২. বারান্দার গায়ে সাইকেল

সুজিত বারান্দার গায়ে সাইকেল ঠেকিয়ে রাখল। শংকর সামনের অফিস ঘরে ঢুকল। মাঝবয়সি ও সি বসে ছিলেন টেবিলের উলটো দিকে। তার মুখোমুখি চেয়ারগুলোতে গুইরাম পাল, কার্তিক, গাড়ির চালক সেই যুবক, এবং গ্রামের আরও দুজন মাতব্বর স্থানীয় লোক। শংকর দুজনকেই চেনে। একজন গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের কমিটি মেম্বার, শরৎ বেরা, শংকর যে স্কুলের শিক্ষক। অন্যজন গুইরামের রাজনৈতিক দলের একজন নেতা, পাশের গ্রামের অধিবাসী শিবু চক্রবর্তী। বোধ হয় কোনও কারণে এদিকে এসেছিল, এবং খবর পেয়ে থানায় এসেছে।

ও সি চেয়ারে বসেই আপ্যায়ন করলেন, এই যে শংকরবাবু, আসুন। কিন্তু আপনার কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা কেন? গালেও দেখছি ওষুধ মাখানো?

ও কিছু নয়। শংকর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। কিন্তু ও অবাক হল, অফিস রুমের পরিস্থিতি আর পরিবেশ দেখে। সকলেই প্রায় সিগারেট টানছে, এবং চা পান চলছে।

ইতিমধ্যে সুজিত ঢুকল। ও সি এ বার দাঁড়িয়ে বললেন, এই তো ডাক্তারবাবুও এসে গেছেন। আসুন আসুন।মুখ তুলে ডাকলেন, ভজন কোথায় গেলে? ছোটবাবুর ঘর থেকে দুটো চেয়ার এনে দাও তো। আরও দুকাপ চা-ও দিতে বলো।

ডান দিকের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে একজন সেপাই দুটো চেয়ার এনে, সামনে জায়গা না পেয়ে, ও সি-র দিকে একপাশে রাখল। শংকর ইতিমধ্যে বাঁ দিকের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল, বেঞ্চের ওপর বসে আছে, গাড়ির সেই দুই তরুণী এবং কিশোর। তাদের হাতেও চায়ের কাপ। সুজিতও সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করল। বাকিরা মুখ ফিরিয়ে দুজনকেই দেখছিল। সুজিত আগে এগিয়ে গেল। চেয়ারের দিকে। তার হাতে হাসপাতালের রিপোর্টিং প্যাড। শংকরও টেবিলের অন্য দিকে যেতে যেতে লক্ষ করল, গাড়ির চালক সেই যুবকটি উঠে দাঁড়াল। তার চোখ শংকরের দিকে।

ও সি চেয়ারে বসে, শংকরের দিকে তাকিয়ে, হাত দিয়ে যুবককে দেখিয়ে বললেন, শংকরবাবু, এ ভদ্রলোক তো আপনার বন্ধুর ভাই, আপনি চিনতে পারেননি?

শংকর থমকে দাঁড়িয়ে যুবকের দিকে তাকাল। এখন আর যুবকের মুখে বা চোখে কোনও ভয়ের ছায়া নেই। সে যেন অনেকটা সহজ আর সাবলীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু শংকরের দিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে তাকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাল, এবং কিছুটা লজ্জিতও। শংকর এই প্রথম যুবকটির মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল, ওর চোখে জিজ্ঞাসু অনুসন্ধিৎসা।

যুবক বলল, আমাকে আপনি অনেক বার দেখেছেন, আমাদের কলকাতার বাড়িতে। আমার দাদার নাম প্রিয়ব্রত বিশ্বাস, আপনার বন্ধু–কথাটা শেষ না করে সে চুপ করে গেল।

শংকরের ভুরু কুঁচকে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি মুখ, মধ্য কলকাতায় একটি বড়

আপনি না শংকরদা, তুমি।’ যুবক বলল, আমাকে আপনি নাম ধরেই ডাকতেন। আমার নাম সুব্রত।

শংকর মাথা ঝাঁকিয়ে অল্প হেসে বলল, চিনতে পেরেছি তবে তোমার চেহারা অনেক বদলে গেছে।

সুব্রত নামে যুবক বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন শংকরদা, আপনাকে আমি চিনতে পারিনি, মানে, ভাবতেই পারিনি, আপনি এ রকম কোনও জায়গায় থাকতে পারেন।

তাই একেবারে খুনির মতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, আর মারাত্মক ভাবে–কথাটা শেষ না করে সুজিত সুব্রতর দিকে তাকাল। ওর চোয়াল আর চোখের দৃষ্টি শক্ত হয়ে উঠেছে।

শংকর সুজিতের দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টিতে তাকে নিরস্ত থাকতে অনুরোধ করল। সুব্রতর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমি কোথায় থাকি না থাকি, তোমার অবিশ্যি জানবার কথা নয়। দাঁড়ালে কেন, বোসো৷

সুব্রত তথাপি না বসে বলল, শংকরদা, আমার অপরাধের তুলনা নেই। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। দাদা যখন সব কথা শুনবে, আমাকে বোধ হয় মেরেই বসবে।

সুজিত ছাড়া, সুব্রতর কথায় সবাই হেসে উঠল। শংকর বুঝতে পারল, সুব্রতর প্রতি কারোই আর। তেমন বিদ্বেষ বা রাগ নেই। সকলেই মোটামুটি প্রসন্ন। ইতিমধ্যে এখানে কী কথাবার্তা হয়েছে বা ঘটেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেবল এটা অনুমান করা যায়, থানার ও সি এবং মাতব্বর ব্যক্তিদের সুব্রত যেভাবেই হোক, নিজের আয়ত্তে আনতে পেরেছে। শংকর স্বস্তিবোধ করলে। ওর আশঙ্কা ছিল, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে, একটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে, নতুন দুর্ঘটনার সূত্রপাত হতে পারে। এখন বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিয়েছে। কোন দিকে, কে জানে। শংকরের মনে অতীতের অনেক ঘটনা ছবির মতো ভেসে উঠতে লাগল, কিন্তু সে বলল, ক্ষমা করার কী আছে। তোমার অনুশোচনাই যথেষ্ট। অন্যায় করা এক কথা, অন্যায়ের বোধ আর এক কথা। তা ছাড়া, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট।

ঠিক, ঠিক বলেছেন শংকরবাবু৷’ ও সি বললেন, পুলিশের লোক হয়েও আমিও কথাটা মানি, অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। তিনি অন্যান্যদের দিকে সমর্থনের প্রত্যাশায় হেসে তাকালেন।

গুইরাম বলল, তা তো বটেই। অ্যাকসিডেন্টের উপর তো কারু কোন কথা চলে নাই।

দৈব বলে কথা! শরৎ বেরা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল, উয়াতে কারু হাত নাই।

শংকরের কাছে, গুইরাম আর শরৎ বেরার আচরণ কেমন অভাবিত মনে হল। তাদের এতটা যুক্তিবাদী আর উদার কখনও দেখা যায়নি। কেবল সুজিতের মুখটা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল, চোখে সন্দেহ। সুব্রত বাঁয়ের খোলা দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকল, করবী এদিকে এসো এক বার।

বাঁ দিকের ঘর থেকে যে-তরুণী বেরিয়ে এল, তার সিথেয় সিঁদুর। তার উৎকণ্ঠিত উদভ্রান্ত চোখে মুখে এখন অনেকটা স্বস্তির ছাপ লক্ষণীয়। সে প্রথমেই তাকাল শংকরের দিকে। সুব্রত বলল, তোমাকে বলেছিলাম, উনি আমার চেনা। আমি প্রথমটায় একেবারে চিনতে পারিনি। শংকরদা আমাদের মেজদার। বন্ধু। সে শংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার স্ত্রী করবী।

শংকর কিছু বলবার আগেই করবী দ্রুত শংকরের কাছে এসে, একেবারে ওর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। শংকর বিব্রত শশব্যস্ত হয়ে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, আহা, করেন কী, করেন কী?

শরৎ বেরা বলে উঠল, আহা আপনি হলেন ওঁয়ার ভাসুরের বন্ধু, পেন্নাম করবেন নাই ক্যানে?

করবীর চোখ ছলছলিয়ে উঠল, ভেজা গলায় বলল, ওর মাথার ঠিক ছিল না, ওকে আপনি ক্ষমা করুন।

আরে, ক্ষমা-টমার কথা আসছে কেন?’ শংকর হেসে বিকৃত স্বরে বলল, আমি জানি, সুব্রতর মনের অবস্থা তখন কেমন ছিল। আপনি বসুন।

করবী তবু বলল, আমি জানি, ও খুব অন্যায় করেছে, আপনি রাগ করবেন না।

আপনি নিশ্চিন্ত হন, আমার কোনও রাগ নেই। শংকর প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চাইল।

 সুব্রত বলে উঠল, ওকে আপনি বলবেন না শংকরদা৷

বটে কথা, বটে কথা। গুইরাম শরৎ বেরা একসঙ্গে বলে উঠল।

সুব্রত আবার বলল, মেজদা তো এখন আমেরিকায় আছে, জানেন বোধ হয়। গত বছর আমার বিয়ের সময় এসেছিল। আপনার খোঁজ করছিল। আপনাদের কাসারিপাড়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে অন্য এক ফ্যামিলি। আপনার মা ভাই।

ও বাড়ি বদলানো হয়েছে তিন বছর।’ শংকর বাধা দিয়ে বলল, মা এখন যাদবপুরে আছেন। একটু দ্বিধা করে করবীকে বলল, তুমি ও ঘরে গিয়ে বসো।

সুব্রত বলল, করবী, ওদের ডেকে দিলে না?

না না, থাক। ওদের আবার ডাকাডাকি কেন?’ শংকর বলল।

করবী ফিরে গেল বাঁ দিকের ঘরে। সুব্রত আবার বলল, ওরা আমার শালি আর শ্যালক। যাচ্ছিলাম বাঁকুড়ায়, শ্বশুরবাড়িতে। কার মুখ দেখে যে যাত্রা করেছিলাম।

উ সব ভেবে আর কী হবেক মশাই। শরৎ বেরা বলল, সবই কপালের লিখন।

শংকর সুজিতের পাশের চেয়ারে বসল। ও সি বললে, এ বার তা হলে কাজের কথা হোক। শংকরবাবু আর ডাক্তারবাবু এসে গেছেন। বদি বাউরির বিধবা বউ না কে, সে কোথায় গেল?

সে হাসপাতালে রয়েছে। শংকর বলল।

ও. সি. বলল, তাকে ডাকতে হয়। সে-ই আসল লোক।

গুইরাম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বদির বউকে আমি ডাকা করাচ্ছি।’ সে বাইরে গেল।

ও সি বললেন, যাকেই পাঠান, সঙ্গে একজন সেপাইও যাক।’ তিনি গলা তুলে ডাকলেন, বচন সিং।

হ সাব। বাইরে থেকে জবাব এল, এবং তারপরেই একজন অবাঙালি সেপাই ডান দিকের ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকল।

ও সি বললেন, তুমি গুইরামবাবুর লোকের সঙ্গে হাসপাতালে যাও। সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, ডেডবডি এখানে আনার কোনও দরকার নেই। যা ব্যবস্থা করার ওখান থেকেই হবে।

গুইরাম আবার ঘরে ঢুকে বলল, শরৎবাবু আপনি এক বারটি হাসপাতালে যান, বদির বউয়ের সাথে কথাবত্তা করেন যেইয়া।

হা হা। শরৎ বেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের বাইরে চলে গেল।

গুইরাম ঘরে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসল। সুজিত ও সি-কে জিজ্ঞেস করল, ডেডবডি কি সদরে চালান দেবেন?

ময়না তদন্তের দরকার না হলে, সদরে পাঠাবার দরকার কী?’ ও সি তাকালেন গুইরামের দিকে, আপনারা যা ভেবেছেন, সে কথা এঁদের বলুন।

গুইরাম গলা খাঁকারি দিয়ে এক বার শিবু চক্রবর্তীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর শংকর আর সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা ভেবে দেখলাম, কেস-টেসের হাঙ্গামায় যেয়্যে কুন লাভ হবে নাই। মামলা মুকদ্দমা হল্যে বিস্তর ল্যাটা। বদির বউয়ের সময় কোথা, কোট-কাঁচারি করবে। মামলার

কী ফল হবে তাই বা কে জানে।

কেস তো করবে পুলিশ।সুজিত বলল, সাক্ষী থাকব আমরা আপনারা। বদির বউ তো কেস করবে না।’

গুইরাম বলল, তা করবে না। পুলিশ কেস করলেও বদির বউয়ের লাভটা কী হবে বলেন।

 সুজিত ও সি-কে জিজ্ঞেস করল, এফ আই আর হয়নি?

না।’ ও সি বললেন, গুইরামবাবুরা মিটমাটের পক্ষপাতী। সুব্রতবাবু বদির বউকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দু হাজার টাকা দেবেন বলছেন। বদির বউ রাজি হলে, টাকাটা তিনি এখনই দিতে পারেন।

শংকরের সঙ্গে সুজিতের চোখাচোখি হল। শংকর মনে মনে অবাক হচ্ছিল, গুইরামের মতো লোক এত সহজে মিটমাটের পক্ষপাতী হল কেমন করে? এফ. আই. আর. না করার অর্থ, ও সি-ও মিটমাটের পক্ষপাতী। এত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটনার গতি এমন একটা মোড় নিয়েছে, মনের মধ্যে কেমন একটা খটকা লাগছে। অথচ করার কিছু আছে বলেও মনে হয় না।

সুজিত বলল, কিন্তু আমাকে তো একটা রিপোর্ট দিতেই হবে।

তা দেবেন না কেন?’ ও সি হেসে বললেন, কিন্তু আপনি তো সুব্রতবাবুর বিরুদ্ধে হোমিসাইডাল রিপোর্ট দিতে পারবেন না, আর ব্যাপারটাও তা নয়। অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ।

গুইরাম বলল, মামলার ফলাফল কার দিকে যাবে, তা কেউ বলতে পারে নাই। গরিব বউটা যদি দু হাজার টাকা পায়, কিছুটা সুরাহা হয়। কী বলেন শংকরবাবু?

শংকর ভাবল, অঞ্চল-প্রধান সহৃদয় হতে পারে, বদির বউয়ের সাশ্রয়ের আশায়। পুলিশের এমন সহৃদয় পক্ষপাতিত্ব একটা অভাবিত ব্যাপার। ওর সন্দেহ বাতিক নেই, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতাকে একেবারে তুচ্ছ করতে পারে না। ওর মন বলছে, কোথায় যেন কী কলকাঠি নাড়া হয়ে গিয়েছে, যার গভীরে মিথা হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। অঞ্চল-প্রধান গুইরাম শংকরকে পছন্দ করে না, কারণ ও এ গ্রামে বাস করে, ইস্কুলে মাস্টারি করেও, তার কথায় সবসময় সায় দিতে পারে না। সেও শংকরের সমর্থন চেয়ে মতামত জিজ্ঞেস করছে। থানার বড়বাবুর আচরণের মতো, এটাও অবাক করার মতো ব্যাপার। আবার অন্য দিক থেকে বিষয়টিকে দেখতে গেলে, বদির বউয়ের করবারই বা কী আছে? একমাত্র দর কষাকষি করে, বদির বউয়ের টাকা আরও কিছু বাড়ানো যায়। সেটাও শংকরের পক্ষে সম্ভব না। গুইরামদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কিন্তু স্বয়ং গুইরাম, পঞ্চায়েত সভ্য কার্তিক, শরৎ বেরার মতো সঙ্গতিপন্ন গ্রামের মাতব্বর আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা শিবু যেখানে এক মত হয়েছে, আর বোধ হয় তার ওপর কোনও কথা চলবে না। নিঃসন্দেহে সুব্রত যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও চালাক ছেলে। শংকরের চোখে যারা অতি কঠিন মানুষ, তাদের সে বশ করতে পেরেছে। কী দিয়ে? সে প্রশ্নও অবান্তর। যে পথ চলতে এক কথায় দু হাজার টাকা বের করে দিতে পারে, সে আরও ক’ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারে, কে জানে। শংকর গম্ভীর মুখে বলল, আমি আর কী বলব। মনে হচ্ছে, আপনারা এর মধ্যেই আলোচনা করে একটা নিষ্পত্তির কথা ভেবেছেন।

সেটা আপনার মনের মতো হয়েছে কি না, সেটাই আসল কথা।’ ও সি বললেন, মামলা হলে আপনিই হবেন প্রধান সাক্ষী, সেজন্যে আপনার মতামতটা জানা দরকার। আপনার কি মনে হয়, মামলা হলে বদির বউয়ের বিশেষ কোনও সুবিধে হবে?

শংকর বিষণ্ন হেসে বলল, হয় তো এক্ষেত্রে যে আসামি তার সাজা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু বদির বউ তার ছেলে বুধাইকে কোনও দিনই ফিরে পাবে না।

কার্তিক বলে উঠল, অই, উ কথাটাই আমরাও বুলছিলাম। তার চেয়ে বউটা যদি কিছু টাকা পায়, উটি অনেক কাজ দিবে।

আমার অবিশ্যি ভিন্ন মত। সুজিত বলল, অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে, কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সুব্রতবাবু ছেলেটাকে চাপা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন, আর সে চেষ্টা, করতে গিয়ে তিনি সুজিত কথা শেষ না করে শংকরের দিকে তাকাল।

শংকর সুজিতের দিকে তাকিয়ে ছিল। সুজিত বলল, যাই হোক, আমি আমার রিপোর্ট দিয়ে দিচ্ছি। হাসপাতালেও একটা রেকর্ড রাখতে হবে। ডি এম ও-কেও আমি রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব।

তা তো আপনি নিশ্চয়ই দেবেন।’ ও সি বললেন, আপনার ডিউটি আপনি করবেন। তবে বদির বউয়ের ব্যাপারটাই যখন আসল ফ্যাকটর, আপনার কি মনে হয় না ডাক্তারবাবু, ডিসিশনটা ঠিকই নেওয়া হয়েছে?

সুজিতের মুখ কঠিন। বলল, এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাইনে। বলার মধ্যে একটাই কথা, বুধাইকে চাপা দেবার থেকেও গর্হিত অপরাধের কাজ করেছেন সুব্রতবাবু। কিন্তু শংকরবাবু যখন ওঁকে ক্ষমা করছেন, আমার আর কী বলার থাকতে পারে। সে হাঁটুর ওপর হাসপাতালের ছাপানো প্যাড। রেখে, পকেট থেকে কলম বের করে খসখস করে বুধাইয়ের মৃত্যুর কারণ লিখতে লাগল।

সুব্রত তাকিয়ে ছিল শংকরের দিকে। শংকর দ্বিধাগ্রস্ত, অথচ কিছুটা অসহায়। গুইরাম, কার্তিক, শিবু। তিনজনেই সুজিতের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকাল। ইতিমধ্যে একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোক দুটো কাচের গেলাসে চা এনে শংকর আর সুজিতের সামনে টেবিলে রাখল। এই সময়েই বাইরে একটা গুঞ্জন শোনা গেল, সেই সঙ্গে কান্নার ফোঁস ফোঁস শব্দ। শরৎ বেরার গলা শোনা গেল, আ, অই শুন ক্যানে বদির বউ, কাদিস না, বিটাটাকে ছাড়, অফিস ঘরকে ঢুকবি চল। মড়া আগুল্যে বস্যে থাকলে কি উ জ্যান্ত হবেক? চল চল।

গোলকের গলা শোনা গেল, তুমরা সব জায়গা ছাড় দি নি, টেচারটা রাখতে দ্যাও ক্যানে।

টেচার নিশ্চয়ই স্ট্রেচার। বুধাইয়ের মৃতদেহ সম্ভবত স্ট্রেচারে বারান্দায় তুলে রাখা হচ্ছে। শরৎ বেরা এক রকম ঠেলতে ঠেলতেই বদির বউকে অফিস ঘরে ঢোকাল। বাঁ দিকের ঘর থেকে করবী বেরিয়ে এসে বদির বউয়ের সামনে দাঁড়াল। সুব্রত উঠে দাঁড়াল। শরৎ বেরা বলল, চখ মেল্যে দ্যাখ ক্যানে, এঁয়ারা কি তোর বিটাকে ইচ্ছা করে মেরে ফেলাইচে?

উ কথা আমি বুঝি নাই গ বাবু। বদির বউ কান্না ভাঙা স্বরে বলল, আমি স্যায়না বয়সে ভাতার খাইচি, বড় বিটা খাইলম, আমার ক্যানে মরণ হয় নাই গ।

শংকর দেখল, সুব্রত আর করবী দৃষ্টিবিনিময় করল। সুব্রত মাথা নিচু করল। গুইরাম চেয়ারে ঘুরে বসে বলল, অই বদির বউ, কেউ কারুকে খায় না, তু ক্যানে সোয়ামি বিটা খাবি? দৈবের কথা কে বুলতে পারে? তু মরলে চলবে ক্যানে। তোর আরও দুটো কাঁচাগুড়া রইচে, উয়াদের মানুষ করতে হবেক নাই?

হ, আর দুটো প্যাটের শব্দুর রইচে, উয়াদের লেগ্যে আমি মইত্তেও পারব নাই। বদির বউ বলল, কথা বাবু ঠিক বুল্যেচ। তা দৈব আমাকে লিলে, উ দুটোকে দৈব অক্ষে কইরবে।

গুইরাম বলল, উ সব কথা এখন রাখ বদির বউ, কাজের কথা শুন। তু কি চাস মামলা লড়বি?

মামলা মুকদ্দমার আমি কী বুঝি গ বাবু। আপনারা যা ভাল বুঝ, কর।’ বদির বউ দেওয়ালে হেলান দিয়ে, ঘাড় কাত করে দাঁড়াল, আমার বুধাইকে ত কেউ ফিরাই দিতে লারবে।

হ, ত তোর ক্ষেতি পূরণের লেগ্যে ই মাঠান আর বাবু তোকে দু হাজার টাকা দিবেন। শরৎ বেরা বলল, এবং করবী ও সুব্রতর দিকে তাকিয়ে গদগদ মুখে হাসল।

বদির বউ লাল ফোলা চোখ দুটো বড় করে, যেন ভয় পেয়ে বলল, দু হাজার টাকা। চখে দেখি নাই কখুনও, অত্ত ট্যাকা লিয়ে আমি কী করব গ? রাখব কুথা? উয়াতে আমার দরকার নাই।

বদির বউয়ের কথায় গুইরামের দল হেসে উঠল। হাসবার কথা বটে। টাকা নিতে ভয় পায়, তাও। যেচে দেওয়া টাকা, এমন মানুষ হাসির পাত্র ছাড়া আর কী হতে পারে? এই সময়েই সুজিত একটি কাগজ ও সি-র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এফ. আই. আর. হয়নি, হোমিসাইড কেস নয়, ব্যাপারটা মিটমাট হচ্ছে অন্য ভাবে, আমার রিপোর্টের মূল্য কিছু নেই, তবু আমি আমার ডিউটি করলাম।

ও সি কাগজটা নিয়ে তাড়াতাড়ি এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, একটা মোটা খাতা টেনে নিয়ে পাতা মেলে কাগজটি রেখে, দ্রুত কিছু লিখলেন, বললেন, আমি সই করেছি, আপনি এখানে একটা সই করে দিন ডাক্তারবাবু।

সুজিত ঝুঁকে পড়ে সই করে বলল, শংকরবাবু, আপনি ওষুধগুলো খেতে ভুলবেন না। জ্বর হলে কালই এক বার খবর দেবেন, আর তিন দিন বাদে হাসপাতালে ড্রেসিংয়ের জন্য আসবেন। সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

শংকর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।

 অই গ মাস্টেরবাবু, আপুনি হেথাকে রইচ? আমি দেখি নাই গা’ বদির বউ শংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপুনি টুকুস থাক, ইয়াদের কথা আমি বুইতে লারছি।

শংকরের সঙ্গে সুজিতের চোখাচোখি হল, সুজিত বলল, আপনি থাকুন, আমি এখন বালিকান্দা গাঁয়ে একটি রুগি দেখতে যাব। সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সকলেই চুপচাপ ডাক্তারের চলে যাওয়া লক্ষ করল। গুইরামের ঠোঁট জোড়া বেঁকে উঠল, এবং কার্তিক আর শিবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। শরৎ বেরা বলেই উঠল, আমাদিগের ডাক্তারবাবুটির বয়স অল্প, মেজাজটি বড় গরম।

থাক, আপনাকে আর ডাক্তারবাবুর সমালোচনা করতে হবেনা।ও সি প্রায় ধমকের সুরে বললেন, উনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন।

শিবু চক্রবর্তী এই প্রথম কথা বলল, তা হয় তো করেছেন, তবে ডাক্তারবাবু এমন একটা ভাব করলেন, যেন আমরা অন্যায় কিছু করেছি।

তা কেন? ’ও সি বললেন, উনি খুশি হন নি, তা না হতেই পারেন। আপনি তো আর জোর করে সবাইকে সব কিছু মানাতে পারেন না।

শিবু চকিতে এক বার শংকরের দিকে দেখল। মুখ শক্ত করে চুপ করে রইল। শংকর বদির বউকে বলল, শোনো বদির বউ, বোঝাবুঝির তো কিছু নেই। এঁরা সবাই ঠিক করেছেন, মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে, একটা মিটমাট করে নেওয়া। তাই তোমাকে দু হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে।

বদির বউ বলল, কিন্তু ট্যাকা লিয়ে আমি কী করব মাস্টেরবাবু? রাখব কুথা?

কোথায় আবার রাখবে, ডাকঘরে রাখবে। ও সি বললেন, টাকা দিয়ে কী করতে হয়, তুমি বোঝ না? ডাকঘরে টাকাটা থাকলে, সুদ জমবে। আপদে বিপদে খরচ করতে পারবে।

মাঝবয়সি দশাসয়ী চেহারার বড়বাবুর কাঠখোট্টা কথা শুনে, বদির বউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকাল শংকরের দিকে। ও সি চারদিকে চোখ বুলিয়ে বিরক্ত স্বরে বললেন, মেজোবাবুর ছোটবাবুর ফিরতে কত দেরি কে জানে। তিনি নিজেই খাতা টেনে কিছু লিখতে লাগলেন, আর লিখতে লিখতেই বললেন, গুইরামবাবু, কাগজ কলমটা নিয়ে একটা খতপত্র লিখে, বউটির টিপ ছাপ নিয়ে নিন। খতের বয়ান যেন ঠিক থাকে। মুখ তুলে সুব্রতকে বললেন, আপনি টাকাটা বের করুন।বলে আবার লিখতে লাগলেন।

সুব্রত করবীর দিকে তাকাল। দুজনেই পাশের ঘরে গেল, এবং দরজাটা ভেজিয়ে দিল। গুইরাম বলল, শরতদা, তুমি খতটা লিখ, তুমি উসব ভাল বুঝ।

ইসটাম্পো পেপার ছাড়া কি খত লিখা হবে?’ শরৎ বেরা জিজ্ঞেস করল।

ও সি মুখ তুলে বিরক্ত স্বরে বলল, আরে মশাই এ কি জমি বাড়ির দলির বেচাকেনা হচ্ছে নাকি? সুব্রতবাবুর নাম ঠিকানা বাড়ির নম্বর ইত্যাদি লিখে, ওঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা লিখে দিন। দুটো কাগজে লিখুন, একটা থানায় থাকবে, আর একটা সুব্রতবাবুকে দেওয়া হবে। আসল কাজ আমার এখানেই হচ্ছে। তিনি বদির বউয়ের দিকে মুখ তুলে ডাকলেন, এসো এদিকে এসো একবার। রাবার। স্ট্যাম্পের কালির প্যাডের ঢাকনা খুললেন।

বদির বউ এগিয়ে গেল। ও সি তার বাঁ হাত টেনে নিয়ে, বুড়ো আঙুলটা কালির প্যাডে চেপে। দিলেন, তারপরে টিপ ছাপ নিয়ে নিলেন খোলা পাতার এক পাশে। শংকরের দিকে ফিরে বললেন, শংকরবাবু এটা একটা নিয়মমাফিক মামুলি ব্যাপার। কেস তুলে নেওয়ার একটা রিপোর্ট। থানার রেকর্ড। কোনও কাজে লাগবে না তবু রেখে দেওয়া ভাল। আপনি আর গুইরামবাবু সই করে দিন, আমি সই করেছি।

শংকর হেসে বলল, আমাকে আর ও সবের মধ্যে টানবেন না। আপনারা যারা মিটমাট করার ব্যবস্থা করেছেন, তাঁরাই সই সাবুদ করুন। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, আমার কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই।

অভিযোগ নেই, সেটা প্রমাণ করার জন্যই সাক্ষী থাকুন না৷ শিবু বলল।

শংকর জানে, শিবু বালিকান্দা গ্রামের ছেলে হলেও, রবীন্দ্র ভারতী থেকে এম. এ. পাশ করেছে। তার কথায় গ্রামীণ আঞ্চলিকতা নেই। সম্ভবত সে সেজন্য গর্বিত। তা ছাড়া শিবু বর্তমান শাসক রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক নেতা। আগামী নির্বাচনে এখন থেকেই স্থির হয়ে আছে, সে এম. এল. এর টিকিট পাবে। পাটির বর্তমান এম. এল. এ রাখাল রায়ের থেকেও তার কর্তৃত্ব আর গলার জোর বেশি। রাখাল রায়ও শংকরের ইস্কুলের একজন মধ্যবয়স্ক শিক্ষক, গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, শিবু তাঁকে কুলাক’ বলতেও দ্বিধা করে না। যদিও সে নিজেও সেই শ্রেণীরই সন্তান, কিন্তু মিলিট্যান্ট, কলকাতার নেতাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাখালবাবুর থেকে বেশি। শংকর হেসেই জবাব দিল, সাক্ষী না থেকেও সেটা প্রমাণ করা যায়। অভিযোগ করলে তো সুব্রতর বিরুদ্ধে আমি আলাদা কেস করতে পারতাম। ও সব কিছুই আমি করছি না।

ঠিক আছে, আপনাকে আমি এ নিয়ে চাপ দেব না।’ ও সি বললেন, গুইরামবাবু আর কার্তিকবাবু সই করলেই হবে। তবে আমি জানি, অ্যাকসিডেন্টের সময় আপনি সেখানে না থাকলে, ঘটনা অন্য রকম ঘটত।

এই সময়ে বাঁ দিকের ঘরের ভেজানো দরজা খুলে করবী আর সুব্রত বেরিয়ে এল। করবীর হাতে একগোছা একশো টাকার নোট। সে বদির বউয়ের সামনে এসে নোটের গোছ এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও। তুমি আমাদের ক্ষমা করো।

অই যা গ আমি কাকে ক্ষ্যামা করবক। বদির বউ ত্রস্ত হয়ে দু পা পেছিয়ে গিয়ে বলল, উ ট্যাকা আমি কুত্থাকে লিয়ে যাব। আপনি মাস্টেরবাবুকে দিয়া কর।

শংকর বলল, না না, ও টাকা এখন থানার বড়বাবুর হেপাজতেই থাক। রাত বিরেতে এতগুলো টাকা নিয়ে বাইরে কারোর না যাওয়াই ভাল। কাল পোস্টঅফিস খুললে, এঁরা কেউ তোমাকে নিয়ে গিয়ে টাকাটা জমা দিয়ে দেবেন।

তবু টাকাটা তুমি নিজের হাতে আগে নাও।ও সি বদির বউকে বললেন।

বদির বউ এক বার শংকরের দিকে তাকাল, তারপর করবীর দিকে। এখন বদির বউয়ের লাল ফোলা চোখ দুটো শুকনো, দৃষ্টি বিভ্রান্ত। দুর্ঘটনায় নিহত ছেলে ঘরের বাইরে। শহরের আধুনিক ধনী পরিবারের তরুণী বধূ টাকার গোছা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। শংকর বুঝতে পারছে, বদির বউয়ের এ বিভ্রান্তি লোভ না, তার শোকসন্তপ্ত প্রাণ এক অভাবিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমূঢ় হয়ে উঠেছে। ঘটনার গতি প্রকৃতি সবই তার অগম্য। করবী বদির বউয়ের ডান হাতটি টেনে নিয়ে নোটের গোছা তুলে দিল। বদির বউ চোখ বুজল, আবার জলের ধারা নামল চোখের কোলে, যেন বড় কষ্টে, রুদ্ধস্বরে উচ্চারণ করল, অই, গা! আমি কী লিচ্ছি গ?

শংকর মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সুব্রত ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে এল, চলে যাচ্ছেন শংকরদা?’

হ্যাঁ ভাই৷’ শংকর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আর কী, সব তো মিটেই গেল।কথাটা বলে ও করবীর দিকে এক বার তাকাল। বুঝল, সামান্য সামাজিকতার কথাটা ও ভুলে যাচ্ছিল। করবীও ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। ও বলল, যাচ্ছি ভাই।

করবী এগিয়ে এল, শংকরকে প্রণাম করবার জন্য নত হল। শংকর একটু সরে গিয়ে ব্যস্ত ভাবে বলল, থাক না। তোমরা সাবধানে যেয়ো।

করবী শংকরের কথার মধ্যেই প্রণাম সেরে নিল। বলল, আপনার কথা আমি দু-একবার শুনেছি। বাঁকুড়া থেকে ফেরার পথে, আপনার সঙ্গে দেখা করে যাব।

শংকর কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। ঘরের সকলের মুখের দিকে দ্রুত এক বার চোখ বুলিয়ে, করবীর কথার কোনও জবাব না দিয়ে, একটু হেসে ঘরের বাইরে গেল। হ্যারিকেনের আলোয় দেখল, বারান্দার ওপর স্ট্রেচারে শোয়ানো বুধাইয়ের মৃতদেহ একটি সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা। পঞ্চু, গোলক এবং আরও প্রায় জনা দশ বারো, বারান্দার ওপরে নীচে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। এখানকার কাজ মিটিয়ে শ্মশানযাত্রা। গ্রামের পূর্ব দক্ষিণ প্রান্তে, অনামী এক শীর্ণকায়া নদীর ধারে তিনটি শ্মশান। একটি ব্রাহ্মণদের, অন্যটি অব্রাহ্মণ, কিন্তু যাদের জল চল আছে, এমন শূদ্র শ্ৰেণীদের জন্য, তৃতীয়টি অন্তজদের, বাউরি বাগদি হাঁড়ি ডোম যাদের বলে। তবু পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বড় গলার ঘোষণা, এ দেশে জাত-পাতের সমস্যা নাকি, বলতে গেলে নেই। এক সময়ে শংকরও তাই বিশ্বাস করত।

শংকর বুধাইয়ের মৃতদেহ থেকে মুখ ফিরিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেটের দিকে এগোল। পিছন থেকে সুব্রত ডাকল, শংকরদা–

সুব্রত! তুমি আবার এলে কেন?’ শংকর থমকে দাঁড়াল।

সুব্রত বলল, না এসে পারলাম না। জীবনে এই আমার প্রথম এ রকম একটা ফ্যাটাল অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু আপনাকে আমি

আবার ও কথা কেন সুব্রত?’ শংকর বলল, আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমরা আজ একটু সাবধানে যেয়ো। সামনে বড় একটা শালবনের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। তোমার মা বড়দা বোনেরা সব ভাল তো?

সুব্রত বলল, হ্যাঁ, মোটামুটি। আমি মেজদাকে সব ঘটনা লিখে, আমেরিকায় চিঠি দেব। আপনার ঠিকানাটা আমাকে বলুন, মেজদাকে লিখে দেব। মেজদা আপনাকে চিঠি দেবে।

অন্ধকারে শংকরের মুখে বিষণ্ণ হাসি ফুটল, বলল, প্রিয়ব্রতকে কেন আর এ সব নিয়ে ব্যস্ত করা। থাক না। কিছু মনে কোরো না, আমি কারোর সঙ্গেই আর যোগাযোগ রাখিনে, কলকাতার বাড়ির সঙ্গেও না। আর রাখবই বা কার সঙ্গে। মা বাবা মারা গেছেন, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাইয়েরা যে-যার সংসার নিয়ে আছে। আমি এখানে এক কোণে ভালই আছি।

আপনি বিয়ে করেননি?’ সুব্রত অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল। শংকর হেসে বলল, না, ওটা আর এ জীবনে হল না, হবেও না। আর একটা কথা, তোমার স্ত্রী বলল, ফেরার পথে দেখা করবে। আমি বরং বলি, তোমরা অন্য পথে কলকাতায় ফিরে যেয়ো। এ পথে আর না-ই ফিরলে।

সুব্রত অন্ধকারে শংকরের মুখ দেখবার চেষ্টা করল, তারপরে বলল, কথাটা আপনি বোধ হয় ঠিকই বলেছেন শংকরদা। টাকা দিয়ে মিটমাট হয় তো হল, কিন্ত এখানকার পরিবেশ–মানে, কেমন যেন ভাল লাগছে না। সব কথা আপনাকে বলতে পারছি নে’

থাক, বলার কী দরকার?’ শংকর বাধা দিয়ে বলল, থানার ঘরের দিকে এক বার দেখল, বলল, তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে চলে যাও। আমি চলি, কাজ আছে।

সুব্রত হঠাৎ নিচু হয়ে শংকরের পায়ে হাত দিল। শংকর চকিত হয়ে বলল, তুমি আবার এ সব ছেলেমানুষি করছ কেন? যাও, কাজ মিটিয়ে নাও গিয়ে। ও গেটের বাইরে গিয়ে, পুবদিকে হাঁটতে লাগল।

অন্ধকার গাঢ়। আকাশ ভরা তারা। দূর থেকে মাইকে হিন্দি গান ভেসে আসছে। পশ্চিমে হাট বাজারের দিক থেকে ভেসে আসছে। এই শালচিতি গ্রামের উপান্তে, হাটের কাছে বড় বড় দোকানপাট। একটা সিনেমা হলও আছে। আছে কোল্ড স্টোরেজ বিল্ডিং। ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে শালচিতির নাম আছে। কেবল এই ঘন অন্ধকার, দুপাশে দিগন্তবিসারী মাঠের মাঝখানে, মাইকের ভেসে-আসা গান কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে।

শংকর এখন শীত বোধ করছে। ও দু হাত পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। কিছুটা যেতেই, পিছনে মাস্টেরবাবু’ ডাক শুনে থমকে দাঁড়াল, পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি লেত্য বটি মাস্টেরবাবু’–অন্ধকারে মিশে থাকা লোকটি বলল।

শংকরের চোখে এখন অন্ধকার কিছুটা সয়ে এসেছে। বাউরিপাড়ার নেত্যকে চিনতে ওর ভুল হল না। ও জিজ্ঞেস করল, তুমি আবার কোথা থেকে এলে?

এঁজ্ঞে, থানা থেকে। নেত্য দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, উ কলকাতার বাবু বদির বউকে কত টাকা দিল্যে গ মাস্টেরবাবু?

শংকর গম্ভীর হয়ে পা বাড়িয়ে বলল, দু হাজার টাকা।

 দু হাজার!’ নেত্য শংকরের সঙ্গে চলতে চলতে বলল, শালা, কততো ট্যাকা! অই ভগমান! আমার কপালে ক্যানে জুটল নাই?

শংকর বলল, তোমার ছেলে তো মরে নি।

মইল্য না ক্যানে গ মাস্টেরবাবু?’ নেত্য বলল, শালা ঘরে আমার সাত-সাতটা কাঁচা গুড়া, খেত্যে পত্যে দিতে পারি নাই, এ্যাটটা গাড়ি চাপা পল্যে–

শংকর ওর অস্বভাববাচিত গর্জনে ফুঁসে উঠল, চুপ করবে?’ বলেই থমকে দাঁড়াল, প্রায় চিৎকার করে উঠল, চলে যাও, চলে যাও আমার সামনে থেকে।

নেত্য বাউরিও থমকে দাঁড়াল। শংকরকে সে কোনও দিন এমন ক্ষ্যাপা রাগে চিৎকার করতে শোনেনি। সে ভয় পেয়ে প্রথমে দু পা পেছিয়ে গেল তারপর হাত জোড় করে বলল, হঁ যাইচি গ মাস্টেরবাবু, যাইচি।’ বলেই পিছন ফিরে প্রায় দৌড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শংকর আবার মুখ ফিরিয়ে চলতে আরম্ভ করল। ওর ব্যান্ডেজ বাঁধা ক্ষতগুলো আর মাথাটা যেন যন্ত্রণা করে উঠল, আর বুকের মধ্যে একটা কষ্টের অনুভূতি তীব্র হয়ে উঠল। ও বুকের ওপর দু’ হাত চেপে চলতে লাগল।

.

শংকর এই শালচিতি গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক ইস্কুলে মাস্টারি নিয়ে এসেছে, তিন বছর আগে। তিন বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, গত ইংরাজি মাসের জানুয়ারিতে। তার আগে ছিল কলকাতার উত্তর উপকণ্ঠে এক ইস্কুলে। কিন্তু শৈশব থেকে কৈশোর এবং প্রথম যৌবন পা দিয়ে কখনও ভাবেনি, ও একজন ইস্কুল মাস্টার হবে। ওর উচ্চাশা ছিল তীব্র, লক্ষ্য ছিল বিশ্বের পশ্চিম জগতের দিকে, ভাবত এমন একটা কিছু করবে, তাক লাগিয়ে দেবে পৃথিবীকে। ষাটের দশকের একেবারে গোড়ায়, রক্তে তখন আরবি ঘোড়ার টগবগে ছটফটে ভাব, ছুটে বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা মাত্র। তখন ও ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে কলকাতার নাম করা কলেজের ছাত্র। দেশ কাল মানুষের প্রতি কেমন একটা কৃপা ও করুণার চোখে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসত। নিজের চিন্তার সেই বৈশিষ্ট্যতাকে ও দেমাক দেখিয়ে জাহির করে বেড়াত না, মনে মনে রাখত। অথচ পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেবার মতো, কাজের ধারা আর যাত্রা পথটা ওর কাছে স্পষ্ট ছিল না। ভালই ছাত্র ছিল সে। খেলাধুলায় ছিল চৌকস। চেহারাটা ছিল ছ’ ফুটের মতো লম্বা, নাক চোখ মুখ সব মিলিয়ে যাকে বলে, কান্তিমান। যে কোনও বিষয়ে কলেজের ডিবেটে অংশ নিয়ে, প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করত অনায়াসে। অধ্যাপকেরা মুগ্ধ ছিলেন। ভক্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ওকে ঘিরে থাকত! সবসময় ওকে তুলনা দিত সেই সময়ের নাম করা খেলোয়াড় বা ফিল্মের টপ হিরোদের সঙ্গে। ও হাত ঝেড়ে সব নস্যাৎ করে দিত, আর মনে মনে ভাবত, খেলোয়াড় হতে হলে বিশ্বের সেরা। খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাব অলিম্পিকের ক্রীড়াঙ্গনে। ফিল্মের জন্য তো হলিউড আছে। কিন্তু ও সব ঘেঁদো ব্যাপার। তার চেয়েও বড় কিছু হবার স্বপ্ন দেখত ও। কিন্তু সেই বড়ত্বের কোন আসনটা ওর জন্য কোথায় পাতা ছিল, সেটাই ভেবে উঠতে পারেনি। তবে অনার্স পাশ করে, ও যে বিলেত চলে যাবে, সেটা এক রকম ঠিক করেই রেখেছিল। কলকাতা দিল্লি বোম্বাইকে ও পাত্তা দিতে রাজি ছিল না।

সব কিছুরই একটা পশ্চাদপট থাকে। শংকরের তখন সেটা মনে রাখবার কথা না, কারণ সেই বয়েসে ওর মতো কোনও ছেলেই সেদিকটার কথা ভাববার প্রয়োজন বোধ করে না। দরকার হয় না। ওর বাবা ছিলেন ইঙ্গো আমেরিকান এক নামকরা বিজ্ঞাপন অফিসের অ্যাসিস্টান্ট জেনারেল ম্যানেজার। আমেরিকা ইয়োরোপ ঘুরে এসেছিলেন বার দুয়েক। পুরনো আলিপুরে সাহেবদের ছেড়ে যাওয়া বাগান ঘেরা বাংলো বাড়িতে ছিল বাস। ভাড়া গুনত কোম্পানি। গাড়ি ড্রাইভারের খরচাও পেতেন। বাড়িতে ঝি-চাকরের অভাব ছিল না। পার্টি লেগে থাকত প্রায়ই। অভাব বিষয়টি, শংকর কোনও দিক থেকেই তখন জানতে পারেনি। বছরে দু বার দেশের দূরাঞ্চলে পারিবারিক ভ্রমণ ছিল বাঁধা। আধুনিক সঙ্গতিপন্ন পরিবারের যা কিছু থাকা উচিত সবই ছিল।

শংকরের বাবা ভবনাথ মিত্রকে সেলফ-মেড ম্যান বলা যায়। ওর ঠাকুরদা ছিলেন সিটি কোর্টের জাজ। বাবারা তিন ভাই তিন দিকে উন্নতি করেছিলেন, এবং কোনও বিবাদ বিসম্বাদ না করেই, তিনজনে আলাদা সংসার করেছিলেন। বাবা বিয়ে করেছিলেন মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। শংকর যখন বি. এ. পড়ছিল, ওর বড়দা তখন এম. এ. পাশ করে, বাবার অফিসে চাকরি নিয়েছে। বড়দার পরেই দু। বোন ছিল। একজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। শংকরের পরে ছিল এক বোন, তারপরে এক ভাই।

এই যখন অবস্থা, শংকর অনার্স ডিগ্রি কোর্সের ফার্স্ট পার্ট পাশ করেছে, আর দুনিয়াকে তাক লাগানোর মতো দুর্দান্ত কিছু ভাবছে, তখনই একটি পিনের খোঁচার মতো, ওর রঙিন বেলুনটা ফেটে গিয়েছিল। বাবার স্ট্রোক হয়েছিল অফিসের টেবিলে, এবং হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই মারা গিয়েছিলেন। অথচ বাবা ছিলেন কর্মঠ শক্ত মানুষ, অসুখের কোনও লক্ষণই তখনও দেখা যায়নি। এমনকী উচ্চ রক্তচাপের ব্যাধিও ছিল না।

শংকরের রঙিন বেলুন ফেটে যাওয়ার থেকেও, সব থেকে সর্বনাশ যেটা ঘটেছিল, সেটা ছিল গোটা পরিবারের। একটা আলো ঝলমলে ঘরে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এলে সবাই যেমন হতচকিত স্তব্ধ হয়ে যায়, ভবনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে সেই রকম ঘটেছিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে, সবাই যেন একটা দম বন্ধ ঘরে আটকা পড়ে গিয়েছিল। কোথায় যাবে, কী করবে, কিছু স্থির করা যাচ্ছিল না। পরিবারের লোকের কান্নাটা অনেকটা ভয়ার্ত আর্তনাদের মতো শুনিয়েছিল। যদিও ভবনাথের অফিসের এবং অন্যান্য বন্ধুরা শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেবার জন্য এসেছিলেন। এসেছিলেন তার দুই প্রতিষ্ঠিত দাদা এবং ভাই। কিন্তু একটি মৃত্যু একটি পরিবারের পতনকে কোথায় তলিয়ে দিতে পারে, সে বিষয়ে সকলে অবহিত থাকলেও, সামাল দেবার ব্যবস্থা কেউই কিছু করতে পারেনি। কোম্পানির গাড়ি কোম্পানিতে ফিরে গিয়েছিল। রাজকীয় বাংলোটি ত্যাগ করার নোটিস এসেছিল তিন মাসের মধ্যে।

ভবনাথের প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং লাইফ ইনসিয়োরেন্সের টাকার অঙ্কটা কিছু কম ছিল না। কিন্তু টাকা, টাকা আনতে পারে, সে সব চিন্তা ভাবনা কৌশল, ভবনাথের স্ত্রী বা ছেলেদের কারোর ছিল না। ভবনাথ মিত্রের ওপরেই ছিল পরিবারের যা কিছু ভরসা। টাকা পাওয়া গেলেও, তার শূন্যতা কোনও দিক থেকেই পূরণ করা যায়নি। পরিবারটির পতনের মধ্যেও, তার পুরনো জীবনযাপনটা সহসা অপসারিত হতে পারেনি। শংকরের বড় ভগ্নিপতি কিছু কিছু উপদেশ দিয়েছিল। তার মধ্যে একটি, শংকরের পিঠোপিঠি ছোট বোন প্রতিমার বিয়েটা আগে দেওয়া। মা সেই একটা কাজ যথার্থ বুদ্ধিমতীর মতো সেরে ফেলেছিলেন, বাংলোর তিন মাসের মেয়াদের মধ্যেই। পিতার পারলৌকিক কারণে, শাস্ত্র মতে ছেলেদের বিয়ে বৎসর কালের মধ্যে আটকালেও, কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে বাধা ছিল না। বলতে গেলে, বাবার মৃত্যুর ছ’ মাস পরেই, বেশ সাড়ম্বরে প্রতিমার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শংকরের বড়দা পিনাকীর মোটেই ইচ্ছা ছিল না, ওই রকম সাড়ম্বরে খরচ-খরচা করে প্রতিমার বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মায়ের একটি কথাই ছিল, ও যে ভাবে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিল, আমি তাই দেব। ’ও’ অর্থাৎ শংকরের বাবা।

শংকরও বুঝেছিল, মায়ের ওটা সেন্টিমেন্টের কথা। অবস্থার চাপে পড়ে মানুষকে অনেক কিছুই। বদলাতে হয়। মা তা করেননি। মায়ের কাছে সেটা মোটেই সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার ছিল না। তাঁর স্বামীর ইচ্ছাকে রূপ দেওয়াটাই ছিল তার একান্ত কাম্য। অবস্থার কথা বিবেচ্য ছিল না। আসলে, কেউ বুঝতেই পারেনি, বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পরেই, মায়ের ভিতরে কতখানি ক্ষয় ধরেছিল। প্রতিমার বিয়ের পরেই, সেটা বোঝা গিয়েছিল। চাকুরে বলতে ছিল দাদা পিনাকী। শংকরের বি. এ. পাশ করতে তখনও এক বছর বাকি পিনাকী চেষ্টা করেছিল, শংকর যদি বাবার অফিসেই একটা চাকরি পায়। ফার্ম রাজি হয়নি, কারণ সেই সময়ে ফার্মেও নানা রকম ঝামেলা চলছিল। বিপদই বোধ হয় আরও বিপদকে টেনে আনে। অন্তত সময় বিশেষে তাই দেখা যায়। ইঙ্গো-আমেরিকান প্রচার ও বিজ্ঞাপন ফার্মটিও তখন তার অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল।

প্রতিমার বিয়ের খরচকে কেন্দ্র করে মায়ের সঙ্গে দাদার বিরোধ দানা বেঁধে উঠেছিল। শংকর প্রথমে ঠিক বুঝেউঠতে পারেনি। বিরোধটাকে এক পক্ষের বলাই ভাল। দাদার বিরোধ। দাদা, এমনকী মায়ের কাছে টাকা পয়সার হিসাবও চেয়েছিল, এবং বাকি টাকাটা কী ভাবে ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগানো যায়, তা মায়ের সঙ্গে নানা রকম কথাবার্তাও বলত। অথচ দৈনন্দিন সংসার চালানোর বিষয়ে দাদারও যথার্থ কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। সে-ই তখন সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি, কিন্তু বাবার আয়ের তুলনায়, দাদার আয় ছিল তুচ্ছ। মায়ের কাছে গচ্ছিত টাকা জলের মতোই খরচ হয়েছিল।

আলিপুরের বাংলো থেকে, ভবানীপুরের কাঁসারিটোলার দূরত্ব হয় তো তেমন ছিল না। ভবনাথ মিত্রের পরিবারের কাছে সে দূরত্ব অসীম, এক জগৎ থেকে আর এক অচেনা জগতে প্রবেশের মতো। মায়ের শরীর ভাঙছিল দুরন্ত গতিতে। তার শোক বোঝবার মতো মনের অবস্থা বোধ হয় কারোরই ছিল। না। মানুষ অনভিজ্ঞ হলেও, পক্ষী পতঙ্গ যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পদধ্বনি শুনতে পায়, শংকর সেই রকম একটা কিছু অনুভব করেছিল। ওর মতো উচ্চাশার অস্পষ্ট ধ্যান-ধারণা ছিল, বি. এ. পাশ করবার আগেই, সে সব যেন কোথায় তলিয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল। এর নাম পশ্চাদপট, যার কথা ওর আগে কখনও মনে হয়নি। কসারিটোলার বাড়িতে বাস করতে এসে, ধ্যান-ধারণাগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল। মা ক্রমাগত রুগ্ন হয়ে পড়ছিলেন। মাকে গ্রাস করেছিল স্বামীর শোক, বাকিদের গ্রাস করেছিল হতাশা।

সন্তান হয়ে ভাবতে হয়তো সেই সময়ে ভাল লাগেনি, আসলে শংকরদের মনে হয়নি, স্বামী বিহীন বিশ্বসংসার মায়ের কাছে অর্থহীন বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বিদায় চাইছিলেন, পেয়েও ছিলেন। শংকর কোনও রকমে অনার্স বজায় রেখে পাশ করার, তিন মাসের মুখে মা মারা গিয়েছিলেন। অর্থাৎ পনেরো মাসের মধ্যেই, শংকরদের তিন ভাইকে দুবার কাছা গলায় নিতে হয়েছিল। খোঁজ খবর নিয়ে। জানা গিয়েছিল, মায়ের নামে ব্যাঙ্কে মাত্র আর হাজার দশেক টাকা পড়ে ছিল। মায়ের অবর্তমানে টাকাটা তোলার ব্যবস্থা ছিল দাদার নামে। দুই ভগ্নিপতি ও কাকা জ্যাঠাদের উপস্থিতিতে, শ্রাদ্ধ শান্তি নমঃ নমঃ। করে মেটাতেও, দশ হাজার টাকার বিশেষ কিছু বাঁচানো যায়নি। তারপরে কসারিটোলার তিন ভাইয়ের সংসার, পিনাকী, শংকর আর বিজিত। মায়ের মৃত্যুর সময়ে বিজিত সবে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল।

নতুনতর সমস্যার শুরু সেই থেকে। পিনাকীর একার আয়ে বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চালিয়ে শংকর। আর বিজিতকে পড়ানো সম্ভব ছিল না। অগ্রজ হিসাবেও পিনাকীর সে মেজাজ বা চরিত্র ছিল না। মা বেঁচে থাকতে, শংকরের ন্যূনতম হাত-খরচাটা জুটত। তা বন্ধ হয়েছিল। দাদার কাছে হাত পাতার কথা ভাবতেই পারেনি শংকর। অতএব, দুরন্ত স্বপ্নচারী কোনও রকমে জুটিয়ে নিয়েছিল দুটো টুইশানি। বিজিত কলেজে ভরতি হয়েছিল, কিন্তু ও হয়ে উঠেছিল এক ধরনের অবিনীত আর রাগী। শংকরকে তেমন পাত্তাই দিত না। দাদা যে নিতান্ত কর্তব্যের খাতিরেই ওকে পড়াচ্ছিল, এবং ও একটা বোঝা, তা বুঝতে পারছিল।

শংকর এখন বুঝতে পারে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে, দাপিয়ে ঝাঁপিয়ে, কলকাতার বুকে একটা স্থান করে নেওয়া যায়, কিন্তু ওর মধ্যে সেই শক্তির অভাব ছিল। অথবা বলা যায়, অল্প সময়ের মধ্যেই, ভাগ্য বিপর্যয় ওকে হতমান করেছিল। দাদার ব্যবহার ওকে কষ্ট দিত, মুখ ফুটে কোনও দিন বলতে পারেনি। অগ্রজের প্রতি কনিষ্ঠের কোনও দাবি থাকতে পারে, সেটা দাদা গোড়া থেকেই যেন মেনে নিতে চায়। নি। বিজিতের জন্য ওর মন খারাপ হত। অথচ ওকে সব দিক দিয়ে আগলে রাখার যোগ্যতা শংকরের ছিল না। দিদি মমতা বা বোন প্রতিমার অবস্থা খারাপ ছিল না। যদিও কলকাতাবাসী কেউ ছিল না। পত্রে কুশল জিজ্ঞাসা ছাড়া কোনও সম্পর্ক ছিল না তাদের সঙ্গে।

শংকরের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সেটাই স্বাভাবিক। নিজেদের তিন ভাইয়ের সংসারের দিকে তাকিয়েই তা বোঝা যাচ্ছিল সংসার বড় কঠিন ঠাই, শংকরের এই বোধ জন্মেছিল। হতাশা কাটিয়ে ও নানা ভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু জীবন এক বার একটা দিকে মোড় নিলে, সহজে তার গতিরোধ করা যায় না। খবরের কাগজের ওয়ান্টেড কলাম দেখে বিস্তর দরখাস্ত পাঠাতে পাঠাতে, ও সাময়িক ভাবে একটা ইস্কুলে চাকরি নিয়েছিল। ইস্কুলের চাকরিটাও খুব সহজ ব্যাপার না। শহরের বুকে কয়েকটা ইস্কুলে কাজ করতে করতে, ও গিয়েছিল কলকাতার উপকণ্ঠে। সেখানে চাকরি করতে করতেই, বি. টি. পাশ করেছিল।

ইতিমধ্যে জল গড়িয়ে গিয়েছিল অনেক। বিজিত কলেজে ঢুকেই রাজনীতি নিয়ে মেতেছিল। লেখাপড়ার থেকে, ক্রমে সেদিকেই ও যেন একটা আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আক্রোশ নিয়ে? হ্যাঁ, শংকরের তো সেই রকমই মনে হয়েছিল। আক্রোশ নিয়ে কোনও কিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অর্থই তো, নিজের মনের মতো কিছু না পেয়ে একটা কিছুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ফলে দাদার সঙ্গে বিবাদ। দাদাও দেখছিল, বয়স হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে ও একটি ছোট সংসারের স্বপ্ন দেখাটা তার পক্ষে দোষের ছিল না। দাদা প্রস্তুত হচ্ছিল। শংকর প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও, রাজনীতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে, ইস্কুলের শিক্ষকতার জীবনে, রাজনীতি ওকে রেহাই দিত না, এবং সেই রাজনীতির আবহাওয়াটা ওর মনকে বিমর্ষ করত, উৎসাহিত করত না। ও নিজে কলেজ জীবনে রাজনীতি নিয়ে মাতেনি, কিন্তু গতি প্রকৃতি সম্পর্কে একেবারে অনবহিত ছিল না। খবরের কাগজ পড়ত নিয়মিত। বুঝেছিল, বিজিত রাজনীতিকে গ্রহণ করেছে একেবারে রক্তে মাংসে। অথচ শংকর বুঝতে পেরেছিল, সেখানে ও বেমানান। বরং ওর মনে একটা সংশয়ের জিজ্ঞাসা জাগত, নৈরাশ্যই কি শেষ পথ হিসাবে রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়?

তা যদি হত, শংকরকেও দিতে পারত। তা দেয়নি। এমন না যে, নানা দলে নানা রাজনীতি করে এমন বন্ধু ওর ছিল না। রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা হত না এমনও না। কিন্তু একটা প্রগাঢ় অনীহা ছিল। বিশ্বাস একটা বড় কথা। তত্ত্বগত দিক থেকে, কোনও মহাপুরুষের লেখাই ওর পড়া ছিল না। সেই হিসেবে ও তাত্ত্বিক হয়েও উঠতে পারেনি। কিন্তু সময় ও সমাজ সম্পর্কে ও নির্বিকার ও অচেতন না। ন্যায় অন্যায় বোধ সম্পর্কে ও অন্ধ ও অনুভূতিহীন না, আর এই সময় সমাজ ন্যায়-অন্যায় বোধের কাছে এসেই, রাজনীতি নিয়ে কেমন বিভ্রান্তি বোধ করেছে। দল ছাড়া রাজনীতি করা যায় না, সেটা রাজনীতির হাটে বিকোয় না, ঘরে বসে শৌখিন মজদুরি করা হতে পারে। চারপাশের জীবন, আর রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি, কাজের ধারাকে ও কিছুতেই মেশাতে পারেনি। সেটা যে ওরই অক্ষমতা, এটা ওকে প্রথম প্রায় চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল, ওর অল্প বয়সের বন্ধু প্রিয়ব্রত বিশ্বাস। প্রিয়ব্রতর সঙ্গে কলেজ থেকে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল। শংকর জানত, প্রিয় বিত্তবান পরিবারের ছেলে। কলেজ ছেড়ে আসার পরেও, প্রিয়র সঙ্গে কয়েক বার দেখা হয়েছে, কিন্তু রাজনীতি করতে দেখেনি। বরং পরিবারের বিদেশ চালানের ব্যবসায়ে কিছু কিঞ্চিৎ কাজ করত, আগের মতোই গাড়ি হাঁকিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করে বেড়াত।

সেই প্রিয়, যার ভাই সুব্রত এই শালচিতি গ্রামে দুর্ঘটনা ঘটাল, একদিন রাত্রে শংকরের কাছে এসে আশ্রয় চেয়েছিল। সময়টা শংকরের ভাল যাচ্ছিল না। বিজিত ঘর ছাড়া। দাদা বিয়ে করে সংসার পেতেছে। আটষট্টির শেষ, উনসত্তরের শুরু। প্রিয় তখন আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্যাল কর্মী, সেই জন্যই আশ্রয়। দাদা প্রিয়কে চিনত না, কিন্তু বাড়িতে শংকরের ঘরে একজন আশ্রয় নিয়েছে, ব্যাপারটা মোটেই ভাল চোখে দেখেনি। একদিন শংকরকে ডেকে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করেছিল, তোর ওই বন্ধু কি নকশাল করে? যদি করে তাড়াতাড়ি ও সব ঝামেলা বাড়ি থেকে হটা। নইলে, এ বাড়িতে তুই থাক, আমি চলে যাচ্ছি।

কাঁসারিটোলার পুরো একটা পাঁচ কামরার দোতলা বাড়ির প্রয়োজন ছিল না। শংকরকেও দাদা পালন করত না। অতএব, ছাড়াছাড়ি হলেও ক্ষতি তেমন ছিল না। শংকরকে অবিশ্যি বাড়িটা ছাড়তেই হত। সেই সময়ে চারশো টাকা ভাড়া দিয়ে, সেই বাড়িতে একলা থাকার কোনও অর্থই ছিল না। কিন্তু দাদা মিথ্যে বলেনি। প্রিয়ব্রত তখন নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল। জড়িয়ে পড়েছিল বললে ভুল বলা হয়। আন্তরিক বিশ্বাস নিয়েই সে নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রিয়ব্রতর সে-চেহারা আলাদা। কথাবার্তা, চোখ মুখের চেহারা। এক কথায় আগুন।

শংকর কেবল অবাক হয়নি, প্রিয়র কাছে ওর নিজেকে কেমন নিষ্প্রভ তুচ্ছ মনে হয়েছিল। স্বপ্নচূড়ার থেকেও অধিক, প্রিয় একেবারে বাস্তব, ও ঐশ্বর্যের মিনার চূড়া থেকে নেমে এসেছিল। ওর রাজনৈতিক তত্ত্বে গভীর বিশ্বাস ছিল, তথ্য প্রমাণ ছিল ওর বিস্তর। সেই সময়েই শংকরের জীবন ও ধ্যান-ধারণা শুনে ও বলেছিল, তুই অন্ধ। বুর্জোয়া আর মেকি বিপ্লবীদের দেখে আর তাদের ধাপ্পাগুলো শুনে, তোর সব গোলমাল হয়ে গেছে। তোকে অবিশ্যি তার জন্য দোষ দিই না। ধাপ্পাতে অনেকেই ভুলে আছে, যেমন আছে তোর ভাই বিজিত। কিন্তু আমাকে দেখে তো তোর আর দল বেছে নিতে ভুল হবার কথা নয়। আমরা দফাওয়ারি কর্মসূচির কথা বলে ভোলাই না, কারণ তার আগে আমরা সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চাই। বুর্জোয়া পার্লামেন্ট আর সংবিধান আমরা ভেঙে ফেলব, তারপরেই আমাদের কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারব। চিন আর ভিয়েতনাম আমাদের পথ দেখিয়েছে।…

সেই সময়ে কথাগুলো শংকরের কাছে নতুন ছিল না। নানা ভাবেই, দেওয়ালের পোস্টার থেকে, বিভিন্ন কাগজপত্রের মাধ্যমে, পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়’ চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান লিন পিয়াওয়ের পথ আমাদের পথ’ হো-চি-মিন যুগ যুগ জিয়ো’ ইত্যাদি সবই নানা ভাবে জানা ও শোনা ছিল। কিন্তু প্রিয়ব্রতর মুখ থেকে শোনার ইমপ্যাক্ট আলাদা। শংকরের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে গিয়েছিল, ওর বুকে প্রিয়র আগুনের আঁচ লেগেছিল। দল নিয়ে যে ওর মনের মধ্যে নানা রকমের সংশয় ছিল, সেই দলই যেন ও খুঁজে পেয়েছিল। প্রিয়ব্রত আদর্শহীন না, আদর্শের জন্য সে নিরাপদ জীবনের সুখ ঐশ্বর্য সব কিছু ছেড়ে এসেছিল। প্রিয় যদি তা পারে, শংকরের কীসের সংশয়? ওর নিজের ভাই বিজিত হতাশা থেকে রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল। প্রিয়র জীবনে কোনও হতাশা ছিল না। আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, মরণ যজ্ঞে ঝাঁপ দিয়েছিল, এবং তার ব্যাখ্যা ও নীতির মধ্যেই ছিল যুক্তি। অন্যান্য দলগুলির প্রতি অবিশ্বাস থেকেই তো অনীহা এসেছিল শংকরের মনে। দলবাজির গ্লানি ছিল না প্রিয়দের মধ্যে। কোনও কূটকচালি ছিল না। সবই স্পষ্ট আর খাঁটি। জনগণকে মিথ্যা আশ্বাসের, পাইয়ে দেবার সুড়সুড়ির কথা ছিল না। সোজা কথা, সোজা কাজ। খতম ও ক্ষমতা দখল, তরপরে নতুন রাষ্ট্র গঠন।

চিনের চেয়ারম্যানই তো সারা বিশ্বের চেয়ারম্যান হবার যোগ্য। তাঁর পথ ছাড়া পৃথিবীর সর্বহারাদের মুক্তির পথ আর কী ছিল?

কিন্তু বাড়ির আবহাওয়া ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল। দাদা আর বউদি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠেছিল, অথচ যেন একটা অলৌকিক ভয়ে তারা বাড়ির মধ্যে মুহ্যমান হয়ে থাকত। শংকর পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, আমার বন্ধু সময় হলেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ও কোনও ক্ষতি করছে না। কিন্তু ওর ক্ষতি কেউ করতে চাইলে, তার পরিণাম হবে মারাত্মক!

শংকর কথাগুলো এমন ভাবে বলেছিল, পিনাকী আশা করেনি। পিনাকী শংকরকেই ভয় পেতে আরম্ভ করেছিল, আর অন্য একটা বাড়ির সন্ধানে তৎপর হয়ে উঠেছিল। ইতিমধ্যে, প্রিয়ব্রতর সঙ্গে, শংকরের মারফত বাইরে পার্টির যোগাযোগ হয়েছিল। নিজেকে ও একজন কর্মী ভাবতে পেরে, গর্ব অনুভব করেছিল। ওর আটাশ বছর বয়সটা ফিরে পেয়েছিল আঠারোর আগুন। কিন্তু প্রিয়ব্রতর কঠিন নির্দেশ ছিল, শংকর যেন কোনও রকমেই, আচরণে, কথাবার্তায় আইডেন্টিফায়েড হয়ে না যায়। ও যেমন সাতে-পাঁচে না থাকা ইস্কুল মাস্টারের জীবনযাপন করছিল, ঠিক তাই করে যাবে, তার এক চুলও এদিক ওদিক না হয়। তা না হলে সব পণ্ড হয়ে যাবে। এমনকী ও যদি কোনও দিন কোনও কারণে ধরাও পড়ে যায়, তা হলে যেন সব বেমালুম অস্বীকার করে। মেরে ফেললেও একটি কথাও স্বীকার করা চলবে না। সামান্য সূত্র থেকে অসামান্য ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

শংকর ওর নেতার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছিল। কিন্তু, মাসখানেক পরেই, একদিন একটা দমকা ঝড়ে যেন সব ছত্রাখান হয়ে গিয়েছিল। বিজিত ঘর ছাড়া মানে এই ছিল না, ও চিরদিনের জন্য গৃহত্যাগ করেছিল। ও ওর বড়দা মেজদার ঘাড়ের বোঝা হতে চায়নি, এই ছিল ওর স্পষ্ট কথা। সেইজন্যই নিয়মিত বাড়িতে থাকত না। কিন্তু দমকা বাতাসের মতো দু-চার মাসে হঠাৎ হঠাৎ ওর আবির্ভাব ঘটত। বড় জোর একটা বেলা, বা এক রাত থেকেই চলে যেত। প্রিয়ব্রতর মতো ওরও ছিল এক মুখ গোঁফ-দাড়ি, শক্ত মুখে কঠিন দৃষ্টি। সামান্য দু-চারটি কথা, যা একান্ত না বললে নয়, তাই বলত। বড়দার সঙ্গে আদৌ কথা বলত না। বউদি তো ওর কাছে একজন অচেনা মহিলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। শংকরই ওকে বাড়িতে থাকতে বলত। সে অধিকারও ওর ছিল। কারণ ও সংসারের কিছু খরচ বহন করত। কিন্তু বিজিতের পরিষ্কার জবাব ছিল, আমার জায়গা আমি বেছে নিয়েছি, তোদের সঙ্গে আমার থাকার কোনও প্রশ্নই নেই মেজদা। আমার জগৎ আলাদা। তবু এদিকে এলে, তোদের কাছে এক বার না এসে পারি না। এখানে কী আছে? বড়দা চাকরিতে উন্নতি করার চেষ্টায় আছে। তুই একটা নেহাত ইস্কুল মাস্টারের জীবন কাটাচ্ছিস। আমি আমাদের পার্টি সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়াই। আমাদের যুক্তফ্রন্টের আঁতাতটা মার খাচ্ছে, কিন্তু চিরদিন এ রকম থাকবে না, চলবে না। বিশ্বাসঘাতকগুলোর মুখোশ একদিন খুলবেই, মানুষকে চিরকাল ধাপ্পা দেওয়া যায় না। আমি একস্ট্রিমিস্ট নই, দক্ষিণপন্থী আপসবাদীও নই। খাঁটি নীতি যদি কিছু থাকে, আমাদেরই আছে।…তুই আমার জন্য ভাবিসনে মেজদা, আমি আমার জায়গা খুঁজে নিয়েছি। তোদের সঙ্গে আমার কোথাও মিল নেই। তবে হ্যাঁ, কিছু মনে করিস না মেজদা, আই পিটি ইউ। তুই কী ছিলি, কী হয়ে যাচ্ছিস।

শংকর নিজেকে একেবারে জানত না, তা না। সবই তো সেই পশ্চাদপট, চালচিত্র সরে যাওয়ার পরেই, ন্যাড়া প্রতিমাগুলোর দুর্ভাগা চেহারা বেরিয়ে পড়েছিল। বিসর্জনের আগের ছবি। সেই ভাঙনটা তো দেখা দিয়েছিল সব দিক থেকেই। বিজিত শংকরকে করুণা করতে পারে, ওর পরিণতিও সেই ভাঙন থেকেই। ভবনাথ মিত্রের তিন বংশধর, তিন দিকে ভেসেছিল। কিন্তু বিজিতের দাবি ছিল, ও ঠিক পথ বেছে নিয়েছে। শংকর প্রতিবাদ করেনি। পিনাকী তো কেবল দায়মুক্ত হতেই চেয়েছিল। তথাপি শংকর তিন ভাইকে নিয়ে একটা সংসার গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখত, যা ছিল অসম্ভব। সে কারণে ও দাদা বউদির সঙ্গেও সহজে জীবনযাপন করতে চেয়েছিল। ও একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি।

কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতাই অনিবার্য করে তুলেছিল প্রিয়ব্রতর আগমন। ও যখন নতুন ভাবে জীবনকে দেখতে আরম্ভ করেছিল, তখনই হঠাৎ একদিন বিজিতের আবির্ভাব হয়েছিল। একটা কথা প্রিয় প্রায়ই বলত, শংকর, তোর আশ্ৰয়টা আমার কাছে সবদিক থেকেই নিরাপদ। তোর দাদা বউদিকে ভয় পাই নে, ওদের তুই ম্যানেজ করেছিস। কিন্তু বিজিত কোনও দিন এসে পড়লে, জানতে পারলেই সব গোলমাল হয়ে যাবে।

শংকরের আশা ছিল বিজিত এলেও, প্রিয়ব্রতকে ও আড়াল করে রাখতে পারবে। পারে নি। হঠাৎ এক রবিবারের সন্ধ্যায় বিজিত বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছিল। প্রিয় দিনের অধিকাংশ সময় দোতলার একটা ঘরে থাকত। রাত্রের অন্ধকারে চিলেকোঠায় আর ছাদে যেত। বাড়িতে সর্বক্ষণের কাজের লোক বলতে এক জনই ছিল। বাবার আমলের একজন পুরনো বয়স্ক লোক, সে প্রায় শংকরদের সবাইকেই বড় হতে দেখেছে। সে-ই একমাত্র পুরনো বেতনে, খাওয়া পরা নিয়ে, এ বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে যায়নি। তার নিজের কেউ ছিল না। মিত্র পরিবারের ছেলেদের ওপর কিছু টানও ছিল। বিজিতকে দরজাটা খুলে দিয়েছিল সে-ই। বিজিত কেবল জিজ্ঞাসা করেছিল, ভাল আছ বেচন চাচা?’ জবাব শোনারও অপেক্ষা করেনি। দাদা বউদি গিয়েছিল সিনেমায়। শংকর আর প্রিয়ব্রত তখন দোতলার ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাচ্ছিল। কাঁধে ব্যাগ, বিজিত এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে।

আকস্মিকতার চমকটা মুখে ফুটে উঠেছিল শংকর আর প্রিয়ব্রতরই বেশি। বিজিতের চোখে ছিল বিস্ময় ও সন্দেহ। শংকর তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলেছিল, বিজু? কখন এলি?

বিজিত তখন প্রিয়ব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। না চেনার কথা না। আলিপুরের বাড়িতেই অনেক বার দেখেছে। তবু অনেকগুলো বছর কেটেছিল। প্রিয়ব্রতর মুখে ছিল গোঁফ দাড়ির জঙ্গল। তবু ঠিক চিনে নিয়েছিল, বলেছিল, প্রিয়দা না?

প্রিয়ব্রত সহজ হতে পারেনি, কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল, হ্যাঁ। তুমি তো বিজিত?

চিনতে পেরেছেন দেখছি। বিজিতের চোখে তখনও সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা, আপনিও দেখছি গোঁফ দাড়ি রেখেছেন।

শংকর হেসে বলেছিল, প্রিয়র ওটা শখ। আজ বিকেলে হঠাৎ আমার কথা এর মনে পড়েছে, তাই দেখা করতে এসেছে। তুই আজ থাকবি তো?

হ্যাঁ, রাতটা থাকব বলেই তো এসেছি৷’ বিজিত বলেছিল, কিন্তু ওর চোখের সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা জেগেই ছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, বাড়ির কর্তাগিন্নি কোথায়? দেখলাম না তো?

শংকর বলেছিল, দাদা বউদির কথা বলছিস? সিনেমায় গেছে। চা-টা কিছু খাবি না কি? বেচনচাচাকে তা হলে বলে দে।

খেলেও চলে, না হলেও চলে। বিজিত পাশের ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোরা কি কোথাও যাচ্ছিলি?

শংকর বলেছিল, ছাদে বলে গল্প করব ভাবছিলুম। তুই আসবি নাকি?

বিজিত মুখ তুলে প্রিয়ব্রতর দিকে তাকিয়েছিল। গোঁফের ফাঁকে একটু হেসে বলেছিল, প্রিয়দা যেন আমাকে ভূত দেখার মতো দেখছেন। তোদের বোধ হয় কোনও গোপন কথা আছে। তোরা যা। ও অন্য ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়েছিল, দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

এক সময়ে ও ঘরটা বিজিতেরই ছিল, এখনও আছে। নীচের তলাটা পুরো দাদা বউদির দখলে। শংকর আর প্রিয়ব্রতর মুখে উদ্বেগ, সন্দেহ, কিন্তু চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছিল। শংকর চোখের ইশারায় ওকে শান্ত আর স্বাভাবিক হতে বলেছিল। জবাবে প্রিয়ব্রত বলেছিল, থাক ছাদে আর যাব না, ঘরে বসেই গল্প করি।

প্রিয়ব্রত দ্রুত ঘরে ঢুকেছিল। শংকরও। প্রিয় ঘরের কোণে সরে গিয়েছিল, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল, কী মনে হয় তোর শংকর? ও কি এমনি এসেছে, না কোনও খবর পেয়ে?

আমার মনে হয় এমনি, যেমন হঠাৎ এসে পড়ে। শংকর জবাব দিয়েছিল, ও তোকে দেখে খুব অবাক হয়েছে।

প্রিয় বলেছিল, ও একটা কিছু সন্দেহ করেছে। আমাকে এ ভাবে দেখবে, ভাবেনি। ওর চোখের চাউনিটা মোটেই ভাল নয়। আমাকে আজ রাত্রেই এ বাড়ি ছাড়তে হবে।

তা কেন?

তা ছাড়া? আমাকে কাল সকালে দেখতে পেলেই সব বুঝে ফেলবে।

আমি তোকে চিলেকোঠায় লুকিয়ে রাখব।

তোর দাদা বউদি কি বেচনচাচা বলে দিতে পারে।

ওদের সঙ্গে বিজু কোনও কথাই বলবে না।

প্রিয়ব্রত খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবেছিল, তারপরে দৃঢ় ভাবে মাথা নেড়ে নিচু স্বরে বলেছিল, না শংকর, আর চাপাচাপি সম্ভব নয়। বিজিত আমাকে চিনতে পেরেছে, সন্দেহ করেছে, আমি আজকাল কী করছি না করছি, খবর পাবেই।

শংকর হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারেনি। কারণ প্রিয়ব্রতর সন্দেহটাও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেনি। ও নিজেও বুঝেছিল, এক মুখ গোঁফদাড়িসুদ্ধ প্রিয়ব্রতকে এ বাড়িতে দেখে বিজিত কিছু একটা সন্দেহ করেছে, সহজ ভাবে নিতে পারেনি। ছোট ভাই হলেও, শংকরের কাছে বিজিত সেই সময়ে অনেকটাই অচেনা। বিজিতকে বুঝে ওঠা ওর পক্ষে মুশকিল ছিল।

প্রিয়ব্রত আবার বলেছিল, তোর বা আমার কারোরই কোনও বিপদের ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না। পার্টির ক্ষতি হয়ে যাবার চান্স আছে। তুই যেমন বলেছিস, আমি বিকালে তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, সেই রকম ভাবেই আমি চলে যাব। আমি বরং তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিই। জামাকাপড় তো আমার তেমন কিছুই নেই। তার আগে কাগজপত্র যা আছে, সব খুঁটিয়ে দেখে ব্যাগে ভরে ফেলতে হবে।

কিন্তু, হঠাৎ কোথায় যাবি?’ শংকর উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, একটা জায়গা ঠিক না করে কি হঠাৎ এ ভাবে বেরিয়ে পড়া উচিত হবে?

হবে। কোথায় যাব, আমি ঠিক করে ফেলেছি। তুইও আমার সঙ্গে যাবি। তারপরেই তোর কাজ হবে, ইস্কুলে যে কমরেড রোজ তোর সঙ্গে দেখা করে, তাকে আমার ঠিকানাটা জানিয়ে দেওয়া।

আর আমি কী করব?

 তোকে ঠিক সময়ে নির্দেশ দেওয়া হবে। আর দেরি নয়, গোছগাছ শুরু করে দেওয়া যাক।

শংকরের মনে হয়েছিল, প্রিয়ব্রত খানিকটা ভয়ও পেয়েছে। সেটাই হয় তো স্বাভাবিক। দরজা বন্ধ করে ওরা দুজনেই ঘর তন্ন তন্ন করে যত কাগজপত্র ছিল সব ব্যাগের মধ্যে তুলে ফেলেছিল। প্রিয়র সামান্য জামাকাপড় ঠেসে ভরা হয়েছিল ব্যাগের মধ্যে। দুজনে যখন নিশ্চিন্ত হয়েছিল, ঘরের মধ্যে সন্দেহজনক কোনও কিছুই আর নেই, দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। বেরোবার মুখেই বিজিত ওর ঘরের দরজা খুলেছিল। তখনও ওর চোখে সন্দেহ। শংকর বলেছিল, বিজু তুই আছিস তো? আমি প্রিয়কে একটু এগিয়ে দিয়ে আসছি।

বাড়ির বাইরে কিন্তু প্রিয়দার গাড়ি দেখতে পাইনি। বিজিত বলেছিল, আপনি গাড়ি ছাড়াই এসেছেন?

প্রিয়ব্রত বলেছিল, হ্যাঁ, সবসময় তো আর হাতের কাছে গাড়ি পাই নে৷ চলি৷ বিজিত কথা না বলে ঘাড় কাত করেছিল। কিন্তু ওর চোখে সেই একই সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। শংকর প্রিয়ব্রতকে নিয়ে নীচে নেমে এসে, বেচনচাচাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিজিত কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কি না। বেচন সাদা ঝোলা গোঁফে ফোকলা দাতে হেসে মাথা নেড়েছিল, বিজু বেটা তো কোনও কথাই বলে না।

শংকর বলতে চেয়েছিল, বিজিত প্রিয়ব্রত সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে যেন কোনও কথা না বলে। প্রিয়ব্রত ইশারায় বাধা দিয়েছিল, এবং বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বলেছিল, কোনও লাভ নেই শংকর। আমি বলেছি, বিজিত ব্যাপারটা জানবেই। এরপর তোকেই সব থেকে বেশি সাবধান থাকতে হবে।

শংকর প্রিয়ব্রতকে ট্যাক্সিতে গড়িয়ায় এক বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছিল। দাদা বউদির খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বেচন জানিয়েছিল বিজিত খেয়ে নিয়েছে। শংকরকে একলা দেখে সে জানতে চেয়েছিল, তার বন্ধু কোথায়? শংকর বলেছিল, ওর বন্ধু আর আসবে না, এবং জিজ্ঞেস করেছিল, বিজিত ওর বন্ধু সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছে কি না? বেচন সরল ভাবেই বলেছিল, হ্যাঁ, এবং সে বলেছে, শংকরের বন্ধু এক মাস ধরে এ বাড়িতেই আছে। শংকরের বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠেছিল। প্রিয়ব্রতর কথা শোনা ওর উচিত হয়নি। বেচনকে বারণ করাই উচিত ছিল। ও বুঝতে পারছিল না, বিজিত কী ক্ষতি করতে পারে। কোনও রকমে মুখে দুটো খুঁজে ও ওপরে উঠেছিল। বিজিত ওর জন্যই ঘরের বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। ওকে দেখেই হেসে বলেছিল, প্রিয়া আমাকে দেখেই সরে পড়লেন?

সরে পড়ার কী আছে?’ শংকর বলেছিল, ওর দরকার পড়েছে, তাই চলে গেছে।

বিজিত তবু হেসেছিল, আমি অবিশ্যি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম। তবু তুই বললি আজ বিকেলে প্রিয়া তোর কাছে এসেছে। বেচনচাচার মুখে শুনলাম, প্রিয়দা মাসখানেক এ বাড়িতে আছে। তার মানে, আন্ডারগ্রাউন্ড শেলটার নিয়েছিল তোর কাছে। শেষপর্যন্ত প্রিয়দাও নকসু?

নকসু মানে?

 নক্সভমিকা–ওষুধের নাম শুনিস নি? তুইও কি ওই চিকিৎসায় আছিস নাকি?

শংকর সহসা রাগে না, কিন্তু বিজিতের কথায় ওর কেমন জ্বালা ধরে গিয়েছিল, বলেছিল, তোর সঙ্গে আমি ও সব নিয়ে কোনও কথা বলতে চাই না।

তা না বললি, কিন্তু সত্যি মেজদা, তুই, প্রিয়দা, তোদের আমি বুঝতে পারি নে। অনেক নকশাল ছেলেকে বুঝতে পারি, তারা কেন হঠকারি রাজনীতির পথে গেছে। কিন্তু তুই বা প্রিয়দা, তোরা কেন এ পথ নিয়েছিস?

কারা হঠকারি আর কারা নয়, এক সময়ে প্রমাণ হয়ে যাবে।

তা তো যাবেই। তবে তুই ভুল করেছিস। আসলে এটাও এক রকমের রোমান্টিক ঝোঁক, হঠাৎ মাথায় বিপ্লবের পোকার কিলবিলোনি। খুব বাজে ব্যাপার। বিপদে পড়ে যাবি।

কীসের বিপদ? তুই ধরিয়ে দিবি আমাকে?

না, আমি তোকে ধরাব না, তোরাই হয় তো এ বার আমার পেছনে লাগবি। প্রিয়দা হয় তো আমার পেছনে তোকেই লাগিয়ে দেবে। আমি অবিশ্যি আর এ বাড়ি আসব না, আমাকে খুঁজে পাবি না। তবে কে বলতে পারে, ইন ফিউচার, তোতে আমাতেই হয়তো লড়াই লাগবে। তোদের সঙ্গে কোনও দিনই। আপস সম্ভব নয়।

তোদের দলকেও তো চিনি, নামে বামপন্থী, আসলে দক্ষিণপন্থী রিভিশনিস্ট। আমরাও কি তোদের সঙ্গে আপস করব ভেবেছিস?

বিজিত হেসে বলেছিল, সত্যি মেজদা, তোর মুখে রাজনীতির কথা শুনতে হচ্ছে, ভাবা যায় না। এর পরে কোন দিন পিনাকী মিত্তিরও (বড়দা) রাজনীতির কথা বলবে।

তুই ভেবেছিলি, রাজনীতিটা এ বাড়ির ছেলেদের মধ্যে তোর একচেটিয়া।

কিন্তু আমি আমার দল চিনে নিয়েছি, সব রকমের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধেই আমরা লড়ব।

বিজিতের চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেছিল, তারপরে আবার হেসে বলেছিল, ঠিক আছে, ভবিষ্যতে তোর সঙ্গে মোকাবিলা হবে। তবে তোকে একটা কথা বলে রাখি, তোর আর প্রিয়দার বিষয়ে আমি কারোকে কিছু বলব না, অবিশ্যি যদি বুঝি, তোরা আমার পেছনে লাগিসনি।

শংকর বিজিতের সঙ্গে কথাবার্তার বিষয় সবই সেই রাত্রে নোট করেছিল। পরের দিন ইস্কুলে ওর। সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষী দূতের মারফত প্রিয়ব্রতকে নোট পাঠিয়ে দিয়েছিল। বিজিতের সঙ্গে ওর অনেক কাল আর দেখা হয়নি। কিন্তু প্রিয়ব্রতর সঙ্গেও আর কখনওই দেখা হয়নি। পার্টির সাংগঠনিক নীতি, আদর্শ, কার্যক্রম, সবই ও জেনেছিল কাগজের লেখায়, প্রিয়ব্রতর মুখে, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির দু-তিনজন কমরেডের সঙ্গে যোগাযোগ ও দূতের কাজ করা ছাড়া, আভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল না। অথচ ও জানত, একদিন ওর ডাক আসবে, ওর প্রতি নির্দেশ আসবে, ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, ওকেও চলে যেতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেই দিনটির জন্য ও মনে মনে অধীর ভাবে প্রতীক্ষা করেছিল। প্রিয়ব্রত এ রকম একটা ধারণা ওকে দিয়েছিল, যে কোনও সময়েই পার্টির নির্দেশে ওকে চলে যেতে হতে পারে কোনও দূরের গ্রামে। বন্দুক হাতে করতে হতে পারে, শত্রুর বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামতে হতে পারে। প্রাণ নিতে হবে, প্রাণ দেবার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

শংকর নিজেকে সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত করেছিল। কারণ ও সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করেছিল, নিজের পার্টিকেই একমাত্র খাঁটি বিপ্লবী পার্টি বলে গ্রহণ করেছিল। বাকিগুলো সবই সুবিধাবাদী, বুর্জোয়া সাংবিধানিক আওতায় থেকে, জনসাধারণকে ধোঁকা দেবার দল। কিছু করবার জন্য ওর বুকের মধ্যে দপদপ করছিল, আগুন লেগেছিল প্রাণে। কিন্তু কোনও ডাক আসেনি ওর কাছে, নির্দেশও আসেনি। যাদের সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল, আস্তে আস্তে তারা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা বোধ করছিল। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে একদিন গড়িয়ায় চলে গিয়েছিল প্রিয়ব্রতর সঙ্গে দেখা করতে। রাত্রের অন্ধকারে প্রিয়ব্রতকে পৌঁছে দিলেও বাড়িটা চিনতে ওর ভুল হয়নি। কিন্তু ও অবাক হয়ে দেখেছিল, সে বাড়ির বাসিন্দা আলাদা। প্রিয়ব্রতকে রাখতে গিয়ে যে দু-একজনের মুখ দেখেছিল, তারা কেউ ছিল না, বরং অচেনা শংকরকে দেখে, সেই বাড়ির লোকেরা অবাক সন্দেহে ওর দিকে তাকিয়েছিল। শংকর প্রিয়ব্রতর নাম উচ্চারণ করতে পারেনি, কিন্তু প্রিয়ব্রতকে পৌঁছে দেবার দিন যাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, সেই ধীরেশদার নামটা বলেছিল। জবাব পেয়েছিল, কয়েকদিন আগেই ধীরেশবাবুরা বাসা বদল করে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন, নতুন ভাড়াটেরা বলতে পারেনি।

আশ্চর্য! প্রায় দেড় মাসের জীবনটাকে একটা ভৌতিক বলে মনে হয়েছিল। যেন আদৌ ওর সঙ্গে পার্টির কোনও যোগাযোগই হয়নি! অথচ যোগাযোগ করা যায় কেমন করে, তা ওর জানা ছিল না। ও তীক্ষ্ণ চোখে রাস্তাঘাটে লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখত। সেই দু-তিনজন কমরেড বা প্রিয়ব্রতকে যদি হঠাৎ দেখতে পায়। প্রিয়ব্রতদের বালিগঞ্জের বাড়িতেও যাওয়া ওর নিষেধ ছিল। পার্টির কোনও নিষেধ ও কখনও অমান্য করেনি। ও বোকা ছিল না। আস্তে আস্তে বুঝতে আরম্ভ করেছিল, পার্টি ওকে ত্যাগ করেছে। কিন্তু কেন, তার কোনও জবাব কোনও কালেই পায়নি।

ইতিমধ্যে, সত্তর সালের মাঝামাঝি দাদা পিনাকী আলাদা বাসা ভাড়া করে বউদিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। শংকরকে আগেই তা জানানো হয়েছিল। ও কলকাতার উত্তরের উপকণ্ঠে, ওর ইস্কুলের এক মধ্যবয়স্ক অঙ্কের মাস্টারমশাই মহিমবাবুর বাড়িতে পেয়িং-গেস্ট হিসাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। মহিমবাবু গরিব, তবে বাড়িটা ছিল পৈতৃক, তিন ভাইয়ের শরিকানায় ভাগাভাগি। বাইরের ঘরের পার্টিশন করা এক ফালিতে ও স্বচ্ছন্দেই বাস করত। বাথরুম যাওয়া বা খাবার জন্য বাড়ির ভিতরে যেতে হত। আসন পেতে মাটিতে কাঁসার থালায় খাওয়া, মহিমবাবুর স্ত্রী তিন সন্তানের জননী হাসিখুশি সরল মহিলা, ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, মাস্টারমশায়ের দেশ কাল শাসন শিক্ষা নিয়ে সবসময় নানান কথা, সব মিলিয়ে, সেই পরিবেশে শংকর নিজেকে ভালই মানিয়ে নিয়েছিল। অথবা বলা যায়, মানিয়ে নেবার কথা ওর আদৌ মনেই আসেনি। জীবনধারণ করতে হবে, করছিল।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে সবদিক থেকে বিচ্ছিন্নতা ওকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছিল। সপ্তাহে এক দিন দাদার সঙ্গে দেখা করতে যেত। আগের তুলনায় দাদা বউদির আচরণ কিছুটা আন্তরিক হয়েছিল। বিজিতের কথাও মনে পড়ত, আর পড়লেই, ওকে প্রিয়ব্রতর এবং পার্টির বিনা নোটিসে ত্যাগ করার যন্ত্রণাটা বেশি তীব্র হয়ে বাজত। প্রায়ই রাজনৈতিক খুনোখুনির সংবাদ কাগজে বেরোত। উত্তরের উপকণ্ঠেও ঘটনা ঘটত। ওর চোখের সামনে প্রিয়ব্রত এবং সেই দু-তিনজন কমরেডের মুখ ভেসে উঠত।

সেই সময়টা সত্তরের শেষ দিক। টিফিনের সময় একদিন এক ভদ্রলোক, দরকারি কথা আছে বলে, শংকরকে ইস্কুলের বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ও নিতান্ত কৌতূহলবশত গিয়েছিল। মনে মনে একটা সন্দেহও ছিল, পার্টির কেউ কি না। বাইরে একটা জিপ অপেক্ষা করছিল। লোকটি ওকে জিপে উঠতে বলেছিল। ও আপত্তি করেছিল, কারণ লোকটিকে চেনে না, ইস্কুলও তখন শেষ হয়নি। কিন্তু ওকে চমকিয়ে দিয়ে, লোকটার সঙ্গের আর একজন হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওকে জিপে তুলে নিয়েছিল। জিপ গিয়েছিল থানায়। প্রথমে হাজতে। সন্ধ্যার পরে জিজ্ঞাসাবাদ। শংকর সাবধান হয়েছিল। যদিও গোলমালটা কোথা থেকে কী ঘটেছে, প্রথমে বুঝতে পারেনি। নাম-ধাম পরিচয়, কোনও কথাই অস্বীকার করেনি। এমনকী প্রিয়ব্রত বিশ্বাস যে ওর বন্ধু, একসঙ্গে পড়েছে, সব কথাই বলেছিল। তারপরেই অস্বীকারের পালা। প্রিয়ব্রতকে আপনি শেলটার দিয়েছিলেন? পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ কত দিন? ছ’জনের নাম জিজ্ঞেস করেছিল, যার মধ্যে তিনজনকে শংকর চিনত। এখন কার কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

শংকরের সবগুলো জবাবই ছিল, নেই। দিইনি। চিনি না। তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। ওরা এ কথাও বলেছিল, শংকর সম্পর্কে ওদের বিশ্বাস আছে, ও পার্টি করে না, কিন্তু যোগাযোগ থাকলে স্বীকার করা উচিত। শংকরের জবাবের কোনও হেরফের হয়নি। ওরা বলেছিল, প্রিয়ব্রতর মুখেই ওরা শংকরের কথা শুনেছে। প্রিয়ব্রত পার্টি ছেড়ে দিয়েছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ভারতবর্ষের বাইরে চলে যাবে। বলা বাহুল্য, শংকর কোনও কথাই বিশ্বাস করেনি। তৃতীয় দিনে ওর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। গলা থেকে মাথা বাদ দিয়ে, প্রায় সারা গায়ে, খালি হাতে আর মোটা রুল দিয়ে পিটিয়েছিল। দুই উরুতের মাঝখানে লাথি মেরেছিল। মুখে থুথু দিয়েছিল। সেই দিনই রাত্রি এগারোটার সময় আবার হাজতের বাইরে এনেছিল। সারা গায়ে তখন অসহ্য ব্যথা, জ্বরের ঘোরের একটা আচ্ছন্নতা। ও দেখেছিল, অফিসের একটা ঘরে প্রিয়ব্রত বসে আছে। গোঁফ দাড়ি কামানো পরিষ্কার মুখ, গায়ে আগের মতোই ফিটফাট পোশাক। বলেছিল, শংকর, আমি পার্টি ছেড়ে দিয়েছি। তুই তো আমার জন্যই পার্টিতে এসেছিলি, তুইও ছেড়ে দে। এখন বুঝেছি, আমরা ভুল পথে চলেছিলাম। সতু, মদন, সুহাসের সঙ্গে তোর যোগাযোগ থাকলে বলে দে। আমার সঙ্গে আর নেই। তারপরে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে যা। আসলে আমি বলতে চাইছি, এ সব তোর আমার জন্য নয়।

শংকর লাল ঘোলা চোখে প্রিয়ব্রতর দিকে তাকিয়েছিল। ও অবাক হয়নি বললে মিথ্যা বলা হয়। কিন্তু তার থেকে বেশি, ও মনে মনে হিংস্র হয়ে উঠেছিল। সেই প্রথম ওর হিংস্রতার অনুভূতি, এবং ঘৃণা। না, ও প্রিয়ব্রতর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েনি, বরং শান্ত ভাবে বলেছিল, কী সব আবোল তাবোল বকছিস। কীসের পার্টি, তোর সঙ্গে কীসেরই বা যোগাযোগ? ও সব যাদের নাম বললি, কখনও শুনিনি, চিনিও না।

প্রিয়ব্রত অবাক হেসেছিল, তুই দেখছি একেবারে লাইনে কথা বলছিস। শোন, এরা (পুলিশ) জানে, তোর কোনও অ্যাকটিভ রোল নেই, অ্যাকশনের মধ্যে নেই, কিন্তু কুরিয়রের কাজ হয় তো চালিয়ে যাচ্ছিস। আমার একটা দায়িত্ব আছে, আমি তোকে পার্টিতে এনেছিলাম। সেই জন্যই বলছি, যোগাযোগ থাকলে বলে দে। নইলে এরা তোকে ছাড়বে না। আমি তোকে অনুরোধ করছি। সময়টা খুব খারাপ, এক কথায় ডেঞ্জারাস। মুখ না খুললে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে–মানে তোর লাইফ।

তোর সঙ্গে আমার আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। শংকর বলেছিল, আমি তোর কথার এক বর্ণও বুঝতে পারছি না। তার সঙ্গে কলেজে পড়েছি, এই পর্যন্ত। বাদ বাকি এ সব কী কথা, কী ঘটছে আমি কিছুই জানি না।

ঘরের মধ্যে দুজন সাদা পোশাকের অফিসার ছিল। প্রিয়ব্রত তাদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়েছিল। একজন অফিসার বলেছিল, বুঝেছি। মিঃ বিশ্বাস, আপনার যা কাজ ছিল, তা হয়ে গেছে। আপনি চলে যান।

প্রিয়ব্রত তবু দ্বিধা করেছিল, ডেকেছিল, শংকর।

শংকর মুখ তোলেনি, তাকায়নি। প্রিয়ব্রতর মুখে ওর থুথু দিতে ইচ্ছা করছিল। প্রিয়ব্রত বেরিয়ে গিয়েছিল, অফিসার দুজনও। কয়েক মিনিট পরেই সেই গাড়ি চলে যাবার শব্দ শোনা গিয়েছিল। অফিসার দুজন আবার ঘরে ঢুকেছিল। সঙ্গে আর একজন, ধুতি আর শার্ট পরা, মাথায় ছোট চুল, চওড়া গোঁফ, বেঁটে খাটো শক্ত শরীর। সে প্রথমেই শংকরকে চেয়ার সুদ্ধ লাথি মেরে মেঝেয় ফেলে। দিয়েছিল। শংকর ছিটকে পড়েছিল। লম্বা শরীরটা গুটিয়ে গিয়েছিল। তারপরে কেবল লাথি। গোটা ঘরের মধ্যে, লাথি মেরে মেরে, ঘরের এক পাশ থেকে আর এক পাশে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মুখ মাথাও বাঁচানো যায়নি। লোকটার খালি পায়ে শক্তি ছিল। কতক্ষণ বাদে জ্ঞান হারিয়েছিল, শংকর মনে করতে পারে না।

তারপরেও তিন দিন জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল। সতু, মদন, সুহাস কোথায়? জানি না। আবার থার্ড ডিগ্রি মেথড প্রয়োগ। শংকর জ্ঞান হারাবার আগে পর্যন্ত ভাবত, কোথায় আছে ওরা? সতু, মদন, সুহাস? ঠিক জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে আছে তো? ওরা কি জানে প্রিয়ব্রত বিশ্বাসঘাতক? ওরা কি শংকরের খবর রাখে? না রাখলেও ক্ষতি নেই। ওরা ঠিক থাকলেই হল।

শংকর ধরেই নিয়েছিল, ওকে খুন করা হবে। কিন্তু হয়নি। ওকে পরের পাঁচ দিন আর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, মারাও হয়নি। ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশের নজরবন্দি অবস্থায় চিকিৎসা করা হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে শেয়ালদা কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। অভিযোগ, পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলা, বোমাবাজি। একটা পাইপগান প্রডিউস করা হয়েছিল, শংকর অপরাধ অস্বীকার করেছিল। কোর্টে দাদা পিনাকী এসেছিল, উকিল দিয়েছিল। জামিন মেলেনি, তিন মাস পরে তারিখ পড়েছিল। কোর্ট থেকে আলিপুর জেলে। জেলে বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে কেউ ওর পরিচিত ছিল না। বন্দিদের নিজেদের তিনটি দল ছিল। প্রায় সবাই ওকে সন্দেহ করত কেউ বিশ্বাস করত না, কেউ কথাও বলত না। যারা কথা বলত, মিশতে আসত, ও তাদের প্রাণ ধরে বিশ্বাস করতে পারত না। ও বুঝেছিল, জেলেও ওর ওপর নজর রাখা হয়। তবুও যাদের সঙ্গে ওর কথা হত, তাদের ও জানিয়ে দিয়েছিল, একটা মিথ্যা মামলায় ওকে ধরা হয়েছে। কেউই প্রায় বিশ্বাস করত না। অনেকেই শক্ত মুখে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসত। কেউ কেউ মুখের সামনেই বিদ্রূপ করত। মিথ্যা মামলার আসামি। নিজস্ব সংবাদদাতা।…

নিজস্ব সংবাদদাতা’র অর্থ পুলিশের গুপ্তচর। শংকরও হাসত, কিন্তু একটা কষ্ট হত মনে, অথচ মুখ ফুটে প্রতিবাদ করত না। এক বছরের মধ্যে তিন বার ওকে কোর্টে হাজির করানো হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে অনেকের, ওর প্রতি বিশ্বাস জন্মেছিল। অনেক শক্ত মুখের বাঁকানো হাসি নরম হয়েছিল। তবু ওকে ঘিরে কৌতূহলিত জিজ্ঞাসার কোনও জবাবও দিতে পারত না। কারণ পার্টির আইডেন্টিটি বলে কিছু ছিল না ওর। ফলে বন্দিরা ধরেই নিয়েছিল, ওকে ভুল করে ধরে আনা হয়েছে। যদিও সতু, মদন, সুহাসের কথা ও কখনও উচ্চারণ করেনি।

বাহাত্তরের নির্বাচন শেষ হতেই, ওকে আর এক বার কোর্টে হাজির করা হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ওকে অভিযোগ প্রমাণের অভাবে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছিলেন। পিনাকীর দেওয়া উকিলের যে কী ভূমিকা ছিল, ও কিছুই বুঝত না। এক বছর কয়েক মাসের মধ্যে, যত বার কোর্টে হাজির হয়েছিল, উকিলের একমাত্র আবেদন ছিল, জামিন মঞ্জুর করা হোক। মুক্তির পর উকিল পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপরেই খুশি আর উত্তেজনায় শংকরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, চলুন, আপনার দাদাকে এখুনি। অফিসে একটা টেলিফোন করি। গলা নামিয়ে বলেছিল, ভেবেছিলাম, পুলিশ আপনাকে আবার অ্যারেস্ট করে, নতুন কোনও মামলা তৈরি করবে; কিন্তু তা আর করবে না।

শংকর বলেছিল, আপনি দাদাকে টেলিফোন করুন। আমাকে বরং দু-চারটে টাকা দিন, আমি আগে আমার ইস্কুলে যাই। চাকরিটা আছে কি না, দেখতে হবে। দাদাকে বলবেন, পরে দেখা করব।

শংকর সোজা কলকাতার নিকট উপকণ্ঠে ওর ইস্কুলে গিয়েছিল। হেডমাস্টারের ঘরে ওকে ঘিরে মাস্টারমশাইদের রীতিমতো সভা বসে গিয়েছিল। ও পরিষ্কার বলেছিল, অকারণ সন্দেহবশত পুলিশ ওকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল। জেনেছিল, মহিমবাবুর বাড়িতে খানাতল্লাশি হয়েছিল। কিছু পাওয়া যায়নি। তবু পুলিশ মহিমবাবুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। হেডমাস্টার বলেছিলেন, ইস্কুল কমিটিই ঠিক করবে, শংকরকে রাখা হবে কি না। তবে মহিমবাবু, ওকে আগের মতোই থাকতে দিয়েছিলেন।

ইস্কুল কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আগামী ছ’ মাসের মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে নতুন কোনও অভিযোগ না এলে, শংকরের চাকরি স্থায়ী হবে। সেই ছ’ মাস কাজ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। শংকরকে অবাক করেছিলেন মহিমবাবু আর তাঁর স্ত্রী। তারা ভয় পাননি। তাঁদের সংসারে অর্থাভাব ছিল। কিন্তু শংকরের অর্থের জন্যই তারা লালায়িত ছিলেন, এমন না। তাঁদের দুজনেরই শংকরকে ভাল লেগেছিল। জেল থেকে ফেরার পরে, শংকর মহিমবাবুর স্ত্রীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখেছিল। সরল হাসিখুশি সংসারগত প্রাণ। স্বামী সেবা, ছেলেমেয়েদের পরিচর্যা, তার মধ্যেও গান বাজনা নাটক সিনেমা, সব দিকে তাল দেওয়া, যাকে বলে দৌড়ঝাঁপ করে জীবন কাটানো। শংকর বউদি বলে ডাকতে আরম্ভ করেছিল। বছর পঁয়ত্রিশের মহিলা, প্রথম সম্বোধনের দিনটিতে অবাক খুশিতে বলেই উঠেছিলেন, যাক, এত দিনে তবু বউদি বলে ডাকতে পারলেন। আমি ভাবতাম, মুখচোরা লাজুক ছেলেটা আমাকে কিছু বলেই ডাকে না কেন? একটা কিছু বলে ডাকবে তো?’ বউদি খুব হেসেছিলেন।

মহিমবাবু শুনে বলেছিলেন, তা হলে আমাকে আর বাবু বলা কেন ভায়া? আমাকেও দাদা বলেই ডেকো।

মহিমবাবুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশের মতো, ফরসা, খাটো, বড় চোখ, চোখা নাক, মাথায় টাক, নিরহংকারী, কথায় আচরণে কিছুটা সাবেকি চাল। বউদি প্রীতিলতা, শ্যামলা রং, চোখ-মুখ সাধারণ, স্বাস্থ্যটি ভাল। সন্তানের মধ্যে বড়টি মেয়ে, বয়স তখন দশ-এগারো, বাকি ছেলে দুটি ছোট, আট-পাঁচের। মধ্যে। বউদি অনায়াসেই একদিন শংকরকে বলেছিলেন, অপারেশন করে মা ষষ্ঠীকে বিদায় দিয়েছি ভাই। মানুষ করব কী করে? বলেই লজ্জা পেয়ে হেসে তাড়াতাড়ি কাছ থেকে চলে গিয়েছিলেন।

শংকরের নিজের দাদা বউদির কথা মনে পড়েছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের কাছে আটকে ছিল। না, দোষ কারোকেই দেওয়া যায় না। মানুষ তো কেউ ছকে বাঁধা না। ও মহিমবাবুর সংসারের একজন হয়ে উঠেছিল। অবিশ্যি নিজের দাদা বউদির কাছে ও যেত। বউদির তখন একটি মেয়ে হয়েছিল। বিজিতের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। বিজিত তর্ক করতে চেয়েছিল। শংকর তর্ক করেনি, হেসে বলেছিল, বিজু, পার্টি হয় তো আমার কোনও কালেই করা হবে না। প্রিয় ভয়ে পালিয়েছে। আমার পালাবারও দরকার নেই। তবে আমার বিশ্বাসকে কেউ টলাতে পারবে না। সংবিধান নির্বাচন, এ সবই এ দেশে মিথ্যা, চরিত্রহীনদের দল বাড়ায়। বিদ্যাসাগর বলতেন, এ দেশের সাত প্রস্থ মাটি উৎখাত করে ফেলে দিলে, প্রকৃত রূপটা দেখা যাবে। কথাটা সত্যি। সাত প্রস্থ মাটি উপড়ে ফেলা মানে, সশস্ত্র বিপ্লব। কবে হবে জানি না, কিন্তু হবে। কোটি কোটি মানুষ বহু বছরের সব অন্যায়কে উপড়ে ফেলে দেবে। নেতৃত্ব দেবে ওরাই, আমরা না। মাঝখানে আর যা সব ঘটবে, তা হল পাপের ভরাডুবিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আনা। দেখতেই পাচ্ছি।

বিজিত বিদ্রূপ করে হেসে বলেছিল, সত্য যুগ আসবে, না? জ্যোতিষী করছিস নাকি আজকাল?

শংকর হেসে বলেছিল, বিশ্বাসের কথা বললাম। তুই যা খুশি বলতে পারিস।

 কিছুই বলব না, তুই অবসেশনে ভুগছিস, এটাই দেখছি।

তা হলে এই অবশেসন নিয়েই মরব।

ছ’ মাসের মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে কোনও অভিযোগ আসেনি। অতএব শংকরের স্থায়ী চাকরিতে কোনও ছেদ পড়েনি। জেলে থাকাকালীন বেতন পায়নি, বিনা বেতনে ছুটি রেকর্ড করা হয়েছিল।

শংকর সেই সময়েই বি.টি. পাশ করেছিল। মহিমা আর বউদি এত খুশি হয়েছিল, যেন কৃতিত্বটা তাদেরই, এক দিক থেকে তাই। বউদি প্রীতিলতার সহায়তা না পেলে, পড়ে পাশ করা সম্ভব ছিল না। ইস্কুলেও শংকরের খাতির বেড়েছিল। ইস্কুল কমিটি বদলে ছিল, এবং কমিটি শংকরের ওপর প্রসন্ন। ছিল। ইস্কুল কমিটি মানেই, বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব। দলীয় ক্ষমতার সঙ্গে সব কিছুই। বদলায়। কমিটির প্রসন্নতার হাত এত দূর অগ্রসর হয়েছিল, কয়েকজনকে ডিঙিয়ে শংকরকে হেডমাস্টার করার প্রস্তাব উঠেছিল। প্রতিদানে শংকরকেও কমিটি তাদের নিজেদের দলে টানতে চেয়েছিল।