২. বিবরণী
৩০শে সেপ্টেম্বর ১৬৫৯ ॥ হতভাগ্য আমি। রবিনসন ক্রুসো আমার নাম। ঝড়ের মুখে পড়েছিল আমাদের জাহাজ। ছন্নছাড়া বিপর্যস্ত। রক্ষা পেয়েছি কোনোক্রমে। উঠেছি এসে এই দ্বীপে। এ-ও এক হতভাগ্য দ্বীপ। এর নাম দিয়েছি আমি হতাশার দ্বীপ। আমার সহযাত্রীরা কেউ আর বেঁচে নেই। জলের বুকে তলিয়ে গেছে কে কোথায় কে জানে। একলা আমিই কোনোক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি।
সারাটা দিন এই নিয়ে আমার কী অনুতাপ। আর কত অশুবর্ষণ। এ কোথায় এলাম! খাব কী আমি? জামা কোথায়, বাড়ি কোথায়! থাকব কোনখানে? কী পরব? অস্ত্রও তো নেই যে বাঁচাব নিজেকে। কত হিংস্র জন্তু আছে, কে তার খোঁজ রাখে। নরখাদক মানুষও তো থাকতে পারে। হয়ত অনাহারে মরতে হবে আমাকে। এই ব চিন্তা একের পর এক। শেষে রাত ঘনিয়ে এল। তখন একটা গাছের উপর উঠে শক্ত করে ডালের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ঘুমিয়ে পড়লাম। কী যে শান্তি। সারা রাত ধরে বৃষ্টি হল। বৃষ্টির মধ্যেই আমি অঘোরে ঘুমোলাম।
১লা অক্টোবর। ঘুম থেকে উঠে দেখি অবাক কাণ্ড। আমাদের জাহাজটাকে ঠেলতে ঠেলতে ঢেউ এনে কূলের কাছে বালির চড়ায় তুলে দিয়ে গেছে। কাত হয়ে রয়েছে। জাহাজ। তবে ডাঙা থেকে সে অনেকখানি দূর। আর চারধারে জল। সানা এই, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় নি বা উলটে পড়ে নি। তার মানে মালপত্র যা ছিল জাহাজে সবই ঠিকঠাক আছে। মনে খানিকটা ভরসা পেলাম। নিজের দরকার মতো খাবার দাবার তাহলে নিয়ে আসা যাবে। সাথীদের কথা ভেবে বুকটা যেন ভেঙে গেল আমার। তড়িঘড়ি ঢেউয়ের মাথায় ডিঙি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, যদি থাকতাম জাহাজে তবে হয়ত এ দশা আজ হত না। পারতাম যেনতেন প্রকারে জাহাজ সমেত নিজেদেরকেও রক্ষা করতে। যদি জাহাজ যেত, ভেঙে, তাতেই বা পরোয়া কী। রইলাম তো আমরা সবাই জীবিত। ভাঙা জাহাজের কাঠকুটো দিয়ে নয় বানিয়ে নিতাম ডিঙি। তাইতে করে সমুদ্রে পাড়ি জমাতাম। এই সব নানান চিন্তা ভরে রাখল মন। গেলাম হাঁটতে হাঁটতে জাহাজের কাছে। দেখি শুকনো একদম, খটখটে। তখন সাঁতার কেটে ঘুরে পেছনধার দিয়ে জাহাজে গিয়ে উঠলাম। আজও বৃষ্টির কামাই নেই। তবে সান্ত্বনা এই, হাওয়ার দাপট আজ কম।
চব্বিশ তারিখ অব্দি আমি ভীষণ ব্যস্ত। বারে বারে প্রায় প্রতিদিনই একবার করে জাহাজে যাই। নিয়ে আসি যা চোখে পড়ে সব। ভেলায় করে। বৃষ্টি আছে। তবে মাঝে মাঝে আকাশ পরিষ্কার হয়। এটা বর্ষাকাল।
২৪শে অক্টোবর। আজ ভেলাটা উলটে গেল। নিজের ভুল বলব না, আসলে স্রোতের টানে পড়ে টাল সামলাতে পারি নি। জিনিসপত্র সব গেল জলে। আমিও জলে হাবুডুবু খেতে খেতে সামলে নিলাম। তবে গভীর জল নয়। লোহালক্কড় জাতীয় যা যা ছিল তা ছাড়া বাকি সব হাতড়ে উদ্ধার করলাম। অনেক কিছু জলের নিচেই রয়ে গেল।
২৫ শে অক্টোবর। সারাদিন সারারাত ধরে আজ বৃষ্টি। সঙ্গে বাতাসের দাপট। কোথায় যে ভেসে গেল জাহাজ, না কি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল তাই বা কে জানে। বাতাসও একটু একটু করে বাড়ছে। আজ আর বাইরে বেরলাম না। সামলে সুমলে রাখলাম মালপত্র। সেটাই আজকের প্রধান কাজ। বৃষ্টির হাত থেকে তো সব কিছু রক্ষা করতে হবে।
২৬ শে অক্টোবর। সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম আজ আস্তানা কোথায় করা যায় তার খোঁজে। রাত্রে নিরাপদে ঘুমোতে হবে। তা ছাড়া হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করাটাও বড় কথা। পেলাম মনের মতো জায়গা বিস্তর ঘোরাঘুরির পর। পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা। মোটামুটি যা চাই আমি সেইরকম। মাটির একটা দেওয়াল তুলব চারদিকে। তার ওপরে তারের বেড়া। ব্যস, আর আমাকে পায় কে। কে আর আমার নাগাল পাবে।
২৬ থেকে ৩০ শে অক্টোবর। নতুন আস্তানায় এনে তুললাম যাবতীয় জিনিসপত্র। কটা দিন এতে কেটে গেল। বৃষ্টি হল মাঝখানে খানিকটা। তবে সে নাম মাত্র। আমার কাজ বন্ধ করার মতো কিছু নয়।
৩১ অক্টোবর। ভোর বেলা বেরলাম বন্দুক কাঁধে। দুটো মতলব আমার।–শিকার করে খাদ্যসংস্থানের ব্যবস্থা করা আর এই ফাঁকে যতখানি সম্ভব দ্বীপের চারধার ঘুরে দেখে আসা। এক ধরনের অভিযান বলা যায়। শিকার বলতে পেলাম একটা ছাগল। সঙ্গে তার বাচ্চা। বাচ্চাটাকে কোলে করে গুহায় নিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম পুষব। কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না। কিছু খেতে চায় না সে। তখন তাকেও মেরে ফেলতে হল।
১লা নভেম্বর। গুহার সামনা সামনি পাহাড়ের ঢালে একটা তাবু খাটালাম। সেখানেই কাটালাম রাত। বেশ বড় সড়। জায়গা বিস্তর। মালপত্র সব রাখলাম চার ধারে টাল দিয়ে।
২রা নভেম্বর৷ আজ বেড়া বাধার কাজ শুরু। ভেলা বানিয়েছি যত্ন কাঠ দিয়ে সব জড় করে খুঁটি গেড়ে সেগুলো পেরেক পুঁতে আটকে দিলাম। বেশ মজবুত হল। সঙ্গে তারের টানা দেওয়া। নিরাপদই বলা যায়।
৩রা নভেম্বর। বন্দুক নিয়ে আজও বেরলাম ভোর সকালে। দুটো মুরগি মারলাম। দেখতে অদ্ভুত। অনেকটা পাতিহাসের মতো। মাংস অতি সুস্বাদু। বিকেলে টেবিল বানাতে বসলাম।
৪ঠা নভেম্বর। কাজের ব্যাপারে এবার একটা শখলা দরকার। অর্থাৎ নিয়ম মাফিক এবার থেকে চলতে হবে। এইভাবে সাজালাম সারাদিনের হিসেব।–সকালে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ব, ঘুরব দু থেকে তিন ঘণ্টা। বৃষ্টি হলে সেটা অবশ্যি বন্ধ থাকবে। ফিরে এসে এসব টুকিটাকি কাজ নিয়ে। চলবে এগারটা অব্দি। তারপর দুপুরের খাবার খাব। বারটা থেকে দুটো অব্দি একটানা ঘুম। এটা দরকারও। কেননা প্রচণ্ড গরমে দুপুরে বসে কাজ করা দায়। বিকেলে ফের বসব কাজ নিয়ে। মোটমাট টেবিলটা আমাকে বানাতেই হবে। পাকা ওস্তাদ তো আমি ছুতোরের কাজে! কিছুতেই আর হিসেব মাফিক কিছু করে উঠতে পারি না। তবে সে যাই হোক। কাজটা যেভাবে হোক শেষ করতে হবে।
৫ই নভেম্বর৷ কাঁধে বন্দুক, পেছনে পেছনে আসছে কুকুর–যথারীতি আমি ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে বেরিয়ে পড়লাম। একটা বন বিড়াল মারলাম গুলি করে। বেশ তুল তুলে নরম চামড়া, কিন্তু মাংস একেবারে বিস্বাদ। মুখে মোটে ঠেকাতেই পারি না। যা বিশ্রী তার স্বাদ! ফেলে দিলাম সব। তবে চামড়াটা নয়। চামড়া আমি সব কটাই রেখে দিই। যখন যে জীব মারি প্রত্যেকের! এলাম সমুদ্রের ধারে। দেখি এক ঝাক মোরগ। এদের ধরন আলাদা। সম্ভবত সামুদ্রিক জীব। আর দেখি দুটো শীল মাছ। বাপরে হঠাৎ দেখে আমার যা ভয়! দেখি নি সাক্ষাৎ আগে কোনোদিন। তবে ভয় তারাও কিছু কম পায় নি। একটু পরে সুড়সুড় করে জলের নিচে তলিয়ে গেল।
৬ই নভেম্বর৷৷ প্রাতঃভ্রমণের পর যথারীতি টেবিল নিয়ে কাজে বসলাম। আজ শেষ করতেই হবে। বহু কষ্টে শেষ হল। তবে সে এক বিতিকিচ্ছিরি চেহারা। মোটে পছন্দ হল আমার নিজেরই। তবু কী আর করা–যাহোক হল তো একটা টেবিল!
৭ই নভেম্বর। আবহাওয়া আপাতত বেশ চমৎকার। ১২ তারিখ অব্দি কদিন ধরে একটানা চলল আমার চেয়ার বানাবার কাজ। বিস্তর চেষ্টা চরিত্র করে সেটাকে মোটামুটি একটা চেহারায় আনা গেল। তবে ঐ–আমার নিজেরই অপছন্দ। তা-ও তো কতবার কতরকম বদলাবদলি করলাম। তাঁ, ভালোকথা। রবিবারের হিসেব রাখতে মাঝখানে হঠাৎ একদিন ভুল হয়ে গেছে। সেই থেকে বেহিসেবেই চলছে রবিবারের দিনটা। তা নিয়ে অবিশ্যি আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই।
১৩ ইনভেম্বর। বৃষ্টি হল ঝমঝমিয়ে। তাই শান্তি। কী যে গরমে হাঁসফাস করেছি কটা দিন! সঙ্গে বন্ধু বিদ্যুতের দাপাদাপি। তাতে করে খানিকটা বারুদে আগুন ধরে গেল। হায় হায়, সে যা দুঃখ আমার! তখন বসে বসে ছোটো ছোটো অনেকগুলো পুরিয়া বানালাম। বাকি যা বারুদ আছে তাই দিয়ে। তখন নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমার এত দরকারী জিনিস–সব একসাথে পুড়ে নষ্ট হবার আর তো সুযোগ রইল না।
১৪-১৬ই নভেম্বর। বিস্তর ছোটোছোট চৌকোনা কাঠের বাক্স বানালাম তিনদিন ধরে। এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। একেকটার আকৃতি একেক রকম। কোনোটাতে ধরবে এক পাউন্ড বারুদ। কোনোটাতে দু পাউন্ড। পুরিয়াগুলো ফের ভেঙে আলাদা আলাদা করে বাক্সে ভরলাম। রাখলাম গুহার একদম ভিতর দিকে। সম্পূর্ণ নিরাপদ এবার। একটা পাখি মারলাম বড়সড়। কী পাখি জানি না। তবে মাংস খুব সুস্বাদু। কদিন বেশ আয়েস করে খাওয়া গেল।
১৭ই নভেম্বর। গর্ত খুঁড়ে গুহাটাকে আরো বড় করার কাজ আজই শুরু হল। কিন্তু সে কি আর শুধু হাতে পারা যায়। ঢাল নেই তলোয়ার নেই…..এক্ষেত্রে ঢাল তলোয়ার বলতে একটা শাবল, বেলচা একটা, আর ঝুড়ি বা ঐ জাতীয় কিছু। কিছুই তো নেই। তখন কাজ বন্ধ করে বসলাম প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম বানিয়ে নিতে। ছিল লোহার একটা মস্ত আটা মতো। সেটাকেই সিধে সাধা করে বানানো হল শাবল। কিন্তু বেলচা বানাব কী নিয়ে? নেহাৎ কোদাল হলেও চলত। কিন্তু বানাবার যে কোনো উপকরণ নেই।
১৮ই নভেম্বর৷৷ বেরলাম ভোর বেলা যথারীতি! আজ সিধে জঙ্গল। কাল রাতেই ভেবে রেখেছি আমি মতলবটা। লোহার অভাবে এক্ষেত্রে কাঠ দিয়ে আমার প্রয়োজন মিটিয়ে নেব। তা খুঁজতে খুঁজতে দেখি সঠিক জিনিসটিই একেবারে চোখের গোড়ায়। মস্ত একটা গাছ। ব্রাজিলে এই গাছের কাঠকে বলে লোহা কাঠ। লোহারই মতোন শক্ত আর সেই অনুযায়ী ভারী। মোটাসোটা দেখে একটা ডাল কাটব বলে মনস্থির করলাম। কিন্তু সে কি আর সহজে পারা যায়! কুড়ুল মোটে বসতে চায় না। ভোতাটোতা হয়ে সে তো যাচ্ছে তাই অবস্থা। সে যাই হোক, ডাল অবশেষে কাটা গেল। নিয়ে যাব কাঁধে করে। পারি না তুলতে। যা প্রচণ্ড ভারী! বহুকষ্টে অবশেষে খানিকটা দড়ি বেঁধে টানতে টানতে খানিকটা বয়ে সেটাকে তাবুর সামনে এনে ফেললাম।
আর তাকে কেটেকুটে মাপ মতোন করা, তাই দিয়ে বেলচা বানানো–সে যে কী ঝকমারি ব্যাপার তা আপনারা আশা করি সহজেই অনুমান করতে পারছেন। তবু পারলাম শেষ অব্দি। এটাই যা সান্তনা। হাতলটা হাতলের মতোই হল। অবিশ্যি লোহার একটা বেড় মতো থাকে, সেটা বাদ। বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। আসলে জোরটা তো হাতলের উপরই পড়ে। তবে কাজ চালাবার পক্ষে চমৎকার। এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।
এবারে দরকার একটা বুডি। অথবা একটা ছোটো চার চাকার গাড়ি। ঝুড়ি বুনবার জন্যে বিস্তর খোঁজাখুজি করলাম কদিন। বেত তো নেইই, উপরন্তু এমন কোনো গাছ নেই যার কচি ডাল দুমড়ে মুচড়ে গোল করে বুড়ি বোনা যায়। সেক্ষেত্রে চাকার গাড়িটা তবু খানিকটা সম্ভব। সব পারব শুধু চাকা বাদে। কেননা চাকার জন্যে লাগবে লোহা। লোহার ডাণ্ডাটা লাগানো থাকবে গাড়ির নিচে, তার সঙ্গে লাগানো থাকবে চাকা। কীভাবে লাগাব? কোথায় বা পাব লোহার ডাণ্ডা? সুতরাং এটাও আপাতত খারিজ? তখন বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটা কাঠের মস্ত চেটানো হলো মতো বানালাম। এতে করে দেখেছি মিস্ত্রী মজুরেরা বাড়ি তৈরির সময় চুন সুরকী মাখা লেই বয়ে নিয়ে যায়। সে যাই হোক। আমার কাজ তো এতে চলবে।
মোটমাট চারদিন লাগল আমার এই সব বানাতে। উদয়াস্ত বলতে গেলে খাটুনি। শুধু সকালের প্রাতঃভ্রমণটুকু বাদ। এটা আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি না পড়লে বন্ধ হয় না। বন্দুক ঘাড়ে ঘুম থেকে উঠেই ঠিক রোজকার নিয়ম মতো বেড়িয়ে পড়া। তাতে লাভও প্রচুর। ফেরার সময় প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিকার আমার সঙ্গে থাকে।
২৩ শে নভেম্বর। অন্য সব কাজ এখন বরবাদ। শুধু নতুন তৈরি সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে গুহার আয়তন বাড়াবার কাজ। লাগল মোট আঠার দিন। আগে যতটুক জায়গা ছিল গুহায়, এখন তার প্রায় দ্বিগুণ।
মোটামুটি এতখানি বাড়াব এই মন নিয়েই আমি কাজ শুরু করেছিলাম। একাধারে আমার ভাড়ার ঘর, বৈঠকখানা, রান্নাঘর, আর তাক। সব আমি গুহাতেই করতে চাই। নিজে এখানে থাকব না, শোবো রাত্তির বেলা তাঁবুতেই। কিন্তু মালপত্রগুলো তো সব রাখতে পারব। তাতে শুকনো থাকবে, ভাঙবার ভয় নেই, এমন কি আগুনে পুড়বারও। তবে তাবুতে বৃষ্টি বেশি হলে ধার দিয়ে জলের হট আসে। এটা অস্বস্তিকর। তখন চার পাশে কখনো খুঁটি গেড়ে কাঠকুটো পাতা দিয়ে চালা মতো একটা তুললাম। বারান্দাও বলতে পারেন। ঢাকা বারান্দা। তবে নিশ্চিন্ত। যাক, বৃষ্টির হাত থেকে তো রক্ষা পাওয়া গেল।
১০ই ডিসেম্বর। গুহা বাড়াবার কাজ শেষ, হঠাৎ একদিন একটা অংশ থেকে খানিকটা মাটি ধসে পড়ল। আমি তো থ। ভয়ও পেয়ে গেছি খুব। যদি থাকতাম আমি এখন ঐ অংশে! তবে তো জ্যান্ত কবর। নতুন করে কবর খুঁড়ে মৃতদেহ শোয়াবার আর ব্যবস্থা করতে হত না। (অবিশ্যি এই বিজন বিভুয়ে কে-ই বা করবে সে ব্যবস্থা!) সে যাই হোক, কাজ খানিকটা বাড়ল। মাটি তুলে ফেলে দিলাম বাইরে। ছাদটাকেও মেরামত করা দরকার। মোটমাট নিশ্চিন্ত হতে চাই, এরকম ধস ভবিষ্যতে আর কখনো নামবে না।
১১ই ডিসেম্বর। মেরামতির কাজে আজ থেকেই লেগে পড়েছি। একদিনে হবার নয়। ঝামেলা যে অনেক। লাগল মোট সাতটি দিন। খুঁটি গাড়লাম ভিতরে বেশ কয়েকটা। খুঁটির মাথায় চেরা কাঠ দিলাম সেঁটে। এইভাবে বলতে গেলে আগাগোড়া ছাদটাই। তাতে এক ঢিলে দু পাখি মারা হল। ছাদের সুরক্ষা, সেই সাথে খুঁটি দিয়ে ঘরের মধ্যে মোটামুটি একটা ভাগাভাগি মতো। অর্থাৎ এ খুঁটি থেকে ঐ খুটি অব্দি রান্নাঘর। ওটা থেকে ঐটা অব্দি ভাড়ার। এই রকম।
১৭ই ডিসেম্বর। ২০ তারিখ অব্দি নাগাড়ে করলাম তাক লাগাবার কাজ। খুঁটির গায়ে পেরেক পুঁতলাম একরাশ। সব জিনিস তো আর বসিয়ে রাখা যাবে না, কিছু কিছু বুলিয়ে রাখারও দরকার হবে। তা হল সে ব্যবস্থা। এবার খিড়কি দোরটার দিকে নজর দিতে হবে।
২০ শে ডিসেম্বর। যাবতীয় মালপত্র গুহায় নিয়ে এলাম। এবার সাজিয়ে রাখার পালা। আরো কটা তাক লাগাতে হল। এদিকে চেরা কাঠের টানাটানি। কত আর থাকতে পারে, সবই তো মোটামুটি এটা নয় ওটা নানান কাজে লাগানো। ইতোমধ্যে আরেকটা টেবিলও বানিয়েছি।
২৪শে ডিসেম্বর। আজ সকাল থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। চলল সারারাত। আমি বাপু গুহার মধ্যে গুটিসুটি মেরে সারাদিন বসা। বাপরে বাপ, এই বৃষ্টিতে কোনো সুস্থ মানুষ বেরতে পারে।
২৫শে ডিসেম্বর। সারাদিন আজও বৃষ্টি। ২৬শে ডিসেম্বর। বৃষ্টি আজ আর নেই। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। বেশ চমৎকার লাগছে। ২৭ শে ডিসেম্বর। একটা ছাগল মারলাম। আরেকটার পায়ে লেগেছে গুলি, যথেষ্ট জখম, আমি গলায় দড়ি বেধে টানতে টানতে তাঁবুতে নিয়ে এলাম। খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখলাম। দেখি পা-টা ভেঙেছে। লতা পাতা দিয়ে বাধা ছাদা করে দিলাম। সারল ধীরে ধীরে পা। পোষও মানল। না মেনে উপায় কী। এতদিন ধরে এত সেবা, এত যত্ন, তার তো একটা প্রতিদান বলেও জিনিস আছে! ঘাস খেত কুচকুচ করে। আমার তাবুর সামনেই তো কত ঘাস! যেত না কোথাও। দেখে দেখে আমারও মনে খেলে গেল, নতুন মতলব। তাই তো, এমন কয়েকটা জীব ধরে এনে পোষ মানালে কেমন হয়! ঘরের থেকে তো আর কিছু দেবার দরকার হবে না। বরং বারুদ ফুরিয়ে গেলে এরাই আমার দিনের দিন অন্ন যোগাবে।
২৮-৩০ শে ডিসেম্বর ॥ ভীষণ গরম। একটুও হাওয়া নেই। প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। গাছের পাতা একটু নড়ে না পর্যন্ত। বিকেলে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লে আমি শিকারের অন্বেষণে বেরই। আর সারাদিন ছায়ায় বসে দরজা তৈরি নিয়ে খুটখাট করি।
১লা জানুয়ারি । প্রচণ্ড তাপ। কমে নি একটুও। ভোর সকালে বেরিয়ে যাই, সূর্য উঠতে
উঠতে ফিরে আসি। ফের বেরই বিকেলে। দুপুরে চিৎপাৎ বিছানায় শোয়া। আজ বিকেলেই একটা নতুন আবিষ্কার হল। পাহাড়ের ওপাশটায় চলে গিয়েছিলাম। দেখি মনোরম এক উপত্যকা। সেখানে প্রচুর ছাগল ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে। বড় লাজুক তো ওরা। আমাকে দেখা মাত্র সে যা ছুট! ক্লাল কুকুরটাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসব। গুলি না চালিয়ে দেখি একটাকেও ধরতে পারি কিনা।
২রা জানুয়ারি। আজ সাথে কুকুর নিয়ে এসেছি। লেলিয়ে দিলাম। দেখি উলটো ব্যাপার। শিং উঁচিয়ে দল বেঁধে সবাই এককাট্টা হয়ে দাঁড়াল। কুকুর মশাই তো হতভম্ব। এমন যে হতে পারে আমার মতো সেও তো আশা করে নি। দেখি মানে মানে পিছু হটতে লেগেছে।
৩রা জানুয়ারি। মাটির দেয়াল আর তারের বেড়াটা নিয়ে ফের উঠে পড়ে লেগেছি। কেবলই মনে ভয় পাছে কেউ যদি অতর্কিতে আক্রমণ করে। মোটমাট আরো পুরু করতে হবে দেয়াল এবং আরো পোক্ত।
[১৪ই এপ্রিল অব্দি একটানা দেয়াল নিয়ে লেগে রইলাম। অন্য কিছু করার সময় আর মোটে করে উঠতে পারি না। এমন একটা বিরাট কিছু নয়। মাত্র ২৪ গজ লম্বা ঘোরানো দেয়াল। একদিক থেকে অপরদিক চওড়ায় মাত্র ৮ গজ। তবু আর গুহা দুটোই দেয়ালের গণ্ডীর মধ্যে। গুহার দরজাটা ঠিক মাঝ বরাবর।]
সে একেবারে উদয়াস্তু খাটুনি। মাঝখানে হপ্তা বলতে গেলে একটানা বৃষ্টি হল। তাতে ক্ষতি হল কাজের। কিন্তু আমারও সেই এক গো। যেভাবে হোক, দেয়ালটা গড়ে তুলতেই হবে। এটা আমার নিরাপত্তার জন্যে একান্ত দরকার। জঙ্গল থেকে কাঠের খুটি কেটে আনা থেকে শুরু করে মাটি কাটা, মাটি তোলা, তাকে কাদা করা–সব এই দু হাতে। এ যেন অসাধ্য সাধনের মতো ব্যাপার।
তা দেয়াল যখন শেষ হল, আমি স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হয়েছে বেশ খানিকটা উঁচু। এমনকি জাহাজ যদি আশেপাশে আসে, হঠাৎ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এটা পাহাড়েরই অংশ না আর কিছু। মনুষ্য-বসতির বিন্দুমাত্র লক্ষণ তাদের নজরে পড়বে না। পড়ুক। আমিও সেটাই চাই।
তাই বলে কাজে যেহেতু ব্যস্ত, ভাববেন না, রোজকার শিকার করা আমি ছেড়ে দিয়েছি। শুধু বৃষ্টি হলে যা অন্য ব্যবস্থা। আর বেরলে সে যে কত নতুন নতুন আবিষ্কার। এক একটা আবিষ্কার হয় আর প্রাণ মন আনন্দে নেচে ওঠে। একদিন দেখি এক ঝাঁক বন-পায়রা। তারা গাছে থাকে না, পাহাড়ের গায়ে ফাঁক ফোকরে বাসা বেঁধে বাস করে। একদিন কয়েকটা ফোকরে হাত ঢুকিয়ে নিয়ে এলাম কটা বাচ্চা। পুষলাম। হল বড়। ওমা, দেখি একদিন ফুড়ুৎ। সে যা দুঃখ আমার! অবিশ্যি ওদের দোষ নেই। খাবার তো কিছু দিতে পারি না। কদিন আর পারে, দাতে দাঁত চেপে সহ্য করতে! তা আমিও হাল ছাড়বার পাত্র নই। ফোকরে হাত গলিয়ে প্রায়ই নিয়ে আসতাম একটা কি দুটো বাচ্চা। কদিন পুষে তারপর কেটে কুটে খেতাম। অপূর্ব সুস্বাদু মাংসের।
অর্থাৎ বলা যায় ইদানীং আমি নিজেকে নিয়ে অতিশয় ব্যস্ত। ঘর গেরস্থালি সাজানো থেকে শুরু করে রান্না বান্না সব এই দুহাতে। কিন্তু নানান জিনিস যে এখনো আমার দরকার। প্রয়োজন যে একটু একটু করে বাড়ছে। যেমন জল রাখবার একটা কুঁজো বা কলসী আমার অবিলম্বে চাই। কোথায় পাব কলসী? বর্ষাবাদলের দিনে ঘরে আগে থেকে জল তুলে না রাখলে বড় অসুবিধে হয়। চেষ্টা করলাম বিস্তর। প্রথমে মাটি দিয়ে, তারপর কাঠ দিয়ে। কিছুতেই আর হয়ে উঠে না। যেমন ভাবে বানাই, কোথাও না কোথাও চুঁইয়ে পড়ার একটা জায়গা থেকে যায়। তাই দিয়ে পড়ে যায় সব জল। তখন বাধ্য হয়ে সে চেষ্টা পরিত্যাগ করলাম।
বাতিরও খুব দরকার বোধ করি। বাতির অভাবে সন্ধে লাগতে না লাগতে আমাকে শুয়ে পড়তে হয়। সাতটা বাজে তখন মোটে! খানিকটা মোম পেলেও চলত। সেই যেমন আফ্রিকায় ছিল সঙ্গে, তাই দিয়ে নৌকোয় জ্বালাতাম বাতি। এখন অবিশ্যি খানিকটা চর্বি সম্বল। সেই একটা ছাগল মেরেছিলাম, তারই চর্বি জমিয়ে রেখেছি। রোদে নিয়েছি শুকিয়ে। বানিয়েছি মাটি দিয়ে একটা ছোট্ট থালা। তাতে শুকনো চর্বি রেখে তার মধ্যে দিয়েছি একটা ন্যাকড়ার পলতে। তাতেই জ্বলে বাতি। আলো অবিশ্যি তেমন একটা জোরাল নয়, তবু কাজ চলে আমার।
ইতোমধ্যে আর এক কাণ্ড। একদিন জাহাজ থেকে আনা এটা ওটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা থলি, তাতে কিছু শস্য দানা। এগুলো মুরগির খাবার। আমাদের জাহাজের সঙ্গেই এসেছে। তবে এ যাত্রায় জাহাজে মুরগি ছিল না। ছিল আগের যাত্রায়। তারই উদ্বৃত্ত খাবার পড়ে ছিল হয়ত থলিতে। কেউ খেয়াল করে নি। তাতে ইঁদুর মহারাজদের পোয়াবার। খেয়েছে প্রাণ ভরে যত খুশি। তা তাবুতে সেই থলিটা খুলে দেখি কিছু খোসা আর আধ খাওয়া দানা। কী হবে এ সব রেখে? ফেলে দিলাম ঝেড়ে তাবুর সামনের উঠোনে। থলিটা তখন আমার খালি করা একান্ত দরকার। বারুদ রাখব। তারপর আর সেই দানার কথা আমার মনে নেই।
মাঝখানে কদিন টানা বৃষ্টি গেল। তারও প্রায় মাস খানেক পর। হঠাৎ একদিন চোখ পড়তে দেখিবা রে বাঃ । সবুজ সবুজ কটা চারা যে বেরিয়েছে! সে কী আনন্দ আমার! গুনে দেখলাম সব মিলিয়ে মোট বারটা। সবই যব গাছ। আমাদের ইংল্যান্ডে এই জাতের যব হয়।
শুধু আনন্দ বুললে কম বলা হয়, যতটা আনন্দ ঠিক ততখানিই যেন বিস্ময়। সত্যি বলতে কি, আমার প্রায় হতবাক মৃক বিমূঢ় অবস্থা তখন। কী বলব একে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া কী অন্য কিছু একে বলা যায়? কিন্তু আমি তো ঈশ্বরকে একবারও ডাকি নি। এই কদিনে এক বারও স্মরণ করি নি তার নাম। ধর্মকর্ম সম্বন্ধে আমার তেমন একটা আসক্তি বা আগ্রহ নেই। তবে কেন আমার মতো মানুষের প্রতি তার এত দয়া! ঐ যে বলে–সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর–একি তাঁরই প্রতিরূপ। হয়ত মানস চক্ষে দেখেছেন তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্যে এখানে এই ছন্নছাড়া দ্বীপে আমার কিছু খাদ্যশস্যের প্রয়োজন। আচমকা তারই ব্যবস্থা করে দিলেন।
চোখ দিয়ে জল পড়ছে তখন আমার। আনন্দের অশ্রু। আমি ধন্য। প্রকৃতির তথা ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ অযাচিত ভাবে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। শুধু যব নয়। পরে দেখি কটা ধানচারাও আছে ওর মধ্যে। একই সাথে দুরকমের খাদ্য। চোখে যে জল আসবে এটাই তো স্বাভাবিক।
অবাক হয়ে এখনো ভাবি সেই সব কথা। মঙ্গলময় ঈশ্বরের অসীম করুণা পরম। তার প্রমাণ আমি আরো অনেক ক্ষেত্রে পেয়েছি। যেমন ধরুন সেই থলি ঝেড়ে ফেলা। যদি ফেলতাম সেটা কোনো মুক্ত জায়গায়, তবে রোদে পুড়ে কবে খাক হয়ে যেত।
ঈশ্বরের অজ্ঞাত নির্দেশে আমি ফেলেছি তা পাথরের আড়ালে ছায়াময় স্থানে। সেখানে জল বুকে নিয়ে প্রাণ পেয়েছে বীজ। একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। তাতে ধান হয়েছে যব হয়েছে আর কী চাই আমার। আমি কৃতার্থ।
জমিয়ে রেখে দিলাম প্রতিটি দানা। থাক আপাতত মজুত। লাগাব ফের বর্ষকালে। অর্থাৎ জুনে। তা থেকে যা ফসল পাব–এবার তো আর আগের মতো দুটো চারটে হবে না, হবে অজস্র, তা দিয়ে রুটি গড়তে পারব, বাকিটা জমিয়ে রাখলে হবে আমার ভবিষ্যতের সঞ্চয়। তা এই সব হিসেব করে সময় মেপে বীজ ফের পরের মরশুমে ছড়িয়ে দিলাম। সবটা নয় অবিশ্যি। কিছুটা। গেল সব নষ্ট হয়ে। সময় হিসেব করতে ভুল হয়ে গেছে। রোদে পুড়ে সব গেল ছারখার হয়ে। এমনি ভাবে চার বছর পার হতে তবে আমি নিজের খাদ্য নিজে চাষ করতে সক্ষম হলাম।
ধানও হল বেশ খানিকটা। মন্দ নয়। মোটের উপর দুরকম ব্যবহার জানি আমি ধানের। গুড়ো করে রুটির মতো করে খাওয়া, কিংবা রান্না করে খাওয়া। সেটা যখন অবিশ্যি যেমন যেমন সুযোগ হবে সেই ভাবেই খাব। এখন তো থাক মজুদ। এই অবকাশে আমি আবার আমার দিনপঞ্জিতে ফিরে আসি।
খুব খাটুনি গেল তিন চার মাস। সেই দেয়াল তোলা নিয়ে। শেষ হতে হতে ১৪ই এপ্রিল। বেশ উঁচু ঢুকবার কোনো ফাঁক ফোকর নেই। আছে শুধু একটা মই। সেটা দিয়ে বেয়ে উঠি দেয়ালের মাথায় তারপর মই তুলে ভিতরে পাতি। নামি বেয়ে বেয়ে। ব্যঙ্গ আমি সব দিক থেকে নিরাপদ।
১৬ই এপ্রিল। মইটা আজ শেষ হল। মন্দ নয়, ব্যবস্থা হিসেবে চমৎকার। দেয়াল টপকে নামতে পারলে আমার আর দুশ্চিন্তা বলতে কিছুই থাকে না। তা কম জায়গা তো ঘিরি নি। ঘুরে ফিরে বেশ স্বচ্ছন্দেই বেড়ানো যায়। আর বাইরের সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ ছিন্ন। মন্দ কী! এই তো বেশ।
পরের দিনই সে এক তুলকালাম কাণ্ড। এত খাটুনির দেয়াল আমার। গেল চোখের নিমেষে তছনছ হয়ে। আর আমি যেন মানুষটা মরতে মরতে প্রায় বেঁচে গেলাম। সে যা দুর্ভোগ! ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি।
গিয়েছিলাম বাইরে, মই বেয়ে সবে ভিতরে নেমেছি কি নামি নি হঠাৎ গুড় গুড় গুম গুম চারপাশে একটা অদ্ভুত শব্দ। আমি তো অবাক। দেখি গুহার উপর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে নামছে এক বিশাল পাথর। দেখতে না দেখতে তাঁবুর দুটো খুঁটি ভেঙে যেন দৈতের মতো আমাকে গ্রাস করবে বলে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে এল। আমি তো ঘাবড়ে এক লাফে মই বেয়ে পাচিলের মাথায় গিয়ে উঠেছি। দেখি পাচিল পায়ের নিচ টলছে। ঠিক দুলুনি যে রকম। কেউ যেন নাড়াচ্ছে সমস্ত শক্তি দিয়ে। চটপট মই তুলে বাইরে নামলাম। নামতে না নামতে হড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল একদিকে দেয়াল। বলতে গেলে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলাম। আর তখনি বিদ্যুৎ চমকের মতো কারণটা মনের পর্দায় এসে ঝাঁপট মারল। তবে কি ভূমিকম্প! নইলে এই যে দাঁড়িয়ে আছি আমি মাটির উপর, এটা এত দুলবে কেন? তিন তিনবার সে যে কী দুলুনি! আমি তো টাল খেয়ে পড়ে যাবার যোগাড়। এমন নড়চড়ানির হাতে কি আর মাটির তৈরি একহারা দেয়াল রক্ষা পায়! বড় বড় দালান অব্দি কাত হয়ে পড়বে দেখতে না দেখতে। সমুদ্রের দিকে চোখ যেতে দেখি জলেও ভীষণ তোলপাড়। ফুলে ফুলে উঠছে জল। ঢেউ হয়ে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপট মারছে পাড়ে। সে যেন ফুসিয়ে ওঠা দুরন্তু একটা কালসাপ। আমার ভাগ্যি ভালো, আমি এখনো এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে বহাল তবিয়তে বেঁচে বর্তে আছি।
তবে একটা কথা। বড্ড ভয় ধরে গেছে মনে। সেই সাথে বিস্ময় বিমূঢ় একটা ভাব। সেই যে বলে না বিপদের মুখে পড়ে থ মেরে যাওয়া, ব্যাপারটা ঠিক তাই। বিশ্বাস করতে পারছি না এতক্ষণ যা নিজের চোখে দেখলাম। সব এখন শান্ত। তবু আমি যেন কান পাতলে শুনতে পাই সেই পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ। কিম্বা সমুদ্রের সেই দুরন্তু তোলপাড় ঢেউয়ের গোঙানি। বুকের ভেতরটায় এখনো যে হাতুড়ি পিটছে। যেন সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে ফিরে এলাম।
বসে রইলাম চুপ করে মাটির উপর। ভাঙা দেয়াল ডিঙিয়ে ওধারে যেতে এখন ভয় করছে। আতঙ্ক যাকে বলে। তবে প্রথমের সেই অতটা ভয় এখন আর নেই। কিন্তু কী করব বা করা উচিত সেটা বুঝতে পারছি না। আর অবাক ব্যাপার, এই যে এতক্ষণ ধরে এত উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল আমার সময়, কই একবারও তো মুখ দিয়ে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করি নি।
বসে থাকতে থাকতেই কালো হয়ে এত আকাশ। সে একেবারে কুচকুচে কালো রঙ। যেন মসীকৃষ্ণ। বৃষ্টি হবে। হল না তখন। আগে উঠল ঝড়। বাতাস বাড়তে বাড়তে সে একেবারে এতপাথাড়ি তুফান যেন। গাছের ডালপালা নাড়িয়ে হু হু বেগে প্রকৃতি ওলট পালট করা ভীষণ তুফান। চলল প্রায় নাগাড়ে তিন ঘন্টা। তারপর বৃষ্টি নামল।
আমি কিন্তু ঠায় সেইখানেই বসা। একটা জিনিস বুঝতে পারছি, এই তুফান এই বৃষ্টি–সব ভূমিকম্পেরই ফল। তার মানে ভূমিকম্প আপাতত আর হবে না। তবে মিথ্যে এখানে বসে বৃষ্টিতে ভিজি কেন? গেলাম তখন তার ভেতর। গুহায় এখন যাব না। তবুটা তা-ও বরং নিরাপদ। আসলে আতঙ্ক তখনো আমার পুরোপুরি কাটে নি। ভয় ভয় ভাবটা আছে। কিন্তু তাও বা কতক্ষণ! বৃষ্টির ঝাঁপট যে ভীষণ। তাঁবুর একটা ধারের চালা গেছে পড়ে, সেখান দিয়ে দমকা ছাঁট আসছে হুহু বেগে। তখন সব ভয় ঝেড়ে ফেলে ছুটতে ছুটতে গিয়ে গুহার মধ্যেই ঢুকলাম।
বৃষ্টি হল সারারাত। পরদিনও প্রায় দুপুর অব্দি। আমি তো ঠায় গুহাতে বসা। বাপরে বাপ, বেরই কখনো! আর বসে বসে কেবল তোলপাড় খাচ্ছে নানান চিন্তা আমার মনে। এই যে ভূমিকম্পের ভয়াল রূপ দেখলাম, এর পরও কি এখানে থাকা সমীচীন। গুহায় থাকা আর সম্ভব হবে না। কোনোদিন হুড়মুড়িয়ে গোটা পাহাড়টা ভেঙে পড়বে, আমি চাপা পড়ে জ্যান্ত কবরে যাব। সে আমার ঘুমের মধ্যেও হতে পারে। তার চেয়ে বরং সময় থাকতে বাইরে কোনো মুক্ত জায়গায় আস্তানা গাড়া ভালো। চারপাশে নয় পঁচিল দিয়ে ঘিরে নেব। তাহলে আর চিন্তা কী! সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকবে না। এবং যত দ্রুত সে রকম ব্যবস্থা করা যায় ততই মঙ্গল।
মোটমাট সরিয়ে নিয়ে যাব যে আস্তানা, এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধা নেই। সিদ্ধান্তে মোটের উপর আমি অটল। কিন্তু কোথায় সরাব সেটাই এখন প্রশ্ন।
এপ্রিল মাসের ১৯ আর ২০ তারিখ এই দুটো দিন জায়গা পরখের কাজেই কাটল।
এদিকে ঘুমটাও কদিন ধরে হয় না বললেই চলে। রাতে শুয়ে থাকি চুপচাপ কিন্তু ঘুম আর আসে না। সেই আতঙ্ক আর কি। যদি পাহাড়টা ভেঙে পড়ে মাথার উপর। যদি জ্যান্ত কবর হয়। তাছাড়া জিনিস পত্র যে টেনেটুনে নিয়ে যাব নতুন জায়গায় এটাও আরেক সমস্যা। কীভাবে নবো কী করব শুয়ে শুয়ে সেই সবই কেবল ভাবি।
মোটের উপর যাই করি না কেন, সেটা সময় সাপেক্ষ। চট করে তো আর ইচ্ছে হল অমনি চলে গেলাম কোনো একটা জায়গায়, তবু গাড়লাম, নিশ্চিন্তে শুয়ে ঘুমোলাম, তা তো আর হয় না। নিরাপত্তাটা সব সময়ই বড় প্রশ্ন। আগে তাঁবু খাটালে চলবে না। এখানেই মোটামুটি মেরামতি করে থাকতে হবে এখনো অনেক দিন। আগে দেয়াল তুলব নতুন জায়গায় এবার আর শুধু মাটি দিয়ে নয়, শক্ত খুঁটি গেড়ে তাতে তারের বঁধুনি দিয়ে তার উপর দেয়াল। সেটা সহজে পড়বে না। তারপর দেয়াল সম্পূর্ণ তৈরি হলে মালপত্র এক এক করে নিয়ে যাব। শেষে করব তাঁবু। তখনি গিয়ে থাকার প্রশ্ন আসে।
২২শে এপ্রিল ৷ আজ সকাল থেকেই কাজে লাগলাম। কিন্তু সে এক নতুন সমস্যা। যন্ত্রপাতি যা ছিল সাথে তার তো বড়ই বেহাল। যেমন করাত বা কুড়ুল, এতদিন তা দিয়ে কেটেছি অজস্র শক্ত কাঠ, তাতে ধার গেছে নষ্ট হয়ে, এখন সবই বলতে গেলে ভেঁতা। তাই দিয়ে কি আর পারা যায় নতুন করে গাছ গাছালি কাটা। তাই সর্বপ্রথম দরকার সেগুলোতে শান দেওয়া। কিন্তু দেব কীভাবে? যা একটা আছে ঠিক, কিন্তু তাতে তো ধার দেবার উপায় নেই। নতুন একটা কোনো পথ বের করতে হবে। হবেই। এবং সেটাই আমার সব কাজের প্রথম কাজ।
তখন বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে দুদিন খেটে তৈরি করলাম একটা চাকা। সেটা পাথরের। তাতে ফুটো করলাম। তারপর দড়ি গলিয়ে নিলাম মাঝখান দিয়ে। খুব একটা ভারী না আবার বড়ও না। প্রান্তর্দেশ মসৃণ। বসে দুপায়ের আঙুলে দড়ি বেঁধে পাক খাইয়ে মোটামুটি সেটা বেশ ঘোরানো যায়, তখন হাত দুটো থাকে আলগা। তাতে কুড়ুল, করাত বা ছুরি নিয়ে স্বছন্দে ধার দেওয়া যেতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, এ ধরনের যন্ত্র সম্পূর্ণ আমার নিজেরই মগজ খাঁটিয়ে তৈরি। আগে কোথাও কোনোদিন দেখি নি বা নিজের হাতে তৈরি করব যে কখনো তাও ভাবি নি। নেহাত অবস্থার চাপে পড়ে করতে হল। বলা যায়, আমার উদ্ভাবনী ক্ষমতা এখানে মৌলিক আবিষ্কারের পথ ধরল।
২৮ শে ও ২৯ শে এপ্রিল। দুদিন ধরে শানালাম আমার যাবতীয় কাজের সরঞ্জাম। শান দেবার বস্তুটা বেশ চমৎকার কাজ করছে।
৩০ শে এপ্রিল ৷ রুটির সঞ্চয় একটু একটু করে কমে আসছে। আজ সময় নিয়ে ভালো করে হিসেব কষে দেখলাম যা পড়ে আছে তাতে আমার আর কতদিন চলতে পারে। মোটমাট কমতির পথে এটা ঘটনা। সেক্ষেত্রে আপাতত বেশ কিছুদিন দৈনিক একখানা করে বিট ছাড়া আমার আর সঞ্চয় থেকে এক কণা খাবারও গ্রহণ করা উচিত নয়।
১লা মে। সকাল। আনমনা রোজকার অভ্যেস মতো তাকিয়েছি একবার সমুদ্রের দিকে, দেখি কুলের কাছে জলের উপর কী যেন একটা ভাসছে। দেখতে যেন একটু বড় সড়। গেলাম ছুটতে ছুটতে। দেখি একটা পিপে। আশে পাশে কয়েকখানা কাঠের টুকরো। মোটমাট ঝড়ের দাপটে যে ভাসতে ভাসতে এখানে এসে ভিড়েছে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ভেতরে বারুদ ঠাসা তবে জল ঢুকেছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। তাতে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে বারুদ। তবু বারুদ তো। সে যে অবস্থাতেই থাকুক তার একটা ব্যবহারিক মূল্য অবশ্যই আছে। তাই ঠেলতে ঠেলতে পিপে নিয়ে এলাম কূলে। ডাঙায় তুললাম। যাক, শান্তি। এটাকে নিয়ে যাব আমার ভঁবুতে।
আর অবাক কাণ্ড, দেখি পাহাড়ের আড়ালে ডাঙা থেকে প্রায় দু আড়াই মাইল দূরে আমাদের জাহাজটাও বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তবে কি এখানেই ছিল এতদিন, আমি দেখতে পাই নি? হয়ত তাই। প্রায় দু ফুট মতো বালির মধ্যে ডোবানো। ভাঙচুর হয়েছে তবে খোলটা আস্ত আছে। আর বালিতে বোঝাই। সে যে কত বালি! ঢেউ এসে তুলে দিয়ে গেছে পরতে পরতে বালির স্তূপ। তাতে চট করে দূর থেকে বোঝাও যায় না এটা জাহাজ। কী করি এখন। যেতে যে ভারি মন চাইছে জাহাজের কাছে। কিন্তু অনেকটা যে জল। আগের মতো আর কী সম্ভব হবে? হোক অসম্ভব, তবু যাবই যাব। নতুন আস্তানা গড়ার প্রয়োজনে অনেক কিছু এখন আমার দরকার। দেখা যাক, তার কতটা পারি জাহাজ থেকে নিয়ে আসতে।
কিন্তু যাব যে জাহাজে, রাস্তা কোথায়! চতুর্দিকে যে জল। পাটাতনে উঠব তারও তো উপায় নেই। বালিতে যে গোটা পাটাতন বোঝাই। তবে কি নিরুদ্যম হয়ে ফিরে যাব? মোটেই না। কোনো জিনিসে হতাশ হওয়া আমার অভ্যাসের বাইরে। যাব সাঁতার কাটতে কাটতে জাহাজের কাছে। ঐ অবস্থাতেই বালি সরিয়ে ওঠার পথ তৈরি করব। ভেঙে চুরে খুলে নিয়ে আশ্ব যা পারি যতটুকু পারি সব। মোটমাট কোনো কিছুই এবার আর ফেলে আসব না। যা পাই তাতেই আমার লাভ। যা আনব তাইতেই আমার নতুন আস্তানা গড়ার কাজ হবে।
৩রা মে। আজ কাজে হাত দিলাম। করাত নিয়ে এসেছি সঙ্গে। কাটলাম মস্ত বড় একটা খুঁটি। অবিশ্যি তার আগে বালি সরিয়ে নিয়েছি। সেটা কাটতে ভিতরে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখা গেল। তবে বালি সেখানেও আছে অল্প বিস্তর। চেষ্টা করলে সেই ফোকর দিয়ে খোলের মধ্যে ঢোকা যাবে। কিন্তু চেষ্টার সুযোগ আর হল না। জল বাড়তে শুরু করেছে। আমি সাঁতার কেটে খুঁটিটাকে ভাসাতে ভাসাতে কূলে এসে উঠলাম।
৪ঠা মে। মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। একটাও ওঠে নি। সমস্ত পরিশ্রম আমার বৃথা। ধরা ঝক্কিও বটে। বঁড়শি তো নেই, শুধু খানিকটা মোটা সুতো। তাতে টোপ বেঁধে ফেলে দিই জলে। তাই খায়। আলটপকা টান মারলে সটান উঠে আসে কুলে। অনেকগুলো আবার ফসকে যায়। তবে যা পাই তাতেই আমি খুশি। কাজ চলে যায়। শুকিয়ে রাখি রোদ্দুরে। পরে কখনো কখনো শিকার না পেলে চিবিয়ে খাই। মন্দ লাগে না। হ্যাঁ ভালো কথা, আজ মাছ ধরতে গিয়ে মস্ত একটা ডলফিন দেখেছি।
৫ই মে ৷ আজ ফের জাহাজে। আবার একটা খুটি কাটলাম। পাটাতন থেকে পর পর কয়েকখানা কাঠ খুলে আনলাম। বাধলাম একসাথে সব দড়ি দিয়ে। ভেলার মতো হল। তাই নিয়ে ভাসতে ভাসতে এলাম কূলে। ঢেউ বাড়ছে।
৬ই মে। আজ অনেকগুলো লোহার বট খুলে ফেললাম। আমার খুব কাজে লাগবে। লোহার পাত অনেকগুলো পাওয়া গেল। আজ খুব পরিশ্রম গেছে। ফিরে এলাম বেলা থাকতে থাকতে আস্তানায়।
৭ই মে। জাহাজে গেলাম কিন্তু কাজের ইচ্ছে নিয়ে নয়। কেমন যেন সকাল থেকেই গা এলানো ভাব। গিয়ে দেখি, বাতাস আর ঢেউয়ের ঝাঁপটায় আমার কেটে নেওয়া খুঁটি বরাবর সব ভেঙেচুরে ডাই হয়ে পড়ে আছে। সেটা অবিশ্যি আমার পক্ষে খুবই মঙ্গল। পরিশ্রমের আর তেমন দরকার হবে না। আর খোলের ভিতরটাও এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেখানে থই থই করা জল আর নিচে বালির স্তূপ।
৮ই মে আজ পাটাতনের সব কাঠ খুলে নিয়ে আসব। সেই মন নিয়ে গেছি খুব সকাল সকাল। কিন্তু সব আনা হয়ে উঠল না। লোহার আংটা ছাড়িয়ে খুলতে পারলাম মোটে খানকতুক। সেগুলোই পর পর দড়ি দিয়ে বেঁধে ভেলার মতো ভাসাতে ভাসাতে স্কুলে নিয়ে এলাম।
৯ই মে। কটা আংটা এমনই কড়া, কিছুতেই পারলাম না ভাঙতে। সে যে কী পরিশ্রম সারাদিন। সীসের সেই পাতটার দিকে চোখ পড়ল। প্রচণ্ড ভারী। কীভাবে যে নিয়ে আসব সেটাই সমস্যা।
১০ থেকে ১৪ই মে। সব কাঠই প্রায় নিয়ে আসা হল। আর বিস্তর লোহার নাট, বল্ট, আটা। সব মিলিয়ে ওজন প্রায় দু তিনশ দর।
১৫ই মে। দুটো হাত কুড়ুল নিয়ে আজ জাহাজে গেলাম। সীসের পাতটা আজ কেটে আনতেই হবে। কিন্তু কাটব কীভাবে, জলের নিচে যে ডোবানো। প্রায় দেড় ফুট মতো জল। কিছুতে পারলাম না জল ভেদ করে কডুলের ঘা মারতে।
১৬ই মে। কাল রাতে ঝড়ের খুব দাপাদাপি গেছে। সকালে উঠে বেরলাম শিকারে। পায়রা ধরতে মিথ্যে অনেকখানি সময় নষ্ট হল। ফিরে এসে দেখি, জল বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় জাহাজে যাওয়ার চেষ্টা করাও বৃথা। তাই আর গেলাম না।
১৭ই মে। ঢেউ ভাসিয়ে এনেছে বিস্তর কাঠ। পড়ে আছে বালির উপর। কিন্তু সে প্রায় দু আড়াই মাইল দূর। গেলাম হাঁটতে হাঁটতে সেখানে। কিন্তু অসম্ভব ভারী। বয়ে আনা আমার মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আনা আর হয়ে উঠল না।
২৪শে মে। এই সাতদিন বোজ একবার করে গেছি জাহাজে। বলতে গেলে উদয়াস্তু পরিশ্রম। খোলাখুলি সব শেষ। কাঠ ছাড়াও পেয়েছি নাবিকের মালপত্র রাখার দুটো পেটি আর কটা মদের পিপে। আজ পিপে আর পেটি দুটো ফেলে দিলাম জলে। চিন্তা নেই, ভাসতে ভাসতে ঢেউয়ের তাড়নায় ঠিক কূল অব্দি পৌঁছে যাবে। কিন্তু কাঠ ভাসাবার সাহস পেলাম না। হাওয়া ছুটছে ডাঙার দিক থেকে। তাতে ঠেলতে ঠেলতে সব নিয়ে যাবে সমুদ্রের দিকে।
১৫ই জুন। অব্দি টানা চলল সব কিছু নিয়ে আসার কাজ। খাটুনি অবিরাম। শুধু দুপুর বেলা গিয়ে দুটি খেয়ে আসি। তখন ঢেউটাও বাড়ে কিনা। তা এনেছি যতখানি মোটের উপর আমি নিশ্চিন্ত। লোহা আর কাঠ দিয়ে এখন যে কোনো মুহূর্তে চমৎকার একটা নৌকো বানিয়ে নিতে পারি। সীসেও অনেকখানি আনতে পেরেছি। তাতে ঝালাইয়ের কাজ হবে।
১৬ই জুন৷ আজ একটা মস্ত বড় কাছিম দেখলাম। ইয়া বিরাট। আগে কখনো কাছিম এতদঞ্চলে দেখি নি। আছে বিস্তর। সেটা এপারে নয়, পাহাড় পেরিয়ে ওদিকে। ইচ্ছে হলে দিনে একশ দুশ অব্দি ধরা যায়।
১৭ই জুন। বেশ করে বঁধলাম আজ কাছিমের মাংস। পেটে প্রায় ষাটটার মতো ডিম। আর মাংসর সে যা স্বাদ। আহা, অপূর্ব! কতদিন যে খাই নি এ জাতীয় মাংস। শুধু তো ছাগল আর মুরগি। খেতে খেতে জিভ যেন বিস্বাদ হয়ে গেছে।
১৮ই জুন। আজ সারাদিন বৃষ্টি। বাইরে বেরলাম না। শীত করছে। হাড়গোড়ের ভিতরে কেমন যেন হিম হিম ভাব। অবাক কাণ্ড, আগে তা কখনো এমন হয় নি।
১৯ই জুন ৷৷ শরীর খুবই খারাপ। কাপুনি দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে গা হাত পা যেন দুমড়ে মুচড়ে দেয়। আর যা শীত!
২০ শে জুন ৷ সারারাত ছটফট করে কাটিয়েছি। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। জ্বর জ্বর লাগছে।
২১শে জুন৷ অসহ্য অবস্থা আজ আমার। ভারি অসুস্থ। মনে হয় এ থেকে আমার আর অব্যাহতি নেই। মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। হায়, কে আমাকে করবে সেবা শুশ্রূষা। কে আমাকে পথ্য দেবে, কপালে বুলিয়ে দেবে সান্ত্বনার হাত। ঈশ্বরকে আকুল কষ্টে ডাকলাম। এই প্রথম। মথার মধ্যে কেমন যেন এলমেল ভাব। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। পারছি না সুস্থির চিত্তে কিছু ভাবতে।
২২শে জুন। সামান্য সুস্থ আজ। অর্থাৎ কালকের তুলনায় একটু ভালো। তবে অসুস্থতা পুরোপুরি কাটে নি।
২৩শে জুন। আজ আবারও প্রথম দিনের মতো অবস্থা। কাপুনি আর সেই সাথে শীত। মাথার যন্ত্রণাও ভীষণ!
২৪শে জুন॥ আজ অনেকটা ভালো।
২৫ শে জুন কাপুনি দিয়ে খুব জ্বর এল। সাত ঘণ্টার মতো বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলাম। কখনো শীত, কখনো গরম। আর দরদরিয়ে স্রোতের মতো ঘাম।
২৬শে জুন৷ একটু ভালো। একটু কেন বলি, অনেকটা। ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু খাবার বলতে মজুত যে কিছুই নেই। বন্দুকটা নিলাম। কিন্তু ভীষণ দুর্বল। হাঁটতে যেন পা ভেঙে আসে। ছাগল মারলাম একটা। বয়ে নিয়ে আসা সে যে কী কষ্ট! ঝলসে নিলাম। খানিকটা দিয়ে একটু ঝোল মতো করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু রাখার যে পাত্র নেই।
২৭শে জুন। আজ আবার সেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। ঠায় শুয়ে সারাদিন বিছানায়। ক্ষিধে খুব। কিন্তু খাব যে কিছু সে সামর্থ্যটুকুও নেই। জল পিপাসাও প্রচণ্ড। কিন্তু ঘরে যে জল নেই। যেতে হবে সেই বাইরে, জল আনতে হবে তারপর খাব। যাব কী ভাবে, আমার কি ওঠার শক্তি আছে। শুয়ে শুয়ে শুধু ঈশ্বরকে আকুল কণ্ঠে ডাকি।–প্রভু আমাকে বাঁচাও। আমাকে শক্তি দাও, আমাকে দয়া কর। দু তিন ঘণ্টা শুধু এই আকুল প্রার্থনা। তখন বেশ ভাব। আর ঘুম ভাঙল তখন মাঝরাত। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু বেশ ভালো লাগছে। সেই ভাবেই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। থাকতে থাকতে ফের ঘুম। তখন দেখলাম একটা নিদারুণ দুঃস্বপ্ন।
সে যা ভয়ঙ্কর। দেয়ালের বাইরে আমি বসা। ঝড় বইছে হু হু করে। সেই ভূমিকম্পের পর। তখন দেখি আকাশে কালো মেঘের বুক চিরে একজন লোক নেমে এল। তার সারা গায়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সেই আগুনে জ্বলে উঠল সারা মাঠ, ঘাট, বন ও পাহাড়। লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি। কী যে বীভৎস তার মুখ! আমার ভাষা নেই আমি সে চেহারা বর্ণনা করতে অপারগ। মাটিতে যখন নামল যেন দুলে উঠল সারা পৃথিবী। ঠিক ভূমিকম্পের সময়কার মতো। আর দাউ দাউ করে চারদিকে জ্বলছে আগুন।
সেই অবস্থাতেই আমার দিকে এগিয়ে এল। হাতে একটা বর্শা। আমাকে তাই দিয়ে গাথবে। দাঁড়াল এসে একটা উঁচু জায়গায়। আমাকে বলল, কীরে, তোর মনে তবু অনুতাপের নামগন্ধ নেই? তবে তোর এখন মৃত্যুই শ্রেয়। জলদপ্রতিম সেই কণ্ঠস্বর। বলে বর্শাটা আমাকে তাক করে শূন্যে তুলল।
সে যা ভয় আমার! আমি ভাষায় ব্যক্ত করে আপনাদের বোঝাতে পারব না। আমার সাধ্যের বাইরে। যদিও স্বপ্ন, কিন্তু দেখছি যখন আমি, সেটা তো বাস্তবেরই মতোন। ভয়টাও বাস্তব। সেই ভয়ের দাপটেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম।
সত্যি বলতে কি আমার তো তেমন ভক্তি টক্তি নেই। আমার বাবা খুব ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ। ধর্মসম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান তিনি একসময় আমাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কি আর লেশমাত্র মনের মধ্যে আছে। আটটা বছর তো দেখতে দেখতে সমুদ্রের বুকেই কেটে গেল। দুঃসাহসিক সব অভিযান। কত শয়তানি, কত নষ্টামি তার ভঁজে ভাঁজে। তাতে কি ধর্মকর্ম বলে কিছু থাকে। নিজেকে নিয়েই যে ব্যস্ত থাকতে হয় সারাক্ষণ। মনে তো পড়ে না, এই দীর্ঘ আট বছরে একটি দিনের তরেও আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি ঈশ্বরের নাম স্মরণ করেছি বা অন্তরে ভেবেছি তার কথা। মনটা যেন মন নয়। যেন কাঠখোট্টা আত্মসুখী বিবেকবর্জিত একটা পদার্থ। তাতে ঈশ্বরকে ভয় করা তো দুরের কথা, বিরাট একটা ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তির পর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যে নিদেন পক্ষে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়, সে বোধটুকুও আমার মধ্যে নেই।
নেই বলেই হয় তো এত দিন ভাবতে পারি নি, এই সব যাবতীয় অঘটন দুর্বিপাকের মধ্যে ঈশ্বরের হাত আছে কিংবা এই যা ঘটছে আমার জীবনেএকের পর এক বিপর্যয়, তা আমার অতীতের কৃতকর্মেরই ফলাফল। অতীত বলতে এখানে আমি বাবার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছি তার কথাই বলতে চাই। তাকে যে অগ্রাহ্য করেছি, মানি নি তার উপদেশ, তার জন্যে শান্তি তোলা ছিল আমার ভাগ্যে, এখন একের পর এক তাই ফলতে চলেছে–এমন বোধ কখনো আমার মনে স্থান পায় নি। কিংবা সেই যখন গিয়ে পড়লাম শাম্পানে করে ভাসতে ভাসতে আফ্রিকার উপকূলে–একবারও মনে হয় নি, কী হবে আমার! আমি কি সুস্থ জীবনের আর দেখা পাব! ঈশ্বরের নাম ভুলেও মুহূর্তের জন্যে মনে উদয় হয় নি। বলি নি একবারও, হে ঈশ্বর, আমাকে এই সংকট থেকে মুক্তি দাও। এমনকি সেই যখন বর্বর মানুষদের মুখোমুখি হয়েছিলাম কিংবা জন্তুর সাথে লড়াইয়ে মেতেছিলাম তখনো। শুধু উপস্থিত বুদ্ধি তখন আমার সহায়। আর মনের জোর। আপনারা হয়ত শুনলে বলবেন, আমি নৃশংস, আমি মহাপাপী। কিন্তু এতটুকু বানিয়ে বলছি না। উপস্থিত বুদ্ধি আর মনের জোর যদি নৃশংসতা হয়, তবে এছাড়া অন্য কারো উপর আমি সেই মুহূর্তে ভরসা করতে পারি নি।
পর্তুগিজ জাহাজের কাপ্তেন যখন আমাকে তুলে নিলেন, তখনো মোটামুটি আমার একই মনের অবস্থা। অপূর্ব তার ব্যবহার, আমার প্রতি দয়া ভালবাসা আন্তরিকতা, সে জন্যে তাকেই আমি জানিয়েছি হাজারো ধন্যবাদ, ভুলেও বারেকের তরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই নি। ফের যখন জাহাজডুবি হয়, যখন অনিবার্য মৃত্যুর কবল থেকে আমি বেঁচে এই দ্বীপে এসে উঠি, তখনো ঈশ্বরের কথা এক লহমার জন্যেও আমার মনে উদয় হয় নি। বরং নিজেকে ভেবেছি আমি মন্দভাগ্য এবং তার জন্যে সম্পূর্ণ নিজেকেই আমি দোষী সাব্যস্ত করেছি।
ডাঙায় ওঠার পর চিত্রটা অন্যরকম। আমি সেই প্রথম বুঝতে পারলাম আমার সহযাত্রীরা সকলেই হত, কেবল একলা আমিই বেঁচে আছি। তখন এক অদ্ভুত বিস্ময়বোধ আমার মধ্যে। বা আনন্দের অপ্রাকৃত এক অবস্থা। আর কেউ হলে একে ঈশ্বরের মহান অবদান বলে চিহ্নিত করতে কালক্ষেপ করতেন না। আমি সেটা পারি নি। আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিহ্বল ভাব কাটিয়ে তখন আমার মধ্যে ভীষণ এক আনন্দের ভাব। আমি যে জীবিত এটা আমার কাছে তখন অনেকখানি। এটা প্রায় প্রতিটি নাবিকের ক্ষেত্রেই সাধারণ ঘটনা। জাহাজ নিরাপদে তীরে ভেড়ার পর সবাই এভাবেই আনন্দ প্রকাশ করে থাকে। তখন আর নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথাই মনে আসে না। আমার ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ভাবে ঈশ্বরের কথা মনে আসার সুযোগ হয় নি।
এমনকি পরেও না। এই যে বিজন দ্বীপে আমার নির্বাসন, এই যে জনমানবের সঙ্গে সংযোগবিহীন একক একাকী এই জীবন, যার থেকে হয়ত সারা জীবনে আমার মুক্তি নেই, নিস্তার নেই–কই তার জন্যে তো ঈশ্বরকে আমি কখনো ডাকি নি। বরং কীভাবে স্বাভাবিক করতে পারি একে, কীভাবে বেঁচে বর্তে সুস্থ হয়ে থাকতে পারি, সেটাই আমার মধ্যে প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার বাঁচাটাই এখন প্রধান ব্যাপার। তার জন্যে ঈশ্বরের সাহায্য বা দূর থেকে তার অনুপ্রেরণা পাবার কোনো প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।
আর ঐ যে যখন ফেলে দেওয়া শস্য কণা থেকে গাছ গজাল প্রথমবার, আমি ঈশ্বরের নাম হয়ত করেছি, কিন্তু তেমন একটা আহামরি ভাবে নয়। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা আমার মনে আদৌ কোনো রেখাপাত করতে পারে নি। সেটা হয়েছে পরবর্তী কালে। তখন এর মধ্যে অলৌকিক যে একটা কিছু আছে আমি তাই ভাবতে শুরু করেছি। শুধু ঈশ্বরের অনুগ্রহ নয়, অতিপ্রাকৃত কিছুও। তবে সে চিন্তা বেশি দিন আমার মনে স্থান পায় নি। ব্যাপারটা যখন সহজ হয়ে এসেছে, তখন সেই সব অবিশ্বাস্য চিন্তাও ধীরে ধীরে মন থেকে লুপ্ত হয়েছে।
ভূমিকম্পের ব্যাপারটা আমি আগে আপনাদের কাছে বলেছি। তার ভয়ঙ্কর আশাকরি আপনাদের বোঝাতে পেরেছি। সে যা মনের অবস্থা আমার! তখন ঈশ্বরের নাম করেছি এটা ঘটনা, কিন্তু ঐ অব্দিই। এ অবস্থায় সকলেই হয়ত এরকম করে থাকেন। বেশি যা করেন তা হল তাকে নিয়ে মাতামাতি । সেটা আমি করতে পারি নি। একবারও ভাবি নি এ তারই মহিমা কিংবা অপরাধীকে শাস্তি দেবার কোনো বীভৎস ব্যবস্থা। মোটমাট ভূমিকম্পের প্রথম চোট কেটে যাবার পর আমি এ থেকে পরিত্রাণের কী উপায় আছে তারই চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়েছি।
শুধু এই মুহূর্তে সব ওলোটপালোট। এই যে অসুস্থ আমি, ভীষণ দুর্বল, পারি না হাঁটতে কি চলতে পারি না প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেলেও জল নিয়ে আসতেএখন এই দুর্বল মুহূর্তে বারে বারে মনে পড়ছে আমার পুরানো দিনের কথা। নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে মন চাইছে। ঈশ্বরের কাছে বার বার প্রার্থনা করছি–হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও, আমাকে দয়া কর। এটা সম্পূর্ণ আমার স্বাভাবিক চিন্তার বাইরে। এবং এর জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী আমার অসুস্থতা। এই যে প্রচণ্ড জ্বর, এই বিকার, এই মাথার যন্ত্রণা, আমার ধারে কাছে পরিচিত কেউ নেই, সেবা শুশ্রূষা করার কেউ নেই, না আছে একটা ওষুধ কি আর কিছু মন যে দুর্বল হবে এসময়, ঈশ্বরের সহানুভূতি যে চাইবে এটা ঘটনা। আমার মুখ, চোখ, মন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সব তালগোল পাকিয়ে আছে মাথার মধ্যে। মরার কথাটা বারবার ঘুরে ফিরে চিন্তার মধ্যে পাক খাচ্ছে। ঠোঁট যে এসময় অসহিষ্ণু হয়ে ঈশ্বরকে ডাকবে এটা তো স্বাভাবিক প্রভু আমাকে এই দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা কর–প্রভু দুঃখী মানুষ আমি প্রভু আমার অসুখ সারলে আমি আর বাঁচব না। মারা যাব, তুমি আমাকে নীরোগ কর। আর চোখ ফেটে বেরয় জল। সে-ও তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এক্ষেত্রে আমি মানুষটা কি ই বা করতে পারি?
আর ঘুরেফিরে বারে বারে মনে পড়ে বাবার উপদেশের কথা। আমাকে বারবার সাবধান করেছিলেন যেন আমি বোকার মতো সমুদ্র যাত্রায় না যাই, এভাবে ভাগ্য পরিবর্তনের যেন চেষ্টামাত্র না করি। এতে ঈশ্বরের দয়া লাভে আমি বঞ্চিত হব, কিছুতেই পারব না একক চেষ্টায় আমার দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে। সত্যি তাই। আমি চিৎকার করে মাঝে মাঝে আপন মনেই বলে উঠি-হ্যাঁ বাবা, তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ঈশ্বরের করুণা আমি লাভ করতে পারি নি। কেউ নেই এই দূর বিদেশে যে আমাকে সাহায্য করে, একটা দুটো পরামর্শ কি বুদ্ধি দেয়। আমি তোমার সদুপদেশে কর্ণপাত করি নি। আমি নির্বোধ। আমি মূঢ় আমি পাপী। আমি তোমার কথা শুনলে সুখে স্বচ্ছন্দে স্বদেশে জীবিকা নির্বাহ করতে পারতাম। আমার কোনো দুঃখ থাকত না। সব হেলায় পায়ে ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি আমি অজানার ডাকে। এখন শুধু তার জন্যে আক্ষেপ আর অনুতাপ। এছাড়া আমার আর করার কিছু নেই। কেউ নেই আমাকে এতটুকু সাহায্য করার। আমি একা, সম্পূর্ণ একা। আমি দুঃখী। ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।
প্রার্থনা বলতে এটাই প্রথম। বহু বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দয়া ভিক্ষা করে ঈশ্বরকে তলব করলাম। কিন্তু সেকথা থাক। আমি আবার আমার দিনপঞ্জীতে ফিরে আসি।
২৮শে জুন। মোটামুটি ঘুম ভালোই হয়েছে। আজ অনেকটা সুস্থ। উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে সকাল সকাল। গতরাতের দুঃস্বপ্নের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটে নি তবু মন অনেক প্রফুল্ল। জোর পাচ্ছি এখন অনেকখানি। কেমন যেন বিশ্বাস, কাল আর জ্বর হবে না। আপাতত পেট ভরাবার মতো কিছু দরকার। যদি ফের কোনো কারণে অসুস্থ হই, তার জন্যে যোগাড় তো রাখতে হবে। তবে সবার আগে চাই জল। একটা বোতলে করে পাশের ঝর্ণা থেকে জল নিয়ে এলাম। মদের বোতল খুলে খানিকটা মদ মিশিয়ে নিলাম জলে। এটা এখন আমার দরকার। চাঙ্গা হতে হবে সবচেয়ে আগে। কিন্তু খালি পেটে খাওয়াটা তো উচিত নয়, তাই খানিকটা মাংস নিলাম। সেই ছাগলের মাংস। কলসে নিলাম। মুখে দিতে মুখটা যেন বিস্বাদ। ইচ্ছে করছে না খেতে। বোতল থেকে খানিকটা তরল ঢেলে দিলাম গলায়। একটু সুস্থ লাগছে। তখন হটলাম একটুখানি। ভারি দুর্বল শরীর। টাল খেয় পড়ে যাই বারবার। ফের সামলে নিই। আর মন দুঃখে ভরে ওঠে। শুয়েই রইলাম। আতঙ্কটা ফের একটু একটু করে মনের আনাচে কানাচে ফিরে আসছে। হয়ত কাল আমার ফের জ্বর হবে। নির্ঘাৎ। তখন উপায়! মৃত্যু কি আসন্ন।
রাত্রে কটা কাছিমের ডিম আগুনে ঝলসে খেলাম। হাঁটলাম খানিকটা। কষ্ট। বন্দুকটা হাতে নিলাম। যেন ভীষণ ভারী। বসে পড়লাম মাটিতে। চাঁদ উঠেছে। সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যায়। ছবির মতো নীল শান্ত নির্বাক সমুদ্র। নানান ভাবনা ঘুরপাক খেয়ে বেড়াতে লাগল মনে।
আচ্ছা, এই যে পৃথিবী এবং এই সমুদ্র–কোথা থেকে এর জন্ম? আমরাই বা এলামি কোথা থেকে?
আমাদের জন্মের পিছনে শুনি আছে এক অলৌকিক শক্তি। তারই মধ্যে এই জগৎ, এই সমুদ্র, এই সব কিছু? তিনি কে?
এর একটিই উত্তর। তিনি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। কিন্তু সৃষ্টির একমাত্র অধিকারী যদি তিনিই হয়ে থাকেন, তবে নিয়ন্ত্রণেরও একাধিপত্য তারই। অর্থাৎ এই জল স্থল আন্তরীক্ষ সব ভঁরই তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত, সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে নিশ্চয়ই তার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা আছে। এবং যদি সত্যি হয়, তবে জগতে কিছুই তার অজ্ঞাতসারে ঘটতে পারে না।
সেটাকে যদি সত্যি বলে মেনে নিই, তাহলে এই যে আমি এখানে, এই অজানা অখ্যাত দ্বীপে এটা আর কেউ না জানুক, তিনি ঠিকই জানেন। আমার ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ভাবে তিনি অবহিত। এবং যদি ধরে নিই তার নির্দেশ ভিন্ন কোনো কাজ হবার সুযোগ হয় না, তবে এই যে আমি এখানে এটাও তার নিজেরই নির্দেশে।
এত অব্দি বলতে গেলে নির্ভুল চিন্তা। নিজের কাছে নিজেরই একের পর প্রশ্ন। একে প্রতিবাদ করার শক্তি বা সাহস আমার নেই। তবে একটিই সানা, যা করেন তিনি জীবের মঙ্গলের জন্যেই করেন। সেক্ষেত্রে আমার এই নির্বাসনের পিছনেও নিশ্চয় কোনো মঙ্গলের সম্ভাবনা আছে। কী সেই মঙ্গল? যদি তার অমোঘ নির্দেশেই সব ঘটনা ঘটে থাকে, তবে কী সেই নির্দেশ?
এবং কেন সেই নির্দেশ তিনি দিলেন? কী করেছি আমি যে এই নির্দেশ আমার উপর বর্তাবার সুযোগ হল?
সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়েছি আমি। এ প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই। ঈশ্বরের উপর খবরদারী করতে পারে কোন মূর্খ? যেন জবাবটাও সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম। কে যেন ভিতর থেকে বলে উঠল–হতভাগা, তোর এতবড় সাহস, কী করেছিস তুই জানতে চাস? তবে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন কর, জবা পাবি। তোর তো আগেই সংহারের অবস্থা হয়েছিল, মনে নেই সেকথা? ইয়ারমাউথে ঝড়ের পর সেই মর্মান্তিক অবস্থা, তার মধ্যেও তোকে বাঁচিয়ে রাখলাম। ভুলে গেলি সেই কাহিনী? জলদস্যুরা জাহাজ দিল তছনছ করে, কত মানুষ মারা পড়ল, তুই রইলি জীবন্ত? তোর লজ্জা হয় না! আফ্রিকার উপকূলে হিংস্র জন্তুর মুখে মরতে মরতে তুই বেঁচে গেলি! এখানেও তো একই হাল। ডুবে মরতিস তোর সাথীদের মতো। একমাত্র তোরই জীবন রক্ষা পেল। এত কিছুর পরেও ফের জবাবদিহি চাস?
সত্যি বলতে কি আমি তখন থ। মূক হতবাক, বিস্ময়ে স্তব্ধ। একটি কথা বলার শক্তিও আমার নেই। ভীষণ বিমর্ষ ভাব। সেই অবস্থাতেই ধীরে ধীরে উঠলাম। গেলাম তাঁবুর ধারে। ঘুমোব এবার কিন্তু ঘুম যে ছুটি নিয়েছে চোখ থেকে। চেয়ারে বসলাম। আলো জ্বালোম। ভয় করছে খুব। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা আতঙ্কের ভাব। যদি ফের আমার জ্বর হয়। যদি কাল আবার পড়ি বেহুশ হয়ে। তখন মনে পড়ল ব্রাজিলের কথা। অসুখ বিসুখ হলে সেখানে সকলে খায় তামাক। তাতেই নাকি সব রোগ সেরে যায়। তামাক তো খানিকটা আমার সাথেও আছে। কিছুটা তার শুকনো, কিছুটা কাঁচা। দেখা যাক না, যদি কোনো উপকারে পাই।
সে যেন ঈশ্বরেরই অদৃশ্য নির্দেশ। উঠলাম ঘোরগ্রস্থ মানুষের মতো। পেটি খুললাম। এই তো তামাক। পাশে জাহাজ থেকে আনা সেই বই ক’খানা। তার মধ্যে বাইবেলও আছে। সেটাও নিলাম। সঙ্গে আমাক। তারপর ফের এসে বসলাম চেয়ারে।
তামাকে কি সারে কতটুকু সারে আমার জানা নেই, তবু এইটুকুই ভরসা, খেয়ে দেখতে হাবে আমাকে, সারবে যে এটা নির্ঘাৎ। একটা পাতা মুখে ফেলে চুষতে লাগলাম। সে যা তেজ। মুহূর্তে যেন টলতে লেগেছে আমার মাথা, সঙ্গে সারা শরীর। কাঁচা পাতা কিনা, তাই তেজ পাকা পাতার চেয়ে বেশি। এদিকে আমি তো আর তামাক টামাকে অভ্যস্ত নই। তখন আরো খানিকটা নিয়ে সেই বোতলের তরলে ভিজিয়ে রাখলাম। তা প্রায় ঘন্টা দুই। মিশল তেজ। এবার এক জুনপান এই বোতল থেকে খাব। এটা আমার ওষুধ। খেলাম তাই। শুকনো পাতাটা নিয়ে আগুনের কাছে ধরলাম। দেখি ঝাজ বেরচ্ছে। তখন নাকটা এগিয়ে নিলাম পাতাটার কাছে। ভক করে খানিকটা ধোয়া ঢুকল নাকে। সরালাম না। মোটমাট যতক্ষণ সহ্য হয় আমি ঘ্রাণ নেব। দেখি ফল কী দাঁড়ায়।
বাইবেল ততক্ষণে খুলে ফেলেছি। পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু মাথা যে এখন দেখি টলে যায়। সেই তামাক পাতা চুষে খাওয়ার ফল। পারছি না পড়ার দিকে মন বসাতে। বই কিন্তু খোলা। ঘুরে ফিরে চোখে পড়ে শুধু একটা মাত্র ছত্র– বিপদের দিনে আমার স্মরণ নিও। আমি তোমার পরিত্রা। আমাকে মহিমান্বিত করবে তুমি।
প্রতিটি শব্দ প্রতিটি অক্ষর গভীর তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে আমার হৃদয় স্পর্শ করল। অপূর্ব সঙ্গীতের মতো এর শুতি, কানের পর্দায় অনুরণন সৃষ্টি করে। কিন্তু সব কথা কি ঠিক? আমার বাস্তব অবস্থায় প্রতিটি কথার কি মূল্য আছে? যেমন : আমি তোমার পরিত্রাতা। কিন্তু কীভাবে তিনি ব্ৰাণ করবেন আমাকে এই অদ্ভুত পরিবেশ থেকে? এ কি আদৌ সম্ভব? আমি তো আশার লেশমাত্র দেখতে পাই না। তবে কেন এই প্রবঞ্চনা?
সে যাই হোক, রাত বাড়ছে। ঝিম মেরে আছে মাথার মধ্যে। তামাকের প্রতিক্রিয়া আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়লাম। আলো নেভালাম না। জ্বলুক। যদি রাত্রে কখনো উঠি দরকারে লাগবে। কী মনে হতে ফের উঠে বসলাম শয্যা ছেড়ে। হাঁটু গেড়ে বসলাম। করি নি এমন কোনোদিন। আজ ভারি ইচ্ছে করছে। প্রার্থনা করব আজ। ঈশ্বরকে বলব তার সব প্রতিশ্রুতি যথাযথ ভাবে পূরণ করতে। আমাকে যেন মুক্তি দেন। এই দুর্দশা থেকে। যেন ত্রাণ করেন। ঈশ্বর তুমি আমাকে রক্ষা কর।…তারপর বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা পানীয় গিলে ফেললাম। খুব কড়া লাগছে। তামাকটা মিশেছে বেশ চমৎকার ভাবে। মনে এবার বেশ জোর পাচ্ছি। আমার আর ভয় নেই। নেই কোনো দুর্ভাবনা। এবার শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। গভীর গাঢ় নিদ্রা। ভাঙতে ভাঙতে সেই বিকেল। তখন তিনটে প্রায় বাজে। ঝলমল করছে রোদ। তবে পরে চিন্তা করে দেখেছি, পরদিন নয়, ঘুম ভেঙেছে তারও পরের দিন। অর্থাৎ ঘুমিয়েছি আমি মোট দেড়দিন এক রাত। নইলে কি করে আমার একটা দিন হিসেব থেকে কমে যায়। পরে হিসেব মেলাতে গিয়ে এটা নজরে পড়েছে।
ঘুম ভাঙতে আমি তো পুরোপুরি সুস্থ। কী যে তাজা লাগছে শরীর! ভিতরে বেশ একটা খুশি খুশি ভাব। মনও প্রফুল্ল। কাজ করতে উৎসাহ লাগছে। আর ক্ষিধে পেয়েছে ভীষণ। মোটের উপর সুস্থ লোকের যা যা হয় তাই। আমার হিসেব মতে সেটা ২৯ তারিখ।
পরদিন যথারীতি বন্দুক নিয়ে বেরলাম। শরীরে তেমন ক্লান্তি নেই, মোটের উপর সুস্থ স্বাভাবিক আমি। বেশ ভালো লাগছে। তবে বেশি দূর যাবার দরকার হল না। পথে দেখি একটা মুরগি। মারলাম। পরে আরো একটা। তাকেও প্রাণ দিতে হল । নিয়ে এলাম তাবুতে। কিন্তু রাঁধতে আজ আর ইচ্ছে করছে না। তখন কাছিমের ডিম ছিল কটা, তাই খেলাম। বেশ লাগছে খেতে। ওষুধ বানালাম আরো একটা বোতল। সেই মদ, তাতে তামাক, মিলে মিশে তামাকের আরক, খেলাম একটুখানি। অর্থাৎ অনুপান মতো। তবে কাঁচা পাতা আর চিবিয়ে বা চুষে খেলাম না। তামাকের ধোয়াও নিলাম না আজ। জানি না সেই জন্যে কিনা, পরদিন অর্থাৎ ১লা জুলাই শরীর আবার গোলমাল করল। সেই অসুস্থ ভাব। তবে ততটা প্রবল নয়। হিম হিম ঠাণ্ডা ভাব আছে, কিন্তু তার দাপট প্রথম দিনের মতো ততটা নেই।
২রা জুলাই। ওষুধ চলছে। অনুপান আগের তুলনায় আরেকটু বাড়িয়েছি। প্রায় দু গুণ। মাথায় ঝিম ধরা ভাবটা আছে।
৩রা জুলাই। সুস্থ বলতে পারি না, তবে ঝিম ঝিম ভাব। বেশ মতো অনেকটা। ওষুধের ক্রিয়া কিনা কে জানে। শরীরে তাগদও আজ কম। পরিপূর্ণ বল ফিরে পেতে আরো অনেকদিন লাগবে এটা সানি। তবে এই দুদিন ধরে সমানে বাইবেলের সেই লাইনটা ফিরে ফিরে আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি তোমার পরিত্রাতা। অসার অহেতুক এই ভাষ্য। তবু একে কেন্দ্র করে মনের গভীরে কোথায় যেন আশার এক চিলতে আলো দেখতে পাই। কে জানে, হয়ত ত্রাণ পেলেও পেতে পারি। উদ্ধার পেতে পারি এই সংকট থেকে। কিন্তু কী সেই উপায়? মোটমাট প্রশ্রয় দিই না একদম। চিন্তা এলেই মন থেকে দূর করে দিই। যা অসম্ভব তাকে নিয়ে কী আর অহেতুক কল্পনাবিলাস ভালো! তবে পুরোপুরি কল্পনাই বা বলি কী করে। কোনোরকম ত্রাণ কি আমি পাই নি? সংকট থেকে এতটুকু মুক্তি কি পরিত্রাণ? এই তো অসুখ হয়েছিল আমার। নেই কেউ কাছে যে একটু সেবা করে বা দেখাশোনা করে। ঈশ্বরই তো অদৃশ্য দু হাতে আগলে রেখেছেন আমাকে সারাক্ষণ, সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছেন। অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে মনে যে ভয়ের জন্ম হয়েছিল তা থেকে তিনিই তো আমাকে উদ্ধার করেছেন। সে ভয় এখন আমার মনে কোথায়? পাশাপাশি, পারি নি তো আমি তাকে গৌরবান্বিত করত। অন্তত এ সবের জন্যে একটু কি ধন্যবাদ প্রাপ্য ছিল না তার? আমি এমনই অবোধ, পারি নি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে মুখ উজ্জ্বল করতে।
মরমে মরে যাওয়া যাকে বলে। আমার অবস্থা ঠিক তাই। হায় হায়, এ আমি কী করেছি! অমনি বসে পড়লাম হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায়। নিজের অন্যায়ের জন্যে মার্জনা ভিক্ষা করলাম। সরবে জানালাম ধন্যবাদ। মনটা এতক্ষণে হালকা লাগছে।
৪ঠা জুলাই। সকালে বাইবেল খুলে বসলাম। গভীর মনোযোগে শুরু করেছি পড়া। এবার থেকে নিয়ম করে সকালে রাত্রে আমি বাইবেল পড়ব। পড়বই। কেউ পারবে না। আমাকে এই নিয়ম থেকে চ্যুত করতে। তা ঐ এক গোল। যেই শুরু করি অমনি মন অনুতাপে দগ্ধ হয়। মনে পড়ে সেই বিকটদর্শন স্বপ্নের কথা। সেই ভয়ঙ্কর মানুষ। হাতে তার বর্শা। আমারই বুক লক্ষ্য করে উদ্যত। বলছে–এত সবের পরেও তোর মনে একটু অনুতাপ নেই?…..ঈশ্বর, তুমি আমাকে অনুতাপ দাও। আমি যেন আমার কৃতকর্মের তেন্যে অনুতপ্ত হতে পারি। এই ভাবি সারাক্ষণ। আর দু চোখ অধীর আগ্রহে পাতার পর পাতা ছত্রের পর ছত্র পড়ে যেতে থাকে। পড়তে পড়তে হঠাৎ থমকে গেলাম একটা জায়গায়।–অনুতাপ পারে মানুষকে মহান করতে, ঈশ্বরকে মহান করতে, রাজাকে সম্মানের আসনে উন্নীত করতে।
অমনি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম বই। আর পড়তে মন চাইছে না। মনে এখন এক গভীর উল্লাস। আমি হাঁটু গেড়ে বসে আকাশের দিকে দুহাত তুলে ধরলাম।–প্রভু, তুমি আমাকে অনুতাপ দাও, আমার মন দুঃখে তাপে জর্জরিত কর। তুমি মহান ত্রাতা। অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আমি তোমাকে আরো মহান করব।
এ আমার অন্তরের প্রার্থনা। এমন ভাবে ঈশ্বরকে আর কখনো ডাকি নি। আমার বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে, আমার অতীত আমার ভবিষ্যৎ সব কিছুরই সঙ্গে মিশ খাইয়ে এ এক অনবদ্য অপরূপ স্বর্গের সুষমা মাখা প্রার্থনা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ঈশ্বর এ প্রার্থনার প্রতিটি শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
নতুনভাবে এখন থেকে সব কিছু আমি বুঝতে পারছি। এতদিনে ‘আমি তোমার পরিত্রাতা’ কথাটির সারমর্ম আমি অনুধাবন করতে পারছি। এ আর কিছুই নয়, মানুষ যে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বন্দী হয়ে পড়ে, তার নিজস্ব ভুল ভ্রান্তির গহ্বরে,–এ তারই থেকে ত্রাণ। দ্বীপ আমার কাছে কারাগার আমি জানি। সেখানে আমি বন্দী, তা-ও আমার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু সে বন্দীত্ব আমার কাছে বড় নয়। তার চেয়েও বড় হল আমার নিজের চেতনা, আমার অতীতের ভুল ত্রুটি পাপ অন্যায় প্রভৃতির কাছে দাসত্ব। এর হাত থেকে মুক্তিই তো আসল মুক্তি। তবে না মন আমার শুদ্ধ সুবে, পাপ স্খলন হবে। সেটাই মানুষের কাম্য। মনকে শুদ্ধ করাই সব চয়ে বড় ব্যাপার। আমি বন্দী দশা থেকে ত্রাণ পাবার আগে চাই নিজেকে শুদ্ধ করতে।
কিন্তু সে অনেক পরের কথা। অনেক গভীর অনেক তাৎপর্যে ভরা চিন্তা। সেটা আপাতত স্থগিত থাক। আমি ফিরে আসি আবার আমার বিবরণীতে।
মনের দিক থেকে এখন আমি অনেকটা মুক্ত। যদিও অবস্থার খুব একটা হের ফের হয় নি। যেমন পরিবেশে ছিলাম তাই আছি। তবু ভাবতে পারি এখন স্বচ্ছন্দে। জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ঈশ্বরের হাতের ছোঁয়া দেখতে পাই। যেন তারই নির্দেশে আমার প্রতিটি পদক্ষেপ, তাকে অগ্রাহ্য করে এক পা চলার শক্তি আমার নেই। রোজ পড়ি তার নির্দেশাবলী। প্রার্থনা করি। মন উন্নীত হতে চলেছে প্রকৃতির ঊর্ধ্বে অচেনা অজানা এক জগতে। তাতে অসীম তৃপ্তি বোধ। জানি না কোন সে দেশ, কী সেই স্থান। তবু ভাবতেও চমৎকার লাগে। আমার শরীরে একটু একটু করে হৃত বল আবার ফিরে আসছে। সম্পূর্ণ সুস্থ বলতে যা বোঝায় তাই। যা চাই আমি সবই এখন মোটামুটি পেয়ে থাকি। জীবনের গতিও এখন অনেকটা স্বাভাবিক।
৪ঠা থেকে ১৪ই জুলাই অব্দি প্রধান কাজ আমার নিয়মিত বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়া। খুব একটা দূর আব্দি যেতে পারি না, এখনো পুরো তাগদ ফিরে পাই নি। তবে রোজই একটু একটু করে বাড়াই যাতায়াতের সীমা। তাতে সুস্থতা একটু একটু করে ফিরে আসে। আগে হলে জানি না এই ভাবে করতাম কিনা। অবিশ্যি সে প্রশ্নও আসে না, কেননা আগে তো আমি ভয়ের কবলে কখনো পড়ি নি। মোটমাট কী করতে হবে করা উচিত সেটা এখন ঠিকঠিক অনুধাবন করতে পারি। এটাই লাভ। মন মুক্ত হলে পারে বোধহয় মানুষ এমন করতে। মাঝে মাঝে কাজ একটু নিয়মছাড়া হলে ভিতরে ভিতরে কাহিল লাগে। তবে সে মুহূর্তের জন্যে। মনে স্থান দিই না সে সব ভাবনা। আশা যে মনে এখন বিস্তর। আশাই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
এরই মধ্যে কতগুলো জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি। বৃষ্টি আমার একদম সহ্য হয় । বিশেষ করে ঝড় বৃষ্টি বজ্রপাত সহ শুকনোর দিনের বৃষ্টি। ভিজলে নির্ঘাৎ আমার শরীর খারাপ হবেই। বরং সেপ্টেম্বর অক্টোবরের বৃষ্টি অনেক ভালো। ঝড় বিদ্যুতের বালাই নেই। ঝরঝর করে খানিকটা ঝরে তারপর শেষ হয়। বছরে এখানে দুটো বর্ষাকাল।
দশ মাস তো হল আমি আছি এই দ্বীপে। মুক্তির চিন্তা আর করি না। স্থানও দিই না মনে। মুক্তি আমার নেই এটাই ধরে নিয়েছি। আমি বোধহয় প্রথম মানুষ যার পায়ের ছাপ এতদিনে এই দ্বীপে পড়ল। বোধহয় বলি কেন, এটাই ঠিক। আর কেউ এলে তার কোনো না কোনো চিহ্ন আমার ঠিকই নজরে পড়ত। তবু একটা কাজ এখনো বাকি। তা হল খুঁটিয়ে খুটিয়ে দ্বীপটাকে একবার পর্যবেক্ষণ করা।
এবং সে কাজে পনেরই জুলাই থেকেই লেগে পড়লাম। প্রথমে যাব খাড়ির দিকে। আমার ভেলা এনে ওখানেই প্রথম ভিড়িয়ে ছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম মাইল দুয়েক পথ। দেখি ঢেউ এদিকটায় কম। নদীটাও এদিকে খুবই সকীর্ণ। কুল কুল করে বয়ে চলেছে আপন খেয়ালে। জল এখন হাঁটু সমান। এটা তো টানের সময় তাই। এই যা জল, এতে নৌকো বাওয়া অসম্ভব।
আর কী চমৎকার মাঠ নদীর ধারে! ঘাসের যেন মখমল বিছিয়ে রাখা। খোলা আকাশের নিচে উদার উন্মুক্ত বিশাল এক ক্ষেত্র। মনে হয় বর্ষার দিনে এই মাঠে জল ওঠে। তবে পুরোটাতে নয়। ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠেছে প্রান্তদেশ। সেখানে কত বিচিত্র যে গাছ গাছালি। বিস্তর তামাক গাছ! আকারে বেশ বড় বড়। সচরাচর এমন তামাক মজার পড়ে না। আরো সব কত কি গাছ, তরতরে সবুজ তাদের পাতা। চিনি না আমি। দেখি নি। আগে কোনোদিন।
ক্যাসাভা গাছের মূল থেকে আদিবাসীরা রুটি বানায়। খুঁজলাম তাই আঁতিপাতি। পেলাম না। দেখি আখ হয়ে রয়েছে বিস্তর। মস্ত বড় বড়। কেউ তো আর চাষ করে নি, তাই বুনো বুনো ভাব, আর গায়ে গায়ে লেগে যেন গভীর এক জঙ্গল। আজ এইটুকুই থাক। মোটামুটি যা আবিস্কার হল আমি খুশি। এতটা যে দেখতে পাব এমন আশা করে তা বেরই নি। আরো দেখার প্রয়োজন আছে। তবে চিনি না যে বিশেষ কিছু। ব্রাজিলে থাকতে খেয়াল করে তা দেখি নি কোনোদিন। কোনটা কোন গাছ, কী তার উপকার এগুলো জেনে রাখা অনেক ভালো। তাহলে বিদেশ বিভুয়ে অনেক সময় উপকার হয়।
পরদিন ষোল তারিখ। একই পথ ধরে এগোলাম। তবে এগিয়ে গেলাম আজ আরো খানিকটা পথ। এদিকে প্রকৃতির ভিন্ন রূপ। ঘাস কমতে কমতে ঘন সবুজ বনানী। বড় বড় গাছ। তাতে অজস্র ফল। কত যে মৌসুখ কত আঙুর আরো কত কী আমি বলে বোঝাতে পারব না। থোকায় থোকায় অঙুর, আর কী মিষ্টি! খেলাম কয়েকটা। বেশ স্বাদ। তবে বেশি নয়। নিজেকে সংযত করলাম। শুনেছি এই জাতীয় ফল খাবার পরিণামের কথা। বন্দীদের ছেড়ে দিত এমনই সব নির্জন দ্বীপে। আঙুর খেত খুব। তারপর জ্বর হত। সে জ্বর আর কমার নয়। তবে আমার তো আর অত খাবার প্রয়োজন নেই। এটা শুকনোর দিনের সঞ্চয়। পানীয় জলের অভাবে গলা ভেজাতে পারব, তৃষ্ণা মিটবে আকণ্ঠ। কিছুটা কিছুটা করে তুলে নিয়ে রোদে শুকিয়েও রাখতে পারি। তখন হবে কিসমিস। দু এক দানা মুখে ফেলে চুষব। সেও তো একটা অন্য ধরনের খাবার।
সারাদিন সেখানেই কাটল। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আসুক, আজ আর বাড়ি ফিরব না। দরকার কী ফেরার। এই তো ফলফলাদি মজুত। একটা রাত কাটাবার পক্ষে যথেষ্ট। বরং বাড়ি ফিরলে কাল আবার এতদূর উজিয়ে আসতে হবে। তারপর ফের এগোনো। দরকার কী অনর্থক বেশি হাটার। তখন কাছের একটা গাছে উঠলাম। বঁধলাম শক্ত করে নিজেকে গাছের সঙ্গে। তারপর ঘুম। তাঁবু গাড়ার পর এই প্রথম আমি বাইরে ঘুমোলাম। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল। শুরু হল ফের হাঁটা। এগিয়ে গেলাম আরো প্রায় মাইল চারেক। চলেছি, উত্তর মুখো। ডাইনে পাহাড়ের রেখা। দক্ষিণ থেকে উত্তর আগাগোড়া বলতে গেলে পাহাড়।
এদিকটা মোটামুটি ফাঁকা। গাছপালা বিশেষ নেই। একটা মোটে ঝরনা। তাতে টলটল করছে সুস্বাদু পানীয় জল। পাহাড়েরই বলতে গেলে লাগোয়া। আর অবাক কাণ্ড। এত সাজানো গোছানো এই দিক! এটা পশ্চিম। মনে হয় যেন কেউ গাছগুলোকে হাতে করে বসিয়েছে। কোনো নিপুণ মালী। আমার ভারি অবাক লাগছে। ‘ উপত্যকা এটা। দেখতে দেখতে চলেছি। অপূর্ব এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর মনে খুব খুশি খুশি ভাব। এই সারা দ্বীপ, এই পাহাড়, এই উপত্যকা, এই ঝর্ণা এই গাছগাছালি–সব কিছুর, আমি একচ্ছত্র অধিপতি। কেউ পারবে না এর মালিকানা আমার হাত থেকে কেড়ে নিতে। ইংল্যান্ডের যে কোনো সামন্ত প্রভুর চেয়ে আমার জমিদারীর পরিমাণ কম নয়। দেখি বিস্তর কোকো, কমলালেবু, লেবু, আর জামির গাছের ছড়াছড়ি। ফল ধরে নি। বুনো গাছ তো। তাই ফুল ধরে না। বা ধরলেও তেমন সুস্বাদু হয় না। বাপি পেলাম অনেক। কাঁচা। মাটিতে ঝড়ে পড়ে আছে। কুড়িয়ে নিলাম ভিতরটা দেখি টকটকে লাল। জলের সঙ্গে মিশিয়ে পরে অনেক খেয়েছি। অপূর্ব স্বাদ। আঃ প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়।
এবার ফেরার পালা। সঙ্গে বিস্তর বাণিজ্যের পশরা। বাণিজ্যই বলব একে, না অন্য কিছু? অাঙুর প্রচুর, সেই সাথে বাতাপি, আর বিস্তর মৌসুম্বি লেবু। কিন্তু নিই কীভাবে? তখন টাল দিয়ে সাজিয়ে রাখলাম পাশাপাশি। নিলাম অল্প স্বল্প । যতটা পারা যায় জামায় বেঁধে। থাক আজ বাকিটা এই অবস্থায়। কাল আসব থলি নিয়ে। তাইতে করে সব নিয়ে যাব।
প্রায় তিনদিন পর বাড়ি ফিরলাম। সে আনন্দ আমার। তাঁবুটাকেই আপাতত বাড়ি বলতে শুরু করেছি। আর সেই গুহ। এসে দেখি আঙুরগুলো সব পচে গেছে। পাকা তো ছিল খুব। বেঁধেছি জামায় শক্ত করে। সে চাপ আর সহ্য করতে পারে নি। বাতাপি আর মৌসুম্বির কোনো বিকার নেই। তবে দুঃখ এই এত বড় বড় ফুল, পারি নি একসাথে অনেকগুলো আনতে।
পরদিন উনিশ তারিখ। গেলাম ফের। সঙ্গে দুটো থলি। অবাক কাণ্ড, পৌঁছে দেখি কাল যে টাল দিয়ে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলাম ভাগে ভাগে ফল–কে যেন দিয়েছে সব তছনছ করে। লণ্ডভণ্ড বলতে যা বোঝায়। ঠিন যেন দাপাদাপি করে পায়ে পিষে দলিয়ে দেওয়া। নির্ঘাৎ কোন জানোয়ারের কাজ। আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার অজ্ঞাতসারে এসে এই কাণ্ড করে গেছে।
আর তো ওগুলো নেওয়া যায় না। তখন চলল নতুন করে আর এক দফা সংগ্রহের পালা। বিস্তর আঙুর নিলাম। সঙ্গে বাতাবি আর মৌসুম্বি। বেদম ভারী। তবে এক কাজ করা যাক। আঙুর আর বাড়ি অব্দি নিয়ে যাব না। দেখেশুনে উঁচু মতো একটা গাছে থলিটা ঝুলিয়ে দিলাম। রোদ পাবে এখানে। তাতে শুকোবে। তারপর সময় সুযোগ বুঝে একদিন এসে নিয়ে যাব। আজ বরং বাতাবি আর মৌসুম্বিই নিয়ে যাই।
মোটামুটি বেশ লাগছে এখন। সাম্রাজ্য আবিষ্কারের কাজ শেষ। খাদ্যেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। এখন নতুন করে আস্তানা গড়ার সমস্যা। কোথায় করি সেটা। মন ছুটে যায় পশ্চিমের সেই অংশে, সাজানো বাগানের মতো সেই যে দিক। ইচ্ছে করে ফাঁকা মাঠে তাবু গেড়ে সুস্থির হয়ে বসবাস করি। কিন্তু তাতে সমস্যা অনেক। প্রথমত মালপত্র টেনে নিয়ে আসা এক ঝামেলা। তার উপর যদি সমুদ্রের কাছ থেকে সরে অন্য দিকে যাই তবে সমুদ্র দেখার যে একটা প্রয়োজন আছে–কোনোদিন যদি দেখা পাই কোনো জাহাজের, কিংবা আমারই মতো কোনো হতভাগ্য যদি ভাসতে ভাসতে এসে দ্বীপে ঠেকে। তার আর পরিচর্যা করা হবে না। কিংবা জাহাজ এলে সেটা দেখাও যাবে না। মোটমাট এ জায়গা ছেড়ে আমার পক্ষে অন্য কোথাও যাওয়া মোটেই সমীচীন নয়।
তবে ই আলাদা একটা ডেরা করা দরকার। বাসা যেরকম। একটু দূরেই নতুন একটা তবু গাড়া হল। মোটের উপর খোলামেলা চারধার। চারপাশে বেড়া দিলাম। গাছের ডাল কেটে সারি সারি তাই পুঁতে দেওয়া। তাঁবুর চারধারে পাল আর মাথার উপর ত্রিপল। গোটা ব্যাপারটাই একটা মাচার উপরে। অর্থাৎ তাবুতে ঢুকতে গেলে আমাকে মই বেয়ে প্রথমে মাথায় উঠতে হয়, তারপর তাঁবু। নিরাপত্তার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। বেশ নিশ্চিত্ত। সব মিলিয়ে খাটতে হল আমাকে জুলাই মাসের বাকি কটা দিন। আগস্টের শুরু থেকে নতুন তাবুতে রাত কাটানো শুরু করলাম।
কিন্তু কদিন কাটতে না কাটতে তুমুল বৃষ্টি। সে কি আর তাবুর ত্রিপল পারে রুখতে। তখন ঢুকলাম গিয়ে ফের গুহায়। আমার তো বৃষ্টিতে ভেজা বারণ। ভিজলেই না আবার জ্বরের কবলে পড়ি। জ্বর নিয়ে আমার আতঙ্ক কিন্তু এখনো আছে।
এদিকে বলতে ভুলে গেছি, ঝড় বাদলের সম্ভাবনা দেখে তিন তারিখ গিয়েছিলাম সেই আঙুর বাগানে, ঝোলানো সেই থলি নিয়ে এসেছি। শুকিয়েছে চমৎকার। যদি বৃষ্টি পড়ত তবে তো পচে গলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড! ভালোই হল। বর্ষার দিনে তো বাইরে বেরনো ঝঞ্ঝাট। চলবে প্রায় অক্টোবর অব্দি। তখন এগুলো দিয়েই যেমন করে হোক। ক্ষুধা নিবৃত্তির কাজ হবে।
এদিকে পরিবার পরিজন ক্রমশ কিন্তু বাড়ছে। দুটো বেড়ালের মধ্যে একটা আছে, আরেকটা পালিয়ে গিয়েছে সেই কবে। তারপর থেকে সে আর আসে না, বা বনে বাদাড়ে ঘুরি দেখাও পাই না কোনোদিন। ধরে নিয়েছি সে আর জীবিত নেই। ওমা, দেখি বর্ষা পড়তে না পড়তে শ্রীমতি বিড়ালনি তিন তিনটা বাচ্চা সমেত গটগটিয়ে সটান গুহায় এসে হাজির। আমি তো হতবাক। আমার বাকি বিড়ালটাও মাদী। এ তাহলে বাচ্চার মা হল কোত্থেকে? একটা বনবিড়াল মেরেছিলাম একদিন এটা ঘটনা। কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে তো বুনো ভাব এতটুকু নেই। তবে নির্ঘাৎ এখানে এমনি বিড়ালও আছে।
দেখতে না দেখতে বছর দুইয়ের মধ্যে গুহা আমার বেড়ালে বেড়ালে ছয়লাপ। সমানে দুটোতে বাচ্চা বিয়োয়। এদিকে পুরানো বাচ্চারাও ক্রমে সাবালক হচ্ছে। তাদেরও পড়ে গেছে বাচ্চা দেবার ধুম। আমার তো ত্রাহি ত্রাহি হাল। তাড়িয়ে দিলেও যায় না। শেষে কটাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হলাম। দূরে পার করে দিয়ে এলাম কটাকে। তবে যা শান্তি।
১৪ই আগস্ট থেকে ২৬ তারিখ অব্দি সমানে বৃষ্টি। যেন মুহূর্তের জন্যেও কামাই নাই। আমার তো বেরনো একদম বন্ধ। বাপরে বাপ, ভুলেও আর বৃষ্টিতে ভিজি! এদিকে খাবারের আকাল। তখন বাধ্য হয়ে বৃষ্টি একটু থামতে বেরিয়ে পড়লাম। একবার। নয়, মোট দুবার। একদিন মারলাম একটা ছাগল, আরেকদিন আস্ত এক কাছিম। সঙ্গে কিসমিস তো আছেই। তোফা ব্যবস্থা। সকাল ঝলসানো ছাগলের মাংস, সঙ্গে একমুঠো কিসমিস, বিকেলে কখনো মাংস নয়ত কাছিমের ডিম! রান্না করার উপায় নেই, কেননা বাটি নেই একটাও আমার সাথে। যদি থাকত তবে ঝোলটোল যাহোক বেঁধে কদিন বেশ দারুণ আয়েস করা যেত।
তাই বলে বসে নেই চুপচাপ বসে থাকলে হাত আমার নিশপিশ করে। শুহাটাকে একটু একটু করে বড় করছি। খুঁড়ছি রোজ। একদিন দেখি খুঁড়তে খুঁড়তে সটান বাইরে এসে উঠেছি। আমার বেড়াটা ছাড়িয়ে আরেকটু ওপাশে। ভালোই হল। এটাকে এবার থেকে দরজা বলে ব্যবহার করব। তবে বেড়ার বাইরে হল দরজাটা। এটাই যা একটু দুশ্চিন্তা। মুখ আগলাতে হবে। নইলে এভাবে খোলা মেলা রেখে নিশ্চিন্তে তো আর ঘুমোনো যায় না। জীবজন্তুর ভয়টাই সবচেয়ে বড় কথা। তবে তেমন কিছু হিংস্র জন্তু নেই বলেই আমার বিশ্বাস। এতদিনে দেখেছি মোটে কটা ছাগল আর ভাম। এছাড়া অন্য কিছু আছে বলে তো মনে হয় না।
৩০শে সেপ্টেম্বর। আমার জীবনের সেই চরমতম দুর্ভোগের দিন। আজ ঠিক একবছর পূর্ণ হল এখানে আসার পর। দাগ মিলিয়ে দেখলাম ঠিক তিনশ পষট্টি দিন। সারাটা দিন ছিলাম অনাহারে। কুলে পড়ে ছিলাম বেহঁশের মতো। তারপর ভাঙা। তারপর অচেতন। মৃত্যুর মুখোমুখি হবার যে কত যন্ত্রণা সেদিন আমি মর্মে মর্মে অনুভব করতে পেরেছি। আজও একইভাবে আমি অনাহারে কাটালাম। সারাদিন প্রার্থনা করলাম ঈশ্বরের কাছেহে করুণাময়, আমাকে ক্ষমা কর, মুক্তি দাও। আমি পাপী। আমি বহু অন্যায় করেছি। তুমি আমার সব পাপ স্খলন কর। এইভাবে রইলাম টানা বার ঘন্টা। এক আঁজলা জল অব্দি মুখে তুলি নি। তারপর সন্ধ্যা ঘনাতে বিস্কুট খেলাম, আর কিসমিস। মাংস সেদিন আর স্পর্শ করলাম না। তারপর সটান বিছানায়। শোবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ জুড়ে ঘুম নামল।
দিনের হিসেব রাখতে গিয়ে মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছে। রবিবার উপাসনার দিন। দাগ কাটার সময় সেটা আর আলাদা ভাবে মার্কা রাখি নি। বস্তুত প্রথম দিকে রাখবার প্রয়োজন আছে বলেও বোধ হয় নি। ধর্মের দিকে তেমন তো মতিগতি ছিল না। এখন যেহেতু রোজ প্রার্থনা করি, বোজ পড়ি বাইবেল, তাই মনটা কেবলই উসখুস করে। তখন গোড়া থেকে ফের হিসেব করে করে রবিবারগুলো ঠিক করলাম। এবার থেকে রাখতে হবে রবিবারের হিসেব। দাগটা একটু বড় করে দিলেই বুঝতে পারা যাবে। মোটমাট উপাসনার দিন এবার আর একটিও আমি বাদ যেতে দেব না। এদিকে কালির সঞ্চয় ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। সেটা আমার কাছে নিদারুণ আশঙ্কার বিষয়। এখন থেকে শুধু দিনপঞ্জী ছাড়া অন্য কিছু লেখা চলবে না।
কোনটা টানের সময় আর কোনটা বর্ষাকাল সেটাও এতদিনে আমি বুঝতে পেরে গেছি। সেইভাবেই মোটামুটি নিজের কার্যক্রম রচনা করি। কিন্তু শুধু দেখে তো আর হয় না, ঠেকেও অনেক কিছু শিখতে হয়। একেকটা ঘটনা ঘটে আর মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে বুঝতে শেখে, জানতে শেখে। যেমন আমার চাষের সেই প্রথম বার। ঘটনাটা কী বলি।
একদম প্রথম বারের ফেলে দেওয়া সেই বীজ, তার যা ফসল আমি তো রেখে দিয়েছি জমিয়ে! ভাবলাম, আসছে বর্ষাকাল, এবার একটু হিসেব মতে চাষবাস করি।
জায়গা ঠিক করলাম। খুড়লাম নিজের যা যন্ত্রপাতি আছে তাই দিয়ে। যব আর ধান মিলিয়ে সঞ্চয় আমার প্রায় দু মুঠো। একবার ভাবলাম সবই ছড়িয়ে দিই। পরে ভাবলাম থাক, বরং এক মুঠো সঞ্চয়ে থাকুক। যদি কোনো কারণে ফসল না ফলে।
তখন এক মুঠো রেখে বাকি এক মুঠো ছড়ানো হল। দিনের পর দিন যায়, দেখি অঙ্কুর গজাবার আর লক্ষণ মাত্র নেই। হাবে কোখোকে? তারপর কি আর বৃষ্টি হয়েছে? রোদের তেজ যে ভীষণ। মাটির বুকে যেটুকু জল ছিল তাও নিয়েছে শুষে। সব চেষ্টা আমার বিফলে গেল।
তারপর এল বর্ষাকাল। নতুন একটা জায়গা ঠিক করলাম। আমার মাচানের ঠিক কাছ বরাবর। জমি তৈরি হল। বীজ ছড়ালাম। দেখি কদিনের মধ্যেই অঙ্কুর গজিয়েছে। সে যে কী আনন্দ আমার! দেখতে দেখতে বড় হল গাছ। তাতে দানা হল। যব আর ধান মিলিয়ে সে অনেকখানি। আমি সব জমিয়ে রেখে দিলাম।
ততদিনে আমি যথেষ্ট অভিজ্ঞ বনে গেছি। ঐ যে বলে না, ঠেকে মানুষ শেখে। একার বীজ নষ্ট হল বলেই না আমি প্রকৃত বর্ষাকাল কোনটা জানতে পারলাম। খরার সময় বাদ দিয়ে দুই বর্ষায় আমি এর পর থেকে দুবার করে ধীজ বুনতাম। তাতে মোটামুটি প্রচুর ফসল হত।
আরো একটা আবিষ্কার হল। আবিষ্কারই বলব, কেননা আচমকা যে উপপত্তি জন্মে তাকে আবিষ্কার বলতে কোনো বাধা নেই। মাচান ঘিরে সেই যে বসিয়েছিলাম নানান গাছের ডাল, দেখি তারই কটা থেকে বর্ষার জল পেয়ে বেশ চমৎকার ডালপালা বেরিয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটা কুঞ্জ। অদ্ভুত সেই আবিষ্কার। কিন্তু পাতা তো পুরোপুরি তখনো হয় নি। কদিন ধরে দেখে দেখে আমি মোটে হদিশ করতে পারি না কোনটা কোন গাছ থেকে কাটা, কোনটার নাম কী। শেষে দেখি উইল গাছ। বেশির ভাগই তাই। দু একটা আলাদা। তখন চটপট আরো কটা ভাল কেটে বসিয়ে দিলাম আমার ভঁবুর দেয়াল ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে সার বেঁধে। বছর তিনেকের মধ্যে সে এক রীতিমতো বেড়া। গাছগাছালিতে ঘেরা অদ্ভুত মনোরম এক পরিবেশ।
ছায়ায় ছায়াও আছে আবার বেড়া বলেত যা বোঝায় অনেকটা তাই। রোদের তাপ বাড়লে এখন আর আগের মতো কষ্ট হয় না।
অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে ফেলে এবার বসলাম খাতা কলম নিয়ে। মাসগুলোকে ঋতু মাফিক সাজিয়ে ফেলতে হবে। ইউরোপে যেমন দুটো প্রধান ঋতু-শীত আর গ্রীষ্ম, এখানে তো তা নয়। এখানে বর্ষা আর গ্রীষ্ম। জলের সময় আর টানের সময়। তালিকাটা মোটামুটি এই রকম :
ফেব্রুয়ারির শেষার্ধ মার্চ এপ্রিলের প্রথমার্ধ — বর্ষাকাল। সূর্যের অবস্থান বিষুবরেখার বরাবর বা কাছাকাছি।
এপ্রিলের শেষার্ধ মে জুন জুলাই আগস্টের প্রথমার্ধ — গ্রীষ্ম। খরার সময়। সূর্যের অবস্থান বিষুবরেখার উত্তরে।
আগস্টের শেষার্ধ সেপ্টেম্বর অক্টোবরের প্রথমার্ধ — বর্ষাকাল। সূর্যের অবস্থান আবার বিষুবরেখা বরাবর।
অক্টোবরের শেষার্ধ নভেম্বর ডিসেম্বর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ — গ্রীষ্ম। খরা। সূর্যের অবস্থান বিষুবরেখার দক্ষিণে।
বর্ষাকালটা যেমন আমি দেখালাম তালিকায়, হুবহু সেই মতো নয়। কখনো তালিকার চেয়ে আরো বেশি দিন স্থায়ী হয়, কখনো বা স্থায়িত্ব কিছুটা কমে। সব নির্ভর করে বাতাসের উপর। তবে মোটের উপর গড় হিসেব মতো দ্বীপে বর্ষাকাল বলতে বছরের চারটে মাস। আমি আর তখন বাইরে বেরই না। গুহার মধ্যে থাকি, আগে থেকে সংগ্রহ করে রাখি আমার খাদ্য সামগ্রী। তাছাড়া বসে বসে করার মতো কাজও কিছু রেখে দিই এই কটা মাসের জন্যে। সময় দেখতে দেখতে কেটে যায়।
যেমন এই এবছর। করার মতো বিস্তর কাজ হাতের গোড়ায় মজুত। শুধু উপকরণের অভাব এটাই যা বড় কথা। কুড়ি বানাতে হবে কয়েকটা। তার জন্যে চাই বেত বা বেতের মতো অন্য কোনো গাছ। বানানোর কৌশল আমি ছোটো বেলা থেকেই জানি। বাড়ির কাছে ছিল একটা ঝুড়ি তৈরীর কারখানা। যাতায়াতের পথে দাঁড়িয়ে দেখতাম তার সৃজন কৌশল। আর বালক বয়েসের যা ধর্ম-নিশপিশ করত নিজের দুহাত, আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতাম, এগিয়ে দিতাম এটা ওটা। তাতে জ্ঞান বেশ ভালোই জন্মেছে। কিন্তু ঐ যে অভাব–উপকরণ নেই। সারা দ্বীপে নেই কোনো বেত গাছ। এ অবস্থায় কী করে ঝুড়ি বানাই।
তখন ভাবতে ভাবতে মাথায় একদিন একটা ফন্দি খেলে গেল। আচ্ছা, ঐ যে উইল গাছের কচি কচি ডাল–আমার মাচানের পাশে জন্মেছে বা দেয়ালের ধারে,যদি তাই দিয়েই বানাবার চেষ্টা করি। ইচ্ছে মতো দোমড়ানো যায়, ভাঙে না–আর সব ডালের মতো মট করে, শুধু ডালগুলো ছোটো ছোটো আকারের হবে, এটাই যা অসুবিধে। বেশ তো, নয় একবার চেষ্টা করেই দেখি।
তখন কেটে আনলাম একরাশ কচি কচি ডাল। বেতের চেয়ে সামান্য একটু মোটা। তাকে ফালি ফালি করে কঞ্চি মতো করলাম। বিস্তর কঞ্চি এইভাবে জমা হল। এবার তৈরির পালা। নেমেছে বর্ষা। চেষ্টা করে দেখিবারে, চমৎকার, বুড়ি তো সত্যি সত্যি একটা তৈরি হল! তখন আরো একটা, তারপর আরো, আরো। সুঠাম বুনুনি। সুবিধে হল খুব। মাটি বইতে হয়, এটা ওটা রাখার দরকার পড়ে–কোথায় পাব অত বাসনপত্র । পরে। ধান আর যবও এই ঝুড়িতে করে রেখে দিতাম।
মিটল একটা সমস্যা। এবার আরেকটি সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। একটি নয়, বলতে ভুল হয়েছে, দুটি। জল জাতীয় কোনো কিছু রাখব –মাত্র কটা বোতল আর একটা কেটলি ছাড়া আমার আর কিছু নেই। অর্থাৎ সর্বপ্রথম জল রাখার একটা পাত্র চাই আর চাই দু একটা বাটি বা ঐ জাতীয় কিছু। ঝলসানো মাংস খেতে খেতে মুখ একেবারে বিস্বাদ হয়ে গেছে। দু একদিন ঝোল টোল বেঁধে খেতে সাধ চায়। নিদেন পক্ষে সেদ্ধ বা ঐ রকমই অন্য কিছু। কিন্তু পাত্রের অভাবে পারি না সে ব্যবস্থা করতে। চটপট আমার কিছু পাত্র চাই।
দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম। বিস্তর ডাল পালা কেটে লাগিয়ে দিলাম দেয়ালের কিছুটা দূরে সার বেঁধে। আগে যে কটা লাগিয়েছিলাম এ তারই সম্প্রসারণ। বলতে গেলে কটা মাস এই কাজেই কাটল।
তখনো হাতে কিছু সময় আছে। ফের আসবে বর্ষা। এখনো সারা দ্বীপ ঘুরে দেখা আমার শেষ হয় নি। পাহাড়ের একটা দিকই মাত্র ঘুরে এসেছি। আরেক দিক এখনো বাকি। তাই বেরিয়ে পড়লাম।
সঙ্গে বন্দুক, কুঠার, বেশ খানিকটা বারুদ আর আমার কুকুর। বিস্কুট আর কিসমিসও। নিয়েছি অনেকখানি। ঝলমল করছে রোদ। পশ্চিম নয়। এবার যাব পুবের দিকে। যতদূর অনুমান গোটা দ্বীপের পরিধি প্রায় পঞ্চাশ মাইলের মতো।
কোথায় যে দ্বীপের প্রকৃত অবস্থান সেটা আমি এখনো অনুমান করতে পারি নি। কখনো মনে হয় আমেরিকার অংশ বিশেষ। স্পেনের কাছাকাছি। যদি সেটা ঠিক হয়, তবে নিকটের স্থলভাগে যে সব মানুষ বসবাস করে তারা আদিম প্রকৃতির। সভ্যতার ছোঁয়াচ এখনো লাগে নি তাদের গায়ে। আমার সানা এই, তাদের মাঝখানে গিয়ে পড়ি নি। তবে যে কী বিপদে পড়তাম তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। সবই ঈশ্বরের অনুগ্রহ। এখন সেকথা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি।
যদি স্পেনের উপকুলস্থ কোনো দ্বীপ এটা হয়, তবে জাহাজ আমি অতি অবশ্য দেখতে পাব। স্পেনের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু জাহাজ যে কখনো পড়ে না নজরে। তবে কি এটা স্পেন এবং ব্রাজিলের মধ্যবর্তী কোনো উপকূলস্থ দ্বীপ? সে ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা প্রবল। এরকম অন্যান্য দ্বীপে আমি শুনেছি নরখাদক বর্বর মানুষ বসবাস করে। তারা অপরিচিত মানুষ দেখলে কেটে কুটে খায়। নৃশংসতায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। আমার সৌভাগ্য আমি সেই জাতীয় কোনো দ্বীপে গিয়ে পড়ি নি।
এই সব চিন্তা করতে করতেই চলেছি এগিয়ে। পশ্চিম থেকে সোজা এবার পুবে। ভারি মনোরম সে অঞ্চল। রাশি রাশি ফুল গাছ। তাতে কী মিষ্টি কী সুন্দর দেখতে ফুল! কত তার রং! আর কাকাতুয়া। সে যেন অগুণতি। আর টিয়া। কথা বলতে পারে কাকাতুয়া। আমার ভারি ইচ্ছে হল একটা ধরে নিয়ে যাই। তাক করে লাঠি ছুঁড়ে একটা বাচ্চা কাকাতুয়া জখম করলাম। নিয়ে এলাম বাড়িতে। পোষ মেনেছ আমার। তাকে পরে আমি কথা বলা শিখিয়েছি। তবে এমন কিছু নয়। আমার নাম ধরে ডাকত। হয়ত শেখাতে পারতাম আরো অনেক কিছু। কিন্তু ঐ যে গোড়ায় সেই বাধা। লাঠি ছুঁড়ে আমি যে ওকে জখম করেছিলাম। সেটা হয়ত মনে রেখেছে। তাইতেই গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে ব্যবধান।
আরো অনেক কিছু দেখতে পেলাম এ যাত্রায়। দেখি পুবের মাঠে হাজারে হাজারে খরগোশ আর অজস্র শিয়াল। সচরাচর যেমন দেখি আমরা সেরকম নয়। মাংসও তেমন একটা সুস্বাদু হবে মনে হয় না। গুলিতে মারা পড়ল অজস্র। মাংসের প্রয়োজনে নয়। এমনি খেয়াল গেল। চালিয়ে দিলাম গুলি। মাংসের প্রয়োজন মেটাবার মতো জীব আমি আবিষ্কার করেছি। ছাগল আর কাছিম। সঙ্গে কিসমিসের মতো মুখরোচক খাদ্য। আর কী চাই।
হাঁটলাম দীর্ঘ পথ। তবে একদিনে নয়। প্রতিদিন দু মাইল হিসেবে একটু একটু করে। আসলে পথ পরিক্রমা আমার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য প্রতিটি অংশ খুটিয়ে দেখা। কী নতুন জিনিস পড়ে দৃষ্টির নিরিখে, তাকে ভালো ভাবে যাচাই করে দেখা। দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে। তখন গাছের উপরে উঠে বিশ্রাম করি। নিজেকে বেঁধে নিই অষ্টপৃষ্ঠে। তারপর ঘুম।
হাঁটতে হাঁটতে এলাম একদিন সমুদ্রের ধারে। দেখে তো আমি অবাক। হায় হায়, এমন মনোরম জায়গা থাকতে আমি কিনা বেছে নিয়েছি বন্ধ্যা খটখটে শুকনো একটা পাহাড়ি এলাকা। এত দেখি হাজারে হাজারে কাছিম! কী বড় বড় আর অগণিত পাখি। মুরগি বলব না। তবে অনেকটা ঐ জাতীয়। পেঙ্গুইনও আছে। কী অপূর্ব তাদের বাহার। জানি না মাংসের স্বাদ কীরকম।
নিশপিশ করছে হাত। চালিয়ে দেব নাকি গুলি। মরবে ঝাঁকে ঝাকে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু লাভ কি। বরং এর চেয়ে একটা ছাগল মারলে আমার অনেক লাভ। মাংস অঢেল, চলে দুচার দিন। দেদার খাও। তবে হাঁ, মারাটাই যা ঝকমারি। কাছে মোটে পারি না ঘেঁষতে। আসতে দেখলেই অমনি পালিয়ে যায়। তখন ওঠো পাহাড়ের উপর, তাক কর, তারপর টেপো ঘোড়া। তবে না পরিশ্রম সার্থক।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এদিকটা আমি যে অঞ্চলে থাকি তার চেয়ে অনেক বেশি মনোরম। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যও প্রচুর। অর্থাৎ সুবিধে যাকে বলে। কিন্তু তথাপি আমি আমার আস্তানা ভেঙে এখানে এসে উঠতে রাজি নই। ওটা যে ঘর আমার। পাকাপাকি ব্যবস্থা। হোক তাবু, তাতে কী এসে যায়। তবু তো গোড়া থেকে ওখানেই আছি। মায়া পড়ে যায় না। পারে কেউ মায়া ত্যাগ করে ছেড়ে যেতে? অসম্ভব। আর কেউ পারুক কি না পারুক আমি পারব না। এই নির্জন পরবাসে এই একটা জিনিসই তো আমার নিজস্ব। এই ঘর। আমি এসেছি এখানে, মনে হয় যেন বেড়াতে এসেছি। কদিন পরে আবার ফিরে যাব বাড়িতে। প্রায় মাইল বার দূর তো বটেই। আর ভালো লাগছে না। এবার ফিরতে হবে। তা এলাম যে এতদূর, একটা খুটি নয় কোথাও গেড়ে রেখে যাই। সমুদ্রের পাড়ে। সেটা হবে। আমার এতদূর পরিভ্রমণের চিহ্ন বিশেষ। পরের বার ঘুর পথে আবার আসব এদিকে। চিহ্নটা দেখে বুঝতে পারব এর পরের জায়গাগুলো আমার আগেই ঘোরা হয়ে গেছে।
আর ফেরার ব্যাপারেও ভিন্ন একটা সিদ্ধান্ত করে ফেলেছি। এসেছি যে পথে, সে পথে আর ফিরব না। যাব নাক বরাবর। দেখি কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারি।
খুঁটি পুঁতে আমি তো সেই ভাবেই রওনা হলাম। দুতিন মাইল হাঁটার পর দেখি মস্ত একটা উপত্যকা আমার সামনে, এখান থেকে কোন পথে যে কেরব সেটা আর ঠিক করতে পারি না। অর্থাৎ পথ ভুল। এদিকে পাহাড়ে বনও বেশ গভীর। সূর্য দেখে একমাত্র এ অবস্থায় পথ ঠিক করা যায়। কিন্তু আকাশে সকাল থেকেই আজ মেঘলা ভাব। সূর্য ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। ফলে চিনবার রাস্তাও বন্ধ।
দুর্ভোগের সে যেন চরম অবস্থা। তিনদিন ধরে সমানে মেঘলা। তিন তিনটে দিন আমি সেই উপত্যকায় অন্ধের মতো পাক খেয়ে ঘুরে বেড়ালাম। শেষে মরিয়ার মতো সামনে যে রাস্তা তাই ধরেই সটান বেড়িয়ে পড়লাম। বেশ খানিকটা পথ গিয়ে দেখি সমুদ্র। খুঁজতে খুঁজতে খুঁটিটা পেলাম। ঢের হয়েছে বাপু। কাজ নেই আর অভিযানে। এবার ভালোয় ভালোয় যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরে যাই বাড়িতে।
হল তাই। এদিকে গরম পড়েছে খুব। ভ্যাপসা ভাব। হাঁটতে চলতে ভারি কষ্ট। সঙ্গে আবার আমার বন্দুক বারুদ আর এটা ওটা নানান যন্ত্রপাতির বোঝা। বোঝা বয়ে নিয়ে হটা যেন আরো কষ্টকর।
ফেরার পথে কুকুরটা গিয়ে তেড়ে ধরল একটা ছাগলছানাকে। আমি হাঁই মাই করে ছুটে গিয়ে ছাড়িয়ে দিলাম। নইলে নির্ঘাৎ জানে মারত। দেখি পায়ে বেশ চোট। কামড়ে ধরেছিল যে ঠ্যাং খানা। তা মন্দ কি। নয় নিয়েই যাই বাড়িতে, পুষব। আমার তো বহুদিনের সাধ এরকম কটা ছাগল টাগল পুষি। তাতে লোকসানের চেয়ে লাভই বরং বেশি। অনটনের দিনে আয় দেবে। মাংসের দরকারটাকে তো আর অবহেলা করা যায় না।
তখন গলায় বাবার মতো একটুকর দড়ি পাকিয়ে নিলাম। আর বেড় দেবার জন্যে একটা ফিতে মতো। সেটাও দড়ির মতো ঘাস পাকিয়ে তৈরি। বাধলাম গলা। টানতে টানতে নিয়ে চললাম। দেখি হাঁটতে আর পারে না। তখন কোলে নিলাম। কিন্তু তাই বা কতক্ষণ সম্ভব। বোঝার উপর যে শাকের আঁটি। বাড়িতে পৌঁছবার আগে পড়ল আমার গায়ের বাড়ি, অর্থাৎ সেই মাচান। তার চারপাশে ঘন গাছের বেড়া। তারই মধ্যে দিলাম ছেড়ে। আমি বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
ও, ফিরে অব্দি সে যা আনন্দ আমার। একেই বোধহয় বলে বাড়ির টান। সটান শুয়ে পড়লাম বিছানায়। যেন দুহাত বাড়িয়ে নরম উষ্ণ আদর আমাকে বুকে টেনে নিল। প্রায় একমাস শুই নি নরম বিছানায়। বাইরে বাইরে কাটিয়েছি রাত। আজ ঘুমোব নিশ্চিন্তে। কোনো উদ্বেগ থাকবে না আমার মনে। ঘুমটাও ভারি চমৎকার হবে।
এক হপ্তা বলতে গেলে টানা বিশ্রাম। ঘর থেকে যেন মোটে বোরতেই ইচ্ছে করে না। শুয়ে বসে আলস্যে কেটে যায় সময়, শুধু কাকাতুয়ার জন্যে একটা খাঁচা বানালাম। বানাবার অবিশ্যি দরকার নেই, কেননা এ কদিনে রীতিমতো পোষ মেনে গেছে আমার। আদর করে নাম দিয়েছি পোল। এখন না ডাকলেও কাছে চলে আসে, কাঁধের উপর উঠে বসে থাকে চুপটি করে। খাঁচা বানাতে বানাতেই হঠাৎ যেন ইশ হল আমার। তাইত, ছাগল ছানাটাকে যে সেই থেকে বেঁধে রেখে এসেছি আমার মাচান বাড়িতে, তার খবর তো আর নেওয়া হয় নি। অমনি ছুটলাম পড়ি কি মরি করে। পৌঁছে দেখি, আহারে বেচারা করুণ চোখে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নাগালের মধ্যে একটা পাতা কি একটু ঘাসও নেই। রোগা হয়ে গেছে খুব। ইস, কী ভীষণ পাপী আমি? না জানি কবে থেকে এই হাল! অমনি চটপট কটা পাতা দিলাম এনে ছিঁড়ে। আটলা ভরে জল এনে দিলাম। ধরলাম মুখের কাছে। সো সেঁ করে এক টানে খেয়ে নিল। আর পাতা তো চোখের নিমেষে উধাও। এনে দিলাম আরো। মোটমাট এইভাবে খানিকটা সুস্থ করে দড়ি ধরে নিয়ে চললাম বাড়ির দিকে। দড়িটা এখন বাহুল্য। কেননা পোষ ইতোমধ্যেই মেনে গেছে। ক্ষুধার মুখে খাবার দিলে কে না মানে পোষ! আমাকে টানতে হচ্ছে না, দেখি নিজের থেকেই লাফাতে লাফাতে চলছে আমার পিছন পিছন।
এদিকে বর্ষাকাল ততদিনে সমাগত। এটা মরশুমের দ্বিতীয় বর্ষা। ফের সেই ৩০ শে সেপ্টেম্বর। আমার এই দ্বীপে অবস্থানের দ্বিবার্ষিকী। অবস্থা একই রকম আছে। আমার মুক্তির আশা ক্রমশই মন থেকে উধাও হতে শুরু করেছে। তবু দিনটিকে আগের বারের মতোই উদযাপন করলাম। অনাহারে রইলাম বার ঘণ্টা। ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানালাম বারে বারে।–ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা কর। আমি মুক্তি আর চাই না। এখানেই থাকতে চাই। জানি না মানুষের মাঝখানে গেলে আমি আর এই দুর্লভ সুখ পাব কি না। আর সত্যি সত্যি কীসেরই বা দরকার আমার মুক্তির। এই তো আছি বেশ। এই একাকীত্ব একটু একটু করে আমার সহ্য হয়ে গেছে। অভাব বোধটাও এখন আর নেই। কীসের অভাবই বা এখানে, আছে তো সব কিছুই। অঢেল মাংস, অঢেল কাছিমের ডিম, পাখি, পায়রা, মুরগি, বিড়াল, শেয়াল আরো কত কী। গাছে আছে থোকা থোকা আঙুর আর বাতাপি আর মৌসুম্বি আরো কত নাম না জানা ফল। আছে তামাক; আরো কতরকম উদ্ভিজ্জ । সর্বশেষ যে অভাব তা-ও ঈশ্বরের অনুগ্রহে পূর্ণ হয়েছে। আমি নিজেই এখন খাদ্যশস্যের চাষ করতে সক্ষম। সুতরাং কেন তবে আর ফিরে যাবার জন্যে আকুলতা!
এ এক অপার অনন্ত শান্তির রাজত্ব। তুলনা করি মাঝে মাঝে আমার পুরানো দিনের সাথে। দুইয়ের মধ্যে ফারাক যেখানে সেখানে, যতখানি বা যত বিশাল, সব হিসেব করে দেখি। ও জীবনে আর আমার কোনো মোহ নেই। থাকবেই বা কেন, কী আছে আমার দেশে যে মোহ থাকবে? আমার জীবনের উদ্দেশ্যটাই এখন সম্পূর্ণ পালটে গেছে। আমি আর আগের মতো ভাবতে পারি না। পারি না আগের মতো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামাতে তার যে কোনো মূল্য নেই এই নির্জনতার মধ্যে। নেই কোনো প্রয়োজন। তবে কেন আর সভ্য দুনিয়ার জন্যে আকুলি বিকুলি ।
তবু পারি না নিজেকে মাঝে মাঝে বাগ মানিয়ে রাখতে। ছটফট করে ওঠে মন। হয়ত বেরিয়েছি রোজকার নিয়মমতো বন্দুক কাঁধে, হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো দুমড়ে মুচড়ে গুমড়িয়ে উঠল মনের ভিতরটা। যেন অদম্য অব্যক্ত যন্ত্রণা এক। আমি যে বন্দী, এ তারই যন্ত্রণা। এই বন্দীদশা আমার আর ঘুচবার নয়। কেউ পরায় নি হাতে শৃখল, পায়ে দেয় নি বেডি, বা কোনো কারাগারে আটকও করে নি, তবু এ যেন দুনিয়ার সব কারাগারের বাড়া। চারপাশে ঐ অসীম অনন্ত জলরাশি যেন কারাগারের দুর্লঘ্য এক পঁচিল। পারব না কিছুতে হাজার চেষ্টা করেও ঐ পঁচিল ডিঙোতে। এই নির্জনতার মধ্যে থাকতে থাকতেই একদিন আমার আয়ু ফুরিয়ে আসবে। জানতে পারবে না কেউ আমার কথা। এ ভারি দুঃখের চিন্তা। তখন কান্না পায়। বুক ফাটিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে মন চায়। কিন্তু পারি না কাঁদতে। কেঁদে লাভই বা কী। কে শুনবে আমার কান্না? কে করবে এর প্রতিকার? তখন গুটিগুটি নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। ছুঁড়ে ফেলে দিই বন্দুক। বসে থাকি ঘাসের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জল আসতে চায় চোখ ফেটে, কিন্তু আসে না। তবু আসত যদি আমি খানিকটা শান্তি পেতাম। আমার দুঃখের বোঝা অনেকটা লাঘব হত। হবে না তা। আমি নিশ্চিত ভাবে জানি।
এটা আগের ভাবনা। এই আমি যা বললাম এতক্ষণ। এখন আমার মনের পরিবর্তন হয়েছে। এখন বাইবেল পড়ি আমি নিয়ম করে। বাইবেলেরে নিদের্শের মধ্যে খুঁজি আমার মনের সান্ত্বনার কথা। সব আছে সেখানে আমি জানি। প্রতি ছত্রে নানান উপদেশ। নিজেকে মিলিয়ে নিয়ে সেই উপদেশের বিচার করি। এখন মোটামুটি আমি নিশ্চিন্ত।
এই যেমন সেদিন। মন ভীষণ খারাপ। বসেছি বাইবেল নিয়ে। দেখি চোখ আটকে গেল একটা কথার উপর,আমি কোনোদিন তোমাকে ত্যাগ করব না, কোনোদিন না, কেউ পারবে না তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে।…… অবাক কাণ্ড, একি আমাকে উদ্দেশ করে লেখা। আমি ভাবতে শুরু করলাম। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আমার দেখি অদ্ভুত মিল। সারা দুনিয়া যখন দিয়েছে আমাকে নির্বাসন, প্রভু বলেছেন, তিনি আমার সঙ্গে আছেন। কোনোদিন ত্যাগ করবেন না আমাকে। তার মানে কি তাহলে এই, যদি এই নির্জনতা ত্যাগ করে আমি আবার সভ্য জগতে ফিরে যাই, অন্তত যাবার মতো কোনো উপায় বের করি–তখন কি তিনি আমাকে দূরে সরিয়ে দেবেন?
হয়ত তাই। সেক্ষেত্রে আমার সভ্য জগতের মায়া অতএব ত্যাগ করতে হচ্ছে। চাই না আমার ঐ সভ্যতা। আমি ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাই। চাই তার করুণার ডালি। আমি ভালবাসা চাই। ঈশ্বরের প্রেম। তার জন্যে এই নির্জনতা আমার পরম প্রিয়। সভ্য জগতের কোলাহল এখন আমার কাছে রীতিমতো দুঃসহ।
ভাবি এখন, পর মুহূর্তেই একরাশ প্রশ্ন এসে আমার মনে ভিড় জমায়। সত্যিই কি সভ্য জগতে আর আমি ফিরে যেতে চাই না? সত্যিই কি তার প্রতি আর আমার কোনো মোহ নেই? নাকি আত্মপ্রবঞ্চনা এসব; নিজেরই সঙ্গে কারচুপি? বেকায়দায় পড়েছি বলেই কি এই নতুন পরিবেশকে আমি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি? যদি না পড়তাম এমন অবস্থায়, তবে কি ঈশ্বরকে এমনভাবে ডাকতাম? প্রার্থনা করতাম তার কাছে আমাকে এই অবস্থা থেকে সরিয়ে না নিয়ে যাবার জন্যে?
তখন আবার নতুন করে ভাবতে বসি। ঈশ্বরকে আর ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে হয় না। শুধু বলতে মন চায়, প্রভু এই অবস্থায় তুমি আমাকে ফেলছ, তাই আমার ভালোমন্দ বিচারের বুদ্ধি জাগ্রত হয়েছে। এক্ষেত্রে নিজেকে খতিয়ে দেখবার ক্ষমতা। বরং সব কৃতিত্ব তোমার। আমি তোমার অনুগ্রহ লাভে ধন্য। চির কৃতার্থ আমি।
দ্বীপে এই ভাবেই দুটি বছর আমার কেটে যায়। শুরু হয় তৃতীয় বছর। মনের আনাচে কানাচে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে। কিন্তু প্রশ্ন কখনো থমকে রাখে না আমায়। অলসের মতো পারে না বসিয়ে রাখতে। কাজ করি নিয়মিত। দৈনন্দিন প্রতিটি কাজ। এখন তো আর আগের মতো নয়, সময় এখন ভাগ করে নিয়েছি প্রতিটি কাজের জন্যে। যেমন সকালে উঠে প্রথম কাজ আমার ঈশ্বরের আরাধনা, তারপর বাইবেল পাঠ। মোট তিনবার পড়ি দিনে বাইবেল। ঘুমের প্রাক মুহূর্তে একবার, আর একবার দুপুরে। সকালে আরেকটি প্রধান কাজ বন্দুক সহ খাদ্যের অন্বেষণে বেড়িয়ে পড়া। এতে ঘণ্টা তিনেকের মতো সময় যায়। তারপর রন্ধনাদি পর্ব। শিকারের ছাল ছাড়ানো থেকে শুরু করে তার মাংস কাটা, তাকে রান্নার উপযোগী করে তোলা। এতেও সময় যথেষ্ট ব্যয়িত হয়। দেখতে দেখতে বেলা দুপুর। তখন খাই পেট ভরে। সূর্য ওঠে মাথার উপর। তখন তো আর বাইরে বেরনো সম্ভব নয়। একটু বিশ্রাম নিই তখন বিছানায় শুয়ে। তারপর উঠি আবার। শুরু হয়। বৈকালিক কাজ। তার জন্যে সময় পাই চার ঘণ্টার মতো। সেটাই যথেষ্ট। বৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড গরম পড়লে দৈনন্দিন কার্য তালিকায় যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। তখন সকালের বদলে কোনো কোনো দিন বিকেলে বেড়িয়ে পড়ি খাদ্য অন্বেষণে। ।
বিকেলের ওই চার চারটে ঘণ্টা কাজ করার যে কত জ্বালা! করতে চাই অনেক কিছু, সম্ভব আর হয়ে ওঠে না। একদিনের কাজে লাগে পাঁচ দিন। করব কী। আমি যে এক অর্থে অসহায়। না আছে কাজের কোনো উপযুক্ত হাতিয়ার, না তার উপযুক্ত পরিবেশ। সাহায্য পাব যে কারুর কাছ থেকে, এমন আশাও নেই। শুধু নিজের দুখানা হাত সম্বল। এই তো দেখুন না, বানাব তাকের জন্যে চওড়া একফালি কাঠের তক্তা, সময় লাগল তাতে মোট দশ দিন। শেষ যেন আর হতে চায় না। কিছুতে হয় না মনের মতোন। অথচ কী-ই বা এমন কাজ। করাতির হাতে পড়লে লাগত বড় জোর দেড় থেকে দু ঘন্টা।
এবার তক্তা বানাতে কী কী করতে হল আমাকে শুনবেন? প্রথমে তো বেশ চওড়া দেখে একটা গাছ বাছলাম। চওড়া এই কারণে কেননা আমার তক্তাটা করতে হবে বেশ চওড়া মাপের। গুঁড়িটা কেটে ফেললাম। বলতে যত সংক্ষেপ কাজের বেলা মোটেই নয়। লাগল সর্বমোট তিনটে দিন। পড়ল অতঃপর সেটা মড়মড়িয়ে মাটিতে। তখন ডালপালা ঘঁটতে হল। তাও কম পক্ষে তিন চার দিনের কাজ। এবার হলকা হল খানিকটা। অর্থাৎ ঠেলে একধার থেকে আরেক ধারে নেওয়া যেতে পারে। নিয়ে গেলাম সরিয়ে। তারপর উপরের দিকটা উঁছলাম। মোটামুটি মসৃণ হল সেই ধার। তখন দিলাম ফের উলটে। সে ধার গেল নিচে, উঠে এল উপরে আরেক ধার। এবার উঁছলাম সেই দিক। তাতে ঝড়তি পড়তি সব বাদ দিয়ে হল তিন ইঞ্চি চওড়া একখানা তক্তা। সব মিলিয়ে মোট বেয়াল্লিশ দিন।
তবে একটা কথা। এই যে করি নানান কাজ, এতে একই সাথে আমার ধৈর্য আর কাজের নিপুণতার প্রমাণ মেলে। ধৈটা এক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন। সময় সাশ্রয়ের তো কোনো ব্যাপার নেই। হাতে আমার অঢেল সময়। অমনি নৈপুণ্যের দিকেও নজর পড়ে। দেখি না, কতটা নিপুণ করতে পারি কাজ। হয়ও মোটামুটি। এটা অবিশ্যি ধীরে ধীরে আয়ত্ত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি হবে যে, সে আশা আমি করি না। ঢাল নেই তরোয়াল নেই। আমি যে এক অদ্ভুত নিধিরাম সর্দার।
আসলে প্রয়োজনটা সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। প্রয়োজন আমাকে সব শিক্ষা দিচ্ছে। আমার নিজের দরকার মতো আমি সব তৈরি করে নিচ্ছি। বা বাধ্য হচ্ছি তৈরি করে নিতে। এর জন্যে যতটা ধৈর্য যতটা নৈপুণ্যের প্রয়োজন, তা আমাকে আয়ত্ত করতেই হবে।
এবার ফলনও খুব ভালো পেয়েছি। এটা নভেম্বর মাস। ডিসেম্বরে আমি শস্য ঘরে তুলতে পারব। যব হয়েছে। প্রচুর ধানও। জমিতে সার দিয়ে মোটামুটি চাষ যোগ্য করে তুলেছি। তা এবার সব মিলিয়ে আধ বস্তা তো হবেই। আরো হত যদি না সেবারের অতগুলো বীজ আমার নিজেরই ভুলে নষ্ট না হত। কিন্তু নতুন এক সমস্যা দেখা দিয়েছে এবার। চারা বাঁচিয়ে রাখাই দেখি এক সমস্যা। শত্রুর অন্ত নেই। একাধারে ছাগল এবং খরগোশ। কচি পাতার কী যে মধুর স্বাদ তারা পেয়েছে । ঘুর ঘুর করে সারাদিন ক্ষেতের ধারে। যেই না পাতা বেরয় অমনি কুটকুট করে খেয়ে নেয়। ফলে চারা থেকে আর শস্য বেরবার সুযোগ হয় না।
মহা সমস্যা। করি কী এখন! ভাবতে ভাবতে চারধারে বেড়া তুললাম। তাতে খাটনি গেল খুব। কাজও করতে হল খুব দ্রুতগতিতে। কেননা যত সময় যাবে, ততই আমার লোকসান। তা-ও লাগল মোট তিন হপ্তা। বেড়া তৈরি হল। ছোটো জমি বলে রক্ষে। বড় হলে না জানি আরো কত দেরি হত। ইতোমধ্যে বন্দুক ছুটিয়ে কটা খরগোশ মেরে ফেললাম। কুকুরটাকে ছেড়ে রাখতাম রাত্রে পাহারা দেবার জন্যে। সে কী ঘেউ ঘেউ সারারাত জুড়ে! সাধ্য কি সেই ডাক আগ্রাহ্য করে কোনো জীব ত্রিসীমানায় ঘেঁষে। ফলন বেশ ভালোই হল। তোলার সময় হয়ে এল প্রায়।
তখন এক নতুন উৎপাত। এবার পাখি। পাখি বলব, না বনমোরগ? সে যে কত এল উড়ে তা আর বলবার নয়। পাকা ফসলের গন্ধ যেন টানতে টানতে নিয়ে এল সকলকে চারধার ঝেটিয়ে। আর এমনই তাদের গায়ের রং মিশে থাকে গাছ গাছালির আড়ালে, আমি বুঝতেও পারি না। হয়ত দেখলাম, একটা ধান খাচ্ছে। অমনি হাই হাই করে বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওমা, দেখি এ যে অসংখ্য। চারপাশ থেকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে শুধু উড়ে পালাতে থাকে। উপরে উঠে মিলে মিশে যেন ধোয়ার এক মস্ত কুণ্ডলী। ৰা ঘোলাটে এক টুকর মেঘ। উড়ে গেল সাময়িক ভাবে, কিন্তু আমি জানি, ফাঁক পেলেই ফের এসে বসবে। কিন্তু ঐভাবে তো আর আমার এত দিনের সব পরিশ্রম নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তাহলে যে আমার খাদ্য বলতে কিছুই আর থাকবে না। তাছাড়া যদি সব ফসল ওরাই খায়, তবে আগামী দিনে আমি চাষ করব কী দিয়ে। মোটমাট বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে বাঁচাব? কী যে করব আমি মোটে দিশা পাই না। এখনো যেগুলো পাকে নি, তা কিছু কম নয়, সেগুলো ওরা খায় নি। জমাতে পারলে আগামী মরশুমে ভালো আয় দেবে। কিন্তু কীভাবে জমাই?
কিছু ঠিক করতে না পেরে ঘর থেকে বন্দুকটা নিয়ে এলাম। ভিতরে ভিতরে সত্যি তখন আমার খুব রাগ। এসে দেখি যে কে সেই। এক মুহূর্ত আমি চোখের আড়াল হতে ফের এসে বসেছে গাছের মাথায়। পুরো একটা দঙ্গল। আসছে আরো সমানে। চারধারে শুধু ডানার ঝটপটানির শব্দ। আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। এক একটা দানা খাবে ওরা, আর আমার মনে হবে দানা নয়, যেন আমার বুকের একেকটা পাজর। তখন বন্দুক চালিয়ে দিলাম। মারা পড়ল একসাথে তিনটে। বাকিরা উড়ে পালাল। তখন সেই তিনটেকে তুলে এনে টাঙিয়ে দিলাম খুঁটির গায়ে গায়ে দড়ি বেঁধে। এটা ইংল্যান্ডে মানুষের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার একটি বিশিষ্টতম পন্থা। একজনকে শাস্তি দিয়ে বাকি দশজনকে দেখায়। তাদের মনে ভয় সঞ্চার করে। আমারও উদ্দেশ্য তাই। তাতে ফুলও হাতে নাতে পেলাম। খেতে তো আর এলই না একটাও মুরগি, উপরন্তু সারা এলাকা ছেড়ে রাতারাতি সবাই যেন পিঠটান দিয়ে বাচল।
এতক্ষণে আমি নিশ্চিন্ত। আর আমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। খরগোশ তাড়িয়েছি, তারপর ছাগল, সবশেষে মুরগি। ফসল পাকল নিরাপদে। সেটা ডিসেম্বর। বলতে গেলে আমার এই দ্বীপে দু নম্বর ফসল চাষ। আরো কয়েকটা দিন দেখে আমি ধান যব কেটে ঘরে তুললাম।
হায়রে, কাটতে সে যা কষ্ট। কাস্তে তো নেই। কাস্তে ছাড়া কি আর ফসল কাটা সম্ভব। শেষে তলোয়ার এনেছিলাম একখানা জাহাজ থেকে, তাই দিয়েই কাস্তের কাজ সারলাম। আগের বার এ অসুবিধে বোধ করি নি কেননা তখন ফসল ছিল কম। এবার যে অনেকখানি। কেটে আনলাম শুধু শস্যের গোছাগুলো। গাছ দাঁড়িয়ে রইল মাটিতে, যেমনটি তেমন। মস্ত একটা বুড়ি বুনেছিলাম, সেটা একেবারে বোঝাই। তারপর ধান আর যব আলাদা করলাম। মাপবার তো কোনো সরঞ্জাম নেই। আন্দাজে বুঝলাম প্রায় দশ সের মতো যব আর দশ সের মতো ধান পেয়েছি। মোটমাট আগামী মরশুমে ফসল বুনতে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।
আহ্লাদে যাকে বলে আমি একেবারে আটখানা। আর ঈশ্বরকে জানালাম যে কত ধন্যবাদ!–আপনি কৃতার্থ করেছেন আমাকে। ঠিক সময় মতো আমার ভাঁড়ারে যখন টান পড়েছে, জুটিয়ে দিয়েছেন খাদ্যশস্য। আপনার দয়ার তুলনা নেই।
কিন্তু তা নয় ঠিক, এবার যে ধান যব ভাঙবার ব্যবস্থা করতে হয়। কী করে ভাঙাব বা কেমন করে এ সব দিয়ে খাদ্য বানানো হয় কিছুই যে জানি না। নয় ভাঙলাম যেন তেন প্রকারে, কিন্তু রুটি গড়ব কীভাবে? কিংবা হয়ত গড়লাম রুটি, তাকে ভাব কেমন করে? আগামী মরশুমের জন্যেই বা কতটা রাখব? এই সব নানান সমস্যা। তখন ভাবলাম, থাক, এক কাজ করি, একটি দানাও খরচ করে লাভ নেই। রেখে দিই বরং আগামী মরশুমের জন্যে। বীজ হবে। তা থেকে আরো বিস্তর ফলন হোক। ততদিনে মাথা খাঁটিয়ে কেমন করে রুটি গড়তে হয় বা কেমন করে তাকে সেঁকতে হয়, আমি একটু বিচার বিবেচনা করে দেখি।
পাঠক হয়ত অবাক হচ্ছেন আমার অবস্থা দেখে। ভাবছেন রুটি গড়া এ আর এমন কী সমস্যা? আমিও জানি, সমস্যা আদৌ নয়। কিন্তু আমার বিশেষ পরিস্থিতিতে সমস্যা তো বটেই। কোনো যে উপকরণ নেই। না চাকি বেলুন, না তাওয়া, না আর কিছু। সে অবস্থায় আমাকে যে নতুন কোনো উপায় বাৎলাতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় আর রাস্তা কোথায়?
কিন্তু ভেবে ভেবে যে কোনো কুল আর পাই না। ভাবছি তো প্রথমবার শস্য পাওয়া থেকে সমানে। কোনো যে সুরাহা হয় না। খানিকদূর এগিয়ে বাতিল করতে বাধ্য হই। এবারও কি তাই হবে?
নেই একটা খস্তা কি খুরপী যা দিয়ে মাটি খুঁড়তে পারি। নেহাৎ প্রয়োজনের তাগিদে কাঠ দিয়ে খন্তা মতো একটা বানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু তার কাজ আর লোহার খন্তার কাজ! –আকাশ পাতাল ফারাক। কাঠের যন্ত্র দিয়ে কাঠের মতোই কাজ পাই। মাটির গভীর অব্দি তা আর পৌঁছতে পারে না। আর সময়ও লাগে বিস্তর। উপকরণ ঠিক ঠিক মতো পেলে আমার কি আর এত সময় নষ্ট হত!
তবু ঐ যে বলে ধৈর্য,–আমি যার দীক্ষা নিয়েছি, বলা চলে, একটু একটু করে ধৈর্যশীল হতে পেরেছি, তাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। কাজে তাই আমার কোনো ক্লান্তি নেই। নিপুণ করে তুলতে চাই প্রতিটি কাজ কিন্তু উপকরণ যে নেই। এই তো জমিটা যখন তৈরি করলাম। কোপানো টোপানো শেষ, এবার যে মই দিতে হবে। কিন্তু কোথায় পাব মই। বাশই বা এখানে কোথায়। তখন মস্ত একটা গাছের গুঁড়ি এনে তাই গড়িয়ে নিয়ে গেলাম এমাথা থেকে মাথা অব্দি কয়েকবার। তাতে কাজ হল ঠিকই, কিন্তু নিপুণ হল না। না হোক, আমার তো কিছু করার নেই।
যখন ফলল ফসল, তখনো কত কি জিনিস আমার দরকার। যেমন ধরুন বেড়া দিতে হবে চারধারে, ফসল রক্ষা করতে হবে, কাস্তে লাগবে ফসল কাটার সময়, তাকে ঝাড়তে হবে, মাড়াই করতে হবে, তারপর তুলে রাখব গোলায়। কী আছে আমার যে এত কাজ নিপুণ ভাবে করতে পারব। তার পরেও তো আরো অনেক কিছু দরকার। যেমন যব পেষাই করার জন্যে যা, তাকে চাবার জন্যে চালুনি, রুটি তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় মশলা আর নুন, তাকে সেঁকবার জন্যে তাওয়াকে দেবে এনে আমার হাতের কাছে! পাব কোথায়! এসব ছাড়াই তাই চেষ্টা করতে হল। তাতে যা এল তাই লাভ। নিপুণ না হোক, তাতে ক্ষতি কী! মোটমাট ফসল যে পেয়েছি বিস্তর এতেই আমি খুশি। জমিয়ে রাখব বেশির ভাগ, খাব যৎসামান্য, জীবন যাপনের মূল একটা চিন্তা থেকে তো অব্যাহতি পেতে পেরেছি। এটাই লাভ। নয় সময় কিছু ব্যয়ই হল। নয় মনমতো ফল পাওয়া গেল না। আমার তাতে ঘেঁচু। আরো সময় লাগিয়ে আগামী মরশুমের মধ্যে দরকারী কিছু কিছু বাসন কোসন আমাকে বানাতে হবে। আরো হাবিজাবি এটা ওটা। সংসার যখন কেঁদে বসেছি তখন তো আর কিছু বাদ গেলে চলবে না।
তবে হ্যাঁ, বাসন কোসন তৈরির আগে যেটা দরকার, তা হল চাষযোগ্য অঢেল জমি। এবার তো আগের মতো ঐটুকু জায়গায় চাষ করলে চলবে না। এবার বীজ বেশি, সুতরাং জায়গাও চাই বেশি। প্রায় এক একর মতো জমি আমার দরকার। আমি হিসেব করে দেখেছি। আর দরকার একটা কোদাল। এত বড় জমিতে কোদাল ছাড়া এবার আর চাষ সম্ভব নয়। তো কোদালটাই আগে বানাই।
লেগে গেলাম কাজে। প্রায় সাত দিন টানা পরিশ্রম। তৈরি যা হল সেটা কোদাল ঠিক নয়, তবে কোদালেরই মতো। বঁটটা ভীষণ ভারী। তুলতে রীতিমতো কষ্ট হয়। তবু সান্ত্বনা, কিছু তো একটা পাওয়া গেছে। এই দিয়েই আপাতত শুরু করা যাক কাজ।
জমি বাছাই হয়ে গেছে। গুহার গা ঘেঁষেই ঢালা একটা মাঠ। সাফ সুতরো করে আগাছা ঘেঁটে ফেলার পর রীতিমতো জুমি বলেই যেন মনে হচ্ছে। তখন সেই ভারী কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করলাম। শেষও হল।
তখন বেড়া দিলাম চারধারে। ঝোঁপের মতো ছোটো একধরনের গাছ। এনে বসিয়ে দিলাম গা ঘেষাঘেঁষি করে চারধারের লাইন বরাবর। তোফা ব্যবস্থা। মোট লাগল তিন মাস। অবিশ্যি এতটা লাগার কথা নয়। কিন্তু বর্ষা যে নেমে গেছে। গায়ে জল লাগানো যে আমার বারণ। হিসেব করে এখন তাই পা ফেলতে হয়।
তা বৃষ্টির দিনে আমি যখন গুহায় কি তাবুতে থাকি, ভাববেন না, চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে আমি বসে আছি। বসে থাকা যে আমার অভ্যেসের বাইরে। তাছাড়া নতুন কাজ তখন পোলকে ভাষা শেখাতে হবে। পোল্ আমার কাকাতুয়ার নাম। পাখিকে দিয়ে কথা বলতে সে যা অসীম ধৈর্য আমার। প্রথমে নামটা দিনরাত মন্ত্র জপবার মতো কানের কাছে পড়ে পড়ে চিনিয়ে দিলাম। তারপর তাকে উরণ শেখাবার পালা। ওমা, দেখি কদিনের মধ্যে শিখে গেছে। প্রায়ই আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে–পোল, পোল! আর বুকটা আমার টিপ টিপ করতে থাকে উত্তেজনায়। দীর্ঘ তিনবছরের মধ্যে এই প্রথম শুনলাম আমি মানুষের মতো উচ্চারণ, আমি ছাড়া দ্বিতীয় একজনের ভাষা। হোক সে পাখি, কী আসে যায়। আমার নিঃসঙ্গতা তো মাচন হল! সঙ্গী পেলাম আরেক জন। কাজ যখন করব একাকী বসে, ও আমাকে শোনাবে মুখের ভাষা। এই না আমার কাছে অনেক!ইত্যবসরে বাসন কোসন বানাবার কাজ শুরু করে দিয়েছি । সে কি কম ঝকমারি মাটি দিয়ে চেপে চুপে বানাই হয়ত একটা কিছু হয় কলসী, নয় থালা, বা গ্লাস দেখতে দেখতে চোখের সামনে ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে। কিছুতে আর আকৃতিতে আসতে চায় না। সে এক বিরক্তিকর অবস্থা যাকে বলে। এবং এরকম বেশ কয়েকবার হবার পরে এই জ্ঞান আমার হয়েছে যে এই মাটিতে কাজ হবে না। চাই আঁঠাল ধরনের মাটি। তাতে জল রাখলে জল গলে বেরিয়ে যেতে পারবে না। অর্থাৎ এককথায় তার ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি।
তা খুঁজে পেতে নিয়ে এলাম অবশেষে সেই রকম মাটি। পাওয়া গেল। বানালাম তা দিয়ে অনেক কিছু। রোদে দিলাম। ফেটে ফুটে তো যাচ্ছেতাই অবস্থা তাদের। আর সে যা তৈরির নিপুণতা আমার! দেখতে প্রতিটা জিনিস এমনই কিম্ভূতকিমাকার যে গোমড়ামুখো লোক অব্দি এক নজর তাকালে হেসে ফেলবে। হাসুক। আমার তো কাজ চলা নিয়ে কথা। এই তো দুটো বানিয়েছি কলসীমতো। অর্থাৎ কলসীই বানাব বলে ভেবেছিলাম, এখন দেখি হয়েছে কিমাকার একটা জিনিস। কী নাম দেব এর ভেবে পাই না। তবু যাহোক, যদি না ফাটত, আমার জল রাখার কাজ তো ঠিকই চলত।
তখন মাটি দিয়ে ফের ফাটা জায়গায় জোড়া লাগিয়ে শুকিয়ে নিলাম। এবার আর ফাটল না। শুকিয়ে একেবারে খটখটে। তখন কলসী দুটো তুলে খুব আলগোছে বসিয়ে দিলাম দুটো ঝুড়ির মধ্যে। মাপ মিলিয়ে তৈরি কিনা।সেগুলোতে শস্য ভর্তি করে রাখলাম। বেশ চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে বলা যায়। শুকনো থাকবে এতে ধান আগাগোড়া। আগামী মরশুমে পোকা লাগবে না বা কোনো ক্ষতি হবে না।
হাতটাও ইতোমধ্যে একটু পেকেছে। কাজ করতে করতে যে জ্ঞান আর কি মানুষের জন্মায়। পটাপট আরো কয়েকটা বাসন বানিয়ে ফেললাম। দিলাম রোদে। এদিকে হয়েছে কি–একদিন ভেঙে গেছে বাসনের টুকরো, আমি তো সেটা তুলে ফেলে দিয়েছি আগুনে। দেখি কদিন পরে পুড়ে একেবারে টকটকে লাল। তখন বুদ্ধিটা হঠাৎ করেই মাথায় এল। –আচ্ছা আমি যদি এইভাবে আমার সবকটা বাসন পুড়িয়ে নিই! অমনি দিলাম এনে সব উনুনে। বেশ খোলামেলা উনুন তো, বেশ বড়সড়, আর নিভবার কোনো ব্যাপার নেই। আগুন কিছুতে নিভতে দিই না। জুলুক না যতদিন খুশি। তা তাতেই পুড়ে চমৎকার হল থালা বাসন। মায় রান্না করার একটা ডেকচী অব্দি। মুখে বলছি ডেকচী, আসলে সঠিক করে সেটাকে কী বলা যায় আমি জানি না। থালা পেলাম অনেক কটা। আর কটা বাটি। আমার তো আলাদ আর ধরে না! এক ঢিলে কত পাখি যে একসাথে মারলাম। খালা বাসন তো হলই মাঝখান থেকে কাজটা আমি পাকাঁপোক্ত ভাবে শিখে নিলাম। এবার থেকে দরকার পড়লে এভাবেই যতখুশি বানিয়ে নেব।
আর শুরু হয়েছে তারপর থেকে দারুণ দারুণ সব রান্ন। ঝোল বানাই, ঝাল বানাই, মাংস নিয়ে সে তো বলতে গেলে একের পর এক চলছে আমার পরীক্ষা নিরীক্ষা। তবে ঐ যে একটা কথা। খেতে পেলে মানুষ চায় একটু আরাম করতে। আমারও মন কেবল হাঁকু পাকু করে একটু মশলার জন্যে। আহা, দুটো একটা রকমও যদি পেতাম! তাহলে দেখিয়ে দিতাম মাংস রান্না কাকে বলে।
সব তো মোটামুটি হল, এবার একটা ভালো যাতা। যব ভাঙাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? আর যাই পারি না কেন–সে ছুতর হোক, কুমোর হোক–পাথর কাটার কাজ যে কখনো শিখি নি। ভাবতে কি পেরেছি ছাই আমাকে এ অবস্থার মুখোমুখি কোনোদিন হতে হবে। তবে নয় আগে ভাগে এটাও শিখে রেখে দিতাম। কিন্তু এ যে দেখি নিরুপায় অবস্থা। পাথর আছে বিস্তর কিন্তু সবই পাহাড়ের শক্ত মজবুত পাথর। মস্ত বড় বড় খণ্ড থেকে শুরু করে বিশাল বিশাল পাথরের চাই। কেমন করে ঐ থেকে আমি আমার প্রয়োজন মাফিক কেটে নেব। যন্ত্র কোথায় আমার! কাজের প্রয়োজনীয় উপকরণ! খুঁজতে খুঁজতে দেখেছি এই পাহাড়েই আরেক অংশে অন্য এক জাতীয় পাথর আছে তা বড় নরম। একটু ঘা দিলে, ঝুরঝুর করে গুড়ো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে। তাতে কি আর যাতা তৈরি হয়। চাপ যে মোটে সহ্য করতে পারবে না। তাহলে উপায়!
শেষ অব্দি অনেক ভেবে চিন্তে পাথরের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে ফের কাঠের দিকে নজর ঘোরালাম। এটা এখন মনে হচ্ছে তুলনায় যথেষ্ট সোজা। চ্যাটাল একটা অংশ গুঁড়ি থেকে তৈরি করে নেব, তাতে গর্ত থাকবে ভিতরে বেশ খানিকটা, আর একটা কাঠের কুঁদো দিয়ে পেটাই করব। বা সামান্য জোর লাগিয়ে নাড়াচাড়া করব। তাতে সব আটায় পরিণত হবে আর ধান থেকে হবে চাল। অমনি বসে গেলাম কুড়ুল টুডুল নিয়ে। খাটুনি হল খুব। আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে খুঁড়ির মাঝখানটা বেশ খানিকটা গর্তও করলাম। বানালাম কাঠের একটা হামন। ভাঙা বা ফাটার তো আর ভয় নেই। দুটোই লোহা কাঠ দিয়ে তৈরি। এবার আর কি। খুঁড়ো হবে যব, ধান ভাঙা হবে। মোটমাট রুটি কি ভাত তৈরির ব্যাপারে আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম।
কিন্তু চালুনি একটা দরকার। এর প্রয়োজনীয়তা অসীম। চালুনি দিয়ে যবের গুঁড়ো সেঁকব, তবে না বেরবে ময়দা। ভুষি যে আলাদা করতে হবে। কিন্তু কী দিয়ে করি চালুনি! চাই শুক্ষ ফুটো ফুটো সিল্ক ধরনের একফালি কাপড়। তেমন কাপড় কোথায়! বিকল্প কিছু সারা দ্বীপ খুঁজেও আবিষ্কার করতে পারলাম না। ফলে মাসের পর মাস ভেবে আমি আর কল পাই না। এদিকে আমার পোশাকের সঞ্চয় বলতে গেলে শূন্যের দিকে। যা আছে কিছু ছেঁড়া খোঁড়া শত তালি দেওয়া এক একটা অদ্ভুত দর্শন জিনিস। তবে হ্যাঁ, ছাগলের ছাল আছে কিছু। আর ছাগলের গায়ের পশম। ওগুলো আমি আলাদা করে জমিয়ে রেখেছি। জানি না তো কবে কী দরকার পড়ে যায়! কিন্তু পশম দিয়ে বুনে যে একটা কিছু তৈরি করব সে কৌশল যে জানি না। বা চেষ্টা যে করব সেজন্যে প্রয়োজনীয় যে সব উপকরণ দরকার, তা-ই বা কোথায়। তখন ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল তাইত কটা টাই তো পোশাক আশাকের সঙ্গে জাহাজ থেকে এনেছিলাম। মখমলের কাপড় দিয়ে তৈরি। তার একটাকে খুলে মাঝখানে দু-একটা সুতো সরিয়ে দিলেই তো চালুনি হয়ে যায়। দেখাই যাক না।
সফলই হলাম বলা যায়। সমস্যা মিটল। ভুষি আর ময়দা হল আলাদা। এবার আর কি।–পরের কাজ রুটি তৈরি ।
কিন্তু গড়ব কীভাবে রুটি! প্রথমত যে উনুনে দিয়ে ফোলাব, ফাঁপাব যেমন পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের বাজারে–সেই মশলা আমার কোথায়! নয় ধরে নিলাম, অতটা ফোলাবার দরকার নেই, ভাজা ভাজা যা হোক একটু হলেই হল–কিন্তু তার জন্যে দরকার তা তাওয়া। আমার কি সেই তাওয়া আছে! বলব কি সে যা মনের অবস্থা আমার–যেটাই করতে চাই, খানিকটা এগিয়ে আর এগোতে পারি না। এটা ওটা নানারকম সমস্যা এসে হাত চেপে ধরে। ভিতরে ভিতরে ভোগ করি নিরুচ্চার এক যন্ত্রণা। শেষে মাসের পর মাস ভাবনার ফলে সমাধানে পৌঁছলাম। মাটির পাত্র বানালাম মস্ত একটা। অনেকটা বাটির মতো কাধ উঁচু। পরিসীমা প্রায় দু ফুটের মতো। গভীর প্রায় নয় ইঞ্চি। সেটিকে আগুনে নিলাম পুড়িয়ে। ব্যস, নিশ্চিন্ত এবার। এই তো আমার হাওয়া। সেঁকার সময় আগুন তুলে নিই চুল্লী থেকে। চারপাশে ছড়িয়ে দিই। মাঝখানে রাখি ময়দা আর জল দিয়ে তৈরি করা মণ্ড। উপরে চাপা দিই চৌকো মতো পোড়া মাটির টালি। ব্যস, একের পর এক রুটি সেঁকা হয়ে যায়।
তবে এ ব্যবস্থা প্রথম দিককার। কাজ করতে করতে যেমন মানুষের অভিজ্ঞতা জন্মায়, আমারও তাই। পরের দিকে তাওয়ার মধ্যে আর আগুন তুলি না। তাওয়াটা নিয়ে আসি চুল্লীর কাহু গোড়ায়, ফলে গরম হয় পোড়া মাটি, চারধারে গনগনে লাল কাঠকয়লা দিই টাল করে। তারপর সরিয়ে নিই সে সব। এবার এই তাওয়ায় দিই ময়দার মণ্ড। উপরে চাপা দিই। সে একেবারে আদর্শ রুটি যাকে বলে। ভাপে সেঁকা হয়ে অপূর্ব তার স্বাদ। আর কী মিষ্টি খেতে! জানি না নিজের হাতে গড়া কিনা তাই। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারি। কালে দিনে আমি একজন পাকা পাঁচক ঠাকুর বনতে চলেছি। এ ব্যাপারে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই। চালের গুঁড়ো দিয়েও এখন নানান ধরনের খাবার বানাই। তার মূল উপাদান ছাগলের মাংস, জল আর চালগুঁড়ো। মুরগির মাংস দিয়েও মাঝে মাঝে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাই। মোটমাট খাদ্য প্রস্তুতের ব্যাপারে আমি এখন পুরোদস্তুর নিশ্চিত।
তৃতীয় বছরের বেশির ভাগ সময় আমার এসব কাজেই কাটল। এ এক নেশা যেন। চাষবাস, পশুপালন, সেই সাথে একের পর এক নতুন নতুন খাবার তৈরি। ফসল তুলেছি এবার ভালো। কেননা মরশুমের শুরুতেই বুনে দিয়েছিলাম বীজ। ফসলের ভারে গাছ ভেঙে পড়ার দাখিল। তুলে এনে জমিয়ে রেখে দিয়েছি গুহার এক ধারে। এছাড়া তো উপায় নেই। জায়গা প্রথমত কম, দ্বিতীয়ত ঝাড়াই মাড়াই করব এমন উপকরণের অভাব। যেমন যেমন দরকার হয় তুলে নিয়ে আসি মুঠো ভরে। হামনে ফেলে গুঁড়ো করি।
কিন্তু না, এরপর থেকে আর এভাবে ফসল রাখা চলবে না। গোলা বানাতে হবে অবশ্যই। সামনের বছর তো আরো বেশি ফলন পাব। কোথায় রাখব তখন! তাছাড়া সঞ্চয় হিসেবেও কিছুটা থাকা দরকার। মরশুমের আগেই দেখি ফুরিয়ে আসে দানা। মোটমাট বুঝতে হবে আমাকে সারা বছর খেতে কতটা মোট ফসলের দরকার হয়।
হিসেব করে দেখা গেল চাল আর যব মিলিয়ে সারা বছরে আমার দরকার প্রায় চল্লিশ বুশেলের মতো খাদ্যশস্য। কি লাভ অহেতুক বেশি চাষ করার! বীজের জন্যে যেটুকু বেশি দরকার তাই হলেই ঢের। মিথ্যে খাটুনির প্রয়োজন কী! ঠিক করলাম এবার থেকে হিসেব করে চল্লিশ বুশেলের একটু বেশি যাতে পাই সেরকম বীজই বুনব।
চাষবাস করি, খাবার বানাই, মাথার মধ্যে ঘোরে কেবল এপার থেকে দেখা ওপাশের ঐ যে দ্বীপ তার কথা। যেতে ইচ্ছে করে বারবার সেখানে। দখল নিতে মন চায়। ইচ্ছে করে ওপারে গিয়ে হাঁটা দিই নাক বরাবর। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। তবে হয়ত বাসস্থানের নিকটবর্তী হব। হয়ত কেউ না কেউ থাকে সেখানে। নিশ্চয়ই কোনো গোষ্ঠী কি জাতি। তাদের সাহায্য নিয়ে রওনা দেব একদিন স্বদেশের দিকে। এই বন্দীদশা আমার ঘুচবে।
কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা হিসেব করে সঙ্গে সঙ্গে ফের নিজেকে গুটিয়ে নিই। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা দ্বীপ কে জানে যদি পড়ে যাই কোনো নরখাদক বর্বরের হাতে! যদি দেখামাত্র আমাকে তারা হত্যা করে। জ্যান্ত কেটে কেটে শরীরের মাংস খায় । এলাকাটা যে বর্বর নরখাদকের, এ আমি অনুমানে বুঝতে পারছি। হিংস্র জন্তুও আছে প্রচুর। তবে তাদের থেকে নরখাদক মানুষকেই আমার বেশি ভয়। পাশাপাশি এমন যদি ধরে নিই, এরা নরখাদক নয়, কোনো সভ্য জাতি, সেক্ষেত্রেও আমার বাবার আশা কম। অনেক ইউরোপীয়েরই এই দুর্গতি হয়েছে আমি শুনেছি। ভাসতে ভাসতে এসে পড়েছে ঐ ধরনের কোনো গোষ্ঠী বা জাতির হাতে। দেখা মাত্র তারা তাকে হত্যা করেছে। কোনো কারণ নেই। এমনিই হত্যা। সভ্য দুনিয়ার মানুষকে এরা বরদাস্ত করতে পারে না। দেখলেই মনের মধ্যে ঘৃণা আর ভয় মুখিয়ে ওঠে।
তবু হাল ছাড়ি না। অর্থাৎ মন থেকে পারি না ইচ্ছেটাকে তাড়াতে। বারবার যেতে মন চায়। জল ডিঙিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে ওধারে। দেখি না, কী আছে ভাগ্যে। আমি যে এখন পূর্ণ মাত্রায় ভাগ্যে বিশ্বাসী।
জুরি সঙ্গে থাকলে এসময় খুব ভালো হত। কত যে ভাবি তার কথা! দুজনে মিলে বানিয়ে নিতাম একটা নৌকো। তাতে করে পাড়ি জমাতাম। কিন্তু নেই যখন নিজেকেই ভাবতে হবে উপায়। নতুন করে নৌকো বানাবার প্রশ্ন ওঠে না। একার পক্ষে তা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে যাই না দেখি গিয়ে জাহাজের নৌকোটা আছে কিনা।
গিয়ে দেখি আছে। স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে সেখানেই পড়ে আছে। তবে সোজা অবস্থায় নয়, উলটো ভাবে। বালি ছেয়ে ফেলেছে প্রায় অনেকটা অংশ। কিন্তু জল নেই। সেটাই সান্ত্বনা। জল থাকলে নির্ঘাৎ কাঠ পচে যেত।
কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি হয় সব সময়। তবে তো পৃথিবীতে হতাশা বলে কোনো কথাই থাকত না। নৌকো তো কদিন ধরে ওখানে পড়ে নেই। তা প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলল। গিয়ে দেখি গেঁথে আছে বালির মধ্যে। একেবারে পাথরের মতো ভারী। পারি নাএকটু নড়াতে কি সরাতে। আর এমনিতে ওজন তো খুব। দু এক জায়গায় সামান্য চোট লেগেছে। সারিয়ে নিলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত। চাই কি এই নৌকোয় চেপে ব্রাজিল অব্দি স্বচ্ছন্দে পাড়ি জমাতে পারতাম। সবই দুরাশা। বিস্তর ঠেলাঠেলি ধাক্কা ধাক্কি করেও পারলাম না একচুল টলাতে। তখন গাছের ডাল কেটে নিয়ে এলাম। তাই দিয়ে চেষ্টা করব। চাড় দিয়ে দেখব পারি কি পারি না। হায়রে, সে যে কী ঝকমারি। এর থেকে গোটা দ্বীপটা ঠেলে নড়ানোও যেন সহজ। পারলাম না একে কোনোমতে স্থানচ্যুত করতে।
চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। আপনারা শুনে হয়ত বলবেন–এটা করেন নি কেন, ওটা করা উচিত ছিল। সবিনয়ে জানাই, আমার সাধ্যে যতটুকু কুলোয় তার এতটুকু কসুর আমি করি নি। প্রায় চার হপ্তা একটানা করেছি পরিশ্রম। শেষমেশ বালি অব্দি চারপাশ খুঁড়ে ফেলেছি। যদি কোনোমতে একটুখানি নিচে ঢোকার উপায় থাকে। বা নিদেন পক্ষে একখণ্ড কাঠ ঢোকাবার অবস্থা থাকে। তবে একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখব।
সে চেষ্টাও বিফল। সেভাবেও পারি নি। এতটুকু নড়াতে। নিচে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আগাগোড়া পেট বোঝাই বালি। আমার সাধ্য কি সেগুলো সরিয়ে ভিতর থেকে ঠেলা মারি। শেষে হতাশ অবস্থায় হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। থাক পড়ে যেমন আছে তেমন। আমার এতে আর দরকার নেই। তবে হ্যাঁ, এতে করে পরপারের যাবার ইচ্ছেটা একদম কমে নি। সেটা বরং বলতে গেলে আগের তুলনায় আরো বেড়েছে।
তখন হঠাৎ মাথায় খেলে গেল নতুন একটা চিন্তা। আচ্ছা, ছোটো একটা ডিঙি যদি নিজের হাতে তৈরি করে নিই। শালতি বলে যাকে। গাছের গুঁড়ি কেটে তার মাঝখানটা খুড়ে দিলেই হল। অনেকে একে বলে ভোঙা। মোটমাট আমার যা বর্তমান অবস্থা যন্ত্রপাতি নেই, সাহায্য করার একটা লোক নেই আমার পক্ষে অন্য কিছু বানানো ঝকমারি। তা ভাবতে যে পেরেছি তাতেও ভারি খুশি খুশি লাগল। _ কিন্তু সমস্যার কি আর অন্ত আছে। ডোঙা নয় শেষ অব্দি বানালাম, কিন্তু জলে টেনে নিয়ে যাব কীভাবে। ধরা যাক মস্ত একটা গাছ বাছলাম, কাটলাম সেটাকে, পেটটা খুড়ে বা প্রয়োজনবোধে পুড়িয়ে বানালাম দুর্ধর্ষ সুন্দর একখানি ডোঙা। কিন্তু সেটাকে জল অব্দি টেনে নিয়ে যাব কীভাবে। সে কি একলা হাতে সম্ভব। তবে তো সব প্রচেষ্টা আমার বিফল যাবে। সে অবস্থায় করণীয় কী।
করণীয় কি হবে কি না হবে সেটা পরে বিচার্য। সব কিছু অত হিসেব কষে আগে ঠিক করা যায় না। নিজের মনকেই নিজে দিলাম প্রচণ্ড ধমক। এখন কাজটা মানে মানে শুরু কর তো বাছাধন!
তখন খুঁজে পেতে বের করলাম মস্ত এক সেগুন গাছ। ফুলেরই খানিকটা কাছাকাছি। তার গুঁড়ির পরিধি নিচের দিকে পাঁচফুট দশ ইঞ্চি আর উপর দিকে চার ফুট এগার ইঞ্চি প্রায়। দৈর্ঘ্যে বাইশ ফুট। শুরু হল কাটার কাজ। একদিনের তো আর কাজ নয়। লাগল মোট বানাতে বাইশ দিন। তবে গাছ মাটিতে শয্যা নিল। তখন ডালপালা ছাঁটা। সে-ও প্রায় চৌদ্দ দিনের টানা পরিশ্রম। তারপর শুরু হল ভিতরের কাঠ খুঁড়ে ফেলা। কী অসীম কষ্ট আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। হত তো মোটে দুখানা। তার উপর দৈনন্দিন নিয়ম মাফিক অন্যান্য কাজ করতে হয়। সব মিলিয়ে সময় লাগল পাকা তিনটি মাস। নৌকো বলেই মনে হচ্ছে। বরং ডোঙা বা শালতির চেয়ে দেখতে অনেক চমৎকার। ভিতরে যা জায়গা তাতে ছাব্বিশ জন লোক অনায়াসে বসতে পারে। তাতেও ফাঁকা খাকে বেশ অনেকখানি। আর একা আমি হলে তো চিন্তাই নেই। আমার যাবতীয় মালপত্র সমেত আমি স্বচ্ছন্দে ডোঙায় চেপে পাড়ি জমাতে পারব।
খুব আনন্দ তখন আমার। কাজ মোটামুটি নিখুঁতই বলা চলে। আগুনের সাহায্য নেবার দরকার হয় নি। যা করেছি সব নিজের হাতে। কুড়ুল আর করাত দিয়ে। আর যা শক্ত কাঠ! কত যে ক্লান্তি জমা হয়ে আছে এর পরতে পরতে। তবু হাল ছাড়ি নি। এটাই সান্ত্বনা যে শেষ করে তবে ইস্তফা দিয়েছি কাজে।
তবে ঐটুকুই। পারলাম না হাজার চেষ্টা করে তাকে জলে নিয়ে যেতে। অসীম কষ্ট করলাম। আর নানান চেষ্টা। মাত্র জলের থেকে শখানেক গজ দূর। কিন্তু পারব কীভাবে, এদিকে যে পাহাড়ী এলাকা। কুল অনেকটা উঁচুতে। ভাঙা পড়ে আছে নিচের দিকে। সেখান থেকে ঠেলে উপরে তুলে ফের জলে নামানো একেবারেই অসম্ভব। তখন ভাবলাম, এক কাজ করি বরং মাটি খুঁড়ে ফেলি–শুরু করলাম কাজ। কিন্তু কিছুদিন পরে ইস্তফা দিলাম। কোনো লাভ নেই। মাটি বঁড়লেও কিছুতে পারব না আমি একার চেষ্টায় ডোঙাটাকে একচুল গড়াতে। আমার শক্তির সম্পূর্ণ বাইরে।
তখন ফের একদফা জমি মাপলাম। নতুন বুদ্ধি উদয় হল মাথায়। আচ্ছা যদি এক কাজ করি! যদি মস্ত গভীর একটা নালা কাটি জল থেকে শুরু করে ডোঙা অব্দি। তাতে স্বাভাবিক নিয়মে জল চলাচল করবে। সেক্ষেত্রে ডোঙা নিজেই জলের নাগাল পাবে। আমার খুব একটা ঠেলাঠেলির দরকার হবে না।
শুরু করব কাজ, তার আগে বসলাম একদফা হিসেব নিয়ে। পাহাড়ী এলাকা। নালা কাটা মানে আগাগোড়া পাহাড় কাটা, তার পাথর ভাঙা। তাতে সময় লাগবে আমার মোট বার বছর। কেননা মুখের দিক থেকে ডোঙার কাছ বরাবর অব্দি খুঁড়তে হবে প্রায় বিশ ফুটের মতো গভীর করে। আমার মতো একলা মানুষের পক্ষে সেটা বার বছরেরই পরিশ্রম। দরকার কী অহেতুক পরিশ্রমে। বরং ডোঙার ব্যাপারটাকেই পুরো বাতিল করি।
ভারি দুঃখ পেয়েছিলাম সেবার। এতদিনের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল দেখে। আসলে নিরুপায় যে আমি। এ অবস্থায় একা মানুষের পক্ষে নতুন কী-ই বা করার থাকতে পারে।
এই সব কাজের মাঝে একদিন চার বছর পূর্ণ হল। দ্বীপে আসার এই আমার চতুর্থ বার্ষিকী। সেই ৩০ শে সেপ্টেম্বর। দিনটি যথারীতি উদ্যাপিত হল। সারাদিন থাকলাম অভুক্ত অবস্থায়। ঈশ্বরকে ডাকলাম। তবে একটা কথা, মনে কিন্তু আমার কোনো দুঃখ, কি তাপ, কি শোক বলতে কিছু নেই। ঈশ্বরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞ আমি এবং কৃতার্থ। আমাকে তিনি এই চার বছরে যথেষ্ট জ্ঞানী করে তুলেছেন। আগে বুঝতাম না এখন সব কিছুই বুঝি। আগে যা যেমন ভাবে দেখতাম এখন অন্য চোখ দিয়ে দেখি। সব কিছু সম্পর্কে ধারণা এখন আগের তুলনায় অন্যরকম। পৃথিবীকে আমি মনে করি এখন দূর গ্রহের মতো কোনো একট গ্রহ। তার কাছে আমার আর কিছু আকাক্ষা নেই। কোনো চাহিদা নেই। বাস্তবিক চাইলে লাভই বা কি। আমি তো আর কোনোদিন সভ্য জগতে ফিরে যাব না। এখানেই থাকতে হবে চিরকাল। সভ্য জগতের দিকে আঙুল দেখিয়ে বাইবেলের ভাষায় এখন শুধু বলতে ইচ্ছে করে তোমার আর আমার মাঝে এখন দুস্তর ব্যবধান।
ব্যবধান সব দিক থেকেই। এই যে এখানে আছি আমি–পৃথিবীর নানারকম দুল চাতুরী থেকে আমি মুক্ত। আমার মোহ বলতে কিছু নেই, না আছে চোখে দেখার মোহ, না আছে জীবন নিয়ে কোনো রকম অহংকার। ঈর্ষা করার মতো কিছু নেই। আর সত্যি ঈর্ষা করার আমার দরকারই বা কী! কীসের অভাব আমার। আমি তো নিজেই এই গোটা ভূখণ্ডের মালিক। সে অর্থে আমি রাজা, বা আরেকটু বড় করে বললে, আমি সম্রাট। আমার কোনো প্রতিদ্বন্দী নেই, নেই কোনো প্রতিযোগী। এমনকি আমার সার্বভৌমত্ব নিয়ে অব্দি কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগার কারণ নেই। ইচ্ছে হলে আমি জাহাজে জাহাজে মাল বিদেশে পাঠাতে পারি। কী হবে আমার এত জিনিসপত্র দিয়ে! আমি তো আর অত ধানচাল, অত যব একলা খেয়ে ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করতে পারব না। সেক্ষেত্রে বাকি সব চালান দেওয়াই উচিত। শুধু ধান চাল যুব নয়, কাঠ চালান দিতে পারি আমি। কাছিম আঙ্গুর আরো কত কি! কিন্তু দেব কীসে! আমার কি কোনো জাহাজ আছে। আছে সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ?
কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে নিজেই আমি এসবের ভোগ দখলের অধিকারী। ব্যয় করি পরিমিত। অহেতুক অপব্যয় আমার একদম পছন্দ হয় না। ধরুন যদি মারি মস্ত একটা ছাগল–কী হবে অত মাংস দিয়ে আমার? আমি তো আর একলা সব একদিনে খেয়ে শেষ করতে পারব না। সেক্ষেত্রে ফেলা যাবে। কুকুরটা খেয়ে নেবে, নয়ত নষ্ট হতে পারে। তখন পোকা ধরবে। পোকা খাবে পেট পুরে। তাতে আমার কী লাভ! বা ধরুন প্রচুর ফসূল ফলোম। আমার লাগবে যতটা তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি। নয় কিছুটা রেখে দিলাম বীজ করবার জন্যে। কিন্তু বাকিটা? সেটা তো নষ্টই হল। কিংবা হয়ত কেটে আনলাম মস্ত বিশাল একটা গাছ। অত কাঠে আমার তো দরকার নেই। তখন মাটিতে পড়ে পড়ে জলে কাদায় পচবে। নষ্ট হবে। নয় রোদের তাপ খেয়ে খটখট শুকনোই হল। কিন্তু কী হবে অত শুকনো কাঠ দিয়ে আমার। অত আগুন কি আমার জ্বালাবার দরকার হয়!
অর্থাৎ বোধ জন্মেছে আমার মনে। এটা আমি নিজেও বুঝতে পারি। শিখিয়েছে সব আমাকে এই প্রকৃতি। এই নিঃশব্দ নির্জন পরিবেশ। অনেক সত্য আমি এই একক একাকীত্বের মধ্যে উপলদ্ধি করতে পারছি। যেমন প্রাচুর্য এবং স্বল্পের মধ্যে সম্পর্ক। প্রাচুর্যের কোনো দরকার নেই। ঠিক যতটুকুর দরকার সেটুকু হলেই দুনিয়ায় মানুষের প্রয়োজন মিটে যায়। যা বাড়তি তাই আমরা দিয়ে দিই অপরকে। নিজেরটুকু ভুলেও কখনো হাতছাড়া করি না। ঈর্ষা মানুষের একটা ব্যাধি বিশেষ। আমার খুব ইচ্ছে হয়, পৃথিবীর জঘন্যতম ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিটি এই নির্জন বিজনে এসে কটা বছর কাটিয়ে যাক। তবে আর ঈর্ষা বলে তার মনে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। এখানে সে ঈর্ষা করার লোক পাবে কোথায়! চারদিকে তো অনন্ত প্রাচুর্য। নিক না তার যতখানি দরকার লাগে ততখানি। দুহাত ভরে নিক। শেষে নিতে নিতে তারও নির্ঘাৎ আমার মতো বিতৃষ্ণা হবে। তখন মিতব্যয়ী হতে শিখবে। সঞ্চয়ও করতে শিখবে মিতভাবে। সব রকম আকাঙ্ক্ষা তার মন থেকে বিদায় নেবে। যেমন আমার এখন আর নেই কোনো আকাঙ্ক্ষা। আমার সঙ্গে টাকা পয়সাও তো বিস্তর রয়েছে। আছে সোনা অনেকখানি আর রুপো। সত্যি বলতে কি, সেগুলো যে আছে আমার কাছে, তা-ও মাঝে মাঝে বিস্মরণ হয়ে যায়। এখানে কী তার মূল্য বলুন দেখি! কী কাজে লাগবে আমার ঐ সোনা রুপো বা টাকা! সব নিরর্থক। সব মূল্যহীন। আমাকে যদি কেউ এসে বলে, তোমাকে আমি তামাক দেব খানিকটা, তুমি বিনিময়ে আমাকে সব সম্পদ দিয়ে দাও, আমি একটুও ইতস্তত না করে সম্পূর্ণ থলিটা এনে তার হাতে তুলে দেব। এক বোতল কালি দিলেও দিয়ে দেব সব। কালিটা আপাতত খুব দরকার। ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। এখন মাত্র তলানি। বিনিময়ে নিয়ে যাক না আমার সব সম্পদ। আমার তাতে প্রক্ষেপ মাত্র নেই।
মোটমাট মনের দিক থেকে এখন আমি যথেষ্ট মুক্ত। খুব স্বাভাবিক বলতে যা বোঝায়। জীবনটাকে এই স্বাভাবিকত্বের ছাচেই ঢেলে নিয়েছি। দৈনন্দিন সংগৃহীত মাংস নিয়ে যখন দুপুরের আহারে বসি, তখন মনে করি এই যে মাংস আমি পেয়েছি, এটা যথেষ্ট স্বাভাবিক। ঈশ্বরের অপরূপ করুণার ফলেই আমি আজ এই জীবটিকে বধ করতে সক্ষম হয়েছি। তাকে ধনাবাদ জানোটাই এক্ষেত্রে স্বাভাবিক { জানাই তাই। হৃদয়ে অসীম তৃপ্তি অনুভব করি। জীবনের ভালোটুকুর দিকেই এখন আমার সবচেয়ে আগে চোখ যায়। অর্থাৎ এক অর্থে আমি আশাবাদী। আগে দেখতাম শুধু কষ্টের দিক, দুঃখের দিক। এখন দুঃখ কষ্টের কথা তেমন আর বিরাট ভাবে মনে পড়ে না। যা পাই তা তো অচেল। সে অর্থে বলতে গেলে আমি রাজসুখে আছি। খোশ মেজাজে কাটছে আমার একটির পর একটি দিন। আমার তো কোনো কিছুর অভাব নেই। পারবে এভাবে সভ্য দুনিয়ার কোনো মানুষ ভাবতে? অসম্ভব। যা দেন ঈশ্বর তাতে কিছুতে তারা সন্তুষ্ট হতে পারে না। মনের মধ্যে কেবলই জমা করে অসন্তোষের কালো ধোয়া। তা থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা আর পরশ্রীকাতরতা। আমার সৌভাগ্য আমি সে সব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।
আর ঘুরে ফিরে কেবলই আসে ঈশ্বরের করুণার কথা! মনকে বলতে গেলে আচ্ছন্ন করে রাখে। কী বিপদেই না পড়েছিলাম প্রথম দিকে ভাবুন দেখি! নির্জন নিরিবিলি একটা জায়গা, সেখানে এসে উঠলাম প্রত্যাশিত ভাবে। ভেবে দেখুন সহায় সম্বলহীন একটা মানুষ। জুটিয়ে দিয়েছে সব কিছুই ঈশ্বর। ভাঙা জাহাজটা ঠেলতে ঠেলতে এনে ফেললেন কুলের কাছে। দুরে থাকলে জানি না সে জাহাজে আমি যেতে পারতাম কিনা। কূলের কাছে বলে স্বাচ্ছন্দ্যে ভাতে গেলাম, প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস একটি একটি করে নিয়ে এলাম। আনলাম কাজ করবার মতো যন্ত্রপাতি, সঙ্গে আত্মরক্ষার অস্ত্র, তার রসদ হিসেবে বারুদ আরো কত কী!
অবাক বিস্ময়ে সে কথাই ভাবি সব সময়। তবে দেখুন, যদি না পেতাম বন্দুক কি গোলা বারুদ। কী হত তবে আমার অবস্থা! পারতাম আমি এইভাবে বেঁচে থাকতে। খাদ্য হিসেবে জুটত আমার তখন শুধু কাছিম আর মাছ। তাও জোটাতে পারতাম কিনা সন্দেহ। শুধু তো হাত দুখানা সম্বল। তা-ও পারতাম না রান্না করে খেতে। কোথায় পেতাম এখানে আগুন! কাঁচা খেতে হত সব চিবিয়ে। বর্বর আদিম মানুষেরা যেভাবে খেয়ে বেঁচে থাকে। হয়ত চিল বা পাথর ছুঁড়ে দুটো একটা ছাগল মারতাম। কিন্তু ছাড়াতে পারতাম কি তাদের ছাল? সেক্ষেত্রে সামনে খাদ্য নিয়ে অনাহারে বসে থাকতে হত আমায় আর তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগোনো ছাড়া উপায় থাকত না।
সবই করুণা। ঈশ্বরের অনন্ত অসীম করুণার ফল। আমি স্পষ্ট সে কথা উপলব্ধি করি। যাদের উপর এই করুণা বর্ষায় না তাদের জীবন দুঃখের। এবং পৃথিবীতে এই জাতীয় দুঃখী মানুষের সংখ্যা কম নয়।
আমার সৌভাগ্য ঈশ্বরকে আমি এই বিজন নিরালায় এসে চিনতে পারলাম। এ আমার জীবনের পরম সুখ। এখানে আমি আগে কখনো তো ভাবি নি এমন করে তার কথা, কখনো তো চিনি নি তাকে এমন করে। বাবা চেষ্টা করেছিলেন আমাকে ধর্মপ্রাণ করে তুলতে, পারেন নি। বাড়ির সব নির্দেশ অগ্রাহ্য করে পরে বেছে নিয়েছিলাম আমি নাবিকের জীবন। সেখানে ধর্মের কোনো চল নেই। নাবিকেরা ধর্মকে পারোয়া করে না। তাদের কাছে সমুদ্র একমাত্র বাস্তব। এছাড়া আর কিছু তারা বোঝে না বুঝতে চায় না। ধর্ম নিয়ে কারুকে বাড়াবাড়ি কিছু করতে দেখলে উপহাস করে, যা-তা গালাগালি দেয়। সেক্ষেত্রে ঐ পেশায় নিযুক্ত থাকলে কোনোদিন যে ঈধরে আমার আসক্তি জন্মাত এখনো মনে হয় না। আমার সৌভাগ্য আমি সে জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে মনের দিক থেকে ঈশ্বরের একান্ত কাছাকাছি হতে পেরেছি।
কত না নির্বোধ ছিলাম আগে। ভাবি এখন, আর অনুতাপে জর্জরিত হতে থাকে হৃদয়। কত সৌভাগ্যের মুখোমুখি হয়েছি কতবার। দস্যুদলের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। পর্তুগিজ জাহাজের কাপ্তেন আমাকে উদ্ধার করেছেন অনিশ্চিতের কবল থেকে, ব্রাজিলে গিয়ে আমার ভাগ্য পরিবর্তন বারে বারে পেয়েছি ঈশ্বরের অনুগ্রহ তবু অন্ধ আমি। নির্বোধ–একবারও মুখ ফুটে উচ্চারণ করি নি হে ঈশ্বর, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি আমাকে কত দুঃখের হাত থেকে বারবার রক্ষা করেছ! সে সব আমার পাপের দিন। আমি পাপী! তাই বারেকের জন্যে মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে পারি নি ঈশ্বরের করুণার কথা। আজ পারি। আজ বুক ভরা আমার অনুতাপের জ্বালা। বলি তাই প্রভু আমার অপরাধ নিও না। আমি অন্ধ ছিলাম তখন। আমাকে দয়া কর।
সেদিন আর আজ। আমি অবাক হয়ে ভাবি সেই কথা। না বুঝে পেয়েছি তখন ঈশ্বরের করুণা, আজ বুঝতে পারি অক্ষরে অক্ষরে। আমার জীবন সার্থকতায় পরিপূর্ণ হয়। দুহাত ভরে ঢেলেছেন প্রভু তার করুণী এই নির্জন নিরালায়। আমার জীবন ধন্য।
তা বলে পূর্ণ হয়েছে কি পাপের ভার? হয়ত না। এখনো বাকি আছে অনেক কিছু। এখনো অনেক দুর্ভোগ আমাকে ভুগতে হবে। অনেক ক্ষমা অনেক অনুগ্রহ চাইতে হবে এখনো দীর্ঘদিন। আরো কত অলৌকিক প্রত্যক্ষ করতে হবে আমার জানা নেই। অলৌকিকই বলব একে। কেননা কী যে ঘটতে পারে আমার ভাগ্যে তা তো এই মুহূর্তে বলতে পারা যায় না। যেমন অলৌকিক এখানে আমার অস্তিত্ব। এই বিজনে তো কত কিছু হতে পারত আমার! থাকতে পারত হয়ত কত নরখাদক। আসা মাত্র আমি তাদের কবলে পড়তাম। থাকত হয়ত অসংখ্য বাঘ কি সিংহ কি অন্য কোনো বাপদ। মুহূর্তে এক গ্রাসে তাদের উদরস্থ হতে পারতাম। কিংবা হয়ত থাকত কোনো বিষাক্ত জীব। ক্ষুধার তাড়নায় তাদের মাংস ভক্ষণ করে আমার জীবন দীপ নির্বাপিত হত। কিন্তু তার কোনোটাই হয় নি। আমি এখনো সুস্থ স্বাভাবিক এবং জীবিত। এটা কি সত্যিই অলৌকিক নয়। মোটমাট জীবনে দুঃখ যে আমার একেবারে নেই, একথা বলব না। কিন্তু দুঃখের চেয়ে দয়ার ভাগই বেশি। দয়া এবং করুণা। তাতে দুঃখ ম্লান হয়ে যায়। ব্যথা কমে। জীবন লাভ করে এক স্বর্গীয় তৃপ্তি। আমি আপাতত সেই তৃপ্তি নিয়েই বেঁচে আছি।