন্য আধঘণ্টা আগে ঘণ্টা পড়ত। তার আগে আমরা কিছু খেতুম না। দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়লে দালানে নেবে যেতুম। মহর্ষি থাকলে তিনিই উপাসনা করতেন, তখন মাও গিয়ে বসতেন। না হয়ত বড়ঠাকুর কিম্বা উনি বসতেন। মেয়েরা একদিকে বসতুম পুরুষেরা আর একদিকে। উপাসনার পর খেতুম লুচি তরকারি দুধ ইত্যাদি। চায়ের রেওয়াজ তখন বড় একটা ছিল না। তারপর নাইতে যেতুম। একতলায় একটা ঘরে বড় একটা চৌবাচ্চা ছিল, সেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে আমোদ করে নাইতুম। এ ওর গায়ে জল দিচ্ছে, কেউ সর ময়দা মাখছে, কেউ মাখাচ্ছে। আমার সেজননদ নানারকম মাখতেন বলে ওঁর স্নান সব শেষে সারা হত। তিনি ওই চৌবাচ্চাতেই সাঁতার দিতে শিখেছিলেন। মোটা ছিলেন বলে সহজেই ভাসতে পারতেন। আমার আর শেষ পর্যন্ত সাঁতার শেখা হল না।
স্নানের পর সবাই মিলে গল্প করতে করতে একসঙ্গে খেতুম। রান্নাঘরের রান্না বড় ভাল লাগত না, তাই চচ্চড়ি বা ঝোলের মাছ নিয়ে টক কি কিছু দিয়ে খেয়ে নিতুম। পাতে যা থাকত তা দাসীরা খেত, তাছাড়া আলাদা চাল পেত। তখনকার কালে দাসীদের ১৲, চাকরদের ২৲ ২॥০ টাকা এই রকম মাইনে ছিল। পরে ক্রমশ বেড়ে গেল। নতুন দাসী এলে তাদের ঘরের কথা জানতে আমাদের খুব আমোদ বোধ হত। তার স্বামী আছে কিনা, তাকে ভালবাসে কিনা ইত্যাদি। দাসীদের নিচে আলাদা ঘর ছিল, সেখানে খাবার নিয়ে গিয়ে খেত, কাপড় রাখত।
উনি বিলেত যাবার পর ওঁর মাসহারা আট টাকা আমাকে দেওয়া হল; তাতে নিজেকে খুব বড়লোক মনে করলুম। তার থেকে মাসে মাসে কোন খাবার আনাতুম, দাসীদেরও খাওয়াতে ভালবাসতুম।
বিয়ের পরে আমার সেজদেওর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে করে আমাদের পড়াতেন। তাঁর শেখাবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। নিজের মেয়েদেরও সব লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। আমরা মাথায় কাপড় দিয়ে তাঁর কাছে বসতুম আর এক একবার ধমকে দিলে চমকে উঠতুম। আমি বিয়ের আগেই লিখতে পড়তে পারতুম আর আমার হাতের অক্ষরের খুব প্রশংসা ছিল। আমার বাবামশায় একটা পাঠশালা খুলেছিলেন। সেখানে মুসলমান পর্যন্ত বড় বড় ছেলেরা যেত; কেবল আমি একলা ছোট মেয়ে ছিলুম। আমার যা কিছু বাংলা বিদ্যা তা সেজঠাকুরপোর কাছে পড়ে। মাইকেল প্রভৃতি শক্ত বাংলা বই পড়াতেন, আমার খুব ভাল লাগত; এখনো লাগে। উনি বিলেত থেকে ঠাকুরপোকে লিখে পাঠিয়েছিলেন আমাকে ইংরিজী শেখাতে, কিন্তু সেটা অক্ষরপরিচয়ের বড় বেশি এগোয় নি। সেজন্য বোম্বাই গিয়ে ওঁর কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলুম, বেশ মনে আছে।
তখন বাড়ীর ছেলেদের জন্যে একজন কুস্তিগির পালোয়ান মাইনে করা থাকত। ছেলেরা সকলেই কুস্তি শিখত। কুস্তির জন্য গোলাবাড়িতে একটা আলাদা চালাঘর ছিল। তাতে অনেকটা ঢিলে নরম মাটি কিরকম তেল দিয়ে মাখা থাকত, যাতে পড়লে না লাগে। বম্বে গিয়েও প্রথম প্রথম উনি ঐরকম মাটির আখড়া তৈরি করাতেন। সেজঠাকুরপোই বেশি কুস্তি করতেন। বোধ হয় ছেড়ে দেবার পর যে বাতে ধরল তাতেই অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে মারা গেলেন। উনিও দাঁও প্যাঁচ খুব জানতেন। আর শীতকালে ভোরবেলা ঈডেন গার্ডেনে হেঁটে যাবার একটা নিয়ম ছিল। সেখানে দরজা বন্ধ থাকত ও কেউ গেলে সান্ত্রী বলত “হুকুম সর্দার” অর্থাৎ who comes there?
উনি বিলেত যাবার সময় আমাকে দিদিমার হাতে সঁপে দিয়ে গেলেন। আমার মনে আছে একদিন রাত্রে বেশ জ্যোৎস্না হয়েছে, আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, মাঝখানে দিদিমা, একপাশে উনি আর একপাশে আমি। আমি লজ্জায় কিছু বলছিনে, কিন্তু চোখে একটু একটু জল আসছে। উনি দিদিমার হাতে আমাকে দিয়ে বল্লেন—একে তোমার মেয়ের মত দেখ। ওঁর কথা দিদিমা যথার্থই রেখেছিলেন। আমাকে তিনি খুবই যত্ন করতেন। যখন পূর্ণিমার দিন খুব জ্যোৎস্না হত, আমি কিছুতেই ঘরে থাকতে পারতুম না, ছাতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতুম। শীতকাল হলে দিদিমাকে আমি একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে দিতুম, বেচারা বুড়োমানুষ বসে থাকতেন। এই জ্যোৎস্না ভালবাসবার কথা ওঁর বম্বের চিঠিতেও পরে উল্লেখ করেছেন।
বিলেত থেকে উনি আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। আমি লিখতুম কিনা মনে নেই। ফিরে এসে বম্বে থেকে যখন কলকাতায় আসতুম, তখন আমাদের নিয়মিত চিঠি লেখালিখি চলত। ওঁর সে সময়কার খানকতক চিঠি এখনো আমার কাছে আছে। আমার মেয়ে সেগুলো নকল করে দিয়েছে, নইলে পুরনো কাগজ সব খসে খসে পড়ছিল।